পনেরো
ছোটকর্তাকে ভয় খায় না, সমীহ করে না, এমন লোক কমই আছে এ-অঞ্চলে। বড় ডাকাবুকো লোক। ডাকসাইটে দারোগা। অসুরের মতো তাঁর চেহারা। একটু খাটো কিন্তু শরীরখানা যেন পেটা লোহায় তৈরি। কালো রং, চোখ দুটো লালচে লালচে, নাকের নীচে প্রকাণ্ড এক কাইজারি গোঁফ। গলার আওয়াজে যেন মেঘ গুড়গুড় করে। কে বলবে, বয়েস তাঁর চল্লিশ পার হয়েছে।
অনেক দিন পরে বাড়ি এলেন ছোটকর্তা। এসে দেখলেন ভালই লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও তাঁর নজরে পড়ল, বাড়িটার জৌলুস যেন আগের মতো আর নেই। যেন বুড়ো হয়ে পড়েছে বাড়িটা। আগে গুদোমবাড়ির মাঠকোঠার গায়ে প্রতি বছর চুনের কলি ফেরানো হত। চকচক করত কোঠাটা। এখন কেমন ভোঁতা ভোঁতা দেখাচ্ছে। কে জানে কতদিন চুন পড়েনি তার গায়ে! সিমেন্টের সিঁড়ির দু’পাশে হাতির শুঁড়ের বর্ডার। ফরমায়েশ দিয়ে বানিয়েছিলেন বড়দা। অযত্নে সেই হাতির মাথার সিমেন্ট খসে গিয়েছে। একটা দাঁতও কী করে যেন ভেঙেছে। চোট খেয়েছে শুঁড়ের ডগাটা। পইঠাগুলাও একের পর এক এবড়ো-খেবড়ো হয়ে উঠছে। বল্টু বসানো বসানো মজবুত দরজার নকশাগুলো আগে কেমন চমক মারত। এখন লোহার বল্টুতে মরচে ধরেছে। নকশার রং উঠে গেছে। দরজার কবজা ঢিলে হয়েছে। চৌকাঠে কুমরে পোকার মাটির দুর্গ একের পর এক সংখ্যায় বেড়েছে।
ঢেঁকিঘরের চারধারে আগে সুন্দর করে বেড়া দেওয়া ছিল। দু’ধারের বেড়া এখন ভেঙে পড়েছে। ধান সিদ্ধ করার মাটির বড় বড় চাড়িগুলোর একটাও আস্ত নেই।
তাঁর নিজের ঘরটার অবস্থাও ভাল না।
মেজদার ঘর তো কবেই পড়ে গিয়েছে। গুদোমে আশ্রয় নিয়েছে মেজদা।
ছোটকর্তা ভাবলেন, বড়দা নিরন্তর থাকেন বাড়িতে, তাই হয়তো এ-সব জিনিস এমন করে তাঁর নজরে পড়ে না। অবিশ্যি বড়দার বয়েসও হয়েছে। এ-সব নজরে পড়লেও, তদারকি আর তাঁর সামর্থ্যে কুলায় না। মেজদা তো চিরকালের উদাসীন।
এত বড় বাড়ির তদারক করা জোয়ান লোকের কর্ম। তাঁর সময় থাকলে হাত লাগাতেন এ কাজে। কিন্তু তিনি কি জোয়ান? জোয়ান ছাড়া কী? বয়স বেড়েছে, সেইজন্যই কি এই প্রশ্ন? এই সন্দেহ? তা বাড়ুক না বয়স। বয়স বাড়লেই লোক বুড়ো হয় নাকি? এখনও তিনি একটানা তিরিশ-চল্লিশ মাইল ঘোড়া দাবড়াতে পারেন। একটুও হাঁফ ধরে না। তাঁর হাতের রদ্দা খেলে এখনও জাঁহাবাজ বদমায়েশ গুন্ডা ত্রিভুবন অন্ধকার দেখে। এক জায়গায় বসে একটা গোটা পাঁঠা খেয়ে নিতে পারেন। পুরো এক বোতল বিলিতি মদ সাবাড় করলেও কর্তব্যে তিলমাত্র ত্রুটি হয় না। কালীগঞ্জে দুটো মেয়েমানুষ তাঁর বাঁধাই ছিল। না, বুড়ো হবার কোনও লক্ষণ নেই, সময়ও নেই তাঁর। বুড়ো হতে যাবেন কোন দুঃখে!
তাঁর হাতে যে সময় নেই, নইলে বাড়িটার ছিরি ফিরিয়ে দিয়ে যেতেন। তবে, ছোটকর্তা মনে মনে ঠিক করলেন, ঝিনেদায় যদি কালীগঞ্জের মতো অতদিন থাকতে পারেন, যদি তাঁকে হুট করে বদলি না করে, তবে বাড়ি-ঘরের চেহারা পালটে ফেলবেন। এ কী কথা! তাঁরা এখনও সবাই জীবিত! এর মধ্যে বাড়িটা অনাথা বিধবার সম্পত্তির মতো হয়ে উঠবে কেন? এ বাড়ির অবস্থা এখনই যদি এই হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে শেষ বয়সে দাঁড়াবেন কোথায়? ছেলেপুলেরা ভোগ করবে কী?
ছেলেপুলে? চকিতে ছোটকর্তার মনে হালকা একটা বেদনার ছাপ পড়ল। একটি মুহূর্ত মাত্র স্থায়ী হল সেটা, তারপর এক ফুঁয়ে উড়ে গেল। ছোটকর্তা মনে মনে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, সুধা, সুধাই তো এ-বাড়ির ছেলে। আমরা থাকতে এ-বাড়ির হাল যদি এই হয়, সুধা তা হলে দাঁড়াবে কোথায়?
নাঃ, বড়দাকে বলে যেতে হবে, বাড়িটা যেন মেরামত করে ফেলেন। যতদিন আমরা জীবিত আছি ততদিন দেওয়ানবাড়ি যেন দেওয়ানবাড়ির মতোই থাকে।
এর আগেও তো মাঝে মাঝে বাড়িতে এসেছেন ছোটকর্তা। এসেছেন, কিন্তু কতক্ষণ আর থেকেছেন বাড়িতে! ছোটকর্তার প্রাণের টান, টানের রশিটা তখন অন্যত্র অন্য গাছে টনটনে হয়ে বাঁধা ছিল। অন্য কোথাও। আর কিছুতে মন দেবার ফুরসত ছিল কোথায়?
এবার সেই বাঁধা নিয়ম পালটে গেল। এই প্রথম, বাড়িটার উপর যেন তাঁর চোখ পড়ল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াতে লাগলেন ছোটকর্তা। ঘুরতে ঘুরতে তিনি কুয়োতলায় এসে পড়লেন। ডবল চাড়ির কুয়ো। কিন্তু ভাঙতে ভাঙতে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, ভয় হয়, একদিন না একেবারে ধসে পড়ে। কুয়োতলাটায় ঢেঁকিশাকের জঙ্গল জমে গেছে। যে বাঁশের ডগায় বালতি বেঁধে জল তোলা হয়, সেটা এত পুরনো, এমন নড়বড়ে হয়েছে আর এমন মচমচ করে যে মনে হয় এই বুঝি সবসুদ্ধ মাথায় ভেঙে পড়ল। দেখে তো ছোটকর্তা অবাক। এ কুয়োয় তো মানুষ খুন হল বলে! না না, এ-সব চলবে না। বড়দাকে একটা পাকা ইঁদারা বানাতে বলে যেতে হবে, এমন ইঁদারা, যা পঞ্চাশ-ষাট বছর অনায়াসে টিকবে। সুন্দর একটা কপিকল লাগাতে হবে ইঁদারায়। তা হলে আর বাঁশের ঢেঁকিকলে জল তুলতে হাত ব্যথা হবে না কারও, মাথায় বাঁশ ভেঙে কারও মরার ভয় আর থাকবে না। সুধার বউ এসে কপিকলে জল তুলবে। মোটেই কষ্ট হবে না তার। সুধার নাতিরা এসেও সেই ইঁদারার জল খাবে। শুনবে তাদের ঠাকুরদাদার বাপ-কাকারা এই ইঁদারা বানিয়ে গিয়েছে। কী ছিল তাঁদের নাম? অহি, মহি আর শীতল। তিন ভাই ছিল একেবারে হরিহর আত্মা। ছোটকর্তা ভাবলেন, ইঁদারাটার গায়ে তাঁদের নাম খোদাই করে রাখলে কেমন হয়? যতদিন ইঁদারাটা থাকবে, ততদিন তাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁদের বংশধরদের মধ্যে। কত পুরুষ ধরে কে জানে?
এ এক নতুন অনুভূতির স্বাদ পাচ্ছেন ছোটকর্তা। দিনরাত চোর ছেঁচড় ডাকাত, খুন জখম, জালিয়াতি জুয়াচুরি বাটপাড়ি, তদন্ত-তল্লাশি মামলা-মোকদ্দমা, কোর্ট-কাছারি নিয়েই তাঁকে পড়ে থাকতে হয়। নিয়ত বিচরণ করতে হয় হিংস্র নৃশংস রুক্ষ এক জগতে। তাঁর দিনরাতের ভাবনা থেকে স্নেহ প্রেম ভালবাসা একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেছে কবে!
আজ এ কী হল? বুড়ির ছেলেটাকে কোলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে সে অপকর্ম করে দিল তাঁর পোশাকে। পাষণ্ডদমন খাকির পোশাকটা ছাড়তে যেন বাধ্য করল তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সত্তার দারোগাগিরির খোলসটা যেন জোর করেই ছাড়িয়ে দিল ওই শিশু। তাঁর মধ্য থেকে বের করে আনল স্নেহময় মমতাময় অন্য এক শীতলকে। এই নতুন শীতলের কোনখানেও আর দারোগা ত্ব লেগে নেই। এই শীতল এখন পুরোপুরি এক গৃহস্থ, এক দাদু!
জীবনের এ এক নতুন স্বাদ পাচ্ছেন ছোটকর্তা। এক নতুন বর্ণ, নতুন গন্ধ, নতুন অর্থ। এই প্রথম তিনি বুঝতে পারলেন, হঠাৎ বুঝলেন, শুধুমাত্র দারোগাগিরিতেই, তার অশুচি পরিবেশেই, শেষ হয়ে যাবে না তাঁর জীবন। তাঁর যদি মৃত্যু হয় এখন, তবুও বিনষ্ট হবে না তাঁদের পারিবারিক জীবনের ধারা। আজ বুড়ির ছেলে হয়েছে, কাল সুধার ছেলে হবে, পরশু হবে চাঁপার। ওদের নাতিপুতি হবে। অনেক ঝরনার জল যেমন নানা স্রোতে বয়ে এসে একটা বড় নদীতে মেশে, তারপর আবার ছড়িয়ে যায় নানা শাখায় প্রশাখায়, বয়ে নিয়ে যায় মূলস্রোতের জলধারা, তেমনি ওরাও ছোটকর্তাদের বংশের ধারাটি বয়ে বয়ে নিয়ে মিশে যাবে হাজারটি পরিবারে। এই হাজারটি পরিবারের মধ্যেই তাঁদের অংশ কিছু না কিছু গচ্ছিত থাকবে। ছোটকর্তার অংশও থাকবে। অনেককাল থাকবে। হয়তো সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত। তার মধ্যে কারও না কারও চেহারায় কোন এক অজ্ঞাত, কী এক রহস্যময় প্রক্রিয়ার ফলে যখন তাঁর সাদৃশ্য দেখা দেবে, তখন সেই পুরুষের লোকেরা বলাবলি করবে; আরে! এর চেহারাটা দেখি শীতল দারোগার মতো, অবিকল তাঁর মতোই হয়েছে। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই গড়ন! হুবহু! কোন শীতল? না, ওই যে আমাদের দেশের ভিটেবাড়িতে অক্ষয় ইঁদারার গায়ে তিন ভাইয়ের মধ্যে যাঁর নাম আছে, সেই।
ছোটকর্তা লেখাপড়া বিশেষ শেখেননি। তাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এ জিনিস সঠিক কি না, তা নিয়ে তাঁর মনে কোনও প্রশ্ন দেখা দিল না। মন বরং বিনাদ্বিধায় এই সিদ্ধান্তই মেনে নিল। মেনে নিয়ে সুখ পেল।
বেলা পড়তেই এক জামবাটি গরম দুধ খেয়ে তিনি জিভ দিয়ে গোঁফ মুছতে মুছতে বারবাড়িতে এসে বসলেন। বড়কর্তা পাশার ছক পরিপাটি করে পেতেই রেখেছিলেন। একমাত্র শীতল এলেই এখন এই খেলা যা জমে। শীতল বড়কর্তার মনের মতো খেলুড়ি। আগে অনেকেই এ খেলাটা জানত। তাঁদের অনেকে মরে-ধরে যাওয়ায় বড়কর্তা এ পাট প্রায় তুলেই দিয়েছেন। আনাড়িদের সঙ্গে খেলে সুখ হয় না।
শীতল এসে বসতেই খেলা শুরু হল। আর দু’-চার দানের পরেই খেলা জমে উঠল।
ছোটকর্তার ইচ্ছে ছিল, খেলতে বসেই বাড়ি সারাবার কথাটা বড়কর্তার কাছে পাড়বেন, কিন্তু তার আগেই, বড়কর্তা এমন তেড়ে দান ফেলতে লাগলেন যে সামলাতে সামলাতে বাড়ির চিন্তা ছোটকর্তার মাথায় উঠে গেল।
অনেক দিন পরে বাড়ি ফিরে এসেছে শীতল। বদলি হবার কথা ছিল মাগরোয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝিনেদাতেই বদলি হয়ে এল। ভালই হল, বড়কর্তা ভাবছিলেন এখন অবরে সবরে দেখা সাক্ষাটাও তো হবে। শীতল অবশ্যি বলছিল, এটা টেম্পোরারি বদলি। কবে কোথায় যেতে হয়, ঠিক নেই। বড়কর্তার ইচ্ছে ছিল, শীতলকে জিজ্ঞাসা করবেন, ঝিনেদায় পাকা বদলি নিতে পারবে কি না সে। কিন্তু বাপ রে, শীতল করছে কী? পর পর এমন সব মোক্ষম দান ফেলছে যে বড়কর্তা কাহিল। প্রায় পাকা ঘুঁটিও মারবে নাকি শীতল? অচিরেই পাশার দানে ডুবে গেলেন বড়কর্তা।
খাওয়ার ডাক যখন পড়ল, তখন দুই ভাইয়ের ধ্যান ভাঙল। ছোটকর্তা আজ সুবিধে করতে পারেননি। দুটো দান চটিয়ে দিয়েছেন, একটা দানে হেরেছেন। কাজেই হারই হয়েছে তাঁর। হার হত না, যদি-না মাঝে মাঝে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেন। অন্যমনস্ক তিনি হতেন না, যদি গলাটা ভিজিয়ে নিতে পারতেন। এটা তাঁর গলা ভেজাবার সময়। একটি পাঁট দিশি টেনে যদি বসতে পারতেন, তো দেখতেন কোন শালা পাশা খেলায় শীতল দারোগাকে হারায়! বড়কর্তা তাঁর দাদা, দাদাদের সামনে মদ খেয়ে এসে বসতে তাঁর এখনও বাধে। সে জ্ঞানটা তাঁর আছে। সে জ্ঞানটা তাঁর আছে বলেই তৈরি হয়ে বসতে তাঁর বেধেছে। তাই তিনি বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন, খেলায় ভাল করে গা-ই লাগাতে পারেননি। ভাল ভাল দান ফেলেও কাজের বেলায় গড়বড় করে ফেলেছেন। তাই তো হেরে গেলেন। এ তো প্রায় ষড়যন্ত্র করে হারানো। মেজাজটা খচে গেল ছোটকর্তার।
রাগের চোটে হারমোনিয়মের ঘিয়ে-ঘিয়ে রিডের মতো হাতির দাঁতের পাশা তিনটে নিয়ে দু’হাতের তেলোয় এমন জোরে ঘষলেন যে সেগুলো খড়মড় করে আর্তনাদ করে উঠল। তারপর থপাস করে ওগুলোকে পাটির উপর ফেলে, বিরক্তি চেপে বেরিয়ে গেলেন।
.
এ বিরক্তি খাওয়াদাওয়ার পরও কাটল না ছোটকর্তার। একটা অস্বস্তি, একটা দুনিয়াহারানো ফাঁকা ফাঁকা ভাব মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। রাত ন’টা, সাড়ে ন’টা হবে। কালীগঞ্জ থানার হাবিলদার ব্যাটা এতক্ষণে বসন্ত সাউয়ের দোকানে খুব জমিয়েছে।
তিনি তো নেই, আর কী, এখন ও ব্যাটাই রাজা হয়ে বসেছে। আর কালিন্দী মাগিও এতক্ষণে গণপতি বেনের পালোয়ান ছেলেটাকে বুকে তুলে নিয়েছে নিশ্চয়। হারামজাদি কি কম শয়তান! ছোটকর্তা জানেন, ইদানীং ছোকরাটা খুবই ঘোরাঘুরি শুরু করেছিল। কিন্তু তাঁর ভয়ে বেশিদূর এগোতে সাহস করেনি। জানে তো সবাই, সদ্য-বিয়োনো বাঘিনির কোলে তবুও হয়তো শোওয়া যায়, কিন্তু শীতল দারোগার মেয়েমানুষের পাশে— একেবারে অসম্ভব। কিন্তু আজ আর কালিন্দীর কোনও ভয় নেই। বাঘ সরে গেছে চিরকালের মতো। শিয়াল কুকুর এখন স্বচ্ছন্দেই চড়তে পারবে তার নাগরদোলায়। এ-কথা চিন্তামাত্রই ছোটকর্তার গায়ে বিরক্তি যেন বিছুটির চাবুক মারল।
মরুক গে কালিন্দী। যার সঙ্গে খুশি শুগ্গে যাক। কিন্তু তিনি এই রাতটা যাবেন কার কাছে? অনেক কাল গ্রাম-ছাড়া। তাঁর ভাবের মানুষ যে ছিল, সে অনেক দিন আগেই এ পথ ছেড়ে ধর্মে মতি দিয়েছে। আগের বারই তা দেখে গিয়েছেন। তিলক কেটে কণ্ঠি পরে সে এখন গোঁসাই বষ্টুমি হয়েছে। এ গ্রামে তার এখন মান-সম্মান খুব। যত ব্যাটা বদমায়েশ কৃতকর্মের যন্ত্রণার হাত এড়াতে তার পায়ে হত্যে দিতে যায়। ছোটকর্তার কাছে সত্যিই এ একটা বড় বিস্ময়! কী করে লোকের এমন আশ্চর্য পরিবর্তন হয়! মানুষ চরিয়ে খেতে হয় ছোটকর্তাকে। আসল নকল চিনতে ভুল হয় না। গোসাঁই বষ্টুমির ধর্মে কর্মে এক ফোটাও খাদ নেই। সে তিনি সেবার তাকে নতুন রূপে দেখামাত্র বুঝতে পেরেছিলেন।
সেবারও এইরকম অনেক দিন বাদে বাড়িতে ফিরেছিলেন ছোটকর্তা। সন্ধ্যাবেলায় দেহের কামড়ে এমনি অস্থির হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন গোপালদাসীর কাছে। কিন্তু গোপালদাসীর বাড়িতে পা দেবামাত্র বুঝলেন অন্য কোথাও, অন্য কারও কাছে এসে পড়েছেন। বাড়িটাই শুধু বদলে যায়নি। মানুষটাও বদলেছে। ইস্তক ওর অথর্ব স্বামীটা পর্যন্ত।
বাড়িটায় সুন্দর একটা আখড়া বসেছে। গোপালের মন্দির হয়েছে। আরতি হচ্ছিল তখন! নানা রকম ফুলের সুবাস বাড়িময় ভুরভুর করছে। আর পরিষ্কার তকতকে করে নিকানো উঠোন। কোথাও ছিটেফোঁটা ময়লা নেই।
ওখানে গিয়ে একেবারে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন ছোটকর্তা। জুতো পায়ে উঠোন মাড়াতেই বাধোবাধো ঠেকল তাঁর। গোপালদাসীর জন্যে মিলের পাছাপেড়ে ফিনফিনে শাড়ি এনেছিলেন হাতে করে। একখানা শাড়ি, এক বোতল মদ, গোপালদাসীর আশ্চর্য-সুন্দর একটা দেহ, এই ছিল ছোটকর্তার গ্রামে এসে একটা রাত কাটাবার উপকরণ। যখনই আসতেন ছোটকর্তা, দেখতেন, তার অথর্ব স্বামীটা বারান্দায় বসে বসে ভুডুক ভুডুক তামাক খাচ্ছে। ছোটকর্তাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য ভুডুক ভুডুক থামাত জয়রাম, তার চোখে বিদ্বেষ আর ঘৃণা আর জিঘাংসার অদৃশ্য তীক্ষ্ণধার ছুরির ফলাটা লিকলিক করে ছুটে বেড়াত। কিন্তু একটা শব্দও সে উচ্চারণ করত না। পরমুহূর্তেই তার হুঁকো আবার ভুডুক ভুডুক ডাক ছাড়তে শুরু করত। কিন্তু সেই লিকলিকে হিংস্র ছুরির ফলাটা সে আর গুটিয়ে নিত না। তিনি তার সেই ধারালো চোখের উপর দিয়েই গট গট করে গোপালদাসীর ঘরে ঢুকে যেতেন। গোপালদাসী হাসতে হাসতে আসত। তাঁর জুতোর ফিতে খুলে দিত। কাচানো একখানা ছোটকর্তারই দেওয়া শাড়ি কাপড়-ছাড়বার জন্য এগিয়ে দিত। হাত মুখ ধোওয়ার জল এনে বারান্দায় ছোট একটা জলচৌকি পেতে দিত, পরিষ্কার একখানা গামছা ভাঁজ করে মাজা চকচকে গাড়ুর মুখে রেখে যেত। ছোটকর্তা হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় ছেড়ে, গোপালদাসীর পরিপাটি করে পাতা নকশিকরা বড়, ফরসা কাঁথা দিয়ে মোড়া বিছানায় এসে আরাম করে বসতেন।
গোপালদাসী মুচকি হেসে ছোটকর্তার প্রাণ কেড়ে নিত। বলত, তিষ্টা পায়েছে বুঝি? শিকের উপরকার হাঁড়ির মধ্যি গিলাসটা আছে, পাড়ে নিয়ে তিষ্টা মিটোতি থাকো। আমি তামুক সাজে আনি।
ছোটকর্তা এলেই গোপালদাসীর দেহে পিরিতের ঢল নামত। প্রবল সেই জোয়ারের টানে টানে সে একখানা নতুন সরার মতো বাড়িময় যেন ভেসে ভেসে বেড়াত। আর আশ্চর্য, তাই দেখতে দেখতে ছোটকর্তার দেহের তাড়না একেবারে কমে যেত। ধীরে ধীরে যে নতুন অনুভূতিটার জন্ম হত তাঁর মনে সেটা রুক্ষ নয়, রাক্ষস নয়, সেটা অনেক স্নিগ্ধ, অনেক প্রাণ-জুড়ানো মন-ভরানো। তখন ছোটকর্তার কাছে শুধুমাত্র সুন্দর, আঁটসাঁট দেহসর্বস্ব গোপালদাসীর আকর্ষণটা আর তত প্রবল থাকত না। এমন সুন্দর করে উঠোন নিকোতে পারে যে গোপালদাসী, যে এত ভাল কাঁথা সেলাই করতে পারে, শিকে বুনতে পারে, এত ভাল কথা বলে যে, এত সেবা করে, যত্ন করে আবদার করে যে, সেই গোপালদাসী পাটরানির রূপ ধরে ছোটকর্তার মনের সিংহাসনে বিরাজ করতে থাকত। মায়া মমতায় প্রেমে ছোটকর্তা কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়তেন, যেন পঙ্গুই হয়ে পড়তেন। অসাড় শিকারকে নিয়ে শিকারি বিড়াল যেমন খেলা করে, গোপালদাসী তেমনি ছোটকর্তার শিথিল ব্যক্তিত্ব নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলা করত। পিরিতের মানুষের হাতে নিজেকে স্বেচ্ছায় এমন বিলিয়ে দিয়ে যে কী অপূর্ব সুখ, গোপালদাসীর মতো ভাবের মানুষের সংস্পর্শে যে কখনও আসেনি, সে কী করে বুঝবে? এ সুখের কাছে ঘর- সংসার, প্রতাপ প্রতিপত্তির সুখ বিলিতি মদের পাশে যেন বেলের পানা বলেই ছোটকর্তার মনে হত।
গোপালদাসী এমনি খানিক ছোটকর্তার সামনে নানা ছলে ঘুরে, খানিক খানিক করে ঘরের কাজ সেরে, প্রায় মাঝ রাত্রে এসে যখন হুড়কো বন্ধ করত, তখন যে লোকটি ঢুলু ঢুলু চোখে, তার বিছানায় মোটা একটা পাশবালিশ কোলে নিয়ে বসে বসে দুলত, সে কিন্তু ছোটকর্তা নয়; মদের নেশায় আর পুলকের আবেশে জরে-যাওয়া সে একতাল পুতুল-গড়ানো মাটি। গোপালদাসীর কারিগরিতে সেই মাটি থেকে একটা নতুন পুতুল জন্ম নিত। গোপালদাসীর দেহের উত্তাপে তাতে নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হত। ভোররাত্রে একটা নতুন ছোটকর্তা বন্দর থেকে রং-ফেরানো জাহাজের মতো, বেরিয়ে যেত গোপালদাসীর বাড়ি থেকে। পুবের পাড়ার মুসলমান-বাড়ির রাতপ্রহরী কুঁকড়ো কোঁকর কোঁ ডাক ছেড়ে তাঁকে স্বাগত করত।
কিন্তু অভ্যাসবশে, দীর্ঘকালের অনুপস্থিতির পর, গোপালদাসীর বাড়িতে পা দিয়েই ছোটকর্তা দেখলেন, আগেকার দুনিয়ার যাবতীয় দলিল তামাদি হয়ে গিয়েছে। পিছন ফিরে গেরুয়া কাপড় গায়ে জড়িয়ে গোপালের আরতি করছে গোপালদাসী, না না, গোসাঁই বষ্টুমি। ভক্তবৃন্দ তাকে ঘিরে বসে আছে। বারান্দায় জয়রাম বসে। তার স্থাণুদেহেও পরিবর্তনের রং লেগেছে। পাতলা পাতলা লম্বা চুলে ঝুঁটি বাঁধা। গায়ে নামাবলি। কপালে তিলক। গলায় তুলসীকাঠের মালা। হুঁকোর শব্দ স্তব্ধ। ছোটকর্তার দিকে চেয়ে জয়রাম হাসল। তার চোখের ছুরি কোথায় গেল?
পুষ্পচন্দনে সুবাসিত সেই পরিবেশে সেদিন অনধিকার প্রবেশ করে ছোটকর্তা বিলক্ষণ বোকা বনে গিয়েছিলেন। তাঁর মুখের মদের গন্ধ, দেহের ঘামের গন্ধ যেন চারিদিক থেকে তাড়া খেয়ে আশ্রয় নেবার জন্য নিরীহ পোষা কুকুরের মতো তাঁরই চারপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বিলাতি মিলের মিহি শাড়ির মোলায়েম ভাঁজের মধ্যে লুকোনো মদের বোতলটির কাঠিন্য এই প্রথমবার নিজের অস্তিত্ব জাহির করল।
ছোটকর্তা কী আর করবেন, চুপচাপ সেই উঠোনের এক পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
আরতি শেষ হল। সবাই হরিধ্বনি দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করল। গোসাঁই বষ্টুমি চরণামৃতের পাত্রটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ছোটকর্তার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। সঙ্গে সঙ্গে গোসাঁই বষ্টুমির চোখমুখে হাসির আলো জ্বলে উঠল। এ বড় স্নিগ্ধ আলো। এতে আভা আছে, তাপ নেই। এ হাসি ছোটকর্তার অচেনা।
দেখেই ছোটকর্তা বুঝলেন, এ হাসির বয়স অনেক, চরিত্রও ভিন্ন। যার মুখে এ হাসি ফুটল, সে লোক আর যেই হোক, ছোটকর্তার সেই আগের মানুষটি নয়। ছোটকর্তার মনে ক্ষোভ হল না, তাঁর রাগও হল না। একটা আশা নিয়ে, একটা পিপাসা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সে আশা মেটবার সম্ভাবনা নেই বুঝে তাঁর মনে হঠাৎ একটা শূন্যতার সৃষ্টি হল। তারপর প্রচণ্ড খিদের সময় খাদ্য না পেলে পাকস্থলীতে যেমন জারক রস ঝরে ঝরে পড়ে, তেমনি তাঁর শূন্য মনে বেদনার রস ঝরে পড়তে লাগল।
গোসাঁই বষ্টুমি ধীরে সুস্থে ভক্তবৃন্দের হাতে চরণামৃত বিলোতে বিলোতে একসময় ছোটকর্তার সামনেও এসে দাঁড়াল। বলল, খুব তিষ্টা পায়েছে না? হাত পাতো তো, ন্যাও তো এই চন্নামেত্ত, দেখো তো তিষ্টা মেটে কি না?
এতক্ষণে নিজেকে ফিরে পেলেন ছোটকর্তা। কী ভাবে আমাকে, অ্যা! আমাকেও কি ওদের দলে চালান করে দিল? না কি ঠাট্টা করছে বষ্টুমি? প্রবল একটা অট্টহাসি বুকের ভিতর থেকে ঠেলে বেরুতে চাইল। কিন্তু না, বষ্টুমি ঠাট্টা করেনি। ওর মুখে, চোখে, ওর ঠোঁটে, কোথাও ঠাট্টা নেই। সেখানে গভীর এক বিশ্বাস। তাই আকাশ-ফাটানো হাসিটা আর হাসলেন না ছোটকর্তা। বষ্টুমির এই গভীর বিশ্বাসটাই যে একটা চরম রসিকতা ও বেচারি তা জানে না। বোধ করি ভেবেছে, এই এক ফোঁটা চরণামৃতে জগাই-মাধাইয়ের মতো ছোটকর্তাও উদ্ধার হয়ে যাবে।
গোসাঁই বষ্টুমির মুখে সেই হাসি। হাতে ছোট্ট একটা পঞ্চপাত্রের হাতা। সেই হাতায় সুবাসিত চরণামৃত এক ফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতো টলটল করছে। হাতাটা সে এগিয়ে ধরল ছোটকর্তার দিকে। ভক্তবৃন্দেরা অধীর আগ্রহে, কী হয় দেখবার জন্য, স্থির-দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তাঁদের দিকে। ছোটকর্তার খুব মজা লাগল এই খেলা দেখে। একবার ভাবলেন, চলে যাবেন। কিন্তু গোসাঁই বষ্টুমির মুখের দিকে চেয়ে সে ইচ্ছে চলে গেল তাঁর। ছোটকর্তার উপর কত গভীর আস্থা যে বষ্টুমি রাখে, তা তার মুখে আঁকা রয়েছে। সে যদি চরণামৃত না দিয়ে বিষও দেয়, তবুও সেটা ছোটকর্তা তার হাত থেকে অম্লানবদনে নিতে পারেন বষ্টুমির মুখে সে-কথা যেন পাকা কালিতে লেখা রয়েছে। এ বিশ্বাসটা ভেঙে দেবার কথা মনে হতেই ছোটকর্তার মনে কষ্ট হল। ছোটকর্তার বয়স হয়েছে। ও সব চ্যাংড়ামি করতে ইচ্ছে হল না। তা ছাড়া ওই গাড়ল ভক্তগুলোর সামনে বষ্টুমিকে অপদস্থ করতেও মন চাইল না ছোটকর্তার। তিনি হাত বাড়িয়ে চরণামৃতটুকু নিয়েই গলায় ঢেলে দিলেন। তারপরে আন্তরিকভাবেই বললেন : না গো, গোঁসাই বষ্টুমি, আমার তিষ্টা এতে মেটবে না।
গোঁসাই বষ্টুমি খুব খুশি হয়েছিল। বলেছিল, আজ না মিটুক, গুপাল একদিন তোমার তিষ্টা মিটোবেনই মিটোবেন। দেখো, এ আমি কয়ে দিলাম।
তারপর ভাঁজ-করা শাড়িটা দেখে ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়েছিল বষ্টুমি। বলেছিল, বেশ সুন্দর কাপড়খানা, দ্যাও আমারে। আমি ওখান ছুপায়ে পরব। শাড়িটা দিতেই বষ্টুমি টের পেল ওর মধ্যে মদের বোতল আছে। তেমনি হাসি হেসেই সে বলেছিল, আমি সবই রাখে দিলাম। জয় গুপাল বলে শাড়ি সুদ্ধু হাত তুলে গোপালকে প্রণাম করল বষ্টুমি। ছোটকর্তাও হাঁটা দিলেন। যেতে না যেতেই পিছন থেকে ভক্তরা জয় জয় রাধেকৃষ্ণ হরি হরি বোল বলে ধ্বনি দিয়ে উঠল।
এবার আর ছোটকর্তা হাসি চাপতে পারলেন না। ব্যাটারা ভেবেছে, নিশ্চয়ই ভেবে নিয়েছে, তাদের গোঁসাই বষ্টুমি আরেক অধমকে তরিয়ে দিলেন। হাঃ হাঃ হাঃ। খুব একটা মজার খেলাই খেললেন বটে। হাঃ হাঃ হাঃ। হাসতে হাসতে তিনি টের পেতে লাগলেন সেই বেদনার ধারটা একটু একটু কমতে শুরু করছে।
পুরনো কথা মনে পড়তেই ছোটকর্তার বিরক্তি একটু যেন কমে এল। গোপালদাসীতে যে সুখ পেয়েছিলেন ছোটকর্তা, কালিন্দী তা দিতে পারেনি। আর কোনও মেয়েমানুষ তা দিতেও পারবে না। পাম্পশুর সুখ কি চটি জুতোয় মেলে! তা না মিলুক, তবু চটিতেও তো পা বাঁচে। তাই গোপালদাসী ধর্মে কর্মে মন দিতে, বৃথা হা-হুতাশে কালক্ষেপ করেননি তিনি। কালীগঞ্জে বদলি হতে কালিন্দীকে জুটিয়ে নিয়েছিলেন। সে ছাড়া আরও একজন ছিল। কালীগঞ্জের সঙ্গে তিনি এখন তাঁদেরও ছেড়েছেন।
.
গোপালদাসীর কথা তাঁর মনে পড়ল আজ। কিন্তু বিশেষ কিছু আলোড়ন তুলল না। দেখবার ইচ্ছাও জাগল না মনে। এই গ্রামে আর কোনও মেয়েমানুষের সন্ধান তিনি আপাতত রাখেন না বলেই তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন। এখন সে বিরক্তি কিছুটা কমল।
কিন্তু শরীরের অস্বস্তি গেল না। হজমের ওষুধ পেটে পড়ল না, ওদিকে গুচ্ছের হাবিজাবি গিলে পেট এখন গজগজ করছে। ম্যাজম্যাজ করছে সর্বাঙ্গ। শরীরের বাঁধনটাই ঢিল হয়ে গেছে। একটা বড় বিছানার বান্ডিল শক্ত করে না বেঁধে কাঁধে করে বয়ে নিতে যেমন অসুবিধে লাগে, ছোটকর্তারও শরীরটা বয়ে বেড়াতে তেমন অস্বস্তি লাগতে লাগল।
সঙ্গে করে কিছু আনেননি। সেইটেই মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলেন বেলা পড়লে লোহাজাঙ্গায় যাবেন, নবীন তাঁতির বাড়ি। নবীন ছোটকর্তার বহুদিনের সঙ্গী। তার ঘরে সরঞ্জাম সব সময় মজুত থাকে।
গেলেই হত লোহাজাঙ্গায়। বাজে কাজে সারাদিন সময় নষ্ট হল। এখন এত রাতে আর যাওয়া যায় না। গায়ে গতরে ব্যথা ধরেছে এতটা পথ ঘোড়া ঠেঙিয়ে। এখন বাসিমুখে কোথাও বেরুবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন ছোটকর্তা। দু’-এক ঢোক গিলতে পারলেও উৎসাহটা চাঙ্গা হয়ে উঠত। এমন নিরামিষ রাত বহুদিন তিনি কাটাননি।
বারবাড়িতে তক্তাপোশের উপর বিষণ্ণ মনে দেহটাকে এলিয়ে ছোটকর্তা রামকিষ্টোকে ডাক দিলেন। ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল রামকিষ্টো। এ বাবা ছোটবাবু, একেবারে কাঁচাখেগো দেবতা। পান থেকে চুন খসলেই অনর্থ।
রামকিষ্টো বলল, ছোটবাবু, ডাকলেন?
ছোটকর্তা বললেন, হ্যাঁ। গা হাত পা একটু টেপেক তো। বড্ড চাবাচ্ছে।
রামকিষ্টো ছোটকর্তার হাত পা যত্ন করে টিপতে লাগল। বেশ আরাম পেলেন ছোটকর্তা।
জিজ্ঞাসা করলেন, এদিককার খবরাখবর কী, ক’ দিনি একটু শুনি। আছিস কেমন?
রামকিষ্টো ফোঁস করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলল।
বলল, আর খবর? কী বা কব ছোটবাবু, অভাব অভিযোগ সে তো লাগেই আছে। ধান পাটের দর নেই। ম্যালোয়ারি আমাগের চিবোয়ে ছিবড়ে বের করে ফেলতিছে। কী সব চিহারা ছিল এক-একজনের, আর কী হয়ে দাঁড়াচ্ছে! হাত পা কাঠি-কাঠি। রক্তশূন্যি। পেটটা ডাগর-ডাগর। এক-একজন যেন তালপাতার সিপাই। সুখ আর কোনওদিকিই নেই। দাঙ্গা কা’জেটাই এ দিগরে ছিল না, ইবার সিটাউ বোধহয় হয়ে ছাড়বে?
দাঙ্গার নাম শুনে ছোটকর্তা উৎকর্ণ হলেন। এতক্ষণ পরে তাঁর দারোগা-সত্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। গোঁফে চুমকুড়ি দিতে দিতে যেন ক্রমশ সজাগ হয়ে উঠতে লাগলেন।
বললেন, দাঙ্গা! দাঙ্গা বাধাচ্ছে কিডা?
গলায় যেন শ্রাবণের মেঘ ডেকে উঠল।
রামকিষ্টো বলল, কিডা আবার বাধাবে! অবস্থা গতিকি বাধে যাতি পারে।
ছোটকর্তা অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। এই একটা মহৎ দোষ ব্যাটার। আসল কথায় আসতে আসতে রাত পুইয়ে দেবে।
রামকিষ্টোকে ধমক মারলেন ছোটকর্তা।
বললেন, কথাগুলোরে দাঁতের ফাঁকে না পুষে বাইরি ছাড়ে দ্যাও। কী, দাঙ্গা করার শখটা চাপল কার?
রামকিষ্টো বলল, নিকিরিগের সঙ্গে গুপাল বিশ্বেসগের। নিকিরিরা আলাদা হাট বসাবে এই হাটের দিন। গুপালবাবুরা নাকি ভাঙে দেবে সিডা। ভুঁয়ে মশাই, বিশ্বেসগের দলের পাণ্ডা হয়েছেন। ধনেশ্বর গাতির উদিকির থে নাকি নমসুদ্দুর লাঠেল আনায়েছে। এই তো সব শুনতিছি। ইবার রক্তারক্তি একটা না হয়েই নাকি যায় না।
.
রামকিষ্টো ছোটকর্তার গা হাত পা টিপতে টিপতে সমস্ত ঘটনা বলে ফেলল। সব শুনে ছোটকর্তা গুম মেরে পড়ে রইলেন। মেজকর্তার মতো বিচলিত হলেন না তিনি। মনে মনে সিদ্ধান্ত করে ফেললেন, সুখে থাকতে যখন ভূতের কিল খাবার সাধ হয়েছে, তখন ব্যাটাদের ত্যালানি নিশ্চয়ই বেড়েছে। এক-একজন মহামাতব্বর হয়ে উঠেছে দেখছি।
রামকিষ্টো বলল, ছোটবাবু, পরশুদিন হাট। তোড়জোড় যে রকম, বুঝি বা রক্তারক্তি সত্যিই ঘটে যায়। নিকিরিরাও তো ছাড়ে কথা কওয়ার লোক না।
এতক্ষণ ছোটকর্তার শরীরটা ঠান্ডাই ছিল। রামকিষ্টোর অভ্যস্ত হাতের টিপুনিতে বেশ আরাম আরাম লাগছিল। রামকিষ্টোর ঘ্যানর ঘ্যানরেও তাঁর মৌজ নষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন তার শেষ কথাটা ঝিমিয়ে-পড়া দারোগার পেটে ঢুঁ মেরেই যেন তন্দ্রাভঙ্গ করল। বলে কী ব্যাটা! পরশু দিন এখানে হাঙ্গামা বাধবে? খুন জখম হবে? তার মানে সব ঝামেলা এসে পড়বে তাঁর ঘাড়ে। তখন তদন্ত করো রে, আসামি ধরে চালান দাও রে, ফেরারিদের পিছু পিছু কুকুরের মতো তাড়া করে বেড়াও রে, কেস তৈরি করো, মামলার তদবির করো, হাজারো বখেড়া। গ্রামের কেস, একটি আধলা আমদানি হবে না। কোনও শালা তো একটি পয়সা উপুড়হস্ত করবে না। শুধু নাকের জলে চোখের জলে হওয়াই সার হবে।
খপ করে ছোটকর্তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। হাত নিশপিশ করতে লাগল। শালারা ভেবেছে কী? দেশ অরাজক হয়েছে? কার রাজত্বে বাস করছে, সেটা ভুলে গিয়েছে সব? আচ্ছা, শীতল দারোগা কাল সকালেই সেটা মালুম পাইয়ে দেবেন। তাঁর সঙ্গে চালাকি!
দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অরুচি নেই দারোগাদের। ছোটকর্তারও না। কায়দা-কানুন রপ্ত আছে ছোটকর্তার। অধিকাংশ সময় হাঙ্গামা মিটে গেলেই ঘটনাস্থল থেকে ডাক আসে। তাতেই সুবিধে। ধীরে সুস্থে তদন্ত করা যায়। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা যায়। এ-বিষয়ে একটা প্রধান নিয়ম হচ্ছে, দারোগা যত পুরনো হন, তাঁর হাতে তত নিরীহ লোক গ্রেপ্তার হয়। কারণ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দুর্বল নিরীহ লোকদের মধ্যেই নালিশ করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। নিজেদের রক্ষা করার মুরোদ নেই, তাই রাজার কাছে আশ্রয় চাইতে থানায় এসে আছড়ে পড়ে। রাজা তো বিলেতে থাকেন, তাঁর নাগাল পাবে কোথায়? তাই দারোগাবাবুর সুখ শান্তিই নষ্ট করে এসে। তার দাওয়াই তাই বের করতে হয়েছে। কারণ ব্রিটিশের রাজত্ব আইনের রাজত্ব। আর আইনের চোখে তো সবল দুর্বল নেই, সবাই সমান। সাহায্য একবার চেয়ে বসলে, সে সাহায্য দিতেই হবে। না দিলে চাকরি নিয়ে টানাটানি। তাই ঘাঘু দারোগা সুযোগ পেলেই নিরীহ লোকদের ধরে বেঁধে থানায় টেনে আনেন। তারপর বিধিমতে তাদের উপর এমন অব্যর্থ সব দাওয়াই প্রয়োগ করেন যে, প্রাণ গেলেও তারা আর থানামুখো হয় না, ফলে দেশের লোকের মনে ঈশ্বরভক্তি বাড়ে। তারা যিশুখ্রিস্টের মতো ক্ষমাশীল হয়। রিপোর্টের খাতায় কমপ্লেন আর জমতেই পায় না। আখেরে দারোগাবাবুদের প্রমোশন হয়।
রামকিষ্টোর কথা শুনে ছোটকর্তার রাগ হল দুটো কারণে। প্রথম কারণ, হাঙ্গামাটা পাকালই যদি, তবে তাঁর নিজের গ্রামে কেন? আর কি গ্রাম ছিল না তাঁর থানার এলাকায়? আর দ্বিতীয় কারণ, হাঙ্গামাটা শেষ পর্যন্ত যদি তাঁর গ্রামেই ঘটছে, তবে এত তাড়াতাড়ি কেন? এখনও তিনি থানায় গিয়ে বসেননি। সমঝোতা হয়নি ছোট দারোগার সঙ্গে, হাবিলদার সিপাইদের সঙ্গে। কেন, পরশু দিনটা পঞ্জিকার কী এমন শুভদিন যে, ওই দিনে দাঙ্গা না বাধালে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
ও-সব কিছু নয়, আসলে এইসব হাঙ্গামা ঘটিয়ে ছোটকর্তাকেই বে-ইজ্জত করবার মতলব ফেঁদেছে ব্যাটারা। মেদ্দা ব্যাটার পেয়ারের দারোগা হঠাৎ বদলি হয়ে গেল, তার জায়গায় ছোটকর্তা এসেছেন তো, ব্যাটা খবর পেয়েছে, ভেবেছে, আচ্ছা, হোক শীতল দারোগা জব্দ। আর ওই ব্যাটা বুদো, ইঁচড়ে পাকা, আপনি-মোড়ল, ওটা তো বহুদিন থেকেই তক্কে তক্কে আছে, কী করে দেওয়ানবাড়ির লোকেদের একটু অপদস্থ করা যায় তার চেষ্টায়। এ বাড়ির লোকের উন্নতি দেখলে তোমার বুকে টিকের আগুন জ্বলে ওঠে বুদো, না? তোমার বাবা ব্যাটাও খুব জ্বালিয়ে গেছে আমাদের। দাঁড়াও দেখাচ্ছি, টের পাওয়াচ্ছি তোমাদের শীতল দারোগার জোড়ন কারে বলে। শীতল দারোগার ওই নামটাই শীতল, বুঝেছ, নাদনাখানা গরম। কত গরম, এবার টের পাবে।
ছোটকর্তা বললেন, রামকিষ্টো, কাল সকালে উঠেই গহরের বাড়ি যাবি। বলবি, ছোটবাবু ঝিনেদায় বদলি হয়ে আয়েছেন। এ খবর তাঁর কানে পৌঁছান মাত্তর তিনি বাড়িতি এসে গেছেন। যদি পিরানে বাঁচার সাধ থাকে, এক প্রহরের মধ্যিই মেদ্দার গদিতে গিয়ে হাজির হও। আর বুদোরে গিয়ে কবি, ও যেন বিশ্বেসগের দুকানে হাজির থাকে। যা এখন। এক ছিলিম তামাক সাজে দিয়ে যাস।
রামকিষ্টো ভয়ে ভয়ে তামাক সেজে দিল। বুঝল, ছোটবাবু এর মধ্যেই বদলে গেছেন। এ হল সেই ছোটবাবু, যার নামে ত্রিভুবন থরহরি কম্পমান।
.
প্রাণভরে তামাক টেনে ছোটকর্তা শুতে চলে গেলেন। অনেক দিন, প্রায় দশ বছর পরে নিজের খাটে শুতে উঠলেন। ওর মধ্যেও তাঁর নজরে পড়ল, আজ জোড়া বিছানাই পাতা হয়েছে। কেন জানি, কেমন যেন একটু বাধোবাধো ঠেকতে লাগল তাঁর। যার-তার সঙ্গে শোয়াই এতদিন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। আজ যেন নিয়ম ভঙ্গ। অনেক দিন পরে পুরনো অভ্যাসে ফিরতে হচ্ছে। যেন দশ বছর আগে ব্যবহার করা জুতোয় আবার নতুন করে পা গলাতে হচ্ছে। পা ঢুকেছে ঠিকই, তবু কেমন অস্বস্তি ঠেকছে।
এই নতুন অবস্থায় পড়ে, ছোটকর্তার মন থেকে হাঙ্গামার চিন্তা আপাতত মুছে গেল। ছোটবউ এখনও ঘরে আসেনি। ওদের কাজ সারা হয়নি এখনও, সারাদিনের পরিশ্রম আর উত্তেজনার পর এখন অবসাদ যেন ছোটকর্তাকে কোলে তুলে নিল। এই বিছানা কে পেতেছে, ছোটবউ? ছোটবউ এমন পরিপাটি করে বিছানা পাততে পারছে তা হলে? তা হলে তো সত্যিই সেরে গেছে। আগের মতোই হয়ে উঠেছে আবার। শরীর এলিয়ে আসছে ছোটকর্তার। কিন্তু পাগল হবার আগে ছোটবউ কেমন ছিল, যাচ্চলে, এ আবার কী কথা!… একটা হাই তুললেন ছোটকর্তা। কী কথা মানে, তখন ছোটবউ কেমন ছিল, সেটা না জানলে, এখন সে আগের মতো হয়েছে কি না, বুঝবেন কী করে? কেমন করে তখন বিছানা পাতত ছোটবউ? খাবার জল ঢাকা দিয়ে রেখে যেত না শুতে আসার সময় সঙ্গে করে আনত? কই, মনে তো পড়ছে না। গোপালদাসী জলের গেলাস হাতে করেই ঢুকত, সেটা মনে আছে। কালীগঞ্জের ওই খানকিগুলোর ও-সব বালাই ছিল না, মদে চুর হয়ে বিছানায় পড়ত হারামজাদিরা, সেটাও মনে আছে। কিন্তু ছোটবউ এক্ষেত্রে কী করত, সেটা তো মনে নেই। কিছুতেই মনে পড়ছে না। মশলা-দেওয়া পান এনে গোপালদাসী তাঁর মুখে দিত। হেসে হেসে বলত, মুখির গন্ধ না গেলি কি চলে! কালীগঞ্জের মাগিগুলো তো নিজেরাই এক-একটা ভাঁটিখানা, এ-সবের সাড় থাকবে কোত্থেকে! কিন্তু ছোটবউয়ের তো সাড় ছিল। তিনি যেদিন মদ খেয়ে আসতেন সেদিন ছোটবউ কি তাঁকে পান খাওয়াত, নাকি মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকত? কিছুই মনে নেই। তিনি যেদিন জেগে থাকতেন, সেদিন ছোটবউ ঘরে ঢুকে কি তাঁর সঙ্গে কথা বলত? যেদিন ঘুমিয়ে পড়তেন, সেদিন এসে কি জাগাত তাঁকে? কী আশ্চর্য, কিছুই যে মনে নেই। পর পর দু’বার হাই তুললেন ছোটকর্তা। মট মট হাতের আঙুল মটকে নিলেন।
তা হলে? তা হলে তিনি কী করে বুঝবেন কতখানি ভাল হয়েছে ছোটবউ? এখনও পর্যন্ত কাছে পাননি তাকে। ওই যা এক ঝলক তখন দেখা হয়েছে। বুড়ির ছেলের পাশে শুয়ে ছিল। তিনি ঢুকতেই ঘোমটা টেনে সরে গেল। একটুখানি তাকিয়েছিল যেন তাঁর দিকে। তাকিয়েছিল কি? ঠিক মনে পড়ছে না। তবে বাঁধা পাগল তো আর নেই। তা হলে তিনি এ-ঘরে শুতে পারতেন কী করে? এখানেই তো শিকল তুলে আটকে রাখা হত তাকে। যতবার এসেছেন এর আগে, একই দশা দেখেছেন। এই ঘরেই সে থেকেছে দশটি বছর। হেসেছে, কেঁদেছে, খেলেছে, চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেছে। একগাদা লোকের সামনে উদোম হয়ে ধেই ধেই করে নেচেছে। বদ্ধ পাগল ছিল তখন।
প্রথমবার এসে ছোটবউয়ের এই অবস্থা দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন ছোটকর্তা। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলেন মনে। কী করবেন বুঝে উঠতে পারেননি। যে ছিল তাঁর বউ, সে হল পাগল। তাঁকে লাথি দেখায়, কাছে এগুতে গেলে গায়ে থুথু ছোড়ে, আদর করে বশে আনতে গেলে কামড়াতে আসে। মারে। সমস্ত বাড়িটাকে অস্থির করে তুলেছিল।
ছোটকর্তার মনে পড়ল সেই বিশ্রী ঘটনার কথা। তাঁরা বারবাড়িতে বসে ছিলেন। অনেক লোক ছিল সেখানে। ছোটবউকে দিদি আর বউদি বোধহয় চান করাতেই নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ তাদের হাত ছাড়িয়ে ছোটবউ বারবাড়িতে এসে পড়ল। একটানে পরনের কাপড় খুলে ফেলে এমন কুৎসিত সব কাণ্ড করতে লাগল যে, ছোটকর্তাদের মাথা কাটা গেল। বড়দা পাঁচজনের মধ্যে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে উঠলেন, শীতু শীতু, তুই উটারে ভিতরে নিয়ে যা। ছোটকর্তা বুঝতে পারলেন, বড়কর্তা গলার স্বরে জমাট ঘৃণা ছুড়ে দিলেন। পিছন থেকে কে যেন হাসি চাপতে পারল না। ছোটকর্তা যেন কী হয়ে গেলেন! তাঁর মনে ছোটবউয়ের প্রতি সহানুভূতি আর সমবেদনার যে উৎসটি সজীব ছিল, সেটি চট করে, সেই মুহূর্তেই শুকিয়ে গেল। ছোটকর্তা দেখলেন, তাঁর স্ত্রী, তাঁর সাত পাকের বউ, তাঁরই চোখের সামনে, সেই বারবাড়ির উঠোন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর পলক না পড়তেই কোনও জাদুকর ঠিক সেখানে রেখে গেল মনুষ্যাকৃতি কিম্ভূতকিমাকার একটা জানোয়ারকে। ছোটকর্তা দ্রুত পায়ে উঠোনে নেমে গেলেন, বিনা দ্বিধায় সেই জানোয়ারটার মানুষের মতো সরু ঘাড়ে মারলেন তাঁর অসুরের মতো হাতের এক প্রচণ্ড ধাক্কা। সেই জানোয়ারটা ছিটকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ছোটকর্তা অবলীলাক্রমে তাকে দুই হাতে মাথার উপর তুলে নিলেন, তারপর ধানের বস্তার মতো ভিতর-বাড়ির উঠোনে ছুড়ে দিলেন। সেটা ঝুপ করে মাটিতে পড়ল। কোত্থেকে যেন রক্ত পড়ছিল, ঠিক খেয়াল ছিল না। হয়তো কোথাও কেটে গিয়েছিল সেটার, হয়তো হাত পা ভেঙে গিয়েছিল। ছোটকর্তা ভিতর-বাড়িতে ঢুকে সেই কুণ্ডলী-পাকানো মাংসের পিণ্ডে খুব জোরে মারলেন একটা লাথি। একটু উলটে গেল সেটা। তারপর আরেকটা লাথি মেরেছিলেন কি না, তাঁর ঠিক স্মরণ নেই। কুকুর বিড়ালকে আমরা যখন মারি, তখন ক’ ঘা মারি তার কি হিসেব রাখি! তাই ছোটকর্তা সঠিক বলতে পারবেন না আরেকটি লাথিও মেরেছিলেন কি না। কিংবা, হঠাৎ অনেকগুলো লোক (কত লোক তাও তাঁর খেয়াল ছিল না) তাঁকে সেদিন পাঁজাসাপটা করে ধরে না ফেললে ওই জন্তুটাকে তিনি থেঁতলে ফেলতেন কি না, তাও জানেন না।
শুধু এটা জানেন, ওই ঘটনার পর থেকে ছোটবউ সম্পর্কে কোনও আগ্রহ, কোনও ঔৎসুক্য ছোটকর্তার মনে আর জাগেনি। তাঁর মনে ছোটবউয়ের জীবন্ত অস্তিত্বটি যেন শীলাপাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ছোটকর্তার যে মনটি স্ত্রীর প্রেমে, তাঁর ভালবাসায় উষ্ণ হয়ে থাকত, এই ঘটনার পর সেটি যেন মৃত উনুনের মতো শীতল হয়ে গেল।
হয়তো এই কারণেই, এখন, ছোটকর্তা বিছানায় শুয়ে স্মৃতি খুঁটেও এমন কোনও চিহ্ন, কোনও নিশানা খুঁজে পাচ্ছেন না, যা দিয়ে আগেকার ছোটবউয়ের সঙ্গে এই ছোটবউকে মিলিয়ে নিতে পারেন।
হঠাৎ ছোটকর্তার সমস্ত ভাবনা বন্ধ হয়ে গেল। একসময় অপ্রস্তুতভাবেই টুপ করে ঘুমের গভীরে তলিয়ে গেলেন। তাঁর চৈতন্যের উপরতলে নানা ভাবনার যে ফাতনাটা এতক্ষণ ধরে টিপ টিপ করছিল, যেন এখন বিরাট ভারী এক মাছের টানে সোঁ করে সেটা অতলে তলিয়ে গেল। পরক্ষণেই হঠাৎ সেটা যেন ভুস করে ভেসে উঠল। ঘুম ছুটে গেল ছোটকর্তার।
ছোটবউ এসে যদি সেদিনের সেই অমানুষিক মারের কৈফিয়ত চায়, তা হলে ছোটকর্তা কী তার জবাব দেবেন? এই ভাবনাটাই গুঁতো মেরে আবার জাগিয়ে দিল ছোটকর্তাকে। কী বলবেন তিনি? সেই মারের পর ছোটবউ হাত পা ভেঙে অনেক দিন শয্যাশায়ী ছিল। একদিনের তরেও কোনও অভিযোগ করেনি, আহত কুকুরও তো গোঙায়, কিন্তু ছোটবউ তাও করেনি। শুধু, তারপর থেকে, যে দু’-একবার ছোটকর্তার কাছাকাছি হতে হয়েছে ছোটবউকে, সেই কয়বারই ছোটবউয়ের চোখের মণি দুটো ধীরে ধীরে জ্যামিতিক শূন্যের মতো প্রাণহীন হয়ে উঠেছে। তার দেহের স্নায়ুগুলো এক অভাবিত আক্রমণ, অকথ্য অত্যাচার সহ্য করার জন্য যেন প্রস্তুত হয়ে থেকেছে। ছোটকর্তা সেটা যেন এই মুহূর্তে আবিষ্কার করলেন, এই এতদিন পরে।
তাই বোধহয় ছোটবউ তখন অমন বোবা দৃষ্টি ফেলেছিল তাঁর উপর। সত্যিই তাঁর পানে তা হলে ছোটবউ চেয়েছিল তখন! হ্যাঁ, এখন ছোটকর্তার মনে হল, তাতে আর কোনও ভুল নেই।
উঃ, গরম লাগছে বড়। হাওয়া নেই। বাইরের মতো ছোটকর্তার মনের মধ্যেও গুমোট। দারুণ অস্বস্তি লাগছে তাঁর। সময়মতো ওষুধ পেটে পড়লে, এ-সব যন্ত্রণা কিছুই ভোগ করতে হত না। নেশার কাছে পুত্রশোকও জব্দ। বিকেলবেলায় নবনের কাছে চলে গেলেই হত। ওই একটিমাত্র মনের বন্ধু, এক গেলাসের ইয়ার এখনও তাঁর আছে এই গ্রামে।
তার কাছে গিয়ে পড়তে পারলে এতক্ষণ আর ভাবনা থাকত না কোনও। তা না করে, কতকগুলো ভাল ভাল ভাবের মোহে পড়ে সময় নষ্ট করলেন। এখন তার ফল ভোগ করুন।
ঘুম ভেঙেছে বটে ছোটকর্তার, কিন্তু চোখের পাতা এখনও খোলেননি। চোখ বুজেই তিনি চারিদিক হাতড়াতে শুরু করলেন। পাখা-টাখা রাখেনি নাকি? না, কোথাও পাখা পেলেন না। ছোটবউ যদি হাতে করে আনে একখানা, একটু যদি বাতাস করে, তবে এক্ষুনি তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু কোথায় ছোটবউ? আসছে না কেন? কত রাত এখন? হেঁশেলের কাজ কি মেটেনি এখনও?
নাকি ছোটবউ আসবেই না তাঁর কাছে? ভেবেছে হয়তো, কাছে গেলেই মার খাবে সেদিনের মতো। সত্যি-সত্যিই তাই ভাবছে নাকি ছোটবউ? পাগল আর কাকে বলে?
সেদিন কি ছোটবউকে মেরেছিলেন ছোটকর্তা? মেরেছিলেন তো একটা পাগলকে। পাগল কি মানুষ? সে তো পশুর সমান। সে তো পশু। সেদিন ছোটকর্তা মেরেছিলেন তেমন এক পশুকে। মানুষকে কি কেউ ওভাবে মারতে পারে? ছোটবউয়ের কাছেই যেন বারবার কৈফিয়ত দিতে লাগলেন তিনি। না না, ছোটবউ, তোমার কোনও ভয় নেই। এসো, এসো, তুমি স্বচ্ছন্দে উঠে এসো খাটে। সরে এসো আমার পাশে। এদিকে ফিরে শোও। দেখো তো, এই হাতের ভয় তুমি করছিলে তো! দেখো এবার, এই হাত কত আদর করতে পারে। কত কোমল, কত স্নেহময়, দেখছ তো! বউকে কি কেউ অমন করে মারতে পারে?
ছোটকর্তা জানতেও পারলেন না, কখন তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলতে লাগলেন ছোটবউয়ের সঙ্গে।
.
রান্নাঘরে মেয়েদের খাওয়াদাওয়া চুকল। হেঁশেলের পাট চুকিয়ে, কপাটে তালা এঁটে চাবিসুদ্ধ আঁচলটা ঝনাত করে পিঠে ফেলে বড়বউ ফিরে দাঁড়াতেই দেখলেন, ছোটবউ তখনও ল্যাম্পোটা ধরে তাঁর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
বড়বউ সস্নেহে বললেন, কী লো ছোট, পান খাবি এটটা?
ছোটবউ কথা বললেন না। বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়লেন। বড়বউ হেঁট হয়ে পানের বাটাটা তুলে নিলেন। একটা পান ছোটবউয়ের হাতে দিয়ে, একটা নিজের গালে পুরলেন। বললেন, নে খা।
ছোটবউ বিনাবাক্যে আদেশ পালন করলেন। বড়বউ আর দুটো পান তার হাতে দিলেন।
বললেন, ঠাকুরপো যদি খাতি চায় তারে দিস, কেমন?
ছোটবউ সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাত করলেন।
বড়বউ তাঁর থুতনিটা ধরে একটু নেড়ে দিলেন।
বললেন, যাও ভাই, অনেক রাত হয়েছে, শুয়ে পড়ো গে, কেমন? আমি বিছানা পাতে দিইছি।
ছোটবউ অমনি আদেশ পালন করতে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন। বড়বউ সেদিকে চেয়ে রইলেন। দেখলেন, ছোটবউ উঠোনে নামামাত্র কেমন অন্ধকারে মিশে গেল। একটুখানি এগিয়ে যেতে তাকে আর দেখা গেল না। শুধু কেরাসিনের ল্যাম্পোটার মোটা শিসটাই যেন কাঁপতে কাঁপতে পুবের ঘরে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বড়বউ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চতুর্দশীর রাত ঘুরঘুট্টি। আকাশে লক্ষ তারার মেলা। অন্ধকার রাতে কত তারা দেখা যায়। বড়বউয়ের এইরকম রাতই খুব ভাল লাগে। তারাগুলো দপ দপ করছে। ওগুলো যেন লক্ষ এয়োতির কপালের টিপ। কেমন জীয়ন্ত। এর কাছে পূর্ণিমার চাঁদের স্থির আলো কিছু না, যেন বিধবার ধপধপে একখানা সাদা থান। রান্নাঘরের পিছনকার কেয়াঝোপ থেকে তীব্র গন্ধ আসছে। এই গন্ধে সাপেরা আসে। কী যেন একটা অন্ধকারে স্যাঁত করে সরে গেল! ভুলো কুকুরটা হবে বোধহয়। ধপ করে তাল পড়ল কার বাগানে, একটা তারা ছুট হল আকাশে। ফেউ ডেকে উঠল গোয়াল জেঠির বাগানে। ছোটকর্তার ঘোড়াটা বারবাড়ির গোয়ালে পা ছুড়ল খটখট। বুড়ির ছেলেটা খুঁত খুঁত করে কাঁদতে লাগল। না, আর না, বড়বউ ভাবলেন, যাই এবার, অনেক রাত্তির হল। কিন্তু মেজদির হয়েছে তো? আর কত পিঠে বানাবে?
বড়বউ ডাক দিলেন, ও মাজদি, হল?
শুভদা চুষির পায়েসের কড়াইয়ে হাতা দিয়ে ঘুঁটতে ঘুঁটতে জবাব দিলেন, এই যে রে মণি, হয়ে আয়েছে। আর-একটু।
বড়বউ নিরামিষ ঘরের বারান্দায় উঠে ভিতরে উঁকি দিলেন। বাস রে, কত পিঠে এর মধ্যে বানিয়ে ফেলেছে মেজদি, ঘর যে প্রায় ভরে গিয়েছে!
শুভদা বললেন, শীতুর কাণ্ড তো, হয়তো বিয়েনে উঠেই ঘুড়ায় জিন চাপায়ে কবে, চললাম। তাই সব সারে রাখলাম।
একখানা পাটিসাপটা হাতে তুলে বড়বউয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে শুভদা বললেন, চাখে দেখ তো বড়বউ, নরম হয়েছে কি না?
বড়বউ সভয়ে পিছিয়ে এলেন।
হাসতে হাসতে বললেন, আমি কি চাঁপা না ফুলি? এত রাত্তিরি এ-সব পেটে গেলি কি আর বাঁচব ভাবিছ কাল?
শুভদা বললেন, নে না লো, একখানা পাটিসাপটায় তোর আর কী এমন খেতি করবে? চাঁপা ফুলি জাগে থাকলে তোরে আর সাধতাম না।
এমন সময় বড়বউয়ের ঘর থেকে চাঁপার আওয়াজ পাওয়া গেল।
আমারে ডাকতিছ নাকি, পিসিমা
বড়বউ আর শুভদা একসঙ্গে হেসে উঠলেন হো হো করে।
বড়বউ বললেন, ন্যাও, তুমার চাখনদারের অভাব মিটিছে তো, ইবার আমি যাই। দেখো, রাত একেবারে শেষ করে দিয়ো না। তাড়াতাড়ি সারো।
চাঁপা চোখ মুছতে মুছতে চলে এল শুভদার কাছে।
শুভদা বললেন, আসো, আসো, লক্ষ্মী মেয়ে। এতক্ষণ আমার হাতই যেন চলতিছিল না।
ছোটবউ ঘরে এসে দেখলেন, তাঁর বিছানাটা অনেক চওড়া হয়ে গেছে আজ। আর ছোটকত্তার বিরাট শরীরটা সে বিছানার অনেকখানি জায়গা এলোমেলোভাবে জুড়ে রেখেছে। আর ঘড়াত ঘড়াত নাক ডাকছে তাঁর। তা হোক, তাতে অবশ্য এমন কোনও মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। যে জায়গাটুকু খালি আছে, তাঁর রোগা পটকা শরীরটুকু তাতেই এঁটে যাবে। এতক্ষণ তাঁর চলাফেরা বেশ স্বচ্ছন্দেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। বড়বউ চালাচ্ছিলেন, তিনি চলছিলেন। একটা পান মুখে দিয়ে, দুটো পান হাতে নিয়ে, যেমন যেমন বড়বউ বললেন, তেমন তেমন চলে তিনি ঘরে এসে পৌঁছোলেন। এখন ও লোকটা যদি আবার নতুন করে কিছু হুকুম দিত তো ভালই হত, সেইমতো কাজই তিনি করতে পারতেন। কিন্তু ও তো ঘুমুচ্ছে। কিছুই বলছে না। ছোটবউয়ের স্বচ্ছন্দ গতির বাঁধা সড়কটা এখানে এসেই যেন ভেঙে গেল। এবার তাঁকে নিজের বুদ্ধিতে চলতে হবে। সেইটেই যা সমস্যা।
প্রথম সমস্যা এই পান দুটো। কী করবেন এ দুটো নিয়ে? এক হাতের ল্যাম্পোটা যত সহজে নামিয়ে রাখলেন, তত সহজে অন্য হাতের পান দুটো নামিয়ে রাখতে পারলেন না। সে দুটো তাঁর হাতেই ধরা রইল কিছুক্ষণ। তারপর কী মনে হল, কুলুঙ্গিতে একটা রেকাবের উপর রেখে দিলেন। তারপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। মশা পনপন করছে। মশারি ফেলা নেই। মশারিটা ফেলে দিলেন। তারপর ফুঁ দিয়ে ল্যাম্পো নিবিয়ে দিতে গেলেন। ল্যাম্পোর শিসটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রথম ফুঁয়ে নিবল না। এবার ছোটবউ কিছুটা সতর্ক হয়ে ফুঁ দিলেন। জোরালো বাতাস ঝপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিখাটার উপর। চুঁটি টিপে ধরল তার। অমনি অন্ধকার হয়ে গেল।
তারপর ছোটবউ খাটের উপর উঠলেন। এ-বিষয়ে তাঁর যেমন কোনও আগ্রহ জাগল না, তেমনি দ্বিধাও হল না বিন্দুমাত্র। এক পাশে শুয়ে পড়লেন। তাঁর পাশে একটা বিরাট শরীর। অন্ধকারে সেটাকে আরও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। নাক ডাকছে তাঁর। ছায়াময় সেই ভারী বস্তুটার সীমারেখাগুলো তালে তালে উঠছে, নামছে। ছোটবউয়ের কানের গোড়াতেই একটা মশা পনপন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে মশারিটা ঝাড়তে ইচ্ছে করল। নইলে মশার কামড়ে কচি ছেলেটা ঘুমুতে পারবে না। পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ল, কোথায় কচি ছেলেটা? সে তো এখানে নেই, সে যে তার মায়ের কোলে, অন্য ঘরে ঘুমুচ্ছে সে। কথাটা মনে পড়তেই ওঠবার, মশারি ঝাড়বার ইচ্ছেটা চলে গেল। পাকা চামড়ায় কামড় মেরে মশা বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না। এখানে শুয়েছেন তো তিনি আর ওই প্রকাণ্ড শরীরটা। সেটা তাঁর চেনা? সেটা তাঁর অচেনা? ওই শরীরটা যদি অচেনাই হত ছোটবউয়ের, তবে কি তিনি এত সহজে খাটে উঠতে পারতেন? এমনভাবে শুয়ে থাকতে পারতেন তাঁর পাশে? এ লোকটা তাঁর চেনা বই কী। ও তো ছোটকর্তা, বড়বউয়ের ছোটঠাকুরপো, ছোটবউয়ের স্বামী। স্বামী? এই কথাটা মনে ধরতে ধরতেও ফসকে যাচ্ছে। ছবিটা পরিষ্কার ফুটছে না। তাই যেমন অচেনাও লাগছে না ছোটকর্তাকে, তেমন খুব চেনাও ঠেকছে না কিন্তু। তাই ওর পাশে শুয়ে পড়তে যেমন দ্বিধাও হয়নি, তেমন ইচ্ছেও হয়নি।
.
বেলা করে ঘুম ভাঙে ছোটকর্তার। অভ্যাস। পাঁড়ে, এক কনেস্টবল ছিল কালীগঞ্জ থানায় সে রাঁধত ছোটকর্তার। সেই ভোরবেলা চা বানিয়ে ছোটকর্তার ঘুম ভাঙাত।
বাড়িতে ঘুম ভাঙানো সিপাই নেই, তাই দেরিটা একটু বেশিই হল। চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন, ঘরে আলো, কিন্তু দ্বিতীয় লোক কেউ নেই। রাত্রে কি এ ঘরে একা কাটিয়েছেন নাকি? চট করে পাশে নজর পড়ল। কেউ নেই সেখানে, তবু বেশ বোঝা যায় ফাঁকা ছিল না জায়গাটা, কেউ একজন ছিল। ওই যে মাথার বালিশে টোল খাওয়া, ওই যে তোশকের ভাঁজে কার একটা লঘু শরীরের আলতো স্বাক্ষর। ওই যে লম্বা একগাছি প্রাণহীন চুল। কার ও চুল? ছোটবউয়ের! ছোটবউ তা হলে এসেছিল রাত্রে। শুয়েছিল তাঁর পাশে। তা সত্ত্বেও তার অস্তিত্ব ছোটকর্তার কাছে অনুপস্থিত থেকে গেল! যেমন থেকেছে এই দশ বছর। বড় মজার ব্যাপার তো! . ছোটকর্তার সেই বাতিকগ্রস্ত মাছ-ধরা ভদ্রলোকের গল্পটা মনে পড়ল। সে সারাদিন চার ছড়িয়ে ছিপ ফেলে পুকুরপাড়ে বসে থাকত, আর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ত তখনই, যে-মুহূর্তে মাছ এসে তার বঁড়শির টোপ গিলত। ফলে, সে রোজ উঠে দেখত ছিপখানা অবধি মাছে টেনে নিয়ে গেছে। ছোটকর্তারও কি সেই দশায় ধরল নাকি? কখন এল ছোটবউ, কখনই বা গেল?
যাক গে, সে চিন্তায় বৃথা সময় নষ্ট করার কোনও মানে খুঁজে পেলেন না ছোটকর্তা। বেলা যথেষ্ট হয়েছে। ছোটকর্তা এক ঝাঁকিতে উঠে পড়লেন। চায়ের অভ্যাস মেজাজটা কিঞ্চিৎ খিঁচড়ে দিল।
বিরক্তি নিয়ে বারবাড়িতে এসে বসতেই রামকিষ্টোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
রামকিষ্টো বলল, ছোটবাবু, খবর দিয়ে আইছি।
কীসের খবর? ছোটকর্তা চট করে মনে করতে পারলেন না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, এখন মনে পড়ল বটে, গোটাকতক লোক দাঙ্গা বাধাবার তালে আছে। আপাদমস্তক জ্বলে গেল তাঁর।
হঠাৎ ছোটকর্তার মনে হল, এ গ্রামের, এ বাড়ির লোকজন, এমনকী ঘরদালান পর্যন্ত যেন তাঁকে জব্দ করতে চায়। জব্দ করতে পারলে খুশি হয়। কাল বাড়ি আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ব্যাপার ঘটেছে তার আনুপূর্বিক হিসেব কষতে বসলেন। তিনি বাড়ি এসে বুড়ির ছেলেকে ভাল মনে আদর করতে গেলেন, প্রতিদানে ছোঁড়াটা তাঁকে অপদস্থ করে ছাড়ল। এ তো গেল এক নম্বর কেস। দু’নম্বর কেসে তাঁকে ঠকাল এই বাড়িটা। কী যে সব ভাল ভাল ভাব উদয় হল মনে বাড়িটাকে দেখে যে, নবর্নের ওখানে যাবার সময় পার করে ফেললেন। স্রেফ একটা ধাপ্পায় পড়ে মৌতাত থেকে বঞ্চিত হলেন। সেই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন বড়দা। ছোটকর্তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাশা খেলায় হারিয়ে দিলেন তাঁকে। এটা তিন নম্বর। চার নম্বর কেসের আসামি ছোটবউ স্বয়ং। কাল রাত্রে কী জব্দটাই না তাঁকে করল ছোটবউ!
এ তো গেল বর্তমানের কথা। অতীতে গোপালদাসী তাঁকে বোকা বানায়নি? এখন বুদো আর গহর শালারাও জোট বেঁধেছে। ভবিষ্যতে তাঁকে জব্দ করার ভার নিয়েছে এরাই! দেখাচ্ছি মজা।
কাল সন্ধে থেকে যে অসন্তোষ, যে অস্বস্তি, যে বিরক্তি, একটু একটু করে মনের মধ্যে জমছিল, সেগুলো এখন একটা সুস্পষ্ট উপলক্ষ পেয়ে ক্রোধের আকার ধারণ করল। রাগটা ফেটে পড়ল এদেরই উপর। দাঙ্গার সাধ দিচ্ছি মিটিয়ে।
ছোটকর্তা এক ধাক্কায় সেই গৃহবিলাসী ভালমানুষ লোকটাকে যেন সরিয়ে দিলেন। গোঁফে চাড়া দিয়ে এবার উঠে দাঁড়াল সেই ডাকসাইটে, সেই চোয়াড়ে দারোগাটা। শরীরটা যার পেটা-লোহায় তৈরি। চেহারাটা যার মহিষাসুরের মতো। চোখ দুটো যার লাল লাল ভাঁটা।
ছোটকর্তা দাঁড়িয়ে উঠেই বাজপড়া স্বরে হাঁকাড় মারলেন, রামকিষ্টো, ঘোড়ায় জিন দে। বলেই ঘরে ঢুকলেন পোশাক আঁটতে। খাকির হাফ প্যান্ট, খাকির হাফ শার্ট, খাকির ফুল মোজা। চওড়া বেল্টটা কোমরে আঁটতেই অস্বস্তিকর ম্যাজম্যাজে ভাবটা অনেকটা কাটল। এই পোশাকে দেহটাই শুধু নয়, চোয়াড়ে মনটাও ফিটফাট হয়ে ওঠে। ক্রস বেল্ট এঁটে, ভারী বুটটা পরতেই মনে হয়, পরোয়া কোনও শালাকেই নেই। তিলমাত্র তেড়িবেড়ি করেছ কি এক লাথিতে খোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেব। এখন আমি কারও বাপ নই, খুড়ো নই, দাদু নই, পিরিতের জলে গলা থপথপে সেই কাদার পুতুলও নই। আমি দারোগা। মহামান্য সম্রাট বাহাদুর পঞ্চম জর্জ, সেই যাঁর সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, আমি তাঁর বান্দা, তাঁর ‘ল অ্যান্ড অর্ডারে’র সদাজাগ্রত কর্তব্যপরায়ণ রক্ষক।
ছয়ঘরা পিস্তলটা কোমরে ঝুলিয়ে একটা তকমা আঁটা খাকি রং পুলিশি হ্যাট মাথায় চাপিয়ে বেরুতে যাবেন, এমন সময় শুভদার সঙ্গে দেখা।
শুভদা অবাক হয়ে বললেন, ও শীতু, এ ‘কী, যাচ্ছিস কনে? খায়ে বেরো। খাবার দিইছি।
শুভদা আর কিছু বলার আগেই ছোটকর্তা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু ভারী গলায় ছোটকর্তা বললেন, তুলে রাখো। সুমায় নেই এখন। ফিরতি দেরি হতি পারে। শুভদা আর কিছু বলবার আগেই ছোটকর্তা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই হতভম্ব শুভদার কানে ঘোড়ার দড়বড়ি বেজে উঠল। আস্তে আস্তে একসময় মিলিয়েও গেল।
ষোলো
ছোটকর্তা এতটা না করলেও হয়তো পারতেন। ধড়াচূড়াটা না পরলে কোনওই ক্ষতি ছিল না। এ-গ্রামের সবাই তাঁর চেনা। সব জানাশোনার মধ্যে। গ্রামের হাটতলাটাও দেওয়ানবাড়ি থেকে বিশেষ দূরে নয়। ঘোড়ায় যাবার কোনও প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু ছোটকর্তা এখন কুটুম্বিতা করতে যাচ্ছেন না। নেমতন্ন রক্ষার জন্যও না বা কোনও াইফেলেও না। সোজা সরকারি কাজে নেমে পড়েছেন তিনি। পোশাকে কি আচার-আচরণে এখন এমন একতিল ফাঁকও তিনি রাখতে চান না, যাতে ব্যাটারা আশকারা পেতে পারে। যাতে ব্যাটারা ‘ও আমাদের ছোটবাবু, আরে উনি তো এই গেরামেরই ছাওয়াল’ বলে দু’পাটি দত্ত বিকশিত করে তাঁকে আমল না দেবার চেষ্টা করতে পারে। তাতে ঘটনার গুরুত্ব লঘু হয়ে পড়বে। আর ব্যাটারা সেই সুযোগে চ্যাংমাছের মতো পিছলে সটকে পড়বে। তারপর বৈঠকে বৈঠকে পান-তামাক উড়তে উড়তে তাঁর কুষ্টি কাটবে, তাঁকে ব্যঙ্গ করবে, বিদ্রূপ করবে, মুখ মুচকে বলাবলি করবে: কই, কী করল তুমাগের শেতলা দারোগা, আমাগের কী করতি পারল, ওই তো তার মুরোদ, হ্যাঁঃ।
ছোটকর্তা যেন চোখের সামনে ওদের জটলা দেখতে পেলেন, ওদের গুজগুজ ফুসফুস কানে শুনলেন। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি।
না, কোনও সুযোগ তিনি ওদের দেবেন না। কোনও আশকারা দেবেন না ওদের। এখন তিনি দারোগা। এখানেও তিনি দারোগা। কেমন দারোগা, তা তিনি টের পাইয়ে দেবেন এবার ওই বুদোটাকে, ওই মেদ্দাটাকে, এই অঞ্চলের সমস্ত বদমায়েশ ক’টাকে।
রাগের চোটে ঘোড়াটার তলপেটে ভারী জুতোর ঠোক্কর মারলেন একটা। ঘোড়ার গতি দ্রুততর হল। খুরের ঘায়ে ধুলোর ঘূর্ণি উঠতে লাগল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায়।
অলক্ষ্যে ঘোঁট পাকাতে যাঁরা খুব দড়, তাঁদের লক্ষ্য করে ছোটকর্তা মনে মনে বললেন, এতকাল ঘুঘু দেখেছ, এবার দেখবে ফাঁদ কাকে বলে।
হাটতলার কাছে এসে আবার এক গুঁতো খেল ঘোড়াটা। সদর্প লাফ মেরে নয়ানজুলিটা পেরিয়ে হাটতলায় ঢুকে পড়ল। চালাগুলোর টিনে তার খুরের খটাবট খটাবট শব্দ প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। একটা বড় কুঁকড়ো ডিঙি মেরে মেরে এগিয়ে আসছিল, আচমকা দড়বড় দড়বড় শব্দ চতুর্দিকে ধ্বনিত হতেই ক্বক্ ক্বক্ করে দৌড় মারল। একঝাঁক পায়রা দানা খুঁটে খাচ্ছিল, ঝপ করে উড়ে গেল। দুটো বিড়াল বেদম ঝগড়া করছিল, পালাল। একটা ঘেয়ো কুকুর গুপে ময়রার দোকানের সামনে মাটি থেকে ছানার জল চেটে খাচ্ছিল, হকচকিয়ে একবার চেয়ে দেখল।
হাটতলা যারা ঝাঁট দিচ্ছিল, তারা ঝাঁটা চালাতে চালাতে চোখ বেঁকিয়ে ছোটকর্তাকে দেখে নিল একবার। আগরওয়ালা গদিতে বসে হিসেব কষছিল। দারোগাকে তার গদির দিকে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। কোনও অপরাধ করেনি সে, আইন ভঙ্গ করেনি, তবুও তার বুক দুরদুর করতে লাগল। আর সে তৈরি হল অবশ্যম্ভাবী একটা অতিশয় বাজে খরচের হিসেব লিখতে। সে তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, দারোগা আসা মানেই কিছু গাঁটগচ্চা যাওয়া।
আগরওয়ালা এখানে অদ্ভুত এক পরিবেশের মধ্যে বাস করে। এখানে তার কারও সঙ্গে সদ্ভাবও নেই, কলহও নেই। দরকার পড়লে টাকার জন্য হাত পাতে সবাই। শোধ দেবার বেলায় বেগ দেয় সবাই। তার ভাই-বন্ধু এখানে কেউ নেই, সমাজও নেই। একমাত্র আইনই তার রক্ষক। তাই স্থানীয় দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের পায়ে সে নফরের মতো লুটিয়ে পড়ে। নজরানা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখে। আগরওয়ালাকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না, এ-গ্রামের তাবৎ লোককে কিনে রাখবার মতো টাকা তার আছে। কিন্তু সে বিষয়ে তার গর্ব নেই, অহংকার নেই। সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি আর অপরিসীম সতর্কতা— হৃদয়বৃত্তির এই দুটি স্রোতে সে তার জীবনের নৌকো খুলে দিয়ে বসে আছে। সে জানে, এখানকার সবাই তাকে মনে মনে ঘৃণা করে। কিন্তু তার বুঝি কাউকে ঘৃণা করার সময়ও নেই।
আগরওয়ালা কোনওরকম বাহানা না করে যা অবশ্যম্ভাবী, তার জন্য তৈরি করতে লাগল নিজেকে। গরিবের উপর বেশি জুলুম যাতে না হয়, তার জন্য প্রয়োজন হলে দারোগাবাবুর হাতে-পায়ে যদি ধরতে হয়, ধরবে সে। ঘাড় তেড়া রেখে, শির না ঝুঁকিয়ে লড়াই করা যায়, প্রাণ ত্যাগ করা যায়, কিন্তু নির্বান্ধব বিদেশে নিঃসম্বল এসে ব্যাবসা করা যায় না। ব্যাবসা করে লক্ষপতি হওয়া যায় না। মূর্খের মতো বীরত্ব দেখিয়ে, প্রাণ খুইয়ে, ফাঁকা হাততালিই পাওয়া যায়, হাতের ফাঁক রুপেয়ায় ভরানো যায় না। সে কাজে বীরত্ব নয়, ধীরত্ব চাই, মান রাখার জন্য তাতে প্রাণ খোয়ালে চলে না, মান দিয়েও প্রাণটি রাখাই আসল। মান খোয়ালে সব যায় না, আগরওয়ালা তা জানে। তাই সে প্রস্তুত হল মনে মনে।
কিন্তু না, দারোগার ঘোড়া আগরওয়ালার দরজায় থামল না। সবেগে বেরিয়ে গেল। বটগাছটাকে বাঁয়ে রেখে, হাটতলায় অর্ধেক একটা চক্র কেটে বিশ্বেসদের গদির দিকে মুখ ফেরাল। সেখানেও থামল না। বিশ্বেসদের গদির ধার ঘেঁষে সোজা পুবমুখে চলে গেল। থামল গিয়ে মেদ্দা ছাহেবের ওখানে।
ভক্ত দফাদার জানত, দারোগাবাবুর ঘোড়া হাটতলায় ঢুকে দুলকি চালে সোজা পথে প্রেসিডেন্ট সাহেবের ওখানে গিয়ে উঠবে। সে তাই জায়গা মতোই দাঁড়িয়ে ছিল। মতলব ছিল, দারোগাবাবুর ঘোড়াটি নাগালের মধ্যে আসামাত্র সে তার লাগামটি ধরে ফেলবে, তারপর দারোগাবাবুকে সসম্মানে নিয়ে যাবে প্রেসিডেন্ট সাহেবের গদিতে। যত্ন করে তাঁকে নামাবে ঘোড়া থেকে। তবে না তার আনুগত্য প্রকাশ পাবে! চাকরি পাকা থাকবে। এই তো দস্তুর।
তাই নিশ্চিন্তে সে হাটতলার কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল তখন, সে যখন দেখল দারোগাবাবুর ঘোড়া গুপে ময়রার দোকান বরাবর না এসে ডান দিকে দড়বড়িয়ে দৌড় মারল। যাচ্চলে, দারোগাবাবু ওদিকে যান কোথায়? ভক্ত ঘোষ ঝোলা লাঠি, বেল্ট পাগড়ি সামলে ছুট দিল ঘোড়ার পিছু পিছু। কিন্তু ঘোড়া যে বাতাসের আগে ছুটেছে, তার পিছু ধরবে কী করে?
ভক্ত হন্তদন্ত হয়ে আগরওয়ালার গদির সামনে দিয়ে যেতেই আগরওয়ালা তাকে ডাকল।
আরে ভাই দফাদার, জরা শুনো তো, কী বেয়াপার আছে আজ, বাতাও না ভাই। দারোগাবাবুকে তো নৌতুন লাগল। বদলি এসেছেন কি?
পালা-পার্বণে ভক্ত ঘোষ পার্বণী বেশ ভাল রকমই পায় মাড়োয়ারি বাবুর কাছ থেকে। তার ডাক অমান্য করতে পারে না অথচ ঘোড়াটা তার চোখের বাইরে চলে যায়।
সে তাড়াতাড়ি হাত-এড়ান জবাব দিল, উরে বাস, এখন কি দাঁড়ানোর সুমায় আছে মাড়ায়ারি বাবু। জবর ইনকোমারি শুরু করিছেন আমাগের নতুন দারোগা। এই গিরামেই ওই দেওয়ানবাড়ির ছোটবাবু ইনি। এই পেরথম নিজির থানায় আলেন। মিজাজ খুব কড়া। আজ কী হয় কে জানে?
মাড়োয়ারির মনে আরও খানিক কম্প তুলে ভক্ত সটকে পড়ল। বিশ্বেসদের দোকানের সামনে দিয়ে যেতেই বুদো, নিরাপদ আরও কে কে সব কলকল করে উঠল: ও ভক্ত, ও দফাদার, শোন দিন দেখি। বলি ব্যাপারটা কী?
ভক্ত আর দাঁড়াল না, যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছে, তা ছাড়া সে জানেই বা কী? কিন্তু সে দফাদার, দারোগার গতিবিধি সম্পর্কে সে কী জানে আর কী জানে না, বাইরের লোকে তা জানবে কেন?
তাই সে, সেখানে একটুও না থেমে, ঘাড়টা ঈষৎ ফিরিয়ে, দফাদারি কায়দায় জবাব দিল, ব্যাপার খুবই গুরুচরণ মশাই, তৈরি থাকেন, সুমায় হলি সবই জানতি পারবেন।
তারপর গটগট করে এগিয়ে গেল মেদ্দা ছাহেবের গদির দিকে।
বুদো ভুঁয়ে এবার ফাঁপরে পড়ল। ভোরবেলায় রামকিষ্টোর মুখে শমন পাওয়া ইস্তক মন খুঁতখুঁত করছিল তার। এই ছোটখুড়ো লোকটা যেন কেমন-কেমন! বুদোকে বাড়ির উপর ডাকলেই তো পারতেন। তা না করে এখানে আসতে বলার মানে কী? নিরাপদকেও আসতে বলা হয়েছে।
স্পষ্ট নয়, ছায়া-ছায়া কতকগুলো আতঙ্ক বুদোর মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। তার সঙ্গে ছোটখুড়োর কী এমন কাজ থাকতে পারে? তাকে এখানে আসতে বলা হল কেন? ছোটখুড়ো ধড়াচূড়ো পরেই বা এমন হাটময় ঘোড়া দাবড়ে বেড়াচ্ছেন কেন? দোকানের সামনে তাঁর ঘোড়া আসামাত্র তারা সবাই তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বুদো ভুঁয়ে মুখিয়েই ছিল— ছোটকর্তা নামামাত্র সে এগিয়ে যাবে, এই যে ছোটখুড়ো আসেন আসেন বলে ভিতরে আনবে তাঁকে, হাঁকডাক করে তামাক দিতে বলবে, ঘোড়াটা বাঁধতে বলবে কাউকে। কিন্তু ছোটকর্তা ভ্রূক্ষেপও করলেন না। থামলেনও না, এমনকী ঘোড়ার গতিও কমালেন না। এ আচরণের মানে কী? তারপর ভক্ত দফাদারই বা তার দিকে আড়চোখে চাইল কেন? বুদো ছুঁয়ের ধারণা ভক্ত শুধু তার দিকেই চেয়েছে। কেন বলল তৈরি থাকতে? তৈরি থাকার মানে কী? নাঃ সব মিলিয়ে ব্যাপারটা খুব সুবিধের ঠেকছে না। হঠাৎ বুদোর মনে হল তার একটা চোখ তিরতির করে নেচে উঠল। কোন চোখ নাচল? সেদিকে মনোযোগ দেবার আগেই চোখের নাচন বন্ধ হয়ে গেল। আরে গেল যা, ডান চোখ নাচল কি বাঁয়েরটা, সেটাও মনে করতে পারছে না সে? কী ব্যাপার! পুরুষমানুষের ডান চোখ নাচা ভাল, বুদো তা জানে। সেটাই নেচেছে, নিশ্চিতভাবে বুদো তা জানতে পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারত। কিন্তু খেয়াল করেনি সে। বুঝতে পারছে না। এখন এই ঘটনাই তাকে যেন অস্বস্তিতে অস্থির করে ফেলল। এবার বুদো সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে তার চোখটা আবার নাচে কি না, সেদিকে মন দিতে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল। যেন চোখ নাচার উপর তার মরা-বাঁচা নির্ভর করছে।
বুদো ভুঁয়ে কতক্ষণ এদিকে তার মনটাকে আটকে রেখেছিল, সে খেয়াল ছিল না। গোপালের ভাইপো গদা গলদঘর্ম হয়ে দোকানে ঢুকে যখন চেঁচিয়ে উঠল, আরে বাস, আজ মেদ্দা ছাহেবের দুকানে যেন ভুইকম্প লাগিছে। আমাগের ছোটবাবু দারোগা গহররে আর ছোলেমানরে, এমন ঘাপান ঘাপাতিছেন যে মেদ্দা পর্যন্ত থরথরিয়ে কাপতি লাগিছে।
এ-কথা শুনেই বুদোর বুক খালি করে নিশ্চিন্তির নিশ্বাস পড়ল।
বুঝে ফেলল বুদো, ছোটকর্তার মতলবখানা কী? রামকিষ্টোর কাছে বুদো শুনেছিল, এই থানায় বদলি হয়ে এসেছেন ছোটখুড়ো। গহর আর ছোলেমানরে যখন ঝুড়েছেন, তখন বিষয়টা নিশ্চয়ই নিরাপদ সংক্রান্ত সেই গোলমালটা।
বুদো হাসতে হাসতে বলল, বুঝলে গুপাল, আমাগের ছোটখুড়ো যেন বাতাসের মুখি খবর পায়।
নিরাপদ বলল, কী ব্যাপার, ও বুদোদা, ছোটবাবু মেদ্দার ওখেনে অত উত্তম-কুস্তম করতিছেন, বলি ব্যাপারখানা কী?
বুদো যেন সব জানে, যেন তার পরামর্শ মতনই ছোটকর্তা মেদ্দার ওখানে গিয়েছেন, এমনি একখানা ভাব করল।
নিরাপদকে চোখ টিপে বলল, যথা ধর্মং স্তথা জয়ং অর্থাৎ কিনা ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এখন চুপচাপ থাকো, ছোটখুড়ো এখন নাড়ে বিটাগের গালে বিনা জলে ক্ষুর ঘষতিছে তো, কাজটা চুকোয়ে মদ্দরে এখেনে আগে আসতি দ্যাও, তখন সবই জানা যাবে। আমারে যখন খবর দিয়ে আনায়েছে এখেনে, তখনই বুঝিছি আজ এক কাণ্ড হবে। তার উপরে সারাক্ষণ ডান চোখটা নাচতিছে। ওরে, তামুক সাজ।
তামাক এলে বেশ জম্পেশ করে টান লাগাল বুদো। তারপর কিছুক্ষণ চক্ষু নিমীলিত করে থাকল।
নিরাপদ বুদোর গা ঘেঁষে বসল এসে।
মিচকি মিচকি হেসে বলল, তার মানে ইবারকার মড়কটা ভাগনি-জামাইর উপর দিয়েই গেল, কী কও।
দোকানসুদ্ধু লোক নিরাপদর কথায় হেসে উঠল।
বুদো হাসতে হাসতে বলল, রসিকতাটা বড় লাগসই হয়েছে। তা ছোটখুড়ো আমাগের থানায় আসে ভালই হল। মাথার উপরে নিজিগের লোক থাকলি উনো বল দুনো হয়ে ওঠে, কী কও
সবাই মাথা নাড়ল, সে তো একশোবার।
এমন সময় ভক্ত ঘোষ এসে সরকারিভাবে ঘোষণা করল, বড়বাবু আসতিছেন।
বুদো ফোড়ন কাঁটল, বড়বাবু আবার কিডা গো?
ভক্ত যথাসম্ভব চাপরাশের মর্যাদা বজায় রাখবার জন্য বিরস কণ্ঠে বলল, দারোগাবাবু।
বুদো হাসতে হাসতে বলল, তোমাগের যিনি বড়, আমাগের তিনি ছোট, বুঝলে দফাদার।
ভক্ত কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ছোটকর্তা উপস্থিত হতেই সে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুলিশি জুতো মশমশিয়ে ছোটকর্তা দোকানে ঢুকে পড়লেন। একগাল হেসে বুদো ‘আসেন, আসেন ছোটখুড়ো’ বলে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল।
ছোটকর্তা সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই গলায় দিলেন এক দাবড়, কুটুম্বিতে রাখো।
সেই আওয়াজে বুদোর প্রায় কাছা খুলে যায়, অবস্থা এমনই বেসামাল হল। গোপালের মনে হল, তার আটচালা টিনের ঘরখানার মটকা বুঝি খুলেই গেল। সব থেকে হকচকিয়ে গেল নিরাপদ। একটু আগে বুদোর কথায় ভর দিয়ে সে যে জমির উপর দাঁড়িয়ে ছিল, ছোটকর্তার এক ধমকে সে-জমি তার পায়ের তলা থেকে সট করে যেন সরে গেল। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে বুদোর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
ছোটকর্তা রুদোকে আরেক ধমক দিলেন, খুব বুঝি মাতব্বর হয়ে উঠিছ, পাখনা গজায়েছে, অ্যাঁ? বলি পিঁপড়েগের পাখনা কখন গজায়, তা জানো?
হ্যাঁ, জানে বই কী। পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে। এ কথা জানে বলেই বুদো আরও ফ্যাসাদে পড়ল। এখন এই মারাত্মক উত্তরটা দেয় কেমন করে?
বুদোর তখন সব তালগোল পাকিয়ে গেছে, বুকের রক্ত শুকিয়ে এসেছে, আর হাঁটু দুটোতে কেমন যেন কম্প ধরেছে।
ছোটকর্তা আবার ধমক দিলেন, পিঁপড়ের পাখা কখন গজায়? মরবার সুমায়। এই অল্প-বয়সে তুমাগের আবার মরবার সাধ হল ক্যান? জেল ফাটকে না যায়ে বুঝি আর ছাড়বা না? দাঙ্গা করার জন্যি খুব যে কোমর বাঁধিছ, ইবার যে ওই কোমরে দড়ি পড়বে।
নিরাপদ চোখে অন্ধকার দেখল। বুদো-ফুদো সব পার পায়ে যাবে। মরতে মরবে সে-ই। সেই তো দোষী। তার কোমরে দড়ি বেঁধে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে পাঁচজনের চোখের উপর দিয়ে। কিন্তু নিরাপদর দোষই বা কোনখানে। হাটে তো সে নতুন তোলা তুলছে না। তোলা দিতে গাঁইগুঁই সব শালাই করে, কিন্তু সে-সব আপত্তি শুনলে তো নিরাপদকে শুকিয়ে মরতে হয়। তাকে গোপাল মাইনে দেয় তো মাত্তর দু’টাকা। দু’টাকায় কার পেট চলে? তারপর নিরাপদর নেশার একটা খরচ আছে। ভূপাল সাউ তার অবশ্য বন্ধুলোক, রোজকার নেশা সে-ই চালিয়ে দেয়, নগদা কড়ি গুনতে হয় না, কিন্তু ভূপাল সাউয়ের ব্যাবসা মদ বেচা, সে তো দানছত্র খুলে বসেনি, তাই নিরাপদ তার হাটের খরচাটা চালিয়ে দেয়। আর আছে ওই খোঁড়া মাগিটা, কেষ্টদাসী। তারও তো খরচ আছে একটা। মাগির আবার নোলাটা ভাল জিনিসের গন্ধে সপসপ করে। তার জন্যই তো নিরাপদকে এই খোয়ার সহ্য করতে হচ্ছে। তা ছোলেমান শালারই বা এত লাটসাহেবি কীসের? তোলা তো সবাই দেয়, গোমস্তাকে মারধর করে কে?
কিন্তু এসব যুক্তি কি টিকবে দারোগাবাবুর কাছে! যে রকম মারমূর্তি তাঁর, কোনও কথা পাড়াই যে দায়। বুদো যে বুদো, অমন চৌকশ লোক, দারোগাবাবুর সঙ্গে যার অত আত্মীয়তা (সে যে কেমন আত্মীয়তা, সে তো দেখা গেল), সে-ই ভুঁয়ের পো কেমন ন্যাতা মেরে গেছে, দেখাচ্ছে যেন বিড়ালের থাবায় নেংটি ইঁদুর, ওর কাছে নিরাপদ তো কীটস্য কীট! অথচ ঘোঁট পাকাতে বুদোই এগিয়ে গেছে। গোপালকে তাতিয়েছে, ব্যবস্থা বন্দোবস্ত যা-কিছু সেই করেছে। কাল যারা নিকিরিদের হাট ভাঙবে তাদের এনে গোপালদের দুর্গাবাড়ির চাল ছাইতে লাগিয়ে দিয়েছে। বুদোর পেটে পেটে বুদ্ধি। কিন্তু এখন? কোনও বুদ্ধি খাটবে না আর ঘর-পোড়ার কাছে। দারোগাবাবুর ঘাপান খাও বসে বসে। নিরাপদর একবার ইচ্ছে হল, সব ফাঁস করে দেয়, দিয়ে দারোগাবাবুর পা জড়িয়ে ধরে এবারকার মতো মাফ চেয়ে নেয়। মরুক শালা বুদো। কিন্তু এর মধ্যে গোপাল রয়েছে যে। বাস রে! গোপাল চটলে এ গ্রাম থেকে চির জীবনের মতো নিরাপদর অন্ন উঠবে। তাই সে চুপ মেরে গেল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল সসেমিরা অবস্থায় পড়েছে। এখন এগুলে ভেড়োর ভেড়ো, পিছুলে গুয়োর ব্যাটা। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল তার। সে মনে মনে জটা-শিবের স্মরণ নিল। এ যাত্রা উদ্ধার করে দাও বাবা, মানত করছি গাজনের দিন এক বোতল আসল মাল তোমার মাথায় ঠেকিয়ে প্রসাদ নেব।
.
গোপাল চুপ করে বসে বসে ভাবছিল, খবরটা থানা অবধি পৌঁছোল কী করে? বড় কেলেঙ্কারি হয়ে গেল দেখছি। ছোটকর্তা যে এই থানায় বদলি হয়ে এসেছেন, সে-খবরও তো কেউ তাকে দেয়নি। কতবড় একটা সুযোগ ছিল, এই সুযোগে সে দিব্যি সরকারি মহলে ঢুকে যেতে পারত। খাতির জমাতে পারত। ইস, কত বড় একটা মওকা মিলেছিল তার। এই উজবুকগুলোর জন্য সব ভেস্তে গেল। খুব আফশোস হল গোপালের। চটেও গেল মনে মনে। বুদোটার জন্য তো কোনও কাজ চুপেচাপে সারবার উপায় নেই। দিনরাত ধর্মরাজার ম্যাড়ার মতো তাল ঠুকে বেড়াচ্ছে। এখন গোঁয়ার মদ্দ যদি টের পায় লেঠেলরা তার বাড়িতে মজুত রয়েছে (টের পায়নি, তাই বা কে বলল? সঙ্গে তো সিপাই নেই, সেগুলো তার বাড়িতে এতক্ষণ মোতায়েন হয়েছে কি না কে জানে?), তা হলে হেনস্থার আর বাকি থাকবে না কিছু।
গোপাল ধীর মাথায় কর্তব্য ঠিক করে নিল। দোকানের পিছন দিকে কাজের ছলে এগিয়ে গেল। ইশারা করে ভাইপোকে ডাকল। চুপিচুপি বলল, যদি দেখিস সিপাইতে বাড়ি ঘিরে রাখেছে, তা হলি তাদের কবি— দারোগাবাবু কলেন, তিনি এক্ষুনি আসতিছেন, বলেই চলে যাবি নীল বাগানে। লাঠিগুলো সব নদীতি ফেলে দিবি। তারপর ঘর ছাওয়া নিয়ে ওগেরে খানিকক্ষণ গালি-গালাজ করবি। বাবারে তাড়াতাড়ি দুকানে পাঠায়ে দিবি। আর যদি দেখিস, সিপাই-টিপাই ধারে-কাছে নেই, তা হলি সব ব্যাটারে টাকা-পয়সা চুকোয়ে দিয়ে বিদেয় করে দিবি। যা, দেরি করিসনে, আমার সাইকেলখানা নিয়ে যা।
ভাইপোকে পাছ-দুয়ার দিয়ে বের করে দিয়ে গোপাল কাপড়ের দোকানে কাজ দেখতে লাগল। বুদোকে এ অবস্থায় একেবারে বাঘের মুখে ফেলে আসার জন্য কিছুক্ষণ তার মনটা খচখচ করতে লাগল। কিন্তু আত্মরক্ষাও তো ধৰ্ম।
বুদো এখন একেবারে একা পড়ে গেল তোপের মুখে। একবার মিনমিন করে বুঝি বলেছিল, সে কোনও অন্যায় কাজ করেনি। তার সমাজকে যারা হুমকি দেখিয়ে অপমান করতে চেষ্টা করেছে, সমাজের মান রক্ষার্থে সে তাদের চোখ-রাঙানির জবাব দিয়েছে।
তার উত্তরে ছোটকর্তা এমন দাবড় দিয়েছেন যে বুদোর মুখের কথা মুখেই জমে গেছে।
খুব যে লম্বা-চওড়া কথা বলতি শিখিছ হে!….
ছোটকর্তার কথাগুলো কথা নয় তো, বুলেট।
…অ্যাঁ, সমাজ রক্ষের ভার তুমার ঘাড়ে চাপাল কিডা? তুমার কথার ভাব দেখলি মনে হয়, এ রাজ্যিটা যেন তুমারই। ভুলে যায়ে না রাজত্বটা হচ্ছে পঞ্চম জর্জের। এখেনে কোনও রকম বদমাইশির জায়গা নেই। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যি আমাগের মতো গুটা কয়েক অধমরি মাইনে দিয়ে পুষে রাখা হয়েছে। সাবধান করে দিচ্ছি বেশি পাকামো করতি যায়ে না। দিনকাল বড্ডই খারাপ। একটু তেড়িবেড়ি করিছ কী, সব ক’টারে বি-এল কেসে ঠেলে দেব। ঘানি টানায় কত সুখ দিন কতক পায়ে আসলি মাতব্বরি ঘুচে যাবে। দাঁড়াও, আজই একটা পাকা বিহিত করে যাই।
ছোটকর্তা হাঁক মারলেন, দফাদার!
ভক্ত লম্বা সেলাম দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, হুজুর।
এতক্ষণে বুদো ভুঁয়ের পিলে সত্যি চমকে উঠল। নিরাপদ আর থাকতে পারল না।
ধর্মত বলছি হুজুর, আমার কোনও দোষ নেই, আমি এ-সবের মধ্যি একেবারে নেই। মাইরি বলছি। জটাশিবির মাথা ছুঁয়েও কতি পারি। এই আপনার পা ছুঁয়ে কচ্ছি।
নিরাপদ ছোটকর্তার দু’খানা পা জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। বুদো ভুঁয়েও নিজের অজান্তে হাত কচলাতে শুরু করল।
ছোটখুড়ো— বলেই বুদো সামলে নিল। বলল, হুজুর, বে-আইনি কোনও কাজ সত্যিই আমি করিনি। গোপালরি জিজ্ঞেস করে দেখেন।
.
এতক্ষণে বাবুরা মচকালেন। ছোটকর্তার মন থেকে মেঘ কেটে যেতে লাগল। মোল্লাদের দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্ত। মেদ্দাটাও আজ হাত কচলিয়েছে। কেমন একটা ফূর্তির ভাব ছোটকর্তার মনের মধ্যে ঠেলে ঠেলে উঠছে। মেঝেয়-শোয়া নিরাপদর দিকে নজর পড়ল। কুকুর, নেড়ি কুত্তা! চাটুক পা। বুদো দু’হাত সমানে কচলে যাচ্ছে। ছুঁচো কোথাকার। যাক গে, রাগ এখন অনেকটা পড়ে এসেছে তাঁর। গোঁফে একটু তা দিয়ে নিলেন ছোটকর্তা।
চারদিক তাকিয়ে ছোটকর্তা বলে উঠলেন, দোহারগেরে ফেলে মূল গায়েন গ্যালেন কনে? আমার চিহারাখান বুঝি গুপালবাবুর তেমন পছন্দ হল না?
আজ্ঞে, এই যে আমি, এখেনেই আছি।— গোপাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।
ছোটকর্তা বললেন, কী, এ-সব কী শুনতিছি!
গোপাল খুব বিনীতভাবে বলল, ওসব মাথাগরমের কথা ছাড়ান দেন। আমরা থাকতি এখেনে কোনও অঘটন ঘটবে না, এ আমি জোর করে কতি পারি। বাবারে আনতি লোক পাঠায়ে দিছি। আলেন বলে।
ছোকরা তো বেশ চালু আছে। গুছিয়ে কাজ করতে পারে। ছোটকর্তা গোপালের ধীরস্থির ভাব দেখে চমৎকৃত হলেন। হুঁ, উন্নতি করবে জীবনে।
এবার একটু নরম হয়ে ডাক দিলেন, দফাদার, প্রেসিডেন্ট সাহেবেরে ডাকে আনো।
খবর পেয়ে মেদ্দা ছাহেব তৎক্ষণাৎ এসে পড়লেন।
.
ছোটকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, কী, পাণ্ডাগুলোন আছে তো?
মেদ্দা ছাহেব বললেন, জে।
ছোটকর্তা বললেন, ঠিক আছে, আপনি একখানা মুচলেকা মুসোবিদে করে আনেন তো, বাবুগের টিপ-দস্তখত করায়ে নিই। আর হ্যাঁ, বিশ্বেসমশাই আসতিছেন, একটা সালিশ বসাতি হয়। সালিশটা বসবে কনে? একটা নিরপেক্ষ জায়গা চাই।
.
মেদ্দা ছাহেব এবার ক্ষুণ্ন হলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট, এতকাল তাঁর ওখানেই সালিশ বসেছে। ছোটকর্তার হুকুমে এবার সে নিয়ম, পালটে গেল। তার মানে ছোটকর্তা তাঁকেও বিশ্বাস করছেন না, দলে ঠেলে দিয়েছেন। ইচ্ছে হল, প্রতিবাদ করেন। কিন্তু এ বড় গোঁয়ার লোক। একটু আগেই তাঁকে কম হেনস্থা করেনি। আর নতুন সুযোগ দিতে ইচ্ছে করল না। কোনও জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলেন তিনি।
ভক্ত ঘোষ বলল, হুজুর, যদি কিছু মনে না করেন তো একটা জায়গার কথা কই।
মেদ্দা ছাহেব, গোপাল, বুদো— সবাই দফাদারের মুখের দিকে চাইলেন।
ছোটকর্তা বললেন, কও।
ভক্ত ঘোষ বলল, হুজুর, মাড়োয়ারি বাবুর গদিতি বসলিই হয়। তিনি সাতেও নেই, পাঁচেও নেই।
ছোটকর্তা বললেন, বেশ কথা, যা, তারে খবর দিগে। আমার ঘুড়াডারেউ নিয়ে আসিস।
মেদ্দা ছাহেব ক্ষুণ্ণ মনে বললেন, আমি তালি মুচলেকার মুসোবিদেটা ওখেনেই নিয়ে যাচ্ছি।
ছোটকর্তা বললেন, বেশ কথা, ওগেরউ আনবেন।
.
সালিশের কাজ চুকিয়ে মুচলেকায় দস্তখত টিপ নিয়ে ছোটকর্তা যখন ঘোড়ার চাপলেন তখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। লোকজন বিদায় নিতে, মাড়োয়ারি হুজুরকে অনেক মিনতি করে পেস্তার শরবত খাইয়েছে আর ঠিক ঘোড়ায় উঠবার মুখে পঁচিশটে রুপোর টাকা তোড়ায় বেঁধে এনে গরুড় পক্ষীর মতো হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। হুজুর যদি কিরপা করে লিয়ে নেন তো মাড়োয়ারি ধন্ন হয়ে যাবে। এটা আবার কী? নজরানা হুজুর। বাঃ রে মাড়োয়ারি, এই গিরামে দেখতিছি মানীর মান তুমিই রাখতি জানো। তা দ্যাও, তুমারে ধন্যই করি। ছোটকর্তা টাকার তোড়া পকেটে পুরলেন।
মনে ফূর্তির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। ঘোড়া তাই দুলকি চালে চলেছে। পায়রাগুলো গোল হয়ে দানা খুঁটতে খুঁটতে বকুম বকুম করছিল, কুকুরটা এখন গুপে ময়রার দোকানের সামনে পাতা ধরাটের নীচের ছায়ায় রোদ বাঁচিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে বিশ্রাম করছে। ছোটকর্তার ঘোড়া এখন তাদের বিরক্ত করল না। সেই মোরগটা এখন বাঁশের বেড়ার উপর বসে ছিল, সেও আর ভয় পেল না, বরং পরম কৌতূহলে গর্বিত ঘাড়টা নেড়ে সে ছোটকর্তার ঘোড়ার চলার ছন্দটা যেন নিরিখ করতে লাগল।
বাড়িতে পৌঁছোতেই রামকিষ্টো এগিয়ে এল। ঘোড়া থেকে নেমে ছোটকর্তা সেটাকে রামকিষ্টোর হাতে ছেড়ে দিলেন। হঠাৎ শুনলেন বুড়ির ছেলেটা তারস্বরে কাঁদছে। বাবা রে, গলাখানা কী! ছোটকর্তা উঠে গেলেন ঘরে। দেখলেন, খুবই বিরক্ত ভাব।
মুখ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী গো বাবু, এত গোসা হল কার উপরে?
অমনি তার কান্না থেমে গেল। ছোটকর্তার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হেসে হাত পা ছুড়তে লাগল।
ছোটকর্তা হা হা করে হেসে উঠলেন। কী রকম পাজি! কোলে উঠবার মতলব!
ছোটকর্তা বললেন, ও শালা, ভাবিছ ঘুঘু বুঝি বারে বারে ধান খাতি আসবে, না আর তুমারে কোলে নিচ্ছিনে। দারোগারা লোক চরায়ে খায়, আর তুমি শালা এমন বাহাদুর সেই দারোগারেও চরাতি চাও!
গিরিবালা ঘরে ঢুকে দেখল ছোটকাকা তার খোকার গাল টিপে টিপে আদর করছে আর তার খোকা হাত পা নেড়ে মনের আনন্দে কত্ কত্ করছে।
তাকে দেখে ছোটকর্তা বললেন, মা, তুমার ছেলের ভয়ে কাল সকালেই পালাতি হবে। যেমন ভাবে ও আগোয়ে আসতিছে, ভয় হয় গেরেপতার হয়ে যাব।
ছোটকর্তা হাসতে হাসতে নিজের ঘরে পোশাক ছাড়তে চললেন। পোশাক ছাড়া হলে রামকিষ্টোকে তেল মাখাতে বললেন। বেশ করে চানটি করে খেতে বসলেন। মেজদির হাতের পিঠে পায়েস, ছোটকর্তার মুখে যেন অমৃতের মতো লাগল। খাও না পাওয়া সেরে একটু গড়িয়েও নিলেন।
ঘুম যখন ভাঙল তখন সন্ধে প্রায় হয় হয়। পাছে আবার কোন মায়ায় আটকে পড়ে যান, তাই ছোটকর্তা আর কালবিলম্ব করলেন না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন নবীন তাঁতির বাড়িমুখো শুধু বড়বউকে বলে গেলেন ফিরতে রাত হবে। বড়বউ বুঝলেন, বললেন, ভাত তুমার ঘরেই ঢাকা থাকবে। আসে খায়ো কিন্তু।
ছোটকর্তা ‘আচ্ছা আচ্ছা’ বলে পাশ কাটালেন।
সতেরো
নবীন তাঁতি হাঁটতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই তার পায়ে জোর নেই। সান্নিপাতিক জ্বরবিকার হয়েছিল। প্রাণে বেঁচেছে, পা দুটো বাঁচাতে পারেনি। তা বলে সে অকর্মণ্য নয়। নাম-করা কারিগর সে। তার মতো ঘুড়ি কেউ বানাতে পারে না। শুধু কি ঘুড়ি, কত রকম পুতুল বানায় নবীন, কত ধরনের খেলনা। নাচের পুতুল তৈরি করতেও সে বাঘা ওস্তাদ। কিন্তু এসবে এক আধলা রোজগার হয় না তার। দরকারই বা কী। বাবা কিছু টাকা রেখে গিয়েছে। বড় ভাল তাঁতি ছিল সে। তার হাতের সুহাগি শাড়ির খুব চল ছিল সে আমলে। ওয়ারিশ বলতে ওই তো এক নবীন। আর এক বোন ছিল, শান্তিপুরে বিয়ে হয়েছে। নবীনের সেই দিদিরই এক বিধবা মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে নবীনের কাছে থাকে।
নবীন বাড়ি থেকে একটু দূরে, নদীর পাড়ে, তার আস্তানা বানিয়েছে। সেইখানেই সে তার যন্ত্রপাতি, পুতুল, খেলনা, ঘুড়ির সরঞ্জাম আর মনোমতো সঙ্গী ধান্যেশ্বরীর বোতল নিয়ে পড়ে থাকে।
ছোটকর্তা যখন এলেন, তখন সন্ধে উতরে গিয়েছে। নবীন হ্যাজাগবাতি জ্বেলে পুতুলনাচের মহড়া দিচ্ছিল। দুটো নতুন পুতুল সে বানিয়েছে। নাম দিয়েছে চন্দ্রাবলী আর চোরা কানাই। নবীনের সুতোর টানে টানে পুতুল দুটো কী সুন্দর নড়ছিল! বিশেষ করে চন্দ্রাবলী। তার চালচলনে সত্যিকার রঙ্গিণী নারীর মতোই চটুলতা। ছোটকর্তার খুব মজা লাগল।
বলে উঠলেন, বাহবা নবীন, বাহবা! তুমি যে শেষ পর্যন্ত বিধেতারেউ টেক্কা দিতি শুরু করলে!
ছোটকর্তাকে দেখেই নবীন খুশি হয়ে উঠল। তার নিঃসঙ্গ জীবনে এই একটা মনের মতন মানুষ সে পেয়েছে।
শশব্যস্তে বলে উঠল, আসেন আসেন ছোটবাবু।
ছোটকর্তা বললেন, ব্যস্ত হয়ে না, ব্যস্ত হয়ে না। আইছি যখন, সহজে যাব না। তুমার এই পুতুল দুটো বড় জবর হয়েছে হে, বিশেষ করে ওই মনকাড়া মাগিডে। আহা কী ছৈরত! ইচ্ছে করে সারা জীবন জাপটায়ে ধরে পড়ে থাকি।
নবীন হা হা করে হেসে উঠল। রসিক মানুষ ছাড়া রসের তত্ত্ব বোঝে কেডা?
বলল, ছোটবাবু, উনি চন্দ্রাবলী, বিন্দেবনে অনেকের বুকিই আগুন জ্বালিছেন। ইবার বড় জব্দ। আগুন নিয়ে খেলতি যায়ে ইবারে নিজির বুকি পড়িছে কিনা ছ্যাঁকা, তাই বিলেপের আর কূলকিনারা নেই।
অপূর্ব কৌশলে নবীন সুতো ধরে টান দিতেই চন্দ্রাবলী জ্যান্ত মানুষের মতোই এক পাক ঘুরে চোরা কানাইয়ের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর দুহাত জোড় করে কানাইয়ের পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ল।
নবীন সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল :
ও আমার কেলে সুনা
তুমি রাতে করতে আনাগোনা
এখন হয়ে রাজপিয়াদা
আমারে আর চেনো না।
ছোটকর্তা উচ্ছ্বসিত হয়ে বেড়ে বেড়ে করে তারিফ দিয়ে ঝপ করে এক জায়গায় বসে পড়তেই ফ্যাসস করে একখানা কৌড়ে ঘুড়ি ফেঁসে গেল। ছোটকর্তা তো মহা অপ্রস্তুত।
বোকার মতো বলে উঠলেন, ঘরে যে আর জায়গা রাখোনি কিছু। ছিঁড়ল তো।
ছিঁডুক ছোটবাবু, ছিঁডুক, ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।
নবীন ততক্ষণে পুতুল দুটোকে গুটিয়ে রেখে মদের বোতল বের করে ফেলেছে। দুটো গেলাসে পরিপাটি করে ঢেলে একটা গেলাস ছোটকর্তাকে এগিয়ে দিল। তারপর নিজেরটুকু এক চুমুকে সাবাড় করে বাঁ হাতের উলটে পিঠ দিয়ে মুখখানা মুছে ফেলল।
তারপরে ভারী গলায় বলল, বলি, সেই ছড়াডা শুনিছেন তো—
পুড়ুক পুড়ুক ছাওয়ালের মাথা
আরও ছাওয়াল পাব,
আলা তামুক ফুরোয়ে গেলি
কার দরজায় যাব!
তা আমারউ সেই কথা। ঘুন্নি গেলি আবার ঘুন্নি পাব, বানায়ে নেব আরেকখান, ও তো এই হাতের মধ্যিই থাকল। কিন্তু আপনি গেলি, কার দুয়োরে খুঁজতি যাব? পাবই বা কনে?
ছোটকর্তার শিরা উপশিরা দিয়ে মদের তীক্ষ্ম স্রোত বইতে লেগেছে। নবীনের কথায় মিচকি মিচকি হাসতে লাগলেন।
নরম গলায় বললেন, কী সুখি তুমি রাতদিন এত ঘুন্নি বানাও?
নবীন আরও খানিক মদ ঢালল গেলাসে, ঢালল গলায়। তার চোখ দুটো চকচক করতে লাগল। সুন্দর হাওয়া উঠে আসছে নদীর দিক থেকে। শীতল হাওয়ায় প্রাণ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে।
নবীন ধরা গলায় বলল, ছোটবাবু, তিন রকম জীব আছে জগতে, স্থলচর, জলচর আর খেচর। আপনারা হলেন গে স্থলচর। কত জায়গা ঘোরেন, কত দেশ-বিদেশে যান! কত কী দেখেন! ভগবান আমারে মারে রাখিছেন। এ জীবনে স্থলচর হওয়া আর আমার হল না। তাই খেচর হবার সাধ হয়েছে। ঘুন্নি বানাই, আর এই ঘুন্নির সঙ্গে মনডারে বাঁধে দিই। জানেন তো—
নবীন গুনগুন করে গান ধরল,
চিলে করে ঢিলে মিলে
কৌড়ে মারে টান,
পতঙ্গা উঠে বলে আরও সুতো আন।
নবীন বলল, ওই পতঙ্গার সঙ্গে মন বাঁধে সুতো ছাড়তি থাকি। মনে মনে বাসনা, একদিন উপরে উঠে পতঙ্গা সুতোর টান আর গেরাহ্যি করবে না, সুতো কাটে উঠে যাবে উপরে, আরও উপরে, মেঘের দেওয়ালের পাশ কাটায়ে সুজা ঢুকে পড়বে চাঁদ-তারার রাজ্যে! ওর সঙ্গে আমার মনও যাবে উড়ে। দিনরাত বসে বসে আর ভাল লাগে না ছোটবাবু। আমার তো ডানা ‘নেই, নাহলি নিজিই একদিন উড়োন দিতাম।
নবীনের কথার জন্যেই হোক, কি মদের তেজেই হোক, ছোটকর্তাও উড়ছিলেন এতক্ষণ। নবীনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন ঠক করে নেমে পড়লেন মাটিতে। আমেজটা নষ্ট হল। ছোটকর্তার মনে হল, নবীনটা সাধক লোক। কী আশ্চর্য, জগৎসুদ্ধ লোক যখন বিষয়- সম্পত্তি নিয়ে, প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য, কামড়াকামড়ি, খেয়োখেয়ি করছে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে ব্যস্ত, নবীন তখন ঘুড়ি বানিয়ে আর পুতুলের জগৎ সৃষ্টি করে কাল কাটাচ্ছে! কী, না চাঁদ-তারায় ঘুরে বেড়াবে! এমন লোক ক’টা হয়!
ছোটকর্তা বললেন, তোমার এই মন যদি জগতের আদ্ধেক লোক পাত নবীন তো দেখতে দুনিয়ার চিহারা বদলায়ে যাত
নবীন বলল, মন বড় জুয়োচোর ছোটবাবু, ওর গতিবিধি কিডা জানতি পারে? ওর কথা ছাড়ান দ্যান। ইবার আপনার কথা কন। আজকাল বড় একটা আসেন না ইদিক। দেশ গাঁ কি ছাড়ে দেলেন?
ছোটকর্তা পরিহাস করলেন, কার কাছে আর আসব কও? ভাবের মানুষ যে ছিল, তিলক কাটে সে বষ্টুমী হল।
নবীনও হাওয়া হালকা করে দিল, বলল, মানষির অভাব আছে নাকি ছোটবাবু? পুরনো যায়, নতুন আসে। ক’টা চাই আপনার? চান তো একেবারে কচি-কাঁচার সন্ধানউ দিতি পারি।
ছোটকর্তা হেসে ফেললেন। বললেন, বয়েসটা যে চল্লিশ পার হয়ে গিয়েছে নবীন, এই বয়েসে আর কাঁচা রাস্তায় পা বাড়াতি সাহস হয় না, পিছলে পড়ে পা ভাঙলি বুড়ো হাড় আর জুড়া লাগবে না, বুঝিছ? আমাগের এই বাঁধা সড়কই ভাল।
নবীন বলল, কথাডা বলিছেন বড় ভাল। তা বাঁধা সড়কে যাতি চান তাই না হয় যাবেন।
ছোটকর্তা বললেন, কাল তো ঠেকে গেলাম সেইখেনেই। কারুর কথাই মনে পড়ল না। এখন অবিশ্যি মনে হচ্ছে পদ্ম কি কুসুমরি একবার দেখলিউ হত।
নবীন বলল, সে গুড়ি বালি ছোটবাবু। শুনি তো কুসুম এখন মেদ্দার বনে ফুটতিছে। আর পদ্মরি নাকি মাড়োয়ারিবাবু একেবারে পরদানশিন ঘরের বউ বানায়ে ফেলিছে। শুধু তার হাতে খায় না।
ছোটকর্তা বললেন, ক্যান?
নবীন বলল, পদ্ম যে বাঙালি, মছলিখোর।
ছোটকর্তা হো হো করে হেসে উঠলেন।
বললেন, অ্যাঃ, ও-শালা মাড়োয়ারির ধম্মজ্ঞান তো বড় টনটনে! বাঙ্গালি মাগির ভাত খাতি মাছের গন্ধ লাগে আর তার জাত খাতি সে আঁশটে গন্ধ বুঝি নাকে ঠেকে না?
নবীন চুপচাপ মদ খেতে লাগল। হঠাৎ ছোটকর্তার একটা জরুরি কথা মনে পড়ল। বললেন, ওহে নবীন, আসল কথাই ভুলে যাচ্ছিলাম, মাড়োয়ারির কথায় মনে পড়ল। দ্যাখো, ওই শালা আজ আমারে পঁচিশটে টাকা নজরানা দিয়েছে। আমার একটা নাতি হয়েছে জানো তো, মাজদার মেয়ের ছেলে, তা সে শালার মুখ দেখলাম, এখন কিছু একটি দিতি হয় তো, এই ন্যাও, নজরানার টাকাটা তুমার কাছে রাখে দ্যাও, আমি কাল ভোরে চলে যাব, তুমি একটা স্যাকরারে দিয়ে ভাল একজুড়া বালা গড়ায়ে দিবা।
নবীনের নেশা ধরেছে। সে চুপচাপ টাকাটা নিয়ে রেখে দিল। তারপর ধীরে ধীরে ছোটকর্তাও চুপ হয়ে গেলেন। তাদের শিরা-উপশিরায় অনেকবার চাঞ্চল্য জাগল। মাথার পিছনটা দপদপ করতে লাগল। চোখ বুজে আসতে লাগল। নবীনের মনে হল, সে দৌড়বাজিতে যোগ দিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। ছোটকর্তার মনে হতে লাগল, তিনি নবীনের পতঙ্গা ঘুড়িতে বসে মেঘের উপর ভাসছেন। কিন্তু এত দুলছে ঘুড়িটা, স্থির হয়ে বসতে পারছেন না। কানে সোঁ-সোঁ শব্দ হচ্ছে। বাতাস হচ্ছে নাকি? ঘুড়িটা টাল খেতেই ছোটকর্তা, মেঝের উপর টলে পড়লেন। গোটা কতক খালি বোতল ধাক্কা লেগে গড়িয়ে পড়ল। ছোটকর্তা উঠে বসতেই নদীর দিকে নজর পড়ল। চাঁদ উঠেছে। জলে তার ছায়া পড়ে ঝিলিমিলি খেলা শুরু হয়েছে। ছোটকর্তার মনে হল কেউ যেন অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে নাচাচ্ছে। রাত হয়েছে। চাঁদ উঠে পড়েছে যখন তখন বেশ রাত হয়েছে। এবার বাড়ি যেতে হয়।
ছোটকর্তা উঠে দাঁড়াতেই শরীরটা টলমল করে উঠল। তিনি সামলে নিলেন।
জড়িত কন্ঠে বললেন, চলি হে, নবীন।
নবীন সাড়া দিল না। সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
.
ঘুমিয়ে ছোটবউও পড়েছিলেন। কিন্তু আচমকা খাটটা নড়ে উঠতে, ধপ করে একটা শব্দ হতেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম ভাঙতেই তাঁর নাকে ঝাঁজালো মদের গন্ধ ঢুকল। গন্ধটা নাকে ঢুকতেই তাঁর গায়ে পাক দিয়ে উঠল। গায়ে পাক দিয়ে উঠতেই একটা অঘটন ঘটে গেল। এ কী, এ যে তাঁর অত্যন্ত পরিচিত এক অস্বস্তিকর গন্ধ! যে লোকটা এই অসহ্য গন্ধ বয়ে আনত, সেই অনেক অনেক দিন আগে, বোধহয় বিগত জন্মে, সেই লোকটা, সেই ছোটকর্তা এসেছে নাকি? ধড়মড় করে উঠে বসলেন ছোটবউ। ওমা তাই তো, ওই তো, গরমে এপাশ ওপাশ করছে, সেই যেমন আগে আগে করত!
যে ভারী আবরণটা এতদিন ছোটবউয়ের স্মৃতির উপর জগদ্দলের মতো চেপে বসে ছিল, এই পরিচিত ঝাঁজালো গন্ধটা তীক্ষ্ণধার ছুরির মতো তাকে ফালা ফালা করে কেটে উড়িয়ে দিল। স্বামীর এত কাছে বসে আবেগের তাড়নায় বুকটা ধুক পুক ধুক পুক করতে শুরু করল তাঁর। অজস্র খুশি একসঙ্গে তাঁর নাভিমূল থেকে উঠে এসে কন্ঠনালিতে আটকে গেল। এইবার দম ফেটে যেন মরে যাবেন ছোটবউ। অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল তাঁর কণ্ঠার কাছে, না না, বুকের কাছে। আবার মুহূর্তে সব ঠান্ডা হয়ে গেল। এবার একটা বেদনার তিক্ষ্ণ তির তরতর করে উঠে আসছে। চোখ ভরে আসছে জলে। সর্বশরীর থরথর করে কাঁপছে। ছোটবউ আর পারছেন না, নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না। ভিতরে ঝমঝম বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। যে অন্তর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল, দশ বছর যাবৎ যে প্রান্তর খাঁখাঁ করেছে, এখন তা প্রবল বর্ষণে ভিজতে লাগল। কী যন্ত্রণা! কী শান্তি!
ছোটবউ বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলেন, প্রথমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তারপর জোরে জোরে। কান্নার জোয়ার নেমেছে। ছোটবউ কুটোর মতো ভেসে চলেছেন— চলেছেন— চলেছেন।
কান্নার শব্দে ছোটকর্তার তন্দ্রা ছুটে গেল। কে কাঁদে? নবীন? নবীনের চন্দ্রাবলী? না তো। ধড়মড় করে উঠতে গেলেন ছোটকর্তা। পারলেন না। মাথাটা বেশ ভারী। সারাদেহে রিমঝিম। বুকে প্রবল তৃষ্ণা। এক গ্লাস জল পেলে হত।
কান্নার শব্দ তখনও আসছে। পিছন থেকে, পাশ থেকে। ছোটকর্তা বিমূঢ়ের মতো দু’হাতের তালু দিয়ে মুখখানা ঘষে নিলেন। মুখখানা তখনও চিনচিন করছে। গভীর রাত্রে কাছেপিঠে কোথাও যেন একখানা বড় রেলের ইঞ্জিন এসে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটকর্তার কানে তারই সিঁ-সিঁ আওয়াজ বাজছে।
এবার তিনি পাশ ফিরলেন। পাশ ফিরতেই দেখলেন ছোটবউয়ের ছায়া-ছায়া শরীরটা উপুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে। বাঃ রে, এখানে, এই নবীনের ঘরে ছোটবউ এল কী করে? নাকি, এটা তাঁর বাড়ি? তিনিই বা বাড়ি এলেন কখন? ছোটবউ আগে থাকতেই ছিল নাকি এই খাটে? নাকি, এখন এল?
কাঁদছে কেন ছোটবউ? আজ সে কাঁদছে কেন? আহা, দশ বছর আগে, খোকা মরে যাবার পর, ওকে যদি এমন করে কাঁদাতে পারা যেত, তা হলে আর ছোটবউ অমন উদোম পাগল হয়ে যেত না। পাগল না হলে কবে আবার ওর কোলে খোকা এসে যেত। সবাই তখন কত চেষ্টা করেছিল ছোটবউকে কাঁদাতে। একটি ফোটাও তখন কাঁদেনি সে। সত্যিই ওর পোড়াকপাল হতভাগী!
কেমন এক সমবেদনায় ছোটকর্তার মনটা ভিজে উঠল। চোখ দুটো করকর করতে লাগল।
ছোটকর্তা ছোটবউয়ের পিঠে আস্তে আস্তে হাত রেখে নরম করে ডাকলেন, ছোটবউ!
সঙ্গে সঙ্গে ছোটবউ তাঁর চওড়া বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আলুথালু মাথা ঘষতে ঘষতে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন, ওগো, আমাকে ফেলে যেয়ো না। আমার ভয় করে, ভয় করে, বড্ড ভয় করে।
আহা, বেচারি, ছোটকর্তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি পরম আদরে ছোটবউয়ের পিঠে মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন।
তারপর গলা ঝেড়ে বললেন, নাঃ, তোরে নিয়েই যাব। তবে ইবার না, আমি যায়ে কোয়ার্টার ঠিক করে নিই আগে, তারপর আসে নিয়ে যাব। ভয় কী, এখন আর তোর ভয় কী, তুই তো একেবারে ভাল হয়ে গিছিস! কাঁদিসনে, ছোটবউ, আর কাঁদিসনে
ছোটকর্তার সান্ত্বনা পেয়ে ছোটবউয়ের কান্না ধীরে ধীরে থেমে এল। ছোটকর্তার বিরাট শরীরটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে তিনি ফোঁপাতে লাগলেন। তারপর একসময় সব-কিছু থেমে গেল। দু’জনেই ঢুলে পড়লেন গভীর ঘুমে। এ ঘুমের জাত একেবারে আলাদা।
আঠারো
সুধাময়কে নামাবার জন্য বাসখানা থামতেই আবার তার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। এবার নিয়ে এই আট মাইল রাস্তায় পাঁচবার “সোহাগিনী”র স্টার্ট বন্ধ হয়েছে।
সুধাময় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, আর তাকে কাদার মধ্যে বাস ঠেলতে হবে না। চার চাকার ঘায়ে পথের কাদা ছিটকে ওর সর্বাঙ্গে মাখামাখি হয়েছে। নতুন কাপড়খানা ফেঁসেছে, জামাটা লাট হয়েছে। জুতোটা খুলে রেখেই এ বাসে চাপা উচিত ছিল তার, সুধাময় এখন সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু এখন আফশোস করে আর কী হবে? এ জুতো দেখে কে এখন বলবে, এটা কলকেতা থেকে কেনা চিনে বাজারের জুতো? এ জুতোর চেহারা দেখে গ্রামের গজা মুচির সেই গবদা-গবদা ডোঙা-ডোঙা জুতোগুলোও হয়তো ফ্যাক ফ্যাক করে হাসবে।
যাক, এবার আপদের শান্তি হল। মনে মনে নাক কান মলল সুধাময়। আর বাবা এ বাসে উঠছিনে। খুব শিক্ষা হয়েছে। কিন্তু কনডাক্টরটা করে কী? গেল কোথায়? মাল নামায় না কেন?
অসহিষ্ণু সুধাময় হাঁক পাড়ল, কই হে কনডাক্টর, মাল নামাও।
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। সুধাময় এদিকে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বুনোপাড়াটা রাস্তার উপর থেকেই এখন বেশ দেখা যায়। এত জঙ্গল সাফ করল কে? সুধাময় একটু অবাক হল। আগে ঘন জঙ্গল ছিল বুনোপাড়াকে ঘিরে। দিনে দুপুরে এলেও গা ছমছম করত। বুনোপাড়ার পরই বাজনদারদের পাড়া। বাজনদারপাড়ার সীমানা ছাড়ালেই সুধাময়দের বসত ভিটের এলাকা শুরু। তিরিশ বিঘে জমির উপর বাড়ি আর আম কাঠাল সুপারি নারিকেলের বাগান। রাস্তা থেকে সুধাময়দের বাড়ি পৌঁছোতে অন্তত দশ মিনিট তো লাগেই। চঞ্চল হয়ে উঠল সুধাময় কোথায় গেল কনডাক্টর?
বুনোপাড়ার থেকে দুম দুম ট্যাম ট্যাম একটানা একঘেয়ে একটা বাজনার আওয়াজ কানে এসে বাজছে। এ আওয়াজ সুধাময়ের খুব পরিচিত। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে সে। সুধাময় জানে, বুনো সর্দাররা এবার দল বেঁধে শুয়োর মারতে বেরুবে, বুনো শুয়োর। এ তারই প্রস্তুতি। এখন ওরা বাড়ির তৈরি হাড়িয়া খাবে আর দুম দুম ট্যাম ট্যাম বাজনা বাজাবে। কদিন ধরে এইরকম চলবে। তারপর ওরা তির ধনুক বল্লম টাঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে দল বেঁধে। গ্রামের জঙ্গল তোলপাড় করে ফেলবে হল্লায় আর চিৎকারে। কদিন ধরে সমানে তাড়া করে বেড়াবে বুনো শুয়োর, চিতা, বাঘ, যাকে সামনে পাবে। শজারু মারবে, গোসাপ মারবে, হিংস্র অহিংস্র কোনও প্রাণীকে বাদ দেবে না। তারপর বড় একটা শুয়োর, দাঁতাল যদি হয় তো আরও ভাল, মারার পর গুষ্ঠিসুদ্ধ সবাই আয়োজন করবে এক মহাভোজের। দু’-তিন দিন ধরে চলবে তার জের। তারপর একদিন বুনো পাড়ার উত্তাল বীররক্তে ভাটা নামবে আর মেয়ে-মরদ আবার শান্ত হয়ে ফিরে আসবে সাধারণ কাজকর্মে। সুধাময় জ্ঞান হওয়া অবধি এই দেখে আসছে। এর মধ্যে কত কী ঘটে গেল দেশে, পৃথিবীর কত যে পরিবর্তন হল, কিন্তু এদের আদিম অভ্যস্ত জীবনের এক তিলও পরিবর্তন হতে দেখল না সুধাময়।
এই তো কলকাতা থেকে আসছে সুধাময়। কাল এমন সময়ও সে খরগতি কলকাতার আধুনিক জীবনস্রোতে দারুণ বেগে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর এখন? একটা নড়বড়ে বাসের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রথম শরতের শ্লথ সকালে সুধাময় আদিম মানুষের শিকারের বাদ্য শুনছে। কলকাতায় অনেক ইংরিজি সিনেমা দেখেছে সুধাময়। তার মনে হল, তারই কোনও একটায় দেখা অরণ্যবাসী আফ্রিকানদের জীবনযাত্রায় সে যেন অকস্মাৎ ঢুকে পড়েছে। দুম দুম ট্যাম ট্যাম, দুম দুম ট্যাম ট্যাম। ঠিক সেই সুর, সেই তাল। মাত্র দুশো-আড়াইশো মাইলের ব্যবধান, বড়জোর ঘণ্টা দশেকের জার্নি, তার মধ্যেই সুধাময় কেমন সভ্যতার একটা স্তর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আর-একটা স্তরে পৌঁছে গেল!
সুধাময়ের চমক ভাঙল প্যাসেঞ্জারদের চেঁচামেচিতে। ওদের মধ্যে জনা পাঁচেক লোক আঠারোখাদায়’ যাবে, কুটুমবাড়ি। এখনও পাঁচ-ছয় মাইল বাকি। একে কুটুমবাড়ি, তায় পয়সাওয়ালা কুটুম। বাস ঠেলতে গিয়ে ওদের পাটভাঙা পোশাকও কাদা মেখে লাট হয়ে গেছে। তাই গরম হয়েই ছিল। তার উপর আবার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। মানে আবার ঠ্যালো। মাথায় রক্ত চড়ে গেল একজনের।
বলি পায়েছ কী, ও মটোরওয়ালা? আবার যে ইস্টাট বন্ধ করে দিলে?
ড্রাইভার স্টিয়ারিংয়ের উপর পা-তুলে নিশ্চিন্তমনে লোহার পিন দিয়ে দাঁত খুঁটছিল। জবাব দিল না।
এই যে, ওগো, ও ডিরাইভার, কানে ছিঁচকে না ঢুকোলি বুঝি কথা প্রবেশ করে না? ড্রাইভার এবারও জবাব দিল না। দাঁত খোঁটা হয়ে গেলে পিচিত করে ছ্যাপ ফেলল। তারপর ধীরে সুস্থে পকেট থেকে চিপটে-যাওয়া কাঁচি সিগারেটটা বের করল, দুই মুড়োয় দু’বার ফুঁ ফুঁ করল, দেশলাইয়ের জন্য পকেট হাতড়াল, পেল না, কী যেন ভাবল একবার।
তারপর সুধাময়কে ডাক দিল, ও ভদ্দরলোক, আসেন দেখি ইদিক, ম্যাচ আছে?
সুধাময়ের কাছে দেশলাই ছিল না, সিগারেট-জ্বালানো কল ছিল। এগিয়ে তাই জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল।
ড্রাইভার তো অবাক।
বলল, বা বা বা, খাসা, ইডা তো ভারী জবর কল রে মশাই! পালেন কনে?
সুধাময় বলল, কলকাতায় কিনেছি।
সিগারেটে জোরে একটা টান মেরে নাক মুখ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ড্রাইভার বলল, আহা, সিগারেটের টেস্টোই বদলায়ে গেছে।
পিছন থেকে আবার গলা শোনা গেল, এই যে ময়নাপাখির বুলি ফুটিছে দেখতিছি, তা এই গভো-যন্তন্না আর কতক্ষণ ভোগ করব, ও মটোরওয়ালা?
ড্রাইভার এবার রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘাড় ফেরাল। ভালভাবে যেন প্যাসেঞ্জারদের একবার ওজন করে নিল।
গম্ভীরভাবে বলল, এ আপনাগের বাতো ঘুড়ার গাড়ি না, মটোর। সিডা ভুলে যাবেন না। এসব যন্তরের কারবার, টাইম হলি তারপরে ছাড়বে।
পিছন থেকে কে যেন ভেঙিয়ে উঠল, এঃ, মোটেই চুল নেই তার আবার চুটকির বাহার। গাড়ি চলে কই যে, তার টাইম দেখাতিছ!
ড্রাইভার এবার চটে গেল। বলল, ইডা কুন্ডু কোম্পানির গাড়ি সিডা মনে রাখবেন। কুন্ডু কোম্পানির গাড়ি চলে না, এ অপবাদ তার শত্তুরিউ দিতি পারবে না।
আহা-হা, চলার কী ছিরি রে, আদ্ধেক পথ তো ঠেলতি ঠেলতিই নিয়ে আলাম।
ড্রাইভার বলল, ইডা মোষ, না, মটোর, তাই শুনি? হাবড়ে পড়লি রাজার মটোরও ঠেলতি হয়। চড়েন তো ছ্যাকড়া, এ সব গাড়ির মর্ম বোঝবেন কী করে?
তারপর সুধাময়কেই যেন সাক্ষী মানল ড্রাইভার।
ও ভদ্দরলোক, আপনিই কন তো কলকাতার লোক কী করে? গাড়ি কাদায় পড়লি ঠ্যালে না?
সুধাময় হাসি চেপে বলল, কাদায় পড়লে হাতি ঠেলতে হয়, আর এ তো মোটর।
ড্রাইভার বলল, শোনেন, একজন বিশিষ্ট ভদ্দরলোকের কথাটা মন দিয়ে শোনেন একবার। কুন্ডুবাবু যে বলেন, মানষির উপগার করতি নেই, কথাটা ঠিক। এইসব মটোর গাড়িরউ যেটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ আছে, মানষির তাও নেই। গাড়ি যে গাড়ি, জল পেট্রোল খাওয়ালি সে-ও সে কথা ভোলে না, তার প্রিতিদান দেয়, আর দ্যাখেন মানষির ব্যাভার, নিজির স্বচক্ষি দ্যাখেন, এতখানি পথ যে-গাড়ি চড়ে আলেন এখন তারই বদনাম গাতিছেন সব। সে গাড়ি নাকি চলে না! আর চলে না তো তোগের আনল কিডা এতদূর টানে।
ড্রাইভার খুব চটেছে। সুধাময়ের মনে হল, এই অবস্থায় ছাত থেকে তার বাক্স বিছানা নামাবার কথাটা খুব মোলায়েম করে বলে ফেলবে কি না?
এমন সময় ড্রাইভার আবার মুখ খুলল।
বোঝলেন, কুন্ডুবাবু যে বলেন, মানুষ একের নম্বরের স্বাথপর, কথাডা ঠিক। নিজির সুবিধেড়া পায়ে গেলিই হল, নিজি বাড়ি পৌঁছোয়ে গেলিই হল, তারপর যা হয় হোক, থাক শালা তুই পড়ে। কী কন?
সুধাময়কে আবার সাক্ষী মানল ড্রাইভার। এবং সুধাময়কে সায়ও দিতে হল।
এই হল প্রিকিত ভদ্দরলোকের ব্যাভার। দ্যাখেন, আপনারা সবাই নিজির নিজির স্বচক্ষই দ্যাখেন।
এমন ট্যাটনের পাল্লায় আগে কখনও পড়েনি সুধাময়। বাড়ি যাবার জন্য মনটা ছটফট করছে। কৌতূহল ফেটে পড়ছে বুড়ির ছেলেটা দেখবার জন্য। বুড়ির আবার ছেলেও হল, সেই বুড়ির, সাত চড়ে যার মুখ দিয়ে রা বেরুত না। বিয়ের আগে দিনরাত যে কাঁদত। সুধাময়ের যে ছিল খেলার সাথী। সুধার থেকে ছয় বছরের ছোট বুড়ি। দু’জনে খুব ভাব। দু’বছর আগেও সুধাময় বুড়িকে দেখেছে। এখন মা হয়ে কেমন চেহারা হয়েছে? কনডাক্টর ব্যাটা এলে যে বাঁচে সুধাময়
ড্রাইভার আবার ডাকল। সুধাময়কে বলল, ভদ্দরলোক কি গাছে ফলে মশাই? ব্যাভার দেখে টের পাওয়া যায়। শুকনো খটখটে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়ায়ে আছে, জলে পড়েনি কেউ, তার মধ্যিই সব বসে আছেন, তারই ঠ্যালা এই, বচনের চোটে তিষ্ঠোনো যাচ্ছে না। সত্যি সত্যিই যদি জলে পড়ত গাড়ি তালি বোধহয় বাবুরা আমার গলাডাই টিপে ধরতেন।
পিছনের সিটগুলোয় যাঁরা বসে ছিলেন, ড্রাইভার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাঁদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। আর-একটা চ্যাপটানো সিগারেট বের করল পকেট থেকে। টিপে টুপে মেরামত করে নিয়ে দু’দিকেই বেশ করে ফুঁ দিয়ে নিল। তারপর সুধাময়কে চোখ মেরে বলল, ও ভদ্দরলোক, আপনার ওই খ্যাচাকলটা জ্বালান দেখি আরেকবার, সিগারেটটা ধরায়ে নিই।
সিগারেটটা ধরিয়ে জোরে জোরে টান মেরে নাক মুখ দিয়ে ড্রাইভার ধোঁয়া ছাড়ল গলগল করে। ডান হাতের দু’আঙুলে সিগারেট ধরা ছিল। মাঝে মাঝে তুড়ি মেরে ছাই ঝেড়ে নিচ্ছিল। বলল, জলে কি পড়ে না গাড়ি? পড়ে। কলকবজার মন তো। বোঝলেন না? এই আমার মতন পাকা লোকের হাতেও গাড়ি গিয়ে খানার জলে পড়িছে। এই সুহাগিনী ইনিই পড়িছেন। তাও বরযাত্তির বুঝাই করে। পবহাটির মজুন্দোররা বিয়ে করতি শৈলকুপোয় যাবেন। ভরা বর্ষা। ওনারা আবার কুন্ডুবাবুগের উকিল। শখ হল মটোরে করে বিয়ে করতি যাবেন। কুন্ডুবাবুরি ধরলেন, মটোর চাই। কুন্ডুবাবু আমারে কলেন, জগবন্ধু, আর কারুর উপর আমার বিশ্বেস নেই। গাড়ি আমার আরউ আছে, ডিরাইবারেরউ অভাব নেই। কিন্তু শৈলকুপোর যা রাস্তা, বিশেষ করে এই ভরা বর্ষায়, সুহাগিনী ছাড়া কারুর সাধ্যি নেই এক পা নড়ে। তুমি ছাড়া এসব রাস্তায় কেউ তো গাড়ি চালাতিই পারবে না। তা গেলাম। ফিরবার সময় সুহাগিনী খানায় গিয়ে পড়ল। বুঝে দ্যাখেন। তিন ঘন্টা আমরা এক গলা জলে বসে ছিলাম। কিন্তু কেউ টু শব্দ অবধি করিছে, কেউ বলুক তো! বোঝলেন না, ভদ্দরলোকের চিহারাই অন্যরকম। বোঝলেন, এই সুহাগিন —
তোর সুহাগিনীর নিকুচি করি।
গাড়ির দরজা ধড়াম করে খুলে পিছন থেকে জনা চারেক প্যাসেঞ্জার হইহই করে ড্রাইভারের কাছে এগিয়ে এল।
শালা, গাড়ি চালাবার নাম নেই, বসে বসে আমাগের কুষ্টি কাটতিছ! এক চড়ে বদন বিগড়োয়ে দেব।
এই গাড়ি আজ তুমার ইয়ের মধ্যি ঢুকোয়ে ছাড়ব।
কানা ছাওয়ালের নাম পদ্মলোচন। ঘাটের মড়া গাড়ি, তার নাম আবার সুহাগিনী। তোর সুহাগিনীর মুখি মারি লাথি।
সুধাময় হকচকিয়ে গেল। দেখল, এক বুড়ো ভদ্রলোক রাগে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর স্পন্দনহীন শীতল বনেটে মারলেন ধাঁই ধাঁই করে দুই লাথি। একটা ছোকরা এগিয়ে এসে পক পক করে হর্নটা বাজিয়ে দিল। দু’-তিনজনে মিলে গাড়ির বড়িকে পাগলের মতো দুমদাম থাপ্পড় মারতে লাগল। ড্রাইভারও প্যাসেঞ্জারদের এই আকস্মিক প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবাক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সে সংবিৎ ফিরে পেল। কী, তার গাড়িকে অপমান! স্টার্ট দেওয়া হ্যান্ডেলটা নিয়ে সে পর-মুহূর্তেই লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। মাথার উপর হ্যান্ডেলটা চরকির মতো বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে গেল কিছুদূর। প্যাসেঞ্জাররা সবাই একটু হকচকিয়ে তফাতে হটে গেল। ড্রাইভার প্রচণ্ড রাগে কখনও লাফাচ্ছে কখনও দাঁত কিড়মিড় করছে।
ড্রাইভারের সেই তাণ্ডব নৃত্য দেখে সবাই একটু ঘাবড়েও গেল।
কিডা আমার সুহাগিনীর মুখি লাথি মারল, মরদের বাচ্চা হলি মারুক দেখি আমার সামনে! ঠ্যাংখান এখনই খুলে নিচ্ছি। এতক্ষণ কিডা গালাগালি দিচ্ছিল আমার সুহাগিনীরি, কই, আগোয়ে আসো বাপের বিটা হও তো, মুখখানারে একটু পালিশ করে দিই।
ড্রাইভার এক একটা কথা শেষ করে আর মাটিতে ধাঁই ধাঁই হ্যান্ডেলের বাড়ি মারে। অপর পক্ষ একেবারে চুপ মেরে গেছে। এমন সময় কানে পইতে গুঁজে কনডাক্টর এসে হাজির। সে তো ‘রণং দেহি’ আবহাওয়া দেখে তাজ্জব বনে গেল।
জিজ্ঞাসা করল, বলি ব্যাপারটা কী?
কনডাক্টরকে দেখে ড্রাইভার হুংকার ছাড়ল, এই শালা পঞ্চা, গিছিলি কনে? শালার খায়ে দায়ে কাজ নেই, না দেখা না শুনা, যারে পালাম গাড়িতি তুলে বসালাম, দে, সব পয়সা ফিরোয়ে দে। কুন্ডুবাবুরি বলে এ লাইনি সার্ভিস বন্ধ করে দিতি হবে।
ক্যান, হল কী?
হবে আবার কী, তুমার মুন্ডু আমার পিন্ডি। ওই যে প্যাসেঞ্জার তুলিছ, ওনারা সুহাগিনীর মুখি লাথি মারিছেন, এই গাড়ি নাকি ঘাটের মড়া! দে, পয়সা ফেরত দে।
পঞ্চ কনডাক্টর ঘুঘু লোক। ব্যাপারটা আন্দাজ করল বলল, দাদা, দাঁড়াও। এ হল কলকবজার ব্যাপার। মাথা গরম করলিউ কাজ হবে না, তড়বড় তড়বড় করলিউ না। বুঝে নিই একটু। গাড়িটা থামতেই পেটটায় মোচড় দিল। তাই একটু বাগানে ছুটিছিলাম আর তার মধ্যিই এত কাণ্ড! যান যান, ও ভদ্দরলোকরা, জায়গা নিয়ে বসে পড়েন গে যান। গাড়ির মর্ম আপনারা কী বোঝবেন! এ হল ফোর্ড গাড়ি উনিশ শো পনেরোর মডেল। এত ভাল গাড়ি আজকাল পাবেন কনে? বয়েস হয়েছে তো, একটু মিজাজে চলে। আমাগের জগোদার মতন আর কী। এমনিতি মাটির মানুষ। রাগলি পরে মুচিগের কুকুর বলে তফাত থাকি। গাড়িটাউ তাই মিজাজ যেদিন ভাল থাকে অক্লেশে চলে, বিগড়োল তো বাস। সেই গাড়িরি কি যা-তা বলে চটাতি আছে? আসেন আসেন, এখন একটু তোয়াজ করে ঠেলেঠুলে ইস্টার্টটা করে দেন সবাই। জগোদা, তুমি উঠে বসো তুমার সিংহাসনে। তুমি হলে রাজা। ছোট কথায় কান দিলি কি তুমার চলে?
দেখতে-না-দেখতে সব গন্ডগোল মিটিয়ে দিল কনডাক্টর। সুধাময়ের তোরঙ্গ আর বিছানার বান্ডিলটা নামিয়ে দিল। তারপর প্যাসেঞ্জারদের জড়ো করে ‘হেঁইও, মারে জোয়ান হেঁইও’, ‘আউর থোড়া হেঁইও’ বলে সোহাগিনীকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল।
সুধাময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। লালচে মোটরখানা বড় বড় কড়ইগাছের ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। এখনও লোকগুলো ঠেলছে। এই স্টার্ট হল। শব্দ করে জেগে উঠল সোহাগিনী। গাড়িখানা আর দাঁড়াল না, বেশ জোরেই এগিয়ে গেল কিছুদূর। প্যাসেঞ্জাররা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে, এখনও সবাই উঠতে পারেনি। সুধাময় জানে, গাড়ি দাঁড়াবে না, দাঁড়ালেই স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাবে আবার। তাই চলতি অবস্থাতেই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে হবে গাড়িতে। এইভাবেই সুধাময় এতখানি পথ এসেছে।
বাড়ি পর্যন্ত এই প্রথম মোটর বাসে এল সুধাময়। দু’বছর আগে সে যখন কলকাতায় যায়, তখনও এই লাইনে বাস আসেনি। এবার ঝিনেদায় এসেই বাস পেল। বাসটা ঝড়ঝড়ে পুরনো— একথা সত্যি, বারবার ঠেলতে হয়েছে— তাও সত্যি, তবুও তো ঘণ্টা দেড়েকে এসে পৌঁছেছে, গোরুর গাড়িতে অন্তত চার ঘণ্টা লাগত। ঘোড়ার গাড়িতে কমপক্ষেও দু’-আড়াই ঘণ্টা।
কাঁপতে কাঁপতে কাদা ছিটকাতে ছিটকাতে চোখের আড়ালে চলে গেল সোহাগিনী। এখন আর তাকে খারাপ লাগল না সুধাময়ের। সোহাগিনী আর যাই হোক, সভ্যতার কিঙ্করী তো বটে। হোক না সেকেন্ড-হ্যান্ড।
আমরাও কি এক সেকেন্ড-হ্যান্ড সভ্যতার মধ্যে বাস করছি না এখন? হঠাৎ এ প্রশ্নটা সুধাময়ের মগজে ঠেলে উঠল। সেকেন্ড-হ্যান্ড সভ্যতা! কথাটা সে ভেবে দেখেনি তো।
ভাববার আগেই সুধাময় দেখল, নরা। ছোট্ট একটা লাঠি নিয়ে লাফাতে লাফাতে কোথায় যেন যাচ্ছিল, সুধাময়কে দেখেই এক ছুটে কাছে এসে পড়ল।
দাদাবাবু, তুমি মটোরে আলে?
সুধাময় হেসে বলল, হ্যাঁ। তুই তো দিব্যি বড় হয়ে গিয়েছিস রে!
নরা খুব খুশি হল। বলল, তুমিউ কিন্তুক খুব বাবু হয়ে গেছ।
সুধাময় হা হা করে হেসে উঠল।
বলিস কী রে?
ঠিক বলতিছি, পেত্যয় না হয় আয়নায় দেখে নিয়ো। খুব সুন্দর হইচ তুমি
সুধাময়ের খুব ভাল লাগল কথাটা। আদর করে নরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, চল বাড়ি যাই। এই বাক্সটা নিতি পারবি তুই?
নরা ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
উনিশ
এমন পাখি-ডাকা, আলো-হাসা সকালে অনেক দিন ঘুম ভাঙেনি সুধাময়ের। সে আজকাল দেরি করে ওঠে। কলকাতার এই অভ্যাসটার কাছে তার আগেকার গ্রাম্য অভ্যাস হার মেনেছে। সন্ধ্যা হতে-না-হতেই এখানে যেন রাত গভীর হয়ে আসে। ঘুম ছাড়া আর কোনও কাজই থাকে না করবার। যেমন পাখিরা, যেমন পশুরা, যেমন সেই সৃষ্টির আদিযুগের গুহাবাসী মানুষেরা রাত্রি হলেই মৃতকল্প হত, তেমনি সুধাময়ের গ্রামের লোকরাও। তাই ভোরের আলো ফুটতে-না- ফুটতে এরা উঠে পড়ে। যেন দিনের আলো ওরা একটুও অপব্যয় হতে দেবে না।
কিন্তু সুধাময়ের ঘরে, তার বিছানায় মশারির চালে আলোর প্লাবন বয়ে যেতে থাকলেও সুধার ঘুম ভাঙল না। একবার তার ঘুম ভেঙেছিল বটে। পাখির গান শুনতে পেয়েছিল, আলোর লুটোপুটিও সে ঘুম-জড়ানো চোখে এক নজর দেখে নিয়েছিল। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কলকাতা রাতকে দিন করেছে। মাঝরাতেও সেখানে ঘুম নামে না। তার বাসিন্দারা তাই যখন ইচ্ছে ঘুমোতে যায়, যখন খুশি ওঠে।
পাড়ার চায়ের দোকানে রোজকার মতোই আড্ডা জমেছে। তর্ক বেধে গেছে প্রচুর। সুধাময় দেখল, সেই আড্ডায় সে অনুপস্থিত বলে নো-চেঞ্জার ছাত্র-নেতা কুঞ্জ ঘোষাল সুধাদের একেবারে কাবু করে ফেলেছে। সি. আর. দাশের নামে যা-নয়-তাই বলে যাচ্ছে। লোকটার জিভে বেজায় ধার। কিছু আটকায় না। দাশসাহেব নাকি কর্পোরেশনের পলিটিক্সে নোংরামি ঢুকিয়েছেন। সেদিন কর্পোরেশনের সভায় তিনি যে অত বেশি ভোটে নিজের রেজলিউশনগুলো পাশ করিয়ে নিলেন, তা নাকি সেরেফ ধাপ্পা দিয়ে। বিরোধী পক্ষের কাউন্সিলারদের এক বাগানবাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিলেন দাশসাহেব। মদ আর মাগি সাপ্লাই করে দু’রাত দু’দিন তাদের আটকে রেখেছিলেন। ভোটের সময় তারা হাজির হতে পারেনি। ইস, কুঞ্জটা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ কেউ করছে না কেন? দেশবরেণ্য নেতার নামে এমন হীন কুৎসা রটনা করে যাচ্ছে লোকটা, আর সবাই তা রসিয়ে রসিয়ে শুনছে! সুধাময়ের সারা শরীর কসকস করছে রাগে। কিন্তু কী করবে সে? দেখছে সব, শুনছে সব, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারছে না। কিছুতেই পৌঁছোতে পারছে না চায়ের দোকানটায়। নাগাল পাচ্ছে না কুঞ্জটার। লোকগুলোই বা কী, ধমক মারছে না কেন লোকটাকে, পিটছে না কেন? দেখছ বেটার আস্পর্ধা!
সামনে কাউন্সিলের ইলেকশন। কুঞ্জরা এমনিভাবে কাদা ছুড়ে ছুড়ে এমন একটা দেবতাকে মলিন করে দেবে! সাধারণ লোক এইসব কদর্য মন্তব্যের প্রতিবাদ করবে না, কান ভরে শুনবে আর দাঁত বের করে হাসবে! মাথায় রক্ত উঠে গেল সুধাময়ের। বিছানায় চাঁটি মেরে চেঁচিয়ে উঠল, চোপরাও রাস্কেল। ঘুম ভেঙে গেল তার। বেশ বেলা হয়েছে। বেশ ঘেমেছে সুধাময়! আর সে ঘুম ভেঙে যেন কাবু হয়ে পড়ল। কোথায় কলকাতা আর কোথায় তার গ্রাম! কিন্তু স্বপ্ন কি এত জীবন্ত হয়?
সুধাময়ের বড্ড ফাঁকা ফাঁকা ঠেকতে লাগল। ভেবে দেখল, স্বরাজ্য পার্টির এই ইলেকশনের মুখে কলকাতা ছাড়াটা তার পক্ষে বুদ্ধির কাজ হয়নি। তাদের মতো কর্মীর প্রচুর দরকার এখন সুধাময় আর যাই হোক, উপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ফাঁকা মাঠে গোল কাউকে দিতে দেবে না।
মনটা উড়ু উড়ু হয়ে গেল সুধাময়ের
সেই ফেনাটা এরই মধ্যে থিতিয়ে এল। কলকাতায় বেশ কিছুদিন কাটিয়ে গ্রামের মাটিতে পা দেওয়ামাত্র আবেগের যে ফেনাটা বুজবুজ করে উঠেছিল সুধাময়ের মনে, চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে-না-কাটতেই সে ফেনা মরে গেল। তার ছিটেফোটা চিহ্নও রইল না কোনওখানে।
কাল যে ঘোরটুকু লেগেছিল, আজ তা কেটে গেছে। গ্রাম নিয়ে অহেতুক মাতামাতি করি আমরা। আমাদের অশেষ কাব্যি রোগের মধ্যে ওটাও একটা। সময়-কাটানো হাই তুলল সুধাময়। ভাবতে বসল।
কাল বাসওয়ালার ক্রিয়াকাণ্ডে বেশ মজাই পেয়েছিল সুধাময়। এখন মনে হচ্ছে ওটা নিছক ভাঁড়ামি। অক্ষম নাট্যকারের রচনা, অ্যামেচারি অভিনেতার পার্ট করা, সস্তা একটা কমিক সিচুয়েশন। কাল যে সুধাময়কেও ওই দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছে, ড্রাইভারের স্থুল ভাঁড়ামোকে প্রশ্রয় দিয়েছে, এখন সেজন্য বিরক্তিই লাগছে তার। বাস ঠেলে ঠেলে গায়েও ব্যথা ধরে গেছে।
কী যেন হয়েছে সুধাময়ের! খুঁতখুঁত করছে সে। সব জিনিসেই যেন খুঁত ধরতে চাইছে। কাল ঘেমে নেয়ে বাড়িতে পৌঁছোতে-না-পৌঁছোতে সবাই ভিড় করে এল তার পাশে। ঘিরে ধরল তাকে। একসঙ্গে একশো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে লাগল সবাই। এমনিভাবেই এই বাড়ি, প্রবাসী ছেলেদের অভ্যর্থনা করে। চিরকাল করে এসেছে। সুধাময়ও বাপ কাকা কিছুদিন অনুপস্থিতির পর ফিরে এলে, এমনিভাবেই আর পাঁচজনের সঙ্গে ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে, এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও। এখন তার মনে হল, এরা অনর্থক বড্ড বেশি চেঁচামেচি করে। মা এসে পাঁচ জনের সামনেই আঁচল দিয়ে তার মুখখানা ফস করে মুছে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সুধাময়ের সমস্ত স্নায়ু যেন তার প্রতিবাদ ঘোষণা করল। সুধাময় মুখে কিছু বলল না। মা তো বরাবরই এই কাজ করে, অন্ধের মতো ভালবাসে তাকে। সুধাময়ও মাকে খুব ভালবাসে। তবুও কাল, এই প্ৰথম, সুধাময়ের মনে হল, সব তাতে বাড়াবাড়িই করাই মা’র স্বভাব।
এদের স্নেহ ভালবাসার প্রকাশ এরা তারস্বরে করতে চায়। যেন পাঁচজনকে জানাতে চায়। এই যে দেখানো-ভাবটা সুধাময় যেন আর বরদাস্ত করতে পারছে না। কলকাতায় এত আদিখ্যেতা নেই।
এবার বাড়িতে এসে সুধাময় বড় অস্বস্তিতে পড়ল। যা দেখে, যা শোনে এখানে, তার মধ্যেই কলকাতা এসে ঝামেলা বাধায়। কলকাতায় তো এমনটি নেই। কলকাতায় তেমনটি হয় না তো। কলকাতায় থেকে যা বুঝতে পারেনি, গ্রামে এসে তা বুঝল সুধাময়, কলকাতা ছাড়া তার গতি নেই। এই গ্রামের আকাশে বাতাসে জলে যে পুষ্টি ছিল, সুধাময়ের জীবন নিঃশেষে তা শুষে নিয়েছে। গ্রামে তার জন্য আর অবশিষ্ট কিছু নেই। তার বাকি জীবনের, তার বয়স্ক দেহমনের রসদ যদি কেউ এখন সরবরাহ করতে পারে সে কলকাতা।
ঘরে শুয়ে শুয়ে সুধাময় এসব চিন্তা করছিল আর অন্যমনস্কভাবে সিগারেট-লাইটারটা জ্বালাচ্ছিল আর নেবাচ্ছিল। সিগারেট খাবার জন্য মনটা আঁকপাঁক করছিল, সে ভাবছিল, ব্যাপারটা সমীচীন হবে কি না? বাড়ির কারও তো তেমন কাণ্ডজ্ঞান নেই, প্রাইভেসি-বোধও নেই। হয়তো বাবা কিংবা পিসিমা হুট করে ঢুকে পড়বেন। তার চেয়ে থাক এখন, বেড়াতে বেরিয়েই খাবে বরং।
.
গিরিবালার বাচ্চাটা জোরে কেঁদে উঠতেই সুধাময় চমকে উঠল। ভাবনা চিন্তা ছিঁড়ে গেল কিছুটা।
কী গলা হয়েছে ছেলের, একেবারে শঙ্খের মতো। উপমাটা মনে পড়তেই লাফিয়ে উঠল সুধাময়! শঙ্খ! হ্যাঁ, এই তো ভাল একটা নাম পাওয়া গিয়েছে। কাল বড্ড নাম-নাম করছিল বুড়ি। বেশ নাম পাওয়া গিয়েছে। শঙ্খ।
সুধাময় ডাক দিল, বুড়ি, এই বুড়ি, শোন শিগগির, এদিকে আয়।
গিরিবালা এল। চাঁপা এল।
সুধাময় বলল, দেখ বুড়ি, তোর ছেলের জন্যে একটা ভাল নাম পেয়েছি, শঙ্খ। কেমন নাম?
গিরিবালা তো অবাক। শঙ্খ! ওটা বুঝি খুব ভাল নাম হল?
আর তা ছাড়া, সুধাময় বলল, কেমন মিলে যাবে তোর ছেলের স্বভাবের সঙ্গে। এইমাত্র ওঘরে কেঁদে উঠল তো। আমি এঘর থেকেই চমকে উঠলাম। ঠিক শঙ্খের আওয়াজের মতোই গলা তোর ছেলের, বুঝলি? তাও যে-সে শঙ্খ নয়, একেবারে পাঞ্চজন্য।
সুধাময়ের কথার ঢং একেবারে বদলে গেছে। অন্তত গিরিবালার তাই মনে হল। দাদা আর সে দাদা নেই। একেবারে অন্য দেশের লোক হয়ে গেছে যেন। চেহারা অনেক চৌকশ হয়েছে, বেশভূষা অনেক প্রখর। আর কথা, কী যে বলে বড়দা, কী যে বলল কাল, তার অনেক মানেই বুঝতে পারেনি গিরিবালা। যেমন এখন পারল না। সুধাময় কি তার ছেলেকে বিদ্রূপ করল? নাকি ভালবেসে শঙ্খ বলল? ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না গিরিবালা।
সুধাময় অনেক দিন পরে বাড়ি ফিরল। কাল যখন বাড়িসুদ্ধ সবাই ওকে নিয়ে মাতামাতি করছে, তখন হঠাৎ গিরিবালার মনে হল, সুধাময় যেন তার মধ্যে নেই। কেন যে এমন ধারণা হল তার, তা সে জানে না। সুধাময়ের ত্রুটিটা কোথায় তাও সে ধরতে পারেনি। জেঠামশায়, বাবা, পিসিমা, বড়মা, কাকিমাকে প্রণাম করেছে সুধাময়, গিরিবালাকেও কুশল-প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে, চাঁপাকে আদর করেছে, গিরিবালার খোকা দেখে তারিফ করেছে, সবই করেছে সুধাময়। তবুও— তবুও কোথায় যেন অদৃশ্য একটা ফাঁক, সূক্ষ্ম একটা ব্যবধান রচনা করে রেখেছিল। সব কিছুর ওজন যেন ঠিক থাকে, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রেখেছিল সুধাময়। বাড়িসুদ্ধ সবাই যে-ধানের চাল, সুধাময়ও সেই ধানেরই চাল। তবে ওরা সবাই যেখানে ঢেঁকিছাঁটা, সেখানে শুধু সুধাময়ের ছাঁটটাই যেন কলের।
হঠাৎ সুধাময়ের খেয়াল হল, গিরিবালা তো কিছু বলল না।
কী রে, নামটা পছন্দ হল না বুঝি?
চাঁপা টুক করে বলে উঠল, যে ছিরির নাম তার আবার পছন্দ! মানষির নাম আবার শঙ্খ হয় নাকি?
চাঁপার বাচালতায় সুধাময় মনে মনে চটে উঠল। এই হল গ্রামের কুশিক্ষার একটা নমুনা।
তবু সুধাময় রাগ দেখাল না। চাঁপাকে বেশ সংযত হয়েই উপদেশ দিল, ছি চাঁপা, গুরুজনের মুখের ওপর ওভাবে কথা বলতে নেই।
চাঁপা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, তুমি কি আমার শ্বশুর যে গুরুজন হবা? বাড়ির লোক আবার গুরুজন হয় নাকি?
এই আচমকা প্রশ্নে সুধাময় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। গিরিবালা আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসিতে কলে-ছাঁটা সুধাময় সাময়িকভাবে পিছু হঠল। পুরনো সুধাময় এগিয়ে এসে প্রাণখোলা হাসিতে ঘর প্রায় ফাটিয়ে ফেলল।
হাসতে হাসতে সুধাময় বলল, ঠিক, ঠিক, ভুলেই গিয়েছিলাম। তা নেবে থোবে কী?
চাঁপা এবার চটে গেল।
বলল, ছোটগের সঙ্গে ইয়ারকি করলি বুঝি দোষ হয় না, না?
দুমদাম পা ফেলে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সুধাময়কে অমন প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখে গিরিবালার বুক থেকে একটা ভার যেন নেমে গেল। একটা যন্ত্রণার যেন উপশম হল। সত্যি, চেনা লোকের মন বুঝতে না-পারার মতো যন্ত্রণা আর নেই। গিরিবালা খুব খুশি হল।
সুধাময় জিজ্ঞাসা করল, কী রে বুড়ি, কথা বলিসনে যে? নামটা বুঝি পছন্দ হল না তোর?
গিরিবালা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না দাদা, খুব পছন্দ হয়েছে। বেশ নাম, সুন্দর নামটা।
সুধাময় খুশি হল।
বলল, এসব কলকাতার নাম। তোদের বিষ্ণুপদ কি ষষ্ঠীচরণ নয়। বুঝলি?
গিরিবালা প্রতিবাদ না করে হাসতে লাগল। দাদার এ ভাষায় মারপ্যাঁচ নেই। একথা গিরিবালা বোঝে!
সুধাময় বলতে লাগল, তোর ছেলে হবার খবর বড়মার চিঠিতে পাওয়া ইস্তক আমার অদ্ভুত লেগেছে। আমাদের সেই বুড়ি, সে আবার মা-ও হল! আমি তো ভেবেছিলাম, প্রায় বড়মার মতোই দেখতে হয়েছিস বুঝি। কিন্তু কই, তোর তো কিছুই বদলায়নি রে।
গিরিবালা এবারও কথা বলল না, শুধু হাসতে লাগল। চাঁপা মুখ ভার করে এসে দাঁড়াল।
বলল, কারুর যদি খিদে লাগে থাকে তো সে য্যান মুখি চোখি জল দিয়ে রান্নাঘরে যায়। বড়মা কয়ে দিল।
সুধাময় চাঁপাকে ভেঙিয়ে বলল, আর কারও যদি লাল ফিতের দরকার থাকে তো সে যেন’ আমাকে এক ঘটি জল এনে দেয়।
অমনি চাঁপার মানভঞ্জন হয়ে গেল। সুধাময়ের হাঁটু ধরে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগল, ও দাদা, আনিছ নাকি ফিতে? সত্যি আনিছ? আমারে ছুঁয়ে কও। আমসত্ত্ব খাবা? তেঁতুলির আচার? পিসিমা পিঠে গড়তিছে, আনে দেব?
চাঁপার কাণ্ড দেখে গিরিবালা হাসি আর চাপতে পারে না।
বলল, জল চালো দাদা, আগে সেইডেই আনে দে, তারপরে না হয় স্বগোড়াই ধরে দিস।
চাঁপা খরখর করে উঠল, আমার কথায় তুই ফোড়ন কাটিস ক্যান ক’ দিনি? আমি কি তোর পাকা ধানে মই দিইছি?
.
চাঁপা জল আনতে গেল। হঠাৎ কী খেয়াল হল গিরিবালার, ও-পাড়ার মামাবাড়িটায় একটু বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছে করল। কতদিন যে যায়নি! আবার কবে হুট করে চলে যেতে হবে। বড়মামিকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে বড়। আসলে ওটা সুধাময়েরই মামাবাড়ি। গিরিবালা সুধাময়কে বলল, যদি আজ নিয়ে যায় সুধাময় তো বড় ভাল হয়।
নিয়ে যাবা, ও দাদা? তা’লি খাওয়াদাওয়া সারেই বেরোয়ে পড়বানে।
সুধাময় রাজি হল। ভালই হল, সে-ও তো সেই কবে গিয়েছিল মামার বাড়ি, তারও এই সঙ্গে দেখাটা হয়ে যাবে। তা ছাড়া করবার মতো একটা কাজও পাবে সে। বাড়িতে এসে কিছুই তো করার থাকে না।
.
দুর্গাবাড়িতে ঘরামি লেগেছে। চাল ছাওয়া হচ্ছে। তার মানে পুজোর বার্তা এসে গেছে। এবার পুজো আশ্বিনের মাঝামাঝি। গিরিবালা থাকবে না তখন। বিয়ের পর একবার মাত্র বাপের বাড়ির পুজো দেখেছে গিরিবালা। তার শ্বশুরবাড়ির দেশে দুর্গোৎসব নিয়ে অত মাতামাতি হয় না। সেখানকার প্রধান উৎসব দোল।
গিরিবালা ফাঁকা মণ্ডপটা দু’চোখ ভরে দেখে নিল। ঠাকুরের সিঁদুর-মাখানো পাটটা একপাশে পড়ে আছে। ঘরের মেঝেয় বিস্তর ইঁদুরের গর্ত হয়েছে। গর্তগুলোর মুখে মাটি উঁচু উঁচু হয়ে আছে। তার উপর চাল থেকে খসা খড়, বাতার টুকরো, দড়ি ঝুর ঝুর ঝরে ঝরে পড়ছে। গিরিবালা ফাঁকা মণ্ডপে গড় হয়ে প্রণাম করল। এ পাশে ভাঁড়ার, তার লাগোয়া পিছনেই ঢাকিদের ঘর। এখনও একটা ঢাক মটকায় বাঁধা আছে। ঢাকিদের ঘরের পিছনে গাব আর কামরাঙাগাছ। সবুজ কামরাঙাগুলো এলোমেলো বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কামরাঙাগাছের তলা দিয়ে হাঁটলে এখনও জিভে জল ভরে আসে গিরিবালার।
চারিদিকে আমের বাগান। মণ্ডপের জমিটা সুধাময়দের, তবে দুর্গামণ্ডপটা বারোয়ারি। এ আমের বাগানও সুধাময়দের। মণ্ডপের পিছনেই গন্ধ আমের গাছ। সামনে রাস্তার ধারের গাছটার নাম চুকুড়ে। চিনিটোরা, টুকটুকে, চাপলে, গন্ধ হলুদ, নাইতোলা আমের গাছগুলোয় যেন খুশির মাতন শুরু হয়েছে গিরিবালাদের দেখে। কতদিন পরে আবার ওদের কাছে সে এল! যে গাছটার দিকে গিরিবালা চায় সেটাই যেন ডালপালা দুলিয়ে গিরিবালাকে ইশারায় ডাকে। ও বুড়ি, ও বুড়ি, কুথায় ছিলি রে এতদিন? মণিরে কত বড্ডা হয়ে গেছ! আসো আসো, আমার ছায়ায় এটটু আসে বসো।
গিরিবালার কানে যেন মানুষের স্বরেই সেই ডাক গিয়ে পৌঁছায়, সত্যিই তো, সে কোথায় ছিল এতদিন! যখন সে ছিল সেই ছোট্ট মেয়েটি, তার দাদার হাত ধরে আম কুড়োতে আসত। তার সেই কচি কচি পায়ের দাগ বুঝি আমগাছের ঝরা পাতার বুক থেকে এখনও মুছে যায়নি। শুকনো পাতার মর্মরে এখনও বুঝি সেই ধ্বনি বেজে উঠবে কোনওখান থেকে।
ঘোর লেগে গেল যেন গিরিবালার মনে। আম কবে শেষ হয়ে গিয়েছে! কিন্তু গিরিবালা যে স্পষ্ট শুনল, ঢিপ করে শব্দ হল চাপলে গাছের নীচে। ও যে পরিষ্কার দেখল আমটা নিয়ে কাড়াকাড়ি বেধে গেল এক আট বছরের মেয়ে আর ষোলো বছরের দাদার মধ্যে? কে ওই মেয়েটা? বুড়ি না? বুড়িই তো। বুড়ি না হলে অমন সরেশ চোখ আর কার হবে, অন্ধকারের মধ্যে গাছতলায় আম আর কার চোখে পড়বে? শেষ পর্যন্ত অবশ্য দাদারই জিত হবে। বুড়ি তা জানেও। দাদার হাতে ব্রহ্মাস্ত্র আছে যে, বেশি ঝগড়া করতে সাহস পায় না সে। সে জানে, একটু তেড়িবেড়ি করলেই দাদা তাকে সেই বিজন বনে গাছতলায় দাঁড় করিয়ে রেখে সড়সড় করে গাছে উঠে পড়বে। একা একা সেখানে, বাপ রে, কী ভয় ভয়, মরেই যাবে বুড়ি। তাই সব সময় তাকেই আপস করে চলতে হয়। বড় ভাগটা সব সময়েই দিতে হয় দাদাকে।
সেই বুড়ি ধীরে ধীরে কেমন করে গিরিবালা হয়ে উঠল! পরের বাড়ির বউ হয়ে গেল! ছেলের মা হল! কী সব আশ্চর্য প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে এমন সব রূপান্তর ঘটল! ব্যবধান রচিত হল গিরিবালা আর বাহিরের মধ্যে! কতকাল সে এমন খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ায়নি! মনটা এমনভাবে খোলা হাওয়ায় মেলে ধরতে পারেনি কতকাল! কত অজস্রবার এই আমের বনে এমনি করে হাওয়ার মাতন লেগেছে, শুরু হয়েছে পাতার নাচন ডালে ডালে, মেঘের ছায়া ঘন হয়ে গাছের নীচে জড়ো হয়েছে, এই কয় বছরে তার কোনও হিসেবই রাখেনি গিরিবালা। তবে কি তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, নাকি কোনও কারাগারে বন্দিনী হয়ে ছিল গিরিবালা?
তুই কী রে দিদি?
চাঁপার ডাকে গিরিবালার ঘোর কেটে গেল।
হাঁ করে দেখতিছিস কী? দ্যাখো দিনি মেয়ের কাণ্ড! এতক্ষণ আমরা যে পৌঁছোয়ে যাতাম।
সুধাময় বলল, একটু পা চালিয়ে চল বুড়ি, বাজনা শুনছিসনে, শুয়োর মারতে বেরিয়েছে সদ্দাররা, বেলাবেলি ফিরে আসতে হবে।
.
পা চালিয়ে ওরা যখন মামাবাড়ি পৌঁছোল, তখনও বেশ বেলা আছে। কিন্তু মামাবাড়িতে যে কাণ্ড ঘটছে তখন, তা দেখে ওরা হতভম্ব হয়ে গেল।
সে-বাড়িতে পা দিয়েই ওরা দেখতে পেল, মামাতো ভাইদের মধ্যে রীতিমতো লড়াই বেধে গিয়েছে। বড়মামার দুই ছেলে গদা আর পদা, দু’জনেই দারুণ গোঁয়ার। গদা বোধহয় একটু আগেই পদাকে মেরেছে লাঠির বাড়ি। পদার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। সেই অবস্থাতেই পদা কোত্থেকে বিরাট এক খাঁড়া এনে বনবন করে ঘোরাচ্ছে পাগলের মতো।
আর হুংকার ছাড়ছে, কুথায় গেল ও শালা! আজ ওরে কাটে দু’ ভাগ করব। ভাবিছ, পদার রক্তপাত করে পালায়ে বাঁচবা! যেখানেই থাক, জলে স্থলে কি অন্তরীক্ষে, সেখেনের থে টানে আনে তোরে আজ দু’খান করব।
গদার বউ তাই দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
ওগো কে কুথায় আছ, শিগগির আসো গো, আমার সুয়ামিরি কাটে ফেলল গো।
চোপ মাগি! পদা একলাফে গদার ঘরের সামনে লাফিয়ে পড়ল।
তোর গলাই তালি দু’ফাঁক করব।
চক্ষের নিমেষে গদার বউ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিয়ে গোঙাতে লাগল।
বড়মামির দু’পায়ে বাত। ঘর ছেড়ে নড়তে পারেন না। ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে দরজার গোড়ায় এসে চৌকাঠে মাথা খুঁড়ছেন আর ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, ও গদা, ছোট ভাইয়ের মাথায় বাঁশটা মারার আগে আমারে মারলিনে ক্যান? ও পদা, খাঁড়ার কোপটা আমার গলাতেই আগে বসা। ওরে, আমিই তো আসল দুষি? তোগের যে এই গভে ধরিছি। ভগবান, এত লোকেরে ন্যাও, আমি তুমার পায়ে কী দোষ করিছি!
উঠোনের একপাশে থ মেরে দাঁড়িয়ে পড়েছে সুধাময়, গিরিবালা আর চাঁপা। সুধাময় নিশ্চল হয়ে গিয়েছে, গিরিবালার বুক ঢিপঢিপ করে কাঁপছে, চাঁপার মুখ চোখ চুপসে গেছে ভয়ে। চোখ কান বুজে দাদাকে চেপে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে।
ওরা দেখল, বড়মামি মাথা ঠুকতে ঠুকতে কপাল ফাটিয়ে ফেললেন। পাগলের মতো কেঁদে কেঁদে চেঁচাতে লাগলেন, মারে ফ্যাল, মারে ফ্যাল, ওরে শত্তুররা, আগে আমারে মারে ফ্যাল। আমি তোগের মা, আমি বলতিছি আগে আমারে মারে তারপর তুরা কাটাকাটি কর।
পদা মাকে ধরতে যাচ্ছিল, এমন সময় দূর থেকে গদার গলা পাওয়া গেল।
কী, খাঁড়া দিয়ে কাটবে, দেখি কত বড় খাঁড়াওয়ালা?
পদাও হুংকার দিয়ে উঠল, এই দেখ তবে। বলেই গদার দিকে ছুটল।
সুধাময় বলল, বুড়ি, চল।
বলেই বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। একটুখানি এগিয়েছে কি অমনি মামাবাড়ির দিক থেকে ‘বাবা গো’ বলে কার যেন বুকফাটা চিৎকার শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে মড়াকান্না উঠল। চাঁপা ও মুখ গুঁজে পড়ে গেল রাস্তায়।
সুধাময় বলল, কী হল রে বুড়ি?
গিরিবালা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, ফিট হয়ে গেছে।
সুধাময় বিরক্ত হয়ে ধমক দিল, কাঁদিসনে ফ্যাঁচ ফ্যাচ করে, আচায্যি-বাড়ি চল, ওর চোখে মুখে জল দিইগে।
কেন যে মরতে এসেছিল মামাবাড়ি।
.
আচায্যি-বাড়ির ফেদি বসে বসে কাঁথা সেলাই করছিল। ওদের এমন করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে সে অবাক হয়ে উঠল।
গিরিবালা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ফেদিদি, শিগগির জল আনো। চাঁপা ফিট হয়ে গেছে।
চাঁপার জ্ঞান ফিরেছিল সঙ্গে সঙ্গেই। ফেদি ওকে এক বাটি দুধ খাওয়াল। চাঁপা চাঙ্গা হয়ে উঠল।
ফেদি অবাক হয়ে গিয়েছিল এদের দেখে। কতদিন দেখেনি ওদের। ফেদির বিয়ে হয়েছে তিন বছর। দু’বছর সে বিধবাই হয়েছে। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলায় যখন এসেছিল ফেদি, তখন একদিন দেখতে এসেছিল গিরিবালা। তার তখনও বিয়ে হয়নি। চাঁপা কতটুকুই বা ছিল! এই যে সুধাদা, আজ একেবারে জোয়ানমদ্দ হয়ে উঠেছে, এই সুধাদাকেও এত বড় কখনও মনে হয়নি ফেদির। আজ তো বেশ লজ্জা-লজ্জাই লাগছে।
গ্রামের মধ্যে সুন্দরী বলে খুব নাম ছিল ফেদির। সত্যিই সে খুবই সুন্দরী। অমন গড়নপেটন, অমন গায়ের রং, অমন মুখ চোখ বড় একটা সহজে চোখে পড়ে না। শ্বশুরবাড়িতে বিয়ের পর যখন গেল ফেদি, যেন মহারানি এলেন এমন খাতির। কিন্তু বছর না ঘুরতেই কপাল পুড়ল তার, সিঁথির সিঁদুর, শাঁখা, লোহা— এয়োতির সমস্ত চিহ্ন ঘুচিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এল ফেদি। এক ফুঁয়ে কে যেন ভাগ্যের প্রদীপ নিবিয়ে দিল। জীবনটাও যদি নিবিয়ে দিতে পারা যেত!
ফেদি অবাক হয়ে গিরিবালাকে দেখতে লাগল। কী অদ্ভুত সুন্দরই না দেখতে হয়েছে এখন অথচ বিয়ের আগে এমন আহামরি কিছু ছিল না। ছোটবেলা থেকে ফেদি ওকে দেখেছে। একসঙ্গে খেলা করেছে, পুজোবাড়িতে। খেলেছে সুধাদার সঙ্গেও। তবে সে সব তো আর-এক জন্মের কথা। তখন এই বুড়ি, আজ যে নতুন মাতৃত্বে লাবণ্যবতী, তার তখন এমন ঢলঢল রূপ ছিল নাকি? ছিল তো রোগা; কাঠ-কাঠ, সামনের দাঁত ক’টা একটু উঁচুই ছিল বরং। সেই বুড়ি এখন মা হয়ে যেন জগদ্ধাত্রীর রূপ নিয়ে এসেছে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। এই রূপই সার্থক। সে কথা গিরিবালাকে দেখে ফেদির আজ মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও ভাবল, তার জীবনে এ সার্থকতা কখনও আসবে না। কখনও না। ঈর্ষা ফেদির বুকে এক ছোবল বসাল। পরক্ষণেই লজ্জা পেল সে। কী নীচ মন তার! দুঃখ পেল।
তাড়াতাড়ি ফেদি বলে উঠল, যেন কৈফিয়ত দিল, রোজ ভাবি, তোর খুকারে দেখতি যাব, তা ভরসা তো পাইনে। এ রাক্ষসীর চোখি বিষ, তাই পুড়া মুখটা যতটা পারি শুকোয়ে রাখি।
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ফেদি। ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। গিরিবালার নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হতে লাগল। যেন ফেদি বিধবা হয়েছে, সে অপরাধ তার। ফেদির ছেলেপুলে হয়নি, গিরিবালার হয়েছে, এর জন্যও যেন সে-ই দোষী। গিরিবালার মনটা খচখচ করতে লাগল। গিরিবালা মনে মনে খুব কষ্ট পেল ফেদির কথা স্মরণ করে। বোকার মতো বসে থাকল। পরক্ষণেই খোকার কথা মনে পড়তে মন তার চঞ্চল হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ দেখেনি তাকে, এতক্ষণ আর কখনও তাকে ছেড়েও থাকেনি। এবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেই হয়।
সুধাময় খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ভাবছে। ভাবছে গদা-পদার কথা। তারই মামাতো ভাই। কিন্তু আচার আচরণ দেখলে নরভুক আদিম মানুষ ছাড়া আর-কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না। কেমন স্বচ্ছন্দে হানাহানি করে চলেছে। যেন এরা সব অরণ্যচর। আদিম প্রস্তরযুগের ভয়াল সব মানুষ গ্রামে সভ্যতা নেই। এখানে দুম দুম বাজনা বাজিয়ে এখনও পশুশিকার চলে। ভাই ভাইয়ের মাথা লক্ষ্য করে খড়্গ তোলে অনায়াসে।
সুধাময়ের হঠাৎ কেমন যেন মনে হল, সে যেন ষোলো-সতেরো শতকের এক বিদেশি পর্যটক। সভ্যতার বার্তা বয়ে এসে পড়েছে অনাবিষ্কৃত কোনও ভূখণ্ডে। না না, এ গ্রামের লোক নয় সে। এ দেশেরই লোক নয়। তার দেশ সেই দেশ, যেখানকার মাটিতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, রামকৃষ্ণদেব, বিবেকানন্দের স্পর্শ মিশে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সেখানে ভাস্বর। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের প্রতিদিনের নিশ্বাসে নতুন প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে। জ্ঞানে বিজ্ঞানে, আধুনিকতায়, অগ্রগতিতে সে দেশ পৃথিবীর যে-কোনও আলোকপ্রাপ্ত প্রান্তের সমগোত্রীয়। এখানে প্রাণ খুলে সে কথা বলতে পারে না। এ দেশের ভাষা সে জানে না। তার কথা কাউকে সম্ভবত বোঝাতেও পারবে না। ওর ভাষাও এখানে কেউ বুঝবে না।
সুধাময়ের মনে প্রবল এক অস্থিরতা দেখা দিল। যত শীঘ্র পারে, সুধাময় আপন দেশে ফিরে যাবে। সেখানে এক মুহূর্ত সে আলস্যে কাটাতে পারে না। অজস্র কাজ তার জন্য পড়ে আছে। এতক্ষণ কত কাণ্ড ঘটছে কলকাতায়! শোভাযাত্রা বের হচ্ছে। পার্কে পার্কে সভা-সমিতির আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। মডারেট, স্বরাজ্যদল আর ‘নো-চেঞ্জারের’ মধ্যে পাঞ্জা কষাকষি শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনে কাউন্সিলের ইলেকশন। দেশবন্ধুর তেজোদৃপ্ত আওয়াজ এত দূর থেকেও যেন শুনতে পাচ্ছে সুধাময়, “আমরা কাউন্সিলে ঢুকছি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য নয়, ভিতর থেকে গুঁতো মেরে ওদের শাসনতন্ত্র ভেঙে দেবার জন্য।”
চলো দাদা, বাড়ি যাই।
গিরিবালার কথায় চমক ভাঙল সুধাময়ের। চেয়ে দেখল আচার্যি-বাড়ির দাওয়ায় বসে বাঁশের খুঁটি হেলান দিয়ে জেগে জেগেই কলকাতার স্বপ্ন দেখছে।
গিরিবালার কথা শুনে ফেদিও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। দেখলেই মনে হয় এতক্ষণ কাঁদছিল ফেদি। বড় বড় গভীর চোখ দুটো এখনও টলমল করছে। নাকের ডগাটা পাকা করমচার মতো রাঙা হয়ে উঠেছে।
ফেদি বলল, কালই যাব তোর খুকা দেখতি, বুঝলি?
গিরিবালা একটু থতমত খেয়ে বলল, আচ্ছা।
.
বাড়ি ফিরেও সুধাময় স্বস্তি পেল না। ঘুরল ফিরল সুধাময়, জোর করে একবার আগের মতো মেলামেশা করতে গেল বাড়ির লোকজনের সঙ্গে। রান্নাঘরে গিয়ে বসল মাছভাজা খেতে অমনি সেটা ওর নিজের কাছেই কেমন আদুরে-গোপালপনা ঠেকল। খুনসুটি করতে গেল গিরিবালার সঙ্গে, কেমন ন্যাকামি-ন্যাকামি লাগল। বাবার কাছে বসতে ইচ্ছে হল না। বাবার কাছে বিশেষ ভিড়তেই চায় না সুধাময়। পড়া আর পরীক্ষার কথা ছাড়া অন্য কোনও কথা বাবার সঙ্গে বলা যায় না। বাবা সংসারের শোচনীয় দুরবস্থার কথা তুলে স্পষ্টই বলেন, সমস্ত সংসার এখন সুধার মুখ চেয়ে বসে আছে। সুধা যেন পাশটা ভালভাবেই করে। কথাটার মধ্যে মিথ্যে কিছুই নেই। তবু সুধাময়ের যেন ভাল লাগে না। তাই বাবার ঘরের দিকে মাড়াল না সে। না, মা-পিসিমার কাছেও নয়। দু’-একবার গিরিবালার ছেলেটাকে নেড়েচেড়ে আদর করতে গেল, একটুও ভাল লাগল না। বাড়ির বের হতেও আর ইচ্ছে নেই তার। মামাবাড়ি গিয়েই যথেষ্ট আক্কেল হয়েছে।
সন্ধে হল, রাত হল। সন্ধে আর রাতে এখানে তফাত বিশেষ নেই। মেজকর্তা বাড়ি ফিরতেই সুধা যেন বেঁচে গেল। এই একটা লোক বাড়ির মধ্যে এখনও আছেন, যাঁকে দেখলে সুধাময় খুশি হয়। যাঁর সঙ্গে সে কথা বলে সুখ পায়।
কাল মেজকর্তার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তার সুযোগ হয়নি। আজও সারাদিন বড় ব্যস্ত ছিলেন। এখন সুধাকে পেয়ে যেন বর্তে গেলেন। পরম আগ্রহে মেজকর্তা সুধাময়ের মুখে কলকাতার সব খবরাখবর শুনতে লাগলেন। কাউন্সিলের ইলেকশনের কথা, কংগ্রেসের মধ্যে মতভেদ, স্বরাজ্য পার্টির পত্তন, তাদের কর্মসূচি সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগলেন। সব কথার ভাল জবাব দিতে পারল না সুধাময়। অত খুঁটিয়ে, অত তলিয়ে সে কোনও ব্যাপার দেখতে পারে না। বিভিন্ন সময়ে সুধাময়ের মনে নানা ধারণা গড়ে ওঠে। সেই সব ধারণার প্রতিফলন সুধাময় যেখানে দেখে, যখন দেখে, যে কাজের মধ্যে দেখে, তার মধ্যেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মন-প্রাণ ঢেলে দেয় সে সে-কাজের মধ্যে।
দেড় বছর আগে, দেশে যখন অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল, অফিস কাছারি, ইস্কুল কলেজ বর্জনের হিড়িক জেগেছিল, সুধাময় তখন সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল। সে তখন সরকারি কলেজের ছাত্র। দেশপ্রেম দেখাবার এতবড় সুযোগ সে কিন্তু কাজে লাগাতে পারেনি। বাদ সেধেছিলেন মেজকর্তা। এই নেতিবাচক আন্দোলনের তিনি বিপক্ষে ছিলেন। সেই সময় সুধাময়কে সামলাতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। মেজকর্তা তখন বলেছিলেন, মূর্খ লোক স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারে না। বলেছিলেন, স্বাধীনতা অন্তরের জিনিস, কোনও বাইরের সামগ্রী নয়। হইহই করে বড়জোর রাষ্ট্রীয় পতাকা বদল করা যায়। ইউনিয়ন জ্যাকের বদলে তেরঙা ঝান্ডা সরকারি দপ্তরের মাথায় উড়ানো যায়, কিন্তু লোককে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করা যায় না।
এই সময় মেজকর্তা এক কড়া চিঠি লিখেছিলেন সুধাময়কে। লিখেছিলেন, যে-সব নেতা মনে করেন, গান্ধী-টুপি মাথায় দিয়ে ঝান্ডা ঘাড়ে করে বন্দেমাতরম্ বলে ঘুরে বেড়ানোতেই দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা—সে সব নেতার কথায় আমার শ্রদ্ধা নেই। তারা অত্যন্ত অদূরদর্শী, সংকীর্ণমনা। আমি মনে করি, একজন ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন এই রকম দশটি নেতার চেয়েও বেশি। তুমি যদি সাময়িক উত্তেজনায় তোমার কর্তব্য পালন করতে অপেক্ষাকৃত শ্রমসাধ্য পথটি ছেড়ে গড্ডলিকার সহজে স্রোতে গা ভাসাতে চাও তা হলে শেষ পর্যন্ত দেশের ক্ষতিই করবে বেশি। যে ভাবোচ্ছ্বাসকে তুমি প্রবল বলে মনে করছ, তার পিছনে সত্যিকারের কোনও শক্তি নেই, তা মহাসাগরের ঢেউ নয়, ফেনা মাত্র। ও একদিন শুকিয়ে যাবে।
সুধাময় এর পর আর কলেজ অবশ্য ছাড়েনি। কিন্তু দুটি বছর চোরের মতো অপরাধী হয়ে ছিল। তার সহপাঠী বন্ধুরা একে একে বুক ফুলিয়ে বন্দেমাতরম্ বলে কলেজ ছাড়ত আর তাদের অব্যক্ত ধিক্কারে সুধা যেন মরমে মরে যেত। শুধু যেদিন কলেজের সামনে পিকেটিং হত, সেদিন আর সে ক্লাসে ঢুকতে চেষ্টা করত না, পালিয়ে যেত। রাগ হত তার নিজের উপর। রাগ হত তার মেজকাকার উপর। যেন মেজকাকার এইসব ওজর কোনও আদর্শের জন্য নয়, যে টাকা সুধার পিছনে ওঁরা ঢালছেন সেটার নিরাপত্তা রক্ষা করাই ওঁদের আসল উদ্দেশ্য। মানসিক দ্বন্দ্বে এই দুটো বছর সুধাময় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। তার মতো যন্ত্রণা তার অন্য কোনও সহপাঠী পায়নি।
তারপর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে দেখল সুধাময়। সত্যিই আন্দোলন একদিন মুখ থুবড়ে পড়ল। আর উঠল না। যে সব নেতা হাত ধরে টেনে টেনে তাঁদের কলেজের ছাত্রদের পথে বের করেছিলেন, তাঁরা আবার নিয়মিত জীবনে ফিরে গেলেন। তার সহপাঠীদের অনেকে আবার ফিরে এল কলেজে। দুটো বছর খামোকা নষ্ট হওয়ায় ইনিয়ে-বিনিয়ে অনুতাপ করতে লাগল। এমনকী এও বলল, তুই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিস সুধা।
সুধার কেমন অবাক লেগেছিল। মেজকাকার কথা এমন ভাবে ফলে যাবে সে কখনও ভাবেনি। কিন্তু যখন ফলল তখন মেজকাকার বিচারবুদ্ধির উপর গভীর শ্রদ্ধা বাড়ল তার। আবার মনের খুব গোপনে যেন খুব দুঃখও পেল। যেন এমন না হলেই সে খুশি হত। তার কলেজের ছোকরা ইংরেজ প্রফেসরেরা এই ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রূপ করত আর সুধাময় জ্বলেপুড়ে মরত। এদের হাত এড়াবার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠল।
হঠাৎ সে একদিন শুনল, দেশবন্ধুর নতুন সংগ্রাম-পদ্ধতির কথা। কাউন্সিলের ইলেকশন আর বর্জন নয়, এবারে গ্রহণ— কাউন্সিলে ঢুকে ইংরেজের কেশর ধরেই নাড়া দিতে হবে। ভারত- শাসন-আইন অকেজো করে দিতে হবে। তবেই ইংরেজদের তাড়াতে পারা যাবে।
চট করে সুধাময়ের মনে হল, হ্যাঁ, এতদিনে একটা পথ পাওয়া গেল। মনপ্রাণ দিয়ে সমর্থন করল দেশবন্ধুকে। এখন দেশবন্ধুই সুধাময়ের দেবতা।
কংগ্রেসে দুটো দল হয়ে গেল। একদল নো-চেঞ্জার। তাঁরা অসহযোগের আদর্শ আঁকড়ে থাকলেন। দেশবন্ধু আর পণ্ডিত মতিলাল নেহরু আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। প্রতিষ্ঠা করলে স্বরাজ্য পার্টি। নো-চেঞ্জাররা ধিক্কার দিতে লাগল দেশবন্ধুকে। মডারেট দল আগেই কাউন্সিলে ঢুকেছিল। মিনিস্টারি নিয়ে পরিষদীয় রাজনীতিতে হাত পাকাচ্ছিল। এবার মডারেটরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কিন্তু হাসুক মডারেটরা, রটাক কুৎসা নো-চেঞ্জাররা, দেশবন্ধুকে ওরা এঁটে উঠতে পারবে না। জয় তাঁর হবেই।
কিন্তু তোমার দেশবন্ধুই বা কী করবেন?
মেজকর্তার আচমকা প্রশ্নে সুধাময় থতমত খেয়ে গেল। মেজকর্তার প্রশ্নটা যে তির্যক, তা সে বুঝতে পারল। অথচ সুধাময়ের ধারণা ছিল, মেজকাকা এ খবরে উল্লসিতই হবেন। কই, তাঁর মুখে চোখে বিন্দুমাত্র উৎসাহের আভাসও তো ফুটে উঠতে দেখছে না সুধা
মেজকাকা বললেন, কী এমন মন্ত্র জানা আছে তোমার দেশবন্ধুর, যাতে তিনি উন্নতির চরম স্তরে পৌঁছে দেবেন দেশের দরিদ্রতম লোকগুলোকে! এই যে সব মূক মূঢ়ের দল জগদ্দল পাথরের মতো অনড় হয়ে রয়েছে, যাদের নিয়েই দেশ, কোন সঞ্জীবনীর বলে তিনি এদের প্রাণসঞ্চার করবেন, বলতে পারো?
সুধাময় যথেষ্ট গরম হয়ে বলল, স্বাধীনতাই সেই সঞ্জীবনী। পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন করতে পারলেই আমাদের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। দেশের প্রাণ আপনি জাগ্রত হবে।
পাগল! মেজকর্তা হাসলেন : এরা সব একই কথা কপচায়। এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষিত অশিক্ষিতের মধ্যে তফাত বিশেষ নেই। দেশের পায়ে শিকল, দেশের প্রাণ, দেশের দুঃখ। কে যে এই সব কথাগুলো আবিষ্কার করেছিল! যে জিনিসের কোনও অস্তিত্ব নেই, সেই ফাঁকা আওয়াজগুলোই আজ মুখে মুখে ফিরছে। তাই নিয়েই যত মাতামাতি চলেছে। এদের কি একবারও এ কথা ভেবে দেখতে ইচ্ছে করে না, যে-কথা ক্রমাগত উচ্চারণ করে চলেছি তার মানে কী?
মেজকর্তার মনে পড়ল, তাঁদের কলেজি জীবনে দেশমাতৃকার এক ছবি ছাপা হয়েছিল। এক সুন্দরী রমণী, তার হাতে পায়ে শিকল। কে একজন তার সামনে ফাঁসিতে লটকে আছে। বোধহয় ক্ষুদিরাম। একটা লোক সেই ছবিটা বাঁধিয়ে সরা হাতে শীতলা ঠাকরুনের সিধে মাঙার মতো করে পয়সা নিয়ে বেড়াত।
অশিক্ষিত সেই লোকটিকে মেজকর্তা বুজরুক বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকদের ধারণাই বা কী এমন পরিণত? এসব বঙ্কিমবাবুর সেই বন্দেমাতরমের এফেক্ট। দেশ এখন পুরোপুরি একটা পৌত্তলিক ধারণায় পরিণত হয়েছে। বললে গলাভরা শোনায়, তাই আমরা বদন ভরে বলি।
যদি জানতাম ব্যাপারটা এত সহজ সরল নয়, অনেক জটিল, দেশোদ্ধার করা কখনওই যায় না, দেশের মানুষের উদ্ধারই করা যায়, তা হলে হয়তো বা কেউ কেউ ভাবতাম, তবে বুঝি স্রেফ তুড়ি মেরেই এ সব কাজ করা যায় না। এর পিছনে যা আছে তার ষোলো আনাই বাস্তব সমস্যা। দেশ-শব্দটা যত অসার, দেশবাসী-শব্দটা কিন্তু ততখানিই সারবান। দেশের মধ্যে আছে পাহাড় পর্বত নদী মাঠ বন। আছে পশু পক্ষী মানুষ।
দেশবাসীর মধ্যে শুধু মানুষই আছে, বিচিত্র সব মানুষ। কৃষক আছে, জমিদার আছে, শ্রমিক আছে, চাকুরে আছে, আবার কলকারখানার মালিক আছে। শোষিত আছে, শোষক আছে। শত রকমের অতাচার অবিচার আছে। আছে হিংসা বিদ্বেষ, পরস্পরের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। এ সমস্যা জড় মৃত্তিকার নয়, সজীব মানুষের। সমস্যা আছে হাজার রকম— আর্থিক সাংস্কৃতিক দার্শনিক। বড় জটিল ব্যাপার।। সম্ভবত এত জটিলতায় দিশেহারা হয়ে যাবার ভয় আমাদের থাকে, এত সব সমস্যার চিন্তা মাথায় ঢুকলে বাক্য স্ফূর্তি না ঘটার আশঙ্কাই থাকে, তাই এই সব জটিলতার মূল অতি বাস্তব এই দেশবাসী-শব্দটাকে উহ্য রেখে ‘ত্বং হি দুর্গা’র কাল্পনিক ধ্যানে নিমগ্ন থাকা পছন্দ করি।
এতে আর যাই হোক, মেজকর্তার বিশ্বাস, লোকে স্বাধীনতা কাকে বলে তার মর্ম কোনওদিনই বুঝবে না, যেমন এর আগেও কখনও বোঝেনি। হাজার হাজার বছর ধরে এই ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। শক হুন গ্রিক এসেছে, পাঠান মোগল রাজত্ব করেছে। তারপর তাদের পরমায়ু ফুরোলে ইংরাজ ফরাসি পর্তুগিজ ওলন্দাজ এসেছে। ইংরেজের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। কী এসে-যায় তাতে এ-দেশবাসীর? কোনওদিন তারা মানুষের মূল্য পায়নি। মানুষের অধিকারে বরাবর তারা বঞ্চিত থেকেছে। স্বাধীনতার আস্বাদ পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে কখনও তারা গ্রহণ করতে পারেনি। তাই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মাথাব্যথাও তাদের নেই।
ইতিহাস আমাদের কিছুমাত্র যদি শিক্ষা দিয়ে থাকে তবে তা এই। কী করবেন গান্ধী, কী করবেন দেশবন্ধু? বড়জোর ইংরাজ তাড়াবেন। তারপর? আবার কোনও গান্ধীরাজ বা দাশশাহীর প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু তাতেই কি স্বাধীনতার ফল ভারতের ছত্রিশ কোটি মনুষ্যবৃক্ষে ফলে যাবে? মূলে যেখানে শূন্য, সেখানে ছত্রিশ কোটি শূন্য যোগ হবে মাত্র, আর যোগফলও সেই শূন্যই দাঁড়াবে। অন্তত মেজকর্তার তো তাই দৃঢ় বিশ্বাস।
সুধাময়ের মাথা ঝিমঝিম করছিল। কতক কথা সে বুঝল, কতক বোঝেনি। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, তাই সব কথা কানেও ঢোকেনি। তবে মেজকাকা যে নিজেও নেতিবাদীই, সেটা যেন আবিষ্কার করল।