দেখবার চোখ

দেখবার চোখ

জর্জ আর আমি সমুদ্রের ধারে বোর্ডওয়াকের বেঞ্চে বসেছিলাম আর সমুদ্রসৈকতের প্রশস্ত বিস্তৃতি ও দূরে ঝকমকে সমুদ্র নিবিড়ভাবে অবলোকন করছিলাম। বিকিনি পরিহিতা তরুণীদের নিরীক্ষণ করার নিষ্পাপ আনন্দে মগ্ন ছিলাম আমি, আর ভেবে অবাক হচ্ছিলাম, জীবনের থেকে ওরা আর কী আনন্দ পেতে পারে, অর্ধেক আনন্দ তো ওদেরই দান।

জর্জকে যতদূর চিনি, আমার বরং সন্দেহ হয়, তার নিজস্ব চিন্তাধারা আমার তুলনায় সূক্ষ্ম নান্দনিক ছিল না।

রীতিমতো বিস্ময়ের কথা, শুনলাম সে বলছে, ‘বন্ধু, এখানে বসে আমরা স্বর্গ থেকে নেমে আসা নারীরূপিনী প্রকৃতির সৌন্দর্যসুধা পান করছি, প্রবাদে বলতে গেলে এবং তবু নিশ্চয়ই প্রকৃত সৌন্দর্য এত স্বচ্ছ হয় না, হতে পারে না। প্রকৃত সৌন্দর্য, যতই হোক এতই মূল্যবান যে তাকে সামান্য পর্যবেক্ষকদের চোখের আড়ালে রাখতে হয়। কখনো কি সে কথা ভেবেছ?’

‘না,’ আমি বলি, ‘আমি কখনো তা ভাবিনি আর তুমি যখন এর উল্লেখ করলেই, আমি তবু করি না। বেশি কথা কি, আমার মনে হয় না, তুমি এসব আদপে চিন্তা করেছ।

জর্জ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধু গুড়ে সাঁতার কাটা, প্রচুর প্রচেষ্টা, খুব সামান্য পাওনা। আমি লক্ষ্য করেছি, যে দীর্ঘাঙ্গিনী অপ্সরাকে তুমি নিরীক্ষণ করছিলে, সেই মেয়েটি যে সূক্ষ্ম মসলিনের আচ্ছাদনে সামান্য কয়েক বর্গ ইঞ্চিও আবরিত করতে কার্পণ্য করেছে, সে যা প্রদর্শন করছে, তা সবই ফালতু এবং অগভীর।’

‘ভেবে দেখ, তোমার মতন ভোঁতা দৃষ্টির নিরপেক্ষ বিচারেও সততা, নিঃস্বার্থপরতা। প্রফুল্লতার চিরন্তনী গৌরবে অধিষ্ঠিতা নারী যদি অনুযোগ জানাতেই না জানে, পরের কল্যাণেই মন সমর্পণ, অর্থাৎ সর্বগুণ সমন্বয়, সংক্ষেপে, যে গুণগুলি নারীর ওপর স্বর্ণ ও মহিমা বর্ষণ করে, তবে সেই যুবতী আরো কত সুন্দর হতে পারে।

‘আমি জীবনে খুব বেশি কিছু চাইনি। বিনয়সহ আমার মতন করে বললাম, ‘ঐ ভাসা ভাসা, ওপর ওপর যা জাহির হচ্ছে, তাতেই আমার তুষ্টি।’

‘জর্জ আমি যা ভাবছি,’ আমি বলি, ‘তুমি কি অধিক পান করেছ? ঐ সমস্ত গুণাবলীর কতটুকু তুমি জানো?’

‘আমি ওই সব গুণাবলীর সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিচিত,’ জর্জ উগ্রভাবে বলল, ‘কারণ আমি ঐ সবই পূর্ণমাত্রায় অধ্যবসায়ের সঙ্গে অভ্যাস করেছি।’

‘নিঃসন্দেহে,’ আমি বলি, ‘শুধু তোমার গৃহকোণের একান্তে এবং অন্ধকারে।

.

তোমার স্থূল মন্তব্য অগ্রাহ্য করেও (জর্জ বলল), আমার তোমাকে বোঝাতেই হবে, যদিও ঐ সব গুণাবলীর ব্যক্তিগত জ্ঞান আমার নেই, তথাপি আমি এক তরুণী মেলিসান্ডে ওট, ওরফে মেলিসান্ডে রেন এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শিখেছি। তার প্রিয় পতি অক্টেভিয়াস ওট যার কাছে সে ম্যাগি বলে পরিচিতা। আমার কাছেও সে ম্যাগি। কারণ সে আমার প্রিয় পরলোকগত বন্ধুর মেয়ে। আর সে আমাকে তার আঙ্কেল জর্জ হিসেবেই জানে।

অবশ্য আমিও স্বীকার করি, ‘আমার মধ্যেও তোমারই মতন, ঐ অস্পষ্ট গুণ, যাকে তুমি ভাসা ভাসা অগভীর’ বলছ, তার জন্য খানিক প্রশংসা রয়েছে হ্যাঁ বন্ধু, আমি জানি কথাটা আমিই প্রথম ব্যবহার করেছিলাম, ‘কিন্তু যদি সামান্য তুচ্ছ বিষয়ে আমাকে বার বার বাধা দিতে থাক, তবে আমরা কখনোই সহমতে আসতে পারবো না।

আমার মধ্যে এই ছোট্ট দুর্বলতাটুকু আছে বলে, স্বীকার করতেই হবে, আমাকে দেখে আনন্দের আতিশয্যে সে যখন চিৎকার করে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরত, তখন আমার আনন্দ অতটা হতো না, যতটা হতে পারত, যদি তার গঠন আরো সুঠাম ও সুষ্ঠু হতো।

সে যথেষ্ট কৃশ এবং অস্থি-সার। মস্ত নাক, দুর্বল চিবুক, চুল পাতলা ও সোজা আর রঙ একেবারে ইঁদুরের মতন, চোখ অবর্ণনীয় ধূসর সবুজ। গালের হাড় চওড়া। তাকে অনেকটা কাঠবেড়ালীর মতন দেখাত, যেন সদ্য সদ্য বাদাম ও বীজ দানার মনোহর সংগ্রহ সম্পন্ন করে এসেছে। সংক্ষেপে, সে যুবতীদের মধ্যে এমনটি ছিল না, যাতে, অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে কোনো যুবকের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হয় এবং কাছে আসার তীব্র তাগিদ জন্মায়।

কিন্তু তার সুন্দর অন্তর ছিল। পূর্বাভাস ছাড়াই যে সব সাধারণ মানের যুবকের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হত, তারা স্বভাবতই বেদনার সঙ্গে নিজেদের গুটিয়ে নিত, আর

আন্তরিক হাসি ছড়িয়ে, মেয়েটি অটল থাকত। সব বান্ধবীদের বিবাহে সে কনের সহচরী হয়ে কাজ করেছে। প্রত্যেকবারই নবীন উচ্ছ্বসিত হাসিতে অসংখ্য শিশুর সে ধর্মমা হয়েছে, কত জনের বেবী সিটার। কত শিশুর মুখে সে দুধের বোতল ধরেছে।

প্রকৃত দুঃস্থদের কাছে সে গরম স্যুপ নিয়ে গেছে, আবার যাদের প্রয়োজন নেই তাদের কাছেও, যদিও অনেকের মতো, অযোগ্যরাই তার সাক্ষাৎ পাওয়ার অধিক অধিকারী ছিল।

স্থানীয় গীর্জায় হরেক রকম কর্তব্য করেছে, কখনো নিজের জন্য, কখনো বা যারা নিঃস্বার্থ সেবার চেয়ে সিনেমা জগতের জাঁকজমক বেশি পছন্দ করে, তাদের হয়েও।

রবিবারের স্কুলে সে পড়িয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের আনন্দ দিয়েছে, নানা রকম মুখভঙ্গী করে। তাদের সম্পর্কে বাইবেলে বর্ণিত মোজেজের নটি বিধান পড়তে অনুপ্রাণিত করেছে। সব সময়ে একটি বিধান বাদ দিয়ে গেছে, যেটি ব্যভিচার সংক্রান্ত। কারণ অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছিল, এটা থেকে নিঃসন্দেহে অনেক

অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসবে। সাধারণ পাঠাগারের স্থানীয় শাখায় স্বেচ্ছামূলক কাজ করেছে।

স্বভাবতই চার বছরে বয়সে, সে কোথাও বিবাহের সম্ভাবনার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। দশ বছর বয়সে পৌঁছেই, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে যেমন তেমন একটা ডেট নেওয়ার সম্ভাবনাও তার কাছে অবাস্তব স্বপ্নে পরিণত হয়েছিল।

কতবারই সে আমাকে বলেছে, ‘আমি অসুখী নই, আঙ্কেল জর্জ। পুরুষের জগতের দরজা আমার কাছে বন্ধ, একমাত্র আপনার প্রিয় সত্তা ও হতাভাগ্য পিতার

স্মৃতি ছাড়া। কিন্ত লোকের কল্যাণ সাধনে প্রকৃত সুখ, অনেক বেশি।’

তখন সে আঞ্চলিক কারাগার পরিদর্শনে যেত, কয়েদীদের অনুতাপে অথবা সুকর্মে প্রণোদিত করার জন্য। দু একজন আরো অশোধিত, যারা নির্জন বন্দী জীবন বরণ করে নিয়েছে, তাদের কাছেও সে পৌঁছে যেত।

আর তখনই, পাওয়ার কোম্পানির দায়িত্বশীল পদের এক তরুণ ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার ম্যাগীর প্রতিবেশী হয়ে এল। সে এক গম্ভীর, পরিশ্রমী, আত্মস্থ, সাহসী, সৎ, সম্মানীয় যোগ্য যুবক, কিন্তু তাকে কোনোমতেই তুমি বা আমি সুদর্শন বলব না। প্রকৃতপক্ষে সূক্ষ্মভাবে বিচার না করলেও, কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ ছিল না, যে কেউ তাকে সুদর্শন বলেছে।

তার অপসৃয়মাণ কেশের সীমারেখা, আরো সঠিকভাবে বললে, ফাঁকাই, কন্দতুল্য কপাল, মোটা চ্যাপ্টা নাক। পাতলা ঠোঁট, মাথার থেকে কান দূরে উঁচিয়ে রয়েছে আর উন্নত চঞ্চল এ্যাডাম্ এ্যাপ্‌ল। যা সামান্য চুল ছিল, সবই মরচে পড়া রং এর। নানা আকারের বলিরেখায় মুখমণ্ডল ও বাহু পূর্ণ ছিল।

ভাগ্যক্রমে আমি ম্যাগির সঙ্গে ছিলাম, যখন রাস্তায় তার প্রথম অক্টেভিয়াসের সঙ্গে দেখা হয়। দুজনই সমান অপ্রস্তুত। যেন একজোড়া খামখেয়ালী ঘোড়া ভয়ঙ্কর পরচুলা সমেত এক ডজন ক্লাউনের মুখোমুখি হয়েছে আর তারা এক ডজন হুইসেল বাজিয়ে দিয়েছে। মুহূর্তের জন্য মনে হল, ম্যাগি ও অক্টেভিয়াস পিছু হটে আনন্দে

চিঁ হিঁ করে ডেকে উঠবে।

যাই হোক, সেই মুহূর্ত কেটে গেল। উভয়েই আতঙ্ক ও চমকের অভিজ্ঞতা সাফল্যের সঙ্গে কাটিয়ে উঠল। মেয়েটি কিছুই করল না, মাত্র বুকে হাত রাখল, যেন তার হৃদয় পাঁজর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে, অন্য কোনো গোপন স্থানে লুকাতে চাইছে আর ছেলেটি তার ভ্রূ মুছল, যেন এক আতঙ্কের স্মৃতি মুছে ফেলছে।

আমার কিছুদিন আগেই অক্টেভিয়াসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাই আমিই তাদের পরস্পরকে পরিচিত করালাম। দুজনেই সাময়িক হাত বাড়িয়ে দিল, যেন দৃষ্টির উপরেও স্পর্শের চেতনায় কেউ আগ্রহী নয়।

সেই বিকেলের পর, ম্যাগি তার দীর্ঘ মৌনতা ভেঙে আমাকে বলল, ‘কী অদ্ভুত যুবক এই মি. ওট!’

আমার সমস্ত বন্ধুরা যা উপভোগ করে, সেই রূপালঙ্কারের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বললাম, ‘বইকে তার মলাট দেখে বিচার করো না, সোনা।’

‘কিন্তু মলাট তো রয়েছেই, আঙ্কেল জর্জ,’ সে আন্তরিকভাবে বলল, আর সেটা তো আমাকে ধরতেই হবে। অসার এবং অনুভূতিহীন সাধারণ যুবতীর মি. ওটের সঙ্গে বনবে না। এটা একটা সহানুভূতির কাজই হবে, যদি তাকে দেখাই, সব যুবতীই অমনোযোগী নয়। অন্তত একজন রয়েছে, যে এক যুবকের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। যে অভাগাকে দেখতে— ‘ সে থামল। কারণ বাক্য সম্পূর্ণ করতে সে, প্রাণী জগতে কোনো উপমা খুঁজে পেল না, তবে নরম করে বলল, ‘যাই-ই হোক, আমার তার প্রতি সদয় হওয়া উচিত।’

জানি না, একইভাবে নিজেকে হাল্কা করতে, অক্টেভিয়াসের অনুরূপ আস্থাভাজন কেউ ছিল কিনা! সম্ভবত নয়, কেননা আঙ্কেল জর্জের মতন আশীর্বাদধন্য কমই আছে। যতই না হোক, পরবর্তী ঘটনাসমূহ বিচার করে, আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত, ঐ ধরনের গল্প নিশ্চয়ই তার মনে এসেছিল, অবশ্যই বিপরীতক্রমে।

যাই হোক উভয়েই উভয়ের প্রতি সদয় হওয়ার চেষ্টা করেছিল, প্রথম দিকে সাময়িকভাবে, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে। তারপর উষ্ণতায় এবং সবশেষে আবেগে। যা শুরু হয়েছিল, লাইব্রেরীতে অকস্মাৎ সাক্ষাৎ দিয়ে, পরিণতি পেল, চিড়িয়াখানায় সাক্ষাৎ, তারপর সন্ধ্যায় সিনেমা দেখা, তারপর নাচ এবং পরিণতিতে যদি তুমি আমার ভাষাকে ক্ষমা কর তো বলি, নির্বাচিত নির্জনে।

লোকজন একজনকে দেখলেই, অপরজনকে সেখানেই আশা করতে লাগল, কারণ তারা তখন অবিচ্ছেদ্য জোড়া। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ তিক্ত অভিযোগ জানাল, অক্টেভিয়াস ও ম্যাগির যৌথ উপস্থিতি মানবচক্ষে ডবল ডোজে পীড়াদায়ক এবং লঘু সম্প্রদায়ের উন্নাসিক কেউ কেউ কালো চশমা কিনে ফেলল।

আমি বলব না, যে ঐ সব চরম মতামত সম্পর্কে আমার সহানুভূতির অভাব ছিল, কিন্তু অন্যরা যারা আর একটু সহিষ্ণু, নজর করেছিল একজনের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অদ্ভুত আকস্মিকতায় অন্যজনের অনুরূপ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিপরীত আকার প্রকার। দুজনকে এক সঙ্গে দেখলে একটা কাটাকাটি হয়ে গিয়ে সহনীয় মনে হয়, একা একা পৃথকভাবে দেখার চেয়ে। অন্ততপক্ষে কেউ, কেউ এমন কথা বলেছিল।

অবশেষে একদিন এল, যখন ম্যাগি আমার কাছে ভেঙে পড়ল, ‘আঙ্কেল জর্জ, অক্টেভিয়াস আমার জীবনের আলো ও অস্তিত্ব। সে শক্তপোক্ত, বলিষ্ঠ, শান্ত, স্থিতধী ও একনিষ্ঠ। সে এক সুন্দর পুরুষ।’

‘অন্তরের দিকে, সোনা।’ আমি বলি, ‘আমি নিশ্চিত, তোমার সব বিশেষণই সত্যি। কিন্তু তার বাইরের চেহারাটা যতই হোক-’

‘শ্রদ্ধেয়’ সে শক্তভাবে, বলিষ্ঠভাবে, শান্তভাবে, স্থিতভাবে, একনিষ্ঠ হয়ে বলল।

‘আঙ্কেল জর্জ, সেও আমার সম্বন্ধে যেমন ভাবে, আমিও ওর সম্বন্ধে তেমনই ভাবি। আমরা বিয়ে করতে চলেছি।’

‘তুমি আর অক্টে’! আমি অস্পষ্টস্বরে বললাম, ‘এই ধরনের বিবাহের মতন একটা বিষয়ে অনৈচ্ছিক কল্পনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল এবং আমি খানিকটা চেতনা হারালাম।

‘হ্যাঁ, সে বলল, ‘ও আমাকে বলেছে আমি তার খুশির সূর্য এবং আনন্দের চাঁদ। তারপর, সে আরো বলেছে, আমি তার সুখের নক্ষত্র। সে একজন কবি মানুষ।’

তাই তো মনে হচ্ছে, দ্বিধাভরে বললাম, ‘তা কবে বিয়ে করছ?’

‘যত শিগগির সম্ভব,’ সে বলল।

আমার দাঁত কিড়মিড় করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। ঘোষণা করা হল, প্রস্তুতি চলল। বিবাহ সম্পন্ন হল, আমারই কন্যাদানে। অবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিবেশীরাও যোগ দিয়েছিল, এমনকি মন্ত্রীও।

কেউই নবদম্পতির দিকে আনন্দে তাকাচ্ছে বলে মনে হয়নি। শুধু মন্ত্রী সামনের দরজার নক্শাদার গোল জানলার দিকে তাকিয়েছিলেন।

.

আমি কিছুদিনের মধ্যেই ঐ অঞ্চল ছেড়ে চলে গেলাম, অন্য এক শহরে, তল্পি- তল্পা গুটিয়ে, আর, ম্যাগির সঙ্গে যোগাযোগও নষ্ট হয়ে গেল। এগারো বছর বাদে, ঘোড়দৌড়ের গুণাগুণ বিচারের প্রেক্ষিতে এক বন্ধুর অর্থ বিনিয়োগ উপলক্ষ্যে আমায় ফিরতে হল। ম্যাগির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ ছাড়লাম না। কারণ নানান গুপ্ত গুণে গুণান্বিতা ম্যাগি ছিল অসাধারণ রাঁধুনি।

আমি দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের সময় পৌঁছে গেলাম। অক্টেভিয়াস ছিল বাইরে, তার কাজের জায়গায়। তাতে কিছু এল গেল না। আমি স্বার্থপর নই, আমার ভাগের উপর অক্টেভিয়াসের ভাগেরটাও আমি খেয়ে নিলাম।

ম্যাগির মুখে এক দুঃখের ছায়া ছিল, যা আমার নজর এড়াল না। কফি খেতে খেতে বললাম, ‘তুমি কি খুশি নও ম্যাগি? তোমার বিয়ে কি ভাল হয়নি?’

‘আরে না, আঙ্কেল জর্জ,’ অত্যধিক জোর দিয়ে সে বলল, ‘আমাদের বিয়ে স্বর্গে হয়েছিল। যদিও আমরা নিঃসন্তান। কিন্তু আমরা এতই একে অপরের জীবনে জড়িয়ে রয়েছি, ঐ অভাবটা ক্বচিৎ অনুভব করি। আমরা অনন্ত স্বর্গ সুখের সমুদ্রে বাস করি, জগতে কিছুই আর চাইবার নেই। ‘

‘তাই নাকি!’

‘তাহলে তোমার মধ্যে আমি দুঃখের ছায়া দেখতে পাচ্ছি কেন!

একটু ইতস্তত করে সে উথলে উঠল, ‘আঙ্কেল জর্জ, আপনি এমন বিচক্ষণ ব্যক্তি। আনন্দের চাকায় কাঁকড়ের মতন একটা জিনিস আটকে রয়েছে।’

‘আর, সেটা কি?’

‘আমার চেহারা।’

‘তোমার চেহারা? কি দোষ হল?- আমি কথা গিলে ফেললাম আর বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারলাম না।

যেন এক গুপ্ত কথা ফাঁস করছে, এইভাবে ম্যাগি বলল, ‘আমি সুন্দরী নই।’

‘আহ’ আমি বলি।

‘আর আমার ইচ্ছা, যদি আমি অক্টেভিয়াসের জন্যই, আমি শুধু ওর জন্যই সুন্দর হতে চাই।

সাবধানে জিজ্ঞাসা করি, ‘ও কি তোমার চেহারা সম্পর্কে অনুযোগ জানিয়েছে?’

‘অক্টেভিয়াস?’ একেবারেই নয়। ও তার দুঃখ মাখানো নীরবতায় সয়ে থাকে।

‘তাহলে, তুমি কি করে জানলে, সে কষ্ট পাচ্ছে?’

‘আমার নারীর হৃদয় তাই বলে।’

‘কিন্তু ম্যাগি, অক্টেভিয়াস নিজেও তো সুদর্শন নয়।’

সে রেগে গিয়ে ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বলল, ‘কেমন করে বলছ! সে দারুণ দেখতে।’

‘কিন্তু হয়তো সেও ভাবে, তুমিও দারুণ!’

‘না না’ ম্যাগি বলল, ‘কেমন করে ও এমন কথা ভাববে?’

‘আচ্ছা, সে অন্য কোনো রমণীতে আসক্ত!’

‘আঙ্কেল জর্জ!’ ম্যাগি আহত হয়ে বলল, ‘কি সাংঘাতিক ভাবনা! আমি আপনার কথায় অবাক হয়ে যাই। আমি ছাড়া অক্টেভিয়াসের কারো দিকে চোখ নেই।’

‘তাহলে, তুমি সুন্দর হও না বা হও, তাতে কী এল গেল!’

আর তখনি অপ্রত্যাশিত ও অসুন্দর ভঙ্গিতে আমার কোলে লাফিয়ে এসে চোখের জলে আমার জ্যাকেটের কলার ভিজিয়ে দিল। যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজেকে সামলে নিতে না পারল, ততক্ষণ চোখের জল বয়ে গেল।

ততদিনে আমি আজাজেলের সঙ্গে দেখা করে নিয়েছি, ‘সেই আজাজেল্‌ যে দুই সে.মি. লম্বা জিন, যার কথা তোমাকে আমি বলেছি, মাঝে-’ বন্ধু, এখন আর তোমার উন্নাসিক ভঙ্গিতে বিরক্তিসহ বিড়বিড় করার প্রয়োজন নেই।

যাই হোক, আমি আজাজেল্‌কে ডেকেছিলাম।

আজাজেল্ ঘুমন্ত অবস্থায় পৌঁছাল। তার মাথায় সবুজ কিছু ভরা থলি, আর ভিতর থেকে দ্রুত সপ্তক স্বরে নাকি সুরের চিৎকার আসছিল, যা তার বেঁচে থাকার সাক্ষ্য দিচ্ছিল। আর বাস্তব সত্যি, একেক মুহূর্ত প্রত্যেকবার তার পুষ্ট লেজ শক্ত হয়ে যাচ্ছিল ও কটকটে আওয়াজে কাঁপছিল।

আপনাআপনি ঘুম ভাঙার জন্য আমি কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম, আর যখন তা ঘটল না, আমি একজোড়া সন্না দিয়ে তার মাথার থলিটা হটিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে তার চোখ খুলল, আমার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হল, আর সে জোরদার নড়েচড়ে উঠল।

আজাজেল্‌ বলল, ‘মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম, দুঃস্বপ্ন দেখছি, তোমার কথা মনে আসেনি।’

তার ছেলেমানুষী বদমেজাজ আমি উপেক্ষা করে বললাম, ‘আমার জন্যে তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।’

‘স্বভাবতই,’ আজাজেল্‌ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘মনে মনে ভেবো না, আমার কাজ করে দেয়ার জন্য আমি তোমার প্রত্যাশায় রয়েছি!’

‘এই মুহূর্তেই করতাম,’ নম্রভাবে বলি, ‘যদি আমার সামান্য সামর্থ্য তোমার মতন নৈতিক গুণ ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য কিছু করার পক্ষে যথেষ্ট হত এবং তোমার কোনো কাজে আসত।’

‘ঠিক, ঠিক’ আজাজেল্‌ প্রশমিত হল।

আরো বলতে গেলে, সংবেদনশীলতা থেকে খোসামদ, দারুণই বিরক্তিকর। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমি দেখেছি, কেউ তোমার অটোগ্রাফ চাইলে নির্বোধ আনন্দে উড়তে থাকে। কিন্তু আবার গল্পে ফেরত আসি, ‘কি সংক্রান্ত!’ আজাজেল্‌ জিজ্ঞেস করেছিল।

‘আমার ইচ্ছে, তুমি একটি মেয়েকে সুন্দরী করে দাও।’

আজাজেল্‌ প্রীত হল। ‘আমার মনে হয় না, আমি এটা পেরে উঠবো। তোমাদের স্ফীত ও জঘন্য প্রজাতিদের মধ্যে সৌন্দর্য্যের মান খুব খারাপ।’

‘কিন্তু সে তো আমাদের। আমি তোমাকে বলে দেব, কী করতে হবে।

‘তুমি আমাকে বলবে, কী করতে হবে! রেগে কেঁপে সে চিৎকার করে উঠল।’

‘তুমি আমাকে বলবে, কেমন করে কেশমূল উজ্জীবিত করতে হবে, পরিবর্তিত করতে হবে, কেমন করে পেশী শক্ত করতে হবে, কেমন করে অস্থি প্রস্তুত করতে বা দ্রবীভূত করতে হবে! তুমি আমাকে এসব বলে দেবে?’

‘মোটেই নয়,’ আমি বিনীত হই, ‘এই কাজের জন্য যে বিস্তারিত কৌশলের প্রয়োজন, তা তোমার মতন চমৎকার দক্ষ লোকের দ্বারাই সম্পাদিত হওয়া যুক্তিযুক্ত। ওপর ওপর কী ফল হবে, সেটুকু বলতে আমাকে অনুমতি দাও শুধু।’

আজাজেল্‌ পুনর্বার বিগলিত হল, আর আমরা বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করলাম।

‘মনে রেখো,’ আমি বলি, ‘ফলাফল সব কার্যকরী হতে থাকবে, ক্রমাগত ষাট দিন ধরে। অতি আকস্মিক পরিবর্তনে উত্তেজিত মন্তব্য আসতে পারে।

‘মানে, তুমি কি মনে কর’ আজাজেল্‌ বলে, ‘আমি তোমাদের ষাট দিন ধরে ক্রমাগত পরিদর্শন করে নিয়ন্ত্রণ করে, সংশোধন করে কাটাব? তোমার মতো কি আমার সময়ের কোনো মূল্যই নেই?’

‘আরে, কিন্তু তুমি তো এটাকে তোমার জগতের জীববিজ্ঞানের পত্রিকায় লিখতে পার। এটা এমন কাজ নয়, যে তোমার জগতের অনেকের একাজ গ্রহণ করার ক্ষমতা বা ধৈর্য রয়েছে। ফলে তোমার বিরাট প্রশংসা প্রাপ্য হবে।’

আজাজেল্‌ চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল।

‘সস্তা তোষামোদ আমি অবশ্যই ঘৃণা করি,’ সে বলল, ‘তবে আমার নিজের প্রজাতির নিকৃষ্ট সদস্যদের কাছে নিজেকে রোল মডেল বানানো, কর্তব্য বলে মনে করি।’

সে তীক্ষ্ণ শিসের মতো আওয়াজ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল, ‘এটা কষ্টসাধ্য এবং বিড়ম্বনা, তবু এ আমার কর্তব্য।’

আমারও তো কর্তব্য ছিল। আমার মনে হল, এই পরির্তনের সময়টা আমার ম্যাগির প্রতিবেশে থাকা উচিত। আমার ঘোড়দৌড়ের বন্ধু জানাল, বিবিধ পরীক্ষামূলক দৌড়ের ফলাফলের ওপর আমার দক্ষতা ও উপদেশের পরিবর্তে, সে খুব কম অর্থই হেরেছে।

প্রত্যেক দিন আমি ম্যাগিকে দেখবার ছুতো খুঁজে নিতাম আর চোখের সামনে ফলাফল দেখতে পাচ্ছিলাম। তার চুল ঘন হয়ে এল, সুন্দর ঢেউ খেলতে লাগল। লাল সোনালি চিকিমিকি জাগল, এক স্বাগত সমৃদ্ধি।

ধীরে ধীরে তার চোয়ালের হাড় চওড়া হল, গালের হাড় নরম ও উঁচু। চোখের রং আদি নীল, দিনে দিনে গভীর, শেষের দিকে প্রায় বেগুনী। চোখের পাতায় ছোট্ট বঙ্কিম ভঙ্গিমা। কানের আকার সুন্দর হল, লতিদ্বয় পরিস্ফুট। সুগোল সৌষ্ঠব, সর্বাঙ্গীণ সুন্দর একটু একটু করে। কটিরেখা ক্ষীণ হয়ে এল।

লোকজনেরা হতবুদ্ধি। আমি নিজের কানে শুনলাম, ‘ম্যাগি’ তারা বলছে, ‘তুমি নিজেকে কী করে তুলেছ বলতো? তোমার চুল অতি চমৎকার। তোমার বয়স দশ বছর কমে গেছে।’

‘আমি কিছুই করিনি,’ ম্যাগি বলতো। সেও অন্য সকলের মতন হতবুদ্ধি। অবশ্যই আমি ছাড়া।

ম্যাগি আমাকে বলল, ‘আঙ্কেল জর্জ, আমার মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?’

আমি বলি, ‘তোমাকে প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। তবে আমার কাছে তুমি সর্বদাই প্ৰফুল্ল থাক, ম্যাগি।’

‘হতে পারে’ সে বলল, ‘তবে এখনকার মতন নিজের কাছে প্ৰফুল্ল আমি ইতিপূর্বে হইনি। আমি বুঝতেই পারছি না। গতকাল এক সাহসী যুবক আমার দিকে ফিরে, তাকিয়ে দেখছিল। এতদিন তারা চোখ নিচু করে তাড়াতাড়ি পালাত। এই যুবক আমার দিকে চোখের ইশারা করল। আমি এত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, তার দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি হাসলাম।’

কয়েক সপ্তাহ বাদে, তার স্বামী অক্টেভিয়াসের সঙ্গে দেখা হল এক রেস্তোরাঁয়। আমি জানলায় দাঁড়িয়ে মেনু দেখছিলাম। যেহেতু সে তখনই রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাবারের অর্ডার দিতে চলেছে, আমাকে তার সঙ্গে যোগ দিতে বলতে, তার এক মুহূর্ত লাগল, আর আমারও এক মুহূর্ত লাগল আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে।

‘তোমাকে অখুশি দেখাচ্ছে, অক্টেভিয়াস,’ আমি বলি!

‘আমি সত্যিই অসুখী,’ সে বলল, ‘আজকাল ম্যাগির মধ্যে কী হচ্ছে জানি না। তাকে সব সময়ে বিক্ষিপ্ত মনে হয়, অর্ধেক সময় সে আমার দিকে খেয়ালই করে না। সে সর্বদা বাইরে মেলামেশা করে চলেছে। আর গতকাল-’

তার মুখে এমন মর্মপীড়িত দুঃখ বর্ষিত হল যে, সে দিকে তাকিয়ে হাসতে যে কেউ লজ্জিত হবে।

‘গতকাল, গতকাল কি?’ আমি বলি।

‘গতকাল সে আমাকে বলল, আমি যেন তাকে মেলিসান্ডে বলে ডাকি। আমি ম্যাগিকে ওরকম একটা হাস্যকর নাম, মেলিসান্ডে বলে ডাকতে পারি না।’

‘কেন না! ওটা তার খৃষ্টীয় নাম।’

‘কিন্তু সে আমার ম্যাগি। মেলিসান্ডে আমার কাছে এক আগন্তুক।’

‘হ্যাঁ, সে একটু বদলে গিয়েছে’ আমি বলি, ‘তুমি লক্ষ্য করেছ, আজকাল তাকে অনেক সুন্দর লাগে!’

‘হ্যাঁ’ অক্টেভিয়াস কথা কাটল।

‘এটা কি একটা ভাল জিনিস নয়।’

‘না!’ সে তীক্ষ্ণভাবে জোর দিয়ে বলল, ‘আমি আমার সাদামাটা দেখতে মজার ম্যাগিকে চাই। এই নতুন মেলিসান্ডে সব সময় চুল ঠিক করছে, নানান শেডের আই স্যাডো লাগাচ্ছে, নিত্যনতুন পোশাক ও বড় ব্রা কিনছে আর ক্বচিৎ আমার সঙ্গে কথা বলছে।’

তার তরফে, মন মরা নীরবতায় লাঞ্চ শেষ হল।

আমি ভাবলাম বরং ম্যাগির সঙ্গে দেখা করে, কথা বলা ভাল।

‘ম্যাগি,’ আমি বললাম।

‘আমাকে, অনুগ্রহ করে মেলিসান্ডে বলে ডাকবেন।’ সে বলল।

‘মেলিসান্ডে’ আমি বললাম, ‘আমার মনে হচ্ছে অক্টেভিয়াস অখুশি।’

‘আচ্ছা! আমিও তাই,’ সে কটুকণ্ঠে বলল, ‘অক্টেভিয়াস ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে। সে বাইরে বার হবে না। সে আনন্দ করবে না। সে আমার পোশাক, সাজ- সজ্জার বিরোধিতা করবে। সে নিজেকে কি মনে করেছে হ্যাঁ?’

‘তুমি একদা তাকে পুরুষের মধ্যে রাজা ভাবতে।’

‘আমি আরো বোকা। সে একটা কুৎসিত বেঁটে লোক। তার সঙ্গে আমার বেরোতে সঙ্কোচ হয়।

‘তুমি শুধু ওর জন্যই সুন্দরী হতে চেয়েছিলে।’

‘সুন্দরী হতে চেয়েছিলাম, মানে? আমি সুন্দরী। আমি সব সময়ে সুন্দরী ছিলাম। শুধু চুলের সুন্দর কায়দা আর ঠিক কীভাবে সাজগোজ করতে হয়, সেটুকু জানা ছিল না। আমার পথে আমি আর অক্টেভিয়াসকে থাকতে দিতে পারি না।’ আর সে দিলও না।

ছয় মাস পরে তার ও অক্টেভিয়াসের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেল। পরের দেড় বছরে ম্যাগি বা মেলিসাড়ে আবার এক সুদর্শন অভদ্র পুরুষকে বিয়ে করল। আমি একবার তার সঙ্গে ডিনার করেছি। বিলটা তুলতে এতক্ষণ ধরে ইতস্তত করছিল, যে আমার ভয় ধরে যাচ্ছিল, আমাকেই না বিল মেটাতে হয়।

বিবাহ বিচ্ছেদের এক বছর পর, আমার অক্টেভিয়াসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে অবশ্যই পুনর্বিবাহ করেনি। কারণ সে একই রকম কুৎসিত, দুধ তার কাছে এলেই দই হয়ে যায়। আমরা তার এপার্টমেন্টে বসেছিলাম। ম্যাগির ফটোতে ভরা ঘর।

পুরনো ম্যাগি, একটা ফটো আরেকটার চেয়ে আরো খারাপ।

‘অক্টেভিয়াস, তুমি নিশ্চয়ই ম্যাগির জন্য মন খারাপ কর, এখনো,’ আমি বলি।

‘ভীষণভাবে’ তার জবাব, ‘শুধু আশা করতে পারি, সে সুখী হয়েছে।’

‘আমার মনে হয় সে সুখী নয়,’ আমি বলি, ‘সে তোমার কাছে ফিরে আসতে পারে।’

বিষণ্ণভাবে অক্টেভিয়াস মাথা নাড়ল। ‘ম্যাগি কখনো আমার কাছে ফিরে আসবে না। একজন নারী যার নাম মেলিসান্ডে, সে হয়তো ফিরে আসতে পারে। কিন্তু ফিরে এলেও, আমি তাকে গ্রহণ করতে পারি না। সে আমার ম্যাগি নয়, আমার ভালবাসার ম্যাগি নয়।’

‘মেলিসান্ডে,’ আমি বলি, ‘ম্যাগির চেয়ে অনেক সুন্দর।’

অক্টেভিয়াস অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ‘কার চোখে?’ সে বলল, ‘আমার চোখে তো নিশ্চয়ই নয়।’

সেই শেষ, তাদের আমি দেখেছি।

.

আমি মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে বললাম, ‘তুমি আমাকে আবিষ্ট করে দিয়েছ, জর্জ, আমি সত্যিই বিচলিত।

‘এটা একটা দুর্বল বাক্য’ জর্জ বলল, ‘আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, বন্ধু। প্রায় এক সপ্তাহের জন্য পাঁচ ডলার নিয়ে, তোমাকে কি অভিভূত করা যায়?’

পাঁচ ডলারের নোট দিতে ইতস্তত করে, বললাম, ‘এই নাও, গল্পের দাম তাই। আমার তরফে এটা উপহার। এটা তোমার কেন নয়? সব ধারই জর্জের কাছে আমার উপহার। কোনো মন্তব্য না করে জর্জ নোটটি তার চির নতুন ওয়ালেটে ঢোকাল (এটা অবশ্যই চির নতুন, কারণ জর্জ কখনো ব্যবহার করে না)।

সে বলল, ‘বিষয়টিতে ফিরে যেতে, আমি প্রায় এক সপ্তাহের জন্য পাঁচ ডলার নিয়ে, তোমাকে কি আমি অভিভূত করতে পারি?’

আমি বলি, ‘কিন্তু তোমার তো পাঁচ ডলার রয়েছে?’

‘ওটা তো আমার,’ জর্জ বলল, ‘তোমার কিসের মাথাব্যথা? তুমি যখন আমার কাছ থেকে টাকা ধার কর, আমি কি তোমার আর্থিক অবস্থা নিয়ে কোনো মন্তব্য করি?’

‘কিন্তু আমি তো কখনো নিইনি- ‘ আমি শুরু করেছিলাম। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে, আরো পাঁচ ডলার তার হাতে দিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *