দুধ-রোটি – শুভময় মণ্ডল

দুধ-রোটি – শুভময় মণ্ডল

৪ এপ্রিল ১৮৫৮/মাঝরাত/দামোদর

মায়ের পিঠে প্রথমে ঠেকল তার নাক, তারপর ঠোঁট, তারপর লেপটে গেল তার সারা মুখ৷ কী সুবাস তার মায়ের শরীরে! মায়ের গন্ধ ছাড়া তার ঘুমই আসে না কোনোদিন৷ যত রাতই হোক, মা ঘরে ফিরে বুকের কাছে তার মুখ টেনে নেবে, মায়ের চেনা, খুব চেনা গন্ধে ভরে উঠবে সে, তবে না তার ঘুম আসে৷ আজ এখন অবশ্য সে মায়ের বুকে নয়, পিঠে বাঁধা৷ মায়ের গন্ধ ক্রমশ তাকে মুড়ে নিচ্ছে, এখন অনেক রাত নিশ্চয়৷ তবে কি আবার ঘুমিয়ে পড়বে সে!

ইদানীংকালে খুব দেরি হচ্ছিল মায়ের ঘরে ফিরতে৷ আংরেজদের সঙ্গে বড়ো একটা লড়াই বাধবে নাকি৷ সারাদিন খুব ব্যস্ত তার মা৷ সেদিন হলদি-কুঙ্কুম পরা সেরে মা যখন ঘরে ফিরেছিল, ‘এখনও ঘুমোওনি, দামোদর!’ বলে তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল, মায়ের শরীরে পরবের আঘ্রাণ, হলদি কুঙ্কুম চন্দনের আঘ্রাণ৷ তার কী ভালো যে লেগেছিল! তাকে ঘুম পাড়াতে মা গুনগুন করে একটা গান গাইছিল৷ কী যেন সেই গান-আঁধি এলে প্রদীপগুলো আঁচল দিয়ে আড়াল করো৷ ধুলোর ঝড়ে প্রদীপগুলো যেন না নিবে যায়৷

বসন্ত এলে হলদি-কুঙ্কুম পরব আসে ঝাঁসিতে৷ ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মা বলছিল, এই পরবে বধূরা দেবী গৌরীর কাছে প্রার্থনা করে তাদের স্বামী আর সন্তান যেন অক্ষয় পরমায়ু পায়! সে কি মায়ের সব কথা বোঝে? আবার মা বললে, কেমন করে যেন অনেকখানি বুঝেও যায়৷ এবার ভারি জাঁক হয়েছিল হলদি-কুঙ্কুম পরবে৷ ‘তুমি দেবী গৌরীকে দেখেছিলে দামোদর?’

‘দেখেছি তো৷’

চিমা বাই তাকে নিয়ে গিয়েছিল গড়ের মধ্যে গৌরী দেখতে৷ সিংহাসনের ওপর দেবী গৌরীর প্রতিমা৷ পায়ের কাছে কত কাপড়, গহনা, পট৷ চারদিকে কত ফুল, মালা, পান, সুপারি চন্দন, মিষ্টি৷ শহর ভেঙে বধূরা এসেছিল ঝাঁসি গড়ে৷ সকলে একবার ছুঁয়ে দেখতে চায় তার মাকে৷ ঝাঁসির রানিমাকে৷ সারা পরবের আঘ্রাণ জমে ঘন হয়েছিল মায়ের বুকে পরব থেকে ফিরে মা যখন তাকে ঘুম পাড়াচ্ছিল৷

-‘তুমি মা গৌরীকে প্রণাম করেছিলে, দামোদর?’

সে হেসেছিল৷ হেসে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়েছিল৷ তারপর বলেছিল,-‘তুমি করেছিলে মা?’

-‘করেছিলাম তো৷ প্রণাম করে কী বললাম বলো তো!’

-‘কী?’

-‘বললাম, আমার দামোদর খুব বড়ো হবে৷ ঝাঁসির রাজা হবে৷ আমার মাথায় যত চুল তত যেন তার পরমায়ু হয়৷’ মায়ের চোখ কি ভিজে উঠেছিল!

ক-দিন আগেই সেই সুন্দর দিনটার কথা ভাবতে ভাবতে এই ক-দিন তার কান্না পেয়েছে, পরবের পরই ধুলোর ঝড় উড়িয়ে আংরেজ দুশমন এসে ঘিরে ধরেছিল তাদের শহর ঝাঁসি৷ কামানের গোলায় থরথর করে কাঁপছে গড়, হাভেলি, জানালা, দরওয়াজা৷ গোলা এসে পড়ছে পইঠায়, আঙিনায়, কুয়ায়৷ ধোঁয়া আর আগুন৷ শেষ ক-দিন দিনরাত লড়াই চলেছে টানা! একটু আগে মা এসে তার ঘুম ভাঙিয়েছিল৷

-‘দামোদর! দামোদর! ওঠো৷’ অনেক রাত৷ গুলি-বন্দুকের আওয়াজ থামেনি৷

মা তাকে দোপাট্টায় বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে নেয়৷ তারপর এগিয়ে যায় তার প্রিয় সাদা ঘোড়াটার গলায় আদর করে দেয় মা৷ নীচু স্বরে তাকে ডাকে, ‘সারঙ্গি’!

মা লাফিয়ে ওঠে ঘোড়ার পিঠে৷ মায়ের পিঠে দোপাট্টায় বাঁধা সে৷ মায়ের সঙ্গে আর কয়েকজন ঘোড়সওয়ার৷ সকলকেই সে চেনে৷ সুন্দর, মান্দার, নানা ভোপাতকার, লালু বক্সি . . .৷

‘কুচ!’ মা বলে উঠতেই সারঙ্গি ছুট শুরু করে৷

তারা কি ঝাঁসি ছেড়ে যাচ্ছে! মা একবার থামে৷ কাদের সঙ্গে কী যেন কথা বলে৷ সে নিজের বুকের ধুকপুক শব্দ শুনতে পায়৷ আবার ছুট শুরু৷ এক ঝাঁক ঘোড়ার খুরের শব্দ৷ ছুট যত বাড়ে তার নাক, চোখ, মুখ তত সে চেপে ধরছে মায়ের পিঠে৷

সে কি একবার মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাবে? না, তাকাবে না৷ রাতের আকাশ পুড়ে যাচ্ছে আগুনে৷ সে চোখ বুজে চোখ নামিয়ে নেয় মায়ের পিঠে৷ তার কি কান্না পাচ্ছে? না, সে কাঁদবে না৷

সে কাঁদলে, তার চোখের জলে মায়ের পিঠ একটুও ভিজলে, মায়ের মন এলোমেলো হয়ে যাবে৷

৪ এপ্রিল ১৮৫৮/মাঝরাত/লক্ষ্মীবাই

এখন তিনি আংরেজদের সাল-তারিখে দিব্যি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন৷ কতশত চিঠি চালাচালি করতে হয়েছে ওদের সঙ্গে! কী লাভ হল?

এখন তিনি আংরেজদের সাল-তারিখ . . .৷ দুর্গের উত্তর দিকের ফটকের কাছে এসে সারঙ্গির ঘাড়ে হাত রেখে তিনি মুহূর্তকাল থমকে দাঁড়ালেন৷ আজ ৪ এপ্রিল আঠারো শত আটান্ন৷ তিনি ঝাঁসিতে এসেছিলেন ষোলো বছর আগে৷ ষোলো বছর আগের এক বৈশাখ শেষে৷ তাহলে, আঠারো শত বেয়াল্লিশ সালের মে মাসে৷ বাবা-মায়ের হাত ধরে এসেছিলেন ঝাঁসির রানি হবেন বলে৷ তখন তিনি আংরেজি সাল-তারিখ জানতেন না৷ তখন তো তিনি মণিকর্ণিকা৷ মণিকর্ণিকা তাম্বে৷ এগারো বছরের এক কিশোরী৷ বাবা ডাকত মান্নু বলে৷ এখনও সেই নামে ডাকে৷ ছোটোমা শুধু আদর করে ডাকে মণি বলে৷

ছোটোমা দরওয়াজার কাছে দাঁড়িয়ে৷ এগিয়ে এসে তাঁর মাথায় হাত রেখেছিলেন৷ মাথায় পাগড়িটা কষে বেঁধেছেন তিনি৷ পাগড়িটা একবার খুলব নাকি! ছোটোমার হাতটা মাথায় পেতে? চেপে ধরব একবার ছোটোমার হাতটা আমার মাথার ওপর! না, সময় নেই৷

গুলির আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসছে৷ গড়ের দিকে৷ প্রাসাদের দিকে৷ এই মাঝরাতেও লড়ই চলছে টানা৷ ওদের হানাদারি৷ আমাদের রুখে-দেওয়া৷ কতক্ষণ রুখে দেওয়া যাবে? গতকাল ওরা আমাদের বারুদঘর তাক করে নিখুঁত লক্ষ্যে গোলা ফেলেছে৷ বারুদঘর উড়িয়ে দিয়েছে৷ ওদের কাছে দারুণ জোরি আতশকাঁচ৷ তা দিয়ে গড়ের আশপাশ, জানালা দরওয়াজাও নাকি দেখা যায় অতদূর থেকে৷ আমাদের নেই৷ খুব কাছ থেকে একটা গুলি শিস দিয়ে আড়াআড়ি বেরিয়ে গেল৷ দেখো, তবু সারঙ্গি পা ধুকছে না! শুধু তিরতির করে কাঁপছে ওর চোখের পলক৷ ও খুব সাহসী ঘোড়া৷ ওসব বুঝতে পারছে৷ স-ব৷

চিমা বাই চোখ মুছলেন৷ ডাকলেন, ‘মণি!’

ছোটোমা কাঁদছে৷ আমি কাঁদব না৷ ষোলো বছর পর আজ ঝাঁসি ছেড়ে চলে যাচ্ছি৷ হয়তো আর কোনোদিন ফেরা হবে না৷ তবু আমি কাঁদব না৷ এসেছিলাম যেদিন, তখন দিনের আলো৷ ফুল, মালা, চন্দন, বাদ্যি, রোশনাই ছিল৷ চলে যাচ্ছি, এখন মাঝরাত, চোরের মতো৷ বারুদ, আগুন, গুলি, গোলা, মৃত্যু৷ তবু আমি কাঁদব না৷ এসেছিলাম কনের সাজে৷ চলে যাচ্ছি যখন গায়ে ফৌজি উর্দি৷ আমি কিছুতেই কাঁদব না৷ ফৌজি কাঁদে না৷

আমি ছোটোমার কাছে এগিয়ে গিয়ে শুধু বললাম, ‘বাবাকে দেখো৷ আমি চললাম৷’

আমি ঝাঁসি ছেড়ে যেতে চাইনি৷ কিছুতেই যেতে চাইনি৷ মানুষটা চলে গেল, সামনের অগ্রহায়ণ এলে পুরো পাঁচ বছর৷ এই পাঁচ বছর আমি একা বুক দিয়ে আগলে রেখেছি আমার ঝাঁসিকে৷ গড়ে তুলেছি৷ আমার দামোদর আর ঝাঁসি৷ দু-জনকেই হয়তো আমি সমান ভালোবাসি৷ বুকের দুই পাঁজরের মতো ভালোবাসি৷ আমি ঝাঁসি ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি৷ আংরেজ ঝাঁসি ঘিরে ধরল চোদ্দো দিন আগে৷ আংরেজি সাল তারিখ এখন আমি . . . ২১ মার্চ৷ বারো দিন সমানে লড়াই চলেছে৷ সড়কে, গলিতে, মহল্লায় বাঘের মতো লড়েছে আমার ঝাঁসি৷ গত দু-দিন হল প্রাকার ফাটিয়ে ওরা শহরে ঢুকে পড়েছে৷ বাছ-বিচার না করে মানুষ খুন করছে৷ লুট করছে৷ লুটে বাধা দিলেই খুন৷ আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে বাড়িতে, দোকানে৷ ঝোখানবাগ পুড়ছে, হালওয়াইপুরা পুড়ছে, লুট আর খুনের নেশায় উন্মত্তের মতো ঢুকছে আংরেজ ফৌজ৷ যেন খাঁচা খুলে একপাল নরকের জানোয়ার হামলে পড়েছে তার সাধের ঝাঁসির ওপর৷

এই চোদ্দো দিন আশা-নিরাশার কী ভীষণ ওঠা-পড়া! কখনো আশায় তোলপাড় ঢেউ জেগেছে বুকের ভিতর৷ কখনো হতাশায় পাথর হয়েছে বুক! না, কখনো কোনো অবস্থাতেই লড়াই ছাড়েনি আমার ঝাঁসি!

বাঘের মতো লড়েছে, বাঘের মতো৷ প্রত্যেকটা কামানের গোলার উত্তর কামানোর গোলা দিয়েই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে! কামান দেগে ওরা শহর-ঘেরা দেওয়াল ভাঙতে চাইছে টানা৷ গোলা ফেলছে দুর্গের ওপর, শহরের ভিতর৷ আগে যারা আংরেজ ফৌজে ছিল, এখন আমাদের হয়ে লড়ছে, সেই সিপাহিরা কামানের মাপজোক জানে! গোলা দেখে ওরা কামানের মাপ বলছিল৷ আংরেজি ভাষাতেই বলছিল, এইটিন পাউন্ডার, দশ ইঞ্চি মর্টার, আট ইঞ্চি মর্টার, হাউইৎজার! আমি কামানের মাপ অত ভালো জানি না৷ গঙ্গাধর ভাইয়া জানে৷ এক লহমাও থামেনি আমাদের কামান! কামানের গোলা-বারুদ জোগান দিয়েছে আমার আওরত বাহিনী৷ দুর্গে কোথাও ফাটল ধরলে, মরদদের পাশে দাঁড়িয়ে জানের ঝুঁকি নিয়ে মেরামতির কাজে হাত লাগিয়েছে৷ শেষ ক-দিন পথে নেমে লড়েছে৷ দুনিয়া দেখুক ঝাঁসি কী পারে! মেয়েরা মা হতে পারে, লড়তে পারবে না কেন! সব আমি নিজে হাতে গড়ে তুলেছি আমার ঝাঁসিতে৷ ঝাঁসি ছেড়ে চলে যাওয়া যায়!

চতুর্থ দিন থেকে দুর্গ-দেওয়ালের একটা জায়গাতে আংরেজ দুশমন টানা কামান দাগছিল৷ ওই জায়গাটাই তো সব থেকে দুর্বল৷ ওইখানটাতেই ফাটল ধরানো যায়৷ কিন্তু আংরেজ জানল কী করে! আমি আর কয়েকজন ছাড়া তো কেউ জানে না, দেওয়ালের ওই জায়গাটা দুবলা! আংরেজ জানল কী করে!

গদ্দারি করেছে কেউ৷

কে সেই বিশ্বাসঘাতক?

লক্ষ্ণণরাও, লালুবক্সি বলছিল, দুলুহাজু সেই বিশ্বাসঘাতক৷ দুলহাজু গদ্দার! আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না৷ আমার ঝাঁসির কেউ ঝাঁসির বিরুদ্ধে গদ্দারি করতে পারে৷

আমার ঝাঁসি একা লড়েছে৷ একা! তাঁতিয়া তোপে মদত করতে এগিয়ে এসেছিলেন৷ বড়া সাগর অবধি চলে এসেছিলেন৷ বেতোয়া পার হয়ে তিনি হামলা চালাতে চেয়েছিলেন আংরেজ ফৌজের ওপর৷ তারপর আমার পাশে দাঁড়িয়ে লড়বার জন্যে চলে আসবেন ঝাঁসি৷ ৩১ মার্চ, সাঁঝ নামতেই বেতোয়ার পাড়ে তিনি আগুন জ্বালিয়েছিলেন৷ বিশাল আগুন৷ আগুনের সংকেত! আমি আসছি, আমি আসছি, ঝাঁসির পাশে দাঁড়াতে৷ ঝাঁসির দুর্গ থেকে দেখা যাচ্ছিল, কত দূরে, দূরে জ্বলছে তাঁতিয়া তোপের আগুন-ইশারা৷ সারা ঝাঁসি, উল্লাসে গর্জন করে উঠেছিল৷ তাঁতিয়া তোপে আসছে! অবরুদ্ধ ঝাঁসির পাশে দাঁড়াতে৷

আমার চরেরা খবর এনেছে-দুর্দান্ত লড়েছে নাকি তাঁতিয়া তোপে৷ সারাদিন দুরন্ত লড়াই৷ কখনো পিছু হটেছে রোজ সাহেব, কখনো তাঁতিয়া ভাই৷ শেষ পর্যন্ত হয়নি৷ হয়নি৷

হয়নি৷

হিউ রোজ সাহেব পুরা ফৌজ জড়ো করে তাঁতিয়া ভাইকে হটিয়ে দিয়েছিল৷ বড়াসাগর থেকে তাঁতিয়া ভাই ফিরে গিয়েছিল কালপিতে৷ আবার একা, বিলকুল একা ঝাঁসির লড়াই!

গত পরশু তো খবর এসেছিল-আংরেজ অবরোধ তুলে নিয়ে ফিরে যাবে৷ ওদের গোলা-বারুদের মজুত ফুরিয়ে এসেছে৷ বুকের মধ্যে আবার আশা ফেনিয়ে উঠেছিল৷ অনেকদিন পরে রাতে ঘুমোতে পেরেছিলাম৷ ঘুমোতে যাবার আগে মহালক্ষ্মীর মন্দিরে গিয়েছিলাম৷ তোমার ঝাঁসিকে দেখো মা! মাঝরাতে কেউ আমায় ডেকে তুলেছিল৷ দক্ষিণ বুরুজের দুটো কামান থেমে গেছে! আমি মাঝরাতেই ছুটে গিয়েছিলাম কামানের পাশে৷ রাত জাগায়, গোলার তাপে ধোঁয়ায় গোলন্দাজদের চোখ লাল! তবু তারা লড়াই ছাড়েনি৷ যেন নিজের পাঁজরা খুলেও কামান চালাতে চায়! আবার চলেছিল বোবা হয়ে-যাওয়া কামান৷ আমি ওদের মাথায় হাত রেখেছিলাম৷ ওদের রানিমাকে ওরা বড়ো ভালোবাসে!

ঝাঁসি ছেড়ে চলে যাওয়া যায়!

দুশমন শহরে ঢুকে পড়েছিল৷ দেওয়ালে ফাটল ধরিয়ে শহরে ঢুকে পড়েছিল৷ কিছু ফৌজি শহরে ঢুকে এক-এক করে সব দরওয়াজা খুলে দিচ্ছিল৷ যাতে হু হু করে আংরেজ ঢুকে পড়তে পারে! আমি নিজে ছুটে গিয়েছিলাম ওদের রুখে দিতে৷ আয় দেখি কে আছিস মরদ! হাতের কাছে যাকে পেয়েছিলাম, কাটছিলাম৷ দু-হাতে কাটছিলাম৷

ভোপাতকার আমায় টেনে ধরেছিল৷ ‘রানিমা গড়ে ফিরে চলুন৷ আংরেজ উঁচু থেকে গোলা চালাচ্ছে৷ টিলার ওপর থেকে, দেওয়ালের ওপর থেকে . . .৷ আপনার কিছু হয়ে গেলে ঝাঁসি বাঁচবে না৷ আপনি বাঁচলে ঝাঁসি বাঁচবে! ফিরে চলুন, রানিমা!’

বাঁচবে আমার ঝাঁসি! আমি চলে গেলে, আমার ঝাঁসি বাঁচবে?

শহরে ঢুকে পড়ার পরও ওরা বাড়িগুলো তাক করে গোলা ফেলছিল৷ শহরের সব বাড়িতে নাকি লুকিয়ে আছে আমার ফৌজিরা-ওদের দুশমন৷ মাঝে মাঝেই ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ছিল এক-একটা হাভেলি! এক-একটা হাভেলি, মুহূর্তে ধ্বংশস্তূপ! এইটিন পাউন্ডার৷ ওদের সেই এইটিন পাউন্ডার!

আজই দেখেছি, আজ, একটা হাভেলি ধ্বংশস্তূপ থেকে বেরিয়ে আছে একটা শিশুর দুটো হাত৷ আহা! শেষ মুহূর্তে হয়তো বার হতে চেয়েছিল! পাথর-কাঠের জঞ্জাল থেকে আর একটা শিশুর মুখ! মরা মুখ৷ কী সুন্দর মুখখানা! মাথা-ভরতি চুল! কত বয়স হবে? আমার দামোদরের চেয়ে বয়সে ছোটোই হবে খানিক!

এর নাম যুদ্ধ! যুদ্ধ তো ফৌজিতে ফৌজিতে! দুধের শিশু মরবে কেন? কার পাপে মরছে এত শিশু! আমার বুকটা মুচড়ে উঠল!

এত আগুন এত ধ্বংস, এত মরণ কার পাপে? আমার পাপে? কী পাপ করেছি আমি?

‘নানাজি! নানাজি!’ তিনি ডাকলেন নানা ভোপাতকারকে৷

‘রানিসাহেবা?’ নানাজি ছুটে এলেন৷

‘নানাজি, আমাদের বারুদঘর জ্বলে যাবার পর এখন আমাদের গোলাবারুদের মজুত কেমন?’

‘লড়াই চালানো যাবে, রানিসাহেবা৷’ ভোপাতকার শান্ত গলায় উত্তর দিলেন৷

‘বারুদের কিছুটা একজায়গায় জড়ো করুন৷’

‘কেন?’ নানা ভোপাতকার জিজ্ঞাসা করলেন৷

‘আমি তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াব, আপনারা আগুন ছুঁইয়ে দেবেন৷’

নানাজি মাথা নীচু করে আছেন৷ রানি লক্ষ্মীবাই বলে চলেছেন, ‘কার পাপে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে আমার ঝাঁসি৷ আমার পাপ, আমার! সে পাপ ধুয়ে ফেলতে আমি বারুদের আগুনে নিজেকে আহুতি দিতে চাই৷ আপনারা বারুদে আগুন দিয়ে দুর্গ ছেড়ে চলে যান৷ আমি পুড়ে মরলে আমার ঝাঁসি যদি বেঁচে যায়৷ ঝাঁসির মানুষ যদি রক্ষা পায় . . .’

‘আত্মহত্যার মতো বড়ো পাপ আর নেই রানিসাহেবা৷’ লক্ষ্মীবাইয়ের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠেন ভোপাতকার, ‘সত্যিই যদি আপনার পাপে পোড়ে ঝাঁসি, একটা পাপকে ধুয়ে ফেলতে আর একটা পাপ ডেকে আনবেন? তাতে বাঁচবে আপনার ঝাঁসি?-‘

দু-জনের নীরবতার মাঝখানে শুধু গোলাগুলির শব্দ ছুটে যায়৷

‘ভগবান শংকরের যদি ইচ্ছা হয় ঝাঁসি ধ্বংস হবে, তবে তা হবেই৷ আমি-আপনি রোখবার কে?’ নানাজি বলে চলেছেন, ‘আমি-আপনি বলবার কে, কার পাপে ঝাঁসি পুড়ে যাচ্ছে৷’ খানিকক্ষণ থেমে আবার বললেন নানা, ‘বরং দেব শংকরের ইচ্ছে অন্যভাবে পালন করুন, রানিসাহেবা৷ ঝাঁসি ছেড়ে চলে যান, উত্তর দিকে৷ কালপি শহরে রয়েছেন নানাসাহেব, তাঁতিয়া তোপে৷ তাদের সাহায্য নিয়ে আংরেজদের শেষ করে দিন, তিনজনের মিলিত বাহিনী নিয়ে৷ তারপর বিজয়িনী হয়ে ফিরে আসুন ঝাঁসিতে, ঝাঁসি উদ্ধার করতে৷’

আমি ঝাঁসি ছেড়ে চলে যাচ্ছি!

আজকের রাতটা কী আন্ধেরা! এত আঁধার দেখা যায় না৷ আঁধার রাতই ভালো দুশমনের নজর এড়িয়ে চলে যাবার জন্যে৷

কেঁদো না ছোটোমা৷ কাঁদতে নেই৷

সারঙ্গি ছুটছে৷ উত্তর দরওয়াজার দিকে৷ গুলি চলছে টানা! এত রাতেও৷ শুধু বুক বাঁচালেই হবে না৷ পিঠও বাঁচাতে হবে! আমার পিঠে রয়েছে আমার দামোদর! এখন আর আমার বুক পিঠ আলাদা কিছু নয়! বরং বুকে গুলি নিতে পারি . . .৷

পার হয়ে যাচ্ছি মহালক্ষ্মী মন্দির! এত আঘাত, এত ধ্বংসের পরও আমার ঝাঁসি যেন বেঁচে থাকে মা! ওই মন্দিরেই তাঁর সঙ্গে আমার গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছিল-মহারাজ গঙ্গাধর রাও৷ সেদিন আমি নাকি বলে উঠেছিলাম, গেরোটা শক্ত করে বাঁধো৷ যেন খুলে না যায়! এগারো বছরের মেয়ের মুখে এ কী পাকা কথা! সে গেরো খুলে গেছে পাঁচ বছর আগে৷ আজ ঝাঁসির সঙ্গে আমার গাঁটছড়াও ছিঁড়ে যাচ্ছে নাকি! আমার ঝাঁসি!

পার হয়ে যাচ্ছি ঝাঁসির রঙ্গশালা! মানুষটা বড়ো ভালোবাসত নাটক! নিজে হাতে দাঁড় করিয়েছিল রঙ্গশালা! নাটক আর কিতাব৷ কত কিতাব পুঁথি যে জড়ো করেছিল! কিতাবঘর ফেলে এসেছি প্রাসাদে! আসার সময় একবার তাকিয়েছিলাম৷ সারিসারি কিতাব! যেন সেই মানুষটাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে-মহারাজ গঙ্গাধর রাও৷ আমি তাকে ফেলে চলে যাচ্ছি৷

উত্তর দরওয়াজায় পৌঁছোবার আগেই আমি দলটা কয়েকটা ভাবে ভাগ করে নিলাম৷ নইলে নজরে পড়ে যাব৷ তবু দরওয়াজা পৌঁছোবার আগেই পথ আটকেছিল একদল আংরেজ ফৌজি৷ আমার হাত নিশপিশ করছিল৷ মনে হচ্ছিল কেটে ফেলে দিই সব কটাকে৷ কোমর থেকে পিস্তল বার করে গুলি চালিয়ে দিই!

না বোকামি হবে৷ ওরা অনেক, আমরা তো কয়েকজন৷ আত্মহত্যা হবে৷ ভোপাতকার বলেছেন, আত্মহত্যা পাপ! তা ছাড়া আমার পিঠে আমার দামোদর! এখন আমি মরতে পারি না৷

গলাটা ভারী করলাম, গাঁওবালা মরদদের মতো, তারপর খাঁটি দেশোয়ালি ভাষায় বললাম, পাক্কা বুন্দেলা ভাষায়, ‘আমরা ওরচা-র লোক৷ ওরচায় ফিরে যাচ্ছি৷’ ওরচা ওদের পা-চাটা রাজ্য৷ কী বুঝল কে জানে, ছেড়ে দিল!

তারপর ছুট৷ ঝাঁসির দেওয়াল পার হয়ে ছুট৷ বুকের মধ্যেটা হু-হু করে উঠছে৷ কত পিছনে সরে যাচ্ছে আমার ঝাঁসি৷

শেষ রাতে আমার পুরো দল, পঁচিশ সওয়ার, তিন-শোর বেশি আফগান সেনা আবার আমার সঙ্গে মিলেছে৷

রাতের পর ভোর৷ সকাল৷ আমি লহমাও থামিনি৷ বাহাদুর বটে আমার সারঙ্গি৷ এতটুকু বিরাম চায়নি৷ সকালেই বুঝতে পেরেছি, দুশমন খবর পেয়ে গেছে৷ দুশমন আমায় ছেড়ে দেবে না৷ দুশমন আমার পিছু নিয়েছে৷ ওরা আমায় নজরের মধ্যে পেতেই গুলি চালাচ্ছে৷ এখন আর রাত নয়, চড়া আলোর দিন৷ এখন আমি ওদের নজরের নাগালের মধ্যে পড়লে . . . চল সারঙ্গি! ছোটো, ছোটো! কিছুতেই পিঠে গুলি খাওয়া চলবে না৷ পিঠে আমার দামোদর৷ রোদ চড়ছে৷ সারঙ্গির মুখে ফেনা৷ ভান্ডারেতে পৌঁছেছি৷ ওরা আমায় থামতে বলল-ভোপাতকার, লালু বক্সী৷ আমি থামতে চাইনি৷ ওরা বলল, ওরা গাঁয়ের লোককে বলে কিছু খাবার জোগাড় করেছে৷

আমি বললাম, আমি কিছু খাব না৷

ওরা বলল, রাজকুমারের জন্য কিছু খাবার . . .

দামোদর! দামোদর! দামোদরের কথা উঠতেই মনটা নরম হল৷ গতকাল রাত শুরু থেকে দামোদর আমার পিঠে বাঁধা! ওর নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে খুব৷ তেষ্টায় জলও পায়নি, খাবার তো দূরের কথা৷

ওরা বলল, রাজকুমারের জন্য একটু দুধ, একটু খাবার জোগাড় হয়েছে, গাঁওওয়ালাদের বলে৷

আমি ভাবলাম, দামোদরকে এক লহমাও পিঠের বাঁধন খুলে শোয়ানো যাবে মাটিতে৷ একটু তেষ্টার জল দেওয়া যাবে৷ একটু দুধ৷ সারঙ্গিও একটু জিরেন পাবে৷ একটু জল৷

আমরা থামলাম ভান্ডারেতে৷

৫ এপ্রিল ১৮৫৮৷ সকাল৷ সারঙ্গি

‘জয় শংকর!’ বলে রানিমা আমার পিঠে চড়ে বসলেন৷ রানিমার পিঠে বাঁধা রাজকুমার৷

তার আগে যখন তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন, তখনই বুঝেছিলাম কোনো কঠিন কাজ আজ আমার ওপর৷ আমি ভয় পাই না৷ অনেকটা ওপর থেকে লাফালাম৷ গড় থেকে নীচে নেমেই ছুট৷ আমি জানি রানিমাকে নিয়ে ঝাঁসি ছেড়ে পালাতে হবে আমায়৷ আমি পারব৷

খানিকটা এগোতেই আমরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে যাই৷ লালু বক্সি একদিকে, জহর সিং আর একদিকে চলে যায়৷ ওদের দিকে দুশমনের নজর পড়বে৷ ওরা দু-দিকে দুশমনের সঙ্গে লড়বে৷ সেই ফাঁকে মাঝখান দিয়ে আমরা পথ করে নেব, শহর ছেড়ে চলে যাব-রানিমা নিশ্চয়ই এমনটা ভেবেছিলেন৷

সেই রাতে দু-দিকে দুরন্ত লড়ছিল জহর সিং আর লালু বক্সি৷ খানিকটা ফাঁকা সড়ক পেয়ে আমরা এগোচ্ছিলাম৷ আট দরওয়াজার শহর আমাদের ঝাঁসি৷ ওরচা, দাতিয়া, সাঁইওয়ার, ভান্ডারে, লক্ষ্মী, খান্ডেরাও, ওনাও আর সাগর দরওয়াজা৷ আমরা ভান্ডারে দরওয়াজার দিকে এগোচ্ছিলাম৷ শেষরক্ষা হল না বোধ হয়৷ উত্তর দরওয়াজা পার হওয়ার মুখে একদল দুশমন আমাদের পথ আগলে দাঁড়ায়৷

রানিমা আমায় থামালেন৷

থামালেন কেন? আমি কি এগুলোকে ফেড়ে বার হতে পারতাম না!

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি৷ পা ঠুকছি না৷ যেন আমার মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই৷ তবে দাঁড়িয়ে মরব না৷ বেচাল দেখলেই রানিমাকে নিয়ে গোলার মতো ছুটে বার হব৷ আমি জানি, আমায় কী করতে হবে! রানিমা ওদের সঙ্গে কী কথা বললেন৷ ওরা পথ ছেড়ে দেয়৷ বুকের মধ্যে বাতাস নিয়ে ছুটে বার হলাম৷ দুশমনকে ফেড়ে বার হই, রানিমা চাননি৷ বুঝেছি, ওরা তাহলে পিছন থেকে গুলি ছুড়ত৷ রানিমার পিঠে বাঁধা নালায়েক রাজকুমার৷

সারা রাত ছুটেছি৷ কিছুক্ষণ চলার পরই আমরা খবর পেয়েছিলাম রানিমার জন্যে পথ করে দেবার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন জহর সিং৷ এখন আর আমাদের শোকের সময় নেই৷ ভোর আসে৷ ভোর পার হয়ে সকাল৷ আমি থামিনি৷ রোদ চড়লে আমার তেষ্টা পেয়েছিল৷ তেষ্টা বেড়েছিল৷ আমি জানবাজি রেখে ছুটছিলাম৷ রানিমা তাই চাইছিলেন৷ যেন দুশমন নাগাল পাওয়ার আগেই আমরা নিশানায় পৌঁছোতে পারি৷ কিন্তু আমি কি আমার অনেক পেছনে আমারই মতো কারও চার পায়ের শব্দ পাচ্ছি৷ আমারই মতো একদল জঙ্গি ঘোড়ার . . .৷ মানুষ টের পাওয়ার আগে আমরা টের পাই৷ কারণ আমরা মাটির কাঁপন টের পাই৷ শুধু বাতাস থেকে নয় আমরা মাটি থেকেও শব্দে পাই৷ আমি ছুট বাড়ালাম৷ জানবাজির গতির থেকেও বেশি গতি৷ আমার হঠাৎ বাড়তি গতি দেখে রানিমা অবাক হন৷ কী যেন ভাবেন৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন অনেক দূরে দুশমন! তাঁর পিছু ধাওয়া করছে৷

রানিমা অন্যদের জানিয়ে দেন, পিছে দুশমন৷

আমায় ডাকেন, ‘সারঙ্গি৷’ আমি জানি আমার কী কাজ৷ আমি হাওয়া কাটচি৷ আমার কলিজায়, কেশরে ঝড়৷

দুশমনদের ঘোড়ার খুরের শব্দ আবার পিছে মিলিয়ে যায়৷ হয়তো কোনো গাঁ-শহরে বাধা পেয়েছে৷

আমরা থামলাম৷ ভান্ডারে৷ গাঁওয়ের মানুষ রানিমার জন্যে, রাজকুমারের জন্যে দুধ এনেছিল৷ কয়েক লোটা দুধ আর রোটি৷ রাজকুমারকে পিঠ থেকে নামিয়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিয়েছিলেন রানিমা৷ আমায় ছেড়ে দিয়েছিলেন পানি আর ঘাসের জন্যে৷ খুব তেষ্টা পেয়েছিল আমার৷ বুক ভরে জল শুষে নেওয়ার সময়েই টের পেয়েছিলাম-মাটি কাঁপছে৷ কাঁপনে আগুয়ান হচ্ছে৷ তাহলে দুশমন পিছু ছাড়েনি৷ দুশমন আবার এগিয়ে আসছে৷ সম্ভবত নিখুঁত জেনে গেছে-আমরা কোন পথে আছি, কোথায় আছি৷

আমি তৈয়ার৷ রানিমা চিৎকার করে উঠলেন৷ চিৎকার করে সকলকে হুঁশিয়ার করে দিলেন৷ চিৎকার করতে করতেই রাজকুমারকে পিঠে তুলে দোপাট্টায় বেঁধে নিলেন আবার৷ খাবারগুলোর দিকে একবার তাকালেন৷ তারপর আবার ছুট শুরু হল৷ প্রবল ছুট৷ খাবার পড়ে রইল৷

কিন্তু ততক্ষণে দুশমন খুব কাছে চলে এসেছে৷ একদল আংরেজ সওয়ার৷ দিনের আলোয় তারা বোধ হয় রানিমাকে চিনে ফেলেছে, যতই তিনি ফৌজি পোশাকে থাকুন৷ শিকার ওদের হাতের মুঠোয়-এই ঝোঁকে ওরা ভয়ানক গতি বাড়িয়েছে৷ একজন সওয়ার তো শয়তানের মতো ছুটছে৷ ছুটে আসছে৷ ওদের দলকে পিছু ফেলে সে একা লাল বিদ্যুতের মতো ছুটে আসছে৷ আমাদের ধরে ফেলবে নাকি! আমি তা হবে দেব না৷ রানিমা তলোয়ার বার করতে চলেছেন৷ প্রায় ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে৷ ওদের বোধ হয় রানিমাকে জিয়ন্ত ধরার বাসনা৷ নইলে এত কাছে এসে পড়েছে, গুলি চালাতেই পারত৷ আমরা ওদের নাগালের মধ্যে ওরা রানিমাকে জিয়ন্ত ধরতে চাইছে৷ আমি তা হতে দেব না৷ কিছুতেই হতে দেব না৷ আমার বাবা-মাও ঝাঁসির দানাপানি খেয়ে বড়ো হয়েছে৷ বহু যুদ্ধে ছুটেছে৷ আমি কিছুতেই রানিমাকে, রাজকুমারকে দুশমনের হাতে তুলে দেব না৷ জিন্দা থাকতে তা হবে না৷ দুশমন ঘাড়ের কাছে৷ আগুয়ান সেই সওয়ারটা৷

রানিমা আমায় রুখে দিচ্ছেন৷ সেকি! কেন? কেন থামার সংকেত? কেন!

রানিমা দ্রুত আমায় ঘুরিয়ে নিলেন৷ সাপের ছোবলের মতো আমি উলটো দিকে ঘুরলাম৷ পিছনের দু-পায়ে ভর রেখে সামনের দু-পা শূন্যে তুলে আমি ঘুরে গেলাম লহমায়৷ আমরা আর দুশমন মুখোমুখি এখন৷ কখন হাতে পিস্তল নিয়েছেন রানিমা, আমি খেয়াল করিনি৷ মুহূর্তে গুলি চালিয়ে দেন রানিমা৷ দুশমন কিছু বুঝে উঠবার আগেই৷ তারপরও এগোতে থাকেন৷ এই কসরতটা কতদিন অভ্যাস করেছি আমরা৷ রানিমার দুই হাতে হাতিয়ার, দাঁতে ধরা লাগাম৷ সেইভাবেই তিনি আমায় হুকুমত দেবেন৷ দাঁতে লাগাম ধরেই আমায় ছুটিয়ে এগোতে থাকেন৷ গুলি নিশানায়৷ আংরেজ সওয়ারটা ঘোড়া থেকে পড়ে যায়৷ তারপর দুশমনের দিকে . . .৷

৫ এপ্রিল ১৮৫৮/সকাল/বুন্দেলখণ্ডের রোদ্দুর

আমি চোখ মেলতেই দেখি ঝাঁসি পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছেন রানি লক্ষ্মীবাই৷ তাঁর সেই সাদা ঘোড়ায়৷ কী যেন নাম ঘোড়াটার-সারঙ্গি! রানির সঙ্গে তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন৷ জহর সিং-এর ভাইপো বুরুজু, মুল্লা কাজি, বিলায়েত খাঁ আর তাঁতিয়া তোপির ভাই, তার নাম আমার জানা নেই৷

আমি চোখ মেলতেই দেখি, রেগে আগুন মেজর জেনারেল হিউ রোজ৷

দেখে মনে হল আগের রাতে অনেকদিন পর তিনি প্রথম ঘুমোতে পেরেছেন৷ ঝাঁসি তাঁর পুরো দখলে৷ ঝাঁসিতে ঢুকে পড়েছে আংরেজ ফৌজ৷ উফ! ঝাঁসি দখল করতে কী বেগ যে পেতে হয়েছে তাঁর৷ তাঁর কানে এসেছে ঝাঁসিতে ঢুকে পাগলের মতো লুটতরাজ চালাচ্ছে তাঁর আর্মি৷ তিনি কানে তোলেননি৷ তিনি বাধা দেননি৷ ঝাঁসিতে এখনও নিজে ঢোকেননি৷ সিনিয়র অফিসাররা ঢুকুন-তাও তিনি বড়ো একটা চাননি৷ তিনি ঝাঁসিতে ঢুকলে, মেজর হ্যামিল্টন ঢুকলে ডিসিপ্লিন ফেরাতে হবে৷ লুটতরাজের সুযোগই পাবে না তাঁর আর্মি৷ লুটতরাজের সুযোগ তো দিতেই হবে৷ সে সুযোগের লোভ আর্মির মনে জাগলে, তবে তো আর্মি ঠিকঠাক অ্যাগ্রেসিভ হবে৷ পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছেন ঢিউ রোজ৷ অবরোধের শেষ দিকে, যেকোনো ইন্ডিয়ান সিটি অবরোধের শেষ দিকে, লুটের লোভে সোলজারদের চোখ চকচক করে ওঠে, সেই লোভ হিংস্রতা দেয়৷ হিংস্রতা দেয় ভেদশক্তি৷ পেনিট্রেটিং ফেরোসিটি৷ মেজর জেনারেল হিউ রোজ জানেন!

সবই ঠিকঠাক চলছিল৷ হঠাৎ তাকে খবর দেওয়া হল-ঝাঁসির রানি ঝাঁসি ছেড়ে পালিয়েছেন৷

কী করে পালাল? না এসব প্রশ্নে মাথা গরম করার আগে মেজর জেনারেল শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন ‘কোন দিকে যেতে পারে?’

‘কালপি৷’ উত্তর দেয় একজন আর্মি অফিসার৷ ‘সেখানেই এখন ঘাঁটি গেড়ে আছেন নানাসাহেব তাঁতিয়া তোপে৷’ রানিকে তাড়া করার নির্দেশ দিলেন মেজর জেনারেল হিউ রোজ৷

আর্মি অফিসার জানালেন, ইতিমধ্যেই সেই কাজ শুরু হয়েছে ফোর্টিন্থ লাইট ড্রাগুনস, দ্য থার্ড লাইট ক্যাভালরি আর হায়দরাবাদ ক্যাভালরি-এই তিন বাহিনী মিলে রানিকে তাড়া করেছে৷ তিন বাহিনীর দায়িত্বে রয়েছেন ক্যাপটেন ফোরবেস৷ তাঁর বাহিনীকে নানাভাবে ছড়িয়ে দিয়ে ক্যাপটেন ফোরবেস রানির সন্ধানে ছুটে চলেছেন৷

রিপোর্ট জানিয়ে সেই অফিসার চলে যায়৷

মুখ দেখে মনে হল, সকালটা তেতো হয়ে গেল মেজর জেনারেল হিউ রোজের কাছে৷ রানিকে ধরা গেল না৷ জিয়ন্ত ধরা তো গেলই না রহস্যময়ী রানিকে৷ সারা শহর ঘিরে আর্মি কর্ডন ছিল৷ এতগুলো পিকেট ছিল৷ সে-সব ফাঁকি দিয়ে কীভাবে পালাতে পারল? কীভাবে? তাঁবুর দরজায় দাঁড়িয়ে যখন তিনি ইতস্তত ধোঁয়া-ওড়া ঝাঁসির দিকে তাকালেন, তখনই তাঁর ভিতরের রাগটা বোঝা গেল৷

আমি সারা বুন্দেলখণ্ডের দিকে তাকিয়ে আছি৷ নানা গাঁও, তহশিল সড়ক থেকে হরেক দিক থেকে সওয়ার আর পদাতিকরা রানির পথে মিলবার চেষ্টা করছে৷ যারা গত রাতে ঝাঁসি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল৷ ওইতো, রানির সঙ্গে মিলবার জন্যে ছুটে চলেছে সুন্দর, মন্দার আর কাশী৷ তাঁর নারী বাহিনীর তিন লড়াইদার-তিনজনেই ওস্তাদ সওয়ার৷ তারই সঙ্গে নানা কোণ থেকে ছুটে বেরিয়ে আংরেজ ফৌজ রানির খোঁজে ছুটছে বুনো কুকুরের মতো৷

ভান্ডারেতে থামলেন রানি৷ কারা যেন খাবার আর দুধ এনেছিল৷ পিঠ থেকে খুলে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিলেন দামোদর রাওকে৷ ঠিক করেননি৷ তিনি জানেন না৷ আমি শুধু জানি-তিনি ঠিক করেননি৷ কারণ তাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছিলাম-রানির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে হায়দরাবাদ ক্যাভালরি৷ সামনে যে ফৌজি, ক্যাভালরিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, ওদের কথা শুনে বুঝলাম ওর নাম ভাওকার-লেফটেন্যান্ট ভাওকার৷ ওরা যেন গন্ধ পেয়ে গেছে-খুব কাছাকাছি রয়েছে ঝাঁসির রানি৷ বেশ কয়েক কদম আগে ছুটছে ভাওকার৷

ঘাস থেকে তুলেছেন দামোদর রাওকে৷ সবে তাকে খাওয়াতে যাবেন-লোটায় দুধ আর থালিতে রোটি, একজন গাঁওওয়ালা জান বাজি রেখে ছুটে আসে, ছুটে এসে জানান দেয়-আংরেজ! আংরেজ! আংরেজ সওয়ার!

লাফ দিয়ে ওঠেন রানি৷ দুধের লোটা আর রোটির থালি পড়ে আছে৷ দশ বছরের দামোদরকে আবার বেঁধে নেন পিঠের দোপাট্টায়৷ ততক্ষণে দেখা যাচ্ছে আংরেজ সওয়ারদের৷ আংরেজ সওয়াররাও দেখে ফেলেছে রানির দলকে৷

দামোদরকে পিঠে বেঁধেই রানি ছুটে গেলেন তাঁর ঘোড়ার দিকে, একবার থমকে দঁড়ালেন, তাকালেন পড়ে থাকা দুধ-রোটি-পানির দিকে৷ ছেলেটার মুখের খাবার, তেষ্টার জল৷ পড়ে রইল৷ তাঁর মুখ দেখে বোঝা যায়, বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে তাঁর! তিনি ঘোড়াটার দিকে ছুটলেন৷ ঘোড়াটাও অনেক আগে টের পেয়েছে সব৷ জঙ্গি ঘোড়া তো! সেও তার রানিমার দিকে এগিয়ে আসে!

রানি লাফ দিয়ে ওঠেন তাঁর ঘোড়ার পিঠে৷ ফের ছুট! ছুট!

কিন্তু ওই এক লহমাও দেরি, থমকে দাঁড়ানো পড়ে-থাকা খাবারের দিকে তাকিয়ে, ঠিক হয়নি৷ হয়তো বিপদ ঘটে গেছে তখনই৷ রানির খুব কাছাকাছি এসে পড়ে, হায়দ্রাবাদ ক্যাভালরি৷ প্রায় ঘাড়ের কাছে ভাওকার৷ যেন এখনই দাঁত বসাবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ যেন শূন্যে ছুটছেন রানি৷ যেন তাঁর সাদা ঘোড়ার পা পড়ছে না মাটিতে৷ যেন হরিণ ছুটে বার হয়ে যেতে চাইছে একপাল চিতার নাগাল থেকে৷

আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে৷

হঠাৎ রানি থামিয়ে দেন সারঙ্গিকে৷ না থামিয়ে নয়, লহমার মধ্যে উলটো দিকে ঘুরিয়ে নেন ঘোড়ার মুখ৷ ঘোড়াটা চাবুক৷ প্রথমে যেন অবাক হয়েছিল, তারপর পিছনের দু-পায়ে ভর রেখে সামনের দু-পা শূন্যে তুলে আধখানা বৃত্ত হাওয়ায় এঁকে ঘুরে যায়৷ এখন ভাওকর আর রানি মুখোমুখি৷ মুহূর্তে গুলি চালিয়ে দেন রানি৷ ভাওকার কিছু বুঝে ওঠবার আগেই কখন কোমর থেকে পিস্তল বার করেছিলেন বুঝতেই পারেনি কেউ৷ ভাওকার গুলি খেয়ে ঘোড়া থেকে পড়েন৷ তবুও এগিয়ে যান রানি৷ এক হাতে পিস্তল, দাঁতে ধরা লাগাম, অন্য হাতে উঁচিয়ে নেন তলোয়ার৷ তেড়ে যাচ্ছেন মাটিতে পড়া ভাওকারের দিকেই৷

অন্যেরা অবাক রানিকে দেখে৷ বেপরোয়া৷ সব যেন ভুলে গেছেন তিনি৷ কেন উলটো দিকে, দুশমানদের দিকেই ছুটে যাচ্ছেন! কেন? তাঁর দলের অন্যেরাও অবাক হয়৷ কী যেন ভয়ানক ক্রোধ ভর করেছে রানির শরীরে৷ এরকম বেপরোয়া তো তাঁকে কখনও কেউ দেখেনি!

ভাওকার গুলি খেয়ে পড়ে আছেন তবু কেন তার দিকে ছুটে যাচ্ছেন তিনি! পিস্তল আর তলোয়ার হাতবদল করেন৷ ডান হাতে নেন তলোয়ার৷ তরবারির ফলা যতদূর পিছনে টানা যায় টেনে কোপ চালিয়ে দেন ভাওকারের ওপর৷ ফেলে আসা দুধ-রোটির সকল ক্রোধ যেন তাঁর কবজিতে ভর করে, ছেলের মুখ দুধ-জল তুলে দিতে না পারার ক্রোধ৷

রানি প্রাণভরে কোপাতে থাকেন ভাওকারকে৷ কী প্রচণ্ড আক্রোশে৷

ফিনকি দিয়ে বার-হওয়া রক্ত ছিটকে আসে রানির শরীরে৷ হায়দরাবাদ ক্যাভালরি বিমূঢ়, এগোতে সাহস পায় না কেউ৷ কোপানোর পর রানি আওয়াজ করে ওঠেন-আ-আঁ-আঁ৷ আকাশের দিকে মুখ তোলেন৷ আকাশ ফেড়ে আওয়াজ করে ওঠেন৷ জন্তুর মতো আওয়াজ৷ শব্দ নয়, বাক্য নয়৷ টানা আকাশ-ফাটানো আওয়াজ!

যেন সারা বুন্দেলখণ্ডের সকল সন্তানের খিদের জ্বালা, ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য মায়ের জ্বালা, যেন বুন্দেলখণ্ডের সকল হাহাকার, শোক-তাপ খিদে ও ক্রোধ রানির কন্ঠে ভর করেছে৷ ভর করে ছড়িয়ে পড়ছে এখন৷ রোদ্দুরে বাতাসে আকাশে৷ তামাম বুন্দেলখণ্ডে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *