একুশ
শ্বশুর-জামাতা একত্রে আহারে বসিয়াছিলেন। শাশুড়ীঠাকুরানী দধি ও মিষ্টান্ন আনিতে স্থানান্তরে গেলে রায়মহাশয় কহিলেন, ষোড়শীর সঙ্গে তোমার দেখা হলো নির্মল?
নির্মল মুখ না তুলিয়াই কহিল, আজ্ঞে হাঁ।
কি বলে সে?
এরূপ একটা সাধারণ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। সে ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিসের সম্বন্ধে?
মন্দিরের সম্বন্ধে। বেটী ভৈরবীগিরি ছাড়বে, না চণ্ডীগড়ের নাম পর্যন্ত ডোবাবে? দেশের লোক ত আর বাইরের দশজনের কাছে মুখ দেখাতে পারে না এমনি হয়ে উঠেছে।
নির্মল চুপ করিয়া রহিল। চণ্ডীগড়ের ভৈরবীদিগের বিরুদ্ধে এ অপবাদ আবহমানকাল প্রচলিত আছে, এবং সেজন্যে গ্রামের কেহ কোনদিন লজ্জায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে বলিয়া প্রবাদ নাই। স্বয়ং চণ্ডীমাতাও কখনো আপত্তি করিয়াছেন বলিয়া লোকে জানে না। ইহাদের রীতিনীতি, আচার-অনাচার সমস্তই সে শুনিয়া গিয়াছিল বলিয়া এ সম্বন্ধে মন তাহার নিরপেক্ষভাবেই ছিল। বিশেষতঃ ষোড়শীর অপবাদ সে বিশ্বাস করে নাই, সুতরাং ইহা মিথ্যা প্রমাণিত হইলেই সে খুশী হইত; কিন্তু এই প্রমাণকেই তাহার ভৈরবী-পদের একমাত্র দাবী বলিয়া সে একদিনও গ্রাহ্য করে নাই। তাহার শ্বশুরের ইঙ্গিত নূতনও নয়, ভীষণও নয়, অথচ এই কয়টা কথাতেই অকস্মাৎ আজ তাহার মন যখন চমকিয়া সজাগ হইয়া উঠিল, তখন নিজের মনের বিক্ষিপ্ততা অনুভব করিয়া সে যথার্থই আশ্চর্য হইয়া গেল। তাহাকে নিস্তব্ধ দেখিয়া রায়মহাশয় পুনশ্চ কহিলেন, কি বল হে?
নির্ভুল ও সময়োপযোগী উত্তর দিবার সময় ও অবস্থা নির্মলের ছিল না, সে শুধু পূর্ব কথারই পুনরুক্তি করিয়া কহিল, ভৈরবীদের দুর্নাম ত চিরদিনই আছে।
রায়মহাশয় অস্বীকার করিলেন না, বলিলেন, আছে। কিন্তু দুর্নাম জিনিসটা ত মন্দ, চিরকালের দোহাই দিয়েও মন্দটাকে চিরকাল চালানো চলে না। কি বল?
কিন্তু সে যে মন্দ এ কি নিশ্চিত প্রমাণিত হয়ে গেছে?
রায়মহাশয় অসংশয়ে কহিলেন, গেছে।
নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, কি করে গেল? নিশ্চয়-প্রমাণ কে দিলে?
রায়মহাশয় বলিলেন, যে দিয়েচে সে আজও দেবে। সন্ধ্যার পরে মন্দিরে যেয়ো, তার পরে বোধ হয় শ্বশুর-জামাই দু’জনকে দু’দিকে দাঁড়িয়ে আর সমস্ত গ্রামের হাসি-তামাশা কুড়োতে হবে না। এই ত তোমার ব্যবসা, অতএব নিশ্চয়-প্রমাণ যে কাকে বলে সে আমাকে আর তোমাকে বলে দিতে হবে না।
গৃহিণী পাথরের থালে মিষ্টান্ন ও বাটিতে দধি লইয়া প্রবেশ করিলেন, কহিলেন, কৈ বাবা, খাচ্চো না যে?
এই যে খাচ্চি, বলিয়া নির্মল আহারে মনোনিবেশ করিল।
কর্তা কহিলেন, নির্মলকে দিয়ে, আমার জন্যে একটু দুধ এনে দাও, শরীরটা ভালো নেই, দই আর খাবো না।
গৃহিনী প্রস্থান করিলে রায়মহাশয় বলিলেন, অন্ধকার দুর্যোগের রাত্রে সে তোমাকে হাতে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল, তার জন্যে শুধু তুমি কেন বাবা, আমরা পর্যন্ত কৃতজ্ঞ; যে উপকার করে, তার অপকার করতে মন চায় না, কিন্তু এ ত আমাদের নিজেদের কথা নয় নির্মল, এ গ্রামের কথা, সমাজের কথা, দেব-দেবতার কথা, সুতরাং যা বড় কর্তব্য তা আমাকে করতেই হবে।
সে রাত্রের ঘটনা যে অপ্রকাশ নাই তাহা সে শুনিয়াছিল, অথচ নিজে গোপন করিয়াছিল বলিয়া লজ্জিতমুখে চুপ করিয়া রহিল।
কর্তা বলিতে লাগিলেন, দেব-দেবীরা ত কথা কন না, কিন্তু তাঁরা শোধ নেন। গ্রামের ভালো যে কখনো হয়নি, উত্তরোত্তর অবনতি হয়েই আসচে, মনে হয় এও তার একটা কারণ। প্রমাণের কথা বলছিলে, কিন্তু তুমি যে আসচো এই বা আমরা জানলাম কি করে? তুমি সন্তানতুল্য, তোমার কাছে সব কথা খুলে বলতে আমার বাধে, কিন্তু না বললেও নয়। জমিদারবাবু সে রাত্রে বোধ করি খেয়ে যাবার ফুরসত পাননি, ষোড়শী খাবার আনতে ঘরের বাইরে যেতে তাঁর চোখ পড়ল একটা চিঠির টুকরোর ’পরে। বোধ হয় তোমাকে লিখে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে শেষে হৈমকেই লিখেছিল। সেখানাও আজ দেখতে পাবে, তিনি সকালবেলা আসবার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
নির্মল ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, মিথ্যা কথা। সে নির্লজ্জ, নিজে অপরাধী, সেই মাতাল পাজী বদমাইশটার কথা আপনারা বিশ্বাস করেন? হতেই পারে না।
রায়মহাশয় শুধু একটু মৃদু হাসিলেন। অবিচলিতস্বরে কহিলেন, হতে পারে, এবং হয়েছে। জমিদার লোকটা যে নির্লজ্জ, মাতাল, পাজী, বদমাইশ তাও জানি। বোধ হয় আরও ঢের বেশী, নইলে তার কলঙ্কের কথাটা মুখে আনতেও পারত না। ওর নিষ্ঠুরতার অবধি নেই। গ্রামের মঙ্গলের জন্যও এ কাজে হাত দেয়নি, ঠাকুর-দেবতা ও মানে না। জোর করে মন্দিরে খাসি বলি দিয়ে খেয়েছিল। আবশ্যক হলে ও-পাষণ্ড মুরগী, শুয়োর, এমন কি গো-বধ করেও খেতে পারে।
তবুও তাঁকে আপনি সাহায্য করতে চান?
না, আমি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাই।
নির্মল অনেকক্ষণ স্থির থাকিয়া কহিল, আপনার কাঁটা উঠবে কি না জানিনে, কিন্তু সে নিষ্কণ্টক হবে। দেবীর যে সম্পত্তিটা সে বিক্রি করতে চায়, ষোড়শী ভৈরবী থাকতে তার সুবিধে হবে না।
রায়মহাশয় কহিলেন, সে গেলেও সুবিধে হবে না—আমি আছি।
তিনি আছেন এতবড় ঘটনাটা নির্মল বিস্মৃত হইয়াছিল, তাহার তৎক্ষণাৎ মনে হইল, জমিদারের সুবিধা না হইতে পারে, কিন্তু দেবীরও সুবিধা হইবে না। তবে সে সুবিধাটা যে কাহার হইবে তাহাও মুখ দিয়া বাহির করিল না।
রায়মহাশয় স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, বাবা নির্মল, তুমি বড় আইনব্যবসায়ী, অনেক বোঝ, কিন্তু সংসারে এসে খালি-হাতে আমাকে যখন লড়াই শুরু করতে হয়েছিল, তখন শুধু কেবল বিষয়-সম্পত্তি জমা করেই কাটাই নি, মাথার ভেতরেও কিছু কিছু সঞ্চয় করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তোমাকে লোকে বলেচে ওই জমিটুকুর ওপরেই জমিদারের লোভ—ষোড়শী কড়া মেয়ে, ও থাকতে কিছু হবার নয়, তাই নিজেদের কলঙ্কটা রটিয়ে তাকে তাড়াতে চায়। আচ্ছা বাবাজী, বীজগাঁর জমিদারের কাছে ওটুকু কতটুকু সম্পত্তি? তার টাকার দরকার, একটা না হলে আর একটা বিক্রি করবে—আটকাবে না। কিন্তু যেখানে তার সত্যিকার আটকেচে, সে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এই জঙ্গলের মাঝে মাসের পর মাস সে আর পারে না, শহরের মানুষ শহরে যেতে চায়। নির্মল, হৈমর মত তুমিও আমার ছেলে, তোমাকে বলতে সঙ্কোচ হয়, কিন্তু ওই ছুঁড়িটার ভালই যদি করতে চাও ত বলে দিয়ো তার ভয় নেই। চণ্ডীগড়ের ভৈরবীগিরির মুনাফা বেশী নয়, যা তার যাবে, জমিদার তার চতুর্গুণ পুষিয়ে দেবে, এ আমি শপথ করে বলতে পারি। সে তাকে কষ্ট দিতেও চায় না—কষ্ট দেবেও না, দু নৌকোয় পা দিয়ে থাকবার অসম্ভব লোভটা যদি সে একবার ত্যাগ করে।
নির্মল নিরুত্তরে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। শ্বশুরকে সে অনেকটা জানিত—এতটা জানিত না। এই শ্বশুর ষোড়শীর কল্যাণের পথ যাহা নির্দেশ করিয়া দিলেন, তাহাতে তর্ক করিবার প্রবৃত্তি পর্যন্ত আর তাহার রহিল না।
শাশুড়ীর দুধ গরম করিয়া আনিতে বিলম্ব হইল, তিনি ঘরে ঢুকিয়া স্বামীর পাতের কাছে বাটি নামাইয়া রাখিয়া আহারের স্বল্পতার জন্য জামাতাকে মৃদু ভৎর্সনা করিলেন, এবং এই ত্রুটি সংশোধন করিবার ভার স্বয়ং গ্রহণ করিয়া অদূরে উপবেশ করিলেন।
কর্তা দুধের বাটি মুখ হইতে নামাইয়া রাখিয়া কহিলেন, কিন্তু মেয়েটার একটা প্রশংসা না করে পারা যায় না—বেটী বিদ্যের যেন সরস্বতী। জানে না এমন শাস্ত্রই নেই।
গৃহিণী তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া কহিলেন, তা আর বলতে! দেখেচ ত কাজকর্মে সে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার শিরোমণিঠাকুর ভয়ে যেন কেঁচো হয়ে যান। চলে গেলে বুড়োর মুখ সহস্রধারে ফোটে, কিন্তু সুমুখে নিন্দে করবার ভরসা পান না।
কর্তা কহিলেন, না না, নিন্দে করবেন কেন, তিনি বরঞ্চ সুখ্যাতিই করেন।
গৃহিণী নাকের মস্ত নথে একটা নাড়া দিয়া ততখানিই প্রতিবাদ করিলেন। বলিলেন, হাঁ, বুড়ো সেই পাত্র কিনা! হিংসেয় ফেটে মরেন, আবার সুখ্যাতি করবেন! মনে নেই সেই অন্তুর বোনের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা নিয়ে কি কাণ্ডই না দিন-কতক করে বেড়ালেন! তা ছাড়া, ছুঁড়ি এদিকে যাই করে থাক, শোকে, দুঃখে, আপদে-বিপদে, গরীব-দুঃখীর এমন মা-বাপও গ্রামে কেউ নেই। যখনি যে কাজেই ডাকো, মুখে হাসিটি যেন লেগে আছে, না বলতে জানে না।
কর্তা খুশী হইলেন না, বলিলেন, হুঁ, সব ভৈরবীই ও-সব করে থাকে।
গৃহিণী বলিলেন, সব? কেন, মাতঙ্গিনীঠাকরুনকে কি আমি চোখে দেখিনি নাকি?
দেখে থাকলেও ভুলে গেছো।
গৃহিণী রাগ করিয়া জবাব দিলেন, ভুলিনি কিছুই। আজও তাঁর কাছে একশ’ টাকা পাই—না বলে উড়িয়ে দিলেন। ষোড়শী কখনো কাউকে ঠকিয়ে খায়নি, মিছে কথাও বলেনি।
কর্তা অত্যন্ত অপ্রসন্ন হইয়া কহিলেন, না—যুধিষ্ঠির! এই বলিয়া তিনি আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
গৃহিণী জামাতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আমি ত ভাবি এঁর কল্যাণেই নাতির মুখ আমরা দেখতে পেলাম। না বাবা, যে যাই বলুক, ঠক-জোচ্চোর সে মেয়ে নয়। তাইতে যখন শুনতে পেলাম ঠাকুরের পুজো করাটি সে ছেড়ে দিয়েচে, তখনি সন্দেহ হলো এ আবার কি? নইলে কারও কথায় আমি সহজে বিশ্বাস করিনি।
কর্তা চৌকাঠের বাহিরে পা বাড়াইয়াছিলেন, কান খাড়া করিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, বলি তার কল্যাণে ত নাতি পেলে, কিন্তু নাতির কল্যাণে মানসপুজোটি তিনি কেন অস্বীকার করলেন একবার ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারো না? বলিয়া তিনি প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই চলিয়া গেলেন।
নির্মলের খাওয়া শেষ হইয়াছিল, সেও উঠিয়া দাঁড়াইল; কহিল, ষোড়শীর ওপর থেকে দেখচি মায়ের ভক্তি আজও একেবারে যায়নি।
না বাবা, মিছে কথা কেন বলব, তার মুখখানি মনে হলেই আমার যেন কান্না পায়। এঁরা সকলে মিলে কেন যে তার বিপক্ষে এত লেগেচেন আমি ভেবেই পাইনে।
নির্মল একটুখানি মৃদু হাসিয়া কর্তার খোঁচার অনুসরণ করিয়া কহিল, কিন্তু মা, তার মন্ত্রতন্ত্রের বিদ্যের কথাটাও একটু ভেবো—
শাশুড়ী কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, দাসী আসিয়া ঘরের আড়ালে দাঁড়াইয়া কহিল, কে একজন জামাইবাবুকে ডাকতে এসেচে—বাবু খবর দিতে বললেন।
নির্মল হাতমুখ ধুইয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল ইতিমধ্যে গ্রামের অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, এবং সন্ধ্যার পরে মন্দিরে যে বৈঠক বসিবে তাহারই আলোচনা শুরু হইয়া গেছে। শিরোমণিমহাশয়ের আজ অমাবস্যার উপবাস, তিনি নির্মলকে ডাকিয়া আশীর্বাদ করিলেন, এবং বাবাজীকে হঠাৎ চিনিতে পারেন নাই, বলিয়া নিজের বৃদ্ধত্বের প্রতি দোষারোপ করিলেন। যে লোকটা থামের পাশে দাঁড়াইয়া ছিল সে নমস্কার করিয়া জানাইল যে, ভৈরবীঠাকরুন অপেক্ষা করিয়া আছেন, তাঁর সহিত বিশেষ কথা আছে।
নির্মলের হঠাৎ অত্যন্ত লজ্জা করিয়া উঠিল। সে পিছনে না চাহিয়াও স্পষ্ট অনুভব করিল সকলে উৎসুক- কৌতুকে তাহার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। ইহার অভ্যন্তরে যে গোপন বিদ্রূপ আছে, তাহা তাহাকে অপমানিত করিল; অন্য সময় হয়ত সে ইহাকে অত্যন্ত সহজে অবহেলা করিতে পারিত, কিন্তু আজ সে নিজের মধ্যে সে-জোর খুঁজিয়া পাইল না, কিছুতেই মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিল না, চল, আমি যাচ্ছি। বরঞ্চ যেন লজ্জিত হইয়াই লোকটাকে বলিয়া ফেলিল, বল গে, আমার এখন যাবার সুবিধে হবে না।
শিরোমণি গায়ে পড়িয়া কহিলেন, ওকে জিরোবার একটু সময় দাও তোমরা—কি বল হে? বলিয়া তিনি চোখের একটা ইশারা করিয়া অকারণে হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে লাগিলেন। কেহ বা সে হাসিতে প্রকাশ্যে যোগ দিল, কেহ বা শুধু একটু মুচকিয়া হাসিল।
নির্মল সমস্ত অগ্রাহ্য করিয়া ভিতরে যাইতেছিল, শিরোমণি ডাকিয়া কহিলেন, বলি, বাবাজীকে কি ও বেটী কৌঁসুলি খাড়া করেচে নাকি?
নির্মল উদ্দীপ্ত ক্রোধ দমন করিয়া শান্তভাবে কহিল, মকদ্দমা বাধলে সে কাজ করতে হবে বোধ হয়।
শিরোমণি এ উত্তরের আশা করেন নাই, একটু থতমত খাইয়া বলিলেন, তা যেন করলে, কিন্তু বলে রাখি বাবাজী, এ পুঁটি মাছের প্রাণ নয়, বাঘা—ভাল্কোর সঙ্গে লড়াই—মকদ্দমা হাইকোর্টে না গড়িয়ে থামবে না, তা নিশ্চয় জেনো।
নির্মল কহিল, মামলা-মকদ্দমা কোথায় গিয়ে থামে এ ত আমার জানবার কথা শিরোমণিমশায়।
শিরোমণি কহিলেন, সে ত বটেই, এ হলো তোমার ব্যবসা, তুমি আর জানবে না! কিন্তু আরও ত ঢের খরচপত্র আছে, সে দেবে কে? বলিয়া তিনি মুখ টিপিয়া হাসিলেন। কিন্তু এ হাসিতে এবার কেহ যোগ দিল না।
নির্মল কহিল, অভাব হলে আমি দেব।
তাহার জবাব শুনিয়া শুধু শিরোমণি নয়, উপস্থিত সকলেই অবাক হইয়া গেলেন। রায়মহাশয় নিজেও ধৈর্য ধারণ করিতে পারিলেন না; রুক্ষকণ্ঠে বলিয়া ফেলিলেন, তোমাদের ঠাট্টা- তামাশার সম্পর্ক নয় নির্মল, বিশেষতঃ শিরোমণিমশাই প্রাচীন এবং সম্মানিত ব্যক্তি—উপহাস করা তোমার সাজে না।
নির্মল চুপ করিয়া রহিল; শিরোমণি সামলাইয়া লইয়া একটু হাসিবার প্রয়াস করিয়া কহিলেন, টাকা ত দেবে, কিন্তু দেবার গরজটা কি একটু শুনতে পাইনে?
নির্মল বলিল, আমার গরজ শুধু আপনাদের অন্যায় অত্যাচার। আমি যেখানে থাকি সেখানে যদি একবার খোঁজ নেন ত শুনতে পাবেন, জীবনে অনেক গরজই আমি মাথায় তুলে নিয়েচি।
যে লোকটা ডাকিতে আসিয়াছিল, সে তখনও যায় নাই; কহিল, আপনার কখন, যাবার সুবিধে হবে তাঁকে জানাবো?
আমার সময়মত দেখা করব বলো। বলিয়া সে বাটীর ভিতর প্রস্থান করিল।
সায়াহ্নবেলায় জনার্দন রায় প্রস্তুত হইয়া আসিয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া ডাক দিয়া কহিলেন, মন্দিরে সকলে উপস্থিত হয়েচেন, তোমাকে তাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, যদি যাও ত আর বিলম্ব করো না।
নির্মল বাহিরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার যাওয়া কি আপনি প্রয়োজন মনে করেন?
জনার্দন কহিলেন, যাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, তাঁরা নিশ্চয়ই করেন, এই বলিয়া তিনি অগ্রসর হইলেন।
সন্ধ্যার অব্যবহিত পরেই দেবীর আরতি শুরু হইল। মাতার বহুবিধ গৌরবের বস্তুই কালক্রমে বিরল হইয়া আসিতেছে, কিন্তু তাঁহার শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসর, ঢাক, ঢোল, সানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রীর সংখ্যা প্রাচীনকাল হইতে অদ্যাবধি তেমনি বজায় আছে। সেই সম্মিলিত তুমুল বাদ্যনিনাদ নির্মল ঘরে বসিয়াই শুনিতে পাইল। কথা ছিল, আরতি শেষ হইলে পঞ্চায়েত বসিবে, অতএব সেই সুপবিত্র ধ্বনি থামিবার পর সে গৃহ হইতে যাত্রা করিল। মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেখিল আলোর বন্দোবস্ত বিশেষ কিছু নাই, প্রাঙ্গণমধ্যস্থিত নাট-বাঙ্গালায় গোটা-দুই লণ্ঠন মাঝখানে রাখিয়া একটা কোলাহল উঠিয়াছে এবং তাহাই বহুলোক ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া উৎকর্ণ হইয়া শুনিতেছে। সেই অন্ধকারে নির্মলকে কেহ চিনিল না, সে জন-দুই লোকের কাঁধের উপর উঁকি মারিয়া দেখিল তথায় কে একজন বাবুগোছের ভদ্রলোক হাতমুখ নাড়িয়া কি-সব বলিতেছেন। কিছুই শোনা গেল না, কিন্তু মানুষের আগ্রহ দেখিয়া এ কথা বুঝা গেল, তিনি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর কাহারও নিন্দা ও গ্লানি করিতেছেন। এই ব্যক্তিই যে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী তাহা সে আন্দাজ করিল, অতএব বক্তব্যবস্তু যে ষোড়শীর জীবনচরিত তাহাতে সন্দেহ রহিল না। ভিড় ঠেলিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইতে যদিচ তাহার প্রবৃত্তি হইল না, কিন্তু দুই-একটা কথা শুনিবার লোভও সে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে না পারিয়া পায়ের দুই আঙুলে ভর দিয়া উদ্গ্রীব হইয়া দাঁড়াইল। কয়েক মুহূর্তেই মনে লাগিয়া গেল, তখনও জীবানন্দ চৌধুরী আসল বস্তুতে অবতীর্ণ হয় নাই—ষোড়শীর মায়ের ইতিবৃত্তেরই আখ্যান চলিতেছিল, অবশ্য সমস্তই শোনা কথা। সাক্ষী তারাদাস অদূরে বসিয়া—এই-সকল অসচ্চরিত্র স্ত্রীলোকদিগের সংস্রবে কিরূপে এই পীঠস্থান ক্রমশঃ ধীরে ধীরে অপবিত্র হইয়া উঠিতেছে এবং সমস্ত দেশের কল্যাণ তিরোহিত হইতেছে—
পিছনে পিঠের উপর একটু চাপ পড়িতে ফিরিয়া দেখিল কে একজন অন্ধকারে আগাগোড়া মুড়ি দিয়া তাহাকে বাহিরের দিকে ইশারা করিল এবং তাহাকেই অনুসরণ করিয়া কয়েক পদ অগ্রসর হইতে নির্মল স্পষ্ট বুঝিতে পারিল এই সুগঠিত দীর্ঘ ঋজুদেহ ষোড়শী ভিন্ন আর কাহারও নহে। সে দ্বারের বাহিরে আসিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল এবং ঈষৎ একটু হাসিয়া অনুযোগের কণ্ঠে কহিল, ছি, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা-তা শুনচেন! কতকগুলো কাপুরুষ মিলে দু’জন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে—তাও আবার একজন মৃত, আর একজন অনুপস্থিত। চলুন আমার ঘরে, সেখানে ফকিরসাহেব বসে আছেন, আপনাকে পরিচিত ক’রে দিই গে।
তিনি কবে এলেন?
কি জানি। বিকেলবেলা ফিরে গিয়ে দেখি আমার ঘরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আনন্দ আর রাখতে পারলাম না, প্রণাম করে নিয়ে গিয়ে আমার ঘরে বসালাম, সমস্ত ইতিহাস মন দিয়ে শুনলেন।
শুনে কি বললেন?
শুধু একটু হাসলেন। বোধ হলো যেন সমস্তই জানতেন। কিন্তু হাঁ নির্মলবাবু, আপনি নাকি বলেচেন আমার মামলা-মকদ্দমার সমস্ত ভার নেবেন? একি সত্যি?
নির্মল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ সত্যি।
কিন্তু কেন নেবেন?
নির্মল একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, বোধ করি আপনার প্রতি অন্যায় অত্যাচার হচ্চে বলেই।
কিন্তু আর কিছু বোধ করেন না ত? বলিয়াই ষোড়শী ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, থাক, সব কথার যে জবাব দিতেই হবে এমন কিছু শাস্ত্রের অনুশাসন নেই। বিশেষ করে এই কূট-কচালে শাস্ত্রের—না? আসুন, আমার ঘরে আসুন।
তাহার কুটীরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ফকিরসাহেব নাই। কহিল, কোথায় গেছেন, বোধ হয় এখনি ফিরে আসবেন। প্রদীপ স্তিমিত হইয়া আসিয়াছিল, উজ্জ্বল করিয়া দিয়া পাতা-আসনখানি দেখাইয়া দিয়া কহিল, বসুন। হাঙ্গামা, হৈচৈ, গণ্ডগোলের মাঝে এমন সময় পাইনে, যে বসে দু’দণ্ড গল্প করি। আচ্ছা, মকদ্দমার যেন সকল ভারই নিলেন, কিন্তু যদি হারি, তখন ভার কে নেবে? তখন পেছবেন না ত?
নির্মল জবাব দিতে পারিল না, তাহার কান পর্যন্ত রাঙ্গা হইয়া উঠিল। খানিকক্ষণ পরে কহিল, হারবার কোন সম্ভাবনা আমাদের নেই।
তা বটে। বলিয়া একবার একটুখানি যেন ষোড়শী বিমনা হইয়া পড়িল, কিন্তু পলকমাত্র। সহসা চকিত হইয়া প্রশ্ন করিল, ছেলে কেমন আছে নির্মলবাবু? কি করে তাকে ছেড়ে এলেন বলুন ত? আমি ত পারিনে।
অকস্মাৎ এই অসংলগ্ন প্রশ্নে নির্মল আশ্চর্য হইল। ষোড়শী একবার এ-দিকে একবার ও-দিকে বার দুই-তিন মাথা নাড়িয়া হাসিমুখে বলিল, আমি কিন্তু হৈম হলে এই-সমস্ত পরোপকার করা আপনার ঘুচিয়ে দিতাম। অত ভালমানুষ নই—আমার কাছে ফাঁকি চলত না—রাত্রি-দিন চোখে চোখে রাখতাম।
ইঙ্গিত এত সুস্পষ্ট যে নির্মলের বুকের মধ্যেটা বিস্ময়ে, ভয়ে ও আনন্দে একই সঙ্গে ও একই কালে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল। এবং সেই অসংবৃত অবসরে মুখ দিয়া তাহার বাহির হইয়া গেল, চোখে চোখে রাখলেই কি রাখা যায় ষোড়শী? এর বাঁধন যেখানে শুরু হয়, চোখের দৃষ্টি যে সেখানে পৌঁছায় না, এ কথা কি আজও জানতে তুমি পারোনি?
পেরেচি বৈ কি, বলিয়া ষোড়শী হাসিল। বাহিরে হঠাৎ একটা শব্দ শুনিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিয়া কহিল, এই যে ইনি এসেচেন।
কে? ফকিরসাহেব?
না, জমিদারবাবু। বলে পাঠিয়েছিলাম সভা ভাঙ্গলে যাবার পথে আমার কুঁড়েতে একবার একটু পদধূলি দিতে। তাই দিতেই বোধ হয় আসচেন। সঙ্গে লোকজন বিস্তর, স্ত্রীলোকের ঘরে একাকী আসতে বোধ করি সাধুপুরুষের ভরসায় কুলোয় নি। পাছে দুর্নাম হয়। বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।
ব্যাপারটা নির্মলের একেবারে ভাল লাগিল না। সে বিরক্তি ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া বলিল, এ কথা আমাকে আপনি বলেন নি কেন?
বেশ! একবার তুমি একবার আপনি, বলিয়া সে হাসিয়া কহিল, ভয় নেই, উনি ভারী ভদ্রলোক, লড়াই করেন না। তা ছাড়া, আপনাদের ত পরিচয় নেই—সেটাও একটা লাভ। বলিয়া সে দ্বারের বাহিরে অগ্রসর হইয়া অভ্যর্থনা করিয়া কহিল, আসুন—আমার কুঁড়ে আর একবার পবিত্র হ’লো।
জীবানন্দ চৌকাঠে পা দিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, ইনি? নির্মলবাবু বোধ হয়?
ষোড়শী হাসিমুখে জবাব দিল, হাঁ, আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে খুব সম্ভব অতিশয়োক্তি হবে না।