দূরে বাজে

দূরে বাজে

গায়ে হাত দিতে হল না। আলো জ্বেলে মুখ দেখেই বুঝলাম, মা মারা গেছে। ঠোঁট অল্প ফাঁক। সেখানে সামান্য হাসি। এই মুহূর্তে নিজের মৃত্যু ছাড়া এমন কোনও ঘটনা নেই যার জন্য মা হাসতে পারে।

চাদরটা মায়ের গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরোলাম বারান্দায় সারারাত বাতি জ্বলে। মাকে বাড়িতে আনার পর থেকে এমনই ব্যবস্থা। এখনও জ্বলছে। হলুদ আলোয় টানা-বারান্দায় হলুদ রঙের অন্ধকার।

এখন রাত কত! বলা শক্ত। আলো দেখে সময় বলা যায়, অন্ধকার দেখে বলা যায় না। আমার ঘড়ি নেই, বিক্রি করে দিয়েছি। আমার ধারণা ছোড়দাও ওরটা বেচেছে। থাক, সময় দেখে কী হবে? ভোর হলে প্রথমে সুমিদের পাঁচিলে রোদ পড়বে। কাঁচা রোদ। খানিক পরে সেই রোদ আসবে আমাদের বারান্দায়। অন্ধকারেই বাবা বারান্দার কোনায় চৌকির ওপর বসে আছে। রাত থেকেই রোদের জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। চাদরটা গা থেকে খসে পড়েছে পাশে। গেঞ্জির ওপর সাদা হাফহাতা সোয়েটার। নামেই সোয়েটার। সেদিন গুনে দেখলাম, সাতাশ জায়গায় ছেঁড়া। বাবার এই সোয়েটার দেখলে মনে হয়, ছেঁড়াটাই বুঝি ডিজাইন। দুটো সোজা, তিনটে উলটোর মতো কোনও সহজ অঙ্কে কেউ মন দিয়ে ছেঁড়া বুয়েছে। ডিজাইন হিসেবে ছেঁড়া কিন্তু মন্দ নয়। ঠান্ডায় মানুষটা গুটিয়ে আছে। মাথাটা দেয়ালে ঠেকানো। নোনা দেয়ালে মাথা রাখলে ঠান্ডা বেশি লাগারই কথা। বাবারও নিশ্চয় লাগছে। চিমসে মার্কা বুকটা উঠছে নামছে। আহা, ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। বুড়ো মানুষটা নিশ্চয় রাতে ঘুমোয়নি। এত রাতে লোকটাকে ঘুম থেকে তুলে মায়ের মৃত্যুর খবর দেওয়ার কিছু নেই। মরা বাসি হয়, মরার খবর বাসি হয় না।

বাবার ইদানীং টাইম ডাইলিউশনের মতো হয়েছে। সময় গুলিয়ে যাওয়ার অসুখ। মাঝরাতে দরজা খুলে দেখে বারান্দায় রোদ পড়েছে কিনা। বিকেলেই বলে, ‘ফুলি, খেতে দিবি না? রাত অনেক হয়েছে।’ প্রথম প্রথম বিরক্ত হতাম। এখন আর হই না। দুটো রুটি এনে দিই। বলি, ‘এসো বাবা, খেয়ে নাও।’ বাবা পরম আগ্রহে খায়। খেতে খেতে বলে, ‘বিছানা পেতে দে। তমাল ফেরেনি? ছেলেটা এত রাত করে কেন? দিনকাল ভাল নয়।’ বড় মায়া লাগে। আমি বলি, ‘চিন্তা কোরো না বাবা। রাত তো এমন কিছু হয়নি! ছোড়দা ঠিক ফিরবে। ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নাও হাতটা সরাও, একটু তরকারি দিই।’

ছোড়দাকে ডেকে তুলি। কী দরকার তোলার? এই মাঝরাতে কী করবে সে? মরমর হলে একটা কথা ছিল। ডাক্তার, অক্সিজেন, ডেকাড্রন ইঞ্জেকশনের জন্য ছুটতে হত। গরিববাড়িতে ‘মরমর’ ব্যাপারটা মৃত্যুর থেকেও অনেক শোকাবহ। আমি যত দূর জানি, এই মুহূর্তে বাড়িতে কুড়িয়ে বাড়িয়ে তিরিশ-বত্রিশ টাকার মতো আছে। বত্রিশ টাকায় ‘মরমর’ স্টেজ সামলানো যায় না। মনে হচ্ছে, টাকার অ্যামাউন্টটা মা-ও জেনে ফেলেছিল। সেই জন্যই এই স্টেজ মা গোপনে পার করে দিল। কখন মারা গেল জানতেও পারলাম না। ছোড়দাকে আস্তে ধীরে ডাকলেই হবে। আলো ফুটুক, একেবারে চা করে নিয়ে যাই। চা ছাড়া ছোড়দার ঘুম ভাঙে না। একেবারে নবাব চা-দৌল্লা! চা করে বাবাকেও তুলব। তুলে কী বলব? যাক, সময় তো আছে একটা কিছু ভেবে নেওয়া যাবে।

বড়লোকের বাড়ির মৃত্যু হল একটা বড় দুঃখের ব্যাপার, তাড়াহুড়ো তাদের সাজে। সেসব বাড়িতে শ্বাস উঠলেই হইচই শুরু করতে হয়। টেলিফোন নম্বরের ডায়েরি নিয়ে একজন বসে যাবে। এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে খবর। গাড়ি চেপে আত্মীয়রা ছুটে আসবে। যাদের গাড়ি নেই তারা ট্যাক্সি করে আসবে। বাড়ির সামনে কাঁদতে কাঁদতে নামবে। নেমে মিটারের কারচুপি বিষয়ে ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে সিরিয়াস ধরনের ঝগড়া শুরু করবে। কান্না আর ঝগড়ার জয়েন্ট ভেঞ্চারে পাড়াসুদ্ধ মানুষ মৃত্যুর খবর জেনে ফেলবে। দুপুরের মধ্যে একশো কাপের ওপর চা। কাঁকিনাড়ার মেজমামাকে খবর দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি আসতে দেরি করবেন। অপেক্ষা করতে করতে বেলা গড়িয়ে বিকেল হবে। মাঝখানে ছোটদের জন্য ডালসেদ্ধ, ভাত, অল্প কার ঘি। বড়দের জন্য লুচি আলুরদম, একটা করে সন্দেশ। ‘খাব না, খাব না’ বলে মৃতদেহের চোখের আড়ালে গিয়ে প্রত্যেকেই খাবে। গাড়ির ড্রাইভারকে পর্যন্ত খাওয়াবে। খেতে খেতে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করবে, ‘কখন হল রে?’ যেন সময়ের একটু এদিক-ওদিক হলে শোকের পরিমাণ কিছু কম হত।

এ-বাড়িতে এসব বালাই নেই। আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়ে লাভ হবে না। খুব কেউ আসবে না। তা ছাড়া গরিবের বাড়িতে তিন বছরের অসুস্থ মানুষের মৃত্যু কোনও বড় দুঃখের ঘটনা নয়। ছোট দুঃখেরও কি? জানি না। তবে আমাদেরটা জানি। আমরা ঝামেলা মুক্ত হলাম। ধারবাকিতে কিছুদিনের জন্য চাল-ডাল হয়, কিন্তু একদিনের জন্য ও চিকিৎসা না। ফলে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই আমরা অপেক্ষা করেছি। আমি যদি এখন সবাইকে ঘুম থেকে তুলে একটা হইচই বাধিয়ে কাঁদতে বসি, সেটা হবে লোক দেখানো। আমাদের দেখার মতো কোনও লোক নেই।

আমি চা করতে রান্নাঘরে ঢুকলাম। রান্নাঘরে অনেকদিন হল আলো নেই। সুইচ খারাপ। অসুবিধে হয় না। সুইচ কিনে লাগাতে হলে অসুবিধে হত। আজকাল সুইচফুইচের অনেক দাম। রান্নাবান্না দিনের আলো থাকতেই সেরে ফেলি। নইলে বারান্দার আলোই রান্নাঘরের আলো। হাতড়ে কৌটো নামালাম। চা-পাতা নেই, কৌটোয় তলানিতে সামান্য গুঁড়ো পড়ে। থাক, ছোড়দা উঠুক, কেটলিটা নিয়ে মোডের দোকান থেকে চা নিয়ে আসবে।

মাকে হাসপাতাল থেকে জবাব দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে মাসখানেক হল। আর একটু বেশিও হতে পারে। ওষুধ চিকিৎসা যখন ফেল করে তখন রোগীকে হাসপাতাল থেকে শান্তি চিকিৎসার জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারের সকলের মাঝখানে শান্তিতে মানুষ মারা যায়। মৃত্যুর মুহূর্তে সে ভাবে, ‘আমি চলে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু এই চমৎকার পৃথিবীতে এরা রয়ে গেল। এদের মধ্যে দিয়ে আমিও রয়ে গেলাম।’ শুনেছি, এই চিকিৎসায় অসুস্থ মানুষ তার মস্ত রোগ ছুড়ে ফেলে দিতে পারে এবং পুরোপুরি সুস্থ হয়। তখন পরম নিশ্চিন্তে মৃত্যুর পথে সে হাঁটা লাগায়। মায়ের ক্ষেত্রে শান্তি চিকিৎসা কাজে লাগে না। মৃত্যুর মূহূর্তে মা তার পরিবারকে পুরো পাশে পেল না।

বড়দার ঘরে তালা, বাড়ি ছাড়ার সময়ই বউদি চাবি নিয়ে চলে গেল। ওদের পাওয়ার প্রশ্ন নেই। রোজকার মতো কাল রাতেও ছোড়দা আর বাবা পাশের ঘরে শুল। আমি মায়ের ঘরে মাটিতে বিছানা পেতে শুলাম। কালও ছিলাম। কিন্তু আসল সময়টা কেউ জানতে পারলাম না।

বেকার হওয়ার ফলে ছোড়দা ভয়ংকর ব্যস্ত। গত সাত বছর ধরে ও নানাবিধ ব্যাবসার প্রজেক্ট তৈরি করেছে। ডটপেনের রিফিল থেকে সাইবার কাফে। গোড়ার দিকে এসব প্রজেক্ট হত তিন পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় অনেক কাটাকুটি সহযোগে পেনসিল দিয়ে রাফ। দ্বিতীয় পর্যায়ে পেন দিয়ে। তিন নম্বর পর্যায় হল চূড়ান্ত পর্যায়। দামি কাগজে শ্যামবাজার মোড় থেকে টাইপ করানোর পর্যায়। যত দিন যাচ্ছে পর্যায় কম। টাইপ, কাগজ এবং কালির খরচ বেড়ে গেলে আমার কাছে ছোড়দার ধার বাড়ছে। টিউশনি করা বোন আর কতটা টানবে? টাইপের অংশটা বাদ পড়েছে বছর তিন হয়ে গেল। পেন দিয়ে লেখাটাও দেখলাম এখন আর নেই। পেনসিলের রাফই এখন ফাইনাল। রাফ প্রজেক্ট নিয়েই সে কার খোঁজে ছোটাছুটি করে।

বউদি নিয়ম করে দিয়েছে একদিন, বড়দা বউদিকে লুকিয়ে সপ্তাহে দু’দিন এ বাড়িতে আসে। কোনওদিন অফিস ফেরত, কোনওদিন অফিস যাওয়ার আগে দেখা করে ঘুরে যায়। রোজই কিছু-না-কিছু বাজার করে আনে। থলি রেখে দেয় রান্নাঘরে। আমাকে বলে, ‘ফুলি, হরলিক্সটা রাখ। মাকে দিবি। গরম গরম দিবি। এনিথিং হট ইজ গুড ফর হেল্‌থ। নার্ভাস সিস্টেম একটা স্টিমুলেন্ট পায়। দেখবি মা ঝিমুনি ভাবটা রিকভার করবে।’ যাওয়ার পর দেখি, বড়দা টেবিলের ওপর ভুল করে পঞ্চাশ-একশো টাকা ফেলে গেছে। সেই টাকায় আমি চাল আনিয়ে নিই। মায়ের ওষুধ কিনি। বেশি দিনের নয়, দু’দিনের। পয়সা শর্ট পড়লে একদিনের। তারপরও পয়সা বাঁচলে চায়ের পাতা, গুঁড়ো দুধ কিনি।

কাল রাতে ছোড়দা ফিরল এগারোটারও পর। বাথরুমে জল তোলা ছিল। হাত-মুখ ধুয়ে বলল, ‘আজ আর রাতে খাব না ফুলি। তুই খেয়ে নে।’

আমি কড়া গলায় বললাম, ‘ছোড়দা, খেয়ে নে।’

‘বললাম তো খাব না। কালা হয়ে গেলি নাকি?’

‘না হইনি। মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই হব। এ বাড়িতে বেশিদিন থাকলে কালা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। টানাটানির সংসারে কালা হওয়াটাই বেস্ট।’

‘ভেরি গুড। হলেই খবর দিস। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক কালা বউ খুঁজছে। বলিস তো কথা বলি। তবে এর সঙ্গে যদি বোবা হয়ে যেতিস খুব ভাল হত। কালার সঙ্গে বোবা হলে মেয়েদের বিয়ের বাজার দারুণ চড়ে।’

‘বাজে কথা বলিস না। কেন, খাবি না কেন?’ গলা আরও গম্ভীর করলাম।

ছোড়দা হেসে বলল, ‘ধমকাচ্ছিস যে, ভয় করছে।’ ছোড়দার চেহারাটা বেশ খারাপ হয়েছে। এরকম হাফ খেয়ে ক’টা দিন চালালে বিছানা নিতে হবে। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, একবেলা খেয়ে ছোড়দা ফ্যামিলি বাজেট কমাতে চাইছে।

‘বেশ করছি, ধমকাচ্ছি। তোরা ভেবেছিসটা কী বল তো? বাড়িসুদ্ধ সবাই অসুখে পড়বি আর আমি তোদর সেবা করব?’

‘ভালই তো। সেবা করতে করতে তুই একদিন সেবা-বিশারদ খেতাব পাবি। রাজ্যপালের হাত থেকে খেতাব নিবি। কাগজে ছবি, টিভিতে খবর। তখন দেখবি তোর বিয়ের বাজার একেবারে হইহই করে চড়ে গেছে। শেয়ারের মতো। শ্বশুর-শাশুড়ির দল সেবা-বিশারদ পুত্রবধূ পাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি তাদের ইন্টারভিউ নেব। জিজ্ঞেস করব চাঁদের তাপমাত্রা কত? চিনের খাদ্যমন্ত্রীর নাম কী?’

ছোড়দার অনেক বদ অভ্যেসের মধ্যে এটাও একটা। ভয়ংকর ভয়ংকর জিনিস নিয়ে মজা করতে পারে। আমি গম্ভীর হয়েই বললাম, ‘সব ব্যাপার নিয়ে রসিকতা চলে না ছোড়দা।’

‘একেবারেই চলে না। তা হলে তোকে সিরিয়াস কথাটা এবার বলে ফেলি। আমার এবারের প্রজেক্ট ব্যাঙ্কের দারুণ পছন্দ হয়েছে। ওরা ফাইনান্স করতে রাজি। সামান্য এদিক-ওদিক করলেই চলবে। এই ধর রানিং ক্যাপিটালটা একটু কমাব। ডেপ্রিসিয়েশন কস্টটা অ্যাডজাস্ট করতে হবে। আজ ছিল তোর ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা। ফাইনাল কথা বলব না, বললে মিথ্যে বলা হবে। অন্যদের মিথ্যে বলা যায়, বোনকে বলা যায় না। তবে সেমিফাইনাল বলতে পারিস। সামনের সপ্তাহে ফাইনাল কথা হয়ে যাবে। অ্যান্ড দেন আই কান স্টার্ট মাই বিজনেস ডিয়ার সিস্টার। আজ ওদের সঙ্গে ডিনার করলাম। চাইনিজ ডিনার। আরে গাধার বোন গাধানি, পৃথিবীর সব বড় বড় ব্যাবসা ডিনার টেবিলেই ফাইনাল হয়েছে। শুনলি তো সিরিয়াস কথা?’

আমি শক্ত গলায় বললাম, ‘না শুনলাম না। তোর ব্যাবসার কথা হল শ্রেষ্ঠ রসিকতার কথা। আসলে তুই এসব বলে বাড়ি থেকে সারাদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিস। এখন রাতে খাচ্ছিস না, এরপর দিনেও খাবি না।’

ছোড়দা অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’

‘মানে কী তুই জানিস না? আয় খেতে আয়, তারপর মানে বলছি। ঝুরো ডিমের তরকারি করেছি। তোর চিনা রেস্তোরাঁর থেকে ঢের ভাল।’

ডিম ভেজে কুচি কুচি করে কেটে ঝুরো ডিম। হোড়দার হট ফেবারিট। ছোড়দা কথা না বাড়িয়ে খেতে বসল।

ঝুরো ডিমের তরকারি করতে পারলাম বড়দা দুপুরে এসেছিল বলে। নইলে রোজকার মতো সেই আলুরদমই হত। দুপুরে আমি সবে খেয়ে উঠেছি। দরজায় ধাক্কা। খুলে দেখি একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। আমার অফিসার বড়দা দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ব্রিফকেস। এক হাতে ঠোঙা। নীল জামা থেকে হলুদ রঙের ডিমের কুসুম গড়াচ্ছে। হাতের ঠোঙা ভিজে গেছে। বোকার মতো হেসে বড়দা বলল, ‘ডিম মনে হচ্ছে ফেটে গেছে। তাড়াতাড়ি ধর। স্নান করতে হবে। ইস কী ঝামেলা। হ্যাঁরে জল আছে তো?’

ঝামেলা তো সত্যিই। কিন্তু বড়দা মহা আনন্দে সেই ঝামেলার মধ্যে ঢুকে পড়ল। উঠোনের টিউবওয়েল নিজেই টিপে জল তুলল। কত দিন যে সে এই বাড়িতে স্নান করেনি। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই তো চলে গেল। আজ মনে হয় বড়দা হাফ ছুটি নিয়েছে। বউদিকে লুকিয়ে আসতে হলে হাফ ছুটি ছাড়া উপায় নেই।

স্নানের পর বড়দাকে ছোড়দার পাজামা-পাঞ্জাবি এনে দিলাম। সেগুলো মহা আনন্দে পরতে পরতে বড়দা বলল, ‘ইস, তমালের এগুলো তো দেখছি ভিখিরি পরারও অযোগ্য হয়ে গেছে রে ফুলি। নিজেকে কেমন ভিখিরির মতো লাগছে। ভিখিরিটার জন্য নতুন একসেট এনে দিতে হবে।’ তারপর ছোড়দার আরও ভিখিরি মার্কা একচিলতে আয়নাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যত্ন করে চুল আঁচড়াল। বললাম, ‘এসো বড়দা, ভাত খাবে এসো।’

‘না না, সকালে ভাত খেয়ে অফিসে বেরিয়েছি। একটু ফাঁক পেলাম, ভাবলাম, যাই মাকে দেখে যাই। ভাতটাত কিছু লাগবে না। মা কেমন আছে?’

‘মনে হচ্ছে, আজ একটু ভাল। সকালে হাফ কাপের মতো হরলিক্স খেয়েছে।’

‘ভেরি গুড। তুই দ্যাখ যদি একটু চা করে দিতে পারিস। চা খেয়েই পালাব।’

বড়দা পালাল না। আমি ভাত বসালাম। বড়দার আনা ডিম দিয়ে ডালনা করলাম। ঝুড়িতে তিনটে আলু ছিল, বড় বড় করে কেটে দিলাম। গরম ভাত আর ডিমের ডালনা দিয়ে বড়দা ভাত খেল। বলল, ‘জঘন্য বানিয়েছিস ফুলি! মুখে তোলা যাচ্ছে না। তোর হাতের রান্নাটা একেবারে গেছে। দে আর একটু ঝোল দে।’ দু’বার ভাত চেয়ে সেই ‘জঘন্য’ রান্না চেটেপুটে খেল বড়দা। বড়দা ঠিক করেছিল খাওয়ার পরই চলে যাবে। যাওয়া হল না। হবে কী করে? জামা কাচতে হবে না? ওই জামা পরে গেলে বউদির কাছে ক্যাচ এক্কেবারে কট। একে তো অফিসে ছুটি নিয়ে এ-বাড়িতে আসার অপরাধ। তার ওপর আবার ডিম নিয়ে ভাই-বোনের বাসায় আসা। আদিখ্যেতার চরম। বাপ রে! ছোড়দার খাটে শুয়ে বড়দা ঘুমোল, আমি জামা কেচে ছাদে মেলে দিয়ে এলাম। ঘুম থেকে উঠতে চা দিলাম। বড়দা খাটে বসে দুধ ছাড়া সেই চা খেল। মায়ের কাছে গেল। বিকেলে যাওয়ার সময় বলল, ‘বুঝলি ফুলি, মাঝেমধ্যে এইভাবে চলে আসব ভাবছি।’ আমি চুপ করে রইলাম। এখানে এলে বাবাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে বড়দা। কাল বারান্দায় বাবার মুখোমুখি হয়ে গেল। বাবা বলল, ‘কী রে এত ভোরবেলা কোথা থেকে এলি? তাড়াতাড়ি যা, অফিসের দেরি হয়ে যাবে।’

বাবা আর ছোড়দাকেও ভেবেছিলাম ডালনা করে দেব। হল না। তেলের পজিশন শর্ট। আলুও মাত্র একটা পড়ে ছিল। অগত্যা ঝুরো ডিমের তরকারি। তেল কম লাগল। একটা আলুই চিরে দিলাম।

ছোড়দার সঙ্গে আমিও থালা নিয়ে বসলাম।

‘ডিম কে দিয়েছে বল তো ছোড়দা?’

ছোড়দা গম্ভীর মুখে বলল, ‘মনে হচ্ছে মুরগি।’

‘মুরগি ডিম দিলেও এ-বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনবে না। দুপুরে অফিস পালিয়ে বড়দা এসেছিল। ভিম নিয়ে এসেছিল। ঠোঙার ভিতর ডিম ফেটে বড়দার জামায় লেগে কেলেঙ্কারির একশেষ। মা খানিকটা ভাল আছে দেখে স্নানটান করে ভাত খেল। অনেক দিন পরে বড়দা এ-বাড়িতে ভাত খেল। খুব ভাল লাগছিল। তুই থাকলে পারতিস। সবাই মিলে বেশ খেতাম।’

‘আর একটু তরকারি দে। তোর ভাল হলেও বড়দার মনে হচ্ছে খুব খারাপ হল।’

‘কেন?’

‘বড়দা এখানে চাল ডিম নিয়ে আসছে ভাল করছে না। মনে হচ্ছে, খুব শিগগিরই বউদির হাতে ধরা পড়বে। স্বামীরা আটআনা পয়সা লুকিয়ে খরচ করলেও বউয়েরা টের পেয়ে যায়। স্বামীর টাকাপয়সার প্রতি স্ত্রীদের একটা অসীম শ্রদ্ধাভক্তি তৈরি হয়। একে বলে পয়সাব্রতা। ভেরি কমন জিনিস। যে স্ত্রী যত বেশি পতিব্রতা হবে, সে তত পয়সাব্রতা হয়। চিন্তা করিস না ফুলি, তোর বিয়ে হোক তুইও হবি। তবে এইসব ডিমফিম বড়দাকে আনতে বারণ করে দিস। দরিদ্র এবং অসুস্থ বাবা, বেকার ভাই, বিবাহযোগ্যা বোন পর্যন্ত বউদি সহ্য করেছে। শুধু শ্বশুরগৃহ ত্যাগ করেছে। ডিমের খবর শুনলে নির্ঘাত ডিমোর্স করে বসবে। তার জন্য দায়ী থাকব আমরা। আর একটা রুটি দে। রুটি আছে না খতম?’

আমি ছোড়দাকে রুটি দিয়ে বললাম, ‘ডিমোর্সটা কী জিনিস?’

‘ডিমোর্স হল ডিমের জন্য ডিভোর্স।’

‘বড়দাকে আনতে বারণ করলে আমাদের চলবে কী করে? খাবি কী একবার ভেবে দেখেছিস? বাবার পেনশন আর আমার ক’টা টিউশনি। তাও পড়ার টিউশনি নয়, গানের টিউশনি। এতে কতটা চলে? অর্ধেকের বেশিটাই তো মায়ের জন্য লাগছে। এর মধ্যে তুই যদি না খেয়ে অসুখ বাধিয়ে শুয়ে পড়িস, তখন কী হবে?’

ছোড়দা এ প্রসঙ্গে না ঢুকে বলল, ‘ভাল মনে করিয়েছিস ফুলি। ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে কথায় কথায় সেদিন গানের কথা বলছিলাম। বললাম, আমার মা ফ্যান্টাস্টিক গাইত। সন্ধেবেলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে মা আমাদের তিন ভাইবোনকে গান শেখাত। নূপুরও বেজে যায় রিনি ঝিনি, আমার মন বলে চিনি চিনি। বড়দা ‘বেজে যায়’-তেই আউট হয়ে গেল, আর আমি ফেল মারলাম ‘চিনি চিনি’-তে। তবে আমাদের বোন এখনও লড়ছে। গানটান শেখায়ও। ভদ্রলোক তো লাফিয়ে উঠল। বলল, বলেন কী মশাই? আমার মেয়েদুটোর গলা একদম হাঁড়াচাচার মতো। গানের এক টিচার রেখেছিলাম, সাতদিনের মধ্যে পালাল। আপনার বোনকে প্লিজ একটু বলুন। কী রে ফুলি বলব? নরেন্দ্রপুরের কাছে থাকে। শেখাবি?’

‘না— শেখাব না। মায়ের যা অবস্থা তাতে অত দূর এখন যাওয়া যাবে না। বাবাও তো ভাল নেই। সেদিন বারান্দায় পড়ে যাচ্ছিল। তার ওপর তুইও বাড়িতে থাকিস না।’

‘বাড়িতে আসতে বলব? ওদের গাড়িফাড়ি আছে। ঘণ্টাখানেক সা গা মা করবি। চারশো ক্যাশ নিয়ে নিবি।’

‘লাভ নেই। বাড়িতে গান শেখানো যাবে না।’

‘কেন? শেখানো যাবে না কেন?’

‘হারমোনিয়াম নেই।’

‘কেন হারমোনিয়ামের কী হল? সেদিনও তো দেখলাম প্যাঁ প্যাঁ করছিস। গেল কোথায়?’

‘বিক্রি করে দিয়েছি।’

‘কেন?’

আমি ছোড়দার চোখের দিকে সরাসরি তাকালাম। বললাম, ‘শনিবার ডলি বন্দনারা এসে খুব ধরল। বলল, চল ফুলি সিনেমায় যাব। সিনেমা দেখে বাইরে কোথাও খাব। আমি বললাম, চল, অনেকদিন সিনেমাও দেখিনি, বাইরেও খাইনি। কিন্তু টাকা কোথায়? ব্যস, হারমোনিয়ামটা বেচে দিলাম। ভাল দামেই বেচেছি। সাড়ে তিনশো। খারাপ করেছি ছোড়দা? ডলি বন্দনাদের চিনিস তো? এমা, চিনিস না? আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত। দুটোরই ভারী সুন্দর বিয়ে হয়েছে। বন্দনার ছেলেটা নাকি এখন এত্ত বড়।’

ছোড়দা অবাক। আমি হাসলাম। বললাম, ‘কী বিশ্বাস হচ্ছে না তো? জানতাম হবে না। দ্যাখ ছোড়দা, সবাইকে মিথ্যে বলা যায়, দাদাকে বলা যায় না। যা রাত হয়েছে শুতে যা।’

হারমোনিয়ামের কথা উঠতেই গানের কথা মনে আসা উচিত। আমার আসছে না। আমার মনে আসছে টাকার কথা। সন্ধ্যার বাড়ি থেকে একবার ঘুরে এলে কেমন হয়? সন্ধ্যা আমার গানের ছাত্রী। সপ্তাহে দু’দিন যাই। একদিন নজরুল, একদিন অতুলপ্রসাদ। একশো টাকা মাইনে। মাইনের এখনও অনেকদিন বাকি আছে। গিয়ে যদি বলি, ‘একটু আগে আমার মা মারা গেছে। এ-মাসের টাকাটা আজ দিয়ে দিলে বড় সুবিধে হত। কিছু খরচ তো হবেই?’ দেবে না? মনে হয় না দেবে। এর আগে একবার চেয়েছিলাম, অর্ধেক দিয়ে বলেছিল, ‘দিদিমণি, এভাবে হুটহাট টাকা চাইলে বড় অসুবিধে হয়।’

অনেকটা সময় গেল, যাই ছোড়দাকে ঘুম থেকে তুলি। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাবা একইভাবে বসে ঘুমোচ্ছে। ঘুম মনে হচ্ছে আরও গাঢ় হয়েছে। আমি মুখের দিকে তাকালাম। কতদিন ভাল করে যে বাবার মুখের দিকে ভাল করে দেখি না! ঘুমন্ত মানুষের মুখ হল সুখী মুখ। বাঃ বাবাকে খুব সুন্দর লাগছে তো! আলো ফুটতে আর বোধহয় দেরি নেই। অন্ধকার ঝাপসা হয়ে আসছে। কোথাও কি কাক ডাকল? মনে হয় ডাকল। ডাকুক, কাক ডাকতে শুরু করুক। বাড়িটা বড় চুপচাপ মনে হচ্ছে। একটা হাওয়া দিচ্ছে। শেষ রাতের এই হাওয়া হল অসময়ের হওয়া। অসময়ের হাওয়া ভাল হয় না। এই হাওয়ায় নানারকম শব্দ শোনা যায়। পাতার শব্দ, জলের শব্দ। সব শব্দ সত্যি নয়। কিছু মিথ্যে শব্দও থাকে। যেমন এখন শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দূরে কোথায় হারমোনিয়াম যেন বাজছে। অনেক দূরে।

একী! আমার চোখে জল নাকি? আঁচল দিয়ে তাড়াতাড়ি মুছতে গেলাম। কী কাণ্ড? ছোড়দা যদি হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে? এসে দেখবে আমার চোখে জল। ইস! কী বিচ্ছিরি যে হবে তখন। অথচ আমি একটা মজার কথা ভেবে রেখেছি! ও যেমন সিরিয়াস জিনিস নিয়ে রসিকতা করতে পারে, তেমনই আজ প্রমাণ করব, আমিও কম যাই না। প্রতিদিনের মতো আজ সকালেও নিশ্চয় চোখ খুলে ছোড়দা আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘মা কেমন আছে রে ফুলি?’ তখন আমি হাসিমুখে বলব, ‘মা ভাল আছে। একটু আগে মারা গেছে।’

চোখে জল নিয়ে এ-কথা আমি বলব কেমন করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *