দূরদৃষ্টি – মতি নন্দী – উপন্যাস
এক
কণা পরের দিন খবরের কাগজ থেকে সময়টা জেনে হিসেব করে দেখেছিল, যখন সে ন’টা-ষোলোর শেওড়াফুলি লোকাল ধরার জন্য হিন্দমোটর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তখন সফদরজং রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ইন্দিরা গান্ধী আকবর রোডের অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁকে যখন একটা অ্যাম্বাসাডারে অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন শেওড়াফুলি লোকাল স্টেশনে ঢুকেছে। প্রায় আঠারো মিনিট লেট। আট বছর আগে এমার্জেন্সির সময় ট্রেন নাকি কাঁটায় কাঁটায় ছাড়ত আর পৌঁছত, এ কথা কণা প্রায়ই ট্রেনে কারুর না কারুর মুখে শুনতে পায়।
হাওড়া স্টেশনে ঢোকবার আগে সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেনটা বামনগাছি ব্রিজের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকেছিল। হিসেব করে কণার মনে হয়েছে, ওই সময়ই ইন্দিরা গান্ধীকে লিফটে করে ন’ তলায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার আগে ক্যাজুয়ালটি সেকশানে রাখা হয়। তখন এক ডাক্তার তাঁর নাড়ি টিপে কোনো স্পন্দন পাননি, চোখ পরীক্ষা করে দেখেন, মণি বড় হয়ে গেছে এবং নিথর।
জীবের শারীরিক মৃত্যু কখন ঘটে, কণা বছর পাঁচ আগে একদিন তার মা শুভাননাকে এই প্রশ্ন করেছিল। ভদ্রেশ্বরে রামকৃষ্ণ কমলাবালা বালিকা শিক্ষামন্দির নামের মেয়ে স্কুলে শুভাননা প্রধান শিক্ষিকা। জীবনবিজ্ঞান তাঁর নিজস্ব বিষয় কিন্তু বিজ্ঞানের সব শাখাই তিনি পড়িয়ে থাকেন। কণা এই স্কুল থেকেই উচ্চচ মাধ্যমিক পাস করেছে। এখন যতদূর তার মনে পড়ছে, মা বলেছিলেন, মৃত্যুর ঠিক মুহূর্তটি আজও ধরা যায়নি। এই নিয়ে অনেক মত রয়েছে। চলতি ধারণাটা হল, কোনো লোকের হৃদস্পন্দনের শব্দ দু মিনিট না পাওয়া গেলেই মৃত ধরে নেওয়া হবে। আর একটা মত হল, মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হলেই মৃত্যু ঘটে। জীবন-সহায়ক যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্তর দিয়ে কৃত্রিমভাবে কোনো লোকের দেহের দরকারি কাজগুলোকে টিকিয়ে রাখা যায় বটে এমনকি গর্ভে সন্তান থাকলে সে বেঁচেও থাকতে পারে কিন্তু মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা না থাকলে বাঁচার কোনো আশাই থাকে না। মস্তিষ্কের মৃত্যুর একটা লক্ষণ হল নিথর, ছড়িয়ে যাওয়া চোখের মণি যার কোনো রকম প্রতিক্রিয়া আলোয় হয় না। কণা ধরে নিল, যখন সে কলেজ স্ট্রিট বাজারের স্টপে বাস থেকে নেমেছে ততক্ষণে ইন্দিরা গান্ধী মারা গেছেন।
রায় অ্যান্ড ঘোষ পাঠ্য বইয়ের বড় ব্যবসায়ী। তার অন্যতম অংশীদার তারকনাথ ঘোষের সঙ্গে কণার দেখা করার সময় এগারোটা। কণা সরকারি আর্ট কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। নানান পাঠ্য বইয়ের জন্য বিশেষত বিজ্ঞান বিষয়ে, ছবি, ডায়াগ্রাম, অক্ষর, চার্ট ইত্যাদি দরকার হয়। আঁকার কাজ পাবার জন্য মায়ের চিঠি নিয়ে এক সপ্তাহ আগে সে দেখা করেছিল তারক ঘোষের সঙ্গে। বিরাট ডিগ্রিওলা এক অধ্যাপকের লাইফ সায়েন্সের চারখানা বই শুভাননাই লিখে দিয়েছে বেনামিতে আর এরাই প্রকাশক। প্রশ্নোত্তরে উচ্চচ মাধ্যমিক বিজ্ঞানের একখানি বই লেখায় শুভাননা এখন ব্যস্ত। তারক ঘোষ বিব্রত হয়েও কণার প্রতি সহৃদয় ছিলেন।
”বাহ চমৎকার নাম তো, শুভাননার মেয়ে শিশিরকণা, বাবার নাম?…য়্যাঁ তুষার! তাহলে তো তুষারকণা, না না তুষারকন্যা হলেই তো ভালো হত।” তারক ঘোষ এইভাবে শুরু করেছিলেন। তারপর ”মা কেমন আছেন? সেদিন এক আত্মীয়ের ছেলের ভাতে শ্রীরামপুর গেছলাম। ফেরার সময় ভাবলাম একবার নেমে মিসেস সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা করি কিন্তু প্রেসারটা বেড়ে ওঠে…আর ট্রেন থেকে নামলাম না। এখন তো দেবার মতো কাজ কিছু নেই, তুমি দিন সাতেক পর, বুধবারই এসো, এইরকম সকাল এগারটা নাগাদ, আমি তারমধ্যেই এসে যাই।”
তারপর ঘরের কোণে বসা টেবলে ঝুঁকে একটা মোটা খাতায় কাজে ব্যস্ত মাঝবয়সী লোকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ”পবিত্রবাবুকে বলে রাখছি কিছু কাজ যদি তোমায় দিতে পারেন। অনেকেই তো করেটরে, তাদের বিনা কারণে বরবাদ করাটাও তো ঠিক হবে না, সবাইকেই তো দেখতে হবে।”
কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে পূর্বে শেয়ালদার দিকে যেতে রাস্তাটা যেখানে সামান্য বাঁক নিয়েছে তার কিছু ডানদিকে রায় অ্যান্ড ঘোষ। ফুটপাত থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি, তারপরই প্রায় পনেরো ফুট কোলাপসিবল লোহার দরজা, তার পিছনে কাঠের দরজা। সাধারণত এক-চতুর্থাংশ বন্ধই থাকে। বিবর্ণ, ময়লাধরা কাঠের কাউন্টারের ওধারে দুটি লোক টুলে বসে থাকে। র্যাকে নানান আকারের, নানান মলাটের পাঠ্য এবং অন্যান্য ধরনের বইয়ে মেঝে থেকে দশ ফুট উচ্চচতা পর্যন্ত দেয়াল ঢাকা। কাউন্টারের এক প্রান্তে ভিতরের অফিস ঘরে যাওয়ার দরজা, আর একটা দরজা গুদামে যাওয়ার।
কণা পৌঁছে দেখল কাউন্টারে একজন কর্মচারী। রুগণ, ফ্যাকাশে মুখ, আধ-ময়লা খয়েরি পাঞ্জাবিপরা বছর তিরিশের লোকটিকে জানাল, তারকবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে লোকটি ক্ষীণস্বরে বলল, ”আসেননি এখনো।”
বিব্রত হয়ে হাতঘড়ি দেখে নিয়ে কণা বলল, ”এগারোটাতেই আসতে বলেছিলেন।”
”আসবেন, হয়তো ট্রেন লেট আছে।”
”ট্রেনে আসবেন?”
”সোনারপুরে থাকেন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।” পাশের খালি টুলটির দিকে একটু হেলে লোকটি ইঙ্গিত করল। কাউন্টারের কাটা জায়গাটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে কাঁধের ঝোলাটা কাউন্টারের উপর রেখে টুলে বসার সময় কণা বলল, ”পবিত্রবাবু আছেন কি?”
”ভেতরে।”
”যাব ভেতরে?”
লোকটি মাথা হেলায়। কণা ঢোকার আগে দরজা দিয়ে উঁকি দিল।
”আসব?”
পবিত্রবাবু একটা পাতলা বই চোখের সামনে তুলে ধরে চেয়ারে হেলান দিয়ে। চশমাটা টেবলে ছিল, সেটা চোখে লাগিয়ে তিন-চার সেকেন্ড পর এক গাল হেসে বললেন, ”আসুন আসুন।”
ঘরটা যেমন স্যাঁতসেঁতে তেমনি শব্দহীন। মোটা দেয়াল ভেদ করে রাস্তার অবিরাম হরেকরকম আওয়াজ ভিতরে আসে না। দুটি জানালাই ঘরের পিছন দিকে, যার ওপারে একটা উঠোন, তালাবন্ধ ঘরের দরজা আর দোতলা থেকে ঝোলানো শাড়ির কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ঘরে আলো কম। সিলিং ফ্যানটা বন্ধ। কার্তিকের মাঝামাঝি তবু এইসময় কলকাতায় ঠান্ডা অন্তত পড়ে না। গরম লাগছে না বটে কিন্তু পাখাটা ঘুরলে ভ্যাপসা গন্ধটা হয়তো থাকত না।
”আজই আসার কথা ছিল, এই সময়েই।”
পবিত্রবাবু নিজেই জানিয়ে দিলেন। কণা আশা পেল। ঝোলাটা কাঁধ থেকে চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে দিল।
”কী আছে ওতে?”
”কিছু কাগজ, ড্রইং খাতা, পেন্সিল।”
”গবরমেন্ট আর্ট কলেজ, সেই জাদুঘরের পাশে?”
”হ্যাঁ।”
”কোন ইয়ার?”
”থার্ড ইয়ার।”
”কী আঁকা শিখতে হয়?”
পবিত্রবাবুর মুখে শিশুর কৌতূহল। কিন্তু এসব আলোচনার জন্য তো এখানে আসা নয়। কণা অন্য কাজে এলে জবাবে বলত, ‘তারকবাবু কখন আসবেন বলতে পারেন? অথবা উনি তো নেই, আপনাকে তো বলে গেছেন কাজ যদি কিছু…।’
এই লোকটি কাজ দিতে পারে। সুতরাং কণা হুঁশিয়ার হল। পবিত্রবাবুকে অখুশি করাটা ঠিক হবে না।
”অনেক রকম আঁকাই তো আছে। স্টিল লাইফ, অয়েল আর ওয়াটার কালারে পোট্রেট, ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং, অ্যান্টিক স্টাডি।”
”ওরে বাবা, এসবের একটাও বুঝি না। আচ্ছা, এই যে সব সিন-সিনারি দেখি রাস্তার ধারে টাঙিয়ে বিক্রি করে, ওসব আঁকা শিখতে হয়?”
”হয়।”
বহু বছর আগে আমি একটা কিনেছিলুম, হেদোর রেলিংয়ে টাঙিয়ে বিক্রি করছিল। দোকান থেকে ফিরছিলুম, রাত হয়ে গেছল। ঘন নীল রঙের আকাশ; তিনটে নারকেল গাছ, নদী, পালতোলা একটা নৌকো, বিরাট চওড়া নদীর ওপারে গ্রাম, কুঁড়ে ঘরের চালা আর সাদা একটা চাঁদ। নদীর জলে সাদা একটা জোছনা চিকচিক করছে, ওপারটাও ভেসে যাচ্ছে। কী ভালো যে লাগল। আড়াই টাকা দিয়ে কিনে ফ্রেমে বাঁধিয়ে শোবার ঘরে রেখে দিলুম। ওহ, হ্যাঁ, দুটো পাখি ঠিক চাঁদের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, পাখিদুটো কী হতে পারে? আমার ধারণা বক, বউ বলেছিল চখাচখি।”
পবিত্রবাবু জিজ্ঞাসুচোখে তাকিয়ে। কাজের কথার ধার দিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছা দেখাচ্ছেন না। কণা ইচ্ছে করেই হাতঘড়ি দেখল কিন্তু টেবলের ওধারে তার মনোবাসনা পৌঁছল না।
”আপনি বক দেখেছেন?”
”নিশ্চয়, ট্রেনে যতবার চেপেছি, কলকাতা একটু ছাড়ালেই দেখতে পেয়েছি।”
”তাহলে বুঝতে পারছেন না কেন ওটা বক না অন্য পাখি?”
পবিত্রবাবু অপ্রতিভতা কাটাবার জন্যই যেন বললেন, ”আর্টের ব্যাপার তো, কত রকমের কায়দা যে হয়। সিংহ এঁকে কানদুটো খরগোশের মতো করে দিল, মেয়েছেলের বুকটা পেটে, পাছাদুটো বগলে বসিয়ে দিল-এই সেদিন একটা ম্যাগাজিনে দেখলুম। আচ্ছা, কেন এসব করে বলুন তো? সোজা জিনিসটাকে সোজা করে আঁকতে পারে না? এসব কি, ঘোড়ার ডিমের আর্ট!”
কণা স্মিত হাসি মুখে ধরে রাখল। ঠিক তখনই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাউন্টারের কর্মচারীটি দুর্বল গলায় বলল, ”পবিত্রবাবু, ইন্দিরা গান্ধীকে নাকি গুলি করে মেরে ফেলেছে?”
চোখ কুঁচকে পবিত্রবাবু তাকালেন, ঠোঁটদুটো ছুঁচলো করলেন, কী যেন ভাবলেন।
”তোমাকে কে বলল?”
”রাস্তায় বলাবলি হচ্ছে, রেডিয়োতে নাকি বলেছে।”
”কোথায় গুলি করেছে, ওড়িশায় তো গেছেন জানতুম।”
”কোথায় তা জানি না।”
”আচ্ছা, তুমি কাউন্টারে গিয়ে বস। গুজবের তো মা-বাপ নেই, ছড়িয়ে দিলেই হল। প্রাইম মিনিস্টারকে গুলি করা যেন সোজা ব্যাপার, তাঁর বডিগার্ড কটা আছে জানো? মনে আছে ক’বছর আগে জয়প্রকাশ নারায়ণকে জ্যান্তই মেরে ফেলেছিল। কী কেলেঙ্কারি রে বাবা!”
পবিত্রবাবু প্রায় গজগজ করার মতই কথাগুলো বলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন, নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টায়। কণার মনে হল কাজের কথায় আসার এটাই সুযোগ।
”তারকবাবু তো আসেননি। আপনাকে বলেছেন কিছু কি?”
”আঁকার কাজ? আগে কখনো করেছেন?”
”না।”
”জানব কী করে আপনি আঁকতে জানেন।”
”কিছু স্কেচ সঙ্গে আছে।”
”দেখি।”
ঝোলা থেকে স্কেচের খাতাটা বার করে কণা এগিয়ে দিল। চেয়ারে হেলে, জানলার আলোয় ধরে পবিত্রবাবু খাতার মলাট সন্তর্পণে ওল্টালেন। তারপর চশমাটা খুলে টেবলে রেখে সরু চোখে প্রথম পাতায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে পাতা ওল্টালেন।
কণা লক্ষ্য করছিল ওঁর মুখে কী কী ভাবের উদয় হয়। কোন স্কেচটা দেখছেন সেটা ওর মুখ থেকে ধরতে পারা যায় কিনা, এটা বেশ মজার ব্যাপার। মুখটা লম্বাটে, নাকটা উঁচু হয়ে সাঁকোর মতো নেমেছে, কানদুটো ছোট এবং তাতে কাশফুলের মতো পাকা চুল। গালে, ঠোঁটের কোলে গভীর রেখা, সামনের চুল ওঠা, লম্বা গলার নলিটা প্রকট।
দেখতে দেখতে কণার ইচ্ছা হল স্কেচ করে নিতে। থলি থেকে একটা কাগজ বার করে স্কেচবোর্ডে এঁটে, কোলের উপর রাখল। চার কোল পেন্সিলের দ্রুত টানে মুখের অবয়বের বহির্রেখা এঁকে ফেলল।
”এই ভিখিরি ছেলেটার হাতে এটা কী?”
”কোনটে?” কণা মুখ না তুলে জানতে চাইল।
”এই যে ট্রেনের কামরায় গুঁতোগুঁতি মারামারি চলছে ওঠার জন্য আর দূরে দাঁড়িয়ে ছেলেটা, মুখে লম্বা মতো কি একটা।”
”ভেঁপু, তালপাতার। রথের দিনে স্কেচ করা। একটা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছিল ট্রেন ধরতে তখন তার হাতের থলি থেকে পড়ে যায়।”
”টের পেল না?”
”না। মানুষের তখন হুঁশ থাকে না। আপনি সন্ধেবেলায় লোকাল ট্রেনে কখনো চেপেছেন?”
পবিত্রবাবুর খেয়াল হল কণা তার দিকে বারবার তাকিয়ে কী যেন আঁকছে। চেয়ার থেকে উঠে দেখে নিলেন।
”চা খাবেন?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই চিৎকার করলেন, ”অবনী অবনী।” এরপর দরজার দিকে তাকিয়ে, ”দুটো চা, আর ইন্দ্রনাথকে বলে দিও আমারটায় কাল চিনি দিয়েছিল যতটা তার থেকেও যেন কম দেয়, তুমিও খাবে নাকি?…আচ্ছা তাহলে তিনটে বলে দাও, জলদি দেয় যেন।”
কণা আর মুখ তোলেনি। পবিত্রবাবু মুখটা শক্ত করে ফেলেছেন। সন্তর্পণে স্কেচ খাতার পাতা উল্টে বললেন, ”ভালোই হয়েছে। আমাদের একটা নিচু ক্লাসের স্বাস্থ্য বই বেরবে। তাতে কিছু ছবি দেওয়া হবে। আদর্শ গ্রামের, ঝকঝকে তকতকে বাড়ি, রাস্তা, পুকুর, বাগান…দাঁতমাজা, নখ কাটা, চুল আঁচড়ানো মাথা, মশারি টাঙিয়ে শোয়া, আজকাল ম্যালেরিয়া হচ্ছে তো,….শিরদাঁড়া সোজা রেখে পড়তে বসা…খুব ইম্পর্ট্যান্ট এগুলো।”
কণা এবার মুখ তুলে শুনছিল। বলল, ”আমরা ক্লাস টু-তে এসব ছবি দেখেছি।”
অবনী সেই সময় ঘরে ঢুকল। উত্তেজিতস্বরে বলল, ”দোকান বন্ধ করে দিয়েছে ইন্দ্রনাথ। রাস্তায় কী লোক, বেরিয়ে এসে একবার দেখুন।”
”কেন?” পবিত্রবাবু ভ্রূ কুঁচকে চেয়ারে সোজা হলেন।
”ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করেছে বললুম না। বাস-ট্রাম বন্ধ করে দিচ্ছে, দোকানও। আমাদের দরজা বন্ধ করে দোব?”
ব্যস্ত হয়ে পবিত্রবাবু উঠলেন। কণা স্কেচটা হাতে নিয়েই ওঁর পিছন পিছন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল কিছুক্ষণ আগের মহাত্মা গান্ধী রোডটার চেহারা একদম বদলে গেছে। লোকে ভরে উঠেছে রাস্তা। এত লোক এল কোথা থেকে! সবার মুখেই বিস্ময়, উত্তেজনা, বিভ্রান্তি। প্রত্যেকে কথা বলতে চাইছে। হাঁটাচলা বদলে গেছে, কেউ এখন আর মন্থর নয়।
”বন্ধ করে দাও দরজা, গেট টেনে দাও।”
পবিত্রবাবু রাস্তায় নেমে এলেন। তার পিছনে কণাও। পাশের নিমন্ত্রণ কার্ডের দোকানের দরজা ভেজিয়ে মালিক দাঁড়িয়ে। পবিত্রবাবু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ”হল কী? সত্যি সত্যি নাকি গুজব ছড়িয়ে লুটপাট করার ধান্দা?”
”না দাদা, সত্যিই। আমার ভাইয়ের বন্ধু এইমাত্র বলে গেল পি টি আই অফিস থেকে সে জেনে এসেছে ইন্দিরাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, অবস্থা খুব খারাপ। তাছাড়া রেডিয়োতে স্পেশাল বুলেটিনে নাকি বলেছে, ইন্দিরার ওপর অ্যাটেম্পট হয়েছে, অবস্থা নাকি খুব খারাপ।”
”সাত-আটজন পথচারী ততক্ষণে জমে গেছে ওদের পাশে। কেউ গলা চড়িয়ে কিছু বললেই তাকে ঘিরে লোক জমে যাচ্ছে।
”কীভাবে অ্যাটেম্পড হল, শুনেছেন কিছু?”
”না, মনে তো হয় গুলি করেছে।”
”কোথায়? অফিসে?”
”তা-ও জানি না।”
ভিড় জমে গেছে দেখে লোকটি অস্বস্তিভরে পিছিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে দোকানে ঢুকে গেল।
”কী অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ব্যাপার!”
”খুব খারাপ হল, এবার খুব খারাপ অবস্থা হবে দেশের।”
নিজের কাছেই ব্যাপারটা যে কেমন লাগছে, কণা তার বিন্দুবিসর্গও বোধ করতে পারছে না। তার মাথার মধ্যে সাদা একটা পরদা ঝুলে গেছে, তাতে কোনো ছায়া বা ছবি পড়ছে না।
রাজনীতি বা রাজনীতি-করা লোকেদের সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ নেই। বাড়িতেও কখনো গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতির কথা ওঠে না। তবে এত বড় মাপের মানুষের অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা শুনলে মাথার মধ্যে নিঃশব্দে প্লাবন ঘটে যেতেই পারে। ইন্দিরা গান্ধীর অজস্র ভাবের ও ভঙ্গির অসংখ্য ছবি সে দেখেছে। তার একটাও এখন মনে পড়ছে না।
”দোকান বন্ধ করে দাও, গতিক ভালো মনে হচ্ছে না। ট্রাম, বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
”বন্ধ হচ্ছে কী, বন্ধ করে দিচ্ছে। ওই দেখুন, ছোঁড়াগুলো কী করছে।”
”করুক, তুমি বন্ধ কর।” পবিত্রবাবু খিঁচিয়ে উঠলেন অবনীর প্রতি।
ওদের সঙ্গে কণা দোকানে ঢুকল। ভিতরের ঘর থেকে পেন্সিল, ঝোলা আর স্কেচ খাতাটা হাতে নিয়ে সে কাউন্টারের কাছে দাঁড়াল। বাইরের দরজার পাল্লা সামান্য ফাঁক, যৎসামান্য আলো ভিতরে।
”অবনী বাইরে দাঁড়িয়ে দেখো অবস্থাটা কী দাঁড়াচ্ছে। তারকবাবু এখনও তো এলেন না, দোকান বন্ধ করে চেলে যেতে হবে কিনা…যা মনে হচ্ছে, একটা গণ্ডগোল না পাকায়।” পবিত্রবাবু ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলেন। কণার সঙ্গে একটা কথাও আর বললেন না, ওর অস্তিত্বটাও যেন ভুলে গেছেন। দোকানের নিরাপত্তা এখন তার সবকিছু।
দরজার ফাঁক দিয়ে কণা রাস্তায় তাকায়। আরও মানুষ। ওপারের গলির মুখে খণ্ড খণ্ড জটলা, তার মধ্যে বয়স্ক মেয়েরাও রয়েছে। ঘটনাটার ধাক্কায় সংসার ফেলে বেরিয়ে এসেছে। এই রকম মাপের কিছু ঘটলে কখনোই আর একা থাকা যায় না। অজস্র কথা আর অনুভূতি ভিতরে কেঁপে ওঠে যা অন্যের সঙ্গে ভাগ না করা পর্যন্ত দমবন্ধ করা অবস্থা তৈরি করে। বারবার জিজ্ঞাসা, একই উত্তর বারবার শোনা, তবুও অবিশ্বাস, তবুও জিজ্ঞাসা।
একটা রিকশয় এক বৃদ্ধ, সঙ্গে এক প্রৌঢ়া। কয়েকটি ছেলে রিকশকে থামিয়েছে। পঞ্চাশ ষাট মিটার দূর থেকে লক্ষ্য করলেও কণা বুঝতে পারছে ঘটনাটা কী। দুটি ছেলে প্রবলভাবে হাত নেড়ে দুজনকে রিকশ থেকে নামতে বলছে। বুদ্ধ ফ্যালফ্যাল চোখে, প্রৌঢ়ার একটা হাত বৃদ্ধের পায়ে, কাতরভাবে কথা বলছেন। বৃদ্ধের ডান পায়ের পাতা থেকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত প্লাস্টারে মোড়া। রিকশওয়ালা আবেদনের ভঙ্গিতে কী একটা বলতেই একটি ছেলে তাকে চড় মারল। আর একজন বৃদ্ধার হাত ধরে টান দিল। তিনি পড়তে পড়তেও হাতল আঁকড়ে সামলালেন।
অবনী হালচাল বুঝে ফিরে এসেছে। কণা দরজা থেকে সরে এল ভিতরে।
”খুব খারাপ অবস্থা। গাড়িটাড়ি চলতে দিচ্ছে না। আগুন লাগিয়েছে নাকি শেয়ালদার দিকে একটা বাসে। আর এদিকে ইউনিভার্সিটির কাছে।”
দমকলের ঘণ্টার শব্দ এগিয়ে আসছে। অবনী চুপ করে রইল। তার কথা যে মিথ্যা, নয়, এটা প্রমাণ হয়ে যাওয়ার স্বস্তি ফুটে উঠেই মুখটায় আবার ফ্যাকাশে রং ধরল।
”সব বন্ধটন্ধ করে দিয়েছি, আর থাকার কোনো দরকার নেই।” ভিতরের ঘর থেকে পবিত্রবাবু বেরিয়ে এসেছেন। কাউন্টারের তলা থেকে ভারী তালাগুলো বার করে বললেন, ”বাড়ি ফেরার যে কী হবে! নিশ্চয় সারা কলকাতার ট্রাম-বাস বন্ধ। এর ওপর গুলিটুলি চললে…বড় রাস্তা দিয়ে না হাঁটাই ভালো। আপনি এখন কোথায় যাবেন?”
”কলেজে।”
”কলেজ টলেজ আজ শিকেয় তুলুন, বাড়ি চলে যান।”
তিনজনে বেরিয়ে এল। অবনী তালা লাগাচ্ছে। কণার দৃষ্টি ফুটপাথে পা ছড়িয়ে বসা বৃদ্ধের দিকে। বৃদ্ধা উবু হয়ে বসে, বাঁ হাত দিয়ে বৃদ্ধের কাঁধ জড়িয়ে। উল্টে দেওয়া রিকশটা সোজা করার চেষ্টা করছে রিকশাওয়ালা। হইহই করে ছেলেগুলো ছুটে গিয়ে থামাল একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়িকে।
কী যেন প্রবাহ কণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত উঠে এসে তাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিল। একটা বাষ্পের গোলা বুকের মধ্যে ফেটে আবেগের কুণ্ডলী তৈরি করল। স্কেচের খাতাটা বুকের কাছে তুলে বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরে ডান হাতে পেন্সিলটা যন্ত্রের মতো বার করল কাঁধের ঝোলাটা থেকে।
দ্রুত হাত চলছে, খচখচ টানে রেখাগুলো কইমাছের মতো লাফিয়ে উঠছে, কোলাপসিবল দরজায় হেলান দিয়ে কণা বারবার মুখ তুলছে আর নামাচ্ছে। এই মুহূর্তটা কতক্ষণ ধরে পাবে সে জানে না।
শাঁখা আর রুলিপরা লোলচর্মের একটি হাত, খোঁচাখোঁচা পাকাচুলের মাথাটা নামানো এবং মাথার নিচে হাতটা শীর্ণ ঘাড়ের উপর দিয়ে, অসহায় কিন্তু আশ্রয়ের আশ্বাসে ভরা। ঘাড়ের দুর্বল সরু দুটো পেশী এবং শিরা দড়ির মতো, নাকছাবিপরা নাকটা ঝুঁকে, ওদের সামনে উল্লাসে রাস্তায় ছুটে-যাওয়া কয়েকটি শরীরের আর একটা মোটরগাড়ির আভাস।
”এভাবে দাঁড়িয়ে ছবি টবি আঁকবেন না, লোক জমে যাবে। কার কী রকম মেজাজ এখন বলা তো যায় না।”
পবিত্রবাবু চাবিগুলো পকেটে রেখে, চারধারে তাকালেন। বিব্রত, বিরক্ত এবং ভয়ার্ত মুখ। ”অবনী, তুমি চলে যাও, কাল যদি গাড়ি টাড়ি চলে তো এস।”
হনহনিয়ে পবিত্রবাবু চলে গেলেন। এমন পরিস্থিতিতে কণা কখনো পড়েনি। কলকাতায় তার নিয়মিত যাতায়াত গত তিন বছর, আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। যা এখন ঘটছে তার কল্পনার বাইরে। পুব দিকে তাকিয়ে সে ধোঁয়া দেখতে পেল। কিছু পুড়ছে। কৌতূহলে সে এগোল।
রাস্তা বাঁক নিয়েছে এমন জায়গায়-পৌঁছেই সে থমকে গেল। দ্রুতপায়ে মানুষ সরে আসছে। একটা ট্রাম দাউদাউ জ্বলছে। দূর থেকে রাইফেলের গুলির শব্দ এল। কিছু লোক ছুটছে আর পিছনে তাকিয়ে দেখছে। রাস্তাটা উঁচু হয়ে উঠে ফ্লাইওভারে পৌঁছেছে। ওখানে একটা লোকও নেই। রাস্তার দু’পাশে কাপড়ের পাড়ের মতো টানা সাইনবোর্ড। বাড়ির জানালায়, বারান্দায়, ছাদে লোক ঝুঁকে দেখছে। কণা একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে উঠে স্কেচ খাতা খুলল। এমন দৃশ্য জীবনে সে আর পাবে না। এখন ড্রইংগুলো করে রেখে পরে সম্পূর্ণ করে নেবে।
”আপনি যাবেন কোথায়?”
কণা মুখ ফিরিয়ে দেখল অবনী।
”কলেজ যাব ভেবেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে বন্ধ হয়ে গেছে। নিশ্চয় ডিস্টার্বেন্স ওখানেও ছড়িয়েছে।”
”এ জিনিস এখন সারা কলকাতায় চলবে।”
কণা ওর স্বরে উদ্বেগ পেল। সে নিজেও এবার ছমছমানি বোধ করল। বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া আর গতি নেই।
”আমি এখন হাওড়া স্টেশন যাব।”
”দেরি করবেন না।”
”আপনি?”
”আমি কাছেই হিদারাম ব্যানার্জি লেনে থাকি। গলি দিয়ে চলে যাব। আপনি সোজা ট্রামলাইন ধরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনু পেরিয়ে, বড়বাজার দিয়ে চলে যান।”
কণার মনে হল তার নিরাপত্তার জন্য অবনী চিন্তিত। স্কেচখাতা থলিতে রেখে সে বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল। এতক্ষণে সে কিছুটা ভয় পেয়েছে।
”তাই যাই।”
পশ্চিমদিকে হাঁটতে শুরু করেছে সবে তখনই একটা হইহই উঠল। লম্বা একটা স্কুলের বাসের সামনে কয়েকটি ছেলে হাত তুলে ছুটে গেছে। বাস ঠাসাঠাসি ভরতি শিশুতে। জানালায় ভীত মুখগুলো সার দিয়ে।
”বাস চলবে না, আজ কিচ্ছু চলবে না।”
”বাচ্চচাদের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি ভাই।” মুখ বার করে একটি লোক বলল।
”হেঁটে যাবে, হেঁটে…হাওয়া বার করে দে তো, এত বড় একটা ব্যাপার ঘটেছে আর বাসে চড়ে আরামসে কিনা বাড়ি যাওয়া। টেনে নামা সব।”
”ভাই, এরা বাচ্চচা, দূর দূর জায়গায় বাড়ি, যাবে কী করে?” লোকটি হাতজোড় করেছে।
”বাচ্চচা তো কী হয়েছে? আজ বাচ্চচাবুড়ো সব সমান।”
বাসের গায়ে ধপাধপ চড় ঘুঁষি মারার শব্দ হতেই কয়েকটি বাচ্চচা ডুকরে উঠল। কণার চোখ আটকে গেল একটা মুখে।
জানালার ধার থেকে ওরা ভয়ে পিছিয়ে। আচমকা মুখে চড় মারলে যেমন হয়, কেউ বিহ্বল, কেউ কান্নার আগের মুহূর্তে। ত্রাস কি জিনিস, কণা এখন তার চেহারা দেখতে পাচ্ছে। বছর দশেকের ছেলেটি, ওদের মধ্যে একটু বড়ই, তাকে দুদিক থেকে জড়িয়ে দুটি বাচ্চচা মুখ চেপে ধরেছে ওর বুকের কাছে। আর সে দুজনকে দুহাতে ঘিরে রেখেছে। একটু আগে দেখা চামড়া কোঁচকানো হাতটিই যেন সুডৌল, নবীন হয়ে উঠেছে। ওর চোখেমুখে বিস্ময়। সেইসঙ্গে বেদনা এবং হয়তো জীবনে প্রথম একটা বীভৎস শক্তির সামনে নিজের অসহায়ত্ব অনুভব করার ক্ষোভও ওকে দগ্ধ করছে। বড় বড় দুটি চোখ, যা কিছুক্ষণ আগেও বালক বয়সের চাঞ্চল্য আর দুষ্টুমিতে ঝকঝকে ছিল, এখন সন্দেহের ঝুলকালিতে জড়িয়ে কুটিল অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে।
এতগুলো বাচ্চচাকে শৈশব থেকে সরিয়ে দিলে ইন্দিরা গান্ধী, কেন যে এভাবে মারা যেতে গেলে! কণা তার চারপাশের লোকেদের দিকে তাকাল। কেউ সমর্থন করছে বলে তার মনে হয় না, কিন্তু এগিয়ে গিয়ে বাধা দেবার ইচ্ছাও কারুর মুখে সে দেখতে পেল না।
”আপনি এখনও দাঁড়িয়ে?” আবার অবনী।
”দেখেছেন কী হচ্ছে।”
”হোক। এখন এরকম অনেক কিছু হবে। তাই বলে দাঁড়িয়ে দেখবেন না, নিজের কথা আগে ভাবুন।”
অবনী যেরকম মন্থর ক্ষীণস্বরে কথা বলে এখন কিন্তু তেমনভাবে নয়, দ্রুত এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
”এরকম বহু দেখেছি। লক্ষ্য করেছেন এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কলেজ স্ট্রিটের মোড় অথচ একটা পুলিশও কোথাও নেই! লুটপাট, গুণ্ডামি।” কণার পাশাপাশি অবনী মোড় পর্যন্ত এল। বাঁয়ে তাকিয়ে দেখল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পোড়া একটা বাসে দমকল থেকে জল ঢালা হচ্ছে।
”আমি এদিকেই যাব, আপনি সিধে চলে যান।” অবনী হাত তুলে কণাকে হাঁটার পথ নির্দেশ করল।
”পুলিশের গুলি কিংবা বোমা টোমার ভয় রয়েছে আপনার দিকে।”
”আমি বাঁ দিকের গলি ধরব, চলি।”
গিজগিজে ভিড়। কণা রাস্তা পার হয়েই একটা ভিড়ের বাধা পেল। কেউ একজন ট্রানজিস্টর রেডিয়ো নিয়ে, তাকে দেখাই যাচ্ছে না, সেতারে মৃদু মন্থর বিষণ্ণ একটা সুর বাজছে। ভিড়টাকে পাশ কাটিয়ে সে চলতে শুরু করল। হাওড়া স্টেশন এখান থেকে অন্তত দেড়-দু’ মাইল পথ।
সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। সব দোকানের সামনেই জটলা। প্রত্যেকের মুখে বিভ্রান্তি, বিষণ্ণতা, কৌতূহল আর ভয়। বহু জায়গায় ট্রানজিস্টর রেডিয়ো ঘিরে ভিড়। পদচারি মানুষ ব্যস্ত পায়ে চলেছে তার মতো একই উদ্দেশে, বাড়ি পৌঁছতে। কণার এতক্ষণে মনে পড়ল মা এবং বাবাকে।
ভাইফোঁটা গেছে শুক্রবার। সোমবার, উনত্রিশে স্কুল খুললেও মা সেদিন স্কুল গিয়েই বৃহস্পতি পর্যন্ত চারদিনের ছুটি নিয়ে ফিরে এসেছিল। নভেম্বরের আগেই বইটা লিখে প্রকাশককে দেওয়ার কথা কিন্তু শেষ করতে এখনো অনেক বাকি। রবিবার প্রকাশকের লোক এসে কপি নিয়ে যাওয়ার সময় তাগিদ দিয়ে গেছে। কণা জানে, মা কখনও কথা রাখতে ভুল করে না। দিনরাত লিখে বইটা শেষ করবেই। দুর্গাপুজোর পর থেকেই টিভি বন্ধ রয়েছে। রান্না করা অবশ্য বন্ধ রাখেনি। এই একটা কাজ নিজে না করলে মা ছটফট করে।
”কে করল শুনেছেন কিছু?”
”বলল তো তাঁর দেহরক্ষী করেছে। …বাড়িতেই নাকি…কাল পেপারে না দেখা পর্যন্ত ভালোভাবে কিছুই জানা যাবে না।”
দুটি লোক কথা বলতে বলতে কণাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। কণা এবার জোরে পা চালাল।
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনু। ওপারে ধোঁয়া উঠছে। রবীন্দ্র সরণির দিকে। কণা রাস্তা পার হতে ভরসা পেল না। এইবার তার বাবাকে মনে পড়ল। বাবা এখনও হয়তো অফিসে, গিয়ে দেখবে কি?
কণা শুধু এইটুকুই জানে বিবাদী বাগের উত্তর-পশ্চিমে নেতাজী সুভাষ রোডে বাবার অফিস। কখনো সেই অফিসে সে যায়নি। এমনকি বাড়িটাও চোখে দেখেনি। স্টেশন থেকে কলেজে ট্রামে বা বাসে যাতায়াতের পথে তার বাবার অফিস পড়ে না।
কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডা দেবার সময় একবার কে যেন কথাটা তুলেছিল, ক’জন তাদের বাবার অফিসে গেছে? ছেলেদের মধ্যে দুজন বাদে প্রত্যেকেই বলেছিল, গেছে। আর ওই দুজন বলেছিল, বাবার অফিস রাইটার্স বিল্ডিংসটা বাইরে থেকেই দেখেছে। মেয়েদের কেউ-ই কখনো বাবার অফিসে যায়নি। শুধু একজন বলেছিল, দূর থেকে দেখেছে। ‘যদি হঠাৎ কখনো বাবাকে দরকার পড়ে তখন কী করবে?’ একজন বলেছিল, ‘রেলের অফিসে বাবা কাজ করে, কয়লাঘাটা জায়গাটা জানি, ডিপার্টমেন্টের নামও জানি। লোককে জিগ্যেস করে করে বার করে নেব।’
কণা অফিসের নামটা জানে। বাবার কাউকে অফিসের নাম বলতে হলে বলে, ‘এনজেম্পি…ভারত সরকারের অধীন একটা সংস্থা।’ যাকে বলা হল সে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকলে বলে, ন্যাশনাল জুট মিল অব প্রোডাক্টস সংক্ষেপে ‘এনজেম্পি’। সেখানে তার বাবা স্টোর্স সেকশনে কেরানি। নিশ্চয় ওই অঞ্চলের লোকজন অফিসটা জানে। এখন গেলে কেমন হয়! কিন্তু যাওয়ারও কোনো দরকার আছে কি?
বাবার জন্য হালকা একটা উদ্বেগ তার মনে ভেসে এল। কিন্তু ওটা অফিস এলাকা। রাইটার্স আর লালবাজার কাছেই। ওখানে কি এইরকম অবস্থা হবে? বাবা ছেলেমানুষ বা ভীতু ধরনের নয়। কিন্তু কোথাও একটা পুলিশ নেই কেন? এই অদ্ভুত নৃশংসতার সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর সম্পর্কটা কোথায়?
সিদ্ধান্তে না এসেই দক্ষিণ দিকে সে হাঁটতে শুরু করল। রাস্তার মাঝ দিয়ে কাতারে কাতারে লোক চলেছে। কণাও রাস্তায় নামল। কলুটোলার মোড়ে পৌঁছে দেখল অনেকেই আর এগোচ্ছে না। ওখান থেকেই দেখা যাচ্ছে বৌবাজারের মোড়ে একটা বাসে আগুন জ্বলছে। দমকলের গাড়ি দাঁড়িয়ে। মনে হল কয়েকজন লোক ইঁট ছুঁড়ছে দমকল গাড়িতে।
”আর এগোস না, কলুটোলা দিয়ে চল। ক্যানিং স্ট্রিট হয়ে-ব্র্যাবোর্ন রোডে পড়ব।”
দুটি লোক ডানদিকের রাস্তায় ঢুকল। কণাও তাদের পিছু নিল। ব্র্যাবোর্ন রোড নামটাই তাকে আশ্বাস জোগাল। চেনা নাম, হাওড়া থেকে বাসে ওই রাস্তা দিয়েই সে কলেজ যায়। বাবার অফিসে এখন যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না, দরকারও নেই। তাকে দেখে বাবা হয়তো রাগ করবে। ‘কী দরকার ছিল এখানে আসার? এরকম বহু দেখেছি জীবনে। নর্থ ক্যালকাটায় আমার জন্ম’। তবে একদিন গিয়ে অবশ্যই অফিসটা দেখে আসতে হবে। কখন যে কী দরকার পড়ে।
রবীন্দ্র সরণির মোড়ে পৌঁছে ডানদিকে তাকিয়ে কণার মনে হল, উত্তেজক কিছু ঘটছে। কত লোক? অন্তত দু-তিন হাজার তো হবেই, তাদের চলাফেরার মধ্যে ব্যস্ততা, ঝাঁঝ এমনকি দু-তিনজনের হাতে লাঠি বা রডের মতো জিনিসও।
একটি কিশোর ওইদিক থেকেই আসছে। পরণে কালো গেঞ্জি আর লুঙ্গি, কাঁধে একটু চুপড়িতে কাঠকয়লা। কণা তাকে জিজ্ঞেস করল, ”কী হয়েছে ভাই?”
”গুরুদ্বারা আছে না ওখানে, আগ লাগাচ্ছে। ভিতর থেকে গোলি চালিয়েছে। বড়বাজারে টেক্সিতে ভি আগ লাগিয়েছে।”
”কেন?”
”ইন্দিরা গান্ধীকে উগ্রপন্থীরা মেরেছে না!”
অবাক হয়ে সে কণার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। আর নয়, এবার সোজা স্টেশন। ভিড়ের মধ্য দিয়ে কাঁধের ঝুলিটা আঁকড়ে যতটা সম্ভব ক্যানিং স্ট্রিট দিয়ে এগোতে লাগল। তখন স্কুলবাসের ছেলেটির মুখ কয়েকবার তার মনে ভেসে উঠল। অসহায় বন্দির মতো, অথচ বিরুদ্ধে ঘটনার দেয়ালে ঘেরা প্রবলশক্তি। কিছু করার নেই অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া। সাহায্য করতে পারে যারা, তারা কেউ এগিয়ে আসছে না। কী ক্ষোভ মুখটায় অথচ বড় বড় চোখদুটিতে কেমন অদ্ভুত একটা সারল্য। বিশ্বাস করতে পারছে না, এরকমও হয়!
ভেঙে দেওয়া একটা চাকা লাগানো খাবার বিক্রির ঠেলাগাড়ি। ভাঙা উনুন আর পোড়া কয়লা রাস্তায় ছড়ানো। ডেকচি বা তাওয়াটা ধারেকাছে নেই অর্থাৎ লুট হয়ে গেছে। চীনেমাটির প্লেটগুলোর টুকরো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো, আছড়ে ভাঙার জন্য। মাংস, ঝোল, আর চানামটর রাস্তায় ছিটিয়ে। কণা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। কিছু লোক দাঁড়িয়ে দেখছে, বোধহয় স্থানীয়, বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। একটা ঘণ্টা এইসব গাড়িতে ঝোলে, মাঝে মাঝে বাজিয়ে জানান দেয়। সেটা তো চোখে পড়ল না! নিশ্চয় কেউ নিয়ে গেছে।
রাস্তার ওপারে বন্ধ দোকানগুলোর মাঝে একটা ছোট্ট ছিটকাপড়ের দোকান খোলা। সামনে দিয়ে দ্রুত লোক চলাচল হচ্ছে। দোকানের ভিতরের তাকে একটা সাদা কাপড়ের রিল কাত হয়ে, আরও কয়েকটি কাউন্টারে এলোমেলো। রাস্তার উপর শো-কেসের কাচ ভাঙা। কণার হঠাৎ-ই মনে হল যত কাপড় ছিল তাতে কটা ব্লাউজ, সায়া হতে পারত? সারা জীবন চলে যাবার মতো? জীবনে কটা ব্লাউজ লাগে, এটা কি কেউ কখনও হিসেব করেছে?
ফ্লাইওভার দিয়ে হাঁটা নিষেধ। আজ সব লোক ওখান দিয়েই হাঁটছে। কণা এইবার ক্লান্তবোধ করতে লাগল। বড় করে শ্বাস নিতে হচ্ছে। একটু তীক্ষ্ন ব্যথা বুকের বাঁদিকে। ওখানেই হার্ট। ফেল-টেল করবে না তো! চলতে চলতে ধপ করে পড়ে অনেকেই তো মারা গেছে। তবে তারা বাইশ-তেইশ বছরের নয়। ডান পায়ের গুলিটা শক্ত লাগছে, ব্যথা করছে। পা ফেললেই ডান কুঁচকিতে টান ধরছে। কণা হাঁটার গতি কমাল।
ব্রিজ বা ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াতের সময় কতবার গঙ্গাকে দেখেছে। এখন হাঁটতে হাঁটতে আবার দেখল। ওপারে হাওড়া স্টেশনের লালবাড়ির ঘড়িতে পৌনে দুটো প্রায়, গঙ্গায় অন্যান্য দিনে যেমনটি থাকে এখন তাই। জলে ভাসা শ্যাওলা আর আবর্জনা যেমন নালার কিনারে থিতিয়ে আটকে যায় তেমনিভাবেই, নৌকো, গঙ্গাবোট, জেটি আর মালের জাহাজগুলো গঙ্গার দু-পার ঘেঁষে জমে রয়েছে দক্ষিণে বাঁক নেওয়া পর্যন্ত। পুরনো গুদাম বাড়িগুলো আর তার পিছনে লম্বা নতুন রং করা অফিস বাড়িটা কিংবা মাল খালাসের জন্য জিরাফের মতো গলা বাড়ানো ক্রেন, ফার্নেসের চিমনি, গঙ্গার পূর্বতীর ধরে মাল-বওয়া ট্রেন আর যাত্রীভরা খেয়া-নৌকো, এইসব নিয়ে দল বেঁধে তারা বহু স্কেচ করেছে। ভোরে ট্রেন ধরে হাওড়ায় এসে ব্রিজের নিচে স্কেচখাতা নিয়ে একা স্নানের ঘাটে বসেছে, ব্রিজের ওপর থেকে, পাশ থেকে, চলমান বা স্থাণু, জড় বা জঙ্গম যা তার ভালো লেগেছে এঁকেছে। তাকে আকর্ষণ করে জীবনের সঙ্গে মেশানো কৌতুককর বা গম্ভীর মানুষ ও ঘটনা। কলেজে তার স্কেচ প্রশংসা পেয়েছে শিক্ষক এবং ক্লাসের বন্ধুদের কাছে। ‘দেখার চোখ আছে’ এই কথা অনেকের মুখ থেকে সে শুনেছে।
কিন্তু আপাতত স্কেচ নিয়ে চিন্তার কোনো ইচ্ছা তার নেই। ক্লান্ত, সে এখন অত্যন্ত ক্লান্ত। তাছাড়া মনের অবস্থাটাও নিরাপদে বাড়ি ফেরা ছাড়া আর কিছু ভাবার মতো নয়। কল্পনার বাইরে থেকে এসে পরের পর ঘটনা, মসৃণ দৃশ্য ও শব্দ তাকে ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে তার সাজানো, ধারণাগুলোকে ওলটপালট করে দিয়ে গেছে। এখন শুধু ট্রেনে উঠে কোনোভাবে পৌঁছনো। কাতার দিয়ে যেভাবে লোক স্টেশনের দিকে দৌড়চ্ছে, অসম্ভব ভিড় হবে, ট্রেনে উঠতে পারলে হয়!
হাওড়া স্টেশনে ঢুকেই কণার মনে হল, কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। এত লোক দাঁড়িয়ে কেন? ট্রেনে ওঠার জন্য যারা আসে, এভাবে জটলা করে বা একা একা হকচকান বা বিরক্তমুখে বাইরের চত্বরে না দাঁড়িয়ে ভিতরে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করে।
কী ব্যাপার ট্রেন নেই নাকি? কণা বাইরে থেকেই দেখতে পাচ্ছে। এক থেকে ছয় নম্বর পর্যন্ত কোনো প্ল্যাটফর্মে ট্রেন নেই। সে আর এগোল না। মাঝবয়সি একটি লোক যার ধুতি ও শার্ট এবং হাতে ঝোলান ছোট্ট কাপড়ের থলিটি থেকে মনে হচ্ছে কৃষি-ব্যবসায়ী বা স্যাকরা কিংবা হোমিওপ্যাথও হতে পারে এবং নিয়মিত নিত্যযাত্রী, এমন লোকের কাছ থেকে খবর নেওয়াই নিরাপদ। এরা আজেবাজে মনগড়া ধারণার বা আন্দাজি খবর দেয় না।
”ট্রেন কি নেই?” কণার স্বর আর্তনাদের মতো।
মাথা নাড়ল লোকটি। ব্যস্ততা বা উদ্বেগ নেই, যেন জানেই এরকম কিছু একটা হবে। কণা দমে গেল।
”কতক্ষণ নেই?”
”আমি এক ঘণ্টা হল এসেছি। সব বন্ধ, খুব গোলমাল হচ্ছে, ট্রেনে আগুন টাগুনও নাকি লাগিয়েছে তাই।”
লোকটি আর কথা বাড়াল না। কণা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
”বলেছে কিছু, কখন চলবে?”
”বলেছে সব ট্রেন পথে আটকে আছে, কখন এসে পৌঁছবে তার নিশ্চয়তা নেই। আর এলেও সেটা যে ছাড়বে আবার তারও নিশ্চয়তা নেই।”
”তার মানে?” এবার কণার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ”ট্রেন তাহলে পাওয়া যাবে না?….বন্ধ!”
”কোথায় যাবেন?”
”হিন্দমোটর।”
লোকটি কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, ”মাইল সাত-আট, হেঁটে গেলে…।” আপাদমস্তক কণাকে দেখে নিয়ে বলল, ”ওব্যেস তো নেই, নয়তো এখন রওনা হলে ঘণ্টা চারেক, কি পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন।”
কণা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। লোকটির কথার মধ্যে যে পরামর্শ রয়েছে সেটা তার মাথায় ঢুকতে একটু সময় নিল। তারপরই শিউরে উঠে বলল, হেঁটে যেতে হবে!”
”এগিয়ে দেখুন না, বহু লোক হেঁটেই রওনা দিয়েছে, মেয়েছেলেও।”
”আপনি কোথায় যাবেন?”
”বর্ধমান।” খুব নিশ্চিন্তভাবে লোকটি বলল।
”হেঁটে যাবেন?”
”মোটেই না। এখানেই শুয়ে কাটাব। দেখুন না, কত লোক আজ স্টেশনেই থেকে যাবে।”
কণা এগিয়ে গেল প্ল্যাটফর্মের দিকে। আশা নিয়ে বহু লোক অপেক্ষা করছে। কেউ ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে আর কথা বলছে না। হতাশা, বিরক্তি, চাপা রাগ থরে থরে মুখগুলোয় সাজানো। এই অকল্পনীয় অবস্থার জন্য কাকে যে দোষারোপ করবে কেউই তা খুঁজে পাচ্ছে না। কণা ভিড় ঠেলে প্ল্যাটফর্মের শেষে পৌঁছল। রেল লাইন ধরে সার দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ চলেছে। সে অবাক হয়ে ভাবল, কোথায় ওদের বাড়ি, কখনই বা ওরা পৌঁছবে?
কী করব তাহলে? দেবাইপুকুরে তাদের একতলা বাড়িটা কণার মনে ঝলসে উঠল। মা বোধহয় এখনও জানে না ট্রেন বন্ধ। গ্রিলঘেরা ঢাকা বারান্দায়, টেবলে মাথা ঝুঁকিয়ে এ-বই সে-বই খুলছে আর লিখে যাচ্ছে। রেডিয়োটা নিশ্চয়ই বন্ধ রয়েছে। হয়তো রাস্তা থেকে বা পাশের বাড়ি থেকে কেউ জানিয়ে দেবে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর খবর। শোনার পর কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে আবার লেখায় মন দেবে। দিদিমা মারা যাবার খবর নিয়ে ত্রিবেণী থেকে মামার বড় ছেলে পানু যখন এসেছিল মা তখন দুটি ছাত্রকে পড়াচ্ছিল। পানুর মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ধীরস্বরে মা বলেছিল, ”মিনিট পনের বস, এখন একটু ব্যস্ত।”
”এই যে ভাই, এখন কী করব বল তো?”
কণা চমকে পাশে তাকাল। মেয়েটি তার থেকে পাঁচ-ছ বছরের বড়, অফিসে চাকরি করে। থাকে কোন্নগরে। বছরখানেক আগে ট্রেনেই আলাপ, কালও দেখা হয়েছে। ভাই নেই তাই পাড়ার চারটি ছেলেকে ফোঁটা দিয়েছে এবং কালীপুজোয় নীলাম্বর অপেরার যাত্রা দেখতে গিয়ে কী ঝামেলায় পড়েছিল এইসব কথা ট্রেনে বলেছিল।
”আমিও তো ভাবছি, কী বিপদে যে পড়া গেল, এখন বাড়ি যাই কী করে?”
”মেয়েটির সঙ্গে বেঁটেখাটো একটি যুবক। সাদা-সবুজ ডোরা দেওয়া স্পোর্টস শার্ট প্যান্টে গোঁজা। তাকে লক্ষ্য করে মেয়েটি বলল, ”আর একবার খোঁজ নিয়ে দেখুন না যদি ট্রেন চলে। গোলমাল বন্ধ হয়েও তো যেতে পারে।”
”বলেই তো দিল, কোনো আশা নেই….বরং আমি যা বললাম তাই করুন।”
”অসিতদার বাড়ি?….খুব ভালো আলাপ নেই।”
”আমার সঙ্গে তো আছে। অত্যন্ত ভালো লোক, বউদিও খুব ভালো, এক রাত্তিরের তো ব্যাপার। ট্রেন তো কাল বন্ধ থাকবে না, থাকতে পারে না। আর গভর্নমেন্ট আজই দেখবেন সব ঠান্ডা করে দেবে।…আপনি ভালো না চিনলেও, অফিসেরই মেয়ে বিপদে পড়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য থাকতে চাইছে তখন কলিগ আশ্রয় দেবে না, তা হতে পারে নাকি?”
যুবকটি খুবই আন্তরিকভাবে কথা বলছে। মেয়েটির ইতস্ততঃ করার কারণও কণা বুঝতে পারছে। হঠাৎ কারুর বাড়ি রাত কাটাতে সঙ্কোচ হওয়ারই কথা।
”আপনি কোথায় থাকবেন?”
যুবকটি দৃশ্যতই খুশি হল কথাটা শুনে। তার সম্পর্কে একটি মেয়ে, যে নিকটবয়সি এবং মাথায় প্রায় সমান চলনসই, সুশ্রী এবং ভরাট স্বাস্থ্য, কণার মনে হল যুবকটি বোধহয় প্রণয়প্রার্থী, সুতরাং এমন বিপন্ন পরিস্থিতিতে মেয়েটি তার জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ায় সে খুশিই হতে পারে।
”আমার জন্য আপনাকে ভাবতে হবে না। রাস্তাঘাটে যেখানে হোক…কত হাজার হাজার লোক যে কলকাতার ফুটপাথে রোজ রাত কাটাচ্ছে…আপনাকে নিয়েই চিন্তা। কলকাতায় এত রকমের বাজে লোক আছে, একা মেয়ের পক্ষে রাত কাটানোটা, বিশেষ করে এইরকম ডিস্টার্বেন্সের সময়…বিপদে পড়লে একটা লোকও এগিয়ে আসবে না। দেখলেন তো লোকটাকে যখন মারছিল কেউ একজনও তাকে রেসকু করতে এগোল না।”
”অসিতদার বাড়ি কত দূরে, কলকাতার কিছুই আমি চিনি না।”
”বড় জোর আধঘণ্টার রাস্তা, সিমলেয়।”
কণার পাশে দাঁড়িয়েই ওরা কথা বলছে। সে মাঝেমাঝে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে, আবার চোখ সরিয়ে লোকজন দেখছে। ওরা বলছে ওদের নিজেদের কথা, তাতে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগই তার নেই। তবু একটা আশা তার মনে জেগেছিল, হয়তো মেয়েটি তাকেও জড়িয়ে নেবে রাতে থাকার সমস্যার সঙ্গে। বোঝাই তো যাচ্ছে সে-ও একই বিপদে। এক্ষেত্রে বিপদটা ভাগ করে নেওয়াই তো উচিত। কিন্তু তাকে বাদ দিয়েই কথাবার্তা হচ্ছে।
”কিন্তু ধরুন যদি কোনো কারণে অসিতদার ওখানে থাকা না হয়…হয়তো কারুর খুব অসুখ কিংবা আমার মতই কোনো নিকট আত্মীয় এসে পড়েছে…”
”নাঃ আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না। বেশ, তখন আবার আপনাকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে যাব, তারপর আপনি নিজেই ডিসিশান নেবেন।”
যুবকটি ছদ্ম ঝাঁঝ মাখিয়ে অভিমানে আহতস্বরে বলল, ”না না, মানে…আপনিই তখন অপ্রস্তুতে পড়ে যাবেন।”
”তাই যাব, আমার ব্যাপার, চলুন তো।”
কণা মুখ ফিরিয়ে রেললাইন বরাবর পশ্চিমে তাকিয়ে ছিল। এবার দক্ষিণে অন্য প্ল্যাটফর্মে ধৈর্য আর হতাশার প্রান্তে পৌঁছনো মুখগুলোর দিকে তাকাল। কিন্তু চোখের কোণ দিয়ে সে নজর করল, যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালো মেয়েটি। বার দুই পিছনে তাকিয়ে যুবকটির সঙ্গে কথা বলে এবার তার দিকেই আসছে। কণার মনে আশা জাগল।
”কিছু মনে কোরো না ভাই। বুঝতেই পেরেছ আমার সঙ্গেই ভালো পরিচয় নেই, অন্য সেকশনে কাজ করেন ভদ্রলোক, শুধু সমরেশবাবুর কথাতেই যাচ্ছি, নয়তো তোমাকেও আসতে বলতাম।”
”না না আপনি ওসব নিয়ে ভাববেন না। বুঝতেই পারছি আপনার অসুবিধেটা।”
”তুমি তাহলে কী করবে এখন, কলকাতায় কোনো বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন নেই?”
”আছে।”
মেয়েটির মুখে স্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল।
”তাহলে আর দেরি করো না, চলে যাও। কলকাতায় আত্মীয়-বন্ধু থাকাটা যে কত দরকার এবার তা বুঝলাম।”
চলে যাবার পর কণার মনে হল, ওর নামটা আজও জানা হয়নি। কাউকে নাম জিজ্ঞাসা করতে তার সঙ্কোচ হয়।
‘আছে’ তো বললাম কিন্তু কে আছে?
কণা পায়ে পায়ে স্টেশনের চত্বর থেকে বেরিয়ে এল। ফাঁকা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এবং স্টিমার ঘাট। রাস্তার ওপারে গঙ্গার দিকটা নোংরা, ফুটপাথ খাবারের দোকানের দখলে। হাওড়া ব্রিজের রুপোলি রঙে সূর্যকিরণ আর ততটা জ্বলজ্বলে লাগছে না। গঙ্গার পুবের বাড়িগুলোয় বিবর্ণ স্যাঁতসেঁতে ভাব ফুটে উঠেছে। হেমন্তের বেলা পড়ে আসছে। এখন ইন্দিরা গান্ধী, কোথায়, কী অবস্থায়, দিল্লিতে কী ঘটছে এখন? এবার কে প্রধানমন্ত্রী হবে, এবার আমি কী করব, এখন যাব কোথায়?
কণা বাস টার্মিনাসে এল। এখনও দলে দলে মানুষ স্টেশনের দিকে আসছে। কলকাতায় কোথাও তার যাবার জায়গা নেই, একটা রাত থাকার মতো আশ্রয় নেই। মায়ের আত্মীয়স্বজনরা, যাদের সে চেনে, সবাই কলকাতার বাইরে থাকে। মেজকাকা বাড়ি করে রয়েছে লেকটাউনে, তার সঙ্গে এখন তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। ঠাকুমাকে নিয়ে ছোটকাকা রয়েছে বেলঘরিয়ায়, কণা সে বাড়িটা চেনে। কিন্তু এখন…এখান থেকে হেঁটে…তার শরীর ক্লান্তিতে ভার হয়ে এল। পায়ের গোছে পুরনো মচকানির ব্যথাটা আবার চাগিয়ে উঠছে। কামিজের বগলদুটো ভিজে।
হাঁটার অভ্যাস একদমই নেই। বাবা প্রায়ই বলে, ‘শরীরটাকে রোজ একবার খাটাবে নয়তো জং ধরে যাবে। শরীরের আর মেসিনের একই রকম যত্ন দরকার।” বাবা খুব ভোরে উঠে ছাদে গিয়ে শরীরটাকে খাটায়। তখনও সে বিছানায় শুয়ে থাকে, অল্পস্বল্প শব্দ পায়। অফিস থেকে হেঁটে বাড়ি চলে যাবার মতো জোর বাবার আছে, হয়তো রওনাও দিয়েছে এতক্ষণে। কণা বোধহয় বাবাকে দেখতে পাবে বলেই ভিড়ের দিকে তাকাল। আর তখনই ওদের দুজনকে দেখতে পেল।
”দেবু, এই দেবু…কল্যাণ।”
কণা পড়িমরি ছুটে গেল। ভাসতে ভাসতে একটা কুটো নয় আস্ত একটা নৌকোই যেন সে পেয়ে গেছে। ওরা তারই ক্লাসের।
”কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
”তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী কচ্ছিস? কলেজ গেছলি?”
”না। যাবার আগেই তো কাণ্ডকারখানা বেধে গেল। এদিকে ট্রেনও বন্ধ।”
”য়্যা!” কল্যাণ ডানহাতের তালু মাথায় রাখল খানিকটা নকল হতাশায়। ”ট্রেন বন্ধ! শাললা…শোকপ্রকাশ হচ্ছে। এবার কী হবে দেবু?”
”কী আবার হবে স্টেশনে পড়ে থাক, কাল ট্রেন চললে বাড়ি যাস। তোর তো বেশি দূর নয় উলুবেড়ে, কাছেই, হেঁটে চলে যা না।”
দেবুর কথায় কান না দিয়ে কল্যাণ জিজ্ঞাস করল:
”কণা ঠিক জানিস, ট্রেন চলছে না?”
”এতক্ষণ তো ওখানে থেকে ফিরে এলাম।”
”কোথায় যাচ্ছিলি?”
”কোথাও না, তোদের জন্যই দাঁড়িয়েছিলাম।”
”এখন রসিকতার সময়? চারদিক তাকিয়ে দেখেছিস মানুষ সব শোকে ভাসতে ভাসতে চলেছে।”
”দেবু, আজ তোর ওখানেই থাকব।”
পাথুরিয়াঘাটায় কলেজের হস্টেলে দেবু থাকে। কল্যাণ বহুবার সেখানে রাত্রিবাস করেছে। রাতে না ফিরলে বাড়ির লোক তার জন্য ব্যস্ত হয় না। টানা এগারো দিনও খবর না দিয়ে সে বাড়ি ফেরেনি।
”কণা, কোথায় যাবি?” দেবু জানতে চাইল।
”কলকাতায় আমার কেউ নেই রে, কোথায় যাব যে বুঝতে পারছি না।” কণা ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় যে এসে গেছে গলার স্বরে দুজনে তা বুঝতে পারল।
”কলেজের কত ছেলেমেয়ের বাড়ি রয়েছে, তোর আবার ভাবনা কী? দেবু, গৌরী কোথায় থাকে রে, ওখানে কণাকে পৌঁছে দিলে তো হয়।”
বাড়ি চিনি না। বেলগাছিয়া না পাতিপুকুর কোথায় যেন থাকে।”
”চিনে ফিনে রাখবি তো। সুললিতের সঙ্গে এখন দেখা হলে ভালো হত, অন্তত সাঁইত্রিশটা ঠিকানা ও বলে দিত।”
মন্থরগতিতে একটা পুলিশ ভ্যান কলকাতার দিক থেকে আসছে ব্রিজ দিয়ে। ওরা কথা বন্ধ রেখে তাকিয়ে রইল। ভ্যানের মধ্যে সাত আটজন খাকি পোশাকের পুলিশ রাইফেল নিয়ে।
”অল ক্লিয়ার, গোলমাল থেমে গেছে। এবার তাহলে ট্রেনও চলবে।” দেবু আশ্বাস দেখিয়ে কণার দিকে তাকাল।
”চল তাহলে, দেখি গিয়ে।”
ট্রেন ফেল যদি হয়, এমন ধরনের উৎকণ্ঠা নিয়ে চেনা দুজনকে পিছনে রেখে স্টেশনের দিকে এগোল। তার হাঁটা দেখে একটা লোক সচকিত হয়ে উঠে বলে ফেলল, ট্রেন চলছে নাকি?”
তিনজন দশ মিনিটের মধ্যেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। দুজন সাইকেল আরোহী ওদের সামনে দিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল, কিছু পরে একটা মোটরও।
”তাহলে রতনের ওখানেই কণাকে পৌঁছেদি।” কল্যাণ বলল দেবুর অনুমোদন চেয়ে।
”রতন! তাই চল, একবার গিয়েছিলাম, খুঁজে নিতে পারব।”
”কত দূরে, আমি কিন্তু বেশি হাঁটতে পারব না।”
”কাছেই জোড়াসাঁকোয়। মিনিট দশ-পনেরো আমাদের হস্টেল থেকে বেশি দূর নয়।”
রতনের বাড়ি খুঁজে বার করতে সময় খরচ হল না। বড় রাস্তা থেকে গলি দিয়ে পঞ্চাশ মিটার ঢুকেই, টানা বারান্দাওলা, তিনতলা বাড়ি। রাস্তার উপরই দরজা। দেবু কড়া নাড়ল।
বাড়ির ভিতর থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসছে। ওরা অস্বস্তিবোধ করল। মনে হচ্ছে ঝগড়া করছে কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষ। দেবু এবার জোরে কড়া নাড়ল। দরজা খুলল এক বুড়ি। চিৎকারের ঝাপটা এল তার পিছন থেকে।
”রতন আছে?”
ঝগড়ার দমকে কিছু কিছু শব্দ উড়ে আসছে। দুটি মেয়ে গলায়-‘শুওরের বাচ্চচা’, ‘খানকির বাচ্চচা’, ‘মর মর, কুড়িকুষ্ঠো হোক তোর।’ এইসব শুনে ওরা দমে গেল।
”একটু আগে বেরিয়ে গেল।”
”ফিরবে কি এখন?”
”তা জানি না। ঝগড়াঝাঁটি হলে বেরিয়ে যায়, কখন ফিরবে ঠিক নেই। কিছু বলতে হবে?”
”বলবেন কলেজ থেকে দেবু কল্যাণ আর কণা এসেছিল। ট্রেন বন্ধ থাকায় কণা, এই যে মেয়েটি, খুব বিপদে পড়ে শুধু রাতটুকু থাকার জন্য এসেছে।”
বুড়ি নিষেধ জানাবার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে গলা নামিয়ে বলল, ”এ বাড়িতে নয়। শুনতে পাচ্ছ না, কী চলছে ভেতরে, মা-মেয়ের ঝগড়া, প্রায়ই হয়। দাদাবাবু তাই তো বেরিয়ে গেছে।”
ভিতর থেকে আবার একটা দমক এল।
”বেশ করব টো টো করব, যার তার সঙ্গেই ঘুরব। বেরিয়ে যাব এ বাড়ি থেকে, বেশ্যা হব।”
”তাই যা, তাই যা, আছিস কেন এ বাড়িতে।”
এরপর একটি পুরুষের গর্জন এবং মারের শব্দ শোনা গেল।
”বাপ পেটাচ্ছে মেয়েকে। বিয়ে হচ্ছে না তো, বয়সও হয়ে গেছে। তোমরা বাবা অন্যত্র কোথাও দেখো।”
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বিষণ্ণমনে ওরা ফিরে চলল।
”এই বাড়িতে থেকে ছবি আঁকা, অ্যাটির্স্ট হওয়া!…রতনকে দেখে কিন্তু কোনো ধারণাই করা যায় না।” কল্যাণ নিস্পৃহস্বরে বলল। দুজনের কেউ মন্তব্য করল না।
পথের আলো জ্বলছে। কলকাতা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনু দিয়ে মোটর, লরি, স্কুটার, রিকশ চলছে। তবে বাস, মিনিবাস নেই। রাস্তার এক জায়গায় ভাঙা ইঁটের টুকরো আর গুঁড়ো কাচ ছড়ানো। মোড়ে রাইফেল নিয়ে পুলিশ। বড় দোকানগুলো বন্ধই রয়েছে।
”চা খাব রে। আর পারছি না।”
একটা ভুজিওলার দোকানের তলায় রাস্তা থেকে এক হাত নিচে চায়ের দোকান।
”খিদেও পেয়েছে।” কণা ঝুলি থেকে ব্যাগ বার করে বলল, ”মুড়ি-বাদাম খাব, তোরা?”
”আমাদেরও তাই-ই, তেল যেন না দেয় আর আস্ত কাঁচালঙ্কা।”
কণা এগিয়ে গেল। যখন সে ভুজিওলার সঙ্গে কথা বলছে তখন কল্যাণ বলল, ”কী করা যায় বল তো? শঙ্কর আর সত্যপ্রিয়র বাড়িতে একবার চেষ্টা করা যায়।”
দেবু মাথা নাড়ল অমত জানিয়ে। ”আর কোথাও গিয়ে দরকার নেই। কে জানে কার বাড়িতে কী প্রব্লেম রয়েছে, এসব অনিশ্চিত ব্যাপার, দেখলিই তো। আমার পিসিমার দেওর, আমরা ডাকি ছানুকাকা, কাছেই নাথের বাগানে থাকেন, সংসারে কোনো ঝামেলা নেই, হাতিবাগানে বাসনের দোকান আছে-শুধু স্বামী-স্ত্রী, ওখানেই বরং যাই। মনে হচ্ছে হয়ে যাবে।”
কণার হাত থেকে ঠোঙা নেবার সময় দেবু প্রস্তাবটা দিল। কল্যাণ বলল, ”সেই ভালো, সন্ধেও হয়ে এল আর কোথায় ঘোরাঘুরি করবি।”
”একেবারেই আমরা অপরিচিত।” কণা আড়ষ্টতা বোধ করছে। কিন্তু সে জানে এসব নিরর্থক কথা। এখন বাছাবাছির প্রশ্নই ওঠে না রাতটুকু থাকার মতো নিরাপদ একটা জায়গা তার এখন চাই।
চিৎপুর ধরে নিমতলা স্ট্রিট থেকে আহিরীটোলা হয়ে গঙ্গার দিকে যেতে ডানদিকে প্রথম রাস্তাটি ছেড়ে ওরা তেলেভাজার দোকানটা ঘুরে দ্বিতীয় রাস্তায় ঢুকল। টিনের চালার দুটো বাড়ি আর গম ভাঙার দোকানের পর রাস্তার আলোর থামের গায়েই ছোট লোহার গেটওলা পুরনো একটা বাড়ি। খড়খড়ির জানালা, প্রতি জানালার মাথায় ফুল লতাপাতার নকশা সিমেন্টের রিলিফে, ছাদের পাঁচিলের মাঝখানটা ঢেউ খেলিয়ে তোলা, তার মাথায় পুতুলের দুটো মূর্তি। বাড়িটায় দীর্ঘকাল কলি পড়েনি।
গেট থেকে তিন ধাপ উঠে দুপাশে দুটো ঘর, সোজা গেলে উঠোন, তার তিনদিকে রক। উঠোনে আবর্জনা ছড়ানো। শ্যাওলায় আটকে আছে পেঁয়াজের খোসা আর কাগজের টুকরো। উঠোনের এক কোণে চৌবাচ্চচা আর কল। উপর থেকে নর্দমার পাইপ উঠোনের আর একধারে দেয়াল দিয়ে নেমে এসেছে। তার তলার দিকে ভাঙা, তাই জল যখন পড়ে ছিটিয়ে যায়।
একতলার রাস্তার দিকের দুটো ঘর, এক ওষুধ কোম্পানি ভাড়া নিয়ে গুদাম করেছে। বিকেলের পরই ঘরে তালা দিয়ে চলে যায়। গেট থেকে উঠে পাথর বসানো মেঝের উপর দিয়ে এগিয়ে উঠোনের রকে পড়ার আগেই বাঁ দিকে দোতলায় যাবার সিঁড়ি। দেয়ালের ইঁট বেরিয়ে রয়েছে। রোদের অভাবে এবং আবর্জনায় একটা গন্ধ তৈরি হয়ে আছে। সেটায় অভ্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত গা গুলিয়ে ওঠে। একটা বেড়াল সিঁড়ির মুখে গুটিগুটি বসে চোখ বন্ধ করে। ঝোলানো বাল্ব থেকে যে আলো পাওয়া যাচ্ছে তাতে উঁচু সিলিংয়ে কাঠের মোটাসোটা কড়ি-বরগায় উইয়ের আবাস বুঝতে পারা যায়। তিনতলার কার্নিশ থেকে হঠাৎ একটা পায়রা বকম বকম করে চুপ করে গেল। রকের একদিকটায় কাঠের পার্টিশান, তার পিছনের ঘরে রেডিয়ো থেকে সুর করে ধর্মীয় কিছু পাঠ ভেসে আসছে।
ওরা দোতলায় উঠল। সিঁড়িটা তিনতলায় যাবার জন্য যেখানে ঘুরেছে সেখানে মুখোমুখি দুটো দরজা।
”তোরা দাঁড়া, আমি গিয়ে ব্যাপারটা আগে বলি।” কণার মনে হল দেবুকে একটু যেন ঘাবড়ানো দেখাচ্ছে।
”তোদের হস্টেলে গিয়ে থাকা যায় না? কণা প্রায় মরিয়া হয়ে বলল।
”ওই ছেলেদের গাদায় একটা মেয়ে!”
”সবাইকেই তো চিনি, ভয়টা কিসের?”
”চুপ করে দাঁড়া তো।” দেবু ধমকে উঠল। ”একটা ছেলেও তাহলে সারা রাত ঘুমোতে পারবে না।”
খুট খুট কড়া নেড়ে দেবু ইশারায় ওদের পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াতে বলল।
”কে?” স্ত্রীলোকের গলা ভিতর থেকে।
”কাকিমা আমি, দেবু।”
দরজার পাল্লা প্রথমে অল্প খুলল। আবার ”কে?” বলেই পুরো খুলল।
”ওম্মা! খবর কী, ভেতরে এস।”
গলার স্বরটা মিষ্টি এবং আন্তরিক। কণা আশ্বস্ত হল। দরজা বন্ধ হবার পর কল্যাণ বলল, ”বাড়িটা কতদিনের বল তো?”
”বঙ্কিমের আমলের।”
”অত নয়, বঙ্গভঙ্গের দু-চার বছর আগে পরে হবে। যখন তৈরি করে বাড়িওলার তখন টাকা ছিল। মেঝের পাথর দেখেছিস?”
”মার্বেল?”
”ধেৎ, এগুলো মার্বেল নয়। কোটা পাথর, কম দামি। তাহলেও…দরজাটা সেগুনের।”
”তুই কাঠ চিনিস?”
কল্যাণ প্রশ্নটা এড়িয়ে বলল, ”কাল সক্কালেই বাড়ি চলে যাবি, বাবা-মা’র তো চিন্তায় সারারাত ঘুম হবে না।”
”বাবাও তো কলকাতায়, অফিসে। নিশ্চয় ফিরতে পারেনি। এখন কোথায় যে আছে কে জানে।”
”অফিসের টেবলে শুয়ে পড়বেন কিংবা চেনাজানা কারুর বাড়িতে। তুই যে কলকাতায় সেটা কি জানেন?”
”হ্যাঁ। কলেজে যাব এটা তো…।”
দরজা খুলে দেবু বলল, ”আয়।”
ভিতরে ঢুকেই কণা দেখল, প্রায় মায়ের বয়সি কিন্তু মায়ের থেকে অনেক সুন্দর, আটপৌরে ভাবে পরা উজ্জ্বল সবুজ পাড় হালকা মেরুন তাঁতের শাড়ি, গড়ন দোহারা, মুখাকৃতি পানের মতো, কপালে বড় সিঁদুর টিপ, মাজা গায়ের রং, হাতে শাঁখা-রুলি, কয়েক গাছা চুড়ি সম্ভবত সোনার, আলগা খোঁপা। ঠোঁট দুটিতে হাসি এবং কৌতূহল নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে।
”আমার কাকিমা, আর এই হল…”
কল্যাণের আগে কণা প্রণাম করল। পায়ে টাটকা আলতা এবং আঙুলের গড়ন তার ভালো লাগল।
”বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করতে আসা কেন, একেবারেই তো ভেতরে নিয়ে চলে আসবি। বোসো তোমরা।…এমন একটা বিপদের সময়ে মানুষ এলে তাকে কি বলব না থাকতে দেব না।”
ঘেরা বারান্দা। দেয়াল ঘেঁষে সরু একটা তক্তপোশ তাতে পাতলা তোষকের উপর ফুলকাটা চাদর আর দুটো তাকিয়া। কথাগুলো শুনেই কণার শরীর চাইল এখুনি বিছানাটায় লুটিয়ে পড়তে। রায় অ্যান্ড ঘোষ থেকে বেরুনোর পর শুধুই হেঁটেছে, এখনও পর্যন্ত একবারও বসার সুযোগ পায়নি।
”ঘরে এসো, কাপড় দিচ্ছি বদলে নাও।”
বাধ্যের মতো কণা ঘরের দিকে এগুলো। তার এমন ঝিমুনি এসেছে যে দেবু বা কল্যাণের দিকে একবার তাকাতেও পারল না।
দুই
স্ট্যান্ডে টিভি সেট, তিনজনের মতো শোবার খাট, একটা স্টিলের আর একটা কাঠের আলমারি যার উপরের পাল্লা কাচের, দাঁড়ানো একটা আলনা, আয়না লাগানো ড্রেসিং টেবল। এতৎসত্ত্বেও ঘরটায় যথেষ্ট জায়গা রয়েছে নড়াচড়ার। আলনায় ভাঁজকরা শাড়ি সাজানো। কিন্তু তিনি স্টিলের আলমারি থেকে ধোবাবাড়ির কাচা একটা ছাপাশাড়ি বার করে দিলেন।
”হিমু, তুমি এখন একটু বাইরে যাও।”
”কেন, দেখব না?”
”একটু পরে, দিদির কাপড় ছাড়া হলে এসো।”
কণা লক্ষ্য করেনি খাটের এক কোণে দুই হাঁটু জড়িয়ে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটি বালক বসে। টিভি চালু রয়েছে কিন্তু শব্দ এত কমানো যে প্রায় অস্ফুট। দেবু বলেছিল, এরা নিঃসন্তান, তাহলে এ কে?
হিমু একবার মাত্র কণার দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
”বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছ?”
”প্রায় ন’টা।”
”বাথরুমটা দেখিয়ে দিচ্ছি এসো।”
কণা বাথরুম থেকেই শুনতে পেল কেউ একজন এসেছে। ”আরে কি ব্যাপার দেবু যে, থাক থাক…” শুনে সে বুঝল ছানুকাকু। ”যা ব্যাপার আজ হল, যা ঘটে গেল অবিশ্বাস্য, এমন পাওয়ারফুল লেডি, তিনিই কিনা…দুপুরেই আমি বাড়ি চলে এসেছি দোকান বন্ধ করে…চা ফুরিয়ে গেছে তাই কিনতে বেরিয়েছিলাম, সব বন্ধ, শেষে কুমোরটুলিতে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে খানিকটা চেয়ে আনলাম। সকাল পর্যন্ত চলে যাবে….একটু করে দাও তো, অনেকক্ষণ খাইনি।”
বাথরুমের লাগোয়া রান্নাঘর। কণা শুনতে পেল, ”মিনিটে মিনিটে চা না হলেই মাথা খারাপ, দেবু বস তোরা, একটু কিছু মুখে দিয়ে যাবি।”
কণার যে অস্বস্তিটা এতক্ষণ ছিল, সেটা সহজ হয়ে আসছে। ছানুকাকার স্বর এবং বলার ভঙ্গি বন্ধুত্বমূলক। লোক কম, জায়গাও আছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সব থেকে বড় কথা দুটি মানুষই গোমড়া নয়। সহজ গেরস্ত এবং সচ্ছল। অচেনা মানুষকে আপন করে নিতে পারে।
এই গুণটা তার মায়ের একদমই নেই, বোধহয় স্কুলে পড়াতে পড়াতে এটা হয়েছে। সে নিজেও দেখেছে শুধু মেয়েরাই নয়, টিচাররাও মাকে ভয় করে, সমীহ করে, শ্রদ্ধাও করে। হেড মিস্ট্রেসদের কঠোর পক্ষপাতহীন হতেই হয়। বাবা প্রচুর কথা বলে কিন্তু বাড়িটা ভরিয়ে রাখার মতো যথেষ্ট নয়। অবশ্য সারাদিনে কতটুকুই বা বাড়িতে থাকে!
কণা যেমনটি ভেবে নিয়েছিল ছানুকাকা একদমই সেইরকম দেখতে নন। বেঁটে কুচকুচে কালো এবং দু পাশ থেকে চুল টেনে এনে টাকের উপর বিছিয়ে দেওয়া। সোনালি সরু ধাতুর ফ্রেমের চশমা। বয়স বাবারই মতো, পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাথরুম থেকে কণা বেরিয়ে আসতেই তিনি অবাক হয়ে তাকালেন।
দেবু নড়েচড়ে বসল। ”এ হল কণা আমাদের সঙ্গেই…কলেজে আমরা এক ক্লাসেই…হিন্দমোটরে থাকে, ট্রেন বন্ধ তাই…এখানে আনলাম।” টেলিগ্রামে খবর জানাবার মতো হল ওর কথাগুলো।
”ফাইন ফাইন, থেকে যাও রাতে।” ছানুকাকা উৎসাহে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ”কোনো অসুবিধে হবে না মানে আমাদের হবে না।”
প্রণাম করবে কি করবে না ইতস্তত করছিল কণা। কল্যাণ চোখের ইশারায় করতে বলল।
”থাক থাক এসব তো…নাম কী? ওহহ কণা…পুরো নাম কী?
”কণা দাশগুপ্ত।”
বদ্যি!” ছানুকাকা খুবই অপ্রতিভ হলেন। কাউকে উদ্দেশ্য না করে বললেন, ”কেন এরকম হল বল তো? কে মারল? কারা মারল?”
প্রশ্নগুলো কে তুলে নেবে? তিনজনেই নিজেদের মধ্যে একবার তাকাল। বাড়িতে নিশ্চিন্ত পরিবেশে অনুৎকণ্ঠায় থাকা মানুষদের আজকের ঘটনা নিয়ে কথা বলার জন্য যত শারীরিক ও মানসিক উৎসাহ রয়েছে তার দশ ভাগের একভাগও, উদ্বেগ ও উত্তেজনা নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত, বিশ্রামের ও নিরাপত্তার জন্য ব্যস্ত এই তিনজনের মধ্যে এখন নেই। কল্যাণই মুখ খুলল, ”বলা তো খুব শক্ত, কাল সকালে খবরের কাগজ না পাওয়া পর্যন্ত আসল ব্যাপার জানা যাবে না।”
কোথায় দিল্লি আর কোথায় আমরা! এখানে তো সব আন্দাজে ধরে নেওয়া হচ্ছে। রেডিয়ো, টিভি তো গর্ভমেন্টের হাতে, যতটুকু গর্ভমেন্ট জানাতে চায় ততটুকুই জানাবে, তার উপর ভিত্তি করে কথা বলে লাভ কী!” দেবু টেনেটেনে তার স্বরে শ্রান্ত ভঙ্গি আরোপ করে এক ধরনের বিজ্ঞতা নিয়ে এল, যার ফলে কথাগুলো যুক্তিবান মনে হল।
”তা ঠিক, তা ঠিক। তবে উগ্রপন্থীরা যখন মেরেছে বুঝতে হবে ওই অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে সোলজার ঢুকিয়ে উনি যা করেছেন হয়তো এটা তারই প্রতিক্রিয়া।”
ওরা কেউ কথা বলল না।
”তোমরা ঘরে এসে বসো না, টিভি আছে।”
”না কাকা, তাড়াতাড়ি হস্টেলে যেতে হবে কল্যাণকে নিয়ে, এখন বসে বসে গীতাপাঠ আর ভজন আর শোকভাষণ শোনা, অসম্ভব।”
রেকাবিতে লুচি আর আলু ছেঁচকি নিয়ে কাকিমা এলেন। বিনা ভণিতায় তিনজনে সেগুলো হাত বাড়িয়ে নিল।
”হিমু, লুচি খাবে তো এসো।” কাকিমা শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন।
”এখানে দিয়ে দাও।” ঘরের ভিতর থেকে আদেশের মতো উত্তর এল।
”ছেলেটা কে?” দেবু জানতে চাইল ছানুকাকার কাছে।
”নিচে থাকে। ওর মা বেহালা ছাড়িয়ে সেই ঠাকুরপুকুরে একটা অফিসে কাজ করে। আজ যা অবস্থা, অতদূর থেকে হেঁটে আসা…এখন তো ফেরেনি?” ছানুকাকা চিন্তিতমুখে লুচির রেকাবির জন্য হাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞাস করলেন, ”হিমুর মা তো ছ’টা সাড়ে ছ’টার মধ্যেই এসে যায়।”
”সে তো অফিস খোলা থাকলে। আজ কি আর কোথাও পুরো অফিস হয়েছে?”
”ভাবনা ধরিয়ে দিল। হেঁটে ঠাকুরপুকুর থেকে একটি মেয়ের পক্ষে আসা!”
কণার মনে পড়ল বাবাকে। রেললাইন ধরে যারা হেঁটে যাচ্ছে তাদের মধ্যে বাবা ছিল কি? কলকাতায় থাকলে বাবা রাতটা কোথায় কাটাবে? তার মনে হল, বাবাও এখন ঠিক এই চিন্তাই করছে তার জন্য।
দেবু আর কল্যাণ চা খেয়ে চলে গেল। দরজা পর্যন্ত গিয়ে কণা জিজ্ঞাসা করেছিল, ”কাল নিশ্চয় কলেজ বন্ধ থাকবে, পরশু তোরা আসছিস?”
”এখন সাতদিন দেশে কোনো কাজকম্ম হবে না। বরং এই সময়টায় পরীক্ষার স্কেচগুলো করে নেব। তোর হয়েছে?”
”কয়েকটা হয়েছে।”
”কাল ভোরে আসব? নাকি নিজেই চলে যেতে পারবি? ছানুকাকাকে বলিস পনেরো নম্বর বাসে তুলে দেবে।”
রান্নাঘর থেকে কাকিমা জানতে চাইলেন রাতে সে ভাত না রুটি খায়।
”যখন যেটা হয়, তবে ভাতই আমার পছন্দ।”
”কে রান্না করেন?”
”মা।…আমিও মাঝে মাঝে…।”
ছানুকাকা তাকে ঘরে এসে টিভি দেখার জন্য ডাকলেন। কণা ইতস্তত করল। শুধু তো দেখা নয়, তখন কথাও বলতে হবে, যেটা একদমই এখন তার ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এখন অন্তত তার এদের কথামতো চলাই উচিত। সে ঘরে এল।
ছানুকাকা আর হিমু খাটে পা ঝুলিয়ে বসে। ঘরের আলো নেভান। কণাকে দেখে হিমু সরে জায়গা করে দিল। টিভিতে বিশেষ খবর পড়ছে একটি মেয়ে।
”ইন্দিরার ছেলে রাজীব প্রাইম মিনিস্টার হল।” ছানুকাকা একটু অবাক যেন। এতক্ষণ বোধহয় বিশ্বাস করেননি ইন্দিরা মৃত। ”রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ নেওয়া হয়ে গেছে পৌনে সাতটায়, সেটা দেখা হল না। সত্যিই তাহলে মারা গেছেন!”
কণাও অবাক। হঠাৎ-ই সময়টা জানতে ইচ্ছা করল তার। হাত তুলে ঘড়িটা দেখতে না পেয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবল। বাথরুমেই কি গা ধোয়ার সময় খুলে রেখেছে? তারপরই মনে পড়ল, চিৎপুরের কাছে রাস্তাটা অন্ধকার দেখে দেবুই বলেছিল, সোনা টোনা গায়ে থাকলে খুলে রাখতে। জায়গাটা ভালো নয়। গহনা সে পরে না। ঘড়িটা তার খুবই পছন্দের, এটা ছিনতাই হোক তা সে চায় না। তখন খুলে ঝোলার মধ্যে রেখেছিল। সেটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা। উঠে গিয়ে সে ঝোলাটা আনল।
ঘড়ির সঙ্গে সে স্কেচ খাতাটাও বার করল। বাইরে সদর দরজায় খুট খুট হতেই ছানুকাকা, ”কে” বলে হাঁক দিয়ে উঠে গেলেন। কণা খাতাটার কয়েকটা পাতা উল্টে, টিভির স্ক্রিনের আলোয় ভালোভাবে দেখতে না পারায় সেটা খাটেই রেখে দিল।
”আমি এটা দেখব?”
হিমু বড় বড় চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কণা, কণা খাতাটা এগিয়ে দিল।
”অন্ধকারে দেখবে কী করে?”
”বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখব?”
কুণ্ঠিত অনুরোধ। কণা মাথা হেলালো। ছেলেটিকে মিষ্টি দেখতে, কণ্ঠস্বরও। ছানুকাকার সঙ্গে একটি লোক ঢুকল। পরনে লুঙ্গি আর হাওয়াই শার্ট, সম্ভবত বাড়িরই অন্য কোনো পরিবার থেকে।
”বসুন দত্তদা, বসুন। হিমু একটু ভিতর দিকে সরে যাও।”
”আমি বাইরে যাচ্ছি।”
খাতাটা নিয়ে হিমু বেরিয়ে গেল। কণাও বাইরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল।
”তুমি বসো, তুমি বসো, কোনো অসুবিধা হবে না।”
”তা নয়, আমার ছোট্ট একটু কাজ রয়েছে, স্কেচগুলো যতটা পারি ফিনিশ করে রাখব।”
”টিভি দেখবে না?”
”এখন ইচ্ছে করছে না।”
রান্নাঘর থেকে ভাজা গরম মশলার চমৎকার গন্ধ আসছে। কণাকে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতে দেখে কাকিমা ব্যস্ত হলেন।
”রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়ার অব্যেস?”
”একদমই না।”
”ধোঁকা করছি। বিকেলে ডাল বাটিয়ে রেখেছিলাম, খাও তো?”
”খুব খাই। তবে আমি আপনার একটা পোট্রেট করব।” উনি বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রয়েছেন দেখে কণা আবার বলল, ”আপনার ছবি আঁকব।”
”আমার! সে কি!” লজ্জায় বিব্রত মুখটা ঘুরিয়ে রান্নায় তাকালেন।
”হ্যাঁ, খুব ইচ্ছে করছে। রাজি না হলে ধোঁকার কিন্তু নিন্দে করব। অবশ্য হাত আমার ভালো নয়, খুবই কাঁচা, তাহলেও সুন্দর মুখ কতটা খারাপ করে দিতে পারি, সেটাও তো জেনে রাখা দরকার।”
”আমার মুখ সুন্দর! হায় ভগবান।” সুখবোধের আভা ওঁর মুখে ছড়িয়ে গেছে। সেটা মুছে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, ”তোমার চোখ নিশ্চই খারাপ হয়েছে, ডাক্তার দেখানো উচিত। আজ অনেক ধকল গেছে তোমার, আজ নয়।”
”রান্নাটান্না সেরে নিন, তারপর বসব।”
কণা তক্তপোশে এসে বসামাত্র হিমু স্কেচখাতার খোলা পাতায় আঙুল রেখে বলল, ”এগুলো কী?”
”বুঝতে পারছ না?”
স্কেচের দিকে কিছুক্ষণ গভীরভাবে তাকিয়ে সে চিন্তান্বিত মুখে মাথা নাড়ল।
”এটা একটা রাস্তা, লোকজন গাড়িঘোড়া যাচ্ছে। দূরে ধোঁয়া উঠছে।”
”ঘোড়া কোথায়?”
”নেই।”
”তাহলে যে বললে?”
”ওটা এমনি কথার কথা। আমরা তো অমন কতই বলি…পথঘাট…যখন পথের ধারে পুকুর কি দিঘি থাকত বা ঘোড়ার গাড়ি চলত তখন কথাগুলো তৈরি হয়েছিল আর ওগুলো মুখে মুখে চলে আসছে, ঠাকুরদা বলতেন, তার কাছ থেকে বাবা, বাবার কাছ থেকে আমি…।”
তাকিয়ে আছে হিমু। ওর মুখটি কণাকে আকৃষ্ট করছে। ভাব প্রকাশের জন্য অত্যন্ত উন্মুখ, অধীর। জলের মতো আবেগ সরে সরে যাচ্ছে মসৃণ পাতলা চামড়ার উপর দিয়ে। প্রশস্ত কপালে হালকা কুঞ্চন পড়েছে। মুখ গতিময়। স্বচ্ছ টলটলে চোখের পিছনে লাইট হাউসের রশ্মির মতো একটা তীক্ষ্ন উজ্জ্বলতা। কিছুক্ষণ পর পর ঝলসে উঠছে। অথচ অচঞ্চল। অথচ উধাও হবার জন্য চোখের মণিদুটি ব্যস্ত। অথচ চোখের দীর্ঘ পলকে আকাশে ভাসা পাখির সারল্য ছড়ানো।
একটা শরীর, অবয়ব, আকৃতি, যার চেনা ব্যাপারগুলোর সবই হাজির। চোখ, চুল, কান, ঠোঁট যথাযথই রয়েছে কিন্তু সবগুলোই আলাদা হয়ে যাচ্ছে ভিতর থেকে হিমুর নিজেকে বার করে আনার ভঙ্গিতে। সবটাই ওর নিজস্ব, কণা কখনও এমনটি আগে দেখেনি।
ওই মুখটি ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই বালকের দিকে। অদ্ভুত রহস্যের মতো অথচ কিছুই রহস্য নেই, এমন একটা বোধ থেকে কণা বলল, ”চোখে যা দেখি জিনিসগুলো কি ঠিক তাই-ই?”
হিমু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল।
”এটা কি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?”
কণা আগুনে-জ্বালা ট্রামের স্কেচটায় আঙুল রাখল। হিমুর মুখে হাসি খেলে গেল। সে মাথাটা অনেকখানি হেলিয়ে বলল, ”মা’র সঙ্গে চেপেছি।”
”কোথায় গেছলে?”
”চিড়িয়াখানা, দুবার চেপেছি। এখান থেকে ধর্মতলা আর সেখান থেকে আবার।”
”কে কে গেছলে?”
কণা স্কেচ খাতাটা ওর হাত থেকে নিয়ে, ঝোলা থেকে পেনসিল বার করল। হিমুকে স্কেচ করবে আর সেজন্য ওকে বসিয়ে রাখতে গল্পে ব্যস্ত রাখা দরকার।
”আমি আর মা।”
”ব্যস, দুজন? বাবা?”
হিমু কাত হয়ে কণার কাজ দেখার চেষ্টা করছে। খাতাটা বন্ধ করে সে বলল, ”এখন নয়। তুমি যেমন ভাবে বসে কথা বলছিলে ঠিক সেইভাবে থাক, খানিকটা হয়ে গেলে তোমাকে নিশ্চয় দেখাব।”
”হিমু অপ্রতিভ হয়ে আগের মতো এক পা ঝুলিয়ে বসল। কৌতূহল আর উত্তেজনা এবার ওকে পেয়েছে। কণার মনে হল ছেলেটি শান্ত আর ঠান্ডা।
”হুঁ, আর কে গেছল?”
”আমি আর মা। বাবা যায়নি।”
”কেন?”
উত্তর না পেয়ে কণা মুখ তুলল। হিমু তার মুখের দিকে তাকিয়ে। রান্নাঘর থেকে কাকিমা চেঁচিয়ে বললেন, ”হিমু, দেখ তো তোর মা এলো কিনা। ট্রাম বাস সব বন্ধ, একা মেয়েমানুষ, হেঁটে ঠাকুরপুকুর থেকে অতটা পথ…এখনো যে কেন…।”
বারান্দার টানা রেলিং কাঠ দিয়ে ঢাকা তার উপর লোহার ফ্রেমে সার্সি বসানো। সার্সির একটা জায়গা কেটে জানলা, সেটা বন্ধই ছিল। হিমু পাল্লা খুলে নিচের দিকে একবার তাকিয়েই বলল, ”আসেনি।”
তক্তপোশে আগের মতো এক পা ঝুলিয়ে বসে হিমু অনুমোদনের জন্য তাকাল।
”হ্যাঁ এইভাবে থাক।”
কিছুক্ষণ কণা ওর মুখে সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে দেখে শুরু করল। ”তোমার মা আছেন, বাবা আছেন, আর কে কে আছেন?”
উত্তর না পেয়ে সে তাকাল।
”আর কেউ নেই।”
”ঠাকুমা?”
”না।”
”মাসি, পিসি, মামা, কাকা…দাদা, বউদি…।”
হিমু হাসছে। কণার বলবার যেন মজা পেয়েছে।
‘নড়ো না নড়ো না…হ্যাঁ, তাহলে তুমি, মা আর বাবা, কেমন?”
”না, আমি আর মা।”
কণা চট করে তাকালো স্কেচ থেকে চোখ সরিয়ে। বিধবার ছেলে? কিন্তু বলল যে ‘বাবা যায়নি’। মারা গেলে কি ‘যায়নি’ বলতো? হয়তো যখন চিড়িয়াখানা গেছল বাবা বেঁচে ছিল।
”অ। তুমি আর মা।…মা অফিসে যায় আর তুমি?”
”স্কুলে যাই।”
”কখন যাও?”
”সকালে। আটটায় যাই, দুপুরে আসি। আচ্ছা, তোমার নাম কী?
”কণা।”
”তুমি কোথায় পড়ো?”
”কলেজে, সেখানে আঁকা শেখানো হয়।”
”তুমি আঁকা শিখছ? কণাকে মাথা নাড়তে দেখে বলল, ”আমাদেরও আঁকতে হয় ক্লাসে, রুমা আন্টি শেখায়…গাছের পাতা, পাখি ফুল…বইয়ে আঁকা আছে তাতে রং করতে হয়। দেখবে তুমি?”
”পরে।”
”দাঁড়াও আমি আসছি।”
হিমু ছুটে রান্নাঘরে গেল। ”জেঠুমণি চাবিটা দাও তো। ছবি দেখাব।”
”কাকে?”
”ওই যে ওকে।”
”ওকে’ কি? বলো দিদিকে। তোমার থেকে কত বড়ো না? দিদি বলবে। এখন ছবি নয়, পরে দেখিও।”
”না, তুমি চাবি দাও, আমি খুলে আবার ঠিক লাগিয়ে দেব।”
চাবি নিয়ে হিমু ছুটে বেরিয়ে গেল। কাকিমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
”ছেলেটা একা একাই থাকে। মা বেরিয়ে যাবার সময় দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা আমার কাছে রেখে যায়। ও স্কুল থেকে ফিরে আমার কাছেই থাকে। পরের ছেলে তো, চোখে চোখে আগলে রাখতে হয়, কিছু একটা হলে আমিই তো তখন দায়ী হব। বাড়ি থেকে বেরোতে দিই না, হারিয়ে টারিয়ে গেলে কি গাড়ি চাপা পড়লে…ছাদে বিকেলে একাই খেলা করে। কিন্তু তা কি আর ভালো লাগে, বড় হচ্ছে তো। রাস্তায় সমবয়সিরা খেলা করে, আমায় বলে জেঠিমণি একটুখানি যাই?’ শুনলে তো কষ্ট হয়, মায়াও লাগে দিই এক-আধদিন খেলতে।…সারাদিন ঘরে বন্দি থেকে থেকে ছেলেটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।”
”বয়স কত?”
”এই তো আট পেরিয়ে হিমু ন’য়ে পড়ল। ওরা ভাড়া এসেছে, আজ দশ বছর।”
”বাবা কি এখানে এসে মারা গেছেন?”
”কার বাবা!”
”হিমুর।”
কাকিমা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে, মাথা নাড়লেন।
”হিমুর বাবা তো দিব্যি বেঁচে আছেন, তবে…এখানে তিনি থাকেন না।” কাকিমা কয়েক পা এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বললেন, ”হিমুর মা দ্বিতীয় পক্ষ। ভদ্রলোক প্রথম বউ নিয়ে থাকেন অন্য জায়গায়।”
”সে কি!” কণা ধাক্কা খেল।
ড্রইং বই হাতে হিমু হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। হাঁফাচ্ছে।
”দরজায় ঠিক তালা দিয়েছ?”
”জেঠিমণি, মা এসে গেছে। আমিও তালা খুলছি আর মা’ও ঠিক তখন পিছনে..জানো জেঠিমণি,” হিমু হাত তুলে কাকিমাকে নিচু হতে ইশারা করল। তিনি মুখ নামিয়ে আনলেন। হিমু তার কানে কানে কিছু একটা বলল।
”ওহহ এই কথা তা অত চুপিচুপি বলার কী আছে, দিদি শুনলে তো কী হয়েছে?”
কণা কৌতূহলে তাকিয়ে রইল।
”হিমুর বাবা এসেছেন, আজ থাকবেন।”
আনন্দে ঝকঝক করছে হিমুর চোখ। মুখের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খুশি। ছেলেটির বিষণ্ণ ভাব কেটে গেছে। বুকটা ওঠানামা করছে দ্রুত।
”বাবা দরজা পর্যন্ত মাকে পৌঁছে দিয়ে দোকানে গেছে, না না, বাজারে গেছে মুরগি যদি পায়।”
ড্রইং বইটা ওর হাতেই ধরা, সেটার কথা একদমই ভুলে গেছে। কণা হাত বাড়িয়ে নিল।
”তুমি এটা দেখো, আমি নিচে যাচ্ছি।”
হিমু উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে দুড়দাড় শব্দ তুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
কাকিমা শোবার ঘরে গেলেন বোধহয় হিমুর মা’র ফেরার খবরটা জানাতে। একটু সময় নিয়ে ফিরলেন কিছুক্ষণ টিভি দেখে।
”সত্যিই একটা মানুষ ছিল বটে! শেষকালে কিনা গুলি করে মেরে তবেই সরাতে হল! দেখি দেখি কেমন আঁকলে হিমুকে।”
স্কেচ খাতাটা নিয়ে কাকিমা তাকিয়ে রইলেন। মুখে কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে বললেন, ”বেশ আঁকো তো তুমি। এটা কি এইরকমই থাকবে? মানে এইটেই পুরো আঁকা নাকি ওর ওপর আরও…হ্যাঁ। হিমুকে বোঝা যাচ্ছে ঠিকই, তবে থুতনিটি অত লম্বা তো নয়!”
কণা হাসছিল। সেই সময় ঘর থেকে ছানুকাকা আর লুঙ্গি পরা প্রতিবেশীটি বেরিয়ে এল।
”একদমই তো কাঁচা, পলিটিক্সের প-ও জানে না, দাদামশাই কি মা প্রাইম মিনিস্টার হলেই যে দেশের হাল ধরার ক্ষমতা থাকবে, এটা মানা যায় না। ডায়নাস্টিক রুলই বহাল রইল, সামন্ত্রতান্ত্রিক ধারণাতেই তো এখনো দেশটা চলছে।”
ছানুকাকা শুনতে শুনতে মাথা নাড়লেন।
”দেখা যাক কিছুদিন না গেলে ঠিক বোঝা তো যাবে না। তবে ক’দিন এখন আর দেশে কাজকম্মো ব্যবসাবাণিজ্য বলে কিছু থাকবে না।”
দুজনে কথা বলতে বলতে দরজা পর্যন্ত গেলেন। প্রতিবেশী বিদায় নিতেই তিনি ফিরে এসে হিমুর, তারপর অন্যান্য স্কেচ দেখতে দেখতে বললেন:
”দিলীপবাবুর কাছে শুনলাম গুলি টুলি চলেছে, শিখরা লালবাজারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। লুঠপাঠও হয়েছে, সবই শিখেদের দোকান। তবে এখন কলকাতা নর্ম্যাল।”
”আমি কাল ভোরে প্রথম ট্রেনেই চলে যাব।”
”ভোরে কেন?” কাকিমা প্রতিবাদ করলেন। ”ভাতটাত খেয়ে তারপর যেয়ো। দোকানবাজার বন্ধ, কিছুই তো রান্না করা গেল না।”
”পরে এসে ভাত খাব। তাছাড়া আপনার একটা পোট্রেট আমি করবই, অয়েলে।”
”অয়েল মানে ওই যেসব বড়লোকদের বাড়িতে অয়েল পেন্টিং, তাই?” ছানুকাকুর স্বরে সমীহ এসে গেল।
”অত বড় নয়, শুধু মুখটুকু এই কাঁধ পর্যন্ত। আমি কিন্তু কাকিমা কাল ভোরেই যাব, দুশ্চিন্তায় মা-র রাতে নিশ্চয় ঘুম হবেনা।”
”হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয় যাবে। মেয়ে রাতে বাড়ি না ফিরলে কোন মা আর সুস্থ থাকতে পারে। আমি স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসব, নিশ্চই কাল ট্রামবাস ট্রেন চলবে।”
রাত্রে খাওয়ার পর কাকিমা দালানে তক্তপোশে বিছানা পাতলেন ছানুকাকার জন্য। কণাকে নিয়ে তিনি ঘরে শোবেন। রাতে এরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন, সূর্য ওঠার আগেই ওঠেন।
”আলো নিভিয়ে দি এবার?”
”দাঁড়ান কাকিমা, একবার বাথরুম যাব। আমি নিভিয়ে দেব, আপনি শুয়ে পড়ুন।”
বাথরুমে অন্ধকার। তবে জানলাটা আধখোলা। সেটা থেকে একতলার আলো ঢুকে পড়ে, আবছা ভাবে চৌবাচ্চচা, বালতি ইত্যাদিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। নিচে কারা কথা বলছে? হিমুর গলা তারপরই একটি পুরুষের।
”চিলি চিকেন খেতে হলে চিনে দোকানে যেতে হবে।”
”আমরা যাব, বাবা?”
”নিশ্চয়।”
কৌতূহলে কণা জানলায় এসে নিচে তাকাল। পরে সে এই কৌতূহলটাকেই দায়ী করেছিল, অভিশাপ দিয়েছিল তার জীবনের প্রচণ্ডতম ধাক্কা এনে দেবার জন্য। কেন সে দমন করতে পারল না তার কৌতূহলকে, কয়েকটা সেকেন্ডের জন্যও। উপেক্ষা করতে পারত। কি দরকার ছিল নিচের দিকে তাকাবার? বহুবার এই প্রশ্ন সে নিজেকে করেছে। কপাল! নিয়তি! তা ছাড়া আর কি?
উঠোনের ধারে রকে হিমু ঝুঁকে হাত ধুচ্ছে। পাজামা পরা, গেঞ্জি গায়ে একটি লোক মগ থেকে তার হাতে জল ঢেলে দিচ্ছে। ওদের পিছনে ঘরের দরজায় পর্দা ঝোলানো, ভিতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে. পর্দার তলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে দুজনের পায়ের কাছে।
কণা থতোমতো। লোকটিকে অসম্ভব চেনা লাগল। হুবহু বাবার মতো। তার মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল, পা দুটি কেঁপে উঠল। অসম্ভব, হতে পারে না।
”সবাই মিলে যাব, তবে এখন নয়। দেখেছ তো কি গোলমাল শুরু হয়েছে।”
বাবার মতোই গলার স্বর! কণা জানলার শিক আঁকড়ে ধরে মুখটা এগিয়ে দিল। আলোটাকে আড়াল করছে তারে মেলা একটা শাড়ি। লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শরীরের আকৃতি একই রকমের। মাথার চুলও ঝাঁকরা, পাশের দিকে সিঁথি করে পাট করা।
”হিমু পর্দাটা সরা তো।”
দু’হাতে ধরা মাজা বাসন। নিশ্চয় ইনিই হিমুর মা, কলঘরের দিক থেকে এল। হিমু পর্দাটা সরাতেই ঘরের আলো বাইরের রকে এসে ওদের তিনজনকেই স্পষ্ট করে দিল।
ওহ মা গো! আর্তনাদটা কণার বুক থেকে মাথায় উঠে গেল। থরথর কাঁপতে শুরু করল। ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসছে শরীর। দেয়াল ধরে ধরে বাথরুম থেকে সে বেরিয়ে এল। আলো নেভালো। কাকিমার পাশে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর সে ফিসফিস করে বলল, ”কাকিমা, হিমুর বাবার নাম কী?”
”তুষারবাবু, তোমার মত ওরাও, ওরাও সেনগুপ্ত, কেউ হয় নাকি?
কণার মনে হল, দাড়িওলা পাগড়ি পরা একজন স্টেনগান হাতে হঠাৎ লাফিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। সে চিৎকার করে ওঠার আগেই লোকটা ট্রিগার টিপল। এক দুই তিন…আট, বারো…পনেরো, বুলেট তার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে।
সে বলল, ”না, কেউ হয় না।”
তিন
তুষার অফিসে পৌঁছেছিল দশ’টার আগেই। তিনতলায় অফিস, অনেকেই লিফটে ওঠে, সে সিঁড়ি ব্যবহার করে। আজও সে দেখে লিফটের জন্য লম্বা লাইন। তাকে দেখে লাইনে দাঁড়ানো সুভাষ এগিয়ে এল।
”তুষারদা একটু দরকার আছে আপনার সঙ্গে। একটা পরামর্শ নেব, অফিসেরই কাজের ব্যাপারে।”
দু’মাস আগে স্টোর্স বিভাগে যে চেয়ারে তুষার বসত, এখন সেটাতেই বসছে সুভাষ। বছর ত্রিশ বয়স, বউয়ের প্রথম বাচ্চচা হবে তাই বাপের বাড়িতে রয়েছে। সুভাষ শৌখিন, একটা নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত, ভারী উদাত্ত কণ্ঠস্বর। স্কুটারে অফিসে আসে, প্যান্টের বেল্টের কিনারে উপচানো চর্বি চোখে পড়ার মতো অবস্থায় এসেছে।
”অফিসের ব্যাপার?”
তুষার বিস্মিত এবং সতর্কও হল। আগস্ট মাসের উনত্রিশ তারিখে একটা চিঠি জেনারেল ম্যানেজারের কাছ থেকে তার টেবিলে এসেছিল। আগামী পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে তাকে বদলি করা হল অ্যাকাউন্টস বিভাগে। তার পদের বা মাইনের কোনো হেরফের হবে না। তিনটি ঘর পরে অ্যাকাউন্টসে একটা লম্বা টেবিলের একধারে বসে তুষার এখন লেজার খাতায় যে কাজ করে সেটা মাধ্যমিক পাস পিয়োন প্রশান্তও পারবে। তার বদলি হয়ে যাওয়ার কথাটা বাড়িতে কাউকে বলেনি।
এই বদলিটা যে হবে, তুষারের প্রত্যাশায় তা ছিল। অ্যাকাউন্টস অফিসার শেষবার তাকে যখন বলে: ”করছেন কী, এসব কী নোট দিয়েছেন? পার্টির পেমেন্ট আটকে যাচ্ছে? জি এম পর্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। এসব নোট আর দেবেন না।”…তুষার তখনই বুঝে গেছে দুর্নীতির চাকার মধ্যে পেরেক ঢুকিয়ে সেটা বন্ধ করার ফল ভালো হবে না।
”কিন্তু হাজার পঞ্চাশ টাকা চুরি করে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা কি বলব না?”
”টাকা কি আপনার না আমার? সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের টাকা, অত মাথা ব্যথার দরকার কি? এই লালচাঁদ অ্যান্ড কোম্পানির লোক তো আপনার কাছে গেছল। মনে রাখবেন এরা কিন্তু খুব পাওয়ারফুল, ওদের লিঙ্কটা উপরে অনেক দূর পর্যন্ত।”
”বলো কী কাজের ব্যাপার?”
”আপনি সিটে বসুন গিয়ে আমি যাচ্ছি।” সুভাষ আবার লিফটের জন্য লাইনে গিয়ে দাঁড়াল।
তিনতলায় পৌঁছে তুষার দেখল অফিসের তিনটি ছেলে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে, তাকে দেখেই, একজন চেঁচিয়ে উঠল, ”তুষারদা স্পোর্টস এই নভেম্বরেই, পনেরোই। আপনি নামছেন।”
”তুষারদা তো এখনো ভেটারেনদের ‘এ’ ক্যাটেগরিতে, তাই তো?”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনো পঞ্চাশ হয়নি, আমি ওর সার্ভিস হোল্ডার দু মাস আগে, অ্যাকাউন্টসে যখন এলেন তখনই দেখেছি এখনো বছর দেড়েক বাকি…কিন্তু শরীরটা কী জব্বর রেখেছেন! আপনার ভেটারেনে নামা উচিত নয়।”
তুষার শুধুই হাসল। তিনজনই অল্পবয়সি। ওদের মধ্যে অনির্বাণকেই শুধু চেনে। অফিসের কাজ বাদে আর সব ব্যাপারে অত্যন্ত খাটিয়ে। খবরও রাখে, বিশেষ করে খেলার। লিফট থেকে বেরিয়ে সুভাষ তার দিকে তাকিয়ে চলে গেল।
”এবার কী প্রাইজ দেবে? প্লাস্টিকের সস্তা জিনিস দিয়ে কাজ সারবে তো?”
”না না এবার অন্যরকম কিছুর কথা ভাবছি। কাল-পরশুই বসে ঠিক করা হবে। ডাবল বেড-শীট আর পিলো কেসের সেট কিংবা কম্বল নয়তো অ্যাটাচি।”
তুষার ঘড়ি দেখল, দশটা পাঁচ। সই করে নিজের চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গেই সুভাষ এল। হাতে একটা ফাইল। ঝুঁকে সে টেবলের পাশে দাঁড়াল।
”কী করব একটু পরামর্শ দিন। এই চালান, চিঠি, জিআরএন, ইম্পোর্ট রিপোর্ট, রিজেকশান রিপোর্ট সব এতে রয়েছে, আর আমার নোট। আপনি পর পর দেখলেই সব বুঝতে পারবেন।”
”তুমি আগে মুখে বল।” তুষার নিরাসক্ত স্বরে বলল। এসব কাগজ ঘাটাঘাটি করার ইচ্ছা সে হারিয়ে ফেলেছে দু মাস আগে। তার পাশের চেয়ারের লোক এসে গেছে। ‘ওই কোণের টেবিলটায় চলো, সরকারদা ছুটিতে আছে।”
”ব্যাপারটা হল, হেড অফিস চালান করে মিলেতে মালটা পাঠিয়েছে, মিল ইম্পোর্ট রিপোর্টও তৈরি করল কিন্তু অর্ধেক মাল, বয়লার আর মেসিনের প্রায় পঞ্চান্ন হাজার টাকার স্পেয়ার পার্টস রিজেক্ট করেছে অথচ মালটা পার্টির কাছে কিন্তু ফেরত যায়নি। এদিকে যে চালানে হেড অফিস থেকে মাল গেছে সেই চালানটাই পাওয়া যাচ্ছে না, তার মানে মাল যেন হেড অফিস থেকে মিলে যায়নি। কিন্তু মিল ইম্পোর্ট রিপোর্ট তৈরি করে ফেলেছে।”
তুষার ফাইলের কাগজগুলোর কয়েকটা উল্টে বলল, ”রিজেকশন রিপোর্টটা কোথায়? ওটা তো রিজেকশন প্রমাণ হিসেবে সাবমিট করতে হবে। তাছাড়া হেড অফিসের যে চালানে মাল গেছে সেটাই বা কোথায়? তাতে তো লরির নাম্বারও থাকবে।”
”কিচ্ছু নেই। চালান পাওয়া যাচ্ছে না।” সুভাষ অসহায় ভঙ্গি করল হাতের তালু উল্টে। ”পার্টিকে ফেরৎ দেওয়া হয়নি যখন, রিজেক্ট মালটা তাহলে মিলেই আছে। এদিকে হেড অফিসের চালান দেখিয়ে এই দেখুন, পার্টি বিল দিয়েছে অথচ চালানটা মিসিং।”
তুষার মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করল। সুভাষও মিট মিট করে হাসি হাসল।
”স্টোরে মাল নিশ্চয়ই ঢুকেছে নয়তো ইম্পোর্ট রিপোর্ট তৈরি হবে কেন? আবার হেড অফিসে চিঠিও রয়েছে মাল রিজেক্ট হয়েছে। চমৎকার!” তুষার ফাইলটা বন্ধ করে সুভাষের দিকে ঠেলে দিল।
”আমি নোট দিয়েছিলাম, রিজেক্ট মাল পার্টিকে ফেরত দেওয়ার কোনো ডকুমেন্ট নেই।”
”মিলের স্টোরস ইনচার্জ তাহলে ফাঁসবে। রিজেক্ট মাল ফেরত যায়নি মানে স্টোরেই আছে।”
সুভাষ মাথাটা হেলিয়ে বোঝাল তাই-ই। ফাইলটা আবার খুলে একটা চিঠিতে আঙুল রাখল।
”মিল চিঠি দিয়েছে আই আর নম্বরটা ক্যানসেল করে ফ্রেশ নতুন নম্বর বসানো হোক। তাই হয়েছে। পার্টিকেও জানিয়েছে তোমার চালান ক্যানসেল, ওই মাল অন্য অর্ডারের এগেনস্টে অ্যাডজাস্ট করা হয়েছে। তুষারদা এর মানেটা নিশ্চয় জানেন, রিজেক্ট মালই অ্যাকসেপ্ট করা হল। পার্টি তারপর ফ্রেশ চালান দিয়েছে। এখন এই দেখুন পেমেন্টের জন্য বিল সাবমিট করেছে।”
”তা তোমার মুশিকলটা কোথায়?”
”কিন্তু আগের ক্যানসেল হওয়া মালটা গেল কোথায়, রিজেকশান মেমো কোথায়, যদি এই সব প্রশ্ন অডিট করে তখন জবাব দেবার কিছু তো নেই।”
”তাহলে তোমার নোটে তাই লিখে দাও।”
”লিখে দেব!”
তুষার এইবার সচকিত হল। সুভাষ কী বলতে চায় সেটা ওর চাহনিতেই ধরা পড়েছে…’এই নোট দিয়েই তো আজ আপনি এই টেবিলে চালান হয়েছেন, আমাকেও কি তাই’…তুষারের মুখ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠল।
”পরামর্শের জন্য আমার কাছে কেন এসেছ? সুভাষ, তোমার বিবেকের সঙ্গে কথা বলো। সেই তোমার বড় বান্ধব…বড় শত্রুও। তোমার পাশেই বড়বাবু নাহাতা আছেন, পার্টিদের সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা ভালোই, ওঁকেই জিজ্ঞেস করে নিতে…’ তুষার বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে পারল না। চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে অনির্বাণ।
”ইন্দিরা গান্ধিকে গুলি করেছে…ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করেছে।”
কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিমূঢ় হয়ে রইল ঘরটা।
”কোথায় খবর পেলে, কে দিল?”
”বাজে খবর, কারা রটাচ্ছে?”
অনির্বাণ হাঁফাচ্ছে, মুখে রক্ত জমেছে, চোখ বিস্ফারিত।
”এক ভদ্রলোক কাজে এসেছেন। তিনিই বললেন, আসার সময় পিটিআই অফিসের সামনে ভিড় দেখে খোঁজ নিয়ে শুনে এলেন।”
”বেঁচে আছেন না মরে গেছেন?”
”বাজে গুজব।”
”কেন হতে পারে না? স্বর্ণমন্দিরে যেভাবে মিলিটারি দিয়ে অপারেশন করালেন…ওরা কি ছেড়ে কথা বলবে? কে গুলি করেছে বলেছে কিছু?”
”রেডিয়ো…অফিসে একটা রেডিয়ো থাকা উচিত। ক্রিকেটের সময় তো গণ্ডা গণ্ডা দেখা যায়!”
”সেসব কিচ্ছু এখনো জানা যায়নি। শুধু একটা ফ্ল্যাশ এসেছে মাত্র।”
”এত বড় ব্যাপার আর পিটিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠান, মিথ্যে খবর কি আর দেবে?”
এরপরই বিশৃঙ্খল কথাবার্তায় ঘরটা ভরে গেল। অনেকেই বেরিয়ে গেলেন খোঁজখবর নিতে! উপরতলা থেকে দ্রুত কিছু লোক নেমে এল। প্রত্যেকেই নিজের বিস্ময়কে প্রকাশ করার জন্য ব্যস্ত, আবেগকে কীভাবে বার করে দেবে সেটা বুঝতে না পেরে অনেকেই অস্থির। এত বড় ধাক্কা দেওয়া ঘটনা জীবনে খুব কমই আসে, বিশেষত অপ্রত্যাশিত, অস্বাভাবিক অঞ্চল থেকে।
অফিসের বাইরে ঘুরে দু’চারজন নানান খবর নিয়ে আসছে। তুষার পিছনের বারান্দায় বেরিয়ে এসে নিচের উঠোনে দেখল প্রতিদিনের মতোই। দরোয়ানদের ঘর, ক্যান্টিনের রান্নাঘর, একটা কালো প্যান্ট আর রঙিন ফ্রক শুকোচ্ছে দড়িতে, কয়েকজন এ’ধার থেকে ও’ধার গেল। অন্য বাড়ির জানলা দিয়ে যা দেখল তাতে মনে হল উত্তেজনা সব অফিসেই একভাবে নাড়া দিচ্ছে। বারান্দার একধারে ডেসপ্যাচের মণিরুল দাঁড়িয়ে। তুষারকে দেখে এগিয়ে এল।
”শুনেছেন কি কে গুলি করেছে।”
”না, কেন?”
”এমনি।” তারপর খাপছাড়াভাবে বলল, ”আমরা হিন্দু এলাকায় থাকি।”
”তাতে কী হয়েছে?”
মণিরুলের শুকনো মুখ। ভিতরের টান টান ভয় ওর ঠোঁটে হাসির মতো একটা করুণ ব্যাপার তৈরি করল।
”যদি কোন মুসলমান গুলি করে থাকে?”
তুষার থ হয়ে রইল। এটা তো তার মাথায় আসেনি! এখনো সে জানে না কে গুলি করেছে। সে প্রায় ছুটেই ঘরের মধ্যে এল।
”জানো? খবর পেয়েছ কি, কে মেরেছে?”
”নিউজ এজেন্সি বলছে, পিএম মারা গেছেন আশঙ্কা হচ্ছে।”
”কিন্তু কে বা কারা মারল?”
তুষার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে উঠে এল অনির্বাণ।
”শেষ।” প্রায় চিৎকার করে উঠল সে। ”মারা গেছেন, পাক্কা খবর। এই একটা চল্লিশে দিল্লি থেকে খবর এল।”
”কে মেরেছে গুলি?”
”ওঁরই বডিগার্ড, দু’জন।…বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশেই যাচ্ছিলেন…”
”বডিগার্ডরা কোন জাতের? কোন ধর্মের।”
”শিখ।”
”ঠিক বলছ?”
”তাই তো শুনলাম।”
তুষারের বুক থেকে বিরাট একটা ভার নেমে গেল। একটি স্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে বুকের খালি জায়গাটা আনন্দে ভরে গেল এবং সেটা অনুভব করা মাত্র অসহায় বোধ করল। এখন আনন্দ! এই বিশাল শোক আর দুঃখের মধ্যে? কিন্তু এই অনুভূতিটার উপর আমার তো কোনো হাত নেই। কোনো অনুভূতির উপরই কি থাকে? এগুলো তো আমি তৈরি করি না, ঘটনায় করিয়ে দেয়। মণিরুল আরতার পরিবার নিরাপদ হয়ে গেল। বিশাল ইন্দিরা গান্ধীর পাশে এই স্বস্তিটুকু তুচ্ছই, নিজেকে অপরাধী করার মতো যোগ্যতাও এর নেই। কিন্তু মণিরুলরা বেঁচে গেল। খুনিরা মুসলমান নয়।
কণা এখন কোথায় কী করছে? ওর তো এখন কলকাতায় থাকার কথা! তুষারের মনে হল, খবরটা শুনেই কণা ‘এ এ এ মা আ আ!’ বলে ডানহাতের তালু মুখে চেপে ধরবে। এইভাবেই ও অবাক হয়।
”গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে, প্রায় রায়টের মতো।”
”কে বলল? দেখেছে কেউ?”
”হ্যাঁ দেখেছে। ট্রাম বাস সব বন্ধ হয়ে গেছে। ভবানীপুরে, হরিশ মুখার্জি রোডের মোড়ে ট্যাক্সি জ্বলছে, হাজার হাজার লোক নাকি বড়বাজারের গুরুদ্বার অ্যাটাক করেছে। ট্রাম-বাসও পুড়েছে।”
ঘরে আতঙ্ক দেখা দিল। সবাই ব্যস্ত বেরিয়ে যেতে। হাঙ্গামা আর ট্রাম-বাস বন্ধ হলে, নিরাপদে বাড়ি ফেরার তাগিদটাই প্রথম ও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। তুষারের প্রথমেই মনে পড়ল কণার কথা। হেঁটে হাওড়া স্টেশন যেতে হবে। যে পথ ধরে যেতে হবে, সেই পথগুলো দ্রুত সে চোখে ভাসিয়ে তুলল। চৌরঙ্গিতে গোলমাল হবে না, ডালহৌসির অফিস পাড়াতেও নয়। তারপর স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাওড়া ব্রিজের দিকে যদি যায়…ওখানে অজস্র গোডাউন, স্টেশনে যাবারও পথ। শিখদের বাস ট্রাক আর ট্যাক্সি ও পথে তো আছেই, যদি জ্বালিয়ে দেয় আর ড্রাইভারদের পিটিয়ে মারে, জ্বালাবার বা মারার লোক ওই অঞ্চলে আছেই, তাহলে কেউ বাধা দিতে এগোবে না। তখন পুলিশের গুলিটাই ভয়ের। এলোপাতারি ছুঁড়বে আর কণা যদি ওখান দিয়ে সেই সময় হাঁটে, পালাতেও তো পারবে না, এসব ও শেখেনি। তবু রক্ষে শাড়ি পরে না, সালোয়ার-কামিজে তবু ছোটা যায়।
”তুষারদা, বসে থেকে কী করবেন, বাড়ি যান।”
”ট্রাম বাস বন্ধ, গুলিটুলিও চলছে। মেয়েটা কলেজে, চিন্তা হচ্ছে।” তুষারের গলা শুকিয়ে আসছে। ”কখনো তো এই সব ঝামেলায় পড়েনি।”
”আজকালকার মেয়ে, ঠিক চলে যেতে পারবে। চিন্তা করবেন না।”
”ইন্দিরা গান্ধীও কি আজকালকার ছিলেন না? চলে গেলেন কিন্তু এভাবে যাওয়ার কথা কি ছিল?”
তুষার দুজনেরই মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল মাত্র। ঘর থেকে বেরোবার সময়ই মনে পড়ল চিনুর কথা। সে থমকে গেল।
ঠাকুরপুকুরে ইস্টার্ণ ইন্ডিয়া ইলেকট্রিক্যালসের লাইটিং প্রজেক্ট ডিভিশনে টাইপিস্ট। সেখান থেকে হেঁটে ফিরতে হবে নাথেরবাগানে। কত মাইল? ওকে ফিরতেই হবে নয়তো হিমু একা থাকবে।
”আচ্ছা ঠাকুরপুকুর থেকে নর্থ ক্যালকাটা কত মাইল?” তুষার ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল।
”বলতে পারব না, আমার কোনো আইডিয়াই নেই। ঠাকুরপুকুর তো বেহালা ছাড়িয়ে, তাই না?”
”হ্যাঁ।”
”মাইল দশ, অত কি হবে? এর বেশি যে নয় এটা বলতে পারি।”
জি এম-এর ঘরের দরজাটা দেখা যাচ্ছে। দু’জন বেরিয়ে এল। অফিসের অন্য ঘরগুলো প্রায় ফাঁকা। রাস্তায় হাঙ্গামা হচ্ছে। বেহালা, তারাতলা আলিপুর ওসব অঞ্চলেও শিখ আছে। তুষারের মাথার মধ্যে বার দুই ঝিমঝিম করল। চিনু তাহলে হেঁটেই বা আসবে কী করে? বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে হিংস্র খুনি কিছু মানুষের মধ্যে দিয়ে একা মেয়ে মানুষের হেঁটে আসাটা বিপজ্জনকই। ওকে এখুনি একটা টেলিফোন করা দরকার।
ইন্টার্নাল টেলিফোন বড়বাবুর টেবলে। রিসিভার তুলে অপেক্ষা করল অপারেটরের ‘হ্যালো’ শোনার জন্য। সাড়া পেল না।
”তুষার বৃথাই ফোন করছ, অপারেটরের বারাসাতে বাড়ি, অনেকক্ষণ সে চলে গেছে। ডাইরেক্ট লাইন আছে জি-এম-এর ঘরে, ওখান থেকে করো।”
”রায়দা আপনি এখনো যে যাননি?”
”আরে আমি তো থাকি চোরবাগানে, হেঁটে আর কতক্ষণই বা, কুড়ি মিনিট!”
জি এম-এর ঘরের দরজা ফাঁক করে সে দেখল তিনি ফোনে কথা বলছেন। ভ্রূ কোঁচকানো, কলমটা টেবিলে ঠকঠক করে যাচ্ছেন। সুভাষ একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে।
”কী ব্যাপার তুষারবাবু?”
”একটা ফোন করব স্যার, খুব জরুরী।”
”ও ইয়েস, ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখুন নাম্বার পান কিনা।”
সুভাষের পিছন দিয়ে টেলিফোনটার কাছে যেতে হল। তখন সে দেখতে পেল ফাইলটা ওর কোলে। চিনুর অফিসের ফোন নম্বরটা তার জানা। ডায়াল করেই সে ‘খুট’ শব্দটার জন্য স্নায়ুগুলো তীক্ষ্ন করে রাখল।
হয়েছে। তুষার নিশ্বাস ছাড়ল। তারপরই ও’ধারে ঘণ্টা বাজার শব্দ।
”হ্যালো, আমি একটু মিসেস সেনগুপ্ত..চিন্ময়ী সেনগুপ্তর সঙ্গে কথা বলতে চাই…হ্যাঁ ধরছি, বলুন ওর হাজব্যান্ড ফোন করছে।”
জি এম মাথা নিচু করে টাইপ করা চিঠি পড়ছেন, সুভাষ সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে। তুষার দেয়ালে টাঙানো ভারতবর্ষের ম্যাপটার দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল। চটপট কথা শেষ করতে হবে।
”হ্যালো বলুন, খুঁজে পাচ্ছেন না? বেরিয়ে গেছে নাকি?” তুষার শুনতে পেল চেঁচিয়ে লোকটি বলছে, ‘চিন্ময়ীদি কি বেরিয়ে গেছেন?’, তারপরই ”ধরুন এসে গেছেন।”
”হ্যালো, হ্যাঁ বলো?”
নরম, ব্যস্ততাহীন গভীর কণ্ঠস্বর। থিয়েটারের সেকেলে নায়িকাদের মতো টেনে টেনে বলা। চিনুর স্বাভাবিক ধরন-ই এটা।
”বাস তো বন্ধ, ফিরবে কী করে? হিমু একা রয়েছে।”
”আমিও তো তাই ভাবছি।” কণ্ঠস্বর দ্রুত হয়েছে এবং উদ্বিগ্ন ও তীক্ষ্ন। ”হেঁটেই যাব, আর কী করব?”
”পথটা ভালো নয়। তুমি অপেক্ষা কর, আমি গিয়ে নিয়ে আসব।”
”আবার তুমি এতটা পথ আসবে? কেন, আমি ঠিকই চলে যেতে পারব।”
”যা বলছি শোনো, এটা নর্ম্যাল টাইম নয়। যতক্ষণ না পৌঁছচ্ছি অপেক্ষা করবে।”
তুষার উত্তরের সুযোগ না দিয়ে রিসিভার রেখে দিল।
”প্রমাণ হল আপনি ভাগ্যবান।”
তুষার যথাযোগ্য হাসল। ”আপনি যাবেন কী করে?”
”হেঁটেই। কলেজে পড়ার সময় তরাইয়ে ট্রেক করেছি। তারপর আর লম্বা হাঁটা হয়নি, আজ হবে। গাড়ি তো চলতে দিচ্ছে না।”
”তুষারদা আপনি বাড়ি ফিরবেন কী করে? ট্রেন তো বন্ধ।” সুভাষ কথাটা বলে এতক্ষণে নিজেকে ঢিলে করল।
”সে কি। ঠিক জানো?”
”স্যারই বললেন।”
”হ্যাঁ। ছোটো শালার যাওয়ার কথা দিল্লি, রাজধানীতে। হাওড়া এনকোয়ারিতে ফোন করেছিলাম। জানালো, সব ট্রেনই বন্ধ, চলবে কি না বলতে পারছে না। তবে না চলার সম্ভাবনাই বেশি।”
নিজের নয়, কণার বাড়ি ফেরার চিন্তাটাই তার মাথায় দপ করে উঠল। মেয়েটা বাড়ি যাবে কী করে, তাহলে এখন করবে কী, থাকবে কোথায়? মাথাটা অসাড় হয়ে আসবে। সে প্রায় ছুটেই ঘর থেকে বেরোল, তার অফিস থেকে আর্ট কলেজ, খুব জোরে হাঁটলে পনেরো মিনিটে পৌঁছোতে পারবে এমন একটা আন্দাজ করে তুষার বারো মিনিটে পৌঁছোল।
কণা তার জন্য ফটকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে এমন প্রত্যাশা তার ছিল না। কিন্তু যাদের সে ঘোরাফেরা করতে দেখল, তারা যে কণাকে চেনে বা সে এখন কোথায় তা জানে এমন মনে হল না। কোনো মেয়েকে দেখতে পেলে বরং জিজ্ঞাসা করে ফল পাওয়া যেত কিন্তু একটি মেয়েও চোখে পড়ল না। সে একতলা, দোতলা, তিনতলা ঘুরল, ঘরে ঘরে উঁকি দিল। সব ফাঁকা। সিঁড়িতে বা ঘরে টাঙানো স্কেচ বা পেইন্টিং-এর ছবিগুলো তাকে মুহূর্তের জন্যও আগ্রহি করল না। ক্যান্টিনের বড় টেবিলটাও ফাঁকা। রাস্তা ভরে বন্যাস্রোতের মতো মানুষ হেঁটে চলেছে। পাঁচ-সাত লাখ লোকের সভা ভাঙলে এমন দৃশ্য দেখা যায়। তুষারের এখন লোক দেখার ইচ্ছে নেই। হয়তো হাওড়া স্টেশনে গেলে কণাকে ধরা যাবে। যাবে কি?
কিন্তু ট্রেন বন্ধের কথা যদি ইতোমধ্যে শুনে থাকে তাহলে কণা স্টেশনের দিকে যাবে না। তখন? তাদের কোনো আত্মীয় স্বজনের বাস কলকাতায় নেই। তুষারের দূর সম্পর্কের কেউ কেউ আছেন, কিন্তু তাদের ঠিকানা সে নিজেই জানে না, কণা জানবে কী করে! তাহলে কোনো বন্ধুর বাড়িতেই চেষ্টা করবে। বোকা মেয়ে নয়, নিজের ব্যবস্থা নিশ্চয় করে নিতে পারবে, করে নিতে পারা উচিত। যা দিনকাল! আর একবার কলেজ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আধ ঘণ্টা পর তুষার প্রথমবার থামল। ডান পায়ের কড়ে আঙুল জ্বালা করছে ঘষা লেগে। জুতো মোজা খুলে আঙুলটা পরীক্ষা করল। হয়তো পরে জুতো হাতে নিয়ে হাঁটতে হবে। এই সময় তার মনে হল চিন্ময়ীর কথাটায় তার রাজী হয়ে যাওয়াই ভালো ছিল। রাস্তায় উত্তেজনা, বিহ্বলতা বা শোকের প্রকাশ রয়েছে কিন্তু মেয়েদের হাঁটা-চলার পক্ষে বিপজ্জনক কিছু তার চোখে পড়েনি। ওকে বরং বললে পারত ‘শহীদ মিনারের নিচে অপেক্ষা করছি তুমি চলে এসো।’ এই কথাটা সে চিন্ময়ীকে প্রথম বলেছিল বারো বছর আগে। তারপর শুধুই বলত, ‘তাহলে কাল ওয়েট করব, সাড়ে পাঁচটায়।’ পরে বলত, ‘কাল আসছি।’
এখন ভুলেই গেছে শহীদ মিনারটাকে। ওদিকে আর তার যাওয়াই হয় না চিন্ময়ী ঘরভাড়া নিয়ে সংসার পেতে বসার পর থেকে। অফিস ছুটির পর সে সোজা চলে যায় নাথেরবাগান। তবে চিন্ময়ীকে দু’বার শহীদ মিনারটা দেখতে হয় অফিস যাতায়াতের সময়। হয়তো তখনকার সন্ধ্যাগুলোকে ওই সময় ওর কখনো কখনো মনে পড়ে। জীবনের মিষ্টি আবেগের খণ্ডগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে ধরে রাখার ক্ষমতাটা মেয়েদের অদ্ভুত জোরালো।
ইন্দিরা গান্ধীর ছবি তুলে ধরে কিছু লোকের একটা মৌন মিছিল দেখে তুষারের মনে হল, এখন তার এই মহিলাটির কথাই ভাবা উচিত কিন্তু গত দু’ঘণ্টায় তার ফুরসতই হয়নি। ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো মনকে কি সাংঘাতিক রকমের ছুট করিয়ে দেয় বহির্জগৎ থেকে। এতক্ষণ সে হিমুর কথা একবারও ভাবেনি, যেহেতু সে বিপদের বাইরে। বাড়ির কাছেই ওর কে জি স্কুল। স্কুলের আয়া ওকে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
”এই যে এই যে, শুনছ।”
তুষার এখন মাঝের হাট ব্রিজের গড়ানে দিকে। ত্র্যস্ত হয়ে সে রাস্তার ওপারে তাকিয়ে চিন্ময়ীকে দেখতে পেল। হাত তুলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ওর সঙ্গে একটি মেয়ে এবং তিনটি পুরুষ। তুষারের কাছে অপ্রত্যাশিত এখানে ওকে দেখতে পাওয়া, সে অবাক হওয়ার থেকেও বেশি পেল স্বস্তি। আর তাকে এগোতে হবে না।
চিন্ময়ী প্রায় ছুটেই রাস্তা পার হয়ে এল। আবিষ্কারের মতো একটা আনন্দ ওর চোখে ঝকঝক করছে।
”বলেছিলাম না আমার জন্য অপেক্ষা করবে।” তুষার ছদ্ম বিরক্তিটা গলায় টেনে আনল। ”যদি না এখানে দেখা হয়ে যেত তাহলে কি হত ব্যাপারটা?”
”কিচ্ছু হত না। তোমাকে এই পথ দিয়ে তো আসতেই হবে, তাই ওরা যখন রওনা হল আমিও ওদের সঙ্গে হাঁটা দিলাম।” চিন্ময়ী উচ্ছ্বসিত স্বর হঠাৎ নামিয়ে দিয়ে, ”অফিসে লোকজন নেই, ফাঁকা, একা থাকাটা ভালো মনে হল না। তাছাড়া জানি আমি ঠিক দেখতে পাবই, হেঁটে আসতে আসতে কিন্তু নজর ঠিকই রেখেছি…কেমন পেয়ে গেলাম তো!” চিন্ময়ীকে উৎফুল্ল দেখাল এই কৃতিত্বের জন্য।
”এলাম বলেই পেলে।..ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।”
তুষারকে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে চিন্ময়ী পরিচয় করিয়ে দিল। চারজন নমস্কার করল। বাড়ি ফেরার তাগিদে আর অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে প্রত্যেকেরই উদ্বিগ্ন মুখ। সৌজন্য দেখাতে দু’চার কথা বলেই সবাই হাঁটা শুরু করল। চারজনই চেতলা, কালিঘাট, ভবানীপুরের লোক। তারা ডানদিকের বর্ধমান রোড ধরে চলে গেল বিদায় জানিয়ে।
বেলা পড়ে আসছে। তুষারের পায়ের আঙুলে জ্বলুনি শুরু হয়েছে। কিন্তু সে ঠিক করল জুতো হাতে নেবে না। শ্রান্তির জন্য কথা বলার ইচ্ছা দু’জনেরই নেই। মাথাটাও যদি এখন সুইচের মতো কিছু একটা টিপে নিভিয়ে দেওয়া যেত, তুষার বারকয়েক এই কামনা করল। কিছুক্ষণ আগে যে খিদেটা পাচ্ছিল, সেটাও এখন পাচ্ছে না।
”হল কী, পায়ে ব্যথা?”
”হ্যাঁ।”
”একটু রেস্ট নেবে?”
”আর একটু পরে।”
”জল খাবে, ওই একটা টিউবওয়েল…আমার তেষ্টা পেয়েছে।” চিন্ময়ী এগিয়ে গেল। এক প্রৌঢ় একহাতে হাতল চালিয়ে পা ধুচ্ছিল, ওকে অপেক্ষা করতে দেখে ইশারা করল জল খেতে। তুষারও জল খেল।
”এটা তো মোমিনপুরের মোড়?” তুষার ভিজে হাত দিয়ে ঘাড় রগড়াচ্ছে।
”হ্যাঁ, এরপর একবালপুর মোড়, তারপর খিদিরপুর।” চিন্ময়ী মুখস্থের মতো বলে গেল।
”লোকটা মুসলমান।”
”তাতে কী হয়েছে?”
”কিছু না, গুলি করেছে শিখ, শুনেছ কি?”
”শুনেছি। প্রাণরক্ষা করার কথা যার, সেই কিনা প্রাণ হরণ করল…অফিসে সবাই বলছিল এটা চরম বিশ্বাসঘাতকতা।…আচ্ছা আমরা তো গঙ্গার ধার দিয়ে যেতে পারি।”
”তাই যাব, সোজা আহিরিটোলা পর্যন্ত। আজ লরি, ঠেলা রিকশা নেই, হাঁটতে বিরক্ত লাগবে না।”
এক সময় ওরা আধা-তৈরি দ্বিতীয় গঙ্গা সেতুর তলা দিয়ে এসে, ম্যান-অব-ওয়ার জেটি পার হয়ে ক্রমশ মন্থর হতে হতে অবশেষে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন অন্ধকার নেমেছে। রাস্তা নির্জন।
”একটু গঙ্গা দেখব।” চিন্ময়ীর অনুরোধটা খোলাখুলি মিনতিরই মতো। তুষার কথা না বলে রেললাইন পার হয়ে পাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।
রেলিংয়ের ধারে বা ঢালু পাড়ে, গাছের নিচে বা আড়ালের বেঞ্চে যেসব জায়গাগুলো ঘন বা আবছা অন্ধকার থাকে সেখানে একজোড়া পুরুষ-মেয়েও বসে নেই। ঝালমুড়ি-বাদামের ফেলিওয়ালারাও নেই। নৌকো বাঁধা কিন্তু তাতে বেড়িয়ে আসবে বলার লোকেরা ঘাটের পথে দাঁড়িয়ে নেই। মালবাহী জাহাজে টিমটিমে আলো জ্বলছে। পঞ্চমী চাঁদ আর দূরে হাওড়া ব্রীজে মুক্তোর সারি হয়ে গেছে আলোগুলো। বাতাসে বেগ নেই। গায়ে লাগছে না বোঝা যায় না, ভাঁটা চলছে। পাড়ের ধার দিয়ে অবিরত কেঁপে বয়ে যাওয়া স্রোত এক ধরনের থেমে থাকার বিভ্রম সঞ্চার করছে, যা দেখতে তুষারের ভালো লাগছে।
”অনেকদিন পর, তাই না?”
তুষারের বাহুতে নিজের বাহু স্পর্শ করিয়ে চিন্ময়ী বলল চোখ আধো বোজা অবস্থায় গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। রেলিংয়ে রাখা তুষারের আঙুলে সে আঙুল ছোঁয়ালো। সব কিছুই আলতো কোমল ভাবে নবীন ভালোবাসার প্রথম অভিব্যক্তির মতো। তুষার মুঠোর মধ্যে আঙুলগুলোকে নিয়ে একবার চাপ দিয়েই রেখে দিল রেলিংয়ে। চিন্ময়ীর বাহু নিবিড় স্পর্শ দিল।
তুষার দু’পাশে তাকাল। এত নির্জনতায় আর এমন দিনে! সারা দেশ প্রথম ধাক্কা সামলে এখন বিষণ্ণতার মধ্যে নামছে। আর এমন সময়ে তারা গঙ্গার ধারে এইভাবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পরস্পরের ছোঁয়া নিচ্ছে। কেউ দেখে ফেললে ভাববে কি! সে জুতো খোলার ছলে একটু সরে গেল।
”মনে হচ্ছে আঙুলের চামড়া উঠেছে ঘষা খেয়ে, জুতোটা ছোট হয়ে গেছে।”
মাঝের রেলিংয়ে পা তুলে সে ঝুঁকে মোজা খুলে আঙুলে হাত বোলাল। চিন্ময়ীও মাথা নিচু করে পায়ে আঙুল রেখে আলতো বোলাল।
”রুমালটা জড়িয়ে নাও।”
ব্যাগ থেকে সে রুমাল বার করে আবার বলল, ”এই বেঞ্চটায় বসো।”
ওরা বেঞ্চে বসল।
”বেশিক্ষণ বসলে পা ভেরে যাবে আর হাঁটতে পারবে না…এখনও মাইল তিনেক যেতে হবে।” তুষার হুঁশিয়ারি দিল। চিন্ময়ী এমনভাবে হাসল যাতে ঔদার্যের বা ক্ষমার মতো মন্থর একটা অনুভব ওর মুখে ছেয়ে এল। তুষার নিজের মধ্যে শান্ত একটা বদল ঘটার মতো কিছু হচ্ছে আঁচ করল। চিন্ময়ীর লম্বাটে মুখ, চওড়া গৌর কপালে খয়েরি টিপ, চৌকো চোয়াল, কাঁধের, চিবুকের আর বাহুর ডৌল, তুষারের কাছে আবিষ্ট হবার মতো জোরালো রেখায় তৈরি একটা ছন্দ মনে হল। ওর সারা অবয়বেই এই ছন্দটা গত বারো বছর ধরে আটকে আছে, বরং বলা যায় ধরে রেখেছে।
চিন্ময়ী রুমালটা জড়িয়ে দিচ্ছে। তুষার পূর্ণদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে।
”অনেকদিন পর আমরা এখানে এলাম।” সে বলল, ”একইরকম আছে জায়গাটা শুধু ভিড়টাই যা নেই।”
চিন্ময়ী মুখ না তুলে বলল, ”আসতে ইচ্ছে করে কি তোমার?
অনুযোগ নয়, ব্যথিত প্রশ্ন, জানার জন্য কৌতূহল। যেন ইচ্ছে যদি করে তাহলে আগের মতো দু’জনে আসবে। কিন্তু এখন যেন একটা ক্লান্তি আর চাপ তুষার অনুভব করছে। দায়-দায়িত্ব বাড়ার জন্যই এটা হয়েছে। কেউ জানে না চিনু বা হিমুর কথা। না জানতে দেওয়ার জন্য অবিরাম একটা চেষ্টা তাকে চালু রাখতে হচ্ছে গত দশ বছর। ‘দু নৌকোয় পা রাখা’ কথাটার অর্থ সে বুঝেছে। ভারসাম্য বজায় রাখার এই পরিশ্রমটা থেকে রেহাই পাবার জন্য চিনু কতটা সাহায্য করতে পারে? ও কি বোঝে এসব?
উত্তর না পেয়ে চিন্ময়ী গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তুষার কষ্ট বোধ করল। আমিও কি বুঝি কতটা ঝুঁকি এই মেয়েটি নিয়েছে! কতটা সাহস দেখাচ্ছে?
”তুমি তো কাছাকাছি রাস্তা দিয়েই অফিস থেকে ফেরো, নেমে পড়তে পার। গম্বুজের কাছে সেই বেঞ্চটায় আমি থাকব। কাল…না পরের বুধবার।” তুষার আশা নিয়ে তাকাল চিন্ময়ীর মুখের দিকে।
”না থাক। হিমু একা থাকে…ওর কষ্ট হয়।”
”উঠবে?”
”আর একটু।” চিন্ময়ী আলতো করে হাতের পাতা তুষারের উরুর উপর রাখল। হালকা একটা যন্ত্রণায় সে এবার বসে যাচ্ছে। চিনুর হাতের সঙ্গে একটা উষ্ণতা তার চেতনায় উঠে এসে তাকে সহজ শিথিল করে দিচ্ছে। আশ্বাস? মমতা? সহানুভূতি? সহিষ্ণুতা? মাত্র একটা মৃদু স্পর্শের আঘাতে তার আত্মকেন্দ্রিকতা ভেঙে পড়ছে। ভাঙার একটা যন্ত্রণা তো আছেই। কিছুটা ভার কিছুক্ষণের জন্য হলেও নেমে যাচ্ছে তো! আমার যে এটা দরকার কাকে কাকে তা বোঝাব, বলব? লেজারে হিসেব রাখাই কি শুধু আমার জীবন? চিন্ময়ীর হাতের উপর হাত রাখল সে। অনেকদিন পর, এইভাবে।
ওদের পিছনে রাস্তা দিয়ে একটা পুলিশের অথবা মিলিটারি ট্রাক চলে গেল। সাইকেলে দুটি লোক যেতে যেতে চিৎকার করল:
”দাদা আজকেও প্রেম চালাচ্ছেন…বাড়ি যান, বাড়ি যান।”
তুষারের প্রচণ্ড হাসি পেল এবং হেসে উঠল। এইবার একটা ফূর্তি তাকে পাচ্ছে। চিন্ময়ীও হাসছে।
”এবার সত্যিই যেতে হয়, ওপরের বউদিকে হিমু নিশ্চয় জ্বালিয়ে মারছে।”
ওরা মন্থরভাবে হাঁটতে থাকল। কুয়াশার মতো আবছা দূরের গাছ, বাড়ি। রাস্তা নির্জন। দু’জনের পদক্ষেপের ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এখানেই একবার পাওয়ার কাট-এর মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তুষার চুমু খেয়েছিল, আচমকাই। চিনু সেটা তারিয়ে ভোগ করেও বলেছিল, ‘এমন খোলা রাস্তার মাঝে উচিত নয়।’ ‘কোথায় তাহলে উচিত?’ ‘কোথায় পাব ঘর?’ ‘তৈরি করে নিতে হবে…করবে?’ কয়েক মাস পর নাথেরবাগানে ঘর পাওয়া গেল।
”আজ ট্রেন চলছে না, তা কি জান?”
”সে কি! তুমি বাড়ি ফিরবে কী করে?”
”ফিরব না…ফুটপাথে থাকব।” তুষার ত্যারছা চোখে চিন্ময়ীর মুখ দেখার চেষ্টা করল। বিস্ময় ও দুর্ভাবনা পরপর মুখের উপর দিয়ে সরে গিয়ে এবার ঠোঁটটেপা একটা লাজুক প্রত্যাশা ফুটে উঠেছে।
”থাকবে?”
”যদি থাকতে দাও।”
চিন্ময়ী নিঃশব্দে হাসল এবং সারাক্ষণ হাসিটায় উজ্জ্বল থেকে বাড়ির দরজায় পৌঁছল। তুষারের সঙ্গে এটাই হবে তার প্রথম রাত্রিযাপন।
”একটু বাজার করার দরকার…কিন্তু সব তো বন্ধ এখন।”
”থলিটা দাও। বাজারের আশেপাশে ঠিকই পাওয়া যাবে, বাংলা বনধ হলে দেখোনি?…মুরগির দোকানটায় একবার চেষ্টা করি।”
রকের ধারে পেরেকে ঝোলান থলিটা চিন্ময়ী আনতে গেল। তুষার তখন দেখল ঘরের তালাটায় হিমু চাবি ঢোকাচ্ছে। তুষারের আন্দাজটায় ভুল হয়নি। পাটাবন্ধ মুরগির দোকানটা থেকে দশ পা দূরেই দোকানি দাঁড়িয়ে ছিল, খদ্দের বুঝে নিজেই এগিয়ে এল। ”চাই?”
”হ্যাঁ। বন্ধ করে রেখেছ কেন?”
”সবাই রেখেছে। দরকার কি ঝুট ঝামেলায় পড়ে, কত বড় চাই?”
”সাত-আটশো।” বলেই তুষারের মনে হল একটু বেশিই নেওয়া যাক, ঠান্ডা পড়েছে, রাতে রেখে দিলে নষ্ট হবে না। কাল তো বনধ হবেই।
”এক কিলোর মতো আছে, চল্লিশ টাকা পড়বে।”
”সে কি! …আচ্ছা দাও, কেটে-কুটে বানিয়ে দিও।”
স্বরটা নিরাসক্ত তো বটেই উদাসীনতাও একটু বেশি দেখাচ্ছে। তুষার বুঝে গেছে দরদাম এখন বৃথা। দোকানের গা ঘেঁষে সরু গলি দিয়ে লোকটি থলিটা নিয়ে চলে গেল। বন্ধ দোকানের মধ্যে সামান্য ঝটপট আর পাখির কাতর শব্দ হল। দশ মিনিট পর সে থলিটা ঈষৎ স্ফীত অবস্থায় ফেরত পেল। নিঝুম, প্রায়ান্ধকার রাস্তা দিয়ে ফিরে আসার সময় ইন্দিরা গান্ধীকে তার মনে পড়ে। থলিটার ওজন এক কিলো হবে কিনা, এই সন্দেহটা অবশ্য তার রয়েই গেল।
হিমু খুশিতে টগবগ করছে। কথার স্রোত থাকছে না, কেউ থামাবার চেষ্টাও করল না। দু’জনে শোয়ার মতো তক্তপোশে বিছানাটা গোটানো। তাইতে মাথা রেখে তুষার পা ছড়িয়ে শুয়ে, পাজামাটা গুটিয়ে হাঁটু পর্যন্ত তোলা। অল্পদিন আগে এটা চিনু কিনেছে, এখনো সাবান-কাচাও হয়নি।
ক্লান্ত বটে কিন্তু সে অবসন্নতা বোধ করছে না। হিমুর কথা সে শুনে যাচ্ছে, নিজে বলছে কম। রকের কিনারে ছোট্ট ঘেরা জায়গায় রান্না হয়। চিন্ময়ী সেখানে কেরোসিন স্টোভের পলতে ঠিক করায় ব্যস্ত। শোবার ঘরেই ভাঁড়ার। ঘর-বার করতে হচ্ছে।
”একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, হিমুকে এবার বড়, ভালো স্কুলে দেব।” হাতে গুঁড়ো সাবান মাখতে মাখতে চিন্ময়ী ঘরে এল। ”হোলি মাদার থেকে ফর্ম আনিয়েছি…বার্থ সার্টিফিকেট লাগবে ওর। সেটাও ওপরের বউদিকে বলেছিলাম শরৎকে দিয়ে যদি কর্পোরেশন অফিস থেকে ফর্ম আনিয়ে দেয়। কাল রাতে ফর্মটা আমায় দিল।”
”এতদিনেও বার্থ-সার্টিফিকেট করানো হয়নি? খুব দরকার ওটা। আমাদের সময় স্কুলে এসব লাগত না কিন্তু এখন বয়সের প্রমাণ সার্টিফিকেট ছাড়া কোথাও তো অ্যাকসেপ্টই করবে না।”
”তোমায় তো কবে, হিমুর সেই তিন বছর বয়সের সময়ই বলেছিলাম। তুমি বললে, সময় পাচ্ছি না কর্পোরেশনে যাবার আর অত তাড়ারই বা আছে কি, সব ভুলে গেলে?”
”দাও তাহলে।”
চিন্ময়ী হাত ধুয়ে এসে দেয়াল-তাকে রাখা একটা বইয়ের মধ্যে থেকে ফর্মটা বার করে কলম সমেত তুষারের হাতে দিল।
”হিমু বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি ততক্ষণ রান্নাঘরে গিয়ে একটু পাহারা দাও। ঢাকনা ফেলে নয়তো মাংস খেয়ে নেবে।”
হিমু তড়বড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মন দিয়ে সে ফর্ম পড়ছে তখন চিন্ময়ী চাপা স্বরে বলল, ”বউদি এটা দিয়ে এ কথা সে কথার পর বলল, বাবার নাম বসাতে তোমার কর্তা রাজী হবেন কিনা জেনে নিও আগে।”
”কেন?” তুষার ঝটকা দিয়ে মুখ তুলল। ”তাহলে কি ওর বাবা নেই? এমনি এমনিই জন্মাল?”
”তা নয়, একটু ঠেশ দিল আর কি। হিমু হবার পর একবার বলেছিল, ‘তোমাদের তো বিয়ে হয়নি তাহলে হিমুর পিতৃ পরিচয় কী হবে?’ বলেছিলাম ‘পিতার পরিচয়েই পরিচয় হবে।’ তাইতে তখন অনেক কথাই বলেছিল: ‘সমাজ কি তা মানবে, এখনো তো এসব দরকার হয়…বৈধভাবে বিয়ে না হলে সন্তান কি বৈধ হয়..হিমু বড় হয়ে যখন জানবে তখন ওর মনের কী অবস্থা হবে, ও তো সমাজের বাইরে হয়ে যাবে, আইনও ওকে স্বীকার করবে না’…কথা তখন বলেছিল, সেগুলোই আবার আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া।”
তুষারের মাথাটা ঘুরে উঠল। চিন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখের সামনে একটা কালো পর্দা মুহূর্তের জন্য ওকে আড়াল করেই সরে গেল। এই মুহূর্তটাকেই সে ভয় করে। অনেকে অনেক কথাই গত দুশো বছর ধরে বলে আসছে, আগামী পাঁচশো বছর ধরে বলবে, বলুক। কিন্তু আসল কথা, নিজের কাছে কে কতটা পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা মাপকাঠি থাকা দরকার আত্মায় জমে যাওয়া ময়লা আবর্জনার হ্রাস-বৃদ্ধি মাপার জন্য। তারও একটা আছে। হিমুকেও সে একটা মাপজোকের পদ্ধতি বুঝিয়ে দেবে যাতে সে সামাজিক আস্তাকুঁড়ের ফাঁসগুলোর দ্বারা বিপন্ন হতে না পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজেই বিপন্ন নিজের তৈরি প্রশ্নের দ্বারা। শুভা বা চিনু, কণা বা হিমু, এদের ভালোবাসার জন্য প্রয়োজনীয় বৈধতার ছাড়পত্র তার আছে কি? পুরোহিত বা কর্পোরেশন দ্বারা সিলমোহর করা ছাড়পত্র নয়। শুচিতা, যেটা কিনা ভালোবাসার প্রধান শর্ত, সততা যার উপর কিনা শুচিতা দাঁড়িয়ে থাকে, এ দুটো জিনিসকেই সে বৈধতা বলে জানে।
”কি এতক্ষণ ধরে ভাবছ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে?” চিন্ময়ী ঝুঁকে, কিছুটা ব্যাকুলতা ওর স্বরে। ”তুমি কি ভেবেছ আমি এসব কথা পরোয়া করি, নাকি শুনে ভয়ে মরে যাচ্ছি? ওঠো ওঠো, হিমুর সঙ্গে লুডো খেল, ও খুব ভালোবাসে।”
তুষার হাতের ফর্মটার দিকে চোখ রেখে বলল, ”কথাকে পরোয়া করো বা নাই করো, সার্টিফিকেটটাকে কিন্তু কোরো, নইলে স্কুলের গেট থেকেই বিদেয় করে দেবে।”
চিন্ময়ী বেরিয়ে যাবার আগে মুখ ভেংচে বলে গেল, ”সে বুদ্ধিটা আমার আছে।…এক ঘণ্টায় মাংস ভাত করে দেব।”
তুষার একটু অবাক হল শুধু এই ভেবে যে, এত পথ হেঁটে আসার পরও পুরণো দিনের মতো ভেংচি কাটার ক্ষমতা চিনু রাখে!
হিমু ঘরে এসেই লুডো পেড়ে বসতে বসতে বলল: ”আচ্ছা বাবা, রাস্তা দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া যায় বলি, কেমন বলি তো? ঘোড়া তো কই যায় না তাহলেও আমরা বলি কেন? পথঘাটও বলি, কই পথে কি কোনো ঘাট আছে? ঘাট তো গঙ্গায় আছে।”
”খুব শক্ত প্রশ্ন। তা এটা তোমার মাথায় এল কী করে?”
”ওপরে একটা দিদি এসেছে, ছবি আঁকে। সে রাস্তার ছবি এঁকে এনেছে, বলল রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলছে। আমি কিন্তু একটাও ঘোড়া দেখতে পেলাম না। জিজ্ঞেসা করলুম ঘোড়া কোথায়?….”
”আমি লাল ঘুঁটি নেব।” কথাটা বলেই তুষারের একবার মনে পড়ল কণাকে। মেয়েটা এখন কোথায়? বাড়ি ফিরতে না পারলে কোথায় রাতটা কাটাতে পারে?…যদি ট্রেন ইতিমধ্যে চালু হয়ে গিয়ে থাকে? কে জানে হতেও পারে! একবার স্টেশনটা ঘুরে এখানে আসা উচিত ছিল।
”তুমি কেন লাল নেবে? লাল নিয়ে তো মা খেলে; তুমি হলদে নাও।…দিদিটা আমার ছবি আঁকছিল, নিয়ে আসব?”
”না,…তুমি সবুজ তাহলে আমি নীল, আমি আগে চালব।”
”আমি কিন্তু নিজের ঘর নিজে গুণব, তুমি গুণে দেবে না। কাল মা গুণে দিচ্ছিল আর ঘর চুরি করছিল, আমি ধরে ফেলেছি।”
”আচ্ছা, আচ্ছা, তোমারটা আমি গুণে দেব না।”
হঠাৎই তুষারের মনে হল কণা তো ছবিই আঁকে আর হিমু কথিত উপরে আসা একটা দিদি’ সেও ছবি আঁকে। অদ্ভুত মিল! তবে উপরে মানে বাসনের দোকানদার পালবাবুদের সঙ্গে কণার পরিচয় থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই, শুভার সঙ্গে বইয়ের দোকানদার ছাড়া কলকাতার অন্য দোকানদারদের পরিচয় ঘটার কথা নয়। কণা এখন কোথায়? রাতটা কোনো ছেলের সঙ্গে যদি…?
চিন্তাটা কী করে মাথায় আসতে পারল? তুষার নিজের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা জাগাতে চাইল। এগুলোই, এইরকম চিন্তাগুলোই অশুচি করে দেয়। কণার নিজস্ব একটা শরীর নিজস্ব একটা মন তৈরি হয়েছে, প্রকাশের জন্য ব্যস্ততা সে দেখায় না। চারুকলার ছাত্রী, রুচি শোভনতার একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে।
”বাবা তুমি অনেকক্ষণ চাল দিচ্ছ না।”
”তুমি আমার হয়ে দিয়ে দাও।”
কণা হাল্কা বা চপল নয়। তবে চিনুর মতো সাহস দেখাবার জোর ওর নেই। কণা নিরাপদ ঘর, আশ্রয়ে থেকে বড় হয়েছে, বাবা মা আছে। চিনুর এসব কিছুই ছিল না, কোন্নগরের বাড়ি থেকে কাকারা ওকে তাড়িয়েই দিয়েছে।
”ঠিক গুনছ তো?”
”আমি মা’র মতো চুরি করি না।”
”এভাবে গুরুজনদের সম্পর্কে বলতে নেই।”
প্রেসারকুকারে স্টিম বেরোবার শব্দে রান্নার শেষ পর্যায়ের সঙ্কেত ভেসে এল। এরপর ভাত বসবে। পিছনের বাড়ির একতলায় রেডিয়ো চলছে। তুষার কানপেতে ভাসাভাসা শুনল, আজ রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীকে আনা হয়েছে। তার আর শুনতে ইচ্ছে হল না। আজ দেশের জীবনে একটা ভয়ঙ্কর দিন, তার জীবনে সুখের দিন…সম্ভবত। তুষার ঠোঁট মুচড়ে ‘আমি কি করতে পারি’ ধরনের হালছাড়া হাসি হাসল।
অন্ধকার ঘরে মেঝেয় মাদুরের উপর কম্বল-চাদর দিয়ে তৈরি বিছানায় শুয়েছিল তুষার। একটাই তোষক, চিনু চেয়েছিল কিন্তু সে তোষকটা নিতে চায়নি। তাহলে হিমু কিসে শোবে? এক সময় চিনু তক্তপোশ থেকে নেমে এল।
”হিমু ঘুমিয়েছে?”
”হ্যাঁ, ওর ঘুম খুব গাঢ়।”
খাওয়ার পর বাসন মেজে স্নান করেছে। এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। তুষার সেন্টের গন্ধ পেল। চিনু মাঝে-মাঝে ব্যবহার করে বাইরে কোথাও যাবার সময়।
”আজ তুমি অনেক হেঁটেছ, ক্লান্ত?” চিন্ময়ী মাথার বালিশে ভাগ নিয়ে পাশ ফিরে তুষারের বুকে হাত রাখল।
”এই মুহূর্তে নয়। তবে খাটুনিটা তোমারই বেশি হয়েছে…রান্নার।”
কনুইয়ে ভার দিয়ে চিন্ময়ী মুখটা ঝুঁকিয়ে তার ঠোঁট কামড়ে ধরল। সুগন্ধটা গলা, ঘাড় থেকে আসছে। বুকের উপর একটা তপ্ত স্পন্দিত ভার ক্রমশ উঠে আসছে। তখন তুষারের চোখের উপর, চিত হয়ে শোয়া একটা রক্তাক্ত নিস্পন্দ দেহের ছবি ঝলকে ফুটে উঠেই নিভে গেল।
চিন্ময়ীর খোঁপার মধ্যে আঙুল ভরে নির্মম মুঠিতে চেপে তুষার মনে মনে বলল, ‘রক্তটাও অবৈধভাবে…’। অতঃপর সে ঘাড় থেকে নিতম্ব পর্যন্ত হাত বোলাতে শুরু করল।
চার
”কাকা আর আপনাকে আসতে হবে না, এবার আমি নিজেই চলে যেতে পারব।”
ছানুকাকা ইতঃস্তত করছেন।
”ওই তো হাওড়া স্টেশন, শুধু তো ব্রিজটা পার হওয়া! কাকিমাকে বলবেন আমি সত্যি সত্যিই কিন্তু ছবি করব। যে কোনোদিন দুপুর নাগাদ চলে আসব।”
”খবর দিয়ে এলে ভালো হয়, রান্নাটান্না করে রাখব তাহলে।”
”কিছু করতে হবে না, যা পাব তাই খাব। আর হিমুর ড্রইং বইটা ফেরত দেওয়া হয়নি।”
হাওড়া ব্রিজের পুবে রাস্তাটা যেখানে বেঁকে পোস্তার দিক থেকে ব্রিজে উঠে গেছে ওরা সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ভোর ছাড়িয়ে দিনটা এইবার ফুটে উঠবে। অন্যান্য দিনের মতই একটা সকাল। মানুষজন মন্থর গতিতে চলেছে। ভোরের ট্রেন ধরার জন্য যাত্রীভরা ট্যাক্সি, গঙ্গাস্নানে মহিলারা, থলিতে যন্তর নিয়ে রাজমিস্ত্রি, সাইকেলে কাগজের হকার আর ঠান্ডা নিথর বাতাস এবং দূরে আবছা নোঙর করা জাহাজ ও মাস্তুল। কণা হাওড়া স্টেশনে এসে দেখল ট্রেন দাঁড়িয়ে। প্ল্যাটফর্মে অল্পই লোক।
”এটা কোন ট্রেন?”
”তারকেশ্বর।”
”হিন্দমোটর ধরবে?”
”ধরবে।”
ট্রেনের সামনের দিকে হেঁটে গিয়ে লাইন পার হতে হয় তাই ট্রেনের সামনের দিকের কামরায় ওঠা তার অভ্যাস। তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে, ট্রেন প্রায় ফাঁকাই। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। ওধারের জানলায় বাবা বসে, ঘাড় নামিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। কণা কামরায় উঠল।
সামনের সিটে একজন বসল। দেখার জন্য তুষার মুখ তুলেই চমকে গেল কণাকে দেখে। তারপরই হাসল।
”দুর্ভাবনা হচ্ছিল তোর জন্য, ছিলিস কোথায়? তোর কলেজে গিয়েছিলাম, কাউকে তো চিনি না..রাতে ছিলিস কোথায়?”
”এক বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়িতে। তুমি?”
”আমিও এক বন্ধুর বাড়িতে।”
কণা তার বাবার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল। জ্ঞানত সে বাবাকে মিথ্যা কথা বলতে শোনেনি, মাকেও নয়। বাবার জন্য কষ্ট বোধ করল।
”কোনো অসুবিধা হয়নি?”
”না, খুব যত্ন করেছে।”
”অবশ্য আমি ধরে নিয়েছিলাম, বন্ধুদের কারুর না কারুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা তোর হবে। তবু, যা হাঙ্গামা হচ্ছিল ওটাতেই ভয় ধরে গেছল। রাস্তাটাস্তায় ঝামেলায় পড়িসনি তো?”
বাবার চোখে অকৃত্রিম উদ্বেগ আর স্বস্তি একই সঙ্গে। এই লোকটিকেই সে চেনে। জন্ম থেকে পরিচিত…কাল রাত পর্যন্তও তাই ছিল।
”আমি তো রায় অ্যান্ড ঘোষে প্রথমে গেছলাম। ওখানে ট্রাম-বাস পুড়তে দেখেছি। শেয়ালদায়, ইউনিভার্সিটির সামনে।”
”হ্যাঁ এই তো কাগজে পড়ছিলাম, তুই পড়বি?”
”এখন নয়। …তবে আমি ওসব এড়িয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে স্টেশনে।”
ট্রেনটা ছাড়ল। তুষার ঘড়ি দেখল।
”তোর মা খুব চিন্তা করছে, আমরা দুজনেই বাড়ি ফিরিনি।”
”কেন ফিরিনি সেটা তো জেনে গেছেই, আর কোথাও না কোথাও যে রাতটায় থাকব তাও ধরে নিয়েছে। কাল কতলোক যে হেঁটে ফিরল…তুমি দেখেছ?”
”না। আমি অফিসেই তো খবর পেয়ে গেছলাম ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে। আর হেঁটে এতটা পথ যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না, যদি না একান্তই খুব জরুরি ব্যাপার থাকে। যাদের কলকাতায় থাকার জায়গা নেই তারাই হন্টন দিয়েছে।”
কলকাতায় থাকার একটা জায়গা আছে বলেই বাবা বাড়ি ফেরার দরকার বোধ করেনি। হিন্দমোটর যদি হাঁটার দূরত্বের মধ্যে হত তাহলেও কি ফেরার চেষ্টা করত? বোধহয় না।
”আজ সব কিছুই বন্ধ থাকবে। কলকাতায় চারটে থানায় কার্ফু জারি হয়েছে। কংগ্রেস মিছিল বার করবে। বারো দিন রাষ্ট্রীয় শোক।”
এখন এসব কথা শুনে তার কি লাভ? আর এসব বলেই বা সময় কাটাবার কী দরকার। কলকাতায় কি হচ্ছে বা হবে সেটা দেবাই পুকুরে একটা ঢিল ফেলার বেশি কিছু নয়।
কণা পিছনের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল। ছবির মতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে…লোল চর্মের হাত ঘিরে রয়েছে একটি শুকনো ঘাড়…স্কুল বাসে একটি বালকের চোখ, উৎকট বীভৎস চীৎকার..হিমুর মুখ।
”ঘুম পাচ্ছে তোর?”
”হ্যাঁ, ঘুম হয়নি।”
”আমারও। এত আচমকা, এত শকিং…শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এমনভাবে ব্রুটালি সরিয়ে দিল!…আর আঠারো দিন পর সাতষট্টিতে পড়তেন…বুড়িই, ষোলোটা বুলেট শরীর থেকে বার করা হয়েছে।”
কণাকে চোখ বুজে থাকতে দেখে তুষার কাগজ পড়ায় মন দিল।
স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে আট মিনিট। দোকানগুলো বন্ধ। রাস্তার ধারে সাদা কাগজে ঢাকা ইঁটের বেদীতে ইন্দিরার ছবি, তাতে বেলফুলের মালা, পিছনে একটা বাঁশের মাঝামাঝি জাতীয় পতাকা বাঁধা রয়েছে। একগুচ্ছ ধূপ জ্বলছে। আরো দুটি বেদীতে ইন্দিরার ছবি, মালা, ধূপ। বোঝাই যায় ব্যস্ততার মধ্যে করা। কয়েকটা বাড়ির জানলা থেকে তিনরঙা পতাকা বাঁশ বা কাঠ দিয়ে ঝোলানো হয়েছে। রাস্তায় অনেকে কাগজ পড়ছে, তাদের ঘিরে ছোট ছোট ভিড়।
”ডিম কিনে রাখা আছে, না?”
”আছে বোধহয়, পরশু তো ডিমওলা এসেছিল।”
দূর থেকেই ওরা দেখতে পেল বারান্দায় গ্রিলের পিছনে চেয়ারে বসা শুভাননাকে। রাস্তার দিকে মুখ। ওদের দেখতে পেয়ে উঠে ভিতরে চলে গেল।
”বোধহয় সারারাত মা বসে ছিল।’
তুষার উত্তর দিল না তবে কুঁকড়ে রইল। দরজা খুলে শুভাননা দাঁড়িয়ে, মুখে দুশ্চিন্তা সরে যাওয়ার রেশ লাগানো। তুষার ব্যস্ত হতে চেয়ে দ্রুত বলল, ”ট্রেন বন্ধের খবর পেয়েছ কখন?…যা হাঙ্গামা কলকাতায়, এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম…এই নাও পড়ে দেখ…রাতে ঘুমোওনি তো…কণা চা করে দিচ্ছে, তুমি এবার ঘুমিয়ে নাও।
”আমি ছিলাম ক্লাশের বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়িতে।”
শুভাননা কথা বলল না। মন্থর হেঁটে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। দুজনে ফিরে এসেছে এটাই তার কাছে যথেষ্ট। কোথায় ছিল তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কণা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। ছাদের ঘরটি তার। চার বছর আগে সে এখনকার বসার, ছাত্রছাত্রী পড়াবার এবং লেখালেখির ঘরটি ছেড়ে দিয়ে উপরে গেছে। ঘরটি এখন শুভাননার দরকারেই লাগে।
ছাদের ঘর বহু বছর, অসম্পূর্ণ ছিল চারটি দেয়াল আর দরজা জানালার জন্য ফাঁকটুকু নিয়ে। ঘরের জন্য তারা দরকার বোধ করেনি। অবশেষে শুভাননাই একদিন বলল, ‘ছাদের ঘরটা এবার শেষ করা দরকার। লোকজন এলে ডাইনিংয়ে বসানো…অসুবিধে হচ্ছে।’
যে দালানটাকে ডাইনিং বলা হয় তার একপ্রান্তে শুভাননা আর কণা বড় ঘরটায় থাকে, অন্য প্রান্তে তুষারের ঘর। ছাদের ঘরটা সম্পূর্ণ করে তাকেই উপরে যেতে হবে। এতে তার আপত্তি নেই। ছাদে দাঁড়িয়ে গাছপালা পুকুর, হাঁস, ছাগল, ফুটবল মাঠ দেখা যায়। কিছুটা গ্রামের আদল যা তুষারকে অনেকক্ষণ আলস্য উপভোগে সাহায্য করে। শীতের দিনে ছুটির সকালে ইজিচেয়ারে সে অনেকবার ছাদে ঘুমিয়ে পড়েছে বই হাতে। বহু গ্রীষ্মের রাতে স্নান করে উঠে এসে অন্ধকার আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাওয়ার কাট হলে কণা আর শুভাননাও ছাদে আসে বড় মাদুরটা নিয়ে।
কিন্তু ঘরটা তৈরি করে নেওয়ার চিন্তা তুষার করেনি। যে ছকটায় সংসার চলছে বরাবর তাইই থাকবে, এমন ধারণাই তার ছিল।
‘কণার আলাদা ঘর এখন দরকার। বড় হচ্ছে, ওর নিজস্ব পার্সোনালিটি এবার গড়ে তোলার সময়।…নিজের ইচ্ছেমতো ঘর সাজানো, চলাফেরা, প্রাইভেসি তাছাড়া যদি আর্ট কলেজে ভর্তি হয় তাহলে আঁকার ব্যাপারও থাকবে, সেজন্য কিছুটা জায়গা, সূর্যের আলো, নির্জনতা…নিচের ঘরে এসব তো নেই। ওকে ঘরটা করে দিয়ে, তোমার ঘরটা বসার ঘর করব।’
তুষার শুধু তাকিয়ে থেকেছিল শুভাননার মুখের দিকে, বরং সঠিক বললে নাকের পাশে দুটো পুরু কাচের দিকে যার পিছনে ওর মনের ক্রিয়াকর্মের আভাস লুকোনো থাকে। ছাদের ঘরটা নেবার ইচ্ছা যে সে কখনো প্রকাশ করেনি এজন্য তুষার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছিল। ইচ্ছাটা জানিয়ে দেবার পর প্রত্যাখ্যাত হলে সে অপ্রতিভ হতই। শুভাননা যা কিছু করে সেটা বহু আগেই ঠিক করে রাখে। ছাদের ঘর যে কণার জন্যই নিশ্চয় সেটা বাড়ির নকশা করার সময়ই মনে মনে সে ঠিক করে রেখেছিল।
এই বাড়ি শুভাননারই, তারই জমিতে তারই অর্থে। যা বলবে তা মেনে নিতে হবেই এমন কোনো বাধ্যতা সে স্বামীর উপর কোনোদিন চাপায়নি বটে কিন্তু তুষার নিজেই তা চাপিয়ে নিয়েছে। বহুবার সে ভেবেছে, ‘আমার ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা দরকার, প্রকাশ করা দরকার।’
তুষারের বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল তাদের পাশের বাড়ির এক বউ। পাত্রী সায়ান্স গ্র্যাজুয়েট, স্কুলশিক্ষিকা অর্থাৎ রোজগেরে, দেওয়া থাওয়া ভালোই করবে। বাবার এক মেয়ে। অবশ্য ছোট এক ভাইও আছে। পনেরো ভরি সোনা, দশ হাজার নগদ আর দেবাই পুকুরে ছ’কাঠা জমি মেয়েকে দেবে। তুষারের মা আপ্লুত হয়ে গেছিলেন। ছেলেকে অনুরোধ করেছিলেন রাজি হয়ে যেতে।
‘এমন সম্বন্ধ যে পাব এ তো ভাবতেই পারি না। তোর মত আছে তো?’
চারমাস আগে তুষার ভারতের বড় তিনটি জুট মিলের অন্যতম ওরিয়েন্টাল জুট মিলসের হেড অফিসে চাকরি পেয়েছে। মিলটা একদা সাহেবদের ছিল, মারোয়াড়ি কিনে নেয়।
‘সবে তো চাকরি পেলাম।’
কিন্তু তুষারের কাছে যৌতুকের জমি, সোনা, নগদ তখন এই সংসার থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন নিজস্ব একটা জীবন শুরুর উপায় বলে মনে হয়েছিল। দুই ভাই, মা, শিক্ষা ও রুচিহীনতা, স্বার্থপরতা এবং অনটনের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ঝগড়াঝাটিতে তুষার ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল। সে জানত এদের সঙ্গে সদ্ভাব নিয়ে বসবাস অসম্ভব; একসময় আলাদা হয়ে যেতেই হবে। তাহলে এই সুযোগেই নয় কেন? জমি পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা থেকে সাত-আট মাইল দূরে, ভিত আর একতলার মেঝে করার মতো টাকাও আসছে। দুজনের চাকরি থেকে জমিয়ে জমিয়ে একখানা শোবার ঘর তুলে উঠে যাওয়া যায়। তারপর একটু একটু করে সম্পূর্ণ করে নেওয়া।
কিন্তু তার বিয়ে থেকে যা কিছু প্রাপ্তির ফল ভাইয়েরা এবং মা ভোগ করতে চাইবেই।
‘কিন্তু আমার মতো পাত্রকে ওরা এত কিছু দেবে কেন? কী দেখে দেবে? একটা কেরানির চাকরি আর এই তো ভাগের বাড়ি।’
‘কেন ছেলে হিসেবে তুই খারাপ কিসে!’
‘মেয়ে দেখেছ?’
‘না, তবে বউমা বলছিল মুখশ্রী ভালো, স্বাস্থ্যও ভালো, রংটা একটু ময়লা। আমি বলেছি ছবি দিতে।’
তুষার ছবি দেখেনি। ওরা পাঠিয়েছিল কিন্তু মা সেটা তাকে দেখায়নি। কয়েকদিন পর মাঝবয়সি একটি লোক এসে অফিসে তার সঙ্গে দেখা করে জানান, ত্রিবেণী থেকে তিনি আসছেন, তারই মেয়ে শুভাননার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে। কিছু জমি আর পুকুরের মালিক, ডানলপে ক্যানভাস সরবরাহের ব্যবসাও করেন।
‘একটা কথা আপনাকে জানাবার জন্যই দেখা করতে আসা। মনে হল এটা জানিয়ে রাখা উচিত। যদিও আমার মেয়ে তবু বলছি পাত্রী দেখতে সুন্দরী কেন খুব সাধারণ মানেও লাবণ্যময়ী নয়। ছোট থেকেই চোখটা খারাপ, কাছের জিনিস চশমা ছাড়া ভালো দেখতে পায় না। হাইট কম, রং বেশ কালো আর একটু মোটাই। বয়স এখন ছাব্বিশ, আপনারই কাছাকাছি। এসব লুকিয়ে বিয়ে দিলে পরে কিন্তু ফল ভালো হয় না। শুধু মুখের ছবিতে সব ব্যাপার তো বোঝা যায় না আর আপনি নিজে গিয়েও যখন দেখতে অনিচ্ছুক, তাই আমিই এলাম।’
পাত্রীর বাবার এমন সোজা সহজ কথায় তুষার একটু অপ্রতিভ হয়ে যায় কিন্তু লোকটির স্পষ্টতার তারিফও করে। এই লোকটির চরিত্র আছে। কিন্তু কিছুই না দেখে বা শুনে একজন বিয়ে করবেই বা কেন? তার কি পছন্দ অপছন্দের কোনো বালাই নেই? নাকি সে নিরেট, অর্থলোভী?
‘আপনি যা বললেন, আমি তা সবই জানি।’ তুষার মিথ্যা বলল স্বচ্ছন্দেই। ছবিও দেখেছি। আমি লেখাপড়া জানা স্বাবলম্বী মেয়ে পছন্দ করি। রূপ যৌবন আর কদিন থাকে।’
লোকটির মুখে যে চাপা উৎকণ্ঠা ছিল সেটা এতক্ষণে সরে গেল।
‘মাধ্যমিক, প্রি-ইউ ফার্স্ট ডিভিশনে, হাই সেকেন্ড ক্লাশ জুলজিতে, এবারই বিটি করে এল। লেখাপড়া নিয়েই দিনরাত থাকে।’
‘একটা জিনিস আপনাকে জানিয়ে রাখি, মেয়েকে যা দেবেন, জমি বা নগদ তা ওর নামেই দেবেন আমি এসব কিছু নেব না।’
তুষার কেন যে তখন এটা বলেছিল পরে অনেক ভেবেও সে বুঝে উঠতে পারেনি। হয়তো এমন স্পষ্ট দৃঢ় চরিত্রের সামনে সেও নিজেকে বড় করে তুলে ধরতে চেয়েছিল।
‘জমি ছ’কাঠা বলেছিলাম পরে দেখলাম ওটা দশ কাঠা। আর শুভার বাড়ি করার ইচ্ছে থাকলে, আমিই করে দেব। আমার বিষয় সম্পত্তির যে ভাগ ওর প্রাপ্য তা এখনই দিয়ে যাব। ভবিষ্যতে মামলা মোকদ্দমার মধ্যে ছেলেমেয়েকে ফেলে যেতে চাই না।’
তুষার অভিভূত হয়ে গেছল। সেটা প্রথম ভাঙল ছাঁদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময়। একজোড়া কাচ বসানো তাল-এর মতো একটি মুখ আর তাতে নাকে, কানে, কপালে সোনা, হীরে, মুক্তো বসানো। ফুলশয্যার রাতে আলো নিভিয়ে শোবার পর সে আলাপের চেষ্টায় জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কদিনের ছুটি নিয়েছ?”
‘দু সপ্তাহের।’ জড়তাহীন স্পষ্ট স্বর কিন্তু মিষ্টি।
‘আমি এক হপ্তার। কিন্তু এখান থেকে যাতায়াতের তো অসুবিধে হবে তোমার।’
‘ত্রিবেণী থেকেই স্কুল করব।’
উত্তরের ভঙ্গিতে তুষারের মনে হল সিদ্ধান্তটি বহু আগেই নেওয়া। বাপের বাড়ি থেকে চাকরি করার কথা নব পরিণীতার মুখে অন্তত রীতিমত বেমানান। তার অফিসের অরুণ বিশ্বাসের বউ কলকাতা থেকে রোজ কাঁচড়াপাড়ায় গিয়ে মাস্টারি করে আসছে আজ পনেরো বছর। তাছাড়া কলকাতা থেকে ভদ্রেশ্বর যতটা কাছে ত্রিবেণী থেকে ততটা নয়।
তুষার নিরুত্তর থাকায় শুভা আবার বলল, ‘দেবাই পুকুরের জমিটায় বাবা সামনের মাস থেকেই বাড়ির কাজ শুরু করাবেন। ওখান থেকে স্কুল অনেক কাছে হবে।’
‘কলকাতা থেকে করা যায় না?’
‘ট্রাম বাসে আমার অসুবিধে হয়।’
‘চশমাটা খুলে কোথায় রাখলে?’
‘বালিশের পাশে।’
‘বিয়ের পর বাপের বাড়িতে থেকে গেলে অনেকরকম কথা হবে।’
অনেকক্ষণ পর শুভা বলেছিল, ”কী আর করা যাবে।”
‘স্কুলের কাজটা ছেড়ে দেওয়া যায় না?’
‘না।’ শান্ত, দৃঢ় এবং দ্রুত জবাব। পূর্বস্থিরীকৃত সিদ্ধান্ত।
এই একটা শব্দের মধ্য দিয়েই তুষার জেনে গেছল তার স্ত্রী জেদী, একগুঁয়ে, কোনো অনুরোধেই ওকে এই ‘না’ থেকে সরানো যাবে না।
‘কাজ আমি করে যাব।’
এইখানেই ফুলশয্যার রাতের আলাপ শেষ। নতুন খাটে নতুন বিছানায় তুষার কুঁচকে থাকে। ফুল, সেন্ট আর বেডকভারের কোরা গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠেছিল। সে ভুলে যায় শরীরের কৌমার্য নষ্ট করার অধিকার।
একেবারে স্নান সেরে তুষার কলঘর থেকে বেরিয়ে দেখল খাবার টেবিলে চা ঢাকা দেওয়া রয়েছে। অন্য বাথরুমে কণা। রান্নাঘরে বাসনের শব্দ, ঝি কাজ করছে। শুভা টোস্ট আর ডিমভাজা টেবিলে রেখে গেল। টেবিলে খবরের কাগজটা ভাঁজ করা। শুভা পড়েনি, খবর জানার আগ্রহ কোনোদিনই ওর নেই। বোধহয় চোখের জন্যই পড়তে অসুবিধে হয়। তুষার কাগজটা টেনে নিল।
‘তারকবাবু ছিলেন না। পবিত্রবাবুর সঙ্গে কথা বলছি তখনই ইন্দিরা গান্ধীর খবরটা এল, ব্যস তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে ভদ্রলোক চলে গেলেন…কদিন পরে আবার যাব।” তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুল ঘষতে ঘষতে কণা বলল।
”কত টাকা দেবে?” তুষার কাগজ থেকে মুখ তুলল ”শুনেছি পাঁচ-ছ’ টাকা দেয় এক একটার জন্য।”
”মাত্র!” সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
”তাই নেবার জন্যই কত ছেলে ঘুরছে।”
”দরকার কি তোর এই সামান্য টাকার কাজে, এতে তো নামও হবে না!”
”করুক।”
তুষার মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। রান্নাঘর থেকে শুভার গলা ভেসে এসেছে। তাদের কথাবার্তায় কান রেখেছে।
‘সেলফ সাফিসিয়েন্ট হওয়ার চেষ্টা এখন থেকেই শুরু করা ভালো।”
”কণা খেতে শুরু করেছে। তুষার চায়ের কাপ তুলে ঠোঁটে ছুঁইয়েই নামিয়ে রাখল। ঠান্ডা হয়ে গেছে। কণা সেটা লক্ষ্য করে স্বর চড়িয়ে ”মা, বাবার চাটা গরম করে দাও।”
শুভা এসে কাপটা নিয়ে গেল। তুষার মৃদু স্বরে কণাকে বলল, ”বইয়ের বা ম্যাগাজিনের কভার তো করতে পারিস, গল্পের ইলাস্ট্রেশনও…তোর স্কেচের হাত তো ভালোই।”
”কে দেবে, আমার কোনো চেনাশোনা নেই।”
কণা পূর্ণ দৃষ্টিতে তার বাবার মুখের দিকে তাকাল। কাল রাতে এই লোকটিই হিমুর হাত ধুয়ে দিচ্ছিল। নিশ্চয় হিমু গল্প করেছে, উপরে একটা মেয়ে এসেছে সে তার ছবি এঁকেছে।
মেয়ে ছবি আঁকিয়ে শুনলেই বাবার কৌতূহল হবে। নিশ্চয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিমুকে প্রশ্ন করবে-নাম কী? দেখতে কেমন? কাঁধের ঝুলিটার রং কী? পরনে কী ছিল? কী রকম জুতো? চুল কেমন? নামটা হিমু জানে না। তবে দেখতে কেমন, সেটা তো বলতেই পারে। বাচ্চচারা অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে পায়।
তখন তার হিমুর মতই বয়স, এক তরুণী এসেছিল মার কাছে, স্কুলের চাকরির জন্য। এই টেবলেই সে বসেছিল। মা তখন বাড়িতে ছিল না। মা যখন ফিরে আসে তখন বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলেছিল, ‘ব্লাউজের হাতা একদমই নেই, বগলেও চুল নেই।’ মা প্রচণ্ড জোরে ধমকে উঠেছিলেন ‘ওসব তোমায় কে দেখতে বলেছে?’
কিন্তু তার চেহারায় এমন কিছু আছে কি যেটা অন্য পাঁচটা মেয়ের থেকে তাকে আলাদা করে বোঝাতে পারে? কণা নিজেকে কলেজের মেয়েদের মধ্যে রেখে একনজরেই চোখে পড়ার মতো কি আছে বার করার চেষ্টা করল।
শুভা চা গরম করে দিয়ে গেছে। এখন সে রান্নায় ব্যস্ত হবে। তুষার কাপটা তুলে নিয়ে ভাবল, একটা চিঠি দিয়ে দিলীপ চৌধুরির কাছে কণাকে পাঠালে কেমন হয়। কলেজে চার বছর তারা একসঙ্গে পড়েছে। কলেজ ম্যাগাজিনে সম্পাদনায় দিলীপ ছিল তার সহকারী। এখন সে পাক্ষিক নবারুণ-এর মালিক এবং সম্পাদকও। বিক্রি নাকি পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে। ম্যাগাজিনটা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিতে ভরা, কিন্তু তার সঙ্গে আর্টিস্টের কী সম্পর্ক? কিন্তু মেয়েদের সেক্সি ফিগারের প্রোভোকেটিভ ভঙ্গির, বিছানায় ইন্টিমেসিস স্কেচ সে নবারুণে দেখেছে। ওইসব কি কণা আঁকবে? তুষার নাকচ করে দিল চিঠি লেখার চিন্তাটা।
”তুই নবারুণ দেখিস?”
অন্যমনস্ক কণা চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। সে ঠিক করে ফেলেছে হিমুকেই জিজ্ঞাসা করবে, ‘আমাকে কেমন দেখতে বলো তো?’
”অ্যা, নবারুণ?”
”ওখানে ছবিটবিগুলো কেমন হয়?”
”অসাধারণ! বীরেন দত্তর, সুনির্মল ঘোষের ড্রইং দেখবার মতো, কত পাকা ওরা! ফিগার আঁকায় এখন ওদের ধারেকাছে কেউ নেই। স্পেসকে ব্যবহার করা, লাইনের কনট্রাস্টে একটা মুডকে তুলে ধরা…।”
”কিন্তু কাগজটা অতি বাজে।”
”হলেই বা, আর্টিস্টকে তো বিচার করবে তার নিজস্ব কাজের গুণ দিয়ে।”
”তোকে ওখানে ছবি আঁকতে বললে আঁকবি?” হালকা স্বরেই তুষার বলল কিন্তু উত্তরটার জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল।
”নিশ্চয়!” টেবিলে মুঠো দিয়ে কণা ধাক্কা দিল। স্বরটা ঈষৎ উত্তেজিত।
বুড়ো আঙুলটা বেঁকিয়ে রান্নাঘরের দিকে নির্দেশ করে তুষার ভ্রূ তুলল। ফিস ফিস করে বলল, ”যদি দেখে?”
কণার মুখে নিঃশব্দ হাসি ছড়িয়ে পড়ল। গত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই প্রথম তার ভিতরটা হালকা ধরঝরে লাগল। গত দিনটাকে এতক্ষণে সে একদমই ভুলে যেতে পারছে। ছোট্ট করে হাত নেড়ে বলল,
”দেখবে না…পড়েই না,”
কণাও জানে শুভা শারীরিক ব্যাপারে কত পিটপিটে, ছুঁচিবেয়ে। স্কুলের বইয়ের বাইরে অন্যকিছু পড়তে সে দেখেনি, এমনকি চিঠিও নয়। মাকে কেউ চিঠি লেখে না। মামাবাড়ি থেকে চিঠি আসে না, বেলঘরিয়া থেকে ঠাকুমাও লেখে না। মার কোনো বন্ধু সে এখনো দেখেনি।
”কিন্তু তোর আঁকা বেরিয়েছে শুনলে ঠিকই দেখবে।”
”আমি বলছি না…বাজি?”
রান্নাঘর থেকে শুভা বেরিয়ে এল।
”তোমরা কি একটু ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর ভাত খাবে?”
”এখন ঘুমোব কেন? রাতে কি ঘুমোইনি নাকি?” কণা অবাক চোখে শুভার তারপর তুষারের মুখ লক্ষ্য করল।” ”বাবা তুমি রাতে ঘুমিয়েছ?”
”যে খাটটায় শুতে দিয়েছিল ভীষণ ছারপোকা ছিল। ঘুমোতে পারিনি।”
”আমি দারুণ ঘুমিয়েছি, এত টায়ার্ড ছিলাম। হাঙ্গামার কতকগুলো স্কেচ করেছি রাস্তায়, রেয়ার এক্সপিরিয়েন্স হল, পরীক্ষায় এবার সাবমিট করব, কদিন এখন লাগবে ফিনিশ করতে।” কণা উঠল। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
”বাজিটার কী হবে?”
কাপ প্লেটগুলো তুলতে তুলতে শুভা তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ”কী?”
”তোমায় নয়, বাবাকে বলছি।”
”আগে ওখানে কিছু বেরোক তারপর তো বাজি। তোর স্কেচগুলো কেমন হয়েছে দেখতে ইচ্ছে করছে।” তুষার আগে কখনো তার এই ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। কণা নিজেই তাকে আঁকা দেখাত।
”শেষ হোক, দেখাব।”
তুষার শোবার ঘরে এল। বিয়ের বড় খাটটায় বাচ্চচা কণাকে নিয়ে তারা দুজন শুত। কণা ছাদের ঘরে যেদিন উঠল তার সঙ্গেই খাটটাকে চালান করে দুটো সিঙ্গল খাট এই ঘরের দুধারের দেয়াল ঘেঁষে পাতা হয়েছে। আলাদা খাটে শোয়ার প্রস্তাবটা প্রথম কে দিল, সেটা তুষারের এখন আর মনে নেই। সম্ভবত সে বলেছিল ‘তোমার পাশে একটা টেবল ল্যাম্প আর ছোট টেবিল থাকলে ভালো হয়। রাতে উঠতে হলে হাত বাড়িয়েই আলো আর চশমাটা পেয়ে যাবে। তাছাড়া, খাটটা বড্ড উঁচু, ওঠানামায় অসুবিধে হয়।’
শ্রীরামপুর থেকে অর্ডার দিয়ে কেনা হয় দুটো খাট আর মাঝের আয়না ড্রয়ার দেওয়া টেবিল। ড্রেসিং টেবিল এটাকে হয়তো বলা যেত যদি শুভার ড্রেস করার দরকার কখনো হত।
কণা ছাদের ঘরে যাওয়ার আগেই তুষারকে দ্বিতীয় ঘরটায় দশবারো বছর কাটাতে হয়েছে। তখন কণা পাঁচ বছরের। একই খাটে তিনজনের, বিশেষ করে ‘বড় হয়ে যাওয়া’ মেয়েকে নিয়ে শোয়ায় শুভাই আপত্তি তুলেছিল। ‘বসার ঘরটায় তো কেউ বসে না, এমনকি পড়ে থাকে, তুমি বরং ওটাতে থাক।…ছাত্রছাত্রীরা কতক্ষণই বা আর বসবে।’
শুভা আর কণা বড় ঘরেই রইল। তাকে আসতে হল ছোট ঘরটায়। সেই সময়ই একদিন বিকেলে সম্ভবত রথের দিন, কেননা শুভার স্কুল বন্ধ ছিল আর সে গেছল স্কুল সেক্রেটারির বাড়ি জরুরি মিটিংয়ে, তখন এসেছিল চিন্ময়ী। শুভার স্কুলের ভূগোলের টিচার বি টি পড়তে যাবেন, তার জায়গায় অস্থায়ী একজনকে নেওয়া হবে। এই খবর পেয়ে সে উমেদার হয়ে এসেছিল।
শুধু তুষার আর কণা ছিল বাড়িতে। খাবার টেবিলের ধারে তারা বসেছিল। লম্বা, ছিপছিপে ফর্সা, চওড়া ভ্রূ ও কপাল, চৌকো চোয়াল মেয়েটির মুখে আত্মপ্রত্যয় ও কাঠিন্য ছিল। কণ্ঠস্বর ঈষৎ কর্কশ, ভরাট যেটা খাদে নামালে পুরুষালি শোনায়। গায়ের চামড়া খসখসে, খোঁপার ফিতে তেলে ময়লা। তাঁতের গোলাপি জমির শাড়িটার রং বিবর্ণ, হাতাবিহীন ব্লাউজের পিঠের হুকগুলোর একটা কি দুটো ছিল না। দেহে কোথাও গহনা নেই, এমনকি লোহার বালাও নয়। চমকপ্রদভাবে শুভার বিপরীত।
তুষার প্রথম দর্শনেই আকৃষ্ট হয়ে ওর সঙ্গে এলোমেলো কথা বলতে থাকে। কণা তার পাশে বসে ছিল, মাঝখানে সেও কথায় যোগ দেয়। এক সময় তুষার চা খাবার প্রস্তাব দেয়। কণা লাফিয়ে ওঠে: ‘আমি চা করব।’ চিন্ময়ীর সৌজন্য আপত্তি অগ্রাহ্য হয়। তারপর কথায় কথায় বাড়িতে কে কে আছেন প্রশ্নটা ওঠে। কোন্নগরে পৈতৃক বাড়িতে কাকা-কাকিমারা আর বিধবা পিসি ছাড়া কেউ নেই। বাবা-মা শৈশবেই মৃত, ভাই বোনও নেই। দুই কাকা জুট মিলে কাজ করেন, সামান্য মাইনে, ছোট কাকা করেন একটা সিনেমার ম্যাগাজিনে।
কী নাম? দিলীপ চৌধুরী।
‘য়্যা দিলীপ! নিশ্চয় আমাদের কলেজের দিলীপ। রোগা, লম্বা, আপনার মতই ফর্সা। চোখ পিট পিট করা অব্যেস। আর পান খায় খুব। ওর খুব ইচ্ছে ছিল ম্যাগাজিন বার করার। আমাকে জপাত, আয় দুজনে মিলে একটা বার করি।’
চিন্ময়ী এবং কণা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হচ্ছিল।
”আপনি ছোটকাকাকে চেনেন?’
‘কলেজের দিলীপ হলে নিশ্চয় চিনি তবে বহুদিন তো আর দেখা সাক্ষাৎ নেই, প্রায় দশ বছর। আপনি তাহলে দিলীপের ভাইঝি!
একটা যোগসূত্র রচনা করতে পেরে তুষার অত্যন্ত আরাম বোধ করেছিল। হয়তো এমন একটা কিছু সে চাইছিল যাতে এই আলাপ কথাবার্তা নিছকই, অতিথিকে বিরসতার হাত থেকে মুক্তি দেবার জন্য হয়ে না যায়। কিছু ব্যক্তিগত স্পর্শ না থাকলে কথা বলে সুখ নেই। কোনো ধরনের একটা সম্পর্ক এজন্য গড়ে নেওয়া দরকার।
চিন্ময়ী এক ঘণ্টারও বেশি শুভার জন্য অপেক্ষা করেছিল আর ততক্ষণ তুষার কথা বলে গেছে।
”আপনি একটু বলবেন ওঁনাকে? কাজটা পেলে কিন্তু সত্যিই খুব উপকার হয়। টেম্পোরারি, তা হোক…ভেকেন্সি হলে কাজ পেয়ে যাওয়ার চান্স থাকে। তাছাড়া টাইপও জানি, আপনি আমার হয়ে বললে…ওঁনার হাতেই সব, আমাকে ওই স্কুলেরই এক টিচার খবরটা দিয়েছেন…এখনও কোনো ক্যান্ডিডেট নেই শুনেছি।..যদি আপনি…কাকার বন্ধু।’
‘কাকারা, দিলীপ তো আপনার জন্য চেষ্টা করতে পারে কোথাও।’
‘আমাকে আপনি বলবেন না।’
তুষারের হাসি পেল। এটা তো অনেকক্ষণ আগেই ওর বলা উচিত ছিল। বোধহয় উৎকণ্ঠায় চাপে ভুগছে।
‘ছোটকা মালিককে বলে ওর কাগজেই বিজ্ঞাপন যোগাড়ের কাজ পাইয়ে দিয়েছিল। একমাস করেছিলাম।
‘ছাড়লে কেন, ভালোই তো কাজ, অনেক মেয়েই করছে।’
‘তা করছে, কিন্তু আমি যথেষ্ট চালু নই। সাকসেসফুল হতে গেলে এইরকম ছোট ম্যাগাজিনের মেয়ে রিপ্রেজেন্টেটিভকে কাজের বাইরেও কিছু কাজ করতে হয়।…আমার পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি।’
‘কেন হয়নি’, এই প্রশ্নটা যাতে তুষার না করে এমন একটা অনুরোধ ওর চোখে ছিল।
‘দিলীপ কী বলল?’
‘আমার উপর বিরক্ত হয়। ক্যাবলা, গাধা মেয়েদের দ্বারা, আপনি বলুন, সংসারের কি কোনো উপকার হয়?’
তুষার বিব্রত হয়ে ওঠে ওর হঠাৎ স্বর পরিবর্তনে।
বাষ্পর এবং চোখে জলের চিকচিকানি ওর কথাগুলো যে ওর নয়, অন্য কারুর উক্তিরই পুনরাবৃত্তি সেটা বুঝতে তাকে বুদ্ধিতে টান দিতে হয়নি।
‘নিজেকে নিজে দাঁড় না করালে কার এত দায় পড়েছে চিরকাল খাওয়াবে পরাবে এমন তো কোনো চুক্তি নেই…সংসার তো বাড়ছে। আমার মতো কত মেয়েই তো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আমিই শুধু পারি না…ইচ্ছে করলেই পারি কিন্তু এসব আমার বদমায়েসি, কাকাদের ঘাড়ে বসে খাব বলেই…”
থেমে গেছল। তুষার এবারও বুঝল কথাগুলো চিন্ময়ীর মুখ দিয়ে অন্য কারুর সম্ভবত কাকিমাদেরই কারুর, বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তুষার। কিন্তু চিন্ময়ী নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। এরপরই সে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তুষার দুটো ছাতা বার করল।
‘চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
চিন্ময়ীর মুখ দেখে সে বুঝল এইটুকু সৌজন্য সে কখনো পায়নি।
‘এগিয়ে দেবার কি আছে, আমি নিজেই তো স্টেশন থেকে এসেছি, পথ তো জানাই।’
‘সন্ধ্যে হয়ে আসছে, পথটা নির্জন, বৃষ্টিও পড়ছে। সুন্দরী তরুণীদের এখন একা পথ চলতে নেই।’
চিন্ময়ীকে কোমল দেখাল। অপ্রতিভ মুখটা ঘুরিয়ে এক পলকের জন্য হেসে নিয়ে বুঝিয়ে দিল, মিথ্যা হলেও সে তুষারের উদারতাকে তারিফ করছে। স্টেশনে তারা পৌঁছয় পথে গম্ভীর কোনো কথা না বলেই।
‘আমি এবার চলে যেতে পারব।’ ছাতাটা মুড়ে চিন্ময়ী এগিয়ে ধরল।
‘জানি, ট্রেনটা আসুক তো। ছাতাটা এখন থাক, নেমে দরকার হবে।’
চিন্ময়ী হয়তো বলতে যাচ্ছিল, ‘ফেরত দেব কী করে’ কিন্তু বলল না। ট্রেন এল। ছুটির দিনে এই সময় ভিড় থাকার কথা। দূরের যাত্রীদের সপরিবারে ঘরে ফেরার সময় এখন। কিন্তু ভিড় নেই। চিন্ময়ী ছুটে কাছের কামরাটায় উঠল। এই সময় তুষার নিজের কাছেও অপ্রত্যাশিত এমন একটা কাজ করে ফেলে, যার যৌক্তিকতা সে পরে অনেকবার ভেবেও খুঁজে পায়নি। তার শুধু মনে হয়েছে রুটিন মাফিক একঘেয়ে জীবনকে মানতে অস্বীকারের চেষ্টা ছাড়া এটা অন্য কিছু নয়।
চিন্ময়ী রীতিমতো অবাক হয়ে গেছল তুষারকে ট্রেনে উঠে পড়তে দেখে। সে কিছু বলার আগেই তুষার বলে ওঠে, ‘ছাতাটার দাম আছে, ফেরত নিতে হবে না?’
কৌতুকটা ওর বিস্ময় ভেদ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কোন্নগর স্টেশন এসে গেল। তিন মিনিটের পথ। তখনো বৃষ্টি পড়ছিল।
‘এই নিন আপনার দামি ছাতা।
‘এখন নেব কি! ভিজে ভিজে বাড়ি যাবে নাকি? দিলীপকে অনেকদিন দেখিনি, চলো একবার দেখা করে যাব।’
চিন্ময়ীকে অনুসরণ করে প্রায়ান্ধকার রাস্তায় যেটা কয়েকটা মোড় ঘুরে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছিল, চলতে চলতে কুণ্ঠিত স্বরে সে বলল, ‘তোমার কি অসুবিধে হবে আমি তোমাদের বাড়িতে গেলে?’
‘না, অসুবিধা আর কি। ওটা হবে আপনার, আমাদের লোক বসানোর জায়গাই নেই। অবশ্য ছোটকা থাকলে তার ঘরে বসতে পারবেন।’
একটু পরে তুষার জানাল ‘স্কুলের কাজটা হবে কি হবে না সেটা আমি আজই জেনে নেব। কিন্তু তোমায় জানাব কি করে?’
‘আমি কাল কি পরশু আপনাদের বাড়ি গিয়ে জেনে নেব।’
‘সেই ভালো। সকালে এলে শুভার সঙ্গে দেখা হবেই আর সন্ধ্যের পর।’
‘একটা অ্যাপ্লিকেশন সঙ্গে রয়েছে, এটা ওঁকে দিয়ে দেবেন?’
‘দাও।’
বোধহয় ব্লাউজের মধ্য থেকেই খামটা বার করল। দোমড়ান, দুভাঁজ করা। একতলা জীর্ণ একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, ছাতাটা বন্ধ করে তুষারের হাতে দিয়ে চিন্ময়ী বলল, ‘ছোটকাকে ডেকে দিচ্ছি, আপনি এখানেই দাঁড়ান।’
মিনিট দুই পর ফিরে এসে বলল, ছোটকার শরীর খুব খারাপ, ঘুমোচ্ছে।’
‘কি হয়েছে? অসুখ বিসুখ কিছু?’
চিন্ময়ী প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনি আমার হয়ে কিন্তু একটু বলবেন।’
তুষার বাড়ি ফিরে দেখল শুভা এসেছে।
‘কে একজন যেন স্কুলের টিচারের চাকরির জন্য এসেছিল কণা বলল।’
‘হ্যাঁ, আমার খুব পুরোনো বন্ধু দিলীপের ভাইঝি, তোমাদের কে একজন বিটি পড়তে যাবে শুনে এসেছিল।’
”তাকে কি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলে? খুব সহজভাবে শুভা বললেও তুষার চট করে ওর মুখটা দেখে নিল। টেবিলে খোলা মিটিংয়ের বিবরণী খাতাটায় মুখ নামাল। ঠোঁটে বা কপালে কোনো কুঞ্চন নেই। পিঠে চর্বির জন্য ওকে কুঁজো মনে হয়, ঝুঁকে বসে থাকলে ঘাড়ের কাছে একটা ডেলা জেগে ওঠে। তার দুপাশে লম্বা পেশী শক্ত হয়ে রয়েছে। তুষার সতর্ক হল।
‘ট্রেনে তুলে দিলাম। ওই ট্রেন থেকেই দেখি আমাদের অফিসের বনবিহারীদা নামল। স্টেশনের ওপারে ভগ্নিপতির বাড়িতে যাবে। গল্প করতে করতে গেলাম এক কাপ চা খেয়ে চলে এলাম।’…তোমাদের স্কুলে কি ভেকেন্সি হবে?’
‘না। আর হলেও যাকে তাকে নেওয়া হবে না। স্কুলেরই দুটি মেয়ে এখন এম এ পড়ছে, নেওয়া হলে ওদেরই কাউকে নেওয়া হবে।’
নিজের ঘরে গিয়ে তুষার শুয়ে পড়ে। আলোটা জ্বালায়নি। একবার পাশ ফেরার সময় পকেটটা খরখর করে ওঠে। চিন্ময়ীর অ্যাপ্লিকেশনটা।
দুদিন পর একটা ফিল্ম দেখে রাত্রে ফিরে সে শুনল চিন্ময়ী এসেছিল। দু সপ্তাহ পর সে চিন্ময়ীকে ডাকে চিঠি দেয়। তাতে লিখেছিল ‘আমাদের অফিসে একজন টাইপিস্ট নেওয়া হবে। তুমি ঠিক সাড়ে পাঁচটায় শহিদ মিনারের নিচে দেখা কর। আমি অপেক্ষা করব।’
চিন্ময়ী দেখা করে। টাইপের পরীক্ষা দেয় এবং ফেল করে।
কার্জন পার্কে বসে চিন্ময়ী দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠেছিল। ‘আমার কিছু হবে না, আমার কিছু হবে না…আমার জীবনটাই অভিশপ্ত, এবার আমি খারাপ হয়ে যাব।’
তখন তুষার আলতো করে ওর পিঠে হাত রেখে বলেছিল, ‘এত হতাশ হচ্ছ কেন, পাঁচ জায়গায় চেষ্টা করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে।…আমি তো আছি।’
.ছাদের ঘরে চেয়ারের মতো কিছু একটা সরাবার শব্দ হল। চিত হয়ে তুষার সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। কণাকে কি চিঠি দিয়ে দিলীপের কাছে পাঠাবে? চিঠিটা বা কণাকে সে কীভাবে নেবে? দিলীপ মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে চিন্ময়ীকে সারারাত পাইখানায় বন্ধ করে রেখেছিল। কেউ দরজা খুলে তাকে বার করে আনেনি। এই লোকটার কাছে মেয়েকে কি পাঠানো যায়? এক গুজরাটির টাকায় নাকি ম্যাগাজিনটা কিনে নব কলেবরে বার করে বউ ছেলেমেয়েকে কোন্নগরের বাড়িতে রেখে সে এখন কলকাতায় ফ্ল্যাটে থাকে। নিশ্চয় গাড়িটাড়িও করেছে। কণাকে বসিয়ে হয়তো বলবে ‘তোমার বাবা লোকটি কেমন জান? আমার ভাইঝিকে সে…’
অসম্ভব। তাহলে সে গুলি করে মারবে ওই স্কাউন্ড্রেলটাকে।
ছাদের ঘরে চেয়ারে বসে নিচু ত্রিপদে পা তুলে কণা। স্কেচ খাতাটা কোলে। হিমুর অসম্পূর্ণ মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল, ছোটবেলায় বাবা বোধহয় এই রকমই দেখতে ছিল। কান, কপাল, খুলির গড়নে দুজনের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। চোখের মণি দুটো বসানো হয়নি, সেখানটা সাদা। তাতে কী হয়েছে! মুখের বাইরের আকৃতিটা তো চিনে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। পাতাটা খাতা থেকে সাবধানে ছিঁড়ে নিতে সে ঠিক করে ফেলল, বাবাকে এটা দেখানো…অসম্ভব।
পাঁচ
”তুষারদা, পয়লা ডিসেম্বরই ঠিক হল।”
মুখ তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তুষার তাকাল। অনির্বাণ টেবিলে ঝুঁকে আবার বলল, ”শনিবার পড়ছে। রোববারটা পাবেন গায়ের ব্যথা মারার জন্য। আপনাদের গ্রুপে তিনটে ইভেন্ট, একটা এবার বাড়ানো হল। একশো মিটার, টাগ অব ওয়ার আর নতুন অ্যাড করা হয়েছে থ্রি লেগেড রেস। আপনি বরাবরের মতো তো শুধু একশো মিটারেই নামবেন? তাহলে কালই রবির কাছে এন্ট্রিটা দিয়ে দেবেন।”
”এবার একটু যেন তাড়াতাড়িই স্পোর্টস করছ।”
”লোকসভা ইলেকশনের আগেই সবাই চাইল। কি আবার ডামাডোল গোলমাল শুরু হবে আর স্পোর্টস শিকেয় উঠবে, তার থেকে বরং আগে হয়ে যাওয়াই ভালো। প্রাইজের টাকা এবার বাড়ানো হয়েছে।”
বছরের এই একটা ব্যাপার যেটা তুষারকে ছেলেমানুষের মতো চনমনিয়ে দেয়। সত্যি সত্যিই সে কয়েকটা দিন যেন স্কুল জীবনের সান্নিধ্য অনুভব করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তেজনায় আর সবাইকে হারিয়ে প্রথম হবার, হাততালি আর হইচইয়ের মধ্যে প্রাইজ নেবার জন্য একটা ঘোরের মধ্যে সে পড়ে যায়। গত চার বছর ধরে অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সিদের গ্রুপে পড়ার পর থেকে সে একশো মিটারটায় প্রথম হয়ে আসছে। অফিসের চল্লিশ বছর বয়সিদের সবাইকে হিসেবের মধ্যে রেখে, রবিই তাকে বলেছিল, ”দাদা পঞ্চান্ন বয়স পর্যন্ত চোখ বুজে আপনি চালিয়ে যেতে পারবেন, একশো মিটারের ফার্সট প্রাইজটা আপনার বাঁধা। অফিসে এখন আপনার ধারেকাছে কেউ তো নেই-ই, আগামী ছ’বছরও আসবার মতো কেউ নেই’। শুনে সে অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছিল। জীবনের বহু কিছু শরীরের ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে। হিমুকে বড় করে তোলার জন্য তাকে আরও পনেরো-কুড়ি বছর বাঁচতে হবে, শরীরটাকে ততদিন টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাজা-ঘষা করে চালু অবস্থায় রাখা দরকার। বছরে এই একবারই এটা পরীক্ষা করে নেবার সুযোগ তার কাছে আছে। তার ভয় হাঁপানি সম্পর্কে, বাবার নাকি এই রোগটা ছিল।
”কী প্রাইজ এবার তাহলে দেবে?” তুষারের বয়স কমিয়ে দেবার এটাও একটা উপলক্ষ্য।
”দোব দোব, এখন সেটা বলা যাবে না, তবে আগের থেকে যে ভালো হবে এটা বলতে পারি।” অনির্বাণ রহস্যটাকে গভীর করে তোলার জন্য নাটকীয়ভাবে প্রস্থান করল।
দুপুরে ডাকে আসা একটা খাম সে পেল। ঠিকানায় হাতের লেখা দেখেই বুঝল মা’র চিঠি। প্রতি মাসে মাইনে পেয়েই সে দু’শো টাকা বেলঘরিয়ায় মা’র নামে পাঠিয়ে দেয়। এই মাসেও পাঠিয়েছে, মানিঅর্ডার রসিদও ফেরত পেয়েছে, আবার তাহলে চিঠি কেন?
”দোসরা ডিসেম্বর তোমার বাবার বাৎসরিক, ওই দিন তুমি অবশ্যই আসিবে। ব্রাহ্মণভোজন করাইব, এ জন্য পঞ্চাশটি টাকা পাঠাইও। অনেকদিন তোমাকে দেখি নাই, বড় ইচ্ছা করে দেখিতে। কবে যে মরিয়া যাইব। শরীর বিশেষ ভালো নয়, চলাফেরা করিতে আর পারি না, কষ্ট হয়। বউ’মা ও কণা কেমন আছে। তাহাদের আমার আশীর্বাদ জানাইবে। ওই দিন কণাকেও লইয়া আসিবে। সে কত বড় হইয়াছে তাহা দেখিতে ইচ্ছা করে। আর বেশিদিন তো বাঁচিব না। এখানে সকলে একপ্রকার। বাসের ধাক্কায় সাইকেল হইতে পড়িয়া গিয়া তরুণের হাত ভাঙিয়াছিল। এখনো তাহার হাত সারে নাই। শ্রীধরজীর কৃপায় সে রক্ষা পাইয়াছে। তুহিনকে চিঠি দিলেও সে উত্তর দেয় না, শুনিলাম সে মোটর কিনিয়াছে। তুমি কিন্তু পঞ্চাশটি টাকা অবশ্যই পাঠাইবে। আশীর্বাদিকা, ইতি তোমার মা।”
হাতের লেখা জড়ানো, লাইনগুলো ক্রমশ ঢালু হয়ে গড়িয়ে পড়েছে। অথচ মায়ের হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। এখন বয়স হবে কত? সত্তর কবে পার হয়েছে! তুষার আবার চিঠিটা পড়ল। প্রতি বছর সে বিজয়ায় প্রণাম করে আসে, গত বিজয়ায় যেতে পারেনি। অনুযোগ করে মা চিঠিও দিয়েছিল। মা বাড়িতে কখনো চিঠি দেয় না। শুভার সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক রাখতে তিনি চান না। তুষারও কখনো শুভাকে বলেনি সে প্রতি মাসে বেলঘরিয়ায় টাকা পাঠায়।
দোষটা যে ঠিক কার এখনো সে বুঝতে পারে না। মা চেয়েছিলেন একসঙ্গে সবাই থাকুক। অর্থের দিক থেকে তরুণই ছিল কমজোরি, এখনো তাই। টেক্সম্যাকো কারখানায় তখন সামান্য কাজ করে অথচ লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিল, তুষারের বিয়ের আগেই। শ্বশুরবাড়িতে রাখা বউ এবং একটি ছেলের খরচ টানা আর তার সাধ্যে কুলোচ্ছিল না। তুহিন তখন নিজেই টাকা জোগাড় করে কেমিক্যালসের ছোটখাট ব্যবসায় নেমেছে। সে কখনো কারুর সাহায্য চায়ওনি, সংসারে তার যতটুকু দেয় তার বেশি দেয়ওনি। প্রায় হস্টেলে থাকার মতই সে থাকত।
মা একদিন কলঘরের দরজার কাছে অফিস যাবার সময় তাকে ধরেছিল। ‘তরুণের বউকে তো আর বাপের বাড়িতে ফেলে রাখা যায় না, এবার তো আনতে হয়’। ফিস ফিস করে বলার দরকার ছিল না। তবু গোপনীয় খবর দেবার মতই স্বরটা ছিল।
”কিন্তু ওর যা মাইনে তাতে ও খাওয়াবে কী?’ তুষার ব্যাপারটা জানত। তবু বিরক্তি দেখায়।
‘কেন, তোরা তো আছিস, বউমা তো ভালোই মাইনে পায়, টেনেটুনে চলে যাবে। ছোট ভাই দুরবস্থায় পড়েছে, দাদারা দেখবে না?”
‘অবস্থাটা তো ও নিজেই তৈরি করেছে তাহলে নিজেই সামলাক। আমরা ওকে বিয়ে করতে বলিনি, মেয়ে দেখে বিয়েও দিইনি, লুকিয়ে করেছে। এখন আমরা ওকে দেখব এটা ও আশা করে কেন?’
‘ও আমায় কিছু বলেনি, আমিই তোকে বলছি।’
তুষার কথাটা বিশ্বাস করেনি কিন্তু মায়ের মুখে তখন ভিখারির কাতরতা দেখে সে কষ্ট বোধ করে।
‘লজ্জায় বলতে পারে না। বোঝে তো যে অন্যায় করে ফেলেছে, দাদাদের কাছে চাইবার মুখ নেই।’
‘তুহিনকে বলেছ?’
‘বলেছি। একটা বাড়তি আধলাও দিতে পারবে না বলল। ব্যবসায় নাকি খারাপ অবস্থা, যে-কোনোদিন উঠে যেতে পারে’।
‘আচ্ছা ভেবে দেখি।’
রাতে সে শুভাকে সব কথা বলে। শুনে ওর মুখে কোনো ভাবান্তর হল না।
‘কিন্তু এ বাড়িতে আমরা আর ক’দিনই বা আছি! দেবাই পুকুরে তো পাঁচ-ছ’ মাসের মধ্যেই চলে যাব তখন ঠাকুরপোর বউ-বাচ্চচাকে কে খাওয়াবে পরাবে?’
তুষার বলতে যাচ্ছিল, মাসে মাসে কিছু টাকা ওকে দেব। কিন্তু বলতে পারেনি। কিসে যেন তার বেঁধেছিল! পরিবারের বা ভাইয়ের সম্মানের কথা ভেবে? নাকি তার নিজের ব্যক্তিত্বের জোর না থাকায়? স্বচ্ছন্দে সে শুভাকে অগ্রাহ্য করে, একটা খবর দেবার মতোই বলতে পারত ‘মা’কে বলেছিলাম তরুণের বউ ছেলেকে আসতে বলো, কি বাপের বাড়িতে এ বাড়ির বউ পড়ে থাকবে? লোকে শুনলে কী বলবে!’ তুষার বলতে পারেনি। তার ভিতরে আবর্জনা জমে গেছে। ‘টাকার জন্য নিজেকে বিক্রি করল’ এই কথাটা, বউ’ভাতে নিমন্ত্রিত অফিসেরই কেউ বলেছিল। কানাকানি হয়ে তার কানেও এসেছিল।
তুষার ঘরের সব কটা মুখ দেখল। তখন সে অন্য ডিপার্টমেন্টে, অন্য ঘরে বসত। এ ঘরের কেউ তার বউভাতে নিমন্ত্রিত হয়নি। ড্রয়ার থেকে মানিঅর্ডার ফর্ম বার করে সে লিখতে শুরু করল। প্রশান্তকে আজই দিয়ে রাখবে যাতে কাল পোস্টঅফিসে প্রথমেই জমা দিতে পারে।
সন্ধ্যাবেলায় সে নাথেরবাগানে গেল। বাবা স্পোর্টসে দৌড়বে, হিমুর কাছে সেটা অবিশ্বাস্য সংবাদ। সন্দেহভরে সে প্রথমে জানতে চাইল, ”তুমি দৌড়তে পার?”
”পারি।”
”কেমন ভাবে দৌড়তে হয় বল তো?”
তুষার ঘরের মাঝে এক জায়গা দাঁড়িয়েই শুরু করল। রান্নাঘর থেকে চিন্ময়ী থালা নিতে ঘরে এল।
”কি ব্যাপার?”
”বাবা স্পোর্টে দৌড়বে।”
”স্পোর্ট নয় স্পোর্টস বলবে।”
”ঘরের মধ্যে স্পোর্টস?” চিন্ময়ী বেরিয়ে গেল। উনুনে কড়া চাপিয়ে তেল দিয়ে এসেছে।
”তুমি প্রাইজ পাবে?”
তুষার দৌড় থামাল। এইটুকু পরিশ্রমেই সে হাঁফিয়ে পড়েছে, হাঁটু আর উঠছে না। হাঁটা আর দৌড়নোর অনেক তফাত।
”কী করে বলব। আগে তো দৌড়ই, তারপর প্রাইজ।”
”তুমি আমার সঙ্গে দৌড়বে?”
”নিশ্চয়।”
”কবে?”
”যেদিন বলবে।”
”কোথায় দৌড়বে?”
”যেখানে বলবে।”
হিমু চিন্তামগ্ন হল। তুষার ওর মুখের দিকে মজার দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
”আমাকে তোমাদের স্পোর্টে দৌড়তে দেবে?”
তুষারের খেয়াল হল, স্টাফেদের ছেলে-মেয়ের জন্যও কয়েকটা ইভেন্ট আছে, বৌয়েদের জন্য মিউজিক্যাল চেয়ার!
”দৌড়বে তুমি? তাহলে নাম দিয়ে দোব। কিন্তু আবার তুমি স্পোর্ট বললে।”
হিমুর হকচকিয়ে যাবার মতো অবস্থা তারপরই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে চিৎকার করতে করতে গেল: ”মা মা, আমি স্পোর্টসে নামব…বাবার অফিসে, জানো মা… হ্যাঁ সত্যি, বাবাকে জিজ্ঞেস করো।”
আবার ছুটে ঘরে ঢুকল সে। ”কোথায় হবে স্পোর্টস?”
”গড়ের মাঠে।”
”কবে?”
”শনিবার, দুপুরে।”
হিমু আবার বেরিয়ে গেল খবরটা দোতলায় জেঠিমাকে দেবার জন্য। রুটি আর আলুভাজা নিয়ে চিন্ময়ী এল।
”সত্যি সত্যিই হিমু নামবে?”
”হ্যাঁ নামুক না। বাচ্চচাদের জন্যও তো আছে এমনকি বউয়েদের জন্যও মিউজিক্যাল চেয়ার।”
চিন্ময়ীর চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলেও পরমুহূর্তেই স্তিমিত হল।
”নামবে?”
”ও তো বউয়েদের জন্য।”
”তাহলে নামটা দিয়ে দিচ্ছি।”
”না।”
ইচ্ছে করেই চিন্ময়ী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তুষার খাওয়ায় মন দিল।
”বাবা, এই দ্যাখো ছবি আঁকার পেন্সিল দিদি রেখে গেছে আমার জন্য।” হিমু একটা স্কেচ পেন্সিল হাতে ঢুকল।
”কে দিদি?” বলেই তুষারের মনে পড়ল সেদিন রাতে যে মেয়েটি এসে পালেদের ঘরে ছিল। ছবি আঁকে। ”কবে এসেছিল?”
”আজ বিকেলে। আমার ছবি আঁকছে তো। আচ্ছা বাবা, ফটোতে আমাকে যেরকম দেখায় সেরকম করে তো আঁকছে না?”
”তোমাকে চেনা যাচ্ছে?”
”হ্যাঁ। তবে মুখের এখানে দাগ ওখানে দাগ চুলটা কেমন এলোমেলো কম কম, আর চোখই আঁকেনি শুধু দুটো গত্তোর মতো হয়ে আছে।”
”পরে আঁকবে। কিন্তু পেন্সিলটা তুমি নিশ্চয় চেয়েছিলে।”
”মোটেই না, মোটেই না, দিদি নিজে থেকে দিয়েছে। আবার আসবে, আমার ছবিটা তো শেষ হয়নি। বলেছে চুপটি করে বসে থাকলে এবার বড়ো দুটো চকোলেট দেবে।”
”আজ একটা দিয়েছে?”
”হ্যাঁ।” বলেই হিমু থতমতো হল। ”আমি চাইনি কিন্তু। আচ্ছা বাবা দিদিকে বলব আমার স্পোর্ট দেখতে যাবার জন্য?”
”হ্যাঁ।”
”জ্যোঠিমাকে বলব?”
”হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আবার স্পোর্ট বললে।”
রাতে খাওয়ার পর দালানে কণা টি ভি দেখছিল। তার পাশের চেয়ারে তুষার। গণতন্ত্র আর নির্বাচন নিয়ে চারটি লোক ইংরাজিতে কথা বলছে ক্লাসে ছাত্র পড়াবার মতো ভঙ্গিতে। শুভা ঘরের মধ্যে।
”বাবা বন্ধ করে দেব না দেখবে? আমি ওপরে যাব।”
টিভি-তে কথার শব্দ কাজে লাগিয়ে নিচু গলায় তুষার বলল, ”দোসরা রোববার তোর ঠাকুরদার বাৎসরিক। বেলঘরিয়ায় যাব, তুই যাবি আমার সঙ্গে? তোর ঠাকুমা তোকে দেখতে চেয়েছে।”
”রোববার কখন?”
”তিনটে, সাড়ে তিনটেয় বেরোব, ন’টার মধ্যেই ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ব।”
কণা টিভি বন্ধ করে বলল, ”যাব।”
ছয়
শনিবার তারা তিনজন শহীদ মিনারে বাস থেকে নামল বেলা বারোটা নাগাদ। মিনিট পাঁচেক হেঁটে পৌঁছল নীলকাপড়ে সাদা অক্ষরে অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাবের নাম লেখা ব্যানার আঁটা সামিয়ানায়। আশেপাশে কয়েকটা মাঠে ক্রিকেট খেলা চলছে। লোকজন খুবই কম।
বাস থেকে নামার পরই মূর্তির, তাঁবুর, রাস্তার নাম জানতে চেয়ে হিমুর কৌতূহল ধারাবাহিক প্রশ্ন হয়ে তুষারকে ধৈর্য্যের পরীক্ষায় নামায়। উত্তর দিতে তার আরামই হচ্ছিল। চিন্ময়ীর প্রশান্ত নির্লিপ্ত কিন্তু সচেতন মুখ, প্রশ্নোত্তর শুনে যাচ্ছিল। রোদের তেজ খুবই মোলায়েম, শীত যতটা লাগবে ভেবেছিল ততটা নয়। তবু হিমুর গায়ে চিন্ময়ীর বোনা হাতকাটা গোল সোয়েটার। তার হাতের পলিথিন ব্যাগে আছে হিমুর কোট, নিজের কার্ডিগান, ওয়াটার বটল।
লম্বা একটি ছেলের সঙ্গে অফিসের এক প্রৌঢ় সহকর্মী তাদের আগে চলেছে। তুষার চেঁচিয়ে বলল, ”ছেলে কি স্পোর্টসে নামবে নাকি রাজেনবাবু?”
”হ্যাঁ।”
চিন্ময়ী অনুযোগের স্বরে তুষারকে বলল, ”অত বড় ছেলে নামলে হিমু পারবে কী করে?”
”জিজ্ঞেস করে দেখি ছোটদের জন্য বয়সের গ্রুপ ভাগ করা হয়েছে কিনা।” বিব্রত বোধ করছে তুষার। জীবনের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হিমু যেন গৌরব পায়, মনেপ্রাণে সে এটাই চাইছে।
স্পোর্টস কিছু আগে শুরু হয়ে গেছে। দুটো টেবিল ভরে প্রাইজ। বিজয়ীদের হাতে ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোলারের বউ সেগুলো তুলে দেবেন। একটা লম্বা সোফায় বুকে ব্যাজ আঁটা স্বামীর সঙ্গে তিনি বসে। মাইক্রোফোনে নানাবিধ ঘোষণা, অনুরোধ, নির্দেশ দেবার কাজে অনির্বাণ ব্যস্ত। সোফার পিছনে চেয়ারগুলোয় বসে কয়েকজন বউ আর প্রবীণ কিছু অফিসার। চিন্ময়ী সেখানেই বসল।
”খোঁজ নাও, হিমু কাদের সঙ্গে দৌড়বে।”
তুষার খোঁজ করতে গেল এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, ”হ্যাঁ দুটো গ্রুপ করেছে। আট থেকে বারো আর বারো থেকে পনেরো, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে কম্পিট করবে।”
”তবু ভালো।”
কিন্তু চিন্ময়ীর ‘ভালো’ কিছুক্ষণের মধ্যেই ”এ অন্যায়, এগুলো দেখা উচিত” হয়ে গেল। বিস্কুট রেসের জন্য হিমু যখন জনা দশেকের সঙ্গে স্টার্টিং লাইনে তখন চিন্ময়ী উত্তেজনার বশে মাঠের কিনারে চলে এসেছে। লাইনে দাঁড়ানো প্রতিযোগিদের মধ্যে অন্তত ছয়জন হিমুর থেকে লম্বা। তখন সে তার পাশে দাঁড়ানো একটি বউকে বলে, ”এ অন্যায়, এগুলো দেখা উচিত। বয়স তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভাঁড়িয়েছে।”
”কে বয়স ভাঁড়িয়েছে?” বউটি চোখ সরু করে তীক্ষ্ন স্বরে বলল।
”ওই তো প্রথম মেয়েটি, তারপরের, তারপরের তিনজন বাদ দিয়ে তারপরেরটি…”
”আপনি কি জানেন কার কত বয়স, বলছেন যে? লম্বা হলেই বয়স বেশি আর খেঁকুরে হলেই কম বয়স?” কণ্ঠস্বরে ঝগড়ার জন্য আহ্বান। চিন্ময়ী মুখ কঠিন করে নিরুত্তর রইল। এর ছেলে বা মেয়ে নিশ্চয় ওই দশজনে আছে।
”বয়স কমিয়ে সুবিধে নেবার মতো ছোটলোক আমরা নই।”
চিন্ময়ী কথাটা শুনে পায়ে পায়ে সরে গেল।
একটা দড়িতে দশটা বিস্কুট সুতোয় ঝুলিয়ে দুটি লোক ধরে নাড়াচ্ছে। সুতোগুলোও ঠিক সমান মাপের নয়। কয়েকটা বিস্কুট বেশি ঝুলে রয়েছে। বিস্কুট কামড়ে সুতো ছিঁড়ে আরও কিছুটা দৌড়ে শেষ করতে হবে। চিন্ময়ীর নজর তৃতীয় বিস্কুটের উপর, ওটাই বেশি ঝুলে। হিমুর কি নজর পড়বে ওটায়? বুদ্ধি করে কি ওটাকেই চেষ্টা করবে? ওকে এটা জানিয়ে দিলে কেমন হয়! সে দ্রুত স্টার্টিং পয়েন্টে যাচ্ছে সেই সময়ই হুইশল বাজল।
”হিমু থার্ড বিস্কুটটা, হিমু থার্ডটার চেষ্টা…”।
ততক্ষণে চিন্ময়ীকে অতিক্রম করে সবাই বিস্কুটের কাছে পৌঁছে গেছে। হতাশ চোখে সে দেখল লাইনের সেই প্রথম মেয়েটিই ওই বিস্কুটাই কামড়াবার চেষ্টা করছে। লোক দুটি সজোরে দোলাচ্ছে দড়িটা। হিমু লাফাচ্ছে, ওর নাকে, গালে ঠোক্কর লাগছে বিস্কুটের। পারছে না। অসহায়ভাবে পাশের ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়ে হিমু আবার চেষ্টা শুরু করল।
একটা হইহই উঠে জানিয়ে দিল বিস্কুট মুখে প্রতিযোগীরা সমাপ্তিতে পৌঁছচ্ছে। হিমু আর তারই উচ্চচতার একটি মেয়ে তখনো চেষ্টা করছে। তুষার প্রবল উৎসাহে দু’হাত মুঠো করে তখন মাঠের ভিতর থেকে চেঁচাচ্ছে, ”চেষ্টা করো হিমু, বাক আপ হিমু, আবার…পারতেই হবে, আর একবার…।” ছেলেমানুষের মতো সে লাফাচ্ছে।
হিমু পারল। কিন্তু তার আগে আটজন পৌঁছে গেছে। যারা দড়ি দোলাচ্ছিল, তারা নাড়ানো বন্ধ রেখে একটু নিচে করে ধরে ব্যাপারটা সহজ করে দেয়। সমাপ্তির কাছে তখন ভিড়, এলোমেলো পরিবেশ। বিস্কুট মুখে নিয়ে ছুটে গিয়ে, দ্বিধাগ্রস্ত হিমু দাঁড়িয়ে পড়ল ভিড় দেখে।
চিন্ময়ী ছুটে গেল। তুষার তখন হিমুকে কোলে তুলে তার দিকেই আসছে।
”প্রোটেস্ট করা উচিত, তোমার প্রোটেস্ট করা উচিত।” চিন্ময়ীর গলা কাঁপছে, চোখে জল আসার মতো অবস্থা। ”বয়স কমানো লম্বা লম্বা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ও পারবে কেন! এভাবে কম্পিটিশন করাটাই অনুচিত। সবাইকে সমান অ্যাডভান্টেজ দেওয়া দরকার। এটা তোমার ওদের বলা উচিত।”
”থাক না, যেতে দাও এসব।” হিমুর হাতে ধরা আধ খাওয়া বিস্কুটটা তুষার কপ করে কামড়ে ধরল। ভেঙে গিয়ে যেটুকু হাতে রইল হিমু তা এগিয়ে ধরল মায়ের দিকে। চিন্ময়ী দৃকপাত করল না।
”আর আমি ওকে এখানে নামতে দেব না, কিছুতেই না। হিমু কোল থেকে নামো, আমার সঙ্গে বসে থাকবে। এই সব দামড়াদের সঙ্গেই তো কম্পিটিশন করবে, সব কটায় ও হারবে।”
”হারুক না!”
”এভাবে হারা উচিত, না এভাবে জেতাও উচিত?
”সব সময় জিততে হবে এমন কোনো কথা আছে? শুরুতেই হারটা জেনে রাখলে জিতটা কি জিনিস সেটা যথার্থ বুঝতে পারবে। ওকে তুমি হারতে দাও।”
”তোমার হিতোপদেশ রাখ।”
”মা, আমি আর দৌড়ব না?”
”জানি না, বাবাকে জিজ্ঞেস কর।”
চিন্ময়ী হনহনিয়ে চেয়ারের দিকে চলে গেল। তুষার কোল থেকে হিমুকে নামিয়ে বলল, ”মা খুব রেগে গেছে।”
সেই সময় পিছনে নারীকণ্ঠে শুনল, ”নিজেরটি হারলেই অমনি সব জোচ্চচুরি। বার্থ সার্টিফিকেট দেখিয়ে নামতে হবে বলে দিলেই পারত, তাহলে সঙ্গে করে এনে দেখিয়ে দিতুম।”
”কেন কেউ কি কিছু বলেছে?” পুরুষ কণ্ঠ।
তুষার আড়চোখে দেখল জিএম-এর স্টেনো অশেষ মুখুজ্জে আর তার বউ।
মিনিট দশেক পর তুষারের ইভেন্ট। ট্রাউজার্সের ভিতর শর্টস পরে বাড়ি থেকে রোজকার মতো অফিসে যাবার সময়েই সে দেবাই পুকুর থেকে বেরিয়েছে। এখনো পর্যন্ত একবারও সে অফিসের স্পোর্টসে, শুভার তো কথাই ওঠে না, কণাকেও নিয়ে যায়নি। প্রাইজ হাতে বাড়ি ফিরে কণাকে গত বছরও অবাক করেছে, শুভার কোনো ভাবান্তর দেখেনি। কাল রাতে কণা খাপছাড়াভাবেই বলেছিল, ”তোমাদের অফিসের স্পোর্টস কবে, বাবা?”
”বলতে পারব না, কেন?”
”কিছু স্কেচ করব তাহলে।”
”হলে বলব।”
ট্রাউজার্স খুলে সে চিন্ময়ীর কোলের উপর সেটা রেখে বলল, ”তেলো হাঁড়ির মতো মুখ করে আর থাকতে হবে না।” তারপর হিমুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ”আর ক’মিনিটের মধ্যেই একটা ম্যাজিক হবে।”
”ম্যাজিক?” হিমুর চোখ বড় হয়ে উঠল।
”তোমার মা’র মুখে হাসি ফুটবে।”
”কী করে?”
”আমি এবার দৌড়ব। ফার্স্ট হলেই দেখবে কী হয়!”
ঠোট টিপে দু’জনেই তাকিয়ে। যথেষ্ট চেষ্টা করেও চিন্ময়ী নিজের হাসি আটকাতে পারল না।
তুষারের কথামতই হল। চিন্ময়ী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় যখন তুষার দ্বিতীয় জনকে অন্তত সাত-আট গজ পিছনে ফেলে ফিতে ছেঁড়ে। অভিনন্দন বাক্য ও পিঠে কয়েকটা চাপড় নিয়ে সে ফিরে এল হাঁফাতে হাঁফাতে।
”ছেলের হারের শোধ নেওয়া হল তো? এর মধ্যে বয়স ভাঁড়ানো টাড়ানো নেই, ক্লিন অ্যান্ড অনেস্ট ব্যাপার।”
”আর তো কিছু তোমার করার নেই, তাহলে প্যান্টটা পরে নাও, হাসি পায় বুড়োদের হাফ প্যান্ট পরা দেখলে।”
খাবারের প্যাকেট বিলি করা হচ্ছে। তুষার প্যাকেট আনল।
”বাবা খাব?”
”না এখানে নয়, বাড়ি গিয়ে।” চিন্ময়ী প্যাকেট তিনটি ব্যাগে ভরল।
”বাবা তুমি বলেছিলে একদিন চাইনিজ খাওয়াবে।”
”কবে বলেছি?” তুষার না জানার ভান করল। হিমুকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সে কখনো ভোলে না।
”বারে, ভুলে গেলে! মা, তুমি বললে না আজ বাবাকে মনে করিয়ে দিতে।”
”আমি আবার কখন বললুম।” অপ্রতিভ মুখটা ঘুরিয়ে চিন্ময়ী দেখল মিউজিক্যাল চেয়ারের জন্য বউয়েরা কোমরের শাড়ি গোছাচ্ছে।
”নামবে তো চলে যাও।” তুষার পিঠে ঠেলা দিল।
”নাহ।”
”না কেন, ভালো প্রাইজ আছে।”
”নাম দেওয়া নেই এখন আমায় নামতে দেবে কেন?” চিন্ময়ীর স্বর অনিশ্চিত কিন্তু প্রায় রাজি।
”এখানে আজ যারা হাজির হয় তাদের নিয়েই এটা করা হয়, সে জন্য আগে নাম দেবার দরকার হয় না। আমি তোমার নামটা বলে আসছি।” তুষার নাম নেওয়ার লোককে খুঁজতে গেল। একটু পরেই দশটি চেয়ারকে ঘিরে এগারোজন দৌড়বে, আসল জোরে হাঁটা শুরু করল, লাউডস্পিকারের রেকর্ডে বাজছে জ্যাজের সুর। হঠাৎ রেকর্ড বন্ধ হতেই হুড়োহুড়ি চেয়ারে বসার জন্য। একজন বসতে পারল না। একটা চেয়ার কমিয়ে দেওয়া হল। চিন্ময়ী দশজনের মধ্যে রয়েছে।
”চেয়ার থেকে আরও দূর দিয়ে ঘোরা উচিত, এত কাছে কাছে থাকলে তো ব্যাপারটা জমে না। অ্যানাউন্স করে এটা ওদের জানিয়ে দিল।”
”জানালেও কিছু হবে না। সব জায়গাতেই এই হয়, চেয়ারের কাছাকাছি দৌড়ের নামে হাঁটবে আর ধাক্কাধাক্কি করবে। মেয়ে-ছেলেদের কাণ্ড তো, যে করে হোক জিততে চায়।” খুবই সুচিন্তিত একটা মন্তব্য করতে পেরে লোকটি হাসল। তুষার পিছনেই দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে চিন্ময়ীকে। শেষ তিনজনের মধ্যে ও আসতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে। অশেষ মুখুজ্জের বউ গত দু’বার জিতেছে এবারও সবাই ধরে নিয়েছে জিতবে।
রেকর্ড বন্ধ হল। প্রতিযোগিতাকে ঘিরে থাকা ছোকরা কর্মীদের জনতা হইহই করে উঠল। তার প্রধান কারণ, দু’জন বয়স্কা গৃহিণী চেয়ারে বসতে গিয়ে অন্যের পাছার ধাক্কায় মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে।
”ফাউল ফাউল।…ডিসকোয়ালিফাই করুন…পুশ করেছে।”
”পুশ কি চার্জ করেছে বল..হিপ চার্জ!”
”হিপ হিপ হুররে?”
চিন্ময়ী ধাক্কা দেয়নি, তুষারের কাছে এটাই স্বস্তির। আদি রসে চোবান যা সব মন্তব্য অফিসেও এই নিয়ে হবে তা তো সে জানেই। হিমু ভিড়ের আগে দাঁড়িয়ে দু’হাত মুঠো করা, মুখটা লালচে, ঘন ঘন ঢোঁক গিলছে।
উত্তেজনাটা তুঙ্গে উঠল শেষ রাউন্ডে। চিন্ময়ী আর অশেষের বউ, চেয়ার মাত্র একটি। কি একটা আপত্তি তুলে চিন্ময়ী স্পোর্টসের এক কর্তাকে হাত দিয়ে জমিতে একটা বৃত্ত তৈরি করার জন্য বলছে। ছোকরারা হইহই করে উঠল। ”সার্কল করে দিন…দাগ কেটে গণ্ডি করে দিন, তার বাইরে দিয়ে, হাঁটা নয় দৌড়তে হবে।” কে একজন বলল, ”এটাতো আগেই করা উচিত ছিল, এখন তাহলে কেন? ফাইনালে নতুন নিয়ম চালু করা যায় না।”
কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোলারের পরামর্শে শাদা রং করা কয়েকটা মাটির গ্লাস উল্টে বসিয়ে চেয়ারকে কেন্দ্র করে পাঁচ গজ ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত রচিত হল। ‘কাম অন চিনু, কাম অন,’ তুষার ফিস ফিস করল। হিমু হাত ঝাঁকিয়ে চিৎকার করছে। চিন্ময়ী হাত নেড়ে হিমুকে চুপ করতে বলল। দূর থেকে ওর চোখ আর চেপে বসা চৌকো চোয়ালের পেশী দেখতে দেখতে তুষারের মনে পড়ল, যখন সে বলেছিল, ‘চিনু এটা খুব কষ্টের জীবন হবে, পারবে? আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু সবার কাছে প্রশ্ন হয়ে উঠবে।’
তখন চিনুর মুখটা এমন কঠিন হয়ে উঠেছিল। ওর মনের প্রকাশের ধরনটা কিন্তু এখনো বদলায়নি! কাঠিন্যটা ওকে আলাদা একটা রূপ দেয়। ‘বহু প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি সবার কাছে।’ সে দিনের স্বরটা তুষার এত বছরেও দ্বিতীয়বার কখনো ওর মুখ থেকে আর শুনতে পায়নি। অমোঘ, চূড়ান্ত।
‘সকাল ন’টায় কোন্নগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ভর্তি লোক, তিনটে ছেলে এসে একটি কলেজ ছাত্রকে ছোরার পর ছোরা মারতে লাগল। চেঁচাচ্ছিল ছেলেটি, বাঁচাও বাঁচাও। একটি লোকও এগোল না। তিনজন ধীরেসুস্থে চলে গেল লাসটা ফেলে রেখে। ট্রেন এল, সবাই ঝাঁপিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল, অফিসে লেট যেন না হয়! এরাই তো তোমার সবাই, এরাই তো প্রশ্ন করবে?’
চিনুর কথাগুলোয় ছিল রোমান্টিক যুক্তি কিন্তু সেদিন সে ওর কাছ থেকে যা জানতে চেয়েছিল তা পেয়ে গেছিল, তুচ্ছ করার মতো সাহস ওর চোয়ালে চেপে বসে ছিল। সেটাই আবার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এখানে কি চিনু কোনো কিছু তুচ্ছ করতে বদ্ধপরিকর?
হুইসল বাজছে। হঠাৎ একটা নৈঃশব্দ্য নেমে এল। রেকর্ডে জ্যাজ বেজে উঠল আর তুষার চোখ বন্ধ করে দু’হাতে কান ঢেকে ঘুরে দাঁড়াল।
বোধহয় আধ মিনিট। তুষারের কাছে সেটা তার সমগ্র জীবনের পরিধি কালের মতো। একদম শূন্য হয়ে গেছে তার চেতনা। শুধু একটা শারীরিক দপদপানি এখন তাকে জানান দিচ্ছে সে বেঁচে আছে।
দুই তালু ভেদ করে বিরাট হর্ষধ্বনি তার কানে ঢোকা মাত্রই মাথা নেড়ে তুষার যন্ত্রণা-কাতর স্বরে বলল, ”হায় ভগবান।” চোখ খুলে সে ধীরে ধীরে ঘুরে দেখল চিন্ময়ী চেয়ারে বসে। হিমু ছুটে যাচ্ছে। মুখ কালো করে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল অশেষের বউ। চিন্ময়ীকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়ে হঠাৎই ট্রেনে উঠে পড়ার মতো তুষার হঠাৎই কাজটা করে ফেলল। ছুটে গিয়ে সে দু’হাতে চিন্ময়ীকে তুলে বনবনিয়ে চার পাক ঘুরে নামিয়ে দিল। তাই দেখে হইহই উঠল, হাততালি পড়ল।
”আমি ভেবেছিলাম তুমি পারবে না, বিলিভ মি!”
লজ্জিত চিন্ময়ী মুখ নিচু করে, সামিয়ানার দিকে এগিয়ে যাওয়া ভিড়ের সঙ্গে চলতে চলতে বলল, ”তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? এত লোকের মাঝে…”
”কে পরোয়া করে লোককে?” বুকটা ঠেলে চিতিয়ে দিয়ে তুষার বীরপুরুষ সেজে দু’পাশে দেহটা ঘোরালো।
অনির্বাণ খুব ব্যস্ত কিন্তু তা সত্ত্বেও মুচকি হেসে বলল, ”দাদার দেখছি আজ বয়সটা পঁচিশ বছর কমে গেছে!”
প্রৌঢ় একজন তুষারের পিঠ চাপড়ে মৃদু অনুযোগ করলেন, ”বউ-তো আমাদেরও আছে, তাই বলে এত লোকের মাঝে কি ওভাবে পাঁজাকোলা করে ঘোরাব? হল কী তোমার?”
কী হয়েছে সেটা তুষার বুঝতে পারছে না। অনেক দিনের অনেক না করতে পারা কাজ, নিজেকে বিকশিত হতে দেখার ইচ্ছা, কুঁকড়ে থাকা ব্যক্তিত্ব, সব যেন নিমেষে পূর্ণতা পেয়ে যাচ্ছে। অনুভব করছে অফুরন্ত একটা উদ্যম তার কোষগুলোকে ফুলিয়ে তুলেছে যার ফলে সে চিন্তাহীন, ভারবিহীন একটা মাথা নিয়ে উত্ত্যক্ত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে।
”বাবা তুমি দেখেছিলে মা কীরকম লাফ দিয়ে চেয়ারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! আর একটু হলেই চেয়ার থেকে কিন্তু পড়ে যাচ্ছিল, দেখেছিলে?”
”না দেখিনি, বাড়ি গিয়ে আমাকে করে দেখাবে।”
বাচ্চচাদের পুরস্কারগুলো আগে দেওয়া হল। পরাজিতরাও সান্ত্বনা হিসাবে পেল এক প্যাকেট বেলুন আর রং পেন্সিলের বাক্স। হাতে নিয়ে হিমঘ্ন সেনগুপ্ত অসম্ভব খুশি। তার জীবনের প্রথম পাওয়া পুরস্কার আঁকড়ে সে ছুটে এসে মায়ের কোলে মুখ লুকোল। তুষার পেল ব্যাটারিচালিত দেয়াল ঘড়ি। ডিম্বাকৃতি শাদা প্লাসিক কেস, সোনালি ধাতুর পাড় দেওয়া, কাঁটাগুলি রুপোলি। কালো ডায়াল। তার মনে হল শ’দুয়েক টাকা হবে!
”বাবা এটা আমাদের ঘরে থাকবে?”
”হ্যাঁ’, বলেই তুষারের মনে পড়ল, প্রতিবার সে প্রাইজ কণার হাতে তুলে দিয়েছে। এবার আর দেওয়া হবে না।
একটা বিরাট উল্লাস জমা ছিল মিউজিক্যাল চেয়ারের বিজয়িনীর জন্য। ছবি তুলছিল একজন, সে তুষারকে টেনে আনল, পাশাপাশি দু’জনকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলবে বলে। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে নাকি কখনো এই অফিসের স্পোর্টসে ফার্স্ট হয়নি!
কাঁধে ঝোলাবার ফোমের ঘিয়ে রঙের ব্যাগটা নেবার সময় চিন্ময়ীর মুখ লজ্জায় নিচু হয়ে ছিল। মুখ নিচু করে রইল ছবি তোলার সময়ও। একটা জেদের বশে নেমে পড়ে হঠাৎ সফল হয়ে যাওয়ার ধাক্কাটা এইবার সে পাচ্ছে।
”প্রাইজ দুটো কাজে দেবে।” ফেরার সময় হাঁটতে হাঁটতে তুষার মন্তব্য করল। রাস্তার দিকে না গিয়ে ওরা গড়ের মাঠের ভিতরের দিকে যাচ্ছে।
”আমারটা কাজে দেবে না?”
”সব থেকে বেশি দেবে। অত বেলুন ফোলাতে ফোলাতে ফুসফুসের যা এক্সারসাইজ হবে না!…এখন আমরা একটু বেড়িয়ে নিয়ে তারপর কোথায় যাব হিমু?”
”বাড়ি?”
”চাইনিজ খেতে।” চিন্ময়ী বলে ফেলল গম্ভীর স্বরে নিশ্চিত ভঙ্গিতে। ”আমি টাকা দেব।”
”খুব উৎফুল্ল মনে হচ্ছে যেন।”
”হিমুর জন্য। অন্যায় কম্পিটিশনে ও হেরেছে, আমি তার শোধ নিতে চেয়েছিলাম। টেরিয়ে বেঁকিয়ে অনেক কথাই শুনিয়েছিল…হিমুর মুখ ছাড়া আর কিছু তখন আমার চোখের সামনে ছিল না।”
সাত
কণার মুখের দিকে তাকিয়েই তুষার চোখ সরিয়ে নিল। ”হ্যাঁ, ঘড়ি একটা কেনা দরকার।” প্রায় স্বগত স্বরে সে বলল।
”কিনতে হবে কেন, সারিয়ে নেওয়া যায় তো! অনেকদিন অয়েল করা হয়নি।”
”শেয়ালদা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ওরা কথা বলছে। ট্রেন নেই। যদিও ট্রেন ছাড়ার সময় পার হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মের বড় দুটো ঘড়ি দেখে কণার মনে পড়ে গেছে, বাড়ির দেয়াল ঘড়িটা মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই বলেছিল, ”বড্ড পুরনো হয়ে গেছে, ওটাকে দোকানে পাঠানো দরকার। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।”
প্রাইজ এবার আর বাড়িতে আনা হয়নি। তুষারের মনের মধ্যে খচখচ করছে। চায়ের স্টলে গিয়ে সে দু’কাপ দিতে বলল। দু’জনে সবে খাওয়া শেষ করেছে তখন একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। ছুটির দিন হলেও ভিড় রয়েছে, ওরা জানলার ধারে বসার জায়গা পেল না।
”বেশিক্ষনের পথ নয়, আমাদের হিন্দমোটরের মতই ডিসট্যান্স। যতদূর মনে পড়ছে একই সময় লাগে।”
”কিছু একটা কিনে নিয়ে গেলে ভালো হয়। তুমি তো তবু বছরে বছরে যাও, আমি তো পাঁচ-ছ বছর পর যাচ্ছি।”
”নেমে সন্দেশ কিনে নেব। তুই বরং তরুণের ছোট ছেলের জন্য একটা কিছু কিনে নিস।”
”চকোলেট পেলে কিনব, ঠাকুরমার জন্যও।”
”এই বয়সে!” তুষার হেসে ফেলল।
মিনিট কুড়ি সময় লাগল বেলঘরিয়া পৌঁছতে। তুষার একটা মিষ্টির দোকান থেকে পনেরো টাকার সন্দেশ কিনল, কণাকে দশ টাকা দিল। সে তিনটে চকোলেট বার কিনে নিল।
সাইকেল রিকশায় বারো মিনিট লাগল। বাস রাস্তা থেকে ডান দিকে নেমে কাঁচা পথ। একতলা ছোট ছোট বাড়ি। অঞ্চলটি বছর তিরিশের কিন্তু বাড়িগুলির চেহারায় মনে হবে ষাট-সত্তর বছরের। অনেকগুলিরই প্লাস্টার নেই। বোধহয় অর্থাভাবে কিংবা বাহুল্য মনে করে বাড়িগুলোকে সুশ্রী করার কাজ সম্পূর্ণ করা হয়নি।
বাড়ি বিক্রির টাকা সমান তিনভাগে ভাগ করা হয়। তরুণ সেই টাকায় তিনকাঠা জমি কিনে একখানা ঘর তুলে বউ, কোলের বাচ্চচা আর মাকে নিয়ে এখানে চলে আসে। কণা তার এক বছর পর জন্মায়। তরুণের এখন তিনটি ছেলে। ঘর বাড়িয়েছে দুটি। রান্না ঘর ও কলঘরের ছাদ পাকা করেছে। কারখানায় সে ইউনিয়নের নিচের সারির নেতা। বড় ছেলেটি পড়া ছেড়ে দিয়েছে ফুটবলের জন্য। দু’বছর ধরে এরিয়ান্সে খেলছে। তুষার দু’তিনবার কাগজে তপেন সেনগুপ্ত নামটা দেখেছে। অফিসে রবি তাকে বলেছিল, ‘আপনার ভাই’পো, গেঁজে যদি না যায়, ইন্ডিয়া খেলবে। ইস্টবেঙ্গল ওকে টার্গেট করেছে, সামনের বছর তুলে নেবে। পঞ্চাশ হাজার দর ইজি পাবে।’ শুনে সে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছিল। শেষবার মাকে প্রণাম করতে এসে তপেনকে দেখতে পায়নি। তরুণের আর দুটি ছেলে স্কুলে পড়ে।
বাইরের দাওয়ার একদিক গ্রিল দেওয়া এবং সেটাই এখন বসার জন্য ব্যবহৃত। একধারে পুরনো একটা সাইকেল। দুটো নতুন বেতের চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। তরুণের হাতে স্লিংয়ে ঝোলানো। লুঙ্গি আর সবুজ খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে হাওয়াই চটি। সে ওদের দেখে এগিয়ে এল।
”হাত কেমন আছে?”
”ভালো। অল্পের ওপর দিয়ে গেছে।”
”সাইকেলটা এবার ছাড়। রাস্তায় যা দেখলাম, না চালানোই ভালো। নিয়ম মেনে কিছুই চলে না।”
কণা প্রণাম করল, তরুণকে।
”এত বড় হয়ে গেছে! শেষ দেখেছি যখন…এসো ভেতরে এসো।”
তুষার সন্দেশের বাক্স মার হাতে দিল। ছোটখাট শীর্ণ দেহ। এখনো কাঁচা রয়েছে অনেক চুল। খোঁপাটা গত দশ বছর একই নুনের পুটলির আকারেই রয়ে গেছে। পরিষ্কার থান পরনে। কণাকে দেখে তিনি তো অভিভূত। বংশে এখন সেই একমাত্র মেয়ে। তুষারের সেজ ভাই তুহিনের একটিই ছেলে।
কণার দুই গালে, চুলে, পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে তিনি বললেন, ”কি লক্ষ্মীমন্ত মেয়েগো!…বিয়ের সম্বন্ধ করছিস?”
‘এখনই কি, আগে পড়া শেষ করুক।” তুষার প্রসঙ্গটা এড়াবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে বলল, ”এ দুটি কে, তরুণ তোর ছেলে?’
”হ্যাঁ, জ্যাঠাকে প্রণাম করো, আর এ হল তোমাদের দিদি।”
কণা রিকশা থেকে নামার সময় একটু দূরে দু’জনকে রাস্তায় দেখেছে আরও তিনটি ছেলের সঙ্গে চেঁচিয়ে তর্কে ব্যস্ত ছিল। দু’একটা কথা শুনে মনে হয়, বিষয়টা ক্রিকেট। ওরা তাকেও প্রণাম করতে যাচ্ছিল, সে ঝুঁকে হাত চেপে ধরল। জীবনে সে কারুর প্রণাম এখনো পায়নি, লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে সে চকোলেট বার দুটি তাড়াতাড়ি দু’জনের দিকে এগিয়ে ধরল।
”নাও মিষ্টিমুখ করো।”
সামান্য ইতঃস্তত করেই দু’জনে দুটো নিয়ে নিল এবং মিনিট খানেকের মধ্যেই মোড়ক ছিঁড়তে ছিঁড়তে তারা মিলিয়ে গেল। ঠাকুরমাকে আর দেওয়া হল না, এই খেদটা তার মনকে কিছুক্ষণ ধরে রাখল।
”আর তো আমাদের মনেই পড়ে না, গরিব কাকিমা মরল কি রইল কি তো বয়েই গেল।”
ঠিক এইভাবে যে শুরু হবে, কণার তা ধারণায় ছিল না। সে অপ্রতিভ হয়ে গেল। রুগণ, ফ্যাকাসে এবং লম্বা এই ছোট কাকি যে একদা সুন্দরী ছিলেন সেটা মুখের ধ্বংসাবশেষ থেকে অনুমান করে নেওয়া যায়। অভাবের সঙ্গে ঘর করার চিহ্ন ওর ঔজ্জ্বল্য ও পুষ্টি হারানো চুলে, চামড়ায়, নখে বা বাহুতে ছড়িয়ে আছে। দ্রুত কথা বলেন কর্কশ স্বরে।
”মা কেমন আছেন? তার সঙ্গে আমার এত বছরে একবারও দেখা হল না।” ছোট কাকি খুব সাধারণভাবে কথাটা বললেন। কণার তখন ইচ্ছে করল, বাইরে বাবার কাছে গিয়ে বসতে।
হাতলওলা চেয়ারে, হাতে বোনা পশমের আসনে ঠাকুরদার প্রায় একহাত লম্বা ফোটো দাঁড় করানো। তাতে একটা গোড়ের মালা। একটু আগে দুটো ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। টাকমাথা, সোজা প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মোটামুটি সুশ্রী। মুখের গড়নটা, কণার মনে হল, দুই ছেলেই পেয়েছে, কম বয়সেই মারা গেছেন।
”বছরে একবারই ছবিতে মালা দেওয়া!”
ছোট কাকির কথায় বিরক্তির থেকে তাচ্ছিল্যই যেন বেশি। কণা অল্পস্বল্প শুনেছে, দীর্ঘকাল বাপের বাড়িতে থেকে, অনাদর অবহেলা পেয়ে একটু অন্যরকম হয়ে গেছেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে সহ্য করতে পারেন না।
”তুমি এখন কী পড়ছ?”
”আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শিখছি।”
”শিখে কী হবে, মেয়েদের কোন কম্মে লাগবে? সেই তো হাঁড়ি ঠেলতে হবে! অবিশ্যি তোমাদের পয়সা আছে, বাপ-মায়ের এক মেয়ে, খরচপাতি করে বিয়ে দেবে। ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার ছেলে পেয়ে যাবে।”
কণা আর কী উত্তর দেবে! চুপ করে রইল।
”তপু, আমার বড় ছেলে, তোমার থেকে একটু বড়, ফুটবল খেলে, এখন খুব নাম করেছে। বেলঘরিয়ার সবাই চেনে। রোজ কত লোক যে আসে, এখানে খেলা ওখানে খেলা তো রোজ লেগেই আছে। আজও গেছে খেলতে…তোমরা ঠাকুমাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখ না কেন?”
কণা নড়ে উঠল, পারিবারিক কথাবার্তা তার ভালো লাগে না, এড়িয়ে চলে। তাছাড়া বাড়িতেও কখনো তার সামনে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বাবা-মা কথা বলে না।
”এসব ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাই না।” যতটা সম্ভব নরম স্বরে কণা বলল। বাইরে কাকা, ঠাকুমার সঙ্গে বাবা কথা বলছে। টুকরো যা কানে আসছে তাতে মনে হল ছেলেদের ছোটবেলার গল্প ঠাকুমা করছেন।
”তোমাদের বাড়িতে ঘর কটা? টি ভি আছে?”
”দু’খানা ঘর, না টিভি নেই।” কণা ঠিক করে ফেলেছে ছোট কাকিকে তৃপ্ত করবে।
”তপু বলেছে কিনবে, আগে কালার টিভি কিনবে, তারপর ফ্রিজ, তারপর সোফা-টোফা। লোকজন আসে তো! তোমাদের ফ্রিজ আছে?”
”নেই।”
”তোমরা দু’বেলাই মাছ খাও?”
”না, একবেলা।”
”তপু হপ্তায় একদিন মাংস আনে। খরচের হাত বড্ড! তোমাদের বাসন মাজার লোক আছে?”
”না, আমি আর মা মাজি, ঘর মোছাটোছাও আমরাই করি। বাবা বাজার করেন।”
”তোমার মা’তো হেডমাস্টার, ভালো মাইনেই তো তাহলে পায়, তবে লোক রাখে না কেন? মেয়ের বিয়ের জন্য পয়সা জমাচ্ছে?….এটা অবশ্য ভালো। লোকজন রাখা আমিও পছন্দ করি না। তোমার মামার বাড়ি তো বেশ পয়সাওলা, পুজোয় মামা কি দিল? মা’কে এখনো দেয় টেয়?”
”মামা একশো টাকা দিয়ে বলেছেন, পছন্দ মতো কিনে নিস।’
”মোটে একশো! তপু আমাকে ফরেন জাপানি সিল্কের শাড়ি কিনে দিয়েছে। শিলিগুড়ি খেলতে গিয়ে কিনে এনেছিল। ভাইয়েদের একটা করে প্যান্ট, বাবাকে গরদের পাঞ্জাবি।”
ঘরে ঢুকলেন ছোটকাকা।
”একটু চা করে দাও। ওরা কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে খিদেও তো পেয়েছে। শীতকালের বেলা, এই দেখ সন্ধে হয়ে এল।”
সন্দেশের বাক্সটা তুলে নিয়ে ছোটকাকি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কণা গ্রিল ঘেরা বাইরের দাওয়ায় এল।
”আয় দিদিভাই, ছেলের সঙ্গে শুধু গপ্পোই করছি। নাতনিকে কীরকম ভুলে গেছি দেখেছিস।”
ঠাকুমা মেঝেয় বসে, ছোটকাকা একটা মোড়া এনে নিজে তাতে বসে খালি চেয়ারটা কণার দিকে ঠেলে দিলেন।
”এই যা দেখে গেলি আমায়, পরের বার এসে আর দেখতে পাবি না। কম কষ্ট করেছি সারা জীবন, এবার শ্রীধরজীর ডাকের জন্য অপেক্ষা করছি।”
”কি আর এমন বয়স আপনার, খুব ভালোই তো স্বাস্থ্য রয়েছে।” কণা যতটা সম্ভব গলায় সজীবতা আনার চেষ্টা করল।
”অসুখে অসুখে ভেতরে আর কিছু নেই রে। তোর ঠাকুরদা বলতেন, মনের শান্তি, সংসারের শান্তি, দুনিয়ার শান্তি সব ঠিক থাকবে যদি শরীরে রোগ-ভোগ না থাকে। তা উনি যদ্দিন ছিলেন আমার কি তোর বাবার কোনোদিন অসুখ করেনি, তুহিনেরও না। তরুণকে তো চোখে দেখারই সুযোগ পেলেন না।”
”কেন?”
”ও তো তখন পেটে যখন উনি মারা গেলেন! তোর বাবা তখন একবছর পাঁচমাসের, ওর থেকে তুহিন এগারো মাসের ছোট। আর এই ছোটকাকা দু মাসের পেটে। এই তিনটে নাবালক নিয়ে অল্পবয়সি বিধবাকে কী কষ্ট করে যে চলতে হয়েছে, আজ তাই ভাবি আর ভগবানকে বলি মুখ তুমি রেখেছ আর প্রণাম জানাই। তবে মানুষ তো করে তুলেছি।” বৃদ্ধার মুখ চাপা গর্বে ভরে উঠল।
”ঠাকুরদা কতদিন মারা গেছেন?”
”এই তো আজ পঞ্চাশ বছর হল। তোর বাবার এখন একান্ন বছর পাঁচ মাস।”
”বাবার একান্ন হয়ে গেছে!” কণা বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকালো তুষারের দিকে। চোখেমুখে তারিফ। ভাবখানা, এত বয়স কিন্তু বোঝা যায় না। ”অফিসের স্পোর্টসে, জানেন ঠাকুমা, বাবা প্রতিবারই ছোটে আর ফার্স্ট হয়। এবারও হবে, তাই তো?”
কণা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। সে কিন্তু জানে গতকালই স্পোর্টস হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে যখন সে বিকেলে দোতলায় কাকিমাকে সিটিং দেবার জন্য অনুরোধ করছিল তখন হিমু তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু স্পোর্টসে বাবা কোনো প্রাইজ পেয়েছে কিনা সেটা এখনো জানে না।
”বড়দাকে লাস্ট যা দেখেছি, সেই একই রকম রয়ে গেছে।”
”ওকে ছোট থেকেই বয়সের তুলনায় কমবয়সি দেখায়। ছোট মেসোমশাই স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেছলেন তখন ওর বয়স দশটশের মতো। মাস্টারমশাই তো ওকে দেখে বললেন, দশ হতেই পারে না, সাত-আট হবে। তাই শুনে ছোট মেসোমশায়ের মাথায় চট করে বুদ্ধি খেলে গেল, তিনি ওর বয়স আড়াই বছর কমিয়ে ভর্তি করালেন।”
”সে কি?”
কণা এবং তরুণ একসঙ্গে তাকাল তুষারের দিকে। অস্বাভাবিক শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, বসার ভঙ্গিটাও। গলা টিপে ধরলে বাতাস টানার জন্য হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করে তুষার দুহাতে চেয়ারের হাতল আঁকড়ে সামনে ঝুঁকে পড়েছে। ঠাকুমা সেটা লক্ষ্য করলেন না।
”ছোট মেসোমশাই তো বাড়ি ফিরে বললেন, ‘পরে বুঝবি, তোর ছেলে আমাকে অনেক ধন্যবাদ দেবে আমার দূরদৃষ্টির জন্য। গরমেন্টের চাকরিবাকরি পেতে কমবয়স দেখবি কি সাহায্য করবে! বয়স কম থাকলে অনেকদিন চাকরিও করতে পারবে।’ আমি অবশ্য এসব অতশত বুঝি না। হ্যাঁরে, তুষু, ছোট মেসোমশাই ঠিক বলেছিল তো?”
বৃদ্ধা মুখ তুলে ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। কণার মনে হল এই মুখের সঙ্গে সেদিন স্কুল বাসে দুটি বাচ্চচাকে জড়িয়ে ধরা ছেলেটির মুখ কোথায় যেন এক হয়ে যাচ্ছে। দুটিতেই ভয়ঙ্কর সারল্য যা একমাত্র প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। সে হিমুর চোখেও কি বিপর্যয়ের আভাস দেখেছে?
”তুহিন, তরুণ এদেরও কি বয়স কমানো হয়েছে?” তুষার নিচু গলায় বলল।
”তা জানি না। বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন।
”বোধহয় না। আমার তো পাসটাসের কোনো সার্টিফিকেট নেই, আর চাকরি পাবার সময় ওসবের দরকারও লাগেনি।” তরুণ অনায়াস স্বরে বলল কণার দিতে তাকিয়ে। ”টেনেটুনে ক্লাস নাইন পর্যন্ত উঠেছিলাম। তবে মেজদাও বি-এ পাস, ওর ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে বয়স লেখা আছে।”
দু’হাতে রেকাব নিয়ে ছোটকাকি এলেন। ঠান্ডা সিঙ্গারা আর দুরকম মিষ্টি প্রতিটিতে। বোধহয় আগে কিনে রাখা ছিল। কোনো ওজর না তুলে কণা খেতে শুরু করল। তার বা তাদের সম্পর্কে ছোটকাকির ধারণাটায় কোনো নতুন রং লাগুক সেটা সে চায় না।
”বউমা, আমি কিছু খাব না, শরীরটা ভালো নেই।” তুষার কেমন এক ম্লান স্বরে বলল।
”কেন, কী হল?” বৃদ্ধা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।
”অম্বল আছে নাকি? আমার কাছে কোবরেজি ওষুধ আছে, দেব?”
”না থাক। শরীরটা এমনিই ভালো লাগছে না।”
”রাতে খাবি তো? চক্কোবত্তি মশাই আর দুগ্গা ভটচাযকে খেতে বলেছি, তোদেরও তো খাবার কথা, চিঠিতে তো বলে দিয়েছি, বলিনি?” বৃদ্ধা ব্যাকুল হয়ে কণার দিকে তাকালেন। ”হ্যাঁরে কণা খাবার কথা বলিনি?”
”আমি তো চিঠি দেখিনি। তবে রান্না হয়ে থাকলে আমি তো খাবই।” সে লক্ষ্য করল, তার কথায় ছোটকাকার মুখে খুশির ছোঁয়া লাগল।
”কণা, তাহলে তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, অনেকটা তো যেতে হবে…ট্রেন, বাস আবার ট্রেন, সময় লাগবে।” তুষার ধীরে ধীরে বলল অসুস্থের মতো। কণার মনে হল বাবা যেন হঠাৎই বদলে গেল। শরীর সম্পর্কে কোনোরকম অভিযোগ গত চব্বিশ ঘণ্টায় সে শোনেনি আর এই মুহূর্তে কী এমন ঘটল?
”এখনি খাবে কি, সবে তো সন্ধে হল!” ছোটকাকি অনুচ্চচ স্বরে বললেন।
”রাতের খাওয়া আমরা সাতটা-আটটার মধ্যেই সেরেনি।” কণা খুব সহজেই মিথ্যাটা বলল। ”আমরা উঠিও খুব ভোরে।”
”তাহলে ময়দাটা মেখে ফেল বউমা। হ্যাঁরে তুষু একটুও কিছু কি খাবি না?”
তুষার মাথা নাড়ল। কণার মনে হচ্ছে, বাবা সত্যিই অসুস্থ। পীড়াপীড়িতেও সে কিছু খেতে রাজি হল না। কণার খিদে নেই তবু সে জোর করেই খেল। কাকার ছেলেদুটিকে একবার সে দেখল রান্নাঘরে ঢুকে কিছু একটা মুখে পুরে বেরিয়ে গেল। জ্যাঠাদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। কণার মনে হল, কয়েক বছর পর দেখা হলে ওরা তাকে চিনতে পারবে না।
ঠাকুমা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন। ”আর কবে দেখা হবে…তুই এসে এক আধবার দেখে যাস আমায়। আমি তো আর কারুর কোনো দরকারে লাগি না, এখন বোঝা হয়ে গেছি।”
”আসব, নিশ্চয় আসব।” কণার চোখেও জল এসে গেছে। পঞ্চাশ বছর আগে তরুণী বিধবা তিনটি ছেলেকে নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। আজ তিনি বলছেন, কারুর কোনো দরকারে লাগি না। আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। কণা রাস্তার আলোয় হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবাক হয়ে গেল। ঠিক এই এইরকম একটা শুকনো, চামড়া-কোঁচকানো হাত সে যেন কোথায় দেখেছে?
”আমি আসব।” কণা হৃদয়ের গভীর থেকে বলল।
আট
কণার কাছে তুষার কৃতজ্ঞ হয়ে রইল হিন্দমোটর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামা পর্যন্ত। পথে সে একবারও জিজ্ঞাসা করেনি হঠাৎ কেন তার শরীর খারাপ হল, কী এমন হল যে একটা মিষ্টিও মুখে দিতে পারলে না? তখন পেটটা এমনই ঘুলিয়ে ওঠে যে একগ্লাস জল খেতেও সে ভয় পেয়েছিল। বমি করে ফেলবে মনে হচ্ছিল। শরীরের এই ভাবটা আস্তে আস্তে থিতিয়ে স্বাভাবিক হয়ে আসে শেয়ালদা স্টেশনে নেমে। কিন্তু তারপরই শুরু হয় মানসিক অস্থিরতা। এখন থেকেই সে তীক্ষ্ন একটা যন্ত্রণা মাথার মধ্যে অনুভব করে চলেছে। এটাকে উপড়ে ফেলার জন্য সে এখন কথা বলতে চায়। কণা একটা নীরবতাকে অদ্ভুত ধৈর্যে এতক্ষণ ধরে আঁকড়ে রয়েছে। কেন? ও বুদ্ধি ধরে, নিশ্চয় বুঝেছে বাবার শরীর খারাপ হয়নি।
”মা এমন একটা কথা তখন বলল…” তুষার হাঁটতে হাঁটতে পাশে তাকাল। মুখ নিচু করে কণা পা ফেলছে। রাস্তাটায় গর্ত রয়েছে, একবার পা মচকে দু’দিন সে বাড়িতে বন্দি ছিল।
”আমার জন্ম সালটা এতবছরে একবারও মনে পড়েনি। অদ্ভুত ব্যাপার নয় কি? রবীন্দ্রনাথ কি নেতাজীরটা কিন্তু মনে আছে!”
”ওঁদের জন্মদিন বছর বছর পালন করা হয় বলেই।”
”জন্মদিন পালনের অভ্যাসটা আমাদের নেই, থাকলে ধরে ফেলতে পারতাম।” তুষার নির্জন রাস্তায় নিজেদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। বেল বাজিয়ে একটা সাইকেল-রিকশা তাদের কাটিয়ে এগিয়ে গেল। চাপ ধোঁয়াশার মধ্যে রিকশাটা ঢুকে যাবার পর সে আর একবার বলল, ”জন্মদিন পালন করলে মনে থাকত আমার ঠিক বয়সটা কত।”
”হঠাৎ এসব কথা তোমার মনে পড়ল কেন?”
”অফিসে স্পোর্টসে পঞ্চাশ বছরের নিচের গ্রুপে দৌড়েছি।”
”কবে?”
”কাল।”
”সে কি, জানি না তো!…বলোনি তো!…প্রাইজ পেয়েছ কিছু?”
তুষার কথাগুলোকে অগ্রাহ্য করে দমবন্ধ হওয়া স্বরে দ্রুত বলল, ”আমার আসল বয়সের থেকে আড়াই বছর কম ধরে আমি সুযোগটা নিয়ে যাচ্ছি এতদিন। ব্যাপারটা অফিসিয়ালিই হচ্ছে কেননা ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে তাই লেখা, অফিসের সার্ভিস বুকেও তাই লেখা! আশ্চর্য! আমি এতকাল জানতামই না, খেয়ালই করিনি!”
”এইজন্য তোমার শরীর খারাপ…মন খারাপ হল? কম বয়সিদের গ্রুপে দৌড়েছ, এটা তো কৃতিত্বেরই!”
কী একটা বলতে গিয়ে তুষার প্রাণপণে নিজেকে সংযত করল। মনে মনে শুধু বলল, আর একটা কারণও আছে, বড় ভয়ঙ্কর সেটা।
শুভা খাবার টেবলে বসে স্কুলের কাজ করছিল। জানলাগুলো বন্ধ। মশা মারার ধূপ জ্বলছে। মুখ তুলে দুজনকে দেখে নিয়ে বলল, ”কণা, দুধটা খেয়ে নিও।”
দুধ টেবলেই গ্লাসে ঢাকা দেওয়া রয়েছে। কণা এক চুমুকে শেষ করে উপরে যাবার আগে, শোবার ঘরে বাবাকে জামা খুলতে দেখল। স্পোর্টসে নিশ্চয় কিছু একটা প্রাইজ পেয়েছে। সেটা এবার তাহলে হিমুই পেল। কণার মনে হল, তার সঙ্গে বাবার কি একটা বন্ধন যেন ছিঁড়ে গেল।
আলো নিভিয়ে তুষার শুয়ে ঘরে। শুভা ঘরের বাইরে এখনো স্কুলের কাজে মগ্ন। মায়ের কথাগুলো মনের মধ্যে সে রেকর্ডারের মতো চালিয়ে শুনছে। একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে বসল। আমি কী করতে পারি? কেন অবিরত প্রতিটি অনুভূতি, অনুভবকে কেটেচিরে বিচার, বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে হয়? এ এক যন্ত্রণা, নিজেকে নিজে এভাবে কয়েদ করে ফেলা! বাবার মৃত্যুর দেড় বছর পর আমি জন্মেছি? তাহলে আমার মা…? ‘তোর ছেলে আমাকে অনেক ধন্যবাদ দেবে আমার দূরদৃষ্টির জন্য।’ হায় মূর্খ! কি ভয়ঙ্কর একটা দমবন্ধ করা অবস্থায় ফেলে দিল এই দূরদৃষ্টি। আমি বেজন্মা হয়ে রয়েছি সেই স্কুল জীবন থেকে। ‘চাকরিবাকরি পেতে কম বয়স দেখবি কী সাহায্য করবে।’ আর সেজন্য আমাকে জন্ম দেওয়ানো হল এমন একটা বছরে যখন বৈধ বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না পিতৃত্বের দাবি প্রতিষ্ঠার। কেউ জানে না, তাতে কী হয়েছে? আমি তো জানলাম, একটা ইতর চালাকি আমাকে দেড় বছর বেশি চাকরি করার লাভটুকু দেবে। অনেকেই তো বয়স কমায়, এটা নিয়ে কেউ কি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাহলে আমি কেন একটা অসহনীয় অবস্থা মনের মধ্যে তৈরি করছি? আমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাচ্ছে?
তুষার দেবাই পুকুরে অন্ধকার ঘরে বসে নিজেকে নিয়ে যখন ছটফট করছে তখন হাজার মাইল দূরে নিদ্রামগ্ন এক শহরের আকাশ খুশি গ্যাসের মেঘে ছেয়ে গিয়ে, ধীরে ধীরে টিপে ধরছিল হাজার হাজার কলিজা। ঘুমের মধ্যেই তারা-কোলের শিশু, মা, বাবা, ঠাকুমা, ঠাকুরদা, জোয়ান বৃদ্ধ-মৃত্যুর মুঠিতে নিষ্পেষিত হতে হতে মারা যাচ্ছিল বিষাক্ত মিথ গ্যাসে। লাখে লাখে মানুষ নিঃশ্বাস নেবার জন্য নির্মল বাতাসের সন্ধানে দিশাহারা হয়ে চিৎকার করে ছুটে বেড়াচ্ছিল। তুষারও ঠিক সেই সময় একটা ক্ষুদ্র ভোপাল তার চেতনার মধ্যে তৈরি করে অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, নির্মল বাতাসের জন্য নিজেকে বার করে আনতে চাইছিল।
পরদিন অফিসে ড্রয়ার থেকে একটা সাদা কাগজ বার করে তুষার তার টেবলে রাখল। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থেকে কলমটা তুলে নিয়ে ঝুঁকে পড়ল।
”শুভা,
একটা কথা বলার জন্য এই চিঠি। মুখেও সেটা বলতে পারতাম। কিন্তু ভেবে দেখলাম মুখে সবসময় গুছিয়ে সব কথা বলা যায় না। অনেক কিছু বলব ভেবেও বহুবার দেখেছি অনেক কথা মনের মধ্যেই হারিয়ে যায়। তাছাড়া কথাগুলো তোমাকে আঘাত করবে, সুতরাং সাবধানে বলা দরকার। মনকে উদঘাটন করতে হলে ভিতর থেকে টেনেটেনে নিজেকে বার করে আনতে হয়। সময় লাগে। ঠিক জায়গায় ঠিক শব্দটি লাগাতে চিন্তা করতে হয়। যে কথাটা বলতে যাচ্ছি সেটা আমাদের উভয়ের জীবনের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ।
তোমার হয়তো মনে আছে বছর বারো আগে একটি মেয়ে বাড়িতে এসেছিল তোমার স্কুলে একটা চাকরির জন্য। লিভ ভেকেন্সিতে একজন টিচার নেওয়া হতে পারে শুনে উমেদার হয়ে এসেছিল। সেদিন ছিল রথযাত্রা, তুমি বাড়ি ছিলে না। তখন তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়…।”
এই পর্যন্ত লেখার পরই তুষার কলম থামাল। টেবলের কাছ দিয়ে অনেকে যাতায়াত করছে। সাদা কাগজে কিছু লিখছে দেখলে কেউ হয়তো, কোনো ছুতোয় কাছে দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করবে। লেখাটা ভাঁজ করে সে পকেটে রাখল। বাড়িতে বসে লিখবে। যখন শুভা রান্নাঘরে কিংবা স্কুলের কাজ নিয়ে অথবা বই লেখায় ব্যস্ত থাকবে, সেই সময় ঘরে বসে চিঠিটা লিখে ফেলবে।
অফিস ছুটির পর সে দেবাই পুকুরে ফিরে এল। শুভা স্কুলের দুটি মেয়ের সঙ্গে বসার ঘরে, কিছু একটা বুঝিয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছাদের দরজার কাছে আলো দেখে বুঝল, কণা তার ঘরে। সন্তর্পণে শোবার ঘরে এসে নিজের খাটে তুষার শুয়ে পড়ল। আধঘণ্টা পর আলো জ্বেলে সে চিঠিটা সম্পূর্ণ করতে বসল।
বসার ঘর থেকে আর কথার আওয়াজ আসছে না। মেয়েদুটি চলে গেছে। কাগজটা ভাঁজ করে তুষার বসার ঘরের দরজায় এসে দেখল শুভা গভীর মনোযোগে খাতা দেখছে। হাতে লাল কলম।
”একটা চিঠি লিখেছি তোমাকে দেব বলে।”
তুষার ভাঁজ করা কাগজটা শুভার সামনে রাখল। ভ্রূ কুঁচকে চশমার ফাঁক দিয়ে তুষারের মুখে একবার তাকিয়ে সে চিঠির দিকে হাত বাড়াল। তুষার ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
কত মিনিট কত ঘণ্টা কেটে গেছে তুষার তা হিসাব রাখেনি। অন্ধকার ঘরে সে চোখ বুজে শুয়ে থেকে শুনে গেছে পায়ের শব্দ। শুভা রান্নাঘরে গেল, কোনো দরকারে একবার শোবার ঘরেও এল, আলো জ্বালল। আলমারি খোলা-বন্ধের শব্দ হল। আবার দীর্ঘক্ষণ নৈঃশব্দ্য একসময় শুভা চেঁচিয়ে কণাকে ডাকল খাবার জন্য। দুজনের কথার শব্দ অস্পষ্টভাবে তার কানে এল। ঘরের দরজার কাছ থেকে কণা ডাকল, ”বাবা, খাবে এস।”
”শরীরটা ভালো নেই, পরে খাব।”
সত্যিই যেন শরীর ভালো লাগছে না। জ্বরের মতো একটা ঘোর তাকে পেয়ে বসেছে। শুভা নিশ্চয়ই এতক্ষণে পড়ে ফেলেছে। যতটা সম্ভব আবেগ, ভাবপ্রণতা থেকে নিজেকে দূরে রেখে সে শুধু কিছু তথ্য ও ঘটনাই লিখেছে। নিজের পক্ষ নিয়ে বা কাউকে দায়ী করে একটি কথাও লেখেনি। শুভাকে প্রভাবিত করা সহজ কথা নয়। তবু ওর প্রতিক্রিয়া না জানা পর্যন্ত সে অসুস্থতার মধ্যে থাকবে। কান্নাকাটি বা রাগারাগি, চিৎকার ঝগড়া কিছু একটা হোক তাহলে এই ঘোরটা কেটে গিয়ে সে সুস্থ হতে পারবে।
শুভা একসময় শুতে এল। আলো নিভিয়ে সে ব্লাউজ খুলবে। বিছানায় শুয়ে ভাঁজকরা চাদরটা খুলে শরীরের উপরে বিছিয়ে নেবে। তুষার অপেক্ষায় রইল।
”ওটা পড়লে?”
তুষার নিশ্বাস বন্ধ করে রইল উত্তরের জন্য।
”কণাকে পড়তে দিয়েছি।”
”কেন? ওকে কেন?” তুষার অস্ফুট আর্তনাদ করে বালিশ থেকে মাথা তুলে ফেলেছে। অপ্রত্যাশিত উত্তরটা সোজা একটা ঘুঁষির মতো এসেছে। শুভা যে এমন একটা কাজ করতে পারে, এই সম্ভাবনাটা একদমই তার চিন্তায় ছিল না। সে বিব্রত হয়ে বলল, ”কণাকে পড়তে দেওয়ার কী দরকার, ওটা তো তোমায় লেখা!”
”আমি চিঠির মালিক, আমি পড়তে দিয়েছি…একটা গল্প ছাড়া ওতে আমার জন্য কিছু নেই। আমার জীবন আমিই কন্ট্রোল করব, বরাবর তাইই করে এসেছি। কেউ নাক গলাক তা আমি চাই না।”
তুষার পাশ ফেরার শব্দ পেল। তার শুধু একটিই প্রশ্ন ছিল: কণা কী বলল? কিন্তু জানে, করে কোনো লাভ নেই। শুভা ‘আমি’ আর ‘আমার’ ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহী নয়।
সকালে খাবার টেবলে কণা কাগজ পড়ছিল। তুষার চেয়ারে বসতেই কাগজটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে দিল।
”কি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ভূপালে হয়েছে দেখেছ? গ্যাসে আড়াই হাজারের মতো লোক মারা গেছে।” কণার স্বর আটকে গেল উত্তেজনায়।
তুষার কাগজটা হাত থেকে নেবার সময় তীক্ষ্ন তদন্ত করল কণার মুখটাকে। চিঠির কোনো ছাপ খুঁজে পেল না। আড়াই হাজার লোকের মৃত্যু যন্ত্রণা ওর চোখ দুটো ঘোলাটে করে দিয়েছে।
”মিথাইল আইসোসায়ানেট একটা বিষাক্ত কেমিক্যাল, পেস্টিসাইডস তৈরিতে লাগে। ছোঁয়া বাঁচিয়ে ভীষণ সাবধানে কাজ করতে হয়।” বাইরে ভিজে কাপড় মেলতে মেলতে শুভা ক্লাসে পড়াবার মতো টানা স্বরে বলল এবং অবশ্যই কণাকে উদ্দেশ্য করে।
তুষার অস্বস্তি ভরে, মৃত্যুর বিবরণ পড়ায় ব্যস্ত কণার মুখের দিকে আড়চোখে কয়েকবার তাকাল। কিছু একটা ঘটেছে ওর মধ্যে। কী সেটা? ভোপাল না তার চিঠি? কে এখন জুড়ে আছে ওর মন? ও কি কিছু বলবে?
অফিসে যাবার জন্য বেরোচ্ছে সেই সময় শুভা তার হাতে একটা বড় খাম দিয়ে বলল, ”কণা এটা তোমায় দিতে বলল, পৌঁছে দেবার জন্য?”
”কোথায়…কাকে?”
”ভেতরে লেখা আছে।”
খামটা টেনে নিয়ে তুষার প্রায় হনহনিয়ে স্টেশনে রওনা হল। ন’টা-বারো ধরতে না পারলে অফিসে লেট হবে। লেট হওয়াটাকে সে কোনোদিন বরদাস্ত করেনি।
প্ল্যাটফর্মে সে এবং ন’টা-বারো প্রায় একসঙ্গেই পৌঁছল। প্রতিদিনের মতই ভিড় এবং প্রতিদিনের মতই ধাক্কা এবং চাপের দ্বারা সে কামরার ভিতরে ঢুকে গেল। হাওড়ায় নেমে লঞ্চ ঘাটের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে যাবার সময় তার হাতের খামটা সম্পর্কে খেয়াল হল। দুমড়ে মুচড়ে বিশ্রী হয়ে গেছে।
ঘাটের দিকে আসা লঞ্চটা মাঝ গঙ্গায়। তুষার সময় পেয়ে সেই ফাঁকে খামের মধ্য থেকে কাগজটা বার করে দেখল, একটা স্কেচ। মুখটা দোমড়ান সত্ত্বেও হিমুকে চিনতে তার কোনো বিঘ্ন হল না। চোখ দুটিতে বড় স্বচ্ছ দৃষ্টি। তুষারের মনে হল অনেক দূরে, যেন ভবিষ্যতকে খুঁজছে, এই রকম একটা অর্থ দৃষ্টি থেকে বার করে নেওয়া যায়। স্কেচের নিচে লেখা: হিমুকে-দিদি।
এখন গঙ্গার হাওয়া, তার খুবই সৎ এবং নির্মল লাগল।