দুর্যোধন – ১

এক 

দুর্যোধনকে নিকৃষ্ট কয়েদির মতো হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কুরুক্ষেত্রের দিকে। দ্বৈপায়ন হ্রদ থেকে কুরুক্ষেত্র দীর্ঘপথ। এবড়ো-খেবড়ো। দুর্যোধনের পদক্ষেপ মন্থর। কিন্তু দৃঢ়। তার অহংকার ও আত্মবিশ্বাস সেই পদক্ষেপে ঝঙ্কার তুলছে যেন! 

দুর্যোধনের দেহ পরিশ্রান্ত, জলসিক্ত। রুধিরাপ্লুত দুর্যোধনের চোখেমুখে তেজস্বিতা এবং আসন্ন যুদ্ধের ক্রোধ ফেটে বেরোচ্ছে। 

দুর্যোধনকে ঘিরে-বেড়ে চলেছে পঞ্চপাণ্ডব। এবং কৃষ্ণ। সামান্য দূরে সৈন্যাধ্যক্ষ আর সৈন্যরা। সবাই সশস্ত্র। সতর্ক। পদাতিক ছাড়া সবাই বাহনে চড়েছে। যুধিষ্ঠিররা এবং কৃষ্ণ রথারোহণে এগোচ্ছে। অন্য রাজন্যদের কেউ ঘোড়ায়, কেউ হাতিতে, কেউ-বা রথে। দুর্যোধনই শুধু হেঁটে এগোচ্ছে। ইচ্ছে করে হেঁটে যাচ্ছে না দুর্যোধন। তাকে তা করতে বাধ্য করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অষ্টধাতুনির্মিত ভারী গদাটি তার কাঁধে চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গদাটি দুর্যোধনের প্রধান যুদ্ধাস্ত্র। নিত্যসঙ্গী এটি তার। হেলায় বাতাসে ঘূর্ণি তুলতে পারে সে গদাটি দিয়ে। আজ, এই মুহূর্তে নিজের গদাটি নিজের কাঁধে অত্যন্ত দুর্ভর বলে মনে হচ্ছে তার। কেননা দুর্যোধন এখন বিধ্বস্ত, আহত, হতমান। 

এই অবস্থাতেও দুর্যোধন হেঁটে চলেছে। উন্নত মস্তক তার। প্রতিটি পদক্ষেপ রাজোচিত। কে বা কারা তার সঙ্গে যাচ্ছে, কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে জানেই, যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, তারাই চারদিক ঘিরে তাকে পদব্ৰজে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। যেন মাতলা হাতিকে ঘিরে নিয়ে চলেছে অতি সাধারণ মানুষেরা। এই মুহূর্তে এবং আগেও কখনো দুর্যোধন পাণ্ডব-কৃষ্ণকে সাধারণ মানুষের অধিক কিছু ভাবছে না, ভাবেওনি। তাই তাকে এখন যারা ঘিরে আছে, তাদের দিকে তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজনবোধ করছে না দুর্যোধন। 

আক্রান্ত আহত শোণিতসিক্ত অবস্থাতেও দুর্যোধনের এরকম নিরুদ্বেগ পাদচার দেখে সাধারণ সেনারা বিপুল বিস্ময়ে বিমূঢ়। মানুষ পারে এরকম! এত অপার ক্ষতির পরও, নিরানব্বই জন ভাইকে হারিয়েও, কর্ণের মতো আরও অনেক অনেক সুহৃদ-আত্মীয়ের মৃত্যুর পরও মানুষ এরকম নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারে! কতটুকু গহিন-গভীর মনোবলের মানুষ হলে আত্মীয়স্বজনের এক সমুদ্র রক্তের মাঝখানেও এমন তেজোময় উদ্ভাসন সারা চোখেমুখে ছড়িয়ে রাখতে পারে! সবার এ মনোবল নেই, সবার এরকম তেজস্বিতা নেই, সবার এরকম গরিমা নেই। কারো কারো আছে। সেই কারো কারোদের একজন দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধ্যক্ষ দুর্যোধনেরই আছে শুধু এ ধরনের বীর্যবত্তা। এগোতে এগোতে, দুর্যোধনকে অবলোকন করতে করতে সাধারণ সৈনিকরা এরকম করেই ভাবছে, বিক্রমশালী দুর্যোধন সম্পর্কে। 

দুর্যোধন এগিয়ে চলেছে তার বধ্যভূমি কুরুক্ষেত্রের দিকে। চব্বিশ লক্ষ পাঁচ হাজার সাতশ সেনার অধিপতি ও সমগ্র ভারতবর্ষের অধীশ্বর ছিল দুর্যোধন। নানা দেশের নৃপতিরা তার অনুজ্ঞা পালন করতে পারলে নিজেদের কৃতার্থ মনে করত। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসের শিকার হয়ে আজ সেই দুর্যোধন চলেছে মশানের দিকে। কুরুক্ষেত্রের দিকে। 

কুরুক্ষেত্র ভারতের অগণিত যোদ্ধার শোণিতসিক্ত পাপভূমি। আবার ভারতপুত্রদের পবিত্র তীর্থভূমিও। কুরুক্ষেত্র পরম পুণ্যস্থান ধর্মক্ষেত্র বলে পরিচিত। কুরুক্ষেত্রের অন্য নাম ব্রহ্মাবর্ত। উত্তরে সরস্বতী, দক্ষিণে দৃষদ্বতী। এই দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের নাম কুরুক্ষেত্র। যুদ্ধের জন্য এই ভূখণ্ডটি অত্যন্ত উপযুক্ত। ভারতবাসীর কাছে এই কুরুক্ষেত্রটি উত্তরবেদী নামে পরিচিত। উত্তরবেদী হলো যজ্ঞের জন্য পরিষ্কৃত সমতল ভূমি। কুরুক্ষেত্র তো উত্তরবেদীই! এখানে তো লক্ষপ্রাণের আত্মাহুতি দেওয়ার যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে গত আঠারো দিন ধরে! শেষ একটি প্রাণের বলি দেওয়ার কাজ এখনো বাকি। সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবার জন্য কৃষ্ণ-পাণ্ডবরা দুর্যোধনকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে কুরুক্ষেত্রের দিকে। কুরুক্ষেত্রের সমতল ভূমিতে গদাযুদ্ধ জমবে ভালো। দুর্যোধন এবং ভীম—দুই গদাশিল্পী তাদের যুদ্ধনিপুণতা উজাড় করে দিতে পারবেন এখানে। 

দুর্যোধন-ভীমের দ্বৈরথটি হওয়ার কথা ছিল দ্বৈপায়ন হ্রদের পাড়ে। দ্বৈরথ শুরু হয়ে গিয়েছিলও বলরাম এসে ওখানে ওই মুহূর্তে উপস্থিত না হলে দ্বৈপায়ন হ্রদের ওই পাড়টি অন্য একটি কুরুক্ষেত্রের রূপ নিত। বলরাম এসে দ্বৈরথে বাদ সাধলেন। বলরাম কৃষ্ণের অগ্রজ। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের মন্ত্রণাদাতা, উসকানিদাতাও। তারই কূটকৌশলে কুরুপক্ষ ধ্বংসপ্রাপ্ত। দুর্যোধনের হত্যা-আয়োজন যখন প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে কৃষ্ণ, ঠিক তখনই বলরাম এসে উপস্থিত হয়েছেন দ্বৈপায়ন পাড়ে। এতে পাণ্ডবরা হতবাক, কৃষ্ণ অস্থির। কারণ সর্বমান্য বলরাম দুর্যোধনের গদাশিক্ষক। গদাযুদ্ধে বলরাম ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। তার গদাদক্ষতার কথা গোটা ভারতবর্ষে চাউর হয়েছিল। সেই খ্যাতকীর্তি বলরামের কাছে দুর্যোধন গদাযুদ্ধের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেছিল। মধ্যম পাণ্ডব ভীম ও বলরামের কাছে গদাপ্রশিক্ষণ নিয়েছিল। দুজনের মধ্যে বলরামের পক্ষপাতিত্ব ছিল দুর্যোধনের দিকে। কারণ দুর্যোধন ছিল ভীমের তুলনায় কৃতী ছাত্র। ভীম যুদ্ধ করত শক্তি দিয়ে, দুর্যোধনের সামর্থ্য ছিল গদা ঘোরানোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কৌশলে। ভীম গায়ের জোরে যুদ্ধ জিততে চাইত আর দুর্যোধনের গদাপ্রয়োগ-কৌশলে বলরামের চোখ ধাঁধিয়ে যেত। ভীম সব কিছুকে শরীরের শক্তি দিয়ে মাপত। দুর্যোধনের দক্ষতা ছিল গদার প্রায়োগিক বিচক্ষণতায়। দুর্যোধনের অধ্যবসায় ও নৈপুণ্যে অধিকতর মুগ্ধ ছিলেন বলরাম। বলরামের সহানুভূতি ও সাহচর্য পেয়ে দুর্যোধন ভীমের অধিক গদাদক্ষ হয়ে উঠেছিল। 

বলরামকে দেখে পাণ্ডবপক্ষ আঁতকে উঠেছিল। কিন্তু তাদের চমকানো বাইরে প্রকাশ করেনি তারা। কৃষ্ণের মতো ধুরন্ধরের সঙ্গে এতদিন কাটানোর ফলে অভিনয়টা ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছিল পাণ্ডবরা। দুর্যোধননিধন তাদের জন্য যত সহজতর ছিল, বলরামের উপস্থিতিতে তা দুরূহ হয়ে উঠল। 

কৃষ্ণের ইশারায় উচাটন ভাবকে নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল পাণ্ডবরা। বলরামের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনে তৎপর হয়ে উঠল তারা। সবচেয়ে বেশি ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল যে কৃষ্ণ, বলরামকে সম্মান প্রদর্শনে সে-ই সবচাইতে বেশি সচেষ্ট হলো। কৃষ্ণ বলরামের সঙ্গে প্রণামালিঙ্গন করল। কুশল বিনিময়েও বেশ খানিকটা সময় নিল কৃষ্ণ। এর মধ্যেই বলরামের প্রশ্নের কী উত্তর দেবে, কীভাবে দেবে, নিজের ভেতর গুছিয়ে নিল কৃষ্ণ। দুর্যোধনের সঙ্গে ভীমের এই যুদ্ধায়োজন যে অন্যায়, কৃষ্ণের চেয়ে বেশি কে জানে? দাদা বলরাম আসতে আর একটু বিলম্ব করলে কৃষ্ণ-পাণ্ডবের উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যেত। কিন্তু বলরামের উপস্থিতির কারণে সেই অন্যায্য সমর সম্পন্ন হলো না। এই যুদ্ধায়োজন যে গর্হিত, তা তো বলরামের চোখ এড়াবে না! প্রশ্ন তো বলরাম করবেনই কৃষ্ণকে! সেই প্রশ্নের সদুত্তর যে কৃষ্ণের কাছে নেই, তাও বোঝে কৃষ্ণ। তাই বলে দাদার প্রশ্নে নিরুত্তর তো থাকা যাবে না। সাতে পাঁচে চৌদ্দ করে একটা উত্তর তো দিতেই হবে তাকে! সেই উত্তরটি মনে মনে আউড়ে রাখল কৃষ্ণ। 

অস্ত্রগুরু বলরামকে দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো দুর্যোধন। সে জানে, গায়ের জোরে, তথাকথিত ধর্মের দোহাই দিয়ে, ন্যায়যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে কৃষ্ণরা দুর্যোধনকে নিয়ে যা করতে চেয়েছিল, বলরামের উপস্থিতির কারণে তা করতে পারবে না। ভীমের সঙ্গে তার মরণপণ যুদ্ধ একটা হবে, তা এতক্ষণে অনুধাবন করে ফেলেছে দুর্যোধন। কিন্তু সেই যুদ্ধে যে কূটকৌশলের মিশেল থাকবে না, এই মুহূর্তে তা বুঝতে পেরে বড় তৃপ্তিবোধ করছে দুর্যোধন। গুরুদেব বলরাম তাকে যে বড় ভালোবাসেন! 

আহত রক্তাক্ত দুর্যোধন মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বলরামের উদ্দেশে প্রণাম করল। 

বিষণ্ণ মর্মাহত বলরাম আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দুর্যোধনের নিকটে এগিয়ে গেলেন তিনি। তাঁর বিশাল বুকে দুর্যোধনকে টেনে নিলেন। দুর্যোধনের মাথায় চুম্বন করে কৃষ্ণের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন বলরাম। উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই অন্যায় যুদ্ধের হোতা তুমিই, তাই না কৃষ্ণ?’ 

দুই 

‘না না দাদা! এই যুদ্ধের হোতা আমি হতে যাব কেন? দুর্যোধন নিজেই তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছে!’ তড়িঘড়ি বলে উঠল কৃষ্ণ। 

গম্ভীর কণ্ঠে বলরাম বললেন, ‘আমি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা বলছি না। বলছি, দ্বৈপায়নপাড়ের এই যুদ্ধায়োজন সম্বন্ধে।’

কৃষ্ণ আমতা আমতা করে বলল, ‘এই দ্বৈরথ তো হতেই হবে দাদা!’ 

‘কেন?’ রাগী কণ্ঠে জানতে চাইলেন বলরাম। 

‘এক রাজ্যে দুজন রাজা থাকতে পারে না। হয় যুধিষ্ঠির থাকবে, না হয় দুর্যোধন থাকবে। তাই এই যুদ্ধ অপ্রতিরোধ্য। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। পাণ্ডবরা জয়ী হয়েছে। কুরুবাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত। এই অবস্থায় দুর্যোধনের বেঁচে থাকার অধিকার আছে কিনা আপনিই বলুন।’ 

‘দুর্যোধনের বেঁচে থাকার অধিকার নেই!’ বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে জানতে চাইলেন বলরাম। 

কৃষ্ণ কোনো উত্তর দিল না। দাদার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। 

বলরাম ধপ করে আসনে বসে পড়লেন। করুণ চোখে রুধিরসিক্ত দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কৃষ্ণ, তোমার কি মনে আছে সেদিনের কথা?’ 

বিচক্ষণ কৃষ্ণ। দাদা বলরামের সঙ্গে দীর্ঘদিনের জীবনযাপন তার। দাদার দেহভঙ্গি, তার কথার ইঙ্গিতময়তা কৃষ্ণের অজানা নয়। আজ দুর্যোধনের সামনে দাঁড়িয়ে দাদা বলরাম কোন দিনের কথা জানতে চাইছেন, বুঝতে অসুবিধা হলো না কৃষ্ণের। 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আসন্ন। কুরু এবং পাণ্ডব-উভয়পক্ষের সৈন্য সংগ্রহের কাজ প্রায় সম্পন্ন। এখন চলছে ধীমান যুদ্ধবিশারদ উপদেষ্টা সংগ্রহের কাজ। একই দিনে দুর্যোধন আর অর্জুন উপস্থিত হয়েছে দ্বারকায়। একই সময়ে বলরাম আর কৃষ্ণকে তাদের উপদেষ্টা হিসেবে যাচনা করল দুজনে। 

বলরাম স্থিতধী। চট করে দুর্যোধন-অর্জুনের যাচনার উত্তর দিলেন না। 

খানিকক্ষণ নীরব থেকে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন তিনি। 

বলরামের তুলনায় কৃষ্ণ চঞ্চল। কোনো যাচনা বা প্রশ্নের ছটফট উত্তর দিতে অভ্যস্ত সে। বলরাম কী বলেন, তার জন্য অপেক্ষা করল না কৃষ্ণ। 

বলল, ‘অর্জুন-দুর্যোধন দুজনই খ্যাতিমান। দুই বংশের প্রতিনিধি হয়ে আজ আমাদের কাছে এসেছে। তাদের প্রার্থনার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছেন দাদা!’ 

‘কী উত্তর দেব, বল তুমি কৃষ্ণ! দুজনেই যুদ্ধের দোসর হিসেবে আমাকে চাইছে। আমি তো একজন! দুপক্ষের বাসনা মিটাব কী করে! তাছাড়া…।’ 

‘তাছাড়া কী দাদা?’ বলরামের মুখের কথা অনেকটা কেড়ে নিয়েই কৃষ্ণ জিজ্ঞেস করল। 

বলরাম বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘তাছাড়া দুর্যোধন এবং ভীম—দুজনেই আমার ছাত্র। আমার কাছে গদাপ্রশিক্ষণ নিয়েছে দুজনে। দুজনই আমার প্রিয়জন। কোন বিবেকে আমি একজনের বিরুদ্ধে দাঁড়াব!’ 

‘একজন তো দাঁড়িয়েছেন দাদা।’ কৃষ্ণ এখনো প্রত্যক্ষভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে না জড়ালেও গুপ্তচরের মাধ্যমে যুদ্ধের সকল সুলুকসন্ধান রাখে। 

বলরাম চমকে উঠে বললেন, ‘কে, কে দাঁড়িয়েছেন? শিক্ষক হয়ে কোন জন ছাত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলবেন?’ 

কৃষ্ণ শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘গুরুদেব দ্রোণাচার্য দাদা। অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য কৌরবপক্ষে যোগদান করেছেন। 

দুই ভাইয়ের কথোপকথন দুর্যোধন আর অর্জুন নীরবে শুনে যাচ্ছিল। দুজনের কেউই দুই ভাইয়ের কথার মাঝখানে কথা বলতে চাইল না। 

বলরাম আকাশ থেকে পড়া কণ্ঠে বললেন, ‘কী! আচার্য দ্রোণ দুর্যোধন-দলে যোগদান করেছেন!’ বলে বলরাম মৌন হলেন। 

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও বলরাম কথা বলছেন না দেখে কৃষ্ণ বলল, ‘এখন আপনার অভিমত কী দাদা?’ 

বলরাম দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। গভীর চোখে সামনে উপবিষ্ট দুর্যোধন-অর্জুনের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘আমি পারব না। আচার্য দ্রোণ পারলেও আমি পারব না।’ 

‘কী পারবেন না দাদা?’ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল কৃষ্ণ। 

ম্লান চোখ দুটি কৃষ্ণের মুখের ওপর রেখে বলরাম বললেন, ‘নিজের হাতে গড়া সন্তানতুল্য শিষ্যদের ওপর আচার্য দ্রোণ অস্ত্র তুলতে পারলেও আমি পারব না।’ 

‘মানে আপনি পাণ্ডব আর কুরু— কোনো দলেই যোগ দিচ্ছেন না?’ কৃষ্ণের এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বলরাম হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা কৃষ্ণ, এই যুদ্ধ কি অনিবার্য? কোনোভাবেই কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটি থামানো যায় না?’ 

‘না দাদা, এই যুদ্ধ কোনোভাবেই থামানো যাবে না। এই যুদ্ধ অনিবার্য। শুধু অনিবার্য নয়, অপরিহার্যও।’ বলল কৃষ্ণ। 

‘মানে!’ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন বলরাম। 

কৃষ্ণ বলল, ‘এই যুদ্ধের পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। উভয়পক্ষ মনে করছে, তাদের দাবি যৌক্তিক। কুরুসভার প্রায় সকল উপদেষ্টা এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। এই যুদ্ধ থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই দাদা। উভয়পক্ষ যুদ্ধমনস্ক এখন। কারো কথা শুনতে রাজি নয় এরা। যুদ্ধ করেই তারা শান্ত হবে। বহু মৃত্যুর মধ্যদিয়েই ওরা সংবিতে ফিরবে।’ অর্জুন-দুর্যোধনের ওপর চোখ রেখে কথা শেষ করল কৃষ্ণ। 

বুক চিরে গভীর নিবিড় একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বলরামের। ম্লান চোখে বললেন, ‘আমি কোনো পক্ষে যোগ দেব না কৃষ্ণ।’ 

চমকে বলরামের দিকে তাকাল দুর্যোধন। 

বলরাম বলে চলেছেন, ‘আমি স্পষ্ট চোখে দেখতে পাচ্ছি, এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে এক সমুদ্র রক্ত ঝরবে, লক্ষ লক্ষ নারী বিধবা হবে, বহু জননী পুত্র হারাবে। তুমি এই যুদ্ধে যোগ দিয়ো না ভাই! আমারই মতো নিজেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখো!’ কাতরতা বলরামের কণ্ঠ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে। 

বিস্মিত কণ্ঠে কৃষ্ণ বলল, ‘তা কী করে হয় দাদা! এই যুদ্ধে আমাকে তো অংশগ্রহণ করতেই হবে!’ 

‘কেন, কেন তোমাকে জীবনক্ষয়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিতে হবে?’ 

‘পাণ্ডবরা যে আমার পিসতুতো ভাই!’ 

‘অ্যা! স্বজনপ্রীতি?’ 

‘স্বজনপ্রীতি বা ভ্রাতৃপ্রেম—যাই বলুন না কেন, আমি অর্জুনদের পক্ষে যোগদান করব।’ 

এবার দুর্যোধন কথা বলে উঠল। তার কণ্ঠ দৃঢ় এবং কিছুটা রুক্ষও। সে বলল, ‘আপনি স্পষ্ট করে বলছেন, আপনি আমাদের দলে যোগ দেবেন না। পাণ্ডবরা আপনার পিসতুতো ভাই হয় বলে আপনি ওদের হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন! গুরুদেব বলরামেরও তো পিসতুতো ভাই হয় ওরা! কই তিনি তো পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করছেন না?’ 

এই সময় কৃষ্ণ হা হা করে উঠেছিল। বলেছিল, ‘তুমি অত চটছ কেন দুর্যোধন? তোমাদের দলে আমি যাচ্ছি না ঠিক, কিন্তু আমার যে বিপুলবিক্রমী নারায়ণীসেনা আছে, ওরা কুরুপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করবে।’ 

দুর্যোধন এবং অর্জুন—দুজনেই চমকে কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকাল। দুর্যোধনের মুখে প্রাপ্তির উল্লাস, অর্জুনের চেহারায় হতাশার গাঢ় আভা। 

বলরাম বলেছিলেন, ‘তুমি এক কাজ করো কৃষ্ণ, আমি যেহেতু কোনো দলেই যোগদান করছি না, তুমি উভয়পক্ষের উপদেষ্টা হও।’ 

কট কট করে হেসে উঠেছিল কৃষ্ণ। বলেছিল, ‘তা কী করে হয় দাদা? একই সময়ে দুই নৌকায় পা দেব কী করে?’ 

.

বর্তমানে ফিরে এলো কৃষ্ণ। ঢোক গিলে বলরামকে উদ্দেশ করে বলল, ‘হ্যাঁ, মনে আছে দাদা।’ 

বলরাম এবার তীব্র কণ্ঠে গর্জে উঠলেন, ‘আজও সেই পক্ষপাতিত্ব ত্যাগ করোনি তুমি! যুদ্ধে অনেকগুলো অন্যায় করেছ তুমি, জানি আমি! আজও সেই অন্যায় করতে উদ্যত হয়েছ?’ 

তিন 

কৃষ্ণ কাতর স্বরে বলল, ‘এসব কী বলছেন দাদা!’ 

‘ঠিকই বলছি আমি।’ একটু থামলেন বলরাম। আবার বললেন, ‘সেদিন তুমি বলেছিলে এবং পিসতুতো ভাইয়ের দোহাই দিয়েই বলেছিলে, তুমি পাণ্ডবপক্ষের লোক। সেদিনই আমি তোমার চোখের ভাষা বুঝে গিয়েছিলাম। সেদিন তোমার চোখ বলছিল, ন্যায় অন্যায়—যেকোনো উপায়েই পাণ্ডবদের জেতাবে তুমি। দুর্যোধন-অর্জুনের অল্প বয়স, কম অভিজ্ঞতা। সেদিন দুজনের কেউই বুঝতে পারেনি তোমার ধূর্ত চোখের ভাষা। দুর্যোধন তো নারায়ণীসেনার আশ্বাস পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল! তৎক্ষণাৎ না বুঝলেও পরে অর্জুন বুঝে গিয়েছিল, নারায়ণীসেনার তুলনায় তুমি শতসহস্রগুণ শক্তিশালী। তোমার কূটবুদ্ধি, তোমার ধুরন্ধরতা তোমাকে তুলনাহীন করে তুলেছিল।’ 

কৃষ্ণ দ্রুত বলে উঠল, ‘আপনার পায়ে পড়ি দাদা, ওসব কথা বলে আমাকে আর হেনস্তা করবেন না। 

‘কিন্তু তুমি তো দুর্যোধনকে হেনস্তা করবার জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছ! কুরুক্ষেত্রে এত রক্ত ঝরানোর পরও তোমার রক্তপিপাসা মিটল না কৃষ্ণ?’ 

‘দাদা, এসব কী বলছেন আপনি!’ কাতর কণ্ঠে কৃষ্ণ আবার বলল। 

বলরামকে আজ কথায় পেয়ে বসেছে। কৃষ্ণের বিরুদ্ধে এতদিনের ক্ষোভ-রাগ আজ যেন ঝেড়ে দিতে চাইছেন তিনি। 

বলরাম বললেন, ‘তুমি দেখছ, দুর্যোধন যুদ্ধাহত। তার দেহের নানা স্থানে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন। সেখান থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। অভুক্ত সে। গতদিন সকালে সে যুদ্ধের ময়দানে এসেছিল। দিনশেষে পরাজিত দুর্যোধন আর রাজপ্রাসাদে ফিরে যায়নি। এই দ্বৈপায়ন হ্রদে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেও তোমরা তাকে থাকতে দাওনি। জিঘাংসা তোমাদের পেয়ে বসেছে। পাণ্ডবরা না হয় নিষ্ঠুর নির্দয়, কিন্তু তোমার ভেতর তো দয়ামায়া ছিল বলেই জানতাম কৃষ্ণ! সেই তুমি, একবারও কি দুর্যোধনকে জিজ্ঞেস করেছ, দুর্যোধন, তুমি কি ক্ষুধার্ত, খাবে কিছু?’ 

মাথা নত করে থাকা ছাড়া কৃষ্ণের কোনো উপায় থাকল না। পাণ্ডবরা নীরব। 

বলরাম আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত নিঃশেষিত শক্তির দুর্যোধনকে দ্বৈরথে প্ররোচিত করেছ তুমি। এটা কি ঠিক করেছ?’ 

আমতা আমতা করে কৃষ্ণ কিছু একটা বলতে চাইল। তর্জনী উঁচিয়ে বলরাম তাকে থামিয়ে দিলেন। রক্তাভ চোখে বললেন, ‘আমি জানি, এই দ্বৈরথ অনিবার্য। দুর্যোধনকে আমি যতটুকু জানি, সে প্রাণ দিতে রাজি আছে, কিন্তু মান খোয়াতে রাজি নয়। যুদ্ধ সে করবেই করবে। কিন্তু কৃষ্ণ, এই যুদ্ধের আগে তুমি দুর্যোধনের জন্য একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে পারতে, কিছু খাদ্য দিতে পারতে তাকে।’ 

ওই সময় দুর্যোধনের হিংসানো কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ভীমকে হত্যার পর আমি বিশ্রাম নেব গুরুদেব। সে আমার নিরানব্বই জন ভাইকে একাই হত্যা করেছে। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়ার কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। আর খাদ্যের কথা বলছেন, গুরুদেব! ও খাদ্য তো বেজন্মাদের খাদ্য। পিতৃপরিচয়হীনদের খাদ্য খাওয়ার চেয়ে বিষ্ঠা খাওয়া ভালো।’ 

কৃষ্ণ বলে উঠল, ‘শুনলেন, শুনলেন দাদা কুলাঙ্গারটা কী বলছে! পাণ্ডবদের জারজ বলছে, খাদ্যকে বিষ্ঠার সঙ্গে তুলনা করছে!’ 

দুর্যোধন বলল, ‘কী শুনবেন গুরুদেব? আমি মিথ্যে বলেছি? ওই যুধিষ্ঠির-ভীমদের পিতার পরিচয় আছে? ঠাকুর দেবতার নাম ভাঙিয়ে ওদের মা-দের দ্বিচারিতাকে ঢাকা হয়েছে। গোটা ভারতবর্ষ জানে সেটা।’ 

বলরাম ডান হাত তুলে বললেন, ‘তুমি এবার থামো দুর্যোধন। তুমি বলো, যুদ্ধ করতে রাজি তুমি? ক্লান্ত অবসন্ন দেহ তোমার। দিনকয়েক বিশ্রাম নাও। তারপর না হয় ভীমের সঙ্গে গদাযুদ্ধে অবতীর্ণ হও তুমি! 

দুর্যোধন ত্বরিত বলল, ‘না না গুরুদেব, শত্রুনিধনে বিলম্ব করতে রাজি নই আমি। পাণ্ডবদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হব আমি। প্রথমে ভীমকে নিধন করব। তারপর অর্জুনকে মারব। এরপর নকুল- সহদেবকে পায়ের তলায় পিষে যমালয়ে পাঠাব আমি। পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির পালিয়ে বাঁচবে তখন। তার মতো ভীরু তো ভারতবর্ষে আর একজনও নেই!’ 

গূঢ় চোখে পাণ্ডবদের দিকে তাকাল কৃষ্ণ। সেই চোখে চুপ থাকার, ধৈর্য ধরার আদেশ। পাণ্ডবরা নিশ্চুপই থাকল। 

বলরাম হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা হলে এই অবস্থাতেই যুদ্ধ করবে তুমি দুর্যোধন? বিশ্রাম নেবে না? আহার করবে না?’ শেষের কথাগুলো নিজেকেই শোনালেন যেন তিনি। 

এবার উদাত্ত কণ্ঠে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘হ্যাঁ গুরুদেব, এই অবস্থাতেই পাণ্ডুপুত্র ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করব আমি।’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন বলরাম। কৃষ্ণ কিছু বলার আগে দুর্যোধন আবার বলল, ‘গুরুদেব, আপনি শুধু দেখবেন, দ্বৈরথে যেন কোনো অন্যায় না হয়। পৃথিবীর অন্য সবাইকে বিশ্বাস করলেও ওই কৃষ্ণকে বিশ্বাস করি না আমি।’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে কৃষ্ণের চোখমুখ শুকিয়ে গেল। বড় করে একটা ঢোক গিলল কৃষ্ণ। 

ওই সময় বলরাম আপন মনে বললেন, ‘যুদ্ধ যখন হবেই, তখন এই দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরভূমিতে নয়। অমসৃণ স্থান এটি। গদাযুদ্ধের জন্য সমতল ভূমির প্রয়োজন। সেরকম সমতলক্ষেত্র এই দ্বৈপায়ন হ্রদের পাড়ে নেই।’ 

কৃষ্ণ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তা হলে দ্বৈরথটা কোথায় হতে পারে দাদা?’ 

দাদা বলরামের কথাবার্তা শুনে কৃষ্ণের এই প্রতীতি জন্মে গিয়েছিল যে, দুর্যোধন-ভীমের দ্বৈরথটা তিনি বন্ধ করেই ছাড়বেন। কৃষ্ণের এমন কোনো শক্তি বা ঔদ্ধত্য নেই যে, দাদার কথার বিরোধিতা করে। অপছন্দের হলেও দাদার প্রস্তাবকেই মেনে নিতে হতো তাকে। এতে দুর্যোধন জীবিত থেকে যেত। নিষ্কণ্টক সিংহাসন বলতে যা বোঝায়, সেরকম সিংহাসনে আরোহণ করতে পারত না যুধিষ্ঠির। দুর্যোধনের মৃত্যুই শুধু পাণ্ডবদের মনে পরম শান্তি ও নিবিড় তৃপ্তি দিতে পারে। হঠাৎ দাদার কথায় পরিবর্তন দেখে নিজের আবেগকে আর ধরে রাখতে পারল না কৃষ্ণ। গলা চিরে উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এলো। 

বলরাম বললেন, ‘যে কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন যুদ্ধ হলো, যে কুরুক্ষেত্র পরম পুণ্যস্থান ধর্মক্ষেত্র বলে সসাগরা ভারতবর্ষে পরিচিত, সেই কুরুক্ষেত্রেই এই যুদ্ধ হবে।’ 

কৃষ্ণ ভেজা বেড়ালের কণ্ঠে বলল, ‘তা হলে এখন আমরা কী করব দাদা?’ 

এতক্ষণ পর যুধিষ্ঠির কথা বলল, ‘হ্যাঁ দাদা, বলুন এখন আমরা কী করব?’ 

বিদ্রূপমাখা চোখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকালেন বলরাম। নিজের দুহাত উল্টে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘কী আর করবে! কুরুক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন করো।’ 

তারপর কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে বলরাম বললেন, ‘প্রত্যাবর্তনের সময় দুর্যোধনের যাতে কোনোরূপ অবমাননা না হয়। মনে রেখো, দুর্যোধন কুরু- অধিপতি না হলেও কুরু-অধিপতির অধিক। মনে রেখো, ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র সে, মনে রেখো, দুর্যোধন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর অতি প্রিয়জন। কুরুক্ষেত্রে ফেরার পথে যাতে তাকে সর্বার্থে মর্যাদা দেওয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রেখো কৃষ্ণ।’ 

‘আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে দাদা।’ বিগলিত কণ্ঠে বলল কৃষ্ণ। 

‘তাহলে আমি এগোচ্ছি।’ বলে আসন ছাড়লেন বলরাম। নিজের রথের দিকে এগিয়ে গেলেন। বলরামের রথ চোখের আড়াল হলে গর্জে উঠল ভীম, ‘দুর্যোধনকে বাহনে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না। হেঁটে যাবে সে। আমাদের নীরবতার সুযোগ নিয়ে যে গালাগালিটা দিল সে, তার শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে।’ 

এই সময় ভীমের কথার বিরোধিতা করার সাহস করল না কোনো পাণ্ডব।

এমনকি কৃষ্ণও ভীম যে তাদের শত্রুমুক্ত করার একমাত্র অস্ত্র! 

চার 

শেষ দিনের যুদ্ধ আজ, আঠারোতম দিনের যুদ্ধ। 

আজ কোনো না কোনো পক্ষের জয় নির্ণীত হবে। অজস্র লোকক্ষয় ও বিপুল ধ্বংসের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষদিনে এসে পৌঁছেছে। 

আজ কৌরবপক্ষের সেনাপতি শল্য। পাণ্ডবপক্ষের যথারীতি যুধিষ্ঠির। 

বিপুল বিনাশের মধ্য দিয়ে যুদ্ধটা আরম্ভ হলো আজ। ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মতো যোদ্ধার তুলনায় মদ্ররাজ শল্য নিতান্ত চুনোপুঁটি। দুর্যোধন জানত, শল্যকে দিয়ে জয় আসবে না। তারপরও নিরুপায় দুর্যোধন শল্যকেই সেনাধ্যক্ষ করল। যুদ্ধ শুরুর আগে শল্য, কৃপাচার্য, কৃতবর্মা, অশ্বত্থামা, শকুনি ও দুর্যোধনের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত হলো, আজকের দিনটার যুদ্ধে এরা পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি থেকে যুদ্ধ করবে। সেই মতো যুদ্ধও শুরু হলো। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে এরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পাণ্ডবসেনা আর সমরনায়কদের বিচক্ষণতা ও যুদ্ধকৌশলের কারণে দুর্যোধনরা যূথবদ্ধ হয়ে থাকতে পারল না। 

প্রথমেই পাণ্ডবপক্ষ তিনভাগে বিভক্ত হলো। ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও সাত্যকির নেতৃত্বে পাণ্ডবসৈন্যরা কৌরবসৈন্যদের দিকে ধাবমান হলো। যুধিষ্ঠির শল্যকে আক্রমণ করে বসল। অর্জুন ধনুক উঁচিয়ে কৃতবর্মার দিকে ধেয়ে গেল। কৃপাচার্যের সঙ্গে ভীম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। নকুল ও সহদেব শকুনিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ বেধে গেল। দেদার সৈন্য ক্ষয় হতে লাগল। 

কখনো চক্রাকারে, কখনো আয়তক্ষেত্রিকভাবে, কখনো-বা ত্রিভুজাকৃতিতে কৌরবে আর পাণ্ডবে যুদ্ধ চলতে লাগল। মদ্ররাজ শল্য আজ দেহের সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। দুর্যোধন শল্যকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করলে শল্য বলেছিল, বাহুবলে কৃষ্ণ বা অর্জুন তার সমকক্ষ নয়। একা হাতে পাণ্ডবদের হারাতে সে সক্ষম। শল্য দুর্যোধনকে আরও ভরসা দিয়েছিল যে রণক্ষেত্রে সে কর্ণ, দ্রোণাচার্য ও ভীষ্মের চেয়েও অধিক পরাক্রম দেখাবে। পরাক্রম দেখাচ্ছিলও মদ্ররাজ শল্য। শল্য অবিরত বাণবর্ষণ করে সাত্যকি আর ভীমকে ত্রস্ত করে তুলেছিল। নকুল-সহদেব শল্যের আপন ভাগনে। আত্মীয়তার কথা ভুলে গেল শল্য। বিপুল পরাক্রমে ভাগনেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রাণ নিয়ে নকুল-সহদেব স্থান ত্যাগ করল। ভাইদের বাঁচাবার জন্য যুধিষ্ঠির এগিয়ে এলো। পাঞ্চাল যোদ্ধারা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ছিল। শল্য তাদের গতি রোধ করল। যুধিষ্ঠিরকে ছাড়বে না সে আজ, প্রাণবায়ু হরণ করেই ছাড়বে। যুধিষ্ঠিরও কম যায় না। তিরাঘাতে যুধিষ্ঠির শল্যকে রক্তাক্ত করল। শল্যের পার্শ্বরক্ষক ও সারথিকেও হত্যা করল যুধিষ্ঠির। মদ্ররাজের করুণ অবস্থা দেখে অশ্বত্থামা দ্রুত এগিয়ে এলো। শল্যকে নিজ রথে তুলে নিয়ে স্থানান্তরে গেল অশ্বত্থামা। 

ওদিকে ভীম-দুর্যোধনে মহারণ চলতে লাগল। দুর্যোধন ভীমের ধনুক ও রথের ধ্বজা কেটে দিল। ক্রোধান্বিত ভীম ক্ষুরপ্র অস্ত্র দ্বারা দুর্যোধনের সারথিকে হত্যা করল। ক্ষিপ্র হাতে দুর্যোধনের বুক বরাবর শক্তিশেল নিক্ষেপ করল ভীম। এই আঘাতে দুর্যোধন মূর্ছিত হয়ে রথমধ্যে পড়ে গেল। কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা ছুটে এসে দুর্যোধনকে রক্ষা করল। 

ভীম গদা নিয়ে কৃতবর্মার দিকে ধাবিত হলে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল কৃতবর্মা। ভীমের পথ আগলে দাঁড়াল শল্য। ভীম ওই গদা দিয়ে মাতুল শল্যকে আক্রমণ করে বসল। গতকাল শল্য কর্ণকে বধ করিয়ে ভাগনেঋণ শোধ করেছে। আজকে যেন ভীম মাতুলঋণ শোধ করতে বদ্ধপরিকর! ভীমের কাণ্ড দেখে শল্যের অক্ষিগোলক বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভীমের ওসবে তোয়াক্কা নেই। প্রচণ্ড গদাঘাতে মামার রথের ঘোড়াগুলো হত্যা করে ফেলল ভীম। 

গদাহাতে শল্যও রথ থেকে নেমে এলো। উভয়ে গদাযুদ্ধে লিপ্ত হলো। উভয়ে পরস্পরকে অবিরাম গদাঘাত করে যেতে লাগল। উভয়ে রক্তাক্ত হতে থাকল। শল্যের জখম ভীমের চেয়ে মারাত্মক। কৃপাচার্য শল্যকে রথে তুলে নিয়ে দূরে সরে গেল। কিন্তু শল্য যুদ্ধের বাইরে বেশিক্ষণ থাকল না। আবার ফিরে এলো। 

সসৈন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে শল্য আর যুধিষ্ঠির আবার মুখোমুখি হলো। উভয়ের মনে প্রবলপ্রতাপী জিঘাংসা। সম্মুখশত্রুকে হত্যা করতে আজ উভয়েই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

গতরাতের মন্ত্রণাসভায় কৃষ্ণ বলেছিল, ‘শল্যকে দুর্যোধন আগামীদিনের সেনাপতি হিসেবে নির্বাচন করেছে। এই শল্য কিন্তু বিপুল পরাক্রমী। মদ্ররাজ শল্য অত্যন্ত ক্ষিপ্রহস্ত। বিচিত্র ধরনের যুদ্ধকৌশল তার অধিগত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্রোণ-কর্ণের চেয়েও বেশি সমরবিশারদ এই শল্য।’ 

অর্জুন বলে উঠেছিল, ‘তুমি এ নিয়ে ভেব না দাদা। আমি একাই তাকে সামলে নেব। শল্যকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। আগামীদিন শল্যমামার দফারফা করে ছাড়ছি আমি।’ 

অর্জুনের কথা শুনে মৃদু একটু হেসেছিল কৃষ্ণ। বলেছিল, ‘ও তোমার কাজ নয় অর্জুন। শল্যকে বধ করতে ঠাণ্ডা মাথার প্রয়োজন। তুমি দক্ষ ধনুর্ধর স্বীকার করি, কিন্তু শল্যের জন্য যুধিষ্ঠিরকেই সেরা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মানি আমি। তাছাড়া…।’ বলে একটু থেমেছিল কৃষ্ণ। 

তারপর আবার বলেছিল, ‘আগামীদিন কৌরবপক্ষ মারমুখী হয়ে উঠবে। দুর্যোধনের বুঝতে বাকি নেই যে তার পরাজয় আসন্ন। নেভার আগে প্রদীপ যেমন হঠাৎ উজ্জ্বল আলো ছড়াতে শুরু করে, দুর্যোধন এবং তার পক্ষের সেনানায়করাও তেমনি সর্বশক্তি দিয়ে আগামীকাল যুদ্ধ করবে।’ 

তারপর অর্জুনের চোখে চোখ রেখেছিল কৃষ্ণ। বলেছিল, ‘তুমি তো অশ্বত্থামাকে জান অর্জুন। তোমার অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের সন্তান সে। তোমার মতো অস্ত্রজ্ঞান তারও আছে। তোমাকে যেমন করে শিখিয়েছেন দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামাকেও সেভাবে অস্ত্রবিশারদ করে তুলেছেন। আগামীদিন অশ্বত্থামা জানপ্রাণ দিয়ে লড়বে। পাণ্ডবপক্ষে অশ্বত্থামাকে প্রতিহত করার শক্তি যে রাখে, সে তুমি অর্জুন। কাল তুমি যুদ্ধ করবে অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে। খেয়াল রেখো, অশ্বত্থামা যাতে কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধনের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে।’ 

যুধিষ্ঠির বলেছিল, ‘তা হলে এটা ঠিক হলো যে, আগামী গোটা দিনের যুদ্ধে অশ্বত্থামার সঙ্গে লড়ে যাবে অর্জুন।’ 

‘আর তুমি লড়বে মদ্ররাজ শল্যের বিরুদ্ধে।’ যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বলেছিল কৃষ্ণ। কৃষ্ণ আরও বলেছিল, ‘দাদা, ওই বিশ্বাসঘাতক শল্যকে হত্যা করতে হবে তোমাকে। তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। বেঁচে থাকলে একদিন তোমাদের সঙ্গে আবার বেইমানি করে বসবে সে। বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।’ 

সেই মতে যুধিষ্ঠির আজ শল্যের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের মনে শল্যবধের প্রতিজ্ঞা। শল্যের মনে ক্রোধ-ক্ষোভ। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে—তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যুধিষ্ঠির তাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তাকে দিয়ে কর্ণের মনোবল ধ্বংস করিয়েছে স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে তো যুধিষ্ঠিরদের কাছে মাতুল শল্যের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে! পাণ্ডবদের কাছে সে এখন ভাঙা কুলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ তো যুধিষ্ঠিরের মস্তবড় অকৃতজ্ঞতা! শুধু তো অকৃতজ্ঞতা নয়, কৃতঘ্নতাও। নইলে কেন এত বড় উপকারী মামার বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলে যুধিষ্ঠির? আজ কৃতঘ্নতার উচিত জবাব দিতে হবে যুধিষ্ঠিরকে। তূণ থেকে তীক্ষ্ণ বাণ বের করে নিল শল্য। 

উভয়ের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হলো। পরস্পর পরস্পরকে খরশান অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে যেতে লাগল। শল্য নিক্ষেপিত শরাঘাত অসহনীয়। অস্ত্রাঘাতে কাতর হয়ে রথের মধ্যে লুটিয়ে পড়তে পড়তে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যুধিষ্ঠির। আবার হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। কিন্তু শল্যের বিক্রমের মুখে যুধিষ্ঠিরকে অত্যন্ত কাতর ও বিপন্ন দেখাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে শেষপর্যন্ত হাতে প্রাণান্তকর শক্তিশেলটি তুলে নিল যুধিষ্ঠির। সর্বশক্তি দিয়ে শল্যের দিকে এটি ছুড়ে মারল। মহাবেগবান অস্ত্রটি মদ্ররাজ শল্যের বুকে গিয়ে আঘাত করল। শক্তিশেলটি মদ্ররাজের বক্ষ বিদীর্ণ করে দিল। তার নাক-চোখ-কান-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল। দুহাত ছড়িয়ে রথের মধ্যেই লুটিয়ে পড়ল মদ্ররাজ শল্য। 

শল্যের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে দুর্যোধনের জয়লাভের সর্বশেষ ক্ষীণ আশাও শেষ হয়ে গেল। কুরুক্ষেত্রের একপ্রান্তে যখন দুমৰ্ষণ, শ্রুতান্ত, জৈত্র, দুর্বিমোচন, দুষ্প্রধর্ষ প্রভৃতি দুর্যোধনভ্রাতাকে হত্যা করতে ব্যস্ত ভীম, অন্যপ্রান্তে তখন শকুনি সহদেবের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধে লিপ্ত। 

শকুনি সহদেবের মাথা লক্ষ করে প্রাস নিক্ষেপ করলে বেহুঁশ হয়ে রথের মধ্যে পড়ে গেল সহদেব। কিছুক্ষণের মধ্যে চেতনা ফিরল তার। ধনু হাতে তুলে নিল সে। তীক্ষ্ণবাণে শকুনিকে বিদ্ধ করতে থাকল সে। বাণাঘাত অসহ্য হয়ে উঠলে পালাতে শুরু করল শকুনি। সহদেব তার পিছু ছাড়ল না। পেছন থেকে প্রাস ছুড়ে মারল সহদেব। প্রাস লক্ষ্যচ্যুত হলো। ছুটন্ত রথ থেকে শকুনিকে লক্ষ করে বিকটাকার এক ভল্ল নিক্ষেপ করে বসল সহদেব। এই ভল্ল শকুনির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করল। শকুনির হত্যাকাণ্ড দেখে কুরুসেনারা পালাতে শুরু করল। 

আজ সেই শকুনি নিহত হলো, যে কপট পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরকে দুবার হারিয়ে কুরুরাজ্য দুর্যোধনের হাতে তুলে দিয়েছিল। আজ তার নির্মম হত্যার সময় সেই ভাগনে দুর্যোধন কাছে থাকল না। 

শকুনি খল হলেও দুর্যোধনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। যুদ্ধের প্রথমদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত অক্লান্তভাবে যুদ্ধ করে গেছে সে। 

যুধিষ্ঠিরের হাতে শল্য যখন নিহত হলো, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। দিনের যুদ্ধ শেষ হতে তখনো অনেক বাকি। আপন ভাইকে যুধিষ্ঠিরের হাতে নিহত হতে দেখে শল্যের অনুজ যুধিষ্ঠিরের দিকে খেপা সিংহের মতো এগিয়ে এলো। অসংখ্য নারাচ অস্ত্রে যুধিষ্ঠিরকে রক্তাক্ত করে তুলল সে। যুধিষ্ঠিরও ক্ষিপ্র হাতে তাকে বাণবিদ্ধ করে যেতে লাগল। শেষে এক সুদৃঢ় ভল্লের আঘাতে শল্যভ্রাতার মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলল যুধিষ্ঠির। 

যুধিষ্ঠিরের হাতে শল্য ও তার অনুজ নিহত হলে পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে উল্লাসধ্বনি উঠল। তারা শঙ্খ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজাতে লাগল। এই ধ্বনি কৌরব সেনাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিল। কৌরবপক্ষ পরাজিত হয়ে গেছে, ভাবল কৌরব সেনারা। পালাতে শুরু করল তারা। অর্জুন-নকুল-সহদেব-সাত্যকি পলায়মান সৈন্যদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে তাদের ছত্রখান করে দিল। 

দুর্যোধন পলায়মান সৈন্যদের মনে উৎসাহ সঞ্চার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগল। কিন্তু ব্যর্থ হলো। 

দিনশেষে দেখা গেল দুর্যোধন একা যুদ্ধময়দানে দাঁড়িয়ে। এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্য সংগ্রহ করেছিল দুর্যোধন। আঠারো দিনের যুদ্ধে সেই বিপুলসংখ্যক সেনা ক্ষয় হতে হতে হাতেগোনা কয়েকজনে এসে দাঁড়িয়েছে। কৃতবর্মা-কৃপাচার্য-অশ্বত্থামার মতো গুটিকয়েক সেনানায়ক বেঁচে আছে শুধু। 

আর বেঁচে আছে স্বয়ং দুর্যোধন। এই মুহূর্তে তার শরীর রুধিরাপুত, ধূলিধূসরিত। এই সময় নিজের চারদিকে তাকিয়ে কৌরবপক্ষের কাউকে খুঁজে পেল না দুর্যোধন। পাণ্ডবপক্ষের জয়সূচক প্রচণ্ড সিংহনাদ এই সময় দুর্যোধনের কানে ভেসে এলো। সে বুঝে গেল, কৌরবপক্ষের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। 

দুর্যোধন সিদ্ধান্ত নিল, রণক্ষেত্র ছেড়ে যাবে সে। 

তখন তার আশেপাশে কোনো বাহন নেই। তার রথটি চূর্ণ-বিচূর্ণ, সারথি নিহত। রথাশ্বের মৃতদেহ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। 

নিজের বিখ্যাত গদাখানি কাঁধে তুলে নিল দুর্যোধন। ক্লান্ত হতমান দুর্যোধন পূর্বদিকে পা বাড়াল। কুরুক্ষেত্র থেকে কয়েক ক্রোশ পূর্বদিকে দ্বৈপায়ন হ্রদ। ওই হ্রদের জলতলের গুহায় কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নেবে সে। 

পাঁচ 

রণক্ষেত্র ত্যাগের আগে সঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা দুর্যোধনের। 

সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের সারথি। পরে কুরুসভার অন্যতম মন্ত্রীও হয়। কুরু-পাণ্ডবে বিরোধ উপস্থিত হলে যুদ্ধ নিবারণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু তার সকল প্রচেষ্টা বিফলে যায়। সঞ্জয় অত্যন্ত বিচক্ষণ। তার পাণ্ডিত্য এবং দূরদর্শিতার কথা সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাধলে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে সংবাদ সংগ্রহকারী হিসেবে নিযুক্ত করে। সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করত এবং কালবিলম্ব না করে অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রকে সরবরাহ করত। সঞ্জয় ছিল অস্ত্রে অনাহত ও শ্রমে অক্লান্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণের সময় সবাই তাকে সমীহ করত। 

সেদিনও যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি ধৃতরাষ্ট্রকে জানাবে বলে রণক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সঞ্জয়। মদ্ররাজ শল্য নিহত হলে গোটা যুদ্ধক্ষেত্রে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়। একদিকে পাণ্ডবপক্ষের তর্জন-গর্জন জয়কার, অন্যদিকে কৌরবপক্ষের নিস্তব্ধতা। শকুনিমামা নিহত হলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। আচমকা চারদিক থেকে আওয়াজ উঠল— কোথায় দুর্যোধন, দুর্যোধন কোথায়? এই দুর্বিষহ শব্দাঘাত যে পাণ্ডবপক্ষ করছে, বুঝতে অসুবিধা হলো না দুর্যোধনের। 

আজ সর্বশেষ পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্নের মুখোমুখি হয়েছিল দুর্যোধন। তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল দুজনের মধ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুর্যোধন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। তার দেহটা আগে থেকেই বেশ ক্লান্ত ছিল। সমস্ত কুরুক্ষেত্র ঘুরে ঘুরে কুরুসেনাদের উদ্দীপনা জোগাতে হয়েছে। ভীম আর অর্জুনের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়েছে বারকয়েক। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধটা দীর্ঘ সময় ধরে চললেও অর্জুন খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে। অশ্বত্থামা যেদিকে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, সেদিকেই দ্রুত রথ ছুটিয়েছে অর্জুন। 

ধৃষ্টদ্যুম্নের বাণাঘাত একটা সময়ে আর সহ্য করতে পারছিল না দুর্যোধন। অনেক চেষ্টার পরও একটিও তির ধৃষ্টদ্যুম্নের বা তার সারথির গায়ে বিদ্ধ করতে পারছিল না। হতমান বোধ করছিল সে তখন খুব। সামান্য অন্যমনস্কতার সুযোগে ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধনের রথ বিচূর্ণ করল, অশ্ব আর সারথিকে হত্যা করল। নিরুপায় দুর্যোধন অন্য একটি অশ্বে আরোহণ করে সম্মুখযুদ্ধ থেকে দ্রুত সরে গিয়েছিল। 

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করে, ‘রাজকুমার, আপনি কি রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন?’ 

থমকেছিল দুর্যোধন। তখন তার খুব বিধ্বস্ত অবস্থা। সঞ্জয়ের কথা শুনে সেই বিপন্ন শরীরে তেজ ও ক্রোধের সঞ্চার হলো। অন্য কেউ হলে হয়তো মস্তক বরাবর গদাঘাত করে বসত। কিন্তু সে সঞ্জয়কে চিনত। সঞ্জয় যে তার পিতা ধৃতরাষ্ট্রের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র, জানে দুর্যোধন। সে আরও জানে যে এই সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্রের খবরাখবর সংগ্রহ করে পিতার কাছে সরবরাহ করে। তাই দুর্যোধন ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল না। 

তবে পরাক্রমী কণ্ঠে বলল, ‘না, আমি যুদ্ধভূমি থেকে পালিয়ে যাচ্ছি না। পালানো আমার স্বভাবে নেই। কাপুরুষতাকে আমি ঘৃণা করি।’ 

‘তা হলে?’ বললেন সঞ্জয়। ‘আপনি যে গদা কাঁধে পূর্বদিকে রওনা দিয়েছেন!’ 

‘এখন, এই মুহূর্তে আমার বিশ্রামের বড় প্রয়োজন। আমি ওই হ্রদে বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি।’ হাত উঁচিয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদকে নির্দেশ করল দুর্যোধন। 

‘বিশ্রামের জন্য রাজপ্রাসাদে যাচ্ছেন না কেন?’ জানতে চাইল সঞ্জয়। 

ক্ষণকালের জন্য মাথা নত করল দুর্যোধন। তারপর কাতর গলায় বলল, ‘কুরুরাজপ্রাসাদ এখন নিরাপদ নয় আমার জন্য। আপনি তো জানেন, কুরু সেনারা আজকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমাদের পরাজয় নিশ্চিত। ওই শুনুন, পাণ্ডবপক্ষের হুঙ্কার আর উল্লাসধ্বনি। ওই আওয়াজই জানান দিচ্ছে, ওরা জয়লাভ করেছে। অচিরেই তারা কুরুরাজপ্রাসাদ দখল করে নেবে। আমি ওদের হাতে বন্দি হতে চাই না। তাই আমি রওনা দিয়েছি দুর্গম হ্রদের দিকে।’ দম নেওয়ার জন্য থামল দুর্যোধন। এই ফাঁকে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, ‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে কী বলব আমি, যদি আপনার কথা জিজ্ঞেস করেন?’ 

‘বলবেন, আমার দেহ ক্ষত-বিক্ষত। বলবেন, শত্রুর অস্ত্রাঘাতে আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। বলবেন, নিজপক্ষের একজন সঙ্গীও বেঁচে নেই আমার। এই সময় আমি বড় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বাবাকে বলবেন, কিছু সময়ের বিশ্রামের আশায় আমি রণক্ষেত্র ত্যাগ করে যাচ্ছি। প্রাণের ভয়ে নয়।’ 

‘তা তো আমরা জানি রাজকুমার। আপনি আর যা-ই হোন, ভীরু নন কখনো।’ বলল সঞ্জয়। হঠাৎ দুর্যোধনের কণ্ঠ তেজোময় হয়ে উঠল। সরোষে বলল, ‘পাণ্ডুপুত্রদের আজকের এই জয় অত্যন্ত সাময়িক। আমি ওদের ওই জয়োল্লাসকে স্তব্ধ করে দেব। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব পাণ্ডবদের ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ।’ 

তারপর কণ্ঠকে কোমল করে বলল, ‘পিতাকে বলবেন, আমার জন্য দুশ্চিন্তা না করতে। বলবেন, আমি এই ভারতবর্ষকে পাণ্ডবশূন্য করেই ছাড়ব। পিতা যে আমাকে বড় ভালোবাসেন! শেষের পঙ্ক্তিটি বোধহয় নিজেকেই শোনাল দুর্যোধন। 

কথা শেষ করে দ্রুত পায়ে পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে থাকল দুর্যোধন। 

একটু পরে অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মার সঙ্গে সঞ্জয়ের দেখা হলো। এরা তিনজনই কুরুপক্ষের মহারথী। আজকের বিধ্বংসী যুদ্ধের পরও এই তিনজন বেঁচে আছে। এরা হন্তদন্ত হয়ে দুর্যোধনকে সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজে ফিরছিল। এই সময় সঞ্জয়কে সামনে দেখতে পেয়েছিল। অনেকটা ছুটেই সঞ্জয়ের সমীপে এসেছিল তারা। 

‘আমাদের রাজকুমারকে দেখেছেন?’ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করেছিল অশ্বত্থামা। এরা সবাই জানত, সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের সংবাদ-সংগ্রাহক। যুদ্ধের সকল তথ্য মহামান্য ধৃষ্টরাষ্ট্রকে এই সঞ্জয়ই সরবরাহ করে থাকে। তাই সঞ্জয়ের কাছে দুর্যোধন সম্পর্কে জানতে চাওয়া। 

‘হ্যাঁ হ্যাঁ? জানেন কিছু। দুর্যোধন সম্পর্কে?’ বলল কৃপাচার্য। 

সঙ্গে সঙ্গে কৃতবর্মাও বলল, ‘তাঁর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আপনি অবগত আছেন?

সঞ্জয় বলল, ‘মান্যবররা, আপনারা উতলা হবেন না। জ্যেষ্ঠ ধার্তরাষ্ট্র বেঁচে আছেন।’

‘বেঁচে আছেন?’ প্রায় সমস্বরে তিনজনে বলে উঠল 

‘কোথায়, কোথায় তিনি এখন?’ উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জানতে চাইল অশ্বত্থামা। 

‘তিনি বিপুলভাবে আহত। দেহ তাঁর অস্ত্রাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। রক্ত ঝরছে ক্ষতস্থান থেকে।’ বলল সঞ্জয়। 

‘আহত! রক্ত ঝরছে!’ কৃতবর্মা বলে উঠল। 

কৃতবর্মার কথার জবাব না দিয়ে সঞ্জয় বলে যেতে লাগল, ‘দুর্যোধন সিংহপুরুষ। আহত হলে কী হবে, শরীর থেকে রুধির ঝরে পড়লে কী হবে, এসবের কোনোই ছাপ নেই তাঁর চোখেমুখে। চোখ তাঁর পূর্বের মতো দীপ্তিমান, মুখ তাঁর বীর্যবত্তায় জ্বলজ্বল করছে।’ 

‘আমি আর স্থির থাকতে পারছি না, আপনি কি বলবেন, তিনি এখন যুদ্ধক্ষেত্রের কোন প্রান্তে? অস্থির কণ্ঠে বলল কৃপাচার্য। 

‘তাঁকে তো আপনারা এখন কুরুক্ষেত্রে খুঁজে পাবেন না!’ 

‘খুঁজে পাব না!’ বিচলিত অশ্বত্থামা বলল। 

কৃতবর্মা ভেঙেপড়া গলায় বলল, ‘আমাদের আর উচাটনের মধ্যে রাখবেন না। দয়া করে বলুন, কোথায় গেলে মাননীয় রাজকুমারকে খুঁজে পাব আমরা।’ 

সঞ্জয় তিনজনের উদ্বেগের ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারল। বলল, ‘আপনারা শান্ত হোন। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। এ অত্যন্ত গোপনীয় সংবাদ। নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন। প্রকাশ পেলে রাজকুমার দুর্যোধনের জীবনসংশয় হবে।’ 

‘জীবনসংশয় হবে!’ বলল অশ্বত্থামা। 

‘হ্যাঁ। জীবনসংশয় হবে। পাণ্ডবরা ওঁকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। উনিই একমাত্র জীবিত ধৃতরাষ্ট্রপুত্র। দুর্যোধন বেঁচে থাকতে পাণ্ডবরা শত্রুমুক্ত নয়। ওরা রাজকুমারকে বাঁচতে দেবে না। তাই সংবাদটা অতি গোপনীয়। আপনারা রাজকুমারের অত্যন্ত নিকটজন। আশা করি, তাঁর সন্ধান আপনারা পাণ্ডবদের দেবেন না।’ 

বিমূঢ় হয়ে শুনে গেলো তিনজনে, সঞ্জয়ের কথা। তাদের মুখে রা নেই। 

সঞ্জয় চাপাস্বরে বলল, ‘রাজপুত্র দুর্যোধন আহত, বলেছি আগে। ওই অবস্থাতেই তিনি দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে চলে গেছেন। বলেছেন, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যাচ্ছেন। পাণ্ডবদের ওপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়বেন তিনি। আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন।’

‘দ্বৈপায়ন হ্রদের সেই বিশ্রামাগারটি সম্বন্ধে জানি আমি। আমরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব।’ করুণ কণ্ঠে বলল কৃপাচার্য। 

ছয় 

সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। ঘনঘোর অন্ধকার। 

আজ অমাবস্যা। তাই আঁধারের গায়ে এমন আলকাতরার রং। 

অগ্রহায়ণের শেষাশেষি। কদিন পরেই শীত জেঁকে বসবে। সমীরণের গায়ে হিমের মৃদু উপস্থিতি। হেমন্তকাল বলেই আকাশ স্বচ্ছ। গাঢ় নীলের প্রলেপ আকাশজুড়ে। মাঝেমধ্যে দু-একটা শুভ্র মেঘখণ্ড উত্তর থেকে দক্ষিণে ভেসে যাচ্ছে। নীলাকাশব্যাপী তারার মেলা বসেছে। সহস্ৰ সহস্ৰ তারার আভা পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে। সন্ধ্যা যখন রাতের দিকে হাঁটছে, তারার আলো মর্ত্যের অমাবস্যার অন্ধকারকে তখন ধীরে ধীরে হালকা করে তুলছে। 

দ্বৈপায়ন হ্রদের চারদিক নানা বৃক্ষ-গুল্মে আকীর্ণ। পাড়গুলোও সমতল নয়। পাড়লগ্ন স্থানগুলোও টিলাময়। সেই টিলাসমূহ অরণ্যসংকুল। সেই অরণ্যে শ্বাপদের প্রাচুর্য। এই অঞ্চলটা মনুষ্যবসতিহীন। তাই নির্জন, মানুষের প্রায়-অগম্য বৃক্ষঘেরা এই দ্বৈপায়ন হ্রদকে বিশ্রামের জন্য বেছে নিয়েছেন দুর্যোধন। 

এই হ্রদের জলের নিচে একটা কুঠরি আছে। সেই কুঠরি জলশূন্য। কী এক বিচিত্র প্রাকৃতিক কারণে, চারদিক জলবেষ্টিত হয়েও, কুঠরিটি জলমুক্ত। শুধু তা-ই নয়, কক্ষটি বায়ুপূর্ণও। হয়তো- বা পাড়ভূমির কোনো এক অজ্ঞাত ছিদ্রপথ দিয়ে এই কুঠরিতে বাতাস যাতায়াত করে। এই কক্ষটি শব্দনিরোধীও নয়। ওপরের শব্দতরঙ্গ এখানে এসে পৌঁছয়, আবার কুঠরিতে উচ্চৈঃস্বরে বলা কথা পাড়ের লোকেরা শুনতে পায়। এই অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত, বিভ্রমসৃষ্টিকারী জলস্থিত কক্ষটির কথা অন্য কেউ জানত না, জানত শুধু দুর্যোধন। 

তখন তার যুবা বয়স। তারুণ্যের উন্মাদনা চোখেমুখে, মনে। রাজপুত্ররা যখন মৃগয়ায় যেত, দুর্যোধন তখন দলছুট হয়ে একা একা ঘুরে বেড়াত। কখনো-বা একাই রাজপ্রাসাদ থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়ত। মন যেদিকে চায়, চলে যেত। প্রথম প্রথম পার্শ্বরক্ষকরা তাকে অনুসরণ করত। দুর্যোধনের নিষেধে একাকী ভ্রমণের সময় তার সঙ্গে যাওয়া ছেড়ে দিল পার্শ্বরক্ষকরা। ধৃতরাষ্ট্রও প্রথম প্রথম উদ্বিগ্ন হতো। দুর্যোধন পিতাকে আশ্বস্ত করত, ‘বাবা, আমি এখন ছোট্টটি নেই। আমি এখন যুবক বাবা। শালপ্রাংশু শরীর আমার। অস্ত্রদক্ষতায়ও পিছিয়ে নেই আমি। আমাকে দেখলে সবাই সমীহ করে, ভয় করে। আমি রাজকুমার না বাবা! আমার কোনো ক্ষতি করার সাহস কে রাখে এই হস্তিনাপুরে? অরণ্যে-জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে আমার। তাই মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়ি। আমার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না আপনি।’ 

ধৃতরাষ্ট্র ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলে, ‘তুমি যে আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান! তোমার জন্যই তো আমার যত দুশ্চিন্তা!’ 

দুর্যোধন বাবার বাড়িয়ে দেওয়া ডান হাতটি স্পর্শ করে বলে, ‘এর পরে আমি বের হলে সূর্যের আলো থাকতে থাকতে ফিরে আসব বাবা।’ 

‘তাই করো বাবা, তাই করো।’ পুত্রের হাতটি নিজের বুকের কাছে টেনে নিতে নিতে বলেছিল ধৃতরাষ্ট্র। 

এরকম একটা একাকী ভ্রমণের সময় দুর্যোধন দ্বৈপায়নতলের এই কক্ষটি আবিষ্কার করেছিল। দীর্ঘপথ ঘোড়া ছুটিয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সেদিন। জলতেষ্টাও পেয়েছিল খুব। হ্রদ দেখে ঘোড়া থেকে নেমেছিল। জলের নিকটে এগিয়ে গিয়েছিল। দু-এক আঁজলা মুখে তুলেছিল। হঠাৎ তার জলে নামতে খুব ইচ্ছে করল। যেরকম ভাবনা, সেরকম কাজ। ধরাচূড়া ছাড়ল দুর্যোধন। হ্রদের শান্ত-শীতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডুবসাঁতারে কেটে গেল অনেকক্ষণ। হ্রদের তল ছুঁতে ইচ্ছে করল হঠাৎ। ডুব দিল। জলের গভীরে নেমে যেতে লাগল। কিন্তু কোথায় হ্রদের তলা? দম তো প্ৰায় ফুরিয়ে এলো। সে মনস্থ করল, আর না। এবার ওপর দিকে উঠে যেতে হবে। ঠিক ওই সময় পায়ে কিছু একটা ঠেকল। প্রস্তরখণ্ডের মতো কিছু একটা! দমের কিছুটা তখনো আছে তার। কৌতূহল হয়ে প্রস্তরখণ্ড ধরে ধরে সুড়ঙ্গের মতো পথ পেয়ে গেল। মাথা ঢুকিয়ে দিল। কী আশ্চর্য! জল নেই কেন এখানে! আরে শ্বাসও তো নেওয়া যাচ্ছে! সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কুঠরিতে পৌঁছে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল দুর্যোধন। 

যথানিয়মে রাজপ্রাসাদে ফিরে গিয়েছিল দুর্যোধন। তার ভেতরটা নতুন কিছু আবিষ্কারের উল্লাসে তখন থর থর। কিন্তু সে ঠিক করেছিল, এই জলকুঠুরির কথা কাউকে বলবে না। বলেওনি কোনোদিন, কাউকে। কিন্তু বিশেষ এক দুর্বল মুহূর্তে, আরও বহু বছর পরে, কৃপাচার্যকে সংক্ষেপে বলেছিল দ্বৈপায়ন হ্রদের রহস্যের কথা। তবে স্পষ্ট করে নয়, আকারে ইঙ্গিতে। কৃপাচার্যকে বড় বিশ্বাস করত দুর্যোধন। 

তারপর অনেকটা বছর কেটে গেছে। পাণ্ডুর সস্ত্রীক অরণ্যগমন, ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক নানা ডামাডোল, প্রাসাদীয় ষড়যন্ত্র—এসবের ঝঞ্ঝাটে কৃপাচার্য দ্বৈপায়ন হ্রদের সেই রহস্যময় কুঠরির কথা ভুলে যায়। দুর্যোধন গদা কাঁধে দ্বৈপায়নের দিকে এগিয়ে গেছে— সঞ্জয়ের এই কথায় বহু বছর পর কৃপাচার্যের ওই কুঠরিটির কথা মনে পড়ে গেল। তাই তো কৃপাচার্য সঞ্জয়কে উদ্দেশে করে বলেছে—দ্বৈপায়ন হ্রদের সেই বিশ্রামাগারটি সম্বন্ধে জানি আমি 

সেই অপরাহ্ণে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে তাদের মধ্যে আরও কিছু কথা হয়েছিল। দুর্যোধন একাকী দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে গেছে—এই সংবাদে অশ্বত্থামা কৃপাচার্য-কৃতবর্মা বেশ সংকুচিত হয়ে পড়ল। 

অশ্বত্থামা বলল, ‘বহুক্ষণ আগে থেকেই আমরা রাজকুমার দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পাণ্ডব সেনারা আজ জীবন বাজি রেখে বারবার আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে দেয়নি আমাদের।’ 

কৃতবর্মা বলল, ‘আমাদের না দেখে তিনি হয়তো ভেবে নিয়েছেন, তাঁর পক্ষের আর কেউ বেঁচে নেই।’ 

কৃপাচার্য বলল, ‘হায়! হায়! কী গোলমালটাই না হয়ে গেল! রাজকুমার বোধহয় জানেনই না যে আমরা বেঁচে আছি!’ 

সবার কথা শুনে সঞ্জয় বলল, ‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। যদি জানতেন, আপনারা বেঁচে আছেন, এমন করে ভেঙে পড়তেন না তিনি। হতাশায় আক্রান্ত হয়ে কুরুক্ষেত্রও ত্যাগ করে যেতেন না হয়তো।’ 

‘হয়তো কী বলছেন আপনি! নিশ্চিত রণক্ষেত্র ছেড়ে যেতেন না রাজপুত্র দুর্যোধন। আজীবন আমি যে দুর্যোধনকে দেখে এসেছি, রণক্ষেত্রত্যাগী এই দুর্যোধন তিনি নন।’ বলল অশ্বত্থামা। 

সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘যা হোক, যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে! পরবর্তী করণীয় কী আপনারা ঠিক করুন। আমি যাই, কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র অপেক্ষা করে আছেন তাঁর পুত্রের সর্বশেষ অবস্থা জানবার জন্য।’ বলে ঘোড়ায় চড়ল সঞ্জয়। 

বিধ্বস্ত রণভূমি। এখানে-ওখানে সবখানে মৃতদেহ—মানুষের, ঘোড়ার, হাতির, মহিষের। রথের চূর্ণ-বিচূর্ণ কাঠামো পড়ে আছে নানা স্থানে। নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্র ছড়িয়ে আছে। কোনোটা মৃত সৈনিকের হাতে ধরা, কোনোটা খণ্ডিত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা। স্থানে স্থানে অগ্নিকুণ্ডলী জ্বলছে। ধোঁয়ায় কুরুক্ষেত্রের আকাশ আচ্ছন্ন। 

এরকম পরিস্থিতিতে রাজরমণীরা উদ্‌ভ্রান্তের মতো হস্তিনাপুরের দিকে ছুটে চলেছে। এরা স্বামীদের সঙ্গে যুদ্ধশিবিরে অবস্থান করছিল। কুরুদের পরাজয় জেনে এরা প্রাণভয়ে পালাচ্ছে। ওদের পিছু পিছু ছুটছে দুর্যোধনের অমাত্যরা। এমনকি যে কর্মীরা রথ সারাত, খাবার সরবরাহ করত, তারাও পালাচ্ছে। 

এদিকে যুদ্ধভূমির চিত্র অন্যরকম। পাণ্ডবরা রণক্ষেত্রের আনাচে-কানাচে দুর্যোধনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মৃতদেহের স্তূপের আড়ালে, ভাঙা রথের তলায় হন্যে হয়ে দুর্যোধনকে খুঁজে ফিরছে তারা। স্ত্রীলোকরা অস্থায়ী শিবির থেকে সরে গেলে, খালি পড়ে ছিল ওগুলো। দুর্যোধন ওখানে গা- ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে, এই সন্দেহে শিবিরগুলোও তন্নতন্ন করে দেখে যাচ্ছে পাণ্ডবরা। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না দুর্যোধনকে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল তারা। এমনিতে গোটাদিনের মরণপণ যুদ্ধ, তার ওপর জয়-পরাজয়ের উদ্বিগ্নতা—এসবের কারণে পাণ্ডবরা ব্যাকুল ছিল। যুদ্ধশেষে দুর্যোধনকে মৃত অথবা জীবিত, খুঁজে না পাওয়ায় তাদের সেই ব্যাকুলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একসময় ভীষণ ক্লান্তি বোধ করতে লাগল পাণ্ডবরা। শরীর তাদের আর চলছিল না। বিষণ্ণতা আর উৎকণ্ঠায় তাদের মন বিপর্যস্ত হলো। তারা দুর্যোধনের অনুসন্ধান থামিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত নিজেদের শিবিরে ফিরে গেল পাণ্ডবরা। 

অশ্বত্থামারা দূর থেকে পাণ্ডবদের অস্থির হয়ে কিছু একটা খোঁজার ব্যাপারটি লক্ষ করেছে। তারা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এই সময় যদি পাণ্ডবদের হাতে ধরা পড়ে যায় তারা, তাহলে তাদের মৃত্যু অনিবার্য। উঁচু মতন মাটির একটা স্তূপ পেয়ে ওরই আড়ালে লুকিয়ে পড়ল তারা। 

সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে তিনজন দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে এগিয়ে গেল। 

সাত 

‘রাজকুমার, রাজকুমার! মহারাজ দুর্যোধন।’ চাপা কণ্ঠে ডেকে যাচ্ছে তিনজনে। 

কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় পাণ্ডবদের চোখ এড়িয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদের পাড়ে উপস্থিত হয়েছে। এ পথ কৃপাচার্যের চেনা। 

বেশ কিছুক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছে তারা। তাদের কণ্ঠস্বর চাপা অথচ স্পষ্ট। কিন্তু ওদিক থেকে কোনো সাড়া মিলছে না। দুর্যোধন বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে জলকুঠরিতে তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। ওদের ডাক তার কান পর্যন্ত পৌঁছলেও চেতনা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ঘুম যে বহির্জগৎ থেকে প্রাণীকে বিচ্ছিন্ন করে ছাড়ে! 

অশ্বত্থামা কণ্ঠকে একটু উঁচুতে তুলল। বলল, ‘মহারাজ, আপনি জল থেকে উঠুন। এই দেখুন আমরা এসেছি—কৃতবর্মা, মান্যবর কৃপাচার্য এবং আমি অশ্বত্থামা।’ 

‘অশ্বত্থামা!’ শেষ শব্দটি কানে ঢুকল দুর্যোধনের। ঘুমের গাঢ়তা হালকা হয়ে এসেছিল। চেতন-অচেতনের মধ্যাবস্থায় দুর্যোধন শুনতে পেল অশ্বত্থামার নামটি। নিজের কানকে বিশ্বাস করল না সে। পাণ্ডবরাও তো অশ্বত্থামার কণ্ঠস্বর নকল করে তাকে সম্বোধন করতে পারে! দুর্যোধন জানে, এই জলকক্ষটির কথা সে এবং কৃপাচার্য ছাড়া কেউ জানে না। কৃপাচার্য তো আজ মারাই গেছে! তাহলে এই কণ্ঠস্বর পাণ্ডবদের নকল কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কী! জলতলে চুপ করে থাকল সে। 

এবার কৃপাচার্য বলে উঠল, ‘মহারাজ, আমার মনে হচ্ছে, আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, আমরা যে আমরা! ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আমি কৃপাচার্য। শুধু তা-ই নয়, আমার সঙ্গে অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মাও আছেন। তাঁরাও অক্ষত। আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি মহারাজ, আপনি জলতল থেকে ওপরে উঠে আসুন।’ 

এবার দুর্যোধনের আর কোনো সন্দেহ রইল না। এ যে কৃপাচার্যেরই কণ্ঠস্বর! দীর্ঘদিনের কথাবার্তা তার সঙ্গে! এই কণ্ঠস্বর যে তার চিরচেনা! 

ভুশ করে জলের ওপর ভেসে উঠল দুর্যোধন। 

সমস্বরে ওরা তিনজন বলে উঠল, ‘জয় মহারাজের জয়!’ 

মুখোমুখি হওয়ামাত্রই দুর্যোধন উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলল, ‘আপনারা বেঁচে আছেন! বেঁচে আছেন আপনারা!’ বলতে বলতে কৃপাচার্যের হাত জড়িয়ে ধরল। 

অশ্বত্থামা বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ মহারাজ, আমরা বেঁচে আছি!’ তারপর দীর্ঘ একটা শ্বাস ত্যাগ করে অশ্বত্থামা আবার বলল, ‘কত খুঁজেছি, আমরা আপনাকে! সমস্ত রণক্ষেত্র তন্নতন্ন করে খুঁজে বেরিয়েছি, পাইনি!’ 

কৃতকর্মা বলল, ‘পরে, বিকেলের দিকে সঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা আমাদের। তিনিই বললেন, আপনি এই হ্রদের দিকে এসেছেন।’ 

‘পাণ্ডবদের চোখ এড়িয়ে অনেকটা সন্ধ্যার আঁধারেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি মহারাজ।’ বলে গেল কৃপাচার্য। 

অশ্বত্থামা বলল, ‘আপনি এই ধারণা নিয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেছেন যে কুরুপক্ষ পাণ্ডবদের হাতে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, কুরুপক্ষের যোদ্ধাদের মধ্যে কেউই বেঁচে নেই।’ 

দুর্যোধন কোনো জবাব না দিয়ে ম্লান মুখে অশ্বত্থামার দিকে তাকিয়ে থাকল। 

‘সে কথা যে অমূলক আমাদের দেখেই তো বুঝতে পারছেন মহারাজ! এই দেখুন, আমরা দিব্যি বেঁচে আছি। হ্যাঁ, শরীরের এখানে-ওখানে আঘাত পেয়েছি আমরা, নানা স্থান থেকে রক্তও ঝরেছে। এটা তো স্বাভাবিক মহারাজ। যুদ্ধ করব, আঘাত পাব না! তা তো হওয়ার নয়!’ বলল কৃতবর্মা। 

অশ্বত্থামা বলল, ‘আঘাত পেলেও আমরা ভেঙে পড়িনি। আমাদের মনোবল কণামাত্র কমে যায়নি। আর ক্ষতি শুধু আমাদের হয়েছে, এমন নয়। মৃত্যু শুধু আমাদের পক্ষেরই হয়েছে, তা নয়। ওদেরও কম সৈন্য ধ্বংস করিনি আমরা! পাণ্ডবরা নিজেরাও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। জয় পেয়েছে তারা ঠিকই, কিন্তু মনোবল বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তাদের। তাদের সামরিক শক্তি এখন ক্ষয়প্রাপ্ত, মানসিক শক্তি বিপন্ন। এখনই সময় যুদ্ধ করার।’ 

বিস্মিত কণ্ঠে দুর্যোধন বলল, ‘যুদ্ধ করার!’ 

কৃপাচার্য এতক্ষণ চুপ করে ছিল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রাজকুমার, এখনই উপযুক্ত সময় পাণ্ডবদের ধ্বংস করার। ওরা এখন যুদ্ধশিবিরে অবস্থান করছে। ওরা নিঃশেষিতশক্তি। আমাদের আজকের আক্রমণে পাণ্ডবপক্ষ তছনছ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় যদি আপনি যুদ্ধে নামেন, আপনার অস্ত্রবেগ ওরা ধারণ করতে পারবে না। অচিরেই সবংশে লয়প্রাপ্ত হবে পাণ্ডবরা।’ 

এত বিপর্যয়ের মধ্যেও একটু করে হাসল দুর্যোধন। অশ্বত্থামা কৃপাচার্যের কথায় খুশি লাগল তার। এই খুশি দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো না তার মনে। কৃপাচার্যের প্রস্তাব মনোলোভা হলেও গ্রহণ করতে পারছে না সে। শারীরিক দিক থেকে সে এখন যুদ্ধ করতে অসমর্থ! এই মুহূর্তে তার মনে আগ্রহ আছে, কিন্তু দেহে শক্তি নেই। পাণ্ডবদের ধ্বংসের কথায় তার মন নেচে উঠল বটে, কিন্তু শরীর বলে উঠল, দুর্যোধন, তুমি এখন যুদ্ধ করতে অসমর্থ। তোমার দেহ অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত আহত তুমি, অভুক্ত তুমি। এখন তুমি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ো না। 

দুর্যোধন শরীরের কথা শুনল। সবার উদ্দেশে বলল, ‘কপাল ভালো যে আপনারা এখনো শেষ হয়ে যাননি। আমারও সৌভাগ্য যে আপনাদের দেখতে পেলাম আর একবার। তবে কথা হলো কী জানেন…।’ বলে থেমে গেল দুর্যোধন। 

কৃপাচার্য আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা রাজকুমার?’ 

দুর্যোধন বলল, ‘আপনাদের দেখেই বুঝতে পারছি, আপনারা খুব পরিশ্রান্ত। আমিও তাই। আমার ওপর দিয়ে আজ প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে। অনেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে আজ আমার। শত্রুদলও আজ মারমুখী ছিল। অস্ত্রাঘাত যেমন আমি করেছি, শত্রুরাও আমাকে ছেড়ে কথা বলেনি।’ 

অশ্বত্থামা বলে উঠল, ‘আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি আমরা।’ 

‘তাই বলছিলাম, আজকের রাতটা বিশ্রাম নিই আমি। ক্ষত-বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে এই মুহূর্তে যুদ্ধ করতে আমি অক্ষম। আগামীকাল বরং আমরা নতুন বিক্রমে পাণ্ডুপুত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। পাণ্ডবদের বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব আমি।’ অদ্ভুত এক ক্ষিপ্ত কণ্ঠে কথা শেষ করল দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের শারীরিক শক্তি যেমন ক্ষীণ হয়ে এসেছে, মনের জোরও কমে গেছে অনেক। কমারই তো কথা! এগারো অক্ষৌহিণীর যে সৈন্যবাহিনী নিয়ে সে যুদ্ধটা শুরু করেছিল, তাদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছে। কোথায় পিতামহ ভীষ্ম! কোথায় অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য! কোথায় প্রিয়তম সুহৃদ কর্ণ! আজ কেউ নেই, কিচ্ছু নেই! দুর্যোধন হতাশ হবে না তো কে হতাশ হবে! নিরানব্বই জন ভাইয়ের একজনও বেঁচে নেই। দুঃশাসন, বিকর্ণ, দুর্মর্ষণ, শ্রুতান্ত, জৈত্র, রবি, ভূরিবল, জয়ৎসেন, সুজাত, দুর্বিষহ, অরিহা, দুর্বিমোচন, দুষ্প্রধর্ষ, শ্রুতা—সব ভাইই ভীমের গদার আঘাতে নিহত হয়েছে। মনে বিপুল বেদনার ভার নিয়ে কুরুক্ষেত্র ছেড়ে এসেছে আজ দুর্যোধন। এই সময় আর কিছুই ভালো লাগছে না তার। এখন শুধু তার ইচ্ছে করছে, শুয়ে থাকতে। 

তাই দুর্যোধন বলল, ‘এখন যুদ্ধের সময় নয়, বিক্রম দেখাবার সময় নয় এখন। এখন আপনারা ফিরে যান। কাল আবার দেখা হবে। আবার মরণপণ যুদ্ধ হবে পাণ্ডুপুত্রদের সঙ্গে। 

অশ্বত্থামা তবু হাল ছাড়ল না। দুর্যোধনকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, শত্রুনিধনের প্রতিজ্ঞা করে বলল, ‘পাণ্ডবদের এখন ক্লান্ত শরীর। তারা অনেকটা নিরুদ্বিগ্নও। নিরস্ত্র তো বটেই! এই সময়টায় যদি আমরা পাণ্ডবশিবির আক্রমণ করি, নিদেনপক্ষে যুধিষ্ঠির ভীমার্জুন, নকুল-সহদেবের শিবির আক্রমণ করি, আমাদের হাতে নিহত হবে তারা।’ 

‘না অশ্বত্থামা, না। চোরের মতো পাণ্ডুপুত্রদের আক্রমণ করব না আমি। আমি যুদ্ধ করব বীরের মতো, দিনের আলোয়। আর সেই যুদ্ধ হবে কাল সকালে।’ 

হতোদ্যম অশ্বত্থামারা হাল ছেড়ে দিল। তারা বুঝল, মহারাজ আজ যুদ্ধ করতে নারাজ। তারা দুর্যোধনকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে উঠে পড়ল। দুর্যোধনও জলতলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী হলো। 

এই সময় সড়াৎ করে পাশের জঙ্গল থেকে কিছু একটা সরে গেল। 

আট 

‘কে, কে? কী? কে ওখানে?’ উৎকণ্ঠিত গলায় কৃপাচার্য বলে উঠল। 

অশ্বত্থামা আর কৃতবর্মা ছুটে গেল সেদিকে, যেদিক থেকে শব্দটি এসেছিল। ইতিউতি করে বেশ কিছুক্ষণ খুঁজল তারা। কিছু দেখতে পেল না। অশ্বত্থামা কিছুদূর দৌড়েও গেল। কিছুকে, কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে এলো। বলল, ‘কোনো জানোয়ার-টানোয়ার হবে বোধহয়। খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে ভয়ে পালিয়েছে। মনে হয়, গর্ভেটর্তে ঢুকে গেছে, নইলে তো চোখে পড়ত!’ 

কৃতবর্মা বলল, ‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে! এই গভীর অরণ্যে, এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে জানোয়ার ছাড়া আর কে-ই-বা আসবে!’ 

‘যা হোক, আপনারা এখন আসুন। কাল সকালে আবার দেখা হবে।’ বলল দুর্যোধন। কৃপাচার্য বলল, ‘ঠিক আছে মহারাজ। কাল সকালে আমরা আসব। জয় মহারাজ দুর্যোধনের জয়।

শব্দসৃষ্টিকারীটি কোনো কুকুর-শেয়াল-শূকর-বিড়াল নয়, বা অন্য কোনো বন্য জানোয়ারও নয়। ও ছিল ব্যাধ। অরণ্যচারী পশুশিকারি ও। 

ওরা দ্বৈপায়ন হ্রদের পথ ধরেই ফিরছিল। ফিরছিল কুরুক্ষেত্রে। শবরদলে বেশ কয়েকজন ছিল। দলনেতা পীতরাম। ওদের কাঁধে নানা মৃত এবং বিদ্ধ পশুর ভার। পীতরাম নামের এই ব্যাধটি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের খুব পরিচিত। ভীম ছিল বিচিত্র ধরনের পশুমাংসভোজী। রণক্ষেত্রে এসেও ভীমের সেই অভ্যাসে খামতি পড়েনি। ভীম পূর্বপরিচিত পীতরামকে ডেকে পাঠিয়েছিল। বলেছিল, তার মাংসভোজনের বাসনার কথা। সে আরও বলেছিল, ‘যত বিচিত্র ধরনের মাংস, তত অধিক অর্থ।’ 

পীতরাম লালায়িত হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, ‘মহারাজ, পশুশিকার মোরাদের কাজ। আপনি যে মাংস খেইতে চাইবেন, সেই মাংস হাজির কইরব। বলেন মহারাজ, কোন পশু শিকার কইরে আইনব?’ 

ভীম খুশি খুশি কণ্ঠে বলেছিল, ‘ওই যে বললাম, যত বিচিত্র পশুর মাংস তত বেশি কড়ি।’ 

‘ঠিক আছে মহারাজ। কাইল থেকে মুই আপনাকে মাংস দিয়া যাব।’ বলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিল পীতরাম। সেই থেকে পীতরাম তার দল নিয়ে বনে বনে পশুশিকার করে বেড়ায়। 

সারাদিন ধরে পশুশিকার করে, সন্ধ্যার আগু-পিছু সময়ে পাণ্ডবশিবিরের ভোজনশালায় শিকার-করা পশু জমা দেয়। ওরা আজ এ-বনে, কাল ও-বনে পশুশিকার করে বেড়ায়। আজ ওর এসেছিল দ্বৈপায়ন হ্রদের অরণ্যে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা উতরে গিয়েছিল। সঙ্গীদের তাড়া দিচ্ছিল পীতরাম, ‘আরে, তোরা আস্তে হাঁটিস কেনে রে! দেরি হইয়ে গেল রে খুব! মহারাজ ভীম না আবার রাগ কইরে বসেন! পা চালা রে তোরা, পা চালা।’ বলতে বলতে নিজেও হাঁটছিল দ্রুত। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে থমকে গিয়েছিল পীতরাম। ডান হাতটা ওপর দিকে তুলে বাঁ হাতের তর্জনীটা নিজের ঠোঁটে চেপে ধরেছিল। সঙ্গীরা বুঝে গিয়েছিল—দাঁড়িয়ে পড়তে হবে, নিশ্চুপ থাকতে হবে। নিষাদ জাতের নিজস্ব ভাষা আছে একটা। তা মুখের ভাষা নয়, দেহভঙ্গির ভাষা। এই ভাষা শিকারিদের সবারই জানা। সর্দার পীতরামের ইশারার অর্থ সঙ্গীরা বুঝে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। 

ব্যাধদের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, কান অত্যন্ত সতর্ক। সামান্য একটু নড়াচড়ার শব্দও তাদের কান এড়ায় না। দূরাগত ক্ষীণ শব্দগুচ্ছটিও পীতরামের কান এড়াল না। মনুষ্যকণ্ঠ কানে ভেসে এলো না? ডান কানটা সামনের দিকে একটু এগিয়ে ধরল পীতরাম। তাই তো! মানুষেরই তো কণ্ঠস্বর! কণ্ঠস্বর নিম্ন এবং চাপা হলে কী হবে, পীতরাম বুঝে গেল, কোথাও কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। কৌতূহল হয়ে উঠল পীতরাম। সঙ্গীদের স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইশারা করে বিড়ালপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। নিস্তব্ধে হাঁটায় অভ্যস্ত ব্যাধরা। ছোটবেলা থেকেই এই কৌশল আয়ত্ত তাদের। পশুপাখি শিকারে নিঃশব্দতা একান্ত প্রয়োজন। পীতরামের হাঁটাতেও কোনো শব্দ নেই। তাদের অতি নিকটে পীতরামের পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারটিও তাই দুর্যোধনরা টের পেল না। পীতরাম উৎকর্ণ হয়ে ওদের শলাপরামর্শ শুনল এবং খুব সহজেই বুঝতে পারল, ওই পরামর্শসভায় দুর্যোধন আছে। আর যারা আছেন, তাদের নিয়ে পাণ্ডবশিবির আক্রমণের পাঁয়তারা করছে দুর্যোধন। 

দুর্যোধনকে না চেনার কথা নয় পীতরামের। এমনিতে রাজধানী হস্তিনাপুরে যাতায়াত আছে তার। আর দুর্যোধন এমনতর বিখ্যাত যে দেশের আপামর জনসাধারণ তাকে চিনেই চিনে। পীতরামও অল্পসময়ের মধ্যে দুর্যোধনকে চিনে ফেলল। কুরু-পাণ্ডবদের যুদ্ধের কথা পীতরামের অজানা নয়। জানে, ভ্রাতৃঘাতী এই যুদ্ধে একপক্ষ আরেক পক্ষের ধ্বংস চায়। সে এ-ও শুনেছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবরা এগিয়ে আছে। যেকোনো সময় পাণ্ডবদের হাতে দুর্যোধনদের পরাজয় ঘটবে। পীতরামের অনুমান করতে অসুবিধা হলো না যে, আজ যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু একটা হয়েছে! পাণ্ডবদের জয় হয়েছে নিশ্চয়ই। নইলে দুর্যোধন এখানে কেন? তার তো যুদ্ধশিবিরে থাকার কথা অথবা রাজপ্রাসাদে! সেখানে না থেকে এই অন্ধকার রাতে, জঙ্গলের মাঝে, এই দ্বৈপায়ন হ্রদের পাড়ে কী করছে দুর্যোধনরা? দুর্যোধন ছাড়া অন্য কাউকে চিনতে পারল না পীতরাম। তাদের কখনো দেখেছে বলেও মনে পড়ল না তার। তবে দুর্যোধনকে চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না পীতরামের। দুর্যোধনকে যে সে রাজধানীতে অনেকবার দেখেছে! 

পীতরাম আন্দাজ করল, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই অরণ্যমাঝে হ্রদের কিনারে প্রাণ বাঁচাবার জন্য পালিয়ে এসেছে দুর্যোধন এবং সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে পাণ্ডবদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা আঁটছে। দুর্যোধন এবং অন্য তিনজনের কথাবার্তায় পীতরাম জানল যে, আজকেই যুদ্ধ করতে অন্য তিনজন অত্যাগ্রহী এবং দুর্যোধন অনাগ্রহী। পীতরাম শুনতে পেল, দুর্যোধন রাতভর এখানেই থাকবে, অন্য তিনজন স্থানান্তরে যাবে। 

পীতরামের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল, নিশ্চয়ই এতক্ষণে যুদ্ধক্ষেত্রে, রাজপ্রাসাদে, রাজধানীর নানা স্থানে, এমনকি রাজধানীলগ্ন স্থানগুলোতেও দুর্যোধনের অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেছে। পীতরামের মনটা তা তা থই থই করে নেচে উঠল। প্রচুর অর্থ পাওয়ার লোভ চাগিয়ে উঠল তার মনে। মধ্যম পাণ্ডবকে পশুমাংস সরবরাহ করে কত অর্থই-বা পায় সে! যা পায়, তার থেকে সঙ্গীদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দিতে হয়। ভাগবাটোয়ারার পর তার হাতে সামান্য অর্থই থাকে। সেই অর্থ দিয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ে পীতরামের। আজ বিরাট অঙ্কের অর্থ পাওয়ার সুযোগ এসে গেছে তার হাতে। দুর্যোধনের অবস্থানের সন্ধান পাণ্ডবদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তার কপাল খুলে যাবে। মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে খবরটা জানাতে পারলে যে-পরিমাণ ধন দেবে সে, তাতে তার জীবনে পরিপূর্ণ সুখস্বাচ্ছন্দ্য আসবে। বনে বনে আর পশুশিকার করে বেড়াতে হবে না তাকে। হঠাৎ নেচে উঠতে ইচ্ছে করল পীতরামের। অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করতে গিয়ে পাশের ঝোপে পেশিময় ডান হাতটা লেগে গেল তার। তাতেই সড়াৎ এবং ওই শব্দ শুনেই চমকে উঠেছিল অশ্বত্থামারা। দ্রুত অনুসন্ধানেও লেগে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তার আগেই সটকে পড়েছিল পীতরাম। দ্রুত সঙ্গীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সে। তাদের নিয়ে অন্য একটা পথ ধরে কুরুক্ষেত্রের দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল পীতরাম। 

ওইদিকে হতাশ হয়ে নিজেদের শিবিরে ফিরেও নিষ্ক্রিয় ছিল না পাণ্ডবরা। কৃষ্ণের পরামর্শে দিকে দিকে গুপ্তচর পাঠিয়েছিল। গুপ্তচররা একে একে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিল। কেউ সুসংবাদ আনতে পারেনি। সবাই বলল, প্রাণান্ত করে খোঁজার পরও কোথাও দুর্যোধনকে পাওয়া গেল না। নৈরাশ্যে ভাঙো ভাঙো অবস্থা তখন কৃষ্ণ-পাণ্ডবদের। সবচেয়ে দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ শত্রুটি যে জীবিত থেকে গেল! 

ঠিক এই সময় যুধিষ্ঠিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল পীতরাম। যুধিষ্ঠিরকে ঘিরে তখন কৃষ্ণ, পাণ্ডব, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অন্য রাজারাজন্যরা। 

যুধিষ্ঠির তার দিকে তাকালে আভূমি প্রণিপাত করল পীতরাম। করজোড়ে বলল, ‘আমার কাছে একটা সুসংবাদ আছে মহারাজ!’ 

যুধিষ্ঠির নিস্পৃহচোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। 

ভীম উৎসুক কণ্ঠে বলল, ‘কী সুসংবাদ পীতরাম? ব্যাধমানুষ তুমি! আমাদের এই সংকটকালে তুমি আবার কী সুসংবাদ নিয়ে এসেছ?’ 

ভূমিকা না করে পীতরাম বলল, ‘মহারাজ দুর্যোধনের খবর আইনেছি মুই।’ 

নয় 

‘দুর্যোধনের সংবাদ নিয়ে এসেছ তুমি! কী সংবাদ নিয়ে এসেছ?’ ত্বরিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ধৃষ্টদ্যুম্ন। 

‘দুর্যোধন এখন কোথায় আছেন, জানি আমি।’ 

‘জান তুমি! কোথায় সেই কুলাঙ্গারটা? এখনই বলো আমায়। এই গদার আঘাতে তার মাথাটা চূর্ণ করেই ছাড়ব আমি।’ বলে গদা হাতে নিতে গেল ভীম।

ভীমের আস্ফালন দেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল পীতরাম। কোনো উত্তর দিল না।

অর্জুন বলল, ‘কে এই লোকটি? জবাব না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন?’ 

ভীম ক্রোধী কণ্ঠে বললেন, ‘কী পীতরাম, আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন?’

পীতরাম এবার মুখ খুলল। বলল, ‘মহারাজ, আজকে নতুন ধরনের বেশ কয়টি জানোয়ার হইত্যে কইরতে পেরেছি। আজকের রাইতের ভোজনটা আপনার খাসা হইবে মহারাজ।’ 

ধমকে উঠল ভীম, ‘রাখ তোমার খাসা ভোজন! যা জিজ্ঞেস করছি, তার জবাব দাও আগে। কোথায় খলনায়ক দুর্যোধন? কোথায় দেখে এলে তুমি তাকে?’ 

ভীমের তর্জন-গর্জনেও পীতরাম ভড়কে গেল না। এ যে জুয়া খেলা! এই খেলায় সামান্য ভুল চাল দিলে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে যে! ভীমের রাগ দেখে দুর্যোধনের অবস্থান বলে দিক সে! অমনি অকুস্থানে ছুটবে সবাই। তার দিকে ফিরেও তাকাবে না তখন তারা। পাপোশের মতো পেছনে পড়ে থাকবে সে। না না, তা হতে দেওয়া যাবে না! আগে অর্থ, তারপর সংবাদ। কথায় বলে না, ফেল কড়ি, মাখ তেল। যতই ধমকাধমকি করুক না কেন পাণ্ডবরা, অর্থের প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত মুখ খুলবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল পীতরাম। 

যুধিষ্ঠিরের কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভেতরের অস্থিরতা সে আর ঢেকে রাখতে পারছে না। উত্তেজনা আর অস্থিরতায় কাঁপছে যুধিষ্ঠির। 

লক্ষ করল কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরের হাতে হাত রাখল সে। 

চাপা স্বরে বলল, ‘বুঝতে পারছি দাদা, তুমি অস্থির হয়ে উঠেছ। যাকে গোটা বিকালটা তন্নতন্ন করে খুঁজলে, পেলে না। যে তোমাদের প্রধানতম শত্রু, তার সংবাদ পেয়েও পাচ্ছ না। শুধু ওই ব্যাধটার ওপরচালাকির জন্য। তোমার মধ্যে রাগ আর উচাটন কাজ করা স্বাভাবিক।’ 

যুধিষ্ঠির হিংসানো গলায় বলল, ‘দেখছ ব্যাধটার কাণ্ড! তার ধূর্তামিটা খেয়াল করেছ?’

এই সময় ভীম দাঁত কড়মড় করে কিছু একটা বলতে চাইল। কৃষ্ণ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। 

আগের মতো অনুচ্চ কণ্ঠে কৃষ্ণ বলল, ‘আমি ওদের চিনি দাদা। ওরা সরল আবার জটিলও। দরিদ্র ওরা। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ ওই ব্যাধরা। আজ অর্থপ্রাপ্তির একটা মওকা পেয়েছে লোকটা। ছাড়বে কেন? তুমি একটা কাজ করো, তোমার কোষাধ্যক্ষকে ডেকে পাঠাও।’ 

যুধিষ্ঠির তখন-তখনই কোষাধ্যক্ষকে ডেকে আনাল। 

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কানে কানে বলল, ‘কোষাধ্যক্ষকে বলো, ওই ব্যাধটির হাতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ দিতে। এবং এখনই সেই অর্থ নিয়ে আসতে বলো।’ 

কোষাধ্যক্ষকে যুধিষ্ঠির নির্দেশ দিতে না দিতে পীতরাম বলে উঠল, ‘কুরুক্ষেত্রের পূর্বদিকে যে হ্রদটি আছে, ওইখানেই আছে তোমাদের পরম দুষমন দুর্যোধন।’ 

সেই সভায় তুমুল হর্ষধ্বনি হলো। সবাই সবার সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। কী করবে, ঠিক করতে পারছিল না তারা। এখন রওনা দেবে, না ভোরের আলোর জন্য অপেক্ষা করবে? এই দোটানায় বিভক্ত হয়ে গেল পাণ্ডবসভা। 

যুধিষ্ঠির বলল, ‘সবাই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। সবারই বিশ্রামের প্রয়োজন এখন। আজ রাতটা বিশ্রাম নেওয়া যাক। কাল দুর্যোধন-সন্ধানে বেরোব আমরা।’ 

অস্বাভাবিক উচ্চ কণ্ঠে কৃষ্ণ বলে উঠল, ‘না।’ 

সবাই চমকে কৃষ্ণের দিকে ফিরল। 

কৃষ্ণ বলল, ‘তোমরা দুর্যোধনকে চেন না। কেউটের চেয়ে হিংস্র সে, ব্যাঘ্রের চেয়ে বলশালী। নিষ্ঠুরতায় তার সমকক্ষ আর একজনও নেই ভারতবর্ষে। সেই দুর্যোধনকে বিশ্রামের সময় দেবে তোমরা? সে যে ওখান থেকে আজ রাতেই অন্যত্র পালিয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কী?’ 

অর্জুন বলল, ‘তা হলে দাদা, তুমিই বলো-আমরা এখন কী করব?’ 

‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি হয়ে নাও তোমরা। এখনই দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে রওনা দেব আমরা। শত্রু আর আগুনের অবশিষ্ট রাখতে নেই।’ বলল কৃষ্ণ। 

আর কালবিলম্ব করল না যুধিষ্ঠির। তখন তখনই দ্বৈপায়নের উদ্দেশে সসৈন্যে রওনা দিল। সঙ্গে চলল ভীম, অর্জুন, নকুল-সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, যুধামন্যু, সাত্যকি, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং পাঞ্চাল ও সোমক যোদ্ধারা। সব কিছুর নেতৃত্বে থাকল কৃষ্ণ। 

চারদিক বিপুল শব্দে উচ্চকিত হয়ে উঠল। নির্জন অরণ্যমধ্যে রথের ঘর্ঘর, শঙ্খনাদ, রণহুঙ্কার। দ্বৈপায়ন হ্রদের পরিবেশ হঠাৎই আকুল হয়ে উঠল। 

দুর্যোধন থেকে বিদায় নিয়ে অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা, কৃপাচার্য অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে তখন। আর দুর্যোধন জলাভ্যন্তরে স্বস্থানে ফিরে গেছে। ঘুম নেই তখন তার চোখে। পরের দিনের চিন্তায় ব্যাকুল তখন সে। আচমকা অনেক মানুষের প্রচণ্ড কোলাহল শুনতে পেল। তার মনে হলো, বাইরে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। জলের মধ্যে থেকেও সে মেঘের গর্জনের মতো তুমুল আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে পাণ্ডুপুত্ররা এখানে পৌঁছে গেছে। 

একেই বলে নিয়তি। নিয়তির ঘুঁটি হিসেবে কাজ করেছে ব্যাধরা। আজকেই ব্যাধরা এই পথ দিয়ে যাবে, তার কোনো কথা ছিল না! অন্য বনেও শিকার করতে যেতে পারত ওরা! কিন্তু দুর্যোধনের দুর্ভাগ্যই যে ওদের টেনে এনেছে এই দ্বৈপায়নপাড়ে! দুর্যোধন হতভাগ্যই যদি না হয়, তা হলে তাদের নিম্নস্বরে করা আলোচনা পীতরাম সর্দার শুনতে পেল কেন? শুনতেই যদি পেল, তার ভেতরে অর্থলোভ এমন করে চনমনিয়ে উঠল কেন? নিয়তি দুর্যোধনের প্রতিকূলে বলেই তো এমন হলো! এমন যদি না হতো, তাহলে দুর্যোধন রাতের এই ঘনঘোর আঁধারে শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়ত না! 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল, তাতে দুর্যোধনের পরাজয় ও মৃত্যু হতোই। কিন্তু ওই কয়েকটি ব্যাধের ভূমিকা তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। মানুষের সময় যখন খারাপ হয়, তখন নানা দিক থেকেই অপ্রত্যাশিতভাবে বিপদ ঘনিয়ে আসে। দুর্যোধনের সঙ্গে অশ্বত্থামাদির আলোচনা ব্যাধরা যদি না শুনে ফেলত, তাহলে শেষপর্যন্ত দুর্যোধনের পতন হলেও যুদ্ধটা অন্তত আরও দীর্ঘস্থায়ী হতো। 

দুর্যোধন কাপুরুষ নয়। বীরশ্রেষ্ঠ সে। ছোটবেলা থেকে বিশেষ একটা বীরত্বব্যঞ্জনার মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে। পালিয়ে যাওয়া কাকে বলে জানে না সে। এই যে বাইরে শত্রুপক্ষের এত কোলাহল হচ্ছে, তাতে এতটুকুও বিচলিত বোধ করছে না সে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আত্মহত্যার কোনো লক্ষণ তার চোখেমুখে ফুটে ওঠেনি। পালিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবছে না দুর্যোধন। ইচ্ছে করলে পালাতে পারত। পাণ্ডবদের শব্দ পাওয়ামাত্র কোনো কৌশলে এই জলকক্ষ থেকে বেরিয়ে হ্রদের নির্জনপাড় দিয়ে এই স্থান সে ত্যাগ করে যেতে পারত। তা কিন্তু দুর্যোধন করেনি। কারণ সে ছিল প্রকৃত বীর। প্রকৃত বীরের বুকেই তির লাগে, পিঠে নয়—এটাই ছিল দুর্যোধনের আদর্শ। সেই আদর্শই তাকে এই মুহূর্তে, এই সংকটময় সময়ে অভঙ্গুর রেখেছে। পাণ্ডবদের মারমুখী কথাবার্তায়, আস্ফালনে, লম্ফঝম্পে, এমনকি হৃদয়বিদারক কটুকাটব্যেও তাই এতটুকু বিচলিত হয়নি জ্যেষ্ঠ ধার্তরাষ্ট্র। নিশ্চেষ্ট শান্ত হয়ে সেই জলকুঠরিতে বসে থেকেছে দুর্যোধন। 

এই সময় উচ্চ কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলে উঠল, ‘দুর্যোধন, আমরা জানি, তুমি এই দ্বৈপায়ন হ্রদের মধ্যেই আছ। ওপরে উঠে এসো তুমি। তোমার পালানোর কোনো পথ খোলা রাখিনি আমরা। তোমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছি।’ 

যুধিষ্ঠিরের কথার কোনো জবাব এলো না ওদিক থেকে। 

অস্থির কণ্ঠে যুধিষ্ঠির আবার বলল, ‘তুই শঠতা করে, ছলচাতুরী করে আর পার পাবি না দুর্যোধন। তোকে আমরা ছাড়ব না। স্বয়ং ইন্দ্র এসে তোকে সাহায্য করলেও তুই বাঁচবি না। তোকে মরতেই হবে।’ দুর্যোধনের এতদিনকার দুষ্কর্মগুলোর কথা যুধিষ্ঠিরের মনে কিলবিল করে উঠল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

দুর্যোধন – ১

দুর্যোধন (১)

ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর জ্যেষ্ঠ পুত্র – কলির অংশে ওঁর জন্ম। ওঁর অপর নাম সুযোধন। কলিঙ্গরাজ চিত্রাঙ্গদের কন্যাকে স্বয়ংবর সভা থেকে বলপূর্বক হরণ করে দুর্যোধন তাঁকে বিয়ে করেন। দুর্যোধনের দুহিতা লক্ষণার সঙ্গে কৃষ্ণের পুত্র শাম্বর বিবাহ হয়। দুর্যোধনের জন্ম মাত্র নানাবিধ দুর্লক্ষণ দেখে বিদুর সহ অনেকে ধৃতরাষ্ট্রকে পুত্র-পরিত্যাগ করতে বলেছিলেন। কৈশোর থেকেই পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনের প্রবল বিদ্বেষ দেখা দিয়েছিল। অতিথি-পরায়ণতা, রাজনীতিজ্ঞান, বন্ধু-বৎসলতা, প্রজাপালন ক্ষমতা ইত্যাদি গুণ থাকা সত্বেও প্রবল পাণ্ডব-বিদ্বেষই তাঁর চরিত্র কলুষিত করেছে। বহুবার নানা উপায়ে পাণ্ডবদের তিনি হত্যা করার চেষ্টা করেছেন। কপট দ্যূতে পাণ্ডবদের সর্বস্য হরণ করেছেন, তাঁদের বনবাসে পাঠিয়েছেন, এমন কি পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীকে জনসমক্ষে লাঞ্ছনা করতে সঙ্কোচ বোধ করেন নি। আবার এই দুর্যোধনই কর্ণের এক লজ্জাকর মুহূর্তে এগিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে আজীবন সখ্যতায় নিজেকে বেঁধেছেন, দক্ষতার সঙ্গে রাজকার্য চালিয়ে প্রজাদের মনোরঞ্জন করেছেন এবং অসংখ্য নৃপতিদের সঙ্গে আমৃত্যু মিত্রতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। দুর্যোধনের লোভ, দলীয় শক্তির ওপর অতি মাত্রায় আত্মবিশ্বাস ও সর্বোপরি পাণ্ডব-বিদ্বেষ – এই ছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মূল কারণ। যুদ্ধের শেষে পুত্র ভ্রাতা ও সুহৃদদের হারিয়ে পরাজিত দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে যখন আত্মগোপন করেছিলেন, তখন খবর পেয়ে পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ সেখানে এসে উপস্থিত হন। পাণ্ডবদের বাক্যবান সহ্য করতে না পেরে দুর্যোধন গদা হাতে বেরিয়ে এসে একে একে সবার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন ভীম এগিয়ে আসায় দুজনের গদাযুদ্ধ শুরু হল। দুজনেই বলরামের সুযোগ্য শিষ্য ভীমের বাহুবল দুর্যোধনের থেকে বেশি, কিন্তু যুদ্ধ-কৌশলে দুর্যোধন ভীমের চেয়ে অভিজ্ঞ। ধর্মসঙ্গত যুদ্ধে ভীমের জয় অসম্ভব। গদাযুদ্ধে নাভির নিচে আক্রমণ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু দ্রৌপদীকে জন-সমক্ষে লাঞ্ছনা করার সময় দুর্যোধন যখন দ্রৌপদীকে নিজের বাম উরু প্রদর্শন করেছিলেন, তখন ভীম শপথ করেছিলেন যে তিনি ঐ উরু ভঙ্গ করে এর প্রতিশোধ নেবেন। সুযোগ পাওয়া মাত্র ভীম গদাঘাতে দুর্যোধনের দুই উরুই একসঙ্গে ভাঙ্গলেন। ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধে প্রাণ হারালে তাঁদের স্বর্গ-লাভ হয় – সেই আনন্দে এবং এই বীরশূন্য শ্মশানতুল্য পৃথ্বি লাভ করেও পাণ্ডবরা সুখি হতে পারবে না – এই সুখ চিন্তায় দুর্যোধন মহাপ্রয়াণে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *