দুর্ঘটনা – জরাসন্ধ

দুর্ঘটনা – জরাসন্ধ

এতদিন যেসব জেল-থেকে-ফেরা অচেনা পত্ৰলেখক ও লেখিকা আমাকে তাঁদের আত্মকাহিনী অশুনিয়েছেন, (যার কিছু কিছু আমি আমার পাঠক-দরবারে পেশ করেছি) তাঁদের দুটো দলে ফেলা যেতে পারে। এক—যাঁরা বলতে চেয়েছেন, তাঁরা নিরপরাধ, অর্থাৎ বিভ্রান্ত বিচারের বলি, দুই—যাঁরা প্রমাণিত অপরাধ স্বীকার করলেও তার পুরোপুরি দায়িত্ব মেনে নিতে চাননি, তার পিছনে দাঁড় করিয়েছেন হয় কোন সামাজিক অসাম্য কিংবা অত্যাচার, অবস্থার প্রতিকূলতা, নয় তো কোন অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন বা সাময়িক উত্তেজনা। আজ যে চিঠিখানা আমার ঝাঁপির তলা থেকে বের করলাম, তার লেখক এর কোন দলেই পড়েন না। তাঁকে জেলে যেতে হয়নি, অর্থাৎ গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হলেও আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেননি। কিন্তু তিনি যে অপরাধী, এই চিঠির মধ্যে সে কথা অকুণ্ঠ অবলীলায় কবুল করেছেন, নিজেকে কোথাও সমর্থন করবার চেষ্টা করেননি। একটি লোমহর্ষক ঘটনার এমন সহজ ও নিরুত্তাপ বর্ণনা দিয়ে গেছেন, যেন তিনি তার নায়ক নন, রিপোটার মাত্র।

বেশির ভাগ আসামীর মত আদালতের কাঠগড়ায় তিনিও নীরব ভূমিকা নিয়েছিলেন; ইংরেজের ফৌজদারী আইন যেটুকু পেলেই সন্তুষ্ট। অর্থাৎ, হাকিমের প্রশ্নের উত্তরে দুটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি নির্দোষ। তার দীর্ঘ দিন পরে এই স্বীকারোক্তির উদ্দেশ্য কী এবং তার শ্রোতার পদে আমাকে কেন বরণ করলেন, সে কথা বলতে গিয়ে আমার সম্বন্ধে যেসব মন্তব্য করেছেন, তার কোনটাই শ্রুতিমধুর নয়। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুটা প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি। তা না হলে তাঁর আসল বক্তব্যের মূল সূত্রটি ধরা যাবে না।

তিনি লিখছেন, ‘গোড়াতেই বলে রাখি, আপনার লেখার সাহিত্যিক গুণাগুণ সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার নেই। সাহিত্য আমি বুঝি না, তা নিয়ে মাথা ঘামাবারও প্রয়োজন বোধ করি না। আমার ইন্টারেস্ট আপনার বিষয়বস্তু,—ক্রিমিন্যাল মাইন্ড—আপনি যাকে কবিত্ব করে বলেছেন, ‘অপরাধী মানুষের মানস-লোক’! দুঃখের সঙ্গে বলছি, সেখানকার রহস্যোদঘাটন করতে গিয়ে আপনি দার্শনিক স্বচ্ছদৃষ্টির পরিচয় দিতে পারেননি, সাহিত্যিক ভাবালুতার আশ্রয় নিয়েছেন। তাই যত কয়েদী আপনি আমদানি করেছেন, কোনটাকেই ক্রিমিন্যাল বলে চেনা যাচ্ছে না, সবাই এক একটি রোমান্টিক হিরো বা হিরোইন।

‘খুনী মাত্রেই মহানুভব, ডাকাত মাত্রেই হৃদয়বান! আপনার ‘আয়রন-গেট’এর অন্তরালে একটাও আয়রন-হার্টেড অমানুষ খুঁজে পেলাম না, সব কটাই গোল্ডেন-হার্টেড অতিমানুষ। আপনার ভক্তেরা হয়তো বলবেন, কী আশ্চর্য লেখনী, যার স্পর্শে সব লোহা সোনা হয়ে গেছে! আমি ভাবছি, কী আশ্চর্য উপাদান আপনার হাতে ছিল! আপনি সেগুলোকে সত্যানুসন্ধানের কাজে না লাগিয়ে টিয়ারগ্যাস্-এর মত ব্যবহার করেছেন, যার ফলে আপনার ভাবপ্রবণ পাঠক-পাঠিকার চক্ষুযুগল থেকে প্রচুর অশুপতন ঘটেছে, আর কোন কাজ হয়নি। আমার মনে হয়, এটাই আপনার উদ্দেশ্য ছিল। তা না হলে, কেমন করে বিশ্বাস করি, এতদিন ধরে এত জেল ঘুরে এমন একটা অপরাধীও আপনি দেখতে পেলেন না, যার হৃদয় বলে কোন বস্তু নেই? হয়তো দেখেছিলেন, কিন্তু তার কথা বলতে চাননি, কিংবা যাদের কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে ঐ পদার্থটি আপনি বসিয়ে দিয়েছেন, যে যা নয়, তার উপর সেটি আরোপ করেছেন প্রকৃতকে বিকৃত করেছেন, সাহিত্যের স্বার্থে সত্যকে বিসর্জন দিয়েছেন।

‘কিংবা এও হতে পারে জেলে বসে আপনার চারদিকে যে লোকগুলোকে বিচরণ করতে দেখেছেন, তারা তাদের আসল চেহারাটা আপনাকে দেখতে দেয়নি। কেউ কেউ সামনে এসে মুখ খুললেও মুখোস খোলেনি। আপনি খোলস্‌কে আসল বলে ভুল করেছেন, খোসাকে মনে করেছেন শাঁস।

‘আজ আমি এমন একজনের কথা আপনাকে শোনাতে বসেছি, যার মুখে কোন মুখোস নেই, কোন খোলসের আড়ালেও যে নিজেকে ঢেকে রাখতে চায় না। জেলের ছাপ তার গায়ে লাগেনি। তার কারণ এ নয় যে সে নিরপরাধ। তার কারণ, তার অপরাধ প্রমাণিত হয়নি; আপনি তো জানেন, সেটা এমন কিছু নতুন বা আশ্চর্য নয়। আইন এবং তার প্রয়োগপদ্ধতি দুইই অতি বিচিত্র ব্যাপার। নিতান্ত নির্দোষ লোকও যেমন অনেক সময় তার জালে জড়িয়ে পড়ে, তেমনি বহু দোষী ব্যক্তিও কোন একটা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি যার কথা বলতে যাচ্ছি, সে এই দ্বিতীয় দলের।

‘ডিটেকটিভ গল্পের মত রহস্যের আবরণটা শেষ পর্যন্ত ঝুলিয়ে না রেখে শুরুতেই তুলে দেওয়া যাক। সে ব্যক্তিটি স্বয়ং আমি, আপনার এই দুর্মুখ পত্র-লেখক। কি, চমকে উঠলেন তো…?’

না, চমকাইনি। অজ্ঞাতসারে চোখ দুটো একবার শুধু চিঠির শীর্ষ ও তলদেশটা চকিতে ঘুরে এল। যা অনুমান করেছিলাম, তাই। নাম এবং ঠিকানা দুই-ই অনুপস্থিত।

এর পরে লেখক তাঁর দীর্ঘ কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। পুরোপুরি পুনরুক্তির লোভ ত্যাগ করছি—দুটো কারণে। এক নম্বর—তার মধ্যে বিকৃত মানব-মনের এমন সব বিস্ময়কর তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, যা আমি বিশ্বাস করলেও আমার পাঠকবৃন্দের কাছে নিতান্ত অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব বলে মনে হবে। দু নম্বর—প্রগাঢ় বীভৎস রসের এমন স্বচ্ছন্দ পরিবেশন কোন কোন কোমলহৃদয় পাঠক-পাঠিকার স্পর্শকাতর স্নায়ুদেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। অন্তত আমার প্রতি বিশেষ বন্ধুভাবাপন্ন কয়েকটি সাময়িক পত্র সেই অভিযোগ তুলে আসর গরম করবার চেষ্টা করবেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

কেবলমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে একথা বলছি না। এর নজির আছে, এবং আশা কার এই সুত্রে তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

ছ-সাত বছর আগেকার কথা। কোন সুপরিচিত সাহিত্যিক তখন অল-ইন্ডিয়া রেডিও’র কলকাতা কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সম্ভবত তাঁরই উদ্যোগে আমার রচনা থেকে সংগৃহীত কয়েকটি কাহিনীর নাট্যরূপ বেতারে পরিবেশন করবার প্রস্তাব এল। আমি সম্মতি দিলাম। শর্ত রইল, নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে। আমি মফস্বলে থাকার দরুন এ বিষয়ে খানিকটা অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। সে কথা এখানে বক্তব্য নয়।

যথাসময়ে ‘বেতার-জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে বিজ্ঞাপিত হল, পরপর ছ’টি নাটক অভিনীত হবে। তিনটি কি চারটি প্রচারিত হবার পর দীর্ঘকাল অনুষ্ঠানসূচীতে বাকী ক’টির কোন উল্লেখ না দেখে স্টেশন ডিরেক্টর মহাশয়কে লিখতে হল, ওগুলোর সম্বন্ধে কি স্থির করলেন, জানালে বাধিত হব, এবং এ বিষয়ে আমার কাছে যে ডজন খানেক অনুসন্ধান পত্র জড়ো হয়েছে, তাদেরও কৌতূহল নিবৃত্তির সুবিধা হবে। উত্তরে বলা হল, আপাতত আমার আর কোন কাহিনীর নাট্যরূপ প্রচার করা হবে না। বললাম, তাহলে সেই মত আর একটা বিজ্ঞপ্তি ‘বেতার-জগতে’ প্রকাশ করুন। ডিরেক্টর অফিস সংক্ষেপে জানালেন, ‘তার কোন প্রয়োজন দেখি না।’

মনে করলাম, দু-একটি নাটক এবং অভিনয় সম্বন্ধে আমি কিঞ্চিৎ বিরূপ মন্তব্য করেছি, এটা বোধ হয় তারই প্রতিক্রিয়া। আসল ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলাম বেশ কিছুদিন পরে।

যে মন্ত্রীবরের আদেশক্রমে আমাকে একদিন কলকাতার বৃহৎ জেল থেকে মফস্বলের ক্ষুদ্রতর জেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনি তখন গদিচ্যুত। তাঁর স্থলে যিনি নতুন অধিষ্ঠিত, তিনি হয়তো আমার সাহিত্যিক কার্যকলাপ তেমন বিপজ্জনক মনে করেননি। অতএব নির্বিবাদে রাজধানীতে ফিরে এসেছি এবং এমন একটি বিশিষ্ট জেলের কর্তৃত্বভার আমার হাতে দেওয়া হয়েছে, যেখানে গোড়া থেকে পুরোপুরি জেলগোষ্ঠিভূক্ত আমিই বোধ হয় প্রথম ভারতীয়। এই ক’বছরে সাহিত্যিক মহলে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সূত্রপাত হয়েছে, এবারে সেই সুযোগ আরও বিস্তৃত হল। তাঁদেরই কারও মুখে একদিন জানতে পারলাম, আকাশবাণীর নাট্যশালায় আমার কাহিনীর উপর্যুপরি অভিনয় জন দুই প্রবীণ সাহিত্যিককে অত্যন্ত বিচলিত করে তুলেছিল, এবং তাঁরাই অগ্রণী হয়ে কোন ইংরেজী দৈনিকপত্রে কয়েকখানা কড়া চিঠি প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল—এই সমস্ত বীভৎস ‘ক্রাইম-স্টোরি’ বহু সুকুমারমতি বেতার-শ্রোতার অন্তরে বিভীষিকার উদ্রেক করছে, তরুণ-তরুণীদের মনে পাপের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলে তাদের বিপথে চালিত করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং এদের প্রচার অবিলম্বে বন্ধ করা হোক।

স্থানীয় বেতার কর্তৃপক্ষ চিঠিগুলোকে বিশেষ আমল দেননি, কিন্তু দিল্লীর কর্তারা হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলেন। সম্ভবত সেখানে কিছুটা সরাসরি তদ্বিরাদি হয়ে থাকবে। কলকাতার অফিস নাকি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, কাহিনীগুলো ঠিক ‘ক্রাইম-স্টোরি’ নয়, যে গ্রন্থ থেকে তাদের সংগ্রহ করা হয়েছে, অল্পদিনেই সেটি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, এবং চিঠিগুলোতে যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই।

মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং এ কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হলেন না। আদেশ হল—অভিনয় বন্ধ কর।

বলা বাহুল্য, ইংরেজী দৈনিকে করেসপন্ডেন্ট বা পত্রদাতার যে নাম ছিল, সেটা কাল্পনিক।

এই কৌতুকাবহ তথ্যটি যিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন, আসল লেখকদের নামও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমি সে সম্বন্ধে নীরব রইলাম। উভয়েই সাহিত্যক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত, তবে যদ্দুর শুনেছি, পাঠকমহলে বর্তমানে তেমন সমাদৃত নন। যাক সে কথা।

আজ যে নির্লজ্জ এবং নিরাবরণ স্বীকারোক্তি আমার সামনে খোলা রয়েছে, তার কাছে সেদিনকার বেতারে প্রচারিত কাহিনীগুলো নিতান্তই দুগ্ধপোয্য। এর হুবহু চিত্রটা যদি প্রকাশ করি, আমার শির লক্ষ্য করে শুধু যে একদল সৎ সাহিত্যিক ও সম্পাদকের তীক্ষ্ণ লেখনী উদ্যত হবে, তাই নয়, পুলিশের বাণও নিক্ষিপ্ত হতে পারে। সুতরাং শুধু অংশবিশেষের উল্লেখ করছি; তাও অনেক ক্ষেত্রে আমার নিজের ভাষায় ‘কোটিং’ দিয়ে।

পত্ৰলেখক জানাচ্ছেন—আমার কাহিনীর প্রধান চরিত্র আমার স্ত্রী। ধরুন, তার নাম মন্দাকিনী। তাকে নিয়েই উদ্বোধন, তাকে দিয়েই উপসংহার। সুতরাং একেবারে বিয়ের রাত থেকে শুরু করা যাক। না, প্রেম-ট্রেমের ব্যাপার কিছু নেই। বিয়ের আগে আমি তাকে দেখিনি, এমন কি ছবি পর্যন্ত না। সম্বন্ধটা আমার বাবা এবং তার বাবা মিলে স্থির করেছিলেন, যেমন আগেকার দিনে হত, বিশেষ করে আমাদের মত পরিবারে। আমার ঠাকুরদার ছিল কতকগুলো পেটেন্ট ওষুধের ব্যবসা। তার সঙ্গে কয়েকটা বাজার-চলতি নামকরা ওষুধের এজেন্সি নিয়ে কারবারটাকে বেশ বাড়িয়ে তুলেছিলেন। তার মূলে কিছু গোপন রহস্য ছিল, আজকের দিনে যা সকলেই জেনে ফেলে দিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে চালাচ্ছে। অর্থাৎ, ওই সব ওষুধের খালি শিশি সংগ্রহ করে আমরা আমাদের নিজেদের তৈরি রসায়ন বা বটিকা ভরে দিতাম। তার জন্যে আমাদের একটা ছোটখাটো কারখানা ছিল। আমি তার দেখাশোনা করতাম। বিশেষ করে সেই উদ্দেশ্যেই বাবা আমাকে বি-এসসি পাশ করিয়েছিলেন। আমার যা কাজ, তাতে অতখানি বিদ্যার দরকার ছিল না। নানা রকমের জংলী গাছগাছড়া সংগ্রহ করে তার নির্যাস বের করা এবং প্রয়োজন মত রং-টং মেশানো—সেসব আমাদের কর্মীরাই করত। যে জিনিস তৈরি হল, তার গুণাগুণ নিয়ে আমরা কখনো মাথা ঘামাইনি। প্রথম প্রথম এ নিয়ে খানিকটা মন খুঁত-খুঁত করলেও অল্পদিনেই সেটা কাটিয়ে উঠেছিলাম।

এই পরিবারে এবং এই পরিবেশে মানুষ হয়ে রোমান্স বা পূর্বরাগের চর্চা করার মত সময় সুযোগ বা মনোবৃত্তি সব কিছুরই অভাব ছিল। সুতরাং বিয়েটাকে নিছক দৈহিক এবং সাংসারিক প্রয়োজন বলে ধরে নিয়ে লক্ষ্মীছেলের মত পিতৃ-আজ্ঞা পালন করেছিলাম।

আমার স্ত্রী যে পরিবারের মেয়ে, সেখানে স্ত্রী-শিক্ষার দৌড় ছিল গ্রাম্য পণ্ডিতের পাঠশালা পর্যন্ত। তারপর রান্নাবান্না এবং যাবতীয় গৃহকর্মে হাতেখড়ি, নানারকম ব্রত ও পূজানুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে ‘পতি পরম গুরু’ নামক বৃহৎ আদর্শে দীক্ষাদান। সে বিষয়ে যে কোন রকম ত্রুটি হয়নি, তার প্রমাণ বিয়ের রাতেই পাওয়া গেল।

আপনারা অর্থাৎ সাহিত্যিক নামক বাস্তবজ্ঞানহীন ভাবপ্রবণ ব্যক্তিরা বলে থাকেন, স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করবার আগে তার মনকে জয় করতে হয় ধীরে ধীরে ধৈর্যের সঙ্গে, মধুর কলাকৌশলের ভিতর দিয়ে তার নারীসুলভ লজ্জা সঙ্কোচময় জড়িমার ঘুম ভাঙিয়ে—ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তার কোনটাই করিনি। বাসর জাগতে যে মেয়েগুলো এসেছিল, তারা সরে যেতেই নিজের হাতে দরজা বন্ধ করে কোন রকম ভূমিকার পথে না গিয়ে সরাসরি তার উপর পুরুষের সনাতন অধিকার প্রয়োগ করেছিলাম। সেই উদগ্র লালসার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সে যে কিছুটা যন্ত্রণা বোধ করছিল, সেটা সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম (তখনো তার বয়স চৌদ্দ পূর্ণ হয়নি,), কিন্তু কথায় বা ব্যবহারে কিছুমাত্র আপত্তি প্রকাশ করেনি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকে তুচ্ছ করে স্বামীর ইচ্ছার কাছে নিজেকে একান্তভাবে বলি দেওয়া—এটাকেই সে ধর্ম বলে জেনেছিল, এবং নিঃশব্দে পালন করেছিল।

আমার দৈহিক দাহ মিটে যেতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরের দিকে যখন ঘুম ভাঙল, দেখি সে পাশে নেই। জ্যৈষ্ঠ মাস। ছোট শহর। বিদ্যুতের এলাকা নয়। অথচ বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। উপরের দিকে তাকাতেই কারণটা ধরা পড়ল। আমার শিয়রের কাছে বসে একটা হাতপাখা দিয়ে সে আমাকে বাতাস করছে। বোধ হয় সারারাত ধরেই চালিয়েছে। বেশ লাগল। তাই বলে মনটা যে স্নেহ ও কৃতজ্ঞতায়, আপনারা যাকে বলেন উদ্বেলিত হয়ে উঠল, তা নয়। স্ত্রীর কাছে যা আমার প্রাপ্য, তাই সে দিয়েছে। এই তো তার কাজ। তবু নেহাৎ কিছু একটা বলতে হয়, তাই বললাম, একি! তোমাকে হাওয়া করতে কে বলেছে?

মন্দাকিনী কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নোয়াল।

—তুমি বুঝি একটুও ঘুমোওনি?

মৃদু কণ্ঠে উত্তর এল, আপনার খুব ঘাম হচ্ছিল।

—তাই বলে সারারাত ধরে এত কষ্ট করে পাখা চালাতে হবে।

—এতে আমার কোন কষ্ট হয় না।

কষ্ট যে তার কোন কিছুতেই হয় না, সে প্রমাণ সে দীর্ঘ জীবন ধরে প্রতি মুহূর্তে দিয়ে গেছে। কষ্ট হয় না—এ কথাটা ঠিক নয়। মানুষের শরীর তো! আমার কথা হল, আমার জন্যে সব কষ্টই সে স্বচ্ছন্দে এবং হাসি মুখে সয়ে নিতে পারে, এবং তাই নিয়েছে। শুধু আমার জন্যে কেন, সমস্ত সংসারের জন্যে।

অনেকদিন আগেই আমার মা মারা গিয়েছিলেন। সুতরাং বাবার সেবা-শুশ্রূষা, যত্ন-আত্তির সব ভারও ছিল তার হাতে। কেউ বলে দেয়নি। স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে সে নিজেই তুলে নিয়েছিল। তার বদলে বাবার কাছ থেকেও যে বিশেষ কোন আদর স্নেহ কিংবা মিষ্টি ব্যবহার পেয়েছে, তা নয়। বরং কোথাও কোন ত্রুটি হলে তৎক্ষণাৎ সেটা তাকে কড়াভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমরা পিতা পুত্র দুজনেই ছিলাম ভোজনবিলাসী। রোজকার রান্নার ব্যাপারটা পদ ও পরিমাণ দুদিকেই বেশ ব্যাপক আকারে চালানো হত। কিন্তু ‘ঠাকুর’ রাখবার মত বিলাসকে আমরা কোনদিন প্রশ্রয় দিইনি। চাকর একটা ছিল, বাকী সব মন্দাকিনী। আমরা একসঙ্গে খেতে বসতাম এবং আশ মিটিয়ে খেতাম। সে অবিরাম যুগিয়ে যেত। তারপর কী থাকত, তা নিয়ে আমরা কখনো মাথা ঘামাইনি। মেয়েদের খাওয়া-পরার দিকে নজর দেওয়া ‘মেনীমুখো’ পুরুষের লক্ষণ। মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে ইচ্ছে হলেও কেমন যেন পৌরুষে বাধত। মনে হত, তাতে করে নিজেকে অনেকখানি নামিয়ে আনা হবে।

বাজার করার ভার ছিল বাবার হাতে। কিন্তু ভাল ভাল জিনিসের লোভ যতখানি, হাত ততটা দরাজ ছিল না। রসনার সঙ্গে পকেটের বিরোধ প্রায়ই লেগে থাকত, এবং তার জের গিয়ে পড়ত পুত্রবধুর উপর। বাজারে বেরোবার সময় রোজই একবার জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কি কি আনতে হবে, বৌমা?’ প্রশ্নটা অনাবশ্যক। ‘বৌমা’ তো গৃহিণী নয়, রাঁধুনী মাত্র। কোন্ কোন্ জিনিসের প্রয়োজন, স্থির করবার কর্তা তিনি নিজেই। মন্দাকিনী তা জানত। তাই মৃদু স্বরে শুধু জানাত, মাছ তরকারি আপনার যেটা পছন্দ হয়, আনবেন। মশলাপাতি, ঘি, তেল সব আছে।

ওসব জিনিস ফি মাসের গোড়াতেই পুরো মাসের মত সংগ্রহ করা হত। সে ফর্দ তিনি নিজে করতেন। মাঝে মাঝে ঘাটতি পড়ত। সেদিনই হত মুশকিল। ‘বৌমা’ হয়তো ঘিয়ের টিনটা হাতে করে সবে ভাঁড়ার থেকে বাইরে পা দিয়েছে, শ্বশুর অমনি গর্জে উঠতেন, ‘এই তো সেদিন ঘি নিয়ে এলাম, এরই মধ্যে শেষ করেছ?’

মন্দা জবাব দিত না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনো বলত না, ইদানীং পরপর ক’দিন রাত্রে রুটি পরটার বদলে লুচি হয়েছে বলেই ঘিটা যদ্দিন যাবার কথা ছিল, তা যায়নি।

মাঝে মাঝে বাবা আবার আমাকে মধ্যস্থ মেনে বসতেন। বৌয়ের সামনে ডাকিয়ে এনে বলতেন, তুমি কী বল? পুরো মাসের হিসেব মত জিনিস আনা হচ্ছে, আর পঁচিশ তারিখ না যেতেই বাড়ন্ত! এ রকম করলে চলবে কেমন করে?

আমি মুখে কোন জবাব দিতাম না বটে, কিন্তু জ্বলন্ত চোখে বৌয়ের দিকে তাকাতাম। চোখ না তুলেও সে নিশ্চয়ই দেখতে পেত। এই ‘অপব্যয়ে’র সব অপরাধ যে তারই, সে বিষয়ে পিতার সঙ্গে পুত্রের মতান্তর হতে পারে, সেটা তার ধারণার অতীত। সব অভিযোগ নিঃশব্দে মেনে নিয়ে কাজে গিয়ে লাগত। উনুনে হয়তো কিছু একটা বসিয়ে এসেছে, পুড়ে গেলে রক্ষা থাকবে না।

‘বন্ধু’ বলতে যা বোঝায়, তেমন কেউ আমার ছিল না। আপনার সাহিত্যিক ডায়াগনোসিস যদি এই হয়, যে তার কারণ, কারও সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠবার মত হৃদয় আমার মধ্যে নেই, আমি আপত্তি করব না। জীবনে আর যা কিছুর চর্চা করে থাকি না কেন, হৃদয়চর্চা কখনো করিনি। ব্যবসায়-সূত্রে কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। তার মধ্যে একজনের নাম ছিল রমণীমোহন (বলা বাহুল্য, আসল নামটা আলাদা)। তার প্রায় সবটুকু জুড়ে থাকত একটি বিশেষ রমণী, অর্থাৎ তার বৌ। তারই হাসি-কান্না, মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ, খেয়াল-খশির লম্বা ফিরিস্তি যখন শুনতাম, আমার মাঝে মাঝে মনে হত, কই, মন্দার মধ্যে তো এর কোনটাই কখনো দেখতে পাই না। রমণীমোহনের বৌয়ের মত সে কোনদিন ‘অকারণ পুলকে’ আমার গলা জড়িয়ে ধরেনি, অহেতুক অভিমানে ছলছল চোখে জানালার গরাদের পাশে বসে থাকেনি। সে ‘বিচিত্ররূপিণী’ নয়, তার একটি মাত্র রূপ। উদয়াস্ত মুখ বুজে কাজ করে, সংসারের প্রয়োজন মেটায় ; অস্তের পরেও তার কাজ থাকে, সেটা আমার প্রয়োজন মেটানো। তাও সে মুখ বুজেই করে।

আমাকে ভুল বুঝবেন না। সেজন্যে আমার কোন আফসোস ছিল না, কোন অভাবও কোনদিন বোধ করিনি। বরং মন্দা যে রমণীমোহনের বৌ-এর মত হাবভাব ছলা-কলার ধার ধারে না, কথায় কথায় বায়না ধরে না, কোন কিছু নিয়ে আবদার করে না, সেজন্যে আমি মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম।

একদিন সন্ধ্যার দিকে রমণীমোহন গম্ভীর মুখে আমার দোকানে ঢুকে বলল, চল, বেরোই।

—কোথায়?

—চল না? যেতে যেতে বলব।

আমি একটু চিন্তিত হয়েই ওর গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। রাস্তায় কোন কথা হল না। নিউ মার্কেটের সামনে গাড়ি রেখে যখন নেমে পড়ল, তখন তার মুখ ভার। বললাম, কী ব্যাপার, বল দিকিনি?

মার্কেটে ঢুকতে ঢুকতে তেমনি মুখেই বলল, একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি ভাই।

—কী ভুল করলে?

—কাল ছিল আমাদের বিয়ের অ্যানিভারসারি, ফিফ্‌থ, মানে পঞ্চবার্ষিক উৎসব। আমার ছাই কিছু মনে নেই। এদিকে কারখানায় স্ট্রাইক, মাথার ঠিক ছিল না। ফিরতেও রাত করে ফেলেছি। ঘরে ঢুকে বৌ-এর দিকে নজর পড়তেই মনে পড়ে গেল। একটা নেহাৎ আটপৌরে ময়লা কাপড় পরে হাঁড়িমুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে খালি হাতে ঢুকতে দেখে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল। সারারাত ঘরে আসেনি। অনেক সাধ্যসাধনা করেও পাশের ঘরের দোর খোলান গেল না। একটা বেশ ভালরকম প্রেজেন্ট নিয়ে না গেলে আজ আর বাড়িমুখো হবার উপায় নেই।

আমি এত জোরে হেসে উঠেছিলাম, আশেপাশের লোকগুলো নিশ্চয়ই মনে করে থাকবে, লোকটা হয় পাগল, নয় একেবারে গেঁয়ো অর্থাৎ কলকাতার মত সভ্য শহরে থাকবার যোগ্য নয়। কি করব, বলুন। ব্যাপারটাকে নিছক হাস্যকর ন্যাকামি ছাড়া আমি আর কোন ভাবে দেখতে পারিনি। আপনি হয়তো আপনার সাহিত্যিক দৃষ্টি দিয়ে এর মধ্যে একটা সম্রাট সাজাহান-সুলভ গভীর প্রেম আবিষ্কার করে বসবেন। আমার সে দৃষ্টি নেই। তাছাড়া, আমার জীবনে এরকম দূরে থাক, এর কাছাকাছি কোন অভিজ্ঞতাও কোনদিন ঘটেনি এবং ঘটতে পারত না। বিয়ের অ্যানিভারসারি উদ্‌যাপন পড়ে মরুক, তার তারিখটাও মনে করে রাখিনি। আমার বিশ্বাস, আমার স্ত্রীও রাখেনি।

রমণীমোহন সেদিন একটা কাণ্ড করে বসল। একগাদা বেনারসীর ভিতর থেকে অনেক বাছাবাছির পর (তার মধ্যে আমাকেও দু-একটা ‘হ্যাঁ ‘না’ বলতে হয়েছে) দুখানা শাড়ি পছন্দ করল। একটা ভীষণ জমকালো, আর একটা ওরই মধ্যে একটু যাকে বলে ‘সোবার’—সেখানা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, এটা তুমি নাও।

আমি! —রীতিমত চমকে উঠলাম।

—আহা, ভয় পাবার কি আছে? ঘরে বৌ থাকলে মাঝে মাঝে দু-একটা বাড়তি খরচ করতে হয়। এমন কিছু দামও নয়। সঙ্গে টাকা না থাকলে আমি চালিয়ে দিচ্ছি। যখন সুবিধে হবে, দিও।

—বৌ-এর শাড়ি কেনা আমার কাজ নয়, ওটা বাবার ডিপার্টমেন্ট। তাছাড়া এরকম দামী শাড়ি সে কখনো পরে না।

—দাও না বলেই পরে না। একদিন দিয়েই দেখ ; কত খুশি হবে।

ততক্ষণে বিল এসে গেছে এবং পুরো টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি বিরক্তির সুরে বললাম, কী যে কর তার ঠিক নেই। কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে একটা শাড়ি নিয়ে গিয়ে উঠব কী বলে? পুজো-টুজোর সময় হলেও না হয়—

—বৌকে প্রেজেন্ট দেবার আবার সময়-অসময় আছে নাকি? নাও।

কাগজের বাক্সটা জোর করে আমার হাতে গুঁজে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠল, চল, চল, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে জুয়েলারীর দোকানটাও একবার ঘুরে যেতে হবে।

বাক্সটা লুকিয়ে নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম এবং লুকিয়ে রেখে দিলাম। তখন বাবা বাড়ি ছিলেন, মন্দাও রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। রাত্রে যখন শুতে এল, কাপড়খানা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, দেখ তো কেমন হল?

এখানে একটা গোপন কথা স্বীকার করছি, যদিও জানি, আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে দ্বিধা করবেন। কিন্তু সত্যি বলছি, শাড়িটা দেবার পর মন্দার মুখে খুশির ঝলক না হলেও অন্তত একটা আভাস দেখতে পাব, এই রকম একটু আশা মনের মধ্যে ছিল। কিন্তু তার বদলে দেখলাম জিজ্ঞাসা। পরে ভেবে দেখেছিলাম, সেইটাই স্বাভাবিক। বস্ত্র নামক বস্তুটিকে খাদ্যের মত নিতান্ত দৈহিক প্রয়োজন হিসেবেই সে দেখে এসেছে। সেটা যে কখনো ‘উপহার’-এর মত অনাবশ্যক রূপ নিতে পারে, সে অভিজ্ঞতা তার ছিল না। কাজেই তার মুখ থেকে যে কথাটি বেরিয়ে এল, সেটি একটি সরল প্রশ্ন, এটা কার?

—কার আবার? তোমার।

—আমার!—এটা নিছক বিস্ময়। আমার তো শাড়ি রয়েছে।

—থাকলই বা। এটা তোলা হিসেবে রইল। কোথাও যেতে আসতে পরবে।

—বাবা জানেন?

আমার পৌরুষে কিঞ্চিৎ আঘাত লাগল, যদিও লাগা উচিত নয়। উম্মার সুরে বললাম, সব কিছুই যে বাবাকে জানাতে হবে, তার কি মানে আছে?

—উনি শুনলে রাগ করবেন।

কথাটা মিথ্যা নয়। তাই আমার মুখে তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর যোগাল না। মন্দা মুহূর্তকাল কি ভেবে নিয়ে বলল, দোকানে ফেরত দিতে গেলে নেবে না?

আমি কিছু বলবার আগেই হঠাৎ যেন সব সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে গেছে, এমনিভাবে বলে উঠল, ভালই হয়েছে, ৭ই বীণার বিয়ে। আজই সকালে চিঠি এসে গেছে। একটা শাড়ি তো দিতে হত। এটা দিলেই হবে।

বলে, বেশ খুশি হয়েই মন্দা কাপড়খানা বাক্সে ভরে আলমারিতে তুলে রাখল। এই ‘খুশি’ই কি আমি দেখতে চেয়েছিলাম?

বীণা আমার পিসিমার মেয়ে। কাপড় দেখে বাবা যথারীতি মন্দার উপরই এক হাত নিতে ছাড়লেন না, যেন সে-ই আমাকে দিয়ে এমন একটা দামী শাড়ি আনিয়েছে। মেয়েমানুষকে তো রোজগারের ধান্দায় বেরোতে হয় না, পয়সার দাম বুঝবে কোথেকে—ইত্যাদি মন্তব্য তার মত আমিও নীরবে গ্রহণ করলাম। বললাম না যে, এর ভিতরে ওর কোন হাত নেই। কেন বলতে যাব? আপনি হয়তো বলবেন, মন্দার এই স্বার্থত্যাগের জন্যে তার উপর আমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত ছিল, অন্তত কিছুটা সহানুভূতি সে দাবি করতে পারত। কিন্তু তার এই প্রত্যাখ্যান তাকে আমার কাছে বড় করা দূরে থাক, আরও ছোট করে দিল। ‘প্রত্যাখ্যান’ কথাটা বোধ হয় ঠিক হল না। তার মধ্যে একটা জোর থাকে, যা ওর চরিত্রে একেবারেই ছিল না। একে বলা যেতে পারে, গ্রহণ করার অক্ষমতা। মন্দাকে যদি আমি ভালভাবে না জানতাম, হয়তো তার উপরে রাগ হত, এই ভেবে যে, সে আমার স্বামীত্বের অধিকারকে অগ্রাহ্য করছে, আমাদের ভিতরকার যে-সম্পর্কটা—প্রভু ও দাসীর সম্পর্ক—সেই বিয়ের রাত থেকে মেনে আসছিল, তাকে যেন অস্বীকার করছে। কিন্তু মন্দাকিনীকে আমার চিনতে বাকী নেই ; একথা তার সম্বন্ধে ভাবাই যায় না। এটা আর কিছু নয়, স্ত্রী হিসেবে তার নিছক অযোগ্যতা। কে জানে, রমণীমোহনের মাথার ভূতটা হয়তো কোন দুর্বল মুহূর্তে আমার মাথায় চেপে থাকবে। মনে মনে তার বৌয়ের পাশে আমার বৌকে কখন বসিয়ে ফেলেছিলাম। ধাক্কা খেয়ে ভুল ভাঙল। হয়তো ওই কল্পিত তুলনার ফলেই ও আমার কাছে আরও খেলো হয়ে গেল ; স্ত্রীকে শ্রদ্ধা বা প্রীতির চোখে আমি কোনদিন দেখিনি। এই ঘটনার পর থেকে তাকে রীতিমত ঘৃণা করতে শুরু করলাম।

আপনার অনুচ্চারিত বিশেষণটা আমি শুনতে পাচ্ছি। বলছেন, লোকটা কি পাষণ্ড! কি বলব, বলুন। আমি যা তাই। আপনি কী ভাববেন, তাই ভেবে মনের আসল রূপটা চাপা দিতে চাই না। তাহলে এই চিঠি লেখার কী প্রয়োজন ছিল?

তবে আপনার তূণে যে-সব কড়া কড়া বিশেষণ আছে, সবগুলো যেন এখনই নিঃশেষ করে বসবেন না। তাদের আসল প্রয়োজন দেখা দেবে শেষ অঙ্কে। অনাবশ্যক ভূমিকা না বাড়িয়ে এবার সেই দিকেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।

আমার এবং আমাদের সংসারের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে মন্দাকিনী কোথাও কোন ত্রুটি রাখেনি। ফাঁক ছিল শুধু এক জায়গায়। আমাদের একটি বংশধর সে দিতে পারেনি। বন্ধ্যা হলে হয়তো বা মার্জনা পেতে পারত। কিন্তু তার অপরাধ তার চেয়েও গুরুতর। সন্তান সে ধারণ করেছিল, জীবিতাবস্থায় পৃথিবীতে আনতে পারেনি। মাস পূর্ণ হবার আগেই কি সব জটিলতা দেখা দেয়, যার ফলে হাসপাতালে না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। ডাক্তারেরা এসব ক্ষেত্রে যা করে থাকেন, তাই করলেন। অর্থাৎ, ওঁদের ভাষায়, ফলের আশা ছেড়ে দিয়ে গাছের দিকেই পুরো নজর দিলেন। অনেক ধাক্কা ও ধকল খেয়ে ‘গাছ’ শেষ পর্যন্ত টিকে রইল বটে কিন্তু জানা গেল, সে চিরদিনের তরে নিস্ফলা হয়ে গেছে।

মোটা টাকা বেরিয়ে যাওয়ায় বাবার মেজাজ আগে থেকেই তেতে ছিল, তার উপরে ডাক্তার এসে যখন এই শুভ সংবাদটি শুনিয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আগুন হয়ে উঠলেন। আমার উপর হুকুম হল, ‘আবার বিয়ে কর।’ আমার বিশেষ আপত্তি ছিল না। মন্দাকে দিয়ে সত্যিই আর কাজ চলছিল না, কিন্তু রমণীমোহন অজান্তে কখন আমার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার ঘরে যে চীজটি আছে, সেই রকম কিংবা তার কাছাকাছি কেউ এসে যদি ঘাড়ে চাপে, তখন কি করব। বাবা এদিকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যেতে লাগলেন। বৌ তাঁকে একটি পৌত্র-মুখ দর্শনে বঞ্চিত করেছে, এইটাই তাঁর একমাত্র কারণ নয়, সংসারের চাকাগুলোকেও সে আর আগের মত স্বচ্ছন্দ গতিতে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না, তাঁর সেবা-যত্ন আরাম-বিরামের ব্যবস্থায় মাঝে মাঝে ত্রুটি দেখা দিচ্ছে এবং সে-সব পূরণ করতে একটি বাড়তি ঝি-এর প্রয়োজন হয়েছে।

যাই হোক, বেশি দিন আর তাঁকে এই অসুবিধাগুলো ভোগ করতে হল না। ইদানীং যাকে তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারছিলেন না, সেই পুত্রবধুর কোলে মাথা রেখেই হঠাৎ একদিন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

গোটা ব্যবসাটা আমার হাতে এসে পড়ল। সেই দিকেই বেশি নজর দিলাম। মন্দা ফালতু ঝিকে ছাড়িয়ে দিয়ে গোটা সংসারের ভার আবার নিজের হাতে তুলে নিল। আমার চিরাচরিত অভ্যাস এবং প্রয়োজনগুলো কোথাও বিশেষ বাধা পেল না। সে বিষয়ে তার দৈহিক অক্ষমতা যতই থাক, অতিরিক্ত উৎসাহ দিয়ে তাকে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করছে, সেটুকু বুঝতে কোন অসুবিধা ছিল না। সেটা লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে উঠতাম।

—এতদিন হাসপাতালে কাটিয়ে এলে, ডাক্তারে ওষুধে এক ঝুড়ি টাকা বেরিয়ে গেল। এদিকে চেহারায় তো তার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। কী হয়েছে, খুলে বলবে তো?

—হবে আবার কী? মুখে একটা মৃদু হাসি টেনে আনবার চেষ্টা করত মন্দা। তাতে তাকে আরও কুৎসিত দেখাত, —আমি তো ভালই আছি।

—তবে শরীর সারছে না কেন?

—আর কত সারবে? এর চেয়ে মোটা তো আমি কোন কালেই ছিলাম না। —বলে কোন একটা কাজের অছিলা করে এখনই আমার সামনে থেকে সরে যেত।

মন্দার এক ভগ্নীপতি থাকতেন পশ্চিমের কোন স্বাস্থ্যকর শহরে। নামটা আপনার পক্ষে নিষ্প্রয়োজন, সুতরাং উহ্য রইল। কলকাতায় বড় একটা আসতেন না। একবার কী কাজে আসতে হল। যাবার আগে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শ্যালিকা এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মন্দা হাসিমুখে বলল, চিনতে পারছেন না?

—পেরেছি ; তবে অতি কষ্টে। একী চেহারা হয়েছে তোমার?

আমি বাড়িতেই ছিলাম। শ্যালিকা সম্বন্ধে তাঁর উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে গত কয়েক মাসের একটা মোটামুটি ইতিহাস দিলাম। বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে আমাদের তরফ থেকে চিকিৎসাদির যথাসাধ্য ব্যবস্থার কোন ত্রুটি হয়নি এবং তা সত্ত্বেও মন্দার স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি দেখা যাচ্ছে না—এই কথাটাই বোঝাবার চেষ্টা করলাম। আমার ভায়রাভাই বললেন, তার মানে একটা চেঞ্জ দরকার। তাহলে এক কাজ করা যাক। আমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। জলহাওয়ার দিক দিয়ে জায়গাটা খুব ভাল। মাসখানেক থাকলেই সেরে উঠবে। না হয়, আরও কিছুদিন কাটিয়ে আসবে। অনেকদিন দেখাশুনো নেই, ওর দিদিও খুব খুশি হবে। তাই করি, কী বল?

আমি বললাম, বেশ তো, আপনি নিয়ে যাবেন, তাতে আর আমার বলবার কী আছে?

সেই সময়ে মন্দা এল চা এবং খাবার নিয়ে। তিনি খুশি মুখে তাঁর প্রস্তাব এবং আমার সম্মতি তাকে জানিয়ে দিয়ে বললেন, কাল সন্ধ্যা সাতটায় গাড়ি। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি সেরে আমি সাড়ে পাঁচটার আগে আসতে পারব না। তুমি একেবারে তৈরি হয়ে থাকবে কিন্তু। ‘আপনি একটু বসুন, আমি চুল বেঁধে আসি, তা বললে চলবে না। বাঁধা-ছাঁধা সব আগেই সেরে রাখবে।

মন্দ চুপ করে রইল এবং ভগ্নীপতি চলে যেতেই বলল, কাল যখন আসবেন, তুমি ওঁকে বুঝিয়ে বলো, আমার এখন যাওয়া হবে না।

—কেন?

কাপডিশগুলো গোছাতে গোছাতে বলল, সংসারে আর কোন লোক নেই, তোমাকে দেখবে কে? তাছাড়া—

‘তাছাড়া’র ফিরিস্তি শোনবার আগেই আমি শ্লেষের সুরে ঝাঁজিয়ে উঠলাম, এই শরীর নিয়ে যা দেখা দেখছ, সেটা কিছুদিন বন্ধ রাখলে কোন ক্ষতি হবে না। তার চেয়ে বরং নিজেকে দেখবার চেষ্টা কর। এই পোড়া-কাঠের ওপরে যদি একটু মাংস লাগাতে পার, তাহলেই আমি কৃতার্থ হব।

এর পরেও বোধ হয় সে এখানকার ব্যবস্থার কথা তুলত। সবরকম অপমান এবং রূঢ় ব্যবহার সহ্য করবার এক অদ্ভুত শক্তি ছিল তার। ‘শক্তি’ না বলে তার অভাব বলাই বোধ হয় ঠিক। এক ধরনের অসাড়তা। যাই হোক, তখনকার মত আর কিছু বলবার সুযোগ আর তাকে দিলাম না। সশব্দে চেয়ারটা পিছনে ঠেলে দিয়ে উঠে পড়লাম।

হাসপাতাল থেকে ফিরবার কিছুদিন পরে যে ঠাকুরকে সে ছাড়িয়ে দিয়েছিল, তাকেই কোত্থেকে খুঁজে পেতে ডেকে এনে নানারকম উপদেশ দিয়ে পরদিন সন্ধ্যার মুখে মন্দাকিনী এই প্রথম আমাকে ছেড়ে দূরে চলে গেল। যাবার আগে যথারীতি প্রণাম, সাবধানে থাকবার এবং অসুবিধা বোধ করলেই ফিরিয়ে আনবার অনুরোধ ইত্যাদি কোন পর্বই বাদ যায়নি। চোখের জলও দেখেছিলাম। কিন্তু কিছুই আমার মনে এতটুকু স্নেহ বা করুণা জাগাতে পারেনি। নিজের চোখ দুটো অবশ্য দেখতে পাইনি। তবু নিশ্চয় করে বলতে পারি, তার মধ্যে তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু ছিল না।

আজ ভাবছি, সেদিন তার চোখে জলের বদলে এক কণা আগুন যদি দেখতাম, হয়তো কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধা সে আমার কাছে পেলেও পেতে পারত, অন্তত এতটা হেয় এবং তুচ্ছ হয়ে যেত না। আপনি কী বলেন?

যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই। মাসখানেক যেতে না যেতেই মন্দার চিঠি পেলাম, সে এরই মধ্যে অনেকখানি সেরে উঠেছে, আর ওখানে পড়ে থাকবার দরকার নেই, সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন তাকে বাড়ি আনবার ব্যবস্থা করি।

শ্যালিকার যে চিঠি পেলাম, তার বয়ান ঠিক উল্টো। মন্দার শরীরের কোন উন্নতি হয়নি। বেশ কিছুদিন ওখানে থাকা দরকার। কিন্তু আমাকে এখানে একা ফেলে সে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সুতরাং আমি যেন এদিকের কাজকর্মের কোন একটা ব্যবস্থা করে অন্তত মাসখানেকের জন্যে ওখানে গিয়ে থাকি। ‘তাহলে আমরা সকলেই খুব আনন্দিত হইব। অনেকদিন তোমাকে দেখি নাই। তোমার দাদা তবু কালে ভদ্ৰে কলিকাতায় যাইতে পারেন। আমার কোথাও নড়িবার উপায় নাই।’ ইত্যাদি।

আমাদের কারবারের কথা আগেই বলেছি। তার মধ্যে কারচুপির অংশটাই বড়। কালক্রমে এইসব লাইনে আরও কিছু লোক এসে জুটল। শুধু প্রতিযোগীর সংখ্যাই যে বাড়ল, তাই নয়, তার মধ্যে কয়েকজন রীতিমত পেছনে লাগল। বাবা পাকা লোক, এদের সঙ্গে খানিকটা এঁটে উঠতে পারতেন। তিনি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে উঠল। ক্রমশ নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম। শ্যালিকার নিমন্ত্রণ যখন এল, তখন আমারও এক পা নড়বার উপায় নেই। মন্দার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হচ্ছে না—এ খবর পেয়ে দুশ্চিন্তার বদলে বিরক্তিটাই বেড়ে গেল। এটা যেন তার ভাল না হবার পণ, এখানকার শত্রুদের মত এই দুঃসময়ে সেও আমার পিছনে লেগেছে। তার উপরে তার ওই প্যানপেনে ‘পতিবিরহ’ অসহ্য আদিখ্যেতা বলে মনে হল। শ্যালিকার চিঠির উত্তরে অবশ্য তাঁর ভগিনীর জন্যে যথারীতি উদ্বেগ প্রকাশের ত্রুটি হল না। সেই সঙ্গে তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণে অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চাইলাম। রীতিমত সুস্থ হবার আগে ফিরে আসার কোন কথাই উঠতে পারে না এবং আমার জন্যে তার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।

এর পরে রমণীমোহনের স্ত্রী বা তার দোসর কোন মেয়ে হয়তো লিখত, না, আমি এখনই যেতে চাই, কিংবা ওই ধরনের একটা কিছু। কিন্তু আমার স্ত্রী একেবারে অন্য জাতের। সে কোন কথাই লিখল না, অর্থাৎ স্বামীর ইচ্ছাকেই নিঃশব্দে মেনে নিল।

যদি বলি, মেনে না নিলেই আমি মনে মনে খুশি হতাম এবং স্পষ্ট বা জোরাল না হলেও আমার চিঠির একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ আশা করে বসেছিলাম, আপনি বিশ্বাস করবেন কি? করবেন না। কিন্তু এটুকু জেনে রাখুন, সে আশা যখন পূরণ হল না, আমার মনটা তার উপরে শুধু তিক্ত নয়, বিষাক্ত হয়ে উঠল।

মন্দার আর কোন চিঠি আমি পাইনি, তার দিদিরও না। পরের চিঠিটা এল তার ভগ্নীপতির কাছ থেকে। বেশ কিছুদিন, তা প্রায় মাস দুই পরে। প্রথমে আমার কুশল সম্বন্ধে আশা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘বড়ই দুঃখের বিষয়, শ্রীমতী মন্দাকিনীর শরীর দিন দিন খারাপের দিকে যাইতেছে। বর্তমানে সে প্রায় শয্যাগত। এখানকার সর্বাপেক্ষা বড় ডাক্তারকে দেখাইয়াছি। তাঁহার মতে শ্রীমতীকে অবিলম্বে কলিকাতায় লইয়া গিয়া কোন বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীনে রাখা প্রয়োজন। এখানে একটি বিশেষ জরুরী কার্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছি। শীঘ্র ছাড়া পাইবার আশা নাই। নতুবা আমিই লইয়া যাইতাম। তুমি অতি সত্বর চলিয়া আসিবে। অন্যথা করিও না। অন্য সকলে একপ্রকার আছে। ইতি।’

অতি সত্বর না হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই আমাকে যেতে হল। দেখলাম, ‘শয্যাগত’ শব্দটিকে আমার ভায়রাভাই যে ‘প্রায়’ নামক বিশেষণ দিয়ে মডিফাই অর্থাৎ মোলায়েম করবার চেষ্টা করেছেন, সেটা প্রকৃত ঘটনার দিকে চেয়ে নয়, আমার দিকে চেয়ে, আমি পাছে অতিরিক্ত বিচলিত হয়ে পড়ি, এই আশঙ্কায়।

মন্দার অবস্থা দেখে, তার ব্যাধির ইতিহাস এবং কাশির শব্দ শুনে আমি সত্যিই বিচলিত হয়ে পড়লাম। বলা বাহুল্য, ওঁদের বা অন্য দশজনের মনে যে কারণ জাগবে, সে কারণে নয়। একে এই ‘শয্যা’ থেকে টেনে তুলে দাঁড় করাতে যে বিপুল অর্থ, পরিশ্রম, শুশ্রূষা এবং সময়ের অপব্যয় হবে, সেই চিন্তাই আমাকে চঞ্চল করে তুলল। তার চেয়েও বেশি মনে হল—একে নিয়ে আমি করব কী।

আশা করি, আমার কথাটা আপনি বুঝতে পারছেন। আপনার গল্পের নায়কদের মত আমার মধ্যে কোন রোমান্স নেই, বা কোনদিন হৃদয়চর্চার ধার ধারি না, সে কথা আগেই জানিয়েছি। আমি রমণীমোহন নই, ‘প্রেম’-জ্বরে কখনো ভুগিনি। দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রীতি এসব বড় একটা নিজেও পাইনি, অন্য কারও জন্যেও অনুভব করি না। নিছক ‘ইউটিলিটি’ বা প্রয়োজন ছাড়া ‘স্ত্রী’ নামক মানুষটিকে আর কোন দিক থেকে দেখিনি। সেও কোনদিন বুঝতে দেয়নি, এর বাইরে তার আর কোন অস্তিত্ব আছে। সেই ইউটিলিটির কষ্টিপাথরে তার দাম অনেক দিন থেকেই কমে আসছিল। আজ যখন সেটা শূন্যে এসে ঠেকল, তখন একটি মাত্র প্রশ্নই আমার মনের মধ্যে মাথা তুলে উঠল—একে নিয়ে আমি করব কী? আমার জীবনে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সেইখানেই শেষ নয়। তারপরেও সে থাকবে—কে জানে কত বছর—আমার বা আমার সংসারের ভার নিয়ে নয়, আমার জীবনের দুর্বহ ভার হয়ে। অথচ—

ফার্স্ট ক্লাসের একটা ‘কুপে’ আমাদের জন্যে রিজার্ভ করা হল। ভাড়াটা অবশ্য আমিই দিলাম, কিন্তু ব্যবস্থাটা আমার ভায়রাভাইয়ের। অনেকটা পথ ; সঙ্গে ওই রকম রুগী, তার ওপর মেয়েছেলে। তৃতীয় যাত্রীর ঝঞ্ঝাট রইল না, নির্বিবাদে যাওয়া যাবে।

স্ট্রেচার লাগল না। দিদি আর ভগ্নীপতি দুজনে দুবাহু ধরে ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মটুকু পার করিয়ে মন্দাকে গাড়িতে তুলে দিলেন। বিছানা করে, ওকে শুইয়ে, ঘণ্টা পড়তে নেমে গেলেন। গাড়ি যখন চলতে শুরু করেছে, আমার শ্যালিকার অনুচ্চ কণ্ঠ থেকে শোনা গেল, ‘দুর্গা দুর্গা’। ভায়রাভাই চেঁচিয়ে বললেন, পৌঁছেই একটা তার করে দিও।

গরম কাল। রাত ন’টা। জামাটা খুলে ঝুলিয়ে দিয়ে মন্দার মাথার কাছে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। ও চোখদুটো তুলে আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁগো, এ গাড়িতে আর কেউ উঠবে না?

—না।

আর কিছু বলল না। লক্ষ্য করলাম, ওর মুখের উপর একটা খুশির আভা ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ পরে বলল, তুমি কোথায় শোবে?

হাত দিয়ে উপরের বার্থটা দেখিয়ে দিয়ে বললাম, ওইখানে।

—ওখানে! উঠবে কেমন করে?

—ওই শেকলটা ধরে উঠব।

—না, না, তার চেয়ে আমার বিছানাটা মেঝেতে নামিয়ে দাও, তুমি এইখানে শোও।

এই ছেলেমানুষী প্রস্তাবে অন্য কেউ হলে হয়তো হেসে ফেলত। আমি গম্ভীর ভাবেই বললাম, মেঝেটা শোবার জায়গা নয়। আমি ওপরেই শোব। তুমি ঘুমোও—আমার এখন ঘুম পাচ্ছে না।

কয়েকটা মিনিট চুপ করে থেকে আবার বলল, একটু উঠে বসব?

—পারবে?

—খুব পারব। তুমি যদি এই বালিশটাকে একটু—

বাকীটুকু আর বলল না। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। নিজের জন্যে আমাকে হঠাৎ কিছু একটা ফরমাশ করে বসেছে—হলই বা সে অতি তুচ্ছ—এটা ওর পক্ষে একেবারে নতুন। সেই লজ্জাটা তখনো ওর চোখে মুখে জড়ানো। আমি উঠে বালিশটা ওর পিঠের দিকে খানিকটা সরিয়ে দিলাম। আধশোয়ার মত বসে মন্দা অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি একমনে সিগারেট টানতে টানতে শুনলাম, এই ক’মাসে তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। খুব কাজ পড়েছে বুঝি?

আমি জবাব দিলাম না। ও তার জন্যে অপেক্ষাও করল না। অনেকটা যেন নিজের মনে বলল, তাছাড়া, দেখাশুনো কে করে? খাওয়া-দাওয়া—

বাধা দিয়ে বললাম, সে সব পরে ভাবলেও চলবে। এখন নিজের কথা ভাবো।

—আমি এবার দুদিনেই সেরে উঠব।

আমার মুখে বোধ হয় অবিশ্বাসের কেন চিহ্ন ফুটে উঠে থাকবে। হাসি মুখে তারই যেন প্রতিবাদ জানাল মন্দা, ‘সত্যি, দেখো তুমি।’

এই জোর, এই তরল সুর—সবটাই আমার কাছে নতুন। যে মন্দাকে এতদিন দেখে এলাম, যাকে নিয়ে এতগুলো বছর ঘর করলাম, তার স্বভাবের সঙ্গে এটা যেন ঠিক খাপ খাচ্ছিল না।

—কী ভাবছ?

—কিছু না। জবাবটা নিজের কানেই বেশ রূঢ় লাগল। —রাত দশটা বেজে গেছে। এবার ঘুমিয়ে পড়। বলে উঠে পড়লাম।

মন্দা আর কোন কথা না বলে, বালিশটা নিজেই ঠিক করে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

রাত বেড়ে চলল। আমার চোখে ঘুম নেই। গাড়ির সব জানলাগুলো খোলা, তার উপরে পুরো দমে পাখা চলছে। তবু মনে হচ্ছে, কী দুঃসহ গরম। দরজা খুলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চাঁদ নেই, কিন্তু আকাশ ভরা তারা। খোলা মাঠের ভিতর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। বিহারের রুক্ষ কঠিন, গাছপালাহীন, অসমান পাথুরে মাঠ। পাতলা অন্ধকারে ঢাকা। তারই মধ্যে চোখ দুটো ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। বৃথা চেষ্টা। তারা বারবার গাড়ির ভিতরে ফিরে আসতে লাগল। মন্দা শুয়ে আছে দেওয়ালের দিকে পিছন ফিরে। আর সব আলো নেভানো। শুধু একটা কম পাওয়ারের নীল আলো জ্বেলে রেখেছি। ওর কাঁধ পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। মুখের একটা দিক আর তার নিচে গলাটা দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট আলোয় শুকনো ভাঙা গালের ঠেলে ওঠা হাড়গুলো আরও ঠেলে উঠেছে, চোখটা যে কোন কোটরে তলিয়ে গেছে, দেখা যায় না। কন্ঠার হাড় ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। মানুষের মুখ যে এত কুৎসিত, এর আগে কোনদিন দেখিনি। শুধু কুৎসিত নয়, কী বীভৎস! একটা জীবন্ত কঙ্কাল। কী মূল্য এই জীবনের। কী সার্থকতা এই বেঁচে থাকার? ভাবতে গিয়ে সমস্ত মনটা গভীর নৈরাশ্যে ভরে উঠল। সেই একই প্রশ্ন মনে হল—এই জীবন্ত অভিশাপ নিয়ে আমি করব কী?

রেলগাড়ির চলন্ত চাকায় তারই প্রতিধ্বনি বেজে চলল—আমি করব কী—আমি করব কী?

এই কিছুক্ষণ আগে সে আমাকে ভরসা দিয়েছে (ভরসাই বটে!)—‘আমি দুদিনেই সেরে উঠব।’ আমি জানি, সে কোনদিনই সেরে উঠবে না। কিন্তু সেই মিথ্যা আশা, বেঁচে থাকবার সেই প্রবল আকাঙক্ষা ওকে সহজে মরতে দেবে না, মৃত্যু-কবলিত প্রাণটাকে কোনরকমে জীইয়ে রেখে দেবে। কে জানে, সে কত কাল, কত বছর!

বিধাতার কি নিষ্ঠুর পরিহাস। আমি যখন প্রায় সারারাত ধরে এমনি করে জ্বলে পুড়ে মরছি, যাকে ঘিরে সেই জ্বালা, সে তখন নির্বিবাদে ঘুমোচ্ছ। মাঝে মাঝে কোন ছোট স্টেশনে গাড়ি থামতেই তার সেই নিশ্চিন্ত নিশ্বাস আমাকে পাগল করে তুলছিল। ভাবছিলাম, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে কত আকস্মিক ঘটনা ঘটছে। এই নিশ্বাসের গতিটা হঠাৎ থেমে যেতে পারে না? নিজে থেকে না থামলেও—

কাশির শব্দে চমকে উঠলাম। একটানা প্রবল কাশি। তার দমকে গলার শিরাগুলো ফুলে উঠছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে পড়ছে। এমনি করেও তো দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু গেল না। কাশির বেগটা কমে যেতেই গলায় কেমন একটা বোবা আওয়াজ তুলে হাত দিয়ে মুখের দিকে ইঙ্গিত করল। বুঝলাম, যেটা উঠে এসেছে, কোথাও ফেলতে হবে। সঙ্গে একটা ঝুড়ি ছিল। তার মধ্যে পিকদানি বা ওইরকম কিছু আছে কিনা খুঁজে দেখছিলাম। মন্দা ইশারায় বাথরুমটা দেখিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করল। ধরে তুলে ধীরে ধীরে সেইখানে নিয়ে গেলাম। বেসিনের দিকে নজর পড়তেই গা পাক দিয়ে উঠল। গয়েরের সঙ্গে জড়ানো রক্ত। অজ্ঞাতসারে বাহুটা ওর হাত থেকে সরে এল। দু’পা পিছিয়ে এলাম। সহসা মাথার ভিতরটাও কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল। ঘৃণায়, আতঙ্কে, আক্রোশে না কিসের তাড়নায় আমি বলতে পারব না। গাড়ির গতিটা একটু কমে এল। তারপরেই তলা থেকে ছুটে এল একটা জোরাল ঘর্ঘর ঝনঝন শব্দ। হঠাৎ চমকে উঠলাম—কিসের শব্দ? বুঝলাম, ভয়ের কিছু নয়, গাড়িটা কোন পুলের উপর দিয়ে চলেছে। তবু সেই বিপুল শব্দের সঙ্গে তাল রেখে কে যেন আমার মাথার ভিতরে অবিরাম হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল। মন্দা এসে দাঁড়াল বাথরুমের বাইরে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান দিকের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল। হাতলটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। খোলা নদীর দমকা হাওয়ায়, কিংবা ব্রীজের ঝাঁকুনি লেগে হঠাৎ খুলে গেছে।

যে-কারণেই হোক, সেদিন সেই মুহূর্তে গাড়ির পাল্লার সঙ্গে আমার গোপন মনের কোন্ অজ্ঞাত কুঠরির অদৃশ্য পাল্লাটাও সহসা খুলে গিয়ে থাকবে। হয়তো তারই আলোয় দেখেছিলাম, আমার ঠিক বুকের কাছে যে এসে দাঁড়াল, সে আমার স্ত্রী নয়, একটা ভয়াবহ বিষাক্ত ভাইপার। তার উদ্যত ছোবল থেকে নিজেকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে—এই একটি মাত্র চিন্তাই সমস্ত মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আর কোন দিকে না চেয়ে দু হাতে তার কাঁধ দুটো চেপে ধরে প্রচণ্ড বেগে খোলা দরজা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলাম।

গভীর রাত্রির বুক চিরে একটা ভাঙা গলার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আমার কানে এসে লাগল।

পাঁঠা-বলি দেখেছেন? গলাটা হাড়িকাঠের মধ্যে পুরে দিলে তার ভিতর থেকে যে অন্তিম ডাক ঢাকের শব্দ ছাপিয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনি একটি আওয়াজ। একবার উঠেই গাড়ির শব্দে মিলিয়ে গেল।

চলন্ত গাড়ির নিচে ও দু-পাশ জুড়ে তখনো সেই তুমুল ঘর্ঘর ঝনঝন বিপুল বেগে বেজে চলেছে, বলির পরেও যেমন চলতে থাকে ঢাক ঢোল কাঁসরের উন্মত্ত গর্জন! আমার মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহে শুধু তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। সেই উত্তপ্ত উদ্দাম উত্তেজনা। আর কিছু নেই। বিশ্ব-সংসার আমার কাছে লুপ্ত হয়ে গেছে।

তারপর এক সময়ে সেই পাগল-করা দুর্দান্ত শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। নদীগর্ভের বিপদ-ঝঞ্ঝা পার হয়ে গাড়িটা যেন আবার নিরাপদ মাটির পৃথিবীতে ফিরে এল। তখনো সেই দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে আছি। সামনে, যতদূর চোখ যায়, বিস্তৃত খোলা মাঠ। সেই দিকে চেয়ে মনে হল, ওটা যেন আমারই অনাগত জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমার সামনেও অমনি অবাধ উন্মুক্ত মুক্তি!

গাড়ির গতি মন্থর হয়ে এল। দেখলাম, সেই একটানা মাঠ আর নেই। এখানে ওখানে দু-চারখানা বাড়িঘর, গাছপালা, রাস্তাঘাট, চলন্ত আলো। ক্রমশ আরও বাড়ি, আরও আলো, মানুষের গলা, অনেক মানুষের কোলাহল। স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে হঠাৎ যেন একটা পরিপূর্ণ জীবজগতের মধ্যে জেগে উঠলাম।

একটা কোন্‌ স্টেশনে এসে গাড়ি থামল। আমি যে দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম, তার উল্টো দিকে প্ল্যাটফর্ম। এদিকে দৃষ্টি ফেরাতেই চোখে পড়ল মন্দার শূন্য শয্যা। মুহুর্তমধ্যে কে যেন একটা ভীষণ ঝাঁকানি দিয়ে আমাকে একেবারে রূঢ় বাস্তব নগ্ন সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিল। সেই অগোছাল এলোমেলো বিছানাটার দিকে চেয়ে ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। তবু সেখান থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না।

এর পরের কয়েকটা মিনিট ঠিক কিভাবে কেটেছিল, আজ আর মনে করতে পারছি না। মনের পর্দায় যেসব চিন্তার রেখা ছায়াছবির চেয়েও অনেক দ্রুত গতি নিয়ে ফুটেছিল এবং মিলিয়ে গিয়েছিল, এতদিন পরে সেগুলোকে গুছিয়ে তোলা অসম্ভব। তার কোন প্রয়োজনও নেই। যে-জাতীয় খুনী মানুষের মনস্তত্ত্ব আপনাকে আকর্ষণ করে থাকে, আমি তাদের থেকে আলাদা। এ ক্ষেত্রে আপনার কৌতুহল না থাকাই স্বাভাবিক। সুতরাং মানসিক বিশ্লেষণে অযথা সময় নষ্ট না করে ঘটনার দিকে যাওয়া যাক।

প্রথমটা যে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম, সেকথা লুকোতে চাই না। একবার মনে হয়েছিল, পালাই। নামতে গিয়ে থেমে গেলাম। কোথায় পালাব? কদ্দিন থাকব পালিয়ে? তার পর? গাড়ির কামরা থেকে একটি অসুস্থ স্ত্রীলোকের এই আকস্মিক অন্তর্ধান বেশি দিন চাপা থাকবে না। গ্রীষ্মের পাহাড়ী নদীর শুকনো চড়ায় মৃতদেহটাই হয়তো তার সন্ধান দেবে। সেই সূত্র ধরে পুলিশ যখন তার একমাত্র সহযাত্রীকে খুঁজে বের করবে, তখন তার এই নীরবে পালিয়ে যাওয়াই তার রুদ্ধে সবচেয়ে সরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। দরজার হাতলটা খুলতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নিলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। হঠাৎ নজর পড়ল উপরের বার্থে। হোল্ড-অল-এর বাঁধন থেকে বিছানাটা খুলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল—আমার ভায়রাভাই-এর চাকরটা বোধ হয় করেছিল কাজটা—কিন্তু সন্ধ্যা থেকে সেটা স্পর্শ করা হয়নি। এতক্ষণে তার প্রয়োজন দেখা দিল। শুধু স্পর্শ নয়, বেশ করে ঘেঁটে, চাদরটাকে এখানে ওখানে কুঁচকে দিলাম। তারপর সোজা গিয়ে শিকলটা টেনে ধরলাম।

গার্ড এসে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার?

—আমার স্ত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না।

—কোথায় ছিলেন তিনি?

—এইখানে ঘুমোচ্ছিলেন।

—আর আপনি?

—ওপরের বার্থে।

—কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?

ভুল করলাম। ব্রীজটা বোধ হয় তখনো আমার মধ্যে ঘুরছিল। বললাম, ব্রীজের পর থেকে।

গার্ড কপাল কোঁচকালেন : ব্রীজের পর থেকে! এতক্ষণ শেকল টানেননি কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর আমার মাথায় যোগায়নি। বেশ কিছুদিন পরে জুগিয়েছিল আমার উকিলের মাথায়। আসামীর এই সন্দেহজনক আচরণ সরকার পক্ষের হাতে একটি ধারাল অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি এক কথায় তাকে ভোঁতা করে দিয়েছিলেন। সেসন্স জজের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ইয়েস, ইওর অনার। ব্রীজ ছাড়াবার পরেই আসামী দেখতে পেয়েছিল, তার স্ত্রী বিছানায় নেই। ওপর থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখেছিল। রুগ্না স্ত্রীর সম্বন্ধে তার মনে গভীর উদ্বেগ ছিল, তার ফলেই দেখা। দেখে, তার পক্ষে যেটা সহজ ও স্বাভাবিক সেই কথাই ভেবেছিল—স্ত্রী বাথরুমে গেছেন! তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। মনে রাখবেন, তখন গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়াটা অপরাধ নয়। আমার মক্কেলের একমাত্র অপরাধ—যক্ষ্মারোগাক্রান্ত স্ত্রীর মনে যে আত্মহত্যার বীজাণু বাসা বেঁধেছে, সেটা সে কিছুমাত্র সন্দেহ করতে পারেনি। স্ত্রী যদি কাছে থাকত হয়তো বুঝতে পারত। কিন্তু মেয়েটির দেহে এবং মনে যখন এই দুটি বীজাণুর আক্রমণ দেখা দেয়, ঘটনাচক্রে তখন সে স্বামীর কাছ থেকে দূরে গিয়ে পড়েছিল।

আত্মহত্যার ব্যাপারটা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে সুচতুর উকিলবাবু মন্দাকিনীর সমস্ত গার্হস্থ্য জীবনটাকে বিচারকের সামনে তুলে ধরেছিলেন। (সে সম্বন্ধে কয়েকজন প্রতিবেশীর সাক্ষ্য আগেই নিয়ে রাখা হয়েছিল।) তারপর শ্রদ্ধাপ্লুত গম্ভীর সুরে বলেছিলেন, এই মেয়েটি বয়সে নবীনা হলেও, আদর্শে প্রাচীনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা সে পায়নি, কিন্তু হিন্দুনারীর যেটা সর্বোচ্চ শিক্ষা, তা সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেছিল। শুধু শিক্ষা নয়, বলব ধর্ম। স্বামীসেবা। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে জানা গেছে, এই মহৎ আদর্শে সে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়োগ করেছিল। স্বামীকে সে একটি সন্তান উপহার দিতে পারেনি, তারই অপরাধে স্বামীর বংশ লোপ পেতে বসেছে—এজন্যে নিজের উপর তার একটা গভীর ধিক্কার ছিল। যে-সেবা ছিল তার মহান ব্রত, স্বাস্থ্য সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এজন্যেও তার মনোবেদনার অন্ত ছিল না। তারপর যেদিন সে জানতে পারল, স্বামীর আদেশে রোগ সারাতে এসে সে তার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক, একটা সংক্রামক রোগ বয়ে নিয়ে চলেছে, তখন সে আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। যে-জীবন তার স্বামীর সেবায় লাগল না, তাকে সে স্বেচ্ছায় এবং স্বচ্ছন্দে শেষ করে দিল।

জজ এবং জুরি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। আমিও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। মনে পড়ছিল, মন্দার সেই শেষ কথাগুলো—‘এবার আমি দুদিনেই সেরে উঠব⋯সত্যি, দেখো তুমি।’ সে মরতে চায়নি, অসম্ভব জেনেও বেঁচে উঠতে চেয়েছিল।

একজন বিরুদ্ধ সাক্ষীর উক্তি জজ সাহেবের মনে কিছুটা ছায়া ফেলে থাকবে। পাশের কামরার এক ভদ্রলোক। স্ত্রীলোকের গলার একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু একবারের বেশি আর শুনতে পাননি। তাই মনে করেছিলেন, ওটা হয়তো তাঁর ভ্রম।

‘এই একবারের বেশি না শোনাটা’কে পুলিশ এবং সরকারী উকিল আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন। আমার উকিল জেরার ঘায়ে ভদ্রলোককে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেও, জজের মনকে সন্দেহমুক্ত করতে পারেননি। কিন্তু ‘সন্দেহ’কে ‘প্রমাণে’ দাঁড় করাবার মত কোন হাতল জজসাহেব শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন না। কোন একটা ‘মোটিভের’ জন্য তিনি আকাশ পাতাল হাতড়ে বেড়িয়েছেন। খামোকা এই লোকটা নিজের স্ত্রীকে খুন করতে যাবে কেন? মোটিভটা কী? তিনি সেই পুরোন থিওরি আঁকড়ে ধরে ছিলেন—খুন মাত্রেরই পিছনে একটি দু-অক্ষরের শব্দ থাকবে—নারী অথবা বিত্ত। হয় ইংরাজি ‘Love’, নয় তো বাংলা ‘লাভ’। তার কোনটাই যেখানে নেই, সেখানে ন্যায়দণ্ড প্রয়োগ করা চলে না।

একথা তিনি একবারও ভাবেননি, যে মন নিয়ে মানুষ তার অনেকদিনের প্রিয় সঙ্গী এক পাটি ছেঁড়া জুতো টান মেরে ফেলে দেয়, সেই মন নিয়েই সে তার বহু-ব্যবহারে জীর্ণা, ব্যাধিগ্রস্তা শয্যাসঙ্গিনীকেও ট্রেন থেকে ঠেলা মেরে ফেলে দিতে পারে।

‘মানুষের’ এই চেহারাটা হয়তো জজ-সাহেবের নজরে পড়েনি ; যদিও পড়া উচিত ছিল। তবু তাঁকে ক্ষমা করা যায়। আসামীকে তাঁরা দেখেন নথিপত্রের ভিতর দিয়ে। সে সংযোগ পরোক্ষ এবং সাময়িক। আপনার কয়েদীর সঙ্গে আপনার যে সংযোগ, সেটা প্রত্যক্ষ এবং দীর্ঘদিনব্যাপী। তাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আপনি দেখতে পেয়েছেন। তবু যে এই জাতীয় একটা খুনীও আপনার নজরে পড়েনি, একথা কেমন করে বিশ্বাস করি? আমার মনে হয়, পড়েছে, আপনি ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন। তার কারণ যাই হোক, এ ত্রুটি ক্ষমা করা যায় না। শুধু তুটি নয়, অপরাধ। আপনি সত্য গোপনের অপরাধে অপরাধী।’

চিঠির শেষ অংশটা পড়তে পড়তে শ্রীকান্তর কয়েকটা উক্তি আমার মনে পড়ল। অন্নাদাদিদির প্রসঙ্গে সে এক জায়গায় বলেছিল, ‘সংসারে পিশাচী কি নাই? নাই যদি, তবে পথে ঘাটে এত পাপের মূর্তি দেখি কাহাদের? সবাই যদি সেই ইন্দ্রর দিদি, তবে এত প্রকার দুঃখের স্রোত বহাইতেছে কাহারা? তবু কেমন করিয়া যেন মনে হয়, এ সকল তাহাদের বাহ্য আবরণ।…বন্ধুরা বলেন, ইহা আমার একটা শোচনীয় ভ্রম মাত্র। আমি তাহারও প্রতিবাদ করি না।…শুধু বলি, ইহা আমার যুক্তি নয়, আমার সংস্কার।’

আমার বিরুদ্ধে এই পত্ৰলেখকের যে অভিযোগ, আমিও তার প্রতিবাদ করছি না। যে রাজ্যে আমি দীর্ঘজীবন কাটিয়ে এলাম, সেখানে ‘পিশাচের’ অভাব নেই, ‘পাপের মূর্তি’ও কম দেখিনি। তবু মনে হয়েছে, সেইটাই সবটুকু নয়, তার অন্তরালে আরও কিছু আছে। কারও কারও বেলায় সেই ‘আরও কিছু’-টাই আমার চোখে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। আজও কোন নির্জন অবসরে যখন পিছন ফিরে তাকাই, সেই কটা লোকই সামনে এসে দাঁড়ায়—সেই বদন মুন্সী, কাশিম ফকির, মংখিয়া, জং, জ্ঞানদা, পরিমল, ব্রহ্মচারী সদানন্দ। তাদের কাছে ম্লান হয়ে যায় অনাথ, কুসুম, বাজাবাহাদুর এবং এই পত্রলেখকের মত আরও যাদের দেখেছি।

হয়তো শ্রীকান্তর মত আমারও এটা একটা সংস্কার। তার মধ্যে যদি অপরাধ থাকে, সে-অপরাধ আমি অকপটে স্বীকার করছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *