দুলালী

দুলালী

ওলেঙ্কা অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসেসর প্লেইয়ান্নিকভের মেয়ে। সে ভাবনায় ডুবে বসেছিল উঠোনের সামনে ছোট্ট বারান্দাটিতে।

গরম, মাছিগুলো আঠার মতো লেগে আছে, বিরক্ত করছে। একটু বাদেই যে সন্ধে হবে সেকথা ভাবতে ভালোই লাগছে। পুব দিক থেকে ঘন কালো মেঘ এসে জমা হচ্ছে, সেইসঙ্গে থেকে থেকে ভিজে হাওয়ার আমেজ আসছে।

উঠোনের মধ্যিখানে আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কুকি। লোকটি থিয়েটারের ম্যানেজার, প্রতিদিন সন্ধেবেলায় এক বাগানে একটি আনন্দমেলার আসর জমায় নাম তিভলি প্রমোদ উদ্যান। থাকে ওলেঙ্কাদের বাড়ির একপাশে ভাড়া নিয়ে।

ককিন হতাশ হয়ে বলল, আবার! আবার এল বষ্টি। রোজ বৃষ্টি, রোজ, যেন আমাকে নাকাল করার জন্যেই নামে। গলায় দড়ি দিই না কেন? সর্বস্ব গেল। দিন দিন লোকসান আর লোকসান।

দু হাত জুড়ে ওলেঙ্কার দিকে ফিরে কুকি আবার বলতে লাগল, এই তো জীবন আমাদের, ওগা সেইয়ন। দু চোখ ফেটে জল আসে। খেটে মরি, যতদূর সাধ্য চেষ্টা করি, সারারাত জেগে ভাবি কী করে জিনিসটাকে উঁচুদরের করে তোলা যায়। হয় কী? এদিকে দেখ, লোকগুলোকে আহাম্মুখ, বর্বর।

আমি ওদের দেখাই সেরার সেরা ছোট ছোট অপেরা, কথা-ছাড়া শুধু ভঙ্গি দিয়ে বোঝানো নাটক, অপূর্ব অপূর্ব ভ্যারাইটি আর্টিস্ট। কিন্তু ওরা কি ও জিনিস চায়? বোঝে তার মর্ম? ওরা শুধু চায় হৈ-হুল্লোড়! ওদের দেখাতে হয় রদ্দি চিজ।

আবার ইদিকে দেখ আবহাওয়াখানা। প্রায় প্রতি সন্ধেয় বৃষ্টি। ১০ মে থেকে শুরু হল, চলছে রোজ, গোটা মে-জুন মাসটাই। দর্শকের দেখা নেই, অথচ বাগান-ভাড়াটা? সেটি ঠিক ধরে দিতে হয়। আর গাইয়ে-বাজিয়েদের মাইনেটা?

পরদিন সন্ধের দিকে আবার দেখা দিল মেঘ। হি হি করে হেসে উঠল কুকি। বলল, এসো, এসো বৃষ্টি। দাও ভাসিয়ে আমার প্রমোদ উদ্যান। সব ডোবাও, তার পর আমাকেও ডোবাও। আমার ইহলোক-পরলোক দুই-ই মজুক। মামলা করুক আমার আর্টিস্টরা আমার নামে, পাঠাক জেলে– সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে ফাঁসিকাঠে! হাহা হাহাঃ।

তার পরদিন আবার ওই।

ওলেঙ্কা চিন্তিত মুখে, নীরবে কুকিনের কথাগুলো শুনত। মাঝে মাঝে তার চোখে জল এসে পড়ত। এত উতলা হয়ে উঠত তার মন কুকিনের দুর্ভাগ্যে যে শেষ অবধি সে ওর প্রেমেই পড়ে গেল।

কুকিন মানুষটি বেঁটে, রোগা। মুখখানা ফ্যাকাসে। চুল আঁচড়ে রগের উপর টেনে নামানো। সরু গলায় কথা কয়, মুখ একপাশে বেঁকিয়ে। চেহারায় চিরকেলে নৈরাশ্যের ছাপ। তবু সে ওলেঙ্কার মনে গভীর এবং অকৃত্রিম একটি ভাব জাগিয়ে তুলল।

ওলেঙ্কা সর্বদাই কারও না কারও প্রেমে অভিভূত হয়ে থাকত। প্রথমে ছিল বাবা। এখন তিনি রুগণ; অন্ধকার একখানা ঘরে সারাদিন আরামকেদারায় বসে তার দিন কাটে। শ্বাসকষ্টে কাতর।

তার পর সে ভালোবাসল তার এক খুড়িমাকে। তিনি থাকতেন ব্রিয়াস্কে, দু বছরে একবার করে আসতেন। তার আগে, যখন সে স্কুলে পড়ত, তখন তার প্রেমপাত্রী ছিল তার ফরাসি শিক্ষিকা।

ওলেঙ্কা মেয়েটি শান্ত, সহৃদয় বড় ভালো স্বভাবের। চোখ দুটি ভীরু, নিরীহ। নিটোল স্বাস্থ্য। তার টলটলে, লালচে গাল দুখানি, ধপধপে সাদা নরম তুলতুলে ঘাড়ের উপর ছোট্ট কালো তিলটি, আর সরল স্নিগ্ধ যে হাসিটি ফুটে উঠত তার মুখে খুশির কোনও কথা শুনলেই, তা দেখে ছেলেরা ভাবত মন্দ নয় তো মেয়েটি। বেশ হাসতও। আর মেয়েরা তার সঙ্গে কথা কইতে কইতে হঠাৎ তার হাতখানি ধরে বলে উঠত, কথার মধ্যিখানে, আনন্দের উচ্ছ্বাসে ও দুলালী!

জন্ম থেকে যে বাড়িতে ওলেঙ্কার বাস, তার বাবার উইল অনুযায়ী সেটি তারই প্রাপ্য। বাড়িখানা ছিল শহরের একটু বাইরের দিকে, জিপসি রোডের উপর। প্রমোদ উদ্যান তিভলি থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানে যখন সন্ধেবেলায় বা রাত্রে, বাজনা বাজত, বাজি ফুটত, ওলেঙ্কার মনে হত যেন যুদ্ধ বেধেছে কুকিনের সঙ্গে তার নিয়তির। কুকি লড়ছে, তার প্রধান শত্রু নিঃসাড় দর্শকগুলোর সঙ্গে। অমনি ওলেঙ্কার মন গলে যেত। ঘুমোতে ইচ্ছে করত না। ভোররাত্রে কুকি যখন বাড়ি ফিরত, তখন ওলেঙ্কা তার শোবারঘরের জানালায় আস্তে আস্তে টোকা দিত, আর পরদার ফাঁক দিয়ে শুধু তার মুখখানা আর কাঁধের একটুখানি দেখিয়ে তার দিকে চেয়ে হাসত, নরম হাসি।

কুকি বিয়ের প্রস্তাব করল, বিয়ে হয়ে গেল। তার পর দেখল, বেশ ভালো করে, ওলেঙ্কার ঘাড়খানি আর তার সুন্দর মোটাসোটা কাঁধ দুটি। দেখে বলে উঠল, দুলালী!

কুকিন খুশি হল, তবে তার বিয়ের দিন এবং রাত্রেও বৃষ্টি হল, তাই মুখের নিরাশ ভাবটা বদলাল না।

দু জনের বনে গেল বেশ। ওলেঙ্কা টিকিট বিক্রির দিকটা দেখত, হিসাব রাখত, মাইনে-পত্তর দিত। তার ছলাকলাবর্জিত হাসিটিতে কখনও টিকিটঘর, কখনও খাবার দোকানটি, কখনও রঙ্গমঞ্চের দুটি পাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

বন্ধুদের সে বলতে আরম্ভ করল, পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার মধ্যে সর্বপ্রধান সর্বাধিক প্রয়োজনীয় এবং উল্লেখযোগ্য বস্তু হল নাট্যশালা–প্রকৃত আমোদ একমাত্র এরই মধ্য দিয়ে পাওয়া যেতে পারে। এর দ্বারাই মানুষ হয়ে উঠতে পারে দ্র এবং মানবতাবোধসম্পন্ন।

কিন্তু লোকে কি তা বোঝে? বলত ওলেঙ্কা। ওরা চায় হৈ-হুল্লোড়। কাল আমরা দেখালাম উল্টোপাল্টা ফাউস্ট বক্সগুলোর প্রায় সব কটিই খালি রইল। কিন্তু যদি ভানিচকা আর আমি দেখাতাম ওঁচা একটা কিছু, দেখতে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত রঙ্গালয়। কাল ভানিকা আর আমি দেখাচ্ছি নরকে অর্ফেউস্ নিশ্চয়ই এসো কিন্তু।

কুকি থিয়েটার সম্বন্ধে, অভিনেতাদের সম্বন্ধে যাই বলত ওলেঙ্কা তারই পুনরাবৃত্তি করত। কুকিনের মতোই সে-ও দর্শকদের অজ্ঞতা এবং রসবোধের অভাবকে ঘৃণা করত। মহড়ায় আসত ওলেঙ্কা, অভিনেতাদের ভুল শোধরাত– বাজিয়েদের গতিবিধির দিকে চোখ রাখত। খবরের কাগজে যদি খারাপ কিছু মন্তব্য করা হত তবে সে কেঁদে ফেলত, যেত সম্পাদকের কাছে, কৈফিয়ৎ চাইত।

অভিনেতারা তাকে ভালোবাসত, ডাকত ভানিচকা আর আমি, দুলালী বলে। ওলেঙ্কার ওদের জন্য কষ্ট হত, মাঝে মাঝে টাকা ধার দিত অল্প-স্বল্প, ঠকালে গোপনে চোখ মুছত, স্বামীর কাছে নালিশ করত না।

শীতের মৌসুমেও ওদের গেল ভালোই। মিউনিসিপ্যালিটির থিয়েটারখানা ওরা ভাড়া নিল, নিয়ে অল্পদিনের মেয়াদে ভাড়া দিল উক্রাইন-দেশি একটা দলকে, এক জাদুকরকে, স্থানীয় একটি নাটুকে সঙ্কে।

ওলেঙ্কা হয়ে উঠল আরও গোলগাল, মুখে ফুটল কায়েম একটা খুশির জৌলুস, কুকিন হয়ে গেল আরও রোগা, মুখ হল আরও হলুদে। ভয়ানক লোকসানের বুলি তার মুখে লেগেই রইল, যদিও শীতের বাজারে ব্যবসা তার মোটেই খারাপ চলেনি।

কুকি রাত্রে কাশে। ওলেঙ্কা ফলের রসের সঙ্গে ফুল মেড়ে তাকে খাওয়ায়, বুকে তেলমালিশ করে, নিজের নরম নরম শালগুলো দিয়ে তার গা ঢাকে।

বলে, কী মিষ্টি তুমি মণি। চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, অন্তর থেকেই, আমার সুন্দর, আমার বুকের ধন।

শীতের শেষে কুকিন গেল মস্কো, নতুন একটা দল নিয়ে আসতে। ওলেঙ্কা কুকিবিহনে ঘুমোতে পারে না। সারারাত জানালার ধারে বসে তারার দিকে চেয়ে থাকে। ঘরে মোরগ না থাকলে মুরগি যেমন সারারাত অস্বস্তিতে কাটায়, জেগে থাকে; ওলেঙ্কারও তেমনি হয়।

মস্কোয় কুকি আটকা পড়ে গেল। চিঠি দিল ও-মাসে ইস্টারের আগেই সে ফিরবে। তিভলির কাজকর্ম বুঝিয়ে লিখল।

যে সময় কুকিনের ফেরার কথা সেই সময়েই একদিন, দিনটা সোমবার, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, হঠাৎ দরজায় অলুক্ষণে রকমের একখানা ঘা পড়ল। সে কী আওয়াজ! যেন কেউ ঢাক পিটছে। দড়াম দড়াম দমাদ্দাম। রাধুনী মেয়েটা ঘুম-চোখে খালি পায়ে থৈ থৈ জল ভেঙে ছুটল বেড়ার দরজা খুলতে।

দরজার ওধার থেকে হেঁড়েগলায় কে বলল, দরজাটা খোলো তো, তোমার নামে তার এসেছে।

ওলেঙ্কা আগেও পেয়েছে টেলিগ্রাম তার স্বামীর কাছ থেকে, কিন্তু এবারে কেমন যেন সে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। থর থর কাঁপা হাতে টেলিগ্রাম খুলে সে পড়ল :

ইভান পেত্রোভিচ আজ হঠাৎ মারা গেল আগরা নির্দেশ সাপেক্ষ মঙ্গলবার শেষকৃত্য।

ঠিক এই ছিল টেলিগ্রামে, শেষকৃত্য আর অবোধ্য কথাটা আগরা। টেলিগ্রামে সই নাটুকে দলের বড়কর্তার।

ওলেঙ্কা কুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমার মণি, ভানিকা, মণি আমার, প্রিয়তম। কেন দেখা হল আমাদের? কেন তোমায় জানলাম, ভালোবাসলাম? তুমি তো ছেড়ে গেলে আমাকে, এখন তোমার দুঃখিনী ওলেঙ্কা কার পানে চাইবে?

মঙ্গলবার কুকিনকে ভাগানকোভো গোরস্তানে কবর দেওয়া হল। ওলেঙ্কা বাড়ি ফিরে এল বুধবার, এসেই বিছানায় আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগল, এমন চেঁচিয়ে যে রাস্তা আর আশেপাশের বাড়ির উঠোন থেকে সে কান্না শোনা গেল।

পাড়াপড়শিরা ক্রুশের চিহ্ন এঁকে বুকে মাথায় কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল আর বলল, বেচারি দুলালী, ওল্গা সেমূইয়ান। আহা, দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে বাছার।

তিন মাস বাদে একদিন গির্জা থেকে ফিরছে ওলেঙ্কা। শোকে-দুঃখে জর্জর। ঘটনাচক্রে বাবাকায়ে কাঠগোলার গোমস্তা ভাসিলি আন্দ্রেয়ি পুস্তভালভ, সে-ও ফিরছিল গির্জা থেকে, তারই সঙ্গে হেঁটে এল। পুস্তভালভের মাথায় কেতাদুরস্ত সাদা টুপি, পরনে সাদা ওয়েস্টকোট তার উপর ঝুলছে সোনার ঘড়ি-চেন। লোকটিকে দেখে মনে হয় না ব্যবসায়ী, দেখায় জমিদারের মতো।

সে বলল গম্ভীর সুরে, যা কিছু ঘটে ওলগা সেমইয়নভনা, সেসব ঘটে তারই আদেশে। স্বরে সমবেদনার রেশ। প্রিয়জনদের কেউ যদি চলে যায়, তবে তার কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছা। বুক বেঁধে মাথা নত করে তা আমাদের মেনে নিতে হবে।

ওলেঙ্কাকে বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে পুস্তভালভ বিদায় নিল। ওলেঙ্কা সারাদিন ধরে শুনল তার গম্ভীর গলার আওয়াজ। চোখ যখন জুড়ে এল, স্বপ্নে দেখল তার কালো দাড়ি। বড় ভালো লাগল তাকে ওলেঙ্কার।

পুস্তভালভের মনে বোধহয় ওলেঙ্কা একটা দাগ ধরিয়ে দিল, কারণ দু দিন না যেতেই একটি আধবয়সী মহিলা, যাকে ওলেঙ্কা প্রায় চেনেই না, এল তার সঙ্গে কফি খেতে, আর খেতে বসেই পুস্তভালভের গল্প জুড়ে দিল। বলল, অতি চমৎকার শক্তপোক্ত লোকটি, বিয়ের বয়সী যে কোনও মেয়ে ওকে বিয়ে করে সুখী হবে। তিন দিন বাদে পুস্তভালভ নিজেই এল। রইল বেশিক্ষণ নয়, মিনিট দশেক হবে, কথা বলল অল্পই, কিন্তু ওলেঙ্কা তার প্রেমে পড়ে গেল– এতদূর যে সারারাত তার ঘুম হল না, জ্বরের মতো জ্বালায় জ্বলল, এবং সকাল হতে সেই আধবয়সী মহিলাকে ডেকে পাঠাল। কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি বিয়েও হয়ে গেল।

বিয়ের পর দু জনের বনিবনা খুব ভালো হল। নিয়মিত পুস্তভালভ কাঠগোলায় বসত দুপুরের খাওয়া অবধি, তার পর যেত কাজে বেরিয়ে, ওলেঙ্কা এসে বসত তার জায়গায়, আপিসে বসে সন্ধে অবধি বিল তৈরি করত, আর অর্ডারমাফিক মাল চালান দিত।

খদ্দেরদের এবং পরিচিত লোকদের ওলেঙ্কা শোনাত কাঠের দর ফি বচ্ছর শতকরা কুড়ি টাকা হিসাবে বাড়ে। আগে আমরা কাঠ নিতাম এখান থেকেই, কিন্তু এখন ভাসিকাকে প্রতি বছর যেতে হয় মগিলেভ অঞ্চলে, কাঠের বন্দোবস্ত করতে। আর ভাড়া কী! তাজ্জব হয়ে গালে হাত দিয়ে ওলেঙ্কা বলত, কী খরচা গাড়িভাড়ার!

তার মনে হত সে কাঠের ব্যবসায় আছে যুগ যুগ ধরে; কাঠ জীবনের সর্বপ্রধান এবং সার বস্তু। গার্ডার, কড়ি, বরগা, তক্তা, বাটাম, বাক্সের কাঠ, ল্যাথ, পিস্, স্ল্যাব কথাগুলো তার কাছে বড় আদরের মনে হত, শুনে মন-কেমন করত। রাত্রে সে স্বপ্ন দেখত পাহাড়প্রমাণ বোর্ড আর তক্তা, অসংখ্য গাড়িভর্তি কাঠের গুঁড়ি সার বেঁধে কোন্ দূর দেশে যাত্রা করেছে, ৮ ইঞ্চি চওড়া ২৮ ফুট লম্বা কড়িকাঠের একটা দল খাড়া দাঁড়িয়ে ধেয়ে চলেছে কাঠগোলার দিকে, কড়িতে কড়িতে, গার্ডারে স্ল্যাবে ঠোকাঠুকি হচ্ছে, শুকনো কাঠে কাঠে খটাখটির ভোতা আওয়াজ হচ্ছে, সবাই পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠছে, এর ওর ঘাড়ে চেপে স্কুপের মতো জমা হচ্ছে ..

ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে ওঠে ওলেঙ্কা। পুস্তভালভ আদর করে বলে, ওলেঙ্কা, কী হল দুলালী? মাথায় কাঁধে বুকে ক্রুশচিহ্ন ছোঁয়াও।

যে ধারণাই তার স্বামীর হত ওলেঙ্কারও তাই হত। পুস্তভালভ যেই বলত ঘরে বড় গরম, অথবা ব্যবসায়ে মন্দা পড়েছে, ওলেঙ্কারও মনে হত তাই। আমোদ-প্রমোদ পুস্তভালভের ভালো লাগত না, ছুটির দিন কাটাত বাড়ি বসে। ওলেঙ্কাও তাই করত।

বন্ধুবান্ধবেরা বলত, তুমি সবটা সময় কাটাও বাড়িতে বা আপিসে। থিয়েটারে সার্কাসে যাওয়াও তো উচিত।

মুরুব্বিয়ানার সুরে ওলেঙ্কা বলে, ভাসিচুকা আর আমি থিয়েটারের ধার মাড়াই না। আমরা খাঁটিয়ে লোক, ওসব ছ্যাবলামির দিকে আমাদের মন নেই। কী হয় ওসব থিয়েটার দিয়ে?

প্রতি শনিবার সন্ধ্যাবেলায় আর ছুটির দিনের সকাল সকাল তারা গির্জায় যেত, পাশাপাশি হেঁটে ফিরত, দু জনেরই মুখে ফুটে থাকত উপাসনার আবেগ। দু জনেরই অঙ্গে লেগে থাকত মনোরম সুবাস। ওলেঙ্কার রেশমি পোশাক থেকে বেরোত একটা খুশি-খুশি খখস্ শব্দ।

বাড়িতে তাদের খাদ্য ছিল চা, মিষ্টি রুটি, আর রকম রকম জ্যাম। তার পর কিমার পাই। রোজ দুপুরবেলা তাদের বাড়ির সামনের উঠোনে, গেটের বাইরে, রাস্তায়, সুরুয়ার ভুরভুরে গন্ধ ছড়াত, ভেড়ার বা হাঁসের ঝলসানো মাংসের কিংবা উপবাসের দিনে মাছের। যে-ই যেত ওবাড়ির পাশ দিয়ে, তারই খিদে পেয়ে যেত।

আপিসে, সামোভারে চায়ের জল সর্বদাই চড়ানো থাকত– খদ্দের এলে দেওয়া হত চায়ের সঙ্গে কড়াপাকের পিঠে।

সপ্তাহে একদিন করে তারা যেত স্নানাগারে, ফিরত একসঙ্গে টকটকে রাঙাবরণ হয়ে।

ওলেঙ্কা বলত বন্ধুদের, সত্যি ঈশ্বরের কৃপায় আমরা সবদিক থেকে বেশ ভালোই আছি। যেমন সুখে-স্বচ্ছন্দে আছি ভাসিচকা আর আমি, তেমনি যদি সবাই থাকত তত বেশ হত।

পুস্তভালভ যখন কাঠ কিনতে মগিলেভে যেত, ওলেঙ্কার ভীষণ মন-কেমন করত। সারারাত সে জেগে কাটাত, কাদত।

মাঝে মাঝে স্মিরনিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসত। স্মিরনিন ছিল সৈন্যদলের পশু-চিকিৎসক। সে ওলেঙ্কাদেরই বাড়ির একপাশটা ভাড়া নিয়ে থাকত। তার অল্প বয়স। সে এসে গল্প-সল্প করত, তাস খেলত, ওলেঙ্কার মনটা ভুলে থাকত।

স্মিরনিননের নানা কথার মধ্যে ওলেঙ্কার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত তার ঘরের খবর। স্মিরনিন বিবাহিত, আর একটি ছেলে আছে। তবে স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকে গেছে, কারণ পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম। বউকে সে দু চক্ষে দেখতে পারে না, তবু মাস মাস টাকা পাঠায় চল্লিশ রুল, তার ছেলের খোরপোশ বাবদ। এসব শুনে ওলেঙ্কা মাথা নাড়ে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর জন্য বড় দুঃখ হয় তার মনে।

যাবার সময় ওলেঙ্কা স্মিরনিনকে মোমবাতি হাতে করে সিঁড়ি অবধি পৌঁছে দেয়। বলে, ভগবান করুন, তোমার যেন কোনও বিপদ-আপদ না হয়। তুমি যে রইলে এতটা সময় আমার সঙ্গে, তার জন্য ধন্যবাদ। স্বর্গের রানি মেরি তোমাকে অটুট স্বাস্থ্যে রাখুন।

তার স্বামীর যেমন চারদিকে বিবেচনা করে গম্ভীরভাবে কথা কইবার ধরন, ওলেঙ্কা তারই অনুকরণ করে। ডাক্তার সিঁড়ির নিচেকার দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে, তখন ওলেঙ্কা তাকে ডেকে ফেরায়, আর বলে, দেখ ভাদিমির প্লাতোনি, স্ত্রীর সঙ্গে তোমার মিটমাট করে ফেলাই উচিত; তাকে ক্ষমা কর, ছেলের মুখ চেয়ে। ছেলেটি হয়তো সবই বোঝে।

পুস্তভালভ যখন ফিরে এল, ওলেঙ্কা তাকে ঘোড়ার ডাক্তারের দুঃখময় জীবনের সমস্ত কাহিনী শোনাল গলা খাটো করে। স্বামী-স্ত্রী দু জনেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, মাথা নাড়ল। দু জনেই বলাবলি করতে লাগল ছেলেটির বিষয়ে। বলল, নিশ্চয়ই ছেলেটির বাবার জন্য মন-কেমন করে। তার পর দু জনেরই মনে যেন কেমন করে এল একই কথা। তারা দাঁড়াল এসে গৃহ-বিগ্রহের সামনে। প্রার্থনা করল মাটি অবধি নুয়ে, ভগবান যেন তাদের সন্তান দেন।

এমনিভাবে পুস্তভালভ পরিবার ছ-টি বছর কাটাল, পরম শান্তিতে, বিনা আড়ম্বরে, ভালোবেসে, পরস্পরের সঙ্গে মিল সম্পূর্ণ বজায় রেখে। তার পর একদিন, শীতকালে ভাসিলি আন্দ্রেয়ি আপিসে বসে গরম চা খাওয়ার পর মাথায় টুপি না এঁটে বেরিয়ে গেল কিছু কাঠ চালান দিতে। তার ঠাণ্ডা লেগে গেল, অসুখ করল। সবচেয়ে বড় বড় ডাক্তার তার চিকিৎসা করলেন, কিন্তু রোগ কিছুতেই সারল না। চার মাস ভোগের পর পুস্তভালভ মারা গেল। ওলেঙ্কা আবার বিধবা হল।

স্বামীর গোর দিয়ে ওলেঙ্কা কুঁপিয়ে কান্না শুরু করল, কার কাছে যাব আমি, ওগো তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকব আমি অভাগী দুঃখিনী? ওগো তোমরা সবাই আমাকে দেখসে।

কালো শোকবস্ত্র পরে ওলেঙ্কা চলাফেরা করে। মাথায় টুপি নেই, হাতে দস্তানা পরে না। চোখের জলের ধারার নকশায় তৈরি সাদা ঝালর অঙ্গে ধরে। বাইরে বেরোয় কদাচিৎ যদিও-বা যায় কোথাও তো সে গির্জায় কিংবা স্বামীর কবর দেখতে। বাড়িতে বাস করে যেন সন্ন্যাসিনী।

ছ-টি মাস কেটে যাবার পর সে বিধবার বেশ ছাড়ল। তার ঘরের জানালার খড়খড়ি উঠতে আরম্ভ করল। কখনও-সখনও তাকে বাজারের পথেও দেখা যেতে লাগল, সকালের দিকে রাঁধুনীর সঙ্গে। কী যে সে করে, বাড়িতে কী করে তার দিন কাটে তা নিশ্চয় করে কেউ জানল না, তবে আন্দাজ একটা করে গেল। দেখা যেত, ওলেঙ্কা বাগানে বসে চা খাচ্ছে ঘোড়ার ডাক্তারটির সঙ্গে, ডাক্তার ওলেঙ্কাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছে। এসব দেখে লোকে অনুমান একটা করে নিত।

আরও একটা ঘটনা ঘটল। ডাকঘরে ওলেঙ্কার একটি চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হল। তাকে সে বলল, আমাদের এই শহরে গরু-ঘোড়ার কী হয় না হয় দেখবার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই, তাই এত ব্যামো। প্রায়ই শোনা যায় দুধ খেয়ে মানুষের অসুখ করে, গরু-ঘোড়ার ছোঁয়াচ লেগে এটা হয়, সেটা হয়। গৃহপালিত পশুর স্বাস্থ্যরক্ষার দিকে, যেমন মানুষের জন্য, ঠিক তেমনি নজর রাখা উচিত।

পশুর ডাক্তারটির মনে যা ধারণা ওলেঙ্কার বক্তব্যও তাই। সকল বিষয়েই ডাক্তারের যা মত তারও আজকাল সেই মত। স্পষ্টই দেখা গেল, কোনও একটা আকর্ষণ বিনা ওলেঙ্কার একটি বছরও কাটে না। আর, এবারে সে নতুন করে খুঁজে পেয়েছে আনন্দ, একেবারে তার নিজের বাড়িরই একপাশে।

মেয়েটি আর কেউ হলে তার নিন্দে হত, কিন্তু ওলেঙ্কার সম্বন্ধে কেউ কুকথা ভাবতে পারত না– সবটাই তার এত সহজ স্বাভাবিক। কি ডাক্তার কি সে– কেউই খুলে বলেনি যে আগে তাদের মধ্যে যে সম্পর্কটা ছিল তা বদলেছে। বরং ওটা ওরা ঢেকে রাখতেই চেষ্টা করত, কিন্তু পারত না, কারণ ওলেঙ্কার কথা গোপন রাখার ক্ষমতা ছিল না।

যখন ডাক্তারের সহকর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসত, ওলেঙ্কা তাদের চা ঢেলে দিতে দিতে বা যাবার সময় তুলত জীবজন্তুর মড়কের কথা। কিংবা বলত পশুদের কোনও ব্যায়রাম অথবা সরকারি কসাইখানার বিষয়। ডাক্তার বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ত। বন্ধুরা চলে যেতেই সে ওলেঙ্কার হাত চেপে ধরে ফোঁস করে উঠত, বার বার তোমাকে মানা করেছি, যা তুমি বোঝ না তা নিয়ে কথা না বলতে। আমরা পশু-চিকিৎসকেরা যখন আলাপ-আলোচনা করি, দয়া করে তুমি তার মধ্যে এসে পড়ো না। সত্যি ভারি রাগ হয়।

ওলেঙ্কা স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকাত, চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করত, তা হলে কী বিষয়ে কথা বলব, ভলকা? তার পর জলভরা চোখে সে ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরত, ডাক্তারকে দিব্যি দিত রাগ না করতে। তার পর দু জনেরই খোশমেজাজ ফিরে আসত।

এ আনন্দ বেশিদিন রইল না। ডাক্তার তার সৈন্যদলের সঙ্গে কোথায় গেল, একেবারের মতো। গোটা দলটাই বদলি হয়ে গেল দূরদেশে হয়তো-বা সাইবেরিয়াতেই। ওলেঙ্কা একা পড়ে গেল।

এবারে সে একেবারেই একলা পড়ে গেল। তার বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন; তার সেই আরামকেদারাটা পড়ে আছে চিলেকোঠার গুদোমে। ধুলোয় ভর্তি, একটা পায়া ভাঙা। ওলেঙ্কা রোগা হয়ে গেল, তার চেহারায়ও আর সে শ্ৰী রইল না। রাস্তায় দেখা হলে আর তার দিকে কেউ আগের মতো চাইত না, হাসত না। বোঝা গেল তার জীবনের সবচেয়ে ভালো দিনগুলো চলে গেল। সেদিন রইল পিছনে পড়ে, এখন যে জীবন শুরু হল তা আলাদা, অনিশ্চিত, তার কথা ভাবতেও বুক কেঁপে ওঠে।

সন্ধেবেলায় বারান্দায় বসে ওলেঙ্কা শুনত তিতোলিতে বাজনা বাজছে, বাজি ফুটছে, কিন্তু তা শুনে তার কোনও কথাই মনে হত না। ফাঁকা উঠোনটার দিকে সে নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে থাকত, কোনও কথা ভাবত না, চাইত না কিছুই। দিন ফুরিয়ে গেলে ওলেঙ্কা শুয়ে পড়ত, স্বপ্নে দেখত ফাঁকা উঠোনটা। খাওয়া-দাওয়া করত, যেন অনিচ্ছায়।

সবচেয়ে বড় আর বিশ্রী ব্যাপার হল যে, তার আর কোনওরকম মতামত রইল না। চোখে পড়ত নানা জিনিস, বুঝত কী হচ্ছে না হচ্ছে, কিন্তু কোনওকিছু সম্বন্ধেই একটা মতামত তার মনে গড়ে উঠত না। কী নিয়ে কথা বলা যায় তা-ও সে বুঝত না।

কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার মতামত না থাকা! ধরো, দেখছ একটি বোতল অথবা বৃষ্টি, কিংবা দেখছ চাষি চলেছে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে, কিন্তু বোতল, বৃষ্টি বা চাষি কী নিমিত্ত, কী তাদের তাৎপর্য কিছুই বলতে পারছ না, হাজার রুপিয়া কবুল করলেও নয়।

যখন তার কুকিন ছিল অথবা পুস্তভালভ কিংবা পরে তার কাছে থাকত পশুর ডাক্তারটি– তখন ওলেঙ্কা সবকিছুই বুঝিয়ে দিতে পারত, চাও তারই সম্বন্ধে একটা মত দিতে পারত। কিন্তু এখন তার মনটা ফাঁকা উঠোনটার মতো। বড় কষ্টমাখা, বড় বিস্বাদ এ জীবন।

শহরটা একটু করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। খোলামেলা রাস্তা জিপৃসি রোড় হয়ে উঠল শহুরে সড়ক। যেখানে ছিল তিভোলির বাগানগুলো আর কাঠের গোলা, সেখানে বাড়ির সারির ফাঁকে ফাঁকে গলিখুঁজি গজিয়ে উঠল। কী তাড়াতাড়ি কেটে যায় সময়।

ওলেঙ্কার বাড়িটা শ্রীহীন হয়ে পড়ল। ছাতে মরচে ধরল, কুঁড়েঘর একপাশে ঝুলে পড়ল, সারা উঠোনটা ভরে গেল লম্বা ঘাস আর বিছুটির ঝোপে। ওলেঙ্কার নিজেরও বয়স হল, চেহারায় সে লাবণ্য আর রইল না।

গ্রীষ্মকালে সে বসত বারান্দাটায়, মন শূন্য, নিরানন্দ, বিরস। শীতে সে বসত জানালার ধারে, তাকিয়ে থাকত বরফের দিকে। কখনও বসন্তের বাতাসে অথবা হাওয়ায় ভেসে আসা গির্জার ঘন্টাধ্বনিতে স্মৃতির বন্যা জেগে উঠত, তখন তার মন গলে যেত, চোখে জল ভরে আসত কিন্তু তা-ও মুহূর্ত-স্থায়ী, সেটা চলে গেলেই আবার ফিরে আসত সেই শূন্যতা, জীবনের উদ্দেশ্যের সেই অনিশ্চয়তা।

কালো বেড়ালের বাচ্চা ব্ৰিস্কা তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াত, ঘড়র ঘড়র শব্দ করত, কিন্তু ওসব বেড়ালি আদরে ওলেঙ্কার মন সাড়া দিত না। ওর কি ওইটুকুরই দরকার? সে চাইত এমন ভালোবাসা যা তার সমস্ত আত্মা, তার মনকে দখল করবে, মনে জন্ম দেবে ধারণার, জীবনে আনবে গতিমুখ, পড়ন্ত বয়সের রক্তে এনে দেবে উষ্ণতা।

কালো বেড়ালবাচ্চাটাকে ওলেঙ্কা তার কোল থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলত, যা এখন থেকে, যাহ্। এখানে কী তোর? এখানে কিছু নেই।

এমনিভাবে চলত দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, কোনও মত নেই, অমত নেই, আনন্দের ছিটেফোঁটা নেই। রাধুনী মাত্রা যা বলত ওলেঙ্কা তাই মেনে নিত।

একদিন– জুলাই মাস, গরম পড়েছে, সন্ধের দিকে, গরুগুলো যখন ঘরে ফিরছে সারা উঠোনে ধুলো উড়িয়ে সেই সময় কে যেন আচমকা দরজায় ঘা দিল। ওলেঙ্কা নিজেই গেল ফটক খুলতে, খুলে যা দেখল তাতে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল– দরজায় দাঁড়িয়ে পশুর ডাক্তার স্মিরনিন। তার চুলে পাক ধরেছে, পরনে বেসামরিক পোশাক।

এক মুহূর্তে ওলেঙ্কার সব কথা মনে পড়ে গেল। সে নিজেকে সামলাতে পারল না, কেঁদে ফেলল। একটি কথাও না বলে সে স্মিরনিননের বুকে তার মাথা রাখল। এত ওলোট-পালট হয়ে গেল তার মন যে, কখন যে স্মিরনিনকে ঘরে নিয়ে গিয়ে সে তার সঙ্গে চা খেতে লাগল তা সে বুঝতেই পারল না।

আনন্দে সে কেঁপে উঠল, মুখে কথা ফুটল, ওগো ম্লাদিমির প্লাতনি, কী জন্যে এলে এখানে?

স্মিরনিন বলল, আমি এসেছি এখানে থাকব বলে। সৈনিকের চাকরি আমার শেষ হয়েছে। এবারে এখানেই বসবাস করে নিজে রোজগার করবার চেষ্টা দেখব। তা ছাড়া ছেলেটিও বড় হল, তাকে উচ্চশিক্ষা দিতে হবে। আর জানো, স্ত্রীর সঙ্গে মিটমাট করে ফেলেছি।

ওলেঙ্কা বলল, কোথায় সে?

হোটেলে, আমার ছেলের সঙ্গে। আমি বেরিয়েছি একটা আস্তানা খুঁজতে। ভাড়া নেব।

সে কি কথা গো! আমার বাড়িটা নাও। ভাড়া। একটি পয়সা ভাড়া নেব না। এলেঙ্কার মন আবার চঞ্চল হয়ে উঠল, সে কাঁদতে শুরু করল। বলল, তোমরা এখানে থাকো। আমার পক্ষে বাড়ির একটা ধারই যথেষ্ট। ওহ কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার!

পরদিনই তারা ছাতে দু-এক পোঁচ রঙ আর দেয়ালে চুনকাম করতে লেগে গেল। ওলেঙ্কা কোমরে হাত দিয়ে উঠোনটার চারদিক ঘুরে কাজের খবরদারি করতে লাগল। সেই পুরনো দিনের হাসি আবার তার মুখে ফুটে উঠল। মনে হল যেন লম্বা একটানা ঘুমের পর তার শরীর তাজা হয়ে প্রাণ ফুটে উঠেছে।

পশুর ডাক্তারের স্ত্রী এল। রোগা মেয়েটি, সাদাসিদে, ছোট করে ছাটা চুল, মুখে একটা খামখেয়ালি ভাব। সঙ্গে তার ছোট ছেলেটি, সাশা, বয়স প্রায় দশ, কিন্তু সে আন্দাজে মাথায় খাটো। ফুলো ফুলো গালে টোল, উজ্জ্বল নীল চোখ। উঠোনে ঢুকেই সে বেড়ালটার পিছনে ছুটতে আরম্ভ করল, সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল খিলখিল হাসি খুশি মনের ফুর্তির।

ছেলেটি জিগ্যেস করল, মাসি, এটা কি তোমার বেড়াল? ওর যখন বাচ্চা হবে, আমাকে দিও। মা ইঁদুর দেখে ভয়ানক ভয় পায়।

ছেলেটির সঙ্গে ওলেঙ্কার গল্প শুরু হল। চা খাওয়াল সে ছেলেটিকে। হঠাৎ তার বুকটা ভরে উঠল। মধুর একটা ভারে তার বুক কনকন করতে লাগল ছোট্ট ছেলেটি যেন তার নিজের।

সন্ধেবেলায় সে যখন খাবারঘরে তার পড়া তৈরি করতে বসল, এলেঙ্কা তার দিকে চেয়ে রইল। মন মুখ তার স্নেহমমতায় ভরে উঠল। সে বলতে লাগল, নিচু গলায়, আমার দুলাল, আমার মানিক, কত বুদ্ধি তোমার–কী সুন্দর দেখতে তুমি।

ছেলেটি জোরে জোরে পড়তে লাগল, বই দেখে, দ্বীপ একটি ভূখণ্ড, সম্পূর্ণরূপে জলবেষ্টিত।

ওলেঙ্কা পুনরাবৃত্তি করল, দ্বীপ একটি ভূখণ্ড।

বহুদিনের ফাঁকা মন থেকে একটি কথা না বলে সে আজ এই প্রথম একটি মত প্রকাশ করল যাতে তার বিশ্বাস আছে।

এইবারে তার নিজস্ব মতামত গড়ে উঠতে আরম্ভ করল। রাত্রে খাবার সময় সে সাশার বাবা-মাকে শোনাতে লাগল যে, হাইস্কুলে ছেলেপিলেদের যা পড়ানো হয় তা কী রকম শক্ত। অবশ্য শুধু কারিগরির কাজ শেখানোর চেয়ে উচ্চশিক্ষা ভালো, কারণ তার দ্বারা সমস্ত পথই খুলে যায়– চাও তুমি ডাক্তার হতে পার … ইঞ্জিনিয়ার হতে পার…

সাশা হাইস্কুলেই যেতে শুরু করল। তার মা খারকভে তার বোনের বাড়ি গেল, গিয়ে আর ফিরল না। বাবা তার পশুর পাল দেখতে বেরোত, কখনও কখনও একনাগাড়ে বাইরে থাকত। ওলেঙ্কার মনে হত সবাই সাশাকে ছেড়ে চলে গেল, কেউ তাকে চায় না, না খেয়ে ছেলেটি মরে যাচ্ছে। ওকে সে সরিয়ে আনল নিজের পাশটিতে ছোট একটি কামরায়। সেখানেই তার থাকবার বন্দোবস্ত করে দিল।

ছ মাস হয়ে গেল। সাশা থাকে তার পাশেই। রোজ সকালে ওলেঙ্কা যায় সাশার ঘরে। সাশা তখনও শুয়ে, গালের তলায় হাতটি রেখে গভীর ঘুমে অচেতন, নিশ্বাস নিঃশব্দে উঠছে-পড়ছে। ওলেঙ্কার মনে কষ্ট হয় সাশার ঘুম ভাঙাতে। তবু বলে, আস্তে আস্তে, সাশেনকা, উঠে পড়ো সোনা। স্কুলে যাবার সময় হল।

সাশা ওঠে, পোশাক পরে প্রার্থনা সেরে খেতে বসে। খায় তিন গ্লাস চা, দুটো বড় কড়া কেক। মাখন-মাখানো আধখানা ছোট রুটি। ঘুম তখনও তার পুরোপুরি কাটেনি, তাই মেজাজটি তখনও ধাতস্থ হয়নি।

এলেঙ্কা বলে, সাশেনকা, গল্পটা তোমার কিন্তু ভালো তৈরি হয়নি।

এমনভাবে চেয়ে থাকে সে তার দিকে, যেন ছেলেকে সে বিদায় দিচ্ছে দূর যাত্রার পথে।

তোমার জন্য আমি ভেবে মরি। প্রাণপণ চেষ্টা করো সোনামণি, ভালো করে পড়াশুনা করো। মন দিয়ে মাস্টারদের কথা শুনো।

সাশা বলে, আহ, আমাকে ছেড়ে দাও দিকি।

 তার পর হেঁটে রওনা হয় স্কুলে।

ছোট মূর্তিটি পথে চলেছে, মাথায় মস্ত একটা টুপি, কাঁধে একটা ঝুলি। ওলেঙ্কা নিঃশব্দে পিছু পিছু যায়। ডাকে, সাশেনকা– আ।

সাশা যেই পিছন ফিরে তাকায় এলেঙ্কা তার হাতে গুঁজে দেয় একটি খেজুর বা কারামেলের একটি টুকরো।

স্কুলের গলি এসে পড়ে। সাশেনকার বিশ্রী লাগে, লম্বা মোটাসোটা একটি মহিলা তার পিছু পিছু আসছেন, দেখে তার লজ্জা করে। পিছন ফিরে সে বলে, মাসি, বাড়ি ফিরে যাও। এখন আমি একা যেতে পারব।

ওলেঙ্কা থামে, কিন্তু তার চোখ সরে না। স্কুলে ঢোকার পথটিতে ছেলে পৌঁছে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সে তার দিকে তাকিয়েই থাকে। আহ, কী ভালোই বাসে সে ছেলেটিকে। মায়ার ফাঁদে সে আগেও পড়েছে, কিন্তু কেউই তাকে এমন করে বাঁধতে পারেনি। আজ তার মায়ের মন জেগে ওঠে যত আনন্দে, যেমন করে তার আত্মাটাকে একেবারে বিলিয়ে দিয়েছে, তেমন কখনও হয়নি আগে। এই ছোট্ট ছেলেটি তার নিজের নয়, তবু তার গালের টোলটি, মাথার টুপিটার জন্য সে তার জীবন দিতে পারে, আনন্দে, মমতায়, জলভরা চোখে। কেন? কেন তা কে বলতে পারে?

সাশাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ওলেঙ্কা শান্ত মনে বাড়ি ফিরে যায়। মনভরা তার তৃপ্তি, প্রশান্তি, ভালোবাসা। গেল ছ মাসে বয়স যেন তার কমে গেছে, মুখে উজ্জ্বল আনন্দ। লোকে তাকে দেখে খুশি হয়, বলে, সুপ্রভাত গো ওলগা সেমইয়নভুনা, দুলালী, কেমন আছ দুলালী?

সে বলে, স্কুলে আজকাল এত শক্ত পড়া দেয়। বাজারে ঘুরে কেনাকাটার ফাঁকে ফাঁকে সে বলতে থাকে, ঠাট্টা নয়। কাল প্রথম ঘণ্টায় ওকে পড়া দিয়েছে একটা গল্প মুখস্ত, লাতিন থেকে একটা তরজমা আর একটি সমস্যাপূরণ। ওইটুকু একটা ছেলের পক্ষে এটা বড্ড বাড়াবাড়ি, বাস্তবিকই।

তার পর সে আরম্ভ করে মাস্টারদের কথা, পড়ার কথা, পাঠ্যবইগুলোর কথা– সাশা যা বলে ঠিক তাই বলে।

তিনটের সময় ওরা একসঙ্গে খায়। সন্ধেবেলায়, মাস্টাররা যে বাড়ির পড়া দেন তা ওরা পড়ে একসঙ্গে, একই সঙ্গে কাঁদে। সাশাকে বিছানায় শুইয়ে ওলেঙ্কা প্রার্থনায় আর ক্রুশচিহ্ন আঁকায় অনেকক্ষণ লাগিয়ে দেয়। তার পর সে নিজে শুতে যায় আর স্বপ্ন দেখে সেই দূর, অস্পষ্ট ভবিষ্যতের, যখন সাশার পড়া শেষ হয়েছে, সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার– তার মস্ত একটা বাড়ি, ঘোড়াগাড়ি। বিয়ে হয়েছে, ছেলে-মেয়ে হয়েছে… এই কথাই ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত চোখ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। পাশে কালো বেড়ালটা শুয়ে আওয়াজ করে…ঘড়র… ঘড়র।

হঠাৎ দরজায় জোরে ঘা পড়ে। ওলেঙ্কার ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। আধ মিনিট বাদে আবার ঘা।

ওলগার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। সে ভাবে, খারক থেকে এসেছে তার। সাশার মা তাকে চেয়ে পাঠিয়েছে। হা ভগবান!

সমস্ত আশাভরসা তার উবে যায়, মাথা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে, মনে হয়, তার মতো অভাগিনী জগতে আর কেউ নেই।

কিন্তু আরও এক মুহূর্ত কেটে যাবার পর সে কার যেন গলা শুনতে পায়; কিছু নয়, পশুর ডাক্তার ক্লাব থেকে ঘরে ফিরল।

ওলেঙ্কা মনে মনে বলে, যাক। ধন্য ভগবান! ক্রমে ক্রমে তার বুকের ওপর থেকে ভারটা সরে যায়। আশ্বস্ত হয়ে সে ফিরে যায় বিছানায়, আর সাশার কথা ভাবে। পাশের ঘরে ঘুমোয় সাশা আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে ঘুমের ঘোরে, দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা! এই, ওকি, মারামারি নয়!

***

গল্পটি চেখফের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। কেউ কেউ বলেন, দি বেস্ট শর্ট স্টোরি অব চেখফ। আবার কেউ কেউ বলেন, পৃথিবীর সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ গল্প।

কেন?

তারই টীকা করেছেন স্বয়ং টলস্টয়। এ-রকম একটা ঘটনা এই বাঙলা দেশেই ঘটেছিল। প্রভাত মুখুয্যে একটা ছোটগল্প লিখেছিলেন। তার মূলে বক্তব্য ছিল, হিন্দুর নীচ জাতির একটি ছেলে অপমানিত বোধ করে খ্রিস্টান হবে বলে মনস্থির করল। তখন দেখে, খ্রিস্টানদের ভিতরও জাতিভেদ রয়েছে। নেটিভ খ্রিস্টানদের জন্য আলাদা ক্লাব, এমনকি ধর্মমন্দির– চার্চ সে-ও আলাদা, এবং সবচেয়ে অবিশ্বাস্য, মৃত্যুর পরও জাতিভেদ যায় না : গোরার জন্য ভিন্ন। গোরস্তান, নেটিভের ভিন্ন গোরস্তান। গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ, সে যুগের ঋষিপ্রধান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একটি সমালোচনা লেখেন– ডাঙায় বাঘ জলে কুমির। হিন্দুর বর্ণাশ্রম সমস্যা নিয়ে এরকম প্রামাণিক প্রবন্ধ এর পূর্বে বা পরে কখনও লিখিত হয়নি। হরিজন আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার বহু বহু পূর্বে।

টলস্টয়ের টীকা পড়ে পাঠক বুঝবেন, আমরা, সাধারণ-পাঠক, কত সহজেই গল্পটির মূল বক্তব্য মিস করে যেতে পারি। অনবদ্য এই টীকাটি।

টীকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর চেখফ সর্বসাধারণকে অনুরোধ জানান তাঁর গল্পটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন টীকাটি পড়েন এবং প্রকাশকদের অনুরোধ করেন, তারা যেন সবসময়ই গল্পটির সঙ্গে টীকাটিও ছাপেন। এটিও অনুবাদ করেছেন সখা খাফী খান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *