দেওয়ার সময়

দেওয়ার সময়

বউদি রীতিমতো হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল।

বলল, তুই যে কী হয়েছিস, তা বলার নয়! নিজেদের জামা, নিজেরা পছন্দ করলেই পারিস। একটা আনলাম, তা রং পছন্দ হল না। আরেকটা আনলাম, বললি, গায়ে ছোটো হচ্ছে। যেমন চেহারা করেছিস। কোনো কোম্পানির স্ট্যাণ্ডার্ড জামাই তোর গায়ে হবে না। কলার সাইজ দেখে কিনলেও জামা গায়ে ঠিক হয় না। এমন কোথাওই শুনিওনি; দেখিওনি।

বিজু বলল। আহা: অত চটছ কেন? একটা কোকাকোলা খাবে? এনে দেব? দেওরের দোষ কী বলো? বউদির মতোই তো দেওর হবে।

মিনু হঠাৎ চটে উঠে বলল, দেখ বিজু, আমার সঙ্গে লাগিস না। মোটা হয়েছি তো বেশ। তোর দাদা মোটা বউই পছন্দ করে। তোর বউ রোগা দেখে আনিস, তাহলেই হবে। যার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস সে তো ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। তাই বুঝি আমার সঙ্গে সবসময় খুনসুটি। মোটা বলে খোঁটা দেওয়া?

বিজু এবার বলল, বোসো বোসো। রাগ কোরো না। আসলে কী জানো, এই পুজোর বাজারের ভিড়ে একগাদা মেয়েদের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে কাউন্টারের সামনে গরমে ঘেমে জামা কেনা আমার কোনোদিনও পোষাবে না।

আহা! মেয়েদের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করতে যেন কী খারাপই লাগে।

বিশ্বাস করো, মেজাজ গরম হয়ে যায়। তোমরা, রিয়্যালি বউদি; নাছোড়বান্দা জাত। দাদার সঙ্গে তো পান থেকে চুনটি খসলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তোমার, অথচ দোকানে গিয়ে শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে ব্লাউজের কাপড় কিনতে তো ধৈর্যচ্যুতি হয় না! সত্যি বউদি! তোমাদের বুঝতে পারি না।

থাক আর বুঝে কাজ নেই। পরীক্ষাটা পাস করো। তার পর কে কাকে বোঝায় আমি দেখব। রাস্তায় রাস্তায় দুজনে দুজনকে বাংলা-পড়ানো আমি বন্ধ করবই।

বিজু হেসে ফেলল। বলল, করেছ কী? ‘বাংলা-পড়ানো’ও শিখে ফেলেছ?

যা দিন-কাল পড়েছে, শুধু বাংলা-পড়ানো কেন, হিব্রু, লাতিন অনেক কিছু পড়ানোই শিখতে হবে।

এমন সময় দাদার সাত বছরের মেয়ে রুমি লাফাতে লাফাতে ঘরে এল। বলল, কাকুমণি, দাদু তোমাকে ডাকছে। তোমার জন্য প্যান্টের কাপড় কিনে এনেছে। দেখবে এসো।

বিজু ইতস্তত করে উঠল। রুমি ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। মিনু আড়চোখে হাসল। তার পর বলল, বুড়ো খোকার জন্যে বাবা লাল জামা এনেছেন, দেখে এসো। পরের বছর হিন্দুস্থান পার্কের শ্বশুরপার্টিস্যুট দেবে। যাও।

বিজু বলল, যা:! বউদি, তুমি একেবারেই বকে গেছ। ‘শ্বরশুরপার্টি’, বলছ? দাঁড়াও। দাদা আসুক, বলে দেব।

মিনু হাসল। বলল, ভালো লোককেই বলবি। শিখলাম কার কাছে? কথায় কথায় আমাকে বলে কী জানিস? বলে, আমার বাবার মতো ‘কঞ্জুস-পার্টি’ নাকি আর দেখেনি।

বিজু হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।



আজ রবিবার। পুজোর আগের রবিবার। মহালয়া চলে গেছে। পাড়ার কারোরই পুজোর কেনাকাটা এখনও শেষ হয়নি। কেউ কেউ সবে বোনাস পেয়েছে। কেউ কেউ পাবে, এই আশায় অফিসের সামনে লাল ফেস্টুন-ঝুলিয়ে ত্রিপলের তলায় বসে আছে দিবারাত্রি। কেউ বা সরকারি চাকরি করে। তাদের বোনাস নেই। তারা নানা উপায়ে পুজোর আগে তড়িৎ-ঘড়িৎ দু-চার পয়সা কামাবার ফিকিরে আছে।

রোদটায় পুজো-পুজো গন্ধ লেগেছে। আকাশের দিকে তাকালে ভালো লাগে। যদিও পড়ার চাপে আকাশের দিকে তাকাবার অবকাশ নেই। পুজো পেরুলেই পরীক্ষা।

রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। এখন পাড়াটা শান্ত। কোনো কোনো বাড়িতে রেডিয়ো বাজছে। গলির মোড়ের নিমগাছে বসে একটা কাক ঘাড় বেঁকিয়ে পাশের বাড়ির দিকে কী যেন দেখছে। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে দু-একটা গাড়ি যাচ্ছে। বিজুদের বাড়ির সামনে রাস্তায় একটি পট-হোল হয়েছে। তার ওপর গাড়ির চাকা পড়ছে আর গুবুক-গাং করে এক-একটা আওয়াজ হচ্ছে। রাস্তায় না তাকিয়েও আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, একটা গাড়ি গেল।

বিজু একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটটা শেষ হলে ঘড়ি ধরে একঘণ্টা শোবে। তার পর চোখে-মুখে জল দিয়ে আবার অ্যাকাউন্ট্যান্সি করতে বসবে।

সিগারেটটা হাতে নিয়ে এমনি সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রাস্তার দিকে চাইতেই বিজুর চোখ পড়ল মেয়েটির দিকে। একটা আট-দশ বছরের মেয়ে। সামনের বাড়ির রকে বসে আছে। মেয়েটির মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। গায়ের রং ভীষণ কালো। গা-মাথা ধুলো ভরতি। গায়ে একটা নীল মোটা কাপড়ের ছেঁড়া জামা। মেয়েটি মাথা নীচু করে রকে বসেছিল। মেয়েটি গড়িয়াহাটার শাড়ির দোকানের ছাপ-মারা সাদা কার্ডবোর্ডের একটা নতুন বাক্স হাতে ধরে বসেছিল। মাঝে মাঝে মেয়েটি বাক্সের ডালাটা একটু খুলছিল, আবার তাড়াতাড়ি বন্ধ করছিল। মেয়েটির টানা-টানা চোখ-মুখে কোথায় কী যেন এক সমর্পণ-তন্ময়তা, এমন এক নির্লিপ্তি ছিল যে মেয়েটির মুখ নীচু করে বসে থাকা, বড়ো বড়ো কালো চোখ মেলে মাটির দিকে চেয়ে থাকা দেখে, মেয়েটিকে আর দশটা ভিখিরির মেয়ের মতো মনে হচ্ছিল না। তা ছাড়া, মেয়েটি নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ওখানে বসে আছে। কিন্তু ভিক্ষা চাওয়া বা চেঁচানো কিছুই সে করছিল না। তার সেই শান্ত তন্ময়তার মধ্যে আশ্চর্য এক করুণ ভাব ছিল, যা, যে দেখে, তাকে ব্যথাতুর করে তোলে।

বিজু ভাবল, ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ও খাবে কি না কিছু। তার পরই ভাবল, বাড়িসুদ্ধু সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। ঠাকুরও বোধ হয় ভাত বেড়ে নিয়েছে। এহেন সময়ে তার হঠাৎ-বদান্যতায় অনভ্যস্ত বাড়ির সকলেই হয়তো বিরক্ত হবে। তাই মনের ইচ্ছে মনেই রইল।

একটু পরে মেয়েটি আবারও সেই শাড়ির বাক্সের ডালাটা খুলল। অমনি ওই মেয়েটির মতোই কালো দুটি ছোটো ছিপছিপে টিকটিকি লাফিয়ে বাক্স থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ল। তার পর তরতর করে দেওয়ালে উঠে রেইন ওয়াটার পাইপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মেয়েটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তার পর সেই পুজোর গন্ধভরা সুন্দর খালি বাক্সটা সাবধানে হাতে নিয়ে রক থেকে নেমে, ধীরে ধীরে হেঁটে বড়োরাস্তার দিকে চলে গেল। বিজু অনেকক্ষণ, যতক্ষণ মেয়েটিকে দেখা যায়; ততক্ষণ ওই দিকেই চেয়ে রইল। কেন জানে না, ওর মনে হল; এই পুজোর পরিবেশ, পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি যে পুজো পুজো আবহাওয়া হয়েছে তার ছোঁয়া মেয়েটির শরীরে কি মনে, কোথাও যেন লাগেনি।



তার পর থেকে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বার বার মেয়েটির কথা মনে পড়ছে বিজুর। সেদিনের পর মাত্র আর একবার দেখতে পেয়েছিল মেয়েটিকে।

সেবার, রকের ওপর বসা অবস্থায় নয়। দরজায় হেলান দিয়ে পথে বসে। আধ-ঘুমন্ত অবস্থায়। ওকে তখন দেখে বিজুর হঠাৎ মনে হয়েছিল যে, মেয়েটির চোখে সমস্ত বুড়ো-বুড়ির ঘুম জড়িয়ে আছে। ও যেন ইচ্ছে করেও তা আর ছাড়াতে পারছে না।

কিন্তু তবু মেয়েটিকে দেখেই ওর জন্যে যে বিজুর কিছু করণীয় আছে তা বিজুর একবারও মনে হয়নি।

যারা চিৎকার করে না, অথবা যারা হাত তুলে ‘চাই! চাই!’ ‘দিতে হবে।’ ‘কেড়ে নেব’। ইত্যাদি বলে না; তাদের দাবি নিরুচ্চারই থাকে। তাদেরও যে কিছু চাইবার আছে তা আমরা চোখেও দেখি না। তাদের নীরব চোখের ভাষা আমাদের চোখে পড়ে; কিন্তু চোখ কাড়ে না। মনে পড়ে; কিন্তু মনে থাকে না। দেওয়া উচিত যদিও বা বুঝি, যতদিন মুখ ফুটে না চায় ততদিন নিজে থেকে হাত-উপুড় করি না। এই হল এদেশের মানুষদের ধর্ম। বড়োলোক, গরিব সকলেই একইরকম। নিজের চেয়ে যার অবস্থা খারাপ তাকে প্রত্যেকেই না-দিয়ে পার পেলে কিছুই দেয় না। তাই বিজুরও মনে হয়নি, একবারও যে; সেই ছোটো মেয়েটির জন্যে তার কিছুমাত্র করণীয় আছে।

হঠাৎ করে মনে পড়ল ষষ্ঠীর দিনে। যখন রাধা, বিজুকে ফোন করছিল। রাধা বলল, আজ বিকেলে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

কেন?

বলব না এখন। তোমার জন্যে একটা জিনিস কিনেছি। আমার পুজোর প্রেজেন্ট।

কেন কিনছ? তুমি কি রোজগার করো?

রোজগার করার অপেক্ষায় বসে থাকলে তোমাকে কিছু দেবার মন, তোমাকে কিছু দেবার সময়, সবই হয়তো ফুরিয়ে যেত। তাই তর সইল না। তা ছাড়া, আমার পকেটমানি থেকে বাঁচানো টাকা কি আমারই নয়?

রাধা যখন একথা বলছিল, ঠিক সেই সময়ই ওই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল বিজুর। বিজুও রোজগার করে না। এখনও ছাত্র ও। তবু অফিস থেকে কিছু অ্যালাওয়েন্স পায় আর্টিকেল্ড-ক্লার্ক হিসেবে। একটু চুপ করে থেকে, বিজু বলল, রাধা, আজ বিকেলে তো যেতে পারব না।

হতাশ গলায় রাধা বলল, পারবে না? কেন?

বিকেলে আমি আধ ঘণ্টার জন্যে বেরুব একটু হাঁটতে। পরীক্ষা তো এসে গেছে। কিন্তু আজ ওই আধ ঘণ্টায় অন্য একটা কাজও করার আছে।

রাধা অভিমানভরা গলায় বলল, কী কাজ? পিয়ালির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বুঝি?

বিজু হাসল। বলল, পিয়ালির সঙ্গে নয়; অন্য একজনের সঙ্গে।

নাম বলবে না?

রাধা ঠাট্টা করল।

নাম জানি না। সত্যি। এখনও তার নাম জানি না।

এমন সময় সিঁড়িতে বউদির গলা পেয়েই বিজু বলল, এই ছাড়ছি। তুমি এক কাজ করো। সপ্তমীর দিন সকালে চাঁদে এসো।

রাধা বলল, চাঁদে? কোন দিকে থাকব? Sea of Tranquility-র দিকে?

বিজু বলল, হ্যাঁ। দশটা নাগাদ এসো। তার পর রণেনদের পাড়ার মন্ডপে একসঙ্গে অঞ্জলি দেব।

ফোন ছাড়তে না ছাড়তেই, বউদি পর্দা ঠেলে বসবার ঘরে ঢুকল।

ঢুকেই বলল কী রে? ফোনে ফোনে কী পড়া হচ্ছিল? অডিটিং?

বিজু সিরিয়াস মুখে বলল, আচ্ছা বউদি, দশ বছরের মেয়ের জামা কিনতে গেলে দোকানে কী বলব? ‘দশ বছরের মেয়ের জামা দিন’ বললেই হবে? না, কোনো সাইজ-টাইজ আছে? ছেলেদের সাইজের মতো?

বউদি বলল, না। গিয়ে বললেই হবে। কার জন্যে জামা কিনবি? রুমির জন্যে কিনিস না কিন্তু? মেয়েটাকে সকলে মিলে তোরা নষ্ট করছিস। ওর প্রয়োজনের চেয়ে অনেকই বেশি আছে।

বিজু বলল, না। রুমির জন্য নয়।

সত্যি বলছি, আর কিছু কিনিস না।

বিকেলের দিকে বিজু লক্ষ্মণকে ঘরে ডেকে শুধোল, ওই যে কালো মেয়েটি চুপ করে সামনের বাড়ির রকে মাঝে মাঝে বসে থাকে, মেয়েটা কে রে?

লক্ষ্মণ বলল, ওর মা-বাবা নেই। ওর মাথা খারাপ। ওর এক কাকা সামনের বাড়ির একতলার মাদ্রাজিদের বাড়ি কাজ করে। ও তাই এসে চুপ করে বসে থাকে।

আজ বিকেলে আসবে?

জানি না। আসতে পারে।

কোন দিক দিয়ে আসে রে?

লেকের দিকের রাস্তা দিয়ে আসে।

চারটে বাজতেই বিজু জামাকাপড় পরে, মানিব্যাগটা হিপ-পকেটে ফেলে, রাস্তা ধরে লেকের দিকে এগিয়ে গিয়ে মোড়ে দাঁড়াল। মেয়েটির আসবার সময় হয়েছে।

বাড়ির সামনে থেকে ওকে ডেকে নিয়ে গেলে ফিরে এসে দশজোড়া কৌতূহলী চোখের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে হবে। মেয়েটি এলে, ওকে নিয়ে গিয়ে একটা জামা কিনে দেবে বিজু। ওকে পছন্দ করতে দেবে। যেটা ওর ভালো লাগে। মা-বাবাহীন বোবা মেয়েটার জীবনে এতবড়ো প্রাপ্তির দিন বোধ হয় আর আসেনি। ওর জামা কিনে দেওয়ার পরও যদি যথেষ্ট সময় থাকে হাতে, তাহলে রাধাকে একটা ফোন করবে দোকান থেকেই। চলে আসতে বলবে Sea of Tranquility-তে। তার পর একটা পুণ্য কর্মের আনন্দে আনন্দিত হয়ে সেদিন বিজু অনেকক্ষণ রাধার সঙ্গে হেঁটে বেড়াবে। রাধার হাতের সঙ্গে হাত ছুঁইয়ে।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরই মেয়েটিকে আসতে দেখা গেল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে চওড়া ফুটপাথের গাছের ছায়ায় ছায়ায় মুখ নীচু করে দশ বছরের মেয়েটি হেঁটে আসছিল। সেই নীল-রঙা জামা গায়ে। জামাটা ছেঁড়া যে শুধু তাই নয়, এতই নোংরা যে, নীল রংটাকে কালো বলে মনে হয়। মেয়েটি নরম কাঁচা সোনা রোদ্দুরে একটি শীর্ণ-গ্রীবা রোগা-কাকের মতো মাথা নীচু করে কী যেন ভাবতে ভাবতে আসছে। বাঁ-হাতে কোমরের কাছে সেই শাড়ির বাক্সটা ঠিক ধরা আছে।

মেয়েটি কাছে এসে গেছে। এবার বিজু ওকে ডাকল, বলল, অ্যাই শোনো। শুনছ?

মেয়েটি ভয় পেয়ে মুখ তুলে তাকাল চারদিকে। তার পর বিজুকে দেখতে পেয়ে খুব অবাক হল। ওর মুখ দেখে মনে হল বহু দিন ওকে এমন আমন্ত্রণী স্বরে কেউ ডাকেনি। এ ডাক যেন ও ভুলে গেছিল। কোন পর্দায় যে আমন্ত্রণের সুর বাজে, ওর কান তা ভুলে গেছিল।

মেয়েটি রাস্তা পার হয়ে গাছের নীচে দাঁড়ানো বিজুর দিকে আসতে লাগল। বিজুর ভীষণ আনন্দ হতে লাগল। নিজেকে বেশ মহৎ মনে হতে লাগল। ওর মনে হল, এ বছর ষষ্ঠীর দিনে ও এমন একটা দারুণ কাজ করতে যাচ্ছে যার জন্যে সারাপুজোই তার আনন্দে কাটবে। শ্লাঘাতেও। এমন সময় হঠাৎ একেবারে হঠাৎই! যেমন হঠাৎ এসব দুর্ঘটনা ঘটে, একটি গাড়ি খুব স্পিডে মোড় ঘুরেই আর সামলাতে পারল না। একজন রোগা ড্রাইভার ছ-জন মোটা যাত্রিণীসমেত অত বড়ো গাড়িটাকে বোধ হয় সামাল দিতে পারল না। ব্রেক-চাপার প্রচন্ড শব্দ সত্ত্বেও গাড়িটা মেয়েটিকে গিয়ে ধাক্কা মারল। মেয়েটি ছিটকে হাত-পা ছড়িয়ে প্রায় বিজুর কাছাকাছি এসে পড়ল ফুটপাথে। হাত থেকে শূন্য সাদা প্যাকেটটা ছিটকে গেল। মেয়েটি বিজুর দিকে তাকিয়ে একবার ওঠবার চেষ্টা করল। তার পর আবারও শুয়ে পড়ল। মনে হল, ও অনেকদিন ভালো করে ঘুমোয়নি বলে এবার আরামে ঘুমোবে।

তার পর কী যে হল বিজুর তা মনে নেই। অনেক লোক দৌড়ে এল, গাড়িটা ঘিরে ফেলল, ড্রাইভারকে চড়-থাপ্পড় লাগাল। তার পর চোখের নিমেষে মেয়েটিকে সেই নতুন-শাড়ির গন্ধভরা গাড়িতে করেই হাসপাতালে নিয়ে গেল। সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

একটু পরে ভিড় পাতলা হয়ে এল। কিছু স্ত্রী-পুরুষ যেখানে কালো মেয়েটার মাথার চাপ চাপ লাল রক্ত পথে ও ফুটপাথে পড়ে ছিল, সেদিকে তাকিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত গলায় নানারকম মন্তব্য করতে লাগলেন।

বিজু তখনও চুপ করে দাঁড়িয়েই ছিল।

বিজুর মনে হল, কাউকে কিছু দেবার থাকলে কখনো দেরি করতে নেই। সমারোহ করে ডেকে নিয়ে, আত্মশ্লাঘায় বেঁকে গিয়ে; গর্বভরে কাউকে কিছু দান করার কথা ভাবতে পর্যন্ত নেই। কারো জীবনেই কাউকে কিছু দেওয়ার সময় বেশি আসে না। ক্বচিৎ কখনো, তা যদি আসেই, তখন একনি:শ্বাসে দৌড়ে গিয়ে তার হাতে, যা দেবার; তা নিজের হাতেই পৌঁছে দিতে হয়। সে নিজে তা নিতে আসবে কবে, সে অপেক্ষায় কখনোই দাঁড়িয়ে থাকতে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *