দুর্গা ষষ্ঠীর কথা
আশ্বিন মাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন মা দুর্গা কৈলাস পাহাড়ে বসে এক মুঠো করে ধুলো তুলছেন আর কাপড়ে হাত মুচ্ছেন। এমন সময় মহাদেব এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও কি হচ্ছে দুর্গা!’ ভগবতী বললেন, ‘আমি কাপড়ে ধুলো মাখাচ্ছি। মানুষের ছেলে হয়, তারা ধুলো মেখে মায়ের কোলে ওঠে; তাতেই যে কাপড়ে ছাপা ছাপা ধুলোর দাগ হয়, তাই আমি পরতে বড়ো ভালোবাসি। আমার কপালে তো আর ছেলে হল না! তুমি সকলকে ছেলে দান করো, আমায় কিন্তু একটিও ছেলে দিলে না।’ মহাদেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘হ্যাঁ পার্বতী, তোমাকে যে সকলে জগৎজননী বলে! এই পৃথিবীতে সকলেই তোমাকে মা বলে ডাকে, তাতেও কি তোমার ছেলের সাধ মেটে না? আর তুমি তো প্রসব-বেদনা সহ্য করতে পারবে না।’ তখন দুর্গার কুমারী অবস্থায় যে কার্তিকের জন্ম হয়েছিল, সেই ছেলের কথা মনে হল। যদিও কার্তিক দুর্গার গর্ভে জন্মাননি, তবুও তিনি শিবের সন্তান। তাই দুর্গা বললেন, ‘আমায় সেই কার্তিককে এনে দাও, নইলে আমি এবার বাপের বাড়ি গিয়ে আর আসব না।’ মহাদেব বললেন, ‘বেশ তো, আমি তোমার কার্তিককে এনে দিচ্ছি।’ কার্তিক তখন চন্দ্রের স্ত্রী কৃত্তিকার কাছে ছিলেন। মহাদেব সেইখানে গেলেন। জয়া, বিজয়া দুর্গাকে তেল-হলুদ মাখাতে বসলেন। যতগুলি গায়ের ময়লা পড়তে লাগল, দুর্গা সেইগুলি নিয়ে ধুলা মিশিয়ে একটি সুন্দর পুতুল গড়লেন।
এমন সময় নারায়ণ সেইখান দিয়ে যেতে যেতে ওই পুতুলটি দেখতে পেলেন। নারায়ণ মনে মনে ভাবলেন, এইবার আমার খুব সুবিধে হয়েছে, আমার চিরকালের আশা পূর্ণ হবে! ভগবতীর স্তনপান করতে আমার বড়ো সাধ। কিন্তু ওঁর গর্ভে জন্মাবার তো কোনো উপায় নেই। ওই পুতুলে আমি আবির্ভাব হব। এই বলে তিনি ওই গড়া পুতুলে আবির্ভাব হলেন। দুর্গাকে ‘মা মা’ বলে কোলে গিয়ে তিনি স্তনপান করতে লাগলেন। দুর্গার আর আহ্লাদের সীমা নেই, ছেলে কোলে করে জয়া, বিজয়াকে সঙ্গে করে স্নান করতে গেলেন। ছেলের গা মুছিয়ে একটি পদ্ম ফুলের কুঁড়ি হাতে দিলেন। তারপর দুর্গা স্নান করে ছেলে কোলে করে বাড়ি এলেন। বাড়িতে এসে দেখেন যে, মহাদেব কার্তিককে সঙ্গে করে বাড়ি এনেছেন। তখন দুর্গা দুই ছেলেকে দুই কোলে নিয়ে চুমু খেতে লাগলেন। মহাদেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দুর্গা! তুমি এ ছেলেটি কোথায় পেলে?’ দুর্গা বললেন, ‘তা জানি না, মাটির পুতুল গড়ছিলুম, সেই পুতুল আমায় ‘মা মা’ বলে ডেকে কোলে উঠল!’ তখন মহাদেব আহ্লাদ করে সমস্ত দেবতাদের নিমন্ত্রণ করে আনালেন, যে দুর্গার ছেলে হয়েছে। ছেলে দেখতে সব দেবতারা এলেন, সেই সঙ্গে শনিও এলেন। ছেলে দেখে সকলে ধন্যি ধন্যি করলেন। শনি আর থাকতে পারলেন না। তিনি দুর্গার ভাই, ছেলের মামা। কাজেই জোর করে যেমনি ছেলের দিকে চেয়েছেন, অমনি ছেলের মুন্ডু উড়ে গেল, রক্তে গা ভেসে গেল। কৈলাসে হাহাকার পড়ে গেল। মা দুর্গা মূর্ছা গেলেন। তারপর উঠে কাঁদতে কাঁদতে মহাদেবকে বললেন, ‘আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দাও।’ দুর্গা রেগে শনিকে কাটতে উদ্যত হলেন। তখন দেবতারা স্তবস্তুতি করে বুঝিয়ে বললেন, ‘মা, আপনি তো ওকে বর দিয়েছেন, আর আপনিই ওকে ভুলে কাটতে যাচ্ছেন।’ দুর্গা তখন একটু ঠাণ্ডা হয়ে কেঁদে-কেটে বললেন, ‘আচ্ছা, বেশ; এখন আমার ছেলেকে তোমরা বাঁচিয়ে দাও।’
মহাদেব তখন নন্দীকে বললেন, ‘দেখ নন্দি, যদি কেউ উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে থাকে, তার মাথাটা কেটে আন।’ নন্দী স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঘুরে দেখে যে, একটা শ্বেত হস্তী উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে আছে। সেই হাতিটার মাথা কেটে নিয়ে নন্দী মহাদেবকে দিলেন। মহাদেব সেই মাথাটা ছেলের কাঁধে জোড়া দিলেন, ছেলে উঠে মায়ের কোলে গিয়ে বসল। দুর্গা কাঁদতে লাগলেন, আমার এমন ছেলে তার হাতির মাথা হল; লোকে কত ঠাট্টা করবে! তখন মহাদেব ও যত দেবতা সকলে মিলে বললেন, ‘তোমার ছেলেকে কেউ নিন্দে করবে না। তোমার ছেলের নাম রইল গণপতি। সিদ্ধিদাতা গণেশের নাম করে যাত্রা করলে কারো কোনো বিপদ ঘটবে না। আর আগে তোমার গণেশের পূজা না হলে কোনো দেবতার পূজা হবে না।’ এই বলে সব দেবতারা যে যার স্থানে চলে গেলেন। দুর্গা কার্তিক ও গণেশকে নিয়ে মর্ত্যে এলেন। মেনকাকে বললেন, ‘মা! আমি এই ষষ্ঠীর দিন এই দুইটি ছেলে পেয়েছি। যে কোনো স্ত্রীলোক আমার এই কথা শুনে ষষ্ঠীর পালনী করবে, সে আমার মতো পুত্র লাভ করবে।’ মা বললেন, ‘তাই হবে মা।’ সেই থেকে সকলে দুর্গা ষষ্ঠী করে।
দুর্গা ষষ্ঠীর কথা সমাপ্ত।