দূরের ম্যাজিক
এইমাত্র গোপন সূত্রে খবর পেলাম, আগামী শনিবার ম্যাজিশিয়ান অর্জুন সেন আমাদের বাড়িতে আসছেন। তিনি অল্প কিছুক্ষণ থাকবেন। গল্প করবেন। চা বিস্কুট খাবেন। অনুরোধ করলে কয়েকটা ম্যাজিক দেখাতে পারেন। খবর বিশ্বাস না হলে বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।
এই চিঠি বাবলার। বাবলা আমার খুড়তুতো ভাই। সাত দিন হল ওর সঙ্গে আমার সঙ্গে ঝগড়া চলছে। ঝগড়ার বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঘুড়ির লেজ। কথা কাটাকাটি দিয়ে শুরু হলেও ঝগড়া শেষে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। আমি চুপচাপ ছাদ থেকে নেমে আসি এবং ভূগোল বই খুলে পড়তে বসে যাই। ঘোর বিকেলে গলা ফাটিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ু পড়বার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। তবু পড়তে লাগলাম। আসলে এর পিছনে আমার একটা অন্য মতলব ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে মতলব কাজে দিল। আমাকে পড়তে দেখে কাকিমা ছাদে উঠে গেলেন এবং বাবলাকে কান ধরে নীচে নিয়ে এসে অঙ্ক করতে বসিয়ে দিলেন। আমি মুখ টিপে হাসলাম।
তারপর থেকেই বাবলা আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে কথা বন্ধ মানে তো এমন নয় যে, আমাদের কোনও কথা নেই। অবশ্যই আছে, সেসব খুবই জরুরি কথা। বাধ্য হয়েই সেগুলো আমাদের বলতে হচ্ছে চিঠি লিখে। এই চিঠি দেওয়া-নেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছে টুম্পা। টুম্পা আমাদের জেঠতুতো বোন। ক্লাস ফাইভে পড়ে। মুখটা বোকার মতো করে রাখে, আসলে দারুণ বুদ্ধিমতী। আমাদের কথা বন্ধে সে খুবই খুশি। কারণ, চিঠিপিছু সে আমাদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক পাচ্ছে। নানা ধরনের পারিশ্রমিক। হজমি গুলি, মৌরি লজেন্স, পুতুলের মাথার ফিতে। চিঠি আর্জেন্ট হলে পরিশ্রমিক দামি। ড্রয়িংখাতা, প্যাস্টেল।
আমাদের বাড়িটা খুব বড়। সামনে খানিকটা বাগান, ভিতরে ছড়ানো উঠোন আর উপরে বড় ছাদ। কলকাতার পুরনো ধরনের বাড়ি যেমন হয়। আমাদের বাড়ি যেমন বড়, তেমন আমরা থাকিও একসঙ্গে অনেকজন। কাকারা থাকেন তিনতলায়। সেখানে টানা বারান্দা। বারান্দার পাশেই ছোড়দি বড়দির ঘর। বর্ষার সময় এই বারান্দায় আমি আর বাবলা ক্রিকেট প্র্যাকটিস করি। দিদিরা বারণ করলেও শুনি না। জেঠুদের চারতলায় আছে মেজদার কম্পিউটার ঘর। আমি, বাবা, মা থাকি দোতলায়। দোতলায় খাবার জায়গা। রাতে আমরা বাড়ির সবাই সেখানে একসঙ্গে খেতে বসি। একতলায় বসবার জন্য দুটো বড় বড় ড্রইংরুম রয়েছে। একটায় টিভি চলে, অন্যটা মাস্টারমশাই এলে আমরা পড়তে বসি। এটা খুব সুবিধের। পড়বার সময় আমরা কান খাড়া করে টিভিতে খেলার কমেন্ট্রি শুনি, পারলে গানটানও শুনি। মাস্টারমশাইও শোনেন। মুখে অবশ্য বিরক্তি দেখান।
আমাদের বাড়ি হইচইয়ের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু কিছুদিন হল, একটা থমথমে ভাব চলছে। রাগরাগ ব্যাপার। শুধু আমার আর বাবলার নয়, এই মুহূর্তে এই বাড়ির অনেকের মধ্যেই কথা কাটাকাটি, মান অভিমান, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ছোড়দা বলেছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা যেমন বাড়িতে ঢুকলে সবাইকে পাকড়ায়, আমাদের বাড়িতেও এখন সেরকম হয়েছে। রাগারাগির ইনফ্লুয়েঞ্জা সবাইকে ধরেছে। ছোঁয়াচে অসুখ।
স্কুলে ছুটি চলছে। পড়ার চাপ কম। হাতে অজস্র সময়। এই সুযোগে আমি একটা কাণ্ড করেছি। একটা লাইন-টানা খাতায় বাড়ির সকলের রাগারাগিগুলো গুছিয়ে লিখে রাখার চেষ্টা করছি। অনেকটা অসুখের কারণ আর লক্ষণের মতো। কাজটা কঠিন। তথ্য সংগ্রহের ব্যাপার আছে। একা সবটা পারছি না। সেইজন্য টুম্পার মারফত বাবলার কাছে মাঝেমধ্যেই সেই খাতা পাঠাতে হচ্ছে। বাবলা মতামত লিখে দিচ্ছে।
এখন পর্যন্ত যতটা লেখা হয়েছে, তা এরকম—
(১) ঘুড়ির লেজ: সম্প্রতি আমার এবং বাবলার মধ্যে ঘুড়ির লেজ নিয়ে মারপিট হয়েছে। সেদিন বাবলা ঘুড়ির লেজ লাগাতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি। বাবলার মতে, লেজ লাগালে ঘুড়ির দাপট বাড়ে। আমি বলছি, লেজ থাকলে ঘুড়িয়ে হনুমানের মতো দেখায়। এই নিয়ে গোলমাল।
লক্ষণ: ঝগড়া, ঘুড়ি ছিঁড়ে ফেলা, মারপিট এবং কথা বন্ধ।
বাবলার সংযোজন: বিকেলে সবাইকে শুনিয়ে ভূগোল পড়তে বসা খুবই অন্যায় হয়েছিল। সব কিছুর ক্ষমা আছে, এর কোনও ক্ষমা নেই। আছে শুধু ভয়ংকর প্রতিশোধ।
(২) কম্পিউটার: বাবলার মেজদা এবং আমার ছোড়দির মধ্যে গত সোমবার সন্ধেবেলা কম্পিউটারের দখল নিয়ে বড় ধরনের একটা ঝামেলা হয়েছে। ছোড়দি বলেছিল, কম্পিউটারে সিডি চালিয়ে সিনেমা দেখবে। মেজদা তেড়ে গিয়ে বলছে, কম্পিউটার কি তোর সিনেমা হল? আমি এখন ইন্টারনেট খুলব।
লক্ষণ: মেজদা আর ছোড়দি কথা বলছে ঠিকই কিন্তু কেউ কারও মুখের দিকে তাকাচ্ছে না।
বাবলার সংযোজন: মনে হচ্ছে না, এই ঝামেলা সহজে মিটবে। মুখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলা খুব কঠিন ঝামেলা। সহজে মেটে না।
(৩) সম্ভবত কানে দুল: বড়দির সঙ্গে জেঠিমার রাগারাগির কারণ মনে হচ্ছে, কানের দুল। শোনা যাচ্ছে, জেঠিমার দেওয়া একটা কানের দুলের ডিজাইন নাকি বড়দির পছন্দ হয়নি। বড়দি সেই দুল পরছে না। তাতেই জেঠিমা খেপে আগুন। তবে এই খবর টুম্পার। খবর ঠিক নাও হতে পারে।
লক্ষণ: মুখোমুখি হলেই দু’জনে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।
বাবলার সংযোজন: শুধু মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে না, কাল বিকেলে বড়দিকে দেখে জেঠিমা ছাদ থেকে নেমে গেছেন।
(৪) বড়ি: কাকিমা আর আমার মায়ের মনোমালিন্যের ইসু হল, বড়ি। সোমবার রান্না করবার সময় দেখা গিয়েছিল, স্টকে বড়ি বেশি নেই। কাকিমা ট্যাংরা মাছের ঝোলে বড়িগুলো দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মা চেয়েছিলেন বড়ি যাক শিম-আলুর তরকারিতে। এই নিয়ে অভিমান।
লক্ষণ: অনেক বড়ি আনা হয়েছে এবং সব খাবারেই আমরা এখন বড়ি পাচ্ছি। এত বড়ি, অসহ্য লাগছে। কিছু করার নেই। মা-কাকিমার ঝামেলা না মিটলে, বড়ি-অত্যাচার থেকে মুক্তির কোনও উপায় নেই। এ বাড়ির রান্নার ইনচার্জ ওঁরা দু’জনেই। কোথায় বড়ি থাকবে, কোথায় থাকবে না, সে সিদ্ধান্ত ওঁদেরই মিলিতভাবে নিতে হবে।
বাবলার সংযোজন: আর সহ্য হচ্ছে না। আরও দুটো দিন দেখব, তারপর আমি বড়ির ব্যাপারে বিদ্রোহ ঘোষণা করব ঠিক করেছি। সেরকম হলে অনশন পর্যন্ত যেতে পারি।
(৫) মোবাইলের রিংটোন: মেজদির সঙ্গে বড়দির গোলমালের বিষয়, মোবাইল ফোনের রিংটোন। গত মাসে দু’জনে মিলিতভাবে একটা মোবাইল কিনেছে। মিলিত মোবাইল কেনার বিষয়টা নিয়ে বাড়ির সকলেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। ওরা শোনেনি। এদিকে বড়দি পছন্দ করে বাংলা গানের সুরওলা রিংটোন। মেজদি রিংটোনে হিন্দি সিনেমার গান ছাড়া ভাবতেই পারে না। তিন দিন আগে এই নিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড।
লক্ষণ: দুই বোনের ঝগড়া এবং ঝগড়া শেষে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কান্না দু’জনেই কেউ আর মোবাইল ফোনটায় হাত দিচ্ছে না। বাবলার সংযোজন: আমার একটা মোবাইলের খুবই প্রয়োজন। ওরা রেগে গিয়ে জিনিসটা আমাকে দিয়ে দিলে খুবই ভাল হয়।
(৬) জানা যায়নি: অল্প ক’দিন হল, বাবা আর জেঠুর মধ্যে একটা ঠান্ডা গরম সম্পর্ক চলছে। কারণটা জানতে পারিনি, তবে ব্যাপারটা মনে হচ্ছে, সিরিয়াস।
লক্ষণ: রাতে পাশাপাশি দু’জনে চুপচাপ বসে খেয়ে উঠে যাচ্ছেন। ‘হুঁ, হুাঁ’ ছাড়া কথা নেই।
বাবলার সংযোজন: কারণ জানার জন্য মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলেছেন, বড়দের ব্যাপারে ছোটদের ঢুকতে নেই।
(৭) ঠান্ডা চা এবং কালু: রান্নার মাসি কালুর মা এবং ড্রাইভারকাকুর খিটিমিটি এখন চরম পর্যায়ে। ড্রাইভারকাকুর প্রধান নালিশ হল, কালুর মা নাকি তাঁকে ইচ্ছে করে রোজ রোজ ঠান্ডা চা দেয়। অন্যদিকে কালুর-মায়ের অভিযোগ, একদিন দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসার মতো সামান্য অপরাধে ড্রাইভারকাকু নাকি কালুর কান মলে দিয়েছেন।
লক্ষণ: রোজ ভোরে দু’জনে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করছে।
বাবলার সংযোজন: কালু অতি বিচ্ছু ছেলে। শুধু কানমলা নয়, সঙ্গে গালে দুটো চড়ও লাগানো উচিত। ও শুধু গাড়িতে উঠে বসেনি, দীর্ঘক্ষণ ধরে হর্নও বাজিয়েছে।
রাগারাগির খাতা বেশ জমে উঠেছে। এবার আমি খাতায় জেঠু এবং কাকার গোলমালটা নোট করব ভাবছিলাম, এমন সময় টুম্পার হাত দিয়ে বাবলার এই মারাত্মক চিঠি এসে পৌঁছোল।
অর্জুন সেন! অর্জুন সেনের মতো এত বড় একজন ম্যাজিশিয়ান আমাদের বাড়িতে আসছেন। বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। দেশ-বিদেশে সর্বত্র ওঁর খ্যাতি। ওঁর তিন ঘণ্টার একটা ম্যাজিক শো দেখলে ঘোর কাটতে পাক্কা তিন দিন লাগে! গত বছর বাবা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। এক মাস আগে টিকিট কেটেও সামনে সিট পাইনি। ওঁর একটা ম্যাজিক নিয়ে তো বিদেশেও খুব হইচই পড়ে গেছে। জাপানের কোনও একটা পত্রিকায় নাকি লিখেছে: এই খেলাটা উনি প্রতিটা শোয়ের শেষে দেখান। সব ম্যাজিশিয়ান শো শেষ হয়ে গেলে হাঁটতে হাঁটতে স্টেজ থেকে বেরিয়ে যান অথবা সামনে পরদা পড়ে যায়। একমাত্র অর্জুন সেন যান উড়তে উড়তে! সবাই দেখতে পায়, স্টেজ থেকে উনি কয়েক ফুট উপরে ভাসছেন! ভানার মতো হাত নাড়ছেন! উইংসের পাশ পর্যন্ত উড়ে গিয়ে উনি আবার ফিরে আসেন। দর্শকদের বলেন, না, ওদিক দিয়ে যাব না। ওদিকে বড্ড মেঘ। মেঘের ভিতর দিয়ে গেলে জামাকাপড় ভিজে যাবে। আমি বরং এ পাশ দিয়ে যাই।
এই ম্যাজিক দেখে দর্শকরা এতটাই অভিভূত হয় যে, হাততালি দেওয়ার কথাও ভুলে যায়। সেদিন টুম্পা তো বাড়ি ফিরে, রাতে ঘুমের মধ্যে হাততালি দিয়েছিল!
সেই অর্জুন সেন এই বাড়িতে আসবেন। আমি খাতাটাতা ফেলে রেখে তিনতলায় ছুটলাম। তিনতলায় পৌঁছে দেখি, অবাক কাণ্ড! যে দু’জন মানুষ কাল রাতেও খাবার টেবিলে চুপচাপ বসে খাচ্ছিলেন, তাঁরা এখন বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে বসে হেসে হেসে কথা বলছেন। রাগটাগ সব গেল কোথায়! কাছে গিয়ে শুনি, ওঁরা ম্যাজিশিয়ানের আসা নিয়েই কথা বলছেন। শুনলাম, গত সপ্তাহে কাকু একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে অর্জুন সেনও যান। তিনি নাকি বরের দূর সম্পর্কের মামা হন। আধ ঘণ্টায় একশো তিনখানা অটোগ্রাফ দিয়ে হাঁপাচ্ছিলেন ম্যাজিশিয়ান। এই অবস্থায় কাকুর সঙ্গে ওঁর আলাপ হল। তারপরই কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল, কাকু আর অর্জুন সেন ছেলেবেলায় লেখাপড়া করেছেন একই স্কুলে। ব্যস, আড্ডা জমে গেল। স্কুলের বন্ধু বলে কথা! ফেরবার সময় কাকু ওঁকে বাড়িতে আসার নেমন্তন্ন করে বসলেন। অর্জুন সেন টেলিফোন নম্বর, ঠিকানা সব টুকে নিয়ে জানালেন, সময় পেলে অবশ্যই যাবেন। কাকু বাড়িতে কথাটা কাউকে বলেননি। ভেবেছিলেন, সত্যি যদি আসেন, তা হলে সবাইকে দারুণ চমকে দেওয়া যাবে।
সেটাই হয়েছে। কাল হঠাৎ অর্জুন সেনের সেক্রেটারি কাকুকে অফিসে টেলিফোন করলেন। বললেন, শনিবার ইভনিং ফ্লাইটে ম্যাজিশিয়ান সেন মুম্বই যাচ্ছেন। সম্মোহন বিদ্যা নিয়ে কী একটা সেমিনার আছে। এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে তিনি স্কুলের বন্ধুর বাড়িতে খানিকটা সময় কাটাতে চান।
আনন্দ আর উত্তেজনা একসঙ্গে হলে যে কী অবস্থা হয়, সেটা এখন টের পাচ্ছি। কেমন একটা পাগল পাগল লাগছে। ইচ্ছে করছে, সবাইকে ডেকে বলি। বাবা বোধহয় মুখ দেখে আমার মনের কথা ধরে ফেললেন। চোখ পাকিয়ে বললেন, “খবরদার টুলু, ঘটনা যেন জানাজানি হয়। জানাজানি হলে গোটা পাড়া এ-বাড়িতে ভেঙে পড়বে। সবাই ম্যাজিক দেখতে চাইবে। তোর কাকুও বারণ করে দিয়েছে।”
আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এখনই বাবলার সঙ্গে বসতে হবে। এত মজা হচ্ছে যে, বাবলা যদি আজ আমাকে ঘুড়িতে একটার বদলে তিনটে লেজ লাগাতে বলে তাতেও মনে হচ্ছে, রাজি হয়ে যাব।
ছাদে, জলের ট্যাঙ্কের পাশে বাবলা আর আমার মিটিং বসল। মিটিংয়ের মাঝখানে টুম্পা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। সেও খবরটা পেয়ে গেছে। আমাদের ভাব হয়ে গেছে দেখে তার ভেঙে পড়ার কথা। আমাদের ভাব মানে তার হজমি গুলি, লজেন্স বন্ধ। আজ কিন্তু ভেঙে পড়ল না। একগাল হেসে বলল, আমি ওঁকে ট্রেনের ম্যাজিকটা দেখাতে বলব।
আমি টুম্পাকে ধমকে বললাম, একেবারে বোকার মতো কথা বলবি না! বাড়িতে এইসব ম্যাজিক দেখানো যায় না।
বাবলা বলল, আমি দেখতে চাইব গানের খেলাটা।
এই ম্যাজিকটা খুব মজার। ম্যাজিশিয়ান মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যে-কথাই বলুন না কেন, মুখ থেকে বের হওয়ামাত্র সেটা হাওয়া থেকে সুর জোগাড় করে গানের মতো হয়ে যায়। বিরক্তি, রাগ, ধমক— সবই যেন এক-একটা গান! একটা সময় সুরের এই বাড়াবাড়ি দেখে ম্যাজিশিয়ান নিজেই ভেঙে পড়েন। তিতিবিরক্ত হয়ে কাঁদতে শুরু করেন। মজার ব্যাপার হল, সেই কান্নাও সুরের মতো শুনতে লাগে! তখন হাততালি আর হাসিতে হল ভেঙে পড়ার জোগাড় হয়। আমি অবশ্য চাইব, অর্জন সেন ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল’ ম্যাজিকটা দেখান। এই ম্যাজিকে একটা রুমাল বিড়াল হয়ে যাবে। তবে এক সমস্যা আছে। এটার জন্য একটা রুমাল আর একটা বিড়াল লাগবে। রুমাল কোনও সমস্যা নয়। দিদিদের কয়েক হাজার রুমাল আছে। একটা সরিয়ে রাখলেই হবে। কিন্তু বিড়াল? চেষ্টা করে দেখতে হবে।
তিনজন ছাদ থেকে নীচে নেমে এসে শুনি, রান্নাঘরে বিরাট হইচই। মা আর কাকিমার গলা। নিশ্চয়ই বড়ি নিয়ে ঝামেলা আরও ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে। ইস, এই সময় ঝামেলা! ভয়ে ভয়ে আমরা রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। দিয়েই চমকে উঠলাম! হইচই হচ্ছে ঠিকই, তবে সেটা গোলমালের হইচই নয়, আনন্দের হইচই। সব মান-অভিমান ভুলে গিয়ে মা-কাকিমা দু’জনে মিলে মহা আনন্দে অর্জুন সেনের জলখাবারের মেনু ঠিক করছেন। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা মেনু শুনতে লাগলাম। মা বললেন, পাটিসাপটা, গোকুল পিঠে, চিঁড়ের পুলি আর শেষে ছানার পায়েস।
কাকিমা একগাল হেসে বললেন, দারুণ বলেছ দিদি। এর সঙ্গে কেক, চিকেন স্যান্ডউইচ, পিৎজার ব্যবস্থা রাখব।
মা বললেন, কেক কিন্তু তোমাকে ঘরে বানাতে হবে। কেক খেয়ে দেখবে অর্জুন সেন ঠিক তোমাকে একটা সার্টিফিকেট লিখে দেবেন— শ্ৰীমতী কেকের ম্যাজিশিয়ান।
দু’জনেই খুব হাসতে লাগলেন। আমরাও হেসে ফেললাম। মা চোখ পাকিয়ে বললেন, অ্যাই, দরজার আড়ালে কে রে?
বিকেলে দেখি, বড়দি, ছোড়দি সেজেগুজে বেরোচ্ছে। ওদের সঙ্গে বেরোবে বলে টুম্পাও রেডি। বাবলা আমার কানে কানে বলল, যা বাবাঃ, এদের অত রাগারাগি, কান্নাকাটি সব গেল কোথায় রে? এ যে দেখি খুব ভাব! ইস ছোড়দির হাতে মোবাইলটাও রয়েছে দেখছি!
আমাদের দেখে বড়দি চোখ বড় করে বলল, শনিবার তুই আর বাবলা কিন্তু সাবধানে থাকিস। অর্জুন সেনকে বলব, তোদের দুটোকে ভ্যানিশ করে দিতে।
টুম্পাটা মহা পাজি। বড়দির কথা শুনে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল।
ছোড়দি বলল, অ্যাই বাবলা, মা’কে বলে দিস, আমরা এখন ড্রেস কিনতে যাচ্ছি। অত বড় একটা মানুষের সামনে তা যেমন-তেমন পোশাক পরে থাকা যাবে না!
শনিবার সকাল থেকে বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড। কাকু অফিস না-গিয়ে সব তদারকি করছেন। এক-একজনের এক-একটা দায়িত্ব। মা, কাকিমা, জেঠিমা ঘরদোর পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়েছেন। ওঁদের সাহায্যে আছে কালুর মা আর ড্রাইভারকাকু। টুম্পা আমাকে খবর দিয়েছে, কালুর মা এবং ড্রাইভারকাকুর মধ্যে ঝামেলা মিটে গেছে। ড্রাইভারকাকু কালুর মাকে আশ্বাস দিয়েছেন, ম্যাজিশিয়ান এলে কালুকে তিনি ম্যানেজ করে বাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দেবেন। তবে কথাটা আগে থেকে যেন কেউ না জানে। যদিও কথা জানাজানি হয়ে গেছে। কালুর মা নিজেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে।
অর্জুন সেন যে ঘরে বসবেন সেটা সাজাচ্ছে বড়দি। এই কাজে বড়দিকে সাহায্য করছেন জেঠিমা। যে জেঠিমার সঙ্গে দু’দিন আগেও মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছিল, সেই জেঠিমাই এখন হাসিহাসি মুখে বড়দির অর্ডার মতো পরদা, সোফার কভার, টেবিল ক্লথ, ফুলদানি সাপ্লাই করছেন! তবে মেজদা আর ছোড়দির কাজটা সবচেয়ে সুন্দর। ওদের এখন দেখলে কে বলবে, কম্পিউটার নিয়ে কয়েক দিন আগে ওদের মধ্যে একটা বড় ধরনের ঝামেলা হয়ে গেছে? ওরা দু’জনে মিলে কম্পিউটারে চমৎকার করে লিখেছে— ‘আমাদের বাড়িতে জাদুকর সেনকে স্বাগতম।’ এই লেখার একটা প্রিন্ট বের করে দরজায় লাগিয়ে দেওয়া হবে।
সব মিলিয়ে বাড়িজুড়ে একটা খুশি খুশি ভাব। দুপুরে খাওয়াও স্পেশ্যাল। অর্জুন সেনের আসা উপলক্ষে বাড়ির লোকদের জন্যও মা আর কাকিমা অনেক আইটেম রেঁধে ফেলেছেন। সকলে দল বেঁধে বসে পড়লাম। খেতে খেতেই মিটিং চলল। ফাইনাল মিটিং। কাকু বললেন, মনে হচ্ছে, পাঁচটা নাগাদ এসে পড়বেন, সুতরাং চারটের মধ্যে আমরা যেন রেডি থাকি। সবচেয়ে ভাল হয়েছে, বাইরের কাউকে বলা হয়নি। ঝামেলা করার কেউ নেই। দু’-চারটে ম্যাজিকট্যাজিক যদি দেখান, তা হলে তো দারুণ হয়! তবে বেশি আবদার করাটা ঠিক হবে না। হ্যাংলামি মনে হবে।
টুম্পা বলল, বাবা, আমি কিন্তু ওঁর হাতে ফুল তুলে দেব।
বড়দি বলল, সে না হয় দিস, কিন্তু দেখিস, সেই ফুলের গোছ অর্জুন সেন যেন তোর পরীক্ষার মার্কশিট না বানিয়ে দেন। তা হলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে।
সবাই খুব জোরে হেসে উঠলাম।
ছোড়দা বলল, অ্যাই, তোমরা হাসি থামিও না। আমি একটা ফোটো তুলে রাখি। দাঁড়াও, আমি হাতটা চট করে ধুয়ে নিই।
ছোড়দা আজ ফোটো তোলার দায়িত্ব পেয়েছে। ঠিক হয়েছে, অর্জুন সেনকে নিয়ে সে একগাদা ফোটো তুলবে। পুরো একটা সিরিজ। বাড়িতে ঢোকা থেকে একেবারে চলে যাওয়া পর্যন্ত। সেই সিরিজের নামও ঠিক হয়ে গেছে। নাম হবে, ‘আমাদের সঙ্গে অর্জুন সেন।’ আমি আর বাবলা ছোড়দাকে আগে থেকেই বলে রেখেছি, আমাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ফোটো তুলে দিতে হবে। স্কুলে নিয়ে যাব। স্কুলে ফোটো না-দেখালে কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে ছোড়দা দেখছি, সকাল থেকেই ফোটো তুলতে শুরু করে দিয়েছে! বড়দির পরদা টাঙানো, মায়ের পাটিসাপটা তৈরি, কাকিমার পরিবেশন, ছোড়দির ড্রেস রিহার্সাল, আমার আর বাবলার গোপন বৈঠক আর আমাদের সকলের হাসি। পটাপট সব তুলছে।
কাল আমাদের যে ভয়ানক মন খারাপ হয়েছিল, তা এখন আর একটুও নেই। কারণ, আমরা এখন দুটো গাড়িতে চেপে বাড়ির সবাই মিলে বসিরহাট যাচ্ছি। বসিরহাটে বাবার এক বন্ধুর দারুণ একটা নার্সারি রয়েছে। সেখানে আজ আমাদের পিকনিক হবে। কালুকেও সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। তাকে বসতে দেওয়া হয়েছে জানলার পাশে। রবিবারের সকালে রাস্তা ফাঁকা বলে গাড়ি ছুটছে হুহু করে।
আসলে কাল রাতে বাবা চুপিচুপি ফোন করে এই পিকনিকের ব্যবস্থাটা করেছেন। আমাদের মন ভাল করে দেওয়ার জন্যই করেছেন। আমাদের মন অনেকটা ভাল হয়ে গেছেও। গাড়ির পিছনের সিটে বসে ছোড়দি আর বড়দি গান ধরেছে। টুম্পাও গলা মেলাচ্ছে। কাকু যে-ই ওঁর হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠলেন, আমরা সকলে হাততালি দিয়ে উঠলাম।
কাল ম্যাজিশিয়ান অর্জুন সেন আমাদের বাড়িতে আসতে পারেননি। এয়ারপোর্ট থেকে টেলিফোন করে অনেক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কথা দিয়েছেন, আর-একদিন আসবেনই আসবেন। আমরা সকলে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। টুম্পা তো কেঁদেই ফেলল। বাবলা দেখলাম, মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আমারও কান্না পাচ্ছিল। ম্যাজিক দেখা হল না।
এখন কিন্তু অন্যরকম মনে হচ্ছে। ম্যাজিক দেখতে না-পাওয়ার দুঃখটা ঠিক নয়। ম্যাজিশিয়ান অর্জুন সেন বাড়িতে আসতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু ম্যাজিক দেখাতে তিনি ভুল করেননি। সেই ম্যাজিক তিনি দেখিয়েছেন দূর থেকে। এত লোকের রাগ, মান-অভিমান, ঝগড়া, কথা বন্ধ— কীভাবে যেন সব একেবারে ভ্যানিশ করে দিয়েছেন!
অর্জুন সেন সত্যি যদি কোনওদিন আমাদের বাড়িতে আসেন, তা হলে ওঁর কাছ থেকে এই রাগ ভ্যানিশের ম্যাজিকটা শিখে নিতে হবে।
উনি শেখাবেন কি?