দৃশ্য-শেষ
যেন দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের চিৎকার কমলেশের কানে এল। আর ঠিক তার পনেরো সেকেন্ড পরেই শোনা গেল দূরাগত কোনও এরোপ্লেনের গুঞ্জন। সেই গুঞ্জন ক্রমে পরিণত হল গর্জনে। কানফাটানো বিকট শব্দ তুলে প্লেনটা বাড়িটার ঠিক ওপর দিয়ে চলে গেল।
ঘরে একটা অল্প পাওয়ারের বালব জ্বলছে। তারই আলোয় কমলেশ ঘড়ি দেখল। রাত দুটো বেজে বত্রিশ মিনিট পনেরো সেকেন্ড।
এবার ও খাটের ওপর উঠে বসল। চোখ বুলিয়ে ঘরটাকে আর-একবার দেখতে লাগল, চোদ্দো ফুট লম্বা, বারো ফুট চওড়া বড় সাইজের ঘর। ঘরে জানলার কোনও বালাই নেই। একটামাত্র দরজা: পুরু শাল কাঠের তৈরি। ঘরের চার দেওয়াল নিরেট কংক্রিটের। সেটা ডিঙিয়ে যখন আওয়াজ আসছে তা হলে কুকুরটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে চিৎকার করছিল। কিন্তু এই পুরু দেওয়ালের জন্য মনে হয়েছে চিৎকারটা দূর থেকে ভেসে আসছে। কমলেশের বুক ঠেলে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। সে বন্দি! এই ছোট্ট ঘরটায় অসহায় পাখির মতোই ডানা ঝাপটে তাকে শেষ হয়ে যেতে হবে। কেউ খোঁজও পাবে না…।
কিন্তু কতক্ষণ ধরে ও এখানে রয়েছে? একদিন? দু-দিন? উহুঁ, মাত্র আট ঘণ্টা। কিন্তু একা-একা এতক্ষণ কাটানোর ফলে মনে হচ্ছে, হয়তো আট ঘণ্টা নয়—আটদিন।
ঘটনার আবর্ত শুরু হয়েছে এখন থেকে আট ঘণ্টা আগে। সেই সন্ধে ছ’টা থেকে। ভগবান জানেন, এর শেষ কোথায়।
কমলেশ সন্ধের মুখে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। গ্যারেজে গাড়িটা রেখে সুরকিঢালা পথ ধরে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই অন্ধকারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে দুই ছায়ামূর্তি: দুজনের মুখেই কালো মুখোশ এবং হাতে অটোমেটিক কোল্ট।
ভীষণভাবে চমকে উঠেছে কমলেশ। কিন্তু ভয় পেলেও বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেনি। তাই সঙ্গে-সঙ্গেই মাথার ওপর দু-হাত তুলে ধরেছে এবং বলে উঠেছে, ‘টাকাটা নেওয়া হয়ে গেলে ব্যাগটা আবার ফেরত দিয়ো।’ কারণ, ওর পকেটে ক্যাশ টাকা ছাড়াও ছিল গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স, আইডেনটিটি কার্ড, তা ছাড়া কিছু দরকারি কাগজপত্র। কিন্তু ওদের কেউই পকেটের ব্যাগের দিকে হাত বাড়ায়নি। অর্থাৎ, ব্যাগের ওই সামান্য টাকার লোভে ওরা আসেনি। লম্বা, দোহারা চেহারার লোকটি রিভলভার নাচিয়ে কমলেশকে এগোতে নির্দেশ করেছে, এবং কমলেশ বুদ্ধিমানের মতো সেই নির্দেশ অমান্য করেনি।
বাড়ির এলাকা ছাড়িয়ে ওরা বাইরে এসে দাঁড়াতেই কোথা থেকে ‘হুউস’ করে এগিয়ে এসেছিল একটা কালো ডেমলার গাড়ি। হাত-পা, চোখ বেঁধে, কমলেশকে পিছনের সিটে ফেলে ওরা গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
প্রথম-প্রথম কমলেশ মনে-মনে হিসেব রেখেছে, গাড়িটা কখন কোনদিকে মোড় নিচ্ছে— কিন্তু একটু পরেই সেটা অনর্থক বুঝে ও আর চেষ্টা করেনি।
ঘণ্টাখানেক একটানা চলার পর গাড়ি থেমেছে। গাড়ি থামামাত্রই কমলেশের হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর কমলেশের কানে এসেছে একটা দরজা খোলার শব্দ। তারপর দরজা পেরিয়ে, ওই চোখ বাঁধা অবস্থাতেই, ওকে উঠতে হয়েছে গোটা-বিশেক সিঁড়ির ধাপ—অবশেষে ও এই কংক্রিটের ঘরে এসে পৌঁছেছে।
চোখের বাঁধন খুলে দিতেই কমলেশের চোখে পড়েছে ঘরের এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা খাটের দিকে। এ ছাড়া কাছেই, কাঠের বিপরীতদিকে, রাখা হয়েছে একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। ভালো করে তাকাতেই কমলেশ লক্ষ করল, টেবিলের ওপর কিছু কাগজ এবং একটা কলমও রয়েছে। তা হলে কি….?’
ঠিক তাই! কমলেশের উপলব্ধির প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বিশাল চেহারার লোকটি কর্কশ স্বরে আদেশ করেছে, ‘বসুন। আপনাকে একটা চিঠি লিখতে হবে, আপনার ওয়াইফের কাছে। দু-লাখ টাকা আমাদের চাই।’
কমলেশ এর উত্তরে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেছে মুখোশধারী লোকটার দিকে: আপনমনেই বিড়বিড় করেছে, ‘দু-লাখ টাকা!’
লোকটির কালো মুখোশের আড়ালে যেন ভেসে উঠেছে একটুকরো বাঁকা হাসি: ঠিক ধরেছেন স্যার, দু-লাখ টাকা। আশা করি এবারে বুঝেছেন, আপনাকে কেন আমরা তুলে এনেছি?’
কমলেশ জিভটাকে শুকনো ঠোঁটজোড়ার ওপরে বুলিয়ে উত্তর দিয়েছে, ‘হ্যাঁ—বুঝেছি। আমার ওয়াইফের কাছ থেকে আপনারা টাকাটা আদায় করতে চান। কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন না, লাস্ট উইকে আমার বউ ওর মা-কে নিয়ে দিল্লি রওনা হয়ে গেছে—।’
এই অভাবনীয় উত্তরে মুখোশধারী লোক দুজন একে অপরের দিকে চেয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছে। ওদের একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়েছে কমলেশের। অবশেষে বিশাল চেহারার লোকটি তার অটোমেটিক কোল্ট উঁচিয়ে ধরেছে, বলেছে, ‘বুঝেছ চাঁদ, দু-লাখ টাকা আমাদের চাই-ই চাই। কোনওরকম কায়দায় আমরা ভুলছি না। তুমি কীভাবে টাকার জোগাড় করবে সে আমাদের জানার দরকার নেই। আমাদের শুধু মালটা পেলেই হল।’
লোকটির নির্দেশে কমলেশ সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল, ‘অমিতাভ রায় আমার লইয়ার। সে-ই আমার সবকিছু দেখাশোনা করে। একমাত্র ওকে লেখা ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না—।’
লোকটির হাতের বন্দুক আরও একবার নেচে উঠেছে, এবং সেইসঙ্গে শোনা গেছে তার আদেশ, ‘তা হলে তাই লেখো। পেন নিয়ে রেডি হও।’
এরপর কমলেশের শ্রুতলিপি লেখা যখন শেষ হয়েছে তখন দোহারা চেহারার লোকটি সেটা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পড়েছে—
প্রিয় অমিতাভ,
যে করে হোক দু-লাখ টাকা আমার চাই। দেখিস, পঞ্চাশটাকার নোটের চেয়ে বড় নোট যেন না থাকে। টাকাটা জোগাড় করার পর কী করতে হবে সেটা পরে জানাব। পুলিশে যোগাযোগ করার কোনও চেষ্টা করিস না। তা যদি করিস, তবে আমাকে আর জীবিত অবস্থায় দেখতে পাবি না।
ইতি—কমলেশ (সেন)
পুনশ্চ—ভীষণ বিপদে পড়ে তোকে এ চিঠি লিখলাম। তোর ওপর আমার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।—ক
চিঠিটা পড়ার পর সন্তুষ্ট হয়ে দুজনেই ঘাড় নেড়েছে। তারপর কমলেশকে ঘরে একা রেখে ওরা চলে গেছে। যাওয়ার আগে ঘরের একমাত্র দরজায় তালা দিয়ে গেছে।
কমলেশ আবার খাটে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল নিজের জটিল অবস্থার কথা।
টাকাটা পেয়ে গেলে ওরা কি কমলেশকে খুন করবে? কিন্তু তাই যদি ওদের ইচ্ছে হয় তা হলে মুখোশ-টুখোস পরে পরিচয় গোপনের এত চেষ্টা কেন? হঠাৎ নিষ্ঠুর বাস্তবের মতোই কমলেশ বুঝতে পারল, যতক্ষণ ওরা মুখোশ পরে থাকবে, ততক্ষণই কোনও ভয় নেই। কমলেশ পরে ওদের আর চিনতে পারবে না।
হঠাৎ দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দে কমলেশ চমকে খাটের ওপর উঠে বসল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল আটটা পঁচিশ। তার মানে শেষদিকে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল? রুদ্ধশ্বাসে ও খুলে যাওয়া দরজাটাকে লক্ষ করতে লাগল—নতুন কোনও বিপদের অপেক্ষা করতে লাগল।
পরক্ষণেই দরজা খুলে ঘরে ঢুকল প্রকাণ্ড চেহারার লোকটি। আশার কথা বলতে হবে, তার মুখে এখনও মুখোশটা রয়েছে। তার হাতে একটা খাবারের ট্রে। সেটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে সে বলল, ‘তোমার ব্রেকফাস্ট।’
কমলেশের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত লোকটি অপেক্ষা করল। তারপর পকেট থেকে একটা চওড়া মোটা কাপড়ের টুকরো বের করে কমলেশের চোখ বাঁধতে শুরু করল ‘তুমি এখন তোমার অফিসে ফোন করবে। ফোন করে তোমার সেক্রেটারিকে বলবে যে, একটা উইক তুমি অফিসে যাচ্ছ না…ওই ক’দিন কোথাও বেড়াতে যাচ্ছ…।’
কথা শেষ করে লোকটি কমলেশকে ঠেলে নিয়ে চলল। কমলেশ আন্দাজে বুঝল, ওর কয়েদখানায় দরজার ঠিক বাইরে কোনও এক জায়গায় ওরা এসে দাঁড়িয়েছে।
‘তোমার ফোন নম্বর কত?’ লোকটি প্রশ্ন করল।
কমলেশ ফোন নম্বর বলার পর টেলিফোনের ডায়াল ঘোরানোর শব্দ পেল। একটু পরেই টেলিফোনের রিসিভারটা ওর হাতে কেউ জোর করে ধরিয়ে দিল।
ও-প্রান্ত থেকে ওর সেক্রেটারি মলিনা চৌধুরীর গলা ভেসে এল, ‘হ্যালো?’
সাততাড়াতাড়ি জবাব দিল কমলেশ, ‘কে, মলিনা? আমি কমলেশ বলছি। শোনো, এই উইকটা আমি বোধহয় অফিসে যেতে পারব না। ভাবছি, এ ক’দিন ছুটি নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসব।’
‘কিন্তু স্যার, যদি খুব দরকার পড়ে, তবে কোথায় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব?’
‘সেসব ঝামেলা করার কোনও দরকার নেই, মলিনা। আমার সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে দাও। আর, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত সমস্ত চিঠিপত্র আমার ড্রয়ারে রেখে দিয়ো, কেমন?’
‘ঠিক আছে, স্যার।’
অপেক্ষাকৃত বেঁটে লোকটি কমলেশের হাত থেকে রিসিভারটা ছিনিয়ে নিয়ে নামিয়ে রাখল। তারপর কমলেশকে লক্ষ করে বলল, ‘তোমার আর কাউকে ফোন করার থাকলে করতে পারো। ভালো করে ভেবে দ্যাখো। নয়তো কেউ যদি তোমার ব্যাপারে বেশি ইন্টারেস্ট নিয়ে পুলিশে খবর দেয়, তবে তোমাকে খালাস করে দেব।’ লোকটা নৃশংসভাবে টেনে-টেনে হাসল।
একমিনিট ভেবেই মনস্থির করল কমলেশ, বলল, ‘আমার বাড়িতে একটা ফোন করা দরকার।’ ও ফোন নম্বর বলার সঙ্গে-সঙ্গে লম্বা মুখোশধারী লোকটি ডায়াল করতে শুরু করল। একটু পরেই সে রিসিভারটা তুলে দিল কমলেশের হাতে।
কমলেশের কানে এল ওর শ্যালক অবিনাশ দত্তর গলা, ‘হ্যালো—।’
‘অবিনাশ নাকি—?’
‘কে, কমলেশদা? কী ব্যাপার? কাল রাত থেকে—।’
‘শোনো অবিনাশ, আমার ফিরতে হয়তো দিনসাতেক দেরি হবে।’
‘তার মানে? আপনি কোত্থেকে কথা বলছেন, কমলেশদা? আজ সকালেও যখন আপনি ফিরলেন না, তখন ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। শেষে দাশুকে খোঁজ করতে পাঠালাম। খোঁজাখুঁজি সেরে ও ফিরে এসে বলল, গাড়িটা নাকি গ্যারেজেই রয়েছে। মানে, কাল আপনি বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু তারপর আবার যে কখন বেরোলেন সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।’
‘হ্যাঁ, আজ খুব সকালে আমি আবার বেরিয়ে পড়েছি। আমার এক বন্ধু ওর গাড়ি করে আমার বাড়ির কাছ থেকে আমাকে তুলে নেয়। তাই তাড়াতাড়িতে বলে যেতে পারিনি।’ কমলেশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কে জানে, অবিনাশের সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে কি না।
‘এই সাতদিন কী করবেন? কোনও জরুরি কাজ, না অন্য—?’
‘না, কোনও কাজ-টাজ নয়। এই একটু বেড়াব-টেরাব ঠিক করেছি।’
‘কিন্তু কাল সন্ধের সময় দিল্লি থেকে দিদির একটা চিঠি এসেছে। আপনি বোধহয় চিঠিটা পাননি?’
‘না, পাইনি। তুমি বরং চিঠিটা রেখে দিয়ো, আমি ফিরে এসে দেখব’খন?’
‘তার কী দরকার? যাওয়ার আগে বাড়িতে নেমে চিঠিটা নিয়ে গেলেই তো পারেন—?’
‘না, তা সম্ভব নয়।’
ও-প্রান্তে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আবার অবিনাশের গলা ভেসে এল, ‘তা হলে আপনার অ্যাড্রেসটা বলুন, আমি চিঠিটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘উহুঁ, আমি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ব। তা ছাড়া পজিটিভ কোনও অ্যাড্রেস দেওয়া অসম্ভব। আমি দিনসাতেক পর ফিরলে চিঠিটা দিয়ো। কেউ যদি আমার কথা জিগ্যেস করে তা হলে বোলো, আমি ছুটি নিয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য বেড়াতে গেছি।’
ফোন করা শেষ হলে লম্বা লোকটি কমলেশকে আবার সেই ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে এল। তারপর ওর চোখ থেকে কাপড়ের পটিটা খুলে নিল। কমলেশ আশা-নিরাশার দোলায় দুলতে-দুলতে খাটে গিয়ে বসল। এখন ওর শেষ ভরসা অমিতাভ রায়।
রাত প্রায় দশটার সময় লম্বা লোকটির সঙ্গী বেঁটেটা কমলেশের খাবার নিয়ে এল। সম্ভবত রাত্তিরে এই লোকটাই দরজার বাইরে পাহারা দেবে।
খেতে-খেতে কমলেশ হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘অমিতাভ রায়ের কাছ থেকে কোনও খবর পেয়েছেন?’
বেঁটে লোকটা মাথা নাড়ল। অধৈর্যভাবে কমলেশের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। কমলেশ লক্ষ করল, লোকটা অন্যমনস্কভাবে ডানহাত দিয়ে ওঁর বাঁ-হাতের নখ খুঁটছে। মুদ্রাদোষ? আপনমনেই হাসল কমলেশ।
পরদিন সকালে মুখোশপরা লম্বা লোকটা আবার কমলেশের ঘরে এল। হাতের ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, ‘খেয়ে নাও।’
কমলেশ একটুকরো পাঁউরুটি নিয়ে দাঁত বসাল। নাঃ, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে লোকদুটো খুব একটা অভদ্র নয় দেখছি। খেতে-খেতে হঠাৎই ওর মনে পড়ল অমিতাভর কথা। সঙ্গে-সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে ও জিগ্যেস করল, ‘অমিতাভ কি টাকার ব্যবস্থা করেছে?’
‘উঁহু,’ জবাব দিল লম্বা মুখোশধারী, ‘তোমার ওই হারামজাদা উকিল এখনও গাঁইগুঁই করছে। আজ তুমি ওকে ফোন করবে। যদি পরিষ্কার করে ওই দু-লাখ টাকার ব্যাপারটা বোঝাতে পারো তো ভালো, নয়তো বউকে চিঠি লিখে খাটিয়া কেনার ব্যবস্থা করতে বলো।’
কমলেশ এক অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠল। না, না—যে করে হোক অমিতাভকে ও রাজি করাবেই।
খাওয়া শেষ হতে লোকটি পকেট থেকে কাপড়ের পটি বের করে কমলেশের চোখ বেঁধে দিল। তারপর আগের দিনের মতোই ওকে নিয়ে চলল টেলিফোনের কাছে।
কমলেশ অমিতাভর ফোন নম্বর বলার পর লোকটা ডায়াল করে কমলেশের হাতে রিসিভার তুলে দিল, ‘নাও, এবার তোমার পেয়ারের দোস্তকে ভালো করে বোঝাও।’
রিসিভারটা সজোরে আঁকড়ে ধরে কানে চেপে ধরল কমলেশ। উত্তেজিত চাপা স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কে?’
‘কমলেশ নাকি? আমি রায় বলছি। কী, ব্যাপার কী তোর?’
‘আমার চিঠি পেয়েছিস?’ ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল কমলেশ।
‘হ্যাঁ, কিন্তু অত টাকা এই ক’দিনে কী করে যে জোগাড় করব বুঝে উঠতে পারছি না।’
‘দরকার হলে আমার সমস্ত প্রপার্টি বেচে দে। দিয়ে যে করে হোক দু-লাখ টাকা আমার চাই। যদি দিন-দুয়েকের মধ্যে জোগাড় করতে পারিস তো ভালো। আর সেটা না পারলে তোকে আর টাকা জোগাড় করতে হবে না। আমার শ্রাদ্ধে টাকাটা খরচা করিস।’ অমিতাভকে জবাব দেওয়ার কোনও সময় না দিয়েই ঠকাস করে রিসিভার নামিয়ে রাখল কমলেশ। ওর কপালে ফুটে উঠেছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।
লম্বা লোকটি ওকে আবার ঘরে ফিরিয়ে এনে চোখের বাঁধন খুলে দিল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘আর মাত্র তিনদিন আমরা ওয়েট করব।’
সেদিন রাতে কমলেশের ঘুম এল না। হাজার চিন্তা যেন ওর মাথায় ছুঁচের মতো বিঁধছে। হঠাৎ ওর কানে এল দূর থেকে ভেসে আসা কোনও কুকুরের চিৎকার। আর ঠিক তার পনেরো সেকেন্ড পরেই ও শুনতে পেল এরোপ্লেনের গর্জন।
গত কয়েকদিন ধরেই ২-৩২ মিনিটের সময় একটা কুকুরের চিৎকার আর তার পনেরো সেকেন্ড পরেই একটা প্লেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে কমলেশ। বাইরের জগৎ থেকে ওকে যে এভাবে আলাদা করে রাখা হয়েছে তা কি কেউ জানে? এখন অমিতাভ যদি টাকাটা জোগাড় না করতে পারে—।
ভাবতে-ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল কমলেশ।
কারও ধাক্কায় কমলেশের ঘুম ভাঙল। ধড়মড়িয়ে খাটে উঠে বসল ও। দেখল, ওর সামনে দাঁড়িয়ে দুই মুখোশধারী।
কমলেশ হঠাৎ ভীষণ ভয় পেল। তা হলে কি ওর জীবনের লাস্ট চ্যাপ্টার কাছে এসে গেছে?
লম্বা লোকটি পকেট থেকে অটোমেটিক কোল্টটা বের করে কমলেশের কপালে ঠেকাল।
কমলেশ চোখ বুজল। ওর কান যে-কোনও মুহূর্তে আশা করতে লাগল একটা বিরাট গর্জন। ওর মস্তিষ্ক এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের অপেক্ষায় রইল।
কিন্তু না, সেরকম কিছুই ঘটল না। তার বদলে কর্কশস্বরে কথা বলে উঠল লোকটা, ‘এই যে, এখন আমরা অমিতাভ রায়কে ফোন লাগাচ্ছি—আর ওয়েট করতে পারছি না। তুমি এখানে বসে-বসে এক-দুই গুনতে থাকো। আমরা ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরব।’
কমলেশ যখন চোখ খুলল তখন ওরা দুজনেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কমলেশের শুধু মনে হতে লাগল, একঘণ্টা—একঘণ্টা—আর মাত্র একঘণ্টা—!
কতক্ষণ যে ওইরকম আচ্ছন্নভাবে ও বসেছিল, মনে নেই। দরজা খোলার শব্দে ওর চমক ভাঙল। লম্বু এবং বেঁটে ঘরে ঢুকল।
ঈশ্বরকে মনে-মনে ধন্যবাদ দিল কমলেশ, কারণ, ওরা এখনও মুখোশ পরে রয়েছে।
‘অমিতাভ কি টাকাটা জোগাড় করতে পেরেছে?’ কৌতূহলে জানতে চাইল কমলেশ।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর লম্বা লোকটা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, জোগাড় তো করেছে বলছে। কিন্তু সত্যি কি মিথ্যে সেটা জানতে পারব রাত আটটায়। সন্ধে সাতটায় ফোন করে টাকাটা নিয়ে কোথায় দেখা করবে তার আইডিয়া রায়সাহেবকে দেব। তারপর আটটার সময় টাকাটা পেয়ে গেলেই ভালো। আর যদি দেখি লোকটা পুলিশে খবর দিয়েছে, অথবা প্যাঁচ খেলার চেষ্টা করছে, তবে তোমাকে প্যাক করে পার্সেল করে দিল্লিতে তোমার বউয়ের কাছে পাঠিয়ে দেব।’
বেঁটে লোকটা অন্যমনস্কভাবে ডানহাত দিয়ে ওর বাঁ-হাতের নখ খুঁটছিল, হঠাৎ বলে উঠল, ‘টাকা পেয়ে গেলে তোমাকে রাত দশটায় ছেড়ে দেওয়া হবে।’
রাতে ঠিক দশটায় ওর ঘরের দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পেল কমলেশ। সঙ্গে-সঙ্গে ও থরথর করে কেঁপে উঠল। এই কি তা হলে কৃতান্তের নিমন্ত্রণ?
দরজা খুলে ঢুকল ওরা দুজন। মুখোশের আড়ালে কি চোখে পড়ছে একটুকরো বাঁকা হাসি? কে জানে।
‘অমিতাভ—অমিতাভ—’ কমলেশের গলা বন্ধ হয়ে এল। লম্বা লোকটা পকেটে হাত ঢোকাল। মুহূর্তের মধ্যে কমলেশের মনে পড়ল ওর সুন্দরী স্ত্রীর কথা—অমিতাভর কথা—এই সবুজ পৃথিবীর কথা—।
লোকটা পকেট থেকে কাপড়ের পটিটা বের করল। তা হলে অমিতাভ টাকা দিয়েছে! আনন্দে কমলেশের কাঁদতে ইচ্ছে করল।
ওর চোখ বাঁধা হয়ে গেলে লম্বা লোকটা বলল, ‘তোমার কপাল ভালো। তোমার দোস্ত টাকাটা দিয়ে দিয়েছে। কোনও ছকবাজির চেষ্টা করেনি। তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর তুমি আবার পুলিশের দালালি কোরো না যেন—।’
তারপর আবার সেই চলন্ত কালো ডেমলার। গাড়ির পিছনের সিটে শুয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় ভাবতে লাগল কমলেশ। ওরা কি সত্যিই ছেড়ে দেবে ওকে? নাকি—।
যখন একটা ফাঁকা অন্ধকার মাঠে ওরা কমলেশকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দিল, তখন ও নড়ার চেষ্টা করেনি। মড়ার মতো নিশ্চল হয়ে একটা বুলেটের অপেক্ষা করেছে।
কিন্তু ওরা কিছু না করে স্রেফ গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
অন্ধকারে বেশ কষ্ট করে হাতঘড়ি দেখল কমলেশ। রাত বারোটা।
টলতে-টলতে ও উঠে দাঁড়াল। চোখে পড়ল, বহু দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু। ক্লান্ত পায়ে ও সেদিকে হাঁটতে শুরু করল। অমিতাভকে ফোন করে খবর দিতে হবে। তারপর চলবে পুলিশের কাছে জবাবদিহির পালা।
রাত দুটোর সময় পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের হাত থেকে রেহাই পেল কমলেশ।
থানা থেকে বেরোতেই দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে অমিতাভ। ওকে দেখেই হাসল, ‘তোকে তা হলে ছাড়ল। ওঃ, আমাকেও কি কম হ্যারাস করেছে। এখন বাড়ি যাবি তো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আর চলতে পারছি না, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।’ অবসন্ন স্বরে জবাব দিল কমলেশ।
‘তা হলে আমার বাড়িতেই চল। ওখান থেকে তোর বাড়িতে একটা ফোন করে দিবি যে, তুই কাল সকালে বাড়ি ফিরবি, তা হলেই হবে।’
অমিতাভর কথায় রাজি হয়ে ওর গাড়িতে গিয়ে উঠল কমলেশ।
কিছুক্ষণ পরেই অমিতাভর বাড়ির দরজায় ওদের গাড়ি এসে থামল। কমলেশ গাড়িতে বসে ঝিমোচ্ছিল, অমিতাভর ধাক্কায় সংবিৎ ফিরে পেয়ে গাড়ি থেকে নামল।
বসবার ঘরে দুজনে আরাম করে সোফায় বসে কথা বলছিল। হঠাৎই অমিতাভ বলল, ‘কীরে, একটু ”ইয়ে” চলবে নাকি? তা হলে এই ম্যাজম্যাজে ভাবটা কেটে যেত।’
কমলেশ আপত্তি করল না।
অমিতাভ পাশের ঘরে গেল গেলাস আনতে। কমলেশ এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। চোদ্দো ফুট বাই বারো ফুট বসবার ঘর। প্রচুর টাকা খরচ করে এটাকে মনের মতো করে সাজিয়েছে অমিতাভ। একা মানুষ, বেশ সুখেই আছে।
এসব কথা ভাবতে-ভাবতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল কমলেশ। দেওয়াল-ঘড়ির ঢং-ঢং শব্দে ওর চমক ভাঙল। রাত আড়াইটা বাজে। ঠিক তখুনি দুটো ভরতি গেলাস নিয়ে ফিরে এল অমিতাভ। সোফায় বসে সামনের টেবিলের ওপরে গেলাস দুটো নামিয়ে রাখল: ‘নে, শুরু কর।’
একটা গেলাস হাত বাড়িয়ে তুলে নিল কমলেশ।
অমিতাভ ওর গেলাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে গেলাসটা টেবিলে রাখল, বলল, ‘তোর কী মনে হয়? পুলিশ কি ওই লোকদুটোর কোনও হদিস পাবে?’
কমলেশ একটু অন্যমনস্ক ছিল। অমিতাভর কথায় ওর দিকে ফিরে তাকাল। বেঁটেখাটো অমিতাভ রায় তখন ডানহাত দিয়ে নিজের বাঁ-হাতের নখ খুঁটছে।
কমলেশ অবাক হল। এক-দু-সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর হাসল ‘তুই কি সত্যি জানতে চাস?’
‘তার মানে?’ অবাক হল অমিতাভ।
এমন সময় কমলেশের কানে এল দূর থেকে ভেসে আসা কোনও কুকুরের চিৎকার। যে-চিৎকার ও বন্দি অবস্থায় প্রতিদিন রাত দুটো বত্রিশে শুনে এসেছে।
নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল কমলেশ। ঠিক ২-৩২ মিনিট।
‘তুই কি সত্যি-সত্যি জানতে চাস?’ আবার একই প্রশ্ন করল কমলেশ।
‘হ্যাঁ, চাই।’ অমিতাভ অবাক হয়ে জবাব দিল।
‘তা হলে তোকে আর মাত্র পনেরো সেকেন্ড ওয়েট করতে হবে।’ বলতে-বলতে হুইস্কির গেলাস হাতে উঠে দাঁড়াল কমলেশ। একদৃষ্টে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে এরোপ্লেনের শব্দটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
ওর হাতঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরে চলল। কমলেশ দেখতে লাগল—একসেকেন্ড—দু-সেকেন্ড—তিনসেকেন্ড—চারসেকেন্ড—পাঁচসেকেন্ড—ছ’-সেকেন্ড—টিক—টিক—টিক—টিক—টিক—।