বিশ
রাজ্যজয়, প্রজারঞ্জন, সামরিক শক্তিবৃদ্ধি, অমাত্যদের বশে রাখা—এসব রাজগুণ।
এ ছাড়া আর একটা রাজগুণ আছে। প্রথমদিকের গুণগুলো যেকোনো রাজা চাইলে অর্জন করতে পারেন, কিন্তু শেষেরটা সব নৃপতির আয়ত্তাধীন নয়। এ বড় জটিল গুণ! সে গুণটি হলো — রাজা যা ভাবছেন অথবা করবেন বলে ঠিক করেছেন, তা চেহারায় প্রকট হতে না-দেওয়া। এই এত অল্প বয়সে দুর্যোধন এই গুণটি আয়ত্ত করে ফেলেছে। দুর্যোধন যেটা করতে চাইছে, তা তার চেহারায় ধরা পড়ছে না। ধরা পড়ছে না তার চোখমুখ-ভ্রূকুটির ভাষায়, অপাঙ্গে, ইঙ্গিতে। এমনকি ধরা পড়ছে না হাতপায়ের বিক্ষেপেও। অত্যন্ত চতুরতায় সে তার ঈন্সিত কাজটি করে গেল।
ভীম ক্লান্তিহীনভাবে খেয়ে গেল সকল খাবার।
খাওয়া শেষে খেলা শুরু হলো—প্রথমে স্থলক্রীড়া। নানারকম খেলায় মগ্ন হলো কৌরব-পাণ্ডবরা। শরীরিক শ্রমের খেলা, মগজের খেলা। শারীরিক শক্তির খেলা যেগুলো, সেগুলোতে পাণ্ডবরা এগিয়ে থাকল। ভীমের জন্যই এগিয়ে থাকল তারা। ভীমের মত্ত হাতির শক্তির জন্যই এগিয়ে থাকল। কিন্তু বুদ্ধির খেলাগুলোতে পাণ্ডবরা তেমন সুবিধা করতে পারল না। বুদ্ধিতে এবং চাতুর্যে দুর্যোধন সবার সেরা। পাণ্ডবরা শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হলো যে বিচক্ষণতায় দুর্যোধন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
স্থলভাগের খেলায় সবাই যখন ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল, প্রস্তাব হলো— এবার জলক্রীড়া শুরু করা যাক। ভীমই দিল প্রস্তাবটা। প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুপঝাপ করে সবাই গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাড়ে যে বটবৃক্ষটি ছিল এবং যার শাখা-প্রশাখা গঙ্গার বেশ দূর পর্যন্ত বিস্তারিত, সেই শাখা-প্রশাখা থেকেই অধিকাংশ কৌরব-পাণ্ডব গঙ্গাজলে ঝাঁপ দিতে লাগল।
তারপর সে কী কলরোল-উতরোল! গঙ্গার জল তোলপাড়। কৌরব-পাণ্ডবদের জলমত্ততায় গঙ্গার ওই অংশের জলের প্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। ভীমই এই জলক্রীড়ার প্রধান কুশীলব। জল দেখলেই তার মতিভ্রম হয়। ডুব-সাঁতারের প্রবল প্রবৃত্তি জেগে ওঠে তখন তার। জল তাকে খেপা করে ছাড়ে। জলে লাফাতে ঝাঁপাতে গায়ের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে এলো ভীমের। একসময় সে জলের কাছে হার মানল। শ্রান্ত-ক্লান্ত শরীরটাকে কোনোরকমে গঙ্গাপাড়ে টেনে তুলল ভীম। তারপর শীতল বাতাসে গা এলিয়ে দিল। কখন নিদ্রা তাকে আচ্ছন্ন করেছে, টের পেল না। বিষের ক্রিয়া তখন শুরু হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। রাজপ্রাসাদে ফেরার সময় হয়ে গেছে। যে যার শিবিরে ফিরে গেছে। প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেছে সবাই। এই ব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে ছাড়া অন্য কারও দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত পেল না কেউ। কে কোথায় আছে, তারও সন্ধান নিল না কেউ। সবাই নিজের নিজের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকল।
এই সুযোগ আর সময়টার অপেক্ষায় ছিল দুর্যোধন। গুটিগুটি পায়ে ভীমের দিকে এগিয়ে গেল সে। কাছে গিয়ে দেখল— ভীম বিষক্রিয়ায় নিশ্চেষ্ট। নাকের কাছে হাত নিল দুর্যোধন। অতি মৃদুলয়ে ভীম নিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছে। গায়ে হাত দিল। ভীমের কোনো চেতনা নেই। নিথর-নিশ্চল ভীম।
দুর্যোধন কয়েক কদম এগিয়ে গেল। অল্পসময়ের মধ্যে শক্ত লতার দড়ি হাতে ফিরে এলো দুর্যোধন। আগেই লতার দড়ি গোপন স্থানটিতে লুকিয়ে রেখেছিল সে।
ওই লতার দড়িতে ভীমের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলল দুর্যোধন। তারপর গঙ্গার জলে ঝপাং করে ফেলে দিল ভীমের অবশ নিশ্চেষ্ট দেহটি। গঙ্গা তখন আপনমনে আপন নিয়মে বয়ে চলেছে। সম্পূর্ণ কাজটি লোকচক্ষুর অন্তরালেই সংঘটিত হলো। কী করে লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিতে হয়, দুর্যোধন জানে। সে যে কূটবুদ্ধিতে পাণ্ডব-কৌরব ভাইদের মধ্যে অনেক এগিয়ে!
প্রস্তুতি শেষে সবাই সবার রথে উঠে পড়েছে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা রথের ব্যবস্থা। রাজপুত্র বলে কথা! সবাই ক্লান্ত। সবার শরীর বিশ্রাম চাইছে। কোনোরকমে রাজপ্রাসাদে পৌঁছতে পারলে আরাম মিলবে। তাই রাজপ্রাসাদে ফিরবার জন্য সবাই তৎপর হলো। এই তৎপরতার মধ্যে কে কোথায় আছে, সবাই সবার রথে চড়ল কিনা—এসবের খোঁজ নিল না কেউ। কারণ সবাই জানে–প্রত্যেকে এখানে নিরাপদ। এখন না দেখলেও প্রাসাদে গিয়ে সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, এই বিশ্বাসে রওনা দিল সবাই।
ভীম যে রথে চড়েনি, তাকে যে অনেকক্ষণ দেখা যাচ্ছে না–এ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পেল না যুধিষ্ঠিররা। দুর্যোধনের হাতের কাজ একেবারে নিখুঁত ছিল, অবিশ্বাসের কোনো রন্ধ্রপথ খোলা রাখেনি দুর্যোধন।
অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের রথ পাশাপাশি চলছিল।
অর্জুন চিন্তান্বিত কণ্ঠে হঠাৎ বলল, ‘বহুক্ষণ হলো মেজদা ভীমকে দেখছি না। তুমি কি তাকে দেখেছ দাদা?’
যুধিষ্ঠির নির্বিঘ্ন কণ্ঠে বলল, ‘না, ভীমকে দেখিনি অনেকক্ষণ। তবে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। ‘ ‘মেজদাকে দেখছি না তো! তাই চিন্তা হচ্ছে তার জন্য!’
‘আরে অর্জুন! তুমি এরকম ব্যাকুল হয়ে উঠলে কেন? ভীমের ক্ষতি করবে, এমন লোক আছে নাকি? তুমি অনর্থক চিন্তা করছ। আছে হয়তো পেছন দিকে! কৌরবদের সঙ্গে খোশগল্প করতে করতে এগোচ্ছে হয়তো!’
এই সময় নকুল রথ ছুটিয়ে যুধিষ্ঠিরের পাশে এলো। উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘দাদা, ভীমদাকে দেখছি না কোথাও। তোমরা কি দেখেছ?’ অর্জুনের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করল নকুল।
অর্জুন বলল, ‘পেছন দিকে মেজদা নেই!’
‘না তো! আমি তো দলের একেবারে পেছন থেকেই রথ ছুটিয়ে এলাম! কোথাও তো দাদা ভীমকে দেখলাম না।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল নকুল।
রথের গতি কমাতে সারথিকে নির্দেশ দিয়ে অর্জুন বলল, ‘এখন কী করবে দাদা! মেজদার কোনো অমঙ্গল হলো না তো!’
‘আরে না না! ভীমের অমঙ্গল হবে কেন? তুমি এত উতলা হয়ো না অর্জুন। ভীমের কোনো অমঙ্গল হয়নি। দেখো গে এতক্ষণে ভীম হয়তো রাজপ্রাসাদে পৌঁছে গেছে! তার মতিগতির তো কোনো ঠিকঠিকানা নেই! হয়তো রোখ চেপেছে সবার আগে বাড়ি পৌঁছবার। দ্রুত রথ ছুটিয়ে দিল! তুমি একদম চিন্তা করো না ভীমের জন্য। তোমার রথের গতি বাড়িয়ে দাও।’ বলল যুধিষ্ঠির।
কিন্তু বাড়ি ফিরে যুধিষ্ঠিররা জানল, ভীম বাড়ি ফেরেনি।
যুধিষ্ঠির কুন্তীকে লক্ষ করে বলল, ‘মা, তুমি ঠিক বলছ তো, ভীম বাড়ি ফেরেনি!’
উৎকণ্ঠিত গলায় কুন্তী বলল, ‘সেই সন্ধ্যার আগ থেকে তোমাদের পথ চেয়ে বসে আছি। দরজা খোলা রেখে যতদূর চোখ যায়, চেয়ে আছি। চোখের পলক ফেলিনি। ভীম এলে আমার চোখে পড়ত না? আর কোথাও থেকে ফিরে সে তো প্রথমেই আমার সঙ্গে দেখা করে! কী হলো আমার ভীমের! অ যুধিষ্ঠির তুমি খোঁজ নাও না বৃকোদরের! মায়ের কণ্ঠ উদ্বেগে বুজে আসতে চাইল।
যুধিষ্ঠির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মনে মনে কিছু একটা স্থির করল সে। তার পর অর্জুন-নকুল-সহদেবকে ডেকে জড়ো করল। মাকেও রাখল কাছে।
বেশ নিচু গলায় সবাইকে উদ্দেশ করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমাদের বেশ বড় একটা অমঙ্গল ঘটে গেছে!’
কুন্তী হাহাকার করে উঠতে চাইলে যুধিষ্ঠির চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘মা, এখন আর্তনাদ করার সময় নয়। এখন ধৈর্যের সময়। এখন বিপদ মোকাবিলা করার সময়। এই সময় উচাটন-হাহাকারে জড়িয়ে পড়লে ভবিষ্য-পরিকল্পনায় ভুল হয়ে যাবে আমাদের।’
অর্জুন বলল, ‘ভবিষ্য-পরিকল্পনা! তুমি কি মনে করছ মেজদার সমূহক্ষতি হয়েছে?’
‘তা-ই মনে হচ্ছে আমার। ভীমকে হত্যা অথবা নিখোঁজ করা হয়েছে। কে বা কারা করতে পারে, অনুমান করতে পারছি আমি। তবে এই মুহূর্তে অপরাধীর সন্ধান না করে ভীমকে আগে খুঁজে বের করা দরকার।
কুন্তী আবার আর্তনাদ করে উঠতে চাইল। যুধিষ্ঠির মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা, চুপ চুপ। ভীমের নিখোঁজের কথাটা অন্যকে জানানো যাবে না। এমনকি জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রকেও নয়।’
অবাক বিস্ময়ে কুন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকেও জানাতে চাইছ না যুধিষ্ঠির? চারদিকে সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে ভীমকে উদ্ধার করে আনা তো তাঁর পক্ষেই সম্ভব!’
যুধিষ্ঠির এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘না মা, জ্যেষ্ঠতাতকে তুমি যা ভাবো, আসলে তিনি তা নন। আমাদের মিত্র ভাবেন না তিনি। আমাদের যত অনিষ্ট, জ্যেষ্ঠতাতের তত স্বস্তি।’
একুশ
‘স্বস্তি! এসব কী বলছ তুমি যুধিষ্ঠির!’ কুন্তীর অক্ষিগোলক বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
‘হ্যাঁ মা। আমি ভুল বলছি না। আমার বয়স কম হতে পারে, জীবনের অনেকটা সময় আমার রাজপ্রাসাদের বাইরে কাটতে পারে, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে এই কুরুরাজপ্রাসাদের মতিগতি অনেকটাই বুঝে ফেলেছি আমি মা।’ মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলে গেল যুধিষ্ঠির।
কুন্তী ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘তোমার কথার সবটুকু আমি বুঝতে পারছি না যুধিষ্ঠির! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সম্পর্কে কীসের ইঙ্গিত দিতে চাইছ তুমি?’
‘সব কিছু খুলে বলার সময় হয়নি মা এখনো। আর এই মুহূর্তটা খুলে বলার সময়ও নয়। এখন মস্তবড় সংকট মা। সেই সংকট থেকে আগে মুক্তি পেতে হবে আমাদের। তার পর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় বসব আমরা।’ বলল যুধিষ্ঠির।
অর্জুন অধীর কণ্ঠে বলল, ‘এখন আমাদের কী করা উচিত দাদা? দাদা ভীমের জন্য আমার খুব শঙ্কা হচ্ছে!’
নকুল-সহদেবও একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমাদেরও খুব ভয় লাগছে দাদা। ভীমদাদার কোনো অমঙ্গল হলো না তো?’
যুধিষ্ঠির হাত-ইশারায় সবাইকে আরও কাছাকাছি হতে বলল। তার পর অত্যন্ত চাপা কণ্ঠে বলল, ‘জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রকে ভীমের নিখোঁজের সংবাদটি জানানো যাবে না। আমাদের এমন অভিনয় করে যেতে হবে যেন ভীম ঘরেই আছে।’
‘তার পর!’ উদগ্রীব অর্জুন বলল।
‘এটা যে আমাদের অভিনয় কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। বাইরে থেকে সবাই যাতে বোঝেন, আমরা অত্যন্ত স্বস্তিতে আছি।’
‘এর পর?’ অর্জুন আবার জানতে চাইল।
যুধিষ্ঠির অর্জুন-সহদেব-নকুলকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তোমরা ভীমের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো। ঘোড়া নিয়ে বেরোবে। কেউ যাতে টের না পায়। প্রথমে প্রমাণকোটিতে যাবে। তন্নতন্ন করে খুঁজবে ভীমকে।’
দ্রুত বেরিয়ে পড়ল ওরা। আর যুধিষ্ঠির বেরোল বিদুরের বাসস্থানের উদ্দেশে।
অল্পক্ষণের মধ্যে যুধিষ্ঠির বিদুরকে নিয়ে ফিরে এলো।
বিদুরের সামনে ভেঙে পড়ল কুন্তী। এই লোকটিকে সবচেয়ে আপন বলে মনে হয় তার। এই রাজপ্রাসাদে আসার পর থেকে এই লোকটি তাদের মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া বিস্তার করে আছে। বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে যখন প্রথম কুরুরাজপ্রাসাদে এসেছিল, তখন অনেকের মধ্যে এই বিদুরকেই তার বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল। পরে পরে প্রাসাদীয় বৃত্তান্ত শুনেছে সে। জেনেছে, বিদুর সম্পর্কে তার দেবর হয়। কিন্তু রাজরক্ত তার শরীরে নেই। দাসীপুত্র বিদুর। বাপ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন হলেও মা কোনো রাজবধূ নয়, সামান্য এক শূদ্রাণী দাসী। তাই বিদুরের কোনো দাম নেই এই রাজপ্রাসাদে। কোনো স্থান নেই মূল রাজমহলে। সেই সময়েই বিদুর স্থান করে নিয়েছিল কুন্তীর অন্তরাসনে।
আজ সেই বিদুরকে সামনে দেখে বড় ভরসা পেল কুন্তী। বিদুরের দুহাত জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আমার ভীমকে পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি যেভাবে পার আমার ভীমকে আমার কাছে এনে দাও বিদুর।’
বিদুরের মাথা অত্যন্ত ঠাণ্ডা। চিন্তাশক্তি সূক্ষ্ম। বিপদে অস্থির না হওয়া বিদুরের বড় গুণ। এ রকম বিপদেও স্থির থাকল বিদুর।
শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’ প্রশ্নটা যুধিষ্ঠিরকেই করল বিদুর।
প্রমাণকোটিতে জলক্রীড়ার ব্যবস্থা থেকে প্রচুর খাবারদাবারের আয়োজন, ওখানে যাওয়ার জন্য দুর্যোধনের অত্যাগ্রহ এবং শেষে তড়িঘড়ি করে তাদের রাজপ্রাসাদে ফিরে আসা — আদ্যোপান্ত সবই খুলে বলল যুধিষ্ঠির।
শুনতে শুনতে বিদুরের চোখ চিকন হয়ে এলো।
এই সময় কুন্তী অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমার কিন্তু দুর্যোধনকেই সন্দেহ হয়।’
চট করে কুন্তীর দিকে ফিরল বিদুর। জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, কেন আপনার দুর্যোধনকে সন্দেহ হয় বৌঠান?’
এবার কণ্ঠকে জলে ভিজিয়ে কুন্তী বলল, ‘দুর্যোধন অত্যন্ত নৃশংস। বখেযাওয়া ছেলে সে। রাজপ্রাসাদে আসার পর থেকে দেখছি—দুর্যোধন কারও কথা শোনে না, বয়োজ্যেষ্ঠদের মান্য করে না। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাকে ভীষণ প্রশ্রয় দেন। তাঁর প্রশ্রয়ে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে দুর্যোধন। ওর মনটা যেমন ছোট, ব্যবহারও অসহনীয়। গর্হিত কোনো কাজ করতে সে দ্বিধা করে না। লজ্জাশরমও তার মধ্যে দেখিনি আমি।’ না থেমে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল কুন্তী।
‘মা মা, থাক এসব কথা এখন। এই মুহূর্তে আমাদের বড় বিপদ। এই বিপদ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেই চেষ্টাই আগে করা দরকার।’ বলল যুধিষ্ঠির।
বিদুর বলল, ‘যুধিষ্ঠির ঠিক কথাই বলেছে, এখন আমাদের প্রথম কাজ হলো ভীমকে খুঁজে বের করা।’
কুন্তী বলল, ‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে জানালে তিনি চারদিকে লোক পাঠিয়ে ভীমকে অবশ্যই খুঁজে বের করতেন।’
‘না না বৌঠান। যুধিষ্ঠির যথার্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছে—জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রকে জানানো যাবে না। হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।’
‘হিতে বিপরীত!’ বিস্মিত কণ্ঠ কুন্তীর।
‘তাই তো বৌঠান। কিছুক্ষণ আগেই তো আপনি বললেন, মহারাজ দুর্যোধনকে প্রশ্রয় দেন! যদি ভীমকে দুর্যোধন সত্যি সত্যি নিখোঁজ করে, তা হলে তাও তো মহারাজের প্রশ্রয়ে হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে।
‘ও মা গো! আমার ভীম! আমার বৃকোদর!’ আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল কুন্তী।
বিদুর কুন্তীকে কাঁদতে দিল। যুধিষ্ঠিরের দিকে মুখ ঘোরাল সে। বলল, ‘তুমি এক কাজ করো যুধিষ্ঠির, একটা অশ্ব নিয়ে তুমিও বেরিয়ে পড়ো। অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সম্ভাব্য জায়গাগুলো খুঁজে দেখো। কোনো স্থান বাদ দেবে না। আর হ্যাঁ, রাজপ্রাসাদ থেকে সাবধানে বের হতে হবে তোমায়। লোকচক্ষুকে এড়িয়ে। দেখি কী করা যায়! আমার নিজের কিছু গুপ্তচর আছে, তাদের কাজে লাগাচ্ছি আমি!’
যুধিষ্ঠির কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলে দু-বাহু বাড়িয়ে কুন্তীকে কাছে টেনে নিল বিদুর। চোখ মোছাতে মোছাতে বলল, ‘তুমি ওরকম করে কেঁদো না বৌঠান। তোমার কান্না দেখলে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। ভীম যেমন তোমার সন্তান আমারও তো কিছু। ভীমের নিখোঁজে আমিও কি উদ্বিগ্ন হইনি বলো!’
বিদুর জনসমক্ষে কুন্তীকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলেও একান্তে ‘তুমি’ বলে। বহু বছর আগেই কুন্তীকে ‘তুমি’ বলার অধিকার পেয়েছিল বিদুর।
পাণ্ডু যখন সস্ত্রীক অরণ্যে গেল, হস্তিনাপুরের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়নি। রাজপ্রাসাদ থেকে ভরণপোষণ যেত। স্বাচ্ছন্দ্যের অন্য জিনিসপত্রও মাঝে মাঝে পাণ্ডুর কাছে পাঠানো হতো। নিরাপত্তাকর্মীরাই এই দায়িত্ব পালন করত। সেই সময় পাণ্ডুর অরণ্য-আবাসে বিদুরের যাতায়াত ছিল। রাজপ্রাসাদের ভালোমন্দ সংবাদ নিয়েই বিদুর পাণ্ডুনিবাসে আসা-যাওয়া করত। এই সময় কুন্তী সর্বাঙ্গসুন্দর এই দেবরটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। মনের উচ্ছল-উতরোলের কথা কাউকে বুঝতে দিত না সে।
তার পর সেই দিনটি এলো, যেদিন পাণ্ডু কুন্তীকে সন্তান-উৎপন্নের জন্য যেকোনো পুরুষকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিল। কুন্তী বিদুরকেই বেছে নিয়েছিল।
উভয়ের সঙ্গম-সম্মিলন হলো। জন্ম নিল যুধিষ্ঠির। কুন্তী বলে, যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য কুরুরাজপ্রাসাদে বিদুরকে সবাই ধর্ম নামে অভিহিত করে।
তাই কুন্তীর বিপদ মানে বিদুরের বিপদ, কুন্তীর সন্তানদের অমঙ্গল মানে স্বয়ং বিদুরের অকল্যাণ। কিন্তু বিপদের সময় যে অস্থির হতে নেই, অস্থিরতা যে বিপদকে আরও ঘনীভূত করে–জানে বিদুর। তাই তো সে স্থির থেকেছে এবং কাছে টেনে নিয়ে কুন্তীকে ধৈর্য না হারাতে পরামর্শ দিচ্ছে!
কুন্তীর মাথায়-পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বিদুর বলে গেল, ‘আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বৌঠান, ভীমকে আমি খুঁজে বের করবই। তুমি শুধু একটু ধৈর্য ধরে থাকো। আমাকে একটু সময় দাও বৌঠান।’
কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ল বিদুর।
বাইশ
সেই রাতে ভীমের সন্ধান মিলল না। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী আট দিনেও ভীমকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
বেদনা-বিষণ্ণতা-হতাশা পাণ্ডুপরিবারকে গ্রাস করে বসল। সবচাইতে বেশি ভেঙে পড়ল বিদুর। তার যেন অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে! অধৈর্য-নিরাশা-অস্থিরতায় বিদুর বিধ্বস্ত।
এ রকম বিধ্বস্ত বিচলিত অবস্থায় বিদুরকে আরেকবার দেখা গিয়েছিল। যেবার দুর্যোধন জন্মাল। ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিল বিদুর। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র জন্মেছে শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল বিদুর। কেন সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল? তার পেছনে তো একটা কারণ আছেই! কী সেই কারণ?
সমসময়ে কুন্তীও গর্ভবতী হয়েছিল। দীর্ঘদিন পাণ্ডুর অরণ্য-আবাসে যেতে পারেনি বিদুর। তাই কুন্তীর সন্তান হলো কিনা, হলে পুত্র না কন্যা—জানে না বিদুর। এর মধ্যে যদি কুন্তীর পুত্রসন্তান না হয়, তা হলে যে তার সকল বাসনা ভেস্তে গেল! পাণ্ডু হস্তিনাপুরের রাজা, ধৃতরাষ্ট্র ভারপ্রাপ্ত রাজা হিসেবে রাজ্য চালাচ্ছে। পাণ্ডুপুত্রেরই যুবরাজ হওয়ার অধিকার, পরে যুবরাজ থেকে মহারাজ। কিন্তু তার আগে একটা শর্ত পূরণ করতে হবে। যে পুত্র যুবরাজ বা রাজা হবে, তাকে ভাইদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হতে হবে। ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধন যে জন্মে গেল! ওদিকে কুন্তীপুত্র জন্মাল কিনা জানতে পারল না বিদুর। তাহলে কি তার পুত্রটি মানে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ জ্যেষ্ঠপুত্রটি কুরুরাজসিংহাসনে বসতে পারল না? এই মুহূর্তে কুন্তীর সংবাদ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। ঘোর দুর্দিন এখন। রাজ্যচুবানো বর্ষাকাল।
ভয়ঙ্কর এক কৌশলের আশ্রয় নিল বিদুর। রাজসভায় তার বশংবদ কিছু ব্রাহ্মণ ছিল। বিদুর তাদের হাত করল। তার পর ধৃতরাষ্ট্রের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তার পেছন পেছন অনুগত বামুনরা।
ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বিদুর বলে উঠেছিল, ‘আপনার যে সন্তান জন্মাল আজ দাদা, সে পাপাত্মা। তার জন্মমুহূর্তে নানা অমঙ্গলের চিহ্ন দেখা গেছে। জন্মমাত্র গাধার ডাক ডেকেছে সে। চারদিকে শেয়াল-শকুনের কলরব শোনা গেছে।
ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে বসে মনোযোগ দিয়ে বিদুরের সব কথা শুনে গেল। তার পর মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী করতে বলো বিদুর?’
বিদুর ভেজা বেড়ালের কণ্ঠে বলল, ‘যদি রাজ্যের মঙ্গল চান দাদা, তাহলে…।’
‘তাহলে?’ বিদুরের মুখের কথা কেড়ে নিল ধৃতরাষ্ট্র।
‘তাহলে ওই দুরাত্মা নবজাতককে হত্যা করুন দাদা।’ বলল বিদুর।
পাশে দাঁড়ানো চাটুকার রাজব্রাহ্মণরাও সমস্বরে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ মহারাজ, আপনার অনুজ মহামন্ত্রী বিদুর ঠিক কথাই বলেছেন—ওই পাপাত্মাকে এই মুহূর্তে মেরে ফেলুন মহারাজ। তাতে রাজার কল্যাণ, প্রজার মঙ্গল।’
ধৃতরাষ্ট্র অল্প একটু হাসল। অল্প একটু খাঁকারি দিয়ে গলায় জমে উঠা শ্লেষ্মা সরিয়ে দিল। তার পর শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘বিদুর, তোমার তো অজানা নয়, সূতিকাগার মূলপ্রাসাদের একটু তফাতে, সংরক্ষিত এলাকায়। সেখানে পুরুষের গমনাগমন নিষিদ্ধ। ধাত্রীমাতারই শুধু অধিকার আছে সূতিকাগারে যাওয়ার। তুমি তো পুরুষ মানুষ বিদুর! তুমি তো দুর্যোধনের জন্মের সময় সূতিকাগারে উপস্থিত ছিলে না নিশ্চয়ই! যদি উপস্থিত না-ই থাকো, তাহলে আমার জ্যেষ্ঠসন্তানটি জন্মমাত্রই যে গাধার ডাক ডেকে উঠেছে, জানলে কী করে তুমি?’
ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বিদুর। দাদার একরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে, ভাবেনি। তাই দাদার এ রকম আচমকা প্রশ্নে একেবারে বোবা হয়ে গেল সে। ভাগ্যিস সে ছাড়া এই মুহূর্তে রাজদরবারে অন্য কোনো মন্ত্রী-অমাত্য নেই! থাকলে তার অপকীর্তিটা যে ফাঁস হয়ে যেত!
এই সময় ধৃতরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, ‘আর তোমার পাশে ওই যে স্তাবক ব্রাহ্মণরা দাঁড়িয়ে আছে বিদুর, তাদের তুমি কী পরিমাণ অর্থ উৎকোচ দিয়েছ তোমার কথায় সুর মিলাবার জন্য?’ মহারাজের কথা শুনে বামুনরা সুড়সুড় করে রাজদরবার ত্যাগ করে গেল। একা দাঁড়িয়ে থাকল বিদুর। তার মুখে রা নেই।
ধৃতরাষ্ট্র এবার দীর্ঘ একটা শ্বাস ত্যাগ করল। ডান হাতটা চিত করে বিদুরের দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘তুমি সংবাদ আনার আগে অন্দরমহল থেকে পুত্র জন্মানোর সংবাদটি আমার কাছে পৌঁছে গেছে বিদুর। তাদের কেউ পুত্রটির কর্কশকণ্ঠে গাধার কান্না করার কথা বলেনি। একবারও বলেনি তারা, এই পুত্র অকল্যাণের দ্যোতক। তুমি কেন যে আমার নবজাতকটিকে পাপাত্মা, দুরাত্মা—এসব বলছ, বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু তো তা-ই নয়, সদ্যোজাতকটিকে হত্যা করারও পরামর্শ দিচ্ছ? কেন বিদুর? এ রকম কুপরামর্শ দিচ্ছ কেন তুমি আমায়? এতে তোমার কী স্বার্থ?’
বিদুর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কী বলবে সে? বলার যে কিছু নেই তার! তার দুরভিসন্ধিটা যে ধরা পড়ে গেল মহারাজের কাছে! দুর্যোধনকে পরোক্ষ হত্যার এই যে আয়োজন করতে চেয়েছিল, তা তো শুধু কুন্তীর তৃপ্তির জন্যই! কুন্তী যদি দুর্যোধনের আগে সন্তান জন্ম দেয়, তা হলে তো তার পুত্রই কুরুরাজসিংহাসনে আরোহণ করবে! এতে কি শুধু কুন্তীরই তৃপ্তি, তার নিজেরও সন্তুষ্টি নয়? অতি অবশ্যই তারও তৃপ্তি। ওই সন্তানের শিরায় যে তার রক্তধারাই বহমান।
সেদিন ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বিদুর। মাথা নিচু করে রাজার সামনে থেকে সরে এসেছিল। তাই বলে পাণ্ডুপুত্র বা কুন্তীদের পাশ থেকে সরে যায়নি বিদুর। ছত্রচ্ছায়া হয়ে তাদের পাশে পাশে থেকেছে আজীবন।
হঠাৎ করে পাঁচপুত্রসহ কুন্তীর রাজপ্রাসাদে আগমনে চারদিকে তোলপাড়। প্রজারা প্রশ্নাকুল, অমাত্যরা দ্বিধাগ্রস্ত। এত বড় বড় পুত্রগুলো কার? পাণ্ডুর যে সন্তান জন্মেছে, জানতাম না তো আমরা! পাণ্ডুর সতেরো দিনের বাসিমড়া নিয়ে হিমালয়শৃঙ্গ থেকে যে কয়েকজন মুনি কুন্তীদের পৌঁছে দিতে এসেছিলেন, তাঁরা রাজপরিবারের কোনো আতিথেয়তা গ্রহণ না করে সংক্ষিপ্ত দু-একটি কথা বলে চলে গেলেন! নগরবাসীরা বলতে লাগল, মহারাজ পাণ্ডু তো মারা গেছেন! বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, এরা যে তাঁরই পুত্র, সাক্ষ্য দেবেন কে? পাণ্ডুও মৃত, মাদ্রীও মৃত
এসব বাচাল মুখকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য বিদুরই প্রধানভাবে উদ্যোগ নিয়েছিল।
বিদুরকে রাজপুত্রের সম্মান না দিলেও সত্যবতী বিশেষভাবে ভালোবাসতেন তাকে। সত্যবতীর ওপরও বিদুরের বিশেষ প্রভাব ছিল। বিদুরের নিরীহ ব্যবহার, নির্লোভতা, সত্যপ্রিয়তা—এসবের জন্য ভীষ্মেরও খুব নৈকট্য পেয়েছিল বিদুর।
কুন্তী এবং পাণ্ডুপুত্রদের সংকটকালে ওই দুইজনের কাছে ছুটে গিয়েছিল বিদুর। তারই প্রভাবে সত্যবতী-ভীষ্ম পাণ্ডুপুত্রদের প্রতি স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। বিদুর ছিল কথার রাজা। তার ভাষা ছিল মধুময়। শব্দপ্রয়োগে অত্যন্ত দক্ষ ছিল বিদুর। কোন পরিস্থিতিতে কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, ভালোভাবেই জানা ছিল তার। ঘটনা নিয়ন্ত্রণের পারঙ্গমতা তার অধিগত ছিল। এই কৌশলটা প্রয়োগ করে ভীষ্ম-সত্যবতীকে নিজের অনুবর্তী করতে সক্ষম হয়েছিল বিদুর।
বিদুর কুরুপ্রাসাদের বিশেষ প্রভাবশালী ওই দুজনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, ওরা মহারাজ পাণ্ডুরই ক্ষেত্রজপুত্র। বিদুরের আবেগঘন কথায় সত্যবতী আর ভীষ্মের স্নেহ উছলে উঠেছিল। ক্ষেত্রজপুত্রদের স্বীকৃতি দিতে বেশি সময় নেননি তাঁরা। রাজপ্রাসাদ থেকে এলান জারি করা হয়েছিল—যুধিষ্ঠিররা মহারাজ পাণ্ডুর ক্ষেত্রজপুত্র। এই ক্ষেত্রজদের প্রতি রাজবাড়ির সর্বময় ক্ষমতাধারী সত্যবতীর অকুণ্ঠ সমর্থন আছে। এরা কুরুরাজপ্রাসাদেরই ছেলে। আজ থেকে পঞ্চভ্রাতার ভরণপোষণ, শিক্ষাদীক্ষার সকল দায় বর্তমানের কুরুমহারাজ গ্রহণ করলেন।
অচিরেই সমালোচকদের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। পঞ্চপাণ্ডব রাজবাড়ির শিক্ষা-সহবতের অন্তর্গত হলো। হস্তিনাপুরবাসীরা জানল— পাণ্ডুর এই ক্ষেত্রজপুত্ররা কুরুসিংহাসনের দাবিদার।
এই ঘোষণায় বিদুর খুশি হলেও ধৃতরাষ্ট্র অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। দুর্যোধনের চেয়ে যুধিষ্ঠির যে বড়! কুরুবিধানে বংশের জ্যেষ্ঠপুত্রেরই যে যুবরাজ হওয়ার অধিকার!
অস্থিরতা-অসহিষ্ণুতা নিয়েই ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য চালাতে লাগল। দুর্যোধন-যুধিষ্ঠিররা বড় হতে লাগল। দুর্যোধনের মধ্যে সিংহাসন লালসা প্রোথিত হলো। তার লোভকে উসকে দিতে লাগল ধৃতরাষ্ট্র। সেই লোভ আর হিংসারই প্রাথমিক ফলশ্রুতি ভীমের নিখোঁজ হওয়া।
নিখোঁজ হওয়ার আটদিন পর ভীম নাগরাজ্য থেকে ফিরে এসেছিল। এসেই দুর্যোধনের অপকীর্তিটির কথা জোরেশোরে বলতে শুরু করেছিল।
যুধিষ্ঠির তার ডানহাতের তর্জনীটি ভীমের মুখে চেপে ধরে বলে উঠেছিল, ‘চুপ করো ভীম, চুপ করো। এসব কথা কোথাও তুমি বলো না। বলার সময় নয় এখন
তেইশ
দুর্যোধনদের পক্ষ থেকে কলহের কোনো উসকানি ছিল না। কলহটা শুরু করেছিল ভীম।
ভীম ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির। অনেকটা জান্তব চরিত্র নিয়ে রাজপ্রাসাদে এসেছে সে। পর্বতপ্রমাণ দেহ তার। তার প্রকৃতিও তার আকৃতির মতো ভয়ংকর। ক্ষমা করতে শেখেনি সে। পরিহাসছলেও হাসে না। তাকায় বক্রভাবে। সে উদ্ধত, বহুভোজী। তার চোখের রং পিঙ্গল, মুখমণ্ডল শ্মশ্রুবিহীন। ছোটবেলা থেকে হিংস্র চরিত্র নিয়েই বেড়ে উঠেছে ভীম। বন্যতা আর নিষ্ঠুরতা তার মনে, দেহে।
প্রথম প্রথম সংযত ছিল ভীম, কুরুরাজপ্রাসাদে কিছুদিন কাটানোর পর বন্যহিংস্রতা তার মধ্যে জেগে উঠেছিল। তার নিষ্ঠুরতার বলি হতে লাগল ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা। খেলবার সময় কৌরবদের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে রক্ত বের করে দিত, সজোরে মাটিতে ফেলে চুল ধরে এমন ঘূর্ণি দিত, ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। এসব অত্যাচার দুর্যোধনের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বড় ভাই সে। তারই তো কর্তব্য ছোট ভাইদের নিরাপত্তা বিধান করা। বহুবার চেষ্টা করেও ভীমকে সংযত করাতে পারেনি দুর্যোধন। তারপরেই তো ওই উদ্যোগ, ভীমকে খুন করার পদক্ষেপ!
ভীম ফিরে এলে কুরুরাজপ্রাসাদ স্পষ্টত দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। দুর্যোধনাদি ভাইয়েরা এবং মামা শকুনি একদিকে, যুধিষ্ঠিরদের নিয়ে বিদুর অন্যদিকে। প্রথম পক্ষের মদতদাতা রাজা ধৃতরাষ্ট্র, দ্বিতীয় পক্ষের অপ্রত্যক্ষ সমর্থক পিতামহ ভীষ্ম।
শকুনির কুমন্ত্রণায় দুর্যোধন রাজপ্রাসাদের রাজনীতিতে বিপুল এক আবর্ত তৈরি করল। এই আবর্তে পড়ে পাণ্ডবরা কোণঠাসা হয়ে পড়তে লাগল। তখনো কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা শুরু হয়নি।
ভীষ্মের আদেশে একদিন তাদের অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ হলো। কুরুপাণ্ডবদের প্রথম অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য। তাঁর আসল নাম কৃপ। অসাধারণ অস্ত্রদক্ষতার জন্য তাঁর নাম হয়ে যায় কৃপাচার্য। বাপ-মায়ের পরিত্যক্ত সন্তান এই কৃপ। একই সঙ্গে কৃপের এক বোনও জন্মেছিল, কৃপী নাম সেই বোনটির। ঋষি গৌতমের এক শিষ্যের নাম শরদ্বান। ধনুর্বিদ্যায় অসাধারণ দক্ষ এই শরদ্বান। জানপদী নামের এক অপ্সরার সঙ্গে শরদ্বারের দৈহিক মিলন হয়। এক সঙ্গে দুই সন্তানের জন্ম দিয়ে জানপদী দেশান্তরে চলে যায়। পথের ধারে পরিত্যক্ত সন্তান দুটোকে দেখতে পান মহারাজ শান্তনু। তাদেরকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন। কৃপ ও কৃপীর লালনপালনের ব্যবস্থা নেন। বড় হয়ে উঠতে থাকে ওরা। কালক্রমে কৃপ দক্ষ ধনুর্ধর হয়ে উঠলেন। কৃপীর সঙ্গে বিয়ে হলো দ্রোণের। এই দ্রোণই শেষপর্যন্ত দ্রোণাচার্য হয়ে উঠেছিলেন। অস্ত্রগুরু হিসেবে গোটা পৃথিবীতে নাম ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর।
ভীষ্মের প্রণোদনায় কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা দিতে শুরু করেছিলেন কৃপাচার্য। পরে দ্রোণাচার্য কুরুপাণ্ডবের অস্ত্রশিক্ষার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
দ্রোণও কৃপের মতো মাতৃ-পরিত্যক্ত এক সন্তান। তাঁর পিতার নাম মহর্ষি ভরদ্বাজ। ঘৃতাচী তাঁর মা। ঘৃতাচীও অপ্সরা। পিতার আশ্রমেই বড় হয়ে ওঠা দ্রোণের। প্রথমে পিতার কাছে, পরে পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেন দ্রোণ। পিতা ভরদ্বাজের আশ্রমে অধ্যয়নের সময় পাঞ্চালরাজার পুত্র দ্রুপদ দ্রোণের সহপাঠী ছিল। পরে দ্রুপদ পাঞ্চালের নৃপতি হয়েছিল। পিতার আদেশে কৃপাচার্যের বোন কূপীকে বিয়ে করেন দ্রোণ। তাঁদের একটি সন্তান জন্মে। দ্রোণ ও কৃপী তাঁদের সন্তানের নাম রাখেন অশ্বত্থামা। জন্মের পর অশ্বের মতো ডেকে উঠেছিল নবজাতকটি।
পিতার মৃত্যু হলে দ্রোণ খুব অর্থসংকটে পড়েন। দরিদ্রতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একদিন দ্রুপদের রাজদরবারে উপস্থিত হন দ্রোণাচার্য। দ্রুপদ দ্রোণাচার্যের সখ্য অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, দ্রোণাচার্যকে একদিনের আহার্যবস্তু ভিক্ষা দিতে চেয়ে দ্রুপদ চরমভাবে অপমানিত করে বাল্যকালের সহপাঠীকে। ক্রুদ্ধ দ্রোণ ফিরে আসার সময় বলে আসেন, ‘একদিন আমি এই অপমানের প্রতিশোধ নেব দ্রুপদ। তোমার এই রাজ্য লন্ডভন্ড করে ছাড়ব। ঐশ্বর্যে আগুন লাগব।’
সেদিন দ্রুপদের উপহাসধ্বনি পেছন থেকে দ্রোণাচার্যের কানে এসে বেজেছিল।
দ্রোণাচার্য ভেবেছেন—দ্রুপদের এই অপমান আর লাঞ্ছনার জবাব দিতে চাইলে প্রবল শক্তিশালী কারোর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। হস্তিনাপুরের কুরুশক্তিকেই বেছে নিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। হস্তিনাপুরে কৃপাচার্যের গৃহেই সপরিবারে গোপনে বসবাস শুরু করেছিলেন দ্রোণাচার্য। একদিন কৌরব রাজকুমারদের কূপে পতিত বীটা অস্ত্রাঘাতে তুলে দিয়ে পিতামহ ভীষ্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভীষ্ম দ্রোণাচার্যকে কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরুর পদে বরণ করেন।
অচিরেই অস্ত্রশিক্ষার পালা শুরু হয়েছিল। দীর্ঘদিনের অস্ত্রশিক্ষা শেষে দেখা গেল— তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনই শ্রেষ্ঠতম বীর। বিশেষ করে ধনুর্বিদ্যায় অর্জুন অবিসংবাদী।
অস্ত্রশিক্ষার আগে কৌরবদের ঈর্ষার পাত্র ছিল ভীম। ভীমকেই তারা তাদের পরম শত্রু বলে ভাবত। অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণের শেষের দিকে দেখা গেল—ভীম নয়, অর্জুনই কৌরবদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। ভীম আর দুর্যোধনের অস্ত্রদক্ষতা প্রায় কাছাকাছি। বিশেষ করে গদাযুদ্ধে উভয়ে বিশেষ পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। ভীম বাহুবলী, দুর্যোধন গদাকুশলী। দুর্যোধনের গদাকুশলতার কাছে ভীমকে বহুবার হাঁটু গেড়ে বসতে হয়েছে। দ্বৈরথে উভয়ে ছিল নাছোড়। দ্রোণাচার্যের সামনে গদাশিক্ষার পরীক্ষা দিতে গিয়ে একজন আরেকজনকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করেছে। তখন তাদের মধ্যে পরীক্ষার অনুশীলনের চেয়ে প্রতিহিংসা বড় হয়ে উঠেছে। দ্রোণাচার্যকে মাঝপথে উভয়ের যুদ্ধপরীক্ষা থামিয়ে দিতে হয়েছে বারবার। একটা সময়ে দুর্যোধন বুঝে গিয়েছিল যে ভীমের গায়ের শক্তি যতই থাক, তাকে হারানো দুর্যোধনের পক্ষে কঠিন নয়।
ভীমভীতি কেটে গেছে দুর্যোধনের। প্রকট হয়ে উঠেছে অর্জুনভীতি। অর্জুন দক্ষ তিরন্দাজে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। তার লক্ষ্য অব্যর্থ। ঝাঁকে ঝাঁকে তির এক সঙ্গে নিক্ষেপ করতে পারে অর্জুন। এই তির নিবারণের কৌশল না-দুর্যোধন, না অন্য কোনো কৌরব অর্জন করতে পেরেছে। হাতের কাছে পেলে গদাঘাতে অর্জুনকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া সহজ, কিন্তু অর্জুন যে তির ছোড়ে বহুদূরে দাঁড়িয়ে! ভীমকে নিয়ে কৌরবদের চিন্তার অবসান হলো বটে, কিন্তু চিন্তা বেড়ে গেল অর্জুনকে নিয়ে। ভীম থেকে অর্জুনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল দুর্যোধন।
কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা চলাকালে একলব্য এসেছিল দ্রোণাচার্যের কাছে। উদ্দেশ্য-অস্ত্রশিক্ষা লাভ। একলব্য ছিল নিষাদপুত্র। নিষাদরাজ হিরণ্যধনু ছিল একলব্যের বাবা। অনার্য নিষাদ পরিচয় পেয়ে একলব্যকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। তাঁর ব্রাহ্মণ্যবোধ তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল I
নিচুজাতের অজুহাতে দ্রোণাচার্য আরেকজনকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেননি। তার নাম কৰ্ণ। কর্ণের আসল নাম বসুষেণ। জলেভাসা বসুষেণকে নদী থেকে উদ্ধার করে অধিরথ এবং তার স্ত্রী রাধা লালনপালন করে। অধিরথ ছিল সূত্রবংশীয় এবং কুরুরাজ পরিবারের রথচালক। প্রত্যাখ্যাত হয়ে একলব্যের মতো বসুষেণও থেমে থাকেনি। পরশুরামের কাছে গিয়ে সকল প্রকার অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করেছে বসুষেণ। পরবর্তীকালে নিজের অঙ্গ কর্তন করে ইন্দ্রকে কবচ ও কুণ্ডল দান করায় বসুষেণের নাম হয় কৰ্ণ।
সেদিন অস্ত্রদক্ষতার পরীক্ষা নেওয়ার দিন। চারদিকে কুরুরাজরাজন্য নিজ নিজ আসনে বসেছেন। নানা দেশের রাজাও আমন্ত্রিত সেদিনের পরীক্ষার ময়দানে। বৃত্তাকারে সৈন্যসামন্ত দাঁড়িয়ে। হস্তিনাপুরের গণ্যমান্য নাগরিকরা উপস্থিত সেদিন।
সবার অস্ত্রশক্তি প্রদর্শনের পর অর্জুন রঙ্গভূমির মধ্যিখানে এসে দাঁড়িয়েছে। অচিরেই অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনের কাজ শুরু করে দিল অর্জুন। তার অস্ত্রবিদ্যার কৌশলে গোটা রঙ্গভূমি প্রথমে মূক স্তব্ধ, পরে সমবেতরা উল্লাসে ফেটে পড়লেন।
ঠিক এই সময়েই রঙ্গভূমিতে এসে পৌঁছল কৰ্ণ।
চব্বিশ
এই কর্ণ মায়ের অবাঞ্ছিত সন্তান। তার মায়ের নাম কুন্তী।
কুন্তীর আসল নাম পৃথা। তার পিতার নাম রাজা শূর। সম্পর্কে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের ভগ্নি এই পৃথা। শিশুবয়সে রাজা শূর তার এই কন্যাটিকে নিঃসন্তান রাজা কুন্তীভোজকে দান করে দেয়। পালকপিতা কুন্তীভোজ আপন সন্তানের মতো কন্যাটিকে লালনপালন করে। কন্যাটির নতুন নামকরণ করেন—কুন্তী।
পালকপিতার রাজপ্রাসাদে কুন্তী যৌবনবতী হলো। যুবতী কুন্তী একদিন মন দিয়ে বসল সূর্য নামের এক আর্যযুবককে। সূর্য মানে-মর্যাদায় কুন্তীভোজদের সমকক্ষ ছিল না। কুন্তীর পাণি গ্রহণ করার মতো সামাজিক পরিচিতি ছিল না সূর্যের। এমনকি কুন্তীর স্বয়ংবর সভায় বসার মতো ও উপযুক্ত ছিল না সে। কিন্তু প্রেম বলে কথা। প্রেম তো বংশমর্যাদা খোঁজে না! প্রেমের আবেগের কাছে কুলশীল, সামাজিক প্রতিপত্তি—এসব ভেসে যায়। কুন্তী আর সূর্যের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। তাদের প্রেমানুভূতি মন থেকে গড়াতে গড়াতে দেহতে এসে স্থিতি পায়। দেহ উছলে ওঠে দুজনেরই। কুন্তী নিজেকে সংযত করলেও সূর্য মাতোয়ারা। কুন্তীর সান্নিধ্যের জন্য ভীষণভাবে লালায়িত হয়ে ওঠে সূর্য। সূর্য আড়াল খোঁজে। একদিন নিভৃত স্থান পেয়ে যায়। নির্জনতার সুযোগ নেয় সূর্য। কুন্তীর কাছে তার দেহ চেয়ে বসে। ভয় পায় কুন্তী। নারীসুলভ লজ্জা ও ত্রাস তাকে ত্রস্ত করে তোলে। কিন্তু সূর্য নাছোড়। আদরে সোহাগে সেই নির্জনতাকে মুখর করে তোলে। উন্মুখর হয়ে ওঠে কুন্তীও। সাড়া দেয়, সান্নিধ্য দেয় সূর্যকে।
অতঃপর কুন্তী গর্ভবতী হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে সন্তানটি কুন্তীর গর্ভে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গর্ভাবস্থায় সর্বদা নিজেকে আবৃত করে রাখত কুন্তী। জনসমক্ষে আসত না। ফলে কেউ বুঝতে পারল না যে কুমারী কুন্তীর পেটে সন্তান এসেছে।
কেউ না বুঝতে পারলেও একজনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল কুন্তী। সে রাজপরিবারেরই এক ধাত্রী। বিশ্বস্ত এই ধাত্রীটির সহায়তায় কুত্তী একদিন অত্যন্ত রূপবান একটি পুত্রসন্তান প্রসব করল। পুত্রটি সহজাত কবচ-কুণ্ডলধারী। কিন্তু কুন্তীর কাছে এ তো পুত্র নয়, কলঙ্কের বোঝা! এর পিতৃপরিচয় যে জানানোর মতো নয়! এই কলঙ্কের বোঝাটিকে যে মাথা থেকে নামাতে হবে! তা না হলে যে তার ভবিষ্য-জীবন অন্ধকারে ছেয়ে যাবে! তার ভূতভবিষ্যৎ বলে যে কিছুই থাকবে না! কোনো রাজপুত্র তাকে বিয়ে করবে না! সূর্য তার কাছে এক অতীত আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই আবর্জনার কলঙ্কের দাগটিকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে হবে। পিতা-মাতা যদি তার এই দুষ্কর্মের বৃত্তান্ত জানতে পারে, মুখ লুকানোর জায়গা পাবে না তারা। নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্য-জীবন এবং মা-বাবার দুর্নামের কথা ভেবে নবজাতকটিকে পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল কুন্তী।
কিন্তু কী উপায়ে পরিত্যাগ করবে এই সদ্যোজাতকটিকে?
ধাত্রীটি বুদ্ধি জোগাল, ‘ছেলেটিকে নদীর জলে বিসর্জন দিন রাজকুমারী।’
‘বিসর্জন! কিন্তু কী উপায়ে?’ বহুক্ষণ অন্ধকারে হাঁটার পর হঠাৎ আলোর দিশা পাওয়া পথিকের কণ্ঠে বলে উঠল কুন্তী।
ধাত্রী বলল, ‘পাশেই অশ্বনদী।’
‘তো?’ কুন্তী জিজ্ঞেস করলেন।
‘মোম দিয়ে ঢাকা বেশ বড় একটা পেটিকায় সন্তানটিকে রেখে নদী জলে ছেড়ে আসুন রাজকুমারী।’
‘নদী জলে ছেড়ে আসব?’
‘হ্যাঁ, তাই করুন। আপনি হয়তো ভাবছেন, নদীজল পেটিকায় ঢুকে পড়ে ছেলেটির মৃত্যুর কারণ হবে না তো?’
কুন্তী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘তাই তো, নদীজলে ভাসিয়ে দেওয়া পেটিকায় ছেলেটি বাঁচবে তো?’
‘বাঁচবে রাজকুমারী, বাঁচবে। পেটিকাটি ওভাবে বানানো হবে। জল ঢুকবে না, কিন্তু বাতাস ঢুকবে। সেই বাতাসে ছেলেটি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে-ফেলতে পারবে। ভাগ্য ভালো হলে কারও হাতে পড়বে, না পড়লে জলেই শেষ ঠাঁই হবে নবজাতকটির।’ একটানা বলে গেল ধাত্রী।
কুন্তী আর্তনাদ করে উঠল, ‘ও মা রে!’
এরপর বেশ বড় একটি মোম-আচ্ছাদিত পেটিকায় করে কাপড়ে জড়ানো শিশুটিকে অশ্বনদীতে ফেলে দিয়ে আসা হলো। সূতবংশীয় অধিরথ এবং তার স্ত্রী রাধা নদীতে পরিত্যক্ত এই সন্তানটিকে বুকের একেবারে নিবিড়ে টেনে নিয়েছিল।
সেই কর্ণই আজ রঙ্গভূমিতে দ্রোণাচার্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বৃত্তাকারে আসনে বসা রাজা ও রাজন্যদের প্রতি ডান হাতটা বাড়িয়ে সঅহংকারে বলল, ‘থামুন আপনারা। মিথ্যা উচ্ছ্বাসে আপ্লুত হয়ে মেকি সোনাকে প্রকৃত স্বর্ণের মর্যাদা দিচ্ছেন! যুদ্ধদক্ষতায় অর্জুন একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয় এই হস্তিনাপুরে।’
দ্রোণাচার্য দ্রুত পায়ে কর্ণের নিকটে এগিয়ে এলেন। সরোষে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহাধনুর্ধর অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বীটা কে? তার নামটি বলবে তুমি আমায়?’
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন গুরুদেব?’ শেষ শব্দটিতে কর্ণের কণ্ঠনিসৃত ব্যঙ্গ ঝলছে উঠল।
চাপা কণ্ঠে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘চিনব না কেন? চিনতে পেরেছি আমি তোমায়। তুমি কর্ণ।
‘অ্যাই-ই! যথার্থ বলেছেন গুরুদেব, আমি কর্ণ। সেই কর্ণ, আপনি যাকে ছোটজাতের দোহাই দিয়ে আপনার অস্ত্রপাঠশালায় ভর্তি করাননি। বলেছিলেন, নিম্নজাতের তুমি কর্ণকে শিষ্য হিসেবে কিছুতেই গ্রহণ করব না আমি।’
‘সেই কৰ্ণ বলছ, অর্জুন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয়!’
‘হ্যাঁ বলছি। আর সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম সূতপুত্ৰ এই কৰ্ণ।’ নিজ বুকে ডান হাতের বুকের বুড়ো আঙুল ঠুকে বলল কর্ণ।
‘তুমি! তুমিই অর্জুনের অস্ত্রবিদ্যার বিরুদ্ধে তর্জনী তুলছ!’
‘হ্যাঁ তো! আমিই আপনার প্রিয় শিষ্যটির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। আপনি প্রত্যাখ্যান করলে কী হবে, মহামান্য অস্ত্রগুরু পরশুরাম আমাকে তাঁর শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন, উজাড় করে শিখিয়েছেন তিনি আমায়। আজ আমি আপনার চেলাটিকে দেখিয়ে দেব, সে এই ভারতবর্ষে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয়, তাকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার মতো অন্য একজন এই মাঠের মধ্যেই আছে।’ বলে দর্শকদের দিকে মুখ ফেরাল কৰ্ণ।
সগর্জনে বলল, ‘ক্ষেত্রজ এই অর্জুন অস্ত্রবিদ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আপনাদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখাচ্ছেন। অর্জুন যা নয়, তা করেই উপস্থাপন করছেন তিনি। আমি বলছি, অর্জুনের অর্জনে খামতি আছে। সে সম্পূর্ণ অস্ত্রবিদ হয়ে উঠতে পারেনি। আপনারা যদি একজন যথার্থ অস্ত্রবিশারদকে দেখতে চান, তা হলে আমার দিকে তাকান। এই কৰ্ণ অর্জুনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।’ থামল কৰ্ণ।
চারদিক থেকে গুঞ্জন উঠল। অচিরেই সেই গুঞ্জন কোলাহলে পরিণত হলো।
কোলাহলকে ছাপিয়ে দ্রোণাচার্যের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এই পরীক্ষা-রঙ্গভূমিতে অর্জুন যা যা করে দেখাল, তা কি তুমি করে দেখাতে পারবে?’ ক্রোধে দ্রোণাচার্যের কন্ঠ থর থর করছে।
কর্ণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠল, ‘পারব মানে! আলবৎ পারব। ও আজ এই রঙ্গভূমিতে যা করে দেখিয়েছে, তা তো আমি এখন করে দেখাবই, আরও বাড়তি কিছু অস্ত্রদক্ষতা আমি দেখাব, যা অর্জুন অর্জন করেনি
কর্ণের কথা শুনে দ্রোণাচার্য থতমত খেয়ে গেলেন। হঠাৎ করেই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগে উঠল—কোন বিদ্যেটি তা হলে গুরুদেব পরশুরাম আমাকে শেখাননি, শিখিয়েছেন এই কর্ণকে? গুরুদেব আমাকে যে যে বিদ্যা শিখিয়েছিলেন, তার তো সবটাই শিখিয়েছি আমি অর্জুনকে! তা হলে অস্ত্রগুরু পরশুরাম থেকে বাড়তি কোন বিদ্যা শিখে এলো কৰ্ণ?
দ্রোণাচার্যের অবস্থা দেখে কর্ণ তখন মিট মিট করে হাসছিল। দর্শকসারি থেকে আওয়াজ উঠল–হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখান আপনার অস্ত্রদক্ষতা। আমরা দেখতে চাই, দেখতে চাই।
দ্রোণাচার্যের দিকে আর ফিরে তাকাল না কর্ণ। সদর্পে রঙ্গভূমির মধ্যিখানে এগিয়ে গেল।
তৃণ থকে একটা তির তুলে নিয়ে আকাশের দিকে ধনুকটি বাগিয়ে ধরল।
অস্ত্রশিক্ষার সমস্ত কায়দা-কেতা, যা যা অর্জুন দেখিয়েছিল, তার সবটাই কর্ণ অনায়াসে করে দেখাল। সবাই এত মুগ্ধ হয়ে পড়ল যে বাড়তি কিছু দেখানোর আগেই গোটা রঙ্গভূমি উল্লাসে- গর্জনে একাকার হয়ে গেল।
এই সময় কর্ণকে লক্ষ করে দ্রুত পায়ে দুর্যোধন এগিয়ে এলো।
পঁচিশ
উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে কর্ণকে জড়িয়ে ধরল দুর্যোধন। উদ্বাহু হয়ে তখন নাচতে ইচ্ছে করল তার।
এই কর্ণ দুর্যোধনের অপরিচিত নয়। কর্ণের পালকপিতা অধিরথ। ক্ষত্রিয় হয়েও রথচালানোর পেশা গ্রহণ করেছিল সে। ধৃতরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত রথের সারথি ছিল অধিরথ। পিতার সূত্রে বালক কর্ণের কুরুরাজপ্রাসাদে যাতায়াত ছিল। তাই বালকবেলা থেকেই কর্ণকে দেখা, দুর্যোধনের। আর দেখেছে অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের পাঠশালায়, যেদিন তিনি নিচুজাতের দোহাই দিয়ে কর্ণকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে অস্বীকার করলেন। সেদিনের প্রত্যাখ্যানের দৃশ্যটি দুর্যোধনের মনে একেবারে দেগে বসে আছে। কী বিপন্ন বিপর্যস্তই না দেখাচ্ছিল সেদিন কর্ণকে! বড় আশা নিয়ে কর্ণ সেদিন অস্ত্রপাঠশালাতে এসেছিল। চোখদুটো তার আলোয় ঝকমক করছিল। দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় শুধু কুরুপাণ্ডবরা তো নয়, ভারতবর্ষের নানা রাজরাজন্যের পুত্ররাও অস্ত্রদীক্ষা নিচ্ছিল। কুরুপাণ্ডব ছাড়াও অন্যান্যের জন্যও অস্ত্রপাঠশালার দরজা অবারিত ছিল। সেই অবারিত দরজার সামনে কর্ণ এসে দাঁড়িয়েছিল।
গুরুদেবের ওই এক অভ্যেস—আগত শিষ্যদের জাতপাতের হদিস নেওয়া। যে-ই আসুক, প্রথম প্রশ্ন—নাম কী? জাত কী? ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় না হলে শিষ্যত্বে গ্রহণ করেন না। অল্পদিন আগে ব্যাধরাজপুত্র একলব্যকে নাজেহাল হতে দেখেছে দুর্যোধন। আজও সেই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে কর্ণকে। খুব কাছ থেকে খেয়াল করছিল দুর্যোধন। একলব্যের মতো আরেকটা ঘটনা
ঘটবে বলে আশঙ্কা করছিল সে। ঘটলও তাই।
নির্মম কণ্ঠে দ্রোণাচার্য বলে উঠেছিলেন, ‘এই পাঠশালা কোনো অনার্যের জন্য নয়। শূদ্র বা বৈশ্যের এখানে প্রবেশ নিষেধ। যার পিতৃপরিচয় দেওয়ার মতো নয়, সেই তুমি কোন সাহসে আমার পাঠশালায় ভর্তি হতে এসেছ?’
কর্ণ সেদিন ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলতে চেয়েছিল, ‘আমার বাবা অধিরথ ক্ষত্রিয়। রাজবাড়ির সারথি।’ আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কর্ণ। দ্রোণাচার্য বলতে দেননি। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘মানে রথচালক! আর্যসমাজে সারথির কাজটা মর্যাদার নয়। অন্ত্যজদের পেশা এটা। তোমার বাবা জন্মে হয়তো ক্ষত্রিয়, পেশায় বর্ণাধম।
‘হয়তো ক্ষত্রিয় বলছেন কেন গুরুদেব! আমার বাবা তো ক্ষত্রিয়ই!’ কর্ণ বলল
দ্রোণাচার্য এবার রেগে গেলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘অত তর্ক করছ কেন বালক? তোমাকে এই পাঠশালায় ভর্তি করাব না আমি। তোমার মতো হীনজাতের ছেলেকে আমি অস্ত্রশিক্ষা দিতে সম্মত নই—ব্যস, এই আমার শেষ কথা।’
তখন কর্ণের মাথা মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে একেবারে স্তব্ধ নিথর কাঁদছিলও বোধহয় কর্ণ! দূর থেকে বুঝতে পারছিল না দুর্যোধন।
রঙ্গভূমিতে অস্ত্রপরীক্ষার দিনও, অর্জুনের সঙ্গে কর্ণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বার আগে কৃপাচার্য কর্ণের বর্ণেতর জাতের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। কর্ণ নিজের অস্ত্রদক্ষতা প্রদর্শনের জন্য যখন বৃত্তের মধ্যিখানে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই অদূরে দাঁড়ানো কৃপাচার্য জাতপাতের প্রশ্নটি তুলেছিলেন।
বলেছিলেন, ‘কর্ণ-অর্জুনে অস্ত্র প্রতিযোগিতা তো হতে পারে না কখনো! কোথায় পাণ্ডুপুত্ৰ অর্জুন আর কোথায় সারথিপুত্র কর্ণ! একজনের জীবন উচ্চতার আলোকে উজ্জ্বল, অন্যজনের জীবন নিচতায় নিমজ্জিত। এই দুইজনের প্রতিযোগিতা দ্রোণাচার্য মেনে নিলেও আমি মানতে নারাজ।’
তারপর বললেন, ‘রাজপুত্রের সঙ্গে রাজপুত্রের বা রাজপুত্রের সঙ্গে রাজার দ্বন্দ্ব হতে পারে, রাজপুত্রের সঙ্গে সূতপুত্রের নয়।’
কর্ণের মধ্যে তেজ ও সাহস দেখে দুর্যোধন মোহিত। কর্ণের মধ্যে অর্জুনের সমকক্ষকে দেখে বিভোর হলো দুর্যোধন। সেই মুগ্ধতা থেকে দুর্যোধন বলে উঠেছিল, ‘আপনি এ কী কথা বলছেন গুরুদেব কৃপাচার্য! কর্ণ শুধুমাত্র রাজপুত্র নয় বলেই তাকে আপনি এ রকম করে অপমান করছেন?’
‘হ্যাঁ করছি। সূতপুত্রকে সূতপুত্রই তো বলছি! ব্যাধপুত্র তো আর বলছি না! কর্ণ কি অস্বীকার করবে ও সারথিপুত্র নয়?’ বললেন কৃপাচার্য।
কৃপাচার্য প্রকৃতপক্ষে বর্ণ-অহংকারী হয়ে এ রকম কথা বলেননি। কর্ণের বর্ণহীনতার প্রশ্ন তোলার পেছনে কৃপাচার্যের একটা উদ্দেশ্য আছে। তিনি মনেপ্রাণে চাইছিলেন কর্ণ-অর্জুনের দ্বন্দ্বটা বন্ধ করতে। কিছুক্ষণ আগেই গদাযুদ্ধের দক্ষতা দেখাতে গিয়ে দুর্যোধন আর ভীমের মধ্যে ব্যক্তিগত সংঘাত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দ্রোণাচার্য থামিয়ে না দিলে উভয়ের মধ্যে রক্তারক্তি হয়ে যেত। ওদের মারমুখী চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন কৃপাচার্য। ভেবেছেন-কর্ণ আর অর্জুনের মধ্যে একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে না, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই! দ্বন্দ্ব যদি হয়, তাহলে তা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। এই ভয়ংকর দ্বন্দ্বটা না হওয়ার জন্যই কর্ণের নিম্নবর্গীয় জাতের কথাটি তুলেছেন কৃপাচার্য।
কিন্তু দুর্যোধন কৃপাচার্যকে ছাড়েনি। সরোষে বলেছে, ‘আপনার মুখে এ রকম কথা মানায় না গুরুদেব। উচ্চ-নীচ কৌলীন্যের প্রশ্ন তুলে আপনি কর্ণকে এভাবে অপমান করতে পারেন না। আর যদি বলেন, অর্জুন যুবরাজ বা রাজা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে না, তা হলে তারও ব্যবস্থা নিচ্ছি আমি।’ বলে ওপর দিকে ডান হাতটা তুলে কী একটা নির্দেশ দিল দুর্যোধন।
তারপর কৃপাচার্যের দিকে মুখ ফেরাল দুর্যোধন। বলল, ‘শুনুন আচার্য, তিনভাবে রাজা হওয়া যায়। এক. রাজার পুত্র হয়ে জন্মালে, দুই. শৌর্যবীর্যের সঙ্গে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে কেউ কোনো দেশ জয় করেও রাজা হতে পারে। তাছাড়া আরেকভাবে রাজা হওয়া যায়। তা হলো কোনো বড় রাজা কাউকে ক্ষুদ্র একটি রাজ্য দান করলে। আমি কর্ণকে সেভাবে রাজা করে দিচ্ছি।’
দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্য–দুজনেই সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘মানে! কী বলতে চাইছ তুমি দুর্যোধন! তোমার গতিমতি তো বুঝে উঠতে পারছি না আমরা!’
দুর্যোধন বলল, ‘দেখাচ্ছি আপনাদের।’
ইতোমধ্যে দুর্যোধনের ইশারামতো ওখানে জলভর্তি সুবর্ণঘট, ফুলের সম্ভার, মাঙ্গলিক অন্যান্য দ্রব্য এসে গেছে। একটি উঁচুমতন বেদিতে কর্ণকে দাঁড় করাল দুর্যোধন। নিজ হাতে কর্ণের মাথায় সুবর্ণঘটের জল ঢেলে দিল।
কর্ণের গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে দুর্যোধন উচ্চকণ্ঠে বলল, ‘আমি কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিলাম। আজ এই মুহূর্ত থেকে কর্ণ রাজপুত্র নয় একেবারে রাজা।
এবার কৃপাচার্যের দিকে ফিরে দুর্যোধন বলল, ‘এবার তো প্রতিযোগিতাটা হতে পারে গুরুদেব?’
দ্রোণাচার্য আর কৃপাচার্যের মুখের কথা ফুরিয়ে গেছে।
তাঁরা যেন বোবা, বধির, অন্ধ। দর্শকমণ্ডলীরও এই দুই অস্ত্রগুরুর মতো অবস্থা। পত্রপতন নিস্তব্ধতা চারদিকে। উচ্চাসনে উপবিষ্ট ধৃতরাষ্ট্র তো দেখতে পাচ্ছেন না, যাঁরা দেখতে পাচ্ছেন তাঁরাও দুর্যোধনের কাণ্ড দেখে বাক্যহারা।
কর্ণের মস্তক তখন অভিষেকে আর্দ্র। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত তার চোখমুখ।
কর্ণকে অঙ্গরাজ্য দান করার পেছনে দুর্যোধনের মহানুভবতা যতটুকু ছিল, স্বার্থ ছিল তার চেয়ে অধিক। দুর্যোধন তার অস্ত্র-অভিজ্ঞতায় বুঝে গিয়েছিল যে ভীমকে পরাস্ত করার শক্তি তার মধ্যে থাকলেও অর্জুনকে দমিয়ে রাখার অস্ত্রজ্ঞান সে কেন, তার অন্য কোনো ভাইয়ের মধ্যেও নেই। অথচ অর্জুনকে থামিয়ে দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। অর্জুনকে দমিত করার শক্তি দুর্যোধন কর্ণের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল। তাছাড়া দুর্যোধনের মনে হয়েছিল, কর্ণ অর্জুনকে তারই মতো ঘৃণা করে। তাই তো তার কর্ণকে কাছে টানবার প্রয়াস! তাই তো কর্ণকে নিজ দলে আমন্ত্রণ জানাবার চেষ্টা!
এরপর তো কর্ণ আর অর্জুন—উভয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়েছিল! কর্ণ তার অস্ত্রনৈপুণ্যে গোটা রঙ্গভূমিকে নিথর নির্বাক করে দিতে সমর্থ হয়েছিল।
তারপর তো প্রতিযোগিতা শেষে কর্ণকে দুর্যোধনের জড়িয়ে ধরা। গভীর আবেগে নাচতে ইচ্ছে করা।
আলিঙ্গন শিথিল করে দুর্যোধন বলেছিল, ‘তুমি আমার গর্ব কর্ণ। তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য। অনেকদিনের একটা ভয়, উদ্বেগ থেকে তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিলে বন্ধু। অর্জুনকে আমার আর ভয় পেতে হবে না। তুমি পারবে বন্ধু, তোমার ভেতরের তেজ দিয়ে তুমি অর্জুনের সকল অহংকার ভেঙে চুরমার করে দিতে পারবে।’
কর্ণ দুর্যোধনের দু-হাত জড়িয়ে বেশ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘একথা বলছ কেন? দুর্যোধন বলল, ‘তুমি ছাইচাপা আগুন কর্ণ। আগুন খোঁচালে নেভে না, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। দ্রোণাচার্যের খোঁচানিতে তোমার ভেতরের আগুন জ্বলে উঠেছে। তুমি আচার্যের কপটতা চূর্ণ করতে পেরেছ। তোমার প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা।’
কর্ণ বলল, ‘আমি তোমার শুধু সখ্য চাই, অন্য কিছু নয়।’
ছাব্বিশ
সমস্ত রঙ্গভূমি প্রথমে স্তব্ধ, তারপর উতরোল।
উপস্থিত জনেরা বুঝে উঠতে পারছিল না, এত অল্প সময়ের মধ্যে এ কী ঘটনা ঘটে গেল! কোথায় সারথিপুত্র কর্ণ, কোথায় অঙ্গরাজ কর্ণ! মুহূর্তেই ফকির থেকে নৃপতি! কিছু সময় আগেও যে কর্ণের তেমন কোনো জাতপরিচয় ছিল না, সেই কৰ্ণই চোখের পলকে হয়ে গেল অঙ্গরাজ্যের রাজা! এ কী বিশ্বাস্য? বিশ্বাস্য তো বটেই! চোখের সামনেই তো ঘটতে দেখলাম ঘটনাটা! নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কী করে?
পাশের জন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ক্ষমতা আছে বলে দুর্যোধনের এমনতরো মাৎস্যন্যায়! রাজ্য তো ওঁর নয়, রাজ্যশাসন করছেন তো তাঁর বাবা ধৃতরাষ্ট্র! রাজ্য যদি দিতে চান কাউকে, তা হলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রই পারেন, দুর্যোধন নন। কিন্তু অরাজকতাটা দেখলে ভায়া, দুর্যোধনই দান করে দিলেন রাজ্যটা! ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া কি একেই বলে না?’
যাকে উদ্দেশ করে বলা, সেই-জন বলল, ‘আমরা তো সাধারণ নাগরিক ভাই! আমরা কি অত বুঝি রাজারাজড়াদের হালচাল? ওঁরা রাজাকে ভিক্ষুক বানান, ভিক্ষুককে করেন রাজা! উদাহরণের জন্য দূরে যাওয়ার তো দরকার নেই! আমাদের সামনেই তো ঘটল ব্যাপারটা! ও হ্যাঁ, আর কী যেন বলছিলে, দুর্যোধন অঙ্গরাজ্য দান করার অধিকার রাখেন কিনা? রাখেন তো! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তো জ্যেষ্ঠপুত্রকে খুব পছন্দ করেন! তার পছন্দে হস্তক্ষেপ করবেন মহারাজ—একথা ভাবলে কী করে ভাই?’
এ তো সাধারণ মানুষের কথোপকথন। উপস্থিত রাজারাজন্যরাও দু-ভাবে বিভক্ত হয়ে গেল। কেউ দুর্যোধনের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। ভীষ্ম নির্বাক। চেহারা দেখে তাঁর মনের ভাব বোঝার উপায় নেই।
কিন্তু হায় হায় করে উঠল বিদুর, ‘দেখলেন, দেখলেন পিতামহ, অর্বাচীনটার কাণ্ড! কোথাকার হীনজাতের কর্ণকে দিয়ে বসল অঙ্গরাজ্যের মতো ধনৈশ্বর্যে সমৃদ্ধ একটা দেশ! দুরাত্মারাই এ রকম কাজ করতে পারে শুধু। আপনি কিছু বলুন পিতামহ, চুপ করে থাকবেন না। দুর্যোধনের এই অরাজকতা ঠেকান, নইলে কুরুরাজসিংহাসন টলে যাবে।’
বিদুরের হাহাকার-আর্তনাদে সাড়া দেন না পিতামহ ভীষ্ম। নিষ্পলক চোখে রঙ্গভূমির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
দুর্যোধন কর্ণের জাতিসংস্কার ঘুচিয়ে দিয়ে তাকে রাজসম্মান দিল। এতে কর্ণের মর্যাদা বাড়ল, দুর্যোধনের তৃপ্তি বাড়ল। কিন্তু ক্রোধ বাড়ল ভীমের। অদূরে দাঁড়িয়ে সে কর্ণ-দুর্যোধনের হাত কচলাকচলি দেখল, দুর্যোধনের অতি আবেগী নাচানাচিটাও চোখ এড়াল না ভীমের। এগুলো দেখেশুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না দুর্যোধনের চিরকালীন প্রতিস্পর্ধী ভীম। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল কর্ণের ওপর।
ভীম তাচ্ছিল্য করে কর্ণের উদ্দেশে বলল, ‘আরে বেটা সারথির পো কর্ণ, ওই মোটা মাথা দুর্যোধনের মাথায় না হয় ঘিলু নেই, তোর মাথায়ও বেটা সব গোবর নাকি রে?’
ভীমের কটুবাক্য নিম্ন স্বরে হলো না। তার নোংরা কথাগুলো রঙ্গমঞ্চ ছাড়িয়ে দর্শকমণ্ডলীর কান পর্যন্ত পৌঁছল। তারা উৎকর্ণ হল। ভীমের কদাচারের জন্য দুর্যোধন প্রস্তুত ছিল না, কৰ্ণ তো নয়ই! কুরু আর পাণ্ডব জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাই জানত কর্ণ এবং অরণ্যচারী অজ্ঞাত পাণ্ডবরা রাজপ্রাসাদে সাড়ম্বর অভ্যর্থনা পেয়ে বসবাস শুরু করেছে—এও কর্ণের অজানা নয়। দুই ভাইয়ের সন্তান হলেও উভয়পক্ষ সৌভ্রাতৃত্বের মধ্যে জীবনযাপন করছে—এ রকমই বিশ্বাস করত কৰ্ণ। কিন্তু আজ এ কী শুনছে সে! এমন দুর্ব্যবহার! তাও মধ্যম পাণ্ডব ভীমের মুখ থেকে! একেবারেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কর্ণ। কী আশ্চর্য! মনোমালিন্যটা না হয় উভয়পক্ষের মধ্যে আছে, ধরে নিচ্ছি—মন কষাকষিটা বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে, তাই বলে রঙ্গভূতিতে, বহুজনের সামনে এ রকম করে দুর্ব্যবহার করল ভীম- ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না কর্ণ।
এই সময় ভীমের ক্লেদময় কথা কর্ণের কানে আবার এসে ঝাপটা দিল। চোখমুখ পাকিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা সামনের দিকে সজোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ভীম বলল, ‘তুই কীসের যোদ্ধা রে কর্ণ? সারথিপুত্র আবার যোদ্ধা হয়েছে! শোন কর্ণ, তুই যতই তির-ধনুক দিয়ে ভেলকি দেখাস না কেন, তুই বেটা অর্জুনের পায়ের নখের যোগ্যও না।’
ভীমের কথা শুনে কর্ণের বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠল, মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল তার। কী বলবে—দিশা পেল না সে। ব্ৰিত মুহ্যমান চোখে দুর্যোধনের দিকে তাকাল কর্ণ। দুর্যোধনের ও দিশেহারা অবস্থা তখন। কর্ণকে পাওয়ার আনন্দ তখন তার মন থেকে উবে গেছে। সেখানে ক্রোধ ঘূর্ণি পাকিয়ে উঠল। তার বুঝতে মোটেই অসুবিধা হলো না যে, ভীম ইচ্ছে করে এই ঘোঁটটা পাকাচ্ছে। সে হয়তো অনুমান করছে, কর্ণ-দুর্যোধনের বন্ধুত্ব পাণ্ডবদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, অস্ত্রক্ষমতায় কুরু ও পাণ্ডব নামের দুটি পাল্লায় সমতা চলে আসবে। তাই কর্ণ-দুর্যোধনের সখ্যের বন্ধন তছনছ করে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে ভীম।
ভীমের পরিকল্পনা কিছুতেই বাস্তবায়িত হতে দেবে না দুর্যোধন। উচিত জবাব দেওয়ার জন্য ভীমের দিকে ঘুরে দাঁড়াল দুর্যোধন।
ওই সময় ভীম পুনরায় বলা শুরু করল, ‘অর্জুনের প্রতিপক্ষ হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল কৰ্ণ। তুই এক কাজ কর, বাপ-পিতামহ এতকাল যে কাজটি করে এসেছে, তুইও সেই কাজটি কর। ঘোড়ার রশি হাতে নিয়ে রথ চালানো শুরু কর রে বেটা। আর ওই অকালকুষ্মাণ্ড দুর্যোধনটা তোকে করে দিয়েছে অঙ্গরাজ্যের নরপতি! রাজ্য চালনার কী গুণটা তোর কাছে আছে রে কর্ণ?’
কর্ণের অবস্থা ডাঙায় তোলা মাছের মতো। কথা বলার মতো সংবিৎ নেই তার। অসহায় চোখে সে ভীমের দিকে তাকিয়ে থাকল।
দুর্যোধন তখন আর চুপ থাকল না। চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বন্ধু কর্ণ অঙ্গরাজ্য চালাতে পারবে কি পারবে না, সে আমি দেখব। তুই বলার কে রে ভীম? তুই একটা পরগাছা। পাঁচজন দামড়া রাজপ্রাসাদে বসে বসে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অন্ন ধ্বংস করছিস। সেই তুই এসেছিস কর্ণের যুদ্ধদক্ষতার হদিস নিতে! দেখলি না কর্ণ ধনুর্বিদ্যায় কী রকম দক্ষ? তোর ভাই, ওই অর্জুন, যার জন্য তোর এত গর্ব, কর্ণের সামনে কী রকম গুটিয়ে গেল, দেখলি না?’
দুর্যোধনের কথা কানে তুলল না ভীম। তার লক্ষ্য তখনো কর্ণ। সে বলল, ‘শোন কর্ণ, তুই একটা লোভী কুকুর ছাড়া কিছুই নস। কুকুর যেমন আহুতির উচ্ছিষ্ট খাওয়ার লোভে যজ্ঞের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ে, তুইও সেই উচ্ছিষ্টলোভী কুত্তার মতো দাঁড়িয়ে সুখের লেজ নাড়ছিস। তোর লেজ নাড়া আমি থামিয়ে দেব রে কর্ণ!’
এ কর্ণকে অপমান করার জন্যই অপমান করা। কৃপাচার্যের কথাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে দুর্যোধন কর্ণকে গোটা একটা রাজ্যই দিয়ে বসল। এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারল না ভীম। তাছাড়া সহোদর অর্জুনের প্রতিস্পর্ধী হয়ে দাঁড়াল কৌলীন্যহীন কর্ণ! মেনে নেয় কী করে ভীম? তাই দুর্যোধনের ওপর যত রাগ ছিল ভীমের, তার সবই কর্ণকে দিয়ে মিটিয়ে দিতে চাইল সে।
এবার শেষ অস্ত্রটা ছাড়ল ভীম, ‘তুই তো অধিরথের পালকপুত্র রে বেটা! তোর জন্মের কোনো ইতিহাস-ভূগোল আছে নাকি?’
ভীমের কদর্য আস্ফালন আর সহ্য করল না দুর্যোধন। সাপের মতো হিংসানো গলায় বলে উঠল, ‘কথাটা তুই একেবারেই সঠিক বলিসনি ভীম। তোর কথায় মিথ্যার মিশেল আছে। শোন ভীম, ক্ষত্রিয়পুরুষের কাছে নিজের বাহুবলটাই একমাত্র পরিচয়, অন্য কিছু নয়। অবশ্য তুই তা জানবি কী করে? তুই তো বনেবাদাড়ে জন্ম নেওয়া বালক! জীবনের পনেরো-ষোলোটা বছর তো বনমানুষদের সঙ্গেই কাটিয়ে এলি! সেই তুই ক্ষত্রিয়সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবি কী করে!’
দুর্যোধনের এসব কথা মাথাগরম ভীম সহ্য করল না।
সগর্জনে বলল, ‘তুই কী বলতে চাইছিস রে দুর্যোধন?’
দুর্যোধন ততোধিক ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘তুই ভীম কর্ণের জন্ম-ইতিহাস জানতে চাইছিস! হাসালি তুই। কী আশ্চর্য, কে কার জন্ম-ইতিহাস খোঁজে! শোন, তোকে একটা কথা বলি ভীম—মহা মহা বীর আর নদীর জন্ম-ইতিহাস খুঁজতে যাস না। ভুল করবি। কারণ কী খুঁজতে গিয়ে কী পেয়ে যাস, তার তো কোনো ঠিকঠিকানা নেই! দেবসেনাপতি কার্তিককে কার ছেলে বলবি তুই—রুদ্রের ছেলে? অগ্নির ছেলে? নাকি গঙ্গার ছেলে? নিজেদের দিকে তাকা না একবার, তোর প্রশ্নের উত্তরটা আপনাতেই পেয়ে যাবি।’
সাতাশ
দ্রোণ-কৃপের সামনে দাঁড়িয়েই কথাগুলো বলল দুর্যোধন।
মহা মহা বীর বলতে কাদের বোঝাল দুর্যোধন, ভীম বুঝল না। কিন্তু যাঁরা বোঝার তাঁরা বুঝে গেলেন। এই শব্দ তিনটি যে তাঁদেরকেই লক্ষ করে, বুঝতে অসুবিধা হলো না দ্রোণাচার্য আর কৃপাচার্যের। দ্রোণাচার্য জননী পরিত্যক্ত, পিতার আশ্রমে লালিতপালিত। পিতা তাঁর ঋষি, মহর্ষি ভরদ্বাজ। মাতা কোনো ব্রাহ্মণী বা ক্ষত্রিয়া নন। স্বর্গের সামান্য একজন অপ্সরা-ঘৃতাচী। ইন্দ্রের আদেশে অন্যের কামার্তি মিটানোই যাঁর কাজ। সুতরাং মায়ের দিক থেকে অহংকার করার কিছুই নেই দ্রোণাচার্যের। আর কৃপাচার্যের ব্যাপারটা তো আরও জটিল! পিতা-মাতা দুজন দ্বারাই পরিত্যাজ্য তিনি। রাজা শান্তনুর কৃপায় বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা। তাই তো দুর্যোধনের কণ্ঠস্বর নিষ্কম্প, দৃঢ়!
দুর্যোধনের কথার ইঙ্গিতটা দ্রোণ-কৃপ বুঝে গিয়েছিলেন। তাই মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলেন।
মহাবীর দুজন দুর্যোধনের কথার মর্মার্থ বুঝলেও ভীমের বোধগম্য হলো না।
গলা উঁচিয়ে বলল, ‘রাখ তোর ওসব বড় বড় কথা! আগে ওই কর্ণ বেটার আসল বাপের নাম বলতে বল, তার প্রকৃত মায়ের পরিচয় জানাতে বল।’
এবার মাথাটা নিচের দিকে নামাল দুর্যোধন। চোখ বন্ধ করল। অল্পক্ষণ কী যেন ভাবল গভীরভাবে। তারপর চোখ খুলল। ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকাল। অদৃশ্যমান কারও উদ্দেশে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। হয়তো স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল দুর্যোধন। তারপর দুর্যোধনের দু-চোখ ক্রোধে ধক ধক করে উঠল।
উদ্ধত কণ্ঠে বলল, ‘আমি ব্যাপারটা ওখানেই শেষ করতে চেয়েছিলাম। তুই শেষ করতে দিলি না ভীম। জানি, তুই দুর্বিনীত। ছোট ভাইদের বারণ শুনবি না। কিন্তু জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের নিষেধ তো মানতি! কিন্তু যে নিষেধ করবে, সে তো জড়ভরত হয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে! তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কর্ণের ব্যাপারটি এখানেই শেষ হোক, চায় না যুধিষ্ঠির। তাই তো সে মূক, বধির!’
‘রাখ তোর কথার কচকচানি। আমি প্রশ্ন করেছি, তোর জানা থাকলে আমার প্রশ্নের উত্তর তুই দে। তোর ওই বন্ধু কর্ণ, তার মুখ তো সেলাই করে দিয়েছি অনেক আগে।’
এবার দুদিকে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল দুর্যোধন। খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। তার পর স্পষ্ট গলায় বলল, ‘একটু আগে ইঙ্গিতে বলেছি, নিজেদের দিকে তাকাবার জন্য। শুনলি না তুই! বুদ্ধিমান হলে থেমে যেতিস। থামবি কী করে? যে জাগ্রত অবস্থার সমস্ত সময়টাই কাটায় খাবারের চিন্তা করে, সে কী করে বুঝবে আমার কথার ইশারা-ইঙ্গিত?’
ভীম উতালমাতাল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওরে কুরুসাম্রাজ্যের চিন্তাবিদ রে! ওরে জ্ঞানী বৃহস্পতি রে! তোর ইশারা-ইঙ্গিতের মাথায় থুতু ছিটাই আমি। ইঙ্গিত ছাড়, স্পষ্ট করে বল কী বলতে চাইছিস তুই।’
দুর্যোধন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। সে জানে তার পরের কথাগুলো মারাত্মক। এই কথাগুলো পঞ্চপাণ্ডবের মাথা হেঁট তো করবেই, গোটা কুরুবংশটাই লজ্জার সম্মুখীন হবে। এই গভীর গহিন লজ্জার হাত থেকে পাণ্ডবদের বাঁচাবার জন্য এতক্ষণ দোনোমনো করে গেছে দুর্যোধন। বলি বলি করেও বলেনি। কিন্তু ভীমের ঔদ্ধত্য আর দুর্ব্যবহার এত বেড়ে যাচ্ছে যে নিজেকে ধরে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল দুর্যোধনের। ক্রোধ তাকে উতলা করে তুলল। সেই ক্রোধ দমন করে দুর্যোধন শেষ চেষ্টাটা করল।
বলল, ‘ভীম, তুই এখানেই থেমে যা, আর এগোস না। আমার মাথাটা আর নষ্ট করে দিস না।’ ভীম এবার সমস্ত রঙ্গভূমি কাঁপিয়ে হেসে উঠল। তার বিকৃত কণ্ঠের হাসিটা আর থামতেই চায় না। সরোষে দুর্যোধনের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে এলো ভীম। তার রুদ্রমূর্তি দেখে কর্ণ দুর্যোধনকে আড়াল করে দাঁড়াল।
ওই অবস্থাতেই ভীম বলে, ‘জন্মপরিচয়হীন কর্ণকে বাঁচাতে গিয়ে কী কথা বলতে এত ইতস্তত করছিস তুই দুর্যোধন? সৎসাহস থাকলে বল না, বলেই ফেল না তোর গলার তলায় আটকানো তথাকথিত সত্যবচনটি।’
দুর্যোধন এবার অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘তুই কর্ণের জন্মপরিচয় জানতে চাইছিস, তার আগে নিজের জন্মঠিকুজির কথা বল। তোর পিতার নাম কী বল। তোর অন্য চার ভাই কীভাবে জন্ম নিল, তার ইতিহাস বল। তুই জানিস কি না জানি না, আমরা জানি। ওই দূরে-কাছে দাঁড়ানো-উপবিষ্টদের সকলেই জানে, তোর বাপ পাণ্ডু নপুংসক ছিলেন। নপুংসক মানে তো জানিস—ক্লীব, হিজড়া। তো হিজড়া হয়ে তোর বাপ পাণ্ডু তোদের জন্ম দিলেন কী করে? ভেবে দেখ, তোরা কার সন্তান! কার ঔরসে জন্ম তোদের? তোরা তো জারজ ছাড়া আর কিছুই নস!’
দুর্যোধনের উচিত কথা শুনে ভীমের সকল লম্ফঝম্প আচমকা থেমে গেল। তার কণ্ঠশক্তি হঠাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকল না। তার মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেল।
এবার ভীমের আরও নিকটে এগিয়ে দুর্যোধন অত্যন্ত নিচু গলায় বলল, ‘আমি এসব নোংরা কথা বলতে চাইনি ভীম। তুমিই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেই প্রথম থেকে রক্তাক্ত করে যাচ্ছ বন্ধু কৰ্ণকে, আমাকে। অনেক চেষ্টা করলাম তোমাকে নোংরা কথাবার্তা থেকে বিরত করতে, কিন্তু পারলাম না। বাধ্য হলাম তোমাদের আসল দুর্বলতায় হাত দিতে।’
ভীম ফানুসের মতো চুপসে গেছে। জোঁকের মুখে নুন দিলে জোঁক যেমন করে কুঁকড়ে যায়, ভীমেরও সেরকম অবস্থা।
দুর্যোধন অদ্ভুত ভঙ্গি করে হাসল একটু। সেই হাসিতে গর্ব আর তেজ। দুর্যোধন বলল, ‘এই কর্ণকে নিয়ে বারবার প্রশ্ন করছিলে তুমি ভীম। একবার ভালো করে চেয়ে দেখ কর্ণের দিকে। এতক্ষণ কর্ণকে ঘৃণা আর অবহেলার চোখে দেখে গেছ। এবার একটু নিরপেক্ষ চোখে তাকাও কর্ণের দিকে! কী দেখছ ভীম? আদিত্যবর্ণের এই যুবকটির দিকে তাকিয়ে তোমার কী মনে হচ্ছে? ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে, না ভালোবেসে নিজের বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করছে? তোমার সামনে যে লোকটিকে দেখছ সহজাত কবচকুণ্ডল নিয়ে জন্মেছে সে! তুমি এই ভারতবর্ষের শুধু আরেকজন লোকের নাম বলো, যে কর্ণের মতো ঐশ্বর্যময় হয়ে জন্মেছে। বলতে পারবে না। কর্ণের মতো আর কোনো দ্বিতীয়জন নেই বলেই আমি তাকে বন্ধু হিসেবে বুকে জড়িয়েছি, এককথায় অঙ্গরাজ্য দান করেছি। ওর মতো বীর্যশালী বন্ধুকে শুধু অঙ্গরাজ্য কেন, আরও আরও রাজ্য দিয়ে দিতে দ্বিধা করব না আমি।’
কর্ণ অবাক হয়ে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়েছিল। দুর্যোধনের কথা শুনে তার অন্তর আবেগে থর থর করতে লাগল। এ কী বলছে দুর্যোধন! আমাকে নিয়ে এ রকম করে ভাবে সে! সে যে দেখতে খুব সুন্দর, আয়নায় ভালো করে দেখেনি তো কখনো! আর ওই যে কবচকুণ্ডল নিয়ে জন্মানো! বিরল কোনো ঘটনা নাকি ওটা? হবেই-বা! নইলে এমন করে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলবে কেন দুর্যোধন? ওভাবে জন্মানো নিশ্চয়ই অদ্ভুত কিছু, বিস্ময়ের কিছু! আর ওই যে অঙ্গরাজ্য দান করার ব্যাপারে যে-কথাটি বলল দুর্যোধন, তা তো বিশ্বাস করতেই চাইছে না মন! এ রকম করে ভাবতে ভাবতে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল কৰ্ণ!
তারপর বলল, ‘তোমার সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। সেই বাল্যকালে বারকয়েক দেখা, দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় ওই দিনটি আর আজকের এই সময়টুকু। এত অল্পসময়ের মধ্যে তুমি আমাকে এত ভালোবেসে ফেললে বন্ধু! আমার কাছে কারো প্রত্যাশা থাকতে পারে, কল্পনাই করিনি। তুমি আমার মতো অতি সাধারণ একজন মানুষকে রাজসিংহাসনে বসালে বন্ধু! কী করলে তোমার এ ঋণের শোধ দিতে পারব, জানি না।’
ভীম তখন এক পা দু-পা করে বেশ দূরে সরে গেছে।
দুর্যোধন কর্ণের হাত ধরে বলল, ‘দীর্ঘদিন ধরে পঞ্চপাণ্ডব, বিশেষ করে ভীমের অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছিলাম আমরা, কুরুভাইয়েরা। যতদূর পারি ঠেকিয়েছি। অস্ত্রপাঠশালায় এসে দেখলাম, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ধনুর্বিদ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেছে। বড় হীনম্মন্যতায় ভুগছিলাম কর্ণ। এমনিতে পিতা ধৃতরাষ্ট্র বিদুরদের কূটচালে কুরুরাজা হতে পারেননি। ভারপ্রাপ্ত হয়েই থাকলেন। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল, আমাদের দিয়ে দুঃখ ভুলবেন। কিন্তু তাও ভেস্তে যেতে বসেছে। যুদ্ধবিদ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে পাণ্ডবরা। একমাত্র তুমিই পারলে সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অর্জুনকে কুপোকাত করতে। আমার বহুদিনের হীনম্মন্যতা ঘুচে গেল। আমার মনে হলো, ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র আর অসহায় নয়। তুমি আমাদের সহায় হয়ে উপস্থিত হলে বন্ধু!
কর্ণ অকস্মাৎ বুকের একেবারে গভীরে দুর্যোধনকে টেনে নিল। তৃপ্তিতে দুর্যোধনের চোখ বুজে এলো।
আটাশ
অস্ত্র-পরীক্ষা নেওয়ার পালা শেষ। এবার প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। ঋণ শোধ করার কাল। দ্রোণাচার্যকে অপমান করার প্রতিশোধ। গুরুর কাছে অস্ত্রবিদ্যা গ্রহণের ঋণ।
এতদিন দ্রোণাচার্যের বুকের তলায় তুষের আগুনের মতো জ্বলে গেছে সেই বাক্যটি—একদিন আমি এই অপমানের প্রতিশোধ নেব দ্রুপদ। তোমার এই রাজ্য লন্ডভন্ড করে ছাড়ব। ঐশ্বর্যে আগুন লাগাব!
পাঞ্চালরাজা দ্রুপদের ঐশ্বর্যে আগুন লাগানোর সময় এসে গেছে।
ব্রাহ্মণপুত্র হয়েও দ্রোণ ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি গ্রহণ করেননি। দ্রোণ রজোগুণের জাতক। তিনি ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্রশিক্ষায় প্রণোদিত হয়েছিলেন। যজন যাজন-অধ্যাপনার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়ার কারণে ব্রাহ্মণসমাজ তাঁকে বর্জন করেছিল। এতে হতোদ্যম না হয়ে অস্ত্রবিদ্যার দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়েছেন দ্রোণ। তাঁর বিশ্বাস – ব্রাহ্মণ্যজীবনে ভিক্ষাবৃত্তিই সার। শুধু ধনবানদের করুণার ওপরই বেঁচে থাকতে হয়। এই ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণা করেন দ্রোণ। কিন্তু বিধির বিপাকে একদিন এক ধনশালী রাজার সামনে হাত পাততে হয়েছিল দ্রোণকে। সেই কাহিনি একটু পরের। তার আগে কিছু বৃত্তান্ত আছে।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম অস্ত্রগুরু পরশুরামের কাছে অস্ত্রপাঠ নিয়েছিলেন দ্রোণ। তাঁর অর্জিত সকল অস্ত্রবিদ্যা উজাড় করে দিয়েছিলেন দ্রোণকে, পরশুরাম। কালক্রমে দ্রোণ অস্ত্রবিদ হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু ধনশালী হয়ে উঠতে পারেননি। দারিদ্র্য তার পিছু ছাড়েনি। ইতোমধ্যে বিয়ে করে ফেলেছেন তিনি। পুত্রও জন্মে গেছে একজন—অশ্বত্থামা। দারিদ্র্যের কারণে পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে পারেন না। সন্তানের ছোট ছোট আবদার পূরণেও অক্ষম দ্রোণ। এমনকি গাভীদুগ্ধ, যা অশ্বত্থামার শরীরবৃদ্ধির জন্য সবিশেষ প্রয়োজন, তাও জোগাড়ে অক্ষম তিনি। অভাবে তাঁর চিন্তাশক্তি লুপ্ত হওয়ার উপক্রম।
ঠিক এই সময়ে বাল্য সহপাঠীবন্ধু দ্রুপদের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল দ্রোণের। কিছু সাহায্য লাভের আশায় গিয়েছিলেনও তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে। রাজা দ্রুপদ দ্রোণের বন্ধুত্ব অস্বীকার করে বসেছিল। শুধু তা-ই নয়, একদিনের আহার্য ভিক্ষা দিতে চেয়েছিল দ্রোণকে। রাজদরবারে এই লাঞ্ছনা-অপমানের কথা ভোলেননি দ্রোণ। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন প্রতিশোধ নেওয়ার। দ্রুপদকে বলে এসেছিলেন—তোমার এই রাজ্য লন্ডভন্ড করে ছাড়ব।
অনেকটা প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্পে কুরুকুলের অস্ত্রশিক্ষক হয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। গভীর নিষ্ঠায় কুরুপাণ্ডবদের শিক্ষা অধ্যায় সম্পন্ন করেছেন।
একদিন সকল ছাত্রকে অস্ত্রপাঠশালায় ডেকে পাঠালেন আচার্য। প্রত্যেকের ওপর নিষ্পলক দৃষ্টি ফেললেন। তারপর ঊর্ধ্বাকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ওই সময় দীর্ঘ এক শ্বাস তাঁর বুক চিরে বেরিয়ে এলো।
সমবেত শিষ্যদের লক্ষ করে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘তোমাদের অস্ত্রবিদ্যাগ্রহণ শেষ হয়েছে বৎসরা। এবার তো আমাকে কিছু দিতে হবে তোমাদের!’
দুর্যোধন বলল, ‘কী দেব গুরুদেব, আমাকে বলুন। আপনি যা চাইবেন, তা-ই দেব আমি।’
দুর্যোধনের কথা শুনে মৃদু একটু হাসলেন গুরুদেব। দুর্যোধনের কথায় তিনি খুব একটা ভরসা পেলেন বলে মনে হলো না। তিনি অর্জুনের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন।
বললেন, ‘গুরুদক্ষিণা বলে শাস্ত্রে একটা কথা আছে। শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকের প্রাপ্যতাকে গুরুদক্ষিণা বলে। গুরুদক্ষিণা একধরনের ঋণও বটে। গুরুর প্রতি ঋণ। শাস্ত্রে যেমন মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, সমাজঋণের কথা আছে, গুরুঋণও সেরকম। শিষ্যদের এই ঋণ শোধ করতেই হয়।’
একটুক্ষণ নীরব থাকলেন দ্রোণাচার্য। তারপর উন্মুক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা কি সম্মত আছ সেই ঋণ শোধ করতে?’
কুরুভাইয়েরা সবার আগে পাণ্ডবদের কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, ‘আমরা রাজি গুরুদেব। বলুন কী করতে হবে?’
দ্রোণাচার্য এবার কণ্ঠকে কখনো চিকন করে, কখনো আবেগাপ্লুত করে তাঁর এবং পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের সকল কথা বলে গেলেন। শেষদিনের অপমান-অপদস্থতার কথা বললেন যখন, তখন তাঁর কণ্ঠ অপমানে থমথমে, চোখমুখ বিপন্নে ব্যাকুল। ছাত্ররা গুরুর অমর্যাদায় ক্ষিপ্ত হলো, কণ্ঠস্বরে প্রচণ্ড প্রভাবিত হলো।
কেউ কিছু বলবার আগে দ্রোণাচার্য আবার বললেন, ‘গুরুদক্ষিণা এমন একটা জিনিস, যাতে ছাত্রদের ‘না’ বলার উপায় নেই। তোমরা কি ‘না’ বলতে চাও বাছারা?’
‘না গুরুদেব। আপনার প্রস্তাবে আমরা ‘না’ বলব না কিছুতেই।’ পাঠশালার অঙ্গন ছাড়িয়ে কুরুপাণ্ডবের কণ্ঠধ্বনি হস্তিনাপুরের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।
ছাত্রদের কথা শুনে পরম তৃপ্তিবোধ করলেন দ্রোণাচার্য। দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে আনতে হবে আমার কাছে। পারবে তোমরা?’
গুরুর কথা শুনে যৌবনোদ্ধত রাজকুমাররা হুড়মুড় করে অস্ত্রাগারের দিকে দৌড়ে গেল। অনেকটা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রণসাজে সজ্জিত হলো। কুরু ও পাণ্ডব—উভয়পক্ষ বেরিয়েও পড়ল দ্রুপদকে ধরে আনবার জন্য। এদের কেউ ভাবল না যে যাকে ধরে আনতে যাচ্ছে, তার সামরিক শক্তি কতটুকু প্রবল? দ্রুপদশক্তির সঙ্গে তারা পেরে উঠবে কি না?
এদিকে দ্রোণাচার্যও ভাবলেন না ছাত্রদের দ্রুপদের প্রতি লেলিয়ে দেওয়ার আগে কুরুবাড়ির কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত কিনা? তবে এটা ঠিক যে, রাজকুমারদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার আগে দ্রোণাচার্য পিতামহের কাছে তাঁর প্রতিশোধস্পৃহার কথা বলে রেখেছিলেন। তাছাড়া বিধান আছে যে, একজন শিক্ষকের তাঁর ছাত্রের কাছে গুরুদক্ষিণা চাওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে।
তড়িঘড়ি করে পাণ্ডবদের আগেই দুর্যোধন তার ভাইদের নিয়ে পাঞ্চালরাজ্য আক্রমণ করে বসেছিল। কর্ণও কুরুভাইদের সঙ্গে ছিল এই অভিযানে। কিন্তু দ্রুপদ আক্রমণকারীদের পর্যুদস্ত করে ছেড়েছিল। কোনোরকমে প্রাণটা হাতে নিয়ে পালাতে শুরু করেছিল দুর্যোধনরা। ওই সময় সশস্ত্র পাণ্ডবরা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত না হলে কুরুরাজপ্রাসাদে বিলাপ শুরু হতো।
এই যুদ্ধে অর্জুন আর ভীম নেতৃত্বে ছিল। ভীমের প্রলয়ঙ্করী গদাঘাতে বহু পাঞ্চাল সৈন্যের মৃত্যু হলো। বিধ্বস্ত দ্রুপদ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে গিয়ে অর্জুনের হাতে জীবন্ত ধরা পড়ল।
অর্জুন সসম্মানে দ্রুপদকে দ্রোণাচার্যের সামনে হাজির করল।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল দ্রুপদ।
দ্রোণাচার্য ব্যঙ্গ কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার কি আমার কথা মনে আছে দ্রুপদ? বলেছিলাম নাতোমার রাজপাট বিধ্বস্ত করে ছাড়ব আমি! এখন তোমার রাজধানী আমার কব্জায়! তোমার পাঞ্চালরাজ্য গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছে আমার ছাত্ররা। এখন কী করবে তুমি? হাঁটু গেঁড়ে বসবে আমার সামনে? প্রাণভিক্ষা চাইবে?
দ্রুপদ নিরুত্তর। তার বলার কিছু নেই যে! ও-ই তো বলেছিল, রাজায় রাজায় বন্ধুত্ব হয়। একজন ভিক্ষুকপ্রায় ব্রাহ্মণের সঙ্গে পাঞ্চাল দেশের মতো একটা সমৃদ্ধ দেশের নৃপতির বন্ধুত্বের কথা তুমি বলো কী করে দ্রোণ?
এই সময় দ্রোণাচার্য আবার বলে উঠলেন, ‘আজ নিজের জোরে তোমার রাজ্য আমি দখল করে নিয়েছি দ্রুপদ। তুমি এখন আমার কৃপার পাত্র। আমি চাইলে তোমাকে প্রাণদণ্ড দিতে পারি। কিন্তু তা আমি করব না। তুমি অস্বীকার করতে পার, কিন্তু আমি ভুলিনি যে এককালে তুমি আমার বন্ধু ছিলে। সেই সখ্যের জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে একেবারে নিঃস্ব করে দেব না। তবে একটা শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে দ্রুপদ।
দ্রুপদ চকিতে দ্রোণাচার্যের দিকে তাকাল।
দ্রোণাচার্য বললেন, ‘তোমার অর্ধেক রাজ্য কেড়ে নিচ্ছি আমি। গঙ্গার উত্তর তীরের পাঞ্চালরাজ্য আমার। আর দক্ষিণ তীরের রাজ্যটুকু তোমাকে দান করলাম আমি। এখন আমি রাজা। এখন তো আমার বন্ধুত্ব স্বীকার করবে তুমি?’
দ্রোণাচার্যের কথা না মেনে উপায় নেই দ্রুপদের। বিজিতকে জয়ীর সঙ্গে তর্ক করতে নেই—জানে দ্রুপদ। তাই দ্রোণাচার্যের প্রস্তাব দ্রুপদ মাথা পেতে নিল।
বহু বছর অপেক্ষার পর দ্রোণাচার্যের প্রতিশোধ নেওয়া হলো। ছাত্ররা গুরুদক্ষিণা দিতে পেরে তৃপ্তি পেল খুব।
উনত্রিশ
পাঞ্চালজয়ে পাণ্ডবরা তৃপ্তি পেলেও দুর্যোধনের ক্ষিপ্ততার অবধি থাকল না।
তার হৃদয় বেদনা-হাহাকারে ভরে উঠল। তার অভিমান-অহংকার যে ধূলিসাৎ হয়ে গেল! পাঞ্চাল অভিযানে তারা শতভাই অংশ নিয়েছে। সঙ্গে ধনুর্ধর কর্ণও। কুরুসেনারা তো ছিলই সঙ্গে! তার প্রতিটি ভাই-ই তো এক একজন দুনিয়া কাঁপানো যোদ্ধা! তার পরও তো দ্রুপদের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না তারা! অল্পক্ষণের মধ্যে পিছু হটতে বাধ্য হলো। কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে ফেরা যাকে বলে, অনেকটা সেইরকমই অবস্থা হয়েছিল কুরুভাইদের। শুধু কুরুভাইয়েরা কেন, ওই মহাবিক্রমশালী ধনুর্ধর কর্ণ, সেও কীরকম নিষ্প্রভ হয়ে গেল দ্রুপদের সামনে! আপ্রাণ চেষ্টা করেও দ্রুপদকে বাগে আনতে পারল না কর্ণ। দ্রুপদ আর তার সৈন্যরা নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল তাদের!
আর ঠিক ওই সময়ে উপস্থিত হলো পাণ্ডুপুত্ররা। কী অদ্ভুত রণকৌশলে পাঞ্চালদের মুখোমুখি হলো তারা! অল্পক্ষণের মধ্যেই দ্রুপদের রণহুঙ্কার থেমে গেল। পাঞ্চাল সেনারা পালাতে শুরু করল। মুহূর্তেই জয়োল্লাস শোনা গেল পাণ্ডবদের মধ্যে। পরে পরেই জানা গেল—ভীম-অর্জুনের হাতে দ্রুপদ বন্দি হয়েছে। সকল কৃতিত্ব পেয়ে গেল ওই পাণ্ডুপুত্ররা। আচার্য দ্রোণ ওদের ওপর মহাখুশি হলেন। গোটা হস্তিনাপুর জুড়ে পাণ্ডবদের জয়জয়কার পড়ে গেল। এই জয়ধ্বনি তাদের জন্যও উঠত, যদি তারা দ্রুপদকে পরাজিত করতে পারত! কিন্তু পারল না তো! জয় তো দূরের কথা, পলায়নের কলঙ্ক নিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসতে হলো দুর্যোধনের। এর চেয়ে কষ্টের, এর চেয়ে অপমানের আর কী হতে পারে! তাই তো দুর্যোধনের মন বিষণ্ণ, তাই তো বেদনা-যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে দুর্যোধন! এই যন্ত্রণা যতটুকু না দ্রুপদের কাছে পরাজয়ের জন্য, তার চেয়ে অধিক ভীম আর অর্জুনের জয় পাওয়ার জন্য। ছটফটানির মধ্যে দিন কাটছে দুর্যোধনের।
দ্রুপদের পরাজয়ের দিন থেকে কুরুরাজপ্রাসাদে পাণ্ডবদের মর্যাদা বেড়ে গেল অনেক। দ্রোণ-কৃপের চোখমুখ তৃপ্তিতে ভরা। বিদুরকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তার আপন সন্তানরাই দ্রুপদকে দ্রোণাচার্যের সামনে বেঁধে এনেছে! যুধিষ্ঠিরাদির প্রতি ভীষ্মের আনুকূল্যও বেড়ে গেল অনেকগুণ। ভীষ্ম-বিদুরের প্রচারণায় ধৃতরাষ্ট্রের দরবারে পাণ্ডুপুত্রদের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। পাঞ্চালজয়ের সুবাদেই রাজপ্রাসাদের বাইরে-ভেতরে পাণ্ডবদের অনুকূলে সুবাতাস বইতে শুরু করল।
এই সুযোগটাই নিল বিদুর। একদিন রাজসভায় কথাটা তুলল। ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বিদুর বলল, ‘এখন আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন এসে গেছে দাদা।’
‘সিদ্ধান্ত! কীসের সিদ্ধান্তের কথা বলছ তুমি বিদুর?’ জিজ্ঞেস করলেন ধৃতরাষ্ট্র।
উত্তর দেওয়ার আগে পিতামহ ভীষ্মের মুখের দিকে একবার তাকাল বিদুর। সেখানে সম্মতির আভাস। বলার আগে নিজের মধ্যে নিজেকে বেশ করে গুছিয়ে নিল বিদুর। তারপর মোলায়েম কণ্ঠে বলল, ‘যুবরাজ সম্পর্কে বলছিলাম দাদা। ভারপ্রাপ্ত হলেও আপনিই তো দীর্ঘদিন ধরে কুরুরাজ্যের রাজা! দাদা পাণ্ডু যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন আপনার মনে অস্থিরতা থাকলেও এখন তো সেই অস্থিরতা কেটে গেছে দাদা। এখন আপনি কুরুসাম্রাজ্যের সর্বসম্মত শাসক।’
‘বলছ তুমি! তোমার পাশে নিশ্চয়ই পিতামহ আছেন, আছেন কৃপাচার্য, কৃতবর্মা-ওঁদের জিজ্ঞেস করো, পাণ্ডুর মৃত্যুর এতদিন পরেও কেন ওঁরা আমাকে কুরুরাজ্যের আসল রাজা হিসেবে ঘোষণা করেননি?’
একটু থামল ধৃতরাষ্ট্র। তারপর বলল, ‘জানি, তাঁরা আগের কাসুন্দি ঘেঁটে একটা যুক্তি দেবেন। বলবেন, আমি জন্মান্ধ, তাই রাজা হওয়ার অধিকার নেই আমার। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাকে নৃপতি না করার যে অপরাধ তাঁরা করে যাচ্ছেন, তার তো শোধন করতে পারেন তাঁরা!’
বিদুর উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে?’
‘আমার ছেলে দুর্যোধনকে যুবরাজ করে।’
‘দুর্যোধনের চেয়েও বয়সে বড় ছেলে আছে, এই বংশে।’
‘জানি আমি। এই কথাই বলবে তুমি। যুধিষ্ঠিরের নাম উচ্চারণ করবে তুমি। বলি, যুধিষ্ঠিরের জন্মঠিকুজিটা দেখাতে পারবে আমায়? কোন সালের কত তারিখে জন্মেছে যুধিষ্ঠির? নাই তো ঠিকুজি তোমার হাতে! কিন্তু দুর্যোধনের জন্মের নাড়িনক্ষত্র তোমার জানা। কুলপুরোহিত দুর্যোধনের কুষ্ঠি তৈরি করে দিয়েছে ওর জন্মের পরপরই। যুধিষ্ঠিরের কুষ্ঠি থাকলে দুজনের বয়স মিলিয়ে দেখা যেত—কে জ্যেষ্ঠ? কিন্তু তার কোনো উপায় রাখোনি তুমি।’
‘আমি!’ অবাক হয়ে ত্বরিত প্রশ্ন করল বিদুর।
‘তুমি নও তো আর কে? পাণ্ডুপুত্ররা রাজপ্রাসাদে এলো যখন, তুমিই তো সবচাইতে বেশি নাচানাচি শুরু করলে ওদের নিয়ে! নীরব থেকেছি, ধৈর্য ধরেছি। আমার নীরবতার সুযোগ নিয়েছ তুমি। জোরেশোরে প্রচার করতে শুরু করেছিলে— দুর্যোধনের চেয়ে যুধিষ্ঠির বয়োজ্যেষ্ঠ। তোমার প্রচারটা এত আবেগঘন ছিল যে রাজদরবারের রাজন্যরা, নগরের গণ্যমান্যরা, হস্তিনাপুরের সাধারণরা বিশ্বাস করেছে তোমার কথা।’
‘এসব কী বলছেন দাদা? যা সত্য তাই-ই তো বলেছি আমি!’
‘তুমি কি ঠিক কথাটাই বলছ বিদুর? যা সত্য, তাই-ই বলেছ? তুমি যুধিষ্ঠিরের জন্মতারিখ জান? জান না। ওরা অরণ্যে, তুমি তখন রাজপ্রাসাদে! এ তোমার ষড়যন্ত্র বিদুর। এই ষড়যন্ত্রে যিনি বাধা দিতে পারতেন, তিনি পিতামহ ভীষ্ম। কিন্তু কোন স্বার্থের কারণে জানি না, তোমার দূরদর্শী ষড়যন্ত্রে পিতামহ নীরব থেকেছেন। নীরবতা তো সম্মতিরই লক্ষণ! এখন রাজ্যের অবস্থা এমন যে আমি যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠতা যদি অস্বীকার করি, তাহলে সবাই বলবেন, আমি শুধু দুর্যোধনকে যুবরাজ করবার জন্য এই প্রশ্নটা করছি।’
গোটা রাজসভা নীরব, নিস্তব্ধ। ধৃতরাষ্ট্র আশা করেছিল—তার এ সকল কথাবার্তার পর পিতামহ কিছু একটা বলবেন। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, তিনি কিছুই বললেন না!
প্রকৃতপক্ষে কিছুই তো বলার ছিল না পিতামহ ভীষ্মের! যুধিষ্ঠিরের জন্মতারিখ নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের যে প্রশ্ন, তার উত্তর কি ভীষ্মের কাছে আছে? নেই তো! যুধিষ্ঠির বয়সে বড়—এই কথাটি তো তাঁরই প্রশ্রয়ে পাণ্ডবদের সেই আগমনের দিনটি থেকে বলে যাচ্ছে বিদুর। নিশ্চিত না হয়ে এ রকম অনৃতভাষণ করে যাওয়া অপরাধেরই শামিল! সেই মিথ্যে প্রচারের জোরে যুধিষ্ঠির আজ পাণ্ডবকুরুদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র। আজ ধৃতরাষ্ট্র চাইলেও সেই অনৃত প্রচারকে মিথ্যে বলে প্ৰমাণ করতে পারবে না। ধৃতরাষ্ট্র একসময় পারত বিদুরের মিথ্যে প্রচারকে থামিয়ে দিতে। পাণ্ডবরা আসার পর প্রথমবার যখন কথাটি তার কানে এসেছিল, সেদিনই আজকের প্রশ্নটা তুলতে পারত সে। তাতে বিদুরের অনৃতভাষণ থেমে যেত। কিন্তু ওই সময় ধৃতরাষ্ট্র ব্যাপারটাকে তত বেশি গুরুত্ব দেয়নি। বাধা না পেয়ে বিদুর তার প্রচার চালিয়ে গেছে নির্বিঘ্নে। ব্যাপারটি আজ কাল হয়ে উপস্থিত হয়েছে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের জীবনে। আজ বিদুরকে ফেরানোর কোনো উপায় নেই ধৃতরাষ্ট্রের!
এত কথা শোনার পরও নির্লজ্জ বিদুর বলল, ‘বলছিলাম দাদা- আপনারও বয়স হয়ে যাচ্ছে, যুবরাজের পদটি খালি পড়ে আছে বহুদিন। যুধিষ্ঠিরের যুবরাজ হওয়ার মতো বয়স হয়ে গেছে। তাছাড়া পাণ্ডবরা যে যুবরাজ হওয়ার উপযুক্ত, দ্রুপদকে পরাজিত করে প্রমাণ করেছে। যুধিষ্ঠিরদের কারণেই দ্রুপদরাজ্য আজ পরোক্ষভাবে আপনার পদানত। আপনি আর দেরি করবেন না দাদা।’
স্থির কণ্ঠে ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞেস করল, ‘কী করব?’
‘যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা দেন দাদা।’
ধৃতরাষ্ট্র মাথা নাড়ে। ভীষ্মের দিকে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কী বলেন পিতামহ?’
ভীষ্ম নীরবতা ভেঙে অদ্ভুত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘বিদুর ঠিক বলেছে ধৃতরাষ্ট্র।’
ম্লান কণ্ঠে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘পিতামহ, আপনিও!’
Why I cant enter next chapter after reading all page & mark completing the previous chapter?