2 of 2

দেখা হবে মাঝরাতে – শুভমানস ঘোষ

দেখা হবে মাঝরাতে – শুভমানস ঘোষ

সুপারভিউ টিভি কোম্পানির কলকাতা জোনের এজেন্ট হিসেবে গ্রামবাংলায় ঘুরে বেড়াতে হয় সুমনকে, চষে বেড়াতে হয় এক শহর থেকে অন্য শহর, এক জেলা থেকে অন্য জেলা। এইরকমই ঘুরতে ঘুরতে সে অনেক দিন পরে এসেছে পানিপাতিনিতে।

পানিপাতিনি বাসস্ট্যান্ডের কয়েক হাত তফাতে মা জগদম্বা লজে বছরকাবারি ঘর রাখা থাকে সুমনের, কোম্পানিই পেমেন্ট করে। কোম্পানির আরও অনেক এজেন্ট আছে। বছরভরই তাদের যাতায়াত চলে পানিপাতিনিতে।

জাতীয় সড়ককে মেরুদাঁড়ার মতো মাঝে রেখে গড়ে ওঠা ছোটো জনপদ পানিপাতিনি। ঠিক শহর নাহলেও ভিডিও পার্লার, ইন্টারনেট পার্লার, বিউটি পার্লার আর মোবাইল ফোন পরিষেবা পুরোপুরি ঢুকে গেছে পানিপাতিনিতে।

ক—দিন ধরে বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে। হোটেলের কাউন্টারে গলায় মাফলার জড়িয়ে বসে ছিলেন হোটেলের মালিক শ্যামবাবু, সুমনকে দেখে খুশি হলেন, বললেন, আসুন সুমনভাই, আসুন। এবার অনেক দিন পরে যে!

শ্যামবাবুর বয়েস পঞ্চাশের আশেপাশে, গায়ের রং দু—পোঁচ কালো কম করে, মাথাখানা বিরাট, ফালা ফালা চোখমুখ, মুখভরতি দাড়ি—গোঁফ—দেখলেই মন আপনা—আপনি সম্ভ্রমে ভরে ওঠে। আজ আবার কপালে লাল টিপ লাগিয়েছেন। হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি তিনি এখানে—সেখানে টুকটাক পূজা—আর্চাও করে থাকেন।

হুঁ, নিয়ার অ্যাবাউট এক বছর হবে। সুমন শ্যামবাবুকে নমস্কার করে জানতে চাইল, আপনারা কেমন আছেন শ্যামবাবু?

শ্যামবাবু চোখ বুজে নমস্কারের প্রত্যুত্তর দিয়ে বললেন, মা মহামায়ার আশীর্বাদে তা একরকম আছি। আপনার সব খবর ভালো তো ভাই?

সুমনের বয়েস বেশি নয়, চল্লিশের আশেপাশে। মাঝারি হাইট, গায়ের রং ফরসার দিকে, মুখ—চোখ ভালো। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ফাইন!

পানিপাতিনির কাজ একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেল সুমনের। পরের দিন আর বেরোল না, হোটেলে বসে ডিস্ট্রিবিউটরের ঘর থেকে কালেক্ট করে আনা তথ্যগুলো এক করে রিপোর্ট তৈরি করে ফেলল। তারপর সন্ধের পরে জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘুরতে।

পানিপাতিনি জায়গাটা বেশ মনোরম। লোকজন, গাড়ি—ঘোড়া, দোকানপাট থাকলেও গ্যাঞ্জাম নেই। এখানকার চমচমের খুব সুনাম আছে। একটা দোকানে বড়ো দেখে খান পাঁচেক চমচম গপাগপ গিলে মন খুশ হয়ে গেল সুমনের।

হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে চলে এল ন—দিঘার মোড়ে। এখান থেকে মিনিট পাঁচ ডাকাতে কালীবাড়ি, তারপর মিনিট দুই হাঁটলেই ছায়াচিত্র সিনেমাহল। পানিপাতিনিতে এলে ছায়াচিত্র হলে নাইট শো—এ একটা করে ছবি বাঁধা সুমনের। বাংলা—হিন্দি—ইংরেজি যখন যেমন হয়।

জীবনে ছবি অনেক দেখেছে সুমন, তার উপর এখন টিভির দৌলতে ঘরে বসেই রিমোট টিপে যত খুশি ছবি দেখা যায়, তাই ছবি দেখাটা তার লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হল, টাইম পাস। বাড়তি হল, সিনেমাহলের মালিক রবিবাবুর সঙ্গে একটু আড্ডা মেরে আসা। টিভি আর সিনেমা নিজেরা ভাই ভাই না হলেও ভায়রাভাই তো বটেই। অতএব রবিবাবু বলতে গেলে তার লাইনেরই লোক।

কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে ছায়াচিত্র হলের সামনে পৌঁছে সুমন হতাশ হল। টিভির দাপটে সিনেমা ব্যবসার হাল দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে সে জানে, তার জন্য রবিবাবু তাকে খোঁচা মেরে কথাও শোনান, কিন্তু তাই বলে এই অবস্থা?

সার্চলাইট, ডে—লাইট দূরের কথা, টিমটিম করে একটা লো—ভোল্টেজের বাতি জ্বলছে। তাতে হলের গায়ে লাগানো ছবির পোস্টারটাও ঠিকমতো পড়া যাচ্ছে না। লোকজনও আশেপাশে বিশেষ চোখে পড়ছিল না।

কাউন্টারে মুখ পর্যন্ত চাদরে ঢেকে একজন বসে বসে ঝিমোচ্ছিল। লোকটাকে চিনতে পারল না সুমন। গেটে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, সেও অপরিচিত। তার চেয়ে বড়ো কথা,গেটকিপারের পাশে রবিবাবু দাঁড়িয়ে থাকেন, কীরকম কী টিকিট বিক্রি হল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করেন, আজ নেই।

রবিবাবু কই? রবিবাবু? সুমন জিগ্যেস করল।

গেটকিপার মুখ তুলে তাকাল সুমনের দিকে। এরও আপাদমস্তক ঢাকা চাদরে। বেশ রোগা, তবে চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। পালটা প্রশ্ন করল, কোন রবিবাবু?

হাউসের মালিক রবিবাবু। রবিরঞ্জন দাস।

উনি তো আজ আসেননি।

আসেননি?

নাহ! উনি ব্যস্ত আছেন কাজে।

লোকটা মুখ ঘুরিয়ে নিল। শুধু ছবি হবে আজ, আড্ডাটা আর হবে না। ভারি রসিক মানুষ এই রবিবাবু, মুখ—চোখের নানান ভঙ্গি করে এক—একটা এমন মজার কথা বলেন হাসি চাপা দায়। ব্যবসার এই দুরবস্থার মধ্যে কী করে এত হাসি খুঁজে পান কে জানে।

মনটা দমে গেল সুমনের। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে সে এগিয়ে গেল ছবির ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে।

বাংলা বই চলছে। স্টিল ফোটোগ্রাফ দেখে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছিল ভূতের বই। কিন্তু অসম্ভব বোকা বোকা নাম, ‘দেখা হবে মাঝরাতে’। বাংলা—সিনেমার সাধে এই হাল! যাক গে, তার তো সময় কাটানো নিয়ে কথা।

সুমন এগিয়ে গেল টিকিটঘরের দিকে। ব্যালকনির একটা টিকিট কেটে ঢুকে পড়ল হলে। গেটকিপার টিকিট ছিঁড়ে অর্ধেকটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, লাইটম্যান নেই, আপনি আপনার মতো জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ুন।

যাচ্চলে লাইটম্যান নেই। নাহ, এইভাবে বেশিদিন রবিবাবু টানতে পারবেন বলে মনে হয় না। যে কোনোদিন হাউসে তালা পড়বে!

দোতলার সিঁড়ির মুখে একটা জিরো পাওয়ার জ্বললেও ব্যালকনি পুরোপুরি অন্ধকার। অনেককাল ধরেই এখানে সুমনের যাতায়াত, তাই লাইটের স্যুইচ খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না তার। আলো জ্বালিয়ে পিছনের দিকে ভালো জায়গা দেখে বসে পড়ল সে। সারি সারি সিট ফাঁকা পড়ে আছে, একটা লোক নেই, দেখতে দেখতে গা—টা হঠাৎ কীরকম ছমছম করে উঠল তার।

মিনিট পনেরো কেটে গেল, ওয়ার্নিং বেল পড়ে গেল, ব্যালকনির গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকে এল কয়েকজন লোক, তারা নিজেদের মতো জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল ছড়িয়ে—ছিটিয়ে। তাদের মধ্যে একজন লুঙ্গিপরা লোকও দেখা যাচ্ছিল। সিটে বসে পা তুলে বেমালুম বিড়ি খেতে শুরু করল। ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এটুকু কম্প্রোমাইজ না করলেই নয়।

দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিল। কী আর করবে—সুমন চুপ করে রইল।

বই শুরু হয়ে গেল। গেট থেকে উপরে এসে ব্যালকনির লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে গেট টেনে চলে গেল গেটকিপার। কয়েকটা বোকা বোকা অ্যাডের পর পর্দায় রক্তপানরত হায়নার মুখ ভেসে উঠল। ব্যাকগ্রাউন্ডে শ্মশান, দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছে। নানান সাইজের মড়ার মাথা সটাসট নাচতে নাচতে ফুটিয়ে তুলছে বইয়ের টাইটেল, ‘দেখা হবে মাঝরাতে’।

বাহ, হেভি টেকনিক তো! নামটা যা—ই হোক, গল্পটা জমে যেতে পারে। সুমন পিঠ টান টান করে বসল।

গল্প শুরু হয়ে গেল। এক বয়স্কা ভদ্রমহিলার উপর ভূত ভর করেছে। ভদ্রমহিলার বাঁশির মতো সরু নাক, জোড়া ভুরু। বয়েস চলে গেলেও এখনও অসামান্য সুন্দরী। চোখ কপালে তুলে অপ্রকৃতিস্থের মতো তিনি সারা ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছেন, চিৎকার করে বলছেন, আমায় রক্ত দাও। আমি রক্ত খাব! বড্ড খিদে আমার! কতদিন না খেয়ে থাকব?

কে বলে বাংলা সিনেমার মান পড়ে গেছে। ভদ্রমহিলা দুর্দান্ত অ্যাক্টিং করছেন, এমন জীবন্ত যে রীতিমতো ভয় ভয় করে উঠল সুমনের। আচমকা সারা শরীর প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকি দিয়ে উঠল ভদ্রমহিলার। আস্তে আস্তে চোখ দুটো নর্মাল হয়ে এল তাঁর, তারপর এদিকে—ওদিকে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক যেন সুমনের চোখে এসে স্থির হয়ে গেল। ওরে বাবা রে, কী ভীষণ সে চোখের দৃষ্টি। সুমন সহ্য করতে পারল না, সরিয়ে নিল চোখ।

ভদ্রমহিলা খলখল করে হেসে উঠলেন, হাসতে হাসতে বললেন, কী রে আমায় রক্ত দিবি নে? আমার সব রক্ত চেটেপুটে খেয়েছিস, আমায় রক্ত দিবি নে?

সিনেমার ছবি কখনো কথা বলে দর্শকের সঙ্গে! মাথাটা কীরকম ভোঁ ভোঁ করে উঠল সুমনের। আর তার পরে সে চোখের সামনে যা দেখল, মাথাটাই খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল তার।

সুমন দেখল, ভদ্রমহিলা সিনেমাহলের পর্দা থেকে সটান বেরিয়ে পা—পা করে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছেন। হাত নামিয়ে স্পষ্ট তাকে লক্ষ করেই যেন বলছেন, দাঁড়া, আমি আসছি। তোর শরীরে অনেক রক্ত। গরম গরম, টাটকা টাটকা রক্ত। আআফ! উসসস!

ভদ্রমহিলা জিব চাটতে শুরু করলেন। শুধু কথাই বলে না, পর্দা থেকে ছবির মানুষ নেমেও আসে? নাহ, এতটা বাড়াবাড়ি কিছুতেই সম্ভব নয়। নির্ঘাত কিছু গোলমাল আছে এর মধ্যে। সিট থেকে তড়াক করে উঠে পড়ল সুমন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যালকনির দর্শকরা সকলে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে হেসে উঠল। সুমন চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল, দর্শক কই, পাঁচটা সিটে স্রেফ পাঁচটা কঙ্কাল বসে আছে।

নাহ, যথেষ্ট হয়েছে! মাথায় থাকুক আমার সিনেমা, মাথায় থাকুক টাইম পাস, আর্তনাদ করে সুমন হুড়মুড়িয়ে ব্যালকনির গেট ঠেলে ছুটল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে প্রাণপণে ছুটতে লাগল। ছুটছে ছুটছে! তারপর আর কিছু মনে নেই তার।

দুই

কতক্ষণ ঠিক বলতে পারবে না, আস্তে আস্তে জ্ঞানটা ফিরে এল সুমনের। চোখ মেলে দেখল, সে শুয়ে আছে। তখনও বুকটা তার উঠছে পড়ছে। আতঙ্কে গায়ের লোমগুলো খাড়া খাড়া হয়ে আছে। ধড়মড় করে উঠে বসল সে।

উঠবেন না সুমনভাই! উঠবেন না! ভারী গলায় কে যেন বলে উঠলেন, আর একটু শুয়ে থাকুন।

এই গলা সে চেনে। সুমন বাঁদিকে ঘাড়টা কাত করতেই দেখল, মা জগদম্বা লজের শ্যামবাবু। সঙ্গে সঙ্গে বুকটা হালকা হয়ে এল তার। বলল, না না, ঠিক আছে। আমি কোথায় শ্যামবাবু?

শ্যামবাবু বললেন, মন্দিরে।

সুমনের মাথাটা পরিষ্কার হয়ে এল। তাকিয়ে দেখল, ঠিক তাই। ডাকাতে কালীবাড়ি মন্দিরের নাটমন্দির এটা। দূরে টিমটিম করে একটা প্রদীপ জ্বলছে। তার সামনে চাদরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে একজন লোক।

এই লোকটা শ্যামবাবুর চেলা। একটু আগে এই পথ দিয়ে সুমন যখন আতঙ্কে পাগলের মতো ছুটছিল তখন সে—ই ছুটে গিয়ে তাকে ধরেছিল, তারপর মন্দির থেকে বেরিয়ে শ্যামবাবুও তার সঙ্গে হাত লাগান। শ্যামবাবু মন্দিরে তখন নিশীথ পূজায় বসেছিলেন। সুমন তারপরেই অজ্ঞান হয়ে যায়।

শ্যামবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, সুমনভাই? এদিকে কোথায় গিয়েছিলেন এই রাতবিরেতে? কে তাড়া করেছিল আপনাকে?

সুমন থরথর করে কেঁপে উঠল। শ্যামবাবু তাকে ভরসা দিয়ে বললেন, আপনি এখন মায়ের মন্দিরে, সম্পূর্ণ নির্ভয়ে সমস্ত খুলে বলুন।

আরও কিছুক্ষণ লাগল সুমনের নিজেকে সামলাতে। তারপর ভয়ে ভয়ে ঢোকা গিলতে গিলতে সমস্ত খুলে বলল। সব শুনে শ্যামবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন, করেছেন কী! ছায়াচিত্র হল তো মাস ছয়েকের ওপর বন্ধ, আপনি গিয়েছিলেন সেখানে বায়োস্কোপ দেখতে? যাওয়ার আগে আমাকে বলবেন তো!

ছায়াচিত্র বন্ধ! কী বলছেন আপনি? সুমন চেঁচিয়ে উঠল।

সে খুব দুঃখজনক ঘটনা। শ্যামবাবু মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, জানেন তো সিনেমার ব্যবসার হাল—ছায়াচিত্র হলের মালিক রবিবাবু হাউস চালাতে গিয়ে ধারদেনায় পুরো ডুবে গিয়েছিলেন। মহাজনদের জ্বালায় পানিপাতিনি থেকেই পালান তিনি। শোকে—দুঃখে বিছানা নেন তাঁর স্ত্রী। পরে সুইসাইড করে মারা যান। এ তল্লাটে তাঁর মতো সুন্দরী আর একটি ছিল না। মরার পরও দেখতে গিয়ে চোখ ফেরাতে পারছিলুম না, বুঝলেন?

দাঁড়ান দাঁড়ান। সুমন হঠাৎ কীরকম উত্তেজিত হয়ে উঠল, ভদ্রমহিলার কি জোড়া ভুরু ছিল?

ঠিক ঠিক! শ্যামবাবু অবাক হলেন, আপনি কী করে জানলেন, সুমনভাই?

সুমন সিনেমার কথা বলল। শুনে শ্যামবাবুর চোখ গোল হয়ে গেল, কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম নিবেদন করে বললেন, জোর বাঁচান বেঁচেছেন আপনি। মা মহামায়াই আপনাকে রক্ষা করেছেন।

সুমন উঠে পড়ল। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, রাত দশটা বেজে গেছে। হোটেলের সারাদিনের হিসেব বুঝে নিয়ে এই সময় রোজই মন্দিরে চলে আসেন শ্যামবাবু। নিশীথ পুজো সেরে এখান থেকেই নিজের বাড়ি চলে যান। কিন্তু আজ আর বাড়ি না ফিরে সুমনকে হোটেলে পৌঁছে দিতে চললেন। সুমনও না করল না, এখনও ভয়ে চমকে চমকে উঠছে বুকটা তার।

ন—দিঘা মোড়ের দিকে স্টার্ট করার আগে শ্যামবাবু হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন, আঙুল তুলে দূরে দেখিয়ে বললেন, ওই আপনার ছায়াচিত্র হল। দেখতে পাচ্ছেন কিছু?

সুমন ভয়ে ভয়ে তাকাল। এখন থেকে ছোটো একটা মাঠ পেরিয়ে তারপর ছায়াচিত্র সিনেমা হল। কিন্তু কোথায় হল? চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার ঘুটঘুট করছে। শ্যামবাবু ঠিকই বলেছেন। মা মহামায়ার কৃপা ছাড়া আজ বেঁচে ফিরতে হত না তাকে।

হোটেলে ফিরে মুখে কিছু রুচল না সুমনের। বড়ো একঘটি জল খেয়ে শ্যামবাবুকে গুডনাইট জানিয়ে তাড়াতাড়ি লেপ টেনে শুয়ে পড়ল। রাতটা কাটিয়ে ভালোয় ভালোয় এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।

কিন্তু সব হিসেব কি আর মানুষের ঠিকঠাক থাকে, না ঠিকঠাক হয়? মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল সুমনের। চোখ মেলে চেয়ে হাড় হিম হয়ে গেল তার। মশারি ঠেলে কালো একটা গোল অন্ধকার ঝুঁকে পড়েছে তার মুখের উপর। মাথায় উঠল ঘুম, লেপ ছুড়ে মশারি ছিঁড়ে নেমে পড়ল সে নীচে। চিৎকার করে বলল, কে কে?

চেঁচাবেন না, সুমনবাবু। অন্ধকারের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠলেন, লাইটটা জ্বালান আগে।

সুমন ছুটে গিয়ে লাইটটা জ্বালিয়ে ভয়ে শিউরে উঠল। ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন রবিবাবু। ছায়াচিত্র হাউসের জলজ্যান্ত মালিক রবিবাবু! সেই মাঝারি হাইট, ফরসা রং, চোখে হাই পাওয়ার রিমলেস চশমা, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।

এ কি আপনি? আপনি এখানে কী করে এলেন? সুমন বলল, আপনি আমার ঘরে ঢুকলেন কী করে, অ্যাঁ?

বলছি। রবিবাবু বললেন, কিন্তু তার আগে বলুন, পালিয়ে এলেই কি বাঁচা যায়, সুমনবাবু? আমার স্ত্রীর হাত থেকে বেঁচেছেন, কিন্তু এবার যে আমার টার্ন! তার জন্যই তো কীরকম দেখা হয়ে গেল আমাদের মাঝরাতে! হা হা হা!

রক্ত জল হয়ে গেল সুমনের। কাঁপতে শুরু করল গলা, আ—আ—আপনি—

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন,শ্যামবাবু আপনাকে রং ইনফরমেশন দিয়েছেন, সুমনবাবু। হাসতে হাসতে নিজের স্টাইলেই কথা বলে চললেন রবিবাবু, আমি বাড়ি থেকে পালাই—টালাইনি, বুঝলেন? আমিও আমার মিসেসের মতো সুইসাইডই করেছিলাম। নদীতে ডেডবডি ভেসে গিয়েছিল বলে কেউ ট্রেস করতে পারেনি আমাকে। হা হা হা!

সুমন কাঠ হয়ে গেল। একবার বেঁচে ফিরেছে, কিন্তু এবার বড়ো কঠিন চক্করে পড়েছে। মাথার চুলগুলো একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল তার, আ—আ—আ—

কী আ আ করছেন তখন থেকে! গলা সাধছেন নাকি? হা হা হা।

সুমন চেয়ে রইল। হঠাৎ রবিবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন, গলা বদলে বললেন, শুনুন মশাই, আপনাকে একটু হেল্প করতে হবে।

আ—আ—মাকে?

রাইট। আপনার সঙ্গে একটু পুরোনো হিসেব চোকানোর আছে। এর জন্য আপনি পানিপাতিনিতে আসবেন বলে কবে থেকে হাঁ করে বসে আছি, জানেন?

হিসেব?

এই তো এতক্ষণে গোটা শব্দ ফুটেছে! রবিবাবু বলে চললেন, যত নষ্টের গোড়া আপনারাই, আপনাদের টিভি কোম্পানিই আমাদের পথে বসিয়েছে, আমাদের এতদিনের সাধের ব্যবসা ডকে তুলে দিয়েছে, শেষ করে দিয়েছে আমাদের। কিন্তু আমরা একা শুধু শেষ হব কেন চাঁদু, আপনাকেও আমাদের পার্টনার হতে হবে, বুঝলেন? ব্যস, হিসেব সমান সমান!

রবিবাবু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। সুমন চেয়ে রইল। চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হল, আর ভয় পাচ্ছে না সে। আসলে খুব বেশি ভয় পেলে মানুষের ভয়বোধটাই কীরকম অসাড় হয়ে যায়। সুমনেরও তাই হয়েছে।

কি সুমনবাবু, আমার প্রস্তাবটা পছন্দ হল না বুঝি? রবিবাবু বললেন, হাঁ করে কী দেখছেন বলুন তো আমার মুখের দিকে? আপনি আমার পার্টনার হলে দু—জনে মিলে আমার হাউসে বসে প্রাণভরে আড্ডা মারব, হ্যাঁ?

সুমন চেয়ে রইল।

আরে কী ভাবছেন, মশাই? কীসের ধ্যান করছেন?

আসলে মাথা থেকে সব ভয়, সব টেনশন বেরিয়ে গেলেন তখন আসল কথাটাই মনে পড়ে যায় মানুষের। সুমনেরও মনে পড়ল। মা মহামায়া। একবার না বলতেই বাঁচিয়েছ, আর একবার নয় বাঁচালে। মায়ের কাছে ছেলে কি এইটুকু আবদার করতে পারে না?

সুমনের চোখ জলে ভরে উঠল। সে মনপ্রাণ দিয়ে মাকে ডাকতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *