দুরন্ত ধারা – ১

এক 

একে শনিবারের বারবেলা, তায় আমাবস্যে। লোহাজাঙার সা’দের কুড়োনের মা ঘাটে গিয়েছিল ভর সন্ধেয়। গা ধোয়াও হবে, এক কলসি জলও আনা হবে। 

কুঠির ঘাটটা জায়গা ভাল নয়। আসশ্যাওড়া, বুনো কুল আর বাবলা গাছের জঙ্গলে ভরতি। আর জঙ্গলের মধ্যে, এখন যেখানে নজর যায় না, নীল জাগ দেবার প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চাড়ি আকাশপানে মুখ তুলে রাক্ষসের মতো হাঁ করে সব বসে আছে। যাকে পাবে তাকেই গিলবে, এই ভাব। 

কুঠির মাঠে নাকি বাঘ-ভাল্লুকও যায় না। কুঠির ঘাটে সন্ধেবেলায় যেতে সাহসী পুরুষও দ্বিধা করে। 

কিন্তু সা’দের বাড়ির কুড়োনের মা’র কথা আলাদা। সে পুরুষমানুষের কাঁধে পা দিয়ে চলে। ভয়-ডর কুড়োনের মা’র ছায়া মাড়ায় না। 

এ দিগরের মধ্যে কুড়োনের মা-ই একমাত্র মনিষ্যি যে নিত্য সন্ধ্যায় কুঠির ঘাটে গা ধুতে আসে আর জল নিয়ে ফেরে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা নেই। বাধা বিপত্তি গেরাহ্যি নেই। 

সেদিনও গা ধুতে এসেছিল কুড়োনের মা। এই চোত-সংক্রান্তির আগের দিন। গা ধুয়ে উঠে ভরা ঘড়া কাঁখে নিয়ে রোজ-দিনের মতোই হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে। কুঠির মাঠের মাঝ বরাবর আসতেই কুড়োনের মা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

এই অসম্ভব স্থানে চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে কোত্থেকে? এই অসময়ে? ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে কাঁদে? কোথায় কাঁদে? 

কুড়োনের মা এদিক ওদিক চেয়ে দেখল। তার মনে হল, কুঠি-মাঠের মাঝ বরাবর, কাছারি-দালানের খিলেনটা যেখানে অখণ্ড পরমায়ু নিয়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে একটা বুড়ো বট আর খেজুর গাছ জড়াজড়ি করে আগাছাদের লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে, অন্ধকার যেখানে কালো পাথরের মতো জমাট, কান্নাটা যেন সেখান থেকেই আসছে। 

ওখানে গিয়ে এই সন্ধেবেলায় কার আবার কান্নার শখ চাপল? কুড়োনের মা দস্তুরমতো অবাক হল। বয়স কম হয়নি কুড়োনের মা’র। অঙ্ক জানে না, তাই সঠিক হিসেব দিতে পারবে না হয়তো। তা যেটের কোলে কুড়োনের বয়েসই তো বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠেছে। বহুদিন মারা গেছে ওর বাপ। তার এতখানি বয়সে আজকের মতো এমন অঘটন আর দেখেনি কুড়োনের মা। জল-ভরা বড় ঘড়াটা এক কাঁখে ব্যথা ধরিয়ে দিয়েছিল। কাঁখ বদলে স্বস্তি পেল। তারপর সে ডাক দিল: ওগো বাছা, তুমি কে গা? কে কাঁদতিছ ওখানে বসে বসে? 

কান্নাটা স্পষ্ট করে শুনতে না পেলেও কুড়োনের মা সেটা মেয়েছেলের কান্না বলেই আন্দাজ করেছিল। দেখল ভুল করেনি। তার ডাক শুনে কান্না থামল। শুকনো পাতার উপর খসখস পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর পাথরকালো অন্ধকার ঠেলে কুড়োনের মা’র সামনে এসে দাঁড়াল অল্পবয়সি অপরিচিত এক গেরস্ত-বউ। অমনি রূপে যেন চারিদিক আলো হয়ে উঠল। 

কুড়োনের মা দেখল, বউটির মুখ পিরতিমের মতো সুন্দর। আর কী চুল! যেন মাথা থেকে কালো জলের ঢেউ নেমেছে, পাছা ছাপিয়ে পায়ের গোছ পর্যন্ত নেমে সে ঢেউ জমে গেছে। পরনে চওড়া লালপাড় শাড়ি। কপালে আর সিঁথেয় সিঁদুর। শাড়ির লাল আর সিঁদুরের লাল টকটক করে যেন জ্বলছে। এ কাদের বাড়ির বউ? একে কোথাও দেখেছে বলে তো কুড়োনের মা’র মনে পড়ল না। 

তুমি কে বাছা? কাদের বউ? তোমারে তো এর আগে কখনও দেখিনি। এই বিজন বনে জনমনিষ্যি ঢোকে না। ওখানে বসে বসে কাঁদতিছ ক্যান? তোমার সঙ্গে লোক কে আছে? 

কুড়োনের মা একসঙ্গে এত কথা জিজ্ঞেস করে বসল। বউটি মৃদু মধুর গলায় যখন সব কথার জবাব দিয়ে গেল তখন কুড়োনের মা’র মনে হল, সে যেন সুন্দর একখানা গান শুনল। 

বউটি বলল, আমার বাড়ি অনেক দূর মা, অনেক দূর। আমার দুঃখের কথা শুনলে পাষাণ ও গলে যায়। সংসার আছে, সোয়ামি-পুতের ঘর আছে। কিন্তু সোয়ামি যার উপর নির্দয়, তার সব থেকেও কী লাভ বলো? সোয়ামি আমার মানুষ নয় গো, পাষাণ। পাষাণ। সতিন তার মাথার মণি, আমি দু’চক্ষের বিষ। নৌকোয় করে আমার সোয়ামি আমায় বাপের বাড়িতে রাখতে যাচ্ছিল। কী মতি উদয় হল তার, আমাকে এই বিজন বনে বনবাস দিয়ে নৌকো নিয়ে চলে গেল। ঘরের বউ পথ চিনিনে, তার উপর এই আমাবস্যের রাত। কোথায় যাব? কার বাড়ি আশ্রয় পাব? জানিনে। তাই, মা, বনে বসে মুখ লুকিয়ে কাঁদতিছিলাম। তোমায় দেখে বল পেলাম। দোহাই ধর্মের, আমাকে এখানে ফেলে তুমি চলে যেয়ো না। রাতের মতো তোমার ঘরে মা, আমাকে একটু ঠাঁই দাও। 

কী কাকুতি! কী আকুতি! আহা বেচারা! কুড়োনের মা গলে গেল। তার চোখ দুটো ভরে উঠল জলে। সঙ্গে করে নিয়ে চলল বাড়িতে। কুড়োনের মা আগে আগে, বউটি তার পিছনে বাড়িতে ঢুকে রান্নাঘরের বারান্দায় ভারী ঘড়াটা নামিয়ে একটু হাঁফ নিয়ে, “বসো বাছা” বলে পিছনে ফিরতেই কুড়োনের মা দেখে, ফাঁকা। কেউ নেই। 

বাঃ রে, কোথায় গেল বউটা? তবে বোধহয় চেগারের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে। লজ্জা পাচ্ছে ঢুকতে। 

আসো মা আসো। লজ্জা কী? পুরুষমানুষ কেউ নেই এখন। থাকার মদ্যি আমার তো ওই শিবরাত্তিরির সলতেটুকুন— ওই কুড়োন। তা সে বাবু সন্ধের আগে তেড়ি বাগিয়ে বেরোন, ফিরতি ফিরতি মদ্যিরাত। 

বলতে বলতে কুড়োনের মা চেগারের কাছে এগিয়ে গেল। বাঁশ ছেঁচে চেগার তৈরি করেছে কুড়োন। যত্ন করে নিজের হাতে আড়াল তুলে দিয়েছে। ভিতর থেকে বাইরেটা দেখা যায় না। 

কুড়োনের মা বাইরে বেরিয়ে গেল। না, এখানেও তো কেউ নেই। বউটা গেল কোথায়? একটু আগেও তো ছিল। হরলাল কামারের বাড়ি ছাড়িয়ে এসেও সে তার পায়ের শব্দ শুনেছে। তা হলে এইটুকুর মধ্যে আর যাবে কোথায়? বেশ মজা তো। সে ভাবল, বউটা কি তবে পাগল? লক্ষণ তো বোঝা গেল না। না কি নষ্ট-টষ্ট? উঁহুঁ, মুখ চোখের অমন ভাব নষ্ট মাগির হয় না। 

কুড়োনের মা হরলাল কামারের বাড়ির দিকে গেল। 

হরলাল দরজার সামনে পিদিম জ্বেলে, নিকেলের চশমা নাকের ডগায় নামিয়ে এনে ঠুকুর-ঠুকুর কাজ করছে। কুড়োনের মাকে ফিরতে দেখে একবার চেয়েই আবার ঠুকুর-ঠুকুরে মন দিল। 

কী গো বউদি, কী খোঁজছ? 

ও কামার ঠাউরপো, আমার সঙ্গে যে বউডা আসতিছিল, সে কি তুমাগের বাড়ি ঢুকে পড়ল?

হরলাল আশ্চর্য হল। 

কোন বউর কথা বলছ? তুমার সঙ্গে আবার বউ গেল কার, তা তো দেখলাম না। ছেলের বিয়ে দিলে কবে? 

কুড়োনের মা চটে গেল। ঠাউরপোর সব তাতেই ঠাট্টাবাজি। রঙ্গরস রাখোদিন। শুনলি গা জ্বালা করে। বলি, দুটো চখির উপর দু’খান পরকলা তো চাপায়েছ বেশ জম্পেশ করে, তাউ অমন জলজ্যান্ত মনিষ্যিডেরে দেখতি পালে না। সেই ঘাটের থে আমার পিছন পিছন আসতিছে। কাঁদে ককায়ে কলো, সোয়ামিতি ফ্যালায়ে গেছে। রাত্তিরডে দয়া করে এটটু আশ্রয় দ্যাও। মনডা নরম হল। ভাবলাম, সোমখ মেয়ে, কাঁচা বয়েস, তার উপর পিরতিমের মতো রূপ— এসব নিয়ে যায়-ই বা কনে! কলাম, চলো আমার বাড়ি। তা দ্যাখো দিন, এখন গেল কনে! 

এবার হরলাল সত্যিই বিস্মিত হল। 

ধর্মত বলছি বউদি, তুমার সঙ্গে আমি কারুর যাতি দেখিনি। রোজ যেমন একা একা ফেরো, আজও তাই ফিরিচ। কামারের চোখ এড়ায়ে, জানো তো, মাছি পর্যন্ত যাতি পারে না। আমার মনে হয়, তুমি ভুল দেখিচ। 

অত ভুল আমার হয় না। আর ভুল কীসির? কথা কলাম। তারে দ্যাখলাম। পিছন পিছন পায়ের শব্দ পালাম। সব ভুল! তোমার মতো আমার তো ভীমরতি ধরেনি। বলি, পথ হারায়ে ফ্যালেনি তো। 

হরলাল এবার বিরক্ত হল। অনর্থক কাজ নষ্ট। কুড়োনের মায়ের ভীমরতিই ধরেছে। জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমার চোখের উপর দিয়ে চলে গেল আর আমি দেখতে পেলাম না! হ্যাঃ। আমার চোখে তো ছানি পড়েনি। বলে কি পথ হারাবে? জবাব দিল ঠুক ঠুক করতে করতেই, সুজা রাস্তা আবার হারাবে কী? দ্যাখো গে, আগেই হয়তো ঢুকে পড়িছে ঘরে। তবে পরের ফ্যাসাদ আবার ঘরে আনলে ক্যান? বিয়েন বেলাতেই বিদেয় করে দিয়ো। 

কিন্তু,কুড়োনের মা এই পরামর্শমতো চলবার আর ফুরসত পেল না। শেষ রাত্তিরে শুরু হল তার ভেদবমি। বিহান না হতেই শেষ। ওলাইচণ্ডীকে ঘরে ডেকে আনার ফল হাতে হাতে পেল কুড়োনের মা। কুড়োনের মা গেল, ধরল কুড়োনকে। কুড়োনও দুপুরের মধ্যেই গেল। তারপর গেল হরলাল কামার, তার বউ, তিন ছেলে, দুই বেটার বউ। নির্বংশ। তারপর গেল গ্রামখানা। তারপর, আঠারোখাদা, বিনেদপুর, ধপধপি, কুড়োল, নলসি— একে একে ওদিগরের সব গ্রাম। 

.

দম নেবার জন্যই বোধকরি বুদো ভুঁয়ে থামল। বেশ বলে বুদো। যেন প্রত্যক্ষদর্শী। মড়ক হয়েছিল একবার। বুদো ভুঁয়ে সবিস্তারে সেই কাহিনীই শোনাচ্ছিল এতক্ষণ। এবার দম নিতে থামল। থামার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-ফাটা এক গর্জন। চকিতে কানে তালা লেগে গেল সবার। বেশ করে তামাক সেজে নরা কলকেটা বামুনের হুঁকোয় পুরতে যাবে, দেয়ার ডাকে আচমকা হাত কেঁপে কলকে পড়ে গেল। 

সরকার মশায় হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, দশ বছর বয়স হল ছ্যামড়ার এখনও কাজকম্ম শিখল না। কী রে, ভাঙলি নাকি? 

স্যান কবিরাজ বললেন, ও বাবা সরকার মশায়ের কলকে, ভাঙলি কি রক্ষে আছে?

সরকার মশায় ছোঁ মেরে যেন স্যান কবিরাজের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলেন। 

আরে ব্বাস, ও কি যে সে কলকে নাকি? এতদ্দেশে ওর জুড়া নেই। আমার জামাইয়ের ভগ্নিপোত এলাহাবাদের উদিকি কোন শহরে য্যান ডাক্তারি করে। সেই আমার জামাইরি এই কলকেডা আনে দিইছিল। তা জামাই কলো, বাবা, উড়া আপনিই নিয়ে যান। যে-সব কুমোর নবাব বাদশাগের কলকে বানায়, তাগের হাতের জিনিস। ভাঙলি ও আর পাব কনে? 

বুধো ভুঁয়ে ফোড়ন কাল, নবাবি জিনিস কি চাষাভুষোর হাতে ছাড়ে দিতি হয়? জামাই এত কষ্ট করে আপনারে যখন একটা নবাবি কলকেই পাঠাতি পারল, তখন একজন হুঁকোবরদার পাঠায়ে দিলিই পারত। 

সরকার মশায় অন্যদিকে চেয়ে কাশতে লাগলেন ঘনঘন। এইসব ছেলে-ছোকরাদের টিপ্পনীর জবাব দেওয়া মানে মান-সম্মান খোয়ানো। 

নরা এবার খুব সতর্ক হয়ে তামাক সেজে বামুনের হুঁকোটা পুরুত ঠাকুরের হাতে দিল। হুঁকোটা বেশ করে মুছে রিদয় ঠাকুর টানতে শুরু করলেন। 

বৃষ্টিটা ধরব ধরব হয়ে এসেছিল। আবার জোরে শুরু হল। ঘন মেঘ-ভরা আকাশের দিকে চেয়ে মেজকর্তার মন কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। আকাশের গতিক ভাল নয়। বৃষ্টি আজ ধরবে কি না সন্দেহ। 

মেজকর্তা অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, নরা, তোর বাপ কই রে? 

নরার পিলে চমকে গেল। কী জানি কেন, মেজকর্তাকে দেখলে সে ভয়ে জড়সড় হয়ে যায়। এক মুখ লম্বা দাড়ি, মাথায় টাক, কথাবার্তা কম বলেন, সেই কারণে? নাকি বিদেশে থাকেন, দেখাসাক্ষাৎ কম, সেই কারণে? কী জানি কেন, মেজকর্তা সম্পর্কে নরার ভয়, সেই ছোটবেলা থেকে। জ্ঞান হওয়া ইস্তক নরার কাছে মেজকর্তা পরম ভয়ের বস্তু। ছোটবেলায় যখনই নরা দুষ্টুমি করেছে, অমনি বাপ বলেছে, দাড়া, মাজে কর্তারে ডাকি। আর নিমেষে নরা শান্ত, বড়কর্তা তেজি লোক, ছোটকর্তা ডাইসাইটে দারোগা, বাঘে গোরুতে তাঁর নামে এক ঘাটে জল খায়। কিন্তু ওঁদের দেখে ভয় হয় না নরার। ওঁদের সামনে গিয়ে নানা ফরমায়েশ খেটেছে, তামাক সেজেছে বহুবার। এমনকী ছোটকর্তার গায়ে তেল পর্যন্ত মাখিয়ে দিয়েছে। তেমন কিছু তো ভয় হয়নি তার। 

যত ভয় মেজকর্তায়। দু’বছর আগে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে এসেছিলেন। তখন নরা আরও ছোট। ভিড়ের মধ্যে মিশেটিশে দিন কাটিয়ে দিয়েছে। এবার তার অদৃষ্টে কী আছে, কে জানে? মেজকর্তার কাছে-কাছেই দেখি থাকতে হচ্ছে। তাই তো, কী যেন একটা জিজ্ঞেস করলেন মেজকর্তা? যাঃ, শুনতেই পায়নি ভাল করে। না, শুনতে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু মনে করতে পারছে না। হেই মা কালী, কী যে হবে! এক ছুটে পালিয়ে যাবে বাড়ি? আর এ-মুখো হবে না জীবনে? 

নরা, তোর বাবা কী করছে? 

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এই কথাই আগে আর একবার জিজ্ঞেস করেছেন মেজকর্তা। কী বলবে, কর্তা, না বাবু, না হুজুর? 

বাবা? বাবা কুঁড়ে বাঁধতিছে। 

যাক, জবাব দিতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল তার। একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। 

আচ্ছা বাবু (বাবুই বেরুল মুখ দিয়ে), আমি দেখে আসতিছি।

রিদয় ঠাকুর বললেন, তুমারে যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে মহি? 

মেজকর্তা বললেন, দাদা বাড়ি নেই। কাল ঝিনেদায় গিয়েছেন। মামলা আছে। এদিকে সকাল থেকে বুড়ির ব্যথা উঠছে একটু একটু করে। 

রিদয় ঠাকুর বললেন, আরে তার জন্যি কিছু ভাবে না। মঙ্গলময়ী মায়ের ইচ্ছেয় সবকিছু মঙ্গলে মঙ্গলেই হয়ে যাবেনে। 

রিদয় ঠাকুরের বিশ্বাসভরা আশ্বাসে একটু আরাম পেলেন মেজকর্তা। 

বললেন, না, ঠিক সেজন্যে চিন্তা করছিনে। ভাবছি বৃষ্টির জন্যে। যেভাবে শুরু হয়েছে, থামলে হয় আজ 

বুদো ছুঁয়ে বলল, ভগবানের লীলা বুঝা ভার। এই বিষ্টির পিত্যেশে আমরা অ্যাদ্দিন মাথা খুঁড়ে মরিছি। বোঝলেন মাজে খুড়ো, ইবার একটার পর একটা যা আপদ আমাগের মাথার উপর দিয়ে গেল, তা আর কহতব্য নয়। ওলাদেবীর দয়ার কথা তো আপনারে আগেই কলাম। শুধু আমাদের গিরামটায় তিনি দয়া করে খাবলটা মারেননি। তাও পুবির পাড়ায় রিয়াজদ্দি গাজি আর ইরফান শ্যাখের বাড়ির জনাচারেক গিয়েছে। মড়কের সময় বিষ্টির দেখা ধারে-কাছেও মেলেনি। তখন যদি একটু বিষ্টিও হয়, তা হলি এই সব্বনাশটা আর হয় না। কিন্তু কনে বিষ্টি? আজ তিনি ছিষ্টি ভাসায়ে দেচ্ছেন। 

হুঁকোটা ঘুরে ঘুরে এতক্ষণে বুদো ভুঁয়ের হাতে এসে পৌঁছাল। ফতুয়ার পকেট থেকে একটা সরু কাঠের নল হুঁকোতে লাগিয়ে বুদো ভুঁয়ে গোটা কতক টান তাড়াতাড়ি দিয়ে পাশের লোকের হাতে হুঁকোটি তুলে দিল। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সুখটা মালুম করে নিল। 

তারপর শুরু করল, যদি বর্ষে মাঘের শেষ ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ। তা মাঘ তো দূরির কথা, ফাল্গুন চৈত গেল, বোশেখ গেল, এক ফোঁটা বিষ্টি নেই। জষ্টিও কাবার হল। কুথায় বিষ্টি? খাল বিল শুকোয়ে খটখট কচ্ছে। নবগঙ্গা হাটে পার হচ্ছে লোকে। অদ্যাবধি কারও মাঠে লাঙল পড়েনি। পড়বে কী করে, মাঠের মাটি শুকায়ে পাথর হয়ে গেছে। আম-কাঁঠালের বোল মুচি ধরতি না ধরতি মাটিতে খসে পড়িছে। মাছ নেই। ঘাস নেই। চারিদিকে হাহাকার। তার উপর মড়ক। কী ভাগ্যি, আজ শেষ রাত্তিরের থে আকাশ মুখ তুলে চালেন। এখন গবগব করে না ঝরলি মাঠ ভেজবে না। পাটের দফা রফা তো ইবারের মতো হলই ধান যদি কিছুডা হয়! 

স্যান কবিরাজ বললেন, পাট লাগায়েও যে কোন চতুর্বর্গ ফল হত, তাও তো বুঝিনে। বছর বছর দর তো দেখি হু হু করে নামে যাচ্ছে। এখন তো চাষের খরচও ওঠে না। সবচে বেশি মার খাচ্ছে মিয়ারা। 

আরে, ওগের কথা ছাড়ান দ্যাও।— সরকার মশাই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ওগের সবই উলটো বুঝলি রাম। আমরা যা করব, উরা তার উলটো করবে। আমরা পুবমুখী আহ্নিক করি, উনারা পশ্চিমমুখী নমাজ পড়েন। আমরা বাইরির থে বাড়ি আসে আগে পায়ে জল দিই, উনারা আগে হাতে জল দেন। আমরা পাঁঠার ঘাড়ে কোপ মারি, উনারা গলায় পৌঁচ মারেন। কত আর কব? 

স্যান কবিরাজ সরকার মশাইয়ের কথার ধরনে হেসে ফেললেন। বললেন, যা বলিছ। দ্যাখছে, পাটের দাম পড়ে যাচ্ছে তবু পরের বার বেশি করে বোনছে। ইডা বোঝে না মাল বেশি হলি দাম আরও কমে যায়। 

সরকার মশাই বললেন, বলি বুঝাতি চাও কারে? মিয়ারে? ওরা যদি কিছু বোঝবেই তা হলি আর চিরকাল নাঙ্গলা চাষা হয়ে থাকে? আমার জামাইয়ের ভগ্নিপোত পশ্চিমির যে শহরে ডাক্তারি করে, সে নাকি জামাইরি কয়েছে, ওদিকির মিয়ারা উকিল, ডাক্তার, এমনকী জজ ম্যাজিস্টরও হয়। শুনে আমি তো অবাক। চোদ্দো শাস্তর পড়ে যদি মোছলমানের পোলা, তবু তার নাহি যায় নাত নোদ নাঙ্গা শাক ত্যাল ব্যাল ক্যালা। রাতিরি যারা নাত, রোদিরি নোদ, .তেলেরে ত্যাল কয় তারা আবার জজ হয় কী করে তা তো বুঝিনে। 

মেজকর্তার মনে পড়ল সরকার মশাই এইমাত্র যে শোলোকটি বললেন, ছোটকাল থেকেই সেটা তাঁরা শুনে আসছেন। যদি না তিনি কিছু লেখাপড়া শিখতেন, যদি না কলকাতায় কাটাতেন কিছুকাল, তা হলে চিরকাল এদের মতোই অজ্ঞ থেকে যেতেন। এদের মতোই বিশ্বাস করতেন মিয়ারা চিরকাল লাঙলই চালায়। 

হঠাৎ তাঁর প্রথম যৌবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়তে লাগল। উজ্জ্বল প্রাণোচ্ছল কলকাতার কথা। কলেজে দিনগুলোর কথা। মনে পড়ল ঋষিতুল্য প্রফেসরদের কথা। ড. হাসানের কথা। হাসান সাহেবের মতো পণ্ডিত, তাঁর মতো চরিত্র জীবনে খুব বেশি দেখেননি মেজকর্তা। 

এরা, এইসব কূপমণ্ডূকেরা কীই বা দেখেছে, কতটুকুই বা জেনেছে! দুরন্ত যৌবনে রক্ত যখন গরম ছিল মেজকর্তার, তখন এইসব মূর্খ অশিক্ষিত লোকেদের তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন তিনি। তখন এই ধরনের মন্তব্য শুনলে তাঁর রক্তে কে যেন আগুন ঢেলে দিত। তাদের মন্তব্য যে কত ভুল তা প্রমাণ করবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করতেন, প্রচণ্ড তর্ক করতেন, শেষ পর্যন্ত ঝগড়া বাধিয়ে দিতেন। 

আজ এই উনপঞ্চাশ বছরের দেহে সে তেজ নেই, সে বোকামিও নেই। তর্ক করে শুধু তর্কই করা যায়, আর-কিছু না। প্রৌঢ়ত্ব তাঁকে সে জ্ঞানটুকু দিয়েছে। তা ছাড়া এদের অজ্ঞতার জন্য আজ আর এদের আগের মতো ষোলো আনা দোষী করতে ইচ্ছা যায় না। জ্ঞানের আলো এদের চোখে জ্বালাবার চেষ্টাই বা কী হয়েছে? কে করেছে? এখন বরং এদের জন্য মেজকর্তার করুণাই হয়। করুণা হয় তাঁর নিজের জন্যও। কীই বা করলেন তিনিও? 

পাটের ব্যাপারে দু’-একটা কথা বরং তিনি বলতে পারেন। পাটের আপিসেই কাজ করেন মেজকর্তা। আমদানি বাবু। রংপুর জেলার পাটের মোকাম ডোমার। সেখানকার বার্কমায়ার কোম্পানির আমদানি বাবু তিনি। তিনি জানেন, পাট চষে পাটরানি পোষার দিন চলে গেছে চাষির। সাহেবদের কারখানায় পাটের চাহিদা দিনদিন কমে আসছে। এবারও তাঁদের আপিসে কলকাতা থেকে হুকুম এসেছে, প্রথম বাজারে পাট না কিনতে। দাম কতদূর নামে তা দেখার জন্য যেন নিস্পৃহভাবে অপেক্ষা করা হয়। 

মেজকর্তা গলা ঝেড়ে বলতে যাবেন, এমন সময় আর-একবার মেঘ ডেকে উঠল জোরে আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতর থেকে যেন গোলমাল শোনা গেল একটা। মেজকর্তার বুকটা কে যেন শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে আবার চট করে ছেড়ে দিল। মুখটাও শুকিয়ে গেল। 

রামকিষ্টো ভিজতে ভিজতে এসে হতাশ হয়ে বলল, মাজেবাবু, কুঁড়েটা ভাঙে পড়ে গেল।

মেজকর্তা ঘাবড়ে গেলেন, তা হলে উপায়? 

রামকিষ্টো বলল, উঠোনে পিরায় এক হাঁটু জল দাঁড়ায়ে গেছে। 

হুঁ, গতিক সুবিধের ঠেকছে না। মেয়েটার কপালে কী আছে কে জানে? বোকার মতো রিদয় চক্কোত্তির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন তিনি। 

পুরুত ঠাকুর সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মহি, আমি বলছি, তুমি মোটেও ভাবে না। নাতনির গর্ভ বিধিমতে শোধন করা আছে। সুপ্রসব না হয়েই যায় না। 

বুদো ভুঁয়ে বলে উঠল, মাজে খুড়োর মেয়ের ঘরে আসতিছেন বটে অ্যাকজন। খরা আর মড়ক পিছনে রাখে, বিষ্টি মাথায় করে অ্যাকেবারে ছিষ্টি জানান দিতি দিতি আসতিছেন। 

রামকিষ্টো বলল, তা তো তিনি আসতিছেন বুঝলাম, কিন্তু আসবেন কনে? কুঁড়ে বাঁধি কুথায়?

রিদয় ঠাকুর বললেন, তুমি পাকা ঘরামি রামকিষ্টো। যেখেনে সুবিধে পাও সেখেনেই বাঁধো গে। মহি অ্যাকেই ঘাবড়ায়ে গেছে, ওরে আর ভয় পাওয়ায়ে দিয়ো না। 

রামকিষ্টো চলে যায় দেখে মেজকর্তা বললেন, তুমি একা, না সঙ্গে লোক আছে রামকিষ্টো?

রামকিষ্টো বলল, এ-সব কাজ কি একা হয় কত্তা, ছোলেমান নিকিরিরউ ডাকে আনিছি। ও-ও খুব সরেশ ঘরামি। কথা তা না। উঠোনে জল জমেই কাজের বীজ মারে ছাড়িছে। অত উঁচো করে পুতা বাঁধলাম, তা এই সুমুন্দির বিষ্টির কাজডা দ্যাখলেন তো, জল পিরায় হাঁটু ছাড়ায়ে উঠতি চায়। ওর মদ্যি কি মাটি বসান যায়? সব একেবারে ঢেয়োয়ে দেচ্ছে। 

মেজকর্তা বললেন, যদি শেষ পর্যন্ত কুঁড়েটা বাঁধতে না পারে, তা হলে ঘরের মধ্যেই না হয় আঁতুড় হবে। করা যাবে কী? কলকাতায় তো হাসপাতালেই প্রসব হচ্ছে। 

মেজকর্তার কথা শুনে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল। ঘরে হবে আঁতুড়! মেজকর্তার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? নাকি খিরিস্টান হয়ে গিয়েছেন? কলকাতার রং আজও মেজকর্তা তা হলে মুছে ফেলতে পারেননি! 

রিদয় ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন, মহির আমাদের চিরটাকাল অ্যাকরকম গেল! ও রামকিষ্টো, আর দাঁড়ায়ে আছ ক্যান বাবা, চিষ্টা-চরিত্তির করে দ্যাখো। ঘরে কি প্রসব হয়? 

ভিতর থেকে চাঁপা ছুটে এল। বড়কর্তার ছোট মেয়ে। 

হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, মাজে কাকা, শিগগির ভিতরে আসো। বড় মা ডাকতিছে বড়দির ব্যথা বাড়তিছে। 

ধক করে হৃৎপিণ্ডে একটা জোর ধাক্কা লাগে। বলিস কী? সর্বনাশ! এখনও যে কুঁড়ে বাঁধা হয়নি। আঁতুড় হবে কোথায়? তবে কি বুড়িকে ওই উঠোনেই নামিয়ে দিতে হবে? মরে যাবে যে মেয়ে। বড়দা এখনও কেন আসছে না? কেন আসছে না? 

গলামুখ শুকিয়ে গেল মেজকর্তার। অস্থিরতা বেড়ে উঠল মনের। বুক-সমান দাড়িতে ঘনঘন হাত বুলোতে লাগলেন। যেন এইটেই তাঁর এই মুহূর্তের একমাত্র করণীয়। 

চাঁপা তাড়া লাগাল, চলো শিগগির। 

দুই 

বাড়ির ভিতরে ঢুকতে মেজকর্তার আর পা সরে না। বুড়ি বড় আদরের মেয়ে। একমাত্র মেয়ে। মেজবউয়ের নয়নের মণি, মেজবউ সেই মেয়ের মায়া কাটিয়ে কবে স্বর্গে চলে গেছে। তা প্ৰায় দশ বছর হল বই কী। কিন্তু মনে হয় যেন সেদিন। 

শেষ সময় সে কী উৎকণ্ঠা মেজবউয়ের। ছবিটা এখনও চোখে ভাসে। ঘরভরতি লোক। খাটে শুয়ে কেমন ছটফট করছে মেজবউ। কাকে যেন কী বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। সবাই বুঝতে পারছে যে মেজবউয়ের সময় হয়ে এসেছে। 

হঠাৎ বড় বউঠানের খেয়াল হল, মেজবউ বোধহয় কিছু বলতে চায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ও মেজবউ, কিছু বলবি? মেজবউ কথা বলল না, শুধু মেজকর্তার দিকে একবার চাইল। দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখের কোনা দিয়ে। 

বড়বউ বুঝলেন। বললেন, সব ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। সরলা কিছু বলতে চায় মেজকর্তাকে। ঘর খালি হয়ে গেল। মেজকর্তা এগিয়ে গেলেন, মেজবউয়ের মাথার কাছে। মেজকর্তার হাত দুটো ধরে মেজবউ ধীরে ধীরে বলল, বুড়ি থাকল। যেন ভেসে না যায়। মেজকর্তা ইঙ্গিতটা বুঝলেন। বললেন, কথা দিচ্ছি বুড়ির অযত্নের কোনও কারণ ঘটাব না। মেজবউ অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। বলল, একটু পায়ের ধুলো দাও। পায়ের ধুলো মাথায় রাখল মেজবউ। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, কথা দাও, বুড়ির বিয়ে দেবার আগে কলকাতায় যাবে না। প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিলেন মেজকর্তা। এত থাকতে হঠাৎ কলকাতার কথা উঠল কেন? এই সময়ে? মুহূর্তে মনে পড়ে গেল কলেজ-জীবনের কথা। একটা মহা বোকামির কথা। তা সে ব্যাপার তো কবেই চুকে গেছে। সংসার পাতার পর একদিনের তরেও মেজকর্তা কলকাতার কথা তুলেছেন বলে তো মনে পড়ে না। মেজবউ এতদিন ধরে মনে মনে সেটাও গেরো বেঁধে রেখেছে। আশ্চর্য! মেজকর্তা বলেছিলেন, কলকাতার কথা ভেবে কষ্ট পেয়ো না মেজবউ। কলকাতায় যাবার কোনও সাধই আমার নেই। 

মেজবউয়ের সেই বুড়ির আজ সন্তান হবে। মেজবউ থাকলে কী খুশিই না হত। কিন্তু সেই মানুষটা আজ কোথায়? মেজকর্তাকেও এত দুশ্চিন্তা মাথায় করে ঘুরে বেড়াতে হত না। 

.

বড়বউয়ের গলার আওয়াজে মেজকর্তার ভাবনা ছিঁড়ে গেল। ফোঁস করে যে টানা নিশ্বাসটা পড়ল তাতেই যেন বুক খানিকটা হালকা হয়ে গেল। 

বড়বউ বললেন, ও মাজে, তুমার কি জ্বর আলো নাকি? 

বড়বউ আর মেজকর্তা একবয়সি। বড়বউয়ের যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়েস আট। মেজকর্তারও তাই। সেদিন থেকে দু’জনের সম্বন্ধ চুলোচুলিরও যত, গলাগলিরও তত। বরাবর তাদের মধ্যে তুই-তোকারি চলে এসেছে। ছেলেপুলে হবার পর তুই থেকে তুমিতে উঠেছেন তাঁরা। হাজার হোক বয়েসটা বেড়েছে তো? 

কী, মুখি কি কুলুপ আঁটিছ? বড়বউ বললেন, রা কাড়তিছ না যে বড়? জ্বর আয়েছে নাকি? 

মেজকর্তা একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, বড়বউ, বুড়ির কী হবে? 

যেন দৈবজ্ঞ ঠাকুর হাত গুনছেন, বড়বউ তেমনই গম্ভীর চালে বললেন, হয় ছেলে, আর না হয় মেয়ে। 

বড়বউয়ের পরিহাসে পরিবেশ হালকা হয়ে গেল। তবে বোধহয় তেমন সাংঘাতিক কিছু ঘটেনি। দুর্ভাবনার ভারী বোঝা নেমে গেল মেজকর্তার কাঁধ থেকে। 

একটু হেসে মেজকর্তা বললেন, পাকা গণতকার হয়ে উঠলে কবে? 

বড়বউ বললেন, যবের থে দ্যাখলাম পুরুষমানুষ মেয়েগেরও অধম হয়ে দাঁড়ায়েছে। দ্যাখ মাজে, তোর এত দুশ্চিন্তা কীসির ক দিনি। বাড়িতি কি লোকজন নেই, না এ বাড়িতি তোর মেয়েই পেরথম বিয়োচ্ছে? 

মেজকর্তা বললেন, বুড়ির কোনও অমঙ্গল-টমঙ্গল— 

কথা শেষ না হতেই বড়বউ ধমকে উঠলেন, ও ছাড়া তুমার মনে আর কোনও চিন্তা নেই? ভাল আমার বাপ হয়েছেন। বালাই ষাট। তুমি এখন যাও দিনি, কুড়েড়া যাতে তাড়াতাড়ি বাঁধা হয়, তার চিষ্টা দ্যাখো। 

মেজকর্তা ধমক খেয়ে একটু চুপ করে গেলেন। তারপর আমতা আমতা করে বলেই ফেললেন কথাটা, বড়বউ, বলছিলাম কী, এই ইয়ে, বুড়িকে ওই ভিজে কুঁড়েতে না পাঠিয়ে ঘরে রাখলে হত না? 

বড়বউ আকাশ থেকে পড়লেন, ও মাজে, কও কী? পোয়াতি খালাস হবে ঘরে? এমন কথা তো আমার চোদ্দো পুরুষিও কেউ শোনেনি। 

মেজকর্তা বললেন, তোমার চোদ্দো পুরুষ তো অনেক কিছুই শোনেনি। তোমার বাবা তো রেলগাড়ির কথাও শোনেননি। তা বলে কি রেলগাড়ি হয়নি? না, তুমি আর রেলে চড়বে না? কলকাতায় তো হাসপাতালেই সব হয়। 

বড়বউ মেজকর্তার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকলেন। মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। মেজকর্তা দেখলেন, ছেলেবেলার দুষ্ট হাসি বড়বউয়ের চোখে ঝিলিক খেলে বেড়াচ্ছে। 

মেজকর্তা সাবধান হতে চেষ্টা করলেন; তিনি জানেন, এর পরেই আসবে একটা আক্রমণ। 

বড়বউ বললেন, কলকাতার বাবুর মনের থে কলকাতার জন্যি দরদ যে বুড়ো বয়সেও গেল না দেখতিছি। কলকাতায় তো অনেক কিছু থাকে। সেখেনে তো আমাগের মতো পেতনি থাকে না, শুনিছি ড্যানাকাটা পরিরে থাকে। কলকাতার শাস্তর কলকাতায় চলুক, দেশে তো তা চলবে না। এখেনকার নিয়ম হচ্ছে, যে ঘরে ছেলেপুলে হয়, সে ঘরডা নোয়ার কামানের দিন ভাঙ্গে ফেলতি হয়। না হলি পোয়াতির উপর দিষ্টি লাগে। তা তুমি কি তোমার মেয়ের জন্যি এই বাড়িডা ভাঙ্গে ফেলতি চাও? 

মেজকর্তা অতটা তলিয়ে দেখেননি। বড়বউয়ের কথার তোড়ে ঘাবড়ে গিয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। 

বড়বউ বললেন, বাজে চিন্তা ছাড়ে দিয়ে, এখন যাও দিনি উদিকি। রামকিষ্টো কী করল দ্যাখো গে। কুঁড়েড়া যেন শক্ত করে বাঁধে। পুতাড়া যেন বেশ উঁচো হয়। ডুয়া যেন ভাঙ্গে না পড়ে। আর হ্যাঁ, বুনোপাড়ায় লোক পাঠায়ে অন্ন দাইরি ডাকায়ে আনো। সে লবাবের বিটির আজ তো দর্শনই পাওয়া যাচ্ছে না। 

.

অন্ন দাইয়ের খোঁজে মেজকর্তা লোক পাঠিয়ে দিলেন। তারপর ভিতর-বাড়ির উঠোনে চললেন কুঁড়ে বাঁধার তদারক করতে। ভিতরের উঠোনে উঁকি মারতেই তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। গবগব শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার ঠ্যালা। রামকিষ্টো আর ছোলেমান নিকিরির সঙ্গে নরাও হাত লাগিয়েছে। 

তিনজনে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। মেজকর্তার মুখ কালো হয়ে গেল দুর্ভাবনায়। একে তো কুঁড়ে বানানো অসম্ভব, তায় কুঁড়ে যদি বানাতে পারেও, তার মধ্যে বুড়িকে রাখা আরও অসম্ভব। চঞ্চল হয়ে উঠলেন মেজকর্তা। বাইরের বাড়িতে চললেন। 

নালা নর্দমা কেটেও উঠোনের জল কমাতে পারেনি রামকিষ্টো। সেই হাঁটুজল উঠোনে, ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি ফেলেছে ছোলেমান। পোঁতা আর তুলতে পারছে না। ভিজে ভিজে গায়ের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। শীত লেগে দাঁত কাঁপছে ঠকাঠক। নরাকে কড়া করে তামাক সেজে আনতে বলেছে রামকিষ্টো। তা সে শুয়োরের বাচ্চা গিয়েছে তো গিয়েছেই। ফেরার নামগন্ধও নেই। বার-বাড়ি থেকে তামাক সেজে এখানে আনতে কলিযুগ না শেষ হয়ে যায়! 

রামকিষ্টো বলল, ছোলেমান, যা দিন বার-বাড়ি। দ্যাখেক তো হারামজাদাডারে যমে ধরল নাকি? দ্যাখা পালিই শালার পিঠি মারবি দুই লাথি। ওই যে আসতিছেন লবাবপুত্তুর। ইচ্ছে হচ্ছে কী এই উঠোনের জলেই ব্যাটারে পানেট করে ছাড়ে দিই। তাড়াতাড়ি আন। 

নরা এসে দাঁড়াতেই ঠাস ঠাস বাপের হাতের চড় খেল। 

কী কত্তিছিলি এতক্ষণ, অ্যাঁ? তোরে কলাম, এক ছিলিম তামুক সাজে আনতি। তা তুই কি সেখেনে তামাকের চাষ শুরু করলি নাকি? হ্যাঁরে এই হারামজাদা! 

নরা সেই প্রচণ্ড চড় খেয়ে চোখে সরষে ফুল দেখল। কেঁদে ফেলল ভ্যাক করে। 

বলল, ইচ্ছে করে দেরি করিছি নাকি? বাবুগের জন্যি চার কলকে তামুক সাজে দিয়াসতি হল। তা আমি করব কী? 

এদিকে কড়া তামাকের ধোঁয়া পেটে যেতেই রামকিষ্টোর মেজাজ চট করে নেমে গেল। কলকেটা ছোলেমানের হাতে দিয়ে নরাকে সস্নেহে কাছে টেনে নিল। 

বলল, চুবো বাবা, চুবো। এই বিষ্টির জলে তুমি আর চোখির জল ঢালে না। মারাডে অলেহ্যই হয়েছে আমার। ন্যাও, এখন একটু তামুক টানো। 

বলেই হাঁক পাড়ল, ছোলেমান, বামুনির মতো কলকে চোষাড়া ছাড় দিন। ওই দুধির ছাওয়ালডারে এটটু পিস্‌সাদ দ্যাও। দিয়ে কাজে লাগ শিগগির, চালাডা বানায়ে ফ্যাল। 

ছোলেমান বলল, আঃ, কী বিষ্টি! ইচ্ছে হচ্ছে এই উঠোনে শুয়ে গড়াই। মাঠ কাদা-কাদা হয়ে উঠল রামকিষ্টো চাচা। ভোর না হতিই মাঠে গিয়ে পড়তি হবেনে। 

রামকিষ্টো বলল, এই ছোলেমান, তোগের পাড়ায় সেদিন অত আলো জ্বলতিছিল ক্যান? যাত্তারা হচ্ছিল নাকি? 

চালা তুলতে তুলতে ছোলেমান বলল, না না, যাত্তারা না। মাগরোর পির ছাহেব আয়েলেন। তাই মেদ্দা ছাহেব কলেন, কোরান-ছরিফ পাঠ হোক, তাই হতিছিল। মেদ্দা ছাহেবের জামাই মুক্তার হয়েছে কিনা, তাই। তা বুঝলে চাচা, পির ছাহেব যেমন অ্যাক কছমের নুর রাখিছে দেখলে রামচরণের ছাগলডার কথা মনে হয়। কোরান-ছরিফ পড়ার সমায় নুরডা আবার বাহার দিয়ে দিয়ে নাড়ে। ঠিক মনে হয় যেন রামছাগলে কাঁঠালপাতা চিবোচ্ছে।  

নরা হি হি করে হাসতে লাগল। রামকিষ্টো তাকে কড়া ধমক দিল। ধমক দিল ছোলেমানকেও। পির মৌলভি গুরু পুরোহিত— ওনারা সব গুনিন লোক। ওনাগের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা রামকিষ্টো বরদাস্ত করতে পারে না। 

.

চালা তুলতে হিমসিম খাওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রমে কুঁড়েটা খাড়া করে তুলল রামকিষ্টোরা। বাকি ডুয়া বাঁধা। সেই কাজটা আরও কঠিন। 

পরিশ্রম গিয়েছে খুব। বৃষ্টির জলে সমানে ভিজে হাড়ে ওদের শীত ধরেছে। তাই নতুন কাজে হাত দেবার আগে ওরা একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছিল। পুবের ঘরের বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিল। এক মালসা আগুনও এনে ফেলল নরা। আনল সেরখানেক দা-কাটা তামাক। বসে বসে তাই টানতে লাগল। 

রামকিষ্টো বলল, দ্যাখ ছোলেমান, বিষ্টির যা বহর দেখতিছি তাতে ডুয়া বাঁধা শুধু তোর আমার কম্ম না। এক কাজ করেক দিনি। সদ্দারপাড়ার থে গুড়া চারেক জুয়ান মদ্দ ধরে নিয়ে আয়। সবাই মিলে হাত লাগালি তাড়াতাড়ি কাজডা হয়ে যাবে নে। 

ছোলেমান লাফিয়ে উঠল, লাখ কতার অ্যাক কথা কইছ চাচা। তুমি যে ক্যান ল্যাখাপড়াড শিখলে না, তাই ভাবি। 

প্রশংসাটা ভালই শোনায় রামকিষ্টোর কানে। আত্মপ্রসাদে চোখ চকচক করে। মুখ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কলকেটা ছোলেমানের হাতে দেয়। বলে, ক্যান রে? ও কথা কলি ক্যান? ল্যাখাপড়া শিখলি আমার কি আর দুডো হাত গজাত? 

ছোলেমান ফস ফস করে কলকেয় টান মারছিল। রামকিষ্টোর কথা শুনে টান থামাল। 

বলল, তালি চাচা, তুমার হাতে আর নাঙ্গলা নড়ি উঠত না। মেদ্দা ছাহেবের জামাইর মতন চখি চশমা আর পায়ে ইস্টাকিন আটে সিগারেট ফুকতি ফুকতি সদরে যাতি পাত্তে মুক্তারি কত্তি। 

নরার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। মেদ্দা সাহেবের জামাইয়ের পোশাকে বাবাকে কল্পনা করল নরা। সে দেখেছে মোক্তার মিঞাকে। মোক্তারি পাশ করার পর থেকেই তাদের গ্রামে মেদ্দা ছাহেবের জামাইয়ের নাম মোক্তার মিঞা হয়ে গেছে। বাবার চখি চশমা, হি-হি হাসি পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে নরার। বাবার পায়ে ইস্টাকিন, ইস্টাকিন আবার কী জিনিস? 

নরা জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁ দাদা, ওই যে ইস্টাকিন না কী কলে, সিডা কী? 

ছোলেমান বলল, মুজা গো মুজা। ছোট কত্তা পরে আসেন না? তাই। বাবুরা তারেই কন ইস্টাকিন। মেদ্দা ছাহেবের জামাই এখন তো ফুলবাবু। দেখলি, কিডা কবে যে ও হল রিয়াজুদ্দি গাজির ছাওয়াল শয়লা! এখন তিনি মুক্তারবাবু। 

বাবার পায়ে ইস্টাকিন, হি-হি-হি। হেসে গড়িয়ে পড়ল নরা। 

রামকিষ্টো ছেলের ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ হল। ক্যান, ইস্টাকিন পরা কী এমন শক্ত কম্ম? অবিশ্যি পায়ে পরলে কুটকুট করতে পারে। ওই কারণেই রামকিষ্টো পিরেনও পরতে পারে না। জামা গায়ে দিলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে। না হলে, বাবু সাজতে যে সে পারে না, তা নয়। লেখাপড়া শিখতে গিয়েও তো রামকিষ্টো ছেড়ে দিয়েছিল। সে কবেকার কথা। সেই সেবার মেজবাবু কলকেতা থেকে লেখাপড়া শিখে ফিরে এলেন। গ্রামে ইস্কুল খোলার তখন খুব ঝোঁক উঠেছিল তাঁর। আর জাত-বেজাতের হাতে জল খাবার ঝোঁক। পাঠশালা খুলেছিলেন মেজবাবু প্রথম প্রথম বেশ চলেছিল দিন কতক। দিনের পাঠশালায় রামকিষ্টোরা যেতে পারত না। মাঠে তা হলে লাঙ্গল দেবে কে? বেশ কথা, মেজবাবু বললেন, তা হলে তোদের জন্য রাত্তিরেই আর একটা পাঠশালা খুলব। 

মেজবাবু সে-পাঠশালাও খুলেছিলেন। হিন্দু মোছলমান সব পাড়ায় ঘুরে ঘুরে পড়ুয়া জোগাড় করেছিলেন। বইপত্তরও আনিয়েছিলেন মেলা। তোড়জোড় করে পড়াশুনা আরম্ভ হয়েছিল। তারপর একদিন সব ভেস্তে গেল। বাছবিচার না করে মেজবাবু যেই জল চালাবার চেষ্টা করলেন সবার, অমনি গ্রামে যেন প্রলয় কাণ্ড ঘটে যাবে, এমন অবস্থা হল। রটে গেল যে, মেজবাবু বেহ্মজ্ঞানী হয়ে এসেছেন। বেহ্মজ্ঞানী কী, রামকিষ্টো তা জানে না। তবে তখনকার গ্রামের হাবভাব দেখে রামকিষ্টোর মনে হয়েছিল, হয় মেজবাবু পাগল, নয় সাংঘাতিক রকমের কিছু। 

প্রথমেই দিনের পাঠশালা উঠে গেল। রাতেরটাও যায় যায়। দেওয়ানবাড়িতে তখন রাতদিন কান্নাকাটি, তর্ক, তর্জন-গর্জন চলেছে। কত্তাবাবু কত্তামা তখনও বেঁচে। সেই কত্তাবাবু, যিনি নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন, বয়সকালে যাঁর দাপটে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত, সেই কত্তাবাবুর শাসনও মেজবাবুকে টলাতে পারেনি। ত্যাজ্যপুত্তুর করতে চেয়েছিলেন মেজবাবুকে। তবু মেজবাবু তাঁর কোট ছাড়েননি। একটু একটু মনেও আছে রামকিষ্টোর, মেজবাবুর সেই আমলের দু’-চারটে কথা। একটা কথা মেজবাবু প্রায়ই বলতেন, ঈশ্বর এক। সকলকেই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তাঁর চোখে উঁচু জাত নিচু জাত নেই। ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে মানুষ। মানুষ মাত্রেই মানুষের ভাই। ভাইয়ের হাতের জল ভাই খাবে বই কী। 

রোজ পাঠশালায় এই কথাগুলো বলতেন মেজবাবু। কেন বলতেন, তা রামকিষ্টো জানে না। ও কথাগুলোর মানে কী তাও তারা বুঝতে পারত না। তবে শুনতে খারাপ লাগত না। আর এটাও বুঝত না রামকিষ্টো, এতে এমন কী খারাপ কথা আছে, যা শোনামাত্রই গ্রামসুদ্ধু মাতব্বররা চটে যেত। বিশেষ করে পুরুত মশায়। তিনিই তো বাড়ি বাড়ি ঘুরে বলে বেড়াতেন, যে মহির পাঠশালায় ছেলে পাঠাবে, সে জাতিচ্যুত হবে, সে উচ্ছন্নে যাবে। পুরুত ঠাকুর খুব তেজি লোক। আটখানা গ্রামে তাঁর বিধান চলে। তাঁর কথা অমান্য করবে কে? পাঠশালায় কেউ ছেলে পাঠাল না। মনের দুঃখে মেজবাবু সাহেবের পাটের অফিসে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর থেকে তো দেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কই প্রায় উঠে গিয়েছিল। মেয়ের অন্নপ্রাশনও বিদেশেই সেরেছিলেন। কর্তাবাবু মারা গেলে সবাই ভেবেছিল, তিনি বোধহয় শ্রাদ্ধশান্তি আর করবেন না। দেখা গেল, সে ধারণা ভুল। দেশেও এলেন। নিয়মমতোই তিনি সে-সব করলেন। কর্তামার বেলাতেও নিয়মের কোনও লঙ্ঘন করেননি। মেজ মা’র বেলাতেও না। মেজমা মারা যাবার পর বড়দিকে বাড়িতে রেখে মেজবাবু একাই গেলেন কর্মস্থলে। তারপর থেকে আবার দেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ শুরু হল। তবে এ মেজবাবুর সঙ্গে রামকিষ্টো আগের মেজবাবুর কোনও যোগই কোথাও দেখতে পেল না। শুধু যে দাড়িই রেখেছেন মেজবাবু তা নয়, তাঁদের সকলের কাছ থেকে যেন দূরেও সরে গেছেন। 

কতদিনকার কথা। মেজবাবুর পাঠশালাটি টিকে থাকলে রামকিষ্টোর লেখাপড়া হয়তো হতেও পারত। না হবার কী আছে! মোক্তারও যে হতে পারত না, তাই বা কে বলল? মেদ্দা সাহেবের জামাই, ওই শয়লা মিয়া, ও কি আর লাঙ্গল ঠেলেনি? ঠেলেছে। কিন্তু সুবিধে পেতেই লেখাপড়া শিখতে চলে গিয়েছে। শিখেছেও খুব কষ্ট করে। এখন পাঁচজনে তাকে মান্য তো করবেই। 

যাক গে, ওসব আবোল-তাবোল ভেবে লাভ কী? যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল রামকিষ্টো।

বলল, যা বাবা তাড়াতাড়ি বুনো-পাড়াড়া ঘুরে আয়। হাতের কাজ নামায়ে ফেলি চটপট। 

ছোলেমান ছুটল বুনো-পাড়ায়। 

মেজকর্তা অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন বার-বাড়ির ভিতর। যারা সকালে জটলা পাকাচ্ছিল তারা কেউই আর নেই। ফাঁকা ঘরের শূন্যতায় তাঁর অসহায় ভাব আরও বেড়ে গেছে। বুড়িকে উঠোনে নামাতে কিছুতেই তাঁর মন সায় দিচ্ছে না। কুসংস্কারে এরা কী পরিমাণ আচ্ছন্ন সেটা ভেবেই অবাক লাগে মেজকর্তার। পৃথিবীর কত দ্রুত যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার কোনও খবর এদের কানে পৌঁছোয় না। তিরিশ বছর আগেও এদের ধ্যান-ধারণা যা ছিল, এখনও তাই-ই আছে। তা থাকুক, সেজন্য আর দুঃখ হয় না তাঁর। সেজন্যে আর মাথাব্যথাও নেই। তাঁর ভাবনা, বুড়ির জন্য। ওই জলের মধ্যে ভিজে কুঁড়েতে নামালে মেয়েকে তাঁর হারাতে হবে। কোনও ভুল নেই। অসম্ভব। এ ব্যবস্থা মেনে নিতে তিনি পারবেন না। 

ক্কড় কড় বাজ পড়ল। মেজকর্তা একটু চমকে গেলেন। কাছেই কোথাও পড়েছে নিশ্চয়। ঝিলিকে তাঁর চোখে প্রায় ধাঁধা লাগে এমন অবস্থা। ভিতর-বাড়িতে যাবেন এমন সময় দেখলেন, অন্ন দাই বড় একখানা মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে আসছে। ভিজে সপসপ করছে তার সর্বদেহ।

মেজকর্তা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে, কোথায় ছিলি তুই? বড়বউ যে তোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। 

এমনভাবে মেজকর্তার একেবারে সামনে পড়ে যাওয়াতে অন্ন একটু হকচকিয়ে গেল। চট করে ঘোমটা টেনে সে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। সেখানে পড়বি তো পড়, একেবারে বড়বউয়ের সামনে। 

বড়বউ ধমকে উঠলেন, এই যে, লবাবের বিটি! বলি সাপের পাঁচ পা দেখিছ নাকি? 

অন্ন কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বড়বউ লাগালেন আর একটা ধমক। 

বলি তোর আক্কেলটা কি গিলে খাইছিস? 

অন্ন কাতরভাবে বলল, দোহাই মা, আগে আমার কথাডা শুনে ল্যাও, তারপর তুমার প্রাণে যা চায়, তাই কয়ো। লুহাজাঙার বদর নিকিরি সেই রাত থাকতি আসে আমারে পিরায় পাঁজাকুলা করে ধরে নিয়ে গেল। কত করে তারে কলাম তুমাগের বাড়ির কথা। কিছুতেই শুনল না। ওর বউর অনেক রাত্তিরি থেই ব্যথা উঠিছিল। তা মা, মঙ্গলে সুমঙ্গলে কাজডা উদ্ধার হতি তবে গিয়ে তুমার এই ছাড়া পালাম। করব কী মা কও দিনি। অ্যাখনও পর্যন্ত দাঁতে একটা দানা কাটিনি। বড়দির জন্যি তুমি ভাবে না। পেরথম পুয়াতি তো, চট করে কিছু হবে না। সুমায় নেবে, নিজিগেরউ তো হয়েছে দুডো-একটা। জানো তো সবই। এখন দুডো খাতি দ্যাও দিনি। একেবারে ভুখচানি পড়ার জুগাড় হয়েছে। 

অন্নকে দেখে, তার কথা শুনে বড় বউয়ের প্রাণে জল এল। বড় ননদকে ডাক দিলেন।

ও দিদি, তুমার রান্না হয়েছে? একবার বেরোও তো? 

শুভদা নিরামিষ ঘরের থেকে বেরিয়ে এলেন। 

ও মা অন্ন আসে পড়িছ! যাক বাঁচালে। বড় ভাবনায় ফেলিছিলে। 

বড়বউ বললেন, ওরে নিয়ে টানাটানির তো শেষ নেই। ভোর রাত্তিরি লুহাজাঙায় ধরে নিয়ে গিছিল। খালাস-টালাস করে এই আসতিছে। এখনও কিছু মুখি দিতি পারেনি। তুমার ঘরে হয়েছে কিছু? ওরে দিতি পারবা খাতি? 

রান্না তো হয়েছে। এখন ওরে দ্যায় কিডা? দ্যাখ দিনি বউ ও ঘরে ফুলি আছে নাকি? থাকলি, দে পাঠায়ে। আমি ভাত ডাল বাড়ে দিই। ও অন্নরে একটু ধরে দিক। যা অন্ন, একখান পাতা-টাতা কাটে আন। 

অন্ন বলল, হ্যাঁ, আমি আর বিষ্টির মধ্যি নামতিছি। পায় আমার হাজা ধরে গেল। এই কচুপাতখান মাথায় দিয়ে আইছি। এইখানাই পাতে বসলাম। এই গুদোমের বারান্দায়। এই পাতেই খাব। তুমি ভাত পাঠায়ে দাও। 

তোর বাপু সবতাতেই অনাছিষ্টি।— বলেই শুভদা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন। 

অন্ন ডাকল, ফুলিদিদি, ও ফুলিদিদি! 

আঁশের হেঁশেল থেকে মুখ নাড়তে নাড়তে বছর তেরোর ফুলেশ্বরী বেরিয়ে এল। কথা না বলে, মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল, কী? 

অন্ন ফুলিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। 

বলল, তুমার গালে কী? 

কোঁত করে ঢোক গিলে ফুলি বলল, আ মোলো, চ্যাঁচায়ে পাড়া মাথায় কত্তিছ ক্যান? গলা নামায়ে শুধোতি পারো না? আমের আচার খাচ্ছি। বড়পিসি জানতি পারলি পেটে পাড়া দিয়ে বের করবে নে। তুমি খাবা একটু আচার? 

অন্ন হেসে বলল, ও মাংকও কী? আচার কি অমন করে খায়! তা ভাল। হাতের জানে গেছে তুমার কিত্তি। এই যে, এই ঘরেই বসে আছে। 

বড়বউ ওঘরে আছে শুনে ফুলির মুখ কালো হয়ে গেল। ভাগ্য ভাল, বড়বউ ফুলিকে আচার নিয়ে কোনও কথাই বললেন না। 

বললেন, দ্যাখো মা, দিদির ঘরের থে আলগোছে ভাত তরকারি আনে অন্নরে খাওয়ায়ে দ্যাও। আঁতুড়ে ঘটিতি করে এক ঘটি জলও ওরে খাতি দিয়ো, কেমন? 

অন্নর খাওয়া মাঝ বরাবর এগিয়েছে, অন্ন ডাক দিল, বড়মা, শোনো। 

বড়বউ বেরিয়ে এলেন। 

অন্ন বলল, আসল কথাডা ভুলেই গিছিলাম। লুহাজাঙায় যাওয়াড়া এক পক্ষে ভালই হয়েছে, বুঝলে। তাঁতি-বউর পা-ধুয়ানো জলও আনে রাখিছি। পেরথম পুয়াতি। বলা তো যায় না, কখন কোনডে দরকাল লাগে! 

এ-অঞ্চলে তাঁতি বউয়ের খুব সুনাম। আট-দশটা ছেলেপুলের মা। একটি ফোঁটা কষ্ট কোনওটার জন্য পায়নি। ব্যথা উঠেছে কি প্রসব হয়ে যায়। তাই এ-অঞ্চলের দাইরা তাঁতি-বউয়ের পা-ধোয়ানো জল এনে রাখে। যে প্রসূতি বেগ দেয়, প্রসব হতে যাদের কষ্ট হয়, দাইরা সেইসব প্রসূতিকে তাঁতি-বউয়ের পা-ধোয়ানো জল খাইয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অব্যর্থ ফল। 

ভিতরের ঘরে গিরিবালা শুয়ে ছিল। অন্নর কথা শুনে তার গা গুলিয়ে উঠল। এবার দুর্গাপূজার সময় তাঁতি-বউকে সে দেখেছে। বারোয়ারিতলায় ঠাকুর দেখতে এসে এ- বাড়িও বেড়িয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে গল্পও করেছে তাঁতি-বউ। গিরিবালা সেই সময় দেখেছে তার দুই পায়ে হাজা। সেই পা-ধোয়ানি জল ওকে খেতে দেবে নাকি? ওয়াক্ ওয়াক্। হড়হড় করে বমি করে ফেলল গিরিবালা। 

ওমা, কী হল মেয়ের? কী হল? বড়বউ ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। 

তিন 

বড়বউ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন, গিরিবালা খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে মেঝেয় বমি করছে। 

বছর পনেরো বয়েস গিরিবালার। শ্যামবর্ণ। মাঝারি গড়ন। এক মাথা কোঁকড়া কালো চুল। দু’-চারগাছি কপালের উপর এসে পড়েছে। প্রথম মাতৃত্বের লাবণ্যের ঢল নেমেছে গিরিবালার গোটা শরীরে। যেন নতুন বর্ষার বিল একখানা 

গিরিবালা শ্রান্ত চোখ দুটো তুলে বড়বউয়ের দিকে চাইল। তারপর মৃগী রোগীর মতো লাফিয়ে উঠে জাপটে ধরল বড়বউকে। 

হাউমাউ করে চেঁচাতে লাগল গিরিবালা। 

বড়মা, ও বড়মা, তুমার দুটো পায়ে পড়ি বড়মা, আমার মাথার দিব্যি, তুমার ঠাকুরির দিব্যি, আমারে ওইসব ছাইভস্ম খাওয়ায়ে না। আমি আর তালি বাঁচব না। ও বড়মা, তুমারে ব্যাগ্যাতা করি— 

গিরিবালার কাণ্ড দেখে বড়বউ ঘাবড়ে গেলেন। 

ও মা, বুড়ি অমন উতলা হচ্ছ ক্যান? কী হয়েছে? ঠান্ডা হও। কীসির কথা কতি চাচ্ছ, কও দিনি। সুস্থির হয়ে কও। 

গিরিবালার উত্তেজনা এক নিমেষে জুড়িয়ে গেল। অবসাদ এসে তাকে গ্রাস করল। খাটের উপর নেতিয়ে পড়ে চোখ বুজে হাঁফাতে লাগল। বড়বউ তার সারা গায়ে, মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। 

কাঁদো-কাঁদো গিরিবালা অতি ক্ষীণস্বরে বলল, অন্ন যা আনেছে তা আমারে খাওয়ায়ে না, দোহাই তুমার 

বড়বউ আরও আশ্চর্য হলেন। 

কী আনেছে অন্ন, হ্যাঁ মা, কও দিনি? আমি তো বুঝতি পারতিছিনে। 

কথাটা স্মরণমাত্রেই আবার পেট গুলিয়ে উঠল গিরিবালার। ওয়াক তুলল বার দুই। তবে এবার আর বমি হল না। এইটুকু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে উঠল গিরিবালা। হাটুরে হাপরের মতো বুকখানা উঠা-নামা করতে লাগল। ধামার মতো পেটটায় বার কয়েক চাপ পড়ল। 

গিরিবালা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ওই যে তাঁতি-বউয়ের পা-ধুয়ানো জল আনিছে অন্ন। আমি সে বউডেরে দেখেছি। তার দুটো পায়েই হাজা। একেবারে থ্যাক থ্যাক করতিছে… ওয়াক্ ওয়াক্… ও আমি মরে গেলেও খাতি পারব না… ওয়াক্…খাতি গেলিই মরে যাব। 

গিরিবালার পেটে ঈষৎ একটা মোচড় লাগল। কপালে ঘামের বিন্দু ফুটে উঠল। বড়বউ আঁচল দিয়ে গিরিবালার মুখ মুছিয়ে দিলেন। হাতপাখা ব্যজন করলেন কিছুক্ষণ। 

বললেন, দ্যাখো দিনি মেয়ের কাণ্ডজ্ঞান! ও চাঁপা, এক ঘটি জল আন, ফুলির মারে ক তো মাঝেডা মুছে দিয়ে যাক। ও মা, বুড়ি! ভয় নেই, ওসব ছাইভস্ম তুমার খাতি হবে ক্যান বালাই ষাট! 

গিরিবালার ধড়ে এতক্ষণে যেন প্রাণ এল। অজানা এক আতঙ্কে দেহের স্নায়ুগুলো ধনুকের ছিলের মতো এতক্ষণ টান টান হয়ে ছিল। এবার তারা শিথিল হল। চাঁপা জল আনল। বড়বউ একটু একটু করে জল নিয়ে গিরিবালার মুখ, চোখ, কপাল, ঘাড়, দু’কানের পিছনটা বেশ করে ধুয়ে দিলেন। ফুলির মা এসে ঘর মুছে দিল। 

বড়বউ জিজ্ঞাসা করলেন, ও ফুলির মা, রান্না হয়েছে? 

ফুলির মা ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। 

তবে যাও, মাজে কত্তারে খাতি দ্যাও গে। ছোট বউরি চান করায়ে দিতি কও। ও ফুলির মা, একটু দাড়াও, তুমার গুঁড়োর কোটোডা দেখি। 

ফুলির মা গুঁড়ো তামাকের কৌটো আঁচলের গিঁট খুলে বের করে দিল। বড়বউ বেশ করে দাঁতে মিশি মেখে নিলেন, উঠে গিয়ে উঠোনে পিচিত করে খানিকটা ছ্যাপ ফেলে আরও খানিকটা গুঁড়ো দাঁতে লাগিয়ে ফুলির মা’র হাতে কৌটোটা ফেরত দিয়ে গিরিবালার পাশে এসে বসলেন। সস্নেহে চাঁপাকে ডাকলেন। 

মণি রে, যাও চান করে নাও গে। আজ একা-একাই নায়ে নিয়ো, কেমন? দিদির শরীরডে খারাপ হয়েছে কিনা, আমি একটু ওর কাছে থাকি। 

বড়বউয়ের কথার সঙ্গে সঙ্গে মিশির গুঁড়ো ফস ফস করে এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছিল। চাঁপা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, বড়মা, কথা কয়ে না, তুমার মুখির গুঁড়ো তালি বড়দির চোখে উড়ে পড়বেনে। 

বড়বউ হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তারপর হেসে ফেললেন। 

বললেন, মেয়ের দিনকের দিন বিদ্দি হচ্ছে, অ্যা! ফাজলেমি রাখে যা কই মন দিয়ে শোন। 

বেশ করে তেল মাখবা, বুঝিছ। গায়, মুখি, পায়ে। তেল মাখে আমারে দেখায়ে তারপর চান করতি যাবা। বুঝলে? 

বড়বউয়ের কথা শেষ না হতেই চাঁপা অদৃশ্য। বড়বউয়ের মনটা খচখচ করতে লাগল। তেলটা ভাল করে চাঁপা মাখবে কি না কে জানে! তেলে-জলেই শরীর। ওইটুকু মেয়ে, ও কি আর নিজে নিজে মাখতে পারে তেল? নাঃ। 

বড়বউ ডাক দিলেন, ও চাঁপা, তুই আমার কাছেই আয়। তেলের বোতলটা নিয়ে আয় এখেনে।

বেচারি চাঁপা! ভেবেছিল এই একটা দিন যদি বড়মার কবল থেকে রেহাই পায়! বড়মার হুকুমে মুখখানা ব্যাজার করে তেলের বোতলটা নিয়ে হাজির হল। 

গিরিবালা শুয়ে শুয়ে রগড় দেখছিল। বড়মার কাছে তেল মাখা যে কী শাস্তি, গিরিবালা তা জানে। বড়দাও জানে। কলকাতায় পড়তে গিয়ে বড়দা বেঁচে গেছে। শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে সেও বেঁচে যাবে। তখন সব কোপ গিয়ে পড়বে চাঁপার উপর। 

বড়বউ ততক্ষণে চাঁপার বিনুনি খুলে ফেলেছেন। চিরুনি চালাচ্ছেন তার চুলে। মুখ গোমড়া করে দুই হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে চাঁপা বসে আছে। 

গিরিবালার হাসি পেল। 

বলল, এই চাঁপা, মুখখানারে বেগুন বেচা করে রাখিছিস ক্যানে? 

সে-কথার জবাব না দিয়ে চাঁপা চেঁচিয়ে উঠল, উঃ বড়মা, লাগে। 

চাঁপার রকম দেখে গিরিবালা মনে মনে হাসতে লাগল। চাঁপাকে চটাবার জন্য বলল, লাগে, না হাতি! মেয়ে একেবারে ফুলির ঘায় মুচ্ছো যাবেন! 

চাপা খরখর করে উঠল, দ্যাখ বড়দি, তুই রুগি, রুগির মতো থাক, ফোড়ন কাটিসনে তো।

বড়বউ ধমকে উঠলেন, আ গেল যা। মেয়ের কথার ছিরিডে দ্যাখো দিনি! ও রুগি হতি যাবে ক্যান? বালাই ষাট। 

চাঁপা অপ্রস্তুত। গিরিবালা মুখ গুঁজে হাসতে লাগল। বড়বউ কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে চাঁপার চুলের জট ছাড়াতে লাগলেন। দাঁতভাঙা চিরুনি। মাঝে মাঝে চুলের মধ্যে আটকে গিয়ে পট পট করে চুল ছিঁড়তে লাগল। ব্যথা লাগলেও প্রচণ্ড অভিমানে চাঁপা মুখ বুজে রইল। উচ্চবাচ্য করল না। জানে, করলেও ফল হবে না। বাঘে ধরলেও কখনও কখনও নিস্তার মেলে, কিন্তু বড়মার কাছ থেকে ছাড়ান নাস্তি। চাঁপা জানে, এখন জবজবে করে সারা শরীরে তেল মাখতে হবে। তারপর খোল দিয়ে, সর-মেশানো হলুদবাটা দিয়ে ঘসে ঘসে তা তুলতে হবে। তারপর পুকুরের জলে নেমে দুটি কি তিনটি ডুব। বাস। গায়ে যত খুশি জল ঢালো, আধ ঘণ্টা, না হয় জলে গলা ডুবিয়ে বসে থাকো, কিন্তু মাথায় বেশি জল দেওয়া চলবে না। চুলের তেল ধুয়ে ফেলা চলবে না। মাথা রুক্ষু হয়ে গেলে রং জ্বলে যাবে চুলের। কালো কুচকুচই যদি করতে না থাকল, তবে সে আর চুল কী? কটা কটা চুলও যা, কুষ্টার ফেঁসোও তাই। ওকে বড়বউ চুলই বলেন না। এ-সব দিকে তাঁর বড় কড়া নজর 

চার 

কড়া নজর ছোটবউয়েরও। 

অয়েলক্লথটা পরিপাটি করে পেতে ছেলেকে যত্ন করে শুইয়ে দিলেন। রাজপুত্তুর ঘুমিয়ে পড়ল। ও ঘুমিয়েই থাকে। পাখার বাতাস করতে করতে ছোটবউ ভাবলেন, তা একরকম ভালই। ডাইনি মাগিদের চোখের আড়াল পড়বে। জানতে পারলে কি রক্ষে রাখবে নাকি, ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে না রাজপুত্তুরকে। তাই তো এত সতর্কতা ছোটবউয়ের। তাই এত কড়া নজর। 

একটা সুন্দর কাঁথা দিয়ে ছোটবউ আপাদমস্তক ঢেকে দিলেন রাজপুত্তুরকে। একটু নিশ্চিন্ত হয়েছেন কী, ক্কড় ক্কড় করে বাজ পড়ল। চমকে উঠলেন ছোটবউ। ষাট ষাট। রাজপুত্তুরের গায়ে আদরে হাত বুলিয়ে দিলেন। যদি চমকে উঠে পড়ত? কেঁদে উঠত রাজপুত্তুর? তা হলে? তা হলে আর কী, ভারী সুবিধে হত ডাইনিটার। কান্নার শব্দ শুনে এই ঘরে এসে হাজির হত। তারপর রাজপুত্তুরের গলাটি মাস। মটরশুঁটির কচি ডগার মতো ভেঙে দিয়ে যেত হারামজাদি। 

হঠাৎ ছোটবউয়ের মাথায় ঝিলিক খেলে গেল। সুর করে বলে উঠলেন, কিন্তু গলাটা পেতে কোথায়, গলাটা পেতে কোথায়? হুঁ হুঁ, নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে! দেখো, খুঁজে দেখো, কোথায় রাজপুত্তুর! কোথায়, বের করো। ছোটবউ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অকস্মাৎ হাততালি দিয়ে নাচতে শুরু করলেন। গান ধরলেন। খুঁজি খুঁজি নারি, যে পায় তারই। খুঁজি খুঁজি নারি, যে পায় তারই। বাতাসকে লক্ষ্য করে বললেন, খোঁজ হারামজাদি, খোঁজ। ভাবছিস খাটের উপর শুয়ে আছে। এই দ্যাখ। একটানে কাঁথাটা তুলে ফেললেন ছোটবউ। 

একটা কোল-বালিশ শোয়ানো রয়েছে সেখানে। 

ডাক দিলেন, কই আয়? গলা ছেঁড়? খলখল করে হেসে উঠলেন প্রচণ্ড উল্লাসে। কলা খা, কলা খা। দুয়ো দুয়ো দুয়ো। 

আবার সশব্দে একটা বাজ পড়ল। ছোটবউ একছুটে জানালার কাছে গিয়ে আকাশপানে চেয়ে তারস্বরে ধমক দিলেন, এইও, চোপরাও। 

নরা ছোটবউয়ের ঘরের দাওয়ায় বসে তামাক সাজছিল। পিছনে ছোটবউয়ের ধমকের আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠেই দিল দৌড়। এক-দৌড়ে একেবারে বাপের কাছে। 

রামকিষ্টো জিজ্ঞাসা করল, কী রে? 

ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নরা ছোটবউয়ের ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, পাগল! 

রামকিষ্টো বলল, তাতে হয়েছে কী? 

নরা বলল, আজ খুব বাড়েছে মনে হতিছে।

রামকিষ্টো বলল, বাড়ুক, তোর তাতে কী?

নরা ভয়ে ভয়ে বলল, যদি মারে? 

রামকিষ্টো ভীষণ চটে গেল। বুনো-পাড়ার সর্দাররা ক’জন এসে গেছে। হাতে হাতে কাজ চলেছে জোর। অমানুষিক পরিশ্রমে ওরা কুঁড়েটা খাড়া করে ফেলেছে। চারিদিকে পগার কেটে উঠোনের জলও কমিয়ে ফেলেছে। ভালমতো একটা বেড়া এবার বেঁধে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এই কি তার ন্যাকরা করার সময়! রামকিষ্টো মনে মনে তার বউকে গাল দিতে লাগল। কী এক গুণধরই বিইয়েছিল মাগি! তরাসেই মরছে ছেলেটা। 

রামকিষ্টো ছেলের গালে ঠাস করে একটি চড় মারবার ইচ্ছে অতিকষ্টে দমন করল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, দ্যাখেক যদি ঘাপান খাতি না চাস তো আমার সামনের থে সরে যা। 

নরা ভয়ে ভয়ে বাপের কাছ থেকে সরে গিয়ে ছোলেমান নিকিরির পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগল। 

.

নতুন কুঁড়েটার উপর ছোটবউয়েরও চোখ পড়ল। খুব গম্ভীর হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরামিদের কাজ দেখতে লাগলেন তিনি। প্রথমে মাথায় কিছুতেই ঢুকল না, ওরা ওখানে জড়ো হয়ে করছে কী? বৃষ্টিতে ভিজছে। তা ভিজুক। দরজায় যে বাইরের থেকে শিকল দেওয়া। নইলে তিনিও একটু ভিজতেন। 

ও সর্বনাশ! এক পলকে ছোটবউ সব বুঝে ফেললেন। ওরা যে কুঁড়ে বানাচ্ছে! আবার এক . রাজপুত্তুর আসছে তা হলে। 

কী একটা কথা, কী একটা ব্যথা যেন ছোটবউয়ের অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভেসে উঠতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। মানসিক জটিলতার গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। কথাটা স্পষ্ট হয়ে ফুটছে না, ব্যথাটা তীব্র হয়ে উঠছে না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে ছোটবউয়ের। অনেকক্ষণ ধরে শান্ত হয়ে আছেন। জানালার গরাদের উপর বুকটা জোর করে চেপে ধরে বুক-শিনশিন ভাবটার উপশম চাইছেন। ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরছে। মক মক মক— ব্যাঙেরা ঐকতান গান জুড়েছে পাছ-দুয়ারে পুকুরটাতে। গোয়াল থেকে রাঙ্গি গাইটা হাম্বা হাম্বা ডাক ছাড়ছে। সব যেন নতুন করে শুনতে পাচ্ছেন ছোটবউ। এমনকী গুদোমের পাশের হাজারি গাছটার রসখাজা-কাঁঠালগুলোও যেন ছোটবউয়ের চোখের উপর নতুন স্বপ্নের মতো ফুটে উঠল। 

হ্যাঁ, একটু একটু করে যেন তাঁর মনের উপরকার ভারী পরদাটা সরে যাচ্ছে। বছর দশেক আগেও যেন এইরকম একটা সমারোহ এই বাড়িতে হয়েছিল। ওইরকম একটা কুঁড়ে বানানো হয়েছিল এ-বাড়ির উঠোনে। ছোটবউকে যেন তার মধ্যে ঢোকানো হয়েছিল। তারপর? হ্যাঁ, তারপর যেন কী হল? কী হল তারপর? মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে না। মনের যে ঘটের মধ্যে এইসব কথা জমানো তার উপর একটা পাথর পড়ে আছে। ভারী পাথর। নাম-না-জানা একটা উদ্‌বেগ ছোটবউয়ের মনের সেই ঘটটা ধরে প্রাণপণে ঝাঁকি দিতে শুরু করল। তার মনের কোন কোনার অন্ধকারে যন্ত্রণার একখানা ধারালো ছুরি যেন ঝুলে ছিল। ঝাঁকি খেয়ে সেইখানাই খুলে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটবউয়ের অন্তরাত্মা প্রচণ্ড আঘাতে দুফাঁক হয়ে গেল। কী যন্ত্রণা, কী অসম্ভব প্রদাহ! 

হঠাৎ ছোটবউয়ের দিব্যচক্ষু খুলে গেল। সব মনে পড়ে গেল। সব। এক রাজপুত্তুর এসেছিল তার কোলে। হিংসেয় সব মাগির বুক ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। হবে না কেন? আর সবার কোলে বাঁদরছানা, শুধু তাঁর কোলেই এসেছিল রাজপুত্তুর। সহ্য হবে কেন ওদের? সবচাইতে বজ্জাত ওই ননদটা। ওটা আসলে ডাইনি। ভাতারপুতের মাথা চিবিয়ে খেয়ে এ-বাড়িতে এসেছে। ওই ডাইনিই তো তাঁর রাজপুত্তুরের ঘাড় মটকে রক্ত চুষে খেয়েছে। তারপর বাঁওড়ের কাদায় পুঁতে রেখে এসেছে রাজপুত্তুরের দেহটা। রাজপুত্তুর কিন্তু মরেনি। ওরা তো মরে না, শুধু দেহ বদলায়। ওই যে সুন্দর শালুক ফোটে, লাল টুকটুকে পদ্ম ফোটে বাঁওড়ে, ওগুলো কী? ওরাই তো রাজপুত্তুর। শালুককুমার, পদ্মকুমার। 

ছোটবউয়ের শান্তভাব আবার কেটে যেতে থাকে। অস্থিরতা বাড়ে। মাথা গরম হয়ে ওঠে। ডাইনি মাগির উপর আক্রোশ ফেটে পড়ে। তাকে মারবার নানা ফন্দি মাথায় ভাসতে থাকে। ও তো আর এমনি মরবে না। ভাতুড়ে পুকুরের পশ্চিম কোনায় জলের নীচে রুপোর একটা কৌটো পোঁতা আছে। কৌটোর মধ্যে আছে এক কালো কুচকুচে ভোমরা। সেই ভোমরাই ডাইনি মাগিটার প্রাণ। আমাবস্যের ঘুরঘুটি রাতে, এলোচুলে এক নিশ্বাসে ডুব দিয়ে কৌটোটা তুলে আনতে হবে। তারপর ভোমরাটা বের করে দুই আঙুলে ধরে একটানে ঘাড়টা ভেঙে ফেলতে হবে। ব্যস, তা হলেই আপদের শান্তি। ছটফটিয়ে মরবে মাগি। মনটা খুশিতে ভরে ওঠে ছোটবউয়ের। মাথাটা অনেক হালকা হয়ে যায়। গরাদ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হি-হি করে হাসতে থাকে আপন মনে। নরা দূর থেকে ভয়ে ভয়ে চায়। 

তার দিকে ছোটবউয়ের নজর পড়তেই হাঁক ছাড়েন তিনি, এই বরকন্দাজ, ইধার আও।

নরা পড়িমড়ি করে লাগায় ছুট। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *