দেখিতে মন রূপনেহারে
জপাৎ সিদ্ধি ন সংশয়ঃ
আমরা চলেছি সিদ্ধনাথের দরবারে। শিববাড়িতে তখন সন্ধ্যায় ঢাকের বাদ্যি বাজছিল। চৈত্রে নহবত বাজে বাবার বিশেষ পূজায়। শিববাড়ির সুবিশাল মাঠ। এই মাঠে চড়কের মেলা বসে। গরু ছোটানো উৎসবও হয়। আশেপাশের গ্রাম থেকে ভক্তরা পুজো দিতে এসে মাঠেই চুপ মেরে বসে। আমরা এসেছি সন্ন্যাসী বাবার জীবন্ত সমাধিবেদিতে ডাকিনী মা এক ভক্তের শাক্তাভিষেক দেবেন বলে।
অভিষেক ক্রিয়া আরম্ভ হবে তখন। আসনে বসে ডাকিনী মা এখন জগন্মাতার চরণচিন্তা করছেন। মন্ত্র বলছেন, ওঁ তৎ সৎ। হ্রীঁ দেবী, তৎপ্রাকৃতং চিত্তংপাপাক্রান্ত মভূন্ময়। তন্নিঃ সারয় চিত্তান্মে পাপং হূঁ ফট চ তে নমঃ।। ওঁ হ্রী সূর্য্যঃ সোমো যমঃ কালো মহাভূতানি পঞ্চ চ। এতে শুভাশুভস্যেহ কর্ম্মনো নব সাক্ষিণঃ।।
গতকাল দীক্ষাভিলাষী বলে মহেশানন্দজির সঙ্গে আমরাও নিরামিষ আহার করেছি। হবিষান্নভোজী হয়ে সংযমে থেকেছি। শিবস্বরূপ আদিগুরু বৃদ্ধ ব্রহ্মানন্দদেবের পুজোও সারা হয়ে গেছে তখন। ডাকিনী মা আদিগুরুর দক্ষিণাচারী শিষ্য—পরম্পরার। এখানে তাই বাহ্য পঞ্চমকারের বিধি কিছু নেই।
ব্রহ্মানন্দ ঠাকুরের কাছে শাক্তাভিষিক্ত হতে এসেছিলেন এই বাংলায় শংকরাচার্য। অদ্বৈতবাদের বিচার প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। শংকরাচার্য যে মঠে অতিবৃদ্ধ আদি তন্ত্রগুরুর কাছে উপদেশ গ্রহণ করেছিলেন সেই জায়গাটি ডাকিনী মা বলেন বাংলার নিভৃত স্থানে এখনও লুক্কায়িত দশায় রয়েছে। মাকে জিজ্ঞেস করলেই তো তিনি খালি বলেন, আদিগুরু এখনও জীবিত। আনন্দমঠে তিনি সিদ্ধনাথের মতোই লিঙ্গশরীর নিয়ে আছেন।
বললাম, এত কৃপা করলেন আমায়। এত শাস্ত্রপুথির গোপনপাঠ দিলেন। একবার আপনার আদিগুরুর কাছে নিয়ে চলুন না আমায়।
আমার আর্তি শুনে ডাকিনী মা এবার চওড়া এক অট্টহাস্য করে রাতের সমাধিবেদিকে যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য কাঁপিয়ে তুললেন। মায়ের এই হাসিতে কলজে ঠান্ডা হয়ে আসত আগে। এখন খালি শরীরে একটু কাঁপানি আসে আমার। গুরুগম্য এই বিদ্যা মঙ্গল শনিবারের মহানিশাতে সম্পন্ন করতে হয়। মা আমাকে বলেছিলেন ওঁর গুরুদেব নরকপাল রক্তপূর্ণ করে ডাকিনী দেবীর পূজা সারতেন। দ্বারকায় স্নান করে তিনি দাদুগুরুর নির্দেশ মেনে চন্দনকাঠের মণ্ডল তৈয়ারি করে তার ভেতরে মন্ত্রময়ী ডাকিনী দেবীর মূর্তি এঁকে তুলে নরকপালে ভরা সেই বলির রক্ত অন্নপাত্রের ওপর মাছের সঙ্গে সাজিয়ে নিয়ে ধ্যানে বসতেন। মাও সেখানে ছিলেন।
মা বললেন, গুরুদেব বলছেন, ওঁ কর্কশে সিদ্ধিদে দেবী মহাবিঘ্ন বিনাশিনী। ঐশ্বর্য্য মতুলং দেহি বলিং গৃহৃ নমোহস্তুতে।। শ্মশানে সাতদিন পুজোর পর অষ্টম দিন রাতে মনোহরা সিদ্ধ ডাকিনী কর্কশাদেবীর আওয়াজখানা শুনতে পেলাম আমি।
বললাম, আপনি তো ছিলেন মা। দেখতে পেলেন না কেন, কর্কশা দেবীকে? আর গুরুদেব কীভাবে একই জায়গায় থেকে সিদ্ধ ডাকিনীর দেখা পেলেন?
দখিনা বাতাস বইছে তখন। কৃষ্ণচূড়া আর বকুল লুটিয়ে আছে বক্রেশ্বরে অঘোরীবাবার ডেরায়। ডাকিনী মায়ের হাতে মড়ার মাংস। ভৈরব খানিক শ্মশান থেকে খুবলে এনেছেন খাবেন বলে।
মা বললেন, লে, মহামাংস তুই—ও খানিকটা খা। পিশাচ সাধনায় গুরুদেবের সঙ্গে আমরা কত মহামাংস খেয়েছি।
ভৈরব দেখলাম মড়ার মাংস কারণের সঙ্গে মাথার খুলির ভেতর চুবিয়ে টুপুস করে গিলে নিলেন। ডাকিনী মা—ও তো একই কায়দায় মহামাংসের প্রসাদ নিলেন। এবার আমার পালা।
শুনেছি এ জায়গায় অষ্টাবক্র ঋষি সাধনে বসেছিলেন। প্রাচীন অশ্বত্থের গোড়া ঘিরে বাঁধানো বেদি। মহাভারতের কিংবদন্তি জড়িয়ে গেছে এ জায়গায়। ঋষি এখানে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন বক্রেশ্বর শিব আর ঈশানী দেবীকে। বিষ্ণুচক্রছিন্ন সতী ঈশানী। আজ এখানে ভোগ হয়েছে আমদানার কুশি দিয়ে। ডাকিনী মা শিলে থেঁতে কটকটে কাঁচা লংকা আর নুন, কাঁচা সরষের তেল দিয়ে মেখে থালাভর্তি গরম ভাতের সঙ্গে দিয়েছেন ভোগ হিসেবে। উপাদেয় সেই ভোগের পর এবার কিনা এই মানুষের মাথার খুলিতে থাকা মদে ভেজা মরার হাড়—পাঁজরাটা খেতে হবে আমায়! আমি ভাবছি।
আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন মায়ের এক দেহাতি বৃদ্ধ ভক্ত। হাতের চেটোয় কপালের ঘাম মুছে তিনি আমাকে বললেন, মহামানসোর ভিয়েন গো ও। খাও না ক্যানে? ভাল লাগবেক বটে। একি চাট্টিখানি ভাগ্য। সাধনে ব্যুসে যাও তবে ক্যানে? সাদু হঞ্ছি, মহামানসো বুঝ লাই ক্যানে? সাধন ভজনে উঁ খ্যালে পাক হবে গ’। উঁ হোল্য গিয়া…
ডাকিনী মা তখন দেহাতি এক মেয়ের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। তার কাঁধে এক মাটির কলসি। কলসি ভর্তি মহুয়ামদ। ওতেই ভিজে আছে মহামাংস। যার প্রসাদ আমি এখনও নিয়ে উঠতে পারিনি।
চোখ পিটপিট করছেন দেহাতি বৃদ্ধ। চৈত্র শেষ। উঁকি মারছে বৈশাখ। আমার সাধনে তবে কি নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার নেই! ভৈরব তখন ত্রিশূলের মতো উঁচিয়ে গলা আকাশটাকে দেখছেন। কিছু আগেই তিনি আমাকে বলে গেছেন কয়েক দিনের ভেতরে ঘূর্ণি হাওয়ার দাপট উঠবে। আকাশের চিবুকখানা তাই খালি কড়কড় কড়কড় করছে। ওর থেকেই তো আকাশ দেবতা তাঁর লকলকে জিহ্বাখানা বের করেন শীৎকারের সময়।
দেহাতি বৃদ্ধ ভক্তকে বললাম, মহামাংসের মধ্যে আর কী কী আছে গো, সাধু?
বৃদ্ধ বললেন, খাও না ক্যানে? সগ্গ থিক্যা ভগবান চড়চড় কোরাঞ লামবেক লাই।
ভগবান তবে কোথায় থাকেন গ’?
সাদু হঞ্ছি, উঁ বুঝ না? মহামাংস পেট্যের ভিত্যর গেলি, দশহাত ম্যেলব্যে গ’ দশভুজার পারা।
ওর ভিতর কী আছে গ’, সাধুবাবা?
মড়ার ঘিলু আর লক্ত, মায়ের মাসিক, বাবার বিজ্য, তালগুড়, বাবলার ছাল, লবং আর ছিটেক ফোঁটাক নবন গ’।
শরীরটা আমার কেমন গুলিয়ে উঠছে তো এবার। তারই ভেতর দেখি কখন এসে দাঁড়িয়ে পরেছেন ডাকিনী মা। হাতে ওঁর নরকপালখানা। যার মধ্যে রয়েছে মহামাংসের প্রসাদি সরবত।
মা বলছেন, অষ্টধাতুর উপাদান কি না। তোর শরীরেও যাওয়া চাই।
জানি না কোথায় গেল সেই ঘিনঘিনে দশা! কোথায় আমার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ! কোথায় আমার বিদ্যাশিক্ষার বহর!
ডাকিনী মা আমাকে সম্মোহিত বিদ্যায় আটকে ফেলেছেন। আমি দেখছি ধীর পায়ে শিরা উপশিরা বেয়ে ছুটছে এক দুরন্ত নেশা। যা পেটের ভিতরে ঢুকে আছে।
মল্লেশ্বর শিববাড়িতে সিদ্ধনাথ ও সিদ্ধেশ্বরী দর্শনের পর আমরা এখন কৃষ্ণানন্দ সরস্বতী আগমবাগীশের জীবন্ত সমাধিবেদিতে বসে। মন্দিরের পুকুরে কিছু আগে স্নান হয়েছে আমার। হাতে আমার ফুল ও ধূপকাঠি।
জায়গাটার নাম মল্লেশ্বরতলা। এখানেই রয়েছে রামপ্রসাদ সেনের গুরু তন্ত্রধারক কৃষ্ণানন্দ সরস্বতী আগমবাগীশের জীবন্ত সমাধি। ভৈরব বলছেন আমায়, রাজার নাম মল্লরাজ। ওঁর নামেই অঞ্চলের নাম। শিববাড়ির লিঙ্গমূর্তির প্রতিষ্ঠা। তখন তো ঘন জঙ্গলে মন্দিরে বাস করেন শিবরূপী বাবা সিদ্ধনাথ। সঙ্গে ওঁর ভৈরবী মা সিদ্ধেশ্বরী। গভীর জঙ্গলে দুজনের কাটছিল দিন সাধনায়। একদিন এলেন নদিয়া থেকে শ্বেতবস্ত্র এক সন্ন্যাসী। তিনি হয়ে উঠলেন এরপর তন্ত্রাচার্য। কুমারহট্ট থেকে রামপ্রসাদ এলেন একসময় গুরুর খোঁজ পেয়ে। কৃষ্ণানন্দ কর্ণমূলে মন্ত্র দিলেন প্রসাদকে। একসময় তিনি মাটি খুঁড়ে গুরু গুরুমায়ের ধারেই নিয়ে বসলেন জীবন্ত সমাধি।
চৈত্রে নিমফুল এখন গন্ধ ছড়ায়। মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ। জঙ্গল থেকে ভেসে আগে ঘুঘু পাখির ডাক। দুপুরে ক্লান্তমন যত না আমার প্রকৃতির মোহিনীমায়ায় আক্রান্ত তার থেকেও তো আমি জখম ডাকিনী মায়ের সম্মোহনে।
গভীর রাতে সেদিন তিনি বেদিতে বসেছেন ধূপ জ্বেলে। রয়েছেন মায়ের ভৈরব। দীক্ষার হোম করতে গিয়েছ রাত বেড়েছে অনেক। আমি মায়ের যত না সাধক শিষ্য তার থেকেও বেশি জিজ্ঞেসু। গুপ্ততন্ত্র, গূঢ়যোগ জানব বলে সাধু সেজে আছি। জানাটাই আমার পথ। সাধু হওয়া নয়।
মা বললেন, মহাপূর্ণ দীক্ষাভিষেক হয়েছিল জানিস, গুরুদেবের। বিরজা সম্পন্ন করে তিনি দর্শন পেয়েছিলেন গুপ্ত সেই মঠের। ও মঠে শিবের আদেশ লেগে। ওখানেই হাতে লেখা বিবিধ তন্ত্র ও যোগের পুথি—পাতরা সব আছে।
বললাম, আপনি গেছেন তো সেখানে?
ডাকিনী মা গম্ভীর হলেন। এর আগেও গুপ্তমঠ নিয়ে আমার প্রশ্নে তিনি নিজের মুখে আগল দিয়েছিলেন। বুঝি আজও তিনি নিজেকে সামলাচ্ছেন। বাংলার মুখে তান্ত্রিক সাধনা শিক্ষার মূল পীঠ না কি এটাই। যার নাম আনন্দমঠ। গঙ্গাসাগরের কাছে কোনও নিভৃত স্থানে এই মঠখানি আছে এখনও অতি সংগোপনে রক্ষিত হয়ে। এখানেই রয়েছে আদি অতিবৃদ্ধ তন্ত্রগুরু ব্রহ্মানন্দ ঠাকুরের লিঙ্গ শরীরখানা। এটুকু বুঝেছি তো আমি এতদিনের অধ্যাত্মবাদচর্চায়, এই জায়গাটা ভৌগলিক জায়গার মতো কখনও নয়, এটা গুপ্তভাবে বিদ্যমান আছে আমাদেরই বাংলায়; তিব্বতে অবস্থিত সেই জ্ঞানগঞ্জের মতো। এ হল চরম সাধনার পরম স্থান। সেজন্যই এই গোপন ভূমির কথা মা আমার থেকে এড়িয়ে যান। আমি জানি না মা নিজে আনন্দমঠ কখনো গেছেন কি না। মা ওঁর গুরুদেবের কথা বলেন। বলেন, লিঙ্গদুয়ারের দক্ষিণ দিকের যে দরজাটি সেই দরজা দিয়ে গুরুদেব ঢুকে গিয়েছিলেন।
তবে কি ডাকিনী মা আনন্দমঠের লিঙ্গদুয়ার অবধি যাওয়ার পর্যায়টুকু অতিক্রম করেছিলেন! ভাবাবেশে ধ্যানস্থ মায়ের শরীর থেকে আমি জ্যোতি বের হতে দেখেছি তো বার কয়েক।
তিনি বলেছিলেন, ওসব কিছু নয়। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে। একটু অন্তর্মুখ হয়ে নিজের ভেতরখানা খুব হালকা করে খুলে দে না রে, তুই। তখন দেখবি আশপাশের আকাশ বাতাসের সঙ্গে নিজেকেও এক বলে মনে হবে তোর। এই একীভূত দশার একখানা আলো আছে রে। যা তুই দেখে ফেলেছিস হঠাৎ করে।
বললাম, আমার কী আর অমন হবে?
মা বললেন, শরীরকে মার। মহামাংসের ছিদ্রপথে শরীরে তোর জ্যোতির পোষণ করেছি। শ্বাসের দিকে চোখ রেখে মানস জপে যা। জপাৎ সিদ্ধিঃ, জপাৎ সিদ্ধিঃ জপাৎ সিদ্ধিঃ ন সংশয়ঃ।
ওঁ হ্রীং হ্রীং
মল্লারপুর শিববাড়ির দক্ষিণদিকটা গাছগাছালির ছায়া দিয়ে ঘেরা। সেই ছায়া ধরে এগোলেই যে গ্রামখানা পড়ে তার নাম মদিয়ান। বেশ কিছু বছর আগে এই মদিয়ান গ্রামের কথা আমাকে বলেছিলেন পূর্ণদাস বাউল। এই গ্রামেই একসময় আখড়া ছিল নবনী দাসের। সেই আখড়াবাড়িতেই জন্মেছিলেন পূর্ণদাস আর ওঁর ভাই লক্ষ্মণদাস বাউল। মদিয়ানের কালীর থান বেশ পুরোনো। সুপ্রাচীন অশ্বত্থতলার নীচে মাটির বেদি। বেদিতেই দক্ষিণ মুখে বসানো এক শিলামূর্তি। শিলার কিছুটা অংশ দেখা যায়। বাকিটা মাটি দিয়ে চাপা। বেদির মাথায় যুগল হয়ে অশ্বত্থকে আগলে রেখেছে আবার সমসাময়িক বট। থানের ধারে খেজুর, তাল, কাঁটা গাছের ঝোঁপ। ঝোঁপ পেরোলেই স্বচ্ছতোয়া একখানি পুকুর। আর এই পুকুর পাড়েই সোমানন্দ অবধূতের সাধন কুঠিয়া।
কঞ্চির বেড়া ঘেরা একটি কুঁড়ে। মাটির দাওয়া। সিঁড়িটা নিকনো, পরিষ্কার। টিনের দরজাটায় শিকল তোলা। সেদিকে নজর পড়তেই চমক লাগল আমার। দেখি, আলকাতরা দিয়ে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে—অপূর্ণাভক্তাবধূত সোমানন্দ।
এর তো মানে বুঝলাম না আমি। বুঝলাম অবধূত বাবাজি কুঠিয়ায় নেই। ডাকিনী মা দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন। আরক্ত চক্ষু, মাজা মাজা রং। দেহের তখন টলায়মান অবস্থা। গত রাতের হোমের পর থেকেই মায়ের বাহ্যদশা চলে গেছে। মাঝে মাঝে শরীর শক্ত হয়ে উঠছে।
হাঁটু অবধি নামানো কাছাহীন ময়লা লাল কাপড় পরা ভৈরব। মাথায় ওঁর চুলের জটা বিড়ে করে বাঁধা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। দুই ডানায় রুদ্রাক্ষের তাগা।
দশাসই চেহারার মানুষটা পর্যন্ত সামলাতে পারছেন না মাকে। সকাল সকাল মায়ের দেহের অবস্থা টলটলায়মান দশায় একেবারেই ঢুকে পড়ায় শিববাড়ির সাধুবাবাই এখানে পাঠালেন খানিক বিশ্রামের জন্য।
মাঝে মাঝেই ডাকিনী মায়ের চাপা গলাটা গরগরিয়ে উঠছে। আরক্ত চক্ষু শিবনেত্র করে তাকিয়ে থাকছেন মা। রক্তিম চোখের দপদাপানিতে শরীর থেকেই আগুন বেরোচ্ছে যেন। নাসারন্ধ্র কাঁপছে থরথর করে। মায়ের সারা গায়ে চোখে মুখেই যেন এবার আগুন লেগেছে। ফণা তোলা সাপিনীর মতন মা আবার কখনো উদ্যত হয়ে উঠছেন, কখনো ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে ওঁর ধনুকের মতো। তিরের মতো একটি শব্দ বেরোচ্ছে, ক্রীং।
রক্ষা করো। ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং হূং হূং হ্রীং হ্রীং দক্ষিণে কালীকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হূং হূং হ্রীং হ্রীং স্বাহা। ক্রীং হল রক্ষা মন্ত্র। দক্ষিণা কালী আমার মস্তক রক্ষা করো। ক্রীং ক্রীং ক্রীং—এই ত্রিবীজরূপিণী খড়্গধারিণী কালিকা আমার ললাট, হূং হূং বীজদ্বয়রূপিণী নেত্রযুগল, হ্রীং হ্রীং বীজদ্বয়রূপিণী আমার কর্ণযুগল রক্ষা করুন। এরপরই তো সাধক বলেন, স্বাহা।
প্রণাম করা। লুটিয়ে পড়া। কেউ আবার বলেন, ফট স্বাহা।
ফট হল সর্বাঙ্গে। মানে কালী সারা দেহে বিরাজমান হও। এ হল গিয়ে সাধনের শক্তি।
বেশ ধরতে পারছি মায়ের শরীরে এখন শক্তিময়ী বিরাজমানা। চোখের তারায় যেন দুটি মুক্তো বসেছে। আলোয় চিকচিক করছে।
কঞ্চির বেড়ার সীমায় দাঁড়িয়ে আছি আমি তখন থেকে। বেড়ার ধারে লাউয়ের মাচা। সবুজ কচি লাউডগা মাচার আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুল ধরেছে অনেক। ফল আসেনি তো এখনও।
ফুলে বসেছে মৌমাছি। এ ফুলের সঙ্গে ও ফুলের রেণুতে রেণুতে মাখামাখি করে সে মিলন ঘটাবে বোধহয় এবার। পরাগমিলন। এও কী সেই নিভু নিভু প্রদীপের আলোয় ঝুঁকে পড়া সেই দুটো দেহের মতোই হয়ে উঠবে! চারপাশে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ঘুম ছিল না কাল আমার চোখে। চললাম পঞ্চমুণ্ডির আসনের দিকে চুপিচুপি।
শিববাড়ির জঙ্গল পঞ্চমুণ্ডির আসন। সেই আসনে ল্যাংটো হয়ে বসে আছেন ভৈরব। মহাশক্তি স্বরূপিণী, শিব ঘরনি উমাকে তখন প্রণাম জানাচ্ছেন মাধবীরূপে—পরমা বৈষ্ণবীশক্তিরূপে—অনন্তবীর্য্যারূপে!
বলছেন হে দেবী, তুমি অনন্তশক্তিশালিনী, বৈষ্ণবীশক্তিরূপে জগৎপালিকা, তুমি বিশ্বের আদি কারণ। সমস্ত জগৎকে মোহঘোরে তুমিই তো ডুবিয়ে রেখেছো। আবার তুমি প্রসন্না হলে, সব শরণাগতকে তুমিই পরমা মুক্তি দিতে পারো।
ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরনন্তবীর্য্যা
বিশ্বস্য বীজম্ পরমাসি মায়া
সম্মোহিতং দেবী সমস্তমেতৎ
ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি হেতুঃ।।
কুঠিয়ার শিকল খোলা হয়ে গেছে তখন। ডাকিনী মা এখন ঘরের ভেতর। চোখের রং বদলাচ্ছে যেন ওঁর, অবধূত সাধুর চণ্ডীপাঠে। চোখদুটিতে শক্ত, উদ্ধত ভাবটি আর নেই। সারা চোখে মুখের রক্তাভ জ্বলজ্বলে ভাবটা যেন চলে যেতে শুরু করেছে।
অবধূত বললেন, বাইরে আসুন। রাতের চক্রেশ্বরী দশা থেকে শরীর স্বাভাবিকতা নিতে আরও খানিক সময় নেবে, বাবা।
ভৈরবের তখন দেখি চোখ নামানো দশা। যেন হেরে যাওয়া একখানি মুখ। আমি ব্যাপারটা তো কিছুই বুঝলাম না।
অবধূত বলছেন, বাবা, নারীই শক্তি, শক্তিময়ীও বটে। সেই তো নিয়ে যাবে সঙ্গমের পথ ধরে ঈশ্বরসঙ্গমে। আপনাকে বানাবেন ঈশ্বর। নিজেকেও করে তুলবেন তিনি ঈশ্বরী।
ভৈরব চুপ মেরে বসে। আমি তো কাল দেখেছি, তিনি পদ্মাসনে বসেছেন। ডাকিনী মাকে কোলে বসিয়ে লিঙ্গস্থাপনা করছেন ওঁর যোনিতে। পদ্মাসনে বসে সব নবাগত সাধক—সাধিকারা। নিরুচ্চার মন্ত্রজপের দোল—দোলানো তাল তখন। তাল কাটতে দিচ্ছিলেন না তো চক্রাধিপতি ভৈরব। চক্রেশ্বরী ডাকিনী মায়ের কঠিন চোখ আমাদের দিকে।
আমি চক্রমধ্যে তখন নেই। শরীর—মন নিয়ে সেই চক্র আসরে নিজেদেরকে মেলে দিচ্ছিলেন সাধক ও সাধনসঙ্গিনী। মায়ের নির্দেশ মতো আমি সকলের নরকপালে কারণবারি ঢেলে দিচ্ছিলাম। পঞ্চশস্যকণার রুটি বানিয়েছিলেন প্রেমানন্দজি। সেই রুটির সঙ্গে মাছপোড়া আমি এগিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিলাম সাধকদের দিকে। ওঁরা সব পদ্মাসনে বসে সাধনসঙ্গিনীদের কোলে বসিয়েই তুলে দিচ্ছিলেন তাঁদের মুখে পঞ্চমকারের আহার। সাধকরা মহাশক্তিরূপে তাঁদের প্রতিটি অঙ্গকে এরপর ন্যাস করে নিলেন। তারপরই চক্রাধিশ্বরীর কথামতো আমাকে আর প্রেমানন্দজিকে স্থান পরিত্যাগ করতে হল। এর বেশি দেখবার অধিকার আমাদের নেই। আমি তখনও প্রকৃতি—পুরুষ সাধনার উপযোগী হয়ে উঠিনি।
অবধূত বললেন, ভৈরব, পদ্মাসনে বসে, চোখ বুজে প্রথমে কল্পনা করে নেবেন এরপর, একটা শুভ্র আলোকপ্রবাহ উজিয়ে চলেছে আপনার শিরদাঁড়াটা বেয়ে মাথার খুলির দিকে। লিঙ্গমূল থেকে সে তো উঠেছে নদীর মতো। তাকে তাতিয়ে তুলতে হবে প্রথমে।
আমি তো তখন মন দিয়েই শুনছি খালি অবধূত বাবাজির কথা। কেননা এই সাধনপাঠ তো ডাকিনী মা আমাকে বছর খানেক হল দিয়েছেন।
ডাকিনী মা বলেন, শিবের পাঠশালাটা রোজ বসবে বুঝলি। এ পাঠশালাই শেখাবে তোরে শরীরের মধ্যে থাকে লতাগুল্ম। বর্ষার নতুন ধারায় যেমন জেল্লা মারে লতাগুল্ম; লকলকিয়ে ওঠে তেমনই ইন্দ্রিয়ের নাচন চলে লিঙ্গ সঞ্চারকালে। যোনির পিচ্ছিল পথে পুরুষ ঢালেন তাঁর রেতঃ। উভয়েই ওই রসধারা শোষণ করেন তখন উত্তাপে পাগল—পাগল হয়ে। আসলে তো এই দশায় জেগে ওঠে শরীরের কতকগুলা মাংসপেশি। তা দিয়ে ওই রেতঃ সঞ্চারিত করে তোলে গোটা শরীরটাকে। ওই রজঃ—রস—রেতঃবস্তুর তদারকি করতে হবে বুঝলি, এই শিবের পাঠশালায়।
বললাম, কেমন করে তা করব?
পঞ্চমকারের সঙ্গমসুধায় চলে যেতে হবে তোকে। চরম মুহূর্তে দমকা মেরে কুম্ভকের দম বন্ধ করে দিতে হবে। ঘুরিয়ে দিতে হবে রেতঃবস্তুর শিহরণকে।
বুঝলাম, ছন্দে—চাপে গতরাত্রেও শরীর উঠছে পড়ছে তখন ধ্যানের পদ্মাসনে। তারই ভেতর লিঙ্গকে অভ্যাসে বেড় দিতে পারেননি ডাকিনী মায়ের ভৈরব। দ্বার রুদ্ধ হয়নি ওঁর। বীর্য বেরোনোর আগল ছিল পুরোপুরি খোলা। আর তখনই ঘটনাটি ঘটে গেছে। ঊর্ধ্বপানে, মাথার ঘিলুতে মায়ের দমিত শিরাগুলির জটলা আর এদিকে দ্বারে চাপ খেয়ে আটকে রাখা রেতঃবস্তুর দাপট—সমস্তটাই রমিত শরীরকে তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে বের করে দিয়েছে। তাতেই ডাকিনী মায়ের উথালপাতাল দশাপ্রাপ্তি। যার জের এখনও কিছুটা চলছে। ডাকিনী মা শুয়ে আছে অবধূত ঠাকুরের ঘরে। রুদ্রাণীমূর্তি স্তিমিত হচ্ছে ক্রমে। ডাবের জল খেয়েছেন তিনি।
জটাধারী ভৈরবের চোখের কোণ কুঁচকে গেছে তখন। মুখ শক্ত দেখাচ্ছে। রসের ঝোঁকে টাল খাওয়া শরীর তাঁর। শরীরে লেগেছে অসিদ্ধি।
আমি বেশ বুঝতে পারছি যারা এই রমণযুদ্ধে হেরে যায়, বমন করে রেতঃবস্তু, তারা ফিরে যায় ঘরে—মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে। তাদেরকে সিদ্ধ তান্ত্রিক সমাজ দল থেকে বের করে দেন ঘাড় ধরে। সে তখন পাগল হয়। বড় মাপের সাধুর বেশ ধরে মঠ—মন্দির বানিয়ে সিদ্ধাই হওয়ার ব্যবসা করে। ভাবছি, ভৈরবের কি তবে যবনিকা পতন হবে এবার?
ভাবতে ভাবতেই অবধূত বাবাজির আলকাতরায় লেখা সেই দরজার দিকে চোখ যায় আমার। তখন দুপুর গড়িয়েছে। পাখির পিক—পিক চিক—চিক ডাক উঠছে পুকুরধার থেকে। গাছগাছালি কেমন থমকে আছে।
অবধূত বাবাজির কাঁচা—পাকা খোঁচা খোঁচা চুল, আঁচড়ানো নেই। রোগা, লম্বা, পঞ্চাশ পেরোনো লোক। মদিয়ান কালীর থানে আছেন দশ বছর। সত্যনারায়ণ সাধুর ডেরা এটা। এখানেই ওঁর বসা সমাধি। এখন সমাধি আগলে আছেন। শিববাড়ির তন্ত্র সাধনায় সাধকরা এলে ওঁর চক্রাধীশ হওয়ার ডাক পড়ে। ওঁর কঠিন চোখ। ভুল হবার জো নেই। ভুল দেখলে শুধরে দেন। তন্ত্রশাস্ত্রের করণজ্ঞান ওঁর ঠোঁটের ডগায়।
বললেন আমায়, দরজায় চোখ গেছে যখন, তখন জিজ্ঞাসা আছে। বলিনি আগে। অবধূতদের তিন দল আছে। গৃহাবধূতরা সংসারী, ভক্তাবধূতরা সব ভক্তিমার্গের মানুষ। তাঁদের একদল পরিব্রাজক শ্রেণির—অপূর্ণভক্তাবধূত। আরেক দল পরমহংস স্তরের—পূর্ণাভক্তাধূত। আর আছেন কূলাবধূত গোত্রীয়রা। এঁরা সন্ন্যাসী। আমার গুরু এই মার্গের। তিনি শৈবাবধূত। ডাকিনী মায়ের গুরু ছিলেন হংসাবধূত। খুব উঁচ্চাই দশা। আর ভৈরবের গুরু ব্রহ্মাবধূত গোত্রীয়।
কথার ফাঁকে শিবের পাঠশালায় কখন এসে বসে পড়েছেন ডাকিনী মা আমি বুঝতেই পারিনি।
গুরু কৃপা হি কেবলম
রাতে শিববাড়ির জঙ্গলে পাকুড় গাছের ডালে ঝুলে পড়লেন ডাকিনী মায়ের ভৈরব ঠাকুর। ভোর ভোর সন্ন্যাসী বাবার সমাধিবেদি ধোয়া—পাকলা করতে গিয়ে সে দৃশ্য চোখে পড়ে যায় বিশুর। সে ছুটতে ছুটতে মদিয়ান এসে অবধূত ঠাকুরকে খবর করেন। আমাদের সেদিন ধর্মরাজ যাওয়ার কথা। ঘাঘার জঙ্গলে।
হল না। তড়িঘড়ি সব ছুটলাম মল্লেশ্বর। ডাকিনী মা প্রথম গেলেন সন্ন্যাসীতলায়। ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিলেন। প্রণাম সারলেন ভক্তিভরে। ধ্যানে তাঁর শান্ত চোখের পাতা বোজা। অবধূত দাঁড়িয়ে রয়েছেন পাশে। কারও শরীরেই যেন কোনও ভাবান্তর নেই।
ভাবান্তর আমার মনে। সন্ন্যাসী বাবার সমাধিতলে বসে ভাবছি, সাধনে অসিদ্ধি নিয়ে, আঘাত পেয়ে ভালো মানুষটা শেষে কি না এভাবে চলে গেলেন! ভৈরব আমাকে কত্তকিছু শিখিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদ যখন থাকতাম, জঙ্গল থেকে কেঁউ মূল তুলে আনতেন আমার জন্য। বলতেন, রোজ কাঁচা কাঁচা চিবিয়ে খা কেঁউ। এতে দেহ—মনের অক্ষমতা দূর হবে। লিঙ্গ শক্ত—সবল হয়ে উঠবে। ঈশ্বর হবার পথে চক্রাধিশ্বরীর আসনে বসে সঙ্গমলীলা লাগে রে। এ কী আর মাল—ফাল খেয়ে মাগি নিয়ে শোয়াশুয়ি না কি রে?
বলি, এ তবে কী, ভৈরব?
সুঠাম দেহ, মুখ ভর্তি সাদা কালো দাড়িগোঁফের জঙ্গল নিয়ে তন্ত্রাচার্য ভৈরব বলেন, পঞ্চমকার হল এক বলবান পদ্ধতি, তন্ত্র সাধনার প্রধান ক্রিয়া। যে ক্রিয়াতে সাধক তান্ত্রিক নিজেকে ভগবান করে তোলেন আর ওঁর শক্তিময়ী সাধনসঙ্গিনী তখন হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ভগবতী।
এর মানে কী গো, বাবা? বলি আমি।
তান্ত্রিক বেদি ঘিরে তখন বসে। চারপাশে প্রচুর মড়ার খুলি, অজস্র হাড়গোড়। সিঁদুর মাখানো। পিলসুজে প্রমাণ সাইজের একখানি মাটির প্রদীপ জ্বলছে। ধূপধুনোর গন্ধে চারিদিক আমোদিত। যে কুঠিয়ায় আমরা বসে আছি তার নাম কাম মন্দির। এখানে থেকেই রোজ সকালে আমি খালি পেটে কেঁউ মূল খাই। স্থানীয় লোকরা বলে, কেমুক। অনেকে বন থেকে তুলে সেদ্ধ করেও খায়। এভাবে অনেকখানি খেলে পেট ভরে। দরিদ্রদের একবেলার ভাত বেচে যায়। কেঁউয়ের মোটা মোটা ছড়া হয় গাছের গোড়ায়—মাটির নীচে। এগুলো হলুদের মতোই মোটা মোটা হয়। কাঁচা চিবিয়ে খেলে আদার মতোই ঝাঁজ লাগে। তান্ত্রিক বাবার কথামতো রোজ সকালে উলটিক্রিয়া করে, পেটের জল বের করে দিয়ে আমি খাই কেঁউয়ের জড়। ভৈরব বলেন, মা আমাদের কাত্যায়নী কেন রে, জানিস?
বলি, কেন?
খাঁড়া হাতে তিনি দাঁড়ায়ে পড়েন বলেই মা আমাদের কাত্যায়নী।
এর আসল মানে কী গো, বাবা?
খাঁড়ার এক নাম হল গিয়ে কাতান রে। কাতান মানে কচুকাটা করা। ভৈরব এবার তাকিয়ে বললেন, কী বুঝলি রে, তুই?
বললাম, ইন্দ্রিয়গুলোকে কচুকাটা করতে হবে বাবা, ওই কাত্যায়নী মায়ের কাতান দিয়েই।
ভৈরব ঠাকুর আমার কথা শুনে মৃদু হাসেন। বলেন, পরনে তোর লাল পট্টবস্ত্র। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ফরসা রঙা তান্ত্রিক রে তুই। কেঁউ জড় খা। লিঙ্গদণ্ডটাকে সবল কর। আদি রসের ধারায় খালি সিক্ত হলে চলবে না রে, বাপ। সেটা হলে আমাদের সঙ্গে থাকা তোর নিষ্ফল হবে।
জিজ্ঞেস করি, তবে?
কাম মন্দিরে পাতা ক্রিয়ার আসনে বসে বাবা এবার বলেন আমায়, জানবি বিশ্বপিতা—মাতা শিব—শিবানী, ওই পঞ্চমকারে সৃষ্টির আদি থেকে লীন হয়ে আছেন। তারই প্রতীকীখানা হল গিয়ে লিঙ্গ ও যোনিপট। শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলাখানাও জানবি পুরোপুরি তান্ত্রিক আচার।
বলি, কীরকম!
গোপীদের সঙ্গে রমণ করতেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বৃন্দাবনে রাসলীলার আসরখানায় তিনি তো সেই তান্ত্রিক মতেরই চক্রেশ্বর রে। রাসেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ; চক্রেশ্বর শিবের মতোই। আর রাসেশ্বরী আমাদের রাধারানি; চক্রেশ্বরী শিবানী। কোনও পার্থক্য নেই রে। সব এক। আর এই কাম—প্রেমের একতায় কামের কাতন দিয়ে প্রেমের মহাদশায় পৌঁছতে হবে।
কীভাবে এই দশাপ্রাপ্তি আসে গো বাবা, শরীরের?
পঞ্চমকারে বসে কোনওভাবেই চক্রেশ্বরীর গর্ভে, গর্ভের বাইরেও কখনো বীর্যপাত করা চলবে না। বীর্যবস্তুর বেগ, যোনিতে অনর্গল ঘর্ষণের বেগ, স্তনমর্দ্দনের বাঁধহীন আবেগকে ঠিক ওই নালা কেটে বাড়িতে জমা বর্ষার জলের মতো বের করতে হবে। জলের মুখ ঘুরিয়ে দিতে হবে।
কেমন করে?
অণ্ডকোষ আর শিরদাঁড়ার ফোকর দিয়ে জল যাবে মাথার কোটরের ছ—ছয়টা গ্রন্থি ভেদ করে। সেই গ্রন্থিত পৌঁছলেই ভগবান বনে যাওয়া যায়। বহু বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া এ কাজ সম্ভবই না রে।
ভাবি আমি, কাম মন্দিরের সেই রমণ যুদ্ধে ভৈরবও শেষে কিনা পরাস্ত হলেন! কাম মন্দিরে তিনি আমাকে পড়াতেন আনন্দমঠের পুথি। স্বতন্ত্রম খুলতাম আমি। ভৈরব বলতেন তখন, বস্তু হল গিয়ে চক্রেশ্বরীর যোনিরস আর রজঃধারা। চক্রেশ্বর সাধকের লিঙ্গমুণ্ডে সারারাত বসা চক্রে বস্তু আসে, সেই বস্তুসাধনে যাওয়ার আগে রাতে মাংস মদ দিয়ে পুজো করতে হবে চক্রেশ্বরী মাতাকে। মাতা নগ্নিকা হবেন। সাধককেও নগ্ন হতে হবে। রমণের আগে চক্রেশ্বরীর রজঃক্লেদকে পুজো করতে হবে। যোনিদ্বারে দিতে হবে ফুল, মদ না খেয়ে রজঃস্বলা চক্রেশ্বরীকে রমণ না করে মাংস মাছ না খেয়ে দক্ষিণাময়ীর সাধনা করলে তান্ত্রিক সাধকের কপালে দুঃখ আছে।
প্রদীপে তেল পেয়ে কাম মন্দিরে আলো উসকে ওঠে। মন্দিরে বাবার ইয়া বড় জটার ছায়া পড়ে আমার পুথি পড়া জলচৌকির কাছে। আমি তখন ডাকিনী মায়ের খাতা থেকে পড়তে থাকি :
রাত্রৌ মাংসাসবৈর্দ্দেবীং পূজয়িত্বা বিধানতঃ।
ততো নগ্নাং স্ত্রিয়ং নগ্নো রমণ ক্লেদযুতোহপি বা।।
বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্তা মাংসং গত্বা রজস্বলাম।
যো জপেদ্দক্ষিণাং দেবীং তস্য দুঃখং পদে পদে।।
কাম মন্দিরে ডাকিনী মায়ের সন্ধ্যাপূজার পর পরই সেরে নেওয়া হত রাতের আহার। ছোটো ছোটো সব আটার রুটি, কাঠের আগুনে ঝলসানো মাংস অথবা মাছ দিয়ে হত রাতের আহার। নরকপালে আমার রুটিকে মদে ভিজিয়ে রাখতেন ডাকিনী মা। আমি মহাপাত্রের আহার সরবতের মতন পান করতাম তখন। বুঝতাম মদে দেওয়া আছে শুকনো গাঁজাপাত্তি পোড়ানো ছাই। বুঝতাম চড়া নেশায় আমাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইচ্ছে করে যাতে আমি রাতের কাম মন্দিরের দেহভঙ্গিমার অপরূপ বিন্যাস দেখতে না পারি।
আমার তখন শাক্তাভিষেক হয়েছে খালি। শক্তিমন্ত্রের বীজ আমার কানে দেওয়া হয়েছে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে। তার আগে আসনে বসা মাত্র মায়ের ভৈরব আমার সারা শরীরে মাখিয়ে দিয়েছিলেন অগুরু, চন্দন আর আমলকি তেলের প্রলেপ। ডাকিনী মা ছিটিয়ে দিয়েছিলেন কালো তিল আমার আদুল শরীরখানা জুড়ে। তারপরই আমি মা—গুরুর কথামতো আদি আনন্দমঠাধীশ অতিবৃদ্ধ শ্রীমদ ব্রহ্মানন্দকে স্মরণ করলাম। মা বলে যেতে থাকলেন, আনন্দমঠ…আনন্দমঠ। বেগবতী সেই নদী। পদ্মফুলের মতো মঠখানা। লিঙ্গময় গুরুর আলো সেখানে… সেই আলো… মহাত্মার ধুনি… হাত পোড়ে না… যোগাশনে উপবিষ্ট এক মহাপুরুষের মুখে খালি মন্ত্রের গুঞ্জরন…
হাতে আমার হলদে রঙের কাঁচসুতোর মাঙ্গল্যসূত্র বাঁধা হচ্ছে তখন। তাতে সাতটি দুব্বো দেওয়া। আমি বলছি, ওঁ হ্রীং অনেন মাঙ্গল্যসূত্রেন……….
কাম মন্দিরে নেশার ঘোরেই দেখছি তান্ত্রিক উপবেশন চলছে পদ্মাসনে। প্রদীপের হালকা আলোয় ঘরজুড়ে এক রহস্যময় কুহক। এক ভৈরব মায়ের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করলেন। মায়ের ভৈরব ডাকিনী মায়ের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন। সেই পাদোদক তিনি পান করলেন এবার ভক্তিভরে। আজ চতুর্দশী তিথি। এই তিথিতেই রমণীকে জননীতে পরিণত করে নিয়েই তো পঞ্চমকারে বসা হয়। শ্বাসের সাহায্যে মুদ্রা চালনা চলে।
তখন আমি মুদ্রা চালনা তো জানতামই না। যখন আমার মহাসাম্রাজ্যভিষেক হয়ে গেল বছর দুয়েকের মাথায়, তখন শাম্ভবীবিদ্যা আমার সামনে হতে আর বাধা তো থাকল না। কালী তারা ত্রিপুরসাধন অবধি চলে যাওয়ার পরই ডাকিনী মা আমাকে যোগদীক্ষাভিষেকও দিয়ে দিলেন।
ভৈরব বললেন এবার, দেহটাকে তোর অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক নারী করে তোলার সময়খানা এসে গেছে। অর্ধনারীশ্বরের ধ্যান শুরু করে দে দিকি, তুই। শূন্য ধারণা কর। দ্বৈতভাবের একাঙ্গে এবার পুরুষ তারপরই দ্বৈতাদ্বৈত অর্ধনারীশ্বর মূর্তির চিন্তা কর না, তুই। দেখবি অনিন্দ্যসুন্দর বিরাট দেহখানা তোর এবার সামনে ঝুলছে।
আমি দেখছি শিববাড়ির জঙ্গলে পাকুড়ডালে ভৈরব ঠাকুর ঝুলে আছেন। যিনি আমার গুরুগম্য এ পথের একজন পথ প্রদর্শক মাত্র। কখনোই গুরু নন। অসিদ্ধ, আত্মঘাতী কেউ আমার গুরু হতে পারেন না।
বাবা মল্লেশ্বর এখন স্নান করছেন। বাণলিঙ্গশিব। এই প্রথম আমি মল্লেশ্বর বাবার স্নানদৃশ্য দেখলাম। ডাকিনী মা গর্ভগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। শিববাড়ির আশেপাশে এই সংবাদ ছড়ানোর আগেই ভৈরব ঠাকুরকে পাকুড়ডাল থেকে নামিয়ে নেওয়া হল।
মা বললেন, আজ চতুর্দশী তিথি, প্রেমানন্দ। কৃষ্ণপক্ষ। শব সাধনার প্রশস্ত সময়।
ভৈরবের শব নিয়ে আমরা তখন মহাশ্মশানের পথে। গণপুর। কাষ্ঠগড়া। আম্বামোড়। রোদ চড়ছে। শুনেছি এ পথ দিয়েই একসময় সিদ্ধিনাথ দর্শন করে তারাপীঠে সাধনা করতে যেতেন বামাখ্যাপা; ওঁর শিষ্য নিগমানন্দ সরস্বতী; মানসপুত্র জ্ঞানানন্দ স্বামী। এ পথেই চলেছি আমরা। যে নারী তাঁর ভৈরবের মৃতদেহ বসে সাধনা করতে পারেন তাঁর আধার নিয়ে কোনোই সন্দেহ নেই আমার। তিনিই আমার গুরু। মনে মনে বললাম, গুরু কৃপা হি কেবলম।
নাদব্রহ্মের ধ্বনি
অবধূত আশ্চর্য লোক। গর্ত থেকে শেয়াল তুলে এনে মাংস খান। আমি দেখেছি জ্যান্ত শেয়ালটাকে কাঁচা চাল খাওয়াচ্ছেন সোমানন্দ অবধূত। শেয়াল আমিষাশী প্রাণী। চাল খাবেই বা কেন! জোর করে শেয়ালের মুখ ফাঁক করে ঠেসে ঠেসে আকণ্ঠ চালের মুঠি গেলাচ্ছেন অবধূত। ওভাবে চাল খেতে খেতে শেয়ালটা শেষে মারাই গেল।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, শেয়ালের মাংস খান কেন? আপনারা তো ভক্তিপথের—অপূর্ণাভক্তাবধূত। এ তো আপনার মুখেই শোনা।
তখন নৈবেদ্যর মতন সাজানো হয়ে গেছে শেয়াল ভাজা। ঠ্যাং—এর ওপর ঠ্যাং তুলে বসেছেন অবধূত। অন্ধকার কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাত। শুনশান ঘাঘার জঙ্গল। ধর্মরাজের বেদির পাশে আমরা সব বসে। কপালে বড়পারা সিঁদুরের টিপ পরা এক মাতাজিও রয়েছেন আজ আমাদের সঙ্গে। ওঁর ভৈরব কাছা দিয়ে লাল ধুতি পরে আছেন। গলায় বড়পারা রুদ্রাক্ষি। মায়ের গলায় হাড়ের মালা। সেজন্যই বোধহয় সকলের কাছে তিনি কঙ্কালী মা।
কঙ্কালী মা ঘাঘার পুকুরে স্নান সেরে এলেন প্রথমে। বাতাসা—মণ্ডা, সিঁদুর, ধূপবাতি দিয়ে পুজো দিতে থাকলেন ধর্মরাজের থানে। ডাকিনী মা দিলেন সরায় করে ছোলাভিজে, গুড়, ফুল—বেলপাতা। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়ে যায়। সকাল থেকে চা ছাড়া খাওয়া হয়নি কিছুই। এবার খেতে বসব আমরা।
ঘাঘার জঙ্গলে কাঠকুটো জ্বেলে কিছু আগে পুড়নো হয়েছে শেয়াল। আগুনে ঝলসে তার মাংস ও পেটের মধ্যেকার চাল সুপক্ক হয়ে উঠেছে। ধারালো ছুরিকায় পেটখানাকে গোলাকার করে ছিঁড়ে অবধূত ঠাকুর বের করে আনলেন ভাত। কঙ্কালী মা পাতায় পাতায় বেড়ে দিচ্ছেন ভাত। আমার সামনেও ভাতের পাতা, শেয়ালের মাংস আর ধর্মরাজের কিছু প্রসাদ। আমি খাচ্ছি ছোলাভিজে আর গুড়। গুরু—মা নির্বিকার। তিনি শেয়ালের মাংস ভাঙছেন। ভাতের গরাস তুলছেন। এমন নির্লিপ্তির আহার আমি কখনো দেখিনি ওঁর। যেন খেতে হবেই বলে খাওয়া। কী খাচ্ছেন সেটা বড় কথা নয়।
ঈশ্বরীয় সাধনার পথে এ আমার কঠিন পরীক্ষা। বিত্ত ও নাম যশের মোহ থেকে আমি তো মুক্ত হতে পারিনি এখনও। পুত্রৈষণাও আমার আছে। বংশের আমি একমাত্র সন্তান। কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ ও ত্রিপাপমুক্ত হওয়া সহজ কথা নয়। ও যে শ্মশানাচারীদের কম্ম। আমি জিজ্ঞেসু। শ্মশান আমাকে টানে। গভীর রাতের ভয়ংকর মৌন শ্মশান যখন কেঁপে ওঠে ডাকিনী মায়ের নাদব্রহ্মের ধ্বনিতে, তখন বুঝি লজ্জা ঘৃণা ভয় লোভ মদ মোহ মাৎসর্যের পাশ ছেঁড়া মানুষ হয়ে উঠতে কতখানি সাধনা দরকার। সেই সাধনবলেই সকলে ওঁরা খেতে পারছেন শেয়ালের পেটের ভাত, ঝলসানো শিবার মাংস। যা আমার পক্ষে এখনও সম্ভব নয়।
শ্রুতি, স্মৃতি, সন্ন্যাসোপনিষদ, পুরাণ, তন্ত্র, গীতায় নানারূপ সন্ন্যাসের কথা আমি পড়েছি। তার মধ্যে জ্ঞান সন্ন্যাস, কর্ম সন্ন্যাস, যোগ সন্ন্যাস, হংস সন্ন্যাস, পরমহংস সন্ন্যাসের পাশাপাশি অবধূত সন্ন্যাসেরও উল্লেখ আছে। শাক্তাবধূত সন্ন্যাস, শৈবাবধূত সন্ন্যাস, ব্রহ্মাবধূত সন্ন্যাস, কৌলাবধূত সন্ন্যাস। আরও কত্ত কী! মাথা গুলিয়ে যায়।
অবধূত ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, সন্ন্যাসী বলতে হলে বলো তুমি। তবে জেনো অবধূত কোনও সন্ন্যাসী নয়।
তবে?
যারা ঘরসংসার ত্যাগ করে আসে তাদের সন্ন্যাসী বলে। তাদের সম্প্রদায় থাকে।
বললাম, জানি তো সেটা। এই যেমন তীর্থ, সরস্বতী, গিরি, পুরী, ভারতী। শঙ্করাচার্যের দশনামীরা তো আলাদা আলাদা সম্প্রদায়।
অবধূত বললেন, আমরা কোনও সম্প্রদায় নয়। অবধূতরা জেনো আশ্রমত্যাগী। এঁরা মুক্ত, কোনও আশ্রম—টাশ্রম করে না। সর্ববন্ধন মুক্ত হলেই অবধূত হওয়া যায়।
সিদ্ধযোগী না হলে অবধূত হওয়া যায় না। এ তো আমিও পড়েছি। অবধূতরা তান্ত্রিক সন্ন্যাসী। জাত ও পাশমুক্ত। সহ্যগুণও এঁদের বেশি, আচারের বাড়াবাড়ি অবধূতদের ভেতরে একদম নেই। ডাকিনী মা সব সময়ই আমাকে বলেন, অতিরিক্ত শুদ্ধাচারী যিনি, যাঁদের খুব বাদবিচার, তাঁদের কখনো ভগবান লাভ হয় না জানবি। আচারবিচার, আঁশ—আমিষ এসব করতে করতেই সময়টা চলে যায়। সাধন আচার হল গিয়ে মনে। মনখানা সাফসুতরো করতে হবে খালি বুঝলি।
বললাম, মনখানাকে কীরকম করে পরিষ্কার করব আমি?
মন থেকে রাগ তোল। বিরক্তি ভাগা। ভবঘুরে হল অবধূতদের জীবন। শহরে তো যাওয়াই যাবে না। গ্রামেও পারতপক্ষে নয়। পথকেই আশ্রম করতে হবে। ফাঁকা মাঠে ডেরা বাঁধতে হবে। ডেরায় বসে অহং উদ্ভূত মনখানাকে আত্মসমাহিত দশায় নিয়ে আসতে হবে। চক্ষু মুদিত করে, স্থির দৃষ্টি নিয়ে রাতটা বসে থাকতে হবে।
আমি দেখেছি কুঠিয়ায় ডাকিনী মা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। ধ্যানস্থ। ভৈরবেরও তেমন দশা। আমার তখন ধাতস্থ দশটা ছিল না বলেই প্রবল ছটফটানি। তারপর একসময় নাড়ির ক্রিয়ায়, প্রবল যোগে আমিও ঠান্ডা হয়ে এলাম। তবে এই খাবারদাবারের বাদবিচারটা এখনও গেল না। শরীরে ঘিনঘিন। ঘেন্নার উদয় খালি। বাচবিচার একেবারে পেড়ে ফেলে আমাকে। ভৈরব ধমকাতেন। এখন আর ধমকানোর কেউ নেই। মাসখানেক হয়ে গেল ভৈরব ঠাকুর আর নেই। শিববাড়ির পাকুড়ডালটা ওঁর মৃত্যুর পর পরই ঝড়ে ভেঙে পড়ল। কালবৈশাখী এসে বলে গেল যেন, ও লতুন তান্ত্রিক, মায়ার পাশ ভাঙো। ও বড় খারাপ জিনিস। সাধনে স্থির হতে দেবেক লা গো তুমায়।
ডাকিনী মা বলেন, আমাদের কর্ম নাই। ছোটাছুটি নাই। সুস্বাদু মোটা খাবারদাবারের তাই দরকারও নাই তো কুন। বেশি খেলে পাকস্থলীখানা বড় হয়ে উঠবে তোর। মেদ বাড়বে। মাংস হবে। শরীরে তখন আলস্য। নানাসব রোগের ঘটা। ভারী খাবারে ইন্দ্রিয়গুলাও সতেজ হয়। রিপু বাড়ে খালি। খেতে হবে ব্রহ্মচেতন হওয়ার জন্য। ব্রহ্মচেতনে ওজঃ লাগে। ওজঃবস্তুর মাত্রা বজায় রাখার জন্যই একাহার। এর বেশি দরকারই নাই তান্ত্রিকের।
জিজ্ঞেসা করি, ওজঃ কী?
মা বলেন, ওজঃ হল তোর মাথার ভেতর জমাট বাধা ঘিয়ের মতন এক পদার্থ বুঝলি। এ হল গিয়ে শক্তিরূপী। ওজঃশক্তি।
কী ওর কাজ?
ওই তো আমাদের ধ্যানচিন্তার গভীরতা দেয়।
ওজঃ কী রেতঃবস্তু?
না না ওজঃ অত ধাতু পদার্থ নয়। মাথার ভেতর দিয়ে যে রক্ত রেতঃবস্তুতে পরিণত হয় সেই বস্তু ওজঃ নয় রে। দেহের মধ্যে আছে চামড়া, চামড়ার মধ্যে রক্ত, রক্তের মধ্যে মাংস, মাংসে মিশে আছে মেদ, মেদের ভেতর মিশে আছে অস্থি, অস্থির মধ্যে মজ্জা থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই মজ্জার ভেতরবাড়িতে রেতঃ আছে। ওখানেই প্রাণের বীজ। কামের বীজও ওখানেই পোঁতা।
বললাম, ওজঃ তবে দেহস্থ প্রাণকে কী করে?
ডাকিনী বললেন, মস্তিষ্কের স্নায়ু থেকেই কেবল ওজঃরস গড়ায়। ওজঃ হচ্ছে ব্রহ্মরন্ধ্রের সুধা। শরীরে ভোজ্যবস্তুর পরিমাণ থেকেই ওজঃ জন্মায়। গাদা গাদা গিলে নিলে কী আর সাররস রক্তে গিয়ে মিশ খায় কখনো? ফলে ওজঃ জন্মায় না শরীরে। গুরুপাক ও সুস্বাদু খাবারও ওজঃশক্তি দিতে পারে না। বরং উলটে শরীরখানাকে তাতিয়ে ফেলে সৎপ্রবৃত্তিগুলোকেই নষ্ট করে দেয়।
ঝলসানো শেয়ালের মাংস আর ওর পেটে ভরা ভাত সুস্বাদু নয়, স্নেহপদার্থ যুক্তও নয় বুঝলাম। ওজঃ নিশ্চয়ই বাড়াবে। কিন্তু আমার যে খাদ্যাখাদ্যের বিচার এখনও যায়নি। কী করি আমি!
ও বড় সাধু বটে, ও মার ভক্ত বটে বিশাল, তু চিবা না ক্যানে? উঁ অর কি হল দ্যাখ না ক্যানে? কঙ্কালী মায়ের কথাতে সম্বিত এল আমার। বুঝলাম শেয়ালের মাংস আর ওকে গেলানো সেই চালের করকরে ভাত আমার মুখের ভেতর ঢুকে গেছে কখন। ওকেই এখন গলাধঃকরণ করতে হবে আমায়।
ঘাঘার জঙ্গলে সন্ধ্যা নামছে। আমার মনের তমোরাশি, তমঃগুণ, অন্ধকারের ঢাকনা সাধনপথকে অনেকখানি নীচে নামিয়ে দিচ্ছিল যেন। শক্তিমন্ত্রে অভিষিক্ত আমি। দক্ষিণাচারে সাধনা করতে গিয়ে মনের পাশগুলিকেও যে এখনও ঠিকঠাক কাটাতে পারিনি আমি। কবে আর হবে আমার বামাচার। যোগসিদ্ধ হয়ে পরমব্রহ্মের পথে যাওয়াটা তো মুখের কথা নয়। ডাকিনী মায়ের ভৈরবের মতো গলাতে ফাঁস পরে ঝুলতেও তো পারব না এই ঘাঘার জঙ্গলে। তবে কী গতি হবে গো আমার!
সংসারের কামনা—বাসনা অপরের হাতে গচ্ছিত রেখে মুক্ত হয়ে সংসার থেকে বেরিয়ে পড়ব তেমন অবধূতও তো আমি নই। আমি তবে কী? কে গো আমি?
অবধূত বলেন একহাজারটি দলবিশিষ্ট মহাপদ্ম আছে আমার শরীরে। মহাপদ্মের নীচে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষম্না নাড়ির ত্রিবেণী সঙ্গম। সেই সঙ্গমে চুপ করে খালি অবগাহন করতে। বাম ও ডান নাক দিয়ে বায়ুর গতিপথকে ঠিক করতে। এখানেই রয়েছে নাকি মৎস্যমুদ্রা ইড়া পিঙ্গলার ভেতর।
যেদিন প্রথম আমার মূলাধার উত্তেজিত হয়ে উঠল কাম মন্দিরে, আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ডাকিনী মা বলেছিলেন গরম বাষ্প তৈয়ারি করতে খালি। ইড়া পিঙ্গলা দিয়ে তখন তাপ বের হচ্ছে তো আমার। ক্রিয়া করলে বীর্যশক্তি ওজঃশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তা ঊর্ধ্বমুখে উঠতে থাকে। আসনে বসলে এসব বেশ বুঝতে পারতাম আমি। এই বাষ্পশক্তি যে সুষুম্না নাড়িতে গিয়ে শেষমেষ অনেক দিনের চেষ্টায় মূলাধারের সঙ্গে লেগে থাকা সাড়ে তিন প্যাঁচের কুণ্ডলিনীকে খুলতে শুরু করেছে সেই অনুভূতি তখন আমার কাম মন্দিরে আসনে বসলেই হত। আর ঘাঘার জঙ্গলে এ কী আজ আমার হল! মড়ার খুলির ঘিলুরস খেয়ে ফেলেছি আমি, খেয়েছি মানুষের মাংসকুচি অথচ একটা চারপেয়ে পশুর মাংস গিলতে পারছি না! ভৈরবের মৃত্যু সব যেন এলোমেলো করে দিল। না হলে আমার তো ঘেন্না জয় হয়ে গিয়েছিল সেই কবে। আমি তো কালীর ব্যাটা। প্রসাদি দেশি গুড়ের মাল, সাধনসঙ্গিনীর মাসিক মেশানো সরবত সবই মেরে দিয়েছি মায়ের কথায়।
কঙ্কালী মা যেন এ সময়ই ঘা দিলেন মনে। বললেন, মায়ের পেসাদ না লিয়ে কী, মাকে ধরতে পারবি? অমাবস্যার দিনে খালি কারণভোগ। কুক্কুটের মাংসভোগ আর আখি—গুড়ের চোলাই। তু আসিস। ছাই মেখে ব্যোম—ব্যোম বলে হাঁকাড় মারতে। লতুন তান্ত্রিক, আমার হেথায় কাহার—ডোম—বাগদি—দুলের বাচ্চাদের সাথে এক থালায় বসে পেসাদ পাবি তোর পাশের সুতা কাটান খাবে। তু আয় না ক্যানে?
ঘাঘর থেকে বেরোচ্ছি আমরা। জঙ্গলে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ধর্মরাজে প্রদীপ জ্বেলেছেন ডাকিনী মা। সেই আলোয় বাজ—বরণ গাছের মতন দেখছি আমার আগা শুকিয়ে গেছে। ভাবছি, কিছুই হবে না আমার। সন্ধ্যারাগে একরাশ হতাশা নিয়ে ঘাঘর পেরোচ্ছি।
ডাকিনী মা বললেন, অভ্যাস কর। একদিন শরীর গ্রহণ করবে সমস্ত খাদ্যের নিবেদন।
গুরুগম্য এ পথ, ভাবছি, গুরুই ধরতে পারেন তাহলে অন্তরের অভিব্যক্তি! পেটে তখন আমার শেয়ালের মাংস। গলায় ঢেকুর উঠছে। টক টক। বমি হবে বোধহয়।
চক্র জাগরণ
অবধূত বাবাজির সাধন কুঠিয়ায় আজ হবে কুলদেবীর অর্চনা। পঞ্চতত্ত্ব দিয়ে বিশেষ পুজো। হোম। বলি। ধাঙড় পাড়া থেকে এসেছে বন্য শূকর। পঞ্চতন্ত্র দিয়ে অর্চনার পর হবে শুয়োর বলি।
ডাকিনী মা বিশেষ পুজোর উপাচার নিয়ে তখন ব্যস্ত। ওঁর সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন কঙ্কালী মা। আছেন আনন্দ ভৈরব।
কঙ্কালী মা বললেন, লতুন তান্ত্রিক, আসো না ক্যানে? মায়ের পূজার জোগাড়ে পরিষ্কার হাত লাগে। তু সাকসাৎ পরমেশ্বরীর ছ্যালে, তু পূজা—হোম করিস না ক্যানে?
আমার গুরুমা উপাচার সাজাচ্ছেন। ছোট ছোট মাটির সরায় এক এক সাজিয়ে ফেলেছেন তিনি গুড়ের জল, মধু, নারকেলের জল। আমি একটি সরায় ভরে দিলাম সম্বিদা—গাঁজা। এগুলো সব পঞ্চতত্ত্ব দিয়ে কুলদেবীর অর্চনায় মদের অনুকল্প বলে শাস্ত্রে উল্লেখিত রয়েছে।
ডাকিনী মা—গুরু এবার সরায় ভরছেন নুন মাখানো আদাকুচি, তিল, আগুনে ঝলসানো ছাঁচি কুমড়ো। এগুলো সব মাছের বিকল্প বলে নির্দিষ্ট হয়েছে সাধন তরিকায়।
কঙ্কালী মা সরায় সরায় ভরছেন ঘিয়ে ভাজা মুগ, মাসকলাই, মটর। এইসব শস্যবীজকে মুদ্রার অনুকল্প বলা রয়েছে শাস্ত্র নির্দেশিকায়। বীরভাবের মুদ্রা সাধনায় আবার দেওয়ার চলে অন্ন, ব্যঞ্জন, পরমান্ন, পিঠা, মিঠাই। কাম মন্দিরে ভৈরব ঠাকুর এই উপাচারের ডালি সাজিয়ে মুদ্রা সাধনায় বসতেন। ভোগ রাঁধতে আসতেন পারুল মা।
ওঁর ভৈরব রাঢ়ের সিদ্ধ কাঁউরে বাবা। আমায় স্নেহ করতেন খুব। নেভা—ছিলিমে আগুন লাগিয়ে গোটা দুই লম্বা লম্বা টান মেরে কথা বলতে থাকতেন। ছিলিম ফের নিভে যেত।
আমার গলায়—হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে ডাকিনীর দেওয়া বড় সিঁদুরের ফোটা।
কাঁউরে বাবা বলতেন, আইছ তো বাপ, জানবার লেগ্যা। শিকবার বাসনা লাই? রাতে ঝা জানবার চাও, ওইডাই হইব। মনে মনে পস্তুৎ হওন তো লাগে। গুরু মায়রে কও, অংশ নিবা কি না? লুত্যন আইছ কিনা! আমাগোর নিয়ম—কানুন সজ্য হইব ত্য?
আমি ঘাড় কাত করি। তাকাই ভৈরবী মায়ের দিকে। আমার দৃষ্টির ওপর চোখ পড়ে যায় মায়ের।
পারুল মা বলেন, আজ কিষনা অমাবস্যা। কুজবার। বরই পুণ্যলগ্ন! সন্দা থ্যিকাই অমাবস্যা শুরু। পনসমুনডির আসনে বাবারে লৈয়া ধ্যানে ব্যসুম।
রাতে শুরু হল সেই ধ্যানক্রিয়া। দেখলাম, আসনে বসা মাত্রই মায়ের নাসা সাপের ফুঁফফুঁসানির মতোই খালি গর্জে উঠছে। মা তাঁর শরীরের বস্ত্র খুলে দিগম্বরী মূর্তি হয়ে গেলেন।
আজ আমার ছাড়পত্র। সমস্ত ক্রিয়াই দেখতে পারব আমি সামনাসামনি।
দুপুরবেলা মায়ের শিষ্য নয়ন বাবা বললেন আমায়, বড়ই কোঠিন পথ গো, ঠাকুর।
বললাম, কীরকম?
সে অনেক কুথা গো, ঠাকুর।
বলো না ক্যানে?
নয়ন বাবা বলতে লাগলেন আমায়, বহুলাপীঠে আজ থেকে দশ বছর আগে ঘটা ওঁর ব্যক্তিগত প্রথম অভিজ্ঞতার কথা।
জনবিরল জা’গা। গা—চমচম রাইত গো, ঠাকুর। শিয়ালগুলান আসনডার পিছারে, ঝুপের মইধ্যে আইয়া ঊক্যা—ঊয়া কইর্যা ডাইকল্য।
জিজ্ঞেস করলাম, তারপর?
কাঁউরে বাবা পূজা কর্ল, আরতি কল্লো মায়ের। পারুল মা—ও তাই কল্লো গো। মাছ খাইলো। মাংস খাইলো। শ্যাশে দুই ঘটি কইর্যা মদও দুইজনায় খাইল।
তুমি?
প্রসাদ পেলাম। দূরপানে তারপর চলি গেলাম।
সামনে বসলে না ক্যানো গো?
নয়ন ভৈরব বললেন, না গো ঠাকুর। তুমার মতন আমার তখন দ্যাখবার ছাড়ান ছিল। শিকবার লেগ্যা পরাণডায় কী আঁকুপুকু লাগত। এই তোমার যেমন হয় এখন। বুঝি গো ঠাকুর, বুঝি।
বলি, কী বোঝো?
এই শরীলডা তো তোমার চিনবার চ্যাষ্টা। গঁপ—দাড়িভরা মুকডা য্যান জ্যানতি চায়। বুইজা লৈয়া সরাৎ কইর্যা খুইল্যা ফালাইতে চায় লিখার ভাষা।
কী করে বুঝলে, যে আমি লিখব?
তোমার দিষ্টির মানে বুঝি গো, ঠাকুর। পাশব প্রবৃত্তির ঘোরপ্যাঁচ আর মারপ্যাঁচে পড়ে চেল্লানো মানুষ তুমি লও।
বলি, তবে আমি কী গো, নয়ন বাবা?
বিকেল নামছে তখন আলোরস ভরা আমাদের এই মায়ামণ্ডলে। খানিকটা এগোলেই শ্মশান—বেশ বিস্তৃত শ্মশানভূমি। চারিদিকে বাবলা গাছের সারি, মধ্যে একটি বিশাল বট। তার অসংখ্য ঝুরি নামিয়েছে চারিদিকেই। গাছের গোড়ায় ছোটো বড় কতকগুলি শিলাখণ্ড। তার একটির গায়ে জবজবে সিঁদুরে ভেজা মস্ত ত্রিশূল। এই ত্রিশূলে ডাকিনী মা পুজো সারেন। তারপরই মন্ত্র পড়তে থাকেন এসে শ্মশানকালীর থানে, ওঁ কালিকায়ৈ বিদ্মহে, শ্মশানবাসিন্যৈ চ ধীমহি, তন্নো ঘোরে প্রচোদয়াৎ।
এই স্থান এখনও যেন আমার মা—গুরুর মন্ত্রঘোরে সম্মোহিত হয়ে আছে। তারই ভেতর যেন ভৈরব ঠাকুর বলে উঠলেন এবার, তু তো একখান বুজদার যুবক। বুঝ ক্যানে।
বললাম, বলো না, তারপর কী হল?
নয়ন বাবা গাঁজা—ঠাসা বিড়িতে টান দিলেন এবার।
বললেন, পদীপের আলুয় হক্ক্যলই দ্যাখলাম পরিষ্কার।
কী দেখলে তুমি এবার?
দেখলাম পনসমুনডীর আসনডায় একডা স্বগ্গীয় আলো য্যান লাইম্যা আইল। মায় ল্যাংডা। বাবায় ল্যাংডা। উঃ, সে কী দশা গো! শিব—পার্বতী য্যান আলিঙ্গন কইর্যা আছে। দ্যখল্যম দুইখান শরীল। ধুঁয়ার পারা মিলাইবার লাগসে বাত্যাসে! আশচয্য হৈলাম। বরই আশচর্য্য হৈলাম। জীবনেও দেহি নাই অমন কাণ্ড কুনোদিন। কাইন্দা ফালাইল্যাম আলন্দে। চক্যু বুজলাম নিমিষের লেগ্যা। অগো আর দ্যাখবার পাইলাম না।
কাম মন্দিরে রাতে আমার প্রথম দর্শন হল এই পঞ্চমকার সাধন। বুকে টেনে নিয়ে মুখে—মাথায়—লিঙ্গে চুমু দিয়ে বার বার পাগল করে তুলছেন কাঁউরে বাবা। আমি সেই পাগলপারা দশার কিছু দূরে কাম মন্দিরের দরজায়। এখনই প্রসন্নময়ীরূপে ডাকিনী এলেন। নৈবেদ্যের মতো একটা গাঁজায়—ঠাসা বিড়ি ধরিয়ে প্রসাদ করে আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলেন। তারপর জানি না কিছু, আচ্ছন্ন দশা। আসলে আমার মা—গুরু কোনওদিনই চাননি আমি পঞ্চমকারে বসি। তিনি আমাকে যুগল সাধনা থেকে বরাবরই দূরে রেখেছেন। জানি না কেন! প্রশ্ন করতে পারিনি কোনওদিন। ভয় ছিল মনে, কাছ থেকে না বিতাড়িত করে দেন। তখন আমার কী হবে! আমি যে জিজ্ঞেসু। তন্ত্রধর্মে মৈথুনের আগে ওই যে পুজো—ন্যাস, ওই পর্যন্ত গিয়ে তাই বারবারই আমার কাম মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি যেতে পারিনি। গুরুগম্য এ পথে গুরুর ইচ্ছে ছাড়া যাওয়াটা তো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটুকু বুঝে গেছি আমি তখন পাঁচ—ছ’বছরের ঘোরাফেরার অভিজ্ঞতায়।
কঙ্কালী মায়ের কথামতো রক্তচন্দন আর কুমকুম দিয়ে আমি তখন ত্রিকোণ যন্ত্রখানা আঁকছি। এই যন্ত্রেই পঞ্চমকার সাধনার হোম হবে। তারপরই শূকর বলি।
ডাকিনী আমাকে তো কবেই জানিয়েছেন শরীরের গুহ্যদেশে কুলদেবী অধিষ্ঠাতা হওয়ার বার্তা। বলেছেন, এখন থেকে পঞ্চতত্ত্ব—গায়ত্রী করবি, তুই। বলেই তিনি আসনে বসে উচ্চারণ করেছেন, ওঁ পৃথ্বি পৃথিবৈ চ বিস্মহে সহস্র মূর্ত্তয়ে ধীমহী তন্নো মহী প্রচোদয়াৎ।
আমিও সঙ্গে সঙ্গে বলেছি তো ওঁর, ওঁ আকাশায় চ বিদ্মহে নভোদেবায় ধীমহী তন্নো গগন প্রচোদয়াৎ। ব্রাহ্মমুহূর্তে তুলে দিতেন আমাদের গুরুমা। মুদ্রা আসনে বসে তখন আমাদের জপধ্যান করতে হত। মনকে এক জায়গাতে এনে আমরা গুরুভাইরা আত্মলয় ঘটাতে খালি চেষ্টাটা করতাম। কিছুই হত না প্রথম প্রথম।
ডাকিনী মা বলতেন, চক্রের উন্মোচন ঘটাতে গেলে যে চেষ্টা করতেই হবে। যোগারূঢ় হতেই হবে। এছাড়া সহজ কোনও রাস্তা নেই। জ্যোতির্ময় পুরুষের দর্শন করতে গেলে চক্রের গুণে গুণান্বিত হয়ে বিভোর হয়ে যেতে হবে।
কাম মন্দিরে শীতকালে সামান্য আগুন জ্বালিয়ে আমরা বসতাম তখন। ত্রিসন্ধ্যা অভ্যাস তখন করতে হত। যোনিমুদ্রা, নাদমুদ্রা, তালুক্রিয়া রপ্ত হয়েছে আমার তখন। দুধ, ঘি খাওয়া একেবারেই বারণ। এরই মধ্যে ডাকিনী মা আমাদের বানালেন ব্রহ্মভিক্ষু। পাঁচ বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে আনেন প্রেমানন্দজি। আমি পারিনি। মা—গুরু উচ্চবাচ্য করেননি। বলেছেন ভিক্ষার চাল সিদ্ধ করে নিতে। নুন ছাড়া খেতে। সামান্য ঘি দেওয়া যেত তখন ভাতের ওপর। এইভাবে সাতদিন আমরা কৃচ্ছ্রসাধনা করেছি। একবার খাওয়া কেবল দিনশেষে। একটা কাপড়ই কেবল পরা। বস্ত্রকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছিলেন আমায় প্রেমানন্দজি। অর্ধেকে স্নান সেরে অর্ধেক পরে বাকিটা রোদে শুকিয়ে নেওয়া হত। আমার খিদে পেত বলে ডাকিনী আমাকেই কেবল একবার আটা গুলে ফুটিয়ে খাইয়ে দিতেন মাঝে। ভৈরব ঠাকুর আটার পিণ্ড বানিয়ে তার ভেতর সামান্য ঘি দিয়ে সেঁকে খেতেন উনানে। আমাকেও দিতেন। অন্যান্য গুরুভাইদের মতো কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনা আমি তো করিনি। মায়ের প্রশ্রয়ে সবেতেই আমার ছাড়। ওঁর আমি মানসপুত্র।
আনন্দ ভৈরব বললেন, আশ্রম চতুষ্টয়ের মধ্যে অবধূতাশ্রমই শ্রেষ্ঠ। ঠিক পথে এসেছিস, তুই। তোর চিন্তা কী রে মায়ের ছেলে। গৃহাবধূত ধর্ম খারাপ কিছু নয়। তোকে শ্মশানচারী সদাশিবের দিগম্বরাবধূত না হলেও চলবে। পড়াশুনা জানা ছেলে। জ্ঞানমার্গী। জানতে জানতেও আনন্দসাগরে যাওয়া যায়। সমাধির সিদ্ধি হয়।
বললাম, শূকর বলি কেন, ভৈরব?
রক্তজবা চোখ ভৈরব ঠাকুরের। বললেন, পাঁচ প্রকার বলি বিহিত আছে কূলদেবীর অর্চনায়। ছাগ, মেষ, মহিষ, হরিণ, শূকর। ছাগ বলিতে স্বর্গসুখ মেলে, মেষে রাজ্যলাভ মানে ওই প্রাপ্তি, মহিষে মুক্তিলাভ, হরিণে মন্ত্রসিদ্ধি, শূকরে ষটকর্ম সিদ্ধি।
বুঝলাম, চক্র জাগরণের দিকে এগোচ্ছে আজ অবধূতের কুঠিয়া!
ওঁ ঐং তারে
সরু শালি নদীর ভাঁজকে ঠিক বলির খড়্গের মতো মনে হচ্ছে এই সকালবেলায়। কোড়ো পাহাড় থেকে শালির কাছে আসতে তো অনেকখানি হাঁটতে হল। শালি পেরোলেই শাল—সেগুনের ঘন জঙ্গল। রণবহাল। বাঁকুড়া।
কোড়ো পাহাড়ে রাত কাটাতে বেশ লাগছিল তো আমার। পাহাড়ে পূর্ণিমা একটা খোলতাই দশা এনে দেয়। এমন সব আজব জায়গাই যেন মনের ভেতর খালি বৈরাগীর রং লাগায়। এমনিতেই বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া আমাকে তাতিয়ে তোলে। বাউল—বাউলানি, তান্ত্রিক—বৈষ্ণব—দরবেশদের দেশ। গেরুয়া—সাদা—লাল পোশাকের ভেক নিয়ে এদেশে কী সহজ যে প্রাত্যহিক ক্ষুন্নিবৃত্তির রেস্ত জোগাড় করা! আর এঁরা তো অল্পতেই তুষ্ট। চাওয়া—পাওয়ার পরিমাণ এতই কম যে মাঝে মাঝে এঁদের আমার মানুষ হিসেবেই সন্দেহ জাগে। কোথায় এঁদের প্রবৃত্তির কলা, জাগতিক ভালো থাকার চাহিদা! সবই বোধহয় ভেকের তলে সেঁধিয়ে মরেছে।
কোড়ো পাহাড়ে থাকেন ফটকে বাবা। মায়ের পুজো করেন। আর সারাদিন চলে দেশি গুড়ের মাল। দিন শেষে অনেকটা খিচুড়ি প্রসাদ নিয়ে বসেন। যারা আসে ওঁর কাছে, তাদের হাতে দলা দলা ভরে দেন তিনি।
আমার হাতে খানিক প্রসাদ দিয়ে তিনি আমায় অন্তর্লীন পুরুষকারকে জাগাতে বললেন। অনেকটা চোলাই হুইস্কি—রামগুলানো মাল মুখে ভরে নিয়ে ওঁর সাকরেদদের বললেন, পেসাদ খেঞে লে শালা। দেবীশিলা সহজ কথা তো লয়। পান—দোষহীন জ্যান্ত তারার বাচ্চা। মহাকালকে দুধ খাওয়াচ্ছে জগজ্জননী—মা হয়ে। ও কী আর তখন শিবের মাগ নাকি রে! সেই মা আজ ভোগ চড়াবেন। রেতে পেসাদ লিয়ে যাস।
ডাকিনী গেছেন শালিতে স্নান করতে। সূর্য বেশ কিছুটা উঠে গেছে। চাল, ডাল, বুনো কচু আর কুড়োনো লতাপাতা দিয়ে এই জঙ্গলেই আজ ভোগ হবে বাণলিঙ্গ শিবঠাকুরের। আমরা স্নান করে তখন জ্বালানি জোগাড় করতে ব্যস্ত।
তিনটে পাথরের টুকরোয় তৈয়ার হয়েছে উনুন। মাটির হাঁড়িতে চাল, ডাল, বুনো কচু, জঙ্গুলে লতা সব একসঙ্গে ফুটছে। ফটকে সাধু স্নান সেরে মন্ত্র বলছেন, ওঁ ঐং তারে হুং ফট স্বাহা।
আমি মুহূর্ত খুঁজছিলাম ডাকিনীকে এই গভীর নিরালায় কথা বলব বলে। কাল রাতে পাহাড়ে ফটকে সাধু সেবিত মা—তারার চ্যাপটা পাথরের শিলামূর্তিতে ভোগের সময় তিনি আমাকে মন্ত্র চেনাচ্ছিলেন। বলছিলেন, হূঁ হল তারাপ্রণব। মা তারার বীজ। এই বীজ তোকে জপ করতে হবে মহাশঙ্খে।
বললাম, আমি তো এখনও মহাশঙ্খের অধিকারী নই গো, মা। তুমি আমকে রুদ্রাক্ষ জপ ধার্য করেছ।
ডাকিনী মৃদু একটু হাসলেন। কোড়ো পাহাড়ের জ্যোৎস্নায় ডাকিনীর মুখে যেন তরতরিয়ে আলো ঝরছে। সেই আলোয় আলোকিত হয়ে আমার গুরু এবার বললেন, তোর সময় হয়ে এসেছে রে। তুই বীরাচারী তান্ত্রিক মায়ের ব্যাটা। ও মালা তোকে গ্রহণ করতেই হবে। আগে শরীরখানা আরেকটু প্রশস্ত হোক। ছেলে যখন মেনেছি, সব সিদ্ধাই দিয়ে যাব তোকে।
মায়ের কথামতো আমি বাড়িতে বসে জপ করার সময় মুখে কর্পূর দানা ভরে নিই। এতে জিভ চওড়া হয়। জপক্রিয়ায় সাহায্য করে। প্রথমে আমি সামান্য মৃদু উচ্চারণ করে ঠোঁট মুখ খুলে জপ করতাম। ভৈরব আমাকে উচ্চারণে একটু বেশি জোর দিয়ে বচন সুস্পষ্ট করে জপ করতে বলেছিলেন কাম মন্দিরে। শেষমেষ ডাকিনী মা আমাকে দিলেন মানসিক জপের বিধি। কোনওরকম ঠোঁট মুখ না খুলে, কোনওরকম শব্দ না করে মনে মনে আমার তাই এখনও রুদ্রাক্ষ জপ চলে।
ভৈরব ঠাকুর আমাকে কাম মন্দিরে আসন পেতে দিয়েছিলেন। যে আসন কখনও তোলা যাবে না। পাতাই থাকত ঘরে। পরিষ্কারের প্রয়োজন হলে ওপর থেকে হাতে করে আসনটি তখন একটু পরিষ্কার করে নিতাম আমরা। কাম মন্দিরে যে ঘরে জপে বসতাম আমি আর প্রেমানন্দজি, সে ঘরে দিন সাত এরকম টানা নিয়মের জপের পর সাপ ঢুকে এল।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ডাকিনী আশ্বস্ত করে বললেন, ভয় পাবি না রে, বেটা। ও সাপ তোদের কিছুই করবে না। জপমন্ত্র পরমব্রহ্মে যুক্ত হলেই সাপ আসে। এ যে ভালো জিনিস রে।
মা সাহস দিতেন। সাপ নিয়ে আমরা তখন ঘর করছি। দেখেছি সাপটা সব সময়ই কেমন মেদা মেরে পড়ে। তিন দিন ওভাবে থেকে সাপ চলে গেল ঘর ছেড়ে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তার যাওয়াটির টেরও পেলাম না।
ডাকিনী মায়ের আছে কৃষ্ণচর্মসার হরিণের আসন। ওর ওপর বসেই তিনি জপ সারেন। আমাকে তিনি কুশ দিয়ে নিজের হাতে বুনে দিয়েছিলেন আসন। সেই কুশাসনে বসেই আমরা জপ করতাম।
প্রথম প্রথম ভৈরব ঠাকুরের কথামতো পূর্বদিকে মুখ করে আমি জপ করতাম। ডাকিনী বললেন, সকাম জপ তোকে আর করতে হবে না।
ভৈরব বললেন তখন, মা, ও যে গৃহী।
ডাকিনী বললেন, ও আমার, বেটা। কামনাবস্তু ওর মনেতে আর নাই। আমি তাড়ায়ে ছেড়েছি। শুধু ভগবৎ প্রাপ্তি ওর উদ্দেশ্য নয় এও আমি জানি, বাবা। তবুও উত্তর মুখে আসন পেতে জপে বসুক।
জপের সময় ধূপের কাঠি জ্বালতে মা নিষেধ করতেন। তিনি কাম মন্দিরে ধুনো জ্বেলে দিতেন ধুনচিতে। ধুনোর ধোঁয়ায় উত্তর মুখে কুশাসন পেতে আমি আর প্রেমানন্দজি জপ করতাম। রাতে কুঠিয়ার ঘুমোনোর সময় মাথা থাকত আমার উত্তর দিকে। পূর্বদিক সকামের। গৃহীর। ডাকিনীর ভালোবাসায় আমি সন্ন্যাসী হয়ে গেলাম। যদিও কামনার ছায়াছন্ন নিবিড়—ও কী আর সহজে ছাড়া যায়! ডাকিনীর সঙ্গে থাকলেই কামনা মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।
কাম মন্দিরে তিন মন্ত্রেই আমাদের মা অভিষিক্ত করে দিয়েছিলেন। শক্তিমন্ত্র জপের সময় সামনে থাকত মধু। বিষ্ণুমন্ত্র জপে বসলে কর্পূর মেশানো জলপাত্রটা আসনের পাশেই রাখতাম। আর শিবমন্ত্র জপে বসলে তামার ঘটিতে দুধ ভরা থাকত। জপের পর পুজো—তর্পণে এগুলো ব্যবহার করতাম। ভৈরব আমাদের পুজো—তর্পণ শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর মৃত্যুর পর ব্যাঘ্রচর্মের জপআসনাখানা প্রেমানন্দজি ব্যবহার করেন। মস্ত আধারের মানুষ তিনি। আমার মতো জিজ্ঞেসু লেখক তিনি নন।
ফটকে বাবার শিলায় কাল রাতে প্রণাম মন্ত্রখানা তখন আমি বলছিলাম বেশ জোরে জোরে। হঠাৎ করে একটা কুবোপাখি ডেকে উঠল যেন এই রাতের বেলায়—কুব কুব কুব কুব। শঙ্খচিল ডাকছে ওই কোড়োর মাথায়—টি ট্টি টি ট্টি। আমি ডাকিনীর ধারে দাঁড়িয়ে মন্ত্র বলছি—হ্রীঁ স্ত্রীঁ হূঁ ফট।
ডাকিনী মায়ের ডাক খেলাম তখন। বললেন, তুই আর ফট বলিস না। সাধু—যোগী—তান্ত্রিকরা ফট বলেন না।
আমি চমকে গেলাম।
মা পাহাড় চিরে মন্ত্র বলতে থাকলেন, ওঁ হ্রীঁ হাঁ হূঁ নমস্তারায়ৈ সকল দুস্তরাং তারয় তারয় ওঁ ওঁ স্বাহা।
ফটকে বাবা বললেন, তু বল না ক্যানে?
মা বললেন, যেসব মন্ত্রের আগে হূঁ কথাটি যোগ আছে, জানবি ওসব হল গিয়ে পুরুষ মন্ত্র। স্বাহা হল স্ত্রী বিদ্যা।
বললাম, স্বাহা তবে মন্ত্র নয়?
স্বাহা হল বিদ্যা। হূঁ হল মন্ত্র। দুয়ে মিলে হল মন্ত্রবিদ্যা।
ওঁ তো প্রণব?
ওঁ দেবতার আগে উঠে গিয়ে আর পরে নমঃ ব্যবহার করে যে মন্ত্র ওগুলো সব গৃহীদের। আমরা তান্ত্রিক ওঁ বলব না কখনো। নমোহস্তেও নয় কখনো।
বললাম, কেন মা?
ডাকিনী বললেন, এটা হল নপুংসক মন্ত্র। মন্ত্রবিদ্যার পর এর কোনও আর দরকার নেই।
জঙ্গলে তখন আমাদের ভোগ রাঁধা সারা। অবধূত বাবাজি ভোগ দেবেন ওঁর বাণলিঙ্গ শিবের। এই শিব সবসময় তিনি শরীরে বহন করেন। শিব থাকেন কণ্ঠনালিতে, ওঁর গলার ভেতরে। বাবার বারে তিনি শিব কণ্ঠনালি থেকে তুলে পরিষ্কার করে—টরে পুজো দেন। আমি বহুবার দেখেছি।
কচি কটা শালপাত্তি আনতে ছুটলাম আমি আর ফটকে সাধু জঙ্গলে। যেতে যেতে তিনি বললেন, ইঁ ত’ বড় আজব ব্যাপার বটে। শিবটো ঘুমান দ্যিছে উঁ বাবার কণ্ঠার ভিত্যরে!
বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ফটকে সাধু আসছেন। আমার হাতে নধর শালের পাতা। তার ওপর বসে সেবা নেবেন অবধূতের কণ্ঠার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা বাণলিঙ্গ ঠাকুর। পাতা ধুয়ে আনলাম শালি নদীর সোঁতার হাতায়।
ফটকে সাধু পেতে দিলেন শালপাতার বিছানা। বিছানার সামনে সরায় ভরা শালি নদীর জল। ওই জলেই স্নান সারবেন আজ অবধূত বাবাজির বরফের মতো সাদা ছোট্ট শিব। ওইটি ওঁর উপাস্য।
পুজোয় বসলেন এবার অবধূত ঠাকুর। ডাকিনী মা ভোগ এনে ধরলেন সামনে। অবধূত বসে আঁক করে গলা থেকে উগরে দিয়ে নুড়িশিলা প্রথমে ওঁর হাতের পাতায় রাখলেন। তারপর ধুয়েপুঁছে বিছানায় বসালেন বাণলিঙ্গ শিব।
মদিয়ানে অবধূতের কুঠিয়ায় বসেই আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম, শিব এভাবে রাখার অর্থ কী?
তিনি তখন বেদিতে বসে। পিলসুজে রাখা প্রদীপের আলোয় ওঁর দেহাবয়ব উদ্ভাসিত হয়েছে। তামা—বরণ জটার লেজওয়ালা এক সাধু ছিলেন সেদিন ওঁর কুঠিয়ায়। প্রদীপের আলোয় জটাটিকে পিঠের ওপর মনে হচ্ছে কালনাগের মতো। অবধূতের রাঙা বস্ত্র। শরীরে নির্মাল্যের গন্ধ। জটাধারী বাণলিঙ্গে আচমন করছিলেন তখন। ডাকিনী গেছেন শিববাড়ি।
অবধূত বললেন, গলা থেকে প্রণব বের হয়। গলা হল ভগবানের পছন্দের জায়গা। তাই ওখানে আমার উপাস্যকে রাখি।
জিজ্ঞেস করলাম, কী করে সম্ভব হল এই কাজ?
জটাধারী বললেন, শক্ত কাজ। সিসের গুলি সব সময় রাখতে হয় গলার ভেতর অমনধারা গর্ত বানাতে। সিসে গলার ভেতরকার মাংস ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে একখানা গর্ত তৈরি করে নেয়। ওর ভেতর সাধুরা ভরে রাখেন প্যারা চিজ।
অবধূত বাণলিঙ্গকে স্নান করাচ্ছেন এখন রণবহালের জঙ্গলে। হাওয়া উঠছে। নানা পাখির ডাক। তারই ভেতর দরাজ গলার মন্ত্রে জঙ্গল গমগম করছে :
ওঁ ত্রাম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্দ্ধনং।
ঊর্ধ্বারুকমিব বন্ধনাম্মৃত্যোর্মুক্ষীয়মামলতাৎ।।
পুজো শেষে অবধূত বাবাজি বাণলিঙ্গখানা আবার কপ করে গিলে নিলেন। ফটকে সাধু একদৃষ্টিতে শিবের শরীরে প্রবেশ দেখে রীতিমতো হাঁ হয়ে গেলেন।