দুর্যোধন – ১০

দশ 

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে কটকট করে হেসে উঠল কৃষ্ণ। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলল, ‘তোমার স্বভাবটা আর গেল না!’ 

‘কেন, কী হয়েছে! আমার স্বভাবে আবার কী দেখলে তুমি!’ ব্ৰিত কণ্ঠে জানতে চাইল যুধিষ্ঠির। 

‘এই যে তুমি মিষ্টি মিষ্টি করে বলছ- পার পাবি না, তোকে আমরা ছাড়ব না, এসব মিষ্টিমধুর কথায় কি ভবি ভুলবে? তুমি ভাবছ, তোকে মরতেই হবে—তোমার এই কথা শুনে দুর্যোধন জলতল থেকে সুড় সুড় করে উঠে আসবে। দুর্যোধনের এত কপটতা, এত নির্মমতা দেখার পরও তার সম্পর্কে এখনো এরকম করে ভাবছ কী করে তুমি? ও তোমার এই নরম মোলায়েম কথায় উঠে আসবে?’ টকঝাল জড়ানো কণ্ঠে বলে গেল কৃষ্ণ। 

যুধিষ্ঠির বিপন্ন চোখে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার দিকে যুধিষ্ঠিরকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বড় মায়া লাগল কৃষ্ণের।’

উচ্ছ্বাসমাখা গলায় কৃষ্ণ বলল, ‘ওভাবে নয়, ওভাবে নয় দাদা।’ 

‘তাহলে কীভাবে?’ ম্রিয়মাণ গলায় জিজ্ঞেস করল যুধিষ্ঠির। 

‘যেমন কুকুর, তেমনই মুগুর লাগবে। বুনো ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুল না হলে তোমার কার্যসিদ্ধি হবে না কখনো।’ বলল কৃষ্ণ। 

কৃষ্ণ বুঝেছে, যুধিষ্ঠির নিজের ধর্মস্বভাবের জায়গা থেকে সরলভাবেই দুর্যোধনকে কথাগুলো বলেছে। ভারতবর্ষীয় যুদ্ধনীতি যুধিষ্ঠিরের অজানা নয়। যে মানুষ নিরস্ত্র কর্মহীন, যে নিশ্চেষ্ট হয়ে জলমধ্যে অবস্থান করছে, তার প্রতি এর চেয়েও কটুকথা বলে কী করে! তাই কৃষ্ণের কথার মাহাত্ম্য ধরতে পারছে না যুধিষ্ঠির। তাই তো কৃষ্ণের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা, যুধিষ্ঠিরের! 

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের মনোভাব বুঝতে পারল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘দেখো দাদা, তুমি তো বুঝতেই পারছ, দুর্যোধন মায়াবিস্তার করে হ্রদের মধ্যে অবস্থান নিয়েছে। সে শঠতার আশ্রয় নিয়ে এই মায়াজাল তৈরি করেছে। সে জলের মধ্যে এমন নিরুত্তর আর নিশ্চেষ্ট হয়ে আছে, যাতে আমরা ওকে আক্রমণ না করি! কিন্তু মনে রেখো দাদা-শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। শঠতা যে করছে আমাদের সঙ্গে, তার সঙ্গে শঠতাই করতে হবে।’ 

যুধিষ্ঠির ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘কী করতে হবে, তুমিই বলে দাও কৃষ্ণ!’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘সময়কালে, পরিস্থিতি বুঝে কাজের কৌশল বদলাতে হয় মহারাজ। যুদ্ধে ওই কৌশলটাই আসল। কৌশলের কাছে বাহুবল বলো, সামরিক শক্তির প্রাবল্য বলো—সবটাই খেলো। উপায়-কৌশলটাই সবচাইতে বড় কথা।’

এই সময় ভীম উভয়ের নিকটে এগিয়ে এলো। ‘কী আলাপ হচ্ছে তোমাদের মধ্যে? আমার হাত নিশপিশ করছে। কিছু একটা করো তোমরা। উপায় বাতলাও।’ 

ভীমের কথা কানে তুলল না কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে বলল, ‘অতএব ও যখন ছলচাতুরী করে জলের মধ্যে পড়ে আছে, তুমিও চালাকির আশ্রয় নাও।’ 

‘চালাকি! কী চতুরতা করব আমি দুর্যোধনের সঙ্গে!’ ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইল যুধিষ্ঠির। 

কৃষ্ণ নিজে শঠতার আকর। নানাজনের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করে গেছে সে। গোটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাই তো কৃষ্ণের খলতা আর ধূর্তামির কারণে চমকে চমকে উঠেছে! দ্রোণাচার্যের হত্যা, কর্ণের নিধন—এসব ঘটনা তো কৃষ্ণের চাতুর্য আর ক্রূরতার উজ্জ্বল উদাহরণ। নানা সময়ে কপটতার আশ্রয় নিয়ে সে পাণ্ডবদের রক্ষা করেছে, জিতিয়েছে। তাই আজকেও শঠতার জয়গান করতে কৃষ্ণের গলা কাঁপল না। কৃষ্ণ জানে, বীরম্মন্য দুর্যোধনের কোন অনুভূতিতে আঘাত করলে সে উম্মত্ত হয়ে উঠবে। রাগে উন্মত্ত দুর্যোধন তখন ভুল সিদ্ধান্ত নেবে। সেই ভুল সিদ্ধান্ত অতি অবশ্যই পাণ্ডবদের অনুকূলে যাবে। সে যুধিষ্ঠিরের কানের কাছে নিজের মুখ এগিয়ে আনল। একেবারেই চাপা কণ্ঠে যুধিষ্ঠিরের কানে কানে কিছু কথা বলে গেল। 

কৃষ্ণের কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের মুখ কালো হয়ে গেল। কৃষ্ণের দিকে একবার তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিল যুধিষ্ঠির। তারপর উচ্চৈঃস্বরে বলল, ‘নিজের বংশের মুখে চুনকালি দিয়েছ তুমি দুর্যোধন। সমস্ত ক্ষত্রিয় বীরের জীবনে বিনাশ ডেকে এনেছ। নির্লজ্জের মতো এখন জলতলে সেঁধিয়ে আছ তুমি। কতটুকু বেহায়া হলে কোনো মানুষ এরকম করে, বলতে পারো দুর্যোধন? সবাইকে শেষ করে দিয়ে একা তুমি বেঁচে থাকবে, তা হতে দেব না আমরা।’ 

যুধিষ্ঠিরের এসব কথার কোনো জবাব দিল না দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের কথার প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট করে তার কানে পৌঁছাচ্ছে, কিন্তু সেই শব্দসমূহের কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না দুর্যোধনের। সে চুপ করে থাকল। 

এবার যুধিষ্ঠির ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। এবার সে দুর্যোধনের আসল অনুভূতিতে ঘা দিল। বলল, ‘অভিমান আর অহংকারে তুমি অন্ধ ছিলে দুর্যোধন। সেই অহমিকায় নিজের বংশ এবং গোটা ক্ষত্রিয় জাতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছ তুমি। সেই গর্ব আর আত্মমর্যাদা এখন কোথায় গেল তোমার দুর্যোধন? ভারতবর্ষের সবাই মহাবীর হিসেবে চিনত তোমাকে। সেই অকুতোভয় বীরশ্রেষ্ঠ তুমি ভয়ে জলের মধ্যে লুকিয়ে আছ!’ 

তারপরও ওপাশটা নিরুত্তর। 

একটু থেমে যুধিষ্ঠির আবার বলা শুরু করল, ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয়, শিষ্টজনের কাজ তো নয়ই। তুমি কি ক্ষত্রিয়? তুমি কি ভদ্রজন? যদি তা-ই হও, তাহলে হীনলোকের মতো আত্মগোপন করে আছ কেন?’ 

ধীরে ধীরে যুধিষ্ঠিরের কণ্ঠ কর্কশ হয়ে উঠতে লাগল। সে বলে চলেছে, ‘আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে শেষ করে নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছ তুমি। আমরা তা হতে দেব না। এতদিন তো জানতাম, তুমি নিজেকে বিশাল বীর বলে ভাব, নিজেকে মহাবীর বলে জাহির করতেও দ্বিধা করো না তুমি। কিন্তু এখন সে বীরযোদ্ধা দুর্যোধন কোথায় গেল? কোথায় গেল তার সাহস আর অহংকার? তুমি কাপুরুষ ছাড়া আর কিছুই নও দুর্যোধন।’ 

কী আশ্চর্য, এরপরও কোনো উত্তর দিচ্ছে না দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের কথাগুলো সে শুনতে পাচ্ছে না, এমন নয়। সকল কথা তার কানে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু কী এক অদ্ভূত সংযমে নিরুত্তর হয়ে আছে দুর্যোধন। 

যুধিষ্ঠির এতক্ষণ এককভাবে দুর্যোধনেরই নিন্দামন্দ করছিল। 

এবার কর্ণ-শকুনির প্রসঙ্গ যুক্ত করল। বলল, ‘তোমার নিজের তো কোনো বুদ্ধিবিবেচনা ছিল না দুর্যোধন। তুমি চলতে শকুনির কুমন্ত্রণায়। তোমার নিজের কোনো বাহুবল ছিল না। তোমার যত আস্ফালন, কর্ণ পাশে ছিল বলেই তো! তুমি তো একটা হীনবীর্য মানুষ! তুমি কর্ণের কথায় আর শকুনির কপটতায় এতই মোহগ্রস্ত ছিলে যে নিজের শক্তি আর বুদ্ধিক্ষমতা বুঝবার চেষ্টা করোনি। ওদের স্তাবকতায় নিজেকে দেবতা ভাবতে শুরু করেছিলে তুমি। আজ তারা কোথায়, তুমি কোথায়? নরকে পচে মরছে কর্ণ-শকুনি। আর তুমি পালিয়ে আছ এখানে। আজ কোথায় গেল তোমার বিক্রম? কোথায় তোমার শকুনি-কর্ণ-দুঃশাসন?’ 

যুধিষ্ঠিরের মুখে এত এত অপমানের কথা শুনে দুর্যোধন আর চুপ থাকতে পারল না। দুর্যোধন জবাব দিল, জলাভ্যন্তর থেকেই জবাব দিল, ‘একজন মানুষের ভয় পাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রাণীমাত্রেই কোনো না কোনো সময় ভয় পায়। তাই বলে যুধিষ্ঠির তুমি ভেবে বসো না যে আমি ভয় পেয়ে লুকিয়ে আছি। প্রাণের ভয়েও আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসিনি।’ দুর্যোধনের কণ্ঠ চড়া নয়। কীরকম একটা ত্রস্ত কম্পন দুর্যোধনের কণ্ঠস্বরে। 

এবার ভীম চিৎকার করে উঠল, ‘তাহলে তস্করের মতো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এখানে মুখ ঢেকে আছিস কেন বীরপুরুষ দুর্যোধন!’ ব্যঙ্গ ঝলসে উঠছে ভীমের কণ্ঠস্বরে। 

দুর্যোধন ভীমের তিরস্কারকে উপেক্ষা করল। যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বলল, ‘দেখো মহারাজ যুধিষ্ঠির, আমার রথ নেই এখন, নেই ধনুক-বাণ-তৃণ।’ 

ভীম আবার গর্জে উঠল, ‘গদা তো আছে?’ 

দুর্যোধন বলল, ‘হ্যাঁ, গদা আছে আমার সঙ্গে। কিন্তু এখন আমাকে ঘিরে কোনো পার্শ্বরক্ষক নেই। আমি এখন একা। এখানে এসে আমি একটু স্থির ও আশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। প্ৰাণ বাঁচাতে আসিনি আমি এখানে, এসেছি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বলে। এই জলতলে শুয়েছিলাম ক্ষণিক বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।’ 

ভীম তেজি গলায় বলে উঠল, ‘বেরিয়ে আয় তুই জল থেকে। আমি তোর বিশ্রাম নেওয়ার সাধ মিটিয়ে দিচ্ছি।’ 

এগারো 

এবার দুর্যোধন সতেজে বলল, ‘আমি তোকে আশ্বস্ত করছি ভীম, আমি উঠব। শুধু তোর নয়, তোর সকল ভাইয়ের, এমনকি তোদের সঙ্গে যারা এসেছে, সবারই যুদ্ধ করার বাসনা আমি ঘুচিয়ে দেব। শুধু কিছুটা সময় আমাকে বিশ্রাম নিতে দে। 

যুধিষ্ঠির তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আশ্বস্ত কী বলছ? আমরা সবাই বিশ্বাস করি যে তুমি জল থেকে উঠবেই উঠবে। তবে কিনা আমরা দীর্ঘ সময় ধরে তোমাকে খুঁজছি। খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমরা। আমরা আমাদের হয়রানি আর বাড়াতে চাই না। তোমাকে যখন পেয়ে গেছি, আমরা চাই, আমাদের হয়রানিরও পরিসমাপ্তি ঘটুক।’ 

‘তুমি এমন কোমল গলায় ওই কুলাঙ্গারটার সঙ্গে কথা বলছ কেন দাদা! অমন করে পিঠে হাত বুলানো ভাষায় কথা বললে ওই নষ্টটা কি জল থেকে উঠে আসবে?’ ভীম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। অর্জুনাদি পাণ্ডবরা এবং অন্যান্য রাজা ধৈর্য ধরে ব্যাপারটা অবলোকন করে গেলেও ভীমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। 

যুধিষ্ঠির হাত উঁচুতে তুলল। দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে আবার বলল, ‘দেখো দুর্যোধন, কাজেই তুমি আমাদের সময় নষ্ট করো না। তুমি জল থেকে উঠে যুদ্ধ করো। জিতে হয় তুমি রাজ্য নাও, নয় আমাদের হাতে মরে আমাদের শত্রুমুক্ত করো। মারো অথবা মরো—শেষ করো ব্যাপারটা। আগের কথার রেশ ধরে বলে গেল যুধিষ্ঠির। 

এবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল দুর্যোধন। হুঙ্কার করে বলল, রাজ্য জিতে নিতে বলছ যুদ্ধ করে! কোন রাজ্য জিতে নিতে বলছ তুমি যুধিষ্ঠির? কীসের জন্য যুদ্ধ? কীসের জন্য রাজ্য? যাদের জন্য এই কুরুরাজ্য চেয়েছিলাম, সেই ভাইয়েরা আমার সবাই যুদ্ধে মারা গেছে! তোমার ওই মাথামোটা উদরসর্বস্ব মূর্খ ভাই ভীমই আমার ভাইদের হত্যা করেছে! যেসব ক্ষত্রিয় বন্ধু রাজারা আমার সহায় ছিলেন, তাঁদের কেউই আজ বেঁচে নেই। আমাদের অর্থ, প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য—সবই ধ্বংস করে দিয়েছ তোমরা! বিধবা রমণীর মতো হতশ্রী ওই রাজ্য আমি চাই না।’ বলতে বলতে ক্রোধে-শোকে কাঁপতে লাগল দুর্যোধন। 

দুর্যোধন বলতে চাইল, ধনৈশ্বর্যময় রাজ্যই তার কাম্য। কুরুরাজ্য ধনৈশ্বর্য-সমন্বিত বহু সহায়সম্পন্নই ছিল। কিন্তু পাণ্ডবরা যুদ্ধ বাধিয়ে ভীরভোগ্যা কুরুরাজ্যকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। আজ হতশ্রী কুরুরাজ্য আর যৌবনবতী রমণীর মতো নেই, এখন কুরুরাজ্য হতমান শ্রীহীন বিধবার মতন হয়ে গেছে। এই রিক্তা, বিষণ্ণা কুরুরাজ্য দিয়ে দুর্যোধন এখন কী করবে? হ্যাঁ, সে যুধিষ্ঠিরদের জন্য অলংকারহীন বর্ণহীন রাজ্য রেখে যাচ্ছে। তাই নিয়েই রাজত্ব করুক যুধিষ্ঠির। 

যুধিষ্ঠির গলা উঁচিয়ে হেসে উঠল, ‘এ যে বিজিতের ব্যর্থ লাফালাফি! পরাজিত হয়েছ বলেই কুরুরাজ্য সম্পর্কে এরকম করে বললে তুমি। জয়ী হলে বলতে না।’ 

দুর্যোধন বললেন, ‘যুধিষ্ঠির, আমি এখনো সমস্ত পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের হাড়গোড় ভেঙে জয়লাভ করার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু সত্যি কথা কী, বিধ্বস্ত রাজ্য লাভ করতে আমার মন চাইছে না। যেখানে দ্রোণ-কর্ণের মতো বীরপুরুষরা মারা গেছেন, পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত, সেখানে কী হবে এই যুদ্ধ করে?’ 

যুধিষ্ঠির আর ভীম অনুচ্চ কণ্ঠে হাসলেও অট্টহাসি দিল কৃষ্ণ। বলল, ‘পরাজিতের হাহাকার! ব্যর্থজনের আর্তনাদ!’ 

কৃষ্ণের কথা দুর্যোধনের কানে গিয়ে পৌঁছল। দুর্যোধন হিংসানো কণ্ঠে বলল, ‘আমার কাছে এখন যুদ্ধের কানাকড়িও দাম নেই কৃষ্ণ। এই ভস্মীভূত ধ্বংসপ্রাপ্ত কুরুরাজ্য এখন তোমাদেরই হোক।’ একটু দম নিল দুর্যোধন। তারপর যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বলল, ‘যুধিষ্ঠির, তোমরা আমাকে নির্বংশ করেছ, রাজ্য হরণ করেছ আমার। আমি এখন সহায়হীন, রণক্লান্ত। যুদ্ধ আমি আর করতে চাই না।’ 

কর্ণ-দ্রোণ-দুঃশাসনাদির হত্যার দায় দুর্যোধন এখন পাণ্ডবদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা ছিল না। ভীষ্ম-দ্রোণ বেঁচে থাকতে সে তাদের একটি কথাও শোনেনি। বিদুর হাজারবার চেষ্টা করেও দুর্যোধনকে যুদ্ধ থেকে বিরত করতে পারেননি। গুরুস্থানীয়দের বহুবার নিষেধ সত্ত্বেও দুর্যোধন যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছে। ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ প্রমুখ পাণ্ডবদের হাতে মারা গেলেও এই মৃত্যুর মূল হোতা তো দুর্যোধনই! দুর্যোধন সেই দোষ এখন পাণ্ডবদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে যুদ্ধ এড়াতে চাইছে। 

যুদ্ধ এড়াতে গিয়ে দুর্যোধন আরও বলেছে, আত্মীয়স্বজনহীন রাজ্য দিয়ে আমি কী করব? আমার বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই, রাজ্যের সকল সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে, শস্যখেতগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। হাতি নেই, ঘোড়া নেই। এরকম পৃথিবীতে আমি আর বাঁচতে চাই না। আমি বনে চলে যাব। মৃগচর্ম পরিধান করে আমি তপস্যায় মগ্ন হব। 

দুর্যোধনের মুখে এরকম উদাসী নৈর্ব্যক্তিক কথা শুনে যুধিষ্ঠির বিন্দুমাত্র মুগ্ধ হলো না। কারণ সে দুর্যোধনকে হাড়ে হাড়ে চেনে। 

পরের কথায় যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের চাতুর্যের বর্ম ভেঙে চুরমার করে দিল। বলল, ‘এখনো তুমি জলের মধ্যে লুকিয়ে থেকেই প্রলাপ বকে যাচ্ছ দুর্যোধন! তোমার প্রলাপ শকুনের আর্তস্বরের মতো শোনাচ্ছে। তুমি তোমার প্রলাপ বন্ধ করো। ওপরে উঠে এসো, যুদ্ধ করো। 

হঠাৎ নীরব হয়ে গেল দুর্যোধন। যুধিষ্ঠির কিন্তু নীরব থাকল না। সে বলল, ‘শোনো দুর্যোধন, আমাকে তুমি রাজ্য দেবার কে? তুমি কি এই কুরুরাজ্যের অধীশ্বর? ধরে নিলাম, তুমি অধীশ্বর, তা হলে আমি দানের রাজ্য নেব কেন? রাজ্য নেব আমি তোমাকে পরাজিত করে। 

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যুধিষ্ঠির। বলল, ‘এই হানাহানি না হওয়ার জন্য একসময় তোমার কাছে সামান্য কিছু জায়গা প্রার্থনা করেছিলাম, দাওনি তুমি। আমাদের প্রতিনিধি কৃষ্ণকে অনেকটা লাঞ্ছিত করেই রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দিয়েছিলে। আজ ফাঁদে পড়ে মিউ মিউ করছ, গোটা রাজ্যটিই দিয়ে দিতে চাইছ! বড় আশ্চর্যের কথা না এটি দুর্যোধন! তুমি পাগল হয়ে গেছ বলে মনে হচ্ছে আমার!’ 

যুধিষ্ঠির আরও বলে চলল, ‘সসাগরা এই পৃথিবীর অন্তত একজন রাজার নাম তুমি আমায় বলো দুর্যোধন, যে আক্রান্ত এবং অভিযুক্ত হয়েই শত্রুপক্ষকে রাজ্য দিয়ে দিয়েছে? তেমন করে তুমিও দাওনি। অনুরুদ্ধ হয়েও তুমি দাওনি দুর্যোধন। তোমার তো সেদিনের কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কৃষ্ণের সন্ধি-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মাত্র পাঁচখানি গ্রাম পর্যন্ত দিলে না তুমি! দম্ভ করে বললে, সুচের মাথায় যেটুকু মাটি ওঠে, সেই মাটিটুকুও তুমি বিনাযুদ্ধে দেবে না আমাদের!’ 

যুধিষ্ঠির গলা ঝেড়ে বলল, ‘সেই তুমি আজ আমাদের সমগ্র পৃথিবী দিয়ে দিতে চাইছ! এর চেয়ে হাস্যকর ব্যাপার আর কী হতে পারে দুর্যোধন?’ 

এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো শব্দ দুর্যোধনের কাছে নেই। এটা তো সত্যি, সে নিজেই কৃষ্ণকে অপদস্থ করে কুরুসভা থেকে বিতাড়িত করেছিল। কৃষ্ণের আকুতি-মিনতিকে কোনোই পাত্তা দেয়নি। আজ সেই দুর্যোধন রাজ্যদানের বাসনা প্রকাশ করছে! হাস্যকরই তো! যুধিষ্ঠির তো যথার্থই বলছে! 

এবার যুধিষ্ঠির মোক্ষম কথাটি বলল। বলল সতেজে এবং কর্কশকণ্ঠে, ‘বাছা, তুমি যতই রাজ্যদানের কথা বল, তোমার সেই তথাকথিত দান আমরা গ্রহণ করব না। যুদ্ধ করে তোমার মতো অভিশপ্ত ধৃতরাষ্ট্রপুত্রের হাত থেকে কুরুরাজ্য ছিনিয়ে নেব আমরা। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা শুনে রাখো আমার, যতই তুমি দানবীর সাজার অভিনয় করো না কেন, আমাদের হাত থেকে তোমার মুক্তি নাই। আমাদের হাতে তোমার মৃত্যু অনিবার্য।’ 

‘কী বললে তুমি! কী বললে যুধিষ্ঠির?’ বজ্রনাদের মতো দুর্যোধনের কণ্ঠ ভেসে এলো। 

যুধিষ্ঠির বুঝতে পারল, তার বাক্যবাণে কাজ হচ্ছে, উত্তেজিত হয়েছে দুর্যোধন। সে কণ্ঠকে আরও শানিত করে বলল, ‘দেখো দুর্যোধন, তুমি আমি—দুজনেই যদি বেঁচে থাকি, তাহলে মানুষে সন্দেহ করবে। বুঝতে পারবে না কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কে জিতল! মানুষের সন্দেহ দূর করার জন্য একজনকে মরতেই হবে। আর সে-জন যে তুমি, বুঝতে নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তোমার? তোমার জীবন এখন আমার হাতে। আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম, কিন্তু তুমি সারাজীবন আমাদের কষ্ট দিয়েছ, যেভাবে পদে পদে লাঞ্ছিত করেছ, তোমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই আর। তাই বলছি, তুমি জল থেকে ওঠো, যুদ্ধ করো। এই যুদ্ধই তোমাকে চিরবিশ্রাম এনে দেবে।’ 

বারো 

এই দীর্ঘ কথাবার্তায় রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে। 

আঁধার ফিকে হয়ে গেছে। চারদিক ফরসা হতে শুরু করেছে। এতগুলো মানুষকে হঠাৎ দেখে বৃক্ষশাখার পাখিরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তাদের কলকোলাহলে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল। 

কূজন দুর্যোধনের কান পর্যন্ত পৌঁছল। সে বুঝতে পারল—সকাল হয়ে গেছে। অদ্ভুত এক শিহরন অনুভব করল সে। এতক্ষণ ধরে যে ক্লান্তি ঘিরে রেখেছিল তাকে, কী এক অলৌকিক মন্ত্রবলে তা তার শরীর থেকে তিরোহিত হয়ে গেল। মনে সকালের ফুরফুরে হাওয়া এসে লাগল যেন! মনটা তার প্রফুল্লতায় হঠাৎ ভরে উঠল। রাত্রিজুড়ে যে ত্রস্ত ভাব ছিল তার দেহমনে, সকালে সেই ত্রস্ততা কেটে গেল। 

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল দুর্যোধন। তারপর যুধিষ্ঠিরের শেষ বাক্যটি মনে পড়ে গেল তার—এই যুদ্ধই তোমাকে চিরবিশ্রাম এনে দেব। কী বলল যুধিষ্ঠির! চিরবিশ্রাম! মানে আমাকে হত্যা করবে? সারাজীবন কষ্ট দিয়েছি আমি পাণ্ডবদের! ওরা দেয়নি আমাদের? পদে পদে লাঞ্ছিত করেনি! আমাকে? পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে? পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুসাম্রাজ্যের অধিপতি হিসেবে স্বীকারই তো করেনি পাণ্ডবপক্ষ! ভারপ্রাপ্ত নরপতি! হ্যাঁ, পিতাকে ভারপ্রাপ্ত রাজা হিসেবেই তো রেখে দিয়েছে সারা জীবন! তাহলে, তাহলে দোষ কি শুধুই কুরুপক্ষের? দোষ কি শুধু আমারই? কেউ তর্জনী উঁচিয়ে, চোখ রাঙিয়ে রূঢ়ভাষায় কথা বলতে সাহস করেনি এতদিন আমার সঙ্গে! আর আজ ভীম, কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির এমন করে কথা বলছে! 

দুর্যোধনের ঠাণ্ডা মেজাজটা আবার উষ্ণ হয়ে উঠতে শুরু করল। নিজেকে শান্ত রাখতে দুর্যোধন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। মনের শীতল ভাবটা ক্রোধে উষ্ণ হতে থাকল। সে জানে, জল থেকে উঠে এলে কঠিন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। হয়তো মৃত্যু ও অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে এই যুদ্ধে। কিন্তু তার পরও জলতলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সে। বারবার দুর্যোধন দীর্ঘ ও উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। তার দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। উঠে দাঁড়াল সে। নিজের গদাটি হাতে নিল দুর্যোধন। তারপর জলের ওপর ভেসে উঠল। সামান্য সাঁতরে কূলে উঠল। বীরদর্পে দ্বৈপায়নপাড়ে উঠে এলো দুর্যোধন। 

কেন জানি, সমবেত সবাই হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল। এটা নীতিবিরুদ্ধ শত্রুপক্ষের কাউকে বাহবা দেওয়া যুদ্ধনীতিতে নেই। কিন্তু মানুষের আবেগ বলে কথা! শত্রু হোক, মিত্র হোক, বীরের প্রশংসা করতে সবাই চায়। এখানেও পাণ্ডবপক্ষের মানুষজনেরা দুর্যোধনকে শত্রু বলে জেনেও নিজেদের অজান্তে দুর্যোধনের সাহস ও বীরত্বকে বাহবা দিল। আহত, রুধিরাক্ত দুর্যোধন যে পদক্ষেপে যুধিষ্ঠিরের সামনে এগিয়ে এসেছে, তা দুর্যোধনের মতো বীর্যশালী যোদ্ধার পক্ষেই সম্ভব। তাই তার অনুকূলে হাততালি আর উল্লাসধ্বনি। 

দুর্যোধনের সমস্ত শরীর তখন জলে ভেজা, সেই জলের সঙ্গে রুধির কণা মিশে আছে। খোলা চুল তার। সেই খোলাচুলে জড়িয়ে থাকা জলরাশি এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলল দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের সামনে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে বলল, ‘এই দেখ, আমি এসেছি। যুদ্ধের বড় সাধ তোর, না যুধিষ্ঠির? বল কে যুদ্ধ করবে আমার সঙ্গে?’ 

যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কাণ্ড দেখে হতভম্ব! মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও একজন মানুষ এরকম করতে পারে? বিপুলবিক্রমী শত্রুপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে এরকম করে কথা বলতে পারে? দুর্যোধনের কি মৃত্যুভয় নেই! 

দুর্যোধন তখন বলে চলেছে, ‘দেখো যুধিষ্ঠির, তোমাদের সাহায্য করার জন্য এখানে অনেকে আছে, রথ আছে, নানা অস্ত্রও আছে। অপরদিকে দেখো, আমি একা। রথ বা অন্য কোনো বাহন—কিছুই নেই আমার। তোমরা সবাই বাহনে চড়ে যুদ্ধ করবে, আর পদাতিক সৈনিকের মতো তোমাদের সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাব আমি, তা তো হতে পারে না যুধিষ্ঠির! এ তো ঘোর অন্যায়! এটা যুদ্ধনীতির মধ্যে পড়ে না যুধিষ্ঠির।’ 

এতক্ষণে অর্জুন কথা বলে উঠল, ‘তাহলে কীভাবে যুদ্ধ করতে চাও তুমি আমাদের সঙ্গে?’

দুর্যোধন চট করে অর্জুনের দিকে তাকাল। ‘এই তো বীরের মতো কথা! সমানে সমানে যুদ্ধ করতে চাই আমি।’ অর্জুনকে লক্ষ করে বলল দুর্যোধন। 

‘মানে!’ কৃষ্ণের মুখ দিয়ে ত্বরিত বেরিয়ে এলো। 

দুর্যোধন ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে কৃষ্ণকে বলল, ‘তোমরা এক-একজন, এক-একবারে পর্যায়ক্রমে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো, একে একে সবাইকে যমালয়ে পাঠাব আমি।’ 

তারপর যুধিষ্ঠিরের দিকে ফিরল দুর্যোধন, ‘শোনো যুধিষ্ঠির, তোমাকে আমি কণামাত্র ভয় পাই না। ভয় পাই না ভীম বা অর্জুনকে। কৃষ্ণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, নকুল সহদেব – যারা যারা তোমার যোদ্ধা আছে, তাদের কাউকে ভয় পাই না আমি। সবাইকে হারানোর ক্ষমতা রাখি আমি। কিন্তু একে একে এসো তোমরা, দলবদ্ধভাবে নয়। 

দুর্যোধনের কথা শুনে সমবেতরা তাজ্জব বনে গেল। বলে কী দুর্যোধন! এই সময়ে ক্ষত- বিক্ষত দেহের এই মানুষটার তো ভয়ে কুঁকড়ে থাকার কথা! তার সামনে ভয়ঙ্কর অস্ত্রধারী যুদ্ধকামীরা উপস্থিত। এদের দেখেই তো দুর্যোধনের স্নায়ুক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা নয়, সগর্জনে ধমকে যাচ্ছে কৃষ্ণকে, যুধিষ্ঠিরকে! কী অসম্ভব স্নায়ুশক্তি দুর্যোধনের! সবাই ভাবছে আর অবাক বিস্ময়ে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। 

ওই সময় দুর্যোধনের বজ্রকণ্ঠ আবার তাদের কানে আসে, ‘একে একে এলে, যত সময় লাগে, আমি তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাব। শুধু তা-ই নয়, তোমাদের বাপের নামও ভুলিয়ে দেব আমি। রাতের আকাশে নক্ষত্ররা যতই দপদপ করে জ্বলুক না কেন, সূর্য উঠলে তাদের আলো যেমন আর থাকে না, তেমনি আমি আমার নিজের তেজে তোমাদের সকলকে নিষ্প্রভ করে ছাড়ব।’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে ভীম হো হো হা হা করে হেসে উঠল। 

যুধিষ্ঠির ভীমের হাসি থামিয়ে দিল। দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘বাহ্ বাহ্ দুর্যোধন! এই তো বীরের মতো কথা! আমার খুশি লাগছে তোমার কথা শুনে। তুমি এখনো ক্ষত্রিয়ধর্ম ভুলে যাওনি। তুমি এখনো, এই অবস্থাতেও যুদ্ধের কথা ভাবছ।’ দুর্যোধন যে আহত এবং রক্ত ঝরছে তার শরীর থেকে, সেদিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলল যুধিষ্ঠির। 

কণ্ঠে উপহাস মিশিয়ে দুর্যোধন বলল, ‘তুমি কি ভুলে গেছ, আমি ক্ষত্রিয়ের সন্তান! তুমি কি ভুলে গেছ, আমার পিতাশ্রীর নাম? ধৃতরাষ্ট্র তিনি।’

এবার কণ্ঠে তিরস্কার ঢালল দুর্যোধন, ‘অন্যদের মতো আমি পিতৃপরিচয়হীন নই। আমার পিতা অন্যদের মতো অজ্ঞাতকুলশীল নন।’ 

এই কথাগুলো যে তাদেরই লক্ষ করে দুর্যোধন বলল, বুঝতে ভীমার্জুনদের অসুবিধা হলো না। অন্যরা শান্ত থাকলেও ভীম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। গদা হাতে তেড়ে এলো দুর্যোধনের দিকে। কৃষ্ণ ভীমকে আটকে না দিলে রক্তারক্তি হয়ে যেত। 

চাপা কণ্ঠে কৃষ্ণ বলল, ‘উত্তেজিত হয়ো না ভীম। দুর্যোধন চাইছে, কোনো একটা অঘটন ঘটুক। তাতে সমস্ত ভারতবর্ষ তোমাদের নিন্দামন্দ করবে। তাদের সমবেদনা দুর্যোধনের অনুকূলে চলে যাবে তখন। আর শোনো, যুধিষ্ঠির ঠিক কাজটিই করছে, ধীরে ধীরে কথার চালে দুর্যোধনকে কুহকাবদ্ধ করছে তোমাদের দাদা। তাতেই উদ্দেশ্য হাসিল হবে।’ 

ভীম শান্ত হলো। 

যুধিষ্ঠির ধীর কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মহাবীর বটে দুর্যোধন। যুদ্ধটা ভালোভাবে শিখেছ তুমি। যুদ্ধে অত্যন্ত দক্ষ বলেই এরকম বীরত্বের সঙ্গে কথাগুলো বলে যাচ্ছ তুমি। কাপুরুষ হলে তুমি কখনোই বলতে সাহস করতে না যে, আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যুদ্ধ করবে তুমি। বাহ্ দুর্যোধন বাহ্! তোমাকে বাহবা না দিয়ে পারছি না আমি।’ 

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল দুর্যোধন। কোথায় গালিগালাজ তর্জনগর্জন করবে যুধিষ্ঠির, তা না, সমানে প্রশংসা করে যাচ্ছে তার! কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল দুর্যোধন। 

জীবনাভিজ্ঞ যুধিষ্ঠির বুঝতে পারল তা। কণ্ঠে আরও কোমলতা ঢেলে বলল, ‘যে অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করতে চাও, সেই অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করো তুমি। ও হ্যাঁ, যেকোনো এক ভাইয়ের সঙ্গেই যুদ্ধ করবে তুমি। অন্যরা চারদিকে দর্শক হয়েই থাকবে। তাদের কেউই তোমার ওপর অস্ত্র তুলবে না তখন।’ 

তেরো 

উল্লাস এবং হাহাকার—দু-ধরনের ধ্বনি উঠল তখন দ্বৈপায়নপাড়ে। 

পরম আনন্দযুক্ত আওয়াজ বেরিয়ে এলো দুর্যোধনের মুখ থেকে।

আর আর্তনাদ করে উঠল পাণ্ডবপক্ষ। 

চাপা কণ্ঠে সবাই বলতে থাকল—একি! মহারাজ যুধিষ্ঠির এটা কী বলল! ভীম বলল, দাদার মাথাটা গোলমাল হয়ে গেছে! অর্জুনের চক্ষু বিস্ফারিত। নকুল-সহদেব ম্রিয়মাণ। সাধারণ সৈনিকরা কোলাহল করে উঠল। সাত্যকি-ধৃষ্টদ্যুম্ন দিশেহারা। কৃষ্ণ বিব্রত, বিভ্রান্ত। এ কী প্রস্তাব যুধিষ্ঠিরের! ক্ষুধার্ত হিংস্র শার্দুলের সামনে হরিণকে এগিয়ে দিচ্ছে! যুধিষ্ঠির কি চেনে না দুর্যোধনকে! তার বাহুবল, তার গদাকৌশল আজীবন দেখে আসেনি যুধিষ্ঠির! ও, আহত হয়েছে বলে যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে দুর্বল, শক্তিহীন, হতকৌশলী বলে ভাবছে! এ যে মস্তবড় ভুল- একবারের জন্যও ভাবল না কেন যুধিষ্ঠির! বলেই ফেলল, যে কোনো ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করবে তুমি! যুধিষ্ঠির জানেন না দুর্যোধন কীরকম যোদ্ধা? দুর্যোধনের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আছে তার? একমাত্র ভীমই যা কিছু সামর্থ্য রাখে দুর্যোধনের মুখোমুখি হওয়ার। অন্য ভাইদের সেই ক্ষমতাটুকু যে নেই, তা ভুলে গেল কী করে যুধিষ্ঠির! এরকম করে ভেবে গেল সাত্যকি থেকে আরম্ভ করে সাধারণ সৈন্যরা পর্যন্ত। কৃষ্ণ ত্বরিত পায়ে যুধিষ্ঠিরের নিকটে এগিয়ে গেল। 

কৃষ্ণ কিছু বলবার আগে সোৎসাহে যুধিষ্ঠির আবার বলে উঠল, ‘তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি দুর্যোধন, আমাদের মধ্যে যেকোনো একজনকে বধ করতে পারলে তুমি রাজা হবে। আর যুদ্ধে তুমি হেরে গেলে তোমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ 

যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব শুনে কৃষ্ণ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে যেন বোবা, বধির! স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কৃষ্ণের করার আর কিছুই থাকল না। আত্মঘাতী প্রস্তাবটি তখন যে যুধিষ্ঠিরের মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে! 

যুধিষ্ঠিরের এই বেফাঁস কথার সুযোগটি নিল না দুর্যোধন। নেবে কেন? সে যে বীর! তার যে শৌর্যবীর্য আছে! বলশালী খ্যাতিমান যোদ্ধা বলেই যুধিষ্ঠিরের আহম্মকি প্রস্তাবের সুযোগটা নিল না দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের এই প্রস্তাবে সে নকুল-সহদেবের যেকোনো একজনকে বেছে নিতে পারত, পারত যুধিষ্ঠিরকে নির্বাচিত করতে। অর্জুনকেও দ্বৈরথে আহ্বান জানাতে পারত সে। গদাযুদ্ধে এই তিনজন মাটির খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয় দুর্যোধনের গদার সামনে। অর্জুনকে হারাতে দুর্যোধনকে কিছুটা বেগ পেতে হতো সত্য, কিন্তু অর্জুন দুর্যোধনের কাছে অপরাজেয় নয়। এসবের কিছুই করল না দুর্যোধন। পাশাখেলার ঘুঁটিটা যুধিষ্ঠিরের দিকে ঠেলে দিল। একজন বীরযোদ্ধা বলে, বিশাল উদার মনের মানুষ বলে দুর্যোধন এরকম কাজটি করল। 

উদাত্ত কণ্ঠে যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ করে দুর্যোধন বলল, ‘একজনকে যদি বেছেই নিতে হয় আমাকে, তাহলে সেই বেছে নেওয়ার কাজটি তুমিই করে দাও যুধিষ্ঠির। তোমাদের মধ্যে যাকে তুমি বীরশ্রেষ্ঠ মনে কর, তাকেই নির্বাচন করো তুমি। আমি তার সঙ্গেই যুদ্ধ করব। তবে হ্যাঁ, যুদ্ধ করব আমি আমার এই গদাটি দিয়ে।’ বলে একটু থামল দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের এই কথা শুনে সমবেতদের মধ্যে আবার গুঞ্জন উঠল। এই গুঞ্জনের মধ্যে প্রশংসাই উৎসারিত। পাণ্ডবরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণের দম বন্ধ করা শ্বাসটি ফেলতে পেরে কৃষ্ণ যারপরনাই তৃপ্তিবোধ করল। 

খোলাচোখে দুর্যোধনের দিকে তাকাল কৃষ্ণ। কৃষ্ণ দেখল, দুর্যোধনের মেদবিহীন পেশিবহুল দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, সেদিকে খেয়াল নেই দুর্যোধনের। তাকে তখন লাভাগ্রাসী পর্বতের মতো দেখাচ্ছে। দুর্যোধনের হাতে লৌহসারময়ী স্বর্ণকেয়ূরভূষিত সেই ভারী গদাটি। কৃষ্ণের চোখে তখন দুর্যোধনকে প্রতপ্ত সূর্য বলে মনে হলো। তাকে তখন দণ্ডধারী যমের মতো লাগছে। 

যুধিষ্ঠির কী বলবে, কী করবে দিশা পেল না। প্রস্তাবটি দেওয়ার পরপরই সে নিজের ভুলটি বুঝতে পেরেছিল। বুকের জল শুকিয়ে গিয়েছিল তখন তার। দুর্যোধনের কথা শুনে রা হারিয়ে ফেলল সে। কথা গলায় আটকে গেল তার। 

এই ফাঁকে দুর্যোধন আবার বলে উঠল, ‘শোনো যুধিষ্ঠির, তোমার বোকামির সুযোগটা অন্য কেউ হলে লুফে নিত। আমি নিলাম না। ওই যে বললাম, বীর আমি।’ 

ক্রুর একটু হাসল দুর্যোধন। তারপর স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘এই মুহূর্তে আমার কোনো রথ নেই, লাগবেও না রথ। এই জন্মভূমির মাটিতে দাঁড়িয়েই যুদ্ধ করব আমি। দেখতেই পাচ্ছ—আমার হাতে ধনুক নেই, পিঠে তিরভর্তি তূণ নেই, কোমরের পাশে ঝুলানো নেই তীক্ষ্ণমুখ অসি। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। এই গদা দিয়েই যুদ্ধ করব আমি।’ বলে গদা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করল দুর্যোধন। ধরণী থর থর করে কেঁপে উঠল। সেই কম্পন যুধিষ্ঠিরের বুকে এসে বাজল। সামান্য সময়ের জন্য চোখ বুজল যুধিষ্ঠির। 

‘আর হ্যাঁ জ্যেষ্ঠপাণ্ডব, আমার সঙ্গে তুমি বা তোমার যে ভাই যুদ্ধ করবে, তাকেও পাদচারী হয়ে যুদ্ধ করতে হবে—এই আমার শর্ত। সে যে অস্ত্র নিয়েই যুদ্ধ করুক, আমার আপত্তি নেই। নানা অস্ত্র দিয়ে আঠারো দিনে অনেক যুদ্ধ করেছি, এবার গদাযুদ্ধটাই করব আমি।’ পরিষ্কার গলায় বলে গেল দুর্যোধন। 

তারপর নিজের গদাটি দু-চারবার মাথার চারদিকে ঘুরিয়ে নিল দুর্যোধন। গদা ঘোরাতে ঘোরাতে পাঞ্চাল-পাণ্ডবদের একেবারে সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। দুর্যোধনের এরকম বীরত্বব্যঞ্জক পদচারণায় উপস্থিত সবাই চমৎকৃত হলো। দুর্যোধনের জন্য হাততালি দিয়ে উঠল সবাই। 

এই হাততালি প্রশংসার। কিন্তু দুর্যোধন ভুল বুঝল। সে ভাবল, তাকে উপহাস করবার উদ্দেশ্যেই পাণ্ডব-পাঞ্চালরা হাততালি দিয়ে উঠেছে। রেগে গেল দুর্যোধন। আগুন চোখে কৃষ্ণ আর পাণ্ডবদের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার করল, ‘এই অপমানের প্রতিফল তোরা এখনই পাবি। তোদের সবাইকে যমের বাড়ি পাঠিয়েই ক্ষান্ত হব আমি।’ 

দুর্যোধনের মনের মধ্যে মৃদু অথচ দৃঢ় একটা ভয় কাজ করছিল তখন। সে বরাবরই ভেবে যাচ্ছে— পাণ্ডবরা শেষপর্যন্ত তার সঙ্গে এককযুদ্ধ করবে না। সবাই মিলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই ভয় থেকেই দুর্যোধনের ক্রোধ-উন্মত্ততা। তার বারবার চিৎকার করে বলা— তোমরা কিন্তু একে একে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসবে। আমি বর্মহীন, শরীরে ক্ষত আছে। গদা ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র নেই আমার হাতে। কাজেই আমার সামনে একে একে এসো তোমরা। 

যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ ধরে দুর্যোধনের মুখে বারবার একই কথা শুনে যাচ্ছে। সে তো বলেছেই, পাণ্ডবদের সঙ্গে এক এক করেই যুদ্ধ হবে। ওই কথাটাও ফিরিয়ে নিয়েছে সে। বলেছে, যেকোনো একজন পাণ্ডবের সঙ্গেই যুদ্ধ হবে দুর্যোধনের। জয়ী হলে কুরুরাজ্য লাভ করবে। কিন্তু তাতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছে না কেন দুর্যোধন! রেগে গেল যুধিষ্ঠির। 

কটু কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘তুমি ভাবছ, আমরা পাঁচ ভাই একত্রে তোমার ওপর আক্রমণ চালাব। তা কিছুতেই হবে না দুর্যোধন। একজনের সঙ্গেই যুদ্ধ হবে তোমার। যুদ্ধনীতি কখনো ভঙ্গ করব না আমি। হে নষ্ট দুর্যোধন, এখানে একটা প্রশ্ন করি তোমায়, তোমরা যেদিন অর্জুনপুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করলে, সেদিন তোমার এই যুদ্ধনীতি কোথায় গিয়েছিল? তুমি, দ্রোণাচার্য, কৃপ, অশ্বত্থামা, শকুনি মিলে কী নির্দয়ভাবেই না হত্যা করলে সুভদ্রার একমাত্র সন্তানটিকে!’ বলতে বলতে গলা বুজে এলো যুধিষ্ঠিরের। অর্জুনের চক্ষু লাল হয়ে উঠল, কৃষ্ণের মাথা ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। 

‘না না। আমি ওরকম করব না তোমায় দুর্যোধন। তুমি বারবার চিৎকার-চেঁচামেচি করে বর্মের কথা বলছ তো? এই নাও তোমাকে দুর্ভেদ্য বর্ম দিচ্ছি আমি। তোমার অবিন্যস্ত চুল বেঁধে নাও দুর্যোধন। আর হ্যাঁ, তোমার যদি অন্য কোনো অস্ত্রের প্রয়োজন থাকে, বলো আমায়। তাও দেব আমি তোমাকে।’ দম নেওয়ার জন্য থামল যুধিষ্ঠির। 

তারপর গম্ভীর এবং উচ্চ কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘সমবেত সবার সামনে আমি আবার ঘোষণা করছি— তুমি পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যার সঙ্গে ইচ্ছে, যুদ্ধ করো। তাকে বধ করো। কুরুসাম্রাজ্যের অধিপতি হও। এ আমার প্রতিজ্ঞা। এই প্রতিজ্ঞা থেকে এক চুলও নড়ব না আমি। তুমি নিশ্চিন্ত হও। নির্ভীকচিত্তে গদাযুদ্ধ করো তুমি।’ 

দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের হাত থেকে লৌহবর্ম এবং শিরস্ত্রাণ নিয়ে সজ্জিত হলো। গদা হাতে নিয়ে বুক টান করে দাঁড়িয়ে দুর্যোধন বলল, ‘এখন বলো তুমি যুধিষ্ঠির, কার সঙ্গে যুদ্ধ করব আমি? তোমার সঙ্গে, না তোমার অন্য কোনো ভাইয়ের সঙ্গে?’ 

চৌদ্দ 

দুর্যোধনের কথা শেষ হতে না হতে তিক্ত কণ্ঠে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলল, ‘এটা কেমন কথা হলো দাদা? এ কোন বোকামি করলে তুমি?’ বলে হেয় চোখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে থাকল কৃষ্ণ। 

যুধিষ্ঠির নিজের ভুলটা ধরতে পারল না। সে বুঝতে পারছে না কোথায় তার অন্যায় হয়েছে! নিজের মধ্যে দ্রুত চোখ রাখল সে। সেখানে তার চোখে কোনো বোকামি ধরা পড়ল না। সে কি ভুল করেছে? নাহ্, কোনো নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে বলে তো তার মনে হচ্ছে না! সে কি ক্ষত্রিয় যুদ্ধনীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে? একজনের সঙ্গে একজনেরই তো যুদ্ধ করার কথা! একাধিক যোদ্ধা একই সময়ে একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া তো অন্যায়! এটাকে যুদ্ধ না বলে সরাসরি হত্যাই তো বলতে হবে! সে একজন রাজা হয়ে দুর্যোধনের ওপর নিজের সব ভাইকে লেলিয়ে দেয় কী করে! তাই তো একজনের সঙ্গে একজনেরই যুদ্ধ করার কথা স্বীকার করে নিয়েছে! কৃষ্ণ তো সকল সামরিক নিয়মকানুন সম্বন্ধে অবগত! অবগত হয়েও কৃষ্ণ জনসমক্ষে এরকম করে বলল কেন? তিক্ত কণ্ঠে? তিরস্কারের ভঙ্গিতে? ভেবে কূল পায় না যুধিষ্ঠির। 

কৃষ্ণ আবার বলল, ‘তুমি বললে, যেকোনো একজনকে বেছে নিতে। দুর্যোধন যদি এখন তোমাকে বেছে নেয়! পারবে তুমি তার সঙ্গে লড়তে? কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে তুমি তার সঙ্গে? 

কৃষ্ণের কথা শুনে যুধিষ্ঠির মৃদু হেসে উঠল। 

যুধিষ্ঠিরের হাসি দেখে কৃষ্ণ আরও রেগে গেল। এবার কণ্ঠে তিক্ততার সঙ্গে রাগ মেশাল কৃষ্ণ, ‘অথবা নির্বাচন করে বসে নকুল, সহদেব কিংবা অর্জুনকে? তা হলে কী হতে পারে একবার ভেবে দেখেছ? তুমি কোন সাহসে এমন কথা বললে, যেকোনো একজন পাণ্ডবকে জিতে এ রাজ্যের রাজা হও দুর্যোধন?’ 

যুধিষ্ঠির কোনোরকম উত্তেজিত হলো না। কৃষ্ণের কথার কোনোই প্রতিক্রিয়া দেখাল না যুধিষ্ঠির। আগের মতো হাসিটা মুখে ছড়িয়ে রাখল। 

যুধিষ্ঠির উত্তেজিত না হলেও কৃষ্ণ বেশ উত্তেজিত হলো। চড়া গলায় বলল, ‘তুমি জানো দাদা, গেল তেরো বছর ধরে এই দুর্যোধন ভীমের লোহার মূর্তি তৈরি করে তার ওপর গদাঘাত করে গেছে। ভীম ছাড়া অন্য কাউকে পেলে চূর্ণবিচূর্ণ করে ছাড়বে দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের কাছে মহান সাজতে গেছ তুমি। কিন্তু তুমি ভাবোনি যে এই মহানুভবতার কী খেসারত দিতে হবে তোমাকে! একই ভুল তুমি শকুনির সঙ্গে পাশা খেলতে বসেও করেছিলে। আজ দুর্যোধনের সামনে যে ভুলটা করলে, তা সেই পুরনো জুয়াখেলার মতো মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ কৃষ্ণকে আজ ক্রোধ পেয়ে বসেছে। ক্রোধে আচ্ছন্ন কৃষ্ণ তাই মুখে যা আসে, তা-ই বলে যাচ্ছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের কাণ্ডারি তো কৃষ্ণ স্বয়ং! মাত্র আঠারো দিনে গোটা যুদ্ধটা গুছিয়েও এনেছে সে। কিন্তু আজ যুধিষ্ঠিরের তথাকথিত মহানুভবতার কারণে ভেস্তে যাচ্ছে সব। তাই তো কৃষ্ণ অধৈর্য হয়ে উঠেছে। 

এবারও কৃষ্ণের মর্মঘাতী কথার কোনো জবাব দিল না যুধিষ্ঠির। নিশ্চুপ থাকল। 

কৃষ্ণের মুখ দিয়ে আসল কথাটি বেরিয়ে এলো এবার। বলল, ‘তুমি ভাবছ, দুর্যোধন প্রতিযোদ্ধা হিসেবে ভীমকে বেছে নেবে। সে গুড়ে বালি। দুর্যোধন তোমার মতো আহম্মকি করবে না। আর হ্যাঁ, যদি করেও-বা ভীম কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে দুর্যোধনের গদার সামনে? জানো তুমি? জানো না! শোনো দাদা, তোমাকে জানিয়ে রাখি, গদাযুদ্ধের পেছনে দুর্যোধন যত পরিশ্রম করেছে, ভীম তার সিকিভাগও করেনি। ভীমের গায়ে জোর আছে, মানলাম। কিন্তু দুর্যোধনের আছে গদাকৌশল। এ কৌশল ভীমের আয়ত্তে নেই। ভীম বলবান, দুর্যোধন নিপুণ কৌশলী। বলবান আর কৌশলীর মধ্যে কৌশলীরই জয় হয়েছে সর্বদা।’ কৃষ্ণের কপাল ঘামে জবজব। 

বহুক্ষণ ধরে কৃষ্ণের তিক্ত-কটু কথা শুনে গেল যুধিষ্ঠির। সে মনে করল, এবার তার কথা বলার সময় হয়েছে। সে বলল, ‘তুমি বেশ উতলা হয়ে পড়েছ কৃষ্ণ। বারো বছর বয়স থেকেই দুর্যোধনকে দেখে আসছি আমি। স্বার্থপর সে মানি, কিন্তু কাপুরুষ নয়। অর্জুন-সহদেব-নকুল কিংবা আমাকে প্রতিযোদ্ধা হিসেবে নির্বাচন করবে না সে। কারণ দুর্যোধন জানে, গদাযোদ্ধা হিসেবে আমরা তার কাছে কিছুই নই। তুমি দেখে নিয়ো, সিংহ সিংহকেই বেছে নেবে।’ 

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনতে নারাজ। শুনলও না। রাগ তার তখনো পড়েনি। সেই রাগের সঙ্গে হতাশা মিশিয়ে কৃষ্ণ বলল, ‘আঠারো দিন ধরে সমস্ত শত্রু জয় করে এসে অবশেষে এক বিপন্ন শত্রুর হাতে অদ্ভুত এক অস্ত্র তুলে দিলে তুমি দাদা! যাতে আমাদের প্রায়-হস্তগত রাজ্যটাই যেতে বসেছে!’ 

এবার ওপর দিকে চোখ তুলল কৃষ্ণ। অদৃশ্য বিধাতাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘হায় ভগবান, তুমি কুন্তী-মাদ্রীর ছেলেদের রাজ্যলাভের জন্য সৃষ্টি করোনি। এতকাল গেছে বনবাসের কষ্টে, আর এখন মনে হচ্ছে, ওদের চিরকালটা যাবে ভিক্ষা করে।’ 

কৃষ্ণের হতাশার কথাগুলো যুধিষ্ঠির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। রাগও তার হচ্ছিল না, এমন নয়। কিন্তু যুধিষ্ঠির সংযমী। নিজের রাগকে সে প্রশান্ত মুখ দিয়ে ঢেকে রাখল। 

কিন্তু ভীম নিজের রাগকে ঢেকে রাখল না। মূলত ক্রোধকে ঢেকে রাখতে জানেও না সে। সেই রাগ জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে হোক কিংবা জননী কুন্তীর বিরুদ্ধে অথবা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। কৃষ্ণের আগের কথাগুলো শুনে এমনিতেই ক্রোধান্বিত হয়ে উঠছিল ভীম। কৃষ্ণ ভীমকে অবমূল্যায়ন করছিল তখন। বলছিল, দুর্যোধন ভীমের চেয়েও নিপুণ যোদ্ধা। দুর্যোধনের কৌশলের কাছে ভীম কিছুই না—ইত্যাদি ইত্যাদি। দুর্যোধনের গদার কৌশলে পাণ্ডবরা আবারও ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হবে—কৃষ্ণের এই কথায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না ভীম। 

ভীমকণ্ঠে ভীম বলল, ‘এতে দুঃখের কিছু ঘটেনি, কৃষ্ণ! আমার সারাজীবনের শত্রুতার প্রতিশোধ আজকে আমি নেব। দুর্যোধনকে আমি চুরমার করেই ছাড়ব। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জয় হবেই। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। 

কৃষ্ণ অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘বৃকোদর তোমার এই বিশ্বাস হচ্ছে কেন যে, দুর্যোধন গদাযুদ্ধে তোমাকেই বেছে নেবে?’ 

ভীম বলল, ‘দেখো, দাদার অনুমান সত্য। দুর্যোধন বীর। দ্বৈরথে সে তার সমকক্ষকেই বেছে নেবে। আমিই হব তার প্রতিযোদ্ধা।’ 

কৃষ্ণ সুর পালটাল। আসলে কৃষ্ণের জীবনাভিজ্ঞতা অন্য সবার চাইতে বেশি। প্রকৃতপক্ষে সে চাইছিল ভীমকে চেতিয়ে তুলতে। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে যে যুধিষ্ঠিরকে কটুকাটব্য করে গেল, তার পশ্চাতে বিশেষ একটা কারণ আছে। আর সে কারণটা হলো ভীমকে ক্রুদ্ধ করে তোলা। পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে তার। ক্রোধান্ধ হয়ে উঠেছে ভীম। এতেই কার্যসিদ্ধি হবে। 

কৃষ্ণ ভীমকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আমি জানি ভীম, তোমাকে আশ্রয় করেই মহারাজ যুধিষ্ঠির বিশাল কুরুসাম্রাজ্যের অধিপতি হবে। দুর্যোধনের সব ভাইকে তুমি হত্যা করেছ। বাকি আছে দুর্যোধন। তাকে ছেড়ে দেবে কেন তুমি? তাকেও তুমি শেষ করে দাও। পাণ্ডবরা নিষ্কণ্টক হোক। 

এই সময় দুর্যোধন চিৎকার করে বললেন, ‘কী যুধিষ্ঠির, বলছ না কেন আমি তোমার কোন ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করব? ঠিক করতে পারছ না কাকে নির্বাচন করবে? নিজে তো হীনবীর্য! তুমি যে আসবে না আমার সামনে, জানি। নকুল-সহদেব আমার কাছে তেলাপোকা। পায়ের তলায় পিষে মারব আমি তাদের। অর্জুন বহুগামী। নারীলোলুপ ওই অর্জুনটার কোমরে বল নেই। সমস্ত শক্তি ব্যভিচারিতায় নষ্ট করেছে সে। তাই আমি বলছি যুধিষ্ঠির, মনোযোগ দিয়ে শোনো, ওই পেটুক বৃকোদরটাকেই আমি আমার প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাচন করলাম। ওই ভীমকেই পাঠাও তুমি আমার সামনে। তাকে হত্যা করে আমি আমার গদার রক্তপিপাসা মেটাই।’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে যুধিষ্ঠির সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। মনে মনে বলল–দুর্যোধন, তুমি আমার যত বড় শত্রুই হও না কেন, সত্যিই তুমি মহাবীর! উদার হৃদয় তোমার! 

এই সময় কৃষ্ণ ভীমকে লক্ষ করে বলল, ‘শুনলে তো ভীম, ওই কুলাঙ্গারটা তোমাকেই তার প্রতিযোদ্ধা হিসেবে নির্বাচন করেছে! তোমার কিন্তু প্রতিজ্ঞা ছিল দাদা, দুর্যোধনের ঊরু দুটো ভাঙবে তুমি। সেই প্রতিজ্ঞা কিন্তু তোমাকে পালন করতে হবে আজ।’ 

কৃষ্ণ জানে, গদাযুদ্ধে ঊরুতে আঘাত করা যাবে না। এটা ক্ষাত্রধর্মের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু কৃষ্ণ তো কোনো ন্যায়নীতির ধার ধারে না! তাই তো বলল—দুর্যোধন যতই গদাকৌশলী হোক না কেন, দরকার হলে অন্যায় করতে হবে ভীমকে। 

পনেরো 

দুই মত্ত হাতি যেন পরস্পরের দিকে ধেয়ে গেল। 

ভীম সেন আগে থেকে যুদ্ধসাজে সজ্জিত ছিল। ধর্ম-শিরস্ত্রাণ আগে থেকেই পরা ছিল তার। গদাটা হাতের নিকটেই ছিল। গদা হাতে ভীমবেগে দুর্যোধনের দিকে এগিয়ে গেল ভীম। মুখে তার গর্জন-তিরস্কার, দুর্যোধনের প্রতি। 

দুর্যোধনও কম যায় না। তার মুখেও আস্ফালন, নাদ। চক্ষু দুটো অগ্নিগোলক যেন। সারাজীবন স্বাচ্ছন্দ্যে ও সম্মানে কাটিয়েছে দুর্যোধন। হস্তিনাপুরের প্রকৃত রাজার পুত্র না হলেও রাজকুমারের মর্যাদায় বড় হয়েছে সে। কখনো কারও মন্দকথা শুনতে হয়নি তাকে। তাকে তিরস্কার করার সাহস রাখত না কেউ। একটা সুস্থ ও শীলিত বাতাবরণের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে সে। গালিগালাজ বা শ্রুতিকটু কথা শোনা তার অভ্যাসে নেই। সেই দুর্যোধনকে অবিরতভাবে ভর্ৎসনা করে যাচ্ছে ভীম! সহ্যের সীমা ভেঙে পড়ল দুর্যোধনের। উন্মত্ত মাতঙ্গের মতো ভীমের দিকে এগিয়ে গেল। 

দ্বৈরথের সংবাদ ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রামেগঞ্জে। এরই মধ্যে উৎসুক মানুষের ঢল নেমেছে দ্বৈপায়নপাড়ে। পাণ্ডব-পাঞ্চালরা এবং তাদের সৈন্যসামন্তরা আর ওই কৌতূহলপ্রিয় সাধারণ মানুষেরা দুইজন যোদ্ধাকে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। বৃত্তের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ভীম ও দুর্যোধন নামের দুই মহাবীর পরস্পরের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছে। 

কামড়াকামড়ি শুরু করার আগে সারমেয়রাও একটু তফাতে দাঁড়িয়ে পরস্পরের প্রতি ক্রোধ উদ্‌গিরণ করে। অনেকটা গান শুরুর আগে গায়কের সারেগামা করার মতোই। কুকুররা যেমন মারামারি আরম্ভ করার আগে পরস্পর খানিকটা চেঁচিয়ে নেয়, মানুষও তেমনই করে। ভীম-দুর্যোধনও তা-ই করল। বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল দুজনে। 

পাঞ্চাল-পাণ্ডবরা ভীমের পক্ষে অবিরাম হাততালি দিতে থাকল। দুর্যোধন একাকী। তাকে উৎসাহ জোগানোর লোক নেই সেখানে। তাই বলে দুর্যোধন ভেঙে পড়েনি। সিংহহৃদয় তার। কাতর হয়ে পড়ার জন্য দুর্যোধনের জন্ম হয়নি। এতজন বলবান যোদ্ধা ভীমকে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে, তাতে কর্ণপাত নেই দুর্যোধনের। একাকী মাথা উঁচু করে সংহারমূর্তির মতো বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুর্যোধন। তার মনে কোনো বিচলিত ভাব নেই, ভয় নেই। চেহারায় কোনো গ্লানি নেই। শরীরের সমস্ত ক্ষত-ব্যথাও যেন সেরে গেছে তার! 

ভীমই আগে আরম্ভ করল। দুর্যোধনের অন্যায়গুলো একে একে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকল ভীম। ছোটবেলাকার দুর্ব্যবহার, বারণাবতের জতুগৃহ দাহ, শকুনির পাশার চালে যুধিষ্ঠিরকে বেঁধে ফেলা-এসব জঘন্য কর্মকাণ্ডের কথা একে একে উচ্চৈঃস্বরে বলে যেতে লাগল ভীম। 

সর্বশেষে তুলল দ্রৌপদীর কথা। 

চোখ রাঙিয়ে তর্জনী বাড়িয়ে ভীম বলল, ‘ওরে পাষণ্ড, আমার স্ত্রী দ্রৌপদীর অপমানের কথা…।’ 

কথা শেষ করতে দিল না দুর্যোধন। ভীমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আরে আরে! বলে কী বেটা পেটুক! আমার স্ত্রী নয়, বল, আমাদের স্ত্রী। দ্রৌপদী তো তোর একার নয় রে পামর! ও তো তোদের সব ভাইয়েরই স্ত্রী। একার বলে দাবি করছিস কোন আক্কেলে রে!’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে কী রকম যেন কুঁকড়ে গেল ভীম! গুটোনো কণ্ঠে বলল, ‘দ্রৌপদীকে তুই লাঞ্ছিত করেছিস। কুরুরাজসভার মাঝে তুই দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে…।’ ভীমের কণ্ঠ থর থর করে কেঁপে উঠল। ক্রোধ তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলল। 

‘তোদের এঁটো বউ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ব্যাপারটি তোরা এবং ওই কৃষ্ণ মিলে বিকৃতভাবে প্রচার করেছিস। ওই ঘটনার সুযোগ নিয়ে ভারতবর্ষের রাজা এবং প্রজাদের মনে আমার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিস তোরা। তোর দাদা, জুয়াড়ি ওই যুধিষ্ঠির শেষপর্যন্ত দ্রৌপদীকে বাজি ধরে হারল। জুয়াতে জিতে পাওয়া তোদের ওই মধ্যবয়সি কালো দ্রৌপদীকে নিজের করে পাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। আমি ঘৃণা করি দ্রৌপদীকে, প্রচণ্ড রকম ঘৃণা করি।’ দম নেওয়ার জন্য থামল দুর্যোধন। 

‘ঘৃণা করিস!’ বিস্মিত ভীম জিজ্ঞেস করল। 

দুর্যোধন সরোষে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঘৃণা করি আমি দ্রৌপদীকে।’ 

.

এরপর কণ্ঠে আরও জোর ঢালল দুর্যোধন, ‘ওইদিন, ওই কুরুরাজসভায় আমি উপহাসের শোধ নিয়েছি। তুই খেয়াল করিসনি বেকুব, দ্রৌপদীর গায়ে আমি আঙুলটি পর্যন্ত ঠেকাইনি! সুযোগ ছিল আমার। সুযোগের সদ্ব্যবহার করিনি। কারণ কী জানিস? স্ত্রী ভানুমতী ছাড়া অন্য কারও প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই রে ভীম! তোরা সব ভাই মিলে তোদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থে যে জলবিভ্রমটি তৈরি করেছিলি, সেই বিভ্রমের ফাঁদে পড়ে আমি হাঁটুরও অনেক ওপরে আমার পরিধেয়কে টেনে তুলে ফেলেছিলাম।’ দুর্যোধনের মুখে-কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমে গেছে। অপমান-অপদস্থতার স্বেদবিন্দু। 

ভীম অট্টহাসি দিয়ে উঠল। দুর্যোধনের সেদিনের লাঞ্ছনার কথা ভীম পরে জানতে পেরেছিল। 

পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্যের দাবিকে ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে উড়িয়ে দিয়েছিল। পরে দ্রোণ-ভীষ্ম-বিদুর প্রমুখ কুরুবৃদ্ধের চাপে পড়ে অর্ধেক রাজ্য পাণ্ডবদের দিতে বাধ্য হয়েছিল ধৃতরাষ্ট্র। দিয়েছিল ইন্দ্রপ্রস্থের মতো ঊষর মরু অঞ্চল। সেখানে কৃষ্ণের সহায়তায় পাণ্ডবরা বিশাল এক রাজপুরী নির্মাণ করল। শুধু তা-ই নয়, নতুন রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করল যুধিষ্ঠির। দুর্যোধনও আমন্ত্রিত হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। সবান্ধবে উপস্থিত হয়েছিল দুর্যোধন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপুরীতে। 

রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তির পরও দুর্যোধন শকুনিকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে থেকে গেল কদিন। উদ্দেশ্য, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভার ঐশ্বর্য পরিমাপ করা। 

রাজবাড়ির ঐশ্বর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছেন দুর্যোধন। পাছে পাছে শকুনি। এক জায়গায় স্ফটিকের উচ্ছ্বাস দেখে থমকে গেল দুর্যোধন। স্ফটিককে জল বলে মনে হলো দুর্যোধনের। ইতোমধ্যে সামনে ডান পা বাড়িয়ে দিয়েছে দুর্যোধন। পেছনে ঘোরার উপায় নেই। জলবিভ্রমে পড়ে ওই সময় তড়িঘড়ি করে নিম্নাঙ্গের পরিধেয়টি হাঁটুর বেশ খানিকটা ওপর পর্যন্ত তুলে ফেলল দুর্যোধন। ঠিক ওই সময় খিল খিল খিল—উপহাসের হাস্যধ্বনি দুর্যোধনের কর্ণকুহর পর্যন্ত এসে পৌঁছল। দুর্যোধনের বুঝতে বিলম্ব হলো না যে, এ দ্রৌপদীর হাসি। এই হাসিতে মিশে আছে বিদ্রূপ, উপেক্ষা আর অবজ্ঞা। দ্রৌপদীর ওই অসভ্যতা দুর্যোধনের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় দুর্যোধনের করার কিছু ছিল না। কিল খেয়ে কিল হজম করে হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছিল দুর্যোধন। জলসদৃশ ওই স্থান থেকে ফিরে আসার সময় অলিন্দ থেকে দ্রৌপদী বলে উঠেছিল, ‘অন্ধের ছেলে অন্ধ বটে। তাই এ অবস্থা।’ 

দ্রৌপদীর এই মন্তব্য বহুদিন ধরে দুর্যোধনের মগজকে পোকার মতো কুরে কুরে খেয়েছে। তাই যখন জুয়ায় দ্রৌপদীকে জিতে নিল দুর্যোধন, দ্রৌপদীকে অন্য অপমান না করে, পরিধেয়র অপমানটাই করেছিল। 

ভীমের অট্টহাসি শেষ হতে না হতেই তাই দুর্যোধন বলে উঠেছিল, ‘কেমন লেগেছে সেদিন কুরুরাজসভায় দ্রৌপদীকে অর্ধনগ্ন দেখে?’ 

ভীম দেখল, তারই ছুড়ে দেওয়া অপমান তারই বুকে বুমেরাং হয়ে এসে ঠেকল। কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলল ভীম। 

দুর্যোধন এই সুযোগটা হারাতে চাইল না। সগর্জনে বলল, ‘তোর এত গরম গরম কথা এক ফুঁ-তে ঠাণ্ডা হয়ে গেল! কী, হাঁ করে চেয়ে আছিস কেন? গদা হাতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। তুই তো বেটা বিড়ালছানা, খোদ ইন্দ্রও যদি আমার সঙ্গে লড়তে আসে এবং সেটা যদি ন্যায়যুদ্ধ হয়, ইন্দ্ৰ পারবে না আমার সঙ্গে। শরৎকালের মেঘের মতো জল না দিয়ে বৃথা গর্জাস না বৃকোদর। ভাষণ দেওয়া থামা। গদা হাতে তুলে নে। এগিয়ে আয়।’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে ভীম সংবিতে ফিরল। গদাহাতে বেশ কয়েক কদম দুর্যোধনের দিকে এগিয়ে এলো ভীম।

এই সময় দুর্যোধন আবার বলে উঠল, ‘আমার অনেক খারাপ কাজের কথা এতক্ষণ গলা ফাটিয়ে বললি তুই। আমি তো অস্বীকার করছি না, তোদের বনবাস করিয়েছি, পরের ঘরে দাসত্ব করিয়েছি। আরে বেটা, কেমন লেগেছে তখন তোদের? শোন পাষণ্ড, ক্ষমতা আর বুদ্ধি ছিল বলেই তোদের নিয়ে এরকম খেলা খেলেছি আমি।’ 

‘সেই খেলার দাম চুকিয়ে দেব আমি আজ।’ বলে গদা ঘোরাতে ঘোরাতে সামনে এগিয়ে এলো ভীম। 

‘শোন বৃকোদর, ধর্মযুদ্ধ করলে তুই কখনো আমাকে হারাতে পারবি না। অন্যায় যুদ্ধ করলে পাণ্ডব আর কৃষ্ণের মুখে সবাই থুতু ছিটাবে।’ 

বলতে বলতে বাতাসে গদার ঘূর্ণি তুলে ভীমের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল দুর্যোধন। 

দ্বৈরথ আসন্ন। দুজনেই প্রস্তুত। বাগযুদ্ধ শেষ। এবার গদাযুদ্ধ শুরু হবে। মুহুর্মুহু হাততালি পড়তে লাগল। এই সময় দূর থেকে একটা রথকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কৃষ্ণের চিনতে অসুবিধা হলো না-এ দাদা বলরামের রথ। 

রথ থেকে নেমেই বলরাম কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হচ্ছে এখানে? এ কী! দুর্যোধন এ রকম রক্তাক্ত কেন? ভীমই-বা তার সামনে এ রকম যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কেন?’ 

বলরামের প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ সাহস করল না। 

ষোলো 

রাজমাতা সত্যবতীর মনে শান্তি নেই। 

গোছানো সংসারটা তছনছ হয়ে গেল তাঁর। কুরুরাজ শান্তনুকে বিয়ে করে অখ্যাত এক জেলেপল্লি থেকে কুরুরাজপ্রাসাদে এসেছিলেন। জেলেকন্যা মৎস্যগন্ধা থেকে হয়ে গিয়েছিলেন যোজনগন্ধা সত্যবতী। ধীবরকন্যা থেকে রাজমহিষী। কী অসাধারণ উত্তরণ হয়েছিল তাঁর! জীবনটা, জীবনের চারপাশটা গুছিয়েও নিয়েছিলেন তিনি। মহারাজ শান্তনুর প্রথম স্ত্রী গঙ্গার পুত্র দেবব্রত। রাজবাড়িতে দেবব্রত ভীষ্ম নামে খ্যাত। গঙ্গা শান্তনুকে ছেড়ে গেলে মৎস্যগন্ধাকে বিয়ে করেছিলেন শান্তনু। বিয়ের আগে শান্তনুকে কুহকজালে আটকে ফেলেছিলেন মৎস্যগন্ধার পালকপিতা ধীবররাজ। শান্তনুর পরে মৎস্যগন্ধা তথা সত্যবতীর পুত্রই হবে কুরুরাজ্যের অধিপতি—এই নির্মম অনৈতিক শর্তেই শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর বিয়ে হয়েছিল। হস্তিনাপুরের কুরুরাজপ্রাসাদে এসে শান্তনুকে ভালোবাসার জোরে জয় করে নিয়েছিলেন। আর বাৎসল্যে জয় করেছিলেন যুবরাজ ভীষ্মকে। পর পর দুজন পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন সত্যবতী — চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। 

কী অপার আনন্দে জীবন চলছিল সত্যবতীর! কিন্তু সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মহারাজা শান্তনু পরলোকে গেলেন। কনিষ্ঠপুত্র বিচিত্রবীর্য তখন নাবালক। রাজা হলেন জ্যেষ্ঠপুত্র চিত্রাঙ্গদ। ভীষ্ম রাজ্য পরিচালনায় সর্বান্তঃকরণে চিত্রাঙ্গদকে সাহায্য করে গেলেন। সত্যবতীর নিরানন্দময় জীবনে স্বস্তি ও আনন্দ ফিরে আসতে লাগল। 

কিন্তু বিধি বাম। চিত্রাঙ্গদ নামের এক গন্ধর্বরাজের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদ। 

চিত্রাঙ্গদ ছিলেন অত্যন্ত ক্রোধপরায়ণ কুরুরাজ। রাজ্যজয় তাঁর নেশা ছিল। নানা দেশ জয়ও করেছিলেন কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদ। চিত্রাঙ্গদের কারণে কুরুরাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। একদিন গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদের সঙ্গে কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলো। কুরুসেনা আর গন্ধর্বসেনা মুখোমুখি। কুরুরাজ আর গন্ধর্বরাজের মধ্যে দ্বৈরথ শুরু হলো। দ্বৈরথে কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হলো। তখন তিনি অবিবাহিত। 

সত্যবতী চোখে অন্ধকার দেখলেন। অথৈ জলে পড়ে গেলেন তিনি। ভীষ্ম কাতর সত্যবতীকে সান্ত্বনা দিলেন। নিজে অভিভাবকত্ব নিয়ে অল্পবয়সের বিচিত্রবীর্যকে কুরুসিংহাসনে বসালেন ভীষ্ম। কালক্রমে বিচিত্রবীর্য বয়ঃপ্রাপ্ত হলেন। কাশীরাজকন্যা অম্বিকা আর অম্বালিকার সঙ্গে বিয়ে হলো বিচিত্রবীর্যের। 

বিচিত্রবীর্য ছিলেন কামুক। দুই রূপসী তরুণী স্ত্রীকে কাছে পেয়ে তাঁর কামুকতা আরও বেড়ে গেল। বিচিত্রবীর্য সংযমের ধার ধারলেন না। কামার্ত বিচিত্রবীর্য অতিমাত্রায় স্ত্রীসম্ভোগে মত্ত থাকলেন। সাত বছরে কামপীড়িত বিচিত্রবীর্য হীনবল হতে শুরু করলেন। একসময় তাঁর যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ল। এই রাজরোগেই মারা গেলেন কুরুরাজ বিচিত্রবীর্য। অম্বিকা আর অম্বালিকা তখন নিঃসন্তান। আবার অকূলে পড়লেন সত্যবতী। 

চন্দ্রবংশ যে বিলুপ্ত হতে চলল! কুরুরাজবংশের ধারাকে এখন কে যুগান্তরে বিস্তৃত করবে! রাজবংশে যে কোনো পুরুষ রইল না! ভীষ্ম আছেন বটে, কিন্তু তিনি তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ — কখনো বিয়ে করবেন না। ভীষ্মের মৃত্যুর পর যে মহারাজ শান্তনুর বংশধারা এই পৃথিবী থেকে মুছে যাবে! কী করা? কী করলে রাজবংশ রক্ষা পায় ভীষ্ম? ভীষ্মের সামনে উপস্থিত হয়ে সকাতরে জিজ্ঞেস করেন সত্যবতী। 

উভয়ে পরামর্শ করে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীর গর্ভে বীর্যপাত করবে কে? সত্যবতী তাঁর কুমারীপুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নাম বললেন। ভীষ্ম দ্বিমত করলেন না। ব্যাসকে আহ্বান জানালেন সত্যবতী। মাতৃ-আজ্ঞা ফেললেন না ব্যাস। সত্যবতী পুত্রবধূ অম্বিকাকে রাজি করালেন। এক রাতে ব্যাসে আর অম্বিকায় সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন হলো। সঙ্গমক্রিয়াটা ছিল একতরফা। ব্যাস সক্রিয়, অম্বিকা ভীতসন্ত্রস্ত এবং নির্জীব। ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছিলেন অম্বিকা। অম্বিকার গর্ভে পুত্র জন্মাল। ধৃতরাষ্ট্র। বলশালী অথচ অন্ধ। 

চিরান্ধ নাতি নিয়ে কী করবেন সত্যবতী? তাঁর সর্বাঙ্গসুন্দর একজন পৌত্র চাই। যে হবে চক্ষুষ্মান। রাগ আর অনুরাগ দেখিয়ে ছোট বধূ অম্বালিকাকে সম্মত করালেন সত্যবতী। 

সঙ্গমকালে অম্বালিকা চোখ দুটো খোলা রেখেছিলেন। কিন্তু ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন খুব। তখন তাঁর চোখমুখ পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করেছিল। এমন বীভৎস, কৃষ্ণদেহী, ভয়ঙ্কর চেহারার জটাজুটধারী ব্যাসকে দেখে কোন নারী না ভয় পাবেন? ভয় অম্বালিকাও পেয়েছিলেন। পুত্রসন্তান হলো তাঁরও। কিন্তু পাণ্ডুবর্ণের। ধৃতরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক ক্ষীণবল পাণ্ডুর। 

হীনশক্তি পাণ্ডুবর্ণের পাণ্ডুকে দেখে খুশি হলেন না সত্যবতী। পুত্রবধূদের গর্ভে আবার সন্তান উৎপাদনের অনুরোধ করলেন ব্যাসকে। ব্যাস এবারও সম্মত হলেন। কিন্তু অম্বিকা-অম্বালিকা যুক্তি করে মিলনশয্যায় এক রূপসী দাসীকে পাঠালেন। পরমতৃপ্তিতে সেই দাসী ব্যাসদেবকে ধারণ করল। তার গর্ভেও পুত্র জন্মাল। নাম বিদুর। শূদ্রাণীর গর্ভজাত বলে বিদুর রাজপ্রাসাদে মর্যাদা পেল না। 

ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ বলে, বিদুর দাসীপুত্র বলে, পাণ্ডুই কালক্রমে কুরুরাজা হওয়ার অধিকার পেল। সেই থেকে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র ক্রোধান্ধও হলো। 

বিয়ের বয়স হলো ধৃতরাষ্ট্রের। রাজকন্যাদের খোঁজা হলো। ভীষ্মাদির পছন্দ হলেও কন্যাপক্ষ রাজি হয় না। রাজভ্রাতা হলেও জন্মান্ধ তো! একজন অন্ধ রাজপুত্রের সঙ্গে কোনো রাজাই তার কন্যাটিকে বিয়ে দিতে চাইল না। শেষমেশ জোরজবরদস্তির আশ্রয় নিল কুরুপক্ষ। গান্ধার দেশের রাজা সুবল। তার কন্যা গান্ধারী অত্যন্ত রূপসী এবং শিক্ষিতা। সেই কন্যাটিকে পছন্দ হলো ভীষ্মের। কিন্তু রাজা সুবল জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীর বিয়ে দিতে সম্মত হলো না। ভীষ্ম ভয় দেখালেন সুবলকে। মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি না হলে গান্ধাররাজ্য গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশ গান্ধার। শক্তিতে কুরুদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। রাজি হতে বাধ্য হলো রাজা সুবল। গান্ধারী মাতাপিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেল না। জন্মান্ধ স্বামীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। সারাজীবন ঘৃণা আর প্রতিবাদ জানিয়ে গেছে গান্ধারী। বিয়ের দিন থেকেই গান্ধারী বস্ত্রখণ্ড দ্বারা নিজের চোখ বেঁধে রাখতে শুরু করেছিল। 

পাণ্ডু প্রথমে বিয়ে করল কুন্তিভোজের পালিতকন্যা কুন্তীকে। পাণ্ডুর এক বিয়েতে থেমে থাকল না ভীষ্ম। মদ্ররাজ শল্যের ভগিনী মাদ্রীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে দিলেন আবার। এই বিয়ে ছিল রাজনৈতিক। শল্য শক্তিশালী রাজা ছিল। তার সঙ্গে কুরুরাজ্যের আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন জরুরি ছিল। 

বিদুরেরও বিয়ে হয়। তবে রাজকন্যার সঙ্গে নয়। বিদুর যে শূদ্রাণীপুত্র! তাই দেবকরাজার এক শূদ্রাস্ত্রীর গর্ভে জন্মানো সুন্দরী কন্যাটির সঙ্গে ভীষ্ম বিদুরের বিয়ে দেন। 

ছোটখাটো রাজপ্রাসাদীয় ষড়যন্ত্র ছাড়া কুরুরাজ্য ভালোই চলছিল। রাজসিংহাসনে পাণ্ডু, যুবরাজ হিসেবে ধৃতরাষ্ট্র। রাজকীয় ঘূর্ণির বাইরে বিদুরের ক্ষমতাহীন জীবনযাপন। সত্যবতী এসব তৃপ্তির চোখে দেখে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের মনে ছিল প্রচণ্ড অতৃপ্তি। সুখ ছিল না তার মনে। জ্যেষ্ঠ হয়েও রাজা হতে পারেনি সে। হতে পারেনি মানে তাকে রাজসিংহাসনে আরোহণ করতে দেওয়া হয়নি। একজন অন্ধের রাজা হওয়ার নিয়ম নেই কুরুশাসনতন্ত্রে। 

শুধু জন্মান্ধ নয়, নপুংসক, জন্মবধির, পাগল, জড়বুদ্ধি, বোবা, বিকলেন্দ্রিয়ের কারও রাজা হওয়ার নিয়ম নেই কুরুসাম্রাজ্যে। 

ভীষ্ম-বিদুর-দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্য এবং বিজ্ঞ অমাত্যরা মিলে তাই চক্ষুষ্মান পাণ্ডুকেই রাজসিংহাসনে বসিয়েছিলেন। বঞ্চনার বেদনা ধৃতরাষ্ট্রকে কুরে কুরে খেয়েছে, অপ্রাপ্তির ক্রোধ ধৃতরাষ্ট্রকে উন্মত্ত করেছে। ধৃতরাষ্ট্র তা জনসমক্ষে তেমন করে প্রকাশ করেনি। কুরুবিজ্ঞদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। 

একদিন রাজবদ্যির কাছে পাণ্ডু জানতে পারল–সে কখনো জনক হতে পারবে না। জনক হওয়ার শারীরিক ক্ষমতা তার নেই। পাণ্ডু রাজবদ্যিকে কথাটা প্রচার না করার জন্য অনুরোধ করল। এই দুঃসংবাদে পাণ্ডু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। তার মনের ভেতর উদাসী হাওয়া বইল। বিবাগী মন চঞ্চল হয়ে উঠল। স্ত্রীদের কাছে দুঃসংবাদটি গোপন রাখল পাণ্ডু। মনকে শান্ত করবার জন্য অরণ্যভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিল। জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্যপরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে সস্ত্রীক অরণ্যবাসে গেল পাণ্ডু। 

অরণ্যবাস অনেক রোমাঞ্চকর হলেও মনে স্বস্তি নেই পাণ্ডুর। সে কি অপুত্রক অবস্থায় মারা যাবে? তার বংশধারা কি এখানেই থেমে যাবে? এই যে এমন রূপময়ী দুটি তরুণীভার্যা তার সামনে বিচরণ করছে, এদের জীবন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে? এরা কি কখনো পুত্রবতী হবে না? ‘রাজমাতা’ সম্বোধন এদের ভাগ্যে নেই? নিজের না হয় প্রজননক্ষমতা নেই, কিন্তু কুন্তী-মাদ্রীর তো পুত্রধারণ-ক্ষমতা আছে! তাহলে তাদের বঞ্চিত করা কেন? 

সতেরো 

একদিন কুন্তীকে কাছে ডাকল পাণ্ডু। নিজের ব্যর্থতার কথা খুলে বলল। বলল, রাজবংশধারা অব্যাহত রাখতে হবে কুন্তী। 

বলল, ‘তুমি এক কাজ করো কুন্তী, ক্ষেত্রজপুত্র নাও তুমি।’ 

চমকে উঠে কুন্তী বলেছিল, ‘এ তুমি কী বলছ মহারাজ!’ 

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তুমি অন্যপুরুষের সঙ্গে মিলিত হও। সন্তান ধারণ করো। আমার বংশধারা রক্ষা পাক।’ 

বিস্ময়ে আর অবিশ্বাসে কুন্তীর চোখ দুটো বেরিয়ে আসতে চাইল। 

পাণ্ডু আদর করে কুন্তীকে কাছে টেনে নিল। ‘ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের রেওয়াজ আমাদের বংশে আছে কুন্তী। আমাদের দিকে তাকাও তুমি। আমরা ভাইয়েরা তো আসল বাবার পুত্র নই। ঠাকুমা সত্যবতী ব্যাসদেবের মাধ্যমে আমাদের ক্ষেত্রজ পদ্ধতিতে জন্মিয়েছেন। এতে কোনো পাপ নেই কুন্তী।’ বলল পাণ্ডু 

স্বামীর কথা শুনে কুন্তী মাথা নিচু করল। 

পাণ্ডু আবার বলল, ‘এখানে অরণ্যচারী মানুষের অভাব নেই। খুঁজলে সর্বাঙ্গসুন্দর কোনো পুরুষ পেয়ে যাবে তুমি। তাকে আমার পুত্রের জনক করো তুমি।’ 

কুন্তী নির্বাক থেকেছিল সেদিন। 

পরে কুন্তীর পর পর তিন তিনটি পুত্র জন্মেছিল—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন। মাদ্রীও বসে ছিল না। পুত্রের জন্য সেও লোভাতুর হয়ে উঠেছিল। একই পদ্ধতিতে সেও পুত্রবতী হয়েছিল। যমজ সন্তান হয়েছিল মাদ্রীর — নকুল সহদেব। 

ওদিকে গান্ধারীও গর্ভবতী হলো একদা। প্রসবের সময় পেরিয়ে গেলেও তার কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো না। দু-বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোনো সন্তান জন্ম না নেওয়ায় অধৈর্য হয়ে উঠল গান্ধারী। ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে গান্ধারী তার গর্ভপাত ঘটাল। তার গর্ভ থেকে লৌহকঠিন একটি মাংসপিণ্ড নির্গত হলো। বলা হয়েছে—ওই মাংসপিণ্ডটিকে শতাধিক খণ্ডে বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন ঘৃতপূর্ণ কলসিতে রাখা হয়। এর এক বছর পর দুর্যোধন এবং এক বছর এক মাসের মধ্যে দুঃশাসন, দুঃসহ, বিকর্ণ প্রভৃতি ভাই, দুঃশলা নামের এক বোনের জন্ম হয়। 

ধৃতরাষ্ট্র ছিল অত্যন্ত কামুক প্রকৃতির। এক গান্ধারীতে সে তৃপ্ত ছিল না। প্রতি রাতে কোনো না কোনো নারী তার চাই-ই চাই। গান্ধারী ছিল সংযমী নারী। ধৃতরাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত কামুকতায় সে বিব্রত ও বিরক্ত হতো। গান্ধারীর রজঃস্বলার সময়েও ধৃতরাষ্ট্র তাকে পেতে চাইত। গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের এই চাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিত। কিন্তু রিরংসা বলে কথা! ধৃতরাষ্ট্র রমণী সম্ভোগের জন্য উতলা হয়ে উঠত। সে তখন উপপত্নী বা রক্ষিতাতে মগ্ন হতো। তার হেরেমে অনেকানেক রক্ষিতা। এই নিয়ম সেই সময়ে অনুমোদনসিদ্ধ ছিল। 

ধরে নেওয়া যেতে পারে গান্ধারীর গর্ভ থেকে যে মাংসপিণ্ডটা বেরিয়েছিল, তা টিউমার ছাড়া আর কিছুই নয়। পরবর্তীকালে গান্ধারী সন্তান ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। 

তা হলে দুর্যোধনসহ একশ একটি সন্তান কোত্থেকে এলো? এটা বললে অমূলক হবে না যে এরা গান্ধারীর সন্তান ছিল না, ছিল উপপত্নীদের সন্তান। পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেছে যে দুর্যোধনরা গান্ধারীর কাছ থেকে তেমন মাতৃস্নেহ পায়নি, যেমন করে যুধিষ্ঠিররা পেয়েছিল কুন্তীর কাছ থেকে। তবে গোটা মহাভারতের কাহিনিতে দুর্যোধনরা গান্ধারীকে মা বলে সম্বোধন করেছে এবং মাতৃসম্মান প্রদান করে গেছে। 

অরণ্য-মধ্যে যেদিন ভীম জন্মাল, সেদিন কুরুরাজপ্রাসাদে দুর্যোধনেরও জন্ম হলো। জন্মেই দুর্যোধন শিশুকান্না করল না, গাধার মতো ডেকে উঠল। শুধু তা-ই নয়, রাজপ্রাসাদের চারদিকে শেয়াল-শকুন-কাকের কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল তখন। এতে রাজব্রাহ্মণরা অমঙ্গল গুনলেন। বিদুর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সহমত হয়ে দাদা ধৃতরাষ্ট্রকে বলল, ‘এই সন্তান হতে আপনার মঙ্গল হবে না দাদা। শিশুটির জন্মে চতুর্দিকে অমঙ্গলের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, এই পুত্রটির দ্বারাই কুরুবংশ ধ্বংস হবে একদিন। আপনি একে ত্যাগ করুন দাদা।’ 

ধৃতরাষ্ট্র অট্টহাস্য করে উঠল। বিদুরের কথাকে উপেক্ষা করল। দুর্যোধনকে বুকের কাছে টেনে নিল। গভীর অপত্যস্নেহ জাগতিক সব কিছুর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। 

অরণ্য-মধ্যে পাণ্ডুর একদিন প্রবল সঙ্গমেচ্ছা জাগল। মাদ্রীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্তও হলো সে। কিন্তু অধিক শ্রমে ক্লান্ত পাণ্ডু সহবাসকালেই মারা গেল। মাদ্রী স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে মনস্থ করল। 

সতেরো দিন পর পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃতদেহ হস্তিনাপুরে আনা হয়। ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর পাণ্ডু এবং মাদ্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে। ধৃতরাষ্ট্র তখন কুরুরাজ্য চালাচ্ছিল, তবে রাজা হিসেবে নয়, পাণ্ডুরাজার প্রতিনিধি হিসেবে। পাণ্ডুর মৃত্যুর পরও ধৃতরাষ্ট্র পূর্বের দায়িত্বেই থাকল। কুরুরাজ হতে পারল না। কুরুবৃদ্ধরা অন্ধত্বের কথা বলে ধৃতরাষ্ট্রকে রাজসিংহাসনে আরোহণ করতে দিলেন না। 

যে সময়ে কুন্তী পুত্রদের নিয়ে কুরুরাজপ্রাসাদে ঢুকল, যুধিষ্ঠিররা নাবালক। কিশোর যুধিষ্ঠিরের বয়স তখন ষোলো, ভীমের পনেরো, অর্জুনের চৌদ্দ। মাদ্রীপুত্র নকুল-সহদেবের তখন তেরো। রহস্যজনক এই পাঁচ কিশোরকে নিয়ে কুন্তী যখন হস্তিনাপুরে পৌঁছল, নানা জনে নানা কথা বলতে শুরু করল। কিন্তু রাজবাড়ির বেশ কজনের প্রভাবে প্রজা আর অমাত্যদের মুখ অচিরেই বন্ধ হয়ে গেল। 

সত্যবতী-অম্বিকা-অম্বালিকা ওদের সাদরে গ্রহণ করলেন। বিদুর অত্যাগ্রহে আপ্লুত। ভীষ্ম পাণ্ডুপুত্রদের নিজের ছায়ায় টেনে নিলেন। 

কুন্তী এবং পাণ্ডবদের এই সাগ্রহ অভ্যর্থনা ধৃতরাষ্ট্র মেনে নিতে পারেনি। রাজ্যের অধিকার নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের মনে এমনিতে ক্ষোভ ও কুটিলতা ছিল। পাণ্ডুপুত্রদের কুরুপ্রাসাদে আগমনের পর থেকে তার রাগ-কুটিলতার মাত্রা অনেকাংশে বেড়ে গেল। মূলত যেদিন থেকে পাণ্ডুকে রাজা করা হলো, 

সেদিন থেকে ধৃতরাষ্ট্রের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল। এরপর যত দিন গেছে, তত তার মনে উদ্বেগ বেড়েছে। উদ্বেগ থেকে তৈরি হয়েছে ক্রূরতা। ক্রূরতার হাত ধরেই ধৃতরাষ্ট্রের মনে বাসা বেঁধেছে শঠতা আর কপটতা। মনের এই ক্ষুব্ধতা এবং কপটতা স্ত্রী গান্ধারীর মনেও সংক্রমিত করতে পেরেছিল ধৃতরাষ্ট্র। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে বোঝাতে পেরেছিল যে, সে নিজে অন্ধ হওয়ার কারণে জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজসিংহাসনে বসতে পারেনি, পারবেও না কোনোদিন। যদি গান্ধারী পাণ্ডুপুত্রদের আগে পুত্র প্রসব করতে পারে, তাহলে জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ার সুবাদে তাদের পুত্রটিই কুরুরাজ সিংহাসনের অধিকার পাবে। উদ্বুদ্ধ হয়েছিল গান্ধারী। তাই তো যথাসময়ে সন্তান জন্ম না নেওয়ায় নিজ গর্ভে আঘাত করেছিল গান্ধারী! সে রাজমহিষী না হোক, রাজমাতা তো হতে পারত! 

ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী—দুজনেরই আশা ভঙ্গ হয়েছে। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের আগে জন্ম নিয়েছে। ফলে সিংহাসনের অধিকার যুধিষ্ঠিরের ওপর বর্তেছে। ধৃতরাষ্ট্র এই বঞ্চনা বাইরে না দেখালেও ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হয়েছে। নিজে রাজা হতে পারেনি, মানে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তার পুত্র দুর্যোধন তো যুবরাজ হতে পারে! ওই যুবরাজই তো শেষ পর্যন্ত দেশে দেশে কালে কালে রাজা হয়। মনের এই সুপ্তবাসনা সে একান্ত পারিবারিক পরিমণ্ডলে আলোচনা করত। সেই আলোচনায় ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষোভ-কুটিলতা-লালসা-ক্রূরতা প্রকাশ পেত। সেই আলোচনায় দুর্যোধন-দুঃশাসন উপস্থিত থাকত। ধীরে ধীরে পিতা দ্বারা সংক্রমিত হলো পুত্ররা। বিশেষ করে দুর্যোধনের মন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে উঠল। ওই বালক বয়সেই দুর্যোধন বুঝতে পেরেছিল যে, পিতৃব্য পাণ্ডুর জন্য বাবা ধৃতরাষ্ট্র কুরুরাজসিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছে, আর সে বঞ্চিত হবে যুধিষ্ঠিরের জন্য। দুর্যোধন তার ক্ষোভ-অসহিষ্ণুতা সরাসরি প্রকাশ করতে শুরু করল। জ্যেষ্ঠ হয়েও পিতার সিংহাসন না পাওয়ার কথা, পিতৃব্য পাণ্ডুর মৃত্যুর পরও পিতাকে রাজা হিসেবে ঘোষণা না দেওয়ার কথা স্পষ্ট কণ্ঠে রাজপ্রাসাদে বলে বেড়াতে শুরু করল দুর্যোধন। ভীষ্ম-বিদুর প্রমুখরা দুর্যোধনকে সংযত করানোর অনুরোধ করলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে তার দুরাচারিতা থেকে নিবৃত্ত করাবে বলল। কিন্তু প্রকৃতই তা করল না। উপরন্তু পুত্রের মধ্যে সেই অল্পবয়সেই রাজ্য-লালসা ঢুকিয়ে দিল। দুর্যোধন উন্মত্ত ও অশিষ্টাচারী হয়ে উঠতে লাগল। গোটা রাজপ্রাসাদ দুর্যোধনের ঔদ্ধত্য ও কদাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। 

ব্যাসদেব বুঝতে পেরেছিলেন রাজনীতির এই সব নীচতা, কুটিলতা তাঁর মা সত্যবতীর সহ্য হবে না। ধৃতরাষ্ট্রকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন সত্যবতী। দুর্যোধনরাও তাঁর অশেষ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। কিন্তু আজ সেই স্নেহাস্পদদের মধ্যে লালসা-কুটিলতা দেখে ভেঙে পড়বেন মা সত্যবতী। মাকে অভব্যতা থেকে রক্ষা করা দরকার। ব্যাসদেব মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন একদিন। বললেন, ‘মা চলো। এখানে, এই কুরুরাজ্যে তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তুমি আমার সঙ্গে বনে চলো মা।’ 

সত্যবতী পুত্র ব্যাসের কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারলেন। একদিন পুত্রবধূ অম্বিকা আর অম্বালিকাকে নিয়ে বানপ্রস্থের উদ্দেশে রওনা দিলেন। আগে আগে চললেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। 

আঠারো 

অরণ্যবাসী ঋষিদের কথায় এবং পিতামহ ভীষ্মের জোর সমর্থনে ধৃতরাষ্ট্র কুন্তী ও পাণ্ডুপুত্রদের রাজপ্রাসাদে স্থান দিয়েছিল। 

পাণ্ডুর আবাসস্থলেই থাকা শুরু করেছিল সপুত্র কুন্তী। এই সময় কুন্তীর পাশে বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিদুর। পাণ্ডুপুত্রদের দেখলে বিদুরের বাৎসল্য উছলে ওঠে, কুন্তীকে দেখলে অব্যক্ত এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয় বিদুর। 

ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে যুধিষ্ঠিরদের বিরুদ্ধে প্রবল উম্মা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধেই তার যত ক্ষোভ। কেন এই পাণ্ডুপুত্রটি দুর্যোধনের আগে জন্মাল? জন্মাল না হয়, পিতৃপরিচয়ের সূত্র ধরে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এসে পৌঁছল কেন? শুনেছে, বড় সুশীল বালক এই যুধিষ্ঠির! সংযত, সদাচারী, সদালাপী। আর নাকি ভীষণ সত্যবাদী! একটা বালকের মধ্যে এতগুলো গুণ থাকার দরকার কী? এই জন্য কুরুপ্রাসাদের সবাই নাকি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে! 

ধৃতরাষ্ট্র ভাবে আর ক্ষোভে-ক্রোধে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। সে নিজে কুরুরাজা হতে পারেনি। তার জ্যেষ্ঠপুত্র প্রথমে যুবরাজ এবং পরে মহারাজ হবে—এই বাসনা ছিল ধৃতরাষ্ট্রের মনে। কিন্তু ওই যুধিষ্ঠিরটা তা হতে দেবে না বোধহয়! যেহেতু সে আগে জন্মেছে এবং পাণ্ডুরাজার জ্যেষ্ঠপুত্র সে, তাকেই তো যুবরাজ হিসেবে চাইবে সবাই। প্রজারা চাইবে, কুরুবৃদ্ধরা চাইবেন, চাইবেন পিতামহ ভীষ্মও। এই চিন্তাটি ধৃতরাষ্ট্রকে কাহিল করে তোলে। 

বড়দের মনে যা-ই থাকুক, খেলার সময় পাণ্ডুপুত্র আর ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা একসঙ্গে খেলে। কিন্তু খেলতে নেমে পাণ্ডবদের ভয়ে সবসময় ত্রস্ত থাকতে হতো কৌরবভাইদের। অন্যরা যা-ই হোক মধ্যম পাণ্ডব ভীমের ভয়ে কুঁকড়ে থাকত ধৃতরাষ্ট্র পুত্ররা। শক্তিমত্তা ও দ্রুততায় সে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকত। এই গুণ ভীমের মধ্যে এত মাত্রাতিরিক্ত ছিল যে, তা পীড়নের মতো ঠেকত দুর্যোধনদের কাছে। কৌরবভাইয়েরা যখন ব্যথায় কোঁকাত, তখন উল্লাসে ফেটে পড়ত ভীম। এই হয়তো দুর্মর্ষণকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ভীম, দু-চারবার ওপর দিকে ছুড়ে মারল। দুমর্ষণ তখন ভয়ে ত্রস্ত গলায় চেঁচাচ্ছে, ‘দাদা, ওরকম করো না! আমার খুব ভয় লাগছে! আমি মাটিতে পড়ে যাব দাদা!’ 

কে শোনে কার আকুতি! ভীম আপনমনে খেলে যাচ্ছে। অন্যের কাছে যা-ই হোক, ভীমের কাছে এ ছিল খেলা। অন্য একদিন হয়তো শ্রুতান্তের মুখ চেপে ধরে আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ভীম। এমন আড়াল, দুর্যোধনরা প্রাণান্ত খুঁজেও ভাইকে পেল না। ওইদিকে মুখ চেপে ধরার কারণে শ্রুতান্তের প্রাণ যায় যায়। আর একদিন হঠাৎ দু-হাতে দুই কৌরবভাইয়ের চুলের মুঠি ধরে চড়কির মতো কয়েক পাক ঘুরিয়ে নিল। জয়ৎ সেন ও সুজাত—দুই ভাই মুমূর্ষু গলায় চিৎকার করে বলছে, ‘দাদা দুর্যোধন, ভীম দাদার হাত থেকে আমাদের বাঁচাও।’ 

দুর্যোধন ছুটে গিয়ে ভীমের সামনে দাঁড়ায়। কর্কশ কণ্ঠে বলে, ‘জানোয়ারের মতো এসব কী করছিস ভীম! আমার ভাইদের ওপর এ রকম অত্যাচার করছিস কেন?’ 

ভীম হয়তো রেগেমেগে দুর্যোধনের গায়ে দিল এক ধাক্কা। পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল দুর্যোধন। অন্য ভাইদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই করলেও দুর্যোধনের সঙ্গে করা সম্ভব নয়। কারণ অন্য ভাইদের মতো দুর্যোধন দুর্বল নয়। তার শারীরিক গঠন ভীমের চেয়ে কম নয়। শক্তির তুল্যমূল্যে ভীম এগিয়ে থাকলেও বুদ্ধি ও কৌশলে দুর্যোধন ভীমের বাড়া। 

নিজেকে সামলে নিয়ে সপাটে ভীমের বুকে ধাক্কা দিয়ে দুর্যোধন বলল, ‘কী মনে করেছিস তুই ভীম আমাকে? অন্য ভাইদের মতো আমাকে দুর্বল মনে করেছিস? এক চড়ে ওই যে দু-পাটি দাঁত আছে না তোর, তার সবগুলোই ফেলে দেব। আর শোন, আর একবার যদি আমার ভাইদের নিয়ে ওরকম বীভৎস খেলায় মাতিস না তুই, তোর ভাই ওই অর্জুন-নকুল-সহদেবদের নিয়েও আমি তা-ই শুরু করব।’

দুর্যোধনের দাবড়ানিতে ভীম কিছুদিন হয়তো চুপ থাকল, দিনকয়েক পরে যেই-কে-সেই সবাই মিলে হয়তো রাজদিঘিতে স্নান করতে নেমেছে, জনাদশেক কুরুভাইকে জাপটে ধরে জলে চুবিয়ে রাখল ভীম। ওদের যখন প্রাণ যায় যায়, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ছেড়ে দিল। ভীমের এরকম জঘন্য অত্যাচারে দুর্যোধনভাইদের খেলার মাঠে আসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। তাদের স্বাভাবিক জীবন অস্থির হয়ে উঠল। 

আরেকদিনের ঘটনা। প্রাসাদলগ্ন বাগানে খেলতে গেছে পাণ্ডব আর কৌরবরা। ফলদবৃক্ষের বাগান। কৌরব ভাইয়েরা ফল পাড়ার জন্য টপাটপ গাছে উঠে গেল। ভীমের তো বৃহৎ শরীর! গাছে ওঠার ক্ষমতা নেই তার! কিন্তু যারা গাছে উঠেছে, তাদের পেড়ে ফেলবার শক্তি আছে তার গায়ে। গাছের গোড়ায় দমাদম লাথি মারতে শুরু করল ভীম। শুধু তা-ই নয়, দুহাত দিয়ে গাছটিকে সজোরে ঝাঁকাতে লাগল। ফলের সঙ্গে কৌরবরাও টুপটুপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল। 

ভীমের এ সমস্ত উৎপাতে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে লাগল। ভীমের কাছে যা দুষ্টামি, দুর্যোধনের কাছে তা হয়ে দাঁড়াল অত্যাচার। দুর্যোদন ধরে নিল, এ ভীমের ইচ্ছাকৃত নির্যাতন, কৌরবদের ওপর। আর তো চুপ থাকা যায় না! নীরবে এরকম করে সবকিছু সহ্য করে গেলে কোনোদিন হয়তো কোনো ভাইকে আছড়ে মেরে ফেলবে ভীম! 

নাহ! এর একটা উচিত জবাব দেওয়া চাই। 

ভীমের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের খেলা দুর্যোধনের ক্রোধকে উসকে দিল। 

ভীমের ব্যাপারে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল দুর্যোধন। এই অসন্তোষ ও ক্রোধ উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। 

একদিন চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল দুর্যোধন। ভীমকে হত্যা করবে সে। প্রত্যক্ষ হত্যা নয়, অপ্রত্যক্ষ খুন। 

একজন নাবালকের মধ্যে এ রকম করে জিঘাংসা জাগল কেন? তাও আবার আপন কাকাতো ভাইকে! 

পাণ্ডবদের জন্য ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রীতি দুর্যোধন জানত। ওই বয়সে সে এ-ও বুঝতে পেরেছিল যে, পাণ্ডবদের প্রতি পিতার যে-ভালোবাসা তা লোকদেখানো। পিতামহ আর বিদুরের চাপে পড়ে এই অভিনয়টা করে যাচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্র। তার প্রকৃত মনোচিত্র ভিন্ন। সেখানে হিংসা আর ঘৃণার আঁকাজোকা। তার প্রতি পিতার সবিশেষ প্রশ্রয়ের কথাও জানত দুর্যোধন। সে অনুমান করে নিয়েছিল, ভীমের মতো খুড়তুতো ভাইকে হত্যা করলেও পিতা ধৃতরাষ্ট্র তার জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। বরং সন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। 

দুর্যোধন মনে মনে আউড়ে গেল—ভীমটাই পাণ্ডব ভাইদের পালের গোদা। ওকে আমি উচিত শিক্ষা দেব। গায়ের জোরে নয়, কৌশলেই তাকে শিক্ষাটা দিতে হবে। ওই নষ্টটা সবসময় আমাদের সঙ্গে টক্কর দেয়। গায়ের জোর দেখায় সে। দেখাচ্ছি জোর কাকে বলে। সব পাণ্ডবকে মেরে একদিন আমিই হব কুরুরাজ্যের রাজা। আমিই শাসন করব গোটা ভারতবর্ষ। 

ওইটুকু বয়সে দুর্যোধনের মনে রাজা হওয়ার বাসনা! এই বাসনা তৈরি হলো কেন দুর্যোধনের মনে?

এই বাসনা তৈরি করিয়েছে ধৃতরাষ্ট্র, জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনের মনে। কুরুরাজা হতে না পারার কষ্ট আর হতাশা পুত্রটির সামনে গোপন রাখেনি ধৃতরাষ্ট্র। যখনই সুযোগ পেয়েছে, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গরণ করেছে। ধৃতরাষ্ট্রের এই যে উদ্বেগ আর উদ্‌গিরণতা দুর্যোধনের বালকমনে দেগে বসেছে। তা-ই তো ভীমকে নিয়ে এ রকম একটা কথা ভাবতে দ্বিধা করেনি দুর্যোধন! 

ধৃতরাষ্ট্রের নানা কথায় সেই ছোট বয়সেই দুর্যোধন বুঝে নিয়েছিল যে, ভবিষ্যতে এই কুরুরাজ্যের অধীশ্বর হওয়ার যোগ্যতা তার আছে। বাদ যদি কেউ সাধার থাকে, তাহলে ওই পাণ্ডবরাই সাধবে। ভীমটাই সবচাইতে বেশি শক্তিশালী। প্রধান কাঁটা ওই ভীমই। অর্জুনের তখনো উদ্‌গম হয়নি। ফলে অর্জুনকে চোখে পড়ে না দুর্যোধনের। ভীমকেই ওই সময় সবচাইতে বড় অন্তরায় বলে মনে হলো তার। তাই তো সে সিদ্ধান্ত নিল পথের কাঁটাকে সরিয়ে দেওয়ার! 

ভাইদের ওপর ভীমের উৎপীড়নের ব্যাপারটি দুর্যোধনের রাজা হওয়ার প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে দিল। ভীমের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার মোক্ষম এক কারণ খুঁজে পেল দুর্যোধন। নিজের ভাইদের যে মারার উদ্যোগ নেয়, তাকে তো হত্যা করা উচিতই। না হলে কীসের বড় ভাই হলো সে? ভ্রাতৃ-অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে পারে না যে, সে আবার জ্যেষ্ঠ ভাই হয় কী করে! না, আর ভাবাভাবির দরকার নেই। এবার সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার সময় হয়ে গেছে। ভীম নামের জন্তুটার আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তাকে বিদায় করতে হবে। শুধু রাজপ্রাসাদ থেকে নয়, একেবারে পৃথিবী থেকে। 

নিজে নিজেই একটা পরিকল্পনা তৈরি করল দুর্যোধন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কিছু অর্থের প্রয়োজন। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রকে ফেরাল না। তবে পিতাকে নিজের দুরভিসন্ধির কথা বলল না দুর্যোধন। 

শুধু বলল, ‘গঙ্গায় জলক্রীড়ার আয়োজন করছি বাবা।’

উনিশ 

গঙ্গার তীর। 

লোকালয় থেকে বেশ খানিকটা দূর। স্থানটির নাম প্রমাণকোটি। নির্জন। প্রশস্ত জায়গাজুড়ে প্রমাণকোটি। একেবারে বৃক্ষশূন্য নয়। কোথাও কোথাও টিলামতন। সমতল ভূমির পরিমাণ বেশি। ওই প্রমাণকোটিকেই জলক্রীড়ার জন্য বেছে নিল দুর্যোধন। 

প্রমাণকোটিতে এলাহি ব্যবস্থা করল দুর্যোধন। রাষ্ট্রযন্ত্র তার সহায়ক। কুরুভাণ্ডার থেকে সব রকমের সহযোগিতা পেল সে। অস্থায়ী আবাস তৈরি হলো, তৈরি হলো বিশ্রামঘর। উঁচু করে চাঁদোয়া খাটানো হলো। চাঁদোয়ার মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা হলো— জলখেলা – উদকক্রীড়ন। হাত বাড়ালেই গঙ্গাধারা। শ্লথগতির জলপ্রবাহ। কাকচক্ষুসদৃশ। মৃদু ঊর্মিমুখর। জলক্রীড়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম জলস্থান আর কী হতে পারে! 

অঢেল ভক্ষ্য, ভোজ্য, লেহ্য, পানীয়। ভালো ভালো পাচক নিয়ে আসা হয়েছে প্রমাণকোটিতে। ওরাই রন্ধনকার্য সম্পন্ন করবে। 

অত্যন্ত মনোরম হয়ে উঠেছে স্থানটি। আগের দৃশ্যপট বদলে স্বর্গীয় এক রূপ ধারণ করেছে প্রমাণকোটি। সব কিছু দেখেশুনে তৃপ্তির শ্বাস ফেলল দুর্যোধন। 

দুর্যোধন নিজে পাণ্ডবকুঠিতে গেল। যুধিষ্ঠিরকে বলল, ‘প্রমাণকোটিতে দারুণ একটা বাগানবাড়ি তৈরি করিয়েছি আমি। নিকটেই গঙ্গা। বড় সুশোভন জায়গাটি। জায়গাটি আমার খুব পছন্দের। তোমাদেরও মনে ধরবে। সবাই মিলে চলো সেখানে যাই।’ 

যুধিষ্ঠির দোনোমনা করে বলল, ‘না। এখন ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমাদের।’ 

পাশে ভীম দাঁড়িয়েছিল। সোৎসাহে বলল, ‘কেন যাবে না দাদা? আমাদের তো এখন কোনো কাজ নেই!’ 

দুর্যোধন বলল, ‘শুধু খানাপিনার আয়োজন তো নয়, জমিয়ে জলক্রীড়ারও আয়োজন আছে ওখানে।’ দুর্যোধন জানে, খাওয়া এবং জলে ঝাঁপানো—এ দুটোর প্রতি ভীমের প্রবল আসক্তি 1 তাই এ দুটোর উল্লেখ করল বিশেষভাবে। 

ভীমের মনে হলো, খাবারের সুস্বাদু সুঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগছে। মনে হলো, গঙ্গার শীতল স্রোতকে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে সে লন্ডভন্ড করে ছাড়ছে। দাদা যুধিষ্ঠির কিছু বলার আগে ভীম সাগ্রহে বলে উঠল, ‘আমি যাব দুর্যোধন, আমি যাবই প্রমাণকোটিতে।’ বলে হুঁশে ফিরল ভীম। দাদার সম্মতির আগে সে যে যাওয়ার কথা বলে ফেলল! রাগ করল না তো দাদা? 

দাদার মুখের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ভীম বলল, ‘চলো না দাদা! ওখানে গেলে বেশ খাওয়া হবে! সাঁতার কাটা হবে! আরও যে কত রকম খেলা খেলতে পারব আমরা!’ 

যুধিষ্ঠির হেসে দিল। বলল, ‘পাগল কোথাকার!’ 

তারপর দুর্যোধনকে লক্ষ করে বলল, ‘ঠিক আছে দুর্যোধন, যাব আমরা।’ 

ভীম হাততালি দিয়ে উঠল 

দুর্যোধন হেসে দিল। এই হাসির বাইরে আনন্দ, ভেতরে ক্রূরতা। 

দুর্যোধন সেই ক্রূরতা লুকিয়ে গলায় উচ্ছ্বাস ঢেলে বলল, ‘খুব আনন্দ লাগল দাদা তোমার কথা শুনে। ওখানে কী যে মজা হবে, তা আন্দাজ করতে পারছ না এখন! গেলেই টের পাবে কী কী সুখ আর রহস্য তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে প্রমাণকোটিতে!’ 

‘সুখ আর রহস্য! সুখ বুঝলাম, রহস্য বুঝলাম না তো! জলক্রীড়ার সঙ্গে রহস্যের সম্পর্ক কী?’ ধন্দে পড়ে গেল যুধিষ্ঠির। 

দুর্যোধন নিজের ভুলটা ধরতে পারল। অতি খুশিতে তার মুখ দিয়ে সত্যটা বেরিয়ে আসতে চাইছিল। গোটা সত্য বেরোল না, ভূমিকাটা বেরিয়ে পড়েছিল। সাততাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল দুর্যোধন। নরম গলায় বলল, ‘আরে দাদা, রহস্য শব্দের মধ্যে তুমি আবার কী খুঁজে পেলে! রহস্যের মানে রসিকতাও তো! তোমার সঙ্গে রসিকতা করে রহস্য শব্দটি বলেছি। অন্য কিছু নয়।’ যুধিষ্ঠির বলল, ‘অ, আচ্ছা। তাহলে এই কথাই রইল, তোমাদের সঙ্গে যাব আমরা। কোনদিন যাবে, জানিয়ে দিয়ো। 

‘কোনদিন মানে কী! কালকে, আগামীকাল ভোরেই রওনা দিচ্ছি আমরা। তোমরা রাতের মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়ো। তোমাদের বাড়ির সামনে রথ প্রস্তুত থাকবে।’ বলে পেছন ফিরল দুর্যোধন। যেতে যেতে স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘বড় মজা হবে যুধিষ্ঠির! বড় আমোদ পাবে প্রমাণকোটিতে গেলে!’ 

পরদিন সকালে বিলাসবহুল রথে চড়ে কৌরব-পাণ্ডবরা প্রমাণকোটিতে উপস্থিত হলো। চোখ ধাঁধিয়ে গেল পাণ্ডবভাইদের। মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা তাদের। জীবনের গোটাটা সময়ই অরণ্যে কাটিয়েছে তারা। সেখানে কোথায় ঐশ্বর্য, কোথায় জৌলুস! সকালে-দুপুরে-সন্ধ্যায় সামান্য কিছু খাওয়া আর অরণ্যের কাঠ-খড় দিয়ে বানানো ঘরে থাকা। আর সারা দিনমান গাছপালা-অরণ্য-শ্বাপদ দেখে যাওয়া। এই তো ছিল জীবন তাদের! হ্যাঁ, তারা কুরুরাজপ্রাসাদে এসেছে কিছুদিন হলো। কিন্তু এত অল্পদিনের মধ্যে রাজকীয় হালচাল আর ঐশ্বর্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি পাণ্ডবরা। রাজপ্রাসাদের এত যে বিপুল ধনসম্পত্তির বিভা, এত আকাশচুম্বী অহংকার, এত ঐতিহ্য—এসবের সঙ্গে তেমন করে চিনপরিচয় ঘটেনি যুধিষ্ঠিরদের। প্রমাণকোটির সজ্জা-বৈভব দেখে তাই তো স্তম্ভিত হয়ে গেল পাণ্ডবরা। তারা ভাবতে শুরু করল—দুর্যোধন তার খুড়তুতো ভাইদের জন্য এত আয়োজন করেছে! অস্থায়ী বাসস্থানে এমন নিপুণ বিলাসের ব্যবস্থা! চারদিক কী তকতকে-ঝকঝকে! বহির্গ্রহও এমন সুন্দর হতে পারে! 

পাণ্ডবদের বিস্ময় কাটতে না কাটতেই দুর্যোধন সামনে এসে দাঁড়াল। খুশি খুশি গলায় বলল, ‘আরে, তোমরা ওরকম ভেলভেলে চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছ কী? এক জায়গায় সব বিস্ময় ফুরিয়ে ফেললে হবে! এসো এসো, এদিকে এসো। এখানে যে আরও আনন্দ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।’ বলতে বলতে ভীমের নিকটে এগিয়ে এলো দুর্যোধন। হাতে টান দিয়ে উচ্ছ্বাসভরা গলায় বলল, ‘আরে ভীম, তুমিই আগে এসো। এখন যেখানে নিয়ে যাব তোমাদের, সেখানে তুমিই সবচাইতে বেশি আনন্দ পাবে।’

বলতে বলতে খাবারস্থলে নিয়ে গেল ভীমকে। পিছু পিছু অন্য চার ভাই। তার আগেই ওখানে বসে আছে দুর্যোধনের ভাইয়েরা। পাণ্ডবরা ঢোকার পর হর্ষধ্বনি আর হাততালি দিয়ে উঠল কৌরবরা। এতে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল পাণ্ডবরা। কারুকার্যময় আসনে বসানো হলো পাঁচ ভাইকে। 

পূর্ব নির্দেশমতো খাবারদাবার এসে গেল। অঢেল রসনাতৃপ্তিকারী হরেক রকমের খাবারে সামনের জায়গাটা ভরে গেল। কোনোটা ভোজ্য, কোনোটা লেহ্য, কোনোটা চর্ব্যচুষ্য কোনোটা-বা পানীয় 

ভীমের জিঘৎসা প্রবল। সামনে নানা ধরনের উপাদেয় খাবার দেখে ভীমের বুভুক্ষায় আগুন লাগল। জিঘৎসু ভীম অন্যের জন্য অপেক্ষা করল না। গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করল। পেটুক ভীম অম্লান বদনে সামনে যা পেল, গিলে যেতে লাগল। 

এটাই চাইছিল দুর্যোধন। ভীম যত বেশি খাবে, তত বেশি তার উদ্দেশ্য সফল হবে। কারণ এই খাবারই যে ভীমের জীবনে অন্তিম সময়টাকে ডেকে আনবে! 

দুর্যোধন মুখে প্রশান্ত হাসি ছড়িয়ে ভীমের পাশে দাঁড়িয়ে তার পাতে নানা উপাদেয় খাবার তুলে দিতে লাগল। তার আগে একটা সূক্ষ্ম শিল্পকার্য সম্পন্ন করে রেখেছিল দুর্যোধন। সকলের চোখের আড়ালে অতি সন্তর্পণে ভীমের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্যদ্রব্যে কালকেউটের বিষ মিশিয়ে রেখেছিল। 

দুর্যোধন ভীমকে খাবার তুলে দিচ্ছে আর বলছে, ‘এটা খাও। আরে আরে ভীম, এক ধরনের খাবার খেয়েই পেট ভরাবে নাকি? ওটা রাখো। আর এইটে খেয়ে দেখো তো রান্নাটা কেমন হয়েছে! বলতে বলতে বিপুল পরিমাণে অজের মাংস ভীমের পাতে তুলে দিল দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের কথার জবাব দেওয়ার সময় নেই ভীমের। জবাব দিতে গেলে যে খাওয়ায় বিরতি দিতে হবে! আর এটা কিছুতেই চায় না ভীম। তার এখানকার প্রধান কাজ যে অবিরত খেয়ে যাওয়া! 

এই সময় দুর্যোধনের চোখেমুখে দেখনদারি হাসি। তার কথাগুলো মধুরতায় পূর্ণ। যুধিষ্ঠির ভেবে গেল, আরে! দুর্যোধন আমার জেঠতুতো ভাই হলে কী হবে, ভাই তো! সমবয়সি খুড়তুতো ভাইদের জন্য তো এমন আয়োজন করতেই পারে দুর্যোধন! এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে!  ওদিকে সূক্ষ্ম চতুরতায় ভীমকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে দুর্যোধন। খাদ্যে ভীমের পেট ভর্তি করে তুলছে না, অমৃতকুম্ভকে বিষভাণ্ডে রূপান্তরিত করে যাচ্ছে দুর্যোধন। দুর্যোধন যা করছে, তা কিন্তু সহজ কাজ নয়। এই সময় মুখমণ্ডলকে স্বাভাবিক রাখা, কণ্ঠস্বরকে মধুর রাখা-চাট্টিখানি কথা নয়। সবাই এ কাজ পারে না। কেউ কেউ পারে! বালক দুর্যোধনও পারে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে খুড়তুতো ভাই ভীমকে হত্যা করতে। ভীম যে তার পথের কাঁটা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *