দুরন্ত ধারা – ২০

কুড়ি 

এত রোদ্দুরে এতখানি পথ ফেদি বেশ জোরে জোরেই হেঁটে এসেছে। বিশেষ করে গোয়ালা বাড়ির কাছ থেকে। বুনোরা আজ এদিককার জঙ্গল তোলপাড় করে ফেলেছে। দুম দুম ট্যাম ট্যাম এই একঘেয়ে বাজনাটা আম কাঠাল বাঁশ বেত আর নানারকম আগাছা জঙ্গলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে কেমন এক রহস্যময়, কেমন এক হিংস্র আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে। মৃত্যুর পরোয়ানাই যেন দিকে দিকে ছুটে চলেছে। যেন রটনা করছে, আজ আর নিস্তার নেই। মাঝে মাঝে বনের এদিক ওদিক থেকে হইহই চিৎকার ভেসে উঠছে। কখনও কখনও বুনো আশশ্যাওড়া গাছ আর মানুষ সমান, উঁচু নরম আগাছার বুকে প্রবল বিক্ষোভ জাগিয়ে কারা যেন তীব্র বেগে ছুটে চলেছে। ওদের দেখা যায় না। জানোয়ারও হতে পারে, আবার মানুষও হতে পারে। 

ফেদির ভয়-ভয় করছিল। গা-ছমছম করছিল। যদিও সে এতটা পথ একা আসতে সাহস করেনি, একটা সেথো সঙ্গে এনেছিল। কিন্তু সে ছোকরা দুর্গাবাড়ির কাছ থেকেই ভেগে পড়েছে। হাটের মাঠে ফুটবল ম্যাচ হবে, তার আকর্ষণেই সে ফেদির হাতছাড়া হয়েছে। 

গিরিবালার উঠোনে এসে দাঁড়াতেই ভয়ডর এক নিমেষে ফেদির শরীর থেকে শুকনো মাটির মতো ঝরে পড়ল। এখানে মানুষের উষ্ণ স্পর্শ পাওয়া গেল। উঠোনে বাঁশে বাঁশে তারে-তারে- মেলে-দেওয়া কাপড় হাওয়ায় দুলছে। একটা বড় কড়াই উপুড় হয়ে পড়ে আছে। একখানা কোদাল, একটা কুডুল, খান কয়েক চ্যালা কাঠ। বাস, এইগুলো চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফেদির ভয় ভাঙল। 

গুরু পরিশ্রমে সে এখন শুধু হাঁপাচ্ছে। তার ফরসা সুন্দর মুখখানা রাঙা হয়ে উঠেছে। থান শাড়ির ভিতর থেকে তার বুক ঘনঘন দুলে উঠছে। তার চিকন নাক ফুলে ফুলে উঠছে। এলোমেলো চুল মুখে কপালে উড়ে পড়ছে। 

বেলা গড়িয়ে এলেও রোদের ঝাঁজ বেশ আছে। বাড়িটা নিস্তব্ধ। প্রাণ আছে বোঝা যায়, সাড়া পাওয়া যায় না। হাতের কাঁথাখানা মুঠো করে ধরে ফেদি গুদোমঘরের হাতি-শুঁড় সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল। বড়বউয়ের ঘরে উঁকি মারল। বাবা, কেমন ঘুম এদের গো! চোরে সর্বস্ব নিয়ে গেলেও বোধহয় ঘুম ভাঙবে না! 

ফেদি গলা বাড়িয়ে সন্তর্পণে ডাকল, ও খুড়ি 

গলা শুকিয়ে যাওয়ায় আওয়াজটা ঠিকমতো বের হল না। 

আবার ডাকল, ও খুড়ি! 

বড়বউ চোখ মেলেই দেখেন ফেদি। ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। দু’হাতে চুলে গিট দিতে দিতে গলা-ভরতি ছ্যাপ নিয়ে উঁ-আঁ করে তাকে বসতে বললেন। তারপর তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে থুথু ফেলে এলেন। 

বললেন, আসো মা, আসো। কতদিন তুমারে দেখিনি! কাল যখন বুড়িরা আসে ক’ল তুমার বাড়ি উরা গিছিল, আমি আরউ কলাম, আহা, ওরে আসতি কলিনে ক্যান? সুনার মুখখানা একবার দ্যাখতাম। 

ফেদি ম্লান হেসে বলল, সুনার মুখ আর সুনার নেই খুড়ি, একেবারে পিতলের হয়ে গেছে। এ মুখ আর দেখাতি ইচ্ছে করে না। 

ফেদির চোখ টলটল করে উঠল। বড়বউয়ের চোখেও জল এসে গেল। 

বললেন, বালাই ষাট। বিধেতার যে দিষ্টি নেই মা, না হলি এমন কপালেউ কি আগুন জ্বালে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেদি বলল, সবই আমার অদিষ্ট। কারে দুষী করব, বলো? 

বড়বউ কোনও কথা না বলে আঁচল দিয়ে ফেদির মুখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর একখানা হাতপাখা টেনে ওকে হাওয়া করতে লাগলেন। 

ঘর-সংসারের কথা উঠল। ফেদির বাবা মা তীর্থে বেরিয়েছেন। গয়া কাশী বৃন্দাবন ঘুরে বেড়াচ্ছেন সব। আসবার সময়ও প্রায় হয়ে এল ওঁদের। আজ আসে কি কাল আসে। বাড়িতে আছে ফেদি আর তার বাউন্ডুলে দাদা সন্তোষ। কাজকর্মে মন নেই, এখন বিয়ে করার শখ চেপেছে। এই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি চলছে। শ্বশুরবাড়ি থেকেও কেউ খোঁজ নেয় না ফেদির। অপয়া অলক্ষুনে বউ, কে তার বার্তা নেবে? কোলে একটা গুঁড়ো-গাড়া থাকলেও না হয় কথা ছিল। 

মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় খুড়ি, আগুনি ঝাঁপ দিই, না হয় জলেই ডুবি আর নয়তো একদলা বিষ খাই। 

ফেদি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। এই তো মাত্র আঠারো-উনিশ বছর বয়েস। কড়ে রাঁড়ির পেরমায়ও নাকি অখণ্ড হয়। সামনের দিকে চাইতে তার ভয়। ভবিষ্যৎ এক রুক্ষ, ধু-ধু মরুভূমি। 

তবে আমার কপাল তো, আগুনিউ ছোঁবে না, জলই হয়তো শুকোয়ে যাবে, বিষ হার মানবে।

বড়বউ শিউরে উঠে ফেদির মুখে হাত চাপা দেন। 

বলতি নেই মা, ওকথা বলতি নেই। 

বড়বউ নিজের বুকের কাছে টেনে আনেন ফেদিকে। দুটো বুকের ব্যথা কাছাকাছি এগিয়ে আসে। সমবেদনার অদৃশ্য প্রবাহ এক গভীর ক্ষতে প্রলেপ দিতে এগিয়ে যায়। বড়বউয়ের চোখের জল ফেদির মাথায় টপটপ করে ঝরে পড়ে, ফেদির চোখের জলে বড়বউয়ের কোল ভিজে সপসপে হয়ে ওঠে। 

ফেদি চোখ মুছে সামলে বসে। তার মুখে অদ্ভুত এক হাসি ফুটে ওঠে। দু’খানা মেঘ চিরে শরতের জ্যোৎস্না যে হাসি ফোটায়, সেই হাসি। 

বলে, দেখো দিনি, কী কাজে আলাম আর কী করতি বসিছি! ও খুড়ি, বুড়িরি একবার ডাকো তো। ওর ছেলের জন্যি এই দেখো একখানা ক্যাথা সিলোইছি। কল্কা নকশাডা কেমন উঠিছে?

কাঁথাখানা মেলে ধরল ফেদি। সরু ফোড়ের সুন্দর কাঁথা। বড়বউ খুব তারিফ করলেন। 

আহা-হা, এ যে গায়ে দেবার দোলাই। অতি চমৎকার! যেমন পাড়ির কল্কা তেমন সুন্দর ভিতরের নকশা। এ বলে আমার দেখ, ও বলে আমায় দেখ। ও বুড়ি, মণি রে, আয় এখেনে ফেদি আয়েছে। দেখ কী আনেছে! 

গিরিবালা আর-একটা ঘরে শুয়ে শুয়ে ছেলেকে মাই খাওয়াচ্ছিল। ফেদি এসেছে সে জানে। তার মনের অপরাধবোধটা সে নামাতে পারছিল না, তাও ও-ঘরে যেতে সাহস পাচ্ছিল না। ফেদি যে দৃষ্টি দিয়ে কাল দেখছিল গিরিবালাকে, তাতে প্রশংসা ছিল, ঈর্ষাও ছিল। সে ভাষা কিছু কিছু পড়তে পেরেছিল গিরিবালা, কিছু কিছু অর্থ গ্রহণ করতে পেরেছিল। বড়মার সঙ্গে ফেদি এতক্ষণ ধরে যা বলাবলি করছিল, তাও শুনেছে গিরিবালা। ফেদির জন্য সত্যিই সে দুঃখ পেয়েছে মনে। কিন্তু গিরিবালার কী দোষ? তার স্বামী বেঁচে আছে ফেদির নেই। তার কোলে ভগবান ছেলে দিয়েছেন, সোনারচাঁদ ছেলে (গিরিবালা চুক চুক করে চুমু খেল, ছেলের গায়ের গন্ধটা শুঁকল) ফেদির কোল খালি রেখেছেন, তা সে কী করবে? তার কী দোষ? গিরিবালার খুব অস্বস্তি লাগছিল। 

গিরিবালা জানে, বুঝতে পেরেছে ফেদির মনে কী তীব্র পিপাসা জেগে উঠেছে! এখন খোকাকে ওর সামনে নিয়ে গেলে কিছু হবে না তো, নজর লাগবে না তো? খোকাকে বুকে চেপে ধরল গিরিবালা। পরক্ষণেই তার চোখে এক বঞ্চিতা মাতৃত্বের করুণ দুটি চোখ ভেসে উঠল। গিরিবালা ভাবল, সত্যি, ফেদিদির চোখ দুটো কত সুন্দর! গিরিবালা নিজেকেই চাবুক মারল যেন। ছিঃ, সে তো বড় স্বার্থপর! ধড়মড় করে উঠে পড়ল। উলঙ্গ শিশুটিকে বুকে নিয়ে সে বড়মার ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢোকার আগে সে অবশ্য খোকার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে আলতো করে একটা কামড় দিয়ে নিল। সাবধানের বিনাশ নেই। 

ফেদির কোলে গেল না খোকা। কিছুতেই না। বড্ড চেনা-অচেনা হয়েছে। একবার জোর করে কোলে নিল ফেদি, কঠিন আয়াসে বুকে চেপে ধরল। কঠিন স্তনে মাতৃত্ব ফলেনি তার। সুধার ভাণ্ড পূর্ণ হয়নি। তাই তার বুক জুড়াল না। কেঁদে ককিয়ে, শরীরটাকে বাঁকিয়েচুরিয়ে প্রবল বিদ্রোহ ঘোষণা করলে গিরিবালার ছেলে। অপ্রস্তুত ফেদি হার মেনে ক্ষুণ্ন মনে আবার তাকে গিরিবালার কোলে ফিরিয়ে দিল। ওর কচি মুখে চুমু খাবার একটা বাসনা ফেদির হয়েছিল। কিন্তু ডাকাত ছেলেকে আর ঘাঁটাতে ইচ্ছে করল না। কেমন এক অবসাদ এসে গেছে তার। কীসের জন্য এতটা পথ এসেছিল, এখন আর তা বুঝতে পারছে না। এবার বাড়ি ফিরতে মন চাইছে। কিন্তু এতটা পথ একা ফিরবে কী করে? বেলাও পড়ে আসছে। 

ফেদি বলল, খুড়িমা, এবার বাড়ি যাই। একটা লোক দিতি পারো একটু আগায়ে দেরে আমারে? 

বড়বউ বললেন, সে কী মা, এখনই যাবি? 

হ্যাঁ, খুড়ি, বাইরি বেরোয়ে দেখো, বেলা আর নেই। 

ওমা, তাই তো! ও ফুলির মা, পানের বাটাটা আনো দিনি, ফেদিরি একটা পান খাওয়ায়ে দিই। একটুখানি বস মা, একটা পান মুখি দে। 

ফেদি বলল, বিধবার ঠোঁট কি রাঙ্গা করতি আছে? আচ্ছা, দাও একটা। কিন্তু যাব কার সঙ্গে?

বড়বউ বললেন, দাঁড়া দেখি, ওরে ও নরা! 

কেউ সাড়া দিল না। নরা নেই। রামকিষ্টো নেই। ফেদির মুখ শুকিয়ে গেল। তা হলে?

বড়বউ বললেন, ভাবিস ক্যান, ব্যবস্থা একটা করতিছি। ও সুধা, সুধা, বাবা, একটু শোন।

সুধা বই পড়ছিল তার ঘরে। মা’র ডাকে এ-ঘরে এল। 

বড়বউ অনুনয় করে বললেন, মণি রে, ফেদিরি একটু আগায়ে দিবি? 

সুধা ভণিতা না করেই বলল, দেব। জামাটা গায়ে দিয়ে আসি। 

.

গাছের মগডালে তখনও আলো। তলায় তলায় সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসছে। দুর্গাবাড়ি ছাড়াতেই সেই দুম দুম ট্যাম ট্যাম বাজনা সজীব হয়ে উঠল। নিমেষের মধ্যে সেই ভয়টা লাফিয়ে পড়ল ফেদির ঘাড়ে। তার বুক ধুকধুক বেড়ে গেল। সুধাময় মনে মনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। এই ক্লান্তিকর বর্বর অনুষ্ঠান যেন শেষ হবে না কোনওদিন। এরা সব ‘মেজকাকার দেশবাসী! হাসি পেল সুধাময়ের। এদের কথা স্মরণ রেখে যদি কাজ করতে হয়, তা হলে তাদের জীবনে কোনও কাজেই আর নামা যাবে না। 

সুধাদা, শুয়োর! 

ফেদি এক চিৎকার দিয়ে সুধাময়কে জড়িয়ে ধরল। চমকে উঠে সুধাময় চেয়ে দেখল একটু দূরে একটা দাঁতাল শুয়োর সর্বাঙ্গে ক্ষত নিয়ে অন্ধকার গাছতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে। ফেদির চিৎকার শুনে শুয়োরটাও চমকে ফিরে দাঁড়াল। সুধাময় দেখল, দু’চোখে আগুন জ্বেলে শুয়োর নয়, ভয়ংকর এক মৃত্যু ছুটে আসছে। 

সুধাময়ের সমস্ত স্নায়ু এই প্রচণ্ড আকস্মিকতায় শিথিল হয়ে গেল। 

সুধাদা, পালাও, পালাও। 

ফেদির এই আর্ত চিৎকার তার কানে ঢুকল না। ঢুকলেও ফল হত না। এক চুলও নড়তে পারত না। তার দেহ পাথর হয়ে গেছে। 

ফেদি রাস্তার ধারে সরে গিয়ে প্রাণপণে সুধাময়ের একখানা হাত ধরে মারল টান। কেউই টাল সামলাতে পারল না। ঢেকির শাকের পাতা দিয়ে মুখ-ঢাকা চোরা নয়ানজুলির মধ্যে হুড়মুড় করে দু’জনেই গড়িয়ে পড়ল। 

ধাতস্থ হতে বেশিক্ষণ লাগল না সুধাময়ের। দেখল, মরেনি সে। শুয়োরের ধারালো দাঁতে তার দেহটা ফালাফালা হয়ে চিরে যায়নি। শুধু অন্ধকার নালায় পড়ে গেছে। তার উপরে পড়েছে ফেদি। ফেদির দেহটা বেশ ভারী লাগছে। সুধাময়ের পেট আর হাঁটুতে ব্যথা করছে। ফেদি একদম নড়ছে না। সেও তখন নড়তে-চড়তে ভরসা পেল না। কী জানি শুয়োরটা যদি এখনও দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে! ভয়ে আবার প্রাণ উড়ে গেল সুধাময়ের। খিঁচুনি শুরু হল তার মেরুদণ্ডে। উঃ, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছে আজ। ফেদি না থাকলে প্রাণই যেত। খুব সন্তর্পণে একটু নড়তেই ফেদির পুষ্ট স্তনের চাপ সুধাময় অনুভব করল। আর সঙ্গে সঙ্গে সুধাময়ের দেহে প্ৰচণ্ড বেগে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল। ভীম এক বিস্ফোরণের ঝাঁকুনি সে অনুভব করল। তার দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার মনে অজানা এক আক্ষেপ দেখা দিল। সুধাময়ের যৌবন এই প্রথম এক নারীদেহের আস্বাদ পেল। অপ্রস্তুত সুধাময়ের অজ্ঞাতসারে তার সর্ব অঙ্গ আরও কিছু পাবার আশায় প্রস্তুত হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল। তার অঙ্গে অঙ্গে তীব্রস্বরে বেজে উঠল কামনার দুরন্ত বাঁশরী। মুহূর্তে মুহূর্তে সুধাময়কে এক মধুর মৃত্যু যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল। 

ফেদি এতক্ষণ নিশ্চল হয়ে পড়ে ছিল সুধাময়ের শান্ত দেহের উপর। সে দেহে চাঞ্চল্য জাগবার সঙ্গে সঙ্গে সে এমন ধড়মড় করে উঠে সুধাময়ের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বসল যে, সুধাময় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ফেদি তার দিকে একবার তাকাল। সুধাময়ের মনে হল সে যেন নীরবে তাকে তিরস্কার করল, ছিঃ সুধাদা, তোমার এমন ব্যবহার! সুধাময়ের দেহের কাঁপুনি তখনও থামেনি। তার যেন জ্বর এসেছে উত্তেজনায়। 

ফেদি খুব শীতল কণ্ঠে বলল, ওঠো সুধাদা, লাগেনি তো? 

সুধার আর কথা বলার অবস্থা নেই। খুব ইতর ভাবছে তাকে ফেদি! খুব খারাপ ভাবছে তাকে! ইচ্ছে হল, ফেদিকে এখানে ফেলে রেখেই সে পিঠটান দেয়। এ মুখ আর দেখাতে চায় না। 

যথাসম্ভব গম্ভীরভাবে সুধাময় জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে একা বাড়ি যেতে পারবে? 

ফেদি একবার চোখ তুলে চাইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, না। চলো, একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছোয়ে দ্যাও। 

.

ফেদিদের বাড়ি পর্যন্ত নীরবে পার হয়ে গেল দু’জন। বাড়ির বাইরে থেকেই ফিরে আসছিল সুধাময়, ফেদির কথায় থমকে দাঁড়াল। 

ফেদি ডাকল, সুধাদা, যায়ে না, ভিতরে আসো, কথা আছে। 

এইবার সুধাময়ের মন রুখে দাঁড়াল। কী তাকে ভেবেছে ফেদি! লম্পট? বদমায়েশ? কী করেছে সে? নয়ানজুলিতে তার যে চিত্তবিভ্রম জেগেছিল তার জন্য সুধাময় একটুও দায়ী নয়। বেশ, ফেদিকে খোলাখুলিই জানিয়ে দেবে সুধাময়। ফেদির দেহের সান্নিধ্যে সুধাময় ওভাবে এসে পড়েছিল বলেই তার দেহে অমন চঞ্চলতা জেগেছিল। স্বীকার করছি ব্যাপারটা শোভন হয়নি। কিন্তু ফেদি বিশ্বাস করুক ও ঘটনার উপর সুধাময়ের কোনও হাত ছিল না। সে এতখানি বয়েস পর্যন্ত কোনও মেয়েকেই পাপচক্ষে দেখেনি। 

সুধাময় ভিতরে ঢুকতেই ফেদি এসে তার হাত চেপে ধরল। এ কী, ফেদিও যে অমনি থরথর করে কাঁপছে! ফেদির গায়ে গা ঠেকামাত্র সুধাময় আবার সেই প্রবল জ্বরের আক্রমণে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। এবার সে একা নয়। দু’জনেই এক তাপে তাপিত হচ্ছে। 

ফেদি কোনও কথা না বলে থরথর-কম্পিত হাতে সুধাময়ের হাত ধরে ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঝনাত করে বাইরের শিকলটা শব্দ করে উঠল। তারপর বদ্ধ কপাটের গায়ে মৃদু মৃদু দুলতে লাগল শিকলটা। 

একুশ 

এ কী হল? এত প্রচণ্ড তৃষ্ণা তার মনে ছিল? এত দাবদাহ তার দেহে? কই, ফেদি তো এর আগে এমনভাবে টের পায়নি! স্বামীর মৃত্যুর পর ওর দেহ আর মনের ক্ষুধা-তৃষ্ণার তেজকে নানা প্রক্রিয়ায় মন্দীভূত করে ফেলেছিল ফেদি। কোনও কোনও মা নিরুপায় হয়ে যেমন তার দামাল সন্তানকে মাদকের নেশায় নির্জীব করে ফেলে রাখে, তেমনি ফেদিও তার কামনা-বাসনাকে তার দেহের আশ্রয়ে পঙ্গু করে ফেলে রেখেছিল। দুটো বছর পার হবার পর ফেদি বুঝি একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিল, বুঝি ভেবেছিল সব চুকেবুকে গেছে, নিজেকে সে তৈরি করে নিয়েছে এক বর্ণহীন গন্ধহীন স্বাদহীন দীর্ঘ জীবন-যাপনের কঠোর সাধনার জন্য। 

কিন্তু এ কী? আকস্মিক এক ঘটনার দুর্বার আঘাতে ফেদির এতদিনের সাধনায় অর্জিত সংযম, বিধবার তপঃক্লিষ্ট শুচিতা—সব ফুৎকারে উড়ে গেল! পরপুরুষের অনধিকার প্রবেশ ঘটল তার দেহের সীমানায়! আর কিনা ফেদিরই আমন্ত্রণে! ছিঃ! 

সে কি তবে কাল পাগল হয়ে গিয়েছিল? 

অন্যদিন খুব ভোরে ওঠে ফেদি। রোদ ওঠবার আগেই তার সংসারের কাজ অর্ধেকের বেশি শেষ হয়ে যায়। আজ ফেদিদের অপরিষ্কার উঠোনে রোদ এসে গড়াগড়ি খেতে লাগল, তবুও ফেদি ঘরের দরজা খুলল না। বাসি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে পড়ে রইল। নড়াচড়াও করল না। কোনও কিছুই করতে ইচ্ছে যায় না আর। আহা, এখন ঠিক এই মুহূর্তে যদি তার মৃত্যু হত! ভগবান, ভগবান— মনে মনে পরিত্রাহি ডাকতে লাগল ফেদি। বলতে লাগল, যদি কায়মনোবাক্যে তোমার পুজো করে থাকি, তবে মৃত্যু দাও দয়াময়। 

দয়াময়কে স্মরণ করামাত্র সুধাময়কে মনে পড়ে গেল ফেদির। ফেদির চিন্তার ভূমি থেকে ভগবানকে কনুইয়ের গুঁতোয় ঠেলে দিল সুধাময়, ফেদির সমগ্র সত্তার দখল নিল নিজে। 

ফেদির ভাবনার গতি ঝড়ের বেগ ধারণ করল। দ্রুত, অতি দ্রুত ধেয়ে চলল সুধাময়ের দিকে। চিন্তার এই গতিতে ভর করে ফেদির দেহটাই যেন ছুটে চলল সুধাময়ের দেহে প্রচণ্ডবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে। সুধাদা কাল এই বিছানায় শুয়েছিল। কথাটা মনে পড়ল ফেদির বিদ্যুৎবেগে কী এক অপূর্ব সুখাস্বাদ ছড়িয়ে পড়ল তার দেহের কোণে, সঙ্গে সঙ্গে সুধাময়ের স্পর্শ প্রাণময় হয়ে উঠল। ফেদির মনে হতে লাগল, তার সর্বদেহে সুধাময়ের অনভ্যস্ত হাতের ছোঁয়া। দারুণ উত্তেজনায় ফেদির দেহে থরথর-কম্পন শুরু হল। বুক ধুকপুক করতে লাগল। চোখের অতল থেকে এক নতুন সূর্যের যেন উদয় হতে লাগল। শরীরে প্রবল তাপ, নাক, কান, মুখে যেন উত্তাপের হলকা লাগছে। কামনার প্রবল তৃষ্ণায় ফেদি ছটফট করতে লাগল। উপুড় হয়ে বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরল প্রাণপণে, নিজেকেই যেন ছোবল দিতে লাগল বারবার। আর পারে না ফেদি, এক্ষুনি যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়বে। যেন মরে যাবে। মর মর, তুই মর হতভাগী। তোর মনে এত পাপ, তোর দেহে এত তাপ, না মরলে তুই জুড়োবিনে। ছিঃ ফেদি, ছিঃ ছিঃ ছিঃ! 

মরবে সে, মরবেই। এই কলঙ্কিত দেহের ভার বয়ে নিজের কাছে ধিকৃত, জগতের কাছে ঘৃণ্য হয়ে সে বাঁচতে চায় না। ভগবান, তোমার কাছে এই মিনতি, শুধু এইটুকু করো, মরণকালে সুধাদা যেন শিয়রে এসে একবার দাঁড়ায়, এই হতভাগীর জন্য যেন দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে। তা হলে জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ নিয়ে ফেদি মরতে পারে। কিন্তু আসবে কি সুধাদা সে সময়! 

হঠাৎ ফেদির হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করে কেঁপে কেঁপে উঠল, সুধাদা আজই আসবে যে! এই দুপুরে। না না, অপরাহ্ণে। যখন তার দাদা বাড়ি থাকবে না। যখন খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে তার পড়শিরা ঘুমের কোলে ঢলে পড়বে, সেই সময় সুধাদা চুপিচুপি আসবে। ফেদি যেন দেখতে পাচ্ছে, ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে দিয়ে সচকিত সুধাময় ফেদির বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। সুধাময়ের মুখে-চোখে সেই নিষ্পাপ সুকুমার ঔজ্জ্বল্য আর নেই। সেই অনাবিল আনন্দের ধারা সুধাময়ের সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারায় আর উপচে পড়ছে না। স্বর্গীয় দীপ্তি হারিয়ে ফেলেছে সুধাময়, আর সে কোনওদিন মাথা উঁচু করে ফেদিদের উঠোনে পা দিতে পারবে না। কখনও আর সুধাময় তাদের বারান্দায় বসে তেমন অনায়াসে বাঁশের খুঁটি হেলান দিয়ে ভাবালু দৃষ্টি মেলে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে পারবে না। সুধাময়ের এই মূর্তিটা খুব ভাল লেগেছিল ফেদির। এই তো পরশুদিনের কথা। অথচ সেই সুধাময় একটি দিনের মধ্যে কী হয়ে গেল? চোরের মতো তাকে এখন আসতে হবে। পাপের গোয়েন্দাছায়া সবসময় অনুসরণ করতে থাকবে তাকে। যে সুধাময় সুস্থ সবল সদানন্দের প্রতীক ছিল, ফেদির মতো অসতীর বিষ-নিশ্বাসে সে এখন মোহগ্রস্ত, অপ্রকৃতিস্থ এক পেশাদার কামুকে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামে যার নমুনা নিতান্ত কম নেই। 

সুধাময়ের এই অধঃপতনের জন্য কে দায়ী? আমি। ফেদি স্বীকার করল, হ্যাঁ, আমি। সুধাময় কাল রাত্রে তাড়াতাড়ি যখন পালাতে চেয়েছিল, কে তার হাত ধরে আটকে রেখেছিল? কে তাকে আধোআধো ভাবে বলেছিল, কাল এসো, কাল দুপুরে এসো? আমি বলেছি, আমি— আমি— আমি। 

কিন্তু পরিণাম ভেবেছিল কি? এর পরিণতি কী হতে পারে, ভেবেছিলে? না। না, ভাবিনি। ভাববার অবকাশ কোথায় ছিল কাল? এক ফেদি দুই হয়ে গেল। তারপর যাত্রাদলের সুমতি-কুমতির মতো তর্ক করতে বসল। 

এখন তবে বুঝতে পারল ফেদি, কাল যে অত তাড়া অনুভব করেছিল গিরিবালার ছেলেকে দেখতে যাবার জন্য, সে তা হলে গিরিবালার ছেলের জন্য নয়! না না, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল ফেদি, ঈশ্বর জানেন, আর-কোনও উদ্দেশ্য ছিল না আমার। গিরিবালার ছেলেকেই দেখতে চেয়েছিল, তাকেই দেখতে গিয়েছিল সে। কোনও কুমতলব ছিল না। তবে, তবে এ কাণ্ড কী করে ঘটল? জানি না, জানি না, জানি না। বালিশে মুখ ঘষতে লাগল ফেদি। 

দুম দুম ট্যাম ট্যাম বাজনাটা ফেদির কানে বেজে উঠল। আহত সেই ভয়ংকর শুয়োরটার চেহারা ভেসে উঠল তার চোখে। বুনোদের হাত থেকে যেমন রেহাই পায়নি সেই দাঁতালটা, বন থেকে বনে তাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে যেমন নিষ্ঠুর উল্লাসে শিকারিরা তাকে শেষ করেছে, ঠিক ফেদিকেও তেমনিভাবে কে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে! তাড়িয়ে তাড়িয়ে তাকে এই পরিণতিতে এনে ফেলেছে। এই ঘটনায় তার সচেতন হাত কোথায়? 

ফেদির হ্যাঁচকা টানে সুধাময় নয়ানজুলিতে গড়িয়ে পড়ল। ফেদিও টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ল সুধাময়ের উপরে। প্রচণ্ড ভয়ে ফেদি তখন আধমরা। তার কি তখন অন্য খেয়াল থাকতে পারে? কতক্ষণ এমনভাবে ছিল সে জানে না। হঠাৎ একসময়, সেই আচ্ছন্নতার মধ্যেও সে তার স্বামীর পরিচিত উষ্ণতার বিদ্যুৎস্পর্শ পেল। সেই স্পর্শটি পাওয়ামাত্র সে চমকে উঠেছিল। তৎক্ষণাৎ সুধাময়ের দেহ থেকে সে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছিল। একটা নতুন আতঙ্ক আর পুরনো উত্তেজনা তাকে মুহূর্তের জন্য আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। থরথর করে কেঁপে উঠেছিল ফেদি। কিন্তু বিধবার সংযমের রাশ পরিয়ে সে মুহূর্তের মধ্যেই সেই ফাজিল চিত্তচাঞ্চল্যকে বশে এনে ফেলেছিল। সুধাময়ের মুখে বিমূঢ়তা এবং অপরাধের যে মিশ্র ছাপ সে সময় ফুটে উঠেছিল, তা ফেদির দৃষ্টি এড়ায়নি। সুধাময়ের শিশুর মতো বিমূঢ়তায় বরং কিছুটা মজাই পেয়েছিল সে। সুধাময় এতই বিব্রত বোধ করছিল যে, ফেদিকে ওখানে ফেলে রেখেই যেন পালিয়ে যাবে। সুধাময় সে-কথাটা বলে ফেলতেই চোখে অন্ধকার দেখল ফেদি। সর্বনাশ! সে তা হলে যাবে কী করে একা। তা ছাড়া কী এমন হয়েছে যে সুধাদা এত কিন্তু কিন্তু করছে! তাই সে যথাসম্ভব সহজভাবেই সুধাময়কে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বলেছিল। 

তারপর সারা পথ তারা দু’জনে চুপ করে হাঁটতে লাগল। সুধাদা কথা বলছে না কেন? এত অপরাধী ভাবছে কেন নিজেকে? এই সম্পর্কে ভাবতে গিয়েই যে সত্য অকস্মাৎ আবিষ্কার করে বসল ফেদি, তাইতেই সর্বনাশ ঘটে গেল। সুধাময়ের দেহটা ফেদিকে বুকে ধরে যে তার স্বামীর দেহের ভাষায় তাকে ডাক দিয়েছিল, সুধাময়ের অপরাধবোধের কারণ কি এই? তবে কি ফেদির দেহে এখনও এমন গুণ আছে যা পুরুষকে টানতে পারে? বিধবা হওয়ার পরেও সে তা হলে ফুরিয়ে যায়নি? এ-সব কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন এক চাঞ্চল্য জেগে উঠতে লাগল ফেদির দেহে! কেমন যেন শিরশিরানি! কেমন একটা অস্থিরতা! কীসের যেন প্রত্যাশা! তার সর্বদা ভয় হতে লাগল, এই বুঝি সুধাময়ের অবুঝ পৌরুষ পিছন থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সত্যি, এখন যদি সুধাদা তাকে জড়িয়ে ধরে, তা হলে কী হবে? কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। কেউ না, কেউ না। কী হবে তা হলে? যত এই কথা মনে পড়তে লাগল, ফেদির শরীর তত বেশি কাঁপতে লাগল। পথ আর চলতে পারে না। যেন এক্ষুনি পড়ে যাবে মাটিতে। তবুও যা হোক, নির্বিঘ্নেই বাড়ি পৌঁছোল। কিন্তু বাড়ি পৌঁছোতে-না-পৌঁছোতে সে বুঝল তীব্র পিপাসা ফেদির যৌবনকে জর্জরিত করে ফেলেছে। সে যেন দিনের পর দিন জল না-খেয়ে এক দুস্তর মরু পার হয়ে এসেছে। সামনেই দেখেছে এক জলাশয়। সামনেই সুধাময়। দিগবিদিকজ্ঞান হারিয়ে তাই ফেদি কাল সন্ধ্যায় সেদিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাল মন্দ, ন্যায় অন্যায়, পরিণাম পরিণতি— কিছুই সে ভাবেনি। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার স্বামীকেই কাছে পেয়েছিল। যেটুকু ঘাটতি ছিল, সে তার কল্পনা দিয়ে পূরণ করেছে। তাই সেই সুখকেই তখন অন্তিম সুখ বলে মনে হয়েছিল তার। এখন দেখল, বুঝল, সে সুখ সুখ নয়, কালসাপের দংশন। এখন যা দীর্ঘস্থায়ী তা হচ্ছে যন্ত্রণা, উত্তরোত্তর সুতীব্র পিপাসা। তাই হয়তো ফেদি সুধাময়কে আবার আমন্ত্রণ করে থাকবে। 

কিন্তু কাজটা উচিত হয়নি। এখন বুঝতে পেরেছে ফেদি। সুধাদাকে বারণ করে দেবে আসতে। সুধাদা চিরকাল সুধাদাই থাক। তার নাগর যেন না হয়। ফেদি নিজেকে নষ্ট করেছে, তা করুক। কিন্তু সুধাময়কে নষ্ট করবে না। 

কিন্তু কী করে বারণ করবে? চিঠি পাঠাবে? ছিঃ ছিঃ! তাতে শুধু মনের কেলেঙ্কারি কালির অক্ষরে জগতে প্রকাশ হবে। তবে কি আজ আবার যাবে ওদের বাড়ি? কিন্তু কী উপলক্ষে? ফেদি সভয়ে দেখল, পৃথিবীটাকে সে কত জটিল করে ফেলেছে। ফেদি দেখল, সে এরই মধ্যে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে। তবে কি সুধাময়কে বারণ করা যাবে না? সে আসবে? তাকে নিবারণ করা যাবে না? আবার… 

না না না, আর না, আর না। যা হবার হয়ে গেছে। ভগবান ভগবান, এবার রক্ষা করো, রক্ষা করো। 

ফেদি বালিশে মুখ গুঁজে অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগল। 

.

ঘুম হয়নি, ঘুমোতে পারেনি সুধাময়। ঘুমোনো কি যায়! 

উত্তেজনার প্রবল আবর্তে পড়ে সারারাত হাবুডুবু খেয়েছে সুধাময়। ফেদির অস্তিত্ব অশরীরী অবয়ব ধরে বারে বারে এসেছে, নিরন্তর তাকে স্পর্শ করেছে। সুধাময়ের রোমে রোমে পুলকের শিহরন জেগেছে। সুধাময় জেগে উঠেছে। আবার হয়তো কখনও ঘুমিয়েছে। ঘুমোনোমাত্র ফেদির কমনীয় দেহের সুঘ্রাণে হয়তো সুধাময়ের ঠুনকো ঘুম টুটে গেছে। ফেদির অজস্র চুল যেন অন্ধকার হয়ে সুধাময়কে ঢেকে রেখেছে। তার প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে, হাত বাড়ালেই যেন এই নরম অন্ধকার সে মুঠো করে ধরতে পারবে। আর মুঠিভোর অন্ধকারের গোছা সুধাময় আলতো করে তার নাকের কাছে টেনে আনলেই তার ভিতর থেকে ফেদির চুলের সেই মাতাল গন্ধ বুঝি পাওয়া যাবে। বুঝি সেই চাপ চাপ অন্ধকারের নীচেতেই ফেদির অপরূপ মুখখানা ভেসে উঠবে, হেসে উঠবে। বুঝি তার নরম ওষ্ঠের দুটি পেলব পাপড়ির গুরু চাপ পড়বে সুধাময়ের ঠোঁটে। সুধাময় চমকে উঠল। ফেদির গরম নিশ্বাস কে ফেলল তার গালে? কে? সুধাময়ের রক্তে যেন প্রচণ্ড বেগে বান নামল। প্রতিটি রক্তকণিকা দুরন্ত স্রোতে গা ভাসিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে অনির্দিষ্ট এক লক্ষ্যে ছুটে চলল। কোথায়, কে জানে? উন্মাদ বিদ্যুৎ-তরঙ্গের ছোঁয়া লাগায় তার দেহের কোষে কোষে বাধাবন্ধহীন উচ্ছৃঙ্খল উল্লাস অবিশ্রান্ত নৃত্যে মেতে উঠল। এই বুঝি সুধাময় ফেটে পড়ে, ভেঙে পড়ে। এই বুঝি তার সত্তা রেণু রেণু হয়ে উড়ে যায়। এ কী নিদারুণ, এ কী দুঃসহ, এ কী পরম আনন্দময় এক অভিজ্ঞতা! সুধাময় একে আর ধরে রাখতে পারছে না। ছেড়ে দিতেও মন চায় না। 

একসময় এই প্রবল জোয়ারও স্তিমিত হয়ে এল। অবসাদে ক্লান্ত হল সুধাময়। আর সে চাঞ্চল্য নেই। আর সে বিক্ষোভ নেই। মহা আলোড়নের পর তার বিধ্বস্ত অস্তিত্বে যেন শান্তি ঘোষিত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ল সুধাময়। 

দু’মিনিটও পার হয়েছে কি না সন্দেহ, কে যেন ধাক্কা দিল সুধাময়ের বন্ধ দরজায়। ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে গেল তার। এত মৃদু তার দুয়ারে নাড়া দিল কে? ফেদি? চুপিসারে ফেদি এসেছে নাকি? দাঁড়িয়ে আছে বাইরে? কালকের মতো থরথর করে কাঁপছে? যে মুহূর্তে দরজা খুলবে সুধাময়, সেই মুহূর্তেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ফেদি? আদরে অস্থির করে দেবে সুধাময়কে সন্ধ্যাবেলার মতো? আবার সুধাময় প্রবল তাড়নায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। আবার তার দেহে, তার মনে প্রচণ্ড তোলপাড় শুরু হল। মাতাল হল রক্ত, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হল। প্রবল চাঞ্চল্যে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় বিদ্রোহ ঘোষণা করল আবার। অস্থির হয়ে উঠল সুধাময়। কাঁপতে লাগল থরথর করে। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। অসহায় হয়ে পড়ে রইল বিছানায়। উন্মুখ আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল ফেদির। যেন ওই বন্ধ কপাট ভেদ করেই এসে উপস্থিত হবে সুধাময়ের শয্যায়। 

কিন্তু ফেদি এল না। দরজায় আর ধাক্কাও দিল না। এর আগেও সম্ভবত দেয়নি। সম্ভবত কেন, নিশ্চয়ই দেয়নি। সুধাময় ভাবল, সে তবে পাগল হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, পাগলই। নইলে সে কী করে ভাবল, ভাবতে পারল, ফেদি এত রাত্রে ও-পাড়া থেকে বন জঙ্গল ডিঙিয়ে তার দুয়ারে এসে হাজির হয়েছে! সেই ফেদি, ভয়ে যে দিনের আলোতেও একা-একা যেতে পারে না। সুধাময়ই তো তাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিল। আর এগোতে গিয়েই তো… 

তা ছাড়া ও-পাড়াতে নাই-ই যদি থাকত ফেদি, যদি সে সুধাময়ের পাশের ঘরেই থাকত, তা হলেই কি আসতে পারত? 

এতক্ষণ পরে সুধাময়ের জ্ঞান হল, যে সুখস্বপ্নে সে ভাসছিল, সেটি অতি গর্হিত। আর সঙ্গে সঙ্গেই সে যেন সপাত করে বিবেকের এক চাবুক খেল। এ কী করেছে সে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে! এ তো অন্যায়, এ তো অপরাধ, এ তো পাপ! যদি ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে পড়ে! সর্বনাশ! চোখে অন্ধকার দেখল সুধাময়। ভয়ে ঘেমে উঠল। এখন উপায়? গলা শুকিয়ে গেল তার। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। কী উপায় এখন? কী করবে সুধাময়? পালিয়ে যাবে কলকাতায়? পালিয়েই কি নিস্তার আছে? সুধাময় দেখল, এমন নিদারুণ এক জালে সে জড়িয়ে পড়েছে, যে জাল কাটবার সাধ্য তার নেই। নেই— একদম নেই। সুধাময় জানে, পাপ কখনও চাপা থাকে না। মা-দিদিমার মুখে কতবার সে কথাটা শুনেছে, নাটক-নভেলে পড়েছে, যাত্রা-থিয়েটারে দেখেছে। না, পাপ কখনও চাপা থাকে না। আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল সুধাময়। তার পাপও চাপা থাকবে না। একদিন ফাঁস হয়ে যাবে। হয়তো এর মধ্যেই জেনে গেছে লোকে। ভর-সন্ধেয় সে ফেদির সঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়েছিল। ফেদি তাকে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল। কারও নজরে কি আর তা পড়েনি? নিশ্চয়ই পড়েছে। সুধাময় ধরা পড়ে গেছে। ফিসফিস করে কথাটা কান থেকে কানে ছড়াতে আরম্ভ করেছে। ঘরে ঘরে কানাকানি শুরু হয়ে গেছে। এ-সব মুখরোচক জিনিসের সদব্যবহার করার সুযোগ পেলে গ্রামের লোক ছেড়ে কথা কয় না। সকাল হতে না হতেই দ্রুতবেগে কথাটা ছুটবে বিভিন্ন পথে। হাটতলায় পৌঁছে যাবে, তারপর মাতব্বররা, সমাজের রক্ষাকর্তারা ছুটে যাবে ফেদির বাড়িতে, আসবে এখানে। হইচই হবে। নালিশ, সালিশ, বিচার। কেলেঙ্কারির বাকি থাকবে না কিছু। কী অবস্থা হবে তার? কী অবস্থা হবে এই পরিবারের, বাবার মা’র পিসিমার মেজকাকার? কী তাকে ভাববে বুড়ি? মা হয়তো এই শোকে মরেই যাবে। সুধাময়ের জীবনের সব আলো নিবে আসতে লাগল। তার মনে হল, সে যেন তাড়া-খাওয়া এক শিকার। সেই বুনো শুয়োরটাই যেন। বন থেকে বনে পালাচ্ছে সে আর গ্রামের লোক ক্ষিপ্ত হয়ে ঝোপঝাড় পিটে তাকে ধরবার জন্য তাড়া করেছে। তাদের হিংস্র চিৎকার শুনতে পাচ্ছে সুধাময়। এ সেই আদিম মানুষের শিকারি চিৎকার। সুধাময়ের কানে উদ্দাম বাজনা বেজে উঠল। দুম দুম দুম— ট্যাম ট্যাম ট্যাম। এর পরিণতি কীসে? সুধাময় বুঝতে পারল, মৃত্যুতে।”পাপের বেতন মৃত্যু”— এই অমোঘ নির্দেশটা সুধাময় কলকাতায় দেখেছে কোন একটা গির্জার দেওয়ালে। আজ সেটাকে তারই কপালে ঝুলতে দেখল। মৃত্যুই তবে একমাত্র পথ? কিন্তু কেমন মৃত্যু! কলঙ্কের কালি মেখে সে মরবে, তার পরিবারে চিরদিনের জন্য এই অক্ষয় কলঙ্ক চিহ্নিত করে দিয়ে যাবে? সুধাময়ের দম আটকে আসতে লাগল। জল তেষ্টা পেল। তার বুক ফেটে যেতে লাগল। 

আর কি কোনও পথ নেই? ভাবতে লাগল সুধাময়।

কেন, সে যদি বিয়ে করে ফেদিকে? 

উত্তেজনায় বিছানার উপর লাফিয়ে উঠল সুধাময়। যদি সে বিয়ে করে ফেদিকে! বালিশটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল। যদি কেন, নিশ্চয়ই সে বিয়ে করবে। সব দায়িত্ব মাথা পেতে নেবে। সে না পুরুষ! সে না আধুনিকতার প্রতিনিধি! ফেদি বিধবা, বামুনের মেয়ে। সুধাময় জানে, তার এই কাজে গ্রামে কী প্রবল আলোড়ন উঠবে! বাবা-মা পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বাধা দেবে প্রাণপণে। তা হোক, পরোয়া করবে না সুধাময়। এ কাজে কেমন যেন এক বীরত্ব আছে। সে ফেদিকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাবে। সেখানে সংসার পাতবে দু’জনে। আবার আলো দেখল সুধাময়। মনোমতো এক পথ দেখতে পেল। অবৈধ নারী-সংসর্গের পাপ সে মুক্ত করবে বিবাহের বৈধতার বন্ধন দিয়ে। দৈব দুর্ঘটনায় যে দুটি দেহ পাপের পঙ্কে এসে মিশেছিল, বিয়ে করে, সংসার পেতে সে দুটি মনে তারা প্রেমের পদ্ম ফুটিয়ে তুলবে। এর জন্য যে বিপদই আসুক, সুধাময় মাথা পেতে নেবে। যদি ত্যাজ্যপুত্র হতে হয়, যদি এ পরিবার ছাড়তে হয় জন্মের মতো, তাও স্বীকার করে নেবে সুধাময়। 

সংকল্পটা নেবার পর সুধাময় দেখল তার মনের গ্লানি কেটে আসছে। নিশানাহীন সমুদ্রে সারারাত তরী বেয়ে সুধাময় যেন ভোরবেলা কোনও নতুন দেশের তটরেখা দেখতে পেল। ধীরে ধীরে তার মনে উল্লাসের সঞ্চার হতে লাগল। সুধাময় তখন আরও এক ধাপ আগে পা বাড়াল। 

কেউ জানুক আর নাই জানুক, ফেদিকে সে বিয়ে করবেই। আর তার ভয়-ডর নেই। অমনি সুধাময়ের কানে ফেদির কাতর আহ্বান বেজে উঠল। গত সন্ধ্যায় তার বুকে মুখ রেখে অতৃপ্তস্বরে বলেছিল, কাল আসো সুধাদা, দুপুরের পর আসো। অমনি আবার সুধাময়ের দেহে জোয়ার আসতে লাগল। প্রবল জ্বরের নতুন জোয়ার। ফেদির কাছে যাবার জন্য দুর্বার ইচ্ছাটা আবার জেগে উঠল। 

হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল সুধাময় 

গ্রামে সুধাময় আর ফেদিকে নিয়ে কম কেলেঙ্কারি হল না। সুধাময় যেমন যেমন ভেবেছিল, ঠিক তেমন তেমন ঘটে গেল। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ল। পিসিমা সুধাময়ের পায়ের উপর মাথা কুটলেন। মা অন্নজল পরিত্যাগ করলেন। বাবা শক্ত পাথর। সুধাময় শুধু মেজকাকার সমর্থন পেল। না পেলেও ক্ষতি ছিল না। মাতার অশ্রুজলে বিচলিত হলে আর সমাজ সংস্কার করা যায় না। বিদ্যাসাগরের মায়ের মতো মা ক’জন লোক পায়! সুধাময়ের একটুখানি আফশোস রইল যে, বিদ্যাসাগরকে সে এ জিনিসটা দেখাতে পারল না। বোঝাতে পারল না যে, বাঙালি এখনও তাঁকে ভুলে যায়নি। ফেদি বড্ড ভিতু। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কলকাতায় আনতে সুধাময়কে বেশ বেগ পেতে হল। সুধাময়ের বন্ধুরা হইহই করে উঠল। কাজের মতো কাজ করছে সুধা। কয়েকটা ফক্কড় অবশ্য ফোড়ন কাটতেও ছাড়ল না: ওইরকম বিধবা আমাদেরও জোগাড় করে দে সুধা। অমন বিধবা পেলে আমরাও বিদ্যাসাগরের শিষ্য হয়ে যাই। সুধাময় গম্ভীরভাবে বলল, ফেদি যে সুন্দরী এটা নিতান্তই অ্যাকসিডেন্ট। বিয়ে বড় নয় সুধাময়ের জীবনে, প্রিন্সিপলটাই বড়। বন্ধুরা সবাই হাততালি দিয়ে সমর্থন জানাল। তারাই চাঁদা তুলে বিয়ের এমন আয়োজন করে ফেলল যে, সুধাময় রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। আরও বিস্ময় বুঝি বাকি ছিল। দেশবন্ধু সেটা পূরণ করলেন। স্বয়ং হাজির হলেন তার বিয়েতে। আশীর্বাদ করলেন। উপহার দিলেন খদ্দরের জাতীয় পতাকা। পরদিন খবরের কাগজে বিয়ের খবরটা ছাপা হয়ে গেল। উদারচেতা যুবক কর্তৃক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান। 

চট করে ঘুম ভেঙে গেল সুধাময়ের। দেখল প্রচুর বেলা হয়েছে। চোখ তখনও জ্বালা করছে তার। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। ঘনঘন হাই তুলল। এত বেলা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে এল। 

সকাল যদি বা গেল, দুপুর আর যায় না। সুধাময় অস্থির হয়ে উঠল। এ-বাড়িতে এখনও খাওয়া-দাওয়াই হয়নি কারও। লক্ষ করল, কত দেরিতে খাওয়া-দাওয়া হয় তাদের বাড়িতে। সময়টা যে কত মূল্যবান বস্তু তা কলকাতার লোকের মতো বোঝে না এরা, এইসব পাড়াগেঁয়ে লোকেরা। তাই শুধু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতেই দিন কাবার করে দেয়। 

কিছুক্ষণ ছটফটিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে সুধাময় নিজের ঘরে গিয়ে বসল। একখানা বই নিয়ে পাতা উলটাতে লাগল। একবর্ণও পড়তে পারল না। বইখানা ছুড়ে ফেলে দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে শুয়ে শুয়ে টানতে লাগল। 

হঠাৎ দুম করে উঠে পড়ল সুধাময়। 

রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে হাঁক দিল, মা, তোমাদের রান্না হল? 

বড়বউ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। বললেন, ক্যান রে মণি, খিদে পায়েছে? 

অসহিষ্ণু সুধাময় জবাব দিল, খিদের আর দোষ কী? কলকাতায় কোন কালে আমাদের খাওয়া হয়ে যায়। এতক্ষণ তো আমাদের টিফিন খাওয়ারও সময় হয়ে এল। রান্না হয়ে থাকে বলো, চানটা করে নিই। 

বড়বউ অপ্রস্তুত হলেন। আহা, বাছার বড্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু মাছ আনতে আজ এত দেরি করে ফেললেন বড়কর্তা যে, এখনও পর্যন্ত মাছটাই রান্না হয়নি। মুড়িঘণ্টটা নামল কেবল। মাছটাও পাওয়া গিয়েছে ভালই। মেস বোর্ডিং-এ কী খায় সুধা কে জানে! কেই বা আছে যত্ন করে খাওয়াবে? তাই পাঁচরকম রাঁধতে বসেছেন বড়বউ। কিন্তু এর মধ্যেই সুধা তাড়া লাগাতে আরম্ভ করেছে। 

বড়বউ তাড়াতাড়ি বলেন, বোস না এখেনে। দু’খোন মাছ ভাজে দিই, খা 

এবার সুধাময় চটে গেল রীতিমতো। 

বলল, ও-সব হাবিজাবি খাওয়ার সময় আমার নেই। ভাত যদি হয়ে থাকে তো দাও। না হলে চিঁড়ে মুড়ি যা থাকে আনো। নিয়মের খাওয়া অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। অনিয়ম এখন সহ্য হবে না। পাংচুয়ালিটির মর্ম তোমরা জীবনেও কখনও বুঝবে না। যাক গে, আমি এখনই চান করে আসছি। 

সুধাময় চলে গেল। বড়বউয়ের মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল। সুধাই যদি না খেল তবে ছিস্টির রান্না কার জন্যে! সমস্ত শ্রম বরবাদ হয়ে গেল। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ও ফুলির মা, রান্না এখন থো। সুধার আমার খিদে পায়েছে খুব। থাকতি না পারে ছ্যান করতি গেল। আসে পড়ল বলে। তাড়াতাড়ি খানকয়েক মাছ ভাজে দ্যাও। আর ও-বেলার জন্যি সব তুলে রাখো। 

.

আসলে খাওয়ার জন্য অত মাথাব্যথা পড়েনি সুধাময়ের। তার তাড়া অন্য কারণে। 

খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে এসে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। দরজায় খিল এঁটে দিল। হ্যাঁ, এইবার সে নির্বিঘ্নে ভাবতে পারবে। যতক্ষণ তার খুশি। কেউ আসবে না তার চিন্তায় ব্যাঘাত জন্মাতে। 

ফেদির কাছে যাবার আগে সে সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে ভেবে নিতে চায়। সুধাময়ের সংকল্প ঠিকই আছে। সে ফেদিকে বিয়ে করবে। এতে আর নড়চড় নেই। এখন ফেদির মত হলে হয়। সেটা খুব সহজে পাবে বলে সুধাময়ের মনে হচ্ছে না। কলকাতার মেয়ে তো নয়, পাড়াগাঁয়ের কুসংস্কারেই ফেদি হয়তো আচ্ছন্ন। হয়তো সে সুধাময়ের প্রস্তাবে প্রবল আপত্তি তুলবে। সুধাময় মনে মনে স্থির করল, তখন অকাট্য সব যুক্তি দিয়ে ফেদির অবৈজ্ঞানিক মনে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বীজ বপন করে দেবে। ফেদি তখন বুঝবে, কী অসার সংস্কার সে আঁকড়ে ধরে আছে। তখন নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করবে ফেদিকে। ফেদি তখন আনন্দের সঙ্গে স্বেচ্ছায় এ বিয়েতে মত দেবে। শুধু বউই নয়, ফেদি হবে তার মন্ত্রশিষ্যাও। এই চিন্তায় বড় সুখ পেল সুধাময়। তার মনে পড়ল, অনেকটা এইরকম ব্যাপার যেন কোন একখানা ইংরাজি ছবিতে ঘটতে দেখেছিল। আদি খ্রিস্টানদের উপর রোমানদের নিদারুণ নির্যাতনের কাহিনী নিয়েই ছবিখানি তোলা। এক সুন্দরী ক্রীতদাসীর মনে খ্রিস্টের মাহাত্ম্য প্রচার করতে গিয়ে নবদীক্ষিত এক খ্রিস্টান যুবককে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল সেই ছবিতে। কিন্তু প্রভুর কৃপায় সব বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে সেই যুবতীকে দীক্ষিত করেছিল। তারপর দু’জনের মিলনের মধ্য দিয়ে ছবিটির সমাপ্তি ঘটেছিল। সুধাময় দেখল, সেই যুবকের সঙ্গে তার কেমন মিল হয়ে যাচ্ছে। ফেদিকেও যে সে তার আদর্শে দীক্ষা দিতে পারবে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই তার। আদর্শ যে জীবনের থেকেও বড়, এ-কথা ফেদিকে সে বোঝাতে পারবে বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস 

ফেদির সঙ্গে সে চিরকাল সুখে কাটাতে পারবে, ফেদি তার হবে, অথচ কোনও কলঙ্কিত পথে চোরের মতো তাকে হাঁটতে হবে না, এই সম্ভাবনা খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুধাময়ের কাছে। 

ফেদির মনটাই শুধু বদলে দেবে না সুধাময়, সে ঠিক করল বিয়ের পর তার নামটাও বদলে দেবে। ফেদি নামটা যে সুচারু নয়, বিশেষ করে যে মেয়েকে কলকাতায় থাকতে হবে, যে হবে সুধাময়ের বউ, সেটা এখন খেয়াল হল সুধাময়ের 

শুয়ে শুয়ে গা এলিয়ে আসছিল সুধাময়ের। তারপর প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত তার মনোমতো হওয়ায় মানসিক উদ্‌বেগও কমে আসছিল। বড় বড় গোটাকতক হাই তোলবার সঙ্গে সঙ্গে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি এসে ঘুমের অতলে নিয়ে ফেলল সুধাময়কে। 

.

ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা শেষ হতে আর অল্পই বাকি। সুধাময়ের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল। একটা বড় হাই তুলে সে পরম নিশ্চিন্তে হাত পা ছড়িয়ে আবার গা এলিয়ে দিল বিছানায়। 

তারপর তার শিথিল মনে যেন বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল। তার না ফেদির কাছে যাবার কথা! সর্বনাশ! বেলা যে আর নেই। সুধাময়ের বুকটা শিনশিন করে উঠল। এক লাফে নেমে পড়ল খাট থেকে। খাবলা খাবলা জল মুখে চোখে ছিটিয়ে দিল। জামাটা গায়ে চাপিয়ে সে দ্রুতপদে বেরিয়ে পড়ল। ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে লাগল ফেদির বাড়ির দিকে। বুক দুরদুর করছে অজানা এক আশঙ্কায়। যদি না থাকে ফেদি? সুধাময় যেন হাটের মাঝে মনিব্যাগ ভুলে ফেলে এসেছিল, মনে পড়তেই সেটা আনতে ছুটছে। কেন সে ঘুমিয়ে পড়ল এমন করে? এতক্ষণ ধরে কেন ঘুমোল? নিজেকে চাবুক মারতে ইচ্ছে করছে সুধাময়ের।

.

বেলা থাকতে থাকতেই সুধাময় ফেদির বাড়িতে পৌঁছোল। তাকে দেখতে পেয়েই ফেদির বাবা হুঁকোয় টান মেরে বেদম কাশতে লাগলেন। 

কাশিটা কোনওমতে সামলে বললেন, আরে কিডা, সুধাময় না? আরে বাপ রে, এত বড়ড়া হয়ে গেছ? আমি ভাবি কিডা না কিডা? আসো আসো। বসো। কবে আলে? থাকবে ক’দিন? 

ফেদির বাবা! কখন এলেন? সুধাময়ের চোখ থেকে ঝপ করে সব আলো নিবে গেল। যে মাটিতে দাঁড়িয়ে ছিল সে, সেটাও সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল। ঠিক এই ব্যাপারটার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেল সে। কী কষ্টে যে সামলে নিল সুধাময়, সেই জানে। বোকার মতো খানিক হাসতে চেষ্টা করল। আন্দাজে আন্দাজে প্রণাম করল ফেদির বাবাকে। তারপর ধপ করে বসে পড়ল মাটিতেই। 

সাড়া পেয়ে ফেদির মা ভিতর থেকে থপথপ করে বেরিয়ে এলেন। বাতে একেবারে কোলাব্যাঙের মতো ফুলে গিয়েছেন ফেদির মা। 

বললেন, ও মা, সুধা? তাই বলো। আমি বলি সুধাময় আবার কিডা? 

আবার বোকার মতো খানিক হাসতে হল সুধাময়কে। প্রণাম করতে হল ফেদির মা’র গোদা পায়ে। এককালে ফেদির মতোই সুন্দরী ছিলেন তিনি। তাঁকে দেখে আজ কেউ কি সে-কথা বিশ্বাস করবে? 

ফেদির মা ডাক দিলেন, ও ফেদি, দ্যাখ আসে, সুধা আয়েছে। আমরাও বাবা আজ দুপুরে আসে পৌঁছোলাম। তীখ করতি গিছিলাম। তা তীখই বলো আর যাই বলো, বাড়ি আসে যেন হাঁফ ছাড়ে বাঁচলাম। ফেদি ক’ল কাল তুমাগের বাড়ি গিছিল। বুড়ির ছাওয়াল নাকি বড় সুন্দর দেখতি হয়েছে? যাব একদিন দেখতি। তা বুড়ি যাবে কবে? 

সুধাময় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ফেদি আছে, কাছাকাছিই আছে। কিন্তু কাছে আর নেই। কাছে হয়তো আসবেই না আজ। আসছেও না। সবাই মিলে সুধাময়কে কেমন বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। কী যেন একটা জিজ্ঞাসা করলেন ফেদির মা। 

ভাল করে না বুঝেই সুধাময় জবাব দিল, বেশ তো, কালই যাবেন একবার।

ফেদি খুব নরম সুরে ডাকল, মা, শোনো। 

ফেদির স্বর সুধাময়ের দেহে যেন ঝংকার তুলল। রোমাঞ্চ হল তার দেহে। 

ফেদির মা বললেন, বসো বাবা, এটটু পিস্সাদ খায়ে যাও। ও ফেদি, সন্ধে লাগল। পিদিম দে মা। তারপর সুধারে একটু মহাপিস্সাদ দে। বেরো না, সুধারে আবার লজ্জা কী? 

ফেদি তাকে লজ্জা পাচ্ছে? তাই বেরুচ্ছে না? সুধাময়ের খুব মজা লাগল। ফেদি তো আচ্ছা!

ফেদির বাবা হুঁকো টানতে টানতে আর কাশতে কাশতে দীর্ঘ এক ভ্রমণকাহিনী ফেঁদে বসলেন। পথের কষ্ট, পাণ্ডাদের অত্যাচার, আরও নানা ব্যাপার। সব কানেও ঢুকল না সুধাময়ের 

বুঝলে বাবা, খাওয়ার সুখ যদি বলো তো তা হল কাশীতি। অ্যাঃ, যেমন মাছ মাংস, তেমন দুধ ঘি আর তেমনিই তরি-তরকারি। কাশীর কাছে কেউ না। ব্যোম ভুলানাথের জায়গা তো। পৃথিবীর বাইরি। 

এইটুকু শুধু শুনেছিল সুধাময়। তারপর যে মুহূর্তে ফেদি সন্ধে-বাতি দিতে বেরোল, তার মন তার চোখ ফেদির সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল। কাল সে যেন ভাল করে দেখেইনি ফেদিকে। এখন নতুন করে তাকে দেখতে লাগল সুধাময়। তুলসীতলায় জলের ছিটে দিচ্ছে ফেদি, গলায় আঁচল দিয়ে তাদের দিকে পিছন ফিরে গড় হয়ে প্রণাম করছে, প্রদীপ দেখাচ্ছে। আর এক এক সময় ফেদির দেহের এক-একটা অংশের উপর দৃষ্টি পড়ছে সুধাময়ের। সে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। পিঠ, কোমর, নিতম্ব প্রতিটি অংশ ওর কত সুগঠিত, কী অসাধারণ সুন্দর! ফেদির হাঁটা চলায়, পইঠে বেয়ে এক-একটা ঘরের বারান্দায় ওঠা-নামায় কতরকম ছন্দ যে ফুটে উঠছে ওর দেহে, তার যেন কোনও সীমা সংখ্যা নেই। বুক ঢিপ ঢিপ করছে সুধাময়ের। একবারও কি আজ নিরিবিলিতে দেখা হবে না? একটা কথাও কি বলবে না ফেদি? একটিবারের জন্যও … 

সুধাময়কে প্রসাদ খেতে দিল ফেদি। জল দিল। কিন্তু একবারও তার চোখে চোখে চাইল না। সে যে সুধাময়কে চেনে, কোনওদিন দেখেছে, ফেদির চালচলনে, মুখ-চোখের ভাবে তা একদম প্রকাশ পেল না। খেতে দেবার সময়েই বোধহয় নিকটতম সান্নিধ্যে এসেছিল তারা। কিন্তু এই সান্নিধ্যে তো কোনও আহ্বান জাগল না? সুধাময় উত্তরোত্তর বোকা বনে যেতে লাগল, উত্তরোত্তর হতাশ হতে লাগল। 

তারপর আবার অনেকক্ষণ দেখা পাওয়া গেল না ফেদির। এ পৃথিবীতে ফেদি বলে যেন কেউ নেই, কখনও ছিল না, এমন মনে হতে লাগল সুধাময়ের। তারপর অকস্মাৎ ফেদির আবির্ভাব হল। হাতে তার ছোট একটা পোঁটলা। 

ফেদি বলল, এই প্রথম আজ কথা বলল সুধাময়ের সঙ্গে, বাড়ি যাও সুধাদা। এই পিস্সাদ ন্যাও। মা দিল। খুড়িরি বোলো। চলো, তুমারে আলোটা ধরে দিই। 

এ কেমন কথার ঢঙ ফেদির? এ কেমন কাঠ-কাঠ ব্যবহার? সুধাময় হাত পেতে পোঁটলাটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। 

ফেদির বাবা বললেন, সুধাময়, সুমায়-টুমায় পালি আরেকদিন আসো, কেমন? 

সুধাময় ঘাড় নেড়ে এগিয়ে চলল। দরজার মুখে আসতেই ফেদি ফস করে একখানা চিঠি সুধাময়ের হাতে গুঁজে দিয়েই ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। চিঠিখানা মুঠো করে ধরতেই চনচন করে রক্তের বেগ বেড়ে গেল সুধাময়ের। থরথর সেই কাঁপুনি আবার ফিরে এল তার শরীরে। চিঠি নয়, যেন ফেদিকেই মুঠোর মধ্যে পেয়েছে সুধাময়। 

.

এক ছুটে বাড়ি এল সুধাময়, ঢুকে গেল নিভৃতে তার ঘরে, সে কি এই জন্য? তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পড়বার জন্য? কাঁপা-কাঁপা হাতে দলাপাকানো চিঠিখানা খুলে পড়েছিল সুধাময়। দু’লাইনের চিঠি। পড়া শেষ করে ফ্যাকাশে মুখে সেই থরথর করেই কাঁপতে লাগল আবার। এই দুই কাপুনির মধ্যে কী আকাশ-পাতালই না ব্যবধান! একটা পুলকের শিহর, অন্যটা অসহ্য যন্ত্রণা। ফেদি লিখেছে, ‘আসতে লজ্জা হল না? আমার সর্বনাশ করার জন্য, এত উৎসাহ কেন?” দুটি মাত্র ছত্র। যেন দুটি শেল। অব্যর্থ লক্ষ্যে তার মর্মে গিয়ে বিঁধল। লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে সুধাময় মৃতপ্রায় হয়ে উঠল। 

চিঠির যা ভাষা তাতে এ-কথা স্পষ্ট যে, ফেদি সব দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। ‘আসতে লজ্জা হল না?’ যেন সুধাময় বিনা আহ্বানে সেখানে গিয়েছে। ‘আমার সর্বনাশ করার জন্য এত উৎসাহ কেন?’ মিথ্যাবাদী। সুধাময় যেন গর্জন করে উঠল। চিঠিখানাকে উঁচু করে ধরে সে বিড়বিড় করে বলল, এ-কথা বলতে কি একটুও বাধল না? লজ্জা হল না তোমার? আমি কি তোমার হাত ধরে টেনেছিলাম? ঘরে নিয়ে খিল দিয়েছিলাম যে আজ আমার ঘাড়ে সব অপরাধ, সব পাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তুমি সতী সাজছ। আমার সম্পর্কে এই তোমার ধারণা! এত খারাপ! অথচ তোমাকে আমি কী ভেবেছিলাম। কত উঁচুতে তুলেছিলাম। আমি কোনও পাপ-মন নিয়ে আজ তোমার কাছে যাইনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। ঈশ্বর জানেন, একটা আদর্শ নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম। মুহূর্তের দুর্বলতায় যা পাপ করে ফেলেছি, চিরতরে তার থেকে মুক্ত হবার পথ দেখাতে তোমার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি, তুমি কী! তুমি নীচ, তোমার মন অতি ছোট, কোনও মহৎ ধারণা তোমার অন্তরে নেই, তাই তুমি আমাকে এমন যাচ্ছেতাই কথা বলতে পারলে। কিন্তু তুমি যা ভাবছ, আমি তা নই, তা নই। তোমার সর্বনাশ করতে আমি যাইনি। বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো। চিঠির একটা কোনা ধরে প্রাণপণে ঝাঁকাতে লাগল সুধাময়। রাগে জ্বলতে লাগল। তার বুকে এক তীব্র যন্ত্রণা বোধ হতে লাগল। ছি-ছি, ফেদি এমন ছোট! এত নীচ, এমন পাজি! আর সেই ফেদিকে নিয়ে সে এক সুখের প্রাসাদ গড়তে শুরু করেছিল! কী বোকা সুধাময়! যদি একা পেত ফেদিকে, তা হলেও না হয় সুধাময় তাকে বোঝাতে পারত, সত্যিই কোনও বদ মতলব তার ছিল না। কিন্তু তা তো হবে না। সে আর একা কখনই ফেদির দেখা পাবে না। প্রয়োজনই বা কী? কে ফেদি? একটা অতি বাজে মেয়ে। সুধাময়কে নিয়ে অনায়াসে যেমন কাণ্ড সে করেছে, তেমন কাণ্ড সে আর কারও সঙ্গে করেনি, তার ঠিক কী? সোমখ বিধবা, তায় আবার এত রূপ। গ্রামে এই ধরনের লোকেরও অভাব নেই। তারা এতদিন ওকে আস্ত রেখেছে! হুঁ! চিঠিখানা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলল সুধাময়। পারলে হয়তো ফেদিকেও ছিঁড়ত। 

সর্বনাশ হয়েছে তার। ফেদির স্পর্শে সুধাময়ের দেহেই পাপ ঢুকে গেছে। কী করবে সে? কীসে সে পরিত্রাণ পাবে? যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল সুধাময়। 

সারারাত ধরে সে এমন ছটফট করল। ভোর হতে-না-হতেই ঠিক করল আজই সে কলকাতায় ফিরে যাবে। আর এখানে থাকবে না। এক মুহূর্তও না। 

কিছুতেই থাকল না সুধাময়। বলল, বিশেষ জরুরি কাজ, না গেলেই নয়। গোটা পরিবারকে হতভম্ব বানিয়ে, মা’র চোখে জল ঝরিয়ে বাড়ির গোরুর-গাড়ি করে সে দশটার মধ্যেই রওনা দিল। এ গ্রামের বাতাসে বাতাসে অসভ্য উদ্দামতা, অবিশ্বাস আর প্রবঞ্চনা। এখানে থাকলে আত্মহত্যা ছাড়া পথ থাকবে না। আর না হয় সে পাগল হয়ে যাবে। 

বাইরে ফাঁকা রাস্তায় এসে কিছুটা হাঁফ ছাড়ল। সামনে তার সোজা সড়ক। আকাশ অনেক উঁচুতে। পরিসর অনেক বিস্তৃত। দম ফেলবার অবকাশ পেল সুধাময়। বিকাল নাগাদ ঝিনেদা পৌঁছে যাবে। তারপর প্রথম রাত্রে চুয়াডাঙা। কাল এমন সময় সে কলকাতার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। কিন্তু ফেদি? ফেদির কথা আবার মনে পড়ল কেন? না না, তার কথা আর ভাববে না সে। কখনও না, কখনও না। 

.

বিকালে ফেদি মাকে সঙ্গে নিয়ে সুধাময়দের বাড়িতে এসে দেখে, সকলেরই মুখ ভার-ভার। সে আর থাকতে পারেনি। কাল বাবা-মা হঠাৎ এসে পড়ায় তার মাথা প্রায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সুধাময় এসে পড়লে কী মনে করবে তারা, যেন ধরা পড়ে যাবে ফেদি, সেই ভাবনায় সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। সারাদিন প্রার্থনা করেছিল সুধাময় যেন না আসে। বিকেল প্রায় পেরিয়ে গেলেও যখন সুধাময় এল না, তখন সে একটু হাঁফ ছাড়ল। আর তার একটু পরেই উদ্‌ভ্রান্তের মতো সুধাময় এসে হাজির। ফেদির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সুধাময়ের উপর বেজায় রেগে গেল। কী এই লোকটা! আবার আজ এসেছে? ভয়-ডর নেই। লালসা তো কম নয় ওর! ঘৃণা হয়েছিল নিজের উপর, ঘৃণা করেছিল সুধাময়কে। তাই জ্ঞানগম্যি হারিয়ে অমন কড়া একটা চিঠি দিয়েছিল। তারপর সারা রাত ধরে বড় কষ্ট পেয়েছে নিজের মনে। সত্যি, সুধাদার কী দোষ? দোষী তো সে নিজেই। ভাল কথায় বুঝিয়ে দেওয়া উচিত ছিল তার। কাল অবশ্য সময় ছিল না। তাই সারা দুপুর ধরে ফেদি গুছিয়ে একখানা চিঠি লিখেছে। নিজের দোষ অকপটে স্বীকার করেছে। সুধাদা যেন তাকে ক্ষমা করেন। আর যেন দু’জনের দেখা না হয়। 

ফেদির মাকে দেখে চোখ ছলছল করে উঠল বড়বউয়ের। খপ করে বসে পড়ল ফেদির মা। আসতে তাঁর বড় কষ্ট হয়েছে। 

বললেন, কী লো বউ, কেমন আছিস? মুখখানা ভার ভার ঠেকতিছে ক্যান? 

বড়বউ বললেন, আসো দিদি, বসো। দুঃখির কথা আর কী কব। সুধা বাড়ি আলো দু’বছর পর। তেরাত্তিরও থাকল না, আজ সকালে কলকাতায় চলে গেল। আজকাল কলকাতার বাবু হয়েছে, বাড়ির ভাত আর মুখি রোচে না। এত ব্যাগাতা করলাম আর দুটো দিন থাকার জন্যে। তা আমরা তার কিডা? দাসী বাঁদি বই তো নই। 

বড়বউ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। ফেদি চমকে উঠল। সুধাদা চলে গেছে? তবে কি তার কারণেই গেল? সেই চিঠিখানা পেয়ে? ফেদির হৃৎপিণ্ডটা শক্ত মুঠিতে কে যেন চেপে ধরল। দম বন্ধ করে কে যেন মেরে ফেলবে তাকে। সুধাদা নেই? আর একবার তার দেখা পেল না? তার মনের কথাটা না শুনেই চলে গেল সুধাদা? 

ফেদির মা বললেন, সে কী, কাল যে দেখা হল সুধার সঙ্গে। কতক্ষণ গল্প করল বসে বসে। কই কিছু তো তখন ক’ল না। 

বড়বউ চোখ মুছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, আমাদেরউ কিছু কয়েছে নাকি কাল? সকালে ঘুমির থে উঠেই ক’ল, চললাম। চললাম বললি তো আর অপিক্ষে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই পিরায় যায়। কোনওমতে দুড়ো ভাত রাঁধে মুখি তুলে দিলাম। এতদিন পরে আলো, একটু খাওয়াব-দাওয়াব, তা কপাল। 

ফেদি আর সেখানে বসল না। বসতে পারছিল না। চোখ জ্বালা করছে। বুকের খাঁজে লুকোনো চিঠিটা বুক যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে। সে চট করে সুধাময়ের ঘরে চলে গেল। দরজাটা কোনওমতে ভেজিয়ে দিয়ে পরিত্যক্ত বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। মনে মনে প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল, যেন ফেদির মনের আওয়াজ সুধাময়ের কানে গিয়ে পৌঁছোবে: ও আমি অন্যায় বলিছি সুধাদা, ও আমার মনের কথা নয়। ও-কথা সত্যি নয়, সত্যি নয়। 

বাইশ 

অবশেষে ভুষণ এল। 

ঘোড়ায় নয় চকচকে একখানা সাইকেল চড়ে। ওখানা ভূষণ সদ্য সদ্য কিনেছে। হারকিউলিস বাইক, উইটকপের ঘোড়া-মুখো সিট আর ডানলপের টায়ার টিউব। ভূষণের মতে বাইক সম্পর্কে শেষ কথা এই। বি এস এ কি র‍্যালে কি হাম্বার, ওগুলোও ভাল, কিন্তু ও-সব শৌখিন লোকেদের জন্য। তার মতো পাড়াগেঁয়ে ডাক্তারের উপযুক্ত সাইকেল এই হারকিউলিস। কাঁচা রাস্তা, মাঠের আল, বেশিরভাগ সময় এইসব পথেই তো তার যাতায়াত। হারকিউলিসের শক্তিই লাগে এ পথে সাইকেল ঠেলতে। 

বেশ মৌজেই চালিয়ে আসছিল সাইকেল। বুনো পাড়ার মুখে আসতেই শ্বশুরের সঙ্গে দেখা একেবারে চোখাচোখি। ভূষণ তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে নেমে পড়ল সাইকেল থেকে। শ্বশুর আর জামাই, দু’জনের মুখেই হাসি ফুটে উঠল। 

ভূষণ কিঞ্চিৎ মুশকিলে পড়ল। তার সামনে শ্বশুর, হাতে সাইকেল। প্রণাম করে কী ভাবে? নাঃ, সাইকেলের সঙ্গে অটোমেটিক একটা স্ট্যান্ডও থাকা দরকার। চাবি টিপে দিলাম অমনি দাঁড়িয়ে রইল সাইকেল। ইচ্ছেমতো তখন প্রণাম করো কি অসুবিধে হলে জিরিয়ে নাও একটু। কাছাকাছি একটা শক্ত গাছও নেই যে ভূষণ সাইকেলটাকে ঠেস দিয়ে রাখবে। কী আর করে, রাস্তার উপরেই শুইয়ে দিল সাইকেলখানা। প্যাডেলে চাপ লাগায় পিছনের চাকাটা পনপন করে ঘুরতে লাগল একটানা শব্দ তুলে। গোল বেলটা ক্লিলিলিং ক্লিলিলিং শব্দে বেজে উঠল। 

মেজকর্তার পায়ের ধুলো নিল ভূষণ। 

মেজকর্তা বললেন, খবর সব ভাল তো? বাড়ির সব ভাল আছেন? বেয়ান ঠাকরুন? 

ভূষণ বশংবদের মতো ঘাড় নেড়ে সব কথার জবাব দিয়ে গেল। প্যাডেলের কোনায় আর ফুটপিনে কাদা লেগে গিয়েছে। শ্বশুরের প্রতি যথেষ্ট ভক্তি থাকা সত্ত্বেও ভূষণের মনটা ওই কারণে খুঁতখুঁত করতে লাগল। 

মেজকর্তা বেরোচ্ছিলেন। বেলা দশটা সাড়ে দশটা। কিন্তু আজ আর বেরুনো হল না। জামাইকে নিয়ে ফিরলেন। 

.

চাঁপার সঙ্গে গিরিবালার একটু খিটিমিটিই বেধে গেল। ওটার কোনও জ্ঞানগম্যি হল না আজ পর্যন্ত। বিরক্ত হল গিরিবালা। 

সে তার তোরঙ্গ গোছাতে বসেছিল। দু’দিন ধরে গিরিবালা তার ভাল ভাল জামা কাপড় তোরঙ্গ থেকে বের করে রোদে দিয়ে শুকিয়ে রেখেছে। তোলা আর হয়ে উঠছিল না। আজ জোর করেই বাক্সটা নিয়ে বসল। ভাল ভাল শাড়ি জামা তার নিতান্ত মন্দ নেই। সব উপহার পাওয়া। এ দু’খানা তার মা’র শাড়ি। একখানা মুর্শিদাবাদি, অন্যখানা বেনারসি। মা বোধহয় বিয়ের সময়েই পেয়েছিল। কিন্তু পরেনি। অন্তত গিরিবালা তার মাকে কখনও এসব পরতে দেখেনি। পাট করে তোলা ছিল। বেনারসিখানার রং একটু জ্বলে গিয়েছে, মুর্শিদাবাদিখানা পোকায় কেটেছে। কলকাতার ভাশুরের দেওয়া জামদানি, যশোরের ভাশুরের দেওয়া কটকি, কাকিমার দেওয়া ভাগলপুরি, শাশুড়ির দেওয়া ফরাসডাঙা, সব এই বাক্সেই পড়ে থাকে। কখনও পরে না গিরিবালা। এসব তার যক্ষের ধন। মাঝে মাঝে, তাও হয়তো বছরে দু’-তিনবার বের করে, নেড়েচেড়ে দেখে, রোদে দেয় আবার ঝেড়েঝুড়ে তুলে রাখে। বড়জোর নাকের ডগায় ধরে একটু একটু শোঁকে। কালোজিরের গন্ধের সঙ্গে শাড়ির গন্ধ মিশে যে এক অদ্ভুত গন্ধ বের হয় তার ঘ্রাণ বড় ভাল লাগে গিরিবালার। 

বাক্স খোলার সময় সে কাউকে কাছে থাকতে দিতে চায় না। কারওর সামনে সে পারতপক্ষে বাক্স খুলতে চায়ও না। একবার শ্বশুরবাড়িতে বাক্স খুলেই তার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। এক ভাশুর-ঝি তার অমন ভাল টাঙ্গাইলখানা দেখতে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কিছু বলতে সে ভরসা পায়নি। তবে মর্মান্তিক কষ্ট পেয়েছিল। 

এ-সব জিনিস সে পরে না, পরতে পায় না। কোথায় পরবে? শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরে তো আর পোশাকি কাপড় পরে যাওয়া যায় না। বিয়ের পর সে কোথাও তো যায়নি। এমনকী পাড়া বেড়াতে ক’বার গিয়েছে তাও এক আঙুলে গুনে বলে দিতে পারে। বাপের বাড়ি এইবার নিয়ে এই তিন বছরে চারবার এল। 

কাজেই ভাল ভাল জিনিস পরার সুযোগ কই তার। তা না পরুক সে, তার জিনিস তার কাছেই থাকুক! যেভাবে খুশি। অন্যেরা তাতে হাত দেবে কেন? তাই চাঁপার উপর চটে গিয়েছিল। চাঁপা অবশ্য শাড়িটাড়িতে হাত দেয়নি। তার লোভ গিরিবালার গন্ধদ্রব্যগুলোর দিকে। ওগুলো তো আরও দুষ্প্রাপ্য। সেই বিয়ের সময় এক সেট কে যেন উপহার দিয়েছিল। ফুলশয্যার দিন ভাশুরঝি-রা তাকে একটু একটু মাখিয়ে নিজেরা খাবলা খাবলা মেখেছিল। ওইসব গায়ে মেখে প্রথম দিকে একটু অস্বস্তি, একটু বাধো বাধো লাগলেও, শেষ পর্যন্ত কিন্তু গিরিবালার কেমন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। আরও কয়েকবার মাখবার সাধ ছিল। কিন্তু আর একদিনও সে সুযোগ গিরিবালা পায়নি। অনেকগুলো জিনিসও লোপাট হয়ে গেল। মুখে-মাখা সেই হিমানী, তার কৌটোটা আর পাওয়া গেল না, সেই গন্ধ পাউডার, সেটাও গায়েব হয়ে গেল। 

তার উপহারের বাক্সটার প্রায় সব খোপগুলোই এখন খালি। এককোণে ছয়কোনা কাচের ছিপিওয়ালা একটা ‘এসেন্টের’ শিশি পড়ে আছে তার খোপে। একফোঁটা এসেন্টও তার মধ্যে নেই। ভাল করে ছিপি না আঁটায় খানিকটা বাক্সে পড়েছে আর খানিকটা উবে গেছে। কিন্তু তার মিষ্টি গন্ধটা এখনও আছে। বাক্সের ডালাটা খুললে এখনও নাকে লাগে। আর, সেই বাক্সের মধ্যে গিরিবালা একটা অগুরুর শিশি কোনওমতে ঢুকিয়ে রেখেছে। সেই শিশির প্রতিই চাঁপার লোভ। বড্ড হ্যাংলা হচ্ছে মেয়েটা। সে একমনে বাক্স গুছোচ্ছে আর সেই ফাঁকে অগুরুর শিশিতে হাত বাড়িয়েছে চাঁপা। ভাগ্যি সে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলেছিল, নইলে নির্ঘাত নিয়ে পালাত। 

গিরিবালা ধমকে উঠল, এ-সব জিনিসি তোর কী দরকার, অ্যা। নোলা একেবারে সক্‌সক্‌ করতিছে। 

আচমকা ধরা পড়ে চাঁপা প্রথমে থতমত খেয়ে গিয়েছিল। তারপর অনুনয় বিনয় আরম্ভ করল। তারপর হাতে পায়ে পড়তে লাগল। দেখল, দিদি এ ব্যাপারে বড় সেয়ানা 

তুই এমন চামার ক্যান রে? একটু দেখতি চাচ্ছিলাম, আমি কি খায়ে ফ্যালাতাম।

গিরিবালার মাথায় আগুন চড়ে গেল। 

যত বড় মুখ না, তত বড় কথা। লাই পায়ে তুমার বড্ড বাড় বাড়িছে, না। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।

চাঁপার চুল ধরে আচ্ছা করে নেড়ে দিল গিরিবালা। 

চাঁপা খরখর করে উঠল, তুই আমার গায়ে হাত তুললি! তোর ওই হাতে পোক না পড়ে তো কী বলিছি। কুড়িকুষ্টি হবে তোর। হবে, হবে, হবে। এই তিন সত্যি করলাম। 

গিরিবালা বলল, দ্যাখ চাঁপা, ইবার সত্যি সত্যি মার খাবি কিন্তু। বড়মারে বলে দেব?

চাঁপা বুড়ো আঙুল নাচিয়ে বলল, তুই করবি আমার কলা। 

গিরিবালা বিয়ে হয়ে যাবার পর যা করেনি, তাই করল। রাগ সামলাতে না পেরে ঠাস করে চাঁপার গালে এক চড় মেরে বসল। আর দু’দিন পরে তো বিয়ে হবে, সভ্যতা শিখল না মেয়েটা। চড় খেয়ে চাঁপা অবাক হয়ে গেল। দিদি যে সত্যি সত্যিই মারবে ও ভাবেনি। 

তৎক্ষণাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সত্যিই দিদি ওকে মারল, মারতে পারল! এই আড়ি আড়ি। জন্মের মতো আড়ি। জীবনেও সে আর কথা বলবে না দিদির সঙ্গে। 

বাইরে থেকে মেজকর্তা ডাকলেন, চাঁপা। 

মেজকাকা এসেছেন। ঠিক হয়েছে। এইবার দেখাচ্ছি দাঁড়াও। বড় হয়ে ভেবেছ, কী না কী হয়েছ। এবার টের পাওয়াচ্ছি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে চাঁপা বাইরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এল। 

দিদি রে, জামাইবাবু! 

বলেই ছুট দিল ভিতরের দিকে। গিরিবালা চমকে উঠল। কে? ভূষণ! সে হকচকিয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারল না। ঢকাস করে বাক্সের ডালাটা বন্ধ করে দিল। যেন এইভাবেই সে তার সমস্ত অস্থিরতাকে ঢেকে রাখবে। গিরিবালা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। 

চাঁপা ততক্ষণে ভয়ানক চেঁচামেচি করতে লেগেছে। 

ও বড়মা, ও পিসিমা, ও কাকিমা, জামাইবাবু আয়েছেন। 

ভিতর-বাড়ির সাড়াশব্দ মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। চট চট করে ঘোমটা উঠতে লাগল সকলের মাথায়। নিঃশব্দে উল্লাসের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে লাগল মনে মনে। জামাই—জামাই এসে গেছে। বাব্বাঃ, কতদিন পরে এল ভূষণ! 

.

খবরটা ছড়িয়ে যেতে দেরি হয়নি। এ-পাড়া ও-পাড়ার পুরুষ মহল দুপুরের আগেই এসে গিয়েছে। বারবাড়িতে বিস্তর তামাক পুড়ছে। জটলা হয়েছে। সরকার মশাই, পুরুত মশাই, স্যান কবিরাজ, বুদো ভুঁয়ে—এসেছেন সবাই। ভূষণের কুশল, বাড়ির খবর আগ্রহ করে জিজ্ঞাসা করেছেন, ভূষণের কাজকর্মের খবর নিয়েছেন। ভূষণ কোটচাদপুরে আছে শুনে, সেখানে এঁদের যেসব পরিচিত লোক আছে, তাদের তত্ত্ব-তল্লাশ এঁরা নিয়েছেন। নানারকম স্মৃতিকথা শুনিয়েছেন ভূষণকে। সমালোচনাও হয়েছে কোটচাদপুরের লোকেদের। 

ভূষণ মন দিয়ে সব শুনেছে। অতি বিনীতভাবে দু’-এক কথার জবাবও দিয়েছে। সে দেখল, এঁরা যে কোটচাঁদপুরের কথা বলছেন তার সঙ্গে আসল কোটচাঁদপুরের কোনও মিল নেই। অবশ্য ভূষণ সে-কথা প্রকাশ করল না। বরং ওদের খুশি করার জন্য দু’-একবার ওদের কথাতেই সায় দিয়ে গেল। 

ভূষণ এসেছে বলেই তাকে নিয়েই যে এই সভা, সে যে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি, সে সম্পর্কে ভূষণ সচেতন হল। নড়েচড়ে বসল। সময়োচিত গাম্ভীর্য আনবার জন্য ভূষণ নানাভাবে তার মনটাকে নাড়াচাড়া করতে লাগল। তবুও ওর মনে হতে লাগল, না, যথেষ্ট হল না, তেমনভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। মন তাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে না। হ্যাঁ, হয়েছে। ভূষণ জামাই-জামাই ভাবটাকে এবার একটু পিছনে সরিয়ে দিয়ে তার ডাক্তার সত্তাটাকে সামনে এনে ফেলল। এঁরা যেন সব আপন আপন ‘কেস’ বিবৃত করে যাচ্ছেন, আর সে সিম্পটমগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। সরকার মশাই যেভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, তা দেখে ভূষণের পালসেটিলা থার্টির কথা মনে পড়ছে। বুদো ভুঁয়ের বকবকানিতে মনে হল নাক্সভোমিকার কথা। 

বুদো ভুঁয়ে, ভৌমিক, ভোমিকা, আরে এ তো দারুণ মিল! কখনও তো খেয়াল হয়নি। একটা গবেষণার গন্ধ পেয়ে গেল ভূষণ। অন্য লোকের কাছে এটা হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু ভূষণের কাছে এ-সব সূত্রের মূল্য অসাধারণ। এই সূত্র ধরে ভূষণ যদি চলতে থাকে গবেষণার জটিল পথে, কে জানে সে হোঁচট খেতে খেতে একদিন কোনও এক মহাসত্যে পৌঁছে যাবে কি না। সেই সত্য প্রচার করবে ভূষণ এই পৃথিবীতে। লক্ষ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। বুদো ভুঁয়ে, ভৌমিক, ভোমিকা, নাক্সভোমিকা। মানুষ আর ওষুধ বা ওষুধ আর মানুষের সঙ্গে কেমন এক নির্ভেজাল সম্পর্কের সন্ধান পেয়ে গেল ভূষণ। একটা ইঙ্গিত কে যেন তাকে ধরিয়ে দিল। এই যে পৃথিবীর পরিবর্তন হয়েছে, বিবর্তন হয়েছে, শূন্য থেকে বিচিত্র সৃষ্টি, অচেতন থেকে চেতন, জড় থেকে জঙ্গম, কীট থেকে মানব, গুহা থেকে আধুনিকতম শহর— কে জানে, এই রহস্যের চাবি বুদো ভুঁয়ে আর নাক্সভোমিকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে আছে কি না! যে বীজ নাক্সভোমিকার জন্ম দিয়েছে, সেই বীজই নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বুদো ভুঁয়ে রূপে হয়তো আত্মপ্রকাশ করেছে। একই পারিবারিক বন্ধনে ওরা পড়েছে বাঁধা 

ভূষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুদো ভুঁয়েকে দেখতে লাগল। এ যেন এক নতুন বুদো। নাক্সভোমিকার জ্ঞাতি। মাসতুতো ভাই। 

বুদো ছুঁয়ে একগাল হেসে বলল, অমন ভুলুক দিলি হবে কী? এ-বান্দা শুধু মুখি ফেরবে ভাবিছেন? খাওয়া-দাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতি হবে ডাক্তার। 

বড়কর্তা বললেন, আরে নিশ্চয়, নিশ্চয়। বুদোর আমাগের দৃষ্টিটা বড় সরেস। মহি, বুদোর কথাটা তো রাখতি হয়। কী বলো? তা হলে পরশু, পরশু দুপুরে একবার পদধূলি দেবেন আপনারা। 

হ্যাঁ, এই হল পাকা ব্যবস্থা 

সরকার মশায় বলে উঠলেন। 

এখন তা হলি উঠা যাক। বেলা যে গড় মারতি লাগিছে। 

.

সভা ভঙ্গ হল। বাইরের ঝামেলা কমল। রান্নাঘরে তখন দারুণ ব্যস্ততা। বড়বউ আর ফুলির মা বিরাট আয়োজন করে বসেছেন। শুভদারও ফুরসত নেই নিরামিষ-ঘরে। 

কী খাওয়াবেন জামাইকে? মাছ মাংস খায় না। তবে? বড়বউ ফাঁপরে পড়েছেন। এক-একবার নিরামিষ-ঘরে যাচ্ছেন, পরামর্শ করছেন শুভদার সঙ্গে, আবার এসে রাঁধতে বসছেন। সুধাময় চলে যাওয়ায় মনে যে ব্যথা পেয়েছিলেন, ভূষণ এসে সেটা আপাতত ভুলিয়ে দিয়েছে। 

ছোটবউ আঁকড়ে ধরেছেন গিরিবালার ছেলেকে। একমাত্র তিনিই বিরক্ত হয়েছেন ভূষণ আসায়। এত কী তাড়া ভূষণের? এইটুকু কচি ছেলেকে নিয়ে যে যাবে, হ্যাঁ, নিয়ে যেতেই তো এসেছে, এই ছেলে এতদূর পথ যেতে পারে? ওর কি হাড়-গোড় কিছু শক্ত হয়েছে নাকি? ডাক্তার হয়ে এই সামান্য জ্ঞানটুকু হয়নি ভূষণের? গাড়ির ঝাঁকুনিতেই তো হাত-পা ভেঙে যেতে পারে। বালাই ষাট। 

ও সওদাগর, তুমি এবার চলে যাবে? 

ছোটবউ বিছানায়-শোয়া শিশুটির মুখের কাছে মুখ নামিয়ে আনলেন। তিনি ওর নাম রেখেছেন ধনপতি, ধনপতি সওদাগর। সুন্দর নাম। তা না, কলকাতার বাবু (সুধাময়কে লক্ষ্য করে বললেন) এসে নাম রাখলেন, শঙ্খ! কী ছিরির নাম! আহা! 

ধনপতি সওদাগর, ও ধনপতি সওদাগর! তোমার বুঝি কাজ মিটেছে! এই বন্দরের সব বেসাতি বুঝি তোমার সপ্তডিঙায় বোঝাই করে ফেলেছ! এবার দেশে ফিরবে, কেমন? সব কি নিয়েছ? 

ছোটবউয়ের মুখের দিকে চেয়ে সে হাসছে। খুব হাসছে, মাঝে মাঝে খলবল খলবল করে উঠছে বিছানায়। 

খুব যে ফূর্তি দেখছি। অত হাসি কীসের? ধনপতি সওদাগর সপ্তডিঙা মধুকর! তোমার মধুকরে আমাকে বুঝি নেবে না? নেবে না? 

আবার সে হাসছে। খুব হাসছে। চোখমুখ বেয়ে তার নধর দেহটায় হাসি ছড়িয়ে পড়ছে। মহা উল্লাসে ছোট ছোট হাত দুটো, ছোট ছোট পা দুটো ছুড়তে লেগেছে। 

বুঝেছি, আমাকে নেবে না। নেমকহারাম, বড্ড নেমকহারাম তুমি। 

ছোটবউয়ের বুকে হা-হা-করা এক বাতাস বয়ে গেল। ব্যথায় বেদনায় মুখে এক ছায়া পড়ল। চুপ করে বসে রইলেন, একদৃষ্টে শিশুটির দিকে চেয়ে। সে হাসতেই থাকল। 

পাড়াপড়শি মেয়েদের ভিড় হল বিকেলে। বাড়িটা ভরে গেল। পান সাজতে সাজতে ফুলির মা’র হাত ধরে এল। 

চরম বিপদে পড়ল গিরিবালা। তার আর লুকোবার জায়গা রইল না। কী দেছে রে ছেলের মুখ দেখে? ওলো, জামাই দেছে কী? 

চাঁপা কোনওরকমে ঘুমন্ত ছেলেটাকে হাঁফাতে হাঁফাতে এনে গোয়ালদির কোলে তুলে দিল। শিশুটির একরাশ চুলের ঝুঁটিতে সুন্দর একটা সোনার টিকলি ঝুলছে। চাঁদ। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এবং যথাসম্ভব সন্তর্পণে চাঁদখানা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। 

বাঃ, বেশ। বেশ হয়েছে। জামাইয়ির নজর আছে গো। আর বেশ ভারীও। 

চাঁপা গম্ভীরভাবে বলল, এক ভরি সুনা আছে যে। 

গোয়ালদিদি বলল, থাম ছুঁড়ি। যেন হরলাল কামারের মা আলেন! 

সবাই খিলখিল করে হেসে উঠতেই চাঁপা বেজায় লজ্জা পেয়ে গেল। চটেও গেল। 

বলল, আহা, বুড়ির কথার ছিরি শোনো। 

গোয়ালদিদি ধমক দিল, আমি হলাম বুড়ি আর তুমি খুব যুবো, না? ভাগ এখেন থে। বড়বউ ধমক দিল, তোর এখেনে কী? যা। 

গোয়ালদিদি এদিক ওদিক চেয়ে দেখে গিরিবালা ঘোমটা টেনে এক কোনায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। 

ডাক দিল, ও মা, ও নাতনি, ওখেনে শুবোচুন্নি ঠাকরুনের মতো বসে আছিস ক্যান? আমি আরউ ভাবতিছি, নাতজামাইয়ের সঙ্গে বসে গল্প করতিছে বুঝি। এদিক আয়। 

গোয়ালদিদিটা কী বলো দিনি? গলা তো ঝিনেদা-মাগরোয় পৌঁছোচ্ছে। গিরিবালা যেন মাটিতে মিশে যাবে। ও-ঘরে বসে রয়েছে না ভূষণ! 

ওলো আয় আয়, ভাতার আমাগেরউ ছিল এককালে। সুহাগের ভাত আমরাউ খাইছি। নে, ছাওয়ালডারে কোলে নিয়ে এটটু বস। দেখি তোরে। যাওয়ার বাঁশি তো বাজেই উঠিছে। 

গোয়ালদিদির বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। 

তা নাতজামাই ক’ল কী? সন্তুষ্ট হয়েছে তো। আরে মর ছুঁড়ি। সুজা হয়ে বস-না। নজ্জায় একেবারে পাতাল প্রেবেশ হচ্ছে। 

.

গিরিবালা কী কষ্টে যে সে বেলাটা কাটাল, সেই জানে। সন্ধের মুখে সব বিদায় নিল। খাওয়া-দাওয়া সারতে রাতও কম হল না। 

ছেলেটাকে খাইয়ে শুইয়ে রেখে এসেছে বিছানায়। রাত্রে আর উঠবে না। ভূষণও এতক্ষণ শুয়ে পড়েছে তার জায়গায়। গিরিবালার শুধু বাকি। সাত মাস পরে স্বামীর সঙ্গে সে শোবে। 

সারাদিন নানা কাজে আড়াল করে রেখেছিল নিজেকে। দুরন্ত অভিমানকে যেন গুঁজে গুঁজে রেখেছিল। একবারও দেখা হয়নি ভূষণের সঙ্গে। না, এখনও সে দেখা করবে না। সুযোগ পেয়ে অভিমান গিরিবালার মনকে দখল করে বসল। না, সে যাবে না, যাবে না, কিছুতেই ভূষণের ঘরে যাবে না। কেন যাবে? এতদিনের মধ্যে একবারও কি তার খোঁজ নিয়েছে ভূষণ? একদিনের তরেও কি এসে দেখে গেছে খোকন সোনাকে? 

দরজার বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল গিরিবালা। চোখ ফেটে জল আসতে লাগল তার। একটা এলোমেলো বাতাস উঠেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া জ্যোৎস্নার আলো নেমে এসেছে। গিরিবালা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, বাইরে দাঁড়িয়েই সে রাতটা কাটিয়ে দেবে। ভিতরে যাবে না। তার প্রতিজ্ঞা শেষ হতে না হতেই ঘরের একেবারে ছানচেতে দুটো শেয়াল খ্যাক খ্যাক করে লুটোপুটি শুরু করে দিল। ভয় পেয়ে গিরিবালা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল। তার প্রতিজ্ঞাটাও একটু বদলে নিল। সে তার খোকার পাশে শোবে। ভূষণের সঙ্গে একটিও কথা বলবে না। 

ভূষণ দেখল, গিরিবালা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। দরজায় ঠেস দিয়ে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ওপাশ ঘুরে বিছানায় উঠে খোকার আড়ালে শুয়ে পড়ল। তার দিকে চাইল না, তার সঙ্গে কথাও বলল না। স্পষ্টতই বুঝতে পারল ভূষণ, গিরিবালা রাগ করেছে। হয়তো এর আগে সে আসেনি, আসতে পারেনি, তাই রাগ করেছে। 

কিন্তু ভূষণ আসবে কী করে? সে যে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিল। মশার স্বভাবচরিত্র পর্যবেক্ষণ করছিল। একটা গবেষণা করার ইচ্ছে জেগেছিল। মশা-ই যে ম্যালেরিয়ার কারণ, তা সবাই জানে। ম্যালেরিয়ার আক্রমণে দেশ-গাঁ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। মশা না মারলে ম্যালেরিয়া যাবে না, সে-বিষয়েও ভূষণ আর সকলের সঙ্গে একমত। তার অমতটা অন্যখানে। ভূষণ জানে, তার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রাণী মাত্রেরই এই সৃষ্টিতে এক-একটি ভূমিকা আছে। সম্ভবত মশারও আছে। সম্ভবত কেন, নিশ্চয়ই আছে। অবশ্য সে ভূমিকাটি যে ঠিক কী, ভূষণ তা জানে না। হঠাৎ একদিন সেটা সে আবিষ্কার করে ফেলল। কলেরার সিজিনে দেশের লোক কলেরার ইঞ্জেকশন নিতে চায় না। জোর করে দিতে গেলেও পালায়। আর হাজারে হাজারে মরে। ভূষণের মনে হয়েছিল, মশার মারফতে কলেরার ইঞ্জেকশন দেওয়াতে পারলে এই সমস্যার সমাধান করা যেমন যায়, মশারও তেমন একটা গতি হয়। এই বিষয়টি নিয়ে গত ছ’মাস ধরে সে গবেষণা চালিয়েছে। মূল আবিষ্কার সম্পর্কে কাজ করতে হলে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করা দরকার, এতদিনে মোটামুটি তার একটা খসড়া করে ফেলেছে। যথা, (১) মশাগুলোর রোগ বহন করার ক্ষমতা হরণ করা, (২) কলেরার প্রতিষেধক বহন যাতে করতে পারে তার ব্যবস্থা করা, এবং (৩) একটা মশা কতটুকু ওষুধ বহন করতে পারে সেটা নিরূপণ করা। 

কাজটি নিতান্ত সহজ নয়, অথচ দারুণ একটা কাজ। বিশ্বমানবের কল্যাণ এর মধ্যে নিহিত। এমন একটা কাজ ফেলে রেখে ভূষণ নিজের ছেলে-বউয়ের তত্ত্ব নিতে আসবে, এমন সংকীর্ণ ও স্বার্থপর করে ঈশ্বর তাকে গড়েননি। 

কিন্তু এসব কথা গিরিবালাকে বোঝাতে যাওয়া খুব সমীচীন বোধ করল না ভূষণ। বিশেষ করে এখন, যখন গিরিবালার ভাবগতিক বিশেষ সুবিধার ঠেকছে না। 

.

ভূষণ পাশ ফিরে চেয়ে দেখল, খোলা জানলা বেয়ে তাদের বিছানায় জ্যোৎস্না নেমে এসেছে। ছেলের পাশে শোয়া গিরিবালাকে সেই জ্যোৎস্নার আলোয় অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে। ভূষণের বেশ ভাল লাগছে। গবেষণা নয়, সাধারণ দু’-চারটে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। গিরিবালার পাশে যাবার ইচ্ছেটাও যে ধীরে ধীরে প্রবল হয়ে উঠছে। কিন্তু অবাধে আজ আর সেখানে যাবার উপায় নেই। মাঝখানে এক বাধা। অপরিচিত এক শিশু। তার ছেলে। ছেলের অস্তিত্ব সম্পর্কে এই প্রথম সচেতন হল ভূষণ। একটু যেন ক্ষুণ্ণ হল। তার আর তার স্ত্রীর মাঝখানে অনধিকার প্রবেশ করেছে ছেলেটা। ছেলেটার বে-আক্কেলে ব্যবহারে কিছুটা ক্ষুব্ধই হল সে। 

গিরিবালা মটকা মেরে পড়ে রইল। অপেক্ষা করতে লাগল, ভূষণ কখন ডাকে। মুখে মুখে যতই রাগ দেখাক গিরিবালা, সত্যিই কি তার উপর রাগ করে থাকতে পারে? গিরিবালা জানে, এখনই যদি ফিসফিস করে ডাকে ভূষণ, কি কিছু না বলে হাতখানা ধরে টানে, সব রাগ, সব অভিমান নিমেষে দূর হয়ে যাবে তার। আজ কী হল সকালে; চাঁপা যখন খবর দিল ভূষণ এসেছে? অভিমানে তার চোখে জল এসে পড়েছিল, এতদিন খোঁজখবর নেয়নি বলে রাগও হয়েছিল ভূষণের উপর, কিন্তু একেবারে গোপনে তার মনটি লতানে ডগায় ঘাসের ফুল হয়ে সুখের বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছিল। 

কী আশ্চর্য, একই বিছানায় আমি আর গিরিবালা, কিন্তু আগের সেই নৈকট্য আর নেই। ভূষণ ভাবছিল। কাছাকাছি শুয়ে আছি বটে, কিন্তু সান্নিধ্যে নেই। গিরিবালার গায়ে ভূষণের গা ঠেকছে না। তার চুলের মেঘে বন্দি হচ্ছে না ভূষণের মুখ। তার দেহের তটে আগের মতো আর আছড়ে পড়ছে না গিরিবালা ঢেউ হয়ে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় পরিবর্তন হল কীসের জন্য? এই শিশু, এই শিশু, এই শিশুটির জন্য। এতদিন গিরিবালা আর ভূষণের মধ্যে কেউ ছিল না। আজ থেকে সর্বদা এক তৃতীয় অস্তিত্ব থাকবে। ব্যাপারটা ভূষণের খুব মনঃপুত হল না। ছেলেটার দিকে আড়চোখে একবার চাইল। কীরকম কীরকম যেন! নেংটি ইঁদুরের মতো। হাত পা অবয়ব, চোখ মুখ নাক কান সব ছোট্ট ছোট্ট। মানুষের যা যা থাকে সবই আছে ওর, তবুও কেমন বেঢপ বেমানান লাগে। কলকাতায় মেজদার টেবিলে ভূষণ শ্বেতপাথরের তৈরি তাজমহলের মডেল দেখেছে। এখন সে-কথা মনে পড়ল। এ-ও যেন সেইরকম একটা মডেলই। মডেল ভূষণ! হাঃ হাঃ। মনে মনে হাসল ভূষণ। শিশুর প্রতি প্রচ্ছন্ন বীতরাগ কমে এল চট করে। স-কৌতূহল দৃষ্টি মেলে ছেলেকে দেখতে লাগল। তবে কি ভূষণ রাগ করেছে গিরিবালার উপর? এমন তো হয় না কখনও। এতক্ষণ চুপ করে থাকবার পাত্র সে নয়। নিশ্চয়ই রাগ করেছে। ওই যে নড়ল ভূষণ। গিরিবালা উন্মুখ হয়ে রইল। এবার ডাকবে তাকে। কাছে টানবে। আদর করবে। কিন্তু কই? তবে কি ভূষণ রাগই করেছে? ছেলে দেখে কি খুশি হয়নি সে? গিরিবালার মুখ কালো হয়ে গেল। 

আজ ব্যাটাকে মডেল বলে মনে হচ্ছে। ভূষণেরই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। কিন্তু দেখতে দেখতে কেমন বেড়ে যাবে। ধীরে ধীরে একদিন ভূষণের মতোই বড় হয়ে উঠবে। তখন ভূষণ আরও এগিয়ে যাবে, অনেক অনেক দূর। ছেলে আর বাবাতে শুরু হবে দৌড়বাজি। একদিন খোকা হয়তো তার বাবার বয়েসটা ধরে ফেলবে, কিন্তু বাবাকে ধরা তার অসাধ্য। 

আজ ভূষণের কাছে গিরিবালার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে গিরিবালা। কোনও আকর্ষণ নেই তার। গিরিবালার চোখ ফেটে জল এসে গেল। বেশ, বেশ তো, তাই যদি হয়, সম্পর্ক তুলে দিক ভূষণ। সে আর যাবে না ভূষণের কাছে। কেন যাবে? কেন? 

কীভাবে শুয়ে আছে দেখো। গিরিবালা এমনভাবে ছেলে শুইয়েছে, তাকে ডিঙিয়ে হাত না বাড়ালে গিরিবালার নাগাল পাবার জো নেই। ব্যাপার কী? গিরিবালা কি ছেলের আড়ালে লুকোতে চায়, নাকি ছেলেটাই দখলিস্বত্ব নিয়ে নিয়েছে? 

আমার স্বত্বই বা আমি ছাড়ব কেন? এই ভেবে গিরিবালার দিকে হাত বাড়াতেই হঠাৎ কেঁদে উঠল ছেলেটা। চমকে উঠল ভূষণ। চাপ পড়ল নাকি? অপ্রস্তুত হয়ে হাতটা টেনে নিল। কাঁদতেই লাগল ছেলেটা। গিরিবালা সাড়া দেয় না যে। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? তড়াক করে লাফিয়ে উঠল বিছানায়। ব্যস্ত হয়ে ঝাঁকাতে লাগল গিরিবালাকে। 

এই এই, দ্যাখো না, এত কাঁদছে কেন, অ্যাঁ? 

গিরিবালা টের পেল ভূষণের স্বরে উৎকণ্ঠা প্রকাশ পাচ্ছে। কেমন জব্দ? মনে মনে খুশি হয়ে উঠল। ছেলের কান্নায় এখন আর ভয় পায় না সে। 

এই, এই, ওঠো না, চাপ-টাপ পড়ল নাকি? 

গিরিবালা এবার উঠল। কোলে নিয়ে বসল ছেলেকে। কান্না থামল না। 

কী হল ওর বলো তো? 

ভূষণের এই দুশ্চিন্তায় গিরিবালার রাগ অভিমান ভেসে গেল কোথায়। ছেলেকে উপেক্ষা করছে না ভূষণ। তার জন্য ভাবছে। উদবিগ্ন হয়ে উঠছে। যে সংশয়, যে ভয়, যে উৎকণ্ঠায় এতদিন একা একা পীড়িত হয়েছে সে, এখন ভূষণও তার ভাগ নিতে এগিয়ে এসেছে। অপূর্ব সুখে গিরিবালার অন্তর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। 

সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, কিছু হয়নি। ছোট ছেলেরা অমন করেই থাকে।

গিরিবালার বুড়োটে কথার ধরনে চিন্তা দূর হল ভূষণের, সঙ্গে সঙ্গে হাসিও পেল।

ভয় পায় কিনা? স্বপনটপন দ্যাখে তো তাই ভয় পায়, ভয় পায়ে কাঁদে ওঠে। কোলে নিলি কি আস্তে আস্তে থাবাতি থাকলি আবার ঘুমোয়ে পড়ে। 

গিরিবালার কথার ধরন দেখে ভূষণের মনে হল, মেট্রন যেমন করে নতুন নার্সকে লেকচার দেয়, তেমনিভাবে গিরিবালাও যেন তাকে বাৎসল্যরস শেখাচ্ছে। 

ভূষণও উঠল। গিরিবালার কাছ ঘেঁষে বসল। তার পিঠের উপর আলতো করে মুখটা বারকয়েক ঘষল। খোঁপার নীচটায় গভীরভাবে একটা চুমু খেল। শিরশির করে উঠল গিরিবালার সর্বদেহ। আবেশে চোখ বুজে এল, গ্রন্থিগুলো শিথিল হয়ে আসতে লাগল। 

আধো আধো স্বরে গিরিবালা বলতে লাগল, এই, অমন করে না, অমন করে না, আমি তা হলি খুকারি ঘুম পাড়াতি পারব না। 

ভূষণ কথা শুনল না। গিরিবালার পিঠে নিজের গালটা জোর করে চেপে ধরল। বসে রইল সেইভাবে। গিরিবালা সম্মোহিত হয়ে গেছে। আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। 

বলতে চেষ্টা করল, আমি, আমি আর পারতিছিনে। শরীর অবশ হয়ে আয়েছে। ছাড়ে দ্যাও, লক্ষ্মীটি, ইবার শুয়ে পড়ো। 

ছেলেটা গিরিবালার কোল থেকে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে কেঁদে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গিরিবালার আবেশের রেশটা কেটে গেল। 

ধমক দিল গিরিবালা, হল তো, ইবার তুমি ছেলে সামলাও। 

সে তাড়াতাড়ি ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। দুষ্টু হাসি ঠোঁটে মেখে আড়চোখে গিরিবালা একবার ভূষণের দিকে চাইল। দেখে, ভূষণও বোকার মতো মিটিমিটি হাসছে। জ্যোৎস্নার আলোর জোর বেড়েছে। গড়িয়ে পড়েছে ভূষণের চুলে ঠোঁটে গালে। ওর বাকি শরীরটা অন্ধকারে ঢাকা। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ভূষণকে 

কিন্তু ছেলের কান্না আর থামে না। ভূষণের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে মিনতি করল গিরিবালা। 

ওদিকে ফিরে শোও দিনি। 

তেমনি ফিসফিসিয়ে ভূষণ জিজ্ঞাসা করল, কেন? 

গিরিবালা বলল, খুকা যে দুধ খাবে। 

খাক না, আমি দেখি। 

ঝলাত করে গিরিবালার বুকের রক্ত লাফিয়ে উঠল। মুখ চোখ গরম হল। ভারী অসভ্য তো! দেখে, ভূষণ হাসছে। তার দাঁতের পাটিতে জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছে। 

না না। তুমি ওদিকে ফেরো। কাঁদতিছে না? 

ভূষণ ওর কানের কাছে মুখ এনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, তা হলে তুমি খোকার বিছানাটা ওপাশে সরিয়ে দাও। 

গিরিবালার বুক ধুকপুক ধুকপুক করে উঠল। চনমন চনমন করে উঠল মন। 

ঘনঘন মাথা নেড়ে বলতে লাগল, না, না, না। তুমি কি আমার খোঁজখবর নাও? 

ঝরঝর করে গিরিবালার চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল। 

খানিক পরে দেখা গেল, খোকার বিছানা সরে গিয়েছে গিরিবালার ওপাশে। সে ভূষণের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে পরম তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। জ্যোৎস্নার ফিনিক-মারা আলো দু’জনের বুক পর্যন্ত এসে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। 

তেইশ 

ওইটুকু শিশু, সে-ও আজ অস্থির হয়ে উঠেছে। কাঁদতে কাঁদতে বেসামাল হয়ে পড়ছে। কোলে কোলে ফিরছে, তবুও তার কান্না থামে না। বড়বউ, শুভদা, গোয়ালদিদি, এমনকী ছোটবউও ওকে ক্ষান্ত করতে পারছেন না। গিরিবালার চোখ দিয়েও অবিশ্রান্ত ধারায় জল ঝরছে। কয়েকবার চোখ মুছে সেও ছেলেকে কোলে নিল। কিন্তু সুবিধে করতে পারল না। 

তার সর্বাঙ্গে গহনা। মাথায় চাঁদ, হাতে বালা, গলায় হার। সর্বাঙ্গেই মহা বিড়ম্বনা। এইসব কারণেই বড় অস্বস্তি লাগছে তার। কিন্তু কেউ তা বুঝল না। 

কে বুঝবে? কেউই তো প্রকৃতিস্থ নেই। বড়কর্তা স্বভাবশান্ত মানুষ। কিন্তু তাঁকেও আজ বিচলিত দেখা যাচ্ছে। কেবল তামাক খাচ্ছেন আর মধ্যে মধ্যে উঠে রামকিষ্টোর কাছে যাচ্ছেন। 

রামকিষ্টো বারবাড়ির উঠোনে গোরুর গাড়ির ছই আঁটছে। 

বড়কর্তা এক-একবার তার কাছে যাচ্ছেন আর বলছেন, ও রামকিষ্টো, খুব কষে বাঁধতিছ তো, দেখো পথের মধ্যি আবার যেন খুলে-টুলে না পড়ে। 

রামকিষ্টো বলছে, বড়বাবু, ভাবেন ক্যান, খুব মজবুত করে বাঁধছি। এ কাজ কি নতুন করতিছি? 

বড়কর্তা বলছেন, হ্যাঁ, আর দ্যাখো, খুব সাবধানে নিয়ে যাবা কিন্তু। বেশি ঝাঁকি-টাকি না লাগে সেদিকে খুব লক্ষ রাখবা, বুঝলে? 

রামকিষ্টো একটু হেসে জবাব দিচ্ছে, আমার হাতে গাড়ি, কিচ্ছু চিন্তে করবেন না বড়বাবু, বড়দিরি অক্লেশে পৌঁছোয়ে দিয়ে আসব। 

বড়কর্তা বলছেন, তা তো বটেই, তুমার জন্যিই তো নিশ্চিন্ত আছি। আর কারুর জন্যি তো ভাবতিছিনে, ওই কচি শিশুটা যাবে তো তাই। 

না না বড়বাবু, কোনও চিন্তে নেই। আমি মোষ দুটো নিয়ে যাব তো। 

মোষ! মোষ নিবা নাকি? না না, ওগের মতিগতি বুঝা ভার। তুমি বরং বলদ দুটোই নিয়ে যাও। বুঝিছ? 

রামকিষ্টো বড়বাবুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। 

বড়কর্তা বললেন, বলদ দুটোই নাও বরং। 

রামকিষ্টো কথা বাড়াল না। সায় দিয়ে গেল। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। বলদ জুতলি বড়দির বাড়ি পৌঁছোতি পৌঁছোতি রাত হয়ে যাবে। 

বলল, তা হলি তাই নেব। বলদই নেব। 

বড়কর্তা নিশ্চিন্ত মনে আবার গিয়ে তামাক খেতে লাগলেন। হঠাৎ কী মনে পড়ল, উঠে ঘরে গেলেন। পঞ্জিকাটা খুলে ফেললেন আবার। দশটা পঞ্চান্ন মিনিট গতে যাত্রা নাস্তি। অশ্লেষা। বড় চেন ঘড়িটার ঢাকনা খুলে সময় দেখলেন, এখন সোয়া আটটা। সর্বনাশ, আর যে সময় নেই! খড়ম খটখট করতে করতে ভিতরে গেলেন। 

ও মাজদি, যাত্তারায় বসায়ে দাও। সুমায় যে আর নেই বললিই হয়। 

শুভদা গোটা ছয়েক বিভিন্ন আকারের মাটির হাঁড়িতে নানা জিনিস ভরছিলেন। এটায় ক্ষীরের ছাঁচ, এটায় আমসত্ত্ব, এটায় নোনা তেঁতুল, এটায় কুলের আচার, এটায় বড়ি, এখন আমচুরগুলো ভরতে পারলেই হয়। 

এমন সময় বড়কর্তার গলা শোনা গেল। 

ও মাজদি, তাড়াতাড়ি করো। 

শুভদা বললেন, এই যে হয়ে আলো। ও বড়বউ, রান্না হয়েছে? 

বড়বউ সাড়া দিলেন, হয়ে আলো। আমি বুড়িরি চ্যানডা করায়ে দিই। 

বড়বউ গিরিবালার চুলের গোছায় তেল দিতে বসেছেন। সামনে চাঁপা বসে আছে। তিনজনের চোখ দিয়েই জল পড়ছে। ফোঁপানি শোনা যাচ্ছে। 

বড়বউ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছেন, খুব সাবধানে ছেলেরে রাখবা মা, একটুও যেন অযত্ন না হয়, অনিয়ম না হয়। গরম ঠান্ডা বাঁচায়ে চলবা। যা-তা খায়ে না। তুমার শরীর ভাল না থাকলি ওর শরীরউ খারাপ হবে। যদি দ্যাখো, বেশি কাঁদতিছে, নাইতি ছেঁকা দিবা। সর্দিকাশি হলি মাষকলাইর তেল গরম করে হাত-পা’র তালো আর কণ্ঠায় মালিশ করে দিবা। ভাল করে তেল মাখায়ে রোজ ছ্যান করাবা, বুঝিছ। 

গিরিবালা ফোঁত ফোঁত ফোঁপাচ্ছিল আর ঘাড় নেড়ে নেড়ে বড়মার কথায় সায় দিচ্ছিল। অবিশ্রান্ত কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ রাঙা হয়েছে, আর জল মুছতে মুছতে নাকের ডগা, মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না গিরিবালা। কেবলই বুকের ভিতর হুহু করা এক ঘূর্ণি উঠছে আর চোখ দিয়ে অবিরল ধারা ঝরছে। দুরন্ত এক ধারা। 

.

ছোটবউ অবশেষে অতিকষ্টে শান্ত করেছেন তাকে। তাঁর কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে সওদাগর। কাল আর এই কোল ভরবে না। যে সূর্যে এত আলো, এত হাসি আছে কাল আর সে সূর্য উঠবে না। যে বাতাস বইবে কাল, তাতে এত শান্তি লাগবে না। আজ একটু পরেই যেন জীবনের সব উজ্জ্বলতা নিবে যাবে। সব সাধ স্তিমিত হয়ে পড়বে। কোনও কাজই থাকবে না আর হাতে। 

ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছেন ছোটবউ। ওই অমিয় মুখে কত সুধা। একটা চুমু খেলেন। ওই ছোট ছোট হাতে কত আকর্ষণ। আরেকটা চুমু খেলেন ছোটবউ। তারপর আরেকটা। আরেকটা— আরেকটা—। আরেকটা। 

আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে? পারবে তুমি? একবারও মনে পড়বে না? একবারও না? কখনও না? আমি না থাকলে তোমার অসুবিধা হবে না। তোমার মা তো আছে। অনেক বন্দর আছে তোমার। এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে পাড়ি মারবে সপ্তডিঙায় জয়ের নিশান তুলে। ডিঙা ভিড়াবে আরেক আশ্রয়ে। কিন্তু আমি? আমি কী নিয়ে থাকব? আমার আর কে আছে? কেউ না, কেউ না, কেউ না। হুহু করে উঠল ছোটবউয়ের অন্তরখানা। যেন সেই শূন্য বন্দরের কূলে সাগরের আকুতি আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল। 

.

মেজকর্তা গেলেন কোথায়? সেই যে বেরিয়েছেন সকালে, এখনও পাত্তা নেই। এদিকে যে যাত্ৰা বয়ে যায়। আর অপেক্ষা করা যায় না। ভূষণ আর গিরিবালাকে পাশাপাশি যাত্রাঘটের সামনে বসিয়ে দেওয়া হল। গিরিবালার ফোঁপানি বিষম বেড়ে গেল। 

বড়বউ, শুভদা, গোয়ালদিদি আঁচলে চোখ মুছে বারবার করে তাকে সাবধান করতে লাগলেন, ওরে, ও মণি, চুবোও চুবোও, যাওয়ার সুমায় কাঁদে না, কাঁদতি নেই। ওরে ও পাগল, ওতে অমঙ্গল হয়। 

একে একে সবাইকে প্রণাম করে উঠে পড়ল ভূষণ। সে এই অবস্থা দেখে যেন চোর বনে গেছে। তার বউকেই তো নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ-বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হল তার, আদালতের পরোয়ানা নিয়ে যেন অনাথার সম্পত্তি ক্রোক করতেই সে এসেছে। মনে মনে অপ্রস্তুত হল ভূষণ। এ-বাড়ি ছাড়তে পারলে এখন বাঁচে। গিরিবালাও সবাইকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। গুরুজনরা বাঁ হাতের কড়ে আঙুল কামড়ে কামড়ে সেটা প্রায় ফুলিয়ে দিল। 

এমন সময় মেজকর্তা বড় একটা রুইমাছ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন এসে। কোনওখানে মাছ নেই। সেই আঠারোখাদার বিল থেকে ধরিয়ে আনতে হল। 

কিন্তু এ কী! সবাই বিস্মিত হয়ে মেজকর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তাঁর দাড়ি কোথায় গেল? পরিষ্কার চাঁছাছোলা গাল। তাঁর চেহারাই বদলে গেছে। মুহূর্তে বাড়িসুদ্ধ সবার ফোঁপানি অবধি বন্ধ হয়ে গেল। 

ম্লান হেসে অপ্রস্তুত মেজকর্তা কৈফিয়ত দিলেন, বড্ড জঞ্জাল হয়েছিল, কেটেই ফেললাম। বাড়ির সকলে গাড়ির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গোয়ালবাড়ি পর্যন্ত এলেন। গিরিবালা মিনতি করল, ও বড়মা, ও পিসিমা, আমারে খুব তাড়াতাড়ি আবার আনো। লোক পাঠায়ো ও বড়মা, মাথার দিব্যি। 

আনব মণি, আনব বই কী, উতলা হয়ে না। ও মুখ কি বেশিদিন না দেখে থাকা যায়! সাবধানে থাকবা। ছাওয়ালরি খুব যত্নে রাখবা। এর বেশি আর কথা বের হয় না। গলায় সব কথা আটকে যায়। 

গোয়ালবাড়ির কাছে এসে সবাই দাঁড়িয়ে পড়লেন। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চললেন মেজকর্তা। নাতি তাঁর বুকে। আজ আসতে বিশেষ আপত্তি করেনি। এই প্রথম তাঁর কাছে ধরা দিল। আ! কী গভীর আনন্দ! কী শান্তি! 

নাতিকে বুকে ধরে গাড়ির সঙ্গে অনেক দূর এলেন মেজকর্তা। গিরিবালা বারবার বলল, বাবা, আর না, আর আসবেন না। 

কী ভাবে গিরিবালা! একে কোলে করে যে পৃথিবীর শেষ সীমান্ত পর্যন্ত এমনভাবে হাঁটা যায়। কোনও ক্লান্তি আসে না, অন্তত মেজকর্তার তাই তো মনে হচ্ছে। 

.

তবু তাঁকে থামতেই হল। জোড়াপুলের কাছে এসে মেয়ের কোলে তুলে দিলেন নাতিকে। তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ ওদের দেখা যায়। ওই যে জামাইয়ের সাইকেল চিকচিক করতে করতে মিলিয়ে গেল। পথের বাঁকে আড়াল হয়ে গেল গোরুর গাড়িটা। আর কী? আর কেন? এবার ফিরুন মেজকর্তা। রোদ এর মধ্যেই প্রায় মাথায় উঠেছে। চারিদিক চেয়ে দেখলেন, কোথাও একটা লোক নেই। খাঁখাঁ করছে নিঃসীম এক শূন্যতা। অভ্যাসবশে দাড়িতে হাত দিলেন, হাত গিয়ে থুতনিতে ঠেকল। 

সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে গেছে তাঁর। ওই খুদে ডাকাতটা। সব খালি করে দিয়ে গেছে। মুখটাও, বুকটাও। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *