সাতাশ
চণ্ডীগড় হইতে নির্মল অনেক দুঃখ পাইয়াই গিয়াছিল। ইহার ভাল এবং সকল সংস্রব হইতে নিজেকে সে চিরকালের মত বিযুক্ত করিয়া যাইতেছে, যাইবার সময়ে ইহাই ছিল তাহার একান্ত অভিলাষ। ভগবানের কাছে কায়মনে প্রার্থনা করিয়াছিল, যাহা গত হইয়াছে তাহা আর যেন না ফিরিয়া আসে, ইহার কোন সংযোগসূত্রই আর যেন না জীবনে তাহার কোথাও অবশিষ্ট রহিয়া যায়। সে সোজা মানুষ। বিলাস ও সাহেবিয়ানার মধ্যে দিয়াও সে সংসারের সোজা পথটি ধরিয়াই চলিতে চাহিত। হৈমই ছিল তাহার একমাত্র—তাহার গৃহিণী, তাহার প্রিয়তমা, তাহার সন্তানের জননী—সৌন্দর্যে, স্নেহে, নিষ্ঠায়, বুদ্ধিতে ইহার বড় যে কোন মানুষই কোনদিন কামনা করিতে পারে তাহা সে ভাবিতেও পারিত না, অথচ এতবড় সম্পদ তুচ্ছ করিয়াও যে মন তাহার একদিন উদ্ভ্রান্ত হইতে চাহিয়াছিল, ফিরিয়া আসা পর্যন্ত এই বিড়ম্বনা যখনই মনে হইত তখনই দুইটা কথা তাহাকে অত্যন্ত বিচলিত করিত। প্রথম এই যে, এই দুর্মতির ইতিহাস তাহাকে হৈমর কাছ হইতে চিরদিন গোপন করিয়া রাখিতে হইবে; এবং দ্বিতীয়, ষোড়শীর চরিত্র। ইহার সম্বন্ধে বস্তুতঃ কিছুই সে জানে না, তবুও যে কেন একদিন মন তাহার আসক্ত হইয়াছিল, নিজের চিত্তকে এই প্রশ্নই বারংবার করিয়া কেবল একটা উত্তরই নির্মল নিঃসংশয়ে পাইতেছিল, ষোড়শী চরিত্রহীনা। অসম্ভব বস্তুতে মন তাহার প্রলুব্ধ হয় নাই, হইতেই পারে না। সে পাওয়ার বাহিরে নয়, ইহা বুঝিয়াছিল বলিয়াই মন তাহার অমন করিয়া উন্মুখ হইয়া উঠিয়াছিল। এই কথা স্মরণ করিয়া সে একপ্রকার সান্ত্বনা লাভ করিত, এবং মনে মনে বলিত, ও-পথে আর কখনও নয়। হৈমর বাপের বাড়ি, ইচ্ছা হয় সে যাক, কিন্তু নিজে সে চণ্ডীগড়ের নাম কখনও মুখে আনিবে না।
সেদিন আদালত হইতে ফিরিয়া হৈমর কাছে শুনিল মায়ের চিঠি আসিয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন, রাত্রে লুকাইয়া ষোড়শী কোথায় যে চলিয়া গেছে কেহই জানে না।
নির্মল পরিহাসের চেষ্টায় জোর করিয়া একটু হাসিয়া বলিল, কেউ জানে না কোথায় গেছে? সাগর সর্দারও না, এমনকি জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী পর্যন্ত না?
হৈম রাগ করিয়া কহিল, তোমার এক কথা। সাগর জানলেও জানতে পারে, কিন্তু জমিদার জানবে কি করে? মেয়েদের নামে একটা দুর্নাম দিতে পারলে যেন তোমরা বাঁচো!
তা বটে। বলিয়া নির্মল বাহিরে যাইতেছিল, হৈম ডাকিয়া কহিল, আরও একটা কাণ্ড হয়েচে। সেই রাত্রে জমিদারের শান্তিকুঞ্জ কে একদম পুড়িয়ে দিয়েছে।
বল কি!
হাঁ। লোকের সন্দেহ, রাগ করে সাগর পুড়িয়েছে। কিন্তু জমিদারের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যে মিথ্যে দুর্নামটা তাঁর গ্রামের সকলে মিলে দিলে, তা সত্যি হলে কি কখনো জমিদারেরই বাড়ি পুড়ত? তুমিই বল?
নির্মল চুপ করিয়া রহিল। হৈম কহিল, যে যাই কেন না বলুক, আমি কিন্তু নিশ্চয় জানি তিনি নির্দোষী। চণ্ডীর এমন ভৈরবী আর কখনো ছিল না। তাঁর দয়াতেই ছেলের মুখ দেখতে পেয়েচ, তা জানো?
এ কথারও নির্মল কোন উত্তর দিল না। সকল ঘটনা জানিতে, চিঠি লিখিয়া সকল সংবাদ সবিস্তারে আহরণ করিতে তাহার কৌতূহলের সীমা ছিল না, কিন্তু এ ইচ্ছাকে সে দমন করিয়া বাহির হইয়া গেল। ষোড়শীর সকল সম্পর্ক হইতে আপনাকে সে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিবেই, এই ছিল তাহার পণ। কিন্তু পরদিন সকাল না হইতেই যখন শ্বশুরের জরুরি তার আসিয়া পড়িল এবং সন্ধ্যার মেলে শাশুড়ীর চিঠি আসিল, পত্র পাওয়ামাত্র জামাই না আসিয়া পৌঁছিলে তাহার বৃদ্ধ শ্বশুরকে এ যাত্রা কেহই রক্ষা করিতে পারিবে না, জেল তাঁহাকে খাটিতেই হইবে, তখন হৈম কাঁদিতে লাগিল, এবং নির্মলকে আর একবার তোরঙ্গ ও বিছানাপত্র বাঁধিবার হুকুম দিয়া তাহার কাজের বন্দোবস্ত করিতে বাটী হইতে বাহির হইতে হইল।
দিন-দুই পরে হৈমকে সঙ্গে করিয়া নির্মল চণ্ডীগড়ে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, একটা ভয়ের মধ্যে সকলের দিন কাটিতেছে। কে যে কখন আগুন ধরাইয়া দিবে তাহার ঠিক নাই। চারিদিকে লোক নিযুক্ত হইয়াছে, কর্তা শুকাইয়া যেন অর্ধেক হইয়া গেছেন, কোথাও বাহির হন না—এতবড় প্রতাপান্বিত ব্যক্তির নিজের গ্রামের মধ্যেই এতবড় দুর্গতি দেখিয়া নির্মল বিস্মিত হইল। এখান হইতে বেশী দিন সে যায় নাই, কিন্তু কি পরিবর্তন! খবর যাহা পাইল তাহা অত্যন্ত উলটা-পালটা রকমের, বিশেষ কিছু বুঝা গেল না; কেবল একটা সংবাদে সকলেরই মিল হইল যে, জমিদার জীবানন্দ চৌধুরীর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। সে মদ ছাড়িয়াছে, প্রজাদের দিয়া নিজের বিরুদ্ধে নালিশ করাইয়া দিয়াছে, যে টাকায় পোড়া বাড়ি মেরামত করা উচিত ছিল, তাই দিয়া মাঠের সাঁকো তৈরি করাইতেছে—এমনি কত কি গল্প, কিন্তু হঠাৎ কিসের জন্য সে এরূপ হইল, তাহা কেহই জানে না। এই লোকটিকে নির্মল অতিশয় ঘৃণা করিত; ইহারই কাছে দরবার করিতে যাইতে হইবে মনে করিয়া সে অতিশয় সঙ্কুচিত হইল। অথচ ব্যাপার যাহা দাঁড়াইয়াছে তাহাতে আর যে কি পথ আছে তাহাও চোখে পড়িল না। ভূমিজ প্রজারা অত্যন্ত বিরুদ্ধে! একে ত তাহাদের সর্বনাশ হইয়াছে, এবং তাহা সম্পাদন করিতে কোন চেষ্টারই ত্রুটি হয় নাই, তাহাতে তাহাদের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষিণী ভৈরবী মাতার প্রতি যে অত্যাচার হইয়াছে, তাহাতে ক্রোধের তাহাদের সীমা নাই। তাহারা কোন কথা শুনিবে না।
এদিকে মাদ্রাজী সাহেবের বিস্তর ক্ষতি, তাঁহার কল-কব্জা আসিয়া পড়িয়াছে, সে ক্ষতিপূরণ করা একপ্রকার অসাধ্য ব্যাপার। জমির দখল তাঁহারই চাই-ই। বিশেষতঃ নিজে অনুপস্থিত থাকিয়া যে এটর্নির দ্বারা তিনি কাজ চালাইতেছেন তিনি যেমন রুক্ষ, তেমনি অভদ্র, তাঁহার কাছে কোন সুবিধারই আশা নাই। একমাত্র ভরসা নিজেদের মধ্যে এক হওয়া; যেহেতু, আর যাহাই হোক, পিনাল কোডের সেই দুরন্ত ধারাগুলোয় তাহাতে বাঁচিবার সম্ভাবনা। নিজেদের মধ্যে কবুল জবাব দিলে আর কোন রাস্তা নাই, অথচ সেই পাগল লোকটা শাসাইয়া রাখিয়াছে হাকিমের কাছে সে কোন কথাই লুকাইবে না। এই কথা নির্মল হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিত, কিন্তু আসিয়া অবধি সে যে-সকল গল্প শুনিল, বিশেষ করিয়া সেই মদ ছাড়ার কাহিনী—হার্টফেলের ভয় দেখাইয়াও ডাক্তারে যাহাকে এক ফোঁটা গিলাইতে পারে নাই, সেই ভীষণ একগুঁয়ে লোকটার মাথায় হঠাৎ কি খেয়াল চাপিয়াছে, কে তাহার কৈফিয়ত দিবে? অথচ, সে আসিয়াছে এই দুর্মদ একান্ত অবোধ ব্যক্তিকে সুবুদ্ধি দিতে। তাহাকে বুঝাইতে হইবে, ভয় দেখাইতে হইবে, অনুনয়-বিনয় করিতে হইবে—কি যে করিতে হইবে সে কিছুই জানে না। এই অত্যন্ত অপ্রীতিকর কার্য হইতে নির্মলের সমস্ত চিত্ত যেন বিদ্রোহ করিতে লাগিল, কিন্তু উপায় কি? দুষ্কৃতকারী যে হৈমর পিতা। তাঁহাকে যে বাঁচাইতেই হইবে। হৈম কাঁদিতে লাগিল, শাশুড়ী কাঁদিতে লাগিলেন, এককড়ি চোরের মত আনাগোনা করিতে লাগিল, শ্বশুর না খাইয়া শয্যা গ্রহণ করিলেন—অথচ মাঝে কেবল একটি দিন বাকী, পরশু দিন আসিবেন হাকিম তদন্ত করিতে।
অপরাহ্ণের কাছাকাছি জীবানন্দের সহিত দেখা হইল তাহার মাঠের মাঝখানে। এতকাল জল-নিকাশের পথ ছিল না, তাই সাঁকো তৈরি হইতেছিল। প্রশান্ত হাস্যে দুই হাত বাড়াইয়া আসিয়া জীবানন্দ তাহাকে গ্রহণ করিয়া কহিল, আপনার আসার খবর আমি কালই পেয়েছি। ভাল আছেন আপনি? বাড়ির সব ভাল? তাহার কথায় আচরণে গরিমা নাই, কৃত্রিমতা নাই—যেমন সহজ, তেমনি খোলা—তাহাকে সন্দেহ করিবার অবকাশ নাই। এতখানির জন্য নির্মল প্রস্তুত ছিল না; তাহার আপনাকে আপনি যেন ছোট মনে হইল। মাথা যদি ইঁহার খারাপ হইয়াও থাকে ত লজ্জা পাইবার নয়। জীবানন্দের কুশল প্রশ্নের উত্তর নির্মল শুধু মাথা নাড়িয়াই দিল এবং প্রতি প্রশ্ন করিবার কথা হঠাৎ তাহার মনে হইল না।
জীবানন্দ কহিল, আপনি কুটুম্ব মানুষ, সমস্ত গ্রামের আদরের বস্তু, কিন্তু ইচ্ছে করে এমন জায়গায় এসে দেখা করলেন যে—সহসা মিস্ত্রী ও মজুরদের প্রতি দৃষ্টি পড়ায় কহিল, বাবারা, আজ আমাদের একটু রাত্রি পর্যন্ত খাটতে হবে। সপ্তাহ ধরে মেঘ করচে, আজকালের মধ্যেই হয়ত জল হবে।
কিন্তু তা হলে ত কোনমতেই চলবে না। আমরা এমন কাজ করে যাবো যে, আমাদের নাতি-পুতিদের পর্যন্ত ঘাড় নেড়ে বলতে হবে যে, হাঁ, সাঁকো করেছিল তারা, সত্যিকারের দরদ দিয়েই করেছিল। সেই ত আমাদের মেহন্নতয়ানা!
লোকগুলা গলিয়া গেল। বীজগাঁয়ের ভয়ঙ্কর জমিদার একসঙ্গে খাটিতেছেন, তাঁহার মুখের এই কথা; তাহারা সমস্বরে প্রতিজ্ঞা করিয়া জানাইল যে, তাহাদেরও সেই ইচ্ছা। জ্যোৎস্না যদি না মেঘে ঢাকে ত তাহারা রাত্রি দশটা পর্যন্ত কাজ করিবে।
নির্মল কহিল, আপনার সঙ্গে আমার একটু কাজ আছে।
জীবানন্দ বলিল, আর একদিন হলে হয় না?
না, আমার বিশেষ প্রয়োজন।
জীবানন্দ হাসিল; কহিল, তা বটে। অকাজের বোঝা বহাতে যাঁরা এতদূর টেনে এনেছেন, তাঁরা কি আপনাকে সহজে ছেড়ে দেবেন!
খোঁচাটা নির্মলের গায়ে বাজিল। সে কহিল, সে ত ঠিক কথা। অকাজ মানুষ করে বলেই ত সংসারে আমাদের প্রয়োজন চৌধুরীমশায়। না হলে আপনাকেই বা এই মাঠের মাঝখানে বিরক্ত করবার আমার প্রয়োজন হত কেন?
জীবানন্দ কিছুমাত্র রাগ করিল না, তেমনি প্রসন্নমুখে বলিল, আমি কিছুমাত্র বিরক্ত হইনি নির্মলবাবু। যে জন্যে আপনি এসেছেন, সে যে আপনার কর্তব্য, এ বিষয়েও আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, না হলে আপনিই বা আসবেন কেন? কিন্তু কর্তব্যের ধারণা ত সকলের এক নয়। রায়মহাশয়ের আমি অকল্যাণ কামনা করিনে; আপনার আসার উদ্দেশ্য সফল হলে আমি বাস্তবিক খুশী হবো, কিন্তু আমার কর্তব্যও আমি ঠিক করে ফেলেচি। এ থেকে নড়চড় করা আর সম্ভব হবে না।
নির্মলের মুখ ম্লান হইল। সে একটু ভাবিয়া কহিল, দেখুন, ভালই হলো যে অপ্রিয় আলোচনার ভূমিকার অংশটা আপনি দয়া করে আমাকে উত্তীর্ণ করে দিয়ে গেলেন। এসে অবধি আপনার সম্বন্ধে আমি অনেক কথাই শুনেচি—
জীবানন্দ সহাস্যে বলিল, একটা এই যে আমার মাথার ঠিক নেই, সত্য কিনা বলুন?
নির্মল কহিল, সংসারে সাধারণ মানুষের বিচার-বুদ্ধির সঙ্গে অকস্মাৎ কারও কর্তব্যের ধারণা যদি অত্যন্ত প্রভেদ হয়ে যায় ত দুর্নাম একটা রটেই। এ কথা কি সত্য যে আপনি সমস্তই স্বীকার করবেন?
জীবানন্দ কহিল, সত্য বৈ কি। তাহার কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য নাই, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা, তথাপি নির্মল নিঃসংশয়ে বুঝিল ইহা ফাঁকি নয়। বলিল, এমন ত হতে পারে আপনার কবুল-জবাবে আপনিই শাস্তি পাবেন, কিন্তু আর সকলে বেঁচে যাবেন।
জীবানন্দ কহিল, নির্মলবাবু, আপনার কথাটা হলো ঠিক সেই পাঠশালার গোবিন্দের মত। পণ্ডিতমশাই! মুকুন্দও যে আম চুরি করছিল! অর্থাৎ, বেতটা চারিয়ে না পড়লে তার পিঠের জ্বালা কমবে না। এই বলিয়া সে হাসিতে লাগিল। তাহার সকৌতুক হাসির ছটায় নির্মলের মুখ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল দেখিয়া সে জোর করিয়া তাহা নিবারণ করিয়া কহিল, রক্ষে করুন আপনি, এ আমি স্বপ্নেও চাইনে। আমার কৃতকর্মের ফল আমি ভোগ করলেই যথেষ্ট। নইলে, রায়মশাই নিস্তার লাভ করে সুস্থদেহে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতে থাকুন, এবং আমার এককড়ি নন্দীমশাইও আর কোথাও গোমস্তাগিরি কর্মে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকুন, কারও প্রতি আমার কোন আক্রোশ নেই।
নির্মল আইন ব্যবসায়ী, সহজে হাল ছাড়িবার পাত্র নয়, কহিল, এমন ত হতে পারে কারও কোন শাস্তিভোগ করারই আবশ্যক হবে না, অথচ ক্ষতিও কাউকে স্বীকার করতে হবে না।
জীবানন্দ তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, বেশ ত, পারেন ভালই। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা করে দেখেচি সে হবার নয়। কৃষকেরা তাদের জমি ছাড়বে না। কারণ এ শুধু তাদের অন্ন-বস্ত্রের কথা নয়। তাদের সাত-পুরুষের চাষ-আবাদের মাঠ, এর সঙ্গে তাদের নাড়ীর সম্পর্ক। এ তাদের দিতেই হবে। একটু চুপ করিয়া কহিল, আপনি ভালই জানেন অন্য পক্ষ অত্যন্ত প্রবল, তার উপর জোর-জুলুম চলবে না। চলতে পারে কেবল চাষাদের উপর কিন্তু চিরদিন তাদের প্রতিই অত্যাচার হয়ে আসচে, আর হতে আমি দেব না।
নির্মল মনে মনে প্রমাদ গণিয়া কহিল, আপনার বিস্তীর্ণ জমিদারি, এই ক’টা চাষার কি আর তাতে স্থান হবে না? কোথাও না কোথাও—
না না, আর কোথাও না—এই চণ্ডীগড়ে। এইখানে আমি জোর করে তাদের কাছে ছ হাজার টাকা আদায় করেচি—আর সে টাকা যুগিয়েছেন জনার্দন রায়—সে শোধ করতেই হবে। কিন্তু অপ্রীতিকর আলোচনায় আর কাজ নেই নির্মলবাবু, আমি মনঃস্থির করেচি।
এই ছ হাজার টাকার ইঙ্গিত নির্মল বুঝিল না, কিন্তু এটা বুঝিল যে তাহার শ্বশুরমহাশয় অনেক পাকে আপনাকে জড়াইয়াছেন যাহা মুক্ত করা সহজ নয়। সে শেষ চেষ্টা করিয়া কহিল, আত্মরক্ষায় সকলেরই ত অধিকার আছে, অতএব শ্বশুরমশায়কেও করতে হবে। আপনি নিজে জমিদার, আপনার কাছে মামলা-মকদ্দমার বিবরণ দিতে যাওয়া বাহুল্য—শেষ পর্যন্ত হয়ত বা বিষ দিয়েই বিষের চিকিৎসা করতে হবে।
জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, চিকিৎসক কি জাল করার বিষে খুন করার ব্যবস্থা দেবেন?
নির্মলের মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। কহিল, জানেন ত, অনেক সময় ওষুধের নাম করলে আর খাটে না! সে যাই হোক, আপনি জমিদার, ব্রাহ্মণ, বয়সে বড়, আপনাকে শক্ত কথা বলবার ইচ্ছে আমার নেই। কিংবা হঠাৎ কি কারণে আপনার ধর্ম-জ্ঞান এরূপ প্রচণ্ড হয়ে উঠল তাও জানবার কৌতূহল নেই, কিন্তু একটা কথা বলে যাই যে, এ জিনিস আপনার স্বাভাবিক নয়। গভর্নমেন্ট যদি প্রসিকিউট করে ত জেলের মধ্যে একদিন তা উপলব্ধি করবেন। আপনি সর্পকে রজ্জু বলে ভ্রম করচেন।
জীবানন্দ কহিল, এ কথা আপনার সত্য, কিন্তু ভ্রম যতক্ষণ আছে ততক্ষণ রজ্জুটাই ত আমার সত্য!
নির্মল বলিল, কিন্তু তাতে মরণ আটকাবে না। আরও একটা সত্য কথা আপনাকে বলে যাই। এইসব নোংরা কাজ করা আমার ব্যবসা নয়। আপনাকে আমি অতিশয় ঘৃণা করি, এবং এক পাপিষ্ঠের জন্য আর এক পাপিষ্ঠকে অনুরোধ করতে আমি লজ্জা বোধ করি; কিন্তু সে আপনি বুঝবেন না—সে সাধ্যই আপনার নেই।
জীবানন্দের মুখের উপর কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। লেশমাত্র উত্তেজনা নাই, তেমনি সৌম্য-শান্তকণ্ঠে কহিল, কিন্তু আপনাকে আমি ঘৃণা করিনে নির্মলবাবু, শ্রদ্ধা করি, এ বোঝবার সাধ্যও ত আপনার নেই!
তাহার নির্বিকার স্বচ্ছন্দতায় নির্মল জ্বলিতে লাগিল, এবং এই প্রত্যুত্তরকে কদর্য উপহাস কল্পনা করিয়া তিক্তকণ্ঠে বলিল, চোর-ডাকাতদের মধ্যেও বিশ্বাস বলে একটা বস্তু আছে, নিজেদের মধ্যে তারাও তা ভাঙ্গে না। বিশ্বাসঘাতককে তারা ঘৃণা করে। কিন্তু জীবনব্যাপী দুরাচারে বুদ্ধি যার বিকৃত, তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই—আমি চললাম। এই বলিয়া সে চক্ষের পলকে পিছন ফিরিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। জীবানন্দ চাহিয়া দেখিল অনেকেই হাতের কাজ বন্ধ করিয়া সবিস্ময়ে চাহিয়া আছে। সে ম্লানমুখে শুধু একটু হাসিয়া বলিল, সময় যেটুকু নষ্ট করলি বাবারা, সেটুকু কিন্তু পুষিয়ে দিস্। কথাটা নির্মলের কানে গেল।
দিন-চারেকের মধ্যেই কৃষককুলের চিরদিনের দুঃখ দূর করিয়া জল-নিকাশের সাঁকো তৈরি শেষ হইল, গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে ভিড় করিয়া লোক দেখিতে আসিল, কিন্তু যে ইহা নির্মাণ করিল, সেই জীবানন্দ শয্যাগত হইয়া পড়িল। এ পরিশ্রম সে সহ্য করিতে পারিল না। এই অজুহাতে এবং সাহেবের সহিত দেখা করিয়া নানা কৌশলে নির্মল তদন্তের দিন এক সপ্তাহ পিছাইয়া দিতে পারিয়াছিল, কিন্তু সে-দিনও সমাগতপ্রায়। কেবল দুটা দিন বাকী। বাঁচিবার একমাত্র পথ ছিল, এবং তাহাই অবলম্বন করিয়া জনার্দন তারাদাসকে দিয়া চণ্ডীমাতার বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করাইলেন, এবং নিজে মন্দিরের একান্তে বসিয়া সকাল-সন্ধ্যায় কায়মনে ডাকিতে লাগিলেন, মায়ের কৃপায় যেন এ যাত্রা জীবানন্দ আর না ওঠে। সাহেব সরজমিনে আসার পূর্বেই যেন কিছু একটা হইয়া যায়।
মেয়েকে লইয়া ষোড়শীর হাতে-পায়ে গিয়া পড়ার কথাও মনে হইয়াছিল, কারণ ছোটলোকদের যদি কেহ ঠেকাইতে পারে ত কেবল সে-ই পারে, কিন্তু কোথায় সে? সাতদিনের সময় পাইয়া হৈমর নিশ্চিত ভরসা হইয়াছিল ছেলেকে সঙ্গে করিয়া গিয়া একবার কাঁদিয়া পড়িতে পারিলে সে কিছুতেই না বলিতে পারিবে না; কিন্তু সে আশা যে বৃথা হইতে বসিল।
এই কয়দিন প্রায় প্রত্যহই নির্মলকে সদরে যাইতে হইতেছিল। এই যে বিশ্রী মামলাটা বাধিবে, তাহার সকল ছিদ্রপথই যে আগে হইতে বন্ধ করা আবশ্যক। সেদিন দুপুরবেলায় সে রেজেস্ট্রী আপিসের বারান্দার একধারে একখানা বেঞ্চের উপর বসিয়া কতকগুলা প্রয়োজনীয় দলিলপত্রের নকল লইয়া নিবিষ্টচিত্তে পড়িতেছিল, হঠাৎ সুমুখেই ডাক শুনিল, জামাইবাবু, সেলাম। ভাল আছেন?
নির্মল চমকিয়া মুখ তুলিয়া দেখিল, ফকিরসাহেব। তাঁহারও হাতে একতাড়া কাগজ।
তাড়াতাড়ি উঠিয়া অভিবাদন করিয়া তাঁহার দুই হাত ধরিয়া পাশে বসাইয়া কহিল, শুনেছিলাম আপনাকে ডাকলেই আপনার দেখা মেলে। এ-কয়দিন মনে মনে আমি প্রাণপণে ডাকছিলাম।
ফকির হাসিলেন, কহিলেন, কেন বলুন ত?
ষোড়শীকে আমার বড় প্রয়োজন। তিনি কোথায় আছেন আমাকে দেখা করতেই হবে।
ফকির বিস্মিত হইলেন না, আনন্দও প্রকাশ করিলেন না, বলিলেন, দেখা না হওয়াই ত ভাল।
নির্মল অত্যন্ত লজ্জিত হইল। কহিল, আপনি হয়ত সর্বজ্ঞ। তা যদি হয়, জানেন ত আমাদের কত বড় প্রয়োজন?
ফকির কহিলেন, না, আমি সর্বজ্ঞ নয়, কিন্তু মা ষোড়শী কোন কথাই আমাকে গোপন করেন না। একটু থামিয়া বলিলেন, দেখা হওয়া না-হওয়ার কথা তিনিই জানেন, আমি জানিনে, কিন্তু তাঁর সমস্ত ব্যাপার আপনাকে জানাতে আমার বাধা নেই। কারণ, একদিন যখন সবাই তাঁর সর্বনাশে উদ্যত হয়েছিল, তখন আপনিই একাকী তাঁকে রক্ষা করতে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি তাঁর মুখেই এ কথা শুনেচি।
নির্মল কহিল, আর আজ ঠিক সেইটি উলটে দাঁড়িয়েচে ফকিরসাহেব। এখন কেউ যদি তাঁদের বাঁচাতে পারে ত তিনিই পারেন।
ফকিরের মুখ অপ্রসন্ন হইল। ইহার বিস্তৃত বিবরণের জন্য তিনি কৌতূহল প্রকাশ না করিয়া কেবল কহিলেন, চণ্ডীগড়ের খবর আমি জানিনে। কিন্তু আমি বলি, তাঁর ভাল করার ভার ভগবানের উপর আপনি ছেড়ে দিন। আমার মাকে আর এর মধ্যে জড়াবেন না নির্মলবাবু।
বিগত দিনের সমস্ত দুঃখের ইতিহাস নির্মলের মনে পড়িল। ইহার জবাব দেওয়া কঠিন, সে শুধু কুণ্ঠার সহিত প্রশ্ন করিল, এখন তিনি কোথায় আছেন?
জায়গাটাকে শৈবাল-দীঘি বলে।
সেখানে সুখে আছেন?
এইবার ফকির মৃদু হাসিয়া কহিলেন, এই নিন! মেয়েমানুষের সুখে থাকার খবর দেবতারা জানেন না। আমি ত আবার সন্ন্যাসী মানুষ। তবে মা আমার শান্তিতে আছেন এইটুকুই অনুমান করতে পারি।
নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আদালতে আপনি কোথায় এসেছিলেন?
ফকির কহিলেন, তা বটে! সন্ন্যাসী ফকিরের এ স্থান নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু সংসারের মোহ ত মানুষকে সহজে ছাড়ে না বাবা, তাই শেষ বয়সে আবার বিষয়ী হয়ে উঠেচি। ভাল কথা, বিনা পয়সায় আপনার মত আইনজ্ঞ ব্যক্তিও আর পাব না, এবং আপনাকেই কেবল বলা যায়। আমার এই কাগজগুলি যদি দয়া করে একবার দেখে দেন।
নির্মল হাত বাড়াইয়া কহিল, এ কিসের কাগজ?
একটা দান-পত্রের খসড়া। বলিয়া ফকির তাঁহার কাগজের বাণ্ডিল নির্মলের হাতে তুলিয়া দিলেন। পরের কাজ করিবার মত সময় ও প্রবৃত্তি নির্মলের ছিল না; সে নিস্পৃহের মত তাহা গ্রহণ করিল, এবং ধীরে ধীরে তাহার পাক খুলিয়া পাঠে নিযুক্ত হইল। কিন্তু কয়েক ছত্র পরেই অকস্মাৎ তাহার চোখের দৃষ্টি তীব্র, মুখ গম্ভীর এবং কপাল কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। এই দানের সম্পত্তি অকিঞ্চিৎকর নয়, কয়েক পৃষ্ঠা ব্যাপিয়া তাহার বিবরণ, সেইগুলির উপর কোনমতে চোখ বুলাইয়া লইয়া অবশেষে শেষ পাতায় আসিয়া যখন তাহার জীবানন্দের সেই চিঠিখানার প্রতি দৃষ্টি পড়িল, তখন লাইন-কয়েকের সেই লিখনটুকু এক নিশ্বাসে পড়িয়া ফেলিয়া নির্মল স্তব্ধ হইয়া রহিল।
ফকির তার মুখের ভাব লক্ষ্য করিতেছিলেন, বলিলেন, সংসারে কত বিস্ময়ই না আছে!
নির্মলের মুখ দিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস বাহির হইয়া আসিল, সে ঘাড় নাড়িয়া শুধু কহিল, হাঁ।
ফকির কহিল, খসড়াটা ঠিক ত?
নির্মল কহিল, ঠিক। কিন্তু এ যে সত্য তার প্রমাণ কি?
ফকির বলিলেন, নইলে এ দান ষোড়শী নিতেন না। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হবে নির্মলবাবু? এই বলিয়া তিনি উৎসুকনেত্রে চাহিয়া রহিলেন, কিন্তু জবাব পাইলেন না। নির্মলের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা এবং কপাল কুঞ্চিত হইয়াই রহিল, মন যে তাহার কোথায় গিয়াছিল ফকির বোধ করি তাহা অনুমান করিতেও পারিলেন না।