দেবতার হাত – অনির্বাণ বসু
ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে কয়েক বছর আগে, আকিদার গোয়েন্দাগিরির সেটাই ছিল প্রথম প্রকাশ। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতদিন পর লিখছি কেন ? প্রথমত, তখন স্কুলে পড়তাম, লেখার হাতটা তেমন তৈরি হয়নি (অবশ্য এখনও যে হয়েছে, এমন দাবি করছি না), তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, তখনই লিখলে এবং প্রকাশ করলে বাবাকে তাঁর কাজের জায়গায় অসুবিধেয় পড়তে হত। লিখেই প্রথমে আকিদাকে দেখিয়েছিলাম। নিজের স্টাইলে বলল, “চললেও চলতে পারে, তবে বেশি ফ্যানাস না। স্ট্রেট ব্যাটে না খেললে পাঠক পাবি না।”
শুরুর তারিখটা ছিল ছাব্বিশে নভেম্বর, আমার বেশ মনে আছে, সেটা ছিল শুক্রবার। পরপর দু’দিন ছুটি বলে স্কুল থেকে ফেরার পরই খুশি খুশি লাগছিল। বসার ঘরে ঢুকে দেখলাম আকিদা খুব মন দিয়ে একটা বই দেখছে।
আমাকে দেখে ডাকল। একটা ছবি দেখিয়ে বলল, “কী দেখছিস ?”
আবার বই ? বিরক্তি চেপে এগোলাম।
“তিনটে স্ট্রেট লাইন, একটা পয়েন্টে কাট করে চলে যাচ্ছে, আর সেগুলোকে জোড়া হয়েছে আরও ছ’টা লাইন দিয়ে।”
“ঠিক করে দেখে বল।”
“দাঁড়াও,… একটা ষড়ভুজের সবক’টা পয়েন্ট জোড়া হচ্ছে তিনটে স্ট্রেট লাইন দিয়ে, আর… না, না, ছ’টা ত্রিকোণ।” আমি কনফিডেন্টলি বললাম।
“তুই সেই বোড়ে তো বোড়েই রয়ে গেলি।” এবার আকিদার গলায় বিরক্তি।
আমার ডাকনাম জুনো। তবে মাঝেমাঝেই এই বিচ্ছিরি নামটা আকিদা ব্যবহার করে।
“তুমিই তো বললে…”
“ঠিক করে দ্যাখ ইডিয়ট,”— বাধা দিয়ে বলল আকিদা। হঠাৎ একটা খুব চেনা জিনিস চোখের সামনে ভেসে উঠল।
“আরে, এটা তো একটা কিউব !” খুব অবাক হয়ে বলে উঠলাম।
“চোখটা খুলেছে এতক্ষণে। শোন, আমার সঙ্গে থাকতে গেলে পর্যবেক্ষণ আর পারসেপশন, এই দুটো ব্যাপার নিয়ে মাজাঘষা করতে হবে তোকে। সব সময় ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রাখবি।”
আমি ততক্ষণে বসে গেছি বইটা নিয়ে। দারুণ ইন্টারেস্টিং তো। এত মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম যে, বুঝতে পারিনি কখন বাবা এসেছেন ঘরে। আকিদা নিশ্চয়ই পেরেছিল, কারণ ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই আমার খেয়াল হয়েছিল। ও বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করে। বলে রাখি, বাবা ওর মামা হন। বেশ কিছুদিন হল আকিদা আমাদের সঙ্গে এখানেই আছে।
সবে অফিস থেকে ফিরেছেন বাবা, এখনও ব্রিফকেসটা পর্যন্ত হাত থেকে নামিয়ে রাখেননি। এমনিতে বসার ঘরে এভাবে কখনও আসেন না বাবা, যখন এসেছেন, নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।
“জানিস আকি, আমার এক কোলিগ, নাম
সুশান্ত সরকার, তারই এক ক্লোজ বন্ধুর বাড়িতে একটা অদ্ভুত ধরনের চুরি হয়েছে।”
আকিদা চুপ করে অপেক্ষা করছে বাবার কথা শেষ হওয়ার জন্য।
“সুশান্ত ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার,” বাবা আবার আরম্ভ করলেন। “সেখানকারই এক বন্ধু— নাম অমিত দেববর্মন— মনে হয় তাসের পার্টনার— বলেছে, ওর বাড়িতে একটা মূর্তি চুরি হয়েছে। অমিতের বাবা নাকি শোকে একেবারে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। বৃদ্ধ মানুষ, শরীর এমনিতেই খারাপ থাকে, আরও ভেঙে পড়েছেন। পুলিশও এসেছিল, কিন্তু কিছু করতে পারেনি। ওদের জেরার চোটে নাকি ভদ্রলোকের শরীর আরও খারাপ হবার উপক্রম। সুশান্ত আমার অ্যাডভাইস চাইছিল, আমি স্রেফ বলেছি, আমার ভাগনেকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি।” গলাটা খাঁকরে নিয়ে বললেন বাবা, “তুই একবার দেখবি নাকি ?”
আকিদা চুপ।
আমি দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। সত্যিই কেসটা হাতে নেবে নাকি ? মূর্তি চুরির সমাধানে নেমে যদি সাকসেসফুল না হয়, তা হলে খুব মুশকিল হবে যে। আর… আমাকে যদি সঙ্গে না নেয় ? টেনশনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাবা সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন আকিদার দিকে। আকিদা কী যেন ভাবছে। অবশেষে মুখ খুলল।
“তুমি যখন বলছ, তখন নিশ্চয়ই দেখব একবার।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বাবা, “তা হলে আজই সুশান্তকে একটা ফোন করে দিই। অমিত দেববর্মনের সঙ্গে কথা বলে ও-ই একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করে রাখুক।”
বাবা ঘরের বাইরে বেরোতেই আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল আকিদা।
“আমি তোমার সঙ্গে যাব,” সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম আমি। বাবা কি শুনতে পেলেন ? একবার পরদা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বেরিয়ে গেলেন দেখে আমার সন্দেহ হল। তবে আপত্তি না করলেই ঠিক আছে।
“শোন বোড়ে, এক নম্বর কন্ডিশন হল, আমার সঙ্গে বেরেলে তুই কিন্তু বেশি কথা বলবি না। দু’নম্বর, যা করতে বলব, তার বাইরে কিছু করবি না।”
খাবার টেবিলে বাবা জানিয়ে দিলেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড। পরদিন সকাল ন’টার সময় ১/২/১ বালিগঞ্জ প্লেস ইস্টে গিয়ে দেখা করতে হবে।
রাতে ভাল করে ঘুমই হল না। পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, তখনও সকাল হয়নি। আকিদা যা হেল্থ কনশাস, ঠিক মর্নিং-ওয়াকে বেরোচ্ছে। আমাকে বলল, “ঘুমিয়ে পড়, ন’টা বাজতে এখনও অনেক দেরি।”
আমাদের বাড়ি থেকে আধঘণ্টার পথ অমিত দেববর্মনের বাড়ি। ন’টা বাজার মিনিটকয়েক আগে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম ১/২/১ বালিগঞ্জ প্লেস ইস্টে। দেখলাম আকিদা মন দিয়ে চারপাশটা দেখছে। কী দেখছে অবশ্য বুঝলাম না, আমার চোখে তেমন কিছুই পড়ল না। দুটো পুরনো বাড়ির মাঝে অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়িটা। তবে তফাত গড়ে দিয়েছে সামনের বাগান, অন্য বাড়ি দুটোতে এত বড় বাগান নেই। বাঁ দিকে একটা গ্যারাজ, একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। গাড়ি-বারান্দাও আছে, তার নীচে দাঁড়িয়ে আছে একটা টুকটুকে লাল মারুতি। দেখতে কিন্তু বেশ বেখাপ্পা লাগছে, অতবড় বারান্দার নীচে একটা পুঁচকে গাড়ি। হাসি পাচ্ছিল আমার। আকিদার দিকে তাকিয়ে দেখি, ও গম্ভীর মুখে ডানদিকের গেটটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বলতে ভুলে গেছি, বাড়িটার দুটো গেট, আমরা দাঁড়িয়ে আছি বাঁদিকের গেটে, ডানদিকেরটার সামনে একটা হাতে টানা রিকশা উলটে রাখা আছে। দেখে মনে হয়, ওটা কেউ ব্যবহার করে না।
“ঘড়িটা দ্যাখ বোড়ে, ন’টা প্রায় বাজে। চল।”
আমি এগিয়ে লোহার গেটটা ঠেললাম, খুলল না।
“সর তো,” আকিদা একটা মৃদু চাপ দিতে ক্যাঁচ করে খুলে গেল দরজা। আমরা এগোলাম গাড়ির রাস্তার দিকে।
আরও কাছে আসতেই ভাল করে দেখতে পেলাম। গ্যারাজে দাঁড় করানো গাড়িটা। বিরাট গাড়ি। চারটে চাকা ছাড়াও বনেটের দু’পাশে লাগানো আছে আরও দুটো। চাকায় আবার সাইকেলের চাকার মতো স্পোক লাগানো। সন্দেহ নেই, খুব পুরনো গাড়ি, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ভিনটেজ’।
“জাগুয়ার,” চাপা গলায় বলল আকিদা।
“কেমন করে বুঝলে ?”
“ম্যাসকট দেখে।”
পরে জেনেছিলাম, গাড়ির রেডিয়েটারের ঢাকনার উপর খোদাই করা স্টিলের মূর্তিটাকে বলে ম্যাসকট।
সেমিসার্কুলার ড্রাইভওয়ে দিয়ে, লাল মারুতির পাশ কাটিয়ে, তিনটে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যখন কলিং বেল টিপছি, তখন পিঁক পিঁক করে আকিদার কোয়ার্টজ ঘড়ি জানাল যে, ন’টা বাজে। বাড়িতে ঢোকার দরজাটা কাঠের, তবে খুব একটা চকচকে নয়।
দরজা খুললেন একজন খুব বয়স্ক দেখতে মানুষ। নভেম্বর মাসে ঠান্ডাই পড়েনি, কিন্তু তা-ও দেখলাম গলায় মাফলার জড়ানো। ইনিই কি অমিত দেববর্মন ?
“কীসকো চাই ?”
হিন্দি-বাংলা মেশানো অদ্ভুত প্রশ্ন। আকিদা জবাব দেওয়ার আগেই মাফলারওয়ালার পিছন থেকে শোনা গেল আর-একটা গলা।
“আর ইউ মিস্টার ডে ?” প্রায় সাহেবদের মতো ইংরেজি উচ্চারণ। এবার দেখতে পেলাম ভদ্রলোককে। গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরা, বেশ সুপুরুষ। হাতে একটা ইংরেজি পত্রিকা, পরে আকিদা বলেছিল, ওটা আমেরিকান কাগজ ‘এসকোয়ার’। চুলগুলো বেশ পাতলা, কানের পাশে সাদার ছোপ লেগে গেছে। লম্বায় প্রায় আকিদার মতোই, তবে ওর মতো স্লিম নন, বেশ ভারী চেহারা।
আকিদা ঘাড় নাড়ায় উনি বললেন, “আই হ্যাভ টু অ্যাডমিট দ্যাট ইউ আর পাংচুয়াল। আমি অমিত দেববর্মন।”
পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর অমিতবাবুর সঙ্গে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আকিদা জিজ্ঞেস করল, “গ্যারাজের ভিনটেজ কারটা কি আপনার ?”
“পাগল হলেন নাকি ? নেহাত বাবার শখের জিনিস তাই এখনও আছে, আমার হলে কবে বিদায় করে দিতাম।”
দোতলায় উঠেই একটা ছোট ল্যান্ডিং। তার পাশেই একটা ঘর। যদিও সেটার দরজা খোলা, সামনে পুরু পরদা ঝোলানো। ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে অমিতবাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, “প্লিজ, বাবা আপনাদের এক্সপেক্ট করছেন।”
ঘরে ঢুকেই চোখ চলে যাবে দেওয়ালে। দাঁত খিঁচিয়ে থাকা নেপালি মুখোশ, সিল্কের কাপড়ের উপর সুন্দর একটা বুদ্ধের মুখ, রংবেরঙের পাথর বসানো নকশা কাটা ছোরা, ছুঁচলো মুখওয়ালা দুটো বর্শা, বহু পুরনো কলকাতার ম্যাপ— আরও নানা হিজিবিজি জিনিসে বোঝাই দেওয়ালটা। তার ঠিক নীচে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। সাদা পাঞ্জাবি- পাজামার উপর খুব দামি সিল্কের কাপড়ের রংচঙে একটা কিমোনো পরা বয়স্ক মানুষটি একটা ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
অমিতবাবু এগিয়ে গেলেন, “ইনি মিস্টার দে। তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারেন— হয়তো।”
প্রতিনমস্কার করে আকিদা আমার পরিচয়টাও দিল।
বেশ মন দিয়ে শুনে ভদ্রলোক মুখ খুললেন। গলার আওয়াজটা বেশ খোনা। “আমি শ্যামসুন্দর দেববর্মন। তোমাকে তুমিই বলি, কেমন ?”
“নিশ্চয়ই।”
আমার চোখ সরছিল না বর্শা দুটো থেকে। সেটা লক্ষ করেই বোধহয় ভদ্রলোক বললেন, “১৮৫৭-র জিনিস, লখনউতে প্রথম যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল।”
“আপনার কালেকশন ?” জিজ্ঞেস করল আকিদা।
“হ্যাঁ, এ বাড়িতে যা-কিছু পুরনো জিনিস দেখবে, সব আমারই। এটা আমার হবি।”
অমিতবাবু বললেন, “বাবা, তুমি কথা বলো, আমি এঁদের চায়ের ব্যবস্থাটা দেখি।”
“ওই ছবিটা রেমব্রান্টের নয় ?” দেওয়ালে টাঙানো আঁকাটা দেখিয়ে বলল আকিদা।
এই একটা প্রশ্নে ভদ্রলোকের চোখের চাউনিটা পালটে গেল, মনে হল ভদ্রলোক যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন এক ঝটকায়।
“ঠিক ধরেছ ভাই, রিটার্ন অব দ্য প্রডিগাল সান। ষোলোশো পঁয়ষট্টি সালে আঁকা।”
“ওটাতে যে সইটা আছে, সেটা জাল এবং পরে ধরা পড়েছিল, জানেন তো ?” আকিদা জিজ্ঞেস করল।
ভদ্রলোকের দৃষ্টি উদ্ভাসিত, “তাই নাকি ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“তোমার যে এ ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে, সেটা জেনে ভাল লাগল। এনিওয়ে, যে জন্য এসেছ, সেটা বলি। দ্যাখো ভাই, আমার যে পুরনো জিনিস সংগ্রহের বাতিক আছে সেটা তো বুঝতেই পারছ, এ ছাড়াও একটা ব্যাপার আছে। আমি বিশ্বাস করি যে, এই প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে আমার উত্থান-পতন জড়িয়ে আছে।”
আকিদা চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে।
“আমার এই বিশ্বাস আমার একমাত্র সম্বল। আমার কালেকশনের কোনও ক্ষতি মানেই এই বিশ্বাসের মূলে আঘাত করা। তাই ব্যাপারটা আমি সহজভাবে নিতে পারছি না কিছুতেই।”
ঘরে একটা থমথমে ভাব।
“চুরি, অথচ চুরি নয়,” আপন মনে বললেন শ্যামসুন্দর দেববর্মন, “পুরোটা গেলেও বুঝতাম, কিন্তু এটা ঠিক বুঝতে পারছি না।”
বেশ কষ্ট করেই নিজের ডান হাতটা তুলে দেওয়ালের একটা বিশেষ দিকে পয়েন্ট করলেন ভদ্রলোক।
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, যে দেওয়ালে বর্শা টাঙানো ছিল সেখানেই পারপেন্ডিকুলার অবস্থায় একটা কাঠের র্যাক রাখা রয়েছে। সেই তাকে অনেক মূর্তি রাখা রয়েছে। এক চান্সেই চিনতে পারলাম হাত ভাঙা ভেনাসের মূর্তিটা। ঠিক পাশেই রয়েছে আরেকটা মার্বেলের মূর্তি, এটারও হাত ভাঙা এবং দুটোর হাইট প্রায় এক, দেড়-দু’ফুট হবে।
“ইংরেজিতে মার্কারি, ল্যাটিনে মারকিউরিয়াস। ইনি রোমানদের ব্যাবসা-বাণিজ্যের দেবতা। গ্রিক পুরাণেও এঁর কথা আছে, তবে নাম পালটে হয়ে গেছে হার্মাস। আমি নাম দিয়েছি উড়ন্ত দেবতা।” এক নিশ্বাসে বলে চলেছেন শ্যামসুন্দরবাবু, “এই মূর্তির একটা বিশেষত্ব আছে— মানে ছিল। এর যে ডান হাত, সেটা আগে ভাঙা ছিল না, এর হাতে ছিল একটা ছোট্ট পার্স। এরকম মূর্তি আর পাওয়া যায় না মি. দে, অত্যন্ত রেয়ার। বেশির ভাগ মূর্তিতে ডান হাতটা খালি থাকে। কিন্তু এটা অন্যরকম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি এই মূর্তি জোগাড় করেছিলাম। ইন ফ্যাক্ট, এই বাড়িটাও কিনি মূর্তিটা কেনার পর। কিন্তু আজ এই হাত আর পার্স মনে হচ্ছে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”
খুব মন দিয়ে আকিদা আর আমি মূর্তিটা দেখছিলাম। মাথা ভরতি কোঁকড়া চুল, তার বেশিরভাগটাই একটা টুপি দিয়ে ঢাকা। টুপিতে দুটো পাখির পালক লাগানো, আর সেই পালকের কাজও দেখার মতো। একই পালক লাগানো রয়েছে পায়ের চটিতেও। দেখলেই মনে হয়, আকাশে উড়ছে। বাঁ হাতে একটা লাঠি, তার দু’ধারে মুখোমুখি দুটো সাপ প্যাঁচানো, সবচেয়ে উপরে আরও দুটো পাখির পালক। ডান হাতের কনুইয়ের তলা থেকে কিছু নেই।
অমিতবাবু ঘরে ঢুকলেন চা এবং টা নিয়ে জিনিসগুলো বয়ে নিয়ে এসেছে আগে দেখা সেই মাফলারওয়ালা মানুষটি। আমার চোখে পড়ল, বয়স্ক লোকটি অদ্ভুতভাবে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
“ব্যাপারটা লক্ষ করলেন কবে ?” চায়ে প্রথম চুমুকটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল আকিদা।
“কুড়ি তারিখে। আমিই প্রথম দেখি। আগের রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। তখনও হাতটা ঠিকঠাক ছিল, আমি দেখেছি। সকালে দেখি ভেঙে গেছে।”
“তারপর ?”
“তারপর অমিকে বলি, কাজের লোকজনকে জিজ্ঞেস করি, তারপর পুলিশে খবর দিই। তাঁরা এসে জেরাটেরা করে জানালেন, মূর্তিটা কারও হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে।” বিরক্ত গলায় বললেন শ্যামসুন্দর দেববর্মন।
“বাড়িতে আর কে কে থাকেন ?”
এ বার উত্তর দিলেন অমিতবাবু, “আমি, বাবা ছাড়া আমার ড্রাইভার জগদীশ আর মিশ্রিলাল। ঘর ঝাড়ার জন্য আছে একটা ঠিকে লোক।”
“এরা কি বিশ্বাসী ?”
“দ্যাখো ভাই, আজকের দিনে কাকে যে বিশ্বাস করব, আর কাকে করব না, তা ঠিক করতেই সময় লাগে। তবে জগদীশ বছর পাঁচেক কাজ করছে, আর মিশ্রি অমিতের আট বছর বয়স থেকে। ঠিকে লোকটিও কাজ করছে বছরখানেক।”
“ঠিক আগের দিন, উনিশ তারিখে কেউ এসেছিল নাকি আপনার কাছে ?”
“নাহ্।”
তাকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল আকিদা, আমিও পিছন পিছন হাজির হলাম। ভেনাস আর মার্কারির মূর্তি ছাড়াও রয়েছে লাফিং বুদ্ধ, আধশোয়া গণপতি আর মাইকেল এঞ্জেলোর ‘পিয়েটা’। তার পাশেই রয়েছে অদ্ভুত দেখতে একটা কাঠের মূর্তি। মুখটা বেশ হাসি হাসি, মাথায় মন্দিরের চূড়োর মতো টুপি, হাত দুটো বুকের উপর রাখা, থুতনি থেকে ঝুলছে পাকানো দাড়ি। অন্য মূর্তিগুলোর মতো এটাও একটা গোল চাকতির উপর বসানো।
“এটি কে ?” জিজ্ঞেস করল আকিদা।
“ওসিরিস, প্রাচীন মিশরীয়দের মতে, মৃত মানুষের দেবতা।”
“আপনার কাজের লোক মন দিয়ে ডাস্টিং করছে না কিন্তু।”
আমি ঝট করে ঘুরে তাকালাম আকিদার দিকে। শ্যামসুন্দরবাবু বসতে যাচ্ছিলেন চেয়ারে, ধপাস করে একটা আওয়াজ পেলাম। অমিতবাবু কাউকে উদ্দেশ না করেই, “আমি নিজের ঘরে আছি,” বলে বেরিয়ে গেলেন।
“ওগুলো আমিই ঝাড়ি,” গলায় ঝাঁঝ এবং বিদ্রুপ মিশে রয়েছে, জবাব এল শ্যামসুন্দরের কাছ থেকে। “কাজের লোকের হাতে ছাড়ি না। অনেকদিন অবিশ্যি ঝাড়িনি, আর এ ঘটনার পর তো হাতই দিইনি।”
“আপনার বাড়িতে খুব ধুলো হয় ?”
“কলকাতা শহরের কোন বাড়িতে ধুলো হয় না ? এই ঘরে তো তাও ধুলো কম, শোয়ার ঘরের জন্য বেঁচে গেছে।”
“শোয়ার ঘরটা একবার দেখা যায় ?”
“অবশ্যই।”
আমরা ডানদিকের ঘরটায় গিয়ে ঢুকলাম। এই ঘরে তিনটে খোলা জানলা দিয়ে প্রচুর আলো-বাতাস আসছে। দেখার তেমন কিছু আছে বলে মনে হল না আমার। পূর্বদিকের জানলার পাশে বড় খাট, তার পাশেই পড়ার টেবিল। সেখানে ডাঁই করে রাখা আছে কিছু পত্রপত্রিকা। বইয়ের আলমারি আর একটা স্টিলের আলমারি রয়েছে ঘরের অন্যদিকে।
“অমিতবাবুর ঘরটা দেখা যাবে একবার ?”
“কেন নয় ? যাও-না।”
আবার মূর্তির ঘরে ঢুকে এবার বাঁদিকে গেলাম। অমিতবাবু ঘরেই ছিলেন। দু’-একটা মামুলি কথাবার্তা বলার পর নিজে থেকেই বললেন, “বাবা যাই বলুন না কেন, আমার মনে হয় এটা কমলার কীর্তি। ওরই অসাবধানতায় কোনওভাবে পড়ে গিয়ে মুর্তিটা ভেঙেছে।”
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে ওঁর কথা শোনার পর কথা বলল আকিদা, “আপনি কোথায় আছেন ?”
“আমার ব্যাবসা আছে, গাড়ির ব্যাটারির। বাবা শুরু করেছিলেন, এখন আমি দেখি। তবে এই কম্পিটিশনের যুগে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবছি ডাইভার্সিফাই করব।”
“তাই ?”
“আসলে কী জানেন,” একটা সোফায় আয়েশ করে বসলেন অমিতবাবু, “বাবা খুব ভেঙে পড়েছেন। এতটাই, যে বাড়িটা ছেড়ে দিতে চাইছেন। ওঁর মতে মূর্তিটা খুব পয়া, এইটা ভেঙে যাওয়ার পর বাবা খুব আপসেট হয়ে পড়েছেন।”
“আপনার মা ?”
“মারা গেছেন বছর দশেক আগে।”
“অন্য কোনও ভাই-বোন ?”
“নাঃ, আই অ্যাম দি ওনলি অফস্প্রিং।”
অমিতবাবুর ঘরটা ওঁর বাবার মতোই। তফাত হল এই ঘরে কোনও বইয়ের আলমারি নেই, আছে একটা টিভি, আর তার পাশেই রংচঙে ছবিওয়ালা একটা তাসের বই।
আবার মুখ খুলল আকিদা, “আপনার অফিস কোথায় ?”
“ফোর বি, লিটল রাসেল স্ট্রিটে। আচ্ছা, আপনার কী মনে হচ্ছে বলুন তো ? কে করতে পারে কাজটা ?”
মুচকি হাসল আকিদা, “এখনও বলার সময় হয়নি।”
ভদ্রলোক বোধহয় এরকম একটা উত্তরের আশা একেবারেই করেননি।
“সেদিন, মানে উনিশ তারিখ রাতে আপনি কোথায় ছিলেন, অমিতবাবু ?”
“কোথায় আবার, বাড়িতেই ছিলাম। তবে, ফিরতে রাত হয়েছিল। একটা পার্টি ছিল ক্যালকাটা ক্লাবে। রাত হবে বলেই জগদীশকেও ছুটি দিয়েছিলাম।”
“কিছু আনইউজুয়াল চোখে পড়েছিল আপনার ?”
“নাঃ।”
“মূর্তিগুলোর দিকে চোখ যায়নি নিশ্চয়ই ?”
“না, জানব কেমন করে কেউ ভেঙে রাখবে ?”
“সকালে কিছু চোখে পড়েনি আপনার ?”
মাথা নেড়ে না বললেন অমিতবাবু।
“তবে কি জানেন,” কিছুক্ষণ ভেবে বললেন অমিতবাবু, “আপনি বলাতে এখন আমার মনে হচ্ছে, সেদিন, মানে কুড়ি তারিখে কমলা বেশ দেরিতে কাজে এসেছিল। তালেগোলে সেটা আর খেয়াল হয়নি।”
“আর ?”
“আর… আর,” ভদ্রলোক অন্যমনস্ক হয়ে মাথা চুলকোচ্ছেন।
কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক ফাইনালি মাথা নাড়লেন, “নাঃ, নাথিং।”
“ঠিক আছে। আজ উঠি।”
“উঠবেন ? বেশ। আমি জগদীশকে বলছি আপনাদের ছেড়ে আসতে।”
ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন অমিতবাবু। ওঁর বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন আমরা নীচে নামছি, তখন দেখলাম মিশ্রিলালও দরজার কাছে চলে এসেছে। আমি গাড়ি-বারান্দায় নেমে দেখি, আকিদা নেই। কোথায় গেল ? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি, মিশ্রিলালের সঙ্গে কথা বলছে।
“জগদীশ” ড্রাইভারকে ডেকে বললেন অমিতবাবু, “তুমি এঁদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এসো, আমি রোজের মতোই এগারোটায় বেরোব অফিসে।”
ড্রাইভারটি বেশ অল্পবয়সি। কেন জানি না, দেখলে মনে হয়, কলকাতার ট্রাফিক ভালই সামলাতে পারে।
আকিদাও চলে এল।
“আসুন তা হলে,” গাড়ির দরজা খুলে বললেন অমিতবাবু।
ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম আমি আর আকিদা। পিছনের সিটে বসে পরপর ভাবার চেষ্টা করছিলাম আজকের ঘটনাগুলো। আকিদা ড্রাইভারের পাশে মাথা নিচু করে বসে।
“উনিশ তারিখ রাতে তুমি কোথায় ছিলে ভাই ?” হঠাৎ জিজ্ঞেস করল আকিদা।
“উনিশ… আমি স্যার… সেদিন তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলাম স্যার। ছোটসাহেব নিজেই ছুটি দিয়েছিলেন আমায়।” প্রথম চমকের ভাবটা কেটে যাওয়ার পর গড়গড় করে বলে গেল জগদীশ।
বাড়ি থেকে রাস্তায় গাড়িটা পড়তেই আকিদা জিজ্ঞেস করল, “এটা এখানে কেন ?”
“কোনটা স্যার ?”
উঁকি মেরে দেখলাম, নিজের পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা জিনিসের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে আকিদা। দেখলে মনে হয় বেশ ভারী, অনেকটা ‘দ’-এর মতো দেখতে।
গাড়ির স্পিড কমিয়ে বাঁদিক ঘেঁষে চলল জগদীশ। আর খুব অবাক হয়ে বলল, “তাই বলি, বড় গাড়ির হ্যান্ডেলটা গেল কোথায় ?”
“বড় গাড়ি মানে ? জাগুয়ার ?”
“হ্যাঁ স্যার। স্টার্টই দিতে পারিনি গত তিনদিন। মিশ্রিকে দিয়ে হ্যান্ডেল মারাতে পারিনি বলে গাড়িটা বসেই আছে।”
“এতদিন এখানে পড়ে আছে, আর তোমার চোখে পড়েনি ?”
“ছিল না তো, কাল অবধি ছিল না। আমি সিওর।” জগদীশ কনফিডেন্ট।
আবার পিক আপ নিয়েছে লাল মারুতি।
গড়িয়াহাটের জ্যামে গাড়ি আটকে পড়তেই আকিদা হঠাৎ বলল, “আমাদের এখানেই নামিয়ে দাও জগদীশ।”
অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি তো এখান থেকে বেশ দূরে। যাই হোক, পিছন পিছন আমিও নেমে পড়লাম।
উলটো দিকে আকিদাকে হাঁটতে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
“বাড়ি যাবে না ?”
“না, ভাবব।”
এ আবার কী ? এখন ভাবতে আবার কোথায় যাবে ? দেখলাম ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে থাকা একটা ফাঁকা ট্রামে এক লাফে উঠে পড়ল আকিদা। অগত্যা আমিও উঠলাম। ঘড়াং ঘড়াং করে ট্রামটা চলতে আরম্ভ করল রাসবিহারী ধরে।
আমরা বাড়ি ফিরেছি দুপুরের মধ্যেই, তারপর থেকে আকিদাকে দেখে মনে হচ্ছে না কোনও টেনশনে আছে বা কিছু ভাবছে। দিব্যি খাচ্ছেদাচ্ছে, ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’ ছবিটার সিডি চালিয়ে দেখছে। আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে। দু’-একবার খোঁচা মারতে গিয়ে বকুনি খেয়ে ফিরে এসেছি। সন্ধের দিকে ইন্টারনেট খুলে বসল। পিছন থেকে উঁকি মেরে দেখলাম সাইটটা মাইথোলজির।
সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু ধরতে পারলে ?”
“মনে হচ্ছে পারছি। এই, তুই এখনও পড়তে বসিসনি ? যা, পালা শিগগির।”
“শুধু একটা কথা বলো, এটা চুরি, না অ্যাকসিডেন্ট ?”
“কোনওটাই নয়। জেনে-বুঝে মূর্তিটা ভাঙা হয়েছে।”
“তাই ? তা হলে…”
“নো মোর বকবক। যাও, পড়তে যাও।”
রাতে শোয়ার সময় আকিদা বলল, পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর আর একবার বালিগঞ্জ প্লেসে যেতে হবে।
আজও ঢোকার সময় দরজা খুলে দিল মিশ্রিলাল। অবাক হয়ে দেখলাম, আকিদাকে পেল্লায় একটা সেলাম ঠুকল ও।
আকিদাকে দেখে শ্যামসুন্দরবাবু বেশ উত্তেজিত, জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু এগোলে নাকি ?”
“বাইরে অমিতবাবুর গাড়িটা দেখলাম না, উনি নেই ?”
আকিদার পালটা প্রশ্নে মনে হল ভদ্রলোক ঝিমিয়ে পড়লেন। নিরুৎসাহ গলায় বললেন, নাঃ, ও রবিবার এই সময় বন্ধুর বাড়ি যায়।”
“আসলে, আপনার কালেকশনের মূর্তিগুলো আর একবার দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।”
“তা দ্যাখো। তবে এসবে আমার ইন্টারেস্ট কমে যাচ্ছে।” খবরের কাগজ তুলে নিলেন ভদ্রলোক।
মৃর্তির র্যাকটার দিকে এগিয়ে গেল আকিদা। তারপর যেটা ঘটল, তার জন্য আদৌ তৈরি ছিলাম না আমি। একটা অস্ফুট আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি, আকিদার মুখে যন্ত্রণার ছাপ, ওর শরীরটা বেঁকে মাটিতে পড়ছে।
রেগুলার ওয়ার্ক আউট করা আকিদাকে কখনও অসুস্থ হতে দেখিনি। শ্যামসুন্দরবাবুর চিৎকার শুনতে পেলাম, “কী হল ? কী করে ?”
আকিদা কোনওরকমে বলল, “জল।”
“এসো তো আমার সঙ্গে,” বলে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শ্যামসুন্দরবাবু। ওঁর পিছনে ছুটলাম আমিও। কাল মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙেছিল, তখনও কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে দেখেছি আকিদাকে। কাজের চাপ সামলাতে না পেরেই কি অসুস্থ হয়ে পড়ল ?
“কাউকে পাওয়া যায় না এই সময়ে, কাজের লোকগুলো সব হাঁ করে টিভি সিরিয়াল দ্যাখে। বরফ বার করতে পারবে তুমি ?” রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলে দিয়ে ভদ্রলোক নিজেই গ্লাসে জল ঢালছেন। হ্যাঁচকা টানে আইস ট্রে থেকে দুটো বরফ ভেঙে নিয়ে গ্লাস হাতে ঘরের দিকে ছুটলাম।
কষ্ট করে উঠে বসেছে আকিদা। লক্ষ করলাম, হাঁপাচ্ছে।
“সরি,” খুব কষ্ট করে বলল আকিদা, “আসলে আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারিনি…”
ব্যস্তভাবে থামিয়ে দিলেন শ্যামসুন্দর দেববর্মন, “এতে সরি ফিল করার কী আছে ? চুপ করে বসো প্লিজ। জলটা খাও। তবে, তোমার ভাই না থাকলে মুশকিলে পড়তাম।”
উঠে দাঁড়াল আকিদা, “আজ আর আপনাকে ডিস্টার্ব করব না, উঠি।”
বুঝতে পারলাম, মক্কেলের বাড়ি এসে অসুস্থ হয়ে পড়ায় রীতিমতো খারাপ লাগছে আকিদার।
“এগোবে ? জগদীশও নেই যে, বলব তোমাদের একটু এগিয়ে দিতে। যাই হোক, তুমি কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা বন্ধ করে রেস্ট নাও ভাল করে। শরীরটা আগে।”
“কিছু চিন্তা করবেন না, উই ক্যান ম্যানেজ।”
“এখন কেমন লাগছে ?” ট্যাক্সিতে উঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“ফাইন। শোন বোড়ে, মামা-মাইমাকে কিছু জানাবার দরকার নেই। বুঝলি ?”
যদিও পছন্দ হল না কথাটা, কিন্তু ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।
“তুই কাল কখন স্কুল থেকে ফিরবি রে ?”
“অ্যাঁ ?” আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম। তারপরেই মনে হল, তা হলে কি মিষ্ট্রি সল্ভ হতে চলেছে ?
“তিনটে !” চেঁচিয়ে উঠলাম, “আমার ক্রিকেট প্র্যাকটিস আছে, বাদ দিই কাল ?”
“হুম,” কিছুক্ষণ ভেবে আকিদা বলল, “নাঃ, সেরেই আয়। তারপর…”
“তারপর কী ?”
“তারপর মূর্তি, হ্যান্ডেল, মিশ্রিলালের সেলাম সব মিলিয়ে দেব।” ট্যাক্সির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল আকিদা। খানিক পরে বলল, “আসল রহস্য কিন্তু পালিয়ে বেড়াচ্ছে, মূর্তি চুরিটা উপসর্গমাত্র।”
মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না।
স্কুলে মন বসছিল না সোমবার— না পড়ায়, না ক্রিকেটে। আজ থেকেই আবার একটা এক্সট্রা প্র্যাকটিস সেশন শুরু হল।
হুড়মুড় করে এসেও সাড়ে চারটের আগে ঢুকতে পারলাম না বাড়িতে।
ঢুকেই ধমক।
“লেট করিস কেন ? চটপট কর, সাড়ে পাঁচটায় বালিগঞ্জ প্লেসে পৌঁছতে হবে আমাদের।”
তৈরি হতে আমার পনেরো মিনিট লাগল। কেন যাচ্ছি জানি না, সমাধানের কতদূর, সে সম্পর্কেও কোনও আইডিয়া নেই। আকিদার মাথা ঘুরে যাওয়ার পর থেকে আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছি না।
আকিদা বারবার ঘড়ি দেখছে। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটা বাজে, এত ঘড়ি দেখার কারণ বুঝতে পারছি না। বেশ শীত শীত করছে। আজ সন্ধে নেমেছে তাড়াতাড়ি, গরম জামা পরেও আসিনি। আজ গাড়ি-বারান্দায় লাল মারুতি আছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখলাম, মিশ্রির সঙ্গে কথা বলছে আকিদা।
শ্যামসুন্দরবাবু আমাদের দেখে ম্লান হাসলেন। আবার ঘড়ি দেখল আকিদা। পাশের ঘর থেকে আমাদের আওয়াজ পেয়ে অমিতবাবু এলেন এ ঘরে।
“ব্যাপার কী ?”
অমিতবাবুর গলায় ঠাট্টার সুরটা খট করে আমার কানে লাগল।
“তা, এগোলেন নাকি কিছু ভেবেটেবে ?”
“আজ কেমন আছ ভাই ?”
দুটো প্রশ্ন একসঙ্গে এল। আকিদা দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটাই আগে দিল, শ্যামসুন্দরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাল।”
“তারপর ?” বেশ মেজাজ নিয়েই বললেন অমিতবাবু, “ভাঙা হাতটা পেলেন নাকি ?”
আকিদার জবাবটাও এল বুলেটের মতো, ছোট্ট করে বলল, “হ্যাঁ, এই তো, এই যে।”
তাকিয়ে দেখলাম ওর ডান হাতে মার্কারির ভাঙা অংশ, তাতে একটা ছোট্ট পার্স।
অমিতবাবুর অবস্থাটা যে ঠিক কেমন সেটা লিখে বোঝানো অসম্ভব। উনি প্রশ্নটা করে বেশ একটা কিস্তিমাতের ভাব নিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন চেয়ারে, কিন্তু বসা আর হল না, দাঁড়িয়েই রইলেন। শ্যামসুন্দরবাবু উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য, বাবা-ছেলে দু’জনেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে।
“চেনেন তো ?” আকিদার গলা থমথমে পরিবেশটাকে ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পাওয়ার অনাবিল আনন্দ দেখতে পাচ্ছিলাম শ্যামসুন্দরবাবুর চোখে-মুখে। অমিতবাবুর মুখে অবাক হওয়ার সঙ্গে মিশে আছে বোকা বনে যাওয়ার ভাব।
আকিদা মার্কারির মূর্তির দিকে এগিয়ে গেল। ভাঙা অংশটা দিব্যি বসে গেল মার্কারির হাতে।
“ফেভিকল দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন,” বলল আকিদা, “চান্স আছে লেগে যাওয়ার।”
আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ম্যাজিক হল নাকি ?
ঘরের নিস্তব্ধ ভাবটা কেটে গেছে। সকলে একসঙ্গে কথা বলছেন। শ্যামসুন্দরবাবু জিজ্ঞেস করছেন, “তুমি পেলে কী করে এটা ?” অমিতবাবু আস্ফালন করছেন, “হাতটা কে দিল আপনাকে ? বলুন নামটা, এখনি ধরব তাকে গিয়ে।”
আকিদা কিছু বলার আগেই সিঁড়ি দিয়ে কারও উঠে আসার শব্দ পাওয়া গেল। যিনি উপরে উঠছেন তাঁর যে বেশ অসুবিধে হচ্ছে উঠতে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকতেই বুঝলাম, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছি। যিনি ঘরে ঢুকলেন, তিনি বিশাল ভুঁড়িওয়ালা এক অবাঙালি, তাঁর মাথাজোড়া টাক এবং মুখে বিজয়ীর হাসি।
“দেখো আমিত, তুমনে বুলায়া ঔর হম চলে আয়ে— হা হা হা।”
হিন্দি গানের সুরের নকল করে বেসুরো একটা গলা— যাঁকে বলা তিনি হাসা তো দূরের কথা, কথা বলার অবস্থাতেও নেই। হাঁ করে তাকিয়ে আছেন আগন্তুকের দিকে।
বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে অমিতবাবু বললেন, “তুমি এখানে ?”
“কিউ ?” ভুঁরু উঁচিয়ে বললেন আগন্তুক, “তুমার নতুন সেক্রেটারি হামকো ফোন করকে বোলা কি তুমি আমার সাথে সাড়ে পাঁচ বাজে মিট কোরবে। ইসি লিয়ে হম আ গয়ে।”
“আমার নতুন সেক্রেটারি !” আকাশ থেকে পড়লেন অমিতবাবু।
“আমি বলছি,” গম্ভীর গলায় বলল আকিদা। ও এখনও মার্কারির মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে, চোখ শ্যামসুন্দরবাবুর দিকে।
তাঁকে বলল, “আপনি কি জানেন, রমেশ কারনানির সঙ্গে প্রোমোটিং-এর ব্যবসায় নেমেছেন অমিতবাবু ?”
“কই না তো। জানি না।”
আকিদা কিছু বলার আগেই খুব অবাক হয়ে রমেশ কারনানি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমনে পিতাজিকো কুছ বতায়া নেহি ? তাজ্জব কী বাত।”
“আজ সকাল দশটা নাগাদ রমেশবাবুর অফিসে গিয়েছিলাম আমি। ওনার সঙ্গে আলাদা বসে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম আমি। তা ছাড়া মোটিভটা না জানলে অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না।”
“মানে ? কী ভেবেছ তুমি ?” এক ধাক্কায় আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলেন অমিতবাবু, “আমাকে অপরাধী বানাচ্ছ ? সাহস তো কম নয় তোমার ?”
অমিতবাবুকে অগ্রাহ্য করে বলে চলল আকিদা, “গিয়ে দেখি উনি আসেননি। তবে, রমেশজি অপেক্ষা করছেন ওঁর জন্য। সুযোগটাকে কাজে লাগালাম আমি। পরিচয় দিলাম অমিতবাবুর নতুন সেক্রেটারি হিসেবে, এবং জানতে পারলাম যে…”
“যে কী ?” শ্যামসুন্দরবাবুর গলা ব্যগ্র।
“রমেশজি আপনিই বলুন, অমিতবাবু কী বলেছিলেন আপনাকে ?”
“আমিত কহিয়েছিল কী যে, বাড়ি ভাঙার বেপারে উসকা লাস্ট অবস্টিকল, মানে বাধা—ইয়ানে কি উহার বাবাকে উ রাজি করিয়ে আনিয়েসে। হামি তো ফাইনাল টক করার জন্য আসিয়েছি। ফাদার কে ওয়াস্তে সহি করার কাগজ ভি আছে হমার কাছে।” গর্বের সঙ্গে শেষ করলেন রমেশ কারনানি। ঘরে সবাই চুপ।
“বাকিটা আমি বলি। অমিতবাবুর ব্যাবসা ভাল যাচ্ছিল না কিছুদিন ধরে।”
“ওর চিরকালই কোনও দিকে মন নেই,” আক্ষেপের সুর স্পষ্ট শ্যামসুন্দরবাবুর গলায়।
আবার শুরু করল আকিদা, “উনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন যে ডাইভার্সিফাই করতে চান, তবে কোন ফিল্ডে, সেটা বলেননি। এত বড় বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট বানাতে পারলে দু’পয়সা আসত ঠিকই, কিন্তু বাদ সাধলেন ওঁর বাবা। তিনি কিছুতেই এ বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। অমিতবাবু জানতেন যে মার্কারির মূর্তির সঙ্গে বাড়িটার ভালমন্দের যোগ আছে বলে মনে করেন ওঁর বাবা। এই অ্যাকিলিস হিলেই তাই আঘাতটা করলেন। উনিশ তারিখ রাতে ক্লাব থেকে ফিরে জাগুয়ারের হ্যান্ডেল দিয়ে…”
“টোটাল কক অ্যান্ড বুল স্টোরি। আগাগোড়া মিথ্যে। প্রমাণ করতে পারবে কিছু ?” চেঁচিয়ে উঠলেন অমিতবাবু।
“আমাদের জন্য চা আনার নাম করে সেদিন আপনি কোথায় গিয়েছিলেন বলবেন কি ?” বরফের মতো ঠান্ডা আকিদার গলা। “বোধহয় জানতেন না যে, আমাদের উপস্থিতি আপনার কাছে এতটা পীড়াদায়ক হয়ে উঠবে, তাই না ? তাই নিজের ঘর থেকে জাগুয়ারের হ্যান্ডেলটা বার করে আর কোনও জায়গা না পেয়ে লুকিয়ে রাখলেন মারুতিতে, ভাবলেন আমার চোখে পড়বে না ? আসলে আপনার উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুটো পাখি মারা, বাড়িটা ভাঙবেন আর গাড়িটাকে বিদায় করবেন। বেশ কয়েকদিন স্টার্ট না নিলেই গাড়িটা অকেজো হয়ে যাবে, তাই হ্যান্ডেলটা সরিয়ে রাখাই যথেষ্ট। কিন্তু…”
“আবার মিথ্যে বলছ তুমি। তোমাকে আমি…”
“মিশ্রিলাল,” আকিদা যে এত উঁচু গলায় কথা বলতে পারে, আমি জানতাম না। রমেশজিকেও দেখলাম আকিদার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন।
মাফলার জড়ানো মিশ্রিলাল এসে ঢুকল ঘরে।
“সেদিন অমিতবাবু আমাদের জন্য চা করতে বলেছিলেন তোমাকে ?” প্রশ্ন করল আকিদা।
“নেহি সাব, ম্যায়নে খুদ বনায়া,” জবাব দিল মিশ্রিলাল।
“আর উনিশ তারিখ রাতে তুমি কী শুনেছিলে বলবে আমাদের ?”
“হামি কুছু তোড়বার আওয়াজ শুনেছিলাম সাব। ফির ম্যায়নে দেখা কে বহুত দের তক ছোটবাবুর রুমমে বাত্তি জ্বলছিল।”
“কুড়ি তারিখে কমলা সময়মতো কাজে এসেছিল ?”
“জরুর সাব।”
“নির্দোষ কমলার ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছিলেন আপনি।” আকিদা ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রয়েছে অমিতবাবুর দিকে।
থপ করে একটা আওয়াজ, রমেশ কারনানি বসে পড়েছেন।
“তুমি এসো মিশ্রিলাল।” মিশ্রি আর এক দফা সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
রমেশজির দিকে ফিরল আকিদা। নরম গলায় বলল, “আপনি কি বুঝতে পারছেন যে, এই বাড়িটা ভাঙলে মার্কেটে আপনার গুডউইল নষ্ট হবে ? আপনি কি সেটা চান ?”
একটা কথাতেই খচমচ করে উঠে দাঁড়ালেন রমেশ কারনানি।
“আরে নেহি, নেহি। এক মকানকে লিয়ে মার্কেটমে কৌন আপনা নাম ডুবায়গা ভাই ? আমি তোবে…”
“হ্যাঁ, আসুন।” গৃহকর্তারা কিছু বলবার মতো অবস্থায় ছিলেন না বলে আকিদাই বিদায় দিল রমেশ কারনানিকে।
“অমিত কোথায় রেখেছিল ওটা ?”বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ খুললেন শ্যামসুন্দরবাবু।
“ইচ্ছে করলেই ওটা ফেলে দিতে পারতেন অমিতবাবু, তাতে অনেক ঝামেলা এড়ানো যেত। কিন্তু আপনার ছেলেও বিশ্বাস করেন আপনার মতো। বাড়িটার ভালমন্দের সঙ্গে মার্কারির মূর্তিটাকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন উনি নিজেও। তাই, ভাঙা হাতটা না ফেলে ওসিরিসের মূর্তির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন ওটা। ওসিরিস সম্পর্কিত প্রবাদ বলে, মৃত মানুষের মধ্যেও প্রাণসঞ্চার করতে পারেন এই দেবতা। আমার ধারণা, এই জমিতে নতুন বাড়ি তৈরি হওয়ার পর আবার মার্কারির হাত উনি নিজেই জোড়া লাগিয়ে দিতেন। উনি জানতেন, ওসিরিসের মূর্তিটা খোলা যায়।”
শ্যামসুন্দরবাবু যেন ঘুম থেকে উঠলেন, “আমিই বলেছিলাম। লন্ডন থেকে ওটা কেনার সময় মেমসাহেব দোকানদার আমায় দেখিয়েছিল, অমিতকে বলেছিলাম বটে, তবে আমার মনে ছিল না।”
“মারকিউরাস কিন্তু রোমানদের চোরের দেবতা। এটা জানলে বোধহয় অমিতবাবু এতটা ঝুঁকি নিতেন না।” আকিদার কথা মোটামুটি শেষ বলে মনে হল।
“তোমার যে এরকম অবনতি হবে, আমি ভাবিনি অমিত। ছিঃ !”
“বিশ্বাস করো বাবা, আমার মাথার ঠিক ছিল না।”
আমার হাতে আলতো টান মারল আকিদা, “চল, আর এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়।”
“উফ ! তুমি কেমন করে ধরলে বলো তো ?”
“বললেই বলবি ‘সিম্পল, এ তো আমিও পারতাম !”
“বলি তো বলব, তুমি বলোই না ?”
“মূর্তিগুলোর পাশে ধুলো পড়েছিল দেখেছিলি ? সেটার উপরে পড়া ছাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কেউ মার্কারি আর ওসিরিসের মূর্তি দুটো নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। মূর্তিগুলো দেখার সময় ওসিরিসের মূর্তিটা তুলেছিলাম একবার। তখনই লক্ষ করেছিলাম, ওই সাইজের কাঠের মূর্তির তুলনায় ওটা বেশ ভারী।”
“অমিতবাবুর দিকে তীরটা ঘোরালে কখন ?”
“প্রথম সন্দেহটা হয়েছিল ট্যারট্সের বইটা দেখে।”
“ট্যারট্স কী ?”
“তাসের তুকতাক। ওনার ঘরে একটা বই দেখিসনি তাসের ?”
“হ্যাঁ, ছিল তো টিভির পাশে।”
“যার ঘরে অন্য কোনও বই নেই, তার ঘরে যদি তাসের ম্যাজিকের বই থাকে, সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। তারপর মিশ্রির সঙ্গে কথা বলেই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হল।”
“ভাঙা অংশটা পেলে কেমন করে ?”
“অভিনয়টা খারাপ করি না তা হলে ? কি বলিস ?” কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে।
“তার মানে সেদিন তুমি অসুস্থ হওনি ?”
“আদৌ না। তোরা ঘর থেকে বেরোনো মাত্রই ওসিরিসের মূর্তির প্যাঁচ খুলে ভাঙা অংশটা পকেটে পুরে ফেলি। আসল কাজটা তো অমিতবাবুই করে রেখেছিলেন। না হলে কি আর সহজে খুলত অত পুরনো প্যাঁচ ? গতকালই গোটা ব্যাপারটা মিটে যেত বুঝলি ? আমি চেয়েছিলাম ওঁকে জেরা করেই সব কিছু বার করতে, তাই অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে রমেশ কারনানিকে পেয়ে যাওয়ায় আরও অনেকগুলো জট খুলে গেল।”
“আচ্ছা, উনি তা হলে নিজেই তোমাকে ডেকে পাঠালেন কেন ?”
“বাবাকে তো দেখাতে হবে যে ছেলে কিছু করছে। তা ছাড়া ফাঁপা সৌজন্যের একটা দাম আছে তো ?”
ভেবে দেখলাম যে, সত্যিই পুরো পারসপেক্টিভ অনুসারে সাজাতে পারিনি। একটা কথা ভেবে মনটা খচখচ করছিল। দোনামনা করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
“আচ্ছা, তোমাকে তো শ্যামসুন্দরবাবু কিছু দিলেনটিলেন না ?”
“মানে ?”
“মানে রিওয়ার্ড টিওয়ার্ড আর কী ?”
খুব নিচু গলায় আকিদা বলল, “সব সময় মেটিরিয়াল রিওয়ার্ড দিয়ে কিছু হয় না রে। আসল ব্যাপারটা হল মনের শান্তি। বড়হ,’ তারপর বুঝবি।”
বালিগঞ্জ প্লেস ইস্টের উপর দিয়ে যখন যাই, বেশ লাগে। পাশের দুটো বাড়ি ভেঙে মাল্টিস্টোরিড হচ্ছে। কিন্ত শ্যামসুন্দরবাবুর বাড়িটা আজও একইরকম আছে।
২০ এপ্রিল ২০০৩
অলংকরণ: দেবাশিস দেব