একাদশ পরিচ্ছেদ : আশমানির দৌত্য
এদিকে বিমলার ইঙ্গিতমত আশমানি গৃহের বাহিরে আসিয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল। বিমলা আসিয়া তাহাকে কহিলেন, “আশমানি, তোমার সঙ্গে কোন বিশেষ গোপনীয় কথা আছে।”
আশমানি কহিল, “বেশভূষা দেখিয়া আমিও ভাবিতেছিলাম, আজ কি একটা কাণ্ড।”
বিমলা কহিলেন, “আমি আজ কোন প্রয়োজনে অধিক দূরে যাইব। এ রাত্রে একাকিনী যাইতে পারিব না; তুমি ছাড়া আর কাহাকেও বিশ্বাস করিয়া সঙ্গে লইতে পারিব না; তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।”
আশমানি জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাবে?”
বিমলা কহিলেন, “আশমানি, তুমি ত সেকালে এত কথা জিজ্ঞেস করিতে না?”
আশমানি কিছু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “তবে তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি কতকগুলা কাজ সারিয়া আসি|”
বিমলা কহিলেন, “আর একটা কথা আছে; মনে কর, যদি তোমার সঙ্গে আজ সেকালের কোন লোকের দেখা হয়, তবে কি তোমাকে সে চিনিতে পারিবে?”
আশমানি বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি?”
বিমলা কহিলেন, “মনে কর, যদি কুমার জগৎসিংহের সহিত দেখা হয়?”
আশমানি অনেক্ষণ নীরব থাকিয়া গদগদ স্বরে কহিল, “এমন দিন কি হবে?”
বিমলাও কহিলেন, “হইতেও পারে।”
আশমানি কহিল, “কুমার চিনিতে পারিবেন বৈ কি।”
বিমলা কহিলেন, “তবে তোমার যাওয়া হইবে না, আর কাহাকে লইয়া যাই–একাও ত যাইতে পারি না।”
আশমানি কহিল, “কুমার দেখিব মনে বড়ই সাধ হইতেছে।”
বিমলা কহিলেন, “মনের সাধ মনে থাক; এখন আমি কি করি?”
বিমলা চিন্তা করিতে লাগিলেন। আশমানি অকস্মাৎ মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল। বিমলা কহিলেন, “মর্! আপনা আপনি হেসে মরিস কেন?”
আশমানি কহিল, “মনে মনে ভাবিতেছিলাম, বলি আমার সোনার চাঁদ দিগ্গতজকে তোমার সঙ্গে পাঠাইলে কি হয়?”
বিমলা হাসিয়া উল্লাসে কহিলেন, “সেই কথাই ভাল; রসিকরাজকেই সঙ্গে লইব|”
আশমানি বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি, আমি যে তামাসা করিতেছিলাম!”
বিমলা কহিলেন, “তামাসা না, বোকা বামুনকে আমার অবিশ্বাস নাই। অন্ধের দিন রাত্রি নাই, ও ত কিছুই বুঝিতে পারিবে না, সুতরাং ওকে অবিশ্বাস নাই। তবে বামুন যেতে চাবে না।”
আশমানি হাসিয়া কহিল, “সে ভার আমার; আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া নিয়া আসিতেছি, তুমি ফটকের সম্মুখে একটু অপেক্ষা করিও।”
এই বলিয়া আশমানি হাসিতে হাসিতে দুর্গমধ্যস্থ একটি ক্ষুদ্র কুটীরাভিমুখে চলিল।
অভিরাম স্বামীর শিষ্য গজপতি বিদ্যাদিগ্গজ ইতিপূর্বেই পাঠক মহাশয়ের নিকট একবার পরিচিত হইয়াছেন। যে হেতুতে বিমলা তাঁহার রসিকরাজ নাম রাখিয়াছিলেন, তাহাও পাঠক মহাশয় অবগত আছেন। সেই মহাপুরুষ এই কুটীরের অধিকারী। দিগ্গছজ মহাশয় দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ সাত হইবেন, প্রস্থে বড় জোর আধ হাত তিন আঙ্গুল। পা দুইখানি কাঁকাল হইতে মাটি পর্যন্ত মাপিলে চৌদ্দপুয়া চারি হাত হইবেক; প্রস্থে রলা কাষ্ঠের পরিমাণ। বর্ণ দোয়াতের কালি; বোধ হয়, অগ্নি কাষ্ঠভ্রমে পা দুখানি ভক্ষণ করিতে বসিয়াছিলেন, কিছুমাত্র রস না পাইয়া অর্ধেক অঙ্গার করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন। দিগ্গজ মহাশয় অধিক দৈর্ঘ্যবশত: একটু একটু কুঁজো, অবয়বের মধ্যে নাসিকা প্রবল, শরীরে মাংসাভাব সেইখানেই সংশোধন হইয়াছে। মাথাটি বেহায়া-কামান, কামান চুলগুলি যাহা আছে তাহা ছোট ছোট, আবার হাত দিলে সূচ ফুটে। আর্ক-ফলার ঘটাটা জাঁকাল রকম।
গজপতি, ‘বিদ্যাদিগ্গতজ’ উপাধি করিয়া পান নাই। বুদ্ধিখানা অতি তীক্ষ্ণ। বাল্যকালে চতুষ্পাঠীতে ব্যাকরণ আরম্ভ করিয়াছিলেন, সাড়ে সাত মাসে “সহর্ণে র্ঘঃ” সূত্রটি ব্যাখ্যা শুদ্ধ মুখস্থ হয়। ভট্টাচার্য মহাশয়ের অনুগ্রহে আর দশজনের গোলে হরিবোলে পঞ্চদশ বৎসর পাঠ করিয়া শব্দকাণ্ড শেষ করিলেন। পরে অন্য কাণ্ড আরম্ভ করিবার পূর্বে অধ্যাপক ভাবিলেন, “দেখি দেখি কাণ্ডখানাই কি?” শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল দেখি বাপু, রাম শব্দের উত্তর অম্ করিলে কি হয়?” ছাত্র অনেক ভাবিয়া উত্তর করিলেন, “রামকান্ত।” অধ্যাপক কহিলেন, “বাপু, তোমার বিদ্যা হইয়াছে; তুমি এক্ষণে গৃহে যাও, তোমার এখানকার পাঠ সাঙ্গ হইয়াছে; আমার আর বিদ্যা নাই যে তোমাকে দান করিব।”
গজপতি অতি সাহঙ্কার-চিত্ত হইয়া কহিলেন, “আমার এক নিবেদন–আমার উপাধি?”
অধ্যাপক কহিলেন, “বাপু, তুমি যে বিদ্যা অর্জন করিয়াছ, তোমার নূতন উপাধি আবশ্যক তুমি ‘বিদ্যাদিগ্গজ’ উপাধি গ্রহণ কর।”
দিগ্গজ হৃষ্টচিত্তে গুরুপদে প্রণাম করিয়া গৃহে চলিলেন।
গৃহে আসিয়া দিগ্গজ পণ্ডিত মনে মনে ভাবিলেন, “ব্যাকরণাদিতে ত কৃতবিদ্যা হইলাম। এক্ষণে কিঞ্চিৎ স্মৃতি পাঠ করা আবশ্যক। শুনিয়াছি, অভিরাম স্বামী বড় পণ্ডিত, তিনি ব্যতীত আমাকে শিক্ষা দেয়, এমন লোক আর নাই, অতএব তাঁহার নিকটে গিয়া কিছু স্মৃতি শিক্ষা করা উচিত।” এই স্থির করিয়া দিগ্গজ দুর্গমধ্যে অধিষ্ঠান করিলেন। অভিরাম স্বামী অনেককে শিক্ষা দিতেন; কাহারও প্রতি বিরক্ত ছিলেন না। দিগ্গজ কিছু শিখুক বা না শিখুক, অভিরাম স্বামী তাহাকে পাঠ দিতেন।
গজপতি ঠাকুর কেবল বৈয়াকরণ আর স্মার্ত নহেন; একটু আলঙ্কারিক, একটু একটু রসিক, ঘৃতভাণ্ড তাহার পরিচয়ের স্থল। তাঁহার রসিকতার আড়ম্বরটা কিছু আশমানির প্রতি গুরুতর হইত; তাহার কিছু গূঢ় তাৎপর্যও ছিল। গজপতি মনে করিতেন; “আমার তুল্য ব্যক্তির ভারতে কেবল লীলা করিতে আসা; এই আমার শ্রীবৃন্দাবন, আশমানি আমার রাধিকা।” আশমানিও রসিকা; মদনমোহন পাইয়া বানর-পোষার সাধ মিটাইয়া লইত। বিমলাও সন্ধান পাইয়া কখনও বানর নাচাইতে যাইতেন। দিগ্গজ মনে করিতেন, “এই আমার চন্দ্রাবলী জুটিয়াছে; না হবে কেন? যে ঘৃতভাণ্ড ঝাড়িয়াছি; ভাগ্যে বিমলা জানে না, ওটি আমার শোনা কথা।”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : আশমানির অভিসার
দিগ্গজ গজপতির মনোমোহিনী আশমানি কিরূপ রূপবতী, জানিতে পাঠক মহাশয়ের কৌতূহল জন্মিয়াছে সন্দেহ নাই। অতএব তাঁহার সাধ পুরাইব। কিন্তু স্ত্রীলোকের রূপবর্ণন-বিষয়ে গ্রন্থকারগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া থাকেন, আমার সদৃশ অকিঞ্চন জনের তৎপদ্ধতি বহির্ভূত হওয়া অতি ধৃষ্টতার বিষয়। অতএব, প্রথমে মঙ্গলাচরণ করা কর্তব্য।
হে বাগ্দেবি! হে কমলাসনে! শরবিন্দুনিভাননে! অমলকমল-দলনিন্দিত-চরণ-ভক্তভজন-বৎসলে! আমাকে সেই চরণকমলের ছায়া দান কর; আমি আশমানির রূপ বর্ণন করিব। হে অরবিন্দানন-সুন্দরীকূল-গর্ব-খর্বকারিণি! হে বিশাল রসাল দীর্ঘ-সমাস-পটল-সৃষ্টিকারিণি! একবার পদনখের এক পার্শ্বে স্থান দাও, আমি রূপ বর্ণন করিব। সমাস-পটল, সন্ধি-বেগুন, উপমা-কাঁচাকলার চড়চড়ি রাঁধিয়া এই খিচুড়ি তোমায় ভোগ দিব। হে পণ্ডিতকুলেপ্সিত-পয়:প্রস্রবিণি! হে মূর্খজনপ্রতি ক্কচিৎ কৃপাকারিণি! হে অঙ্গুলি-কণ্ডূয়ন-বিষমবিকার সমুৎপাদিনি! হে বটতলা-বিদ্যাপ্রদীপ-তৈলপ্রদায়িনি! আমার বুদ্ধির প্রদীপ একবার উজ্জ্বল করিয়া দিয়া যাও। মা! তোমার দুই রূপ; যে রূপে তুমি কালিদাসকে বরপ্রদা হইয়াছিলে, যে প্রকৃতির প্রভাবে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা জন্মিয়াছিল, যে প্রকৃতির ধ্যান করিয়া বাল্মীকি রামায়ণ, ভবভূতি উত্তরচরিত, ভারবি কিরাতার্জুনীয় রচনা করিয়াছিলেন, সে রূপে আমার স্কন্ধে আরোহণ করিয়া পীড়া জন্মাইও না; যে মূর্তি ভাবিয়া শ্রীহর্ষ নৈষধ লিখিয়াছিলেন, যে প্রকৃতিপ্রসাদে ভারতচন্দ্র বিদ্যার অপূর্ব রূপবর্ণন করিয়া বঙ্গদেশের মনোমোহন করিয়াছেন, যাহার প্রসাদে দাসরথি রায়ের জন্ম, যে মূর্তিতে আজও বটতলা আলো করিতেছ, সেই মূর্তিতে একবার আমার স্কন্ধে আবির্ভূত হও, আমি আশমানির রূপ বর্ণন করি।
আশমানির বেণীর শোভা ফণিনীর ন্যায়; ফণিনী সেই তাপে মনে ভাবিল, যদি বেণীর কাছে পরাস্ত হইলাম, তবে আর এ দেহ লোকের কাছে লইয়া বেড়াইবার প্রয়োজনটা কি! আমি গর্তে যাই। এই ভাবিয়া সাপ গর্তের ভিতর গেলেন। ব্রহ্মা দেখিলেন প্রমাদ; সাপ গর্তে গেলেন, মানুষ দংশন করে কে? এই ভাবিয়া তিনি সাপকে ল্যাজ ধরিয়া টানিয়া বাহির করিলেন, সাপ বাহিরে আসিয়া, আবার মুখ দেখাইতে হইল, এই ক্ষোভে মাথা কুটিতে লাগিল, মাথা কুটিতে কুটিতে মাথা চেপ্টা হইয়া গেল, সেই অবধি সাপের ফণা হইয়াছে। আশমানির মুখচন্দ্র অধিক সুন্দর, সুতরাং চন্দ্রদেব উদিত হইতে না পারিয়া ব্রহ্মার নিকট নালিশ করিলেন। ব্রহ্মা কহিলেন, ভয় নাই, তুমি গিয়া উদিত হও, আজি হইতে স্ত্রীলোকদিগের মুখ আবৃত হইবে; সেই অবধি ঘোমটার সৃষ্টি। নয়ন দুটি যেন খঞ্জন, পাছে পাখী ডানা বাহির করিয়া উড়িয়া পলায়, এই জন্য বিধাতা পল্লবরূপ পিঁজরার কবাট করিয়া দিয়াছেন। নাসিকা গরুড়ের নাসার ন্যায় মহাবিশাল; দেখিয়া গরুড় আশঙ্কায় বৃক্ষারোহণ করিল; সেই অবধি পক্ষিকূল বৃক্ষের উপরেই থাকে। কারণান্তরে দাড়িম্ব বঙ্গদেশ ছাড়িয়া পাটনা অঞ্চলে পলাইয়া রহিলেন; আর হস্তী কুম্ভ লইয়া ব্রহ্মদেশে পলাইলেন; বাকি ছিলেন ধবলগিরি, তিনি দেখিলেন যে, আমার চূড়া কতই বা উচ্চ, আড়াই ক্রোশ বই ত নয়, এ চূড়া অন্যূন তিন ক্রোশ হইবেক; এই ভাবিতে ভাবিতে ধবলগিরির মাথা গরম হইয়া উঠিল, বরফ ঢালিতে লাগিলেন, তিনি সেই অবধি মাথায় বরফ দিয়া বসিয়া আছেন।
কপালের লিখন দোষে আশমানি বিধবা! আশমানি দিগ্গনজের কুটীরে আসিয়া দেখিল যে, কুটীরের দ্বার রুদ্ধ, ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। ডাকিল, “ও ঠাকুর!”
কেউ উত্তর দিল না।
“বলি ও গোঁসাই!”
উত্তর নাই।
“মর্ বিট্লে কি করিতেছ? ও রসিকরাজ রসোপাধ্যায় প্রভু!”
উত্তর নাই।
আশমানি কুটীরের দ্বারের ছিদ্র দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল, ব্রাহ্মণ আহারে বসিয়াছে, এই জন্য কথা নাই, কথা কহিলে ব্রাহ্মণের আহার হয় না। আশমানি ভাবিল, “ইহার আবার নিষ্ঠা; দেখি, দেখি, কথা কহিয়া আবার খায় কি না।”
“বলি ও রসিকরাজ!”
উত্তর নাই।
“ও রসরাজ!”
উত্তর। “হুম্।”
বামুন ভাত গালে করিয়া উত্তর দিতেছে, ও ত কথা হলো না –এই ভাবিয়া আশমানি কহিল, “ও রসমাণিক!”
উত্তর। “হুম্।”
আ। বলি কথাই কও না, খেও এর পরে।
উত্তর। “হ-উ-উম্!”
আ। বটে, বামুন হইয়া এই কাজ – আমি স্বামিঠাকুরকে বলে দেব, ঘরের ভিতর কে ও?
ব্রাহ্মণ সশঙ্কচিত্ত শূন্য ঘরের চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। কেহ নাই দেখিয়া পুনর্বার আহার করিতে লাগিল।
আশমানি কহিল, “ও মাগি যে জেতে চাঁড়াল! আমি যে চিনি!”
দিগ্গিজের মুখ শুকাইল। বলিল, “কে চাঁড়াল? ছুঁয়া পড়েনি ত?”
আশমানি আবার কহিল, “ও, আবার খাও যে? কথা কহিয়া আবার খাও?”
দি। কই, কখন কথা কহিলাম?
আশমানি খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, “এই তো কহিলে।”
দি। বটে, বটে, বটে, তবে আর খাওয়া হইল না।
আ। হাঁ ত; উঠে আমায় দ্বার খুলিয়া দাও।
আশমানি ছিদ্র হইতে দেখিতেছিল, ব্রাহ্মণ যর্থাথই অন্নত্যাগ করিয়া উঠে। কহিল, “না, না, ও কয়টি ভাত খাইয়া উঠিও।”
দি। না, আর খাওয়া হইবে না, কথা কহিয়াছি।
আ। সে কি? না খাও ত আমার মাথা খাও।
দি। রাধে মাধব! কথা কহিলে কি আর আহার করিতে আছে?
আ। বটে, তবে আমি চলিলাম; তোমার সঙ্গে আমার অনেক মনের কথা ছিল, কিছুই বলা হইল না। আমি চলিলাম।
দি। না না, আশমান! তুমি রাগ করিও না; আমি এই খাইতেছি।
ব্রাহ্মণ আবার খাইতে লাগিল; দুই তিন গ্রাস আহার করিবামাত্র আশমানি কহিল, “উঠ, হইয়াছে; দ্বার খোল|”
দি। এই কটা ভাত খাই।
আ। এ যে পেট আর ভরে না; উঠ, নহিলে কথা কহিয়া ভাত খাইয়াছ, বলিয়া দিব।
দি। আঃ নাও; এই উঠিলাম।
ব্রাহ্মণ অতি ক্ষুণ্ণমনে অন্নত্যাগ করিয়া, গণ্ডূষ করিয়া উঠিয়া দ্বার খুলিয়া দিল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : আশমানির প্রেম
দ্বার খুলিলে আশমানি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র দিগ্গজের হৃদ্বোধ হইল যে, প্রণয়িনী আসিয়াছেন, ইহার সরস অভ্যর্থনা করা চাই, অতএব হস্ত উত্তোলন করিয়া কহিলেন, “ওঁ আয়াহি বরদে দেবি!”
আশমানি কহিল, “এটি যে বড় সরস কবিতা, কোথা পাইলে?”
দি। তোমার জন্য এটি আজ রচনা করিয়া রাখিয়াছি।
আ। সাধ করিয়া কি তোমায় রসিকরাজ বলেছি?
দি। সুন্দরি! তুমি বইস; আমি হস্ত প্রক্ষালন করি।
আশমানি মনে মনে কহিল, “আলোপ্পেয়ে! তুমি যে হাত ধোবে? আমি তোমাকে ঐ এঁটো আবার খাওয়াব।”
প্রকাশ্যে কহিল, “সে কি, হাত ধোও যে, ভাত খাও না।”
গজপতি কহিলেন, “কি কথা, ভোজন করিয়া উঠিয়াছি, আবার ভাত খাব কিরূপে?”
আ। কেন, তোমার ভাত রহিয়াছে যে? উপবাস করিবে?
দিগ্গজ কিছু ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, “কি করি, তুমি তাড়াতাড়ি করিলে।” এই বলিয়া সতৃষ্ণনয়নে অন্নপানে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।
আশমানি কহিল, “তবে আবার খাইতে হইবে।”
দি। রাধে মাধব! গণ্ডূষ করিয়াছি, গাত্রোত্থান করিয়াছি, আবার খাইব?
“হাঁ, খাইবে বই কি। আমারই উৎসৃষ্ট খাইবে।” এই বলিয়া আশমানি ভোজনপাত্র হইতে এক গ্রাস অন্ন লইয়া আপনি খাইল।
ব্রাহ্মণ অবাক হইয়া রহিলেন।
আশমানি উৎসৃষ্ট অন্ন ভোজনপাত্রে রাখিয়া কহিল, “খাও।”
ব্রাহ্মণের বাঙ্নিষ্পত্তি নাই।
আ। খাও, শোন, কাহাকে বলিব না যে, তুমি আমার উৎসৃষ্ট খাইয়াছ। কেহ না জানিতে পারিলে দোষ কি?
দি। তাও কি হয়?
কিন্তু দিগ্গজের উদরমধ্যে অগ্নিদেব প্রচণ্ড জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন। দিগ্গজ মনে মনে করিতেছিলেন যে, আশমানি যেমন সুন্দর হউক না কেন, পৃথিবী ইহাকে গ্রাস করুন, আমি গোপনে ইহার উৎসৃষ্টাবশেষ ভোজন করিয়া দহ্যমান উদর শীতল করি।
আশমানি ভাব বুঝিয়া বলিল, “খাও – না খাও, একবার পাতের কাছে বসো।”
দি। কেন? তাতে কি হইবে?
আ। আমার সাধ। তুমি কি আমার একটা সাধ পুরাইতে পার না?
দিগ্গজ বলিলেন, “শুধু পাতের কাছে বসিতে কি? তাহাতে কোন দোষ নাই। তোমার কথা রাখিলাম।” এই বলিয়া দিগ্গজ পণ্ডিত আশমানির কথায় পাতের কাছে গিয়া বসিলেন। উদরে ক্ষুধা, কোলে অন্ন, অথচ খাইতে পারিতেছেন না – দিগ্গজের চক্ষে জল আসিল।
আশমানি বলিল, “শূদ্রের উৎসৃষ্ট ব্রাহ্মণে ছুঁলে কি হয়?”
পণ্ডিত বলিলেন, “নাইতে হয়।” আ। তুমি আমায় কেমন ভালবাস, আজ বুঝিয়া পড়িয়া তবে আমি যাব। তুমি আমার কথায় এই রাত্রে নাইতে পার?
দিগ্গজ মহাশয় ক্ষুদ্র চক্ষু রসে অর্ধ মুদ্রিত করিয়া দীর্ঘ নাসিকা বাঁকাইয়া মধুর হাসি আকর্ণ হাসিয়া বলিলেন, “তার কথা কি? এখনই নাইতে পারি।”
আশমানি বলিল, “আমার ইচ্ছা হইয়াছে তোমার পাতে প্রসাদ পাইব! তুমি আপন হাতে আমাকে দুইটি ভাত মাখিয়া দাও।”
দিগ্গজ বলিল, “তার আশ্চর্য কি? স্নানেই শুচি।” এই বলিয়া উৎসৃষ্টাবশেষ একত্রিত করিয়া মাখিতে লাগিল।
আশমানি বলিল, “আমি একটি উপকথা বলি শুন। যতক্ষণ আমি উপকথা বলিব, ততক্ষণ তুমি ভাত মাখিবে, নইলে আমি খাইব না।”
দি। আচ্ছা।
আশমানি এক রাজা আর তাহার দুয়ো শুয়ো দুই রাণীর গল্প আরম্ভ করিল। দিগ্গজ হাঁ করিয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া শুনিতে লাগিল – আর ভাত মাখিতে লাগিল।
শুনিতে শুনিতে দিগ্গিজের মন আশমানির গল্পে ডুবিয়া গেল–আশমানির হাসি, চাহনি ও নথের মাঝখানে আটকাইয়া রহিল। ভাত মাখা বন্ধ হইল–পাতে হাত লাগিয়া রহিল–কিন্তু ক্ষুধার যাতনাটা আছে। যখন আশমানির গল্প বড় জমিয়া আসিল–দিগ্গজের মন তাহাতে বড়ই নিবিষ্ট হইল – তখন দিগ্গজের হাত বিশ্বাসঘাতকতা করিল। পাত্রস্থ হাত, নিকটস্থ মাখা ভাতের গ্রাস তুলিয়া চুপি চুপি দিগ্গিজের মুখে লইয়া গেল। মুখ হাঁ করিয়া তাহা গ্রহণ করিল। দন্ত বিনা আপত্তিতে তাহা চর্বণ করিতে আরম্ভ করিল। রসনা তাহা গলাধ:করণ করাইল। নিরীহ দিগ্গ জের কোন সাড়া ছিল না। দেখিয়া আশমানি খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, “তবে রে বিট্লে – আমার এঁটো না কি খাবি নে?”
তখন দিগ্গজের চেতনা হইল। তাড়াতাড়ি আর এক গ্রাস মুখে দিয়া গিলিতে গিলিতে এঁটো হাতে আশমানির পায়ে জড়াইয়া পড়িল। চর্বণ করিতে করিতে কাঁদিয়া বলিল, “আমায় রাখ; আশমান! কাহাকেও বলিও না।”
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : দিগ্গজহরণ
এমন সময় বিমলা আসিয়া, বাহির হইতে দ্বার নাড়িল। বিমলা দ্বারপার্শ্ব হইতে অলক্ষ্যে সকল দেখিতেছিল। দ্বারের শব্দ শুনিয়া দিগ্গজের মুখ শুকাইল। আশমানি বলিল, “কি সর্বনাশ, বিমলা আসিতেছে – লুকোও লুকোও|”
দিগ্গজ ঠাকুর কাঁদিয়া কহিল, “কোথায় লুকাইব?”
আশমানি বলিল, “ঐ অন্ধকার কোণে একটা কেলে-হাঁড়ি মাথায় দিয়া বসো গিয়া – অন্ধকারে ঠাওর পাইবে না।” দিগ্গেজ তাহাই করিতে লাগিল – আশমানির বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় বিস্মিত হইল। দুর্ভাগ্যবশতঃ তাড়াতাড়িতে ব্রাহ্মণ একটা অড়হর ডালের হাঁড়ি পাড়িয়া মাথায় দিল – তাহাতে আধ হাঁড়ি রাঁধা অরহর ডাল ছিল – দিগ্গজ যেমন হাঁড়ি উলটাভইয়া মাথায় দিবেন, অমনি মস্তক হইতে অড়হর ডালের শতধারা বহিল – টিকি দিয়া অড়হর ডালের স্রোত নামিল – স্কন্ধ, বক্ষ, পৃষ্ঠ ও বাহু হইতে অড়হর ডালের ধারা, পর্বত হইতে ভূতলগামিনী নদীসকলের ন্যায় তরঙ্গে তরঙ্গে নামিতে লাগিল; উচ্চ নাসিকা অড়হরের প্রস্রবণবিশিষ্ট গিরিশৃঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। এই সময়ে বিমলা গৃহে প্রবেশ করিয়া দিগ্গণজের শোভারাশি সন্দর্শন করিতে লাগিলেন। দিগ্গজ বিমলাকে দেখিয়া কাঁদিয়া উঠিল। দেখিয়া বিমলার দয়া হইল। বিমলা বলিলেন, “কাঁদিও না। তুমি যদি এই অবশিষ্ট ভাতগুলি খাও, তবে আমরা কাহারও সাক্ষাতে এ সকল কথা বলিব না।”
ব্রাহ্মণ তখন প্রফুল্ল হইল; প্রফুল্ল বদনে পুনশ্চ আহারে বসিল – ইচ্ছা, অঙ্গের অড়হর ডালটুকুও মুছিয়া লয়, কিন্তু তাহা পারিল না, কিংবা সাহস করিল না। আশমানির জন্য যে ভাত মাখিয়াছিল, তাহা খাইল। বিনষ্ট অড়হরের জন্য অনেক পরিতাপ করিল। আহার সমাপনান্তে আশমানি তাহাকে স্নান করাইল। পরে ব্রাহ্মণ স্থির হইলে বিমলা কহিলেন, “রসিক! একটা বড় ভারি কথা আছে।”
রসিক কহিলেন, “কি?”
বি। তুমি আমাদের ভালবাস?
দি। বাসি নে?
বি। দুই জনকেই?
দি। দুইজনকেই।
বি। যা বলি, তা পারিবে?
দি। পারিব না?
বি। এখনই?
দি। এখনই।
বি। এই দণ্ডে?
দি। এই দণ্ডে।
বি। আমরা দুজনে কেন এসেছি জান?
দি। না।
আশমানি কহিল, “আমরা তোমার সঙ্গে পলাইয়া যাইব।”
ব্রাহ্মণ অবাক হইয়া হাঁ করিয়া রহিলেন। বিমলা কষ্টে উচ্চ হাসি সম্বরণ করিলেন। কহিলেন, “কথা কও না যে?”
“অ্যাঁ অ্যাঁ, তা তা তা তা” – বাঙ্নিষ্পত্তি হইয়া উঠিল না।
আশমানি কহিল, “তবে কি পারিবে না?”
“অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, তা তা – স্বামিঠাকুরকে বলিয়া আসি।”
বিমলা কহিলেন, “স্বামিঠাকুরকে আবার বলবে কি? এ কি তোমার মাতৃশ্রাদ্ধ উপস্থিত যে স্বামিঠাকুরের কাছে ব্যবস্থা নিতে যাবে?”
দি। না, না, তা যাব না; তা কবে যেতে হবে?
বি। কবে? এখনই চল; দেখিতেছ না, আমি গহনাপত্র লইয়া বাহির হইয়াছি।
দি। এখনই?
বি। এখনই না ত কি? নহিলে বল, আমরা অন্য লোকের তল্লাস করি।
গজপতি আর থাকিতে পারিলেন না, বলিলেন, “চল, যাইতেছি।”
বিমলা বলিলেন, “দোছোট লও।”
দিগ্গজ নামাবলী গায়ে দিলেন। বিমলা অগ্রে, ব্রাহ্মণ পশ্চাতে যাত্রা করেন, এমন সময়ে দিগ্গজ বলিলেন, “সুন্দরি!”
বি। কি?
দি। আবার আসিবে কবে?
বি। আসিব কি আবার? একেবারে চলিলাম।
হাসিতে দিগ্গজের মুখ পরিপূর্ণ হিল, বলিলেন, “তৈজসপত্র রহিল যে।”
বি। ও সব তোমায় কিনে দিব।
ব্রাহ্মণ কিছু ক্ষুণ্ণ হইলেন; কি করেন, স্ত্রীলোকেরা মনে করিবে, আমাদের ভালবাসে না, অভাবপক্ষে বলিলেন, “খুঙ্গীপুতি?”
বিমলা বলিলেন, “শীঘ্র লও।”
বিদ্যাদিগ্গজের সবে দুখানি পুতি, – ব্যাকরণ আর একখানি স্মৃতি। ব্যাকরণখানি হস্তে লইয়া বলিলেন, “এখানিতে কাজই বা কি, এ ত আমার কণ্ঠে আছে।” এই বলিয়া কেবল স্মৃতিখানি খুঙ্গীর মধ্যে লইলেন। “দুর্গা শ্রীহরি” বলিয়া বিমলা ও আশমানির সহিত যাত্রা করিলেন।
আশমানি কহিল, “তোমরা আগু হও, আমি পশ্চাতে যাইতেছি।”
এই বলিয়া আশমানি গৃহে গেল, বিমলা ও গজপতি একত্র চলিলেন। অন্ধকারে উভয়ে অলক্ষ্য থাকিয়া দুর্গদ্বারের বাহির হইলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া দিগ্গজ কহিলেন, “কই, আশমানি আসিল না?”
বিমলা কহিলেন, “সে বুঝি আসিতে পারিল না। আবার তাকে কেন?”
রসিকরাজ নীরব হইয়া রহিলেন। ক্ষণেক পরে নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “তৈজসপত্র।”
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : দিগ্গজের সাহস
বিমলা দ্রুতপাদবিক্ষেপে শীঘ্র মান্দারণ পশ্চাৎ করিলেন। নিশা অত্যন্ত অন্ধকার, নক্ষত্রালোকে সাবধানে চলিতে লাগিলেন। প্রান্তরপথে প্রবেশ করিয়া বিমলা কিঞ্চিৎ শঙ্কান্বিতা হইলেন; সমভিব্যাহারী নিঃশব্দে পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছেন, বাক্যব্যয়ও নাই। এমন সময়ে মনুষ্যের কণ্ঠস্বর শুনিলে কিছু সাহস হয়, শুনিতে ইচ্ছাও করে। এই জন্য বিমলা গজপতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রসিকরতন! কি ভাবিতেছ?”
রসিকরতন বলিলেন, “বলি তৈজসপত্রগুলা!”
বিমলা উত্তর না দিয়া, মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিলেন।
ক্ষণেক কাল পরে, বিমলা আবার কথা কহিলেন, “দিগ্গজ, তুমি ভূতের ভয় কর?”
“রাম! রাম! রাম! রামনাম বল”, বলিয়া দিগ্গজ বিমলার পশ্চাতে দুই হাত সরিয়া আসিলেন।
একে পায়, আরে চায়। বিমলা কহিলেন, “এ পথে বড় ভূতের দৈরাত্ম্য।” দিগ্গজ আসিয়া বিমলার অঞ্চল ধরিলেন। বিমলা বলিতে লাগিলেন, “আমরা সেদিন শৈলেশ্বরের পূজা দিয়া আসিতেছিলাম, পথের মধ্যে বটতলায় দেখি যে, এক বিকটাকার মূর্তি!”
অঞ্চলের তাড়নায় বিমলা জানিতে পারিলেন যে, ব্রাহ্মণ থরহরি কাঁপিতেছে; বুঝিলেন যে, আর অধিক বাড়াবাড়ি করিলে ব্রাহ্মণের গতিশক্তি রহিত হইবে। অতএব ক্ষান্ত হইয়া কহিলেন, “রসিকরাজ! তুমি গাইতে জান?”
রসিক পুরুষ কে কোথায় সঙ্গীতে অপটু? দিগ্গজ বলিলেন, “জানি বৈ কি।”
বিমলা বলিলেন, “একটি গীত গাও দেখি।”
দিগ্গজ আরম্ভ করিলেন,
“এ হুম্ – উ, হুম্ –
সই, কি ক্ষণে দেখিলাম শ্যামে কদম্বেরি ডালে।”
পথের ধারে একটা গাভী শয়ন করিয়া রোমন্থন করিতেছিল, অলৌকিক শব্দ শুনিয়া বেগে পলায়ন করিল। রসিকের গীত চলিতে লাগিল।
“সেই দিন পুড়িল কপাল মোর –
কালি দিলাম কুলে।
মাথায় চূড়া, হাতে বাঁশী কথা কয় হাসি হাসি;
বলে ও গোয়ালা মাসী–কলসী দিব ফেলে।”
দিগ্গ জের আর গান হইল না; হঠাৎ তাঁহার শ্রবণেন্দ্রিয় একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল; অমৃতময়, মানসোন্মাদকর, অপ্সরোহস্তস্থিত বীণাশব্দবৎ মধুর সঙ্গীতধ্বনি তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। বিমলা নিজে পূর্ণস্বরে সঙ্গীত আরম্ভ করিয়াছিলেন।
নিস্তব্ধ প্রান্তরমধ্যে নৈশ গগন ব্যাপিয়া সেই সপ্তস্বরপরিপূর্ণ ধ্বনি উঠিতে লাগিল। শীতল নৈদাঘ পবনে ধ্বনি আরোহণ করিয়া চলিল।
দিগ্গোজ নিশ্বাস রহিত করিয়া শুনিতে লাগিলেন। যখন বিমলা সমাপ্ত করিলেন, তখন গজপতি কহিলেন, “আবার।”
বি। আবার কি?
দি। আবার একটি গাও।
বি। কি গায়িব?
একটি বাঙলা গাও।
“গায়িতেছি” বলিয়া বিমলা পুনর্বার সঙ্গীত আরম্ভ করিলেন।
গীত গায়িতে গায়িতে বিমলা জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার অঞ্চলে বিষম টান পড়িয়াছে; পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, গজপতি একেবারে তাঁহার গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছেন, প্রাণপণে তাঁহার অঞ্চল ধরিয়াছেন। বিমলা বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, “কি হইয়াছে? আবার ভূত না কি?”
ব্রাহ্মণের বাক্য সরে না, কেবল অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইলেন, “ঐ।”
বিমলা নিস্তব্ধ হইয়া সেই দিকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ঘন ঘন প্রবল নিশ্বাসশব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল, এবং নির্দিষ্ট দিকে পথপার্শ্বে একটা পদার্থ দেখিতে পাইলেন।
সাহসে নির্ভর করিয়া নিকটে গিয়া বিমলা দেখিলেন, একটি সুগঠন সুসজ্জীভূত অশ্ব মৃত্যুযাতনায় পড়িয়া নিশ্বাস ত্যাগ করিতেছে।
বিমলা পথ বাহন করিতে লাগিলেন। সুসজ্জীভূত সৈনিক অশ্ব পথিমধ্যে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখিয়া তিনি চিন্তামগ্ন হইলেন। অনেক্ষণ কথা কহিলেন না। প্রায় অর্ধ ক্রোশ অতিবাহিত করিলে, গজপতি আবার তাঁহার অঞ্চল ধরিয়া ধরিয়া টানিলেন।
বিমলা বলিলেন, “কি?”
গজপতি একটি দ্রব্য লইয়া দেখাইলেন। বিমলা দেখিয়া বলিলেন, “এ সিপাহির পাগড়ী।” বিমলা পুনর্বার চিন্তায় মগ্না হইলেন, আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন, “যারই ঘোড়া, তারই পাগড়ী? না, এ ত পদাতিকের পাগড়ী|”
কিয়ৎক্ষণ পরে চন্দ্রোদয় হইল। বিমলা অধিকতর অন্যমনা হইলেন। অনেক্ষণ পরে গজপতি সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুন্দরি, আর কথা কহ না যে?”
বিমলা কহিলেন, “এ পথে কিছু চিহ্ন দেখিতেছ?”
গজপতি বিশেষ মনোযোগের সহিত পথ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিয়া কহিলেন, “দেখিতেছি, অনেক ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন।”
বি। বুদ্ধিমান – কিছু বুঝিতে পারিলে?
দি। না।
বি। ওখানে মরা ঘোড়া, সেখানে সিপাহির পাগড়ী, এখানে এত ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন, এতে কিছু বুঝিতে পারিলে না? – কারেই বা বলি?
দি। কি?
বি। এখনই বহুতর সেনা এই পথে গিয়াছে।
গজপতি ভীত হইয়া কহিলেন, “তবে একটু আস্তে হাঁট; তারা খুব আগু হইয়া যাক।”
বিমলা হাস্য করিয়া বলিলেন, “মূর্খ! তাহারা আগু হইবে কি? কোন্ দিকে ঘোড়ার খুরের সম্মুখ, দেখিতেছ না? এ সেনা গড় মান্দারণে গিয়াছে” বলিয়া বিমলা বিমর্ষ হইয়া রহিলেন।
অচিরাৎ শৈলেশ্বরের মন্দিরের ধবল শ্রী নিকটে দেখিতে পাইলেন। বিমলা ভাবিলেন যে, রাজপুত্রের সহিত ব্রাহ্মণের সাক্ষাতের কোন প্রয়োজন নাই; বরং তাহাতে অনিষ্ট আছে। অতএব কি প্রকারে তাহাকে বিদায় দিবেন, চিন্তা করিতেছিলেন। গজপতি নিজেই তাহার সূচনা করিয়া দিলেন।
ব্রাহ্মণ পুনর্বার বিমলার পৃষ্ঠের নিকট আসিয়া অঞ্চল ধরিয়াছেন; বিমলা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আবার কি?”
ব্রাহ্মণ অস্ফুট স্বরে কহিলেন, “সে কত দূর?”
বি। কি কত দূর?
দি। সেই বটগাছ?
বি। কোন্ বটগাছ?
দি। যেখানে তোমরা সেদিন দেখেছিলে?
বি। কি দেখেছিলাম?
দি। রাত্রিকালে নাম করিতে নাই।
বিমলা বুঝিতে পারিয়া সুযোগ পাইলেন।
গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “ই:।”
ব্রাহ্মণ অধিকতর ভীত হইয়া কহিলেন, “কি গা?”
বিমলা অস্ফুট স্বরে শৈলেশ্বরনিকটস্থ বটবৃক্ষের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন “সে ঐ বটতলা।”
দিগ্গবজ আর নড়িলেন না; গতিশক্তিরহিত, অশ্বত্থপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিলেন।
বিমলা বলিলেন, “আইস।”
ব্রাহ্মণ কাঁপিতে কাঁপিতে কহিলেন, “আমি আর যাইতে পারিব না।”
বিমলা কহিলেন, “আমারও ভয় করিতেছে।”
ব্রাহ্মণ এই শুনিয়া পা ফিরাইয়া পলায়নোদ্যত হইলেন।
বিমলা বৃক্ষপানে দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন, বৃক্ষমূলে একটা ধবলাকার কি পদার্থ রহিয়াছে। তিনি জানিতেন যে, বৃক্ষমূলে শৈলেশ্বরের ষাঁড় শুইয়া থাকে; কিন্তু গজপতিকে কহিলেন “গজপতি! ইষ্টদেবের নাম জপ; বৃক্ষমূলে কি দেখিতেছ?”
“ও গো – বাবা গো___” বলিয়াই দিগ্গ জ একবারে চম্পট। দীর্ঘ দীর্ঘ চরণ – তিলার্ধ মধ্যে অর্ধ ক্রোশ পার হইয়া গেলেন।
বিমলা গজপতির স্বভাব জানিতেন; অতএব বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি একেবারে দুর্গ-দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইবেন।
বিমলা তখন নিশ্চিন্ত হইয়া মন্দিরাভিমুখে চলিলেন।
বিমলা সকল দিক ভাবিয়া আসিয়াছিলেন, কেবল একদিক ভাবিয়া আইসেন নাই; রাজপুত্র মন্দিরে আসিয়াছেন কি? মনে এইরূপ সন্দেহ জন্মিলে বিমলার বিষম ক্লেশ হইল। মনে করিয়া দেখিলেন যে, রাজপুত্র আসার নিশ্চিত কথা কিছুই বলেন নাই; কেবল বলিয়াছিলেন যে, “এইখানে আমার সাক্ষাৎ পাইবে, এখানে না দেখা পাও, তবে সাক্ষাৎ হইল না।” তবে ত না আসারও সম্ভাবনা।
যদি না আসিয়া থাকেন, তবে এত ক্লেশ বৃথা হইল। বিমলা বিষণ্ণ হইয়া আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন যে, “এ কথা আগে কেন ভাবি নাই? ব্রাহ্মণকেই বা কেন তাড়াইলাম? একাকিনী এ রাত্রে কি প্রকারে ফিরিয়া যাইব! শৈলেশ্বর! তোমার ইচ্ছা!”
বটবৃক্ষতল দিয়া শৈলেশ্বর-মন্দিরে উঠিতে হয়। বিমলা বৃক্ষতল দিয়া যাইতে দেখিলেন যে, তথায় ষণ্ড নাই; বৃক্ষমূলে যে ধবল পদার্থ দেখিয়াছিলেন, তাহা আর তথায় নাই। বিমলা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইলেন; ষণ্ড কোথাও উঠিয়া গেলে প্রান্তর মধ্যে দেখা যাইত।
বিমলা বৃক্ষমূলের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত করিলেন; বোধ হইল, যেন বৃক্ষের পশ্চাদ্দিকস্থ কোন মনুষ্যের ধবল পরিচ্ছদের অংশমাত্র দেখিতে পাইলেন, সাতিশয় চঞ্চলপদে মন্দিরাভিমুখে চলিলেন; সবলে কবাট করতাড়িত করিলেন।
কবাট বন্ধ। ভিতর হইতে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন হইল, “কে?”
শূন্য মন্দিরমধ্য হইতে গম্ভীর স্বরে প্রতিধ্বনি হইল, “কে?”
বিমলা প্রাণপণে সাহসে ভর করিয়া কহিলেন, “পথ-শ্রান্ত স্ত্রীলোক।”
কবাট মুক্ত হইল।
দেখিলেন মন্দিরমধ্যে প্রদীপ জ্বলিতেছে, সম্মুখে কৃপাণকোষ-হস্তে এক দীর্ঘাকার পুরুষ দণ্ডায়মান। বিমলা দেখিয়া চিনিলেন, কুমার জগৎসিংহ।