দুয়ে শূন্য বিষ (প্রথম পর্ব)

দুয়ে শূন্য বিষ

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে সে আর একবার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল। একটা বেজে পাঁচ। পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাটের থার্ড ফ্লোরে, সাত নম্বর রুমে যে সাংঘাতিক নাটকটা শুরু হবে আর একটু পরে, তার আঁচটা কল্পনায় কিছুটা অনুমান করবার চেষ্টা করল।

সত্যি, কী মর্মান্তিক ব্যাপারই না হবে এবার! কী করে যে খবরটা দেবে! অথচ দিতেই হবে। মনকে শক্ত রেখে কোনওরকম দুর্বলতাকে মনের মধ্যে স্থান না দিয়ে এই বার্তা শোনাতে হবে।

ওর বলিষ্ঠ দেহের মাংসপেশিগুলো সংকুচিত হয়ে রক্তস্রোত চঞ্চল হয়ে উঠল যেন।

এতটুকু নার্ভাস হলে চলবে না। কেননা ও নিজে নার্ভাস হলে সোমাকে সামলাবে কে? খবরটা শুনে বেচারি সেন্সলেস না হয়ে যায়।

ওপরে উঠে সে একবার থমকে দাঁড়াল।

অসহ্য গরম। নেহাত উগ্র ওডিকোলন মেখেছিল স্নানের সময় তাই, না হলে নিজের ঘামের বিশ্রী গন্ধে নিজেরই গা গুলিয়ে উঠত।

এক—দুই করে গুনে গুনে সে সাত নম্বর ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে দারুণ একটা উত্তেজনার ঢেউ তোলপাড় করছে। আশপাশেও কেউ কোথাও নেই। নিস্তব্ধ নিঃঝুম দুপুরে ভিআইপি রোডের এই চারতলার ফ্ল্যাট যেন প্রেতপুরীর মতো থমথমে।

ক্রি—র—র—রিং।

ডোরবেলটা টিপে আর—একবার কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়ে দেওয়ালের নেমপ্লেটটার দিকেও তাকাল। সব ঠিক আছে। এই সেই ঘর।

দরজা খুলে গেল।

বিস্রস্তবসনা এক রমণীর দেহ খোলা দরজার ফ্রেমে ধরা পড়ল। সদ্য—ঘুম—ভাঙা ফোলা ফোলা মুখ। স্বপ্নালু চোখ। অপূর্ব। চোখ ফেরাতে পারছিল না সে, সংবিৎ ফিরতে সে বলল, ‘মাফ করবেন, আপনাকে এই দুপুরবেলা বিরক্ত করতে এলাম। অথচ না এসেও উপায় ছিল না।’

‘কে আপনি?’

‘আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি কলকাতা পুলিশের ডিসি ট্রাফিকের একজন। এই যে আমার আইডেন্টিটি কার্ড। এখন সিভিল ড্রেসে আছি, সেজন্যই এটা আপনাকে দেখানো প্রয়োজন মনে করলাম।’ বলে সে আইডেন্টিটি কার্ডটা আবার পকেটে রাখল।

রমণীর চোখ ভয়ে—বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠেছে।

সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আপনিই মিসেস সোমা নন্দী?’

‘হ্যাঁ। বাইরে কেন, ভিতরে আসুন না।’

সে ঘরে ঢুকলে সোমা একটি রংচঙে সোফায় তাকে বসতে বলল। তারপর দরজা বন্ধ করে খাটের একপাশে বসে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল, ‘আপনি পুলিশের লোক? মানে, কী ব্যাপার বলুন তো? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘এখানে আপনার নিজের লোক বলতে আর কে আছেন?’

‘কেউ না। এই ফ্ল্যাট কিনে মাত্র কয়েক মাস হল আমরা এখানে এসেছি। পাশের ফ্ল্যাটে দু’জন নন—বেঙ্গলি দম্পতি আছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের খুব একটা সদ্ভাব নেই।’

‘হুঁ। তাহলে তো…।’

‘তাহলে কী?’

‘আপনি অধৈর্য হবেন না। মাথাটা একটু ঠান্ডা রাখবার চেষ্টা করবেন।’

‘কেন, কী ব্যাপার?’

‘আপনার স্বামীর গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’

‘সে কী!’ সোমা থরথর করে কেঁপে উঠল, ‘কখন?’

‘অফিসে যাবার সময়।’

সে তার মনকে শক্ত করল। এরপর যে—দৃশ্যের অবতারণা হবে তা দেখে ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজেকে দারুণ সংযত এবং নির্বিকার থাকতে হবে।

সোমা দু’হাতে মুখ ঢেকে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়। আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘এ কী খবর নিয়ে এলেন আপনি! বলুন, সে বেঁচে আছে কি না বলুন? সত্যি করে বলুন? আমি যে এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।’

‘আপনি এত ভেঙে পড়লে কী করে হবে? এই সময়ে নিজেকে সংযত রাখুন। ভয় পাবার কিছু নেই, বেঁচে আছেন তিনি। তবে অবস্থা গুরুতর।’

সোমা ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার মন কিন্তু বলছে ও বেঁচে নেই।’

‘মনকে বোঝান।’

‘সম্ভব নয়। আপনার দুটি পায়ে পড়ি, আপনি আমাকে নিয়ে চলুন ওর কাছে। ও কোথায় আছে? কোন হাসপাতালে?’

‘আপনি অধীর হবেন না। তিনি বেঁচে আছেন। না হলে আপনার ঠিকানা জানলাম কী করে? তাঁর পকেটের কাগজপত্তর থেকেই এখানকার ঠিকানা পেয়েছি। তা ছাড়া একটু আগে জ্ঞানও ফিরেছে তাঁর। জ্ঞান ফেরার পরই আপনার নাম করেছেন তিনি। ডাক্তারেরা বললেন আজ রাতের মধ্যেই একটা মেজর অপারেশন করতে হবে। তার জন্য আপনার কনসেন্ট লাগবে। তবে…’

‘তবে কী?’

‘ওঁর একটা পা হয়তো কেটে বাদ দিতে হবে।’

সোমা শিউরে উঠল সে—কথা শুনে। বলল, ‘আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আপনি বলুন ও কোন হাসপাতালে আছে, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।’

‘না না, এই অবস্থায় আপনি একা যাবেন কেন? আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আমার আজ রেস্ট ডে, মিসেসকে নিয়ে সিনেমায় যাচ্ছিলাম। এক আত্মীয়র বাড়ি হয়ে যাব বলেই সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম। এমন সময়…।’

সোমা বলল, ‘তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুনি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তা ছাড়া হাসপাতালে তো টাকাও লাগবে। আসছি আমি।’

সে বলল, ‘বেশ তো। আমি নীচে গাড়ির কাছে আছি। আপনি আসুন।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ধীরে ধীরে।

অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল সোমা। তারপর দরজায় লক করে চাবিটা যথাস্থানে রেখে দ্রুত নীচে নেমে এল।

ফ্ল্যাটের সামনেই একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে এক সুন্দরী তরুণী বসে ছিল। সোমাকে দেখে বেদনাভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে সে সরে বসে জায়গা করে দিল।

সোমা গাড়িতে উঠে বসল।

সোমা গাড়িতে উঠতেই সে—ও উঠে বসল ড্রাইভারের পাশে। বলল, ‘জলদি চলো।’

আদেশ হতেই ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলল গাড়িটা। সোমা তখনও কাঁদছে।

ধর্মতলা স্ট্রিটের এক বার—কাম—রেস্টুরেন্টের দোতলার ঘরে এক কোনায় মুখোমুখি বসে মদ্যপান করছিল ইব্রাহিম আর সূরয।

ইব্রাহিম অত্যন্ত বলিষ্ঠ চেহারার লোক। গুটিবসন্তের দাগ মুখমণ্ডলের সর্বত্র। দেখলেই মনে হয় পাক্কা শয়তান একটি। চোখে—মুখে সর্বত্র হিংস্রতার ছাপ। আর সূরয সুন্দর সুপুরুষ এক যুবক। তবে ধীর স্থির নম্র নয়। বয়স খুব বেশি নয়, আঠাশ—ত্রিশের মধ্যে। উত্তরপ্রদেশের ছেলে। বহুদিন বাংলায় থেকে বাঙালির মতো হয়ে গেছে। বর্ন ক্রিমিনাল বলতে যা বোঝায় এক কথায় ও তাই। অত্যন্ত রাগী ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। ওর চোখের দৃষ্টি যেন সাপের চোখের দৃষ্টিকেও হার মানায়। ওর সুন্দর সুঠাম শরীরের মধ্যে যে এক নৃশংস দানব বাসা বেঁধে আছে সেটা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। সবে কিছুদিন হল সে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। বছরখানেক আগে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের নিষিদ্ধপল্লীর একটি মেয়েকে খুন করে সে মার্ডার কেসে জড়িয়ে পড়েছিল। খুন অবশ্য ও নিজেই করেছিল, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সেই কেস থেকে রেহাই পেয়ে যায় সূরয। কিন্তু ওর নামে তো একটা মাত্র কেস নেই। ফলে অন্য কেসে ঝুলে যেতে হয়েছিল তাকে। এক বছর জেল খাটার পর আবার এসে লাইনে ভিড়েছে।

ইব্রাহিম বোতল থেকে খানিকটা নেশার জিনিস সূরযের গ্লাসে ঢেলে দিয়ে নিজেও ঢক ঢক খেয়ে নিল খানিকটা। তারপর বলল, ‘এতক্ষণ যা বললাম তা মন দিয়ে শুনেছ নিশ্চয়ই?’

সূরয কোনও উত্তর না দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিতে লাগল।

‘বিকেল ঠিক চারটের সময় রিনার সঙ্গে দেখা করবে তুমি। লাইট হাউসের সামনে ও তোমার জন্য অপেক্ষা করবে।’

‘তা নাহয় করব। কিন্তু আবার এইসব ঝামেলায় জড়াচ্ছ কেন? সামলাতে পারবে তো?’

‘তোমার কাজ চাই বলছিলে না? তাই কাজ দিচ্ছি।’

‘কিন্তু….।’

‘কোনও কিন্তু নয়। এই কাজ তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। কেননা তুমি এই কাজে অভ্যস্ত।’

‘কেন, মদনলাল?’

‘মদনলালকে দিয়ে আমি অন্য কাজ করাচ্ছি।’

‘এই কাজে ঝুঁকি কিন্তু অনেক বেশি।’

ইব্রাহিম গম্ভীর হয়ে বলল, ‘মদনলাল এর চেয়েও বড় ঝুঁকির কাজ করছে কাল। তা ছাড়া তোমরা দুজনেই তো জুটি। রিনা আর তুমি। পুরোনো অভ্যাসটা বরং আর একবার নতুন করে ঝালিয়ে নিতে পারবে এই সুযোগে।’

সূরয একটু যেন নার্ভাস হয়ে বলল, ‘সবে কিছুদিন হল জেলের ঘানি টেনে বেরিয়েছি। আবার যদি ঢুকিয়ে দেয়?’

‘তাহলে ফুটে পড়ো। আমার এখানে কাজ নেই। হুঁশ করে কাজ করলে গোলমাল হবে কেন? যে—কাজে পাঠাচ্ছি সেই কাজে ঝুঁকি থাকলেও ফেঁসেছ কখনও? এ তো তোমার হাতেখড়ি নয়। এর আগে অনেকবার করেছ এই কাজ।’

‘তা অবশ্য করেছি।’

‘তবে? বেকায়দার কাজ করলেই ফাঁসবে। দেদার মদ গিলে ওইসব জায়গায় যাবে, মনের আনন্দে ফুর্তি করে টাকা দেবে না, তা হলে কেন ফাঁসবে না শুনি?’

আরে, ‘মেয়েটা ফট করে এমন গালাগালি দিতে শুরু করল…’

‘বলবেই তো। আমিই যদি তোমাকে কাজ করিয়ে টাকা না দিই তুমিই কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে? সেও তো ব্যবসা করতে বসেছে। যাক, যা বললাম তাই করো। শ’পাঁচেক টাকা কাছে রেখে দাও। আজ যেমন করেই হোক—।’

‘আমি কিন্তু এখনও বলছি এইসব কাজ না করে অন্য কোনও মতলব এঁটে কিছু একটা করো। এই কাজে ঝুঁকি অনেক। বারবার একই ঘটনা হয়ে যাওয়ার ফলে সবাই কিন্তু সতর্ক। পুলিশের কড়া নজর এ—দিকে।’

‘আমি অনেক ভেবেচিন্তেই এই কাজের ঝুঁকি নিচ্ছি সূরয। তুমি জেলে থাকায় গত এক বছরে এই কাজে আমি কাউকে লাগাইনি। ফলে ব্যাপারটা জুড়িয়ে গেছে। তুমি আর দেরি না করে চলে যাও।’

সূরয একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল, ‘এখনও তো অনেক সময় আছে। এত তাড়াতাড়ি গিয়ে কী ভাপাব?’

এমন সময় নীচের তলা থেকে একটি মেয়ে এসে ইব্রাহিমের কানে কানে কী যেন বলতেই ইব্রাহিম দারুণ উত্তজনা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর দ্রুত নেমে গেল নীচে।

ইব্রাহিম চলে যাবার পর মেয়েটিও শূন্য মদের বোতল ও গেলাস দুটো নিয়ে যাবার জন্য হাত বাড়াল।

বাধা দিল সূরয। খপ করে ওর একটা হাত শক্ত করে ধরে টান দিল।

মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল একবার। তারপর আস্তে করে বলল, ‘আঃ, ছাড়ো।’

‘ছাড়ব না।’

‘আমার এখন অনেক কাজ।’

সূরয হাত ছাড়ল না। একইভাবে ধরে রেখে বলল, ‘কাছে আয় ছলিয়া।’

‘কাছেই তো আছি।’

‘আরও কাছে।’

ছলিয়া মেয়েটির নাম। চব্বিশ—পঁচিশ বছরের পূর্ণ যুবতী। দারুণ আঁটোসাঁটো গোলগাল চেহারা। গায়ের রং পিচের মতো কালো। ঝকমকে দাঁত আর রুপোর পাতের মতো চকচকে চোখ। চেহারায় শরীরী আবেদনকে আরও তীব্র করে তুলেছে পরনের সাদা ভেলভেটের মিনি স্কার্ট ও সামান্য বক্ষবাস। মেয়েটিকে বিহারের সুলতানগঞ্জ থেকে মদনলাল নিয়ে এসে রেখেছে এখানে। ওর আসল নাম বদলে এখানে ওর নাম রেখেছে ছলিয়া। ছলিয়া সারাদিন অতিথিদের মদ সরবরাহ করে, আর রাত্রিবেলা দেহ বিলায়। বলতে গেলে ছলিয়ার টানেই অতিথিরা আসে এই অস্বাস্থ্যকর বারে।

‘ছলিয়া বলল, না।’

সূরয বলল, ‘না কেন?’

‘এখনও আমার অনেক কাজ। নীচে ওরা ড্রিংক করছে।’

‘তাতে কী?’

‘বাঃ রে, ওদের দেখাশোনা করতে হবে না? কেউ কিছু চাইলে দেবটা কী? তা ছাড়া বস এসে পড়বে এখুনি।’

‘আসুক না। বসকে অত ভয় কীসের শুনি? আমাদের দিয়ে পুতুলনাচ নাচিয়েই তো ওর যত হম্বিতম্বি।’

‘তুমি তো জানো কীরকম পাক্কা শয়তান ও।’

‘জানি। তো? ওরকম লোককে আমি হিঁয়ায় রাখি।’

‘তুমি তো সবাইকেই হিঁয়ায় রাখো। শুধু আমাকেই যা দূরে রাখো তুমি। আমার গায়ের রং কালো বলে, তাই না?’

তা কেন?

‘তাহলে কেন তুমি ওইসব খারাপ জায়গায় গিয়েছিলে? আমার কাছে কি পেতে না?’

সূরয হেসে বলল, ‘এটা যে এত ভালো জায়গা আগে জানতাম না তো।’

‘কথা ঘুরিয়ো না। বলো কেন গিয়েছিলে? রোগের ভয় নেই তোমার?’

‘আসলে ওইসব জায়গায় আমি যাই না। সে—দিন ওই মদনলালটার সঙ্গে অন্য একটা কাজে ওখানে গিয়েছিলাম। তা মেয়েটা এমন সেজেগুজে দাঁড়িয়ে ছিল যে না ঢুকে থাকতে পারলাম না।’

‘তাহলে ছাড়ো। হাত ছাড়ো আগে। তার কাছেই যাও।’

‘সে তো এখন ওপরে।’

‘এমন সুন্দর রাজপুত্রের মতো দেখতে তুমি, অথচ এত নিষ্ঠুর?’

সূরয তখন প্রায় জোর করেই ছলিয়াকে কাছে টেনেছে।

ছলিয়া বাধা দিল না। মুখে শুধু ‘আঃ ছাড়ো, ছাড়ো’ করতে লাগল।

সূরয ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে লম্বা বেণীটা নাক দিয়ে সরিয়ে ঘাড়ের উপর চুমু খেতে লাগল।

ছলিয়া ছটফট করল না।

সূরয বলল, জীবনে কত মেয়েকে দেখলাম। কিন্তু তোর মতো কাউকে পেলাম না।

‘এ—সব কথা তুমি অন্য কাউকে শুনিয়ো, আমাকে নয়।’

‘বিশ্বাস কর ছলিয়া।’

‘বাজে বোকো না, যাও। কত করে বললাম, এ—সব লাইন ছেড়ে দাও। পালাই চলো এখান থেকে। দু’জনে ঘর বাঁধব, কত সুখে থাকব দেখো!’

‘হুঁ! বনের বাঘকে খাঁচায় পুরবি? তা ছাড়া পালিয়ে যাব কোথায় বল?’

‘যে—দিকে দু’চোখ যায় সে—দিকে।’

‘এত সোজা? বসের চোখ দুটো সারা ভারত কেন, তার বাইরেও মেলা আছে। পালালেই হল?’

‘এ—দিকে বলছ বসকে তুমি হিঁয়ায় রাখো, আবার এসব কথা কেন? আসলে তুমি কারও সঙ্গেই ঘর বেঁধে সারা জীবন থাকতে চাও না। তোমার কাজ হল ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ানো। ছাড়ো বলছি।’

এমন সময় ইব্রাহিম নীচ থেকে ওপরে এল।

সূরয ছেড়ে দিল ছলিয়াকে।

ছলিয়া সূরযের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে শূন্য বোতল ও গেলাস নিয়ে নেমে গেল।

ইব্রাহিম আড়চোখে সব কিছু দেখেও যেন দেখল না এমন ভান করে সোজা নিজের জায়গায় এসে বসল। তারপর পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ধরাল। চুরুটের ধোঁয়াটা যখন বেশ পাকিয়ে পাকিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল, ইব্রাহিম তখন সূরযের দিকে তাকিয়ে আবার একটা লম্বা টান দিল চুরুটে।

সূরয বুঝল এই শয়তানের ধাড়িটার কোনও বদবুদ্ধি সফল হয়েছে নিশ্চয়ই। কুমতলব চরিতার্থ না হলে এতখানি মৌজ আসে না ওর ভেতরে।

সূরয জিগ্যেস করল, ‘এনি গুড নিউজ?’

ইব্রাহিম মৃদু হাসল। বলল, ‘মদনলালকে কাল একটা কাজে পাঠিয়েছিলাম।’

‘সে তো শুনলাম একটু আগেই।’

‘রিনাও সঙ্গে ছিল।’

‘তারপর?’

‘চমৎকার প্ল্যান। দারুণ ভাবে সাকসেসফুল হয়েছে। মোটা টাকার অফারও একটা পেলাম এইমাত্র।’

‘তবে তো দারুণ খবর। কাজটা কীরকম শুনি?’

‘পরে জানতে পারবে।’

‘টাকার অঙ্কটা জানতে পারি কি?’

‘না। ওটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। প্ল্যান যখন সাকসেসফুল, টাকা তখন হাতের মুঠোয়। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, বিশাল অঙ্কের টাকা।’

সূরয উঠল। আর কোনও কথা না বলে বা কোনও দিকে না তাকিয়ে শিস দিতে দিতে তরতরিয়ে নেমে এল নীচে। নামার সময় দেখল একটা আধবুড়ো লোক নেশাগ্রস্ত হয়ে অসভ্যের মতো ছলিয়ার স্কার্ট ধরে টানাটানি করছে।

লাইট হাউস সিনেমার সামনে সূরয যখন গিয়ে পৌঁছল তখন কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটা।

হলের সামনে অসম্ভব ভিড়।

একটা উত্তেজনাপূর্ণ মালয়ালম ছবি হচ্ছে। কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। সারা কলকাতার ভিড় যেন এখানে এসে উপচে পড়েছে। এক—একটা টিকিট ব্ল্যাক হচ্ছে পঞ্চাশ—একশো, দুশো টাকায়।

সূরয ভেবে পেল না এইভাবে ছবি দেখে লাভটা কী! এই টাকাটা এক ঘণ্টার জন্য কোনও নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েকে দিলে তাকে নিয়ে অনেক ফুর্তি করা যায়।

একটা সিগারেট বার করে ধরাল সূরয। তারপর জোরে টান দিয়ে রিং করে ধোঁয়া ছেড়ে কাকে যেন খুঁজল।

চোখ পড়ল একজনের চোখে। অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে। যেমনি স্মার্ট তেমনি লাস্যময়ী।

মেয়েটি সূরযকে ইশারা করল।

সূরযও চোখের ভাষায় প্রত্যুত্তর দিল তার।

মেয়েটি ওদেরই দলের মেয়ে। ওর সঙ্গেই কাজ করতে হবে আজ। দীর্ঘ এক বছর পরে।

মেয়েটি হাসল।

মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল সূরয। ইশারায় জানাল, ও কে। অর্থাৎ আবার এসে গেছি। পুরোনো খেলায় আবার নেমেছি আটঘাট বেঁধে।

মেয়েটির আসল নাম কী যেন ছিল। এখন সে—নাম মুছে গেছে। লাইনে এলে এরকমই হয়। ওদের দলে ওর নাম এখন রিনা রাইন। রাইন কী কারও সারনেম হয়? কে জানে! ইব্রাহিমের মাথা থেকেই বেরোয় এইসব নাম। রায়, রায়ান, রায়না এমন হয়। কিন্তু রাইন? হয় কি না জানা নেই। মেয়েটির গানের গলাও যেমনি, অভিনয়ও করতে পারে ভালো। তবে রঙ্গমঞ্চে নয়, লোক ঠকানোর কাজে। ঢাকার মেয়ে। মেয়েটি নাকি স্বেচ্ছায় এসেছে এই লাইনে। চাইলেই দেশে ফিরে যে—কোনও একজন সুস্থ সুন্দর যুবককে বিয়ে করে ও চুটিয়ে ঘর—সংসার করতে পারে। যে কেউ ওকে দেখলেই পছন্দ করবে।

এক ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে টিকিটের জন্য ঘুরছিলেন, কিন্তু কিছুতেই জোগাড় করতে পারছিলেন না একটা টিকিট।

একজন ব্ল্যাকারের কাছে একটাই মাত্র টিকিট ছিল। বলল, ‘দোশো রুপাইয়া।’

ভদ্রলোক পিছিয়ে এলেন।

ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মনে হল বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের। সাঁইত্রিশ—আটত্রিশ বছরের যুবক। গাড়ি নিয়ে এসেছেন। দামি ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়। গলায় সোনার মোটা চেন। সোনার দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের গলায় এইরকম চেন আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, এবং ওগুলোর অধিকাংশই নকল নয়। বাঁ—হাতে গোল্ডেন ব্যান্ডের দামি রিস্টওয়াচ। রীতিমতো ধনী যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যেমনই কেতাদুরন্ত তেমনই সুপুরুষ।

রিনা তাকিয়ে দেখল ভদ্রলোককে।

ভদ্রলোকও ওর দিকে তাকিয়ে দেখলে রিনা এগিয়ে গেল ভদ্রলোকের কাছে। চাপা গলায় বলল, ‘শুনছেন?’

ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেলেন রিনাকে দেখে। একটু সন্দেহও জাগল বুঝি মনে। কেননা এইসব এলাকায় অনেক কলগার্লও ঘোরাফেরা করে। মেয়েটি সেরকমই কেউ নয় তো? তবে মেয়েটির সাজ—পোশাক বা হাবভাব দেখে তা মনে হচ্ছে না। তবুও অবাক হলেন। এমন এক সুন্দরী মেয়ে যেচে এসে ডাকল বলে খুশিও হলেন। ভদ্রলোক স্মিত হেসে বললেন, ‘বলুন?’

‘আপনি কি টিকিট চাইছেন?’

দারুণ উৎসাহে ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘হ্যাঁ। এক্সট্রা টিকিট আছে আপনার কাছে?’

‘আছে।’

রিনার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় কুড়ি—পঁচিশজন এসে ঘিরে ফেলল রিনাকে, ‘আমাকে দিন, আমাকে দিন।’

তাদের দলে সূরযও ছিল। বলল, ‘আমাকে দিন। যা দাম চাইবেন তাই দেব।’

রিনা বলল, ‘কী আশ্চর্য! কেন দেব আপনাকে?’

‘আমি ওঁরও আগে থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছি।’

‘তাতে কী? আমি টিকিট ব্ল্যাকার নই। যান আপনারা।’

সূরয বলল, ‘আমি দুশো টাকাই দেব।’

‘ওই ওখানে একজন দুশো টাকার টিকিট দিচ্ছে। যান ওখানে যান।’

‘আমি আপনারটা চাই।’

‘আমি পাঁচশো টাকাতেও এ টিকিট কাউকে দেব না। ভদ্রলোকের মেয়ে আমি। সিনেমা দেখতে এসেছি। টিকিট ব্ল্যাক করতে আসিনি।’

ভদ্রলোক বিনীত ভাবেই বললেন, ‘আপনি কিন্তু আমাকেই দেবেন বলেছিলেন।’

‘আমি আপনাকেই দেব। তবে এখানে নয়। এই বাঁদরগুলোর কাছ থেকে একটু তফাতে চলুন। এখানে টিকিট বার করলেই ছিনতাই হয়ে যাবে।’

ভদ্রলোক রিনার সঙ্গে চৌরঙ্গীর দিকে এগিয়ে চললেন।

ওদের পিছু পিছু সূরযও চলল।

‘আঃ জ্বালালে!’

সূরয বলল, ‘একটা টিকিট অন্তত আমাকে দিন ম্যাডাম, প্লিজ। অনেক দূর থেকে এসেছি আমি।’

রিনা এবার চলা থামিয়ে কঠিন গলায় বলল, ‘মাত্র একটাই টিকিট আছে আমার কাছে, এবং সেটা আমি আপনাকে দিচ্ছি না।’

‘আমি তো বেশি টাকা দিতে চাইছি।’

‘তবে রে! যান আপনি। না হলে পুলিশ ডাকব।’

সূরয এবার তফাতে গেল।

রিনা ভদ্রলোককে বলল, ‘আসলে আমার এক বান্ধবীর আসবার কথা ছিল। সে বলেছিল কোনও কারণে পাঁচটার মধ্যে না এলে টিকিট বিক্রি করে দিতে। পাঁচটা তো অনেকক্ষণ বেজে গেছে। টিকিটটা যে কী করে বেচব তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। এখানে টিকিটের যা চাহিদা তাতে এই ভিড়ের মধ্যে টিকিট বেচতে যাওয়া মানেই নিগৃহীত হতে যাওয়া। একবার বেচব বললে আর রক্ষে নেই। জ্বালিয়ে মারবে সব। দেখলেন তো কী অবস্থা হল?’

‘সত্যি। কী বলে যে ধন্যবাদ দেব আপনাকে তা ভেবে পাচ্ছি না। আমি ভাবতেও পারিনি এই পরিস্থিতিতে কেউ ডেকে আমাকে টিকিট দেবে। সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম আপনি বেশি টাকার লোভও ছেড়ে দিলেন। অবশ্য ও টিকিট অন্য কাউকে নিতে আমি কোনও মতেই দিতাম না। কেননা প্রতিদ্বন্দ্বীতার ক্ষেত্রে আমি অত্যন্ত জেদি পুরুষ। তেমন হলে ওই টিকিট আমি পাঁচশো কেন, হাজার টাকাতেও নিতাম। দশ—বিশ হাজার টাকা পকেটে না নিয়ে আমি রাস্তায় বেরোই না।’

‘একটা টিকিটের জন্য আপনি হাজার টাকাও খরচা করতেন! কেন?’

‘এটা আমার জেদ। অনেকটা ফাটকাবাজি খেলার মতো। আমার সঙ্গে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বীতা করলে আমি ওইরকমই করি। এতেই আমার আনন্দ। প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করাই আমার কাজ। বিশেষ করে যদি জানতে পারতাম আপনি নিজেও ওই ছবিটা দেখবেন।’

‘তাই?’

‘হ্যাঁ। আপনার পাশে বসতে পাব জানলে ওই টিকিট আমি নিতামই।’

রিনা একটু লাল হয়ে বলল, ‘আশ্চর্য লোক তো আপনি।’

‘আপনার মতো সুন্দরীর পাশে বসে সিনেমা দেখাটা আমি পুরুষ হিসেবে সৌভাগ্যের বলে মনে করি।’

রিনা টিকিটটা ভদ্রলোককে দিয়ে বলল, ‘কী এমন সুন্দরী আমি? আমার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী ঘুরে বেড়াচ্ছে সব জায়গায়।’

‘জানি। তবে আপনিও তাদের কারও চেয়ে কোনও অংশে কম যান না।’

‘আপনি বড় বেশি বাড়িয়ে বলছেন।’

‘মোটেই না। আমি যা বলি তা ঠিকই বলি।’ তারপর একটু আস্তে করে বললেন, ‘আপনিও দেখছেন তো?’

‘দেখব বই কী। আপনার পাশে বসেই দেখব।’

ভদ্রলোক এবার টিকিটের দাম দিতে গেলেন রিনাকে।

রিনা বলল, ‘দাম নিতাম, কিন্তু এইসব কথাবার্তার পরে দাম নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’

‘সে কী! আপনি তো ওটা বেচতেই চেয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু এখন আর তা চাইছি না। আপনার কথাবার্তায় এমন এক আন্তরিকতার সূর পেয়েছি যে এখন আপনাকে আমার বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ, দাম দিয়ে আমাকে ক্ষুণ্ণ করবেন না।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘বেশ, তাই হবে। তবে আমার একটা অনুরোধ কিন্তু রাখতেই হবে আপনাকে।’

‘কী অনুরোধ, বলুন?’

‘তার আগে আপনার নামটা জানতে পারি কি?’

‘আমার নাম রিনা রাইন।’

‘হাউ লাভলি! আমার নাম অরুণ রায়।’

‘কিন্তু আপনার অনুরোধটা?’

সিনেমা দেখা শেষ হলে আপনি আমার সঙ্গে আমার গাড়িতে চেপে কোনও একটা ভালো রেস্তোরাঁয় যাবেন। সেখানে আমরা ডিনার করব। তারপর আমার গাড়িতেই আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব আপনার বাড়িতে। ‘আপত্তি নেই তো?’

‘কী যে বলেন! আপনার মতো পুরুষের সঙ্গ পাওয়া যে—কোনও মেয়ের কামনার বস্তু।’

‘আপনার মতো মেয়ের সান্নিধ্যও যে—কোনও পুরুষের প্রত্যাশার অধিক।’

‘আমি অতি সামান্যা।’

‘আপনি অসামান্যা এবং অতুলনীয়া। আচ্ছা, এই যে আপনি আমাকে বিশ্বাস করে আমার সঙ্গে যাবেন, আপনার ভয় করবে না?’

‘কেন ভয় করবে?’

‘যদি আমি খাওয়াদাওয়ার পর আপনাকে আর বাড়ি ফিরতে না দিই? যদি হোটেলের দরজা—জানলা বন্ধ করে আপনার সবকিছু দস্যুর মতো লুটেপুটে নিই?’

‘নিন না, ক্ষতি কী? আজকের দিনে এসব কোনও ব্যাপারই নয়। কাল সকালে যখন সাবান মেখে চান করব তখন সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। মেয়েদের দেহ কি এতই পলকা যে একটু সুখের জন্য কেউ সেটা ব্যবহার করলে তাকে ফেলে দিতে হবে? আমার শরীর সেরকম নয়। মনও না। আমাকে পেয়ে আপনি যদি তৃপ্ত হন তো সানন্দে রাজি আমি।’

অরুণ রায় অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ইউ সো অ্যামেজিং, মিস রাইন। রাস্তায় লোকজন না থাকলে এখনই আমি আপনাকে—।’

রিনা হেসে বলল, ‘তাই নাকি? যাক, এবার হলে ঢোকা যাক। তারপর কোথায় যেন নিয়ে যাবেন বলছিলেন সেখানে নিয়ে গিয়ে যত ইচ্ছে—।’

ওরা দুজনে কথা বলতে বলতে হলের দিকে এগোল।

দূর থেকে এক চোখ টিপে সংকেত দিল সূরয।

রিনাও ওকে ইশারা করল।

মাকড়সা যেমন তার জালে অপরাপর কীটপতঙ্গকে জড়িয়ে ফেলে, রিনাও ঠিক সেইভাবে জড়িয়ে ফেলল অরুণ রায়কে।

পৌনে আটটায় শো শেষ হল। রক্ত—গরম—করা উত্তেজনাপূর্ণ মালয়ালম ছবি। দর্শকেরা ছবি দেখে বুঁদ হয়ে হল থেকে বেরোল এক—এক করে।

অরুণ রায়ের সঙ্গে রিনাও বেরিয়ে এল।

বাইরেই একপাশে রাখা ছিল অরুণ রায়ের অস্টিন গাড়িটা। সেই গাড়িতেই চেপে বসল দুজনে।

অরুণ রায় নিজেই স্টিয়ারিং ধরলেন। উনি কিন্তু টেরও পেলেন না যে আর একটা ভাড়া—করা—ট্যাক্সি লেজুড়ের মতো তাঁরই পিছু পিছু অনুসরণ করে আসছে।

পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা হোটেলের সামনে গিয়ে থামল অস্টিনখানা। এই হোটেলে রিনা অবশ্য এর আগেও কয়েকবার এসেছে। এখানে তিনশো টাকা ঘণ্টায় ঘর পাওয়া যায়। এখানে কোনও বান্ধবী বা ফুসলে আনা কোনও মেয়েকে নিয়ে এক—দু’ঘণ্টা ধরে দারুণ ফুর্তি করে অনেকে। এছাড়াও অনেক কিছুই চলে এখানে। যাই হোক, ওরা গাড়ি থেকে নামল।

পিছনের ট্যাক্সি থেকে সূরযও একটু দূরত্ব বজায় রেখে নেমে পড়ল। তারপর এগিয়ে এল। আলো—অন্ধকার মাখা দেওয়ালের গায়ে গায়ে।

অরুণ রায় এবং রিনা ভিতরে ঢুকলেন।

একটু পরে সূরযও ঢুকল। তারপর এক কোণে কারও জন্য প্রতীক্ষা করার ছলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগল দুজনকে। বাইরে বেরোবার রাস্তাটাও একবার দেখে নিল। পকেটে হাত দিয়ে রিভলবারটা শক্ত করে ধরে রইল মুঠোর মধ্যে। বেগতিক দেখলেই যাতে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে।

অরুণ রায় আর রিনা প্রথমেই ঢুকলেন রিসেপশনে। তারপর রুম নিয়ে একজন বেয়ারার সঙ্গে পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন দোতলায়।

সূরয এখানেও ধাওয়া করল। নিঃশব্দে। অরুণ রায়ের নজর এড়িয়ে। সকলের নজর এড়িয়ে।

একেবারে কোণের ঘরখানিই পছন্দ করেছেন অরুণ রায়।

দুজন বেয়ারা বসে বসে গল্প করছিল। তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম জানাল।

অরুণ রায় মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকলেন রিনাকে নিয়ে।

একজন বেয়ারা এগিয়ে এসে বলল, ‘এনি ড্রিংকস?’

‘নো, থ্যাঙ্কস। ওনলি কফি অ্যান্ড স্ন্যাকস।’

বেয়ারা চলে গেল।

ঘরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেল রিনা। এই হোটেলে এর আগে দু—একবার এলেও এ—ঘরে এই প্রথম। কী দারুণ সুন্দরভাবে সাজানো ঘর। এই ক’বছরে কলকাতা শহরে এমন কোনও নামী—দামি হোটেল বা লজ নেই যেখানে রাত কাটায়নি রিনা। কিন্তু এই হোটেলের এই ঘরখানি যে একেবারেই অন্যরকম। ভেতরে বড় আয়না, ড্রেসিং টেবিল, খাটের ওপর সুন্দর বেড—কভার বিছানো পুরু গদির বিছানা, একপাশে বাথরুম। দেওয়ালের সর্বত্র নরনারীর মৈথুন দৃশ্যের নানা ধরনের ছবি। রিনা লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বলল, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন আপনি?’

‘কেন?’

‘যত্তো সব খারাপ খারাপ ছবি।’

‘তাতে কী? যে কাজ করতে এসেছি আমরা তাতে এমন ঘরই তো দরকার। তা ছাড়া এখানে আমি আর আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই। থাকবেও না কেউ। এখানে আপনাকে নিয়ে আমি যা খুশি তাই করব। প্রয়োজনে সারারাত থাকব এখানে।’

রিনা হাসল, ‘বাঃ রে, আমার বাড়ির লোক চিন্তা করবে না বুঝি?’

‘করবে। কাল সকালে বাড়ি গিয়ে পৌঁছলে চিন্তাও দূর হবে।’

অরুণ রায় আর রিনা দুজনেই গুছিয়ে বসলেন বিছানায়।

রিনা সরে এসে অরুণ রায়ের গায়ে স্তনের পরশ দিল। এই মধুর উত্তাপ যে—কোনও পুরুষেরই দেহে—মনে উন্মাদনা জাগায়।

দরজায় টোকা পড়ল। বেয়ারা এসে কফি আর স্ন্যাকস রেখে গেল।

অরুণ রায় বললেন, ‘শোনো, আমি চাই না এই ঘরে কেউ কোনও ডিস্টার্ব করে। প্রয়োজনে আমি বেল বাজাব।’

‘ইয়েস স্যার।’

চলে গেল বেয়ারা।

কফি খাওয়া শেষ হলে অরুণ রায় বললেন, ‘জাস্ট এ মিনিট। তুমি একটু বসো রিনা, আমি একবার বাথরুম থেকে আসি। চোখে—মুখে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ না হলে আর চলছে না।’

রিনা বসে রইল। এরই মধ্যে একবার রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল সাড়ে আটটা বাজে।

অরুণ রায় বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই একবার চকিতে দরজাটা খুলে চট করে বাইরেটা দেখে নিল রিনা। দূরে এক কোণে একটা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল সূরয। রিনাকে দেখেই ঘাড় নেড়ে জানাল, আমি রেডি।

অরুণ রায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। এবার বেশ ঝরঝরে লাগছে তাঁকে।

রিনা বলল, ‘ভারী সুন্দর লাগছে কিন্তু আপনাকে।’

অরুণ রায় হাসলেন। ‘বললেন, দূরে কেন, কাছে এসো রিনা।’

রিনার বুক এক আশ্চর্য সুখে যেন ভরে উঠেছে তখন।

বহুভোগ্যা রমণীর অন্তরেও কি কামনা জেগে উঠল এবার? রিনা পায়ে পায়ে চতুরা নায়িকার মতো এগিয়ে গেল অরুণ রায়ের কাছে। সে নিজেই অরুণ রায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। সত্যি! পুরুষের মতো পুরুষ বটে অরুণ রায়। কিন্তু তবুও মনকে দুর্বল করলে চলবে না। যে—কাজের জন্য সে এসেছে, ইচ্ছে না থাকলেও সেই কাজ তাকে করতেই হবে। দলের নির্দেশ মতো কাজ না করলেই ও ব্ল্যাকলিস্টে চলে যাবে। একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দেবে ওরা।

অরুণ রায় অনেকক্ষণ তাকে ধরে রাখলেন বুকের মধ্যে। তারপর হঠাৎই গুপ্তস্থান থেকে রিভলবারটা বার করে উঁচিয়ে ধরলেন রিনার দিকে। বললেন, ‘খুব সাবধান। চেঁচিয়েছ কী মরেছ।’

রিনা ভাবতেও পারল না এমন অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার ঘটে যাবে বলে। এ কাজটা তো তারই করবার কথা। অরুণ রায়কে জামা—প্যান্ট ছেড়ে রাখতে বলে নিজে বাথরুমে ঢুকে একেবারে তৈরি হয়ে আসবে কোথায়, তার জায়গায় এ কী হল! সূরয যাতে সহজে আসতে পারে সেজন্য সে দরজার লকটাও খুলে রাখল। অথচ তার আগেই—।

অরুণ রায় কঠিন গলায় বললেন, ‘হাত ওপরে ওঠাও।’

রিনা হাত ওঠাল।

অরুণ রায় দরজাটা আবার লক করে দিলেন।

‘আপনি হঠাৎ এমন হয়ে গেলেন কেন মি. রায়? আমি তো স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করছি আপনার কাছে। আপনি আমার শরীর নিয়ে যা ইচ্ছে করুন, আমি না করব না। এত ভয় দেখাবার কী আছে?’

ও—দিকে সূরযও তখন বসে বসে ঘেমে উঠছে। কী আশ্চর্য! এত দেরি করছে কেন মেয়েটা? এতক্ষণে তো ওর ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করবার কথা। আর সেই শব্দ শুনেই নারীধর্ষণের ধুয়ো তুলে সে শিকারের উপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। এইভাবেই তো ব্ল্যাকমেলের কাজ চলে আসছিল এতদিন। কিন্তু আজ কী হল? এত দেরি হচ্ছে কেন? তবে কি ওই সুন্দর সুপুরুষ ভদ্রলোকের প্রেমে পড়ে গেল রিনা? উঠে গিয়ে উঁকি মেরে দেখবে নাকি একবার?

কিন্তু সূরয তা করল না। বেগতিক বুঝে আর—একবার পালাবার রাস্তাটা দেখে নিল। ওর সারা গা ঘামছে। মনের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। না হলে এমন হবার তো কথা নয়।

উত্তেজনায় ও অধীর হয়ে উঠল। নাইলনের লম্বা ফিতেটা এরই মধ্যে বাঁধা রেডি। এটা ধরেই ঝুলে লাফিয়ে পড়বে পাশের ছাদে। তারপর লাইটপোস্টের গা বেয়ে একেবারে উধাও।

অরুণ রায় তখনও একভাবে রিভলবার উঁচিয়ে আছেন।

রিনা ব্যাপারটাকে একবার হালকা করে দেখে তামাশা মনে করল। তারপর ভাবল যদি সত্যিই হয়? তাই আড়ষ্ট গলায় মেকি স্বাভাবিকতার সুর আনবার চেষ্টা করে বলল, ‘আমাকে আপনার ভালো লাগছে না? আমি কিন্তু আমার সবকিছুই আপনাকে উজাড় করে দিতে চাই।’

অরুণ রায় ধমক দিলেন, ‘চুপ করো। তোমার মতো একটা লাইনের মেয়ের সঙ্গে শুয়ে আমি কি রোগে ভুগব?’

‘আমি লাইনের মেয়ে?’

‘না, গৃহস্থের কুলকন্যা। তোমাকে ধরবার জন্য আমি অনেক দিন ধরে ওৎ পেতে আছি। এইভাবে ফাঁদে ফেলে অনেককে ব্ল্যাকমেল করেছ তুমি।’

‘এসব কী বলছেন আপনি?’

‘যা বলছি তা তো বাংলাতেই বলছি। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?’

রিনা আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখল বিছানার ওপর পড়ে থাকা তার ভ্যানিটি ব্যাগটার দিকে।

অরুণ রায় বললেন, ‘ওদিকে তাকিয়ে কোনও লাভ হবে না মিস চারশো বিশ।’

‘আমি বড় ঘেমে যাচ্ছি, প্লিজ। আমার রুমালটা ওর ভিতরে আছে।’

‘না। রুমাল ওখানে নেই। ওর ভিতরে তোমার রিভলবারটা আছে।’

রিনার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

‘এখন আমি যা জিগ্যেস করি ভালো মেয়ের মতো এক—এক করে তার উত্তর দাও। খবরদার, চেঁচাবে না কিন্তু। তাহলে মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব।’

রিনা তুলে থাকা হাতটা নামাতে গেল।

‘উঁহু। হাত নামাবে না।’

‘অসাড় হয়ে পড়ছে যে?’

‘পড়ুক। ওই হাতে অনেক অপকর্ম করেছ তুমি।’

‘কী জিগ্যেস করবেন করুন তাড়াতাড়ি।’

‘সোমা নন্দী কোথায়?’

‘কে সোমা নন্দী?’

‘আকাশ থেকে পড়লে যে!’

‘আমি চিনি না।’

‘মেরে মুখ থেঁতো করে দেব, শয়তান মেয়ে! চেনো না?’

‘সত্যি বলছি চিনি না।’

‘ফের মিথ্যে কথা? কাল দুপুরে ভিআইপি রোডের ফ্ল্যাট থেকে যে মহিলাকে তোমরা নিয়ে গেছ সে এখন কোথায়?’

‘জানি না।’

‘জানো না?’

‘না।’

অরুণ রায় এবার গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এই! তোমরা চলে এসো এবার। মেয়েটার হাতে হাতকড়া লাগাও।’

বলামাত্রই বাথরুমের ভেতর থেকে দুজন সশস্ত্র পুলিশ ও একজন মেয়ে পুলিশ বেরিয়ে এল।

তাদের দেখেই চিৎকার করে উঠল রিনা। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল বাইরে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল যেন। বোমার শব্দে সারা এলাকা কেঁপে উঠল।

অরুণ রায় তাড়াতাড়ি দরজা খুলেই দেখলেন চারদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন। তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই ওদের দলের কেউ আড়ি পেতেছিল দরজায়। তারপর হাওয়া খারাপ বুঝে কেটে পড়েছে। যাবার আগে সে এই চিরাচরিত চাল চেলে গেছে। যাক। মেয়েটা তো এখন হাতের মুঠোয়। কান টানলেই মাথাটা আসবে এবার।

হোটেলের ম্যানেজার, বেয়ারা থেকে অন্য লোকজন সবাই ছুটে এল শব্দ শুনে।

অরুণ রায় বললেন, ‘ধন্যবাদ মি. মাকিন। আপনার সহযোগিতার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।’

রিনার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে ওকে নীচে নামানো হল। অরুণ রায়ের গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল বাইরেই। কিন্তু ওকে গাড়িতে ওঠাতে গিয়েই চরম বিপত্তিটা ঘটে গেল। কোথা থেকে যেন একটা বুলেট সশব্দে ছিটকে এল রিনার দিকে। অব্যর্থ লক্ষ্য। রিনা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল সেখানেই।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতচকিত হয়ে রইল। তারপর রিনাকে মোটরের ভেতরে শুইয়ে সবাই উঠে বসল। অরুণ রায় গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দেখলেন গাড়ি চলছে না। তাজ্জব ব্যাপার। এমন তো হবার কথা নয়। হল কী গাড়িটার? নেমে এসে দেখলেন মোটরের চারটে চাকারই হাওয়া বার করে দেওয়া হয়েছে।

সদর দফতরের সামনে এসে পুলিশের গাড়িটা থামতেই অরুণ রায় তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলেন।

দফতরের প্রধান বললেন, ‘কী ব্যাপার মি. ত্রিবেদী! এত উদ্বিগ্ন কেন?’

অরুণ রায় হাসলেন। বললেন, ‘কে ত্রিবেদী? আমি অরুণ রায়।’

‘সে তো মঞ্চে। এখন নয়।’

অরুণ রায় ওরফে ত্রিবেদী হাসলেন। বললেন, ‘এত অভিনয় করে পাখিটাকে ধরেও ধরতে পারলাম না স্যার। এখুনি একটা ফোন করতে হবে।’

ত্রিবেদী টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করে প্রথমেই ব্যবস্থা করলেন নিজের গাড়িটাকে ঠিক করবার। তারপর হাসপাতালে। কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলার পর হতাশ হয়ে বসে পড়লেন।

মি. বর্মন বললেন, ‘ব্যাপারটা কী?’

‘অবস্থা খুব গুরুতর। বোধহয় বাঁচবে না। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।’

‘কে?’

‘মিস রিনা রাইন।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’

‘রিনা হল মেয়েচুরি চক্রের অন্যতম নায়িকা। কাল দুপুরে শিবেন নন্দীর সুন্দরী স্ত্রীকে যারা অপহরণ করেছিল তাদেরই দলের মেয়ে।’

‘আপনি তাহলে খোঁজ পেয়েছেন ওদের?’

‘কই আর পেলাম? মেয়েটা না সুস্থ হওয়া পর্যন্ত কোনও কিছুই জানা যাবে না।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে আর কী? যদি মারা যায় তো সবই অতল জলে। দিন, একটা সিগারেট দিন। অনেকক্ষণ স্মোক করিনি।’

বর্মন ত্রিবেদীর দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কীভাবে কী করলেন শুনি একবার?’

ত্রিবেদী সিগারেটে পরপর কয়েকটা টান দিয়ে বললেন, ‘প্রথমেই আমি ঘটনাস্থলে গেলাম। ভিআইপি রোডের ফ্ল্যাটে। দেখলাম মহিলার স্বামী শিবেনবাবু পাগলের মতো কান্নাকাটি করছেন। তাঁর কাছ থেকেই কথাপ্রসঙ্গে জানলাম ভদ্রলোকের স্ত্রী চলে যাবার সময় কোনোরকম চিঠিপত্র রেখে যাননি, এমনকি একটা ভালো শাড়িও বার করে পরেননি। শুধু ঘরে তালা দিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। কাজেই আমার মনে একটু সন্দেহ হল। যুবতী স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় অপর কারও সঙ্গে পালিয়ে যায় তাহলে সাধারণত সে যাবার সময় একটা চিঠি তো রাখেই, উপরন্তু নিজের গয়নাগাঁটি বা কিছু জামাকাপড় কি প্রয়োজনীয় জিনিস তো নিয়ে যায় অন্তত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেসব কিছুই হয়নি। পোস্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম কোনও জরুরি তার বা ওই ধরনের কিছুও ও—দিন ওই ফ্ল্যাটে আসেনি। তাই সন্দেহ ঘনীভূত হল। বুঝলাম ভদ্রমহিলা স্বেচ্ছায় কোথাও যাননি। কিডন্যাপিং কেস। এই বছর দুয়েকের মধ্যে নানারকম ঘটনা ঘটিয়ে সুচতুর পরিকল্পনায় বেশ কয়েকজন বিবাহিতা—অবিবাহিতা যুবতীকে অপরহণ করা হয়েছে। এদের একজনকেও এখনও পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এইসব মেয়ে যে কীভাবে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রে পাচার হয়ে যাচ্ছে তা রহস্যাবৃত। শুধু তাই নয়, এই নারীহরণের সঙ্গে সঙ্গেই সিনেমা—পাড়া থেকেও ধনী ঘরের ছেলেদের ব্ল্যাকমেল করার ঘটনাও শোনা যাচ্ছে। সুন্দরী মেয়েরা রূপের ফাঁদে ফেলে কুখ্যাত হোটেল—বারে ছেলেদের নিয়ে গিয়ে সর্বস্বান্ত করছে। বাধা দিতে গেলে মারধোরও করছে সময়ে সময়ে। তাতেই বুঝে নিলাম কাজটা একই দলের। বিশেষ করে মারধোর যারা করছে তারাও রীতিমতো দাগী শয়তান। অতএব সিনেমা—পাড়াতেই আজকের ফাঁদটা পাতলাম।’

বর্মন বললেন, ‘এ তো প্রায় কোনও হিট সিনেমার গল্প মনে হচ্ছে।’

‘ঠিক তাই। প্রথমেই একটা নামকরা হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম।’

‘কোন হোটেল? ধর্মতলায় না পার্ক স্ট্রিটে?’

‘পার্ক স্ট্রিটে।’ বলে আস্তে করে হোটেলের নামটা বললেন।

‘ওরে বাবা! ওটাও তো একটা খাস জায়গা। বেশ ভালো রকমই কালো তালিকায় আছে ওই হোটেলের নাম।

‘জানি। ওখানকার যিনি ম্যানেজার সেই মি. মাকিন আমার বিশেষ পরিচিত। কাজেই আমার পরিকল্পনা মতো কাজ করতে কোনও অসুবিধা হল না। সবকিছুর ব্যবস্থা করে ভাবলাম লাইট হাউসে একটা রগরগে ছবি যখন হচ্ছে আর টিকিট নিয়ে ব্ল্যাকারদের দাপাদাপিও যখন চলছে, তখন টোপটা ওইখানেই ফেলা যাক। যাবার আগে ওই এলাকার কয়েকজন সমাজবিরোধীর ফোটোও দেখে নিলাম। হঠাৎ হলের সামনে দেখলাম সূরয তেওয়ারিকে। সে আমাকে চেনে না। কিন্তু আমি তাকে চিনি। সে একজন নামকরা জেলঘুঘু। আমি হলের সামনে ঘোরাফেরার সময় অনেকক্ষণ ধরেই একটা মেয়েকেও হানটান করতে দেখেছি। মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী। যার জন্য বিশেষভাবেই আমার নজর তার ওপর পড়েছিল। সূরয আসতেই দেখলাম তার সঙ্গে মেয়েটির চোখে চোখে ইশারা হল। আমি নিঃসন্দেহ হলাম। তারপরই বঁড়শিতে গাঁথা পড়ল মাছ। আমার চেহারা আর চালচলন দেখে মেয়েটি ওর রূপের ফাঁদে ফেলবার জন্য আমাকেই বেছে নিল সর্বাগ্রে। আমিও প্যাঁচ কষলাম। তারপর সিনেমা হলে ঢুকে ইন্টারভ্যালের সময় ল্যাট্রিনে যাওয়ার অছিলায় মি. মাকিনকে আর একবার ফোনও করলাম। আগেই বলেছি মাকিন আমার পরিচিত লোক। তাই দারুণ সহযোগিতা করলেন। আমার পরিকল্পনা মতো দুজন কনস্টেবল ও একজন মেয়ে পুলিশকে ওই হোটেলের সবচেয়ে লোভনীয় একটা কক্ষের বাথরুমে আগে থেকে লুকিয়ে রাখা হল। এমনভাবে কাজটা হল যাতে হোটেলের অন্য কর্মচারীরাও টের পেল না। এরপর হোটেলের ওই ঘরে মেয়েটিকে নিজের কবজায় এনে হঠাৎই রিভলবার বার করে চমকে দিলাম। তার আগে অবশ্য নিখুঁত অভিনয় করতে হয়েছিল, যাতে আমার সম্পর্কে ওর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না জাগে। যাই হোক, মেয়েটিকে চমকে দেওয়ার চাল চাললাম, কেননা মেয়েটি হয়তো এই দলের না—ও হতে পারে। তবু প্রশ্ন করলাম, সোমা নন্দী কোথায়? কোথায় রেখেছ তাকে? সোমা নন্দীর নাম শুনেই মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেল মেয়েটির মুখ। ওই মুখই তখন পরোক্ষ ভাবে স্বীকার করাল ওর অপরাধ। মেয়েটিকে সন্দেহ করবার আরও কারণ ছিল। ভিআইপি রোডের ফ্ল্যাটে তদন্তের সময় একজন আইসক্রিমওয়ালাকে জিগ্যেস করে জেনেছিলাম, সেদিন যে সময় সোমা নন্দীকে অপহরণ করা হয়েছিল সেই দিন ঠিক সেই সময় ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে রাস্তার ধারে একটা ট্যাক্সির পিছনের সিটে সে এক সুন্দরী মহিলাকে বসে থাকতে দেখেছিল, এবং কিছু পরে একজন লম্বাচওড়া সুন্দর চেহারার লোকের সঙ্গে এক সুন্দরী মহিলাকেও ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সে ট্যাক্সিতে উঠতে দেখেছিল। এর দ্বারাই ব্যাপারটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম খানিকটা। এখন আমার মনে হচ্ছে সন্দেহটা যথার্থই। ভগবানের দয়ায় যদি কোনোরকমে মেয়েটির জ্ঞান ফেরে তাহলে সব জানা যাবে। আর তা যদি না হয়, তবে যেমন করেই হোক তন্নতন্ন করে খুঁজে বার করতে হবে ওই সূরয তেওয়ারিকে। তাকে ধরতে পারলেই বড় চাঁই ধরা পড়বে। কেননা সূরয যে একই দলের লোক সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মেয়েটির সঙ্গে ওর দৃষ্টিবিনিময় আমি দেখেছি। সম্ভবত সূরযের গুলিতেই মেয়েটা প্রাণ হারাতে বসেছে।’

বর্মন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব শুনলেন। তারপর বললেন, ‘স্ট্রেঞ্জ! আপনি তো দারুণ কাজ করেছেন। তাহলে তো আমাকে একবার হাসপাতালে যেতে হচ্ছে।’

‘যান না, ঘুরে আসুন। দেখে আসুন মেয়েটাকে। তবে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, মেয়েটা আমার সঙ্গে ঠিক অন্তর দিয়ে দুর্ব্যবহার করতে চাইছিল না।’

‘বলেন কী?’

‘হ্যাঁ। বাধ্য হচ্ছিল করতে।’

‘কী করে বুঝলেন?’

‘ওর ব্যবহার এবং চোখ—মুখ দেখেই আমার তা মনে হচ্ছিল। তবে আমি যখন ওর মুখোশ খুলে দিলাম তখন আত্মরক্ষার জন্য ও মরিয়া হয়ে উঠতে যাচ্ছিল।’

‘তাই নাকি? হাসপাতালের ডাক্তাররা কী বলছে?’

‘কোনও আশা নেই।’

‘ঠিক আছে, আমি আসছি।’ মি. বর্মন তাঁর সহযোগী অন্য একজনকে সেখানে রেখে চলে গেলেন।

ত্রিবেদীও আদ্যোপান্ত তদন্তের বিবরণ লিখে তাঁর রিপোর্ট জমা দিয়ে বেরোলেন।

বেরিয়ে গাড়িতে উঠলেন। তারপর নিজেই গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে চললেন ভিআইপি রোডের দিকে। যে—বাড়ি থেকে মাত্র একদিন আগে সোমা নন্দীকে তুলে আনা হয়েছে, সেই বাড়ির নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন।

শিবেন নন্দী ঘরেই ছিল তখন। সাতাশ—আঠাশ বছরের ছিপছিপে পাতলা চেহারার যুবক। মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। শোকে মুহ্যমান হয়ে কপালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল খাটের ওপর।

ওর পাশে বসে ওই ফ্ল্যাটেরই এক অবাঙালি ভদ্রলোক সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে।

এমন সময় ত্রিবেদী এসে হাজির হলেন সেখানে। বেশ ভালোভাবে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেন ঘরটাকে। ছোট্ট কিন্তু সাজানো—গোছানো ঘর।

ত্রিবেদীকে দেখে চোখের জল মুছে উঠে বসল শিবেন।

পাশের ভদ্রলোক ত্রিবেদীর দিকে তাকালে ত্রিবেদী বললেন, ‘আপনি?’

‘আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি।’

‘কাইন্ডলি আপনি যদি কিছু সময়ের জন্য একটু আপনার রুমে যান তাহলে আমি শিবেনবাবুকে কতকগুলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘অবশ্যই। বলে তাঁর নিজের ঘরে চলে গেলেন।’

ত্রিবেদী এবার বেশ ভালোভাবে নজর দিলেন শিবেন নন্দীর দিকে। ময়লা রোগাটে চেহারার এই যুবকের অমন সুন্দরী বউ কীভাবে হয় তা ভেবে পেলেন না। সোমা নন্দীকে দেখেননি, তবে ফোটো দেখেছেন। প্রকৃতির নিয়মে এমনই বোধহয় হয়ে থাকে। আর সেই কারণেই বোধহয় রিনা রাইনের মতো মেয়েকে অত রূপ—যৌবন থাকা সত্ত্বেও লাইনে নামতে হয়।

ত্রিবেদীর দিকে আশাভরা চোখে তাকিয়ে শিবেন বলল, ‘কী, খবর পেলেন কিছু?’

‘না। তবে শিগগির পাব বলে আশা রাখছি।’

‘এখনও পাননি?’ শিবেনের চোখে—মুখে হতাশা।

‘এত ভেঙে পড়লে কী করে হবে? ধৈর্য ধরুন। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি আপনার স্ত্রীকে উদ্ধার করে আপনার হাতে ফিরিয়ে দেবার। এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। আপনি কিন্তু ঠিক ঠিক জবাব দেবেন।’

‘আমি কোনও কিছুই গোপন করব না আপনার কাছে। বলুন আপনি কী জানতে চান?’

‘আপনাদের বিবাহিত জীবন শুনেছি খুব বেশি দিনের নয়। আপনাদের বিয়েটা কি প্রেম—ভালোবাসার পথে, নাকি…।’

‘দেখেশুনেই বিয়ে আমাদের।’

‘স্ত্রীর বাপের বাড়ি কোথায়?’

‘দুর্গাপুরে।’

‘ওঁর বাড়ির লোকজন কাউকে দেখছি না তো?’

‘আমি এখনও এই দুঃসংবাদটা জানাইনি কাউকে। ওর, আমার কারও বাড়িতে নয়।’

‘আজ কিন্তু দু—একটা কাগজে ছোট করে এই সংবাদটা ছেপে বেরিয়েছে।’

‘আমি সকাল থেকে কোনও কাগজই দেখিনি আজ।’

‘না দেখুন, এমন বিপদের কথা কখনও চেপে রাখতে নেই। বাড়িতে খবর দিন। আপনার, ওঁর দুজনেরই। এটা আপনার নৈতিক কর্তব্য।’

শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, জানাব। আজই জানাব। জানাতে তো হবেই। কত দিন আর চেপে রাখব এ—সব কথা?’

ত্রিবেদী বললেন, ‘স্ত্রীকে আপনি খুবই ভালোবাসতেন?’

‘ও আমার প্রাণ। এইটুকুই শুধু বলতে পারি।’

‘ধরুন আপনার স্ত্রীকে যদি আমরা উদ্ধার করতে পারি, আপনি কি তাকে আবার আগের মতো মেনে নিতে পারবেন?’

‘এ—কথা বলছেন কেন? আমার স্ত্রীকে আমি মেনে নিতে পারব না এমনটা ভাবলেন কী করে?’

‘আমরা পুলিশের লোক। ক্রিমিনালদের চরিত্র আমাদের জানা। এতক্ষণে তার শরীরের উপর যে বেশ কয়েকজনের অত্যাচার হয়নি তা কি বুকে হাত দিয়ে বলা যায়?’

শিবেনের মুখটা শুকিয়ে গেল। অতিকষ্টে বলল, ‘তবুও মেনে নিতে হবেই। ওকে ছাড়া যে আমি বাঁচব না। শুধু মনে করব অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট। তা ছাড়া এই ব্যাপারে ওর তো কোনও দোষ নেই।’

‘এটাই আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম। এবার কিন্তু আমি আপনাকে অন্য একটা প্রশ্ন করব।’

শিবেন ত্রিবেদীর মুখের দিকে তাকাল।

‘এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে কিন্তু আপনার স্ত্রীর অপহরণের একটা সূত্র সন্ধান আমি পাব।’

‘কী প্রশ্ন?’

‘আপনার সিনেমা দেখার অভ্যাস আছে?’

‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন?’

‘আপনি আমাকে প্রশ্ন করবেন না। কিছু জানতেও চাইবেন না। আমি তদন্তকারী অফিসার। আমি আপনাকে প্রশ্ন করব। আপনি সঠিক উত্তর দেবেন। কোনও কিছুই লুকোবেন না।’

‘হ্যাঁ আছে।’

‘লাইট হাউস বা নিউ এমপায়ারে সম্প্রতি কোনও সিনেমা দেখেছেন?’

‘দেখেছি। বেশ কয়েক মাস ধরে দারুণ একটা সুপারহিট মালয়ালম ছবি হচ্ছে। কিছুদিন আগেই দেখে এসেছি সেটা।’

‘স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন?’

‘না। ও বাংলা ছবি ছাড়া দেখে না। হিন্দি ছবি দেখে। তবে তেলেগু, মালয়ালম বা ইংরেজি ছবি একদম দেখে না। তাছাড়া ওই সময় কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে ছিলও।’

‘মনে হচ্ছে আপনি সত্যি কথাই বলছেন এবং বলবেন। একেই বলে দুই আর দুইয়ে চার। ওখানে কোনও সুন্দরী মহিলার কাছ থেকে টিকিট কেটেছেন কখনও?’

‘হ্যাঁ, এইবারই কেটেছিলাম। কেননা কাউন্টার খোলার সঙ্গে সঙ্গে সব টিকিট ব্ল্যাকারদের হাতে চলে গিয়েছিল। তাই—।’

ত্রিবেদী তাঁর অ্যাটাচি থেকে একটা মেয়ের ফোটো বার করে বললেন, ‘দেখুন তো, এই মেয়েটি কি না?’

ছবি দেখেই চমকে উঠল শিবেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো! এই তো সেই মেয়ে। এর কাছ থেকেই টিকিট কেটেছিলাম।’

‘মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল?’

‘হয়েছিল।’

‘মেয়েটি দারুণ মিষ্টি, তাই না?’

শিবেন মাথা নত করল। কী যে উত্তর দেবে তা ভেবে পেল না। এই মুহূর্তে ত্রিবেদীকে ওর ভয় করতে লাগল খুব।

ত্রিবেদী বললেন, ‘আমার কথার উত্তর দিন।’

‘হ্যাঁ।’

‘আলাপ—পরিচয়ের পর কোনও একটা হোটেলে গিয়ে ঘরের সুন্দরী স্ত্রীর কথা ভুলে কিছুক্ষণের জন্য শুয়েও পড়েছিলেন তার সঙ্গে, কী বলুন?’

‘আমরা কোনও হোটেলে যাইনি।’

‘তবে কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘সে আমার ফ্ল্যাটেই এসেছিল।’

‘চমৎকার! পুলিশ, গুন্ডা সবার নজর এড়িয়ে দারুণ নিরাপদ জায়গা ভেবে স্ত্রীর অবর্তমানে তারই সুখশয্যায় ওই বাইরের মেয়েকে নিয়ে দারুণ এনজয় করেছিলেন। ভালোও লেগেছিল নিশ্চয়ই?’

শিবেন বলল, ‘না না, অত দূর ব্যাপারটা গড়ায়নি।’

‘তা হলে?’

‘মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী, তার ওপর দারুণ মিশুকে। মনে হয় বেশ ভালো ঘরের মেয়ে। ওর এক বান্ধবীর সিনেমা দেখতে আসবার কথা ছিল। সে আসেনি, তাই ওই টিকিটটা আমাকেই দিয়েছিল।’

‘কত টাকায়?’

‘টাকার প্রশ্নই নেই। শুনলে হয়তো অবাক হবেন, আলাপের পরে টিকিটের দামটা পর্যন্ত সে নেয়নি।’

‘বলেন কী!’

‘তাই তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তাছাড়া অমন একজন সুন্দরী মেয়ে আলাপী হলে তার সঙ্গ সহসা কে ছাড়ে বলুন? ও বলেছিল আমাদেরই এই এলাকার কাছাকাছি সে থাকে। তাই আসবার সময় ওকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরেছিলাম। স্ত্রী ছিল না বলে ফ্ল্যাটে এনে অনেকক্ষণ ধরে ওর সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করেছিলাম। পরে ওকে যখন বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে গেলাম তখন ও রাজি হল না। বলল ও একাই যেতে পারবে। কেননা ওর সঙ্গে আমাকে দেখলে ওর বাড়ির লোকেরা অন্যরকম ভাবতে পারে।’

‘হুঁ। এবার বলুন ওর সঙ্গে আপনার কী কী কথা হয়েছিল?’

‘কিছুই না।’

‘সে কী! এ—দিকে বলছেন অনেকক্ষণ ধরে চুটিয়ে গল্প করেছিলেন, এখন বলছেন কিছুই না।’

‘না মানে সবই ব্যক্তিগত ঘরোয়া কথাবার্তা। আমার স্ত্রীর ফোটো দেখে বারবার তার রূপের প্রশংসা করেছিল এবং সেই সঙ্গে আমার ভাগ্যের। পরে একদিন আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করবে বলে সেই যে গেল আর আসেনি।’

‘আর কিছু জানবার প্রয়োজনও আমার নেই শিবেনবাবু। তবে আপনার অবগতির জন্যই জানাই, ওই মেয়েই আপনার স্ত্রীকে অপহরণ করেছে।’

চমকে উঠল শিবেন, ‘ওই মেয়ে!’

‘হ্যাঁ। অবশ্য চক্রে ও একা নয়, আরও আছে।’

শিবেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। বলল, ‘ক্ষণিকের মোহে এ আমি কী করলাম! এমন যে হবে তা আমি ভাবতেও পারিনি।’

‘মেয়েটি ধরা পড়েছে। আমি গ্রেফতার করেছি তাকে। তবে সে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। আচ্ছা, আমি আসি।’

শিবেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ত্রিবেদীর চলে যাওয়া পথের দিকে। গভীর বেদনায় ওর দু’চোখ জলে ভরে উঠল।

বারদুয়ারি থেকে কিছু দূরে সেই বার—কাম—রেস্টুরেন্ট। রাত দশটা বেজে গেছে, তবু এখানে লোকজনের আনাগোনার কমতি নেই। কেননা অন্যান্য জায়গার চেয়ে এর আকর্ষণ অনেক বেশি। অবশ্যই সেটা ছলিয়ার কারণে।

এখানকার আলো—অন্ধকারের পরিবেশে হঠাৎ করেই সূরযের আবির্ভাব ঘটল। রীতিমতো উত্তেজিত হয়েই প্রায় ঝড়ের বেগে দোতলার খুপরি ঘরটায় এসে ঢুকল সূরয।

ইব্রাহিম তখন কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছিল।

ছলিয়া বসে ছিল একপাশে। সবেমাত্র একজনের পাশবিক অত্যাচারের কবল থেকে মুক্ত হয়ে সে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল।

সূরয ঘরে ঢুকেই বলল, ‘তুই নীচে যা ছলিয়া। তোর জন্য অনেকে অপেক্ষা করছে।’

‘আমি এখন ক্লান্ত।’

‘যা বলছি তাই কর। আমাদের জরুরি কথা হবে এখানে, চলে যা।’

সূরযের এই গলার সঙ্গে ছলিয়া বেশ ভালোরকমই পরিচিত। তাই আর কোনও কথা না বলে সে নীচে নেমে গেল।

ইব্রাহিম বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কী খবর সূরয! তুমি এত উত্তেজিত কেন? কোনও খারাপ খবর?’

‘সে কোথায়?’

ইব্রাহিম সূরযের চোখের দিকে তাকাল।

সূরয ভারী গলায় বলল, ‘কোথায় রেখেছ তাকে?’

ফোন রেখে ইব্রাহিম বলল, ‘কার কথা বলছ?’

‘সোমা নন্দীর কথা বলছি।’

‘তুমি কি করে জানলে? ওই শয়তান মেয়েটি বলে দিয়েছে বুঝি? আসুক সে একবার।’

‘সে আর কোনও দিনই আসবে না ওস্তাদ।’

‘তার মানে? কাল সেই যে গেল, সারাদিনে আজ আর দেখা নেই। ব্যাপারটা কী?’

‘আমি তাকে গুলি করেছি।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ইব্রাহিম, ‘ইউ স্কাউন্ড্রেল!’

‘তার বডি এখন পুলিশের হেফাজতে।’

‘সূরয!’

‘আমাকে ধমক দিয়ে কোনও লাভ হবে না।’

‘কী সাংঘাতিক কাজ করেছ তুমি তা জানো?’

‘জানি। কিন্তু কোনও উপায় ছিল না।’

‘তুমি একটা হোপলেস।’

‘তোমাকে তখনই বলেছিলাম এ—সব খেলা ছাড়ো। তুমি তো শুনলে না। ও একেবারে পুলিশেরই একজন গোয়েন্দা অফিসারকে ব্ল্যাকমেল করতে গিয়েছিল। আমাদের ফাঁদে অন্য কেউ না পড়ে পুলিশের ফাঁদেই আমরা পড়েছিলাম। কাজেই গুলি না করে উপায় ছিল না। না হলে ওকে মোচড় দিয়ে আমাদের সবাইকে ধরে ফেলত।’

‘ঠিক জানো, একেবারে মরে গেছে?’

‘মনে তো হয়। পুলিশের লোকেরা নিয়ে গেছে ওকে।’

‘কী—ভাবে কী হল শুনি?’

সূরয তখন আগাগোড়া সমস্ত ঘটনার কথা খুলে বলল। ইব্রাহিমও এক—এক করে শুনল সব।

সূরয বলল, ‘কাল রাত্রি থেকেই আমি গা ঢাকা দিয়ে আছি।’ তারপর বলল, ‘তুমি কিন্তু সোমা নন্দীর কথা আমাকে বলোনি ওস্তাদ। চুপিসাড়ে কখন কাজ সেরেছ?’

‘বলিনি, তার কারণ তুমি যে—ধরনের শয়তান তাতে সুন্দরী মেয়ের সন্ধান পেলে তার রস নিংড়ে না নেওয়া পর্যন্ত তোমার জ্ঞান থাকে না। এতে আমার ব্যবসার ক্ষতি হয়। অথচ তুমিই আমার ডান হাত। এখন তুমি যদি ওকে নিয়ে মেতে থাকো তা হলে আমি ক’দিক সামলাব?’

‘তুমি একটা নপুংসক, আর ওই মদনলালটাও। টাটকা টাটকা মেয়েগুলোকে নিয়ে আসা মাত্রই পাচার করে দাও। ভুলেও একবার চেখে দেখো না। তোমরা শুধু টাকাই চিনেছ, লাইফটাকে এনজয় করতে শেখোনি।

আসলে তুমি নিজে একটা বিকারগ্রস্ত যুবক, না হলে এত মেয়ের সঙ্গ করেও তোমার লোভ যায় না! কেন যে তোমাকে রোগে ধরে না তাই ভাবি। যাক, টাকার কথা যখন বললে তখন শোনো। কাল বিকেলে যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন একটা ফোন এসেছিল, মনে আছে?’

‘ফোন তো যখন—তখনই আসে।’

‘ওই মেয়েটির দাম উঠেছিল দেড় লাখ টাকা। আমি দু’লাখ চেয়েছিলাম। এখন দেখছি এইসব গোলমালের পর আর বেশিক্ষণ নিজেদের কাছে রাখা ঠিক হবে না মেয়েটিকে। দেড় লাখেই দিয়ে দেব।’

সূরয গম্ভীর গলায় বলল, ‘মেয়েটিকে কোথায় রেখেছ?’

‘জেনে তোমার লাভ?’

‘লাভ—লোকসানের হিসেব পরে করবে। এখন বলো কোথায় রেখেছ মেয়েটিকে?’

‘ওকে খড়দার বাড়িতে গঙ্গার ধারে আন্ডারগ্রাউন্ডে রেখেছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাবছি পাচার করে দেব।’

‘ও—কাজের ভারটা আমাকে দাও। তুমি এখুনি ছলিয়াকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও গা ঢাকা দাও। নীচের লোকজনদের বিদায় দিয়ে এখুনি তালা মারো। পুলিশ যে—কোনও সময় এসে যেতে পারে।’

‘এইরকম ব্যাপার নাকি?’

‘হ্যাঁ, এইরকমই ব্যাপার। ভাগ্য ভালো যে এখনও পুলিশ আসেনি। তবে আসবে। রিনা যদি সত্যি সত্যিই মারা না যায় তাহলে কিন্তু সমূহ বিপদ। ওর মুখ থেকে ঘাঁটির সন্ধান পেয়ে যাবে পুলিশ।’

ইব্রাহিম এবার বিপদের আঁচটা অনুমান করতে পারল। বলল, ‘তুমি যদি একবার আমাকে ফোনেও জানাতে।’

‘আমার অত সময় ছিল না। কাল রাত্রি থেকে আজকের সারাটা দিন যে আমি কী—ভাবে আত্মগোপন করেছিলাম তা তুমি ধারণাও করতে পারবে না। এখন এ—সব কথা থাক। গুলি আমি করেছি এবং সেটা লেগেওছে মোক্ষম জায়গায়। তবু ওর মৃত্যুর ব্যাপারে এখনও আমি কোনও পাকা খবর পাইনি।’

‘মেয়েটা মরে গেলে বিপদের আশঙ্কাটা থাকে না। যদি বেঁচে যায় তা হলে সত্যিই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

‘বেঁচে গেলে আমাদের কারও রেহাই নেই। অবশ্য ও মরে গেলেও পার পাব না আমরা। কেননা যে অফিসার রিনাকে কবজা করেছে সে যদি আমাকে দেখে থাকে তাহলে আমার পিছনে লোক লাগাবেই। তাই এখনই সরে পড়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।’

কথা শেষ করেই সূরয হঠাৎ নেমে গিয়ে সিঁড়ির নীচে মেন স্যুইচটা অফ করে দিয়ে এল।

অন্ধকারে ভরে গেল চারদিক।

ইব্রাহিম বলল, ‘হঠাৎ করে এ কীর্তি করলে কেন?’

‘প্রয়োজন ছিল। নীচের অতিথিদের তাড়াতে হবে তো।’

‘তুমি একটা ইডিয়ট।’

ইব্রাহিমের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠল সূরয, ‘পুলিশ! পুলিশ!’

ব্যাস, চোখের পলকে সব ফাঁকা।

ইব্রাহিম ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর রুষ্ট স্বরে বলল, ‘কোথায় পুলিশ? ঢপ দেবার জায়গা পাওনি?’

সূরয হো—হো করে হাসল একবার। তারপর বলল, ‘এই অন্ধকারের ভেতর দিয়েই রেড অ্যালার্ট জারি করে দিলাম। এতদিন ধরে অনেক টাকা কামিয়েছ, এবার বিশ্রাম নাও। পরে অন্য কোথাও অন্য নামে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করা যাবে।’

ইব্রাহিম বলল, ‘একটু ভুলের জন্য সব ওলট—পালট হয়ে গেল।’

সূরয বলল, ‘ভুলের জন্য নয়, তোমার গোঁয়ার্তুমির জন্য। আমি বারবার মানা করেছিলাম এ—সব কাজ না করতে। কিন্তু তুমি শুনলে না।’

ইব্রাহিম রেগে বলল, ‘মেয়েটাকে গুলি করার সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন ছিল?’

‘ছিল। না হলে এতক্ষণ তুমি—আমি দুজনেই পুলিশের লক—আপে থাকতাম।’

‘এখন তাহলে কী করতে বলো?’

‘পালিয়ে যাও। পরে সুযোগ—সুবিধে মতো এসে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে। ছলিয়ার দায়িত্ব তুমি নাও।’

‘আমি? আমি ওর দায়িত্ব নিয়ে কী করব?’

‘তার আমি কী জানি। ওকে কোনও নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দাও।’

‘তুমি তাহলে কী করবে?’

‘আমি সোমা নন্দীর একটা ব্যবস্থা করে তারপর যাব।’

‘না। সোমা নন্দীর ব্যবস্থা তুমি নয়, আমি করব। তুমি এখনই কানপুরের টিকিট কেটে ছলিয়াকে নিয়ে পালাও।’

এখন ট্রেন কোথায়?

‘রাত এমন কিছু বেশি নয়। কানপুরে না হোক, যেখানে খুশি চলে যাও। এখানে থেকো না।’

‘আমি এত বোকা নই যে পুলিশের হাতে মার খাব বলে এখানে পড়ে থাকব। আমার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তোমার গাড়িতে ছলিয়াকে নিয়ে তুমি এখনই ধানবাদের ডেরায় চলে যাও।’

‘দেড় লাখ টাকার পার্টি হাতছাড়া করে কখনোই যাব না আমি।’

‘নিজের নিরাপত্তার চেয়েও কি টাকাটা তোমার কাছে বড় হল? মেয়েটিকে কোথায় পৌঁছে দিতে হবে বলো, কাজ হাসিল করে কালকের মধ্যে টাকা নিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করব।’

‘টাকা মদনলাল নিয়ে যাবে।’

‘কেন, আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না?’

‘বিশ্বাস—অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়, তোমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে, তাই।’

‘ঠিক আছে, তাই হবে। মেয়েটিকে কোথায় কার কাছে পৌঁছে দিতে হবে বলো?’

‘রাত দুটো কুড়ি মিনিটে জোয়ারের জলে নৌকো ভাসিয়ে এমভি অমরাবতীতে পৌঁছে দেবে মেয়েটিকে। মদনলাল আর তুমি। নৌকো বাঁধাই আছে পিলারের সঙ্গে। খুব সাবধানে কাজ করবে। আর একটা কথা, মেয়েটিকে অযথা মারধোর কোরো না যেন।’

সূরয হেসে বলল, ‘কথা না শুনলে দু—চার ঘা দিতে হবে বই কি।’

‘এইজন্যই তো এই কাজের ভার তোমাকে দিই না। সেবার একটা মেয়েকে এমন মেরেছিলে যে তার দাঁত ভেঙে চোখ—মুখ ফুলে…। তোমার জন্য দশ হাজার টাকা কম নিতে হয়েছিল আমাকে।’

এমন সময় ছলিয়া এসে দাঁড়াল সেখানে। ওর চোখে—মুখে বিস্ময়। বলল, ‘কী ব্যাপার! হঠাৎ আলো নেভালে কেন? অযথা পুলিশ পুলিশ করে চেঁচালেই—বা কেন? ব্যাপারটা কী?’

ইব্রাহিম বলল, ‘তুই এখুনি তৈরি হয়ে নে ছলিয়া, পালাতে হবে আমাদের।’

‘কোথায়?’

‘জানি না। নীচের ওরা সব গেছে?’

দু—একজন ফিরে এসেছে আবার।

‘ওদের বিদেয় কর।’

ছলিয়া টর্চের আলোয় পথ দেখে নীচে গেল। তারপর একটু পরেই আবার উঠে এল ওপরে।

ইব্রাহিম বলল, ‘আজ রাতেই এখানে পুলিশি ঝামেলা হতে পারে। তুই রেবা ম্যানসনের ওই নাইটগার্ডের কাছে চলে যা। কাল সকালে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে ধানবাদ চলে যাবি। আমরা ওখানে তোর জন্য অপেক্ষা করব। সেখানেই ঠিক হবে কী—ভাবে কী করা যায়। শ—পাঁচেক টাকা রাখ। বলে একটা বাতি জ্বেলে পাঁচশো টাকা ওর হাতে দিল।’

ছলিয়া বলল, ‘এখানে কে থাকবে তা হলে?’

‘কেউ না। নাথনু ছেলেটাকেও সরিয়ে দেব অন্য জায়গায়।’

‘তার মানে তালা বন্ধ থাকবে?’

‘হ্যাঁ, যে যেখানে আছে সবাইকে বিদায় দেব আজ।’

‘তোমরা যাবে না কেন?’

‘যাব। মেয়েটির ব্যবস্থা করে যাব। আমাদের বাড়িতে তোকে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধে আছে।’

‘রিনাদি কার সঙ্গে যাবে? সে—ও তাহলে আমার সঙ্গে যাক?’

‘না। সে এখন পুলিশের হেফাজতে। সূরযের গুলিতে হয় সে মারা গেছে নয়তো এখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।’

‘তার অপরাধ?’

‘আর কিছু জানার দরকার নেই। আমি নীচে গিয়ে অন্যদের ব্যবস্থা করে আসছি।’

ইব্রাহিম অন্ধকারেই টর্চ হাতে নীচে গেল।

সূরয আর ছলিয়া মুখোমুখি হল।

ছলিয়া বলল, ‘ভালোই হল। এবার এ—সব ছেড়ে দাও। চলো, তুমি আর আমি দুজনেই পালাই এখান থেকে। এ জীবন আর ভালো লাগছে না। চলো আমরা নতুন করে জীবন শুরু করি।’

সূরয গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ওস্তাদ তোকে যেখানে বলছে তুই সেখানেই চলে যা। কাল ধানবাদে তোর সঙ্গে আবার দেখা হবে।’

ছলিয়া এগিয়ে এসে সূরযের একটা হাত চেপে ধরল এবার, ‘না। আমি কোথাও যাব না।’

সূরয ধমকে উঠল, ‘ছলিয়া!’

‘তুমি না কোরো না। তোমাকে আমি কত ভালোবাসি তা তুমি জানো। আমার অনেক দিনের সাধ তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার। এইভাবে পুলিশের তাড়া খেয়ে ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়? তোমাদের কথাবার্তা আমি সব শুনেছি। আসলে তুমি ওই মেয়েটিকে নির্যাতন না করে যাবে না। কী হবে সূরয ওইসব করে? অনেক তো করলে। ওতে কী সুখ পাও তুমি?’

‘তুই যাবি?’

‘কেন, আমি কি পারি না তোমার খিদে মেটাতে? চলো ওকে বরং মুক্তি দিয়ে আমরা দূরে কোথাও চলে যাই। এমন সুযোগ আর হবে না কিন্তু।’

‘মেয়েটিকে দেখেছিস তুই?’

‘মেয়ে! একজনের স্ত্রী।’

‘সে যাই হোক, দেখেছিস কি না বল।’

‘আমিই তো গিয়ে তার খাবার দিয়ে আসি।’

‘ওর কথা তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন?’

‘সময় পেলাম কখন?’

‘কালও তো বলতে পারতিস।’

‘ইচ্ছে করেই বলিনি। বললে তুমি যা করতে তা আমি জানি। তাছাড়া মেয়েরা যাকে ভালোবাসে তারা কি পারে তার মনের মানুষকে আর কারও কাছে যেতে দিতে? আমিও তাই পারিনি। ওর কথা বললেই তুমি ও—দিকে যেতে। তাছাড়া বসেরও নিষেধ ছিল।’

‘বুঝেছি।’

‘কী বুঝেছ?’

‘কী বুঝেছি?’ বলেই ঠাস ঠাস করে বেপরোয়ার মতো ছলিয়ার গালে এলোপাথাড়ি চড় মারতে লাগল সূরয। রেগে বলল, ‘তোর ভালোবাসার কাঁথায় আগুন। কে চায় তোর ভালোবাসা?’

সূরযের মার খেয়ে ছটফট করতে লাগল ছলিয়া। ওর ঠোঁটের পাশ কেটে রক্ত ঝরতে লাগল।

এমন সময় একটা লণ্ঠন হাতে ওপরে উঠে এল ইব্রাহিম। ছলিয়ার অবস্থা দেখে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। হুঙ্কার দিয়ে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সূরযের ওপর।

কিছুক্ষণ দুজনের প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি। তারপর কিছু সময়ের মধ্যেই ইব্রাহিমকে মাটিতে ফেলে তার বুকের উপর চেপে বসল সূরয। হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে আঘাত করতে লাগল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইব্রাহিম আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগল। সূরয ওর গলাটা শক্ত করে টিপে ধরল এবার। প্রথমটা একটু ছটফট করল ইব্রাহিম, তারপর স্থির হয়ে গেল।

রণক্লান্ত সূরয উঠে বসল ওর বুকের উপর থেকে, তারপর ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল।

কিন্তু ছলিয়া কই? ছলিয়া? এই ফাঁকে সে কখন কোথায় কেটে পড়ল?

ওকে দু—একবার ডেকেও যখন সাড়া পেল না তখন অন্য একটা আশঙ্কায় ওর মন সজাগ হয়ে উঠল।

ছলিয়াটা বেইমানি করবে না তো? অর্থাৎ ও গিয়ে মুক্তি দিয়ে বসবে না তো মেয়েটিকে?

এ—কথা মনে হতেই ওর মন উত্তেজিত হল। নীচে নেমেই দেখল সব ফাঁকা, এমনকি বাইরে বেরোনোর পথও বন্ধ। তার মানে ওকে এখানেই আটকে রাখতে চায়। তাই দরজায় তালা দিয়ে ওকে বন্দি করে পালিয়েছে ছলিয়া। তাহলে ওর আশঙ্কাটাই ঠিক।

সূরয একটুও দেরি না করে ছাদে এসে উঠল। তারপর আলসে টপকে কার্নিশে ঝুলে লাফিয়ে নামল পাশের ছাদে।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। নিমেষে এ—ছাদ ও—ছাদ করে নেমে এল মুক্তির আলোকে। তারপর গলির মোড়েই ধরে নিল একটা ট্যাক্সিকে।

ড্রাইভার সূরযের দিকে তাকালে সূরয বলল, ‘খড়দা।’

এই সময় রাস্তায় জ্যামজট থাকে না বললেই হয়, তাই ঝড়ের গতিতে ছুটে চলল ট্যাক্সিটা।

বিটি রোড ধরে যেতে যেতে সিঁথির মোড়ে আসতেই সূরয বলল, ‘রোখো।’

ড্রাইভার রাস্তার ধারে গাড়ি থামালে সূরয ওর পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে ড্রাইভারে হাতে দিয়ে বলল, ‘ভাই, যদি কিছু মনে না করেন তো ওই সামনের দোকান থেকে পঞ্চাশ টাকার সন্দেশ নিয়ে আসুন তো। দুজনে খেতে খেতে যাই। ওই দোকানের সন্দেশ খুব ভালো। তবে ওদের সঙ্গে একবার আমার একটু চটাচটি হয়ে গেছে, তাই যাচ্ছি না। এ—দিকে খিদেও পেয়েছে খুব।’

ড্রাইভার একগাল হেসে সরল বিশ্বাসে সন্দেশ আনতে চলে যেতেই সূরয ড্রাইভারের আসনে বসে গাড়ি নিয়ে উধাও।

বেশ খানিকটা আসার পর এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে অন্য একটা গাড়ির নাম্বার প্লেট নিজের গাড়িতে লাগিয়ে এই গাড়ির নাম্বার প্লেট সেটাতে লাগিয়ে দিল। তারপর মনের আনন্দে শিস দিতে দিতে আবার এগিয়ে চলল ঝড়ের গতিতে।

মনে মনে ভাবল ছলিয়া যাবার অনেক অনেক আগেই ও পৌঁছে যাবে খড়দাতে। কেননা এত রাতে পরিবহন কমে গেছে অনেক। নেই বললেই চলে। ছলিয়া ট্যাক্সি করে গেলেও ওর আগে ও পৌঁছবেই। অথবা ছলিয়া পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই ও—ও গিয়ে হাজির হবে। ছলিয়া যতই চেষ্টা করুক না কেন সোমা নন্দীকে ও মুক্তি দিতে পারবে না। সূরযের রাহুগ্রাস থেকে সোমা নন্দীর মুক্তি নেই।

ডানলপ ব্রিজ পার হয়ে একটা পেট্রল পাম্পে বেশ কিছুটা পেট্রল ভরে নিল সূরয। গাড়ি ছিনতাই করে তেলের অভাবে যেন বিপদে পড়তে না হয়। ওর এই পথযাত্রা যে কোথায় শেষ হবে তা ও নিজেই জানে না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে কিছুই করে না সূরয। রিনার কথা ভেবে মনটা বারেকের জন্য খারাপ হল ওর। ইব্রাহিম ওর কথা শুনলে এ—ভাবে মরতে হত না রিনাকে। এখন ইব্রাহিমেরও খেলা শেষ।

জোরে ট্যাক্সি চালিয়ে যেতে যেতে সূরয ভাবল তেমন বুঝলে এই গাড়িতেই সোমা নন্দীকে উঠিয়ে নিয়ে ও পালাবে। মেয়েটি যদি সত্যই রমণীয়া হয় তাহলে কিছুতেই ওকে মদনলালের মারফত অন্যের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। কিন্তু মদনলাল কোথায়? সে কি সবার আগে পৌঁছে গেছে? গিয়ে থাকলেও আজই ওর শেষ রাত। মদনলালকে খুন করে খুনের সংখ্যা তিন করবে। ছলিয়াকে পাত্তাই দেবে না। বরং ওকেই ঘা কতক দিয়ে তালাবন্ধ করে রাখবে একটা ঘরে। তারপর মোকাবিলা করবে সোমা নন্দীর। ওকে নিয়ে চলে যাবে অনেক দূরে। বেশ কয়েক দিন ভোগসুখের পর সিদ্ধান্ত একটা নিজেই নেবে। এখন ভালোয় ভালোয় পৌছে যাওয়ার অপেক্ষা।

খড়দহে গঙ্গার ধারে সচরাচর কারও নজরে পড়বে না এমন একটি জায়গায় ট্যাক্সিটাকে রেখে চারদিক একবার ভালো করে দেখে নিল সূরয। এই রাতে শুনশান চারদিক। তবু সাবধানের মার নেই। এখানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে সেই বাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বাড়িটা রাস্তা থেকে দেখলে মনে হবে একতলা। কিন্তু এটাই আসলে দোতলা। কেননা গঙ্গার গর্ভ থেকে গাঁথনি দিয়ে তোলা হয়েছে বাড়িটাকে। নীচের ঘরটায় তাই সচরাচর চোখ পড়ে না। এটাই আন্ডারগ্রাউন্ড। সুন্দরী সোমা নন্দী ওখানেই আছে।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা দূরে নিক্ষেপ করল সূরয। তারপর ধীরে ধীরে এগোতে লাগল বাড়িটার দিকে।

একটা বামনের মতো অদ্ভুত চেহারার লোক এগিয়ে এল অন্ধকারের দিক থেকে। সূরযকে দেখেই সেলাম জানাল।

সূরয বলল, ‘মদনলাল আয়া?’

‘নেহি তো।’

‘ছলিয়া?’

‘দু’পহর মে আয়া থা।’

ছলিয়া আসেনি শুনে ও অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। কেননা ছলিয়া এলেই পালাবার সুযোগ করে দিত সোমা নন্দীর। সূরযের সমস্ত উদ্যম নষ্ট হয়ে যেত।

সূরয বলল, ‘যাও, চাবি লে আও।’

বামনটা চাবি নিয়ে এল।

‘এক জেনানা হ্যায় অন্দর মে?’

‘হ্যায়। লেকিন উয়ো কুছ ভি খাতা নেহি। দিনভর স্রেফ রোতা।’

সূরয বলল, ‘ঠিক হ্যায়। তুম তুরন্ত ভাগো হিঁয়াসে। মুলুক চলা যাও।’

‘কাহে কো বাবুজি? ইতনি রাত মে!’

‘পোলিশবালেকো ইয়ে আড্ডা কা পতা চলা গিয়া। হাম সবকো অ্যারেস্ট করেগা। পোলিশ আনেবালা হ্যায় আভি।’ বলে ওর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল।

বামনটা একটুও দেরি না করে টুকিটাকি জিনিসপত্তর যা কিছু ছিল ওর, তাই নিয়ে চোখের পলকে গা ঢাকা দিল।

বামনটা চলে গেলে দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢুকল সূরয। তারপর দরজাটা বন্ধ করে খিল আঁটল।

ঘর থেকে দালানে এসে মেঝেয় পেতে রাখা একটা কার্পেট সরাতেই সে আংটা লাগানো একটা কাঠের ডালা দেখতে পেল। এ—সবই ওর জানা। পরিচিত। বহুবার এ বাড়িতে এসে আত্মগোপন করেছে। ফুর্তি করেছে। আইডিয়াল প্লেস একটা।

ডালাটা তুলতেই ধাপে ধাপে নীচে নামার সিঁড়ি দেখতে পাওয়া গেল। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই আবার একটা ঘরের দরজায় শিকলে তালা লাগানো দেখতে পেল। সেই ঘরের তালা খুলে সে ভিতরে ঢুকল। তারপর আস্তে আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে খিল দিল।

খুব কম পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছিল ঘরের ভেতর। সেটা নিভিয়ে একটু জোরালো আলোয় ঘরটাকে ভরিয়ে তুলল সূরয।

ঘরের ভেতর তক্তপোশের ওপর পুরু গদির বিছানায় এক ভয়ার্ত রমণী হাঁটুতে মুখ গুঁজে এলো চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে বসে বসে কাঁদছিল। কান্নার আবেগে ফুলে ফেঁপে উঠছিল তার দেহটা। সূরয একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে—দিকে। শুধু তাকিয়ে থাকা নয়, রীতিমতো আশ্চর্যও হল। কেননা স্বর্গীয় সৌন্দর্যের এমন রমণীয়া প্রকাশ আর কোনও নারীর মধ্যে সে কখনও দেখেনি।

আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সচকিত হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকাল রমণী। তারপর তক্তপোশের ও—ধারে গিয়ে সে সরে বসল।

সূরযের চোখ দুটো শিকার দেখে চকচকিয়ে উঠল।

সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ভীতা হরিণীর মতো আর একটু সরে তক্তপোশ থেকে নেমে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল রমণী। অর্থাৎ অপহৃতা সোমা নন্দী। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কে তুমি?’

সূরয সে—কথার উত্তর না দিয়ে শয়তানের হাসি হেসে এক পা এক পা করে তার দিকে এগোতে লাগল।

সোমা নন্দীও সূরযের চোখে চোখ রেখে বুঝল এই শয়তান দস্যুর কবল থেকে আজ ওর নিস্তার নেই। তবুও কঠিন গলায় বলল, ‘খবরদার এগিয়ো না আমার দিকে। প্রাণ থাকতে আমার এই দেহ আমি কাউকে নিতে দেব না।’

সূরয তেমনই হেসে বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে দেব বলে তো আমরা এখানে নিয়ে আসিনি। আমরা যাকে ধরি তাকে ছাড়ি না।’

‘তুমি কি আমার উপর জোর করবে?’

‘রাজি না হলে বাধ্য হব।’

সোমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল এবার, ‘তোমার দুটি পায়ে পড়ি। আমার অনিষ্ট কোরো না। দয়া করে ছেড়ে দাও আমাকে।’

সূরয বলল, ‘হাঁ, ছেড়ে তোমাকে দেবই। দিতে বাধ্য হব। এই বাঘের গুহায় ঢুকে আজ পর্যন্ত কেউই ছাড়া পায়নি। একমাত্র তুমিই পাবে। সত্যই তুমি ভাগ্যবতী। কেননা এখনকার পরিস্থিতিতে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই। পুলিশ আমার পিছু নিয়েছে। আমাদের গ্যাং ছত্রভঙ্গ হয়েছে। পুলিশ হয়তো এই মুহূর্তে এখানেও এসে পড়তে পারে। তাই ছেড়ে তোমাকে দেবই। তবে একটা শর্তে।’

‘কী সেই শর্ত?’

‘আমার হাতের মুঠোয় এসে কোনও নারী আজ পর্যন্ত রেহাই পায়নি। তুমিও পাবে না।’

‘তাহলে জেনে রাখো আমি কিন্তু অন্য মেয়েদের মতো নই।’

‘তুমি ভুল করছ সুন্দরী। সামান্য একটু জেদ বজায় রাখতে গিয়ে তুমি কিন্তু সর্বস্ব হারাবে। তোমার প্রিয়জন, তোমার স্বামী, তোমার সতীত্ব এবং তোমার অমূল্য জীবন। তোমার ওপর বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হলে তুমি কিন্তু প্রাণে বাঁচবে না।’

‘বাঁচতে আমি চাই—ও না।’

‘তুমি কি মনে করো আমি তোমার কিছুমাত্র ক্ষতি না করেও তোমাকে ছেড়ে দিলে তোমার স্বামী বা স্বজনদের বিশ্বাস তুমি ফিরে পাবে?’

‘জানি না।’

‘তুমি ফিরে গেলে এক—দশ—নয় উনিশের হিসেবটা হয়তো ঠিক থাকবে কিন্তু দুয়ে শূন্য ‘বিষ’ হয়ে যাবে। বিশ হবে না। আর তোমাকে আগের মতো কেউ বিশ্বাস করবে না।’

সোমা স্তব্ধ হয়ে গেল। এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল ওর বুকের ভেতরটা। সত্যিই তো, এই শয়তান যা বলছে তার এক বর্ণও মিথ্যে নয়।

সূরয বলল, ‘এখনও ভেবে দেখো কী করবে।’ বলে ঘরের একপাশের ছোট্ট দেওয়াল আলমারি থেকে এক বোতল মদ বের করল। নিয়ে ঢকঢক করে গিলতে লাগল।

সোমা অসহায় ভাবে কিছুক্ষণ সূরযের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ভেবে দেখলাম।’

সুরষ বলল, ‘কী ভেবে দেখলে?’

‘আমি রাজি।’

সুরষ হেসে বলল, ‘এই তো বাধ্য মেয়েটির মতো কথা বলছ।’

সোমা বলল, ‘তোমার কাছে পিস্তল আছে?’

‘আছে। হঠাৎ পিস্তলের খোঁজ কেন?’

‘আমার শরীরের দখল নেওয়ার আগে তুমি আমার বুকে একটা গুলি করবে। আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ব। তখন তুমি আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারো। আমি একটুও বাধা দেব না।’

‘বুঝেছি। সোজা আঙুলে ঘি তাহলে উঠবে না। তোমার মতো অবাধ্য মেয়েকে পোষ কী করে মানাতে হয় তা আমি জানি। ওই যে দেখছ আলমারিটা, ওর ভেতরে শিশি ভর্তি ক্লোরোফরম আছে। রুমালে ঢেলে তোমার নাকে যদি চেপে ধরি তারপরেও কি পারবে তোমার সতীত্ব রক্ষা করতে?’

‘কিন্তু তোমার কথায় বিশ্বাস করে তোমাকে আমার দেহটা দিলেই কি পারব আমি এই শত্রুপুরী থেকে বেরিয়ে যেতে? তোমরা প্রতারক। আমার স্বামীর মিথ্যা দুর্ঘটনার খবর দিয়ে আমাকে অপহরণ করেছ তোমরা। এখন এইসব বলে তুমি আমার সর্বনাশ ঘটিয়ে চলে যাবার পর যে আর একজন এসে ওই কাজ করতে চাইবে না তাই—বা কে বলতে পারে? কাজেই কোনও প্রতারণায় আমি ভুলছি না। আমার ডেডবডির ওপর তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আমি দিলাম। কিন্তু জীবিত দেহের আশা তুমি ত্যাগ করো।’

‘এইসব কথা এই ঘরে বসে তোমার মতো অনেক মেয়েই বলে গেছে এর আগে। ঠিক একই কথা। এখন তারা দেশ—বিদেশের নিষিদ্ধ পল্লীতে নীরবে বাধ্য মেয়েটির মতো একের পর এক ক্ষুধার্ত পুরুষের কাছে দেহ দান করছে। এখানে একবার এই চক্রে এসে পড়লে আর ফিরে যাবার পথ থাকে না। শুধু তুমিই একমাত্র সৌভাগ্যবতী যাকে ওই কাজ অন্তত করতে হবে না। কেননা তোমাকে পাচার করে দেবার মতো সময় আমরা পাব না। অতএব দেরি না করে রাজি হও। না হলে বাধ্য হব আমি অন্য উপায় দেখতে।’

সোমা স্থির। চোখের সামনে ওর চরম সর্বনাশের কালো ছায়া দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল যেন।

সূরয দেরি করল না। এক লাফে তক্তপোশের ওপরে উঠে দেওয়ালেরগা থেকে সজোরে টেনে আনল সোমাকে। তারপরে বিছানায় শুইয়ে বুকে চাপ দিতেই মরিয়া হয়ে ওর একটা হাত কামড়ে দিল সোমা।

যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল সূরয। কী গভীর ভাবে দাঁত বসে গেছে হাতের মাঝখানে। ওর বজ্রমুষ্টি সহসা শিথিল হয়ে এল।

সেই সুযোগে সোমা ছিটকে পড়ল তক্তপোশ থেকে। তারপর সূরযের আধখাওয়া বোতলটা তুলে ছুড়ে মারল সূরযের মাথা লক্ষ করে।

সূরয চকিতে মাথাটা সরিয়ে নিল।

বোতলটা সজোরে দেওয়ালে লেগে চুরমার হয়ে গেল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কাচের টুকরো।

সোমা পাগলিনীর মতো ছুটে গেল দরজার কাছে। গায়ের জোরে খিলটা খুলতে গিয়েই বাধা পেল।

সূরয ততক্ষণে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। ভয়ঙ্কর আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে সোমাকে টেনে আনল সূরয। তারপর ওকে তক্তপোশের উপর প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেই ভাঙা বোতলের ছুঁচলো মুখটা তুলে আনল সূরয। ওর চোখ দুটো কী সাংঘাতিক রকমের হিংস্র হয়ে উঠেছে। সেটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, এটা দিয়ে তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে, তাই না? এখন আমিই এটা তোমার পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেব? একটু একটু করে এটা তোমার পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে যদি মোচড় দিতে থাকি তাহলে দেখবে তোমার ভিতরের মাল—মশলাগুলো কেমন ননীর মতো বেরিয়ে আসবে। দেব?

ওই নিষ্ঠুর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর আশঙ্কায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল সোমার মুখ। ও প্রচণ্ড ভয় পেয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। আতঙ্কে নীল হয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘না না না!’ ওর সারা শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। কোনও রকমে শেষবারের মতো বাঁচবার জন্য উঠে দাঁড়াতে গিয়েও ধপ করে বসে পড়ল। ওর আর বাধা দেবার কোনও শক্তিই রইল না।

অনেক পরে সমস্ত উত্তেজনার শেষ হলে সোমাকে মুক্তি দিল সূরয।

আর সোমা? ওর অসংলগ্ন বেশবাস ঠিক করে কোনও রকমে উঠে বসে একভাবে তাকিয়ে রইল সূরযের দিকে। এই সুন্দর সুঠাম পুরুষের কামনার আগুনে দগ্ধ হয়ে সে নিজেই যেন নিজেকে হারাল। পুরুষের সব অত্যাচারই অত্যাচার নয়, কখনও—সখনও মধুময়ও হয়ে ওঠে। এই মত্ত মাতঙ্গের দাপটে দলিত মথিত হয়ে যেন এক অন্তহীন সুখের সাগরে ভেসে গেল সোমা। মিলনে যে এত সুখ, এর আগে সে এমন গভীরভাবে কখনও অনুভব করেনি। সত্যি কথা বলতে কী, এত সুখ ওর স্বামীর কাছেও সে পায়নি কখনও। সেখানে যা কিছু ঘাটতি ছিল তার সবই পূরণ করে দিল এই দুষ্টু দানব।

সূরয নিজেও কেমন যেন অভিভূত। সে ভেবে পেল না কী আছে এই রমণীর শরীরে যার ছোঁয়ায় তার দেহ—মন মোহিত হয়ে গেল! যৌবনের এমন অফুরন্ত ভাণ্ডারের খোঁজ এর আগে সে আর কারও মধ্যে পায়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই, সোমা নন্দীর চোখের ভাষা যেন অন্য কথা বলছে। সেখানে কোনও রাগ নেই, ঘৃণা নেই। শুধু তাই নয়, ওর চোখে—মুখে গভীর প্রসন্নতা। সোমার এই অভাবনীয় পরিবর্তনে বিস্মিত হল সূরয। এ—ও কী সম্ভব!

এমন সময় দরজায় প্রচণ্ড করাঘাত।

সচকিত হল দুজনেই।

ছলিয়ার গলা শোনা গেল, ‘খোলো, খোলো, দরজা খোলো। শিগগির দরজা খোলো।’

সূরয দ্রুত গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।

ছলিয়া ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘তুমি এসে গেছ? এখুনি এখান থেকে চলে যাও সূরয। আর এক মুহূর্ত এখানে থেকো না। ঘাটে নৌকো বাঁধা আছে। মাঝগঙ্গায় নৌকো ভাসাও।’

সূরয বলল, ‘আমি তো বাইরের দরজা লক করে এসেছিলাম। তুই কী করে ভিতরে ঢুকলি?’

‘এখানে আসার অন্য একটা গুপ্ত পথ আমার জানা আছে। আর দেরি না করে এখুনি পালাও তুমি।’

‘কেন? পালাব কেন? যাবার যখন সময় হবে তখন ঠিকই যাব।’

‘পুলিশ! এখুনি পুলিশ আসছে সোমা নন্দীকে উদ্ধার করতে।’

‘পুলিশ কী করে খবর পেল? নিশ্চয়ই তুই খবর দিয়েছিস পুলিশকে?’

‘হ্যাঁ, আমিই দিয়েছি। আমি চাই এই চক্রান্তের জাল ছিন্ন হোক। তোমাদের প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া পড়ুক। তাই ফোনে আমি সব কথা জানিয়েছি পুলিশকে। আমি জানতাম দরজায় শিকল লাগিয়ে তোমাকে আটকে রাখতে পারব না। তুমি ঠিকই এখানে আসবে। তাই তোমাকে সাবধান করতে এলাম। তোমাকে আমি জেলের ঘানি টানতে দেব না। তোমাকে ঘিরে আমার অনেক আশা। আমার স্বপ্ন তুমি সফল করো সূরয। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।’

সূরয বলল, ‘আমি সেটা জানি। তাই বারবার না বললেও হবে। এতদিনে তোর সেই ভালোবাসার প্রতিদান আমি দেব রে ছলিয়া।’

আবেগমথিত গলায় ছলিয়া বলল, ‘সত্যি বলছ?’

‘সত্যি না তো কি মিথ্যে? যা তাড়াতাড়ি গিয়ে ওপরের ঘরের দরজাগুলো ভালো করে খিল এঁটে বন্ধ করে দিয়ে আয়।’

‘সে—কাজ আমি আগেই করে এসেছি।’

‘তবু যা। আর একবার দেখে আয় ভালো করে। বলা যায় না তো, যদি ভুল হয়ে গিয়ে থাকে তাড়াতাড়িতে।’

ছলিয়া সূরযের কথা মতো এ ঘরের দরজার খিল খুলে ওপরে উঠতে গেল। কিন্তু যেতে আর হল না তাকে। ততক্ষণে সূরযের রিভলবারের গুলিতে করুণ একটা আর্তনাদ করে সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়ল ছলিয়া। ওর দেহটা বারেকের জন্য কেঁপে উঠেই নিথর হয়ে গেল।

রিভলবারটা যথাস্থানে রেখে দরজায় খিল দিয়ে সোমার মুখোমুখি দাঁড়াল সূরয। বলল, ‘বিদায় সোমা নন্দী। আমি বলেছিলাম আমার কাজ শেষ হলেই আমি তোমাকে মুক্তি দেব, এখন মুক্তি দিলাম। একটু পরেই পুলিশ এসে তোমাকে উদ্ধার করবে। আমার এই রিভলবারের আর একটা গুলি তোমার জন্যও খরচ করতে পারতাম কিন্তু করলাম না। তুমি আমাকে এই সামান্য কিছুক্ষণের জন্য যে চরম আনন্দ দিয়েছ তা এর আগে আর কোনও নারী দিতে পারেনি। সে—জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। গুড বাই।’ বলে বিদায় অভিনন্দন জানিয়ে গঙ্গায় যাবার সিঁড়ির দরজার দিকে এগোতেই সোমা ওর একটা হাত শক্ত করে ধরে টান দিল, ‘শোনো।’

থমকে দাঁড়াল সূরয, ‘কী ব্যাপার!’

সোমা করুণ ভাবে বলল, ‘একা তুমি কোথায় যাবে? আমাকে নিয়ে যাবে না?’

‘তোমাকে? তোমাকে কোথায় নিয়ে যাব আমি? আমি তোমাকে বরাবরের জন্যই মুক্তি দিয়ে গেলাম।’

সোমা দু’হাতে সূরযের গলা জড়িয়ে ধরে ওকে গাড় আলিঙ্গনে বদ্ধ করে বলল, ‘চাই না, চাই না আমি মুক্তি।’

‘কী চাও তুমি তবে?’

‘আমি শুধু তোমাকে চাই।’

সূরয অবাক বিস্ময়ে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

সোমা বলল, ‘তুমিই তো বলেছিলে আমার জীবনে এক—দশ—নয় উনিশের হিসেবটা ঠিক থাকলেও আমার সব কিছু দুয়ে শূন্য বিষ হয়ে যাবে। কিন্তু না, তা তো হয়নি। তোমার জাদুতে আমার সমস্ত গরল অমৃতে ভরে গেছে। মনে মনে তোমারই মতো একজন দামাল পুরুষকে আমি চেয়েছিলাম। তোমার মধ্যে তাকেই আমি খুঁজে পেয়েছি। আর তো তোমাকে ছাড়ব না।’

সূরয স্তব্ধ হয়ে গেল সোমার কথা শুনে। এ—ও কী সম্ভব! তার মতো একজন দুশ্চরিত্র খুনে গুন্ডার জন্য এমন এক রমণীর অন্তরের এই আকুতি যে অভাবনীয়। প্রেম কী বস্তু সূরয জানে না। মায়া—মমতা—করুণার ছিটেফোঁটাও ওর মধ্যে নেই। অথচ এই আকুতি ওকে যেন নিথর করে দিল। কেঁপে উঠল বুকের ভেতরটা।

ওপরের ঘরের দরজায় তখন ঘন ঘন করাঘাত হচ্ছে। দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম প্রায়। ভারী বুটের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। পুলিশ।

সূরযও তখন কেমন যেন আবেগতাড়িত হয়ে আলিঙ্গনে বদ্ধ করেছে সোমাকে। ওর চোখে চোখ রেখে যেন নিশ্চল হয়ে গেছে।

সোমা বলল, ‘এ কী! কী হল তোমার? এখনও দাঁড়িয়ে কেন তুমি? ওই শোনো পুলিশ আসছে। শিগগির আমাকে নিয়ে পালিয়ে চলো এখান থেকে।’

পুলিশ তখন ওপরের ঘরের দরজা ভেঙে ফেলেছে।

সূরয তেমনই নির্বিকার।

‘তুমি কি পাষাণ হয়ে গেলে? ছাড়ো, ছাড়ো আমাকে। আমাকে নিয়ে মাঝদরিয়ায় খেয়া ভাসাও। এসো।’ বলে নিজেই ওর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ওর হাত ধরে টানল সোমা।

নীচের ঘরের দরজাতেও তখন ঘন ঘন করাঘাত হচ্ছে, ‘খোল খোল, দরজা খোল। শিগগির খোল।’ পুলিশের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।

আর দেরি নয়। ওরা ঘাটে যাওয়ার সিঁড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল গঙ্গার কূলে। জোয়ারের গঙ্গা এখন ছল ছল করছে। নাইলনের শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা নৌকোটা ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে। ওরা বাইরে এসে দরজায় শিকল দিয়ে মাঝগঙ্গায় নৌকা ভাসাল। আকাশে শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদ। এই ভরা জোয়ারের উজান স্রোতে সোমা তার রূপ যৌবন অতীত জীবন সব কিছুই যেন গহিন গাঙে ভাসিয়ে দিল। কোন কূলে গিয়ে ভিড়বে ওর তরীখানি তা সে—ও জানে না। ও একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ওর সর্বস্ব হরণকারী সুদর্শন পুরুষ সূরযের দিকে। ওর চোখে চোখ রেখে নিজেকে হারাল সূরযও। নৌকো ভেসে চলল

__

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *