পঞ্চম অধ্যায় – দেবতাদের সম্বন্ধে কবিদের রসিকতা ও কৌতুক
॥ ১ ॥
সত্যি কথা বলতে কি, কবিরা একেবারেই চাননি যে, তাঁদের দেবতারা আকাশের ইন্দ্রধনুর রঙ মেখে দেবত্বের দূরত্ব নিয়ে থাকুন। এমনকি যে সব দেবতাদের বেশ-বাস, ধরন-ধারন আলাদা, অর্থাৎ মানুষের থেকে আলাদা, তাঁদেরকে আমাদের কবিরা ঠারেঠারে রীতিমত সতর্ক করে দিয়েছেন। প্রাচীন কালের এক বিশিষ্ট কবি মজা করে শিবকে বলেছেন—
দেখ শিব! শুধুই মানুষের থেকে আলাদা দেখানোর জন্য তোমার যে এই বিলক্ষণ ঐশ্বরিক ভাবভঙ্গি— এগুলি তোমার জীবন থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা কর। কবি বলছেন— এই যে তুমি সারা গায়ে ভস্ম মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছ, তাতে কি লোকের চন্দন মাখার সখ চলে গেছে, নাকি সবাই চন্দন ছেড়ে ভস্ম মাখতে আরম্ভ করেছে? তুমি বাঘ-ছাল পর বলে ভদ্রলোকেরা কি সবাই দামী রেশমী কাপড় আর তেমন ভাল চোখে দেখছে না, নাকি সবাই তোমার দেখাদেখি বাঘছাল পরছে— কং ক্ষৌমং কলয়াঞ্চকার ন কৃতী কৃত্তিং বসানে ত্বয়ি? তুমি শিব, ধুতরো ফুলের গন্ধ তোমার খুব ভাল লাগে, কিন্তু মানুষ কি তাই বলে কেতকী ফুলের সুবাস নেওয়া বন্ধ করেছে, নাকি সবাই কেতকী ফুল বিদায় দিয়ে ধুতরো ফুল মাথায় নিয়ে নাচছে? দেখ, কেউ কোনটাই নেয়নি, তোমার ভস্ম, বাঘছাল, ধুতরো— কোনটাই নয়। তাই বলি কি প্রভু! শুধুমাত্র জনসমাজে বিলক্ষণ আলাদা দেখানোর জন্য তোমার যে ওই ঐশ্বরিক গুণগুলি, বিলক্ষণ ভস্ম, বাঘছাল, ধুতরো— এগুলি বাদ দাও, লোকে এমনিই তোমাকে মাথায় করে রাখবে— স্বাতন্ত্র্যাদ্ জহিহি ত্বমীশ্বরগুণান্ লোকো’স্তি তদ্বাহকঃ।
মানুষের সঙ্গে দেবতার সম্পর্ক বিশ্লেষণে এই শ্লোকটিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ওপরে দেওয়া শ্লোকটি নিশ্চয়ই কোন শিবভক্ত কবির লেখা। তিনি যদি কৃষ্ণভক্ত হতেন, তাহলে অবশ্যই কৃষ্ণকে উপদেশ দিতেন তাঁর মাথার ময়ূরপুচ্ছগুলি একটি একটি করে খসিয়ে ফেলে দিতে এবং এই অভিমানী কবির হাতে কৃষ্ণের বামে-হেলা চূড়া তথা কুঞ্চিতাধরে মোহন বাঁশীটিরও যে উচিত সদ্গতি হোতে— সে ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহ। একই গোত্রের অন্যতর কবির আক্ষেপ শুনে করালবদনা কালীকে তাঁর নরমুন্ডের মালাটি বিসর্জন দিতে হত এবং রক্তমাখা খড়গটি ভাসিয়ে দিতে হত গঙ্গায়। শুধুমাত্র স্নেহময়ী জননীর রূপ ছাড়া আর সবই মনে হত বেশি বেশি, বিলক্ষণ, ঐশ্বরিক। আসলে দ্বিধাটা আছে ভক্তপ্রাণের আকুল দ্বন্দ্বে। কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের মত আমরা ঈশ্বরের বিচিত্র বিশ্বরূপ না দেখা পর্যন্ত তাঁর মুখোদ্গীর্ণ জ্ঞান, যোগ ভক্তি— কিছুই বিশ্বাস করতে পারি না। অর্থাৎ কিনা আমাদের আপন বিশ্বাসের জন্যই একান্ত স্বারোপিত বিশ্বরূপ আমাদের দেখা চাইই। আবার সেই অনন্তবাহু, শশিসূর্যের চোখ-ওয়ালা বিরাট রূপ যদি কোনক্রমে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমরা অর্জনের মতই সবিশেষ ভীত-সন্ত্রস্ত হব। ঈশ্বরকে আমাদের অচেনা লাগবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস—বিশেষ বিশেষ দেবতার যে বিলক্ষণ রূপের বর্ণনা আছে, সেইরূপে যদি অন্ধকার রাত্রে তাঁদের দু-একজন আমার সামনে দেখা দেন, তাহলে আমার তো রীতিমত ভূতের ভয় লাগবে। যদি বা ভূতের ভয় নাও লাগে তো অর্জুনের মত আমার পালানোর রাস্তা খুঁজে পাওয়া ভার হবে— দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম— ওই রূপ দেখেই আমার ভয় করবে— ভয়েন চ প্রব্যথিতং মনো মে— আমি বলব— তুমি যেমনটি ছিলে বাপু মানুষের মত, তেমনটি হও। ভগবানও তখন মুচকি হেসে বাস্তবতা বুঝবেন। বুঝবেন যে, ঐশ্বরিক স্বতন্ত্রতা মানুষভক্তকে সব সময়ই বিচলিত করে। অতএব সময় বুঝে তিনিও মানুষের সামনে একেবারে সৌম্য মানুষের মূৰ্ত্তিতেই ধরা দেবেন— ভূত্বা পুনঃ সৌম্যবপুর্মহাত্মা।
তাহলে মানুষের ইচ্ছাতেই ভগবানের রূপকল্প। মানুষের বিশিষ্ট ইচ্ছাতেই শিব ভস্মমলিন কৃত্তিবাস, মানুষের ইচ্ছাতেই কালী নগ্না, করালবদনী। আমরা চৈতন্য-পার্ষদ গোপালভট্টের গল্প জানি। চৈতন্যদেবের কাছ থেকে তিনি নিত্যসেবার জন্য একখানি শালগ্রাম শিলা পেয়েছিলেন। গন্ডকী নদীর কীটদষ্ট ওই শালগ্রাম শিলায় যজ্ঞেশ, নারায়ণ, কৃষ্ণ, বিষ্ণু— যাঁরই অধিষ্ঠান থাক না কেন, গোলাকার, ভাবলেশহীন ওই শালগ্রাম মূর্ত্তিতে তাঁর মন ভরছিল না। সাধারণ প্রবাদেই তো গোলাকার শালগ্রামের ওঠা-বসা নিয়ে মজাদার ঠাট্টা আছে, অনেক মন্দবুদ্ধি ব্যক্তি নেতিবাচকভাবে বিভিন্ন শালগ্রাম দিয়ে বাটনা বাটার প্রস্তাবও করে বলেছেন— সব শিলাই শালগ্রাম হলে বাটনা বাটি কিসে? গোপালভট্ট হয়তো এতটা ভাবেননি, কিন্তু শালগ্রাম নিয়ে তাঁর ভালও লাগছিল না। শেষ পর্যন্ত মানুষ ভক্তের ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে শালগ্রাম ফুঁড়ে বেরোল কৃষ্ণের মানুষ মূৰ্ত্তি, সেই চিরাভ্যস্ত গোপবেশী বাঁশিওয়ালা।
কৃষ্ণ তো বহু বছর আগের ব্যাপার। মানুষের ইচ্ছায় স্বয়ং চৈতন্যদেবের কি অবস্থা হয়েছে কল্পনা করতে পারেন। সংসার ত্যাগের পর পুরীতে গম্ভীরার পরিবেশে তাঁকে আমরা কৌপীন-পরা, মাথা-ন্যাড়া সন্ন্যাসী হিসেবেই চিনি। অথচ এই কঠোর ত্যাগব্ৰতী মানুষটি শ্রীখন্ড সম্প্রদায়ে নরহরি সরকার কি লোচনানন্দের হাতে পড়ে একেবারে রসিক নাগরটি হয়ে ধরা দিয়েছেন। কৃষ্ণের মত চৈতন্যও এখানে নদীয়া-নাগরীদের মনচোরা। হ্যাঁ, এই গৌর-নাগরীভাবের দার্শনিক অথবা রসতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্য নদীয়ার সেরা সেরা সুন্দরীদের যৌবন-তরঙ্গে সাঁতার দিচ্ছেন অথবা “যে ঘরেতে সুন্দরী বৌ/ সেই ঘরেতেই” তিনি চুরি করছেন— এ ভাব একান্ত মানুষেরই তৈরী। অতএব যে যেমন দেখে, যে যেমন ভাবে, ঈশ্বরের রূপও তেমনি তেমনি প্রকটিত হয়। শিব, কৃষ্ণ, কালী— বিচিত্ররূপী প্রত্যেক ঈশ্বর-রূপেরই নিজের জগতের কবি আছে, যে কবি কখনও তাঁকে স্তুতি করে, কখনও বিপদে ফেলে, কখনও হাসায়, কখনও কাঁদায়, কখনও বা তাকে দিয়ে ঝগড়া করায় আবার কখনও কপট লীলায় ছলী পুরুষে পরিণত করে।
এক্ষেত্রে পুরাণ-ইতিহাসে বিশিষ্ট দেবতার বিশিষ্ট রূপ যা আছে, পরবর্ত্তী কবি সেইটুকুই মাত্র মেনে নেবেন, কিন্তু যেভাবে অথবা যে কাহিনী অনুসারে/সেই রূপ তৈরী হয়েছে, কবি তা নাও মানতে পারেন। অর্থাৎ পরবর্ত্তী কবিরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরাণোক্ত দেবতারূপের ‘বেয়ার আউটলাইন’গুলি মেনে নিয়েছেন, যেমন কালী নগ্না, কি শিব শ্মশানবাসী অথবা লক্ষ্মী চপলা— এইটুকুই। কিন্তু কেন কালী নগ্না, কেন শিব শ্মশানবাসী অথবা কেন লক্ষ্মী চপলা— এ বিষয়ে পরবর্ত্তী কবিদের নিজস্ব কল্পনা আছে। অর্থাৎ এইখানে তাঁরা পুরাণের কল্পকাহিনীর পরিসর থেকে সরে এসে দেবতাকে নিজস্ব কল্পনার জগতে বসিয়েছেন। এতে কবিতা কখনও অত্যন্ত রসসমৃদ্ধ হয়েছে, কখনও রসের বদলে রসাভাস হয়েছে, আবার কখনও ঠাট্টা-তামাশার চুড়ান্ত হয়ে দেবতাকে একেবারে মনুষ্যধর্মের সাধারণ পর্যায়ে নেমে যেতে হয়েছে, আবার কখনও এমন হয়েছে যাতে মনে হয়— কবি তো মন্দ লেখেননি, ভাবটা তো বেশ ভালই।
যেমন ধরুন— কালী নগ্না। কালী নগ্না কেন— সে সম্বন্ধে পুরাণ-কাহিনী যাই থাকুক না কেন, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এক সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার কালীর নগ্নতা সম্বন্ধে তাঁর আপন একটি অনুমান দিয়েছেন। তাঁর ধারণা— প্রতিদিন সকাল, বিকেল, দিন, রাত্রি-সব সময় এই সৃষ্টিরূপা জননী অসংখ্য সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন, ফলত দিনরাত্রির কোন মুহূর্ত্তেই তিনি আর গায়ে কাপড় রাখার সময় পান না— বস্ত্রাবরণসময়ং নৈব লভসে। কালীকে তাই সর্বদাই নগ্ন থাকতে হয়— ভব্যতা নগ্নত্বং ভগবতি ভবত্যেব। পুরাণগুলিতে বিশেষত মার্কণ্ডেয়চণ্ডী কালী মহামায়া চণ্ডীর স্বরূপ থেকে মসীবর্ণ কালোরূপ ধারণ করেছিলেন। তিনি নগ্না ‘নিমাংসা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা’। মুহুর্মুহু তিনি মদ্য পান করেন অসুর-বধের জন্য। কিন্তু কবির চোখে কোথায় চণ্ডী তাঁর চর্মকোষ পরিত্যাগ করে কালী হলেন, সেই তত্ত্বের ইতিহাস নেই। কবি নিজের জীবন ও জগতের অনুকরণে কাব্য রচনা করতে করতে বুঝতে পারেন—মায়ের আদুরে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে নিজের ফর্সা রঙ কালো করে ফেলছে। এর জন্য সংস্কৃতের কবিতায় যেতে হবে না, স্বয়ং ঈশ্বর গুপ্ত হিমালয়-ঘরণী মেনা-মায়ের মধ্যে বাঙালী-মায়ের মমতা মিশিয়ে লিখেছেন—
শিবের স্বভাব দেখিয়ে ভেবে ভেবে কালী হয়ে।
উমা আমার রাজার মেয়ে পাগলিনী অভিমানে।
সেজে বিপরীত সাজ বিরাজে ত্যজিয়ে লাজ।
কি শুনি দারুণ কাজ মাতিয়েছে সুধাপানে ॥
হতে পারে, এই শ্লোকের মধ্যে কোন রসিকতা নেই, আপাত চমকও কিছু নেই। কিন্তু কবি পুরাণকাহিনীতে বর্ণিত কালীর নগ্নতাটুকু মাত্র বজায় রেখে, তাঁর নিজস্ব অনুমানখন্ডে এসে পৌঁছেছেন। কথা হল— এই অনুমানই কিন্তু আস্তে আস্তে রসিকতার সঙ্গে চমৎকারিতার জন্ম দেয়, আবার এই অনুমানই রসিকতার সঙ্গে লঘুতার জন্ম দেয়। উদাহরণ দিয়ে একটু পরিস্কার করে বিষয়টা বোঝা যাক। মনুষ্য লোকে সাধারণ মানের মানুষেরা অনেকেই শ্বশুরবাড়ি যেতে ভালবাসে, অনেকে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেও ভালবাসে। বিশেষ করে দশমগ্রহের মত যেসব কুলীন জামাইরা একমাত্র কন্যারাশিতেই থাকতে ভালবাসেন, তাঁদের কাছে অসার সংসারে শ্বশুরমন্দিরই একমাত্র সার। কিন্তু কবি বলেছেন— মানুষের কথা ছেড়ে দাও— হিমালয় পর্বতের মেয়ে বিয়ে করে শিব যে চিরকালের মত হিমালয়ের কৈলাসেই থেকে গেলেন, আর সমুদ্রসুতা লক্ষ্মীকে বিয়ে করে ভগবান নারায়ণ যে চিরকালের মত সমুদ্রে শেষশয্যা বিছোলেন— সেটা কি শ্বশুরবাড়ির রসে নয়? অতএব একথা ঠিকই যে— অসারে খলু সংসারে সারং শ্বশুরমন্দিরম্।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল— শিব কৈলাসে থাকেন— আমরা জানতাম ; আমরা জানতাম নারায়ণ সমুদ্রে অনন্তশয্যায় শুয়ে থাকেন। কিন্তু কবি এখানে পুরাণ-কাহিনী থেকে একটি রৈখিক বস্তুমাত্র সংগ্রহ করে হরি, হর-দুজনকেই ফেলে দিয়েছেন। শ্বশুর-গৃহামাদী কলঙ্কী জামাতার ছাঁচে। এতে তিনি হরি-হরকে লঘু করলেন, নাকি শ্বশুর গৃহের পক্ষপাতী জামাইদের খানিকটা যৌক্তিকতায় স্থাপন করলেন— সেটা সহৃদয় পাঠকেরা বুঝে নেবেন। কিন্তু এই রসিকতায় হরি-হর-কারোরই যে সম্মান খুব লঘু হয়ে গেছে, তা আমরা মনে করি না। আমাদের ভয়—দেবতার পৌরাণিক রূপকল্প থেকে স্বাধীনতা নিয়ে পরবর্তী কবিরা আরও কি না বলেন। আমাদের পরবর্তী উদাহরণ থেকে বুঝতে পারবেন— পুরাণ-পিতামহেরা কি পরিমাণ প্রশ্রয় দিলে তাঁদের পৌত্রকল্প কবিরা দেবতাদের সঙ্গে সস্তা ঠাট্টা-মস্করায় মেতে উঠতে পারেন। রসের চমৎকারিতা থেকে রসিকতা, রসিকতা থেকে একেবারে রসোদগার।
মহাদেব শিব। ইতিহাস-পুরাণে তাঁর পাঁচ-দশটা নাম আছে। তাঁর চেহারাটাও কল্পনা করা আছে বড় মোটা দাগে। শিবের চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং তাঁর নামগুলিকে শ্লেষ করে কবিরা শিব-পার্বতীকে দিয়ে কিরকম মানুষের মত ঝগড়া করিয়েছেন দেখুন। হ্যাঁ, পুরাণগুলিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিব এবং পার্বতীর ঝগড়াঝাঁটি মাঝে মাঝেই আছে বটে। তা ঝগড়াঝাঁটি হলে মাঝে মাঝে রুষ্টা স্ত্রী ইচ্ছে করে স্বামীকে না চিনতেও পারেন, না পুঁছতেও পারেন। কিন্তু এই সুযোগ কবি কাজে লাগিয়েছেন স্রেফ শিবের নামগুলিকে শ্লেষ করে। কবির দৃষ্টিতে শিব এসেছেন রুষ্টা পার্বতীর কাছে। শিবকে দেখা মাত্রই পার্বতী বললেন— কে হে তুমি! শিব বললেন— আমি শূলী শম্ভু। শূলী বলতে যে ত্রিশূলধারী বোঝায়— এটা কে না জানে! কিন্তু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে শূল বলতে ব্যথা-বেদনা বোঝায়, যেমন দন্তশূল, পিত্তশূল, অম্লশূল ইত্যাদি। আর সোজাসুজি বাংলায় শূলবেদনা বলতে আমরা বুঝি— ভয়ংকর রকমের পেটব্যথা, এবং যে রোগীর এই পেটব্যথা আছে, তাকে আমরা শূলী বলে চিহ্নিত করতে পারি। পার্বতী শূলী শব্দের এই অর্থ বুঝে— (অর্থাৎ ইচ্ছে করেই এই অর্থ বুঝে) বললেন— আহা, তুমি শূলবেদনার রুগী? তা আমি কি করব! ডাক্তার-বদ্যি দেখাও— মৃগয় ভিষজম্। শিব ভাবলেন পার্বতী বুঝি ‘শূলী’ নামটা বুঝতে পারছেন না। বললেন— তুমি আমায় চিনতে পারছ না প্রিয়ে, আমি নীলকণ্ঠ। সমুদ্রমন্থনের সময় বিষ খেয়ে শিব নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন। অবুঝের মত উল্টে নীলকণ্ঠ মানে সোজা অর্থে ময়ূর বুঝে পার্বতী বললেন— ও, তুমি নীলকণ্ঠ ময়ূর! একবার কেকাধ্বনি করতে দেখি। শিব দেখলেন— বড়ই ঝামেলা, তিনি কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না তিনি কে। শিব এবার আরও বেশি পরিচিত একটি নাম উল্লেখ করে বললেন— হ্যাঁ গো! আমি পশুপতি। পার্বতী সবিস্ময়ে বললেন— পশুপতি! তা বেশ তো, কিন্তু তোমার দাঁতজোড়া কোথায় গেল? আসলে পশুপতি বলতে হাতী কিংবা বন্য শুয়োরও বোঝায় এবং তাদের দাঁত থাকে। শিব বললেন—না, না, আমি স্থাণু। স্থাণু শব্দের একটি অর্থ গাছ কিংবা কোন স্থির পদার্থ। পার্বতী বললেন— গাছ কি এ রকম চলাফেরা করে নাকি? শিব এবার কোন উপায় না দেখে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করে বললেন— আমি যে শিবার প্রাণের প্রাণ প্রাণারাম— শিব, আমায় চিনতে পারছ না— জীবিতেশং শিবায়াঃ? পার্বতী তবু শিবের নামে শিবানী হতে চাইলেন না। হায়! পার্বতী আপাতত ‘শিবা’ শব্দের অর্থ শেয়াল ধরে বললেন— শৃগালিনীর প্রাণসখা! তুমি বনে যাও, সেটিই তোমার উপযুক্ত স্থান। কবি লিখেছেন— এই যে পার্বতীর কথায় শিব একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন, এই থতমত খাওয়া হতবাক শিব তোমাদের রক্ষা করুন।
ঠিক এইসব জায়গায় কবিদের আসল ইচ্ছেটা বোঝা যায়। তাঁরা দেবতার আশীর্বাদও চান, আবার থতমত ভাবটিও চান। চৈতন্যস্বরূপ এক চরম দার্শনিক তত্ত্বকে স্ত্রীর কাছে একেবারে থতমত খাওয়াতে না পারলে কবিদের ভাল লাগে না। অনুরূপ অন্য একটি শ্লোকে পুরাণ-পুরুষ, বিভূতিযোগী কৃষ্ণকে বৃন্দাবনবিলাসিনী রাধার মুখ দিয়ে বাঁদর থেকে আরম্ভ করে ভ্রমর — কি-ই না বলা হয়েছে। সমস্ত জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কর্তা বলে, সংসার-মহীরুহের বীজ বলে তাঁরা যে গৃহিণীর কাছে মুখঝামটা খাবেন না—তা কবিরা সহ্য করবেন না। সংসার জীবনের শতেক ঝকমারি যদি কবিদের সইতে হয়ে থাকে, তবে তা শিব, কৃষ্ণ, রাম—সবাইকেই সইতে হবে। বিয়ের আগে যে যুবক পুরুষ ‘বোহেমিয়ান’ জীবন যাপন করত, তাকে যদি বউয়ের পাল্লায় পড়ে সংসারের মাপজোক করা আদব কায়দা শিখতে হয়, তো শিবকেও তা শিখতে হবে— কৃষ্ণকেও তা শিখতে হবে। ফলত দিগম্বর শিবকে দিগ্বাস ছেড়ে দিয়ে বিয়ের পর ভাল জামাকাপড় পরতে হয়েছে—উজ্ঝিত্বা দিশমম্বরং বরতরং বাসো বসানশ্চিরং। বিয়ের আগে শ্মশানে মশানে, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ ছিল শিবের, কিন্তু এখন তাঁকে থিতু হতে হয়েছে শ্বশুরের দেওয়া ভিটেতে—কৈলাসে। পার্বতীর পাল্লায় পড়ে শেষ পর্যন্ত ভস্ম মাখা ছেড়ে দিয়ে শিবকে আজকাল একটু-আধটু স্নো-পমেটমও মাখতে হয়—তত্তৃা ভস্ম কৃতাঙ্গরাগনিচয়ঃ। হিমালয়ের মেয়েকে বিয়ে করার পর থেকে শিবের জীবনে এই যে একটা বাঁধা-ধরা ভাব এল, এই যে তিনি আর যা ইচ্ছে তাই করতে পারছেন না—এই সংসার বাঁধনের জাঁতাকলে পড়া গৃহস্থ শিবকে কবির ভাল লাগছে—হিমাদ্রিজাপরিণয়ং কৃত্বা গৃহস্থঃ শিব।
আমরা বেশ জানি—যে কবি এতকাল ছাড়া-ছাড়া, জীবনে বসন্তের হাওয়া গায়ে মেখে, চাঁদের জ্যোৎস্না খেয়ে, ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁকে যদি সংসার-গৃহের কর্তা হয়ে বউয়ের কাছে মুখঝামটা খেতে হয়, কি বউয়ের পাল্লায় পড়ে সাজ বদল করতে হয়, তাহলে তিনি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকেও যে স্ত্রীর কাছে মুখঝামটা খাওয়াবেন কিংবা তাঁর কপাল খারাপ করে দেবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি! আমাদের ঠাকুরেরা তাতে রাগ করেন না।
আর রাগ করবেনই বা কেন? সবই কপাল। মানুষেরও কপাল, ভগবানেরও কপাল। কপাল দোষে ভগবানের খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত মানুষের মত হয়ে গেছে। এই যে রামচন্দ্র অথবা মহামতি কৃষ্ণ—এঁরা মধুর ক্ষত্রিয় জন্ম লাভ করে সেকালের বহু পাঁঠা-শুয়োর (আবিকবারাহৈঃ) হজম করেছেন। কিন্তু তারপর চৈতন্যদেব কৃষ্ণভক্তদের জন্য নিরামিষ বৈষ্ণব মত প্রচার করলেন, এবং তার প্রভাব এত গভীর হল যে, কৃষ্ণ-রামেরা যে কোনকালে মাছ-মাংস খেতেন—সে কথা শুনলেও লোকে ওঁ বিষ্ণু বলে কানে হাত দেয়। অবশ্য চৈতন্যকে দোষ দিলে হবে না শুধু, তাঁর আমলে অবস্থা খারাপ হয়েছে মাত্র, রাম-কৃষ্ণের আমিষ খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বহুকাল। কোথাও তাঁদের পূর্ব-খাদ্যাভ্যাসের নমুনা স্মরণ করে পাঁঠা-শুয়োরের ভোগ নিবেদিত হয় না। ঘোর আমিষাশী ভগবানদের যদি নিরামিষাশী মানুষের পাল্লায় পড়ে শাক-শুকতো খেয়ে জীবন কাটাতে হয়, তাহলে তাঁদের যে বউয়ের কাছে মুখঝামটা খেতে হবে, শুয়োর-বাঁদরের সম্বোধন শুনতে হবে তাতে আর আশ্চর্য কি?
সংস্কৃতের কবি তাই ঠাকুর-দেবতার অবস্থা দেখে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন—প্রণাম যদি করতেই হয় তো বাপু কপালকে প্রণাম কর, কর্মের ফেরকে নমস্কার কর—তস্যৈ নমঃ কর্মণে। কেন, তেত্রিশ কোটি শক্তিমান শক্তিমতী ঠাকুর-দেবতা ছেড়ে কর্মকে নমস্কার কেন? কবি বলেছেন—বেচারা কুমোর যেমন কপালের ফেরে দিনরাত হাঁড়ি-কলসীর মাথা-মুণ্ডু জোড়া দিয়ে দিয়েই জীবন কাটাল, তেমনি ওই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকেও কপালদোষে দিনরাত ব্ৰহ্মাণ্ডভাণ্ডের বিধি-ব্যবস্থা করতে করতেই জীবন কাটাতে হচ্ছে। আর স্বয়ং বিষ্ণু, যিনি দেবতাদের দেবতা বলে বিখ্যাত, তাঁকে কিনা দশ দশটা অবতার হওয়ার ঝামেলায় পড়ে একবার মাছ হতে হচ্ছে, একবার শুয়োর হতে হয়েছে আর সেই অবস্থায় পড়েও তাঁকে কিই না করতে হয়েছে। শিবের কথা আর বলতে নেই। রুদ্র শিব! কপালের ফেরে তাঁকে ভিক্ষাপাত্র হাতে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াতে হয়েছে—রুদ্ৰো যেন কপালপাণিপুটকে ভিক্ষাটনং কারিতঃ—কাজেই প্রণাম যদি করতেই হয়, তাহলে আর এই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে নয়, প্রণাম কর কপালকে, প্রণাম কর কর্মকে—তস্মৈ নমঃ কর্মণে।
দেবতাদের যে সবাইকে কর্মের ফের সহ্য করতে হয়—এ কথা শাস্ত্রযুক্তির বাইরে নয়। ভগবদ্গীতা থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন পুরাণে আমরা দেখব যে, দেবতারা মানুষের মতই কমধিীন। এমনকি তাঁরা কেউ অমরও নন। পুরাণকারেরা লক্ষ করেছেন—প্রলয়ের সময় নিজেদের অন্তকালের কথা ভেবে-বুধ্বা পর্যায়মাত্মনঃ—দেবতারা মানুষের মতই সবিশেষ ব্যাকুল হন। এমন মনুষ্যধর্ম চিহ্নিত দেবতাদের মানুষের মতই যে কপালের দোষ সহ্য করতে হবে—তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। কবি তো দেবতাদের মুখের ওপর একেবারে দৃষ্টান্ত দিয়ে বলে দিয়েছেন—দেখ বাপু! বিদ্যে-বুদ্ধিই বল আর পেশীর জোরই বল, কপালে না থাকলে, কোনটাই কামে লাগবে না। এই যে এত বড় সমুদ্র মন্থন হয়ে গেল, তাতে কত রত্ন, মণি-মাণিক্য উঠল। তাতে কপাল দেখ—ভগবান শ্রীহরি পেলেন ভুবনমোহিনী লক্ষ্মীকে আর ভগবান মহেশ্বরের কপালে জুটল বিষ—সমুদ্রমন্থনাল্লেভে হরি র্লক্ষ্মীং হরো বিষম্।
একথা অবশ্য ঠিক যে, আমরা যে কবিতাগুলি উল্লেখ করছি, এগুলি কোন বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থের বিশিষ্ট কবিতা নয়। হাজারও কবির ব্যক্তিগত জীবনের অনুভূতি এই কবিতাগুলি। ফলে যে কবির যে অভিজ্ঞতা, তারই ছায়াপাত ঘটেছে দেবচরিত্রের ওপর। হতে পারে—যে কবি দেবতাদের কর্মবিপাকে বন্ধন করেছেন, তিনি নিজেও ভাগ্যহত। কিন্তু তাঁর ভাগ্যবিড়ম্বনার ছায়া যখন দেবতার ভাগ্যে বর্তায়, দেবতাও সেই মুহূর্তে চরম মনুষ্য পদবী লাভ করেন। শুধু মনুষ্য কেন, কবি বলেছেন—বিদ্যেবুদ্ধি দিয়েই যদি সব হত, তাহলে গণ্ডকীর শালগ্রাম কিংবা নর্মদার বাণেশ্বর শিব—এই দুটো পাথর কোনদিনই দেবতা হতে পারতেন না—পাষাণস্য কুতে বিদ্যা যেন দেবত্বমাগতঃ।
আমাদের মতে—এই রকম ভাগ্যহত কবির বর্ণনা, দাম্পত্যজীবনে আহত কবির বণনা, অথবা রঙ্গপ্রিয় কবির বর্ণনাই শেষ পর্যন্ত শিবকে ‘বোম্ ভোলানাথ’ বানিয়েছে, দুগাকে ‘রণচণ্ডী’ বানিয়েছে, কৃষ্ণকে ‘কলির কেষ্ট বানিয়েছে, অথবা গণেশকে ‘গোবর-গণেশ’ বানিয়েছে। সবই কপাল।
॥ ২ ॥
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। সেটা হল—কর্ম বলতে যে শুধু—এই কর্ম করেছি, তার এই ফল হল—তা ভাববেন না। কারণ, বায়ু পুরাণের মত প্রাচীন পুরাণ বলেছে—কেউ পুরুষকারকে কর্ম বলেন, কেউ দৈবকেও কর্ম বলেন, এমনকি নিজ নিজ স্বভাবকেও অনেকে কর্ম বলে থাকেন—
কেচিৎ পুরুষকারন্তু প্ৰাহুঃ কর্ম চ মানবাঃ।
দৈবম্ ইত্যপরে বিপ্রাঃ স্বভাবং দৈবচিন্তকাঃ।।
এই নিরিখে দেখতে গেলে দেবতাদের নানা ক্রিয়াকর্ম এবং তাঁদের স্বভাবও একটা বড় ব্যাপার, যে কারণে অনেক দেবতাই অনেক সময় হাস্যাস্পদ হয়ে গেছেন, এবং তার অবধারিত ফল কবিদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অবশেষে প্রবাদ। আগেই বলেছি ব্যাপারটা ঘটে দুটি কল্পে। প্রথমে পরম শ্রদ্ধেয় দেবতার নানা ক্রিয়াকলাপ এবং স্বভাব দেখে তাঁর ওপর মানুষের রূপ, গুণ, বৈশিষ্ট্য আরোপিত হতে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে তাঁকে একেবারে মনুষ্যায়ণের চূড়ান্ত করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানে প্রথম পোঁচটি লাগান পৌরাণিকেরা, দ্বিতীয় পোঁচটি লাগান কবিরা এবং তৃতীয় পোঁচ লাগায় সাধারণ লোকেরা, যারা প্রবাদ তৈরী করে।
এই যে আমাদের সিদ্ধিদাতা গণেশ, যাঁর মাথাটি হাতির মত বলে নানা পুরাকাহিনী আছে, কিন্তু সেটাই তো সব নয়। লক্ষণীয় বিষয় হল—যে শিব-পার্বতীর ক্ষণিকের স্মিতহাস্যে পুত্ৰহীনের পুত্র হয়, ধনহীনের ধনলাভ হয়, পৌরাণিকেরা মনুষ্যায়ণের তাগিদে সেই শিব-পার্বতীকে বহু বৎসর অপুত্রক রেখে দিয়েছেন। আবার কোন পুরাণ যদি বা এই পুত্রহীনতার জন্য পার্বতীকে দিয়ে ‘পুত্ৰক ব্রত’ পালন করিয়েছেন, তো অন্য পুরাণকারেরা একেবারে আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদের মত পুত্রহীনা পার্বতীকে দিয়ে দিনের পর দিন পুতুল-খেলা করিয়েছেন। সেই পুতুলই এক সময় শিব কিংবা পার্বতীর ইচ্ছেতে সঞ্জীবিত হয়েছে পার্বতীর পুত্ররূপে। কবির সকৌতুক কটাক্ষ নিয়ে বাপ ছাড়া, মা ছাড়াই—বিনাপি তাতেন বিনা জনন্যা—গণপতি গণেশ শিবের ছেলে হয়ে পার্বতীর কোল আলো করে বসলেন। ছেলে হলে মনুষ্যসমাজে আত্মীয়স্বজন যেমন দেখতে আসে, তেমনি গণেশকেও দেখতে এসেছেন আত্মীয় দেবতারা। ক্রূগ্রহ শনি নাকি আপন কুদৃষ্টির জন্য গণেশকে দেখতে চাননি, কিন্তু সুকুমার পুত্রটিকে কোন জননীর না দেখাতে ইচ্ছে করে! পার্বতীর পীড়াপীড়িতেই শনি শেষ পর্যন্ত তাঁর ছেলের মুখের দিকে তাকালেন, অমনি গণেশের মুখ খসে পড়ল। শেষে হাতির মাথা ছেলের গলায় সেলাই করে কোনরকমে ছেলেকে বাঁচালেন পার্বতী। কিন্তু অশেষশক্তিরূপিণী এই দেবী বহুজনের হিতসাধন করলেও মনুষ্যায়ণের তাগিদে কোন দৈব বিভূতি দেখিয়ে ঝ্যাং করে পুত্রের মুখ গজানোর চেষ্টা করেননি। সুবিখ্যাত দাদাঠাকুর আরও একটু কটাক্ষ করে বোধ হয় বলেছিলেন— যে ঠাকুর নিজের ছেলের মুখ ঠিক করতে পারে না, সে পরের ছেলের অসুখ সারাবে কি করে?
আমরা অবশ্য এতদূর যেতে চাই না। আমরা বলি—ঠাকুর যতই অলৌকিক শক্তির অধিকারী হন না কেন, তাঁকে মানুষের রীতিনীতি লঙ্ঘন করলে চলে না। ফলে খাঁদা-বাঁকা যাই হোক হস্তিমুখ ছেলেটির ওপর বাপ-মায়ের স্নেহের অন্ত ছিল না। আবার ছেলে হিসেবে গণেশও তাঁর বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে যথেষ্ট বুঝমান। কবি লিখেছেন—শিব-পার্বতী দুজনেই যখন একসঙ্গে গণেশের গালে অর্থাৎ গজমুখে চুমো খেতে চাইছিলেন— যুগপৎস্বগণ্ডচুম্বনলোলৌ—তখন নাকি তিনি নিজের মুখখানি বারবার মাঝখান থেকে সরিয়ে নিয়ে দারুণ মজা পাচ্ছিলেন। এই মজার ফল আমরা যেমন টের পাচ্ছি, তেমনি গণেশের মা-বাবাও কিছু টের পাচ্ছিলেন। মাঝখান থেকে মুখ সরিয়ে নেবার ফলে শিব-পার্বতীর অধরোষ্ঠ মাঝে মাঝেই মিলিত হচ্ছিল এবং এতে নাকি গণেশ বেশ মজা পাচ্ছিলেন— তন্মুখমেলনকুতুকী। বোঝা যাচ্ছে, কচি বয়সেই গণেশ বেশ পাকা ছেলে। বিশেষত মায়ের ব্যাপারে তাঁর দরদ একটু বেশি।
পুরাণমতে বিভিন্ন সময়ে বাবা শিবের সঙ্গে ছেলে গণেশের অনেক মারামারি হয়েছে এবং তা হয়েছে মায়ের কারণেই। গণেশ মায়ের অতন্দ্র প্রহরী এবং মায়ের ওপর পিতা মহেশ্বরের এতটুকু বেয়াদবী অধিকার ফলানো দেখলেই বাপের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ পর্যন্ত লেগে যায়। কোথাও কোন পুরাণে আবার এমনও পাই যে, পার্বতী স্নানের ঘরে ঢুকলেই ওই অরক্ষিত স্থানে শিবের হুট্হাট্ ঢুকে পড়ার অভ্যাস ছিল, এবং এই স্নান-কালীন বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্যই সমাধান হিসেবে একান্ত অনুচর গণেশের সৃষ্টি হয়েছিল। যাই হোক, হাতির মাথা জুড়ে পৌরাণিকেরা যে সিদ্ধিদাতা গণেশ তৈরী করেছেন, পরবর্তী কবিরা শুভলাভের জন্য তাঁকে যথেষ্ট মর্যাদা দিলেও গণেশকে তাঁরা আরও কাছের মানুষটি করে ফেলতে দ্বিধা করেননি।
এমনকি হাতির মত মুখে মানুষের আদল আনবার জন্য কবিরা গণেশের গোঁফের ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছেন, এবং হাতির মুখে সে গোঁফজোড়া বসাতে কবিদের বেশ কষ্ট হয়েছে। কবিরা জানেন—মদমত্ত হস্তীর গাল বেয়ে মদবারি স্খলিত হয় এবং ছাতিম ফুলের মত মোদো গন্ধ আছে সেই গাল-চুয়ানো মদবারির। স্বাভাবিক কারণেই সপ্তচ্ছন্দগন্ধী এই মদবারির গন্ধে প্রচুর ভ্রমর আকৃষ্ট হয়ে উড়ে এসে বসে হাতীর মুখে। এই ধারণাকে সম্বল করে কবি কল্পনা করেছেন— সেই ‘নিলীনমধুপকুল’ গণেশের গজমুখে একজোড়া গোঁফ এঁকে দিয়েছে যেন। অথাৎ হাতির গালে-বসা মধুকর-শ্রেণীর রেখাকেই কবিরা গণেশের গোঁফ কল্পনা করে নবশ্মশ্রুমণ্ডিত গজাননকে নমস্কার করেছেন— উদ্ভিন্ন-নবশ্মশ্রুশ্রেণিরিব দ্বিপমুখো জয়তি। সিদ্ধিদাতা দেবতাকে মানুষ করার জন্য ভ্রমরের গোঁফ উপহার দিয়ে কবিরা তাঁকে আমাদের কাছাকাছি এনে দিয়েছেন বলেই পরে কিন্তু এই গণেশকেই আমরা গোবর গণেশ বলেছি।
শাস্ত্রের প্রমাণে গণেশের কিন্তু বুদ্ধি কম ছিল না। মহাভারতের লেখক হবার সময় বুদ্ধির জোরে স্বয়ং ব্যাসকেও খানিকটা বিপাকে ফেলেছেন তিনি। কার্তিক-গণেশ দুই ভাই বিয়ে করার জন্য পাগল হলে পার্বতী ছেলেদের পরীক্ষা নিলেন। সে পরীক্ষায় কার্তিক সারা পৃথিবী পরিক্রমা করে মরলেন, আর গণেশ দশ পা হেঁটে মাকে প্রদক্ষিণ করেই পরীক্ষা পাশ করে ফেললেন। শাস্ত্রমতে মাতৃসেবীর চরম পুরস্কার হিসেবে গণেশকে বুদ্ধিমান বলা হয়েছে বটে, কিন্তু এমন মা-নেওটা ছেলেকে লোকে গোবর গণেশ বলেছে। অবশ্য গোবর গণেশ হওয়ার জন্য শুধু মায়ের আঁচল-ধরা অভ্যাসই যে গণেশের কাল হল, তাই নয়, তাঁর ওই থসথসে চেহারা, মোটা ভুঁড়ি, শরীরের ওপর হাতির মাথা থাকার ফলে সেই অনুযায়ী খাওয়ার কল্পনা—এই সব কিছু মিলে কেমন যেন জরদগবের আভাস নিয়ে আসে গণেশের কল্পনায়। মনুষ্যলোকের অতি সাধারণ জনেরও তাই কুণ্ঠা হল না—গণেশকে গোবর গণেশ বলে ডাকতে।
কোন কোন পুরাণমতে শিবের অভিশাপেই নাকি গণেশের ওই রকম ভুঁড়ি, এবং তাঁর মুখ যে হাতির মত হয়ে গেছে—সেও নাকি শিবের অভিশাপে। অপেক্ষাকৃত লোকায়ত সাহিত্যে কিন্তু কোন দেবতার শারীরিক বিকৃতির জন্য অভিশাপের কথা মনে থাকে না। শিবের সঙ্গে ঝগড়া হলে পার্বতী নিজেই ভারতচন্দ্রের কথা ধার করে বলেন—
বড় পুত্র গজমুখ চারিহাতে খান।
সবে গুণ সিদ্ধি খেতে বাপের সমান ॥
লোক সমাজে সাধারণ মানুষের ভুঁড়ি থাকার ফল এই যে, সময়ে অসময়ে তার বাবা-মাও সেই ভুঁড়ি নিয়ে কটূক্তি করতে ছাড়েন না। কিন্তু বাপ-মা যাই বলুন, যিনি স্বয়ং অন্নদামঙ্গলের কবি, যিনি আপন গ্রন্থের নির্বিঘ্ন পরিসমাপ্তির জন্য গণেশ-বন্দনা দিয়েই কাব্যারম্ভ করেছেন, সেই ভারতচন্দ্রও এক সময়ে রাজার জবানিতে রেগে বলেন—
রাজ্য কৈলি ছারখার তল্লাস কে করে কার,
পাত্রমিত্র গোবর গণেশ।
আসলে গণেশের নামের সঙ্গে এই যে অকর্মণ্যতার আভাসটুকু জড়িয়ে আছে, এই যে প্রচুর খাওয়ার সঙ্গে কাজে না লাগার একটা অনুষঙ্গ গণেশ-নামের সমার্থক হয়ে গেছে, এর কারণ যাই হোক—তাঁর চেহারাই হোক কিংবা স্বভাব—এটা দেবতার চরিত্র থেকেই মনুষ্য চরিত্রে প্রবাহিত, না, মনুষ্য চরিত্র থেকে দেবচরিত্রে প্রবাহিত—সেটা সুধী ব্যক্তি মাত্রেই বিচার করে দেখবেন।
আমরা দ্বিতীয় কল্পের পক্ষপাতী, অর্থাৎ মনুষ্য চরিত্র অনুযায়ীই দেবচরিত্র তৈরী হয়, কারণ এর উদাহরণ তো একটা নয়। ধরুন, এক বাড়িতে দুটি ছেলে আছে, অথচ তাদের একজন কাজে কুঁড়ে ভোজনে দেড়ে, এবং অন্যজন ফুলবাবু। ঠিক এই রকম একটা পারিবারিক পরিস্থিতির প্রতিরূপ পাওয়া যাবে পার্বতীর সংসারে। গণেশের পরিচয় যাই হক, পার্বতীর অন্য ছেলেটি ইতিহাস-পুরাণে দেবতাদের সেনাপতি বলেই সমধিক পরিচিত। এত বড় একজন সামরিক পদাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও লোকসমাজে কার্তিকের পরিচয় কিন্তু একেবারে নববাবু বলে। সেরকম মানুষ দেখলে আমরা এখনও ‘কেলে কার্তিক’ কি ‘বাঁকা কার্তিক’ বলে ডেকে থাকি। অথবা কারও মধ্যে কার্তিকের সমস্ত রূপ-গুণ দেখে শুধুমাত্র ময়ূরটি নেই বলে খেদ অনুভব করি। বস্তুত আমাদের সমাজের অতি রূপবান নববাবুর মত মানুষটিকে ভারতচন্দ্রের মত কবিও কার্তিকের নামে উপহাস করেছেন। দেবদেব মহাদেবের সঙ্গে পার্বতীর যে মঙ্গলকাব্যিক ঝগড়া হয়েছিল তাতে পার্বতী স্বয়ং অনুযোগ করে বলেন—
ছোট পুত্র কার্তিকেয় ছয় মুখে খায়।
উপায়ের সীমা নাই ময়ূরে উড়ায় ॥
সত্যি কথা বলতে কি, কার্তিক তাঁর ময়ূরবিলাসে কিংবা অন্যান্য বাবুয়ানায় কি পরিমাণ পয়সা ওড়াতেন—তার হিসেব আমরা কোথাও পাইনি। কিন্তু তাঁর জন্মলগ্নে ছয় কৃত্তিকা মাতা তাঁকে স্তন্য দান করেছিলেন বলে তিনি যেমন ‘ষন্মাতুর’ বলে বিখ্যাত, তেমনি নিজেও ‘ষন্মুখ’ অথাৎ ছয়-মুখো বলেও বিখ্যাত। কিন্তু সেই ছয়-মুখের সূত্র ধরে তথা চ তাঁর ময়ূর-বাহনের সূত্র ধরে ভারতচন্দ্র কার্তিককে একেবারে বাপের হোটেলে-খাওয়া রক্বাজ ছেলেটি করে ছেড়ে দিয়েছেন। আমাদের যেটা আশ্চর্য লাগে, সেটা হল—কার্তিকের এই ময়ূরবিলাসী নববাবু রূপটির কোন পূর্বকল্প আমরা ইতিহাস-পুরাণে পাইনি। আরও আশ্চর্য লাগে এই জন্যে যে, যেখানে সব কটি প্রধান দেবতা সম্বন্ধে পৌরাণিক কিংবা পরবর্তী কবিরা রসিকতার চূড়ান্ত করে ছেড়েছেন, সেখানে কার্তিকের এই বাবুয়ানি প্রায় কোথাওই ধরা পড়েনি। লোকপ্রথা অনুসারে যে মানুষের চেহারা খুব সুন্দর অথবা পুরুষ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও যার চোখ দুটি পটলচেরা, নাকখানি বাঁশীর মত অথবা মুখখানি একেবারে নিখুঁত—তাকে আমরা ‘ময়ূরহীন কার্তিক’ বলে খেপাই বটে, কিন্তু কার্তিক যে সাংঘাতিক কিছু সুন্দর ছিলেন—সে বর্ণনা আমরা ইতিহাস-পুরাণে কোথাও পাইনি। এখন আপনি যদি নানা পুরাণের মেলায় স্কন্দ, মৎস্য, পদ্ম, বামন ঘেঁটে প্রমাণ দিয়ে বলেন—কে বলেছে কার্তিকের রূপ নেই? এই তো তাঁকে ‘বালার্কদীপ্তিং’, ‘তরুণম্ আদিত্যপ্রভম্’ অথবা ‘সিন্দুরারুণতেজসে’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে——তা হলে আমরা বলব—ওরকম রূপ ভারতবর্ষের সব দেবতারই আছে; বরঞ্চ বেশিই আছে। মহাদেব, কৃষ্ণ, রামচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে বুদ্ধ, চৈতন্য, এমনকি বিবেকানন্দ পর্যন্ত, ওরকম রূপবর্ণনা সবারই আছে। বস্তুত ‘রূপে কার্তিক’ এই রূপ-প্রবাদের ব্যাপারে আমাদের কোন পূর্বানুরাগ না থাকার ফলে কার্তিকের রূপানুসন্ধানের ক্ষেত্রে আমরা প্রায় ব্যর্থ। কেউ যদি পুরাণ-মহাভারত থেকে আরম্ভ করে মঙ্গলকাব্য পর্যন্ত কার্তিকের সর্বাতিশায়ী অসমোর্ধব রূপবর্ণনা দেখাতে পারেন—যে রূপের বশে এই কালে আমরা কুরূপ পুরুষের মধ্যে রূপের ঢঙ দেখে বলি—’কেলে কার্তিক’ কি ‘বাঁকা কার্তিকতা’— তা হলে কার্তিকের সম্বন্ধে একটা পরম্পরা পাই।
আরেক কথা—কার্তিক যে খুব বড় মানুষের মত দেবসেনাপতি হয়ে গেলেন—সে ব্যাপারেও আমাদের ধন্দ আছে। পৌরাণিকেরা অনেকেই কার্তিককে রুদ্রশিব, অগ্নি ইত্যাদি বড় বড় দেবতার পরিবর্তিত রূপ বলে আনন্দ লাভ করেছেন বটে, কিন্তু একমাত্র তারকাসুর বধের জন্য কুমার-সম্ভব হওয়া ছাড়া আরও অনেকানেক দেবাসুর যুদ্ধে কার্তিকের কোন যুদ্ধোন্মাদ মূর্তি আমরা দেখিনি। দক্ষিণ ভারত থেকে আরম্ভ করে অনেক জায়গাতেই কার্তিককে অবিবাহিত নবীন যুবকটি করে রাখা হয়েছে। সেই জন্যই তাঁর এমন একটা রূপে কার্তিক রমণীমোহন রূপ-কল্পনা সৃষ্টি হয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু আমার বন্ধুবর, বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক অভিজিৎ ঘোষ তাঁর সূক্ষ্ম গবেষণার পথ ধরে প্রথম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন—কার্তিকের বউয়ের নামই দেবসেনা এবং বউয়ের নামেই তিনি শেষ পর্যন্ত ‘দেবসেনা-পতি’ হয়ে বসেছেন। কথাটা শোনার পর কিন্তু কিন্তু করছিলাম। বন্ধু বললেন—তুই এই একটা উদাহরণ দেখে ঘাবড়াস না, ওই শচীপতি ইন্দ্রের কথাই ধর না। বেদের ভাষায় ‘শচী’ শব্দের মানে হল শক্তি, চতুরতা ইত্যাদি। প্রবল শক্তিধর হিসেবেই দেবরাজ ইন্দ্র প্রাথমিকভাবে শচীপতি হয়ে গেছেন, তারপর ইতিহাস-পুরাণের দৌলতে শচী হয়েছেন ইন্দ্রের স্ত্রী আর ইন্দ্র হয়েছেন শচীপতি।
দেখলাম—কথাটা ভাববার মত। বন্ধুর কথা শুনে মহাভারত-পুরাণ আবারও নাড়াচাড়া করলাম। শেষে খোদ মহাভারতের মধ্যেই চোখে পড়ল—অন্ধকার দূর করে যেমন সূর্য প্রকাশিত হয়, ঠিক তেমনি বিপত্তারণ কার্তিককে দেখে সমস্ত দেবসেনা ধেয়ে এসে বলেছিল—এই আমাদের প্রভু, ইনি আমাদের পতি—অস্মাকং ত্বং পতিরিতি। ‘সেনা’ শব্দ সংস্কৃতে স্ত্রীলিঙ্গ, অতএব সমস্ত দেবসেনাকে স্ত্রীত্বে বরণ করে কার্তিক দেবসেনাপতি হয়ে গেলেন। কিন্তু কার্তিক সম্বন্ধে এই সামান্য কথাটা জানিয়েও আবার বলি যে, কার্তিকের সৌন্দর্যের পরম্পরা সন্ধানে আমরা তুলনামূলকভাবে ব্যর্থ। তুলনামূলকভাবে এই জন্যে যে, অন্যান্য দেবতার পরম্পরা আমরা শাস্ত্র-কাব্য এবং সর্বশেষে প্রবাদের ধারায় এখনও জনসমাজে চালু দেখতে পাই, কিন্তু কার্তিকের বিশেষ রূপকল্পনা অথাৎ রূপে কার্তিক—এমন একটা প্রাবাদিক বিস্ময় আমাদের মতে প্রায় ভিত্তিহীন।
তবু, তবু কথা কিছু থেকেই যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস—দেববিষয়ক কোন বাংলা প্রবাদ আকাশ থেকে উড়ে মানুষের মুখে এসে বসেনি। কার্তিকের সম্বন্ধে একটা কথা খেয়াল করতেই হবে যে, তিনি চিরকুমার। অবিবাহিত পুরুষমাত্রেই, বিশেষত সে পুরুষ যদি দেবতার মত সুপুরুষ হয়, তবে সে চিরকুমারের বদলে চিরনায়ক হয়ে যায়। কার্তিকেরও তাই হয়েছে, আর চিরনায়ক হওয়ার জন্যই তাঁর রূপটাই হয়ে গেছে প্রধান। শতপথ ব্রাহ্মণ থেকে কার্তিকের কুমার উপাধি জুটেছে। মহাভারত পুরাণে এসে কার্তিকের কৌমার্যরক্ষার কবচ ‘কামজিৎ’, ‘শুচি’, এমনকি ‘যোগীশ্বর’ উপাধিও জুটেছে। ফলত একদিকে কার্তিককে যত স্ত্রীলোকের সঙ্গ থেকে দূরে রাখা হয়েছে, আমার মনে হয় কার্তিকের রূপের প্রবাদ ততই বেড়েছে। এটা নিশ্চয়ই জানেন যে, কার্তিক যতই রূপে কার্তিক হন না কেন, কার্তিকের মন্দিরে কিন্তু মেয়েদের ঢোকা বারণ। কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয় নাটকে দেখেছি—স্বয়ং স্বৰ্গনায়িকা উর্বশী কার্তিকের মন্দিরে ঢুকে ‘লতা’ হয়ে গিয়েছিলেন। উর্বশী নিজে রাজা পুরূরবাকে জানিয়েছিল যে, ওই কার্তিকের নামাঙ্কিত বনটি মেয়েদের কাছে ছিল পরিহরণীয়—অম্বকাজণপরিহরণীয়ং কুমারবনং পবিঠ্ঠা। কার্তিকের মন্দিরে ঢুকলে নাকি মেয়েদের অভিশাপ লাগে—বিশস্তি শাপভীতা হি ন কুমারবনং স্ক্রিয়ঃ (কথাসরিৎসাগর)। কার্তিকের ওপরে গবেষণা করে অসীমকুমার চ্যাটার্জিমশায় জানিয়েছেন যে, মারাঠী বই শিবলীলামৃতে নাকি লেখা আছে—মেয়েরা কার্তিকের মূর্তি দেখলে সাত-জন্ম বিধবা হয়। আর এখনও নাকি মহীশূর প্রদেশে সন্দুরের কাছে কার্তিক-কুমারস্বামীর মন্দিরে কোন স্ত্রীলোকের ঢোকার অনুমতি নেই।
দেবতাদের যে দৈব-দুর্বিপাকের কথা আগে বলেছিলাম কার্তিকের বিয়ে না হওয়ার মধ্যেও সেই দৈবের গন্ধই পেয়েছেন কবিরা। তাঁরা বলেছেন—যাঁর মা হলেন ‘ধরাধরেন্দ্রদুহিতা’ পার্বতী, আর বাবা হলেন মহেশ্বর শিব, এমন অসীম ঐশ্বর্যশালী বাপ-মাও তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। আচ্ছা বেশ বাপ-মায়ের কথা ছেড়েই দিন, যাঁর ভাই সিদ্ধিদাতা গণেশ জনে জনে বিঘ্ন বিনাশ করে বেড়ান, তিনিও কার্তিকের বিয়ের ফুল ফোটাতে পারলেন না। যদি বলেন—শিব নিষ্কিঞ্চণ যোগী, টাকা-পয়সা না থাকলে সে ঘরে কেউ বিয়ে দেয় না, তাহলে কবি যুক্তি দেবেন—শিবের টাকা-পয়সা নাই থাকুক, তাঁর অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু হলেন ধনপতি কুবের। এতই কাছে তাঁর বাড়ি যে, এখানে শিব বসে থাকলে তাঁর বাড়ির উঠোনে শিবের মাথার এক ফালি চাঁদের জ্যোৎস্নার ছায়া পড়ে, সেই ধনকুবের বন্ধু থাকতেও কার্তিকের বিয়ে হল না। আর কার্তিক নিজেই কী কিছু কমা লোক। যিনি দেবপক্ষের সেনাপতি হয়ে তারকাসুরের মত শত্রু পাতন করলেন, সেই মহাবীরের বিয়ে হল না! কবিরা বলেছেন—এত ঐশ্বর্যযোগ আর বাপ-মা, ভাই-বন্ধুর এত বড় ‘কানেকশন্’ থাকতেও যে কার্তিকের বিয়ে হল না, তাকে কপালের দোষ ছাড়া আর কীই বা বলব—তদ্ দুর্দৈববলেন কুত্র ঘটতে নাদ্যাপি পাণিগ্রহঃ।
আরও আধুনিক দুর্দৈব দেখুন, এত যে বললাম—কার্তিকের মন্দিরে মেয়েদের ঢোকা নিষেধ, কার্তিক ব্রহ্মচারী, কার্তিক স্ত্রীমুখ দর্শন করেন না, অথচ দেখুন— কার্তিকের পুজো কারা করেন, জানেন বেশ্যাপল্লীতে যে রমণীটি প্রথম কুমারীত্ব ভঙ্গ করে বেশ্যার ধর্মে দীক্ষিত হয়, সে কার্তিক পুজো করে তবে তাঁর কর্ম-জগতে প্রবেশ করে। কার্তিকের উপাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে ভীষণভাবে উল্লেখযোগ্য হল চোরেরা। কার্তিক চোরের দেবতা, কার্তিক পুজো সেরে চোরেরা চুরি করতে বেরোয়। আর এক দল কার্তিক পুজো করেন পুত্র-সন্তানের মানসে। ছোটবেলায় শুনেছি—কার্তিক পুজো করে রাতের আঁধারে বা উষার আলো ফোটার আগে যাঁর বাড়িতে নিশ্চুপে কার্তিক ঠাকুর রেখে আসা হবে, তাঁকে নাকি কার্তিক-পুজো করতেই হবে।
একজন ব্রহ্মচারী, স্ত্রী-মুখ-নিস্পৃহ দেবতার উপাসক-বৃন্দ হলেন গণিকা, চোর এবং সন্তানকামী—এ যেন কেমন বিপরীত লাগে।
বস্তুত কার্তিকের সম্বন্ধে পুরাণে যত গপ্লোই থাকুক যে, ইন্দ্র তাঁর নিজের মেয়ে দেবসেনাকে কার্তিকের রতিতৃপ্তির জন্য বিয়ে দিয়েছিলেন কার্তিকের সঙ্গে, আসলে কিন্তু কার্তিকের কোন বিয়েই হয়নি। মহাভারতের প্রমাণে আমরা পরিষ্কার বলতে পারি ইন্দ্র কার্তিককে তাঁর আপন সেনাবাহিনীর সর্বময় কর্তা নিযুক্ত করে সেই দেবসেনাবাহিনীর সঙ্গে কার্তিকের গাঁটছড়া বেঁধে দিয়েছিলেন। ওইটাই কার্তিকের বিয়ে। হায়! এই রকম একটা করুণরসের বিয়ে করেও কার্তিকের পরিচয়—তিনি কুমার। পরবর্তীকালে মন্দিরে বিগ্রহ হয়েও তিনি একটি স্ত্রীমুখ দর্শন করতে পারেন না এবং লোকসমাজের নীতিনিয়ম অনুযায়ী রমণীসঙ্গবিরহিত রাজার উপমা দেওয়া হয়েছে—কার্তিক যেমন সদা সর্বদা রমণীসঙ্গ পরিহার করে চলেন, তেমনি আমাদের রাজামশাই—কুমার ইব সর্বদা পরিহৃতাঙ্গনাসঙ্গমঃ। এই যে স্ত্রী-কামনা-রহিত কার্তিকের ব্রহ্মচারী-কল্পনা, যাকে মহাভারতকার উপাধি দিয়েছেন যোগীশ্বর বলে, ধর্মাত্মা-কামজিৎ বলে অথবা পবিত্র-ব্রহ্মচারী বলে—সেই ব্রহ্মচর্যের দীপ্তির মধ্যেই কার্তিকের অতিশায়ী রূপের ধারণা নিহিত আছে বলে আমরা মনে করি। লোকসমাজেও ব্রহ্মচারী পুরুষের রূপ সম্বন্ধে এক বিশেষ কল্পনা করা হয়, কার্তিকের ব্যাপারেও তাই।
অন্যান্য সমস্ত পুরাণ একপাশে ঠেলে দিয়ে একমাত্র ব্রহ্ম পুরাণ খুললে দেখা যাবে যে, একবার, অন্তত একবারের জন্য কার্তিকের মতিভ্রম হয়েছিল। স্ত্রীলোক-সংক্রান্ত ব্যাপারে ‘মিলিটারি’ পুরুষের সংযম নিয়ে অতি বড় বন্ধুও খুব ভাল ধারণা পোষণ করে না। তা কার্তিক যখন দেব-শত্রু তারকাসুরকে মেরে ফেললেন, তখন ‘মিলিটারি’ ছেলের মনের অবস্থা বুঝে মাতা পার্বতীই পুত্রকে বললেন—বাবা! তুমি আমার ইচ্ছায় এবং শিবের প্রসাদে এই পৃথিবীর যত ভোগ আছে—ভোগ কর। মা-বাবার ইচ্ছার মধ্যে সব সময়ই সীমা থাকে, কিন্তু প্রশ্রয় পেয়ে কার্তিক সমস্ত দেব-রমণীদের জোর করে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যেতে থাকলেন এবং তাঁদের ভোগ করতে থাকলেন। দেবপত্নীরাও কম যান না, কার্তিকের মত অসুরজয়ী পুরুষ পেয়ে তাঁরাও রমণে বেশ স্বাদ পেতে লাগলেন—যথাসুখং বলাদ্ রেমে দেবপত্ন্যো’পি রেমিরে। দেবতাদের, মানে যে-দেবতাদের ঘর পুড়েছে, তাঁরা কেউই কার্তিককে আটকাতে পারলেন না বরং অবশেষে নালিশ জানালেন পার্বতীর কাছে। পার্বতীও বার বার বারণ করলেন পুত্রকে। কিন্তু কে কার কথা শোনে! কার্তিকের বদ অভ্যাস তখন চরমে উঠেছে, রমণীসঙ্গ ছাড়া তাঁর চলে না—স্ত্রীষু আসক্তস্তু ষম্মুখঃ।
ছেলে এবং দেবতা—দুপক্ষেরই বিপদ বুঝে পার্বতী ঠিক করলেন—কার্তিক যেই কোন দেবরমণীকে সম্ভোগ করতে যাবে, তখনই সেই রমণীর মধ্যে নিজেকে প্রতিফলিত করবেন। ফলে বাসনামাত্রেই কার্তিক রমণীর বদলে নিজের মায়ের রূপ দেখতে পাবে—যস্যাং তু রমতে স্কন্দঃ পার্বতী অপি তাদৃশী। একদিন হল কি, কার্তিক দেবরাজ ইন্দ্র এবং বরুণদের স্ত্রীদের আহৃান করলেন রতিতৃপ্তির জন্য। কিন্তু যেই না তাঁদের দিকে তাকালেন, অমনি দেখেন—মাতৃমূর্তি পার্বতী। এইভাবে একটা একটা করে সমস্ত স্ত্রীমূর্তি তাঁর কাছে মাতৃমূর্তি হয়ে গেল, অখিল জগৎ তাঁর কাছে মাতৃময় হয়ে ধরা দিল—দৃষ্টৃা মাতৃময়ং জগৎ। সেই যে কার্তিকের বৈরাগ্য হল, স্ত্রী বিষয়ে সে বৈরাগ্য আর ভাঙেনি। ব্রহ্মপুরাণ একটিবার মাত্র কার্তিককে ধর্মচ্যুত করে তাঁকে আজীবন বৈরাগ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিন্তু অন্যত্র সব জায়গায় তিনি আজীবন ব্রহ্মচারী, শুচি, শান্ত। এই ব্রহ্মচর্য এবং শুচিতার দীপ্তিতেই কার্তিক, রূপে কার্তিক। নইলে আবারও বলছি—কার্তিকের প্রবাদকল্প রূপের পরম্পরা অনুসন্ধানে আমি অন্তত ব্যর্থ। এ ব্যাপারে কোন পৌরাণিক হদিশ আমাকে যদি কেউ দেন, তাহলে আমার এই প্রবন্ধের ভাবনা-যুক্তি আরও দৃঢ় করতে সুযোগ পাব আমি।
॥ ৩ ॥
কার্তিককে বাদ দিলে শিব, কৃষ্ণ, বলরাম, লক্ষ্মী, দুর্গা, রাধা—সবারই একটা পরম্পরা পাব, যে পরম্পরা পৌরাণিক আমল থেকে একেবারে লোক-প্রবাদ—প্রায় একই খাতে প্রবহমান। আমরা শিব-শম্ভুকে অবশ্যই প্রথমে ধরব। আজকে যে সংসারবুদ্ধিহীন আপনভোলা মানুষটিকে আমরা ভোলানাথ বলছি এবং শিবকে বলছি ‘বোম ভোলা’—তার একটা পরম্পরা আছে, এবং সে পরম্পরা এই সেদিনের মঙ্গলকাব্য থেকে আসেনি, এসেছে পুরাণের শ্লোকগুলির মাধ্যমে, এসেছে সহস্র কবির শত ভাবনার মন্থনে। এই প্রবন্ধের আরম্ভে আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল যে, আমরা শুধু পুরাণ অথবা রামায়ণ-মহাভারত থেকে দেবতাদের মানুষোচিত বৃত্তিগুলি দেখিয়েই ক্ষান্ত হব না, দেবতাদের নিয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন সংস্কৃত কবির তীব্র রসিকতাগুলিও আমরা উল্লেখ করব। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে শিবকে নিয়ে শাস্ত্রকার, পৌরাণিক, কবি, কবিওয়ালা—সবাই একেবারে পঞ্চমুখ! বস্তুত ভারতবর্ষের ধর্মীয় ইতিহাসে শিব এমনই এক সর্বাত্মক চরিত্র যে, প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান ধর্মমতেই শিব সাদরে, সাড়ম্বরে স্বীকৃত। লৌকিক দেবদেবীর জগতে শিবের মাহাত্মের কথা ছেড়েই দিলাম, ছেড়েই দিলাম শৈব, শাক্ত সম্প্রদায়ে শিবের প্রাধান্যের কথা। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মেও শিব আছেন অন্যতম প্রধান ভূমিকায়। প্রকৃষ্ট বৈষ্ণবের উদাহরণ হিসেবে শিবকেই বেছে নেওয়া হয়েছে অনেক বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ে। বলা হয়েছে—বৈষ্ণবাণাং যথা শম্ভুঃ।
এমন একটি সর্বতন্ত্রসম্মত দেবতাকে নিয়ে প্রাচীন এবং পরবর্তী কবিরা যে যথেষ্ট রসিকতা করেছেন, তার ইন্ধন যুগিয়েছেন বিভিন্ন পুরাণকারেরাই। একথা অবশ্য ঠিক যে, বেদের আমল থেকে আরম্ভ করে একেবারে মঙ্গলকাব্য কি কবিওয়ালার গান পর্যন্ত শিবের যে বিবর্তন ঘটেছে, তাতে তাঁর পরমযোগিত্ব এবং পরমভোগিত্ব—দুটিই চরমভাবে প্রকট। অনেকে শিবের এই ‘অ্যাসেটিসিজম্ অ্যান্ড সেক্সয়ালিটি’ নিয়ে বড় বড় প্রবন্ধও রচনা করেছেন। কিন্তু বহু পুরাতন এই ঈশ্বরের জীবন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে যত আলোচনাই হোক না কেন, সমস্ত কিছুর ওপরে আছে এই আশুতোষ দেবতাটির আত্মভোলা সদানন্দ ভাবটি। তিনি যখন তখন অসুর-রাক্ষসকে এমন অসম্ভব বর দিয়ে ফেলেন যে, তাঁর ওই খুশ-মেজাজের ফলে সুরকুলে মহা সংকট উপস্থিত হয়। আবার সেই সংকটমোচনের দায়ও বর্তায় তাঁরই ওপর, যদিও তিনি আত্মভোলা ভাবেই সে সংকট মোচন করেন। যে-শিব বিষ্ণুর মোহিনী মূর্তি দেখে রেতঃস্থলন করতে করতে রমণীর পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকেন, সেই শিবই অন্যকালে পর্যঙ্কবন্ধন করে যোগাসনে বসেন—তাঁর যোগাগ্নিতে কাম দগ্ধ হয়। যে-শিব দেবতাদের বিপদ মুক্ত করতে বিষপান করে নীলকণ্ঠ হন, সেই শিব শ্বশুরবাড়িতে সামান্য নেমন্তন্ন না পেয়ে দক্ষযজ্ঞ নাশ করেন, আবার অপার ভালবাসায় পত্নীর মৃতদেহ কাঁধে করে পাগলের মত পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ান। তাঁর নির্মোহ তপস্যা আরম্ভ হলে সে তপস্যা ভাঙানো যেমন কঠিন, তেমন, পার্বতীর সঙ্গরঙ্গে রতিক্রীড়া আরম্ভ হলে তার জেরও চলে কমপক্ষে হাজার বছর। এই আপাতবিরোধিতার ফলেই কখনও তাঁর পরম-রমণীয় নটরাজ মূর্তি দেখি, আবার কখনও বা ভূঁড়ি-ভাসানো থপথপে বুড়ো-মার্কা সরল সদাশিব মানুষটি দেখি। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়—তিনি অতুল সম্পদের ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভিখারি। শাস্ত্রে পুরাণে বর্ণিত শিবের এই সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি মনে রাখলে পরে মানুষ হিসেবে কবিদের রসিকতাগুলি অর্থপর হয়ে উঠবে।
পৌরাণিক মিথ অনুসারে ভগীরথ যখন আপন তপস্যায় গঙ্গাকে পৃথিবীবাহিনী করেন, তখন সুরনদী গঙ্গাকে জটাজুটে ধারণ করে শিব ভগীরথের তপঃশ্রম সার্থক করেন। কিন্তু এ বাবদে কবিদের রসিকতা কিন্তু অন্যরকম। কবির ধারণা—শিব যে তাঁর মাথায় গঙ্গার জলধারা ধারণ করে আছেন, তার কারণ হল শিবের সারা অঙ্গ সব সময় জ্বলছে। সাধারণত আমাদের গরম লাগলে বা শরীরে জ্বালা করলে আমরা স্নান করি, কিংবা ঠাণ্ডা জল গায়ে ঢালি। কবি মনে করেন—শিবের গাও সব সময় জ্বলছে। একদিকে অত্যগ্র সমুদ্রমন্থন বিষ পান করে তাঁর গলা পুড়েছে, অন্যদিকে বিষাক্ত সাপের নিঃশ্বাসে শিবের সারা গা জ্বলছে। তার ওপরে তাঁর নিজের কপালে আগুন জ্বলছে ধিকি ধিকি করে। চারদিক দিয়ে এই অবিরাম জ্বালা-পোড়া খানিকটা কম রাখার জন্যই গঙ্গাধর শিব গঙ্গাকে আর মাথা থেকে সরিয়ে দেওয়ার সাহস পান না—ইতি গঙ্গাধরো গঙ্গাম্ উত্তমাঙ্গান্ন মুঞ্চতি।
এই কবি যদিও বা শিবের মাথায়-থাকা সুরনদী গঙ্গার চিরবাসের একটা কারণ খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু অন্য কবির দৃষ্টিতে এই গঙ্গার কারণেই শিবের সাংসারিক শাস্তি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে, দাম্পত্যকলহও একেবারে স্থায়ী হয়ে গেছে একই কারণে। আমরা যেমন মেনিমুখো পুরুষকে গালাগালি দিয়ে বলি—বউকে তো একেবারে মাথায় করে রেখেছ—তেমনি ষষ্ঠ/সপ্তম খ্ৰীষ্টাব্দের এক বিখ্যাত নাট্যকার তাঁর নাটকের আরম্ভেই পার্বতীর মুখে শিবের ওপর বিশ্বাসহননের দায় আরোপ করে একই কথা বলেছেন। পার্বতী বললেন—কে ওই ধন্যি মেয়ে যাকে অমন মাথায় করে রেখেছ? পৌরাণিক প্রয়োজনেই গঙ্গাধর শিব গঙ্গাকে মাথায় রেখেছেন, কিন্তু মানুষ কবি গঙ্গার মধ্যে উপপত্নীর কল্পনা এনে পার্বতীর প্রশ্নাবাণ নিক্ষেপ করেছেন শিবের উদ্দেশ্যে। এমন অবস্থায় শিবও কোন পুরাণকথা শোনান না। ‘ধন্যি’ শব্দটির মধ্যে যেন কোন বিশেষ ইঙ্গিতই নেই—এমন একটা ভাব করে শিব ন্যাকা সেজে বললেন—কেন! কাকে আবার মাথায় করে রেখেছি? ওটা তো শশিকলা।
পার্বতী—বলি, শশিকলা কি ওই মেয়ের নাম?
শিব—হ্যাঁ, ওটাই তার নাম। আর এই শশিকলা তো তোমার অপরিচিত কেউ নয়, এরই মধ্যে সব ভুলে গেলে? শিবের দিক থেকে এইরকম এড়িয়ে যাওয়ার বুদ্ধি দেখে পার্বতী ভাবলেন—এই বুঝি চলতে থাকবে। তিনি এবার স্পষ্ট কথায় জবাব চেয়ে বললেন—বলি, ওই মেয়েছেলেটা কে? আমি তোমার মাথায় ওই চাদের কলা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, বরং যে মেয়েছেলেটাকে মাথায় করে রেখেছ, সেইটা কে তাই বল—নারীং পৃচ্ছামি নেন্দুম্। শিব মহাবিপদে পড়লেন এবং শেষ পর্যন্ত পার্বতীর সখী বিজয়াকে সাক্ষী মেনে বললেন—তাহলে বিজয়াই বলুক। তুমি যদি আমার কথায় বিশ্বাসই না কর, তাহলে তোমার সখীই বলুক।
শিব-শিবানীর এই দাম্পত্যকলহ কোনদিকে মোড় নিয়েছিল, সে কথা মুদ্রারাক্ষসের কবি লেখেননি, তবে শিবের দিক থেকে সুরনদী গঙ্গাকে লুকিয়ে ফেলার এই যে চেষ্টা, পার্বতীর সামনাসামনি দাঁড়িয়েও তাঁকে ধোঁকা দেওয়ার মত শিবের এই যে শঠতা—এই শঠতারই স্তুতি করেছেন কবি, কারণ মুদ্রারাক্ষস নাটকের পরিসরে চাণক্যের শঠতা নিয়েই তাকে নাটক রচনা করতে হবে। মুদ্রারাক্ষসের কবি আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিবের শঠতাটুকু আহরণ করেই নাটকের নান্দীপাঠ করলেন বটে, কিন্তু শেষ প্রশ্নের উত্তর আমরা পেলাম না। শিবের জটাজুটের মধ্যে স্ফুরিতধারা গঙ্গার মধ্যে পার্বতী যে স্ফুরিতাধরা সপত্নীর আভাস পেয়েছেন—লোকসমাজে সে কল্পনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সতীন হিসেবে গঙ্গার প্রতিপত্তি তেমন বেশি নেই, কারণ পার্বতীর ক্ষমতা অনেক বেশি। পার্বতীর তুলনায় গঙ্গার সামাজিক এবং সাংসারিক প্রতিষ্ঠা কম বলেই আমাদের রাজকুমার ন্যায়রত্ন অসাধারণ একটি কবিতা লিখেছিলেন। কালীঘাটে যে গঙ্গা বয়ে চলেছে, প্রাকৃতিক কারণে এবং সংস্কারের অভাবে সে গঙ্গা এমনিই নোংরা এবং ক্ষীণধারা। কিন্তু ন্যায়রত্নমশাই টিপ্পনী করেছেন—কলিকালের কালীঘাটে কালীর অনেক বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। লোকে যেমন এখানে টাকা-পয়সার প্রণামী দিচ্ছে, তেমনি মানত করে একবার সোনার জিব গড়িয়ে দিচ্ছে কালীর আবার নোলক গড়িয়ে দিচ্ছে নাকে, আরও কত কি! সতীনের ঘর টাকা-পয়সায় এবং শ্রদ্ধায় ফুলে ফেঁপে উঠছে দেখে হিংসায়, অপমানে গঙ্গা মলিন (নোংরা) এবং রোগা (ক্ষীণজলধারা) হয়ে গেছেন কালীঘাটে—সপত্নীবিভবং দৃষ্টৃা গঙ্গাভূন্মলিনা কৃশা।
গঙ্গা যত রোগাই হোন কিংবা যতই গৌণা, শিবের সংসার তাতে কোনমতেই সুখের হয়নি। অশান্তিময় সংসারচক্র সব মানুষকেই গ্রাস করে, সেখানে কৃষ্ণ-বিষ্ণু থেকে আরম্ভ করে শিবের সংসারেও যে গভীর অশান্তি থাকবে—তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। কবিরাও সেটা বারবার বলেছেন। এক কবির মতে তো শিবের স্ত্রীভাগ্য এবং পুত্ৰভাগ্য—দুইই খুব খারাপ। এক বউ যুদ্ধবাজ রণচণ্ডী, আরেক জনের গতি কেবল নীচের দিকে। বুঝতেই পারছেন একজন দুর্গা, অন্যজন নিম্ন ভূতলগামিনী গঙ্গা—একা ভার্যা সমররসিকা নিম্নগাচ দ্বিতীয়া। ছেলেগুলোই বা কি? বড় ছেলেটা যেমন বিটকেল দেখতে, ছোটটাও তেমনি। বড়টার দেহে হাতির মাথা, ছোটজনের আবার ছটা মাথা। ঘরের চাকরবাকর নন্দী-ভৃঙ্গী—দেখতে ঠিক বাঁদরের মত। ব্রহ্মার হংস কিংবা বিষ্ণুর গরুড়ের মত একটা ভদ্রস্থ বাহনও তাঁর জোটেনি। নিষ্কর্মা, সারাদিন জাবরকাটা একটা ষাঁড় তাঁর বাহন, যাকে লোকে বলে শিবের ষাঁড়। কবির ধারণা—আপন গৃহের এই বিচিত্র চরিত্র এবং ততোধিক বিচিত্র চেহারাগুলি দেখেই শিব শেষ পর্যন্ত গায়ে ছাই মেখে যোগী হয়েছেন—স্মারং স্মারং স্বগৃহচরিতং ভস্মদেহে মহেশঃ। কথায় যেমন বলে ঠেলার নাম বাবাজি, শিবও সেইরকম সংসারের ঠেলায় ছাই মেখে যোগী হয়েছেন।
পৌরাণিকদের নানা কল্প-কাহিনী, দেবতাদের নানা লোকোত্তর কাণ্ডকারখানার ফলে শিব কখনও হলাহল পান করেছেন, কখনও শ্মশানবাসী হয়েছেন, কখনও ভস্ম গায়ে মেখেছেন আবার কখনও বা দিগম্বর হয়েছেন। কিন্তু কবিদের কল্পলোকে শিবের বিষ খাওয়া অথবা শ্মশানবাসী হওয়ার কারণ একান্তভাবেই লৌকিক এবং মানুষোচিত। এর ফলে পৌরাণিক দৈব ঘটনার চেয়েও অবিকল্পে আমরা মুগ্ধ হই বেশি। কারণ তাতে শিবের মত ত্রিগুণাতীত বিরাট দেবতাটিও সাধারণ মনুষ্য-লক্ষণে আক্রান্ত হন। আর্থিক কষ্টে, সংসারের চাপে মানুষ যেমন কখনও বিষ খায়, চারিত্রিক বা বংশগত কলঙ্ক চাপা দেওয়ার জন্য মানুষ যেমন ঘর ছেড়ে মনের দুঃখে বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তেমনি দেবাদিদেব শংকরের জীবনেও ঠিক একই রকম কারণগুলি ঘটায় কবিদের কল্পলোকে শিবকে আমরা আরও আপন করে পাই। কবির কল্পনায় পার্বতীর বাহন সিংহের ভয়ে শিবের বাহন বুড়ো ষাঁড় কোনদিন তার মালিকের ধারেকাছে থাকে না, প্রতিদিনই এবার পালায়—বৃদ্ধোক্ষঃ প্রপলায়তে প্রতিদিনম্। ছেলে কার্তিকের ময়ূর দেখে শিবের অঙ্গভূষণ সাপগুলি ভয়ে চঞ্চল হয়ে গায়ের মধ্যে কুটিলগতিতে এদিক ওদিক করে। গণেশের ক্ষুদ্র ইদুরটি পর্যন্ত তাঁকে ছাড়ে না, রাত্রিবেলায় ভিক্ষার ঝুলিতে অবশিষ্ট চালের রসদ খুঁজতে গিয়ে সে কৃত্তিবাস শিবের কৃত্তিবসন কুট্কুট্ করে কেটে দেয়।
এত সব দেখে কবির মনে হয়েছে—শিব এমনি এমনিই সাধ করে দিগম্বর হননি, সংসারের চাপই তাঁকে ন্যাংটো করে ছেড়েছে। ছেলে, বউ—এত সব আপনজনের চাপে প্রতিনিয়ত হেনস্থা হওয়ার থেকে তিনি সমুদ্রজাত বিষপান করে আত্মহত্যাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছেন—দুঃখেনেতি দিগম্বরঃ স্মরহরঃ হালাহলং পীতবান। আসলে সমস্ত দেবচরিত্রের মধ্যে মহাদেবই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যাঁকে চিরকাল বড় বঞ্চিত বলে মনে হয়। দেব-সমাজের জন্য তিনি করেছেন অনেক, কিন্তু পাননি কিছুই। সমুদ্রমন্থনে অনেকেরই অনেক লাভ হয়েছে, কিন্তু দেবদেব মহাদেব যা করেছেন তার বদলে তাঁর শূন্যটি জুটেছে। কৌস্তুভ-মণির মত বিশাল একটি রত্ন গলায় ঝুলিয়ে স্বয়ং বিষ্ণু লক্ষ্মীর মত সুন্দরীকেও বক্ষ-লগ্না করে নিয়েছিলেন। এদিকে দেবরাজ—ঐরাবত কি উচ্চৈঃশ্রবার মত হাতী-ঘোড়া বাগিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, অন্যান্য মহার্ঘ্য বস্তুর মধ্যে বিশাল নন্দন-কাননও তাঁর একটা বড় পাওনা। অন্যদিকে শিবের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিষপান করেও তাঁর ভাগ্যে স্বর্গীয় পারিজাত ফুলের একটি ছোট্ট তোড়াও জোটেনি।
এর কারণ পৌরাণিকেরা হিসেব না করলেও, পরবর্তী কবিরা মহাদেবের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। এমনকি মনস্তত্ত্বের কথাটাও এখানে বিচার করেছেন অত্যন্ত আধুনিকভাবে। দেখুন, আমাদের সমাজে ধনী-দরিদ্রের ভেদ আছে। তার ওপরে সমাজে যাঁরা কেতা-দুরস্ত পোষাক-পরিচ্ছেদে অত্যন্ত রুচিশীল—আমরা তাদেরই বেশি পছন্দ করি। কিন্তু অতি-পরিচিত নিজের লোক যখন শুধু গরীব বলে, জামা-কাপড়ের চাকচিক্য নেই বলে অথবা শুধু ‘স্মার্টনেস’ নেই বলে উপযুক্ত মর্যাদা বা প্রাপ্য বস্তু থেকে বঞ্চিত হয়, তখন আমরা হা-হুতাশ করে দাতা বা কর্তৃপক্ষকে দুষেও থাকি। মুখে বলিও যে, শুধু আলগা চটক দেখে ভুললে, একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে না। ঠিক এই ব্যাপারটা মহাদেবের প্রসঙ্গেও এসেছে।
সংস্কৃত কবিতার জগতে সমুদ্র মন্থন করেই যেহেতু নানা মহার্ঘ্য জিনিস উঠেছিল, তাই রত্নাকর সিন্ধুকেই এই সমস্ত বস্তুর জনক বা দাতা বলা হয়। এই সূত্র ধরে কবি বলেছেন—দেখ বাপু! যারা ভাবছে, বুদ্ধি আছে, মগজ আছে, অতএব জামা-কাপড়ের পরিপাটি করে কী হবে—তারা কিন্তু ভুল করছে। কবি সেই কত কাল আগেই খেদ করে বলেছেন—জামা-কাপড়ই আসল বাপু! জামাকাপড়ই আসল। জামা-কাপড়ই এখন যোগ্যতার মাপকাঠি। দেখ না, এই রত্নাকর সমুদ্র, তিনি পীতাম্বর বিষ্ণুর ঢঙ্-ঢাঙ্ আর হলুদ কাপড়ের পরিপাটি দেখে তাঁর হাতে ত্রিভুবনের সেরা সুন্দরী নিজের মেয়ে লক্ষ্মীকে তুলে দিলেন, আর পশুর চামড়া-পরা মহাদেবের বোম-ভোলা রকম-সকম দেখে তাঁর হাতে তুলে দিলেন বিষ—পীতাম্বরং বীক্ষ্য দদৌ স্বকন্যাং চর্মাম্বরং বীক্ষ্য বিষং সমুদ্রঃ।
দেখুন, পুরাণকাহিনীতে পৌরাণিক কারণেই শিব দিগম্বর হয়েছিলেন, দেবতাদের প্রয়োজনেই তিনি বিষপান করেছিলেন। কিন্তু এই যে সংসার সমরাঙ্গনে স্ত্রী-পুত্রের চাপে নিরীহ কার্তাবাবুটির মত কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন—শিবের এই কল্পনা অনেক সাধারণ সংসারের সঙ্গেই মিলে যাবে। মজা হল, এই সংসার-যাতনার চিত্রটুকু শুধুমাত্র দেবতার বাহনগুলির রেখায় অপূর্ব ব্যঞ্জনায় এঁকে ফেলেছেন কবি। ঠিক যেমন আরেক কবির বাহনের কল্পনাতেই শিব শেষ পর্যন্ত স্ত্রীলোকের হাতে-গড়া মাটির মূর্তিতে ধরা দিয়েছেন। এই কবিতায়—শিবের গায়ে জড়ানো সাপ সব সময় চায় গণেশের ইঁদুরটিকে খেয়ে ফেলতে, আর সাপটাকে খেতে চায় কার্তিকের ময়ূর। দেবীর বাহন সিংহ আবার আরেক কাঠি সরেস। সে শুধু গণেশের মাথায় জোড়া-দেওয়া হাতির মাথাটুকু মুড়মুড়িয়ে খেতে চায়—সিংহো’পি নাগাননম্। ওদিকে শিবের স্ত্রী পার্বতী নিরন্তর হিংসে করে যাচ্ছেন গঙ্গাকে। শিবের কপালের আগুন—সেও কিছু কম যায় না। সে সব সময় চায়—শিবের মাথায় আটকানো প্রতিপদের চাঁদের দীপ্তিটুকু শুষে নিতে। এইভাবে পরস্পরবিরোধী কতগুলি জীবজন্তু এবং ততোধিক বিরোধী জীবন যাপনের গ্লানিতে শিব শেষ পর্যন্ত সংসার-বিরাগী যোগী হয়ে গেলেন। মনে রাখতে হবে শিব কিন্তু এমনিতেই নির্গুণ, নির্বিন্ন, বীতরাগ, কিন্তু মানুষের বেশির ভাগ সময় মানুষের যেহেতু সংসারের ঠেলায় বিষয়-বৈরাগ্য উপস্থিত হয়, কবির মতে শিবের বৈরাগ্যও সংসারের ঠ্যালাতেই। শুধু তাই নয়, মেয়েরা যে মাটির শিব গড়ে পুজো করে, সেই মাটির মানুষটি হয়ে যাবার পেছনেও কারণ নাকি ওই সংসারের ঠেলা অথাৎ সংসারের সমস্ত অভিযোগ-উপরোধে। বাড়ির কর্তাবাবু যেমন মাটির ঢেলার মত কানে তুলো গুঁজে বসে থাকেন, শিবও তেমনি মৃন্ময় রূপ ধারণ করেছেন—নির্বিন্নঃ স শিবঃ কুটুম্বকলহাৎ মূৰ্ত্তিং দধো মৃন্ময়ীম্।
এই যে শিব মৃন্ময় হয়ে মাটির মানুষের কাছাকাছি এসে পড়লেন, তাতে মধ্যযুগীয় একটি সংসারের বুড়ো কতার সঙ্গে তাঁর উপমা এসে পড়ে আরও সযৌক্তিকভাবে। সেকালে স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর বয়স অনেক ক্ষেত্রেই কম হত। তবে স্বামীটি বয়সে যত বড়ই হোন না কেন দু-তিনটি ছেলেপুলে হওয়ার পরেই স্ত্রীর বয়স যেমন একটু বাড়ত তেমনি সংসার-যুদ্ধে তিনি আস্তে আস্তে সিংহবাহিনী হয়ে উঠতেন। তাঁর সংসার সামলানোর দাপটে এবং হুংকারে বয়স্ক কর্তাবাবুর পালিয়ে গিয়েও শান্তি হত না। শান্তি হত না, কারণ অমন সহস্রবার বিদায় নিয়ে সহস্রবার ফিরে আসার ফলে স্ত্রীর জিহ্বা আরও খরতর হত। তবে এই সব কিছুরই পেছনে সাধারণ সংসারে আর্থিক অনটনই যে কারণ—সে কথা কবিরা ভালই বুঝতেন। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর তুমুল ঝগড়ার মধ্যে কারোরই কিন্তু সেই আর্থিক অনটনের কথা মনে থাকে না, ঝগড়া চলে এবং বেড়ে চলে আরও ঝগড়ার সূত্র ধরে। শিবরূপী স্বামীরা এসে বলেন—প্রতিদিন এত টাকাপয়সা আনি—”সাধ করে একদিন পেট ভরে খাই।”
শিবের ধারণা—স্বামী হিসেবে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেন এবং যথেষ্ট পয়সাও আনেন। কিন্তু এমনই তাঁর সংসার যে, এতকাল এত টাকা-পয়সা এনেও তিনি নিজের বাঘছালটি পালটে একটি ভাল কাপড় পর্যন্ত পরতে পেলেন না। এমন অবস্থায় সমস্ত ক্ষুব্ধ স্বামীর ক্রোধ গিয়ে পড়ে স্ত্রীর ওপর, যেমন শিবেরও পড়ল—
বিধাতার লিখন কাহার সাধ্য খণ্ডি।
গৃহিণী ভাগ্যের মত পাইয়াছি চণ্ডী ॥
সর্বদা কোন্দল বাজে কথায় কথায়।
রসকথা কহিতে বিরস হয়ে যায়।। ভারতচন্দ্র
শুধু দোষ চাপিয়েই নয় ; প্রত্যেক স্বামী এবং প্রত্যেক স্ত্রীই যেমন ভাবেন—অন্য দম্পতিরা সবাই কিই না সুখে আছেন এবং বিশ্বসংসারে শুধু তারাই সবচেয়ে খারাপ বউ বা বরটি পেয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবেই শিব বললেন—
আর আর গৃহীর গৃহিণী আছে যারা।
কতমতে স্বামীর সেবন করে তারা।।
অনির্বাহে নির্বাহ করয়ে কত দায়।
আহা মরি দেখিলে চক্ষুর পাপ যায়।।
শিবের এই আক্ষেপ থেকে অন্নপূর্ণা উমার সতী নামে কলঙ্ক হল কিনা জানি না, কিন্তু সাধারণ সংসারে যারা শিবের মত পয়সা উপায় করতে পারে না, তাদের গৃহিণীদের মুখঝামটা খেতেই হয়। আমরা ভাবি—যিনি পরম ঈশ্বরের গৃহিণী, তিনি না হয় দাম্পত্য অভ্যাসে দুটো কথা স্বামীকে বলেইছেন, তাই বলে কবিরা, মানে ভারতচন্দ্র আর কতটুকু বলেছেন, সংস্কৃতের কবিরা শিবের আর্থিক অবস্থা চরম বিন্দুতে নিয়ে গেছেন। সবাই জানেন—শিব যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি ধারণ করেছিলেন, তা প্রধানত পার্বতীর প্রেমে। দু-একটি পুরাণে অন্য কথা যাই থাকুক, মহাদেবের প্রেমে পার্বতীর অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি আর পৃথক সত্তা না রেখে স্বামীর শরীরে খানিকটা মিশে যেতে চাইলেন। অনন্য পত্নী-প্রেমে শিব শিবানীকে অর্ধ অঙ্গে ধারণ করলেন। সেই থেকে শিব অর্ধনারীশ্বর।
অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে অর্ধেক শিব, আর অর্ধেক পার্বতী। পুরাণ কিংবা স্থাপত্যশিল্পের এই অসাধারণ কল্পনাটিকে পরবর্তী কবিরা কিন্তু অন্যতর মাত্রায় রূপায়িত করেছেন। কবি বিশ্বাস করেন— শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি-ভাবনায় যত মাহাত্ম্যই দেখা যাক, আর শিব যতই ঐশ্বর্যের পরিচয় দিন পার্বতীকে আত্মসাৎ করে—আসলে এরও পেছনে আছে দারিদ্র। কবি লিখেছেন—সংসার ভূমিতে শিবের মত দেবতার পক্ষে নিজের পেট এবং স্ত্রীর পেট—দুটো পেট ভরানো কঠিন ছিল। সেই কারণেই শিব তাঁর একই অঙ্গে ঢুকিয়ে নিয়েছেন নিজের স্ত্রীকে—উদরদ্বয়ভরণভয়াৎ অর্ধাঙ্গাহিদারঃ। ভাবটা এই—সাধারণ গরিব মানুষও—যারা দিনান্তে এক থালায় ভাগাভাগি করে ভাত খায়—উপায় থাকলে তারাও নিজের পেটের মধ্যে প্রিয়া পত্নীর পেটটি ঢুকিয়ে নিয়ে খাওয়ার ভাবনা কমাত। নেহাত শিবের দেবতা হওয়ায় বাস্তব কিছু সুবিধে আছে, তাই নিজের পেট আর স্ত্রীর পেট এক করে নিয়েছেন। কিছু সকরুণ কবি এইখানেই থামেননি। তিনি মনে করেন—শিবের সংসারে তাঁর নিজের স্ত্রীকে যেখানে উদর-সম্পূরণের জন্য স্বামীর পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে হচ্ছে, সেখানে তাঁর একটা ছেলে কার্তিক আর বিয়ে করবেন কি করে? অথাৎ শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি ধারণ করার পেছনে যদি উদরভরণের ভয়টাই না কাজ করে থাকে তাহলে, কার্ত্তিক কি আজও বিয়ে না করে আইবুড়ো থাকেন—যদি নৈবং তস্যৈকসুতঃ কথমদ্যাপি কুমারঃ।
আসলে যে ঈশ্বর সমস্ত জাগতিক ধনসম্পত্তির বীজভূত বলে ইতিহাস-পুরাণে বর্ণিত, সেই পুরাণই তাঁকে ভিখারি বানিয়ে ফেলায় কবিরা শিবের সংসারে নিতান্ত সাধারণ মানুষের জীবনধারণের গ্লানিগুলি দেখতে পেয়েছেন। বস্তুত প্রথম থেকেই শিবের কল্পনাটা এই রকম। বঞ্চনা, দারিদ্র্য, দৈনন্দিন গ্লানি—শিবের সবই সাধারণ মানুষের আদলে। শিবের জীবনও আরম্ভ হয়েছে বড় ছন্নছাড়াভাবে। তার ওপরে আবার এই জটাধারী সন্নিসি মানুষের বিয়ে করার শখও আছে। সমস্ত নরলীল দেবতা, যাঁরা স্বর্গে সিংহাসনে বসে উবশী-রম্ভা সহযোগে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের টাকা-পয়সাও যেমন, পরিচয়ও তেমন, ঐশ্বরিক ক্ষমতাও তেমনি। কিন্তু এই শিবের কোন পিতৃপরিচয় নেই, ধনসম্পত্তি নেই, কিছুই নেই। ভারতচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যাঁরা শিবের বিয়ে নিয়ে দু-চার কথা বলেছেন, তাঁরা নিশ্চয় জানতেন যে, খোদ পুরাণের মধ্যেই পার্বতীর মা মেনকা কপাল চাপড়ে বলছেন—হতচ্ছাড়ী মেয়ে আমার! কি বর পছন্দ করেছে, দেখ সবাই—বরশ্চ কীদৃশো লোকে লব্ধশ্চ দুষ্টয়া পুনঃ। ওর বাপ নেই, মা নেই, ভাই নেই, বন্ধু নেই, এমন কি সাত কুলে কেউ নেই—ন চ গোত্রজঃ। চেহারা বল, বুদ্ধি বল, ঘর-বাড়ি, কাপড়চোপড়, গয়না-গাঁটি কিছু নেই। এমনকি একটা ভাল বাহন পর্যন্ত নেই। তাও যদি বুঝতাম বয়স থাকত, টাকা-পয়সা থাকত, তাও নেই—ন বয়ো ন ধনং তথা। কি দেখে আমি মেয়ের বিয়ে দেব এই ছেলের সঙ্গে—কিং বিলোক্য ময়া পুত্রী দীয়তে, কিং করোম্যহম্।
মেয়ের মায়েদের এসব জ্বালা চিরকালই আছে বোঝা যাচ্ছে। মেয়ে নিজে নিজে প্রেম করে বিয়ে করতে চাইলে, সে পাত্র যদি বুড়ো হয়, নির্গুণ হয় কিংবা তার যদি পয়সা-কড়ির স্বাচ্ছন্দ্য না থাকে, তাহলে মায়ের হৃদয়ে যে কি হয় তা যে-কোন জননীমাত্রই জানেন। শিবপুরাণে হিমালয়-গৃহিণী যে-কোন ক্ষুব্ধ জননীর মতই মেয়েকে বললেন—ওরে আবাগীর বেটী! তোকে আমি বিষ খাইয়ে মারব অথবা কেটেই ফেলব অথবা ভাসিয়ে দেব সাগরের জলে—গরং দদামি তাং পুত্ৰীং … সাগরে বা ক্ষিপাম্যহম্। মায়ের বিলাপ এমনি ধারা চলতে থাকল। কিন্তু অপাত্রে প্রেম করে বিয়ে করার গোঁ ধরেছে যে মেয়ে, মায়ের বিলাপ তার কানে ঢোকে না। সে জোর করেই বিয়ে করতে চায়, যেমন পার্বতীও চাইলেন।
এরই মধ্যে দ্বিজ কালিদাসের শিব আজকের দিনের রক্বাজ মাস্তানের মত উপস্থিত হয়েছেন ভাবী শ্বশুরের কাছে। তিনি যেন হাতে খৈনী টিপতে টিপতে রীতিমত রসিকতা করে শ্বশুরকে বলছেন—
দেখে তব গৌরী কন্যে জামাই হবার জন্যে
তব পুরে হৈল আগমন।
কথা শুনে হিমালয় আর রাগে অঙ্গ দয়
অতিশয় কোপেতে কম্পয়।।
রাগের চোটে হিমালয় দিশেহারা হয়ে যান—
কোপে কহে কিঙ্করেরে মুষ্টি-ভিক্ষা দিএ এরে
ধাক্কা মেরে করহ নির্গত।
শিবও কিছু কম যান না। ভাবী শ্বশুরের রাগ দেখে তিনি আরও রসিক হয়ে ওঠেন। ভিক্ষার চেয়ে গৃহস্থের মেয়েটিই তার বেশি পছন্দ। অতএব—
হেসে বলে ত্রিপুরারি কিবা ভিক্ষা দিবে গিরি
অন্য ভিক্ষা উপজীবী নই।
যদি হও পুণ্যবান কন্যারত্ন কর দান
মর্মদুঃখে শাম্য তবে হই।
শিবের উত্তর শুনে বাবা হিমালয়ের মনে যেমন রাগ হল তেমনি বোধ হয় একটু সন্দেহও হল। তাঁর মনে হল—এর মধ্যে মেয়ে উমাও নিশ্চয় জড়িত, নইলে এত জোর আসে কোত্থেকে? যাই হোক, মেয়ের সঙ্গে তিনি পরে বুঝে নেবেন। এখন দুরন্ত ক্রোধে তিনি ফেটে পড়লেন—
বলে বেটা এত জোর এক চড় মেরে তোর
কাঁথা বাঘছাল, কেড়ে লব।
বাস্তব জগতে দেখি— স্বয়ং মেয়ে যদি তার প্রেমিকের ওপর সব আস্থা রাখে এবং তার প্রেম যদি অবিচল থাকে, তাহলে ভাবী শ্বশুর প্রথমে যতই গালাগালি দিন, জামাই মেজাজ সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা রেখে রসিক হয়ে উঠতে পারে—
হাসি বলে ত্রিপুরারি শুন শুন শুন গিরি
কাঁথা ঝুলি সব তুমি লয়।
ইহা আমি নাহি চাই কেবল হব জামাই
মম বামে গৌরীরে বসায় ॥পুরাণগুলিতে বিয়ের আগে শিব এত রসিকতা করতে পারেননি বটে, কিন্তু তাঁর সপক্ষে যে প্রেমিকার জোর ছিল, তা বেশ বোঝা যায়। গিরিপত্নী মেনকার রাগ যত চড়তে থাকল, বিষ্ণু ব্রহ্মা ইত্যাদি দেবতারা তাঁকে তখন শিবের মর্যাদা, ক্ষমতা এবং অলৌকিকতা সম্বন্ধে তত বোঝাতে থাকলেন, ঠিক যেমন আজও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরা প্রেমিক-প্রমিকার অবিচল ভাব দেখে বর হিসেবে এবং কনে হিসেবে তাদের নিজস্ব গুণ এবং শক্তি সম্বন্ধে ইতিবাচকভাবে সিদ্ধান্তে আসেন বা সেইমত মা-বাবাকে বোঝান। পুরাণগুলিতে শিবের ঐশী শক্তি, মাহাত্ম্য এবং মর্যাদা খানিকটা সুবিধে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু খোদ পুরাণেই গিরিপত্নী যতখানি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তার সূত্র ধরেই কবিরা তাঁকে এমন ছন্নছাড়া করে বিয়ে দিয়েছেন যে, এমনটি আর হয়নি, হবেও না।
শিব বিয়ে করতে এসেছেন আর সংস্কৃতের কবি লিখছেন যে, বিয়ের আসরে, কন্যাপক্ষের কোন বয়োবৃদ্ধ মানুষ শিবকে নিজের প্রয়োজনে এবং আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন— তা বাবাজির গোত্র কি? কি করা হয়? টাকা-পয়সার গোছ কি রকম? বংশ পরিচয় কি? বয়স কত? পড়াশুনো কত দূর? মাথা গোঁজার জন্য একটা বাড়িটাড়ি আছে তো? তোমার বন্ধুবান্ধব কারা? জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে কে কে আছেন? মা-বাবা—তাঁদের পরিচয়ই বা কি?
আমরা জানি— আজ থেকে যাঁরা পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেরও বিয়ে করেছেন, সেই সব বর-বেচারাদের এসব প্রশ্ন শুনতেই হত। এখনও হয়, তবে একটু মার্জিতভাবে। শিবকেও তাই শুনতে হয়েছে। কবি লিখেছেন— এসব প্রশ্ন শুনে ছন্নছাড়া শিবের মনে ভারি কষ্ট হল, কারণ এসব প্রশ্নের সদুত্তর তাঁর কাছে ছিল না। নিরুত্তর শিব শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করেছিলেন বটে, তবে কবির ধারণা— সেই যে অপ্রস্তুত হয়ে তিনি লোকালয় ছেড়ে শ্মশানে বাস করা আরম্ভ করলেন, আর তাঁর বাড়ি ফেরা হয়নি— মালিন্যেন হৃদঃ স্বকীয়ভবনাং তক্ত্বা শ্মশানে স্থিতঃ।
ভাবুন একবার! শিব শ্মশানবাসী ঠিকই। কিন্তু শ্মশানবাসের কারণ হিসেবে কবি যা বললেন— তা একেবারে মনুষ্যলোকের অভিসন্ধিতে ভরা। চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে মানসিক নির্বেদ উপস্থিত হলেই মানুষ দু-একবার শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ায়। শিবের শ্মশানবাসের পেছনেও যে নিতান্ত সেই মানুষের মনস্তত্ত্বই কাজ করেছে— এ ধারণাটা সংস্কৃত কবির স্বকপোলকল্পিত রসবৈচিত্র্য হলেও খোদ পুরাণকারেরাই যে তার সূত্র করে দিয়েছেন— তা আমরা শিবপুরাণে মা মেনকার ক্রোধোক্তি থেকেই বুঝতে পারি।
শিবের বিয়ের সময়,অনুরূপ আরেকটি শ্লোকে স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মাকে তো রীতিমত মিথ্যা কথা বলতে হয়েছিল। শিব বিয়ের সাজে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। যজ্ঞ-টজ্ঞ হচ্ছে, কন্যাপক্ষের পুরোহিত মন্ত্র পড়তে পড়তে শিবকে বললেন— বাবাজি! এবার তোমার পিতৃ-পিতামহের নাম বল। প্রশ্নটা শুনেই শিব লজ্জায় মাথা নীচু করে রইলেন— নতমুখকমলো জাতলজ্জো বভূব— তাঁর বলার কিছুই নেই। ব্ৰহ্মা দেখলেন—শিব সবার সামনে অপ্রতিভ হয়ে কোন কথাই বলতে পারছেন না। ব্রহ্মা সমস্ত দেবকুলের দাদু বলে কথা, বিশেষত তিনি শিবের বিয়েতে বরযাত্রী এসেছেন, শিবের বিপদ তো তাঁকে দেখতেই হবে। তাছাড়া বিয়ের সময় বয়োবৃদ্ধ বরকর্তা হিসেবে তিনি বরের হয়ে উত্তর দিতেই পারেন। ব্রহ্মা তাই বেশ বুদ্ধি করে কন্যাপক্ষের পুরোহিতকে বললেন— শুনুন তাহলে। ওর প্রপিতামহের নাম বেদকণ্ঠ, পিতামহ হলেন গিয়ে উগ্রকণ্ঠ, পিতার নাম শ্রীকণ্ঠ আর ওর নিজের নাম নীলকণ্ঠ।
লক্ষণীয়, ব্রহ্মা যে হরকুলের পিতৃ-পিতামহের নাম করলেন, তা একেবারেই দেবকুলের মত নয়, বরঞ্চ পুরোপুরি মনুষ্যলোকের মত। ‘কণ্ঠ’ শব্দটা শিবের প্রত্যেকটি আদি নামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বেশি করে যেন মানুষের গন্ধ পাওয়া যায়, কেননা আমাদের মধ্যে বাপ-পিতামহের নামের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে নাম রাখাটা অনেক ক্ষেত্রেই প্রথা। ব্রহ্মাও তাই মনুষ্যনামের প্রথায় নীলকণ্ঠের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে শিবের বাপ-ঠাকুর্দার নাম বলে গেলেন। কিন্তু যা বলছিলাম— চতুর্মুখ ব্ৰহ্মার যে মুখগুলি সমস্ত বেদমন্ত্র প্রথম উচ্চারণ করে চিরশুদ্ধ হয়েছিল, সে মুখে তিনি কি মিথ্যেটাই না বললেন। আসলে এই বেদকণ্ঠ, উগ্রকণ্ঠ কিংবা শ্ৰীকণ্ঠ বলে নীলকণ্ঠ শিবের সাত কুলে কেউ নেই। এগুলো শিবেরই এক একটা নাম, যে নামে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে শিবকে ডাকা হয়েছে, কিংবা যে নামের দু-একটি খুব সুপ্রযুক্ত না হলেও তা দিয়ে শিবকে বোঝাতে বা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
বিয়ের সময় শিবের এই যে অপ্রস্তুত অবস্থা— এটা তাঁর মনুষ্যায়ণের একাংশমাত্র। বাস্তবিক, শিবকে অপ্রস্তুত করে, সমুদ্রমন্থনে বিষবঞ্চনা করে কবিরা যতটা না আনন্দ পেয়েছেন, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছেন তাঁকে ভিখারি সাজিয়ে, যে কথা আমি আগেও একটু বলেছি— যে কথার সূত্র ধরে শিবের ছন্নছাড়া স্বভাবের কথা উঠল। একথা মনে রাখতে হবে যে, কবিরা সবাই কালিদাস বাণভট্টের মত রাজসভার কবি ছিলেন না। যে সব কবিদের কবিতা আমরা ব্যবহার করেছি, তাঁদের অনেকেই একটি কি দুটি কবিতা-মুক্তক রচনা করেছেন এবং তাঁদের অনেকেই ছিলেন অত্যন্ত গরিব। স্ত্রী-পুত্র-সংসার প্রতিপালনের যাতনা নিয়ত তাঁদের দগ্ধ করেছে, এবং সেই সংসার-যাতনা, আর্থিক কষ্ট ধরা পড়েছে তাঁদের শিব-কল্পনায়। শিব যেহেতু পৌরাণিক কল্পনাতেই যোগী-ভিখারি, তাই শিব সম্বন্ধে শ্লোক রচনা করার সময় কবিদের জীবন-যন্ত্রণা মিশে গেছে শিব-কল্পনায়। ফলত শ্লোকগুলি বাস্তব জীবনের অসাধারণ প্রতিফলনে এতই চমৎকার যে, সে শ্লোকগুলি পড়লে কবিদের ওপর আমাদের মায়া হয়।
আপনারা নন্দী-ভৃঙ্গীর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। এই যুগল শব্দটি আমরা অনেক মানুষের ওপর ব্যবহারও করে থাকি, বিশেষত সদা অনুগত ভৃত্য কিংবা অভদ্র চেহারার অনুচরদের সম্বন্ধে নন্দী-ভৃঙ্গী শব্দটা প্রায় প্রাবাদিক। শিবের এই দুই অনুচরের মধ্যে ভূঙ্গী হচ্ছে ভীষণ রোগা। কবিদের মতে ভৃঙ্গী যে দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে— তা তার প্রভুর বাড়ির অবস্থা চিন্তা করেই। যে বাড়িতে গৃহকতার গৃহিণীরই ভাত জোটে না, অথচ যার দুই ছেলেই ভীষণ খায়, সে বাড়িতে কর্তা এতগুলি মুখে অন্নের যোগান দিয়ে, তারপর চাকর পুষবেন কি করে— সে কথা ভৃত্য ভৃঙ্গীকেই চিন্তা করতে হচ্ছে এবং সে রোগাও হয়ে যাচ্ছে— দেবঃ কথং পোক্ষ্যতি/ ইত্যালোক্যেব বিশুষ্ক-পঞ্জর-তনুঃ।
যে মানুষ ধনী লোকের ব্যবহার নকল করে বাড়িতে সব সময়ের কাজের লোক রাখেন, তার যদি খেতে দেওয়ারই ক্ষমতা না থাকে, সে বাড়ির চাকর-বাকরও প্রভুর কাজ-কারবার এবং চরিত্রের সমালোচনা করে। শিবের সদা-অনুগত ভৃত্য ভৃঙ্গীও তাই করছে। ভৃঙ্গী ভাবছে— আচ্ছা মালিকের পাল্লায় পড়েছি আমি! লোকটা আমারই মত গতর খাটিয়ে লোকের বাড়িতে কি রাজার বাড়িতে কাজ করলে পারে, তাও করবি না— সেবাং নো কুরুতে। আচ্ছা, লোকের বাড়িতে কাজ করতে যদি তোর লজ্জা করে, তো চাষ কর, তাও করবি না— করোতি ন কৃষিং। যদি বল— চাষ-বাস করা অধম পুরুষের কাজ, তা বেশ তো, তুই বুদ্ধি খাটিয়ে, পরিশ্রম করে ব্যবসা-বাণিজ্য কর— সে মুরোদও নেই— বাণিজ্যম্ অস্যাস্তি নো।
আপনারা ভাবছেন— শিবের পুরাতন ভৃত্য, একান্ত অনুচর, ভৃঙ্গী কি তার মালিকের সম্বন্ধে এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতে পারে? আমরা বলি—নিশ্চয়ই পারে। চাকর-বাকরেরা, বিশেষত সে চাকর-বাকর যদি পুরনো হয় এবং তার মালিকের যদি রুজি-রোজগার না থাকে, তাহলে মালিকের পেছনে তারা এমনি করেই কথা বলে। তা ছাড়া ভৃঙ্গীর এই বক্তব্যের পেছনে পার্বতীর আশকারা ছিল। কারণ বাড়ির গৃহিণী হিসেবে পার্বতী ভারতচন্দ্রের বয়ানে শিবের ওপর রাগ করে বলেছিলেন— ‘বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বাস/ তাহার অর্ধেক চাষ’ — কিন্তু চাষ-বাস, বাণিজ্য — কোনটাই শিবের পোষায় না, কারণ তাঁর বয়স হয়েছে অনেক—
বৃদ্ধকাল আপনার নাহি জানি রোজগার
চাষবাস বাণিজ্য-ব্যাপার।
এসব রুজি-রোজগার নিয়ে কথা কাটাকাটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেখানে বারবার চলেছে, সেখানে পুরাতন ভৃত্য যে তাঁদের আড়ালে দুটো কথা স্বগতোক্তি করবে— এতে আশ্চর্য কিছু নেই। তা ছাড়া ভৃঙ্গী শিব-পার্বতীর স্বভাবদোষও লুকোয়নি। শিবের রুজি-রোজগার কিচ্ছুটি নেই, অথচ মাঝে মাঝেই তিনি পার্বতীর সঙ্গে বসে বসে পাশা খেলেন, জুয়ো খেলেন। তা ছাড়া মেয়েছেলের ব্যাপারে শিব বড় স্ত্রৈণ, পার্বতীর আঁচল ছাড়েন না কখনও। ভৃঙ্গী ভাবে— এই মানুষ তাস-পাশার নেশা এবং স্ত্রীর নেশা কোনটাই ছাড়তে পারে না— দূতস্ত্রীব্যসনং ন মুঞ্চতি— তবু তাঁকে লোকে দেবতা বলে ডাকে! এই বাড়িতে কি চাকরি চলে— এত সব ভেবে ভেবেই ভঙ্গী রোগা হয়ে যাচ্ছে। ভৃঙ্গীর ধারণা— শিব যে পার্বতীর প্রেমে ভূলে তাঁকে স্বদেহে আত্মসাৎ করেছেন এবং অর্ধনারীশ্বর হয়েছেন এ তাঁর স্ত্রৈণতারই ফল। ভঙ্গীর ভয় হয়— যে ভাবে এক স্ত্রী তাঁর মনিবের স্ত্রৈণতার সুযোগ নিয়ে শিবের অর্ধ অঙ্গ গ্রাস করেছে তাতে তাঁর আরেক সতীন গঙ্গা যদি রাগ করে শিবের মাথা থেকে টুপ করে নেমে এসে তাঁর আরেক অঙ্গ অধিকার করেন, তাহলে শিব গোটাটাই মেয়েছেলে হয়ে যাবেন। শিবের আর কোন আলাদা সত্তাই থাকবে না— তস্যার্ধং কুপিতা হঠাৎ যদি হরেন্মূর্ধ্নি স্থিতা জাহ্নবী— এ অবস্থায় ভৃঙ্গী কোথায় থাকবে, কোথায় চাকরি করবে— এটাই তার চিন্তা।
এ কথায় অবিশ্বাসের কোন হেতু দেখি না, কারণ পুরাণকারেরা জানিয়েছেন যে, শিব পার্বতীর সঙ্গে পয়সা বাজি রেখে পাশা খেলতেন। শিবের দ্যূতাসক্তির সুযোগ। নিয়ে পার্বতী জিততেন এবং শিবকে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষায় বেরোতে হত। পাশাখেলায় সর্বস্ব হারিয়ে শিবকে তাঁর পরনের কৌপীনটি পর্যন্ত পার্বতীর কাছে বাঁধা দিয়ে দিগম্বর হয়ে ভিক্ষা করতে হত। এই যে পাশাখেলায় নেশা, এই দারিদ্র্য এবং এই গাঁজা-ভাঙের মৌতাত—এর মধ্যে গরিব ঘরের নির্লজ্জ ব্যসনগুলি লুকিয়ে আছে। হয়তো পৌরাণিকদের শিব-কল্পনায় বাড়াবাড়ি আছে, নইলে কেমন করে আমরা অণিমাদি অষ্টসিদ্ধির নায়ককে শুধু সিদ্ধির নেশায় মাতিয়েছি, বিভু, সর্বব্যাপ্ত ঈশ্বরকে দিগম্বর করে ছেড়েছি, শিব-শক্তির অভেদ-কল্পনাকে স্ত্রৈণতার আকারে বদ্ধ করেছি। এমনকি তাঁর স্থিতপ্রজ্ঞ যোগিস্বভাবকে দারিদ্র্যের ছাঁচেও ফেলেছি। দেবতা যে কিভাবে মানুষ হয়ে যান, ঈশ্বর-স্বভাব যে কিভাবে মনুষ্যায়িত হয়ে মানুষের তালে-লয়ে বাঁধা পড়ে, তারও একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আছে শিব-পরিকর ভৃঙ্গীর জবানীতেই। তবে এ কবিতার সামান্য একটু ভূমিকা দরকার। মনে রাখবেন— আগেকার দিনের রাজা-মহারাজারা অনেকেই অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং নিত্যনতুন কবিবর্গকে উৎসাহ দিতেও তাঁরা ভুলতেন না। একদিন এক নতুন কবি এসেছেন এইরকমই এক সমঝদার রাজার কাছে। উদ্দেশ্য— রাজাকে কবিতা শুনিয়ে যদি কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটে। রাজা প্রথমেই কবিকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন— দেখ বাপু! নিত্যি নিত্যি ওই শৃঙ্গাররস আর বস্তাপচা ভাঁড়ামি শুনে আমার কান পচে গেছে। যদি নতুন কিছু থাকে তো বল। কবি বললেন— মহারাজ? আমার কবিতার মধ্যে বেশি কিছু তো নেই, তবে মহারাজ! থাকবেই বা কি করে— আমার ইষ্টদেবতা দেবাদিদেব মহাদেব যে মারা গেছেন। আমারও তাই আকাল চলছে। রাজা বললেন— বল কি? যিনি এই তিন ভুবনের সংহারকর্তা, দুষ্টজনের কৃতান্ত, তিনি মারা গেছেন? তোমার কি কাব্য করতে করতে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে, কবি? যাও, তুমি বরং মাথায় ভাল করে মধ্যম-নারায়ণ তেল ঠেসে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করে, তারপর এস। কবি বললেন— মহারাজ সত্যিই শিব মারা গেছেন, নইলে আজকে আমি শিবের অনুচর ভূঙ্গীর মত ভিক্ষা করতে বেরোই? রাজা কিছুই বুঝতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন না যে, কবির অথাগমের ইচ্ছার সঙ্গে ভৃঙ্গীর ভিক্ষা করা অথবা শিবের মারা যাবারই কি সম্পর্ক। আসলে রাজা ববাঝেননি যে কবি ততক্ষণে তাঁর কবিতার ভূমিকা রচনা করে ফেলেছেন, যেমনটি আমরাও করে ফেলেছি। অবশ্য এই কবিতা বুঝতে হলে পাঠকের মনে রাখতে হবে যে, ভগবান শ্রীহরির সঙ্গে একাকার হয়ে হরিহর মূর্তি ধারণ করেছিলেন এবং অন্য সময় পার্বতীর সঙ্গে একতনু হয়ে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি ধারণ করেছিলেন। দ্বিতীয় কল্পনাটা আমরা আগে বলেছি। বিদ্বান মানুষ হিসেবে রাজার সমস্ত পৌরাণিক কাহিনী জানা আছে। অতএব এবার কবি তাঁর কবিতা আরম্ভ করলেন।
কবি বললেন— মহারাজ! সত্যিই শিব মারা গেছেন। স্বয়ং শিবেরই অতিরিক্ত দৈব রসাবেশের ফলে তাঁর শরীরের অর্ধেক চলে গেছে হরি-হর মিলনে। আমরা হরি-হর আত্মার অনেক মাহাত্ম কীর্তণ করি বটে, তবে এই ঘটনায় ভগবান শ্রীহরি আত্মভোলা শিবের অর্ধ অঙ্গ হরণ করেছেন— অর্ধং দানববৈরিণা। শিবের শরীরের আরেক অর্ধ গেছে তাঁর আপন স্ত্রী পার্বতীর প্রতি অতি-প্রেমের ফলে। পার্বতী একটু ভয় পেয়ে শিবের শরীরে মিলিত হতে চাইলেন, আর অমনি বোমতোলা শিব রাজি হয়ে গেলেন। তাহলে আর থাকল কি মহারাজ। শরীরের দুটো অর্ধই তো চলে গেল, তাই বলছি শিব মারা গেছেন। কবি এবার একটু রসিয়ে বললেন— হ্যাঁ মহারাজ! আপনি এখনও সন্দেহ করতে পারেন বটে, তবে আমার হাতে আরও প্রমাণ আছে। মহারাজ নিশ্চয় আপনি জানেন— মানুষ মারা গেলে মৃত মানুষের ধনসম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয় অন্য লোকে। তা মহারাজ এখানেও তো তাই হয়েছে। এই দেখুন না— শিবের তিরোভাবের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা চলে গেছে সাগরের হাতে। ভাবটা বুঝবেন মহারাজ! গঙ্গা শিবের অন্যতম নায়িকা, শিবেরই সোহাগে ভুলে শিবের মাথায় উঠে বসেছিল। চিরকালের স্বামী সাগরকে ছেড়ে নতুন মানুষের সোহাগ বেশিদিন বিধাতার সয় না। তাঁকে আবার ফিরে যেতে হয়েছে পুরাতন ‘তরঙ্গাধরদানদক্ষ’ সাগর-নায়কের কাছে। তারপর শিবের শিরোভূষণ শশিকলার অবস্থা দেখুন। শিবের মৃত্যুর পর পরই তাকে চলে যেতে হয়েছে আকাশে— গঙ্গা সাগর অম্বরং শশিকলা। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে আর ছিল শিবের সাপখানি— তিনি চলে গেছেন পাতালে। মহারাজ! যদি আপনি স্থাবর সম্পত্তির কথা তোলেন— তাহলে সে হল তাঁর স্বর্গীয় ঐশ্বর্য এবং বৈরাগ্য। তা মহারাজ! ওই স্থাবর গুণ দুটি আশ্রয় করেছে আপনাকে— রাজার ঐশ্বর্য আপনার আছে, কিন্তু তাতে আপনার আসক্তি নেই। তাই স্বাধিকারবশে ও দুটি আপনারই করতলগত। আর বাকি রইল শিবের ভিক্ষাবৃত্তি— মহারাজ! সেটি অধিকার করেছি আমি। শিবের মৃত্যু হওয়ায় চাকরি খুইয়ে শিবের অনুচর ভৃঙ্গী যে বৃত্তি গ্রহণ করেছিল আজ আমিও সেই বৃত্তি গ্রহণ করেছি। তাই বলছি মাহারাজ! শিব মারা গেছেন, তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিও সবার মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে। আপনি অবহিত হোন।
এমন সুন্দর একটি শ্লোক শুনে রাজা অত্যন্ত পুলকিত হলেন বোধ করি। ভিক্ষার্থী কবি পৌরাণিক কবিকল্প কাজে লাগিয়ে যাচনা করার বেদনাকে যে এমনভাবে কাজে লাগাতে পারেন— তা ভাবা যায় না। কবি অথবা ভৃঙ্গীর দৃষ্টি থেকে শিবের দারিদ্র-কষ্ট আমাদের কাছে যতটা না তীব্র হয়, তার থেকে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ এবং চমৎকার লাগে যে— কবি মানুষের শিবায়ন ঘটিয়ে নিজের আদলে শিবকে গড়েছেন। শব্দশ্লেষ করে নিজের সঙ্গে শিবের অভেদ কল্পনার শেষ পর্যায়ে এসে আর এক কবি একটু বিড়ম্বনায় পড়েছেন। কবির বক্তব্য—লোকে শিবের আরাধনা করে দেহান্তে শিবত্ব লাভ করে, আমি জীয়ন্তেই শিবত্ব লাভ করেছি প্রায়। শিব শ্মশানে-মশানে শুয়ে শ্মশানের ছাই গায়ে মেখে ভস্মে ধূসর হয়েছেন, আমিও মাটিতে শুয়ে, খড়ের ওপর শুয়ে ধুলায় ধূসর হয়েছি। শিবের হাতে ত্রিশূল আছে বলে শিব যেমন শূলী-শম্ভু, তেমনি আমিও শূলী, তবে আমার হাতে শূল নয়, পেটে শূল। দিনের পর দিন সাত-বাসী পচা খাবার খেয়ে খেয়ে পেটে আমার শূল বেদনা ধরে গেছে। শিবের মাথায় একরাশ জটা আছে, দিনের পর দিন তেল না মেখে আমার ঘন চুলগুলিও এখন জটার আকার ধারণ করেছে— তৈলাভাববশাৎ অমী শিরসি মে কেশাঃ জটাত্বং গতাঃ। শিবের বাহন যেমন ষাঁড় আছে, তেমনি আমার ঘরেও একটি শিবের ষাঁড় ছেলে আছে। শিবের বুড়ো ষাঁড়ের যেমন লাঙল বইবার ক্ষমতা নেই, আমারটারও তেমনি সংসারের জোয়াল কাঁধে নেবার ক্ষমতা নেই। আর বউ যা একখানি আছে আমার ঘরে, তার সঙ্গে শিবের বউয়ের তফাত নেই কোন— দিনরাত ঝগড়া-ঝাঁটি, গৃহযুদ্ধ চলছে— ভার্যা গৃহে চণ্ডিকা।
কবির সিদ্ধান্ত— শিব হতে গেলে যা যা প্রয়োজন, সবই আমার প্রায় আছে, নেই শুধু শিবের অর্ধচন্দ্রখানি। না, না, তার জন্যে শিবের মাথা থেকে তাঁর শিরোভূষণ বাঁকা চাঁদখানি ছিনিয়ে আনার প্রয়োজন নেই। আমার সংসারে যা অবস্থা তাতে তোমরা যদি কেউ আমাকে একটি অর্ধচন্দ্র দাও, মানে গলা ধাক্কা মেরে বাড়ি থেকে বার করে দাও, তাহলেই সম্পূর্ণ শিবত্ব প্রাপ্ত হই।
শিবসংক্রান্ত শ্লোকগুলির মধ্যে আমি এটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। দারিদ্র্য, সংসার যাতনার চরম বিন্দুতে পৌছেও সংসারের মায়াতেই মানুষ ঘর ছাড়তে পারে না। এই সময় একটা ধাক্কা চাই —যা বাইরের মানুষ নয়, ঘরের মানুষ দিলেই সম্পূর্ণ হয়। শুধুমাত্র শব্দশ্লেষের মাধ্যমে একটি শ্লোকের মধ্যে দারিদ্র্য, যাতনা, মমতা এবং বৈরাগ্যের ইচ্ছা যে এমন নিপুণভাবে প্রকাশ করা যায়, তা রসিক মানুষমাত্রেই বুঝবেন। শব্দের ব্যঞ্জনায় দেবতার চরিত্রের মাধ্যমে আপন অবস্থার প্রকাশ আরও একটি শ্লোকে দেখেছিলাম— সেটি অবশ্য নারায়ণ-হরি সংক্রান্ত। দার্শনিক এবং শাস্ত্রমতে ভগবান শ্রীহরির আদি নেই, অন্ত নেই, মধ্যও নেই অর্থাৎ তিনি অনাদি, অনন্ত, সর্বব্যাপ্ত বিভু, পুরাণ-পুরুষ। সংসার জগতের জন্ম-মরণাদি দশাও তাঁকে স্পর্শ করে না। কিন্তু লৌকিক জগতের দরিদ্র কবি শুধুমাত্র এই কটি দার্শনিক বিশেষণ মাত্র উপজীব্য করে শব্দশ্লেষে নিজের অবস্থা বর্ণনা করছেন। কি অসাধারণ সেই কবিতা। কবি বলছেন— আমার পরিধানের কাপড়টির মত যে ভগবান শ্রীহরি, তাঁকে আমার নমস্কার। ভগবান শ্রীহরি যেমন পুরাণ-পুরুষ, তেমনি আমার কাপড়টিও বহু পুরাতন। তাঁর যেমন আদি নেই, মধ্য নেই, অন্ত নেই, শত-ব্যবহারে আমার কাপড়টিও তেমনি জীর্ণ— কোথায় সে কাপড়ের বুনুনিতে কোনদিন আরম্ভ ছিল, কি শেষ ছিল— তা টের পাওয়া যায় না— আদি-মধ্যান্ত-বিহীনং দশাহীনং পুরাতনম্। ভগবান— আদি, মধ্য, অন্তহীন, অনাদি, অনন্ত— দশাহীন। শোনা যায়— ভগবান শ্রীহরি জন্ম-মরণশীল মানুষের মত দশ-দশায় আবদ্ধ নন। আমার কাপড়টির অবস্থাও তাই। দশাহীন। দশা— মানে আরেক অর্থে কাপড়ের পাড়। গরীবের থান কাপড় জুটেছে— এই যথেষ্ট, তার আবার পাড়! লজ্জা নিবারণের জন্য শুধু এক ফালি কাপড় পরে আছি, তা সেটা কাপড়ের মাঝখানের অংশ, না প্রথম অংশ, না শেষ — তা ভাল করে ঠাহর করতে পারি না, পাড়ের বাহার দূরে থাকুক। এমন নয় যে এমনি কাপড় আরেকখানা আছে আমার। এক্ষেত্রে ভগবান শ্রীহরির সঙ্গে মিল আছে আমার শতচ্ছিন্ন কাপড়খানির। শ্রীহরি অদ্বিতীয়, এক, ব্রহ্মস্বরূপ, একমেবাদ্বিতীয়ম্। আমার কাপড়ও তেমনি, একটি বৈ দ্বিতীয় নেই। আমার পরিধেয় বসনখানির সঙ্গে যাঁর দার্শনিকভাবেই এত মিল, সেই ভগবান হরিকেই আমার প্রণাম— অদ্বিতীয়ম্ অহং বন্দে মদ্বস্ত্রসদৃশং হরিম্।
॥ ৪ ॥
হরের কথা বলতে বলতে হরির কথায় চলে এলাম। শাস্ত্রযুক্তি বলেছে— হরি-হরে ভেদবুদ্ধি মোটেই ভাল নয়। আমরা তাই দীনতার পরিসরে যে দুই কবি হরি-হর আত্মা, তাঁদের কথা বললাম। তা ছাড়া সব কথা শিবকে নিয়েই হবে কেন? আরও তো দেবতা আছেন। তাঁদের কথাও তো একটু আধটু বলতে হবে। বিশেষত ধরুন, যিনি এই সম্পূর্ণ বিশ্বসংসারের ঠাকুরদাদা বলে পরিচিত, সকলের আদিভূত, সৃষ্টিকর্তা সেই ব্রহ্মার সম্পর্কে কবিরা খুব বেশি মন্তব্য করেননি। তবে ব্রহ্মা খুব মানিয়ে চলা মানুষ এবং যথেষ্ট রসিকও বটে। পুরাণে, ইতিহাসেও তাঁর বর্ণনা সেই ধারাতেই হয়েছে। ব্রহ্মার পৌরাণিক বৈশিষ্ট্য হল—বিষ্ণুর নাভিপদ্মে তাঁর জন্ম, তিনি আদি পিতা, তিনি বুড়ো এবং তিনি সৃষ্টিকর্তা।
পরবর্তী কবিরা ব্রহ্মার সম্বন্ধে যত রসিকতা করেছেন, তা প্রধানত তাঁর বৃদ্ধত্ব নিয়ে এবং আপাতদৃষ্টিতে তাঁর সৃষ্টির ত্রুটি নিয়ে। ব্রহ্মা আদি সৃষ্টিকর্তা বলেই পৌরাণিকেরা তাঁকে বৃদ্ধ বলেছেন, পিতামহ বলেছেন। কবিরাও তাঁকে বুড়ো ঠাকুরদাদাই বলেছেন— তবে তার কারণ অন্য। তাঁদের ধারণা— অসাধারণ যৌবনবতী। সুন্দরীদের সৃষ্টি করেও যে দেবতা ভোগ না করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, তিনি অবশ্যই বুড়ো হবেন। প্রতিনিয়ত বেদাভ্যাস করতে করতে তিনি হয়তো অত্যন্ত জড় হয়ে পড়েছেন, কালিদাস যাকে বলেছেন ‘বেদাভ্যাসজড়ঃ’; নয়তো অতিরিক্ত জরাবৈকল্যের ফলে তাঁর রমণী সম্বন্ধে কৌতুহল বলে কোন জিনিস নেই। আমাদের পুরনো কালের যুবক-যুবতীরা আবার নানা কারণেই সৃষ্টিকর্তার ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। যুবকগোষ্ঠীর নালিশ হল— শরীরের মধ্যে দু-একটি অঙ্গ সংস্থান করার ব্যাপারে বিধাতার কার্পণ্য আছে, ত্রুটিও আছে। ভাগবত পুরাণের কবি গোপীদের যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন—অভীষ্ট নাগর পুরুষের রূপ দেখতে দুটিমাত্র চোখ মোটেই পর্যাপ্ত নয়, তার ওপরে আবার সেই চোখেও খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার উপায় নেই চোখে আবার পাতা পড়ে। গোপীরা তাই ডাক্তার-বদ্যির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মুখে ছাই দিয়ে ওই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকেই দুষে গেছেন— যৎ-প্রেক্ষণে দৃশিষু পক্ষ্মকৃতং শপন্তি। স্বয়ং চৈতন্যদেব রাধাভাবে পুরাণ-কবির গোপী-বিরহ সৰ্বথা মেনে নিয়ে কবিরাজ গোস্বামীর ভাষায় খেদোক্তি করেছেন—
না দিলেক লক্ষ কোটি সবে দিল আঁখি দুটি
তাহে দিলে নিমেষ আচ্ছাদনে।
বিধি জড় তপোধন রসশূন্য তার মন
নাহি জানে যোগ্য সৃজনে ॥
ভাব-ভালবাসার রাজ্যে বিধাতাপুরুষের ক্রিয়া-কর্ম এতই নিন্দিত যে প্রায়ই তাঁকে শত শত যুবক-যুবতীর গালমন্দ শুনতে হয়। আরও একটি ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অপবাদ হল এই যে, তিনি গুণীর সঙ্গে সমঝদারের মিলন ঘটাতে পারেন না। বিশেষত শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আরও বড় কারসাজি আছে তাঁর। রুচিশীল কবি সেই দশম-একাদশ খ্রীষ্টাব্দে স্তুতিচ্ছলে বিধাতাকেই নিন্দা করে বলেছেন— আশ্চর্য, কি আশ্চর্য! সময়কালে ঠিক উচিত সৃষ্টিটি করে ফেলা— এ বিধাতার হাতে আসে না। কিন্তু কপালগুণে একটি মাত্র ক্ষেত্রে তিনি দারুণ ঔচিত্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন—জাতা দৈবাদ্ উচিতরচনা সংবিধাতা বিধাতা। কবি বলেছেন—নিম গাছে হাজার হাজার বিষতেতো নিমফল যেমন দিয়েছেন বিধাতা, তেমনি সেগুলিকে আশ মিটিয়ে খাবার জন্য নিম্বরসজ্ঞ হাজার হাজার কাকও তৈরি করেছেন বিধাতা।
স্পষ্টতই এটা কবির ব্যাজস্তুতি। পৃথিবীতে বাজে কবিতা, অসহ্য কাব্য-উপন্যাসের অভাব নেই, তেমনি সেই সব কাব্য, উপন্যাস, কবিতা গোগ্রাসে পড়ার মত কাক-পণ্ডিতেরও অভাব নেই। বড় দুঃখে, বড় যাতনায় কবি বিধাতা পুরুষকে ধন্যবাদ দিয়ে এই কবিতা লিখেছেন। তাঁর দুঃখ— সুলেখক সুধীজনের সহৃদয় পাঠক পাওয়া যায় না, কিন্তু রুচিহীন অথবা কুরুচি কবির নিজের জগতের ভূরি ভূরি সহৃদয়ও আছে, যারা শুধু লোভাতুর কাকের মত নোংরা জিনিসও গিলতে ভালবাসে— কবলনকলাকোবিদঃ কাকলোকঃ, তাদের কাছে রুচির বালাই নেই। এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে কবি মনে করেন— বিধাতার সৃষ্টি উপযুক্ত হয়েছে— যোগ্যের সঙ্গে যোগ্যতমের যোগে।
ভারি রসিকতা হল! জীবনযন্ত্রণায় কাতর কবি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে খুব এক প্রস্থ গালাগালি দিয়ে নিজের যন্ত্রণার তথা নিজের পোড়া কপালের ঝাল মেটালেন। বেশ বুঝতে পারি— এসব রসিকতা নেহাতই রসধর্মী, ঠাকুরদাদা ব্রহ্মার গায়ে এসব পরিহাস বড় বেশি বেঁধে না। তবে ব্রহ্মার নির্মোহ এবং পক্ষপাতহীন ব্যবহার নিয়ে চরম রসিকাটি বোধ হয় করেছেন আর্যাসপ্তশতীর কবি আচার্য গোবর্ধন। কবির বক্তব্য— নায়ক এবং নায়িকা— দু’জনেরই ভাব বুঝে চললে চিরকালই তাদের সঙ্গে থাকা যায়, তাদের চিরদিনের বন্ধু হওয়া যায়। এর উদাহরণ হলেন বিষ্ণুর নাভি-কমলে উপবিষ্ট ব্রহ্মা। কবি মনে করেন— বিষ্ণু যখন লক্ষ্মীর সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হন এবং আবেশে চোখ বুজে থাকেন— ব্রহ্মাও নিশ্চয়ই তখন অন্ধের মত চক্ষু মুদে থাকেন। আবার রমণকালে লক্ষ্মী-বিষ্ণু যখন দুজনেই লজ্জাকর নিষিদ্ধ বাক্যালাপ করেন, তখন ব্রহ্মা নিশ্চয়ই বধিরের মত থাকেন। ঠিক যখন অন্ধের মত থাকা প্রয়োজন, তখন অন্ধের মত থেকে এবং ঠিক কানে যখন কিচ্ছুটি না শোনা উচিত, তখন না শুনে, ব্রহ্মা, লক্ষ্মী এবং বিষ্ণু— দুজনেরই অন্তরঙ্গ বন্ধুটি হয়ে উঠেছেন, বিষ্ণুর নাভিকমলে নিরন্তর বাস করতেও তাঁর কোন অসুবিধে নেই— শ্রীকেশবয়োঃ প্রণয়ী প্রজাপতি র্নাভিবাস্তব্যঃ।
ব্রহ্মা না হয় সবার সঙ্গে খুব মানিয়ে চলতে পারেন—এটা বোঝা গেল। তার ওপরে ভগবান বিষ্ণু পুরুষ মানুষ—তাঁর লজ্জা-শরম একটু কম। রতিকেলির সাধারণ নিয়মে তিনিই কমলদলে বসা ব্রহ্মাকে দেখতে পান বটে, তবে তিনি গ্রাহ্য করেন না, যদিও চক্ষু মুদেই থাকুক আর তাকিয়েই থাকুক ব্যাপারটা মানুষ মাত্রেরই অস্বস্তিকর। তা আমরা না হয় বিষ্ণুর কথাটা বুঝলাম। একে ত্রিভুবন-পালনের ব্যস্ততা, তাতে স্বর্গে-মর্ত্যে-পাতালে—সর্বদাই তাঁর স্ত্রীসঙ্গের অভ্যাস আছে। তাই তাঁর লজ্জা-শরম কম ধরে নিলেই আমাদের সুবিধে হয়। কিন্তু সব সময় তো আর একই অবস্থা থাকে না এবং সে অবস্থাটা আচার্য গোবর্ধনের অন্তত একশ বছর আগে একাদশ খ্রীস্টাব্দেই বুঝতে পেরেছিলেন এক আলংকারিক। অবশ্য একাদশ খ্রীস্টাব্দের কথাটা এক দিক দিয়ে ভুল হল, কারণ, কাশ্মিরী আলংকারিক মম্মটাচার্য শ্লোকটি উদ্ধার করেছেন বহু পুরাতন প্রাকৃত গাথা জয়বল্লভের বজ্জালগ্ন থেকে। শ্লোকটিতে লক্ষ্মীদেবীর অবস্থা বড়ই করুণ এবং পিতামহ ব্রহ্মার স্বভাবও এখানে ভাল দেখা যাচ্ছে না। শ্লোকটি উল্লেখ করার আগে বলে নিই যে, মম্মটের মত জাঁদরেল আলংকারিক যেখানে তাঁর কাব্যপ্রকাশে এই শ্লোকটি উল্লেখ করেছেন, সেখানে শ্লোকটিকে একটু ধৈর্য ধরে লক্ষণা-ব্যঞ্জনা আঁচ করে বুঝতে হবে। আমি অবশ্য একই সঙ্গে সব সারব।
বহুদিন পর লক্ষ্মীদেবী ভগবান বিষ্ণুকে কাছে পেয়েছেন কাজেই তাঁর রসাবেশের মাত্রা কিঞ্চিৎ বেশি, স্বয়ং কবির প্রাকৃত ভাষায়— রসাউলা অর্থাৎ রসাকুলা। ফলে রতিকেলির সাধারণ আসন লঙ্ঘন করে লক্ষ্মী বিপরীত-রতিতে মত্ত হয়েছেন। এমত মত্ত অবস্থাতেও হঠাৎ লক্ষ্মীর নজর পড়ল কমলাসন ব্রহ্মার ওপর। দেখলেন— বুড়োর কৌতূহল মোটেই কম নয়, ব্রহ্মা ঠিক ড্যাব্ ড্যাব্ করে চেয়ে আছেন মুক্তবসনা লক্ষ্মীর দিকে। এহেন অবস্থায় কোন্ লক্ষ্মীমতী শরমে বিজড়িত না হয়? এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় কালিদাসের নায়িকা হলে ফুল ছুঁড়ে তৈলপূর প্রদীপ নিবিয়ে দিত। কিন্তু লক্ষ্মীর অবস্থা আরো করুণ, তিনি তখন এতই ‘রসাকুলা’ যে না পারছেন নিজেকে সংযত করতে, না পারছেন ব্রহ্মাকে বাধা দিতে। নাভিকমলস্থ ব্রহ্মাকে দেখেই তিনি তখন তাই খুব তাড়াতাড়ি নিজের হাতে চেপে ধরলেন শ্রীহরির দক্ষিণ নয়নখানি—হরিণো দাহিনণঅণং রসাউলা ঝত্তি ঢক্কেই। এই আরম্ভ হল আলংকারিকের লক্ষণা-ব্যঞ্জনা। মম্মট বললেন— শ্রীহরির দক্ষিণ নয়নটি হল সূর্য-স্বরূপ, কেননা গীতায় তাঁকে বলা হয়েছে— শশিসূর্যনেত্রম্। তা হরির ডান চোখটি চেপে ধরা মানেই সূর্যের গতি রুদ্ধ। সূর্যের গতি রুদ্ধ হলেই পদ্ম নিমীলিত হয়, অতএব পিতামহ ব্রহ্মা তাকাবেন কি, তিনি একেবারে আটকা পড়ে গেলেন পদ্মদলের মধ্যে। এই অবস্থায় মুক্তবসনা লক্ষ্মীকে আর যেমন চোখে দেখা গেল না, তেমনি নিরুপদ্রব হল বিপরীত-রতা লক্ষ্মীর রতিকেলির সুখ, যাকে মম্মটাচার্য তাঁর আলংকারিক ভাষায় লিখেছেন— অনির্যন্ত্রণং নিধুবনবিলসিতম্ ইতি। এই সঙ্গে লক্ষ করলেন নিশ্চয়ই যে, নিগূঢ় রতিকেলির অর্থে ‘নিধুবন-বিলসিত’ শব্দটি মম্মট প্রয়োগ করলেন গোবর্ধনেরও একশ বছর আগে।
যাই হোক, পদ্মাসনে বসে বসে শুধু এদিক ওদিক ফালুক-ফুলুক করে তাকিয়েই কিন্তু ব্রহ্মার দিন কাটে না। চতুরানন ব্রহ্মার অনেক কাজ। বিশেষত দেবকুলে প্রচুর অবুঝ লোক আছেন। তাঁরা যে-কেউ একটা গোলমাল করলেই ব্রহ্মাকে ছুটে যেতে হয় সামলাতে। অসুরদের হাতে দেবতারা ধরুন মার খাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মাকে সমস্ত দেবতার হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে সেই সাগরে, যেখানে কারণসমুদ্রে শুয়ে আছেন বিষ্ণু, অথবা যেতে হবে কৈলাসে শিবের কাছে। এই পাহাড় থেকে সমুদ্র, সমুদ্র থেকে পাহাড়— বুড়ো বয়সে এইসব ধকলের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সব চেয়ে দুঃখের কথা তাঁকে কাজ করতে হয় ‘কনট্রাক্ট বেসিস’এ। কারণ ব্রহ্মা মানুষের মতই মারা যান। আমাদের শাস্ত্রমতে ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবতারা সবাই মরণশীল। তবে হ্যাঁ, ব্রহ্মার আয়ু প্রচুর। গীতায় যে হিসেব আছে, তাতে মানবলোকে এক হাজার বার সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি অতিবাহিত হলে তবে ব্রহ্মার এক দিন হয়, রাত্রিও তাঁর সেই মত। এই হিসেবে ব্রহ্মার আয়ু ভাবা যায় না। কিন্তু এত আয়ু সত্ত্বেও তাঁর অবস্থা পরিবেশ দপ্তরের মন্ত্রীর মত। এই কোথায় যুদ্ধ লাগল, এই কোথায় প্রজাক্ষয় হচ্ছে, এই পৃথিবী থরথর করে কাঁপছে। আর এই পৃথিবীরও বলিহারি যাই। কয়েক কোটি বছর বয়স হয়ে গেল, তবু এখনও যেন তিনি নবীনা বধূটি। কিছু একটা হলেই তিনি নাকি কাঁপতে থাকেন। যখন ভাল আছেন তখন তিনি সাগরের মেখলা পরে, মাথায় হিমালয়ের মুকুট পরে স্বয়ংবরা হন— ‘সাগরাম্বরা’, ‘শৈলরাজাবতংসকা’। অমন সুন্দরী মোহিনী রূপ দেখে যদি কোন বলদর্পিত অসুর, রাক্ষস কি মানুষ পৃথিবীর দিকে হাত বাড়ায়, অমনি তিনি কাঁপতে থাকেন। তার ওপরে যুদ্ধ যদি একটা লাগে—সে স্বর্গে দেবাসুরের যুদ্ধই হোক, কিংবা মতে রাম-রাবণের যুদ্ধ— বসুন্ধরা-লক্ষ্মীর কাঁপা স্বভাব, তিনি কাঁপতে থাকবেন। তাঁর কাঁপুনি সব চেয়ে বেড়ে যায়, যদি স্বর্গে কোন অসুর রাজা হন, কিংবা মতে কেউ অত্যাচারী রাজা। ব্যাপারটা তাঁর কাছে একই। ইতিহাসে, পুরাণে বারবার এই চিত্র দেখা যাবে যে পৃথিবী-রানী অত্যাচারী রাজার বলাৎকারে ধর্ষিতা বোধ করছেন আর ব্রহ্মা দেবগণ সমভিব্যাহারে তাঁর দুরবস্থার কথা নিবেদন করছেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে। এর অবধারিত ফল— বিষ্ণুর অবতার এবং সেই অত্যাচারী অসুর বা রাজার নিপাত।
আগেই বলেছি— বারবার এই অবতার গ্রহণের কষ্ট, বারবার এই অসুর-রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করা—এও যেন বিষ্ণুর কপালের ফের। তা ছাড়া এই অবতার গ্রহণের হ্যাপাও তত কম নয়। পরম ঈশ্বর যদি পৃথিবীতে অবতার গ্রহণ করেন, বিশেষত যদি মনুষ্যরূপে তাঁকে আসতে হয়, তবে ‘প্রোটোকল’ অনুযায়ী স্বর্গে অন্যান্য প্রধান দেবতাকে তাঁর আগেই পৃথিবীতে নেমে আসতে হয়। বিশ্বাস না হয়, রামায়ণ খুলে দেখুন। সেখানে বিষ্ণু রামচন্দ্র হয়ে জন্মাবেন বলে প্রধান দেবতাদের অনেককেই বাঁদর হয়ে জন্মাতে হয়েছে। আবার কৃষ্ণ অবতারের আগেও দেবতা এবং দেবরমণীদের যুগপৎ জন্মাতে হয়েছে মানুষের ঘরে। তাঁদের কাজ হল লীলাপুরুষোত্তমকে নানাভাবে সাহায্য করা। মানুষরূপে অবতার হওয়ার মধ্যে খুবই ঝামেলা আছে, কিন্তু ঈশ্বর অবতারের অন্যান্য স্বরূপের মধ্যেও ঝামেলা কিছু কম নয়। দশ অবতারের মধ্যে গোটা তিনকে অবতার যাবার পরেই ঈশ্বর অনেকটা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে উঠেছেন। তাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন যে, মৎস্য, কৃর্ম ইত্যাদি অবতারে পরম ঈশ্বরকে মাছ কিংবা কচ্ছপ হয়ে জন্ম নিয়ে কি অমানুষিক কষ্টই না করতে হয়েছে।
আমার মনে আছে— নবদ্বীপে আমি এক বৈষ্ণব গোসাঁই-বাড়িতে খোদ গোস্বামী-প্রভুর সঙ্গে দেখা করতে গেছি। একথা সেকথার পর প্রভু আমাকে মধ্যাহ্নের প্রসাদ নিয়ে যেতে বললেন। ভোজন প্রসঙ্গে গোস্বামী প্রভু প্রশ্ন করলেন— আপনি কি অবতার-সেবা করেন? আমি তো প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। সেবা করা মানে না হয় খাওয়া বুঝলাম, কিন্তু অবতার-সেবা ব্যাপারটা কি? আমার অবস্থা বুঝে গোসাঁই বললেন— অবতার বুঝলেন না? অবতার, ভগবান বিষ্ণুর প্রথম অবতার? আমি এতক্ষণে বুঝলাম যে, প্রকারান্তরে গোসাঁই জিজ্ঞাসা করছেন— আমি মাছ খাই কিনা? বৈষ্ণব মানুষ, মাছ শব্দটাই মুখে আনবেন না। এই মুহূর্তে ভগবান বিষ্ণুর জন্য আমার খুবই মায়া হল। মনে হল—চৈতন্যপন্থী কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবদের বৈষ্ণব না বলে ‘কার্ষ্ণ’ বলা উচিত। কেননা বিষ্ণুর ভক্ত যদি বৈষ্ণব হন, তাহলে বিষ্ণুর প্রথম অবতার সম্বন্ধে এই জুগুপ্সা থাকবে না। আর কৃষ্ণের ভক্ত ‘কার্ষ্ণ’ হলে অবশ্য আলাদা কথা, যদিও ক্ষত্রিয় পুরুষ হিসেবে বন্য বরাহ থেকে আরম্ভ করে মহিষ, হরিণ ইত্যাদি সব জন্তুই কৃষ্ণের খাদ্য ছিল।
যাক সে কথা। বিষ্ণুর প্রথম অবতারে মৎস্যরূপী বিষ্ণুর কষ্ট কম ছিল না। চারিদিকে অফুরান জলরাশি পৃথিবীকে প্লাবিত করছে, আর তার মধ্যে ভগবান একটি শিংওয়ালা মাছের রূপ ধরে বাঁচালেন মানব-জাতির আদি-পিতা মনুকে, সৃষ্ট হল মানবজাতি। ওদেশের ‘নোয়া’জ আর্ক’ আর এদেশের শতপতব্রাহ্মণে মনু-মাৎস্য কথার একই সুর। তবে পুরাতাত্ত্বিকেরা এই আদি-মৎস্যের মধ্যে দেখেছেন সৃষ্টি এবং প্রজননের কল্প, কারণ এই প্রাণীটি প্রজননের প্রতীক বলে সমস্ত পৌরাণিক কথায় বিধৃত। আজকের দিনে মাছের আঁশের সঙ্গে যদি ঋগ্বেদ সামবেদ যদি এক সঙ্গে রাখি তাহলে ধর্মধ্বজীরা আমাকে হেঁই হেঁই করে মারতে আসবেন, কিন্তু প্রলয়-পয়োধিজলে ওই বিরাট শিঙি মাছটাই আমাদের বেদকে রক্ষা করেছিল। এই মৎস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বাংলার জয়দেব কবি মালব রাগে রূপক তালে গান ধরেছিলেন— প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্…।
সৃষ্টির প্রথম কল্পে মৎস্যরূপী ঈশ্বরকে যা কষ্ট করতে হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়েছে কূর্ম অবতারে। বিষ্ণু তো স্বর্গের দেবতা এবং অসুরদের সমুদ্রমন্থনের আদেশ দিয়েই খালাস হতে পারতেন; কিন্তু যখন দেখা গেল সমুদ্র-মন্থনের মন্থনদণ্ড মন্দর পর্বত স্থির হওয়ার জন্য কোন সাপোর্টই পাচ্ছে না, তখন বিষ্ণুকে স্বয়ংই কচ্ছপ সেজে পিঠ পেতে দিতে হল মন্দর পর্বতের তলায়। সমুদ্রমন্থন হল তার পর। সাধারণ কিন্তু সমুদ্রমন্থনকালে বিষ্ণুর এই সাময়িক কষ্টটুকু তেমন আমল দেয় না। তারা বলে যে, বিষ্ণু আজও পৃথিবীকে তাঁর পিঠে ধরে রেখেছেন। কবি জয়দেব তো এই ঘটনায় এত কষ্ট পেয়েছেন যে, তিনি মনে করেন— এই পৃথিবী-ধারণের ঘষায় ঘষায় সেই বৃহৎ কচ্ছপের পিঠের খোলায় চাকার মত একটা কড়া পড়েছে— ধরণীধারণ-ক্কিণচক্ৰগরিষ্ঠে। পৌরাণিকেরা আবার টিপ্পনী কেটেছেন। বলেছেন— ওসব কড়া-টড়া কিছুই নয়, কচ্ছপ হল সেই স্থিরতা এবং প্রজননের প্রতীক। ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতএব তাকে সুরক্ষা দিতেই বিষ্ণুর কূর্ম রূপ-কল্পনা।
বুঝলাম— সৃষ্টি, সৃষ্টির সুরক্ষা সব বুঝলাম। এমনকি সৃষ্টির ক্রমে মৎস্য থেকে কর্মে প্রতীকী বিবর্তনের কথাও বুঝলাম। আবার আমরা ঈশ্বরের ঝামেলার কথায় আসি। অনেক মা-বাবাকে কোলের শিশু সম্বন্ধে এমন মত ব্যক্ত করতে শুনেছি যে, দুধের বাচ্চাটি বড় হলেই আর ঝামেলা থাকবে না; কিন্তু অভিজ্ঞ পিতা-মাতারা এই মত উড়িয়ে দিয়ে বলেন— বাচ্চা যত বড় হবে, ঝামেলা ততই বাড়বে, ‘টেনশন’ও ততই বাড়বে। ঈশ্বরের সৃষ্টির ব্যাপারটাও প্রায় একই রকম। মৎস্য-কৃর্ম অবতারে তাঁর যে ঝামেলা ছিল, বরাহ অবতারে তাঁর ঝামেলা তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে।
তাত্ত্বিকতার খাতিরে একটা কথা এখনই বলে নেওয়া ভাল যে, পৃথিবী কিন্তু বিষ্ণুর স্ত্রীকল্পা— দার্শনিক ভাষায় ভূশক্তি, কবির ভাষায় প্রেয়সী নায়িকা। তাঁকে রক্ষা করা যত কষ্টেরই হোক, সেটা ঈশ্বরের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বরাহ অবতারের সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, কর্তব্যের সঙ্গে আরও যেন কিছু আছে। তা ছাড়া বরাহ অবতারের সময় থেকেই পুরাণে পুরাণে জটিলতাও অনেক বেড়েছে— একেক জায়গায় একেক গাথা। কিথ সাহেব তো বরাহ অবতারের প্রথম কল্পটি খুঁজবার চেষ্টা করেছেন ঋগ্বেদ এবং তৈত্তিরীয় সংহিতায়। শতপথব্রাহ্মণে আবার দেখতে পাচ্ছি— প্রজাপতি এমুষ নামে একটি শূকরের রূপ ধারণ করেছেন। বেদে-ব্রাহ্মণে মৎস্য, কৃর্ম, বরাহ— সকলেই প্রজাপতির রূপকল্প। সে যাই হোক— ওই এমুষ নামে শুকরটি জলের মধ্যে ডুবে যাওয়া পৃথিবীকে উদ্ধার করে ঠিক জায়গায় এনে রেখেছিল। পুরাণে, ইতিহাসে প্রজাপতিই বিষ্ণু হয়ে গেছেন। কোন পুরাণে আবার দেখি— দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বড় দাদা হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীকে একেবারে সাগরের জলে ডুবিয়ে দেবার উপক্রম করেছিল। হয়তো সেই অসাধু দৈত্যের অত্যাচারে পৃথিবী একেবারে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছিলেন। বিষ্ণু তখন বরাহের রূপ ধরে হিরণ্যাক্ষকে মেরে ফেলেন এবং পৃথিবীকে উদ্ধার করে আনেন।
পণ্ডিতেরা বলবেন— এটাও বুঝলেন না! গ্রীস দেশের পুরাকাহিনী থেকে মিশর দেশের পুরাকাহিনী— সব জায়গাতেই শূকর হল— জমির উর্বরতা, ফসল এবং প্রজননের প্রতীক। গ্রিম সাহেব আবার “ডয়েট্শে মিথলজি” লিখে প্রমাণ করলেন— এই প্রাণীটি নাকি তার বুনো দাঁতে মাটি চিরে মানবজাতিকে প্রথম হাল চাষের কায়দা শিখিয়েছিল। কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়, কেননা এই আদিবরাহের দাঁত কিন্তু দুটি নয়, একটি। মহাভারত বলেছে— একশৃঙ্গ। শৃঙ্গ শব্দটি শুনেই তোত আবার অনেকের ভাবোদয় হয়। বিশেষত পণ্ডিতেরা একশৃঙ্গের বিবরণ এবং মায়ার সাহেবের ভাবোদয় দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন— এই শৃঙ্গ হল প্রজনন চিহ্নের প্রতীক অথবা ‘penis erectus’।
আমরা বলি—সাহেব! তোমরা পারও বটে। একটা দাঁতাল শুয়োরের দাঁত দেখে পুরুষ চিহ্নের দৃঢ়তা, হাল-চাষ— সবই তোমরা বুঝে ফেলেছ! তা তোমাদের বোঝাটা না হয় আমরাও কষ্টেসৃষ্টে বুঝে নিলাম, কিন্তু আমাদের কথাটাও তোমরা একটু বোঝ। আমরা যে ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাসের বংশধর। আমরা বাপু শুধু ওই প্রজনন আর হালচাষের মত গদ্যজাতীয় কথকতায় ভুলি না। আমরা দেখছি— বরাহ অবতার থেকেই আমাদের পরম প্রভুর কিঞ্চিৎ চিত্তবিভ্রম ঘটেছে। অর্থাৎ কিনা পৃথিবী রক্ষার মত শুষ্ক কর্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রভুর মনটা কিঞ্চিৎ রসসিক্ত হয়ে উঠেছে। আগেই বলেছি— পৃথিবী নায়িকা বলে কথা। আর সেই সৃষ্টির প্রথম প্রথম তিনি কি আর আজকের মত প্রৌঢ়া ছিলেন নাকি? আমরা তাই আদিবরাহকে এঁকেছি একেবারে মানুষের আদলে। বিশ্বাস না হয়— ভারতীয় যাদুঘরে চলে যান অথবা সপ্তম শতাব্দীতে তৈরি মহাবল্লীপুরমের বরাহ মূর্তিটি দেখুন।
সেকালের শিল্পীরা চিত্র কিংবা ভাস্কর্যের রূপ দিতেন শাস্ত্রের মর্মকথা জেনে। এখানেও তাই শিল্পীরা আদিবরাহের হাত-পা, সব কিছুর সংস্থান ঠিক করেছেন মানুষেরই আদলে। তাঁর গলায় আবার একখানা পৈতেও আছে— আভিজাত্যের চিহ্ন হিসেবে। শুধু এটুকু হলেও হত। বরাহটি তাঁর সামনের দুই হাতে এমন করে তুলে আনছেন পৃথিবীরানীকে, যেন মনে হবে— কতকাল পরে প্রাণের বঁধুয়াকে পেয়েছেন তিনি। ভাস্কর্যবিদেরা সন্দেহ করেন— বিষ্ণুর শূকর-মুখে কেমন যেন আধো হাসিটিও ফুটেছে তখনই, যেন বিষ্ণু তাঁর শূকর-চোখে বসুন্ধরা নায়িকার পানে আড়াআড়ি কামনার দৃষ্টি হেনে চলেছেন— এবং এই ভাবটি সম্বন্ধে নাকি কোন সন্দেহই নেই। স্বয়ং জিতেন ব্যানার্জি লিখেছেন— The Pallava artist has taken care to emphasise the aspect of loving reunion between the God and his divine consort Prithivi.
আমরা জানি— এই মিলনের একটা ফলও হয়েছিল। প্রিয়মিলনের মুহূর্তে ভগবানের শূকরমূর্তি এমনভাবেই ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন বসুমতীর সঙ্গে যে, তাঁদের একটি ছেলেও হয়েছিল। এই ছেলেই পরবর্তীকালের নরকাসুর, যিনি প্রাগ্জ্যোতিষপুরের রাজা হয়েছিলেন পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বকালে। ভূমিপত্নীর ছেলে বলে তাঁকে ভৌমাসুরও বলা হত। আদিবরাহের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ছেলেটি পরে এমন দুর্দান্ত হয়ে ওঠে যে, আর্যভূখণ্ডে সে নিন্দিত হতে থাকে। জন্মলগ্নেই তার মধ্যে পিতার কোন বরাহ-গুণ অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল কিনা জানি না, তবে নরকাসুরের অভ্যাস ছিল দেশ-বিদেশের সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এসে আসামের মণি-পর্বতে লুকিয়ে রাখার। শেষে একদিন যখন এই নরকাসুর স্বর্গে গিয়ে উচ্ছ্বঙ্খল আচরণ করে দেবতাদের বুড়ো মা অদিতির সোনার কানপাশা ছিনিয়ে নিল, সেইদিনই ইন্দ্রের দূত হয়ে নারদ এসে পৌঁছলেন কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ তখন পূর্বাহ্লেই ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ। সব সংবাদ শোনার পর কৃষ্ণ ছুটলেন নরকাসুর বধ করতে। নরকাসুরের জন্মবৃত্তান্তের বিন্দুবিসর্গ তখনও সবাই জানত না, বোধ করি কৃষ্ণও জানতেন না। শেষে যখন নরকাসুর বধ হয়ে গেল, তখন হরিবংশে দেখছি— বড় করুণ এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। নরকমাতা বসুন্ধরা ছেলের মৃত্যু দেখে কৃষ্ণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন— তুমিই আমাকে এই ছেলে দিয়েছিলে, এখন তুমিই একে মেরে ফেললে— দত্তস্ত্বয়ৈব গোবিন্দ ত্বয়ৈব বিনিপাতিতঃ— বাচ্চা ছেলেরা যেমন পুতুল নিয়ে খেলা করে, তেমনি তুমিও আমাদের নিয়ে পুতুল-খেলা করছ— বালঃ ক্রীড়নকৈরিব।
কথাটার মধ্যে দর্শনবোধের সঙ্গে জননী-হৃদয়ের আক্ষেপ মিশে গেছে। পরবর্তীকালে যাঁরা ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে কাব্য-নাটক লিখেছেন, তাঁরা বলেছেন—নরকের দৃষ্টান্ত নাকি পরম প্রভুর ভক্ত-বাৎসল্য সূচনা করে। পঞ্চদশ খ্রস্টাব্দের গোড়ায় ধর্মসূরি নরকাসুরবিজয় নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন— শরণাগত আর্ত দেবতারূপী ভক্তদের জন্য ভগবান নিজের ছেলেকেও মেরে ফেলতে কুণ্ঠিত হন না— অপত্যেভ্যোপি ভক্তা মে রক্ষণীয়া বিশেষতঃ। নরকাসুরকে মারার পেছনে নাকি এই ভক্তবাৎসল্যই আসল কারণ। আমরা বলি— ঈশ্বর যখন অবতাররূপে পৃথিবীতে আসেন, তখন তিনি নানা বিষয়ে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যা সাধারণ লোকেও অনুসরণ করে। তবে দৃষ্টান্ত বলতে শুধু ওই ভক্ত-বাৎসল্যের দৃষ্টান্তই বোঝায় না, আরও কত রকম দৃষ্টান্ত হতে পারে। এই যে ঈশ্বররূপী বড় মানুষের এমন একটা বদমাশ ছেলে হল— এটাও তো সমাজে একটা উদাহরণ, অন্তত যাদের এরকম ছেলে হয়েছে তাদের কাছে বরাহনন্দন নরকাসুর তো একটা সান্ত্বনা বটে। এ সত্ত্বেও অনেকে অবশ্য বিষ্ণুরূপী বরাহের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চান না, যদিও পুত্রের অন্যায়-অশালীনতার দায় পিতার ঘাড়ে পড়তেই পারে; লোকে বলতেই পারে— শুয়োরের বাচ্চা তো, আর কত হবে!
নরকাসুরের খারাপ হওয়ার পেছনে তাই একটা যুৎসই কারণ খুঁজে বার করা হয়েছে— যাতে ভগবান বরাহ এবং ভগবতী বসুমতী দু’জনেই পার পেয়ে যাবেন। কথিত আছে— কৃষ্ণ যখন নরকাসুরকে মারতে যান, তখন কৃষ্ণ-প্রেয়সী আদরিণী সত্যভামা যুদ্ধ দেখার বায়না করে দারুকের রথে চেপে বসলেন। পথে যেতে যেতে অভিজ্ঞ কোচোয়ান দারুক নরকাসুরের সাংঘাতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা শোনাচ্ছিলেন। সত্যভামা শোনেন আর একান্ত স্ত্রীস্বভাবে চোখ দুটি গোল গোল করে অবাক হন। শেষে কৌতূহল চাপতে না পেরে দারুকে জিজ্ঞাসা করলেন— এত প্রভাব তার হল কি করে? দারুক বললেন— হবে না! ও যে বিষ্ণুরূপী বরাহের ছেলে। সত্যভামা বললেন— বিষ্ণুর অংশে জন্মেও তার এই কুস্বভাব! ভাবা যায় না যে! দারুক বললেন— এর একটা কারণ আছে। অতকাল পরে আপন প্রেয়সীর কৃতজ্ঞ কাতর মুখখানি দেখে আদি-বরাহ আসঙ্গ-লিপ্সায় অত্যন্ত উত্তেজিত হলেন বটে, তবে তখন ছিল সন্ধ্যার সময়। দিন-রাত্রির সন্ধিক্ষণটা মিলনের পক্ষে মোটেই উপযুক্ত নয়, এবং সেই সান্ধ্য-রমণে জন্ম বলেই নরকের অমন অসুরের মত চেহারা, অসুরের মত স্বভাব— তৎ সন্ধ্যাসময়-সমুৎপন্নতয়া তাদৃশীম্ আসুরীং তনুমাশ্রিতম্। (ধর্মসূরি, নরকাসুরবিজয়ব্যায়োগ)।
অর্থাৎ কিনা ছেলের যে স্বভাবচরিত্র খারাপ হল— তার কারণ গ্রহদোষ, কালদোষ— বাপ-মায়ের কোন দোষ নেই। ভক্ত কবিরা ঈশ্বরকে এইভাবে বাঁচাতে চান, বাঁচান। কিন্তু তাতে ঈশ্বর বাঁচেন না। ঈশ্বরের সৃষ্ট সমাজে আরও মানুষ-জন আছেন, যাঁরা ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব মাথায় রেখেও তাঁদের নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়েন। ধন্যবাদ সেই অবাচীন কবিকে, যিনি মৎস্য-কূর্ম-বরাহ— এই তিন ঈশ্বর-প্রাণীকে চিবিয়ে খাবার কৃতিত্ব দিয়েছেন মিথিলাবাসীদের। আসল কথা— মৈথিলরা অনেকেই মাছ-মাংস খান এবং কচ্ছপ-শূকর কেউই তাঁদের অন্নগ্রাস থেকে মুক্তি পায়নি। কবি তাই লিখেছেন— বিষ্ণুর প্রথম তিনটি অবতারকে মৈথিলরা খেয়ে খেয়েই শেষ করে দিয়েছিল— অবতারত্ৰয়ং বিষ্ণোঃ মৈথিলৈঃ কবলীকৃতম। পরম ঈশ্বর দেখলেন— মহা বিপদ, অবতার-স্বরূপ মৎস্য-কূর্ম-শূকরকে মৈথিলরা খেয়েই মেরে দিল! এ জিনিস তো চলতে পারে না। ঈশ্বর নাকি এই ভাবনায় ব্যথিত হয়েই শেষ পর্যন্ত তাঁর অপ্রতিহত নরসিংহ মূর্তি ধারণ করলেন।
দেখুন, আমরা শাস্ত্রপ্রমাণে জানি যে বিষ্ণু নরসিংহরূপ ধারণ করেছিলেন হিরণ্যকশিপুর মত দুষ্টের দমন এবং প্রহ্লাদের মত শিষ্টের প্রতিপালনের জন্য। কিন্তু রসিক কবি নৃসিংহ অবতারের কারণ হিসেবে কত সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মৈথিলরা মাছ, কচ্ছপ, শুয়োর—যাই খাক না কেন, সিংহ বা মানুষ খায় না— এইটাই যা ঈশ্বরের বাঁচোয়া। এমনিতে পুরাণকার এবং কবিরা নরসিংহ অবতারের সিংহভাগে সিংহের রূপ এবং গুণাবলী সন্নিবেশ করলেও—তাকে মানুষের আদল দিতে ভোলেননি। এইটাই বিষ্ণুর প্রথম অবতার—যার মধ্যে পৃথিবীর দুঃখ মোচন করার থেকেও করুণাগুণের প্রত্যক্ষ স্পর্শ পাওয়া যায়।
পণ্ডিতেরা বলেন, হিরণ্যকশিপু যে স্তম্ভটিকে— ‘কই তোর হরি’ বলে পদাঘাত করেছিলেন, প্রতীকীভাবে দেখতে গেলে সেটি আসলে পৃথিবী— অথাৎ সেই ভূভারহরণ— ‘সেভিয়ার মোটিভ’। অন্য ‘মোটিভ’ হল— ভগ্ন স্তম্ভ থেকে আবির্ভূত হয়ে ঈশ্বর তাঁর সর্বময়তার প্রমাণ দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু দুষ্ট হিরণ্যকশিপুকে বধ করেও, তাঁকে ঊরুতে ফেলে বুক চিরে রক্ত খেয়েও নরসিংহ যে শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারছেন না— এইখানেই তাঁর মনুষ্যত্বের অপেক্ষা। কবিরা দেখিয়েছেন— ক্রুদ্ধ নরসিংহ সিংহমুখে গর্জন করছেন, অত্যাচারী দৈত্য নিহত হয়েছে, তবুও গর্জন করছেন। ভারমুক্তা পৃথিবী এমনটি তাঁর তিন বারের অভিজ্ঞতায় দেখেননি। নতুন বিপদ দেখে আবার তাঁর কাঁপুনি আরম্ভ হল। কবি-দার্শনিকেরা দেখলেন এবারে আর ভূশক্তিতে হবে না, তাই তাঁরা বিষ্ণুর চিরকালের প্রেয়সী শ্ৰীশক্তি লক্ষ্মীদেবীকে নৃসিংহের কোলে বসিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতেও কোন সুবিধে হল না। রাগের মাথায় যা চাইছি, তা পাচ্ছি না, মাঝখান থেকে একটি স্ত্রীলোক এসে কোলে বসল— এতে আরও রাগ হবার কথা। লক্ষ্মীদেবী নরসিংহের কাছ থেকে ভীতচকিত হয়ে চলে গেলেন— পুরাতনী গৃহবধূর মত। যেন কর্তাবাবু কি নিয়ে বাড়ি মাথায় করেছেন, জানিনে বাপু—এমনি ধারায় লক্ষ্মীদেবীর প্রস্থান হল। শেষে ভক্ত প্রহ্লাদের স্তুতি-প্রার্থনা আরম্ভ হল। অমনি সব শান্ত হল, নরসিংহ শান্ত হলেন, তাঁর গর্জনও থেমে গেল। ভক্ত প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে সিংহ মুখেই তাঁকে চাটতে থাকলেন নরসিংহ, তাঁর রাগে ফুলে-যাওয়া কেশরগুচ্ছ নুয়ে পড়ল সব। কবি-শিল্পীরা তখন নির্ভয়ে তাঁর বাম কোলে বসিয়ে দিলেন লক্ষ্মীদেবীকে এবং ডান কোলে বসিয়ে দিলেন প্রহ্লাদকে। একই অঙ্গে এত রূপ দেখে সুদূর ফ্রান্স থেকে বিদেশিনী বিদুষী মাদাম বিয়ার্দো ‘নরসিংহ : মিথ্ এত্ কাল্ত্’ লিখে মন্তব্য করলেন— এই নরসিংহের মধ্যেই অবতারবাদ প্রথম মিশে গেল ভক্তিবাদে।
অবতারের অনুক্রমে নৃসিংহ হলেন মনুষ্যেতর প্রাণী এবং মানুষের সন্ধিলগ্ন, বিবর্তনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আপনারাও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, বিষ্ণুর অবতারগুলি কেমন করে মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে অর্ধেক প্রাণী এবং অর্ধেক মানুষের কল্পনায় এসে পৌঁছল। এর পরেই তো সেই বেঁটে বামনটি, যিনি প্রহ্লাদের নাতি বলির কাছে ত্রিপাদ ভূমি ভিক্ষা চেয়ে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল নিজের দখলে এনেছিলেন। পণ্ডিতেরা কেউ, বামনের পাদপ্রসারণের মধ্যে বিষ্ণুর সর্বময়তা দেখেছেন, কেউ বা তাঁর ছলনা দেখে মন্তব্য করেছেন— Visnu’s original character emerges from the realm of witchcraft, from the world of fairy being and charms. বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত ইয়ান্ খণ্ডা লিখেছেন— বেঁটে বামন নাকি সবসময়ই ছলনা, বৃদ্ধি এবং ভূসম্পত্তির প্রতীক, সেই কারণেই বলির সঙ্গে ছলনা করে দেবতাদের ভূসম্পত্তি উদ্ধারের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় বামন-অবতারের মধ্যে। এ ব্যাপারে পণ্ডিতেরা যে যাই বলুন, ভাগবত পুরাণের কবি কিন্তু বামনকে এমন একটা নান্দনিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যাতে পরম ঈশ্বরের সর্বময়তার থেকেও মনুষ্যোচিত ছলনা এবং মমতা সাহিত্যের বিন্দু স্পর্শ করেছে।
বামনের প্রথম পায়ে সম্পূর্ণ মর্ত্যভূমি এবং অন্তরীক্ষলোক ছেয়ে গেল, দ্বিতীয় পায়ে ছেয়ে গেল স্বর্গলোক, যা বলি সদ্য সদ্য অধিকার করেছিলেন। তৃতীয় পা-টি আর রাখবার জায়গা হয় না। মনে রাখতে হবে, এই তৃতীয় পা-টিই কিন্তু সেই— তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্, যা বেদে এবং ব্রাহ্মণে অমৃতত্বের প্রতীক বলে চিহ্নিত। এই পা-টিই রাখবার জায়গা হচ্ছিল না। ভূমিদানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলি মহারাজ অসাধারণ নাটকীয়তার মধ্যে নিজের মাথাটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন— তোমার তৃতীয় পাটি রাখ আমার মাথায়— পদং তৃতীয়ং কুরু শির্ষ্ণি মে নিজম্। বাস্, পরম ঈশ্বর একেবারে মমতায় গলে গেলেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজের মুখে স্বীকার করলেন আপন ছলনার কথা। বললেন— ধর্মের কথা বললে কি হবে, আমি যা বলেছি, ছল করে বলেছি। কিন্তু বলি তাঁর সত্য প্রতিজ্ঞা থেকে চ্যুত হননি— ছলৈরুক্তো ময়া ধর্মো নায়ং ত্যজতি সত্যবাক্। ছলনার কথা নিজের মুখে এমন পরিষ্কার করে বলেছিলেন বলেই জয়দেব তাঁর গীতগোবিন্দে সোজাসুজি পদ আরম্ভ করতে পেরেছেন—সেই ছলনার কথা তুলেই—ছলয়সি বিক্রমণে বলিমদ্ভুত বামন।
এই রকম ছলনা করার পর ঈশ্বরের নাকি বড় মায়া লেগেছে। তিনি নিজে বলির বাসস্থান ঠিক করে দিয়েছেন সুতলে পাতালে। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে তাঁর বাড়ির রক্ষী দ্বারপাল হতে স্বীকৃত হয়েছেন। পণ্ডিতেরা এর মধ্যে পুনশ্চ আর্য-অনার্যের মিলন-মহোৎসব দেখতে পেয়েছেন, কিন্তু ওসবের মধ্যে না গিয়ে আমরা কবির রসিকতায় আসি। রসিক কবি বামনের মধ্যে যতখানি ভগবত্তা, যতখানি সর্বময়তা দেখতে পেয়েছেন, তার থেকে অনেক বড় করে লক্ষ করেছেন বামনের ভিক্ষুক-বৃত্তি। অন্তত দুই থেকে তিনজন কবি বলেছেন যে, ভিক্ষাবৃত্তি অথবা লোকের কাছে যাচনা মানুষের সমস্ত মহত্ত্ব নষ্ট করে। এই দেখুন না, যেমন পরম ঈশ্বরও যখন বলির কাছে। ভূমি প্রার্থনা করেছেন, তখন তাঁকেও লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে বেঁটে বামনটি হতে হয়েছে— হস্ত! বামনপদং প্রতিপেদে ভিক্ষুতামুপগতো জগদীশঃ। বঙ্ক বলে আরেক কবি, যদিও তাঁর কথার সুর প্রায় একই রকম, তবু তিনি আরও সুন্দর করে বলেছেন— এই পৃথিবীতে এ জিনিসটা আমাদের না দেখা নয় যে, ভিক্ষাবৃত্তি মানুষের সদ্গুণগুলিকে খাটো না করে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। ‘সহস্ৰশীর্ষা’ পুরুষটি বিশ্বম্ভর হয়েও যখন বলির কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ভিক্ষা চেয়েছিলেন, তখন লজ্জায় তাঁর সমস্ত অঙ্গগুলি তাঁর নিজের অঙ্গেই সেঁধিয়ে গিয়েছিল— বিশদ্ভি র্বিশ্বাত্মা স্ববপুষি বলিপ্রার্থনকৃতে/ ত্রপালীনৈরঙ্গৈ র্যদয়মভবদ্ বামনতনুঃ।
প্রাণী, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক প্রাণী, তারপর ছোট বেঁটে মানুষটি থেকে অবতারতত্ত্ব পরিণতি লাভ করল পরশুরামে এসে। রক্তে-মাংসে, রাগে, ক্ষোভে, বীরত্বে এই অবতারটিকে পরিষ্কার স্পর্শ করা যায় যেন। জাতিতে ব্রাহ্মণ, ক্রোধে ক্ষত্রিয়ের অধিক। জমদগ্নি ঋষির পাঁচ ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি হলেন পরশুরাম। পরশুরামের প্রথম পরিচয়— ইনি নিজের মাকে মেরে ফেলেছিলেন। মাতৃকাবতে চিত্ররথ নামে ভোজবংশের এক রাজাকে দেখে পরশুরামের মার ভারি ভাল লেগেছিল। তপস্বীর ঘরে পাঁচ ছেলের মা রেণুকার এই চিত্তচাঞ্চল্য ঘটল কেন—তা নিয়ে রীতিমত সামাজিক-অর্থনৈতিক গবেষণা চলতে পারে ; কিন্তু মোদ্দা কথা হল— চিত্ররথ্কে দেখে রেণুকার মনে হল— আহা! এই রাজা যদি শুধু আমারই হতেন—স্পৃহয়ামাস রেণুকা। ফল খুব খারাপ হল। জমদগ্নি সবই জানতে পারলেন, কিন্তু প্রথম চার ছেলেকে তিনি মাতৃবধে রাজী করাতে পারলেন না। পরশুরাম কিন্তু বাবার আজ্ঞামাত্র মা রেণুকার মাথা কেটে ফেললেন।
পরশুরামের দ্বিতীয় কীর্তি কাৰ্ত্তবীর্যার্জুন-বধ এবং সেই সূত্রে একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করা। কৃতবীর্যের ছেলে কার্ত্তবীর্য-অর্জুন হৈহয় বংশের নামী রাজা। তিনি লঙ্কার রাবণকে পর্যন্ত যুদ্ধে বেঁধে ফেলেছিলেন। সেই কার্ত্তবীর্য-অর্জুন পরশুরামের পিতা জমদগ্নিকে মেরে ফেলেছিলেন। পরশুরামের খুবই ভক্তি ছিল পিতার ওপর। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি কার্ত্তবীর্য-অর্জুনকে তো মারলেনই, উপরন্তু তাঁর ক্রোধকে প্রলম্বিত করে বার বার একুশবার পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয় বংশগুলি উৎসাদিত করেছিলেন।
সত্যি কথা বলতে কি, নিঃক্ষত্রিয় মানে তো ক্ষত্রিয়হীন। পরশুরামের এই অভিযানে তো তাহলে সমস্ত ক্ষত্রিয়দেরই মারা পড়ার কথা। কিন্তু আসলে তা পড়েনি এবং পড়েনি বলেই অবতারের সমস্ত শক্তিমত্তা, সমস্ত ক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁর চেয়ে কনিষ্ঠ অবতার রামচন্দ্রের হাতে তাঁর তেজ খাটো হয়ে গেল। একেবারে নববধূর সামনে রামচন্দ্র বলে বলে তাঁর ধনুক ভেঙে দিলেন এবং অপমানের চূড়ান্ত করলেন। লক্ষণীয় বিষয় হল, এই অবতারকে নিয়ে কবিরা নয়, রসিকতা করেছেন আমাদের মুসলমান ভায়েরাই।
গপ্পোটা একটু খুলে বলি। আপনারা পণ্ডিতরাজ জগন্নাথের নাম শুনেছেন কিনা জানি না, তিনি তাঁর আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত, আলংকারিক এবং কবি ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল— বীণাবাদিনী সরস্বতী পর্যন্ত তাঁর কবিতা শুনলে বীণা-বাদন বন্ধ করে দিতেন এবং সযত্নে তাঁর কবিতা শুনতেন। জগন্নাথ কবি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ বয়সটা কাটিয়েছেন বাদশাহ শাহজাহানের সভাকবি হিসেবে— দিল্লী-বল্লভ-পানি-পল্লবতলে নীতং নবীনং বয়ঃ। এ ছাড়া সেই যুগে তিনি বিয়ে করেছিলেন এক মুসলমান সুন্দরীকে। দিল্লিতে আসার আগে তিনি ছিলেন জয়পুরে। মহারাজ জয়সিংহ পণ্ডিতরাজ জগন্নাথকে কাশী থেকে নিয়ে এসেছিলেন একটি মাত্র কারণে। রাজস্থানের রাজপুত রাজারা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করতেন; কিন্তু সেখানকার মুসলমান মোল্লারা বলতেন— মহারাজ! এটা হয় নাকি? আপনাদের পরশুরামজি একবার নয়, দুবার নয়, একুশবার এই পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করে রেখে গেছেন। পৃথিবী এতবার নিঃক্ষত্রিয় হয়ে থাকলে আপনার পূর্বপুরুষেরাই শুধু বেঁচে ছিলেন— এটা তো কোন বাস্তব কথা নয়।
প্রশ্ন শুনে পণ্ডিতরাজ বললেন— এ আর এমন কি কথা! এর জবাব আমি এক্ষুনি দিচ্ছি। মহারাজ! নিঃক্ষত্রিয় মানে যদি ক্ষত্রিয়হীনতাই বোঝাত, তাহলে প্রথমবার পরশুরামের কোপে পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হওয়ার পর আর কোন ক্ষত্রিয়ই বেঁচে থাকত না, যাতে দ্বিতীয়বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করার প্রশ্ন আসে। তার মনে—একটা লোককে যখন একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করতে হয়েছে, তখন প্রতিবারেই নিশ্চয় কিছু না কিছু ক্ষত্রিয় বেঁচে ছিলেন, নইলে বারবার একুশবারের প্রয়োজন হত না। আসলে নিঃক্ষত্রিয় কথাটার মধ্যে যতই নির্মমতা এবং শূন্যতার হিসেব থাক, এখানে ওই শব্দটার মানে হল— পরশুরাম প্রচুর ক্ষত্রিয় মেরেছিলেন এবং তিনি হয়তো অনেকবার এই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ক্ষত্রিয়েরা তবু অনেকেই বেঁচে ছিলেন। আপনার পূর্বপুরুষেরা সেই বেঁচে থাকা ক্ষত্রিয়দেরই অধস্তন পুরুষ। রাজা খুশী হলেন বটে কিন্তু তাতে পরশুরামের মাহাত্ম্য কিছুটা কমল, যদিও আগেই বলেছি যে, পরশুরামের গর্ব পূর্বাহ্নেই খর্ব হয়ে গেছে অন্য অবতার রামচন্দ্রের কাছে।
॥ ৫ ॥
এ পর্যন্ত যা দেখা গেছে, তাতে মনে হয় অবতার হিসেবে রামচন্দ্রের ভাগ্যটা হল সবচেয়ে খারাপ। এ কথা অবশ্যই মানতে হবে যে, রসিক ভক্তেরা তাঁদের প্রাণের ঠাকুরকে যখন একান্ত মানুষের মতই দেখতে পান, তখনই তাঁরা সবচেয়ে আনন্দ অনুভব করেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তো পরিষ্কার বলেছেন—কৃষ্ণের যতেক খেলা/ সর্বোত্তম নরলীলা/ নরবপু তাঁহার স্বরূপ। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে রামচন্দ্র একেবারে সম্পূর্ণ মানুষটি। প্রশংসা, বঞ্চনা, দুঃখ-শোক এবং পরিশেষে বিজয়লাভ—এ সব কিছুই তাঁকে সম্পূর্ণ মানুষটি করে তুলেছে। যে মহাকবি রামকথা জগতে অমর করে রেখেছেন, তিনিও রামচন্দ্রকে গড়তে চেয়েছিলেন একটি আদর্শ মানুষেরই আদলে।
কিন্তু হলে হবে কি, পরম ঈশ্বরের অতিরিক্ত মানুষ-ভাব জনসমাজে তাঁর ঐশ্বরিক দূরত্ব নষ্ট করে দেয়, এবং তাঁকে খানিকটা অবহেলার বস্তু করে তোলে। এটা ঠিক—রাবণ রাজার সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ জয়লাভ রামচন্দ্রের গুরুত্ব এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যে, যে কোন বড় জিনিসের উল্লেখ করতে গেলেই আমরা ‘রাম’ শব্দটিকে প্রথমে ব্যবহার করি। যেমন ধরুন যে দা দিয়ে আমরা পাঁঠা বলি দিই, কিংবা যে দা আমরা কোন বিশেষ-নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার করি, তাকে আমরা বলি ‘রামদা’। কিংবা আকাশে বিরাট ইন্দ্রধনুর আভা দেখে আমরা বলি ‘রামধনু’। একই রকমভাবে ‘রামশিঙা’র মধ্যেও বৃহদর্থে ব্যবহারটি বুঝলাম। কেন না, বাল্মীকি নিজেই যেখানে রামচন্দ্রের মধ্যে আদর্শ হিসাবে বিরাট, উদাহরণ হিসেবে মহত্তম একটি মানুষের আদল আনতে চেয়েছেন, সেখানে বিরাট অথবা মহত্তম কোন কিছুর ক্ষেত্রেই ‘রাম’ শব্দটি পূর্বে ব্যবহার করায় আমরা একটু আশ্চর্য হচ্ছি না। এই দৃষ্টিতে দেখলে ‘রামদা’, ‘রামধনু’ কিংবা রামশিঙা’ও দা, ধনুক কিংবা শিঙার শ্রেষ্ঠ এবং বৃহত্তম উদাহরণ।
কিন্তু বাল্মীকি কি কখনও ভেবেছিলেন যে, তাঁর উপযুক্ত বংশধরেরা রামের মর্ম বুঝে বৃহদর্থে ‘রামছাগল’ শব্দটি ব্যবহার করবে! কিংবা ব্যঙ্গ করে অতি বোকা লোকটিকে বলবে, ‘রামবোকা’? এমনকি শুধু ব্যঙ্গও নয়, মহাকবির কল্পনাতেও কি কখনও এই ছবি ছিল যে, একটি লোভাতুর মানুষ শুধুমাত্র লোভের বশবর্তী হয়ে মুরগির নাম দেবে ‘রামপাখি’? সে কি মুরগিটি শুধু সাধারণ পাখির থেকে বড় বলেই? জানি, বাল্মীকির পক্ষে এ ভাবনা ভাবা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকে যে বোকা লোককে ‘হাঁদারাম’, ‘বোকারাম’ অথবা ‘ক্যাবলরাম’ সম্বোধন করে তার একটা পরম্পরা নিশ্চয়ই থাকা দরকার, সত্যি কথা বলতে কি—তা আছেও।
পরবর্তী কালের ধুরন্ধর কবিরা রাম এবং রামায়ণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেও তাঁর কতগুলি ব্যবহারে বোকামি খুঁজে পেয়েছেন। কেউ কেউ তো বলেছেন—কপাল, সবই কপাল। নইলে যে বিয়েতে জামাই হলেন পুরুষোত্তম, বিয়ের কনে স্বয়ং স্বয়ং লক্ষ্মীস্বরূপা সীতা, যাঁর বিয়ের ঘটক বিশ্বামিত্র মুনি, পুরোহিত বশিষ্ঠ, যে বিয়েতে কন্যাদান করেছেন রাজর্ষি জনক, আর বিয়ের সময়ে সমস্ত গ্রহগুলি যার একাদশ স্থানে, সেই লোকও বনে যায়! কি আর বলব—কবি বলেছেন—সবই কপাল—কিং ব্রূমো ভবিতব্যতাং হতবিধে রামো’পি যাতে বনম্।
কপাল যাই হোক, কপালের ধুয়ে দিয়ে কারও বোকামি ঢাকা যায় না। কবিদের মতে রামচন্দ্রের সবচেয়ে বড় বোকামি মোটেই বনে যাওয়া নয়। সেখানে পিতৃসত্য পালন করার মত মহৎ ব্যাপারও ছিল। তাঁর সবচেয়ে বড় বোকামি হল অজানা অচেনা বনে বসে সোনার হরিণ দেখে ভুলে যাওয়া। খোদ রামায়ণে সীতা যখন হরিণের জন্য বায়না ধরলেন, তখন লক্ষ্মণ কিন্তু পরিষ্কার বলেছিলেন যে, এই হরিণটাকে কিন্তু আমি মায়াবী মারীচ বলে সন্দেহ করছি—তমেবৈনমহং মন্যে মারীচং রাক্ষসং মৃগম্। শুধু তাই নয়, লক্ষ্মণ তাঁর সদাজাগ্রত বাস্তব-বোধে যে কথাটা বলেছিলেন—সেটা রামচন্দ্রের কাছে চরম পথ্য হতে পারত। লক্ষ্মণ বলেছিলেন—এমনটি হতে পারে না, এ রকম মণি-রত্নের গয়না-পরা হরিণ এই পৃথিবীতে থাকতে পারে না; এটি পরিষ্কার কোন রাক্ষসের মায়া—
মৃগো হ্যেবংবিধো রত্নবিচিত্রো নাস্তি রাঘব।
জগত্যাং জগতীনাথ মায়ৈষা হি ন সংশয়ঃ।।
রাম কিন্তু সব বুঝেও সীতার কথায় মোহগ্রস্ত হলেন। লক্ষ্মণকে অনেক বড় বড় কথা শুনিয়ে বললেন—সীতার যখন এই হরিণ নিতে এত ইচ্ছে হয়েছে, তবে এই হরিণকে আর জ্যান্ত ফিরে যেতে হবে না। এমনকি ও যদি মারীচ রাক্ষসও হয়, তা হলেও তার মৃত হওয়া উচিত, কেন না মারীচ এতদিন অনেক মুনি-ঋষি খেয়ে বহু অন্যায় করেছে। অতএব মারীচ হলেও তার মরাই উচিত।
প্রাসঙ্গিক হোক অথবা অপ্রাসঙ্গিক, আমি একটি সামান্য ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। ঘটনাটি আমার পরিবারের কাছে শোনা এবং আমাদের দুজনেরই উচ্চারণগত ত্রুটি থাকতে পারে। ঘটনাটা হল—পুরুলিয়া অঞ্চলে দেহাতী গোছের মানুষেরা রামলীলা অভিনয় করছেন। ক্রমে ক্রমে সেই সোনার হরিণের ‘সিন’ এসে গেল। সুদূর গ্রামে গঞ্জে ভাল আঁকা হরিণের ‘সিন’ আর কোথায় পাওয়া যাবে? অতএব হরিণের প্রতিনিধি হিসেবে গয়লাদের কাছ থেকে একটি মোষের বাচ্চা এনে গ্রাম্য ‘সিনে’র মাঝখানে খুঁটিতে বেঁধে রাখা হল। অভিনয় আরম্ভ হল। অভিনেতা নায়ক এই একটু আগে কিঞ্চিৎ মদ্যপান করেছেন, কিন্তু তাতে অভিনয়ে কোন অসুবিধে হচ্ছে না।
নায়িকা সীতা হরিণ দেখতে পেয়েছেন। দেখা মাত্রই সীতা বায়না ধরলেন—উই হরিণটা আমি লিব। সদ্যোমদ্যগ্রস্ত নায়ক বলছেন—উটা আবার কি লিবি, লিতে লাই। সীত তবু ছাড়েন না—তিনি খালি বলে যাচ্ছেন—উই হরিণটা আমি লিব আর নায়ক বারবার তাঁকে বোঝাচ্ছেন—নঃ, উটা লিতে লাই। ও দিকে অভিনেতৃ-দলের দুজন লোক দুটো দড়ি সেই মোষের বাচ্চার গলায় পরিয়ে দিয়ে একেবারে পরস্পরের বিপরীত দিক থেকে মোষের বাচ্চাটিকে একবার এদিকে টানছে, আরেকবার ওদিক টানছে—মানে সোনার হরিণ দৌড়চ্ছে আর কি। সীতার বায়না আরও খানিকক্ষণ চলার পরে নায়ক কিন্তু একটু খেপেই গেলেন। মদের ঘোরেই হোক অথবা বাস্তব-বুদ্ধিতেই হোক—নায়ক এবার বলে উঠলেন—উটা কি লিবি, উটা ঘোষদিগের কাড়া বঠে—মানে গয়লাদের কাছ থেকে ধরে নিয়ে আসা মোষের বাচ্চা—ওটা নিয়ে কি হবে?
আমি শুধু ভাবি—মদের ঘোরেও একজন অভিনেতৃ পুরুষের যে বাস্তববোধ কাজ করেছে, আসল রামন্দ্রকে বারংবার মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, প্রাণের ভাই লক্ষ্মণ তাঁকে বারবার সাবধান করে দিলেও—রামচন্দ্রের একবারও মনে হল না যে, এটা বোকামি হচ্ছে। মনে করবেন না—আজকে এই কলিযুগে বসে আমি পরমপুরুষ নরচন্দ্রমা রামচন্দ্রকে বোকা বলছি। তবে এটা আমি কিংবা আমার মত করে অন্য লোকে না বললেও অন্যান্য বড় বড় কবিরাই এই ঘটনার মধ্যে রামচন্দ্রের বোকামি দেখতে পেয়েছেন। এ যুগের রবীন্দ্রনাথ না হয় কায়দা করে—’আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই’—বলে মনুষ্যজীবনের একটি অধরা-ধরা কল্প সৃষ্টি করে গেছেন, কিন্তু সংস্কৃতসেবী কবিরা রামচন্দ্রকে একেবারেই ছাড়েননি এবং ছাড়েননি বলেই আজও আপনারা ‘বোকারাম’, ‘ক্যাবলারাম’, সম্বোধন এবং একেবারে বেমক্কা বোকামির ক্ষেত্রে—‘রামো’, ‘হায় রাম’ অথবা পুরো নাম ধরে ‘রামচন্দ্র’ বলে ধিক্কারসহযোগে নিজে নিজেই রামচন্দ্রকে স্মরণ করেন অথাৎ রামচন্দ্রের বোকামি স্মরণ করেন।
এর জন্য খুব বেশি পরে ঘোর কলির সংস্কৃত কবিদের কাছে যেতে হবে না। বাল্মীকির যুগের অব্যবহিত পরেই স্বয়ং ব্যাসদেব রামচন্দ্রের বোকামির উদাহরণ দিয়েই। যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলার গোয়ার্তুমি ব্যাখ্যা করেছেন। অবশ্য ব্যাস তো আর আমাদের মত ‘বোকারাম’, ‘ক্যাবলারাম’ বলবেন না, তিনি তাঁর অনবদ্য ভঙ্গিতে একেবারে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কথাটা বসিয়ে দিয়েছেন মহাভারত-বক্তা বৈশম্পায়নের মুখে। বৈশম্পায়ন তৎকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বললেন—যুধিষ্ঠির দ্বিতীয়বার পাশা খেলতে রাজি হলেন। পাশাখেলা: ক্ষতিকর হবে জেনেও—জানন্নপি ক্ষয়করং—যুধিষ্ঠির আবার পাশা খেলতে বসলেন। এখানে উদাহরণ কি? না, সোনার হরিণের অস্তিত্ব অসম্ভব জেনেও—অসম্ভব হেমমৃগস্য জন্তোঃ—রামচন্দ্র সেই কাল্পনিক মায়াবী হরিণের পেছনে ধাওয়া করেছিলেন। বৈশম্পায়ন রামচন্দ্রের এই বোকামি মাথায় রেখে ভদ্রভাবে মন্তব্য করেছেন যে, বিপদ যখন এসে পড়ে, তখন অতি বুদ্ধিমান লোকেরও বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে।
অবতারপ্রমাণ নরচন্দ্রমার বিষয়ে এর থেকে ভদ্রভাবে আর কিই বা বলতে পারতেন ব্যাস। কিন্তু অন্য কবিরা তো আর এইভাবে ছেড়ে দেবেন না। তাঁরা একই কথা আরও একটু কড়াভাবে বলেছেন। একজনের মতে—সোনার হরিণ বলে কোন বস্তু কোন কালে ছিল না, সোনার হরিণ কেউ দেখেনি—কিংবা তার কথা কেউ শোনেওনি—ন ভূতপূর্বো ন চ কেন দৃষ্টো/ হেম্নঃ কুরঙ্গো ন কদাপি বার্ত্তা। তথাপি রঘুনন্দন রামচন্দ্রের লোভ হল—সেই অবাস্তব সোনার হরিণ চাই বলে। আসলে এই হয়, মরণের সময় লোকের উলটো বুদ্ধি হয়—বিনাশকালে বিপরীতবুদ্ধিঃ।
রামচন্দ্রে কতগুলি গুণ যদি পর্বে পর্বে ভাগ করা যায় এবং সেই সঙ্গে যদি হিসেব করা যায় যে, তাঁর জীবনে কোন জিনিসটা কখন সফল হচ্ছে, তাহলেও কিন্তু মহান রামচন্দ্রকে সাময়িক বোকামিগুলি থেকে রক্ষা করা যাবে না। যেমন আমরা প্রথমে কবির মত করে বলে নিই যে, রামচন্দ্রের শিশুসুলভ খেলাধুলো শেষ হল হরধনুভঙ্গে, পিতার প্রতি নম্রতা প্রকাশের শেষ সীমা বনগমনে, তাঁর কৃপাগুণের পরাকাষ্ঠা সুগীবের সঙ্গে বন্ধুত্ব, তাঁর রাজোচিত আদেশ দেওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সমুদ্রে সেতু-বন্ধন, যশের চরম চিহ্ন রাবণ-হত্যায়, আর তাঁর লোকাপেক্ষা এতটাই যে রামচন্দ্রের জীবন কেটে গেল তপোবন-প্রবাসিত জানকীর জন্য অপেক্ষায়—শ্রীরামস্য পুনাতু লোকবশতা জানক্যপেক্ষাবধি। জীবনের মধ্যে এতগুলি পর্ব থাকলেও রামচন্দ্রের বনে যাওয়া থেকে আরম্ভ করে অনেক কিছুই পরবর্তী কবিদের চোখে বোকামি বলে মনে হয়েছে। হ্যাঁ, তাঁর মধ্যে মহত্ত্ব থাকলেও সেটা বুদ্ধিমত্তা বলে কবিরা ভাবতে পারেননি। মুশকিল হয়েছে—ভারতবর্ষের জনমানসে রামচন্দ্র ঈশ্বরপুরুষ বলে স্বীকৃত, তাই রামচন্দ্রের বোকামির কথা বলতে গেলেও সংবেদনশীল মনে আঘাত লাগার ভয়ে কবিরা সুর নরম করে বাক্বৈদগ্ধ্যে সে বোকামি প্রকাশ করেছেন।
বাল্মীকি রামায়ণ খুললে আপনারা পরিষ্কার দেখতে পাবেন যে, পিতার রসমধুর দাম্পত্য-শপথের দায় বহন করে অতি বশংবদ পুত্রের মত রামচন্দ্র বনে চলে গেছেন বটে, কিন্তু অযোধ্যার জনপদের বাইরে যেদিন প্রথম রাত্রির অন্ধকার ভয়ংকর শ্বাপদ আর ঝিল্লির শব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, সেদিন রামচন্দ্র যে নিজের ভুল খানিকটা বুঝতে পেরেছিলেন। সাময়িকভাবে হলেও তাঁর মনে হয়েছে যে, তাঁর বনে আসার ফলে সুবিধে হল শুধু কৈকেয়ীর। এই প্রসঙ্গে তিনি পিতাকেও এক হাত নিতে ছাড়েননি। নিজের হাতে সংগ্রহ করা তৃণ-পল্লবের শয্যায় শুয়ে শুয়ে লক্ষ্মণকে তিনি প্রাণের আবেগে বলেছেন—ভরতকে সামনে রেখে সম্পূর্ণ রাজ্য গ্রাস করার জন্য কৈকেয়ী। পিতা দশরথকেই মেরে না বসে—অপি ন চ্যাবয়েৎ প্রাণান্। একে তো আমি নেই, তাতে রাজা বুড়ো এবং কাম-পরবশ, কৈকেয়ীর কথায় তিনি ওঠেন বসেন—কি যে করবেন কে জানে—কিং করিষ্যতি কামাত্মা কৈকেয্যা বশমাগতঃ।
রামচন্দ্র এইটুকু বলেই থামতে পারতেন, কিন্তু পিতৃসত্য পালন করতে এসেও পিতার অন্যায় ব্যবহার তিনি ভুলতে পারছেন না। তিনি বললেন—রাজা দশরথের মতিভ্রম দেখে আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারছি যে, সাধারণের চতুর্বর্গ-চিন্তায় ধর্ম, অর্থ এবং কামকে যদিও ভাগ করে নিয়ে সমান প্রাধান্যে অর্থ ও কামের সেবা করতে বলা হয়েছে, কিন্তু এখন বুঝেছি যে, ধর্ম এবং অর্থের থেকেও কামই বড়—কাম এবাৰ্থধর্মাভ্যাং গরীয়ানিতি মে মতিঃ, নইলে আমার বাবা আমাকে যেভাবে নির্বাসন দিয়েছেন, কোন মূর্খ পুরুষ তার আজ্ঞাবহ পুত্রকে এইভাবে পরিত্যাগ করতে পারে? এর পরে রামচন্দ্র খানিকটা অসুখী পুরুষের মত লক্ষ্মণকে বলতে থাকলেন—ভরতই আজ সবচেয়ে সুখী, কেন না নিজের বউ নিয়ে সেই আজ এই বিরাট কোশল রাজ্য ভোগ করবে। আমি রইলাম বনে, আর পিতাঠাকুরের জীবনই বা কদিন—তখন ভরতই এই সুসমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ করবে—এক অধিরাজের মত। এত বয়স হয়ে গেল, তবু যে পিতা দশরথ কামনায় পীড়িত হয়ে বউয়ের কথায় নাচন-কোঁদন করছেন—তার আর কি হবে, তার এইরকমই গতি হয়—ছেলে বনবাসে যায়, আর তাঁর জীবিত অবস্থাতেই অন্য জন রাজ্য শাসন করে।
শেষে রামচন্দ্র মায়ের জন্য অনেক কষ্ট পেলেন। জননী কৌশল্যাকে কোনদিন সুখে রাখতে পারলেন না বলে বহুতর বিলাপ করলেন। পরমপুরুষ রামচন্দ্র একা তাঁর বাণযুদ্ধের ক্ষমতায় এখনও যে অযোধ্যা এবং সমস্ত ভূমণ্ডল অধিকার করেননি—সে শুধু অধর্ম আর পরলোকের ভয়ে—অধর্মভীতশ্চ পরলোস্য চানঘ। সত্যি কথা বলতে কি, এই লোকাপেক্ষাই রামচন্দ্রের কাল হয়েছে। হয় পরলোকের ভয়ে রাজ্যত্যাগ করেছেন, নয়তো ইহলোকের ভয়ে বালিবধের কলংক মাথায় নিয়েছেন, নয়তো বা শুধুই লোকের ভয়ে—পাছে লোকে কিছু বলে— এই ভয়ে নিজের প্রাণপ্রিয়া পত্নীকেও বিসর্জন দিয়েছেন। এত যাঁর লোকাপেক্ষা, তাঁকে যে পরবর্তী কালের লোকেরা একটু আধটু হাঁদারাম, ক্যাবলারাম বলবে, তাতে আর আশ্চর্য কি! আদর্শ ভাল, তাই বলে এত আদর্শ কি ভাল?
আমি জানি, আপনারা বলবেন—বৃদ্ধ পিতার এক কথায় আজ্ঞাবহ পুত্র বনবাসে গেলেন—এতবড় আদর্শ থেকে আমি রামচন্দ্রকে চ্যুত হতে বলছি? মহাশয়গণ! আমার এই আস্পর্ধা নেই। এমনকি আস্পর্ধা থাকলেও আদর্শবাদী রামচন্দ্র তা শুনতেন না। আপনারা জানেন—আপন আদর্শ বিষয়ে রামচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত গোঁয়ারগোবিন্দ। (এই রে! এ যে দেখি আরেক পরম পুরুষ গোবিন্দকে লোকে গোঁয়ার বলেছে আমাকে নিশ্চয়ই এর জন্য চিন্তা করতে হবে।) রামচন্দ্র যেটা মনে করবেন করবেন, তা থেকে তাঁকে কেউ সরাতে পারবে না। আস্পর্ধার কথাই যদি বলেন, তাহলে তাঁর প্রাণের ভাই লক্ষ্মণ কি কম আস্পর্ধা করেছিলেন? কামাসক্ত বুড়ো বাপকে তিনি মেরে ফেলার কিংবা পরিত্যাগ করার হুমকিও দিয়েছিলেন, কিন্তু রামচন্দ্র শোনেননি। আমি তাই আদর্শ ত্যাগের কথা কখনও বলছি না, আমি শুধু বলছি অতিরিক্ত আদর্শ সৃষ্টিরও একটা কুফল আছে। কুফলটা বেশি না—ওই কলিকালের ছেলে-ছোকরা কবিরা তাঁকে একটু মশকরা করবেন হয়তো, হয়তো বা তারও পরবর্তী কালের বাঙালিরা তাঁর প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা রেখেও ভুল-করা ছেলেটিকে বলবেন হাঁদারাম, ক্যাবলারাম। আপনারা আবারও বলবেন-অতিরিক্ত আদর্শ পালনের জন্যই যে এমনটি হয়েছে, তা কি করে জানলে? আমি আবারও বলব—জানি, যদি এ উদাহরণ বিশ্বাস না হয়, আরও আছে। যুধিষ্ঠির। সারা জীবন ‘ধর্ম, ধর্ম’ করে কি তিনি খারাপ কিছু করেছিলেন? শুধু পরবর্তী কালের লোকেরা ধর্মধ্বজী ব্যক্তমাত্রকেই কি যেন একটা ইঙ্গিত করে বলে—ধর্মপূত্র যুধিষ্ঠির। এর মধ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি বিশেষ অশ্রদ্ধা নেই, আছে অতিরিক্ত ‘ধর্ম ধর্ম’ করার ওপরে কিঞ্চিৎ বিদ্রূপ।
যাক সে কথা। পিতার কথায় বনবাসে এসে রাম না হয় খুবই ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ বালি বধের মত বোকামি করতে গেলেন কেন, তা পণ্ডিতেরা কেউ বোঝেননি। বস্তুত এই মুহূর্তে রামচন্দ্রের অত্যাদর্শের সূত্র ধরে না হলেও, একাদশ শতকের কবি ক্ষেমেন্দ্র লিখেছেন—যাঁর মধ্যে ঔচিত্যবোধ সদা জাগ্রত এবং উচিত-অনুচিত নিয়ে যিনি যথেষ্ট বিচার আচার করেন (ইঙ্গিতটা রামচন্দ্রের দিকেই), তিনি যেন নিজের মনে মনে একটা যুক্তি খাড়া করে স্বার্থসাধনের চেষ্টা না করেন—ঔচিত্যপ্রচুরাচারো যুক্ত্যা স্বার্থং ন সাধয়েৎ। যদি এই রকম আদর্শ ব্যক্তি ওই ধরনের স্বার্থ সাধন করে, তবে তাঁর চরিত্র লোকচক্ষুতে মলিন হতে বাধ্য। ক্ষেমেন্দ্র বলেছেন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন রামচন্দ্র। ঔচিত্যের ব্যাপারে তাঁর প্রচুর এবং প্রখর বোধ থাকলেও অন্যায়ভাবে বালিবধ করে তিনি তাঁর এতকালের যশের আদর্শ নষ্ট করলেন—ব্যাজবালিবধেনৈব রামকীৰ্ত্তিঃ কলঙ্কিতা। আসলে রামচন্দ্র স্বার্থও যে খুব ভাল বুঝেছিলেন তা নয়। স্বার্থের কথা চিন্তা করলে সুগ্রীবের চেয়ে বালিকে দিয়েই তাঁর বেশি সুবিধে হত। প্রথমত বালি সুগ্রীবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ছিলেন—একথা রামায়ণ থেকে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয়ত, যদি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের কথা বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে রাক্ষসরাজ রাবণকে দমিত করার ব্যাপারে বালি ছিলেন পরীক্ষিত শক্তি। কারণ, উত্তরকাণ্ডে দেখা যায় রাবণ রাজা বালির সঙ্গে স্পর্ধা করলে বালি তাঁকে বগলের তলায় পুরে ত্রিসন্ধ্যা জপ করেছিলেন চার সমুদ্রের তীরে। যদি উত্তরকাণ্ডের প্রক্ষিপ্ত কথা বলে বিশ্বাস না হয়, তা হলে কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে বালি নিজেই যে কথা বলেছিলেন, তা বিচার করুন। বালি বলেছিলেন—সীতা উদ্ধারের কথা তুমি যদি আমায় বলতে, তাহলে রাবণকে আমি মৃত অবস্থায় গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে আসতাম—কণ্ঠে বদ্ধ্বা প্রদদ্যাস্তে’ নিহতং রাবণং রণে।
এ কথা আমাদের অবিশ্বাস হয় না, এবং বালির এই আস্ফালন উত্তরকাণ্ডের বালির ক্ষমতার সঙ্গে মিলে যায়। যাই হোক, রাম যে বালিবধ করে অনুচিত কাজ করেছিলেন। তার কারণ— সুগ্রীব নিজের দোষ ঢেকে, বালির দোষের কথা রামচন্দ্রের কাছে প্রকট করেছিলেন এবং রামচন্দ্রও নিজের স্বার্থ চেতনায় সাময়িকভাবে সুগ্রীবের তেলে ভিজেছিলেন। এই তেলে ভেজার ব্যাপারটা সবচেয়ে ভাল ধরেছেন চৈতন্যপন্থীরা, যাঁরা রামচন্দ্রকে ত্রেতাযুগের অবতার বলেই বিশ্বাস করেন। চৈতন্যলীলার ব্যাস। বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে পরমানন্দ পুরীর প্রসঙ্গ টেনে চৈতন্য মহাপ্রভু সম্বন্ধে লিখেছেন—অর্কর্তব্যো করে প্রভু সেবক রখিতে। তার সাক্ষী বালিবধ সুগ্রীব-নিমিত্তে। (৩/৩/২৫২)
আদর্শবান ঈশ্বরপুরুষের এই স্বার্থচেতনা এবং আদর্শচ্যুতিতে রামচন্দ্রের অতি বড় ভক্তও ব্যথিত হয়েছেন। বাঙালি কথাকার কৃত্তিবাস বাষ্প-রুদ্ধ কণ্ঠে বলেছেন—
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের ঘটিলা বিষাদ।
বালিবধ করে কেন করিলা প্রমাদ ॥
অবশ্য কলঙ্ক আর বোকামি তো এক নয়! বালিবধ রামের কলঙ্কই, বোকামি নয়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে বালিবধের মধ্যে রামচন্দ্রের বোকামিই বেশি, কারণ রাম যদি বালির সাহায্য নিতেন, তাহলে সীতার উদ্ধার হত অনেক তাড়াতাড়ি এবং তাও অনেক সহজে। আচ্ছা ধরে নিলাম—এটা রামের বোকামি নয়, কলঙ্ক। তাতেই কি কিছু আরাম হবে? সীতা দেবীর পূনরায় নির্বাসন—সেও তো আরেক বোকামি। একবার লঙ্কাকাণ্ড করে সীতা উদ্ধার, তারপর অতগুলো বানরের সামনে তাঁর অগ্নিপরীক্ষা, পুনশ্চ লোকের মুখে ঝাল খেয়ে আবার তাঁকে বাল্মীকির তপোবনে নিবাসন দেওয়া—বোকামির এই মালোপমা রামচন্দ্রের জীবন ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? একাদশ শতকের কবি ক্ষেমেন্দ্র তো একেবারে চাণক্য-শ্লোকের মত শ্লোক লিখে বলেছেন—দেখ বাপু! একান্ত অনুগামী, গভীরভাবে আসক্ত, হিতকামী, অনুরাগী এবং সবচেয়ে বড় কথা নির্দোষ ব্যক্তিকে খবরদার ত্যাগ কর না। করলে রামের মত অবস্থা হবে। সতী সীতাকে ত্যাগ করে রামচন্দ্রকে যেমন সারা জীবন কেঁদে যেতে হল, তেমনি নিদোষ ব্যক্তিকে বিনা কারণে বিসর্জন দিলে অন্যেরও একই অবস্থা হবে—রামস্ত্যক্ত্বা সতীং সীতাং শোকশল্যাতুরো’ভবৎ।
অন্য সব কিছুর থেকেও সীতাকে ফের বনবাস দেওয়াটা ক্ষেমেন্দ্রের কাছে বেশি বোকামি মনে হয়েছে। ক্ষুব্ধ আলংকারিক শেষ পর্যন্ত রামচন্দ্রকে তুলনা করেছেন একটি হাতির সঙ্গে। সংস্কৃতে অবশ্য প্রশংসা করার জন্যই হাতির তুলনা দেওয়া হয়, ক্ষেমেন্দ্রও তাই করেছেন। কিন্তু কনকজানকী গ্রন্থের শ্লোক লিখতে গিয়ে কবি বুঝেছেন যে, শুধুমাত্র লোকের কাছে ভাল সাজতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে এত কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয় না, এবং এই মুহূর্তে অনুশোচনা করার কোন মানে হয় না। ক্ষেমেন্দ্র লিখেছেন—সীতা পরিত্যাগের শোকে তাপে, রাঘব-কুঞ্জর একেবারে শুকিয়ে গেছেন—ক্লেশোষ্মণা শুষ্যতি। কিরকম রাঘব-কুঞ্জর? না, সোজা কথায়, যাঁর দুদিকে দই কানের কাছে দুটি চামর দোলে, শঙ্খ-ধবল রাজছত্র যাঁর রাজবিভবের চিহ্ন বহন করছে—সেই রাজসুখ বিদ্বেষ করে রামচন্দ্র এখন শুধু চক্ষু মুদে ভাবেন। ভাবেন আর শুকিয়ে যান। ভাবেন—একান্ত অনুরক্ত প্রিয়তমা পত্নীকে বিজন বনে একাকিনী কি কষ্টেই না রেখেছেন। শুধু এই অনুশোচনায় এতদিন পরে যে রাজ্যভোগের গ্রাস মুখের মধ্যে এল—সেই রাজ্যভোগ চিরতরে ত্যাগ করে তিনি এখন কেবল কষ্টে কষ্টে শুকিয়ে যাচ্ছেন—সংত্যক্তাং চিরমুক্তভোগকবলঃ ক্লেশোষ্মণা শুষ্যতি।
এমনই রামের অবস্থা। প্রথম জীবনে রাজ্যত্যাগ করে এসে জননী কৌশল্যার জন্য কষ্ট পেয়েছেন। লঙ্কাকাণ্ডে সীতা উদ্ধার করে তিনি সবার সামনে বলেছেন—তোমাকে আমার জন্য উদ্ধার করিনি, করেছি অযোধ্যার রাজমর্যাদা রক্ষার জন্য। আবার সীতা উদ্ধার করে সুখে রাজ্য করতে করতে প্রজাদের মুখে ঝাল খেয়ে হঠাৎ অনুরাগিনী পত্নীকে গর্ভবতী অবস্থায় পরিত্যাগ করলেন। এই সবগুলি আদর্শই যে তিনি জনসমক্ষে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন, তার কারণ কিন্তু একটাই—লোকে তাঁকে ভাল বলবে, লোকে তাঁকে আদর্শ পুরুষ বলবে। তা বলেছে, চিরকাল বলেছে, এখনও বলে। আর সেইসঙ্গে আরও একটু বলে—হাঁদারাম, ক্যাবলারাম, বোকারাম। রামচন্দ্র জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন, অতএব বিশিষ্ট আদর্শ স্থাপনের জন্য জনগণের কাছ থেকে যদি এই বিদ্রূপটুকু তাঁকে শুনতে হয়—তা তিনি ‘হথ্থি চলে বাজার’ নীতিতে অবহেলা করবেন বলে আশা করি।
॥ ৬ ॥
পরশুরাম, রামচন্দ্র—দু’জনের অবস্থাই দেখলাম, বাকি থাকলেন আরেক রাম—বলরাম—কাঁধে বাড়ি বলরাম, হল কাঁধে বলরাম। সমস্ত দেবচরিত্রগুলির মধ্যে এই এক চরিত্র, যাঁর মধ্যে মনুষ্যলোকের সম্পূর্ণ ঠিকানাটি পাওয়া যাবে। সরলের সরল, অন্যায়ে ক্রোধী, ফুর্তিতে পান-পাত্রের মুখচ্ছদ ভঙ্গকারী এক বিচিত্র চরিত্র এই বলরাম। মুশকিল হল, এই বলরামের কাঁধে একটি লাঙলখণ্ড মাত্র দেখে মিথলজিস্টরা বলরামের সঙ্গে চাষবাস আর ফসলের যোগাযোগ খুঁজে পেয়েছেন। কৃষি-সম্পর্কাম্বেষী এই পণ্ডিতদের আমরা কোনভাবেই আহত করতে চাই না, এই প্রবন্ধ তার উপযুক্ত পরিসরও নয়। আমরা চাই বিশিষ্ট দেবচরিত্রের মনুষ্যায়ণের সূত্রগুলি খুঁজে বার করতে, যে সূত্র আজও আমাদের ভাষায়, কথায়, প্রবাদে বর্তমান। একদা এক চরিত্রহীন গুরুদেব সময় বুঝে তাঁর রূপবতী শিষ্যাকে বললেন— ‘তুমি রাধে আমি শ্যাম’। দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্যক্রমে সেই যুবতী শিষ্যার স্বামী জীবিত ছিলেন এবং তিনি তাঁর আপন স্ত্রীর রতিলিপ্সু গুরুদেবের প্রণয় নিবেদন শুনেই গুরুর কাঁধে একটি মোক্ষম লাঠির ঘা কষিয়ে বললেন— ‘তুমি রাধে আমি শ্যাম’—তাই না? তবে এই নাও ‘কাঁধে বাড়ি বলরাম’। কথাটি প্রবাদবাক্যে পরিণত, এবং কৃষ্ণ-বলরামের সাধারণ চারিত্রিক গুণগুলিও এই প্রবাদে যা এক ঝলক দেখা গেল, তাতে বোঝা যায়—আমরা এখন দেবতার মনুষ্যাণের চরম বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি। নইলে, বলরামের মত এক কঠিন চরিত্রকেও এইভাবে উপস্থিত করা প্রবাদ-প্রণেতার পক্ষে সম্ভব হত না।
বস্তুত এই হলেন বলরাম। পান থেকে একটু চুন খসলেই তিনি কাঁধের লাঙলটি নামিয়ে এনে হত্যার ভয় দেখান, এবং সামান্য সম্মানে লাগলেই তাঁর কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না। সাধারণ চরিত্রটিও তাঁর বড়ই খোলামেলা। আমাদের এই বঙ্গের লাগোয়া বগুড়া জেলার প্রাচীন কবি লক্ষ্মীধর, যিনি হয়তো ১২শ/ ১৩শ খ্রীষ্টাব্দের লোক হবেন, তিনি ভারি সুন্দর একটি শ্লোক লিখেছেন বলরামের সম্বন্ধে। লক্ষ্মীধরের মতে বলরামের সাময়িক অবস্থাটা এইরকম— তিনি অতিরিক্ত মদ্য পান করে ফেলেছেন এবং মদের ঘোরে নিজের স্ত্রী ভিন্ন অন্য একটি মহিলার নাম করে কিঞ্চিৎ আসক্তি দেখিয়ে ফেলেছেন। ফল যা হয়, তাই হল। বলরামের প্রিয়া মহিষী রেবতী ঠোনা মেরে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলেন। বলরাম কিন্তু জাতে মাতাল তালে ঠিক। গৃহিণীর ওইটুকুনি অভিমানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মদের ঘোর কিঞ্চিৎ কাটল কিন্তু মত্ততা যেন আরও বেড়ে গেল। তিনি বুঝলেন, রেবতীকে তুষ্ট করতে না পারলে অনর্থ ঘটবে। অতএব প্রিয়া পত্নীকে প্রসন্ন কারার জন্য তিনি এমন করতে আরম্ভ করলেন, কি বলব! লক্ষ্মীধরের কল্পনায় তিনি যতটুকু ধরা পড়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে—তিনি একবার রেবতীকে গাঢ় চুম্বন করছেন, একবার তাঁকে জড়িয়ে ধরছেন, আবার কখনও বা রেবতীর বুকের আঁচল সরিয়ে দিচ্ছেন—বিচুম্বন্ সংশ্লিষ্যন্ স্তনবসনম্ অস্যন্নবিরতম্। মদ্যপানে তাঁর মত্ততা এসেছে, আবার স্ত্রী মানিনী হওয়ার ফলে তিনি কি বুঝেছেন কে জানে—রেবতীকে প্রসন্ন করার পদ্ধতিগুলি একবার নয় বারবার প্রয়োগ করছেন তিনি—অবিরতং মধূন্মাদাবিষ্টঃ।
আসলে এই মুহুর্তে রেবতীর সামনেই যেহেতু বলরামের মুখ ফসকে অন্য এক রমণীর নাম বেরিয়ে গেছে, তাই তাঁর অবস্থা কিঞ্চিৎ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বাস্তবে কিন্তু বলরাম রেবতীকে অসম্ভব ভালবাসেন। আপনারা তো পৌরাণিকদের কৃপায় এবং স্বয়ং রাজশেখর বসু মহাশয়ের কল্যাণে এটা নিশ্চয়ই জানেন যে, রেবতী বলরামের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন এবং লম্বায়ও বড় ছিলেন। বলরাম তাঁকে লাঙলের আঁকশি দিয়ে নিজের মত করে ছোট করে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই তিনি রেবতীকে অতিক্রম করতে পারতেন না। এই ত্রেতা যুগীয় মহিলাটির ওপর তাঁর আকর্ষণ এবং অত্যাচার দুইই ছিল চরম। যে কোন কবিই বলরামের কথা উল্লেখ করেছেন, তাঁরা রেবতীর উল্লেখ না করে পারেননি। রেবতী এবং মদ্য—এইদুটিই ছিল কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ পুরুষটির প্রধান নেশা। সপ্তম/ অষ্টম খ্রীষ্টাব্দের কবি মাঘ শিশুপালবধের পরিকল্পনা করার জন্য তিনজন বৃষ্ণিবীরের একটি আলোচনাসভার ব্যবস্থা করেন। কি করা উচিত—সেটা ছিল কৃষ্ণের প্রশ্ন। এর উত্তরে বৃষ্ণিদের নামী মন্ত্রী উদ্ধব কথা বলতে যাবেন তার মধ্যেই প্রথমে চেঁচিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন বলরাম। তাঁর গলার স্বরে সভাভিত্তি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তিনি কথা বলছিলেন কি ভাবে? না—ঘূর্ণয়ন্ মদিরাস্বাদ-মদপাটলিতদ্যুতী—মদের আস্বাদনে চোখ দুটি যাঁর লাল হয়ে গেছে, সেই চোখ দুটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছিলেন বলরাম। কবির কল্পনায়—বলরাম যতই চোখ ঘুরিয়ে কথা বলুন না কেন, তাঁর চোখের পাতাটি ছিল রেবতীর চুম্বন-আলিঙ্গনে পবিত্র—রেবতীবদনোচ্ছিষ্টপরিপূততটে দৃশৌ।
কবি বলে মাঘ যে কথা বলেছেন, রাজা বলে ভোজদেব বলরামকে তার চেয়ে আরও আধুনিক করে ফেলেছেন। রেবতীর বদনোচ্ছিষ্ট আঁখিতারার মালিকটিকে ভোজদেব একেবারে নিয়ে এসেছেন পানশালার মাতাল যুবকদের মধ্যে। ভোজ লিখেছেন—ওই পানগোষ্ঠীতে বসেই বলরাম তোমাদের মঙ্গল বিধান করুন—হলী মদক্ষীবঃ পানগোষ্ঠ্যাং পুনাতু বঃ। কথাটা যে বাস্তবসম্মত তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, যত বড় দেবতাই হোন, তাঁর যদি মদোমাতালদের মত মুহুর্মুহু মদ্যপান করার অভ্যাস থাকে, তবে সে দেবতার আসন যে পানশালায় পানগোষ্ঠীতেই বিছিয়ে দেওয়া হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা তো হবেই। মনুষ্যলোকে আমরা যেমন বিশিষ্ট একটি মানুষের স্বভাব, আচরণ অনুযায়ী তার চরিত্র বিশ্লেষণ করি এবং সমাজে তার স্থান নির্দেশ করি, দেবলোকের মনুষ্যগুলিও সেইরকম! দেবতাদের মনুষ্যায়ণ পদ্ধতিতে বলরামের চরিত্র এতই সজীব, এতই পরিষ্কার যে তাকে মাতাল সাজাতে কবিদের একটুও বাধেনি। তবে হ্যাঁ, বলতে পারেন—কবিরা এত আশকারা পেলেন কোথ্থেকে? আমরা বলব—শাস্ত্রকারেরাই এই আশকারা দিয়েছেন, নইলে তাঁদের এত জোর কোথায়? এই দেখুন না, হরিবংশ পুরাণ শাস্ত্রগুলির মধ্যে প্রথম শ্রেণীর মধ্যে পড়ে—দেবদ্বিজে বিশ্বাসী হলে হরিবংশকে আপনার ‘শাস্ত্র’ বলে মানতেই হবে। —সেই হরিবংশে, একবার নয় অন্তত দশ-পনেরবার দেখবেন—বলরাম কিরকম মদ খান। রেবতীর সঙ্গে বিয়ের পর নানা রসের অনুষঙ্গে এই সুরাপানের মাত্রা হয়তো বেড়েছে, নইলে এ অভ্যাস তাঁর বহুদিনের। সেই যখন মথুরার রাজা কংস সবে মারা গেছেন, এবং সেই সূত্রে জরাসন্ধের সঙ্গে কৃষ্ণের ঝগড়াঝাঁটি চলছে, তখন বলরামের পাল্টা আক্রমণের চেহারাটা দেখবার মত। জরাসন্ধ এবং তাঁর সহায় রাজারা গোমন্ত পর্বতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, কেন না কৃষ্ণ-বলরাম ওই পর্বতে ছিলেন। নিজে বাঁচতে এবং জরাসন্ধের দলকে উচিত শিক্ষা দিতে বলরাম যখন গোমন্ত পর্বত থেকে লাফ দিলেন, তখন তাঁর পরনে ছিল নীল বসন আর গলায় ছিল কদম-ফুলের গন্ধ দেওয়া মদ—কাদম্বরীমদক্ষীবো নীলবাসাঃ সিতাননঃ।
বলরামের তখন বিয়েও হয়নি। জরাসন্ধের সঙ্গে সেসময় একবার সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। হঠাৎ বলরামের মনে হল—কয়েক দিনের জন্য বৃন্দাবনে ঘুরে আসলে কেমন হয়! যেমন বলা তেমনি কাজ। কৃষ্ণকে একবার বলে তিনি চলে গেলেন বৃন্দাবনে। পরিচিত পুরনো ব্রজবাসীরা বলরামকে দারুণ অভ্যর্থনা করল। এ-কথা সে-কথা, কংসের গল্প, জরাসন্ধের গল্প, গোপরমণীদের বিস্ময়চকিত মুখ—এই সব কিছুর পর বলরাম ঢুকলেন বনে, বৃন্দাবনের বন থেকে বনান্তরে। ঠিক এই সময়ে বলরামের মন বুঝে গোপালকেরা সব কড়া বারুণী মদ নিয়ে এল—গোপালৈ র্দেশকালজ্ঞৈ রুপানীয়ত বারুণী। বলরাম তখন তাঁর ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে সেই টলটলে হলদে বারুণী পান করলেন। সঙ্গে ছিল ভালরকম খাবারদাবার। বলরামের নেশা হচ্ছিল, নেশা জমছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর বেশ মত্ততা এসে গেল, তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাঁর চোখ-মুখ সব ঘুরছে—স মত্তো বলিনাং শ্রেষ্ঠো ররাজাঘূর্ণিতাননঃ।
মদ্যপানে এই বলরামের অবস্থা—এই অবস্থার আরও উন্নতি হয়েছে বিয়ের পরে। ধরে ফেলবার লোক থাকলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। কাজেই বিয়ের পর একটা সুবিধে হল। তখন তিনি মদে মাতাল লাল চোখে রেবতীর কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটেন—রক্তেক্ষণো রেবতীমাশ্রয়িত্বা। মদ যাঁরা খান, তাঁদের যুক্তির অভাব হয় না। দুঃখে মদ খাচ্ছেন, আবার আনন্দে বহুজনের মিলনে তাঁরা বলেন—এত আনন্দ রাখব কোথায়, মদের গেলাস আন। ফলে গোমন্ত পর্বত থেকে লাফানোর সময় বলরামকে মদ খেতে হয়, ব্ৰজের বনে ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গেও মদ খেতে হয়, আবার এখন বিলাসিনী বারবধূরা যখন অভিনয়, নৃত্যগীত আরম্ভ করেছে, তখন কাদম্বরী মদ খেয়ে ফোলা ফোলা মুখ-চোখে রেবতীর সঙ্গে তাল দিতে দিতে তিনি সমে ঠেকা দিলেন এবং চেঁচিয়ে গান ধরলেন—কাদম্বরীপানমদোৎকটস্তু/ বলঃ পৃথুশ্রীঃ স চুকূর্দ রামঃ।
হরিবংশের এই শাস্ত্র-প্রমাণ দেখেও কি আমাদের কবিরা চুপ করে থাকবেন? দ্বাদশ শতাব্দীরও খানিকটা আগের এক বৌদ্ধ কবি এবং ভাষাবিদ্ পুরুষোত্তমদেব, যাঁর এই বুদ্ধ এবং বলরাম—দু’জনের ওপরেই একটু আকর্ষণ বেশি ছিল, তিনি তো বলরামকে এমনভাবে এঁকেছেন যে, তাতে বলরামকে দেবতা বলে চেনাটা খুবই কঠিন হবে। আপনারা জানেন যে, মদে মাতাল হলে মানুষের কথাবার্তা স্খলিত হয় এবং কথার এক একটি শব্দ কেমন যেন প্রলম্বিত হয়। সংস্কৃত ভাষায় ছন্দ রেখেও যে এই মাতলামি করে কথা বলা যায় সেটা পুরুষোত্তমদেবের কল্যাণে বলরাম দেখাতে পেরেছেন। বলরাম বলছিলেন—পৃথিবীটা যেন কেমন ঘু-ঘু-ঘুরছে—সংস্কৃতে—ভ্ৰভ্ৰভ্ৰমতি মেদিনী, চাঁদটা কিরকম ঝুলে পড়েছে মনে হচ্ছে, কৃষ্ণ! আমাদের স্বজাতি বৃষ্ণিরা সব হাহাহা হাসছে কেন—হহহসন্তি কিং বৃষ্ণয়ঃ। দেখ, আমার মদটা আমার মমমদের গ্লাসে আটকে গেছে, ওটাকে একটু খুখুলে দাও তো, কৃষ্ণ—শিশীধু মুমুমুঞ্চ মে পপপপানপাত্রস্থিতম্।
পুরুষোত্তম কবি লিখেছেন—এইভাবে যিনি মদস্খলিত স্বরে আলাপ করে যাচ্ছেন, সেই হলধার বলরাম আপনাদের মঙ্গল বিধান করুন। দেখুন, দেবতার কাজ মঙ্গল বিধান করা, তা তিনি অবশ্যই করবেন, বহুবার করেওছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বহুবার তিনি বৃষ্ণিবীরদের রক্ষা করেছেন, কৃষ্ণকে বহুবার আগলে রেখেছেন এবং মদ খান বলে তাঁর যুক্তি-তর্কও সব সময় লুপ্ত হয়নি। অত বড় ভারত যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তিনি তাঁর নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন, এবং সময়ে সময়ে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে গিয়েও তিনি আপন স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। সেদিক দিয়ে তাঁর যৌক্তিকতারও অভাব নেই। কিন্তু এত বড় মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কবিরা তাঁর ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র নিয়ে বক্রোক্তি করতে ছাড়েননি, কিংবা বলতে ভোলেননি যে, ধরণী তাঁর কাছে চিরকালই ঘূর্ণায়মান রয়ে গেছে, সেই সঙ্গে তাঁর মাথাটাও।
একটা ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করে থাকা যাচ্ছে না। অষ্টাদশ খ্রীষ্টাব্দের ব্রিটিশদের মাথা-ঘোরানো পণ্ডিত ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে আপনাদের মনে আছে, আশা করি। তিনি একবার রথযাত্রা উপলক্ষে পুরীতে জগন্নাথ দর্শন করতে গেছেন। রথযাত্রা আরম্ভ হবে। দেবদেব জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রাকে তাঁদের পৃথক পৃথক রথে তোলা হচ্ছে। রথযাত্রার পূর্বাহ্লে জগন্নাথ-বলরামকে রথে কি ভাবে তোলা হয়—সেটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন—ওই পর্বে ওড়িশাবাসীদের ভক্তির থেকেও অন্য ভাব বেশি প্রকাশ পায়। ওঁরা অবশ্য বলেন—ওটা হল, জগন্নাথের প্রতি তাঁদের সহজ ভালবাসা, যাতে করে রথে ওঠবার সময় গোঁয়ার্তুমির জন্য তাঁদের কাছে গালাগালিও খেতে হয় জগন্নাথ-বলরামকে। যাই হোক, রথযাত্রার আগে নানা কসরত করে জগন্নাথ-বলরামকে মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে নিয়ে এসে রথে ওঠানো হচ্ছে—ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন সেখানে দাঁড়িয়ে। ভারতবর্ষের অদ্বিতীয় পণ্ডিত তিনি, সবকিছুই তিনি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দেখবার সুযোগ পেয়েছেন।
অন্যান্য পণ্ডিত এবং গ্রহবিদ্ ব্রাহ্মণেরাও সেখানে আছেন। আর আছেন তদানীন্তন পুরীর রাজা মহারাজা চলদ্বিষ্ণু—তিনি সোনার ঝাঁটা হাতে প্রস্তুত হয়ে আছেন। কারণ রথযাত্রার আরম্ভেই রাজার অভিমান-মঞ্চ থেকে নেমে এসে সাধারণ ঝাড়ুদারের মত তাঁকে রাজরাজ জগন্নাথের যাবার রাস্তা পরিষ্কার করে দিতে হবে—এটাই পুরীর রাজবংশের চিরকালের প্রথা।
কিন্তু এ দিকে একটা ঘটনা ঘটে গেল। রথে ওঠানোর সময় বলরামের মূর্তি পাণ্ডা-ঠাকুরদের হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল। উপস্থিত জনতা হৈহৈ করে উঠল। সংস্কারের বশে অনেকেই এ ঘটনাকে দুর্লক্ষণ বলে মনে করতে লাগল। স্বয়ং পুরীর রাজা চলদ্বিষ্ণুও একইভাবে বলরামের দারুমূর্তি পতনের ঘটনা দেখে বিচলিত হলেন এবং এতে করে যে নানা উৎপাতের সম্ভাবনা হতে পারে—সেটা ভেবেও চিন্তিত হলেন। ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন দেখলেন—এই ‘ঔৎপাতিক’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমবেত জনসাধারণের আনন্দ মাটি হবার যোগাড়, স্বয়ং রাজাই চিন্তাহত হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থায় তিনি একটা কিছু বললে সবারই মনে একটু বল আসে। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন মহারাজ চলদ্বিষ্ণুকে বললেন— মহারাজ! আপনি বললেন— ‘ঔৎপাতিক, ঔৎপাতিক’। কিন্তু এটা উৎপাতের ঘটনা তখনই হত, যদি নারায়ণস্বরূপ জগন্নাথ পড়ে যেতেন, কিংবা যদি পড়ে যেতেন শক্তিরূপিণী সুভদ্রা। তা তো হয়নি। পড়েছেন বলরাম। যে বলরাম সব সময়ই মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে আছেন, কাদম্বরী পান করে যাঁর চোখ সব সময়ই ঘুরছে, সেই বলরামের মাটিতে পড়ে যাওয়াটা আশ্চর্যও নয়, ঔৎপাতিকও নয়; বরঞ্চ যুক্তিযুক্ত—যুক্তং হি লাঙ্গলভৃতঃ পতনং পৃথিব্যাম্।
হায়! ভগবৎস্বরূপ অবতার প্রমাণ বলভদ্রের যে এই অবস্থা হল, তাতে সাধারণের কোন অভক্তি হয়নি। পণ্ডিত-প্রবর জিতেন ব্যানার্জির গ্রন্থগুলি খুললেই দেখবেন—বলরামের উপাসনা, বলরামের মন্দির নির্মাণ আরম্ভ হয়ে গেছে সেই কোন খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। আজও তাঁর উপাসনা চলছে।
স্বীকার করি, সুযোগ দেখে মানুষ বুঝে বলরামকে নিয়ে না হয় কবিরা একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছেন, কিন্তু এ দুঃখ তাঁর থাকবে না—যখন তিনি দেখবেন আমরা কাউকেই ছাড়িনি। এই যে ভগবান বুদ্ধ, যার শান্ত প্রসন্ন মুখখানি দেখলে যে কোন কবিশিল্পীর হৃদয় বিগলিত হবে—সেই বুদ্ধ তো আর প্রথমে মূল ব্রাহ্মণ্য ধারার দেবতা ছিলেন না। আমাদের পণ্ডিত দার্শনিকেরা তো বুদ্ধ এবং বৌদ্ধপন্থীদের যা নয় তাই গালাগাল দিয়েছেন। ধরে নিলাম—তিনি মূল দার্শনিক প্রস্থানগুলির অন্যতম নন বলেই বুদ্ধকে গালাগাল খেতে হয়েছে। কিন্তু যখন তিনি আমাদের হলেন? অর্থাৎ কি না, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা যখন দেখলেন বুদ্ধকে আপন করে না নিলে এ দেশের অনেকেই বৌদ্ধ হয়ে যাবে—সেই তখন তাঁরা বুদ্ধকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আত্মসাৎ করে নিলেন। জয়দেব কবি তাঁর আপন ব্রাহ্মণ্য-পরিমণ্ডলের মধ্যে বসেই গান ধরলেন—কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর। বুদ্ধ যাগযজ্ঞ বৈদিক বিধির নিন্দা করেছেন জেনেও জয়দেব দশাবতারস্তোত্রে বুদ্ধের স্থান নির্দিষ্ট করেছেন। এটা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের কূট কৌশলই হোক, কি উদারতাই হোক, কি সাময়িক সহাবস্থানই হোক—বুদ্ধ যেই আমাদের হলেন, অমনি তাঁকে নিয়ে মানুষের গালাগলি আরম্ভ হল। আজও পর্যন্ত যে হতভম্ব, বেচার-বেচারা মানুষটিকে দেখে আমরা বুদ্ধ বলি—সে দোষ ভগবান তথাগতের মুখখানির। শিল্পরসিকেরা বলেন—বুদ্ধের মুখে যে নির্লিপ্ত হাসিটুকু, তাঁর চোখে যে নিবাণের নির্মোহ ভাবটুকু—তার নাকি কোন তুলনা হয় না। অথচ দেখুন, ওই রকম একখানি মুখ সাধারণ্যে দেখলেই—তদুপরি সে যদি কথা না কয়, তার চোখ দুটি যদি প্রভাহীনতার দরুন অর্ধনিমীলিত হয়, তবে অবশ্যই সেই জড়বৎ মানুষটিকে আমরা বুদ্ধ বলে ডাকব। বুদ্ধের মুখে যে নির্লিপ্ত ভাবখানি আছে, যা এমনই নিস্তরঙ্গ, এমনই বুদ্ধমুক্ত যে, সাগরপারের লোকেরা পর্যন্ত তাঁর ভাব নিয়ে কল্পনা করেছেন। প্রখ্যাত ডি. এইচ. লরেন্স প্রায় একটি রতিবেগমুক্ত মানুষকে বুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আমাদের কবিরা কিন্তু অন্তত বুদ্ধের ওপর আমাদের মত নির্দয় নন। তাঁরা বরঞ্চ বুদ্ধের দার্শনিক মতের ওপর তীব্র কটুক্তি করেছেন, যদিও তা এতই কায়দা করে যে, সাধারণের চোখে প্রায় ধরাই পড়বে না। আমরা মহারাজ লক্ষণসেনের সভাকবি গোবর্ধন আচার্যের একটি শ্লোকে দেখব—ফুলে ফুলে মধু-খাওয়া বহুবল্লভ নায়কের ক্ষণচঞ্চল প্রেমকে বৌদ্ধদের ক্ষণিক বস্তুর মত অস্থির বলা হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শন মতে প্রত্যেকটি ভাবই ক্ষণিক বা অস্থির। এই মুহূর্তে যার অস্তিত্ব আছে; পরমুহূর্তে সেটি নেই। কিন্তু পরমুহূর্তে অন্য একটি নৃতনতর ভাব অবশ্যই আছে, তারও পরের মুহূর্তে সেটি কিন্তু বিলীন, যদিও আরও এক পৃথক ভাব তার স্থান নিয়েছে। এমন ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত ক্ষণভঙ্গের মধ্যেও বৌদ্ধেরা কিন্তু এটা স্বীকার করেন যে, প্রত্যেকটি ভাব স্বতন্ত্র বা ক্ষণস্থায়ী হলেও তাদের মধ্যে একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ আছে। এবারে দুটি তত্ত্বই কবি কিরকম মিলিয়ে দিয়েছেন দেখুন।
নায়িকার খবর নিয়ে এসে নায়িকার দূতী নায়ককে বলছে—বহু রমণীকে প্রেম নিবেদন করে আপনি বহু-বল্লভ। ক্ষণভঙ্গবাদীদের বস্তুর মত আপনার প্রেম ক্ষণে ক্ষণে ভঙ্গুর অথাৎ এই আছে, এই নেই, আবার এই অন্যত্র আছে, আবার সেখানেও নেই। কিন্তু আমার সখীর প্রেম! সে প্রেম বহুভঙ্গে ভঙ্গুর ভ্রূভঙ্গের মত নিরবচ্ছিন্ন। বস্তুত নায়িকার প্রেমে বৌদ্ধ ক্ষণভঙ্গবাদের দ্বিতীয় অংশের স্বরূপটি উদঘাটিত। বারবার ভগ্ন হলেও ওই রমণীর ভ্রূভঙ্গে যেমন একটি অবিচ্ছিন্ন চিত্তচমৎকারিতা আছে, বৌদ্ধ ক্ষণিকবাদেও তেমনি ক্ষণে ক্ষণে ভঙ্গুর ভাবগুলির মধ্যে একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ বর্তমান। এখানে বুদ্ধ কিংবা বৌদ্ধ দর্শনের ওপর যত কটাক্ষই থাক, নায়িকার প্রেমের অবিচ্ছিন্নতা এবং নায়কের প্রেমের অস্থিরতা বোঝনোর জন্য কবি গোবর্ধনের এই যে দার্শনিক কূটকাচালি—এ আর আমাদের ভাল লাগছে না। আমরা অন্য প্রসঙ্গে আসি এবং সে প্রসঙ্গ এতই সজীব, এতই মনুষ্যজনোচিত যে, দেবতা বলে আর কোন ভয়ই থাকবে না।
॥ ৭ ॥
দেবতা যে একান্তভাবে মানুষই এবং মানুষ যে পরমেশ্বরকে মানুষ ভাবতেই ভালবাসে—তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ হলেন কৃষ্ণ। এই কারণেই কৃষ্ণ কোন অবতার নন, জয়দেবের দশ অবতারের মধ্যেও তাঁর স্থান হয়নি, তিনি একেবারে অবতারী অথাৎ সমস্ত অবতারের মূল নিদান। এত অবতারবাদ, এত ভগবান-ভগবান করে শেষে কি না একটা মনুষ্যাকৃতি যুবককে পরম ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হল! আমাদের ধারণা—ব্যাপারটা সবার চাইতে ভাল ধরেছেন চৈতন্যপন্থীরা। মানুষের চেহারাটাকেই তাঁরা পরম ঈশ্বরের আসল স্বরূপ বলে বুঝেছেন—কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা/ নরবপু তাঁহার স্বরূপ। শুধু তাই নয়, মানুষের হাব ভাব, মানুষের হৃদয় রসবৈচিত্র্য, ভালবাসা, শৃঙ্গার, ছেলেমানুষী, বড়মানুষী—সব কিছুই কৃষ্ণের মধে চাপিয়ে আমরা এত খুশি হয়েছি যে, কৃষ্ণের ভগবত্তাই গেছে হারিয়ে। চৈতন্যপন্থীরা তো আবার সেই ভক্ত-বৈষ্ণবদের তেমন আমলই দেন না, যাঁরা কৃষ্ণের মধ্যে ভগবত্তা বা ঈশ্বরের ঐশ্বর্যবোধ বড় করে দেখেন। তাঁদের কাছে—কৃষ্ণের কৈশোরগন্ধী বয়সের লীলখেলাগুলিই আরাধ্যতম ; এমন কি ভগবানের বাসস্থান হিসেবে অন্তরীক্ষলোকের কোন গোপন স্থানও তাঁরা নির্দেশ করতে পারেননি, বৃন্দাবনই তাঁদের কাছে সব—ধ্যেয়ং কৈশোরকং ধ্যেয়ং বনং বৃন্দাবনং বনম্।
এই যে সাধারণ মনুষ্যলোকের অতি সাধারণ একটি স্থানের বিশিষ্ট একটি মানুষকে নিয়ে মানবায়িত কল্পনা—এর সুফল এবং কুফল দুইই আছে। সুফল এই যে, দার্শনিক তত্ত্ব এবং তথ্য দিয়ে আমরা একটি মানুষের পরম দেবত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। কঠিন হলেও জীব গোস্বামীর মত দার্শনিক বলেছেন—আমরা কৃষ্ণের ভগবত্তা প্রতিষ্ঠা করতে বসেছি, ভগবানের কৃষ্ণত্ব প্রতিষ্ঠা বসিনি—কৃষ্ণস্যৈব ভগবত্ত্বলক্ষণো ধর্মঃ সাধ্যতে, ন তু ভগবতঃ কৃষ্ণত্বম্। একটি মানুষের পরম ভগবত্তা অন্তরে সদা জাগ্রত রেখেও, তাকে সম্পূর্ণ মর্যাদা দিয়েও, তাঁকে ঘরের মানুষ করার সাধনা অতি কঠিন, তবু সে সাধনায় আমরা দার্শনিক ভাবেও সফল, ধর্মীয় ভাবেও সফল। কিন্তু এই অমিতমানবায়নের কুফলও আছে। কুফল এই যে, এতে আমাদের পূবর্তন জ্ঞান-সাধনা কিংবা ব্রহ্মচচার ওপরে এক অনর্থক ঘৃণা এসেছে। অতি মূর্থ একাধিক কৃষ্ণভক্তকে আমি নিজের কানে বলতে শুনেছি যে, অনির্বচনীয় ব্রহ্ম যেন একটি আবর্জনা-বিশেষ এবং জ্ঞানমার্গ যেন একটি বিষ্ঠাক্লিন্ন পথ। মজা হল, চৈতন্যদেবের বহু পূর্বে রসিক বিল্বমঙ্গল আগম-নিগমের কঠিন পথ ঘুরে ঘুরে শেষে মন্তব্য করেছেন যে, বৃন্দাবনের গোপিনীদের উলূখলের মধ্যে সমস্ত উপনিষদের অর্থ নিবদ্ধ আছে—উপনিষদর্থমুলূখলে নিবদ্ধম্। কিন্তু পরবর্তীকালের অনেক বৈষ্ণবই কোন কিছু ভাবনামাত্র না করে প্রথমেই মন্তব্য করেন—ব্রহ্মচচা ঘৃণ্য, এবং জ্ঞানমার্গ ততোধিক।
আমরা আবার দার্শনিকদের প্ররোচনায় প্রলুদ্ধ হচ্ছি। কিন্তু এ আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল না। আমরা বলেছিলাম—পরম ঈশ্বরকে আমরা কতটা মানুষ করে ফেলেছি এবং কবিরা তাঁকে কতদূর মানবায়িত করেছেন—সেইটা আমরা দেখাব। বলেছিলাম—আমরা এটাও দেখাব যে, কবিদের পরম্পরায় আমরা পরম ঈশ্বরকে সাধারণ ভাষায় কতটা লঘু করেছি। বস্তুত এ বিষয়ে কৃষ্ণই সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ, কারণ তাঁর ক্ষেত্রে বেশিটাই মানুষের দেবায়ন হয়েছে, দেবতার মনুষ্যায়ণ হয়নি। ফলে কৃষ্ণের নাম নিয়ে, বাসস্থান নিয়ে, তাঁর বিচিত্র ক্রিয়কলাপ নিয়ে আমরা জগৎসংসারে কিই না করেছি। পাঁচ-দশটি ছেলে যদি পাঁচ-দশটি মেয়ে নিয়ে এখানে ওখানে বসে থাকে, কি এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে তাহলেই আমরা বলব—বৃন্দাবন বানিয়ে ফেলেছে, রাসলীলা চলছে—আরও কত কি? অথচ দেখুন, বৃন্দাবন কিংবা রাসলীলা বৈষ্ণব সিদ্ধান্তে কি পরম পবিত্র ব্যাপার। ভাগবত বক্তা শুকদেব পরীক্ষিৎকে বলেছিলেন রাধাকৃষ্ণের লীলামূক্তক রাসলীলা যে মানুষ শুনবে তার হৃদয়ে আগে ভক্তি আসবে, তারপর তার মন থেকে কাম কিংবা মৈথুন চিন্তার মত যত রোগ আছে সব চলে যাবে। অবশ্য তার জন্য আপনার প্রথম কাজ হল শ্রদ্ধালু হওয়া। পুরাণকারেরা তো এইসব বৃন্দাবনের রাসলীলা ভক্ত ছাড়া অন্য কাউকে বলতেই না করেছেন—নাভক্তায় কদাচন।
কিন্তু কি আর করা যাবে। অভক্ত লোকেরা সব সময় ভক্তদের থেকে বেশি চালু হন। ফলে ভক্তদের গুপ্ত কথা তাঁরা জেনে নিয়ে অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করেন। কিন্তু শুধু এও হলে কথা ছিল। বুঝতাম যে অভক্তেরা ভক্তের শত্রু, তাই অমন করে ভক্তদের ধর্ম-তত্ত্বের কুপ্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তা তো নয়, ভক্তদেরও আমি এই সব কথা নিজের কানে বলতে শুনেছি, যুবক-যুবতী একত্রে হলেই এই উপমা তাঁদেরও মুখ থেকে বেরিয়েছে। ব্যাপারটা কি? ব্যাপারটা সেই অতিরিক্ত মানবায়ন। আপনারা ভাববেন না যে, শুধু আমরাই প্রেমাবিষ্ট যুবক-যুবতীদের—বৃন্দাবন বানিয়ে ফেলেছে, রাসলীলা চলছে—বলে গালাগালি দিয়েছি, এ বিষয়ে আমাদের গুরু হলেন কবিরা, অথচ তাঁদের কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা কম ছিল না। আমি উদাহরণ দিয়ে বলছি, একেবারে দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দের কলিকালের উদাহরণ। আপনরা নিশ্চয়ই ‘নিধুবন’ শব্দটি শুনেছেন। রাধাকৃষ্ণ পদাবলী সম্বন্ধে যাঁদের অ-আ জ্ঞান আছে তাঁরা ‘নিধুবন’ শব্দটি অবশ্যই শুনেছেন। কোথাও না শুনে থাকেন, সিনেমার গানে শুনেছেন—আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমারই সনে/ একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে।
বোঝা যাচ্ছে—নিধুবন জায়গাটা লোকালয়ের একটু বাইরে, যেখানে হঠকারী প্রেমাস্পদকে একা পেলে প্রেমিকারা ছাড়ে না। আসল নিধুবনের তাৎপর্য কিন্তু আরও গভীরে। হ্যাঁ, শাস্ত্রমতে নিধুবন বৃন্দাবনের অন্তর্গত একটি কুঞ্জবন মাত্র, যেখানে রাধাকৃষ্ণের শৃঙ্গার লীলা চলত। কিন্তু আসলে এই নিধুবন শব্দটির অর্থই হল রতি-কেলি। বিশ্বাস না করেন রাজকবি গোবর্ধন আচার্যের শ্লোক খুঁজে দেখুন। তিনি অন্তত তিনবার ‘নিধুবন’ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন সাধারণের রতিকেলি বোঝাতে, ঠিক যেমন আমরা ‘বৃন্দাবন’ কি ‘রাসলীলা’ শব্দটির প্রয়োগ করি সাধারণ যুবক-যুবতীর নির্জন-রোমাঞ্চে। আচার্যকবির এক নায়িকা নায়কের সঙ্গে মিলন-আরম্ভেই ঘামতে আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু রতিক্রীড়ার এই ব্যাপারটা বোঝাতে কবি অন্য কোন শব্দ খুঁজে পাননি। তিনি নায়কের মুখ দিয়ে নায়িকাকে বলেছেন—নিধুবনী খেলা আরম্ভ না হতেই ঘামতে আরম্ভ করলে—প্রারব্ধ—নিধুবনৈব স্বেদজলম? গোবর্ধনের লেখাতেই আবার আরেক জায়গায় দেখছি—এক চতুরা নায়িকার সঙ্গে এক বোকা নায়কের বিয়ে হয়েছে। পৃথিবীতে এমন গোবেচরা স্বভাব এবং চেহারার অনেক পুরুষ মানুষ আছে, যাদের দেখলে মনে হয়—সে বুঝি রমণীর প্রত্যঙ্গসংস্থান ভাল করে জানে না, বা বোঝে না। এমনই একটি মানুষের সঙ্গে এক চটকদার মহিলার বিয়ে হওয়ায় নায়িকার বন্ধুটি বলছে—সত্যি বটে ওর স্বামীটা একটা আস্ত বোকা—সত্যং পতিরবিদগ্ধঃ। কিন্তু আমার বন্ধুটি ওই সব নিধুবনের রসে নিজেই দারুণ পোক্ত—সা তু স্বধিয়ৈব নিধুবনে নিপুণা। সংস্কৃত শব্দটা খেয়াল করলেন? ‘কামকলায় দারুণ, নিপুণ’—এই কথাটা বোঝাতে কবি বললেন— ‘নিধুবনে নিপুণা’, ঠিক যেমন আমরা বলি—অমুকে রাসলীলা করছে। প্রসঙ্গে বলে রাখি, এই নায়িকাটি নিজে নিজেই স্বশিক্ষায় কামকলা অধিগত করেছে, ঠিক যেমন দ্রোণাচার্যের মাটির মূর্তি সামনে বসিয়ে একলব্য ধনুর্বেদ শিক্ষা করেছিলেন। এক্ষেত্রে ব্যঞ্জনা বুঝি সেই ধৃষ্ট নায়কের প্রতি, যার সঙ্গে এই চতুরার বিয়ে হয়নি।
যাই হোক, বৃন্দাবন কিংবা রাসলীলা বলতে আজকে আমরা যেমন বুঝি, দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দের সন্ধ্যায় বসন্তের বাতাস দিলে ঠিক তেমনিই বুঝতেন কবিরা এবং তারা নিঃসংকোচে কৃষ্ণের ‘নিধুবন-পাণ্ডিত্য’ স্মরণ করতেন যুবক-যুবতীর প্রেমবেশ বোঝাতে। এ তো গেল বৃন্দাবন কিংরা রাসলীলার তাৎপর্যের কথা, কৃষ্ণের নামের তাৎপর্যই কি কম? একাধিক বহু রমণীর সঙ্গে আমরা যদি একটি যুবককে প্রেম করতে দেখি, কিংবা এটা-ওটা করতে দেখি তাহলে আমরা ওই ছেলেটির উপাধি দিই ‘কলির কেষ্ট’। এর জন্য দায়ী কিন্তু সেই কৃষ্ণচরিত্র, সেই বৃন্দাবন, সেই শত শত গোপিনীরা এবং অবশ্যই মধুর মুরলীর পঞ্চম-চুরি করা যমুনা-পুলিন। কৃষ্ণ ভগবান কিন্তু নিজেও কলি যুগেরই লোক—একথা বেশ প্রমাণ দিয়েই বলা যায়। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগের অবতার-পুরুষ যাঁরা, তাঁরা জনগণের প্রতীতিতে অত্যন্ত সৎ এবং চরিত্রবান। পূর্বতন রামচন্দ্রের কথা তো আপনার জানেনই, তাঁর ভাই লক্ষ্মণের কথা উল্লেখ করে ঘরের বউরা পর্যন্ত দুরভিসন্ধানী দেওরদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করতেন—এ খবর আমরা হালের গাথাসপ্তশতীতে পেয়েছি। সেখানে কলি যুগ পড়া মাত্রই কৃষ্ণ ভগবান শতেক গোপীর সঙ্গে যে কীর্তিকলাপ করে গেছেন, তাতে তাঁর আপন কালের লোকেরাই তাঁকে ‘কলির কেষ্ট’ বলত কিনা আমাদের সন্দেহ। দেখুন, কৃষ্ণ যা করে গেছেন, তাতে উচ্চমার্গের দর্শন, মানে—পুরুষ-প্রকৃতি, আত্মা-পরমাত্মা, ব্যূহ-কায়ব্যূহ—এইসব সাংখ্য-বেদান্তের কূটকচালি ছাড়া—তাঁর সঙ্গে রাধা কিংবা অন্য গোপীদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা কঠিন। এ কথা স্বীকার করতে কোন বাধা নেই যে, পুরুষ মানুষ হিসেবে কৃষ্ণের আকর্ষণ ছিল সাংঘাতিক। দ্বিতীয়/ তৃতীয় খ্রীষ্টাব্দে লেখা সেই গাথাসপ্তশতীতেই আমরা খবর পেয়েছি যে, কৃষ্ণের যখন তরুণ বয়স ঘনিয়ে এল এবং তাঁর বিয়ের কথাবর্তা উঠল, তখন নাকি বৃন্দাবনের ররুণীরা সব জননী যশোদার সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়তার সূত্র চেপে যেতে লাগল। নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা থাকলে যেহেতু বর-কনের বিয়ে হয় না, তাই কনেরা সব নিজেরাই যশোদার সঙ্গে আত্মীয়তা লুকোতে লাগল—সম্বন্ধাঃ নিহ্নূয়ন্তে/ সমং যশোদয়া তরুণগোপীভিঃ। আশঙ্কা এই—আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে বলে পাছে কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে না হয়। স্ত্রীলোকের কাছে এই যাঁর আকর্ষণ, সে মানুষটির পক্ষে বস্ত্রহরণ অত্যন্ত সাবলীল, রাসলীলা অত্যন্ত স্বাভাবিক। রাসলীলার বক্তা শুকদেব কিন্তু ভাগবত পুরাণে বারবার সাধারণ মানুষে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন— বাপু হে! কৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে যা করেছেন করেছেন, তোমরা যেন বাপু ভুলেও এমন কাজ কর না, মনে মনেও না, কারণ তুমি ঈশ্বর নও—নৈতৎ সমাচরেজ্ জাতু মনসাপি হ্যনীশ্বরঃ। আর যদি আমার কথা না শুনে এমনটি কর, তাহলে মরবে, শিব ছাড়া অন্য লোকে বিষ খেলে যেমনটি হওয়ার কথা, তোমারও তেমনই হবে।
হয়তো হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক যুবক পুরুষ এই কৃষ্ণায়ণ করতে গিয়ে মরেছেন। কিন্তু তাই বলে তো আর উদাহরণ লুপ্ত হয়ে যায় না। বিপদ আছে আরও। কৃষ্ণ ভগবদ্গীতার দার্শনিক ভাষণে বড় গলা করে অর্জুনকে বলেছিলেন—বড় মানুষেরা যে আচরণ করেন, সাধারণ লোকেরাও তাই করে—যদ্ যদ্ আচরিত শ্রেষ্ঠস্তত্ তদেবেতরে জনাঃ। বড় মানুষ যদি একটা উদাহরণ রেখে যায়, লোকে সেটা অনুসরণ করবেই—লোকস্তদ্ অনুবত্তর্বতে। মহামতি শুকদেব পরীক্ষিৎকে রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা বোঝাচ্ছেন, তখন কিন্তু এই গীতাবাক্য তাঁর স্মরণে ছিল। পরীক্ষিৎকে তাই তিনি বললেন—দেখ বাপু! ঈশ্বরের কথা হল আসল, তাঁর আচরণটা নয়। হ্যাঁ, আচরণটাও মাঝে মাঝে অনুসরণীয় বটে (যেমন ধর রামচন্দ্রের আচরণ), কিন্তু তাঁর কথাটাই ধরতে হবে ভাল করে এবং বুদ্ধিমান লোক তাঁর কথা অনুসারেই চলবে, আচরণ অনুসারে নয়—তেষাং যৎ স্ববচোযুক্তং বুদ্ধিমাস্তে সমাচারেং। কিন্তু শুকদেবের এত সাবধান-বাণী সত্ত্বেও অনেক লোকেই সে কথা শোনেনি। তাঁরা বলেন, মানে, আমরা বলি আর কি, যে, তুমি ভগবান হয়ে এক কথা বলবে, আর মানুষ হয়ে আরেক খেলা খেলবে তা তো হবে না। এই দ্বৈত আচরণের ফলে মানুষ বিমূঢ় হয়ে পড়েছে এবং তোমার উদাহরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তোমার আচরণও কিছু কিছু করে ফেলেছে। ফলত তার স্বাভাবিক উপাধি জুটেছে ‘কলির কেষ্ট’। বলা যেতে পারে—সে না হয় আজকের দিনের চুল উড়ু-উড়ু বহুবিলাসী নায়কটিকে ‘কলির কেষ্ট’ বলে ডাকা গেল, কিন্তু তাই বলে তো আর সংস্কৃত ভাষায় কেউ বৃন্দাবনের বহুগোপীরমণ কৃষ্ণকে ‘কলেঃ কৃষ্ণঃ’ বলে ডাকেনি। হ্যাঁ, মানলাম তা ডাকেনি। কিন্তু ওই যেমন আজকের ‘বৃন্দাবন বানিয়ে ফেলেছ’ কি ‘রাসলীলা চলছে’—এই কথাগুলো সেকালে ‘নিধুবন’ শব্দে প্রকাশ করা হয়ছে, তেমনি চোর, লম্পট, বিট-বিটলে— এসব শব্দ তো কৃষ্ণের গা-সওয়া হয়ে গেছে। হতে পারে, এসব কথা আদর করে ভালবেসেই বলা হয়েছে এবং সে ভালবাসা এতটাই যে, প্রাণপ্রিয় পুরুষটির কোন দোষ দেখতে পায় না, অথচ স্ত্রীলোক সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁর অতি-আবেশের জন্য তাঁকে গালাগালি না দিয়েও পারে না। স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তিনি রাধাভাবে কৃষ্ণকে ভালবাসতে গিয়ে মহা ফাঁপরে পড়ে গেছেন। তাঁর বক্তব্য হল—কোন এক অতি শঠ যুবক তাঁর আপন মাধুর্যে হঠাৎ করে আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে, আর আমরাও যেন কেমন বাধ্য হলাম তাঁর ভালবাসার ভিখারি সাজতে—আসলে লোকটা কিন্তু কামুক, গোপরমণীদের সঙ্গে প্রচুর বিটলেমি করেছে—দাসীকৃত গোপববিটেন।
দেখুন বিটলে, বিটলেমি এমনকি বিটকেল শব্দটিও ওই সংস্কৃত ‘বিট’ শব্দের সঙ্গে বাংলা প্রত্যয় নিষ্পন্ন বলে মনে করি, যদিও বাংলা শব্দগুলির মধ্যে বিটের আসল চেহারাটা নেই। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বিটের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তাতে তবুও বিটকে মোটামুটি ভদ্রলোক বলা যায়। কিন্তু সেই ভদ্র পরিচয়ের মধ্যেও একটু বলা আছে যে, গণিকালয়ের আচার-ব্যবহারে সে একেবারে পাকা লোক, এবং সবচেয়ে বড় কথা—সে বুদ্ধিমান এবং চতুর ভরতের নাট্যশাস্ত্র, বাৎস্যায়নের কামসূত্র, সাহিত্যদর্পণ, ধ্বন্যালোক—ইত্যাদি গ্রন্থে বিটের সংজ্ঞা এবং উদাহরণ একত্রে সারসংক্ষেপ করলে দেখা যাবে—বিটের সবচেয় বড় পরিচয় হল—সে কামকলাকোবিদ এবং রমণীলম্পট, যদিও সে শিক্ষিতও বটে, রসিকও বটে। এখন শিক্ষিত লোক যদি কামকলায় অভিজ্ঞ হয়, তথা রসিক লোক যদি রমণীলম্পট হন, তাহলে তাঁর মাধুকরী ভালবাসায় যতটা আকর্ষণ থাকা উচিত, কৃষ্ণের তাই ছিল। ফলে ভাগবতপুরাণের সংস্কৃত পয়ারে রাধাকে একবার তীব্রভাবে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে বলতে হয়—তোমরা সব মৌমাছির দল, অন্য রমণীর স্তনকুম্কুম্-রাঙানো ঠোঁটে আমার পা-দুটিও ছুঁয়ো না, ছিঃ ; আবার পরমুহূর্তেই নম্র হয়ে বলতে হয়—তিনি কি এখনও তার অগুরুগন্ধী হাতখানি গালে দিয়ে, কোনদিন কোন কর্মহীন অবকাশে আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করেন? জিজ্ঞাসা করেন এই দাসীদের কথা?
আমি তবু এই অবলা সরলা গোপরমণীদের কথা বুঝি, যাঁরা ওই চতুর রাখালের বাঁশি শুনে মজেছেন, কিন্তু আমাদের চৈতন্য মহাপ্রভু! তিনি কেন রাধার অবস্থা জেনেশুনেও অমন বিষময় রাধাভাব ধারণ করলেন? তাঁর অবস্থাও রাধার মতই হয়েছে। অন্তরে তাঁকে ভালবাসেন, আর মুখে বলেন লম্পট। আবার মহাপ্রভুর কথা কেমন—সে লম্পট আমার যাই করুক, তবু তাকেই আমি ভালবাসি, শুধু তাকেই—যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো মৎপ্রাণনাথস্তু স এব নাপরঃ।
নীতিশাস্ত্র পড়ে পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে, জন্মান্ধ লোকেরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি সুখী, তাদের চেয়ে—যাদের চোখ ছিল এবং চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে। ঠিক যেমন যাদের জীবনে প্রেম এসেছিল এবং প্রেম ভেঙে গেছে, তাদের চেয়ে সেই সব লোকেরা অনেক বেশি সুখী যাদের জীবনে প্রেম আসেইনি কোনদিন। কিন্তু প্রেমেও পড়ব আবার প্রেমিককে লম্পট, বিটলে বলে গালাগালিও দেব- এ আবার কেমন ধারা, বিশেষত প্রেমিক যখন সত্যিই লম্পট। হয়তো প্রেমের গহন রাজ্যে এও এক ধরনের বিলাস, যা আমরা ভাল বুঝি না। অন্যদিকে কৃষ্ণের অবস্থাটা আন্দজা করুন। এতগুলি মেয়ে তাঁকে ভালবাসে যে, তাঁর প্রথম যৌবনটা কেবলই এই দ্বন্দ্বে কেটেছে—শ্রীরাধিকে চন্দ্ৰবলী! কারে রাখি কারেই ফেলি। শুধু এই দুজনই মাত্র নয়, আর যাঁরা আছেন তাঁরা শুধু কৃষ্ণপ্রেমের ওই প্রধান দুই দাবিদারকে তুষ্ট করতে গিয়ে আপন প্রেম বিসর্জন দিয়েছেন।
যাক এসব কথা, আমি তো কৃষ্ণপ্রেমের মাধুর্য ব্যাখ্যা করতে বসিনি। আমার কথা হল-কৃষ্ণের ওই নিতি নিতি নৌতন প্রেমের সুযোগ নিয়ে কবিরা কিংবা সাধারণ লোকেরা কৃষ্ণকে কিংবা রাধাকে কতটা টেনে নামিয়েছেন, কতটা মর্ত্যলোকের ছাঁচ দিয়েছেন তাঁদের দেবত্ব উল্লঙ্ঘন করে। এমনকি কবিরা যে এই দেবতার কাছে আশীর্বাদ ভিক্ষা করেছেন কিংবা প্রনাম করেছেন কৃষ্ণকে, সেখানেও কৃষ্ণের রূপ হয়ে গেছে এমন, যার সঙ্গে দেবত্বের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই ; উল্টোদিকে বরঞ্চ লাম্পট্য আছে এতখানি যে এখনকার রাস্তার সবচেয়ে বেহায়া যুবকটিকেও আমরা কৃষ্ণের থেকে ভদ্রলোক মনে করতে পারি। একটি শ্লোকে দেখতে পাই-যশোদা চোখ পাকিয়ে কৃষ্ণকে জিগ্যেস করছেন,—তুমি কতটা মাখন চুরি করেছ কৃষ্ণ? উত্তরে কৃষ্ণ সুমুখে দাঁড়ানো রাধার পয়োধরে আপন দুটি হস্ত সংস্থাপন করে নবনীতহরণের একটি পরিমাপ দেখিয়ে দিলেন এবং মুখে বললেন—এই এতটুকু নিয়েছি—ইয়দিতি গুরুজনসংসদি করধৃত-রাধাপয়োধরঃ পাতু বঃ। কবি লিখেছেন—এই যে নবনীতহরণের পরিমাণ দেখানোর জন্য রাধার উত্তমাঙ্গে এইমাত্র হস্ত সংস্থাপন করলেন কৃষ্ণ—এই হস্তই তোমাদের রক্ষা করুক।
আমাদের রক্ষা করার জন্য দেবতার আর কোন অভয়মুদ্রা খুঁজে পেলেন না কবি! গুরুজনের সামনে আপন পুত্রের শৃঙ্গারমুখর ব্যবহার অতিরসিক ভক্তকে যত আনন্দই দিক, আমাদের মত সাধারণ কৃষ্ণভক্তকে তা বড়ই লজ্জা দেয়। ওপরের শ্লোকটি থেকে কৃষ্ণকে বাঁচানোর একটি সূত্র বেরিয়ে আসতে পারে যে, কৃষ্ণ রাধার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছিলেন এবং ‘খোকা তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা খোকা তোমার ভারি ছেলেমানুষ’—এই নিয়মে কৃষ্ণ সাময়িকভাবে একটা গোলমেলে ব্যবহার করেছেন, আর এরকম হবে না। পৌরাণিকেরাও গর্গসংহিতা, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ইত্যাদির প্রমাণ দিয়ে এই কবিকে খানিকটা বাঁচাতে পারেন, কারণ, এটা সত্যি কথাই যে, গর্গসংহিতা এবং ব্রহ্মবৈবর্তের বর্ণনায় দেখা যায় যে, কোন এক ঝড়ের রাতে পিতা নন্দ যখন তাঁর শিশু পুত্রটি নিয়ে এক বটগাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছেন, তখন কেমন কেমন করে রাধা এসে উপস্থিত হন সেখানে। নন্দগোপ রাধাকে দেখেই তাঁর কোলে কৃষ্ণকে দিয়ে বললেন— তুমি একে বাড়ি পৌঁছে দাও। রাধা কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে ঘরের পানে এগিয়ে চললেন, বটে তবে বাংলার জয়দেব কবি এই ঘটনার মধ্যে অভিসন্ধি দেখেছেন, তাতে আর ব্যাপারটা অত সহজ রইল না। জয়দেব যা দেখেছেন, তাতে সেই মেঘ-মেদুর রাত্রে দুই পুরুষ-রমণী নাকি রাস্তার প্রত্যেকটি ছায়া-ঘন কুঞ্জের নির্জনতায় এমন কেলি করেছিলেন, যে কেলির অকুণ্ঠ জয়গান না করে পারা যায় না—প্রত্যধ্বকুঞ্জমং/ রাধামাধবয়ো জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃকেলয়ঃ। শিশু কৃষ্ণের এ কি খেলা! ব্রহ্মবৈবর্ত, গর্গসংহিতা কি নিদেনপক্ষে এই শ্যাম বঙ্গ দেশের জয়দেবের ভাব ভনিতা আমরা ভুলিনি। এই সেদিনও সুশীল দে মশাই তাঁর নবীন বয়সের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে বলেছেন— “যাত্রার সময় অল্প বয়স্ক কৃষ্ণকে যখন অধিক বয়স্ক রাধা কোলে তুলিয়া আদর করিত, যখন গান হইত—
চম্পকবরণী রাধা শ্যাম কচি খোকা।
রাধাশ্যামে শোভে যেন আরশুলা-কাঁচপোকা॥
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে এই যে যাত্রা দলের গান আমরা শুনলাম, এতে যে রাধাকৃষ্ণের প্রতি গায়েনদের কোন অশ্রদ্ধা আছে—তা আমরা মনে করি না ; ঠিক যেমন আমাদের পূর্বতন সংস্কৃত কবি এইমাত্র যে রাধার নবনীত-পয়োধর কৃষ্ণের হাতে দিয়ে, সেই হাতেই আমাদের রক্ষার ভার দিলেন—তাতেও আমরা মনে করি না যে, বর্তমান কবির কোন অশ্রদ্ধা ছিল রাধাকৃষ্ণের প্রতি। এবং এই রকম কবি শুধু একজন নয়, শত শত আছেন, যামরা রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গমাত্রেই কিঞ্চিৎ আদিরসাপ্লত হয়ে পড়েন। এমনকি গুরুজনের সামনেও এই আপ্লুতি তাঁরা চাপতে পারেন না এবং কৃষ্ণের শৈশবকালেও তাঁর মধ্যে যৌবনোচিত আবেগ সংক্রমিত করে এমন এক রসের সৃষ্টি করেন, যাকে রস না বলে রসাভাস বলাই ভাল। অথচ দেখুন—এ রসেরও পরম্পরা আছে। আমরা যাত্রাদলে যেমন গান শুনেছি, তার পূর্বসূত্র আছে সংস্কৃত কবির লেখায়, আবার তারও পূর্বসূত্র আছে পুরাণে—ব্রহ্মবৈবর্তে, গর্গসংহিতায় অর্থাৎ আমাদের শাস্ত্রে।
জানি, কৃষ্ণের থেকে রাধার বয়স বেশি বললে গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা আমায় মারতে আসবেন, এবং উপরিউক্ত সংস্কৃত শ্লোকে শৃঙ্গাররসের গৌণতা সম্পাদন করে বাৎসল্য রসের মহিমা খুঁজে বার করবেন। এ অভ্যেস তাঁদের আছেই। কাজেই এ ক্ষেত্রে দোষ যদি কিছু থেকে থাকে তা হলে তা যশোমতীর বাৎসল্যের দোষ, যে দোষে বা গুণে কিশোর বয়সের কৃষ্ণকেও যশোদা গোপালটি করে রেখেছেন। অথাৎ বৈষ্ণবরা বললেন—ওই শ্লোকটিতে কৃষ্ণের বয়স মোটেই রাধার চেয়ে কম নয়, নেহাত জননীর সামনে কৃষ্ণ শৈশব-চাপল্য প্রকাশ করছেন মাত্র। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা রূপ গোস্বামীর লেখা উল্লেখ করতে পারেন। অন্যেরা যশোদাকে বললেন—কৃষ্ণের আয়ু বাড়বে বলে রাধা তোমার বাড়িতে প্রতিদিন রান্না করে দিতে আসে, ওদিকে এসব দেখে রাধার শাশুড়ি জটিলা বড় সন্দেহ করে। যশোদা বললেন—দুধের বাছা কৃষ্ণের ওপর এই সব সন্দেহ কিন্তু বড়ই বাড়াবাড়ি। এ কথায় কুন্দলতা ফুট কাটলেন—হ্যাঁ, দুধের বাছাই বটে, গোবর্ধন পর্বত হাতে তুলছে যে ছেলে, সে তো দুধের বাছাই বটে! কুন্দলতা সম্পর্কে কৃষ্ণের বউদিদি, রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের মিলন ঘটাতে তিনি কৃষ্ণের বড় সহায়। এরই মধ্যে কৃষ্ণ বাড়ি ফিরলেন। বড়মা রোহিণী বললেন— সেই কখন থেকে তোমার মা তোমার ফেরার পথ চেয়ে বসে আছেন, সেই বিকেল হওয়ার দুই প্রহর বাকি থাকতে। এখন তুমি মায়ের কোল জুড়ে বস দেখি বাছা। কৃষ্ণ পুরো বসলেন না, কেননা তিনি নিজে জানেন তাঁর শরীর ভারী হয়েছে। মায়ের কোলে বুক থেকে মাথা পর্যন্ত শুইয়ে দিয়ে কৃষ্ণ বললেন— মা! আমাকে একটা পাথর বসানো গয়না গড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু। রূপ গোস্বামী মন্তব্য করেছেন—কৃষ্ণ এইভাবে বালক-সুলভ চপলতা করতে লাগলেন—ইতি বাল্যবিলাসং প্রপঞ্চয়তি। কুন্দলতা বউদির বোধ হয় মনে মনে কিঞ্চিৎ রাগ হচ্ছিল। কারণ তিনি সনর্মস্মিতহাস্যে বললেন—কৃষ্ণ! কুঞ্জে কুঞ্জে নানা খেলা করে তুমি বোধহয় একটু ক্লান্ত। তুমি বরং মায়ের কোলে শুয়ে মায়ের দুধ খাও। যশোদা একেবারে ক্ষেপে উঠলেন। বললেন—বাছা! অত হাসির কিছু নেই। দেখ এখনও তোমার কৌমার বয়স পেরোয়নি, তবে দুধ খেতে বাধা কি? কুন্দলতা বললেন—তা তো বটেই, তা তো বটেই, অজকেই তোমার ছেলে মেয়েদের সঙ্গে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রাসের নাচ নাচ্ছিল কিনা। যশোদা বললেন রাস আবার কি? এই সময়ে নাকি কৃষ্ণ লজ্জায় মরে গিয়ে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন কুন্দলতার দিকে—সাপত্রপং ভ্রূভঙ্গেন কুন্দলতামবলোকতে।
আমরা এই বৈষ্ণব নাটকের প্রসঙ্গ আর বেশি দূর নিয়ে যেতে চাই না। তবে এটুকু বুঝেছি যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা যেখানে বাৎসল্যের মহিমায় শৃঙ্গারকে আবরণ করবেন, অন্য সাধারণ কবিরা সেখানে বাৎসল্যের মোড়কে রাধাকৃষ্ণের শৃঙ্গাররোচ্ছল মুহূর্তটিকেই রসসিক্ত করবেন। এই যেমন আরও একটি প্রাচীন শ্লোকে দেখা যাচ্ছে—কৃষ্ণ বলছেন—মা! আমি যমুনার তীরভূমিতে কিছুতেই আর বাছুর চরাতে যাব না। যশোমতী চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করেন—কেন বাছা! কেন কেন? কি হয়েছে? কৃষ্ণ বললেন—গোপীরা সব আমাকে তাদের পীন স্তনযুগলে পিষ্ট করে ছেড়ে দেয়—কস্মাদ্ বৎস! পিনষ্টি পীবরকুচদ্বন্দ্বেন গোপীজনঃ। কৃষ্ণ যখন এসব কথা নিবেদন করছেন, তখন অনেক গোপীকুলবধূ যশোদার কাছে কাছেই ছিলেন। তাঁরা যশোদারও পরিচিত জন—সেই সুবাদে কৃষ্ণ গোষ্ঠ থেকে বাড়ি ফেরার আগে-পরেই যশোদার ঘরে ঢুকেছেন তাঁরা। উদ্দেশ্য—কৃষ্ণকে আরও খানিকক্ষণ দেখা যাবে। কিন্তু কৃষ্ণ যে এইভাবে তাঁদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেবেন তা কে জানত! কাজেই কৃষ্ণ যখন গোপীকুলের তথাকথিত নিষ্ঠুরতার কথা জানাচ্ছিলেন যশোদাকে, তখন গোপীরা প্রথমে ঠারেঠোরে আড়চোখে বহুতর ইঙ্গিত করলেন কৃষ্ণকে থামাবার জন্য। কিন্তু ধৃষ্ট নায়ককে যদি দুষ্টুমি একবার পেয়ে বসে সে কি আর থামতে চায়! অতএব ‘ভ্রূসংজ্ঞাবিনিবারিতোপি’ কৃষ্ণ বলতেই থাকলেন। বিপদ বুঝে গোপীরা তখন দু হাত দিয়ে কৃষ্ণের মুখ চেপে ধরলেন, আর আমাদের কবি বললেন— গোপরমণীর হাত-চাপা-দেওয়া—গোপীপাণিসরোজমুদ্রিতমুখো-ওই কৃষ্ণের মুখই তোমাদের রক্ষা করুন।
কবির আশীবার্দটি ভাল। এই অীশর্বাদের মধ্যে একটা মিষ্টি ছবিও আছে, যা আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা—এও কি সেই শিশু কৃষ্ণ! নাকি এ সব-বোঝা পক্ক কৃষ্ণটি, যিনি শুধুই গোস্বামীমতে ‘বাল্যবিলাস’ বিস্তার করছেন। যদি বলেন ইনি শিশু কৃষ্ণ, তাহলে আমরা বলব—শিশু বয়স থেকেই তাঁর ওপরে কবিদের যৌবনোচিত ব্যবহার আরোপের ফলে অনেকের মত আমরা যেমন বিপদে পড়েছি, তেমনি যারা দেবতাদের লীলা-খেলা বোঝে না, তারা কিছু কদৰ্থও করেছেন। আপনারা জে. এল. ম্যাসন সাহেবকে চেনেন কিনা জানি না, তবে আমরা তাঁকে চিনি। তিন ভারতবর্ষীয় রসতত্ত্বের ওপর বিলক্ষণ ভাল কাজ করেছেন, তবে আমাদের ধারণা তাঁর ওপরে মাঝে মাঝে ফ্রয়েডের ভূত চেপে বসে। বড় মানুষ। কিছু বলতেও পারি না, আবার গিলতেও পারি না। বিশেষত, কৃষ্ণলীলার তিনি যে বাখানি শুনিয়েছেন, তাতে আমারই বিব্রত অবস্থা, সেখানে খোদ কৃষ্ণভক্তেরা তো অভিনব সাত্ত্বিক বিকারে মুচ্ছো যাবেন। ম্যাসন সাহেব আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটির মত এক নামী পত্রিকায় বাংলার লক্ষণসেনের আমলে সংকলিত একটি শ্লোককে উপজীব্য করে পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে ফ্রয়েডীয় পদ্ধতির একটি জীবন্ত উদাহরণ বানিয়ে ফেলেছেন।
শ্লোকটি আগে বলি। প্রথমেই স্মরণ করানো ভাল যে, কবি আবারও বলেছেন— কৃষ্ণ তোমাদের রক্ষা করুন। কি রকম কৃষ্ণ? এই জিজ্ঞাসায় কিন্তু সেই শিশু কৃষ্ণের কথা আসবে। ব্যাপারটা হল—গোপীযুবতীরা সব শিশু কৃষ্ণের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চুমো খাচ্ছিলেন, কোলে নিয়ে নিজেদের কাঁধে কৃষ্ণের কাঁধ মেলাচ্ছিলেন—অধরম্ অধরে কণ্ঠং কষ্ঠে। ঠিক একইভাবে কৃষ্ণের চোখে চোখে, কপালে কপাল। আবার যদি-বা কখনও কুলবধূদের অতি-আদরে কেঁদে উঠেছেন কৃষ্ণ তখন তাঁরা শিশু বলে কৃষ্ণকে বুকেও চেপে ধরেছেন। ফল হয়েছে খুব খারাপ, কবির পক্ষেও, আমাদের পক্ষেও। সুবিধে হয়েছে দু’জনের—স্বয়ং কৃষ্ণের এবং ফ্রয়েড-মানা ম্যাসনের। কবি লিখেছেন—গোপযুবতীদের এই অতি-আদরের ফলে কৃষ্ণের সুখ-শিথিল শরীরের কোন গহনে যেন পুলক দেখা গেল, সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য একটা রহস্যময় হাসিও দেখা দিল তাঁর মুখে—নিভৃতপুলকঃ স্মেরঃ পায়াৎ স্মরালসবিগ্রহঃ।
কবি বলেছেন—ওই হাসিই তোমাদের রক্ষা করুক। কিন্তু মজা হল, কৃষ্ণের এই মুহূর্তের মোহন হাসিটি আমাদের রক্ষা করতে পারেনি। বিশেষত ম্যাসন সাহেবের ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাইনি বলেই কবি স্বয়ং এবং আমরাও খুব একটা সুরক্ষিত বোধ করছি না। ম্যাসন লিখেছেন—বৃন্দাবন হল এক কল্পলোক, মানুষের মনোরাজ্য। বৃন্দাবনের চৌহদ্দিতে সব কিছুই ভারি মনোরম, ভারি সুন্দর আর সুন্দরশেখর শিশু কৃষ্ণ সেখানে রাজা। এটা কিছুই আশ্চর্য নয় যে, এমন একটি শিশুকে স্তন্যদান করার জন্য মাতৃকল্প সমস্ত রমণীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। ম্যাসন মনে করেন অধুনা উদ্ধৃত দিবাকরদত্তের কবিতার মধ্যে যেখানে কৃষ্ণের মাতৃকল্পারা কেউ কৃষ্ণকে চুম্বন করেছেন, কোলে নিচ্ছেন, কিংবা বুকে চেপে ধরেছেন—এই পরিবেশ কদিন পরেই কৃষ্ণ ফিরে পাবেন তাঁর যৌবনের ক্রীড়াভূমিতে সহস্র গোপীজনের সান্নিধ্যে। কারণ মাতৃকল্পাদের সান্নিধ্যে তাঁর যে আঙ্গিক বিকার হচ্ছে—‘নিভৃতপুলকঃ’ ‘স্মরালসবিগ্রহঃ’—এগুলি কৃষ্ণের ‘প্রি-অ্যাডোলেসেন্ট’ কোন পর্যায়। ফ্রয়েড এবং কোহুতের শিশু-মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যার পথ ধরে ম্যাসন শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, কৃষ্ণ হলেন একজন ‘নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি’, যিনি একটি মাত্র রমণ-পাত্রে সন্তুষ্ট হন না, তাঁর যৌন-তৃষ্ণা অশেষ। হরিবংশ পুরাণের রাসনৃত্তে শতশত গোপরমণীরা যে কৃষ্ণকে যৌন আনন্দ দিয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন, তা নাকি এই ‘নার্সিসিজম’-এর কারণে।
এই রকম একটা বিশ্লেষণ যদি বিশ্বাস করতে হয় তাহলে এটাও ধরে নিতে হবে কৃষ্ণের পরবর্তী জীবনে কিছু বিকার ঘটেছিল। ম্যাসন যেটা বুঝলেন না সেটা হল— কবিদের বিদগ্ধ ভণিতাকে কখনই ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। কৃষ্ণের বিভিন্ন লীলামুহূর্তগুলি অবলম্বন করে কবিরা যা লিখছেন, তা নিতান্তই ব্যক্তি-কবির হৃদয়ের প্রতিফলন। যেহেতু রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের শৃঙ্গারোজ্জ্বল লীলাগুলি আমাদের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত, তাই কোন কোন কবি নিজের বাগবৈদগ্ধ্য প্রকাশ করার জন্য রাধা-কৃষ্ণকে তাঁর আপন হৃদয়ের প্রতিরূপে বর্ণনা করেছেন। এতে যেমন কখনও আমরা অতি মধুর ‘রোম্যান্টিক’ শ্লোকগুলি পেয়েছি, আবার কখনও ব্যক্তিকবির মনের বিকারও চেপে গেছে রাধা-কৃষ্ণের ওপর, অবশ্য যদি ওগুলোকে বিকার বলা যায়। কৃষ্ণের প্রতি আমার আত্যন্তিক ভক্তি সত্ত্বেও, তথাচ ওই কবিতাগুলির মধ্যে শৃঙ্গার রসের গভীর বৈচিত্র্য থাকলেও, আমি এগুলিকে বিকার বলেই মনে করি। নইলে দেখুন আরও একটি অর্বাচীন শ্লোকে দেখবেন ‘লীলাপুরুষোত্তম’ অথবা ‘অবতারলীলাবীজ’ কৃষ্ণকে একেবারে এখনকার রাস্তার ‘লোফার’ ছেলেটির মত লাগবে। সৌভাগ্যের বিষয়, বিকারের বলি এখানে রাধা নন। বলি-অন্য কোন ভাগ্যপীড়িতা গোপী, অন্তত আমাদের মতে তিনিই ভাগ্যহতই, কেননা ভর দুপুরবেলায় কাজে বেরিয়ে এরকম বিড়ম্বনা সবার কপালে জোটে না। তবে কবির মতে তিনি ধন্য হয়েছেন কেননা এটা কৃষ্ণের মজা, মশকরা এবং এই মজা করে তিনি ক্রমান্বয়ে গোপীটিকে, আমাদের কবিকে এবং আমাদেরও ধন্য করেছেন। কৃষ্ণ একটি গোপীকে চোর অপবাদ দিয়ে রাস্তা আটকে দিয়েছেন। বলছেন—কে বটে তুই চোর, নাম-ধাম-পরিচয় দে, কোথ্থেকে আসা হচ্ছে? গোপিনী বললে— তুমি কে হে বাবা, তোমার কাছে এসব বলব কেন? কৃষ্ণ বললেন—আমি নগরপাল, প্রহরী। গোপিনী বললে বটে, তা হয়েছেটা কি? কৃষ্ণ বললেন— আমাদের রাজার দুটি সোনার ঘট চুরি গেছে, তাই চোর চাই? গোপীনী বললে—চুরি করেছে কে? আমি? তা হলে তো আমার কাছেই সে দুটি থাকত? কৃষ্ণ বললেন— তোমার আঁচলের তলায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তুমি লুকিয়ে রেখেছ। গোপিনী সন্ত্রস্ত লজ্জায়—কোথায় কোথায়— বলে গা-ঝাড়া দিয়ে বুঝি দেখাতে চাইলে তার কাছে কিছুই নেই! কিন্তু ততক্ষণে রসিকশেখর কৃষ্ণ— তাহলে ‘আমিই দেখি বলে’ যা করলেন— কবি, তাতে একটুও অপ্রস্তুত নন। কিন্তু সেই ‘ধৃতবল্লবীকুচযুগ’ পীতাম্বরকে দেখে আমরা স্বস্তি বোধ করি না, বিশেষত যে বাহানায় তিনি যে কাজ করলেন, তাতে তো নয়ই।
অথচ রাধাকৃষ্ণের তথা গোপী-কৃষ্ণের শৃঙ্গারলগ্ন মূর্তি আমাদের মোটেই অপরিচিত নয়। চিত্রকল্প কিংবা ভাস্কর্যে তো নয়ই, সংস্কৃত কবিতাতেও নয়। বাংলার দানলীলা, নৌকাবিলাস কি রাসলীলা সংক্রান্ত পদাবলীতেও শৃঙ্গারের কোন অভাব নেই। কিন্তু শৃঙ্গার যদি এতটা আভিধানিক হয় তাহলে বক্তা এবং শ্রোতা—দুয়ের পক্ষেই সেটা অস্বস্তিকর। কিন্তু এই অস্বস্তিকর পরিবেশের জন্য কৃষ্ণ নিজেই দায়ী আর দায়ী তাঁর নিজের জগতের কবিরা, যাঁরা তাঁকে মনুষ্যজগতের চরম আস্বাদন করানোর জন্য ‘লোফার’ সাজাতেও দ্বিধা করেননি। মূল কৃষ্ণচরিত্রে পারদারিক দার্শনিক এবং লৌকিকভাবে স্বীকৃত, কিন্তু এই স্বীকারের ফলেই এমন কবিরাও জুটে গেলেন, যাঁদের মানসিতার বিকৃতি এতটাই যে, অন্তরের দেবতাকে রাস্তায় নামাতেও তাঁদের দ্বিধা হয়নি। আমার বক্তব্য এই টুকুই, এবং কৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ কবিদের আরও বহুতর উক্তি আমি সংকলিত করব না। যা করেছি, তাতে আমারই মানসিকতা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু মনে রাখা দরকার—আমি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রবন্ধ লিখতে বসেছি, তাতে প্রণম্য দেবতা মানুষের দ্বারা লীলায়িত হতে হতে কতটা ব্যঞ্জনাহীনভাবে লোকায়ত হতে পারেন, তার পরম্পরাটি আমি তুলে ধরতে চেয়েছি। যাতে বুঝতে অসুবিধে না হয় যে, কেন আরাধ্য দেবতার নাম ধরে এক জন বাতুলকে আমরা ‘কলির কেষ্ট’ বলতে দ্বিধা করি না। অস্বীকার করতে বাধা নেই যে, কৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গে কবিরা যতটা ‘ক্রুড’ হতে পেরেছেন অন্য কোন দেবতা সম্বন্ধে ততটা নয়। তার কারণ, এই নয় যে, শিব কিংবা অন্য কোন দেবতা রতিসৰ্বস্বতার ব্যাপারে অকুলীন ছিলেন, তার কারণ কৃষ্ণ একান্তভাবে লোকায়ত এবং পারদারিকতার দরুন তাঁর লোকায়ন অনেক ক্ষেত্রে বিকারে পর্যবসিত হয়েছে। একটি অবাচীন শ্লোকের কথা মনে পড়ছে, যেখানে কবির উদ্দেশ্য ছিল সাধু, কিন্তু তাঁর শব্দচয়ন তাঁকে আমাদের কাছে বিকারযুক্ত করে তুলেছে।
কে না জানে—মধুযামিনীতে প্রেমিক-প্রেমিকা—দুজনের দেখা হলে দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। রাধা-কৃষ্ণের মিলন-মুহূর্তগুলি তো এই বিস্মরণের মাধুর্যে এতটাই নান্দনিক যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কতগুলি কবিতার জন্ম হয়েছে এই সূত্র ধরেই। অথচ দেখুন এই হতভাগা কবি লিখেছেন—কৃষ্ণকে সমস্ত মন-প্রাণ নিবেদন করে রাধার অবস্থা হয়েছিল এমনই যে, তিনি এমন একটি পাত্রে মন্থন-দণ্ড ঘেঁটে যাচ্ছেন যাতে দই বা দুধ কিছুই নেই—মহানমালয়তী দধিরিক্তপাত্রে। আর কৃষ্ণর অবস্থাটা কি? রাধার উঙ্গে স্তন-চুচুকের দিকে লোল দৃষ্টি পড়ায় তিনি এতই উন্মনা যে, দুধ দুইছেন মনে করে তিনি একটি ষাঁড়ের অণ্ড দোহন করেছিলেন—দেবো’পি দোহনধিয়া বৃষভং দুদোহ।
এতসব দেখেশুনে আমার স্থির সিদ্ধান্ত যে কবিরা কৃষ্ণের ব্যাপারে যতটা নিষ্করুণভাবে লেখনী ধর্ষিত করতে পারেন, আর কোন দেবতার ক্ষেত্রে তা নয়। এর কারণ অবশ্যই সেই বিশিষ্ট দেবচরিত্র, যা কবিদের ইন্ধন যোগায়। কই শিবের ব্যাপারে তো আমরা কোন নাসিকাকুঞ্চন করি না। আমরা এমন শ্লোক দেখেছি— যেখানে ব্রহ্মার কাছে কার্তিকের জন্ম-সংবাদ পেয়ে পুত্রজন্মের আনন্দে শিব নাকি ব্রহ্মাকে সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরনের বাঘছালটি খুলে দিয়েছিলেন। সঙ্গে অবশ্য তাঁর কণ্ঠাভরণ সাপটিওে দিতে ভোলেননি। কিন্তু এতে কি হয়েছে? শিবের এই কাণ্ড-কারখানার কথা শুনে তাঁর আপন গৃহিণী পর্যন্ত ঈষৎ হেসেছেন— ভাবটা এই— ‘আমার পাগলা ভোলার কাণ্ড দেখ।’ আর আমরা মানুষেরাও শিবের এই নির্মল ব্যবহারে এমন মোহিত হই যে, সঙ্গে সঙ্গে দেবতার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার নমস্কার জানাই—দিগম্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়/ নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়।।
॥ ৮ ॥
আসলে এইটাই কথা। যে-দেবতা যে রকম, তাঁর স্বভাব-চরিত্রের পথ ধরে আমরাও ততটাই গিয়েছি। যৌন ক্রিয়াকলাপে শিব যে কিছু কম, তা আমরা মনে করি না। কালিদাসের কুমারসম্ভবের সপ্তম অধ্যায়ের পর যে বর্ণনা আছে, তা কিছু কম নয়। তবে শিবের সুবিধে তিনি পারদারিক নন, কাজেই সংসার সীমার মধ্যে আপন স্ত্রীর সঙ্গে তিনি যাই করুন না কেন, তাতে বড় জোর কবিরা তাঁকে পার্বতীর পেছন ধরা স্ত্রৈণ পুরুষটি বলতে পারেন, তাতে পতিব্রতা পার্বতীর মাহাত্ম্য আরও বাড়ে। কবিরা তো পার্বতীকে ‘হরনিতম্বিনী’ উপাধি দিয়েছেন, মানে বোধ হয় শিব সব সময় পার্বতীর পেছনে এমনভাবে সেঁটে আছেন যে, তাঁকেই পার্বতীর নিতম্ব বলা যায়। কিন্তু এতে কুলবধূ হিসেবে পার্বতীর মাহাত্ম্য আরও বাড়ে। হ্যাঁ, এদিক ওদিক থেকে শিবের ওপর হঠাৎ হামলা করা গঙ্গাকে আমরা কম্প্রবক্ষে নম্র নেত্রপাতে শিবের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে দেখেছি কিন্তু চণ্ডিকার রক্তচক্ষু সব সময় আড়াল থেকে তাঁর দিকে নজর রাখছে— গিরিসুতাসাকেকরালোকিনী।
পুরুষ দেবতার অনুক্রমে স্ত্রী-দেবতার কথা এসে গেল, কিন্তু জগজ্জননী চণ্ডিকার কথা আমরা আগেই বলেছি। মনুষ্যায়নের পরিসরে একটি অভাবময় গৃহস্থের গৃহিণীর গৌরবে তিনি বরঞ্চ মহিমান্বিত। বলা বাহুল্য, এত সৌভাগ্য অন্য কোন স্ত্রী দেবতার হয়নি। এঁদের মধ্যে আবার সবচেয়ে ভাগ্যহত বোধ হয় স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী, যাঁকে আমরা ধনদায়িনী বলে প্রতি লক্ষ্মীবারে বন্দনা করে থাকি। আর সত্যি কথা বলতে কি—তাঁর মানসিক অবস্থা আর কতদিন ভাল থাকতে পারে! সেই কবে দেবাসুরের হুড়োহুড়ির মধ্যে সম্পূর্ণ মথিত হয়ে সমুদ্র থেকে উঠতে হয়েছিল, তার পর থেকেই তাঁর ধকল চলছে, জনগণকে টাকা-পয়সা দিতে দিতে তাঁর অফুরান ঘটেও বুঝি এখন টান ধরেছে। তার ওপরে মানসিক ধকলই কি কম? প্রথমে তো সমুদ্র থেকে উঠেই টান-টান হয়ে স্বয়ংবরা হয়ে দাঁড়ানো। তবু তার মধ্যে কিছু রোমাঞ্চ ছিল। সমুদ্র থেকে ওঠবার সময় আধেক দেখা দিতেই সমস্ত দেবতাদের চোখ এক সঙ্গে পড়েছিল তাঁর মুখে, বুকে, সর্ব অঙ্গে। সম্মিলিত দেবতাদের আনন্দ, অসুরদের বিস্ময়, রম্ভা-মেনকাদের অসূয়ার মধ্যে আমরা দেখেছি স্বয়ং নারায়ণের হাত থেকে মহুনরজ্জুটিই কখন অজান্তে খসে পড়ে গেছে— অজ্ঞাত- স্বকরদ্বয়ী-বিগলিত। মহারাজ লক্ষ্মণসেনের ঠাকুরদাদা কেশবসেনের মতে অবশ্য ব্যাপারটা এইখানেই শেষ হয়নি—ভগবান হরির চোখ নাকি পড়েছিল লক্ষ্মীর আপাণ্ডুর স্তনসীমার প্রান্তভাগে, তাঁর চোখ নাচ্ছিল। এ জিনিস লক্ষ্মীরও চোখ এড়ায়নি। বরমাল্য হাতে শ্রীহরি যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মী কি করেন? সমবেত দেবমণ্ডলীর সবার চোখ যে তাঁর দিকেই। একাদশ শতাব্দীর কবি ক্ষেমেশ্বর কিন্তু জানেন—লক্ষ্মী বিদগ্ধা মহিলা বটে। তিনি তাঁর বাগবৈদগ্ধ্যেই বুঝিয়ে দিলেন—কে তাঁর কাম্য কে তাঁর কাম্য নয়। দেবকুলপতি ব্রহ্মাকে দেখেই তিনি হেলায় হেসে বললেন—পেন্নাম হই ঠাকুরদাদা আখ্যাতে হসিতং পিতামহ ইতি। অর্থাৎ তোমার সঙ্গে সে সম্বন্ধ সম্ভবই নয়। শিব দেখে লক্ষ্মী যেন প্রমাদ গণলেন—বাবা এঁর হাতে যে নরকপালের ভিক্ষাপাত্র। দেবগুরু বৃহস্পতিকে দেখে লক্ষ্মী বললেন—নমস্কার গুরুদেব। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অগ্নিদেবতা। তাঁর তাপে তপ্ত হয়েই যেন ভীরু যুবতীটি দু’পা সরে আসলেন। এবারে দেবরাজ ইন্দ্রের পালা। পুলোমদুহিতা পৌলোমী শচীর নাম ধরে ডেকে তাঁর প্রতি অসূয়া প্রকাশ করার জন্যই যেন ইন্দ্রকে উপহাস করলেন লক্ষ্মী। ভাবটা এইখ নাকি পড়েছিল লক্ষ্মীর আপাণ্ডুর স্তনসীমার প্রান্তভাগে, তাঁর চোখ নাচ্ছিল। এ জিনিস লক্ষ্মীরও চোখ এড়ায়নি। বরমাল্য হাতে শ্রীহরি যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মী কি করেন? সমবেত দেবমণ্ডলীর সবার চোখ যে তাঁর দিকেই। একাদশ শতাব্দীর কবি ক্ষেমেশ্বর কিন্তু জানেন—লক্ষ্মী বিদগ্ধা মহিলা বটে। তিনি তাঁর বাগবৈদগ্ধ্যেই বুঝিয়ে দিলেন—কে তাঁর কাম্য কে তাঁর কাম্য নয়। দেবকুলপতি ব্রহ্মাকে দেখেই তিনি হেলায় হেসে বললেন—পেন্নাম হই ঠাকুরদাদা আখ্যাতে হসিতং পিতামহ ইতি। অর্থাৎ তোমার সঙ্গে সে সম্বন্ধ সম্ভবই নয়। শিব দেখে লক্ষ্মী যেন প্রমাদ গণলেন—বাবা এঁর হাতে যে নরকপালের ভিক্ষাপাত্র। দেবগুরু বৃহস্পতিকে দেখে লক্ষ্মী বললেন—নমস্কার গুরুদেব। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অগ্নিদেবতা। তাঁর তাপে তপ্ত হয়েই যেন ভীরু যুবতীটি দু’পা সরে আসলেন। এবারে দেবরাজ ইন্দ্রের পালা। পুলোমদুহিতা পৌলোমী শচীর নাম ধরে ডেকে তাঁর প্রতি অসূয়া প্রকাশ করার জন্যই যেন ইন্দ্রকে উপহাস করলেন লক্ষ্মী। ভাবটা এই—পৌলোমী শচীকে বিয়ে করেও যে মানুষ আমার প্রতি এরকম লোলদৃষ্টি দিতে পারে সে আমাকেও ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন মহিলার ওপর একই চোখে তাকাতে পারে, তোমাকে বিশ্বাস নেই বাপু! এতগুলি দেবতাকে শুধু কথার জালে ফেলে লক্ষ্মী শেষে শ্রীহরিকে সম্বোধন করলেন পুরুষোত্তম বলে, স্বয়ংবরের পুস্পাঞ্জলিটিও ন্যস্ত করলেন তাঁরই পায়ে।
লক্ষ্মীস্বয়ংবরের এত বড় খবর, তা আর অল্প করে রটবে কেন? আরও এক রসিক কবির কল্পনাতে উড়ে গিয়ে কে যেন এই খবর দিয়েছিল শিবদয়িতা পার্বতীকে। সে কিভাবে, কি গল্প বানিয়ে পার্বতীকে খুশী করার চেষ্টা করেছিল জানি না, তবে কোন এক সন্ধ্যার আতাম্র আলোকে শিব যখন পার্বতীর মুখের পানে তাকিয়ে অদ্ভুত এক আবেশ অনুভব করছেন, সেই সময় আমাদের সপ্তম শতাব্দীর প্রথম রাজা হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের মনে হল— পার্বতীকে পুরো ন্যাকা সাজিয়ে দিই। সবাই জানেন শিব কালকূট বিষ খেয়েছিলেন লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে উঠবার অনেক আগে। কিন্তু হর্ষদেব শিবকে পার্বতীর কাছে হেনস্থা করার জন্য সেই বিষপাত্র শিবের হাতে ধরিয়ে রেখেছিলেন লক্ষ্মীর আবির্ভাব পর্যন্ত। নইলে পার্বতী কি করে বলেন—হ্যাঁগা শম্ভু! সবাই যে বলে-সমুদ্রমন্থনের সময় লক্ষ্মী উঠে যখন কেশবকে বরমাল্য পরিয়ে দিলে, তখনই নাকি তুমি দুঃখে আনমনা হয়ে বিষ খেলে? হ্যাঁগো! কথাটা কি সত্যি—শম্ভো সত্যমিদম? শিব আর কি করেন, একে ভোলা, তায় এমন একটা অভিযোগ, তার ওপর সত্যিই তো ওই সময়, ওই অবস্থায় তিনি বিষ খাননি, বিষ খেয়েছিলেন দেবতাদের প্রয়োজনে, সৃষ্টিরক্ষার প্রয়োজনে। কিন্তু কপাল খারাপ, বিষ খাওয়ার ব্যাখ্যা পার্বতীর কাছে এইরকম।
তবে সুখের বিষয় মাতা চণ্ডিকা সেদিন খুব একটা রেগে ছিলেন না। আর সত্যিই তো, পার্বতী কি সব সময়ই রেগে চণ্ডী হয়ে থাকবেন! আমাদের ভাষার দোষে আমরা চণ্ডী শব্দটাকে দজ্জাল মহিলাদের ওপর বারবার চাপিয়ে দিয়েছি, অর্থ না বুঝে। কিন্তু আমার কাব্যগুরু শ্রীকালিদাস ভট্টাচার্য মশাই কর্কশ গাম্ভীর্যে আমাকে এক বকা দিয়ে বলেছিলেন—ওরে! অমর সিংহ থেকে আরম্ভ করে মল্লিনাথ—সবাই তো ‘চণ্ড’ মানে বুঝলেন অত্যন্ত কোপন স্বভাবের লোক—চণ্ডস্তু অত্যন্ত কোপনে। আর শব্দটাকে স্ত্রীলিঙ্গে ফেলেই চণ্ডী মানে করে দিলেন অত্যন্ত রাগী মহিলা। জগজ্জননীর রূপ আর নিজের গৃহিণীর রূপ একই ছাঁচে ঢালা হল। কিন্তু চণ্ডী শব্দের সত্যিকারের মানেটা কখনও ভেবে দেখেছিস? আমি সলজ্জে বলেছিলাম— সত্যিই ভাবিনি। অন্তত আপনার মত করে ভাবতে পারব এমন দুরাশা করি না। স্মিত হেসে কালিদাসবাবু বলেছিলেন— তবে শোন হতভাগা! মূলে চণ্ডী মানে যদি কোন রাগী মহিলাকে বোঝাত, তাহলে মায়ের নাম চণ্ডী হত না। আর মেঘদূতের উত্তরকল্পে যক্ষ যখন প্রিয়ঙ্গুলতায় আপন প্রিয়ার শরীর অনুভব করছেন, হরিণের চকিত চাহনিতে প্রিয়ার কটাক্ষ দেখছেন কিংবা চাঁদের মধ্যে প্রিয়ামুখের ছায়া দেখছেন, তখন যক্ষ সেই প্রিয়াকে সম্বোধন করলেন ‘চণ্ডী’ বলে। বললেন-চণ্ডী আমার! সব জায়গায় একটু একটু করে তোমাকে অনুভব করছি বটে, কিন্তু এক জায়গায় তোমায় পুরোটা পাচ্ছি না কোথাও—হন্তৈকস্মিন্ ক্কচিদপি ন তে চণ্ডি সাদৃশ্যমস্তি। তা এইখানে যে বিরহাতুর প্রেমে যক্ষ ‘চণ্ডী’ বলে সম্বোধন করলেন ঈপ্সিতা প্রিয়াকে—এর মানে কি কখনও দজ্জাল রাগী মহিলা হতে পারে? শিল্পী অধ্যাপক এখনও আমার কাছে রহস্য রেখে যাচ্ছেন, পুরোটা বলছেন না। আমি বললাম—তা এই চণ্ডীরহস্যের সমাধান কি স্যার? কালিদাসবাবু বললেন—তাও বুঝলি না! এ হল সংস্কৃত ভাষার ওপর প্রাকৃত ভাষার প্রভাব। প্রভাব এতটাই যে, মূল সংস্কৃত ভাষা থেকে একটা শব্দ প্রাকৃতে গিয়ে, আবার সংস্কৃতে ফিরে এসেছে। মুলে শব্দটি ছিল ‘চন্দ্ৰী’। আমি আঁতকে উঠলাম। কালিদাসবাবু সস্মিতে বললেন—চাঁদের জ্যোৎস্না বলতে যে চন্দ্রিকা শব্দটা, সেটা যদি প্রাকৃতে—‘চণ্ডিমা’ বা ‘চণ্ডিআ’ হয়, তাহলে চন্দ্ৰী শব্দটাও প্রাকৃতে হবে চণ্ডী এবং সেক্ষেত্রে মানেটা দাঁড়াবে চাঁদের জ্যোৎস্না ধোয়া মোহিনী সুন্দরী, যার মধ্যে চাঁদের আহ্লাদকত্ব, সৌন্দর্য, স্নিগ্ধতা—সব আছে। শুধু এই অর্থ হলে, তবেই না জগজ্জননী দুর্গার অভিধা হিসেবে চণ্ডী শব্দটা সার্থক হবে, মেঘদূতের প্রিয়া সম্বোধনের অর্থও খুঁজে পাওয়া যাবে। আর ভাষাতত্ত্বের সূত্রে চন্দ্ৰী থেকে চণ্ডী হল প্রাকৃতে, আবার সেই চণ্ডী চলে এল সংস্কৃতে। এ রকম উদাহরণ আরও কত আছে।
বলা বাহুল্য—এই অভিনব ব্যাখ্যায় আমি চমকিত হয়েছিলাম। দেবী চণ্ডীর অসুরমারণ স্বভাব আমরা বাংলার দজ্জাল ঘরনীদের ওপর আরোপ করে তাদের রণচণ্ডী, ক্ষ্যাপা চণ্ডী বলে কতই না দুঃখ দিয়েছি। কিন্তু হর্ষবর্ধনের লেখা শ্লোকটিতে দেখলাম—পার্বতীর অভিযোগ শুনে শিব বললেন— আমাদের সৌভাগ্য বলে কি কিছুই নেই পার্বতী, শেষে কিনা লক্ষ্মীর মুখ দেখে বিফল হয়ে আমি বিষ খাব! তা ছাড়া সবার ওপরে সাক্ষী আছেন ভালবাসার দেবতা অনঙ্গ—যাঁর প্রথম প্রয়াসে তোমাকে দেখেই আমি প্রথম আনমনা হয়েছিলাম। পার্বতীর সব স্মরণ হল। সেই হিমালয়ের কোলে অকাল বসন্তের হাওয়ায় নিজের অবস্থা এবং শিবের অবস্থা। পূর্বকথার স্মরণে, শিবের আকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে পার্বতী শুধু হাসলেন, হাসি দিয়ে ভুলিয়ে দিলেন নিজের অভিযোগ।
লক্ষ্মীর সঙ্গে শিবের কোন সম্পর্ক নেই ; তবু কবিরা তাঁকে জড়িয়ে শিবের সঙ্গে তামাশা করতে ছাড়েননি। আমরা যেমন বলি—আজকাল জামা-কাপড়ই সব, বিদ্যা, শিক্ষা, রুচির কোন মূল্য নেই। গরিব হলে তো আরও। দেবতাদের সমাজেও স্বাভাবিকভাবেই একই রকম রীতি হবে, যদি-বা নাও হয় কবিরা মিলিয়ে দেবেন। উদ্ভটসাগরের লেখক পূর্ণচন্দ্র একটি শ্লোক সংকলন করেছেন— যাতে লেখা আছে—মানুষ কিংবা দেবতা সর্বত্রই ওই একই কথা—ভাল জামা-কাপড়ই যত যোগ্যতার জন্ম দেয়। জামা-কাপড়ের চেকনাই না থাকলে লক্ষ্মীও সেখানে থাকেন না। এই দেখুন— সাগর-শ্বশুর যে বিষ্ণুকৃষ্ণকে সুন্দরী কন্যা লক্ষ্মীকে দান করলেন, সে শুধু তাঁর চকমকে হলুদ রঙের কাপড়খানির বাহার দেখে। বাবাদের পাটোয়ারি বুদ্ধিটা চিন্তা করুন ; তিনি পীতাম্বর দেখে মেয়েটিকে দিলেন তাঁর হাতে, আর দিগম্বর দেখে শিবকে দিলেন বিষ— পীতাম্বরং বীক্ষ্য দদৌ তনুজাং/ দিগম্বরং বীক্ষ্য বিষং সমুদ্রঃ।
কবিরা দেবতাদের ব্যবহারে মানুষের কল্পনার রঙ লাগাতে বিষ্ণু কিংবা নারায়ণকে যে কৃষ্ণ বানিয়ে ছেড়ে দেন—সেটা আমার ভাল লাগে না। ভাল লাগে না এই জন্য যে, প্রথমত, লক্ষ্মীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে হয়নি মোটেই, দ্বিতীয়ত, নারায়ণ কিংবা বিষ্ণু—কেউ পীতাম্বর ছিলেন না, তৃতীয়ত, সৃষ্টির প্রথম কল্পে যখন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের রাজত্ব চলছে, তখন কৃষ্ণ কোথায় আর তাঁর পীতাম্বরই বা কোথায়? কিন্তু তাই বলে ভগবান বিষ্ণু যত গম্ভীরই হোন, তাঁকে যে আমরা মানুষ বানাতে পারিনি— মোটেই নয়। বরঞ্চ একান্নবর্তী পরিবারে নববিবাহিত বরটিকে যেমন রাত হলেই উসখুশ করতে দেখা যায়, আমরা লক্ষ্মীর সঙ্গে বিয়ের পর বিষ্ণুর অবস্থাও তাই দেখেছি। পুরুষ মানুষের আর কি! ইচ্ছা প্রবল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিষ্ণু লক্ষ্মীর নীবিবন্ধে হস্তস্থাপন করেছেন। তখন রাত কি, ভাল করে সন্ধেই হয়নি। লক্ষ্মী গুণবতী বধূটির মত বিষ্ণুকে বলেছেন—লক্ষ্মীসোনা! এখন নয়, এই দেখ না তোমার শেষ নাগ যার ওপর পালঙ্ক রচনা করে শুয়ে আছি আমরা, সেই পালঙ্কই এখনও স্থির হয়নি, শেষ নাগ যে এখনও নড়াচড়া করছে! সন্ধ্যার অন্ধকার পর্যন্ত এতটুকু গাঢ় হয়নি যাতে তোমার কৌস্তুভমণির ছটাটুকু ঢাকা পড়ে। আর ব্রহ্মাটাকে দেখছ, একটু আগে সামগান গেয়েছে আর এখন চক্ষু দুটি মুদে দেখাচ্ছে যেন ধ্যান করছে—মুকুলিতনয়নো নিদ্রয়া ধ্যায়তীব।
এই সব গূঢ় কথা লক্ষ্মী খুব চুপিসারে বিষ্ণুর কানে কানে বললেন এবং নীবীবন্ধ-বিঘটনার জন্য উদ্যত হরির হস্তটিকে সরিয়ে দিলেন মৃদু হেসে। এইভাবে তবু ভালই চলছিল লক্ষ্মীদেবীর। শেষ নাগের পালঙ্কে ক্ষীর সাগরের হাওয়ায় লজ্জিত বাসর শয্যায় ভালই দিন কাটছিল লক্ষ্মীর। কিন্তু লক্ষ্মীর কপাল ভাল না। একে তো তাঁর স্বামী বড় ব্যস্ত লোক। দশ অবতারের কাজকর্মে তাঁকে মাঝে মাঝেই পৃথিবীতে নামতে হয় আর স্বামীর সদা ব্যস্ততার ফলে লক্ষ্মীর চরিত্রও গেল খারাপ হয়ে। তবু যেন কেন শ্বশুর শাশুড়িরা গৃহবধুটিকে লক্ষ্মী বলতে ভালবাসেন তার কারণ বুঝি না। দশ অবতারের মধ্যে অন্তত দু-তিনটিতে লক্ষ্মী স্বামীকে সঙ্গ দেবার জন্য ধরাতলে অবতীর্ণ হয়ে কখনও সীতা সেজেছেন, কখনওবা লক্ষ্মী সেজেই এসেছেন কিন্তু তাঁর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল যখন বিষ্ণু কৃষ্ণ হয়ে জন্মালেন। কৃষ্ণের মাহাত্ম এমনই যে ভগবান বিষ্ণুকেও কবিরা হলুদ কাপড় পরিয়ে ছেড়েছেন। কাজেই কৃষ্ণ অবতারের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীর মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল। এই দ্বিতীয়/তৃতীয় শতাব্দীতে যেখানে হালের কবিতায় লক্ষ্মীকে নারায়ণের দেহারূঢ় হয়ে পুরুষায়িত অভ্যাস করতে দেখেছি, দেখেছি সেই অবস্থায়ও কৌস্তুভ মণির আয়নায় লক্ষ্মীর নিষ্কলঙ্ক মুখের প্রতিবিম্ব—যস্য বসি লক্ষ্মীমুখং কৌস্তুভে সংক্রান্তম্—সেই নারায়ণই যখন কৃষ্ণ হলেন, তখন লক্ষ্মীর সমস্ত আদর গেল ফুরিয়ে। তখন গোপীদের চিকন গালে কৃষ্ণের ছায়া পড়তে থাকল। আর মাত্র দশম খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই বাক্পতি মুঞ্জের পাথরে লেখা হয়ে গেল যে, লক্ষ্মীর মুখ আর ভগবান শ্রীহরির মনে ধরছে না—যল্লক্ষ্মীবদনেন্দুনা ন সুখিতং—ক্ৰমেই তিনি রাধার বিরহে কাতর হয়ে পড়ছেন, শরীরে মনে কেবলই তখন রাধা-রাধা—রাধাবিরহাতুরং মুররিপো র্বেল্লদব্পুঃ পাতু বঃ। এরই মধ্যে নষ্টদৃষ্টি কলিতে ভাগবত পুরাণ সূর্যের মত উদয় হয়ে লক্ষ্মীর মর্যাদা একেবারে ঢিলে করে দিল। মহামহিমময়ী লক্ষ্মীকে সে একেবারে বৃন্দাবনের গোপীদের পায়ের ধুলোর সমান করে দিল। সগর্বে ঘোষণা করল—ওই লক্ষ্মীর ওপর পুরুষোত্তম কৃষ্ণের আর কোন অনুগ্রহ নেই—নায়ং শ্রিয়ো’ঙ্গ উ নিতান্ত রতেঃ প্রসাদ।
এ অবস্থায় কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। ভাগবত পুরাণের নতুন সূত্রে অভিভূত হয়ে পঞ্চদশ শতকের চৈতন্য মহাপ্রভু ঐশ্বর্যময়ী লক্ষ্মীকে একেবারে অচ্ছুৎ করে করে দিলেন। কিন্তু লক্ষ্মীর কি সর্বনাশ হল ভাবুন। আমরা তাঁকে দোষই বা দেব কি, ভাগবত পুরাণ কি চৈতন্যদেব, যত ক্ষতি করেছেন লক্ষ্মীর, তার থেকে অনেক বেশি করেছেন জন-সাধারণ। এবং তা কেমন করে জানেন? যারই ভাঁড়ারে টান পড়েছে, যে মানুষই টাকা-পয়সা খুইয়ে দরিদ্র হয়েছে, কিংবা যে কোনদিন টাকা-পয়সা পায়ইনি—তারা প্রত্যেকে লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে গালাগালি দিয়েছে। দুঃখ লাগে—যে মানুষ প্রচুর অর্থলাভ করেছে, সেও যখন নেমকহারামি করে লক্ষ্মীকে গালাগাল দেয়। মহাকবি বাণভট্টের কথা স্মরণ করুন। তাঁর পৃষ্ঠপোষক মহারাজ হর্ষদেব কি বাণভট্টকে কম ধন-সম্পত্তি দিয়েছিলেন! কিন্তু এত পেয়েও. বাণভট্ট লক্ষ্মীকে কিই না বলেছেন! গণিকা, খলজনের প্রিয়া, দুষ্টপিশাচী, হিড়িম্বা রাক্ষসী—কোন গালাগালিই তাঁর লেখনীতে বাদ পড়েনি, কারণ গালাগালিই হোক, কি ভাল কথাবাণভট্টের লেখায় কিছু বাদ পড়ে না।
কিন্তু বাণের কথা থাক। বাণ ছাড়া অন্য কবি যাঁরা আছেন তাঁরাও বাণের উচ্ছিষ্ট উগরে দিয়েছেন কবিতায়। সোলুক আর শালূক বলে দুই কবি ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে। তাঁদের দুজনের ধারণা— মানুষের গুণ বলে যদি কিছু থাকে, লক্ষ্মী তার কদর জানে না। আসলে অনেক গুণ থাকার ফলে যেসব মানুষের অনেক টাকা-পয়সা থাকা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি, অথচ দুভাগ্যবশত টাকা-পয়সা তাদের হয়নি, সেই হতাশা থেকেই লক্ষ্মীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমা হয়েছে। এককালে বাণভট্ট যা লিখেছিলেন, ঠিক তাঁর ছয় শতক পরে সোলুক তার পদ্যানুবাদ করে লিখেছেন— লক্ষ্মীর খুরে খুরে নমস্কার। তিনি বিদ্বান লোকের ধার মাড়ান না এই ভেবে যে পুঁথি পড়তে পড়তে যেন তার বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে গেছে—বিদ্বান্ অক্ষরনষ্টধীরিতি। শুদ্ধশুচি লোকটিকে লক্ষ্মী ভাবেন যেন তার ধর্মের বাই আছে। ধীর স্থির লোককে তিনি ভাবেন বুঝি নিষ্কর্মা। রাগী লোককে ভাবেন বুঝি গ্রহের প্রকোপে ভুগছে। ক্ষমাশালী মানুষটিকে নিবীর্য বলে, নীতিবাগীশ মানুষকে মায়াবী বলেই যেন লক্ষ্মী এড়িয়ে যায়। সোলুক-কবির ধারণা— গুণ থাকতেও যাঁদের গুণকে এইভাবে দোষ দিয়ে তাঁদের ধনসম্পত্তি দেন না লক্ষ্মী, সেই লক্ষ্মীর খুরে খুরে দণ্ডবৎ। শালুক কবি কিন্তু সোলুকের এক কাঠি ওপরে। তিনি তাঁর স্বরচিত কবিতায় সোলুকের উল্টো পথে লক্ষ্মীলাভের মনস্তত্ত্বে পৌছেছেন। শালুক মনে করেন— টাকা-পয়সা এমন জিনিস যে ওটা থাকলে টাকা-ওয়ালাদের দোষও গুণের পযায়ভুক্ত হয়। ধনদায়িনী লক্ষ্মীর দোষ এইখানেই। শালুক বলেন— লক্ষ্মীর কৃপায় ধনী মানুষের রাগটাকে মনে হয় তেজ, বদমায়েশিকে মনে হয় লীলাখেলা, ব্যবহারের কৌশলকে মনে হয় ইন্দ্রজাল, বোকামিকে মনে হয় সরলতা। আর বড় মানুষ যদি অসভ্যতা করেন তখন মনে হয় লোকটা ভারি স্পষ্টবাদী। এমন লক্ষ্মীকে কি নমস্কার না করে পারা যায়?
বিশ-পঁচিশটা লক্ষ্মীবাদী কবিতা পড়ে আমরা বেশ বুঝেছি যে, অন্যান্য দেবতার গালাগালি খাওয়ার কারণ যদি সেই সেই দেবতার স্বভাব-চরিত্র হয়, লক্ষ্মীর ব্যাপারটা সেখানে পুরো আলাদা। তিনি গালাগালি খেয়েছেন মূলত টাকা-পয়সার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত আছে বলে। বিশেষত মূর্খ কিংবা অযোগ্য লোকের যদি টাকা-পয়সা থাকে, তবে তো, বিদ্বান কবিরা সঙ্গে সঙ্গে কবিতার জন্ম দিয়েছেন, একজন তো ব্যঙ্গ করে এমন লিখেছেন যে— লক্ষ্মী ঠাকুরানী বড় পতিব্রতা। তাঁর স্বামী বিষ্ণুরূপী কৃষ্ণ গরু চরাতেন বলে লক্ষ্মী এখনও গরুর মত মানুষের সঙ্গেই ওঠাবসা করেন— অহো দেবী পতিব্রতা। এই কবিতার পরেই যে কবিতাটিতে আমার মজা লাগে, সেটি এক বামুন কবির বানানো। কে না জানে বামুনরা অনেকেই বড় গরিব ছিলেন। রাজার ঘরে, কি জমিদার বাড়িতে ডাক-পাওয়া বামুনদের কথা ছেড়ে দিন, সাধারণ বামুনেরা চিরকালই বড় গরিব। তা বামুনের ঘরে লক্ষ্মী কেন থাকেন না, তার কতগুলি সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বার করেছেন বামুন কবিরা। কবিতাটি লেখা হয়েছে বেশ পৌরাণিক কায়দায়। যেন ভগবান বিষ্ণু লক্ষ্মীকে প্রশ্ন করছেন— প্রিয়ে বামুনবাড়ির দিকে তোমার গতাগতি কম কেন—ভাবটা এই যে, অন্যের তুলনায় তাদের এত টাকা-পয়সা কম কেন? এইবার কবিতাটি : নাথ! এর কারণ শুনুন।
কারণ হিসেবে অবশ্য লক্ষ্মীর জবানীতে যা ধরা পড়েছে, তা অনেকটা ওই বাঘ-ছাগলের গপ্পোর মত—সেই যে সেই—জল তুই ঘোলা করিসনি, করেছে তোর বাবা। যাই হোক লক্ষ্মী বললেন— বামুনবাড়িতে আমি বেশি থাকি-না কেন জানেন? দেখুন—বামুন অগস্ত্য আমার পিতা কালনিধি সাগরকে শুষে নিয়েছিলেন, এ কি কম অপমান! (অগস্ত্য অঞ্জলিপুটে সমুদ্র পান করেছিলেন এটা পৌরাণিক প্রসিদ্ধি।) আবার আস্পর্দ্দা দেখুন—ভৃগু শুধু বামুন বলে ক্ষণিকের দেরি সইতে না পেরে আমার স্বামীর বুকে লাথি মেরেছিল! (ভাগ্যিস লক্ষ্মী কবি নজরুলকে চিনতেন না, কারণ এই কলিযুগে তিনি আবার বিদ্রোহী হয়ে ‘ভগবান-বুকে’ পদচিহ্ন আঁকতে চেয়েছিলেন।) আর এই আবাগী বামুনগুলোর ব্যবহার দেখুন! ছোটবেলা থেকে আমার সতীন কাঁটা সরস্বতীকে যেন সব সময় মুখে করেই রয়েছে—স্ববদনবিবরে ধারিতা বৈরিণী মে। সব সময় পুঁথি পড়ছে আর পুজোর সময় আমার সাধের আসন, পদ্মগুলিকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে শিবপুজো করছে। প্রভু বামুনদের ওপর আমার যে রাগ এবং আমি যে তাদের ঘরে পা রাখি না, তার এতগুলো কারণ— তস্মাৎ খিন্না সদাহং দ্বিজকুলসদনং নাথ নিত্যং ত্যজামি।
আমরা বেশ জানি— বামুনবাড়ির ওপর লক্ষ্মীর নির্দয়তার কারণ হিসেবে যা দেখানো হল—তা নেহাতই কবিদের বাক্চাতুরী। বস্তুত বামুনেরা সে যুগে পড়াশুনো নিয়ে থাকতেন— তাঁদের মধ্যে গুটি কয়েকেরই নামডাক হত এবং তাঁরাই রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ির পরিপোষণা লাভ করতেন। সবার কপাল একরকম হয় না, তার ওপরে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকর্মে লিপ্ত হলে তাঁদের জাত যেত, সম্মান নষ্ট হত। ফলে সাধারণ ব্রাহ্মণেরা এদিকেও যেতে পারতেন না, ওদিকেও যেতে পারতেন না। স্বাভাবিক কারণেই ব্রাহ্মণের টাকা-পয়সা হোত না, অতএব অভিমানে কবিতা লিখে লক্ষ্মীর চরিত্র ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কবিরা সব বোঝেন। স্থান কাল পাত্র—সব তাঁদের জানা বলেই লক্ষ্মীর ব্যাপারে যেমন তাঁরা অভিমান ব্যক্ত করেছেন, তেমনি বাস্তব বুঝে এ কথাও তাঁরা পরিষ্কার লিখেছেন যে, লক্ষ্মী চপলাও না, অধম কিংবা মূর্খ-প্রিয়াও নয়। বীর, মানী, শঠ, বদমাস—যে-কেউ যে লক্ষ্মীলাভ করছেন—সে তাদের প্রাক্তন কর্মফল অথবা ইহজন্মের কাজের পুরস্কার। কিন্তু লোকের স্বভাব এমনই যে কারও টাকা-পয়সা দেখলেই অসহ্য হয়ে ওঠে এবং তার কলঙ্ক বার করে নিন্দা করে—লোকানাং কিমসহ্যতা সখি পুন দৃষ্ট্বা পরাং সম্পদম্। লক্ষ্মীর কথা বলতে বলতে কবি আর শেষে দেবতা বোঝেননি, বুঝেছেন টাকা-পয়সাই লক্ষ্মী। দেবতার আরাধনা, ফুল বেলপাতা আর নৈবেদ্যে যে লক্ষ্মী মেলে না, সে বিষয়ে কবিরা শেষ পর্যন্ত রায় দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন—টাকা পয়সা যার আছে, তার আছে, যার নেই, তার নেই। অর্থাৎ যার আছে, তার লক্ষ্মী আছে, যার নেই, তার লক্ষ্মীও নেই। কবি মনে করেন—টাকা-পয়সারই আরেক নাম লক্ষ্মী, লক্ষ্মী কোন দেবতা নয় এবং সে লক্ষ্মী যার আছে, সে কি কি করতে পারে? সে বাঁকা মনে ধার্মিক লোকদের ঠকাক, মা-বাবাকে পেটাক, মাল খাক আর ঘরের সতী লক্ষ্মীকে ঝাঁটা মারুক—তাতে তার কিছুই আসে যায় না—হস্তু স্বাং জননীং পিবত্বপি সুরাং শুদ্ধাং বধূম্ উজ্ঝতু। সে চার বেদের মুখে ঝামা ঘষে দিক, কি কাউকে খুনই করুক—বেদান্ নিন্দতু বা হিনস্তু জনতাং—এসব চিন্তায় তার কিছুই আসে যায় না। টাকা-পয়সা যার আছে, সেই জগতের সবচেয়ে প্রশংসনীয় লোক, কোন কিছুতেই তার কিছু যায়-আসে না—লক্ষ্মীর্যস্য গৃহে স এব ভজতি প্রায়ো জগদ্বন্দ্যতাম্।
এই সার কথাটা অনেক কবিই বুঝেছেন, আর এটা বোঝার ফলে ধনহীন দরিদ্র কবি শেষ পর্যন্ত দেবতা লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিয়ে বলেছেন— লক্ষ্মী! তুমি কোন দেবী নও, নীচ মানুষের অনুরাগিণী বেশ্যা তুমি। তুমি আরও একবার সেই সমুদ্দুরে ঢোক দেখি, যেখানে তুমি প্রথম ছিলে। দেখব— আবার সমুদ্রমন্থনকালে মন্দর পর্বত মন্থনদণ্ড হতে এগিয়ে আসে কিনা, দেখব আসেন কিনা সেই দেবতারা, যাঁরা সমুদ্রনস্থন করেছিলেন। একবার সেই অগাধ সমুদ্রে ঢুকলে আর কেউ তোমাকে তোলে কিনা— সেটাই আমার দেখার— কস্ত্বাম্ উত্তোলয়িষ্যতি?
এ কোন ঠাট্টা-ইয়ার্কি বা গালাগালি নয়, দেবতার ওপর স্পষ্ট অবিশ্বাস— অভিমানে, হতাশায়। সৌভাগ্যের বিষয়— এক লক্ষ্মী ছাড়া আর কোন দেবতার ওপর মানুষের এই অবিশ্বাস নেই। আমার ধারণা —অন্য কোন দেবতার সঙ্গে যদি মানুষের ঐহিক লাভের বিষয়টি এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকত, যেমন লক্ষ্মীর ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা— তা হলে তাঁর অবস্থাও লক্ষ্মীর মতই হোত। লক্ষ করে দেখবেন লক্ষ্মীর সতীন কাঁটা সরস্বতীও এ ব্যাপারে অনেক বেশি ভাগ্যবতী। তাঁর জন্মলগ্নে পিতৃগামিতার মত পৌরাণিক কলংক থাকলেও, প্রায় কোন কবিই কিন্তু সরস্বতীকে বেশি কলংকিত করেননি, বিদ্যা না হলেও না। বরঞ্চ কারও হাতে যদি-বা সরস্বতীর অবমাননা ঘটেছে, কবিরা সেখানে এমন সুন্দরভাবে শব্দার্থ গ্রন্থনা করেছেন, যাতে অন্যায়টা কোনভাবেই সরস্বতীর ওপর না পড়ে। যেমন আনুমানিক ষোড়শ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ববর্তী একটি শ্লোকে এক কবি লিখেছেন— এই পোড়া পেটের জন্য পণ্ডিতেরা কিই না করতে পারে ! এমন কি সরস্বতীকেও তাঁরা বানরীর মত লোকের বাড়ি বাড়িতে নাচায়— বানরীমিব বাগ্দেবীং নর্ত্তয়ন্তি গৃহে গৃহে। এই শ্লোকটির মর্মকথা আরও ভাল করে বোঝা যাবে একাদশ খ্রীষ্টাব্দে লেখা কাশ্মীরী ক্ষেমেন্দ্রের একটি শ্লোকে। বস্তুত যাঁরা বিদ্বান, যাঁরা কবি, পণ্ডিত— তাঁরাই তো সরবতীর আশ্রয়, কিন্তু তাঁরা যদি আপন স্বার্থে কিংবা কোন প্রাতিষ্ঠানিক ভয়ে নিজের কথা কিংবা লেখার ভাষা বিকৃত করেন, তা হলে অনেকের কাছেই সেটা মর্মচ্ছেদী হয়ে পড়ে। ক্ষেমেন্দ্র লিখেছেন— রাজাদের তেল দেবার জন্য লুব্ধ কবিরা সরস্বতীকে দামী দামী শাড়ি-গয়না পরিয়ে বেশ্যার মত পরের কাজে লাগিয়েছেন বাণী—বেশ্যব লোভেন পরোপকরণীকৃতা। আজ রাজা নেই বটে, তবে রাজনীতি আছে ; রাজনীতির প্রয়োজনে, নিজের উন্নতির প্রয়োজনে কিছুই না থাকলে উত্তম পুরুষকে তৈলসিক্ত করার জন্য আজও আমরা সরস্বতীর অপব্যবহার করে চলেছি। কিন্তু এরই মধ্যে সুখের কথা এইটুকুই যে, বাগদেবীর এই অবমাননায় কবিদের মনে তবু এক শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ আছে, যাতে দোষী সাবযস্ত হয়েছে কতগুলি বিদ্বান মানুষই ; স্বয়ং দেবতা এখানে নির্দোষ, মানুষ দিজের দোষেই তাঁকে যেন ক্লিন্ন করেছে।
সবখানেই তাই। দেবতার সঙ্গে রসিকতাই হোক, তাঁর উদ্দেশ্য গালাগালিই হোক কিংবা দেবতার অপব্যবহার— সব কিছুর জন্য মানুষই দায়ী। দেবতার কোন ক্ষমতাই নেই ভাল কিংবা খারাপ হবার। মানুষ-কবির কল্পনাতেই দেবতার স্নিগ্ধ-মধুর, তিক্ত-ক্লিন্ন আকারকল্প। আমার স্বর্গীয় অধ্যাপক বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য কোন একটি আলোচনা-সভায় একটি শ্লোক উদ্ধার করে বলেছিলেন— যাঁর যে রকম বোধ, সেইভাবেই তাঁর ভাবগ্রহ। কবি-পুরুষদের বচন এবং পুরাণ-পুরুষ দেবতাদের ব্যাপারেও যাঁর যেরকম কল্পনা সেই পথেই হৃদয়ের ভাব প্রকাশ পায়—উন্মীলতি কবি-পুঙ্গববচনে চ পুরাণপুরুষে চ। ব্যক্তিমনের স্পর্শে যে শালগ্রাম শিলা নারায়ণ, সেই শিলাই আবার ব্যক্তিকবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কল্পনারসে
তুমি শালগ্রামশিলা
শোয়া বসা যার সকলি সমান
তারে নিয়ে রাসলীলা!
বাংলা প্রবাদে যেমন ‘শালগ্রাম বাঁধা দিয়ে মদ খওয়া’র ঘটনায় ভগবন্নারায়ণের সমস্ত দেবত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে, তেমনি বেদ-ব্রাহ্মণ্য— এগুলিও কবির বাক্-পারুষ্য থেকে মুক্তি পায়নি। আরও আশ্চর্য লাগে যখন দেখি— এই পুরুষবাক্য কোন বিরোধী লোকের মুখ থেকে বেরোয়নি, বেরিয়েছে স্বয়ং সেই মানুষটির লেখা থেকে যিনি বেদ এবং ব্রাহ্মণ্যের একান্ত নিষ্ঠ ভক্ত। ভাবতে পারেন— লক্ষ্মণসেনের ধর্মাধ্যক্ষ হলায়ুধ মিশ্রের মত লোক, যার বাড়িতে হোম যজ্ঞ-বেদবিধির অন্ত ছিল না —তিনি বেদ-শ্রুতিকে তুলনা করেছেন বেশ্যার সঙ্গে। কেন? না, যেহেতু অনেক ব্রাহ্মণ্যহীন ব্যক্তিও বেদ পড়েন—কণ্ঠে কেন ধৃতা ন কুতুকাৎ পণ্যাঙ্গদেব শ্রুতিঃ। কবির কল্পনার রঙে তাই বেদ, ব্রাহ্মণ, দেবতা— সবাই রাজার কাছে দণ্ড্যজনের মত কখনও স্বর্গে উঠছেন, কখনও নরকে ডুবছেন।
॥ ৯ ॥
আসলে মুশকিলটা করেছেন স্বয়ং ব্যাসদেবই। তাঁরই নামে আরোপিত একটি অসাধারণ শ্লোকে তিনি তাঁর দোষমুক্তির জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। নিজ মুখে যা বলেছেন তাতে দেখাযাচ্ছে— তাঁর অপরাধ প্রধানত তিনটি। তাঁর প্রথম দোষ— তিনি নিরূপ, নিরাকার, সর্বময় ঈশ্বরের রূপকল্পনা করেছেন ধ্যানযোগে। এই যেমন রাম, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, নারায়ণ ইত্যাদি। দ্বিতীয় দোষ— যে ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, তার সর্বব্যাপিত্ব সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন কতগুলি তীর্থের মধ্যে। অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ তীর্থে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অধিক মাহাত্ম্য খ্যাপন করে তাঁর সর্বময়তার হানি ঘটিয়েছেন। তৃতীয় দোষ— ভগবানের স্তুতি-প্রশংসা এবং নাম-লীলাদি কীর্তনের দ্বারা পরমেশ্বরের অনির্বচনীয়তার ক্ষতিসাধন করেছেন ব্যাস।
এই শ্লোকের অন্তিম পঙ্ক্তিতে ব্যাস মন্তব্য করেছেন— এই তিন রকমের অপরাধ যা আমি করেছি, তার জন্য তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও প্রভু— ক্ষন্তব্যং জগদীশ তৎ দোষত্রয়ং মতকৃতম্। হাজার, দু হাজার বছর আগে ব্যাস যে দোষগুলি করে গেছেন, তার জন্য বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে এসে খেসারত দিচ্ছি আমরা। মুশকিলটা এইখানেই। আরও মুশকিল এই জন্য যে, ব্যাস যে দোষগুলি করেছেন তার সঙ্গে আরও গোটা তিনেক দোষ জুড়ে গেছে। ব্যাসের দোষ শুধুমাত্র ঈশ্বর-ঘটিত, অর্থাৎ অরূপের মধ্যে রূপের খোঁজ পাওয়া, অসীমের মধ্যে সীমা নিরূপণ এবং অনির্বণীয়কে বচনে আবদ্ধ করা— এই তিনটি। বস্তুত এর সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ আছে কিনা সন্দেহ! যোগ থাকলে সে কোন ধর্ম? শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, বৈদিক— কোনটা? ধর্ম বলতে তো কোন কালে ভারতবর্ষে একক কোন কিছুকে বোঝায় না। আর শৈব শাক্ত বৈষ্ণব— এগুলি তো ধর্মের বিশেষণমাত্র। যদি বলি সনাতন হিন্দু ধর্ম— তারই বা কি মানে হয়? বৈদিক ধর্মের সঙ্গে, উপনিষদের ধর্মের বিলক্ষণ ভেদ আছে, বিলক্ষণ ভেদ আছে ঔপন্যাসিক ব্রহ্মের সঙ্গে পৌরাণিক দেবতা-মণ্ডলীর। পুরাণগুলির মধ্যে যদি-বা বেদ-উপনিষদের মিশ্রক্রিয়ায় নতুন দেবতার জন্ম হল—তাতে লাভ বা ক্ষতি হল এই যে, ধর্ম আর কোন একাত্মতার জন্ম দিল না, উল্টে ধর্মের কতগুলি বিশেষণ জুটে গেল—শাক্ত, শৈব, গাণপত্য, বৈষ্ণব— ইত্যাদি।
একটা কথা এই শেষ মুহূর্তেও বলে নেওয়া ভাল যে, ভারতবর্ষে কোনদিন কোন দেবতার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে একই দেবতাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতবর্ষে একই ধর্মের কল্পনা বৃথা। বৈদিক যুগে ইন্দ্র যে পদ পেয়েছেন, অগ্নি যে মর্যাদা ভোগ করেছেন, পরবর্তী যুগে তাঁরা তা সম্পূর্ণ হারিয়েছেন। হারিয়েছেন এতটাই যে, বহু দেবতার কল্পনায় বৈদিক ঋষিদের মনে পর্যন্ত সন্দেহ এসেছে—কেন দেবতাকে আর তেল-ঘি পুড়িয়ে আহুতি দেব— কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম? ঐতিহাসিকতার নিরিখে বৈদিক দেবকল্পনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে উপনিষদের ব্রহ্মচিন্তা— নিরাকার, নির্বিশেষ, নিরঞ্জন। কিন্তু এও টেকেনি, ভারতবর্ষের মানুষ ব্রহ্মের সাকার বিগ্রহ চেয়েছে। ফলে রাম, কৃষ্ণ, কালী, শিব পাদপ্রদীপের আলোয় এসে পড়েছেন। মজা হল, এঁরাও কিন্তু কেউ একচ্ছত্র নন। বিশেষ বিশেষ এলাকায় যদি একচ্ছত্রী হনও, তবু এঁদের সঙ্গে আছেন শীতলা, মঙ্গলচণ্ডী, সন্তোষী মা-ও। আমরা এদের সবাইকে গড় করি আর কবির ভাষায় বলি—
থাকো হৃদয়-পদ্মটিতে
এক দেবতা আমার চিতে—
চাই নে তোমায় খবর দিতে
আরো আছেন তিরিশ কোটি।
ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে এখন যাঁরা বুঝেছেন যে, ভারতবর্ষে ধর্মও একটা ভারী ব্যাপার, তাঁদের চৈতন্য দেরীতে হলেও সুখের। বোধ করি একই সঙ্গে তাঁরা এটাও স্বীকার করে নেবেন যে, বহু দেবতার বিভিন্নমুখী এবং ততোধিক ভিন্নপন্থী ভক্তদের দিয়ে কখনও ধর্মযুদ্ধ সম্ভব হয় না। বিশেষত যে দেশে ধর্মের সঙ্গে যুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই। স্বীকার করতেই হবে যে, যে জাতির ব্যক্তিগত দেবতার সংখ্যা তিরিশ কোটি, সে জাতির দেবতারাও গণতন্ত্র মেনে চলেন। না চললে তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এই কারণেই ভাগবত পুরাণে শিব, দুর্গা— সবাই কৃষ্ণের ভক্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু শিবপুরাণে সেই কৃষ্ণেরই শিব-অনুগতি না থাকার ফলে তেজোহানি ঘটে। আবার দেবীভাগবত পুরাণে শিব-কৃষ্ণ— সবাই পরমা প্রকৃতির কলা-বিকলা মাত্র। কাজেই ব্যাপারটা এই রকমই। প্রত্যেক দেবতারই নিজস্ব অনুগামী দল আছে—সময়বিশেষে যে দেবতার আধিপত্য ঘটে, তাঁর ভক্তদলেরও তখন প্রাধান্য ঘটে, ঠিক যেমন গণতন্ত্রে প্রধান রাজনৈতিক দল মন্ত্রী-সভা গঠন করে সেই রকম। কিন্তু তাই বলে গণতন্ত্রে অন্য দলগুলি যেমন মিথ্যে নয়, তেমনি দেবতার রাজ্যেও এক দেবতার প্রাধান্য ঘটলে, অন্য নেদবতার মাহাত্ম্য লুপ্ত হয় না, কিংবা তাঁর ভক্তদলও নিস্ক্রিয় হয়ে যান না। তাঁরা সবাই থাকেন এবং সময়ে আসন ফিরে পান আপন দেবতার অভ্যূত্থানের সঙ্গে সঙ্গে।
কিন্তু বিশেষ দেবতার এই অভ্যূত্থান কিংবা পতনের সঙ্গে বিশদ অর্থে ধর্মের কোন যোগ নেই। রামায়ণ-মহাভারতে রামচন্দ্র কিংবা কৃষ্ণ যে যুদ্ধপর্বের সঙ্গে জড়িত আছেন, তা ধর্মের জন্য হলেও, সে ধর্ম মূলত ন্যায়-নীতির প্রতিশব্দ মাত্র। সত্যি কথা বলতে কি, এতটা বিশদ অর্থেই চিরকাল ধর্ম শব্দটির ব্যবহার হয়েছে ভারতবর্ষে। উপনিষদ যখন বলেছে—সত্যং বদ, ধর্মং চর— সত্য কথা বল, ধর্মাচরণ কর— তখন ন্যায়-নীতি এবং চিরন্তন সত্যগুলিরই ধর্মের আওতায় এসে পড়েছে ; রাম কিংবা কৃষ্ণপন্থী বৈষ্ণব ধর্মও সেখানে আচরণের বিষয় নয়, শৈব কিংবা শাক্তধর্মও সেখানে অনুসরণের বিষয় নয়। একই কারণে পরম ঈশ্বরকে যেখানে সমস্ত ধর্মের মর্যাদারক্ষার কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করা হয়, সেখানে সেই ঈশ্বর, জীবনের সত্য এবং ন্যায়-নীতির রক্ষক বলে পরিচিত। গীতায় সেই জন্যই অর্জুন বিশ্বরূপ দেখতে দেখতে বলেছেন— প্রভু! তুমি ক্ষয়হীন, তুমি চিরন্তন ধর্মের রক্ষাকর্তা— ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা। এই শাশ্বত ধর্ম কি কখনও কৃষ্ণভক্ত, রামভক্ত কিংবা শিবভক্তদের মধ্যে পৃথক কোন অর্থ বহন করতে পারে? বিশেষত যেখানে রাম, কৃষ্ণ কিংবা শিবকে আমরা আপন আপন দোষ, ত্রুটি, আপন আপন মাহাত্ম্য এবং সৌন্দর্যে কল্পনা করেছি। শিব আমাদের গৃহস্থ সংসারের প্রতিরূপ, রাম আমাদের ন্যায়-নীতির প্রতিশব্দ, কৃষ্ণ আমাদের হৃদয়বৃত্তির উদগ্র দ্বন্দ্ব। আমরা এঁদের অনুসরণ করিনি আমরাই এঁদের ভেঙেছি আর গড়েছি— ঠিক মাটির ঢেলাটির মতই। কখনও এক গড়তে অন্য গড়েছি, কখনও শিব গড়তে বাঁদরও।
সূত্র
এই অধ্যায়ের সূত্রগুলি প্রধানত সুভাষিতরত্নভাণ্ডাগার, মহাসুভাষিত সংগ্রহ, ক্ষেমেন্দ্র-লঘুকাব্যসংগ্রহ, গাথাসপ্তশতী এবং আর্যাসপ্তশতী থেকে সংগৃহীত।
গ্রন্থপঞ্জী
‘অভিধর্মকোশ’, বসুন্ধুবিরচিত, দ্বারিকাদাস শাস্ত্রী সম্পাদিত। বারাণসী : বৌদ্ধভারতী, ১৯৭১।
‘উদ্ভটসাগর’, পূর্ণচন্দ্র কবিভূষণ বিরচিত। কলিকাতা : গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, ১৯১৭।
‘ঋগ্বেদসংহিতা’, কলিকাতা ; হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৬। দুই খণ্ড।
‘ঋগ্বেদসংহিতা’, হোসিয়ারপুর : বিশ্বেশ্বরানন্দ বৈদিক শোধ সংস্থানম্, ২০০২ বিক্রম সংবৎ।
‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’, বাসুদেবশর্মা সম্পাদিত। বম্বে ; নির্ণয় সাগর প্রেস, ১৯২৫।
‘কাব্যপ্রকাশ’, মন্মটাচার্য বিরচিত, ভট্টভীমাচার্য ঝালকিকর কৃত বালবোধিনী টীকাসহ, রঘুনাথ দামোদর কারমারকর সম্পাদিত। পুণা, ১৯৬৫।
‘কূর্মপুরাণ’, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত। কলিকাতা : নবভারত পাবলিশার্স, ১৩৯৫ সন।
‘ক্ষেমেন্দ্র-লঘুকাব্যসংগ্রহ’, ভি.ভি, রাঘবাচার্য ও ডি.জি. পাধ্যে সম্পাদিত। হায়দ্রাবাদ : ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬১।
‘গাথাসপ্তশতী’, হালবিরচিত, রাধাগোবিন্দ বসাক সম্পাদিত। কলিকাতা : এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯৭১।
‘গীতগোবিন্দ’, জয়দেব রচিত, প্রবোধানন্দ সরস্বতীর টীকাসহ হরিদাস দাস সম্পাদিত। নবদ্বীপ : গৌরাব্দ ৪৭০।
‘চৈতন্যচরিতামৃত’, কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত, তীর্থ মহারাজ সম্পাদিত। মায়াপুর চৈতন্যমঠ, গৌরাব্দ ৪৭০।
‘চৈতন্যচরিতামৃত’, কৃষ্ণদাস করিরাজ বিরচিত, রাধাগোবিন্দ নাথ সম্পাদিত। কলিকাতা : সাধনা প্রকাশনী, ১৩৭০ সন।
‘চৈতন্য ভাগবত’, বৃন্দাবন দাস রচিত, রাধাগোবিন্দ নাথ সম্পাদিত। কলিকাতা : সাধনা প্রকাশনী, ১৯৬৭।
‘দেবী-ভাগবত’, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত। কলিকাতা : বঙ্গবাসী।
‘ধ্বন্যালোক’, আনন্দবর্ধন রচিত, জগন্নাথ পাঠক সম্পাদিত। বারণসী : চৌখাম্বা বিদ্যাভবন, ১৯৬৫।
‘নিরুক্ত’, যাস্কবিরচিত, মুকুন্দ ঝা বক্শী সম্পাদিত। বম্বে : নির্ণয়সাগর প্রেস, ১৯৩০।
‘ন্যায়-কুসুমাঞ্জলি’, উদয়ন রচিত, মহাপ্রভুলাল গোস্বামী সম্পাদিত। দারভাঙ্গা : মিথিলা রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ১৯৭২।
‘পদ্মপুরাণ’, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত। কলিকাতা, নবভারত, ১৩৯৭ সন।
‘পদ্যাবলী’, রূপগোস্বামী রচিত, সুশীল কুমার দে সম্পাদিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৪ ।
‘পুরাণপ্রবেশ’, গিরীন্দ্রশেখর বসু রচিত। কলিকাতা : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৫৮ সন।
‘বঙ্গে নব্যন্যায়-চচা’, দীনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত। কলিকাতা : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৫৮ সন।
‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ’, দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ সম্পাদিত। কলিকাতা : ১৩৪০ সন।
‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত। কলিকাতা : ১৯৮৫। চতুর্থ খণ্ড।
‘বায়ু পুরাণ’, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত। কলিকাতা : নবভারত, ১৩৯৭ সন।
‘বিদগ্ধমাধব’, রূপ গোস্বামী রচিত, রামনারায়ণ তর্করত্ন কর্তৃক অনূদিত। বহরমপুর ১২৮৮ সন।
‘বেদান্ত দর্শন’, দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ সম্পাদিত। কলিকাতা : ১৩৭৬ সন।
‘বেদের পরিচয়’, যোগিরাজ বসু রচিত। কলিকাতা : ফার্মা কে. এল, এম, ১৯৮০।
‘ভক্তিগীতি’, ভক্তিকুমুদ গোস্বামী সম্পাদিত। খড়গ্পুর : গৌরাঙ্গ প্রেস, ১৩৯৪ সন।
‘ভগবদ্গীতা’, বাসুদেব লক্ষ্মণ শাস্ত্রী সম্পাদিত। দিল্লী : ইণ্ডোলজিক্যাল বুক হাউস, ১৯৮৪ ।
‘ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী’, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত। কলিকাতা : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬৯ সন।
‘ভাষা পরিচ্ছেদ’, বিশ্বনাথ ন্যায় পঞ্চানন রচিত, পঞ্চানন ভট্টাচার্য সম্পাদিত। কলিকাতা :১৩৭৭ সন।
‘ভাস-নাটকচক্র’, সি. আর. দেওধর সম্পাদিত। দিল্লী : মোতিলাল বনারসী দাস, ১৯৮৭।
‘মৎস্যপুরাণ’, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত। কলিকাতা : নব ভারত, ১৩৯৫।
‘মনুসংহিতা’, কলিকাতা : আর্যশাস্ত্র, ১৩৬৯ সন।
‘মহাভারত’, হরিদাস সিদ্ধাঙবাগীশ অনূদিত। কলিকাতা : বিশ্ববাণী প্রকাশনী, ১৩৮৩-১৪০১ সন।
‘মহাসুভাষিত-সংগ্রহ’, এল্ স্টার্নর্বাক্ সম্পাদিত। দিল্লী : মোতিলাল বনারসী দাস, ১৯৭৪।
‘মাধুর্য কাদম্বিনী’, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী রচিত, ভক্তিশাস্ত্রী ঠাকুর সম্পাদিত। মেদিনীপুর : ১৩৬৩ সন।
‘মীমাংসা দর্শন’, শবরভাষ্য সহ। বম্বে : আনন্দাশ্রম, ১৩৮৪।
‘মীমাংসাদর্শন’, ভূতনাথ সপ্ততীর্থ সম্পাদিত। কলিকাতা : বসুমতী, ১৩৪৫ সন।
‘যুক্তিদীপিকা’, পুলিনবিহারী চক্রবর্তী সম্পাদিত। কলিকাতা : ১৯৩৮।
‘রামায়ণ’, বাল্মীকি রচিত। বম্বে : নির্ণয় সাগর প্রেস, ১৯০৫।
‘রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র’, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত। কলিকাতা : গ্রন্থমালা, ১৩৮৩ সন।
‘শতপথব্রাহ্মণ’, দিল্লী : নাগ প্রকাশক, ১৯৯০।
‘শ্রীমদ্ভাগবত’, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত। কলিকাতা : বঙ্গবাসী, ১৩০৯ সন।
‘সাহিত্যদর্পণ’, বিশ্বনাথ কবিরাজ রচিত, হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ সম্পাদিত। নকীপুর : হরিপুর হরিচরণ চতুষ্পঠী, ১৩৩৫ সন।
‘সুভাষিত রত্নভাণ্ডাগার’, কাশীনাথ পাণ্ডুরঙ্গ পরব সংকলিত। বম্বে : ১৯৩৫।
‘হরিবংশ’, পি. এ. বৈদ্য সম্পাদিত। পুণে : ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ১৯৬৯।
‘হরিবংশ’, শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ সম্পাদিত, আর্যশাস্ত্র
‘হিন্দুদের দেবীদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’, হংস নারায়ণ ভট্টাচার্য রচিত। কলিকাতা ফার্মা, কে. এল্. এম্., ১৯৮২।
Aspects du mythe de Krsnagopala dans L’Inde Anicente, by Charlotte Vaudeville. In Melanges d’ Indianisme a la memoire de Lous Renou. Paris: 1968.
Aspects of early Visnuism, by J. Gonda. Delhi: Motilal Banarsidass, 1966.
Brahman, by P. Thieme. In ZDMG, Vol II Wiesbaden: 1952.
A History of Philosophy, Vol. I pt. I, by Frederick Copleston. New york: Image Books, 1960.
Indian Theogony, Sukumari Bhattacharji, Firma K.L.M. Calcutta, 1978.
Mysteries, ERANOs, Princeton, 1971.
The Pre-Socratic Philosophers, by G. S. Kirk and J.E. Raven. Cambridge University Press, 1957.