দুলালীর সমালোচনা

দুলালী (‘দুশেচকা’)র সমালোচনা

টলস্তয়

বাইলের গণনাপুস্তকে একটি গল্প আছে। তার অর্থ অতি গভীর। গল্পটিতে বলা হয়েছে, ইরাএলিরা যখন মোআবের রাজ্যসীমায় এসে উপস্থিত হল, মোআবীয়দের রাজা বালাক তখন নবী বালআমকে ডেকে পাঠালেন ইসরাএলিদের অভিসম্পাত দেবার জন্য; কাজটি সেরে দিলে বালা বালআমকে বহু পুরস্কার দেবেন। তার লোভে বালআম বালাকের কাছে গেলেন এবং তাকে নিয়ে উঠলেন পর্বতে। সেখানে একটি বেদি তৈরি করা হল, গোবৎস ও মেষ উৎসর্গ করা হল অভিশাপের উদ্যোগে। বালা রইল অভিশাপের প্রতীক্ষায়, কিন্তু বালআম ইসরাএলের লোকদের অভিসম্পাত না দিয়ে তাদের আশীর্বাদ করলেন।

২৩ পরিচ্ছেদ ১১ চরণ : বালা বালআমকে কহিল, তুমি আমার প্রতি এই কী করিলা? আমার শত্রুগণকে শাপ দিতে তোমাকে আনিলাম, কিন্তু দেখ, তুমি তাহাদিগকে সর্বতোভাবে আশীর্বাদ করিলা।

তাহাতে সে উত্তর করিল, পরমেশ্বর আমার মুখে যে কথা দেন, সাবধান হইয়া তাহাই কহা কি আমার উচিত নহে।

১৩। পরে বালাক কহিল, আমি মিনতি করি, অন্যস্থানে আমার সহিত আসিয়া সেখানে থাকিয়া আমার নিমিত্ত তাহাদিগকে শাপ দেও।

কিন্তু আবার শাপ না দিয়ে বালআম আশীর্বাদ করলেন। তৃতীয় বারেও তাই।

২৫ পরিচ্ছেদ ১০ম চরণ : তখন বালআমের প্রতি বালাকের ক্রোধ প্রজ্বলিত হইল, সে আপনা হস্তে হস্তের আঘাত করিল এবং … বালআমকে কহিল, শত্রুগণকে শাপ দিতে আমি তোমাকে আনিলাম, কিন্তু দেখ, তুমি তিনবার সর্বতোভাবে তাহাদের আশীর্বাদ করিলা।

১১। অতএব তুমি এখন স্বস্থানে পলায়ন কর; আমি তোমাকে অতিশয় সম্মানিত করিব ভাবিয়াছিলাম কিন্তু দেখ পরমেশ্বর তোমায় সম্মান পাইতে নিবৃত্ত করিলেন।

তখন বালআম পুরস্কার লাভ না করেই প্রস্থান করলেন, কারণ তিনি বালাকের শত্রুদের অভিসম্পাতের পরিবর্তে দিলেন আশীর্বাদ।

বালআমের যা হয়েছিল প্রকৃত কবি ও রসস্রষ্টাদের প্রায়ই তা হয়। বালাকের পুরস্কার জনপ্রিয়তার লোভে কিংবা ভ্রান্ত ধারণার বশে কবি দেখে না যে তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে দেবদূত, গাধাও যাকে দেখতে পায়*। [*বালাকের আমন্ত্রণে বালআম যখন যাত্রা শুরু করে তখন তার পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল য়িহুহের দূত। বালআম তাকে দেখতে পায়নি, কিন্তু যে গাধার পিঠে চড়ে সে আসছিল সে পেয়েছিল দেখতে– অনুবাদক।] চায় সে অভিশাপ দিতে, কিন্তু অহহ! সে দেয় আশীর্বাণী।

ঠিক তাই হল খাঁটি কবি এবং রসস্রষ্টা চেখফের মনোহর এই দুলালী গল্পটি লেখবার বেলায়।

লেখক নিশ্চিত চেয়েছিলেন কৃপার পাত্রী এই জীবটিকে উপহাস করতে। হৃদয় দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে বিচার করেছিলেন দুলালীকে যে প্রথমে কুকিনের দুশ্চিন্তার বোঝা কাঁধে তুলে নেয়, তার পর কাঠ কেনা-বেচার বিষয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার পর পশুর ডাক্তারের আওতায় এসে গরু-মহিষের ব্যায়োকেই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার বলে ঠিক করে, আর শেষে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ব্যাকরণের প্রশ্ন এবং মস্ত টুপি পরা ছোট্ট বাচ্চাটির ভালোমন্দ নিয়ে।

কুকিন পদবিটি উদ্ভট, তার অসুখ, যে টেলিগ্রামে তার মারা যাবার খবর জানানো হল তা-ও উদ্ভট, কাঠের ব্যাপারি আর খানদানি ঠাট পশুর ডাক্তার, এমনকি ছোট্ট ছেলেটি, সবাই, সবই উদ্ভট, কিন্তু দুলালী, তার অন্তর, যাকেই সে ভালোবাসে তারই মধ্যে তার সমস্ত সত্তার। নিবেদন– এ উদ্ভট নয়, অনির্বচনীয় পবিত্র।

আমার বিশ্বাস, দুলালী গল্পটি লেখার সময়ে লেখকের হৃদয়ের নয়– মনে ছিল একটি অস্পষ্ট মূর্তি, নব্য নারীর, স্বয়ং পুরুষের সমকক্ষ, মানসিক উৎকর্ষসম্পন্ন, শিক্ষিতা, সমাজহিতব্রতে স্বয়ং-নিযুক্ত দক্ষতায় পুরুষের তুল্য কিংবা আরও সুদক্ষ, নারীসমস্যা কথাটা যে তুলেছে এবং তোলে।

দুলালী লিখে লেখক দেখাতে চেয়েছিলেন মেয়েদের কী হওয়া উচিত নয়। জনমত বালা-চেখফকে বলেছিল, দুর্বল, একান্ত অনুগত, অনুন্নত, পুরুষসেবায় নিয়োজিত স্ত্রীদের অভিশাপ দাও। চেখফ পর্বতে উঠলেন, বেদির উপর গোবৎস এবং মেষ রেখে দেওয়া হল, কিন্তু যখন তাঁর মুখ খুলল, তখন, যাদের শাপ দিতে এসেছিলেন তাদের তিনি শোনালেন আশীর্বচন।

অনবদ্য স্বচ্ছ পরিহাসের রসে লেখা অপরূপ এই গল্পটি : তবু, এর কোনও কোনও অংশ পড়তে গিয়ে আমি অন্তত আমার চোখের জল সামলাতে পারিনি। মন ভিজেছে– কুকি, যা কিছু নিয়ে কুকি মেতে থাকে, কাঠ-ব্যবসায়ী, পশুর ডাক্তার এসবের প্রতি দুলালীর একান্ত অনুরাগ ও অভিনিবেশের বিবরণ পড়ে; আরও বেশি যখন সে একা, আর তার ভালোবাসার কেউ নেই– তখন তার যে যন্ত্রণা, তার বিবরণ, আর সবার শেষে, নারীর মাতৃত্বের যে অনুভূতি তার নিজের জীবনে সে পায়নি তার সমস্ত শক্তি এবং অপরিসীম প্রেম যখন সে নিয়োগ করে ভবিষ্যতের মানব মস্তবড় টুপি-পরা স্কুলের ছেলেটির মধ্যে, তার বিবরণ পড়ে।

লেখক মেয়েটিকে ভালোবাসলেন উদ্ভট এক কুকিনকে, নগণ্য এক কাঠ ব্যবসায়ীকে, কাঠখোট্টা এক পশুর ডাক্তারকে, কিন্তু প্রেমের পাত্র একটা কুকিনই হোক আর একটি স্পিনোজা পাস্কাল বা শিলারই হোক, প্রেমাস্পদ ঘন ঘন বদলাক– যেমন দুলালীর বেলায় অথবা চিরকাল একই থাক, প্রেম তাতে কিছু কম পবিত্র হয় না।

কিছুদিন আগে আমি নোভোয়ে ভ্রেমূইয়া কাগজে নারী সম্বন্ধে চমৎকার একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। প্রবন্ধটিতে লেখক নারীদের সম্বন্ধে অতি চতুর এবং বড় গভীর একটি মতবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, মেয়েরা আমাদের দেখাতে চেষ্টা করছে যে যা কিছু আমরা পুরুষেরা পারি, তারাও পারে। এ নিয়ে আমার বিবাদ নয়; আমরা মানতে রাজি যে, পুরুষেরা যা পারে মেয়েরাও তার সবই পারে, হয়তো পুরুষের চেয়ে ভালোই পারে। কিন্তু মুশকিল এই যে, মেয়েরা যা পারে পুরুষদের কীর্তি তার ধারেকাছেও যেতে পারে না।

ঠিক, কথাটি যে সত্য তাতে সন্দেহ নেই। এবং এটি যে শুধু শিশুর জন্মদান, লালন-পালন ও বাল্যশিক্ষার ক্ষেত্রেই সত্য তাই নয়। পুরুষ সেই সর্বাধিক উন্নত শ্রেষ্ঠ কার্যটি সাধন করতে পারে না যার দ্বারা মানুষ ঈশ্বরের নিকটতম সন্নিধানে আসতে পারে– এই কীর্তি প্রেম, প্রেমাস্পদে একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ। এটি শ্রেষ্ঠ নারী পেরেছে, পারে এবং পারবে– অতি উত্তমভাবে এবং সহজ স্বাভাবিক উপায়ে। কী হত এই জগতের যদি মেয়েদের এই ক্ষমতাটি না থাকত এবং যদি এর প্রয়োগ তারা না করত।

মেয়ে ডাক্তার, টেলিগ্রাফের কেরানি, নারী-বৈজ্ঞানিক, মেয়ে-উকিল, লেখিকা– এ সব না থাকলেও আমাদের চলত, কিন্তু যারা মানুষের মধ্যে যা সর্বোত্তম তাকে ভালোবাসে এবং সেইটিকে অগোচরে তার মধ্যে সঞ্চালিত, উদ্বুদ্ধ করে তার সহায় হয়, সেই মা, সহায়িকা, সান্ত্বনাদাত্রী– তারা না থাকলে জীবনটা বিপরীত একটা ব্যবহার হয়ে উঠত। যিশুখ্রিস্টের কাছে কোনও মগদলিনি আসত না, সাধু ফ্রান্সিসের সঙ্গে ক্লারা থাকত না, ডিসেম্বরের বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের পত্নীরা সাইবেরিয়ায় যেত না, দুখবরদের স্ত্রীরা যে তাদের স্বামীদের সত্যের জন্য আত্মদানের পথ থেকে না সরিয়ে দিয়ে বরং সেই পথেই তাদের প্রবৃত্ত করেছিল, তা-ও হত না। থাকত না সেই হাজার হাজার অজানা মেয়েরা নারীকুলশ্রেষ্ঠা এরা– অজ্ঞাতেরা চিরকালই যা হয়– যারা সান্তনা দেয় মদ্যপ, দুর্বল, উচ্ছল জনকে, প্রেমস্নিগ্ধ সান্ত্বনার প্রয়োজন যাদের সবার চেয়ে বেশি। এ প্রেম যাতেই প্রযুক্ত হোক, কুকিনে বা খ্রিস্টে, এইটেই নারীর প্রধান, মহীয়সী, অনন্যলভ্যা শক্তি।

কী প্রচণ্ড বোঝার ভুল, এইসব তথাকথিত নারীসমস্যা– যার কবলে পড়েছে শুধু মেয়ে নয়, পুরুষদেরও বেশিরভাগ। অর্বাচীন যে কোনও ধারণার কবলে এরা পড়বেই।

মেয়েদের মন চায় নিজেদের উন্নতি। এর চেয়ে ন্যায় যুক্তিসঙ্গত কথা আর কী হতে পারে?

কিন্তু স্বভাবগুণে মেয়েদের কাজ পুরুষদের কাজ থেকে ভিন্ন। অতএব মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের আদর্শ এবং পুরুষদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের আদর্শ এক হতে পারে না। মেনে নেওয়া যাক যে, মেয়েদের আদর্শ কী তা আমরা জানি না। যাই হোক সেটা, এটা নিশ্চিত যে সেটা পুরুষের চরম উল্কর্ষের আদর্শ নয়। অথচ, নারীজাতির পথকণ্টক এক শৌখিন নারী আন্দোলনের সমস্ত উদ্ভট কার্যকলাপের লক্ষ্য হচ্ছে ওই পুরুষালি আদর্শে পৌঁছানো।

আমার মনে হয়, এই ভুল বোঝার প্রভাব চেখফের ওপর পড়েছিল দুলালী লেখার সময়।

 বালআমের মতো তিনি চেয়েছিলেন অভিশাপ দিতে, কিন্তু কাব্যদেবতা তাঁকে নিষেধ করলেন, আদেশ দিলেন আশীর্বাদ করতে। আশীর্বাদই তিনি করলেন এবং অজ্ঞাতে এমন অপূর্ব প্রভামণ্ডিত করলেন এই মাধুরীময়ী প্রাণীটিকে যে সে চিরকালের মতো একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রইল– যে নিজে আনন্দ চায় এবং নিয়তি যাকেই তার সান্নিধ্যে আনে তাকেই আনন্দ দিতে চায়, এমন একটি নারী যে কী হতে পারে তার।

গল্পটি যে এত অপরূপ তার কারণ, এই পরিণতি পূর্বকল্পিত নয়।

.

আমি বাইসিকেল চালাতে শিখেছিলাম একটা হলঘরে। সেটা এত বড় যে তার মধ্যে একটি সৈন্যবাহিনী কুচকাওয়াজ করতে পারে। অপর প্রান্তে একটি মহিলা শিখছিলেন বাইসিকেল চড়া। আমি ভাবলাম, হুশিয়ার থাকব, ওঁর ওপর চোখ রাখলাম। চেয়ে থাকতে থাকতে ক্রমেই আমি ওঁর দিকে এগিয়ে পড়তে লাগলাম। উনি বিপদ দেখে তাড়াতাড়ি পিছু হটতে আরম্ভ করলেন। তবু আমি গিয়ে পড়লাম ওঁর ঘাড়ের উপর, ধাক্কা মেরে বাইসিকেল থেকে তাকে ফেলে দিলাম অর্থাৎ যা চেয়েছিলাম তার উল্টোটাই করে বসলাম শুধু এই কারণে যে, আমার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল মহিলাটির ওপর।

চেখফেরও তাই হল, বিপরীত মুখে। উনি চেয়েছিলেন দুলালীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে, কিন্তু তাঁর কবির দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ থাকায় তিনি দিলেন তাকে তুলে।

.

এই টীকাটি পড়ার পর আর কার কী বলবার থাকে?

[চেখফ বলেছিলেন, এর চেয়ে বড় সম্মান আমি আমার জীবনে আর কী আশা করতে পারি?]।

সত্যেন্দ্রনাথ যখন একদিন দেখলেন, কবিগুরু তার একটি বাঙলা কবিতা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন (অর্থাৎ নিজের সৃজনীকর্ম মুলতবি রেখে) তখন তার হৃদয়ে কী শ্লাঘার উদয় হয়েছিল, তার কি কল্পনাও আমরা করতে পারি।

ধন্য দুলালীর প্রেম। তা সে যাকেই বাসুক না, যতবারই বাসুক না কেন। রমণীর এই প্রেমই তো জগৎকে শ্যামল করে রেখেছে।

কিন্তু আমার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হয়। সহৃদয় পাঠক আমার দম্ভ ক্ষমা করবেন।

দুলালী যখন ভানিচকাকে ভালোবাসছে তখন যদি হঠাৎ ভাসিলিকে দেখে তার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে হৃদয়হীনার মতো হৃদয় খান খান করে তার প্রেমকে পদদলিত করে (ইংরেজিতে যাকে বলে তাকে জি করে) ভাসিলিকে বরণ করত তখনও দুলালীর সে-প্রেম ধন্য?

ঠাকুর-দেবতার কার্যকলাপ আমাদের সমালোচনার বাইরে। এই যে কেষ্ট-ঠাকুর রাধাকে জিট করে মথুরা গিয়ে একাধিক প্রণয় এবং শুধু তাই নয়, রাধার কানের কাছে ঢাকঢোল বাজিয়ে বিয়ে করলেন, সেগুলোও ধন্য? অথচ আমাদের হৃদয় তো পড়ে রইল শ্রীরাধার রাঙা পায়ে। শত শত বছর ধরে এই বাঙলা দেশে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিরা আপন আপন বিরহবেদনা আপন আপন পদদলিত প্রেমের নিবিড়তম পীড়া তুলে দিলেন রাধার মুখে। তাই দিয়ে মাথুর আর সেই জিনিসই পদাবলীর হৃদয়খণ্ড, –মেরুদণ্ড যে নামেই তাকে ডাকা যাক। পৃথিবীর ইতিহাসে এর তুলনা আমি পাইনিঃ শত শত বছর ধরে হাজার হাজার কবি (এবং সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়, তার ভিতর নাকি প্রায় শ-তিনেক বিধর্মী মুসলমান কবি। ভাবলে আশ্চর্য বোধ হয়, এই অভাগিনী জিলটেড রাধার প্রেমে কী যাদুমন্ত্র লুকানো ছিল যে, শত শত বিধর্মী কবিকেও তার সামনে নতমস্তক হতে হল!) আপন আপন হৃদয়বেদনা– যার মূল্য বিশ্বাসঘাতক, প্রেমগ্ন নিরতিশয় স্বার্থপর, নীচ দয়িত দিল না– নিজের মুখে প্রকাশ না করে সর্ব বৈভব নত নমস্কারে রেখে দিল পাগলিনী শ্রীরাধার অধরোষ্ঠে। তার হয়তো একমাত্র কারণ, উপনিষদ বলেছেন, তাকে ত্যাগ করে ভোগ করবে। শ্রীরাধা প্রেম দিয়ে আনন্দ পেতে চাননি, মাতৃত্বের বিগলিত মধুরিমা, যশোদার মতো বিশ্বজয়ী পুত্রের গৌরবও তিনি কামনা করেননি। তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে ভোগ করলেন। এ ভোগ দুলালীর ভোগ নয়। এ শচীপতি ইন্দ্রের ভোগ নয়, এ শ্মশানবাসী নীলকণ্ঠের বৈরাগ্য। কিন্তু আশ্চর্য, রবীন্দ্র-সৃষ্টিতে পদদলিত প্রেমের উদাহরণ নেই। যার জন্য তাঁর বিরহবেদনা তাঁর শত শত গানে প্রকাশ পেয়েছে তিনিও কবিকে ভালোবাসেন তার প্রেমের বেদনাতে কবির মূল্য আছে- শুধু তিনি চলে গেছেন দূরে। রবিপ্রেম কখনও লাঞ্ছিত হয়নি। সে অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না।

কিন্তু এ তো একটা দিক। আমার মূল প্রশ্ন এখনও পাঠকের কাছে রইল, অতি ঘরোয়া ভাষায় শুধাই, এই যে আমাদের সোসাইটি লেডি, আজ মুখুয্যেকে জিট করে কাল সেনকে, পরশু সেনকে জিটু করে ঘোষকে– তাঁর প্রত্যেক প্রেমের জয়ধ্বনি গাইবেন টলস্টয়?

সর্বশেষে পুনরায় বিস্ময় মানি চেখফের এই গল্পটির সামনে। বিস্ময় মানি টলস্টয়ের টীকার সম্মুখে। আমাদের মতো জড় পাষাণ-হৃদয়কে বিগলিত করে বইয়ে দিল শত শত প্রশ্নধারায়।

৩ জুলাই, ১৯৬৩

[আন্তন চেখফ : The Darling and other short stories, রুশ কনস্ট্যান্স গার্নেটের তরজমা, London, Chatto & Windus, 1918]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *