ত্রিশ
অসহায় ধৃতরাষ্ট্র, নিরুপায় ধৃতরাষ্ট্র। কুরুবৃদ্ধদের চাপে পড়ে কুরু-আইন মেনে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ বলে ঘোষণা দিল।
যুবরাজ হওয়ার পর যুধিষ্ঠিরের ক্ষমতা বাড়ল। ভীম আর অর্জুনকে নিয়ে ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্য আক্রমণ করে কুরুসাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলল। স্রোতের মতো অর্থ-সম্পদ আসতে লাগল কুরুরাজকোষে। চারদিকে পাণ্ডবদের জয়ধ্বনি। অর্জুনের নামেই বেশি প্রশংসা শোনা যেতে লাগল—অর্জুনের মতো এত বড় ধনুর্ধারী যোদ্ধা পৃথিবীতে আর নেই।
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র শোনে আর মন ভারী করে।
এর মধ্যে পর পর দুদিন একই ঘটনা ঘটল। প্রথম দিন কুরুরাজ্যের সভাগৃহে, ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখে। দ্বিতীয় দিন প্রাসাদের বাইরের চত্বরে।
প্রথমদিন রাজসভায় কিছু মানুষ জড়ো হলো। কথা বলতে লাগল উচ্চ কণ্ঠে। কথা বলবার অনুমতি নেয়নি তারা রাজার কাছ থেকে। তাদের কথায় কীরকম যেন উগ্রতা! প্রহরীরা তাদের থামাতে চাইল। কিন্তু প্রহরীদের কথা শুনতে তারা নারাজ। সবার কণ্ঠকে ছাপিয়ে একজনের কণ্ঠস্বর ধৃতরাষ্ট্রের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছাল।
উদ্ধত কণ্ঠে সেই নাগরিক বলল, ‘যুধিষ্ঠির রাজকার্য ভালোই চালাচ্ছেন। আমরা তাঁকে রাজা হিসেবে দেখতে চাই।’
চমকে মাথাটা উঁচু করল ধৃতরাষ্ট্র। এ কী! এ তো স্পষ্ট প্রজাবিদ্রোহ! যুধিষ্ঠিরকে রাজা চাই মানে কী! তা হলে তার সিংহাসনচ্যুতি চায় ওই প্রজাটি! এত বড় সাহস ওই প্রজাটির হলো কী করে! কার ইন্ধনে সে এই রাষ্ট্রদ্রোহী কথাটা বলল। এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে কে? এখন এই রাজসভায় ভীষ্ম-বিদুর-দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্যরা বসে আছেন! তাঁরা শুনছেন না প্রজাটির কথাবার্তা? যদি শুনছেন, তা হলে কোনো প্রতিবাদ করছেন না কেন? দ্রুত ভেবে গেল কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র।
রাজা কিছু বলবার আগেই সেই উদ্ধত প্রজাদের ঝেঁটিয়ে রাজসভা থেকে বের করে দিল কুরু সেনারা।
দুঃসহ বেদনা নিয়ে রাত কাটাল মহারাজ।
পরের দিনের ঘটনা আরও ভয়াবহ।
প্রাসাদের প্রধান ফটক থেকে বেশ একটু দূরে খোলামতন জায়গা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওখানে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল। তারা যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের কাজকর্মে দারুণ খুশি। ওই সমবেতদের মধ্যে নেতা গোছের একজনকে লক্ষ করা গেল। তার নাম দীপক। একটু গভীর চোখে দেখলে বোঝা যাবে, দীপকের প্ররোচনাতেই লোকগুলো এখানে জমায়েত হয়েছে। দীপক ডান হাত বাম হাত নেড়ে নেড়ে লোকগুলোর উদ্দেশে কী যেন বলে যাচ্ছে!
কাছে গেলে তার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা গেল।
দীপক বলছে, ‘দেখ, বহুদিন তো অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র আমাদের শাসন করল! কী হলো তাতে আমাদের? রাজধানীর বাইরে তেমন ভালো রাস্তাঘাট তৈরি হলো কোথাও? প্রজাদের কল্যাণের জন্য ধৃতরাষ্ট্র কী করেছে? অভাবের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছে? বন্যার্ত মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে?’
দীপকের মুখে রাজদ্রোহী কথাবার্তা। তার কথাগুলো উস্কানিমূলক। রাজাকে সম্মান জানিয়ে ‘আপনি’ও বলছে না সে।
দীপকের কথার সূত্র ধরে অন্য একজন বলল, ‘এই যে আমাদের যুবরাজ যুধিষ্ঠির, তাঁর কোনো তুলনা হয় না! কী মধুর ব্যবহার তাঁর? তাঁর সঙ্গে যখন ইচ্ছে, দেখা করা যায়। সুখদুঃখের কথা বলা যায়।’
অপরজন বলল, ‘আরে, তিনি যুবরাজ হওয়ার পর তো অনেক দেশ এই হস্তিনাপুরের পদানত হয়েছে। ভীম আর অর্জুনের যুদ্ধকৌশলে অনেকগুলো যুদ্ধ জিতেছেন যুধিষ্ঠির।’
‘শুধু তো তাই নয়, ধনসম্পদে রাজকোষ ভরে উঠেছে শুনলাম।’ লাঠি হাতের বৃদ্ধটি বলল। এবার দীপক জ্বালাময়ী কণ্ঠে বলল, ‘যুধিষ্ঠিরকে আমরা কুরুরাজ্যের রাজা হিসেবে চাই। তোমরা কী বলো?’
দু-চারজন একসঙ্গে ধুয়ো দিল, ‘তুমি ঠিক বলছ দীপক। আমরা চাই—যুধিষ্ঠিরই আমাদের রাজা হোন।’
সেই অন্যজন অবহেলার ভঙিতে বলল, ‘দুদ্দুর! ধৃতরাষ্ট্রকে দিয়ে এই রাজ্য চলবে না। অন্ধ বলে তো তাকে আগে থেকেই রাজা করা হয়নি! ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাজ চালিয়েছে!’
দীপক বলে উঠল, ‘আর এখন আমাদের মহারাজ পাণ্ডু মারা যাওয়ার পরও তো কুরুবৃদ্ধরা তাকে রাজা নির্বাচন করেননি! যেই কে সেই রেখে দিয়েছেন! ভারপ্রাপ্ত রাজা দিয়ে এই হস্তিনাপুর আর কতদিন চলবে? এবার আমরা আসল রাজা চাই।’
‘আর সেই আসল মহারাজা হবেন যুধিষ্ঠির।’ দীপকের উস্কানিতে ঘি ঢালল বুড়োটা।
এবার দীপকের মুখ দিয়ে আসল কথাটি বেরিয়ে এলো, ‘ধৃতরাষ্ট্রের রাজা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্মের কথাই ধর। বাপের পুত। বিয়ে করবেন না বলেছেন, করলেনই না! রাজা হবেন না বলেছেন, কিছুতেই কুরুসিংহাসনে বসলেন না তিনি! তা হলে বোঝ—এখন কার রাজা হওয়া উচিত।’
সেই বৃদ্ধটি চেঁচিয়ে বলল, ‘কী প্রশ্ন করছ তুমি দীপক! কার রাজা হওয়া উচিত মানে! যুধিষ্ঠিরকেই হস্তিনাপুরের রাজা হিসেবে চাই আমরা। বয়সে যুবা, তাতে কী? বড়দের মর্যাদা দিতে জানেন, সৎপথে চলেন। মমতা আছে সবার জন্য।’
সমবেত সবাই চাপাস্বরে গর্জে উঠল, ‘যুধিষ্ঠিরকে রাজা করবার জন্য যা যা করা দরকার আমরা করব। প্রয়োজনে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে হাতে অস্ত্র তুলে নেব।’
চট করে তর্জনী দিয়ে নিজের ঠোঁট চাপা দিল দীপক। হিসহিসিয়ে বলল, ‘চুপ চুপ! এ রকম খোলামেলা জায়গায় এ রকম করে বলতে নেই। তোমরা শুধু অপেক্ষা করো। দেখি উপর থেকে কী নির্দেশনা আসে!’
বৃদ্ধটি চোখ গোল করে বলল, ‘উপর থেকে?’
দীপক বৃদ্ধের প্রশ্নের জবাব দিল না। শুধু বলল, ‘আজ তোমরা বিদেয় হও। পরে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে।
মুহূর্তেই গাঁট্টাগোট্টা দশ-বারোজন দীপককে ঘিরে ধরল। তারা রাজগুপ্তচর। আগের দিনের গোলমালে সেনাপতি সতর্ক হয়েছে। নিষ্ক্রিয় বসে থাকেনি। গুপ্তচরপ্রধানকে ডেকে পাঠিয়েছে। আজ রাজপ্রাসাদের বাইরের চত্বরে জটলা দেখে সাধারণ পোশাকে গুপ্তচররা ওই জটলায় ঢুকে পড়েছে। রাজদ্রোহমূলক সকল কথা নীরবে শুনে গেছে এবং সঠিক সময়ে দীপককে ঘিরে ধরেছে।
এই পরিস্থিতিতে উপস্থিত মানুষেরা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারা এ রকম অবস্থার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। দীপক তাদের হাতে হাতে উৎকোচ গুঁজে দিয়ে বলেছিল, ‘তোমাদের কিছুই করতে হবে না। যা বলার, বলব আমি। তোমরা শুধু সায় দিয়ে যাবে। মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বলবার ইচ্ছা জাগলে বলবে। আর হ্যাঁ, আমার কথার মাঝখানে মাঝখানে যুধিষ্ঠিরকে সমর্থন করে আওয়াজ তুলবে।’ ওতেই রাজি হয়ে এই চত্বরে জমায়েত হয়েছিল উৎকোচভোগী নাগরিকরা। সেখানে যে রাজার সেনা ঢুকে পড়বে—ভাবেনি তারা। তাই দীপকের অবস্থা দেখে লেজ গুটিয়ে যে যে-দিকে পারল, পালাল।
গোপন কক্ষে নিয়ে আসা হলো দীপককে। এটা রাজপ্রাসাদলগ্ন আঁধারমতন একটা ঘর। দূরের কোনায় দুটো মশাল আলো ছড়াচ্ছে।
বিকেলের দিকে দুর্যোধনের হাত ধরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সেই কক্ষে এলো। তার আগেই সেখানে উপস্থিত ছিল সেনাপতি এবং গুপ্তচরপ্রধান।
প্রথম দিকে তো দীপক মুখ খুলবেই না! শুধু বলছে, ‘ওসব কথা নিজের থেকে বলা। যুধিষ্ঠিরকে ভালো লাগে বলেই বলেছি।’
দুর্যোধন বলেছে, ‘তোমার এই ভালোলাগার পেছনে অন্য একজনের প্ররোচনা আছে। বলো, কে সে?
‘আপনি ঠিক কথা বলছেন না। অন্য কারও প্ররোচনা নেই।’ উদ্ধত কণ্ঠে বলল দীপক
পাশে দাঁড়ানো যামতন সৈনিকটি দীপকের গাল বরাবর জোর একটা চড় কষাল।
আপনাতেই দীপকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘বলছি, বলছি প্রভু।’
দুর্যোধন বলল, ‘কে সে?
দীপক বলল, ‘আপনাদের এই রাজপ্রাসাদেরই একজন।’
দুর্যোধন আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কে সে?’
একত্রিশ
আরেকটা চড় এসে দীপকের মুখে পড়ল।
হড়বড়ানো গলায় দীপক বলল, ‘মহামান্য বিদুর।’
ক্রোধস্পর্শিত কণ্ঠে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘মহামান্য!’
‘মহামান্য’ শব্দটি মহামহিম ব্যক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়। হস্তিনাপুরে এই শব্দটি শুধু দুজন ব্যক্তির নামের আগে ব্যবহার করে মানুষেরা। তাঁরা হলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং পিতামহ ভীষ্ম। অন্য কারও জন্য এই সম্মানের শব্দটি ব্যবহার করার নিয়ম নেই কুরুরাজ্যে। কিন্তু আজ দীপক বিদুরের নামের আগে ‘মহামান্য’ শব্দটি ব্যবহার করল। উপস্থিত অন্যরা তো অবাক হলোই, সবচাইতে বেশি অবাক হলো রাজা ধৃতরাষ্ট্র। তাই তো তার মুখ দিয়ে ওরকম বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে এলো!
এর পর নানা ধরনের প্রশ্ন করে গেল গুপ্তচরপ্রধান। সেনাপতিও চুপ থাকল না। দীপকের উত্তর শুনতে শুনতে কপালে চোখ উঠে গেল তাদের। তলে তলে এত গভীর ষড়যন্ত্র! ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে! দুর্যোধনের বিরুদ্ধে!
দীপকের সকল কথার সারমর্ম এ রকম—
গোটা রাজধানীজুড়ে অঢেল অর্থ ছড়িয়েছে বিদুর। এর মধ্যে বেশ কিছু মানুষকে হাত করে নিয়েছে। নেতাশ্রেণির ওই মানুষেরা আবার কিছু উপনেতা তৈরি করেছে। উপনেতাদের কাজ হলো স্থানে স্থানে সাধারণ মানুষদের জড়ো করে ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধনের দুর্নাম করে যাওয়া। আর দাবি জানানো—ধৃতরাষ্ট্রের জায়গায় যুধিষ্ঠিরকে রাজা হিসেবে চাই আমরা।
দীপকের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র মুহ্যমান। এখনই বুঝি আসন থেকে ভূতলে পড়ে যাবে! শক্ত হাতে বাবাকে ধরে থাকল দুর্যোধন।
সেনাপতি ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি আদেশ দিন মহামান্য মহারাজ। বিদুরের ধড় থেকে মস্তকটা বিচ্ছিন্ন করে দিই।’
চট করে ডান হাতটা উপর দিকে তুলল ধৃতরাষ্ট্র। বিমূঢ় কণ্ঠে শুধু বলল, ‘না সেনাপতি, না। বিদুর আমার ভাই। সে আমার ধ্বংস চাইতে পারে, আমি পারি না সেনাপতি।’ বলতে বলতে মাথা নিচু করল ধৃতরাষ্ট্র।
বেশ কিছুক্ষণ পর ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘দীপককে বন্দি করে রাখা হোক। চারদিকে গুপ্তচর পাঠিয়ে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত, তাদের শনাক্ত করা হোক।’
তারপর পুত্রের দিকে মুখ ঘোরাল মহারাজ। নিচু স্বরে বলল, ‘বাছা, আমাকে আমার কক্ষে নিয়ে চল।’ বলে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ধৃতরাষ্ট্র।
শয়নকক্ষে পৌঁছালে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আমাকে শয্যায় শুইয়ে দাও দুর্যোধন। আমি যতক্ষণ কথা না বলি, আমাকে ডাকবে না। কাউকে আসতে দিয়ো না এ ঘরে এখন।’
দুর্যোধন পিতাকে পালঙ্কে শুইয়ে দিল। চিত হয়েই শয্যা নিল মহারাজ। বিষণ্ন বিপর্যস্ত দুটো চোখ বুজে এলো ধৃতরাষ্ট্রের। ওই অবস্থাতেই মহারাজ বলল, ‘তুমি এই কক্ষ ছেড়ে যেয়ো না দুর্যোধন। আমি একটু সুস্থ বোধ করি। তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’
দুর্যোধন আসন টেনে পিতার শিয়রের কাছে বসল। পিতার মলিন চেহারার দিকে গভীর চোখে তাকাল একবার। এই সময় তার চোখের সামনে বিদুরের চেহারাখানি ভেসে উঠল।
একদিনের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল দুর্যোধনের। তখনো খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ভীমকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়নি সে। ওরকম দুর্বুদ্ধি তার মনে জাগেওনি তখন। তখন ভীমের হাতে মার খেতে খেতে বিপর্যস্ত কৌরবরা। শত ভাই মিলেও ভীমের হিংস্রতা থামাতে পারছে না। তাই নিরুপায় হয়ে এক বিকেলে বিদুরের সামনে উপস্থিত হয়েছিল দুর্যোধন।
কোনো ভূমিকা না করে দুর্যোধন সরাসরি বলেছিল, ‘কাকা, নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি।’
‘আমার কাছে! কিন্তু কেন বাছা? কোন বিপদে পড়ে রাজপুত্র আমার কাছে এলো?’ বাহির দিকে তাকিয়ে বাক্য শেষ করল বিদুর।
দুর্যোধন বিদুরের কথার হুলটা বুঝতে পারল। সেও ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠল, ‘ভীমের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। এবার তাকে তুমি একটু সামলাও কাকা।’
আকাশ থেকে পড়ল বিদুর। বলল, ‘আমি সামলাব! ভীমকে! ভীম আমার কে হয় যে আমি তাকে সামলাব?’
‘শোনো কাকা, তোমার আস্কারা পেয়েই ভীম মাথায় উঠেছে। চোখ তো এড়ায় না আমার! তুমি আমাকে যত ছোট ভাব, বুদ্ধিতে আমি কিন্তু তত ছোট নই। সব বুঝি আমি।’
এবার সত্যি অবাক হলো বিদুর। এত ছোট্ট একটা ছেলে এমন চোখা চোখা কথা বলবে, ভাবেনি সে।
ভীম বলল, ‘ছোট মা কুন্তীর কাছে নালিশ জানিয়ে কোনো ফল পাইনি। তুমিও গায়ে মাখছ না। তা হলে আমরা যাই কোথায় বলো! তোমরা সবাই মিলে এই রাজপ্রাসাদে কি আমাদের টিকতে দেবে না?’
বিদুর ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এক হাতে তালি বাজে না। ভীম তো ভীষণ শান্ত ছেলে! তোমরা সবাই মিলে ওর পেছনে লাগ বলেই তো ও খেপে যায়।’
‘তুমি তা হলে ভীমের কোনো দোষ দেখতে পাও না, না? কুরুভাইদের অপরাধী করতে পারলে তোমার খুব সুখ লাগে? ছোট মা কুন্তী আর তোমার কাছে কী অপরাধ করেছি আমরা ভাইয়েরা? শুধু আমাদের দোষই দেখ তোমরা? ভীম তোমাদের কাছে ধোয়া তুলসীপাতা ছাড়া আর কিছুই নয়?’
বিদুরের চোখেমুখে ক্রুর হাসি ছড়িয়ে পড়ল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ভীম মারামারি করে, তোমরা বুঝি করো না? একসঙ্গে খেলতে গেলে অমন মারপিট হয় একটু-আধটু। ওটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অত বড় করার কী আছে! তবে কী আর বলব, ওটা তো তোমার স্বভাব!’
দুর্যোধন ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি এরকম করে বলছ কাকা? আসলে তুমি তো আমাকে সহ্য করতে পার না। তোমার কাছে নালিশ জানাতে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।’
বিদুর এবার দুর্যোধনকে ধমকে বলল, ‘চুপ করো বাছা। এক রত্তি একটা ছেলে ওরকম বুড়োদের মতো কথা বলছ কেন? ভীমকে ঈর্ষা কর তুমি। শুধু তো তা-ই নয়, হরদম তার ক্ষতি করবার তালে থাক। তুমি আর দুঃশাসন ছাড়া তো তোমার আর কোনো ভাই অভিযোগ করে না!’
‘চমৎকার কাকা! তোমার বিচারবোধ দেখে আমি হতবাক হচ্ছি। শোনো কাকা, ভাইদের মধ্যে আমি সকলের বড়। ছোট ভাইদের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমার অন্যান্য ভাই অভিযোগ করে না বললে। কী করে অভিযোগ করবে ওরা? বড় ভাইকে ধুরছাই করছ, ছোট ভাইদের কী করবে, তা অনুমান করতে পারার বয়স তাদের হয়ে গেছে।’
বিদুর দাঁত কড়মড় করে দুর্যোধনের দিকে তাকাল।
দুর্যোদন বেপরোয়া কণ্ঠে আবার বলল, ‘তুমি আর ছোট মা ভীমকে আমাদের দিকে লেলিয়ে দিয়েছ, এখন বুঝতে পারছি। ওকে দিয়ে আমাদের দাবিয়ে রাখতে চাইছ তোমরা। ভীমকে দিয়ে আমাদের রাজপ্রাসাদ ছাড়া করতে চাইছ বুঝি?’
বিদুরের মুখ রাঙা হয়ে উঠল। দুর্যোধনকে তিরস্কার করে বলল, ‘দুর্যোধন, গুরুজনদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি তুমি?’
‘কে গুরুজন কাকা? যে মঙ্গল চায়, সে-ই তো গুরুজন—তাই না কাকা? কবে তুমি আমার মঙ্গল কামনা করেছ?’
‘তোমার মতো বাজে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আমার মন তিক্ততায় ভরে যায়।’ বলে বিদুর। ‘তিক্ততার কথা তুললে কাকা? প্রশ্ন করি—খুড়তুতো আর জেঠতুতো ভাইদের মধ্যে তিক্ততা তৈরি করে যাচ্ছে কে? তুমি নও কি?’
‘এতই যদি বোঝ বাছা, তা হলে নালিশ করতে আমার কাছে এলে কেন?’ ধূর্ত গলায় জিজ্ঞেস করল বিদুর।
বত্রিশ
বিদুরের কথা শুনে দুর্যোধন ক্ষুব্ধ হলো না।
ভেতরের রাগকে কঠিন মুঠিতে চেপে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, ‘পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে এলো যখন, তোমরা বিপুল আবেগে তাদের স্বাগত জানালে। মহারাজও বেশ খুশি হয়েছেন দেখলাম। আমরা কুরুভাইয়েরা আনন্দে ফেটে পড়লাম। আমাদের আরও পাঁচজন খেলার সাথি জুটল বলে। কিন্তু সেই আনন্দকে বেশিদিন টিকতে দিলে না তুমি। ভীমকে ক্ষিপ্ত করে তুললে আমাদের বিরুদ্ধে ভাইয়ে ভাইয়ে ভালোবাসাবাসিতে ফাটল ধরালে। ভীমকে লেলিয়ে দিলে আমাদের বিরুদ্ধে। ভীম শরীরে যেমন মোটা, মাথায়ও মোটা তেমন। ওই বোকাটা তোমার হাতের পুতুল হয়ে গেল।’ দম ফুরিয়ে আসার উপক্রম হলো দুর্যোধনের। শ্বাস নেওয়ার জন্য থামল।
বিদুর বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘এই সেদিনের ছোকরা, আমার সম্বন্ধে বেশ একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছ দেখছি! তা আর কী ভেবেছ আমাকে নিয়ে? আমি বড় দুষ্ট, আমি বড় খারাপ-এ রকম ভাবছ আমাকে নিয়ে, না?’
‘আগে কখনো তোমাকে নিয়ে এ রকম হীনভাবে ভাবিনি কাকা।’
‘এখন ভাবছ বুঝি? আমার মতো মন্দ লোক হয় না!’ বিকৃত হাসি বিদুরের মুখে।
দুর্যোধন এবার স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমাদের মনে একটা প্রশ্ন বারবার উঠছে—আমাদের বিদুর কাকাটি এ রকম হয়ে গেল কেন? এ রকম একজন ভালো মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠল কেন? তুমি এ রকম একচোখা বর্বর হয়ে উঠলে কেন কাকা? নালিশ করতে এসে ছোটমাকে আর তোমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। তখন মনে হয়—তোমাদের একটি অঙ্গুলি হেলনেই ভীম ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কিন্তু ভীম দৌরাত্ম্য থামাক, তা তোমরা চাও না।’
‘আমরা চাই না? কে বলেছে তোমাকে?’
‘তোমাদের চোখমুখই বলেছে— ভীম হিংস্রতা থামাবে না। তার এই হিংস্রতা তোমাদের পরিকল্পিত।’
কদর্য কণ্ঠে বলল বিদুর, ‘তাই নাকি! এই রকমই ভেবে নিয়েছ তা হলে তুমি!’ তার মুখে নোংরা হাসি!
বিদুরের নোংরা হাসির মধ্যেই দুর্যোধন বলে গেল, ‘এই নিষ্ঠুর খেলায় তুমি আর ছোট মা মেতে না উঠলে কুরু-পাণ্ডবের সৌহার্দ্য অটুট থাকত। কিন্তু তোমরা দুজনে তা আন্তরিকভাবে চাও না। আর চাও না বলেই আমাদের কাছ থেকে পাণ্ডবরা আলাদা হয়ে গেল।’
‘আলাদা হয়ে গেল! আলাদা হলো কোথায়! আমার তো তা মনে হয় না দুর্যোধন!’ বলে বিদুর।
‘যুধিষ্ঠিররা নিজেদের কী বলে পরিচয় দেয় কাকা?’
দুর্যোধনের এই প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল বিদুর।
দুর্যোধন আবার বলল, ‘ওরা নিজেদের পাণ্ডব বলে পরিচয় দেয়। তাদের এই পরিচয়টা কি যথার্থ কাকা?’
‘যথার্থ নয়?’ বোকা বোকা মুখ করে জানতে চায় বিদুর।
দুর্যোধন গরম কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘না। এটা তাদের পরিচয় হতে পারে না। তুমি তো সেই প্রথম থেকে বলে আসছ—ওরা হলো এই কুরুবংশের উত্তরাধিকারী। তাই না কাকা, বলোনি তুমি? এরা যদি কুরুবংশেরই হয়, তা হলে তো এদের পরিচয় হওয়া উচিত কৌরব বলে। কিন্তু না, তুমি তা হতে দাওনি। তুমি তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছ—ওরা কৌরব নয়, ওরা পাণ্ডব।’
‘আমি শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছি!’ ধরা পড়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল বিদুর।
‘তুমি নও, তো কে কাকা? বলো কে? বুকে হাত দিয়ে আমার কাছে মিথ্যে বলো না আর।’ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে দুর্যোধন।
মানুষ নিজের জঘন্য কাজের জন্য অন্যের কাছে ধরা পড়ে গেলে লজ্জায় অপমানে তার ভেতরটা তপ্ত হয়ে ওঠে। তার চোখ-কান-মুখ গরম হয়ে যায়। দুর্যোধন বিদুরের চোখেমুখে সেরকম একটা গনগনে ভাব দেখতে পেল। ওই অবস্থাতেই বিদুর বলল, ‘পাগলরা কত রকমের প্রলাপ বকে। প্রলাপের জবাব কি হয়? নাকি প্রলাপের জবাব দেওয়া উচিত? তুমি এখন যাও দুর্যোধন।’
দুর্যোধন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘না, আমি যাব না। আমার প্রশ্নের উত্তর না নিয়ে আমি এখান থেকে যাব না কাকা।’
দপ করে জ্বলে উঠল বিদুর। বলল, ‘যুধিষ্ঠিররা নিজেদের পাণ্ডব বলে পরিচয় দেয় কেন, জানতে চাইছ তো? বলছি, শোন। জিজ্ঞেস করি, তোমরা তাদের কৌরব বলে মেনে নিয়েছ কখনো? আকারে ইঙ্গিতে বলে গেছ—ওরা পাণ্ডুপুত্র নয়, ওরা কৌন্তেয়। ওরা হস্তিনাপুরের নয়, ওরা বহিরাগত। কুরুবংশের সঙ্গে ওদের কোনোই সম্পর্ক নেই। পরগাছা বলে অবিরাম তোমরা যুধিষ্ঠিরদের অবজ্ঞা করে গেছ। তোমাদের সেই হেনস্তা অবহেলারই তো জবাব দিচ্ছে যুধিষ্ঠিররা!’
‘জবাব দিচ্ছে! জবাবটা তাদের মুখে জোগাল কে?’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে শুধাল দুর্যোধন।
বিদুর দুর্যোধনের প্রশ্ন কানে তুলল না। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘তোমাদের অবহেলার-তিরস্কারের বদ-হাওয়ার বাইরে এসে ওরা খোলা হাওয়ায় শ্বাস ফেলতে চেয়েছে। অন্য কারো তাঁবেদার হয়ে থাকতে চায় না ওরা। ওরা স্বাধীনতা চায়, কুরুপ্রভাব থেকে মুক্তি চায়। কুরুপ্রভাবের ছায়া থেকে দূরে গিয়ে নিজেদের মতো করে বাঁচতে চাইছে তারা। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার তো আছে? তাই তো তারা নিজেদের কৌরব হিসেবে পরিচয় দেয় না, বলে তারা পাণ্ডব। এতে অপরাধ কোথায়, বুঝতে পারলাম না দুর্যোধন!’
‘অপরাধ তোমার কানফুসলানিতে। তুমিই ওদের মাথা বিগড়ে দিয়েছ। ওদেরকে লোভী করে তুলছ, হিংস্র করে তুলেছ।’ বলল দুর্যোধন।
বিদুর বলল, ‘তুমি মিছেমিছি আমাকে দোষারোপ করছ। ভালো করে সব না বুঝেই করছ। যে মানুষ উত্তম, সে বোঝে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ। আর অধম মানুষদের ভালোমন্দের বোধশক্তি নেই। উত্তম অন্যকে শ্রদ্ধা করে, অধম অন্যকে ঈর্ষা করে। তুমি দেখ দুর্যোধন, তুমি উত্তম না অধম?’
রাগে দপ করে জ্বলে উঠল দুর্যোধন। ‘তুমি আমাকে অধম বলছ কাকা? অধম মানে নিন্দিত- জানি। কিন্তু অধমের আরও একটা মানে আমার জানা আছে। তা হলো—তুচ্ছ। তুমি তুচ্ছার্থেই আমার জন্য অধম শব্দটি ব্যবহার করেছ। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি কাকা — তুমি কি জান, গোটা কুরুরাজপ্রাসাদে আড়ালে সবাই তোমাকে ক্ষত্তা নামে ডাকে? তুমি জ্ঞানী মানুষ। ক্ষত্তার অর্থ তোমার জানা। তারপরও বলি, ক্ষত্তা অর্থ দাসীপুত্র। তুমি যতই নিজেকে কৌরব ভাবো না কেন, প্রাসাদের সবাই তোমাকে নিকৃষ্ট ভাবে। দাসীপুত্র হিসেবেই তোমাকে চেনে সবাই।’ দম নিল দুর্যোধন।
তারপর আগের মতো সতেজে বলল, ‘সেই ক্ষত্তা তুমি, পাণ্ডুপুত্রদের কৌরবধারার সঙ্গে মিলতে দেবে কেন? তোমার ওই পক্ষপাতিত্বের জন্য তোমার ওপর আমরা মানে কৌরবভাইয়েরা যদি শ্রদ্ধা হারাই, তা হলে খুব কি ভুল হবে ক্ষত্তা?’
দুর্যোধনের এ রকম কথা শুনে বিদুরের সকল উদ্ধত দুর্বিনীত ভাব কোথায় হাওয়া হয়ে গেল! মুখের কথা ফুরিয়ে গেল তার। নিজের অজান্তেই মাথা হেঁট হয়ে এলো বিদুরের।
ঠিক এই সময় ধৃতরাষ্ট্র ডেকে উঠল, ‘দুর্যোধন। তুমি আছ?’
পিতার ডাকে দুর্যোধনের ভাবনাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। দূর-অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো সে। দ্রুত পিতার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে দুর্যোধন বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, আমি আছি। কোথাও যাইনি।
পুত্রের কণ্ঠস্বর শুনে শয্যায় উঠে বসল ধৃতরাষ্ট্র। পালঙ্ক থেকে নেমে নিজ আসনে গিয়ে বসল। বহুদিনের অভ্যাসে কক্ষের কোথায় কোন আসবাব আছে, জানা তার।
দীর্ঘ একটা শ্বাস বুকের নিচে লুকিয়ে ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞেস করল, ‘এখন আমাদের কী করা উচিত সুযোধন?’ ধৃতরাষ্ট্র মাঝেসাঝে তার জ্যেষ্ঠপুত্রকে আদর করে ‘সুযোধন’ বলে সম্বোধন করে।
তেত্রিশ
‘আমি কী বলব, দিশা পাচ্ছি না বাবা! মাতা ভিন্ন ভিন্ন, আপনাদের তিন ভাইয়ের পিতা তো একজনই। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচাইতে বঞ্চিত কে বাবা? আপনি। জ্যেষ্ঠ হয়েও সিংহাসন পাননি। চক্রান্তের ফলে রাজসিংহাসনে চড়ে বসেছেন আপনার ছোট ভাই পাণ্ডু। আপনার সেই ভাইটিও তো একধরনের প্রতিবন্ধী! রোগাক্রান্ত রক্তশূন্য একজন মানুষ। ঘটনাক্রমে রাজ্য চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন আপনি! ভারপ্রাপ্ত রাজা। আমার ছোট্ট এই জীবনে আপনাকে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতে দেখিনি। ওই যে বিদুর কাকা, তাকে তো কোনোদিন ঘৃণা-অবহেলা করেননি আপনি। উপরন্তু তাকে মন্ত্রী করে রাজসিংহাসনের বাম পাশে বসিয়েছেন। দাসীপুত্র বলে আপনি তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারতেন। এ রকম কত কত দাসীপুত্র এই রাজপ্রাসাদে আছে। দৈনিক পরিশ্রম করে জীবন নির্বাহ করছে তারা। বিদুরও তো দাসীপুত্রদের একজন! তাকে দাসদের দলে ঠেলে না দিয়ে রাজপ্রাসাদে থাকতে দিলেন কেন? মহামন্ত্রী করলেন কেন?’ দুর্যোধনের কথার মধ্যে ঘৃণা, ক্রোধ আর অসহায়তার উপস্থিতি।
ধৃতরাষ্ট্র করুণ কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের পিতা যে একজন! ক্ষত্তা হতে পারে বিদুর, কিন্তু ভীষণ বিচক্ষণ। তার জ্ঞানে মুগ্ধ ছিলাম আমি। তাই তাকে কাছে টেনেছি।’
‘আজ ওই কাছে টানার ফল ভোগ করুন। বিদুর কাকার জ্ঞান স্বার্থপরতায় জড়িয়ে গেছে। আপনার ধ্বংস চায় সে এখন। কারণটি আপনার অজানা নয় বাবা। আপনি যেমন আপনার সিংহাসন-উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাকে চিন্তা করেন, তেমনি বিদুর কাকাও যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের রাজা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। আমরা পুত্র যে!’
‘তোমার শেষ কথাটির মানে…?’
ধৃতরাষ্ট্রের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দুর্যোধন বলল, ‘আর নিজের সঙ্গে নিজে লুকোচুরি খেলবেন না বাবা। যুধিষ্ঠিরদের জন্ম-ইতিহাসকে আর এড়িয়ে যাবেন না।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে! এখন আমরা কী করব বলো দুর্যোধন! কী করে বিদুরের কুহক থেকে নিজেদের বের করে আনব?’
পিতার প্রশ্নের সরাসরি জবাবে গেল না দুর্যোধন। তার যুবক মনটার মধ্যে কী বিপর্যয় যে আজ ঘটে গেছে, পিতাকে তার সবটুকু ঠিকমতন বোঝাতে পারবে না সে। বোঝানোর ভাষা, তার মধ্যে নেই। শরীরের কোনো একটা স্থানে মানুষ জোর আঘাত পেলে সে-স্থানটা যেমন চেতনাশূন্য হয়ে পড়ে, দুর্যোধনের মনটারও সেরকম অবস্থা দাঁড়িয়েছে এখন। ধৃতরাষ্ট্রের ভালোবাসার জায়গাটিতে কী জোর আঘাতটাই না করল বিদুর কাকা! সেই আঘাতের ধাক্কা মহারাজ সহ্য করতে পারলেন না। দীপকের তথ্যটি মহারাজকে একেবারে শুইয়ে ছেড়েছে। হয়তো পিতা ঘুমাননি এতক্ষণ। চোখ বন্ধ করে বিদুর কাকার বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভেবে গেছেন। ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মহারাজ। পরে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে চোখ খুলেছেন। জিজ্ঞেস করেছেন—এখন আমরা কী করব বলো দুর্যোধন? দুর্যোধন কী জবাব দেবে বাবার এ প্রশ্নের? বিদুর কাকার রাজদ্রোহী কর্মকাণ্ড তাকেও কি কম হতভম্ব করেছে? সে তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি দীপকের কথা! দীপক যখন সেনাপতির ধমকে ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলল, সে একচুলও মিথ্যে বলছে না, তবেই না দুর্যোধন বিশ্বাস করল বিদুর কাকার ষড়যন্ত্রের কথা! তার তো রক্ত চলাচল বন্ধই হয়ে গিয়েছিল! অনুভূতির সবটুকুই লোপ পেয়ে গিয়েছিল তার। তার চোখ খোলা, কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না; কান খোলা, কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। সকল অনুভব-স্পন্দন জমে গিয়ে নিরেট বরফের মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল দুর্যোধন। ওই সময় পিতা না ডাকলে ওই বন্দিকক্ষেই দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ কেটে যেত তার।
বাবা আজ তাকে জিজ্ঞেস করছেন–আমাদের এখন কী করা উচিত? বাবা তাকে ভরসা করে বলেই তো এ রকম প্রশ্ন করছেন! দুর্যোধন ভাবল- বাবার সঙ্গে আরও কিছু কথা অসমাপ্ত থেকে গেছে তার। সে কথাগুলো বলে ফেলা দরকার। তারপর না হয় দুজনে মিলে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে।
গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিল দুর্যোধন। তারপর অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে বলতে শুরু করল, ‘বিদুর কাকার এই ষড়যন্ত্র যদি সার্থক হয়, মানে আপনাকে হটিয়ে যুধিষ্ঠির রাজা হয়, তা হলে আমাদের কী অবস্থা হবে, ভেবে দেখেছেন? সারাজীবন সন্তানদের নিয়ে পাণ্ডুপুত্রদের করুণার পাত্র হয়ে থাকবেন। আপনি আর মা হবেন রাজপ্রাসাদের অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আমরা শতভাই সবাই পাণ্ডবদের ক্রীতদাসে পরিণত হব।’
‘উফ্! আর বলো না দুর্যোধন! আমি আর সহ্য করতে পারছি না!’ দু-হাত দিয়ে মাথার দুদিকে চেপে ধরে বলে উঠল ধৃতরাষ্ট্র।
‘যতই অসহনীয় হোক আমার কথাগুলো, আপনাকে শুনতে হবে বাবা।’ বেদনাবিপন্ন চোখে ধৃতরাষ্ট্রের দিকে একবার তাকাল দুর্যোধন।
তারপর আবার বলল, ‘এখন বিদুর কাকা উৎকোচসেবী কিছু মানুষকে দিয়ে রাজ্যময় বলাচ্ছে—কুরুরাজ্যের লোকজন পাণ্ডবদের চায়। আপনাকে, এমনকি পিতামহ ভীষ্মকেও রাজা হিসেবে চায় না ওরা। আরও বলাচ্ছে- পাণ্ডু রাজা ছিলেন, যুধিষ্ঠির পাণ্ডুরাজার পুত্র। রাজার পুত্র রাজা হবে, সেটাই তো নিয়ম! বাবা, বিদুর কাকার ষড়যন্ত্রে এবং পিতামহের নির্বিকারত্বে আপনি রাজা হতে পারেননি। আপনি রাজা নন বলে, আমি বা আমার ভাইদের কেউই রাজা হতে পারব না। ভেবে দেখুন, প্রথমেই যদি আপনি রাজ্য পেতেন, তা হলে আজকে আমার যুবরাজ হওয়া বা পরবর্তীকালে রাজা হওয়া আটকাতে পারত না কেউ। আপনার সকল স্বপ্ন-সাধকে নস্যাৎ করে দিয়েছে ওই বিদুর কাকা।
ধৃতরাষ্ট্র এতক্ষণ ধরে দুর্যোধনের সকল কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল। তারপর বেদনামথিত গলায় বলল, ‘এতদিন আমি আঁধারে ছিলাম পুত্র। এখন আমার দুচোখ খুলে গেছে। যাকে দুধকলা খাইয়ে এত উঁচুতে স্থান দিলাম, সে নাকি আজ আমার মাথায় ছোবল মারল! দাঁড়াও, কাল আমি বিদুরকে বন্দি করে অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করছি।’
‘উঁহো উঁহো!’ দ্রুত বলে উঠল দুর্যোধন। ‘ভুলেও একাজ করবেন না বাবা। বিদুর কাকা হস্তিনাপুরের মানুষজনের কাছে ধর্মের অবতার। তার মতো সৎলোক ভূ-ভারতে নেই—কুরুরাজ্যের সাধারণ মানুষেরা এভাবেই জানে তাকে। শুধু সাধারণ লোকজন কেন, আপনার রাজসভার অনেক মন্ত্রী-উপমন্ত্রী-রাজন্যেরও বিশ্বাস – বিদুর একজন অত্যন্ত ছাপোষা মানুষ। ন্যায় ও সত্যের পক্ষের লোক সে। সে শুধু আপনার মঙ্গল চিন্তাই করে। আপনার ক্ষতি করার লোকই নয় বিদুর কাকা। সেই বিদুর কাকাকে যদি আপনি বন্দি করেন, তা হলে অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। তারা তো আর কাকার বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানে না! আর এই মুহূর্তে আপনি বিদুর কাকার আসল রূপ ওদের সামনে উদ্ঘাটন করতে পারবেন না। তার জন্য দীর্ঘসময়ের দরকার।’
‘তা হলে!’ ধৃতরাষ্ট্র বলল।
‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। কথায় আছে না–শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ, ঠিক ওই নীতিটাই অনুসরণ করতে হবে আমাদের।’
‘তোমার কথা বুঝে উঠতে পারলাম না পুত্র।’
‘বুঝিয়ে বলছি। তার আগে আপনি গোপন পরামর্শ সভায় প্রচারমন্ত্রী আর গুপ্তচরপ্রধানকে ডেকে পাঠান।
হাততালি দেওয়ার পর প্রহরী এলে ওই দুজনকে রাজার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিল ধৃতরাষ্ট্র।
দুর্যোধন বলল, ‘গুপ্তচরপ্রধানকে বলুন বিদুর কাকার ওপর কড়া নজর রাখতে। কখন কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে কী কথা হচ্ছে, তার সবটুকুই সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিন বাবা।’
ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘প্রচারমন্ত্রীকে কী জন্য ডাকালে পুত্র?’
‘বাবা, ওই যে বললাম — শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। আমাদের সঙ্গে বিদুর কাকা যেরকম আচরণের আয়োজন করেছে, আপনাকেও সেরকম ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রচারমন্ত্রীকে বলুন, রাজ্যের আনাচেকানাচে প্রজাদের দিয়ে এই বলে বেড়ানো শুরু করতে হবে — ধৃতরাষ্ট্র কুরুবংশের শ্রেষ্ঠতম রাজাদের একজন। তিনি সুশাসক, প্রজারঞ্জক। তাঁর প্রজাহিতৈষণা তুলনাহীন। ধৃতরাষ্ট্র আমাদের রাজা আছেন, থাকবেন। আর যুধিষ্ঠিরের পরিবর্তে দুর্যোধনকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ হিসেবে চাই আমরা।’
দুর্যোধনের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের অক্ষিগোলক প্রশান্তিতে স্থির হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর প্রশান্ত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি এ রকম করে ভাবলে দুর্যোধন!’
‘এ রকম করে ভাবতে আমাকে কে শেখাল জানেন বাবা?’
‘কে?’ উৎসুক কণ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের।
‘আপনার ভাই ক্ষত্তা বিদুরই আমাকে ওর মতো করে ভাবতে এবং করতে প্ররোচিত করল। ও হ্যাঁ বাবা, প্রজাদের মুখ দিয়ে ওসব কথা বলানোর জন্য রাজকোষ থেকে কিছু অর্থ আপনাকে খরচ করতে হবে কিন্তু।’
ধৃতরাষ্ট্রের সারা মুখজুড়ে কুটিল জটিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
চৌত্রিশ
পরদিন থেকে রাজধানী হস্তিনাপুরে এবং দিনপাঁচেকের মধ্যে সমস্ত কুরুরাজ্যজুড়ে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের পক্ষে প্রচারকার্য জোরেশোরে শুরু হয়ে গেল।
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বিকল্প নেই। পাণ্ডু রাজা ছিলেন, ঠিক আছে। কিন্তু রাজ্য চালিয়েছেন কে? আমাদের মহান নৃপতি ধৃতরাষ্ট্র তো! আরে, পাণ্ডু তো রাজা ছিলেন নামকাওয়াস্তে! সারাজীবনই তো রোগেশোকে ঝুঁকিয়ে যেতে দেখে গেলাম তাঁকে। অধিকাংশ সময় রাজসভায় অনুপস্থিত। তার ওপর বউদের নিয়ে বনে-অরণ্যে ঘুরে বেড়াতেন। প্রজাদের দিকে নজর ছিল নাকি তাঁর? কোনোদিন প্রজাদের সুখদুঃখের সাথি হয়েছেন পাণ্ডুরাজা? আজ কুরুরাজ্যজুড়ে এই যে শান্তি-শৃঙ্খলা-প্রাচুর্য—সবতাতেই তো মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অবদান! তাঁর কারণেই তো হস্তিনাপুর এত সমৃদ্ধিশালী! আর ওই যে যুধিষ্ঠির, যাকে পাণ্ডুরাজার পুত্র হিসেবে প্রচার করা হলো, ও যে আসলেই পাণ্ডুপুত্র, তার কোনো প্রমাণপত্র আছে? সবই তো বিদুরের বানানো কথা! ক্ষত্তার অপপ্রচারেই তো আজ যুধিষ্ঠির পাণ্ডুপুত্র! আসলে যুধিষ্ঠির যে কার ছেলে কে জানে বাপু! এই কথাগুলো যত্রতত্র উচ্চারিত হতে থাকল।
হাটে-বাজারে-গাঁয়ে-গঞ্জে-নাটমন্দিরে-বটতলায় মেলায়-উৎসবে—সবখানেই নিয়োজিত মানুষেরা কথাগুলো ছড়িয়ে দিতে লাগল। ছড়াতে ছড়াতে একদিন রাজসভায় আছড়ে পড়ল বার্তাসমূহ। বিদুর স্তব্ধ, ভীষ্ম হতবাক। কৃপাচার্য দ্রোণাচার্য কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। অন্যান্য মন্ত্রী এবং রাজসভার রাজন্যরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। সবচাইতে বেশি ম্রিয়মাণ যুবরাজ যুধিষ্ঠির।
পিতামহ ভীষ্ম বললেন, ‘এ কী শুনতে পাচ্ছি ধৃতরাষ্ট্র!’
ধৃতরাষ্ট্র কোমল মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী শুনতে পাচ্ছেন পিতামহ?’
‘এই যে অপপ্রচার!’ ভীষ্মের কণ্ঠে ক্রোধ কিনা বোঝা গেল না।
‘অপপ্রচার! কার বিরুদ্ধে?’
‘কার নয়, বলো—কাদের বিরুদ্ধে?’
‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না পিতামহ। খুলে বলুন!’
নিজেকে সংযত করলেন ভীষ্ম। বললেন, ‘তোমার রাজ্যজুড়ে বিদুর আর পাণ্ডুপুত্রদের বিরুদ্ধে জোর অপপ্রচার হচ্ছে। বিদুর আর যুধিষ্ঠিরের চরিত্রে কলঙ্কলেপন করা হচ্ছে।’
‘তাই নাকি পিতামহ? আমি তো শুনিনি! প্রচারমন্ত্রীকে এখনই তলব করে জেনে নিচ্ছি আমি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
দুর্যোধন আস্তে করে নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ততদিনে সে রাজসভায় বসতে শুরু করেছে। পিতাকে বলে যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের আসনের অদূরে নিজের আসনের ব্যবস্থা করে নিয়েছে দুর্যোধন।
দুর্যোধন বলল, ‘মহামান্য পিতামহ, আপনি বিদুর কাকা আর যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কথা শুনেছেন, তার আগে অনেকদিন ধরে যে পিতাশ্রী ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিরূপ কথাবার্তা প্রচার হচ্ছে, সেটা শোনেননি?’
‘ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে!’ পিতামহ কথাটা বললেন বটে, কিন্তু গলায় তেমন জোর আছে বলে মনে হলো না।
‘এ অপপ্রচার নয়, এ রীতিমতো রাজদ্রোহ। রাজদ্রোহের শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড—সবারই জানা।’ বলল দুর্যোধন।
বিদুর মিউ মিউ করে বলল, ‘এসব কী বলছ তুমি দুর্যোধন! কে আবার অপপ্রচার চালাবে! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে উৎখাত করতে চাইছে কে?’
ক্রূর হাসি হেসে দুর্যোধন বলল, ‘আমাদের হাতে প্রমাণ আছে কাকা।
তারপর সভাজনদের দিকে তাকিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে দুর্যোধন বলল, ‘আমরা দীপক নামের এক দলনেতাকে বন্দি করেছি। সে এই রাজপ্রাসাদের সকল ষড়যন্ত্রের কথা আমাদের কাছে স্বীকার করেছে। এই অপপ্রচারের পেছনে কে অর্থ ঢেলেছে, কে পিতাশ্রীকে উৎখাত করে রাজসিংহাসনে বসতে চায়, সবই আমাদের জানা হয়ে গেছে। ওদের বন্দি করবার অপেক্ষায় আছি। এই রাজসভায় সবার সামনে সেই ষড়যন্ত্রকারীদের সাবধান করে দিচ্ছি আমরা। সবারই প্রাণের দাম আছে।’
এই সময় ধৃতরাষ্ট্র ধমকে উঠল, ‘আহ্ দুর্যোধন! থাম তুমি।
তারপর কণ্ঠকে নরম করে বলল, ‘আমি পাণ্ডবদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি পিতামহ। কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ যদি রাজদ্রোহে ইন্ধন দেয়, তাকেও সাবধান হওয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি আমি।’
বিদুরের কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে তখন। চোখমুখ দেখার মতো। এই বুঝি আসন থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়বে সে।
‘আমাদের মধ্যে কেউ তোমার বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগাচ্ছে!’ বিমূঢ় কণ্ঠে বললেন পিতামহ।
‘হ্যাঁ, মহামান্য পিতামহ। এই কুরুরাজপ্রাসাদেরই একজন আমাদেরই খেয়ে-পরে আমাদেরই বিপক্ষে জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তুলছে। পিতাশ্রীর হয়ে আমিও তাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। রাজদ্রোহের পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না।’ বলল দুর্যোধন।
অন্য সময় হলে বয়োজ্যেষ্ঠদের কথার মধ্যে কথা বললে বিদুর-দ্রোণ কৃপাচার্য-কৃতবর্মা—এঁদের কেউ না কেউ দুর্যোধনকে তিরস্কার করতেন। কিন্তু আজ কেউ কিছু বললেন না। কীরকম হতমান দেখাল সবাইকে। সবাই ভাবছেন, দীপক নামের দলনেতাটি তাঁর নামটি বলেনি তো! কিন্তু যে প্রকৃত দোষী, সে কী এক অদ্ভুত মনোবলে নিজেকে গুছিয়ে নিল।
বিদুর মাথা সোজা করে এপাশ-ওপাশ তাকাল একবার। তারপর বলল, ‘আমরা সেই উস্কানিদাতার নামটি জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকলাম।’
হঠাৎ হা হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। তার জলদগম্ভীর কণ্ঠের হাসি আর থামতেই চায় না। গোটা রাজসভা গম গম করে উঠল। রাজাকে এরকম করে হাসতে আগে কেউ কোনোদিন দেখেনি।
পিতামহ অস্থির কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘তুমি ওভাবে হেসো না ধৃতরাষ্ট্র। ওরকম উন্মাদের মতো হেসো না। রাজার কণ্ঠে ওইরকম হাসি মানায় না পুত্র।’
পিতামহের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র হাসি থামাল। বলল, ‘আমি দুঃখিত পিতামহ। হঠাৎ হাসি পেল, তাই হাসলাম। এই হাসি আপনাদের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করেছে মানি, কিন্তু ওই হাসির মধ্য দিয়ে আমার ভেতরের জ্বালা-যন্ত্রণা এবং ভালোবাসা বের হয়ে গেল।
‘ভালোবাসা বের হয়ে গেল!’
‘হ্যাঁ পিতামহ। কারো কারো জন্য আমি আমার বুকের তলায় ঘনজমাটি এক ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছিলাম। আজ এই অট্টহাসির মাধ্যমে সেই ভালোবাসাটুকুকে ঝেঁটিয়ে বুকের মধ্যিখান থেকে বের করে দিতে পারলাম। এখন আমার পরম আনন্দ লাগছে পিতামহ।’
পিতামহের উদ্দেশে কথাগুলো বললেও ধৃতরাষ্ট্রের মুখটা ঘোরানো কিন্তু বিদুরের দিকে। অন্য মানুষ হলে মুখের রক্ত সরে যেত, চোখ বন্ধ করে ফেলত। কিন্তু বিদুরের ওরকম কিছুই হলো না। নিরুদ্বিগ্ন চোখমুখ নিয়ে নিজ আসনে স্বচ্ছন্দে বসে থাকল।
রাজার কন্ঠস্বর শোনা গেল আবার, ‘আজকের মতো রাজসভার কার্যক্রম এখানেই শেষ। আপনারা বিদায় গ্রহণ করুন।’
.
সবাই বিদায় নিলে পিতার অতি নিকটে সরে এলো দুর্যোধন। দুর্যোধনের মুখে হতাশার ছায়া। অনেকটা ভীতও সে। বিদুর-পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যে চালটা চেলেছেন মহারাজ, সে চাল থেকে সরে আসবেন না তো! সরে যে আসবেন, সেটা তো নিশ্চিত। পিতাশ্রীই তো বললেন, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার থামিয়ে দেবেন। যা মুখে বলেন বাবা, তাই-ই তো করেন! যদি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে এই কর্মকাণ্ড থামিয়ে দেন পিতা, তা হলে যে ওরা জিতে যাবে! না, কিছুতেই তা হতে দেবে না দুর্যোধন। যেকোনো প্রক্রিয়ায় বাবাকে থামিয়ে দিতে হবে। যদি না থামেন পিতাশ্রী! যদি আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন! হতাশা এবং ভয় দুর্যোধনকে আঁকড়ে ধরল।
ওই অবস্থাতেই পিতার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল দুর্যোধন।
জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাবা, সত্যি কি আপনি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার থামিয়ে দেবেন? তা হলে যে আমরা…।’
‘তোমার কী মনে হয় পুত্র? আমি কি আগের ধৃতরাষ্ট্র আছি বলে তোমার মনে হচ্ছে?’
ভেতরে জমে থাকা উষ্মা ফুঁ দিয়ে বের করে দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘বিদুর আমার সকল প্রকার সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছে। আমার সরলতার অবসান ঘটিয়েছে সে। আমার ভালোবাসাকে হত্যা করেছে। এখন আমি নিজেকে আর আমার পুত্রদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করি না, ভালোবাসি না। তুমি নিশ্চিন্ত থাক পুত্র, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে প্রচারণা বন্ধ হবে না কখনো। বরং আরও জোরদার হবে।’
দুর্যোধন আনন্দে বলে উঠল, ‘বাঁচালেন বাবা!’
পঁয়ত্রিশ
প্রচারমন্ত্রীকে ডেকে এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র রাজসভায় বলেছিল, সে ব্যবস্থা নিল না। উপরন্তু দুর্যোধনকে দায়িত্ব দিল, যাতে প্রচারে ভাটা না লাগে, তার তদারক করার জন্য।
দুর্যোধন পাণ্ডববিরোধী অপপ্রচারে ভাণ্ড ভাণ্ড ঘি ঢালতে শুরু করল।
বিদুর এবং পাণ্ডবরা অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু ওই প্রচারণার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারল না। একটা সময়ে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, যুধিষ্ঠির যুবরাজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হতে লাগল। যুধিষ্ঠিরের ভালোত্ব এবং ভীম-অর্জুনের শারীরিক শক্তির সবটাই ভেসে গেল প্ররোচিত জনগণের কুৎসার জোয়ারে। রাজপ্রাসাদের বাইরে বিদুরের পা দেওয়াটাই মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। আগে বিদুরকে দেখলে প্রজারা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠত—জয় মাননীয় বিদুরের জয়। এখন সমস্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে—ক্ষত্তা, ক্ষত্তা।
দুর্যোধনের চক্রান্তে বিদুর আর পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে বসবাসই হারাম হয়ে উঠল। প্রাসাদে এবং প্রাসাদের বাইরে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলল দুর্যোধন।
পাণ্ডবরা রাজসভায় এই বিষয়ে কথা তুলতে চাইলে বিদুর বাধা দিল। বলল, ‘পিতামহের মতো মানুষ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়ে পাননি। অধিকন্তু পিতা-পুত্র মিলে দু-কথা শুনিয়ে ছেড়েছেন। সেই ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়ে কোনো লাভ হবে না। আমাদের আরও একটু সাবধান হতে হবে। তোমরা ধৈর্য ধরো। আমাকে ভাবতে দাও।’
কুন্তী বলে উঠেছিল, ‘যা ভাবতে চাও, তাড়াতাড়ি ভাবো। আমার সন্তানরা যাতে কোনো বিপদে না পড়ে। ওদের রক্ষা করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার বিদুর।’ কুন্তীগৃহেই মন্ত্রণাসভা বসেছিল।
বিদুর বলেছিল, ‘আমি তো স্বেচ্ছায় এই দায়িত্বটা নিয়েছি বৌঠান। আপনার পুত্রদের বাঁচিয়ে রাখা আর তাদের সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার সকল দায় আমার বৌঠান। আমাদের জীবনে এখন সামান্য একটু ঝাপটা এসেছে, অচিরেই তা কাটিয়ে উঠব আমরা। অপেক্ষা করুন, দেখুন—যুধিষ্ঠিরদের কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যাই আমি।’
বিদুর কুন্তী এবং কুন্তীপুত্রদের যা-ই বলে আশ্বস্ত করুক না কেন, ঝাপটাটা একসময়ে ঝড়ে পরিণত করল দুর্যোধন। বিদুর-পাণ্ডবদের দৈনন্দিন জীবনে যতরকম সম্ভব বিঘ্ন তৈরি করে যেতে লাগল।
.
বহুদিন পর কণিককে ডেকে পাঠাল ধৃতরাষ্ট্র। গোপন কক্ষে। দুর্যোধনও থাকল সেখানে। এমন যে আপন মামা শকুনি এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্ণ, দুর্যোধন তাদেরও সঙ্গে রাখল না সেসময়। যা সিদ্ধান্ত, পিতা-পুত্রের। তৃতীয় কোনো পক্ষ অতিগোপন পরামর্শে উপস্থিত থাকা বাঞ্ছনীয় নয়-ভালো করেই জানে মহারাজা এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন।
কণিক মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কূটমন্ত্রী। করদ রাজাদের পদানত রাখার জন্য, রাজসভার মন্ত্রী-রাজন্যদের কব্জায় রাখার জন্য, আত্মীয়স্বজনদের দমিয়ে রাখার জন্য রাজাকে সময়ে সময়ে কূটনীতির আশ্রয় নিতে হয়। নইলে রাজসিংহাসন নিষ্কণ্টক থাকে না। এই জন্য চাই কুমন্ত্রণামন্ত্রী। এই মন্ত্রীর কাজ হলো প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার কৌশলগুলো রাজাকে বাতলে দেওয়া। বিচক্ষণ রাজাদের এ রকম একজন কূটমন্ত্রী থাকেই থাকে। ধৃতরাষ্ট্রেরও একজন ছিল। তার নাম কণিক। বহু বছর কূটবুদ্ধি জুগিয়ে আসছিল সে ধৃতরাষ্ট্রকে। কিন্তু একদা তাকে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছিল এবং তা হয়েছিল বিদুরেরই কুটিল চালে। কথায় বলে না- বাঘের ওপর ঘোগ আছে!
বিদুর তখন রাজসভায় ঠাঁই করে নিয়েছে। এমনিতেই তখন রাজ্যে বিদুরের খুব সুনাম! সজ্জন, সত্যবাদী, ধর্মপরায়ণ, পরোপকারী ইত্যাদি। তার নামে চারদিকে জয়জয়কার। ধৃতরাষ্ট্রের কানেও বিদুরের সততার কথা পৌঁছে গেছে তখন। তাই প্রীত হয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে দরবারে ডেকে নিয়েছিল।
কয়েকদিনের মধ্যেই বিদুর বুঝে গিয়েছিল—ওই কণিকই মহারাজার সবচাইতে কাছের লোক। মহারাজ কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কণিকের সঙ্গে আলাপ করে নেয়। সুতরাং মহারাজার কাছাকাছি যেতে হলে ওই কণিককে সরাতে হবে।
কাজ শুরু করে দিয়েছিল বিদুর। এমনিতেই সে মিষ্টভাষী, তার ওপর সৎস্বভাবের। এই দুটোকে পুঁজি করে ধৃতরাষ্ট্রের অতি নিকটে পৌঁছে যেতে পেরেছিল বিদুর। মহারাজার কান ভারী করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। রাজাকে কণিকের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে পেরেছিল একদিন। সেইদিনই কণিকের মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিয়েছিল ধৃতরাষ্ট্র। অনেকটা অপমান করেই রাজসভা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল কণিককে।
যাওয়ার সময় বয়োবৃদ্ধ কণিক সেই কূট হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে বলেছিল, ‘মনে হয় খুব ভালো করলেন না মহারাজ। ফাঁদে পড়লেন। এখন হয়তো বুঝছেন না, পরে বুঝবেন। তখন যদি প্রয়োজন হয়, ডাকবেন আমায়।’
উত্তেজিত কণ্ঠে রাজা হুঙ্কার দিয়েছিল, ‘বেরিয়ে যাও কণিক। বহু পরামর্শ দিয়েছ, আর দিয়ো না। ও হ্যাঁ, তোমার মতো কূটচালের লোককে আমার আর কোনোদিন দরকার হবে না।’
কণিক সেদিন আর দ্বিরুক্তি করেনি। আগের হাসিটা মুখ থেকে না মুছে মহারাজকে প্রণাম করে রাজদরবার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
বহু বছর পর, লজ্জার মাথা খেয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সেই কণিককে গোপন পরামর্শ কক্ষে ডেকে পাঠিয়েছে।
বুদ্ধিমান কণিক পূর্বের তিক্ততার কথা তুলল না।
বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী সমস্যা মহারাজ?’
পিতাশ্রীকে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার ক্লান্তি থেকে বাঁচানোর জন্য দুর্যোধনই কথা বলে উঠল। দুর্যোধন এখন পাকা যুবক। কথায় বিচক্ষণতা। প্রথমেই পিতার সেই দিনের আচরণের কথা তুলল দুর্যোধন। বিদুর কাকা যে পিতাশ্রীকে বিভ্রান্ত করেছে, তা বলল এবং সর্বশেষে কুরু-পাণ্ডবদের ভূগোল-ইতিহাস আগাগোড়া খুলে বলে গেল। বিদুরই যে মূল ঘুঁটিচালক— সবিস্তারে বলল।
সবশেষে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আপনি আমার পিতার আমল থেকেই কূটমন্ত্রী। বার্ধক্যের সঙ্গে বুদ্ধির অভিযোজনা হয়েছে আপনার মধ্যে। বিদুর আর পাণ্ডবরা মিলে আমাদের কাছ থেকে রাজ্য কেড়ে নিতে চায়। আমাদের ধ্বংস চায় ওরা। এই বিপদের সময়ে আমাদের করণীয় কী পরামর্শ দিন আপনি।’
‘একমাত্র আপনিই পারেন এই সংকট থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার উপায় নির্দেশ করতে।’ বিনীত কণ্ঠে বলল দুর্যোধন।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকল কণিক। তারপর মাথা তুলল। স্বভাবজাত কুটিল হাসিটা লেগে আছে তখন তার মুখে। ঘন চোখে মহারাজার দিকে একবার, দুর্যোধনের দিকে আরেকবার তাকাল। দুর্যোধনের মুখের ওপর নিজের চোখ দুটোকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখল। দেখল— দুর্যোধনের চোখেমুখে প্রতিহিংসার গনগনে আগুন। ক্রোধ, ঈর্ষা, অসহিষ্ণুতার ঝড় বয়ে যাচ্ছে দুর্যোধনের মুখমণ্ডলে। কণিকের হাসিটা আকর্ণ বিস্তৃত হলো। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে তো তেমন করে বোঝা যাচ্ছিল না! চোখই তো মানুষের ক্রোধ-ভালোবাসা-বিপন্নতা-বিপর্যয় প্রকাশের দর্পণ! সেই দর্পণই তো নেই মহারাজের! মুখমণ্ডলের রেখা- উপরেখা দিয়ে মানুষের ভেতরের আবেগ আর কতটুকুই-বা প্রকাশ হয়! কণিক তাই উপস্থিত দুজনের মনের প্রকৃত চিত্র খুঁজে ফিরছিল। দুর্যোধনে তা পেয়ে গেল কণিক। বুঝল—উভয়ের মনে পাণ্ডবদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সংকল্প এবং বিদুরের প্রতি সুতীব্র ঘৃণা।
নিজেকে প্রস্তুত করে নিল কণিক। তারপর মৃদু অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘রাজনীতির অপর নাম কূটনীতি। কূটনীতিতে বিশ্বাসের, সততার, ভ্রাতৃত্বের, সৌজন্যের কোনো ঠাঁই নেই। যে রাজা কূটনীতিতে যত দক্ষ, সেই রাজা ততই সার্থক। প্রজারঞ্জন, মহানুভবতা, সত্যপ্রিয়তা, মমতা—এসব একজন নৃপতির বাইরের পরিচয়। কিন্তু দুরভিসন্ধি, কূটনীতি একজন রাজার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। নইলে রাজ্য টিকানো সেই রাজার পক্ষে সম্ভব নয়। মহারাজ, আপনার মধ্যে কূটনীতির অভাব আছে। স্বজনপ্রিয়তা আপনাকে বিভোর করে রেখেছে।’
ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘খুলে বলুন কণিক। বুঝিয়ে বলুন।’
ছত্রিশ
‘তা হলে বলি। শুনুন মহারাজ। যুবরাজ দুর্যোধনকে বলছি- আপনিও শুনুন।’ কণিক বলল।
চমকে উঠল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। তাড়াতাড়ি বলল, ‘আপনি ভুল করলেন কণিক। দুর্যোধন হস্তিনাপুরের যুবরাজ নয়, সাধারণ রাজপুত্র।’
‘ভুল আমি করিনি মহারাজ। ভুল করেছেন আপনি। বিদুরদের চালে ভেঙে পড়েছেন। নিজপুত্রকে বাদ নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ ঘোষণা করছেন। আপনার এই ঘোষণা কি ভুল ছিল না? বিদুরের চালাকি ধরতে পারেননি আপনি। সেদিন যদি কূটনীতির আশ্রয় নিতেন আপনি, আজ এই সংকটে পড়তেন না।’
‘কূটনীতির আশ্রয়!’ অসহায় ভঙ্গিতে বলল মহারাজ।
‘হ্যাঁ, সেদিন যদি বিদুরের কাছে যুধিষ্ঠিরের জন্মঘটনাটা বিস্তারিত জানতে চাইতেন, আটকে যেত বিদুর। সঠিক উত্তর দিতে পারত না সে। তখন আপনি স্বচ্ছন্দে দুর্যোধনকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিতে পারতেন। বিদুরচক্র কী করত তখন? দু-চারদিন লম্ফঝম্প করত। তারপর ঠাণ্ডা হয়ে যেত। দুর্যোধন যুবরাজ হতেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকে আপনাদের দুজনকে এই সংকটে পড়তে হতো না।’ কূটবুদ্ধিপরায়ণ কণিক শান্ত কণ্ঠে বলে গেল।
দুর্যোধন বলল, ‘যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে! এখন মুক্তির পথ দেখান। পাণ্ডুপুত্রদের বিধ্বস্ত করবার মন্ত্র শিখিয়ে দিন।’
‘তার আগে একটা গল্প শুনতে হবে।’ একটুক্ষণ চুপ থাকল কণিক। গল্পটা নিজের ভিতর সাজিয়ে নিল।
তারপর বলতে শুরু করল, ‘গল্পটা একাদিক্রমে বলে যাব। নীরবে শুনবেন আপনারা। প্রশ্ন থাকলে গল্পশেষে করবেন।’ নিজের উত্তরীয়টা দিয়ে বৃদ্ধশরীরটা ভালো করে ঢেকে নিল কণিক।
‘এক বনে বাঘ, ইঁদুর, নেকড়ে আর নকুলের সঙ্গে এক শেয়াল বাস করত। সবার মধ্যে খুব সদ্ভাব। কেউ কারো ক্ষতি চায় না। শেয়াল সহজাতভাবে ধূর্ত আর স্বার্থপরায়ণ হলেও বন্ধুদের সামনে তা দেখায় না। নিঃস্বার্থপরতার জন্য সঙ্গীদের সবাই শেয়ালকে খুব পছন্দ করে। একদিন তারা সবাই ক্ষুধার্ত হলো। খাদ্য চাই। কিন্তু খাদ্য জোগাড় হবে কী করে? ওই সময় শেয়ালটি অদূরে বিচরণরত এক হরিণকে দেখতে পেল। হরিণটি ছিল বেগবান ও বলশীল। বাঘ হরিণকে শিকার করার জন্য প্রস্তুত হলো। শেয়াল বলল, বন্ধু, তুমি ওভাবে হরিণটিকে কব্জা করতে পারবে না। ওই হরিণটি যখন ঘুমে আচ্ছন্ন থাকবে, তখন ইঁদুর গিয়ে তার ধারাল দাঁত দিয়ে হরিণের খুরগুলো কেটে দিয়ে আসবে। এরপর তুমি হরিণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়। খুর হারিয়ে হরিণের তখন চলৎক্ষমতা থাকবে না। তোমার থাবায় হরিণের তখন প্রাণ যাবে।’ থামল একটু কণিক। বড় বড় শ্বাস ফেলল কয়েকটা। শরীরটা এখন আর কথা শুনতে চায় না। সামান্যতে নেতিয়ে পড়ে।
দম নিয়ে কণিক পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘শেয়ালের কূটবুদ্ধিমতে ইঁদুর গিয়ে নিদ্রামগ্ন হরিণের খুর কেটে দিয়ে এলো। খুরগুলো হারিয়ে পালাতে পারল না হরিণটি। ব্যাঘ্র তাকে হত্যা করল। খাওয়া শুরু করার আগমুহূর্তে শেয়াল সবাইকে বলল, এরকম মহাভোজ বহুদিন হয়নি আমাদের। তোমরা এক কাজ করো। ওই সরোবর থেকে স্নান করে এসো সবাই। আমি হরিণটিকে পাহারা দিই। শেয়ালের কথা বিশ্বাস করে সবাই স্নান করতে চলে গেল। স্নান সেরে প্রথমে ফিরে এলো বলবান ব্যাঘ্রটি। তখন শেয়ালটি গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। বন্ধুকে চিন্তাযুক্ত দেখে বাঘটি বিচলিত হলো। জিজ্ঞেস করল, শেয়ালভাই, তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? শেয়ালটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, দেখলে দেখলে বন্ধু, ইঁদুরটির কাণ্ড! তুমি আসার আগে ইঁদুরটি এসেছিল। এসেই কী বলল, জান? বলল, এই হরিণটি মেরেছি আমি। বাঘের বলকে ধিক্কার দিচ্ছি আমি। আজ আমারই বাহুবলের কারণে তোমাদের সকলের খাদ্য জুটল। তোমাকে কী বলব বন্ধু, ইঁদুরটির সে কী অহংকার! শুনে বাঘ তো খেপে আগুন! এই কথা ইঁদুরের? দেখাচ্ছি মজা। ক্রোধান্ধ ব্যাঘ্রটি শেয়ালকে বলল, এখন কোথায় সেই ইঁদুরের বাচ্চাটি। শেয়াল বলল, ওই তো ওইদিকেই গেল আবার। বলে সরোবরের বিপরীত দিকটা দেখিয়ে দিল। বাঘটি গলায় গরগর আওয়াজ তুলে সেদিকেই ছুটে গেল। একটু পরেই ফিরল ইঁদুরটি। ব্যস্তসমস্ত হয়ে শেয়াল বলে উঠল, প্রাণে বাঁচতে চাইলে এখনই পালাও তুমি। বাঘ তোমাকে মেরে ফেলবার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে।
কী কারণে বাঘ তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে—জিজ্ঞেস করবার ফুরসত পেল না ইঁদুরটি। প্রাণভয়ে সে পালিয়ে গেল। এর পর ফিরল নেকড়ে। নেকড়েকে দেখে শেয়াল কান্না জুড়ে দিল। বলল, ভাই নেকড়ে তোমার সঙ্গে কি বাঘের কোনোদিন মনোমালিন্য হয়েছিল? নেকড়ে জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছে? শেয়াল কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলল, কী হয়েছে তা তো জানি না! তবে বাঘটিকে বেশ মারমুখী দেখলাম। হাতের কাছে পেলে এখনই তোমাকে হত্যা করে। এরকম রাগতে আগে কখনো দেখিনি বাঘকে! শেয়ালের কথা শুনে নেকড়েটি ভীত ও সংকুচিত হয়ে পড়ল। প্রাণহাতে নিয়ে দৌড়ে পালাল সেও। এই অবসরে উপস্থিত হলো নকুলটি। নকুল শেয়ালের চেয়ে কমজোরী। নকুলের সামনে স্বমূর্তিধারণ করল জম্বুকটি। গা ঝাড়া দিয়ে বেজিটির সামনে দাঁড়িয়ে সরোষে বলল, ওরে বেজির বাচ্চা বেজি, এই দেখ সবাইকে নিজ বাহুবলে পরাস্ত করে মৃত হরিণটি সামনে নিয়ে বসেছি। তুই আমার খাবারে ভাগ বসাতে চাস? মরণে যদি তোর ভয় না থাকে, তা হলে সামনে এগিয়ে আয়। আগে তোকে খাই। তারপর না হয় মৃগমাংস খাব। নকুলটি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ওদেরকেই যদি তুমি পরাজিত করতে পার, তা হলে আমি তো কোন ছার! তুমিই সর্বাপেক্ষা বলবান। তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা নেই আমার। আমি চললাম। এই রকম মিথ্যাবাক্য আর কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে শৃগালটি পরম সুখে মৃগমাংস ভক্ষণ করল।’ বলা বন্ধ করল কণিক।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল তিনজনেই।
প্রথমে কথা বলল কণিক, ‘মহারাজ এবার বলুন—এই গল্পে শৃগাল কে, হরিণ কী?’
ধৃতরাষ্ট্র কোনো উত্তর দিতে পারল না। দুর্যোধন নিজের মধ্যে উত্তরগুলো খুঁজে ফিরতে লাগল।
কণিক বলল, ‘শেয়ালটি বিদুর। হস্তিনাপুর রাজ্যটিই হলো ধৃত মৃত হরিণটি। বিদুর নামের শেয়ালটি ঠিক একইভাবে আপনাদের হটিয়ে-তাড়িয়ে হস্তিনাপুরের রাজ্যাসনে যুধিষ্ঠিরকে বসাবার পথ পরিষ্কার করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে মহারাজ।’
ধৃতরাষ্ট্র হতভম্ব কণ্ঠে বলল, ‘বিদুরের এই পরিকল্পনা!’
কণিক বলল, ‘অপরাধ ক্ষমা করবেন মহারাজ, এই চুল, এই দাড়ি এমনি এমনি পাকেনি, বয়সে পেকেছে। আপনার পিতার আমল থেকে কূটমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে এসেছি আমি। বহু মানুষ দেখেছি, বহু বিচিত্র ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। বিদুরকে তো আমি আজকে দেখছি না! সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তাকে। বাইরে নিরীহ ধরনের, ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত চালাক। আপনি তাকে যদি ধূর্ত বলতে চান, আপত্তি করব না আমি।’
ধৃতরাষ্ট্রের ভেতরটা শক্ত হয়ে উঠল। ক্রোধ আর হিংসা তার চোখ-মুখ-মন আবৃত করে ফেলল। মনে মনে গর্জে উঠল মহারাজ, আর না, বিদুরের প্রতি কোনো প্রীতিভাব নয়, পাণ্ডুপুত্রদের প্রতি আর কোনো সহানুভূতি নয়।
কণিক যেন মহারাজার মনের ভাষা স্পষ্ট পড়তে পারল। দ্রুত বলে উঠল, ‘না না মহারাজ, আপনি যেভাবে ভাবছেন, সেরকম করে নয়। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না-এই পদ্ধতিতে আপনাকে এগোতে হবে। আপনার বাহিরটা থাকবে অত্যন্ত ঠাণ্ডা, সহানুভূতি আর ভালোবাসায় মোড়ানো। মনের কথা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।’
দুর্যোধন অবাক হয়ে কণিকের কথা শুনে যাচ্ছিল আর ভাবছিল মামা শকুনি এই কণিকের এক দাঁতের বুদ্ধি রাখে না। মামা যতই কূটবুদ্ধিপরায়ণ হোক না কেন, আরও বহু বহু বছর পরও কণিকের সমান হতে পারবে না।
কণিক আবার বলল, ‘এটা নিশ্চিত যে আপনাকে সিংহাসনচ্যুত করবার জন্য বিদুর চক্রান্তের নেতৃত্ব দিচ্ছে; তবে এটাও সত্য যে পিতামহ ভীষ্ম যতদিন আছেন, ততদিন প্রজাবিদ্রোহ ঘটিয়ে আপনাকে উৎখাত করা সাঁতার কেটে সমুদ্র অতিক্রম করার মতোই অসাধ্য ব্যাপার। এই মুহূর্তে যদি বিদুর এই রাজ্যের দখল নিতে চায়, তা হলে অন্য কোনো শক্তিমান রাজার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।’
‘অন্য রাজার সাহায্য নিয়ে উৎখাত করবে সে আমায়!’ ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল ধৃতরাষ্ট্র।
‘না না। সেটা এখন সম্ভব নয়। এটা বিদুরের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এই মুহূর্তে আপনার সামনে সে ভেজাবেড়াল হয়ে থাকবে। তবে এটা সত্য যে, আপনাকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। নইলে আপনার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল কণিক।
সাঁইত্রিশ
‘ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে! কৌরবদের? মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের?’ বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠল দুর্যোধন।
‘হ্যাঁ যুবরাজ। আমার অনুমান মিথ্যে হতে পারে না। আপনারা সতর্ক না হলে আগে যা বললাম, তার সবটাই ঘটবে এই রাজপ্রাসাদে, এই কুরুরাজ্যে।’
‘এখন আমাদের কী করা উচিত?’
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে অর্থাৎ মূল পরামর্শটি দেওয়ার আগে আরও কয়েকটি পরামর্শ দেওয়ার আছে আমার।’
‘আরও কয়েকটা পরামর্শ?
‘হ্যাঁ, মহারাজ। আমার আরও কয়েকটি কথা আপনাকে শুনতে হবে। তারপর মূল কথায় আসব আমি।’
‘বলুন।’ ধৃতরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বরে যুগপৎ উদ্বেগ ও ক্রোধ।
মশালের মৃদু আলো সারাকক্ষে। প্রহরীদের এই কক্ষের ধারেকাছে আসা নিষেধ। শুধু অতি বিশ্বস্ত একজন দেহরক্ষী সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে কক্ষটার ওপর কড়া নজর রেখে যাচ্ছে। একটা মক্ষিকাও তাদের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না।
কণিক নিজের আসনটিকে টেনে পিতা-পুত্রের আরও নিকটে নিয়ে এলো। তারপর কণ্ঠস্বরকে নিচুগ্রামে নামিয়ে কণিক বলল, ‘রাজনীতিতে আর যা-ই থাকুক, নীতি নামের কোনো বস্তু নেই—এটা মনে রাখবেন প্রথমেই।’
‘নীতি মানে সুনীতির কথাই কি বলছেন মাননীয়?’ দুর্যোধন জানতে চাইল।
কণিক বলল, ‘ঠিকই ধরেছেন যুবরাজ। মনে রাখবেন, তথাকথিত সুনীতি দ্বারা কোনোদিন কোনো রাজ্য চলেনি কখনো, চলতে পারেও না। রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতি মানে কূটনীতির মিশেল না ঘটালে রাজ্য পরিচালনা করা যায় না, সিংহাসন টিকানো মুশকিল হয়।’
ধৃতরাষ্ট্র হতাশ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এ বড় কঠিন ব্যাপার! মনুষ্যত্ব, সরলতা, বিশ্বাস—এগুলোর স্থান রাজনীতিতে নেই বলছেন আপনি?’
‘রাজনীতিতে এই মূল্যবোধগুলোর ঠাঁই নেই—এই কথা বলতে চাইছি না। তবে যা বলতে চাইছি, তা হলো এই মানবিক মূল্যবোধগুলোকে অবলম্বন করে রাজ্য চালাতে পারবেন না আপনি, শত্রুমুক্ত হতে পারবেন না মহারাজ।’
‘তা হলে!’ বলে উঠল দুর্যোধন।
‘বলছি।’ বলে একটু থামল কণিক। উত্তরীয়টা আবার ঠিক করে জড়িয়ে নিল গায়ে। কুঁজো শরীরে পট্টবস্ত্রের উত্তরীয়টা আটকে থাকতে চায় না। শুধু পিছলে পিছলে পড়ে যেতে চায়।
কণিক বলল, ‘একজন যথার্থ রাজার কী করা উচিত পর্যায়ক্রমে বলছি। একজন রাজার সর্বদা তেজ দেখানোর দরকার নেই। রাগকে বশে রাখবেন, প্রয়োজনে চণ্ডমূর্তি ধারণ করবেন। দ্বিতীয়ত, রাজকোষের কোনো তথ্যই প্রতিপক্ষকে জানানো যাবে না। প্রতিপক্ষ রাজভাণ্ডারের কোনো অনুসন্ধান যাতে নিতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তৃতীয়ত, একজন রাজা সবসময় শত্রুপক্ষের রন্ধ্র অন্বেষণ করে যাবেন।’
ধৃতরাষ্ট্র বলে উঠল, ‘আরও আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ মহারাজ, আছে। নিজের কোথায় কোথায় দুর্বলতা বা অক্ষমতা আছে, তা জেনে রাখবেন রাজা। শত্রু দুর্বল হলেও তাকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। আমি নই, আমার চেয়ে জ্ঞানী বিচক্ষণ কূটনীতিজ্ঞ উপদেশ দিয়ে গেছেন— যতক্ষণ পর্যন্ত না সময় ও সুযোগ আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত শত্রুকে কাঁধে বহন করবে। অতঃপর নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হলে কাঁধ থেকে ফেলে চূর্ণ করবে। ও হ্যাঁ, আরেকটি কথা আপনার সবিশেষভাবে মনে রাখা দরকার মহারাজ।’ বলে একেবারে চুপ মেরে গেল কণিক।
দুর্যোধন দ্রুত বলে উঠল, ‘কোন কথা! কোন কথাটি বিশেষভাবে মনে রাখার কথা বলছেন মাননীয়?
কণিক নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল, ‘শত্রুকে বধ করাই সর্বতোভাবে প্রশংসনীয়।’
দুর্যোধন কী একটা বলতে চাইল। কণিক ডান হাতটা তুলে কথা বলতে বারণ করল। হাত ইশারায় বলল, তার কথা এখনো শেষ হয়নি।
এই সময় ধৃতরাষ্ট্র ভেবে চলল, কণিকের এই সকল পরামর্শের সারমর্ম কী? এতদিন রাজ্যশাসন করল, রাজনীতি সম্পর্কে এভাবে তো চিন্তা করেনি কোনোদিন! ভাই-ভ্রাতৃত্ব, স্বজন-স্বজনপ্রীতি, প্রজা-প্রজারঞ্জন– এসবই তো ভেবে গেছে অবিরাম! এই যে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে আত্মীয়- পরিজনরা, তারা কোনোদিন তার ক্ষতি করতে উদ্যোগী হবে, চিন্তাই করেনি তো! আজ কণিকের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার এতদিনের বিশ্বাস টলে উঠেছে। মিথ্যে একটা আবেগের ওপর সে দাঁড়িয়ে ছিল এতদিন। বাস্তবতার সঙ্গে আবেগের কখনো সমন্বয় হয় না। আবেগ ঠুনকো মিথ্যে, বাস্তবতা নিরেট সত্য। বিদুরই সত্য, সে নিজে মিথ্যে।
এই সময় কণিকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আমার আরও দু-একটি কথা বাকি আছে। সেগুলো আপনাদের শোনাতে চাই। শত্রুকে প্রথমে অর্থদান করে, ভালোবেসে কাছে টেনে তারপর বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করতে হবে। মনে রাখবেন, একজন রাজা তখনই খ্যাতিমান হয়ে যান, যখন তিনি শত শত শত্রুকে বিনাদ্বিধায় হত্যা করেন। দণ্ডযোগ্য শত্রুকে কখনো ধনমানাদি দিয়ে অনুগ্রহ করতে নেই। যদি কোনো রাজা তা করেন, তা হলে নিজের মৃত্যুকে স্বাগত জানান এবং শেষকথা এই যে শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অল্প হলেও কখনো তাদের উপেক্ষা করতে নেই।’
স্তব্ধ বিস্ময়ে পিতা-পুত্র দুজনে কণিকের কথা শুনে গেল।
কণিক বলল, ‘আপনার শত্রুপক্ষ মাত্র ছয়জন—বিদুর এবং পঞ্চপাণ্ডব। আপনার সামরিক শক্তির কাছে এরা অতি তুচ্ছ। কিন্তু মনে রাখবেন, এই ছয়জন কালক্রমে ছয় অক্ষৌহিণী হতে পারে।
ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আপনি শেষ পরামর্শ দেবেন বলেছিলেন, সময় কি হয়েছে সেই পরামর্শ দেওয়ার?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’
‘তা হলে বলুন, কী করলে আমরা শত্রুমুক্ত হব? কী পদক্ষেপ নিলে আমাদের সকল অমঙ্গল কেটে যাবে?’
‘শত্রুপক্ষকে, সবাইকে না পারলে অন্তত অধিকাংশকে স্থানান্তরে পাঠান। অবস্থা বুঝে স্থানান্তরিতদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। এই সুযোগে রাজপ্রাসাদ গুছিয়ে নিন।’
‘আর কিছু?’ ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্ন করল।
‘আমার শেষ কথাগুলো ইঙ্গিতময়। শব্দের ভিতরে ভিন্ন অর্থ আছে। অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন মহারাজ।’
দুর্যোধন বলল, ‘আমি আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে বুঝে গেছি। কমজোরী শত্রুকেও বাঁচিয়ে রাখতে নেই।’
‘ঠিক বুঝেছেন যুবরাজ।’ বলল কণিক। ‘এখন ওদের স্থানান্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা নিন।’
দুর্যোধন এবার ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বলল, ‘পিতাশ্রী, আপনি যদি কিছুদিনের জন্য পাণ্ডবদের সপরিবারে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেন, তা হলে বিদ্রোহী জনগণকে ধনসম্পদ দিয়ে বশে নিয়ে আসতে পারব।’
‘কিন্তু কোথায় পাঠাব? কী বলে পাঠাব?’ হতাশ কণ্ঠে বলল ধৃতরাষ্ট্র।
‘আপনি ওদের বারণাবতে পাঠিয়ে দিন বাবা। অরণ্যময় অতীব মনোহারী জায়গা বারণাবত।’
‘কিন্তু কী বলে পাঠাব! কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ করে পাণ্ডুপুত্রদের বারণাবতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে নানা জনে প্রশ্ন করবে। বিশেষ করে বিদুর…।’
পিতার কথা শেষ করতে না দিয়ে দুর্যোধন বলল, ‘পিতামহকে গুণছেন না কেন বাবা? দেখবেন প্রস্তাব শুনে প্রথমেই যিনি প্রশ্ন করবেন, তিনি আর কেউ নন, আপনার পিতামহ ভীষ্ম।’
‘সেই প্রশ্নের কী উত্তর দেব আমি?’ ইতস্তত কণ্ঠে বলল ধৃতরাষ্ট্র।
দুর্যোধন বলল, ‘এই সময় বারণাবতে সুন্দর একটা মেলা হয়। অনেক মানুষের সমাগম হয় সেখানে। অরণ্যাঞ্চল বলে প্রচুর আদিবাসী আসে ওই মেলায়। এই মেলায় গেলে পাণ্ডবরা আমোদ পাবে খুব।’
ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আচ্ছা।’
কণিকের সারামুখে বিজয়ের আনন্দ-আভাস ছড়িয়ে পড়ল। আজ ধৃতরাষ্ট্রের সেদিনের অপমানের শোধ নিতে পারল সে। উঠে দাঁড়াল কণিক। বলল, ‘আমি যাচ্ছি মহারাজ।’
ধৃতরাষ্ট্রের মুখমণ্ডলে কৃতজ্ঞতার গভীর উপস্থিতি।
দুর্যোধন দূরে দাঁড়ানো রথ পর্যন্ত কণিকের সঙ্গে হেঁটে গেল।
আটত্রিশ
কণিকের এত কথার পরও ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিধা কাটতে চায় না।
কেন পাণ্ডুপুত্রদের দেশান্তরে পাঠাবে? বিদুরের কুমন্ত্রণায় সায় দিয়ে সামান্য অপরাধ হয়তো ভ্রাতুষ্পুত্ররা করেছে, তাই বলে সেই অপরাধের দণ্ড তো নির্বাসন হতে পারে না। দেশান্তরে কাউকে যদি পাঠাতেই হয়, তা হলে তো বিদুরকেই পাঠানো উচিত! সে-ই তো মূল হোতা! কিন্তু কূটমন্ত্রী কণিক বিদুরের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখালেন না। ইঙ্গিতে পাণ্ডবদেরই তো দেশান্তরে পাঠাতে বললেন! পাণ্ডুপুত্রদের তো তেমন জঘন্য অপরাধ দেখছে না সে! যুধিষ্ঠির যুবরাজ হিসেবে ভালোই তো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে! রাজ্যের খুঁটিনাটি সংবাদ পর্যন্ত আমাকে জানাচ্ছে, সকল ব্যাপারে আমার মতামত নিচ্ছে। তা হলে দায়িত্বশীল পাণ্ডুপুত্রদের ওপর এত বড় অবিচার করি কী করে! এসব সাতপাঁচ ভেবে যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র। আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দীর্ণ হচ্ছে।
কণিককে রথারোহণ করিয়ে পিতার কাছে ফিরে এলো দুর্যোধন। ফিরেই পিতাকে খুব চিন্তান্বিত দেখল সে। সিংহাসনে হেলান দিয়ে কীরকম অসহায় অবস্থায় বসে আছেন রাজা! শঙ্কায় দুর্যোধনের ভেতরটা যে একটু কেঁপে উঠল না, এমন নয়। বাবা কি কোনো কারণে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন? নাকি একটুক্ষণ আগে নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে চাইছেন পিতাশ্রী? দ্রুত ভেবে গেল দুর্যোধন। কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে বাবা আপনার? বেশ ত্রস্ত দেখাচ্ছে আপনাকে! ‘অস্থির অস্থির লাগছে আমার।’ ইতস্তত গলায় বলল ধৃতরাষ্ট্র।
‘কী ব্যাপারে অস্থিরতা আপনার পিতাশ্রী?’
‘পাণ্ডুপুত্রদের ব্যাপারে।’
‘ওদের ব্যাপারে আবার কীসের অস্থিরতা? অল্পক্ষণ আগে ওদের নিয়ে না একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন আপনি? ঠিক করলেন না ওদের বারণাবতে পাঠিয়ে দেবেন!’
‘সিদ্ধান্ত তো নিয়েছিলাম! কিন্তু এখন ভাবছি- ওঁরা কী বলবেন?
‘ওঁরা মানে কারা!’ অবাক হয়ে জানতে চাইল দুর্যোধন।
‘পিতামহ ভীষ্ম, অস্ত্রগুরু দ্রোণ-কৃপ। মন্ত্রী-সচিব, জনগণ—এঁদের অনেকেই তো যুধিষ্ঠিরকে সমর্থন করে, তার ভালো কাজের প্রশংসা করে! সেই প্রশংসিতদের দেশান্তরে পাঠাই কী করে দুর্যোধন?’
ভ্রাতুষ্পুত্রদের দেশ থেকে বিতাড়নের সিদ্ধান্তে এলেও মনের ইতস্ততা কিছুতেই কাটে না ধৃতরাষ্ট্রের। দুর্যোধন তো বলেই খালাস! কিন্তু ব্যাপারটা কি অতই সোজা? যুবরাজের সকল দায়িত্বভার সামলাচ্ছে যুধিষ্ঠির। অন্যান্য পাণ্ডুপুত্রের সহায়তাও তো কিছু কম নয়! এই অবস্থায় হঠাৎ করে তাদের বারণাবতে পাঠিয়ে দিলে ভীষ্ম কী বলবেন, দ্রোণ কী বলবেন, কৃপাচার্য কী বলবেন, বিদুরই-বা আবার কী জোট পাকাবে? তাঁরা তো পাণ্ডবদের এই নির্বাসন মেনে নেবেন না! হঠাৎ করে বারণাবতে পাঠানো তো নির্বাসনই!
কিন্তু পিতার এই দ্বিধাকে উড়িয়ে দিল দুর্যোধন। পিতার দ্বিধান্বিত কথা শুনে হতাশ হলো না। বয়স তার তুলনামূলকভাবে যতই কম হোক, কুরুবৃদ্ধদের চরিত্রপাঠের দক্ষতা তার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। পিতার সকল দুর্ভাবনার সমাধান সে সহজেই করে দিল।
পিতার ইতস্ততার উত্তরে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘আপনি শুধু শুধু কুরুবৃদ্ধদের নিয়ে চিন্তা করছেন পিতাশ্রী! আপনি তাদের পুরোপুরি চিনে উঠতে না পারলেও এই বয়সেই আমি তাদের চিনে ফেলেছি। আপনি পিতামহ ভীষ্মের কথা বললেন তো? আমি পিতামহকে নিয়ে ভাবি না। তিনি মধ্যস্থ মানুষ।’
‘মধ্যস্থ মানুষ মানে!’ ধৃতরাষ্ট্র বলল।
দুর্যোধন বলল, ‘মধ্যস্থ মানুষ মানে উদাসীন মানুষ। পিতা শান্তনু তাঁকে বঞ্চিত করার পর থেকে তাঁর মধ্যে উদাসীনতা ঢুকে গেছে। পরবর্তীকালে আপনার পিতামহী সত্যবতীর নানা স্বার্থপরতায় মহামান্য ভীষ্মের নির্লিপ্ততা আরও বেড়ে গেছে। এরপর তো আপনি তাঁকে দেখেই যাচ্ছেন! কী অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা আর বৈরাগ্যভাব তাঁকে গ্রাস করে চলেছে! তাছাড়া পিতামহ পাণ্ডব আর কৌরবদের সমান চোখে দেখেন। আপনি দেখে নেবেন পিতাশ্রী, পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানোর প্রস্তাব দিলে বিরোধিতা করবেন না তিনি, বরং নিস্পৃহ থাকবেন। শুনুন না, ভীমকে বিষ খাওয়ানোর ঘটনাটা যখন ঘটল, তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি পিতামহ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানোর সিদ্ধান্তেও উদাসীন থাকবেন তিনি।’
ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘আর অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য? তিনি তো বিরোধিতা করবেন!
শব্দ করে হেসে উঠল দুর্যোধন। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘দ্রোণাচার্যকে নিয়ে আমি চিন্তাই করি না বাবা।’
‘কেন, কেন তুমি দ্রোণাচার্যকে আমলে নিচ্ছ না দুর্যোধন?’ ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইল ধৃতরাষ্ট্র।
‘কারণ দ্রোণাচার্যের একমাত্র ছেলে অশ্বত্থামা পুরোপুরি আমার সঙ্গে আছে। অশ্বত্থামা আমার বড় বশীভূত বাবা। আমার কথার বাইরে একটা পদক্ষেপও দেয় না সে। পুত্রটিকে প্রাণের অধিক ভালোবাসেন গুরুদেব। সুতরাং পুত্র যেদিকে, পিতাও সেদিকে বাবা। এরপর তো কৃপাচার্য বিষয়ে জানতে চাইবেন আপনি?’
‘তাই তো! কৃপও তো পাণ্ডবদের সমর্থক! আমার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা তিনিও তো করতে পারেন!’ আমতা আমতা করে বলল মহারাজ।
‘বাবা! আবার আপনি ভুল করছেন! দ্রোণাচার্য আর কৃপাচার্যের মধ্যে সম্পর্ক কী? কৃপাচার্যের বোনকেই তো বিয়ে করেছেন দ্রোণাচার্য! এবং এই কৃপাচার্যের আপ্রাণ চেষ্টাতেই তো দ্রোণাচার্য রাজবাড়ির ছেলেদের অস্ত্রবিদ্যা শেখানোর কাজটি পেয়েছেন! এখন রাজসভায় যতই উচ্চাসনে বসুন না কেন, কৃপাচার্যের এককালের উপকারের কথা কিছুতেই বিস্মৃত হননি দ্রোণাচার্য। যথার্থ মর্যাদা দেন তিনি কৃপাচার্যকে। কৃপাচার্যও দ্রোণাচার্যকে অপার ভালোবাসেন। এই ভালোবাসায় কখনো টোল খেতে দেবেন না কৃপাচার্য। দ্রোণাচার্য যেদিকে থাকবেন, কৃপাচার্যের সমর্থনও থাকবে সেদিকে। অর্থাৎ কৃপাচার্যও আপনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন না।’ বলল দুর্যোধন।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হওয়ার কারণে তার মনুষ্যচরিত্র পাঠের মধ্যে ঘাটতি থেকে গিয়েছিল। কিন্তু চক্ষুষ্মান দুর্যোধনের সেই ঘাটতি ছিল না। চোখ দিয়ে সবাইকে দেখে সে, সবার মনের ভাষা পড়তেও পারে। সবারই মনের ভাব-অনুভব যে চোখেমুখে ফুটে ওঠে!
তাই অর্জিত অভিজ্ঞতার জায়গায় দাঁড়িয়ে চক্ষুষ্মান দুর্যোধন পিতার উদ্দেশে বলে, ‘কাকা বিদুর কি আপনার দুশ্চিন্তার বিষয় হতে পারে? কৌরব প্রাসাদের আশ্রিত সে। পরান্নভোজী। স্ত্রীপুত্র-পরিজন নিয়ে রাজপ্রাসাদের রাজকীয় এলাকায় দিব্যি বসবাস করে যাচ্ছে কাকা। আপনারই তো কৃপাশ্রয়ী সে! কিন্তু কাজ করে যাচ্ছে পাণ্ডুপুত্রদের পক্ষে! কতটুকু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল সে, মহারাজ পাণ্ডুর কাছ থেকে? কত বছরই-বা রাজত্ব করেছেন পাণ্ডু কাকা? সামান্য কয়েকটি বছরই তো! গোটাটা সময়জুড়ে ভারপ্রাপ্ত হয়ে হস্তিনাপুর শাসন করে গেলেন তো আপনি! আপনারই তো খেলো-পরলো বিদুর কাকা! কিন্তু শুরু করল আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! কী অদ্ভুত ব্যাপার না পিতাশ্রী?’
ধৃতরাষ্ট্র আর কী বলবে, চুপ করে থাকল।
ইত্যবসরে দুর্যোধন বলল, ‘পরাশ্রয়ী এই বিদুর কাকা যতই পাণ্ডবপক্ষপাতী হোক না কেন, সে নিজে একা কিছুই করতে পারবে না। আর মন্ত্রী-রাজন্যদের কথা বলছিলেন না? আমাকে তো নিজ চক্ষে দেখতে পাচ্ছেন না বাবা, দেখতে পেলে বুঝতেন, আপনার দুর্যোধন কী বলশালী, দুর্ধর্ষ আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আমার সামনে আপনার রাজসভার যত বড় মন্ত্রী বা রাজন্যই হোক না কেন, মাথা তুলে কথা বলবার সাহস করবেন না। আর জনগণ হলো অর্থের কাঙাল। অর্থ দ্বারা বশ না হলে চোখরাঙানিতে বশ হবে।’
‘বাঁচালে তুমি আমায় পুত্র। আমার সকল দুশ্চিন্তা কেটে গেল দুর্যোধন। তোমার কথায় বুঝতে পারছি এবং কূটমন্ত্রী কণিকের পরামর্শে অনুধাবন করতে পেরেছি, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ভাবাবেগ ত্যাগ করতে হবে, বাস্তববাদী হতে হবে আমায়। আমি পাণ্ডুপুত্রদের বারণাবতে পাঠানোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
দুর্যোধন প্রশান্তির হাসি হেসে বলল, ‘তা-ই করুন পিতাশ্রী।’
উনচল্লিশ
দুর্যোধনের অনুমান অনেকটাই সত্য হলো।
পাণ্ডুপুত্রদের বারণাবতে যাওয়ার প্রস্তাবে দ্রোণাচার্য নীরব থাকলেন। কৃপাচার্য তাঁকে অনুসরণ করলেন। বিদুর প্রথমে হতভম্ব হলো। পরে ঘন ঘন ভীষ্মের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। নিজে কিছু বলবার সাহস করল না। মন্ত্রী-রাজন্যদের দু-একজন কিছু একটা বলবার জন্য উসখুস করল। কিন্তু সেদিনের দুর্যোধন, প্রতিদিনের দুর্যোধন নয়। এক অপরিসীম ক্রোধ তাকে যেন ঘিরে রেখেছে! তার চোখেমুখে তারই প্রকাশ লক্ষিত হচ্ছে।
যুধিষ্ঠির নির্বাক। যুধিষ্ঠির অনেকটাই আত্মহারা।
পিতামহ ভীষ্ম বিষয়ে দুর্যোধনের অনুমান সত্য হয়নি। ধৃতরাষ্ট্রের প্রস্তাব শুনে নিজ আসনে শিরদাঁড়া সোজা করে বসলেন পিতামহ। বললেন, ‘এ কী বলছ তুমি ধৃতরাষ্ট্র! পাণ্ডুপুত্ররা এই হস্তিনাপুরে তো ভালোই আছে! নিজের কাজের জন্য প্রশংসা কুড়াচ্ছে যুধিষ্ঠির! এখন তো কুরুরাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে!’
পিতামহকে আর কথা বলার অবকাশ না দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বলে উঠল, ‘সেইজন্যই তো ভ্রাতুষ্পুত্রদের কিছুদিন অবকাশ যাপন করে আসবার জন্য বলছি। জীবনের অনেকটা বছর বনে-অরণ্যে খেয়ে না খেয়ে কাটিয়ে এসেছে বেচারারা। সুখের মুখ দেখেনি, ঐশ্বর্য উপভোগ করার সুযোগ পায়নি বাছারা। জানি, হস্তিনাপুরে যুধিষ্ঠিরের প্রয়োজন অপরিহার্য। কিন্তু আপনিই তো বললেন, রাজ্যজুড়ে এখন শান্তি আর স্বস্তি; তাই এই সুদিনগুলো অরণ্যনগর বারণাবতে কাটিয়ে আসার প্রস্তাব করেছি। আপনার কোনো আপত্তি আছে পিতামহ?’
‘না না। আমার আপত্তি থাকবে কেন? তোমার প্রস্তাব উত্তম প্রস্তাব। ব্যাপারটা পাণ্ডুপুত্ররা কীভাবে নেয় দেখো।’
এই সময় ওপরে তোলা বিদুরের দুটো হাত তার উরুর ওপর আছড়ে পড়ল। হাত দুটো মৃদু কাঁপছে। বিদুর খুব আশা করেছিল, মহারাজের প্রস্তাবে পিতামহ বাধা দেবেন। দাদার এই প্রস্তাবের পেছনে যে ক্রূর এক দুরভিসন্ধি আছে, তা পিতামহ অনুধাবন করে প্রস্তাবের বিরোধিতা করবেন। কিন্তু তা তিনি করলেন না। উপরন্তু সমর্থন করে বসলেন। ছেড়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরদের ওপর। মহারাজের প্রস্তাবকে অস্বীকার করার ক্ষমতা যুধিষ্ঠিরের নেই। নাহ, তাকে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতেই হবে। এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরদের বারণাবতে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। কোনো একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে। এই প্রস্তাবের পরিণতি নিশ্চয়ই পাণ্ডবদের অনুকূলে যাবে না।
আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেল বিদুর।
চট করে প্রচারমন্ত্রীকে কী একটা যেন ইশারা করল দুর্যোধন।
প্রচারমন্ত্রী চটজলদি দাঁড়িয়ে পড়ল। সভাজনকে সম্ভাষণ করে বলতে শুরু করল, ‘প্রচারমন্ত্রী আমি। কুরুরাজ্যের কোথায় কী দ্রষ্টব্য আছে, নখদর্পণে আমার। মহামান্য মহারাজ যে বারণাবতের কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত সুরম্য অঞ্চল। টিলাময়, অরণ্যঘেরা। ভ্রমণের জন্য বারণাবত অতি উৎকৃষ্ট স্থান। এই সুন্দর নগরীতে মাননীয় পাণ্ডবরা ভ্রমণে গেলে খুবই আনন্দ পাবেন। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তা হলে আমি বলব, বারণাবতের মতো এরকম মনোহারী স্থান কুরুসাম্রাজ্যে খুব বেশি নেই। ও হ্যাঁ, আরেকটি কথা, ভাগীরথী তার স্বচ্ছ জলধারা বুকে নিয়ে বারণাবতের অদূর দিয়ে বয়ে চলেছে।’
সভার চারদিক থেকে ধ্বনি উঠল— বাহবা বাহবা!
ওই বাহবা ধ্বনির মধ্যে বিদুরের প্রতিবাদ করার ইচ্ছে হারিয়ে গেল। হতোদ্যম হয়ে নিজ আসনে বসে পড়ল সে।
রাজসভায় সিদ্ধান্ত হয়ে গেল—আগামী কোনো এক শুভদিনে পাণ্ডুপুত্ররা মা কুন্তীকে নিয়ে বারণাবতের উদ্দেশে যাত্রা করবে। তাদের যাতায়াতের সকল সুব্যবস্থা সম্পন্ন করবে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। বারণাবতে সুরম্য সজ্জিত গৃহে থাকবার, অতি উত্তম খাবারদাবার সরবরাহের সকল দায়িত্ব পালন করবে কুরুরাজকোষ।
আবার দাঁড়াল প্রচারমন্ত্রী। বিনীতভাবে বলল, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। সামনের মাসের শেষ দিকে ওই অরণ্যনগরীতে একটা মেলা হয়। মূলত এটা আদিবাসীদের মেলা। প্রচুর মানুষের সমাগম হয় ওই মেলায়। প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে সবাই। নাচে-গানে নিজেদের উজাড় করে দেয় সকল অরণ্যবাসী। তখন মনে হয়, এ শুধু সুন্দরের মেলা, এ শুধু আনন্দের সম্মিলন।’ একটা আবেগের কবিতা পাঠ করে শেষ করল যেন প্রচারমন্ত্রী।
প্রচারমন্ত্রীর কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের ভেতরটা উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে উঠল। ফেলে আসা অরণ্যস্মৃতি তাকে বিভোর করে তুলল। প্রচারমন্ত্রীর প্রতিটি শব্দের মধ্যে তার ফেলে আসা অরণ্যজীবন কথা কয়ে উঠল।
উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠির আগ্রহভরে বলল, ‘বারণাবতে যেতে আমার আপত্তি নেই।’
সভায় আবার আনন্দধ্বনি উঠল।
বিদুর দু-হাতের দশ আঙুল দিয়ে নিজের ঊরু খামচে ধরল। পিতামহ ভীষ্মের কাছ থেকে কোনো বিরোধিতা না পেয়ে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে ছিল বিদুর। নিজে কিছু বলতে চাইলেও প্রচারমন্ত্রী কৌশলে তাকে বলতে দেয়নি। এটা যে সর্বাংশে দুর্যোধনের কৌশল, তা বুঝতে তিলমাত্র বিলম্ব হয়নি বিদুরের। বারণাবত যাওয়া মানে নির্বাসনে যাওয়া। মৃত্যুও হতে পারে সেখানে পাণ্ডবদের। এই আশঙ্কা প্রায়-বিপর্যস্ত করে ফেলল বিদুরকে। এখন একমাত্র ভরসা যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির যদি বারণাবতে যেতে রাজি না হয়, তা হলে রক্ষা পেল। বিদুর তাই পলকহীন চোখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু যুধিষ্ঠির একবারের জন্যও বিদুরের দিকে তাকাল না। তাকালে যেকোনো ইঙ্গিতে সম্মত না হওয়ার নির্দেশটি দেওয়া যেত। কিন্তু দুর্মতি হয়েছে যুধিষ্ঠিরের! তাকাল না তো তাকালই না! উপরন্তু দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলল – বারণাবতে যেতে আমার আপত্তি নেই। বাছা, তোমার আপত্তি নেই মানে, ভীম-অর্জুন-নকুল-সহদেব এমনকি তোমার মা কুন্তী বৌঠানেরও কোনো আপত্তি টিকবে না আর। নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে বিদুরের। রাগে-ক্ষোভে- অভিমানে চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসতে চাইছে।
এই সময় ধৃতরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। মহারাজ বলছেন, ‘বেশ তো যুধিষ্ঠির, কিছুদিন না হয় সবান্ধবে ও সপরিবারে বারণাবত থেকে ঘুরে এসো। পরম সুখ পাবে সেখানে। যখন ইচ্ছে জাগবে, আবার ফিরে এসো হস্তিনাপুরে।’
যুধিষ্ঠিরদের বারণাবতে পাঠানোর কথায় যারা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল, মহারাজের ‘আমোদ-আহ্লাদ শেষে কিছুদিনের মধ্যে ফিরে এসো’—এই কথার মধ্য দিয়ে তাদের সন্দেহ মুহূর্তেই মুছে গেল।
আর সবাই নিঃসন্দিগ্ধ হলেও বিদুর কিন্তু সন্দেহমুক্ত হলো না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলছে-বারণাবতে নিশ্চয়ই হৃদয়বিদারক কিছু একটা ঘটবে।
রাজসভা সেদিনের মতো সমাপ্ত হয়েছিল।
যুধিষ্ঠিরের বারণাবতে যাওয়ার সম্মতিতে দুর্যোধন কূটকৌশলের সরণিতে দশ কদম এগিয়ে গেল।
এক রাতে নিভৃত কক্ষে পুরোচনকে ডেকে পাঠাল দুর্যোধন।
পুরোচন ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। শিল্প ও গৃহায়ন মন্ত্রণালয় পুরোচনের অধীনে। পুরোচন দুর্যোধনের অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
পুরোচন এলে দুর্যোধন বলল, ‘আপনি একজন শিল্পকর্মবিশারদ। গৃহনির্মাণের সকল বিদ্যা আপনার অধিগত।’ বলে একটু থামল দুর্যোধন।
তারপর বলল, ‘আপনাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে।’
‘কী দায়িত্ব?’ পুরোচন জানতে চাইল।
‘তার আগে শপথ নিতে হবে, আমাদের আজকের আলোচনা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কানে যাবে না কখনো।’
‘এই শপথ অনেক আগেই আমার নেওয়া আছে রাজপুত্র। আপনার পিতাশ্রীর একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী আমি।’
‘আমিও আপনাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করি।’
‘আমি কখনো আপনার বিশ্বাসকে অপমান করব না। আপনার যদি গোপনীয় কিছু বলার থাকে নির্বিঘ্নে বলুন।
দুর্যোধন বলল, ‘বেশ কিছুদিন ধরে কাকা বিদুর পাণ্ডবদের নিয়ে পিতাশ্রীকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অনেক চেষ্টার পরও কাকাকে সংযত করা যাচ্ছে না। বহিরাগত পাণ্ডুপুত্রদের খেপিয়ে তুলছে দিন দিন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই হস্তিনাপুরে হয় পাণ্ডবরা থাকবে, নয় থাকবেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজসিংহাসনে কার থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?’
‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের।’ কালবিলম্ব না করে বলল পুরোচন।
‘পিতাশ্রীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছি আমি। পাণ্ডুপুত্রদের অরণ্যনগর বারণাবতে পাঠানো হচ্ছে। আপনি ওখানে একটি সুরম্য গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা নিন। এমনভাবে গৃহটি নির্মাণ করবেন, যাতে অগ্নির অল্প একটু সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে।’
একেবারেই নির্বিকারচিত্তে দুর্যোধনের কথা শুনে গেল পুরোচন। তাকে দেখে মনে হলো না যে সে অবাক হয়েছে।
এরপর দুর্যোধন সবিস্তারে বারণাবতের প্রত্যন্ত এলাকায় লাক্ষাগৃহ বানাবার পরিকল্পনা ছক কষে দিল। দাহ্যপদার্থ কীভাবে গৃহসামগ্রীর সঙ্গে মিশেল দিতে হবে এবং পরিশেষে কীভাবে ওই জতুগৃহে আগুন লাগাতে হবে, তাও পুরোচনকে বলে দিল দুর্যোধন।
কম কথার মানুষ পুরোচন। সংক্ষেপে বলল, ‘আপনার নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হবে রাজপুত্র।’
জতুগৃহ-সংক্রান্ত ব্যাপারটি দুর্যোধন সযত্নে পিতার কাছে গোপন রাখল।