দূরে বৃষ্টি
আরে, নিন না। কী আশ্চর্য! লাইটারটা নেবেন তার জন্যে এত কিন্তু-কিন্তু কেন? নিন্। আমি তো এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম, আপনার লাইটার জ্বলছে না। ভাবছিলাম, আমারটা আপনাকে পাঠিয়ে দেব। আপনি নিজেই উঠে এলেন। ভালই হল। বসুন না, স্যার। টেবিলে আমি একলাই বসে আছি। আপনিও তো একাই ছিলেন। আসুন, দু জন হওয়া যাক্।
আপনার সঙ্গে আমার আলাপ নেই। আমি কিন্তু আপনাকে চিনি। চিনি মানে আপনাকে এখানে দু চার বার দেখেছি। তবে তখন জানতাম না, আপনি মশাই একজন গুণী লোক। গত হপ্তায় কবে যেন বাড়ি থেকে বেরুতে পারলাম না, ফ্লু-গোছের হয়ে গেল। সন্ধ্যেবেলায় টিভি-র সামনে গিয়ে বসলাম, জাস্ট ফর এ চেঞ্জ। টিভি খুলতেই—ও হরি, দেখি আপনি টুক করে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছেন পর্দায়। আপনারা তিনজন: আপনি, গোলগাল গোপাল গোছের এক ভদ্রলোক আর এক মহিলা, কী লম্বা নাক মশাই মহিলার—কথা বলছেন। আপনার গায়ে নকশা করা এক বুশ শার্ট ছিল। ঠিক কি না বলুন! চোখ আমার পাকা, ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। আপনাকে দেখে দারুণ মজা লাগল। বেপাড়ায় চেনা মুখ দেখলে যেমন লাগে। আপনারা কিসের একটা ডিসকাশন করছিলেন। আমার কেমন ইন্টারেস্ট গ্রো করে গেল। আমি মশাই প্রোগ্রামের প্রথমটা শুনিনি, দেখিনি। বলতে পারব না—সাবজেক্টটা কী ছিল আপনাদের ! তবে শুনতে শুনতে মনে হল—আপনারা আজকাল মানুষের নানা রকম উপসর্গ—মানে মেন্টাল ডিস্টারবেন্সেস নিয়ে আলোচনা করছিলেন। অ্যাম আই রাইট? আমি খুব মন দিয়ে শুনছিলাম। তার আগে বলি, আপনাকে স্যার দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছিল, স্মার্ট আর…কী বলব… কী বলব… ভেরী সাউন্ড, মানে মনে হচ্ছিল আপনার কথাবার্তার মধ্যে একটা অথরিটি আছে। ওই এজেড্ ভদ্রলোক—গোলগাল গোপাল—ওঁকে মনে হচ্ছিল ছেলের বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে গেছেন। না না হাসবেন না, রিয়েলি সেই রকম দেখাচ্ছিল। তবে হ্যাঁ, বেশ ধীরেসুস্থে গুছিয়ে কথা বলছিলেন। আর ওই মহিলা, মনে হল বেশ শানিয়ে এসেছেন। ভেতরে বাইরে দু দিকেই শানানো। আপনার সঙ্গে লেগে যাচ্ছিল মাঝে মাঝেই। আমি তো ভাই একবার নারদ নারদ করে উঠলাম, লেগে যাক দু জনে। তা লাগল না, গোলগাল গোপাল মাঝখানে পড়ে থামিয়ে দিলেন। এইটেই হল মারাত্মক, বুঝলেন স্যার। আপনি যখন তাল ঠুকে আসরে নামলেন তখন কেউ যদি পেছন থেকে আপনার কাছা টেনে ধরে—হয়ে গেল, বারোটা বেজে গেল তালের। …যাক্ গে, আলোচনাটা যে কোথায় গড়ালো শেষ পর্যন্ত তাও জানতে পারলাম না, কেন না আলো চলে গেল, যথারীতি। আমাদের দিকে সকাল সন্ধে রাত মিলিয়ে ঘন্টা আষ্টেক আলোফালো থাকে না! আপনাদের দিকে?
এই দেখুন, আমি একতরফা বকবক করেই যাচ্ছি। আপনার কথা জিজ্ঞেসই করা হচ্ছে না। আপনার নাম কী স্যার? টি ভি-তে ওরা ডক্টর বাগচি ডক্টর বাগচি বলছিলেন। একবার বোধ হয় নামটা লেখাও দেখলাম, ভাল পড়তে পারলাম না, আসলে আমি খানিকটা পর থেকে দেখছিলাম তো! নামটা মিস করেছি। তবে নামে কী আসে যায়! আপনি এখানে আসেন, নামটা তো আমি জেনেই নিতে পারি।
আপনি এখানে, মানে আমাদের এই প্রীতিসুধার সুরা সঙ্গমে কতদিন স্যার? আমি আপনাকে নতুন দেখছি। মাস দুই তিন হল। তাই না? আপনি তো রেগুলার ভিজিটারও নয় এখানকার। রেয়ার আসেন। আমরা হলাম পুরনো পাপী। প্রীতি আমাদের বন্ধু। ওর পোশাকী নাম প্রীতিসুধা। নামের সিগনিফিকান্সটা ভেবে দেখুন। সুধা সরবরাহ করে করে বেটার চেহারাটা কেমন হয়েছে দেখেছেন! তুখোড় লোক ও! তা আমরা ওর মদ্যখানার নাম দিয়েছি সুরা সঙ্গম। খারাপ নাম, বলুন! বাইরে তোর সাইনবোর্ডে তুই যা খুশি লাগা, আমরা বাবা সুরা সঙ্গমই বলব। কবির দেওয়া নাম। আমাদের এক কবি বন্ধু নামটা দিয়েছিল।
ও হো, আপনাকে শুধু মুখে বসিয়ে রেখেছি তখন থেকে। অপরাধ নেবেন না। …কী পছন্দ করেন আপনি? হুইস্কি? সেই ভাল। ভদ্রলোকের পক্ষে বাঁজা বউ আর হুইস্কি এই হল বেঁচে থাকার নিরাপদ উপায়। …দাঁড়ান—একটু হাঁফ ছাড়ি। …সাধুচরণ, এই যে সাধু, শোনো বাবা, এদিকে এসো। শোনো বাবা, এই যে সাহেবকে দেখছো—সাহেব খুব নামকরা লোক। শোনো, এঁর জন্যে একটা বড় হুইস্কি আনবে। হুইস্কি। আমায় যা দাও। সাহেবের জন্যে সোড়া দিও। আর আমারও তো ফুরিয়ে এল, আমার জন্যেও এনো, নো সোড়া—ঠাণ্ডা পানি। …আর সাধুবাবা, তোমাদের মটন পকৌড়া না কী একটা আছে তাই দিও দু প্লেট।
কী বলছিলাম স্যার আপনাকে? প্রীতির কথা না? সে এক দারুণ গল্প! প্রীতি বি এ-তে তিনবার লটকে গেল; ফিল্ম লাইনে ঘুরল কিছুদিন, দেখলো ব্যাপারটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো; তারপর গাড়ির দালালি ধরলে, সুবিধে করতে পারল না; তখন এই সরাইখানা খুলে বসল। প্রীতিদের ফ্যামিলি হল দু পুরুষের ন্যায় দর্শনের ফ্যামিলি মানে প্রীতির ঠাকুর্দা আর বাবা ন্যায় দর্শন পড়িয়ে এসেছেন। সেই বংশের ছেলে শেষে মদ্যখানা খুলবে! প্রীতির বাবা রেগে আগুন, বললেন, আমার ছেলে শুঁড়িখানা খুলবে! বাড়ি থেকে বার করে দাও হারামজাদাকে। মরতে বলো। ছি ছি ছি। …প্রীতি ঘোড়েল ছেলে। শুঁড়িখানা খোলার আগে রেস্তোরাঁ খুলল। বাইরে রেস্তোরাঁ, সন্ধের পর ভেতরে মদ্যখানা। বাবা মারা গেল, শ্বশুর বেশ কিছু টাকা ফাইনান্স করল জামাইকে। প্রীতি এই মদ্যখানাকে সর্বাঙ্গ সার্থক করে ফেলল। দেখুন স্যার, যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে হবে। প্রীতির বরাবরই নজর ভাল, সে একটা হট্টশালা কিংবা পাতি মাতালদের মার্কেট করতে চায়নি জায়গাটা। এখানে ফালতিন-থ্রি হেডস্ তু মাতাল, কাপ্তেন টাইপের লোক, রেসুড়ে কেরানী—এ-সব পাবেন না। এটা ভদ্রলোকদের জায়গা, আশপাশে দেদার মালখানা আছে—বেলাল্লাপনার আড়ত সেগুলো; এখানের অ্যাটমস্ফেয়ারই আলাদা। নিরিবিলি, শান্ত, কেউ যাচ্ছে, কেউ গল্প করছে, সন্ধের দিকে পেছনের বারান্দায় তাসের আসরও বসে। এনি ওয়ে আমাদের মতন প্রীতির ইয়ার দোস্ত ছাড়া অন্য যারা আসে সকলেই হিসেবী, সাবধানী, বউ শালীর কথা ভাবে, খবরের কাগজে লেখেটেখে। সরকারী ফ্ল্যাট ট্ল্যাট বাগিয়ে ফেলেছে। মানে, এরা কেউ লোফার লোচ্চা নয়।
প্রীতির নজর কেমন উঁচু দরের তার একটা একজামপ্ল—ওই যে, দেখুন। আপনি যেখানে বসেছিলেন, জানলার পাশে, তার মাথার ওপরটা দেখেছেন? নিশ্চয় দেখেছেন। আমাদের আর্টিস্ট বন্ধু, হরিবিষ্টুকে দিয়ে প্রীতি ওটা…ওই ছবিটা আঁকিয়েছিল। ছবিটার মর্ম বুঝতে পারেন? পারেন না? গাছতলায়, লতাপাতার পাশে মাটিতে উদোম হয়ে দেড়মণি যে মেয়ে লাশটি শুয়ে আছে, তার ক’টা মাথা দেখেছেন? তিন—থ্রি হেডস্। একটা নরম্যাল মাথা, বাকি দুটো কাল্পনিক মাথা। মাঝখানের মাথাটা জাগতিক, বাকি দুটো কিসের? স্বর্গের আর নরকের? ভগবান জানেন কিসের! মাগীর হাত পাঁচটা মানে পঞ্চবাণ হয়ত, চারটে পা। গোটা ছয়েক স্তন বেলুনের মতন উড়ছে। পেটের বাহারখানা দেখলে পিত্তি উঠে আসে। হরিবিষ্টুর এই ছবিটাকে প্রীতি মাস্টারপিস করে টাঙিয়ে রেখেছে। কাস্টমারকে চমকে দেয়। আবার বলে, ‘ছবিটার নাম কী জানিস? এ স্টাডি ইন জেনানা মহল।’ শালার কী রসিকতা! হরিবিষ্টুরও কী কপাল! ছবিটা আঁকার পর প্রীতির শ্বশুর বাড়ির দেশ—মজঃফরপুরে ড্রয়িং মাস্টারী পেয়ে গেল।
এই যে সাধুচরণ এসে গেছে। এনেছ সব ঠিক ঠাক? দেখি—! সাহেবের, আমার—! ঠিক। সোডা, ঠাণ্ডা পানি। ও. কে.। পাকৌড়া আর পটেটো চিপস্, পাঁপর ভাজা। অল রাইট সাধুবাবা।
নিন স্যার। মুখে তুলুন। আপনার সঙ্গে পরিচয়ের শুভ মুহূর্ত দীর্ঘ হোক। চিয়ারস্!
কথায় কথায় কোথায় চলে গেলাম। এই হল আমার দোষ। মদ্যপানে আমার মুখের আগল খুলে যায়। নন্ স্টপ বলে যেতে পারি যদি কথা বলতে চাই। তবে আমি খুব কমই কথা বলার আগ্রহ বোধ করি। আজ করছি। আপনাকে পেয়েই।
আমার আসল কথাটা এবার বলি, স্যার। ইন্ ফ্যাক্ট—আপনার ওপর আমার ইন্টারেস্ট গ্রো করার একটা কারণই হল—আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। বলি আপনাকে।
মাসখানেক আগে আমি একদিন কতগুলো গোলমেলে কাজ করে ফেলি। আমার এ-রকম হয়। যেমন ধরুন আমি বাড়িতে হইচই লাগিয়ে দি, দু পাঁচটা কাচের বাসনপত্ৰ ভাঙি আওয়াজ করে, ড্রেসিং টেবিলের কাচে রঙ লাগিয়ে দি, বিছানাটিছানা নষ্ট লণ্ডভণ্ড করে রাখি—এই রকম আর কি! মারাত্মক কিছু করি না। ডাক্তারদের বললেই বলে, টেনশান থেকে ব্যাড্ টেম্পার হয়ে ওঠে, তারই জের সব, মাথা গরম, গ্যাস, অনিদ্রা। যে যা পারে একটা করে ওষুধ দেয়: হজমের, ঘুমের, মেজাজ ঠান্ডা রাখার।
তবে সেদিন, যেদিনের কথা আপনাকে বলছি, বাড়াবাড়ি রকমের গোলমাল হয়ে গেল। সকালে উঠেই সাডেন্লি আমার মনে হল, আমার স্ত্রী স্বার্থপর, পাজি, রদ্দি। ওর সঙ্গে থাকা যায় না। স্ত্রীকে জানিয়ে দিলুম, আমি কলকাতার বাইরে চলে যাচ্ছি ফিরতে হপ্তাখানেক হবে। আধ ঘন্টার মধ্যে আমার সব রেডি চাই। মায় জুতো পালিশ পর্যন্ত। স্ত্রী চটে গেল। আধ ঘন্টার মধ্যে সব তৈরি হয় নাকি? ওই ছুতো দিয়ে শুরু হল স্যার, বুঝলেন, তারপর দু জনে ঝগড়া বাড়তে লাগল, বাড়তে বাড়তে একসময় দেখি স্ত্রী শাড়ি পালটাচ্ছে তার বড়দির কাছে চলে যাবে বলে আর আমি শোবার ঘরের অবস্থাটা ভয়াবহ করে তুলেছি। তাতেও হয়ত ব্যাপারটা মিটে যেত যদি আমি চুপ করে যেতাম। আমার যে কী হয়ে গেল, মুখটুখ দিয়ে একেবারে ছোট লোকের ভাষা বার করতে লাগলুম, শাড়ি টাড়ি যা সামনে পড়েছিল—ছিঁড়ে খুঁড়ে দোয়াতের কালি ঢেলে দিলাম, ফেলে দিলাম রাস্তায়, বাসনপত্র এটা সেটা ভাঙচুর হল কিছু, তাতেও যখন আমার সাধ মিটল না—নিজের গলা নিজে কাটব বলে ছুরির সন্ধান করতে লাগলাম। ব্যাপারটা এখন আপনার কাছে ছেলেমানুষি মনে হচ্ছে তো! আমার কাছেও হচ্ছে! কিন্তু ওই সময়টায়—যখন এসব ঘটছিল তখন—ছেলেমানুষির ছ-ও ছিল না। আপনাকে লুকোবো না, রাত্রে আমার আত্মহত্যা করার ভীষণ এক টান এসেছিল। আমি হাতের কাছে ঘুমের বড়ি ছাড়া কিছু আর পেলাম না। এখানে বলে রাখি, স্ত্রীর সঙ্গে আমার চটাচটি বিকেলের পর আর ছিল না। দু জনেই ক্লান্ত, অনুতপ্ত হয়ে পড়েছিলাম। তা সত্ত্বেও রাত্রে আমার আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে।
আপনি মশাই, বসেই আছেন, না, খাচ্ছেন? কই পদার্থ কমছে কোথায়? আমার দেখুন। কত তাড়াতাড়ি, শেষ হয়ে আসছে।
যাক্গে, পরের ব্যাপারটা বলি। আমার মানসিক অবস্থাটা মাঝে মাঝেই এইরকম গোলমেলে হচ্ছে দেখে আমার স্ত্রী এক ডাক্তার ঠিক করে এল লুকিয়ে। আমায় কিছু বলল না প্রথমে। পরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা বলল। কাকুতি মিনতি করে বলল, ‘দয়া করে ডাক্তারকে কোঅপারেট করো, তেড়িয়া হয়ে উঠো না। এখন আমাদের বয়েস হচ্ছে, অসুখ বিসুখ অবহেলা করা উচিত নয়; বুঝলে?’
ডাক্তারটির পুরো নাম আমার মনে নেই। পি. হাজরা। হাজরা আমায় নিয়ে ঘন্টা খানেক লড়ে গেল। কত রকম প্রশ্ন, মশাই। মা বাবা ছেলেবেলা স্কুল খেলাধুলো থেকে শুরু করে এই বুড়ো বয়েসের গোপনীয় কথা পর্যন্ত। তারপর যা হল সেটাই মজার। হাজরা আমায় বলল, ‘আপনি কী হামেশাই স্বপ্ন দেখেন?’
‘স্বপ্ন! দেখি।’
‘কিসের স্বপ্ন?’
‘মানে! যখন যা এসে পড়ে দেখি।’
‘পশুপাখির স্বপ্ন দেখেন?’
‘কই না। পাখিটাখির দেখি না। কুকুর বেড়াল দেখলেও দেখতে পারি।’
‘আচ্ছা গাছপালার স্বপ্ন?
‘আলাদা করে নয়। মনে হচ্ছে না।’
‘ফুলটুলের?’
‘না। একদিন দেখেছিলাম। মনে আছে। অন্য কিছু মনে নেই।’
‘ধন্যবাদ। …কিছু একটা দেখলে ভাল করতেন। গাছ পাখি ফুল—এসব স্বপ্ন তো আমাদের জীবন থেকে মুছে যাচ্ছে। …মেয়ের স্বপ্ন দেখেন?’
‘দেখি।’
‘কেমন মেয়ে?’
‘কেমন মেয়ে! এমনি মেয়ে— রাস্তা ঘাটে যেমন দেখা যায়।’
‘আলাদা কিছু নয়।’
‘না। …না তবে …না কিছু নয়।’
“আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত। আবার একদিন, বসব, আপনাকে নিয়ে। আপাতত আপনাকে কোনো ওষুধ দিচ্ছি না। ঘুম না হলে যা খাচ্ছিলেন খাবেন, বেশি খাবেন না। বী নরম্যাল। স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে যা প্রাণে চায় করুন, ঘাবড়াবেন না।’
ডাক্তারের কাছ থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা কী? কথা নেই বার্তা নেই, আমার সঙ্গে কোনো আলোচনাই হল না, তুমি দুম করে এক মাথার ডাক্তার ঠিক করে ফেললে! আমি কী পাগলা হয়ে গিয়েছি নাকি? তাও যদি বা করলে, ওই হাজরা কেন? বেটা যেসব প্রশ্নট্রশ্ন করছিল সবই তোমার দিকে টেনে টেনে। যেন আমি যা কিছু করি সবই বউকে জব্দ করার জন্যে। গায়ের জ্বালাটা তারই ওপর। তা ছাড়া, আপনি ভেবে দেখুন, লোকটার কী অদ্ভুত প্রশ্ন। পাখিটাখির স্বপ্ন দেখেন, গাছপালার স্বপ্ন! আর স্বপ্ন কি আমার হাতে ধরা? ফরমায়েস মতন আসবে? থাকি চণ্ডী ব্যানার্জি লেনে, কাক আর চড়ুই ছাড়া যেখানে পাখির একটা পালকও দেখা যাবে না সেখানে পাখির স্বপ্ন! আর গাছপালা? মশাই, আমাদের বাসস্থানের, যাকে বলবেন রেসিডেন্স—তার একদিকে দে-বাবুর বস্তি; আর অন্যপাশে বার্লির কারখানা। গাছপালা কি বাতাসে জন্মাবে!
কী হল? নিন না, আর-একটু সোডা মিশিয়ে নিন। আপনি বড্ড স্লো। তাড়াতাড়ি শেষ করুন। আমার পাত্র ফুরিয়ে এসেছে। আর এক রাউন্ড দরকার।
যা বলছিলাম, ডাক্তারের কাছ থেকে বেরিয়ে মেজাজ খারাপ ছিল এমনিতেই তারপর সুমনা—মানে আমার স্ত্রী—রাস্তায় নেমেই কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করল, ‘কী বললে গো?’ …প্রথমে কোনো জবাবই দিই নি। হাজরার কথা ভাবছিলাম। ট্যাক্সিতে উঠে আবার যেই সুমনা বলল, ‘ডাক্তার কী বললে গো?’—সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় এক শয়তানি বুদ্ধি এল, সুমনাকে জব্দ করতে হবে; বললাম—‘তোমায় বলতে বারণ করেছে। এমনভাবে বললাম যাতে সুমনার মনে হয়, ব্যাপারটা ভয়ের, শুনলে সে ঘাবড়ে যাবে।’
সুমনা, আমার স্ত্রীর মুখ সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেল, চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। বুঝলাম, সে ভয় পেয়েছে। ভয় পাবারই তো কথা। আমার এমন কিছু হয়েছে বা হতে চলেছে যা সুমনাকে জানানো চলবে না, ডাক্তারের বারণ—এর মানেই হল সুমনার এবার সম্মুখে শমন। বী রেডি ডিয়ার, বৈধব্য আসছে।
মানুষ অন্য পাঁচটা ছোট ব্যাপারে ভয় পেলে চট্ করে আবার সামলেও নেয় খানিকটা। বড় ব্যাপারে ভয় পেলে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে। তবে, আমি দেখলাম—সুমনা বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আমি আরও একটু চালাকি করলাম, মানে ওকে আরও একটু খেলাবার জন্যে বললাম, ‘তোমারই তো চেনা ডাক্তার—তুমি জিজ্ঞেস করলেই পার। তবে তোমায় যদি সত্যি কথাটা বলেন। দেখো।’ ব্যাস্, সুমনার মুখ দেখেই বুঝলাম, ভীষণ দোটানায় পড়েছে। নে, এবার বোঝ।
কই স্যার, শেষ হল! নাঃ, আপনি একেবারে খোকা-মাতাল। আপনাদের মতন লোকের সঙ্গে খেয়ে সুখ নেই। আমি কিন্তু নিচ্ছি, আপনি কিছু মনে করবেন না। এই যে সাধুচরণ…সাধু…সাধুবাবা। শোননা, আমায় আর-একটা দাও। ছোট। সাহেবের এখনও শেষ হয়নি। পরে দিও ওঁকে…।
হ্যাঁ, সুমনার কথা বলছিলাম আপনাকে, তাই না বাগচি সাহেব? আমার কথাবার্তা থেকে হয়ত আপনার মনে হবে–স্ত্রীর সঙ্গে আমার বনিবনা নেই, সুমনার প্রতি, আমার বিরক্তি, ঘৃণা, বিদ্বেষ—এই সব এত প্রচণ্ড পরিমাণে রয়েছে যে আমার মধ্যে যত কিছু উগ্রতা নিষ্ঠুরতা সব কিছু প্রকাশ পায় আমার স্ত্রীর সান্নিধ্যে, তার ওপরেই বর্ষায়। হ্যাঁ, তা মনে হতে পারে।
কিন্তু আমি নিজে ঠিক বুঝতে পারি না। আমার জীবন সম্পর্কে একটু বলি আপনাকে। আমি স্টিল টাউনের ছেলে, সেখানেই মানুষ। বাবা সাহেবভজা, মানে মনিরভজা মানুষ ছিল, বাঙালী সাহেবদের মজা হল, তারা হোল ফ্যামিলি তোয়াজ চায় সাবঅরডিনেটের। বাবা সে-ব্যাপারে কমতি ছিল না। তোয়াজের চোটে বাবা ধাপে ধাপে মাইনে এবং কোয়ার্টার পালটে পালটে শেষে ক্লাস ওয়ান বাংলো কোয়ার্টারে ঠাঁই পেয়েছিল। গোছানো, কৃপণ, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ছিল বাবা। তবে—একটা ব্যাপারে বাবার মনিবরাও বাবাকে দিয়ে হ্যাঁ করাতে পারত না; বাবা ঘুষ খেত না—যে কোনো রকমের ঘুষ হোক, আর নিজের কাজ গোছাবার জন্যে অন্যের নামে মিথ্যে বলত না। হয়ত এই জন্যে বাবার তোয়াজ আরও রেসপেক্টেব্ল হয়ে উঠেছিল। …আমার মা স্টিল টাউনেরই মেয়েদের স্কুলে মাস্টারনী ছিল। মাকে দেখতে গুটগুটে লাগত। মোটা, ফরসা, বেঁটে। এক্কেবারে গোল। মা ডাইনে বাঁয়ে দুলে দুলে হাঁটত, মানে সোজা হাঁটত না। মার বেশ মজা ছিল, কোনো রকমে স্কুলটা করা, আর বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে ছেলের জন্যে হু হু করে কাঁদা।
অযত্নে, অ-নজরে, আড়ালে আড়ালে ছেলেটা মানুষ হচ্ছে না বাঁদর হচ্ছে—বুঝতে না পেরে মা কাঁদত; আর বাবা হিসেব করে বছরে একদিন ছেলেকে ধরে আগাপাশতলা চাবকে দিত। বাৎসরিক ধোলাই। আপনাকে মিথ্যে বলব না, বাবাকেই আমার বেশি পছন্দ হত। বছরে একদিনের হিসেবটা ভাল। মার ছিল তিন শো পঁয়ষট্টি দিনের কান্না। জিনিসটার কোনো এফেক্ট ছিল না।
আমি, বাগচি সাহেব, মজাসে বড় হয়ে উঠেছি। দেখ দেখ, ধর ধর, পড়তে বোস, দাঁত মাজ, দুধ খা, ইংরিজিতে বারো পেয়েছিস কেন—এ-সব বলার লোক থেকেও আমায় কিছু শুনতে হয়নি। মানে রোজ সকাল সন্ধে পেছনে লেগে থাকার ব্যাপার আমার ছিল না। এক আধ দিন তো শুনতেই হবে। স্বাধীনভাবে এবং খানিকটা আড়ালে আবডালে মানুষ হলেও বয়ে যাইনি। ছেলেবেলার বদমায়শি মারপিট হাতাহাতির কথা কেউ ধরে না। পাড়ার দু একটা মেয়েকে পেয়ারা বা কুল ছুঁড়ে মারাতেই বা কী রয়েছে বলুন! দোপাটি বলে একটা মেয়ে ছিল, যেমন রোগা তেমনি মুখরা, তার সঙ্গে আমার পেরেম জমছিল বেশ, মেয়েটা আমার হাত থেকে ভুট্টা কেড়ে নিয়ে খেতে গিয়ে দুটো দাঁত ভেঙে ফেলল। পেরেম চুকে গেল।
হাসবেন না, মশাই। ছেলেবেলা এই রকমই। …এই যে সাধুচরণ, ভেরি গুড্। এবার সাহেবকেও একটা দাও? বড় আর দিও না, সাহেব পাকা নয়, এখনও লারনার লাইসেন্স নিয়ে প্র্যাকটিস করছেন। সিগারেট। নিন স্যার, সিগারেট নিন।
হ্যাঁ বাগচিসাহেব, যা বলছিলাম, আমার যখন স্কুল চলছে—তখন ফট্ করে মা মারা গেল। একেবারে অবিশ্বাস্যভাবে। দোলের দিন—সারা দিন দোল খেলা হয়েছে, রঙে রঙে ভূত। বিকেলে আবির নিয়ে ছুটোছুটি করছি, হঠাৎ শুনি মা উঠোনেই পড়ে গেছে আর উঠছে না। আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না, উঠোনময় শুকনো রঙ, আবিরের গুঁড়ো, কয়েকটা অশ্বত্থ পাতা উড়ছে একপাশে আর তার ওপর মা পড়ে আছে, গায়ে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, মাথার চুল রুক্ষ, চোখের চশমা চোখেই। বাবাকে দেখলাম, মায়ের কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
আপনি হয়ত স্বীকার করতে চাইবেন না। বলবেন, বাচ্চা বয়েসের ভুল। কিন্তু স্যার, আমি বলছি, জীবনের তলায়, অনেক তলায়, মানুষের হয়ত এমন কোনো কথা থাকে যা মৃত্যুর পরই বলা যায়। আমার বাবাকে দেখে সেদিন আমার তাই মনে হয়েছিল।
যাক্ গে, মা মারা যাবার পর বাবা আমাকে হস্টেলে পাঠিয়ে দিল। হস্টেলে থেকে থেকেই স্কুল শেষ করলাম। কলেজের বেলাতেও সেই হস্টেল। তবে আমি স্যার, মফস্বল কলেজের ছেলে ছিলাম। ক্রিশ্চান কলেজ। খুব পুরনো। দারুণ দিন কাটিয়েছি কলেজে। হ্যাপিয়েস্ট ডেজ্ অফ মাই লাইফ। বন্ধুরা এক একটা রত্ন ছিল। এক বেটা ছিল, তার কাজই ছিল ফুটবল মাঠে নেমে কারও না কারও পা খোঁড়া করা, টমাস বলে এক শালা ছিল—নামেই টমাস, ঘোর বামুনের ছেলে, তমসকান্ত থেকে টমাস হয়ে গিয়েছিল—সে-শালা মুখের মধ্যে আগুন জ্বালাতে পারত। আলেয়ার মতন ব্যাপার। জ্বালাত, নেভাত। চন্দন ছিল আরেক রত্ন। কী গানটাই গাইতে পারত। এই রকম আরো জনকয়েক।
সুখের দিন ওখানেই শেষ। কলেজ ছাড়তে না ছাড়তেই বাবা মারা গেল। আহা, কী কষ্ট পেয়েছিল বাবা! গ্যাংগ্রিন। বাবা মারা যাবার পর দেখা গেল, মানুষটা তার জীবনের সঞ্চয়ের আট আনা মঠ-মন্দিরে দিয়ে গিয়েছে। ভেরি স্ট্রেঞ্জ! দেব-বাতিক বাবার ছিল না। এই হল মানুষ। মনে হয়, এক; হয় অন্য।
বাবা মারা যাবার পর আমার খেলা। বলতে ভুলে গিয়েছি—আমি কেমিস্ট্রির লোক। কেমিক্যাল কারখানায় হাতে খড়ি হয়েছিল, আজ এখান কাল সেখান ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত এখন হ্যামলিনে আছি। মশাই, এই যে চাকরি—একপাল কুকুরের সঙ্গে নিত্যদিন খেয়োখেয়ি—এ-বড় ডিপ্রেসিং জব। আমি ওসব পারি না। তুই আমায় সিনিআর করবি কি করবি না, আমি বেটা তোকে ল্যাং মেরে সাইড করে দেব, তোর নামে উড়ো চিঠি দেব—এ-সবে আমি নেই। যা দিবি, নেব। মাইনেটা পয়লা দিস আর পেছনে লাগিস না—তাতেই আমি খুশী। তবে শালা, আমি বেওয়ারিশ মাল নই। কেতাবী বিদ্যে ফলাতে এসো না, ধরাশায়ী করে দেব।
আমার, বাগচিসাহেব, কেরিয়ার টেরিয়ারে কোনো আগ্রহ নেই। কোনোদিন ছিল না। বাবার ঠিক উলটো। পেট ভরাতে, বাড়িভাড়া দিতে, বেঁচেবর্তে থাকতে যা দরকার…ব্যাস্, তার বেশি কিছু নয়। আপনি এই মালখানায় খরচের কথা তুলবেন। না স্যার, আমি মুক্তকচ্ছু হয়ে খাওয়া-দাওয়া করি না এখানে, কদাচিৎ সেরকম হয়। তবে ধরে নিতে পারেন, আমি রেগুলার ভিজিটার। প্রীতি—না প্রীতি কেন, ওই সাধুচরণ, অনাদি, আলি—যাকেই জিজ্ঞেস করবেন সবাই বলে দেবে আমি মাপের বাইরে যাই না। আমার কথা হল, ভদ্রলোকের বেঁচেবর্তে থাকার মধ্যে এটাও পড়ে, দু এক পেগ খাওয়া। তাছাড়া, বাগচিসাহেব, আমার আছেই বা কী, আমি আর আমার বউ সুমনা—আপনি আর কোপনী—এই তো দুজন। ও হে, আমার বিয়ের কথা তো আপনাকে বলা হয়নি। আমার বিয়েও বেশ ড্রামাটিক।
সুমনা আর আমি একদিন একটা ট্যাক্সি শেয়ার করে হাওড়া থেকে ফিরছিলাম। আমি আসছিলাম টাটা থেকে, আর ও খড়গপুর থেকে। কেউ কাউকে চিনি না। হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সির কেচ্ছা তো আপনি জানেন। তা যাই হোক ট্যাক্সিঅলার ঘটকালিতে দু জনকে একই ট্যাক্সি শেয়ার করতে হল। একই রাস্তা। আমি নামব আগে, ও পরে। কেউ কাউকে চিনি না। জাস্ট—আপনি কোত্থেকে আসছেন কোথায় যাবেন—এই পর্যন্ত কথাবার্ত। আর ওই গরম, গাড়ি লেট—এই সব তুচ্ছ কথা। …মশাই, ট্যাক্সিটা করল কী, রেড রোড দিয়ে যেতে যেতে সেরেফ অন্ধের মতন এক গাছের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিল। মনে হয় স্টিয়ারিংয়ের কনট্রোল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল কোনো কারণে। আমি তো বাঁচলাম, সুমনার মাথায় লাগল, কপাল ফেটে রক্ত, দরদর করে। ওর সঙ্গে আবার মালপত্রও ছিল। ভারি কিছু হয় নি, তবু অ্যাকসিডেন্ট। পি জি হাসপাতাল হয়ে সুমনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরতে ফিরতে আমার প্রায় বিকেল হয়ে গেল।
ভাগ্যে যা লেখা আছে, স্যার, তাই ঘটল। সুমনার খোঁজ খবর নিতে গিয়ে আলাপ জমতে লাগল। তারপর মাঝে মাঝে ঘোরা ফেরা দু জনে। শেষে ঘনিষ্ঠতা, এবং বিয়ে।
আপনি কি আর একটা নেবেন? আমি ফর দি লাস্ট টাইম। আজ মনটা বড় এলোমেলো হয়ে আছে। বলতে পারেন, আমার মধ্যে একটা ইমোশন্যাল ডিস্টারবেন্স দেখা দিয়েছে। কেন দিয়েছে, পরে বলছি। আমার এই একতরফা বকবকানির জন্যে আশা করি আপনি আমায় মাফ করবেন। ওই যে সাধুচরণ…। সাধু, কাম হিয়ার। শোনো, আমার জন্যে আর-একটা আনো। ছোট। ব্যাস্। তারপর আজকের মতন সব বন্ধ।
আজকালকার সিগারেটগুলো একেবারে থার্ডক্লাস। শালা ধোঁয়াই আসে না। ধ্যুত্।…যা বলছিলাম, বাগচিসাহেব। সুমনার সঙ্গে আমার বিয়ের পর আজ পনেরো বছর কেটে গেছে। ঠিক ঠিক বলতে গেলে ষোল বছর চার মাস। আমাদের বাচ্চাকাচ্চা নেই। দাঁড়ান মশাই, নেই শুনেই আপনি ভাবছেন—আমি কোনো কম্মের নহ। উহুঁ, ব্যাপারটা তা নয়। বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় সুমনা পর পর দু বার কনসিভ করে, প্রথমবার বোধ হয় চার কি পাঁচ মাসে, আর দ্বিতীয়বার সাত মাসে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। তখনই ডাক্তাররা বলেছিল, চান্স কম। কিসের এক গণ্ডগোল আছে সুমনার। তা ব্যাপারটা আমরা অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছিলাম। কী আর করা যাবে, হবে না। কত কী তো হয় না জীবনে।
আপনাকে ফ্র্যাংকলি বলছি, দ্বিতীয়বার, সুমনাকে যখন নার্সিং হোমে দিয়ে আসি ওর শরীর খারাপ লাগছিল বলে—তখন আমি একটা অন্যায় কাজ করেছিলাম। হয়ত মেনটাল টেনশানের জন্যে। সুমনাকে বিকেলে নার্সিং হোমে দিয়ে আমি সন্ধে নাগাদ রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে আমার এক পরিচিত মহিলার দেখা পেয়ে যাই। তাকে আমি দিদি বলতাম। সেই দিদি আমায় তার বাড়ি নিয়ে যায়, ওয়েলেসলিতে। আমি সেখানে অনেকটা রাত পর্যন্ত ছিলাম। দশ সাড়ে দশ। ভালবাসাবাসি সেরে যখন বাড়ি ফিরে এলাম—শুনলাম—পাশের বাড়িতে নার্সিং হোম থেকে ফোন করেছে ক’বার। সুমনার অবস্থা ভাল নয়।
তা এই ব্যাপারটা একটা গিল্ট্-এর মতন, মানে পাপকর্মের মতন আমার মনে চেপে ছিল অনেকদিন। সুমনাও একসময় সব জানতে পেরে যায়। বুঝতেই পারছেন—দু জনের মধ্যে একটা তিক্ততার সম্পর্ক তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়। তবে সেটা প্রথম দিকে যেমন উগ্র হয়ে দেখা দিয়েছিল পরে আর ছিল না। মানে, ধার ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সুমনাই বা কি এমন ধোয়া তুলসী পাতা ছিল! চুলোয় যাক ও-সব বাজে কথা। আসলে, বাগচিসাহেব, ওই যে একটা ধারণা, হাজরার কথাবার্তা থেকেও আমার যা মনে হল, সুমনার ওপর আমার একটা জাতক্রোধ থেকে গেছে বলেই—তাকে জব্দ করার জন্যে এই অশান্তি আমি করি—আমি কিন্তু তা মনে করি না। মানি না, স্যার। আই ডোন্ট অ্যাডমিট অ্যান্ড অ্যাকসেপ্ট।
মশাই, আমি আপনাদের কেতাবী বিদ্যেবুদ্ধি ধরি না। কিন্তু আমি বেটা আজ পঁয়তাল্লিশ বছর একটা জীবন তো কাটালাম। আমার কথা হল, এ ম্যানস্ লাইফ ইজ নট্ এ ডগস্ লাইফ্। কুত্তারা, সে যেমন কুকুরই হোক, বাড়িতে থাকলেই ঘেউ ঘেউ করবে। খানিকটা তার স্বভাব, খানিকটা শিক্ষা। মানুষের বেলায় তা নয়, নেভার। সংসারে আমরা হরদম চেঁচামেচি, ফাটাফাটি করি, রাগারাগি হামেশাই হয়—তা বলে সেটা ওই কুকুর জাতীয় নয়। আমি যোল বছর সুমনাকে নিয়ে ঘর করছি আর কুকুরের মতন ঘেউ ঘেউ করছি—তা হতেই পারে না। কুকুররা স্যার, ব্যথা পায়, মনিবের জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকে, মনিবকে দেখলে লেজ নাড়ে। কিন্তু মানুষ! মানুষ ব্যথার চেয়েও শতগুণ যা বেশি তাও পায়। তাকে কী বলে বাগচি সাহেব, জানেন? আমিও জানি না। তবে এই মানুষই বিষণ্ণতা বোধ করে দিনের পর দিন, সে মনের মধ্যে কোনো তেপান্তরে যেন একা ঘুরে বেড়ায়—সঙ্গী পায় না, মানুষ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, তার বুক ভারি হয়, গলা টনটন করে। কেন? এসব কেন? কার জন্যে? কিসের জন্যে?
সুমনার ওপর আমার স্থায়ী কোনো রাগ, বিদ্বেষ, ঘৃণা নেই। তার শরীরের কলকব্জার গোলমাল নিয়েও আমার কোনো আফসোস নেই। হতেই পারে তার বাচ্চাকাচ্চা হল না। জিনিসটাকে সে নিজের কোলে টেনে নেয় কেন! আমি যা করি, হয়ত-হয়ত-আমার অন্য কোনো অসুখের জন্যে।
স্যার, একটা কথা আপনাকে বলি, ওই হাজরা—আমার স্ত্রীর পছন্দের ডাক্তার, আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি গাছপালার স্বপ্ন দেখেন না! পাখিটাখির স্বপ্ন? ফুলফলের?
আপনিই বলুন—এ-কথার কোনো মানে হয়। আমি মফস্বলের ছেলে—গাছপাল, পাখি, ফুলফল আমার কাছে স্বপ্ন নয়। আপনি কি মনে করেন বাগচি সাহেব, আমাদের এই বাড়ি, অফিস বাড়ি, বাজার, বাস, খবরের কাগজ, অ্যাসিডিটি, মাথাধরা, বিয়ে বাড়িতে মুখ দেখাতে যাওয়া, বউকে নিয়ে দীঘা-ভ্রমণ—এই একঘেয়েমি ও ক্লান্তিকর জীবনের অবস্থা থেকে আলটপকা একঝাঁক পাখির স্বপ্ন বা বনজঙ্গলের স্বপ্ন কোনো রিলিফ? আমি মনে করি না। আমি সেদিনের কথাটা এবার বলি।
সেদিন আমি মাছ ধরতে গঙ্গানগরের কাছে গিয়েছিলাম। আমার মাছ ধরার বাতিক আছে। মানে নেশা। মাছ যত না ধরি তার চেয়েও নিজেকে মেলে ধরি গাছতলায়, লতাপাতার সবুজে, মাটিতে, জলে, ছায়ায়, পাখির ডাকে। ছিপ হাতে সারা দুপুর আমার কেটে যায়। এই রোদ এই মেঘলা, হাওয়া এল সোঁদা গন্ধ নিয়ে, ঘুঘু ডাকছে কোথাও, টপ টপ করে ক’ফোটা বৃষ্টি পড়ল কচু পাতার ওপর আমি বসে থাকতে থাকতে আর আমাতে থাকি না—যেন অন্য কোনো জগতের মধ্যে চলে যাই। …সেদিন, গঙ্গানগরের কাছে এক বড় পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। সকাল থেকে বৃষ্টি লুকোচুরি খেলছিল। আশ্বিনের বৃষ্টি।
এমন পুকুর আমি কম দেখেছি। কেমন যেন লম্বাটে, নদীর কোনো ফালি ঢুকে পড়লে যেমন হয়। গাছপালা অজস্র রকমের। আম, কাঁঠাল, নিম। ঝোপ জঙ্গলে ভরে রয়েছে পাশগুলো। আকন্দ গাছ অজস্র। একেবারে ঘন দুপুর। মেঘলা আকাশ কালো হয়ে এসে এসে আচমকা বৃষ্টি নামল। ছাতা মাথায় রেন কোট গায়ে বসে থাকলাম ছিপ হাতে। বৃষ্টিটা সাদা পরদার মতন পুকুরের চারদিকে উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখি পুকুরের ওপারে কে যেন! কে? ভাল করে দেখা যায় না। অনেক কষ্টে নজর করে দেখি—একটা বাচ্চা মেয়ে, কিশোরী, পরনে শাড়ি জড়ানো, আলগা গা, মাথার চুলগুলো কাঁধে লুটোচ্ছে, যেন বৃষ্টি বাঁচাতে কোনো গাছের পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের সামনে পুকুরের ঘাট, কতকগুলো হাঁস জড় হয়ে আছে পায়ের কাছে। মেয়েটা যেন হাত দিয়ে কী ছড়িয়ে দিচ্ছে হাঁসগুলোর সামনে—আর কী বলছে। হঠাৎ মেয়েটা আমার দিকে তাকাল। কী অপরূপ দেখাচ্ছিল তাকে। আমি তাকে হাত নেড়ে ডেকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, বলতে যাচ্ছিলাম তুমি এই ছাতার তলায় এসো। সে হাত নেড়ে ইশারা করে আমায় কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বৃষ্টির আড়াল, বাতাস আর দূরত্বের জন্যে আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না, বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল সে বলছে, আমার ছাতার তলায় আসতে চায় না সে।
বৃষ্টি যখন থামল, মেয়েটি নেই।
বাগচিসাহেব আপনাকে সত্যি বলছি, তার পরের দিনই বাড়িতে আমি অশান্তি করেছিলাম। কেন করেছিলাম আমি জানি না। আপনি বলুন কেন করেছিলাম।
সাধুচরণ, এসো। এবারটাই আজকের মতন আমার শেষ।