দুরন্ত ধারা – ১০

দশ 

এমন কিছু পেল্লায় বোঝা সোনা মিঞা চাপায়নি তার গাড়িতে। পাঁচ মন পাটও আছে কি না সন্দেহ। সুমুন্দির গোরু তাও টানতে পারে না। রাগে কসকস করছে সোনা মিঞার শরীর। দ্যাখো দিকিনি, দ্যাখো দিকিনি, শালার গোরুর রকম দ্যাখো দিকিনি! সোনা মিঞা বিপদ বুঝে চঞ্চল হয়ে উঠল। বাঁয়ের গোরুটার লেজ মলে, ডাইনের গোরুটার পেটে পায়ের গুঁতো মেরে মেরে, হেই গুটি বাঁ বাঁ, বাঁ বাঁ, হেই হেই— করতে করতেই তার গাড়ি খানায় পড়ল। ভাদ্দর মাসের কড়া রোদ, পিঠের উপরকার প্রকাণ্ড মোষে-দাদখানায় রোদ পড়ে অসহ্য জ্বলুনি ধরিয়েছে, যেন করাত দিয়ে কেউ তার পিঠের মাংস কেটে নিচ্ছে। দরদরে ঘাম আবার তার উপর নুনের ছিটে মারছে। 

সোনা মিঞার মাথায় খুন চেপে গেল। লাফ দিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। বিরাট একটা লাঠি বের করে, দু’হাত দিয়ে ধরে গায়ের জোরে গোরু দুটোর পিঠে মারল দমাদ্দম দুই বাড়ি। হাড় জিরজিরে গোরু দুটোর শিরদাঁড়া বেঁকে ঝুলে পড়ল নীচের দিকে। হুড়মুড় করে তারা এগোবার চেষ্টা করল। প্রাণপণ শক্তিতে। কিন্তু গাড়ির চাকা শক্ত কাদায় ঠেকেছে। এক চুলও নড়াতে পারল না। বাঁ পাশের গোরুটার পিঠে বড় বড় ঘা। ফেটে রক্ত বেরোতে লাগল। ডান পাশের গোরুটা ধ্যাড় ধ্যাড় করে খানিকটে ধেড়িয়ে দিল। তবু গাড়ি এগোল না। 

সোনা মিঞার চেহারা তার বলদ দুটোর চেয়ে কিছুমাত্র উন্নত নয়। ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে সে নিজেও তার জেলার আর দশজন চাষির মতো হাড্ডিসার। বড় লাঠির দুটো ঘা কষিয়ে সে যেমন তার গোরু দুটোকে কাবু করল, তেমনি ওইটুকু পরিশ্রমে নিজেও কাহিল হয়ে হাঁফাতে লাগল। 

বলদ দুটোর চেহারা একটু অদ্ভুত ধরনের। সৃষ্টিকর্তা যেন প্রথমে পেট মোটা দু’দিক সরু দুটো বৃহৎ নারিকেল-কুল বানিয়েছিলেন। তারপর তাঁর বলদ তৈরির স্পৃহা জাগরূক হওয়ায় সেই নারিকেল-কুলেরই একদিকে মাথা অন্যদিকে লেজ জুড়ে নীচের দিকে চারটি করে খুরওয়ালা পা বসিয়ে দিয়েছেন। 

অবশ্য, সোনা মিঞা সে জন্য পরিতাপ করল না। তার গায়ের জোর কমে এলেও রাগের তেজ কমেনি। কারণ, আর একটুখানি পথ এগিয়ে গেলেই সে খেয়াঘাটে পৌঁছোত এবং একটু সকাল সকাল পৌঁছাতে পারলে নতুন ফড়ে ধরে তার পাটগুলো গস্ত করতে পারত। নতুন ফড়েদের কাছে পাট বেচার সুবিধে এই, দামটা নগদ পাওয়া যায়। আর ঘাঘু আড়তদারদের চাইতে তারা লোকও একটু ভাল হয়। দামটাও ওরা দু’-এক আনা বেশি দেয়। 

পাটের আড়তদারদের মধ্যে সব থেকে ঘুঘু ওই কানা মাড়োয়ারি আগরওয়ালা। ওই শালাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না সোনা মিঞা। অবশ্য, না দেখতে পারার প্রধান কারণ, সোনা মিঞা আজ আট বছর ধরে ওর কাছে কিছু টাকা ধারে। যুদ্ধের মধ্যে পাটের দাম হুহু করে বেড়ে গিয়েছিল। পাট তখন সোনার দামে বিকিয়েছে। সোনা মিঞার তখন বোল-বোলাও অবস্থা। বউয়ের জন্য মল খাডু কিনেছে, কাঁসার থালায় ভাত খেয়েছে, ভাইকে সাইকেল কিনে দিয়েছে, ঘরের চালে টিন তুলেছে, চালের মাথায় আবার শখ করে পাকা মিস্তিরি লাগিয়ে টিন কেটে ময়ূরও বসিয়েছিল। তখন সোনা মিঞা প্রকৃত মিঞাদের মতোই চলাফিরা করেছে। পশ্চিম দেশের দামি বদনাই কিনেছিল চারটে। ঘনঘন দাওয়াত দিয়েছে বাড়িতে। তখন সে মাতব্বর। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার। যে-সে লোক নয়। তাদের গ্রামে সিল্কের লুঙ্গি, জুতো আর ইস্টাকিনের চল সে-ই প্রথম করেছিল। চশমা কেনবার ইচ্ছেও ছিল। মেদ্দা ছাহেব যে চশমা চোখে দেন, সেই কছমের একটা। সে শখটাই শুধু মেটেনি সোনা মিঞার। 

তার আগেই নসিবে আগুন লাগল। যুদ্ধ থেমে গেল। পাটের দাম নামতে লাগল। চার বছরের মধ্যেই কী হয়ে গেল দেখো। 

সেই উঠতি সময়ে ওই আগরওয়ালা মাড়োয়ারি সোনা মিঞাদের একেবারে বুকে করে রেখেছিল। চাইলেই টাকা দিত, বাঁধ বাঁধ টিন দিত, সাইকেল, ঘড়ি, লণ্ঠন, নাও-না, কে কী নেবে। দাদনের চিটেয় সই মারো, না হয় বুড়ো আঙুলের টিপ ছাপ দাও, দিয়ে মাল নিয়ে চলে যাও, পাট দিয়ে দাম শোধ করো। 

সেই টিপ ছাপের মারপ্যাচে কী করে যেন সোনা মিঞাকে দেনার জালে জড়িয়ে ফেলেছে ওই মাড়োয়ারি সুমুন্দির পো। প্রথমে ছিল তিরিশ টাকার দেনা। বাড়তে বাড়তে এখন সেটা নাকি ষাট টাকায় দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এই দেনা দেখিয়ে দেখিয়ে প্রতি বছর ওর কাছ থেকে সস্তা দরে পাট নিয়েছে। জবরদস্তি করে নিয়েছে। বাজারের দর যখন কুড়ি টাকা, তখন মাড়োয়ারি দর দিয়েছে আঠারো। শালা কানা হলে হবে কী, পেটে পেটে বুদ্ধি। এক চোখ কানা যার বিরোআশি বুদ্ধি তার। সারা হাটে শালা লোক বসিয়ে রাখে। খাতকরা যে ফাঁকি মেরে অন্যের কাছে মাল গস্ত করে পালাবে, তার উপায় নেই। 

পলেনপুরের বদু কলু এই ব্যবসায় নতুন নেমেছে। তার সঙ্গেই সোনা মিঞার কথা হয়েছিল। হাটে না ঢুকে সোনা মিঞা পাশ কাটিয়ে খেয়াঘাটে যাবে। সেখানেই বদু কলুকে মাল গস্ত করে দেবে। বদু কলু একটু সকাল সকাল যেতে বলেছিল। তার পুঁজি কম। যার মাল আগে পাবে তারটাই কিনে ফেলবে। তবে? এর মধ্যে যদি অন্য লোকের মাল কিনে ফেলে বদু? 

তড়াক তড়াক করে রক্ত সোনা মিঞার মাথায় উঠতে লাগল। বড় লাঠি রেখে দিয়ে পাচন-নড়িখানা তুলে নিল হাতে। ডান দিকের গোরুটার পাছায় মারল খোঁচা। খোঁচা খেয়ে গোরুটার পাছার থলথলে মাংসে কাটা কাছিমের মতো খিচুনি শুরু হল। তবু গাড়ির চাকা এক বিন্দু নড়ল না। সোনা মিঞা পাগলের মতো ধাঁই ধাঁই পিটতে থাকল বলদ দুটোকে। 

আর পাগলের মতো চেঁচাতে থাকল, সুমুন্দির গোরু বাড়ি যায়ে আজ তোগের জবাই করব। শালা বলদ না হলি এতদিন তো পাঁচ ছাওয়ালের বাপ হতিস, আজউ ডান বাঁ সড়গড় হল না। খানায় গাড়ি ফেলে ভাবিছ, দিনির মতো কাজ চুকোয়ে দিলাম, এখন বসে বসে জাবর কাটবা তোল গাড়ি। ভাল চাস তো শিগগির শিগগির টানে তোল। না হলি তোগের একদিন কি আমার একদিন, তা বুঝোয়ে দিবানে আজ। 

সোনা মিঞা চেঁচায় আর গোরু দুটোর পিঠে ধপাস ধপাস পাচনের ঘা কষায়। মার খেয়ে বলদ দুটোর পিঠে অজস্র কালশিরে পড়ে গেল। বলদের সাদা সাদা পিঠের ওপর কালো কালো দাগ, মনে হল, কে যেন সাদা কাঁথায় কালো সুতোর ফোঁড় তুলেছে। বলদ দুটো যথাসম্ভব ঘাড় পিঠের শক্তি দিয়ে বারবার গাড়ি টানতে লাগল। ওদের দু’কশ বেয়ে ফেনা ঝরতে লাগল, কিন্তু গাড়িকে একটুও নড়াতে পারল না। হঠাৎ ডান দিকের গোরুটা হাঁটু মুড়ে শুয়ে পড়ল পাচন-নড়ির ভোঁতা মাথার গুঁতো দিয়ে সোনা মিঞা বলদটাকে তুলতে চেষ্টা করল। পারল না। তখন সোনা মিঞা তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলদটার তলপেটে অবিশ্রান্ত পাচন-নড়ির গুঁতো মেরে চলল। তার তখন দিগবিদিজ্ঞান লোপ পেয়ে গেছে। 

রামকিষ্টো গোটা চারেক কেঁড়ে আর বড় এক খালুই হাতে নিয়ে হাটে যাচ্ছিল। সোনা মিঞার কাণ্ড দেখে ভয় পেয়ে গেল। কেঁড়েগুলো আর খালুইটা রাস্তার এক পাশে রেখে ছুটতে ছুটতে এসে সোনা মিঞার হাত চেপে ধরল। করো কী, করো কী, বলে পাচন-নড়ি কেড়ে নিল। 

ধমকে বলল, ওরে আমার চাষার ঘরের পাঁঠা, বলদ মরলি যে তুমিও মরবা। দ্যাখো দিকি, কী করিছ, মারে মারে যে শেষ করে আনিছ 

হাঁফাতে হাঁফাতে সোনা মিঞা বলল, মারব না তো করব কী? শালার গোরু খানায় গাড়ি ফেলিছে। বেলা গেলি হাটে যায়ে ও কুণ্ঠা কার পুঙায় ঠাসব, ওই গোরুর, না আমার? 

রামকিষ্টো বলল, সুনা ভাই, খ্যামতা না থাকলি মারে কি গাড়ি তুলতি পারবা? বাঁজা বউরি সাধ খাওয়ালিই কি তার পেটে ছাওয়াল জন্মায়? 

রামকিষ্টোর কথা শেষ হতে না হতেই ডান দিকের গোরুটা ঘাড় কাত করে এলিয়ে পড়ল। তার চোখ দুটো বুজে আসতে লাগল। গলার দড়িটা তখনও গাড়ির জোয়ালে বাঁধা। ফাঁস পড়ার উপক্রম হল। বলদটার চোখের কোল, মুখের কশ আর নাক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। 

রামকিষ্টো তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল, সুনা ভাই, গলার দড়ি খুলে দ্যাও। শিগগির।

রামকিষ্টো তাড়াতাড়ি জোয়াল উঁচু করে ধরল। সোনা মিঞা দড়ি খুলে দুটো বলদই আলগা করে দিল। রামকিষ্টো ডানদিকের বলদের চোখে মুখে ফুঁ দিতে লাগল। ব্যাপার দেখে সোনা মিঞা ঘাবড়ে গেল। ভয়ে তার প্রাণ উড়ে গেল। ইয়া আল্লা। বলদটা মরে যাবে নাকি! তবে তো সর্বনাশ! বাঁ দিকের গোরুটা নির্বোধ চোখে এতক্ষণ ধরে তার সাথীটার উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চলছিল তা দেখছিল। এখন ড্যাবা ড্যাবা চোখ তুলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মৃতপ্রায় সঙ্গীটির দিকে। কী মনে হল তার হঠাৎ, হয়তো সাড়া নেবার জন্যই ভয়ে ভয়ে ভাঙা গলায় ডেকে উঠল হা-ম-বা। তারপর কোনও সাড়া না পেয়ে, ধীরে ধীরে রাস্তার পাশে সরে গিয়ে খুঁটে খুঁটে ঘাস খেতে লাগল। একটা চিল কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উড়ে গেল উপর দিয়ে। একখানা ফঙ্গবেনে মেঘ খুব আলতো করে একটা ছায়া বুলিয়ে দিয়ে গেল। 

ফুঁ দিতে দিতে রামকিষ্টোর মুখ ব্যথা হয়ে উঠল, সোনা মিঞা এগিয়ে এল ফুঁ দিতে।

রামকিষ্টো বলল, ওই কাড়েগুলোয় করে শিগগির জল ভরে আনোদিনি। মনে হচ্ছে ভিরমি খায়েছে। মারির চোটে ওর পিরানডা তো কণ্ঠায় তুলে ছাড়িছ। ছিঃ! 

রামকিষ্টোর ভর্ৎসনা গায়ে মাখল না সোনা মিঞা। সে দোষী, দোষ করেছে। ন্যায্য অপরাধে এখন তাকে জুতিয়ে দিক না রামকিষ্টো, সোনা মিঞা তাকে একটি কথাও বলবে না। 

সোনা মিঞা কেঁড়েগুলো ছোঁবে ছোঁবে, হঠাৎ রামকিষ্টোর খেয়াল হল। 

চেঁচিয়ে উঠল রামকিষ্টো, আরে রও রও, সুনা ভাই, ও কাড়ে বাবুগের, ছুঁয়ে না, ছুঁয়ে না। তুমি এদিকি আসো, বসে বসে চোখ মুখি ফুকোও, তলপেটটা আস্তে আস্তে ডলে দ্যাও। আমি বরং জল আনে দিই। 

সোনা মিঞা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে এল। রামকিষ্টো দুটো কেঁড়ে নিয়ে জল আনতে ছুটল। সোনা মিঞা বলদটার কাছে বসে বসে কখনও তার মুখে চোখে ফুঁ দিতে লাগল, কখনও তলপেটে মোলায়েমভাবে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, কখনও বা পিঠের শিরদাড়া ডলে দিল পরম যত্নে রাগের ধার পড়ে এসেছে। ভয়ের একটা শুলুনি মাঝে মাঝে তার মগজে গুঁতো মারছে। ধীরে ধীরে সহানুভূতির এক অব্যক্ত বেদনা জন্ম দিতে থাকল সোনা মিঞার মনে। 

.

বেলা-পড়া তেজালো রোদ গদির সামনেকার কড়ুই গাছটার ফাঁক দিয়ে ঝপ করে মেদ্দা ছাহেবের চোখে গিয়ে পড়ল। রোজই পড়ে। সাহেবালি মৃধার মনটা অমনি আনচান করে উঠল। বুঝলেন চা পানি খাবার সময় হয়েছে। চকচকে রোল্ডগোল্ডের টনকো চশমাটা বাঁ হাতের টানে খুলে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে পাকা ভুরু দুটো ঈষৎ ঝুলে পড়ল। ভারী কাঁঠালকাঠের একখানা পোক্ত ডেস্ক সামনে; ডেস্কের উপর জাবেদা খাতা। খোলা। চশমাটা খাপে পুরে খাতার উপর রেখে দিলেন। তারপর গদি থেকে নেমে রুপোলি রঙের চকচকে বদনাটা হাতে নিয়ে খড়ম পায়ে গাঙের পাড়ে চললেন। অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন। তলপেট টনটন করছে। এবার একটু হালকা হওয়া দরকার। 

এটা তাঁর নৈমিত্তিক কর্ম। এবার গিয়ে গদিতে বসলে আর বিষয়কর্ম হয় না। সন্ধে পর্যন্ত গল্পগুজব চলে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট তিনি। তার কাজকর্মও কিছু হয়। দফাদার চৌকিদারেরা আসে। চা পানি আর তামাক ঘনঘন সরবরাহ হয়। আজ হাটবার। ভিড় একটু বেশিই হবে। 

মেদ্দা ছাহেব কলকাতার আদমজি হাজি দাউদ কোম্পানির এজেন্ট। এই তল্লাটের পাট ওই কোম্পানির চটকলে যত চালান যায়, তার সবই যায় মেদ্দা ছাহেবের হাত দিয়ে। অবস্থা যুদ্ধের আগে এমন বিশেষ কিছু ভাল ছিল না তাঁর। তবু যুদ্ধের বাজারে আল্লার রহমতে তাঁর নসিবের রং বদলে গিয়েছে। এখন তিনি বাইশ নম্বর ইউনিয়নের পনেরোখানা গ্রামের মাতব্বর। 

গাঙের পাড়ে মেদ্দা ছাহেবের বড় বড় দুটো পাটের গুদোম। আগে আমদানির সময় পাট ধরত না তার ভিতরে। আর এখন, কী যে মতলব কোম্পানির বুঝতে পারছেন না মেদ্দা ছাহেব, তাই প্রাণে ধরে পাট কিনতেও পারছেন না, গুদোমে অনেকখানি জায়গা খালি পড়ে থাকছে। যুদ্ধের মধ্যে তিন হাজার, চার হাজার মন মাল পাঠিয়েও মন পাননি কোম্পানির। আরও পাঠাও আরও পাঠাও বলে হুকুম ঝেড়ে ঝেড়ে জান পরেশান করে দিয়েছে। আর এখন, হাজার, পাঁচশো মন মাল পাঠালেই টেলিগ্রাম আসে, বাস করো, আর না। বছর বছরই দেখি পরিমাণ কমে আসছে। গত বছরের মালই পড়ে আছে গুদোমে। এবারের আমদানির সময়ও তো এসে গেল। কলকাতা থেকে পরিষ্কার কথা এখনও এল না। বড়ই সমস্যায় পড়েছেন মেদ্দা ছাহেব। আগরওয়ালা অবিশ্যি কিনছে। কিন্তু ওর সঙ্গে টক্কর মেরে চলবার মতো হিম্মৎ এখনও মেদ্দা ছাহেবের হয়নি। 

আর আগরওয়ালার সঙ্গে তাঁর তুলনাও চলে না। বেটা এক নম্বরের চশমখোর। কেনা বেচার ব্যাপারে ও যতটা শক্ত হতে পারে, তিনি ততটা কী করে পারবেন? আগরওয়ালা গ্রামের কে? কেউ না। এখানকার লোকেদের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক? আগরওয়ালার ব্যাবসার মন্ত্র হচ্ছে— ফেলো কড়ি মাখো তেল। আগরওয়ালা জানে, টাকা তার হাতে। চাষিরা যতই ফুটুনি করুক, তেজ দেখাক প্রথমে, শেষ পর্যন্ত তার পায়েই গড়াতে হবে। যে দাম সে বলবে, সেই দামেই তার কাছে চাষিকে মাল গস্ত করে যেতে হবে। 

কিন্তু মেদ্দা ছাহেব এখানকারই মানুষ। যদিও তিনি জানেন, মনে মনে জানেন, আগরওয়ালার রাস্তাই ব্যাবসার ঠিক রাস্তা, তবু ও-পথে তিনি স্বচ্ছন্দে পা বাড়াতে পারেন না। যদি পারতেন তা হলে গত বছর অত মাল তিনি কিনতেন না। মাল তো আগরওয়ালাও কিনেছে, তাঁর থেকে অনেক কম দাম দিয়ে কিনেছে। তিনি চেষ্টা করেও অত কম দাম দিতে পারেননি। কোন প্রাণে দেবেন? এখন তিনি আতর মাখেন, শেখ ফসিউল্লার গোলাপজল মিল্লাদ মহফিলে পিচকিরি দিয়ে ছড়ান, তা সত্ত্বেও তাঁর গায়ের পসিনা থেকে যে বদবু বের হয়, তা যে এই চাষিদের মতোই। এই আর্ত, বেকুব চাষিগুলো যে তাঁর আত্মার আত্মীয় সেই সত্যটাকে এখনও তিনি জবাই করতে পারেননি। 

তবে মেদ্দা ছাহেব এও বুঝতে পারছেন, এভাবে ব্যাবসা চালালে তাঁকে অচিরেই লালবাতি জ্বালতে হবে। কী যে তিনি করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। 

মেদ্দা ছাহেব দেখলেন, নদীতে পাট-বোঝাই নৌকো সার বেঁধে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর পাড়ে গোরুর গাড়িতেও পাট আমদানি হয়েছে বেশ। 

মেদ্দা ছাহেব বদনাটা মাটিতে নামিয়ে রেখে, মাথার নকশা কাটা গোল টুপিটা বাঁ হাতে উঁচু করে ধরে টাকে খানিক হাওয়া লাগিয়ে নিলেন। তারপর ডান হাতের তেলো দিয়ে টেকো মাথার ব্রহ্মতালুটা বার কয়েক ডলে নিলেন। দেখলেন, তাঁর গোমস্তা তুফান মিঞা পাটভাঙা তফন আর মলমলের পিরেন পরে, হাওয়াগাড়ি সিগারেট ধরিয়ে, বকের মতো ডিঙি মেরে মেরে, বেশ্যে মাগিদের ঘরগুলোর কাছে ঘুরঘুর করছে। ভাবলেন, ব্যাটার তো বড় পাখনা গজিয়েছে। তার মানে দেদার পয়সা মারছে। 

হাঁক ছাড়লেন, এই তুফানে! 

কর্তার ডাকে চমক খেয়ে ফিরে তাকাতেই তুফান মিঞা হকচকিয়ে গেল। সদ্য-ধরানো সিগারেট আঙুলের ফাঁক দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে বলল, শালার বুড়োর সব দিকি চোখ। মুখখানা পরম বেকুবের মতো করে, কুতকুত চোখে মেদ্দা ছাহেবের দিকে চেয়ে, মেহেদি দিয়ে রং করা আঙুলের নখ দাঁতে খুঁটতে লাগল। 

মেদ্দা ছাহেব ধমক দিলেন, এই হারামজাদা, এখানে কী করতিছিস? 

তুফান মিঞা তুডুক জবাব দিল, হুজুর, আমদানি দেখতিছি। 

ছোকরার তো রস আছে। আমদানি দেখছেন এখানে! কী জানি কেন, জবাবটা শুনে মজা‍ই লাগল মেদ্দা ছাহেবের। রাগটা খপ করে পড়ে গেল। টুপিটা মাথায় বসিয়ে দিলেন। হয়তো গুরুত্ব বাড়াবার জন্য। 

গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলেন, কোন আমদানি দেখতিছ? 

কোস্টার আমদানি হুজুর 

তেমনভাবেই হুকুম দিলেন মেদ্দা ছাহেব, হুঁ। তা দ্যাখো। তবে লালি ছাড়া ছুঁয়ো না আর এটটু বাছবিচার করো। 

গদির দিকে দু’পা এগুতেই মেদ্দা ছাহেব দেখলেন, মেজকর্তা যাচ্ছেন। 

ডাক দিলেন, আরে ও মাজেবাবু, আছছালাম ওয়ালেকুম। নাতি পায়ে যে ভুলেই গেলেন আমাগের। 

মেজকর্তা বললেন, সেলাম, প্রেসিডেন্ট সাহেব 

মেদ্দা ছাহেব বললেন, নাতি বুঝি বুকি বুকিই থাকে। একেবারে যে ডুমুরির ফুল হয়ে ওঠলেন। 

মেজকর্তা বললেন, বুকে থাকা তো দূরের কথা। আমার মুখ দেখলে আঁতকে ওঠে নাতি। দাড়ির জঙ্গল সাফ না হলে বাবু কোলে উঠবেন বলে তো মনে হয় না। 

মেজকর্তার কথায় হোহো করে হেসে উঠলেন মেদ্দা ছাহেব। 

হাঃ হাঃ হাঃ, তবে তো খুদ্দুর বদমাইশডে বড় কলে ফেলিছে আপনারে। হাঃ হাঃ হাঃ। শখের দাড়ি আর পিরানের নাতি, কার টানের জোর বেশি, ইবার দেখা যাবে, কী কন, হাঃ হাঃ হাঃ! 

মেদ্দা ছাহেবের রকম দেখে মেজকর্তাও হেসে ফেললেন। 

বললেন, বিচারের আশায় আবার না প্রেসিডেন্ট সাহেবকে সালিশ মানতে হয়। 

মেদ্দা ছাহেব বললেন, তার জন্যি ভাবনা কী? ঝোলের লাউ আর অম্বলের কদু আমি তো আছিই। চলেন এক পেয়ালা চা-পানি খায়ে যান। 

এই গ্রামে চা খাবার চল করেছেন মেদ্দা ছাহেব। বিকাল থেকে তাঁর গদিতে চায়ের আসর বসে, বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সমানে চা চলে। একটা বড় হাঁড়িতে জল অনবরত ফোটে। একটা লোক আছে চা বানাবার জন্য। তার মাইনে পাঁচ টাকা। 

হিন্দু মাতব্বররা বিশেষ কেউ এই আসরে যোগ দেয় না। তবে ছোকরার দল এসে জোটে। মেজকর্তার কোনও বাছবিচার নেই। এ তো চা, কলেজ-জীবনে কলকাতায় বন্ধু-বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে মুসলমান হোটেলে অনেক শক্ত জিনিসও খেয়েছেন। 

হিন্দু মাতব্বররা এই কাজটাকে বিশেষ সন্দেহের চোখে দেখেন। বুদো ভুঁয়ের ধারণা, এটা মোদ্দা ছাহেবের জাত মারার ফন্দি। প্রকাশ্যে সে কিছু বলে না। প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাবান লোক। ঘনঘন শহরে যায়, এস ডি ও, মুনসেফ, এস পি, ডি এস পি-র সঙ্গে দহরম মহরমও আছে। কাজেই সামনে কিছু বলে না। আড়ালে ঘোট পাকায়। 

এই নিয়ে তার সঙ্গে মাতঙ্গিনী টেলারিং-এর প্রোপাইটার সুশীল দত্তর সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বাধে। বুদো ভুঁয়ে বলে, নাড়ের গায়ে যে রোজ গিয়ে গা ঘষিস, কী পাস, বল দিন। সুশীল দত্ত হেসে জবাব দেয়, ওমা, বুদোদাদা, তাউ জানো না, আতরির বাসনাই। তুমিউ দিনকতক ঘষে দ্যাখো না, তুমার গা-র ওই পাঁকের গন্ধে কেমন গুলাপের খোশবা ভুরভুর করবেনে। বুদো চটে যায়। বলে, অত মাখামাখি ভাল না সুশীল, ভাল না। একদিন যদি মোল্লা ডাকে ওই মেদ্দা তোগের কলেমা পড়ায়ে না ছাড়ে তো আমার নামে কুকুর পুষিস। আর এই বয়সে ছুন্নৎ করলি কেমন লাগে, তখন বুঝবা। সুশীল রাগে না। বলে, নিজিরডা সামলে রাখো, তালিই আমাগের ধম্ম রক্ষে পাবে। এরপর দোকান সুদ্ধু হাসির যে গররা ওঠে, বুদো তা আর সইতে পারে না। রাগে গরগর করতে করতে সুশীল দত্তের সিঙ্গার মেশিনের উপর রাখা বিড়ির বান্ডিল থেকে একটা বিড়ি বেছে নিয়ে বিশ্বেসদের দোকানমুখো সরে পড়ে। 

এগারো 

মেদ্দা ছাহেবের আসরে লোক সমানে বাড়ে। 

চা খাবার পালা শেষ হতে না হতেই সেদিন দফাদার ভক্ত ঘোষ গদিতে ঢুকল। মাথা নুইয়ে মেদ্দা ছাহেবকে সেলাম করল, মেজকর্তার পায়ের ধুলো নিল, তারপর হাতের বিরাট লাঠিটা গদির ছক্কা-পাঞ্জা ছাপ মারা পুরু অয়েল পেপারে মোড়া মেঝেতে শুইয়ে রেখে, এক পাশে উবু হয়ে বসল। 

এক গাল হেসে মেদ্দা ছাহেবকে বলল, হুজুর, এটটুসখানি চা কি এই অধীনির বরাতে জোটবে? 

ওর কথার ঢঙে গদির লোক হেসে ফেলল। 

মেদ্দা ছাহেব হাসতে হাসতে বললেন, দফাদার আমাদের বিনয়ে একেবারে মা-গোঁসাই। তুমি দফাদার না হয়ে ভক্ত বোরেগি হলিই পারতে। 

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভক্ত বলল, ইচ্ছে তো তাই ছিল হুজুর। কিন্তু গিরামের বোরেগি যে ভিক্ষে পায় না। তাই তো দফাদার হলাম। বাঁশরীর বদলে হাতে তাই তো বাঁশ ধরতি হল। নামাবলির বদলে মাথায় বাঁধলাম সরকারের লাল পাগড়ি, কাঁথার ঝুলার বদলে কাঁধে নিলাম এই নীলমণি ঝুলাখান। তা দফাদারের ঝুলা হুজুর, দেখিছেন তো একেবারে শ্যাম বন্ন। ধরে নেন, এর মধ্যিই শ্যাম আছেন। 

আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠল। 

মেদ্দা ছাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ভক্তর সঙ্গে কথায় পারবে কিডা? ওরে, ভক্তরে এটটু চা পানি দে। 

সঙ্গে সঙ্গে ভক্তের জন্য চা এসে গেল। একটা জর্মান-সিলভারের গেলাসে। গেলাসটা গনগনে গরম। হাতে তাত লাগায় ভক্ত পাগড়িটা খুলে তার এক মুড়ো দিয়ে গেলাসটা ধরে ফুঁ দিয়ে দিয়ে সুপ সুপ করে চা খেতে লাগল। 

মেদ্দা ছাহেব বললেন, ন্যাও, ইবার এটটু কাজের কথা কও দিন। ঝিনেদায় গিছিলে?

ভক্ত চা খেতে খেতে মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ। 

দেখা হল দারোগাবাবুর সঙ্গে? 

আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর। 

চায়ের গেলাসটা ঠকাস করে নামিয়ে রেখে ভক্ত জবাব দিল। বলল, আপনার বাঘের হিসেব চুকোয়ে দিয়ে আলাম। শুনে সুখী হবেন হুজুর, আপনার ইউনিয়ন ছাড়া আর কেউ হিসেব বুঝ দিতি পারেনি। দারোগাবাবু খুব চটিছেন ওগের উপর। 

সংবাদে সত্যিই খুশি হলেন মেদ্দা ছাহেব। 

বললেন, বিস্তারিত কও দিন শুনি। 

ভক্ত নড়ে-চড়ে বসল। চায়ের গেলাসে আর-একটা চুমুক দিল। 

তারপর বলল, হুজুর, গিয়ে দেখি, দফাদারগের ভিড়ি থানা ভরতি। এক এক জন দারোগাবাবুর ঘরে ঢোকছে, হিসের দিতি পারছে না, আর দারোগাবাবুর দাবড় খায়ে মুখখানারে চুনির গুদোম করে বেরোয়ে যাচ্ছে। আমারে ডাকে দারোগাবাবু এক দাবড় মারলেন, কী, হিসেব আনোনি তো? আমি হাতজোড় করে কলাম, সে কী কথা হুজুর! আপনি মা-বাপ, একটা হুকুম করিছেন, তা কি অমান্যি করতি পারি? পরিষ্কার হিসেব আনিছি। দারোগাবাবু অমনি নড়ে-চড়ে বসলেন। কলেন, বেশ, তুমার ইউনিয়নে বাঘের সংখ্যা কত? কলাম, হুজুর, আগে সাতটা ছিল, বত্তমানে ছয়। দারোগাবাবু কলেন, আরেকটা গেল কনে? কলাম, হুজুর, সিডা সঠিক কতি পারব না। তবে পায়ের দাগ দেখে আন্দাজ হয়, একুশ নম্বরের দিক হাঁটা দিয়েছে। দারোগাবাবু কলেন, ক্যান তুমার ইউনিয়নের উপর তেনার এত বীতরাগ হল ক্যান? কলাম, হুজুর, জুড়া পাচ্ছিল না, আমার ইউনিয়নের বাঘিনিগুলো বড় সতী কিনা, তাই। দারোগাবাবু কলেন, বেশ, যে কড়া আছে তার কড়া বাঘ, কড়া বাঘিনি? কলাম, হুজুর, তিনডে বাঘ, তিনডে বাঘিনি। দারোগাবাবু কলেন, ঠিক জানো তো? কলাম, হুজুর, না জানলি ঠিক ঠিক কচ্ছি কেমন করে? দারোগাবাবু কলেন, সিডাও একটা কথা বটে। তারপর খুশি হয়ে দুডো টাকা বকশিশ দিয়ে দারোগাবাবু কলেন, তুমার প্রেসিডেন্টরে আমার ছালাম দিয়ো। 

ভক্ত ঘোষের বিবরণে মেদ্দা ছাহেব খুব খুশি। তিনিও তাকে দু’টাকা বকশিশ দিলেন।

মেজকর্তা বাঘের হিসেব কী, বুঝতে পারছিলেন না। 

জিজ্ঞাসা করলেন, বাঘের হিসেব কী? 

মেদ্দা ছাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, সরকারের খেয়াল, আবার কী? হুট করে হুকুম আলো, দেশে কত বাঘ আছে গোনো। গুনে এক হপ্তার মধ্যি থানায় গিয়ে তার রিপোর্ট দাও। সরকারি হুকুমির তো আর কোনও বাপ-মা নেই। আলিই হল। আমাগেরই যত ঝামেলা। 

ভক্ত বলল, হুজুর, হিসেবডা বুঝ করাই হল আসল। না হলিই ঝামেলা। সরকারি কাজের রগড়ই হল ওইডে, যে বুঝিছে সে মজিছে। 

মেদ্দা ছাহেব বললেন, তা যা বলিছ। 

মেজকর্তা ভাবলেন, ভক্ত একেবারে সার বুঝে গেছে। 

ভক্ত বলল, হুজুর, ঝিনেদায় এক নতুন কথা শুনে আলাম। উকিলবাবুগের মধ্যি খুব আলাপ হচ্ছে। কী যেন হয়েছে কলকেতায়, কী, হিন্দু-মুসলিম প্যাকটো না কী, তাই। ইবার নাকি ভোট হবে। 

মেদ্দা ছাহেব আর মেজকর্তা দু’জনেই উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন। 

মেদ্দা ছাহেব উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, এটটু খোলসা করে কও দিন, শুনি। 

ভক্ত ঘোষ বলল, হুজুর, আমরা হলাম নিরেট গুরুর শিষ্য। বিদ্যের দৌড় যে কত সে তো ভালই জানেন। ওই কয়ে কলাগাছ পর্যন্ত। বাবুগের ভাবের কথা কি সব বুঝতি পারি? তাও আবার কোন বাবু না উকিল বাবু! মা-রে যিনারা কথার প্যাঁচে মাওই বানায়ে ছাড়ে দ্যান। 

ভক্ত একটু থামল। শুধু হাতে চায়ের গেলাস ধরে বুঝল তাতটা কমে এসেছে। স্‌স্‌প্ স্‌স্‌প্ করে দুই চুমুকে গেলাস খালি করে দিল। তারপর পাগড়ির কোনা দিয়ে মুখটা বেশ করে মুছল। 

বলল, খুসালের মামলার তত্ত্ব নিতি যোগেন মুউরির কাছে গিছিলাম। যায়ে দেখি উকিলবাবুরা একখান খবরের কাগজের উপর হুমড়ি খায়ে পড়িছেন। মড়ির উপর শগুন পড়লি যেমন শোভা হয়, তেমনি হয়েছে। আর ব্যাঙাচির ন্যাজের মতো মুউরিরা সব নিজির নিজির বাবুর কাছার কাছে দাঁড়ায়ে আছেন। আর ওই কুল বকশি, অভয় বোস আর রামতারণ উকিলির ছাওয়াল গুড়গুড়ে চক্কোত্তি মুখ নাড়ে বাক্যির তুফান ছুটোয়েছেন। ভাবলাম, কলি উলটোল নাকি? শেষে শোনলাম সে-সব কিছু না, কলকাতায় হিন্দু মুসলমানের প্যাকটো না কী ক্যাকটো, তাই হয়েছে। ভোট হবে। বাবুরা কাউন্সিলি যাবেন। হিন্দুরা হিন্দুগেরে ভোট দেবে, মুসলমানরা দেবে মুসলমানগেরে। হিন্দু মোছলমানে একতা হয়ে যাবেনে। এই তো বিত্তান্ত, আমি যা বুঝিছি। হ্যাঁ, এইসব নাকি সি আর দাস না কেডা, তিনার আজ্ঞে। যা জানি কলাম, এখন হুজুর, আপনারা বুঝে নেন। 

ভক্ত ঘোষের বয়ান শেষ হলে কিছুক্ষণের জন্য গদির মানুষদের মুখে কথা সরল না। এদিকের কথা থেমে যেতেই হাটের কোলাহল মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। হাটের তখন যৌবন অবস্থা। বেচা-কেনা, দর-কষাকষি, ছোটখাটো তর্ক-বিতর্কের শব্দগুলো মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, কখনও একতাল শব্দপিণ্ডের সঙ্গে আরেক তাল শব্দপিণ্ডের প্রচণ্ড সংঘর্ষ বাধছে। প্রচণ্ড ধাক্কায় পিণ্ডাকৃতি গন্ডগোল যেন আবার ভেঙে ছোট ছোট শব্দে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই ভাঙাচোরা তোবড়ানো শব্দগুলো আবার নতুন নতুন শব্দসমষ্টির গায়ে লেপটে নতুন নতুন সব অর্থহীন আওয়াজ সৃষ্টি করছে। 

মেজকর্তা অন্যমনস্কভাবে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ভক্ত ঘোষের কথার মর্ম বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। 

মেদ্দা ছাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কী বোঝছেন মাজেবাবু? 

এ-সব রাজনীতির তত্ত্ব মেজকর্তা ভাল বোঝেন না। নিশানাহীন শিকারিরা বনের মধ্যে দুমদাম বন্দুকের দ্যাওড় করে গ্রামের লোকেদের মনে যেমন সম্ভ্রমের সৃষ্টি করে, মেজকর্তার কাছে রাজনীতিকদের ক্রিয়াকলাপ অবিকল তেমনিই ঠেকে। 

মেদ্দা ছাহেবের প্রশ্নে মেজকর্তা একটু হাসলেন। 

বললেন, বুঝলাম হুজুগের আরেকটা ঢেউ আসছে। 

ক্যান মাজেবাবু, আপনি ইডারে হুজুগ কচ্ছেন ক্যান? সফিকুল মোল্লা এক পাশে এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, এবার শান্ত গলায় প্রশ্ন করল। কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে উঠল, আমি তো মনে করি, অ্যাদ্দিন পরে হিদুগের আক্কেলের গুড়ায় পানি পড়িছে। ভোট যদি সত্যিই আলাদা আলাদা হয়, মোছলেম জাহানের তাতে তরক্কিই হবে। চাকরিবাকরির সুবিধে আমাদের কিছু হতি পারে। 

মেজকর্তা বললেন, সে তো এখনও হতে পারে ফটিক মিঞা। 

সফিক একটু তিক্ত হাসি হাসল। 

বলল, পাগল হয়েছেন মাজেবাবু, আমাগের কি চাকরি কেউ দেয়! গায় যে পিয়াজ রসুনির গন্ধ। তা ছাড়া আপনাগের ঘরে ঘরে আই এ, বি এ, এম এ। মোছলমানের ছাওয়াল এন্ট্রান্স পাশ করল যদি সে বড় পির। সুজা রাস্তায় আপনাগের নাগাল ধরতি আমাগের দুটো-তিনডে জনম কাবার হয়ে যাবে। তা তদ্দিনের এন্তেজারে কি কেউ থাকতি চায়! 

মেদ্দা ছাহেব বললেন, ফটিক মিঞার দেখি মাস্টারি করতি করতি বুদ্ধির চিরাগে রোশনি ধরিছে। কথাটা বলিছ বড় ভাল। এই যে আমার জামাইডে মুক্তারি পাশ করে ঝিনেদার কোর্টে ঘষ পাড়তিছে। পিরেন পাতলুন ছাপ করার কড়িউ জুটাতি পারতিছে না। মোছলমান মুক্তারির হাতে কেস তুলে হিঁদুতিউ দ্যায় না, মোছলমানেও দ্যায় না। ভরসাই পায় না। তাই তো খায়ে না-খায়ে নুরুরি কলকেতায় পাঠালাম। যাও বাপু, অন্তত গিরাজুয়েট পাশ করে আসো গে। 

সফিকুল বলল, খোদা আপনার মনের ইচ্ছে পুরোয়ে দেন। কিন্তু দিনকাল যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাতে নিজির কোলে ঝোল টানার চিষ্টা না করলি বাঁধা মার খাতি হবে। মোছলেমদের জন্যি আলাদা ব্যবস্থা করার সত্যিই দরকার হয়ে পড়িছে। 

তর্কে বিতর্কে মেজকর্তা বড় একটা ভিড়তে চান না আজকাল। সফিকুলের কথা শুনে তাঁর মনে হল, লোকটা যা বিশ্বাস করে তাই বলছে। এইসব লোক কোনও কিছু তলিয়ে বোঝে না। আস্থাভাজন লোকেরা যা বুঝিয়ে দেয়, তাই এদের কাছে শেষ কথা। চাকরি চাকরি করেই এরা হন্যে হয়ে উঠেছে। শুধু এরা কেন, হিন্দু মুসলিম সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিয়েছে চাকরির ফল পাড়ার জন্য। কিন্তু ক’টা চাকরি আছে দেশে? 

মেজকর্তা বললেন, আমাদের দোষটা কী জানো? আমরা বড় হাওয়ায় নেচে বেড়াই। কোনও জিনিসটাই তলিয়ে দেখার চেষ্টা করিনে। ফটিক মিঞা, তুমি জানো, বাংলায় সরকারি চাকুরের সংখ্যা মোট কত? 

ফটিক মাথা নাড়ল। না, সে জানে না। সত্যিই জানে না। 

মেজকর্তা বললেন, সরকারি হিসেবেই, আমার যতদূর মনে পড়ছে, তিন লক্ষ একুশ হাজার, কি বাইশ হাজার। না হয়, ধরো চার লক্ষই। আর বাংলার লোকসংখ্যা এখন পাঁচ কোটি, তার মধ্যে মুসলমান ধরো পৌনে তিন কোটি। এখন বলো, ওই চার লক্ষ চাকরিই যদি মুসলমানদের দেওয়া যায়, একটা পদও যদি হিন্দুদের না দেওয়া হয়, তা হলেই কি বাংলার মুসলমানদের সমস্যা মিটবে? তা হলেও যে দু’কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ মুসলমানের সমস্যা থাকে। তার ব্যবস্থা কী দিয়ে করবে? 

মেদ্দা ছাহেব আর সফিকুল একসঙ্গে বলে উঠল, বলেন কী মাজেবাবু! এমন কথা তো কেউ শুনোয়নি। 

মেজকর্তা বললেন, আমাদের আসল সমস্যা কি এই যে, কার ভাগে ক’টা চাকরি পড়বে? সমস্যা তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি জটিল। এই পাঁচ কোটি লোকের জন্য কী ভাবে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করা যায় তাই ভাবা, তার জন্যে ব্যবস্থা করা, তাই হল প্রকৃত সমস্যা। এখন বলো, সরকারি চাকরি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিলেই কি দেশের তাবৎ লোককে দুধে-ভাতে রাখার ব্যবস্থা করা যাবে? দেশের আসল যা রোগ, দারিদ্র্য, তার চিকিৎসা না করে, কলকাতায় বসে কালনেমির লঙ্কা ভাগ হচ্ছে। কলকাতায় বসে ফতোয়া ঝাড়লে, তা সে যিনিই ঝাড়ুন, আমার ধারণা, তাতে দেশের লোকের এক তিল উপকার হবে না। সে তুমি প্যাক্টই করো আর যাই করো। 

মেজকর্তা অনেক দিন পর একটু গরম হয়ে উঠছেন যেন। অনেক দিনের অনেক কথা উৎসমুখে জমে ছিল। ধীরে ধীরে যেন গলতে শুরু করেছে। 

বললেন, আশ্চর্য আশ্চর্য সব ব্যাপার ঘটছে। বাইরে থেকে দেখলে তার যেন কোনও মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই পাটের কথাই ধরো। ভাবলেই আমার কেমন অবাক লাগে। বাংলা দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও পাট হয় না। অথচ পৃথিবীর সব দেশে বাংলার পাটের চাহিদা। এই পাট জন্মায় যে চাষি তাকে যদি পাটের দামের ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত, তা হলে এই একটা ফসল দিয়েই আমার ধারণা, আজ দেশের অর্ধেক চেহারা বদলে ফেলা যেত। সে তো দূরের কথা, আজ পাটের চাপে আমাদের চাষির জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। এক দিকে এই অবস্থা, আরেক দিকে চটকলের মালিকরা কোটি কোটি টাকা লাভ করছে। 

মেজকর্তার কথা শুনে সফিকুল চুপ করে গেল। মেদ্দা ছাহেব, ভক্ত ঘোষ, গদির লোকেরা চেয়ে রইল মেজকর্তার মুখের দিকে। 

মেজকর্তা বলতে লাগলেন: সাহেব কোম্পানিতে কাজ করলাম এত বছর। দেখলাম তো সব। এমন দরদী লোক থাকত যদি দেশে, এমন বিচক্ষণ সব নেতা, যারা এসে অভয় দিত চাষিদের, বুঝিয়ে বলত, তোমার গায়ের জল দিয়ে তৈরি ফসল নিয়ে অন্য লোকে মোটা টাকা লাভ করছে, এই আমরা পাটের ন্যায্য দাম ঠিক করে দিলাম, তার নীচে কেউ তোমরা পাট বেচো না। তোমরা সবাই যদি একমতে থাকো, তবে এই দামেই ওরা পাট কিনতে বাধ্য হবে। না যদি কেনে তবে সাধের কারখানা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তবে ইংরেজের জাত বেনের জাত, প্রাণ গেলেও ব্যাবসা বন্ধ করবে না, ওই দামেই পাট কিনবে বাধ্য হয়ে। ওরা শক্তের বড় ভক্ত। তা হলে দেখতে দেশের ভোল ফিরে যেত। কোনও নেতা একদিনের জন্যও এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, এমন তো শুনিনি। দেশের লোক নিয়েই তো দেশ। এরাই তো দেশের লোক। এদের দুর্দশা লাঘবের কথা না ভেবে, তার সুরাহার ব্যবস্থা না করে, দেশ দেশ বলে চেঁচানো যদি হুজুগ না হয়, তো হুজুগ আর কাকে বলে? একবার বলছি হিন্দুর জন্য হিন্দুর ভোট, মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের ভোট, আবার সেই সঙ্গেই বলছি হিন্দু মুসলিম ঐক্য। এ-সব ব্যারিস্টারি ভেলকিবাজিতে কাউন্সিলেই ঢোকা যায়। তার বেশি কিছু হয় বলে তো আমার মনে হয় না। 

মেজকর্তার হঠাৎ মনে হল, যেন কেরাসিন কাঠের বাক্সে দাঁড়িয়ে একটা লেকচার দিচ্ছেন। সেই পুরনো আমলের রোগ। অমনি তিনি মুখ বন্ধ করে ফেললেন। অনেক কথা মনের মধ্যে জমে উঠতে লাগল। কিন্তু না, আর বক্তৃতা নয়। সে-সব দিন চুকে গেছে। তবু, মেজকর্তা ভাবলেন, লোকে যে বলে ‘স্বভাব যায় না মলে’, কথাটা মিথ্যে নয়। 

সফিকুলের চোখে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ছবি ভেসে উঠল। এ ছবি সে দেখতে আদৌ অভ্যস্ত নয়। কিন্তু মাজেবাবুর কথা এত পরিষ্কার, ফটিক তা উড়িয়ে দিতে পারল না। ওর মনে কথাগুলো ধারালো কলম দিয়ে যেন লেখা হয়ে যেতে লাগল। 

মেজকর্তা উঠে পড়লেন। বেলা যে গড়িয়ে গেল। হাট সারতে দেরি হয়ে যাবে। 

শ্যাম রানার দু’খানা চিঠি তাঁর হাতে তুলে দিল। মেজকর্তা দেখলেন, একখানা চিঠি সুধাময়ের, কলকাতা থেকে আসছে। আরেকখানা ভূষণের, কোত্থেকে আসছে বোঝা গেল না। সুধাময়ের কলেজ বন্ধ ক’দিনের জন্য। সে আসছে বাড়িতে। ভূষণও আসছে বলে লিখেছে। 

বেলা পড়ে আসছে। মেদ্দা ছাহেবের সাঁঝের নমাজের সময় প্রায় হয়ে এল। নিয়মিত পাঁচ ওত নমাজ পড়েন মেদ্দা ছাহেব। একটু পরেই তিনি উঠবেন। মাথায় এবার একটা কাপড়ের টুপি পরবেন, তারপর একখানা শতরঞ্চি আর বদনাটা নিয়ে উঠবেন। চলে যাবেন নদীর ধারে। বদনায় পানি ফিরিয়ে উজু করে নেবেন, তারপর পরিষ্কার জায়গায় শতরঞ্চি বিছিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে নমাজ পড়বেন। ফকিরের দেওয়া একটা মালা আছে তাঁর। সেইটে জপতে জপতে ফিরে আসবেন আবার। 

সফিকুলও উঠব উঠব করছিল। মেজকর্তার কথাগুলো তখনও তার মগজে ঘোরাফেরা করছিল। 

এমন সময় সোনা মিঞা মুখটি চুন করে গদিতে ঢুকে পড়ল। 

আছছালাম ওয়ালেকুম বড় মিঞা। মেদ্দা ছাহেবকে সে সালাম দিল। 

ওয়ালেকুম ছালাম। মেদ্দা ছাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কী খবর, সোনা মিঞা? 

সোনা মিঞার বুক দুরদুর করে উঠল। কী করে কথাটা পাড়বে ভেবে পেল না। বদু কলুকে শেষ পর্যন্ত ধরতে পারেনি। রামকিষ্টোর সাহায্যে বলদটাকে অতিকষ্টে চাঙ্গা করে সে যখন খেয়াঘাটে গেল, তখন সব ভোঁ-ভোঁ। কোথায় বদু কলু আর কোথায় কে? চোখে অন্ধকার দেখল সোনা মিঞা। আগরওয়ালার খপ্পরে পড়তে ইচ্ছে হল না তার। গাড়িটাকে অন্যের জিম্মায় রেখে নতুন ফড়ে ধরবার আশায় এদিক ওদিক ঘুরঘুর করতেই মেদ্দা ছাহেবের গোমস্তা তুফান মিঞার সঙ্গে দেখা হল। লালি পাট আছে শুনে সে সোনা মিঞাকে গদিতে আসতে পরামর্শ দিল। তাই সে এসেছে। টাকার তার বড় দরকার। আবার ছায়াদটাও আজ বড় খারাপ। কী আছে নছিবে কে জানে? 

সাহস সঞ্চয় করে সোনা মিঞা বলল, জে, মন পাঁচেক কুষ্টা ছিল। 

মেদ্দা ছাহেব কথা শেষ করতে না দিয়েই ছোবহান আল্লাহ্ বলে উঠে পড়লেন। 

বললেন, নমাজের ওপ্ত হয়ে গেছে মিঞা। কুষ্টা এই সালে যাতে কিনতি পারি, যাই তার জন্যি খুদাতালার কাছে আর্জি পেশ করে আসি গে। যা দিনকাল পড়িছে উপরআলার মেহেরবানি না পালি কিনাকাটা সব খতম করে দিতি হবে নে। 

শেষ ভরসাও হাতছাড়া হয় দেখে সোনা মিঞা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। মেদ্দা ছাহেব নীচে নেমে আসতেই হুড়মুড় করে তাঁর পায়ে গড়িয়ে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। 

বলল, বড় মিঞা, আপনি মেহেরবানি না করলি জানে মারা যাই যে। 

আরে, পা ছাড় পা ছাড়, বেকুব। 

মেদ্দা ছাহেব অস্থির হয়ে উঠলেন। 

বললেন, গুণা হবে, গুণা হবে আমার। মুছলমান আল্লা রহুলের বান্দা, কারও পায়ে হাত দিলি দোজখে যাতি হয়। কোথাকার পাগল! 

সোনা মিঞা পা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার ছোট ছোট চোখের দু’কোণ বেয়ে মোটা মোটা জলের ধারা বুকের হাড়তোলা খাঁচার উপর পড়ে এবড়ো-খেবড়ো জমির উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে লাগল। 

বলল, গোস্তাকি মাফ করবেন বড় মিঞা। আজ আমার মাথার ঠিক নেই। ঘরে বিবি মরোমরো। ছাওয়াল নষ্ট হয়ে গিয়ে নাকি প্যাট পচে উঠিছে। ঝিনেদার বড় ডাক্তার না দেখালি বাঁচবে না। সরকারি ডাক্তাররি দেখাতি হবে। তা সে ষাট-সত্তর টাকার ধাক্কা। কিছু কুষ্টা ধুয়ে আনিছিলাম। দোহাই খোদার, কুষ্টা ক’টা নিয়ে নেন। ভাল লালি কুষ্টা আছে, নিজির চোখি রং দেখে নেন। 

মেদ্দা ছাহেব বললেন, বড় বিপদেই ফেললে মিঞা। বিক্রি নেই, শুধু কিনেই যাচ্ছি। তা খোদার যা ইচ্ছে। বলি আজকের দর জানো তো? সাড়ে তিন টাকা। 

সোনা মিঞা আঁতকে উঠল, কন কী বড় মিঞা? জানে মরব তালি। এ যে লালি কুষ্টা। রেশমের মতো মুলায়েম। লম্বায় মাথা ছাড়ায়ে যায়। এর দাম সাড়ে তিন টাকা! মাত্তর! 

মেদ্দা ছাহেব এবার একটু উগ্র হলেন। তুমি বড় ঘুঘু মিঞা। তুমারে চিনিনে, আজ কারে পড়িছ তাই মেদ্দার কথা মনে পড়িছে। ভাবিছ চোখের জলে পথ পিছল করে সড়সড়ায়ে চলে যাবা! সুখির দিন আগরওয়ালা বাপ সাজে, কই, সে বাপ এখন দেখে না ক্যান? অ্যাঁ! আগরওয়ালার কাছে গিয়ে তো কই ট্যাঁ-ফোঁ করো না। যত তড়পানি আমার কাছে! নরম মাটিতি বিড়েলে হাগে। 

বললেন, দ্যাখ মিঞা, বাহাসের সুমায় নেই। নমাজের ও পার হয়ে যাচ্ছে। দিতি হয় দ্যাও, টাকা নিয়ে বিবির ইলাজ করো গে। আর না হয় রাস্তা দ্যাখো। 

উপায় কী? মেপে দিল সোনা মিঞা, টাকা গুনে লুঙ্গির খুটে বাঁধতে বাঁধতে ভাবল, এই প্রথমবার ভাবল, এই পাটের দর আগরওয়ালা সত্যিই কি এত কম দিত? 

সফিকুলও বসে বসে ভাবছিল। একটু আগেই মেজবাবু এই ঘরে বসে বলে গেলেন পাটের চাপে এদেশের চাষির নাভিশ্বাস উঠেছে। মেজবাবু যা বলে গেলেন, তা সোনা মিঞা সফিকুলের চোখে যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল। সে ভাবছিল, সোনা মিঞা আর মেদ্দা ছাহেব দু’জনেই কি মুসলমান? একই মুসলমান? 

এমন কথা আগে আর ভাবেনি, এমন করে ভাবেনি সফিকুল। 

বারো 

রামকিষ্টো মেছোহাটায় গিয়ে ছোলেমানকে খুঁজে বের করল। দেখল, ছোলেমান, ছিরিপদ কৈবত্ত আর বুনো পাড়ার বিধু সদ্দার একত্র বসেছে। বুঝল, তিনজনে আজ জোট বেঁধে মাছ ধরতে গিয়েছিল। রামকিষ্টো খালুই এগিয়ে দিতেই ছোলেমান হাত বাড়িয়ে সেটা নিল। রেখে দিল তার পাশে। 

রামকিষ্টো বলল, মাজেবাবুর খালোই। কী মাছ ধরলি আজ? 

ছোলেমান বলল, ওই দুই কল্লার পাল্লায় পড়ে আজ জান বেরোতে গেছে চাচা। সারাদিন জাল বয়ে পালাম গিয়ে তুমার শোল আর সরপুঁটি। শোলগুলো বাড়িতি নিয়ে তো ছালুন রাঁধে খাতি হবে। হাট ভরতি শোল, কেনবে কেডা? সরপুঁটিগুলোই যা ভরসা। বড়ই আছে। চার আনা-পাঁচ আনা কুড়িই যদি বেচতে পারি, তালি দু’-আড়াই টাকা হতি পারে। 

রামকিষ্টো বলল, গিছিলি কোন পালি? 

ছোলেমান টিটকিরি কাটল, ওই যে ছিরিপদ, উনি আসে খবর দেলেন, আঠারোখাদার বিলি রুই মাছ, কাতল মাছ, উনার হাতে ধরা পড়ার জন্যি ছটফট ছটফট করতিছে— 

ছিরিপদ বলল, দ্যাখ ছোলেমানে, তুই তখনের থে আমার কুষ্টি কাটতি বসিছিস, ইবারে ছাড়ান দে। আচ্ছা কওদিন রামকিষ্টো দাদা, জলের মনে কী আছে কেউ কতি পারে? সবাই কয়, আঠারোখাদার বিলি বড় মাছ আছে, ভাবলাম দেখে আসি, তাই তিনজনে গাছো জাল নিয়ে গিছিলাম। সত্যি, দিনডা একেবারে মাঠে মারা গেছে। 

বোকার মতো হাসতে লাগল ছিরিপদ। গা জ্বলে গেল ছোলেমানের। 

বলল, কসনে, কসনে, বড় মুখ করে ও কথা কসনে ছিরিপদ। শুনলি, লোকে তোর জন্মে সন্দ করবে। পানি দেখে মাছের তল্লাস নিতি পারিসনে, সে কথা আবার জানান দিতিছিস! তুই ঠিক ঠিক কৈবর্তের ছাওয়াল তো? 

এইবার ছিরিপদ বেশ রেগে গেল। 

বলল, দ্যাখ, ফের যদি একটা কথা কস, এই কোচের এক ঘায় তোর মুখির দফা রফা করে দিবানে। 

বিধু সর্দার বলল, লাও ভাই, লাল সুতোর বিড়িটো খাও, খেইয়ে মেজাজটো ঠান্ডা করো। লাও রামকিষ্টো ভাই, তুমহিও একটো ধরাও। ঝগড়া রাগ করলে ছোল পুঁটি তো রুই কাতলা হয়ে উঠবেক নাই। 

বিড়ি ধরিয়ে রামকিষ্টো বলল, সরপুঁটি এক খালুই রাখিস ছোলেমান। মাজেবাবুরি শুধোয়ে আমি এক্ষুনি আসতিছি। 

কেঁড়েগুলো হাতে নিয়ে রামকিষ্টো ভিড় ঠেলে ঠেলে মেজকর্তার সন্ধানে বিশ্বেসদের দোকানের দিকে চলতে লাগল। 

.

হাটের মধ্যে কেন, এই অঞ্চলের মধ্যেই বিশ্বেসদের দোকান সব থেকে বড়। বছর তিরিশ আগে অনুকূল বিশ্বেস এই দোকানের পত্তন করেন। তাঁর ছেলে মকর বিশ্বেস বুকের রক্ত ঢেলে দোকানটাকে এমনিভাবে বাড়িয়ে তোলেন। মকর বিশ্বেসের বয়েস হয়েছে। লোহাজাঙ্গার তাঁতিসমাজের তিনি এখন মাতব্বর ব্যক্তি। হাটবারে ভিড় বেশি হয়, ছেলে গোপাল বিশ্বাস যথেষ্ট লায়েক, সে-ই এখন দোকানের কাজকর্ম দেখে, তবু হাটবারের ভিড় ঠেকাতে এখনও বুড়ো এসে দোকানে বসেন। 

লোকে বলে, মকর বিশ্বেসের টাকার সীমা নেই। বুড়ো হাড়-কেপ্পন। হাত দিয়ে জল গলে না। কিন্তু বিশ্বেসরা যে কোথায় টাকা রাখে সে সন্ধান কেউ জানে না। বারকয়েক বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, একটা তামার পয়সাও কোনওবার কেউ পায়নি। হাটের দোকান দু’বার লুঠ হয়েছে, মাল ছাড়া নগদ টাকা মেঝে ছুঁড়েও পাওয়া যায়নি। 

বিশ্বেসদের দোকানের তিনটে ভাগ। এক পাশে কাপড়-জামার দোকান, মাঝখানে মনিহারি, সাইকেল, তেল আর অন্য পাশে মুদিখানা। 

গোপাল বিশ্বেস যুবক। বয়েস তিরিশ-বত্রিশ। কিন্তু হাবেভাবে প্রৌঢ়। কালো মোটা চেহারা। পরনে ফিনফিনে রেলির ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ধুতি। তবুও তা পরার গুণে হাঁটুর উপর উঠেছে। গায়ে মলমলের পাঞ্জাবি, বোতামের ঘর বাঁ-কাঁধের দিকে। সোনার চেন-বোতাম। হাতের আট আঙুলে আংটি। গলায় সরু চেন হার। পরিপাটি পাতা কাটা সিঁথি। খুব পান খায় গোপাল 

দোকানের মাঝখানে উঁচু বেদি। আগে এখানে মকর বিশ্বেস আটহাতি মোটা ধুতি আর ফতুয়া পরে একা একা বসতেন। এখন গোপাল সেখানে নবরত্ন সভা বসিয়েছে। জাতে তাঁতি হলেও, সেই এখন এ-তল্লাটে হিন্দু সমাজের মাথা। সরকার মশাই, স্যান কবিরাজ, বুদো ভুঁয়ে, ইস্তক রিদয় ঠাকুরও গোপালের সভার নিয়মিত সভাসদ। গোপাল আগরওয়ালাকে গ্রাহ্য করে না। শিকড় নেই তার। টাকা রোজগার করতে এসেছে, রোজগার করছে কারবার ফেঁদে। ওর কথার দাম কী? কে মানে ওকে? এখানে ওর কোনও সমাজ নেই। মেদ্দা ছাহেবের গদির দিকেই গোপাল আড়চোখে মাঝে মাঝে চায়। ওই লোকটা এখানকার আর এক সমাজের মাথা। ধনে-দৌলতে শুধু নয়, মানে-মর্যাদায়ও লোকটা দিন দিন বাড়ছে। সরকারের ঘরে মেদ্দা ছাহেবের খাতির খুব। ওই জায়গাটায় গোপাল হার মেনেছে। 

নইলে ওর তুল্য কে? এই হাটের ইজারা ওর, খেয়াঘাটের ইজারা ওর, কেরাসিন তেলের সোল এজেন্সি ওর। সমাজের বামুন কায়েত ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ইচ্ছে করলে আঙুলের ইশারায় ওঠবোস করাতে পারে তাদের। কিন্তু সে ইচ্ছেই করে না গোপালের, কখনও করবেই না। ব্রাহ্মণ বর্ণশ্রেষ্ঠ, এ বিধির বিধান, গোপাল সেটা মানে। জানে সে বৈশ্য। রিদয় ঠাকুর বিধান দিয়েছেন বৈশ্যের জল, বিশেষ করে লক্ষ্মীর যে বরপুত্র, তার হাতের জল সমাজে চল। বাপের উপর এইখানেই টেক্কা মেরেছে গোপাল। তার পরিবারকে সমাজে উঠিয়েছে। তার ছেলের অন্নপ্রাশনে ব্রাহ্মণ এসে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন। কায়স্থ বৈদ্য পাত পেড়ে খেয়ে গিয়েছেন। আর তার জন্য গোপালকে বিদ্রোহ করতে হয়নি, ঘটা করে শুদ্ধি আন্দোলন করতে হয়নি, ভিক্ষুকের মতো কারও কৃপাপ্রার্থীও হতে হয়নি। শুধু সে একবার মনের ইচ্ছা সবিনয়ে প্রকাশ করেছিল মাত্র। শাস্ত্রমতেই সমাজ আপনা থেকেই তাকে কোলে তুলে নিয়েছে এখন, সত্য বলতে কী, গোপালই এখানকার সমাজের মাথা। হাটের ইজারা খেয়াঘাটের ইজারা, কেরাসিন করোগেট টিন আর সিমেন্টের সোল এজেন্সি যেমন তার, গোপাল জানে, এই সমাজও তেমন তার, তারই। তার এখন একটিমাত্র বাসনা, সরকারের সঙ্গে একটু দহরম-মহরম করে। কিন্তু সেখানে যে ওই মেদ্দাটা আগে থেকেই পাত বিছিয়ে বসে আছে। লোকে যে বলে, না’ড়েরা বড্ড সরকারের পা-চাটা হয়, তা সে-কথাটা নিতান্ত মিথ্যে নয়। মেদ্দা ব্যাটা আবার তা সবার ঘাড়ে পা দিয়ে চলে। 

মেজকর্তা দোকানে ঢুকেই দেখেন গোপালের মজলিশ বেশ জমেছে। বুদো ভুঁয়ে হাত-পা নেড়ে কী যেন বলছিল, মেজকর্তাকে দেখেই কলকল করে উঠল। 

আসেন আসেন মাজে খুড়ো। বসতি আজ্ঞে হয়। ও গুপাল, তুমার এখেনে তো আবার চায়ের বন্দোবস্ত নেই, মানী লোকরা আসবে ক্যান তুমার এখানে, তা মাজে খুড়োর জন্যি টিকে ধরাতিই কও। 

গোপাল গম্ভীরভাবে হুকুম দিল, ওরে, খুড়ো মশাইরি তামুক দে। 

বুদো ভুঁয়ে বলল, শুধু ধুঁয়ো ঠ্যাকালি আজকাল আর চলবে না গুপাল, বুঝিছ, চা-র ব্যবস্থাও করে ফেলো। সত্যিই মেদ্দার তুলনায় আমাগের আসরডা হল শুষ্কং কাষ্ঠং, কী কন স্যানমশাই? 

মেজকর্তা হাসতে হাসতে খোঁচাটা হজম করলেন। 

বললেন, সর্বনাশ! বুদো, তুমিও কি শেষে চাচার চর হয়ে উঠলে? সবাইকেই ওই দলে ভেড়াবে নাকি শেষ পর্যন্ত! 

বুদো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। 

বলল, ক্যান খুড়োমশাই, ও কথা কলেন ক্যান? 

মেজকর্তা বললেন, এক চা দু’বার চাইলেই তো চাচা হয়ে গেল হে। 

সভাসুদ্ধু সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বুদো ভুঁয়ের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। বোকার মতো হাসতে লাগল সে। 

সরকার মশাই বললেন, মাজেবাবুর বোড়ের চালেই আমাগের বুদোবাবু মাত। 

মেজকর্তা বললেন, গোপাল, মন দুয়েক চাল পাঠিয়ে দিয়ো তো। 

সরকার মশাই বললেন, কন কী মাজেবাবু, দেওয়ানবাড়ির এই অবস্থা হয়েছে নাকি আজকাল। এখনই চাল কিনে খাতি হচ্ছে? 

মেজকর্তা বললেন, তালপুকুর হয়ে উঠেছে দেওয়ানবাড়ি। ঘটিও ডুবছে না। গোপাল, আর-এক টিন কেরাসিন তেল পাঠিয়ে দিয়ো। 

গোপাল বলল, খুড়োমশাই, কেরাসিনির টিন পরশু পালি কি খুব অসুবিধে হবে? সাদা তেল আর নেই। কুঠির সাহেবের ওখেনে চার রাত্তির যাত্তারা হবে। সকালে লোক পাঠায়ে বারো টিন তেল নিয়ে গেছে। 

সবাই অমনি কুথাকার দল, কুথাকার দল করে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। 

গোপাল বলল, কলো তো ছিরিচরণ ভাণ্ডারীর দল। 

তামাক দিয়ে গেল। মেজকর্তা দু’টান দিতে না দিতেই রামকিষ্টো এসে হাজির। 

বলল, মাজেবাবু, দুধ কিনিছি। ছোলেমান ভাল সরপুঁটি আনেছে। খালোই রাখে আইছি। নেবেন নাকি? 

মেজকর্তা বললেন, এক খালোই ন্যাও গে যাও, আমি আসছি। 

রামকিষ্টো বেরিয়ে যেতেই দোকানের এক কর্মচারী এসে জানাল, কত্তাবাবু মেজকর্তাকে ডেকেছেন। 

.

যেখানে কাপড় বিক্রি হয় মকর বিশ্বেস এখন সেখানে বসেন। মেজকর্তা আসতেই তাঁকে একেবারে পাশে নিয়ে বসালেন। এখনও তাঁর পরনে সেই চিরকেলে সাজ, সেই আটহাতি ধুতি আর ফতুয়া। 

মকর বিশ্বেস বললেন, এই যে মহি, অহির খবর কী? আজকাল আর বেরোয়-টেরোয় না, নাকি? অনেক দিন দেখিনি। 

 মেজকর্তা বললেন, ম্যালেরিয়া ধরে বড়দাকে খুব কাবু করে দিয়েছে। পারতপক্ষে বেরোন না।

মকর বিশ্বেস জিজ্ঞাসা করলেন, শীতল কনে এখন? ওর বউ নাকি সুস্থ হয়েছে একটু? সেইরকম য্যান শুনলাম। 

মেজকর্তা বললেন, শীতল এখন কালীগঞ্জ থানায় আছে। লিখেছে তো, শিগগির মাগরোয় বদলি হবে। তখন একবার বাড়ি আসবে। তা ওর কথা— মেজকর্তা থামলেন একটু। 

তারপর বললেন, ছোটবউমার ব্যাপারটা বড় আশ্চর্য। দশ বছর ধরে কত রকম চিকিৎসেই তো হল। কিন্তু কিছুতেই ভাল হলেন না। বুড়ির ছেলে হবার সময় কী যে হল, একেবারে ভাল হয়ে গেলেন। 

মকর বিশ্বেস বললেন, সব তাঁরই ইচ্ছে। কীসির থে যে কী হয়, বুঝা ভার। তা তুমার নাতি যাবে কবে? যাব যাব ভাবি নাতিরি দেখতি, তা সুমায় আর করে উঠতি পারিনে। জামাই কি আয়েছেন? 

মেজকর্তা বললেন, চিঠি এসেছে জামাইয়ের। আর কী, এসে পড়লেন বলে। 

মকর বিশ্বেস বললেন, তুমার আর ছুটি ক’দিন আছে? 

মেজকর্তা বললেন, ছুটি তো ফুরিয়েছে অনেক দিন। কাজে যাবার আর ইচ্ছে নেই। ভালও লাগে না এই বয়সে বিদেশে একা একা পড়ে থাকতে। ভাবছি এবারে গিয়ে ইস্তফা দেব। 

মকর বিশ্বেস বললেন, তবে তো বড় সুমায় তুমারে ডাকিছি। সবই দেখতিছি ভগবানের ইচ্ছে। দ্যাখো মহি, অনেক দিন ধরে একটা কথা ভাবতিছি। আমাগের ধারেকাছে কোনও ইস্কুল নেই। হয় মাগরো আর না হয় গাঙ পেরোয়ে সেই হরিশঙ্করপুর। ইস্কুলির অভাবে এদিককার ছেলেপেলেরা মুখু হয়ে থাকতিছে। আমার ইচ্ছে একটা ইস্কুল হোক। টাকা দু’-পাঁচ হাজার লাগে, আমি দিবানে। আমার ভাবনা, ম্যাও ধরে কিডা! এখন তুমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ভগবান হয়তো কাজডা করালিউ করাতি পারেন। তুমি তো চাকরি ছাড়বাই ঠিক করিছ। এখন ভাবে দ্যাখো, ব্যাগারডা খাটবা কি না? 

মকর বিশ্বেস চুপ করলেন। মেজকর্তা অপ্রত্যাশিত এ প্রস্তাবের জবাব চট করে দিতে পারলেন না। এই গ্রামে ইস্কুল করা, এ যে তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন। কিন্তু মকর বিশ্বেস এতদিন চুপ করে ছিল কেন? এখন তাঁর যৌবন বয়ে গিয়েছে, ভাঁটা পড়েছে উৎসাহ উদ্যমে। দেহযন্ত্রের নাট বল্টু আলগা হয়ে পড়েছে। এই শিথিল শরীর নিয়ে পারবেন কি এত বড় একটা দায়িত্বের ভার কাঁধে তুলে নিতে? 

মকর বিশ্বেস বললেন, এদিককার কেউ যদি এ কাজ পারে, তবে একমাত্র তুমিই পারবা। তুমি একটু ভাবে দ্যাখো। যাওয়ার আগে জবাব দিয়ো। 

মেজকর্তা কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় হাটের মধ্যে তুমুল গন্ডগোল বেধে গেল। 

.

ছোলেমানকে নিয়েই হাঙ্গামাটা পাকল। 

হাটের গোমস্তা নিরাপদ রিদয় ঠাকুরের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। যেমন মাতাল তেমনি লোভী। ওর তোলা তোলার বিরুদ্ধে হাটসুদ্ধ ব্যাপারীর মনে নালিশ জমে আছে। দুটো পেয়াদা নিয়ে হাটময় ঘুরে বেড়ায়, আর যার যা ভাল জিনিস খপ খপ করে তুলে নিয়ে ধামায় ফেলে। 

ছোলেমানের ডালায় বড় বড় সরপুঁটি দেখে লোভ সামলাতে পারেনি নিরাপদ। খপ খপ করে চারটে মাছ তুলে নিতেই ছোলেমান ‘আরে আরে ঠাউর, করো কী’ বলে তার হাত থেকে মাছ কেড়ে নিয়েছে। 

বলল, মাছ দেখলিই বুঝি খাবল দিতি ইচ্ছে করে! মারে দিলি বড় ভাগটা, না। 

নিরাপদ নেশায় টলছিল। তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। 

চেঁচিয়ে বলে উঠল, শালা নিকিরি, তোর এত বড় আস্পদ্দা, আমার হাটে বসে তুই আমার গায়ে হাত তুলিস! বামন হয়ে চাঁদ পাড়তি চাস! বেচাচ্ছি তোর মাছ! 

নিরাপদ একটানে ডালার মাছ মাটিতে ফেলে দিল, আরেক টানে চুবড়ির মাছ দিল ছড়িয়ে। তারপর বড় বড় সরপুঁটিগুলোকে দু’পায়ে মাড়াতে লাগল। 

আর বলতে লাগল, ব্যাচ শালা, মাছ ব্যাচ, হারামজাদা, মাছ ব্যাচ। 

আকস্মিক এই ব্যাপারে ছোলেমান থ হয়ে গেল। কিছু বুঝতে পারছিল না সে। তার চোখের সামনে চকচকে মাছগুলো শিলাবৃষ্টির মতো ছড়িয়ে পড়ল। এই দ্যাখ করে কী, লাথি মেরে মেরে মাছগুলোরে করে কী ঠাউর? একটু আগেই মাছগুলো তার ডালায় ছিল। রুপোর মতো চকচক করছিল সরপুঁটিগুলো। পড়ন্ত রোদ্দুরে কী সুন্দর জেল্লা বেরুচ্ছিল ওগুলোর গা দিয়ে! ছোলেমান দেখল, মাছগুলো হঠাৎ তার ডালা থেকে যেন উড়ে গিয়েই প্যাঁচপেচে কাদায় পড়ল। যাঃ, ডালির মাছগুলোও গেল! ওই যে, ঠাউর কী নিষ্ঠুর আক্রোশে পা দিয়ে থেঁতলে দিচ্ছে। আহা, অমন রুপোর শরীর কাদা লেগে কালো হয়ে উঠল। এই দ্যাখো, প্যাট প্যাট করে কেমন পিত্তি গলে যাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, মাছগুলো তার। তার আজকের পেটের ভাত জোগাবার একমাত্র সামগ্রী। আর তার ওই দশা! বিস্ময়ের ভাবটা কেটে যেতে লাগল ছোলেমানের। তার মাছের ওই দশা করছে! ওই মাতাল, বদমায়েশ তারই চোখের উপর তার সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলকে লাথিতে লাথিতে ওইভাবে বরবাদ করে দিচ্ছে! 

খাবে কী সে? কীসের ভাগ দেবে ছিরিপদকে? বিধু সদ্দারকে? 

হঠাৎ যেন ছোলেমানের ভাবনা চিন্তা বন্ধ হয়ে গেল। তার মাথাটা খালি, একেবারে খালি হয়ে গেল। এক সেকেন্ড, দু’সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড। তারপর— 

প্রচণ্ড ক্রোধের আগুন ছোলেমানের মগজে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। চৈত্র মাসে খড়ের ঘরে যেন খপ করে আগুন লেগে গেল। দমকে দমকে বেড়ে উঠল সে আগুন। ছড়িয়ে পড়ল তার শিরা-উপশিরায়। খুন চেপে গেল তার। চোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরুতে লাগল। 

বাঘের মতো হুংকার দিয়ে উঠল ছোলেমান, শালার বামুন, তোর গুষ্টির জাত মারি। 

বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল নিরাপদের ঘাড়ে। ঠাস করে মারল এক চড়। ছোলেমানের এক চড়ে বাবা গো বলে নিরাপদ উলটে পড়ল। ছোলেমান তার বুকে হাঁটু দিয়ে গলা টিপে ধরল। পেয়াদা দুটো প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল ছোলেমানের ওপর। লাথি কিল চড় সমানে মারতে মারতে নিরাপদকে অতিকষ্টে ছোলেমানের কবল থেকে রক্ষা করল। লোকজনের ভিড় বাড়ল। মজা দেখতে অনেকে এগিয়ে এল। সাবধানীরা দশ হাত দূরে পালাল। লোকের পায়ের চাপে ছোলেমানের মাছের ডালা চুবড়ি, মেজকত্তার খালুই একসঙ্গে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এদিক ওদিক ছড়াল মাছ, কিছু পায়ে পায়ে থেঁতলে গেল। কিছু গেল লোকের হাতে হাতে। 

একটু দূরে, একটা পাগল; গাছের ডালে সরসর করে উঠে গিয়ে নাচতে নাচতে বগল বাজাতে লাগল, লাগ ভেলকি লাগ, ঘুরে ফিরে লাগ, কার আজ্ঞে, বাবা নারদের আজ্ঞে। 

একসময় পা ফসকে পড়ে গেল পাগল। তখন সেদিকে শোরগোল উঠল। কিছু লোক দৌড়োল সেদিক, কিছু লোক ভাগল। 

রামকিষ্টো দু’হাতের জোরে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে যখন মেছোহাটায় এল, তখন ছোলেমানের অবস্থা বেশ খারাপ। মারের চোটে তার কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। দুটো যমদূতের মতো পেয়াদা তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলেছে বিশ্বেসদের দোকানে। নিরাপদ গাল ফুলে গেছে, নেশাও ছুটেছে। সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। আর পেয়াদা দু’জনের আগে আগে যাচ্ছে। ছোলেমান পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে আছে। তার চোখ দিয়ে শুধু আগুন ছুটছে। 

বিশ্বেসদের দোকানের সামনে ভিড় আর ধরে না। পেয়াদা দুটো ছোলেমানের হাত গামছা দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে। 

নিরাপদ কাঁদতে কাঁদতে নালিশ করল, ছোলেমান তোলা দিতে চায়নি। সে অতি ভদ্রভাষায় বলেছে, তোলা না দিলে হাটের মালিকের চলবে কী করে! তার উত্তরে ছোলেমান অশ্রাব্য ভাষায় বাপ-মা তুলে গালাগাল দিয়ে তাকে বেদম মেরেছে। পেয়াদা দুটো না থাকলে আজ নিরাপদর হয়ে যেত। 

শোনামাত্র বুদো ভুঁয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কী, না’ড়ে হয়ে বামুনের গায়ে হাত তোলা, এত বাড় বাড়েছে না’ড়েগের! দেশে আর বাস করা যাবে না দেখতিছি! গুপাল, এর নেহ্য বিচার তুমার করতি হবে। 

গোপাল নিরাপদর নালিশ শুনেই ঘটনার মধ্যে মেদ্দা ব্যাটার উসকানি আবিষ্কার করে ফেলেছে। নইলে সামান্য নিকিরি তোলা দিতে অস্বীকার করে! এত সাহস পায় কোথায়! 

গোপাল নেমে এসে হুংকার দিল, শালা, তুমি ভাবিছ, বড় গাছে দড়া বাঁধিছ, না? নিরাপদ, মার শালার মুখে দশ ঘা জুতো। 

ছোলেমান বলতে গেল, বাবু— 

বুদো ভুঁয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, চোপ শালা। 

সে-কথা শোনামাত্র নিরাপদ বীরবিক্রমে এক পাটি জুতো তুলে নিয়ে পটাপট মারতে লাগল ছোলেমানের মুখে। একটা কথাও বলল না ছোলেমান। কোনও প্রতিবাদ করল না। 

মেজকর্তা এসে মাঝপথে নিরাপদকে থামিয়ে দিলেন। তাঁর মুখ চোখ থমথম করছে।

গোপালের দিকে চেয়ে শুধু বললেন, গোপাল, ওকে ছেড়ে দিতে বলো। বিচার করে সাজা দিয়ো। ন্যায়-অন্যায়ের বিচার গরম মেজাজে করা যায় না। সময় লাগে। 

মেজকর্তার গলার স্বরে কী ছিল কে জানে, গোপাল তাঁর কথা অমান্য করতে পারল না। ছোলেমানকে ছেড়ে দিতে হুকুম দিল। 

ছোলেমান ছাড়া পেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। 

মেজকর্তা বললেন, যা, বাড়ি যা। 

ছোলেমান মেজকর্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল। তার চোখ দুটো টলটল করে উঠল। কী একটা বলতে গিয়ে বলল না। নিদারুণ অপমানে লজ্জায় মুখ নিচু করে তপ্ত গনগনে মন আর জর্জরিত দেহ টানতে টানতে ভাঙা হাটের ভিড়ে মিশে গেল। 

তেরো 

দুই ভাই মুখোমুখি বসে ছিলেন। অনেকক্ষণ। কথা ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন বিশ্রাম। দুপুর-গড়ানো রোদ এখন আলস্য ঢালছে। মেয়েদেরও হেঁশেলের পাট চুকে গেছে। ঘরে ঘরে তারা মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। 

দুই ভাই শুধু বসে আছেন মুখোমুখি। বড়কর্তা স্বভাবতই কৃশ। সম্প্রতি ম্যালেরিয়া তাঁকে আরও কাবু করেছে। তাঁরও মাথায় টাক, তবে সে শুধু চাঁদিটুকুতে। তারপরেই বেশ চুল আছে। যাত্রাদলের রাজমন্ত্রীরা যে ধরনের পরচুলো মাথায় পরে, অনেকটা সেই ধরনের। কানেও উঁকি-মারা চুল এবং বুকে লোমের বাহার। সবেতেই পাক ধরেছে। 

বড়কর্তা চুপচাপ বসে বসে বুকের খাঁচায় পুরনো ঘি ডলতে লাগলেন। শ্লেষ্মা কুপিত হওয়ায় ক’দিন ধরে বড় কষ্ট পাচ্ছেন। রাত্রে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। 

কিন্তু সেই কারণে বেশি ভাবছেন না বড়কর্তা। শরীর থাকলেই আধি-ব্যাধি থাকবে। শরীর ব্যাধির মন্দির। যত বয়স বাড়বে ততই পাড়ু হবেন রোগে। হতেই হবে, এ তো জানা কথা। না, সেজন্যে ভাবছেন না বড়কর্তা। তিনি ভাবছেন, হাজরাহাটির সাত বিঘে জমির কথা। বড় ভাল আমন জমি। রাখতে পারলে বছরে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ মন চাল ঘরে উঠত। কিন্তু ও-জমি রাখা যাবে না। এই বয়সে, এই শরীরে, ছয়-সাত মাইল ঠেঙিয়ে ওই জমিতে চাষের তদারক করা আর পোষায় না। না, আর নিজে না দেখলে কি চাষ ওঠে? 

তিন-চার বছর ধরে কাহিল হয়ে পড়েছেন বড়কর্তা। তেমন চলাফেরা করার তেজ ফুরিয়ে এসেছে তাঁর। তাই যে মুহূর্তে ঢিল দিয়েছেন তিনি, সেই মুহূর্ত থেকে চারিদিকে ছড়ানো জমিজমা বাপের বেয়াড়া ছেলের মতো ব্যবহার শুরু করেছে। আয়ত্তে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে ক্রমশ। আয় কমে আসছে সংসারের। বড়কর্তার ক্ষমতা যতদিন অটুট ছিল, ততদিন সংসারের চাকা গড়গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়েছে। কাউকে কিছু ভাবতে হয়নি। ভাবনা-চিন্তার ছোঁয়া ভাইদের গায়ে যাতে না লাগে প্রাণপণে সে চেষ্টা তিনি করে এসেছেন। বুড়ির বিয়েতে দেনা করতে হয়েছে, ছোটবউয়ের চিকিৎসাতেও দেনা জমেছে, দেনা করেই তো পৈতৃক দুর্গোৎসব চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তার খবর সামান্য কিছু মহি জানে, পুরো জানেন তিনি, আর জানেন বুড়ো মকর বিশ্বেস। 

মহি হুট করে কলকাতায় পড়া ছেড়ে দিয়ে এল, এম. এ-টা আর পড়ল না। গ্রামে এসে ইস্কুল খুলল বিনা পয়সায়। ছোটলোকদের উন্নতি নিয়ে মেতে উঠল। জাতিভেদ উঠিয়ে দেবার জন্য কোমর বেঁধে লেগে পড়ল। বছর দুয়েক গ্রামে ছিল। কী বক্তৃতাটাই না করেছে! শুধু বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালে হয়তো অতটা হইচই উঠত না। যা ও তখন বলেছে, তা কাজেও করেছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাঁড়াল মুচি ডোমের হাতের জল খেয়েছে। মুসলমানের রাঁধা খাদ্য খেয়েছে। বাবা বেঁকে দাঁড়ালেন ওর কাজে, সমাজ মার মার করে উঠল। রটে গেল, মহি বেহ্ম হয়েছে। কলকাতায় নাকি এক বেহ্ম-মেয়ের সঙ্গে বিয়েও ঠিক করে এসেছে। কিন্তু কোথায় কী? বেহ্ম-মেয়ে নয়, বাবার ঠিক-করা পাত্রীকেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করল মহি। তিক্তবিরক্ত হয়ে একদিন গ্রামও ছাড়ল। বার্কমায়ার কোম্পানিতে সামান্য চাকরি জুটিয়ে ডোমার রওনা দিল। কলকাতায় গেল না কেন, সে এক রহস্য। সেখানে গেলে একটা ভাল চাকরিই পেতে পারত। ছেলে তো সে ভাল। 

অবশ্য কলকাতায় গেলেও গ্রাম ছাড়তে হত। ডোমার গিয়েও তাই করেছে মহি। বাবা মধুপুরের সাহেবকে ধরে শীতলকে দিলেন পুলিশে ঢুকিয়ে। আর সংসারের বড় ভারী জোয়ালটা দিলেন তাঁর কাঁধে চাপিয়ে। সেই জোয়ালই তিনি এতদিন টেনে এসেছেন সাধ্যমতো। টেনেছেন মুখ বুজে। এখন বড় ঠেকে পড়েছেন। 

শুধু শরীরের দিক থেকে নয়, মনের দিক থেকেও ঠেকে পড়েছেন বড়কর্তা। এখন কেবল মনে হয়, হিসেবে বুঝি ভুল হয়ে গিয়েছে। জমির উপর জোর না দিয়ে ব্যাবসা-ট্যাবসায় মন দিলেই ভাল হত হয়তো। মকর আর তিনি তো একই বয়সি, একই সঙ্গে জীবন আরম্ভ করেছেন, অথচ দেখো, শেষ বয়সে মকর কী জমাল আর তিনি কী জমাতে পারলেন! 

যে ভাবনাটা তাঁর এখন হচ্ছে, সেটা জীবনের শুরুতেই কেন ভাবেননি? এখন বড় আপশোস হয় তাঁর। 

জমিদারি করবার সাধ কখনও মনে জাগেনি তাঁর। তবু-যে জমির পিছনে ছুটেছেন সারাজীবন, সে শুধু নিশ্চিন্তে অনায়াসে দুধে-ভাতে থাকবার লোভে। খেতের ধানের ভাত খাব, বাড়ির পুকুরের মাছ খাব, নিজের গোয়ালে গোরু থাকবে, সেই গোরুর দুধ খাব, আর বারবাড়িতে শতরঞ্চি বিছিয়ে দাবা পাশা খেলব; কোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে যাব না— এই ছিল আশাটা। সে আশা যে মরীচিকা, সে আশা কুহক স্বপ্ন, তা তো জানা ছিল না আগে। যখন জানা গেল, তখন বেড়াজালে ভয়ানক জড়িয়ে পড়েছেন বড়কর্তা। জাল কেটে বেরিয়ে আসবার আর উপায় নেই। 

ধীরে ধীরে অনেক কিছুই শিখলেন। বুঝলেন, ভদ্র গৃহস্থ যারা, নিজে হাতে লাঙল ঠেলতে যারা পারে না, পারবেও না, তারা যদি গৃহস্থালি রাখতে চায় তবে তাদের দয়া ধর্ম ভদ্রতা বিসর্জন দিতে হবে। কিষানকে এমনভাবে দাবিয়ে রাখতে হবে, যাতে সে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। চোখে-ঠুলি-বাঁধা কলুর বলদের অবস্থায় চাষিকে নিয়ে যেতে না পারলে, ও হারামজাদাদের কাছ থেকে আর কাজ পাওয়া যাবে না। বড়কর্তার নরম মন, তিনি কখনওই পুরো পাওনা আদায় করতে পারেননি তাঁর প্রজা-চাষিদের কাছ থেকে। তাঁর ভদ্রতা, তাঁর মমত্ববোধের সুযোগ নিয়ে প্রচুর ঠকিয়েছে তারা বড়কর্তাকে। শয়তান, আস্ত শয়তান সব। মহিটা পাগল, এইসব স্বার্থসর্বস্ব কুটিল লোকগুলোর হিত করবার আশায় সময় নষ্ট করেছে। মহির ধারণা, চাষা ব্যাটারা খুব সরল, এক-একটা ধোয়া তুলসীর পাতা! হুঁঃ! 

এখনকার বড়কর্তা যেন সেই আগের আমলের নাবালক বড়কর্তাকে সেরেস্তার কাজ বুঝাতে বসলেন। তোমার নিজের যদি কিষান থাকে তবে তাকে এমনভাবে রাখো, যাতে সে পুরো পেট খেতে না পারে, তার পেটে খিদের আগুন জ্বলতে থাকলে সে আরেকবার খাবার আশায় তোমার কাজটি হাসিল করে দেবে। পেট ভরে খেতে দিয়েছ কি মরেছ। সে তখন একটু গড়াতে চাইবে, বসে বসে তামুক পোড়াবে, দু’-চারটে খোসগল্প করে সময় নষ্ট করবে। যদি ভাগচাষে জমি করো, তবে দেখো, চাষির ঘরে যেন ছিটেফোটাও বাড়তি খাবার না থাকে। ঋণের দায়ে সে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে তোমার কাছে বাঁধা থাকে। তবে চাষির জাত শায়েস্তা হবে। তবে তোমার গোলা ভরবে। বুদো ভুঁয়েকে দেখো, সরকার মশাইদের ক্রিয়াকর্ম লক্ষ করো। তোমার চেয়ে অনেক কম জমি বুদো ভুঁয়ের, অনেক খারাপ জমি সরকার মশায়ের কিন্তু তারা চাষিদের চিনেছে, ঠিক চিনেছে, ভদ্রতা ছাড়তে পেরেছে, পেরেছে বলেই ধান খন্দ তাদের গোলা থেকে উপচে পড়ছে। 

কিন্তু বড়কর্তাকে তাঁর গৃহস্থালি ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে, কারণ তিনি লোকটি বড় ভদ্র। দয়ামায়াটা তিনি ছাড়তে পারেননি। খাতকরা তাঁর কাছ থেকে টাকা ধার নেয়, তিনি সে টাকা সব সময় আদায় করতে পারেন না। সময় বুঝেই যেন ব্যাটাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে, আর এমনই খারাপ হয় যে, নিতান্ত পাষাণ হৃদয় না হলে টাকার কথা উচ্চারণই করা যায় না। বেশ, অসময়ে না হয় টাকা দিতে না পারলি, সময়ে শোধ দে। তখন কোনও ব্যাটার টিকিও দেখা যায় না। ভাগচাষিরা বীজ নিয়ে যায়, সারের টাকা নিয়ে যায়, অথচ পারতপক্ষে তাঁর জমি চষে না। বীজ, সারের টাকা খেয়ে ফেলে। তারপরে এসে পায়ে ধরে। বদমায়েশগুলো জানে গ্রামের মধ্যে এই একটা মানুষ আছে— বড়কর্তা, পা জড়িয়ে ধরতে পারলেই যার কাছ থেকে মাফ পাওয়া যায় সব অপরাধের। 

আর কৃতজ্ঞতার বদলে এইসব চাষি তাঁকে ধান দেয় না, কলাই সরষে দেয় না, তবে কী দেয়? দেখা হলেই সেলাম দেয়, দেবতার মতো খাতির করে। ভাগের ভাগ ফসল কড়ায় ক্রান্তিতে শোধ দেয় তাদেরই, যারা নাদনা উঁচিয়ে বসে থাকে, দেনা-পাওনায় কড়া-ক্রান্তি কারচুপির চেষ্টা করলে যারা বুকে বাঁশ ডলে তা আদায় করে নেয়, যাদের ওরা দু’বেলা গাল না দিয়ে জল খায় না। এই আমাদের চাষি! 

এ-সব জানা সত্ত্বেও জমির কুহকে ভুললেন কেন বড়কর্তা? কেন শুধু জমির পর জমিই কিনে চললেন? ভুল ভুলই। হয়তো ভেবে থাকবেন, জমির পরিমাণ বেশি থাকা ভাল। কিছু কিছু করেও ফসল যদি সব জমি থেকে আসে তা হলে ওই যে যাকে ‘রাই কুড়িয়ে বেল’ বলে তাই হতে পারে। 

আজ বুঝছেন, সে হিসেবেও ভুল হয়েছে তাঁর। তাই কয়েক বছর ধরে জমি বেচতে শুরু করেছিলেন। দূরের দূরের জমিই বেচে দিচ্ছেন প্রথমে। দিয়ে দেনা শোধ করছেন। 

হাজরাহাটির এই জমি মহির টাকায় কেনা। বড়কর্তা জানেন, মহি এ-সব ব্যাপারে তাঁর কথার উপর কথা বলবে না। তবু যে তাঁর মতামত জানতে চাইছেন সে জমিটা মেজকর্তার টাকায় কেনা হয়েছে বলে নয়, মেজকর্তা বাড়িতে আছেন বলেই। বড়কর্তার সিদ্ধান্তের কোনও প্রতিবাদ মেজকর্তা করেননি। 

কথাবার্তা চুকে গিয়েছে। দুই ভাই মুখোমুখি বসে আছেন চুপ করে। বড়কর্তা বুকে পুরনো ঘি সমানে ডলে যাচ্ছেন। তার দুর্গন্ধে ঘরের দুপুর ভারী হয়ে উঠেছে। একটা জলচৌকির উপর তামার টাটে কতকগুলো পুরু পুরু আকন্দপাতা পড়ে আছে। পুরনো ঘিটুকু ডলা শেষ হলে ওগুলোর কাজ শুরু হবে। 

বড়কর্তা ঘড়ঘড় করে কেশে উঠলেন। বুকের খাঁচাটা কাশির দমকে ফুলে ফুলে উঠে আবার চুপসে গেল। বড়কর্তার অর্শের ব্যথাটায় চাড় লাগায় জায়গাটা দপ দপ করতে লাগল। কী রকম একটা বিরক্তি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। ঘি ডলে ডলে হাতটাও ধরে এসেছে। 

মেজকর্তা আগুনের মালসাটা চুপিসারে টেনে নিলেন। একটা আকন্দের পাতা আগুনের আঁচে গরম করে বড়কর্তার হাতে দিলেন। 

বললেন, হয়েছে, এবার সেঁক দিতে থাকুন। 

বড়কর্তা হাত বাড়িয়ে গরম পাতাটা নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। একটা কাশির বেগ এল, কিন্তু কাশিটা এবার চাপতে পারলেন বড়কর্তা। চাপতে পেরে খুশিই হলেন। আকন্দের তাতটায় বেশ আরাম লাগছে। 

.

কারও মুখে কথা নেই। দু’জনে শুধু বসে থাকলেন মুখোমুখি। 

জমিজমার ব্যাপারে মেজকর্তা কোনওদিনই কোনও কথা বলেননি, আজও বললেন না। ও-জিনিস তাঁর মাথায় একদম ঢোকে না। বড়কর্তা যা বললেন তিনি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে তাতেই সায় দিয়ে গেলেন। সব না জানলেও এটা তিনি জানেন, সংসারের মাথায় একটা বিরাট দেনার বোঝা চেপে আছে। 

চাকরিটা ছেড়ে এলে এক থোক টাকা পাওয়া যাবে কোম্পানির কাছ থেকে। একটু বুঝে চলতে পারলে সুধাময়ের রোজগার পর্যন্ত ওই টাকায় চালানো যেতে পারবে। অবশ্য আর-একটা খরচ আছে, চাঁপার বিয়ের। তার এখন দেরি আছে, বছর তিন-চার তো বটেই। তার মধ্যে সুধাই দাঁড়িয়ে যেতে পারবে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে সুধাময়। ফাইন্যাল দেবে। এ বছর। ক’টা দিন আর! 

সুধা খুব বুদ্ধিমান ছেলে, তার জন্য মেজকর্তার কোনও দুর্ভাবনা নেই। 

মেজকর্তার মনে দুর্ভাবনা দেখা দিয়েছে অন্য কারণে। গহর এসে আজ সকালে যে খবর দিয়েছে, সেটা মোটেই সুবিধের নয়। তখন থেকে তিনি সেই কথাটাই ভাবছেন। 

ছোলেমানের ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াবে। কতদূর যেতে পারে, মেজকর্তা সে-কথাই ভাবছিলেন। 

গোপালের নির্দেশে নিরাপদ দশজনের সামনে ছোলেমানকে যখন জুতোর বাড়ি মারছিল, মেজকর্তার চোখে তখন জুতো মারার বর্বরতাটাই খুব প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছিল। ছোলেমান কোনও অপরাধ করেছে কি করেনি, সেটা তিনি জানেন না। সেটা তাঁর কাছে বড় বলে মনে হয়নি। একটা অত্যন্ত বর্বর পদ্ধতিতে একটা মানুষকে অপমান করা হচ্ছে, দশজনের সামনে প্রবল পক্ষ জুতো মারছে দুর্বল একজনের মুখে, এইটেই তাঁর কাছে বড় হয়ে ফুটে উঠেছিল। তাই তিনি গোপালের কাছে আবেদন করেছিলেন ছোলেমানকে নিষ্কৃতি দিতে। বলেছিলেন, বিচার করে সাজা দিতে। গোপাল এক অর্থে তাঁর দুটো অনুরোধই রক্ষা করেছে। তৎক্ষণাৎ ছোলেমানকে মুক্তি দিয়েছিল সে। এবং পরে সে ছোলেমানকে সাজাও দিয়েছে, বিচার করেই দিয়েছে। নিরাপদ অভিযোগ করেছিল, ছোলেমান তোলা দিতে অস্বীকার করেছে, আর হাটের ইজারাদারের গোমস্তাকে মেরেছে। দু’জন পেয়াদাই একবাক্যে হলপ করে সাক্ষী দিয়েছে, নিরাপদর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এবং যেহেতু দুটো অপরাধই গুরুতর, গোপাল তাই বিশেষ বিবেচনাপূর্বক ছোলেমানকে নামমাত্র সাজা দিয়েছে, ও-হাটে ছোলেমান আর বসতে পারবে না। 

মেজকর্তা ভাবছিলেন, বর্বরতার যা সংজ্ঞা, গোপালের বিচারকে তার মধ্যে ফেলা যায় কিনা? অনেক ভেবেও এটাকে বর্বর বলতে তিনি পারলেন না। একেবারে খাঁটি সভ্য জগতের বিচার করেছে গোপাল। ইংরেজের আদালতেও অনেক সময় এমন সূক্ষ্ম বিচারই ঘটে থাকে। মেজকর্তার আর-কিছু বলার মুখ রাখেনি। 

কিন্তু এই বিচারে নিকিরিকুল ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে। ওরা দরবার করতে গিয়েছিল গোপালের কাছে। গোপাল ওদের হাঁকিয়ে দিয়েছে। এখন নিকিরিরা একজোট হয়ে বলছে, বিনাদোষে ছোলেমানকে মারা হয়েছে, ওর মাছ নষ্ট করা হয়েছে, ওকে অপমান করা হয়েছে, আবার ওকেই সাজা দেওয়া হল। বেশ বিচার বটে! 

গহর এসেছিল এই ব্যাপারে মেজকর্তাকে মধ্যস্থ মানতে। মাজেবাবুর উপর ওদের পাড়ার সকলেরই নাকি অগাধ বিশ্বাস। তিনি নাকি কারও পক্ষ টেনে কথা বলবেন না। সাক্ষীসাবুদ ডেকে তত্ত্বতালাশ নিয়ে যে রায় মাজেবাবু দেবেন, গহররা মাথা নিচু করে তা মেনে নেবে। 

মধ্যস্থ হতে মেজকর্তা রাজি হননি। গহর ক্ষুণ্ন মনে চলে গিয়েছে। মেজকর্তা গহরকে বোঝাতেই পারেননি যে, এক পক্ষের আস্থা থাকলেই মধ্যস্থ হওয়া যায় না, মধ্যস্থতা করতে গেলে দু’পক্ষের আস্থাই দরকার। গহররা যেন এমন লোককে সালিশ মানে যার কথা দু’তরফেই মানবে। 

বলাই বাহুল্য, গহর খুশি হয়নি এ-কথায়। কী ভাবল কে জানে? এ-কথা ভাবলে না তো, বিরোধটা গোপালের সঙ্গে লেগেছে বলেই মেজকর্তা কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেলেন। ভাবল কি তাই? মনটা খচখচ করতে লাগল তাঁর। বুড়ো হলে মানুষ অনেক ভিতু হয়। এ কথাও তো গহর ভাবতে পারে। কিন্তু এটাই বা কী এমন সান্ত্বনার বাক্য! নিজের উপর মেজকর্তা বিরক্ত হলেন। সংকটের মুখে যে হাল ধরতে না পারে তার আবার বড় বড় কথা বলার সাধ কেন? নিজেকেই তিরস্কার করলেন মেজকর্তা। 

গহর যাবার সময় বলে গেল, ছোলেমানের অপমান, তাদের সকলের অপমান বলেই তারা ধরে নিয়েছে। তিল থেকেই ব্যাপারটা আবার তালের আকার না ধরে! 

বেলা পড়তেই বুদো ভুঁয়ে হস্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। 

বলল, এই যে মাজে খুড়ো, আপনি নাকি গহররে কয়েছেন, গুপালের বিচার অন্যায় হয়েছে। ন্যায্য বিচার না হলি তুমরা ওর হাটে বসো না। 

বুদো ভুঁয়ের কথা শুনে মেজকর্তার আপাদমস্তক জ্বলে গেল। অতি কষ্টে আত্মসংবরণ করলেন। পাছে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেন, তাই চুপ করে থাকলেন। 

বুদো ভুঁয়ে বলল, গুপালের গোমস্তার অপমান করাউ যা, গুপালের অপমান করাউ তাই। ও একই কথা। তুমি যারে খাবা তার বুকি বসে দাড়ি উপড়াবা, এ তো হয় না। আর বিচারডা এমন অনেহ্যই বা কী হয়েছে, যারে জেলে পাঠানো উচিত ছিল, তারে হাটে বসতি বারণ করা হয়েছে। আমি আরউ গুপালরে কলাম— গুপাল, হারামজাদা খুনেটারে এত অল্পে ছাড়ে দিলে? বিট্টা নাড়ে, বামুনের গায়ে হাত তুলিছে! এত বড় আস্পর্দা! এই সুযোগে বিটার বিষ দাঁত কটা ভাঙ্গে দেওয়া যাত। তা গুপাল কল— দাদা, ওগের মতো একতা আমাগের যদি থাকত তো দ্যাখতেন, কী কত্তাম। মাজে খুড়ো বোধহয় আমার উপর সেদিন একটু অসন্তুষ্টই হয়ে গেছেন। আমি কলাম— আরে না না, উডা তুমার ভুল। আজ আবার এই কথা শুনতিছি। বলি ব্যাপারডা কী?

মেজকর্তা বিরক্তি চেপে বললেন, গোপালের চোখ তোমার চেয়ে দেখি ভালই। এখন দেখছি, শুধু চোখ না, তোমার কানেও দোষ আছে। 

মেজকর্তার কথার ধরনে, বুদো ভুঁয়ের উৎসাহ খানিকটা নিবে গেল। 

একটু থতমত খেয়ে বলল, ক্যান খুড়োমশাই, আমার কানের দোষটা দ্যাখলেন কীসি? 

মেজকর্তা বললেন, আমি যে গহরকে ও-কথা বলেছি, তা তুমি শুনলে কার কাছ থেকে? গহর তোমাকে বলেছে? 

বুদো ভুঁয়ে এতক্ষণে জোর পেল। 

বলল, গহরের মুখির থে আমার শুনতি হবে ক্যান? গহর কি আমার মিতে, না গুরু ঠাউর? আমি যে কথা কলাম, তা বাজারের সবাই জানে। আপনি কি কতি চান, বাজার সুদ্ধ সবারই কানের দোষ হয়ে গেল? 

মেজকর্তা এ-প্রশ্নের জবাব দিলেন না। সম্ভবত একটু বিব্রতই বোধ করলেন। আবার কি সবাই তাঁর বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাচ্ছে নাকি? তাঁর সঙ্গে সবার লড়াই শুরু হবে নাকি আবার? কিন্তু কেন? এবার তাঁর অপরাধ কী? আর তো কারও ভাল করবার বাসনা তাঁর নেই? তাঁর মাথার সেই পোকা মরেছে। তাঁর যৌবনও ফুরিয়েছে। এখন তো তিনি একটা হাঁটু-ভাঙা দ। 

না না, আর কারও সঙ্গে বিরোধ নয়, আর কোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নয়। এবার তিনি নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে চান ক’টা দিন। শেষের ক’টা দিন নিরুপদ্রবে এই গ্রামেই, একটা পরিচিত তাঁর অত্যন্ত আপন গণ্ডির মধ্যেই কাটাতে চান। যতদিন তেজ ছিল তাঁর, যৌবন ছিল, অফুরন্ত বল ছিল মনে, ততদিন এই গ্রামের বিরুদ্ধে তাঁর একটা প্রবল অভিযোগ ছিল, এককালে তীব্র বিদ্বেষও ছিল। ভেবেছিলেন, আর কখনও পা দেবেন না গ্রামে। ডোমারকেই আপন করে নেবেন। কিন্তু বয়স যখন বাড়ল, স্ত্রীর মৃত্যু হল, তখন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, এতদিন যেখানে কাটালেন, সেটা নিতান্তই বিদেশ। সেখানে তাঁর কোনও শিকড় নেই। জন্মসূত্রে যে মাটিতে তিনি বাঁধা পড়েছেন, সেই তাঁর আপন মাটি। একা, সম্পূর্ণ একা বিদেশে আর থাকতে ভাল লাগে না। তাই তো ঠিক করেছেন, গ্রামেই এসে বাস করবেন। 

এখন বুদো ভুঁয়ের কথা শুনে মেজকর্তা তাই কিছু শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। 

মেজকর্তা বললেন, বাজারে কী রটেছে, তা আমি জানিনে। তুমি যা বললে সেই কথাই যদি রটনা হয়ে থাকে, তা হলে শোনো, আমি ওর একটা বর্ণও বলিনি। 

কথাটা বলেই মেজকর্তার মনে হল, তিনি কি কৈফিয়ত দিতে বসলেন নাকি? কে কী মিথ্যে কথা রটিয়ে বেড়াবে আর তার জন্য তাঁকে যার-তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে? কেন, কী এমন চোরের দায়ে ধরা পড়েছেন তিনি? তা ছাড়া, কে এই বুদো? একটা অর্বাচীন, অশিক্ষিত গ্রাম্য গোঁয়ার। ওর আস্পর্ধাও তো কম নয়। হঠাৎ দপ করে রাগ চেপে গেল তাঁর। ইচ্ছে হল, তক্ষুনি উঠে চলে যান বুদো ভুঁয়ের সামনে থেকে। 

বুদো ভুঁয়ে তৎক্ষণাৎ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠল। মেজকর্তার জবাব শুনে একগাল হেসে ফেলল সে। 

বলল, খুড়োরে কি আমি চিনিনে! আমি কথাডা শুনা মাত্তর গুপালরে কয়ে দিছি, মাজেখুড়ো এ ধরনের কথা কওয়ার লোকই না। গুপালের অপমান যে আমাগের সবারই অপমান, সে-কথা মাজেখুড়ো জানেন। আমারে কয়েছেন তিনি। 

মেজকর্তা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বললেন, সে-কথা আমি আবার কখন বললাম? 

বুদো ভুঁয়ে চোখ টিপে বলল, আহা, আপনি কবেন ক্যান? আপনার জবানিতে আমিই গুপালরে কইছি। কথাডা তো মিথ্যে নয়। গুপাল এখন আমাগের সমাজের মাথা। ওর মান-অপমানে আমাগের সকলেরই মান-অপমান। 

মেজকর্তার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছিল ঠাস করে একটা চড় বুদো ভুঁয়ের গালে কষিয়ে দেন। কিন্তু তা পারলেন না। পারলেন না বলেই রাগের ঝাঁজটাও বেড়ে উঠল। আরেকবার ভাবলেন, ওটাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তাও শেষ পর্যন্ত পারলেন না। বুদো ভুঁয়ে গ্যাঁট হয়ে তাঁর সামনে বসে রইল। তারপর স্থির করলেন, ও যা বকে বকুক, চুপ করে থাকাই শ্রেয়। 

বুদো ভুঁয়ে বলল, অনেক খবরই রাখি। মেদ্দা উসকোয়েছে নিকিরিগের। উরা নাকি আর হাটে বসবে না মাছ বেচতি। না বসলি তো ভারী খেতি। কোট ধরে ক’দিন থাকে দেখি। গুপাল কয়েছে, অন্য জায়গা থে জালে আনবে হাটে। একটা পয়সা হাট-খাজনা নেবে না তাদের থে। দেখি মিঞাগের ত্যালানি কদ্দিন থাকে! তুরা আমাগের জাতে মারার চিষ্টা করিস, ইবার আমরা তোগের ভাতে মারব। 

সর্বনাশ! এইসব মতলব চলছে নাকি! বলে কী বুদো! 

মেজকর্তা বললেন, দেখো বুদো, তোমরা কি একটা হাঙ্গামা বাধাবে নাকি শেষ পর্যন্ত।

বুদো হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেজকর্তার মুখের কাছে। 

জিজ্ঞাসা করল আওয়াজ চেপে, উরা কি সেইরকম উদযুগ করতিছে নাকি? মেদ্দা বিটার মনের ইচ্ছেটা কী, কন দেখি মাজেখুড়ো? 

মেজকর্তা হঠাৎ খুব শীতল হয়ে গেলেন। বললেন, দেখো বুদো, একটু হিসেব করে কথা বলতে শেখো। মেদ্দার মনের খবর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো কোন সাহসে? 

বুদো ভুঁয়ে বলল, আপনি আমার উপর রাগই করেন, আর যাই করেন, উচিত কথা কতি বুদো ডরায় না। গুপাল কয়, মেদ্দার হাঁড়ির খবর এই গিরামে শুধু এক মাজেবাবুই জানেন। তা সে তো মিথ্যে বলার লোক না। আপনার তো আমাগের সঙ্গে কোনও ওঠবোস নেই, যা কিছু ওই মেদ্দার সঙ্গে। তা যাক গে সে কথা, উরা কি সত্যিই হাঙ্গামার জুগাড়যন্তর করতিছে নাকি? তা বাধাক না ইবার কাজিয়া, মুগুরির গুঁতো কারে কয় মিঞাগের বুঝোয়ে দিবানে। 

মেজকর্তা এতক্ষণে বুঝলেন, জল অনেকদূর গড়িয়েছে। কীসের থেকে কোন ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেল। মেজকর্তার মনের রাগ পড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। দুশ্চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। 

বললেন, দেখো বুদো, একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে তোমরা কী পাগলামি শুরু করলে! ছোলেমানের বিষয়টা তার চেয়ে একটা নিরপেক্ষ সালিশের হাতে তুলে দাও না। যারা নিজের চোখে ঘটনাটা দেখেছে তাদের সবাইকে ডেকে, বেশ করে খোঁজখবর নিয়ে, একটা বিচার হোক। সাজা যার প্রাপ্য, সে পাক। 

বুদো ভুঁয়ে এবারে বেজায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, ব্যাপারটা আপনি যত তুচ্ছু মনে করতিছেন, তত তুচ্ছু নয়। এর ভিতরে অনেক বড় জিনিস লুকোয়ে আছে। আপনি তা জানেন না। হয়তো বোঝবেনও না। মাজেখুড়ো, এই গিরামে আপনার জন্ম হতি পারে, তবুও আমি কব, আপনি এখেনে বিদেশির মতনই নতুন। আপনি যদি আমাগের সমাজের লোক হতেন তো বোঝতেন, আমাগের বুকি কী আগুন জ্বলতিছে। যারা চিরকাল পায়ের তলায় ছিল, তারা যখন দল পাকায়ে চোখ রাঙ্গাতি আসে, তখন বুকি অপমানের শেল যে কেমন জোরে বাজে, তা আপনি কী করে বোঝবেন? জমির খাজনা চালি যখন চোখ পাকায়, ফসলের ন্যায্য ভাগ চালি যখন ন্যায্য অন্যায্যর বিচার করতি চায়, আমাগের মেয়েগের ধরে ধরে নিয়ে যায়, তখন বুকি যে কী আগুন জ্বলে ওঠে, তার আঁচ আপনি টের পাবেন কী করে? যদি পাতেন তালি আর ইটারে তুচ্ছু বলে উড়োয়ে দিতি পারতেন না। ভাবে দ্যাখেন, দিনকাল কতদূরি গড়ায়েছে? নিকিরির ব্যাটা ছোলেমান, হারামজাদার বাড় কতদূর বাড়েছে, সে নিরাপদর গায়ে হাত তোলে! আর আপনি ইটারে কন তুচ্ছ। আপনার কাছে তুচ্ছু হতি পারে, আপনি জাত মানেন না, আমাগের সমাজের পরোয়াও করেন না। করলি ওগের মোড়ল, ওই ভেড়ার দলের বাছুর পরামানিক, ওই মেদ্দার ওখানে বসে অম্লানবদনে চা খাতি আপনার বাধত, ওগের পক্ষ টানে কথা বলতিও পারতেন না। আমাগের মনে আগুনির ছ্যাঁকা অনেক আছে। ছোট ছ্যাঁকাতেও পোড়ে, বড় ছ্যাঁকাতেও পোড়ে। কোনওটাই তুচ্ছু নয়। 

বুদো ভুঁয়ে একটু গরম হয়েই উঠে পড়ল। মেজকর্তা লেখাপড়া জানেন। বুদো ভুঁয়ে তাই শ্রদ্ধা করত তাঁকে। সেই শ্রদ্ধার ভিতে ফাটল ধরেছিল ইদানীং, আজ বেশ নড়ে উঠল। একটা কাপুরুষ, ভেকধারী বুড়ো। মেদ্দার চরও হতে পারে। ঘর-শত্রু বিভীষণ। লেখাপড়া শেখার এই পরিণাম! দূর দূর! তার স্বর্গত পিতা যে তাকে লেখাপড়া শেখাননি, সেই কৃতজ্ঞতায় তাঁর নিরাকার পায়ে বুদো ভক্তিভরে প্রণাম জানালে মনে মনে। 

বুদো ছুঁয়ের পেটে যে এত কথা থাকতে পারে, এমনভাবে যে সে তা বলতে পারে, সেটা আশা করেননি মেজকর্তা। বুদো ভুঁয়ের সম্পর্কে তাঁর ধারণা কিছু বদলাল। বুদোর অভিযোগ হয়তো অস্পষ্ট, কিন্তু ওই সব অভিযোগ যে বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে তার মনে তা অতি সুস্পষ্ট। বুদো ছুঁয়ের যা নালিশ, তা এ গ্রামের প্রায় সকলের, বিশেষ করে মাতব্বরদের নালিশ। খাতকরা টাকা দিতে চায় না, চাষি তাদের পরিশ্রমে চাষ-করা ফসলের ভাগ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে ফতুর হবার সময় অসন্তোষ জানায়, কিছু দুর্বৃত্তস্বভাবের লোক কখনও কখনও নারীহরণ করে, তাদের উপর অমানুষিক বর্বরোচিত অত্যাচার করে। এ সবই সত্যি। এই গ্রামের, এই মহকুমার, এই জেলার অধিকাংশ চাষিই মুসলমান। তাই অধিকাংশ অপরাধে মুসলমানরাই অপরাধী। মেজকর্তা জানেন, এটাও সত্যি। মেজকর্তার একটা কথা মনে হল, মনে হল যেখানে মুসলমান নেই, সেই সব জায়গাতেও যে এই একই ধরনের অপরাধ (বুদোর চোখে যেগুলো গুরুতর অপরাধ বলে মনে হয়) ঘটে, বুদো যদি তার খবর রাখত, তা হলে সে এত জোরে কার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করত? 

সফিকুলের কথা মনে পড়ল মেজকর্তার। সফিকুলের প্রবল নালিশ হিন্দুদের বিরুদ্ধে। তার ধারণা, সরকারি চাকরির সব ধান হিন্দু-বুলবুলিতে লোপাট করে দিচ্ছে, তাদের ভাগে আর – কিছুই জুটছে না। ব্যাবসার সবটুকু শাঁস হিন্দুরা খেয়ে ফেলেছে, মুসলমান চাষির মুখের গ্রাস খাজনার নামে সুদের নামে হিন্দুরা জবরদস্তি কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

ছোলেমানকে অপমান করল নিরাপদ, তাকে সাজা দিল গোপাল। ন্যায় করুক আর অন্যায় করুক, তার দায় দায়িত্ব তো নিরাপদর আর গোপালের। কিন্তু গহর তা মানবে না। তার কাছে ছোলেমানও কেউ না, গোপাল নিরাপদও কেউ না। সে ধরে নিয়েছে, বিশ্বাস করেছে, মুসলমানের উপর অবিচার করেছে হিন্দু। বলা যায় না, হয়তো মেদ্দা ছাহেবও এই কথাই বিশ্বাস করেন। এরা এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত, এই বিশ্বাস নিয়েই এরা জন্মেছে। মরতেও চায় বিশ্বাসের কোলে মাথা রেখে। 

ছোলেমান আর গোপাল। দু’জনে ছিল দুটো মানুষ। দুটো সুস্পষ্ট অবয়ব ছিল তাদের। তাদের ধরা যেত, ছোঁয়া যেত। কথা বলা যেত তাদের সঙ্গে। বলা যেত, গোপাল, ছোলেমান অপরাধ করেনি। তোমার বোঝার ভুল হয়েছে। ছোলেমানকে ডাকো। ভুল করে যাকে সাজা দিয়েছ তাকে কাছে ডেকে দুটো মিষ্টি কথা বলো। তাকে বুঝিয়ে দাও, নিরাপদর গায়ে হাত তোলা তোমার উচিত হয়নি ছোলেমান। নিরাপদ অন্যায় করেছে তোমার মাছ ফেলে দিয়েছে, তুমি এসে নালিশ করলেই পারতে। তোমার মাছের দাম আমি ওর কাছ থেকে আদায় করে দিতাম। ছোলেমান অমনি দোষ স্বীকার করত। অমনি হাত দুটো জোড় করে বিনীতভাবে বলত, হুজুর, কসুর হয়ে গিয়েছে, মাপ করে দিন। ওই মাছ ক’টাই ছিল সম্বল হুজুর, তার ওই দুর্দশা দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। ঘরে হুজুর উপোস চলছে। ছোলেমানের চোখ টলটল করে উঠত। ওরা যে এই স্বভাবের লোক। গোপাল, ওই কথা শুনে তোমারও বুক টনটন করে উঠত। নিরাপদকে তুমি ছি ছি করতে। ব্যাপারটা ওইখানেই চুকে যেত। মানুষের দুঃখ মোচন করতে মানুষের আর কতটুকু সময় লাগে! 

কিন্তু মানুষ যে মানুষ থাকতে চায় না। ভালবাসে নুনের পুতুল হতে। সমুদ্রের নোনা জলে মিলিয়ে যেতেই তার আগ্রহ প্রবল। তাতে প্রবল গর্জন সহজেই তোলা যায়। ঢেউয়ের গুঁতোয় অস্থির করে দেওয়া যায়। একটা নিরাবয়ব সমষ্টি সম্পর্কে নিদারুণ সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তোলা যায় সকলের মনে। 

তাই তো গোপাল আর গোপাল থাকল না। সে হিন্দু সমাজের বিস্তীর্ণ সমুদ্রের জলে নুনের পুতুলের মতোই গলে গেল। ছোলেমানও মিলিয়ে গেল মুসলমান সমাজের মধ্যে। 

মেজকর্তা জানেন, বিতর্কে বিশ্বাসের ভিত নড়ানো যেমন যায় না, তেমনি নুনের পুতুলকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোও যায় না। 

.

কিন্তু এখন কী কর্তব্য তাঁর? 

বুদো ভুঁয়ে মিথ্যে বলেনি। এ গ্রামে তিনি অতিথি। আগে তাঁর এ-কথা মনে হয়নি, এখন বুদো ছুঁয়ের চাঁছাছোলা কথা শুনে মনে হচ্ছে, সত্যিই তিনি এ গ্রামের কেউ না। কেউ না? এ তাঁর গ্রাম নয়? তবে তিনি কোন গ্রামের লোক? মেজকর্তা সে-কথা জানেন না। তবে এটা বুঝেছেন, এ গ্রামের কেউ নন তিনি। কিন্তু কেন, কেন তিনি কেউ নন? এখানে কি তিনি জন্মাননি, এই বাড়ি কি তাঁর নয়? হ্যাঁ, তাঁরই। তবে? 

গ্রাম কি শুধু একটা নিরেট বাড়ি আর একটুখানি জন্মাবার জায়গা? গ্রামের লোক, গ্রামের সমাজ, এদের নিয়েই গ্রাম। এরাই হল গ্রাম। এদের সঙ্গে যোগ কোথায় তাঁর? এখানকার সুখ দুঃখে কি বুদোর মতো উদবেলিত হন তিনি? না। এখানকার ভাবনা- চিন্তার শরিক কি তিনি? না। এদের সিদ্ধান্তে কি সায় দিতে পারেন তিনি? না না। তবে, এদের সঙ্গে তাঁর যোগ কোথায়? এই মাটিতে তাঁর শিকড় কোথায়? 

মেজকর্তার মনে হল, সত্যিই তাঁর এখানে কোনও শিকড় নেই। নেই বলেই এখানকার ঘটনাপ্রবাহে ভাসমান ভেলায় তাঁর ভূমিকা অসহায় এক যাত্রীর। ভাল মন্দ যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, কোনও কিছুই মোড় ফেরাবার সাধ্য তাঁর নেই। বুদো ভুঁয়ের এই মাটিতে শিকড় আছে, শক্ত শিকড়। যতই মারাত্মক হোক, একটা ঘটনার সৃষ্টি সে করতে পারে। মেদ্দা ছাহেবও পারেন। কারণ ওরা সব নুনের পুতুল। নিজের নিজের সমাজের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে ওরা সহজেই গলে যেতে পারে। 

তিনি তা পারেন না। তাঁর শিক্ষা দীক্ষা, তাঁর বিচার বিবেচনা, তাঁর বিবেক তাঁকে নিটোল একটি ব্যক্তিত্ব দিয়েছে। সেটি গোষ্ঠীর সমুদ্রে গলে না। গলে না বলেই তো সমাজের সঙ্গে মিলে মিশে পিণ্ডাকার হতে তিনি পারেন না। আর গোষ্ঠীর সমুদ্র তাঁকে হজম করতে পারে না বলেই তো ঢেউয়ের গুঁতোয় তাঁকে কিনারে ফেলে দেয়। সেই কারণেই তিনি এখানে অপাঙ্ক্তেয়। এদের লোক নন। সিন্ধবাদ নাবিকের গল্পের সেই মায়াবী বৃদ্ধের মতো ব্যক্তিত্বের এই বোঝাটি মেজকর্তার কাঁধে চেপে আছে। এটি কলকাতার দান। এককালে এই বোঝাটি ছিল তাঁর গর্বের বস্তু। আজ যখন তাঁর বয়স বেড়েছে, শক্তি কমেছে, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন, তখন কী দুর্বহই না হয়ে উঠেছে এই বোঝা! 

মেজকর্তাকে কে নিঃসঙ্গ করেছে? এই ঘাড়ের বোঝাটি। কে তাঁকে তাঁর গ্রাম থেকে, তাঁর সমাজ থেকে, তাঁর আপন জনেদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে? এই এই, এই দৈত্যটি। যাকে তোমরা বিবেক বলো, ব্যক্তিত্ব বলো, মনুষ্যত্ব বলো, সেই দুরারোগ্য ব্যাধিটি। 

এখন এই বৃদ্ধবয়সে কোথায় যাবেন তিনি? কোথায় গিয়ে শান্তিতে একটু আশ্রয় নিতে পারবেন? এমন কি কোথাও জায়গা আছে, যেখানে তিনি তাঁর আপন সমাজ পাবেন? এমন কোনও রাজ্য আছে কি, বিবেক যার রাজা? যাত্রাদলের বিবেক নয়, যুক্তি আর বিচারের যে সন্তান, সেই বিবেক। 

কেন, কলকাতা? কলকাতা! কলকাতাতেও তো সেই নুনের পুতুলদেরই রাজত্ব। মূলে মূলে কোনও তফাত নেই। গ্রামের লোকের বিদ্যে কম, তারা নিজেদের চেহারা ঢাকতে পারে না, কলকাতা ছদ্মবেশ ধরার কায়দাটা বেশ রপ্ত করেছে। প্রায় তিরিশ বছর আগেই তিনি কলকাতার ছল ধরে ফেলেছিলেন। সে কী যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা! মেজকর্তার কাছে একদিন সভ্যতা আর কলকাতার অর্থ একই ছিল। যে-আলোকে তিনি একদিন নতুন-জীবনের-পথ-দেখানো আলো বলে মনে করেছিলেন, সেটা যে রংমশাল ছাড়া আর কিছু নয়, এটা যেদিন আবিষ্কার করলেন, সেই দিনই তিনি কলকাতা ছেড়েছেন। কী নিদারুণ ব্যথাই না সেদিন তাঁর বুকে বেজেছিল! এখন আর সে ব্যথা নেই। আছে আতঙ্ক। অচেনা ঘরে একা একা রাত কাটাতে শিশুর যে আতঙ্ক হয়, সেই আতঙ্ক। কোথায় যাবেন তিনি? 

.

কখন তাঁর ঘরে সন্ধ্যা ঢুকে পড়েছে মেজকর্তা তা টের পাননি। এই আরেক জ্বালা। দিনে প্রচুর আলো থাকে। পৃথিবী তখন কত বড় হয়ে যায়। কত প্রসারিত। আর সন্ধ্যা তাকে গুটোতে গুটোতে কত সংকীৰ্ণ এক ঘরে পুরে ফেলে। তাঁর এই ছোট্ট ঘরখানির মাপে বাঁধা পড়ে পৃথিবী। না, তাও না। আরও অন্ধকার বাড়ে, পৃথিবী আরও গুটোয়। চলে আসে মশারি-ঢাকা খাটের চৌহদ্দির ভিতরে। মেজকর্তার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃসঙ্গতা অসহ্য ঠেকে। অসহ্য। অসহ্য। বড় ইচ্ছে হয়, কেউ এসে কাছে বসুক। গায়ে পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দিক। কারওর শরীরের উত্তাপ পেয়ে তাঁর এই নিঃসঙ্গত্বের ভয় দূর হোক। কেউ এসে দুটো কথা বলুক। তাঁর ক্ষতবিক্ষত মনে একটু স্নিগ্ধ প্রলেপ পড়ুক। 

বাড়ির সকলে এখন কাজে ব্যস্ত। মেয়েরা রান্নাঘরে। দাদার বোধহয় ঘুম এসেছে। সন্ধ্যার সময়টাতেই ঘুম আসে বড়কর্তার। একমাত্র মেজকর্তাই এখন বেকার। একেবারে একা। 

হঠাৎ মনে পড়ল নাতির কথা। মনে পড়ল জামাইয়ের চিঠি এসে গেছে। এবার যে-কোনওদিন সে এসে পড়বে। তার মানে মেয়েরও যাবার দিন ঘনিয়ে এল। তাঁর বুকটা শিন শিন করে উঠল। 

বাড়িটা বেশ কিছুদিন ঝিমিয়ে পড়বে। ওইটুকু এক শিশু সমস্ত বাড়িটাকে কেমন ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল এতদিন। এবার বাড়িসুদ্ধ সবাই একেবারে বেকার হয়ে পড়বে। 

খুদে ডাকাতটা এ বাড়ির সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পালাবে। মেজকর্তার মনে হল তাঁকেও ভরত রাজার দশায় ধরেছে। শিশু হরিণের মায়ার শিকল তাঁর পায়েও জড়িয়ে গেছে। বুঝলেন, এবার তাঁর কর্মনাশ হবে। 

হঠাৎ মেজকর্তার ইচ্ছে হল, ওকে একটু দেখেন। ইচ্ছে হল, একবার বুকে জড়িয়ে ধরেন ওকে। আবার ভাবলেন, কী আর আছে দেখবার! মেয়ের ছেলে কার ঘরে ক’টা থাকে। স্বভাবের নিয়মেই একদিন তাকে নিজের ঘরে যেতে হবে। যেতে হয়, যাবে। যাবে? এখনও যে কোলে নিতে পারলেন না নাতিকে? একদিনের তরেও যে বদমায়েশটা উঠল না তাঁর কোলে। 

ওদের যে একদিন চলে যেতে হবে, মেজকর্তা এ-কথা তো জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, জামাইয়ের চিঠি পাওয়ার আগে পর্যন্তও তো জিনিসটা তাঁর কাছে এমন মারাত্মক সত্যে প্রকট হয়ে ওঠেনি। তা যদি উঠত, তা হলে তিনি কি এত ঢিল দিতেন নাতির সঙ্গে ভাব করতে? মোটেই না। চেষ্টার মাত্রা আরও না হয় বাড়িয়ে দিতেন। দিয়ে দেখতেন কী ফল হয়। 

মেজকর্তা আর বসে থাকতে পারলেন না। গুটি গুটি চললেন নাতির ঘরের উদ্দেশে। ঘরে তখন কেউ ছিল না। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ঘুমকে তাড়িয়ে সে আপন মনে খেলা করছিল। মেজকর্তা ঢুকে দেখলেন, ঘর ফাঁকা। জোরালো লণ্ঠনটা আরেকটু উসকে দিয়ে, আস্তে আস্তে তার বিছানার কাছে গিয়ে খপ করে তাকে তুলেই এক চুমু খেলেন। আচমকা সেই দাড়ির জঙ্গলে তার মুখটা ডুবে যেতেই সে ভয়ে তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। এ পাশের ঘর থেকে কী হল, কী হল করে ছোটবউ ছুটে এসে মেজ ভাশুরের কোলে তাকে দেখেই জিভ কেটে ঘোমটা টেনে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় সেই সঙ্গেই আর-এক ঘর থেকে বড়বউ আর গিরিবালাও এসে পড়ল। 

বাবার দাড়ি দু’মুঠোয় শক্ত করে ধরে ছেলে চোখ বুজে চেঁচাচ্ছে আর বাবা তাকে না পারছেন কোলে রাখতে, না পারছেন নামাতে। তাদের দেখে বাবা আরও অপ্রস্তুত হলেন। যেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছেন। বাবার মুখ চোখের ভাব দেখে গিরিবালা আর স্থির থাকতে পারল না, খিলখিল করে হেসে ফেলল। 

বড়বউ হাসতে লাগলেন। 

বললেন, ও, তুমি! সেউ ভাল। আমি আরও ভাবলাম, ছেলেরে বুঝি বাঘে ধরল। তা তুমি এখেনে আইছ কোন কম্মে! চুরি করে নাতিরি আদর খাওয়াতি নাকি? মাজেবাবু ইবার বড় কলে পড়িছ। ওই দাড়ি ইবার মাটিতি গড়াগড়ি দেবে, বুঝিছ। নাতিরি যদি কোলে তুলে নাচাবার শখ থাকে তা হলি পরামানিক ডাকে ওই জঙ্গল ঝুড়ে আসো গে। 

সামান্য ব্যাপারটা এতদূর গড়াল দেখে প্রথমটায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন মেজকর্তা। তারপর মনে মনে রাগ হল তাঁর। রাগ হল ওই বিচ্ছুটার উপর। 

বড়বউয়ের কথার উত্তরে বললেন, বয়ে গেছে আমার। লাটসাহেব সামান্য লোকের কোলে উঠতে বড়ই নারাজ দেখছি। তা থাকুন, তিনি পালঙ্কেই থাকুন। 

নাতিকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই তার কান্না থেমে গেল। চোখ বড় বড় করে সে দেখতে লাগল মেজকর্তাকে। সেই চাউনিতে মেজকর্তার ব্যক্তিত্ব যেন হেলে পড়ল। তিনি ক্ষুণ্ন মনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। 

মনকে প্রবোধ দিলেন, তুমি আপন আপন ভাবলে হবে কী, আসলে এ সংসারে কেউ কারও নয়। কী আশ্চর্য, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তামাক খাবার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠল। বড় বাজে কাজে দিনটা গিয়েছে। এতক্ষণে তবু একটা কাজের মতো কাজ পাওয়া গেল। 

চোদ্দো 

দড়বড়িয়ে ঘোড়া দাবড়ে এই অবেলায় যিনি এসে পৌঁছোলেন, এ-বাড়ির কেউ তাঁকে আশা করেননি। 

রামকিষ্টোই তাঁকে প্রথমে দেখল। কিন্তু চিনতে পারেনি। ঘোড়াটা গোয়ালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার কালে রামকিষ্টো সওয়ারের মুখ দেখতে পায়নি। গাছের আড়াল পড়ে গিয়েছিল। 

বাড়ির সকলেরই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গিয়েছে। তা বেলা তিনটে সাড়ে তিনটে হল বই কী। শুভদা ছাড়া আর সবাই যে যার ঘরে ঢুকে গড়িয়ে নিচ্ছে। বড়কর্তার একটু তন্দ্রা এসেছে, মেজকর্তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকাখানা খুলে দু’পাতা পড়ছিলেন, ঘুমের আক্রমণে সেই পাতাখোলা ‘প্রবাসী’ তাঁর বুকের উপর ঢলে পড়েছে। বড়বউয়ের ঘরে ফুলির মা’র সঙ্গে বড়বউ গল্প করছিলেন একটু আগে, চাঁপা আর ফুলিতে সমানে খুনসুটি চলছিল, এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। ফুলির মা’র নাক ডাকছে এখন। বড়বউয়ের চোখ বুজে এসেছে,’ ঠোঁট ফাঁক হয়ে সামনের দাঁত দুটো বেরিয়ে পড়েছে। চাঁপা আর ফুলি গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফুলির মুখ থেকে লালার একটা ঘন স্রোত গালের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে। একটা গুয়ে মাছি বারবার ফুলির গালে গিয়ে বসছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফুলির গালটা নড়ে নড়ে ওঠায় আবার সেটা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। 

আরেকটা ঘরে ছেলেকে নিয়ে শুয়ে ছিল গিরিবালা। ছোটবউও পাশে শুয়ে ছিল। গিরিবালা ঘুমে অচেতন। ছোটবউ ঘুমিয়েছে কি না কে জানে, তবে একেবারে নিশ্চল। 

হাত-পা নেড়ে ঘুমকে প্রাণপণে প্রতিরোধ করছিল একমাত্র ছেলেই। বড়রা যার আক্রমণে কাবু, সেই ঘুমকে সে যেন কচি কচি হাত-পা নেড়ে বেদম শায়েস্তা করছে। দু’-একবার ধমক দিল যেন কাকে? বো বো। তার শরীরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। ম্‌ম্‌ম্‌ ম্‌ম্‌ম্‌ বলে জানাতে চাইল সে-কথা। কেউ তার কথায় কর্ণপাত করল না। দিবানিদ্রা ভঙ্গ হল না কারও। সেই অস্বস্তিটা প্রবলভাবে বেড়ে উঠছে তার শরীরে। বিরক্ত লাগছে তার। যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে। এবার খুঁত খুঁত করে কেঁদে উঠল। তাতেও কেউ দৃষ্টি দিল না তার দিকে। এবার হয়তো সে তার কান্নার স্বরগ্রাম চড়াতে তুলে দিত কিন্তু তার আগেই চূড়ান্ত উপশম হয়ে গেল। আর কাঁদল না সে। কাঁথাটি জবজবে করে ভিজিয়ে পরমানন্দে আঙুল চুষতে শুরু করল। না, আর কোনও উদ্‌বেগ অভিযোগ নেই তার। বেশ আরামই লাগছে। 

.

এ-বাড়িতে দিনের কাজ শেষ হতে সবার চেয়ে দেরি হয় শুভদার। বিধবা মানুষ। কাজকম্ম সেরে নাইতে-খেতে রোজই বেলা গড়িয়ে যায়। সেদিনও হেঁশেলে শিকল তুলে বারান্দায় নামছিলেন, ঘোড়ার পায়ের শব্দ বাইরের উঠোনে এসে থামতেই চৌকাঠ ধরেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। কে আবার এল? ডিঙ্গি মেরে চেগারের ওপাশে উঁকি মেরেই অবাক হয়ে গেলেন। 

খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলেন, ও মা, শীতল! ওলো ও বড়বউ, বড়বউ, ওঠ ওঠ, শীতল আয়েছে।

শুভদার চিৎকারে বড়বউয়ের ঘুম ছুটল। কে? ছোট ঠাকুরপো? ও মা! ধড়মড়িয়ে উঠে গায়ের আঁচলটা সামলে নিলেন, এলোচুল জড়িয়ে নিলেন তাড়াতাড়ি, একটা বড়সড় হাই তুললেন। তারপর ফুলির মাকে ঠেলেঠুলে তুলে দিলেন। 

বললেন, ও ফুলির মা, আখাটা ধরাও গে দিনি, ছোট ঠাকুরপো আয়েছেন।

আবার একটা হাই তুললেন বড়বউ। 

ফুলির মাকে বললেন, এটটু গুঁড়ো দ্যাও তো দাঁতে ঘষি। 

ফুলির মা কৌটো খুলতে খুলতেই বড়বউ পাশের ঘরে হাঁক দিলেন, ওরে, ও ছোট, ওঠ, ছোটঠাকুরপো আয়েছেন রে। উঠে পড়। 

কথাটা কানে গেল ছোটবউয়ের। কিন্তু অর্থটা তাঁর কাছে তেমন পরিষ্কার হল না। কোনওরকম চঞ্চলতা জাগল না তাঁর মনে। কেউ একজন এসেছে, সেটা বেশ বুঝলেন। কে এসেছে, সেটা তত পরিষ্কার হল না। তিনি তেমনি নিশ্চলভাবেই শুয়ে রইলেন। তাড়াহুড়ো করে উঠবার কোনও তাগিদ বোধ করলেন না। 

কে এসেছে? বড়দি বলল, ছোটঠাকুরপো? হ্যাঁ, ছোটবউয়ের মনে পড়ল মনে পড়ছে, ধীরে ধীরে, একটু একটু করে মনে পড়তে লাগল, ছোটকর্তাকে বড়দি এই নামেই ডেকে থাকেন বটে। তার মানে ছোটকর্তা এসেছেন। বুঝলেন ছোটবউ। তবু কেন তাঁর আগ্রহ জন্মাচ্ছে না ছোটকর্তা সম্পর্কে? কেন ছোটকর্তার ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে না তাঁর মনে? কোনও চাঞ্চল্য জাগছে না, উৎসাহ জাগছে না, উষ্ণতার জন্ম হচ্ছে না ছোটবউয়ের ভোঁতা মনে। দশ বছর আগে পর্যন্ত ছোটকর্তার সঙ্গে ছোটবউয়ের কী একটা যেন জীবন্ত সম্পর্ক ছিল। আবছা আবছা আন্দাজ হচ্ছে তাঁর। তারপর কী যেন হয়ে গেল হঠাৎ, ঝপ করে একটা বিরাট ভারী আর ভয়ংকর কালো আবরণ পড়ে গেল তাঁর মনে। পুরনো দিন, পুরনো সম্পর্ক সব যেন মুছে গেল। সে-সব কথা আর স্পষ্ট করে মনে রইল না কিছু। 

আবার একদিন হঠাৎ কী হল, ছোটবউ গিরিবালার খোকাকে ঝোঁকের মাথায় বুকে তুলে নিলেন। অমনি অশ্বত্থামার ঘেয়ো মাথায় যেন তেলের প্রলেপ পড়ল। কী একটা জ্বলুনি আরাম হয়ে গেল। আশ্চর্য ঘটনা! আরও আশ্চর্য, যেই সেই অহরহ মনপোড়ানি ঠান্ডা হল, অমনি সেই ভারী অন্ধকারের পরদাটা ছিঁড়ে ফরদাফাঁই হয়ে গেল। দশ বছর পরে আবার তাঁর মনে পিলপিল করে ঢুকতে লাগল প্রখর আলোর রশ্মি। আবার সেই ভুলে-যাওয়ারা চেনা হয়ে পড়ল। তবে সবটা অন্ধকার এখনও দূর হয়নি, এখনও ছোট বউয়ের মনের কোনায় কোনায় বিস্তর ঝুলকালি জমে আছে, এটা তিনি বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন, সেই কারণেই তাঁর মনের সর্বত্র সমানভাবে আলো পড়ে না। শীতলের দিকটা হয়তো সেই কারণেই অন্ধকার। 

তাই হয়তো শীতলের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ফুটছে না তাঁর মনে। কিংবা কিছু কিছু হয়তো ফুটছে, সবটা নয়। মনের যে আয়নায় প্রিয়জনের ছবি সুস্পষ্ট হয়ে ফোটে, দশ বছরের অব্যবহারে ছোটবউয়ের সেই আয়নাটির বহু জায়গা থেকেই পারা খসে খসে গেছে। 

তাই, ছোটবউ সেই আয়না দিয়ে প্রাণপণে শীতলের ছবিটা দেখতে চেষ্টা করেও তাঁকে পুরো দেখতে পাচ্ছিলেন না। কোথাও মুখের একটা কোনা, কোথাও নাকের সামান্য একটু আভাস, কোথাও বা কপালের একটু ভগ্নাবশেষ দেখতে পাচ্ছিলেন। সেই কারণেই ছোটবউয়ের মনে কোনও আগ্রহ, কোনও উৎসাহ, কোনও উষ্ণতার জন্ম হচ্ছিল না। 

গিরিবালার খোকা শব্দ করতেই ছোটবউ তার দিকে ফিরলেন। দেখেন সে উসখুস করছে, দেখেছ কাণ্ড, কাঁথা ভিজিয়ে শুয়ে আছে! তৎক্ষণাৎ ছোটবউয়ের স্তিমিত রক্তস্রোতে যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হল। উৎসাহ, আগ্রহ এবং তৎপরতা ফিরে এল তাঁর মনে। তিনি চটপট কাঁথাটি বদলে দিলেন। 

.

ছোটকর্তা ঘোড়া থেকে নেমে চারিদিক চেয়ে রামকিষ্টো বা নরা কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন নিজেই ঘোড়ার পিঠ থেকে জিনটা খুলে ফেললেন। জিন খুলতেই ঘোড়ার পিঠের গরম ভাপ তাঁর গায়ে লাগল। বাঁ হাত দিয়ে ঘোড়াটার পিঠে চটাস চটাস দুটো আদরের চাপড় মেরে জিনটা বারবাড়ির বারান্দায় রেখে দিলেন। তারপর ঘোড়াটাকে পুবদিকের গায়ে, লম্বা ছায়ায়, একটা খুঁটিতে বাঁধলেন। লাগামটা ঘোড়ার মুখেই থাকল আপাতত। সে ল্যাজ দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে খট খট করে বার কয়েক পা ঠুকল, ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মাথাটা দু’বার ঝাঁকিয়ে নিল, তারপর নিশ্চিন্ত মনে লাগামের লোহাটা কড়াত কড়াত চিবোতে লাগল। 

ছোটকর্তা পিছন ফিরতেই দেখেন চেগারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে শুভদার হাসি হাসি মুখখানা উঁকি মারছে। মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠল ছোটকর্তার। দেড় বছর পরে আজ বাড়ি ফিরলেন। 

শুভদা বললেন, ও শীতু, শরীর ভাল আছে তো তোর? 

ছোটকর্তা হাসতে হাসতে বললেন, দারোগার শরীর ইস্পাতের শরীর মাজদি। ও আগুনিউ গলে না, জলেউ মরচে ধরে না। তারপর তুমাগের খবর ভাল তো? 

শুভদা তাড়াতাড়ি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, নে ঘরে আয়, জামাকাপড় ছাড়, মুখি হাতে জল দে। রোদি একেবারে যে ঝামড়া পুড়া হয়ে গিছিস। 

শুভদার কথা শেষ হতে না হতেই বড়বউ গুদোমবাড়ির দরজা দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন। 

বললেন, এই যে মদ্দ বাহাদুর, বাড়িঘরের কথা তালি এতদিনি স্মরণ হল? সযযু আজ কোন দিকি উঠিছে? 

ছোটকর্তা.হা হা করে হেসে উঠে বললেন, হুরি পরিরা নেকনজরে চায় না গো বউঠান, বাড়ি আসার সুখটা কী কও? 

বড়বউ হাসতে হাসতে টিপ্পনী কাটলেন, বুঝলাম, যেই খবর পাইছ, নিজির হুরিডে মেরামত হইছে, অমনি বুঝি বুকি পুলকের হাওয়া গড়াগড়ি খাতি লাগিছে আর বাবু পক্ষীরাজ দাবড় দিয়ে আসে পড়িছে। তা আসে এখন বুঝ সমঝ করে ন্যাও। 

 শুভদা তাড়া দিলেন, নে বড়বউ, তোর ঠাট্টা-তামাশা এখন রাখ, শীতুরি জামাকাপড় ছাড়তি দে।

ছোটকর্তা বললেন, দাড়াও, বুড়ির ছেলেরে আগে দেখি, শালা কতবড় বাহাদুর একবার বুঝে নিই। চলো দিন বউঠান। 

.

ছোটকর্তা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকতেই ছোটবউ শশব্যস্তে উঠে পড়লেন। ছোটকর্তার দিকে বোবা নজরে একবার চেয়ে ঘোমটা টেনে বেরিয়ে গেলেন। গিরিবালা একপাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। আগে সে কাকাকে মনে মনে ভয় করত, এখন লজ্জাও তার সঙ্গে এসে যোগ দিল। 

ছোটকর্তা একনজর ছোটবউয়ের দিকে চেয়ে নাতির দিকে মন দিলেন। দারোগার অদ্ভুত পোশাকের জন্যই হোক কি লোকটা অপরিচিত বলেই হোক, সে বড় বড় চোখ তুলে ছোটকর্তাকে বেশ অভিনিবেশ সহকারে দেখতে লাগল। 

বেশ মোটাসোটা ছেলে হয়েছে বুড়ির। বেশ মুখ চোখ। আর বেশ সাহসও আছে শালার। কেমন চেয়ে আছে গুলগুল করে। কাঁদছে না তো! 

নাতিকে খুবই ভাল লাগল ছোটকর্তার। 

আয় শালা, কাঁধে ওঠ, বলেই ছোটকর্তা ন্যাদনেদে কচি দেহটাকে এক হ্যাঁচকায় তুলে তাঁর বিশাল কাঁধে বসিয়ে দিলেন। আর বসামাত্র সে ওখানে অপকর্ম করে বসল। প্রবল প্রতাপান্বিত সরকার বাহাদুরের মোহরমারা খাকি পোশাকের উপর দিয়ে সেই অপকর্মের তরল সাক্ষী গড়িয়ে পড়ল। ডাকসাইটে দারোগাবাবু অভাবনীয় এই ঘটনার আকস্মিকতায় কিঞ্চিৎ বিমূঢ় হয়ে গেলেন। 

বড়বউ এবং শুভদা দু’জনেই হেসে ফেললেন। শুভদা ঠোঁট টিপে, বড়বউ খিলখিল করে। একমাত্র গিরিবালার মুখ শুকিয়ে গেল। ভয়ে তার অন্তরাত্মা ঠক ঠক করে কাপতে লাগল। 

বড়বউ হাসতে হাসতে বললেন, কেমন দারোগাবাবু, এখন বোঝো কেমন! 

ছদ্ম গাম্ভীর্য মুখে টেনে ছোটকর্তা বললেন, বড়ই সাংঘাতিক ব্যাপার। দারোগার ঘাড়ে হাগে, এ শালা তো বড় কমলোক হবে না। 

বলেই ছোটকর্তা হা হা করে ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন। অপকর্মটি করা ইস্তক সে বেচারি ও অস্বস্তি ভোগ করছিল। ছোটকর্তার পিলে চমকানি হাসিতে সে ভয় পেয়ে তারস্বরে কেঁদে উঠল। 

ছোটকর্তা খোকাকে গিরিবালার কাছে গছিয়ে দিতে দিতে বললেন, বড় জবরদস্ত ছেলে হয়েছে রে তোর। যা ধুয়ায়ে মুছায়ে নিয়ে আয়। 

ছোটকর্তার স্বরে প্রসন্নতার সুর পেয়ে গিরিবালা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, কাকা তা হলে দোষ ধরেননি খোকার। উঃ ভগবান! স্বস্তির একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল গিরিবালা। 

ছেলেটাকে দু’হাতে ঝুলিয়ে নিতে নিতে গিরিবালা খুব চটে গেল তার উপর। কত বড় আস্পদ্দা ভাবো দিকি একবার! কী দুঃসাহস! পরক্ষণেই গোটা দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ভয় ডর বিরক্তি তার মন থেকে দূর হয়ে গেল। ফিক ফিক করে হাসতে থাকল। সত্যি খোকা, মাঝে মাঝে কী যে কাণ্ড বাধাস! গিরিবালা সস্নেহে অপরিচ্ছন্ন খোকার ভালমানুষি মাখানো মুখখানা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। 

বাড়ির মধ্যে এই অসময়ে কলরব শুনে মেজকর্তার ঘুমটি ছুটে গেল। উঠে এসে শোনেন শীতল এসেছে। জামাকাপড় ছাড়তে গেছে তার ঘরে। বাইরে বেরিয়ে দেখেন, শীতলের ঘোড়াটা ল্যাজ উঁচু করে নাদছে আর ঘরের খুঁটিতে ঘাড় ঘষছে। 

মেজকর্তা রামকিষ্টোকে ডাক দিলেন জোরে। গোয়াল থেকে সে সাড়া দিল। 

মেজকর্তা বললেন, এদিকে আয় দিকি একবার। 

রামকিষ্টোর হাতে অনেক কাজ। সে ভাবল মাজেবাবুর বোধহয় তামাকের তেষ্টা পেয়েছে। ছেলেটাকে পাঠাতে চাইল। কিন্তু সে ‘লবারের বিটা’ যে কোথায় এখন আছেন তা ভগবানই জানেন। 

তবু, কাছেপিঠে যদি থাকে, তাই হাঁক পাড়ল, ওরে ও নরা! 

নরা কাছেই ছিল। গোপালভোগ আমগাছটার সাফ সাফ তলায় বসে নালসে পিঁপড়ের আনাগোনা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। পিঁপড়ে সম্পর্কে নরার আগ্রহ প্রবল। ফাঁক পেলেই এই অদ্ভুত খুদে খুদে প্রাণীগুলোর ক্রিয়াকলাপ খুব মন দিয়ে লক্ষ করে থাকে। 

নরা অনেক দিন ধরে, একটু একটু করে, অনেক কীর্তিই দেখেছে ওদের। কী করে ওরা বাসা বাঁধে? আচ্ছা শোনো, যা দেখেছি, তাই বলছি। ওদের মধ্যে অনেকগুলো বড় বড় পিঁপড়ে আছে। ওরা বোধহয় মোড়ল। শুঁড় নেড়ে নেড়ে ওরা যা বলে আর সবাই তা মান্য করে। বর্ষার আগে দেখো, এই গোপালভোগ আমগাছের পাতায় পাতায় ওই বড় বড় পিঁপড়েগুলো ঘুরে ঘুরে কী যেন খোঁজে? বলো তো, কী খোঁজে? বাসা বানাবার জায়গা। যেই জায়গা ঠিক হয়ে গেল, জায়গা মানে কী, আমগাছের গোটা কতক শিয়ারা, যে সব শিয়ারা পেড়ে এনে ঠাকুরমশাই পুজোর সময় ঘটের মুখে দেন সেই শিয়ারা। দেখে দেখে নরা এখন বুঝে গেছে কোন ধরনের শিয়ারায় নালসে পিঁপড়ে বাসা বাঁধে আর কোথায় বাঁধে না। ওদের তরিবত খুব। বড় ডালে খুব শক্ত রুক্ষপাতায় ওরা পারতপক্ষে বাসা বাঁধতে চায় না। একেবারে ফুল কচি পাতাতেও না। শক্ত সমর্থ যুবো পাতা আর নরম ডালই ওদের পছন্দ। নরাকে আমের শিয়ারা আনতে বললে সে এ-সব ডাল কক্ষনও ভাঙে না। বাবা, কেষ্টর জীব! ওদের ঘর ভেঙে দেওয়া কি যে সে কথা! পাপ লাগবে না! 

হ্যাঁ, তারপর যা বলছিল নরা, শোনো। বাসা বাঁধার জুতমতো শিয়ারাগুলো ঠিক করা হল। তারপর কী যেন একটা হুকুম দেয় মোড়লগুলো আর দলে দলে পিঁপড়ে এসে বাসা বাঁধবার শিয়ারাগুলোর উপর ঘুরে বেড়াতে থাকে। ঘুরছে তো ঘুরছেই। শুধু ঘুরছেই। দিনরাত শুধু ঘোরাফেরাই চলছে। তারপর হঠাৎ একদিন দেখবে, আম শিয়ারার নরম পাতাগুলো একের পিঠে আরেকটা জুড়ে জুড়ে গিয়েছে। আর সমস্ত শিয়ারাটা ধীরে ধীরে ফুলে উঠে, গুটিয়ে গুটিয়ে একটা বড়সড় টোপরের মতো হয়ে উঠছে। এই অদ্ভুত দৃশ্যটা কতদিন যে গোপালভোগের শিকড়ে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে দেখেছে নরা, তার সীমাসংখ্যা নেই। এই সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায় সে। কাজকর্মে মন থাকে না তার। বাবার বকুনি বেড়ে যায়। কুঁড়ে বলে তার বদনাম হয়। চড়চাপড়ও খায়। তবু এ নেশা তার যায় না। বড়রা কিছু দেখে না, দেখতে চায় না। ওরা শুধু চড়ই মারতে পারে। আচ্ছা বলুক দেখি বাবা, কেন আমের শিয়ারাগুলো একদিন এমন করে গুটিয়ে যায়, বলুক দেখি, কোন কায়দায় এমন ঘটে? সে বেলায় মুখ ভোঁতা। 

পিঁপড়েরা পালে পালে ওই যখন পাতায় পাতায় ঘোরে, ওরা কি বিনা কাজে ঘোরে ভেবেছ! মোটেই না, ওরা বিনা কাজে ঘোরে না, ওরা তখন আঠা মাখায় পাতায়। একদিন হাত দিয়ে দেখেছিল নরা, তাই জেনেছে। সেই আঠা যত শুকিয়ে আসে, শিয়ারার পাতাও তত গায়ে গায়ে জুড়ে যায়। ততই শিয়ারাটা ফুলে ফুলে ওঠে। একদিন সব ফাঁক যখন বন্ধ হয়ে যায় মালপত্তর মুখে মুখে বয়ে এনে পিঁপড়েরা সব তার ভিতরে ঢুকে পড়ে। দু’-একটা বাইরে থাকে পাহারায়। ভিতরে অন্যেরা বোধহয় ডিম পাড়ে। 

.

এই দিনও নরা শুয়ে শুয়ে দেখছিল। তবে এখন সে চিত হয়ে শোয়নি। শুয়ে ছিল উপুড় হয়ে নরার চোখের সামনে একটা কচুপাতার উপর বড় একটা নালসে পিঁপড়ে। পিঁপড়েটার চোট লেগেছে বলে নড়তে পারছে না। নরার পিঠের চাপেই থেঁতলে গেছে পিঁপড়েটা তাই নরার দুঃখের অন্ত নেই। নরা তাকে কচুর পাতায় তুলে দিয়েছে। 

কচুর পাতায় গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল পিঁপড়েটা। দাঁড়াতে পারছে না। উবদো হয়ে, পাগুলো ওপরে তুলে পিলপিল করছে। নরা জানে না এ অবস্থায় কী করলে পিঁপড়েটা ভাল হয়ে উঠতে পারে। পিঁপড়ের রোগের ওষুধ আছে বলে তো সে শোনেনি। বাবা হয়তো জানতে পারে। কিন্তু তাকে এ-বিষয়ে জিজ্ঞাসা করাটা নিরাপদ কি না বুঝতে পারছিল না। বাবার হাতের চড়গুলো খুব কড়া এবং সেগুলো তার পিঠে পড়বার এত কারণ চতুর্দিকে ছড়ানো আছে যে একা সে সামাল দিতে পারে না। তাই যেচে আরেকটা সুযোগ সে বাবার হাতে তুলে দিতে চাইছিল না। হঠাৎ পিঁপড়েটা কচুপাতার উপর উঠে দাঁড়াল। উত্তেজনায় নরার বুক ধুকধুক করে উঠল। উঠেছে! উঠতে পেরেছে! 

পিঁপড়েটা উঠে দাঁড়াল বটে, কিন্তু এক পা-ও নড়তে পারল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল প্রায় একটি ঘণ্টা। মাঝে মাঝে পাগুলোর মধ্যে শুঁড় দিয়ে কী করছিল কে জানে। ভাঙা পা মেরামত করছে নাকি? সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে, পাতার উপর হুমড়ি খেয়ে, নরা দেখবার চেষ্টা করল। নাঃ, কিছুই দেখা গেল না। নরা কিঞ্চিৎ নিরাশ হল। 

পরক্ষণেই নরা দেখল নালসেটা ঢিপ ঢিপ করে মাজা নাচাচ্ছে। কী রে বাবা বাহ্যি করবি নাকি? আবার নরার হতাশ প্রাণে আশার সঞ্চার হল। এটা নরার মনের অনেক দিনের প্রশ্ন: পিঁপড়ে কি বাহ্যি পেচ্ছাব করে? আজ সে প্রশ্ন নিরসনের জন্য ভগবান এই পিঁপড়েটাকে তার হাতে তুলে দিয়েছেন। জয় ভগবান! 

ঠিক কোনখানটি দিয়ে যে পিঁপড়েরা ওই সব কাজকর্ম হাসিল করে সেটি মনোযোগ দিয়ে দেখার জন্য নরা যে মুহূর্তে তৈরি হল, ঠিক সেই সময় তার কানে বাপের ডাকটি তিরের মতো এসে বিঁধল। ডাকটি শুনেই বুঝল বাবা একটু গরম হয়েছে। এবং এ জগতে গরম বাবা যেহেতু ঈশ্বরের চাইতে শক্তিমান, সেই কারণেই নরা ভগবানের ইচ্ছেটা তাঁর হাতেই অর্পণ করে ক্ষুণ্ণ মনে বাবার হুকুম তামিল করতে ছুটল। 

নরাকে দেখে রামকিষ্টোর মনে বাৎসল্যভাব বিন্দুমাত্র জাগরূক হল না। কারণ, খেয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গোয়াল পরিষ্কারের কাজে লাগতে হয়েছে। পচা গোবর আর চোনায় ভেজা মাটি কোদাল দিয়ে চেঁছে ওগুলোকে সারগাদায় নিয়ে ফেলা যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য কাজ। কোমর পিঠ টনটন করতে থাকে। মেজাজ ভাল থাকার কথা নয়। শালার গোরুগুলোও হয়েছে তেমনি। দুধ তো সব ক’টা বন্ধ করেছে। হাটবাজার থেকে কিনে আনতে হয় রোজ। কেন, ওই সঙ্গে নাদাটাও বন্ধ করলে পারত। তা হলে রামকিষ্টোর আর এত ঝামেলা পোয়াতে হয় না। হারামজাদিরা দুধ দেবার কেউ না, জাবনা খাওয়ার মা গোঁসাই। 

রামকিষ্টোর মনের অবস্থা যখন এইরকম ঠিক সেই সময়ে তার সামনে নরা এসে ব্যাজার মুখে দাঁড়াল। রামকিষ্টো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। পেট পুরে খেতে দাও, বিছানা পেতে ঘুমোতে দাও, অমনি ছেলের মুখে হাসি উথলে ওঠে। আর কাজের গন্ধ পেলেই মুখখান একেবারে অমাবস্যে। মারে ওই মুখে এক লাথি! 

রামকিষ্টো অবশ্য লাথি মারল না। ছেলের সঙ্গে যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহারই করল। গোবরমাখা হাত দিয়ে নরার চুলের ঝুঁটি ধরে দুটো ঝাঁকুনি দিল। 

দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এক ডাকে আসা হয় না, বাবুর মন কোন গাছে বাঁধা, অ্যাঁ? যাও, মাজেবাবু ডাকতিছেন, বোধহয় তামাক খাবেন, সাজে দ্যাও গে। তারপর এক কলকে এখানে আনে দ্যাও। দেরি করলি মাজা সুজা থাকবে নানে। 

ঝাঁকির জন্য নয়, পচা গোবরের গন্ধে নরার পেট গুলিয়ে উঠল। কান্নার একটা প্রবল ইচ্ছা মনে গুঁতো মারতে লাগল। নিতান্ত মাজেবাবুর সামনে পড়তে হবে তাই সামলে নিল। তবে বিলক্ষণ চটে গেল তার উপর। মানুষটা কেমন ধারা গো! তামুক খাবার সময় অসময় নেই! একমুঠো আশ-শ্যাওড়ার পাতা ছিঁড়ে মাথা ঘষতে ঘষতে মেজকর্তার সামনে গিয়ে হাজির হল নরা। 

মেজকর্তা বললেন, নরা, তোর বাবা কোথায় রে? 

নরা মিনমিন করে বলল, গুয়াল ফিরোচ্ছে। 

মেজকর্তা বললেন, ও। তা তুই ঘোড়াটা মাঠে বেঁধে দিয়ে আসতে পারবি? 

ঘুড়া! নরা চমকে উঠল। কয় কী মাজেবাবু। কার ঘুড়া? নরা হকচকিয়ে চাইতেই দেখে মস্ত একটা ঘোড়া বারবাড়ির পুব ছামুতে বাঁধা আছে। দেখেই চিনল, ছোটবাবুর ঘোড়া। কখন এলেন ছোটবাবু? নরার মনে পড়ল, খানিকক্ষণ আগে ঘোড়ার টগবগি একটু শুনেছিল বটে। তেমন খেয়াল করেনি। 

মাজেবাবু তারে ওই ঘুড়া বাঁধতি কচ্ছেন! নরার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। উরে সব্বোনাশ! উডা যে ডাকাত। অমন জুয়ানমদ্দ ছাওয়াল বড়বাবুর, তারেই মারিছিল এক আছাড়। নরা কি আর আস্ত থাকবে নাকি? ওই দ্যাখো, খালি মাটিতেই কেমন খটাস খটাস লাথি ঝাড়তিছে। ওর একখানা নরার প্যাটে পড়লি, প্যাট গলে যে ডাল-ভাতে হয়ে যাবেনে। 

মেজকর্তার কথা শুনে শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল নরার।

অতিকষ্টে বলল, বাবু, বাবারে ডাকে নিয়ে আসব? 

মেজকর্তা বললেন, যা 

আর নরা অমনি প্রাণপণে দিল ছুট। যেন মেজকর্তার হুকুম এখনই বদলে যাবে।

হাঁফাতে হাঁফাতে গোয়ালের দরজায় গিয়ে নরা উত্তেজিতভাবে ডাক দিল, বাবা রে, শিগির আয়, ছোটবাবু আয়েছেন। 

রামকিষ্টো বেরিয়ে এসে দেখল, নরার মুখ চুবসে গেছে। থরথর করে কাঁপছে ছেলে।

অবাক হল রামকিষ্টো 

বলল, ছোটবাবু আয়েছেন তা তোর পিরানডা বেরোয়ে যাচ্ছে ক্যান? তুই কি খুনি আসামি? তোরে জেলে দেবে নাকি ছোটবাবু? 

হাঁফাতে হাঁফাতে নরা বলল, ছোটবাবুর সেই ঘোড়াটাও আয়েছে যে। মাজেবাবু কয়, নরা, ঘুড়াডা বাঁধে দিয়ে আয় দিনি মাঠে। 

নরার ভয়ের কারণডা এতক্ষণে বুঝল রামকিষ্টো। ছেলের তড়াসে ভাবটা আর কাটল না। বড্ড ভিতু। এবার কিন্তু আর রাগ হল না রামকিষ্টোর। জীবনে কিচ্ছু করতে পারবে না ও। মায়ের আদর খেয়ে খেয়ে একেবারে ননিগোপাল হয়ে উঠেছে। নরার ভবিষ্যৎ ভেবে দুঃখ হল রামকিষ্টোর। কেমন যেন আলাভোলা গোছের হয়ে উঠেছে ছেলেটা। মায়া হল তার। 

রামকিষ্টো হঠাৎ গোবরমাখা হাতখানা দিয়ে পরম আদরে নরার গালটা টিপে দিল। বলল, তালপাতার সিপাই! তোর ওই বয়েসে আমি শিঙেল মোষ চরাইছি, বুঝলি। 

গালে পচা গোবর লাগতেই নরা বেজায় চটে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল, করতিছ কী? উঃ, গন্ধ! থু থু।

নরা দু’হাতে গাল ঘষতে লাগল। ছেলের রকম দেখে হো হো করে হেসে উঠল রামকিষ্টো। বাপকে হাসতে দেখে নরা একটু অবাক হল প্রথমে। পরক্ষণেই খুশি হয়ে উঠল। বাবাকে হাসতে দেখলে খুব আনন্দ হয় নরার। কী আশ্চর্য, যেই খুশি খুশি ভাবটা নরার মনে জেগে উঠল, অমনি পচা গোবরের গন্ধটাও ওর নাকে আর অত বিকট লাগল না। সেও বাপের সঙ্গে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। 

রামকিষ্টো বলল, চল দিনি দেখি কনে তোর ঘুড়া। 

রামকিষ্টোর হাত ধরে নরা গুটিগুটি বারবাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। এখন সে এই দুনিয়ার কাউকে ভয় করে না। মাজেবাবুকেও না, ছোটবাবুর ওই ঘোড়াটাকেও না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *