দেখা হল না
পাড়ার পুজা প্যান্ডেল। অষ্টমীর সকাল। সামনে দশভুজা। তাঁরা পরিবার সহ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন। হালকা গান চলছে মাইকে । একপাশে একটা চৌকির ওপর বসে আছে ঢাকিরা। একটু আগে একপ্রস্থ বাজিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঢাকির দলের ছোট কিশোরটি নতুন প্যান্ট-জামা পরে খুশিতে খুশি খুশি। তার হাত নিশপিশ করছে। কাঁসরে আলতো করে কাঠি ঠুকছে। ঠিংঠিং করে শব্দ হচ্ছে। একটু আগে বেশ জটলা মতো হয়েছিল। এখন সব ফাঁকা। কয়েকটা বাচ্চা ছোটাছুটি করছে। তাদের কেউ কিছু বলছে না। বছরের এই ক’টা দিন। পরের বছর এদের বয়েস এক বছর বেড়ে যাবে। তখন আর এই আনন্দ থাকবে কিনা কে জানে।
প্রতিমার সামনে ঘেরা জায়গায় আরও একপ্রস্থ পুজোর আয়োজন চলছে। বৃদ্ধ পুরোহিত মশাই-র গায়ে সদ্য সাদা উত্তরীয়, পাশে পইতে ঝুলছে। চোখে কালো ফ্রেমের নড়বড়ে চশমা। মাথা নীচু করে একমনে পুথির পাতা ওলটাচ্ছেন। তাঁর দুপাশে সুন্দর চেহারার দুই যুবক নীরবে নৈবেদ্য সাজাচ্ছে। টকটকে লাল সিল্কের শাড়ি পরে টকটকে ফরসা চেহারার নতুন বউ প্রতিমা-দর্শনে এসেছে। নতুন কিন্তু সাধারণ কাপড়ের ফ্রক-পরা মলিন একটি মেয়ে বউটিকে অবাক চোখে দেখছে। তার দামি শাড়ি। শ্যাম্পু-করা রেশমি চুলের ঢল। চকচকে ফরসা মুখ। উজ্জ্বল চোখ। মেয়েটি কাকে দেখবে। প্রতিমাকে না জীবন্ত প্রতিমাকে। দুজনেই তার কাছে আকাশের আগন্তুক।
প্রবীণ এক মানুষ পায়ে পায়ে এসে প্রতিমার একেবারে সামনেটিতে দাঁড়ালেন। গায়ে ইস্ত্রি না-করা সাদা পাঞ্জাবি। মোটা ধুতি। পায়ে ন্যাকড়ার জুতো। চোখে পুরু লেনসের ছানিকাটা চশমা। এক সময় গায়ের রঙ ফরসা ছিল। স্বাস্থ্যও ভালো ছিল। এখন খাঁচাটাই তাঁর প্রমাণ। পুরু লেন্সের আড়ালে চোখ দুটো বেশ বড় দেখাচ্ছে।
ভদ্রলোক প্রতিমার মুখের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। নিজের মুখটাকে যতদূর সম্ভব উঁচু করে আছেন। দু-পা পেছলেন, এক পা এগোলেন। ডানপাশে সরলেন, বাঁপাশে ঘুরলেন। চোখের ওপর হাতের আড়াল দিলেন। ভুরু আর নাক কোঁচকালেন। চোখ ছোট হল, বড় হল। আরও কাছে সরে গেলেন। চোখ থেকে সরিয়ে নিলেন চশমা। অসহায় ভাবে তাকালেন এদিক ওদিক। চশমাটা আবার চড়ালেন চোখে। হাত জোড় করে করুণ মুখে অপরাধীর মতো বললেন, ‘না মা হল না, এবার আর তোমাকে দেখা হল না। তুমি এমনিই আমার প্রণাম নাও, মা। সামনের বার থাকব কি না কে জানে।’
যে বাচ্চাগুলো ছোটছুটি করছিল তাদের একজন ছিটকে এসে বৃদ্ধের বুকের কাছে ধাক্কা খেল। টলে পড়ে যেতে যেতে তিনি বাঁশ ধরে সামলে নিলেন নিজেকে। কিছু বললেন না। সামান্যতম রাগের ভাব জেগে উঠল না তাঁর মুখে। বৃদ্ধ ঘুরে দাঁড়াতেই আর এক প্রবীণের মুখোমুখি হলেন। দ্বিতীয় বৃদ্ধ বললেন, ‘এই যে সুরেন?’
সুরেন থতমত খেয়ে গেলেন, বললেন, ‘ কে যোগেন?’ তারপর অতি করুণ গলা, ‘ দেখতে পেলুম না, ভাই। অনেক চেষ্টা করলুম। সব ঝাপসা। একেবারে ধোঁয়া।’
‘এই তো সেদিন ছানি কাটিয়ে এলে।’
‘কিছুই হল না। টাকাটাই জলে গেল। ও হয় না। যা যায় তা যায়। অত কষ্টের টাকা। তুমি দেখতে পাচ্ছ?
‘তা পাচ্ছি।’
‘স্পষ্ট?’
‘না, স্পষ্ট না হলেও ঝাপসা নয়। তুমি দেখতে না পেলেও, মা তোমাকে দেখেছেন। তুমি তোমার অন্তরের চোখে দ্যাখো। সে চোখে তো ছানি পড়ে না।’
‘সে চোখ ক-জনের ফোটে, ভাই। আমার তো ফোটেনি।’
বৃদ্ধ সুরেনবাবু হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে অনিশ্চিত পদক্ষেপে এগোতে লাগলেন। ধরতে চান, ধরার কেউ নেই। পৃথিবী বড় ব্যস্ত।