দুর্যোধন
হস্তিনাপুর রাজ্যের ভূসম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলে দুর্যোধন যদি আজকের গণতান্ত্রিক মতে ‘কোর্ট’-এ নালিশ করার সুযোগ পেতেন, তা হলে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়াত? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরাজিত দুর্যোধনের স্বার্থে এ রকম একটা সওয়াল-জবাবের আয়োজন আমাদের করতেই হবে। কেন না, একে তো পরাজয় এবং মৃত্যুর মতো শাস্তি তাঁকে পেতে হল, তাঁর ওপরে যদি দেখি— সে মৃত্যুর জন্য মহাভারতের কবির ইচ্ছেটাই শুধু দায়ী— তা হলে সেক্ষেত্রে ব্যাসের বিরুদ্ধেও আমাদের অভিযোগ আনতে হবে। দুর্যোধনের উত্তরাধিকারে যদি কোনও আইনগত অথবা বিচারের ত্রুটি থাকে, তা হলে সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যাসকে দূষে বলতে হবে যে— তুমি তো শুধু মহাভারতের কবি নও, তুমি এক অর্থে পাণ্ডব-কৌরবদের বংশরক্ষক ঠাকুরদাদাও বটে। তুমি এক পক্ষের ওপর পক্ষপাত করে আরেক পক্ষকে ডুবিয়ে দিয়েছ। পাণ্ডবদের জন্মের সময় তুমি স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করিয়েছ। শঙ্খ-দুন্দুভি বাজিয়ে তাঁদের জন্ম-মঙ্গল গান করেছ, আর বেচারা দুর্যোধনের জন্মের সময় তুমি স্বয়ং দুর্যোধনকে দিয়েই গাধার ডাক ডাকিয়েছ এবং তাঁর ‘রাসভ’ ক্রন্দনের উত্তরে তুমি শেয়াল-শকুন এবং কাকের প্রত্যুত্তর শুনিয়েছ— তং খরাঃ প্রত্যভাষন্ত গৃধ্রগোমায়ূবায়সাঃ। তা হলেই বলি— তুমি সেকালের ঠাকুমা-দিদিমাদের মতো শুধু জন্মলগ্নে হাঁচি-টিকটিকি-শকুনের অমঙ্গল দেখিয়ে শেষে একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেবে— সে আমাদের কলিকালের ধম্মে সইবে না বাপু। আরও আছে, বলছি একে একে।
পাঠক! আমাদের এই সামান্য অভিযোগেই মহাভারতের কবির কিন্তু রাগ হতে পারে। তিনি বলতে পারেন— তোমাদের কলিকালের ছেলেদের ওই এক দোষ— তোমরা এখনও সওয়াল-জবাব কিছুই করলে না, শুধু আমাকে আসামি ঠাউরে গালমন্দ করে যাচ্ছ। ব্যাস বলতে পারেন— তোমাদের বিপদ আছে আরেকটা। তোমরা যাকে আসামি ভেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছ, সেই আমিই কিন্তু তোমাদের প্রধান সাক্ষী। এতকাল ধরে আমি যা নথিপত্র জোগাড় করে মহাভারতের দলিল রচনা করেছি, প্রধানত তার ওপরে নির্ভর করেই তোমাদের সওয়াল-জবাব করতে হবে। আমার নথি ছাড়া যেখানে তোমাদের দু’-পা যাবার ক্ষমতা নেই, সেখানে আমাকেই তোমরা ঘাবড়ে দিতে চাইছ! কলিকালের ছেলে-ছোকরাদের এই যে জঘন্য প্রবণতা— মূল সাক্ষীকেই ধমকে কবুল করানোর এই যে একটা চেষ্টা— এটা বাপু আমাদের ধম্মেও সয় না। তার ওপরে ব্যাস আরও বলতে পারেন— তোমরা বাপু যাকে উকিল ঠিক করেছ— ওই তোমাদের এই বর্তমান লেখকটি— ও নিজেই একবার মহা ঝামেলায় পড়েছিল এবং তা পড়েছিল আমারই দলিল-দস্তাবেজ ভাল করে ঘাঁটেনি বলে। শেষে আমারই সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করে আমাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।
সত্যি কথা বলতে কী, এ রকম ঘটনা একটা ঘটেছিল। একটি আলোচনা চক্রে আমারই এক বন্ধুর সঙ্গে তর্ক বেঁধেছিল। সেখানে ইলিয়াড-ওডিসি থেকে আরম্ভ করে রামায়ণ-মহাভারত— সব কিছুরই আলোচনা এবং সমালোচনা চলছিল। কথাপ্রসঙ্গে দুর্যোধনের মৃত্যুর প্রসঙ্গ ওঠে। বন্ধুবর বললেন— দুর্যোধনের বীরোচিত মৃত্যুর সময় তাঁর মাথায় পুণ্যগন্ধী পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে এবং আরও অনেক মাঙ্গলিক সংকেতও সেখানে পাওয়া যায়। কথাটা শুনেই তো আমি হেঁই হেঁই করে উঠলাম। বললাম— দূর মশাই, যে মানুষের জন্মের সময় শেয়াল-শকুন ডেকেছিল, তার মারা যাবার সময় এই পট-পরিবর্তন হতেই পারে না। বন্ধুবর নিজে ইংরেজি লোক হওয়ায় প্রাথমিকভাবে একটু দমে যান বটে, কিন্তু মহাভারতের ওই বিশেষ জায়গাটির ওপর তাঁর দুর্বলতা থাকায়, বিশেষত পশ্চিমি মহাকাব্যগুলির নায়কোচিত মৃত্যুর সুর ওই বিশেষ জায়গাটিতে অনুরণিত হওয়ায় তাঁর স্মরণশক্তি তাঁকে দ্বিগুণভাবে তর্কে প্রয়োজিত করে। একসময় তিনি আর থাকতে না পেরে লাইব্রেরি থেকে মহাভারতের একটি ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে এসে বিতর্কিত জায়গাটি আমাকে দেখিয়েও দেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই হতপ্রভ বোধ করি, এবং অনন্তপার মহাভারত শব্দ-শাস্ত্রের এই বিশেষ অংশটি মনে না থাকার জন্য দুঃখও প্রকাশ করি। বন্ধুর জয় হল বটে, তবে সে জয়ে শেষ পর্যন্ত আমারই জয় হল। মহাভারতের হাজারও টুকিটাকির মধ্যে দুর্যোধনের মৃত্যুর এই কল্পনা আমাকে নতুন করে ভাবাতে আরম্ভ করল।
ঘটনাটা শুধু এইটুকু হলে আমি এর উল্লেখ করতাম না, কিন্তু সেদিন থেকে মহাভারতের কবির ওপর আমার শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বেড়ে গেল এইজন্য যে, সমগ্র মহাভারত জুড়ে মহাকাব্যের নায়কের ওপর কবির অনেক মমতা দেখেছিলাম, দেখলাম— মহাকাব্যের প্রতিনায়কও তাঁর মমতা থেকে বঞ্চিত হননি। দুর্যোধনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথার ওপরে স্বর্গের মন্দারমঞ্জরী ঝরে পড়েছে। নৃত্যপটু গন্ধর্বেরা তাঁর কাছে নন্দনের সংবাদ বহন করে এনে ঢ্যাঙ-কুড়াকুড় বাদ্যি বাজিয়েছে। স্বর্গসুন্দরী অপ্সরারা দুর্যোধনের কীর্তিকথা গান করে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে। শুধু কী তাই! সিদ্ধ-চারণেরা দুর্যোধনকে সাধুবাদ দিতে থাকে, পুণ্যগন্ধী বাতাস বইতে থাকে— মৃদু সুখের স্পর্শ দিয়ে। দুর্যোধনের বীরোচিত মৃত্যুর ঐশ্বর্যে সমস্ত আকাশ যেন বৈদূর্যমণির ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মৃত্যুর সময় দুর্যোধনের এমন প্রতিপত্তি দেখে সমস্ত পাণ্ডব ভাইদের মুখও লজ্জায় লাল হয়ে উঠল— দুর্যোধনস্য পূজান্তু দৃষ্টা ব্রীড়ামুপাগমন্। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বর্তমান লেখকের লজ্জাও হয়ে উঠল দু’গুণ, কেন না আমি মহাকাব্যের কবিকে আপন ক্ষুদ্র কল্পনার ছাঁচে ফেলে অবিচার করেছিলাম। এখন তাই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নিরপেক্ষ নথিপত্রগুলি একটি একটি করে ‘টেবিলে’ ফেলে একটা নকল-বিচারসভার আয়োজন করব।
দুর্যোধন যেহেতু পরাজিত, তাই একেবারে ‘ফুল বেঞ্চে’ আপিল করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে এবং তিনজন জজ-সাহেবের নাম হবে ভীষ্ম, বিদুর এবং ব্যাস। বলতে পারেন— তা হলে তো দুর্যোধনের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, কেন না দুর্যোধনের মতে এঁদের প্রথম দু’জনই তো পাণ্ডব-পক্ষপাতী, এঁরা দুর্যোধনের সপক্ষে রায় দেবেন কেন? একথা বললে আইন-আদালত চলে না, কারণ মামলাতে জয় একজনের হবেই; এবং অপরপক্ষ তখন অবধারিতভাবে জজ সাহেবের বিচারশক্তিতে সন্দেহ করে। তা ছাড়া পাণ্ডব-কৌরবের হাজারও সমস্যার নিষ্পত্তি এঁরা দুজনেই করেছেন, এবং তাও অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে। আর ব্যাসকেও আমাদের রাখতে হবে, কারণ তিনি মূলত পাণ্ডব এবং ধার্ত্তরাষ্ট্রদের বংশকর পিতামহ। ‘ফুল বেঞ্চে’ আমরা চতুর্থ একটি মহিলা জজ-সাহেবাকে রাখতে পারতাম, কিন্তু তিনি আপাতত বনে। তিনি ব্যাসের মা সত্যবতী। বিচিত্রবীর্য যেদিন দুই যুবতী বউ রেখে অকালে মারা গেলেন, সেদিন প্রধানত এই সত্যবতী, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এবং মহামতি ভীষ্মের চেষ্টাতেই ছিন্ন-তন্তু ভরতবংশের উত্তরাধিকার স্থাপিত হয়।
উচ্ছিন্ন ভরতবংশে যেদিন ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর জন্মালেন— দগ্ধ বংশতরুর প্রথম অঙ্কুরের মতো— সেদিন অনেক উৎসাহে পিতামহ ভীষ্ম বলেছিলেন— আমাদের বংশ যাতে নির্মূল না হয়ে যায়— নোৎসাদমগমচ্চেদং— সে জন্য আমরা অনেক চেষ্টা করে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের মাধ্যমে আমাদের কুল-তন্তু পুনঃস্থাপনা করেছি— সমবস্থাপিতং ভূয়ঃ। সেটা করেছে কারা জানো— এই আমি, সত্যবতী আর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস— ময়া চ সত্যবত্যা চ কৃষ্ণেন চ মহাত্মনা। এই যে বিরাট অধিকারবোধ, ভরতবংশের প্রতিটি তন্তুর ওপর এই যে মমতা— সমবস্থাপিতং ভূয়ো যুম্মাসু কুলতন্তুষু— এই মমত্বের অধিকারেই ভীষ্ম এবং ব্যাসকেই আমরা বিচারকমণ্ডলীতে রেখেছি। আর বিদুরকে আমাদের রাখতেই হবে, কারণ তিনি অতি অল্প বয়স থেকেই কুরুবংশের হিতাহিত চিন্তা করছেন। ওপরের যে কথাগুলি ভীষ্মের মুখে আমরা শুনেছি, তা বলা হয়েছিল অতি অল্পবয়সি বিদুরকেই। ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুদাদাদের বিয়ের কনে নিয়ে সেই সময় কুরুবৃদ্ধ পিতামহ আলোচনা করছেন সর্বকনিষ্ঠ বিদুরের সঙ্গে। দুর্যোধনের কালে বিদুর আরও অনেক বড় ব্যক্তিত্ব, কাজেই তাঁকেও আমাদের ‘ফুল বেঞ্চে’ রাখতে হবে।
এই বিচারব্যবস্থার কথা শুনে স্বভাব মতো দুর্যোধন প্রথমেই ফুঁসে উঠে বলতে পারেন— হয়েছে, হয়েছে। তোমাদের ‘ফুল বেঞ্চ’ আর ‘সিঙ্গল বেঞ্চ’। ফল ওই একই। ওই ভীষ্ম যেদিন সবার বড় আমার পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা হতে দিল না, সেদিনই আমাদের ওপর বঞ্চনা শুরু হয়ে গেছে। আর রাজা না করার ‘গ্রাউন্ড’ কী? না, ধৃতরাষ্ট্রের চোখ নেই, ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ। ওই একটি কথার খোঁচায় সর্বজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের রাজত্ব চলে গেল— ধৃতরাষ্ট্রস্তু অচক্ষুষ্ট্বাদ্ রাজ্যং ন প্রত্যপদ্যত। বাঃ চমৎকার বিচার, চোখ নেই— অতএব রাজা হবে না!
বেশ বোঝা যাচ্ছে— এ অভিযোগ পিতামহ ভীষ্মকে লক্ষ্য করে। কারণ পাণ্ডু যখন রাজা হন, তখন ভীষ্মই ছিলেন হস্তিনাপুর রাজ্যের হর্তা, কর্তা, বিধাতা। বিচিত্রবীর্যের অবর্তমানে রানি-মা সত্যবতীর অনুমতিক্রমে ভীষ্মই তখন সমস্ত রাজ্যের দেখ-ভাল করছিলেন। বিচিত্রবীর্যের তিন উত্তরাধিকারীকে তিনি পুত্র নির্বিশেষে পালনও করেছিলেন। সমস্ত ভাইদের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র সবার থেকে বলবান ছিলেন— সন্দেহ নেই— অন্যেভ্যো বলবান্ আসীদ্ ধৃতরাষ্ট্রো মহীপতিঃ। কিন্তু তাঁর চোখ ছিল না বলে ধনুর্বেদ, গদাযুদ্ধ, যেগুলি প্রত্যেক রাজপুত্রের অবশ্য শিক্ষণীয়— এগুলি তাঁকে শেখানো যায়নি। তা ছাড়া চোখ না থাকলে রাজ্য পরিচালনার অনেক অসুবিধে আছে। কাজেই দুর্যোধনের অভিযোগের উত্তরে ভীষ্মের অবশ্যম্ভাবী জবাব হবে— দেখো বাপু! তুমি যতই তোমার বাবার পক্ষ হয়ে লড়ো, ব্যাসের মতো সাক্ষী বলছে তোমার বাবার ওপর আমার স্নেহ কারও চেয়ে কম ছিল না। ওদের তিন ভাইকেই আমি জন্ম থেকে ছেলের মতো দেখেছি— জন্ম প্রভৃতি ভীষ্মেণ পুত্রবৎ প্রতিপালিতঃ। এ সব সত্ত্বেও স্বয়ং কুরুজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্য দেওয়ার ব্যাপারে আমার যে আপত্তি ছিল তার কারণ অত্যন্ত বাস্তব। কারণ ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। তা ছাড়া রাজধর্মের ব্যবহারিক কারণ তো আছেই। দেশে আইন-কানুন আছে। ভারতবর্ষের আইন-প্রণেতা স্বয়ং মনু-মহারাজ শাসন দিয়েছেন— নপুংসক, পতিত ব্যক্তি, জন্মান্ধ, জন্ম-বধির, পাগল, জড়বুদ্ধি, বোবা, বিকলেন্দ্রিয়— এরা উত্তরাধিকার হিসেবে বাবার ধন-সম্পত্তি কিছুই পাবে না— অনংশৌ ক্লীব-পতিতৌ জাত্যন্ধবধিরো তথা। উন্মত্ত-জড়-মূকাশ্চ— সেখানে এই বিরাট রাজ্যের রাজা হওয়া তো দূরের কথা, কোনও ছোট রাজ্যেও তাঁর অধিকার আসে না।
ভীষ্ম বলতে পারেন— মনুর মতে এইসব মানুষকে গ্রাসাচ্ছাদন মাত্র দেওয়ার কথা। সেখানে মহারাজ পাণ্ডুর জীবৎকালেই ধৃতরাষ্ট্রকে যে পরিমাণ ধন-রত্ন দেওয়া হয়েছে, যে সম্মান করা হয়েছে— তা দুর্যোধন, তুমি তোমার কালে যুধিষ্ঠিরকে করলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হত না! তুমি ভাবতে পারো দুর্যোধন! পাণ্ডু দিগ্বিজয় করে এসে আমাকে সত্যবতীকে কিংবা তাঁর নিজের মাকে যে উপহার দিয়েছিল— তাও রাজমুকুটহীন ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে দিয়েছিল— ধৃতরাষ্ট্রাভ্যনুজ্ঞাতঃ স্ববাহুবিজিতং ধনম্। ভীষ্ময় সত্যবত্যৈ চ মাত্রে চোপজহার সঃ। সেই সময়ে এ সব ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা না করেও যে পাণ্ডু অন্ধ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, সেদিন আমি পাণ্ডুর মহানুভবতায় আশ্চর্য হইনি, আশ্চর্য হয়েছি বিকলেন্দ্রিয় ভাইয়ের প্রতি তাঁর অসীম মমতা এবং সম্মানবোধে। আরও একটা কথা। আমি যেমন অন্ধ বলে ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা হবার সুযোগ দিইনি, তেমনি আমাদের বিদুরকেও তো রাজ্যে অভিষিক্ত করিনি, তিনি মহাপ্রাজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও করিনি। কারণ তাঁকে যদি রাজা করতাম, তা হলে আমার কালের মানুষেরা পাঁচ রকম কথা বলত। বলত— বিদুর ‘পারসব’— ব্রাহ্মণের শক্তিতে শূদ্রার গর্ভে জাত— তাকে কেন রাজা করা হল। বলত— তার মধ্যে কুরুকুলের পুরুষের শক্তিও নেই, আবার কুরুকুলের রানিদের কারও রক্তও নেই তার মধ্যে— সে ব্যাসের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত সন্তান। অতএব রাজা হওয়ার তালিকা থেকে সেও বাদ গেছে, যেমন ধৃতরাষ্ট্র বাদ গেছেন— জন্মান্ধতার জন্য। কাজেই রাজা হওয়ার মতো লোক ছিল একজনই। সে পাণ্ডু, এবং সেই রাজা হয়েছে— পারসবত্বাদ্ বিদুরো রাজা পাণ্ডুর্বভূব হ।
ভীষ্ম এসব যুক্তি দিতে পারেন বটে, তবে দুর্যোধনের চরিত্র হল— নিজের মত থেকে তিনি কখনও এক চুলও সরেন না। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে দেখা গেছে যে, স্বয়ং কৃষ্ণ দুর্যোধনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছেন— তিনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না, নিজে যা বোঝেন তা থেকে তিনি একটুও সরে আসেন না— ম্রিয়েতাপি ন ভজ্যেত নৈব জহ্যাৎ স্বকং মতম্। এ হেন দুর্যোধন ভীষ্মের এই যুক্তি মানবেন কেন? তিনি বরং উলটে বলতেন— দেখুন পিতামহ! আপনার আইন কানুন আপনার কাছেই থাক। সব জায়গায় কি আইন দেখিয়ে কাজ হয়! আপনি যদি জন্মান্ধ হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা করতেন, তা হলে আপনার যে সর্বাতিশায়ী স্নেহের পরিচয় পাওয়া যেত, অন্য কিছুতে তা নয়। ভীষ্ম বলতেন— তা হলে ব্যাপারটা তোমার বাবার মতনই দাঁড়াত। এই বিরাট সাগরমেখলা পৃথিবী এবং তার বিচিত্র প্রজাবৃন্দের ভার যদি আমি আমার স্নেহবশে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের ওপরে ন্যস্ত করতাম, তা হলে মহাভারতের সাক্ষী ব্যাস যেমন ধৃতরাষ্ট্রের উপাধি দিয়েছেন স্নেহকাতর পিতা বলে— ‘ধৃতরাষ্ট্রঃ সুতপ্রিয়ঃ’ বলে, তেমনি আমারও কিছু উপাধি জুটত— যা আমি চাইনি।
দুর্যোধন বলতেন— তা কেন! আপনি আইন দেখাচ্ছেন, তা, আপনি জন্মান্ধের উত্তরাধিকার বাদ দিয়ে, জ্যেষ্ঠ পুত্রের দায়ভাগটুকুও তো মানতে পারতেন— যাতে বড় ছেলেই রাজা হবে, অন্য কেউ নয়। এই আপনিই না মহাভারতের শান্তিপর্বে আর অনুশাসনপর্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে কত ধর্ম উপদেশ দিয়েছেন। আমি স্বর্গ থেকেও শুনতে পেয়েছি— আপনি কত বিজ্ঞের মতো যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন— পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে বড় ছেলেই ভূসম্পত্তির প্রধান অংশ পাবে— হরেদ্ জ্যেষ্ঠ প্রধানাংশম্। হায়! উপদেশটা যদি আমার বাবার ব্যাপারে আপনার খেয়াল হত! পিতামহ ভীষ্ম কিন্তু এ কথায় একটুও অপ্রস্তুত হবেন না। তিনি বলবেন— দুর্যোধন! এই তোমার এক স্বভাব-দোষ। তুমি সব কথার আশয় বুঝতে পার না। আমি কোথায় শান্তিপর্বের তিনশো পঁয়ষট্টি অধ্যায় ধরে নানা উপদেশ দিয়ে অনুশাসন পর্বের সাতচল্লিশ অধ্যায়ে গিয়ে সাধারণ চতুর্বর্ণের উত্তরাধিকার সূত্র নিয়ে আলোচনা করলাম, আর তুমি উকিলামি করতে গিয়ে সেটা চাপিয়ে দিলে রাজধর্মের ওপর। উকিলরা এইরকম করে বটে, তবে তুমি যদি ভাল উকিল হতে, তা হলে আমার শান্তিপর্বের আরম্ভ-উপদেশগুলিই খেয়াল করতে। আমি বলেছিলাম— রাজার প্রধান কাজ হল লোকরঞ্জন, এবং রাজ্যচালনার অসুবিধে হচ্ছে— এরকম যে কোনও ব্যাপারে প্রথম থেকেই রাজার কঠোর হওয়া উচিত। এমনকী সে যদি গুরুও হয়, কি রাজার বন্ধু-বান্ধবও হয়— তাকে দণ্ড দেওয়া উচিত। তুমি মনে রাখোনি— আমি সে সময়ে মরুত্তরাজার মতো নামি বাজার লেখা শ্লোক উদ্ধার করে, বৃহস্পতির রাজনীতি উদ্ধার করে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম যে, রাজ্যের জন্য, প্রজার জন্য সগর রাজা নিজের বড় ছেলে, অসমঞ্জকে ত্যাগ করেছিলেন— সুতো জ্যেষ্ঠ স্ত্যক্তঃ পৌরহিতৈষিণা। ব্রাহ্মণদের মধ্যে উদ্দালক ঋষি অমন ব্রহ্মিষ্ঠ ছেলে শ্বেতকেতুকে ত্যাগ করেছিলেন। হ্যাঁ, বলতে পারো মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ওই ধরনের কোনও অপরাধ করেননি। রাজধর্মের বিপরীত কাজও তিনি তখন কিছু করেননি! কিন্তু আমরাও তাঁকে কখনও ত্যাগ করিনি। শুধুমাত্র এই রাজ্যপরিচালনার অসুবিধের কথা ভেবে তাঁকে শুধু খাতায়-কলমে রাজত্বটুকু দেওয়া হয়নি। কিন্তু তুমি বলতে পারবে না যে কোথাও তাঁর শক্তি কুঞ্চিত করা হয়েছে।
দুর্যোধন এবার বলবেন— ওসব সগর-টগরের কথা রাখুন। ওঁরা সব সূর্যবংশের লোক— সূর্যবংশের রামচন্দ্রকে দেখেই বোঝা যায়— ওসব নিপাট ভালমানুষি দিয়ে রাজ্যপাট চলে না। আপনি আমাদের বংশের কথা বলুন, আমরা সব চন্দ্রবংশের ছেলে। আমাদের বংশে আপনি যা করলেন— তা নজিরবিহীন।
‘নজিরবিহীন!’ ভীষ্ম এবার হেসে কুটিকুটি হতে পারেন। তারপরেই প্রসন্ন গাম্ভীর্যে বলে উঠতে পারেন— তুমি সেদিনকার খোকা, দুর্যোধন! আমাদের বংশের পুরনো কথা তুমি কিছুই জানো না। বেশি কথা বলব না, কথায় কথা বাড়ে, অপ্রিয় কথাও এসে যায়। তবে দুটো কথা তোমায় না বলে পারছি না। সেটা হল— আমাদের বংশে রাজধর্মের স্বার্থে ছোট ভাইয়ের রাজা হওয়াটা কোনও ব্যাপার নয়। বরঞ্চ আমি বলব আমাদের, অন্তত আমাদের বংশটা আরম্ভই হয়েছিল বড় ভাই বেঁচে থাকতেও ছোট ভাইয়ের রাজত্ব দিয়ে। শুধু তাই নয়, জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র রাজা না হওয়ায় রাজ্যের অভিজাত পুরুষেরা অথবা প্রজারা আমার নিয়োগে কোনও প্রশ্ন তোলেনি; কিন্তু পূর্বতন ক্ষেত্রগুলিতে জ্যেষ্ঠের কোনও অঙ্গবিকারও ছিল না, তবু তাঁরা রাজা হননি, আবার প্রজারা, অভিজাত ব্রাহ্মণেরা সেই অনভিষিক্ত জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের জন্য দরবার করতে এসেও শেষে ক্ষান্তি দিয়েছেন— সে ঘটনাও আছে। তোমাকে একটু খুলেই বলি, কারণ আইন-কানুনের সওয়াল-জবাব করতে গেলে পুরনো ‘কেস্-হিস্ট্রি’– দু’-একটা সামনে রাখতেই হয়।
বেশি কিছু নয়, আমি সেই পুরাতন যযাতি রাজার কথা বলছি— সেই যযাতি, যিনি ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানীর সঙ্গে প্রতিলোমভাবে অসবর্ণ বিয়ে করেছিলেন; সেই যযাতি, যিনি গুরুবৎ শুক্রাচার্যের আদেশ অমান্য করে দৈত্যকন্যা শর্মিষ্ঠার রূপেগুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং সেই যযাতি, যাঁর ছেলেদের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র পুরু পিতার রাজ্যে অভিষিক্ত হন। সেই পুরু থেকেই এই বিখ্যাত পৌরব বংশ, যার উত্তর পুরুষদের মধ্যে আছেন মহারাজ ভরত, মহারাজ কুরু।
এই সব হস্তিনাপুর-টুর তখন কোথায়? মহারাজ যযাতি তখন রাজত্ব করতেন। (এলাহাবাদের কাছে) প্রতিষ্ঠান নামে একটি জায়গায়। যযাতি শর্মিষ্ঠার প্রেমে পড়ে তাঁর গর্ভে গোপনে সন্তান উৎপাদন করার ফলে দেবযানীর কোপভাজন হন। অপি চ দেবযানী তাঁর রাগের কথা পিতা শুক্রাচার্যকে বলায় তাঁর জন্য হাজার বছরের অকাল-বার্ধক্যের অভিশাপ— জরা বরাদ্দ হল। রাজা প্রমাদ গুনলেন এবং শুক্রাচার্যের কাছে খুব করে কান্নাকাটি করায় তিনি বললেন— তুমি যদি তোমার পুত্রদের কারও মধ্যে তোমার জরা সংক্রমিত করতে পারো তা হলে তুমি আপাতত বেঁচে যাও। যযাতি ঘোষণা করেছিলেন— আমার যে ছেলে জরা-গ্রহণ করবে, সে যেমন অসীম পুণ্য-কীর্তির অধিকারী হবে, তেমনি তার ঐহিক লাভও ঘটবে— সেই পাবে পিতার রাজ্য। স্বয়ং শুক্রাচার্য রাজার এই ঘোষণা যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন এবং তা করেছিলেন বোধকরি এই কারণে যে— ব্রাহ্মণী দেবযানীর গর্ভে জাত ছেলেগুলি নিশ্চয়ই হবে উৎকৃষ্ট-জাতের। তারা পিতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হবে না।
কিন্তু বাস্তবে অন্য ঘটনা ঘটল। যযাতির পাঁচ ছেলে— যদু, তুর্বসু— দেবযানীর গর্ভে আর দ্রুহ্যু, অনু এবং পুরু হলেন শর্মিষ্ঠার গর্ভে। প্রথম চারজনকে রাজা একে একে জরাগ্রহণের প্রস্তাব দিলে প্রত্যেকেই নানা ওজর-আপত্তি করে সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করলেন। বিশেষত যযাতির জ্যেষ্ঠপুত্র যদু তো নিজের যৌবন নিয়েই এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, বাপের যৌবনের জন্য তার ভারী বয়েই গেছে। যাই হোক পর পর চার ভাইই যখন জরা নিতে অস্বীকার করলেন, তখন সানন্দে জরা গ্রহণ করলেন কনিষ্ঠ পুত্র পুরু। যযাতি রাজা হাজার বছর যৌবন উপভোগ করে বুঝলেন— মেলা উপভোগে ফল কিছুই হয় না বরং আরও উপভোগের ইচ্ছায় যন্ত্রণা শুধু বাড়ে। রাজা এবার নিজে জরা ফিরিয়ে নিয়ে পুত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করতে চাইলেন।
সেই মুহূর্তে পুরবাসীদের সঙ্গে নিয়ে অভিজাত ব্রাহ্মণেরা উপস্থিত হলেন রাজা যযাতির কাছে। তাঁরা হয়তো ভাবলেন— জন্মসূত্রে বাপের জাতি লাভ করে না হয় রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি ক্ষত্রিয় হয়ে গেছে, কিন্তু ব্রাহ্মণের রক্ত আছে তাঁর গায়ে— তার মা ব্রাহ্মণের মেয়ে, দাদু স্বয়ং ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্য। তার ওপরে জ্যেষ্ঠপুত্রের রাজা হওয়ার জিগির তো আছেই। তাঁরা এসেই যযাতিকে বললেন— এটা কেমন বিরুদ্ধ আচার হচ্ছে, রাজা! ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের নাতি, আপনার জ্যেষ্ঠা স্ত্রী দেবযানীর গর্ভে জাত আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে বাদ দিয়ে একেবারে কনিষ্ঠটিকে রাজা করছেন— এটা কীরকম বিচার— কথং জ্যেষ্ঠম্ অতিক্রম্য কনীয়ান্ রাজ্যমৰ্হতি? এবারে রাজার পালা। তিনি বললেন— শুনুন তা হলে। কেন বড় ছেলেটাকে বাদ দিয়ে আমি ছোট ছেলেকে রাজা করছি। প্রথমত, আমার বড় ছেলে যদু, ছেলে হিসেবে বাবার কষ্ট একটুও বোঝেনি। তাও বুঝতাম যদি অল্প কথা বলেই ছেড়ে দিত। ওমা! আমাকে দশটা উপদেশ দিয়ে সে আমাকে বলে কিনা তোমার তো আরও অনেকগুলো ছেলে আছে— সন্তি তে বহবঃ পুত্রাঃ— তোমার জরাগ্রহণের জন্য তাদের কাউকে তুমি বরণ করো— তস্মাদন্যং বৃণীষ্ব বৈ— আরে আমার কি স্বয়ংবর হচ্ছে?
যযাতি বললেন— আমার বড় ছেলে যেমন কাজ করেছে, তেমনি আমার অন্য ছেলেগুলোও একই আচরণ করছে। যারা বাবা বেঁচে থাকতেও বাপের কষ্ট বুঝল না, উপরন্তু অবজ্ঞা করে পাঁচটা কথা শোনাল— যদুনাহম্ অবজ্ঞাতঃ— সেই বড় ছেলেকে আমি রাজা করব? যে ছেলে বাপের বিরোধী, বাপের সুখ-দুঃখ বোঝে না, বাপ-মায়ের পথে চলে না, তাদের কাউকে রাজ্য দেওয়ার কথাই ওঠে না— সে বড়ই হোক আর মেজই হোক। বরং আমার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু আমার কথা যেমন শুনেছে, তেমনি সম্মান করে কথা বলেছে, অতএব সেই আমার যোগ্য উত্তরাধিকারী। তা ছাড়া মহামতি শুক্রাচার্যের অভিলাষও তাই— অর্থাৎ যে জরা নেবে, সেই রাজ্য পাবে। অতএব সমস্ত প্রজাবৃন্দকে আমি জানাচ্ছি— আপনারা পুরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করুন।
ভীষ্ম দুর্যোধনকে বলতে পারেন— এই যে শেষ অনুনয়টি রাজা করলেন— এটা কিন্তু অভিজাত ব্রাহ্মণদের কাছে নয়, এ অনুনয় সাধারণ প্রজার কাছে। ব্রাহ্মণেরা জ্যেষ্ঠ পুত্রের হয়ে কথা আরম্ভ করেছিলেন বটে— ব্রাহ্মণপ্রমুখা বর্ণা ইদং বচনমব্রুবন্— কিন্তু রাজার কথা শেষ হলে উত্তর দিল সাধারণ প্রজারা— প্রকৃতয় উচুঃ। তারা বুঝেছিল— যে ছেলে বাবা-মায়ের কষ্ট অমন করে বোঝে সে বয়সে কনিষ্ঠ হলেও সে পুত্র হিসাবে উত্তম— অতএব তারই রাজ্য পাওয়া উচিত। ভাবটা এই যে ছেলে বাপ-মায়ের দুঃখ বোঝে সে প্রজাসাধারণের দুঃখও তেমনি করে বুঝবে— অতএব তারই রাজা হওয়া ভাল। ভীষ্ম বলবেন— হ্যাঁ আমি একথা বলছি না যে পুত্র হিসেবে ধৃতরাষ্ট্র কোনও অন্যায় ব্যবহার করেছে। কিন্তু তুমি যে ভাবছ কনিষ্ঠের রাজ্য পাওয়াটা আমাদের বংশে কোনও ‘নজিরবিহীন’ ঘটনা— তা কিন্তু নয়। যযাতির উদাহরণে আমার বক্তব্য ওইটুকুই— তার বেশি নয়।
ভীষ্ম আরও বলতে পারেন— অত দূরে যাওয়ার দরকার কী দুর্যোধন। এই যে আমার পিতা শান্তনু— অর্থাৎ কিনা তোমার প্রপিতামহ— তাঁরা তো ছিলেন তিন ভাই এবং তাঁদের সবার বড় হলেন দেবাপি। দেবাপি, শান্তনু আর বাহ্লীক। তা এঁদের মধ্যে দেবাপি ছোট বেলাতেই প্রব্রজ্যা নিয়ে অরণ্যবাসী হলেন— বাল এব অরণ্যং বিবেশ— তখন তো মেজভাই শান্তনুই রাজা হলেন। তখন তো কেউ বড় ছেলে দেবাপিকে বন থেকে এনে সিংহাসনে বসায়নি— কারণ প্রজারা জানত যে, অরণ্যবাসী মোক্ষকামী ব্যক্তিকে দিয়ে রাজ্যপাট চলে না, ঠিক যেমন ধৃতরাষ্ট্রের বেলাতেও জানত যে, জন্মান্ধ ব্যক্তিকে দিয়ে এই বিশাল রাজ্যের পরিচালনা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি যদি নিয়মের ব্যতিক্রম করতাম, কিংবা বিরুদ্ধ আচার গ্রহণ করতাম, তা হলে প্রজারা অন্তত প্রতিবাদ করত, ঠিক যেমন যযাতি রাজাকে প্রতিবাদ জানিয়েছিল জ্যেষ্ঠপুত্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে। আমি আর বলতে চাই না, কারণ এর পরে বলতে গেলে সুপ্রসিদ্ধ ভরতবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ ভরতের কথা এসে পড়বে এবং সে প্রসঙ্গে তোমার কথাও এসে পড়তে পারে। কাজেই সে প্রসঙ্গ থাক।
দুর্যোধন বলবেন— বলুন না, আমার কথা। আমার কি কম ক্ষতি করেছেন আপনারা? মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র না হয় রাজা হলেন না, কিন্তু তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে আমি তো আর অন্ধ ছিলাম না।
মহাভারতের প্রমাণমতো ভীষ্মকে আমরা এখানেই থামিয়ে দিতে চাই। কেন না আমাদের আদালতে আরও একজন বিচারক রয়েছেন— মহামতি বিদুর। ভীষ্ম থামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কথা আরম্ভ হবে বলে— আমরা মনে করি। বিদুর বলতে পারেন— তোমার সব কথার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, তবে প্রসঙ্গত দু’-একটা কথা না বললে নয়। যেমন ধরো— ভীষ্ম বললেন— মহারাজ ভরতের প্রসঙ্গে তোমার কথা এসে পড়বে। কিন্তু আমি বলি— তোমার কথাতেই মহারাজ ভরতের প্রসঙ্গ আসবে এবং ভরতের প্রসঙ্গ উঠলে তোমার পিতা ধৃতরাষ্ট্রের প্রসঙ্গও আসবে। ব্যাপারটা কী জানো দুর্যোধন! জ্যেষ্ঠপুত্র বেঁচে থাকা সত্ত্বেও আমাদের পূর্বতন বংশে যখন কনিষ্ঠেরা রাজা হয়েছেন— তখন জ্যেষ্ঠদের কোনও রাজ্যলোভ দেখা যায়নি। কিন্তু মহারাজ পাণ্ডু রাজা হতে অবস্থাটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাণ্ডু রাজা হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র খুশি হননি, সুখী তো দূরের কথা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আমার বড় দাদা বটে। তবে অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে অভিনয় করাটা ভাল জানেন— সেকথা স্বয়ং ব্যাসই বলবেন সময়মতো। আমার বক্তব্য— পাণ্ডু রাজা হলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র খুশি হননি, তবে খুশি খুশি ভাব দেখিয়েছেন মাত্র। তিনি যে আদৌ খুশি হননি— তার প্রমাণ পাওয়া যাবে তোমারই জন্মের সময়ে। জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অন্ধতাবশত রাজ্য না পাওয়ার ফলে তাঁর মনে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, সে জটিলতা তিনি সচেতনভাবে সংক্রামিত করতে পেরেছিলেন স্বয়ং গান্ধারীর মধ্যেও। যে গান্ধারী তাঁর ধর্মশীলতা এবং নিরপেক্ষতার জন্য বিখ্যাত, তাঁকেও তিনি প্রাথমিকভাবে কলুষিত করতে পেরেছিলেন। কথাটা পরিষ্কার করে বলি শোনো।
বিদুর আবার পুরনো কথা স্মরণ করে বলতে পারেন— তুমি তো জানো, দুর্যোধন! তোমার মা তাঁর শ্বশুরপ্রতিম ব্যাসদেবের কাছে শতপুত্রের জননী হবেন বলে আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তিনি যখন গর্ভ ধারণ করেছিলেন, সময়ের হিসেবমতো তোমারই সেখানে জ্যেষ্ঠ হয়ে জন্মানোর কথা। কারণ গান্ধারী গর্ভ ধারণ করেছিলেন কুন্তীর এক বছর আগে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে গান্ধারীর গর্ভ দু’বছর পরিপক্ক হলেও অতি সুখের সেই প্রসব যন্ত্রণা লাভ করলেন না। এদিকে গান্ধারীর এক বছরের মাথায় কুন্তী গর্ভ ধারণ করলেন— সংবৎসরধৃতে গর্ভে গান্ধাৰ্য্যা জনমেজয়। গর্ভকাল পূর্ণ হলে কুন্তী পুত্র লাভ করলেন, কিন্তু গান্ধারী তখনও পুত্ৰমুখ দেখেননি। তিনি তাঁর দুই বছরের গর্ভকালে হঠাৎ শুনলেন কুন্তী পুত্রবতী হয়েছে। এই অবস্থায় তিনি দুঃখে আত্মহারা হয়ে আপন গর্ভে নিষ্ঠুর আঘাত করলেন। কাল পরিপক্ক না হলে যা হয়— লোহার মতো শক্ত একটি মাংসপেশি জন্মাল। সেটিকে তিনি ফেলেই দিচ্ছিলেন— নেহাত কোথা থেকে খবর পেয়ে দ্বৈপায়ন ব্যাস এসে উপস্থিত হলেন গান্ধারীর কাছে।
এর পরের ঘটনা তোমার জানা, দুর্যোধন। কিন্তু এই যে কুন্তীর পুত্র হয়েছে শুনেই গান্ধারী নিজের পেটে আঘাত করলেন— শ্রুত্বা কুন্তীসুতং জাতং… স্বোদরং ঘাতয়ামাস— এটা কোন ঈর্ষা থেকে? এক কথায় যে ব্যাস বলেছিলেন— আমি মহাভারতে গান্ধারীর ‘ধর্মশীলতা’র পরিচয় দেব— সেই ধর্মশীলা গান্ধারীর মধ্যে এই ঈর্ষা, এই ক্ষোভ কোথা থেকে এল? বেশ বোঝা যাচ্ছে— রাজ্যের অধিকার নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের মনে যে ক্ষোভ এবং কুটিলতা ছিল, তার অন্তত একাংশ তিনি গান্ধারীর মনেও ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ধর্মশীলা গান্ধারীর মনেও তিনি এই প্রত্যয় সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন যে, তিনি না হোন, অন্তত তাঁর পুত্র যদি বাড়ির বড় ছেলে হয়ে জন্মায়, তা হলেও রাজ্যভোগের তৃপ্তি তিনি খানিকটা পেয়ে যাবেন। বস্তুত ধৃতরাষ্ট্রের এই মনোবৃত্তির জন্যই গান্ধারী ধর্মশীলা হওয়া সত্ত্বেও কুন্তীর ছেলে হওয়ার খবর পেয়েই ‘দুঃখমূৰ্ছিতা’ হন এবং আপন গর্ভে অন্যায়ভাবে আঘাত করেন। এর পরে স্বয়ং ব্যাস এসে গান্ধারীর গর্ভমুক্ত মাংসপেশির শুশ্রুষায় নিযুক্ত হলেন। তিনি পরম যত্নে সেই মাংসপেশিকে একশোভাগে ভাগ করে সুরক্ষিত স্থানে রাখলেন এবং গান্ধারীকে বললেন— ঠিক সময় মতো ঘটের মুখগুলি খুলতে হবে।
বিদুর পুরনো কথা স্মরণ করে তাঁর জবাব দিচ্ছেন। তিনি বলবেন— তারপর এক এক করে তোমাদের জন্ম হতে লাগল, দুর্যোধন। যেদিন প্রথম তোমার জন্ম হল, সেদিন একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। মহামতি ব্যাস সেদিন উপস্থিত। জানি না-কেন, কী মনে করে তিনি আমাদের জানালেন— জন্মের হিসেবে কিন্তু পাণ্ডুর ছেলে যুধিষ্ঠিরই এই বংশের সকলের বড় ছেলে। মনে রেখো— এ কথাটা তিনি আমাকে এবং ভীষ্মকে খবর দেওয়ার মতো করে জানালেন— তদাখ্যাতন্তু ভীষ্মায় বিদুরায় চ ধীমতে। আজকে ভাবতে হচ্ছে যে, এ খবরটা তো আমরা জানতাম। স্বয়ং গান্ধারী এই খবর শুনেই নিজের গর্ভে আঘাত করেছিলেন। তবু ব্যাস কেন আবার আমাদের স্মরণ করালেন? শুধু মহাভারতের কর্তা হিসেবে তিনি এই খবর দিয়েছেন তা আমাদের মনে হয় না; অথবা তিনিই যেহেতু ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর জন্মদাতা— অতএব নাতি হল, তাই ডগমগ হয়ে জানালাম— এটাও আমাদের মনে হয় না। আমাদের ধারণা— জনক হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রের সম্বন্ধে তাঁরও কিছু সন্দেহ ছিল বোধহয়।
সন্দেহ প্রমাণিত হয়ে গেল, যখন তুমি গাধার ডাক ডেকে জন্ম নিলে এবং জন্মমুহূর্তে নানা দুর্লক্ষণ দেখে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অনেক ব্রাহ্মণকে আনিয়ে এক সভা ডাকলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সভায় আমিও ছিলাম এবং তোমার পিতামহ ভীষ্মও ছিলেন। তোমার পিতা ধৃতরাষ্ট্র বললেন— হ্যাঁ, আমি জানি— যুধিষ্ঠির আমাদের কুলবর্ধক রাজপুত্র এবং সেই সবার বড়— জ্যেষ্ঠো নঃ কুলবর্ধনঃ। ধৃতরাষ্ট্র আরও বললেন— আমি এও জানি যে, সে নিজগুণেই রাজ্য পাবে— আমার সেখানে কিছু বলারও নেই। কিন্তু আপনারা গুণে গেঁথে দেখুন— অন্তত যুধিষ্ঠিরের পরে আমার এই ছেলে রাজা হবে কিনা— অয়ং ত্বনন্তরং স্তস্মাদ্ অপি রাজা ভবিষ্যতি? আপনারা ঠিক করে বলুন ঘটনা ঠিক কোন দিকে গড়াবে?
বিদুর বলতে পারেন— দেখো দুর্যোধন! এ কথাটার মানে কী? যে মানুষ ভালভাবে জানেন যে— যুধিষ্ঠির সবার বড় এবং তিনিই রাজা হবেন অথবা যিনি এও জানেন যে, যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তোমার বয়সের তফাত বেশি নয়— তিনি কী করে, এই প্রশ্ন করেন যে, যুধিষ্ঠিরের পরে তুমি রাজা হবে কিনা! এ প্রশ্ন থেকে নিশ্চিত মনে আসে যে, হয় ধৃতরাষ্ট্র পুত্রপ্রতিম যুধিষ্ঠিরের মৃত্যুর দিন গুনছেন অথবা কীভাবে তোমাকে রাজা করা যায়— তারই একটা হিসাব কষছেন মনে মনে। যাই হোক, ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে পুনশ্চ চারদিকে শেয়াল-শকুনের ডাক শোনা গেল। এমন অবস্থায় ব্রাহ্মণেরা কেউ আর গোনা-গাঁথার কষ্ট-পরিশ্রম করলেন না। চারদিকে অমঙ্গল-ধ্বনি শুনেই সমবেত ব্রাহ্মণেরা— অবশ্য সঙ্গে আমিও ছিলাম— সবাই তখন রায় দিল— আপনি এ ছেলে ত্যাগ করুন, মহারাজ! যা দেখছি তাতে এ ছেলে আপনার বংশ ধ্বংস করে ছাড়বে— ব্যক্তং কুলান্তকরণো ভবিতৈষ সুতস্তব। আপনি আপনার নিরানব্বুইটা ছেলেকে আপনার কাছে রাখুন, কিন্তু এই একটাকে ত্যাগ করুন। নীতিশাস্ত্র বলে— দরকার হলে সমস্ত বংশের জন্য একটা ছেলে ত্যাগ করবে, একটা সম্পূর্ণ গ্রামের স্বার্থে নিজের বংশও ত্যাগ করবে। একটা বৃহৎ জনপদের জন্য গোটা গ্রামের স্বার্থও ত্যাগ করতে হবে— গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ!
দুর্যোধন বলবেন— সাবাস খুড়ো সাবাস! আর নীতিশাস্ত্র আওড়াতে হবে না। কোথায় আপনারা একটা দুটো শেয়াল-শকুনের ডাক শুনলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ত্যাগ করার ফরমান জারি করে দিলেন। ধন্যি আমার পিতাঠাকর! ভাগ্যি তিনি আপনাদের কথা শোনেননি। অন্তত তিনি আমাকে ত্যাগ করেননি। বরঞ্চ পরম স্নেহে আমাকে লালন-পালন করেছেন— ন চকার তথা রাজা পুত্রস্নেহসমন্বিতঃ।
বিদুর উত্তর দেবেন— এটা স্নেহ নয় দুর্যোধন! এটা অন্ধতা, অন্ধ স্নেহ। জন্ম থেকে যিনি অন্ধ, তিনি আসলে স্নেহেও অন্ধ— এইটাই আশয়। আর তুমি যাকে শেয়াল-শকুনের ডাক বলছ— ব্রাহ্মণেরা যাকে শেয়াল-শকুনের ডাক বলেছেন— তার আশয় কী জানো? ওই অমঙ্গল ধ্বনির মধ্যে আমি অন্ধ-রাজার রাজ্যলোভ আর লালসার বিকারধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম— যে বিকার ধ্বনিত হচ্ছিল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আপাত-করুণ সেই প্রশ্নে— যুধিষ্ঠিরের পরে আমার ছেলে রাজা হবে তো— অপি রাজা ভবিষ্যতি? আর তুমি আমাদের বংশের নজিরের কথা বলছিলে না? বুদ্ধিমান ভীষ্ম সে কথা বলতে লজ্জা পেলেন বটে, তবে এত কথা যখন হল, তখন সেটাও আমার বলে ফেলাই ভাল।
যে প্রসিদ্ধ ভরত-বংশের গৌরব করে আসছ এতকাল সেই ভরত কী করেছিলেন জানো? ভরতকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না তো? সেই দুষ্ম্যন্ত-শকুন্তলার পুত্র সর্বদমন ভরত, যিনি চক্রবর্তী রাজা হয়েছিলেন এই পৃথিবীতে, যাঁর নামের খ্যাতিতে এই দেশটিই ভারত-ভূমি নামে প্রসিদ্ধ, সেই ভরত। আমাদের বংশে তিনি বহু পূর্বতন রাজা হওয়া সত্ত্বেও এখনও যে তাঁরই নামে আমাদের বংশ অসীম গৌরব অনুভব করে— ভরতাদ্ ভারতী কীৰ্ত্তিৰ্যেনেদং ভারতং কুলম্— তার কারণ হল মহারাজ ভরতের প্রজারঞ্জনের ক্ষমতা। এই প্রজারঞ্জনের জন্য তিনি নিজের যে কোনও স্বার্থ ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন। মনে রেখো— এই ভরতের তিন মহারানির গর্ভে তিনটি তিনটি করে ন’টি ছেলে হয়েছিল। সময়কালে দেখা গেল, ছেলেগুলি একটাও তাঁর নিজের মতো হয়নি, অর্থাৎ কিনা প্রজানুরঞ্জনের যে বৃত্তি নিয়ে মহারাজ ভরত জীবন কাটাচ্ছিলেন, সেই বৃত্তির লেশমাত্র তিনি তাঁর পুত্রদের মধ্যে দেখতে পেলেন না। অতএব নয় ছেলের একজনকেও তিনি পরবর্তী রাজপদের যোগ্য অনুভব করলেন না— নাভ্যনন্দত তান্ রাজা নানুরূপা মমেত্যুত। ভরতের রানিরাও সেই রকম। যে ছেলের মধ্যে বাপের রাজবৃত্তির একাংশমাত্র নেই, সেই ছেলেদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন তাঁরা অনুভব করেননি, তাঁরা ছেলেদের মেরেই ফেলেছিলেন— ততস্তান্ মাতরঃ কুদ্ধাঃ পুত্রান্ নিন্যুর্যমক্ষয়ম্। মনে রেখো, দুর্যোধন! মহারাজ ভরত তাঁর নয় ছেলের একটিকেও রাজ্য দিয়ে যাননি। রাজ্যের জন্য তিনি দত্তক নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজের পুএ ভূমন্যুকে। তুমি নজিরের কথা বলছিলে না? তা এর থেকে বড় নজির আর কী আছে? যেন তেন প্রকারেণ রাজ্য পাওয়াটাই আমাদের বংশে বড় কথা নয়, দুর্যোধন! রাজধর্ম পালনের যোগ্যতা আছে কিনা সেইটাই বড় কথা। ব্যক্তিগত স্বার্থ, এবং রাজ্যপ্রাপ্তির লালসা যখন পিতার ঔরস থেকে পুত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়— তখন আমাদের মতো দুর্মুখ মানুষ মুখর হয়ে উঠে বলে— এ ছেলে ত্যাগ করলেই শান্তি আসবে, নইলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। ঠিক তাই হয়েছে।
ভীষ্ম, বিদুর এবং দুর্যোধনের সওয়াল-জবাব আমরা পরস্পরের অনুক্রমে সাজিয়ে দিয়েছি মাত্র। বলাবাহুল্য, মহাভারতের কবি এই সম্ভাব্য বাদ-বিতণ্ডার আয়োজন করেননি। আমরা তা করেছি এইজন্য যে, পরাজিত প্রতিনায়কের প্রতি মহাকাব্যের পাঠকেরা এক ধরনের করুণা অনুভব করেন, কখনও বা সেই করুণা এতই আর্দ্রভাবাপন্ন হয় যে, পাঠকের মনে হয়— দুর্যোধনের রাজ্য পাওয়াটাই বুঝি উচিত ছিল। ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য পাননি এবং দুর্যোধন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ায় এ করুণা আরও দৃঢ় হয়। আমাদের বক্তব্য— সেকালের আইন অনুসারে দুর্যোধন কোনওভাবেই রাজ্য পাওয়ার অধিকারী নন। বয়সের অনুপাতেও না, আবার রাজার ছেলে রাজা হবে— সেই অনুপাতেও না। কারণ, বয়সের অনুপাতে যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠ। আবার সিংহাসনে আসীন রাজা পাণ্ডু মারা গেলে তাঁরই পুত্রের রাজ্য পাওয়ার কথা। যদি বলেন— পাণ্ডু মারা গেলে ধৃতরাষ্ট্রের বড় ছেলে হিসেবে দুর্যোধন রাজা হতে পারেন, তা হলে প্রশ্ন আসবে— ধৃতরাষ্ট্র নিজেই রাজা ছিলেন না, তাঁর ছেলের রাজা হওয়ার কোনও উপপত্তি হয় না। পাণ্ড বনে ভ্রমণ করতে গেলে কিংবা তিনি মারা গেলে ধৃতরাষ্ট্র ‘কেয়ার-টেকার’ সরকার চালাচ্ছিলেন মাত্র। তিনি রাজার প্রতিনিধি, রাজা নন। অতএব কোনও ভাবেই দুর্যোধনের রাজ্য পাওয়ার প্রশ্ন আসে না।
কিন্তু আইনগতভাবে আমাদের সন্তুষ্টি কোনও বড় কথা নয়। কারণ, রাজনীতির ক্ষেত্রে রাজ্যলাভের প্রশ্ন আসে লালসার পথ ধরে, নীতি কিংবা যুক্তির পথ ধরে নয়। বিশেষত, দুর্যোধনের যে চরিত্র আমরা দেখতে পাই, তার জন্য তিনি যতখানি দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী তাঁর বাবা ধৃতরাষ্ট্র। দুর্যোধনের কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে তাই ধৃতরাষ্ট্রের কথা এসে পড়বে। ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য-লালসার অসন্তোষ দুর্যোধনের মধ্যে মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল। ফলত তিনি অকারণের মধ্যে রাজ্যলাভের কারণ আবিষ্কার করেছেন, অপ্রাপ্যের মধ্যে প্রাপ্যতার যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন। মহামতি ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রের জন্মদাতা হিসাবে আপন জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিকার জানতেন, এবং তা জানতেন বলেই দুর্যোধন ইত্যাদির ভ্রূণ শুশ্রূষার সময়েই তিনি আগেভাগে পাণ্ডুর প্রথম পুত্রের জন্মতিথি কুরু বৃদ্ধ পিতামহকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিদুরকেও।
দুর্যোধনের জন্মলগ্নেই ধৃতরাষ্ট্র নিজের ছেলের রাজ্যপ্রাপ্তি নিয়ে যে প্রশ্ন করেছেন, সে প্রশ্ন যে আরও গভীরতর উদ্বেগের চিহ্নে অঙ্কিত হবে— সেটা ব্যাস আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। পাণ্ডু মারা গেলে ধৃতরাষ্ট্র যত ঘটা করেই— রাজবদ্ রাজসিংহস্য— পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ করুন না কেন, ব্যাস জানতেন ধৃতরাষ্ট্র যেভাবেই হোক এই মৃত্যুর সুযোগ নেবেন। ব্যাস জানতেন— রাজনীতির এই সব নীচতা, কুটিলতা তাঁর মা সত্যবতীর পক্ষে সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন হবে। অসীম ব্যক্তিত্বময়ী এই মহিলা যে চেষ্টায় প্রসিদ্ধ ভরতবংশের সূত্র-রক্ষা করেছেন এবং দগ্ধ বংশতরুর প্রথম অঙ্কুরের মতো যে ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি স্নেহ করেন, তিনি যদি সব কিছু বিপরীত দেখেন— তা হলে তাঁর ব্যক্তিত্বে সেটা হবে অসহ্য। পাণ্ডুর শ্রাদ্ধশান্তির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাস তাই সোজা মায়ের কাছে গেছেন এবং নিজের আন্দাজ মতো বলেছেন— সুখের দিন সব শেষ, মাগো— অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ। দিন যা আসছে খুব খারাপ। পৃথিবী আস্তে আস্তে তার সৌন্দর্য হারিয়ে নিষ্ফলা হবে। কুরুদের অন্যায় অভব্যতায় এই রাজ্যের তথা এই বংশের যা হাল হবে— সেই ক্ষতি দেখার জন্য তুমি আর এখানে বসে থেকো না। তুমি আমার সঙ্গে বনে চলো এবং যোগ অবলম্বন করো।
উপযুক্ত পুত্রের একটা কথাতেই সত্যবতী সব বুঝে নিয়েছেন। ব্যাস, সাধারণভাবে বলেছিলেন, ‘কুরুদের অন্যায়-অত্যাচারে পৃথিবী ধ্বংস হবে।’ কিন্তু সত্যবতী এই বিরাট সামান্যীকরণের মধ্যেও ব্যাসের আশয়টি ঠিক বুঝে নিয়েছিলেন। বানপ্রস্থের প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বীকার করলেন বটে, কিন্তু একবারের জন্য হলেও ভারতবর্ষের তাবৎ শাশুড়িদের মতো বড় বউমা অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের মাকে খোঁটা দিয়ে বললেন— হ্যাঁগো বউমা— এ সব আমি কী শুনলাম। তোমার নাতি আর ছেলের দুর্নীতিতে নাকি এই ভরতবংশ নষ্ট হবে— অম্বিকে তব পৌত্রস্য দুর্নয়াৎ কিল ভারতাঃ— এই রাজ্য, রাজ্যের মানুষ সব ছারখারে যাবে। এখনও সময় আছে, যদি ইচ্ছে করে তো আমার সঙ্গে বনে চলো। অসীম মর্যাদাসম্পন্ন শাশুড়ির কথা ধৃতরাষ্ট্রের মা ফেলেননি, সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বনের পথ ধরেছেন। হতপুত্রা পাণ্ডুর মাও অবশ্য আর পাণ্ডুহীন সেই রাজগৃহে থাকতে চাননি। তিনিও চলে গেছেন সত্যবতীর সঙ্গে।
পাণ্ডুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই যে একটা সন্দেহের চোখ গিয়ে পড়ল ধৃতরাষ্ট্রের ওপর— এই সন্দেহই আস্তে আস্তে মূর্ত-রূপ লাভ করেছে দুর্যোধনের মধ্যে। দেখুন, ধৃতরাষ্ট্রের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ভুল একটা হয়ে গেছে— সেটা হল রাজনীতির চালে ভুল। তিনি অরণ্যবাসী ঋষিদের কথায় পাঁচজন পাণ্ডব ভাইকে রাজবাড়িতে স্থান দিলেন বটে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি যদি জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে মেরে ফেলতে পারতেন, তা হলে তাঁর সুবিধে হত অনেক বেশি। কিন্তু যত সুবিধেই হোক, মেরে ফেলাটা অত সহজ ছিল না। প্রজারা ছিলেন, কুরুবৃদ্ধ পিতামহ তখনও বেঁচে এবং সবার ওপরে আছেন সদা হিতৈষী বিদুর।… তবে এই মেরে ফেলার কথাটা ভাবতে বেশিদিন সময় লাগেনি ধৃতরাষ্ট্রের। অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রেরও অনেক আগে পাণ্ডবদের বিশিষ্ট একজনকে মেরে ফেলার যিনি ফন্দি আঁটলেন— তিনি কিন্তু সামান্য একটি বালক। সেই বয়সেই দুর্যোধনের অন্তরে সমবয়সি একটি ছেলেকে হত্যা করার দুর্বুদ্ধি এসে গেছে এবং সে কাজটি তিনি এত নিপুণভাবে খেলা-খেলা করে করলেন যে তাঁর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশঙ্কা হয়। অবশ্য এ কাজের জন্য তাঁর একটা পূর্বের প্রতিক্রিয়া ছিল। নিরপেক্ষ কবি হিসেবে ব্যাস সে কথা লুকোননি।
অল্পবয়সি ছেলেদের খেলার মধ্যে শক্তিমত্তা এবং দ্রুততার মূল্য সবার চেয়ে বেশি। এই দুটি গুণই মধ্যম পাণ্ডব ভীমের মধ্যে মাত্রাধিক থাকায় তাঁর খেলাগুলি কৌরব ভাইদের কাছে পীড়ন হয়ে দাঁড়াত— সর্বান্ স পরিমর্দতি। একজন মেজাজে খেলছে, তাকে ভীম কোলসাপটা করে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন এবং লুকিয়ে পড়লেন। অথবা দু’জনকে চুলের মুঠি ধরে বেশ খানিকটা ওপরে উঠিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিলেন। সবাই পুকুরে চান করতে নেমেছে— ভীম তখন অন্তত দশজন কৌরব ভাইকে একসঙ্গে জলে চুবিয়ে রাখলেন এবং যখন প্রায় দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল, তখন ছাড়লেন— মৃতকল্পান্ বিমুঞ্চতি। কৌরব ভাইয়েরা হয়তো ফল পাড়তে গাছে উঠেছে, ভীম তখনই সেই গাছে লাথি মারতে আরম্ভ করবেন এবং সজোরে গাছে ঝাঁকি দিতে থাকবেন। ফলের সঙ্গে টুপ টুপ করে কৌরবরাও একই সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ত— সফলাঃ প্রপতন্তি স্ম দ্রুতং ত্ৰস্তা কুমারকাঃ।
ব্যাস লুকোননি, বরং পরিষ্কার লিখেছেন— এই সমস্ত উৎপাত, বাল্যকাল থেকেই ভীমের এই অপ্রিয় ব্যবহার কিছুদিনের মধ্যেই যেমন ভীমের অতি মানুষিক শক্তির পরিচয় প্রকট করে তুলল, তেমনি একই সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের ওপর ভীমের দুষ্টামি বড় বেশি করে চোখে পড়তে লাগল— অপ্রিয়ে অতিষ্ঠদ্ অত্যন্তং বাল্যান্ন দ্রোহচেতসা। হয়তো এর মধ্যে ভীমের দ্রোহচেতনা ছিল না, কিন্তু বালক বয়সে সমবয়সি বন্ধুর শক্তিমত্তা সব সময়ই অপর ভাই বন্ধুকে কৌশলী এবং বেশি দুষ্ট করে তোলে। দুর্যোধনেরও তাই হল, তিনিও ভীমের বিরুদ্ধে দুষ্টভাব দেখাতে লাগলেন— দুষ্টভাবম্ অদর্শয়ৎ— অর্থাৎ তিনি ভীমের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেন উত্তরোত্তর। এই দুষ্টভাবই পরে হিংসায় পরিণত হয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হল— মানুষ হিসাবে ভীম অত্যন্ত সহজ এবং সরল। সে মানুষটা সদা-সর্বদা কৌরবদের অপ্রিয় আচরণ করতে আরম্ভ করল কেন, তার কোনও কারণ মহাভারতের কবি দর্শাননি। শুধু শক্তিমত্তাই যদি পরপীড়নের হেতু হয়, তা হলে নিজের ভাইদেরও তিনি ছাড়তেন না। কাজেই বার বার এখানে মনে হয় যে, পাণ্ডবদের আশ্রয়দাতা হিসাবে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রীতি এবং অপরপক্ষে পুত্র দুর্যোধনের ব্যাপারে তাঁর প্রশ্রয় অবিদিত ছিল না। অন্য পাণ্ডব ভাইয়েরা এটা জানলেও আপাতত চেপে যাওয়ার বুদ্ধি তাঁদের ছিল, কিন্তু সরলতা এবং অধিকতর শক্তিমত্তার জন্য বাল্যকালেও ভীম এই অপ্রিয় আচরণ করতে দ্বিধা করতেন না। অপরদিকে রাজবাড়ির একান্ত গোপন আলোচনাতে দুর্যোধন নিশ্চয় এতটাই আশ্বস্ত ছিলেন যে, সেই বালক বয়সেও ভীমের বিরুদ্ধে তিনি একা একাই একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করলেন না। আমরা যে ঠিক যুক্তির পথ ধরে এগোচ্ছি তার প্রমাণ পাওয়া যাবে দুর্যোধনের একটি কথাতেই। সেই বালক-বয়সেই তিনি রাজ্য শাসনের কথা ভাবছেন। এ জিনিস বাড়ির বড়দের মুখ থেকে ছোটদের মুখে এসে গেছে। তিনি বলছেন— এই ভীমটাই হল সমস্ত পাণ্ডব ভাইদের পালের গোদা, ওকে আমরা কায়দা করে, কৌশল করে উচিত শিক্ষা দেব— নিকৃত্যা পরিগৃহ্যতাম্। ওর গায়ের জোরও যেমন, তেমনি ও একাই সব সময় আমাদের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে— স্মর্ধতে চাপি সহিতান্ অস্মান্ একো বৃকোদরঃ। ওকে এবার উচিত শিক্ষা দেব। ও যখন ঘুমিয়ে থাকবে তখন ওকে আমাদের বাগানবাড়ির গঙ্গার ঘাট থেকে জলে ফেলে দেব। আর ওর বড় ভাই যুধিষ্ঠির আর ছোটভাইগুলোকে বেঁধে রেখে আমিই রাজ্যশাসন করব— প্রশাসিষ্যে বসুন্ধরাম্।
এই খেলা-খেলার বয়সে রাজ্যশাসনের কথা আসে কেমন করে— যদি না এত বড়দের মদত থাকে? আমাদের ধারণা— বড়দের নানা আলোচনা থেকে ছোটরা যেমন বড়দের মনোভাব বুঝতে পারে এবং সেই অনুসারে নিজেদের ছোট ছোট কর্তব্য নির্ধারণ করে, তেমনি ছোটদের বিশেষত নিজের ছেলেদের মনোভাব থেকে বড়রাও অন্যান্য বালকদের সম্বন্ধে একটি বিশেষ ধারণা করে নেন। এসব ক্ষেত্রে যাচাই করার প্রশ্ন আসে না, আপন পুত্রের প্রতি মমতা এবং ঘনিষ্ঠতার ফলেই ছেলেদের খেলার বন্ধুদের সম্বন্ধে অমনিই একটা ধারণা হয়। যেমন ভীমের সম্বন্ধে দুর্যোধনের যে ধারণা— এই ধারণাই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে তাড়া করে বেড়িয়েছে ভারত-যুদ্ধের পূর্বে উদ্যোগপর্ব পর্যন্ত। সেখানে তিনি জনান্তিকে সঞ্জয়কে বলেছেন— হরিণ যেমন রেগে-যাওয়া বাঘকে ভয় পায়, আমারও তেমনি ওই রাগি ভীমটাকেই শুধু ভয়— ভীমসেনাদ্ধি মে ভূয়ো ভয়ং সঞ্জায়তে মহৎ।
দেখুন, ধৃতরাষ্ট্র যে অর্জুনের ধনুবীর্য প্রকাশ পাবার পরেও ভীমের সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তাঁর কারণ কিন্তু দুর্যোধন। সেই ছোটবেলা থেকে দুর্যোধনও একই ধারণা পোষণ করেছেন বলেই ধৃতরাষ্ট্রের অমন ধারণা। এ সব আমরা পরে দেখব। আমাদের মনে হয়, অনুরূপভাবে দুর্যোধনও ধৃতরাষ্ট্রের নানা কথায় সেই ছোট বয়সেই বুঝতে পেরে থাকবেন যে, দুর্যোধনই রাজ্য পেতে পারেন এবং পাণ্ডবেরাই তার প্রতিবন্ধক। প্রধানত এই ধারণার বশবর্তী হয়েই সেই ছোট বয়সেই দুর্যোধন ভীমকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি আঁটলেন— পাপা মতিরজায়ত। দুর্যোধন তক্কে তক্কে থাকলেন এবং ক’দিনেই ভীমের দুর্বলতাগুলি সমঝে নিলেন। এরপর পাকা খুনির মতো রাজবাড়ি থেকে অনেক দূরে, একটা সুন্দর জায়গা বেছে নিলেন দুর্যোধন, যেখানে জলক্রীড়া এবং স্থলক্রীড়া একই সঙ্গে হতে পারে।
রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সেই বালক-বয়সেই এলাহি ব্যবস্থা করলেন দুর্যোধন। লোকালয় থেকে বেশ দূরে গঙ্গার তীর। জায়গাটার নাম প্রমাণকোটি। গঙ্গার তীরে দুর্যোধনের নির্দেশে অস্থায়ী আবাস তৈরি হল, তৈরি হল বিশ্রাম-ঘর, উঁচু চাঁদোয়া খাটানো হল এবং তার মাথায় বড় বড় করে নাম লেখা হল— জল-খেলা— উদকক্রীড়ন। ভাল ভাল পাচক নিয়ে যাওয়া হল, যারা ভক্ষ্য, ভোজ্য, লেহ্য-পানীয়ের সুব্যবস্থা করবে। দুর্যোধনের নির্দেশমতো ব্যবস্থা সব পাকা হয়ে যাবার পর দুর্যোধন নিজেই গিয়ে পাণ্ডবদের বললেন— প্রমাণকোটিতে গঙ্গার ধারে রীতিমতো একটা বাগান-বাড়ি তৈরি করে ফেলেছি আমরা। সবাই মিলে চলো সেখানে যাই, সবাই মিলে জলক্রীড়ার আমোদ করব— গঙ্গাঞ্চৈবানুযাস্যাম উদ্যানবন-শোভিতাম্। সরল যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কূটবুদ্ধি এতটুকুও বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন— বেশ তো, সবাই যাব তা হলে।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে কৌরব-পাণ্ডবেরা সকলে বিলাসবহুল রথে চড়ে উপস্থিত হলেন প্রমাণকোটিতে। পাণ্ডব-ভাইদের মাথা একেবারে ঘুরে গেল। দুর্যোধন তাঁর জ্ঞাতিভাইদের ঝকঝকে-তকতকে, বহির্গৃহও এমন সুন্দর হতে পারে! পাণ্ডব-কৌরবরা আরাম করে বসতেই খাবার-দাবার এসে গেল পূর্ব-নির্দেশমতো। এর পরের ঘটনা সকলের জানা থাকলেও বলি— দুর্যোধন সন্তর্পণে সকলের চোখের আড়ালে ভীমের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্যদ্রব্যে কালকেউটের বিষ মিশিয়ে দিলেন— উদ্দেশ্য, ভীমকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হবে— বিষং প্রক্ষেপয়ামাস ভীমসেন-জিঘাংসয়া। দুর্যোধন নিজের হাতে ভীমকে খাবার তুলে দিচ্ছেন— এটা খাও সেটা খাও বলে— এবং এই খাওয়ানোর মধ্যে এমন সুন্দর এক দেখনদারি ছিল, এমনই মধুর ছিল দুর্যোধনের কথাবার্তা যে, মনে হচ্ছিল— সত্যিই তো এর মধ্যে তো কোনও আশ্চর্য নেই, নিজের জ্যাঠতুতো ভাই এবং সমবয়সি ভাই দুর্যোধন তো খুড়তুতো ভীমের জন্য এমন করতেই পারেন— স বাচামৃতকল্পশ্চ ভ্রাতৃবচ্চ সুহৃদ্ যথা। মুখে এবং মুখের ভঙ্গিতে এমন মধুরতা, যেন কিছুই হয়নি, এমনটাই তো হবার কথা ছিল— এমন মধুরতা বজায় রাখলেও মনের মধ্যে দুর্যোধন কিন্তু হত্যা করছেন ভীমকে— হৃদয়েন ক্ষুরোপমঃ।
সত্যি বলতে কী, দুর্যোধন যা করছেন, সেটা খুব সহজ কথা নয়। প্রাচীন রাজশাস্ত্র প্রণেতারা— মনু থেকে মহাভারত অথবা কৌটিল্য থেকে কামন্দক— সকলেই এমন রাজগুণের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। রাজা যা ভাবছেন, অথবা যা তিনি করবেন বলে ভাবছেন, তা তাঁর বাইরের চেহারায় যেন এতটুকু প্রকট না হয়ে ওঠে— এই সাবধান-বাণীর নিরিখে রাজা যে গুণ অর্জন করার চেষ্টা করেন, দুর্যোধনের ক্ষেত্রে সেটা কিন্তু সহজাত গুণ, যেমনটি লিখেছেন কবি কালিদাস— তস্য সংবৃতমন্ত্রস্য গূঢ়াকারেঙ্গিতস্য চ— অর্থাৎ কিনা দুর্যোধন যেটা করতে চান, সেটা তাঁর বাইরের চেহারায় আকারে ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে না চোখ-মুখ-ভ্রুকুটির ভাষায়, অপাঙ্গে, ইঙ্গিতে। এমনকী তা ধরা পড়ে না হাত-পায়ের বিক্ষেপে, আঘাতে বা অন্য কোনও ক্রোধোদ্দীপ্ত আঙ্গিক চেষ্টায়। এমন রাজগুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধনকে আমরা সার্থকভাবে রাজযোগ্য বহুমানন করতে পারছি না, তার কারণ— যাঁকে বা যাঁদের তিনি জন্মের শত্রু বলে মনে করছেন এবং সেই তথাকথিত শত্রুদেরও যা চরিত্র অথবা চারিত্রিক গুণ, তাতে তাঁর শত্রুতার কারণই নেই। প্রথমত যুধিষ্ঠির তাঁর চাইতে বয়সে বড় এবং তিনিই পূর্বতন রাজার সঠিক উত্তরাধিকারী। অথচ দুর্যোধন তাঁকে ছলে-বলে-কৌশলে সরাতে চান এবং নিজে রাজা হতে চান যেনতেন প্রকারেণ। নির্দিষ্ট এবং আগ্রাসী শত্রুকে বাদ দিয়ে দুর্যোধন যে ভীমকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছেন, নিতান্ত অবোধ বালক বয়সেও নিজের আপন খুড়তুতো ভাইকে বিষ-নিদ্রায় আচ্ছন্ন করে গঙ্গায় ফেলে দেবার কথা ভাবছেন, এইখানেই তাঁর রাজযোগ্য গুণগুলি অতিসংকীর্ণ স্বার্থভাবনায় কলঙ্কিত হতে থাকে। ভবিষ্যতে যিনি সুপ্রসিদ্ধ ভরতবংশের কুলমর্যাদা ধারণ করে প্রজারঞ্জনের বৃত্তে প্রতিষ্ঠিত হবেন, তিনি যদি শত্রুরাষ্ট্র-দমনের প্রক্রিয়ায় নিজের ভাব-গোপনের সিদ্ধিগুলি প্রয়োগ করতেন, অথবা এই বালক-বয়সে শুধু প্রকৃত শত্রু চিনে নেবার শিক্ষাটুকু লাভ করতেন, তা হলেই সেটা সার্থক রাজোচিত বৃত্তি হতে পারত।
অথচ কী করছেন দুর্যোধন! একটি একটি করে অনেকগুলি বিষমিশ্রিত ভক্ষ্য তিনি তুলে দিচ্ছেন ভীমের হাতে, আর মনে মনে তিনি হাসছেন, কেন না তাঁর চিকীর্ষিত কাজটি সন্দেহাতীত মাত্রায় সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে— কৃত-কৃত্যমিবাত্মানং… হৃদয়েন হসন্নিব। আর সরল, দুর্ভাবনাহীন ভীম কী করছেন!
ভীম পেটুক— সেগুলি তিনি অম্লানবদনে গিললেন। খেলা আরম্ভ হল, জলখেলা, স্থলখেলা সব হল। ভীমও খেললেন, জলের মধ্যে ভাইদের কাধে করে সাঁতার দিলেন, নিজেও খেললেন অনেক পরিশ্রম করে। তারপর শ্রান্ত ক্লান্ত কাউকে কিছু না বলে, কারও খেলায় বিঘ্ন না করে গঙ্গার তীরে এসে ঠান্ডা হাওয়ায় গা এলিয়ে দিলেন— যেন একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে সব। দুর্যোধন কিচ্ছু না দেখে, সব দেখছেন, ফাঁক খুঁজছেন— নিত্যমেবান্তরপ্রেক্ষী। দেখলেন— ভীম বিষক্রিয়ায় নিশ্চেষ্ট; এবার লতার দড়িতে শক্ত করে হাত-পা বেঁধে ভীমকে তিনি ফেলে দিলেন গঙ্গায়— স্থলাজ্জলমপাতয়ৎ।
খুনি দুর্যোধনের জলক্রীড়ার ব্যবস্থা, আহার-বিহারে ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা এতই নিখুঁত ছিল যে, পরস্পর অতি-ঘনিষ্ঠ পাণ্ডব ভাইরা পর্যন্ত বাড়ি ফেরার আগের মুহূর্তেও কিছুই বুঝতে পারেননি। রাস্তায় যখন ভীমের কথা এসেছে, তখন নিজেরাই বলাবলি করেছেন— ও আগেই বেরিয়ে গেছে। লক্ষণীয় বিষয় হল— বাড়ি ফিরে যুধিষ্ঠির যখন মাকে ভীমের কথা জিজ্ঞাসা করলেন তখন কুন্তী খুব হাহাকার করে উঠলেন বটে, তবে কথাটা মোটেই পাঁচ কান হতে দিলেন না। তাঁর পরিবারের পোষক হিসাবে কিংবা কুরুরাজ্যের পালক হিসাবে ধৃতরাষ্ট্রকেও তিনি কিছু বললেন না। ভীমকে খোঁজার জন্য কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যের কোনও উপকরণ, যাকে আমরা ‘রয়াল মেশিনারি’ বলতে পারি, তাও ব্যবহার করলেন না। একদিকে তিনি চার ভাইকে পাঠালেন ভীমকে খুঁজতে অন্যদিকে বিদুরকে ডেকে পাঠালেন শলাপরামর্শ করার জন্য। বিদুরের কাছে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুন্তী তাঁর প্রথম সন্দেহের কথা ব্যক্ত করলেন এই ভাষায়— দুর্যোধন অত্যন্ত নৃশংস এবং বকে-যাওয়া ছেলে। ওর মনটা যেমন ছোট, তেমনি এই রাজ্যের ওপরে ওর লোভ; লজ্জা-শরমও কিছুই নেই— ‘ক্রূরোহসৌ দুর্মতিঃ ক্ষুদ্রো রাজ্যলুব্ধোহনপত্রপঃ।
একথা থেকে বেশ বোঝা যায় অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যলাভের ব্যাপারে তাঁর আপন ক্ষোভ দুর্যোধনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই দুর্যোধন বুঝেছেন— তাঁকে রাজ্য পেতে হবে। এজন্য পাণ্ডবদের একজনকে মারলে যে ধৃতরাষ্ট্র অসুখী হবেন না— এটা যেমন দুর্যোধনের ধারণা, তেমনি এটা কুন্তীরও ধারণা, — নইলে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে কিচ্ছুটি জানালেন না কেন? এমনকী ভীম হারিয়ে যাবার পর আটদিন চলে গেল— তবু কুন্তী বা বিদুর কেউই কিন্তু ব্যাপারটা রাজ্যের রাজাকে জানাচ্ছেন না— এবং জানাচ্ছেন না— এই কারণেই যে, কিছুই প্রতিকার পাওয়া যাবে না। এমনকী আটদিন পরে ভীম যখন নাগ-রাজ্য থেকে ফিরে এসে নিজেই নিজেকে নিবেদন করলেন, অপি চ দুর্যোধনের ফন্দিফিকির, মুক্তকণ্ঠে বলতে আরম্ভ করলেন, তখন যুধিষ্ঠির তাঁকে সাবধান করে বললেন– চুপ করো ভীম! এসব কথা কোথাও তুমি বলবে না— তুষ্ণীং ভব ন তে জল্প্যমিদং কার্যং কথঞ্চন।
মহাভারতের নিরপেক্ষ কবি হিসেবে ব্যাস লিখেছেন— যুধিষ্ঠির যে কথাটা বলেছেন, সেটা নাকি খুব দামি কথা— বচোহৰ্থবৎ। এরপর থেকেই দেখছি কুরুরাজ্যে দুটো ‘লবি’ হয়ে গেল। দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি— এঁরা এক ‘লবি’তে এবং অবশ্যই এঁদের মন্ত্রণার পিছনে রাজা হিসাবে ধৃতরাষ্ট্রের মদত রয়েছে। অন্য ‘লবি’তে পাঁচ ভাই পাণ্ডব এবং তাঁদের আপ্ত সহায়ক হয়ে উঠলেন বিদুর। দুর্যোধন যে ভীমকে বিষ খাইয়েছিলেন, সে সময় তাঁকে কেউ এই বুদ্ধি দেয়নি। কিন্তু ভীম যখন বেঁচে ফিরলেন, তখন বোধকরি দুর্যোধন শকুনি এবং কর্ণকে এ ঘটনা জানিয়েছেন— ব্যাপারটা ফেঁসে গেল বলে। প্রথম কোপেই দুর্যোধন রাজবাড়ির রাজনীতি ঘাঁটিয়ে তুললেন এবং তখনও তাদের অস্ত্রশিক্ষাই আরম্ভ হয়নি। দুর্যোধনের বালক-বুদ্ধিতেই পাণ্ডবেরা একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়লেন এবং তাঁরা যে রাজবাড়ির কোনও সাহায্য পাবেন না এটা বুঝে গেলেন। মহাভারতের শ্লোকের অন্যতর একটি পাঠে দেখা যায়— যুধিষ্ঠির ভীমকে কিচ্ছুটি না বলার আদেশ দিয়েই বলছেন— আজ থেকে আমরা পাঁচ ভাই, পাঁচ ভাইকে পরস্পর রক্ষার করার ব্রত নেব— রক্ষতান্যোন্যমাদৃতাঃ। এই চলল। রাজনৈতিক দাবার আসরে দুর্যোধন প্রথম দানেই বাজিমাৎ করতে পারলেন না বটে (কারণ তা কখনওই করা যায় না), কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীদের তিনি ‘ডিফেন্সে’ খেলতে বাধ্য করেছেন। এর পরেই কৃপাচার্য এবং দ্রোণাচার্যের কাছে পাণ্ডব-কৌরবের অস্ত্র শিক্ষার পালা।
সমস্ত অস্ত্রশিক্ষার পর্ব থেকে যে জিনিসটা অপ্রত্যাশিতভাবে বেরিয়ে এল— সেটা হল অবিসংবাদী বীর হিসাবে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের উদয়। অস্ত্রশিক্ষার পূর্বে একমাত্র ভীমই ছিলেন কৌরবপক্ষের একমাত্র ঈর্ষা এবং বিদ্বেষের পাত্র। কিন্তু অস্ত্রশিক্ষা যখন শেষ হয়ে আসছে তখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে ভীম এবং অর্জুন দু’জনকেই কৌরবরা আর সহ্য করতে পারছেন না— প্রাণাধিকং ভীমসেনং কৃতবিদ্যং ধনঞ্জয়ম্। ধার্ত্তরাষ্ট্রা দুরাত্মানো নামৃষ্যন্ত পরম্পরম্। দুর্যোধন জানতেন— ভীম যত শক্তিধরই হোন, তাঁকে তিনি একাই ঠেকাতে পারবেন। দু’জনেই পরস্পরের প্রতি আক্রোশে গদাযুদ্ধেই বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসা অর্জুনের বাণ কখন, কীভাবে যে কৌরবদের দিকে ছুটে আসবে— তা ভেবে অবশ্যই তিনি চিন্তিত ছিলেন। অস্ত্রশিক্ষার আসরে গদাশিক্ষার পরীক্ষা দিতে গিয়ে দুর্যোধন এবং ভীম যখন চক্রাকারে একজন আরেকজনকে প্রহার করছেন, তখন তাঁদের মধ্যে পরীক্ষার অনুশীলনীর থেকেও বড় হয়ে উঠেছিল প্রতিহিংসা। বুদ্ধিমান দ্রোণাচার্য মাঝপথে এই যুদ্ধ-পরীক্ষা থামিয়ে দিয়েছেন এবং পরীক্ষা-রঙ্গভূমির পবিত্রতা বজায় রেখেছেন। কিন্তু দুর্যোধন বুঝে গেছেন— ভীমের গায়ের শক্তি যতই থাক, সে অজেয় নয়।
ভীমকে নিয়ে চিন্তার অবসান হল বটে, কিন্তু চিন্তা বেড়ে গেল অর্জুনকে নিয়ে। তিনি ততক্ষণে তাঁর অস্ত্রবিদ্যার কৌশলে সমস্ত রঙ্গভূমিকে প্রায় মূক এবং স্তব্ধ করে দিয়েছেন। ঠিক এমনই সময় রঙ্গভূমিতে এসে পৌঁছলেন কর্ণ। একেবারে ‘চ্যালেঞ্জ জানাতে জানাতে তিনি রীতিমতো চিৎকার করতে থাকলেন রঙ্গভূমির দ্বারদেশ থেকে। অস্ত্রশিক্ষার আসরে অর্জুনের সমস্ত কৌশলের জবাব দিতে চাইলেন কর্ণ। দুর্যোধন কর্ণকে আগে থেকেই চিনতেন, কুরুদের সঙ্গেও তিনি পূর্ব-পরিচিত। অস্ত্রশিক্ষার আরম্ভে কর্ণ দ্রোণাচার্যের কাছে কোনও সুযোগ পাননি এবং তিনি সোজা চলে গিয়েছিলেন পরশুরামের কাছে। আজ যখন অস্ত্রপরীক্ষার দিনে কর্ণ উপস্থিত হয়েই নিজের জানান দিলেন সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধন উঠে যাচ্ছিলেন রঙ্গভূমির দরজার দিকে। আর কিছুই নয়, যে লোক অর্জুনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, তাঁকে প্রাথমিক অভিনন্দন জানাবেন না দুর্যোধন— এই কী হতে পারে? অন্যের কাছে এই আচরণ যতই অভদ্র দেখাক, তবু দুর্যোধন তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবেন এবং সেটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে স্বাভাবিক।
রঙ্গভূমিতে ঢুকে কর্ণ অর্জুনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধন খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলেন, অন্যদিকে লজ্জা এবং ক্রোধ একসঙ্গে পীড়া দিতে লাগল অর্জুনকে। অস্ত্র শিক্ষার সমস্ত কায়দা-কেতা, যা যা অর্জুন দেখিয়েছিলেন, তা সবই যখন কর্ণ করে দেখালেন, তখন একশো ভাইদের সঙ্গে দুর্যোধন উঠে এসে কর্ণকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন— এ আমাদের সৌভাগ্য যে তুমি আজ এখানে এসেছ। এখন তুমি মেজাজে এই কুরুরাজ্য উপভোগ করো— কুরুরাজ্যঞ্চ যথেষ্টমুপভুজ্যতাম্। কর্ণ বললেন— থাক ওসব। আমি তোমার বন্ধুত্ব চাই শুধু। আশ্চর্যের বিষয়— দুর্যোধন তখনও যুবরাজ নন, কিছুই নন। কিন্তু অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে দলে পাবার জন্য তিনি কুরু রাজ্যের সমস্ত সুখ উপভোগের ‘অফার’ দিলেন কর্ণকে। বোধকরি এর পেছনেও ধৃতরাষ্ট্রের মদত ছিল। আরও আশ্চর্য— কর্ণ দুর্যোধনের কাছে প্রশ্রয় পাবার সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। কাজটি যে বীরোচিত— তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা আমাদের বিচলিত করে। দুর্যোধন কর্ণের মুখে নিজের মনের মতো কথা শুনে আবারও ভোগ-সুখের অঞ্জলি বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং সমবেত বৃদ্ধদের সামনে নিজের খুড়তুতো পাণ্ডব ভাইদের অপমান করে বলেছেন— তুমি আমারই সঙ্গে সমভাবে এ রাজ্যের সুখ ভোগ করো, আর দুষ্ট-মনের মানুষগুলির মাথায় পা মাড়িয়ে চলতে থাকো— দুহৃদাং কুরু সর্বেষাং মূর্ধ্নি পাদম্ অরিন্দম।
কর্ণ আরও বেড়ে গেলেন। নিজের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুর্যোধনের তোয়াজ করার ঢঙ দেখে অর্জুন আর থাকতে পারলেন না। বস্তুত কর্ণের মধ্যে অর্জুনের একজন সমান প্রতিস্পর্ধী লক্ষ করে দুর্যোধন একেবারে নির্লজ্জভাবে তোয়াজ করছিলেন কর্ণকে। হ্যাঁ, এটা বুঝলাম যে, উন্মুক্ত রঙ্গস্থলে দুই প্রতিস্পর্ধীর যোগ্যতার মাপকাঠি হল বীরত্ব। সেই নিরিখে কুলগুরু কৃপাচার্য কর্ণের বংশ মর্যাদার প্রশ্ন তুলে খুবই অন্যায় করেছেন। তবে এ-ছাড়া বোধহয় কোনও উপায়ও ছিল না তাঁর হাতে। একটু আগেই গদাযুদ্ধের দক্ষতা দেখাতে গিয়ে দুর্যোধন এবং ভীমের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সংঘাত তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তেমনটা যদি অর্জুন-কর্ণের মধ্যেও লেগে ওঠে, তবে সেটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। অতএব যে-কোনও উপায়ে একটা তাচ্ছিল্যসূচক অপমান করেও যদি একজনকে থামানো যায়, সেই চেষ্টাতেই কৃপাচার্য নিম্নবর্গীয় জাতির প্রসঙ্গ তুলে কর্ণকে অর্জুনের অথবা অর্জুনকে কর্ণের হাত থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছেন। তবে হ্যাঁ, উভয়-পক্ষের প্রতিস্পর্ধার মধ্যে কৃপাচার্য যে কর্ণকেই অপমান করলেন, সেটা যতখানি অর্জুনের ওপর পক্ষপাতবশত, তার চেয়ে বেশি দুর্যোধনের বাড়াবাড়ি রকমের কর্ণপ্রীতি দেখে। কিন্তু শুধুমাত্র রাজপুত্র নয় বলেই মহাবীর কর্ণকে এইভাবে অপমানিত হতে দেননি দুর্যোধন। হয়তো পাণ্ডব অর্জুনের প্রতিপক্ষে একজন বলবত্তর ব্যক্তিকে পাশে পেয়ে যাওয়াটাই দুর্যোধনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তবু উচ্চ-নীচ কৌলীন্যের প্রশ্নে দুর্যোধন কিন্তু প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি এবং সে প্রতিবাদ যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ছিল শেষ পর্যন্ত।
দুর্যোধন বলেছিলেন— এটা কীরকম কথা হল, আচার্য! রাজা-রাজড়াদের জন্মের উৎস হতে পারে তিনরকম। ভাল বংশে রাজার জন্ম, সে তো হতেই পারে। কিন্তু শৌর্য-বীর্যই একজন কৃতকৃত্য রাজার সঠিক উৎস নির্ধারণ করে। তৃতীয়ত, রাজা হবার আর এক উপযুক্ত আধার হলেন তিনি, যিনি সৈন্যবাহিনীর সফল নেতৃত্ব দিতে পারেন অথবা বিপক্ষের সৈন্যব্যূহ ধ্বংস করে দিতে পারেন— সৎকুলীনশ্চ শূরশ্চ যশ্চ সেনাং প্রকৰ্ষতি। যুক্তির কথা বললেও যদি আচার্য কৃপের কর্ণপাত না থাকে, তাই সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন— আর যদি এমনই হয় যে, অর্জুন রাজা বা রাজপুত্র ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না— যদ্যয়ং ফাল্গুনো যুদ্ধে নারাজ্ঞা যোদ্ধুমিচ্ছতি— তা হলে এই মুহূর্তে কর্ণকে আমি অঙ্গ-রাজ্যের রাজা করে দিচ্ছি।
সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের নির্দেশমতো সুবর্ণ ঘটে জল ভরা হল, এল ফুলের সম্ভার, মাঙ্গলিক লাজমুষ্টি শত শত। কর্ণকে সুবর্ণপীঠিকায় দাঁড় করিয়ে দুর্যোধন কর্ণের মাথায় জল ঢেলে দিলেন। মন্ত্রবিদ ব্রাহ্মণেরা মন্ত্র পড়ল, সূতজাতীয় কর্ণ দুর্যোধনের মমতায় এখন অভিষেক-আর্দ্রশির, অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন— আমি এই রাজ্যদানের কী প্রতিদান দিতে পারি। দুর্যোধন বললেন— তোমার সখ্য ছাড়া আর কিছু নয়— অত্যন্তং সখ্যমিচ্ছামি ইত্যাহ তং স সুযোধনঃ।
মৌখিকভাবে দুর্যোধন-কথিত এই সখ্য যতই শুনতে মধুর লাগুক, তবু মনে রাখতে হবে— দুর্যোধন যে সেই মুহূর্তে কর্ণকে অঙ্গরাজ্য দান করলেন— তার পেছনে মহানুভবতার কারণ যতখানি দায়ী, তাঁর থেকে অনেক বড় কারণ হল তাঁর স্বার্থ। যদি বীরত্বের উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়াই দুর্যোধনের আন্তর ধর্ম হত, তা হলে বলব— দুর্যোধন তাঁর জীবনে অনেক বীর দেখেছেন তাঁদের তিনি সেই মর্যাদা দেননি। কিন্তু কর্ণ যেহেতু অর্জুনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়েছেন এবং এমন একজন ‘চ্যালেঞ্জার’, যে অর্জনকে তাঁর মতোই ঘৃণা করে— সেই প্রতিস্পর্ধীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দুর্যোধন অর্জুনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন— আর কিছু নয়।
দুর্যোধন কর্ণের জাতি-সংস্কার ম্লান করে দিয়ে তাঁকে রাজ-সম্মান দিলেন বটে, কিন্তু সামাজিক কটু-কাটব্যগুলি এতটুকুও রুদ্ধ হল না তাতে। বরঞ্চ কর্ণকে নিয়ে দুর্যোধন যেহেতু নাচানাচি শুরু করেছিলেন, তাই দুর্যোধনের চিরকালীন প্রতিস্পর্ধী ভীম আর বসে থাকতে পারলেন না। সারথি-জাতির পিতা অধিরথকে কর্ণ যেই অভিষেক-সিক্ত শিরে প্রণাম করলেন, সঙ্গে সঙ্গে ভীম টিপ্পনী কেটে দুর্যোধনকেই তাচ্ছিল্য করে বললেন— আরে ব্যাটা সারথির পো! অর্জুনের সঙ্গে তুই যুদ্ধ করবি কিরে! তার চেয়ে বাপ-পিতামহের এতকাল যে কাজ ছিল, সেই কাজটা কর, ঘোড়া হাতে নিয়ে রথ চালা-রে ব্যাটা— কুলস্য সদৃশস্তূর্ণং প্রতদো গৃহ্যতাং ত্বয়া। আরে অঙ্গরাজ্য নিয়ে তুই কী করবি? তোর কোনও ক্ষমতা আছে রাজ্য ভোগ করার? না রাজ্য শাসন করবি তুই? যজ্ঞের যে-আগুনে ঘি-আহুতি পড়ে, সেটা আগুনেরই হজম হয় রে, সেখানে যদি আহুতির পুরোডাশ খাবে বলে এটা কুত্তা দাঁড়িয়ে থাকে লোভীর মতো, তা হলেই কি সে যজ্ঞের আহুতি খেতে পারে— শ্বা হুতাশ-সমীপস্থং পুরোডাশমিবাধ্বরে।
এ একেবারে অপমান করার জন্যই অপমান করা। কৃপাচার্যকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে দুর্যোধন একটা রাজ্য দিয়ে বসলেন কর্ণকে, সেখানে অর্জুনের সঙ্গে সম-মর্যাদার প্রশ্নটা যেহেতু এক মুহুর্তেই উত্তীর্ণ হয়ে গেল, সেখানে দুর্যোধনের ওপর রাগটা কর্ণকে দিয়ে মিটিয়ে নিলেন ভীমসেন। কিন্তু খানিকটা স্থূল বুদ্ধির কারণেই ভীম কিছুতেই অনুধাবন করতে পারলেন না যে, পিতৃত্ব এবং হীনজাতিত্বের প্রশ্নে কর্ণকে বিব্রত করতে গিয়ে এমন কথা শেষ পর্যন্ত শুনতে হবে অস্বস্তি আরও বাড়বে। কেন না দুর্যোধন ভীমের এই আস্ফালন মেনে নিলেন না। তিনি বললেন— কথাটা একেবারেই তুমি ঠিক বলোনি, ভীম! একেবারেই ঠিক নয়। ক্ষত্রিয়-পুরুষের কাছে শক্তি এবং বলের ব্যাপারটাই প্রধান হওয়া উচিত, তাই নয় কী? তা ছাড়া সেই বিখ্যাত কথাটা একবার ভেবে দ্যাখো। নীতিশাস্ত্রই তো বলেছে— দ্যাখো বাপু! মহা মহা বীর আর নদী, এদের উৎস খুঁজতে যেয়ো না। দ্যাখো, সমুদ্রের জল থেকে জন্মায় ব্যাপ্ত বড়বানল, আর দধীচি মুনির হাড় থেকে বজ্র। আর ওই যে দেব-সেনাপতি কার্তিক, তাঁকে কার ছেলে বলবে— রুদ্রের ছেলে? অগ্নির ছেলে? গঙ্গার ছেলে? নাকি কৃত্তিবাসের ছেলে?
বড় বড় উদাহরণ ছেড়ে দুর্যোধন এবার নিজেকে নিয়ে স্থাপন করলেন সেই রঙ্গমঞ্চ-স্থলে যেখানে দ্রোণ, কৃপ সকলেই দাঁড়িয়ে আছেন। বস্তুত দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্য দু’জনেই তো জননীর পরিত্যক্ত, এঁদের পিতারা নিজস্ব ক্ষেত্রে ঋষি-মুনির খ্যাতি নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন বটে, কিন্তু দ্রোণ যদি বা পিতার সঙ্গ কিছু পেয়েছিলেন, সেখানে কৃপাচার্য তো এই কুরুবাড়িতেই মানুষ; অথচ এই কৃপাচার্যই অর্জুন-কর্ণের দ্বন্দ্ব মেটানোর জন্য রাজায়-রাজায় যুদ্ধের সঙ্গতি খুঁজেছিলেন। দুর্যোধন ভীমের কথার উত্তর দিতে গিয়ে দ্রোণ এবং কৃপের জন্মের কাসুন্দি ঘেঁটে দিলেন— আচার্যঃ কলশাজ্জাতঃ… শরস্তম্বাচ্চ গৌতমঃ। এবার শেষ কথায়— পঞ্চপাণ্ডব ভাইদেরই মূল ধরে টান দিলেন দুর্যোধন। বললেন— ওহে ভীম! তোমরা কোথা থেকে আসছ? সবটাই তো আমার জানা হয়ে গেছে— ভবতাঞ্চ যথা জন্ম তদপ্যাগমিতং ময়া— অতএব এই কর্ণ লোকটাকে দেখেই বা কী মনে হয়? সহজাত কবচ-কুণ্ডল নিয়ে এই যে আদিত্যবর্ণ পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে দেখে কি তোমার এই মনে হচ্ছে যে, এই বাঘটার জন্ম দিয়েছে কোনও হরিণী— কথমাদিত্যসদৃশং মৃগী ব্যাঘ্রং জনিষ্যতি। আর আমার কথা যদি কারও ভাল না লাগে তবে সে উঠে আসুক রথে, ধনুক-বাণ নিয়ে দাঁড়াক আমার সামনে।
দুর্যোধন শুধু ভীমের কথাই ফিরিয়ে দেননি, নিজের সাহস এবং মৌখিকতায় উপস্থিত সবাইকেই প্রায় চুপ করিয়ে দিয়েছেন। এখানে উদ্দেশ্য অবশ্য একটাই অর্জুনের সমান প্রতিদ্বন্দ্ব কর্ণকে নিজের পাশে সুস্থিত করে তোলা। দুর্যোধন কর্ণকে আবারও বীরত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন বটে, কিন্তু মহাভারতের কবি একেবারে শেষ শ্লোকে পেছন থেকে অঙ্গুলি-সংকেত করে বলেছেন— আসলে যা হল— অর্জুনের বীরত্ব দেখে যে পরিমাণ ভয় পেয়েছিলেন দুর্যোধন, কর্ণকে পেয়ে তাঁর সেই ভয় এক্কেবারে চলে গেল— ভয়ম্ অর্জুন-সঞ্জাতং ক্ষিপ্রম্ অন্তরধীয়ত। সবচেয়ে বড় কথা কর্ণের বাগাড়ম্বরের সঙ্গে দুর্যোধনের বাগাড়ম্বর যুক্ত হওয়ায় স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের পর্যন্ত মনে হল— বুঝি কর্ণের মতো বীর আর পৃথিবীতে নেই— যুধিষ্ঠিরস্যাপ্যভবত্ তদা মতি/র্ন কর্ণতুল্যোহস্তি ধনুর্ধরঃ ক্ষিতৌ। দেখুন ভীমকে বিষ খাওয়ানোর পরেও যুধিষ্ঠিরেরা যে একটা প্রতিবাদ-শব্দ উচ্চারণ করতে পারেননি— এটা যেমন দুর্যোধনের প্রাথমিক ক্ষমতা, তেমনি অস্ত্রশিক্ষার পর নতুন নায়ক অর্জুনের প্রতিভাকেও সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দেওয়ার মধ্যেই কিন্তু কর্ণকে নিয়ে দুর্যোধনের মাতামাতির রাজনীতি। এর বেশি কিছু নয়। কারণ জীবনের বৃহৎ ক্ষেত্রে অর্জুনের যেমন কোনও পরীক্ষা হয়নি, তেমনি কর্ণেরও পরীক্ষা হয়নি।
তবে পরীক্ষা হয়ে গেল। দ্রোণাচার্যের গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য কৌরবপক্ষের একশো ভাইয়ের সঙ্গে কর্ণও গিয়েছিলেন দুর্যোধনের মান রাখতে। কিন্তু কেউই দ্রুপদ রাজাকে জ্যান্ত ধরে আনতে পারলেন না,— দুর্যোধনও না, কর্ণও না। বরঞ্চ এঁরা দুজনেই দ্রুপদের হাতে বেশ মার খেলেন, যদিও বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এঁরা— আমি আগে, আমি আগে— বলে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। শেষে যখন অর্জুন একা ভীমকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুপদকে জ্যান্ত ধরে আনলেন— সেদিন থেকেই পাণ্ডবদের মর্যাদা আরও বেড়ে গেল। আমাদের ধারণা— এরই ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত আইন মেনে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজের পদ দিলেন এবং তা দিলেন দ্রুপদ-শাসনের ঠিক এক বছর পরে।
যৌবরাজ্য লাভের পর অর্জুন এবং ভীম যুধিষ্ঠিরের হয়ে চারদিকে কুরুরাজ্যের সমৃদ্ধি আরও বাড়িয়ে তুললেন। সমুদ্রমেখলা পৃথিবীর চারদিকে একই গুঞ্জন শুরু হল— অর্জুনের মতো এত বড় ধনুর্ধারী যোদ্ধা পৃথিবীতে আর নেই— অর্জুনস্য সমো লোকে নাস্তি কশ্চিদ্ ধনুর্ধরঃ। তার মধ্যে আবার দু’-একজন রাজা, যাদের কেউ শায়েস্তা করতে পারেনি, তাদেরও ঠান্ডা করে দিলেন অর্জুন। কুরুরাজ্যে টাকা-পয়সা আসতে লাগল স্রোতের মতো। কৌরবদের এত শ্রীবৃদ্ধি সত্ত্বেও সেটা যেহেতু নিজের ছেলে দুর্যোধনের সূত্রে হয়নি, অতএব ধৃতরাষ্ট্রের মনে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে যেটুকু আলগা ভদ্রতা, যেটুকু লোক-দেখানো সদ্ভাব ছিল— তাও উবে গেল— দূষিতঃ সহসা ভাবো ধৃতরাষ্ট্রস্য পাণ্ডুষু। দু-এক জায়গায় তিনি এইরকম বলেও ফেললেন যে— পাণ্ডবরা বড্ড বেড়ে গেছে, ওদের সুখ-সমৃদ্ধি দেখে আমার আর ভাল লাগছে না— উৎসিক্তা পাণ্ডবা নিত্যং তেভ্যোহসূয়ে দ্বিজোত্তম।
কুমার যুধিষ্ঠির যুবরাজ হয়েছেন। কাজকর্মও ভালই চলছে। এরই মধ্যে পরপর দু’দিন একই ঘটনা ঘটল। কতগুলি লোক কুরুরাজ্যের সভাগৃহে জড়ো হল। আবার পরের দিন কতগুলি লোককে বাইরের চত্বরে জড়ো হতে দেখা গেল। তারা যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের কাজকর্মে দারুণ খুশি। তারা বলছে— দুদ্দুর! ধৃতরাষ্ট্রের হবে কী! তার চোখ নেই বলে আগেই তাকে রাজা করা হয়নি, এখন তো তার রাজা হবার প্রশ্নই আসে না— স কথং নৃপতিৰ্ভবেৎ। তারা আরও বলছে— আবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্মের কথা ধর— তিনি আগেই সত্যপালনের জন্য রাজ্য প্রত্যাখ্যান করেছেন— তিনি এখনও রাজ্য নেবেন না। তা হলে আমরা সবাই এখন ওই পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকেই রাজার মর্যাদায় অভিষেক করব— ছেলেটা বয়সে তরুণ হলে কী হয়, বড়দের মর্যাদা রাখতে জানে। এখন থেকেই সৎপথে চলে, আর তেমনি মমতা আছে সবার ওপর। দেখো, এই ছেলে যদি রাজা হয়, তা হলে বয়োবৃদ্ধ ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্রকে এমনকী তাঁর ছেলেদেরও ও দারুণ আরামে রাখবে— সপুত্রং বিবিধৈর্ভোগৈর্যোজয়িষ্যতি পূজয়ন্। অর্থাৎ যারা রাজ্য পেল না তাদেরও মনে কোনও দুঃখ থাকবে না।
রাস্তাঘাটে, রাজসভায়— চত্বরেষু সভাসু চ… গুণান্ সংসৎসু ভারত— এই কথাগুলি উপর্যুপরি জনগণের মুখে শুনতে পেলেন দুর্যোধন। তিনি সম্যক বুঝলেন— জনগণের পক্ষপাত সম্পূর্ণই যুধিষ্ঠিরের দিকে চলে গেছে। রাগে ঈর্ষায় জ্বলতে জ্বলতে তিনি পৌঁছলেন একা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, যে ধৃতরাষ্ট্র ক’দিন আগেই কণিক নামে এক মেকিয়াভেলিগোছের নির্মম রাজনীতিকের কানভাঙানি খেয়ে মনে মনে ঠিক করেছেন— পাণ্ডবরাই যত নষ্টের গোড়া— ওদের এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। এইরকম ধৃতরাষ্ট্রকে একা পেয়ে দুর্যোধন বললেন— কুরুরাজ্যের লোকজন— সবাই পাণ্ডবদের চায়। আপনাকে এমনকী ভীষ্মকেও বাদ দিয়ে তারা পাণ্ডবদের সিংহাসনে বসাতে চায়— পতিমিচ্ছন্তি পাণ্ডবম্। তারা বলে কিনা— মহারাজ পাণ্ডু নিজগুণে রাজ্য পেয়েছে, আর তুমি অন্ধ ছিলে বলে রাজ্য পেতে পেতেও হারিয়েছ। এখন পাণ্ডুর ছেলে পাণ্ডবরাই রাজা হবে। আবার পাণ্ডব যুধিষ্ঠির মারা গেলে তার ছেলে, সে মারা গেলে তার ছেলে— তস্য পুত্রো ধ্রুবং প্রাপ্তস্তস্য তস্যাপি চাপরঃ। এমনি করে বংশের পর বংশ ধরে আমরা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা কোনওদিন রাজ্য পাব না। সারাজীবন ছেলেপুলে নিয়ে এইভাবে যাতে পরের পিণ্ডির ওপর নির্ভর করে থাকতে না হয়, সেইরকম একটা ব্যবস্থা করুন, বাবা! ভাবুন তো, যদি পূর্বে আপনিই রাজ্য পেতেন, তা হলে আমাকে কেউ আটকাতে পারত, আমরাই রাজা হতাম এই কুরুরাজ্যে।
দুর্যোধন একান্তে তাঁর কথা জানাতে না জানাতেই সেখানে এসে পড়লেন কর্ণ, শকুনি, দুঃশাসন। দুর্যোধন এবার আরও স্পষ্ট করে বললেন— আপনি পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠিয়ে দিন, তা হলেই আর কোনও ভয় থাকবে না। ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে— কেন কী হল, ওরা তো ভালই চালাচ্ছে, সমস্ত খুঁটিনাটি আমাকে জানাচ্ছে, সব ব্যাপারে আমার মত নিচ্ছে— এমনি ধারা কথা বললেন। তাঁর কাছে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হল— লোকে কী বলবে? মন্ত্রী-সচিব এবং জনগণ— সবাই যাঁকে সমর্থন জানাচ্ছে— সেই যুধিষ্ঠিরকে এখন তিনি তাড়ান কী করে? দুর্যোধন বললেন— আজকের ভোটাকাঙ্খী রাজনৈতিক প্রবক্তা যে কথা সবসময় মনে মনে জানেন, সেই কথা বললেন। বললেন— আপনি আগে দেখেছেন যে, জনসাধারণকে টাকাপয়সা আর মৌখিক সম্মান দিলেই সব ঠিক হয়ে যায়। যাদের এতকাল পাণ্ডু টাকাপয়সা আর সম্মান দিয়ে পুষেছেন— তারা আজ আমার হাতে পড়ক, দেখবেন কালই তারা আমার পক্ষে কথা বলবে— ধ্রুবম্ অস্মৎসহায়াস্তে ভবিষ্যন্তি প্রধানতঃ।
বেশ বোঝা যাচ্ছে— দুর্যোধন রাজনীতির এই চালটা ভাল বুঝতেন। ভারতবর্ষের জনগণের রাজনীতি তিনি সম্পূর্ণ পাঠ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, দুর্যোধন নিজের ব্যক্তিত্বে এতটাই বিশ্বাস করেন যে, তিনি সব কথাই সবার সামনে অত্যন্ত জোরে বলেন। রাজনৈতিক ধুরন্ধরদের অন্তত এই সরলতা মানায় না। কিন্তু না মানালেও তিনি ছাড়বেন না। তিনি বললেন— আপনি পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠান— তারপর আমি রাজ্যে ভাল করে প্রতিষ্ঠিত হই, তারপর না হয় পাণ্ডবেরা সমাতৃক আবার ফিরে আসুন। ভাবটা এই— রাজ্য একবার পেলে জনগণকে এমন টাকাপয়সা খাওয়াব যে, পাণ্ডবরা ফিরে এলেও তখন পাত্তা পাবে না। দুর্যোধনের বুদ্ধি— এই কথাগুলি তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে শোনালেন মাত্র। তাঁর মনে ছিল আরও গভীরতর কৌশল। কিন্তু দুর্যোধন আর কতটুকু কৌশল করলেন! তাঁর চেয়ে গভীরতর কুটিলতার কথা হল— দুর্যোধনের কথা শুনেই ধৃতরাষ্ট্র ভাবলেন— ছেলে আমার মনের কথাটা একেবারে কেড়ে নিয়েছে। তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন— আমার মনের মধ্যেও ওই তোমার কথাটাই ঘুরঘুর করছে, দুর্যোধন! শুধু জিনিসটা অন্যায় বলে আমি কিছু বলিনি— দুর্যোধন মমাপ্যেতদ্ হৃদি সংপরিবৰ্ত্ততে।
মনে মনে ভ্রাতুস্পুত্রদের সর্বনাশ চেয়ে ফেললেও আগের জেনারেশনের লোক বলেই ধৃতরাষ্ট্রের মনে কিছু দ্বিধা কাজ করে। দুর্যোধন তো বলেই খালাস হয়ে গেলেন যে, পাণ্ডবদের কৌশলে পাঠিয়ে দাও বারাণবতে— নিপুণেনাভ্যুপায়েন… তান্ বিবাসয়তাং ভবান্। কিন্তু ব্যাপারটা কি অতই সোজা? যুবরাজের মতো যুধিষ্ঠির রাজ্যভার সামলাচ্ছেন, অন্য পাণ্ডব-ভাইদের সহায়তাও কিছু কম নয়। এই অবস্থায় হঠাৎ করে তাদের সবাইকে বারাণবতে পাঠিয়ে দিলে ভীষ্ম কী বলবেন, দ্রোণ কী বলবেন, কী বলবেন বিদুর এবং কৃপাচার্য? তাঁরা কেউ পাণ্ডবদের এই নির্বাসন বা বিবাসন মেনে নেবেন না— ন চ ভীষ্মো ন চ দ্রোণো ন ক্ষত্তা ন চ গৌতমঃ। ধৃতরাষ্ট্রের এই দুর্ভাবনার উত্তরে দুর্যোধনের সমাধান এই সময় দেখবার মতো। ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রী হলেও কৌরব-গৃহে থাকা এই বৃদ্ধবর্গের চরিত্র কতখানি পাঠ করে ফেলেছিলেন দুর্যোধন, সেটা ভাবলেও অবাক লাগে। অথচ এই বুদ্ধির যদি স্থিরতা থাকত এবং শত্রুর ক্ষতিটা অত তাড়াতাড়ি না চেয়ে সাম-দানের মাধ্যমে যদি তিনি ধীর পায়ে এগোতেন, তা হলে তাঁর ওই রাজনৈতিক চরিত্র-পাঠ আরও কার্যকর হত।
দুর্যোধন বলেছিলেন— পিতামহ ভীষ্মকে নিয়ে ভাবি না, তিনি মধ্যস্থ পুরুষ। মধ্যস্থ মানে সোজা কথায় উদাসীন। কিন্তু এখানে মধ্যস্থ বলতে যে অর্থ দাঁড়ায়, সেটা হল এই যে, পাণ্ডব-কৌরবদের সমান চোখে দেখেন ভীষ্ম। অর্থাৎ কিনা, কৌরব দুর্যোধন যদি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে একটা অন্যায় কাজ করেও তবে তিনি দুর্যোধনের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁকে কড়া শাস্তি দিয়ে ফেলবেন, এমনটা হবে না। ফলে ভীষ্ম তো খানিকটা উদাসীন থাকবেন, সেটা দুর্যোধন বুঝে গিয়েছিলেন এতদিনের নিরীক্ষায়। কেন না, তেমনটি হলে ভীমকে বিষ খাওয়ানোর পরেই দুর্যোধনের ব্যাপারে ভীষ্মের অসহ্যতা প্রকট হয়ে উঠত। কিন্তু তা হয়নি। অতএব পাণ্ডব-কৌরবের একতরের বিপন্নতায় অন্যতর ভীষণ শাস্তি কিছু পাবেন না।
দুর্যোধনের সবচেয়ে সঠিক পাঠ ছিল দ্রোণাচার্য সম্বন্ধে এবং তাঁর এই পাঠ পরবর্তীকালে ভীষণভাবে মিলে যাবে। দুর্যোধন বলেছিলেন— দ্রোণাচার্যকে নিয়ে আমি চিন্তাই করি না। কেন না দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামা পুরোপুরি আমার সঙ্গে আছে— দ্রোণপুত্রো ময়ি স্থিতঃ। আর ছেলের ওপরে দ্রোণাচার্যের এমনই টান যে, অশ্বত্থামা যেদিকে থাকবে, দ্রোণাচার্যও সেই দিকেই থাকবেন— যতঃ পুত্র স্ততো দ্রোণঃ ভবিতা নাত্র সংশয়ঃ। অন্যদিকে আচার্য দ্রোণ যেদিকে থাকবেন, সেইদিকে অবশ্যম্ভাবী থাকবেন কৃপাচার্য। কৌরব-গৃহের মধ্যে পরাশ্রিত এই গোষ্ঠীটি কীভাবে নিজেদের প্রাধান্য রেখেও দুর্যোধনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেন, তার প্রমাণ ভূরি ভূরি আছে। কিন্তু নিজের বিরুদ্ধে কৃপাচার্য এবং দ্রোণাচার্যের পরোক্ষ অথচ মৌখিক প্রতিবাদ সত্ত্বেও, এমনকী মাঝে মাঝে অশ্বত্থামারও অনেক হম্বিতম্বি সত্ত্বেও দুর্যোধন তাঁদের হৃদয় কতটা পড়ে ফেলেছিলেন, সেটা এই অল্প বয়সের মন্তব্য থেকেও কতটা স্পষ্ট হয়ে যায়! দুর্যোধন এটাও বুঝিয়ে দিলেন যে, ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ-অশ্বত্থামার এই সামাজিক অবস্থানের নিরিখে বিদুর যতই পাণ্ডবপক্ষপাতী হোন না কেন, তিনি নিজে একা কিছুই করতে পারবেন না। দুর্যোধনের এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাঁর পিতা ধৃতরাষ্ট্রেরও ছিল না। কিন্তু দুর্যোধন বড় তাড়াহুড়ো করেন, সবকিছুই তিনি এত তাড়াতাড়ি পেতে চান যে, পরিকল্পনার আগুন গনগন করে জ্বলে উঠেই নিভে যায়। বিদুর একা বলে দুর্যোধন যে তাঁর রাজনৈতিক এবং কূটবুদ্ধির সূক্ষ্মতা খাটো করে দেখছেন, সেটা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। একই সঙ্গে নিজের অধৈর্যের সঙ্গে পিতা ধৃতরাষ্ট্রের অধীর কামনা তাঁর পরিকল্পনাগুলিকে অনর্থক বেগবতী করে।
পিতা-পুত্রের অভিপ্রায় খোলাখুলি এক সুরে বাঁধা হল। নজরদারির রাজত্ব চালাতে গিয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মদত করতে আরম্ভ করলেন উচ্চাভিলাষী পুত্রের। দুর্যোধন প্রথম যে কাজটি করলেন, সেটা হল— কুরুরাজ্যের পৌরপরিজনের মধ্যে একশো ভাই একসঙ্গে প্রচুর টাকা-পয়সা ছড়াতে লাগলেন। দু’দিনের মধ্যেই তাদের মন জয় করে নিলেন তিনি— অর্থমানপ্রদানাভ্যাং সঞ্জহার সহানুজঃ। ওদিকে স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র তাঁর মন্ত্রীদের দিয়ে পাণ্ডবদের কাছে বারণাবত নগরের গুণ গাওয়াতে লাগলেন। ক’দিন যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের কাছে স্বয়ং প্রস্তাব করলেন বারণাবত যাবার ব্যাপারে। বললেন— এমন সুন্দর জায়গা নাকি আর হয় না, যদি ইচ্ছে হয়— তে তাতা যদি মন্যধ্বং— তো একবার ঘুরে এসো তোমরা। কয়েকদিন বেশ মজা করে কাটিয়ে এসো।
সব পাণ্ডব ভাই আর জননী কুন্তীকে নিয়ে যুধিষ্ঠির সবার কাছে অনুমতি নিলেন এবং দুর্যোধন তাঁকে বেশ ঘটা করে অনুগমন করে বিদায় দিলেন— অম্ববৰ্ত্তন্ত পাণ্ডবান্। এর পরের ঘটনা সবার জানা। পুরোচন নামে সেই লোকটাকে ডেকে দুর্যোধন বারণাবতের প্রত্যন্ত দেশে লাক্ষাগৃহ বানাবার পরিকল্পনা ছকে দিলেন। দাহ্যপদার্থ কীভাবে মিশেল দিতে হবে, কীভাবে তা ঢেকে দিতে হবে, কীভাবে সব খবর চেপে রাখতে হবে এবং পরিশেষে কীভাবে ঘরে আগুন দিতে হবে— তাও পুরোচনকে বলে দিলেন দুর্যোধন।
ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বারণাবত প্রসঙ্গে কথা বলার সময় দুর্যোধন বুঝিয়ে দিলেন যে, পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসিত করলে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ— এইসব বয়োবৃদ্ধেরা প্রাথমিকভাবে একটু অসন্তুষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের কৌরবপক্ষে ফিরিয়ে আনতে অসুবিধে হবে না। শুধু একটাই ঝামেলা ওই বিদুরকে নিয়ে— সে এই রাজপরিবারের খায়-পরে বটে, কিন্তু তাকে হাত করেছে অন্য পক্ষ— প্রচ্ছন্নং সংযতঃ পরৈঃ— অর্থাৎ পাণ্ডবরা। সে যাক গে যাক— ও একা পাণ্ডবদের পক্ষ নিয়ে আমাদের কিছুই করতে পারবে না— ন চৈকঃ স সমর্থোহম্মান্ পাণ্ডবার্থেহঅধিবাধিতুম্।
কিন্তু দুর্যোধনের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে বিদুর একাই পাণ্ডবদের বাঁচিয়ে দিলেন। শুধু সেই ম্লেচ্ছভাষায় যুধিষ্ঠিরকে ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, সময়মতো লোক পাঠিয়ে জতুগৃহ থেকে পাণ্ডবদের পালিয়ে যাবার জন্য সুড়ঙ্গ খোঁড়বার ব্যবস্থাও তিনিই করেছিলেন। দুর্যোধন আগে যতই লম্ফ-ঝম্প করুন না কেন, তাঁর প্যাঁচ এবার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। জতুগৃহে আগুন লাগার খবর ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরা পেলেন বটে, তবে সেটা ছিল ভুল খবর। আপাতত ধৃতরাষ্ট্র নিজেকে খুবই শোকাবৃত দেখালেন বটে, কিন্তু পাণ্ডবদেব শ্রাদ্ধক্রিয়াও করলেন খুবই ধূমধাম করে। কৌরববাড়ির সবাই বিলাপ করতে লাগল, পৌরপরিজনেরাও গলা মেলাল। এদের মধ্যে একটি মাত্র লোক খুব অল্পই শোকাবেগ প্রকাশ করলেন— তিনি বিদুর। কারণ তিনি আসল কথাটা জানতেন। দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ এবং শকুনি— এই দুষ্ট-চতুষ্টয়ের চক্রান্ত এবার ব্যর্থ হল, জয়লাভ করল বিদুরের ‘লবি’।
অবশ্য বিদুরকে আর বেশিদিন পাণ্ডবদের দেখে রাখতে হয়নি। রাজনৈতিকভাবে দুর্যোধন যে কতটা পর্যুদস্ত হলেন— তা পরিষ্কার হয়ে গেল দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বিয়ের পর। বস্তুত পাণ্ডবরা যে রাজনৈতিকভাবে খানিকটা এগিয়ে গেছেন— তা পাণ্ডবরা নিজেরাও বুঝতে পারেননি। বিদুর যে তাঁদের জন্য কতটা করেছেন, সেটা গঙ্গার তীরে বনে বসে যুধিষ্ঠির-ভীমরা বুঝতে পারেননি। মধ্যম পাণ্ডব ভীম তো কেবলই রাগে হাতে হাত ঘষে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শান্তাত্মা যুধিষ্ঠির তাঁকে মোটেই ইন্ধন জোগালেন না। দুর্যোধনের রাজনৈতিক হার হল এই কারণে যে, জতুগৃহ দগ্ধ হয়ে যাবার পর রাজ্যের নাগরিক পুরুষেরা দুর্যোধন এবং ধৃতরাষ্ট্রের পরিকল্পনা সম্বন্ধে যা-তা বলতে লাগল। দুর্যোধনের পক্ষে এর থেকেও বড় বিপদ হল— জতুগৃহে পাণ্ডবদের নিশ্চিত মৃত্যু হয়েছে কিনা— সেটা পরখ করার জন্য সুদূর দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ এসে পৌঁছলেন বারণাবতে। দগ্ধ জতুগৃহের ছাই উড়িয়ে তাঁর কেমন সন্দেহ হল। মহাভারতের পরিপূরক গ্রন্থ হরিবংশ বলেছে— কৃষ্ণও তাঁর পিসতুতো ভাইদের একটা লোকদেখানি শ্রাদ্ধ করলেন বটে, কিন্তু তিনি যে এ খবর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেননি— তার কারণ— তিনি পাকা গোয়েন্দার মতো বৃষ্ণিবীর সাত্যকিকে নির্দেশ দিলেন— পাণ্ডবদের অস্থি সংগ্রহ করার জন্য।
কৃষ্ণ শ্রাদ্ধ করলেন ধৃতরাষ্ট্রের লোকদের দেখাদেখি; কিন্তু ক’দিন পরে যখন দ্রৌপদীর স্বয়ংবর হল তখন সমস্ত রাজাদের মধ্যেও কৃষ্ণ ব্রাহ্মণবেশী পঞ্চপাণ্ডবকে একবার দেখেই চিনতে পারলেন এবং দাদা বলরামকে আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিলেন— ইনি যুধিষ্ঠির, উনি ভীম ইত্যাদি। কৃষ্ণ এর আগে পাণ্ডব-ভাইদের দেখেনওনি, শুধু বর্ণনা শুনেছেন এবং শুনেছেন জ্ঞাতিশত্রুতার কথাও। কিন্তু যে চেনার সে ঠিক চেনে। দুর্যোধন-দুঃশাসনেরাও দ্রৌপদীর আশায় পাঞ্চাল রাজ্যে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু পাণ্ডবদের তাঁরা চিনতে পারলেন না। দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় মালা দেবার পর যখন ভীম-অর্জুনের সঙ্গে সমস্ত রাজাদের যুদ্ধ বাধল, তখন অজ্ঞাত অর্জুনের বীরত্ব দেখে কর্ণ শুধু বলেছিলেন— মর্ত্যলোকে একমাত্র পাণ্ডব অর্জুন ছাড়া আমার সঙ্গে এমনি করে যুদ্ধ কেউ করতে পারত না। তা তুমি কে হে বাপু! অৰ্জুন বলেছিলেন, আমি ব্রাহ্মণ। কর্ণও নিঃসন্দেহে অর্জুনকে ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্বয়ংবর পর্বের পর দুটি লোক পাণ্ডবদের আবিষ্কার করলেন— একজন কৃষ্ণ, অন্যজন ধৃষ্টদ্যুম্ন।
পাণ্ডবদের নতুন করে আবিষ্কার করার দায় দুর্যোধনের ছিল না, কেন না তাঁদের নিশ্চিন্ত ধারণা ছিল— পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুনে মারাই গেছেন। দ্রুপদের পঞ্চাল-দেশে যাওয়াটাই সার হল। দুর্যোধন হস্তিনাপুরে ফেরার পথ ধরলেন, সঙ্গে কর্ণ, শকুনি-মামা, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং অবশ্যই দুঃশাসন। রাস্তায় কারও মুখে কোনও কথা ছিল না, শুধু নির্লজ্জ দুঃশাসন অস্পষ্ট বিরক্তিতে বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিলেন— যদি ওই বামুনটা না থাকত, তা হলে আর দ্রৌপদীকে পেতে হত না। সাঙ্গোপাঙ্গে ফিরতে ফিরতে দুর্যোধনরা সঠিক আন্দাজ করতে পারলেন না যে, অর্জুনই দ্রৌপদীকে জিতে নিয়েছেন— ন হি তং তত্ত্বতো রাজন্ বেদ কশ্চিদ্ ধনঞ্জয়ম্। অদ্ভুত ব্যাপার হল— গুপ্তচর মারফত এই খবরটা কিন্তু পঞ্চালে উপস্থিত সব রাজাদের কাছে চাউর হয়ে গেল যে, জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার ছক কষা হয়েছিল। তাঁরা সবাই ধৃতরাষ্ট্রের নামে ছি ছি করতে লাগলেন, এমনকী মহামতি ভীষ্মও তাঁদের মৌখিক লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পেলেন না। আর দুর্যোধন যে পুরোচন নামক লোকটিকে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন, তার সম্বন্ধে গালাগালি চলল বিস্তর। যুদ্ধ করেও দ্রৌপদীকে লাভ করতে না পেরে দুর্যোধন-দুঃশাসনরা প্রধানত ভাগ্যকে দোষ দিলেন, পাণ্ডবরা বেঁচে গেছেন বলে নিজের দোষ দেখলেন এইভাবে— যেন ভাগ্য যদি সহায় না হয় তা হলে পৌরুষ তাঁর কাজ করতে পারে না। এমন অবস্থায় পুরোচনকে গালাগালি দিতে দিতে — নিন্দন্তশ্চ পুরোচনম্— হস্তিনাপুরে প্রবেশ করা ছাড়া দুর্যোধনের আর কোনও গতি রইল না।
ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে কিছু বুঝতেই পারেননি। গুপ্তচরেরাও তাঁকে এসে কেউ কিছু বলেনি, কেননা এটা তাঁর রুচিকর সংবাদ নয়; অন্যদিকে দুর্যোধনরাও নিশ্চুপে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন বটে, কিন্তু পিতার কাছে কোনও কিছুই তাঁরা জানালেন না। ফলত ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে কিছু বুঝতেই পারেননি। অথচ যে বিদুরকে দুর্যোধন একা ভেবে অবজ্ঞা করছিলেন, তাঁর কাছে কিন্তু সব খবর চলে এসেছে। দ্রুপদ পাঞ্চালের সঙ্গে পাণ্ডবদের বৈবাহিক সংযোগ তাঁদের যে রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটিয়েছে, সেটা যে ধৃতরাষ্ট্র অগ্রাহ্য করতে পারবেন না, সেটা বুঝে নেবার সঙ্গে সঙ্গে বিদুর লক্ষ্য করলেন যে, দুর্যোধন এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীরা একেবারে চুপসে গেছেন— ব্রীড়িতান্ ধার্তরাষ্ট্রাংশ্চ ভগ্নদর্পানুপাগতান্। অবস্থা দেখে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে গিয়ে বললেন— মহারাজ! কুরুদের তো এবার বেশ বাড়-বাড়ন্ত হল— উবাচ দিষ্ট্যা কুরবো বর্ধন্তে ইতি বিস্মিতঃ।
বিদুরের কথার মধ্যে দ্ব্যর্থক শ্লেষ ছিল। কেন না, কুরু হলেন এই বংশের বিখ্যাত প্রাচীন পূর্ব-পুরুষ। বংশ-পরিচয়ে কৌরব দুর্যোধন যেমন নিজেকে কুরু বলে চিহ্নিত করতে পারেন, তেমনই পাণ্ডবরাও নিজেদের ওই একই আখ্যায় চিহ্নিত করতে পারেন। বিদুর এই হেঁয়ালিটুকু বজায় রেখে পাণ্ডবদের দিকে ইঙ্গিত করলেও কৌরব বলতে সাধারণ্যে যেহেতু দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইরাই বেশি পরিচিত, তাই ধৃতরাষ্ট্র নিজের দিকেই বিদুরের ইঙ্গিতটুকু গ্রহণ করে বললেন— হ্যাঁ তো! হ্যাঁ তো! এ তো আমাদের বিরাট সৌভাগ্য। ধৃতরাষ্ট্র গুপ্তচরের খবর জানেন না, হতদর্প পুত্রেরাও তাঁকে কিছুই জানায়নি। তিনি ভাবলেন– বড় ছেলে দুর্যোধনের সঙ্গেই বিদগ্ধা কৃষ্ণা পাঞ্চালীর বিয়ে হয়েছে— মন্যতে স বৃতং পুত্রং জ্যেষ্ঠং দ্রুপদকন্যয়া। ধৃতরাষ্ট্র আনন্দে দ্রৌপদীর জন্য বহুতর গয়না আনার আদেশ দিলেন, ডেকে আনতে বললেন পুত্র দুর্যোধনকেও। ধৃতরাষ্ট্র তখনও পর্যন্ত দুর্যোধনের হতাশার কথা কিছুই বুঝতে পারেননি।
মুহূর্তের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের ভুল ভেঙে দিলেন বিদুর। জানালেন— পাণ্ডবদের বরণ করেছেন দ্রৌপদী এবং বৈবাহিক সূত্রে এখন দ্রুপদ তাঁদের রাজনৈতিক মিত্রগোষ্ঠীর অন্যতম। সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে নিলেন ধৃতরাষ্ট্র। পাণ্ডবদের ব্যাপারে তো বটেই, এমনকী দ্রুপদের ব্যাপারেও তাঁর গলায় এখন অন্য সুর। সবারই একটু ভয় ভয় হল। ভয় হল এইজন্য যে, বৈবাহিক সম্বন্ধের খাতিরে দ্রুপদ এখন পাণ্ডবদের শ্বশুর এবং রাজশক্তি হিসেবে তিনি মোটেই ফেলনা নন। ধৃতরাষ্ট্র নিজেই বিদুরকে বললেন— এ জগতে কে আছে যে দ্রুপদকে বন্ধু হিসেবে না চায়। দ্রুপদের সম্বন্ধে ধৃতরাষ্ট্রের মুখে প্রশংসা শোনার পর দুর্যোধনের মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল। কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি সোজা বললেন— এ তোমার কীরকম খামখেয়ালিপনা। তুমি শেষে শত্রুর প্রশংসা আরম্ভ করলে? কোথায় তুমি দেখবে— যাতে পাণ্ডবরা আমাদের সমূলে গ্রাস না করতে পারে, সেখানে তুমি তাদের প্রশংসা আরম্ভ করলে।
বোঝা যাচ্ছে দুর্যোধন রাজনীতির গভীর চালগুলি কিছুই বোঝেন না, অন্তত অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র যতটুকু বোঝেন ততটুকুও নয়। পাণ্ডবরা বেঁচে আছেন শোনামাত্র তাঁর আর কোনও কাণ্ডজ্ঞান রইল না— মৃত পুরোচন, যাকে জতুগৃহে আগুন দেওয়ার ভার দওয়া হয়েছিল, তাকে গালাগালি দিয়েই তাঁর শ্রাদ্ধ করছিলেন দুর্যোধনেরা সবাই— নিন্দস্তশ্চ পুরোচনম্। এর ওপরে ধৃতরাষ্ট্রের ভাল্ভালাই দেখে দুর্যোধনের মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল। ধৃতরাষ্ট্র পরিষ্কার বললেন— তোমার মনে যা, আমার মনেও তাই, আমি বিদুরকে শুধু দেখাচ্ছিলাম মাত্র। তা তুমি বলো না— তোমরা কী ভাবছ? তোমার বন্ধু কর্ণই বা কী ভাবছে?
দুর্যোধন কিছুই ঠিক করতে পারছেন না। রাজ্যের নজরদার রাজাকে পিতা হিসাবে লাভ করেও যেখানে তাঁর অভীষ্ট এখনই পূরণ হচ্ছে না, অতএব তাঁর মাথাটাই গুলিয়ে গেল। তিনি বললেন— আজই কতগুলি ছদ্মবেশী বামুন দ্রুপদের রাজ্যে পাঠিয়ে কুন্তীর ছেলে আর মাদ্রীর ছেলেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করব। অথবা মহারাজ দ্রুপদ, তাঁর ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং পাঞ্চাল রাজ্যের মন্ত্রীদের এমনভাবে টাকা খাওয়াতে হবে, যাতে ওরা যুধিষ্ঠিরকে তাড়িয়ে দেয়। আবার এমনও করা যায় যে, সমস্ত ভাইদের মধ্যেই গোলমাল লাগিয়ে দাও। অবশ্য সংখ্যায় ওরা অনেক বলে শুধু একা সুন্দরী কৃষ্ণার মনে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে অবিশ্বাস গড়ে তুললেই কাজ হয়ে যায়— এবং সেটা করা অনেক সহজ।
দুর্যোধন বলেই যেতে থাকলেন। প্রস্তাবের পর প্রস্তাব, অন্যায়ের পর অন্যায়। শেষে মনের কথাটি তাঁর বেরিয়ে এল। আগেই বলেছি ভীমের ওপর দুর্যোধনের খুব রাগ। দুর্যোধন এবার বললেন— ওই ভীমটাকে আগে শেষ করুন তো, ওটাই পালের গোদা, প্রধানত ওই ভীমের ওপর ভরসা করেই পাণ্ডবরা আমাদের আগেও ‘কেয়ার’ করেনি— পুরা চাস্মান্ন মন্যতে, এখনও করে না। আমি বলছি— ওই ভীমটা মরলেই ওদের সব বল-ভরসা চলে যাবে, জীবনে আর রাজ্যটাজ্য চাইবে না। ওই যে আপনারা অর্জুন অর্জুন করেন, ওই ভীম ব্যাটা অর্জুনের পেছন থাকলে— পৃষ্ঠগোপে বৃকোদরে— তবেই অর্জুনের ক্ষমতা, নইলে ওই অর্জুন আমাদের কর্ণের নখের যুগ্যি নয়— রাধেয়স্য ন পাদভাক্। অথবা যদি এসব ঝামেলায় না যেতে চান— তা হলে বেশ ভাল ভাল কতগুলি মেয়েছেলে পাঠান, যাতে প্রত্যেকটি পাণ্ডবের মুখোশ খুলে পড়বে— সুন্দরী কৃষ্ণাও ওদের ছেড়ে চলে যাবে। অথবা ওই পাণ্ডবদের আনার নাম করে পাঠান কর্ণকে, তারপর রাস্তায় আমাদের লোক গিয়ে পাণ্ডবদের প্রত্যেককে গুমখুন করবে।
দুর্যোধন কথা শেষ করে সিদ্ধান্ত নিলেন— আপনাকে অনেকগুলি প্রস্তাব দিলাম, পিতা! এগুলির মধ্যে যেটা আপনার সবচেয়ে নির্দোষ মনে হয়— যস্তে নির্দোষবান্ মতঃ— সেইটাই করুন। তবে হ্যাঁ, যতদিন দ্রুপদের ওপরে পাণ্ডবদের ভরসা না বাড়ে, ততদিনই ওদের আটকে রাখা যাবে, তারপরে আর নয়।
দুর্যোধনের সমস্ত প্রস্তাব এক ঝটকায় উড়িয়ে দিলেন তাঁর বন্ধুবর কর্ণ। বললেন— তোমার বুদ্ধি কাজ করছে না দুর্যোধন— তব প্রজ্ঞা ন সম্যগিতি মে মতিঃ। ও সব কায়দা করে পাণ্ডবদের কিছুই করা যাবে না। পাণ্ডবরা যখন এই এতটুকু বাচ্চা ছিল সব, একটুও পাখা গজায়নি তাদের, তখনই তাদের কিছুই করা যায়নি। আর এখন বিদেশের মাটিতে তাদের পুরো পাখা গজিয়ে গেছে, এখন ওসব কায়দা করে কিছুই হবে না। কর্ণ দুর্যোধনের প্রস্তাবগুচ্ছ শুধু উড়িয়েই দিলেন না, তাঁর সিদ্ধান্ত কথঞ্চিৎ সংশোধনও করলেন। কর্ণ বললেন— শুধু দ্রুপদ নয়, আরও একজন আছে। যতক্ষণ কৃষ্ণ তাঁর যাদববাহিনী নিয়ে দ্রুপদের সঙ্গে যোগ না দেন, ততক্ষণই সময়, এর আগেই পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করো। দ্রুপদকে ঠান্ডা করে পাণ্ডবদের এখানে নিয়ে আসব— প্রমথ্য দ্রুপদং শীঘ্রম্ আনয়ামেহ পাণ্ডবান্।
কিন্তু এত প্রস্তাব, প্রতিপ্রস্তাব— কিছুতেই কিছু করা গেল না। ধৃতরাষ্ট্র সবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত বুঝতে পারলেন যে জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার দায় তাঁর ওপরে এমনভাবে চেপে গেছে যে, এখন পাণ্ডবদের একটু না তোষালে তিনি নিজেই বিপদে পড়বেন। স্বয়ং ভীষ্ম জতুগৃহের প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং ধৃতরাষ্ট্র নয়— সোজা দুর্যোধনকেই কথা শুনিয়ে বলেছেন— যেদিন থেকে শুনছি পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুনে মারা গেছে, দুর্যোধন! সেদিন থেকে আমি তোমার দিকে তাকাতে পারছি না। এখন যদি তুমি অর্ধেক রাজ্য পাণ্ডবদের ছেড়ে না দাও, তা হলে লোকে মৃত পুরোচনকে দুষবে না, দুষবে তোমাকে— যথা ত্বাং পুরুষব্যাঘ্ৰ লোকো দোষেণ গচ্ছতি। অতএব যদি ভাল চাও, তবে অর্ধেক রাজ্য পাণ্ডবদের দিতেই হবে— ক্ষেমঞ্চ যদি কৰ্ত্তব্যং তেষাম অর্ধং প্রদীয়তাম্।
কুরুকুলের বৃদ্ধদের চাপে, জনমতের চাপে আপাতত দুর্যোধনকে পিছু হটতে হল। দুর্যোধন নয়, বলা উচিত ধৃতরাষ্ট্রকে পিছু হঠতে হল। ধৃতরাষ্ট্রকে রীতিমতো নম্র হয়ে পাণ্ডবদের ডেকে আনতে হল এবং অর্ধেক রাজ্যও দিতে হল, যদিও এমন ভূসম্পত্তি তাঁদের দিলেন ধৃতরাষ্ট্র যে, সেখানে শস্য-সম্পদ কিছুই হয় না। কিন্তু দুর্যোধন লক্ষ করলেন যে, সেই ঊষর মরু রাজ্যেই খাণ্ডবপ্রস্থে পাণ্ডবদের প্রতিষ্ঠা করতে এলেন স্বয়ং কৃষ্ণ, যদিও তিনি তাঁকে একটুও পাত্তা দিলেন না, কেন না তাঁর প্রধান শত্রু হলেন ভীম, অর্জুন তাঁর কাছে কোনও বস্তুই নয়, কৃষ্ণ তো নয়ই। দুর্যোধন বুঝি আবার ভুল করলেন। দুর্যোধন কি লক্ষ করলেন না যে, এরই মধ্যে কৃষ্ণের বোন সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে হয়ে গেল! এমনকী খাণ্ডব বন দগ্ধ করে সেখানে যে বিশাল রাজপুরী নির্মাণ করা হল, সেখানেও যে কৃষ্ণের অবদান আছে, সেটাও তিনি অত ভাল করে অনুধাবন করলেন না। অনুধাবন করলেন না— যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের প্রাক্কালে প্রধানত কৃষ্ণের সহায়তায় সেকালের সবচেয়ে নামি রাজা জরাসন্ধকে বধ করলেন। এমনকী যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেও দুর্যোধনের মাথায় কিছুই ঢুকল না। রাজনীতির মঞ্চে কে কতটা উঁচুতে, কে কতটা নিচুতে খেলা করছেন— এসব তিনি কিছুই বুঝলেন না। বরঞ্চ মহারাজ যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তি উৎসবে ভালবেসে দুর্যোধনকে যে কাজে নিয়োগ করলেন, সেটাই তাঁর মন আরও বিষিয়ে তুলল।
যুধিষ্ঠির ভাবলেন— দুর্যোধন রাজা মানুষ, হস্তিনাপুরের রাজা বলে কথা— তাঁকে এমন একটা কাজ দিতে হবে, যাতে তাঁর বেশ ভাল লাগে, পাঁচজনে যাতে বেশ সম্মান করে কথা বলে। এই ভেবে তিনি দুর্যোধনকে বললেন— দেশ-বিদেশের রাজারা যে সব উপহার নিয়ে আসবে— সেগুলি সংগ্রহ করবে তুমি— দুর্যোধনস্তু অর্হণানি প্রতিজগ্রাহ সর্বশঃ। আচ্ছা, এর মধ্যে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কোনও চালাকি ছিল না তো? হয়তো ছিল, হয়তো ছিল না, আমাদের কেমন যেন সন্দেহ হয়, যুধিষ্ঠিরের ভাবটা ছিল এই— যাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলে, যাকে তোমরা কোনওদিন সামান্য মানুষের মর্যাদাও দাওনি, তাঁর প্রতিপত্তি কীরকম— সেটা একটু অনুভব করো।
দুর্যোধন অত কিছু তলিয়ে দেখলেন না, অনুভবও করলেন না। শুধু তাঁর বিস্ফারিত চোখে যুধিষ্ঠিরের সব কিছু ঈর্ষার আকারে ধরা দিল। এমনকী যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে অত বড় কাটা হয়ে গেল, শিশুপাল কৃষ্ণের হাতে মারা গেলেন, তবু যেন দুর্যোধনের কোনওদিকে মন নেই। যজ্ঞ শেষ হয়ে গেল। সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন, শুধু দুর্যোধন আর শকুনি থেকে গেলেন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভার ঐশ্বর্য পরিমাপ করার জন্য। সবাই সেই ঘটনাটা খুব মনে রাখেন— সেই যে সেই রাজবাড়ির মধ্যে এক জায়গায় স্ফটিকের উচ্ছ্বাস দেখে দুর্যোধন ভাবলেন বুঝি জল আর অমনি কাপড় তুলে চললেন, হোঁচট খেলেন এবং বুঝলেন— স্থলে জলভ্রম হয়েছে। আবার অন্যত্র জল থাকা সত্ত্বেও স্ফটিকের কৌশলে তিনি স্থল বলে ভাবলেন এবং মেজাজে গট গট করে চলতে গিয়ে কাপড়-চোপড় সহ জলে ধপাস করে পড়লেন— সবাসাঃ প্ৰাপতজ্জলে। মান-সম্মান একেবারে চুলোয় গেল। ঠিক এইরকম একটা জায়গায় দূর-দর্শনওয়ালারা দ্রৌপদীকে দিয়ে রাজবাড়ির অলিন্দ থেকে খিলখিল করে হাসিয়েছেন এবং এই অসভ্যতার শাস্তি হিসেবে দুর্যোধনকে দিয়ে রাজসভায় দ্রৌপদীর কাপড় খুলিয়েছেন। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি— দুর্যোধন জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদীর মুখ দিয়ে মন্তব্য করানো হয়েছে— অন্ধের ছেলে অন্ধ বটে, তাই এই অবস্থা। দূরদর্শনে এই মন্তব্যের শাস্তি বস্ত্রহরণে।
দূরদর্শনের এই পর্ব ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অত্যন্ত মর্মাহত করেছে। আমার মনে হয়েছে— বি আর চোপরাজি কি ব্যাসদেবের থেকেও বড় কবি, নাকি এর পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে? চলচ্চিত্র বা চিত্রায়ণের স্বার্থে যেখানে মূল কাহিনি বিকৃত বা অন্যরকম করা হয়, তার পেছনে পরিচালকের স্বার্থ থাকেই। কিন্তু চোপরা-মশাই যা করলেন তা কিন্তু হাস্যকর নয়, বরং অসদ্ উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। প্রথম কথা, মহাভারতের কবি অসমান-বৈরিতা কখনও পছন্দ করেন না। কাজেই দুর্যোধন হাস্যকরভাবে জলে পড়ে গেলে দ্রৌপদী হাসবেন কেন? আমি তো মনে করি— দ্রৌপদী এতটাই বিদগ্ধা যে, তিনি যদি ওই চত্বরে থাকতেন, তা হলে যারা এই কাণ্ড দেখে হেসেছিল, তাদের তিনি রমণীয়ভাবে শাসন করতেন। মহাভারতে দুর্যোধনের অবস্থা দেখে যিনি হেসেছিলেন— তিনি প্রথমত ভীম। অন্য ভাইরাও হেসেছিল, তবে যুধিষ্ঠির বাদে। মহাভারতের কবি জানেন— যাঁরা দুর্যোধনের কাণ্ড দেখে হাসলেন, তারা দুর্যোধনের মোকাবিলা করতে পারবেন। অনুচিত কিছু ঘটলে তাঁর জবাব দিতে কুণ্ঠিত হবেন না তাঁরা। কিন্তু এই পর্বে দূরদর্শনওয়ালারা দ্রৌপদীকে আমদানি করে তাঁকে দিয়ে যে হাসিটা হাসালেন— এর পেছনে বস্তাপচা হিন্দি-সিনেমার প্রভাব ছাড়াও আরও একটি কদুদ্দেশ্য আছে। পরিচালক জানতেন না যে, মহাভারতের পুরুষশাসিত সমাজটি অন্তত তাঁর আপন সৃষ্ট মহাভারত-সমাজ থেকে অনেক বেশি উন্নত ছিল। বি আর চোপরা তাঁর স্খলিত বুদ্ধি অনুযায়ী দ্রৌপদীকে দিয়ে যে মন্তব্য করিয়েছেন, তাতে পরবর্তী সময়ে তাঁর বস্ত্রহরণের দায় দ্রৌপদীর ওপরেই পড়েছে। যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলায় অন্যায় এবং দুর্যোধনের বিকৃত স্বভাব— যা দেখানো মহাভারতের কবির উদ্দেশ্য ছিল— সেটা চেপে গিয়ে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কারণ হিসেব দ্রৌপদীর পূর্ব মন্তব্যকেই দায়ী করা আমার মতে গভীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আজকের প্রগতিশীল নারী-পুরুষেরা নারী-মুক্তির জন্য যেখানে প্রায়শই সোচ্চার হচ্ছেন, সেখানে দ্রৌপদীর মুখ দিয়ে অশালীন মন্তব্য করিয়ে তাঁরই ঘাড়ে অন্যের অন্যায়ের দায় চাপানো আমার মতে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। বস্তুত মহাভারতের সমাজে যে যা অন্যায় করেছেন, তার প্রাপ্য শাস্তি তারা নিজেরাই বহন করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে দ্রৌপদীকে কলঙ্কিত করে যুধিষ্ঠির কিংবা ভীমকে বাঁচানোর যে অপচেষ্টা— এটা এখনকার পুরুষশাসিত সমাজের কতখানি পৌরুষ প্রকাশ করে— তা চোপরা-পুঙ্গবেরা ভেবে দেখতে পারতেন।
থাক এসব কথা। এতদিন পরে দুর্বুদ্ধি চিত্র-পরিচালকের অভব্যতা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। আমরা দুর্যোধনের প্রসঙ্গে আসি। স্ফটিকের ভ্রমে দুর্যোধন জলে পড়ে গেলেন এবং পড়া মাত্রই ভীমের প্রচণ্ড হাসি পেল, এমনকী তাঁর চাকর-বাকরেরাও হেসে উঠল। দুর্যোধনকে সঙ্গে সঙ্গে নতুন কাপড়, নতুন উত্তরীয় দেওয়া হল বটে, তবে ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব কেউই যুবক এবং দাম্ভিক যুবরাজের হঠাৎ জলে-পড়া দেখে হাসি চাপতে পারলেন না— …ভীমসেনো মহাবলঃ। অর্জুনশ্চ যমৌ চোভৌ সর্বে তে প্ৰাহসংস্তদা।
পাণ্ডবদের সভাগৃহে বারবার অপ্রস্তুত হলেও সেটাই যে দুর্যোধনের মনে দাগ কেটে বসল— এত অল্পসত্ত্ব তিনি নন। বরঞ্চ পাণ্ডবদের ওই বিরাট ঐশ্বর্য দেখে পরশ্রীকাতরতায় জ্বলতে জ্বলতে কেবলই ভাবতে লাগলেন, ভাবতে লাগলেন— কেমন করে এমনটি হল, কেমন করেই বা পাণ্ডবদের জব্দ করা যায়— পাণ্ডবশ্রী-প্রতপ্তস্য ধ্যায়মানস্য গচ্ছতঃ। এত ঋদ্ধি, এত মর্যাদা, এত লোকরঞ্জন— সবই তাকে বিপর্যস্ত করে তুলল। আনমনা ভাবতে ভাবতে তাঁর সোনার মতো গায়ের রং— তাও কালি হয়ে গেল— বিবর্ণঃ সমপদ্যত। হস্তিনাপুরে ফিরে তিনি সবার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন। শকুনি তাঁকে কেবলই খুঁচিয়ে তোলেন— কী হল, দুর্যোধন? এত ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ার কী আছে? আমাকে বলোই না কী হয়েছে? অনেক সাধাসাধি, ধরাধরির পর দুর্যোধন একান্তে শকুনির কাছে মুখ খুললেন।
দুর্যোধন বললেন— সমস্ত দুনিয়া এখন ওই যুধিষ্ঠিরের হাতের মুঠোয় চলে গেছে— পৃথিবীং কৃৎস্নাং যুধিষ্ঠিরবশানুগাম্— এবং তা গেছে ওই অর্জুনের ক্ষমতায়। আর কী যজ্ঞটাই না করল মামা— স্বর্গের দেবতাও হার মানবে। এসব দেখে রাগে আমার সারা শরীর দিনরাত পুড়ে যাচ্ছে। বোশেখ-জষ্টির কাঠফাটা রোদ্দুরে যেমন অল্প জলের জায়গাগুলি শুকিয়ে খাঁক হয়ে যায়, তেমনি পাণ্ডবদের জন্য যেটুকু স্নেহপদার্থ— কিছুই নেই— তবু যেটুকু স্নেহ মায়া আমার মনের মধ্যে ছিল, তাও শুকিয়ে যাচ্ছে রাগের দহন-জ্বালায়— শুচিশুক্রাগমে কালে শুষ্যেৎ তোয়মিবাল্পকম্।
হ্যাঁ, এই রাগ এবং অপমানের মধ্যেও দুর্যোধনের সামান্য খেয়াল আছে যে, রাজনৈতিকভাবেও পাণ্ডবরা খানিকটা এগিয়ে গেছেন। তিনি শুধু লক্ষ করেছেন— সাত্ত্বতবংশের প্রধান পুরুষ কৃষ্ণ যজ্ঞসভায় দাঁড়িয়ে শিশুপালকে সোজা সহজভাবেই মেরে ফেললেন এবং সেখানে একটি মানুষও শিশুপালের হয়ে কিছুই করতে পারেননি। — ন চ তত্র পুমান্ আসীৎ কশ্চিত্ তস্য পদানুগঃ। পাণ্ডবদের ক্ষমতার আগুনেই দেশ-দেশান্তের রাজারা যেন পুড়ে যাচ্ছেন, তাঁরা নিরুপায় হয়েই যেন এই অপরাধ ক্ষমা করলেন।
দুর্যোধনের দোষ হল— তাঁর ব্যক্তিগত ঈর্ষা, ব্যক্তিগত ক্রোধ এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রভুত্বের ইচ্ছা সবসময় এতই তাঁকে পীড়া দেয় যে, বড় বড় রাজনৈতিক পালাবদলগুলি তাঁর নজর এড়িয়ে না গেলেও, সেগুলি যথাযথ গুরুত্ব লাভ করে না। তিনি বুঝলেন না— জরাসন্ধের মতো প্রবল পরাক্রান্ত রাজা, যিনি দু’দিন আগেও সমস্ত রাজমণ্ডলকে অঙ্গুলিহেলনে ওঠাতেন বসাতেন, এমনকী দুর্যোধনকেও উঠিয়েছেন বসিয়েছেন— সেই জরাসন্ধ মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের যজ্ঞসভায় নতুন দিনের নায়ক হিসেবে কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দান করা হয়েছে। দুর্যোধন বুঝলেন না— কুরুদের বৃদ্ধতম লোকটি অর্থাৎ ভীষ্ম— এই অর্ঘ্যদানের ব্যাপারে একমত হয়েছেন এবং তার প্রতিবাদ করতে গিয়েই শিশুপাল মারা পড়লেন, সেই শিশুপাল— যিনি জরাসন্ধ বেঁচে থাকতে ডাইনে বাঁয়ে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। কিন্তু জরাসন্ধ মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে শিশুপাল তাঁর হাজার হাজার পুরনো সমর্থকদের সামনেই মারা পড়লেন; কারণ রাজারা, বিশেষত সাধারণ সামন্ত রাজারা জানেন যে, জরাসন্ধের মৃত্যু ঘটনার সম্পূর্ণ বুদ্ধিটাই হল কৃষ্ণের এবং পাণ্ডবরা তাঁর হন্তা। এরকম ক্ষেত্রে সাধারণ রাজারা স্বভাবসিদ্ধভাবে বিজেতার বশ্যতা স্বীকার করেন। এখানেও কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবরা সেই সম্মান পেয়েছেন এবং তার ফলে শিশুপাল কারও কাছে কোনও সোচ্চার সমর্থন পাননি।
দুর্যোধন কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনটা বুঝেছেন মাত্র অথচ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যেটা রাজনৈতিকভাবে করণীয় ছিল— সেটা কিন্তু তিনি করলেন না। উলটে একান্ত ব্যক্তিগত ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতায় দুর্যোধন শকুনিকে বলতে লাগলেন— সমস্ত সামন্ত রাজারা ধনরত্নের হাজারও পসরা সাজিয়ে ব্যবসাদারদের মতো যুধিষ্ঠিরকে কীরকম তোষানোর চেষ্টা করছিল। এই ছিরি দেখে— শ্রিয়ং তথাগতাং দৃষ্ট্বা— আমার গা একেবারে জ্বলে যাচ্ছে। এসব দেখার থেকে আমার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরা ভাল। আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব, মামা, আমি জলে ডুবে মরব— বহ্নিমেব প্রবেক্ষ্যামি ভক্ষয়িষ্যামি বা বিষম্৷ পৃথিবীতে এমন কোনও ভদ্রলোক আছে— যে শত্রুর উন্নতি দেখেও নিজে হীন অবস্থায় বেঁচে থাকে? আসলে আমার অবস্থাটা কী হয়েছে জানো তো মামা— আমি একটা মেয়েছেলেও নই, আবার না-মেয়েছেলে— তাও নই, একজন পুরুষ-মানুষও নই, আবার না-পুরুষ যে, তাও নই— সোহহং ন স্ত্রী ন চাপ্যস্ত্রী ন পুমান্ নাপুমানিতি। শকুনি বলবেন— এ আবার কেমন হেঁয়ালি হচ্ছে? দুর্যোধন বলবেন— আমি একজন স্ত্রীলোক নই এইজন্য যে, স্ত্রীলোক হলে নিরুপায় হয়ে অগত্যা শত্রুর মতো সতিনকাঁটা সহ্য করতে হয়, আমার তো সেই নিরুপায় অবস্থা নয়; আবার আমি যে না-মেয়েছেলে— অর্থাৎ পুরুষ-মানুষ— তাও নয়। কেন না— পুরুষ-মানুষ হলে যুদ্ধ করে পাণ্ডবদের জয় করার প্রশ্ন আসে। কিন্তু না-মেয়েছেলে অর্থাৎ পুরুষ মানুষ হলেও অর্জুনের মতো অস্ত্রবল আমার নেই। যদি বলো— তা হলে সেই অস্ত্রবলের দিকেই মন দাও, তা হলে বলতে হবে— আমি পুরুষই নেই, কেন না পুরুষ-মানুষ হলে অর্জুনের মতো উৎকৃষ্ট অস্ত্রবলের অধিকার থাকত আমার। যদি বলো— পুরুষ যখন নও, তা হলে কি ক্লীব? তা হলে বলব— আমি যে ক্লীব, তাও নয়— কারণ একটু একটু ক্ষমতা যে আমার নেই— তা তো নয়— নাপি অত্যন্তম্ অসমর্থোস্মীতি।
টীকাকার নীলকণ্ঠ এতক্ষণ দুর্যোধনের শোকের হেঁয়ালিতে বাঁধা পড়েছিলেন। এবারে শ্লোক ব্যাখ্যা করে শেষে সিদ্ধান্ত করলেন— আসলে দুর্যোধন বিষও খেতে চান না, জলেও ঝাঁপ দিতে চান না। এই যে দুর্যোধন বললেন— একটু একটু ক্ষমতা যে নেই— তা তো নয়— নাপুমানিতি— তার মানে ওই ক্ষমতাটা সোজা-সরল নয়। ঠিক ওইখানেই ইঙ্গিতটা আছে কূটবুদ্ধি শকুনির প্রতি। দুর্যোধনের লক্ষ্য কখনও রাজনৈতিক নয়, তাঁর শুধু চাই যুধিষ্ঠিরের মতো প্রভুত্ব, যুধিষ্ঠিরের মতো টাকা-পয়সা, উপহার— ঈশ্বরত্বং পৃথিব্যাশ্চ বসুমত্তাঞ্চ তাদৃশীম্। দুর্যোধন শকুনিকে কুটিল ইঙ্গিত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পুরাতন কুটিলতাগুলি সম্বন্ধে স্বগতোক্তির মতো করে বলেছেন— ওদের বিপাকে ফেলবার জন্য আমি আগেও অনেক চেষ্টা করেছি— কৃতো যত্নো ময়া পূর্বম্— কিন্তু সবকিছু অতিক্রম করে পাঁকে-পড়া পঙ্কজ পদ্ম যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি সমস্ত বিপাকের পাঁক কাটিয়ে উঠে ওই পাণ্ডবেরাই পাঁকের মধ্যে পদ্মটির মতো ফুটে রয়েছে। কিন্তু সত্যি আমি আর পারছি না, ওই সভা, ওই টাকা-পয়সা… ওঃ ভাবতেই আবার আমার গা জ্বলে যাচ্ছে— পরিতপ্যে যথাগ্নিনা।
দুর্যোধনের সব কথা শুনে শকুনি বললেন— সবই কপাল, ভাগ্নে, সবই কপাল। তুমি তো ওদের দমিয়ে রাখার কম চেষ্টা করনি, কিন্তু কপালে ওরা সবাই বেরিয়ে গেছে— ভাগধেয়পুরস্কৃতাঃ। শেষে দ্রৌপদীর মতো সুন্দরী বউ পেল, দ্রুপদের মতো মহাবীর শ্বশুর পেল, কৃষ্ণের মতো নেতাকে সহায় হিসেবে পেল, এমনকী বাপের সম্পত্তির অংশও পেয়ে গেল। তবে কী জানো— এগুলির জন্য অনুশোচনা করে লাভ নেই। তা ছাড়া তোমার পক্ষেও তো বীর কম নেই— ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ— আরও কত কে। দুর্যোধন কিন্তু বললেন— এঁদের কাউকেই আমার প্রয়োজন নেই মামা। আমি তোমার সহায়তায় ওদের রাজ্যপাট সব জিতে নিতে চাই। শকুনি বললেন— একথা অবশ্য ঠিক যে, ভীম, অর্জুন— ইত্যাদি মহারথ বীরেরা যে পক্ষে যুদ্ধ করবেন, তাঁদের সঙ্গে পেরে ওঠা খুব কঠিন। তবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কাউকে কোনও কষ্ট না দিয়ে যদি পাণ্ডবদের জিতে নিতে হয়, তবে একটা উপায় আছে এবং সেটা আমিই জানি। এই যে রাজা যুধিষ্ঠির— ও পাশা খেলতে খুবই ভালবাসে, কিন্তু খেলায় জেতার কৌশল জানে না। পাশা খেলতে ডাকলে রাজা যুধিষ্ঠির কিছুতেই নিজেকে সংযত করতে পারবেন না। অন্যদিকে পাশাখেলায় আমাকে হারাবে— এমন কেউ এখনও জন্মায়নি। অতএব তুমি যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলতে ডাক— ওর রাজ্যপাট, টাকা পয়সা সব জিতে আমি তোমাকে দেব। তুমি শুধু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে রাজি করাও। দুর্যোধন বললেন— আমি নয়, মামা, তুমি আগে কথা বল ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে, তারপর তো আমি আছিই।
এই সব বাঁকগুলোতে দুর্যোধনের চরিত্র বড় অদ্ভুত লাগে আমার। যেন বিরাট একটা বিপরীত সত্তা-সংস্থান কাজ করে তাঁর মধ্যে। বিশেষ বিশেষ কত ক্ষেত্রে আমরা দুর্যোধনের যুদ্ধশ্লাঘা, মৌখিক অহংভাব এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের আড়ম্বর দেখে মুগ্ধ হই, কিন্তু পর-মুহুর্তেই কেমন এক বিভ্রান্তি কাজ করে। এই অহংকারী দুর্যোধনই একদিন ভীমকে সবার অলক্ষ্যে বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছিলেন। এই মানুষটাই বারণাবতে নিজের ঘাতক গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন জতুগৃহের আগুনে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্যে। আবার দেখুন, এই দুর্যোধনই এখন ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডব-সভা দেখে এসে মৎসরতায় কাতর, তিনি এখন সম্মুখ-বিরোধের ভাবনা ত্যাগ করে শকুনির ছলের বল আশ্রয় করছেন শত্ৰু-শাতন করার জন্য। দুর্যোধনের নীচতম সত্তা এখানে কাজ করে, ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা অথবা উদ্দাম যুদ্ধৈষণার বিপরীতে এই যেন-তেন-প্রকারের অনৈতিক কৌশল আমাদের বিভ্রান্ত করে। ক্ষত্রিয়ের দুর্মদ সাহংকার অভিব্যক্তি ছেড়ে শকুনির পাশায় পাণ্ডবদের রাজ্য জেতার জন্য কী অদ্ভুত বিপরীত উৎসাহ দেখাচ্ছেন দুর্যোধন। কীভাবে বলছেন— তুমি যদি আমার সহায় হও, মামা! তবে এই সমস্ত পৃথিবী আমার হবে, সমস্ত রাজারা থাকবেন আমার শাসনে। আর ওই যে ইন্দ্রপ্রস্থের মহার্ঘ সভা, সে-সভাটিও হবে আমার— সর্বে চ পৃথিবীপালাঃ সভা যা চ মহাধনা।
ভাগনে দুর্যোধনের ওপর মায়ায় মামা শকুনি শেষ পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্রের কাছে উপস্থিত হলেন। পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহ আকর্ষণ করার জন্য শকুনি সোজাসুজি অক্ষক্রীড়ার প্রসঙ্গে না গিয়ে প্রথমে ভণিতা করে বললেন— মহারাজ! পুত্র দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন একবারও। কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে তার চেহারা, গায়ের রং ফ্যাকাশে আর শরীরটাও তো রোগা হয়ে গেছে, ভীষণ রোগা— দুর্যোধনো মহারাজ বিবর্ণো হরিণঃ কৃশঃ। সব সময় যেন কী একটা ভেবে যাচ্ছে। আপনি কিন্তু মহারাজ! আপনার বড় ছেলেটার দিকে একেবারেই নজর দিচ্ছেন না। নইলে, ওর মনের মধ্যে যে কী হচ্ছে একবারও একটু ভেবে দেখলেন না— জ্যেষ্ঠপুত্রস্য হৃচ্ছোকং কিমর্থং নাব্বুধ্যসে?
ধৃতরাষ্ট্র এ-কথা শুনে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন। তবে তিনি ছেলের অন্তর বোঝেন না, এটা বোধহয় ঠিক নয়। কেন না তাঁর নিজের মনের মধ্যেও তো ওই একই মাৎসর্য। ছেলেকে ডেকে তিনি বললেন— শকুনির কাছে শুনলাম— তোমার নাকি অনেক কষ্ট। তা কীসের জন্য এত কষ্ট, সেটা একবার আমায় বলা যায় কি— দুর্যোধন কুতো মূলং ভূশমার্তোহসি পুত্রক? ধৃতরাষ্ট্র জানেন— পরশ্রী, পরের উন্নতি বাইরে থেকে যতটুকু দুর্যোধনকে দগ্ধ করে, অন্তরে তার প্রতিফলন আরও শতগুণ, কেন না সেখানে তিনি বাইরে দেখা শত্রুকুলকে হত্যা করতে থাকেন। ধৃতরাষ্ট্র আপন অন্তর দিয়ে এটা বোঝেন বলেই ছেলের কষ্টটা নিজে থেকেই বলেন না প্রথমে, বরঞ্চ একটু উলটো সুরেই কথা আরম্ভ করেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন— শকুনি বলছে তোমার মনে নাকি অনেক কষ্ট, তা তোমার কীসের এত কষ্ট, বাছা! ভাল জামা-কাপড় পরছ, মাংস-পোলাও খাচ্ছ— আচ্ছাদয়সি প্রাবারাণ্ অশ্লাসি পিশিতৌদনম্— যেখানে খুশি বেড়াতে যেতে পারছ, নরম বিছানায় স্ত্রীলোকেরও অভাব নেই কোনও— শয়নানি মহার্হানি যোষিতশ্চ মনোরমাঃ— তবু কীসের এত কষ্ট তোমার? স্বয়মাগত এইসব ভোগ-বিলাসের কথা, যেমনটি ধৃতরাষ্ট্র বোঝাচ্ছেন, সেটা যদি শুধু বাইরের আড়ম্বর বলে ধরে নিই, তবু বলতে হবে, তার চেয়েও সার্থক তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিসর। মহাভারতের কবির আলংকারিক স্ফুরণের অন্যতম বাঙ্ময় উপমাটি ব্যবহার করে ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন— দেবতাদের কথায় ‘তথাস্তু’ বা অন্য শব্দ যেমন মুখ থেকে বেরোলেই ফল হয়, তেমনই তোমার বাক্য তো এই কুরুরাজ্যে সেইভাবে পালিত হয়। তোমার ঈপ্সিত কর্মের পালন-ব্যাপারটা তোমার বাক্য উচ্চারণের মুহূর্তের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট, সেই রকম একটা মানুষের আবার কষ্ট আসে কোত্থেকে— দেবানামিব তে সর্বং বাচি বদ্ধং ন সংশয়ঃ।
পুত্রের উদ্দেশে যতই সাক্ষেপ বচন উচ্চারিত হোক ধৃতরাষ্ট্রের মুখে, আজন্ম-অভিমানী এই পিতাকে চেনেন দুর্যোধন। অতএব ধৃতরাষ্ট্রের ছেলে-ভোলানো কথার অন্তে দুর্যোধন বাবা-ভোলানো কথা বলতে আরম্ভ করলেন অভিমানের সপ্তম সুরে। বললেন— ভাল খাওয়া! ভাল পরা! যে-সব পুরুষ শুধু ভাল খাওয়া-পরা পেয়েই সুখীও হয়, তাদের মতো অধম কুপুরুষই তো আমি— অশ্নাম্যাচ্ছাদয়ে চাহং যথা কুপুরুষস্তথা— তবে হ্যাঁ, মনের মধ্যে হাজার দুঃখ নিয়েও আমি শুধু সময়ের অপেক্ষা করছি। ভাল খাওয়া! ভাল পরা! আপনি পুরুষের কথা বলছেন তো পিতা! একটা কথা ভাবুন, আমার রাজ্যের প্রজাদের যদি অন্য লোকে আপন বলে ভাবে, সেটা যে সহ্য করে না, সেই তো পুরুষ— আমি সেই পুরুষ হতে চাই। এমনকী তাকেও আমি পুরুষ বলতে রাজি আছি, যিনি অন্তত প্রজাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য আপাতত আশায় বুক বেঁধে শত্রুর জ্বালা সহ্য করছেন এবং প্রতিকার করার চেষ্টা করছেন।
কোন রাজ্যের প্রজাকে কোন রাজা নিজের মনে করছেন— দুর্যোধনের কথা শুনলে চমকে উঠতে হয়। হস্তিনাপুরের এলাকা ছেড়ে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের ‘রিহ্যাবিলিটেট্’ করেছিলেন অতিহীন খাণ্ডবপ্রস্থে। সে জায়গাটা পাণ্ডবদের প্রচেষ্টায় এবং গুণে ইন্দ্রপ্রস্থে পরিণত হতেই সে রাজ্যের প্রজারা এখন দুর্যোধনের তাৎক্ষণিক প্রজা-রঞ্জক মানসে একান্ত আপন হয়ে উঠছেন— মানুষের আগ্রাসনী বৃত্তি কোন স্তরে পৌঁছলে এমন মাৎসর্য তৈরি হয়। যদিও দুর্যোধন এটাকেই বিজিগীষু রাজার একান্ত ধর্ম বলে মনে করেন এবং এটাকেই পৌরুষ বলে মনে করেন— মহাভারতীয় রাজনীতি-শাস্ত্রের একাংশ, বিশেষ করে কণিক-নীতিতে এই আগ্রাসন ন্যায়সঙ্গত বলেই দুর্যোধন পিতাকে বললেন— জীবনের চলার পথে সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা সব নষ্ট করে দেয়। ঐশ্বর্য-সম্পদ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা-অভিমান সব নষ্ট হয়ে যায় যদি সন্তুষ্টি এসে যায় মনে। আর দয়া, ভয় এগুলো যদি কাজ করতে থাকে, তা হলে আর জীবনে বড় হতে হবে না কোনও দিন— যৈর্বৃতো নাশ্নুতে মহৎ।
রাজনীতিতে সন্তুষ্টি মানায় না— এই সাধারণ কথাটা বলেই দুর্যোধন সোজা ভাষায় জানালেন কেন তাঁর গা জ্বলছে এত। ভাল খাওয়া, ভাল পরা— এত সব সন্তুষ্টির কথা দুর্যোধনকে বলেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু সাধারণের এই সাধারণ সম্পদ-প্রাপ্তি দুর্যোধনকে সন্তুষ্ট করে না। তাঁর নিজের কথায়— সাধারণ সুখ আর সাধারণ বিত্তে আমার কোনও তুষ্টি নেই— ন মাং প্রীণাতি রাজেন্দ্র লক্ষ্মীঃ সাধারণী বিভো— তাও যদি আমি যুধিষ্ঠিরের ঘরে বসে না দেখতাম যে, সুখ আর বিত্ত কত বিপুল হতে পারে! আমাকে বলছিলে না— আমি রোগা হচ্ছি কেন, গায়ের রং ফ্যাকাশে কেন! আমি বলছি— যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমান রাজলক্ষ্মী আমাকে বিবর্ণ করে দিয়েছে, আমি সহ্য করতে পারছি না আর— তস্মাদহং বিবর্ণশ্চ দীনশ্চ হরিণঃ কৃশঃ। শুধু নিজের মৎসরী অসহনীয়তার সিদ্ধান্ত জানিয়েই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের ঐশ্বর্য তাঁকে বিপ্রতীপভাবে মুখর করে তুলল। দুর্যোধন বললেন— কী না দেখেছি আমি যুধিষ্ঠিরের বাড়িতে? আশি হাজার স্নাতক বামুন গৃহস্থ হয়ে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যে আছে। যুধিষ্ঠির তাদের ভরণ-পোষণ করছেন নির্বিবাদে এবং এক-একটা গেরস্ত-বামুনের বাড়িতে সেবা করার দাসী দিয়েছেন তিরিশটা করে॥
দুর্যোধনের ঈর্ষা-কাতর পরশ্রী-বর্ণনায় কাম্বোজ দেশের রাজার পাঠানো ষোলোটা নীল কালো এবং ঈষৎ লাল মসৃণ পট্টবস্ত্র যেন চোখ টাটানোর মতো উজ্জ্বল ভাবে ধরা দিয়েছে। হাতি, ঘোড়া, উট এবং যজ্ঞে আহৃত ধনের উপহার, বিভিন্ন বৈদেশিক বস্তু এবং হাজার হাজার প্রত্যন্ত রাজাদের বশ্যতা এবং রাজকর দেবার বহর দেখে দুর্যোধন আর স্থির থাকতে পারছেন না। মুখে তিনি স্বীকার করে ফেলছেন সরল মাৎসর্য-পরায়ণ নীচ ব্যক্তির মতো— আমি এইরকম টাকা-পয়সার আমদানি কোনও দিন দেখিওনি, কোনও দিন শুনিওনি— ন ক্বচিব্ধি ময়া দৃষ্টস্তাদৃশো বৈ ন চ শ্রুতঃ। তার মধ্যে আবার এমন সব বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছে, তাতে দুর্যোধনের মাথা আরও আরও খারাপ হয়ে গেছে। যুধিষ্ঠির নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে, এক লক্ষ নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের খাওয়া শেষ হলে একবার করে শঙ্খধ্বনি করা হবে। তা এই শঙ্খ পর পর এতবার বেজেছে, এতবার লক্ষ লক্ষ ভোজন শেষের ইঙ্গিত দিয়েছে যে, রাগে দুর্যোধনের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে।
যুধিষ্ঠিরের সভায় আহৃত বিপুল ধনরাশি দেখে এতই গা পুড়ছে দুর্যোধনের যে, অতি সরল মানসিকতায় তিনি বারবার বলে উঠছেন পিতার কাছে— আমি শান্তি পাচ্ছি না, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না— শান্তিং ন পরিগচ্ছামি দহ্যমানেন চেতসা। এই কথার মধ্যেই এসে পড়ল যুধিষ্ঠিরের সরল কৌশলের বুদ্ধিটিও। দুর্যোধন পিতাকে বললেন— তোমরা তো ভাবছ— কুরু-ভাইদের মধ্যে আমি জ্যেষ্ঠ বলে, রাজাদের মধ্যে আমি শ্রেষ্ঠ বলে যুধিষ্ঠির আমাকে কত না আদর করে অন্য রাজাদের আনা উপহার-সামগ্রী গুছিয়ে রাখতে বলেছে— জ্যেষ্ঠোহয়মিতি মাং মত্বা শ্রেষ্ঠশ্চেতি বিশাম্পতে। কিন্তু এর মধ্যেও ওর বজ্জাতি আছে। দেশ-বিদেশের রাজাদের আনা উপহারের সম্ভার দেখে যাতে আমার চোখ টাটায়, সেইজন্যই এই ব্যবস্থা। নইলে তুমি ভাবতে পার, পিতা! এত রকমারি উপহার, এতই তা দামি এবং এতই তা বিপুল যে, কোনওটাই আমার হাতে ধরছিল না। উপহার নিতে নিতে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে আমি বসে পড়েছিলাম এক জায়গায়। তখনও দেখলাম— দূরাগত রাজারা তাঁদের আনা ধন-রত্নের উপহার হাতে নিয়ে বিরাট পংক্তি ধরে দাঁড়িয়ে আছে— অতিষ্ঠন্ত ময়ি শ্রান্তে গৃহ্য দূরাহৃতং বসু।
দুর্যোধনের এই অবস্থাটা তাঁর ভাবনালোকের আভাস দেয়। সাধারণ বিত্ত, সাধারণ ঐশ্বর্য, বিশেষত বিপুল অর্থসম্পত্তিও যদি দুর্যোধনকে তুষ্ট করে দেয়, তা হলে সেই সন্তোষ তিনি পছন্দ করেন না। এই অসন্তোষ অবশ্যই খুব যুক্তিযুক্ত, কেন না সেটা রাজধর্ম, বিজীগিষু রাজার পক্ষে সন্তোষ সর্বনাশা বিপদ। কিন্তু দুর্যোধনের এই অসন্তোষ আমরা যেন বীরত্বের মাহাত্ম্যে ব্যাখ্যা করতে পারি না। দুর্যোধনের পরশ্রী-কাতরতা এবং মাৎসর্যকে আমরা উত্তম ক্ষত্রিয়সুলভ বীরত্বের অভিধাতে কিছুতেই যেন চিহ্নিত করতে পারি না। একবার মাত্র তিনি শকুনিমামাকে বলছিলেন— চলো সকলে মিলে আমরা যুদ্ধ করি পাণ্ডবদের সঙ্গে। কিন্তু শকুনি যেই না তাঁর দেশওয়ালি বুদ্ধিতে বলেছেন— তোমায় যুদ্ধও করতে হবে না, কোনও কষ্টও করতে হবে না, আমি পাশার চালে পাণ্ডবদের সমস্ত ধন-সম্পত্তি বেঁধে ফেলব— সেই মুহূর্তেই বীরত্ব-বুদ্ধি ত্যাগ করেছেন দুর্যোধন এবং এখন এই মুহূর্তে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বায়না করছেন— এই আমার শকুনি-মামা পাশার চালে পাণ্ডবদের ধনহরণ করবেন বলেছেন, আপনি সেটা অনুমতি করুন— দ্যূতেন পাণ্ডুপুত্রেভ্যঃ… শ্রিয়মাহর্তুমক্ষবিৎ।
ধৃতরাষ্ট্র পড়েছেন মহাফাঁপরে। একদিকে পুত্রের এই মাৎসর্যে তিনি প্রশ্রয় দিতে চান, অন্য দিকে কুরুরাজ্যের বিশাল রাষ্ট্রযন্ত্র, যেখানে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুরের মতো প্রজ্ঞাসম্পন্ন মানুষ রয়ে গেছেন, যাঁদের একবারও জিজ্ঞাসা না করে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যম ব্যবহার করে জ্ঞাতিসম্পর্কের সঙ্গে পাশা খেলা যায়? ধৃতরাষ্ট্র বললেন— দ্যাখো বাছা। মহামতি বিদুরকে একবার জিজ্ঞাসা করতেই হবে। সে আমাদের মন্ত্রী এবং সে পাণ্ডব-কৌরব সকলেরই হিতকামী। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে— তেন সঙ্গম্য বক্ষ্যামি কার্যস্যাস্য বিনিশ্চয়ম্। ধৃতরাষ্ট্রের মুখে বিদুরের নাম শুনেই দুর্যোধন বললেন— আবার বিদুর! বিদুর এলেই আপনাকে তিনি বারণ করবেন এই কাজটা করতে। আর আপনি যদি এই পাশাখেলার ব্যাপার থেকে পিছিয়ে আসেন, তা হলে তো আমায় মরতে হবে। অবশ্য সেটাই ভাল, আমি মরে গেলে আপনি বিদুরকে নিয়ে মনের সুখে এই কুরুরাজ্য ভোগ করুন— স ত্বং ময়ি মৃতে রাজন্ বিদুরেণ সুখী ভব।
দুর্যোধনের মুখে এই আর্ত হাহাকার শুনে প্রথমত ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের অভিমত কর্মের দিকে ঝুঁকেই পড়লেন— দুর্যোধন-মতে স্থিতঃ। এ-অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্র প্রথম কাজ যেটা করলেন, সেটা হল— ভৃত্যদের ডেকে আদেশ দিলেন নতুন একটি সভাগৃহ তৈরি করার জন্য এবং সেটা যাতে বিশাল, সুনির্মিত এবং রত্নখচিত হয়, সে-ব্যাপারেও নির্দেশ দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র ভাবলেন— যুধিষ্ঠিরের ময়-নির্মিত সভাঘরের দুগ্ধস্বাদ যদি তক্ৰপান করলে মেটে, যদি দুর্যোধনের এতটুকু শান্তি হয়— দুর্যোধনস্য শান্ত্যর্থমিতি নিশ্চিত্য ভূমিপঃ। দ্বিতীয় কাজ যেটা করলেন, সেটা হল— বিদুরকে ডেকে পাশাখেলার ব্যাপারটা একটা প্রস্তুতির জায়গায় নিয়ে আসা। বেশ বোঝা যায়, দুর্যোধন যে অদম্য দুর্যোধন হয়ে উঠেছেন, তার পিছনে তাঁর সমহৃদয় পিতার অবদান কতটা! যতই অভিমানভরে আর্তি জানান দুর্যোধন, এই সময়ে পিতার দিক থেকে যে এই অন্যায় লালন, সেটা দুর্যোধনের ব্যক্তিত্ব লক্ষ্যভ্রষ্ট করে তুলেছে। পুত্রকে তিনি বীরোচিতভাবে যুদ্ধেও প্রবৃত্ত করেন না এবং নিকৃষ্ট উপায় বেছে নেবার ব্যাপারে পুত্রকে সাহায্য করেন।
বিদুর এসে ধৃতরাষ্ট্রের মুখে পাশাখেলার প্রস্তাব শুনলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বারণ করতে আরম্ভ করলেন। জ্ঞাতিবিরোধের এই ভয়ংকর বীজ যাতে ধৃতরাষ্ট্র বপন না করেন, তার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করতেই ধৃতরাষ্ট্র দ্যূতক্রীড়ার ব্যাপারটা খুব হালকা করে দিয়ে বললেন— আরে! ভাইতে ভাইতে বন্ধুর মতো খেলা হবে, তাতে আর কী বিপর্যয় ঘটবে। তা ছাড়া আমি আছি, ভীষ্ম-দ্রোণ আছেন, তুমি আছ, সেখানে কী এমন ঘটতে পারে— ময়ি সন্নিহিতে দ্রোণে ভীষ্মে ত্বয়ি চ ভারত। কিচ্ছু হবে না। বরঞ্চ তুমি আমার দূত হয়ে পাণ্ডবদের নেমন্তন্ন করে এসো। তুমি আর বারণ কোরো না। বিদুর দুঃখিত হয়ে চলে গেলেন।
ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের সামনে দুর্যোধনের কথাটাই চালিত করলেন বটে, কিন্তু মনে মনে তাঁর একটা পাপ বোধ কাজ করছিল। দুর্যোধনকে তিনি অনেক বোঝালেনও। পাশাখেলার কুফল নিয়ে কথা তো বললেনই, তা ছাড়া অনেক বোঝালেনও দুর্যোধনকে। পিতৃ-পিতামহের রাজ্য, তার শাসন, অপার ঐশ্বর্য, সব কিছু পেয়েও দুর্যোধনের মনে কেন এত না-পাওয়ার শোক— ধৃতরাষ্ট্র তা বোঝেন না। আসলে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র অন্ধতার কারণে রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন বলে রাজ্যের অধিকার পেতেই তাঁর সুখ এসেছে। দুর্যোধনকেও তিনি তাই বলেছেন— তুমি তো পিতৃপিতামহের পরম্পরাগত রাজ্য হাতে পেয়েছ, তাও কেন এই কষ্ট— প্রাপ্তস্ত্বমপি তৎ পুত্র পিতৃপৈতামহং পদম্। এই জিজ্ঞাসার উত্তরে আবারও সেই যুধিষ্ঠির-সভার ঐশ্বর্য নিয়ে ক্ষোভ উচ্চারিত হয়েছে দুর্যোধনের মুখে— যার নিষ্কর্ষ এই— আমার যতই থাক, ওদের কেন এত থাকবে? ওদের কিছু থাকা চলবে না। দুর্যোধনের শোকসিন্ধু উদ্বেল হয়ে উঠল, তিনি আবারও বলতে আরম্ভ করলেন—
হায়! তুমি না একটু আগেই আমার দুঃখ শুনে আমাদের এই রাজসভাতে একশোটা দরজা করার আদেশ দিলে, সুন্দর করে সাজাতে বললে এই পুরনো সভাগৃহ। তুমি যুধিষ্ঠিরের সভা দেখনি, তাই এত কথা আসছে। ওদের সভায়— দুর্যোধনের গলার স্বর কিন্তু নিশ্চয়ই এখন থেকে কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠছে— ওদের সভায় শুধু স্ফটিক আর রত্ন দিয়ে একটা সরোবর বানিয়েছে— আমার মনে হল যেন সত্যিই জল, তাতে পদ্মফুল পর্যন্ত ফুটে আছে। ঘরের মধ্যে আর কত জল থাকবে— এই ভেবে জল পার হওয়ার জন্য আমি যেই না কাপড় তুলেছি— ওমনি ভীম আমাকে দেখে হা হা করে হাসল। আসলে জলটল কিছুই ছিল না, সবই স্ফটিকের ভ্রম। যদি তখনই আমি ভীমকে মেরে ফেলতে পারতাম! কেন না তা করতে গেলে আমার অবস্থা হত অসহায় শিশুপালের মতো, যাক ওসব কথা। আমি আরেক জায়গায় স্ফটিক-রত্নের মিশানো ওইরকম আরেকটি সরোবর দেখলাম— দেখে ভাবলাম বুঝি জল নেই। সোজা হাঁটছি— ওমা একেবারে সবার সামনে অপ্রস্তুত অবস্থায় জলে গিয়ে পড়লাম। আর জানো বাবা, আমার অবস্থা দেখে স্বয়ং কৃষ্ণ, অর্জুন এমনকী দ্রৌপদী পর্যন্ত মেয়েদের নিয়ে হাসতে আরম্ভ করল। কী অপমান! কী অপমান! ভাবতে পারি না।
দূরদর্শন সমর্থকেরা এবার আমাকে পেড়ে ফেলবেন। বলবেন— এই না তুমি বড় বড় কথা বলছিলে— দ্রৌপদী অমন করতে পারেন না, অমন হাসতে পারেন না, এ, সে। এইতো মহাভারতে স্বয়ং দুর্যোধনই বলছেন— দ্রৌপদী হেসেছে— দ্রৌপদী চ সহ স্ত্রীভিঃ ব্যথয়ন্তী মনো মম।
আমি প্রথমে সলজ্জে বলব— হ্যাঁ বলেছি এবং ঠিকই বলেছি।
তারপরেও যদি আপনারা অল্পবুদ্ধি, মহাভারত-না-পড়া দূরদর্শনওয়াদের মতো টেঁই ধরে বসে থেকে আমারই বলা প্রমাণ দিয়ে বলেন— স্বয়ং মহাভারতের কবি বলছেন— দ্রৌপদী হেসেছিলেন আর তুমি বড় বেঁড়ে পাকা— বলছ— না হাসেননি? এক্ষেত্রে আমি কিন্তু রেগে যাব এবং চোখ পাকিয়ে বলব মহাভারত শুধু পড়লেই হল না, একটু বুঝতে হবে। আমার বিপদ— আমি সামান্য প্রবন্ধ লিখিয়ে— আমার জায়গা বড় কম, সব কথা বুঝিয়েও বলতে পারি না, আবার না বলেও থাকতে পারি না। আমার প্রথম কথা— মহাভারত যদি শুধুই ধর্মশাস্ত্র হত, তা হলে প্রত্যেকটি অক্ষর আপনি ধর্মের মাহাত্ম্যে পুজো করতে পারতেন। কিন্তু মহাভারত যে প্রথমত মহাকাব্য এবং ব্যাসের প্রধান পরিচয়— তিনি মহাকবি। মহাকবি যে চরিত্র-চিত্রণ করেন, তা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম। দুর্যোধন এখন ঈর্ষায় অন্ধ এবং স্নেহান্ধ পিতাকে দিয়ে তিনি যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলায় আহ্বান করাতে চান। তার জন্য তিনি সুপরিকল্পিতভাবে লেগে পড়েছেন। তিনি জানেন— কোথায় তাঁর বাবার লাগতে পারে। এখন তিনি সব কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন। দুর্যোধনকে জলে পড়ে যেতে দেখে বেহায়া মেয়েদের মতো দ্রৌপদী পর্যন্ত হেসেছে— একথা বললে— ধৃতরাষ্ট্রের মনে লাগবে, পুত্রের জন্য মায়া লাগবে— তাই বাড়িয়ে বলেছেন।
আপনারা বলবেন— তোমার কথার প্রমাণ কী? আমি বলব— তা হলে দুর্যোধনের বলা পুরো কথাটা খেয়াল করুন। দুর্যোধন বলছেন— আমার দুর্গতি দেখে স্বয়ং কৃষ্ণ তার বন্ধু অর্জুনের সঙ্গে মিট মিট করে হাসছিল— তত্র মাং প্ৰাহসৎ কৃষ্ণঃ পার্থেন সহ সুস্বরম্, এমনকী আমার মনে ব্যথা দিয়ে দ্রৌপদী পর্যন্ত অন্য মেয়েদের সঙ্গে হাসছিল— দ্রৌপদী চ সহ স্ত্রীভি ব্যথয়ন্তী মনো মম।
পাঠক! এবার আপনি মহাভারতের সেই জায়গায় আসুন, যেখানে এই ঘটনা ঘটেছিল। খেয়াল করবেন— মহাভারতকার পরিষ্কার জানিয়েছেন— যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হয়ে গেলেই কৃষ্ণ সবার কাছে বিদায় নিয়ে দ্বারাবতী, মানে দ্বারকায় চলে গেলেন। এইবার ব্যাস লিখছেন— কৃষ্ণ দ্বারকায় চলে গেলে— গতে দ্বারবতীং কৃষ্ণে— যুধিষ্ঠিরের সভায় বাইরের লোক বলতে রয়ে গেলেন শুধু একজন লোক— তিনি দুর্যোধন এবং তাঁর সঙ্গে থাকলেন শকুনি— একো দুর্যোধনো রাজা শকুনিশ্চাপি সৌবলঃ।
এবার আপনারা বলুন— দুর্যোধন তা হলে কৃষ্ণের হাসার কথাটা নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলেছেন, কারণ আসল ঘটনার সময়েও আমরা দেখেছি— কৃষ্ণ সেখানে ছিলেন না এবং তাঁর হাসার প্রশ্নও আসে না। অথচ দুর্যোধন কৃষ্ণের নামে ধৃতরাষ্ট্র কাছে অনেক কিছু বলেছেন। একইভাবে আসল ঘটনার সময় যেহেতু আমরা দ্রৌপদীকেও হাসতে দেখিনি, তাই এখানেও দুর্যোধনের কথা বিশ্বাস করব না। যিনি পিতার স্নেহ কাড়ার জন্য অনুপস্থিত মানুষকে দিয়েও সুস্বরে হাসাতে পারেন, তিনি যে নিজের করুণ অবস্থা বোঝানোর জন্য অন্তত রাজগৃহে উপস্থিত দ্রৌপদীকে ব্যবহার করবেন, তাতে আশ্চর্য কী? আপনারা এটা বলতে পারবেন না যে, — আমরা দূরদর্শনওয়ালাদের মতো— দ্রৌপদীর হাসিটা বিশ্বাস করি কিন্তু কৃষ্ণের হাসিটা নয়। আমার কথা— বিশ্বাস করলে দুটোই করুন, নইলে কোনওটাই করবেন না।
বস্তুত বিশ্বাস করার কারণই নেই, কারণ মহাকাব্যের কবি জানেন— মানুষকে উত্তেজিত করে নিজের পক্ষে আনার সময় কথা বাড়িয়েই বলতে হয়, বিশেষত সে যদি এমন একজন পিতা হয় যিনি বিগলিত হয়েই আছেন এবং আরও বিগলিত হতে চান। মহাভারতের কবিকে এই পুত্ৰকৃত পিতার বিগলন পদ্ধতি দেখানোর জন্য আরও অন্তত চারটি পরিপূর্ণ মহাভারতীয় অধ্যায় খরচ করতে হয়েছে এবং প্রত্যেকটি অধ্যায়ের সারভূত কথাটি হল ‘দুর্যোধন-সন্তাপ’। হ্যাঁ, একথা অনস্বীকার্য— যুধিষ্ঠির অনেক পেয়েছেন, রাজসূয়ের সম্মান, উপহার— সব কিছুই। কিন্তু দুর্যোধন সেগুলির প্রত্যেকটি পৃথকভাবে, নিখুঁতভাবে এবং বিশদভাবে এমন প্রতিতুলনায় উপস্থিত করেছেন যে, ধৃতরাষ্ট্র মোহগ্রস্ত হতে বাধ্য। তবু ধৃতরাষ্ট্র অনেক মনের জোর নিয়ে বসেছিলেন, কারণ তিনি রাজনীতিটা দুর্যোধনের থেকে ভাল বুঝতেন। প্রথমত তিনি এই পাশা খেলার উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝেছেন এবং সে উদ্দেশ্য এতই প্রকট যে, কুরু সভার বৃদ্ধদের কাছে তাঁর মান-সম্মান কিছুই থাকবে না। দুর্যোধনের চতুরধ্যায় সন্তাপোক্তি শুনেও তিনি বললেন— তুমিও একটা বড় যজ্ঞ করো না দুর্যোধন, তা হলে হাজারও ঋত্বিক তোমারও যজ্ঞমন্ত্র উচ্চারণ করবে, হাজারও রাজাও আসবে একইরকম রত্নোপহার নিয়ে— আহরিষ্যন্তি রাজান-স্তবাপি বিপুলং ধনম্। তুমি এই ন্যূতক্রীড়ার পরিকল্পনা ছাড় দুর্যোধন, জ্ঞাতিশত্রুতা বেশি ভাল নয়, তার মধ্যে আবার এই অব্যাপারে ব্যাপার করতে চাইছ!
দুর্যোধন দেখলেন— বুড়ো ভিজল না। আমরা জানি কেন ভিজল না। ঘটনাটা যদি এমন হত যে, কাকপক্ষী কেউ টের পাচ্ছে না, অথচ পাণ্ডবদের জিনিসপত্র ঘরে চলে আসছে, তা হলে বুড়ো ধৃতরাষ্ট্র বারণাবতী বুদ্ধিতেই বলতেন— আমারও এইরকম মনে হয়, তোমরা ভাব দেখি। কিন্তু এখানে তেমন কিছু চলবে না। এখানে যা হবে, সবই প্রকাশ্যে এবং দুর্যোধনের মনের অবস্থাও এখন এমন হয়ে গেছে যে, তার কোনও চক্ষুলজ্জাই আর অবশিষ্ট নেই। চার অধ্যায় ধরে বকে বকে, বাড়িয়ে বলে দুর্যোধন যখন শ্রান্ত হয়ে গেলেন এবং বুঝলেন— তবুও অন্ধ বুড়ো পথে আসছে না— তখন তিনি দাবড়ানি দিতে আরম্ভ করলেন। চক্ষুলজ্জাহীন, বেহায়া দাবড়ানি।
দুর্যোধন বললেন— তোমার অবস্থাটা কেমন জানো বাবা? খুব খানিকটা বই মুখস্থ করে তোমার শাস্ত্রজ্ঞান হয়েছে বটে, তবে যার বুদ্ধি বলে কোনও জিনিস নেই, সে যেমন শাস্ত্রের আসল মর্ম কখনও বুঝতে পারে না, তোমারও হয়েছে সেইরকম। তরকারি পরিবেশন করার হাতা যেমন তরকারির স্বাদ বুঝতে পারে না, তেমনি তোমার মতো শাস্তর-পড়া বুদ্ধিহীন ললাকেরাও শাস্ত্রের মর্মার্থ বোঝে না— ন স জানাতি শাস্ত্রার্থং দর্বী সূপরসানিব। তা ছাড়া সব সময় তুমি আমাকে নিজের একটা ‘স্যাটেলাইট’ বানিয়ে রাখতে চাইছ, একটা বড় নৌকোর সঙ্গে একটা ছোট নৌকো বাঁধা থাকলে ছোট নৌকোটার যে অবস্থা হয়, আমার অবস্থাও তেমনি— নাবি নৌরিব সংহতা। তুমি নিজের প্রয়োজনটাও লক্ষ করছ না, আবার আমাকেও উলটো কথা শোনাচ্ছ। সত্যি কথা বলতে কী— তুমি যখন আমাদের শাসনকর্তা হয়েছ, তখন আমাদের কাউকে আর বেঁচে থাকতে হবে না। তোমার মতো যারা নিজেই সবসময় পরের মতে চলে, তাদের পদে পদে স্খলন হতে বাধ্য এবং সবচেয়ে বড় কথা— বশংবদ লোকেরা কাকে অনুসরণ করবে— তোমাকে, না, যাদের কথায় তুমি উঠছ-বসছ তাদের—?
খুব খানিকটা গালাগালি দিয়ে দুর্যোধন শেষে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নিয়ে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন। তাঁর মত হল— যেভাবেই হোক শত্রুকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। শত্রুর বাড়বৃদ্ধি হচ্ছে আর আমি চোখ গোল গোল করে দেখছি— এ হল— শরীরে যে রোগ আছে, তাকে আমন্ত্রণ করে নিশ্চিন্তে বসে থাকা। রথের সারথি যেমন বেত মেরে মেরে তার ইচ্ছেমতো ঘোড়াগুলিকে যেদিকে ইচ্ছে চালায়, ক্ষত্রিয় পুরুষও তেমনি যেদিকে শত্রুর ধন-সম্পত্তি আছে, সেইদিকে নিজেকে চালনা করে। আর এতে কোনও ন্যায়নীতির বালাই নেই। দুর্যোধন উদাহরণ দিয়ে বললেন— এই দেখুন না— স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র বলেছিলেন— আমি আর কারও অপকার করব না, তারপর যেই দেখলেন— তাঁর শত্রু নমুচি বড় বেড়ে যাচ্ছে, অমনি তার গলাটি কেটে নিলেন। কাজেই ওসব কথা রাখারাখির ব্যাপার নেই, আপনার ন্যায়-নীতির কথা মাথায় থাক— ন্যায়ঃ শিরসি ধিষ্ঠিতঃ।
দুর্যোধনের এই সব লম্বা-চওড়া কথার মধ্যে শকুনি কিন্তু বারবার ফুট কেটে যাচ্ছেন। বার বার তিনি বলে যাচ্ছেন— পাশাখেলার পণে আমি ওদের সব জিতে নেব। ধৃতরাষ্ট্র তবু একবার বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা তুললে দুর্যোধন বিদুরকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন— সে তো শুধু পাণ্ডবদের স্বার্থ দেখে বেড়াচ্ছে— পাণ্ডবানাং হিতে যুক্তঃ— সে তো তোমার সব বুদ্ধি ওলটপালট করে দেবে। ধৃতরাষ্ট্র তবু মানতে চাইলেন না, কিন্তু শেষে তাঁকে মত দিতেই হল এবং ছেলেকে তিনি ‘রাজা’ সম্বোধন করে বললেন— যা তোমার মনে চায়, তাই করো— যৎ তে প্রিয়ং তৎ ক্রিয়তাং নরেন্দ্র— আমার বাপু এসব ভাল লাগছে না।
কেন ধৃতরাষ্ট্রের ভাল লাগছে না, আমরা জানি। প্রথমত ব্যাপারটা প্রকাশ্যে ঘটছে, এর ফলাফল যাই হোক, প্রকাশ্যভাবে ধৃতরাষ্ট্রকেই তার মোকাবিলা করতে হবে। দ্বিতীয়ত তিনি যদি দুর্যোধনের কথা না শুনতেন, তা হলে দুর্যোধনের পক্ষে বিদ্রোহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। যেভাবে দুর্যোধন পূজনীয় পিতৃদেবকে গালাগালি দিয়ে গেলেন, সেটা বিদ্রোহেরই নামান্তর এবং সেইজন্যই নিজের ব্যক্তিগত অমত থাকা সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র এই দ্যূতক্রীড়ার দায় নিজে সরাসরি নিতে চাননি, বলেছেন— যা ইচ্ছে করো, তুমি যখন রাজা, তখন যা মনে চায়— তাই করো। এসব বললেন বটে, কিন্তু এর পাশাপাশি মিস্ত্রিদের বিরাট এক পাশাঘর বানানোর আদেশও দিয়ে দিলেন। বিদুরকে ডেকে বললেন— যাও বিদুর শিগগির যাও, যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলায় নেমন্তন্ন করে ডেকে আনো— ক্ষিপ্রম্ আনয় দুর্ধর্ষং কুন্তীপুত্রং যুধিষ্ঠিরম্।
দুর্যোধনের ঈর্ষা, লোভ এবং পরশ্রীকাতরতা তাঁকে যেমন নিজের মতো করে রাজনীতির ব্যাখ্যা দিতে প্ররোচিত করল, তেমনি এই প্রথম ধৃতরাষ্ট্র একেবারে রাশ ছেড়ে দিলেন। কুরুসভার আইন, আভিজাত্য এবং শিষ্টতা— সবই দুর্যোধনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। এমনকী খেলার যে সাধারণ নিয়ম-নীতি, তাও দুর্যোধনের অঙ্গুলী হেলনে চলতে লাগল। পাশাখেলা আরম্ভের মুখেই জুয়ারি বলে বিখ্যাত শকুনির বোলচাল দেখে যুধিষ্ঠির ভয় পেয়েছিলেন, হয়তো সেই ভয় থেকেই যুধিষ্ঠির বলেছিলেন মৃদুভাষে— কার সঙ্গে কার খেলা হবে, আর পণের টাকা-পয়সাই বা কে দেবে? দুর্যোধন কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন— পণের টাকা দেব আমি, আর আমার হয়ে পাশার চাল দেবে আমার মামা শকুনি— মদর্থে দেবিতা চায়ং শকুনির্মাতুলো মম। যুধিষ্ঠির বললেন— এটা তো অনুচিত কথা হল বড়, তোমার হয়ে অন্য লোক খেলবে, সে তো অসমান খেলা। তুমি যখন পণ ধরছ, তখন তোমারই উচিত পাশার দান চালা, এখানে অন্য লোক তোমার হয়ে খেলবে, এটা খেলার নিয়ম নয়— অন্যেনান্যস্য বৈ দ্যূতং বিষমং প্রতিভাতি মে।
যুধিষ্ঠিরের এই কথার কোনও উত্তরই দেননি দুর্যোধন। দ্যূত সভার এমন পরিবেশ, পাকা-পাকা জুয়াড়িদের লাইন দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন দুর্যোধন, একশো ভাই সভা সামলাচ্ছে, কর্ণ-দুঃশাসন দুর্যোধনের পাশে বসে, যুধিষ্ঠিরকে কোনও পাত্তাই দিলেন না দুর্যোধন। এরই মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র এসে সভায় বসলেন, এলেন অখুশি মনে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর— যুধিষ্ঠিরের কথা একেবারে চাপা পড়ে গেল। খেলা আরম্ভ হল ধৃতরাষ্ট্রের প্রবর্তনায়। শকুনি একটার পর একটা পণ জেতা আরম্ভ করলেন জুয়াড়ির কপটতা কাজে লাগিয়ে। শকুনির প্রথম চাল এবং প্রথম জয়েই কিন্তু যুধিষ্ঠির বলেছিলেন— আপনি কিন্তু অন্যায় শঠতায় পণ জিতলেন, জুয়াড়িরা এ-রকম করে— মত্তঃ কৈতবকেনৈব যজ্জিতোহসি দুরোদরম্— কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই প্রতিবাদে কেউ কান দেননি বা দেবার মতো পরিবেশই রাখেননি দুর্যোধন। এরপর যখন একটার পর একটা পণ জিতে নিচ্ছেন শকুনি, তখন শুধু দুর্যোধন কেন, ধৃতরাষ্ট্রও বুঝি মনে মনে ভাবতে আরম্ভ করেছেন— ছেলের আমার বুদ্ধি আছে বটে। ভিতরে ভিতরে স্নেহান্ধ পিতার লোভ মাৎসর্য তৃপ্ত হতে লাগল, অথচ বহিরঙ্গের প্রকাশনে তিনি কত উদাসীন।
তখনও যুধিষ্ঠির ভাইদের পণ রাখেননি, তখনও দিগ্বিজিত রাজ্যগুলি অথবা ইন্দ্রপ্রস্থের রাজধানীও পণ-ঘোষণায় আসেনি, সভায় উপস্থিত একমাত্র বিদুর বুঝতে পারছেন— দুর্যোধন-শকুনি কোন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পাশার চাল। তিনি আর থাকতে না পেরে ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে দুর্যোধনের মন্দবুদ্ধির নিন্দা আরম্ভ করলেন শতমুখে। বিদুর অনন্ত যুক্তিতে বুঝিয়ে দিলেন যে, দুর্যোধনকে প্রশ্রয় দিলে জ্ঞাতিশত্রুতা এমন জায়গায় পৌঁছবে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ থাকবে না। পাশাখেলার ভয়ংকর পরিণতির কথা উচ্চারণ করে বিদুর দুর্যোধনকে ত্যাগ করার পরামর্শ দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিলেন যে, দুর্যোধনের এই লোভ এবং মৎসর স্বভাব নেমে আসছে ধৃতরাষ্ট্রের আপন হৃদয় থেকে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন— ধন-সম্পত্তির ওপর তোমার যে কী অদম্য আকর্ষণ, তা আমরা জানি। যুধিষ্ঠিরের ধন-সম্পত্তি হরণ করার এই যে মানসিক ব্যাধি, তাও বহুদিন ধরেই তোমার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে, তার চেষ্টাও চলছে বহু দিন ধরে— আকর্ষস্তে স্বে ধনে সুপ্রণীতো/ হৃদি প্রৌঢ়ো মন্ত্রময়োইয়মাধিঃ। তোমাকে আবারও বলছি, তুমি মূর্খ দুর্যোধনের অনুসরণ কোরো না। এই যে শকুনি খেলছে তাঁর খেলার মধ্যে যে শঠতা চলে, কপটতা চলে, তাও খুব ভাল করে জানি আমরা, অতএব বন্ধ করো এই পাশাখেলা, পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ো না।
লক্ষণীয়, ধৃতরাষ্ট্র একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না, অথচ এই মানুষটাই একদিন পুত্র দুর্যোধনের কাছে বিদুরের বুদ্ধি এবং হিত-স্বভাবের প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু আজ যখন ছেলের বুদ্ধিতে বিনা যুদ্ধে একটার পর একটা পণ জিতে ঐশ্বর্য আসছে, তখন বিদুরের কথা তাঁর কানেও ঢুকল না। আসলে কুরুসভার সমস্ত কর্তৃত্ব তখন দুর্যোধনের হাতে চলে গেছে। পাশাখেলা আরম্ভ করার জন্য শুধু ধৃতরাষ্ট্রের অনুমোদন লেগেছে তাঁর। ভাইতে ভাইতে বন্ধুর মতো খেলার নাম করে একবার পাণ্ডবদের ডেকে আনার জন্যই শুধু ধৃতরাষ্ট্রকে প্রয়োজন ছিল দুর্যোধনের এবং ধৃতরাষ্ট্রও সেটা জানতেন মনে মনে। অতএব আজ যখন এইরকম অসভ্য খেলা আরম্ভ হল, সেখানে যুধিষ্ঠির বারবার কপটতার কাছে হার মেনে চলেছেন এবং দুর্যোধনের লাভ হচ্ছে, সেখানে বিদুরের হিতবাক্যে ধৃতরাষ্ট্র একটা কথাও সমর্থনে বললেন না, কেন না দুর্যোধনের স্বার্থের সঙ্গে তাঁর স্বার্থ এখন একাকার হয়ে গেছে। অতএব বিদুরের সাবধানবাণী আর নিজের ওপর নিন্দার আক্ষেপ মাথায় রেখে বিদুরের প্রতিবচন দিলেন দুর্যোধন। কুরুরাষ্ট্রের এই পরম হিতৈষী পুরুষটিকে তিনি এমন ভাষায় গালাগালি দিলেন, যে-ভাষা রাজার ঘরের আভিজাত্য এবং তৎকালীন দিনের গুরুগৌরবের মান্যতায় একেবারেই মানানসই নয়। পাশাখেলা আরম্ভ হল, শকুনি একটার পর একটা জিনিস জিতছেন— আস্তে আস্তে ধৃতরাষ্ট্রও বুঝি ভাবতে আরম্ভ করলেন— ছেলে আমার ভাল বুদ্ধি করেছে তো! কুরুসভার প্রাজ্ঞ মন্ত্রী বিদুর আর থাকতে পারলেন না। আবারও তিনি শতমুখে পাশাখেলার নিন্দা করে ধৃতরাষ্ট্রকে বারবার সাবধান করে দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র একটি কথাও বললেন না। দুর্যোধন আবারও অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিলেন বিদুরকে। দুর্যোধন বললেন—
তুমি শুধু শত্রুর গুণ গাও আর আমাদের নিন্দা কর। তোমার কাছে ভাল কারা— তা আমরা বেশ জানি। আর আমাদের কি বাচ্চা ছেলে পেয়েছ, যে সব সময় পাঁচ কথা শোনাচ্ছ— বালানিব অস্মান্ অবমন্যসে নিত্যমেব। ব্যাটা! বামুনের বীজে দাসীর ঘরে জন্মক্ষত্তা! কোলের মধ্যে কালসাপ পুষলে যা হয়, তুই হলি আমাদের কাছে তাই। বাড়িতে বিড়াল পুষলে সে যেমন বাড়ির জিনিসই মেরে খায়, তুইও তাই করছিস— মার্জারবৎ পোষকঞ্চোপহংসি। তুই আমাদের খাচ্ছিস-পরছিস, আর নির্লজ্জের মতো আমাদের নামেই যা ইচ্ছে বলছিস— তদাশ্রিতোহপত্রপ কিন্ন বাধসে/যদিচ্ছসি ত্বং তদিহাবভাষসে। যা বলেছিস, বলেছিস। আর নয়— বুড়োদের কাছে বুদ্ধি নে গে, যা। নিজের সম্মান নিজে রাখ, অন্যের ব্যাপারে আর মাথা ঘামাস না— যশো রক্ষস্ব বিদুর… মা ব্যাপৃতঃ পরকার্যেষূ ভূস্ত্বম্। তুই নিজেকে বেশ একটা কর্তাব্যক্তি ঠাউরে নিয়ে যা নয়, তাই বলে যাচ্ছিস আমাদের। তুই একটা কথা জেনে রাখ, তোকে তো কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। আমি কি তোর কাছে গিয়ে একবারও বলেছি— বাবা বিদুর! কীসে আমার ভাল হবে বলে দিন। তা হলে আমাদের অপমান করে এত কথা বলছিস কেন— অহং কর্তেতি বিদুর মাবমংস্থাঃ… ন ত্বাং পৃচ্ছামি বিদুর যদ্ধিতং মে— শেষ কথাটা এবার তোকে বলি— দেখ, বদমাশ মেয়েছেলেকে বারবার ভাল কথা বললেও সে যেমন স্বামীর কাছে থাকে না, তেমনি তোর অবস্থাও তাই— তুই যেখানে ইচ্ছে চলে যা— স যত্রেচ্ছসি বিদুর তত্র গচ্ছ/ সুসাত্ত্বিতা হ্যসতী স্ত্রী জহাতি।
মহামতি বিদুর এর পরেও প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র একটি কথাও বললেন না; কথা বললেন না ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ কিংবা অন্য কোনও শুভাকাঙ্ক্ষী পুরুষ। ফলত দুর্যোধন একেবারে পেয়ে বসলেন। আবার পাশাখেলা আরম্ভ হল। যুধিষ্ঠির ভাইদের পণ রাখলেন, নিজেকে পণ রাখলেন এবং পরিশেষে কুলবধূ দ্রৌপদীকেও পণ রেখে হেরে গেলেন। সভায় সমবেত বৃদ্ধদের সবাই মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। কুরুদের সহর্ষ জয়ধ্বনির মধ্যে শুধু একজন বুড়ো রাজার সংশয়ান্ধ প্রশ্ন বারবার শোনা যেতে লাগল— জিতেছে তো? দ্রৌপদীকে জিতেছে তো— কিং জিতং কিং জিতমিতি? তিনি স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র, যিনি অনেক সময়েই নিজের মুখের ভাব গোপন রেখে পুত্রদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন, এ সময় পাশাখেলায় জেতার তালে তিনি নিজেকে আর গোপন রাখতে পারলেন না। নিজের আনন্দ একেবারে নির্লজ্জভাবে প্রকট করে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন— জিতেছে তো? জিতেছে তো? তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শকুনির নির্মম উত্তর শোনা গেল— জিতেছি, দান জিতেছি, জিতব না তো কী— জিতমিত্যেব।
ভাল এবং মন্দ, যে কোনও কাজেই যদি হঠাৎ লাভের অংশ প্রকট হয়ে ওঠে, তা হলে যে ব্যক্তি পূর্বে ওই কাজের বিরোধিতা করেছিল, তার ওপরেই তাচ্ছিল্য এবং রাগ হয় সবচেয়ে বেশি। দুর্যোধনেরও তাই হল। পাশাখেলায় দ্রৌপদী পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন দান জেতার পর দুর্যোধন এবার যেন নরকের জঘন্যতম ব্যক্তিটির সমস্ত ব্যবহার প্রয়োগ করতে আরম্ভ করলেন। প্রথমেই তিনি তালি বাজালেন বিদুরের দিকে এবং যাতে তিনি সবচেয়ে অপমানিত হবেন, সেইভাবেই তাঁকে বললেন— ওহে বিদুর! যাও এইবার, পাণ্ডবদের প্রেমের বউ দ্রৌপদীকে ধরে নিয়ে এসো— এহি ক্ষত্তর্দ্রৌপদীমানয়স্ব। সে এসে আমাদের অন্যান্য কাজের লোকের সঙ্গে কুরুবাড়ির ঘরদোর ঝাড়ামোছা করুক। বিদুর এই অসভ্যতার কী উত্তর দিতে পারেন! আবার উত্তর তো কিছু দিতেই হবে। বিদুর বললেন— তুমি এখন ঝুলে রয়েছ, দুর্যোধন! একটা উঁচু জায়গায়, দর্পশিখরে ঝুলে আছ, কখন মাটিতে পড়বে ঠিক নেই। তুমি হরিণ হয়ে বাঘ ক্ষেপিয়ে তুলছ। মাথার ওপর ক্ষিপ্ত সাপ নিয়ে ঘুরছ, তাকে আর রাগিয়ে দেবার ভুল কোরো না। মনে রেখো, দ্রৌপদীকে পাশায় জেতার কোনও প্রশ্নই নেই, কেন না যুধিষ্ঠির পাশার দানে নিজেকে আগে হেরেছেন, তারপরে আর পণ ধরার অধিকারই নেই তাঁর। সেখানে দ্রৌপদীকে পণ রাখাটা আইনসিদ্ধই নয়। অথচ দ্রৌপদীকে দাসী করার জন্য তুমি যে আগ্রহ দেখাচ্ছ, তাতে একটা ছোট্ট গল্প মনে হচ্ছে— এক সময় একটি ছাগল মাটিতে রাখা একটি ছুরি গিলে ফেলেছিল। ফলটা এই হয়েছিল যে, ছাগলের গলাটাই কেটে গিয়েছিল। ছাগলটা কী গিলছে এটা বোধ না থাকার জন্যই যেমন তার গলা কেটে গেল, তোমার অবস্থাও সেই রকম না হয়। একটা কথা বলতেই হবে, সেটা হল— মানুষের মধ্যে কিছু লোক আছে কুকুরের মতো, তারা বিদ্বান, বুদ্ধিমান, তপস্বী, যাকেই দেখুক চেঁচাতে থাকে— ভষন্তি হ্যৈবং শ্বনরাঃ সদৈব— পাণ্ডবরা কখনও এই ভাষায় কথা বলত না– ন কিঞ্চিদ্ ইত্থং প্রবদন্তি পার্থাঃ।
বিদুরের সৎপরামর্শ বা হিতকথায় কান দেবার লোক দুর্যোধন নন। এই মুহূর্তে দ্রৌপদী, পঞ্চস্বামী-গর্বিতা দ্রৌপদী তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরছে। পাণ্ডবরা নয়, পাণ্ডবদের ভালবাসার কেন্দ্রস্থল তাঁদের স্ত্রীকে হেনস্থা করে মনের জ্বালা মেটাতে চান দুর্যোধন। বিদুরকে খানিকটা অপমান করেই একজন সারথি-জাতীয় ব্যক্তি, প্রতিকামী তার নাম, তাকে ডেকে দুর্যোধন মহামতি বিদুরের উদ্দেশে আরও খানিকটা অপমান ছুড়ে দিয়ে বললেন— ওহে এই! যাও তো দ্রৌপদীকে নিয়ে এসো এখানে। এই বিদুরটাকে দেখলে তো? সব সময় কেমন ভয় পায় পাণ্ডবদের, আর সেই ভয়েই আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করে যাচ্ছে চিরকাল। সব সময় আমাদের খারাপ চাইছে এই লোকটা। তা এবার যাও তো প্রতিকামী! তুমি নিয়ে এসো দ্রৌপদীকে, পাণ্ডবদের কোনও ভয় নেই তোমার। প্রতিকামী গেল দ্রৌপদীর কাছে এবং সেই বিখ্যাত প্রশ্ন ফিরে এল— যুধিষ্ঠির আগে নিজেকে পণ রেখে হেরেছেন, নাকি আগে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন। প্রতিকামী সভায় এসে এই কথা জানালে দুর্যোধন বললেন— সে নিজেই সভায় এসে এই প্রশ্নটা করুক না— ইহৈবাগত্য পাঞ্চালী প্রশ্নমেতং প্রভাষতাম্।
দুর্যোধনের ভাবটা এই সময় অদ্ভুত ফুটে ওঠে। পাণ্ডব-ভাইদের ওপর তাঁর এতকালের সঞ্চিত ক্রোধ সব এখন গিয়ে পড়েছে দ্রৌপদীর ওপর। কেন না সবচেয়ে বড় দোষ তিনি বিদগ্ধা সুন্দরী হয়েও কেন পাণ্ডবদের মতো অভাজন মূর্খদের বিয়ে করে বসলেন। এত বড় অপরাধ যিনি করেছেন, সেই দুর্বিদগ্ধা রমণীকে শাস্তি দেবার একমাত্র উপায় হল— সকলের সামনে তাঁর স্ত্রীজনোচিত মান, সম্ভ্রম অথবা রমণীয় লজ্জা নষ্ট করে দেওয়া। আর ঠিক সেইজন্যই যে ভাবে হোক দ্রৌপদীকে উন্মুক্ত সভার মধ্যে একাকী টেনে আনা দরকার। প্রতিকামী বিমুখ দ্রৌপদীকে নিতে এসেও বলেছিল— সভায় তোমাকে নিয়ে যাবেই ওরা। কেন না ওদের সর্বনেশে বুদ্ধি হয়েছে। নিজেরা ক্ষুদ্র হয়েও তাই বড় মানুষের সম্মান রাখতে পারছে না— ন বৈ সমৃদ্ধিং পালয়তে লঘীয়ান্/যত্ত্বাং সমানেষ্যতি রাজপুত্রি। প্রতিকামীর কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সম্মান নষ্ট করবেন বলেই দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে যাবেনই দুর্যোধন এবং সে-কথা প্রতিকামীর মতো একজন ঘনিষ্ঠ রাজভৃত্যও বোঝে।
প্রতিকামী দুর্যোধনের কথা মেনে দ্রৌপদীকে জোর করে ধরে আনতে রাজি হল না এবং ছোট ভাই দুঃশাসনের উদ্দেশে এবার সেই নির্দেশ ভেসে এল— তুমি নিজে যাও, ভাই! নিয়ে এসো যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীকে। পরাধীন বশীকৃত শত্রু পাণ্ডবরা আর কিছুই করতে পারবে না— স্বয়ং প্রগৃহ্যানয় যাজ্ঞসেনীং। কিং তে করিষ্যত্যবশাঃ সপত্নাঃ। দুর্যোধন এটা বুঝলেন না যে, কাউকে যদি জোর করে বা অন্যায় কৌশলে বেঁধে রেখে তাঁর সামনে অন্যায় করা যায়, তবে সামনে কিছু করতে না পারলেও তার হাত নিশপিশ করে। এখন না পারলেও সে সুযোগ খুঁজবে এমন মানুষকে শেষ করে দেবার। এখানে দুর্যোধনের রাজনৈতিক বুদ্ধির অপরিণত রূপগুলি বেমানানভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। দুঃশাসন দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে কুরুসভায় নিয়ে এলেন সকলের সামনে।
দ্রৌপদী সভায় আসতে বাধ্য হলেন এবং এর পরের কাহিনি আমি বাড়াতে চাই না, কারণ সে সব কথা আমি পূর্বে দ্রৌপদী প্রবন্ধে বলেছি। তবে এ প্রসঙ্গে এটুকু বলা দরকার যে, কুরুসভায় সেদিন দুঃশাসন অথবা কর্ণের মতো ব্যক্তিরা যত অসভ্য আচরণ করেছিলেন— সে সবই কিন্তু দুর্যোধনের আশকারায়। আবার দুর্যোধন যে শেষ পর্যন্ত নিজের উরুর কাপড় সরিয়ে দ্রৌপদীর দিকে চেয়ে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করলেন— সেও কিন্তু ওই দুঃশাসন-কর্ণের পরের পর বাড়াবাড়িতে। আপনারা লক্ষ করবেন— বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা-নিরঞ্জনের সময় কতগুলি ছেলে স্বভাবতই তাসা-পাটির তালে তালে কুৎসিতভাবে নাচতে থাকে। তারপর যখন নাচ জমে ওঠে, দ্রুত হয় তাসা-ব্যান্ডের তাল, তখন যে কখনও নাচেনি, সেও নাচে। কখনও বা নৃত্যরত একজন আরেকজনকে ঠেলা মেরে নাচের আবর্তে নিয়ে আসে। দুর্যোধনের অবস্থাও তাই— কুরুসভার পরিবেশ বাদে-প্রতিবাদে, হর্ষে-উল্লাসে এত দ্রুত রঙিন হয়ে উঠছিল যে, দুর্যোধন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলেন না। এই দুঃশাসন দ্রৌপদীকে বলছেন— তুমি লজ্জা ছেড়ে একবার দুর্যোধনের দিকে তাকাও দেখি— দুর্যোধনং পশ্য বিমুক্তলজ্জা; এই কর্ণ বলছেন— পাণ্ডবরা আর তোমার কেউ নয় গো দ্রৌপদী, এবার কৌরবদের মধ্যে থেকেই তোমার একটা নতুন স্বামী বেছে নাও— অন্যং বুণীষ্ব পতিমাশু ভাবিনি— এত সব উত্তেজক প্ররোচনা শুনে দুর্যোধনের মতো লোক আর কতক্ষণ নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেন। লজ্জা-সম্মানের মাথা খেয়ে দুর্যোধন তখন নিজের ‘কদলীস্তম্ভসদৃশ’ ঊরুখানির ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দ্রৌপদীকে দেখাতে লাগলেন।
মহাভারতের প্রমাণে আমরা বেশ জানি— দুর্যোধনের স্ত্রীলোকসংক্রান্ত কোনও ব্যভিচার দোষ ছিল না। কিন্তু এই যে তিনি দ্রৌপদীর দিকে নির্মম ইঙ্গিত করে বসলেন— এর পেছনেও কারণ কিন্তু সেই হেয় করার চেষ্টা। পাণ্ডবদের রাজ্যপাট তিনি বাজিতে জিতেছেন, অতএব তাঁদের যতখানি অপমান করা যায়, তিনি করবেন। ক্ষত্রিয় বীরের কুলবধূকে উন্মুক্ত সভাস্থলে হিঁচড়ে টেনে এনে তাঁকে বিবস্ত্র করার ইচ্ছে প্রকাশ করা অথবা তাঁকে ঊরু-দেখানো— এইসব কিছুর পিছনে আছে পাণ্ডবদের চরম অপমান করার চেষ্টা। এই বিপন্ন মুহূর্তেও মহাভারতের কবি কিন্তু দুর্যোধনকে কামুক, কিংবা লম্পটের অভিধায় বিশেষিত করেননি। তিনি বলেছেন— ঐশ্বর্যের অহংকারে অর্থাৎ আমি পাণ্ডবদের চেয়ে কত বড়— এই রকম কোনও বিমূঢ়তায় দুর্যোধন ঊরুর কাপড় সরিয়ে পাঞ্চালী কৃষ্ণার দিকে মুচকি হেসে কুৎসিত ইঙ্গিত করলেন— স্ময়ন্নিবৈক্ষ্য পাঞ্চালীম্ ঐশ্বর্যমদমোহিতঃ।
আইনত কিন্তু দ্রৌপদীর প্রশ্নটা ঠিক ছিল এবং ঠিক ছিল বলেই একমাত্র বিদুর এবং বিকর্ণ ছাড়া আর কোনও কুরুবৃদ্ধ দ্রৌপদীর প্রশ্নের কোনও সমাধান দিতে পারেননি। পারেননি যে, তার একমাত্র কারণ দুর্যোধনের ভয়। আর এই ভয়টাও তো সবার ক্ষেত্রে একরকম নয়। সমবেত সামন্ত রাজারা যে দুর্যোধনের কথার কেউ প্রতিবাদ করছিলেন না, সেটা অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে ভয়েই— নোচুর্বচঃ সাধ্বথবাপ্যসাধু বা/ মহীক্ষিতে ধার্তরাষ্ট্রস্য ভীতাঃ। কিন্তু ভীষ্ম-দ্রোণের মতো মান্য ব্যক্তিত্বও যে দুর্যোধনের বিপক্ষে কোনও কথা না বলে সমস্ত ব্যাপারটা যুধিষ্ঠিরের হাতেই ছেড়ে দিলেন, তার কারণ এই নয় যে, তাঁরা দুর্যোধনের বৃত্তিভোগী দাস। বরঞ্চ আমরা বলব, সেটাও দুর্যোধনের ভয়। এই ভয়টা আক্ষরিক অর্থে ভয় নয়, বরঞ্চ বলব— এটা অপমানের ভয়। সঠিক এবং উচিত কথা বলতে গিয়ে মহামতি বিদুর যে অপমানের সম্মুখীন হয়েছেন, বৃদ্ধ পিতামহ সেই অপমান সহ্য করতে পারবেন না বলেই তিনি আর দুর্যোধনের বিরোধিতা করেননি। বিদুরকে উপলক্ষ করে পিতামহ এবং আচার্যের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়াটা কম মুনশিয়ানা নয়।
কিন্তু এই ভয় দেখানোর ক্ষমতাকেও আমরা দুর্যোধনের রাজনৈতিক বুদ্ধির সরসতা বলতে পারি না। বরঞ্চ ভীষ্ম যেহেতু কোনও নিশ্চিত উত্তর দিলেন না, অতএব দুর্যোধন সেটারই সুযোগ নিয়ে দ্রৌপদীকে বললেন— তোমার এই প্রশ্নের উত্তর তোমার অন্য চার স্বামীর যে কোনও একজন বলুন না। ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব যে কোনও একজন বলুন যে, যুধিষ্ঠির তোমার স্বামী নন, তাঁর কোনও অধিকারই নেই তোমাকে পণ রাখার, অথবা যুধিষ্ঠির নিজেই বলুন না যে, তিনি তোমার অধিকারী প্রভু না অপ্রভু। দুর্যোধন কী অসম্ভব ভাল কৌশলের প্রশ্ন করেছেন— এই স্তাবকতায় মুগ্ধ স্তাবক রাজারা দুর্যোধনের উদ্দেশে গায়ের উত্তরীয় উড়িয়ে সমর্থন জানালেন, হাসাহাসিও চলল প্রচুর!
সামান্য সামন্ত রাজাদের স্তাবকতাকেই দুর্যোধন যশ বলে মনে করছেন, তাতেই তাঁর অভিমান-অহংকারের মাত্রাটা এমনভাবে চড়ে গেল যে, কর্ণ-দুঃশাসনের মতো তাঁর আপ্ত-সহায়কেরা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলেন। বাড়াবাড়ির জন্য মুক্ত একটি পরিসর ছিল। পাশাখেলার পণে পাণ্ডবদের ‘দাস’ হয়ে যাবার শর্ত ছিল, আর দ্রৌপদী হবেন কৌরবদের দাসী। কিন্ত দাসত্বের মধ্যে গায়ে-গতরে খেটে দেবার অথবা আদেশ শোনার মর্ম যতই থাক, ‘দাসী’ হবার মধ্যে দৈহিক পরিশ্রমের চেয়েও স্ত্রীলোকের দেহ ব্যবহারের ব্যঞ্জনাটা সেকালে বেশি হয়ে দাঁড়াত। আমরা বলেই ছিলাম এ-কথা যে, অভিমান-অহংকারের বিকার অনেক থাকতে পারে দুর্যোধনের মধ্যে, কিন্তু রমণী-বিষয়ক কোনও কুরুচি অথবা লাম্পট্য দুর্যোধনের চরিত্রে ছিল না। কিন্তু অভিমান-অহংকার এমনই এক অমূর্ত বিশদ বিকার সৃষ্টি করে যা কুরুচি এবং অসভ্যতার রূপ ধারণ করতে পারে রমণীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেও। মনে রাখতে হবে যে, দুর্যোধন কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে ভোগ্যা স্ত্রী হিসেবে পাননি, কর্ণ প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, উলটোদিকে পাণ্ডবরা পাঁচ ভাইই দ্রৌপদীকে স্ত্রী হিসেবে লাভ করেছেন। এই ঘটনাই বিশেষত পাণ্ডবদের দ্রৌপদীকে পাওয়ার যে নান্দনিক বৈপরীত্য, এটা দুর্যোধনের অহংকারের আঘাত করে বলেই এখানে তাঁর অহংকার লাম্পট্যের রূপ ধারণ করে, কেন না তাতে পাণ্ডবরা পর্যুদস্ত হন।
দাসীত্বের মধ্যে সেকালের দিনের পৌরুষেয় সংস্কার ভোগ্যাত্বের সূচনা দিত। দাসীরা অনেক ক্ষেত্রেই রাজা-রাজড়াদের ভোগ্যা এবং উপভোগ্যা হতেন গৃহিণীদের বিস্তারিত পরিসরে এবং তাঁদের অক্ষমতায়, অসুবিধায়, সাময়িক অনুপস্থিতিতে। দাসীদের সম্মান নেই অথচ তাঁরা ব্যবহৃত হতেন বহুল ভাবে এমনকী কখনও বা গৃহিণীর চেয়েও সাদরে এবং অবশ্যই সেটা পৌরুষেয় কামনার অন্তরঙ্গ পরিসর। আজ দ্রৌপদী যখন পণজিতা হয়ে দাসীর অভিধান লাভ করলেন, কৌরব সভায় তখনও বুঝি দুর্যোধন দাসীর সঙ্গে লাম্পট্যের অংশটুকু তেমন করে অনুভব করেননি নিজের চরিত্রগত কারণেই অথবা একেবারে প্রথম সম্বোধনে তাঁকে আহ্বান করতে চেয়েছেন কৌরবগৃহের অন্যান্য নিম্নস্তরা দাসীদের সঙ্গে একত্র ঘরদোর ঝাড়াপোঁছা করার জন্য— সম্মার্জতাং বেশ্ম পরৈতু শীঘ্রং/তত্ৰাস্তু দাসীভিরপুণ্যশীলা।
কিন্তু দাসীত্বের এই অবনমিত সংজ্ঞার সঙ্গে যে কাম চরিতার্থতারও সম্বন্ধ আছে, সে-কথা মনে করিয়ে দিলেন দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণ। তিনি দ্রৌপদীকে এইকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দুর্যোধনের মনেও সেই দুর্বিনীত লাম্পট্যের সূচনা করে দিলেন। কথাটা কৌরবসভায় দুর্যোধনের ভাই-বেরাদরের মুখে বারবারই ভেসে আসছিল দ্রৌপদীর উদ্দেশে, বারবারই বলা হচ্ছিল— তুমি এবার পাণ্ডবদের ছাড়, কৌরবদের মধ্যেই কাউকে এবার স্বামী হিসেবে বেছে নাও। দ্রৌপদী কর্ণপাত করেননি। কিন্তু এই মাত্রাছাড়া কুৎসিত ইঙ্গিতের সঙ্গে কর্ণ এবার দুর্যোধনের লাম্পট্যের সুযোগটুকু জুড়ে দিয়ে দ্রৌপদীকে বললেন— তুমি যদি কৌরবদের মধ্যে থেকেই কয়েকটা স্বামী বেছে নাও— মনে রাখবেন, পঞ্চ-পাণ্ডবের অনুকারে দ্রৌপদীর স্বামীর প্রশ্নে কর্ণ বহুবচন ব্যবহার করছেন— কর্ণ বলছেন— তুমি যদি কৌরবদের মধ্যে থেকেই কয়েকটা স্বামী বেছে নাও, তা হলে দাসীত্ব করার সময় এটা যেন তোমার মনে থাকে যে, স্বামীদের সঙ্গে রতিরঙ্গে কামভাব কোনও নিন্দনীয় ব্যাপার নয়— অবাচ্যা বৈ পতিষু কামবৃত্তি/নির্ত্যং দাস্যে বিদিতং তত্তবাস্তু— এ-বাড়িতে দাসীবৃত্তি করার সময় সেই দাসীত্বের অঙ্গ হিসেবেই এই কামব্যবহার যেন স্মরণে থাকে।
কর্ণ বুঝিয়ে দিতে চাইলেন— এই কামব্যবহার দাসীর জীবনে সুবিদিত এবং প্রচিলত ঘটনা, দ্রৌপদী যেন সেই ব্যাপারটাকে নিন্দনীয় না ভাবেন অর্থাৎ সেই সম্পর্কসেতু যেন পরিহার্য না হয়। কর্ণের এই কথাগুলি দ্রৌপদীর কাছে যতই ইঙ্গিতপূর্ণ হোক এবং দ্ৰৌপদীও যতই উদাসীন থাকার চেষ্টা করুন, এই ইঙ্গিত পৌছে গেল দুর্যোধনের কাছে, বিদ্যুৎ-গতিতে। ফলে দুর্যোধন জীবনে যা করেননি এবং যে ব্যাপারে তাঁর নৈপুণ্যের সুনাম নেই, তিনি সেই লাম্পট্য ব্যবহারের আশ্রয় নিলেন আপন অহংকার তীক্ষ্ণ করার জন্য। তিনি বুঝেছেন— এখন এবং এখানে দ্রৌপদীর প্রতি কোনও লাম্পট্যের উচ্চারণ অথবা লাম্পট্যের ভঙ্গি প্রদর্শনই তাঁর শত্রুদের অর্থাৎ পাণ্ডবদের পক্ষে এবং তন্নিষ্ঠা দ্রৌপদীর পক্ষে সবচেয়ে বেশি অপমানজনক হয়ে উঠবে। অতএব দুর্যোধনের অন্তর্গত অহংকার এই মুহূর্তে অনূদিত হল লাম্পট্যের ভাবনায়। বন্ধু কর্ণের ইঙ্গিত যে তিনি বুঝেছেন সেটা বোঝানোর জন্য এবং জন্মশত্রু মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের সামনেই তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণের ইঙ্গিত দিলে ভীমকেও সমান্তরালভাবে ধর্ষণ করা যাবে, এই ভাবনায় দুর্যোধন তাঁর বজ্রসার বাম উরু দ্রৌপদীকে দেখাতে লাগলেন এবং সেটা দ্রৌপদীর সমস্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে— দ্রৌপদ্যা প্রেক্ষমাণায়াঃ সব্যমূরুমদর্শয়ৎ।… অভ্যুস্ময়িত্বা রাধেয়ং ভীমমাধর্ষয়ন্নিব।
দুর্যোধন তো এটাই চেয়েছিলেন এবং সেটাই হল। পাণ্ডবদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে নিজের অহংকার প্রতিষ্ঠা করতে যাবার এই ফল হল যে, ভীম সমস্ত সভাস্থলী উচ্চকিত করে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। ভীম দুর্যোধনের সমস্ত অসভ্যতা চোখে দেখলেন এবং ক্রোধে রক্তচক্ষু ঘুরিয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যুদ্ধে যদি গদার আঘাতে ওই ঊরু আমি ভেঙে না দিই তবে আমি আমার বাপ-পিতামহের সঠিক বংশধরই নই। তবে এই প্রতিজ্ঞা তো পরাজিত-বিজিত জনের অক্ষম আস্ফালন। সভাস্থলে তখনও দুর্যোধনের দিক থেকে ভয় এবং শঙ্কা এতটাই বেশি কাজ করছে যে, কারও কোনও বিরুদ্ধ কথা বলার সাহসই নেই। বিদুর ছাড়া, বিকর্ণ ছাড়া কেউ একটা কথাও বললেন না। ধৃতরাষ্ট্র তো এতক্ষণ মজা দেখছিলেন। শেষে যখন কুরুসভায় উৎপাত দেখা দিল, স্বয়ং জননী গান্ধারী পর্যন্ত যখন ক্ষেপে উঠলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে ডেকে, বর-টর দিয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলেন। সম্পূর্ণ একটা লোকদেখানি অভিনয় করে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে ডেকে বললেন— কিছু মনে কোর না বাপু! দুর্যোধনের উলটোপালটা কথা মনে রেখ না কিছু— দুর্যোধনস্য পারুষ্যং তং তাত হৃদি মা কৃথাঃ। এই বুড়োর দিকে তাকাও, অন্ধ পিতার দিকে দৃষ্টিপাত করো, তা হলেই বুঝতে পারবে।
এসব কথার পর যথোচিত সম্মান দেখিয়ে যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে যেই ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে রওনা দিয়েছেন, ওমনি দুঃশাসন বড় দাদা দুর্যোধনকে জানাল— এত কষ্ট করে সব জিতে নিয়েছিলাম আমরা, আর দিলে বুড়ো সব মাটি করে— স্থবিরো নাশয়ত্যসৌ। খবর শুনেই দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি আর দুঃশাসনের মিটিং বসে গেল। দুর্যোধন খুব রাগ করে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন— তুমি কি বৃহস্পতি-শুক্র, এই সব বড় বড় লোকদের রাজনীতির উপদেশ কিছুই শোননি। রেগে যাওয়া সাপ আর শত্রুকে একবার মাথায় উঠিয়ে দিলে তাকে কি আর নামানো যায়! আমরা পাণ্ডবদের বাগে পেয়ে খেপিয়েছি, এখন যদি তাদের ছেড়ে দিই, তা হলে কি তারা আমাদের ছেড়ে দেবে? তুমি তো লক্ষ করোনি— অর্জুন কীরকম ফুঁসতে ফুঁসতে গাণ্ডীবে মোচড় দিচ্ছে, দেখনি তো— ভীম কীরকম গদায় হাত গরম করতে করতে দৌড়চ্ছে, দেখনি তো নকুল-সহদেবের আস্ফালন! ওরা আমাদের কিছুতেই ছাড়বে না, বিশেষত দ্রৌপদীকে আমরা যা করেছি, কোন মানুষ তা ক্ষমা করতে পারে— দ্রৌপদ্যাশ্চ পরিক্লেশং কস্তেষাং ক্ষন্তুমর্হতি?
অন্তত এই মুহূর্তটি দুর্যোধন চমৎকার বুঝেছেন। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে এই মুহুর্তে দুর্যোধনের সিদ্ধান্ত ঠিক। ধৃতরাষ্টের কথা থেকে যুধিষ্ঠির যাই বুঝে আসুন না কেন, সেই মুহূর্তে রাজনৈতিক দিক থেকে পাণ্ডবদের অবস্থা ছিল বেশি সুবিধাজনক, কারণ সর্বত্র ছিল পাণ্ডবদের প্রতি সমবেদনার হাওয়া এবং অপমানিত ভীম-অর্জুনকে কোনওভাবেই যুধিষ্ঠির থামিয়ে রাখতে পারতেন না। দুর্যোধন সেটা বুঝেছিলেন এবং বুঝেছিলেন বলেই তিনি পুনরায় পাশাখেলার প্রস্তাব করলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। বললেন— ওদের ঠান্ডা করার একটাই উপায়, আবার পাশা— পুনর্দীব্যামঃ। এবারে আর সেই চেখে চেখে পণ নেওয়া নয়, পণ একটাই— হারলে বারো বচ্ছরের জন্য বনবাস এবং এক বছরের অজ্ঞাতবাস। অজ্ঞাতবাসে ধরা পড়লে ফের বারো বচ্ছরের জন্য চালান হয়ে যাবে বনে। আর পিতা তুমি তো জানো— জিতব আমরাই— জেষ্যামস্তান্ বয়ং রাজন্— তুমি কেবল একবার মত করো।
ধৃতরাষ্ট্র দেখলেন— ভাল ফন্দি তো! সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন ডাক ডাক ওদের, এখনও গেলে রাস্তায় পাবি, শিগ্গির ডাক— তৃর্ণং প্রত্যানয়স্বৈতান্ কামং বাধ্বগতানপি। সবাই না করলেন— ভীষ্ম, দ্রোণ, সোমদত্ত, কৃপাচার্য, বিকর্ণ, যুযুৎসু— সবাই ধৃতরাষ্ট্রকে বারণ করলেন, তিনি কারও কথা শুনলেন না। শেষে গান্ধারী স্বামীর মতিগতি আর সহ্য করতে না পেরে তাঁকেই বলে উঠলেন— সাধে কি এ ছেলে জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিদুর বলেছিল একে মেরে ফেলতে। এই কুলাঙ্গার ছেলের জন্য নিজেকে ডুবিয়ো না। অসভ্য চ্যাংড়া ছেলেদের মতে মত দিয়ে নিজেকে কুলক্ষয়ের কারণ করে তুলো না। পাণ্ডব-কৌরবের মধ্যে যে কুলবন্ধনের সাঁকো আছে, সেই সাঁকোটা তুমি এমনি করে ভেঙে দিয়ো না। একটা বুড়ো মানুষ যদি একটা বাচ্চা ছেলের মতো ব্যবহার করে— তাও কি শোভা পায়— ন বৈ বৃদ্ধো বালমতিৰ্ভবেদ্ রাজন্ কথঞ্চন। তুমি এ ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করো মহারাজ! গান্ধারীর সব কথা শুনে-টুনে ধৃতরাষ্ট্র গোঁয়ার-গোবিন্দের মতো রায় দিলেন— এ বংশের বারোটা বেজে যাক— অন্তঃ কামং কুলস্যাস্তু— আমার পক্ষে তা ঠেকানো সম্ভব নয়। দুর্যোধনেরা যেমন চায়, তাই করতে হবে। পাণ্ডবরা আবার পাশা খেলুক আমার ছেলেদের সঙ্গে, তারা আবার আসুক— প্রত্যাগচ্ছন্তু পাণ্ডবাঃ।
তা হলে দেখুন— সুপ্রসিদ্ধ কৌরববংশ ধ্বংসের জন্য শুধু দুর্যোধনকে দায়ী করলে হবে না। তাঁর সমস্ত ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা এবং অভিমানের মধ্যে তাঁর পিতার ঈর্ষা এবং অভিমানের পরম্পরা আছে। বিশেষত ধৃতরাষ্ট্র একটু আগেই বুঝেছেন— জয় করতে পারলে কেমন লাগে। কাজেই ধর্মশীলা গান্ধারীর মুখের ওপর ছেলের হয়ে সাফাই গাইতে তাঁর লজ্জা হল না। স্বয়ং মহাভারতের কবি এই মূহূর্তে দুর্যোধনের থেকেও তাঁর পিতা ধৃতরাষ্ট্রের আততায়ী চরিত্রের প্রকাশ করেছেন মাত্র একটি শব্দে, একটি বিশেষণে। ব্যাস বলেছেন— ধৃতরাষ্ট্র পুনরায় পাণ্ডবদের পাশাখেলায় আহ্বান করলেন এবং তা করলেন ছেলেকে আশকারা দিয়ে— অকরোৎ পাণ্ডবাহ্বানং ধৃতরাষ্ট্রঃ সুতপ্রিয়। তাঁর এই ‘সুতপ্রিয়তার’ জন্যই পাণ্ডবেরা অন্যায়ভাবে শকুনির হাতে পরাজিত হলেন। এই ‘সুতপ্রিয়তা’র জন্যই বনে যাবার মুখে দুঃশাসন পাঞ্চালীকে যা নয় তাই বলতে পারলেন, ভীমকে খোঁচা দিয়ে ‘গোরু, গোরু’ বলে পরিহাস করতে পারলেন। তবে হ্যাঁ, বনে যাবার সময় পাণ্ডবদের মেজাজ দেখে পুত্রপ্রিয় অন্ধরাজা একটু ভয় পেয়েছেন। নিজের ব্যক্তিগত সচিব সঞ্জয়কে জানিয়েওছেন সে কথা। সঞ্জয় ছাড়েননি। কুরুসভায় প্রধানত দ্রৌপদীর অপমান এবং পাণ্ডবদের যা-নয় তাই বলা— এই দুটি চরম ঘটনার উল্লেখ করে সঞ্জয় সিদ্ধান্ত করেছেন— সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই আমার কাছে ভয়ংকর লাগছে মহারাজ— ইতি সর্বমিদং রাজন্ আকুলং প্রতিভাতি মে। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের মনেও এখন ভয় ধরেছে। এতদিন অপ্রকাশ্যে এবং প্রকাশ্যে পাণ্ডবদের তিনি সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু এখন যা হল— তাতে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন— ভীম-অর্জুন কৌরবদের ছেড়ে দেবে না। অল্প হলেও তিনি এখন অনুধাবন করছেন যে, তাঁর আশকারা পেয়েই দুর্যোধন মাথায় উঠেছে এবং এ কথা ছোট ভাই বিদুর বারবার বললেও স্নেহান্ধতার কারণে তিনি কান দেননি— উক্তবান্ ন গৃহীতং বৈ ময়া পুত্ৰহিতৈষিণা।
॥ ৪ ॥
এই যে বেশ বোদ্ধার মতো কথা বলছিলেন ধৃতরাষ্ট্র— এর কোনও মানে নেই। দুর্যোধনের কারণে তিনি ছোট ভাই বিদুরকে তাড়িয়েও দিয়েছিলেন, আবার তাঁকে যে ফিরিয়ে এনে ক্ষমা চেয়েছিলেন— সেও দুর্যোধনের কারণেই। কিন্তু বিদুর ফিরে আসতেই কুরুসভার যুবকগোষ্ঠী এবং শকুনির সঙ্গে আলোচনা করতে বসলেন দুর্যোধন। উদ্দেশ্য— পাণ্ডবদের কীভাবে আরও নাকাল করা যায়। দুর্যোধন বললেন— পাণ্ডবদের ভালবাসার লোক বিদুর আবার ফিরে এসেছে। এবার যদি ধৃতরাষ্ট্র প্যাঁচে পড়ে আবার পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনে, তা হলে আবার আমাকে উপোস করে মরার কথাই ভাবতে হবে। কারণ কোনও অবস্থাতেই পাণ্ডবদের বাড়বাড়ন্ত আমার দ্বারা আর চোখে দেখা সম্ভব নয়— ন হি তান্ ঋদ্ধান্ পুনর্দ্ৰষ্টুমহমুৎসহে।
এসব অভিমানের কথায় বন্ধুজনের মায়া লাগে। তবু শকুনি, দুঃশাসন, কর্ণ সবাই মিলে দুর্যোধনকে বোঝালেন যে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে যুধিষ্ঠিরদের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এতেও যখন দুর্যোধনের মন খুব খুশি হল না, তখন কর্ণ বললেন— আমরা একটা কাজ করতে পারি— আমরা বেশ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে হঠাৎ আক্রমণে বনচর পাণ্ডবদের মেরে ফেলতে পারি। এই প্রস্তাব দুর্যোধনের মনে বেশ ধরল এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে সদলবলে রওনা হলেন। ওদিকে মহামতি ব্যাসদেব, যিনি এই কৌরবকুলের বংশধর পিতামহও বটে— তিনি দুর্যোধনের এই কু-মতলবের কথা জানতে পারলেন এবং রাস্তায় দুর্যোধনকে ধরে তাঁকে নিষেধ করলেন এই অসভ্যতা না করতে। ধৃতরাষ্ট্রকেও তিনি সাবধান করে দিলেন ছেলেকে বেশি প্রশয় দেওয়ার জন্য। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের অবস্থা তখন সেই ন্যাকা ন্যাকা বাবা-মায়ের মতো, যারা ছেলেমেয়েকে আদর দিয়ে মাথায় ওঠান, আর পরকে বলেন— তোমরা একটু বলে যাও তো, ছেলে আমাদের কথা একটুও শোনে না। তোমরা বললে শুনবে। ধৃতরাষ্ট্রও সেই ভাবে ব্যাসকে বললেন— আপনি যা বলেছেন সব ঠিক। তবু যদি আমাদের এই কৌরবকুলের ওপর আপনার একটুও দয়ামায়া থাকে তা হলে ওই বদমাশ ছেলেটাকে একটু শাসন করে যান— অন্বশাধি দুরাত্মানং পুত্রং দুর্যোধনং মম।
ব্যাস বললেন— ওই আসছেন মৈত্রেয় ঋষি। যা বলার তিনিই বলবেন দুর্যোধনকে। আমরা জানি— পাণ্ডব-কৌরবদের পিতামহ হিসেবে ব্যাস কোনও কটু কথা দুর্যোধনকে বলতে চাননি। বললে অপমানিত হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল, তথা অপমানিত হলে অভিশাপের শব্দ দিয়ে নিজের নাতিকে তিনি কণ্টকিত করবেন কী করে! সত্যি কথা বলতে কী— দুর্যোধন অদ্ভুত কায়দায় মৈত্রেয়কে অপমান করলেন। মৈত্রেয় ঋষি নরমে এবং গরমে অনেক বোঝালেন দুর্যোধনকে। কিন্তু যে মানুষ পিতা-মাতাকেই মানেন না, পরোপদেশে তাঁর কী আসে যায়! অদ্ভুত কায়দায় দুর্যোধন অপমান করলেন মৈত্রেয় ঋষিকে। যখন মৈত্রেয় নরম করে বুঝিয়ে বলছেন, তখন তাঁকে অগ্রাহ্য করার জন্য দুর্যোধন তাঁর কথায় কোনও কান না দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলেন, কখনও বা মুচকি-মুচকি হেসে মাথা নিচু করে রইলেন— তমশুশ্রুষমানস্তু বিলিখন্তং বসুন্ধরাম্। আর যেখানে মৈত্রেয় পাণ্ডবদের ভয় দেখালেন দুর্যোধনকে অথবা তাঁদের সঙ্গে সন্ধি করার কথা বললেন, সেই সব কথা উড়িয়ে দিয়ে দুর্যোধন নিজের ক্রোধ প্রকাশ করার জন্য নিজের ঊরুতে থাপ্পড় মেরে শব্দ করতে আরম্ভ করলেন— ঊরুং গজকরাকারং করেণাভিজঘান সঃ। ফলত মৈত্রেয় অভিশাপ দিলেন, যদিও সে অভিশাপ মধ্যম পাণ্ডব ভীমের প্রতিজ্ঞাত ঊরুভঙ্গের শব্দান্তর মাত্র।
মৈত্রেয়র অভিশাপ বা ব্যাসের বিরক্তি— এইসব ব্যক্তিগত আচরণে লক্ষ করার মতো আর কিছু থাকুক বা না থাকুক— এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সেকালের সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণেরা দুর্যোধনের ব্যবহারে, বিশেষত পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর অপব্যবহারে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। মহাভারতের কবি একবার প্রায় সমাজতাত্ত্বিক ঐতিহাসিকের মতো ধৃতরাষ্ট্রের মুখে জানিয়েছেন যে, দ্রৌপদীর কাপড় টানাটানি করে কৌরবেরা তৎকালীন সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্রাহ্মণদের অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং কুপিত করেছিলেন— ব্রাহ্মণাঃ কুপিতাশ্চাসন্ দ্রৌপদ্যাঃ পরিকর্ষণে। ভর দুপুরে কৌরবদের ওই কাণ্ড দেখে ব্রাহ্মণেরা বাড়িতে ফিরে গিয়ে কেবলই ছেলেপুলেদের সঙ্গে দ্রৌপদীর অপমানের গল্পই করছেন। অনুশোচনায় তাঁরা তাঁদের নিত্যকর্ম অগ্নিহোত্র পর্যন্ত করতে পারেননি সেদিন। এই ক্ষুব্ধ কুপিত ব্রাহ্মণেরা বনবাসী যুধিষ্ঠিরের পক্ষে গেছেন এবং বনে গিয়েই তাঁরা দুর্যোধনের সম্বন্ধে অত্যন্ত ঘৃণিত ধারণা প্রকাশ করেছেন।
ঠিক কথা— ব্রাহ্মণেরা দুর্যোধনের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি রাজনীতির কিছুই বুঝতেন না— তা তো নয়। বনবাসী যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদী আর ভীমের কাছে তাঁর মিনমিনে স্বভাবের জন্য অনেক কটু কথা শুনলেন, তখন তিনি দুর্যোধনের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কথা বলেই ভীম-ভাইকে শান্ত করেছিলেন। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন— তুমি দুর্যোধনদের অত কাঁচা ছেলে মনে কোরো না। অস্ত্রজ্ঞান এবং নৃশংসতার ব্যাপারে দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইরা প্রত্যেকেই সাংঘাতিক। তার মধ্যে রাজসূয় যজ্ঞ করার সময় যে সব রাজাদের আমরা হেনস্থা করেছি, যুদ্ধে যাদের পরাজিত করেছি, তারা সবাই এখন দুর্যোধনের সঙ্গে এসে জুটেছে। শুধু তাই নয়, তারা তাকে ভালবাসে— সংশ্ৰিতাঃ কৌরবং পক্ষং জাতস্নেহাশ্চ তং প্রতি। সময় বুঝে দুর্যোধনও সেই সব রাজাদের এত খাতির-যত্ন করেছেন যে তারা শুধু দুর্যোধনের হিত চিন্তা করছে— তাই নয়, তারা দুর্যোধনের জন্য প্রাণও ত্যাগ করতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা— এদের সবার ওপরে আছেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের মতো সাংঘাতিক যোদ্ধারা। এদের সবাইকে জয় না করে দুর্যোধনকে জিতে নেওয়া অসম্ভব।
যুধিষ্ঠিরের এই সাবধানতা এবং ‘ধীরে চলো’ নীতি থেকেই বোঝা যায়— রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে দুর্যোধন কতখানি সফল ছিলেন। অন্তত এই পর্বে সম্পূর্ণ ক্ষমতা-পাওয়া দুর্যোধনকে যে একা কেউ রুখতে পারবে না— সেই কথা ভেবে ভেবে যুধিষ্ঠিরের ঘুম হত না রাত্রে। এ-কথা আমরা স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের মুখেই শুনতে পাচ্ছি— ন নিদ্রামধিগচ্ছামি চিন্তয়ানো বৃকোদর। যুধিষ্ঠিরের অবর্তমানে সমস্ত রাজ্য এবং প্রজা-সাধারণকে দুর্যোধন কীভাবে, কতখানি বশীভূত করে ফেলেছিলেন, তার একটা যুতসই বর্ণনা প্রাচীন কবি ভারবির কিরাতার্জুনীয় কাব্যের প্রথম অঙ্কে আছে এবং তা মহাভারতের ভাবনা-চিন্তা অনুযায়ীই আছে। কিন্তু এই সম্পন্নতা, এই ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দুর্যোধনের লুব্ধতা এবং ঈর্ষা কিছুই কমেনি। ভারবি কথাটা বলেছেন এইভাবে যে, রাজসিংহাসনে বসেও দুর্যোধন বনবাসী যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে পর্যুদস্ত করবেন কিংবা জয় করবেন— এই চিন্তাটা ছাড়তে পারেন না। বড় মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ হয়তো বা অন্তহীন— এমনই একটা কল্পনায় ভারবি কবি দুর্যোধনকে খানিকটা ক্ষমা করে দিয়েছেন বোধহয়, কিন্তু মহাভারতে দেখছি— দুর্যোধনের ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতা এতদূর প্রসারিত যে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল— পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়েও দুর্যোধন সুখে নেই। কর্ণ-শকুনিরা দুর্যোধনকে বুঝিয়েছিলেন— পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়ে এখন তুমি সেই সাম্রাজ্য একা ভোগ করছ। সমস্ত রাজারা এখন তোমাকে কর দিচ্ছে, মুখে কেবলই বলছে— মহারাজ দুর্যোধনের জন্য আমরা কী করতে পারি— আদেশ করুন। যে সম্পদ-লক্ষ্মী আগে পাণ্ডবদের ভজনা করেছিল, সে এখন তোমার। কর্ণ-শকুনিরা বললেন— সবই হল— কিন্তু এই সময়ে বনবাস-ক্লিষ্ট পাণ্ডবদের মনে একটু জ্বালা ধরানো দরকার। তোমার যতটা আছে— সেটা একটু ওদের দেখালেই ওদের মনে জ্বালা ধরবে— তাপয়ন্ পাণ্ডুপুত্রাংস্ত্বং রশ্মিমানিব তেজসা। ধনসম্পত্তি, টাকা-পয়সা, পুত্র-কন্যা— এইসবে ঘর ভরে গেলেও যত আনন্দ হয়, বিপন্ন শত্রুর দুরবস্থা দেখে তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ হয়। তুমি একবার তোমার মেজাজ আর টাকা-পয়সার গরমটা পাণ্ডবদের দেখিয়ে এসো। কৌরব-ঘরের বউরা সব দারুণ সেজেগুজে চলুক তোমার সঙ্গে আর বাকল-পরা দ্রৌপদী সেটা দেখুক আর ভাবুক যে, পাণ্ডবদের গলায় মালা দিয়ে সে কতটা ভুল করেছে— বিনিন্দতাং চাত্মানং জীবিতঞ্চ ধনচ্যুতা।
কর্ণ-শকুনির কথা দুর্যোধনের বেশ ভাল লাগল। তিনি বললেন— আমারও ছিল মনে— সর্বং মনসি মে স্থিতম। কিন্তু এ ব্যাপারে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি পাওয়া যাবে না। নইলে আমার কি ইচ্ছে হয় না— ওই ভীম, অর্জুন আর দ্রৌপদীকে একটু দেখিয়ে দিয়ে আসি কিংবা দেখে আসি একবার বিজন অরণ্যবাসে কেমন গতর খাটিয়ে চলতে হচ্ছে ওদের। সত্যি কথা বলতে কী এর থেকে বেশি আনন্দ আর কীসে হতে পারে— কিং নু স্যাদ্ অধিকং তস্মাৎ। কর্ণ বলেছিলেন— মসৃণ সমভূমিতে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাউকে যদি বিষম ভূমিতে হোঁচট আর ঠোক্কর খেতে দেখি তা হলে মনে বড় আরাম হয়। কিংবা যদি পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে সমভূমিতে অধিষ্ঠিত যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষগুলোকে একবার দেখি, তা হলে কী অদ্ভুত মজা হয়, কী বলব— জগতীস্থান্ ইবাদ্রিস্থঃ কিমতঃ পরমং সুখম! কর্ণ অন্য পাণ্ডবদের পাত্তা না দিয়ে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ অর্থাৎ যাঁকে তিনি একতম প্রতিপক্ষ মনে করেন, সেই অর্জুনের কথা বলে বলেছিলেন— আর ওই ব্যাটা ধনঞ্জয় অর্জুন! ওকে যদি গাছের বাকল-পরা অবস্থায় দেখি, তাহলে যে কী সুখ! কোথায় রাখব এমন সুখ! আর দ্রৌপদী! কী গুমোর ছিল ওই মহিলার! তোমার বউদের যদি বেশভূষায়, সোনার অলংকারে সজ্জিত দ্যাখে, তা হলে মনেমনে আত্মগ্লানি অনুভব করবে, ধিক্কার দেবে নিজেকে এবং নিজের জীবনকে— পশ্যন্তু দুঃখিতাং কৃষ্ণাং সা চ নির্বিদ্যতাং পুনঃ।
লক্ষণীয়, দুর্যোধনও পাণ্ডবদের এই বিমানিত অবস্থায় নিগৃহীত দেখতে চান। কর্ণের সঙ্গে তাঁর মত মিলে গেছে, শুধু কর্ণের স্বাত্মারোপিত প্রতিপক্ষ অর্জুনের সঙ্গে তিনি স্বভাবিত প্রতিপক্ষ ভীমকেও বাকল-পরা দেখতে চান। দেখতে চান দ্রৌপদীকে, যিনি দরিদ্রতা-নিবন্ধন গেরুয়া পরে ঘোরাফেরা করবেন পাণ্ডব-কুটিরে— দ্রৌপদীং কর্ণ পশ্যেয়ং কাষায়বসনাং বনে। এই যে বিকৃত আনন্দ, যার মধ্যে যুদ্ধজয়ের বীরভাব নেই, ক্ষত্রিয় পুরুষের রুচি-মর্যাদা নেই, শুধু প্রতিপক্ষ নায়কদের ক্লিষ্ট, হীন দেখে আনন্দ— এটা বুঝি দুর্যোধনের বীরমানিতার মানসলোকে কর্ণ-শকুনির নীচতার সংক্রমণ। বক্তব্যের আরম্ভে একবার শুধু দুর্যোধন বলেছিলেন — দ্বৈতবনে আমরা যে পাণ্ডবদের দেখতে যাব, সেখানে পাণ্ডবদের বিনাশ করা ছাড়া আমাদের অন্য কোনও প্রয়োজন নেই— ন হি দ্বৈতবনে কিঞ্চিদ্ বিদ্যতেহন্যৎ প্রয়োজনম্। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে এই বীরভাব ঈর্ষা, অসূয়া আর সংকীর্ণ গ্রাম্য ভাবনায় পর্যবসিত হয়েছে। পরাশ্রিত কৰ্ণ-শকুনির প্ররোচনা যে এখানে কাজ করে, সেটা বোঝা যায় দুর্যোধনের কথায়। দুর্যোধনের নিশ্চিত ধারণা ছিল যে, দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের কাছাকাছি যাওয়াটা ধৃতরাষ্ট্র কিংবা অন্যান্য কুরুপ্রধানেরা মোটেই মেনে নেবেন না। সেইজন্যেই কর্ণকে দুর্যোধন বলেছিলেন— আমি যখন ভীষ্ম এবং ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে কুরু সভায় বসে থাকব, তখন তুমি যা বলার শকুনির সঙ্গে গলা মিলিয়ে কথা বলবে, যে কৌশলই স্থির হোক, সেটা শকুনির সঙ্গে একত্রে বোলো— উপায়ো যো ভবেদ্ দৃষ্ট স্ত্বং ব্ৰূয়াঃ সহসৌবলঃ। উপায় তো একটা বার করতেই হবে।
দুর্যোধনের কথার সঙ্গে সঙ্গেই কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনির ‘মিটিং’ আরম্ভ হয়ে গেল। কর্ণ বুদ্ধি দিয়ে বললেন— আমরা ধৃতরাষ্ট্রকে বলব— দ্বৈতবনে যে গয়লাপাড়া রয়েছে, সেখানকার গয়লারা সবাই দুর্যোধনের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। সেখানে একবার যাওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
যেই বুদ্ধি সেই কাজ। তাঁরা ‘কেস’টাও সাজালেন খুব কায়দা করে। আগে থেকেই একটা গয়লাকে গোরু-টরু দিয়ে দ্বৈতবনের প্রজা সাজিয়ে তাঁরা তাঁকে উপস্থিত করলেন ধৃতরাষ্ট্রের সামনে— ততস্তৈর্বিহিতঃ পূর্বং সমঙ্গো নাম বল্লবঃ। গয়লাটির নাম সমঙ্গ। সে আশপাশ থেকে কিছু গোরু ধরে নিয়ে এসে গয়লাদের মোড়ল সাজল বোধহয়। সেই এসে ধৃতরাষ্ট্রকে বলল— আপনার যত গোধন দ্বৈতবনে আছে, তার একটা হিসেব হওয়া দরকার— সমীপস্থাস্তদা গাবো ধৃতরাষ্ট্রে ন্যবেদয়ৎ। খুব অবিশ্বাসের কারণ নেই, কেন না তৎকালীন দিনে ‘কাউ-ব্রিডিং’ পশুপাল আর্যজনজাতির অন্যতম ব্যবসায় ছিল এবং রাজারাও রাজ্যের প্রান্তিক ‘ব্রজভূমি’তে এই পশুচর্যা করতেন। সমঙ্গ-গয়লা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আসতেই কর্ণ-শকুনিরা তার হয়ে বললেন— মহারাজ! দ্বৈতবনে গয়লাদের পাড়ায় যেসব গোরু আছে, সেগুলি তো আমাদেরই। কাজেই সেগুলি তো গুনে-গেঁথে নেওয়া দরকার। এরপর আজকের দিনে ‘রুরাল ব্যাংকিং’য়ের ভাষায় যাকে ‘ট্যাগিং’ বলে, কর্ণ যেন তারই একটু আভাস দিয়ে বললেন— এতদিনে যতগুলি গোরু এবং তার বাছুর হয়েছে— সেগুলির গায়েও একটু মার্কা মারা দরকার— স্মরণে সময়ঃ প্রাপ্তো বৎসানামপি চাঙ্কনম্। আর বচ্ছরকার এই সময়ে মৃগয়াটাও বেশ ভাল জমবে। আপনি একবার অনুমতি করুন।
ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু এই প্রস্তাবের মধ্যে কৌরবদের কুবুদ্ধির গন্ধ পেলেন। বললেন— দ্বৈতবনে যেহেতু পাণ্ডবরাও আছে তাই সেখানে গিয়ে তোমরা উলটো-পালটা অসভ্যতা করবে, সেটা ঠিক হবে না— যূয়ং চাপ্যপরাধ্যেয়ুর্দৰ্পমোহসমন্বিতাঃ। না, না, তোমাদের যেতে হবে না, তার চেয়ে কিছু ভাল ভাল রাজপুরুষ পাঠাও। তারাই গিয়ে গোরুটরু দেখে আসবে, তোমাদের যেতে হবে না।
শকুনি বললেন— এসব আপনি কী বলছেন, মহারাজ! ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সেখানে বউ-ভাই নিয়ে নিরুপদ্রবে প্রতিজ্ঞা পালন করছেন, আর আমরা সেখানে গিয়ে গোলমাল করব? আমরা ওঁদের ধারে কাছে যাব না— ন চ তত্র গমিষ্যামো যত্র তেষাং প্রতিশ্রয়ঃ। আমরা যাব, গোরুর গায়ে মার্কা মারব, চলে আসব। পাণ্ডবদের চোখের দেখা দেখারও প্রয়োজনও নেই আমাদের— ন তু পাণ্ডবদর্শনম্।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র অনুমতি দিলেন এবং যথারীতি কৌরবরা দুর্যোধনের আনুগত্যে হাতি-ঘোড়া আর ভৃত্য-বাহনের বিরাট দল নিয়ে দ্বৈতবনের দিকে রওনা দিলেন। সঙ্গে রইলেন স্ত্রীরা। ভার্যা, দাসী এবং অন্যতরা রমণীরাও। দ্বৈতবনের ঘোষপল্লীতে অস্থায়ী আবাস তৈরি হল। অফিসিয়াল কাজটুকু মন দিয়েই সেরে ফেললেন দুর্যোধন। ব্রজভূমিতে পশুসম্পদ শত শত গোরু দেখা ছাড়াও তাদের চিহ্নিত করা, গণনা করার কাজটা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই করলেন দুর্যোধন— অঙ্কৈর্লক্ষৈশ্চ তাঃ সর্বাঃ লক্ষয়ামাস পার্থিবঃ। এমনকী ভবিষ্যতের দৃষ্টি মাথায় রেখে গোবৎসগুলিকেও গণনা করে চিহ্নিত করার পর অতিশিশু গোবৎসগুলির একটা তালিকা রাখলেন দুর্যোধন এবং দুষ্ট গোরুগুলিকে পৃথক করে দমন-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কীভাবে তাদের শিক্ষিত করে তোলা যায়, সে-ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন তিনি। সত্যি বলতে কী, এই বেলায় পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞাত সত্যে যেন স্থিত রইলেন দুর্যোধন।
কিন্তু কাজ যখন মিটে গেল, তখন দ্বৈতবনবাসী পাণ্ডবদের তিনি জানান দিলেন মৃগয়ার ছলে। বন আলোকিত করে মৃগ-পক্ষীর শিকার ধরা হল। এবার আসল কাজ। দ্বৈতবনের মধ্যেই এক মনোরম সরোবরের তীরে পাঁচ পাণ্ডব ভাই এবং দ্রৌপদীর অরণ্য-কুটির। দুর্যোধন সেই সরোবরের অন্য প্রান্তে অস্থায়ী অথচ বিলাসবহুল ক্রীড়াগৃহ নির্মাণ করার আদেশ দিলেন ভৃত্যদের। ভৃত্যেরা ‘যে-আজ্ঞে’ বলে তাদের কাজ আরম্ভ করতে গেল বটে, কিন্তু বাধা আসল অন্য একটি উৎস থেকে। গন্ধর্ব চিত্রসেন কুবেরের বাসভবন ছেড়ে বহুতর গন্ধর্ব এবং অপ্সরাদের নিয়ে অনেক আগে থেকেই সেই সরোবরের তীরে বসবাস করছিলেন। ভৃত্যেরা এই সমস্যা জানালে দুর্যোধন সৈন্যদের আদেশ দিয়ে বললেন— সরিয়ে দাও ওই সব গন্ধর্বদের— উৎসারয়ত তানিতি। রাজার আদেশ পেলে সৈন্যদের তেজ বেড়ে যায়, তারা গিয়ে গন্ধর্ব-বাহিনীকে উদ্দেশ করে বলল— ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র মহাবলী দুর্যোধন এই সরোবরের তীরে বিহার করার জন্য আসছেন, তোমরা সরে যাও, সরে যাও এখান থেকে— বিজিহীর্ষুরিহায়াতি তদর্থমপসর্পত।
ঠিক এইখানেই দুর্যোধনের সমস্যা আছে। তিনি প্রতিপক্ষের বলাবল, শক্তি, ক্ষমতা কিছুই খবর নিলেন না, এমনকী তারা পাণ্ডবদের হয়ে কাজ করছে কি না, সেটাও কিছু বিচার করলেন না, অথচ সামান্য সৈন্যদের মুখে গন্ধর্ব চিত্রসেনকে হুমকি দিয়ে বসলেন। মহাভারত খুব লৌকিক দৃষ্টিতে গন্ধর্ব চিত্রসেনের দ্বৈতবনে পদাপর্ণের কারণ জানায়নি। পরে চিত্রসেনের মুখেই আমরা শুনেছি যে, তিনি নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে দুর্যোধনকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্যই দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের কুটিরের পাশেই বাসা বেঁধেছেন। দেবরাজ ইন্দ্র নাকি জানতেন যে, দুর্যোধন সপরিবারে সবান্ধবে পাণ্ডবদের বিব্রত করার জন্যই দ্বৈতবনে আসছেন। অর্জুন যেহেতু ইন্দ্রের ঔরস পুত্র, তাই ইন্দ্রের দিক থেকে এত সতর্কতা। আমরা অবশ্য এই দেবলৌকিক সংস্কারে তেমন বিশ্বাস করি না, কেন না পাণ্ডবদের আজীবন বিপদে আরও গভীর ঘটনা অনেক ঘটেছে যখন দেবরাজের সাহায্য কিছু পাননি পাণ্ডবরা। কাজেই এখানে দেবতার সংক্রমণ খুব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নয়। আবার এটাও মানতে হবে যে, ইন্দ্রের নির্দেশ নাই থাকুক, তিনি ভারতীয় জনজাতির গোষ্ঠীভুক্ত কেউ নাই হোন, কিন্তু উন্নততর কেউ, যাঁকে উপদেবতার সংজ্ঞায় চিহ্নিত করা যায়, তেমনই কেউ অর্জুনের হিতৈষণায় আগে এসে উপস্থিত হয়েছেন দ্বৈতবনে।
দুর্যোধনের সৈন্যরা দুর্যোধনের বড়াই করেই গন্ধর্বদের সরে যেতে বললে সেই গন্ধর্বরা তাচ্ছিল্যভাবে উত্তর দিল— আমরা হলাম গিয়ে দেবলোকের বাসিন্দা। তোরা মূর্খ, কাকে কী বলছিস, বুঝিসও না। তা ছাড়া মরবার ইচ্ছেটাও তোদের মনে বড় জোরদার হয়ে উঠেছে। সৈন্যমুখে এ-সব কথা শুনে দুর্যোধন আরও ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন— সব শেষ করে দাও, আমার বিরুদ্ধাচরণ করে এত বড় সাহস! কে গন্ধর্ব! কীসের গন্ধর্ব! স্বয়ং ইন্দ্র আসলেও তাকে দূর করো এখান থেকে। দুর্যোধন কিছু বুঝলেন না, কে এল পাণ্ডবদের সাহার্য্যার্থে, তার বলাবল কত, তার উদ্দেশ্য কী— কিছুই বিচার করলেন না। সসৈন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রতিপক্ষের ওপর। গন্ধর্ব-সৈন্য তেড়ে আসতেই কুরুসৈন্যরা অনেকেই দুর্যোধনের সামনেই পালাতে আরম্ভ করল, এমনকী পালালেন দুর্যোধনের ভাইরাও। দ্বৈতবনে আসার ব্যাপারে বন্ধু কর্ণই যেহেতু দুর্যোধনের বুদ্ধিদাতা ছিলেন, অতএব তিনি প্রথম যুদ্ধ আরম্ভ করলেন নির্ভয়ে। প্রাথমিক সাফল্যও তাতে এল এবং দুর্যোধনের বাহিনীতে উল্লাসও শুরু হল।
এবার গন্ধর্ব চিত্রসেন নিজে এলেন যুদ্ধ পরিচালনায়। দুর্যোধন, শকুনি, দুঃশাসন, বিকর্ণ সকলেই কর্ণকে সামনে রেখে যুদ্ধ করছিলেন, কিন্তু চিত্রসেন স্বয়ং যুদ্ধে নামলে কর্ণের অবস্থা বেসামাল হয়ে উঠল। রথ নষ্ট হয়ে যেতে তিনি কোনওমতে বিকর্ণের রথে উঠে যেভাবে ঘোড়াগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে চালিত করলেন, তাকে এক কথায় পালানো বলে। কিন্তু এই অবস্থায় দুর্যোধন কী করেন? সৈন্য-সেনাপতি-যোদ্ধা এবং অবশেষে কর্ণও পালিয়ে গেলে নিজের অভিমান প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাঁর একা যুদ্ধ করা ছাড়া অন্য আর কোনও উপায় ছিল না। গন্ধর্বরা সবাই মিলে তাঁকে ঘিরে ধরল এবং তাঁকে বন্দি করে নিয়ে চলল। দুঃশাসন তো বটেই, তাঁর সঙ্গে কুরুকুলের রাজবধূদের সকলকে ধরে নিয়ে চলল গন্ধর্বরা। নিরুপায় কৌরবসৈন্যরা তাদের অবশিষ্ট রথ, বাহন এবং সহাগতা বেশ্যাদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হল যুধিষ্ঠিরের কাছে। তারা দুর্যোধন এবং বিশেষত রাজবধূদের বন্দি হবার খবর আর্তভাবে জানাল যুধিষ্ঠিরকে।
কথায়-কথায় অবশ্য সবই বেরিয়ে পড়ল— কেন এখানে এসেছিলেন দুর্যোধন এবং কী তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এই ঘটনায় সবচেয়ে খুশি হয়েছেন বুঝি মধ্যম পাণ্ডব ভীম। দুর্যোধন যেমন তাঁকে সইতে পারেন না, তেমনই ভীমও সইতে পারেন না দুর্যোধনকে। এমন অবস্থায় দুর্যোধনের লোকেরা যখন দুর্যোধন এবং কুরুকুলবধূদের প্রাণ বাঁচানোর ভিক্ষা চাইতে লাগলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, তখন ভীম বড় খুশি হলেন। বললেন— ওরে শোন তোরা, আমরা হাতি-ঘোড়া-রথ সাজিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যেটা করতাম, গন্ধর্বরা সেটা আমাদের হয়ে করে দিয়েছে— অস্মাভির্যদনুষ্ঠেয়ং গন্ধর্বৈস্তদনুষ্ঠিতম্। দুর্যোধন যে বুদ্ধি করে এসেছিল এখানে, সেটা অন্যরকম হয়ে গেছে। আমরা খারাপ অবস্থায় অক্ষম হয়ে এখানে বসে আছি, আর দুর্যোধন নিজের ঐশ্বর্য আর মেজাজ দেখানোর জন্য এখানে এসেছিল। সামর্থ্যহীন লোকের ওপর যারা এইভাবে মানসিক অত্যাচার করতে আসে তাদের এইরকমই হয়। বেশ হয়েছে। গন্ধর্বরা ঠিক কাজটাই করেছে।
ভীমের এই কথার প্রতিবাদ করলেন স্বয়ং যুধিষ্ঠির। ভীম এক্কেবারে চিবিয়ে-চিবিয়ে মুখ বেঁকিয়ে কথা শোনাচ্ছিলেন দুর্যোধনের লোকদের— ভীমসেনম্ অপস্বরম্। যুধিষ্ঠির বললেন— এমন কঠিন সময়ে এত কঠিন কথা কি বলতে আছে ভাই! দুর্যোধন বিপদে পড়েছে, ভয়ার্ত হয়ে তার পক্ষের লোকেরা আমাদের সাহায্য চাইতে এসেছে, আর তুমি বাছা তাদের অকথা-কুকথা শোনাচ্ছ। দ্যাখো, জ্ঞাতি-শরিকদের মধ্যে পরস্পর ভেদ হয়, বিবাদ হয়, শত্রুতাও হয়। কিন্তু তাই বলে বাইরের লোক এসে আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বংশের মানুষদের মেরে যাবে, বন্দি করে নিয়ে যাবে, তাতে আমাদের বংশ-মর্যাদা কোথায় যায়?
মহাভারতের এই একটা জায়গা, যেখানে দুর্যোধন এবং যুধিষ্ঠিরকে আমরা বিপ্রতীপ মানসিকতায় পরস্পরের কাছাকাছি আসতে দেখছি— আমাদের বারবার মনে হয়েছে— গন্ধর্ব চিত্রসেন এখানে একটা তৃতীয় উপস্থিতি, যিনি এই দুই চরম প্রতিপক্ষের মানস-লোক বিপ্রতীপভাবে প্রতিষ্ঠা করছেন। কতখানি নীচ এবং হীন মানসিকতায় দুর্যোধন সহায়হীন পাণ্ডবদের দরিদ্র বনবাসী জীবনের মধ্যে আপন সাহংকার উপস্থিতি ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন এবং কতখানি উদারতা এবং মহত্ত্বে যুধিষ্ঠির সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে মহাকাব্যিক সত্তায় প্রতিষ্ঠিত করছেন— এই ঘটনা তারই প্রমাণ করে। গন্ধর্ব চিত্রসেন এখানে অবান্তর করণ-মাত্র। যুধিষ্ঠির বলেছেন— গন্ধর্বরা দুর্যোধন এবং তাঁর সহাগত স্ত্রীদের অপহরণ করে আমাদের বংশের মর্যাদা নষ্ট করেছে। ভাইরা! প্রস্তুত হও তোমরা, দুর্যোধনকে যেভাবে হোক বাইরের লোকের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে— মোক্ষয়ধ্বং নরব্যাঘ্রাঃ হ্রিয়মাণং সুযোধনম্।
আমরা জানি— গন্ধর্ব চিত্রসেনের সঙ্গে পাণ্ডবদের অনেক যুদ্ধ হয়েছিল। বিশেষত অর্জুনের সঙ্গে। অবশেষে চিত্রসেন দুর্যোধনের দুষ্ট পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠির তবু দুর্যোধন এবং কুরু-বাড়ির সালংকারা রাজবধূদের ছেড়ে দিতে বলেছিলেন বংশমর্যাদার কারণে। চিত্রসেন যুধিষ্ঠিরের কথা মেনে দুর্যোধন, দুঃশাসন এবং সমস্ত কৌরব-স্ত্রীদের মুক্ত করে দিলেন যুধিষ্ঠিরের সামনে। চিত্রসেন বিদায় নিলে দুর্যোধন যেন এক অদ্ভুত অপমানজনক পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়লেন। যাঁদের তিনি চরম অপমান করতে এসেছিলেন, তাঁরাই তাঁকে অন্যতর শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করে আনলেন। শত্রুর এই মহাপ্রাণতা, বদান্যতা কতখানি পীড়া দিতে পারে, তা যে কোনও অহংকারী অভিমানী মানুষমাত্রেই জানে। তার মধ্যে লজ্জায় অধোমুখ দুর্যোধনকে যুধিষ্ঠির সদুপদেশ দিচ্ছেন, সেই উপদেশ দুর্যোধনের মনে বৃহত্তর কষ্ট জাগিয়ে তুলল।
যুধিষ্ঠির বললেন— এমন সাহসের কাজ, এমন হঠকারিতা আর কোর না ভাই— মাস্ম তাত পুনঃ কার্ষীরীদৃশং সাহসং ক্কচিৎ। এমন হঠকারিতা করে কোনও দিন সুখ আসতে পারে না। তুমি এবার বাড়ি ফিরে যাও, কোনও অপমান হয়েছে বলে দুঃখ রেখো না মনে— গৃহান্ ব্রজ যথাকামং বৈমনস্যঞ্চ মা কৃথাঃ।
অপমানিত অবস্থায় অযাচিত উপদেশ শুনে দুর্যোধনের রাগ আরও পাঁচগুণ বেড়ে গেল। লজ্জায় মাথা নিচু তিনি করে বাড়ির পথ ধরলেন— বিমনা, হতভ। বন্ধু কর্ণ আগেই চিত্রসেনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর মুক্ত দুর্যোধনের কাছে তিনি যখন এসে ভাগ্যের দোহাই দিলেন, তখন দুর্যোধনের দুঃখের বাঁধ ভেঙে গেল। বললেন— যাদের আমি শত্রু বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছি— তারাই আমায় বাঁচাল— এর চাইতে বড় অপমান আর কী হতে পারে? তার ওপরে আমাদের যে পরিকল্পনা ছিল— পাণ্ডবদের গরম দেখানো— সেই গোপন পরিকল্পনাও যুধিষ্ঠিরের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে ওই গন্ধর্ব চিত্রসেন। এর পরে আর আমি হস্তিনাপুরে মুখ দেখাব কী করে? স্বয়ং পিতা ধৃতরাষ্ট্র থেকে আরম্ভ করে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ— এঁরা তো যা-তা বলবেন আমাকে। তাঁদের কাছে আমি কীই বা উত্তর দেব— কিং মাং বক্ষ্যন্তি কিং চাপি প্রতিবক্ষ্যামি তানহম্?
অন্তত এই মুহূর্তে দুর্যোধন যেন নিজেকে একটু চিনতে পারছেন। চরম লাঞ্ছনা এবং অপমানের মধ্যে আজ তাঁর আন্তরিক অনুভূতি হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন— দুর্বিনীত, অহংকারী লোকের যদি বিদ্যা অথবা ঐশ্বর্য লাভ হয়, তা হলে তার অবস্থা এই রকমই হয়। নিজের দোষেই তাঁর আজ এই অপমান জুটেছে, নিজের দুঃখের কথা তিনি কাকে বলবেন— আত্মদোষাৎ পরিভ্রষ্টঃ কথং বক্ষ্যামি তানহম্? দুর্যোধন যখন ক্ষণেকের জন্য এই আত্মসমালোচনায় মগ্ন ঠিক তখনই কর্ণ বললেন— এতে এত লজ্জা বা দুঃখের কী আছে? পাণ্ডবরা তোমাকে রক্ষা করেছে?— তো? রক্ষা করাই তো উচিত। তারা তোমারই রাজ্যের অন্তর্গত বনাঞ্চলে বাস করছে, তারা তোমার প্রজা মাত্র। তা ছাড়া তাদের আমরা জিতে নিয়েছি— তারা তোমার দাস। দাসের কাজই হল প্রভুকে সব সময় রক্ষা করা। পাণ্ডবরা তাই করেছে, তাতে এত হা-হুতাশের আছেটা কী? তুমি ওঠো তো। কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন একটু নড়েচড়ে বসলেন বটে, কিন্তু পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারলেন না। তারপর শকুনিও বোঝালেন অনেকক্ষণ। কিন্তু না, চরম এক বিষন্নতা দুর্যোধনকে আজ পেয়ে বসেছে। অপমানে জর্জরিত দুর্যোধন আত্মহত্যা ছাড়া কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষে একেবারে অলৌকিকভাবে এক অনার্য দৈত্যের কাছে পাণ্ডব-বধের আশা পেয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন দুর্যোধন। এই অনার্য দৈত্য হয়তো বা তাঁর মানসলোকের প্রতিরূপ, যে তাঁকে আবার আশায় বুক বাঁধতে প্রেরণা যোগায়।
হস্তিনাপুরে ফিরে এসে আবার একই রকম দুর্যোধনকে দেখতে পাই আমরা। পাণ্ডবদের দেওয়া মুক্তিতে অপমানিত হয়ে সাময়িক যে নির্বেদ এসেছিল তাঁর মনে, তা উবে গেছে দৈত্যের কাছে সংশপ্তক রাক্ষসবাহিনী পাওয়ার প্রত্যাশায়। দুর্যোধন বুঝে এসেছেন ওই সংশপ্তক বাহিনী কৃষ্ণ-অর্জুন সবাইকে মেরে ফেলবে। কাজেই আত্মহত্যার প্রয়াস শান্ত হয়েছে নবায়মান পাণ্ডববধের প্রতিজ্ঞায়। হস্তিনাপুরে ফিরে আসার পর ভীষ্ম একবার কথাটা তুলেছিলেন বটে, কিন্তু দুর্যোধন তাঁর মুখের ওপর এমন উড়িয়ে-দেওয়া হাসি হেসেছিলেন যে, ভীষ্ম লজ্জায় সভাস্থল ছেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে লুকোতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই তো দুর্যোধন যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে আছে শুধু জ্ঞাতিভাই-পাণ্ডবদের যন্ত্রণা দেওয়ার উপলব্ধি নিয়ে। এর সঙ্গে আছে হাস্যকর প্রতিযোগিতা। পাণ্ডবরা দিগ্বিজয় করেছিলেন, অতএব তার নকলে কর্ণও দিগ্বিজয়ে বেরোলেন। যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন। অতএব কর্ণের মামুলি দিগ্বিজয়ের পর দুর্যোধন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের ডেকে বললেন— আমিও রাজসূয় যজ্ঞ করব। ব্রাহ্মণেরা বললেন— তা তো হবে না, বাপু! যুধিষ্ঠির বেঁচে থাকতে তোমার কুলের আর কেউ দ্বিতীয়বার রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবে না। দুর্যোধনকে অতএব মুখ ভারী করে বৈষ্ণব যজ্ঞ করতে হল— রাজসূয়ের বিকল্প।
শুধু কী এই। বস্তুত দুর্যোধন যদি অন্য কারও সঙ্গে ভদ্র কিংবা উচিত আচরণ করেন— তার পেছনেও কোনও-না-কোনওভাবে পাণ্ডবদের ক্ষতি করার তাড়না আছে। অস্থিরমতি, ক্রুদ্ধ দুর্বাসা মুনিকে তিনি ভৃত্যের মতো সেবা করে তুষ্ট করেছিলেন। কিন্তু বর চাওয়ার সময় সারল্যের ভান করে এমন একটা বর চাইলেন যাতে পাণ্ডবরা ভীষণ বিপাকে পড়েন। মনে আছে নিশ্চয়ই— সেই শত শিষ্য নিয়ে দুর্বাসার পাণ্ডব-বাড়িতে অসময়ে অতিথি হওয়ার কথা। দুর্যোধন এই রকমই চেয়েছিলেন। সূর্যের দেওয়া থালিতে দ্রৌপদীর খাওয়া হয়ে যাবে, এমন সময় দুর্বাসা ভোজনের জন্য উপস্থিত হবেন। দুর্বাসা কথা রেখেছিলেন, কিন্তু পাণ্ডব-সখা কৃষ্ণের কারণে সফলকাম হননি। দুর্বাসা চলে গেলেই বনবাসের নির্জনতায় দ্রৌপদীকে উত্ত্যক্ত করেছিলেন দুর্যোধনের ভগ্নিপতি জয়দ্রথ। অবশ্য এ ব্যাপারে দুর্যোধনের সরাসরি কোনও হাত ছিল না। কিন্তু তিনি যে এতে যথেষ্ট খুশি হয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে অনেক।
॥ ৫ ॥
শেষে বুঝে গিয়েছিলেন দুর্যোধন। বুঝে গিয়েছিলেন যে, বনবাসে বারবার পাণ্ডবদের উত্ত্যক্ত করে লাভ নেই। একে তো পাণ্ডবদের দিকে সহানুভূতির পাল্লা ভারী, অন্যদিকে বনবাসীর কাছে হস্তিনাপুরের রাজার অপমান আরও বেশি দুর্ভাগ্য বয়ে আনে— ঘরে বাইরে সবখানে। তার চাইতে যদি অজ্ঞাতবাসের সময় একটিবার পাণ্ডবদের ধরে ফেলা যায়, সেটাই হবে তাঁর রাজত্বের পক্ষে অনেক বেশি স্বস্তিকর। দেখতে দেখতে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় এসে গেল। এই বারো বছর দুর্যোধন চুটিয়ে রাজত্ব করেছেন, ভোগ সুখ সবই এখন তাঁর করতলের আমলকীর মতো। কিন্তু এরই মধ্যে একটি চিন্তা তাঁকে কীটের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে— পাণ্ডবদের বনবাসের সময় অতীত। অজ্ঞাতবাসের ত্রয়োদশ বৎসর চলছে। শুধু তাই নয়, ভোগে, সুখে, মত্ততায় সময়টা কতটা পার হয়ে গেল— তা অতটা খেয়াল করেননি দুর্যোধন। অনেকানেক চর লাগিয়ে রাখা আছে যদিও, কিন্তু সেই জন্যই যেন আরও মনে নেই। কেবলই ভেবেছেন— চরেরা তো খুঁজছে, পেলেই খবর দেবে। এদিকে বিরাট-রাজ্যে বিরাটের অত্যাচারী শ্যালক কীচক মারা গেল অদ্ভুতভাবে। চরেরা ভাবল— পাণ্ডবদের খবর নাই দিতে পারি, অন্তত এই খবরটা দুর্যোধনকে দিলে রাজা খুশি হবেন। চরেরা এসে বলল— হাটে, মাঠে, গৃহে, গোঠে, গ্রামে গঞ্জে, পাহাড়ে-গুহায়, কুঞ্জে, বনে— কোথায় খুঁজিনি? কিন্তু পাওয়া গেল না পাণ্ডবদের। ওরা যেন হারিয়ে গেছে, লুপ্ত হয়ে গেছে যেন এই পৃথিবী থেকে— সর্বথা বিনষ্টাস্তে। যাই হোক মহারাজ! একটা ভাল খবর দিচ্ছি— মৎস্যদেশের রাজার অত্যাচারী শ্যালক কীচক মারা গেছে। মৎস্যদেশ আপনার শত্রু রাজ্য। সেই রাজ্যের সেনাপতিকে রাতের গভীরে অদৃশ্য অবস্থায় কারা সব মেরে রেখে গেছে। এইরকম একটি শক্ৰ উৎখাত হওয়ার প্রিয় সংবাদ শুনে অন্তত যা করার করুন, মহারাজ!
মনে রাখা দরকার— যে রাত্রে কীচক বধ হল, তার পরের দিন থেকে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হতে বাকি ছিল আর তেরো দিন। দ্রৌপদীর কথায়— ত্রয়োদশাহমাত্রং মে রাজা ক্ষাম্যতু ভামিনি। মৎস্য দেশ, মানে এখনকার ‘পিংক সিটি’ জয়পুর থেকে চরেরা হস্তিনাপুর— অর্থাৎ আধুনিক মিরাটের কাছাকাছি অঞ্চলে আসতে যদি দুই-একদিন সময় নিয়ে থাকে তা হলে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হতে আর বাকি মোটামুটি দশ দিন। স্বাভাবিকভাবেই কীচকবধে দুর্যোধনের কোনও ভাবান্তর হল না। তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন— পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হতে আর অল্পদিনই বাকি আছে— অল্পাবশিষ্টং কালস্য। এখন সবাই মিলে নেমে পড়— ওদের খুঁজে বার করতেই হবে। এই সময় যদি শেষ হয়ে যায়, পাণ্ডবরা সব সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ফিরে আসবে— ক্ষরন্ত ইব নাগেন্দ্রাঃ সর্বে হ্যাশীবিষোপমাঃ। আমি যাতে আরও বেশ কিছুকাল নির্দ্বন্দ্বে, নিরাপদে রাজ্য চালাতে পারি— সে ব্যবস্থাটা তো করতে হবে।
কর্ণ দুর্যোধনের কথা সম্পূর্ণ সমর্থন করে চারদিকে আরও দক্ষ, ধূর্ত দূত পাঠাতে বললেন; দুঃশাসনও তাই বললেন। কিন্তু কর্ণ-দুঃশাসনের এই প্রস্তাব দ্রোণ-ভীষ্ম কেউই মানলেন না। এমনকী কৃপাচার্যও প্রতিবাদ করলেন একটু অন্য কায়দায়। এদিকে হল কী বিরাট রাজার চিরশত্রু ত্রিগর্ত দেশের রাজা কীচকের মৃত্যুতে অত্যুৎসাহী হয়ে দুর্যোধনকে বিরাট রাজার দেশ আক্রমণ করতে বললেন। তাঁর বক্তব্য— পাণ্ডবদের তো এখন অর্থ, ক্ষমতা এবং সহায় কিছুই নেই, ওদের খুঁজে বার করে কী লাভ? বরঞ্চ বিরাট রাজ্য আক্রমণ করলে কত কিছু পাব ভাবতে পার! দুর্যোধন হঠাৎই ত্রিগর্তরাজ সুশর্মার কথায় নেচে উঠে বিরাট রাজ্য আক্রমণেরই সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক হল আক্রমণ হবে দ্বিমুখী। সুশৰ্মা একদিকে বিরাটকে আক্রমণ করে ব্যস্ত রাখবেন, অন্যদিকে কৌরবরা লুটে নেবেন বিরাটের গোশালা।
কিন্তু রণক্ষেত্রে নীতি-নিয়ম, সদিচ্ছা— সবই পালটে যায়। সুশর্মা যা ভাবতেও পারেননি, তাই হল। তিনি যেহেতু কৌরববাহিনী রওনা হবার আগেই যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, কাজেই কৌরবদের অজ্ঞাতেই তাঁকে ভীম, নকুল, সহদেব— এঁদের হাতে মার খেয়ে ফিরতে হল। ওদিকে দুর্যোধন যখন ভীষ্ম-দ্রোণ সবাইকে নিয়ে বিরাটের গোরু চুরি করতে গেলেন, তখন বিরাট-রাজার ছেলে কুমার উত্তরের সঙ্গে সংগ্রাম-ভূমিতে উপস্থিত হলেন অর্জুন। অর্জুনকে দেখে ভীষ্ম-দ্রোণ— এইসব কুরুবৃদ্ধের যার যা প্রতিক্রিয়া হওয়ার হল। দুর্যোধন কিন্তু অর্জুনের প্রসঙ্গ শোনামাত্রই ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপকে ডেকে বললেন— আমি কিংবা কর্ণ এ কথা বহুবার বলেছি, আবারও বলছি। আমরা কিন্তু ছাড়ব না, আমরা আগেই বলেছি— অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবদের কাউকে দেখা গেলে আবার বারো বছরের জন্য তাদের বনে যেতে হবে। দুর্যোধন যথাসম্ভব অঙ্ক কষে বললেন— আমার ধারণা— ওদের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে যায়নি, তেরো বছর হতে এখনও কিছুদিন বাকি আছে— তেষাং ন তাবন্নিবৃত্তং বর্ত্ততে চ ত্রয়োদশম্। তাই বলছি এই সময়ে অর্জুন যদি দেখা দেয়, তা হলে কিন্তু বারো বছরের জন্য পাণ্ডবদের আবার যেতে হবে বনে।
কথাটা বলেই দুর্যোধনের মনে হল— হিসেবে কোনও গণ্ডগোল হল না তো! এত জোর দিয়ে কি তিথি নক্ষত্রের সব হিসেব মনে মনে রাখা যায়? একটু সামলে নিল দুর্যোধন— হয় এই অর্জুনটা রাজ্যের লোভে প্রতিজ্ঞাত কালের আগেই কিচ্ছু না বুঝে বেরিয়ে পড়েছে, নয়তো বা আমিও কালাকাল বিচার না করে বলে ফেললাম। তা এই গণনায় যাই থাক, দিন কম হোক আর বেশি হোক, ভীষ্ম সেটা জানবেন। আমাদের স্বার্থ আছে, কাজেই গণনায় ভুল থাকতেই পারে, কারণ স্বার্থ থাকলেই লোকে নিজের বক্তব্যে একপেশে হয়— স্বার্থে সর্বে বিমুহ্যন্তি। অতএব ভীষ্ম বলুন।
দুর্যোধন বুঝেছেন— এত বড় একটা ব্যাপার, সেখানে গণনায় ভুল করে উলটোপালটা বলাটা একেবারেই ঠিক হবে না। ব্যাপারটা তিনি ভীষ্মের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্বার্থের ব্যাপারটা তাঁর মাথায় রয়ে গেছে। ভীষ্ম চান্দ্র মাস, সৌর মাস, তিথি, নক্ষত্র, নানা পদ্ধতিতে হিসেব করে দুর্যোধনকে বুঝিয়ে বললেন— অজ্ঞাতবাসের সময় পূরণ হয়ে গেছে এবং সেটা ধ্রুব জেনেই অর্জুন আজ যুদ্ধ করতে এসেছে। দুর্যোধন দেখলেন— এ কথার পরে যদি ভীষ্ম প্রস্তাব করে বসেন যে— তা হলে বাপু পাণ্ডবদের রাজ্য এবার পাণ্ডবদের ফিরিয়ে দাও, তা হলে তো তার কাছে আরেক বিপদ। অতএব কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি প্রস্তাব করলেন— সে যাই হোক যুদ্ধ ছাড়া আমি কিন্তু পাণ্ডবদের এক ফোঁটা জমিও ছাড়ব না পিতামহ— নাহং রাজ্যং প্রদাস্যামি পাণ্ডবানাং পিতামহ। অতএব আপনি যুদ্ধের তোড়জোড় করুন।
দুর্যোধনের কথা শুনে মহামতি ভীষ্ম অনেক যুদ্ধ-কৌশল প্রয়োগ করলেন বটে, তবে অর্জুন যুদ্ধ জিতে নিলেন। কর্ণ, দ্রোণ, ভীষ্ম— এই মহারথীদের স্তব্ধ করার পর দুর্যোধনের সঙ্গেও অর্জুনের সোজাসুজি যুদ্ধ হয়েছিল এবং তিনি পালিয়ে বেঁচেছিলেন। অর্জুন তাকে বলেছিলেন— তোমাকে বাঁচাবার মতো কোনও সহায়ই আজ তোমার দেখছিনে, তুমি অন্তত পালিয়ে বাঁচো— অপৈহি যুদ্ধাৎ পুরুষপ্রবীর। দুর্যোধন পালিয়েই গিয়েছিলেন, সবাই মিলে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এতে তাঁর কোনও লজ্জা হয়নি। বস্তুত দুর্যোধনের লজ্জা ব্যাপারটাই একটু কম। যে মানুষ জতুগৃহে জ্ঞাতিভাইদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেও আবার তাঁদের সামনে দাঁড়াতে পারে, যে মানুষ নির্দ্বিধায় কুলবধূকে সর্বসমক্ষে বিবস্ত্রা করার প্রয়াস নিতে পারে, এবং যে মানুষ কপটভাবে একজনকে প্রাপ্য রাজ্য থেকে বঞ্চিত করতে পারে— স্বভাবতই তাঁর লজ্জা কম। লজ্জা কম বলেই অর্জুনের অতিমানবিক যুদ্ধ-কৌশল দেখেও দুর্যোধন পুনরায় যুদ্ধের উদ্যোগ করতে আরম্ভ করলেন। অপি চ এই উদ্যোগ কোনও সাধারণ যুদ্ধোদ্যোগ নয়— নিজের স্বার্থে দূর এবং নিকট জনের সবার রক্তক্ষরণের উদ্যোগ।
অজ্ঞাতবাসের শেষে যেদিন বিরাট রাজার ঘরে পাণ্ডবদের সঙ্গে ‘মিটিং’ বসল, সেখানে বলরামের মতো যুদ্ধবীর শান্তির প্রস্তাব করলেও যদুবীর সাত্যকি এবং পাঞ্চাল নেতা দ্রুপদ— কেউই আর শান্তির পায়রা ওড়াতে পারেননি। বিশেষত দুর্যোধনের চরিত্র বিশ্লেষণে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের অনুমান ছিল অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। দ্রুপদ বলেছিলেন— দুর্যোধনকে নরম কথা অথবা শান্তির বাণী শুনিয়ে কোনও লাভ নেই। কারণ দুর্যোধনের বুদ্ধি যেমন, তাতে নরম কথায় কোনও কাজ হয় না— ন হি মার্দবসাধ্যোহসৌ। দ্রুপদ মনে করেন— এবং সেটাই ঠিক যে, যদি কোনও মানুষ দুর্যোধনের সঙ্গে নরম ব্যবহার করেন কিংবা নরম করে কথা বলেন, তবে দুর্যোধন তাঁকে অবধারিতভাবে শক্তিহীন মনে করেন— মৃদুং বৈ মন্যতে পাপো ভাষমানম্ অশক্তিকম্। অতএব ভাল কথা বলে দুর্যোধনকে কখনওই বাগে আনতে পারবে না, ওর সঙ্গে তীক্ষ্ণ আচরণ করতে হবে।
দ্রুপদের বিশ্লেষণ যে কতটা ঠিক তা প্রমাণ করবে মহাভারতের যুদ্ধপর্বগুলি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা— দুর্যোধন এমন একজন লোক যে শুধু নরম কথা বললে তাকে নিঃশক্তিক ভেবেই ক্ষান্ত হন না, যদি কেউ তাঁর সঙ্গে গরমে কথা বলে তবে তার ওপরে তিনি আরও বেশি ক্রুদ্ধ হন। বস্তুত অহংকারের সঙ্গে ব্যক্তিগত বীরত্ব মেশার ফলেই দুর্যোধনের চরিত্র হয়ে পড়েছে সীমাহীন উন্মাদনার আধার। দ্রুপদের কথামতো পাণ্ডবদের দূত হয়ে দ্রুপদের পুরোহিত এসে পাণ্ডবদের হয়ে রাজ্য চাইলেন এবং দ্রুপদ যেহেতু চেয়েছিলেন যে, দূত যেন একটু মেজাজে কথা বলে— তাই তিনি বেশ মেজাজেই তাঁর বক্তব্য রেখেছিলেন। এতটাই মেজাজে যে, সমদর্শী ভীষ্ম তাঁর সব কথা সমর্থন করেও বলেছিলেন,— আপনি যা বলছেন সব ঠিক, কিন্তু কথাগুলি খুব তীক্ষ্ণ এবং সেটা হয়তো আপনি ব্রাহ্মণ বলেই— অতি তীক্ষ্ণন্তু তে বাক্যং ব্রাহ্মণ্যাদিতি মে মতিঃ। কিন্তু এই মেজাজি ভাষণ শুনে দুর্যোধনের কী প্রতিক্রিয়া হল? প্রথমত তিনি রাগে কথাই বলতে পারেননি। তাঁর হয়ে কর্ণ বলেছেন— দুর্যোধন আপনার কথায় ভয় পেয়ে পাণ্ডবদের পৈতৃক অংশ একটুও ছেড়ে দেবেন— এটা ভাববেন না— দুর্যোধনে ভয়োদ্বিগ্নো ন দদ্যাৎ পাদমন্ততঃ। কর্ণ যা বললেন— এটাই কিন্তু আসলে দুর্যোধনের মত।
এরই মধ্যে দুর্যোধন আবার এক নতুন প্যাঁচ কষতে আরম্ভ করেছেন। তিনি যেহেতু কোনওভাবেই পাণ্ডবদের এক কণা জমি ছাড়বেন না, তাই পাণ্ডবদের অধার্মিক সাজিয়ে নতুন এক উপন্যাস তৈরি করার চেষ্টা করছেন। মোদ্দা কথা, বিরাট রাজার সঙ্গে যুদ্ধের সময় ভীষ্ম যে চান্দ্র-মাসের অঙ্ক দিয়ে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের অবশেষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, দুর্যোধনেরা এখন সেসব উলটে দিয়ে অন্য কথা বলছেন। বেবুঝ, যুক্তিহীন ছেলেটির মতো দুর্যোধন জানেন— এমনিও যুদ্ধ করব, ওমনিও করব, মাঝখান থেকে পাণ্ডবদের হীন সাজানোয় দোষ কী? কর্ণ দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে দ্রুপদের দূতকে বললেন— দুর্যোধনের হয়ে শকুনি পাণ্ডবদের সব জিতে নিয়েছিল। পাণ্ডবদের প্রতিজ্ঞা ছিল— তারা বনে যাবে। হ্যাঁ, বনে গেছে। এখন প্রতিজ্ঞা অনুসারেই তারা পিতার রাজ্য ফিরে পেতে চাইছে— সেটাও বুঝলাম। কিন্তু এর মধ্যে মৎস্যরাজ বিরাট আর পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের মদত আছে— এটাই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এটা মনে রাখবেন— বিরাট আর দ্রুপদের মদতে চোখ রাঙিয়ে দুর্যোধনকে দিয়ে কিছু করানো যাবে না। আমাদের কথা হল— যদি পিতা-পিতামহের রাজ্য চাও, তা হলে তোমাদের আবার বনে যেতে হবে, কারণ অজ্ঞাতবাস শেষ হবার আগেই আমরা তোমাদের দেখে ফেলেছি। কাজেই প্রতিজ্ঞা অনুসারে আবার বনে যাও— যথাপ্রতিজ্ঞং কালান্তং চরন্তু বনমাশ্রিতাঃ। হ্যাঁ, ধর্ম অনুসারে ন্যায় পথে চলো, তা হলে দুর্যোধন শত্রুকেও রাজ্য দিয়ে দেবেন, কিন্তু আমাদের কাছে কোনও অধর্মীয় কাজ চলবে না। ধর্মপথে থেকে তোমরা তোমাদের প্রতিজ্ঞামতো ফের বনবাসে যাও, ফিরে এসে দেখবে— তুমি দুর্যোধনের কোলে বসে খেলা করতে পারছ— ততো দুর্যোধনস্যাঙ্কে বৰ্ত্তন্তামকুতোভয়াঃ।
কর্ণের কথা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে দুর্যোধন নিজের অধিকার রাখার জন্য কীরকম নিজের বোলচাল সবই পালটে ফেলতে পারেন। হায়! জীবনে যে মানুষ কখনও ন্যায়নীতি পালন করেননি, সেই দুর্যোধন ধর্ম, ন্যায়— এসব বোঝাচ্ছেন, তাও বোঝাচ্ছেন আবার যুধিষ্ঠিরকে! আসলে এ সবই বাহানা; দুর্যোধন শুধু রাজ্য চান না, পাণ্ডবরা যাতে একটুও রাজ্য না পান— সেটাও চান। তাঁর সমস্ত কাজ, কথা, ব্যবহার— ওই একদিকে লক্ষ করেই— পাণ্ডবরা যাতে কিচ্ছু না পান। দ্রুপদের দূত ফিরে যাবার পর ধৃতরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত সচিব সঞ্জয় গেলেন পাণ্ডবদের কাছে। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের কাছে পাণ্ডবদের বলাবল এবং সমবেত রাজন্যবর্গের উৎসাহ, উদ্দীপনার কথা শুনে বেশ একটু ঘাবড়েই গেলেন। পরের দিনই সভা ডাকলেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। সভাস্থলে সঞ্জয় একইরকম জোর দিয়ে পাণ্ডবদের উন্মাদনার কথা প্রকাশ করলেন। ধৃতরাষ্ট্র নিজে বারবার করে দিব্যাস্ত্রপ্রাপ্ত অর্জুনের শক্তিমত্তার কথা বলে দুর্যোধনকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। প্রায় তিন-চার অধ্যায় ধরে পাণ্ডবদের ক্ষমতাধিক্য নিজের পিতার মুখেই প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে দুর্যোধন প্রথমটা একটু স্তিমিতভাবে কথা আরম্ভ করলেন। প্রথমেই বললেন— ভয় পাবেন না মহারাজ— ন ভেতব্যং মহারাজ!
দুর্যোধন এটা ঠিকই বুঝেছেন যে, তাঁর পিতা সঞ্জয়ের মুখে তেরো বছরের চাপা পাণ্ডব-প্রশংসায় প্রাথমিকভাবে হকচকিয়ে গেছেন। কারণ উপায় থাকলে তাঁর পিতাও যে পাণ্ডবদের পৈতৃক রাজ্য থালায় সাজিয়ে পাণ্ডবদের উপহার দেবেন না— এটা দুর্যোধন জানেন। স্বাভাবিক কারণে দুর্যোধন তাই পিতার মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য কৌরবপক্ষের, যোদ্ধাদের ক্ষমতা এবং শক্তির বর্ণনা দিতে আরম্ভ করলেন। শুধু তাই নয়, যে অর্জুনের থেকে এত ভয়, সেই অর্জুনের সঙ্গে লড়াই করার মতো উপযুক্ত প্রতিপক্ষ যে কৌরবদের মধ্যেই রয়েছে— সেটা প্রমাণ করে ছাড়লেন দুর্যোধন। এ ছাড়া তিনি বললেন যে, কৌরবপক্ষের ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম এককালে একা এই সমস্ত ভারতবর্ষের রাজাদের সঙ্গে লড়েছিলেন— সেই ভীষ্ম রয়েছেন আমাদের পক্ষে— স ভীষ্মঃ সুসমর্থোহয়ম্ অস্মাভিঃ সহিতো রণে। অতএব আপনি ভয় পাবেন না পিতা। দুর্যোধন এমনি করে দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা— ইত্যাদি সবার যুদ্ধশৈলী বর্ণনা করে শেষে বললেন— এই যে এক এক জন মহাবীর রাজার কথা বললাম— এঁদের প্রত্যেকেই পাণ্ডবদের সঙ্গে একা একটা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন— এষাম্ একৈকশো রাজ্ঞাং সমর্থঃ পাণ্ডবান্ প্রতি— সেখানে আমার জন্য সবাই এখানে প্রাণ দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি সমস্ত ভয় মন থেকে সরিয়ে দিন— ব্যেতু তে ভয়মাগতম্।
ধৃতরাষ্ট্র সবচেয়ে ভয় পাচ্ছিলেন ভীমের চিন্তায়। কারণ একেবারে ছোটবেলাতেও তিনি যেহেতু কৌরবদের শক্তিতে পর্যুদস্ত করেছেন, সেই তিনি যে কখন কী করে বসবেন— সে ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্রের সব সময় ভয় আছে। তা ছাড়া খোদ দুর্যোধনকে মারার ব্যাপারেই তাঁর প্রতিজ্ঞা রয়ে গেছে। দুর্যোধন বাবাকে বোঝালেন— একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন, মহারাজ! এই যে আজকে যুধিষ্ঠির সব অংশ ছেড়ে দিয়ে পাঁচখানি গ্রামমাত্র চাইছেন— সে আমারই সৈন্যসমান্তের ভয়ে। আর ভীমের কথা বলছেন— আমার সঙ্গে গদা নিয়ে যুদ্ধে জিতবে, এমন কেউ এখনও জন্মায়নি— মৎসমো হি গদাযুদ্ধে পৃথিব্যাং নাস্তি কশ্চন। ভীমের ক্ষমতাও নেই যুদ্ধের সময় আমার গদার আঘাত সহ্য করে। আমার যদি রাগ চেপে যায়— তখন যদি ওই ভীমকে একটিবার মাত্র গদার বাড়ি কষাই না— একং প্রহারং যং দদ্যাং— তাহলে বিশ্বাস করুন মহারাজ— ও শুধু চোখে আঁধার দেখবে— সে এবৈনং নয়েদ্ ঘোরঃ— ও মারা যাবে। আর সত্যি কথা বলতে কী আমার বড় ইচ্ছে ভীমকে একবার বাগে পাই। যুদ্ধ লাগলে যে ও মরবে— সে কথা আমি কেন, সে কথা ভীম নিজেও জানে, এমনকী কৃষ্ণ এবং অর্জুনও জানে। অতএব ভীমের ব্যাপারে একটুও ভয় পাবেন না মহারাজ— মা রাজন্ বিমনা ভব।
দুর্যোধন এইসব বড় বড় বীরদের কথা ছেড়ে দিয়ে একটা সোজা অঙ্ক রেখে দিলেন ধৃতরাষ্ট্রের সামনে। বললেন— মহারাজ! বৃহস্পতির মতো রাজনীতিজ্ঞ পণ্ডিত বলেছেন— শত্রুর যদি আমার থেকে তিন গুণ বল কম থাকে; সেই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা কোনও ব্যাপারই নয়। আপনি এটা ভাবুন যে, ওদের মাত্র সাত অক্ষৌহিণী সেনা আর আমার হল গিয়ে এগারো, এইখানেই তো পাণ্ডবদের থেকে আমরা অনেকটা এগিয়ে রয়েছি। অতএব আপনি একটুও বিব্রত হবেন না মহারাজ— আমার অবস্থা অনেক ভাল— বলাগ্র্যং মম ভারত।
এই সমস্ত কথা বলার আগে দুর্যোধন আরেকটা কাজ করেছিলেন। ভ্রাতুষ্পুত্র হিসেবে অথবা সেই ভ্রাতুষ্পুত্রেরা এতদিন অনেক কষ্ট করেছে— এই ভেবে ধৃতরাষ্ট্র যদি একটু নরম হয়ে যান, তাই দুর্যোধন আপাতত সমস্ত দায়টা চাপিয়ে দিলেন কৃষ্ণের ওপর। ভাবটা এই যে, যদি এটা শুধু জ্ঞাতিশত্রুতার ব্যাপার হত— তা হলে অন্যভাবেই ব্যাপারটা সেরে ফেলা যেত। কিন্তু এখানে রাজনৈতিকভাবে তৃতীয় শক্তিই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি তো জানেন মহারাজ— বাসুদেব কৃষ্ণ আমাদের এই কুরু বংশের উচ্ছেদ করে ছাড়বে, ঠিক করেছে। এই পাণ্ডবরা যখন বনে গেল, তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অন্যান্যদের নিয়ে সেই বনেই এসে পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করেছেন কৃষ্ণ। তাঁরা যেভাবে সবাই মিলে আমাদের রাজ্য কেড়ে নেবার ভাবনা করেছিলেন, তাতে আমি ভয় পেয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ— ইত্যাদি বৃদ্ধদের বললাম— কৃষ্ণ এবং অন্যান্য রাজারা আমাদের উচ্ছিন্ন করে ছাড়বে এবং ওদের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে পাণ্ডবরাও যুদ্ধ করবে। আমি তখন প্রস্তাব করলাম— আমরা এখন আত্মসমর্পণ করতে পারি অথবা পালিয়ে যেতে পারি অথবা প্রাণপণ যুদ্ধ করতে পারি। আমি আরও বলেছিলাম— যদি যুদ্ধ করি তা হলে হয়তো আমাদের পরাজয় অনিবার্য, কারণ সমস্ত রাজারাই এখন যুধিষ্ঠিরের প্রতি সহানুভূতিশীল।
দুর্যোধন আরও স্মরণ করে বললেন— আমি এত দূর বলেছিলাম— আত্মসমর্পণ অথবা চিরকালের জন্য পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করলেও আমি তাতে লজ্জা পাব না, শুধু আমার এইটুকু আপশোষ রইল যে, পিতা ধৃতরাষ্ট্র শুধু আমারই জন্য খামোকা কষ্ট পেলেন। তোমার তো কোনও দোষ ছিল না, শুধু শুধু তোমার ছেলেদের অন্যায় অপরাধেই আজ পাণ্ডবদের হাতে তোমার বংশ লুপ্ত হতে বসেছে। আমি এসব কথা বলার পর ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতি আচার্য-বৃদ্ধেরা আমাকে বলেছিলেন— পাণ্ডবদের সঙ্গে আমাদের যদিও কোনও গোলমাল নেই, তবুও তুমি ভয় পেয়ো না, দুর্যোধন! ওরা যদি নিজে থেকে এই হস্তিনাপুর রাজ্য আক্রমণ করে, তা হলে আমরাও ছাড়ব না। ওদের ক্ষমতা হবে না— আমাদের সঙ্গে লড়ে যেতে। যুদ্ধ করে জিততে হলে যে ক্ষমতার দরকার, সে ক্ষমতা ওদের নেই। আর আমরা এক একজন ইচ্ছে করলে সমস্ত রাজমণ্ডলকে জয় করতে পারি, পাণ্ডবরা তো কোন ছাড়।
হয়তো পাণ্ডবদের বনে যাবার পর তাঁদের কৃষ্ণ-ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে একত্রিত হওয়া এবং দুর্যোধনের ভয় দেখে ভীষ্ম-দ্রোণরা এসব কথা বলেছিলেন, কারণ, তাঁরা যেমন পাণ্ডবদের কষ্ট চাইতেন না, তেমনি দুর্যোধনের কষ্টও চাইতেন না। দুর্যোধন পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাক— এটা যেমন ভীষ্ম-দ্রোণরা চাইতেন না, তেমনি পাণ্ডবরা কোনও কারণে কৌরবদের কুলচ্ছেদে প্রবৃত্ত হোক— এটাও তাঁরা চাইতেন না। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হচ্ছি— দুর্যোধন কোথাকার কথা কোথায় এনে লাগালেন— সেই কথা ভেবে। যেহেতু ভীষ্ম-দ্রোণরা কোনও এক সময় দুর্যোধনের অবস্থা দেখে নিজেদের পেশিশক্তির কথা বলেছিলেন, অতএব সেই কথা এখন উন্মুক্ত সভার মধ্যে তাঁদের গিলতে হল এবং তাও কখন? যখন পাণ্ডবরা নিজেদের মাথা গোঁজার জন্য পাঁচখানি গ্রাম মাত্র ভিক্ষা করছেন। দুর্যোধনের কূটবুদ্ধি কতখানি যে, যখন তাঁর মহারাজ পিতা পাণ্ডব-পক্ষের বাহু-আস্ফোটনে ভীত-ত্রস্ত, তখন তিনি সমদর্শী ভীষ্ম-দ্রোণদের নিজের কথা ব্যবহার করে পিতার মনোবল বাড়িয়ে তুলছেন। অন্যদিকে আমরা বেশ জানি— ভীষ্ম-দ্রোণরা দুর্যোধনের এই কথা ফেলতেও পারছেন না, অথচ তাঁরা এই প্রসঙ্গে, এই সময়ে তাঁদের পুরনো কথা যে খাটে না— তাও বলতে পারছেন না।
ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু পুত্রের সমস্ত কথাবার্তা শুনেও যুদ্ধে কোনও উৎসাহ দেখালেন না। এরপর আরম্ভ হল বিচার— কার কীরকম শক্তি, কে কার সঙ্গে লড়বে— তার অনুপুঙ্খ বিচার এবং অনুপুঙ্খ অনুমান। দুর্যোধন বারবার বললেন— অত ভয়ের কী আছে— যুদ্ধে পাণ্ডবদেরই জয় হবে— এটাই শুধু ভাবছ কেন, জয় তো আমাদেরও হতে পারে। বুদ্ধি বলো, শক্তি বলো, প্রতিভা বলল, অথবা বয়স বলো— সব ব্যাপারে আমরা যেরকম, ওরাও সেইরকম— সমেন বয়সা চৈব প্রতিভেন শ্রুতেন চ। কাজেই তুল্যবলীদের মধ্যে বিরোধ হলে জয়ের সম্ভাবনা দু’পক্ষেরই পঞ্চাশ ভাগ। তা হলে শুধু পাণ্ডবদেরই জয় হবে— এটা ভাবছ কী করে— কথম্ একান্তত স্তেষাং পার্থানাং মন্যসে জয়ম্। ধৃতরাষ্ট্র তবু কিছুতেই মানছেন না। তিনি একবার বিদুরের কথা শোনেন, একবার সঞ্জয়ের কাছে পাণ্ডবদের তোড়জোড় কতদূর— খবর নেন, একবার গান্ধারীকে সাক্ষী মানেন, আবার কখনও বা দুর্যোধনের প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একান্তে সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করেন— ঠিক করে বলো তো সঞ্জয়! তুমি তো পাণ্ডবদের সৈন্যসামন্ত সব দেখে এসেছ, সত্যি করে বলো তো— ওদের সৈন্যবল অথবা ওদের অবস্থা আমাদের থেকে ভাল না মন্দ— কিমেষাং জ্যায়ঃ কিন্নু তেষাং কনীয়ঃ?
দুর্যোধনের কিন্তু কোনও দ্বিধা নেই। তিনি যখন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে শুনলেন যে, কৃষ্ণ আসছেন শান্তির দূত হয়ে, তখন পিতার মুখের ওপর বললেন— পাণ্ডবদের ওই পরম বন্ধু আর মদতদাতাটিকে আমি বন্দি করব। ওটাকে বন্দি করলে সমস্ত বৃষ্ণি-বীরেরা এবং পাণ্ডবেরা আমার শাসনে চলবে। ধৃতরাষ্ট্র কিংবা ভীষ্ম কেউই এই ভীষণ কথা শুনে স্বস্তি পাননি, কিন্তু দুর্যোধন মরিয়া। কৃষ্ণ আসবার আগে তিনি পূর্বাহ্নেই ঠিক করে নিলেন যে, তাঁকে তিনি বন্দি করবেন।
সভায় কৃষ্ণ যেদিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন, সেইদিনই দুর্যোধন কৃষ্ণকে দোষ দিয়ে বললেন— তুমি আমাদের সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করেছ, কৃষ্ণ! আমরা তোমার খাওয়া-থাকার সুবন্দোবস্ত করেছিলাম। তুমি সেগুলো অস্বীকার করে বিদুরের বাড়ি গিয়ে খেয়েছ, থেকেছ— আমি এর কারণটা শুনতে চাই— তত্র কারণম্ ইচ্ছামি শ্রোতুং চক্রগদাধর। কৃষ্ণের জবাবটা দুর্যোধনের কাছে মোটেই রুচিকর হয়নি এবং তিনি দুর্যোধনের প্রত্যুত্তর না শুনেই বেরিয়ে গেছেন। তারপর নিয়ম অনুসারে ডাকা সভায় দুর্যোধনের সঙ্গে আবার কৃষ্ণের দেখা হল।
স্বাভাবিকভাবেই কৃষ্ণ সেদিন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করে পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে যথোচিত নিবেদন করলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর সবাই দুর্যোধনকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন এবং কৃষ্ণের কথার সারবত্তা মেনে নিতে বললেন। কিন্তু ওই যে আমি বলেছিলাম দুর্যোধন তখন মরিয়া, মহাভারতের নিরপেক্ষ বক্তা বৈশম্পায়নও তাই আরেকটি বিশ্লেষণে দুর্যোধনকে বলেছেন— ‘শাসনাতিগম্’— মানে সমস্ত শাসনের বাইরে। অতএব এবার মনুষ্য সমাজের চরম এবং পরম ব্যক্তিটিকে চরম কথাটি বলতে আরম্ভ করলেন দুর্যোধন।
ঠিক এই মুহূর্তে কুরুসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি তিনি নিজে নিয়ে নিলেন। অবশ্য সিদ্ধান্তের এই চরম মুহুর্তে ব্যক্তিগতভাবে দুর্যোধনকে আমার বড় বিপর্যস্ত লাগে। একটা কথা আমার বার বার মনে হয় যে, দুর্যোধনের যা মানসিক গঠন, তাতে তাঁর এক ধরনের ‘ফ্রাস্ট্রেশন’ থাকা অবশ্যই সম্ভব। আইনগত যুক্তি যাই থাকুক না কেন, তাঁর মনে এটা আসতেই পারে যে শুধুমাত্র অন্ধত্বের দায়ে তাঁর বাবা রাজা হতে পারেননি, এমনকী পাণ্ডু মারা যাবার পরে যে রাজ্য ধৃতরাষ্ট্র চালাচ্ছেন, সেখানেও তিনি বিধিসম্মত রাজা নন। আবার ধৃতরাষ্ট্র যেভাবেই রাজ্য চালান না কেন দুর্যোধনের রাজা হবার সম্ভাবনা চুকে গেছে জন্মলগ্নেই। অথবা যেখানে ধৃতরাষ্ট্র বেঁচে রয়েছেন, সেখানেও সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই ধৃতরাষ্ট্রকে ছুঁইয়ে নিতে হচ্ছে। ধৃতরাষ্ট্র যদি জীবিত না থাকতেন এবং সে অবস্থায় যদি পাণ্ডবরা বনে গিয়ে থাকতেন, তা হলে উদ্যোগপর্বে নিজের ঘরে দুর্যোধনের কোনও ‘টেনশন’ থাকত না। তাঁকে জনে জনে বোঝাতে হত না অথবা কোনও তর্কে যেতে হত না। যা সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিতেন এবং তা নিতেন খুব তাড়াতাড়ি। পাঠকের মনে আছে— দুর্যোধন একবার রাজসূয় করতে চেয়েছিলেন। দুর্যোধনের এই সদিচ্ছায় পুরোহিত-ব্রাহ্মণেরা প্রথম বিধান দিয়েছিলেন যে একই কুলে দুই ব্যক্তি রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারে না। ফলত যুধিষ্ঠির বেঁচে থাকতে দুর্যোধনের পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা সম্ভব নয়। যদি বলা যায় যুধিষ্ঠির পাশা খেলে রাজসূয়ের বৈভব খুইয়েছেন, অতএব দুর্যোধন এখন রাজসূয় করতে পারেন, তা হলে পুরোহিতদের যুক্তি হল— তাই বা হবে কী করে? সেক্ষেত্রে রাজসূয়ের অধিকারী হবেন স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন নন। পুরোহিতরা সেখানে রীতিমতো আক্ষেপ করে দুর্যোধনের মুখের ওপর বললেন— তোমার পিতা অত্যন্ত দীর্ঘজীবী এবং তিনি বেঁচেও রয়েছেন— দীর্ঘায়ুর্জীবতি চ তে ধৃতরাষ্ট্রঃ পিতা তব— অতএব সেখানেও তোমার রাজসূয় করার ইচ্ছেতে কোনও সুবিধা হচ্ছে না।
পিতার দীর্ঘজীবিত্ব ও ভারতবর্ষের অনেক রাজপুত্রকেই পিতার বিরুদ্ধে যেতে প্ররোচিত করেছে। সাধারণ জানে এই বিষয়ে মুসলমান রাজাদের কথা স্মরণ করে থাকেন, কিন্তু আমরা বলব— এ ক্ষেত্রে দুর্যোধন সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যুবরাজ পদবিতে থেকে তিনি যতই মহারাজোচিত সুখভোগ করুন না কেন, চরম সিদ্ধান্তটি তিনি বিনা তর্কে কখনওই নিতে পারেননি। এই যে পদে পদে বাধা— এই বাধাই তাঁকে যেমন বড় বেশি অভিমানী করে তুলেছিল, তেমনি এই বাধাই তাঁকে আস্তে আস্তে স্বতন্ত্রও করে তুলেছিল। তিনি যেন আর মানতে পারছেন না, এবারে তিনি যেন সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এক ফুৎকারে সবাইকে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করবেন। কুরুসভায় কৃষ্ণের সামনে তাই অবাধ্য শিশুটির মতো দুর্যোধন নিজেকে একেবারে উন্মোচিত করে ফেললেন। ভীষ্ম, বিদুর কেউ নয়, এমনকী তাঁর পিতাও নয়, এবার তিনি যা বলার নিজে বলবেন এবং সেইটাই হবে সিদ্ধান্ত। তবে লক্ষণীয় তাঁর এই বক্তব্য এবং সিদ্ধান্তের মধ্যে তাঁর হতাশা এবং একটা মরিয়া ভাব একসঙ্গে ফুটে উঠেছে।
কুরুসভায় প্রত্যেকেই যখন আলাদা করে দুর্যোধনের বিরুদ্ধে কথা বললেন, তখন দুর্যোধন কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বলতে আরম্ভ করলেন— আপনিই এটা বিবেচনা করে বলুন যে, মূলত আমাকেই কেন সবাই আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করে গালাগালি দেয়। আপনি নিজেও এই পাণ্ডবদের তেল খেয়ে— ভক্তিবাদেন পার্থানাম্— এখন হঠাৎ করে আমার নিন্দা শুরু করলেন। এই আপনি, ওই বিদুর, আমার বাবা যিনি রাজাও বটে, আচার্য দ্রোণ, পিতামহ ভীষ্ম— এঁরা সব সময় আমাকেই গালাগালি দেন— মামেব পরিগর্হন্তে— অন্য কাওকে নয়। আমি এমন কিছু অন্যায় করিনি, যাতে করে সবাই মিলে দল পাকিয়ে আমার নিন্দা করতে হবে। আমি অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু আমি নিজের অন্যায় একটুও দেখতে পাইনি।
দুর্যোধনের যত হতাশাই থাক, মহাভারতের কবি দেখাতে চেয়েছেন— যে-কোনও অন্যায়কারী মানুষই দুর্যোধনের মতো করেই ভাবে অথবা কথা বলে। কেন না, আপন বুদ্ধি এবং কৌশল-ভাবনায় প্রত্যেকেই বড় সন্তুষ্ট থাকে। দুর্যোধন বললেন— সেই যে পাশা খেলাটা হল, সেখানে শকুনি দান ফেলে পাণ্ডবদের রাজ্য জয় করে নিল— সেখানে আমার কী দোষ— তত্র কিং মম দুষ্কৃতম্? নিজেরা ইচ্ছে করে— প্রিয়াভ্যুগতে দ্যূতে— যারা পাশা খেলল এবং সে খেলায় পরাজিত হয়ে বনে গেল— তাতে আমার অপরাধটা কী?
পুরোপুরি একজন মতলববাজ মানুষের মতো দুর্যোধনের এবার আসল বক্তব্যে আসছেন। তিনি বললেন— আমরা এমন কী করেছি কৃষ্ণ, যাতে করে পাণ্ডবরা পাঞ্চালদের সঙ্গে মিলে আমাদের হিংসে করছে। তবে আপনি এটা মনে রাখবেন যে, দেবরাজ ইন্দ্রও যদি প্ররোচনামূলক কাজকর্ম করেন অথবা মেজাজ গরম করে কথা বলেন, তা হলেও আমরা কখনও বিচলিত হই না অথবা বিচলিত হয়ে তাঁর কাছে নত হই না— প্ৰভ্রষ্টাঃ প্রণমামেহ ভয়াদপি শতক্রতুম্। আমরা ক্ষত্রিয়, অতএব ক্ষত্রিয়ের মতো যুদ্ধ করে শরশয্যায় শুয়ে পড়ব, তবু যুদ্ধের ব্যাপারে আমরা উদ্যমও হারাব না অথবা বাঁশের মতো ভেঙে পড়ব, কিন্তু মচকাব না— অপি অপর্বনি ভজ্যেত ন নমেদিহ কস্যচিৎ। দুর্যোধন নিজেকে ভালই চিনতেন। কারণ ‘ভাঙব তবু মচকাব না’— এই নীতিতেই দুর্যোধন চলেন— এটা তাঁর শত্রুরাও জানত। দুর্যোধনের স্বভাবটা এমনই একবগ্গা ছিল যে, যেটা তিনি ভেবে ফেলেছেন, সেখানে মা-বাবা, ভাই-বন্ধু কেউ কিচ্ছু করতে পারবেন না। তাঁকে এক চুলও সরানো যাবে না, নিজের জায়গা থেকে। এ কথাটা ভীম বলেছিলেন কৃষ্ণকে, শান্তি-প্রস্তাব নিয়ে কুরুসভায় আসার আগে। ভীম বলেছিলেন— দুর্যোধনের সঙ্গে শান্তির চুক্তি করা বড় কঠিন হবে, কৃষ্ণ! কারণ, ও মরে যাবে তবু নুয়ে পড়বে না অথবা নিজের মতও ছাড়বে না— ম্রিয়েতাপি ন ভজ্যেত নৈব জহ্যাৎ স্বকং মতম্। চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য থেকেই দুর্যোধন কৃষ্ণকে শেষ কথা বললেন। বললেন— কৃষ্ণ, আসল কথাটি মনে রেখো— আমার বাবা ধৃতরাষ্ট্র পূর্বে পাণ্ডবদের যতটুকু রাজ্যাংশ দেবেন বলেছিলেন, আমি বেঁচে থাকতে সেটা আর ওদের মিলবে না— ন স লভ্যঃ পুনর্জাতু ময়ি জীবতি কেশব। মনে রেখো— যতদিন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বেঁচে থাকবেন, কিংবা যতদিন আমরা অস্ত্রশস্ত্র ধারণ করে বেঁচে আছি, ততদিন ওই রাজ্যটাজ্য কিছু পাবে না পাণ্ডবরা, কারণ তাদের রাজ্য এখন পরের হাতে— রাজ্যং পরবতো মম। অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন সোনামুখী সূচের আগায় যতটুকু মাটি ওঠে— যাবদ্ধি তীক্ষ্ণয়া সূচ্যা বিধ্যেদগ্রেণ কেশব— ততটুকু মাটিও ছাড়ব না পাণ্ডবদের।
এই সব অভব্য কথার পরে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবেন না দুর্যোধনকে। তিনিও আচ্ছা করে গালাগালি দেওয়া আরম্ভ করলেন দুর্যোধনকে, সঙ্গে ভয় দেখানোও চলল। কৃষ্ণের কথা শুনে দুঃশাসন পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে দুর্যোধনকে সন্ধি প্রস্তাব মেনে নিতে বললেন। তাতে দুর্যোধন আরও রেগে গিয়ে সভা ছেড়ে চলে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্থিরমতি গান্ধারীকে ডাকালেন এবং বললেন দুর্যোধনকে বোঝাতে। দুর্যোধন তাঁর সমস্ত কথা এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বার করে দিলেন এবং আবারও সভা ছেড়ে চলে গেলেন। আবার সেই দুষ্ট চতুষ্টয়— কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি, দুর্যোধনের ‘মিটিং’ বসল। ঠিক হল, কৃষ্ণ কিছু করার আগেই তাঁকে বন্দি করতে হবে। তাতে পাণ্ডব-পাঞ্চালদের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যাবে— নিরুদ্যমা ভবিষ্যন্তি পাণ্ডবাঃ সোমকৈঃ সহ।
কিন্তু দুর্যোধনের সমস্ত কূটকৌশল ভেস্তে গেল কৃষ্ণের তেজে, বিশ্বরূপের মহিমায়। অন্যদিকে তাঁর দৌত্যও ব্যর্থ হল, দু’পক্ষেই ঘোষিত হল যুদ্ধের সংকল্প। সৈন্যসংগ্রহ, রাজাদের খবর দেওয়া— এ সব আগেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, এখন তাতে উদ্দীপনার মাত্রা যোগ হল। শান্তির দূত হয়ে কৃষ্ণ আসবার আগেই দুর্যোধন দ্বারকায় গিয়ে কৃষ্ণের নারায়ণী সেনা পছন্দ করে এসেছেন, একা কৃষ্ণকে তাঁর পছন্দ হয়নি। সোজা কথায় যুদ্ধ জিততে গেলে যতখানি সেনা সংগ্রহ করা দরকার, তার চেয়ে বেশি তাঁর জোগাড় হয়ে যাওয়ায় দুর্যোধন ছিলেন নিশ্চিন্ত। কৌরবপক্ষে মানী ব্যক্তি অনেক, অতএব সেনাপতি মনোনয়ন করা ছিল অত্যন্ত দুরূহ। দুর্যোধন কিন্তু এক্ষেত্রে যথেষ্ট বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ভীষ্মকে সেনাপতির পদ দিলেন। শুধু তাই নয়, দুর্যোধন ভীষ্মের এই শর্তে রাজি হলেন যে, ভীষ্ম যতদিন যুদ্ধ করবেন কর্ণ যেন ততদিন যুদ্ধ না করে স্তব্ধ হয়ে থাকেন।
দুর্যোধনের যেটা সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেল— যাঁদের ওপরে তিনি যুদ্ধের ভার স্থাপন করছেন অথবা যাঁদের দিয়ে তিনি কাজ করিয়ে নেবেন ভাবছেন— তাঁদের তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না অথবা তাঁদের কথাও তিনি শুনছেন না। ধরুন, যে ভীষ্ম-দ্রোণ তাঁকে দিনরাত পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করতে বলছেন, সেই ভীষ্ম-দ্রোণ সম্বন্ধে তিনি বারবার সরকারিভাবে ঘোষণা করেছেন— এঁরা আমাদের পক্ষে লড়বেন ভয় কী? অথচ তাঁদের কথা তিনি শুনছেন না। একথা ঠিক যে, ভীষ্ম কিংবা দ্রোণ কৌরবপক্ষে লড়বেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতির দায়ে কতটা প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করা সম্ভব— এটা কি দুর্যোধন জানতেন না? জানতেন, আমাদের ধারণা, বেশ জানতেন, কিন্তু জেনেও এই অপ্রতিম বলশালী দুই যোদ্ধাকে তিনি যুদ্ধে ব্যবহার করেছেন মাত্র, বিশ্বাস করেননি। স্বয়ং গান্ধারী পর্যন্ত একসময় পুত্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন— দেখো বাপু! ভীষ্ম-দ্রোণেরা পাণ্ডব কৌরবদের সমান চোখে দেখেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা যে সর্বশক্তি দিয়ে তোমার পক্ষে লড়বেন— এ কথা মনে বিশ্বাস করো না— যোৎস্যন্তে সর্বশক্ত্যেতি নৈতদদ্যোপপদ্যতে।
গান্ধারীর এই সতর্কবাণী কি দুর্যোধনের মনে ছিল না? সবই মনে ছিল। ভীষ্ম-দ্রোণরাও বারবার একথা কবুল করেছেন যে, তাঁরা পাণ্ডবদের প্রচুর সৈন্যক্ষয় করবেন কিন্তু পাণ্ডবদের গায়ে হাত দেবেন না। তবু দুর্যোধন এঁদের সেনাপতিত্বে নিযুক্ত করেছেন এবং তা হয়তো এই ভেবে যে, এঁদের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে পাণ্ডব সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা প্রচুর বাড়িয়ে নিয়ে তারপর কর্ণকে দিয়ে পাণ্ডবদের সাবাড় করে দেওয়া যাবে। মহাভারতকার দুর্যোধনের এই ‘স্ট্র্যাটেজি’র কথা স্বকণ্ঠে পরিষ্কার করে বলেননি। কিন্তু শুধুমাত্র সৈন্যক্ষয় করা ছাড়া দুর্যোধনের আর কী কারণ থাকতে পারে ভীষ্ম-দ্রোণকে সেনাপতি হিসেবে বরণ করার।
যাই হোক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হল। ভীষ্ম তাঁর ইচ্ছা এবং সাধ্যমতো পাণ্ডবদের সৈন্যশাতন করে চলেছেন, কিন্তু কাজের কাজ, অর্থাৎ দুর্যোধন যাকে কাজের কাজ বলে মনে করেন, সেই পাণ্ডব বধের এখনও কিছুই হয়নি। ছয় দিন যুদ্ধ হয়ে গেল— দুর্যোধন দেখলেন কিছুই হচ্ছে না। মাঝখানে থেকে ভীমের হাতে এবং অর্জুনের হাতে কৌরবসেনা বেশ মার খাচ্ছে। দুর্যোধন এক সময় অস্থির হয়ে ভীষ্মকে বলেই ফেললেন— পিতামহ। আমি জয় চাই, আমি চাই পাণ্ডবরা মরুক। ভীষ্ম পাণ্ডবদের শক্তিমত্তা এবং সহায়শক্তির পরিচয় দিয়ে বারবার বললেন— আমি অনেক চেষ্টা করছি এবং আমি চাই তোমার জয় এবং সুখ— দুইই ভাগ্যে আসুক। কিন্তু ব্যাপারটা অত সস্তা নয়। আমি তোমার জন্য মরতে পারি— রণে তব্যার্থায় ময়ানুভাব/ন জীবিতং রক্ষিতব্যং ময়াদ্য— কিন্তু হঠাৎ করে মুহূর্তের মধ্যে পাণ্ডবদের জিতে নেব— এই ভাবনা অবাস্তব— তে নেহ শক্যা সহসা বিজেতুম্। প্রাথমিকভাবে দুর্যোধন একটু শান্তি পেলেন বটে, কিন্তু অষ্টম দিনের যুদ্ধও যেদিন শেষ হয়ে গেল এবং পাণ্ডবদের কাউকেই কিছু করা গেল না, তখন আবার সেই শকুনি-দুঃশাসন-কর্ণের সঙ্গে বসে গেলেন মন্ত্রণা করতে— কেমন করে পাণ্ডবদের জয় করা যায়— কথং পাণ্ডুসুতাঃ সংখ্যে জেতব্যাঃ সগণা ইতি।
দুর্যোধন সোজাসুজি কর্ণকে যেন ভরসা মেনে বললেন— আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বাপু! এই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য— এঁরা তো কেউই পাণ্ডবদের আটকাতে পারছেন না— ন পার্থান্ প্রতিবাধন্তে ন জানে তত্র কারণম্। পাণ্ডবদের কেউ মরা তো দূরের কথা, বরঞ্চ তাদের চাপে আমাদের সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র সবই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এখন ভাবছি শেষ পর্যন্ত ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করব কী করে? কর্ণ বললেন— তুমি এক কাজ করো! তুমি পিতামহ ভীষ্মকে যেভাবে হোক বসিয়ে দাও। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা ছেড়ে দাও আমার হাতে। আমি পাঞ্চালদের সঙ্গে সমস্ত পাণ্ডবদের গুঁড়ো করে দেব। দুর্যোধন কর্ণের কথা মেনে নিলেন এবং সোজা চলে গেলেন ভীষ্মের কাছে। কারণ, কর্ণ তাঁকে বলেছেন— ওই ভীষ্মের এমন ক্ষমতা নেই যে পাণ্ডবদের জিততে পারে— অশক্তশ্চ রণে ভীষ্মো জেতুম্ এতান্ মহারথান্। আর যদি বা ক্ষমতা থাকেও, ও দয়া দেখাচ্ছে পাণ্ডবদের ওপর।
সত্যি কথা বলতে কী, আগেই বলেছি, দুর্যোধনের ‘স্ট্র্যাটিজি’তে ভুল ছিল। দুর্যোধন যদি সৈন্যক্ষয়ের জন্য ব্যস্ত না হয়ে প্রথম থেকেই পাণ্ডববধের জন্য চিন্তিত হতেন, তা হলে প্রথমেই তাঁর কর্ণকে সেনাপতি করা উচিত ছিল। এটা যদি হত, তা হলে কর্ণের একাঘ্নীবাণ থেকে রক্ষা পাওয়া অর্জুনের পক্ষে কঠিন ছিল। অবশ্য এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, অর্জুনের সারথি ছিলেন কৃষ্ণ। একাঘ্নী বাণের উত্তরে তিনি কী করতেন সেটাও চিন্তা করার মতো। যাই হোক, দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে সোজা গিয়ে বললেন— আমি আপনার ওপর ভরসা করে— ত্বাং হি সমাশ্রিত্য— এই বিরাট যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলাম। ভেবেছিলাম— আপনি যুদ্ধে দেবতাদেরও জয় করবেন, পাণ্ডবদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সেক্ষেত্রে আপনি চেষ্টা করুন পাণ্ডবদের হত্যা করতে, কারণ আপনিই তো বলেছিলেন যে, পাণ্ডব-পাঞ্চাল— সবাইকে আপনি যুদ্ধে ছারখার করে দেবেন। অবশ্য পাণ্ডবদের ওপর যদি আপনার দয়া থাকে, অথবা আমার ওপর আপনার বিদ্বেষ থাকে, অথবা নিতান্তই এটা যদি আমার দুর্ভাগ্য হয়, তা হলে আপনি যুদ্ধটা আপাতত কর্ণের হাতে ছেড়ে দিন। সে সমস্ত সৈন্যসহ পাণ্ডবদের জয় করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস— স জেষ্যাতি রণে পার্থান্ সসুহৃজ্জনবান্ধবান্।
একজন যশস্বী বীরের কাছে যদি তাঁর চেয়ে অল্পগুণী মানুষের প্রশংসা করা যায়, তা হলে তার ধৈর্য থাকে না। ভীষ্মও ধৈর্য হারালেন বটে তবে সেনাপতিত্ব ত্যাগ করলেন না। ভারতযুদ্ধের নবম এবং দশম দিনে অমানুষিক যুদ্ধ করে ভীষ্ম শরশয্যা গ্রহণ করলেন। সেনাপতির পতনে সাময়িকভাবে দুর্যোধন একটু বিমনা হলেন এবং ভীষ্ম মৃত্যুশয্যা গ্রহণ করেও তাঁকে অনেক বোঝালেন কিন্তু দুর্যোধন কিছুই শুনলেন না। ভীষ্ম এ কথাও বললেন— বাবা! আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই লোকক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হোক, তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করে ভাই ভাই মিলেমিশে থাকো— যুদ্ধং মদন্তমেবাস্তু তাত সংশাম্য পাণ্ডবৈঃ। কিন্তু হায়! মরণাপন্ন ব্যক্তি যেমন ওষুধ খেতে চায় না, তেমনি ভীষ্মের সদুপদেশ দুর্যোধন একটুও সহ্য করলেন না।
॥ ৬ ॥
আমরা ছোটবেলায় নীতিকথা পড়তাম— কোনও কিছুরই অতিরিক্ত ভাল নয়। সেখানে উদাহরণ দেওয়া হত— রাবণের অতিদর্পে সোনার লঙ্কা ধূলিসাৎ হল, আর দুর্যোধনের অতি মানে সমূলে নষ্ট হল কৌরবকুল। দুর্যোধনের অভিমান এত বেশি যে, তিনি যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ করেছেন সে অবস্থায় কোনও মূল্যেই তিনি তাঁর অভিমান মঞ্চ থেকে নীচে নামবেন না। বঙ্কিম কমলাকান্তের মুখ দিয়ে বলেছেন— মহাভারতকার মানবহ্নি সৃজন করিয়া দুর্যোধন পতঙ্গকে পোড়াইলেন;— জগতে অতুল কাব্যগ্রন্থের সৃষ্টি হইল।
সত্যি কথা বলতে কী দুর্যোধনের অবস্থা বহ্নিমুখে প্রবেশলিপ্সু পতঙ্গের মতোই। ঈর্ষা এবং স্বাভিমান তাঁকে এমন তাড়িয়ে বেড়ায় যে, তিনি কারও কথা শোনেন না অথবা শুধু তাঁদের কথাই শোনেন যাঁরা তাঁর মানবহ্নির ইন্ধন জোগান। কর্ণের কাছে সুড়সুড়ি খেয়ে তিনি পিতামহ ভীষ্মকে যেভাবে অপমান করলেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, যে ভাবে কুরুবৃদ্ধের মৃত্যু হল, তাতে দুর্যোধনের কোনও অনুশোচনা হল না। পরবর্তী পর্বে তিনি কর্ণের মন্ত্রণাতেই দ্রোণাচার্যকে সেনাপতি নির্বাচন করেছেন, কিন্তু তাই বলে নিজের হতাশা ঢাকতে নিজের অস্ত্রগুরু দ্রোণকে অপমান করতেও তাঁর বাধেনি। ঘটনাটা একটুখানি বলা দরকার নইলে দুর্যোধনের স্বচ্ছন্দচারিতার বহর কতখানি তা বোঝা যাবে না।
দ্রোণের সেনাপতিত্বে দুর্যোধনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় হল সপ্তরথী মিলে অভিমন্যু বধ। দুর্যোধনের একটুও লজ্জা করল না কুরুপাণ্ডবের সন্তানবীজ অভিমন্যুকে এইভাবে হত্যা করতে। বরঞ্চ তাঁরা বেশ আনন্দ পেলেন। ভারতবর্ষের কোনও কোনও সংস্কৃত নাট্যকার একসময় কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের মধ্যেও অভিমন্যুর প্রতি দুর্যোধনের মায়া দেখিয়ে নতুন ‘প্লট’ তৈরি করেছেন; কিন্তু তাতে মহাভারতের কবির লেখনী ম্লান হয়নি। এই শত শত বৎসর পরেও অভিমন্যু বধের চিত্রে আমরা দুর্যোধনের ওপর সমান ক্ষুব্ধ হই। যাই হোক অভিমন্যু বধের পরেই অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র জামাই জয়দ্রথকে বধ করবেন, কারণ চক্রব্যূহে অভিমন্যু ঢুকে গেলে জয়দ্রথই অন্য সমস্ত বীরদের আটকে রেখেছিল। সেনাপতি হিসেবে দ্রোণ এবং যুদ্ধের সময় সর্বময় কর্তা হিসেবে দুর্যোধন তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করে ছিলেন নানা কৌশলে জয়দ্রথকে রক্ষা করতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, কৃষ্ণের বুদ্ধি এবং অর্জুনের ক্ষমতায় শেষপর্যন্ত জয়দ্রথ মারা যান। জয়দ্রথ-বধের আগে মহাগুরু দ্রোণাচার্য দুর্যোধনের অভিলাষ বুঝে এমন ব্যূহ রচনা করেছিলেন, যা ভেদ করা সাধারণ জনের পক্ষে ছিল অসম্ভব। ছয়জন সাংঘাতিক যোদ্ধার মধ্যে কর্ণ এবং দুর্যোধন নিজেও ছিলেন জয়দ্রথের সুরক্ষা দৃঢ়তর করতে। শেষে যখন সব ভেদ করে অর্জুনের রথ এসে পৌঁছল কর্ণের কাছে, তখন দুর্যোধন চেঁচিয়ে কর্ণকে বললেন— কর্ণ! এই হল সেই সময়, যখন তুমি তোমার যুদ্ধক্ষমতা দেখাতে পারো। মারো অর্জুনকে যাতে সে আর একটুও এগোতে না পারে। কিন্তু হায়। যে কর্ণ সব সময় দুর্যোধনের কাছে বাহু আস্ফালন করে গেছেন, সেই কর্ণ এখন বলছেন— একটু আগেই ভীম আমাকে আচ্ছা মার মেরেছে, যুদ্ধ করতে এসে পালিয়ে যেতে নেই তাই শুধু দাঁড়িয়ে আছি এখানে।
যে কর্ণ নিজের ভরসায় ভীষ্মকে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছিলেন, যে কর্ণ পৌরুষকেই শুধু নিজের আয়ত্ত মনে করেন, সেই কর্ণ এখন দৈবের দোহাই দিয়ে বলছেন— আমি লড়ব বটে, তবে জয় কিংবা পরাজয় দৈবের ঘটনা— জয়ো দৈবে প্রতিষ্ঠিতঃ। কর্ণ কেন, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এমনকী দুর্যোধন নিজেও অর্জুনকে রুখতে পারলেন না। জয়দ্রথ মারা গেল।
এই প্রথমবারের মতো দুর্যোধনের চোখে জল এল। এই প্রথমবার তিনি নিরুৎসাহ বোধ করলেন, দাঁত-ভাঙা বিষধর সাপের মতো তিনি এখন শুধু ফুঁসছেন, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই— দুর্মনা নিঃশ্বসন্ উষ্ণং ভগ্নদংষ্ট্র ইবোরগঃ। দুর্যোধন এই প্রথম এবং শেষবারের মতো আবিষ্কার করলেন যে, দ্রোণ নয়, অশ্বত্থামা নয়, কৃপ নয়, এমনকী কর্ণও কেউ নয় অর্জুনের কাছে। দুর্যোধনের কাছে ভীষ্ম-দ্রোণ যোদ্ধা হিসেবে ফাউ মাত্র, প্রধানত কর্ণের ভরসায় তিনি যুদ্ধে নেমেছিলেন। কিন্তু কর্ণের হাল দেখে তিনি মনে মনে বুঝলেন— যাকে ভরসা করে আমি এই বিরাট যুদ্ধে নেমেছিলাম, সেই কর্ণকে অর্জুন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেরে গেল, যাকে ভরসা করে পাণ্ডবদের পূর্বে অবমাননা করেছিলাম, সেই কর্ণকে অর্জুন শিক্ষা দিয়েছে— স কর্ণো নির্জিতঃ সংখ্যে হতশ্চৈব জয়দ্রথঃ। দুর্যোধনের সত্য জানা হয়ে গেছে, জানা হয়ে গেছে কর্ণের মুরোদ। এবার তিনি ভাবলেন— যদি কেউ পারেন, তো দ্রোণই পারবেন অর্জুনকে মারতে। কিন্তু দ্রোণাচার্যের ওপর তাঁর এই বিশ্বাস নিতান্তই সাময়িক। এর পরেই তিনি সেনাপতি হিসেবে এতাবৎ অসফল দ্রোণকে একটু লজ্জা দিতে চাইলেন। বললেন— আপনার শিষ্য হয়ে সব্যসাচী অর্জুন দু’হাতে যুদ্ধ চালিয়ে আমার সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য ভেদ করে চলে গেল, জয়দ্রথকেও মেরে আসল। আমার ওপর ভরসা করে যে সব রাজারা ভবিষ্যতে বৃহত্তর রাজসিংহাসনের স্বপ্ন দেখছিল, তারা আজ যুদ্ধক্ষেত্রে শুয়ে আছে।
দুর্যোধন এবার যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতির একটা হিসেব দিলেন দ্রোণকে। কিন্তু একটু আগেই যিনি কর্ণকে ‘দুচ্ছাই’ বলে মনে করেছিলেন সেই দুর্যোধন এখন দ্রোণাচার্যকে শুনিয়ে বললেন— আর আপনি কী করছেন? আপনি আপনার শিষ্য বলে অর্জুনকে সব সময় যুদ্ধে এড়িয়ে যাচ্ছেন এবং সেই জন্যই আজকে আমার পক্ষের জয়-প্রার্থী পুরুষেরা সবাই মারা পড়েছে— অতো বিনিহতাঃ সর্বে যেহস্মজ্জয়চিকীর্ষবঃ। সোজাসুজি এই দোষারোপও হয়তো দ্রোণাচার্যের সহ্য হত, কিন্তু এর পরেই দুর্যোধন বললেন— আমি দেখছি— কর্ণই একমাত্র লোক যে সত্যি সত্যি মনে প্রাণে চায় যে আমার জয় হোক— কর্ণমেব তু পশ্যামি সম্প্রত্যস্মজ্জয়ৈষিণম্।
ভাবুন একবার— দুর্যোধন আচার্যের ওপর এমনভাবে দায় চাপালেন যেন তাঁর দোষেই কৌরবপক্ষের এত ক্ষয়ক্ষতি। এতদিনের অভিজ্ঞতায় বুড়ো আচার্যও সব বোঝেন। তিনিও আচ্ছা করে দুর্যোধনকে শোনালেন। শেষে বললেন— যারা হিতৈষী বন্ধুদের ভাল কথা শোনে না, শুধুই নিজের মতে চলে, তাদের অবস্থা তোমার মতোই হয়— স্বমতং কুরুতে মূঢ় স শোচ্যো নচিরাদিব। দ্রোণাচার্য দুর্যোধনের সব পুরনো অন্যায়-অসভ্যতা নতুন করে শোনালেন, তারপর সিদ্ধান্ত করলেন— তোমার কী হয় জানো? সব ব্যাপারে ওই শকুনি তোমার মদত করে, ওই তোমার ছোটটি, মানে, দুঃশাসন সব ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে জুটে যায়, আর কর্ণ তোমাকে উস্কায়— দুঃশাসনেন সংযুক্তঃ কর্ণেন পরিবর্ধিতঃ— এইভাবেই তোমার বাড় বেড়েছে এবং ভদ্রলোকের ভদ্র কথা না শোনাও তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে— ত্বয়াভ্যস্তঃ পুনপুনঃ।
দ্রোণাচার্যের এই ধিক্কারের মধ্যে দুর্যোধনের চরিত্রের সব ক’টি বীজ আছে। নিজের দোষ সামলাতে দুর্যোধন পরকে দোষ দেন। দ্রোণ তো বললেন— আমার কথা ছেড়ে দাও, তোমরা সব এত বড় বড় বীর— তা তুমি কর্ণ, কৃপ, শল্য সব্বাই তো সেখানে ছিলে, তবু জয়দ্রথ মরল কেন— স বো মধ্যে কথং হতঃ? দুর্যোধনের কাছে এ কথার জবাব নেই। তিনি শুধু দোষারোপ করতে পারেন, অপমান করতে পারেন, দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায় শুধু উপযুক্ত পুরুষের মর্যাদা নষ্ট করতে পারেন, তার বেশি কিছু পারেন না। যা কিছুই পৃথিবীতে হয়ে যাক, তার মন ঘুরে ফিরে সেই দুষ্ট কুহকচক্রে আবর্তিত হয়— শকুনি, দুঃশাসন, কর্ণ— আর নিজের মত, যাকে দ্রোণ বলেছেন— স্বমতং কুরুতে মূঢ়। এমনকী মানের আগুন চড়লে দুর্যোধনের কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না। যে অবস্থায় অর্জুনের জন্য জমিয়ে রাখা কর্ণের একাঘ্নী বাণটি পর্যন্ত ঘটোৎকচের ওপর খরচ হয়ে গেছে, সে অবস্থাতেও দুর্যোধন আচার্যকে বলে যাচ্ছেন— আপনার আশকারাতেই পাণ্ডবরা বেড়ে চলেছে। আপনি চান তো— আমি, দুঃশাসন, কর্ণ আর শকুনি মিলে দেখিয়ে দিই— কী করে অর্জুনকে মারতে হয়— অহং দুঃশাসনঃ কর্ণঃ শকুনির্মাতুলশ্চ মে। একথা শুনে দ্রোণ শুধু হেসেছেন আর বলেছেন— তা হলে আর এত লোকক্ষয় কেন? এই বিরাট যুদ্ধের মূল হলে গিয়ে তুমি, যাও না, অর্জুনের মোকাবিলা করো। আর যাক তোমার পাশা-খেলোয়াড় মামা শকুনি। ওই কর্ণের কথা, দুঃশাসনের কথা, শকুনির কথা, তোমার নিজের কথা ধৃতরাষ্ট্রের প্রত্যেক সভায় শুনেছি— শ্রুতং সংসদি সংসদি— তোমরা নাকি পাণ্ডবদের জয় করবে— তা যাও না বাপু সব, আগে বাঢ়ো— মা ভৈর্যুধ্যস্ব পাণ্ডবম্।
এত কথা, এত অভিমান— দ্রোণ নিজেই মারা গেলেন। দুর্যোধন নিজের মতো অভিমানমঞ্চে যেমন বসেছিলেন, তেমনি বসে রইলেন। আসলে দুর্যোধন নিজে অত্যন্ত ক্রূর এবং তিনি সবাইকে যুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছেন এবং তারা পাণ্ডবদের সঙ্গে না পারলে অপমান করছেন। বাস্তবিকপক্ষে নিজে যখনই অর্জুনের মুখোমুখি হয়েছেন, তখনই পরাভূত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই পরাভব তাঁকে কিছু শেখায়নি বরং সে পরাভব তাঁকে দ্বিগুণ উৎসাহিত করেছে অন্যকে অপমান করার ব্যাপারে। এক সময় তিনি যেমন ভীষ্মের ওপর পাণ্ডব-পক্ষপাতের দায় চাপিয়েছেন, তেমনি দ্রোণ সম্বন্ধেও তাঁর একই আশঙ্কা। আবার প্রতিপক্ষের বয়স যদি কাঁচা হয়, তবে তাকে দুর্যোধন যুদ্ধে প্রবৃত্ত করেন আরও এক আশঙ্কা তার ওপর ছুড়ে দিয়ে, ঠিক যেমন তিনি অশ্বত্থামাকে করেছিলেন।
ঘটোৎকচ বধ তখনও হয়নি, তবে তার তাণ্ডব আরম্ভ হয়ে গেছে, এমন অবস্থা যে রাত্রেও যুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে, অর্থাৎ তখনও দ্রোণ সেনাপতি, দুর্যোধন আপন স্বভাবে বন্ধু কর্ণকে একটু তেল দিলেন; বললেন— হ্যা হ্যা এইবার তোমায় দেখাতে হবে— অয়ং স কালঃ— তুমি তো আমাদের বাঁচাবে হে— ত্রায়স্ব সমরে কর্ণ। কথাগুলি আলাদাভাবে যদি কর্ণকে বলতেন, তা হলে দুর্যোধনকে কেউ দুষত না। কিন্তু তিনি এই কথাগুলি বললেন কৃপাচার্য এবং অশ্বত্থামার সামনে। দ্রোণের সেনাপতিত্ব চলছে, সেই অবস্থায় তাঁর শ্যালক এবং পুত্র এই কথাগুলি সহ্য করেন কী করে? বিশেষত, কর্ণ যখন দুর্যোধনের কথায় ফুলে ফেঁপে ‘হ্যান-করেঙ্গা ত্যান-করেঙ্গা’ বলে যাচ্ছেন, তখন কৃপাচার্য তাঁর কথার প্রচণ্ড প্রতিবাদ করলেন। অশ্বত্থামাও বললেন আচ্ছা করে। এরই মধ্যে হল কী অর্জুন আর কর্ণের একটা ছোট্ট যুদ্ধ হয়ে গেল এবং তাতে কর্ণ এতই নাকাল হলেন যে তাঁকে কৃপের রথে উঠে পড়তে হল। এই অবস্থায় দুর্যোধন এক নতুন খেলা খেললেন। মারামারি হবার সময় পাড়ার দু’-একটি পালের গোদা যেমন নিশ্চিন্ত থাকে যে, সে মারামারির উপক্রম করলেই অন্যেরা তাকে আটকাবে, এখানেও ঠিক সেই কায়দায় দুর্যোধন এগিয়ে চললেন অর্জুনের সঙ্গে লড়তে। বিপদ বুঝে কৃপ অশ্বত্থামাকেই বললেন দুর্যোধনকে আটকাতে, কারণ তিনি জানেন— অর্জুনের সামনে পড়লে দুর্যোধনের কী দুর্গতি হবে।
অশ্বত্থামা স্বয়ং যুদ্ধের জন্য এগিয়ে এলেন এবং দুর্যোধনকে আটকালেন। কিন্তু এর জন্য কৃতজ্ঞতা দূরে থাক, দুর্যোধন বললেন— আচার্য দ্রোণ তো পাণ্ডবদের নিজের ছেলের মতো আগলে রাখছেন, আর তুমিও পাণ্ডবদের এড়িয়ে এড়িয়ে চলছ। হয়তো আমারই দুর্ভাগ্য যে, যুদ্ধে তোমার ক্ষমতা পুরোপুরি আমি দেখতে পাচ্ছি না। অথবা এমনও হতে পারে যে, যুধিষ্ঠিরের জন্য তোমার হৃদয়টা নরম আছে, নাকি তোমার এই ব্যবহার চারুহাসিনী দ্রৌপদীর ভাল লাগবে বলে করছ— ধর্মরাজপ্রিয়ার্থং বা দ্রৌপদ্যা বা ন বিদ্ম তৎ। বস্তুত এ কথায় অশ্বত্থামা একেবারে ফেটে পড়লেন। আমরা সেসব ক্রোধ হুংকার সবিস্তারে বলব না, তবে অশ্বত্থামার বিশ্লেষণে দুর্যোধন সম্বন্ধে চারটি দামি বিশ্লেষণ আছে। অশ্বত্থামা বলছেন— আপনার মতো লোভী, বিশেষত রাজ্যলোভী আর দ্বিতীয় নেই পৃথিবীতে। ছল-চাতুরিও বেশ ভালই জানেন। তার ওপরে এ সংসারে এমন বুঝি কেউ নেই, যাকে আপনি সন্দেহ করেন না। আমাদের প্রত্যেকটি যোদ্ধাকে আপনি সন্দেহ করেন— সর্বাভিশঙ্কী মানী চ— এবং ভাবেন, ওরা প্রত্যেকে মনে মনে পাণ্ডবদের হয়ে লড়ছে।
দুর্যোধনের একটি আশঙ্কা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে নয়, তা অশ্বত্থামা নিজেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্বীকার করেও আবার বলেছেন— হ্যাঁ, আমার বাবাই হোক কিংবা আমি আমরা পাণ্ডবদের ভালবাসি— এ কথা মানলাম। এ কথাও মানলাম— তারাও আমাদের ভালবাসে, কিন্তু যুদ্ধের সময়ে তার কী— ন তু যুদ্ধে কুরুদ্বহ। অশ্বত্থামা যতই বলুন— যুদ্ধের সময়ে তার কী— আমরা জানি যুদ্ধের সময়েও ভালবাসা একটু একটু কাজ করে, বিশেষত ভীষ্ম-দ্রোণের মতো বৃদ্ধদের সস্নেহ পক্ষপাত তো পাণ্ডবদের ওপর অবশ্যই ছিল। একথা ওই বৃদ্ধেরাও জানতেন, দুর্যোধনও জানতেন। তাই দেখি, যখনই দুর্যোধন এই পক্ষপাতের খোঁচা দিয়েছেন, তখনই— ভীষ্মকেও দেখেছি, দ্রোণকেও দেখেছি— দেখেছি— তাঁরা আহত হয়েছেন বটে, তবে তার পর থেকেই দ্বিগুণ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজে মরে আপন পক্ষপাতদুষ্টতার দোষ ক্ষালন করেছেন। দুর্যোধন সেটা একটুও বুঝতে পারেননি।
দুর্যোধনের নিন্দাপঙ্কে তিলকরচনা করে ভীষ্ম-দ্রোণ তো মারা গেলেন, এবার কর্ণের পালা। দুর্যোধন যাকে বিশ্বাস না করে পারেন না, সেই কর্ণের পালা। এই প্রথম দুর্যোধন একেবারে বিধিমতে স্নান-টান করিয়ে সেনাপতির অভিষেক করলেন। হ্যাঁ ভীষ্ম-দ্রোণেরও অভিষেক হয়েছে হয়তো, কিন্তু এ যে দুর্যোধনের চির-বিশ্বস্ত কর্ণ— মহাভারতকার তাঁর অভিষেকের একটু বিশেষ বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু যত অভিষেকই হোক, কিংবা যত বিশ্বাসই থাকুক কর্ণের ওপর, তাঁরই সেনাপতিত্বে দুর্যোধনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয়ে গেল। দুঃশাসন বধ এবং তার রক্তপান। কর্ণ নিজেও মারা গেলেন অনেক বীরত্ব দেখিয়ে। এবার আর দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনির ‘মিটিং’ বসল না, কারণ দুর্যোধনের বুদ্ধি এবং বৃদ্ধির সহচর দু’জনেই মৃত। এখন দেখছি কৃপাচার্য এসে দুর্যোধনকে আবার বোঝাচ্ছেন সন্ধির প্রস্তাব মেনে নিতে। বিমূঢ় দুর্যোধন এখন একে একে তাঁর পুরনো পাপগুলি স্মরণ করছেন— কপট পাশা, কুরুসভায় কৃষ্ণার কাপড় ধরে টানাটানি, পাণ্ডবদের বনবাস এমনকী শান্তির দূত কৃষ্ণের সঙ্গে অপব্যবহারও তিনি স্মরণ করছেন। কিন্তু কৃপাচার্যের কাছে এই সব অন্যায় নিয়ে যত অনুশোচনাই দেখান দুর্যোধন, এর মধ্যেও তাঁর কপটতা আছে। তিনি দেখাতে চাইছেন— এত সব অন্যায়ের পরে পাণ্ডবরাই সন্ধির প্রস্তাব মেনে নেবে না। যেন দুর্যোধন এখন সন্ধি চাইলেও পাণ্ডবরাই যেহেতু সন্ধি চাইবে না, তাই যুদ্ধ বন্ধ করার প্রশ্ন আসে না। দুর্যোধন স্বকৃত অন্যায়ের নানা উদাহরণ তুলে তুলে বলতে লাগলেন— ওরা এর পরেও আমাকে কেন বিশ্বাস করবে— কথং সোহস্মাসু বিশ্বেসেৎ, আমাকে কেন তারা ক্ষমা করবে, আমার হিতের জন্য তারা কেন সন্ধি করবে?
দুর্যোধনের এই অনুশোচনায় কৃপাচার্য যদি কোনওভাবে বলেন যে— সে ঠিক আছে, তুমি নিজে রাজি হও, ওদের রাজি করানোর ভার আমার— তা হলে দুর্যোধন কী করবেন? এইখানেই আসল কথাটি বেরিয়ে আসে। আসল কথা, মানে, সেই অভিমানের কথা, মানের কথা— মহাভারতকার মানবহ্নি সৃজন করিয়া দুর্যোধন পতঙ্গকে পোড়াইলেন— সেই মানের কথা। দুর্যোধন এতক্ষণ পাণ্ডবদের কথা বলছিলেন, এবার বাচ্য পরিবর্তন করে বললেন— আমার সঙ্গে ওদের সন্ধি হবে কী করে— সন্ধেয়ঃ স কথং ময়া? আমি এতকাল এই সাগরমেখলা পৃথিবী একা ভোগ করেছি— সেই আমি কী করে পাণ্ডবদের দয়ায় বেঁচে থাকব? দুর্যোধন মানবহ্নিতে পুড়ছেন। বললেন— যে আমি এতকাল সমস্ত রাজাদের মাথার ওপর সূর্যের তেজে জ্বলেছি, সেই আমি কী করে চাকর-বাকরের মতো যুধিষ্ঠিরের পেছন পেছন ঘুরব— যুধিষ্ঠিরং কথং পশ্চাদ্ অনুযাস্যামি দাসবৎ। দুর্যোধন মনে করেন— তাঁর আর পাবার কিছু নেই, বিশেষত এতকাল শত্রুর মাথায় পা রেখে চলার পর এখন সেই শত্রুর কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠানো তাঁর সম্মানে বাধে— ন তু সন্ধিমহং মন্যে প্রাপ্তকালং কথঞ্চন। দুর্যোধনের এই অতিমানী স্বভাবের মধ্যেও একটা কথা অতি মধুর। তিনি বলেছিলেন— যাঁরা এই বিরাট যুদ্ধে আমার জন্য মরেছে তাঁদের কাছে আমার ঋণ আছে। যে যুদ্ধে আমি আমার বন্ধু, ভাই এমনকী ঠাকুরদাদাকে পর্যন্ত লড়িয়ে দিয়েছি, সেই যুদ্ধ যদি আমিই না করি, তা হলে লোকে আমায় নিন্দে করবে। আর পাণ্ডবদের কাছে খাটো হয়ে আমি যে রাজসুখ ভোগ করব, তাতে আমার কী লাভ হবে, আত্মীয়স্বজন নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, কেবলই শূন্যতা— কীদৃশং তদ্ভবেদ্ রাজ্যং মম হীনস্য বন্ধুভিঃ।
দুর্যোধন কৃপাচার্যের সন্ধির প্রস্তাব উড়িয়ে দিলেন— বেশির ভাগটাই মানহানির ভয়ে। পূর্ব যোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত এখুনি দুর্যোধন যে কথা বলেছেন— তাও কিন্তু মানহানির ভয়ে এবং শেষ পর্যন্ত যে শল্যকে সেনাপতি করলেন দুর্যোধন সেও মানহানিরই ভয়ে। শল্যের সেনাপতি হওয়া দেখে ধারাভাষী সঞ্জয় পর্যন্ত হেসে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন— ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মতো যোদ্ধারা রসাতলে গেল, আর শল্য জিতবে পাণ্ডবদের? দুর্যোধনের মান রাখতে শল্য মারা গেলেন, দুর্যোধনের সব ভাই মারা গেলেন, মারা গেলেন কূটবুদ্ধি শকুনি। যোদ্ধা বলতে যাঁরা দুর্যোধনের পক্ষে তখনও বেঁচে আছেন, তারা হলেন কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা এবং দুর্যোধন নিজে। শল্যকে সেনাপতি করার সময়েও দুর্যোধনের যতটুকু জয়ের আশা ছিল, শল্যবধের সঙ্গে সঙ্গে সে আশা তিরোহিত হওয়ায় শ্রান্ত, ক্লান্ত দুর্যোধন এবার হ্রদের জলে প্রবেশ করলেন— একাদশ অক্ষৌহিণীর নায়ক দুর্যোধন মানবহ্নিতে পুড়তে পুড়তে শুধু একখানি গদা হাতে নিয়ে খালি পায়ে হ্রদের জলে গা জুড়োতে নামলেন। রাস্তায় দেখা হল সত্যদ্রষ্টা সঞ্জয়ের সঙ্গে। তাঁকে হাতে ধরে দুর্যোধন বললেন— আমার কথা জানিয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে। বোলো— তাঁর ছেলে জলে নেমেছে বিশ্রামের জন্য। বোলো— বন্ধু নেই, আত্মীয়স্বজন নেই, ছেলেপুলে, ভাই-বেরাদর সব গেছে, রাজ্যও এখন পাণ্ডবদের দখলে। এমন অবস্থায় আমার মতো লোক কি বেঁচে থাকতে পারে— কো নু জীবেত মাদৃশঃ? দুর্যোধন হ্রদে প্রবেশ করলেন।
সঞ্জয়ের ‘রিপোর্ট’টা ঠিক এতটুকু নয়। আসলে যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বশেষ পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে এসে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে জানাবেন বলে সঞ্জয় চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মদ্ররাজ শল্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একদিকে পাণ্ডবপক্ষের তর্জন-গর্জন, জয়কার অন্যদিকে দুর্যোধনের দিকে সব শেষ। দুর্যোধনের শকুনি-মামা মারা গেলে পরিস্থিতিটা আরও অন্যরকম হয়ে উঠল। এমনিতেই যুদ্ধভূমিতে একটা রবই উঠে গিয়েছিল যে, দুর্যোধন কোথায় গেলেন। শেষবার যখন তাঁকে দেখা গেছে, তখন এই পরিস্থিতি ছিল যে, পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্নের বাণে তাঁর রথ, অশ্ব, সারথি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে এবং তিনি একাকী অন্য একটি অশ্বে আরোহণ করে সম্মুখ-যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গিয়েছেন— অপাক্ৰামদ্ হতরথো নাতিদূরম্ অরিন্দম— তখনও সম্পূর্ণ যুদ্ধভূমি থেকে তিনি সরে পড়েননি। তিনি বুঝতেই পারছিলেন— আরও কয়েকটি ভাই তাঁর অবশিষ্ট আছে, আছেন মামা শকুনি, পাণ্ডবরা তাদের ছেড়ে দেবে না। অতএব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘোড়া চালিয়ে, তিনি শকুনির কাছে গেলেন— প্রযযৌ যত্র সৌবলঃ।
ওদিকে কৌরবদের মধ্যে যুদ্ধবীর যাঁরা জীবিত ছিলেন, সেই অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা হঠাৎই দুর্যোধনকে পূর্বস্থানে দেখতে না পেয়ে সেখানে এসে লোকজনদের জিজ্ঞাসা করলেন— কোথায় গেছেন দুর্যোধন? তাতে কতক লোক বলল— ওই হোথায় গেছেন, যেখানে শকুনি আছে। অন্য সামন্ত রাজারা, যাঁরা তখনও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যুদ্ধ করছিলেন দুর্যোধনেরই জন্য, তাঁরা অদ্ভুত ভঙ্গীতে বললেন, দুর্যোধনকে দিয়ে কী কাজ আপনাদের, তিনি কী করবেন, তাঁকে দিয়ে কী হবে— দুর্যোধনেন কিং কাৰ্যং… কিং বো রাজা করিষ্যতি? ভাবটা এই— যান না, নিজেরা যুদ্ধ করুন সকলে মিলে। তারপরে বেশ একটু নৈর্ব্যক্তিকভাবে, বেশ একটু নির্বিণ্ণভাবে সেই সামন্তরাজারা বললেন, ঠিক আছে খুঁজছেন, খুঁজুন দুর্যোধনকে, দেখুন বেঁচে আছে কিনা— দ্রক্ষ্যধ্বং যদি জীবতি।
আসলে যুদ্ধক্ষেত্রের তখন এমন অবস্থা, দুর্যোধনের সৈন্য সামন্ত এত ক্ষয় গেছে, যোদ্ধারা তখন পাণ্ডবদের কাছে এত সহজেই মৃত্যুর লক্ষ্য হয়ে উঠছে যে, নিজের প্রাণ বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। হয়তো সেই কারণেই সামন্ত ক্ষত্রিয় রাজাদের ওই হতাশ বচন— দেখুন গিয়ে, আগে বেঁচে আছে কিনা দেখুন, তারপর তো…। অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা অবশ্য প্রথম মন্তব্যটিই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে তাঁরা কোনওমতে পৌঁছতে চেষ্টা করলেন শকুনির কাছে, যেখানে দুর্যোধন আগেই পৌঁছেছিলেন। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। তাঁর অবশিষ্ট ভাইয়েরা সব ভীমের হাতে মারা পড়ল, শকুনি মারা পড়লেন সহদেবের বাণে। অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা পাণ্ডবপক্ষের ধৃষ্টদ্যুম্ন, অর্জুনকে পেরিয়ে এসে দুর্যোধনের সঙ্গে যোগ দিতে পারলেন না। হঠাৎই দুর্যোধন দেখলেন— তাঁর পক্ষের সৈন্য-সামন্ত-সহায় কেউই নেই— নাপশ্যৎ সমরে কঞ্চিৎ সহায়ং রথিনাং বরঃ। তাঁর পক্ষের যোদ্ধা, বল, বাহন সমস্ত প্রায় শূন্য। পাণ্ডবদের তর্জন গর্জন শোনা যাচ্ছে বড় কাছ থেকে। এই অবস্থায় তাঁর পালিয়ে না গিয়ে উপায় কী। সমস্ত মৃত্যু এবং ধ্বংসের শেষে যার নিজেরই বীরদর্পে মৃত্যু বরণ করা উচিত ছিল, এমনকী যিনি এই শেষ মুহূর্তে একটু আগেই, এই শকুনি মারা যাবার আগেই অবশিষ্ট সৈন্যদের পৃষ্ঠ-প্রদর্শন না করে সম্মুখ-যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করার উপদেশ দিচ্ছিলেন, সেই দুর্যোধন এবার কিন্তু পলায়নে মনোনিবেশ করলেন— অপযানে মনশ্চক্রে বিহীন-বল-বাহনঃ।
নিজের অশ্ব ত্যাগ করে একাকী নিজের বিখ্যাত গদাখানি হাতে নিয়ে দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে চললেন। নিজের চোখে দেখে এসে সঞ্জয় ‘রিপোর্ট’ করছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। তাঁর সঙ্গে সঞ্জয়ের দেখা হয়েছিল খুব বিধ্বস্ত অবস্থায়। দুর্যোধন তাঁর কাছে জানিয়েছেন— তিনি পালিয়ে যাচ্ছেন না, নিজের প্রাণ বাঁচাতে যাচ্ছেন না, তিনি বিশ্রাম নিতে যাচ্ছেন। তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত, শত্রুর অস্ত্রপাতে এবং রক্তপাতে সমুজ্জ্বল। নিজ পক্ষে একটিও সঙ্গী বেঁচে নেই দেখে স্বভাবতই হতাশ এবং সেই জন্যই বিশ্রামের ভাবনা আসছে মাথায়। সঞ্জয় ‘রিপোর্ট’ থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা— এই তিন মহারথ যোদ্ধা শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেছিলেন দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে মিলিত হবার, কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁদের সঙ্গে দেখা হবার আগেই হতাশ্বাস দুর্যোধন যুদ্ধ ছেড়ে প্রায় এক ক্রোশ পথ চলে গেছেন দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে।
সঞ্জয় জানিয়েছেন যে, তিনি খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেই যুদ্ধের গোলমালে আটকে গিয়েছিলেন। অশ্বত্থামা এবং কৃপ-কৃতবর্মার সঙ্গেও তাঁর পূর্বেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা সঞ্জয়ের কাছে দুর্যোধনের সর্বশেষ সংবাদ জিজ্ঞাসা করলে সঞ্জয় একই কথা জানিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি একাকী দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে গেছেন। অশ্বত্থামা-কৃপ-কৃতবর্মারা এই সংবাদে সংকুচিতই হয়েছেন বেশি। তাঁরা সঞ্জয়কেই সলজ্জে বলেছেন— হায়! হায়! কী গোলমালটাই না হয়ে গেল। রাজা বোধহয় জানেনও না যে, আমরা বেঁচে আছি। আমরা তো তাঁর সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করতে পারতাম— পর্যাপ্তা হি বয়ং তেন সহ যোধয়িতুং পরান্। কিন্তু এই মিলন হবার আগেই দুর্যোধনের প্রস্থান ঘটেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে।
বস্তুত সঞ্জয় কৃপাচার্যের রথে চড়েই আরও একবার যুদ্ধ শিবিরে প্রবেশ করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তিনি জানিয়েছেন— বিধ্বস্ত রণভূমিতে কৌরবপক্ষের আর কেউই বেঁচে নেই ওই তিনজন এবং দুর্যোধন ছাড়া। রাজরমণীরা যাঁরা স্বামীদের কাছাকাছি শিবিরে ছিলেন, তাঁরা সকলে উদ্ভ্রান্ত হয়ে হস্তিনাপুরের পথে রওনা হয়েছেন। স্ত্রীলোকরক্ষী বৃদ্ধ পুরুষেরা তাঁদের কোনও মতে নিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের আর্তনাদ কানে শোনা যায় না। দুর্যোধনের অমাত্যেরা কৌরবপক্ষের যুদ্ধফল দেখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে দুর্যোধনের স্ত্রীদের হস্তিনানগরীর দিকে নিয়ে চললেন— রাজদারান্ উপাদায় প্রযযুর্নগরং প্রতি। স্ত্রীলোকদের এইভাবে রাজধানীর দিকে নিয়ে যাবার মধ্যে চরম পরাজয়ের ইঙ্গিত মেলে। এমনকী কর্মীরা পর্যন্ত, যারা রথ সারায়, খাবার সরবরাহ করে তারাও ফিরে চলল সস্ত্রীক। সঞ্জয় এই চিত্র দেখে এসেছেন, কিন্তু যুদ্ধভূমিতে এই নির্যান নিঃসরণের চেয়েও পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তাঁর পুত্রই শুধু নয়, আরও তিনটি মানুষের গতিবিধিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অর্থাৎ দুর্যোধনের সঙ্গে অশ্বত্থামা-কৃপ-কৃতবর্মারা কী করছেন, এটা আকুল করছে ধৃতরাষ্ট্রকে। কী অদ্ভুত লাগে এই মর্মান্তিক হৃদয় বোঝা। অন্ধ পিতার আশা, আকাঙ্ক্ষা, তৃষ্ণা বুঝি এখনও শেষ হয়নি। ওই যে তিনি একবার ওই তিন যোদ্ধার মুখে শুনেছেন— তাঁরা এখনও দুর্যোধনের সঙ্গে লড়তে চান।
কিন্তু যুদ্ধভূমির চালচিত্র একেবারে অন্যরকম হয়ে আছে। পাণ্ডবরা তখন বিপক্ষভূমির আনাচে-কানাচে সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন দুর্যোধনকে। স্ত্রীলোকদের অস্থায়ী শিবির থেকে সরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ায় সেখানে দুর্যোধন লুকিয়ে আছেন কিনা, এই সম্ভাবনায় যদি পাণ্ডবরা দুর্যোধনকে খুঁজতে আসেন, সেই ভয়ে তিন রথী অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মাও শিবির ছেড়ে দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে চললেন দুর্যোধনকে খুঁজতে। কিন্তু এই প্রস্থানও তখনই সম্ভব হয়েছে, যখন বিচরণশীল পাণ্ডবরা দুর্যোধনকে খুঁজে শ্রান্ত হয়ে নিজের নিজের শিবিরে ঢুকে পড়েছেন— সন্নিবিষ্টেষু পার্থেষু প্রয়াতাস্তং হ্রদং শনৈঃ আমার কাছে এটাও আশ্চর্য লাগে যে, দুর্যোধনের জন্য যাঁরা এতটা চিন্তা করছেন, তাঁরা এমন লুকিয়ে থাকছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন! এর আগেও আমরা দেখেছি— এঁরা যখন সঞ্জয়ের কাছ থেকে দুর্যোধনের খবর নিচ্ছিলেন, তখনও পাণ্ডবদের শব্দ পেয়েই পালিয়ে গিয়েছিলেন। সঞ্জয় নিজেই ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন এ-কথা— আমার সঙ্গে কথা বলার সময় দূর থেকে পাণ্ডবদের দেখেই এই মহাযোদ্ধারা দ্রুত পালিয়ে গেলেন— প্রাদ্রবন্ রথিনাং শ্রেষ্ঠা দৃষ্ট্বা পাণ্ডুসুতান্ রণে।
অর্থাৎ আমাদের মতো সঞ্জয়ও কিন্তু এঁদের সাহসিকতায় সংশয়ী। তবু ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্ন করছেন বলেই বুঝতে পারি যে, জটিল মন হয়তো কোনও নতুন জটিলতার সম্ভাবনায় আশাবাদী হচ্ছেন। ঘটনাও ঠিক তাই। অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা দ্বৈপায়ন হ্রদের কাছে এসে দেখলেন— দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের জলের মধ্যে যৌগিক প্রক্রিয়ায় জলস্তম্ভন করে প্রায় শবাসনে বিশ্রাম করছেন। মায়াবলে জলস্তম্ভন করা অথবা যৌগিক প্রক্রিয়ায় জলের মধ্যে বসে থাকা সম্ভব কিনা, সে-কথা অনেকটাই অলৌকিকতার পরিসর, কিন্তু মহাজনের বচন এবং জীবন প্রমাণে এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, যৌগিক প্রক্রিয়ায় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিরুদ্ধ করে স্থির এবং লঘু হয়ে থাকা সম্ভব। তা ছাড়া আলংকারিক ভাষায় ‘গঙ্গায়াং ঘোষঃ’ বললে যেমন লক্ষণা-বৃত্তিতে গঙ্গার স্রোতঃপ্রবাহের মধ্যে ঘোষেরা বাস করে, এমন বোঝায় না, বরঞ্চ গঙ্গার জল-ধোয়া তীরভূমি বোঝায় অথবা ‘দক্ষিণেশ্বরে থাকি’ বললে যেমন দক্ষিণেশ্বরের কালী-মন্দিরে থাকার কথা বোঝায় না, বরঞ্চ মন্দির-লক্ষিত এলাকা বোঝায়, তেমনই দ্বৈপায়ন হ্রদে দুর্যোধন প্রবেশ করলেন— এ কথার বাস্তব-সম্মত অর্থ বোধহয় এইরকমই যে, তিনি দ্বৈপায়ন হ্রদের প্রায় অগম্য কোনও প্রদেশে বসে যোগ অবলম্বন করে নিস্তরঙ্গভাবে বসে ছিলেন তপস্বীর মতো।
ঠিক এই রকম অবস্থায় কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা অপরাহ্নের নিস্তব্ধতায় পাণ্ডবদের এড়িয়ে দুর্যোধনের কাছে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধনকে দেখামাত্রই তাঁরা বললেন— মহারাজ! আপনি জল থেকে উঠুন, আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করুন পাণ্ডবদের সঙ্গে— রাজন্ উত্তিষ্ঠ যুধ্যস্ব সহাস্মভির্যুধিষ্ঠিরম্। আমাদের জয় হোক, অথবা আমাদের মৃত্যু হোক, এটাও তো খেয়াল করবেন যে, ওদেরও কম সৈন্য আপনি ধ্বংস করেননি। পাণ্ডবরা নিজেরাও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছে। এই অবস্থায় আপনি যদি যুদ্ধে নামেন, তা হলে আমাদের দ্বারা রক্ষিত আপনার অস্ত্রবেগ ওরা ধারণ করতে পারবে না।
অশ্বত্থামা এবং কৃপ-কৃতবর্মার কথায় এবং হিতৈষণায় দুর্যোধন বেশ খুশি হলেন বটে, কিন্তু শারীরিক দিক থেকে তাঁর এমন পটুতা বোধহয় ছিল না যাতে করে তাঁদের কথায় নেচে উঠে তিনি আবারও যুদ্ধযাত্রা করতে পারেন। দুর্যোধন বললেন, কপাল ভাল যে, এই যুদ্ধে আপনারা এখনও শেষ হয়ে যাননি এবং আমারও কপাল, আপনাদের দেখতে পেলাম আর একবার। তবে কিনা আজকের দিনটা বাদ দিন। আপনারাও খুব পরিশ্রান্ত, আমিও তাই, শরীরটাও খুব ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে; আজকের দিনটা আমরা সকলেই বিশ্রাম নিই। কালকে বরং নতুন উদ্যমে ভালভাবে যুদ্ধ করব— বিশ্রাম্যেকাং নিশামদ্য ভবদ্ভিঃ সহিতো রণে।
কেন জানি না দুর্যোধনকে আজ সমস্ত বৈমনস্য গ্রাস করেছে, গ্রাস করেছে হতাশা। শুধুমাত্র দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বলে যুদ্ধদুর্মদ দুর্যোধন যুদ্ধ করতে চাইছেন না, এটা বোধহয় ঠিক নয়। হঠাৎ বৈমনস্য গ্রাস করেছে তাঁকে, একশো ভাইয়ের এক ভাইও বেঁচে নেই, কর্ণ-শকুনি-দুঃশাসন মারা গেছেন নিত্য সহচর। আজ যুদ্ধ ছেড়ে এসে খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর এই দিনটায় আর কিছু ভাল লাগছে না তাঁর। বারবার বলছেন, আজ এই সময়টা আমাদের বিক্রম দেখাবার সময় নয়— নায়ং কালঃ পরাক্রমে। অশ্বত্থামা তবু হাল ছাড়লেন না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন দুর্যোধনকে, শত্রু নিধনের প্রতিজ্ঞাও করলেন অনেক। কিন্তু ফল হল কী হল না বোঝবার আগেই একটা ঘটনা ঘটল এবং সেটা সঞ্জয় প্রত্যক্ষ দেখে এসে রিপোর্ট করছেন।
কতগুলি ব্যাধ-শবর বিদ্ধ-মৃত পশুর ভার কাঁধে নিয়ে ফিরছিল দ্বৈপায়ন হ্রদের পথ ধরেই। এই ব্যাধেরা মধ্যম পাণ্ডব ভীমের খুব পরিচিত, বিচিত্র পশুমাংসভোজী ভীমকে এরা প্রতিদিন বিচিত্র পশুমাংস খাওয়াত এবং ভাল অর্থও পেত ভীমের কাছ থেকে। এই ব্যাধেরা দুর্যোধনের সঙ্গে অশ্বত্থামা-কৃপ-কৃতবর্মাকে কথা বলতে দেখল। আদার ব্যাপারীর মতো হলেও পাণ্ডবরা যে দুর্যোধনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, জাহাজের এই খবরটুকু তারা জানে। বিশেষত এই বিরাট যুদ্ধ যে পাণ্ডবদের অনুকূলে শেষ হচ্ছে এবং তাদের আনীত মাংসের ক্রেতা ভীমের দাদা যুধিষ্ঠিরই যে এ-পক্ষের সর্বাধিনায়ক, এই খবর ব্যাধেরা রাখত।
আগন্তুক-ত্রয়ীর সঙ্গে দুর্যোধনের যেভাবে কথা হচ্ছিল এবং আজই যুদ্ধ করার ব্যাপারে তিন জনের অত্যাগ্রহ এবং দুর্যোধনের অনাগ্রহের কথাও তারা শুনতে পেল। তারা পরিষ্কার বুঝতে পারল যে, দুর্যোধন এই দ্বৈপায়ন হ্রদের এখানেই আছেন এবং থাকবেনও— ব্যাধা হ্যজানন্ রাজেন্দ্র সলিলস্থং সুযোধনম্। বিশেষত এই আজকেই যুধিষ্ঠির এই বহুল-বিচরণশীল ব্যাধদের কাছে জিজ্ঞাসাও করেছেন দুর্যোধনের ব্যাপারে। সরল ব্যাধেরা নিজেদের মধ্যে অনুচ্চ-স্বরে কথা বলে ঠিক করল যে, এখনই মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে খবরটা জানানো দরকার। বিশেষত তাদের মাংসভোক্তা ভীমের কাছে দুর্যোধনের হদিশ দিলে তিনি যে পরিমাণ ধন দেবেন, তাতে এই মাংস-বেচার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পাওয়া যাবে— দুর্যোধনং খ্যাপয়ামো ধনং দাস্যতি পাণ্ডবঃ।
ব্যাধেরা চলে গেল যুধিষ্ঠিরের কাছে। পাণ্ডবদের নিযুক্ত গুপ্তচরেরা বহু খোঁজ নিয়েও যে খবর দিতে পারেনি, পশুশিকারি ব্যাধদের কাছ থেকে সেই অমূল্য খবর পেয়ে পাণ্ডবরা সদল-বলে কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন দ্বৈপায়ন-হ্রদে, যেখানে দুর্যোধন আছেন— দ্বৈপায়ন-হ্রদং খ্যাতং যত্র দুর্যোধনোহভবৎ। চারিদিকে বিপুল শব্দ হচ্ছে, হঠাৎই নির্জন বনস্থলীতে রথের ঘর্ঘর, শঙ্খনাদ, রণহূংকার— দ্বৈপায়ন হ্রদের পরিবেশ আকুল হয়ে উঠল। আর ঠিক এই সময়, দুর্যোধন যখন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন— কিছু একটা ঘটতে চলেছে, কেননা জলের মধ্যে থেকেও তিনি মেঘগর্জন-সদৃশ তুমুল শব্দ শুনতে পারছেন, ঠিক এই সময় অশ্বত্থামা-কৃপ-কৃতবর্মারা দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ! বিজয়-ভাবনায় উদ্ধত হয়ে পাণ্ডবরা মহানন্দে এদিকেই ধেয়ে আসছে, অতএব অনুমতি করুন, এবার আমরা এখান থেকে চলে যাই— অপযাস্যামহে তাবদনুজানাতু নো ভবান্।
আমাদের অবাক লাগে এই ‘অ্যাটিটুড’টা। যাঁরা একটু আগেই— বিশেষত অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা, কৃপ— এঁরা কেউই কম বড় যোদ্ধা নন, এঁদের মধ্যে অশ্বত্থামা তো ব্রহ্মশির নামক মারণাস্ত্রের অধিকারী এবং যে অস্ত্র তিনি অন্যায় লক্ষ্যে চালিত করবেন ভবিষ্যতে, সেই লোকগুলি— যাঁরা একটু আগেই সদ্যযুদ্ধের জন্য দুর্যোধনের চুল ছিঁড়ে খাচ্ছিলেন, সেই লোকগুলি পাণ্ডবদের দূর থেকে দেখামাত্রই দুর্যোধনের কাছে প্রস্থানের অনুমতি চাইলেন এই বলে যে, পাণ্ডবরা ওই আসছে, আমরা এবার যাই— ইমে হ্যায়ান্তি সংহৃষ্টা পাণ্ডবা জিতকাশিনঃ।
আমাদের অবাক জিজ্ঞাসা হয়— দুর্যোধন কি ওই যোদ্ধাত্রয়ীর আন্তরিক মানসিকতা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন! এমনকী বুঝেছিলেন যে, এঁরা তেমন সুযোগ পেলেই প্রস্থান করবেন এবং সেইজন্যই তিনি এঁদের দুরাগ্রহ সত্ত্বেও যুদ্ধে যেতে চাননি। কিন্তু এই মুহুর্তেও দুর্যোধনের বীরোচিত সম্ভাষণ লক্ষ্য করার মতো। অশ্বত্থামারা প্রস্থান করতে চাইলে একবারও তিনি প্রতিপ্রশ্ন করলেন না। বললেন না— এই তো তোমরা পাণ্ডবদের সঙ্গে আমৃত্যু যুদ্ধ করবার জন্য প্রতিজ্ঞা করছিলে আমার কাছে, তা এখন চলে যাচ্ছ কেন? দুর্যোধন কিচ্ছু বললেন না, কোনও অনুযোগ করলেন না এবং তাঁদের প্রস্থান-উদ্যোগের তাড়া দেখে— দুর্যোধনস্তু তচ্ছ্রুত্বা তেষাং তত্র তরস্বিনাম্— সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, তোমরা এসো। এবং তারপরেই আবারও নিশ্চেষ্ট অবস্থায় দ্বৈপায়ন-হ্রদের জলস্তম্ভন করে সুপ্তের মতো পড়ে রইলেন আগের মতো। হয়তো তিনি ভাবছিলেন— এইভাবে পূর্বাভ্যাস-কৌশলে জলের ওপর নিশ্চেষ্টভাবে পড়ে থাকলে বীরমানী শত্রুপক্ষ আর তাঁকে বিরক্ত করবে না।
লক্ষণীয়, দুর্যোধন কিন্তু এমন কিছু করছেনও না বা ভাবছেনও না যার মধ্যে আত্মহত্যা বা নির্বিণ্ণ বৈরাগীর লক্ষণ ফুটে ওঠে। তিনি পালিয়েও যাচ্ছেন না বা যেতে চানওনি। কেননা পালাতে চাইলে তো সত্যি ওই অশ্বত্থামা-কৃপদের মতো পাণ্ডবদের শব্দমাত্রে সচকিত হয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে দৌড় লাগাতে পারতেন, তার পর দূরে কোনও বটবৃক্ষের তলায় বসে ভাবতেন— কী রকম ঠকানোটাই না ঠকালাম পাণ্ডবদের। আসলে এই ঠকানোর পর্বটাও তাঁর জীবনে শেষ হয়ে গেছে, কেননা শকুনি মারা গেছেন। শকুনি পাশে না থাকলে দুর্যোধন বোধহয় এইরকমই যে, পাণ্ডবরা তাঁকে মারবার জন্য আসছেন জেনেও এতটুকু বিচলিত না হয়ে তিনি নিশ্চেষ্টায় গা ভাসিয়ে রাখলেন দ্বৈপায়ন হ্রদের জলে।
দ্বৈপায়ন হ্রদের জল কোনও মিথিক্যাল কালা দিঘির শীতল জল কিনা জানি না, কিন্তু বেশ বুঝতে পারি— তিনি একা থাকতে চাইছিলেন। ক্ষত-বিক্ষত দেহ, আঠেরো দিনের যুদ্ধের ক্লান্তি, বিষম পশু দিয়ে রথ চালানোর মতো বিষম যুদ্ধ-নায়কদের দিয়ে এতদিন ধরে যুদ্ধ চালানোর স্নায়ুভেদী তৎপরতা এবং অবশেষে সমস্ত স্বজনহানির পরেও নিজে বেঁচে থাকা— দুর্যোধন তাই একা থাকতে চাইছিলেন যৌগিক অভ্যাসে নিজেকে শান্ত করে, শান্ত জলে শান্ততর নিশ্চেষ্টতায় নিজেকে নিজের মধ্যেই নিরুদ্ধ করে।
ওদিকে খবর পেয়ে পাণ্ডবরা, পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অন্যান্য অবশিষ্ট জনেরা তুমুল হর্ষে তুমুল শব্দ করতে করতে দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে এসে পৌঁছলেন। এমন সাড়ম্বর শত্ৰু-আগমনের মধ্যেও দুর্যোধন এতটুকু বিচলিত হলেন না। তিনি যেমন শান্ত পড়েছিলেন গা এলিয়ে শবাসনে, তেমনই পড়ে রইলেন নিশ্চেষ্টভাবে। মহামতি যুধিষ্ঠির সারা জীবন ধরে দুর্যোধনের পক্ষ থেকে তাঁর পিতা-মাতুলের কপটতা এত দেখেছেন যে, সেই অভিজ্ঞতায় দুর্যোধনের স্বভাব-বিরুদ্ধ এই নিশ্চেষ্ট ব্যবহারও তাঁর কাছে মায়া বা চাতুরী বলে মনে হল। কৃষ্ণকে তিনি বলেও ফেললেন সে কথা। বললেন— দ্যাখো কৃষ্ণ! দ্যাখো! দুর্যোধন কীভাবে অদ্ভুত মায়া-চাতুরীতে নিজেকে স্থিরভাবে জলের ওপর শায়িত করে জলটাকেও স্থির করে রেখেছে। এমনভাবেই রয়েছে যেন কোনও মানুষের কাছ থেকে ওর ভয় নেই— বিষ্টভ্য সলিলং শেতে নাস্য মানুষতো ভয়ম্।
সরল যুধিষ্ঠির সরলভাবেই নিজের ধর্মস্বভাবে যা বলেছেন, যুদ্ধশাস্ত্রের নৈতিকতায় সেটাই এক্কেবারে ঠিক। সত্যিই তো যুদ্ধের নীতিতে যে মানুষ শুয়ে আছে, যে বর্মহীন, যার চুল এলিয়ে খোলা, যার হাতে অস্ত্র নেই এবং যে নিশ্চেষ্ট, তার ওপরে অস্ত্রপ্রহার করা যায় না। এ-কথা মনু থেকে মহাভারত সর্বত্র একইভাবে স্বীকৃত। সেকালের যুদ্ধশাস্ত্রের এই নীতিযুক্তি মেনেই যুধিষ্ঠির আপন ধর্মস্বভাবে এই উক্তি করেছেন— মানুষের কাছ থেকে এখন ওর কোনও ভয় নেই— নাস্য মানুষতো ভয়ম্। কিন্তু এই নীতিবোধের সঙ্গে দুর্যোধনের এতকালের অনিষ্ট কর্মগুলি মাথায় রেখে যুধিষ্ঠির অবশ্য গ্রাম্য প্রৌঢ়ার বিলাপোক্তির মতো বলে যাচ্ছেন— তুই শঠতা করে, ছল-চাতুরী করে আর পার পাবি না। তোকে আমরা ছাড়ব না। স্বয়ং ইন্দ্র এসে তোকে সাহায্য করলেও তুই বাঁচবি না, তোকে মরতে হবে।
কিন্তু এই বাহ্যিক প্রলাপোক্তির পূর্বে ওই একটা কথা— মানুষ থেকে ওর ভয় নেই এখন— ওই একটা কথাই সচকিত করে দিল কৃষ্ণকে। বিশালবুদ্ধি এই মহাভারত-সূত্রধার দুর্যোধনকেও চেনেন, দাদা যুধিষ্ঠিরকেও চেনেন। তিনি বুঝলেন— যুধিষ্ঠিরের নৈতিক বুদ্ধিকে যদি এখন পরিস্থিতির প্রয়োজনে পরিস্থিতির নৈতিকতায় চালিত না করা যায়, তা হলে দুর্যোধনকে হত্যা করা অসম্ভব। অতএব সেই ভাবনাতেই তিনি যুধিষ্ঠিরকে তাঁরই কথা ফেরত দিয়ে বললেন, তুমি তো বুঝতেই পারছ যে, দুর্যোধন মায়া প্রয়োগ করে শঠতা বশত এই নিশ্চেষ্ট ভাবটা দেখাচ্ছে, যাতে আমরা তাকে এই অবস্থায় আক্রমণ না করি। কিন্তু মনে রেখো— শঠতা যে করছে, তার সঙ্গে শঠতাই করতে হবে— মায়াবী মায়য়া বধ্যঃ সত্যমেতদ্ যুধিষ্ঠির।
কৃষ্ণ দেবতাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ইন্দ্র মায়াবী বৃত্রাসুরকে মায়া দিয়েই বধ করেছেন। ভগবন্নারায়ণ বামন অবতারে দৈত্যরাজ বলির সঙ্গে ছলনা করেছেন, এমনকী হিরণ্যকশিপুকে মারার জন্যও নৃসিংহের মূর্তি ধারণ করে ছল আচরণ করতে হয়েছে ওই নারায়ণকেই। কৃষ্ণ আরও অনেক উদাহরণ দিলেন, অনেক মান্য গণ্য, মহতের উদাহরণ, যাতে যুধিষ্ঠির বোঝেন— তিনি সেখানে অনেক সাধারণ স্তরের মানুষ, যিনি অন্য রকম করলে শাস্ত্ররাশি কেঁদে কেটে মরবে না। কৃষ্ণ বললেন, সময়কালে, পরিস্থিতি বুঝে কাজের কৌশলটাই আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মহারাজ! উপায়-কৌশলটাই সবচেয়ে বড় কথা, আর কিচ্ছু নয়, আর কিছু নয়— ক্রিয়া বলবতী রাজন্ নান্যৎ কিঞ্চিৎ যুধিষ্ঠির। অতএব ও যখন ছলচাতুরী করে পড়ে আছে, তখন ওই জলের মধ্যেই তুমি তোমার মায়া প্রয়োগ কর— ক্রিয়াভ্যুপায়ৈর্বহুভিৰ্মায়ামপ্সু প্রযোজ্য চ।
জলের ওপর শুয়ে আছে, সেই জলের মধ্যেই তোমার কূটবুদ্ধি প্রয়োগ কর— এ-কথার মানে যে, হঠাৎই শুয়ে থাকা দুর্যোধনের ওপর একটা ব্রহ্মাস্ত্র করে মেরে ফেলা নয়— এটা কৃষ্ণও জানেন এবং যুধিষ্ঠিরও সেটা বুঝেছেন। বিশেষত এতকাল ধরে যিনি নানাজনের বুদ্ধিতে নানান শঠতা করেছেন, তাঁকে শিক্ষা দিতে গেলে যে একটা উপায় বার করতে হবে, সেটা যুধিষ্ঠির এমনভাবেই ঠিক করলেন যাকে ঠিক মায়া বা ছল-চাতুরী বলাও যায় না। বরঞ্চ বলা উচিত, একজন বীরম্মন্য মানুষকে কোন জায়গায় আঘাত করলে তার দুর্বল স্থানে আঘাত লাগবে, যুধিষ্ঠির সেইটা সঠিক বুঝেই স্থির করলেন— যেভাবে হোক, এই লোকটাকে আগে জল থেকে তুলতে হবে। সেই অভিপ্রায়েই যুধিষ্ঠির বললেন, নিজের বংশটার মুখে চুনকালি দিয়ে, সমস্ত বীর ক্ষত্রিয়দের ঘরে বিনাশ ডেকে এনে এখন তুমি জলের মধ্যে গিয়ে সেঁধিয়েছ। সবাইকে শেষ করে দিয়ে এখন নিজে শুধু বেঁচে থাকব— এই বুদ্ধিতেই তো তুমি এখানে এসে শুয়ে আছ— সর্বং ক্ষত্ৰং ঘাতয়িত্বা স্বকুলঞ্চ বিশাম্পতে।
এই সামান্য দুটো কথায় দুর্যোধন জল থেকে উঠে আসবেন না, এ-কথা জানাই ছিল। অতএব দুর্যোধনকে সেই জায়গায় ঘা দিলেন যুধিষ্ঠির, যেখানে তার সবচেয়ে অবমাননা ঘটে। যুধিষ্ঠির বললেন— যে অভিমান আর অহংকারে তুমি নিজের কুল এবং সমস্ত ক্ষত্রিয়-কুলকে মৃত্যুর পথ দেখিয়েছ, সেই মান, আর সেই অহংকার এখন কোথায় গেল দুর্যোধন— স তে দর্পো নরশ্রেষ্ঠ স চ মানঃ ক্ক তে গতঃ? এত দিন বড় বড় রাজসভায় মহাবীর বলে তোমার নাম উচ্চারণ করত লোকে, সেই তুমি কিনা এই প্রসিদ্ধ কুরুবংশের জাতক হয়ে এখন ভয়ের চোটে জলের মধ্যে গিয়ে লুকিয়েছ— যুদ্ধাদ্ ভীত স্তত স্তোয়ং প্রবিশ্য প্রতিতিষ্ঠসি? যুধিষ্ঠির নিজের অভিজ্ঞতাতেই জানেন যে, যুদ্ধের ভয়াল পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য দুর্যোধন কত বার পলায়ন-পরায়ণ সৈন্যদের সম্মুখ-যুদ্ধের উৎসাহ যুগিয়েছেন। অতএব তাঁর কথাই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, যুদ্ধ না করা বা যুদ্ধস্থান থেকে পালিয়ে যাওয়াটা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয়, ভদ্রলোকের কাজও নয় এটা। বিশেষত তুমি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে শেষ করে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর প্রয়াস করছ? এতদিন তো শুনতাম যে, তুমি নিজেকে বিশাল বীর বলে ভাব, মহাবীর বলে তুমি খুব জাহিরও কর নিজের সম্বন্ধে, — শূরমানী ন শূরস্ত্বং মৃষা বদসি ভারত— কিন্তু সেগুলো সবই মিথ্যে, কেননা বীর মানুষেরা কখনও যুদ্ধ থেকে পালায় না।
যুধিষ্ঠির এতক্ষণ যে সব তিরস্কার বাক্য শোনাচ্ছেন, এটাই বস্তুত মায়া-প্রয়োগ বা চাতুরী। যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষের পক্ষে দুর্যোধনের অহংকারে আঘাত করা ছাড়া অন্য কোনও ছল-প্রয়োগ যেমন সম্ভব নয়, তেমনই অহংকারী এবং অতিমানী দুর্যোধনকে এই কঠিন কথাগুলিই উত্তেজিত করে তুলবে— এটাই যথেষ্ট ছলনা। যুধিষ্ঠির এতক্ষণ এককভাবে দুর্যোধনকে তিরস্কার করছিলেন, এবারে সেই তিরস্কার তীব্রতর করার জন্য কর্ণ-শকুনির প্রসঙ্গ তুলে তিনি বললেন— তুমি নিজে কতটা পার, কতটা তোমার নিজের ক্ষমতা, এটাই তুমি ঠিক মতো কোনও দিন বোঝোনি, দুর্যোধন। কর্ণের কথায় আর শকুনির কপট বুদ্ধিতে তোমার এতটাই মোহ তৈরি হয়েছিল যে কোনও দিন তুমি তোমার নিজের শক্তি বুদ্ধি-ক্ষমতা বোঝবারও চেষ্টা করোনি। ওদের স্তাবকতায় নিজেকে তুমি অমর্ত্য দেবতার মতো ভেবে এসেছ চিরকাল— অমর্ত্য ইব সম্মোহাত্ ত্বমাত্মানং ন বুদ্ধবান্। অথচ দেবতার সেই অলৌকিক পৌরুষ, সেই মান, সেই বিক্রম এবং সেই তেজ আজ কোথায় গেল, যাতে এমন পালিয়ে বেড়াতে হয়— ক্ক চ তে তৎ পৌরুষং যাতং ক্ক চ মানঃ সুযোধন?
যুধিষ্ঠিরের শেষ প্রস্তাব— হয় তুমি জল থেকে উঠে এসে আমাদের পরাজিত কর এবং রাজ্যের দখল নাও, নয়তো আমাদের হাতে মৃত্যু বরণ করে শান্ত ঘুম ঘুমাও এই পৃথিবীর বুকে— অথবা নিহতোহস্মাভির্ভূমৌ স্বপ্স্যসি ভারত। যুধিষ্ঠিরের মুখে এতক্ষণ এত অপমানজনক কথা শুনে দুর্যোধন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। দুর্যোধন জবাব দিলেন, জল থেকেই জবাব দিলেন, যদিও অবসন্ন বলেই হোক, অথবা এতক্ষণের শান্ত যৌগিক নিরুদ্ধতার ফলেই হোক দুর্যোধনের গলা এখন খুব চড়া নয়। তিনি বললেন, এটা আশ্চর্যেরও কিছু নয়, এমনকী অপূর্বও কিছু নয় যে, প্রাণীমাত্রেই কোনও-না-কোনও সময় ভয় পায়। কিন্তু তাই বলে এটা ভেবো না মহারাজ যে, আমি এখানে ভয় পেয়ে লুকিয়ে আছি বা প্রাণের ভয়ে যুদ্ধ ছেড়ে এসেছি— ন তু প্রাণভয়াদ্ ভীতো ব্যপযাতোহস্মি ভারত। লক্ষণীয়, দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে ‘মহারাজ’ বলে সম্বোধন করছেন এবং নিজের কথা স্বীকার না করলেও সাধারণ মানুষ যে কখনও ভয় পেতে পারে, সে কথা স্বীকার করছেন।
কিন্তু সাধারণ মানুষ আর দুর্যোধন তো এক নন। অতএব এতটুকুও দমে না গিয়ে তিনি বললেন, দ্যাখো, এ কথাটা তো বুঝবে যে, আমার রথও নেই এখন, নেই ধনুক-বাণ-তূণ, আমার পিছনে-পাশে থেকে যাঁরা আমার এবং আমার রথের সুরক্ষা দিত, তারাও সব মারা গেছে। আমি এখন একা এবং একজন সহায়ও আমার পাশে নেই, তাই এখানে এসে একটু স্থির এবং আশ্বস্ত হবার চেষ্টা করছিলাম। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যও নয়, ভয়েও নয়, কোনও বিষন্নতার জন্যও নয়, আমি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বলেই এই জলে শুয়ে ছিলাম ক্ষণেক বিশ্রামের জন্য— ইদমম্ভঃ প্রবিষ্টোহস্মি শ্রমাত্ত্বিদম্ অনুষ্ঠিতম্। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করে বলছি, এমনকী তোমার সঙ্গে যারা পিছন পিছন এসেছে, তাদেরও আশ্বস্ত করে বলছি যে, আমি এই জল থেকে উঠে আসব এবং তোমাদের প্রত্যেকের যুদ্ধ করার ইচ্ছা মিটিয়ে দেব— অহমুত্থায় বঃ সর্বান্ প্রতিযোৎস্যামি সংযুগে।
যুধিষ্ঠির বুঝলেন— আরও কথা বলতে হবে, উত্তেজনা আরও বাড়াতে হবে। তিনি বললেন, আশ্বস্ত কী বলছ? আমরা সকলেই আশ্বস্ত যে, তুমি জল থেকে উঠবে। তবে কিনা আমরা বহুক্ষণ তোমাকে খুঁজছি— আশ্বস্তা এব সর্বে স্ম চিরং ত্বাং মৃগয়ামহে। ভাবটা এই— আমরাও তোমাকে খুঁজে খুঁজে পরিশ্রান্ত। কাজেই সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তুমি জল থেকে উঠে যুদ্ধ করো। হয় তুমি যুদ্ধ জিতে এই রাজ্য নাও, নয় আমাদের হাতে মরে বীরলোকে যাও। হয় মারো নয় মরো— শেষ করো ব্যাপারটা।
জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসেও দুর্যোধন কথা শোনাতে ছাড়লেন না যুধিষ্ঠিরকে। পাণ্ডবরা যুদ্ধে জয়লাভ করলেও যে তাঁরা বাস্তবিক কোনও সুখ পাবেন না, সেইটা শোনানোর জন্য দুর্যোধন যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার সুখ পেতে চাইলেন। দুর্যোধন বললেন— রাজ্য জিতে নিতে বলছ যুদ্ধ করে, কিন্তু কীসের জন্য যুদ্ধ, কীসের জন্য রাজ্য? যাদের জন্য এই কুরুরাজ্য চেয়েছিলাম, সেই ভাইয়েরা আমার সবাই যুদ্ধে মারা গেছে। যে সব ক্ষত্রিয় বন্ধু রাজারা আমার সহায় ছিলেন, তাঁরাও কেউ আজ বেঁচে নেই। অর্থ, ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য সবই নষ্ট হয়ে গেছে। অতএব হতশ্রী বিধবা রমণীর মতো এই পৃথিবীকে আমি ভোগ করতে চাই না— নাভ্যুৎসহাম্যহং ভোক্তুং বিধবামিব যোষিতম্।
এই একটি পংক্তির মধ্যে দুর্যোধনের বাক্য-যন্ত্রণা দেবার ক্ষমতাটুকু বোঝা যায় এবং এই ক্ষমতার মধ্যে গঞ্জনা যতটা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি আছে গঞ্জনার ব্যঞ্জনা। এটা অবশ্যই ঠিক যে, শক্তিদৃপ্ত রাজকীয় পুরুষের কাছে ধনৈশ্বর্য-সমন্বিতা এবং বহু সহায়সম্পন্না পৃথিবীই যৌবনবতী রমণীর মতো ভোগ্যা হয়ে ওঠেন। কিন্তু দুর্যোধনের বক্তব্য হল— এই রকম সম্পন্না পৃথিবীই তাঁর ভোগ্যা ছিল এবং তিনি না থাকায় রাজলক্ষ্মী আজ বিধবা রমণীর মতো রিক্তা, বিষণ্ণা এবং অগম্যাও বটে। তার মানে, যে পৃথিবীকে তিনি যুধিষ্ঠিরের জন্য রেখে যাচ্ছেন, তিনি দুর্যোধনের পূর্বোপভুক্তা এবং অধুনা তাঁর অবর্তমানে বিধবার মতো অলংকারহীন, বর্ণহীন বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি।
যুদ্ধের কথায় দুর্যোধন এখনও ভাঙেন কিন্তু মচকান না। ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা টের পাওয়া যায় তাঁর সদ্য উচ্চারিত বৈরাগ্যের কথায়, কেননা এমন বৈরাগ্য তিনি জীবনেও দেখাননি। আর তিনি যে মচকে পড়েন না, সেটা বোঝান অল্প কথায়। দুর্যোধন বললেন, যুধিষ্ঠির! আমি এখনও সমস্ত পাণ্ডব এবং পাঞ্চালদের উৎসাহ ভেঙে দিয়ে জয় লাভের আশা করি, কিন্তু সত্যিই এই রাজ্যের অধিকার আর আমার ভাল লাগে না। যেখানে দ্রোণ-কর্ণের মতো ব্যক্তিরা মারা গেছেন, পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত, সেখানে কী হবে এই যুদ্ধ করে— ন ত্বিদানীমহং মন্যে কার্য্যং যুদ্ধেন কৰ্হিচিৎ। তার মানে, দুর্যোধন যে যুদ্ধ করতে চাইছেন না, সেটা নিজের অক্ষমতা বা শক্তিক্ষয়ের জন্য নয়। আসলে রাজ্য ভোগ করার কোনও উপযুক্ত মানসিকতাই তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। দুর্যোধন বললেন, যুদ্ধের কোনও প্রয়োজনই নেই মহারাজ! এই রিক্তা পৃথিবী এখন তোমার হোক। আমার মতো সহায় শূন্য হয়ে কোন রাজা রাজ্য চাইবে! তোমরা আমার ভাই-বন্ধু-স্বজন-পিতৃস্থানীয় সবাইকেই মেরে ফেলেছ, রাজ্যও হরণ করেছ, এখানে আমার মতো লোক এখন সহায়হীন হয়ে কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে— ভবদ্ভিশ্চ হৃতে রাজ্যে কো নু জীবেত মাদৃশঃ!
নিজের দোষগুলিকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে প্রধান প্রস্তাবিত প্রসঙ্গটাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়াটাও একটা আর্ট। দুর্যোধন নিজের বাকশৈলীতে কী অসাধারণভাবে সেটা সম্পন্ন করছেন! দুর্যোধনের মুখে কর্ণের কথাটা ঠিকই আছে, কিন্তু দ্রোণাচার্য অথবা ভীষ্মের জন্য তাঁর এত দরদ যে, কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন তাঁদের জন্যই দুর্যোধনের কাছে প্রার্থিত ছিল এই রাজ্য। অথচ ভীষ্ম-দ্রোণ বেঁচে থাকতে তিনি তাঁদের একটি কথাও শোনেননি এবং তাঁরা হাজারও বারণ করা সত্ত্বেও দুর্যোধন যুদ্ধ ডেকে এনেছেন এবং তাঁদেরও তিনি যুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ এবং অন্যান্যদের মৃত্যুর পিছনে সর্বশেষ নিমিত্ত কারণ পাণ্ডবরা হলেও এঁদের মৃত্যুর মূল কারণ অবশ্যই দুর্যোধন এবং সে দোষ এখন তিনি পাণ্ডবদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজে আপাতত যুদ্ধ এড়াতে চাইছেন।
দুর্যোধনের বক্তব্য— আত্মীয়-স্বজন নেই বলেই রাজ্য-সম্পদে তাঁর আর কোনও স্পৃহা নেই। তিনি বলছেন— আমার পক্ষের একটা লোকও বেঁচে নেই, এ রাজ্য নিয়ে কী করব আমি। আমি এখন মৃগচর্ম পরিধান করে বনে যেতে চাই— অহং বনং গমিষ্যামি হ্যজিনৈঃ প্রতিবাসিতঃ। আমার বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই, এই ভুক্তভোগা পৃথিবীর সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে, শস্যক্ষেত্রগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে, হাতি নেই, ঘোড়া নেই, এই পৃথিবীতে আর আমি বাঁচতে চাই না। তুমি যাও, নিশ্চিন্তে এখন এই জনশূন্যা অনাথা পৃথিবী ভোগ করো— গচ্ছ ত্বং ভুঙ্ক্ষ্ব রাজেন্দ্র পৃথিবীং নিহতেশ্বরাম্। এই যে আদেশের মতো এক প্রবচন— এই পৃথিবীর স্বামী আর বেঁচে নেই, যাও তুমি এখন এই পৃথিবী ভোগ করো— এইখানেই দুর্যোধনের সাহংকার প্রতিষ্ঠা অথবা বলা উচিত মৌখিক প্রতিষ্ঠা। নিজের, অর্থাৎ আসল স্বামীর অবর্তমানে যুধিষ্ঠিরকে তিনি তাঁরই বিধবার স্বামিত্বের অধিকার দিচ্ছেন নিজেই আদেশ জারি করে— এষা তে পৃথিবী রাজন্ ভুঙ্ক্ষ্বৈনাং বিগতজ্বরঃ।
তবে কিনা দুর্যোধনের কাছে এই যে হন্তারক সময়, সেই সময় এখন আর তাঁর অহংকার সুস্থিত রাখছে না। প্রতিভাষণে যুধিষ্ঠির একেবারে ভেঙে দিলেন দুর্যোধনের আজন্ম-লালিত অহংকার। যুধিষ্ঠির বললেন, এখনও তুমি জলের মধ্যে শুয়েই প্রলাপ বকছ, বাছা! মাংসলোভী শকুনের আর্ত স্বরের মতো এই প্রলাপ বন্ধ করো তুমি। ধরে নিলাম, তুমিই আমাকে এই রাজ্য দিচ্ছ। তো সে-রাজ্য আমি নিতে যাব কেন— নাহমিচ্ছেয়মবনিং ত্বয়া দত্তাং প্রশাসিতুম্। আমি তোমাকে যুদ্ধে জয় করেই এই পৃথিবী ভোগ করব। তা ছাড়া এটাও একবার ভাবো যে, তুমি আমাকে রাজ্য দেবার কে? তুমি তো এই রাজ্যের অধীশ্বর নও। একটা সময় ছিল যখন সমস্ত হানাহানি মারামারি বন্ধ করার জন্য, আমরা তোমার কাছেই রাজ্য প্রার্থনা করেছিলাম, কই তখন তো তুমি আমাদের প্রাপ্য রাজ্য দাওনি! যুধিষ্ঠির এবার সেই বক্তব্যের জবাব দিলেন, যেখানে কৌরবপক্ষের দ্রোণ-ভীষ্মের মৃত্যুর জন্য দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে দায়ী করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন— যে-তুমি কৃষ্ণের সন্ধি-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পাঁচখানা গ্রাম পর্যন্ত দিতে চাওনি— বার্ষ্ণেয়ং প্রথমং রাজন্ প্রত্যাখ্যায় মহাবলঃ— সেই তুমি এখন হঠাৎ রাজ্য দিতে চাইছ, তুমি কী পাগল হয়ে গেলে, বাছা— কো হি তে চিত্তবিভ্রমঃ?
দুর্যোধনকে পূর্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠির সময়োচিত তর্কপাশে বেঁধে ফেললেন একেবারে। তিনি বললেন, এমন কোনও রাজা আছেন নাকি এই পৃথিবীতে, যিনি আক্রান্ত এবং অভিযুক্ত হলেই রাজ্য দিয়ে দেন। তুমিও দাওনি। তুমি জোর করে, জোর দেখিয়েই আমাদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলে। এমনকী দম্ভ করে বলেছিলে, সূচের মাথায় যেটুকু মাটি ওঠে, সেই মাটিটুকুও তুমি আমাদের দেবে না— তন্মাত্রমপি চেন্মহ্যং ন দদাতি পুরা ভবান্— আর সেই তুমি এখন আমাদের সমগ্র পৃথিবী দিতে চাইছ, এটা তো হাস্যকর কথা। এত সম্পদ, এত অধিকার, এত বড় শাসন হাতে পেয়েও, এখন সব দিতে চাইছ, এর পিছনে তো রহস্য আছে, দুর্যোধন— সূচ্যগ্রং নাত্যজঃ পূর্বং স কথং ত্যজসি ক্ষিতিম্? যুধিষ্ঠির এবার দুর্যোধনের অন্তর্গত শব্দ উচ্চারণ করে বললেন— বাছা! তুমি যতই রাজ্যদানের সংকল্প করো, এখন দান করেও তুমি আমাদের হাত থেকে মুক্তি পাবে না— পৃথিবীং দাতুকামোহপি জীবিতে ন বিমোক্ষ্যসে।
যুধিষ্ঠির বোধহয় নিজেও জানতেন না যে, তিনি তাঁর চির-আচরিত বৈরাগ্য-যুক্তি উপেক্ষা করে এমন সযৌক্তিক প্রত্যুত্তরে দুর্যোধনকে শেষ পর্যন্ত উত্তেজিত করে দিতে পারবেন। তিনি দুর্যোধন-কৃত প্রধান অপরাধ এবং অন্যায়গুলি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে অসম্ভব ঠাণ্ডা মাথায় বলেছেন— দ্যাখো বাপু! এই মহাযুদ্ধের শেষে তুমি এবং আমি দু’জনেই যদি জীবিত থাকি, তা হলে লোকের মনে সন্দেহ আসবে। তারা বুঝতে পারবে না— যুদ্ধে সত্যিই কে বিজয়ী হল— সংশয়ঃ সর্বভূতানাং বিজয়ে নো ভবিষ্যতি। আর আমি এও জানি যে, তোমার জীবন এখন আমাদের হাতে। ইচ্ছা হলে সত্যিই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম এখন, কিন্তু সারা জীবন ধরে তুমি যত কষ্ট আমাদের দিয়েছ, যত অপমান আমাদের করেছ, তাতে তুমি আর বাঁচার যোগ্য নেই; তোমার মতো মানুষের বেঁচে থাকা উচিত নয়— এতস্মাৎ কারণাৎ পাপ জীবিতং তে ন বিদ্যতে। এত ভণিতা না করে তুমি এবার জল থেকে ওঠো, যুদ্ধ করো, এ-যুদ্ধে মৃত্যুই তোমার পক্ষে মঙ্গলজনক হবে— উত্তিষ্ঠোত্তিষ্ঠ যুধ্যস্ব তত্তে শ্রেয়ো ভবিষ্যতি।
দুর্যোধনকে এই ধরনের কথা কখনও কেউ বলেনি, কিংবা এমন তর্জনী-চিহ্নিত রূঢ় ভাষা দুর্যোধন কারও কাছে এমন করে শোনেনওনি— ন হি সন্তর্জনা তেন শ্রুতপূর্বা কথঞ্চন। সঞ্জয় এতক্ষণ দুর্যোধন-যুধিষ্ঠিরের পারস্পরিক কথোপকথন ‘রিপোর্ট’ করছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। যুধিষ্ঠিরের তীক্ষ্ণ কটু বাক্য শুনে এখনও যে তিনি ক্রোধে জল থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে এলেন না এবং বসে বসে এখনও শুনছেন— দুর্যোধনের এই আপাত শীতল ভাব দেখে পিতা ধৃতরাষ্ট্রও অবাক হচ্ছেন। তিনি বলছেন— এ তো আমি ভাবতেই পারছি না। এই সমগ্র রাজ্যটা যার অঙ্গুলি হেলনে চলত, সমস্ত মানুষ যার অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করত, যার সমস্ত শাসন সকলে মেনে নিত, সেই মানুষটা পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের কাছে এমন কটু কথা শুনেও চুপ করে বসে আছে— স শ্রুত্বা কটুকা বাচো জয়যুক্তা পুনঃ পুনঃ— এটা কী করে সম্ভব!
সত্যিই এটা সম্ভব নয়, যদিও চুপ করে শুয়ে বসে থাকলেই ভাল করতেন দুর্যোধন, হয়তো বা পিতা ধৃতরাষ্ট্রও মনে মনে তাই চাইছিলেন। কিন্তু সেটা দুর্যোধনের স্বভাববিরুদ্ধ। যদিও জল থেকে উঠে এবার যুদ্ধ আরম্ভ করলে মৃত্যু যে অনিবার্য, সে কথাটাও বোধহয় বুঝে গিয়েছিলেন দুর্যোধন। হয়তো সেইজন্যই শেষ জবাব দেবার আগে বারবার তিনি দীর্ঘ এবং উষ্ণ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস এইজন্য যে, তিনি সত্যিই এখন আশাহত, উষ্ণ নিশ্বাস এইজন্য যে, যুধিষ্ঠিরের কথায় তিনি এখন ক্রুদ্ধ এবং উত্তেজিত। যুধিষ্ঠির এটাই চেয়েছিলেন এবং এখানেই কৃষ্ণের বলা মায়া-প্রয়োগের সফলতা।
দুর্যোধন এতক্ষণে জলের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছেন। গাত্রস্থিত জলকণা এবং খোলাচুলে জড়িয়ে থাকা জলরাশি যথাসম্ভব ঝেরে ফেলে হাত ঘুরিয়ে দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তোমাদের সকলেরই এখানে সহায়তা করার লোক আছে, রথ আছে, বাহন আছে। কিন্তু আমি একেবারেই একা, মনটাও শোকক্লিষ্ট, তার মধ্যে রথ, বাহন কিছুই নেই— অহমেকো পরিদ্যূনো বিরথো হতবাহনঃ। তোমাদের এতগুলি সশস্ত্র লোক রথে চড়ে যুদ্ধ করবে, আর পদাতিক সৈনিকের মতো আমি তোমাদের দ্বারা পরিবারিত অবস্থায় বিনা অস্ত্রে যুদ্ধ করব, এটা হতে পারে না, এটা অন্যায়। তোমরা এক-এক জন, এক-এক বারে পর্যায়-ক্রমে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো, আমি যুদ্ধ করতে রাজি আছি। মনে রেখো, তোমাকে আমি এতটুকুও ভয় পাই না যুধিষ্ঠির, ভয় পাই না ভীম কিংবা অর্জুনকে, কৃষ্ণ বাসুদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, নকুল, সহদেব— যারা যারা তোমার সৈনিক আছে, কাউকে আমি ভয় পাই না। তোমরা একে একে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো, আমি সকলকে একে একে হারিয়ে দেব। কিন্তু একে একে এসো তোমরা, সেটাই ধর্ম— একৈকশশ্চ মাং যূয়ং যোধয়ধ্বং যুধিষ্ঠির।
দুর্যোধন ন্যায়ের কথা বলছেন, দুর্যোধন ধর্মের কথা বলছেন। বলছেন— ধর্ম এবং তোমার সুনামের কথাটা ভেবেই আমি এই কথাটা বলছি— ধর্মঞ্চৈবেহ কীর্তিঞ্চ পালয়ন্ প্রব্রবীম্যহম্। যে মানুষটা নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখার জন্য, ক্ষত-বিক্ষত দেহে খানিক বিশ্রামের জন্য রণক্ষেত্র ছেড়ে দ্বৈপায়ন-দিঘির শীতল জলে গা ভাসিয়ে শুয়ে আছেন, তাঁর সামনে যদি ভয়ঙ্কর অস্ত্রধারী যোদ্ধারা যুদ্ধকামী হয়ে উপস্থিত হয়, তবে এমনিতেই তাঁর প্রাণভয়ে সমস্ত স্নায়ুক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কী অসম্ভব স্নায়ুশক্তি এই দুর্যোধনের। তিনি এই অবস্থাতেও মানসিক বল হারিয়ে ফেলছেন না। যুধিষ্ঠিরের কথার জবাব দেবার সময় এখনও তাঁর বর্ণনার মধ্যে মহাকবির আলংকারিক ভাষা কাজ করে। মহাভারতের কবি বোঝাতে চাইছেন— এই বিপন্ন সময়েও মহাকাব্যের প্রতিনায়কের কী অদম্য ক্ষমতা! দুর্যোধন বলছেন— সম্পূর্ণ বৎসর যেমন ক্রমান্বয়ে আগত ছয়-ছয়টি ঋতুকে গ্রহণ করে, তেমনই একে একে এলে তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমি যুদ্ধ করব— অনুগত্যাগতান্ সর্বান্ ঋতুন্ সংবৎসরো যথা। শুধু তাই নয়, আমার রথ-অশ্ব-বাহন না থাকলেও সশস্ত্র সবাহন তোমাদের সকলের যুদ্ধ করার সাধ আমি পূরণ করে দেবো, শেষ করে দেবো আমি তোমাদের। রাতের আকাশে নক্ষত্র-তারা যতই দপ্দপ্ করে জ্বলুক, প্রভাতের সূর্য উঠলেই যেমন তাদের আলো থাকে না এতটুকু, তেমনই আমিও আমার নিজের তেজে তোমাদের নিষ্প্রভ করে দেবো সকলকে। ক্ষণিক দাঁড়াও তোমরা— তেজসা নাশয়িষ্যামি স্থিরীভবত পাণ্ডবাঃ।
যুধিষ্ঠির বললেন, বাঃ! এই তো কথা! আমার ভাল লাগছে এ-কথা শুনে যে, তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম এখনও ভুলে যাওনি এবং এখনও তুমি যুদ্ধ করার কথা ভাবছ। এটা আমি অবশ্যই মানি যে, তুমি মহাবীর বটে এবং যুদ্ধটা তুমি ভালভাবেই শিখেছ— দিষ্ট্যা শূরোসি কৌরব্য দিষ্ট্য জানাসি সঙ্গরম্— না হলে তুমি এমন কথা বলতে পারতে না যে, তুমি আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। মহাভারতের সহৃদয় পাঠককুল, যাঁরা এতকাল পাণ্ডবদের অপমানে, বঞ্চনায় তাদেরই পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা এবার যুধিষ্ঠিরের মুখে দুর্যোধনের এই প্রশংসা শুনে নড়েচড়ে বসেন। মরণান্তিক সময়েও দুর্যোধনের ‘অ্যাটিটুড’ দেখে পাঠক এবার মহাকাব্যের প্রতিনায়ক দুর্যোধনের সম্বন্ধে বিপ্রতীপ মাহাত্ম্যে বিচার করতে আরম্ভ করেন। যুধিষ্ঠির এই মুহূর্তে দুর্যোধনের প্রস্তাব মেনে নিয়ে তাঁকে বলেছেন, যে অস্ত্র নিয়ে তুমি যুদ্ধ করতে চাও, সেই অস্ত্র নিয়েই তুমি আমাদের একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করো, আমরা অন্যেরা দর্শক হিসেবে থাকব— প্রেক্ষকাস্তে বয়ং স্থিতাঃ— তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমাদের মধ্যে যে কোনও একজনকে বধ করতে পারলেই তুমি রাজা হবে, আর যুদ্ধে হারলে তোমার স্বর্গের দ্বার খোলা— হত্বৈকং ভব নো রাজা হতো বা স্বর্গমাপ্নুহি।
যুধিষ্ঠির নিজেও বোঝেননি যে, তিনি কতটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন। ‘আমাদের মধ্যে যে কোনও একজন’— — এই ভয়ংকর বিকল্পের উত্তরে দুর্যোধন নিজের বীরত্ববোধে নতুন বিকল্প দিয়ে বলেছেন— একজনকেই যদি দিতে হয়, তবে তুমিই সেই বিকল্প গ্রহণ করো, এই ভয়ংকর যুদ্ধে তোমাদের মধ্যে একজন বীরকে তুমিই পছন্দ করে দাও, আমি তার সঙ্গেই যুদ্ধ করব এবং অস্ত্র হিসেবে আমার নিজের এই গদাটাই যথেষ্ট— একশ্চেদ্ যুদ্ধমাক্রন্দে শূরোহদ্য মম দীয়তাম্। আমার রথ নেই, রথ লাগবে না এবং তোমাদের মধ্যেও যে যুদ্ধ করবে, সেও পদচারী হয়ে যুদ্ধ করুক আমার সঙ্গে। তা ছাড়া এই আঠেরো দিনের যুদ্ধে হাতি-ঘোড়া-রথ নিয়ে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। এবারে সেই অদ্ভুত গদাযুদ্ধটাই হোক, যেমন যুদ্ধ কেউ কখনও দেখেনি— ইদমেকং গদাযুদ্ধং ভবত্বদ্যাদ্ভুতং মহৎ।
যাঁরা দুর্যোধনকে এই সময়ে দেখছেন, তাঁদেরকে আমি সেই যুগের মহাকাব্যিক পরিমণ্ডলটুকু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দুর্যোধনের এই যে বীরত্ব এর মধ্যেও এক ধরনের ‘রোম্যান্টিসিজম’ আছে, অথবা ‘রোম্যান্টিসিজম্’ শব্দটা কী এখানে অনুপযুক্ত? শুধু ‘হেরোয়িক’ বললে আমার মন ভরে না। ‘হেরোইজম্’ এর সঙ্গে ‘এপিক রোম্যান্টিসিজম’-এর যোগ আছে বলেই উত্তম অশ্ব যেমন কশাঘাত সহ্য করতে পারে না, ঠিক সেইরকম যুধিষ্ঠিরের কথায় অসহ্য হয়ে উঠে দুর্যোধন যখন জলের থেকে মহানাগের মতো ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে উঠলেন তখন তাঁর কী রূপ! মেদবিহীন পেশীবহুল দেহের বিভিন্ন ক্ষতস্থান থেকে রুধির-ধারা গড়িয়ে পড়ছে, তাঁকে দেখতে লাগছিল গৈরিক ধাতুস্রাবী পর্বতের মতো— শরীরং স্ম তদাভাতি স্রবন্নিব মহীধরঃ। দুর্যোধনের হাতে লৌহসারময়ী স্বর্ণকেয়ূরভূষিতা সেই বিখ্যাত গদা। মহাভারতের কবির সমস্ত উপমান এখন মর্ত্যলোকের সীমা ছাড়িয়ে অমর্ত্যলোকে উঠেছে। দুর্যোধনকে দেখতে লাগছে প্রতপ্ত সূর্যের মতো, দণ্ডধারী যমের মতো, বজ্রধারী ইন্দ্রের মতো অথবা শূলধারী মহাদেবের মতো।
আপাতত শুনলে মনে হবে— এ আর কী এমন! মহাকাব্যের কবির সামনে এতগুলি দেবতা আছেন, তাঁদের নাম সাজিয়ে উপমা দিতে আর কষ্ট কীসের। সবিনয়ে জানাই— মর্ত্য মানুষকে যখন এইসব সংহার-মূর্তি দেবতার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন সেই মানুষটির মধ্যে এই সমস্ত দেবতার শত্ৰু-সংহার কালীন ‘মিথ’ এবং তাদের ধ্বংসের স্বরূপগুলিও অন্তর্নিহিত করা হয়। এতে একই সঙ্গে এই মুহূর্তে দূর্যোধনের অদম্যতা এবং দুর্দ্ধর্ষতা এমনভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, যাতে প্রতিতুলনায় পাণ্ডবদের এতগুলি ভাই এবং অন্যান্য সহায়রাও অপ্রতুল এবং নিষ্প্রভ হয়ে ওঠেন। দুর্যোধন তাঁর লৌহসার গদাটি দু-চারবার অভ্যাসের ভঙ্গিতে ঘোরাতে ঘোরাতে যখন বীরদর্পে পাঞ্চাল-পাণ্ডবদের সামনে উপস্থিত হলেন তখন এক অদ্ভুত এবং অভূতপূর্ব বীর-যুদ্ধের সম্ভাবনায় পাণ্ডব পাঞ্চালরা দুর্যোধনের জন্য সপ্রশংসভাবে হাততালি দিতে লাগলেন— পাঞ্চালাঃ পাণ্ডবেয়াশ্চ তেহন্যোন্যস্য তলান্ দদুঃ।
এই ঘটনার মধ্যে সত্যিই কোনও অসদুদ্দেশ্য ছিল না। ক্রিকেট-মাঠে বিপক্ষ দলের ভাল ব্যাটসম্যান ভাল রান করে গেলে যেমন বিপক্ষ দলের সমর্থকরাও সম্ভ্রমে হাততালি দেন, তেমনই এখানে সম্ভ্রম ছিল বীর দুর্যোধনের জন্য। সঙ্গে হয়তো এইটুকু অন্তর-টিপুনি থাকতে পারে যে, যাক শেষ পর্যন্ত এই শেষ যুদ্ধ-বীরকে হ্রদ-জলের শীতল নিষ্ক্রিয় শবাসন থেকে উঠিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করা গেছে। ফলত দুর্যোধনের বেগবলোৎফুল্ল দর্পিত আগমন দেখে পাণ্ডব-পাঞ্চালেরা খুশি হয়েই হাততালি দিয়ে উঠেছিলেন— তমুত্তীর্ণন্তু সম্প্রেক্ষ্য সমহৃষ্যন্ত সর্বশঃ। কিন্তু এতকাল ধরে পাণ্ডব-পাঞ্চালদের মুখে দুর্যোধনের প্রশংসা-বাক্য যেহেতু বেশি শোনা যায়নি, এতএব হঠাৎই এই যুদ্ধোন্মাদনার মুহূর্তে তাঁকে তাঁর চিরশত্রুরা অভিনন্দন জানাচ্ছে, দুর্যোধন এটাকে বেশ অপমান হিসেবেই গ্রহণ করলেন। বিশেষত পূর্বে তিনি যুদ্ধে নিস্পৃহ ছিলেন, অথচ এখন পরম দর্পে তিনি হেঁটে আসছেন— এটাতে পাণ্ডব-পাঞ্চালরা মজা পেয়েই হাততালি দিয়েছেন— এইরকম মানসিক জটিলতা থেকেই দুর্যোধন তাঁর শত্রুপক্ষের এই অভিনন্দন প্রক্রিয়াকে সরলভাবে গ্রহণ না করে অপমান হিসেবেই নিলেন— অবহাসন্তু তং মত্বা পুত্রো দুর্যোধনস্তব।
অপমানে জ্বলে-ওঠা দুর্যোধনের মুখখানি ভ্রুকুটি-কুটিল হয়ে উঠল, আগুনপানা চোখ-দুটি দিয়ে তিনি যেন কৃষ্ণ আর পাণ্ডবদের দগ্ধ করে দিতে চাইলেন— দিধক্ষুরিব পাণ্ডবান্। দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে দুর্যোধন পাণ্ডব এবং কৃষ্ণকে বললেন— এই অপমানের প্রতিফল এখনই পাবি তোরা— অস্যাবহাসস্য ফলং প্রতিভোক্ষ্যথ পাণ্ডবাঃ— তোদের সব কটাকে আমি যদি যমের বাড়ি না পাঠাই, তো আমি কী বলেছি। কিন্তু এই উত্তেজিত মুহূর্তেও তাঁর একটা বুদ্ধি কাজ করছে এবং সেটাকে সামান্য এটা ভয় বলেও চিহ্নিত করা যেতে পারে— তিনি বারবারই ভাবছেন— পাণ্ডবরা শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে একক যুদ্ধ করবেন না। তেমন প্রয়োজনে তাঁরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বেন তাঁর ওপর। যার জন্য যুদ্ধোন্মাদনায় ষাঁড়ের মতো ক্রুদ্ধ গর্জন করতে করতেও থেকেও দুর্যোধন বার বার একই কথা বলছেন— তোমরা কিন্তু একে একে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসবে। দেখছ তো আমি বর্মহীন, তাতে শরীরে ক্ষত আছে, গদা ছাড়া অন্য অস্ত্রও নেই আমার হাতে। কাজেই একে একে এস, আমি সবার সঙ্গে যুদ্ধ করব। দেবতারা দেখুন আকাশ থেকে, আমি কিন্তু একা আছি, রণস্থলে একজন বীরের সঙ্গে বহুজনের যুদ্ধ কিন্তু একেবারেই উচিত নয়— একাকিনং যুধ্যমানং পশ্যন্তু দিবি দেবতাঃ।
যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ ধরে বারবার দুর্যোধনের মুখে একই কথা শুনছেন। তিনি সকলের সামনে তাঁকে কথা দিয়েছেন যে, এক-এক করেই যুদ্ধ হবে, এমনকী তাও নয়, তিনি পাণ্ডবদের যে-কোনও একজনকে বেছে নিতে বলেছেন যুদ্ধ করার জন্য, অথচ এখনও দুর্যোধন জ্ঞানগর্ভ কথা বলছেন— একজনের সঙ্গে বহু বীরের যুদ্ধ করাটা চরম অন্যায়— ন হ্যেকো বহুভির্ন্যায্যো বীরো যোধয়িতুং রণে— যুধিষ্ঠির এবার একটু রেগেই গেলেন। বললেন— ভাগ্যিস এই যুদ্ধমর্যাদা তোমার জানা আছে যে, অনেকে মিলে একক যুদ্ধবীরকে আক্রমণ করতে নেই। আমার জিজ্ঞাসা হয়, অভিমন্যুকে মারার সময় এই নীতিবোধ তোমার কেথায় ছিল— যদাভিমন্যুং বহবো জঘ্নুর্যুধি মহারথাঃ? ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অত সোজা নয়, এখানে নির্দয়তা, নির্মমতা সবই আছে, সম্পর্কের বোধও এখানে গৌণ হয়ে ওঠে, কিন্তু ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক যুদ্ধে যে চিরাচরিত নীতি, সেটাও তো মানতে হয়। এখন তুমি সেই নীতির কথা বারবার বলছ, কিন্তু অভিমন্যুকে মারার সময় সেই ধর্মবোধ কোথায় ছিল তোমার? আমি যেকথা বলেছি, তার অন্যথা হবে না। সেই নীতিবোধেই আমি বলছি— তুমি বর্মহীন অবস্থায় আছ, এই নাও আমি দিচ্ছি তোমাকে বর্ম, তুমি তোমার অবিন্যস্ত এলিয়ে পড়া চুলও বেঁধে নাও— আমুঞ্চ কবচং বীর মূর্ধজান্ যময়স্ব চ। তোমার যদি অন্য কোনও অস্ত্রের প্রয়োজন থাকে, তাও আমি দেব। তুমি পঞ্চ পাণ্ডবের মধ্যে যার সঙ্গে ইচ্ছে যুদ্ধ করো এবং তাকে বধ করে রাজা হও— পঞ্চানাং পাণ্ডবেয়ানাং যেন যুদ্ধমিহেচ্ছসি।
দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের কাছে লৌহবর্ম এবং শিরস্ত্রাণ নিয়ে গদা হাতে দাঁড়ালেন চরম প্রস্তুতি নিয়ে এবং যুধিষ্ঠিরের কথাটা তিনি বোধহয় তেমন করে খেয়ালই করেননি, অথবা কর্ণ-শকুনি নেই বলেই তিনি এখন পদ-বাক্যের প্রমাণ আর তেমন করে ধরেন না, অতএব যুধিষ্ঠিরের উচ্চারিত শব্দ মাথায় না রেখেই অত্যন্ত সরলভাবেই জিজ্ঞাসা করেন দুর্যোধন— বলো, আমি কার সঙ্গে যুদ্ধ করব? আমি কি সহদেব অথবা ভীম অথবা নকুলের সঙ্গে যুদ্ধ করব; নাকি তোমার সঙ্গে অথবা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব— সহদেবেন বা যোৎস্যে ভীমেন নকুলেন বা।
আসলে বর্ম, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদির সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে গদাযুদ্ধের বিকল্পটি যুধিষ্ঠিরের সম্মত হয়ে যাওয়ায় দুর্যোধন ভীষণভাবে নিশ্চিন্ত যে তিনি জিতে যাবেন যুদ্ধে। পাণ্ডবদের মধ্যে গদাযুদ্ধের বীরতম নায়ক হলেন ভীম। তাঁকেও দুর্যোধন তেমন আমল দেন না বলেই কৈমুতিক ন্যায়ে যুধিষ্ঠির-অর্জুন কিংবা অন্যান্যদের তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য করেন না। অতএব যুধিষ্ঠিরের কথা খেয়াল করলেন না বলে নয়, বীরোচিত ভাবনায় তিনি নিজেকে এই মুহূর্তে অপ্রতিরোধ্য মনে করছেন বলেই যুধিষ্ঠিরকেই তিনি বিকল্প দিয়েছেন— ভীম, অর্জুন কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে বলো। মুখে নিজের ভাবনার কথাটা সোচ্চারে বলেও ফেললেন দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন— এই যে সোনা দিয়ে বাঁধানো আমার গদাটা দেখছ, এই গদা আমার হাতে থাকলে কেউ আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না— গদাযুদ্ধে ন মে কশ্চিৎ সদৃশোহস্তীতি চিন্তয়ে। কথাটা আমার নিজের মুখে শুনছ বলে উদ্ধত গর্বোক্তি বলে মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু এর প্রমাণ পাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। তোমরা এক-এক করে এসো, তোমাদের সব ক’টাকে আমি যমের বাড়ি পাঠাব। আমি গর্বোক্তি করলাম কিনা তোমাদের সামনেই প্রমাণিত করব— অথবা সফলং হ্যেতৎ করিষ্যে ভবতাং পুরঃ।
এই খানিক আগে পর্যন্ত যুধিষ্ঠির বেশ ভালই কথা বলছিলেন। তিনি যে সফলভাবে দুর্যোধনকে জল থেকে তুলে এনে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে পেরেছেন, এতে হৃষ্ট হয়েছেন সকলেই, বিশেষত কৃষ্ণ— যিনি এতক্ষণ ধরে দু’জনের কথা-প্রবন্ধ খেয়াল করছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তিনিও বেশ খুশিই ছিলেন, কিন্তু যে মুহূর্তে আবেগতাড়িত যুধিষ্ঠির বলে ফেললেন, আমাদের যে কোনও একজনকে মেরে তুমি এ-রাজ্যের রাজা হও, সেই মুহূর্ত থেকে তিনি বিরক্ত হয়ে উঠলেন যুধিষ্ঠিরের ওপর। তার মধ্যে দুর্যোধন যখন শেষ রায় দিয়ে সগর্জনে বললেন— আয় কে লড়বি? আয়, আমার সামনে গদা হাতে— তখন কৃষ্ণ বেশ একটু রেগেই বললেন যুধিষ্ঠিরকে— যুধিষ্ঠিরস্য সংত্রুদ্ধো বাসুদেবোহব্রবীদিদম্।
কৃষ্ণ বললেন— এটা কেমন কথা হল দাদা? ও যদি এখন তোমাকে— কথাটা যুধিষ্ঠির বলেছেন বলেই আগে তাঁকেই খানিকটা হেয় করে কৃষ্ণ বললেন— ও যদি এখন তোমাকে যুদ্ধে বরণ করে— যদি নাম হ্যয়ং যুদ্ধে বরয়েত্ত্বাং যুধিষ্ঠির— অথবা বরণ করে নকুল-সহদেব কিংবা অর্জুনকে, তা হলে কী হতে পারে একবার ভেবে দেখেছ? তুমি কোন সাহসে এমন একটা কথা বললে যে, আমাদের যে কোনও একজনকে যুদ্ধে জিতে তুমি এ-রাজ্যের রাজা হও— কিমিদং সাহসং রাজন্ ত্বয়া ব্যাহৃতমীদৃশম্!
এমন একটা কঠিন মন্তব্য করেই কৃষ্ণ চুপ করে থাকেননি, তাঁর কথার যৌক্তিকতা বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন— জানো তুমি, শুধু ভীমকে মেরে ফেলার জন্য এই তেরোটা বছর ধরে একটা লোহার পুরুষ-মূর্তি বানিয়ে তার ওপর এই দুর্যোধন গদা প্রহারের অভ্যাস করেছে। সেই লোকটা আজ ভীম ছাড়া অন্য কাউকে পেলে কী হতে পারে বলো তো? তুমি দুর্যোধনের প্রতি বেশি বীরোচিত উদারতা দেখাতে গিয়ে বেশি সাহসের কাজ করে ফেলেছ। এর আগে তুমি শকুনির সঙ্গে পাশা খেলতে গিয়ে যে অসমান যুদ্ধটা করেছিলে, ঠিক সেইরকমই আজও দুর্যোধনের কাছে তুমি এমন বিষম বিকল্প উচ্চারণ করলে, যাতে সেটাও সেই পুরাতন জুয়োখেলার ফাটকাবাজির মতো হয়ে যাচ্ছে— তদিদং দ্যূতমারব্ধং পুনরেব যথা পুরা।
এই মুহুর্তে কৃষ্ণের মুখে কোনো রেখে-ঢেকে কথা নেই। অন্যান্য ভাইদের কোনও প্রসঙ্গই আসে না, এমনকী ভীমের ব্যাপারেও কৃষ্ণ স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললেন— হ্যাঁ মানি, ভীম যথেষ্ট গদাযুদ্ধ শিখেছেন, এবং এই মুহূর্তে তিনি ছাড়া দুর্যোধনের দ্বিতীয় কোনও প্রতিযোদ্ধাও নেই কিন্তু সঙ্গে এটাও জেনে রেখো যে, গদাযুদ্ধের পিছনে দুর্যোধন যত পরিশ্রম করেছেন ভীম তা করেননি— স চ নাতিকৃতশ্রমঃ। এটা ঠিক, ভীমের গায়ের জোর দুর্যোধনের চাইতে বেশি এবং সে অনেক বেশি কষ্টসহিষ্ণু বলে দুর্যোধনের তুলনায় অনেক বেশি সময় ধরে যুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু দুর্যোধন গদাযুদ্ধে অনেক বেশি নিপুণ এবং কৌশলী। বলবান এবং কৌশলীর মধ্যে কৌশলী যোদ্ধাই কিন্তু শ্রেষ্ঠ— বলবান্ বা কৃতী বেতি কৃতী রাজন্ বিশিষ্যতে।
কৃষ্ণ খানিক তির্যক ভাষায় যেটা বোঝাতে চাইলেন, সেটা হল— ভীম খুব বলবান বটে, কিন্তু গদাযুদ্ধের ব্যাপারে দুর্যোধন বেশি বুদ্ধিমান। আর বলবত্তা আর বুদ্ধিমত্তার দ্বৈরথে বুদ্ধিমত্তারই জয় হয়। ফলত দুর্যোধনের কাছে উদারতা দেখিয়ে যুধিষ্ঠির শেষ পর্যন্ত নিজেকে এবং অন্য সকলকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। কেননা কৃষ্ণের মতে পাণ্ডবরা তো কেউ ননই, দেবতারাও কেউ গদাধারী দুর্যোধনকে পরাজিত করতে পারবেন না। তবু কিনা ‘ওরই মধ্যে ভদ্রমত’ ভীমসেনকেই শুধু দুর্যোধনের সামনে ফেলা যায়, কিন্তু তার মধ্যেও কৃষ্ণের সেই সতর্কবাণী উচ্চারিত হল— আমরা যদি ভীমকে নিয়ে ন্যায় অনুসারে যুদ্ধ করি, তবু জয়লাভে আমাদের সন্দেহ থেকেই যায়— ন্যায়তো যুধ্যমানানাং… সংশয়ো বিজয়ে হি নঃ।
কৃষ্ণ বেশ হতাশাই প্রকাশ করলেন। একবার তিনি যুধিষ্ঠিরের বাক্য-কৌশলের ঘাটতি দেখিয়ে বললেন— সমস্ত শত্রু জয় করে এসে অবশেষে এখন এক বিপন্ন শত্রুর হাতে তুমি কী অদ্ভুত এক অস্ত্র তুলে দিলে, যাতে আমাদের প্রায়-হস্তগত রাজ্যটাই চলে যাবার যোগাড় হয়েছে। এর পরে একেবারেই হতাশা থেকে কৃষ্ণ বললেন— হায় ভগবান! কী আর বলব! বিধাতা কুন্তী আর পাণ্ডুর ছেলেদের রাজ্যলাভের জন্য সৃষ্টি করেননি। এতকাল গেল বনবাসের কষ্ট, আর এখন মনে হচ্ছে, চিরকাল ভিক্ষা করে খাবার জন্যই পাণ্ডবদের সৃষ্টি করেছেন বিধাতা— অত্যন্ত-বনবাসায় সৃষ্টা ভৈক্ষ্যায় বৈ পুনঃ।
কৃষ্ণ যতই হতাশার কথা বলুন, যুধিষ্ঠির-কৃত বিকল্প-খ্যাপনায় রাগও তাঁর হতেই পারে, কিন্তু শেষটা এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। দুর্যোধন আপন ঔদ্ধত্যে যুধিষ্ঠিরকেই বলেছেন— যাকে ইচ্ছে পাঠাও, এই আমি গদা হাতে প্রস্তুত— এই অবস্থায় যুধিষ্ঠির এখনও মনস্থির করে কাউকে পাঠাননি এবং কৃষ্ণের আক্ষেপ-বাক্য শুনছিলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এই আক্ষেপ-বাকের মধ্যে বৃকোদর ভীমেরও খানিকটা অবমূল্যায়ন ঘটায় তিনি প্রথমে কোনও কথাই বলছিলেন না। কিন্তু দুর্যোধনের মহাবল-কৌশলে পাণ্ডবরা আবারও ভিক্ষাবৃত্তি আশ্রয় করবেন এবং ভীমও মারা পড়বেন দুর্যোধনের হাতে— এমন একটা অবমূল্যায়ন ভীম খুব সইতে পারলেন না। তিনি বললেন— এত দুঃখের কিছু ঘটেনি, কৃষ্ণ! আমার সারা জীবনের শত্রুতার প্রতিশোধ আজকে আমি নেব। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জয় হবেই, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো— বিজয়ো বৈ ধ্রুবং কৃষ্ণ ধর্মরাজস্য দৃশ্যতে।
দুর্যোধন এবং ভীমের বল-কৌশলের একটা তুলনা করে কৃষ্ণ ভীমের চাইতে দুর্যোধনকে একটু এগিয়ে রেখেছিলেন নৈপুণ্যের দিক থেকে। কিন্তু ক্রিকেট খেলায় অনেক কুশলী ব্যাটসম্যান যেভাবে ভারী ব্যাট নিয়ে নিজের সামান্যতম দুর্বলতা প্রতিপূরণ করে, বলাধিক ভীম সেই বুদ্ধিতেই বললেন— আমার গদাটা দুর্যোধনেরটার চেয়ে দেড় গুণ বেশি ভারী— অধ্যর্ধেন গুণেনেয়ং গদা গুরুতরী মম— অতএব চিন্তা কোরো না কৃষ্ণ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের গলায় আজ আমি জয়ের মালা পরাব।
কৃষ্ণ এটাই চাইছিলেন। ভীম যাতে আপন দুর্বলতার কথা শুনে আরও চেতিয়ে ওঠেন, এটাই কৃষ্ণ চাইছিলেন। অতএব ভীমের বাক্যশেষ মাত্রেই তিনি তাঁর প্রশংসা করে বললেন— তোমাকে আশ্রয় করেই যুধিষ্ঠির তাঁর পুরাতনী রাজলক্ষ্মী লাভ করবেন, এটা আমি জানি। তা ছাড়া দুর্যোধনের সব ভাইগুলোকে তো তুমিই শেষ করেছ। এবারে দুর্যোধনকেও শেষ করতে হবে। এত সব প্রশংসা এবং উৎসাহ-বাক্যের মধ্যেও কৃষ্ণ কিন্তু ভীমকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন— তোমার কিন্তু প্রতিজ্ঞা ছিল, দাদা! তুমি দুর্যোধনের ঊরু-দুটি ভেঙে দেবে। সেই প্রতিজ্ঞা পালন করতে হবে কিন্তু— ত্বমস্য সক্থিনী ভঙ্ক্ত্বা প্রতিজ্ঞাং পালয়িষ্যসি। কৃষ্ণ কিন্তু কথার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন— দুর্যোধনের যুদ্ধ-ক্ষমতা এবং গদা-যুদ্ধের নৈপুণ্য যতই বেশি থাকুক, দরকার হলে অন্যায় করতে হবে এবং ঊরুভঙ্গের ক্ষাত্র-প্রতিজ্ঞা রয়েছে বলেই এ-অন্যায় ন্যায় বলেই গণ্য হবে।
পাণ্ডব-পাঞ্চালদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন গদা হাতে এগিয়ে গেলেন দুর্যোধনের দিকে, দুর্যোধনও ভীমের যুদ্ধাহ্বান শুনে ক্রোধাগ্নি উদ্গিরণ করতে করতে এগিয়ে গেলেন ভীমের দিকে। মনে হল যেন দুই মত্ত হস্তী পরস্পরের দিকে এগোল— প্রত্যুপস্থিত এবাশু মত্তো মত্তমিব দ্বিপম্। দুর্যোধন একাকী, তাঁকে উৎসাহ-জয়কার দেবার জন্য সেখানে কোনও মানুষ ছিল না, পাণ্ডবরাও বিযূথ মাতঙ্গের মতো দুর্যোধনকে একাকী দেখে খুশি হচ্ছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে একাকী দুর্যোধনের সম্বন্ধে অসাধারণ একটি মন্তব্য করলেন মহাভারতের কবি। বললেন— এতগুলি বলবান যোদ্ধার উৎসাহ-প্ররোচনা ভীমের দিকে থাকলেও একাকী দুর্যোধনই যেন সংহারমূর্তি সিংহের মতো। তাঁর মনে কোনও বিচলিত ভাব নেই, ভয় নেই, গ্লানি নেই, শরীরের সমস্ত ক্ষত-ব্যথাও যেন সেরে গেছে— ন সম্ভ্রমো ন চ ভয়ং ন চ গ্লানির্ন চ ব্যথা।
যুদ্ধের আরম্ভ মুহূর্তটা সব সময়েই কুকুরের ঝগড়ার মতো হয়— এ-কথা অন্যত্র বলেছেন মহাকবি। কুকুর যেমন মারামারি করার আগে পরস্পর খানিকটা চেঁচিয়ে ক্রোধোদ্গার করে, সম্মুখ যুদ্ধে মানুষও পরস্পরের বিরুদ্ধে গালাগালি দেয়। এ-ক্ষেত্রে ভীমই আগে আরম্ভ করলেন। দুর্যোধনের সমস্ত অন্যায়গুলির জঘন্যতমগুলো স্মরণ করিয়ে দেবার সময় বারণাবতের জতুগৃহ দাহ এবং শকুনির পাশার চালে যুধিষ্ঠিরকে বেঁধে ফেলে রজস্বলা দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে আসার কথাটাই প্রধানভাবে বললেন ভীম। তার সঙ্গে ভীষ্ম-দ্রোণ, কর্ণ-শল্য এবং অন্যান্য কৌরবভাইদের মৃত্যুর জন্য যে দুর্যোধনই মূলত দায়ী— এইসব দোষ চাপিয়ে ভীম বললেন, আজ তুই সবকিছুর ফল পাবি— তস্য পশ্য মহৎ ফলম্।
মৌখিক ভীতিপ্রদর্শন এবং তর্জন-গর্জনে দুর্যোধন কিছু কম যান না এবং একাকী অবস্থায় তর্জন-গর্জন আরও মানসিক শক্তি বাড়ায় বলেই দুর্যোধন ভীমকে বললেন— এত গরম গরম কথা বলার দরকার নেই তো তোর। তুই আয় যুদ্ধ কর আমার সঙ্গে— কিং কথ্থিতেন বহুনা যুধ্যস্বাদ্য ময়া সহ— আমি গদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এই অবস্থায় যদি ইন্দ্রও যুদ্ধ করতে আসে আমার সঙ্গে এবং সেটা যদি ন্যায়যুদ্ধ হয়, তবে সে পারবে না আমার সঙ্গে। অতএব শরৎকালের মেঘের মতো জল না দিয়ে বৃথা গর্জে মরিস না, নিজের ক্ষমতা কতটা আছে দ্যাখা এবার— মা বৃথা গর্জ কৌন্তেয় শারদাভ্রমিবাজলম্। প্রথমে ভীমকে দাবড়ে নিয়ে তারপর ভীমের প্রতিশোধ-ভাবনার যুক্তিগুলির উত্তর দিয়ে দুর্যোধন বললেন— আমার অনেক খারাপ কাজের নমুনা দিয়ে বেশ তো একটা বড় ভাষণ দিলি, তার উত্তরে বলি— তুই যত অন্যায়ের কথা বললি, ততটা আমার পক্ষে করাই সম্ভব নয়, আমি একা সব করিনি। তবে হ্যাঁ, আমি তোদের বনবাস করিয়েছি, পরের ঘরে দাসত্ব করিয়েছি, এটা আমি মানছি। আর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যত মারা গেলেন এ যুদ্ধে, সে ক্ষতি আমারও যেমন, তোদেরও তেমনই। ভাবটা এই— আমি যদি তাঁদের যুদ্ধে প্রবৃত্ত করে থাকি, তবে তোরাও তো ছেড়ে দিসনি তাঁদের। এতে আমাদের সমান লজ্জা। সবার কথা শেষ করে, সব প্রতিযুক্তি শেষ করে দুর্যোধন বললেন, আমি একা শুধু বাকি আছি। ধর্মযুদ্ধ করলে এখনও আমাকে মেরে যুদ্ধ জয় করবে এমন লোক নেই। আর যদি অন্যায় করে যুদ্ধ জিতিস, তা হলে সারা জীবন ধরে লোকে তোদের কুখ্যাতি করবে শুধু নয়, এই অন্যায়ের জন্য তোদেরও পশ্চাত্তাপও করতে হবে।
দুর্যোধনের যুক্তি, তর্ক এবং আক্ষেপ-বাক্য শুনে উপস্থিত পাণ্ডব-পাঞ্চালরা সপ্রশংসভাবে অভিনন্দন জানালেন তাঁকে। আর সাধারণ লোক যারা কৌতুহলবশত এই যুদ্ধ দেখার জন্য এই জায়গায় এসে জমেছিল, তারা হাততালি দিল দুর্যোধনের কথা শুনে, ঠিক যেমন রাস্তার মধ্যে বিরাট একটা হাতি দেখলে লোকে সম্ভ্রম, প্রশংসা এবং কৌতূহলে হাততালি দেয়— তং মত্তমিব মাতঙ্গং তলশব্দেন মানবাঃ। আমরা বুঝতে পারি— দুর্যোধনের এখনও কতটা ক্ষমতা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে পাণ্ডবরাও তাঁর বীরত্ব ভাবনায় অভিভূত। মহাকাব্যের কবি তাঁর প্রতিনায়কের চরিত্র-চিত্রণ করতে গিয়ে এমনই উদার আকাশের নীচে এসে দাঁড়িয়েছেন, যাতে সর্বশত্ৰুজয়ী পাণ্ডবরা এখনও ভাবতে পারছেন না যে, তারা নিশ্চিন্ত জয়ের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিনায়কের অনতিক্রম্য গুণগুলির জন্য তাঁদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ভীম-দুর্যোধনের বাগযুদ্ধ আপাতত নিরস্ত হলেও যুদ্ধ এখনই আরম্ভ হল না। কেননা যুদ্ধের আরম্ভ মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত হলেন কৃষ্ণাগ্রজ বলরাম।
দুর্যোধন বলরামের অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য। সেকালের দিনে গদাযুদ্ধে বলরামের সমান কেউ ছিলেন না, দুর্যোধন বলরামের কাছে গদাযুদ্ধের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। মধ্যম পাণ্ডব ভীমও এই পাঠ নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু দুর্যোধন তাঁর কৃতী ছাত্র, তাঁর অধ্যবসায় এবং নৈপুণ্যে বলরাম অধিকতর মুগ্ধ ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধারম্ভে বলরাম কোনও পক্ষেই যোগ দেবেন না বলে তীর্থদর্শনে বেরিয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষ খবর পাবার পর আজ দুই শিষ্যের শেষ যুদ্ধ দেখার জন্য বলরাম দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে উপস্থিত হলেন। তিনি এসে যাওয়ায় যুদ্ধারম্ভ খানিক বিলম্বিতই হল। কেননা বলরামের মতো অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত হওয়ায় সম্বোধন-নিবেদন, প্রণামালিঙ্গন এবং কুশল বিনিময়েও বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। তার মধ্যে বলরাম নিজেই জানালেন যে, তিনি দুই প্রিয় শিষ্যের যুদ্ধ দেখার কুতূহলেই তীর্থদর্শনের মাত্রা শেষ করে এখানে এসেছেন— শ্রুত্বা তচ্ছিষ্যয়ো রাজন্ আজগাম হলায়ুধঃ। বলরামকে দেখে সবচেয়ে যিনি খুশি হলেন, তিনি দুর্যোধন— সমহৃষ্যত বীর্যবান্। পাণ্ডবরাও খুশি হলেন না, তা নয়। সৌজন্যের প্রদর্শনে তাঁরা কেউ কম গেলেন না। কিন্তু মনে মনে একটা ক্ষত অবশ্যই কাজ করেছে, কেননা বলরাম পূর্বে পাণ্ডবদের মতো কৌরবদেরও সাহায্য করার কথা কৃষ্ণকে বলেছিলেন এবং কৃষ্ণ তাতে রাজি হননি বলেই তিনি নিরপেক্ষ ভাবনা দেখিয়ে তীর্থপর্যটনে বেরিয়েছিলেন।
বলরাম আজ প্রিয় শিষ্যদ্বয়ের যুদ্ধ দেখতে এসেছেন যতখানি, তার চেয়েও বেশি তিনি দুর্যোধনের যুদ্ধ দেখতে এসেছেন এবং সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে বলরামই দুর্যোধনের সবচেয়ে বড় ‘মর্যাল সাপোর্ট।’
আমাদের আরও একটা কথা মনে হয়। মনে হয় যেন মহাকাব্যের মহাপ্রতিনায়ক তাঁর শেষ যুদ্ধ করার সময় এমন একজনকে সামনে পেলেন যিনি পাণ্ডবদের অন্ধ সমর্থক নন, এমনকী পাণ্ডবদের সর্বসাধক বুদ্ধিদাতা কৃষ্ণেরও তিনি বড় ভাই! অর্থাৎ অনেক কিছু করতে পারলেও সমস্ত পাণ্ডব তো বটেই, কৃষ্ণকেও সংকুচিত থাকতে হবে বলরামের সামনে। মহাকাব্যের প্রতিনায়কের জন্য মহাকবির এই উদার প্রসন্ন বিবেক-সমাবেশ মহাকাব্যের পাঠককে এক মুহূর্তে সচেতন এবং জাগ্রত করে তোলে।
বলরাম এসেই উদ্যত যুদ্ধ সজ্জার মধ্যে নতুন এক আরম্ভ সূচনা করেন। বলরাম বললেন— যুদ্ধ যখন হবেই তখন এই দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরভূমিতে নয়। যে কুরুক্ষেত্রে এতদিন যুদ্ধ হল, যে কুরুক্ষেত্র পরম পুণ্যস্থান ধর্মক্ষেত্র বলে পরিচিত, সেইখানেই এই যুদ্ধ হবে। অতএব চলো আমরা সকলে স্যমন্তপঞ্চকে যাই, কেননা এই স্থানটি প্রজাপতি ব্রহ্মার যজ্ঞ স্থানের উত্তরবেদী বলে দেবলোকে চিহ্নিত। আসলে উত্তরবেদী হল যজ্ঞের জন্য পরিষ্কৃত ভূমি। আমরা আগেও বারবার দেখেছি যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাকে একটা যজ্ঞের স্বরূপে বর্ণনা করা হয়েছে মহাভারতে। আর লৌকিক দৃষ্টিতে গদাযুদ্ধের জন্য একটা মসৃণ পরিষ্কৃত ভূমিরই প্রয়োজন ছিল, অসমান ভূমিতে বলবান লোকের যুদ্ধের সুবিধে হয় যত, নিপুণ যুদ্ধশিল্পীর ততটা নয়। সেইজন্যই হয়তো বলরাম আবারও সমন্তপঞ্চকের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাবৃত্ত হতে বলেছেন সকলকে। বলরামের কথা মান্য করে যুধিষ্ঠির সকলকে আদেশ দিলেন সমন্তপঞ্চকে ফিরে যাবার জন্য।
দ্বৈপায়ন হ্রদ থেকে দুর্যোধনের এই সমন্তপঞ্চকে যাওয়ার বিবরণের মধ্যে দুর্যোধনের রাজোচিত মর্যাদা যতখানি ফুটে উঠেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সমব্যথায় জাগ্রত এখানে নির্মাণ-নিপুণ মহাকাব্যের কবি। দুর্যোধনের চোখে-মুখে তেজস্বিতা এবং আসন্ন যুদ্ধের ক্রোধ ফেটে বেরোচ্ছে, অথচ গদা-হাতে দুর্যোধন পাণ্ডব শত্রুদের দ্বারা রাজোচিতভাবে পরিবৃত হয়ে পায়ে হেঁটে চলেছেন। তাঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই— কে বা কারা তাঁর সঙ্গে যাচ্ছেন। যাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে তাঁরাই তাঁকে চারদিক ঘিরে নিয়ে পদব্রজে চলেছেন— স পাণ্ডবৈঃ পরিবৃতঃ— যেন মাতলা হাতিকে ঘিরে নিয়ে চলেছে মানুষের ভিড়— দুর্যোধন তাদের দিকে তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করছেন না— মত্তস্যেব গজেন্দ্রস্য গতিমাস্থায় সোহব্রজৎ। তথাকথিত আক্রান্ত অবস্থাতেও দুর্যোধনের এই নিরুদ্বেগ পাদচার দেখে স্বর্গ থেকে দেবতারাও সাধুবাদ দিয়েছেন। চারিদিকে সিংহনাদ, শঙ্খ-ভেরীর শব্দ। পাণ্ডবদের দ্বারা চতুর্দিকে সসমাদরে বেষ্টিত হয়ে সকলে সরস্বতী-নদীর দক্ষিণ দিকে এক প্রশস্ত ভূমিতে জমায়েত হলেন। এখানেই যুদ্ধ হবে।
সুন্দর শুভ্রকান্তি বলরাম বসলেন যুদ্ধ দেখতে, বসলেন অন্যান্য সকলে। ভীম-দুর্যোধনের বাক্যযুদ্ধ, পরস্পর দোষারোপ গালাগালি এবং আত্মশ্লাঘা চলল আবার। তারপর সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ হল। খুব সঙ্গত কারণেই এই যুদ্ধের বর্ণনা আমরা বাংলা ভাষায় দেব না। কেননা তৎকালীন দিনে গদাযুদ্ধের আরম্ভ-নিয়ম প্রক্রম এবং প্রহারের যে অসাধারণ পদ্ধতিগুলি বর্তমান ছিল, তা সবই মহাভারতের কবি এখানে বর্ণনা করেছেন। আমাদের মানুষী বর্ণনায় এই যুদ্ধের ভয়ংকর রূপ তেমন করে ধরা পড়বে না বলেই এই পারস্পরিক সংঘর্ষ মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে কখনও দুই মত্ত হস্তীর উপমায়, কখনও দুই সিংহ আবার কখনও রাম-রাবণ, বালী-সুগ্রীব অথবা সুন্দ-উপসুন্দের মিথিক্যাল উপমায়। আমরা এত সবের মধ্যে যাব না, শুধু শেষ প্রহোরের পূর্বকালে, ভীম যখন প্রহার করতে করতে কোনও অন্ত দেখতে পাচ্ছেন না এবং দুর্যোধনও ঠিক তাই— এই জায়গাটায় দুই বিশেষ যুদ্ধ-দর্শকের কথোপকথনের মধ্যে আমরা সদর্থকভাবেই প্রবেশ করব।
দুই প্রতিস্পর্ধীর গদাযুদ্ধ যখন তুমুল আকার ধারণ করেছে— সমুদীৰ্ণং ততো দৃষ্ট্বা সংগ্রামং কুরুমুখ্যয়োঃ– অথচ কেউই কারও কাছে হারছেন না, এই অবস্থায় অর্জুন ঠাণ্ডা মাথায় কৃষ্ণকে সেই পুরনো প্রশ্ন করলেন— ভীম-দুর্যোধনের মধ্যে কার ক্ষমতা বেশি— কো জ্যায়ান্ ভবতো মতঃ? কৃষ্ণও সেই পুরাতন উত্তর দিলেন— গুরুর উপদেশ এঁরা দু’জনেই এক রকম পেয়েছেন, কিন্তু ভীমের শারীরিক শক্তি বেশি, অন্যদিকে দুর্যোধন বেশি কুশলী। অস্ত্রের অভ্যাসও দুর্যোধন বেশি করেছেন, হয়তো সেই কারণেই তিনি বেশি কুশলী। কৃষ্ণ এইটুকু উত্তর দিয়েই তাঁর কর্তব্য শেষ করলেন না। কুশলী যোদ্ধা যেহেতু চরম প্রহার এড়িয়ে যেতে পারেন, কৃষ্ণ তাই বললেন— ন্যায় অনুসারে যুদ্ধ করলে ভীম কোনও দিন এঁর সঙ্গে পেরে উঠবে না। অতএব অন্যায় আশ্রয় করেই দুর্যোধনকে মারতে হবে— অন্যায়েন তু যুধ্যন্ বৈ হন্যাদেব সুযোধনম্। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই।
যুদ্ধ চলছে একই ভাবে, হার-জিতের ফয়সালা নেই। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের ‘স্ট্রাটিজিক’ ভুল দেখিয়ে বললেন— দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করাই উচিত ছিল না। ও বনে চলে যেতে চাইছিল, সেটা যেতে দিলেই হত। কিন্তু যুধিষ্ঠির ভাবলেন— শেষ শত্রু বেঁচে থাকলে আবারও যদি রাজ্যটা চলে যায়, তাই যে কোনও একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করার শর্তে ধর্মরাজ দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ চাইলেন বটে, তবে সেটা এক্কেবারে ভুল ‘স্ট্রাটিজি’। কৃষ্ণ এবার রাজনীতির প্রযুক্তি-বোদ্ধা শুক্রাচার্যের মত উল্লেখ করে বললেন, যে-শত্রুর সব গেছে, পরাজিত এবং হতাবশিষ্ট অবস্থায় সেই শত্রু যদি আবার ফিরে আসে, তবে তাকে জয় করা খুব কঠিন। কারণ সে জানে, তাঁর হারাবার কিছু নেই এবং মৃত্যু ব্যাপারটাকে নিশ্চিত ধরে নিয়েই যেহেতু সে যুদ্ধ করে— সহসোৎপতিতানাঞ্চ নিরাশানাঞ্চ জীবিতে— এমন শত্রুকে তাই দেবতারাও জয় করতে পারে না। অতএব এই দুর্যোধন মোটেই সুসাধ্য নন। তেরোটা বছর ধরে শুধু ভীমকে মারার জন্য দুর্যোধন অভ্যাস চালিয়ে গেছে। এখন সে নিরাশার জায়গা থেকে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করছে। ফলত অন্যায় যুদ্ধ না করে দুর্যোধনকে মারা যাবে না— এনঞ্চেন্ন মহাবাহুরন্যায়েন হনিষ্যতি।
কৃষ্ণের কথার মর্মার্থ বুঝলেন অর্জুন এবং পাগলের মতো যুদ্ধ করতে থাকা ভীমকে দেখিয়ে দেখিয়ে নিজের বাম উরুর ওপরে হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন তিনি। এর পরের ঘটনা সকলের জানা। কৃষ্ণের বুদ্ধি এবং অর্জুনের সংকেত কাজে লাগালেন ভীম। দুর্যোধন উঁচুতে লাফ দিয়ে উঠে ভীমের ওপর সবেগে গদার বাড়ি মারবেন ঠিক করেছিলেন। কিন্তু ওপর থেকে লাফিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই ভীমের গদার বাড়ি দুর্যোধনের দুই উরু ভেঙে দিল। সবাই দেখল; সসাগরা পৃথিবীর নায়ক আর কোমর তুলতে পারছেন না, পা নাড়াতে পারছেন না, স্থাণুর মতো মাটিতে পড়ে আছেন, যন্ত্রণায় কাতর, সর্ব অঙ্গ ধুলায় ধূসর।
দুর্যোধনের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা পাণ্ডব-পাঞ্চালদের মধ্যে সিংহনাদ, জয়ধ্বনি, শঙ্খ-ভেরীর তুমুল শব্দ হতে থাকল। এই অবস্থায় সমবেত হর্ষধ্বনির মধ্যে মহাবলী ভীমসেন ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন দুর্যোধনের দিকে। তখনও কেউ কিছু বোঝেনি— কী ঘটতে যাচ্ছে। ভীম গদা হাতে দুর্যোধনের কাছে এসে তাঁর ওপরে চোখ রেখে বললেন, অসভ্য ছোটনোক কোথাকার! তুই সেদিন একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে রাজসভায় টেনে এনে আমাদের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার হাসি হেসেছিলি, মুখে বলেছিলি— আমরা নাকি সব ‘গোরু’। বলির পশু ছাড়া পেলে যেমন হয়, আমাদের নাকি তোরা বাগে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিস। সেই ‘গোরু’ বলার ফল আজকে পাবি তুই— তস্যাবহাসস্য ফলমদ্য ত্বং সমবাপ্নুহি।
এই কথা বলে ভীম তাঁর বাঁ পা রাখলেন দুর্যোধনের কপালের ওপর, তারপর পা দিয়েই তাঁর মাথাটা ঘষে-পিষে দিলেন। মহাভারতের নিরপেক্ষ ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় দেখেছেন— সময়ের আবর্তনে কত বড় বীর পুরুষের কতখানি অবমাননা হতে পারে। এই অসঙ্গতি অথবা স্বকর্মসাধিত কালগতি বোঝানোর জন্য সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, রাজসিংহ দুর্যোধনের মাথাটা ভীম বাঁ পা দিয়ে ঘষে পিষ্টে দিলেন মাটিতে— শিরশ্চ রাজসিংহস্য পাদেন সমলোড়য়ৎ। মানুষ যখন প্রতিশোধের কথা বলে তখন একবার বলে না, বারবার বলে। ভীম আবারও বললেন— যারা আগে আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে, ‘গোরু গোরু’ বলে নেচেছিলি, এখন আমরা তোদের অবস্থা দেখেও ‘গোরু গোরু’ বলে উলটে নাচছি— তান্ বয়ং প্রতিনৃত্যামঃ পুন গৌরিতি গৌরিতি— দেখে যা ব্যাটারা! দ্রৌপদীকে সভায় টেনে এনে পাশার পণের সুযোগ নিয়ে তোরা আমাদের ‘হিজড়ে’ ‘ষণ্ঢতিল’ বলে গালাগালি দিয়েছিলি, আজ দ্যাখ— সেই দোষে তোরা সব ক’টা ভাই আমার হাতে মরলি। এখন আমরা স্বর্গেই যাই বা নরকেই যাই, আমাদের দুঃখ নেই কিছু, আমরা প্রতিশোধ নিয়েছি। ভীম আবারও এগিয়ে গেলেন দুর্যোধনের দিকে, আবারও বাঁ পা দিয়ে মাটিতে ঘষে দিলেন তাঁর মাথা, মুখে গালাগালি দিলেন— শঠ, প্রবঞ্চক, জুয়োচোর কোথাকার— বামেন পাদেন শিরঃ প্রমৃদ্য/ দুর্যোধনং নৈকৃতিকেতবোচৎ।
ভীমের এই প্রতিস্পর্ধী আচরণ অনেকেরই ভাল লাগেনি, নিরপেক্ষ ধারাভাষ্যকার সঞ্জয়ের ভাল লাগেনি, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাঞ্চালদেরও ভাল লাগেনি। অত বড় মানুষ— দুনিয়ার লোক তাঁকে চিরকাল রাজার মতো সম্মান করেছে— রাজভাবেন মান্যশ্চ সর্বলোকস্য সো’ ভবৎ— ভোগে-বিলাসের ছাতার তলার সূর্যতাপটুকুও যাঁর পছন্দ হত না, রাজ্যের সমস্ত লোক যাঁর অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করত— প্ৰসাদাদ্ ধ্রিয়তে যস্য প্রত্যক্ষং তব সঞ্জয়— সকলে তাঁর প্রতাপ দেখেছে, সেই মানুষটাকে ভীম বাঁ পায়ে মাথা ঘষে দিচ্ছেন— যেহেতু ভগ্ন ঊরুতে তাঁর দাঁড়িয়ে ওঠার ক্ষমতা নেই— এটা কেউ ভালভাবে নিলেন না— দৃষ্ট্বা কৃতং মূর্ধনি নাভ্যনন্দন্… ক্ষুদ্ৰাত্মনা ভীমসেনেন পাদম্। সকলের মধ্যে অবশ্য সবচেয়ে অস্বস্তি বোধ করলেন যুধিষ্ঠির, ভীমের আচরণে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হলেন তিনি।
এটা অবশ্যই ঠিক যে, এখানে একটা ‘মাইলেজ’ পাবার ব্যাপার আছে, করুণ অবস্থায় সুযোগ পাবার ব্যাপার আছে, পরপক্ষের আচরণের তীক্ষ্ণতা এই ‘মাইলেজ’ এবং সুযোগ বাড়িয়ে দেয়। আমি এমন ঘটনা এবং দুর্ঘটনা অনেক দেখেছি, যেখানে অন্যায়কারী বহুতর দুস্কৃত কর্ম করার পর সামগ্রিকভাবে বহুতর নিন্দিত হতে হতে যখন তুমুল বিপদে পড়ে, তখন কখনও মহিলা বলে, কখনও বালক বলে এবং কখনও পূর্বে বড় মানুষ ছিলেন বলে এই মুহূর্তে ভগ্ন, চুর্ণ, দুর্বল অবস্থায় অন্যায় সুযোগ পেয়ে যান। বিশেষত যে তীক্ষ্ণকারী ব্যক্তি তীক্ষ্ণ কথায় সেই বড় মানুষের মুখোশ খুলে ফেলল, তার ওপরেই পাশ্ববর্তী জনের ক্ষোভ তৈরি হয়— যেন এতটা ক্ষতি, এতটা অবমাননা সে না করলেই পারত। এই অবস্থায় সেই বড় মানুষ, মহিলা বা বালকের পূর্বকৃত জঘন্য অপরাধও লঘু দৃষ্টিতে দেখা হতে থাকে।
ভীমের ক্ষেত্রেও তাই হল। দ্রৌপদীকে চুলের মুঠি ধরে রাজসভায় টেনে এনে যেদিন বাম উরু প্রদর্শন করেছিলেন দুর্যোধন, অথবা বনবাসে যাবার সময় ভীমের হাঁটা নকল করে দুর্যোধনেরা যখন ‘গোরু গোরু’ বলে চিৎকার করেছিলেন, অথবা পাণ্ডবদের নপুংসক বলে দ্রৌপদীকে যখন কুপ্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তখন কিন্তু ভীমের মতোই প্রতিশোধ-স্পৃহা সবার মনে জেগেছিল। কিন্তু আজ যখন স্বজন-বন্ধু-আত্মীয় হারিয়ে সেই বড় মানুষ দুর্যোধনের মাথায় লাথি মারছেন ভীম, তখন অতিতীক্ষ্ণকারী ভীমকে কেউ ভাল চোখে দেখছেন না। আসলে ভয়েই হোক অথবা অনতিক্রমনীয় ব্যক্তিত্ব বলেই হোক, পূর্বে যিনি বড় মানুষ ছিলেন, পরাজিত ভগ্ন অবস্থাতেও তাঁর বড় মানুষির অবমানন ঘটলে এক ধরনের সমব্যথার আবরণ তৈরি হয়। নইলে দেখুন, দুর্যোধনের ওপর এই অবজ্ঞা-মুখর প্রতিশোধ-স্পৃহা কিন্তু সকলের মনেই ছিল। কিন্তু দুর্যোধনের রাজকীয় পতনের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ভীম যখন তীক্ষ হয়ে ওঠেন, তখন তিনিই যেন কেমন অমানবিক অন্যায়ের নিমিত্ত কারণ হয়ে ওঠেন। তাঁর আচরণ যেন অন্যায় বলে মনে হয়। অন্য দিকে এটাই হল, প্রতিনায়ক-শ্রেষ্ঠতমের মহাকাব্যিক প্রতিষ্ঠার বিপ্রতীপ উপায়, যেখানে উজ্জ্বলতম নায়ক যোদ্ধার সমালোচনার মাধ্যমে প্রতিনায়কের শ্রেষ্ঠত্বের আস্বাদন তৈরি হয়।
ভীম বাঁ পায়ে দুর্যোধনের মাথা ঘষে দিচ্ছেন মাটিতে, প্রতিশোধ খ্যাপন করতে গিয়ে আত্মশ্লাঘায় নেচে বেড়াচ্ছেন, এতে সকলের মধ্যেই যে এক আরোপিত সমবেদনার আবরণ তৈরি হল, সেই আবরণ আরও তীব্রতর হয়ে উঠল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সোচ্চার হস্তক্ষেপে। যুধিষ্ঠির বললেন, ন্যায় বা অন্যায় যেভাবেই হোক তোমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে, তোমার প্রতিজ্ঞাপূরণও হয়ে গেছে। তো, এখানেই তো তোমার শত্রুতার শেষ হওয়া উচিত— গতোহসি বৈরস্যানৃণ্যং প্রতিজ্ঞা পূরিতা ত্বয়া। কিন্তু এখন যেটা করছ, এই কাজটা বন্ধ করো, তুমি পা দিয়ে দুর্যোধনের মাথা মাটিতে ঘষে দিয়ো না এইভাবে, ধর্ম যেন তোমাকে অতিক্রম না করে— মা শিরোহস্য পদা মর্দীৰ্মা ধর্মস্তেহতিগো ভবেৎ। প্রাথমিক আক্ষেপ-বাক্যে ভীমকে নিয়ন্ত্রণে আনার সঙ্গে-সঙ্গেই বিজয়ী প্রতিপক্ষের মুখ দিয়ে প্রতিনায়কের মহাকাব্যিক প্রতিষ্ঠা ঘটল যুধিষ্ঠিরের মুখে। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম! তুমি মনে রেখো— ইনি রাজা এবং আত্মীয়-সম্বন্ধে ইনি আমাদের জ্যাঠতুতো ভাই, বিশেষত ঊরুভঙ্গের কারণে তাঁর যে পতন ঘটেছে, তা তাঁর কাছে মৃত্যুরই মতো— রাজা জ্ঞাতির্হতশ্চায়ং— এই অবস্থায় তোমার এই সাবজ্ঞ আচরণ রীতিমতো অন্যায়।
যুধিষ্ঠির এবার অধুনা অসহায় দুর্যোধনের পূর্বমর্যাদা ভীমকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর রাজোচিত প্রাপ্য সম্মানটুকু সকলকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন মহাকাব্যিক শ্রদ্ধায়। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ দুর্যোধন এগারো অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি, সমগ্র কুরুকুলের তিনি নেতা, এবং কুরুদেশেরও নেতা, এমন একটা সম্মানিত মানুষের মাথাটা তুমি পা দিয়ে স্পর্শ কোরো না— মা স্প্রাক্ষী ভীম পাদেন রাজানং জ্ঞাতিমেব চ। এই মুহূর্তে দুর্যোধনের অসহায়তার কথাও উল্লেখ করছেন যুধিষ্ঠির। তাঁর সৈন্য-সেনাপতি, অমাত্য-সচিব, আত্মীয়-বন্ধু সকলেই মারা গেছে, নিজেও তিনি ভগ্ন ঊরু-দুটি নিয়ে বিধ্বস্ত, এই অবস্থায় তাঁকে পদাঘাত করা শোভন হয় না। ভাবটা এই যে, সব ঠিকঠাক থাকলে দুর্যোধনকে কি এত সহজে অপমান করা যেত? অতএব একজন মানী এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির শোচনীয় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁকে এইভাবে অপমান করা যায় না, বরঞ্চ তাঁর জন্য মায়াই হওয়া উচিত— সর্বাকারেণ শোচ্যোহয়ং নাবহাস্যোহয়মীশ্বরঃ।
ভীমকে এইভাবে শাসন এবং নিয়ন্ত্রণ করে দুর্যোধনের রাজোচিত সম্মানটুকু ফিরিয়ে দিলেন বটে যুধিষ্ঠির, কিন্তু শব্দার্থের অসাধারণ মার্জনায় যুধিষ্ঠির তাঁর এই নির্মম পরিণতি সযৌক্তিক বলেই তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন সাশ্রুকণ্ঠে, দণ্ডদাতার অসীম ক্ষমায়। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস! রাগ কোরো না, তুমি কষ্টও পেয়ো না, নিজের জন্য শোকও কোরো না। বিধাতা এমন এক বিষম কর্ম সৃষ্টি করেছেন, যাতে সারা জীবন ধরে তুমিও আমাদের বিনাশ করার চেষ্টা করে গেলে, আর আমরাও শেষ পর্যন্ত এই হত্যালীলায় মেতে উঠলাম। কিন্তু এটাও বড় ঠিক যে, তুমি নিজের অনতিক্ৰমণীয় লোভ, মত্ততা, মূঢ়তার জন্য আজকে নিজেই এই বিপদ ডেকে এনেছ— আত্মনো হ্যপরাধেন মহদ্ব্যসমীদৃশম্। আজকে তোমার জন্যই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলে মারা গেল, অথচ আমরা তার নিমিত্ত কারণ হয়ে রইলাম।
যুধিষ্ঠির শেষ পর্যন্ত দুর্যোধনের কথাটাই মেনে নিয়েছেন। যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে দিয়েছেন কীভাবে মানুষের পৃথিবীতেই স্বর্গ-নরক তৈরি হয়। যে এমন একটা যুদ্ধ করে মারা গেল, সে স্বর্গে গেল— এ-কথার মানে দুর্যোধনকে আর কোনও শোক-দুঃখ ক্লেশ সইতে হবে না, দেখতেও হবে না। কিন্তু যুদ্ধের পুরুষমেধ যজ্ঞ শেষ হলে ভাই-বন্ধু, পুত্র-পৌত্রের বিধবা-বধূরা যে শোক করতে থাকবেন, সেই শোক দেখার মধ্যে এক নারকীয়তা আছে, যুধিষ্ঠিরকে সেই নারকীয়তা সহ্য করতে হবে— বয়ং নারকি-সংজ্ঞা বৈ দুঃখং ভোক্ষ্যাম দারুণম্। গদাযুদ্ধের প্রাককালে দুর্যোধন এই কথাই বলেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। বলেছিলেন, তিনি যা ভোগ করার করেছেন, কিন্তু দুর্যোধনকে মেরে বিধবা পৃথিবী শাসন করতে হবে যুধিষ্ঠিরকে।
প্রধানতম শত্রু হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে হত্যা করা এবং অপমান করার মধ্যে যে নৈতিকতার তত্ত্ব আছে, সেখানে স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের মাধ্যমে দুর্যোধনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেই মহাকাব্যের কবি শান্ত হননি। প্রতিনায়কের প্রতিও তাঁর মমতা থাকে, তাঁর শৌর্য-বীর্য অহংকারের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাটাও থাকে বিপরীত চমৎকারিতায়। আমরা আগেই বলেছিলাম— কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরাম তীর্থদর্শন ছেড়ে দুই শিষ্যের যুদ্ধ দেখতে এসেছিলেন যতখানি, তার থেকেও তিনি বেশি উপস্থিত সংজ্ঞাচেতক বিবেকের মতো। সেই বিবেক বুঝিয়ে দেয় যে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যও কিছু জাগতিক অন্যায়ের প্রয়োজন হয়; হয়তো বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এমন অন্যায়ও কথঞ্চিৎ নৈতিক হয়ে ওঠে, কিন্তু তবু সে অন্যায়টুকু ধরিয়ে দেন মহাকাব্যের কবি। এখানে বল রাম সেই কাজটা করছেন নিরপেক্ষ সাক্ষী-চৈতন্যের মতো।
প্রথমেই বলে রাখি, দুর্যোধনের ঊরুদেশে অন্যায়ভাবে আঘাত করার পরেই বলরামের প্রতিক্রিয়ার কথা আমাদের জানানো উচিত ছিল, কিন্তু মহাভারতের কবি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দুর্যোধনের মাথায় ভীমের সাবজ্ঞ পাদস্পর্শ এবং যুধিষ্ঠিরের শাসনের পর। আমরা মহাকাব্যের অনুক্রম মেনেছি বটে, তবে স্বাভাবিকতার দৃষ্টিতে এটাই স্বাভাবিক যে, বলরাম তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন দুর্যোধনের উরুদেশে ভীমের গদাঘাতের পরেই। তা ছাড়া ক্রুদ্ধ বলরামের উপস্থিতিতে দুর্যোধনের মাথায় ভীম পদাঘাত করবেন, এটাও সম্ভব ছিল না। নিরপেক্ষ ধারাভাষ্যকার সঞ্জয়ের কথা থেকেও তাই বোঝা যায়। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন, ভীম আপনার পুত্রের ঊরুদেশে আঘাত করেছে, এটা দেখামাত্রই বীরশ্রেষ্ঠ বলরাম ভীষণ রেগে গেলেন— ঊর্বোরভিহতং দৃষ্ট্বা ভীমসেনেন তে সুতম্। আমরা বলব— এ শুধু রাগ নয়, ভীমের প্রহার-মাত্রই বলরাম পীড়াব্যঞ্জনক আর্তকণ্ঠে— যেন তাঁর নিজেরই ঊরুদেশে লেগেছে এইভাবে চেঁচিয়ে উঠে বললেন— ছিঃ ভীম! ছিঃ ছিঃ! এবারে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বলরাম বললেন, ভীম যেভাবে দুর্যোধনের নাভির নীচে ঊরুদেশে গদা-প্রহার করল, যুদ্ধের নীতিতে এটা চরম অন্যায় এবং লোকসমাজেও এমন কেউ করে না। এই মূর্খ কোনও নিয়মের ধার ধারে না, ও কি নিজের ইচ্ছামতো সমস্ত নীতি-নিয়ম লঙঘন করে যুদ্ধ করবে নাকি— নৈতদ্ দৃষ্টং গদাযুদ্ধে কৃতবান্ যদ্ বৃকোদরঃ।
বলরাম এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর চিরাভ্যস্ত যুদ্ধাস্ত্র লাঙ্গল নিয়ে ছুটে চললেন ভীমের দিকে— ততো লাঙ্গলমুদ্যম্য ভীমমভ্যদ্রবদ্ বলী। এই অবস্থায় কৃষ্ণ এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে না আটকে দিলে ভীমের বিপদ ছিল। কৃষ্ণ তাঁকে কথঞ্চিৎ শান্ত করে রাজনীতি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বিশেষত পাণ্ডবরা তাঁদের আত্মীয়, আত্মীয়ের রাজনৈতিক যুদ্ধ জয় তো নিজেদেরই জয়— এইসব কথার সঙ্গে দুর্যোধনের পূর্বকৃত অত্যাচার এবং ভীমের ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞার প্রসঙ্গও বলরামকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কৃষ্ণ। বলরাম কৃষ্ণের যুক্তিগুলি মেনে নিলেন বটে, সাময়িকভাবে শান্তও হলেন বটে, কিন্তু তিনি খুশি হলেন না। কৃষ্ণের কথা মেনে নিয়েও তিনি ভীমকে ‘কৃটযোধী’ বা অন্যায়যুদ্ধকারী বলে চিহ্নিত করলেন চিরকালের মতো এবং যুদ্ধে নিহত হলেও যে দুর্যোধন চিরস্থায়ী স্বর্গ লাভ করবেন, সেই সান্ত্বনাবাক্য দুর্যোধনকে শোনালেন বলরাম। বলরামের শেষ কথাটা এখানে ভীষণ-ভীষণ প্রণিধানযোগ্য। সম্পূর্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাকে একটা যজ্ঞের প্রতিরূপে বর্ণনা করে বলরাম বলেছেন, এই যজ্ঞে শত্রুরূপ অগ্নিতে দুর্যোধন আত্মাহুতি দিয়ে মহাযজ্ঞসমাপ্তির পুণ্যফল লাভ করেছেন— হুত্বাত্মানম্ অমিত্রাগ্নৌ প্ৰাপ চাবভৃথং যশঃ।
দুর্যোধনের পতনের পর বলরাম আর সেখানে থাকেননি। কৃষ্ণের কথায় তিনি ক্রোধ সম্বরণ করলেও মনে মনে ক্রোধ পোষণ করেই তিনি রথে চড়ে দ্বারকায় চলে গেছেন। আমাদের ধারণা, বলরাম চলে যাবার পরেই ভীম এগিয়ে গিয়ে দুর্যোধনের সঙ্গে বিরূপ ব্যবহার করেছেন তাঁর মাথায় পদাঘাত করে। দুর্যোধনের ঊরুদেশে ভীমের প্রহার থেকে আরম্ভ করে এই পর্যন্ত যে-সব ঘটনা ঘটল, তাতে পাণ্ডবদের বিজয়-ভাবনা কেমন কলুষিত এবং তিক্ত হয়ে গেল যেন। বিশেষত অন্যায়ের কলঙ্ক-রোপন করে বলরাম চলে গেলেন বলেই এমন একটা পরিবেশ তৈরি হল, যাতে প্রবল-শত্রু-বিনিপাতের উল্লাসটুকুও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠছে না, আবার ভীমের ওপর আরোপিত অন্যায়টুকুও ঠিক জাস্টিফাই করা যাচ্ছে না। তার মধ্যে, যে-ভীম এত লড়াই করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্যোধনের পতন ঘটালেন, তাঁকেও কেউ স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা না করায়, তাঁরও মনটা বিষণ্ণ হল। পরিস্থিতিটা এইরকম যে, কেউই খুশি নেই— পাঞ্চালাশ্চ সবার্ষ্ণেয়া পাণ্ডবাশ্চ বিশাম্পতে।
বস্তুত বিজয়ী যোদ্ধা-পুরুষদের মধ্যে এই যে বিষণ্ণতা, এইখানেই প্রতিনায়ক দুর্যোধনের মহিমা এবং মর্যাদা বিপ্রতীপভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই বিপরীত-প্রতিষ্ঠার আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, কৃষ্ণের মতো ভগবৎ-প্রমাণ ব্যক্তিত্বের অভিপ্রবেশ অথবা ‘ইনটারভেনশন’ জরুরি হয়ে পড়ে। মহামতি যুধিষ্ঠির ভীমকে শাসন-নিয়ন্ত্রণ করার পর নিজে বিষণ্ণ এবং চিন্তাকুল হয়ে অপোবদনে বসেছিলেন। এই অবস্থায় সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ধর্মরাজ! ধর্মের বিষয় তো সব আপনার জানা। তা হলে এই ঘটনাটাকে আপনি অধর্ম বলে মনে করছেন কেন? ভূপতিত চৈতন্যহীন দুর্যোধনকে ভীম পদাঘাত করে ভীষণ অন্যায় করেছে, এটাই বা আপনি ভাবছেন কেন? যুধিষ্ঠির এতক্ষণে বুঝলেন যেন। মন থেকে ভীমের ওই সাবজ্ঞ আচরণ মোটেই পছন্দ না করলেও এতদিনকার জ্বালা, এতদিন এত শঠতার যন্ত্রণা থেকেই যে ভীম দুর্যোধনকে অপমান করেছেন, সেটা যুধিষ্ঠির অনুধাবন করলেন এতক্ষণে। আর যুধিষ্ঠির সেটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষ্ণ ভীমকে খুশি করার জন্য তিনি যা যা এতক্ষণ করেছেন তার সবকিছু সপ্রশংসভাবে অনুমোদন করলেন— অন্বমোদত তৎ সর্বং যদ্ভীমেন কৃতং যুধি।
আমাদের বক্তব্য হল— বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও সেই বিজয়ের আস্বাদন লাভ করার জন্য এতটা যে সময় লেগে গেল এবং সেই আস্বাদন ভোগ করার জন্য এতটা যে যৌক্তিকতার সাধন করতে হল— এই সময় এবং এই যৌক্তিকতার সন্নিবেশই এখানে প্রতিনায়ক দুর্যোধনের মহাকাব্যিক প্রতিষ্ঠা তৈরি করে দেয়। এমনকী কৃষ্ণ ভীমকে সমর্থন করে একটা উল্লাস-পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পরেও যখন পাঞ্চাল-বীরেরা অতি উৎসাহে ভীমের বেশি বেশি প্রশংসা করার জন্য দুর্যোধনের নিন্দা আরম্ভ করলেন, তখন কিন্তু কৃষ্ণকেই আবার রাশ টেনে ধরে বলতে হয়েছিল— শুনুন মহাশয়েরা! দুর্যোধন মন্দবুদ্ধি, সে নিহত হয়েছে, এখনও তাঁর মৃত্যু না হলেও সে এখন নিরুপায় নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু এই অবস্থায় উগ্র তীক্ষ্ণ কাঠ-কাঠ কথা বলে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ো না— বাগ্ভিঃ কাষ্ঠসধর্মণা— মরা মানুষকে এমন কষ্টকর কথা বলে আবারও মারতে নেই— ন ন্যায্যং নিহতং শত্ৰুং ভূয়ো হন্তুং নরাধিপাঃ। কৃষ্ণ বুঝতে পারছিলেন দুর্যোধনের অতিরিক্ত নিন্দাও তাঁর গুরুত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে একভাবে। ঠিক সেই জন্যই তিনি বেশি কথা না বলে সবাইকে এবার তাড়াতাড়ি করে রথে উঠতে বললেন। কিন্তু আমরা মনে করি— অতিখ্যাত বীর প্রতিনায়কের প্রতি এই ঔদাসীন্যও বুঝি মহাভারতের কবির পছন্দ হয়নি।
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল। তুমুল আনন্দধ্বনির মধ্যে পাণ্ডবরা এখন রওনা হবেন হস্তিনাপুরের দিকে। আনন্দে কেউ গায়ের চাদর ওড়াতে লাগল, বিজয়ী খেলোয়াড়ের মতো কেউ ধনুক উড়িয়ে দিল আকাশে। সমবেত মানুষজনেরা ভীমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। দুর্যোধন ঊরুভঙ্গের বেদনাও কোনওক্রমে সইছিলেন, কিন্তু সবার মুখে ভীমের প্রশংসা, আর নিজের গালাগালি শুনে আর থাকতে পারছিলেন না। এর মধ্যে কৃষ্ণ আবার যখন মিষ্টি মিষ্টি করে বলতে আরম্ভ করলেন, তখন তাঁর অধৈর্য চরমে উঠল। কৃষ্ণ বলেছিলেন— ভাগ্যক্রমে এই দুষ্ট মারা গেছে— এখন তাড়াতাড়ি রথে ওঠো, বাড়ি যেতে হবে— রথেষ্বারোহত ক্ষিপ্রং গচ্ছামো বসুধাধিপা।
দুর্যোধন তখনও মারা যাননি, তবে ব্যথায়, যন্ত্রণায়, অপমানে, মরার মতোই পড়েছিলেন। কৃষ্ণের তাচ্ছিল্যভরা কথা শুনে দু’হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে কোনওরকমে শরীরটাকে খানিকটা উঁচু করলেন দুর্যোধন। মহাভারতের কবি এমন একটি উপমা দিয়েছেন এখানে, যা শুধু মহভারতের কবির মতো। তিনি বলেছেন— রেগে-যাওয়া সাপের ল্যাজের দিকটা ছেঁচে দিলে, সে যেমন সামনের দিকটা কোনওরকমে খানিকটা উঁচু করে, ভগ্ন ঊরু দুর্যোধনও তেমনি হাতের সাহায্যে নিজের মাথাটা, বুকটা একটু উঁচু করে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন— অর্ধোন্নত শরীরস্য… ক্রুদ্ধস্যাশীবিষস্যেব ছিন্নপুচ্ছস্য ভারত। প্রাণ বের-করে-দেওয়া ব্যথা-বেদনা তুচ্ছ করে তিনি কৃষ্ণকে কটু কথা বলতে আরম্ভ করলেন। বললেন— ব্যাটা, কংসের বান্দার ব্যাটা— তুই ওই অর্জুনকে শিখিয়ে দিলি, তারপরেই না ভীম তার কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে আমার ঊরু দুটি ভেঙে দিল অন্যায়ভাবে। তোরই কূট বুদ্ধিতে আমার পক্ষের সমস্ত মহাবীরেরা মারা গেছেন, তবু তোর লজ্জা নেই। ভীষ্মের মরণে শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুনের যুদ্ধ করাটা তোরই বুদ্ধি। অশ্বত্থামা নামে একটা হাতি মেরে আচার্য দ্রোণকে দিয়ে অস্ত্র ত্যাগ করানো— এটাও তোর বুদ্ধি। ঘটোৎকচকে যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে কর্ণের একাঘ্নী বাণটি খরচ করা, এটাও তোর বুদ্ধি। মাটিতে রথ আটকে গেছে— এই অবস্থায় কর্ণকে মেরে ফেলাটাও তোর বুদ্ধি। যদি তুই এত সব অসাধু উপায়ে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে সোজাসুজি যুদ্ধ করতি— তা হলে জীবনেও তোরা জিততে পারতি না।
কৃষ্ণ এবার একটি একটি করে দুর্যোধনের সমস্ত পাপ এবং অন্যায়গুলি স্মরণ করিয়ে দিলেন— ভীমকে বিষ দেওয়া, জতুগৃহ, পাশাখেলা, দ্রৌপদীর অপমান, বনবাস, অভিমন্যুকে মারা— সব একটি একটি করে কর্কশ ভাষায় উল্লেখ করলেন। বললেন— তোমার দোষেই, তোমার লোভ আর অতিরিক্ত রাজ্য স্পৃহাতেই তোমার আত্মীয়স্বজন ভাই-বন্ধু সব মারা গেল, তুমি নিজেও তার ফল ভোগ করছ। কৃষ্ণের তর্জন-গর্জন শুনে দুর্যোধন যেন একটু থতমত খেয়ে গেলেন। তবু দাম্ভিকের যে আত্মতৃপ্তি হয়, সেই আত্মতৃপ্তিতে উচ্চারণ করলেন আপন সফলতার কথা— ধীরে ধীরে, তারিয়ে তারিয়ে। দুর্যোধন বললেন— বেদ অধ্যয়ন করেছি বিধিমত, দানধ্যানও করেছি প্রচুর, শত্রুর মাথায় পা দিয়ে নিজের হাতে শাসন করেছি এই সসাগরা পৃথিবী। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কে আছে? যে ভোগ সাধারণত দেবতারা ভোগ করে, সেই ভোগ সেই ঐশ্বর্য আমি চুটিয়ে ভোগ করেছি। সেদিক দিয়েও আমার মতো ভাগ্যবান কে আছে? আমি এখন আমার আত্মীয়-বন্ধু নিয়ে ক্ষত্রিয়ের প্রাপ্য জায়গা স্বর্গে যাচ্ছি, আর তোমরা সারা জীবন ধরে এই শূন্য পৃথিবী ভোগ করো।
দুর্যোধন এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপর স্বর্গের মন্দারমঞ্জরী ঝরে পড়ল। গন্ধর্বপুরুষেরা বাদ্যি বাজাল, স্বর্গের অপ্সরারা দুর্যোধনের যশোগান করল। সিদ্ধচারণেরা দুর্যোধনের প্রশস্তি করে বললেন— সাধু সাধু। আমরা যে কথা দিয়ে দুর্যোধনের চরিত্র-বিশ্লেষণ আরম্ভ করেছিলাম, সেই কথায় আমরা পুনরায় উপস্থিত।
সারা জীবন যে মানুষটাকে দুষ্টচেতা, পাপী, হাড় বদমাশ ভেবে এসেছেন পাণ্ডবেরা, তাঁরই মৃত্যুর পূর্বে স্বর্গের সমারোহ দেখে সমবেত পাণ্ডব-পাঞ্চালদের একটু লজ্জাই করতে লাগল। তাঁরা ভাবলেন— যাঁকে এতক্ষণ গালমন্দ করেছিলাম, তাঁর জন্য বোধহয় একটু বিলাপ-টিলাপই করা উচিত। বিশেষত ভীষ্ম, দ্রোণ— এঁদের কথা স্মরণ করে পাণ্ডবরা একটু শোক-কাতরই হয়ে পড়লেন। বেশ একটু চিন্তাও হল তাঁদের— যা করেছি, ঠিক করেছি তো? পাণ্ডবদের চিন্তাকুল দেখে কৃষ্ণ এবার বললেন— ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধনের মতো মহা-মহাবীরদের যে এত তাড়াতাড়ি তোমরা বধ করতে পারলে, তার কারণ আমাকে কিছু কিছু কুটিলতার আশ্রয় নিতেই হয়েছে। যদি ধর্মপথে চলে সোজাসুজি যুদ্ধ হত এবং আমি যদি ছলনার আশ্রয় না নিতাম, তা হলে কোথায় থাকত তোমাদের জয়লাভ, কোথায় রাজ্য আর কোথায় এই ধন সম্পত্তি— কুতো বো বিজয়ো ভূয়ঃ কুতো রাজ্যং কুতো ধনম্। এই যে দুর্যোধনকে দেখছ, ওর হাতে গদা থাকলে ওকে ন্যায়যুদ্ধে সোজাসুজি জয় করা অসম্ভব। তবে হ্যাঁ, যদি বল— তা হলে কি আমরা অন্যায় যুদ্ধ করে পাতকী হলাম— সে ক্ষেত্রে আমি বলব সেরকম কিছু হয়নি, কেন না স্বয়ং দেবতারাও অসুর মারতে গিয়ে কত ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন তার ঠিক নেই। তা ছাড়া, আমাদের আগে অনেকেই এ জিনিস করেছেন, বড় বড় মানুষেরাও তার অনুমোদনও করেছেন, অন্যেরাও সেই পথেই চলেন—
পূর্বৈরনুগতো মার্গো দেবৈরসুরঘাতিভিঃ।
সদ্ভিশ্চচানুগতঃ পন্থাঃ স সর্বৈরনুগম্যতে॥
সহৃদয় পাঠককুল! কৃষ্ণের এই শেষ যুক্তিটি একটু মাথায় রাখবেন। আমরা প্রথমদিকে প্রশ্ন তুলেছিলাম— দুর্যোধন এমন কী মানুষ যে তাঁর মাথাতেও স্বর্গের পুষ্পবৃষ্টি ঝরে পড়ে? আমরা বলেছিলাম— কবি হিসেবে ব্যাসের নিরপেক্ষতা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। মুগ্ধ হই এই কথা ভেবে যে, মহাকাব্যের নায়ক বা নায়কোচিত ব্যক্তিদের তিনি যেমন নানা বিপদ এবং অপমানের মধ্যে ফেলে প্রতিতুলনায় তাঁদের চরম জয়লাভ এবং শেষ সম্মানটুকু আরও ভাস্বর করে তুলেছেন, তেমনি তিনি তাঁর প্রতিনায়ককেও ভোলেননি। প্রায় সেই যুগেই স্বয়ং ভগবান বলে খ্যাত কৃষ্ণ বাসুদেবকে দিয়ে অর্থাৎ একেবারে ধর্মপ্রবক্তার মুখ দিয়ে আপন ছলনার স্বীকারোক্তি আদায় করিয়ে নিয়েছেন মহাভারতের কবি, অপি চ সেই মৃত্যুপথযাত্রীর মাথার ওপর স্বর্গের স্নিগ্ধ পুষ্পবর্ষণ করে তাঁকে দৈবমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
কিন্তু এ তো গেল কাব্যিক দৃষ্টিতে কবির বিচার। তার্কিকেরা এ সব কথা মানবেন কেন? তাঁরা বলবেন— এ তো বাপু কবির পাগলামি। সারা মহাভারত জুড়ে দুর্যোধনকে দাম্ভিক, পাজি, নচ্ছার, অসভ্য, শাসন মানে না— এত সব কথা বলে হঠাৎ তাঁর মরার সময় স্বর্গ থেকে ফুলটুল ফেলে সাধু সাজানো হচ্ছে। তাও কোন লোকটা? যে লোকটা নাকি মরার মুখেও লোকমুখে খবর পাঠিয়ে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাকে ডেকে এনেছে এবং নিজে পারছে না বলে কৃপাচার্যের মাধ্যমে তাঁকে আবার সেনাপতি নিযুক্ত করেছে— যদি পাণ্ডবদের ক্ষতি করা যায়। এ কেমন মানুষ, মরেও যার রাগ যায় না? তাঁর মাথায় আবার পুষ্পবৃষ্টি। তার্কিকেরা এইখানেই থামবেন না। তাঁরা বলবেন— দুর্যোধন কী রকম মানুষ— যে নাকি অশ্বত্থামার হাতে ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অসহায় ঘুমন্ত পাণ্ডব সন্তানদের মৃত্যুর খবর শুনে বিকৃত আনন্দে বলেছিল— গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম যা আমার জন্য করতে পারেননি, কর্ণ যা পারেনি, দ্রোণ যা পারেননি, আজ তুমি কৃপ আর কৃতবর্মার সহায়তায় আমার সেই কাজ করেছ, অশ্বত্থামা, আজ তুমি আমার সেই কাজ করে দিয়েছ— যত ত্বয়া কৃপভোজাভ্যাং সহিতেনাদ্য মে কৃতম্। আজ আমি নিজেকে দেবরাজ ইন্দ্রের মতো কৃতকৃত্য মনে করছি। এই কথা বলে দুর্যোধন অত্যন্ত খেলোয়াড়চিতভাবে অশ্বত্থামাদের বললেন— তোমাদের ভাল হোক— স্বস্তি প্রাপ্নুত ভদ্রং বঃ— আবার তোমাদের সঙ্গে স্বর্গে দেখা হবে। দুর্যোধন মারা গেলেন।
তা হলে দুর্যোধন কী রকম অসভ্য এবং দুর্জন, যিনি কুরু-পাণ্ডবদের সন্তানবীজ ভাইগুলির মৃত্যুর খবর শোনার জন্যই যেন মৃতকল্প হয়েও জীবন ধারণ করেছিলেন। শত্রুর ওপর কতখানি আক্রোশ এবং নির্মমতা থাকলে এই ব্যবহার সম্ভব! অথচ তাঁকেই আবার বীরোচিত পুষ্পবৃষ্টি এবং গীত-বাদিত্রের কবিকল্পে মহীয়ান করে তোলা হচ্ছে। এই আপাত বিরোধের কথা বাদ দিয়েও দুর্যোধন-চরিত্রের সরল নির্মমতা নিয়ে আমি প্রশ্ন করেছিলাম দার্শনিক-পণ্ডিত শ্ৰীঅনন্তলাল ঠাকুরকে। তা তিনি আমার বিশ্লেষণ এবং মর্মাহত ভাব উড়িয়ে দিয়ে বললেন— চরিত্রগত দিক দিয়ে দুর্যোধন ঠিক আছেন। আপনি দুর্যোধনকে বৈদিক যুগের আর্যধারার সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করবেন, তা হলেই দুর্যোধনের শঠতা, নির্মমতা এবং শাসনাতীত ব্যবহারের ব্যাখ্যা পাবেন। এই কথা শোনার পরে দেখলাম— সত্যিই তো বৈদিক যুগ থেকে মহাভারতের যুগ পর্যন্ত আর্য পুরুষদের যে ধারা আমাদের দেশে প্রবাহিত— সেটা বিশ্লেষণ করলে বেশ বোঝা যায় ভূমি, সম্পত্তি এবং রাজ্যের জন্য প্রাচীন আর্যরা যথেষ্ট লালায়িত ছিলেন। এই বাবদে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছল-জুয়াচুরি কিছুই তাঁদের করণীয় থেকে বাদ যেত না। স্ত্রীলোকের ব্যাপারেও তাঁদের অসংযম মাঝে মাঝেই প্রকট হয়ে উঠেছে। যাঁদের কাছে পশু-বিত্ত, উত্তম গৃহ এবং সন্তানই মঙ্গলজনক ধর্ম বলে পরিগণিত হত, তাঁরা যে এগুলির জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন— তাতে আশ্চর্য কী!
আমার কথা শুনে কেউ যদি আবার উলটো ব্যাখ্যা করে বলেন— আর্যরা জাতি হিসেবে তা হলে বর্বর ছিলেন, তা হলে আবার আমার বিপদ বাড়ে। এইজন্য বাড়ে যে, প্রথমত, দুর্যোধনের চরিত্র লিখতে গিয়ে সম্পূর্ণ আর্য পুরুষের চরিত্র এই স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, নির্মমতা, বর্বরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ছল— এগুলি অসভ্য এবং বর্বর জাতির কোনও বৈশিষ্ট্য নয়। আধুনিক কালে ইরাক অথবা আমেরিকা— এই দু’টির এক দিকে তাকালেই আমার কথা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইরাক অথবা আমেরিকা কেউই জাতিগতভাবে বর্বর নয়, কিন্তু নিজের একগুঁয়েমি এবং স্বার্থের ক্ষেত্রে দুই পক্ষই এক এক সময় কী রকম বর্বর হয়ে উঠেছেন, তা নিরপেক্ষ জনমাত্রেই বুঝতে পারবে।
অনন্তলাল ঠাকুর বলেছিলেন— আপনি যযাতিকে দেখুন, নহুষকে দেখুন— তা হলেই দুর্যোধনের ব্যাখ্যা পাবেন। যযাতি, নহুষ— এঁরা সব কুরু-ভরতবংশের বিখ্যাত রাজা। রাজ্য-সম্পত্তি বাড়ানো এবং রক্ষার জন্য এঁরা অন্যায়, অত্যাচার, লুণ্ঠন এবং পরস্ত্রীর প্রতি অবিচার কোনওটাই বাদ দেননি। অথচ রাজা হিসেবে তাঁদের কীর্তি স্বর্গীয় শ্রুতি লাভ করেছে। শ্রীঠাকুরের মুখে যযাতি-নহুষের প্রসঙ্গ শোনার পরেই দুর্যোধনের অন্তকালে কৃষ্ণের সেই সান্ত্বনা বাণীটি আমার কাছে বেশি অর্থবহ হয়ে উঠল। আমি পাঠককে সেই শ্লোকটি স্মরণে রাখতে বলেছিলাম। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের বলেছিলেন— দেবতা থেকে আরম্ভ করে অনেকেই ছলনা এবং অন্যায়ের সাহায্যে তাদের শত্রুশাতন করেছেন, সাধু-সজ্জনেরাও সেসব অনুমোদন করেছেন, এখানকার লোকেরাও সেই পথেই চলে— স সর্বৈরনুগম্যতে। খেয়াল রাখবেন— কথাটা বলা হয়েছিল যুদ্ধে পাণ্ডবদের অন্যায় এবং ছলনার প্রসঙ্গে। কৃষ্ণ দেবতা এবং মহান ক্ষত্রিয়দের অন্যায় যুদ্ধের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে পাণ্ডবদের ‘জাস্টিফাই’ করছিলেন এবং অন্যায় যুদ্ধের কারণে তাঁদের সাময়িক মনোবেদনা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা বলি— পূর্ব ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তে পাণ্ডবদের অন্যায়গুলি যৌক্তিকতা স্থাপন করে কৃষ্ণ নিশ্চয় উলটো দিক দিয়ে দুর্যোধনের ব্যবহারেও যৌক্তিকতা এনে দিয়েছেন। অর্থাৎ কিনা কপট পাশা, বনবাস, অন্যায় আক্রমণ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ— ইত্যাদি যে সব জঘন্য অন্যায় দুর্যোধন করেছেন— দেবতা এবং পূর্ব ব্যক্তিত্বদের অন্যায় ব্যবহারে অপি চ আধুনিকদের সেই পথ অনুসরণের মধ্যে দুর্যোধনের ব্যবহারেও এক ধরনের যৌক্তিকতা আসে। স্মরণ করে দেখবেন— যেখানে যেখানে দুর্যোধন পাণ্ডবদের অন্যায় যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলেছেন; সেখানে সেখানে পাণ্ডবরাও দুর্যোধনের পূর্বকৃত অন্যায়গুলি উল্লেখ করে নিজেদের সাফাই গেয়েছেন। এই অন্যায়ে অন্যায়ে কাটাকুটি খেলার কথাটাই কৃষ্ণ বলেছেন— পূর্বে দেবতা এবং রাজারাও এইরকম করেছেন— এখনকার লোকেরাও এই রকম করেন। পাণ্ডবপক্ষের সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং সন্তানগুলি যখন অশ্বত্থামার হাতে মারা গেলেন, তখন দুর্যোধন বলেছিলেন— আজ আমি নিজেকে দেবরাজ ইন্দ্রের মতো মনে করছি। ইন্দ্রের উল্লেখে কৃষ্ণ সমর্থিত দেবতাদের ব্যবহার এবং অপব্যবহারগুলি যেমন দুর্যোধনের ক্ষেত্রে সমর্থনযোগ্য হয়ে ওঠে, তেমনি অনন্তলাল ঠাকুরের বলা বৈদিক আর্যদের পূর্বতন ব্যবহারগুলিও দুর্যোধনের বিষয়ে যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। আপনারা লক্ষ করে দেখবেন— তেমন তেমন পণ্ডিত আছেন— যাঁরা ভারতবর্ষের শাস্ত্র-দর্শন এবং মহাকাব্যের ওপর সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও আর্যদের বর্বর বলেছেন— শব্দের সমাস করে বলেছেন আর্য-বর্বর— Aryan barbarians. ফরাসি পণ্ডিত রেইঁকোর্ত— আমার উচ্চারণে ভুল হতে পারে তাই পুরো নাম দিয়ে বলি— Amaury de Reincourt বলেছেন—
The tall, fair-skinned Aryan barbarians emerged with the broad plains of the Indus mounted on horses, clad in heavy coats mail (বর্মিনঃ) with weapons made of iron and military equipments which the refined men of Harappa obviously did not possess— proving perhaps for the first but certainly not the last time that barbarism and technical superiority are perfectly compatible. Looking down contemptuously upon the dark-skinned, flat-nosed. Dasyus, decadent discendants of those men who had created the Harappa Civilisation, the victorious Aryan tribes (Bharatas, Yadus, Anus, Druhyus, Purus, etc) gradually occupied large part of Hindustan as Goths, Visigoths, Lombards, Franks and Vandals were to over run the Roman empire two thousand years later. Indra, the great god of the Rg-veda, is first and foremost destroyer of “forts” (purandara), a wrecker of cities who “rends forts as age consumes a garment”. He is the barbaric god of loot, destruction and fire…
এর পরেও কি দুর্যোধনের জতুগৃহ-দাহ, বিরাটের গোধন হরণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং অন্যান্য বর্বরতা ব্যাখ্যা করতে আমাদের অসুবিধে হবে? আর্যচরিত্রের এই পরম্পরাগত ধারার নিরিখেই পুরু-ভরতবংশীয় দুর্যোধনের মাথায় স্বর্গের মন্দারমঞ্জরী ঝরে পড়েছিল, গন্ধর্ব পুরুষেরা বাদ্যি বাজিয়েছিল সেই কারণেই, স্বর্গসুন্দরী অপ্সরারা দুর্যোধনের সুসম্বন্ধ যশোগান করেছিল সেই কারণেই; কেন না পুষ্পবৃষ্টি হয় দেবতাদের জয়লাভে, আর্য রাজার জয়লাভে— যযাতি, নহুষ, রাবণ, রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণের জয়লাভে। নিজস্ব ক্ষেত্রে দুর্যোধনও তাই মহান, উদ্যমী এবং একভাবে স্বর্গের পুষ্পবৃষ্টির অধিকারী।