দেনা-পাওনা – ১৯

উনিশ

জীবানন্দের উচ্ছিষ্ট ভোজনপাত্র ও ভুক্তাবশেষ প্রভৃতি ফেলিয়া দিতে এবং রান্নাঘরের কিছু কিছু কাজ সরিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া আসিতে ষোড়শী বাহিরে চলিয়া গেলে, তাহার সেই চিঠির ছেঁড়া টুকরাখানি জীবানন্দের চোখে পড়িল। হাতে তুলিয়া লইয়া সেই মুক্তার মত সাজানো অক্ষরগুলির প্রতি মুগ্ধচক্ষে চাহিয়া সে প্রদীপের আলোকে রাখিয়া সমস্ত লেখাটুকু একনিঃশ্বাসে পড়িয়া ফেলিল। অনেক কথাই বাদ গিয়াছে, তথাপি এটুকু বুঝা গেল, লেখিকার বিপদের অবধি নাই, এবং সাহায্য না হোক, সহানুভূতি কামনা করিয়া এ পত্র যাহাকে সে লিখিয়াছে, সে নিজে যদিও নারী, কিন্তু অক্ষরের আড়ালে দাঁড়াইয়া আর এক ব্যক্তিকে ঝাপসা দেখা যাইতেছে যাহাকে কোনমতেই স্ত্রীলোক বলিয়া ভ্রম হয় না। এই পত্র তাহাকে যেন পাইয়া বসিল। একবার, দুইবার শেষ করিয়া যখন সে আরও একবার পড়িতে শুরু করিয়াছে, তখন ষোড়শীর পায়ের শব্দে মুখ তুলিয়া কহিল, সবটুকু থাকলে পড়ে বড় আনন্দ পেতাম! যেমন অক্ষর তেমনি ভাষা—ছাড়তে ইচ্ছে করে না।

ষোড়শী তাহার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন সহজে লক্ষ্য করিয়াও কহিল, একবার উঠুন, কম্বলটা পেতে দিই।

জীবানন্দ কান দিল না, বলিল, নরপিশাচটি যে কে তা সামান্য বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, কিন্তু তাকে নিধন করতে যে দেবতার আবাহন হয়েছে তিনি কে? নামটি তাঁর শুনতে পাইনে?

এবারেও ষোড়শী আপনাকে বিচলিত হইতে দিল না। শীতের দিনে আকস্মিক একটা দখিনা বাতাসের মত তাহার মনের ভিতরটা আজ অজানা পদধ্বনির আশায় যেন উৎকর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, সেখানে জীবানন্দের বিদ্রূপ বেশ স্পষ্ট হইয়া পৌঁছিল না, সে তেমনি সহজভাবেই কহিল, সে হবে। এখন আপনি একটু উঠে দাঁড়ান আমি এটা পেতে দিই।

জীবানন্দ আর কথা কহিল না, একপাশে উঠিয়া দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে চোখ মেলিয়া তাহার কাজ করা দেখিতে লাগিল। ষোড়শী ঝাঁটা দিয়া প্রথমে সমস্ত ঘরখানি পরিষ্কার করিল, পরে কম্বলখানি দু’পুরু করিয়া বিছাইয়া চাদরের অভাবে নিজের একখানি কাচা কাপড় সযত্নে পাতিয়া দিয়া কহিল, বসুন। আমার কিন্তু বালিশ নেই—

দরকার হলেই পাবো গো—অভাব থাকবে না এই বলিয়া সে কাছে আসিয়া হেঁট হইয়া কাপড়খানি তুলিয়া যথাস্থানে রাখিয়া দিতেই ষোড়শী মনে মনে অত্যন্ত লজ্জা পাইয়া আরক্তমুখে কহিল,কিন্তু ওটা তুলে ফেললেন কেন, শুধু কম্বল ফুটবে যে!

জীবানন্দ উপবেশন করিয়া কহিল, তা জানি, কিন্তু আতিশয্যটা আবার বেশী ফুটবে। যত্ন জিনিসটায় মিষ্টি আছে সত্যি, কিন্তু তার ভান করাটায় না আছে মধু, না আছে স্বাদ। ওটা বরঞ্চ আর কাউকে দিয়ো।

কথা শুনিয়া ষোড়শী বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। তাহার মুখের উপর চোখের পলকে কে যেন ছাই মাখাইয়া দিল।
জীবানন্দ কহিল, তাঁর নামটি?

ষোড়শী কয়েক মুহূর্ত কথা কহিতে পারিল না, তাহার পরে বলিল, কার নাম?

জীবানন্দ হাতের পত্রখণ্ডের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া বলিল, যিনি দৈত্যবধের জন্য শীঘ্র অবতীর্ণ হবেন? যিনি দ্রৌপদীর সখা, যিনি—আর বলব?

এই ব্যঙ্গের সে জবাব দিল না, কিন্তু চোখের উপর হইতে তাহার মোহের যবনিকা খান খান হইয়া ছিঁড়িয়া গেল। ধর্মলেশহীন, সর্বদোষাশ্রিত এই পাষণ্ডের আশ্চর্য অভিনয়ে মুগ্ধ হইয়া কেমন করিয়া যে তাহার মনে ক্ষণকালের নিমিত্ত ক্ষমামিশ্রিত করুণার উদয় হইয়াছিল, ইহা সে সহসা ভাবিয়া পাইল না। এবং চিত্তের এই ক্ষণিক বিহ্বলতায় সমস্ত অন্তঃকরণ তাহার অনুশোচনায় তিক্ত, সতর্ক ও কঠোর হইয়া উঠিল। মুহূর্তকাল পরে জীবানন্দ পুনশ্চ যখন সেই এক প্রশ্নই করিল, তখন ষোড়শী কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া কহিল, তাঁর নামে আপনার প্রয়োজন?

জীবানন্দ কহিল, প্রয়োজন আছে বৈ কি? আগে থেকে জানতে পারলে হয়ত আত্মরক্ষার একটা উপায় করতেও পারি।

ষোড়শী তাহার মুখের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, আর আত্মরক্ষায় কি শুধু আমারই অধিকার নেই?

জীবানন্দ বলিয়া ফেলিল, আছে বৈ কি।

ষোড়শী কহিল, তা হলে সে নাম আপনি পেতে পারেন না। আমার ও আপনার একই সঙ্গে রক্ষা পাবার উপায় নেই।

জীবানন্দ একটুখানি স্থির থাকিয়া বলিল, তাই যদি হয়, রক্ষা পাওয়া আমারই দরকার এবং তাতে লেশমাত্র ত্রুটি হবে না জেনো।

ষোড়শীর মুখে আসিল বলে, তা জানি, একদিন জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কে সাহেবের কাছে এ প্রশ্নের মীমাংসা হইয়াছিল। সেদিন নিরপরাধা নারীর স্কন্ধে অপরাধের বোঝা চাপাইয়া তোমার প্রাণ বাঁচিয়াছিল, এবং তোমার আজিকার বাঁচিয়া থাকিবার দামটাও হয়ত ততবড়ই আর একজনকে দিতে হইবে, কিন্তু সে কোন কথাই কহিল না। তাহার মনে হইল, এতবড় নরপশুর কাছে অতবড় দানের উল্লেখ করার মত ব্যর্থতা আর ত কিছু হইতেই পারে না।

জীবানন্দের হুঁশ হইল। তাহার এতবড় ঔদ্ধত্যের যে জবাব দিল না, তাহার কাছে গলাবাজির নিষ্ফলতা তাহার নিজের মনেই বাজিল। তাহার উত্তেজনা কমিল, কিন্তু ক্রোধ বাড়িয়া গেল। কহিল, অলকা, তোমার এই বীরপুরুষটির নাম যে আমি জানিনে তা নয়।

ষোড়শী তৎক্ষণাৎ কহিল, জানবেন বৈ কি, নইলে তাঁর উদ্দেশে ঝগড়া করবেন কেন? তা ছাড়া, পৃথিবীর বীরপুরুষদের মধ্যে পরিচয় থাকবারই ত কথা।

জীবানন্দ শক্ত হইয়া কহিল, সে ঠিক। কিন্তু এই কাপুরুষকে বার বার অপমান করার ভারটা তোমার বীরপুরুষটি সইতে পারলে হয়। যাক, এ চিঠি ছিঁড়লে কেন?

ষোড়শী বলিল, আর একখানা পাঠিয়েছিলাম বলে।
কিন্তু সোজা তাঁকে না লিখে তাঁর স্ত্রীকে লেখা কেন? এই-সব শব্দভেদী বাণ কি সেই বীরপুরুষের শিক্ষা নাকি?

ষোড়শী কহিল, তার পরে?

জীবানন্দ বলিল, তার পরে, আজ আমার সন্দেহ গেল। বন্ধুর সংবাদ আমি অপরের কাছে শুনেচি, কিন্তু রায়মশাইকে যতই প্রশ্ন করেচি, ততই তিনি চুপ করে গেছেন। আজ বোঝা গেল তাঁর আক্রোশটাই সবচেয়ে কেন বেশী।

ষোড়শী চমকিয়া গেল। কলঙ্কের ঘূর্ণি-হওয়ার মাঝখানে পড়িয়া তাহার দেহের কোথাও দাগ লাগিতে আর বাকী ছিল না, কিন্তু ইহার বাহিরে দাঁড়াইয়াও যে আর একজন অব্যাহতি পাইবে না, ইহা সে ভাবে নাই। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর সম্বন্ধে আপনি কি শুনেচেন?

জীবানন্দ কহিল, সমস্তই। একটু থামিয়া বলিল, তোমার চমক আর গলার মিঠে আওয়াজে আমার হাসি পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হাসতে পারলাম না—আমার আনন্দ করবার কথা এ নয়। সেই ঝড়জলের রাত্রির কথা মনে পড়ে? তার সাক্ষী আছে। সাক্ষী বেটারা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আগে থেকে কিছুই বলবার জো নেই। আমি যখন গাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে পালাই, ভেবেছিলাম কেউ দেখেনি।

ষোড়শী কহিল, যদি সত্যই তাই হয়ে থাকে সে কি এতবড় দোষের?

জীবানন্দ বলিল, কিন্তু তাকে গোপন করাটা? এই চিঠির টুকরোটা? নিজেই একবার পড়ে দেখ ত কি মনে হয়? এ আমি সঙ্গে নিয়ে চললাম, আবশ্যক হয়ত যথাস্থানে পৌঁছে দেব। আমার মত ইনিও তোমার একবার বিচার করতে বসেছিলেন না? দেখচি তোমার বিচার করবার বিপদ আছে। বলিয়া সে মুচকি হাসিল।

ষোড়শী চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। বিপদের বার্তা জানাইয়া বাস্তবিক সে যে একজনকে উপলক্ষ মাত্র করিয়া আর একজনকে পত্র লিখিয়াছে, একজনের নাম করিয়া আর একজনকে আসিতে ডাকিয়াছে—সেই ডাকটা যখন এই ছেঁড়া চিঠির টুকরা হইতে এই লোকটাকে পর্যন্ত ফাঁকি দিতে পারিল না, তখন সম্পূর্ণ পত্রটা কি হৈমর চক্ষুকেই ঠকাইতে পারিবে? এবং ঠিক সেইদিকে কেহ যদি আজ আঙুল তুলিয়া হৈমর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাহে ত লজ্জার কিছু আর বাকী থাকিবে না।

তাহার চক্ষের পলকে হৈমর ঘর-সংসারের চিত্র—তাহার স্বামী, তাহার ছেলে, তাহার বহু দাসদাসী, তাহার ঐশ্বর্য, তাহার সুন্দর স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার ধারা—যে ছবি সে দিনের পর দিন কল্পনায় দেখিয়াছে—সমস্ত একনিমেষে কলুষের বাষ্পে সমাচ্ছন্ন হইয়া উঠিবে মনে করিয়া সে নিজের কাছেই যেন মুখ দেখাইতে পারিল না। আর এই যে পাপিষ্ঠ তাহারই ঘরে বসিয়া তাহাকে ভয় দেখাইতেছে, যাহার কুকার্যের অবধি নাই, যে মিথ্যার জাল বুনিয়া অপরিচিত, নিরপরাধ একজন রমণীর সর্বনাশ করিতে কোন কুণ্ঠা মানিবে না, ষোড়শীর মনে হইল এ জীবনে এতবড় ঘৃণা সে আর কখনো কাহাকেও করে নাই, এবং এ বিষ যে হৃদয় মথিত করিয়া উঠিল, তাহার সমস্ত গর্ভতল সেই দহনে যেন অনলকুণ্ডের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল।
নির্মল আসিবেই! তাহার যত অসুবিধাই হোক, এই দুঃখের আহ্বান সে যে উপেক্ষা করিতে পারিবে না—নিজের মনের এই স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাসের লজ্জায় সে যেন পুড়িতে লাগিল। তখন তাহারই কলঙ্ককে কেন্দ্র করিয়া শ্বশুর ও জামাতায়, পিতা ও কন্যায়, জমিদার ও প্রজায় সমস্ত গ্রাম ব্যাপিয়া যে লড়াইয়ের আবর্ত উঠিবে, তাহার বীভৎসতার কালো ছায়া তাহার সাংসারিক দুঃখ-কষ্টকে কোথায় যে ঢাকিয়া ফেলিবে সে কল্পনা করিতেও পারিল না।

বোধ করি মিনিট পাঁচ-ছয় নিস্তব্ধতার পরে ঠিক এইসময়ে জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, কেমন, অনেক কথাই জানি, না?

ষোড়শী অভিভূতের ন্যায় তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, হ্যাঁ।

এ-সব তবে সত্য বল?

ষোড়শী তেমনি অসঙ্কোচে কহিল, হ্যাঁ, সত্যি।

জীবানন্দ অবাক হইয়া গেল। এই অপ্রত্যাশিত সংক্ষিপ্ত উত্তরের পরে তাহার নিজের মুখেও সহসা কথা যোগাইল না। শুধু কহিল,—ওঃ—সত্যি! তাহার পরে হাত বাড়াইয়া স্তিমিত দীপশিখাটা উজ্জ্বল করিয়া দিতে দিতে ক্ষণে ক্ষণে তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া অবশেষে জিজ্ঞাসা করিল, এখন তাহলে তুমি কি করবে মনে কর?

কি আমাকে আপনি করতে বলেন?

তোমাকে? বলিয়া জীবানন্দ স্তব্ধ নতমুখে বসিয়া তৈলবিরল প্রদীপের বাতিটা অকারণে শুধু শুধু কেবল উস্‌কাইতে লাগিল। খানিক পরে যখন সে কথা কহিল, তখনও তাহার চক্ষু সেই দীপশিখার প্রতি। কহিল, তাহলে এঁরা সকলে তোমাকে অসতী বলে—

এতক্ষণ পরে সে কথার মাঝখানে বাধা দিল, কহিল, সে কথা এখানে কেন? এঁদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে ত আমি নালিশ জানাই নি। আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন। কোন কারণ দেখাবার দরকার নেই।

জীবানন্দ বলিল, তা বটে। কিন্তু সবাই মিথ্যে কথা বলে, আর তুমি একাই সত্যবাদী, এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও অলকা?

প্রত্যুত্তরে ষোড়শী তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কি-একটা বলিতে গিয়াও হঠাৎ চুপ করিয়া গেল দেখিয়া জীবানন্দ আপনাকে আর একবার অপমানিত জ্ঞান করিল। বলিল, একটা উত্তর দিতেও চাও না?

ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

জীবানন্দ কহিল, অর্থাৎ আমার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার চেয়ে দুর্নামও ভাল। বেশ! কিন্তু সমস্ত স্পষ্টই বোঝা গেছে। এই বলিয়া সে ব্যঙ্গ করিয়া হাসিল।

কিন্তু ইহাতেও ষোড়শীর কণ্ঠস্বরের স্বাভাবিকতা নষ্ট হইল না, কহিল, স্পষ্ট বোঝা যাবার পরে কি করতে হবে বলুন?

তাহার প্রশ্ন ও অচঞ্চল কণ্ঠস্বরের গোপন আঘাতে জীবানন্দের ক্রোধ ও অধৈর্য শতগুণ বাড়িয়া গেল, কহিল, তোমাকে কি করতে হবে সে তুমি জানো, কিন্তু আমাকে দেবমন্দিরের পবিত্রতা বাঁচাতেই হবে।
সত্যকার অভিভাবক তুমি নয়, আমি। পূর্বে কি হতো আমি জানিনে, কিন্তু এখন থেকে ভৈরবীকে ভৈরবীর মতই থাকতে হবে, না হয় তাকে যেতে হবে। এ-রকম চিঠি তার লেখা চলবে না। বলিয়া সে মুখ তুলিতেই তাহার ঈর্ষার ক্রূরদৃষ্টি ষোড়শীর চোখে পড়িতে তাহার নিজের দৃষ্টি একমুহূর্তে যেমন যোজনবিস্তৃত হইয়া গেল, তেমনি লালসার তপ্ত নিঃশ্বাস নিজের সর্বাঙ্গে অনুভব করিয়া বিশ্বসংসারে যেন তাহার অরুচি ধরিয়া গেল। মনে হইল হৈম, তাহার সংসার, এই দেবমন্দির, তাহার অসহায় প্রজাদের দুঃখ, তাহার নিজের ভবিষ্যৎ কিছুরই আর তাহার কাজ নাই—সকল বন্ধন হইতে অব্যাহতি পাইয়া অজানা কোথাও গিয়া লুকাইতে পারিলে যেন বাঁচে। সকলের চেয়ে বেশী মনে হইল নির্মল যেন না আসে। অনেকক্ষণ নীরবে স্থির থাকিয়া শেষে আস্তে আস্তে বলিল, বেশ, তাই হবে। যথার্থ অভিভাবক কে, সে নিয়ে আমি ঝগড়া করব না, আপনারা যদি মনে করেন আমি গেলে মন্দিরের ভাল হবে, আমি যাবো।

ইহাকে বিদ্রূপ মনে করিয়া জীবানন্দ জ্বালার সহিত কহিল, তুমি যে যাবে সে ঠিক। কারণ, যাতে যাও তা আমি দেখব।

ষোড়শী তেমনি নম্রকণ্ঠে বলিল, আমি যখন যেতে চাচ্চি, তখন কেন আপনি রাগ করচেন? কিন্তু আপনার উপর এই ভার রইল, যেন মন্দিরের সত্যিই ভাল হয়।

জীবানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কবে যাবে?

ষোড়শী উত্তর দিল, আপনারা যখনই আদেশ করবেন। কাল, আজ, এখন—যখনি বলবেন।

জীবানন্দর ক্রোধ বাড়িল বৈ কমিল না, কহিল, কিন্তু নির্মলবাবু? জামাইসাহেব?

ষোড়শী কাতর হইয়া বলিল, তাঁর নাম আর করবেন না।

জীবানন্দ কহিল, আমার মুখে তাঁর নামটা পর্যন্ত সহ্য হয় না? ভাল। কিন্তু তোমাকে কি দিতে হবে?

আমাকে কিছুই দিতে হবে না।

জীবানন্দ কহিল, এ ঘরখানা পর্যন্ত ছাড়তে হবে জানো? এ-ও দেবীর।

ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া সবিনয়ে কহিল, জানি, যদি পারি ত কালই ছেড়ে দেব।

কালই? ভাল, কোথায় থাকবে ঠিক করেচ?

ষোড়শী কহিল, এখানে থাকব না, এর বেশী কিছুই ঠিক করিনি। একদিন কিছু না জেনেই ভৈরবী হয়েছিলাম, আজ বিদায় নেবার সময়েও আমি এর বেশী কিছুই চিন্তা করব না।

জীবানন্দ চুপ করিয়া রহিল। তাহার হঠাৎ মনে হইল এতক্ষণ কোথায় যেন তাহার ভুল হইতেছিল।
ষোড়শী বলিল, আপনি দেশের জমিদার, চণ্ডীগড়ের ভালমন্দের বোঝা আপনার উপর রেখে যেতে শেষ সময়ে আর আমি দুশ্চিন্তা করব না। কিন্তু আমার বাবা বড় দুর্বল, তাঁর উপর ভার দিয়ে আপনি যেন নিশ্চিন্ত হবেন না।

তাহার কণ্ঠস্বর ও কথায় বিচলিত হইয়া জীবানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি সত্য সত্যই চলে যেতে চাও নাকি?

ষোড়শী তাহার পূর্বকথার অনুবৃত্তিস্বরূপ কহিতে লাগিল, আর আমার দুঃখী দরিদ্র ভূমিজ প্রজারা—এদের সুখ-দুঃখের ভারও আমি আপনাকে দিয়ে চললাম।

জীবানন্দ তাড়াতাড়ি কহিল, আচ্ছা তা হবে হবে। কি তারা চায় বল ত?

ষোড়শী কহিল, সে তারাই আপনাকে জানাবে। কেবল আমি শুধু আপনার কথাটাই যাবার আগে তাদের জানিয়ে যাবো। হঠাৎ সে বাহিরের দিকে উঁকি মারিয়া কহিল, কিন্তু এখন আমি চললাম—আমার স্নান করতে যাবার সময় হলো। বলিয়া সে তাহার কাপড় ও গামছা আলনা হইতে তুলিয়া লইয়া কাঁধে ফেলিল।

জীবানন্দ বিস্ময়ে অবাক হইয়া কহিল, স্নানের সময়? এই রাত্রে?

রাত্রি আর নেই। আপনি এবার বাড়ি যান। বলিতে বলিতেই ষোড়শী ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল। তাহার এ অকারণ আকস্মিক ব্যগ্রতায় জীবানন্দ নিজেও ব্যগ্র হইয়া উঠিল; কহিল, কিন্তু আমার সকল কথাই যে বাকী রয়ে গেল অলকা?

ষোড়শী কহিল, আপনি বাড়ি যান।

জীবানন্দ জিদ করিয়া কহিল, না। কথা আমার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি এইখানেই তোমার প্রতীক্ষা করে রইলাম।

প্রত্যুত্তরে ষোড়শী থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না, আপনার পায়ে পড়ি, আমার জন্যে আর আপনি অপেক্ষা করবেন না। বলিয়া সে বামদিকে বনপথ ধরিয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *