দেবতার চাবি – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

দেবতার চাবি – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

তাঁবুর ছায়ায় একলা বসে ছিলাম। বিকাল পাঁচটা হলেও নুবিয়ান মরুভূমিতে রোদের তেজ প্রচণ্ড। বাইরে আগুনের হলকা ছুটছে। দিন তিনেক হল এসেছি এখানে। সুদানের একদম উত্তর প্রান্তে এ মরুভূমি। শুষ্ক, প্রায় প্রাণহীন। কাঁটা ঝোপও চোখে পড়ে না। আমার যেখানে তাঁবু, তার চারপাশে কিছু দূরে বেশ কিছু প্রাচীন সৌধ আজও দাঁড়িয়ে আছে। আফ্রিকার প্রখর রৌদ্র, মরুভূমির প্রচণ্ড বালুঝড় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চেষ্টা চালিয়েও তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। পিরামিড। এক সময় এ অঞ্চল ছিল প্রাচীন মিশরের অন্তর্গত। তিন হাজার বছর আগে মিশরীয় সভ্যতার উষা লগ্নে সুদান মিশরীয়দের কাছে নুবিয়া নামে পরিচিত ছিল। ওই পিরামিডগুলি তাঁদেরই কীর্তি। গিজা এসনার মতো নুবিয়ান মরু অঞ্চলও ছিল মিশরীয়দের গোরস্থান। এ অঞ্চলের স্থানীয় নাম, ‘মৃতের নগরী’।

আমি অবশ্য কোনো ইতিহাসবিদ নই। কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজেও এখানে আসিনি আমি একজন জিয়োলজিস্ট। মুথাইয়া শ্রীনিবাসন, জন্মসূত্রে ভারতীয়। কর্মসূত্রে ‘রিপাবলিক অফ দ্য সুদান’ এর এক ভূতাত্ত্বিক গবেষণা সংস্থাতে কাজ করি। তাদের কাজেই আমি এ অঞ্চলে এসেছি কিছু ভূতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করার জন্য। অতি সরলভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, এখান থেকে কিছু নুড়ি, পাথর সংগ্রহ করে নিয়ে যাব আমি। এ জায়গার ভূতাত্ত্বিক গঠন বহু বছর ধরে পরিবর্তিত হয়েছে। 8000 বছর আগে এ অঞ্চলে ছিল ঘন বনভূমি ও জলাভূমি। বহু প্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র। আদিম মানবগোষ্ঠী এখানে পশুশিকার করতে আসত। তারপর একদিন প্রকৃতি তার রূপ বদলাতে শুরু করল। জলাভূমি, নদী এসব শুকিয়ে গেল। ধীরে ধীরে তৃণভূমি গাছপালা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে এ অঞ্চল পরিণত হল ঊষর মরুভূমিতে। তবে এ কাজ সম্পন্ন হয়ে যায় মিশরীয় সভ্যতা পত্তনের আগেই। এ অঞ্চলে কিছু গভীর প্রাকৃতিক কূপ বা কুয়ো আছে। যদিও তাতে জলের চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু এ সব কূপগাত্রের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে আছে ভূপ্রাকৃতিক বিবর্তনের নানা চিহ্ন। সেখান থেকেই তুলে আনা হচ্ছিল নুড়িপাথর।

‘তুলে আনা হচ্ছিল’ বললাম এই কারণে যে দুপুরের পর থেকে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। যারা কাজ করছিল তারা ফিরে গেছে। কাল রাতে একটা উল্কাপাত হয়েছে এখানে। আকাশ থেকে সোনালি পুচ্ছ সহ গোলাকার এক আগুনের বল নেমে আছড়ে পড়েছে কিছুদূরে একটা পিরামিডের পিছনে। রাত দশটা নাগাদের ঘটনা। তাঁবুর সামনে বসে আমি ও আমার সঙ্গীরা মেঘমুক্ত রাতের আকাশে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেছি ব্যাপারটা। উল্কা পতনের সঙ্গে সঙ্গেই মুহূর্ত্তের জন্য কেঁপে উঠেছিল পায়ের তলায় মাটিও। যদিও উল্কাপাতে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি, আমরা যাইওনি সে জায়গাতে, এবং ব্যাপারটা নেহাতই প্রাকৃতিক, কিন্তু এ ঘটনা প্রচণ্ড ভীতি সঞ্চার করেছে আমার মজুরদের মনে। ওরা অশিক্ষিত আফ্রিকান যাযাবর গোষ্ঠীর লোক। প্রচণ্ড কুসংস্কারগ্রস্ত। এমনিতেই এ জায়গা ‘মৃতের নগরী’ বলে প্রথমে ওরা এখানে আসতে চায়নি। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে ওদের কাজে এনেছিলাম। যাই হোক, কাজেও মন দিয়েছিল ওরা। কিন্তু উল্কাদর্শনের পরই আজ সকালে উঠে তারা বলল যে তারা এ তল্লাটে আর থাকবে না। উল্কাদর্শন নাকি মৃত্যু ডেকে আনে। তবুও বুঝিয়ে সুঝিয়ে সকালের দিকে তাদের কুয়োতে নুড়ি তুলতে নামিয়ে ছিলাম। কিন্তু কুয়োতে নেমে একজনের পাথুরে দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়ে মাথা ফেটে গেল। যদিও তার আঘাত মারাত্মক কিছু নয়, তবু তারা দুপুরবেলা কুয়ো থেকে উঠে এসে বলল, উল্কাদর্শনের কুফল ফলতে শুরু করেছে। সে কারণেই মাথা ফেটে এই রক্তপাত! তাদের গ্রামে ফিরতে হবে। সেখানে গিয়ে উল্কা দর্শনের দোষ খণ্ডন করার জন্য মরুগ্রামের জাদুকর ওঝার থেকে তাবিজ নিয়ে কাল ফিরবে তারা। আর ফেরার সময় আমার জন্যও একটা তাবিজ আনবে। কিছুতেই তাদের আর আটকে রাখতে পারলাম না। আমাকে ফেলে রেখে তারা চলে গেল।

তাঁবুতে বসে বসে ভাবছিলাম। কাল সকাল পর্যন্ত এই প্রাচীন মরুস্থানের মৃতদের নগরীতে আমি কাটাব কী করে? না, ভূতপ্রেত অপদেবতা বা উল্কা দর্শনের কুসংস্কারের ভয় আমার নেই। আমি বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। আমার ভাবনার অর্থ হল, একলা এতটা সময় আমি অতিবাহিত করব কী করে? সঙ্গে বইপত্তরও কিছু আনিনি। কোনো সঙ্গী পাওয়া গেলে অন্তত গল্প করে সময় কাটত। কিন্তু এখানে সঙ্গী পাওয়া যাবে কোথায়? সবচেয়ে কাছের মরু গ্রাম পঁচিশ মাইল দূরে। এ তিনদিনের মধ্যে জীবিত প্রাণী বলতে কালরাতে একটা মরুশিয়াল শুধু চোখে পড়েছে। উল্কাপাতের সময় সম্ভবত ভয় পেয়ে গর্ত ছেড়ে পালাচ্ছিল প্রাণীটা। মানুষ এখানে কই? কিন্তু এর পরই আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল একজন লোকের কথা। আজ সকালে তাকে আমি দূর থেকে দেখেছি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা নীল রঙের লম্বা আরবি পোশাক পরা একজন বেশ ঢ্যাঙা একটা লোক! যে কুয়োতে আমার লোকেরা কাজে নেমেছিল, তার কিছু দূরে একটা পিরামিডের সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে পিরামিড গাত্রে কী যেন দেখছিল লোকটা! গত তিনদিন আমাদের কাছাকাছি অন্য কোনো তাঁবু বা লোক চোখে পড়েনি। তাই কৌতূহলী হয়ে তার পরিচয় জানার জন্য তাকে ডাকব ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল পিরামিডের ভিতরে। আমার ধারণা লোকটা কোনো পুরাতত্ত্ববিদ অথবা ‘ইজিপ্টম্যানিয়াক’ হবে। দ্বিতীয়টার সম্ভবনাই বেশি। ‘মিশর ইতিহাসের ভূতগ্রস্ত লোক’ বা ‘ইজিপ্টম্যানিয়াক’রা এভাবেই একলা একলা দূরে বেড়ান প্রাচীর মিশরীয় সৌধগুলির আশেপাশে। কাজ করতে গিয়ে মিশর, লিবিয়াতে এ জাতীয় লোক আমি দেখেছি। ও লোকটাকে পেলেও দুদণ্ড গল্প করা যেত।

তাঁবুতে বসে লোকটার কথা মনে পড়ায় আমি ভাবছিলাম যে রোদের তাত কমলে একবার তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে খোঁজ করে দেখব যে আশেপাশে কোথাও লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা? সেও সম্ভবত একলা। আমাকে পেলে তারও গল্পগুজবে সময় কেটে যাবে।

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমি তাঁবুর কোণে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকা ছোটোছোটো নুড়ি পাথরগুলি পরীক্ষা করতে লাগলাম। আজকেই কুয়োর থেকে তোলা হয়েছে ওগুলি। কাদামাখা পাথরগুলির থেকে প্রয়োজনীয় নমুনাগুলি বেছে নিয়ে তা জলে ধূয়ে প্যাকেট বন্দি করতে হবে নিয়ে যাবার জন্য। অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের সিলিকা। কিছু লাইমস্টোনও আছে। তার গায়ে চিহ্ন আঁকা আছে উদ্ভিদের। এই ফসিলগুলি সাক্ষ্য দিচ্ছে, সুদূর অতীতে এই মরুভূমি একসময় সবুজ ছিল। পাথরগুলি ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা পাথর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। গোলকৃতি, ইঞ্চিতিনেক ব্যাসের চ্যাপটা পাথরটার চারপাশে কেমন যেন খাঁজ কাটা। কী সব অস্পষ্ট আঁকিবুকি আছে তার গায়ে। প্রাথমিক অবস্থায় আমি জিনিসটাকে কোনো মোলাস্কার ফসিল বলে ভেবেছিলাম। তাঁবুকে রাখা জল দিয়ে জিনিসটার গায়ের কাদামাটি ধুয়ে ফেলতেই সেটি দেখে আমি একটু বিস্মিত হলাম। ‘ফসিল-টসিল’ কিছু নয়, এটা আসলে একটা ধাতব চাকতি। চাকতির চারপাশে ত্রিভুজাকৃতির খাঁজ কাটা। আর সেই খাঁজগুলির সংযোগস্থলে বেশ কিছু দাগ কাটা আছে। দাগগুলি সম্ভবত কোনো পরিমাপ জ্ঞাপক চিহ্ন। চাকতির একপাশে মিশরীয়দের প্রাচীন প্রতীক ডানা অলা সূর্য ও অন্যপাশে স্ক্র্যাব বা গুবরে পোকার ছবি। এ ছবি দুটো দেখে জিনিসটায় যে অতি প্রাচীন তা বুঝতে অসুবিধা হল না। কিন্তু জিনিসটা আসলে কী? কোন যন্ত্রাংশ? ধাতুটাও কেমন সবুজাভ! আমার পরিচিত কোনো ধাতুর মতো নয়। চাকতিটা হাতে নিয়ে ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি। ঠিক এমন সময় বাইরে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে দেখি তাঁবুর দরজার ঠিক বাইরে বালির মধ্যে একটা মানুষের ছায়া এসে পড়েছে। তাহলে কি আমার মজুরদের মধ্যে কেউ মত পরিবর্তন করে ফিরে এল? আমি ছায়াটা দেখে উৎসাহিত হয়ে চাকতিটা আমার ব্রিচেসের পকেটে ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম।

2

বাইরে এসে আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। এ লোকটা আমার দলের কেউ নয়। আপাদমস্তক আরবি আলখাল্লাতে ঢাকা অন্য একজন লোক। মুহূর্তখানেক দেখার পরই তার দীর্ঘ আকৃতি দেখে চিনতে পেরে গেলাম তাকে। আরে এতো সেই আজ সকালে দেখা লোকটা! যার কথা কিছুক্ষণ আগে ভাবছিলাম আমি! লোকটার মুখমণ্ডলের প্রায় সবটাই নীল রঙের কাপড়ে আবৃত। শুধু উজ্জ্বল চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে। আমি তাকে কিছু বলার আগে সে নরম স্বরে বলল, ‘দেখলাম আপনার লোকজন সব চলে গেল! একা আছেন দেখে পরিচয় করতে এলাম।’

আমি জবাবে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিও আপনাকে সকালে দেখেছি। তা আপনিও এক একলা নাকি? ইতিহাসের খোঁজে এসেছেন?’ সে বলল, ‘তা অনেকটা ওই রকমই বলতে পারেন। আমার নাম ‘টি-রেক্স’। তবে নাম শুনে আবার আমাকে ডাইনোসর ভাববেন না। আপনি আমাকে রেক্স বলে ডাকতে পারেন।’ এই বলে সম্ভবত মুখের ঢাকার আড়ালে একটু হাসল লোকটা। আমিও একটু হেসে নিজের নাম, পরিচয় ব্যক্ত করে বললাম, ‘যাক, পরিচয় হয়ে ভালোই হল। তা দুজনেই যখন একলা তখন আপনার অসুবিধা না হলে চলুন একটু বসে গল্প করা যাক।’ রেক্স আমার কথায় সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে আমার তাঁবুর কাছেই একটা ছোট্ট বালির ঢিপি আঙুল তুলে দেখাল। ও জায়গাতে আমার লোকেরা বিশ্রামের জন্য ছাউনি টাঙিয়ে রেখেছিল। বেশ ছায়া আছে জায়গাটাতে। গরম বাতাসটাও কমে আসছে। সুতরাং তাঁবুতে আর না ঢুকে তার ইশারানুযায়ী দুজনে সেই বালির ঢিপির ওপর গিয়ে বসলাম।

সেখানে বসার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ; ‘আপনি কবে এসেছেন এখানে? কতদিন থাকবেন?’

সে জবাব দিল, ‘কালই এসেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরতে হবে আমাকে। কিন্তু যেটা খুঁজছি সেটা না পেলে…., কথাটা আর শেষ করল না সে।

লোকটার কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারছিলাম সে স্থানীয় অধিবাসী নয়। তার কথায় কোনো আরবি টান নেই। তাছাড়া মিশরীয় বা লিবিয়ানরা সাধারণত এত ঢ্যাঙা হয় না। রেক্সের জন্মস্থান জানার কৌতূহল হওয়াতে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কোন দেশের নাগরিক?’

রেক্স শুধু উত্তর দিল, ‘এক সময় এ দেশেরই ছিলাম।’ এই বলে সে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল কিছু দূরে বালিয়াড়ির মধ্যে জেগে থাকা সার সার পিরামিডের দিকে।

বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। রেক্স যেন পিরামিডগুলির দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে কী যেন ভাবছে!

আমি আবার তার সাথে কথোপকথনে ফিরে আসার জন্য তার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘এ জায়গাটা কেমন অদ্ভুত তাই না?

‘জনহীন মরুপ্রান্তরে রোদ ঝড় উপেক্ষা করে ওই পিরামিডগুলি হাজার হাজার বছর পরও কেমন মাথাতুলে দাঁড়িয়ে আছে।’

‘আধুনিক বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদেরও বিস্মিত করে এই সব স্থাপত্য। সেদিনের মানুষেরা কী কৌশলে যে…’

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রেক্স নামের লোকটা আঙুল তুলে পিরামিড সারির একটা পিরামিডের দিকে দেখিয়ে মৃদু হেসে যেন বলল ; ‘ওটা খেয়াল করেছেন?’

আমি তাকালাম সে দিকে। সূর্য এখন পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। তার বিদায় বেলার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে পিরামিডগুলির শীর্ষে। তার মধ্যে একটা পিরামিডের মাথা যেন স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। সূর্যালোক যেন পিরামিডের মাথার কয়েকটা ধাপকে ভেদ করতে পারছে। তবে কাচের মতো স্বচ্ছ দেখানো বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু নয়। ওই পিরামিডটাই দেখাচ্ছে রেক্স।

আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম ; ‘হ্যাঁ, খেয়াল করেছি। ওই পিরামিডের চুড়োটা সম্ভবত অ্যালাবাস্টার পাথরের তৈরি। তাই ওরকম আপাত স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। ওই পাথরে তৈরি বেশ কয়েকটা প্রাচীন মূর্তি আমি কায়রো মিউজিয়ামে বেড়াতে গিয়ে দেখেছি।’ এই বলে একটু থেমে আমি বললাম, ‘ফুঞ্জু যাযাবর উপজাতির আমার মজুর সর্দার গতকাল ওই পিরামিড দেখিয়ে বলছিল ওখানে নাকি ‘দেবতার কবর’ আছে! এক সময় নাকি নুবিয়ান মরুভূমিতে দেবতাদের কবর দেওয়া হত। মরুভূমির যাযাবররা বংশপরম্পরায় এ কাহিনি নাকি শুনে আসছে!’

আমার কথা শুনে রেক্স যে এবার স্পষ্ট হাসল তা বুঝতে পারলাম। সেই পিরামিডটার দিকে চোখ রেখেই সে বলল, ‘আপনি পিরামিড নিয়ে এখনকার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের বিস্মিত হবার কথা কী বলছিলেন?’

যদিও এ ব্যাপারে জ্ঞান আমার সীমিত, তবু তার প্রশ্নের জবাবে কিছু কথা বলার লোভ আমি সম্বরণ করতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আধুনিক প্রযুক্তিবিদদের কাছেও এগুলি বিস্ময়ের কারণ। ভাবুনতো একবার, সভ্যতার সেই সূচনাকালে সে দিনের মানুষরা কী ভাবে এ সব বিরাট বিরাট পিরামিড বানিয়েছিলেন? কী ভাবে এই সমকৌণিক পাথরগুলিকে গাণিতিক নিয়ম মেনে একটার ওপর একটা বসিয়ে পিরামিড রচনা করেছিলেন? তাঁদের সময়তো ক্রেন ছিল না, কী ভাবে তারা ভারী ভারী পাথরের ব্লককে অত উঁচুতে তুলেছিলেন? আমি একটা বইতে একবার পড়েছিলাম যে, গিজার গ্রেট পিরামিড তৈরির ব্যাপারে তার নির্মাণকাল ও শ্রমিক সংখ্যা ঐতিহাসিক হেরোড়োাটাসের বিবরণ সঠিক মানলে সেই হিসাব অনুযায়ী প্রতি দু-সেকেন্ডে এক একটা পাথরের ব্লক ওপরে তুলে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল! অনেকক্ষেত্রে যেখানে একএকটা পাথরের ওজন ছিল দশ টন! আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাছেও যা অসম্ভব, তা কোনো কৌশলে সম্ভব করেছিলেন প্রাচীন মিশরীয়রা? এ এক অমীমাংসিত রহস্য!’

আমি প্রযুক্তিবিদ নই, আমার স্বল্প জ্ঞানের মধ্যে আমি আর কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আগন্তুক বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, প্রাচীন স্থাপত্য বিদ্যা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম অমীমাংসিত আরও কয়েকটা রহস্যের কথা আমিও বলতে পারি। যেমন, পেরুর প্রাচীন ইনকা রাজধানী কুজকোর, সাকসাহুয়ামান দুর্গে বিশাল পাথরের ব্লকগুলোর সংযোগস্থল গলিয়ে জোড়া লাগানো হত কী ভাবে? যে ইনকারা চাকার ব্যবহার পর্যন্ত জানত না, তারা পাথর গলানোর মতো উত্তাপ সৃষ্টি কী ভাবে করত? কী ভাবে মেক্সিকোর বর্বর অ্যাজটেক অধিবাসীরা তাদের নরবলি দেবার বিশাল মন্দিরগুলি এমন নিখুঁত জ্যামিতিক জ্ঞানে আর স্থাপত্য কৌশলে বানিয়ে ছিল যে তাদের স্থাপত্যগুলি ভূমিকম্প নিরোধক! অথবা, মায়া সভ্যতার মানুষরা কীভাবে সৌরমণ্ডলীর গ্রহ নক্ষত্রর নিখুঁত অবস্থান নির্ণয় করে বানিয়েছিল তাদের বিখ্যাত ক্যালেন্ডার? ব্রুনো, গ্যালিলিও ইত্যাদি সভ্য পৃথিবীর মানুষের আগে কীভাবে মায়াজনজাতি জেনেছিল সূর্যকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ তত্ত্ব? কিংবা, ভারতবর্ষের মেহেরৌলির সেই লৌহস্তম্ভ! আধুনিক বিজ্ঞান ইস্পাত তৈরির বহু আগে প্রাচীন ভারতীয়রা কীভাবে সৃষ্টি করেছিল মরিচারোধী লৌহ?’ ইস্টার দ্বীপে সার সার হাজার টনের মানুষাকৃতি মূর্তিগুলিকেই বা কীভাবে মাটিতে প্রোথিত করেছিল আদিম মানুষরা?’ একটানা কথাগুলি বলে লোকটা হাসল। আমি তার কথা শুনে চমৎকৃত হয়ে বললাম, ‘বাঃ,. আপনি এ সব ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন দেখছি! তা আপনি কী ইতিহাসের এ রকম কোনো অমীমাংসিত রহস্যের খোঁজ করছেন এখানে?’

সে জবাব দিল, ‘খুঁজতে এসেছি ঠিকই। তবে কী খুঁজছি সেটা আমার জানা।’

আমি বললাম, ‘আপনার এ কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।’

রেক্স নামের লোকটা যেন আমার কথা যেন শুনতেই পেল না। চুপ করে তাকিয়ে রইল সেই স্বচ্ছ পিরামিডের মাথার দিকে।

সূর্য দ্রুত পশ্চিমে হাঁটতে শুরু করেছে। পিরামিডগুলির শীর্ষে তার লাল আভা। লোকটা আর কোনো কথা বলছে না। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে আছে সে। যেন তন্ময় হয়ে কী ভাবছে। এক সময় মনে হল সম্ভবত সে এবার উঠে দাঁড়াবে। হয়তো তার আর এখানে থাকতে বা আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমি তাকে আরও কিছুক্ষণ যদি ধরে রেখে গল্প করা যায় এই অছিলায় পকেট থেকে সিগারের বাক্সটা বার করে বললাম, ‘আপনি একটা সিগার খাবেন?’

রেক্স এবার আমার দিকে ফিরে তাকাল, আর তারপরই আমার হাতের দিকে তাকিয়েই তার দৃষ্টি কেমন পালটে গেল। আমি সিগারের বাক্সটা খুলতে যেতেই পার মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। সিগারের বাক্স এটা নয়, বেখেয়ালে পকেট হাতড়ে সেই সবুজ ধাতব চাকতিটা বার করে ফেলেছি! ভুলটা বুঝতে পেরে আমি আবার সেটা পকেটে রাখতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই বিস্মিত কণ্ঠে রেক্স বলে উঠল, ‘ওটা আপনি পেলেন কোথায়? সারা সকাল পিরামিডের ভিতর ওটাইতো খুঁজেছি আমি। যে কুলুঙ্গিতে ওটা থাকার কথা ছিল সেখানে খুঁজে পাইনি। আপনি কোথায় পেলেন ওটা?’

আমিও একটু বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, ‘এটা কী দুর্মূল্য কিছু? আমার লোকেরা আজ সকালে কূপের থেকে পাথরের টুকরোর সঙ্গে এটা তুলে এনেছে। আমিতো বুঝতেই পারছি না এটা কী?’

লোকটা আমার হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। উজ্জ্বল হযে উঠেছে তার চোখের তারা।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম ; কী এটা?’

সে এবার অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘এটা হল, ‘দেবতার চাবি।’

‘দেবতার চাবি মানে?’ জানতে চাইলাম আমি।

রেক্স জিনিসটা দেখতে দেখতে জবাব দিল, ‘এর অর্থ আপনি ঠিক বুঝবেন না। আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। এ জিনিসটা আমাকে দিতে হবে। আজই এখানকার কাজ শেষ হয়ে যাবে আমার। এটা নিয়ে আজ রাতে আমি প্রবেশ করব পিরামিডের অভ্যন্তরে। এই চাকতিটা আপনার কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু আমার কাছে এটা অনেক দামি।’ তার কথা শুনে আমি কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললাম। ‘ঠিক আছে, আপনাকে এটা আমি দিতে পারি। কিন্তু একটা শর্ত আছে। আপনার অভিযানের সঙ্গী হতে চাই আমি। তবে আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। পিরামিডের অভ্যন্তরে ধনরত্ন বা ওই জাতীয় কিছু পেলে, তাতে ভাগ বসাব না আমি। আমি শুধু দেখতে চাই আপনি এই চাকতিটা দিয়ে কী করেন?’

আমার প্রস্তাব শুনে কিছুক্ষণ কী যে ভাবল লোকটা। তারপর হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, চাকতিটা যখন আপনি খুঁজে পেয়েছেন তখন এ দাবি আপনি করতেই পারেন। এটা এখন আপনি আপনার কাছে রাখুন। মাঝ রাতে আমি আসব আপনার কাছে। আপনাকে নিয়ে যেতে?’—এই বলে জিনিসটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে লোকটা হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঢ্যাঙা দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল পিরামিডগুলির আড়ালে।

সে চলে যাবার পর আমি চাকতিটা বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পরও তার মর্মোদ্ধার করতে পারলাম মা। এরপরই সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার নামল মরুভূমিতে। ঠান্ডাও নামতে শুরু হল। মরুভূমির এই নিয়ম, দিনে যত গরম, রাতে তত ঠান্ডা। তাঁবুর বাইরে বসে আমি চিন্তা করতে লাগলাম। এই অদ্ভুত আগন্তুকের কথা। কীসের খোঁজে লোকটা প্রবেশ করতে চলেছে পিরামিডের অভ্যন্তরে? ধনরত্ন-টাকাকড়ি নাকি কোনো ফারাওর লুকানো মমির সন্ধানে? বেশ অনেকক্ষণ তার কথা ভাবার পর আমি তাঁবুর ভিতর প্রবেশ করলাম খাওয়া সেরে আমার সম্ভাব্য নৈশ অভিযানের প্রস্তুতির জন্য।

3

রাত ঠিক বারোটাতে সেই দীর্ঘ ছায়া আবার এসে পড়ল আমার তাঁবুর দরজায়। প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলাম। লোকটার পরনে সর্বাঙ্গ ঢাকা সেই একই পোশাক তবে তার সঙ্গে এবার একটা ছোটো মতো ধাতব বাক্স আছে। চাঁদের আলোতে বেশ রহস্যময় দেখাচ্ছে তাকে। সে বলল, ‘আপনি তৈরি?’ আর চাকতিটা সঙ্গে আছে তো?’

আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই সে ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলে বালির ওপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল। চাঁদের আলোতে উদ্ভাসিত চারদিকে অনেকদূর পর্যন্ত দৃশ্যমান। চাঁদ যেন আজ হাসছে। তার আলোতে দাঁড়িয়ে আছে সহস্র বছরের প্রাচীন সারসার পিরামিডগুলি। নুবিয়ান মরুভূমির মেঘমুক্ত আকাশে অগুনতি নক্ষত্ররাজি ঝিকমিক করছে। যেন কেউ এক রাশ হিরের কুঁচি ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। আমি লোকটার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আকাশটা কী সুন্দর তাই না? যখন আকাশের দিকে তাকাই তখন নিজেকে, এই পৃথিবীকে কত ক্ষুদ্র মনে হয়। কত অসীম এই মহাকাশ। কত অপার রহস্য লুকিয়ে আছে তার বুকে।’ আমার কথা শুনে চলতে চলতে লোকটা হাসল মনে হয়। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। যে ছায়াপথের মধ্যে পৃথিবীর অবস্থান সেই ছায়াপথে তারার সংখ্যা অন্তত দুশো কোটি। আর সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বলতে যা বোঝায় তাতে নক্ষত্রপুঞ্জের সংখ্যা দশ লক্ষ কোটি। আর গ্রহগুলি আবর্তিত হয় নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে। পৃথিবী থেকে মাত্র ‘ছ’ আলোকবর্ষ দূরে বার্নাড নক্ষত্ররও দুটো গ্রহ আছে। এই হিসাবে গ্রহর সংখ্যা নির্ণয় করতে হলে তাতে পৃথিবীর অবস্থান এই বালুকাময় প্রান্তরের একটা বালুকণার মতোই অতি নগণ্য। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষের জানার পরিধিতো আরও নগণ্য।’

তার কথা শুনে চমৎকৃত হয়ে আমি মন্তব্য করলাম, ‘আপনার অনেক বিষয়ে বেশ জানা আছে দেখছি!’

সে আমার কথায় কোনো মন্তব্য করল না। বাদ বাকি পথ নিশ্চুপ ভাবে অতিক্রম করে এক সময় আমাকে নিয়ে উপস্থিত হল সেই পিরামিডের সামনে। যার শীর্ষদেশ বিকালের সূর্যালোকে স্বচ্ছ বলে মনে হচ্ছিল। মরু উপজাতিরা যাকে বলে দেবতার কবর? পিরামিডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার আগের মুহূর্তের জন্য একবার থামল লোকটা। আমার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনার ভয় করছে নাতো? আজ রাতে এত বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী হবেন আপনি।’

আমরা প্রবেশ করলাম পিরামিডের অভ্যন্তরে। একটা বৈদ্যুতিক টর্চ জ্বালাল লোকটা। অন্ধকার পাথুরে সুঁড়ি পথ বেয়ে প্রথমে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম আমরা। বহু শতাব্দী সম্ভবত এখানে মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। শত শত বছরের জমাট ধুলো, মাকড়শার জাল সরিয়ে একের পর এক সংকীর্ণ অলিন্দ, সুঁড়িপথ ভাঙতে লাগলাম। মাঝে মাঝে আমাদের হাতের স্পর্শে খসে যাচ্ছে দেওয়ালের ধুলোর স্তর। তার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে প্রাচীন মিশরীয় দেবতাদের নানা চিত্র। অনুবিস, হ্যাথোর, খুনম, ওসিরিস ইত্যাদি নানা দেবতার প্রতিমূর্তি। টর্চের আলোতে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে তাদের দেহের সোনালি অলংকরণ। লোকটা কোনো কথা বলছে না। শুধু সে এগিয়ে চলছে। সে যে ভাবে এগিয়ে চলছে তাতে মনে হচ্ছে এ পথ যেন তার নখদর্পণে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন অন্ধকার সুঁড়ি পথ বেরিয়ে গেছে বিভিন্ন দিকে। তার মধ্যে পথ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে যেন এগোচ্ছে সে।

আমি চলতে চলতে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘এখানে কি এর আগে এসেছিলেন?’

সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, অনেক অনেক দিন আগে। যখন আমরা…।’ কথাটা শেষ করল না রেক্স।

পিরামিডের গোলকধাঁধা অতিক্রম করে এক সময় এসে উপস্থিত হলাম ভূগর্ভস্থ এক কক্ষে। তার চারপাশে নিরেট পাথুরে দেওয়াল। আমি বললাম, পথতো শেষ হয়ে গেল। এবার কোন দিকে যাবেন?’

সে জবাব দিল, ‘না পথ শেষ হয়নি। বলতে গেলে পথ শুরু হল এবার। পথ এবাব করে নেব আমরা।’

আমাকে নিয়ে একটা দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা, তারপর হাতের বাক্সট খুলল। ওমনি একটা বিপ বিপ শব্দ করে বাক্সর ভিতর কয়েকটা লাল নীল আলো জ্বলে উঠল। একটা ‘কি-বোর্ড’ আর বেশ কয়েকটা সুইচও রয়েছে তার মধ্যে। বাক্সটা যে একটা যন্ত্র তা বুঝতে অসুবিধা হল না আমার। বাক্সর আলোগুলি জ্বলে ওঠার পর লোকটা আঙুল ছোঁয়ালো কি-বোর্ডে। আর ওমনি নীল রঙের একটা আলোকরশ্মি বাক্সর থেকে নির্গত হয়ে একবার চক্রাকারে আবর্তিত হল দেওয়ালের একটা অংশে? আর কী আশ্চর্য। সঙ্গে সঙ্গে পাথরের দেওয়ালের ওই অংশটা খসে পড়ল। ঠিক কেউ যেন ছুরি দিয়ে মাখনের দেওয়াল থেকে একটা বৃত্তিকার অংশ কেটে নিল! ঘটনাটা দেখে আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘নীল আলোটা কী কোনো লেসার রশ্মি?’

সে জবাব দিল, ‘তা বলতে পারেন। তবে এ তরঙ্গ রশ্মির ক্ষমতা তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি।’

কাজ শেষ হবার পর আবার বাক্সটা বন্ধ করল লোকটা। তারপর দেওয়ালের সেই ফোকড় গোলে আমাকে নিয়ে প্রবেশ করল ওপাশে। সামনেই এক সিঁড়ি উঠে গেছে। আমরা সেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম।

ওপরে ওঠার যেন বিরাম নেই। মাথার ওপর ঢালু ছাদ। দু-পাশের দেওয়াল বহু বর্ণে চিত্রিত। কত রকমের জিনিস চিত্রিত আছে সেখানে। সে সব কিছু ভ্রূক্ষেপ না করে লোকটা আমাকে নিয়ে কেবল ওপরে উঠেই চলল। মাঝে মাঝে শুধু আমি যখন হাঁফ নেবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম, তখন মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াচ্ছিল। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওপরে ওঠার পর অবশেষে আমরা থামলাম। আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে খোদিত আছে আকাশদেব হোরাসের বিশাল এক ছবি। রেক্স দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আমরা পৌঁছে গেছি।’ তার কণ্ঠস্বরে একট চাপা উত্তেজনা।

আমি বললাম, ‘কোথায় পৌঁছেছি? এ দেওয়ালটাও লেসার বিম দিয়ে ভাঙবেন নাকি?’

সে বলল, ‘না। এই দেওয়াল ধাতব। কোনো লেসার বিম দিয়ে এ ধাতুকে ভাঙা বা কাটা যাবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমাও এ দেওয়াল ভাঙতে পারবে না। দিন, এবার আমাকে ওই চাবিটা দিন। ওটা ছাড়া এ দেওয়াল কেউ খুলতে পারবে না।’

আমি পকেট থেকে সেই চাকতিটা বার করে তার হাতে দিলাম। লোকটা চাবিটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল দেওয়ালে খোদিত হোরাস মূর্তির সামনে। টর্চের আলোতে আমার এবার মনে হল, চাকতিটা আর দেওয়ালটা যেন একই ধাতুর তৈরি। দেওয়ালের গায়েও একটা সবুজ ছটা আছে। হোরাস দেবের বুকের কাছে একটা খাঁজ কাটা জায়গা আছে। রেক্স চাকতিটা সেখানে বসাতেই খুব সুন্দবভাবে চাকতির দাঁতগুলি দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে বসে গেল। তারপর কম্বিনেশন লক যে ভাবে খোলা হয় রেক্স সে ভাবে দেওয়ালের খাঁজে ঘোরাতে লাগল সেটা! তাহলে চাকতিটা আসলে সত্যিই একটা চাবি!!

চাকতিটা ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একটা ধাতব শব্দ হল, আর তার পরই আকাশদেব দু-পাশে ভাগ হয়ে গেলেন। খুলে গেল একটা ছোট্ট ধাতব দরজা। রেক্স চাবিটা খুলে নিয়ে ইশারায় আমাকে অনুসরণ করতে বলল।

তার পিছনে দরজার ওপাশে প্রবেশ করলাম আমি। একটা ত্রিভুজাকৃতির ঘর। একটা হালকা আলোয় ঘরে আছে ঘরটা। ঘরের চারপাশে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ঘরটা যেন একটা এরোপ্লেনের ককপিট। নানা ধরনের বৈদ্যুতিক আধুনিক প্যানেল-যন্ত্রপাতি বসানো আছে ঘরটাতে। আর ঘরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে সেই সবুজাভ ধাতুর তৈরি বিরাট এক শবাধারের মতো বাক্স। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এ কোন জায়গাতে এলাম আমরা?’

রেক্স বলল, ‘দেওয়ালের কাছে যান, বুঝতে পারবেন।’

তার কথা শুনে দেওয়ালের কাছে যেতেই চমকে উঠলাম। অনেক ওপর থেকে বাইরের সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! চন্দ্রালোকিত মরুভূমি, আশেপাশের পিরামিড, মায় আমার তাঁবু পর্যন্ত! আকাশের চাঁদটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এ ঘরের আলোটা আসলে চাঁদেরই আলো!

রেক্স এবার বলল, ‘আপনি যে পিরামিডের মাথাটা অ্যালাবাস্টারের তৈরি ভেবেছিলে সেটা আসলে বিশেষ ধরনের ক্রিস্টালের তৈরি। যে প্রয়োজনে স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ দুই হতে পারে। এ এক কঠিনতম অ-ভঙ্গুর ক্রিস্টাল। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি সেই পিরামিডের শীর্ষদেশে’। কথাগুলি বলতে বলতে লোকটা গিয়ে উপস্থিত হল ঘরের মাঝে রাখা বাক্সর সামনে। তারপর তন্ময় হয়ে. তাকিয়ে রইল বাক্সটার দিকে। বাক্সর গায়েও খোদিত আছে একটা ডানা অলা হোরাস দেবের ছবি। তার বুকের কাছেও চাবি বসানোর খাঁজ। তার পিছনে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম। তার পর বললাম, ‘এ বাক্সতে কী রাখা আছে?’

রেক্স বলল, ‘দেখাব আপনাকে। এই বাক্সটার জন্যই তো আমার অতদূর থেকে এখানে আসা।’ এই বলে সে চাবিটা বাক্সর গায়ে লাগিয়ে ধীরে ধীরে ঘোরাতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান মাত্র। তারপরই ডালাটা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা হিমেল স্রোত যেন ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। আমার হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল তাতে। বাক্সর মধ্যে একটা শীতল কুয়াশার আবরণ ছিল সেটা সরে যেতেই রেক্সের সাথে আমিও ঝুঁকে পড়লাম বাক্সর ওপর। আর তার পরই হতবাক হয়ে গেলাম আমি। বাক্সর ভিতর একটা স্বচ্ছ ক্রিস্টালের আধারে শুয়ে আছে একজন। না, এ কোনো ন্যাকড়া জড়ানো, পোকায় কাটা, মাংসহীন হাড় সর্বস্ব মিশরীয় মমি নয়। যেন একজন সর্বাঙ্গ সুন্দর ঘুমন্ত মানুষ। তবে মানুষের সাথে তার একটা পার্থক্য আছে। তার কাঁধের দু-পাশ থেকে নেমে এসেছে সোনালি রঙের দুটো ডানা!! ডানা অলা মানুষ???

এত বিস্মিত আমি জীবনে কোনো দিন হইনি। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে আমি বলে উঠলাম, ‘এ কে?’

রেক্স শান্ত স্বরে বলল, ‘এ হল তাদেরই একজন, যারা সভ্যতার উষা লগ্নে ছায়াপথ অতিক্রম করে নেমে এসে ছিল পৃথিবীর মাটিতে। পৃথিবীর স্থানে স্থানে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে যারা প্রথম শিখিয়েছিল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশবিদ্যা। মানুষের চেয়ে অনেক বুদ্ধিসম্পন্ন যারা মানুষকে সাহায্য করেছিল গিজার পিরামিড, অ্যাজটেক মন্দির গড়তে, শিখিয়ে ছিল কী ভাবে তৈরি করতে হয় মায়া ক্যালেন্ডার অথবা মরিচাহীন ইস্পাত। ইতিহাসের আপনার সেই অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তরগুলি যাদের জানা ছিল, বিভিন্ন সভ্যতার পৌরাণিক গাথায় যাদের বর্ণনা করা হয়েছিল ‘দেবতা’ বলে, এ তাদেরই একজন। পৃথিবীতে কাজ শেষে আবার যদি পৃথিবীর কোনো প্রয়োজন হয়—এই ভেবে হিমায়িত অবস্থায় ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যাওয়া হয়েছে ওকে। পাঁচ হাজার বছর ধরে ঘুমচ্ছে ও। এবার ওর ফিরে যাবার সময় হয়েছে।’

রেক্সের কথা শুনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আমার মাথার ভিতরটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। ক্রিস্টালের ঘরের ভেতর শৈতপ্রবাহ ক্রমশই যেন বেড়ে চলছে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না ঠান্ডা। রেক্স এক সময় বলল, ‘চলুন এবার আপনাকে নীচে নামাই।’ রেক্সের পিছন পিছন তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো নীচে নামতে শুরু করলাম। যে পথে আমরা ওপরে উঠেছিলাম রেক্স কিছুটা সে পথে নেমে রশ্মি দিয়ে পাথর কেটে অন্যপথ বার করে বেশ দ্রুতই বাইরে বার করে আনল আমাকে।

পিরামিডের বাইরে চন্দ্রালোকিত বালু প্রান্তরে আমরা এসে দাঁড়ালাম। মাথার ওপর উন্মুক্ত আকাশে পূর্ণচন্দ্র আর ঝিকমিকে তারাগুলি যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমাকে নিয়ে কয়েক পা এগোবার পর দাঁড়িয়ে গেল রেক্স। তারপর আমার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনি এবার তাঁবুতে ফিরে যান। পিরামিডের মধ্যে যে ঘুমিয়ে আছে তাকে নিয়ে আমাকে অনেকটা পথ আমাকে পাড়ি দিতে হবে। আর আমাদের সাক্ষাতের স্মৃতি হিসাবে আপনি এটা রেখে দিন।’ এই বলে সে তার পোশাকের ভিতর থেকে বলের মতো একটা সবুজাভ ধাতুপিণ্ড বার করে তুলে দিল আমার হাতে। সম্ভবত এই ধাতু দিয়েই তৈরি সেই দেবতার চাবি। এরপর সে মৃদু হেসে বলল, ‘তাহলে চলি বন্ধু। আর আপনার সঙ্গীরা ফিরে এলে তাদের বলবেন, এখানে আর উল্কাপাত হবে না। আপনাকে বলি, ওটা আসলে উল্কা ছিল না।’ এই বলে পিছনে ফিরতে যাচ্ছিল রেক্স। আমি তার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘একটু দাঁড়ান। আপনার সঠিক পরিচয়টা? কোথায় ফিরে যাবেন আপনি?’

রেক্স থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার কথা শুনে। আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সে খসিয়ে ফেলল দেহের আলখাল্লা। আমি দেখলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক সুন্দর পুরুষ। আর তার কাঁধ থেকে নেমে এসেছে দুটো সোনালি ডানা! ঠিক সেই পিরামিডের কফিনে শায়িত মানুষটার মতো! চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে সেই দুটো পাখা! টি-রেক্স এরপর একবার মৃদু হাসল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, তারপর বিদায়ের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে এগোল পিরামিডের দিকে।

আমি ফিরে এলাম আমার তাঁবুর কাছে। বিস্ময়ের ঘোরে তখন আচ্ছন্ন আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি খেয়াল করলাম যে পিরামিডে আমি গেছিলাম তার শীর্ষদেশে নানা রঙের আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। একটা সার্চ লাইটের মতো ঘুর্ণায়মান তীব্র আলো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। সে আলো আমাকে, আমার তাঁবুকেও স্পর্শ করছে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পিরামিডের মাথাটা হঠাৎ সোনালি আলোতে ভরে উঠল। আর তার পরমুহূর্তের পিরামিডের উজ্জ্বল আভা যুক্ত মাথাটা ছিটকে আকাশে উঠে গেল। আমার পায়ের নীচের মাটি থরথর করে কেঁপে উঠল। একটা হিসহিস শব্দ করে সেই সোনালি ত্রিভুজ একবার পাক খেল মরুভূমির আকাশে, তারপর উল্কার গতিতে ধাবিত হল মহাশূন্যের দিকে। টি-রেক্স তার সঙ্গীকে নিয়ে যাত্রা করল হয়তো অন্য কোনো ছায়াপথে নিজেদের বাসস্থানে অথবা অন্য কোনো গ্রহে—যেখানকার অধিবাসীদের হয়তো উন্নত করে তুলবে তারা। আকাশের লক্ষ তারার মাঝে ক্রমশ অপসৃয়মান একটা আলোক বিন্দুর দিকে হাত নেড়ে আমি বললাম, ‘বিদায় বন্ধু।’

পুনশ্চ !—সপ্তাহ খানেক পর ‘সুদান ক্রনিকালে’ একটা খবর ছাপা হয়েছিল,—’শ্রীনিবাসন নামে এক ভারতীয় জিয়োলজিস্ট স্থানীয় এক সংস্থার হয়ে নুবিয়ান মরুভূমিতে ভূতাত্ত্বিক গবেষণার কাজে গিয়ে একটা কূপের মধ্যে একটা ধাতবপিণ্ড কুড়িয়ে পান। সেই ধাতবপিণ্ড তিনি পদার্থ বিজ্ঞানীদের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠালে তারা জানাচ্ছেন যে পৃথিবীর পরিচিত কোনো ধাতবখণ্ডর সাথে তার কোনো মিল নেই। আধুনিক বিজ্ঞান কোনোভাবেই অজানা মৌলে তৈরি এই ধাতুখণ্ডকে ভেদন বা ছেদন করতে পারছে না। যে দিন ওই ধাতুখণ্ডটি উদ্ধার হয় তার আগের দিন ওই অঞ্চলে উল্কাপাত হয়। বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা ওই উল্কার সাথেই বহির্বিশ্বের কোনো স্থান থেকে ধাতুখণ্ডটি পৃথিবীতে এসে পড়তে পারে। যিনি ওই ধাতব বলটি পেয়েছেন তাঁর ইচ্ছানুসারে বিজ্ঞানীরা ওই অজানা ধাতুর নামকরণ করেছেন, —’টি-রেক্স’। যদিও এই অদ্ভুত নামকরণ কেন তা আমাদের জানা নেই। ইত্যাদি, ইত্যাদি…।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *