দৃষ্টিহীন
আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন একা একা৷ শেষ সময়ে তাঁর বিছানার পাশে আমরা কেউই ছিলাম না, যদিও মা ছাড়া আমরা সকলেই তখন হাসপাতালে৷ দাদা, ছোড়দা, দিদি, আরও অনেকে৷ আমিও৷
মারা যাওয়ার ঠিক ন-দিন আগে বাবাকে হাসপাতালে ভরতি করা হয়৷ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ৷ ক-দিন ধরেই তিনি ইনটেনসিভ কেয়ারে ছিলেন, আমরা কেউ তাঁর দেখা পেতাম না৷ দেখা পেয়েই বা কী হত৷ ডাক্তার-নার্সদের মুখে শুনতাম তিনি নাকি কোমাতেই আছেন৷ বাবাকে বাঁচানোর জন্য খরচে কার্পণ্য করিনি আমরা, নামি হাসপাতাল, দামি চিকিৎসা সবই হয়েছিল৷ ডাক্তাররা যখন যেমন বলেছে— ওষুধ ইঞ্জেকশান কিনে দিয়েছি৷ দিনে-রাতে সর্বসময়ে কেউ না কেউ পালা করে থেকেছি৷ বাবার চিকিৎসায় যেন সামান্যতম ত্রুটি না হয় সেদিকে আমাদের সতর্ক নজর ছিল৷ আমরা কাজের মানুষ, প্রত্যেকেরই সুবিধে অসুবিধে আছে, সেগুলো সামলে-সুমলে চার ভাইবোন একসঙ্গে মিলতাম বিকেলে৷ ভিজিটিং আওয়ারের পর চারজনেই বড়ো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতাম৷ তিনি খুব একটা আশা দেননি, তবু যেন মনে হত এতদিন যখন কেটে গেছে, বাবা হয়তো এ যাত্রা বেঁচে গেলেন৷
বাড়ি ফিরে মাকে রোজকার সংবাদ দিতাম আমরা৷ মা সচরাচর কিছু বলত না৷ শুনত শুধু৷ নীরবে৷ বাবা হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন থম মেরে গিয়েছিল আমাদের স্বল্পভাষী মা৷
বাবা টিকলেন না৷ মারাই গেলেন৷ এক চৈত্রের বিকেলে৷
নামে চৈত্রমাস হলেও দিনটা ছিল খুব গুমোট গরম৷ শেষ বসন্তে যে একটা এলোমেলো বাতাস বয় তার কোনো চিহ্নই ছিল না কোথাও৷ শুকনো পাতারা উড়ছিল না, শহরের সমস্ত গাছ নিস্পন্দ, হাসপাতালের পুকুরের জলেও তরঙ্গ ছিল না এতটুকু৷ সব কিছুর মধ্যেই ছিল এক মৃত্যুর পূর্বাভাস৷
আমরা অবশ্য তেমন কিছু লক্ষ্য করিনি৷
লক্ষ্য করার তখন অবকাশই বা কোথায়? অন্তত আমার? সেদিন দুপুর থেকেই আমার নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়, বিকেল নাগাদ বেশ বেড়ে যায় কষ্টটা৷ অসুখটা নতুন কিছু নয়, তখন প্রায়ই হত৷ কোনো ঋতু একটু চড়া হলেই ওই রোগ ছিল আমার নিত্যসঙ্গী৷ সে কিবা শীত, কিবা গ্রীষ্ম, কিবা বর্ষা৷ গুমোট হলেও নিঃশ্বাসে টান, ঘোর বর্ষায় দম আটকে আসে, ঠাণ্ডা হাওয়া চললেও ভালো করে শ্বাস নিতে পারি না৷ কড়া গন্ধ আমার শত্রু, ধুলোবালি বিভীষিকা, যেকোনো মানসিক উদবেগই আমার ফুসফুসের শমন৷ এই চেনা কষ্ট যে এক আসন্ন মৃত্যুর সংকেত, আমি তা বুঝব কী করে৷
সিঁড়িতে বসে তখন হাঁপাচ্ছি আমি, দাদাদিদিরা এলোমেলো কথা ছেড়ে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ দিদি বলল, তোর তো ব্যাগে ট্যাবলেট আছে, একটা খেয়ে নে না!
ছোড়দা বলল, জল এনে দেব?
বড়োবউদি বলল, তোমার কাছে স্প্রে থাকে না, মুখে একটু টেনে নাও৷
ছোটোবউদি বলল, ওকে একটু চা এনে দাও৷ গরম চা খেলে এখন আরাম হবে৷
আমার অস্বস্তি হচ্ছিল৷ আমি আর খুকিটি নেই৷ ঊনত্রিশ বছর বয়স হয়েছে আমার, চাকরিবাকরি করি, নিজের ভাবনা নিজেই ভাবা আমার প্রকৃতি৷ তা ছাড়া হাসপাতালে বসে আমাকে নিয়ে বিব্রত হয়ে ওঠাও ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না আমার৷ হাত তুলে দু-দিকে মাথা নাড়লাম— কিচ্ছু লাগবে না৷
জামাইবাবু তবু কোত্থেকে ছুট্টে এক ভাঁড় চা নিয়ে এসেছে৷ খেতেই হবে৷ ভাঁড় হাতে নিয়ে সবে চুমুক দিয়েছি, তখনই ডাকটা এল৷ মৃত্যুদূতের মতো কে যেন হাঁকছে, আই সি ইউ সেভেনটিন… আই সি ইউ সেভেনটিইইন৷ পেশেন্টের বাড়ির লোক কেউ আছেন?
আমাদের বাবা চিত্তপ্রিয় রায় যে আই সি ইউ সেভেনটিন হয়ে গেছেন, সেটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল আমাদের৷
দাদা হঠাৎ সিগারেট ফেলে লাফিয়ে উঠল, আমাদের ডাকছে! বাবা…
হুড়মুড় করে ছুটল সবাই৷ চেষ্টা করেও আমি উঠতে পারলাম না কিছুতেই৷ বুকের ভেতর তখন আমার আস্ত পাহাড়ের ভার, শ্বাসকষ্টে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, সামনে শুধু চাপ চাপ ধোঁয়া৷ বাবাকে দেখতে যাব কী, মনে হচ্ছিল আমিই বুঝি তক্ষুনি মরে যাব৷
কতক্ষণ এ অবস্থা চলেছিল মনে নেই৷ বড়োজোর আরও মিনিটখানেক৷ তারপরেই চাপ ভাবটা সরতে লাগল৷ ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে এল শরীর৷ অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে দেখতে পেলাম নতমুখে নেমে আসছে দিদি-দাদারা, আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুবৎ!
দাদা নীচু স্বরে, অনেকটা টেলিগ্রাফিক মেসেজ শেষ হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ওভার!
কে যেন প্রশ্ন করল৷ বোধ হয় আমার মাসতুতো ভাই, টাইমটা নোট করেছ?
—আমার পৌঁছনোর আগেই…! ওরা বলল পাঁচটা সাত৷
ছোড়দা ক্ষুব্ধস্বরে বলল, আমাদের আরেকটু আগে ডাকতে পারত!
মৃত্যুর আগে বাবার কি একবারও জ্ঞান ফিরেছিল! বাবা কি খুঁজেছিলেন আমাদের!
দিদি কাঁদছিল, বড়োবউদি ছোটোবউদিরাও৷
দাদা সিগারেট ধরাতে গিয়ে কয়েকটা কাঠি নষ্ট করল৷ চোখের কোল মুছল আঙুল দিয়ে, এখানে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি কোরো না৷ বাড়ি গিয়ে মাকে খবর দাও, আমরা বডি নিয়ে আসছি৷
মা খুব শান্তভাবেই গ্রহণ করেছিল দুঃসংবাদটা৷ যেন জানতই বাবা আর ফিরবে না৷ যেন এই ক-দিন ধরে একটা এলেবেলে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছিলাম আমরা৷ অমোঘ নিয়তির সঙ্গে৷ কিছুক্ষণ স্থির থেকে বলল, এবার তাহলে তোমাদের শেষ কর্তব্যগুলো সেরে ফেল৷
মা চিরকালই শক্তপোক্ত মানুষ, নিজেকে প্রকাশ করে না সহজে৷ তা বলে বাবার মৃত্যুতেও এত নিরুত্তাপ! এত সমাহিত৷
নিজেকে দেখেও খুব আশ্চর্য হচ্ছিলাম আমি৷ বাবার জন্য যতটা কাঁদা উচিত, ততটা কান্না আসছে না৷ বরং কেমন নির্ভার লাগছিল নিজেকে৷ সেই যে ভয়ংকর টানটা হাসপাতালে উঠেছিল, সেটা যেন কোন ম্যাজিকে উধাও৷ সামান্য চাপ ভাব একটা ছিল বটে, তবে তা তেমন কিছু নয়৷ অথচ আমি ট্যাবলেটও খাইনি, স্প্রেও নিইনি, বাতাসে গুমোট ভাবও কমেনি এতটুকু! কেন এমন হয়েছিল৷
মেয়েরা সাধারণত শ্মশানে যায় না, যেতে চায় না, কিন্তু আমি গেলাম৷ দিদি গেল না, বউদিরাও গেল না, আমি কেন গেলাম কে জানে৷ ভেতর থেকে কেউ কি ঠেলছিল আমাকে? শেষ দেখা পাক না-পাক, সবাই তো দৌড়ে গিয়েছিল, একা আমি যেতে পারিনি— এই ঘটনাটুকুই কি উচিত-অনুচিতের বোধ উসকে দিচ্ছিল? নাকি কর্তব্য অবহেলার বোধ?
শ্মশানে পৌঁছতে সেদিন রাত হয়েছিল অনেক৷ প্রায় সাড়ে বারোটা৷ বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন দেরি করে এল, তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল৷ শ্মশানে গিয়েও অপেক্ষা, ইলেকট্রিক চুল্লির সামনে সেদিন মৃতদেহের মিছিল৷ গুনে দেখা গেল আমরা হচ্ছি পনেরো নম্বরে, যত তাড়াতাড়িই হোক, ঘণ্টা ছয়েকের আগে বাবা চুল্লিতে ঢোকার সুযোগ পাবেন না৷
হালহকিকত বুঝে দাদাই তুলল কথাটা, আমার মনে হয় এখানে আমাদের অপেক্ষা করার কোনো মানেই হয় না৷
আমরা দাদার কথা ঠিক ধরতে পারিনি৷ ছোড়দা জিজ্ঞাসা করল, তাহলে কী করব?
—পাশেই তো কাঠের চুল্লি ফাঁকা পড়ে আছে৷ আমরা বাবাকে কাঠেও পোড়াতে পারি৷
গত ন-দিনে পাঁচ রাত জাগার পালা পড়েছিল ছোড়দার, কালও জেগেছিল হাসপাতালে৷ সে খুব একটা ভাবার সময় নিল না৷ বলল, কাঠে পোড়ানোই তো ভালো৷ মোর ট্র্যাডিশনাল৷ বাবা মাঝে মাঝে বলত না, আমাকে তোরা কাঠেই দিস, চুল্লিতে ঢুকলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে৷
আমি বাবার দেহটা ছুঁয়ে বসেছিলাম৷ এক ঝলক দেখলাম বাবাকে৷ মরার পরেও দম বন্ধ হওয়ার ভয়! বাবার মাথাতেই এসব আসত বটে!
দাদা জিজ্ঞাসা করল, কী রে পুতুল, তুই কী বলিস?
অন্যমনস্কভাবে বলে দিলাম, তোমরা যা ভালো বোঝ করো৷
প্রচুর চন্দন কাঠে চিতা সাজানো হল৷ জামাইবাবু অনেকটা ঘি কিনে এনেছিল, সবটুকু মাখিয়ে দেওয়া হল বাবাকে৷ যথাযথ শাস্ত্রবিধি মেনে চিতা প্রদক্ষিণ করল দাদা৷ বাবার মুখে আগুন ছুঁইয়ে দিল৷ চিতা জ্বলে উঠল দাউদাউ৷
বাবা পুড়তে শুরু করলেন, বাবা নিঃশেষ হতে শুরু করলেন৷
তখনই একটা বাতাস উঠল৷ ঝোড়ো৷ ঠাণ্ডা৷ সারাদিনের ভ্যাপসা গরম ফুঁড়ে ছুটে এল এক দামাল কালবৈশাখী৷ রক্তবর্ণ আকাশ ফালা ফালা হয়ে গেল নীল বিদ্যুতের চাবুকে৷ ঝমাঝম বৃষ্টি নামল৷
ঝড়ের আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেছি আমরা৷ শ্মশানেই একটা পাকা শেড ছিল, প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় পলকে ছুটে গেছি তার নীচে৷ নিজেদের মাথা বাঁচাতে৷
মুহূর্ত পরেই হুশ ফিরল৷ বাবা একা৷ মুহূর্তেই ছুটে গেছি বাবার কাছে৷ দাদারাও এসেছে পিছন পিছন৷ চিতা অবধি পৌঁছানো হল না, তার আগেই শিউরে উঠছি আমরা৷
যা দেখছি তা কি সত্যি৷
জল পড়ে চিতা প্রায় নিভু-নিভু৷ ধিকিধিকি আগুনের মধ্যিখানে খাড়া উঠে বসে আছেন বাবা৷ শরীরের প্রায় কিছুই পোড়েনি তখনও৷ এখানে ওখানে কিছু ঝলসে যাওয়ার দাগ৷ একমাত্র চোখ দুটো গলে গেছে৷ চোখের জায়গাটা দুটো বড়ো বড়ো গর্ত৷
ঠিক যেন এক অন্ধ মানুষ৷
দুই
বাবা কোনোদিনই খুব একটা চক্ষুষ্মান ছিলেন না৷ সফলও না৷ বরং তাঁকে মোটামুটিভাবে সাংসারিক দৃষ্টিহীন এক আদর্শ বিফল মানুষ বলা যায়৷ চাকরি করতেন খুব সাধারণ৷ সারাজীবন খেটেখুটে কনিষ্ঠ কেরানি থেকে বড়োবাবু হয়েছিলেন, এইটুকুনই তাঁর সাফল্য৷ অফিসের ছেলেছোকরারা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত৷ বলত, চিত্তদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিব্যি সব কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, গাধার খাটুনি খেটে ধন্য হয়ে যায় চিত্তদা৷ সত্যি, চাকুরি নিয়ে বাবার মধ্যে কখনো কোনো ক্ষোভ দেখিনি! অফিসের কর্তাব্যক্তিরা বাবার পরিশ্রমের কোনো মূল্য দেয়নি, তাই নিয়ে বাবার কোনো হিলদোল ছিল না৷ বাবা শুধু কাজ করেই সন্তুষ্ট৷
বাবার এই অল্পে সন্তুষ্টি আমাদের পছন্দ ছিল না৷ ছেলেবেলাটা আমাদের বেশ অনটনে কেটেছে, হয়তো সেই জন্যই৷ আমাদের বড়ো হয়ে ওঠার মূলে বাবার বিশেষ অবদান ছিল না৷ মা-ই আমাদের সংসারের শক্ত খুঁটি৷
বাবার সামান্য আয়ে কী নিপুণ হাতে মেপেজুপে সংসার চালাত মা!
মা-র সঙ্গে বাবার সব বিষয়েই ঘোরতর অমিল৷ আমাদের মা প্রকৃত সুন্দরী৷ বাবাকে চেষ্টা করেও সুদর্শন বলা কঠিন৷ মা-র গানের গলাটি চমৎকার, বাবার কণ্ঠে সুরের রেশটি ছিল না৷ মা বলত মূর্তিমান অ-সুর৷ মা-র সেলাইয়ের হাতটি কী অসাধারণ৷ শিল্পীর আঁচড়ে আগে কাপড়ে ছবি এঁকে নিত মা, তারপর রং মিলিয়ে সুতোর কাজে ভরাট করত ছবি৷ দেখে মনে হত যেখানে যে রঙটি মানায়, সেখানে ঠিক সেই রঙটিই পছন্দ করেছে মা৷ আর বাবা? তিনি তো ভালো করে রঙই চিনতেন না৷ মেরুন, ম্যাজেন্টা, রানি সবই বাবার চোখে এক— লাল৷
মাঝে মাঝে বড়ো বিস্ময় জাগে, কী করে বাবার সঙ্গে মা-র বিয়েটা হয়েছিল৷ খুব গরিব ঘরের মেয়ে ছিল মা, সেই জন্যই কি? কিন্তু বাবাও তো এমন কিছু রাজাবাদশা ছিলেন না? শুনেছি, দাদু মানে আমার মা-র বাবা নাকি একবার এক দুর্ঘটনায় আহত হন, বাবাই নাকি তাঁকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান৷ বাবার দৌলতেই সেবার প্রাণে বেঁচে যান দাদু৷ তিনি হাসপাতাল থেকে ফেরার বছরখানেকের মধ্যেই মা-বাবার বিয়েটা ঘটেছিল৷ সম্ভবত দাদুর আগ্রহেই৷ মা কি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছিল বিয়েটা? কে জানে৷ তবে লক্ষ্য করেছি, বাবার প্রতি মা-র চিরকালই একটা নাকউঁচু ভাব ছিল৷ শীতল ঔদাসীন্যও৷ বাবার একবার এক কঠিন অসুখ হয়৷ খুব খারাপ ধরনের প্লুরিসি৷ আমি তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি৷ আমাদের কাউকে তখন বাবার ঘরে ঢুকতে দিত না মা৷ বাবা আমাদের চুপি চুপি ডাকলেও মা ঠিক দেখতে পেয়ে যেত, ঘর থেকে টেনে বার করে নিত সঙ্গে সঙ্গে৷ বাবার থালা আলাদা, গ্লাস আলাদা, বাবা তখন বলতে গেলে প্রায় অচ্ছুত৷ একমাত্র মা ঢুকত বাবার ঘরে৷ ওষুধ-বিষুধ খাওয়াত, পথ্যি দিত, রাত্রে শুতও বাবার কাছে, কিন্তু বাবার অসুখে মা খুব কাতর হয়ে পড়েছে, এমনটি কখনো মনে হয়নি৷
বাবা ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর৷ আমাদের নাক দিয়ে এক ফোঁটা কাঁচা জল ঝরলেও মাকে অতিষ্ঠ করে তুললেন৷ শুধু আমাদের কী বলি, কোন আত্মীয়স্বজনের বিপদে অসুখে না ছুটতেন বাবা৷ নিজের ভাইবোনদের জন্য তো বটেই, এ ছাড়াও যত নিকট-দূরের জ্ঞাতিগুষ্টি আছে, কারোর একটু খারাপ খবর পেলেই বাবা সেখানে হাজির৷
মা ভীষণ চটে যেত৷ বলত, সাতজন্মে কে কবে তোমার খোঁজ রাখে? আমাদের হাঁড়ি চড়ছে কিনা ভুলেও দেখতে আসে কেউ?
বাবার এক উত্তর, কী করব, থাকতে পারি না যে৷ বুকের ভেতরটা কেমন আনচান করে৷
আত্মীয়স্বজনরা বাবাকে দেখে যে খুব গদগদ হয়ে পড়ত, তাও কিন্তু নয়৷ একবার তো মেজকাকার বাড়িতে বাবা যথেষ্ট অপমানিত হয়েছিলেন৷ ভাইঝির খুব কাশি হয়েছে শুনে কোথাও কোনো ঝোঁপ ঘেঁটে গাদাখানেক বাসকপাতা ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ সেই পাতার রস খেয়ে কাকার মেয়ের গলা ফুলে ঢোল৷ পাতায় বোধ হয় বিষাক্ত কিছু লেগেছিল৷ কাকিমার মুখে পাঁচ কথা শুনে বাড়ি এসে মুখ চুন করে বসেছিলেন বাবা৷
মা বলেছিল, ঠিক হয়েছে৷ যাও আরও৷ গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল৷
বাবার মুখ কাচুমাচু, আমি ওদের কাজের মেয়েটাকে পাতা ধুয়ে বাঁটতে বলেছিলাম৷ সে যদি ভুল করে…
—থামো তো৷ ওদের কি ওষুধ কিনে খাওয়ার পয়সা নেই, তুমি পাতা গেলাতে গেছ?
বাবার মুখে নির্ভেজাল হাসি, নেড়ির গলা একটু ফুলেছে, কিন্তু সত্যিই কাশিটা চলে গেছে গো৷ কাশতে কাশতে গলা চিরে গিয়েছিল বেচারির৷
তো এই ছিলেন আমাদের বাবা৷ যেচে অন্যের দায় নিজের ঘাড়ে নেওয়া, অকারণ উদবেগে আকুল, শিল্পসৌন্দর্য বিষয়ে রসকষবিহীন এক মাটো মানুষ৷
কত ঘটনা যে আছে বাবার, বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যায়৷ কত পারিবারিক প্রলয় ঘটে গেছে বাবার জন্য৷ মারা যাওয়ার মাসচারেক আগে কী কাণ্ডটাই না হল৷ ছোড়দার ছেলের সামান্য জ্বর, তেমন কিছুই না, ওরকম জ্বরজারি বাচচাদের হয়ই৷ বাবা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ দিনের বেলা টুটুলের মাথার কাছে বসে আছেন, ঠিক আছে— রাত্তিরেও যা শুরু করলেন, আধ ঘণ্টা অন্তর ছোড়দাদের দরজায় টোকা দিচ্ছেন৷
—বাচচু, টুটুল ঘুমোল!
—এই বাচচু, একবার থার্মোমিটার দিয়ে জ্বরটা দ্যাখ৷
—বাচচু, টুটুল কাশল কেন? সিরাপটা একটু খাইয়ে দে না?
একে শীতের রাত, বার বার লেপ ছেড়ে উঠতে হচ্ছে, তার ওপর বাবার প্যানপ্যানানিতে ছোড়দা ছোটোবউদি ধৈর্যের শেষ সীমায়৷
শেষমেশ ছোড়দা বলে উঠল, আহ বাবা, বিরক্ত কোরো না তো! টুটুল তোমার ছেলে নয়, আমাদের ছেলে, ওর ভাবনা আমাদেরই ভাবতে দাও৷
ছোটোবউদি ছ্যারছ্যার শুনিয়ে দিল— সাধে কি দাদারা কেটেছে এখান থেকে? ওই আদরের অত্যাচার সহ্য হয় না৷
মা কোনোদিন বাবার পক্ষ নেয় না, সেদিন ছোটোবউদির খোঁটায় দুম করে খেপে গেল, তোমাদের না পোষায় তোমরাও চলে যাও, কে আটকে রেখেছে?
এক কথা থেকে দু-কথা৷ দু-কথা থেকে চার কথা৷ ছোটোবউদি পরদিনই ছেলে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি৷ তিনি না ফেরা পর্যন্ত ছোড়দারও মুখ এতখানি৷ বাড়ির লোকের সঙ্গে টোটাল নন-কোঅপারেশান৷
আমি তখন বাবাকে বলেছিলাম, কী এক-একটা কাণ্ড করে বসো বলো তো? যেচে মান খোয়াতে তোমার ভালো লাগে?
বাবার কোনো তাপ-উত্তাপ নেই৷ বললেন, ওদের কথা গায়ে মাখলে চলে? রাগের মাথায় কী বলতে কী বলেছে, রাগ পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে৷
—তোমার শিক্ষা হবে না বাবা৷ দাদার মতো ছোড়দাও যখন মানে মানে সরে পড়বে তখন টেরটি পাবে৷
—কী যে তোরা বলিস! বাবলু কি শখ করে এ বাড়ির থেকে গেছে? নেহাত অফিসের কোয়ার্টারে না গেলে নয়, তাই না…
আমার আর বোঝানোর প্রবৃত্তি হয়নি৷ দাদা-বউদি যে পৃথক হবে বলেই চলে গেছে, অফিসের কোয়ার্টার পাওয়াটা একটা ক্যামোফ্লেজ, এ কথা বাবার মাথায় কোনোদিনই ঢোকেনি৷
দাদার চলে যাওয়াতে আমি অবশ্য তেমন দোষ দেখি না৷ দাদার যেরকম বড়ো চাকরি, যে ধরনের মানুষের সঙ্গে দাদার ওঠা-বসা, ক্লাব-পার্টি, এ বাড়িতে থেকে সেটা মানাত না৷ তাও কি দাদা বাবার হাত থেকে ছাড়ান পেয়েছিল? দিব্যি কর্তাগিন্নি মনের মতো করে সংসার পেতেছে, সেখানেও প্রতিদিন সকাল না হতেই গিয়ে বসে আছেন বাবা৷ এটা ঝাড়ছেন, ওটা পরিষ্কার করছেন, এই শো-কেসের পুতুল ওই ক্যাবিনেটের মাথায় তুলছেন, যেন ওটা বাবার নিজেরই ফ্ল্যাট৷ দাদা বাড়িতে পার্টি দিল, সেখানেও হংসো মধ্যে বকো যথা হয়ে বসে আছেন বাবা৷ অফিসের লোকদের সামনে দুমদাম বেফাঁস মন্তব্য করে বসছেন৷ বাবলুটা আমার কমজোরি, ওকে যেন বেশি খাটাবেন না৷ অত মদ খাচ্ছেন কেন, মাতাল হয়ে যাবেন যে! দাদা তো খেপেমেপে এসে মাকেই শাসিয়ে গেল৷ বাবার যদি ও-বাড়ি যাওয়া বন্ধ না করো, তাহলে কিন্তু আমরা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেব! সে এক বিদিকিচ্ছিরি পরিস্থিতি৷
দিদির শ্বশুরবাড়িতে কম কেচ্ছা করে এসেছেন বাবা! দিদির শাশুড়িটার আট বছর আগে সেরিব্রাল হয়েছিল, তারপর থেকে তিনি চবিবশ ঘণ্টাই বিছানায়৷ হাত নড়ে না, পা নড়ে না, পাশ ফিরতে গেলেও ফিরিয়ে দিতে হয়, কিন্তু মুখের কমতি নেই বুড়ির৷ বেডপ্যান দিতে পনেরো সেকেন্ড দেরি হলে গালাগালির চোটে দিদির ভূত ভাগিয়ে দেবেন, অথচ তাঁর সব কিছু করতে হবে দিদিকেই৷ আয়া একটা রাখা আছে, তাকে দিয়ে চলবে না৷ ওই শাশুড়ির পিছনে খাটতে খাটতে দিদির অ্যানিমিয়া হয়ে গেল৷ মুখ শুনতে শুনতে প্রেসার লো৷ জামাইবাবু ভীষণ মাতৃভক্ত, সে মায়ের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই শোনে না৷ বাবা গিয়ে ঝপ করে একদিন তাকে বলে এল, তোমাদের আমি মেয়ে দিয়েছি বিপ্লব, ঝি দিইনি! তোমার মা তো মরবেনই, তার সঙ্গে আমার মেয়েটাকে মারছ কেন?
জামাইবাবুর সঙ্গে দিদির এই লাগে তো সেই লাগে৷ বাড়ি বয়ে এসে কেঁদে গেল দিদি৷ মা বাবাকে থামাও৷ এমনিতেই প্রচুর অশান্তির মধ্যে আছি, তার ওপর উটকো ঝঞ্ঝাট আর ভালো লাগে না৷
বাবাকে থামানো কি সহজ কথা৷ বাবার স্নেহের রথ ছুটবেই৷ এক অদ্ভুত বাস্তববোধহীন কাছাখোলা মানুষ ছিলেন বাবা৷
বাবাকে দেখে আমরা লজ্জাই পেয়েছি চিরকাল৷ তাঁর দৃষ্টিহীনতায় আমাদের মাথা হেঁট থেকেছে৷ তাঁকে দেখেই আমরা শিখেছি কী-রকম হলে জীবনে ব্যর্থ হয় মানুষ, আর কী-রকমটি না হলে এই দুনিয়ায় প্রাপ্তিযোগের কমতি থাকে না৷
আমরা কি চূড়ান্ত সফল? জানি না৷ তবে বাবার মতো হেলাফেলার বস্তুও নই৷ পড়াশুনোয় আমরা ভালোই ছিলাম৷ দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচুতলার চাকুরে৷ ছোড়দা অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রিতে এম. এস. সি, নিজের কেমিক্যালসের কারখানা আছে৷ চালু ব্যবসা৷ আমাদের মধ্যে দিদি মার গলাটি পেয়েছিল, গানও শিখেছে মনপ্রাণ দিয়ে৷ এক জলসায় দিদির গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল জামাইবাবু৷ পাত্র হিসেবে জামাইবাবু এ ক্লাস৷ চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট৷ নিজেরই ছোটো ফার্ম৷ গাড়ি আছে, ফ্ল্যাটও৷ আমি কলেজে পড়াই, বিয়ে করিনি৷
আমার বিয়ে না করার কারণটা কেউ স্পষ্ট জানে না৷ সকলের ধারণা ওই বেয়াড়া হাঁপানির টানটার জন্যই বিয়েতে আমার অনীহা৷ সেরকমই আমি বলতাম কিনা৷
এ ছাড়া বলিই বা কী? জগৎসুদ্ধু লোককে কী করে বলে বেড়াই শৈবাল নামের একটা বোকা ছেলে আমার অহংকারেই আত্মহত্যা করেছে৷ হুল্লোড়বাজ অপদার্থ ছেলেটা যদি একতরফা আমার প্রেমে পড়ে সে কি আমার দোষ? প্রথম থেকেই তো আমি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, তোমার লিমিট কেরানিগিরি, ইউনিভার্সিটির সেরা মেয়েটার দিকে চোখ তুলে তাকানো তোমার শোভা পায় না৷ শৈবাল শুনল কই! অবুঝপনা করত৷ বিরক্ত করত৷ তুমি রিফিউজ করলে আমি বিষ খাব! রেললাইনে গলা দেব! রাগ করে বলেছিলাম, সেটাও অন্তত করে দেখাও৷ সত্যি সত্যি করে দেখিয়ে দিল! উল্টোডাঙার কাছে রেললাইনে দু-আধখানা হয়ে পড়ে রইল শৈবাল৷ পকেটে চিরকুট— কেউ দায়ী নয়৷
কিচ্ছুটি জানতে পারল না কেউ৷ আমার দিকে আঙুলও তুলল না৷ শুধু আমার ফুসফুসটা কেমন কমজোরি হয়ে গেল৷ সর্বনাশা রোগ বাসা বাঁধল শরীরে৷ কতবার নিজেকে বলেছি, একটা নিপাট মূর্খের জন্য কষ্ট পাওয়ার কোনো যুক্তি নেই৷ কিন্তু বুককে চাবকে সিধে করি সে জোর আমার কোথায়? নিজে নিজেই পুড়ি আমি৷ নিজের মধ্যেই রচনা করি এক অকারণ যন্ত্রণার বৃত্ত৷
একমাত্র বাবাই কি আন্দাজ করেছিলেন কিছু? নাহলে মৃত্যুর বছরতিনেক আগে কেন হঠাৎ বললেন, রোগটা তোর কী করে এল রে পুতুল? এ কষ্ট তো আগে ছিল না তোর! আমাদের বংশেও তো কারও এ রোগ নেই!
মনে আছে তখন শীতকাল৷ পিঠে তিনটে বালিশ নিয়ে কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছি আমি, হিমকণা জমাট বেঁধেছে বুকে৷ অজান্তেই জল ঝড়ছে চোখ বেয়ে৷ তবু প্রাণপণে হাসার চেষ্টা করছিলাম, শহরে যা পলিউশন! এ অসুখ এখন ঘরে ঘরে!
বাবা আমাকে দেখছিলেন৷ হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন মাথায়৷ কেউ যেন শুনতে না পায় এমন নীচুস্বরে বললেন, মনের কষ্ট চেপে রাখিস না পুতুল, উগরে দে৷
বাবা কি জেনেছিলেন কিছু! না নিছকই অনুমান!
অনুমান, না অনুভব!
আমার অন্ধ বাবার কি তৃতীয় নয়ন ছিল!
তিন
বাবার শ্রাদ্ধশান্তি হয়েছিল খুব ঘটা করে৷ আমরা চার উপযুক্ত ছেলে-মেয়ে প্রচুর খরচা করেছিলাম শ্রাদ্ধে৷ চারদিকে যত আত্মীয়-পরিচিত আছে, সববাইকে বলেছিলাম৷ সে প্রায় শ-পাঁচেক মতো হবে৷ নিয়মভঙ্গের দিনও দেড়শো পাত পড়েছে৷ কেটারার দিয়ে মাছ মাংস পোলাও মিষ্টি, সে এক এলাহি আয়োজন৷ শ্রাদ্ধের দিন বাবা যা যা খেতে ভালোবাসতেন সব একটা থালায় সাজিয়ে ছাদে রেখে আসা হয়েছিল৷ স্বচক্ষে দেখেছি কাকের পাল এসে খেয়ে গেল সবটুকু৷
বাবা তৃপ্ত হলেন৷ আমরাও৷
কিছুদিন পর থেকে কয়েকটা ঘটনা ঘটতে শুরু করল৷ ঘটনা ঠিক নয়, হয়তো এগুলো হওয়ারই ছিল৷ কিন্তু এমনভাবে ঘটতে থাকল, আমরা নজর না করে পারলাম না৷ বেশ কিছুদিন ধরে দাদা কোম্পানিতে একটা লিফট পাওয়ার জন্য ছটফট করছিল, হঠাৎ পেয়ে গেল৷ এক ধাপ নয়, একেবারে কয়েক ধাপ৷ কোম্পানির ব্যাঙ্গালোরের ফ্যাক্টরির প্রায় কর্ণধার হয়ে বসল দাদা৷ বছরখানেক ধরে ছোড়দা কেমিক্যাল এক্সপোর্টের চেষ্টা চালাচ্ছিল, হঠাৎই একসঙ্গে তিন দেশ থেকে অর্ডার— বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড৷ কয়েক কোটি টাকার অর্ডার, ছোড়দা যা কখনো কল্পনা করেনি৷ দিদির শাশুড়ি, যাঁর সম্পর্কে ধারণা ছিল তিনি অন্তত হাজার বছর বাঁচবেন আর বিছানায় শুয়ে অবিরাম মানসিক অত্যাচার চালাবেন দিদির ওপর, ঝুপ করে এক ঘুমের মধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন চিরতরে৷
সবই ঘটল বাবার মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে৷
আমার মধ্যেও এক অভিনব পরিবর্তন এল৷ বাবা চলে যাওয়ার ক্ষণেই শেষ দেখা দিয়েছিল টানটা, তারপর থেকে যেন একেবারে হালকা হয়ে গেছে৷ গরমকাল আর বর্ষাকাল— একটি বারের জন্য পাথর-চাপা ভাবটা ফিরল না৷ রুক্ষ, গোঁড়া মেজাজি বলে আমার বদনাম ছিল, কারও সঙ্গে মিশতে ভালো লাগত না, সবটাই কি শারীরিক কারণে? হয়তো না৷ মনেও বোধ হয় কিছু বাধা ছিল৷ আচমকা আবিষ্কার করলাম, দিব্যি হাসিখুশি হয়ে গেছি আমি৷ জোরে জোরে কথা বলছি, হাসতেও ভালো লাগছে আমার৷ মাঝেমধ্যে দু-একটা গানের কলিও গুনগুন করছে বুকে৷
মাও যেন আর ঠিক আগের মতো নেই৷ মাকে আমি কোনো দিনই বেশি কথা বলতে দেখিনি, কেজো সাংসারিক কথা ছাড়া মার যেন কোনো কথা থাকত না৷ সেই মাকে দেখি আমি কলেজ থেকে ফিরলেই কত হাবিজাবি গল্প করে আমার সঙ্গে৷ ছেলেবেলার কথা, দাদু, দিদা, মামা-মাসিদের গল্প, আরও কত কী যে! কবে একবার ছাতুবাবুর চড়কের মেলায় গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল, গরমের ছুটিতে কোন নস্যিবুড়ির গাছ থেকে জামরুল পাড়তে যেত, কুয়োয় ঘটি পড়ে গেলে কোত্থেকে ঘটিতোলা এসে হাজির হয়ে যেত, এরকম অজস্র গল্পের ঝাঁপি খুলে বসত মা৷
মা-র মধ্যেও এত গল্প জমা ছিল৷ নাকি আমাকে খুশি দেখেই মা-র ওই অর্গলমুক্তি! ছোটোতে তো আমি হাসিখুশিই ছিলাম, তখন মা-র মুখে ওসব গল্প শুনিনি কেন? মা-র সুখের স্মৃতি কি হঠাৎ উথলে উঠল?
দাদা, ছোড়দা, দিদি, মা এমনকী আমার জীবন থেকেও অনেক অবরোধ সরে যাচ্ছিল৷ খুব দ্রুত৷ এত দ্রুত যে কাকতালীয় বলে মনেই হয় না৷ ধন্দ জাগে৷
কে ওই অেবরোধ সরাচ্ছিল— মনের, বাইরের পৃথিবীর?
বাবা!
চার
পুজোর পর ব্যাঙ্গালোর থেকে দাদার চিঠি এল৷ চিঠিতে দাদা এক অদ্ভুত কথা লিখেছে৷ বাবাকে নাকি পর পর তিন চারদিন দেখতে পেয়েছে দাদা৷ রোজ কাকভোরে দাদা সামনের পার্কে জগিং করতে যায়, সেখানেই নাকি বসে থাকেন বাবা৷ একটা পাথরের বেঞ্চিতে৷ কাছে গেলেই মিলিয়ে যান৷
আমরা পড়ে খুব হাসাহাসি করলাম৷ ছোড়দা বলল, দাদার কত বয়স হল রে?
—কত আর! মা জবাব দিল, এই তো পৌষে তেতাল্লিশ পুরে চুয়াল্লিশে পড়বে!
—ওহ, তাহলে নির্ঘাত চালসে ধরেছে৷ চশমা নিতে লিখে দাও৷
আমি বললাম, যাহ৷ চালসে হলে তো কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধে হয়, দূরের জিনিস ভুল দেখবে কেন?
ছোটোবউদি বলল, আমার মনে হয় দূর বিদেশে আছেন… দাদার বোধ হয় বাবাকে এখন মনে পড়ে৷
টুটুল সাত বছরেই সর্বজ্ঞ৷ সে বলল, তোমরা কিচ্ছু জানো না, এই সময়ে ভোরে খুব কুয়াশা থাকে, জেঠু কী দেখতে কী দেখেছে!
ব্যাপারটা হাসি-ঠাট্টাতেই ধামাচাপা পড়ে গেল৷ সাতদিন যেতে না যেতে দিদি একদিন হাঁপাতে হাঁপাতে উদিত হল বাড়িতে৷ কী কাণ্ড, পরশুদিন নিউ মার্কেট থেকে বাজার করে বেরোচ্ছি, হঠাৎ দেখি বাবা! উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি তো ভাবলাম মনের ভুল৷ হয়তো বাবার মতো দেখতে অন্য কেউ৷ আমি যখন রাস্তা পেরোচ্ছি, তখনও বাবা ওখানে দাঁড়িয়েছিল৷
আমি চোখ টিপলাম, তুই আজকাল জামাইবাবুর দেখাদেখি চুমুক-টুমুক দিচ্ছিস নাকি?
—নারে! আজকেও দেখলাম! মিতুনকে নাচের স্কুলে দিয়ে ফিরছি, দেখি ঢাকুরিয়া ব্রিজ দিয়ে হেঁটে আসছে বাবা— আমার দিকে! খুব কাছে এসে হঠাৎ উবে গেল!
হাসতে হাসতে বললাম, জামাইবাবুকে বলেছিস?
—কী বলব? বাবার কথা? ও তো হেসে উড়িয়ে দেবে!
আমি দিদির কাঁধে চিমটি কাটলাম, তোর তো কপাল ভালো রে! বাবাকে দেখেছিস, ভাগ্যিস তোর শাশুড়ি দেখা দেননি!
মা চুপ করে শুনছিল৷ কিছু বলল না৷
রাত্রে ছোড়দাকে শোনালাম গল্পটা৷ ছোড়দা আগের বারের মতো হাসল না, বরং খানিকটা গম্ভীরই হয়ে গেল৷ বলল, আমি তোদের একটা কথা বলিনি পুতুল! বাবাকে আমিও দেখেছি৷ বেশ কয়েকবার৷ একদিন ট্রামের পাদানিতে দাঁড়িয়েছিল, আমি সিট থেকে উঠে এগিয়ে যেতেই ভ্যানিশ৷ একদিন এসপ্ল্যানেডে দেখলাম৷ মনোহর দাস তড়াগের পাশে গম্বুজগুলো আছে না, তার নীচে দাঁড়িয়ে৷ আমাকেই দেখছিল৷ পাশে দু-তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, তারা কিন্তু কেউ বুঝতে পারছে না ওখানে আরেকটা মানুষ আছে৷
ছোটোবউদিও চিন্তিত, হ্যাঁ, তোমার ছোড়দা ক-দিন ধরে ঘুমোতে পারছে না৷ বলতে বারণ করেছিল, তাই বলিনি৷ কী করা যায় বলো তো?
আমি কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ বুকের ভেতরটা কেমন যেন শিরশির করছিল৷ এরা যা বলছে তা কি কখনো সত্যি হতে পারে? এতগুলো লোক একসঙ্গে হ্যালুসিনেশনও দেখবে কী করে?
কলেজ খোলার পরদিনই আমার পালা এসে গেল৷ ছুটির পর কলেজের ফাঁকা করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছি, বাইরের বাগানে স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবাকে৷ একটা গাঁদাগাছের পাশে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন৷ পরনে ধুতি আর ফুলহাতা শার্ট, যেমনটি নিত্যই থাকতেন৷ ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক হয়ে আছে বাবার, যেন কিছু বলছেন৷
আমি কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল৷ বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে৷ চমকটুকু কাটিয়ে পলকে ছুটে গেছি বাগানের দিকে৷ নেই— কোথাও কেউ নেই৷ কুঁড়িভরা গাঁদাফুলের গাছ, শুধু দুলছে হাওয়ায়!
কলেজ থেকে ফিরেই মাকে কথাটা বললাম৷ মা যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল৷ বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, আমি জানি সে আমাদের ছেড়ে যায়নি৷
—তুমিও কি দেখেছ নাকি?
—নাহ৷ মা মাথা নাড়ল, তবে সব সময়েই মনে হয় আশেপাশেই কোথাও আছে, এই ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাব৷
পরদিন সন্ধেবেলা দিদিকে ডেকে জরুরি মিটিং বসল একটা৷ আমরা কেউই আমাদের চোখের দেখাটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করছি না, কিন্তু আমাদের সকলেরই মনে হচ্ছে বাবা যেন কিছু বলতে চান৷ যদি সত্যিই আত্মা বলে কিছু থাকে, তাহলে তো তাঁর কথা আমাদের শোনা উচিত৷ আমরা শেষ মুহূর্তে বাবার কাছে কেউ পৌঁছতে পারিনি, নিশ্চয়ই বাবা খুঁজেছিলেন আমাদের৷ হয়তো বাবার কিছু বলার ছিল৷
অনেক ভেবেচিন্তে দাদাকে টেলিফোন করলাম৷ কী করা যায়?
দাদা তেমন সদুত্তর দিতে পারল না৷ বলল, তোরা যা করবি, তাতে আমিও আছি৷ আমারও বড়ো অস্বস্তি হচ্ছে রে৷
কয়েক মাস দোলাচলে কাটল৷ ঘনিষ্ঠ দু-চারজনের সঙ্গে আলোচনা করা হল, একেকজন একেকরকম পরামর্শ দেয়৷ কেউ বলে, গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে এসো৷ কেউ বলে, বাড়িতে শান্তিস্বস্ত্যয়ন করো, হোমযজ্ঞের ঠেলায় অতৃপ্ত আত্মা পালাতে পথ পাবে না৷ গোটা ব্যাপারটাকে উপেক্ষাও করতে বললে কেউ কেউ৷ তাদের মতে সময় গেলে মন স্থির হবে, তখন নিজেরাই আমাদের মনের ভুল বুঝতে পারব৷
কোনো পরামর্শই আমাদের ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না৷ যেমনই আলাভোলা মেঠো মানুষ হোন বাবা, তাঁকে কি ভূত বলে ভাবা যায়?
আরও কিছুদিন কাটল৷ ধীরে ধীরে বাবার দর্শন পাওয়ার হারটাও কমে আসছিল৷ দশদিন পনেরোদিন অন্তর হঠাৎ হয়তো কেউ একজন দেখতে পায় বাবাকে৷ মেট্রো রেলের স্টেশনে৷ লেকের পাড়ে৷ চৌরাস্তার মোড়ে৷
বাবার বাৎসরিকের দিন-কুড়ি আগে ছোড়দা একটা কথা তুলল৷ ছোড়দার বন্ধুর কে এক মামা আছেন, তিনি নাকি সরাসরি আত্মার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন৷ টাকা পয়সার কোনো ব্যাপার নেই, তিনি নাকি সাধুসন্ন্যাসীও নন, এ নাকি তাঁর এক বিচিত্র খেয়াল৷ ছোড়দার কয়েকজন বন্ধুও নাকি ওই ভদ্রলোকের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে কথা বলেছে৷ যদি আমরা চাই, ছোড়দা তাহলে আমাদের পারিবারিক ঘটনা নিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলোচনা করবে৷
দিদি তো খুবই রাজি৷ আমিও নিমরাজি হয়ে গেলাম৷ মাও বিশেষ আপত্তি করল না৷
ছোড়দা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে এল৷ ভদ্রলোক বললেন, তিনি আসবেন৷ বাবার বাৎসরিকের দিন রাত্রিবেলা৷ আমাদের সব ভাইবোন আর মাকে উপস্থিত থাকতে হবে৷
দাদাকে জানানো হল৷
অধীর আগ্রহে বাৎসরিকের দিনটার প্রতীক্ষায় রইলাম আমরা৷ দিন যায়, বুক কাঁপে৷ বুক কাঁপে, দিন যায়৷
কী বলার আছে বাবার?
পাঁচ
বাৎসরিকে প্রাণ ছিল না৷ কোনোভাবে নমো নমো করে শেষ হল কাজটা৷ আমাদের বুক গুড়গুড় করছিল, অতি সহজ কাজেই ভুল হয়ে যাচ্ছিল বারবার৷ পিণ্ডদানের সময়ে দাদার তো স্পষ্টতই হাত কাঁপছিল৷ সামান্য ক-জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া কাউকে নিমন্ত্রণ করিনি এবার, তারা সবাই খাওয়াদাওয়া করে চলে যেতেই আমরা টানটান৷
অপেক্ষা করছি সন্ধ্যার৷
সন্ধ্যা এল৷ গড়িয়ে গড়িয়ে পার হচ্ছে৷ যেন ভয় পাচ্ছে এগোতে৷
সাড়ে আটটা নাগাদ ভদ্রলোক এলেন৷ সুপুরি গাছের মতো লম্বা চেহারা৷ ঋজু৷ কৃশ৷ দেখে বোঝা যায় গায়ের রং একসময়ে টকটকে ফর্সা ছিল, এখন তামাটে৷ বয়স বছর ষাটেক, কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি৷ চোখ দুটো ভীষণ তীক্ষ্ণ৷ ঈগলনয়ন৷
আমাদের সঙ্গে নিয়ে মা-র ঘরের দরজা বন্ধ করলেন ভদ্রলোক৷ নিজে মেঝেতে বসলেন, আমাদেরও বসতে বললেন ভূমিতে৷ ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা মাটির প্রদীপ বার করে সামনে রাখলেন, সঙ্গে এক শিশি রেড়ির তেল, খানিকটা তুলোও৷ প্রদীপে তেল ঢেলে তুলোর সলতে পাকাচ্ছেন৷
এ কেমন প্ল্যানচেট! তেপায়া টেবিল নেই৷ মোমবাতি নেই৷
ভদ্রলোক মুখ তুলছেন না, কী যেন বিড়বিড় করছেন৷ প্রদীপের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন, ঘরের আলো নিভিয়ে দিন৷ পাখা বন্ধ করুন৷
আলো নিভতেই অন্ধকার ঝেঁপে এল৷ ছমছম আঁধারে মার গা ঘেঁষে বসেছি আমরা— দাদা ছোড়দা দিদি আমি৷
ভদ্রলোক প্রদীপ জ্বাললেন৷ শিখা একটু একটু করে উজ্জ্বল, কাঁপতে কাঁপতে স্থির হল একসময়ে৷ প্রদীপের শীর্ণ আলোয় যেন ঘরটাকে কেমন রহস্যময় লাগছিল৷ দেওয়ালে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ছায়া৷ ছায়ামূর্তিগুলো কি আমরাই!
ভদ্রলোকের ভারী স্বর শোনা গেল, আপনারা প্রদীপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন৷
পীতবর্ণ শিখা দেখছি আমরা৷ বিভ্রম জাগছে চোখে৷ শিখা কি রং বদলাচ্ছে৷ এই তো হলুদ ছিল৷ এই নীল! নাকি লাল!
জলদগম্ভীর স্বর বাজল আবার, দেখছেন?
সমস্বরে বললাম, দেখছি৷
—এবার আপনারা তাঁর মুখ স্মরণে আনুন৷ ওই শিখাতেই দৃষ্টি রেখে৷
বাবার মুখ মনে করার চেষ্টা করছি৷ কী আশ্চর্য, কোনো মুখই মনে আসে না কেন? শৈশবের দেখা মুখ নয়, কৈশোরের নয়, যৌবনেরও নয়৷ প্রাণপণে মনঃসংযোগের চেষ্টা করলাম৷ কিছুই স্মরণে আসে না৷ চুরি করে দেওয়ালের দিকে তাকালাম৷ ও হরি, বাবার ছবিটা তো আজ বাৎসরিকের জন্য বাইরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ ছবিটা যেন কেমন? ভাঙা-ভাঙা চোয়াল! চমশাপরা চোখ৷ চুল পাটপাট করে আঁচড়ানো! কিন্তু বাবার মুখটা কোথায় গেল? যত ভাবার চেষ্টা করি অন্য মুখ ফুটে ওঠে! শৈবাল!
কেমন যেন সংশয় হল৷ ঝট করে একবার দিদি-দাদাদের দেখে নিলাম৷ তাদের চোখের মণিও ইতিউzতি ঘুরছে৷ দিদির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই আবার চোখ রেখেছি শিখায়৷
ভদ্রলোক বললেন, আপনারা নিষ্ঠার সঙ্গে চিত্তপ্রিয়বাবুর মুখ মনে করছেন তো?
সত্যি বলতে সংকোচ হল৷ বললাম হ্যাঁ৷
কথাটা যেন কোরাসে বেজে উঠল৷ আবছায়ামাথা ঘরে মাথা খুঁড়ছে বার বার৷ মা একমাত্র নির্বাক৷ যেন সমাধিস্থ৷
—এবার তাহলে আপনাদের কাছে আসবেন তিনি৷ কথা বলবেন৷
সময় যাচ্ছে৷ সময় বয়ে যাচ্ছে৷ কতক্ষণ বসে আছি আমরা? দশ মিনিট? বিশ মিনিট? অনন্ত কাল?
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না৷ উঁহু, পাচ্ছি৷ দুটো চোখ৷ গলে বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে৷ চোখের জায়গায় দুটো গর্ত৷ কুচকুচে কালো৷ নিবিড় অন্ধকারের মতো কালো৷
ভদ্রলোকের মুখমণ্ডল ক্রমশ কঠিন হচ্ছিল৷ চোয়ালে চোয়ালে ঘষছেন, নিশ্বাস ফেলছেন ঘন ঘন৷ কেমন যেন নির্দয় দেখাচ্ছিল তাঁকে৷ একসময়ে গমগমে স্বরে বলে উঠলেন, আপনারা মিথ্যে কথা বলছেন৷ আপনারা সময় নষ্ট করছেন৷
আমরা নিরুত্তর৷ পাথরে ঘা খেয়ে ফিরে গেল কথাটা৷
হাতের ঝাপটায় প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন ভদ্রলোক৷ নিকষ কালিমায় ছেয়ে গেল ঘর৷ যেন ঘর নয়, কয়লাখনির ভয়ংকর খাদান৷
কালো অন্ধকার গর্জে উঠল, চিত্তপ্রিয়বাবু আসবেন না৷ তিনি আপনাদের মধ্যে তো ছিলেনই না কোনোদিন৷
দাদা মিনমিন করে বলল, তাহলে আমরা তাঁকে দেখি কী করে?
—চোখ আর কতটুকু দেখে! দেখে তো মন! মনকে জিজ্ঞাসা করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন!
অলৌকিক বাতাসের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক৷ আমরা নিথর বসে আছি৷ মা-ও৷ চৈত্রের তাপে ঘামছি দরদর৷ আলো জ্বালাতে ভয় পাচ্ছিলাম আমরা৷ যদি পরস্পরের মুখ দেখে ফেলি! যদি ধরা পড়ে যাই!
ক্রমশ একটা শব্দ শোনা গেল৷ কান্নার৷ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মা৷ ফ্যাসফেসে একটা আওয়াজ বেরোচ্ছিল মা-র গলা দিয়ে, অস্ফুটে কী যেন বলছিল মা, আমরা শুনতে পাইনি৷
আমাদেরও চোখ ভিজে যাচ্ছিল৷ বাবাকে আমরা আদৌ দেখিনি কখনো৷ মৃত্যুর আগেও না, পরেও না৷ যা দেখেছি তা এক নির্জন ভালোবাসার অলীক ছায়া৷
আমরা কষ্ট পাচ্ছিলাম৷ বাবার মৃত্যুতে সেই আমাদের প্রথম শোক৷
বাবা শুধু একা-একাই মারা যাননি৷ বাবা বেঁচেও ছিলেন বড়ো একা৷