দুরন্ত ধারা – ৫

পাঁচ 

গিরিবালার ব্যথা উঠল বেলা থাকতে থাকতেই। যন্ত্রণার চেয়ে লজ্জাটাই প্রথমে বড় হয়ে উঠেছিল ওর কাছে। তাই কাউকে কিছু বলেনি। কেমন এক অজানা আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল ওর মনে। ক্রমেই অসহায় বোধ করছিল সে। বারকয়েক পায়খানায় গেল। স্বস্তি পেল না। বিছানায় এসে এলিয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে দু’হাত দিয়ে তলপেট চেপে ধরতে লাগল। শেষে অস্থির হয়ে উঠল। 

গিরিবালার মনে হল, সাক্ষাৎ এক আগ্নেয়গিরি বাসা বেঁধেছে তার উদরে। প্রথমে ভ্রূণ, পরে একটু একটু করে পুষ্ট হয়েছে অঙ্কুর। অঙ্কুর পুষ্ট হয়ে এখন ফেটে পড়বার মতো বিরাট শক্তি সঞ্চয় করেছে। সে আর বাধা মানবে কেন? তাকে বাধা দেবে কে? বাইরের আলো বাতাস মুক্তি তার অপেক্ষায় আকুল হয়ে আছে। সে কি আর ভিতরের অন্ধ গুহায় বৃথা কালক্ষেপ করতে পারে? এখন বেরিয়ে আসার পথ চাই তার। তারই সন্ধানে সে ব্যস্ত। 

গিরিবালা ক্রমেই কাতর হয়ে উঠতে লাগল। নিদারুণ বেদনা তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করল। আজ সকাল থেকেই এই ব্যথা তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে। প্রথম দিকে খুব লঘুপায়ে তার আনাগোনা শুরু হয়েছিল। তখন গিরিবালা পরিণাম বুঝতে পারেনি। কাউকে কিছু বলেওনি। শুধু একবার যখন বেশ বড় রকমের একটা মোচড় খেল, তখন লজ্জার মাথা খেয়ে বড়মাকে কথাটা বলে ফেলেছিল। তারপর থেকেই বড়মা তাকে চোখে চোখে রেখেছেন। পরে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ল ব্যথাটা। অনেকক্ষণ আর কিছু টের পায়নি। গিরিবালা ভাবল, যাক, এবার বোধহয় নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। অনেকটা হালকা মনেই খাওয়া-দাওয়া সারল। 

বিকালের দিকে গিরিবালা প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল। অতর্কিত আক্রমণে হকচকিয়ে গিয়েছিল সে। সামলে উঠতে না উঠতেই আর-এক ঝাঁকি খেল সে। তার মনে হল, এই দুই ঝাঁকিতেই তার মর্মস্থল বুঝি উপড়ে এল। ককিয়ে উঠল প্রচণ্ড বেদনায়। চোখে অন্ধকার দেখল। মৃত্যুর আতঙ্ক ফুটে উঠল তার মুখে চোখে। 

কী করলে পরিত্রাণ মিলবে, বুঝে উঠতে পারল না গিরিবালা। বুঝতে পারল না, তার এখন কী করা উচিত। একটু একটু বিরতির পর ঢেউয়ের পর বেদনার ঢেউ এসে গিরিবালাকে নাস্তানাবুদ করতে লাগল। প্রতিবার তার মনে হতে লাগল, এই বুঝি তার প্রাণটা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। গিরিবালা ছটফট করতে শুরু করল। উঠে বসল। শুয়ে পড়ল। চিত হল। উপুড় হল। আবার চিত হল। হাঁটু মুড়ে তলপেটে চাপ দিয়ে যন্ত্রণার উপশম করার চেষ্টা করল। বাইরে গেল। একটু পায়চারি করল। পায়খানায় গেল। কিছুতেই আরাম পেল না, তখন আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে গোঙাতে লাগল। বড়বউ পাশের ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করছিলেন। চাঁপা ঘুমিয়ে পড়েছে সামনে। বড়বউ মাঝে মাঝে হাত নেড়ে তার গা থেকে মাছি তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। গিরিবালার অস্পষ্ট গোঙানি তাঁর কানে গেল। ধড়মড় করে উঠে তার কাছে গিয়ে বসলেন। দেখেন, গিরিবালার মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে। বেশবাস আলুথালু, দরদর করে ঘাম ঝরছে গিরিবালার। 

মণি রে, ব্যথা উঠল নাকি? 

গিরিবালা কথা বলতে পারল না। বড়বউয়ের একখানা হাত প্রাণপণে চেপে ধরে থাকল।

বড়বউ ব্যস্ত হয়ে ননদকে ডাক দিলেন, ও মা’জদি, আসো দিনি। বুড়িরি বোধহয় নামাতি হবে। 

শুভদা নিকেলের চশমা পরে ভাগবত পড়ছিলেন। চশমা খুলতে খুলতে এসে পড়লেন।

বললেন, বড়বউ, অন্নরে ডাকো। সাধের শাড়িডে পাড়ে আনো। আর মহিরি ক’ ঠাকুর মশাইরি আনতি লোক পাঠায়ে দিক। 

বড়বউ চলে গেলে শুভদা গিরিবালার পাশে গিয়ে বসলেন। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে আশ্বাস দিলেন। 

বললেন, ভয় পায়ে না মা। এমন দিন সব মেয়েরই আসে। কোনও ভয় নেই। 

তিনি গিরিবালার খোঁপা খুলে চুল এলো করে ডগায় একটা আলগা গিঁট বেঁধে রাখলেন। গায়ের গহনাগুলো সব খুলে ফেললেন। অন্ন এসে দরজায় দাঁড়াল। 

শুভদা বললেন, অন্ন, যা, কুড়েডা ঠিক কর গে। মালসায় আগুন কর। ফুলির মা’রে জল গরম করতি ক’। 

মেজকর্তা হন্তদন্ত হয়ে এলেন। ভয়ে ভাবনায় মুখ চুপসে গিয়েছে। দাড়িতে হাত চলছে ঘনঘন। 

জিজ্ঞাসা করলেন, বুড়ি আছে কেমন? 

স্বরে একরাশ উৎকণ্ঠা। ভয়ে বিছানায়-শোয়া মেয়ের দিকে চাইতে পর্যন্ত পারলেন না।

শুভদা জবাব দিলেন, ব্যথা উঠিছে। ভয় নেই। ভয় কী? তুই লোক পাঠালি ঠাকুর মশায়ের কাছে? 

মেজকর্তা বললেন, হ্যাঁ। আচ্ছা মেজদি, যা জল পড়ছে তাতে কুড়েটা তো ভিজে সপসপ করছে। নাই বা নামালে বুড়িকে। গুদোমের পশ্চিমের বারান্দাটা না হয় ঘিরে দিই। আর একটা ডাক্তার নিয়ে আসি। আঠারোখাদার গোবিন্দ ডাক্তারের তো বেশ হাতযশ আছে। 

শুভদা বললেন, মহি, তুই কি মেয়ের চিন্তায় সত্যিই পাগল হলি? ছেলেমেয়ে কি এই বাড়িতে নিহাত কম হয়েছে। কুড়ে ছাড়া কোনডে ঘরে হয়েছে ক’ দিনি? নিয়ম রীত মানতি হবে তো, না কি? ডাক্তার বরং একটা আনতি পারিস। তাতে বুড়ির উপকার হোক না হোক, তোর মাথা ঠান্ডা হবে। তালি আর দেরি করিসনে, এখনই লোক পাঠায়ে দে। 

মেজকর্তা আর কথা বাড়ালেন না। লোকও পাঠালেন না। নিজেই ছুটলেন আঠারোখাদায়। আকাশের আক্রোশ তখনও কিছুমাত্র কমেনি। 

.

গিরিবালা কাটা পশুর মতো ছটফট করছে কুঁড়েখানার ভিতর। একটানা গোঙানি শোনা যাচ্ছে তার। উপশমহীন যন্ত্রণার অনন্ত সমুদ্রে সে ভাসছে। দোসরহীন। একেবারে একা। কোঁথায় তার এই বেদনার উৎস? পেটে। তলপেটে। গিরিবালা তার ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে। অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে বেদনার কাছে। মৃত্যুর কাছে। গিরিবালা জানে তার মৃত্যুর আর দেরি নেই। তবে আর দেরি কেন? মরণ হোক তার। সে আর পারছে না। তার প্রাণটা যেন ভারী এক ভোঁতা জাঁতার মধ্যে পড়ে গেছে। একটু একটু করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। 

শুভদা ঠাকরুন কুঁড়ের মধ্যে গিয়ে বসেছেন। তিনি গিরিবালার চুলের ডগের গিঁটটাও খুলে দিলেন। কী একটা শিকড় বেঁধে দিলেন এলোচুলে। বড়বউ লেপের ওয়াড়, বালিশ-তোশকের ওয়াড় খুলে ফেললেন। সব বন্ধন মুক্ত করা চাই। বাইরের বাঁধন খুলে দিলে যদি গিরিবালার পেটের বাঁধন আলগা হয়! তখন যদি ত্বরায় প্রসব হয়। বাক্সের তালা, কাঠের সিন্দুক, হাত বাক্সের ডালা খোলো। কুড়ের বেড়া কেটে দাও। নিয়ম-রীতি মেয়েদের যা জানা ছিল, সব তাঁরা পালন করলেন। ফল কিছু হল না। রিদয় ঠাকুর এসে মন্ত্র পড়লেন, অস্তি গোদাবরী তীরে জম্ভোলী নামা রাক্ষসী, তস্য স্মরণমাত্রেণ সুখপ্রসবং ভবেৎ। কিন্তু জম্ভোলীর স্মরণেও প্রসব হল না। 

শুভদা বললেন, ও অন্ন, বুড়ির বগলে হাত পুরে ওরে খাড়া করে তোল, তারপর হাঁটাতি থাক। ও অন্ন, ইবারে বুড়িরি উপুড় করে শুয়া, শুয়ায়ে আস্তে আস্তে বুড়ির মাজায় চাপড় মার। বুড়ির চুলির গুছা ওর মুখি পুরে বমি করা। 

সবরকম করা হল। কিন্তু কোনও কৌশলই খাটল না। 

সব প্রক্রিয়াই ব্যর্থ হল। গিরিবালা ক্রমশই নির্জীব হয়ে পড়তে লাগল। 

.

সন্ধে গেল। রাত হল। ছোটবউ গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কাণ্ডকারখানা সব দেখতে লাগলেন। দেখলেন, ডাইনি আবার তার কাজ শুরু করেছে। আবার এক রাজপুত্তুর আসছে। আবার তার ঘাড় মটকাবার আয়োজন চলেছে। 

ছোটবউ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। প্রবল উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। দাঁড়াও, দ্যাখাচ্ছি এইবারে মজা! খুঁজে পেতে ঘর থেকে বার করলেন পুরনো আমলের মরচে ধরা এক খাঁড়া। দুমদাম লাথি মারতেই দরজার শিকল খুলে গেল। 

পা টিপে টিপে কুঁড়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সেই মুহূর্তে অন্ন একা ছিল কুঁড়েটাতে। একটু আগে শুভদা গরম জল আনতে গেছেন। ছোটবউ খাঁড়া হাতে ‘মাগি তোর রক্ত খাব’ বলে হুংকার দিয়ে, এক লাফে কুঁড়ের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তা দেখেই অন্নর প্রাণ খাঁচাছাড়া উপক্রম হল। বাপ রে মা রে করে সে দিল এক ছুট। ছোটবউ চোখের পলকে গিরিবালাকে পাঁজাকোলা করে এনে নিজের ঘরে ঢুকলেন। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই ঝপ করে দরজায় খিল এঁটে দিলেন। 

ছয় 

ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লাগল সবার। শুভদা আর বড়বউয়ের ধমকে অন্ন হাউমাউ থামিয়ে আসল খবরটা যখন বলল, তখনও তার কাঁপুনি থামেনি। 

বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করার পর সবার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। বড়বউ তো ভয়ে ভাবনায় থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। শুভদা গুম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। 

হঠাৎ শুভদা বললেন, অন্ন, একখানা মুটা লাঠি আমারে আনে দে তো। পাগলের পাগলামি আজ বের করে দিই। 

রাগে শুভদার চোখ বাঘের মতো জ্বলতে লাগল। 

বললেন, আর যা, তুই শিগগির রামকিষ্টোরে ডাকে আন। বাড়িতি পুরুষ মানুষ অ্যাকটা থাকা ভাল। বড়বউ, তুই আয় আমার সঙ্গে। 

দু’জনে চললেন ছোটবউয়ের ঘরে। 

ছোটবউয়ের আজ ভয়ানক দুশ্চিন্তা। চারিদিকে শত্তুর। রাজপুত্তুরকে বাঁচাই কী করে! একবার করে তিনি ছুটে ছুটে গিরিবালার কাছে যাচ্ছেন। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ভয় নেই, ভয় নেই করে সাহস দিচ্ছেন তাকে। পরমুহূর্তেই খাঁড়া বাগিয়ে দরজার গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ ঢুকেছে কি ঘ্যাঁচ করে এক কোপ। একেবারে দুফাঁক 

এমন সময় যা ভেবেছেন তাই, বাইরে থেকে দুমদাম দরজায় ঘা। এই ওই ডাইনির কাজ। ঠিক তাই। অমনি শুভদার গলা শোনা গেল। 

এই হারামজাদি, খোল দরজা। ভাল চাস তো এক্ষুনি দরজা খোল। নাহলি মারে তোর হাড় গুঁড়োয়ে দিবানে। 

ছোটবউ ভিতর থেকে হুংকার দিলেন, ঢুকিছিস কি ঘ্যাঁচ, দু’খান করে দেব। রক্ত খাওয়া তোর জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেব। ডাইনি কোথাকার! ঢুকে দ্যাখ একবার, আমার হাতে মন্তর-পড়া খাঁড়া রয়েছে। 

এমন সময় শুভদার চিৎকার শোনা গেল। 

মহি, শিগগির আয়। সব্বোনাশ হয়ে গেছে। পাগল বুড়িরি আতুড়ির থে তুলে ওর ঘরে নিয়ে গেছে। খাঁড়া হাতে দরজায় দাঁড়ায়ে আছে। কী সব্বোনাশ যে হল কে জানে? 

বলো কী? মেজকর্তা আর্তনাদ করে উঠলেন। তাঁর পায়ের তল থেকে মাটি যেন সরে গেল।

এখন উপায়? 

উপায় ছোটবউই বাতলে দিলেন। মেজ ভাশুরের উপর তাঁর অগাধ ভরসা। জানলা খুলে ভাশুরকে ডাক দিলেন। 

বললেন, আমি দরজা খুলছি, কিন্তু খবরদার, ওই ডাইনিগুলো যেন না আসে। আর আমি ওদের কারও রক্ত চুষতে দিচ্ছিনে। আপনি বলুন, কথা দিন, ওদের এ-ঘরে ঢুকতে দেবেন না। বড়গিন্নি ইচ্ছে করলে ঢুকতে পারেন। কিন্তু ডাইনিটিকে ঢুকতে দিচ্ছিনে। 

মেজকর্তা যেন কূল পেলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। 

বললেন, হ্যাঁ ছোটবউ, তাই হবে। ও তো তোমারই মেয়ে। তুমি যা বলবে তাই হবে।

ছোটবউ খুব খুশি। দরজা খুলে দিলেন তাড়াতাড়ি। হুড়মুড় করে সবাই ঢুকতে যাচ্ছিল, মেজকর্তা বাধা দিলেন। মেজকর্তা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে ঢুকলেন। আর এল অন্ন। আর কাউকে ঢুকতে দিলেন না তিনি। 

.

এত যে ব্যাপার ঘটল গিরিবালা তার কিছুই জানে না। দুঃসহ বেদনার ভারে আচ্ছন্ন সে। তখন খেয়া মারছে চৈতন্য আর অচৈতন্যের মাঝখানের ঘাটে। 

বিন্দুমাত্র শক্তিও আর তার অবশিষ্ট নেই। গোঙানির তেজও নিবু নিবু। চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। মাঝে মাঝে অস্ফুট শোনা যাচ্ছে, মা, মা, আর পারিনে। ছোটবউয়ের চোখে জল। 

বাইরে প্রকৃতি হিংস্র। মাতাল। বৃষ্টি আর ঝড়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। 

ডাক্তারবাবু গিরিবালাকে পরীক্ষা করলেন। মেজকর্তাকে বললেন, আপনি বাইরে যান। একটা জোরালো বাতি পাঠিয়ে দিন। অন্নকে বললেন, গরম জল আর সাবান আনো। ফরসা ছেঁড়া কাপড় নিয়ে এসো। ছোটবউয়ের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। বললেন, খাঁড়াটা মেজবাবুকে দিয়ে দিন। আপনি গোলমাল করবেন না কিন্তু। 

ছোট্ট শিশুর মতো ছোটবউ ডাক্তারবাবুর কথা মেনে নিলেন। মেজভাশুর তো শিব। ভোলানাথ। 

ডাক্তারের অভ্যস্ত নিপুণ হাত প্রায় অচেতন গিরিবালার অঙ্গস্পর্শ করতে লাগল এখানে সেখানে। 

বেদনার সমুদ্রে গিরিবালা হালভাঙা নৌকোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। উঠছিল, নামছিল, হাবুডুবু খাচ্ছিল। কতক্ষণ ধরে সে জানে না। হঠাৎ সে টের পেল পুঞ্জীভূত বেদনার স্তূপ থেকে তাকে এক ধাক্কায় কে যেন উপশমের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। তার ভারী দেহটা মুহূর্তের জন্য যেন হালকা ঠেকল। অবসাদ আর আরামের অন্তহীন গহ্বরে সে ক্রমশ নেমে যেতে লাগল। একটা কথা সে যেন স্বপ্নের ঘোরে শুনতে পেল, ছেলে। 

গিরিবালার অচৈতন্য ঠোঁটে পরিব্যাপ্ত এক টুকরো মৃদু হাসি একাদশীর চাঁদের মতো ভেসে উঠল। একটু সলজ্জ, সৃষ্টির কৃতিত্বে একটু-বা গর্বিতও। 

বাইরে ঝড় থেমেছে। বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। দুরন্ত দুর্নিবার বৃষ্টি। সমস্ত বিশ্ব করুণা-করুণ। 

সাত 

তার কাছে কেউ ছিল না। সে একা। এই বিশাল পৃথিবীতে, এই অন্তহীন শূন্যতার সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট সে। ভেসে চলেছে একা। কে তাকে চেনে? সে কাকে চেনে? একাকিত্বের বিশাল অজানা মহাসাগরে সে শুধু হাবুডুবু খেয়ে চলেছে। কখনও ভুস করে ভেসে উঠছে উপরে, কখনও বা টুপ করে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর তলদেশের উদ্দেশে। কত দূরে, কত গভীরে, কোন অতলে, সে জানে না। সে তলিয়ে যেতে চায় না। ডুবতে চায় না। প্রাণপণে হাত পা ছোড়ে। হয়তো প্রতিবাদ জানায় ছোট ছোট দুটি কচি মুঠোয় শূন্যকেই বারবার আঁকড়ে ধরে আশ্রয় পেতে চায়। কিন্তু শূন্য কি আশ্রয় দিতে পারে? আশ্রয় সে পায় না। ডুবতে থাকে অনিচ্ছায়। অসহায়। হঠাৎ ভয় পায়। প্রবল ভয়। ককিয়ে কেঁদে ওঠে। ওয়াঁ ওয়াঁ। 

তার চারিপাশে গাঢ় অন্ধকার। ভয় ওত পেতে তার শিয়রে বসে আছে। সংশয় হিংস্র থাবা উঁচিয়ে অপেক্ষা করছে পায়ের কাছে। সন্দেহ অস্থির পায়ে লেজ আছড়াতে আছড়াতে তার ‘চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় সে যাবে? কোনখানে আশ্রয় নিলে সে পরিত্রাণ পাবে? তার সন্ধান সে জানে না। এখানে সে যে আগন্তুক। সব যে তার অচেনা। তার হয়তো ধারণা এটা তার শত্রুপুরী। ষড়যন্ত্র আর মৃত্যুর জটলা তার চারিপাশে। এ কোথায় সে এল? কেন এল এখানে? ভয়ে সে চোখ বোজে। চোখ বুজে শুধু কাঁদে। ওয়াঁ ওয়াঁ ওয়াঁ। 

ভয়ে সে অস্থির হয়ে ওঠে। পালাতে চায়। হাত ছোড়ে, পা ছোড়ে। প্রাণপণে। কিন্তু গতিহীন তার কোমল দেহটা বিছানায় বন্দি হয়ে থাকে। এক চুলও সরে না। সরে না মৃত্যুর আর ভয়ের সান্নিধ্য থেকে। অসহায়ভাবে তাই শুধু কাঁদে। ওয়াঁ ওয়াঁ ওয়াঁ। 

অকস্মাৎ নিজের তুলতুলে হাতখানা মুখে ঠেকে তার। নিজের দেহের উষ্ণতার স্বাদ পেয়ে নিজেই প্রচণ্ড বিস্ময়ে অবাক হয়ে যায়। এ আত্মীয়তার স্পর্শ থেকে মুক্তি পেতে চায় না। চেটে চেটে উষ্ণতাটুকু ষোলো আনা আত্মসাৎ করতে চায়। শক্ত মুঠি মুখে পুরে চুকচুক চাখতে থাকে। উত্তাপ, আরও উত্তাপ পেয়ে খুশি হয় সে। উল্লাসে পশুর মতো শব্দ করে কম কম কম। 

এতক্ষণ সে ভয়ে চোখ বুজে ছিল। এইবার সে চোখ মেলে চায়। দিশে হারিয়ে যায় তার। আবার সেই শূন্য শূন্য শূন্য। দিগদিগন্তহীন মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে তার দৃষ্টির নিরিখ পথ হারিয়ে ফেলে। ঘরের মটকা অনেক দূর। দেয়াল তো কয়েক যোজন। অতদূরে কচি নজর কি পৌঁছোতে পারে! আবার সে চোখ বোজে ভয়ে। বোজে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার খোলে। তার শুধু ভয়ই নেই, কৌতূহলও আছে। আছে অজানা পরিবেশকে জানার আগ্রহ। অন্ধকারই নেই শুধু, আছে আলোর ঝলকও। মৃত্যুর আতঙ্কই শেষ সত্য নয়, সত্য প্রাণের মহা প্রেরণাও। চোখ খুলতেই সূর্যের উজ্জ্বল আলো তার চোখ থেকে অন্ধকার আর মন থেকে মৃত্যুভয় দূর করে। তার প্রাণে তেজ সঞ্চারিত হয়। বর্ণের সমারোহে তার পুলক লাগে। খুশির হাসি উপচে পড়ে তার মুখ চোখ বেয়ে। সে অকারণেই হাসির ঢেউ তুলে তুলে জীবনের নতুন নতুন গান রচনা করতে থাকে। আপন খেয়ালে। 

শুধু জেগে থাকলেই যে সে এমন করে তা নয়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার রচনা সে করে যায়। তার ঘুম আর জাগরণের সীমানায় কেউ শক্ত হাতে প্রাচীর তুলে দেয়নি। তাই দুই রাজ্যে গমনাগমন তার এত অবাধ। ঘুমের ঘোরেও সে ভয় পেয়ে কাঁদে, আহ্লাদে হেসেও ওঠে। 

মাথায় আস্ত-সর্ষের বালিশ আর দুই ধারে দুই নরম পাশবালিশ চাপা দিয়ে তাকে রোদে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে এইমাত্র উঠল। ভয়ানক নিঃসঙ্গ বোধ হল তার। কঁংঘাটা ভিজে গেছে। খুব অস্বস্তি ঠেকছিল। আর দেহের কোনও যন্ত্রে যেন একটু বেদনাও অনুভব করছে। আর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তার। এখন অহর্নিশি তার পেটে দাউ দাউ আগুন জ্বলে। এখনও তার পেট জ্বলছে। মোটের উপর ভাল লাগছে না তার। দু’-একবার খুঁত খুঁত করে কাঁদল। কেউ শুনল না। কেউ এলও না তার কাছে। তখন দুরন্ত অভিমানে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। কেউ নেই, ওর ব্যথার ব্যথী কেউ নেই এই সংসারে। ও একা, একা, একা।

চাঁপা ছুটতে ছুটতে এল। দেখল, ছেলে একেবারে কেঁদে ফেটে পড়ার জো হয়েছে। তাড়াতাড়ি ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে ও ও ও করে আদর করতে লাগল। 

সুনা আমার, মণি আমার, কাঁদে না, কাঁদে না, কী হয়েছে, কী হয়েছে, ও ও ও, কিডা মারেছে আমার সুনারি, কিডা মারেছে, তারে আমি মারে দিবানে, এই দিলাম এক চড়, কাঁদে না, কাঁদে না, ও আমার বাবা, ও আমার সুনা, না না, অত রাগ কি করতি হয়, টিয়েপাখি নিবা, ঝুমঝুমি নিবা! 

চাঁপা ঝুমঝুমিটা নিয়ে ওর মুখের কাছে নাড়তে লাগল। অদ্ভুত রকমের আওয়াজ শুনে সে প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়ে কান্নাটা কিছুক্ষণের জন্য থামিয়েছিল, কিন্তু শরীরের অস্বস্তি নিরন্তর খোঁচা মারতে আবার দ্বিগুণ ব্যথায় কাঁদতে লাগল। কেউ যে ওর কান্না লক্ষ করছে, ওর কান্নার যে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা ওর সহজাত বোধ ওকে বলে দিল। তাই আরও সুবিধা আদায় করবার জন্য সে পরিত্রাহি ককিয়ে ককিয়ে কাঁদতে লাগল। 

থামাতে না পেরে চাঁপা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। অতি কষ্টে তার ওই নাদুস নুদুস ভারী শরীরটা চাঁপা কোলের উপর তুলে নিল। তারপর হাঁটু ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ওকে ঠান্ডা করতে চেষ্টা করল। 

ও ও ও, সুনা আমার, মণি আমার, বাবা আমার, চুপ করো, চুপ করো, আমসত্ত্ব খাবা, কুলির আচার খাবা, ও দিদি, শিগগির আয়, না না না, কাঁদে না, কাঁদে না, অত কি কাঁদে, ছি ছি, না না, বকিনি, বকিনি, ও ধন ও ধন, ও সুনা। ধ্যাত্তোরি। 

এবার চাঁপা রেগে গেল। 

আচ্ছা ছেলে রে বাবা, কানাই বাঁশি বাজাতি আরম্ভ করলেন তো তার আর খ্যামা নেই। ও দিদি, ও বড়মা, কানে কি সব তুলো ঠাসে রাখিছ? ছেলে যে এদিক আকাটা হয়ে গেল। 

চাঁপা অত ভারী ছেলেটাকে ভাল করে নাড়তেও পারে না। এতক্ষণ কোলে নিয়ে ওর পায়ে ঝিঁঝি ধরে গিয়েছে, তাই ছেলেটাকে যেই একটু নড়াতে গেল অমনি টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে খাটের উপর থেকে মেঝেয় পড়ে গেল। ছেলেটা ক্যাক করে একবার শব্দ করেই চুপ মেরে গেল। চাঁপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। 

দিদি রে, শিগগির আয়, তোর ছেলে বুঝি মরে গেল। 

.

ভাত খেতে খেতে গিরিবালা ছেলের কান্না শুনতে পাচ্ছিল। উঠি উঠি করেও উঠতে পারছিল না। আজকাল রাক্ষসের মতো খিদে পায় তার। সে এমনিতেই বড় লাজুক। চেয়ে খেতে পারে না, নিয়ে তো নয়ই। বারবার খাই খাই করাটাও সে পছন্দ করে না। তাই দুপুরের খাওয়াটা একটু বেশি করেই খায়। বড়মা বসে থাকেন সামনে, পিসিমা তদারক করেন, তাতেই গিরিবালা যেন লজ্জায় থালার সঙ্গে মিশে যায়। 

আজ রান্নাটাও চমৎকার হয়েছে। বিশেষ করে বড়ি দিয়ে টাটকিনি মাছের ঝোলটা। এ জিনিস খুব ভালবাসে গিরিবালা। তাই তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল। হঠাৎ চাঁপার চিৎকার শুনে খাওয়া ‘মাথায় উঠে গেল তার। মরে গেল তার ছেলে! দুম করে কে যেন তার মাথায় ডাঙস মারল। বোঁ করে বাড়িঘরগুলো ঘুরে গেল একবার। গিরিবালা উঠতে চেষ্টা করল, প্রথমবার পারল না। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে উঠেই পাগলের মতো দিল ছুট। 

হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে গিরিবালা দেখল ঘর ফাঁকা। চাঁপা নেই, তার ছেলে নেই। সব ফাঁকা। কিছু বুঝতে পারল না গিরিবালা। ফ্যালফ্যাল করে তার ছেলের শূন্য বিছানার দিকে চেয়ে রইল। তার হৃৎপিণ্ডটা বুকের ভিতর প্রবল শব্দে হাতুড়ি পিটতে শুরু করেছে। হাত পা সর্বশরীর তার কাপতে লাগল থরথর করে। কী করবে সে, কী তার করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিল না। 

চাঁপা ঢুকল ঘরে। চাঁপার চোখের জল তখনও শুকোয়নি। গিরিবালার দিকে চেয়ে অপরাধীর হাসি হাসল চাঁপা। 

বলল, ধন্যি ছেলে তোর দিদি। আমার কোলে একটুও চুপ করল না। পড়ে ধড়ে একেবারে আকাটা হয়ে গেলেন। যেই ছোটকাকিমা আসে কোলে তুলে নেলেন, অমনি চুপ। দিব্যি খেলা করছেন হাত পা নাড়ে 

কী বলল চাঁপা! হড়বড় করে কী বলল! কাকিমার কোলে খেলা করছে। হাত পা নাড়ছে। তবে মরেনি। বেঁচে আছে। বেঁচে আছে। গিরিবালা অনেক কষ্টে তার এলোমেলো চিন্তাকে মগজের মধ্যে গুছিয়ে নিল। বেঁচে আছে তার ছেলে। এবার সে অনেক স্পষ্টভাবে তা বুঝতে পারল। কিন্তু কই, তার অস্বস্তির, তার মানসিক যন্ত্রণার তো উপশম হল না। হাতুড়ি আরও দ্রুত-তালে পিটে চলল তার বুক, তার দেহের কম্পন আরও বেড়ে গেল। বসে না পড়লে মাথা ঘুরে পড়েই যেত গিরিবালা। খাটের কোনায় বসে পড়ল। তার ছেলে বেঁচে আছে। আঃ! ভগবান, ভগবান, ভগবান! 

তার হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে একটা যন্ত্রণাদায়ক বাতাস এতক্ষণ ধরে পাক খেয়ে খেয়ে ঠেলে উঠছিল, এবার একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে হুস করে বেরিয়ে গেল। সেটা বেরিয়ে যেতেই গিরিবালার বুক নিমেষে হালকা হয়ে গেল। এতক্ষণের সব দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক গলে জল হয়ে তার দুই চোখের কোণ দিয়ে টস টস করে ঝরে পড়তে লাগল। আঃ, কী শান্তি, কী শান্তি! 

দিদির কান্না দেখে চাঁপার হাসি শুকিয়ে গেল। সে ভাবল, ছেলেকে ফেলে দিয়েছে বলে দিদি রাগ করেছে। মুহূর্তে চাঁপার চোখেও জল এসে গেল। 

দিদির কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, সত্যি দিদি, বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছে করে ওরে ফেলিনি। কান্না থামাতি আমি ওরে কোলে তুলে নিছিলাম। কিন্তু আমি ওই খাটাসরি সামলাতি পারব ক্যান? এমন ঝাঁকি মারল, আমি সুদ্ধু নীচে চিতপটাং। ডানির দিন, যে ওর কিছু হয়নি। আমার দোষটা কনে ক। 

গিরিবালার মনের মেঘ কেটে গেল। সে সস্নেহে চাঁপার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। না, আর কোনও যন্ত্রণা নেই গিরিবালার মনে। এখন শুধু একটা ইচ্ছে জেগে উঠছে তীব্র পিপাসার মতো। তার দুটি স্তন টনটন করছে দুধের ভারে। এখন একবার ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে গিরিবালার। মুখখানা দেখতে ইচ্ছে করছে সোনাধনের। বাস, আর কোনও আকাঙ্ক্ষা, আর কোনও বাসনা তার নেই। একবার ভাবল, চাঁপাকে আনতে বলে। আবার ভাবল, নিজেই যায় একবার কাকিমার কাছে। তার ছেলে যে-সে নয়, খুব পয়মন্ত। কাকিমার পাগলামি একেবারে সারিয়ে দিয়েছে ছেলে। নাতি নিয়েই আত্মহারা হয়ে আছে। 

হঠাৎ চাঁপা খরখর করে উঠল, তুই কী রে, পিচেশ! এখনও আঁচাসনি? আর ওই আটো হাত তুই আমার গায়ে মাথায় বুলয়ে দিলি? 

গিরিবালা একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। চাঁপার ধমকে ধাতস্থ হয়ে দেখে, আরে, সত্যিই তো সে আঁচায়নি। ছিছি, কী কাণ্ড বলো দিকি! পিসিমা জানতে পারলে সৃষ্টি ধুইয়ে তবে ছাড়বে। 

চাঁপাকে মিনতি করল গিরিবালা, মণি রে, তোর দুখখানি পায়ে পড়ি, চেঁচাসনে। আমি এক্ষুনি আঁচায়ে আসতিছি। বড় হয়ে ছোটর পায়ে পড়লাম কিন্তু, এ-কথা আবার কয়ে দিয়ে না কারুরই। তালি দেখ কী হয়? পোক পড়বে ওই পায়। বুঝলে? 

আট 

এই শিশু তার! তারই দেহের অংশ! ভাবলে বিস্ময় লাগে গিরিবালার। রীতিমতো বিস্ময়। 

ও শুধু বোকার মতো, হাবার মতো চেয়ে থাকে, নির্নিমেষ চেয়ে থাকে তার ছেলের ঘুমন্ত মুখখানার দিকে। চোখের পলক ফেলতেও ইচ্ছে হয় না তার। 

লোকজন থাকলে সে দূরে সরে থাকে। এখনও লজ্জা ভাঙেনি গিরিবালার। বাবাই হন আর বড়মা কি পিসিমাই হন, এমনকী চাঁপার সামনেও সে সহজ হতে পারে না। কোলে তুলতে চায় না। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ এলে, ওর সমবয়সি কোনও মেয়ে এলে, এসে ওর ছেলের কথা জিজ্ঞেস করলে, তৎক্ষণাৎ লজ্জায় লাল হয়ে যায় তার মুখ। আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে পড়ে। কিন্তু সরে পড়েও কি নিস্তার আছে? কেউ কেউ আসে দস্যুর মতন। গিরিবালাকে টানাটানি করে বের করে আনে। জবরদস্তি তার কোলে ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে মজা দেখে তারা। এইসব অবস্থায় গিরিবালা না পারে ছেলে সামলাতে, না পারে নিজেকে সামলাতে। 

সব থেকে বিপত্তি হয় ও-পাড়ার গোয়ালাদিদি এলে। সম্পর্কে ঠাকুরমা হয় গিরির। তাই ইয়ারকির কোনও বাঁধন থাকে না বুড়ির ফোকলা মুখে। গোয়ালাদিদির ত্রিসীমানায় থাকতে চায় না গিরিবালা। তাকে ভালও বাসে বুড়ি। খুব ভালবাসে। যখনই আসে, সর-বাটা ঘি আনে, ক্ষীর আনে। কাঁচা পোয়াতি। ওদের কি আর খিদের আদিঅন্ত আছে? অষ্টপ্রহর পেটে জ্বলতেই থাকে রাবণের চিতা। বুড়ি এসেই ওকে ডেকে আনবে, কাছে বসাবে, ছেলেকে তুলে দেবে ওর কোলে। তারপর বাটি থেকে ক্ষীর হোক, সর হোক, ছানা হোক— যখন যা আনবে, একটু একটু করে নিজের হাতে তুলে দেবে গিরিবালার মুখে। চাঁপা একদিন চেয়েছিল, ও গুয়ালদি, আমারে এট্‌টু সর দ্যাও-না। খরখর করে উঠেছিল বুড়ি: ওরে আমার নোলা রে! সোহাগের সুখতনি। আগে একটা বিয়োয়ে নে দিদির মতন, তারপর গুয়ালদির কাছে সুহাগ খাতি আসিস। 

কিন্তু গোয়ালাদির সোহাগ খেয়ে হজম করাও শক্ত। গিরিবালার মনে পড়ল সেদিনের কথা, যেদিন গোয়ালাদি ওকে মাই খাওয়াবার কায়দা শিখিয়ে দিয়েছিল। কী কাণ্ড! কোলের উপর ছেলে কাঁদছে। গিরিবালা বুঝতে পারছে, খিদে পেয়েছে তার। কিন্তু তখন সেখানে জোর জটলা চলেছে মেয়েদের। অত লোকের মাঝে গিরিবালা মরে গেলেও দুধ খাওয়াতে পারবে না ছেলেকে। উঠতেও পারে না। গোয়ালাদিদি তার চুলের জট ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। উঠবার কথাটা বলব বলব করেও মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। গোয়ালাদিদি ধমক দিল, কী রে, কোন রাজ্যি আছিস? ছেলের গলা যে শুকোয়ে কাঠ হয়ে গেল। মাই খাওয়া। গিরিবালা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বসে রইল। গোয়ালাদিদি ফোড়ন কাটলেন, মেয়ের নজ্জা নাগতিছে। বলিহারি নজ্জার! ভাতারের কোলে উদো হয়ে শুতি নজ্জা হয়নি, নজ্জা হল ছেলের মুখি মাইয়ের বুটা ঢুকতি। এক চড়ে ছিনালি ভাঙে দিতি হয়। নে, মাই বের কর, খাওয়া ছেলেরে। 

কী যাচ্ছেতাই কথা গোয়ালাদির! বড়মা, পিসিমা ও পাড়ার জেঠি খুড়িরা সব বসে রয়েছেন। গিরিবালার কান মুখ গরম হয়ে উঠল। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল, ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু এক গিরিবালা ছাড়া সেই মজলিশের আর-কেউ গোয়ালাদির মন্তব্যে বিচলিত হল না। বরং গিরিবালার বিব্রত ভাব দেখে যেন সবাই আমোদই পেল। 

বিয়ের আগে এই মজলিশের ধারে-কাছেও ঘেঁসতে পায়নি গিরিবালা। হুকুম ছিল না বড়দের। দৈবাৎ কোনও কাজে যদি এসেও পড়ত, বড়দের মুখ বন্ধ হয়ে যেত। থমথম করত মজলিশ। স্পষ্ট মনে হত, সে অনধিকার প্রবেশ করেছে। বুঝতে পারত, কেউ তার উপস্থিতি বরদাস্ত করতে পারছে না। ভয়ে ভয়ে কাজের কথাটি সেরে সরে পড়ত সেখান থেকে। বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। সেই গিরিবালার এই সভায় এখন অবাধ-প্রবেশ। এখন তার অধিকার মেয়ের নয়, মায়ের। তার পদোন্নতি ঘটেছে। 

গিরিবালা এখন মা। পৃথিবীর সব মায়েদের পঙ্ক্তিভোজে বসার অধিকার মিলেছে তার। কোন জাদুবলে এমন আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল? 

এই জাদুর বলে। এই যে সেই জাদু। আমার জাদুমণি। 

গিরিবালা ঘুমন্ত ছেলের কাতর মুখের দিকে চেয়ে রইল অপলক। কত ছোট্ট, কতটুকু জীব, অ্যা! কী তাড়াতাড়ি বুকটা উঠছে নামছে দেখো। গিরিবালা নিজেই নিজেকে ডেকে ডেকে দেখাতে লাগল তার খোকাকে। ওই দেখো, ওই দেখো, ঠোঁট নড়ছে। কথা বলছে ষষ্ঠী ঠাকরুনের সঙ্গে। খুব কথা চলে এখন দু’জনের মধ্যে। কী কথা বলিস, ও খোকা? ইচ্ছে হয় জিজ্ঞাসা করে। পাগল নাকি গিরিবালা? খোকা এখন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শিখেছে নাকি যে, বলে দেবে? এখন সব কথা ওর ষষ্ঠীর সঙ্গে। ওই ওই, ওই দেখো স্পষ্ট ঠোঁট নড়ছে, এবার একেবারে বুড়ো মানুষের মতো। মুখখানা বেশ রাগী রাগী হয়ে উঠেছে বাবুর। তার মানে নালিশ করা হচ্ছে। কেন বাপু, আবার নালিশ কেন? আমি কি যন্ত্রণা দিই, কষ্ট দিই? কই, মনে তো পড়ে না। যাই হোক, অজান্তে যদি দোষঘাট কিছু করেও থাকি, তার জন্য অপরাধ নিয়ো না, মা ষষ্ঠী। তোমার দাসীর সর্বদা মঙ্গল করো। যে প্রার্থনা গিরিবালা ছেলেবেলা থেকে বড়মা পিসিমার মুখে হাজারবার উচ্চারিত হতে শুনেছে, মনে মনে ষষ্ঠীর উদ্দেশে ভক্তিভরে প্রণাম করে সেই প্রার্থনাই নিজে আবার করল। 

না, জেনে-শুনে কোনও দোষ করিনি। গিরিবালা মা ষষ্ঠীকেই শোনাল। কোনও অযত্ন করিনি। ষষ্ঠী ঠাকরুন যেন বিচারের আসনে ছড়ি উঁচিয়ে বসে আছেন। ফরিয়াদি তার খোকা, সোনার খোকা। আর গিরিবালা আসামি। জগতের সমস্ত মায়েদের হয়ে সে যেন জবানবন্দি দিতে এসেছে। 

বিরক্ত হইনে আমি, অধৈর্য হইনে। খোকা কি কম বিরক্ত করে? কম জ্বালায়? প্রথম প্রথম ঘুমোত। রাতদিন ঘুমোত। মাঝে মাঝে ভিজে কাঁথা বদলে দিলে, ও অকাতরে ঘুমোত। ওকে ইচ্ছে মতন নাড়ো-চাড়ো, চান করাও, কাজল পরাও, সোহাগ করো, কিছু বলত না ও। সে সময়টা ছিল যেন ওর ঘুমের বয়স। তখনও কি আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি? ওর ওই অকাতর ঘুম দেখে হঠাৎ মনটা ছ্যাঁক করে উঠেছে। এতক্ষণ সাড়া নেই, শব্দ নেই, তবে কি ও মরে গেল? বেজায় ভয় পেয়ে গিয়েছি। সত্যি বলছি মা, তখন আদর করার ছলে ওর গাল টিপে, ওকে অসংখ্য চুমু খেয়ে ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছি। ঘুম ভেঙে বিরক্ত হয়ে ও কতবার ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠেছে। ওর কান্না শুনে আমার প্রাণে জল এসেছে। আবার তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। পরক্ষণেই দেখেছি ঠোঁট নেড়ে নেড়ে তোমার কাছে ও নালিশ জানাচ্ছে। আনাড়ি মায়ের প্রাণের শঙ্কা যদি অপরাধ হয়, তবে স্বীকার করছি, সেই অপরাধে আমি অপরাধী। রাত্রে ও ঘুমিয়ে থাকে, সাড়াশব্দ দেয় না। পাশে আমি শুয়ে থাকি। কিন্তু আমার তো ঘুম আসে না। এই বুঝি কাঁথাটা ওর মুখে এসে পড়ল, এই বুঝি আমার ঘুমন্ত ভারী দেহের চাপে ওর কচি শরীর থেঁতলে গেল! কতরকম ভয় যে হয়, কী বলব? কতবার আমাকে উঠতে হয়। কতবার যে আঙুল নিয়ে ওর নাকের ডগায় ধরতে হয়, ওর নিশ্বাস পড়ছে কি না বুঝতে হয়। একবার মনে হয় শ্বাস বুঝি পড়ছে, পরক্ষণেই দেখি, না তো, নিশ্বাস পড়ছে না তো। তখন যে মনের অবস্থা কী হয়, তোমাকে কী বলব! তখন আমার বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে যায়। চেতনা থাকে না। পাগলের মতো ওর নাকের কাছে আমার হাতের ও-পিঠ নিয়ে যাই, গাল নিয়ে যাই। বুঝতে পারিনে। ওর বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি, কান ঠেকিয়ে ওর বুকের ধুকধুকানি শুনতে চেষ্টা করি। বুঝতে পারিনে। একটুও বুঝতে পারিনে। তখন এক হেঁচকা টানে বাছাকে বুকে তুলে ফেলি। ওর ঘুম ভেঙে যায়। বিরক্ত হয় আচমকা ঘুম ভেঙে। প্রবল অভিমানে কেঁদে ওঠে। আঃ, সেই শব্দে— কী বলব, সেই শব্দে আমার মরা প্রাণ বেঁচে ওঠে আবার। ও খুব মিথ্যে নালিশ তোমাকে করে না। খুব বিরক্ত করি ওকে। 

.

অপরাধী গিরিবালা স্বীকার করে অকপটে। এবার উলটো চাপ দেয় পাকা উকিলের মতো। বিচারককে এনে নামায় আসামির কাঠগড়ায়। বলে, এ তোমার দোষ ঠাকরুন। সব দোষ তোমারই। তুমি মায়ের কোলে সন্তান দাও, তার বুকে স্নেহ দাও। তার মনে কেন নির্ভরতা দিতে পারো না? কেন তাকে নিশ্চিন্ত করতে পারো না? সবসময় এক হারাই-হারাই আশঙ্কার পাথারে তাকে নাকানি-চুবানি খাওয়াও কেন? 

এর জবাব মা ষষ্ঠী গিরিবালাকে দিলেন না। হয়তো তার খোকনের কানে কানে দিয়ে থাকবেন। গিরিবালার নজর পড়ল তার খোকনের মুখের উপর। 

খোকন তখন মুখ টিপে টিপে হাসছে। 

দুধের বালকের মতো গিরিবালার মনের আবেগ তাই দেখে হঠাৎ উথলে উঠল। গিরিবালা ছেলেকে বুকে সাপটে ধরে তার মুখে গালে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল। 

বলল, ওরে দুষ্ট, ওরে দুষ্ট, দু’জনে মিলে আমায় জব্দ করার ফাঁদ পাতিছ, অ্যাঁ! 

নয় 

গিরিবালা স্বপ্ন দেখছিল: 

ভূষণ এসেছে। খবর নেই, বার্তা নেই, হুট করে এসে গেল ভূষণ। এসেছে টাট্টু-ঘোড়ায় মালকোঁচা মেরে ধুতি পরেছে। পিরেনটা ধুতির ভিতর গোঁজা। তার উপর বুক-খোলা আলপাকার কোট। কোটের ভিতর-পকেট থেকে স্টেথিসকোপের হলদে ডান্ডির উপর বসানো হাতির দাঁতের মুখ দুটো উঁকি মারছে। পায়ে গার্ডার-দেওয়া মোজা আর ডার্বি জুতো আর মাথায় সোলার হ্যাট-টুপি। নতুন-কেনা ঘোড়ার জিনের একপাশে কালো একটা বাক্স আংটায় ঝোলানো। গিরিবালা চিনল, ওটা ভূষণের চিরসঙ্গী হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্সটা। কিন্তু জিনের ওপাশে চকচক করছে, ওটা কী? গিরিবালা আশ্চর্য হল। ঠাহর করে চেয়ে দেখল, ওটা সাইনবোর্ড। নতুন লেখা রুপোলি আর সোনালি অক্ষরগুলোয় রোদ পড়ে চিকচিক করছে। আর্তকল্যাণ দাতব্য চিকিৎসালয়। কলিকাতা কলেজের পাশকরা, গোল্ডমেডেলপ্রাপ্ত, ভূতপূর্ব হাউস ফিজিশিয়ান ডা. ভূষণচন্দ্র বসু, এম. বি. (হোমিও)। সাইনবোর্ডটা বাংলায় লেখা, তাই গিরিবালার পড়তে অসুবিধা হল না। কিন্তু গিরিবালার বিদ্যায় সব কথার মানে বুঝতে পারল না। 

তবে এইসব সাইনবোর্ড তো সচরাচর দোকানেই টাঙানো থাকে। অন্তত গিরিবালা তো তাই দেখে এসেছে বরাবর। ঘোড়ার পিঠে আবার সাইনবোর্ড ঝোলায় কে? তাও শ্বশুরবাড়ি আসবার সময়? 

না না, শ্বশুরবাড়িতে বিজ্ঞাপন দিতে আসেনি ভূষণ। ঝিনেদার এক চিত্রালয়ের মালিকের কঠিন অসুখ হয়েছিল, ভূষণের চিকিৎসায় ভাল হয়ে উঠেছে, পয়সাকড়ি দিতে পারেনি ডাক্তারকে, ভালবেসে সাইনবোর্ডখানা লিখে দিয়েছে। পাঁচখানা গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবেন ডাক্তারবাবু। দেখুক না লোকে। 

তাও ভাল। গিরিবালা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ভূষণের কৈফিয়ত শুনে। ছেলে দেখে ভূষণ খুব খুশি। অবিকল নাকি তার মতো দেখতে হয়েছে। কী জানি বাপু, হবেও বা। কিন্তু গিরিবালা কিচ্ছু বুঝতে পারে না। এইটুকু ছেলে দেখে বোঝা যায় নাকি কিছু? 

তবে এখন পাঁচজনের কাছ থেকে কথাটা শুনতে শুনতে তারও বিশ্বাস হচ্ছে, খোকা বাপের মতোই দেখতে হবে। তা খোকা যার মতোই দেখতে হোক, ভূষণ যে খুশি হয়েছে তাকে দেখে, গিরিবালা তাতেই খুশি। 

ভূষণ সেইদিনই ওদের নিয়ে রওনা হল। একটুও অপেক্ষা করল না। সেজ ভাশুর কলকাতায় থাকেন। তিনি খোকাকে দেখতে চেয়েছেন। এখন ওরা কলকাতায় যাবে। ফিরে এসে ভূষণ ঝিনেদায় বসবে নতুন ডাক্তারখানায়। তাই তার মোটেই সময় নেই। 

ঝড়ের মতো এল ভূষণ, ঝড়ের মতোই ওদের নিয়ে চলে গেল। এখান থেকে ঝিনেদা পর্যন্ত ভূষণ গেল ঘোড়ায়, ওরা পালকিতে। ঝিনেদা থেকে চুয়াডাঙায় ওরা গেল বাস-মোটরে। চুয়াডাঙা থেকে কলকাতায় যেতে হবে রেলে— ঢাকা মেলে। 

রেলগাড়ি আসছে না, আসছে না। গিরিবালা ছেলে-কোলে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। ভূষণ কাছে এসে দাঁড়াতেই খোকা তার কোলে যাবার জন্য যেই ঝুঁকি দিয়েছে, অমনি প্রচণ্ড শব্দে গাড়ি এসে পড়ল আর ইঞ্জিনটা যেন ছোঁ মেরে গিরিবালার কোল থেকে খোকাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। স্টেশনসুদ্ধু লোক ‘গেল গেল’ ‘ধর ধর’ করে উঠল। ইঞ্জিনের পিছু পিছু সব ছুটল। 

গিরিবালা দেখল, ইঞ্জিনের ধোঁয়া কালো কালো হাত বের করে খোকাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে চোঙের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে চাইছে। খোকা প্রাণপণে কাঁদছে, লোকগুলি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ভূষণ খোকাকে ধরবার জন্য হাত বাড়িয়ে লাফাচ্ছে, নাগাল পাচ্ছে না। গিরিবালাকে কে যেন পেরেক মেরে প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে। উঠতে পারছে না। উঠবার জন্য মাথামুড় খুঁড়ছে গিরিবালা। পারছে না, একটুও উঠতে পারছে না, কিছুতেই না। দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে গিরিবালার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দম আটকে আসছে তার। বুক যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আর পারে না গিরিবালা। একটু বাতাস— একটু বাতাস! 

এমন সময় গিরিবালার ঘুম ভাঙল। 

ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে তার। ঘর অন্ধকার, হারিকেন কখন নিবে গেছে। গিরিবালা হাঁফাচ্ছে। হাঁফাতে হাঁফাতে অভ্যাসবশে খোকার বিছানায় হাত দিল। খোকা নেই। ছ্যাঁক করে উঠল তার বুক। আশে-পাশে হাত দিল। খোকা নেই। কী হল? তড়াক করে লাফিয়ে উঠল গিরিবালা। বসে পড়ল বিছানায়। গোটা খাটটায় হাত বুলিয়ে নিল। কোথায় খোকা! গিরিবালা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। দ্বিগুণ বেগে ঘামের স্রোত বয়ে চলল তার দেহে। 

হঠাৎ খাটের নীচ থেকে খোকার কান্না শোনা গেল। সর্বনাশ! নীচে পড়ে গিয়েছে খোকা! যেন ছোঁ মেরেই তুলে নিয়ে এল খোকাকে। বুকে চেপে ধরে কান্না থামাল। মাই খাইয়ে ঘুম পাড়াল। শতবার ধিক্কার দিল নিজের দায়িত্বহীনতাকে, অভিসম্পাত দিল অঘোর ঘুমকে। কপাল ভাল, কিছু হয়নি এবার। কিন্তু কিছু একটা খারাপ হলে, কে ঠেকাত? ষাট— ষাট— ষাট! কোলে তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে, চাপড় মেরে মেরে গিরিবালা ছেলের চোখে ঘুম ঢেলে দিল। খোকার চোখে ঘুম এল, এল না গিরিবালার চোখে। 

ছেলের পাশে শুয়ে বারবার ঘুমোতে চেষ্টা করল। ঘুম নেই, কে কেড়ে নিয়েছে। কে আবার নেবে ভূষণ ছাড়া? 

স্বপ্নে খোকাকে হারিয়েছিল গিরিবালা, ভূষণকে পেয়েছিল। ঘুম ভেঙে সে খোকাকে পেল, কিন্তু ভূষণকে হারাল। 

এ এক আশ্চর্য অবস্থা তার। ছিল এক গিরিবালা, যখন সে জন্মাল তখন থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত গিরিবালা তো একটাই ছিল। এক ঘর, একটি পরিবার জুড়েই তার যা-কিছু ধারণা গড়ে উঠেছিল। সে তখন দেওয়ানবাড়ির মেয়ে। ওই একটি বাড়ির সুখে তার সুখ, দুঃখে তার দুঃখ, একটি বাড়ির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই তার আশা তার আকাঙ্ক্ষার ছিল লেনদেন। 

যেই তার বিয়ে হল, গিরিবালা দেখল, সে অমনি দুটো বাড়ির মানুষ হয়ে পড়ল। যেন ভোজবাজি। ওদিকের জন্যও তার ব্যথা, এদিকের জন্যও তার ব্যথা। ওদিকে কাটলেও লাগে, এদিকে কাটলেও লাগে। বিয়ের আগে গিরিবালা যেন ছিল ফোয়ারা, একটিই ছিল তার আধার। বিয়ের পর, গিরিবালা হয়ে উঠল নদী, দু’দিকে তার দুটি তীর। একটি বাপের বাড়ি, আর-একটি শ্বশুরবাড়ি। 

তবু তাও একরকম ছিল। কিন্তু যেই মা হল গিরিবালা অমনি আর-এক ভোজবাজি ঘটল। এবারে গিরিবালা নিজেই দুটো গিরিবালা হয়ে গেল— খোকার মা আর ভূষণের বউ। 

ঠিক ঠিক, সে তো ভূষণের বউও। আগে সে ভূষণের বউ, তারপরে তো সে খোকার মা। এতদিন শুধু খোকাকে নিয়েই সে মত্ত ছিল, তার মনে যে জায়গা এতদিন শুধু ভূষণের জন্যই ছিল মৌরসি, সেই জায়গা থেকে গিরিবালা ভূষণকে কখন যেন উচ্ছেদ করে দিয়েছে। তাই বুঝি ভূষণের অভিমান হয়েছে। তাই সে আসেনি। আসছে না। খোঁজখবরও নিচ্ছে না। 

ভূষণের বউটা যেন এতদিন গিরিবালার মনের কোনার ভাঙা বাক্সের গাদায় আশ্রয় নিয়ে ছিল, এইবার সে সুযোগ পেয়ে খোকার মাকে ঠেলতে ঠেলতে সেই কোনায় পাঠিয়ে দিল। 

ওই যে, যে-গিরিবালা এখন খোকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানলার দিকে পাশ ফিরে শুল, শুয়ে শুয়ে অন্ধকার আকাশের গায়ে ফোটা সহস্র নক্ষত্রের মুখে অনেক দিনের না-দেখা স্বামীর মুখখানি মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করতে লাগল, ওই গিরিবালাই ভূষণের সেই বউ। 

গিরিবালা দেখল অনেক তারা ফুটেছে আকাশে। কৃষ্ণপক্ষ, তাই চাঁদ নেই। ঘরের ভিতরে অন্ধকার। বাইরে নিটোল রাত। বিরাট কালো একদলা কর্পূর কে যেন একটা প্রকাণ্ড বারকোশে বসিয়ে রেখেছে। একটু একটু করে একসময় এই রাতের কর্পূর সবটুকু উবে যাবে। তখন সকাল হবে। 

কিন্তু কখন সকাল হবে? এখন কত রাত? 

মাঠে মাঠে ঝিঁঝি ডাকছে। কখনও কখনও ঝটপট ঝটপট পাখা ঝাড়ছে বাদুড় কি প্যাঁচা। তখক, তখক— মটকা থেকে তক্ষক ডেকে উঠল। ভুতুম ভুতুম, তুই থুলি না মুই থুলি, কতরকম ডাক শুনতে পেল গিরিবালা। অথচ ভয় পেল না একটি ফোঁটাও। আর আগে? ওরে বাব্বা, রাত্রি হলেই রাজ্যের ভয় এসে ঘিরে ধরত গিরিবালাকে। আর তুই থুলি মুই থুলির ডাক শুনলে? ভয়ে তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেত। কতদিন জড়িয়ে ধরেছে না বড়মাকে! 

কেন, ভূষণের গলা জড়িয়ে ধরেনি বিয়ের রাতে? 

কথাটা গিরিবালার মনে পড়তেই টিকটিকি ডেকে উঠল। থপ করে একটা ভারী মতো কী যেন পড়ল মশারির চালে। মশারির ভিতরে অন্ধকার। মশার পনপনানি শুনতে লাগল গিরিবালা। বুঝল, ভিতরে মশা ঢুকেছে বেশ। ভাবল, উঠে একবার ঝেড়ে নেয় মশারি। কিন্তু পারল না উঠতে। বেজায় কুঁড়েমি লাগছে তার। ভয়? ভয় আর এখন পায় না গিরিবালা। ভয়-তাড়ানো মন্তর যে তার পাশেই শুয়ে রয়েছে। এই যে এক ফোঁটা এই ছেলে, এই তো সেই ভয়-তাড়ানো মন্তর। 

চুপচাপ শুয়ে ভূষণের কথা ভাবতে লাগল। স্বপ্নে-দেখা সাইনবোর্ডটার কথা মনে পড়ল গিরিবালার। ওইরকমভাবে আসবে নাকি ভূষণ? কিছুই বিচিত্র নয় তার কাছে। হয়তো সত্যিই কোনও সাইনবোর্ড-ওয়ালাকে বাঁচিয়ে তুলেছে ভূষণ, আর সে পয়সার বদলে সাইনবোর্ড লিখে দিয়েছে। 

গহর নিকিরিকেও তো ভূষণ অমনিভাবে বাঁচিয়ে তুলেছিল। টাকা দেয়নি গহর। ঘটকালি করে বিয়ে দিয়ে দিল তার ডাক্তারবাবুর। 

সত্যি, গিরিবালার বিয়েটা কী অদ্ভুতভাবেই না ঘটেছে! গহর তাদের প্রজা। গিরিবালাদের গ্রামের নিকিরি জেলেদের খুব নামডাক আছে ও-অঞ্চলে। ক্রিয়াকর্মে মাছ জোগানোর বায়না ওদের কাছে আসত দূর দূর গ্রাম থেকেও। গহর আবার নিকিরিদের মোড়ল। তার প্রতাপ-প্রতিপত্তি রাজার মতোই। 

দু’বছর আগে একদিন গহর গিয়েছিল মাছের জোগান দিতে ভূষণদের গ্রামের কাছেই। নেমন্তন্নটা ভালভাবেই উসুল করেছিল সে। খাওয়াটা তার একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। আর তখন সময়টাও তেমন ভাল ছিল না। ওলাওঠায় ধরল গহরকে। সেই যাত্রাই শেষ যাত্রা হয়ে যেত গহরের, কিন্তু বাঁচিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। বয়সে ছোকরা হলে হবে কী, ডাক্তার বটে ভূষণবাবু। গিরিবালা জানে, গহর এইভাবে বলে বলে তার বাবা জ্যাঠা আর খুড়োর মন ভূষণের দিকে ফিরিয়েছিল। ভূষণের নামে গহর আটখানা হয়ে উঠত। প্রায়ই এসে জ্যাঠামশাইকে বলত : বড়বাবু, দিয়ে দ্যান বিয়েটা। এই ঘরে পড়লি দিদি আমার সুখীই থাকবেনে। 

খবর পেয়ে গিরিবালার বাবাও এসে পড়লেন। গহর তাঁকে জানাল, ডাক্তারবাবুরা চার ভাই। ডাক্তারবাবুই ছোট। বড় আর ছোট বাড়িতে আছেন। সেজ ভাই কলকাতায়। মেজ থাকেন যশোরে। গহরের কথা নিয়ে বাড়িতে এত আলোচনা হয়েছে যে, গিরিবালার সব-কিছু প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। 

আর তখন সব থেকে মজা করত চাঁপা। কার মুখ থেকে কী শুনত আর তাই নিয়ে এমন সব কাণ্ড করত যে বাড়িসুদ্ধ সবাই হেসে কুটিকুটি হত। 

একদিন খেতে বসেছে সবাই, চাঁপা হঠাৎ পাকা গিন্নির মতো জিজ্ঞাসা করল, তা নেবে-থোবে কী? 

প্রথমে কেউ বুঝতে পারেনি চাঁপার কথা। চাঁপা নিজেই পরে বুঝিয়ে দিল। 

বুড়োদের মতো মাথা নেড়ে বলল, বলি বিয়ে তো দেচ্ছ মেয়ের, তা উরা নেবে-থোবে কী?

এইবার হেসে গড়িয়ে পড়ল সবাই। তখন থেকে চাঁপার নামই হয়ে গেল—নেবে-থোবে কী কী খ্যাপান খেপে যেত চাঁপা তাকে ওই নামে ডাকলে! কত আর বয়েস তখন চাঁপার! সাতও পেরোয়নি। তখন থেকেই ওটা এমন টরটরে। 

জব্দ শুধু শ্যাম রানারের কাছে। শ্যাম রানারকে দেখলেই চাঁপা ভয়ে কোথায় পালাবে তার দিশে পেত না। শ্যাম রানারের সঙ্গে গিরিবালার কিন্তু খুব ছেলেবেলা থেকেই ভাব। গিরিবালা যখন খুব ছোট, তখন তাদের বারবাড়িতেই পোস্টাপিস ছিল। বছর কতক হল, সেটা এখন হাটে উঠে গিয়েছে। এখন নাকি মেদ্দা সাহেবের গদিতে হয়েছে পোস্টাপিস। দেখেনি গিরিবালা, শুনেছে। 

তাদের বাড়িতে যখন পোস্টাপিস ছিল তখন থেকেই তার ভাব শ্যাম রানারের সঙ্গে। শ্যাম রানারের একটা বল্লম ছিল, ঘণ্টি-বাঁধা বল্লম। তার এক দিকে ডাকের থলি ঝুলিয়ে নিয়ে ঝুনুত ঝুনুত ছুটে চলত শ্যাম রানার। আর ফিরে এসে যখন খেতে বসত তখন কত গল্প বলত। তার মুখ থেকে নানা বিবরণ সংগ্রহ করেই তো গিরিবালা জগৎ সম্পর্কে একটা ভৌগোলিক ধারণা গড়ে তুলেছিল তার মনে। 

জেনেছিল, ওদের এই গ্রাম ছাড়িয়ে কিছুদুর গেলেই মধুপুর বলে এক গ্রাম আছে। সেখানে আছে টুইডি সাহেবের কুঠি। সেই কুঠির দেওয়ান ছিলেন তার ঠাকুরদার বাবা, তার ঠাকুরদাদাও। মধুপুর পার হয়ে আরও এগিয়ে যাও। গেলেই পাবে ধোপাঘাটা। এমন এক ভয়ংকর দহ আছে সেখানে, কেউ নাকি তার উপর দিয়ে পাকা পুল বাঁধতে পারেনি, সাহেবরাও না। দড়াটানা নৌকোয় পারাপার চলে। ধোপাঘাটার পরেই ঝিনেদা শহর। এ-সব গল্প সবার আগে গিরিবালা শ্যাম রানারের মুখে শুনেছে। তার অনেক পরে, বাবার সঙ্গে যখন ডোমার গিয়েছে, বিয়ে হয়ে যখন শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছে, তখন গিরিবালা এ-সব দেখেছে নিজের চোখে। গিরিবালার হঠাৎ মনে পড়ল, শ্যাম রানার খুব খেতে পারত। আস্ত আস্ত কাঁঠাল সে খেয়ে ফেলত নিমেষে। ভুতুড়ি, বিচি— এ-সবও ফেলত কিনা সন্দেহ। 

গিরিবালার বাবা যেদিন সম্বন্ধ করতে যান, সেদিন কীসের যেন এক স্নান ছিল। ওরা সবাই ঘাটে যাচ্ছিল চান করতে। বড়মারা এগিয়ে গিয়েছেন, ও আর চাঁপা পড়েছে পিছিয়ে। ওরা রাস্তায় উঠতেই ঝুনুত ঝুনুত শব্দ শুনল। শ্যাম রানার আসছে দৌড়োতে দৌড়োতে। অনেক দিন দেখেনি তাকে। গিরিবালা দাঁড়িয়ে পড়তেই চাঁপা ভয়ে তার পিছনে গিয়ে লুকোল। 

ছবির পর ছবি ফুটে উঠছে গিরিবালার চোখে। শ্যাম রানার দাঁড়িয়ে পড়ল গিরিবালার সামনে। ঘাম মুছে বলল, দিদিমণি, তুমার বিয়ে হবে গো! বেশ বেশ! বিয়ের কথা শোনামাত্র লজ্জায় প্রায় নুয়ে পড়ে গিরিবালা। কিন্তু আশ্চর্য, শ্যাম রানারের মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনতে তার তো তেমন অস্বস্তি লাগল না! বরং মজাই লাগল তার। গিরিবালা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কার কাছে শুনলে? শ্যাম রানার বলল, গহর যে ঘাটে নৌকোয় ছই বাঁধছে। মাজেবাবু আজ পাত্তর দেখতি যাবেন যে। বেশ বেশ দিদিমণি, খুব ভাল কথা। ভগবান তুমারে সুখী করুন। আর দাঁড়াল না শ্যাম। ঝুনুত ঝুনুত ঝুনুত ঝুনুত ঘণ্টির ধ্বনি তুলে তুলে শ্যাম রানার ফিকে ধুলোর ঘুর্ণি উড়িয়ে উড়িয়ে গিরিবালার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। 

চান করে ফিরবার সময় দেখে, মেজকর্তা আর গহর সেজেগুজে ঘাটের দিকে চলেছেন। লজ্জায় গিরিবালা চোখ নিচু করে পথের এক পাশ দিয়ে তার কুমারী শরীরটাকে অতিকষ্টে টানতে টানতে নিয়ে চলেছিল। কিন্তু চাঁপাটা এমন অসভ্য, চেঁচিয়ে উঠল, ও মাজেকাকা, কনে যাচ্ছ? জবাব দিল গহর, বর খুজতি গো ছোড়দি। চাঁপা দুই হাতে তালি দিয়ে নেচে উঠল, জানি গো মশাই, জানি। বড়দিও জানে। না রে বড়দি? কী রকম পাজি হয়েছে মেয়েটা বলো দিকিনি— রাগে গিরিবালার ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, চলো বাড়ি, তুমার নাচা কুদা ভাঙে দিবানে। কিন্তু এ-সবে চাঁপার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সমানে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে, রাঙ্গা টুকটুকে বর আনবা কিন্তু আর আস্ত দেখে আনো, ভাঙা হলি নেব না, বুঝলে? চাঁপার কথায় সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। অতি কষ্টে চাঁপার মুখটি বন্ধ করে সেদিন গিরিবালা ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল। 

.

ছেলে একটু শব্দ করতেই গিরিবালা পাশ ফিরল। ফিরে এল ঘাটের রাস্তা থেকে ফিরে এল অতীত থেকে, এসে গেল একেবারে মশারির মধ্যে, তার ছেলের পাশে। 

উসখুস করছে ছেলে। গিরিবালা হাত বাড়িয়ে টের পেল ছেলে তার কাঁথা ভিজিয়েছে। শিয়রে ডাঁই-করা অনেক কাঁথা ছিল। শুয়ে শুয়েই তা থেকে একটা শুকনো দেখে টেনে নিয়ে নিপুণ হাতে বদলে দিল। এর মধ্যেই গিরিবালা একেবারে পাকা কারিগর হয়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম এই কাঁথা-বদলানো নিয়েই তাকে কি কম ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয়েছে! আনাড়ি হাতের খোঁচা খেয়ে খোকার ঘুম ভেঙে যেত। কেঁদে উঠত খোকা। কত কেলেঙ্কারিই না হত! কিন্তু দু’-আড়াই মাস যেতে-না-যেতেই গিরিবালা কতবড় ওস্তাদ হয়ে পড়ল! এখন তার খোকা বিন্দুবিসর্গও টের পায় না। 

কাজের তাড়া পেয়ে যে সব স্মৃতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, গিরিবালার হাতের কাজ ফুরোতেই আবার সেগুলো পরিষ্কার অবয়ব ধরে ফিরে ফিরে আসতে লাগল। 

ছায়াবাজির খেলা দেখছে যেন গিরিবালা অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। 

…গিরিবালার বিয়ে। বাড়ি-ভরতি লোকজন। পাইকপাড়া পলেনপুর থেকে জেঠি খুড়িরা এসেছেন, বিনোদপুর থেকে এসেছেন মামি মাসিরা, ছত্তরপাড়া থেকে এসেছেন জ্ঞাতিগোষ্ঠী কুটুম্বের দল। আমোদ করছে, ফূর্তি করছে, মৃতদের উদ্দেশে অশ্রুবর্ষণও চলছে, পরক্ষণেই সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তারস্বরে ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে। এই হট্টগোলের মধ্যে গিরিবালাই শুধু তফাত তফাত আছে। তার কোনও-কিছুই ভাল লাগছে না। কেন, তা কে বলবে? কেন ওই বিষণ্ণতা, কীসের অস্বস্তি? তাও জানে না গিরিবালা। তার ভাল লাগছে না। 

…আচ্ছা, তার বিয়ের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠল কেন বাড়ির সবাই? সে কি মাথামুড় খুঁড়ছিল বিয়ে দাও, বিয়ে দাও বলে। তবে? বাবার উপর প্রচণ্ড অভিমান হল তার। বড়মা, পিসিমা, জ্যেঠামশাই, কাকার উপরও। বড়দাও কম না। সেও ও-দলে যোগ দিয়েছে। ওদের ভালবাসা স্নেহ— সব উপরে উপরে। আসলে গিরিবালা ওদের গলায়-বেঁধা কাঁটা। সাত-তাড়াতাড়ি নামাবার জন্য তাই এত বিড়ালের পায়ে ধরে সাধাসাধি! বিড়াল কে? কেন, ওই যে ভূষণ না, কে? যাকে এত সাধ্যসাধনা করে ওঁরা ডেকে আনছেন গলার কাঁটা নামাবার জন্য? 

…বিয়ে হলেই এখান থেকে অন্ন উঠবে গিরিবালার? এই ঘর, এই বারান্দা, এই উঠোন, এই গ্রাম, গিরিবালার পরিচিত পৃথিবী, তার আপন জগৎ— যা-কিছু অবলম্বন করে সে এতদিন বেড়ে উঠেছে, যার যার সঙ্গে তার নাড়ির যোগ, সে সবই তার পর হয়ে যাবে? বড়মা, পিসিমা, চাঁপা, তার সই মহামায়া— এদের সবার চোখে সে হবে ভিন গেরামের বউ। 

…এদের ছেড়ে, এই পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে গিরিবালা যে বাঁচতে পারে, কই, কোনও দিন ঘুণাক্ষরেও তো সে-কথা তার মনে স্থান পায়নি। ভগবান জানেন, এদের ছাড়া সে কখনও আর কারও কথা ভাবেনি। তবে? 

…তবে এরা তাকে পরের ঘরে ঠেলে দেবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠল কেন? তাকে পর করে দেবার জন্যই বা এদের এত তাড়াহুড়ো কেন? সে কি কোনও অন্যায় করেছে? গুরুতর অপরাধ কিছু করেছে? সে-কথা গিরিবালার জানতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে প্রবল এক অস্বস্তি তার মনের মধ্যে ঢুকে ঝড় তুফান তোলে। সে সময় গিরিবালা আর কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারে না। মা’র মৃত্যুর পর ফুল দিয়ে সাজিয়ে যে ফোটোখানা তোলা হয়েছিল, সেই ঝাপসা ফোটোখানার নীচে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারা ধরিয়ে কাঁদে। কেঁদে কেঁদে বুকের পাষাণ নামায়। 

…কেন, তা গিরিবালা জানে না, তবে এই সময়টাতে মৃত্যুকে বড় নিকট-আত্মীয় বলে মনে হত গিরিবালার। মুহূর্তের জন্যও তার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করত না। তার কেমন দৃঢ় ধারণাই জন্মে গিয়েছিল, সে বিয়ের আগেই মরে যাবে। মরে মা’র কাছে গিয়ে আশ্রয় পাবে। চিরদিনের মতো নিশ্চিন্ত আশ্রয়। কিন্তু মরল না গিরিবালা। উপরন্তু সেই ভয়াবহ দিনটি ধীরে ধীরে এক পা দু’পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। বিয়ের ক’দিন আগে সে বিকট এক দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। সে স্বপ্ন এখনও তার মনে গাঁথা আছে। সম্ভবত চিরকালই থাকবে। গিরিবালা স্বপ্ন দেখল: প্রকাণ্ড একটা কোলাব্যাং তার বুকের ওপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে মুখের কাছে এগিয়ে এল, লকলকে জিভ বের করে আকাশ-পাতাল হাঁ করল। এবারে গিলে ফেলবে তাকে। ভয়ে কাঠ হয়ে গিরিবালা চোখ বুজতে যাবে, হঠাৎ তার নজর পড়ল ব্যাংটার মাথার ওপর। ব্যাঙের মাথায় একটা টোপর। এই তবে তার বর! হাউ মাউ করে চেঁচিয়ে উঠল গিরিবালা। এক ছুটে চলে গেল বড়মার ঘরে। বড়মার কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। 

…শুভদৃষ্টির সময় সে চোখ খোলেনি। বাসরে এসেও না। সে জানে, চোখ খুললেই ব্যাঙের মুখ দেখতে হবে। কী বোকাই না ছিল গিরিবালা! কোথায় ভূষণ আর কোথায় কোলাব্যাং! 

.

বাজনদার পাড়ার থেকে কুঁকড়োর ডাক শোনা গেল। যাক, রাত তা হলে পোহাল। কী সব আজেবাজে চিন্তায় রাতটা কাটল! এখন একটু ফরসা হলেই গিরিবালা বাঁচে। সে উঠতে পারে। 

কিন্তু গিরিবালা স্মৃতির হাত থেকে রেহাই পেল না। যতই সে ঢেউ দিয়ে সরিয়ে দিক, একটু সুযোগ পেলেই কুচো পানার মতো স্মৃতি তার মগজে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। 

…আশ্চর্য লোক ভূষণ! তার হাবভাব সবই আশ্চর্য লাগে গিরিবালার কাছে। বাসি বিয়ের দিন কী কাণ্ডটাই না করল! গহর এক মন মাছ ধরে দিয়ে গেল। এ তার ঋণ শোধ। 

…বড়বউ নাম-করা রাঁধুনি। জামাই-ভোজের রান্না একা হাতেই তিনি রাঁধলেন। সাত-আট রকম শুধু মাছেরই ব্যঞ্জন। বড় থালার চারিপাশে বাটি সাজিয়ে জ্ঞাতিকুটুম্বের মাঝখানে জামাইয়ের সামনে যেই থালা ধরে দেওয়া হল, অমনি জামাই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। যেন বিষধর সাপ তাঁর সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হাঁ-হাঁ, করেন কী, করেন কী!— জামাই পরিত্রাহি চেঁচিয়ে উঠলেন, মাছমাংস স্পর্শ করাও যে নিষেধ। সে কী, সে-কথা কি কেউ জানিয়ে দেয়নি? সভাসুদ্ধ লোক অপ্রস্তুত। ভোজটাই বুঝি পণ্ড হয়ে যায়। হঠাৎ ভূষণ হাতজোড় করে বলল, অপরাধ আমাদের, আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করে খেতে বসুন। আমিও বসছি। আমাকে নিরামিষ রান্না এনে দিন। জামাইয়ের বিনয়ে সবাই খুশি হলেন। দুঃখ থেকে গেল শুধু গহরের। তার পরিশ্রম বৃথাই গেল। 

…ছোট বড় আরও নানান নাটকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছে ভূষণ। আজ মাস-আড়াই তার কোনও খবরই নেই। ছেলে হল, সবাই এসে দেখে গেল। শ্বশুরবাড়ির থেকে বড় ভাশুরের ছেলে এসেও দেখে গেল। শুধু ভূষণেরই দেখা নেই। কোটচাঁদপুর না কোথায় যেন আছে, ভাশুরপো ও ঠিকমতো জানে না। কী ধরনের মানুষ! 

গিরিবালার বুকটা টনটনিয়ে উঠল। অভিমানে জল এল চোখে। সে না হয় ফ্যালনা, তা বলে খোকনসোনা, তার কথাও কি মনে পড়ে না ভূষণের, দেখতে ইচ্ছে হয় না! চোখের কোনা দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে বালিশ ভিজতে লাগল। খোকার গায়ে হাত রেখে গিরিবালা মনে মনে বলল, তোর বাবা আমারে বড় কাঁদায়, তুইও কি অমন করে কাঁদাবি, হ্যাঁ খুকা? 

খোকা ততক্ষণে জেগে উঠে হাত পা ছুড়ে খেলা করতে শুরু করেছে। 

গিরিবালা তার মুখে চুমু খেতে খেতে বলল, ধন আমার, সনা আমার, বাবারে ডাকে আনতি পারো না? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *