দুর্যোগের রাত

দুর্যোগের রাত

১৯৬২ সালের কথা।

আমার বয়স তখন একুশ বছর। রেলে চাকরি পেয়ে মেদিনীপুরে আছি।

তখন বৈশাখের শেষ। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছি সকলে। তার ওপর ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে কুলি-খালাসির কাজ। মেদিনীপুর শহরের প্রান্তে কাঁসাই নদীর তীরে বাঁধের ওপর আমাদের তাঁবু পড়েছে। ব্রিজে স্ক্র্যাপিং হচ্ছে তখন। সারাটা দিন রোদে কাজ করতে করতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছি। হঠাৎ বিকেলের দিকে আকাশ কালো করে একটা মেঘ এল।

আমাদের সঙ্গে ছিল গুণধর মেট। বলল, “ওরে বাবা! এ যে ঈশানে মেঘ, বৃষ্টি একটু হবেই।”

আমি বললাম, “হোক না! হলে তো বাঁচি। সারাটা দিন যা গেল, একটু যদি বৃষ্টি হয় তো স্বস্তি পাই।”

আমাদের সঙ্গে যারা কাজ করছিল কাজের শেষে তাদের অনেকেই যে যার বাড়ি চলে গেল।

রইল শুধু গুণধর ও গোষ্ঠদা।

গোষ্ঠদা কার্পেন্টার। ব্রিজের কাজ তো, রেলের স্লিপারের কাঠে বিধ করতে, কাঠ ছাঁট করতে কার্পেন্টার লাগে। সবসময়ই প্রয়োজন এদের। তা সেই গোষ্ঠদা ও গুণধর দু’জনেই বাজারের থলি হাতে চলে গেল বাজার করতে।

নদীর ধারে নির্জন স্থানে তাঁবুর মধ্যে রইলাম আমি একা। কিছুতেই থাকতে চাইনি আমি। কেননা একে দুর্যোগের পূর্বাভাস, তার ওপরে ওই ভয়ঙ্কর নির্জনতা। অথচ উপায়ও নেই। একজন অন্তত পাহারায় না থাকলে সর্বস্ব চুরি হয়ে যাবে। তাঁবু পাহারা দেওয়ার জন্য চৌকিদার একজন থাকে, তবে সে লোকটা আজ দু’দিন হল অনুপস্থিত।

চৌকিদারের নাম জগাইদা। বড় ভালমানুষ। বয়স হয়েছে। আমাকে বলে, “এসব কাজ তোমাদের নয়। এর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এ কাজ ছেড়ে কোনও অফিস টফিসে যাতে ঢুকতে পারো সেই ধান্দাই লাগাও দেখি।”

জগাইদা তো বলেই খালাস। কিন্তু অফিসের চাকরি আমাকে দেবে কে? তাই শুনেই যাই জগাইদার কথা। আর শতকষ্ট সহ্য করেও চাকরিটা বজায় রাখি। হাজার হলেও রেলের চাকরি তো!

যাই হোক, সবাই চলে গেলে আমি একা মনমরা হয়ে বসে রইলাম।

হঠাৎ আমার শরীরের ওপর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। বুঝলাম বৃষ্টি হচ্ছে কোথাও।

চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।

তবুও কোনওরকমে আলোটা জ্বাললাম।

হঠাৎ ঝড় উঠল। প্রথমে গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ। তারপরই কড়কড় করে বজ্রপাত। আলোর চাবুক একটা দিক থেকে দিগন্তে ছিটকে গেল।

আমার যেন ডাক ছেড়ে কান্না এল তখন। সত্যি বলতে কি, এই ভয়ঙ্কর নির্জনে আমার তখন ভূতের ভয় করতে লাগল খুব। যত রাগ হল আমার গুণধর ও গোষ্ঠদার ওপর। আমাকে এইভাবে একা রেখে ওদের চলে যাওয়াটা কি উচিত হল? আসলে বাজার করতে যাওয়াটা ওদের অছিলা। ওরা গেল নেশা করতে। বাজার হয়তো করবে। কিন্তু আজ তা না করলেও কোনও ক্ষতি ছিল না। এখন আমি একা এখানে কী করি? এই নির্জনে ভূতের ভয়, সাপের ভয়, সবকিছুই পেয়ে বসল আমাকে।

এই দুঃসময়ে মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলাম। এমনকী এও ঠিক করলাম, এই চাকরি আর নয়! কাল সকাল হলেই পালাব। গার্ডেনরিচের কর্তাদের বলব শালিমারে পোস্টিং দেন তো ভাল, না হলে ইস্তফা।

আমার এইসব চিন্তাভাবনার মধ্যেই দেখি না টর্চ হাতে কে যেন একজন দ্রুত আমার দিকে ধেয়ে আসছে। শুধু আসছে নয়, আমার নাম ধরেও ডাকছে। আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেই দেখি না জগাইদা।

জগাইদা রক্তচক্ষুতে বললেন, “শয়তান দুটো কোথায় রে?”

বললাম, “ওরা তো বাজারে গেছে।”

“বাজারে গেছে? এই নির্জনে তোকে একা রেখে? তার ওপর এই দুর্যোগ। আমি না থাকলেই দেখি ওদের সাহস বেড়ে যায় খুব।’

“কিন্তু জগাইদা! তুমি এই দু’দিন কোথায় ছিলে?”

“আর বলিস না ভাই। গিয়েছিলুম একটু মেয়ের বাড়ি। তা সে কী বিপদ—। যাক সে কথা। আমি যখন এসে গেছি তখন তোর আর কোনও চিন্তা নেই। কিন্তু এইখানে এক মুহূর্তও থাকিস না আর।”

“কেন জগাইদা? এই অন্ধকারে যাব কোথায় আমি?”

“চল, তোকে আমার পরিচিত একজনদের বাড়িতে রেখে আসি। এই পরিস্থিতিতে মাঠের মাঝখানে কি পড়ে থাকা যায়? তা ছাড়া আকাশের যা অবস্থা তাতে ঝড় এখনই উঠল বলে! একটু পরে তাঁবু টাঁবু কোথায় থাকবে তা কে জানে?”

বলার সঙ্গে-সঙ্গেই দারুণ একটা ঘূর্ণিঝড় হঠাৎই ধুলোবালি উড়িয়ে চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগল। তারপরই দেখি বাঁধের ওপর আমরা দু’জন। কিন্তু তাঁবু উধাও। এরপর নামল বৃষ্টি।

জগাইদা ভিজে-ভিজেই আমাকে নিয়ে এলেন এক গোয়ালার বাড়িতে।

এসে হাঁকডাক করতেই বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এল। জগাইদার বিশেষ পরিচিত এঁরা। জগাইদা বললেন, “আজ রাতটুকুর মতো এই ছেলেটাকে তোমাদের বাড়িতে একটু আশ্রয় দাও দিকিনি। ভদ্রলোকের ছেলে। ওইরকম ফাঁকা জায়গায় এই দুর্যোগে থাকতে পারে কখনও?”

আমি তো আশ্রয় পেলাম। কিন্তু জগাইদা?

বললাম, “জগাইদা, তুমি কোথায় যাবে? তাঁবুর তো চিহ্ন নেই। তার ওপর এইরকম ঘন ঘন বাজ পড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে। শিলাবৃষ্টিও হতে পারে।”

জগাইদা বললেন, “হোক। আমি যে চৌকিদার। এইটাই তো আমার ডিউটি ভায়া। না হলে রেলের অত দামি দামি যন্ত্রপাতি, একটু চোখের আড়াল হলে ওর একটিও অবশিষ্ট থাকবে না আর।”

“সে তো বুঝলাম। কিন্তু ওই দুর্যোগে তুমি থাকবে কী করে?”

“আমার জন্য চিন্তা করিস না। আমরা হচ্ছি জল-কাদার মানুষ। এসব আমাদের গা সওয়া।”

আমি সে রাতে ওই গোয়ালার বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে সত্যিই বেঁচে গেলাম। ওদের বাড়িতে পোস্তর তরকারি, মৌরলা মাছের টক আর পেটভরে ভাত খেয়ে আরামে শুলাম বটে কিন্তু জগাইদার চিন্তায় আমার ঘুম হল না। কেননা জগাইদা চলে যাওয়ার পর দুর্যোগ আরও প্রবল রূপ ধারণ করল। ঘন ঘন বাজ পড়ার শব্দে বুকের ভেতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল আমার।

ভোরবেলা সবে একটু ঘুমিয়ে পড়েছি এমন সময় গুণধর ও গোষ্ঠদার ডাকে ঘুম ভাঙল। দুর্যোগ কাটলেও অন্ধকার তখনও কাটেনি। একেবারেই নিশিভোর যাকে বলে।

গুণধর বলল, “শোন, আমরা স্টেশন ধারে যাচ্ছি জগাইদাকে দেখতে। তুই সকাল না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাক। বেলায় একবারে শ্মশানে চলে যাবি।” চমকে উঠলাম আমি, “সে কী! কেন?”

‘মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে জগাইদা সাপের কামড়ে মারা গেছে। একেবারে জাত কেউটেয় কেটেছে জগাইদাকে। বুঝলি, দারুণ বিষ তার।”

আমার সারা গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল।

ওদের কথা যদি সত্যিই হয় তা হলে কাল সন্ধেবেলা কে আমাকে এই বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল?

আমি সকাল হতেই গোয়ালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে আমাদের সেই কর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন সেখানে অনেক লোকজন। আমাদের কুলি-খালাসিরাও আছে।

সবাই বলল, “আমরা তোমার কথাই ভাবছিলাম গো। কী দুর্যোগই না গেল কাল।

তিন-তিনজন সহকর্মীকে হারালাম। জগাইদা তো মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সাপের কামড়ে মরল। গুণধর আর গোষ্ঠ মরল ফাঁকা মাঠে বজ্রাঘাতে।” “কখন?”

“কাল সন্ধেবেলা, নেশা করতে গিয়ে।”

আমার তো হাত-পা তখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

এমনও নাকি হয়? আমি আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে স্টেশনের পথ ধরলাম। সেই শেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *