দুটি তিনটি ঘর – উপন্যাস – মতি নন্দী
এক
সমবায় আবাসনটির নাম ‘আনন্দ নিকেতন’। সবাই ছোটো করে বলে আনন্দ। চারতলা পাঁচটি বাড়িতে আশিটি ফ্ল্যাট এই আবাসনে আছে, এর অর্ধেক দুই শয্যাঘরের বাকিগুলি তিন শয্যাঘরের। মফসসল কলেজের অধ্যক্ষপদ থেকে অবসর নেবার ছ—মাস আগে থেকে পূর্ণেন্দু গুপ্ত যখন তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় বসবাসের জন্য বাড়ি খুঁজছেন কিন্তু দামের অঙ্ক শুনে মুখ শুকিয়ে ফেলছেন তখন বাল্যবন্ধু কল্যাণ দত্তর সঙ্গে রাণাঘাট লোকাল ট্রেনে হঠাৎ তার দেখা হয়ে যায়। কথা প্রসঙ্গে কল্যাণ জানায় সে সল্ট লেকে বাড়ি করে বাস করছে এবং একটি বড়ো ব্যাঙ্কের মানিকতলা শাখার ম্যানেজার। তার শাখার এক কাস্টমার শুভেন্দু হালদার বাগমারিতে একটি সমবায় আবাসনের সেক্রেটারি। শুভেন্দু তিনদিন আগে কথায় কথায় তাকে বলেছিল তার আবাসনে এখনও একতলার দুটি ছোটো ফ্ল্যাট রয়ে গেছে। কিন্তু উচ্চচশিক্ষিত, ভদ্র এবং ভালো পদে চাকরি করে অথবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমন লোককে ছাড়া সমবায়ের মেম্বার করানো হবে না এবং দু—কামরার ফ্ল্যাট নেবার জন্য তেমন লোক শুভেন্দু এখনও পায়নি।
ট্রেনে সেদিন কল্যাণ তাকে বলে সে যদি আগ্রহী হয় তা হলে ‘শুভেন্দুর কাছে কলেজ প্রিন্সিপালের নাম রেকমেন্ড করবে।’ পূর্ণেন্দু সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন বাল্যবন্ধুর দুটি হাত ধরে। উত্তর কলকাতার ভাড়াবাড়িতে ফিরে পূর্ণেন্দু খবরটা স্ত্রী মায়াকে দেন। সব শুনে মায়া প্রথমেই বলেন, ‘শোবার ঘর তো দুটো, একটায় রবু আর নবু শোবে, অন্যটায় আমরা দুজন, তাহলে ছায়া শোবে কোথায়? বাইরের লোকজন এলে বসবেই বা কোথায়?’
পূর্ণেন্দু বিব্রত হয়ে বলেন, ‘শোয়াশুয়ির কথা ভাবলে আমরা যা পুঁজি তাতে ফ্ল্যাট নেওয়া যাবে না।’
বিরক্ত হয়ে মায়া বলেন, ‘ফ্ল্যাট তো কিনব থাকার জন্য, তা হলে শোয়াবসার কথা আগে ভাবব না?’
পূর্ণেন্দু বোঝাবার চেষ্টায় বলেন, ‘আগে দরকার মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই সেটা পেলে তখন শোয়াবসাটা ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। হয়তো একটু অসুবিধে হবে, তা হোক। ভাড়াবাড়ি নয় নিজস্ব মালিকানা। নতুন বাড়ি, নতুন পরিবেশ, নতুন প্রতিবেশী নতুন করে জীবন শুরু করা এটাই তো বড়ো লাভ।’
মায়া বলেন, ‘তা হোক নেবার আগে একবার গিয়ে দেখে আসা দরকার। তুমি কল্যাণবাবুকে বলো আমরা ফ্ল্যাটটা আগে দেখব।’
পূর্ণেন্দু অতঃপর কল্যাণের ব্যাঙ্কে যান খবর নিতে। কল্যাণ হাসিমুখে তাকে জানায়, ‘বলেছি তোর কথা শুভেন্দুবাবুকে। ওদের হাউজিংয়ে হেডমাস্টার আছে কিন্তু প্রিন্সিপাল নেই। রাজি হয়ে গেছে। আমি বুঝিয়ে বলেছি এডুকেশনিস্টরা মার্জিত নম্র ভদ্র হয়, সাতেপাঁচে থাকে না, ঝগড়া করে না, ঘোঁট পাকিয়ে দলাদলি করে না, যা হয় এইসব হাউজিংগুলোয়। তবে একটা কথা যেটা শুভেন্দুবাবু বলল, ওকে কিন্তু সব ব্যাপারে তোকে সাপোর্ট দিতে হবে। কমিটি গড়ার জন্য যখন ভোট হবে তখন ওর প্যানেলকে ভোটটা দিবি, অর্থাৎ তুই ওখানে ওর লোক হয়ে থাকবি।’
ঘাড় নেড়ে পূর্ণেন্দু সম্মতি জানিয়ে বলেন, ‘ফ্ল্যাটটা আগে কী একবার দেখা যায় না?’
‘কেন যাবে না? দাঁড়া ওকে পাওয়া যায় কি না দেখি। কেরোসিন স্টোভ তৈরির ব্যবসা করে, হয়তো এখন বাড়িতে আছে।’ কল্যাণ ফোন তুলে ডায়াল করল। পূর্ণেন্দু উৎকণ্ঠিত চোখে কল্যাণের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝলেন শুভেন্দু হালদার তার ফ্ল্যাটে রয়েছে।
‘শুভেন্দুবাবু? কল্যাণ দত্ত বলছি। আমার সেই প্রিন্সিপালবন্ধু যার কথা বলেছিলাম সে একবার ফ্ল্যাট দেখতে চায়।…আজই দেখাতে পারেন?’ ফোনের মুখে হাতটা চেপে কল্যাণ বলল, ‘হ্যাঁরে আজ যাবি?’
পূর্ণেন্দুর মনে চট করে ভেসে উঠল মায়ার বিরক্ত মুখটা। তিনি বলেন, ‘কাল সকাল দশটায় বল।’
কল্যাণ ফোনে কথাগুলো বলে উত্তর শুনে ফোন রেখে বলল, ‘তা হলে কাল দশটায় গিয়ে দেখে আয়। ‘আনন্দ কোথায়’ তোকে তো বলেই দিয়েছি। শুভেন্দুবাবু থাকে গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে বি ব্লকের দোতলায়, ফ্ল্যাট নম্বর চার। ওর থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাট। তোর জন্য অপেক্ষা করবে।’
পরদিন সকাল পৌনে দশটায় কাঁকুড়গাছি রেল ব্রিজের পরের স্টপে ওরা দুজন বাস থেকে নামে। বাঁদিকে রাস্তা, দু—ধারে দোকান, বাড়ি। দুশো গজ গিয়ে ডান দিকের প্রথম রাস্তা ছেড়ে আরও দুটো বাড়ি পরে দ্বিতীয় রাস্তাটিতে তারা ঢুকল। তখন মায়া মন্তব্য করেন, ‘রাস্তাগুলো বেশ সোজা সোজা, নোংরা নয়।’ মিনিট দুয়েক হাঁটার পর প্রায় একশো গজ লম্বা পাঁচিল। মধ্যিখানে গাড়ি ঢোকার মতো চওড়া লোহার ফটক। তার পাশে একটা কাঠের বাদামি বোর্ডে চওড়া সাদা অক্ষরে লেখা ‘আনন্দ নিকেতন।’
ঢুকেই একটা ঘাসবিহীন ছোটো মাঠ। তার তিনদিকে পাঁচটি বাড়ি। বাড়িগুলোর মাঝে সাত—আট হাত করে ফাঁকা জমি। প্রতি বাড়িতে দুটি করে সিঁড়ি। প্রতি সিঁড়িতে আটটি ফ্ল্যাট। কল্যাণের নির্দেশমতো শুভেন্দু হালদারের ফ্ল্যাট খুঁজে নিতে পূর্ণেন্দুর অসুবিধে হল না। কলিং বেলের বোতাম টেপার আগে নিজের ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবির দিকে মুখ নামিয়ে দেখে নিলেন। জুতোজোড়া অল্পদিন আগে কেনা এবং চকচকে। বাঁ কাঁধের মুগার চাদরটি আর একবার বিন্যস্ত করলেন। মায়া অনেকদিন পর জরির চওড়া পাড় সাদা শাড়ি, তুলে রাখা চটি এবং সোনার বালাজোড়া পরেছেন। শুভেন্দু হালদার ওদের সাধারণ মধ্যবিত্ত যেন না ভাবে সে জন্য দু—জনে সাধ্যমতো যত্ন নিয়েছেন পরিচ্ছেদে।
দরজা খুললেন শুভেন্দু হালদার। পরনে ঢিলে পাজামা ও আদ্দির পাঞ্জাবি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। আঙুলে দুটি আংটি। পূর্ণেন্দু প্রথমেই বুকের কাছে দুই করতল জোড়া করে নমস্কার করলেন, শুভেন্দু ডান হাতের মুঠো গলা পর্যন্ত তুলে নামিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি। এখুনি ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে, একটা মেশিন বিগড়ে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। চলুন আপনাদের ফ্ল্যাট দুটো দেখিয়ে আনি।’
আনন্দ নিকেতনের উত্তরের দুটি বাড়ির একটির একতলায় সিঁড়ির দু—ধারে ফ্ল্যাট দুটি। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ ছিল। শুভেন্দু যখন জানলা খুলছে মায়া তখন ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘরগুলো বড্ড ছোটো ছোটো।’ পূর্ণেন্দু জবাব দেননি।
শুভেন্দু একের পর এক দেখিয়ে বলে গেলেন, ‘এই কিচেন এই বাথরুম, এই ডাইনিং স্পেস, ওদিকে, একটা ছোটো বারান্দা রয়েছে দেখে যান।’
ওরা দু—জন ঘরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে তিনহাত চওড়া একটা গ্রিলঘেরা বারান্দায় এলেন। পূর্ণেন্দু প্রফুল্লস্বরে মন্তব্য করলেন, ‘পূর্বদিকটা খোলা দেখছি।’
‘সদর দরজার পাশে যে ফালি জায়গাটা রয়েছে ওখানে একটা ছোটো সোফা একটা চেয়ার কী টেবল রাখা যেতে পারে, এটাকে বসার পারপাসে ইউজ করা যায়, এখানকার অনেকেই তাই করেছেন।’ শুভেন্দু পরামর্শ দিলেন।
ওরা মিনিট দশেক ছিলেন ফ্ল্যাটের মধ্যে। বাড়ি ফিরে এসে মায়া বলেন, ‘জামাকাপড় শুকতে দেওয়া হবে সমস্যা। চারতলার ছাদে কে উঠতে যাবে? বাইরে দিলে তো চুরি হবে। তার থেকেও বড়ো কথা রবু নবুর তো একদিন বিয়ে হবে তখন থাকবে কোথায়? ছায়া নয় বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে কিন্তু আমরা দুজন তখন থাকব কোথায়, ওই একচিলতে বসার জায়গাটায়?’
পূর্ণেন্দু একটু রেগে একটু হতাশ হয়ে বলেন, ‘তা হলে যেমন আছি তেমনই থাকি। যেদিন তিন বেডরুমের পাব আর কেনার জন্য পয়সা দিতে পারব সেদিনই নয় ফ্ল্যাট কিনব। রবু কি নবু বউ নিয়ে কী আলাদা থাকতে পারবে না?’
রবিন্দু তখন বিকম প্রথম বর্ষের ছাত্র, নবেন্দু স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে, ছায়া নবম শ্রেণিতে। সে দিন মায়া স্বামীর সঙ্গে তর্কে নামেননি শুধু মুখভার করে বলেছিলেন, ‘যা ভালো বোঝ তাই করো তবে মনে রেখো জীবনে কয়েকটা জিনিস আছে যা একবার করে ফেললে তা আর শুধরে নেওয়া যায় না।’
পূর্ণেন্দু বলেন, ‘যেমন?’
‘যেমন বিয়ে করা, যেমন বাড়ি করা।’
পূর্ণেন্দু হিসেব করে ঠিক করেছিলেন ছ—মাস পর রিটায়ার করে যে টাকা হাতে পাবেন তাই থেকে তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্র কিনবেন সেটা সাড়ে পাঁচ বছরে ডবল হবে তখন ছায়াও বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠবে। অবশ্য সব টাকাই তিনি ছায়ার বিয়েতে খরচ করবেন না। অতঃপর ফ্ল্যাট কেনার জন্য, শুভেন্দু হালদার যা বলল তাতে লাগবে চল্লিশ হাজার। এরপর যা হাতে থাকবে সেটা রেখে দিতে হবে। সংসারের হাল ধরার মতো ক্ষমতা হতে দুই ছেলের আরও অন্তত পাঁচটা বছর তো লাগবে।
হিসেবটা তিনি মনে মনে কষে রেখেছিলেন মায়াকে জানাননি। নতুন ফ্ল্যাটে মালপত্তর নিয়ে আসা এক ঝকমারির ব্যাপার। সেই ঝামেলাটা চমৎকারভাবে সামলায় রবিন্দুর কলেজের বন্ধু অমিয় বিশ্বাস। থাকে বৌবাজারে। অবস্থাপন্ন। বাড়ির কাছেই ওদের যে ফার্নিচারের দোকান, সেটা চালায় বাবা। অমিয় এখন থেকেই সেখানে বসছে। ছেলেটি চটপটে, চতুর ও মিশুকে। সব বিষয়েই কিছু না কিছু খবর রাখে। একটু বেঁটে, স্বাস্থ্যটা ভালোই এবং মুখ সুশ্রী। অমিয় দু—দিনেই মায়ার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে।
বুদ্ধিটা অমিয়ই দিয়েছিল, ‘মেসোমশাই এমন একটা বাসা অমনি অমনি ছেড়ে দেবেন? জানেন এখন কলকাতায় ঘরের ডিমান্ড কেমন? আপনি ছাড়লেই বাড়িওলা পঞ্চাশ হাজার টাকা সেলামি নিয়ে এক হাজার টাকায় পুরো দোতলাটা ভাড়া দিয়ে দেবে। আপনি তো দিচ্ছেন মাসে তিনশো টাকা। আপনি উঠে গেলে বাড়িওলার কী লাভটা হবে ভাবুন! কিছু টাকা ওর কাছ থেকে আদায় করে নিন। এভাবে সবাই নেয়।’
পূর্ণেন্দু আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘না, না, না, এটা খুব অনৈতিক কাজ হবে। এভাবে টাকা নিলে আত্মমর্যাদা থাকে না, নিজের কাছে ছোটো হয়ে যেতে হয়।’
.
অমিয় পূর্ণেন্দুবাবুর গলার স্বর ও মুখের ভাব দেখে চুপ করে যায় কিন্তু মায়া মুখর হয়। ‘কী এমন অন্যায় কথা অমিয় বলেছে? বাড়িওলা যদি সেলামি নিতে পারে তা হলে আমরাও টাকা চাইতে পারি তাকে ঘর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।’
সমর্থন পেয়ে অমিয় বলে, ‘টাকা যদি না দেয় তা হলে ঘরও ফেরত পাবে না, আমরা ভাড়াটে বসিয়ে দিয়ে যাব, নাও এবার ঠ্যালা বোঝো। মাসিমা বাড়িওয়ালা যদি বুদ্ধিমান হয় তা হলে হাজার দশেক তো দেবেই।’
‘দশ বাজার!’ মায়ার চোখ চকচক করে উঠেছিল। পূর্ণেন্দুকে তখন বলেন, ‘তুমি আজই হরেনবাবুর কাছে গিয়ে বলো, দশ হাজার পেলে ঘর ছেড়ে দেব।’
গোঁয়ারের মতো মুখ নামিয়ে পূর্ণেন্দু, ‘আমি পারব না’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অমিয় বলল, ‘মাসিমা আপনি বাড়িওলাকে চেনেন?’
‘চিনি, কাছেই বেনেটোলায় থাকে।’
‘চলুন আমি আর আপনি গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলি। এতগুলো টাকা যখন পেতে পারি তখন মিছিমিছি নৈতিকতার কথা তুলে ছেড়ে দেব কেন।’
মায়া এবং অমিয় হরেন রায়চৌধুরির সঙ্গে দেখা করে, পূর্ণেন্দু ঘুণাক্ষরেও তা জানেন না। ওরা পনেরো হাজার টাকা চেয়েছিল, পাঁচ মিনিটেই রফা হয়ে যায় দশ হাজারে। স্থির হয় মালপত্তর গাড়িতে উঠলে পর তখন ক্যাশ টাকা মায়ার হাতে দিয়ে হরেনের লোক ঘরগুলোয় তালা লাগিয়ে দেবে। ফিরে আসার সময় আপশোস করে অমিয় বলে, ‘মাসিমা লোকটা এভাবে রাজি হয়ে যাবে জানলে আর একটু বাড়িয়ে পঁচিশ হাজার বলতুম, তা হলে নির্ঘাত কুড়ি হাজার পাওয়া যেত।’
‘যাক গে, পড়ে পাওয়া ধন চোদ্দোআনা। তুমি কিন্তু বাবা, রবুকে এই ব্যাপারে একটি কথাও বলবে না। ও আবার বাপের ধাঁচ পেয়েছে।’
বত্রিশ বছরের ঘরকন্নার জমে ওঠা মালপত্র বাঁধাছাদা, লরি ও কুলি ভাড়া করে এনে তাতে তোলা, প্রায় একাই করল অমিয় অবশ্য রবিন্দু, নবেন্দু এবং ছায়াও তাকে সাহায্য দেয়। মালপত্রের সঙ্গে পূর্ণেন্দু লরিতে ড্রাইভারের পাশে বসেন চিনিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। দুই ছেলেও লরিতে ওঠে। রয়ে যায় মায়া এবং ছায়া। অমিয় ওদের ট্যাক্সিতে করে নিয়ে যাবে। তালা এবং টাকা নিয়ে হরেনের লোক তৈরি হয়েইছিল। টাকা যখন মায়া গুনছিল তখন ছায়া কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করে, ‘মা কীসের টাকা?’
মুচকি হেসে মায়া বলেন, ‘তোর বিয়ের গয়নার টাকা, বাড়িওলার কাছে জমিয়ে রেখেছিলুম।’
অমিয় হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ছায়ার বিয়েতে আপনাদের টাকা খরচ করতে হবে না মাসিমা। মেয়ে আপনার সুন্দরী, পাত্রপক্ষ সোনা দিয়ে মুড়ে নিয়ে যাবে।’
মায়া লক্ষ করলেন জিভ দেখিয়ে চোখে ছদ্ম কোপ প্রকাশ করে ছায়া হাতের মুঠি তুলে অমিয়কে দেখাল। দেখে তার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল।
.
দুই
নতুন আবাসে নতুন পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে গুপ্ত পরিবারের অসুবিধা হল না। মায়া খুশি, কয়লার উনুনে রান্না করার বদলে তিনি এখন গ্যাসের উনুনে রাঁধেন, একটা দেশলাই কাঠি জ্বালালেই আগুন, রান্নাঘরেই চব্বিশ ঘণ্টা জল পড়ছে কল খুললে, মেঝেয় বসে খাওয়ার বদলে তারা এখন খায় চেয়ারে বসে টেবলে, রান্না করা খাবার থাকছে ফ্রিজে। অসুবিধা এবং বড়ো রকমের অসুবিধা স্থান সংকুলানের। রবু নবু একঘরে দুটো খাটে, বাকি তিনজন অন্য ঘরটায়। পূর্ণেন্দু সোফা কাম বেড কিনেছেন তাইতে শোন। সকালে উঠে এলেন গায়ে ব্যথা করছে। সরু ফালি জায়গাটা হয়েছে বসার ঘর, সেখানে রয়েছে একটা ছোটো সোফা, দুটো মোড়া আর একটা টেবলের উপর টিভি স্টে। সন্ধ্যা থেকে পূর্ণেন্দু টিভি দেখে সময় কাটান। এখন খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছু পড়েন না। মায়ার হাঁটুতে বাত, বেশি চলাফেরা করলে যন্ত্রণা হয়।
আবাসনে দুর্গাপুজোর সময় পূর্ণেন্দু একটা ব্যাপারে উত্যক্ত হয়ে প্রতিবেশীদের কাছে চিহ্নিত হয়ে যান ‘ঝামেলার লোক’ বলে। সপ্তমীর সকাল থেকে মাইকে ইংরেজি গান বেশ জোরেই বাজানো হচ্ছিল। অ্যামপ্লিফায়ারের বাক্সটা তার ফ্ল্যাটের দিকে মুখ করিয়ে বসানো ছিল বারান্দার কাছেই। পুজোর সময়টুকু বাদে সারাক্ষণ বাজছিল, জানলাগুলো বন্ধ রেখেও শব্দের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছিল না। পূর্ণেন্দু সুরেলা গান পছন্দ করেন কিন্তু তার আবাল্য পরিচিত সুরের সঙ্গে এই ইংরেজি গানের সুরকে একদমই মেলাতে পারছিলেন না। তার মনে হচ্ছিল প্রচুর ঢাকঢোল বাজছে আর চিৎকার করে যাচ্ছে এক বা একাধিক বলির পাঁঠা। অষ্টমীর দুপুরে অসহ্য বোধ করে তিনি পুজো প্যান্ডেলে হাজির হন।
তিনটি কিশোর দুটি মহিলা চেয়ারে বসেছিল। পূর্ণেন্দু ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ক্যাসেট চালানো এবার বন্ধ করো, শুনতে হয় নিজেদের ঘরে বসে শোনো। অন্যকে জ্বালাতন করা কেন?’
ছেলে তিনটে প্রথমে অবাক হয়ে শোনে তারপর একজন বলে, ‘কই আর কেউ তো বলেনি জ্বালাতন হচ্ছে!’
‘কেউ বলেনি তো কী হয়েছে, আমি বলছি।’ পূর্ণেন্দু অবাধ্য ছাত্রদের ধমক দেওয়ার মতো স্বরে বললেন। ‘এটা কী গান হচ্ছে? গানের কথাগুলো কী তোমরা বলতে পারবে?’
ছেলেরা চুপ করে রইল দেখে তিনি বললেন, ‘গানের কথাই যদি বুঝতে না পারলে তা হলে সে গান শুনে লাভ কী? বাংলা গান বাজাও, রবীন্দ্রসংগীত, পল্লিসংগীত কিংবা সানাই কী সেতার!’
একটি ছেলে বলল, ‘কথার থেকেও বড়ো জিনিস রিদম, আমরা রিদম শুনি। নেকিয়ে নেকিয়ে গাওয়া বাংলা গান, রবীন্দ্রসংগীত আর ভালো লাগে না।’
মহিলা দুজনের যিনি মধ্যবয়সি তিনি তখন বলেন, ‘পুজো তো মোটে চারটে দিনের জন্য। দু—দিন তো কেটেই গেল, আর দুটো দিন একটু কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দিন দাদা। পুজো তো ছেলেপুলেদের জন্যেই।’
‘মানছি কিন্তু বুড়োদের কথাটাও তো তাদের ভাবা উচিত।’ পূর্ণেন্দু যতদূর সম্ভব উত্তেজনা সংযত রেখে বলেন। ‘এই বক্সটা আমার বারান্দার সামনে থেকে সরিয়ে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে বসাও। আর বাজাতে হলে ভল্যুম কমাও।’ এই বলে তিনি চলে আসেন। আধঘণ্টা পরে যখন তিনি দেখলেন বক্সটা সরল না, ভল্যুমও কমল না, তখন তিনি গিয়ে বক্সের মুখ বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আসেন।
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন বিশ্বনাথ ঘোষ। তিনি মন্তব্য করেন, ‘ঠিক করেছেন দাদা, কানোর পোকা বার করে দিচ্ছিল।’
‘তা হলে প্রতিবাদ করেননি কেন?’ পূর্ণেন্দু কড়া চোখের মারফত ধমকালেন।
‘ছেলেছোকরাদের চটাবার দরকার কী!’ অপ্রতিভ বিশ্বনাথ এই বলে ঘরে ঢুকে গেলেন।
কিন্তু অন্য একটা কারণে মায়া চটলেন। ছায়া উচ্চচমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য দিন গুনছে। রবিন্দু ভালোভাবেই বিকম পাশ করেছে। পূর্ণেন্দু তার অধ্যাপকজীবনের প্রথম দিকের ছাত্র সুরেশ্বর বোসকে অনুরোধ করে তারা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট অফিসে রবিন্দকে শিক্ষানবিশ করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। নবেন্দু দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠতে পারেনি এখন সে কলকাতার দ্বিতীয় ডিভিশন ফুটবল লিগে সবুজ সংঘের মিডফিল্ডার। উদীয়মান হিসাবে দু—তিনটি প্রথম ডিভিশন ক্লাবের রিক্রুটারদের চোখে সে পড়েছে। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার জন্য পূর্ণেন্দু তাকে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। মায়া অবশ্য বলেছিলেন, ‘নবু লোকে বলবে কী! এমন বাপের এমন মুখ্যু ছেলে! অন্তত হায়ার সেকেন্ডারিটা পাশ কর। তোর বাবা মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন, বলছিলেন পঁয়ত্রিশ বছর পড়িয়ে কত ছাত্রকে শিক্ষা দিলাম আর আমার ঘরেই অশিক্ষিত তৈরি হল। প্রদীপের নীচেই অন্ধকার।’
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নবু চোখ কুঁচকে শুনল। তারপর বলল, ‘আমাকে নিয়ে বাবা, তুমি, দাদা আজ লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু আর তিন—চার বছরের মধ্যেই দেখবে মোহনবাগান কী ইস্টবেঙ্গলে যখন খেলব তখন আমাকে দেখিয়ে তোমরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছ। লোকের কাছে তখন বলবে নবেন্দু গুপ্ত আমার ছেলে। লেখাপড়া তো টাকা রোজগারের জন্য। যদি ফুটবল খেলে বছরে পঞ্চাশ—ষাট হাজার টাকা রোজগার করতে পারি তা হলে ডিগ্রি দিয়ে আমার কী দরকার। ওই তো একজন ডিগ্রি বাগিয়ে অফিসে কলম ঘষে মাসে তিনশো টাকা পাচ্ছে, বছরে ছত্রিশ শো।’
‘রবু পার্মানেন্ট হবে ছ—মাস পরেই তখন শুরু হবে আটশো দিয়ে। তোর বাবা শুরু করেছিল দেড়শো দিয়ে। তুই কী ভেবেছিস তিরিশ—চল্লিশ বছর ধরেই বছরে পঞ্চাশ—ষাট হাজার টাকা ফুটবল খেলে আয় করবি? কিন্তু রবু করবে।’
‘তুমি জানো না মা, বড়ো ক্লাবে যারা যায় তারা একটা চাকরিও আদায় করে নেয়। আমি তো স্কুল ফাইনাল পাশ, চাকরি ঠিক পেয়ে যাব। কয়েকটা বছর শুধু অপেক্ষা করা।’ নবুর গলায় প্রত্যয় ফুটে ওঠে।
কিন্তু মায়া খুব ভরসা পেলেন না নবুর কথায়। নবু কেমন খেলে, কত বড়ো ফুটবলার হবে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। স্বামীর কাছে শুনেছেন, খেলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, অর্থ পাওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না, এটা লটারির মতো। সবাই বড়ো প্লেয়ার হয় না কেউ কেউ হয়। হাজার হাজার ছেলে বড়ো হবার স্বপ্ন দেখে, বড়ো হয় একজন কী দু—জন। খবরের কাগজে কখনো নবুর নামও তিনি দেখেননি অবশ্য দ্বিতীয় ডিভিশনের খেলার রিপোর্ট কাগজে ছাপাও হয় না। কিন্তু নবেন্দু গুপ্ত একদিন কাগজের খেলার পাতার খবর হল।
পূর্ণেন্দু খবরের কাগজের খেলার পাতাটা খুঁটিয়ে পড়েন। এক রবিবার তার চোখ আটকে গেল একটা মোটা হেডিংয়ে—’রেফারিকে ঘুসি মেরে ফুটবলার গ্রেপ্তার।’ খবরের প্রথম বাক্যটি পড়েই তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ‘রেফারি বিপুল নাগকে ঘুসি মেরে পুলিশ হেফাজতে গেল সবুজ সংঘের ফুটবলার নবেন্দু গুপ্ত।’ এরপর তার হাতের কাগজ থরথর কেঁপে উঠল। কাগজটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে পড়ে গেলেন: ‘শনিবার দ্বিতীয় বিভাগীয় খেলায় ওয়াই এমসিএ মাঠে মুখোমুখি হয়েছিল সবুজ সংঘ ও টালিগঞ্জ ইনস্টিটিউট। খেলা শেষের মিনিট তিনেক আগে টালিগঞ্জ গোলরক্ষকের সঙ্গে এক সংঘষে আহত হন সবুজ সংঘের বলাই দাস। মাঠে পড়ে থাকা বলাইকে ঘিরে সবুজ সংঘের ফুটবলারদের সঙ্গে হঠাৎই ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় রেফারি বিপুল নাগের। সেই সময় বিপুল সবুজের নবেন্দু গুপ্তকে রেডকার্ড দেখান। এরপরই নবেন্দু রেফারির কানের নীচে ঘুসি মারে। বিপুল তৎক্ষণাৎ ঘোড়াপুলিশের সাহায্য চান। ঘোড়াপুলিশ এসে নবেন্দুকে মাঠের বাইরে নিয়ে যায়। তারপর তারা নবেন্দুকে তুলে দেয় হেস্টিংস থানার পুলিশের হাতে। পরে অবশ্য তাকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রায় মিনিট দশেক বন্ধ থাকার পর খেলাটা কোনোক্রমে শেষ করেই আবার মাঠে শুয়ে পড়েন বিপুল। তাকে তখন অ্যাম্বুলেন্সে করে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পরই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। হেস্টিংস থানার রাতে এফ আই আর করেছেন বিপুল। তার বক্তব্য, খেলা শেষের তিন মিনিট আগে টালিগঞ্জ গোলরক্ষকের সঙ্গে সংঘর্ষে বলাই পড়ে গেলে আমি স্ট্রেচার ডাকি। তখনই নবেন্দু আমায় গালাগালি করলে লালকার্ড দেখাই। কার্ড দেখাতেই ও আমায় মারে। বাধ্য হয়ে পুলিশকে ডাকি। নবেন্দু থানায় বসে জানান, জীবনে কখনো লালকার্ড দেখিনি। বলাইকে পড়ে থাকতে দেখে বললাম ও জল চাইছে। তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি হতেই কার্ড দেখাল। তারপর পুলিশকে ডেকে নাম করে বলল আমার বার করে দিতে। আমি ওকে মারিইনি।’
এর পাশেই আর একটা সরু হেডিং : ‘সাসপেন্ড হচ্ছে নবেন্দু’। পূর্ণেন্দু সেটাতে চোখ রাখলেন : ‘রেফারি বিপুল নাগের ওপর সবুজ সংঘের ফুটবলার নবেন্দু গুপ্তর হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন আই এফ এ এবং সি আর এ—র কর্মকর্তারা। আই এফ এ সচিব বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এখন রেফারির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করবে আই এফ এ পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। শৃঙ্খলারক্ষাকারী কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে ফুটবলারটির ব্যাপারে। রেফারির রিপোর্ট সোমবার আই এফ এ—তে জমা পড়বে।’
পূর্ণেন্দুর প্রথমেই মনে হল এই খবরটা অন্য সব কাগজেও নিশ্চয় বেরিয়েছে। আনন্দর সব ফ্ল্যাটেই কাগজ রাখে। প্রত্যেকে এটা পড়বে। তিনি মায়াকে ডেকে কাগজটা তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখো। গুণধর ছোটো ছেলের কীর্তি।’ মায়া পড়লেন, পড়ে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন। পূর্ণেন্দু বললেন, ‘কাল অত রাত্রে ফিরল কেন, কারণটা এখন বুঝতে পারছ, নবু কী করছে?’ মায়া বললেন, ‘ভোরে উঠে বেরিয়ে গেছে, কিছু বলে যায়নি। আচ্ছা সাসপেন্ড হচ্ছে কথাটার মানে কী? আজীবনের জন্য খেলা বন্ধ করে দেওয়া?’ পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে জানালেন তিনি বুঝতে পারছেন না।
বেলা দশটা নাগাদ মোটরবাইকে দুজন লোক এল নবেন্দুর খোঁজে। পূর্ণেন্দু তাদের বসার ঘরে আনলেন। তারা প্রথমে নবেন্দু আছে কি না জানতে চাইল। নেই শুনে, তাদের মধ্যে লাল—কালো ডোরাকাটা স্পোর্টস শার্ট আর জিনস পরা বলিষ্ঠ চেহারার, গালে লম্বা একটা ক্ষতের দাগটানা যুবকটি নিজের পরিচয় দিল, ‘আমার নাম সমরেশ ঢালি, আমি সবুজ সংঘের কোচ আর ইনি হলেন বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি ক্লাবের সেক্রেটারি। কাগজে নিশ্চয় দেখেছেন কালকের ঘটনার কথা। নবাকে নিয়ে যত্তোসব আজেবাজে কথা লিখেছে, গপ্পো ফেঁদেছে। আপনি অযথা মন খারাপ করবেন না কাকাবাবু, সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। ওই রেফারি আমাদের ওদিকেই বাগুইহাটিতে থাকে। একটু চমকে দিলেই ওর রিপোর্টের ভাষা বদলে যাবে।’
পূর্ণেন্দু অবাক হয়ে বললেন, ‘চমকে দেওয়া মানে!’
সমরেশও অবাক হয়ে তাকাল, তার ভাবখানা লোকটা তো আচ্ছা গাড়োল, চমকে দেওয়ার মতো সহজ কথাটার মানে জানে না? বলল, ‘চমকে দেওয়া হল একটু ভয়টয় দেখানো। বউ—বাচ্চচা নিয়ে সংসার, রেশন অফিসে চাকরি করে একদম ছাপোষ।’
‘কী ভয় দেখাবেন?’ পূর্ণেন্দু গম্ভীর স্বরে জানতে চেয়ে খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে শুরু করলেন।
ধুতি পাঞ্জাবি পরা বছর চল্লিশ বয়সি সেক্রেটারি বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি এবার মুখ খুললেন, ‘আমরা প্রথমে রিকোয়েস্ট করব নবেন্দু যাতে সাসপেন্ড না হয় এমনভাবে রিপোর্ট লিখতে। একটা প্রমিসিং ফুটবলারের কেরিয়ারে যাতে দাগ না পড়ে।’
‘কিন্তু রেফারি তো থানায় নবুর বিরুদ্ধে এফ আই আর করে বলেছে নবেন্দু তাকে ঘুসি মেরেছে। এখন রিপোর্টে অন্য কথা লিখবে কী করে?’ পূর্ণেন্দু পালটা যুক্তি দিলেন।
‘লিখবে লিখবে কাকাবাবু লিখবে। দিনকে রাত করে দেবে রেফারি, যখন ওকে চ্যাংদোলা করে তুলে আনব। ওর বাচ্চচাকে সকালে স্কুলে পৌঁছে দিতে যায় ওর বউ, যখন বলব স্কুলে নয় বাচ্চচা অন্য কোথাও পৌঁছে যাবে তখন দেখবেন বিপুল নাগ রিপোর্টে লিখবে—থানায় বসে মাথা ঘুরছিল, কার নাম লিখতে কার নাম লিখে ফেলেছি ভিড়ের মধ্যে আমাকে ঘুসি মেরেছিল তাকে দেখতে পাইনি। এরকম রিপোর্ট রেফারিয়া আগেও প্রচুর দিয়েছে।’
পূর্ণেন্দু বিব্রত ও বিরক্ত মুখে কিছুটা ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, ‘না না এভাবে একটা লোককে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করাটা খুব অন্যায় কাজ হবে। আমি এটা অ্যাপ্রুভ করতে পারছি না।’
ওরা দুজন পরস্পর মুখচাওয়াচাওয়ি করল। বুদ্ধদেব একচোখ টিপে সমরেশকে কথা বলতে বারণ করে পূর্ণেন্দুকে নম্রগলায় বলল, ‘স্যার আপনি যখন বলছেন তখন মানতেই হবে। নবেন্দু এলে ওকে বিকেলের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন। ওকে নিয়ে যাব রেফারির বাড়িতে। ক্ষমা চেয়ে যদি মন গলাতে পারে। এ ছাড়া তো ওর সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।’
‘তাই করুক। দোষ করলে অবশ্য শাস্তি পাওয়া উচিত।’ পূর্ণেন্দুর স্বরও নম্র হয়ে এল। ‘আমার ছেলে এমন একটা কাজ করে বসল, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘নবেন্দু ছেলে হিসেবে তো খুবই ভালো।’ বুদ্ধদেব নরম স্বরে বলল, ‘প্রায়ই তো আমাদের বাড়িতে আসে। বাড়ির প্রত্যেকে ওর প্রশংসা করে।’
পূর্ণেন্দু এরপর জিজ্ঞাসা করলেন সমরেশকে, ‘আপনি কোচিং ছাড়া আর করেন কী?’
‘একটা মিনিবাস আছে তা ছাড়া বিল্ডিং মেটিরিয়াল সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করি। কোচিংটা আমার সখের ব্যাপার। দু—বছর ইস্টার্ন রেলে খেলেছি। বাঘা সোমের কোচিংয়ে ছিলুম, ওর কাছ থেকেই যা কিছু শিখেছি। কাকাবাবু আপনার ফিগার দেখে মনে হচ্ছে একসময় খেলাধুলো করেছেন।’
পূর্ণেন্দু মনে মনে খুবই প্রীতবোধ করলেন, বললেন, ‘আরে না, না খেলাধুলো যা কিছু ওই ছাত্রাবস্থায়, কলেজ আর ইউনিভার্সিটির পর মাঠে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ক্রিকেটটা যৎসামান্য খেলেছি, বঙ্গবাসীর টিমে ছিলুম।’
‘কাকাবাবু তা হলে আসি। বুদ্ধদার আবার এগারোটার সময় পার্টি মিটিং আছে, ওকে পৌঁছে দিতে হবে।’
দুজনে উঠল। পূর্ণেন্দু ওদের সঙ্গে বাইরে এলেন। মোটরবাইকের পিছনে বসে বুদ্ধদেব চ্যাটাজি বলল, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, ব্যাপারটা যাতে ভালোভাবে মিটে যায়। সেটা আমরা দেখব।’
মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন উৎকণ্ঠিত হয়ে। বললেন, ‘ওরা কী বলল?’
‘সবই তো আড়াল থেকে শুনেছ। ওই সমরেশ ছেলেটা খুব সুবিধের নয়, সঙ্গের লোকটাও। প্রথমে কীভাবে কথা শুরু করেছিল তারপর যেই আমি আপত্তি করলুম অমনি কথা ঘুরিয়ে নিপাট ভদ্দরলোক হয়ে গেল। বলে কিনা রেফারির বাচ্চচা ছেলেকে তুলে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেবে তার মানে কিডন্যাপ করবে!’
‘মেরে তো ফেলবে না।’ মায়া কথার সুরে বোঝালেন কাজটায় তার অসম্মতি নেই। পূর্ণেন্দু তীব্র দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
‘মেরে হয়তো ফেলবে না কিন্তু বাপ—মার ওপর কী ভয়ংকর মানসিক অত্যাচার হবে সেটা মনে করার চেষ্টা করো।’
‘মানসিক অত্যাচার কী আমাদের ওপরও হচ্ছে না? অবশ্য বলতে পার অত্যাচারটা করছে আমাদেরই ছেলে। এখানকার পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাতে হলে নবুকে নির্দোষী প্রমাণ হবে হবে আর সেটা সম্ভব রেফারির রিপোর্ট কেমন হবে তার ওপর। আমি তো কথা শুনে তাই বুঝলুম।’
‘ঠিকই বুঝেছ। তোমার চিন্তা হল পাঁচজনের কাছে মুখ দেখানো। আর তা দেখানোর জন্য একটা বাচ্চচাকে যদি গুম করে ফেলতে হয় তো ফেলুক, কেমন, তুমি তাতে অন্যায় কিছু দেখছ না।’ পূর্ণেন্দুর চোখে চাপা আগুন, গলায় চাপা ক্রোধ। মায়া সরে গেলেন স্বামীর সামনে থেকে।
নবেন্দু সেদিন আর ফিরল না। মায়া ভীত গলায় বললেন, ‘কিছু করে টরে বসল না তো।’ শুনে পূর্ণেন্দু ঠোঁট বাঁকালেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দায় চেয়ারে বসে রইলেন মায়া, পথ চেয়ে। ছায়া বা রবিন্দু এই প্রসঙ্গে সারাদিনে একটি কথাও বলেনি, রাতে একটি ছেলে এসে জানিয়ে গেছল ‘নবু সমরেশদার বাড়িতে আছে, ওখান থেকেই কাল সোজা কোর্টে যাবে।’
সোমবার খামে ভরা সীলকরা রেফারির রিপোর্ট জমা পড়ল আইএফএ অফিসে কিন্তু খাম খোলা হল না। শৃঙ্খলারক্ষাকারী কমিটির সভায় খোলা হবে বলে তুলে রাখা হল। সোমবারই ব্যাঙ্কশালকোর্টে নবেন্দু হাজির হয়ে এক মিনিটেই জামিনে পেয়ে যায়, কোর্টে সবুজ সংঘের ফুটবলার ও কর্মকর্তারা হাজির ছিল।
সোমবার খুব সকালেই অমিয় আনন্দে এসে হাজির হয়। রবিন্দুকে সঙ্গে নিয়ে সে কোর্টে যাবে। তার চেনা উকিল আছে তাকে দিয়ে সে জামিনের জন্য আবেদন করাবে।
‘তোমায় কিছু করতে হবে না অমিয়, নবুর জন্য যা করার তা ওর ক্লাবই করবে।’ নিস্পৃহ স্বরে বলেছিলেন পূর্ণেন্দু।
মায়া প্রতিবাদ জানান, ‘যাবে না কেন, বাড়ি থেকে কারওর যাওয়া উচিত। তুমি যাবে না জানি, নীতিবাগীশ তো রবি তুই তো আবার বাপের মতো, তোর যেতে লজ্জা করবে না তো? অপিস আছে বলে পাশ কাটাসনি, ভাইয়ের বিপদ, এখন দাদার কর্তব্য পাশে দাড়ানো, অমিয়র সঙ্গে তুইও যা।’
ওরা যখন কোর্টে পৌঁছল নবেন্দু তখন জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। যখন সে বেরিয়ে আসছে তখন কোর্টের গেটে তার সঙ্গে দেখা হল অমিয় ও রবিন্দুর। নবেন্দুকে ঘিরে জনাপনেরো লোক।
তাদের মধ্যে সমরেশও রয়েছে। সে নবেন্দুকে বলল, ‘এখন কোথায় যাবি, বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ, আমার দাদা এসেছে, ওই যে দাঁড়িয়ে।’ আঙুল তুলে সে রবিন্দুকে দেখাল। তিনজনকে ট্যাক্সিতে তুলে দিল সমরেশ। সারা পথে রবিন্দু শুধু একটাই প্রশ্ন করে, ‘সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস?’
‘খিদে নেই।’
তিন
লাল কার্ড দেখার জন্য দুটি ম্যাচে বসে থাকা ছাড়া নবেন্দুর কোনো শান্তি হয়নি। কোর্ট তাকে বেকসুর খালাস দেয়, আই এফ এ—ও। রেফারির রিপোর্টে সেই কথাগুলিই ছিল সমরেশ যেমনটি বলেছিল পূর্ণেন্দুকে। খবরের কাগজে পড়ে তার সন্দেহ হয় নবেন্দুকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হয়নি, সমরেশ ও বুদ্ধদেবরা নিশ্চয় ভয় দেখিয়ে রিপোর্টটা লিখিয়েছে। এই সন্দেহটা তিনি মনের মধ্যেই গোপন করে রেখে দেন।
নবেন্দুর ব্যাপারটা নিয়ে আনন্দ আবাসনের একটি লোকও কৌতূহল দেখায়নি। খবরের কাগজ নবেন্দুর পক্ষ নিয়ে যা যা লিখেছে তারা সবাই পড়ে জেনেছে নবেন্দু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার। বরং সে আবাসনের সহানুভূতিই পেয়েছে। পরের বছর নবেন্দু ক্লাববদল করে প্রথম ডিভিশনের উয়াড়িতে এসে হঠাৎই বিখ্যাত হয়ে গেল মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলকে একটি করে গোল দিয়ে। অবশ্য ম্যাচ দুটি উয়াড়ি হেরে যায়।
ফুটবল মরশুম শেষ হতেই নবেন্দুর কাছে ওই দুটি ক্লাবের লোকেরা আসা—যাওয়া শুরু করে। পূর্ণেন্দু এরপর বিশ্বাস করতে শুরু করেন, লেখাপড়ার দিকে এগোতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে তার ছোটো ছেলে ঠিক পথেই গেছে। মায়ার মাথায় নবেন্দু ‘যদি ফুটবল খেলে বছরে পঞ্চাশ—ষাট হাজার রোজগার করতে পারি’ বলে উচ্চচাশার যে ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিল, সেটায় এবার তিনি দোতলা তুলে ফেললেন।
একদিন কথায় কথায় মায়া বললেন, ‘নবু একদিন বিয়েথা তো করবি, এ বাড়িতে বউ নিয়ে থাকবি কোথায়? আগে একটা বাড়ি করিস।’
ছায়া আর অমিয় সেখানে হাজির ছিল। ছায়া বলল, ‘না দাদা বাড়ি নয় ফ্ল্যাট, হাজার স্কোয়ার ফুটের।’
অমিয় বলল, ‘না না বাড়িই ভালো, মাসিমা ঠিকই বলেছেন, বাড়ি হল একটা নিজের ব্যাপার, নিজের রাজত্বে নিজে সম্রাট। ফ্ল্যাট বাড়ি তো পাঁচ ভূতের রাজত্ব। সিঁড়ির বালব ফেটে গেলে ছোটো সেক্রেটারির কাছে, দু দিন লাগবে বালব পালটাতে। গড়িয়ার দিকে এখনও জমি পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দশ কাঠা কিনেছি অফিস ফার্নিচার বানাবার কারখানা করব বলে। এখন পাঁচ হাজার টাকা কাঠা, তিন কাঠা এখনই বায়না করে ধরে রাখো। লোকে এখন বাড়ি করার জন্য হন্যে হয়ে জমি খুঁজছে। জমির দামও হু হু করে বাড়ছে। নবু যা করার এখনই কর, হাজার দশেক টাকা দিয়ে বায়না করে ফেল। পরে ক্লাব থেকে অ্যাডভান্সের টাকা পেলে বাকি টাকাটা চুকিয়ে দিও।’
নবেন্দু চুপ করে মুখে হাসি লাগিয়ে শুনে যাচ্ছে। শুনতে তার ভালোই লাগছে। সে বলল, ‘বায়নার দশ হাজার এখনই পাব কোথায়?’
অমিয় নাটকীয়ভাবে চোখ সরু করে মায়ার দিকে তাকাল। মায়া অবাক হয়ে ভাবলেন, এ আবার কী!
‘মাসিমা ছায়ার বিয়ের গয়না কী গড়ে ফেলেছেন?’
‘কেন বলো তো?’ মায়ার জিজ্ঞাসু চোখ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠল। তিনি ধরতে পেরেছেন অমিয় কেন একথা বলল। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে নেওয়া দশ হাজার টাকাকেই খোঁচাচ্ছিল। খোঁচাটা জ্বালা ধরাল।
‘না এমনি বললুম।’ অমিয় নির্লিপ্ত করে নিল মুখভাব।
‘এমনি এমনি বললে?’ মায়ার চোখে স্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠল। সেটা এড়াল না অমিয়র নজর। সে প্রমাদ গুনল, বলল, ‘বিশেষ কিছু ভেবে বলিনি মাসিমা।’
‘ভেবে বলোনি? দেখ অমিয় ছায়ার বিয়ের গয়না গড়িয়েছি কী গড়াইনি তাই নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই। বাইরের লোক তুমি, আমাদের ঘরের ব্যাপার নিয়ে বেশি মাথাব্যথা করো না। তুমি রবুর বন্ধু, দরকারের সময় আমাদের অনেক সাহায্য করেছ, ঠিক আছে। তাই বলে এতটা গায়েপড়া ভালো নয়।’ মায়া কর্কশ স্বরে গলায় তিক্ততা ঢেলে কথাগুলো বললেন।
মায়ার এমনভাবে ফেটে পড়ায় নবেন্দু এবং ছায়া বিস্ময়ের চূড়া স্পর্শ করল। তারা জানে মা খুব পছন্দ করে অমিয়দাকে। তলায় তলায় এতটা যে অপছন্দ করে কোনো দিনই বুঝতে পারেনি। মা যে ওকে ‘বাইরের লোক’ বলবে এটা তাদের কাছে কল্পনার বাইরে ছিল।
‘আমি অন্যায় করেছি মাসিমা, আমাকে ক্ষমা করবেন।’ অমিয় দু—হাত জোড়া করে বলল, মুখ শুকিয়ে গেছে এবং অপমানে কালো। মাথা নীচু করে সে বসে রইল। অস্বস্তিকর পরিবেশটা হালকা করতে প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য নবেন্দু বলে উঠল, ‘অমিয়দা তোমাদের দেশে যে নিয়ে যাবে বলেছিলে তার কী হল?’
অমিয় শুকনো হেসে বলল, ‘নিয়ে যাব। নতুন ব্যবসা এখন সারাক্ষণই লেগে পড়ে থাকতে হয়, দুটো দিনও বার করতে পারি না।’
নবেন্দু হালকা সুরে বলল, ‘বাড়ি করলে তোমাকে দিয়েই ইনটিরিয়র ডেকরেশনের কাজটা করাব।’
ছায়া থমথমে মুখে বসেছিল এবার সে দ্রুত ঘরে ঢুকে বালিশে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়ল। পূর্ণেন্দু ফ্ল্যাটের বাইরে ছিলেন এখন ফিরলেন হাতে তেলে ভাজার ঠোঙা।
‘একটা লোক ফুটপাথে বসে ভাজছে, আগে কখনো দেখিনি। অনেকদিন পলতার বড়া খাইনি দেখে লোভ লাগল।’ তিনি ঠোঙাটা মায়ার সামনে ধরলেন। মায়া মাথা নেড়ে নিতে অস্বীকার করে বললেন, ‘অম্বল হবে।’ পূর্ণেন্দু অমিয়র সামনে ধরলেন, সে একটা বড়া তুলে নিল। নবেন্দুও একটা তুলল। তিনি নিজেও একটা নিলেন, চেয়ারে বসে চিবোচ্ছেন তখন অমিয় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি এখন যাই।’
‘অমিয়দা দু মিনিট, আমিও বেরোব।’ নবেন্দু দ্রুত ঘরে গেল জামা ও ট্রাউজার্স পরে নিতে।
‘আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।’ অমিয় এই বলে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
নবেন্দু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজার দিকে যেতে যেতে মায়াকে বলল, ‘অমিয়দাকে এভাবে তোমার বাইরের লোক বলাটা উচিত হয়নি।’
পূর্ণেন্দু বিস্মিত চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। ‘কী বলেছ অমিয়কে?’
‘যা বলেছি ঠিকই বলেছি, বাইরের লোক নয়তো কী?’ মায়া নিজের অন্যায় বুঝতে পেরেও জেদ ধরে নিজেকে সমর্থন করলেন। ‘এমন একটা কথা বলল যে মাথা গরম হয়ে গেল, ছায়ার বিয়ের জন্য গয়না গড়িয়েছি কিনা! ছায়ার বিয়ে নিয়ে ওর কেন মাথাব্যথা তা কি আর বুঝি না? এ বাড়িতে এত আসা—যাওয়া এত মাসিমা মাসিমা করা সেকি আমার জন্য না রবুর জন্য। আস্তে আস্তে হাত বাড়াচ্ছিল ছায়ার দিকে।’
‘তাতে কী হল?’ পূর্ণেন্দু শেষ বড়াটা তুলে নিয়ে ঠোঙাটাকে মুঠোয় তালগোল পাকালেন, ‘ছায়াকে বিয়ে করতে চায়, এই তো।’
‘তুমি জানো অমিয় জাতে জেলে।’ মায়া তীব্র স্বরে বললেন।
‘তাতে কী হল!’ পূর্ণেন্দু তীব্র চোখে তাকালেন, ‘এইসব জাতগোত্তোর নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘামাতো। ছেলে হিসেবে অমিয় তো বেশ ভালোই। স্বাস্থ্যবান সুদর্শন, বাড়ির অবস্থা ভালো, নিজেও ব্যবসা শুরু করেছে, যথেষ্ট শিক্ষিত। তা হলে জাতের প্রশ্ন আসছে কেন?’
‘তুমি বলছ কী?’ মায়ার চোখ ফেটে বেরিয়ে এল আহত বিস্ময়। জেলের ঘরে মেয়ে দেবে? বামনু কায়েত হলেও নয় কথা ছিল। তোমার ভীমরতি ধরেছে আমার ধরেনি।’
মায়া ঝটকা দিয়ে চেয়ার সরিয়ে দাঁড়ালেন। রান্নাঘরে গিয়ে টিন খুলে আটা বার করে মাখতে শুরু করলেন। পূর্ণেন্দু বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে দিয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পর্দায় কী ভেসে উঠছে তা দেখতে পাচ্ছেন না। মাথার মধ্যে দপদপ করছে অন্ধ রাগ, তার মনের পর্দায় সায় দিয়ে ভেসে চলেছে মৃতদেহ, প্রত্যেকটাই মায়ার। কোনোটা মুণ্ডবিহীন ধড়। কোনোটার বুকে ছোরা বসান, কোনটা আগুনে পোড়া, কোনোটার শরীর পচে ফুলে উঠেছে। পূর্ণেন্দু টিভি বন্ধ করে সোফায় পা গুটিয়ে শুয়ে পড়লেন। শরীরটা কেমন করছে।
কলিংবেল বাজাল। মায়া দরজা খুললেন, রবিন্দু ফিরল। পূর্ণেন্দু শুনতে পেলেন মায়া জিজ্ঞাসা করছেন, ‘আজ যে তোর এত দেরি হল?’
‘বোস সাহেবের বাড়িতে গেছলুম। ওর ছোটো ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, অঙ্কে কাঁচা। আমায় বললেন একটু দেখিয়ে দিতে। ওর সঙ্গেই গাড়িতে সল্টলেকে গেলুম। ছেলেটা সত্যিই কাঁচা। কী করে যে ক্লাস টেন পর্যন্ত উঠল কে জানে! আমি এখন আর কিছু খাব না, লুচি বেগুনভাজা খেতে দিয়েছিল, সন্দেশও।’
‘হঠাৎ তোকে কেন অঙ্ক পড়াতে বলল?’
‘আমার হায়ার সেকেন্ডারির মার্কশিট উনি দেখেছেন তো তাইতে ওর ধারণা হয়েছে অঙ্কটা আমি ভালো জানি।’
‘তোর সম্পর্কে তাহলে ওনার ধারণা ভালো।’
পূর্ণেন্দু, মায়ার গলায় চাপা উচ্ছ্বাসের আভাস পেলেন।
‘মনে তো হয় ভালো।’
‘রোজ পড়াতে হবে?’
‘তেমন কিছু বলেনি। আমি বললুম হপ্তায় দুদিন এসে অঙ্ক দেখিয়ে দিয়ে যাব। আমাদের এখান থেকে বাসে তো মিনিট দশেক সল্টলেকের বি সি ব্লক। অফিস থেকে বেরিয়ে সল্টলেক হয়ে বাড়ি ফিরব।’
জুতো খুলে জামা প্যান্ট বদল করতে করতে রবিন্দু কথা বলে চলেছে। চাকুরিদাতাকে খুশি করতে পারার জন্য প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব ওর গলার স্বরে। পূর্ণেন্দুর কানে সেটা ধরা পড়ল।
মায়া জানতে চাইলেন, ‘কিছু দেবে টেবে বলল?’
‘বলেনি।’
‘তুই কিছু যেন বলতে যাসনি। যদি নিজে থেকে কিছু বলে তো বলুক।’
‘এরকম টিউশনিতে কত টাকা মাস্টারকে দেয়?’
‘একশো টাকা তো বটেই।’
‘টাকার কথা তুললে বলবি নোব না। একশো টাকা অবশ্য বোস সাহেবের কাছে কোনো টাকাই নয় কিন্তু ছেলের পাশ—ফেল করাটা মানমর্যাদার ব্যাপার। ছেলেটা পাশ করলে অফিসে তোর ভালোই হবে।’
পূর্ণেন্দু বাথরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলেন। রবু স্নান করতে গেল। এরপরই তিনি ছায়ার গলা পেলেন। মেয়েটা এতক্ষণ শোবার ঘরে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়েছিল।
‘অমিয়দাকে ওভাবে অপমান করাটা তোমার উচিত হয়নি মা।’ ছায়া একটা বোঝাপড়া করতে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। বি. এ. সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে, এখন তার ব্যক্তিত্ব কিছুটা কঠিন হয়েছে। ‘এত বছর আসা—যাওয়া করছে, বাবাবাছা করে ওকে দিয়ে কতরকমের কাজ করিয়ে নিয়েছো, ওর কাছ থেকে কত উপকার পেয়েছো, তখন তোমার মনে ছিল না ও বাইরের লোক?’
পূর্ণেন্দু ইচ্ছে হল দেখতে এখন মায়ার মুখটা কেমন দেখাচ্ছে। রাগে চোখ দুটো দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে না জ্বরগ্রস্ত চোখের মতো স্তিমিত।
‘মনে ছিল না। কিন্তু সব রকম সম্পর্কেরই একটা সীমা আছে। কিন্তু ও সীমা ছাড়িয়ে কথা বলেছিল বলেই মনে পড়ল।’
‘কী কথা! সেই দশ হাজার টাকা নেওয়ার কথা তো? অমিয়দা আমাকে বলেছে কীভাবে ওই টাকা তুমি পেয়েছ। কীভাবে তুমি হরেন রায়চৌধুরীর কাছ থেকে টাকাটা আদায় করেছিলেন। আমার চোখের সামনে গুনে গুনে টাকা তুমি ব্যাগে ভরেছিলে।’
পূর্ণেন্দু কান খাড়া করলেন। তার মনে পড়ল অমিয় বলেছিল অমনি অমনি ঘর ছেড়ে দেবেন! কিছু টাকা বাড়িওয়ালার কাছ থেকে আদায় করে নিন, এভাবে সবাই নেয়, মায়া তখন অমিয়র কথাগুলোকে সমর্থন করেছিল। মায়া কী দশ হাজার টাকা আদায় করেছিল! আশ্চর্য, কিছুই আমি জানি না এতদিন ধরে।
‘যেভাবেই আমি টাকা আদায় করি না কেন, যেভাবেই আমি গুনে গুনে ব্যাগে ভরি না কেন তাতে তোর কী? গয়না আমি ঠিকই গড়িয়েছি আর সেটা তোরই জন্যে।’ মায়া প্রাণপণ চেষ্টা করছেন গলা চেপে কথাবলার জন্য। ছোটো ফ্ল্যাট একটু জোরে কথা বললে সব ঘর থেকে শোনা যাবে। এমনকী বন্ধ বাথরুমেও।
‘এতগুলো টাকা অমিয়দা না বলে দিলে তুমি পেতে না আর তাকেই বিনা বাইরের লোক বললে? ও যদি বাইরের লোক হয় তাহলে ভেতরের লোক কে?’
‘যেই হোক, জেলে কৈবত্তর ছেলেকে ভেতরের লোক করতে পারব না। তুই ওর হয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করছিস কেন তা কী আমি বুঝি না? কিন্তু জেনে রাখিস এই বদ্যি বংশের একটা মর্যাদা আছে, আত্মীয়স্বজনের কাছে মাথা উঁচু করে আমরা থেকেছি, থাকবও। এ বংশের সঙ্গে অমিয়র সম্পর্ক গড়তে আমি দোব না। তুই আর তোর বাবা যতই আধুনিক হোস এখনও জাত—বর্ণ—গোত্তর বংশ কৌলিন্যের দাম সমাজে আছে। ছায়া, সংস্কার মেপে চলতে হয়। লেখাপড়া আমিও কিছুটা শিখেছি।’ এতগুলো কথা গলা চেপে বলতে গিয়ে মায়া হাঁফিয়ে উঠলেন। শেষ দিকে কণ্ঠস্বরে অধৈর্য ফুটে উঠল। পূর্ণেন্দু ভাবলেন এখন ঘর থেকে বেরোবেন কি না, তাকে দেখলে মায়া হয়তো চুপ করে যাবে। বেরোতে গিয়ে দেখলেন বাথরুমের দরজা খুলে রবু একদৃষ্টে মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মায়াও একদৃষ্টে ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, পূর্ণেন্দু ঘর থেকে বেরোলেন না, টিভি খুলে বসে রইলেন।
অমিয় আর এই ফ্ল্যাটে আসেনি, ছায়া বউবাজারে অমিয়দের দোকানে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করে। টেবিলে মুখোমুখি বসে অমিয় নম্র কিন্তু কঠিনভাবে তাকে বলে, ‘উঁচুজাতের মেয়েকে বিয়ে করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে আমার নেই। তুমি জাত—গোত্র মিলিয়ে কোনো ছেলেকে বিয়ে করে নিও। দেখতে সুন্দরী, লেখাপড়া শিখেছে, পাত্রের অভাব হবে না।’
ছায়া বলে, ‘আমরা তো রেজিস্ট্রি বিয়ে করে নিতে পারি।’
অমিয় বলে, ‘তা পারি। কিন্তু লুকিয়ে এভাবে বিয়ে করলে তো একরকম মেনেই নেওয়া হবে এই উঁচু জাত—নীচু জাত সংস্কারটাকে। আমি টোপর পরে সানাই বাজিয়ে নিজের জাতকুলের পরিচয় জানিয়ে বিয়ে করতে চাই। তোমার মা কি তা মেনে নেবেন?’
ছায়া মাথা নাড়ে। ‘বাবা মেনে নেবে কিন্তু মা নয়।’
‘তাহলে!’ অমিয় দু—হাতে টেবিল চাপড়ায়। ‘ল্যাঠা চুকেই গেল, তোমার মা—র ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাবা যেতে পারবেন না, আমি জানি।’
ছায়াও জানে। সে চুপ করে ছলছল চোখে শুধু তাকিয়ে রইল।
‘সংসারে অশান্তি গন্ডগোল পাকিয়ে লাভ কী ছায়া।’ অমিয় আড়চোখে দেখল দোকানের দু—জন কর্মচারীর একজন খাটে শিরিষ কাগজ ঘষছে, অন্যজন টেবিলে বার্ণিশ লাগাচ্ছে। ওরা তাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। দোকানে খদ্দের নেই এখান থেকে কথাবার্তা ওদের কানে পৌঁছচ্ছে না বটে তবে ছায়ার চোখমুখের ভাব তো দেখতে পাচ্ছে। অমিয় অস্বস্তি বোধ করল।
‘তুমি এখন যাও ছায়া।’
‘তাড়িয়ে দিচ্ছ।’
অমিয়র এতক্ষণের কাঠিন্য, কণ্ঠের কর্কশতা এবার ভেঙে পড়ল। তার মুখে বেদনার আভাস ফুটে উঠল। গাঢ়স্বরে প্রায় অস্ফুটে সে বলল, ‘ছায়া এই বুকের মধ্য থেকে জীবনে কখনো তোমার ছায়া সরবে না। আমার কষ্ট আমার যন্ত্রণা আমার ভালোবাসা আজীবন তোমার ছায়াকে ঘিরে থাকবে।’ অমিয়র গলা কেঁপে উঠল। সে আলতো করে হাত রাখল টেবিলে রাখা ছায়ার হাতের উপর।
‘ভালোবাসার থেকেও বড়ো হল তোমার জেদটা।’ ছায়ার গলার অভিযোগ আর অভিমান।
অমিয় হাসার চেষ্টা করলে তাইতে মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল। ‘পুরুষ মানুষের অনেক রকম দোষ থাকে যেগুলো সে কাটিয়ে উঠতে পারে না বা চায় না তার একটা হল আত্মমর্যাদা বোধ। এটা নষ্ট হলে আমি আর আমি থাকব না।’
দোকানে ঢুকল এক প্রৌঢ় দম্পতি। তারা তিনটি ড্রেসিং টেবিলের একটির সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। একজন কর্মচারী গেল তাদের কাছে। ছায়া উঠে দাঁড়াল, ‘আমি যাই। তবে জেনে রেখো মর্যাদাবোধটা মেয়েদেরও আছে। আমি আর কখনো আসব না।’
অমিয় ছায়ার সঙ্গে দোকানের দরজা পর্যন্ত গেল। ছায়া আর একটি কথাও বলল না, অমিয়র চোখে লহমার জন্যও চোখ রাখল না। দোকান থেকে বেরিয়ে সে ক্লান্ত মন্থর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। যতক্ষণ ওকে দেখা যায় অমিয় দেখল।
এরই দিন কুড়ি পর বিকেলে কলিংবেল বাজতে পূর্ণেন্দু দরজা খুললেন। এখানকারই এক গৃহিণী দাঁড়িয়ে থাকে তিনি সন্ধ্যাবেলায় আবাসনের মধ্যে একাকী প্রায় পনেরো মিনিট ধরে জোরে হাঁটতে দেখেন। সম্ভবত সুগারটা বেশি। চোখে চশমা, ফর্সা গায়ের রঙ, মুখ সুশ্রী। বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্নর মধ্যে। থাকেন বোধহয় তিন ঘরের ‘বি’ ব্লকের দোতলায় শুভেন্দু হালদারের পাশের ফ্ল্যাটে। পূর্ণেন্দু অবাকই হলেন। তার পাশের ফ্ল্যাটের বউটি ছাড়া গত ছ—বছরে আর কাউকে বিশেষ আসতে দেখেননি।
ভদ্রমহিলা ঘোমটায় ছোটো একটা টান দিয়ে লাজুকভাবে হাসলেন, বাধ্য হয়ে পূর্ণেন্দুও হাসলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল তার গেঞ্জির বগলটা ছেঁড়া।
‘মিসেস গুপ্ত আছেন?’
‘আছেন, ভেতরে আসুন।’
মায়া চা করেছিলেন, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এত দিন একসঙ্গে রয়েছি প্রায় রোজ তো আপনাদের দেখি অথচ আলাপ পরিচয় হয়নি।’
পূর্ণেন্দু প্রায় বলতে যাচ্ছিল, সেটা কী এতদিন পর মনে পড়ল। নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ইনি এসেছেন।
মায়া হেসে বললেন, ‘আমিও তো আপনাকে রোজ দেখি সন্ধেবেলায় আমার বারান্দার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। অবশ্য তখন আপনাকে দাঁড় করিয়ে আলাপ করা সম্ভব নয়। আসুন ঘরে আসুন।’
ভদ্রমহিলাকে নিয়ে মায়া বসার ঘরে ঢুকলেন। পূর্ণেন্দু শোবার ঘরে গেলেন পাঞ্জাবি পরে নিতে। ছায়া এখনও কলেজ থেকে ফেরেনি। অন্য ঘরে নবেন্দু এখনও ঘুমুচ্ছে।
‘চা করছি, খাবেন?’
‘আধ কাপ, চিনি ছাড়া।’
তখন পূর্ণেন্দু ঘরে ঢুকলেন। ‘আপনার কী সুগার বেশি?’
ভদ্রমহিলা স্মিত হেসে মাথা হেলালেন।
মায়া বললেন, ‘আপনার নাম কিন্তু এখনও জানা হয়নি। নাম না জেনে আলাপ করতে খুব অসুবিধে হয়। আমার নাম মায়া, ওনার নাম পূর্ণেন্দু আমাদের পদবি গুপ্ত।’
‘ওনার নামটা জানি আপনারটা জানতুম না। আমার নাম বাসন্তী দাসগুপ্ত। থাকি বি ব্লকে দোতলায় তিন নম্বরে। এই হাউজিংয়ে বদ্যি শুধু আমাদের এই দুটো পরিবার।’ বাসন্তী তাকালেন এমনভাবে যেন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে ঘুরতে হঠাৎ লোকালয় দেখতে পেলেন। মায়া চা আনতে গেলেন।
‘এখানে আসার আগে আপনারা কোথায় থাকতেন?’ পূর্ণেন্দু আলাপটাকে সচল রাখার জন্য কথা পাড়লেন।
‘থাকতুম হাতিবাগানে। শ্বশুরদের শরিকি বাড়ি, খুব অসুবিধে হত।’
‘আপনার কথায় বাঙালে টান পাচ্ছি। দেশ কোথায় ছিল?’
‘বরিশালে, ঝালকাঠিতে। আপনাদের?’
‘গুপ্তিপাড়ায়।’
‘আমি এসেছি কিন্তু একটা বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে।’ বাসন্তী ঘোমটায় চিমটি কেটে টান দিলেন। মুখে মৃদু হাসি ফোটালেন। পূর্ণেন্দু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলেন। একটা প্লাস্টিকের ট্রে—তে তিন কাপ চা নিয়ে ঢুকলেন মায়া। দুজনে একটি করে কাপ তুলে নিল, মায়া তৃতীয়টি হাতে নিয়ে বসলেন।
‘বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমি এসেছি।’ কাপে চুমুক দিয়ে বাসন্তী শুরু করলেন। ‘আপনাদের মেয়েটিকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের একমাত্র ছেলে সুকুমার এমটেক. পাশ করে বোম্বাইয়ে বিলিমোরিয়া অ্যান্ড ওয়াদওয়ানি নামে খুব বড়ো একটা কনস্ট্রাকশন ফার্মের প্ল্যানিং ডিভিশনে চাকরি পেয়েছে। আমাদের ইচ্ছে ও বোম্বে যাওয়ার আগেই ওর বিয়ে দিয়ে দি। আপনাদের মেয়ের নাম তো ছায়া, আপনারা বোধহয় সুকুকে দেখেছেন কিংবা দেখে থাকলেও হয়তো তেমন করে লক্ষ করেননি। সুকুরও পছন্দ হয়েছে ছায়াকে।’ টানা বলে গিয়ে বাসন্তী থামলেন। পূর্ণেন্দু মনে মনে তারিখ করল ওর গুছিয়ে বলার ভঙ্গি এবং উচ্চচারনকে, ইতিহাস বা অর্থনীতির ভালো ক্লাস নিতে পারবেন, এই মহিলা।
মায়া দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে পূর্ণেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার চাহনিতে নির্দেশ, যা বলার তুমিই বল। নির্দেশটা আন্দাজে বুঝে পূর্ণেন্দু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘এতো আমাদের কাছে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। কী বল?’ তিনি অনুমোদনের জন্য মায়ার দিকে তাকালেন।
‘নিশ্চয়’। অপ্রত্যাশিত আনন্দের ধাক্কায় মায়ার বুকের মধ্যে হাসফাঁস শুরু হল। তিনি কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলেন অমিয়র প্রতি টানটা থেকে ছায়াকে বার করে আনতে হলে এখুনি ওকে একটা ভালো ছেলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া দরকার। বিএ পাশ করার জন্য অপেক্ষা করে থাকার নেই। ওদের সম্পর্কটা কতটা গভীর তা তিনি জানেন না। বিয়ের ব্যবস্থা করলে ছায়া বেঁকে বসবে কিনা, সেটাই শুধু তাকে উদবিগ্ন করে তুলল।
‘সুকুর এখন মাইনে হবে তিন হাজার টাকা, ফার্নিশড কোয়ার্টার পাবে। ওর ইচ্ছে একেবারে বউ সঙ্গে নিয়েই কাজে জয়েন করবে।’ গুপ্ত দম্পতির মুখভাবে আপ্লুত ভাব লক্ষ করে বাসন্তীর কণ্ঠস্বরে ভারিক্কি চাল এসে গেল।
‘কিন্তু ছায়া তো এখন সেকেন্ড ইয়ারে। গ্র্যাজুয়েশনটা তাহলে হবে না এখন বিয়ে হলে।’ পূর্ণেন্দু দোটানা ভাব দেখালেন।
বাসন্তী বললেন, ‘বোম্বাইয়ে গিয়েও তো পড়াশুনো চালাতে পারবে।’
মায়ার কপালে ভাঁজ পড়ল। পূর্ণেন্দু আবার পড়াশুনোর ফ্যাকড়া তুলল কেন? যত তাড়াতাড়ি ছায়ার বিয়ে হয়ে যায় ততই ভালো। এমন ছেলে হাতছাড়া করলে আর কী এত ভালো পাত্র পাওয়া যাবে। দরকার কী ছায়ার বি.এ. পাশ করার, ওতো আর চাকরি করতে যাবে না। মায়া তাড়াতাড়ি বাসন্তীর কথার খেই ধরে জুড়ে দিলেন, ‘বোম্বাইয়ে অনেক ভালো ভালো কলেজ আছে শুনেছি, ছায়ার কোনো অসুবিধে হবে না।’
পূর্ণেন্দু মায়ার কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘সুকুমারকে তো একবার দেখতে হয়, একটু আলাপ করতে পারলে ভালো হত।’
‘নিশ্চয় আলাপ করবেন। যাকে জামাই করবেন তাকে তো আগে যাচাই করে নেবেনই। আলাপ করে আপনি খুশিই হবেন। একটু লাজুক মুখচোরা, স্বভাবটা খুব শান্ত। গান ভালোবাসে, কোনোরকম নেশা নেই, সব সময় বই হাতে। আসুন না রবিবারে, উনি সিটি সিভিল কোর্টে চাকরি করেন। ছায়াকেও সঙ্গে করে আনবেন, সেও দেখুক তারও তো পছন্দের ব্যাপার আছে। আপনার বড়ো ছেলেটিও যদি আসে তাহলে খুবই ভালো হয়, ভারী সুন্দর দেখতে, সিনেমায় নামার মতো চেহারা।’
বাসন্তীর কথা থেকে দুজনেই বুঝল এই বিবাহ প্রস্তাবের পিছনের কারণ ছায়ার সৌন্দর্য। রবিন্দু এই আবাসনের সকলের চোখে পড়েছে। তার কান্তির জন্য।
‘বিয়েটা হলে, কবে দিতে চান?’ মায়া জানতে চাইলেন।
‘পয়লা ফেব্রুয়ারি আঠারোই মাঘ সুকুর জয়েনিং ডেট। চোদ্দোই মাঘ বিয়ের একটা তারিখ আছে সেদিনই হতে পারে।’ বাসন্তী জানালেন।
পূর্ণেন্দুর মনে হল বাসন্তী দাশগুপ্ত বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক করে বলতে এসেছেন। উনি ধরেই নিয়েছেন এই বিবাহ প্রস্তাব গুপ্ত পরিবার খারিজ করতে পারবে না, করার মতো জোরালো অবস্থা নয়। দু ঘরের ফ্ল্যাটে যারা বাস করে তাদের পুঁজিপাটা কতটা থাকতে পারে সে সম্পর্কে এই মহিলা যেন স্বচ্ছ একটা ধারণা তৈরি করে রেখেছেন। পূর্ণেন্দুর ইচ্ছে করল বিয়েটায় রাজি না হয়ে ধারণাটা ভেঙে দিতে। চার—পাঁচ সেকেন্ড পরেই তিনি ইচ্ছেটা প্রত্যাহার করে নিয়ে হাঁফ ছাড়লেন। মনে মনে নিজেকে বললেন বয়স হয়েছে, এখন তুমি অবসরপ্রাপ্ত এখন যে কোনোরকম হঠকারিতা তোমার বা পরিবারের পক্ষে হিতকর হবে না। তুমি এখন আর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নও, এই মহিলাও তোমার ছাত্রী নন। এর ছেলেটি সোনার টুকরো তার সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সুযোগটা নষ্ট কোর না।
মায়া চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘মাঘ মাস তো এসে গেল আর তো মাত্র ক—টা দিন হাতে। এর মধ্যে সবকিছু জোগাড়যন্ত্র করা তো সম্ভব হয়ে উঠবে না।’
বরাভয় দেবার ভঙ্গিতে বাসন্তী ডান হাত তুলে বললেন, ‘আরে রাখুন তো জোগাড়যন্ত্র। শুধু শাঁখা সিঁদুর দিয়েই বউ নিয়ে যাব। ঠাকুরের কৃপায় আমার কোনো অভাব নেই।’ বাসন্তী উঠে দাঁড়ালেন। ‘ছায়া বোধহয় কলেজে, কোনোদিন কথা বলা হয়নি ওর সঙ্গে। রবিবার বিকেলে তাহলে আসছেন বড়ো ছেলে আর ছায়াকে নিয়ে।’
বাসন্তীকে বাড়ির বাইরে মাঠ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন পূর্ণেন্দু ও মায়া। ফ্ল্যাটে ফিরে এসে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘কথা থেকে মনে হল আমাদের সম্পর্কে ভালোই হোমওয়ার্ক করে তবে এসেছেন। নবুর নাম পর্যন্ত করল না। থানা পুলিশ কোর্ট জামিন করেছে বলেই বোধহয় ক্রিমিনাল তাই নবুকে যেতে বলল না। কিন্তু আমরা তো ওদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। ওরা বদ্যির ছদ্মবেশে নমোশুদ্দুর কিনা, ছেলেটি আসলে এম. টেক. না হায়ার সেকেন্ডারি, বোম্বাইয়ের চাকরিটা বেয়ারার না প্ল্যানারের এ সবের খবরাখবর নেওয়া দরকার, কিন্তু কে নেবে? ছেলেটিকে শুধু চোখের দেখা দেখে আর দুটো কথা বলেই কী সব জানা বোঝা হয়ে যায়? শরীরে কোনো রোগ—টোগ আছে কিনা সেটাও তো জানা যাবে না। তবু ভালো কুষ্ঠি—ঠিকুজির কথা তোলেনি।’
.
‘হ্যাঁ এতেই সব জানা বোঝা হয়ে যায়।’ মায়া হালকা গলায় বললেন। এখন তার সারা দেহে বইছে স্বস্তির আর সুখের প্রবাহ। ছায়ার জন্য এমন একটা সুপাত্র বাড়ি বয়ে এসে ধরা দেবে, এমন ব্যাপার তো রূপকথার গল্পেই ঘটে। ‘আমার বাবা তো তোমাকে মিনিট দশেক দেখেই পছন্দ করেছিল, বাড়িতে এসে বলেছিল একটা ভালো ছেলে পেয়ে গেছি।’ মায়া অনেকদিন পর তার যৌবনকালের হাসি হাসলেন।
পূর্ণেন্দু বললেন, ‘ছায়ার মতামতটা আগে নেওয়া উচিত। আমরা রাজি হলেই তো হবে না যার বিয়ে তাকে আগে জিজ্ঞাসা করা দরকার। তোমাকে করেনি?’
‘না।’ মায়া জবাব দিয়েই যোগ করলেন, ‘বাবার পছন্দ হয়েছে তারপর আর জিজ্ঞাসা করার কী থাকতে পারে!’
‘এখন অন্যরকম দিনকাল, ছায়ার মতটা জানা দরকার। তোমার আমার পছন্দ হলেই তো হবে না। মেয়েরও নিজস্ব পছন্দ আছে।’
‘মত জানতে তুমিই ওর সঙ্গে কথা বল।’ মায়া দায়টা স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও তাকে নিশ্চিন্ত দেখাল না।
আধঘণ্টা পর ছায়া কলেজ থেকে ফিরল। তারও আধঘণ্টা পরে পূর্ণেন্দু ছায়াকে ডাকলেন।
‘আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। বিকেলে কলিংবেল বাজতে দরজা খুলে দেখি এখনকার এক মহিলা দাঁড়িয়ে। তুই নিশ্চয় তাকে দেখেছিস, বি ব্লকের দোতলায় চার নম্বর ফ্ল্যাটে থাকে।’
ছায়া বলল, ‘দাসগুপ্ত?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’
‘ওদের মেয়ের সঙ্গে অনেকদিন আগে একবার পরিচয় হয়েছিল, ডাল, বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। খুব সিনেমা দেখে আর শুধু তারই গপ্পো। মহিলা মানে ওর মা এসেছিল, হঠাৎ?’
‘ওর একটি ছেলে আছে তারই জন্য বিয়ের সম্বন্ধ করতে।’ কথাটা বলে পূর্ণেন্দু মেয়ের মুখভাব লক্ষ করতে লাগলেন, ছায়ার কৌতূহলী মুখ পলকের জন্য গম্ভীর হয়ে স্বাভাবিক হল।
‘সম্বন্ধ কি আমার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য?’ সহজ স্বরে ছায়া জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ।’ পূর্ণেন্দু আটকে যাওয়া শ্বাসটা স্বস্তিতে বার করলেন। ‘ছেলেটি লেখাপড়া করেছে। এম. টেক.। বোম্বাইয়ে ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। ওখানেই থাকবে। ছেলেটিকে নিশ্চয় দেখেছিস, সুকুমার নাম।’
স্বাভাবিক স্বরে ছায়া বলল, ‘হ্যাঁ দেখব না কেন। ভালো ছেলে। তুমি দেখেছ?’
‘হয়তো দেখেছি। এখানে তো কতই ছেলে রয়েছে। আমার পক্ষে ছেলেছোকরাদের সঙ্গে আলাপ করা তো সম্ভব নয়। রোববার ছেলেটিকে দেখতে যাব। কিন্তু তার আগে তোর মতামত আমাদের জানা দরকার। অমত থাকলে ওদের জানিয়ে দেব আর মত থাকলে দেখতে পাব।’ পূর্ণেন্দু অনুভব করছেন জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবার ছায়াকে নিতে হবে। যদি হ্যাঁ বলে তাহলে তো সমস্যার কিছু থাকবে না। যদি না বলে তাহলে সমস্যা তৈরি করবে ওর মা।
‘তুমি বললে বিয়ের পর বোম্বাইয়ে থাকবে, তাই তো?’ ছায়া যাচাই করার জন্য প্রশ্নটা করল।
‘হ্যাঁ তাই তো বললেন ভদ্রমহিলা।’
ছায়া দ্বিতীয়বার আর ভাবল না, বলল, ‘আমার আপত্তি নেই। তুমি রোববার গিয়ে ছেলে দেখে আসতে পার।’
‘তোকেও যেতে হবে। উনি চান তুইও সুকুমারের সঙ্গে আলাপ করিস। রবুকেও যেতে বলেছেন।’
ছায়া অসহায়ের মতো গলায় বলল, ‘আমি আবার কী আলাপ করব। বিয়ে যখন হবেই তখন এইরকম আলাপটা একেবারেই ফালতু ব্যাপার। ধরো আলাপ করে খুব খারাপ লাগল, তাহলে কি সম্বন্ধ ভেঙে যাবে?’
পূর্ণেন্দু জবাব দিলেন না। ছায়ার নিস্পৃহভাবে কথা বলার ধরনটা তাকে ভাবাল। বিয়ের কথায় যে স্বাভাবিক লজ্জা মেয়েদের চোখেমুখে আলতো একটা মেদুর প্রলেপ লাগায় ছায়ার মুখে বা কণ্ঠস্বরে তার ছিটেফোঁটাও তিনি পাচ্ছেন না। ও কি বাবা—মাকে খুশি করার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হল!
‘তুই ভেবে চিন্তে মত দিচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ দিচ্ছি। বিয়ে একদিন না একদিন তো করতেই হবে।’
‘রোববার আমরা তাহলে যাচ্ছি, তুইও।’
রবিবার বিকেলে সদরে তালা দিয়ে ওরা চারজন দাসগুপ্তের ফ্ল্যাটের উদ্দেশে রওনা হল। বেরোবার আগে মারা আলমারিতে রাখা শাড়ির তলা থেকে, পূর্ণেন্দু পাঁচ বছর আগে কলেজে যেতেন যে পাটকরা চাদরটি বাঁ কাঁধে ফেলে, সেটি বার করে হাতে দিয়ে বলেন, ‘এটা নাও।’ অনেকদিন পর চাদরটি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে তিনি খুশি হলেন। রবিন্দু মন্তব্য করে, ‘বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ফর্মে আবার ফিরে এসেছে।’ ছায়াকে সিল্কের শাড়ি পরতে বলেছিলেন মায়া, সে পরেনি। বলেছিল, ‘আমি তো ছেলে দেখতে যাচ্ছি, দরকার কী আমার সাজগোজের।’ নবেন্দু প্রতি রবিবার সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ফেরে রাত্রে। ফিরে বলে ‘সমরেশদার বাড়িতে খাইয়ে দিল।’
কলিং বেলের বোতাম টিপল রবিন্দু। তার পিছনে পূর্ণেন্দু সবার শেষে দাঁড়িয়ে ছায়া। দরজা খুলল সুকুমারের বোন সীমন্তি। মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘আসুন।’
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ গায়ের রঙ, ঘনজোড়া ভুরু, নীচের ঠোঁটটি উপরের তুলনায় পুরু তাতে গাঢ় লাল রঙ, লাল রিবন বাঁধা কোঁকড়া চুল পিঠে ছড়ান, কপালটি ছোটো। লম্বা দেহ, ছিপছিপে গড়ন। একে দেখে কেউ মেলাতে পারবে না বাসন্তীর সঙ্গে। সীমন্তি যার মুখশ্রী ও রঙ পেয়েছে তিনি পিছনেই দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে অভ্যর্থনা জানালেন। ছ—ফিটের উপর লম্বা, শীর্ণ দেহ কোমর থেকে নোয়ানো, মাথার সামনের অর্ধেকটায় চুল নেই, সিল্কের পাঞ্জাবি চেক লুঙ্গি পরনে, দু—হাতের আঙুলে পাথর বসানো চারটি আংটি।
‘আসুন আসুন, আমি সুকুমারের বাবা সূর্যশেখর গুপ্ত।’ মাথা নোয়ালেন বিনয় দেখিয়ে। কথা বলার সময় সামনের বড়ো বড়ো দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।
চন্দনধূপের গন্ধে ঘর ম—ম করছে। ঘরটা বড়ো। দেওয়াল ঘেঁষে সমকোণে দুটি সোফা। দুটি চেয়ার, কাচের ছোটো সেন্টারটেবল। টেবলে ফুলদানিতে রজনিগন্ধার ছড়। বিপরীতে একটা কাচের পাল্লার আলমারিতে রবীন্দ্র রচনাবলীর সেট, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল লক্ষ্মীসরা দেওয়ালে সাঁটা। একসঙ্গে বসা রামকৃষ্ণ—সারদামণির রঙিন ছবি ছাড়া আর কোনো ছবি নেই। ছবিতে বেলফুলের মালা জড়ানো, চন্দনের ছিটে লাগা। ঘর দেখে যেমন প্রীত হলেন পূর্ণেন্দু তেমনি সন্দিহানও। ছেলেও কী হবে নাকি বাবার মতো দেখতে? আস্বস্ত হলেন বাসন্তীর সঙ্গে সুকুমারকে ঢুকতে দেখে, মা হাত ধরে টেনে আনলেন নত মুখ লাজুক ছেলেকে। পূর্ণেন্দু হাঁফ ছাড়লেন, সুকুমার মায়ের মতোই দেখতে। সাধারণ উচ্চচতা, একটু মোটা গড়ন, পাজামা পাঞ্জাবি পরে থাকলেও পূর্ণেন্দুর মনে হল সামান্য ভুঁড়ি আছে। পাতাকাটা চুলের ডগা কপালের উপর এসে পড়েছে। বয়স তিরিশের নীচে মনে হয়, সুকুমারকে বোধহয় আবাসনেই দেখে থাকবেন, মুখটা চেনা লাগছে।
বাসন্তী ছেলেকে পূর্ণেন্দু ও মায়ার মাঝে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই দেখুন ছেলেকে।’ তিনি গিয়ে বসলেন অন্য সোফাটিতে ছায়ার পাশে। পূর্ণেন্দু বিব্রত বোধ করলেন। কথা বলতে হবে, কিন্তু কী কথা বলবেন? বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না, তিনি ইতিহাসের লোক। একে কী জিজ্ঞাসা করা যায় পলাশীর যুদ্ধে নবাবের ফৌজের হার কী কী কারণে হয়েছিল? ছায়া মুখ ঘুরিয়ে আলমারির দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্র রচনাবলী দেখছে। রবু ফর্সা মুখটা লম্বা করে কাঠ হয়ে বসে কেননা সীমন্তি একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। একঘর লোকের মাঝে একটি তরুণের মুখের দিকে পরিচয় না থাকা কোনো তরুণী এভাবে তাকিয়ে থাকলে, পূর্ণেন্দুর ধারণায় মেয়েটি বেহায়া অথবা বোধ বুদ্ধিহীনা।
তুমি কোন স্কুলে পড়েছ? অবশেষে পূর্ণেন্দু শুরু করতে পারলেন।
‘হিন্দু স্কুলে।’ সুকুমারের গলাটি মিহি, নম্র স্বর, প্রায় শোনাই গেল না।
‘কলেজ?’
‘প্রেসিডেন্সি।’
‘রবীন্দ্র রচনাবলী কি তুমি কিনেছ?’
‘না।’
পূর্ণেন্দু তাকালেন বাসন্তীর দিকে। ছায়ার একটা হাত কোলে নিয়ে বাসন্তী তখন অভিযোগের সুরে বলছেন, ‘সাজগোজের দিকে এত অমনোযোগী কেন, মুখে একটু কিছু তো লাগাবে, চুলটাও ঠিকমতো বাঁধোনি।’
ছায়া উত্তর না দিয়ে হাসল। মায়া বললেন, ‘ও ছোটোবেলা থেকেই অমন। নিজের সম্পর্কে একটুও হুঁশ নেই।’
বাসন্তী বললেন, ‘সুন্দর মেয়েরা ধরেই নেয় তাদের আর সাজগোজের দরকার কী, খোদার উপর খোদকারী না করলেও চলে। সাজলে—গুজলে রূপ যে আর একটু খোলে তাতে পাঁচটা লোকের যে চক্ষু সার্থক হয় এটা ওরা বোঝে না।’
পূর্ণেন্দু দেখলেন ছায়ার চোখে বিরক্তি ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল।
‘তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়েছ?’ পূর্ণেন্দু সুকুমারকে নিয়ে পড়লেন।
‘সব নয়, কিছু কিছু।’
‘ওর কোনো রচনা তোমার ভালো লাগে, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ না নাটক?
‘কবিতা।’
পূর্ণেন্দু ইচ্ছে হল বলতে, একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবে? বললেন না।
‘রবীন্দ্রসংগীত?’
‘রোজ রাতে শুনি, ক্যাসেট।’
পূর্ণেন্দু ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার নম্বর দিলেন সুকুমারকে।
সূর্যশেখর একটা চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি রবিন্দুকে নিঃসঙ্গ দেখে আলাপ শুরু করলেন।
‘তুমি কী কর?’
‘একটা অডিট ফার্মে কাজ করি, ল পড়ি আর হায়ার সেকেন্ডারির দুটো কমার্সের ছেলেকে পড়াই।’
‘তাহলে তো সারাদিনই ব্যস্ত থাকো, কাজের লোক!’ সূর্যশেখরের গলায় তারিফ ধরা পড়ল।
মায়ার কান ওদের কথার দিকে ছিল, বললেন, ‘কাজের লোক বললে তো কম বলা হবে। এর উপর রয়েছে ইউনিট ট্রাস্ট, এল আই সি, পোস্টাপিসের এজেন্সি!’
সূর্যশেখর মুগ্ধ চোখে রবিন্দুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অ্যাত্তোসব! ভাবতেই পারি না। মনে হয় নাওয়া—খাওয়ার সময় পাও না, ঠিক কিনা?’
সীমন্তি আঁকপাকু করছিল রবিন্দুর সঙ্গে কথা বলার জন্য। এবার সে সুযোগ নিল। ‘আপনি স্কুলের ছেলেদের পড়ান, কলেজের মেয়েদের পড়ান না?’
‘সময় কোথায়।’ রবিন্দুর স্বর আড়ষ্ট।
সীমন্তি আবদারে গলায় বলল, ‘করুন না একটু সময়, তা হলে আমি আপনার কাছে অ্যাকাউন্টেন্সিটা পড়তুম।’
ছায়া বাদে ঘরের সবাই রবিন্দুর মুখের দিকে তাকাল। দাশগুপ্তদের চোখে ফুটে রয়েছে সম্মতি পাবার প্রত্যাশা। গুপ্তদের চাহনিতে দ্বিধা, অস্বস্তি। পূর্ণেন্দুর মনে হল মেয়েটি গায়ে পড়া।
মায়া হিসেবি গলায় বললেন, ‘যদি সময় করে উঠতে পারে তাহলে পড়াবে না কেন, নিশ্চয় পড়াবে।’
সীমন্তি অধৈর্য বাচ্চচার মতো পা ঠুকে দু হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না মাসিমা না, সময় করতেই হবে। কোনো কথা শুনব না। অ্যাকাউন্টেন্সিতে আমি ঠিক ফেল করব।’
মায়া সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘যখন তোমার দরকার পড়বে যেও, রবু নিশ্চয় পড়া দেখিয়ে দেবে।’
পূর্ণেন্দুর মনে হল, ছায়ার এই সম্বন্ধটা জমাট করে তোলার জন্যই মায়া কথাটা বলল, নয়তো এককথায় নাকচ করে ওর আহ্লাদীপনা ঘুচিয়ে দিত।
‘ঠিক বলছেন তো? আমি কিন্তু তাহলে কালই যাব।’
রবিন্দুর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্ণেন্দুর মনে হল ছেলেকে বাঁচানো দরকার। তিনি বললেন, ‘সূর্যবাবু যা বললেন, রবুর সত্যিই নাওয়া—খাওয়ার সময় নেই। ভয় হয় অসুখবিসুখে না পড়ে যায়। কিছুদিন আগেই জন্ডিস থেকে উঠল। এখন ওর রেস্ট দরকার। বিয়েটা চুকে যাক তারপর তুমি পড়তে এসো বা রবু এসে পড়িয়ে যাবে।’
জন্ডিস তো নয়ই গত এক বছরে রবিন্দুর সর্দি পর্যন্ত হয়নি। নিরীহ মিথ্যাটা বলে নিজের বুদ্ধির প্রমাণ দাখিল করতে পেরে পূর্ণেন্দু মায়ার প্রশংসিত চোখ দেখার জন্য মুখ ফেরাতেই দেখলেন সুকুমার ছায়ার দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে এবং ছায়া সোফায় হেলান দিয়ে লক্ষ্মীসরার দিকে তাকিয়ে আনমনে কানের পাশের চুল টেনে যাচ্ছে। তাচ্ছিল্য স্পষ্ট ওর বসার ভঙ্গিতে।
বাসন্তী বললেন, ‘সীমু চিরুনিটা আনত ছায়ায় চুলটা আঁচড়ে দি। এত সুন্দর চুল অথচ যত্ন নেয় না।’
ছায়া প্রতিবাদ করে উঠতে যাচ্ছিল। মায়া কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে নিরস্ত করলেন।
সূর্যশেখর রবিন্দুর দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘ভাবছি কিছু টাকা ইনভেস্ট করব, কিসে লাগান যায় বল তো? করলে অবশ্য তোমাকে দিয়েই করাব।’
‘ইউনিট ট্রাস্টে করতে পারেন, এল আই সি—রও কয়েকটা ভালো স্কিম আছে, পোস্ট অফিসে এন এস সি কিনতে পারেন সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা ডবল হবে। বাজারে অনেক নন—র্যাঙ্কিং চিট ফান্ড কোম্পানি হয়েছে, প্রচুর সুদ দেয়, আমার মনে হয় সুদের লোভে ওসব জায়গায় টাকা রাখা ঠিক হবে না। সেফ হচ্ছে গভর্নমেন্টের ঘরে টাকা রাখা।’
‘ঠিক বলেছ বাবা,’ বাসন্তী উৎসাহে নড়েচড়ে বসলেন। ‘আমিও তাই বলি। পাশের ফ্ল্যাটের শুভেন্দুবাবু এক লাখ টাকা রেখেছে সঞ্চয়িতা নামে একটা কোম্পানিতে। ওকে বাড়ি বয়ে মাসে মাসে নাকি চার হাজার টাকা সুদ দিয়ে যায়, আমাদের নীচের অনুপবাবু রেলের ড্রাফটসম্যান উনি প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে তুলে লাগিয়েছেন ষাট হাজার। আর দেড় বছর পরই রিটায়ার করবেন, মাসে মাসে পান প্রায় আড়াই হাজার। এটা তো উপরি আয়। কী খাওয়া—দাওয়া, জিনিসপত্তর কেনার ঘটা। ওই দেখে উনিও নেচে উঠলেন, টাকা লাগাবেন। অনেক কষ্টে আটকে রেখেছি। বেশি লাভ ভালো নয়। শুনলে তো রবিন্দু কী বলল, সেফ হচ্ছে গরমেন্টের ঘরে টাকা রাখা!’ বাসন্তী হাত বাড়িয়ে সীমন্তির কাছে থেকে চিরুনিটা নিয়ে ছায়ার চুল আঁচড়াতে শুরু করলেন।
মায়া মৃদুস্বরে সুকুমারকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোয়ার্টার কী ঠিক হয়েই আছে, নাকি চাকরিতে জয়েন করার পর ঠিক হবে।’
‘জয়েন করেই পাব। সেই রকমই তো লিখেছে।’
‘ফার্নিসড কথাটা বলতে কী বোঝায়, খাট পর্দা, বাসনকোশন, উনুন, চেয়ার—টেবিল এই সবই কী?’ মায়া বুঝে নিতে চাইলেন তার মেয়ে প্রথমেই কোনো অসুবিধাগুলোর সামনে পড়বে কিংবা পড়বে না।
‘আমি ঠিক বলতে পারব না।’ সুকুমার জানাল।
মায়া এবার মুখ নীচু করে চাপা স্বরে মোক্ষম প্রশ্নটা করলেন, ‘ছায়াকে তোমার পছন্দ হয়েছে?’
লাল হতে গেলে যতটা ফর্সা হতে হয় সুকুমার ততটা ফর্সা নয় বলে তার গালে শুধু বার্নিশের পোঁচ পড়ল। চোখ নামিয়ে সে বলল, ‘আমি তো ওকে অনেকবার দেখেছি। আমিই তো মাকে ওর কথা বলেছি।’
মায়া বুঝলেন ছেলের চাপে পড়েই এই বিবাহ প্রস্তাব। তার মন প্রসন্ন হয়ে উঠল এই ভেবে, ছায়া বাধ্য অনুগত একটি স্বামী পাবে। মেয়ে বিয়ের পরই আলাদা সংসার পাতবে, তিন কামরার ফ্ল্যাটের ছোটো গণ্ডিতে শ্বশুর শাশুড়ি ননদ নিয়ে ঘর করতে হবে না এটাকে তিনি ছায়ার সৌভাগ্যই বিবেচনা করেছেন। রবু হওয়ার আগে পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারে তাকে কাটাতে হয়েছে, তিনি জানেন নতুন বউয়ের সংকুচিত, গণ্ডিবদ্ধ আপন ইচ্ছাকে বিসর্জন দেওয়া জীবনটা কেমন হয়। নিজের পরিবারে নিজে কর্ত্রী হওয়ার সুখ ছায়া প্রথম থেকেই পাবে এমন ভাগ্য তাঁর নিজের হয়নি। এই বিয়েটা তাই মনেপ্রাণে তিনি চাইছেন।
‘তোমার সঙ্গে বিয়ের কথা পাড়তেই ছায়া একবাক্যে হ্যাঁ বলে দেয়।’
মায়া দেখলেন কথাটা শুনে সুকুমারের মুখ ভিজে উঠল তরল আবেগে। সে আবার ছায়ার দিকে তাকাল। ছায়া হেসে কথা বলছে বাসন্তীর সঙ্গে।
‘রান্না তো মা আমাকে করতেই দেয় না। অন্য কারুর হাতের রান্না বাবা মুখে দিতে পারেন না, কী করে আমি তাহলে শিখব?’
সীমন্তি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘আমারও ঠিক তাই, মা তো রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয় না, শ্বশুরবাড়িতে যে কী খোঁটা খেতে হবে তা ভেবে এখন থেকে আমার ভয় ধরে যাচ্ছে।’
‘আচ্ছা খুব হয়েছে।’ বাসন্তী মেয়েকে কপট ধমক দিলেন। ‘খোঁটা দেবে না এমন একজন ভালো শাশুড়ির ঘরে তোর বিয়ে দোব।’ এই বলে তিনি মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
সূর্যশেখর চেয়ার থেকে ঝুঁকে পড়লেন রবিন্দুর দিকে। ‘নগদে না চেকে দিতে হবে?’
‘চেকে দিলে মাসখানেক কী দেড়েক দেরি হবে সার্টিফিকেট পেতে, নগদে দিলে পরের দিনই পাবেন।’
‘হাজার কুড়ি টাকা, ব্যাঙ্ক থেকে তুলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে নিয়ে আসব।’
সূর্যশেখর চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘যা দিনকাল! রোজই তো কাগজে দেখছি রাহাজানির খবর। এই তো কালই পড়লুম পেট্রল পাম্পের প্রায় লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিতে যাচ্ছিল কর্মচারী, তাকে ভোজালি মেরে টাকার থলি ছিনিয়ে, ভিড় রাস্তার মধ্যে দিয়েই ছুটে পালাল দুটো লোক। ধরা পড়েনি।’ সূর্যশেখরের বিস্ফারিত দৃষ্টি রবিন্দুকে মজা পাওয়াল। অদ্ভুত গোলাকার চোখ। বোঝা যাচ্ছে বাপের কাছ থেকে সীমন্তি পেয়েছে।
রবিন্দু হেসে বলল, ‘চেকটা আমাকে দেবেন আমিই ভাঙিয়ে নিয়ে নগদ টাকা পোস্ট অফিসে জমা দিয়ে, সার্টিফিকেটটা আপনাকে এনে দেব। আপনার আর মাসিমার নামে জয়েন্টলি করবেন তো?’
‘না না না, সীমন্তির নামে করব। এটা হবে ওর বিয়ের যৌতুক। মানে সাড়ে পাঁচ বছর পর চল্লিশ হাজার টাকাটা তো ওর স্বামীই পাবে। সুকুর বিয়েটা চুকুক, তারপর চেকটা তোমায় দেব।’
পূর্ণেন্দু চুপ করে দেখে ও শুনে যাচ্ছেন। তার মনে হচ্ছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এরা কথা বলছে। রবুকে কী ওরা সীমন্তির সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়? তাহলে এরা ভুল চিন্তা করছে। এই মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে তিনি ভাবতে রাজি নন। তিনি নিশ্চিত রবুও রাজি হবে না। পাঞ্জাবির হাতা টেনে তুলে ঘড়ি দেখলেন। বাসন্তীর সেটা নজরে পড়ল।
‘একটু মিষ্টিমুখ এবার হোক।’
সূর্যশেখর স্ত্রীর হয়ে কথার খেই ধরে বললেন, ‘আজ প্রথম এলেন, একটু মিষ্টি মুখে না দিয়ে ছাড়ি কী করে। গেরস্তর অকল্যাণ হবে।’
‘অগত্যা’! এমন একটা ভাব দেখালেন পূর্ণেন্দু। কিছু যে এরা খেতে দেবেই সেটা তো জানা কথা। বাসন্তী আর সীমন্তি রান্নাঘরে গিয়ে চারটে প্লেট হাতে নিয়ে ফিরল।
‘সামান্য একটু, হাতে হাতেই দিচ্ছি।’ বাসন্তী এই বলে তার হাতের প্লেট দুটো পূর্ণেন্দু ও মায়ার হাতে তুলে দিলেন। সীমন্তি দিল বাকি দুজনের হাতে। আট দশটি নানান আকৃতির ও রঙের সন্দেশ, রাজভোগ ও খাস্তার কচুরি ভরা প্লেটের দিকে তাকিয়ে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘আমি তো মিষ্টি খাই না, আর খেলেও এতগুলো অসম্ভব।’
‘আপনারও সুগার?’ সূর্যশেখরকে উৎফুল্ল দেখাল।
‘আমাদের দুজনেরও আছে, আমার কম ওর বেশি।’
বাসন্তী ছোট্ট ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘আহা কত যেন বেশি, তোমার পিপি একশো আশি আমার আড়াই শো। মাত্র তো সত্তর বেশি।’
‘ডায়বিটিস শুনেছি বাবা মায়ের থাকলে সন্তানদেরও হতে পারে এটা হেরিডিটারি।’ পূর্ণেন্দু এই বলে প্লেট থেকে একটা খাস্তা কচুরি তুলে প্লেটটা সেন্টার টেবলে রেখে দিলেন।
কথাটা বাসন্তীর কান এড়াল না। তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘তাই বলে সুকু আর সীমুর আছে ভাববেন না। সুকু তুই তো গত হপ্তায়ই ব্লাডটেস্ট করিয়েছিস, কত হয়েছিল?’
‘একশো নয়।’ সুকুমার কথাটা বলে উঠে গিয়ে আলমারিতে রবীন্দ্র রচনাবলীর ফাঁকে গুঁজে রাখা ব্লাড রিপোর্টটা এনে পূর্ণেন্দুর হাতে দিল। তিনি একবার চোখ বুলিয়ে কাগজটা ফিরিয়ে দিলেন।
সীমন্তি বলল, ‘আমারও সুগার ফুগার নেই।’
মায়া বললেন, ‘না থাকলেই ভালো। তবে এত মিষ্টি খেলে সুগার না থাকলেও সুগার হয়ে যাবে। একটা প্লেট আনুন তুলে দিই।’
হাহা করে উঠলেন সূর্যশেখর, ‘সেকি সেকি, মাত্র তো এই কটা।’
পূর্ণেন্দুর মনে হল যেন প্রদর্শনী খোলা হয়েছে, কত রকমের মিষ্টি খাওয়াতে পারি এবার সেটা দেখো। একই জাতের মিষ্টি চার পাঁচটা শুধু রঙ আর আকৃতিটা ভিন্ন। এরা খাওয়াতে জানে না, টাকা খরচ করতে চায়। প্লেট হাতে নিয়ে রবিন্দু ও ছায়া চুপ করে বসে। বাসন্তী বললেন, ‘তোমরাও কী মায়ের দলে?’
‘হ্যাঁ; সত্যিই এত খাওয়া যায় না।’ রবিন্দু বলল।
‘ছায়া তুমি?’ বাসন্তী শুকনো গলায় হেসে জানতে চাইলেন।
‘আমি দাদার দলে।’ বলেই সে সুকুমারের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, ‘নিন না এখান থেকে।’
সুকুমারের কাছে প্রস্তাবটা অপ্রত্যাশিত। সে ইতস্তত করছে দেখে প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধরুন।’
ছায়ার কণ্ঠস্বরে কী যেন ছিল, সুকুমার উঠে গিয়ে প্লেটটা ধরল। ছায়া একটা সন্দেশ তুলে নিয়ে বলল, ‘সুগার তো নেই, প্লেটটা এবার খালি করে দিন।’
রবিন্দু তার হাতের প্লেট বাড়াল সীমন্তির দিকে। সে একটা কচুরি তুলে নিয়ে বলল, ‘সব খেতে হবে, কোনো ওজর শুনব না। না খেলে প্যাকেট করে বাড়িতে দিয়ে আসব।’
রবিন্দু একসঙ্গে দুটো সন্দেশ মুখে পুরে চিবোতে শুরু করে দিল। দেখে পূর্ণেন্দু কোনোক্রমে হাসি চাপলেন। বেচারা, মেয়েটার প্যাকেট দিতে যাওয়া বন্ধ করতে রবুকে এ বার পুরো প্লেটটাই শেষ করতে হবে।
ছেলে দেখার পর্ব শেষ করে ফিরে আসার সময় সুকুমার ও সীমন্তি তাদের সঙ্গে এল ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত। পাশে পাশে হাঁটছিল সুকুমার, মায়া তাকে বলেন, ‘ছায়ার পড়াটা যেন বন্ধ না হয় সেটা দেখো বাবা।’
ব্যস্ত হয়ে সুকুমার বলে, ‘না না পড়া বন্ধ হবে কেন, উনি পড়তে চাইলে নিশ্চয় পড়বেন, আর একটা কথা, যদি কিছু মনে না করেন তো বলি।’
‘বলো।’ মায়ার বুকের মধ্যে দুরু দুরু করে উঠল, কী বলতে চায়? ছায়ার সম্পর্কে কিছু কী? তাদের সামনে চলেছে রবিন্দু তার গা ঘেঁষে সীমন্তি। তাদেরও আগে পূর্ণেন্দু ও ছায়া।
‘আমাকে যতটুকু দেখলেন তাতে কী ধারণা হল আপনার?’
হাঁফ ছাড়লেন মায়া। চলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, ‘ছায়ার জন্য যেমন ছেলে চাইছিলাম তুমি ঠিক তেমনটি।’
‘আপনারা আমাকে কিছু দেবেন না। দেখেছি তো বিয়েতে কত জিনিস মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলেকে দেয়, আপনারা কিন্তু কিছু দেবেন না।’
‘মেয়েকে যদি দি তাহলে কি তুমি আপত্তি করবে?’
‘না, কিন্তু আমাকে নয়।’
রবিন্দুকে জিজ্ঞাসা করল সীমন্তি, ‘আপনি অত সকালে সল্ট লেকে ছেলে পড়াতে যান আবার বাড়ি ফিরে এসে তখুনি অফিস যান। কষ্ট হয় না?’
‘হয়।’
‘বাড়ির কাছে টিউশানি করেন না কেন?’
‘ভালো মাইনে দিলে করব।’
‘কত করে নেন আপনি?’
‘হপ্তায় দুদিন, আড়াই শো টাকা।’
‘আপনার কী খুব টাকার দরকার?’
‘কার না টাকার দরকার হয়।’
সীমন্তি কথা বাড়াল না। পূর্ণেন্দু আরা ছায়া তালা খুলে ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকে গেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে সীমন্তি বলল, ‘সকালে অত দূরে গিয়ে না পড়িয়ে আমাকে পড়ান না।’
‘আগে মেয়েদের পড়িয়েছি এখন আর পড়াই না।’ রবিন্দু হালকা চালে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল।
‘কেন?’
‘ঝামেলা তৈরি হয় সেটা আমার ভালো লাগে না।’ বলেই রবিন্দু বিদায় জানাতে মাথা একবার হেলিয়ে হেসে ভিতরে ঢুকে গেল।
সুকুমারের সঙ্গে মায়া এসে পৌঁছলেন।
‘সীমন্তি, মাঝে মাঝে এসো না, ছায়ার তো বাড়িতে কথা বলার লোকই নেই।’
শুকনো মুখে সীমন্তি বলল, ‘আমি এলে ঝামেলা হবে না তো?’
মায়া ওর গাল টিপে দিয়ে বললেন, ‘একদম হবে না।’
বসার ঘরে ছেলে বউয়ের সঙ্গে বসলেন পূর্ণেন্দু।
‘রবু কেমন লাগল সুকুমারকে, আমার তো ভালোই লাগল, বেশ ভালো লাগল।’ পূর্ণেন্দু ‘ভালো লাগল’—টা পুনরাবৃত্তি করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি বিয়েতে মত দিচ্ছেন।
‘আমারও ভালো লেগেছে। কোয়ালিফায়েড, ভালো চাকরি পেয়েছে। দেখতে শুনতে কথাবার্তায় ভালো, নিজেদের ফ্ল্যাট—’
রবিন্দুর কথা শেষ করতে না দিয়ে মায়া ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন, ‘তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট, ছায়ার থাকতে কোনো অসুবিধে হবে না। তাছাড়া ভাইটাইও নেই। বিয়ে হলে বোন তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, গোটা ফ্ল্যাট টাই হবে ছায়া—সুকুমারের। এদিক থেকে ছায়ার যে লাভটা হচ্ছে সেটা ভেবে দেখো!’
পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে স্ত্রীর কথাগুলো মেনে নিয়ে বললেন, ‘সুকুমার যদি চাকরিটায় রয়ে যায় তাহলে বোম্বাইতেই থেকে যাবে, এই ফ্ল্যাটে আর ফিরছে না। শুধু ওর বাবা—মা—ই তিনটে ঘর নিয়ে থাকবে।’
রবিন্দু ঠাট্টায় সুরে বলল, ‘মনে হচ্ছে, বাবার যেন হিংসে হচ্ছে।’
‘তা একটু হচ্ছে। যখন কল্যাণের কাছে খবর পেলুম তখন দুটোমাত্র দু—ঘরের ফ্ল্যাট খালি পড়েছিল। অগত্যা তাই নিতে হল।’ পূর্ণেন্দুর স্বরে আপশোস। ‘একটা ছেলে থাকলে ফ্ল্যাটে বাস করে সুবিধে আছে। আগে যদি জানতুম ফ্ল্যাটে এসে উঠতে হবে তাহলে—
‘তাহলে কী?’ মায়া তীক্ষ্ন স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
‘কিছু না।’ পূর্ণেন্দু খোলার জন্য পাঞ্জাবিটা মাথার উপর দিয়ে গলাতে লাগলেন।
‘জায়গা নেই, চলাফেরা করা যায় না। ঘেঁষাঘেঁষি, ঠাসাঠাসি, এই সব বলে তোমাকে আর গজগজ করতে হবে না। নবু বড়ো ক্লাবে যাচ্ছে, ত্রিশ হাজারে পাকা কথা হয়ে গেছে। আদ্দেক পেমেন্ট পেলেই জমি বায়না করবে বাগুইহাটিতে, ওর সমরেশদা জমি কিনিয়ে দেবে বলেছে, মিস্ত্রি দিয়ে বাড়িও করিয়ে দেবে।’
‘কবে!’ পূর্ণেন্দু প্রত্যাশা আর বিস্ময় মিশিয়ে তাকালেন। ‘নবু এতদূর এগিয়েছে তা তো জানতুম না, একেবারে জমি—বাড়ি পর্যন্ত।’
‘বলবে কী, তুমি কী কখনো খোঁজ রেখেছ না জানতে চেয়েছ। ওর সঙ্গে তো কথাও বলো না।’
‘বলব কী, যদি ক্রিকেট খেলত তাহলে নয় কথা বলা যেত। নবু কতক্ষণ আর বাড়িতে থাকে!’
রবিন্দু গলা ঝেড়ে বলল, ‘এই সমরেশ লোকটা সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছি। ওর এলাকায় বাড়ি করতে গেলে নাকি ওকে পাঁচ হাজার টাকা সেলামি দিতে হয় আর ওর কাছ থেকেই বাড়ি তৈরির জিনিসপত্তর কিনতে হবে। তা নইলে বাড়ি তৈরির জন্য জমিতে যে সব মালমশলা এনে রাখা হবে, সব রাতারাতি হাওয়া হয়ে যাবে। ওর একটা বড়ো গ্যাং আছে, রেলের ওয়াগন ভেঙে লুট করে। আমাদের অফিসের একজন বাগুইহাটিতে থাকে, সে বলছিল। সমরেশের ভয়ে নাকি সবাই তটস্থ।’
পূর্ণেন্দু বললেন, ‘নবু বাচ্চচা ছেলে নয়, নিশ্চয় এসব কথা সে জানে।’
মায়া বললেন, ‘জানে নিশ্চয় তবে ওর তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, ওকে ভালোবাসে সমরেশের বাড়ির লোকেরা। বড়ো ক্লাবের সঙ্গে কথাবার্তা তো সমরেশই বলছে। বাড়িটা হলে নবু এখানে আর থাকবে না তখন রবুর বিয়ে দোব।’
ক্ষীণভাবে হেসে রবিন্দু বলল, ‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।’
‘কেন, কারুর সঙ্গে ভাবসাব হয়েছে নাকি? এখনি পরিষ্কার করে বল। নইলে মেয়ে দেখে কথাবার্তা এগোবার পর তখন বলবি বিয়ের পাত্রী নিজে ঠিক করে রেখে দিয়েছি, তখন লজ্জায় পড়ে যাব।’ মায়ার হালকা সুরের আড়ালে থাকা উৎকণ্ঠা পূর্ণেন্দু ধরতে পারলেন। তাঁর মনে হল মায়া ঠিকই বলেছে, যদি কোনো মেয়েকে ভালো লেগে থাকে তাহলে এখনই তা বলে দেওয়া ভালো। রবুর পছন্দের উপর তাঁদের আস্থা আছে। মায়ার অবশ্য আপত্তি হবে মেয়ে যদি ছোটো জাতের হয়। এটা রবু জানে।
রবিন্দু স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘সেসব কিছু নয়। উন্নতি করতে হলে এখনই খাটার সময়। রোজগার পাঁচ হাজারে না পৌঁছলে বিয়ের কথা ভাবতে রাজি নই। এখন ছায়ার বিয়ের কথাটা ভাবো তো।’
‘রবু ঠিকই বলেছে ছায়ার বিয়ের তারিখ তো চোদ্দোই মাঘ ঠিক হয়েছে। কটা দিন আর বাকি। তোড়জোড় তো এখন থেকেই শুরু করতে হয়।’ পূর্ণেন্দু উঠে গিয়ে ইংরিজি—বাংলা তারিখ দেওয়া ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটালেন।
‘আসার সময় সুকুমার একটা কথা বলল, শুনে ওকে আরও ভালো লাগল।’ মায়া একটা নাটকীয় নীরবতা তৈরি করে দুজনের জিজ্ঞাসু চোখকে সময় দিলেন অধৈর্য হয়ে ওঠার জন্য।
‘বলল, বিয়েতে আমাকে একটা কিচ্ছু দেবেন না, ভাবতে পার?’ মায়ার চোখে ঝিলিক দিল গর্ব ও তৃপ্তির ছটা। ‘এখনকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায়। সব তো হাত বাড়িয়ে থাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে ভিক্ষে পাবার জন্য।’
‘শ্বশুরবাড়িরই তো দোষ। ভিক্ষে দেয় কেন? ভিখিরি তো ওরাই তৈরি করে। সুকুমারের বাবা বলল, শুনলে না, সাড়ে পাঁচ বছর পর জামাই পাবে চল্লিশ হাজার টাকা। এর মানে কী?’ দাঁত চেপে বলল রবিন্দু। ‘ওই মেয়েকে যে বিয়ে করবে সে চল্লিশ হাজার নগদ পাবে, তা ছাড়া হ্যানাতানা নানান জিনিস, গয়নাগাটি এসব তো আছেই।’ রবিন্দু উত্তপ্ত হয়ে উঠে গেল নিজের ঘরে।
দুজনে মুখ চাওয়া—চাওয়ি করলেন। ছেলের হঠাৎ রেগে ওঠার কারণ তাঁরা ভেবে পেলেন না।
‘সুকুমারকে বললুম তুমি নয় নেবে না কিন্তু আমরা যদি মেয়েকে কিছু দিই, বলল দেবেন কিন্তু আমাকে নয়।’
‘কিন্তু তাই বলে খরচ যে কিছু কম হবে তা ভেবো না। লোকজন খাওয়ানো, নানান আনুষ্ঠানিক খরচ, মেয়ের কিছু গয়নাগাটি। এসবেই তো বহু হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে।’
‘সুকুমারের মা তো বললেন, শুধু শাঁখা সিঁদুর দিয়ে বউ নিয়ে যাবেন।’
‘ওটা মুখের কথা, ওটা ধরো না। বলেছে কি কত ভরি সোনা চাই?
‘এখন ভরি কত করে, দু—হাজার টাকা?’
‘গয়নার কথা ওঠেইনি। তবে আমি পাঁচ ভরি গয়না গড়িয়ে রেখেছি, দু—বছর আগেই।’
অবাক পূর্ণেন্দু প্রশ্ন করলেন, ‘টাকা পেলে কোথায়?’
‘ছিল আমার কাছে।’
ভ্রূ কুঁচকে পূর্ণেন্দু তাকিয়ে রইলেন ঠোঁট টিপে কঠিন মুখে বসে থাকা মায়ার দিকে। বুঝে গেলেন এই প্রসঙ্গে তাঁর স্ত্রী আর একটিও কথা বলবে না।
‘বিয়ে হবে কোথায়?’ পূর্ণেন্দু প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, ‘সামনের মাঠে?’
‘এখানে সব বিয়ে তো মাঠেই প্যান্ডেল করে হয়, ফ্ল্যাটে জায়গা কোথায়?’
‘ডেকরেটর ঠিক করতে হবে তারপর আছে কেটারার ঠিক করা। এই সময়ই অমিয়কে দরকার ছিল, ছেলেটা কোথায় যে গেল, বহুদিন আর আসে না। ও থাকলে কিচ্ছু ভাবতে হত না।’ পূর্ণেন্দুর আক্ষেপে মায়া বিরক্ত হলেন।
‘তোমার দুটো ছেলে কী অপদার্থ না তাদের পক্ষাঘাত হয়েছে! বোনের বিয়েতে তারা কী খাটাখাটনি করতে পারবে না? এইটুকু ব্যাপারেই অমিয় অমিয় করে হেদিয়ে মরছ!’
পূর্ণেন্দু অপ্রতিভ হলেন, সত্যিই তো, নিজের ছেলেদের প্রতি আস্থা না থাকার তো কোনো সংগত কারণ তাঁর জানা নেই। ওরা নিজেরাই নিজেদের কেরিয়ার তৈরি করছে, তিনি রবুকে চাকরি পেতে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছু তো করেননি। নবু তো নিজেই বেছে নিয়েছে তার পথ। তিনি ভেবেছেন শুধুই ছায়ার ভবিষ্যৎ। দু—মাস আগে জাতীয় সঞ্চয় পত্রগুলোর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় তিনি ষাট হাজার টাকা পেয়েছেন। টাকা ব্যাঙ্কে রয়েছে। ছায়ার বিয়ের কথা ভেবেই এই পত্র কিনেছিলেন। মেয়াদ পূর্ণ হতে না হতেই বিয়ে স্থির হয়ে গেল। একে পূর্ণেন্দু, যা কখনো বিশ্বাস করেন না সেই, ভাগ্যের আশীর্বাদ পেয়েছেন বলে মনে করলেন।
বিয়ের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন সূর্যশেখর, এমনকী পুরোহিত জোগাড় করা পর্যন্ত। পরামর্শ দিলেন, ‘শুধু এই বাড়ির আটটা ফ্ল্যাট ছাড়া এখানকার আর কাউকে নেমন্তন্ন করবেন না। এখানে এটাই রেওয়াজ।’ নিমন্ত্রিতদের নামের ফর্দ মায়া সবাইকে জিজ্ঞাসা করে তৈরি করলেন। নবুই লক্ষ করে অমিয়র নাম ফর্দে নেই।
‘মা এটা কী করলে, এত বড়ো ভুল। অমিয়দার নামটাই বসাতে ভুলে গেলে।’
‘ছায়া তো বলল, নেমন্তন্ন করার দরকার নেই। যার বিয়ে সেই যদি বারণ করে তাহলে আমি আর কী করব।’ মায়ার গলার স্বরে কোনোরকম দ্বিধা বা মালিন্য নেই।
সুচারুভাবে সম্পন্ন হল বিয়ে। শুধু বিয়ের এক ঘণ্টা আগে কিছুক্ষণের জন্য পাওয়ার কাট হওয়া ছাড়া আর কোনো বিঘ্ন ঘটেনি, অবশ্য জেনারেটর থাকায় এটাকে বিঘ্ন বলা যায় না। ফুলশয্যার পরের দিনই সুকুমার বোম্বাই রওনা হল ছায়াকে নিয়ে ট্রেনে। সঙ্গে গেল রবিন্দু আর বাসন্তী নবদম্পতির সংসার পেতে দিয়ে আসার জন্য। ট্রাঙ্ক কলে কথা বলে সুকুমার আগেই জেনে নিয়েছিল তাদের জন্য সান্তাক্রুজ ইস্টে এক গুজরাতি হাউজিং সোসাইটিতে একটা তিন ঘরের ফ্ল্যাট আসবাব সমেত প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তারা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশন থেকে সোজা চলে যেতে পারে। তাকে আর একটা কথা বাঙালি বলেই জানিয়ে দেওয়া হয়, আবাসনটি পুরো নিরামিষ। মাছ মাংস ডিম ওর চৌহদ্দির মধ্যে রান্না করা বা খাওয়া চলবে না। আবাসনে রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে।
তারা ঠিকমতো নির্বিঘ্নেই পৌঁছল। সেদিন সন্ধ্যাতেই বাসন এবং খাওয়ার জিনিস কিনতে বেরোয় তারা। আবাসন থেকে বেরিয়েই দোকান আর বাজার, স্টিলের বাসন আর দুটো প্লাস্টিকের বালতিতে মুদির দোকানের ঠোঙা, সর্ষের তেলের টিন, থলি ভরা কাঁচা বাজার আর টিফিন কেরিয়ারে ডাল—ভাত, চারজনে হাতে নিয়ে ফিরল।
‘ভাগ্যিস বড়দা এসেছে নইলে এত জিনিস হাতে করে রয়ে আনতে পারতুম না, সুকুমার খাটে পাতা ছোবড়ার গদিতে বসে ওয়াড়হীন ময়লা বালিশ কোলে টেনে নিয়ে হাঁফ ছাড়ার ভান করল।
রবিন্দু বলল, ‘এরকম আরও কয়েকবার তোমাকে দোকান বাজার থেকে জিনিসপত্তর আনতে হবে সুকু। দুটো ঘরে দুটো খাটের গদির যা অবস্থা, ওর ওপর তোষক না পাতলে শুতে পারবে না। চাদর, বেডকভার, বালিশ, দরজা জানলার পর্দা তো সর্বাগ্রে চাই। তারপর আরও কত কী যে লাগবে সেটা সংসার করতে করতে টের পাবে। হোটেলের থেকে টিফিন কেরিয়াবে ভাত এনে কদিন আর চালাবে। কাল সকালে প্রথমেই কেরোসিন আর উনুন কিনে আনব।’
সুকুমার বলল, ‘গ্যাসের ব্যবস্থা নিশ্চয় অফিস করে দেবে।’
বাসন্তী নীচের ঠোঁট উলটে বললেন, ‘এই তোর ফার্নিশড কোয়ার্টার!’ এরকম জানলে দুদিন আগে এসে কেনাকাটা গোছগাছ করে দিতুম, দেখত ছায়ার কত কষ্ট হবে। দুদিন থেকে কতটা আর গুছিয়ে দিয়ে যেতে পারব।’
‘মা জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। এইবার আমি তোমার বউমার সাঁতার কাটাটা দেখব।’
‘পারবে পারবে, ডুববে না। কী গো ছায়া পারবে না?’ বাসন্তী নিশ্চিন্ত স্বরে বললেন।
ছায়া মনে মনে উত্তেজিত। নতুন ঘর পেতে বসাটা তার কাছে চ্যালেঞ্জের মতো লাগছে। সে বলল, ‘এখন দু—চারদিন পিকনিকের মতো ব্যাপারটা হবে। যে কষ্ট করতে পারবে না সে যেন বাইরে খাওয়ার ব্যবস্থা করে।’ ছায়া আড়চোখে সুকুমারের দিকে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করল।
ছায়া—সুকুমার খুনসুটি দেখে রবিন্দুর মনে হল বিয়েটা ভালোই হয়েছে। মনের মিলটা খুব তাড়াতাড়িই ঘটে গেছে। আসার সময় ট্রেনে দুজনে জানলার ধারে পাশাপাশি বসে বহুক্ষণ গল্প করেছিল। এক সময় রবিন্দুর একটা ক্ষীণ সন্দেহ ছিল ছায়া বোধহয় অমিয়র প্রতি অনুরক্ত। বন্ধুর সুন্দরী বোনের প্রতি দুর্বলতা যেকোনো তরুণেরই ঘটতে পারে। অমিয় সম্পর্কে এটা রবিন্দুর মনে হত। ওর যখন তখন আসা মায়ার মন জুগিয়ে কথা বলা, দরকার দেখলে যেচে সাহায্য করা—এসব থেকেই রবিন্দুর মনে হয়েছিল ছায়ার সঙ্গে অমিয়র মানসিক যোগ গড়ে উঠেছে। কোনো মেয়ের সঙ্গে টানা পনেরো মিনিট কথা বলার সুযোগ আজও তার জীবনে আসেনি, এলে কী হত তাই নিয়ে সে ভাববার অবকাশই পায়নি। বহু ছেলেমেয়ের জীবনে হালকা মেঘের মতো বিয়ের আগে প্রেম উড়ে আসে, আবার উড়ে চলে যায়, ছায়ার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে।
‘একটা ঝাঁটা সবার আগে কেনা উচিত ছিল, এটা আর কারুর মনে পড়েনি। কী ধুলো ময়লা দেখেছ!’ বাসন্তী চারিদিকে তাকিয়ে ধুলোর উপস্থিতি বোঝালেন মুখ বিকৃতি করে।
কলিং বেল বাজল। সবাই অবাক হয়ে মুখ চাওয়া—চাওয়ি করল, এখানে চেনা তো কেউ নেই যে দেখা করতে আসবে। ভুল করে কেউ বেল বাজাল না তো! সুকুমারই দরজা খুলতে গেল।
শ্যামবর্ণা, চশমা পরা এক মহিলা, বাসন্তীর কাছাকাছি বয়সি। সপ্রতিভ স্বরে বললেন, ‘আপনারা তো আজই এলেন, আমি দোতলায় ঠিক আপনাদের উপরেই থাকি। বারান্দা থেকে দেখলুম আপনারা এলেন, আগেই জেনেছিলুম এক বাঙালি পরিবার আসছে। শুনে কী আনন্দ যে হয়েছিল, এখানে চল্লিশটা পরিবার, বাঙালি শুধু একা আমরা। আমার স্বামী একটা টেক্সাটাইল ডিজাইনিং ফার্মে কাজ করেন। আলাপ করতে এলুম!’ ভদ্রমহিলা হাসলেন। হাসিটা সুকুমারের কাছে খুবই মিষ্টি লাগল। ভিতর থেকে ছায়া এসে তার পাশে দাঁড়াল।
সুকুমার ছায়াকে বলল, ‘ইনি ওপরে থাকেন, বাঙালি, আলাপ করতে এসেছেন।’
ছায়া নমস্কার করে বলল, ‘থাকব আমরা দুজন। আমার দাদা শাশুড়ি পরশু চলে যাবেন।’
‘কদ্দিন বিয়ে হয়েছে?’
‘ফুলশয্যা হয়েছে তিন দিন আগে।’
‘দেখে মনে হয়েছিল অল্পদিন বিয়ে হয়েছে কিন্তু সেটা যে এত অল্পদিন বোঝা যায় না।’
‘ভেতরে আসুন, মা—র সঙ্গে আলাপ করবেন।’ ছায়া হাত ধরে মহিলাকে ভিতরে আনল।
কলকাতায় ফেরার সময় ট্রেনে বাসন্তী বললেন রবিন্দুকে ‘কী ভাগ্য দেখো ওদের, মেঘ না চাইতেই জলের মতো ওপর থেকে নেমে এল ভগবতী ঘোষ। বোম্বাইয়ে দু—বছর আছেন, এখানকার হালচাল বেশ ভালোই জানেন, ছায়ার কোনো অসুবিধে হবে না।’
‘ছায়ার ভাগ্যটা সত্যিই ভালো।’
‘রবু তুমি কোষ্ঠী ঠিকুজি মানো?’
রবিন্দু ইতস্তত করে বলল, ‘খানিকটা খানিকটা বিশ্বাস করি।’
‘আমি পুরোটাই বিশ্বাস করি।’ বাসন্তীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘তোমার মেসোমশায়ের কোষ্ঠীতে সম্পত্তি, অর্থহানির সম্ভাবনার কথা লেখা আছে। আমি ওকে সঞ্চয়িতায় টাকা রাখতে দিইনি আর দেখো কী ঘটে গেল। শুভেন্দুবাবু চারদিন খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বিছানায় পড়েছিলেন। উনি নয় ব্যবসায়ী, পয়সাওলা লোক, লাখ টাকা চোট খাবার ধাক্কাটা সামলে নেবেন কিন্তু অনুপবাবুর কথাটা ভাবো, দেড় বছর পর রিটায়ার করবেন। প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে ষাট হাজার টাকা তুলে সঞ্চয়িতায় রাখলেন, দুটো মেয়ে রয়েছে, বিয়ে দিতে হবে, ভদ্রলোক তো পাগলের মতো হয়ে গেছেন। ওই অবস্থা তো তোমার মেসোমশায়েরও হতে পারত। আমি বারণ করেছি, তুমিও নিষেধ করলে, তাই না উনি লোভ সামলালেন।’ বাসন্তী নিজের কৃতিত্বের অর্ধেকটা রবিন্দুকে দিয়ে লক্ষ করলেন কতটা ভাবান্তর ওর চোখেমুখে ঘটল। ঘটেছে দেখে আবার বললেন, ‘আসলে আমার বারণ উনি শুনতেন না, তুমি বলায় উনি পিছিয়ে গেলেন, তোমার উপর ওনার ভীষণ বিশ্বাস, শুধু ওর কেন আমাদের সবাইয়েরই বিশেষ করে সীমুর।’
‘আমার ওপর বিশ্বাস! কেন? রবিন্দু অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘এই কেনর কোনো জবাব তো জানা নেই। সীমুর কোষ্ঠীতে আছে, কুড়ি বছর বয়সে কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী পুরুষ দ্বারা উপকৃত হবে। এখন ওর বয়স কুড়ি। আমি অনেক খুঁজে এমন কোনো পুরুষ দেখতে পাইনি যে ওর উপকারে আসতে পারে, এক তুমি ছাড়া।’
‘আমি! আমি ওর কী উপকার করতে পারি?’
‘ওকে পড়াতে পার, বি কম—টা পাশ করিয়ে দিতে পার। আমাদের কাছে এখন তো তুমি হাউজিংয়ের আর পাঁচটা ছেলের একজন নও, এখন তুমি সীমুর দাদার শালা, আত্মীয়, আমাদের ফ্ল্যাটে তো সবসময়ই আসতে পার কেউ কিছু মনে করবে না। এই ক—দিনেই আমি দেখেছি তুমি বুদ্ধিমান, বিবেচক, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কাজ কর, এমন একজন লোকের পরামর্শ নিয়ে চললে বৈষয়িক ব্যাপারে কখনো ঠকতে হবে না। এতদিন পরামর্শ নিতুম সুকুর কিন্তু এখন তো আর চট করে তাকে পাব না কিন্তু তোমাকে পাব।’
‘আমি কী পরামর্শ দোবো।’
‘পরামর্শ দেবার মতো ব্যাপারের কী অভাব আছে। লেখাপড়ার ব্যাপারটা আমাদের থেকে তুমি ভালো বোঝো। সীমুর পড়াশুনোটা তো তুমি গাইড করতে পার, পার না কী? সিমুর জন্য ওর বাবা পোস্ট অফিসের যে সার্টিফিকেট কিনল সেটা ম্যাচুওর করলে টাকাটা ও কী করবে, সেটা তো তুমি বলে দিতে পার।’
‘ততদিনে ওর বিয়ে হয়ে যাবে নিশ্চয়, তখন তো ওর স্বামীই বলে দিতে পারবে!’ রবিন্দু আশ্চর্য বোধ করল বাসন্তীর হিসেবে এমন ভুল হওয়ায়।
‘তা পারবে, কিন্তু কেমন পারবে তাতো এখন জানি না তবে এখন জানি তুমিই পারবে।’
রবিন্দুর অস্বস্তি লাগছে এই সব দায়িত্ব ঘাড়ে এসে যাচ্ছে বুঝতে পেরে। বোনের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ করে তার লাভ কী? সীমুকে গাইড করে পাশ করিয়ে দিতে হবে। পাস করাটা কী হাতের মোয়া! আর আমিই বা অমন ফাঁকিবাজ মাথামোটা, আহ্লাদী মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে শেষে বদনাম কুড়তে যাব কেন? মেয়ে চল্লিশ হাজার টাকার মালিক হবে, একথা বারবার শোনাচ্ছেন কেন? মতলবটা কী? ভদ্রমহিলা বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করছেন। উদ্দেশ্যটা বুঝে নেবার চেষ্টা করল রবিন্দু।
‘না, আমি পরের টাকা সম্পর্কে কোনো পরামর্শ দিতে পারব না। তাছাড়া পরামর্শ দেবার আছেটাই বা কী! ম্যাচুওর করবে আবার তাই দিয়ে সার্টিফিকেট কিনবে নয়তো টাকাটা খরচ করবে যদি প্রয়োজন দেখা দেয়, ব্যস। এ জন্য পরামর্শ নেবার কী দরকার তাতো বুঝছি না।’ রবিন্দুর স্বরে বিরক্তি ও উগ্রতা প্রকাশ পেল, বাসন্তী গম্ভীর হলেন।
রবিন্দু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ কেউই কথা বলল না। বাসন্তীই শুরু করলেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছো। আচ্ছা রবু, সীমুকে কী তোমার পছন্দ নয়?’
ঝুলি থেকে তাহলে বেড়ালটা বেরোল। এই ধরনের একটা প্রশ্ন আসতে পারে সেটা অনুমান করেছিল। রবিন্দু মনে মনে হাসল এবং সতর্ক হল। ‘এ কথা বলছেন কেন?’
‘সীমুর জন্য আমরা তোমাকে পাত্র ঠিক করেছি।’ শান্ত গলায় বাসন্তী ভণিতা না করে সহজভাবে বললেন।
‘ঠিক করে ফেলেছেন?’ রবিন্দুর মাথা গরম হয়ে উঠল। মুখটা কঠিন করে সে আবার জানলার বাইরে তাকাল। ভদ্রমহিলা এমনিতে কথাবার্তায় বেশ ভালো, আন্তরিক, ওর মনে আঘাত দিতে তার ইচ্ছে করছে না। সীমুকে বিয়ে? একদমই ভাবা যায় না। ছায়ার বিয়ের কথা বলতে এসেছিলেন নিজেরা ঠিকঠাক করে একদম নিশ্চিন্ত হয়েই। ধরেই নিয়েছিলেন তার ছেলেকে এরা লুফে নেবে। ব্যাপারটা তাই—ই হয়েছিল। তবু রবিন্দুর মনে খচখচ করেছিল একটা কথা, আমাদের কী এতই দীন মনে হয়, দু—ঘরের ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটে বাস করি বলে, বড়োমানষি দেখাবার মতো চাকরি নেই বলে? সম্বল শুধু মুখশ্রীটুকু! একবার মুখের দিকে তাকালে আর একবার ফিরে দেখতে হয়। আর সেই জন্যই ছায়াকে এরা পুত্রবধূ করেছে। তাই বলে শুধু এই কারণে তাকেও জামাই করতে চায়? মুখশ্রী ছাড়া কী এমন তার যোগ্যতা? সামান্য একটা চাকরি, দুটো টিউশনি আর শেয়ার সার্টিফিকেট, ডিবেঞ্চার, নানান কোম্পানির পাবলিক ডিপোজিট স্কিম ফিরি করে বেড়ানো এই তো তার উপার্জনের হাতিয়ার। এগুলো দিয়ে অগুস্তি পদাতিকের একজন হওয়া যায়, ছোটোখাটো সেনাপতিও হওয়া যায় না।
তাকে এরা জামাই করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন এবং বোধহয় ধরেই নিয়েছেন ছেলেটি না বলবে না, রবিন্দু ঠান্ডা মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি বুদ্ধিমান, বিবেচক, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কাজ করি, মাত্র এই কটা গুণ দেখেই আপনারা আমায় বাছাই করে ফেললেন? বিয়ে করে বৌকে নিয়ে থাকার ঘর আমার নেই সেটা তো জানেন।’
‘জানি। যতদিন না থাকার মতো ঘর পাচ্ছ ততদিন সীমু আমাদের কাছেই থাকবে। সুকু নেই ওর ঘরটা খালিই রয়ে যাবে, সেখানে তোমরা দুজন থাকবে, মনে হয় সুকু বোম্বাইতেই থেকে যাবে, কলকাতায় শিগ্গিরি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে দিয়েছে। এত ভালো চাকরি কলকাতায় কোথায় পাবে?’ বাসন্তী কথা থামিয়ে লক্ষ করলেন রবিন্দু মন দিয়ে তার কথা শুনছে। উৎসাহিত হয়ে তিনি যোগ করলেন, ‘সুকুর জন্য সল্টলেকে তিন কাঠা জমি কেনা আছে, ও বাড়ি করে নেবে। ফ্ল্যাটটা আমরা সীমুকেই দেব ঠিক করেছি।’
‘আমি তো দেখছি বেশ ভালোই আটঘাট বেঁধে আপনারা পাত্র ধরার কাজে নেমেছেন, যা অফার দিচ্ছেন তাতে আমার থেকেও অনেক ভালো ছেলে পেয়ে যাবেন, তাহলে আমাকে কেন?’ রবিন্দুর কথাগুলো হালকা ব্যঙ্গের মোড়কে মোড়া। বাসন্তী কিন্তু মোটেই উত্তেজিত হলেন না বরং মুখ টিপে হাসলেন।
‘হ্যাঁ, তোমার থেকে ভালো পাত্র পেয়ে যাব, পেয়েছিলুমও কিন্তু কেউ তোমার মতো দেখতে সুন্দর নয়। আমরা সুন্দর বউ চাই, সুন্দর জামাই চাই।’
‘কিন্তু আমিও যে সুন্দরী বউ চাইতে পারি, এটা বোধহয় খেয়ালে রাখেননি। আপনার মেয়ে কি সুন্দরীর পর্যায়ে পড়ে?’
‘একদমই না। আর সে জন্যই তার সুন্দর স্বামী চাই। আমরা চাই সুন্দর চেহারার নাতি নাতনি, সুন্দরের বংশ তৈরি করতে। সুকুর ছেলেমেয়েরা সুন্দর হবে, সীমুরও তাই হোক, এটাই চাই।’
রবিন্দু অবাক হয়ে বাসন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলে কী! সুন্দরের বংশ তৈরি করার জন্য মানুষ এইভাবে পরিকল্পনা করে এগোতে পারে, এটা তার ধারণার বাইরে ছিল।
‘তুমি খুব অবাক হচ্ছ রবু আমার কথা শুনে, হবারই কথা। সুকুর বউভাতে আমাদের যে আত্মীয়স্বজনরা এসেছিল তাদের তুমি দেখেছ প্রত্যেকেই চলনসই রকমের হ্যান্ডসাম তার মধ্যে তোমার মেসোমশাই আর সীমুকে কী বেখাপ্পা লাগছিল সেটা হয়তো তুমি নজর করোনি কিন্তু আমি করেছি। আমি দেখেছি সবাই তোমার সঙ্গে তোমার বাবার সঙ্গে অন্যরকম ভঙ্গিতে অন্যরকম গলায় কথা বলছিল। এর প্রধান কারণ চেহারা আর ব্যক্তিত্ব। আমি এই দুটো চাই ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য।’ বাসন্তী নিজের মনের বাসনা আর গোপনে রাখলেন না, কেন রবিন্দুকে জামাই রূপে পেতে চান তা খোলাখুলি বলে দিলেন। তিনি বুঝে গেছেন, রবিন্দুকে আয়ত্তে আনতে হলে স্পষ্টাস্পষ্টি কথা বলাই ভালো।
রবিন্দু আবার জানলার বাইরে তাকাল অন্যমনস্ক ভাবে। বাসন্তীর এই চাওয়াটাকে কী বাতিক বলা যায়? জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার সুন্দরের বংশ তৈরি করেছে বেছে বেছে সুন্দরী মেয়েদের বউ করে এনে। বাসন্তীও সেই পন্থা নিয়েছেন সামাজিক সম্ভ্রম পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেজন্য তাকে কেন হাড়িকাঠে মাথা দিতে হবে। সীমন্তির সঙ্গে আজীবন কাটানোর কথা ভাবতে গিয়ে তার শরীর মন বিমর্ষ বোধ করতে শুরু করল। বাসন্তী টাকা আর ফ্ল্যাটের টোপ রেখেছে। এ দুটো জিনিস খেটেখুটে সংগ্রহ করা যায় কিন্তু সীমন্তি একবার ঘাড়ে চেপে বসলে তাকে নামানো যাবে না।
‘মাসিমা, আমি এখন বিয়ের কথা একদমই ভাবছি না, অন্তত তিন—চার বছর ভাবব না।’
‘তারপর ভাববে তো? সীমুর বয়সও এমন কিছু নয়, তিন—চার বছর সে অপেক্ষা করে থাকতে পারবে।’
বাড়িতে ফিরে এসে ছায়ার নতুন সংসার বিষয়ে পূর্ণেন্দু ও মায়ার অজস্র কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে হল রবিন্দুকে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে বলল না ট্রেনে বাসন্তীর সঙ্গে তার কী কথাবার্তা হয়েছে। সে এটা বুঝেছে বাসন্তীর প্রস্তাব রীতিমতো অমর্যাদাকর এবং শুনলে তার বাবা ওদের সঙ্গে হয়তো বাক্যালাপ বদ্ধ করে দেবে। সম্পর্কটা তিক্ত যাতে না হয় সেজন্যই সে মুখ বুজে রইল।
বোম্বাই থেকে ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরই রবিন্দু শুনল মোহনবাগান থেকে নবেন্দু ত্রিশের অর্ধেক পনেরো হাজার টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে। খবরের কাগজে সম্ভাব্য দলবদলের আলোচনার মধ্যে খবরটা বেরোয় এবং তাতেই নবেন্দু আনন্দ আবাসনে এবং উল্টোডাঙ্গা—বাগমারি এলাকায় পরিচিতি পেয়ে গেল। মাদার ডেয়ারির দুধ আর মুরগির মাংস বিক্রি করে যে লোকটি সে একদিন পূর্ণেন্দুকে বলল, ‘আপনি নবেন্দু গুপ্তর বাবা। আমার খদ্দের, দোকানের কাছেই থাকেন অথচ আপনাকে চিনি না!’ লোকটিকে খুব লজ্জিত দেখায়।
‘হ্যাঁ তাতে হয়েছি কী, সেজন্য আপনি কী একশো গ্রাম মাংস বেশি দেবেন?’ মজা করেই পূর্ণেন্দু বলেন।
লোকটি অপ্রতিভ হয়ে বলে, ‘আমাদের এদিকে বড়ো ক্লাবের প্লেয়ার তো কেউ এতদিন ছিল না, অভাবটা পূর্ণ হল।’
‘আপনি ফুটবল ভালোবাসেন।’
‘দু—বছর আগেও রেগুলার মাঠে যেতুম মোহনবাগানের খেলা থাকলে। এখন দোকান ফেলে আর যেতে পারি না।’ লোকটির স্বরে আক্ষেপ ফুটে উঠল।
‘নবেন্দুর খেলা আপনি দেখেছেন?’
‘দেখব কী করে, ও তো মোহনবাগানে আগে কখনো খেলেনি। গতবছর একটা গোল দিয়েছে তখনই তো নামই জানলুম, অবশ্য ইস্টবেঙ্গকেও একটা দিয়েছে। ওকে যে মোহনবাগান তুলে নেবে সেটা তখন বুঝে গেছলুম।’ লোকটির মুখে ছড়িয়ে পড়ল নিজ অনুমান সফল হওয়ার হাসি। ‘এল তো কিন্তু খেলার চান্স পাবে কিনা বলা শক্ত। সেট টিম, কাকে বসিয়ে ওকে খেলাবে?’ একটু উদবেগ মাখান মুখে লোকটি পূর্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে রইল।
পূর্ণেন্দু মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়লেন প্রশ্নটাকে গুরুত্ব দিয়ে। ফুটবল, মোহনবাগান এই দুয়ের কোনোটা নিয়েই তিনি মাথা ঘামান না শুধু ক্রিকেট ছাড়া, পূর্ণেন্দুর মুখ দেখেই লোকটি বুঝে গেল ময়দানের গূঢ় ব্যাপার—স্যাপার এই প্রৌঢ় কিছুই জানেন না। সে গলা নামিয়ে বলল, ‘এরকম উঠতি বিপজ্জনক প্লেয়ারদের ক্লাব ক্যাচ করে নিয়ে এসে বসিয়ে রেখে দেয়, না খেলিয়ে খেলিয়ে নষ্ট করে দেয়। একবছর বসে থেকে সেই প্লেয়ার যখন বিরক্ত হতাশ হয়ে অন্য ক্লাবে চলে যায় তখন আর আগের মতো খেলতে পারে না। এরকম অনেক দেখেছি। আপনার ছেলেকে বলবেন পলিটিক্স করে হোক বা অন্য যেভাবেই হোক এক আধটা ম্যাচে যেন খেলার জন্য চান্স করে নেয়। ক্লাবে ওর মুরুব্বি কে?’
পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে বললেন, ‘জানি না।’
‘নিশ্চয় কেউ আছে। সেই মুরুব্বির ক্লাবে ক্ষমতা কতটা? ক্ষমতা যদি থাকে তাহলে নবেন্দু খেলার চান্স পেতে পারে, আর একবার মাঠে নামার সুযোগ পেলেই যেন সাপোর্টারদের বুঝিয়ে দেয় ওকে বসিয়ে রেখে ভুল করা হয়েছে। আমার কথাগুলো ছেলেকে বলবেন। আর বলবেন ভুনোদার গ্রুপটা এখন ভেরি স্ট্রং, ওর কথামতো টিম হয়।’
পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে, সাড়ে সাতশো গ্রাম মুরগির মাংস নিয়ে ফিরে আসেন।
.
চার
মাংসের দোকানদার যা বলেছিল ঠিক তাই ঘটল। খবরের কাগজে মোহনবাগানের খেলা থাকলেই পূর্ণেন্দু খেলার পাতাটা পড়েন। মোহনবাগান টিমে নবেন্দু গুপ্ত নামটা একদিনও দেখতে পাননি। তখন দোকানদারের কথাগুলো তার মনে পড়ে। ভাবেন নবুকে জিজ্ঞাসা করবেন। জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আড়ষ্ট বোধ করেন। লক্ষ করেছেন তার ক্লাবের খেলার দিনে নবু খিটখিটে অধৈর্য হয়ে ওঠে। ফ্ল্যাট থেকে আর বেরোতেই চায় না।
এই রকম একটা দিনে পূর্ণেন্দু দেখলেন বিকেলে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। অবাক হয়ে বললেন, ‘আজ তো মোহনবাগানের খেলা হয়েছে, তুই গেলি না?’
নবেন্দু কোনো জবাব দিল না। পূর্ণেন্দু আবার জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, ‘শরীরটা ভালো নেই।’
ওর বলার ভঙ্গিতে পূর্ণেন্দু বুঝলেন, এই প্রসঙ্গে আর কথা বলতে চায় না। রাত্রে একসঙ্গে খেতে বসে পূর্ণেন্দু কথাটা তুললেন, ‘ব্যাপার কী বলত, খেলার দিন আজকাল তুই বাড়িতেই থাকিস! তোকে কি খেলায় চান্স দিচ্ছে না?’
নবেন্দু গুম হয়ে থালার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’
‘লিগের একটা ম্যাচেও তো টিমে তোর নাম দেখলুম না। সাত—আটটা ম্যাচ হয়ে গেছে!’
নবেন্দু কথা না বলে রুটি ছিঁড়ে তাই দিয়ে তরকারি তুলে মুখে দিল।
‘ক্লাবে নাকি পলিটিক্স হয়? অনেকগুলো গ্রুপ আছে, সত্যি?’
‘তোমায় কে বলল?’
‘মুরগির মাংসা বিক্রি করে যে লোকটা, সে বলেছে।’
‘ঠিকই বলেছে।’
‘বলেছে তুই একটা গ্রুপে ঢুকে পড়, ভুনোদার গ্রুপে ঢুকলে চান্স পাবি।’
‘আমাকে সমরেশদা নিয়ে গেছল, সমরেশদা বরুণ ভটচাযের গ্রুপের লোক। বরুণদা আবার ভুনোদার অ্যান্টি গ্রুপের। আমি বরুণদার লোক বলে দাগি হয়ে গেছি। আসলে এখনই বড়ো ক্লাবে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়ে গেছে। সমরেশদার কথাতেই গেছি, বলেছিল তিনটে ম্যাচ খেলিয়ে দেবে এখন দেখছি ওর কোনো পাওয়ারই নেই।
‘তোকে শুধু বসিয়ে রাখার জন্য ক্লাব তিরিশ হাজার টাকা খরচ করবে?’ পূর্ণেন্দুর গলায় আগাগোড়া অবিশ্বাস।
‘তিরিশ হাজার নয় পনেরো হাজার। বাকি পনেরো আর কোনোদিন আদায় করা যাবে না।’ নবেন্দু নিশ্চিত স্বরে কথাটা বলল। তাতে হতাশা নেই। সে যেন জানে টাকা না পাওয়াটাই নিয়ম।
‘এবার সমরেশকে গিয়ে বল, তোমার কথা শুনেই আমার কেরিয়ারের ক্ষতি হল। তুই নিজেও কী বুঝিস না নিজের ভালো কিসে হবে আর কিসে হবে না?’ বহু বছর পর পূর্ণেন্দু প্রায় ধমক দিলেন নবেন্দুকে। বরাবরই অবাধ্য ও উদ্ধত তার ছোটো ছেলে, তাই শাসন করতে যেতেন না মান খোয়াবার ভয়ে।
মুখ নামিয়ে রইল নবেন্দু। মায়া শুনছিলেন ওদের কথা। পাংশু মুখে ভীত স্বরে বললেন, ‘আর টাকা দেবে না? জমি কেনা, বাড়ি করা এ সব তা হলে হবে না? হ্যাঁ রে নবু কিছুই তাহলে হবে না?’
নবেন্দু মরা মাছের মতো ফ্যাকাসে চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে পূর্ণেন্দুকে বলল, ‘সমরেশদাকে আমি বলেছি তুমি আমার যে ক্ষতি করলে তা আর কোনোদিন পূরণ করা যাবে না। এই উঠতি সময়ে একটা বছর নষ্ট হলে মন ভেঙে যায়। ভাঙা মন নিয়ে বড়ো হওয়া যায় না।’
‘সমরেশ কী বলল?’ পূর্ণেন্দু তার অজানা এক জগতের দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা দেবার মতো করে জানতে চাইলেন।
‘বলল, আবার তুই কোনো ছোটো ক্লাবে গিয়ে শুরু কর। মোহনবাগান থেকে যাব ছোটো ক্লাবে? লোকে হাসবে কিন্তু কিছু করার নেই। বলেছিল ব্যাঙ্কে চাকরি পাইয়ে দেবে। তাও আর হবে না। বড়ো ক্লাবের বড়ো প্লেয়ারকেই ব্যাঙ্ক নেবে, আমাকে নেবে কেন? নতুন করে আবার উঠে দাঁড়াবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। হ্যাঁ ছোটো ক্লাবেই যাব, আবার গোল দিয়ে মোহনবাগানকে শিক্ষা দোব নইলে হাজার মাধ্যমিক পাশ করাদের একজন হয়েই আমাকে বাঁচতে হবে।’ নবেন্দু খাবারের থালা ঠেলে দিয়ে বেসিনে হাত ধুতে গেল। পূর্ণেন্দু আর মায়া ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন! হাত ধুয়ে প্রায় ছুটেই নবেন্দু ঘরে চলে গেল।
একটা তিনতলা বাড়ি ধসে পড়ছে মায়ার চোখের সামনে আর তিনি ভাঙা বাড়ির চাঙড় সরিয়ে সরিয়ে খুঁজতে লাগলেন এই দুই ঘরের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথটা। পথ না পাওয়া বিভ্রান্ত চোখ দুটি স্বামীর দিকে মেলে তিনি বললেন, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
একই ভাবে তাকিয়ে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘আমিও পারছি না।’
‘ওকে ভালো করে জিজ্ঞেস করে দেখো না। রবু তো বলেছিল সমরেশ লোকটা ভালো নয়।’
‘ক্লাবের ব্যাপার—স্যাপার আমি একদম বুঝি না, এখন জিজ্ঞেস করে দরকার নেই। নবুই ভালো বোঝে, যা করার ওই করবে।’
রবিন্দু ফিরল একটু রাত করে। পূর্ণেন্দু তাকে বসার ঘরে ডেকে নিয়ে নীচু গলায় নবেন্দুর হতাশা ও ভেঙে পড়ার কথাটা বললেন।
চিন্তিত মুখে রবিন্দু বলল, ‘এরকম হয় শুনেছি। টিমের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে এমন অপোনেন্ট প্লেয়ারকে রিক্রুট করে তারপর তাকে বসিয়ে রেখে নষ্ট করে দেয়। আর সব অল্পবয়সি ছেলেরই তো স্বপ্ন বড়ো ক্লাবের জার্সি পরা। আশ্চর্য ব্যাপার, নবুকে একটা ম্যাচেও খেলাল না।’
স্বপ্ন রবিন্দুও দেখেছিল, ভাই বাড়ি করবে তারপর এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে সেই বাড়িতে নবু উঠে যাবে। একটা ঘরে দুটো খাটে তারা দুজন শোয়, একটা আলনা ভাগ করে দুজনে ব্যবহার করে, টুলের মতো দুটো টেবলে তারা ছোটোখাটো জিনিস রাখে, খাটের নীচে দুজনের দুটো সুটকেশ, ঘরে নড়াচড়ার জায়গা নেই। রবিন্দুর আশা ছিল পুরো ঘরটাই একদিন তার হবে। হলে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পাবে। এমনকী তখন বিয়ের কথাও সে ভাবতে পারবে।
রবিন্দু বলল, ‘কিন্তু ও ক্লাবে যাওয়া বন্ধ করল কেন? এটা ঠিক কাজ নয়। যাক, রোজ যাক। বলা তো যায় না একদিন চান্স তো পেয়েও যেতে পারে।’
‘সেটা তুইই ওকে বুঝিয়ে বল। আমি বললে শুনবে না।’
অন্ধকার ঘরে চিৎ হয়ে নবেন্দু শুয়ে, কপালে আড়াআড়ি রাখা দুটো হাত। দেখেই রবিন্দু বুঝল ঘুমোয়নি, ভাবছে।
নবেন্দুর পাশে খাটে বসে সে বলল, ‘যাচ্ছিস না কেন ক্লাবে? ভুল করছিস, নজরের বাইরে থাকলে তোকে তো ওরা ভুলে যাবে। ফুটবল এমন একটা খেলা কখন যে কাকে দরকার পড়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। বড়ো ক্লাবে মান অভিমান চলে না আর তুই এতবড়ো প্লেয়ার নোস যে বাড়িতে এসে সাধাসাধি করবে। ধৈর্য ধরে থাকতে হয়। কালই যাস।’
দাদার সহানুভূতি ভরা আন্তরিক স্বর নবেন্দুর মাথায় ঢুকল। পরদিন থেকে সে ক্লাবে গিয়ে সকালের প্র্যাকটিসে যোগ দিল। রবিন্দু যা বলেছিল ঠিক তাই ঘটল। মিড ফিল্ডার গৌতম পালের কুঁচকির পুরোনো চোটটা আবার ফিরে এল ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে খেলায়, পরের ম্যাচ এরিয়ান্সের বিরুদ্ধে সে খেলতে পারবে না। স্থির হল দুই নবাগত সমীর পোল্যে আর নবেন্দু গুপ্তকে ম্যাচটায় খেলানো হবে আধাআধি করে, প্রথমার্ধে সমীর দ্বিতীয়ার্ধে নবেন্দু। খবরটা নবেন্দু বাড়িতে জানাল ম্যাচের আগের দিন।
পূর্ণেন্দু কখনো ফুটবল ম্যাচ দেখতে ময়দানে যাননি, মোহনবাগান মাঠটাও চেনেন না। ঠিক করলেন ম্যাচটা দেখতে যাবেন। বেলা তিনটে নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহিদ মিনারের কাছে বাস থেকে নেমে একটি অল্পবয়সি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলেন মোহনবাগান মাঠটা কোন দিকে। ছেলেটির আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া দিক লক্ষ করে কয়েকটা রাস্তা ও মাঠ পেরিয়ে পৌঁছলেন সবুজ গ্যালারির টিকিটের জন্য দাঁড়ানো লাইনে। মিনিট পনেরো পর তিনি জীবনে প্রথম ঘেরা মাঠে ঢুকলেন।
গ্যালারির মাঝ বরাবর বসে তিনি সামনে ঝুঁকে আধাবয়সি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্লেয়াররা মাঠে নামবে কোনখান দিয়ে?’
লোকটি মাথা ঘুরিয়ে কয়েক সেকেন্ড পূর্ণেন্দুর মুখ দেখে নিয়ে মাঠের ওপারে সিমেন্টের সদস্য গ্যালারির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওর মাঝে যে সরু পথটা দেখছেন ওখান দিয়ে। মাঠে আজ প্রথম এলেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
যখন এসে বসেন তখন গ্যালারি অর্ধেক ভরা ছিল, ক্রমশ ঠাসাঠাসি হয়ে ভরে উঠল। পূর্ণেন্দুর মনে হল মাঠের তিন দিক ঘিরে হাজার কুড়ি পঁচিশ লোক তো হবেই। চতুর্থ দিকে কোনো গ্যালারি নেই। গোলপোস্টের পিছনে কিছুটা ফাঁকা জমি তারপর বেড়া। তার ওধারে কেল্লার ঢালু জমিতে থিকথিক করছে লোক। এই ঢালে দাঁড়িয়ে মাঠটা দেখা যায়। পূর্ণেন্দু ভেবে পেলেন না অতদূর থেকে লোকগুলো খেলার কতটা দেখতে পাবে!
চারপাশের লোকেদের কথাবার্তা থেকে তার মনে হল সবাই মোহনবাগানের সমর্থক আর সহজেই জিতে যাব এমন ধারণা কেউ করছে না।
‘আরে মশাই সবার ধারণা ইস্টবেঙ্গলই বুঝি মোহনবাগানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী, ভুল ভুল, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হল এরিয়ান্স সেই জন্মের সময় থেকে।’ পূর্ণেন্দুর পিছনে কেউ একজন বলল। ‘বাগবাজার আর শ্যামপুকুর দুটো পাড়ার রেষারেষি আকচাআকচি থেকে খেয়োখেয়ি। আশি নব্বুই বছর আগের কলকাতার সঙ্গে গ্রামের কোনো তফাত ছিল না।’
‘দাদা আজও কী কোনো তফাত আছে।’ কেউ ফোড়ন কাটল।
‘দেখবেন মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা পড়লেই নড়বড়ে এরিয়ান্স কী রকম শক্ত হয়ে যায়। আলাদা একটা জেদ ওদের ওপর চেপে বসে। সেই দুখিরামবাবুর আমল থেকে এটা হয়ে আসছে।’
কে দুখিরামবাবু? পূর্ণেন্দু সামনের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করবেন ভাবলেন। কিন্তু সেই চাহনি আর ‘মাঠে প্রথম এলেন’ তাকে দমিয়ে রাখল।
‘গৌতম পাল আজ খেলছে না, তার জায়গায় দুটো হাফে দুটো নতুন ছেলেকে খেলিয়ে দেখবে। ওদের খেলা দেখেছেন নাকি?’
‘সমীর ছেলেটা স্পোর্টিংয়ের এগেনস্টে সেকেন্ড হাফে খেলেছিল, চলনসই তবে নবেন্দু ছেলেটাকে দেখিনি।’
পূর্ণেন্দু উৎকর্ণ হলেন নবেন্দুর নাম শুনে।
‘গত বছর মোহনবাগানকে গোল দিয়েছিল। এ বছর একটাও ম্যাচ খেলেনি।’
‘গোলটা দেখেছি, বিশ গজ থেকে মেরেছিল, ছেলেটার মাথাটা পরিষ্কার, দু পায়ে শট আছে, ভিড়ে ঢুকে ধাক্কাধাক্কি করতে পারে, কেন যে বসিয়ে রেখেছে বুঝতে পারছি না।’
কথাগুলো যে বলল তার গলায় দরদের ছোঁয়া পেয়ে পূর্ণেন্দুর মন কৃতজ্ঞতায় ফেঁপে উঠল, মাঠের একটা কোণের দিকের গ্যালারি থেকে মৃদু হাততালি উঠল। এরিয়ান্স দল মাঠে নেমেছে। তিন মিনিট পর বিপুল হো হো ধ্বনি আর সারা মাঠের হাততালির সঙ্গে গ্যালারির মানুষরা দাঁড়িয়ে পড়ল। পূর্ণেন্দুও উঠে দাঁড়ালেন। মোহনবাগান দল মাঠে আসার জন্য সরু পথটা দিয়ে এগিয়ে আসছে। খেলোয়াড়দের আসতে দেখেই এই সম্বর্ধনা। জমিতে হাত ঠেকিয়ে হাত কপালে ছুঁয়ে ওরা চোদ্দোজন মাঠে পা রাখল। পূর্ণেন্দুর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নবেন্দুকে। অবশেষে দেখতে পেলেন।
চারটে বল নিয়ে মোহনবাগান মাঠে নেমেছে। গোলে শট নিচ্ছে, নিজেদের মধ্যে দেওয়া নেওয়া করছে যারা তাদের একজন নবেন্দু। কিছুক্ষণ পর রেফারির বাঁশি শুনে নবেন্দু আরও দুজনের সঙ্গে মাঠের বাইরে এসে বেঞ্চে বসল। প্রথমার্ধের খেলায় কোনো দল গোল করতে পারল না। পূর্ণেন্দু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলেন দ্বিতীয়ার্ধের জন্য। দেখলেন নবেন্দু নেমেছে। বলের জন্য ছোটাছুটি করছে, তাড়া করছে। একবার বল পেয়ে ডানদিকে একজনকে এমন ঠেলে দিল যে বলটা এরিয়ানসের প্লেয়ারের পায়ে জমা পড়ল।
পূর্ণেন্দুর মনে হচ্ছে নবু একটা কিছু করে দেখাবার জন্য মরিয়া হয়ে এলোমেলো করে ফেলছে তার খেলা। এইভাবে খেলতে খেলতে নবেন্দু একটা পঁচিশ গজের শট নিল। গোলকিপার কোনোক্রমে বলটা বারের উপর তুলে দিল। কর্নার, কর্নার কিক থেকে বলটা গোলের সামনে উঁচু হয়ে পড়ছে। গোলকিপার বল ধরার জন্য এগিয়ে এসেও পিছিয়ে গেল। মোহনবাগানের লম্বা বাক্যটি উঠে এসেছে সে হেড করে বল গোলের মধ্যে পাঠিয়ে দিল।
গগনবিদারী চিৎকার কী বস্তু পূর্ণেন্দু জীবনে এই প্রথম তার স্বাদ পেলেন। চিৎকার সবে থিতিয়েছে তখনই মোহনবাগান গোল খেয়ে গেল। দোষটা ছিল ওই লম্বা ব্যাকেরই। গোলের সামনে সে পায়ে বল নিয়ে অযথা বাহাদুরি দেখাতে বিপক্ষ ফরোয়ার্ডকে একবার কাটিয়ে আবার কাটাতে গেল। বলটা পা থেকে একটু বেরিয়ে যেতেই ফরোয়ার্ডটি দুম করে বলটা গোলে মেরে দেয়। গোলকিপারকে হতভম্ভ করে বলটা গোলে ঢুকে যায়। সারা মাঠ স্তব্ধ।
দশ মিনিট পর মাঝমাঠ থেকে বল দিয়ে নবেন্দু বুনো মোষের মতো সোজা ঢুকল এরিয়ান্স রক্ষণের মধ্যে। দুজনকে শুধু গতিতে পার হয়ে বলটা পাশে একজনকে ঠেলে দিতেই সে সঙ্গে সঙ্গে বলটা ছুটন্ত নবেন্দুর সামনে বাড়িয়ে দিল। বাঁক নেওয়া পনেরো গজের প্রচণ্ড একটা শট এবং গোল। আবার গগনবিদারী চিৎকার। সহখেলোয়াড়রা জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে নবেন্দুকে। থরথর কেঁপে উঠলেন পূর্ণেন্দু। সবার সঙ্গে তিনিও চিৎকার করে উঠেছিলেন। নবু এখন মাঠের হিরো। চেঁচিয়ে তার বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ও আমার ছেলে, আমার ছেলে।’
‘বহুদিন পরে একটা গোলের মতো গোল দেখলুম মশাই।’ সামনের লোকটি মুখ ফিরিয়ে বলল।
‘ছেলেটাকে এতদিন বসিয়ে রেখেছিল।’ পূর্ণেন্দু ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে।
খেলা যত এগিয়েছে পূর্ণেন্দু ততই খেলার সঙ্গে মিশে যেতে লাগলেন। হাজার হাজার দর্শকের সঙ্গে একাত্ম বোধ করছেন। এমন ভাবে কখনো তিনি নিজেকে উপভোগ করেননি। দুই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপর দিকে ছুঁড়লেন, পা ঠুকলেন, চিৎকার করলেন এবং নিজের বয়সটা ভুলে গেলেন। নবেন্দুকে নিয়ে প্রশংসার ঘূর্ণির মধ্যে তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। উঠে এল নবু, সমর্থকরা ওর পিছনে এসে দাঁড়াবে। আর ওকে বসিয়ে রাখা যাবে না। খেলায় নবেন্দুর গোলেই মোহনবাগান জিতল। ভিড়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসপ্ল্যানেডে আসার পথে তিনি অনেকবার মায়ার মুখটি দেখতে পেলেন।
বাস থেকে নেমে বহুদিন পর মুরগির মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে আজ তিনি এলেন। দোকানদার তাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কাকাবাবু, রিলেতে শুনলুম নবেন্দুর গোলে আমরা জিতেছি।’
পূর্ণেন্দু চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন, ‘তাই নাকি! বাঃ বেশ ভালো খবর দিলেন।
‘মাংস নেবেন না? আজই তো খাবার দিন।’
ইতস্তত করে তিনি বললেন, ‘দিন এক কেজি।’
.
পাঁচ
রবিবার সন্ধ্যাবেলায় টিভি—তে বাংলা সিনেমা দেখছিলেন মায়া ও পূর্ণেন্দু। ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই। কাজের মেয়েটি এইমাত্র চলে গেল। এমন সময় কলিং বেল বাজল। মায়া উঠতে যাচ্ছিলেন তাকে হাত তুলে বারণ করে পূর্ণেন্দু উঠলেন। মায়ার বাতের ব্যথা দিনকয়েক হল বেড়েছে। দরজা খুলে পূর্ণেন্দু অবাক।
‘আরে অমিয়, তুমি!’
‘অবাক করে দিলুম তো। প্রায় দু—বছর পর।’
‘হ্যাঁ প্রায় দু—বছর পর এলে। ভেতরে এসো।’ পূর্ণেন্দু টিভি বন্ধ করলেন।
অমিয় বসার ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসে বলল, ‘মাসিমা কেমন আছেন?’ মায়ার মুখে স্বচ্ছন্দ হাসি ফুটে উঠল। ছায়ার বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাচচা হওয়ার তারিখ আর পাঁচমাস পর। বোম্বাইয়েই হবে। তখন ওখানে গিয়ে তার মাস দুই থাকার ইচ্ছা। অমিয় এখন আর তার কাছে অবাঞ্ছিত নয়, সুতরাং হাসতে পারেন।
‘এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল।’ মায়া প্রথামাফিক অনুযোগ করলেন।
‘মনে ঠিকই পড়ত, আসার সময় করে উঠতে পারিনি। কাঁকুড়গাছিতে একটা কাজ শুরু করেছি তাই এদিকে আসতে হচ্ছে।’
‘তুমি তো ইনটিরিয়ার ডেকরেশনের ব্যবসা শুরু করেছিলে। সেটাই চালিয়ে যাচ্ছ?’ পূর্ণেন্দু কৌতূহল দেখালেন।
‘হ্যাঁ, যাচ্ছি। এই উল্টোডাঙ্গার মোড়ে একটা বড়ো চশমার দোকান হচ্ছে, সেটারই কাঠের ব্যতীত কাজ, আর্ট ডেকরেশন এইসব করছি। গুজরাতি মালিক কলকাতায় চারটে দোকান, ওখানে প্রচুর পয়সা ঢালছে। আপনাদের এই দিকটা, বেলেঘাটা থেকে উল্টোডাঙ্গা পর্যন্ত সল্টলেকে আর এয়ারপোর্টে যাবার রাস্তাটা বিরাট উন্নতি করবে, দশ বছর পর আর চেনা যাবে না। কলকাতার সেরা জায়গা হবে।’
‘কী করে বুঝলে তুমি?’ পূর্ণেন্দু আগ্রহ দেখালেন।
‘রাস্তার দু—ধারে পয়সাওলা লোক বেশিরভাগই মাড়োয়ারি বা অবাঙালিতে ভরে যাচ্ছে। দামিদামি জিনিসের দোকান হচ্ছে, প্রত্যেকটা বড়ো ব্যাঙ্ক এখানে ব্রাঞ্চ খুলেছে, গন্ডায় গন্ডায় হাউজিং হচ্ছে তাতে বাস করছে উচ্চচ মধ্যবিত্তরা। মেসোমশাই আপনাদের এদিকটায় লোকের হাতে প্রচুর টাকা।’
‘কই আমার হাতে তো টাকা নেই। এই দেখোনা আমার ঘরদোরের অবস্থা, যা তুমি দেখে গেছলে এখনও তাই রয়েছে একটা নতুন জিনিসও বাড়েনি,’ পূর্ণেন্দু হাত দিয়ে ঘরের চারপাশটা দেখালেন।
‘বাড়েনি বলছ কী!’ মায়া ছদ্ম গাম্ভীর্য মুখে এনে বললেন, ‘আমার বাতের ব্যথাটা বেড়েছে না?’
‘নিশ্চয় নিশ্চয়, আর আমার চশমার পাওয়ার।’ পূর্ণেন্দু হাসলেন, তার সঙ্গে অমিয়ও।
‘কাগজে নবুর নাম দেখি, ভালোই খেলছে।’ অমিয় কথা চালাবার জন্য বলল, ‘জমিটমি কিনেছে? বলেছিল আমাকে দিয়ে ইন্টিরিয়র ডেকরেশন করাবে। বলেছিলুম গড়িয়ার দিকে কিনতে, এখন দাম বিশ হাজারে উঠে গেছে।’
‘আর জমি কেনা!’ পূর্ণেন্দু সোফায় হেলান দিলেন হতাশভঙ্গিতে। ‘তখন বলেছিল বটে বাড়ি করব, এখন বলছে হাতে লাখ দুয়েক টাকা না জমলে বাড়ি করতে যাওয়াটা বিপজ্জনক। প্রথম বছরেই যে ভাবে বসিয়ে রেখেছিল তাতে ওর শিক্ষা হয়ে গেছে। আবার যে বসতে হবে না তার কী কোনো গ্যারান্টি আছে? প্লেয়ার সব সময় ফর্মে থাকবে তার নিশ্চয়তা কী কেউ দিতে পারে? যে কটা টাকা পেয়েছে তা জমি বাড়িতে ইনভেস্ট করল, ওদিকে টিম থেকে বসিয়ে দিল, চাকরিবাকরিও নেই অবস্থাটা তখন কী হবে একবার ভাব!’
পূর্ণেন্দু অমিয়কে ভাববার জন্য চার—পাঁচ সেকেন্ড সময় দিয়ে নিজেই সমাধানের সূত্রটা তুলে নিলেন। ‘ও যা বলেছে আমার মনে হল সেটাই ঠিক, এখন তো প্লেয়ারদের দর লাখ টাকায় উঠেছে। মজিদ বাসকার পেয়েছে আরও অনেকে লাখের কাছাকাছি পাচ্ছে। আমি বলছি না নবু মজিদের ক্লাসের, তবে বছর দশেক যদি বড়ো ক্লাবে খেলতে পারে ফর্ম রেখে আর চাকরি যদি একটা পায় তাহলে সাত—আট লাখ জমিয়ে ফেলতে পারে, পারবে না?’
পূর্ণেন্দুর ও মায়ার মুখ দেখে অমিয় বুঝে নিল তাকে কী উত্তর দিতে হবে। ‘সাত—আট লাখ কেন, দশ বছরে প্লেয়ারদের এক একটা সিজনের জন্য পাঁচ—ছ লাখে পৌঁছে যাবে। নবু দশ বছর খেলতে পারলে পনেরো ষোলো লাখ কামাবে। ততদিনে নিশ্চয় একটা চাকরিও পেয়ে যাবে।’
মায়া খুশি হয়ে বললেন, ‘অমিয় চা খাবে?’
‘এই একটা নেশা, কখনো না বলতে পারি না। দিনে বারো—চোদ্দো কাপ হয়ে যায়।’
মায়া সোফা থেকে উঠতে গিয়ে ‘আহহ’ বলে হাঁটু ধরে আবার বসে পড়লেন। ‘ব্যথাটা সকাল থেকে আবার চাগিয়েছে। কাজের মেয়েটা এই একটু আগে চলে গেল, থাকলে চা—টা করে দিত।’
‘আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না মাসিমা, চা না খেলেও এখন চলবে।’
‘এই একটা রোগ মানুষকে অথর্ব করে দেয়।’ মায়া চেষ্টা করে এবার উঠে দাঁড়ালেন, ‘তুমি বোসো অমিয় অনেকদিন পর এলে, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাও।’
মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অমিয় বলল, ‘মেসোমশায়ের এখন সময় কাটছে কেমন করে?’
‘টিভি দেখে। অখাদ্য প্রোগ্রাম, যা দেখায় সেটাই গিলতে হয়। মনোপলির এই এক ঝামেলা, কম্পিটিটার নেই ফলে উন্নতির কোনো চেষ্টাও নেই।’
পূর্ণেন্দুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই বিকট শব্দে বাইরের মাঠে একটা পটকা ফাটল। তিনি উঠে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখে ফিরে এলেন।
‘বোধহয় একটা রয়ে গেছল সেটাই ফাটাল। দুদিন ধরে যা হল, কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল। টিভি—তে দেখলুম, অমিয় তুমি দেখেছ? কপিল কী ক্যাচটাই নিল ভিভ রিচার্ডসের!’
‘ক্যাচ বলে ক্যাচ! পনেরো কুড়ি গজ পিছনে ছুটে গিয়ে ওইভাবে ধরা! ম্যাচটাতো তখনই ঘুরে গেল। ভিভ থাকলে একশো তিরাশি তো হেসে খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলে নিত।’ অমিয় চেয়ারের কিনারে এগিয়ে এল উত্তেজিত হয়ে।
‘তুমি বলছ ম্যাচের ওটাই টার্নিং পয়েন্ট? কিন্তু জিম্বাবোয়ের এগেনস্টে যে ইনিংসটা কপিল খেলল তাকে কী বলবে? ওটা তো সারা টুর্নামেন্টের টার্নিং পয়েন্ট!’
‘হান্ড্রেড পারসেন্ট একমত আপনার সঙ্গে। টার্ন ব্রিজ ওয়েলসে ওইরকম ব্যাটিং…সতেরো রানে পাঁচটা উইকেট পড়ে গেছে—’।
‘অমিয় কথাটা টার্ন নয় টান, টান ব্রিজ ওয়েলস।’
পলকের জন্য অমিয়র মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। সামলে নিয়ে সপ্রতিভ ভাবে লঘু স্বরে সে বলল, ‘এই আমার বড়ো ঘাটতি মেসোমশাই, ইংরিজি উচ্চচারণটা ঠিকঠাক হয়না, পেস বোলিংটা স্পেস বোলিং হয়ে যায়, ডাইভ হয়ে যায় ড্রাইভ।’ কথা শেষে সে বোকার মতো হাসল।
‘এই যে ভুল উচ্চচারণের কথা বললে, এর বড়ো কারণ শব্দগুলো যখন পড় তখন বানানটা লক্ষ করোনা। অভ্যাসটা ছোটোবেলা থেকে তৈরি হয়ে গেছে। এই যে ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের অফ স্টাম্পের বাইরে ব্যাট বাড়িয়ে স্লিপে ক্যাচ দেওয়া, এটাও সেই অভ্যাসের ব্যাপার।’ অধ্যক্ষ পূর্ণেন্দু গুপ্তকে বহুদিন পর যেন ফিরে পেলেন পূর্ণেন্দু। ক্লাসে এই ভঙ্গিতেই ছাত্রদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেন।
‘মেসোমশাই, সত্যিকারের একটা ফাস্ট বোলার নেই, একটা স্পিনার নেই, তা সত্ত্বেও লয়েডের টিমকে একশো চল্লিশ রানে শেষ করে দেওয়াটা স্রেফ মিরাকল।’
পূর্ণেন্দু বহুদিন পর ক্রিকেট নিয়ে কথা বলারও শ্রোতা পাওয়ার সুযোগ পেয়ে সুদীপ্ত হয়ে উঠলেন। নবুর সঙ্গে ফুটবল ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলা যায় না, রবুর কোনো খেলাই পছন্দ নয়, মায়ার কাছে বিশ্বকাপের থেকে চায়ের কাপ অনেক মূল্যবান।
‘অমিয় ওই জয়টা মিরাকল বা ফ্লুক বলতে পার কিন্তু দ্বিতীয়বার এটা ঘটবে না, এ জিনিস একবারই হয়। খবরের কাগজটা মন দিয়ে যদি পড়তে তাহলে একটা খবর তোমার চোখে পড়ত, এবার ইংল্যান্ডে সিজনের গোড়ায় খুব বৃষ্টি হয়েছিল। মাঠ, পিচ ভিজে ছিল, আবহাওয়াও স্যাঁতসেঁতে, উইকেট স্লো, বল যতটা সীম করে তার থেকেও বেশি করেছে। এই রকম কন্ডিশনে মারাত্মক হয়ে ওঠে সেই সব মিডিয়াম পেসারেরা যাদের লেংথ, লাইন আর সুইংয়ের ওপর ওস্তাদি আছে, ইন্ডিয়ান বোলারদের তা ছিল, ঠ্যাঙাড়ে ব্যাটসম্যানদের ঠান্ডা করে দেওয়ার মতো আইডিয়াল কন্ডিশন আমাদের বোলাররা পেয়ে গেছল। আমার কথার পয়েন্টটা কী তুমি ধরতে পারছ?’ পূর্ণেন্দু উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
‘বরাত জোরে আমরা জিতেছি।’ অমিয় একটি বাক্যে সার কথাটা বলে দিল।
‘আর কমাস পরেই তো ওরা ভারতে ট্যুর করতে আসছে। দেখো ইন্ডিয়ান কন্ডিশনে কী হয়, দুরমুস করে দিয়ে যাবে।’ পূর্ণেন্দু প্রত্যয় ভরে বললেন।
অমিয় মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনি এত নেগেটিভ চিন্তা করছেন কেন, আমরা তো ওদের হারাতেও পারি।’
পূর্ণেন্দু স্থির চোখে সামনে বসা উদীয়মান ব্যবসায়ীটিকে লক্ষ্য করতে করতে বললেন, ‘নেগেটিভ চিন্তা নয় এটা হল যুক্তিযুক্ত বিবেচনা প্রসূত ধারণা, নানান দিক দেখে একটা সিদ্ধান্তে আসা। আমার এই মানসিকতাই পেয়েছে শুধু রবু কিন্তু নবু পায়নি। তবে একটা কথা কী জানো, কখন যে কোথা থেকে অজানা ঘটনা এসে সব হিসেব নিকেশ, কষে রাখা ছক তছনছ করে দেবে কেউ তা জানে না; তেমনই ভালো ঘটনাও ঘটে যায় ছায়ার বিয়েটার মতো।’
পূর্ণেন্দু লক্ষ করলেন না অমিয়র বসাটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। বলার ঝোঁকে তিনি বললেন, ‘আমি তো ভেবেছিলুম চেনাশোনা লোকেদের কাজে পাত্রের কথা বলতে হবে, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে চিঠিপত্র লিখতে হবে। তখনই বাড়িতে বেল বাজিয়ে ছেলের মা হাজির। এম টেক, উচ্চচশিক্ষিত, বোম্বাইয়ে তিন হাজার টাকা মাইনের চাকরি, দেখতে ভালো, ভদ্র মার্জিত রুচি, বয়স কম, দাবি দাওয়া নেই, সব থেকে বড়ো কথা স্বজাতি স্বগোত্র—আর কী চাই! ভাবতে পার অমিয়, এটাকে মিরাকল বলবে না?’
‘নিশ্চয় মিরাকল, ইন্ডিয়ার ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার মতো।’ অমিয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎসাহ দেখিয়ে বলল, ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ কাকে বলবেন?’
‘তোমার মাসিমা।’
তখন ট্রেতে চায়ের কাপ আর পাঁপর ভাজা নিয়ে মায়া ঘরে ঢুকলেন।
‘আমার কথা যেন হচ্ছে মনে হল।’
‘ছায়ার বিয়েটাকে অমিয় ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার মতো বলল। আমি বললুম ম্যান অব দ্য ম্যাচ তোমার মাসিমা।’ পূর্ণেন্দু নিঃশব্দে হেসে একটা পাঁপড় তুলে নিয়ে বললেন, ‘অমিয় শুরু করো।’
মায়া বিব্রত স্বরে অমিয়কে বললেন, ‘এত তাড়াহুড়োয় বিয়েটা হল যে সবাইকে নেমন্তন্ন করা গেল না।’
অমিয় কথাটা না শোনার ভান করে বলল, ‘মাসিমা এই পা নিয়ে কষ্ট করে রান্না ঘরে যাচ্ছেন কেন, একটা রাঁধুনি রাখলেই তো পারতেন, কত আর খরচ? আড়াইশো বড়োজোর তিনশো।’
‘ব্যাপারটা তো খরচের নয় পারিবারিক রীতির। এনাদের আবার বাইরের লোকের হাতে রান্না মুখে রোচে না।’ মায়া ঠোঁট মুচড়ে স্বামীকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ‘তাই বাড়ির মেয়ে—বউয়েদের দিয়ে রাঁধান। এই রীতি নাকি ঠাকুরদার বাবার আমল থেকে চলে আসছে। কত শিক্ষিত শিক্ষিত ছেলে তো এদের বংশে জন্মেছে কেউ কিন্তু মেয়েদের মুখ চেয়ে এই রীতিটা ভাঙার চেষ্টা করেনি, ইনিও সেই দলের।’ মায়া আবার আঙুলটা স্বামীর দিকে তুলে দেখালেন। অমিয় বুঝতে পারল মায়ার অভিযোগের আড়ালে প্রশ্রয় রয়েছে।
‘আসলে কী জান অমিয়, তোমার মাসিমার হাতের রান্না একবার খেলে অন্য কারুর রান্না আর মুখে দেওয়া যায় না। যদি উনি চান তাহলে আমি রীতি ভাঙতে রাজি আছি।’ পূর্ণেন্দু ঠোঁট টিপে তেরছা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
‘থাক থাক এই বুড়ো বয়সে রীতি ভেঙে আর কাজ নেই। মায়ার কথার মধ্যে তিক্ততা আর পরিহাস দুটোই রয়েছে।
‘মাসিমা ঠিকই বলেছেন, রীতি ভাঙতে যাবেন কেন। ওনার এখন কষ্ট হয়। রবুর বিয়ে দিন, রান্নাঘরটা ছেড়ে দিন বউমার হাতে, প্রবলেম সলভড!’ অমিয় দুটো কাঁধ তুলে সমস্যার ফয়শালা বুঝিয়ে দিল, দুই প্রৌঢ়র মুখের ভাব সে লক্ষ করল। সেখানে দ্বিধা জড়িত অনুমোদন।
‘কিন্তু রবু কী এখন বিয়ে করতে রাজি হবে?’ পূর্ণেন্দু সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
‘রাজি না হবার কী আছে। বয়স বত্রিশ—তেত্রিশ তো হল, আর কবে বিয়ে করবে?’
‘একটা রিজনেবল লেভেলে রোজগার না হলে কী বিয়ে করা যায়? রবু বলেছিল মাসে হাজার পাঁচেক আয় করতে পারলে আর নবু বাড়ি করে চলে গেলে তখন বিয়ের কথা ভাববে।’
অমিয় অবাক হয়ে বলল ‘কিন্তু আপনি যে এইমাত্র বললেন নবু এখন বাড়ি করবে না, হাতে লাখ দুয়েক জমলে তখন করবে।’
‘রবু বলেছিল অনেকদিন আগে তখন নবু বাড়ি করবে বলেছিল, তার পর মত বদলায়। আমি ওকে বলি তুই কোথাও বাসভাড়া করে থাক না। তাইতে নবু বলে ক্লাব থেকে যে টাকা পাই তাই দিয়ে বাসভাড়া করে থাকতে পারব বটে কিন্তু যদি কোনো কারণে ক্লাব খারাপ ব্যবহার শুরু করে, যদি টাকা আটকে দেয়, লিখিত তো নয় সবই মৌখিক চুক্তি। প্রথম সিজনটা নবু খুব ভালো খেলে টিমে জায়গা করে নেয়, পরের বছর তত ভালো খেলতে পারেনি, পরপর ছটা ম্যাচে গোল পায়নি, ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ভাইটাল ম্যাচে দুটো প্রায় ওপেন নেট মিস করে। ওকে বসিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছিল। নবু সেই যে তখন নিজের ওপর আস্থা হারাল আজও তা উদ্ধার করতে পারেনি।’
পূর্ণেন্দুর কথায় সুর থেকে অমিয়র কানে ধরা পড়ল এই পরিবারের জীবনযাপনের মধ্যে অসঙ্গতি এবং সেটা শুধুই নবুর ফুটবল কেরিয়ারকে উপলক্ষ্য করে, নবু যেমন চাপের মধ্যে রয়েছে তেমনি এই দুই প্রৌঢ়, হয়তো রবুও।
‘মাসিমা আপনি কতদিন আর কষ্ট করে এ ভাবে রান্না করে সংসার দেখাশোনা করবেন? আপনার তো এখন বিশ্রাম নেবার কথা। মেসোমশাই আপনাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছেড়ে এবার বেরিয়ে আসুন, একটা রাঁধুনি আর নয়তো রবুর বিয়ে দিয়ে একটা বৌমা আনুন।’
পূর্ণেন্দু সিধে হয়ে বসে গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আমি তো বলেছি রাঁধুনি রাখো। কিন্তু এই উনি—’ তিনি আঙুল তুললেন মায়ার দিকে আর তখনই দরজায় বেল বাজল। অমিয় দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলল। রবিন্দু দাঁড়িয়ে। অমিয়কে দেখে বিস্ময়ে তার ভ্রূ উঠে গেল।
অমিয় বলল, ‘আয়, তোর কথাই হচ্ছিল।’
‘এতদিন পর এলি আমার কথা বলার জন্য!’ রবিন্দু ঘরে এসে বসার জায়গা না পেয়ে খাওয়ার টেবিলের একটা চেয়ার নিয়ে এল।
‘তুই বিয়ে করছিস না কেন? মাসিমার কষ্ট কী তার চোখে পড়ে না?’
রবিন্দুর হাসি মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। চোখ কুঁচকে মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা আমি করিনি। বিয়ে করে থাকব কোথায়?’
অমিয় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘কেন, এই ফ্ল্যাটে।’
‘নবু তাহলে থাকবে কোথায় আর বাবা মা? ঘর তো মোটে দুটো!’
‘তুই বিয়ে করবি বল, নবুর থাকার ব্যবস্থা আমাদের গড়িয়ার নতুন বাড়িতে করে দোব। ব্যাচিলার, একটা ঘর হলেই তো চলে যাবে, কোনো অসুবিধে হবে না থাকতে। নবু নিশ্চয় দাদার মুখ চেয়ে রাজি হয়ে যাবে। তার আগে তুই বল, তুই রাজি?’
দরজায় বেল বাজল, রবিন্দু উঠে গিয়ে দরজা খুলল। ঘর থেকে ওঁরা শুনতে পেলেন একটি মেয়ের গলা, ‘জানলা থেকে দেখলুম আপনি ফিরছেন তাই ভাবলুম অঙ্কটা একটু ঝালিয়ে নিয়ে আসি। আপনি কী খুব ব্যস্ত?
‘আমার এক পুরোনো বন্ধু এসেছে।’
‘তাহলে আমি এখন যাই।’
‘না না বোসো, পরীক্ষার তো আর এক মাসও বাকি নেই। তুমি বরং খাওয়ার টেবলে বোসো।’
রবিন্দু ঘরে বসে অমিয়কে বলল, ‘মিনিট পনেরো একটু বোস, পড়তে এসেছে সামনেই পরীক্ষা।’
রবিন্দু চেয়ারটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল। অমিয় জিজ্ঞাসু চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছাত্রী?’
মায়া বললেন, ‘কুটুম, ছায়ার ননদ এই হাউজিংয়েই থাকে।’ তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে জুড়ে দিলেন, ‘ছায়ার শাশুড়ি রবুর সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে, নানান টোপ ফেলে যাচ্ছে। রবুও গিলছে না আমরাও গিলছি না।’
পূর্ণেন্দু বললেন, ‘বিয়ের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
গুরুতর বিষয়ে আলোচনার মতো স্বরে অমিয় বলল, ‘যদি বলেন তো রবুর জন্য পাত্রী আমি দেখতে পারি।’
দুজনেরই ভ্রূ কুঁচকে উঠল, পূর্ণেন্দু বললেন, ‘তোমার হাতে আছে নাকি?’
‘আছে, তবে বদ্যি নয়, চলবে?’
‘কেন চলবে না।’ মায়া কিছু বলে ওঠার আগেই পূর্ণেন্দু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘বিজ্ঞাপনের ভাষায় যা সব লেখা হয়—শান্ত, কোমলস্বভাবা, গৃহকর্মনিপুণা, সুমুখশ্রী, গৌরবর্ণা, স্বাস্থ্যবতী, পাঁচফুট তিন ইঞ্চি, বিএ পাশ, বয়স তেইশ—চব্বিশ হলেই চলবে।’
‘মেসোমশাই বোধহয় খবরের কাগজের পাত্র—পাত্রী কলাম খুব পড়ছেন।’
‘সমাজের শিক্ষিতরা জাত—গোত্রের সংস্কারে এখনও যে কতটা আচ্ছন্ন সেটা বোঝার সেরা উপায় হল পাত্রপাত্রী কলামে চোখ বোলানো। তোমার মনে হবে একশো বছর আগের খবরের কাগজ পড়ছি। এই দেখো না—’পূর্ণেন্দু তার পাশেই সোফার উপর পড়ে থাকা ভাঁজ করা খবরের কাগজটা মুখের সামনে ধরে বললেন, ‘শুধু একটা কলামেই কতগুলো গোত্রের নাম পেলুম জান? শাণ্ডিল্য, গৌতম, মউদগল্য, কাশ্যপ, ব্যাসঋষি, আলিম্মান, অবৎস্য।’ সাতটা, প্রত্যেকটা বিজ্ঞাপনে পাত্র বা পাত্রী পূর্ববঙ্গের না পশ্চিমবঙ্গের তাও বলা আছে। এটা বলার কি কোনো দরকার আছে? লেখাপড়া জানা উচ্চচবর্ণের বাঙালি হিন্দুরা সাবেকি রীতির পিছু পিছু অন্ধের মতো এখনও চলেছে। সেকেলে চিন্তাধারার কিছু বদলায়নি। অথচ আধুনিক কবিতা, গল্প—উপন্যাস, ফিল্ম, পেইন্টিং, নাটক তৈরি হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, এসব পড়ে বা দেখে কতজন?’ পূর্ণেন্দু উত্তরের জন্য অমিয়র দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘শতকরা পাঁচজনও নয়।’ অমিয় নির্বিকার মুখে বলল।
মায়া অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, পূর্ণেন্দুর কথাগুলো শুনতে শুনতে বললেন, ‘তোমার বকবকানি থামাও তো। অমিয় যা বলেছিলে বল, মেয়েটি বদ্যি নয়, তাহলে কী জাত?’
‘বামুন।’
মায়ার মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল।
‘মেয়েটির বাবা নেই। বিধবা মা, দাদা আর ছোটোভাই, অবস্থা ভালো নয়, থাকে গ্রামে।’ এই পর্যন্ত বলে অমিয় আর বলবে কিনা জানার জন্য দুজনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।
পূর্ণেন্দু বললেন, ‘গরিবঘরের মেয়েতে আপত্তি নেই।’
মায়া বললেন, ‘দেখতে শুনতে কেমন, পড়াশুনো কদ্দুর?’
অমিয় বুঝল এরা শুনতে অনাগ্রহী নয়। ভেজানো দরজার ওধারে রবিন্দু এই ঘরের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে না, এটা ধরে নিয়ে সে বলল, ‘মেসোমশাই বিজ্ঞাপনের পাত্রীর যে বর্ণনা দিলেন তার মধ্যে মাত্র দু—তিনটির সঙ্গে মিল এই পাত্রীর রয়েছে যেমন সুমুখুশ্রী, গৃহকর্মে নিপুণা, স্বাস্থ্যবতী তবে মোটা বা আলগা গড়ন নয়, ছিপছিপে। মিলছে না যেগুলোর সঙ্গে, শান্ত কোমলস্বভাবা নয়, ছটফটে, সাহসী, ডানপিটে ভদ্র—সভ্য নম্র, ফরসা নয় কালো, পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি বাঙালি মেয়ের পক্ষে বেশ লম্বাই, বিএ পাশ নয় উচ্চচমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনের বার দেবে, বয়স তেইশ—চব্বিশ নয় আঠারো—উনিশ।’
পূর্ণেন্দু বললেন, ‘রবুর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য অনেক, বারো—তেরো বছরের।’ মায়া হালকা প্রতিবাদ করলেন, ‘হোক অনেক, আমার ঠাকুমার থেকে ঠাকুরদা বাইশ বছরের বড়ো ছিলেন। মেয়ে কালো বললে, কতটা কালো?’
‘কয়লার মতো নয়, বলতে পারেন, বেলে মাটির মতো। ছেলে হলে ওটা কালো গন্য হবে না।’
মায়া স্বামীকে প্রশ্ন করলেন, ‘পাঁচ ফুট ছ—ইঞ্চিটা কতখানি হবে বল তো?’
পূর্ণেন্দু ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনী খানিকটা ফাঁক করে তুলে ধরে বললেন, ‘তোমার থেকে এতটা লম্বা।’
মায়া চোখ সরু করে আন্দাজ করতে করতে বললেন, ‘রবুর কাছাকাছি হবে।’
পূর্ণেন্দুর মনে ধরে গেছে মেয়েটি সাহসী ডানপিটে শুনে, বললেন, ‘মেয়েদের লম্বা হওয়াটা খারাপ নয়, ছেলেপুলেরাও লম্বা হবে।’
‘অমিয় বামুন বললে, কোন শ্রেণির?’ মায়া আবার জেরা শুরু করলেন।
‘শ্রেণিট্রেনি তো বুঝি না জানিও না তবে চাটুজ্জে।’
‘তুমি কতটা চেনো?’ মায়ার প্রশ্ন।
‘জন্ম থেকেই। মেয়েটি আমার ভাগনি, আপন দিদির মেয়ে।’
ঘরের মধ্যে বোমা ফাটল যেন। ওরা দুজন স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। অমিয় এটাই আশা করেছিল। হাসি পেলেও সে মায়ার মুখ দেখে উৎকণ্ঠিত হল।
‘দিদি শ্যামবাজারে শ্যামল চ্যাটার্জির কাছে গান শিখতে যেন। তিনিই ওকে বিয়ে করেন, জাত নিয়ে জামাইবাবুর বাড়িতে আপত্তি উঠেছিল। উনি তা অগ্রাহ্য করে দিদিকে রেজেস্ট্রি বিয়ে করেছেন। বিয়ের দশ বছর পর ক্যানসারে মারা যান। বড়ো, একান্নবর্তী পরিবার, ওর রোজগার অন্যদের তুলনায় কমই ছিল। আধুনিক গানের দু—খানা রেকর্ড করেছিলেন, বিক্রি হয়নি। চিকিৎসা করতে গিয়ে দিদির সব গয়না বিক্রি করতে হয়। তারপর থেকেই বড়ো ভাসুর আর তার পরিবার দিদিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করে, নানাভাবে চাপ দিতে থাকে যাতে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ির অংশ ভাসুরকে বিক্রি করে চলে যায়। একটা মেয়ে আর দুটো ছেলে সবাই বাচ্চচা, তাদের নিয়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় দিদির বাস করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তখন আমার বাবাই বললেন, থাকতে হবে না ওখানে বাড়ির অংশ বেচে দিয়ে বর্গাপুরে গিয়ে থাক। আমিই তোকে দেখব। আমি মরে গেলে ভাইয়েরা তোকে দেখবে। আঠারো হাজার টাকায় দিদি তার ভাগের অংশ বিক্রি করে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে চলে আসে আমাদের দেশের বাড়ি বর্গাপুরে। টাকাটা বাবা ফিক্সড করে দিয়েছে বর্গাপুরে পোস্ট অফিসে আর দশ বিঘে ধেনোজমি লিখে দিয়েছেন দিদির নামে, একটা দেড় বিঘের পুকুর আছে, তার জমা দেওয়ার টাকা আমরা নিই না, দিদিই পায়, ছোটো একটা আমবাগান আছে সেটারও জমা দেওয়ার টাকা আমরা দিদিকেই দিই। বাবা বড়ো নাতিটাকে কলকাতায় নিজের কাছে এনে রাখেন লেখাপড়া করাতে। বিএ পাশ করে এখন সে আমার ব্যবসায় আমার ডান হাত হয়ে কাজ করছে। মাসিমা এই হল পাত্রীর পরিচয়। মোনার আর্ধেকটা ব্রাহ্মণ আর্ধেকটা কৈবর্ত। এতে কী আপনাদের আপত্তি হবে? রবুকে জানি বলেই প্রস্তাবটা দিলুম, মোনা আমাদের ফ্যামিলির আদরের নাতনি, সে সুখী হোক এটাই আমি চাই।’
অমিয় অনেক আশা নিয়ে ওদের দু—জনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পূর্ণেন্দুর মুখের উপর আবেগ ঘোরাফেরা করছে, মায়ার মুখও অল্পবিস্তর নরম।
‘অমিয় তোমার ভাগনিকে দেখাবার ব্যবস্থা কর, আমাদের জন্য নয়, রবুর জন্য। আগে ও দেখুক।’ পূর্ণেন্দু গম্ভীর স্বরে কর্তৃত্ব ভরা গলায় বললেন, মায়ার দিকে না তাকিয়ে, মায়া বুঝে গেলেন এখন চুপ করে থাকতে হবে।
পূর্ণেন্দু কপালে আঙুলের টোকা দিতে দিতে বললেন, বিয়ে করার জন্য মেয়ে দেখছি এভাবে নয়, তাহলে মনটা আগে থেকেই সমালোচকের মতো তৈরি হয়ে থাকে খুঁত ধরার জন্য, তখন ভুলে যায়, খুঁত মানুষমাত্রেরই আছে। এই ভুলটাই তখন ঘটে, পাঁচ মিনিটেই বিচার করে ফেলে। তার থেকে তোমার ভাগনিকে রবু দেখুক কিছু না জেনেই।’ পূর্ণেন্দু ভেজানো দরজার দিকে সন্তর্পণে তাকিয়ে গলা নামিয়ে নিলেন, ‘ওকে বরং তোমাদের বাড়িতে একদিন নেমন্তন্ন কর, ভাগনি খাবারটাবার পরিবেশন করুক, মামার বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা বলুক, একটা ঘরোয়া স্বাভাবিক পরিবেশে দু—জনে দু—জনকে দেখুক কিছু না জেনেই। মেয়েরও একটা পছন্দ—অপছন্দ আছে এটাও মান্য করা উচিত, কী বলো?’
সদর দরজা বন্ধ করার শব্দ এল, রবিন্দু এখন ঘরে আসবে। ওরা কথা থামিয়ে রাখলেন। রবিন্দু চেয়ারটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল। মুখে বিরক্তি।
‘টেনেটুনে পাশটা হয়তো করে যাবে। একদম খাটে না, এতদিন ফাঁকি দিয়ে এসে পরীক্ষার দু—দিন আগে বই খাতা নিয়ে বসলে আমি কী করতে পারি!’ রবিন্দু গজগজানি থামিয়ে অমিয়কে বলল, ‘তোদের দোকানে দু—দিন ফোন করেছিলুম তোকে পাইনি। খুব ব্যস্ত থাকিস মনে হচ্ছে।’
‘ঘুরে বেরিয়ে কাজ দেখতে হয়। দোকানে কম সময়ই থাকি। এই দেখনা এদিকে কাজ শুরু করেছি বলে তাই আসার সময় আর সুযোগ পেলুম। দেশ থেকে দিদি চিঠি পাঠিয়েছে ভাগনের হাত দিয়ে, যে লোকটার উপর বর্গা চাষের দায়িত্ব দেওয়া ছিল সে হঠাৎ আন্ত্রিকে মরে গিয়ে গন্ডগোল পাকিয়েছে, যেতে হবে আমাকে। চল না আমার সঙ্গে তিন—চারটে দিন বর্গাপুরে কাটিয়ে আসবি। সাত বছর আগে তো আমার সঙ্গে একবার গেছলি। দিদির হাতের এঁচোড়ের ডালনা আর মৌরলামাছের অম্বল খেয়ে কী বলেছিলিস মনে আছে? আবার খেতে আসব বলে আর তো গেলি না, দিদি অনেকবার তোর কথা বলেছিল, ছেলেটি বড়ো শান্ত, ছেলেটির স্বভাবটি খুব মিষ্টি, দেখতে খুব সুন্দর।’ অমিয় হেসে উঠল।
রবিন্দু মুখ নীচু করে নিল লজ্জায়। ফর্সা গালে টোল পড়ল। পাতলা গোলাপি অধর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। গভীর চাহনির টানা চোখ দুটি তুলে বলল, ‘সত্যিই আমার অনেকবার ইচ্ছে করেছিল যাওয়ার। শুধু দিদির হাতের রান্না খাওয়ার জন্যই নয়, গ্রাম দেখতে আমার ভালো লাগে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল তোর ভাগনি, কী যেন নামটা?’
‘মোনা।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ মোনা। বিশাল একটা বাঁশবন, ইটের ভাঁটি, বিশাল একটা দিঘি তাতে হাজার খানেক পদ্মগাছ আর ধানখেত ধু ধু করছে, প্রায় মাইল দেড়—দুই তারপর একটা গ্রাম। ধানকাটা চলছে, তখনও অনেক জমিতে ধান রয়ে গেছে। শীতকাল ছিল বোধহয় জানুয়ারির শেষাশেষি, অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস, রোদ্দুরটা যে কী ভালো লাগছিল! অমিয়, ভাবলে সত্যিই মন কেমন করে।’
‘শীতকালে গেছিস এবার বর্ষার শুরুতে চল। ভাগ্যে থাকলে গ্রামের বৃষ্টি দেখতে পাবি। আমাদের আমবাগানটা তো দেখেছিস, ভালো হিমসাগর হয়েছে, খাবি।’ অমিয় রবিন্দুর গ্রামপ্রীতিটা উসকে দেবার জন্য কথাগুলো বলে পূর্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে এমনভাবে মাথাটা হেলাল, যার দ্বারা সে বলতে চাইল, মেসোমশাই রবু যাচ্ছে।
‘তোর ভাগনে ভাগনিরা কত বড়ো হয়েছে?’
‘সাত বছরে যত বড়ো হওয়া উচিত তত বড়োই হয়েছে। মোনা এখন রীতিমতো তরুণী, দেখলে চিনতে পারবি না, ক্লাস টুয়েলভে পড়ে আর বাবু ক্লাস সিক্সে। কবে যাবি বল?
‘যাব বললেই কী দুম করে যাওয়া যায়। তোর মতো ব্যবসা তো করি না, চাকরি করার অনেক ফ্যাসাদ। ছুটি চাইতে হবে, যদি তেমন কাজকর্ম না থাকে তাহলে ছুটি পাব।’
‘আমি তো এদিকে আসছিই, চার—পাঁচ দিন পরে এসে খোঁজ নেব।’ অমিয় উঠে দাঁড়াল। ‘দিন সাতেকের জন্য ছুটি নে।’
অমিয় চলে যাবার মিনিট পাঁচেক পরই নবেন্দু ফিরল একটা মোটরবাইকের পিছনে বসে। পূর্ণেন্দু বারান্দায় বেরোলেন বাইকের ইঞ্জিনের শব্দে। দেখলেন সন্তর্পণে নবু নামল। বাঁ পা ফেলেই ঝুঁকে পড়ল। বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে অল্পবয়সি চালক নবুর পাশে গিয়ে ওর একটা হাত নিজের কাঁধে রেখে বলল, ‘হাঁটতে পারবি?’
কাঁধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নবু ফ্ল্যাটের দরজায় এল। তার আগেই দরজা খুলে পূর্ণেন্দু আর রবিন্দু দাঁড়িয়ে।
‘কী হয়েছে?’ পূর্ণেন্দু উদবিগ্ন চোখে তাকালেন।
নবেন্দুর সঙ্গের ছেলেটি বলল, ‘অ্যাঙ্কেলটা টুইস্ট করে গেছে, মাঠটা খুব বাজে ছিল। হাবড়াতেই ডাক্তার দেখান হয়েছে। মলম মাখিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন আর বলেছেন কালকেই যেন এক্স—রে করে দেখা হয়। হাঁটাচলা যেন একদম না করে, পা—টাকে রেস্টে রাখতে হবে। এখনও ব্যথা করছে?’ ছেলেটি নবেন্দুকে জিজ্ঞাসা করল।
নবেন্দু মুখ বিকৃত করে বলল, ‘করছে।’
রবিন্দু এবার ওর একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে নিল, অন্য হাতটা পূর্ণেন্দু কাঁধে নিতেই ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আপনি ছাড়ুন, আমি ধরছি।’ পূর্ণেন্দু সরে দাঁড়ালেন।
দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে একটা একটা করে পা ফেলে নবেন্দু ঘরে এল। ওকে খাটে শুইয়ে দিল রবিন্দু। ছেলেটি যাবার সময় মনে করিয়ে দিয়ে গেল, ‘কালই যেন এক্স রে করা হয়।’
সন্তর্পণে নবেন্দুর পা—টা তুলে তার নীচে বালিশ রাখতে রাখতে মায়া জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছেলেটি কে?’
‘গোলকিপার খেলে, থাকে দমদমে।’
‘হাবড়ায় কীসের খেলা ছিল?’ পূর্ণেন্দু জানতে চাইলেন।
‘এগজিবিশন ম্যাচ।’
‘মোহনবাগান খেলল?’
‘না। প্রাইমারি স্কুলের ঘর তোলার জন্য এম এল এ—র দলের সঙ্গে জেলা সভাধিপতির দলের খেলা ছিল।’
‘ক্লাবের প্র্যাকটিস তো পয়লা বোশেখের পর শুরু হবে, আর কটা দিনই বা রয়েছে, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা দরকার।’ পূর্ণেন্দুর মুখে চিন্তার মেঘ জমে উঠল। নবেন্দুর মুখের উপর দিয়ে উড়ে গেল হালকা একটা ভয়ের মেঘ।
রাত্রে পাশের খাটে শুয়ে রবিন্দু বলল, ‘এইসব ম্যাচ খেলা তোর উচিত নয় নবু। নিশ্চয় টাকা দিয়েছে?’
ক্ষীণ স্বরে নবেন্দু বলল ‘হ্যাঁ। না হলে যাব কেন খেলতে।’
রবিন্দু টাকার অঙ্কটা জানতে চাইল না। ভর্ৎসনার সুরে বলল, ‘ক—টা টাকার জন্য খারাপ মাঠে খেপ খেলতে নেমে চোট পেয়ে গেলি। টাকা দু—দিনে ফুরিয়ে যাবে, চোটটা দু—দিনে যাবে না।’
‘কাল সকালে আমাকে এক্স—রে করাতে নিয়ে যাবে দাদা?’ নবেন্দুর স্বরে কাতরতা আর ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠল।
এক্স—রে রিপোর্টে পাওয়া গেল হেয়ারলাইন ফ্র্যাকচার। ডাক্তার বাঁ পায়ের গোড়ালি আর পাতা প্লাস্টার করে দিলেন। পাঁচ দিন পর অমিয় এল রবিন্দু ছুটি পেয়েছে কি না জানতে। সে জানিয়ে দিল নবেন্দুর এখন সাহায্য দরকার, বাড়িতে শুধু বাবা—মা। ওদের ভরসায় ভাইকে রেখে বর্গাপুরে এখন সে যেতে পারবে না। দ্রুত সেরে ওঠা দরকার নবেন্দুর কেননা আর দু—সপ্তাহ পরেই ক্লাবের প্র্যাকটিস শুরু হবে ওকে মাঠে নামতে হবে।
প্র্যাকটিস শুরু হবার তিন দিন পর নবেন্দু সকালবেলায় মাঠে গেল। ক্লাবের গেটের সামনে ট্যাকসি থেকে নেমে যখন টেন্টের দিকে যাচ্ছে তখন কেউ যদি ওর হাঁটাটা একটু মন দিয়ে লক্ষ করত তা হলে ধরতে পারত নবেন্দু বাঁ—পাটা আলতো করে জমিতে ফেলছে, এখনও সে পুরো সেরে ওঠেনি। কোচকে বলে সে বিশ্রাম নিতে পারে। কিন্তু এই বলাটাকেই সে ভয় পেল। চোট আছে, এই কথাটা চাউর হলে বিপদ, খেলায় সামান্য ত্রুটি ঘটলেই চোটের কথা বলে তাকে সরিয়ে রাখা হবে। টিমে ফিরে আসা তখন কঠিন হয়ে পড়বে। নবেন্দু প্র্যাকটিসে এসে বোঝাতে চাইল চোটটা খুবই সামান্য ছিল, এখন সে ফিট।
নবেন্দু মাঠে যাচ্ছে দেখে রবিন্দু অফিসে ছ—দিনের ছুটি চাইল এবং তা মঞ্জুর হয়ে গেল। অফিস থেকেই সে অমিয়র দোকানে ফোন করে তাকে পেয়ে গেল।
‘সোম থেকে শনি ছ—দিন আর দুটো রোববার মোট আট দিনের ছুটি পেয়েছি। ছুটি শুরু হবে পঁচিশে এপ্রিল রবিবার থেকে, ওই দিনই বর্গাপুর রওনা হলে কেমন হয়?
অমিয় বলল, ‘খুব ভালো হয়। তবে তিন দিনের বেশি আমি থাকতে পারব না, ওখানকার কাজ মিটে গেলেই চলে আসব, এখানে অনেক কাজ হাতে রয়েছে, আমার থাকা দরকার। তুই বর্গাপুরে আট দিনই থেকে থেকে যাস, কোনো অসুবিধে হবে না। থাকে তো মোটে তিনটে লোক, কেউই তোর অপরিচিত নয়। রবু তাহলে পঁচিশে সকাল নটায় হাওড়ায় বড়ো ঘড়ির নীচে থাকিস, ট্রেন নটা সতেরোয়। এই কথা রইল। আমি দিদিকে কালই খবর পাঠাচ্ছি।’
.
রাতে খাওয়ার পর ঘরে শুতে এসে রবিন্দু দেখল বিছানায় চিত হয়ে নবু বাংলা কমিকস পড়ছে। ছবিওলা বাচ্চচাদের বই পড়তে ভালোবাসে। পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে গোছা করে এই বইগুলো কিনে আনে। রবিন্দু একদিন বলেছিল ‘কী সব হাবিজাবি বই পড়িস, ভালো বই পড়তে পারিস না! পথের পাঁচালি পড়।’ নবু বলেছিল ‘দেখা হয়ে গেছে।’ এরপর ভেবেচিন্তে রবিন্দু বলে, ‘আবোল তাবোলও তো পড়তে পারিস।’ উত্তর পেয়েছিল ‘পাউরুটি আর ঝোলাগুড় তো, স্কুলে পড়েছি।’ রবিন্দু আর কখনো নবুকে ভালো বই পড়তে বলেনি।
আজ সে বলল, ‘তোর একটা বগলে ঝোলানর বড়ো নাইলনের ব্যাগ এক সপ্তাহের জন্য আমায় দিতে পারিস?’
‘কী জন্য, কোথাও যাবে?’
‘অমিয়দের দেশের বাড়িতে যাব। সুটকেস নেওয়ায় হ্যাঙ্গামা অনেক লোকাল ট্রেনে, বাসে।’
‘ওটা নিয়ে যাও’ নবেন্দু আঙুল দিয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা দেড় হাত লম্বা, চেইন দেওয়া ব্যাগটা দেখাল। ‘নোংরা করো না যেন।’
সেই ব্যাগ বগলে ঝুলিয়ে রবিবার সকাল নটায় রবিন্দু হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখল অমিয় বর্ধমান লোকালের টিকিট কেটে অপেক্ষা করছে। তাকে দেখেই তাড়া দিল অমিয়, ‘তাড়াতাড়ি চল নয়তো বসার জায়গা পাবি না, সরকারি অফিসের বাবুরা এই ট্রেনটা ধরে।’
‘এই ট্রেনে গেলে তো অফিসে লেট হয়ে যাবে।’ রবিন্দু অবাক সুরে বলল।
‘লেটই যদি না হল তাহলে সরকারিবাবু হবে কী করে? সরকারি অফিসে তো চাকরি করিস না বুঝবি কী করে!’
মিনিট পনেরো লেট করে ট্রেন তালান্ডু স্টেশনে পৌঁছল। ভ্যান রিকশা চেপে অমিয়দের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
.
.
ছয়
পুরোনো দোতলা বাড়ি। মানুষসমান উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। আলকাতরা মাখানো কাঠের দরজা দিয়ে ঢুকেই মাটির উঠোন। তার প্রান্তে একটা মরাই। তার পিছনে খড়ের চাল দেওয়া উঁচু মাটির ঘরে রান্না হয়। তার পাশে টিউবওয়েল, দেওয়াল ঘেরা টালির চাল দেওয়া স্নানের জায়গা। একটা ঘোড়া নিমগাছ, তুলসীমঞ্চ, আর রান্নাঘরের চালে চালকুমড়ো, পাঁচিল ঘেঁষে কয়েকটা নয়নতারা ছাড়া উঠোনে আর কোনো গাছ নেই। উঠোনের ডান দিকে উঁচু টানা চওড়া রক। চারটে সিঁড়ি ভেঙে রকে উঠে বাড়িতে ঢুকতে হয়। ঢুকেই রকের সমান্তরাল টানা দাওয়া। লাগোয়া তিনটে ঘর আর উপরে ওঠার সিঁড়ি। দাওয়ার ঠিক উপরে দোতলায় দক্ষিণে টানা রেলিং দেওয়া বারান্দা, কাঠের খুঁটির উপর টালি দিয়ে বারান্দাটা ঢাকা। দোতলায় বড়ো দুটি ঘর।
রবিন্দু উঠোনে দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বলল, ‘আরে কিছুই তো বদলায়নি, সব তো একই রকম আছে!’
অমিয় তার ছোটো সুটকেস আর রবিন্দুর ব্যাগটা, হাফপ্যান্ট আর রঙিন স্পোর্টস শার্ট পরা শ্যামলা রঙের লম্বা ছিপছিপে ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল, ‘ওপরে বড়োঘরে রেখে আয়।’ তারপর রবিন্দুকে বলল, ‘দিদি খুব গুছোনো আর খুঁতখুঁতে। একটা জিনিসও এধার ওধার হবার উপায় নেই। ভোররাতে উঠে আগে উঠোন ঝাঁট দেয়।’
রবিন্দু একবার উপর দিকে তাকাল। বারান্দায় খুঁটি ধরে ঝুঁকেছিল একটি মুখ। রবিন্দু শুধু দেখল ঝুলে পড়া চুলের মধ্য দিয়ে হালকা শ্যামবর্ণ একটা মেয়ের মুখ আর বড়ো বড়ো টানা চোখ তার দিকে কৌতূহলভরে তাকিয়ে। তাকে মুখ তুলতে দেখেই চট করে সরে গেল।
‘রবু ডাব খাবি? হ্যাঁরে সোনা, বাসু কোথায় রে? ওকে ডাব কেটে দিতে বল।’
দোতলায় ব্যাগ ও সুটকেস রেখে সোনা ফিরে এসে রবিন্দুকে কৌতূহলী চোখে নিরীক্ষণ করায় ব্যস্ত। সে বলল, ‘বাসুদা তো ডাব পেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। ডেকে আনব?’
‘থাক পরে খাব।’ রবিন্দু বলল।
‘এই সোনা, শোন।’ আধভেজানো দরজার পাশ দিয়ে একটা হাত হাতছানি দিল। তুঁতে রঙের শাড়ির আঁচল দেখতে পেল রবিন্দু। সোনা ‘কী’ বলে রকে উঠে দরজার কাছে গেল। সেখান থেকেই বলল, ‘দিদি ডাব কেটে দিচ্ছে।’
‘কাটারি দিয়ে ডাব কাটবে! না না দরকার নেই।’ রবিন্দু প্রায় আঁতকে উঠল। সে ভাবতে পারে না, হাতের তালুতে ভাব রেখে খচাত খচাত করে কাটারির কোপ দিয়ে কোনো মেয়ে ডাব কাটছে। যদি একটা কোপ হাতের উপর পড়ে!
ততক্ষণে খচাত খচাত শব্দ শুরু হয়ে গেছে। অমিয় হাসছে।
‘তোকে ডাবের জল না খাইয়ে ছাড়বে না মোনা।’
সোনা দুটো কাচের গ্লাসে ডাবের জল নিয়ে এল। রকের সিঁড়িতে বসে দু—জনে দু—গ্লাস করে জল খেল।
অমিয় বলল, ‘ওপরে চল, জামা প্যান্ট ছাড়বি, সোনা, দিদি কোথায় রে, রান্নাঘরে তো?’
‘মা সকাল থেকে শুয়েছিল, এখন রান্নাঘরে গেল।’
অমিয় বিব্রত স্বরে বলল, ‘আবার শরীর খারাপ? কী হয়েছে, সেই শ্বাসের টান?’
‘হ্যাঁ, কাল থেকে।’ সোনা ম্লান স্বরে বলল।
‘তাহলে তো মুশকিল হল।’ অমিয়কে চিন্তিত দেখাল। ‘তোকে দিদির হাতের রান্না খাওয়াব বলে আনলুম।’
রবিন্দু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘তাতে কী হয়েছে। নাইবা ডালনা ঘণ্ট অম্বল হল, ঝোল—ভাতই খাব।’
অমিয়র দিদি অরুণা রান্নাঘর থেকে গেলেন। বয়স পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, কৃশকায়, শ্যামবর্ণ, মুখাকৃতি ডিমের মতো, দীর্ঘ চোখ, পরনে কালো পাড় সাদা শাড়ি। দু—হাতে একগাছা করে সরু সোনার চুড়ি।
‘ঝোল ভাত খাবে কী!’ রবিন্দুর প্রণাম নিতে নিতে বললেন। তাই দেখে সোনার এতক্ষণে খেয়াল হল, সে তাড়াতাড়ি রবিন্দুকে প্রণাম করল।
‘বাড়িতে কী রান্না করার লোক নেই? আমি তো শুধু কচুর শাকটা করে দিচ্ছি। রবিন্দু তুমি কিন্তু রোগা হয়ে গেছ।’
‘বলছেন কী দিদি! নীচু হয়ে মোজা পরতে গেলে এখন পেটে চাপ পড়ে।’
অমিয় হালকা চালে বলল, ‘থাক এখানে সাতদিন, মোজা পরাই তোর বন্ধ করে দেবে দিদি।’
অরুণা তাড়া দিলেন, ‘বারোটা বেজে গেছে, এবার চানটান করে খেয়ে নাও। কলঘরে জল ধরা আছে।’
দোতলায় উঠেই প্রথম ঘরটা বড়ো ঘর। পালঙ্কের মতো জমকালো একটা খাট, পুরু গদি, দুটো মাথার ও দুটো পাশবালিস। ধবধবে চাদর। নতুন ইলেকট্রিক ওয়্যারিং, সিলিং ফ্যান। বর্গাপুরে বিদ্যুৎ এসেছে। রবিন্দু চেইন টেনে ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ল সোনালি মোড়কে দুটো চকোলেট বার। সকালে বাসে ওঠার আগে কিনেছিল অমিয়র ভাগনেভাগনিকে দেবার জন্য, ভুলে ছিল এতক্ষণ। পরে দেবে ভেবে রেখে দিল।
স্নান করে দুজনে খেতে এল একতলার লম্বা দালানে। রঙিন পশমের নকশা করা আসন, কাঁসার বগি থালার মাঝখানে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা ভাতের স্তূপ, তার ধারে আলু ও বেগুন ভাজা, পাতিলেবুর টুকরো, নুন, দুটো কাচালংকা। থালা ঘিরে চারটি বাটি ও ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাস। ধাতব বাসনগুলি ঝকঝকে। সারা ব্যাপারটার যত্ন ও আন্তরিকতা ছড়িয়ে রয়েছে। দেখেই, রবিন্দুর মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। বহু বছর পর সে বাবু হয়ে খেতে বসল।
বসেছিলেন অরুণা হাতপাখা নিয়ে, আস্তে আস্তে সেটা নাড়ছেন থালার উপর যদিও কোনো মাছি নেই। তার পাশে দাঁড়িয়ে মোনা। এখানে এসে এই প্রথম রবিন্দু ভালো করে দেখল মোনাকে। লম্বা, ছিপছিপে, দৃঢ় গড়ন। পরিপূর্ণভাবে যৌবনের ফুটে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে দেহ। স্নান করে পরেছে হলুদ ডুরে শাড়ি, ভিজে চুল পিঠে ছড়ানো। চোখে সরু কাজল, খয়েরি টিপ, মুখের গড়ন মায়েরই মতো ডিম্বাকৃতি, নাকটি টিকালো, পায়ের নখে খয়েরি রঙ। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে সে তাকিয়ে রয়েছে রবিন্দুর মুখের দিকে। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল।
‘দিদি ভাত তুলুন, যা দিয়েছেন তাতে আমার দু—বেলার খাওয়া হয়ে যাবে।’
‘সে কী, এই ক—টা ভাত খেতে পারবে না! খুব পারবে।’
অমিয়র পাতেও সমান আকারের স্তূপ। সে ভাত ভেঙে তাতে ডাল ঢালতে ঢালতে বলল, ‘খেয়ে নে খেয়ে নে, না পারিস তো ফেলে রাখবি।’
‘না রে, অমিয়, সত্যি বলছি পারব না। ফেলে নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।’
অরুণা চোখের ইশারায় মোনাকে ভাত তুলতে বললেন। একটা ছোটো থালা হাতে সে রবিন্দুর পাতের সামনে ঝুঁকে ছোট্ট মুঠোয় ভাত তুলল। যেন কঠিন দুঃসাধ্য কোনো কাজ তাকে করতে হচ্ছে মুখের ভাব এমনই। মুঠোয় ভাত নিয়ে সে অনুমোদনের জন্য রবিন্দুর মুখের দিকে তাকাল।
‘একে কী তোলা বলে? আরও তোলো।’ রবিন্দু হালকা স্বরে বকুনির মতো বলল।
গম্ভীর মুখে দুই ঠোঁট টিপে মোনা আবার ভাত তুলল মুঠোটা আরও ছোটো করে।
‘উঁহু, এইভাবে তোলো।’ রবিন্দু হাতের চেটো থাবার মতো মেলে ধরে দেখাল।
মোনা এই প্রথম কথা বলল, ‘এটুকু খেতে পারবেন।’ কথাটা বলেই সে থালা হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিল আর সে ভাত তুলবে না।
‘দিদি এটা কী?’ রবিন্দু একটা বাটি আঙুল দিয়ে দেখাল।
‘চালকুমড়োর পাতুরি, নারকোল আর সর্ষেবাটা দিয়ে। আমি তো আজ রান্নাঘরে যেতেই পারিনি, সব তো মোনাই রেঁধেছে। মুখে যতটুকু পেরেছি বলে দিয়েছি। দেখো তো খেয়ে কেমন হয়েছে!’
রবিন্দু চালকুমড়োর একটা চাকলা তুলে ভাতের সঙ্গে মেখে প্রথম গ্রাস মুখে দেবার সময় আড়চোখে মোনার মুখটা দেখে নিল। উৎকন্ঠায় পাংশু হয়ে রয়েছে।
‘ইসস একদম নুনে পোড়া।’ রবিন্দু মুখ বিকৃতি করল।
‘সে কী রে, কই আমার তো নুন ঠিক লাগল!’ অমিয় খুবই অবাক হয়ে বলল। অরুণাকে সন্ত্রস্ত দেখাল।
রবিন্দুর মনে হল মোনার মুখ থেকে পলকের জন্য রক্ত সরে গেল। ‘আপনাকে ওটা খেতে হবে না’ বলে থমথমে মুখে সে বাটিটা প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিল।
‘তুমি একটু টেস্ট করে দেখো।’ রবিন্দু নির্দেশ দিল গম্ভীর মুখে।
মোনা বাটি থেকে আঙুলে কোরা নারকোল ও বাটা সর্ষের কাই তুলে মুখে দিয়ে জিভে পরখ করে ঢোঁক গিলেই শিউরে উঠল, ‘মাগো কী মারাত্মক নুন। পরেশ মুদি এবার নুন দিয়েছে, একেবারে বিষের মতো।’ হাসিতে ঝকমক করে উঠল তার চোখের মণি।
রবিন্দু বুঝে গেল মোনা রসিকতা বোঝে এবং পালটা করতেও পারে। অরুণাও মোনার কথা থেকে বুঝে গেলেন রবিন্দু ঠাট্টা করেছে।
‘বাটিটা দাও। নুন যখন একবার খেয়েছি তখন গুণও গাইব।’ রবিন্দু হাত বাড়াল। ‘দিদি এমন জিনিস কখনও খাইনি, অপূর্ব। নুন খেয়ে কিন্তু বলছি না, দ্রৌপদীও হার মেনে যাবে।’
‘এঁটো হয়ে গেছে বদলে আনি।’ মোনা রান্নাঘরের দিকে ছুটল এবং একই গতিতে অন্য একটা বাটিতে পাতুরি নিয়ে ফিরে এল। রবিন্দু বাটি উপুড় করে পাতে ঢালল।
কুচো চিংড়ি আর ছোলা দিয়ে কচুশাকের ঘণ্ট এবং মসুর ডাল দিয়ে ভাত খাবার পর একটা বাটিতে ঝোলে ডুবে থাকা একটা বড়ো গলদা চিংড়ির মাথা দেখে রবিন্দু বলল, ‘আমাকে দিয়েছেন কিন্তু অমিয়কে তো দেননি?’
অরুণা কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘পুকুরে জাল দিয়ে ওই একটাই পাওয়া গেছে।’
‘অমিয় এটাকে তাহলে ভাগাভাগি করা যাক। তুই ধড়টা নে আমি মাথাটা নিচ্ছি।’
আপত্তি করে উঠল অমিয়। মোনা বলল, ‘চিংড়ি মাছে মামার অ্যালার্জি আছে, আপনি একাই খান।’
‘আমারও অনেক কিছুতে অ্যালার্জি আছে।’
রবিন্দু বুঝে যাচ্ছে না তার মধ্যে কী এমন ঘটল যে এইভাবে সে ছেলেমানুষের মতো কথা বলে যাচ্ছে! হঠাৎ একটা সজীব প্রফুল্লতায় সে আক্রান্ত হল কেন? সবাই তার সম্পর্কে প্রশংসা করে বলে বিবেচক, বিচক্ষণ, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কাজ করে, আবেগের বশে কিছু করে না। অথচ যুক্তির এবং বিজ্ঞতার গণ্ডির বাইরে বেরোবার জন্য তার মধ্যে কী একটা যেন ফাঁপিয়ে উঠছে। এখন তার কৈশোরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।
রবিন্দুকে অবশ্য গোটা গলদাটাই খেতে হল। তারপর চালতার টক। অরুণা জানালেন টাটকা মৌরালা মাছ বাজারে আজ ওঠেনি, পরে অম্বল করে খাওয়াবেন। খাওয়ার পর রবিন্দু হাত ধুতে বাইরের রকে এল। বালতিতে জল আর মগ হাতে নিয়ে মোনা দাঁড়িয়ে, অন্য হাতে গামছা ও সাবান। হাতে সাবান মাখতে মাখতে রবিন্দু নীচু গলায় বলল, ‘তোমাকে চেনাই যায় না, বড়ো হয়ে গেছ।’
‘হবেই তো, বয়স বাড়লে তো বড়োই হয়। আপনি কিন্তু একটু মোটা হয়েছেন, মা যাই বলুক।’
ভিতরের দালানে অমিয় তখন দিদিকে বলছে চাপা গলায়, ‘মনে হচ্ছে ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষাটায় মোনা ফার্স্ট ডিভিশন পাবে, ফাইনালে কী হয় সেটাই ভাবাচ্ছে।’
.
অমিয় যখন বর্গাপুরে তার দিদিকে কথাটা বলছিল সেই সময় কলকাতায় আনন্দ নিকেতনে পূর্ণেন্দুর ফ্ল্যাটের দরজার বেল বাজল। পূর্ণেন্দু তখন খেয়ে উঠে বসার ঘরে সোফায় শুয়ে খবরের কাগজের সম্পাদকীয় পড়ছিলেন। মায়া পাশের ঘরে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সময় কে এল! রবু কলকাতায় নেই, নবু ক্লাবের ক্যান্টিনে ভাত খেয়ে কোনোদিন ফিরে আসে কোনোদিন ফেরে না। আর ওর আসার সময় পার হয়ে গেছে। তাহলে ভরদুপুরে কে এল!
দরজা খুলে দেখলেন একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। একে আগে কখনো দেখেননি। এই সময় নানান রকম জিনিস বিক্রি করতে আসে মেয়েরা, কিন্তু এর হাতে তো চামড়ার লেডিজ ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। বোধহয় ফ্ল্যাট ভুল করেছে।
‘কাকে চাই?’
‘আপনি কী পূর্ণেন্দু গুপ্ত?’ দ্রুত অস্থিরভাবে মেয়েটি বলল।
পূর্ণেন্দু বিস্মিত চোখ নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমিই।’
‘আপনার সঙ্গে কথা আছে, ভেতরে যেতে পারি?’
‘আসুন।’ বলেই পূর্ণেন্দু মেয়েটির আপাদমস্তক দেখে নিলেন। বেশ ফর্সা, মাঝারি উচ্চচতা, বয়স বাইশ—চব্বিশ হবে, গোলগাল শরীর। মুখটি চোখা, প্রসাধন নেই শুধু ঠোঁটে হালকা রঙ, চোখের চাহনি তীক্ষ্ন, রঙিন ফুলছাপ ভয়েলের শাড়ি, রিস্টওয়াচ, একহাতে সোনার বালা, লাল পাথরের আংটি। মনে হয় গেরস্থ ঘরেরই।
বসার ঘরে এসে বলার আগেই মেয়েটি সোফায় বসে পড়ল। সামনের চেয়ারে বসলেন পূর্ণেন্দু। ‘বলুন কী দরকার?’
‘আমাকে আপনি চিনবেন না আমার নাম স্মৃতি চ্যাটার্জি। আমার দাদার নাম বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি একবার তিনি এখানে এসেছিলেন।’
পূর্ণেন্দুর মনে পড়ল সমরেশের মোটরবাইকের পিছনে বসে ধুতি পাঞ্জাবি পরা যে লোকটা একদিন এসেছিল, তার নাম বলেছিল বুদ্ধদেব। সবুজ সংঘের সেক্রেটারি, ওর ক্লাবেই খেলত নবু। সেদিন বুদ্ধদেব চ্যাটার্জিকে এখান থেকেই পার্টির মিটিংয়ে নিয়ে যায় সমরেশ।
‘হ্যাঁ বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি একদিন এসেছিলেন।’
‘নবেন্দুকে আমার দাদা খুব পছন্দ করতেন। নবেন্দু সমরেশদার বাড়িতে প্রায়ই যেত, আমিও যেতাম, একই পাড়ায় আমরা থাকি। ওখানেই আমার সঙ্গে আলাপ হয় নবেন্দুর। তখন ও প্রমিসিং উঠতি প্লেয়ার। বড়ো কিছু একটা হবে আমাদের সেই রকম ধারণাই হয়েছিল। নাম হবে, টাকা হবে ও আমাকে বুঝিয়েছিল। আমি বিশ্বাসও করেছিলুম। দাদাই সমরেশদাকে বলে ওকে মোহনবাগানে ঢোকায়। কিন্তু যা হতে পারত তা হল না। আর বোধহয় হবেও না। ওর পায়ে একটা ইঞ্জুরি হয়েছে সেটা লুকিয়ে রেখেছিল। এখন ক্লাবের সবাই তা জেনে গেছে। নবেন্দু আগে বাগুইহাটি যেত এখন আর যাচ্ছে না। এসব কথা বলে আমি বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করছি। ভাবছেন দুপুরবেলায় একটা মেয়ে এসে কী আবোল—তাবোল বকছে।’ স্মৃতির চোখ দুটি তীক্ষ্ন হয়ে উঠল। চোয়ালের নীচে শক্ত হয়ে গেল মাংসের দলা। চোখ নামিয়ে কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি আপনার আর সময় নষ্ট করব না।…আমি মা হতে চলেছি, বাবা নবেন্দু।’
কথাটা ভালো করে পূর্ণেন্দুর মাথার মধ্যে বসতে সেকেন্ড দশেক সময় লাগল। ‘কী বললে তুমি!’
‘আমি প্রেগনান্ট, চার মাস চলছে।’
পূর্ণেন্দুর মাথার মধ্যে অন্ধকার নেমে এল। স্তম্ভিত হয়ে পাথরের মতো বসে রইলেন, স্মৃতির মুখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সারা শরীরের রক্ত দ্রুত বুকে এসে জমা হচ্ছে। একটা কাতরধ্বনি অস্ফুটে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। তিনি ধীরে ধীরে শরীরটাকে আলগা করে চেয়ারে হেলান দিয়ে জানলার দিকে মুখ ফেরালেন।
‘নবেন্দুকে বলেছ?’
‘ও জানে।’
‘আর কেউ?’
‘না। শুধু আপনি এখন জানলেন। একথা কী কাউকে জানানো যায়।’
‘নবেন্দু কী বলছে!’
‘যা বলেছে সেটা আমি পারব না, সন্তান নষ্ট করব না, তা ছাড়া অ্যাবরশনের সময়ও পার হয়ে গেছে।’
‘এখন তুমি কী করতে চাও?’
‘বিয়ে।’ পুকুরে ঢিল ফেলার মতো একটা শব্দ যেন উঠে এল স্মৃতির উচ্চচারণে।
পূর্ণেন্দুর মনে হচ্ছে দৃঢ় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে মনস্থির করে সেই মেয়েটি একবার শেষ চেষ্টা করতে তাঁর কাছে এসেছে।
‘নবেন্দু বিয়েতে রাজি নয়। স্বীকার করতে চায়নি, বলছে অন্য কেউ এর বাবা।’ স্মৃতি পেটের উপর দুটি তালু চেপে ধরল। পূর্ণেন্দু দুটি চোখ আবার জানালার বাইরে রাখলেন।
‘নবেন্দু এভাবে আমার চরিত্রে কালি ছিটোবে আমি ভাবিনি।’ স্মৃতির ঠোঁট কাঁপছে। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল ক্রোধের হলকা। আঙুলগুলো দুমড়ে বেঁকে উঠল। চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে ধরে রাখতে, শেষ পর্যন্ত পারল না। চোখ থেকে দরদর করে জলের ধারা নামতে শুরু করল।
‘আমার দাদাকে আমি জানি, মারাত্মক লোক। ওর পলিটিক্যাল প্রোটেকশনেই টিকে আছে সমরেশ ঢালির মতো দু—তিনটে খুনি যারা দাদার কথায় কাজ করে। দাদা যদি একবার শোনে, আমার এই হাল কে করেছে তাহলে কী যে কাণ্ড ঘটবে তা ভাবতেও পারছি না।’
স্মৃতি সোফা থেকে নেমে আচমকা পূর্ণেন্দু দুটো পা জড়িয়ে ধরল। ‘বিশ্বাস করুন আমার পেটে নবেন্দুরই বাচ্চচা। ও যদি বিয়ে না করে তা হলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।’
পূর্ণেন্দু ডান হাতটা সামান্য তুললেন নিষেধ করার ভঙ্গিতে। শ্রান্ত স্বরে বললেন, ‘বিয়ে হয়তো করতে হবে কিন্তু তুমি ওকে এতটা প্রশ্রয় কেন দিলে? তোমার কথা বলা থেকে মনে হচ্ছে কিছু লেখাপড়া শিখেছ।’
মাথা নামিয়ে স্মৃতি চুপ করে রইল।
‘যাও উঠে বসো। নবেন্দুর বাবা আমি, যতটা লজ্জা পাওয়ার আমি পাচ্ছি। সে এখন বড়ো হয়েছে, সাবালক। নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তার নিশ্চয় হয়েছে। যা করেছে তার দায় তাকেই নিতে হবে। আমি বড়ো জোর তাকে ত্যাজ্য পুত্র করতে পারি, এই ফ্ল্যাট থেকে বার করে দিতে পারি, এর বেশি আর কী করতে পারি যদি সে আমার কথা না শোনে? নবেন্দু এখন স্বাবলম্বী।’
দিগভ্রষ্ট পথিকের মতো স্মৃতি বলল, ‘আপনি কী আমায় কোনো সাহায্যই করতে পারেন না?’ পূর্ণেন্দু আবার হাতটা তুললেন।
‘ওকে আমি নিশ্চয় বলব বিয়ে করতে। কিন্তু মা তুমি কী এই বিয়ের পর সুখী হবে?’ পূর্ণেন্দু আবার হাতটা তুললেন।
‘ওকে আমি নিশ্চয় বলব বিয়ে করতে। কিন্তু মা তুমি কী এই বিয়ের পর সুখী হবে? তোমাদের সম্পর্ক তো কখনো স্বাভাবিক হবে না। নবেন্দু বলছে, সে পিতা নয়, তার মানে সে দায় এড়িয়ে পালাতে চায়। কেন পালাতে চাইছে? উত্তরটাও সহজ—তোমাকে ভালোবাসে না। এমন লোককে তুমি বিয়ে করবে!’ পূর্ণেন্দু কথার শেষে সামনে ঝুঁকে পড়লেন জবাবের অপেক্ষায়। স্মৃতির মন এখন কীভাবে কাজ করছে সেটা তাঁর জানা দরকার। ‘বলো, এমন একটা স্বামী কী তুমি চাও?’
‘কিন্তু সমাজে আমি মুখ দেখাব কেমন করে, মাথা তুলে চলব কেমন করে? সবাই ছি ছি করবে। বিয়ে না হওয়া মা বিদেশে চলে, আমাদের উঁচু সমাজে চলে আর ঝুপড়ি বস্তির সমাজে চলে কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজে চলে না। আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে আপনি বারণ করছেন। না, আমি বিয়ে করতে চাই চাই চাই।’ উত্তেজিত হয়ে স্মৃতি উঠে দাঁড়িয়ে আবার সোফায় বসে পড়ল। তার চোখ দিয়ে ধকধক করে বেরিয়ে আসছে হিংস্রতা।
ঠান্ডা গলায় পূর্ণেন্দু বললেন, ‘বিয়ে করতে আমি বারণ করছি না, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। শুধু বলতে চাইছি ওটা নিছকই পুতুলের বিয়ের মতো ব্যাপারে দাঁড়াবে। প্রেমহীন দাম্পত্য, যা বেশিরভাগ পরিবারেই তুমি দেখতে পাবে, যদিও তারা বাইরে দেখায় খুবই সুখী দম্পতি, এমন একটা সম্পর্ক কী তুমি আজীবন চাও? দিনকাল যে বদলেছে, মানুষের চিন্তা যে এগিয়ে গেছে এটা কী তুমি বুঝতে পারো না?’
স্মৃতিকে বিভ্রান্ত দেখাল। পূর্ণেন্দু বুঝলেন তাঁর থেকে বয়সে কম করে চার দশকের ছোটো একটি মেয়ে বিপন্ন হয়ে তাঁর কাছে জীবনের ব্যক্তিগত লজ্জার কথা খুলে ধরেছে কিন্তু নিজের অবস্থানটিকে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। এই বিপন্নতা কোনোকালে নবেন্দুর মতো কোনো পুরুষ অনুভব করতে পারবে না যা এই মেয়েটির জীবনে এসেছে। ওর ধারণা বিয়ে করলেই বোধহয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু একটি পুরুষ ও নারীর মধ্যে গূঢ় বোঝাপড়ার সম্পর্কটা সাতপাকে বাঁধার বা মালাবদলের দ্বারাই তো স্থির হয়ে যায় না! ‘
স্মৃতির চোখে আবার জ্বলে উঠল আগুন। কণ্ঠস্বর চেপে বলল, ‘দেখুন আমি অতশত কথার মধ্যে যেতে চাই না, নবেন্দুকে বিয়ে করতেই হবে নয়তো আমি এই হাউজিংয়ের ঘরে ঘরে গিয়ে আপনার ছেলের কীর্তির কথা বলে আসব। একটা কথা বলে রাখছি, নবেন্দুর জীবন কিন্তু নিরাপদ থাকবে না, স্মৃতি চ্যাটার্জির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ফল ও হাতে হাতে পাবে। এটা আপনার ছেলেকে বলে দেবেন, আমার চরিত্রে কাদা ছিটিয়ে ও যদি ভাবে পার পেয়ে যাবে, তাহলে ভুল করবে। নবেন্দুকে আমি ভালোবাসি, হ্যাঁ, এত কিছু বলার পরও।’
‘তাহলে তুমি নবেন্দুর সঙ্গেই বোঝাপড়া করে নাও। আমাকে এখানে এসে হুমকি দিচ্ছ কেন?’ পূর্ণেন্দু বিরক্ত ও তিক্ত স্বরে বললেন ধমক দিয়ে, তিনি ইতিমধ্যেই যথেষ্টভাবে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। এই নির্বোধ মেয়েটির কাছ থেকে আর কিছু শুনতে চান না।
‘বেশ তাই হবে। নবেন্দুকে শেষবারের মতো বলব, যদি রাজি হয় তাহলে ভালো। নয়তো—’ কথা অসমাপ্ত রেখে সে ঘর থেকে বেরিয়েই থমকে পাশে তাকাল। মায়া দেয়ালে হাত রেখে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে। স্মৃতি সদর দরজা খুলে বেরিয়ে আস্তে পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিল।
পূর্ণেন্দু মুখ তুললেন মায়াকে দেখে। বজ্রাহাতের মতো মায়া সামনে বসলেন। কেউই কোনো কথা বলছেন না। অবশেষে নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠতে মায়া মুখ খুললেন, ‘এখন কী করব?’
‘নবেন্দুকে বলব।’
‘বিয়ে করতে? এমন মেয়েকে?’
‘এমন ছেলের জন্য এমন মেয়েই তো যোগ্য।’ যেন কালমেঘ পাতা চিবিয়ে ফেলেছেন এমনভাবে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘বিয়ে ওকে করতেই হবে, নয়তো যা মেয়ে দেখলুম, নির্ঘাৎ এখানে এসে হুলস্থুল বাধাবে। তুমি কী চাও আমরা এখানে মাথা নীচু করে বাস করি, ফ্ল্যাট বেচে দিয়ে চলে যাই? আমার আরও একটা ছেলে আছে তারও বিয়ে দিতে হবে, মেয়ে—জামাই আত্মীয়স্বজন আছে।’
‘রবু ফিরে আসুক, ওর সঙ্গে কথা বলে যা ঠিক করার করো।’
‘কেন, রবুর সঙ্গে কথা বলতে হবে কেন? আমি কী নিজেই ঠিক করতে পারি না?’ পূর্ণেন্দু চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমার থেকে রবুর বিদ্যেবুদ্ধিটা কী বেশি?’
স্বামীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পূর্ণেন্দু বেসিনে গিয়ে ঘাড়ে মুখে জল দিয়ে এসে সোফায় শুয়ে পড়লেন।
নবেন্দু আজ ফিরল তাড়াতাড়িই। বাঁ পায়ে নতুন করে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা। খোঁড়াচ্ছে। মায়াকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বলল, ‘আজ আবার লাগল, আবার এক্স—রে করাতে হবে।’
মায়া কথা না বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। খাওয়ার টেবলে একা বসে থেকে বিরক্ত হয়ে নবেন্দু নিজ মনে বিড়বিড় করল, ‘টিভি—টা বন্ধ কেন, এখন তো সিরিয়াল হয়!’ সে উঠে অন্ধকার বসার ঘরে ঢুকল। আলো জ্বালতেই দেখল পূর্ণেন্দু চিত হয়ে সোফায় শুয়ে।
‘অন্ধকার শুয়ে যে! টিভি দেখছ না?’
‘আজ একটা মেয়ে এসেছিল নাম বলল স্মৃতি চ্যাটার্জি।’ পূর্ণেন্দু উঠে বসলেন। নবেন্দুকে তিনি মানসিক প্রস্তুতি নেবার সময় দিতে চান না, কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, ‘কেন এসেছিল নিশ্চয় তা অনুমান করতে পারছিস। নোংরা কথাটা আমি আর উচ্চচারণ করতে চাই না।’
নবেন্দু টিভির সুইচে আঙুল সবে দিয়েছে, সরিয়ে নিল। চোখ কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘স্মৃতি এখানে এসেছিল! আশ্চর্য, সাহস তো কম নয়! বারণ করেছিলুম তা সত্ত্বেও?’
‘ব্যাপারটা যখন চরম লজ্জার মেয়েরা তখন সাহসী হয়ে ওঠে।’
‘কী বলল?’
‘বিয়ে না করলে এখানে এসে ঘরে ঘরে বলে যাবে তোর কীর্তির কথা। আর তোর জীবন নিরাপদ থাকবে না।’
‘তার মানে মেরে ফেলবে? তা ওর দাদা পারে, একটা মাফিয়া!’
‘তোর জীবন নিয়ে আমি ভাবছি না কিন্তু অন্য ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছে—তোকে বিয়ে করতে হবে।’ অচঞ্চল অনুত্তেজিত পূর্ণেন্দুর গলা।
‘কেন করতে হবে?’ নবেন্দুর ভঙ্গিটা তেরিয়া হয়ে গেল। ‘প্রমাণ করুক আগে, ব্লাড টেস্ট করতে হয় তো করুক। আমি কী একা নাকি, ওর তো আরও বয় ফ্রেন্ড আছে।’
‘তাহলে এমন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলিস কেন? এখন তো খেসারত দিতেই হবে। মেয়েটা কিন্তু বাজে থ্রেট করে যায়নি নবু, খুব সিরিয়াস, মরিয়া।’
‘আমার ব্যাপার আমি বুঝব, তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না।’
‘হবে।’ চিৎকার করে ধমকে উঠলেন পূর্ণেন্দু।
ঘর থেকে দ্রুত বেরোতে যাচ্ছিল নবেন্দু, ‘উহহহ’ বলে মুখ বিকৃতি করে দাঁড়িয়ে পড়ল চেয়ার ধরে। বাঁ পা তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন মায়া। তিনি বললেন, ‘এ মেয়ে বউ হয়ে এলে সংসার ছারখার করে দেবে।’
‘কে বিয়ে করতে যাচ্ছে! ঘরে ঘরে বলে বেড়াবে, আমিও ওর পাড়ায় বাড়ি বাড়ি বলে আসব। কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দোব।’
.
নবেন্দু যখন কলকাতায় ওই কথাগুলো বলছিল তখন বর্গাপুরে অমিয়দের পাশের বাড়িতে বড়ো জ্যাঠা কমলাপতি বিশ্বাসের শোবার ঘরে বসে রবিন্দু গল্প করছিল সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধ পাঠশালার প্রাক্তন শিক্ষকের সঙ্গে।
বৃদ্ধ কমলাপতি পিঠে উঁচু করে রাখা বালিসে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে আধশোয়া। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে মোনা চুলে আঙুল ডুবিয়ে মাথা টিপে দিচ্ছে। রবিন্দু খাটের ধারে একটা টুলে বসে, পায়ের কাছে বিছানায় বসে সোনা।
‘কী নাম বললে? ভগবতী পাঠশালা, সেখানে তুমি পড়েছ? কলকাতায় এখনও তা হলে পাঠশালা আছে!’
রবিন্দু বলল, ‘এখনও পর্যন্ত আছে। তবে ইংলিশ মিডিয়াম পাঠশালা যেভাবে গজাচ্ছে তাতে বাংলা পাঠশালায় গরিবরা ছাড়া আর কেউ পড়বে না।’
‘কেন পড়বে না?’ কমলাপতি কৌতূহলী হলেন।
‘মাইনে। ইংলিশ মিডিয়ামে চার—পাঁচ বছরের বাচ্চচাকে দিতে হয় মাসে ষাট টাকা, তাও ভরতির জন্য কী ভিড়! গত বছর ছিল চল্লিশ টাকা, সামনের বছর হবে পঁচাত্তর টাকা এইভাবে বেড়ে চলেছে মাইনে। শুনছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরিজি পড়ানো বন্ধ করে দেবে গভর্নমেন্ট স্কুলে।’
‘জানো রবু, আমাদের ছোটোবেলায় গ্রামের পাঠশালায় ধনী—দরিদ্র সবাই একসঙ্গে পড়ত। মাইনে ছিল শিশু শ্রেণিতে দু আনা, প্রথম শ্রেণিতে চার আনা, প্রথম মান ছ আনা, দ্বিতীয় মান আট আনা, পঁচিশ—তিরিশজন ছাত্র ছিল, মোট আদায় হত সাত—আট টাকা। ছাত্র পিছু মাসে এক সের করে চাল সিদে বাবদ দিতে হত। সত্তর বছর আগে কালীমাস্টারের এই ছিল মাসে রোজগার।’ এই বলে বৃদ্ধ চোখ পিটপিট করে মুখ টিপে হাসলেন।
‘ভাবা যায় না এখনকার সঙ্গে তুলনা করলে।’ রবিন্দু বলল।
‘কালীমাস্টার প্রথমে মেনুয়া গ্রামে মাস্টারি করতেন। স্টেশন থেকে দশ—বারো মাইল দূরে, অতটা রাস্তা তাকে হেঁটে যেতে হত, ভাবতে পার! তারপর আমার ঠাকুরদা বেণীমাধব বিশ্বাস ওনাকে বর্গাপুরে আনেন। আমাদের বৈঠকখানা ঘরেই থাকতেন। পরে বংশগোপাল দাস মশায়ের বৈঠকখানা ঘরে থাকতেন। ঘরের বারান্দায় পাঠশালা। একটা টিনের চেয়ারে বসে উনি পড়াতেন।’
কমলাপতি ঝরঝরেভাবে টানা বলে যাচ্ছেন তাঁর বাল্যকালের পাঠশালার কথা, খুঁটিনাটি কিছুই ভোলেননি, তখন রবিন্দু লক্ষ করল মোনা অপলকে তার দিয়ে চেয়ে রয়েছে। চোখাচুখি হতেই চোখ নামিয়ে মুখ নীচু করে বৃদ্ধের মাথা দিয়ে ব্যস্ততা দেখাল। রবিন্দু নড়েচড়ে চোখে একাগ্রতা ফুটিয়ে বৃদ্ধের মুখের দিকে চোখ ফেরাল কিন্তু মোনার মুখটি তার দৃষ্টির অন্তর্গত করে রাখল।
‘তারপর জ্যাঠামশাই।’ রবিন্দু মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা নিল।
‘কালীমাস্টার গরমের আর পুজোর ছুটিতে বাড়ি যেতেন, নয়তো দশ মাসই দিনরাত পড়ানো নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।’
মোনা অবাক হয়ে বৃদ্ধের দিকে তারপর রবিন্দুর দিকে তাকিয়ে চোখ বিস্ফার করে বলল, ‘দিনরাত পড়াতেন! বাব্বা, ছাত্রদের কী অবস্থা হত?’
রবিন্দু মুগ্ধ দৃষ্টিতে মোনার চোখদুটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যারা হায়ার সেকেন্ডারিতে ফেল করতে চায় না তাদের জন্য দরকার এই কালীমাস্টারের মতো পড়াবার লোক।’ যাকে উদ্দেশ্য করে বলল সে মুখ নীচু করে মৃদুস্বরে বলল, ‘ফেল করায় আমার অ্যালার্জি আছে, জীবনে ফেল করিনি।’
‘তারপর জ্যাঠামশাই।…দিনরাত উনি পড়াতেন।’
মোনা এতক্ষণে কথা বলল, ‘বড়োদাদু মাস্টারমশাই খেতেন কোথায়?’
‘কেন নিজে রেঁধে খেতেন। সিদেয় পাওয়া চাল ছাড়াও ছাত্ররা এটাসেটা আনাজ তেল নুন এনে দিত। পালা করে ছেলেরা জল আনা, উনুনে আঁচ দেওয়া, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড়জামা কাচার কাজ করে দিত।’
বড়োজ্যাঠাকে কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রবিন্দু একটা কৌতূহল ধরিয়ে দিল, ‘শুনেছি তখনকার পাঠশালায় খুব ভালো অঙ্ক শেখান হত?’ মোনার সঙ্গে যতবার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে তার বুকের মধ্যে তিরতিরে একটা ভাব হালকা ছলক দিয়েছে, এমনভাবে শরীরটা কখনো পালকের মতো লাগেনি।
‘শেখানো হত মানে! আট—ন বছর বয়সে আমরা পাটিগণিতের যেসব অঙ্ক শিখেছি হাইস্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত তাই ভাঙিয়ে চলে গেছে। তার সঙ্গে ছিল শুভঙ্করের অঙ্ক—মনকষা, সেরকষা, মাসমাইনে, বিঘাকালি, কাঠাকালি। প্রত্যেকটার জন্য আলাদা আলাদা আর্যা মুখস্থ করতে হত। এখনকার ছেলেমেয়েদের তো শিখতেই হয় না, এ সবের নামও শোনেনি, এখন তো মিটার লিটার ডেসিমেল। বিঘাকালির আর্যা কী ছিল জান?—কুড়ুবা, কুড়ুবা কুড়ুবা লিহ্যে, কাঠায়া কুড়ুবা কাঠায় লিহ্যে; কাঠায় কাঠায় ধূল পরিমাণ, বিশধূলে হয় কাঠায় প্রমাণ। কুড়ুবা মানে বিঘে, ধূল মানে গণ্ডা বুঝলে কিছু?’ বৃদ্ধ মিটমিট চোখে হাসতে লাগলেন।
সেই সময় বাড়ির বাইরে থেকে নারীকণ্ঠ চেঁচিয়ে ডাকল ‘মোনা সোনা শিগ্গিরি এসো, দিদি তোমাদের বাড়ি আসতে বলছে।’
মোনা জানলায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন গো কাতুর মা?’
‘কেন আবার কী, সন্ধে হয়ে গেছে তোমরা পড়তে বসবে না? মাস্টারমশায়ের আসার টাইম হয়ে গেছে।’
জিভ কেটে মোনা ‘সোনা আয়’ বলেই সিঁড়ির দিকে ছুটল।
রবিন্দু উঠে দাঁড়াল, ‘জ্যাঠামশাই আজ তা হলে আসি। আবার এলে দেখা করব।’
ফিরে এসে রবিন্দু দেখল খাওয়ার দালানের একধারে মাদুর পেতে দুই ভাইবোন পড়তে বসার জন্য তোড়জোড় করছে। সে দোতলায় উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ‘মোনা গল্পের বইটই কিছু আছে?’
মোনা একতলার শোবার ঘর থেকে দুটো বই আনল, বঙ্কিম গ্রন্থাবলী আর রামকৃষ্ণ কথামৃত।
‘কার বই এগুলো?’
‘মায়ের।’
‘তুমি পড়েছ?’
‘একটু একটু…চা খাবেন?’
‘খাব, তোমার কপালের কাটা দাগটা কীসের?’
কপালের কাটা দাগটায় আঙুল ঠেকিয়ে মোনা হাসল, ‘পড়ে গিয়ে।’
মোনা চা করে আনতে রান্নাঘরের দিকে যেতেই সোনা বলল, কী করে পড়ে গেছল জানেন রবু মামা? হনুমান সাইকেল থেকে দিদিকে ফেলে দিয়েছিল।’
‘সাইকেল থেকে মানে!’ রবিন্দু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
‘আমাদের জামরুল গাছে বসে একদিন পাঁচ—ছ—টা হনুমান জামরুল খাচ্ছিল আর চারিদিকে ছড়াচ্ছিল। দিদি একটা বাঁশ নিয়ে ওদের তাড়া করে, গোদাটাকে এক ঘা বসিয়েও দেয়। পরদিন দিদি মহাকালীর মাঠে কবাডি খেলে যখন সাইকেল চালিয়ে আমাদের পুকুর ধারের বাঁশবনের পাশ দিয়ে আসছে তখন বাঁশবন থেকে গোদা হনুমানটা দিদির ঘাড়ের উপর লাফ দিয়ে পড়ে এক চড় কষায়। দিদি ছিটকে রাস্তার ইটের ওপর পড়ে, তাইতেই কপালটা কেটে যায়। লজ্জায় দিদি কাউকে বলে না হনুমানের চড় খেয়েছে’ সোনার চোখমুখ এই গোপন তথ্যটি ফাঁস করার মজায় ঝকঝক করে উঠল। ‘জানেন রবুমামা, হনুমানটার সাইজ প্রায় আমার কাঁধ সমান, গায়ে খুব জোর, ওর একটা চড় খেলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব, দিদি হয়নি। হনুমানটা আমাদের ছাদ থেকে লাফিয়ে বড়োদাদুর ছাদে চলে যায়। সেদিন দিদি মহাবাঁচান বেঁচে গেছল।’
‘তোমার দিদি সাইকেল চালাতে জানে?’
‘হ্যাঁ দিদির তো সাইকেল আছে, বড়োমামা কিনে দিয়েছে। ওই যে শেকলতোলা ঘরটা, ওর মধ্যে রাখা আছে, দেখবেন?’
‘না না থাক এখন।’
‘আপনি সাইকেল চালাতে জানেন?’
‘না, কলকাতায় এত গাড়ি লোকে সাইকেল আর চড়ে না। স্কুটার আর মোটরবাইকে চাপে নয়তো ট্রাম বাসে। তোমার দিদি কবাডি খেলে?’
‘আপনি জানেন না! দিদি তো মাধ্যমিক পাশ করার আগে পর্যন্ত মহাকালী সংঘে খেলত। চন্দননগর, চুঁচড়ো কত জায়গায় খেলে এসেছে মেডেলও পেয়েছে। আপনি কবাডি খেলেছেন?’
‘না।’ রবিন্দু জীবনে কোনো খেলাই খেলেনি লুডো আর ক্যারম ছাড়া। প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি বলল, ‘তোমার দিদি আর কী কী পারে, সাইকেল কবাডি ছাড়া?’
সোনা নাকে আঙুল ঠেকিয়ে পাঁচ—ছ সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, ‘ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারে, ডুব সাঁতারে মাঝ পুকুর পর্যন্ত যেতে পারে, বড়ি দিতে পারে—’
চায়ের কাপ হাতে মোনাকে আসতে দেখে সে চুপ করল। তখনই উঠোন থেকে গম্ভীর গলায় ‘মোনা সোনা।’ বলে ডেকে উঠল কেউ।
‘ওরে বাবা মাস্টারমশাই।’ সমীহ আর ভয় ফুটে উঠল মোনার গলায়। চায়ের কাপ আর বই দুটো হাতে নিয়ে রবিন্দু দোতলায় উঠে এল। খাটে চিত হয়ে শুয়ে কথামৃতের প্রথমেই যে পাতাটা খুলল সেখান থেকে পড়তে শুরু করল—
‘ভক্ত—সংসারে কেন তিনি রেখেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মায়া। কামিনীকাঞ্চন দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছেন।
ভক্ত—কেন ভুলিয়ে রেখেছেন? কেন তাঁর ইচ্ছা?’
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন তা হলে আর কেউ সংসার করে না, সৃষ্টিও চলে না।
চালের আড়তে বড়ো বড়ো ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ওই চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদার একটা কুলোতে খই মুড়কি রেখে দেয়। ওই খই মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলো সমস্ত রাত কড়রমড়র করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না।
কিন্তু দ্যাখো, এক সের চালে চোদ্দোগুণ খই হয়। কামিনীকাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি। তাঁর রূপচিন্তা করলে রম্ভা তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়।
রবিন্দু এই পর্যন্ত যখন পড়েছে তখন ঘরে এল অমিয়। সকালে বেরিয়ে ছিল। মুখচোখ বসে গেছে।
রবিন্দু বই বন্ধ করে বলল, ‘কাজ কত দূর হল?’
অমিয় বলল, ‘অনেকটা এগিয়েছে। ঘটপুকুরের জমিটা নিয়েই গন্ডগোল। কুড়ি বিঘে জমি, বর্গাদার ছিল আমাই শেখ। ও হঠাৎ আন্ত্রিক রোগে মরে গেল, রেখে গেল বউ আর দুটো বাচ্চচা। ওরা তো আর ব্যক্তিগতভাবে চাষ করতে পারবে না। কী হবে?’
‘কেন তুই চাষ করবি।’
‘অত সোজা নয় রে, ভূমিসংস্কার আইন বলে একটা আইন আছে। বর্গাদার মরে গেলে তার বৈধ ওয়ারিশদের থেকে একজন বর্গাদার হবে। আমাই—এর বউ দুই ছেলে নিয়ে এখান থেকে আট মাইল দূরে হাদিসপুরে বাপের বাড়ি চলে গেছে। সে আর চাষ করতে চায় না।’
‘ভালোই তো এবার তোর জমি তুই ফেরত নিয়ে লোক দিয়ে চাষ করা।’
‘করা যাবে না। নিয়ম হচ্ছে ভূমিহীন কাউকে দিয়ে বর্গায় চাষ করাতে হবে। জমি আমার হলেও ফেরত পাব না। মুশকিলটা হয়েছে তিনজন চাইছে বর্গাদার হতে। গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে গেছলুম, সে ঠিক করে দিক তিনজনের মধ্যে কাকে বর্গাদার করা হবে। ঠিক করবে কী, ওখানে বিরাট দলাদলি। পার্টির ব্যাপার, দুটো তিনটে উপদল। গেলুম আর আই অফিসে। ইন্সপেক্টরবাবু অসহায়। দলাদলিতে যে পক্ষেই যান না কেন তার সরকারি চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।’
‘তা হলে কী করবি?’
‘তিন জনকেই বর্গাদার করে দেব বলে এসেছি। জমি ছ—মাস পড়ে রয়েছে, এতদিনে দুটো ফসল তো তোলা যেত। একজন চাষ করলে আমার ভাগে যা পাব, দশজন চাষ করলেও তাই পাব তা হলে আমি কেন দলাদলির ঝামেলায় যাব। চাষের খরচখরচা আমি দিচ্ছি, ফসলের ফিফটি পারসেন্ট ভাগ আমার পেলেই হল। তোর কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? বড়ো জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে কথা বলে এলি?’
‘হ্যাঁ। চমৎকার লোক, স্মৃতিশক্তি প্রখর।’
‘কালও তোকে একা থাকতে হবে। জমি ইন্সপেকশন করতে আসবে আমাকে থাকতে হবে। যদি কাজ হয়ে যায় পরশু আমি কলকাতায় ফিরে যাব।’
পরদিন সকালে রবিন্দু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁতে ব্রাশ করছে। তখনই চোখে পড়ল উঠোনের নিমগাছটায় মোনা উঠে ডাল ভেঙে নীচে ফেলছে কুড়োচ্ছে সোনা। ব্রাশ চালানো বন্ধ করে রবিন্দু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। পড়ে গেলে তো হাত—পা ভাঙবে। মোনা নামতে শুরু করল। সাবধানে পা ফেলে এ ডাল ও ডাল করে নামছে। নীচের দিকের একটা ডাল দু—হাতে ধরে ঝুলে পড়ল। জমি থেকে প্রায় চারফুট উপরে ঝুলছে তার পা। হাত ছেড়ে দিয়ে ঝপাৎ করে মোনা মাটিতে পড়ল। চোখ তুলেই রবিন্দু তাকিয়ে আছে দেখে লজ্জায় মুখ নীচু করে ছুটে পালাল।
রবিন্দু হাঁফ ছেড়ে আবার ব্রাশ করতে শুরু করল। বারান্দা থেকে পুকুরটা দেখা যায়। একটা লোক খ্যাপলা জাল ফেলে মাছ ধরছে। তার খুব ইচ্ছে করল পুকুর পাড়ে গিয়ে মাছ ধরা দেখতে। মুখ ধুয়ে সে নীচে নেমে এল। খিড়কির দরজা দিয়ে পুকুরে যেতে হয়। সে দরজার দিকে এগোচ্ছে তখন সোনা তার সঙ্গ নিল।
‘জালফেলা দেখতে যাচ্ছি। চলো আমার সঙ্গে।’
‘আপনি কখনো দেখেননি?’
‘না। সিনেমায় দেখেছি।’
‘বাসুদা খুব ভালো জাল ফেলে। বেছে বেছে ঠিক জায়গাটায় ছুঁড়বে।’
নারকোল গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ঘাটটা থেকে একটু দূরে পাড়ে দাঁড়িয়ে বাসু জালটা ঘোরাতে ঘোরাতে পুকুরে ছুঁড়ল। শূন্যে ছাতার মতো ছড়িয়ে গিয়ে জলে পড়ল। একটু পরে ধীরে ধীরে টেনে তুলতে লাগল। রবিন্দু উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষায় রইল, জালে কী ওঠে! কটা মাছ, কী জাতের মাছ? এই সময়টাই মাছ শিকারের আসল সময়, এই প্রত্যাশাটা। বাসু জালটা টেনে ডাঙায় তুলল। ছটফটাচ্ছে জালে বন্দি কয়েকটা মাছ। তেলাপিয়া, চারাপোনা, বাটা, কই, একটা প্রায় আধ কিলো ওজনের কাতলা, কিছু গেঁড়ি আর গলদার বাচ্চচা।
রবিন্দু হতাশ হল, এত ছোটো ছোটো মাছ! ভেবেছিল দু—তিন কেজি ওজনের রুই কাতলা জালে উঠবে। সোনা বলল, ‘বড়ো বড়ো মাছ উঠবে টানা জাল দিয়ে যখন ধরবে। এই তো মাসখানেক আগে, যারা পুকুর জমা নিয়েছে তারা ধরল।’
‘তোমাদের এখানে এসে মাছ ধরা দেখলুম, আর কী দেখার আছে বল তো?’
‘দেখার।’ সোনা নাকে আঙুল ঠেকাল। ‘হালদারের রাধাগোবিন্দ মন্দির। মন্দিরের গায়ে পোড়া মাটির দেবদেবীর মূর্তি আছে, হাটতলার রথটা তিনতলা উঁচু, রথের সময় খুব বড়ো মেলা বসে, আমাদের স্কুল বাড়ি।’ আর কিছু সে খুঁজে পেল না।
‘মাত্র এই কটা, আর কিছু দেখার নেই?’
‘আপনি বুঝি শুধু বর্গাপুর দেখতে এসেছেন? আপনি তো এসেছেন দিদিকে দেখতে!’
‘দিদিকে দেখতে, কেন?’ রবিন্দু কথাটা বলল, আমোদ পেয়ে।
সোনা চুপ করে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘মা তো বলল, দিদিকে দেখতে বড়ো মামার বন্ধু আসবে।’
রবিন্দুর মাথার মধ্যে একটা চমকানি লাগল। ‘বড়োমামার বন্ধু কী জন্য দিদিকে দেখতে আসবে?’ তার কৌতূহল এবার তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছে।
‘বারে, বিয়ের আগের মেয়েকে দেখতে আসে না? দেখে পছন্দ হলে তবেই তো বিয়ে হবে।’ সোনা বিজ্ঞের মতো মুখভঙ্গি করল।
বলে কী, বিয়ে হবে! রবিন্দু সোনার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে তো এই সবের কিছুই জানে না, অমিয় তো তাকে কিছুই বলেনি কী উদ্দেশ্যে তাকে বর্গাপুরে নিয়ে আসছে। দিদির হাতের রান্না, গ্রামের মিষ্টি, হিমসাগর আম এই সবই তো বলেছিল, মেয়ে দেখানোর কথা তো বলেনি।
‘আপনি কিন্তু কাউকে বলে দেবেন না আমি এ কথা বলেছি। মা বারণ করে দিয়েছে।’ সোনার মুখে অস্বস্তি আর মিনতি।
‘না না বলব না, তোমার দিদি জানে?’
সোনা মাথা কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ।’
বড়ো জ্যাঠার মাথার কাছে দাঁড়ানো মোনার চোখ ও চাহনি এখন রবিন্দুর কাছে বিশেষ অর্থ নিয়ে ধরা দিল। চেপে রাখা পুলক উচ্ছ্বসিত হয়ে মোনার চোখের মণি দুটিকে উজ্জ্বল করে রেখেছিল। অল্প বয়স তাই জীবনের প্রথম ভালোলাগা পুরুষটির কাছে সে আবেগ গোপন করতে পারছিল না। হৃদয়ের অঙ্কুরিত ভীরু লজ্জা দিয়ে সে স্বাভাবিক চঞ্চলতার রাশ টেনে ধরতে চেষ্টা করে হার মানছিল। রবিন্দুর কাছে সোনার ভাবভঙ্গি কথাবার্তার বিশ্লেষণ অন্য এক মোনাকে তার সামনে দাঁড় করাল।
‘তুমি আজ স্কুলে যাবে না?’
‘না, দিদিও যাবে না। আপনার দেখাশোনা করতে হবে, বড়োমামা বলে দিয়েছে। মা ঘরে থেকে বেরোয়নি, হাঁপানির টানটা বেড়েছে।’
‘তা হলে এখন কী করে সময় কাটানো যায়?’ রবিন্দু হালকা চালে বলল। সে যে এখানে তাকে আনার উদ্দেশ্যটা জানে না, সেটাই বজায় রাখবে ঠিক করল। এরা সবাই আশাই আশায় থাকবে। অমিয় একি ফ্যাসাদ তৈরি করল। মোনাকে বিয়ে! ঠাট্টা তামাশা ছেলেমানুষি কথাবার্তা বেশ লাগছে কিন্তু স্ত্রী হিসেবে ভাবতে গেলেই মনে কী যেন একটা খচখচ করছে। বড্ড ছেলেমানুষ, বড্ড কম বয়স। তবে সীমন্তির থেকে সব দিক দিয়েই ভালো।
‘আপনি ছিপ ফেলতে জানেন?’ সময় কাটানোর একটা ভালো উপায় বার করতে পেরে সোনা খুশিতে চোখ ভরিয়ে ফেলল।
‘দি আইডিয়া, গুড, ভেরিগুড।’ রবিন্দু উৎসাহ দেখাতে বাতাসে ঘুঁষি মারল। ‘ছিপ আছে?’
‘দিদির আছে।’
দুজনে ফিরে এল বাড়ির মধ্যে। মোনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
‘আম খাবেন?’
‘নিশ্চয়। অমিয় বলেছিল খুব হিমসাগর হয়েছে।’
মোনা একটা থালাভরে রবিন্দুর জন্য কাটা আম নিয়ে এল আর একটা আস্ত আম নিজের জন্য। আমের তলায় দিকটায় দাঁত দিয়ে ফুটো করে মোনা চুষতে শুরু করল। ওইভাবে আম খাওয়া রবিন্দু দেখেনি আগে। থালাটা রেখে দিয়ে সে বলল, ‘আমিও ওইভাবে খাব, আম আর আছে?’
ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে মোনা একটা বড়ো পাকা আম এনে দিল রবিন্দুকে। ফুটো করে টিপে রস বার করে সে চুষতে লাগল মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটা কথাই, মেয়েটি জানে না আমি অনেক কিছুই জেনে ফেলেছি। যাবতীয় যত্নআত্তির পিছনে একটা স্বার্থ কাজ করছে। তাকে ঘিরে এই বাড়িতে একটা সুখস্বপ্ন সবাই দেখছে। মোনার চোখেও সে দেখতে পাচ্ছে সুখাবেশ। রবিন্দু বুঝতে পারছে সে একটা বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। এরা খুবই ভালো, আন্তরিক। সে অসহায়ভাবে জেনে যাচ্ছে মায়া মমতা তাকে কোণঠাসা করে দিয়ে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতাটা কেড়ে নেবে।
‘মোনা তোমার ছিপ আছে শুনলাম, দেবে একবার। কখনো মাছ ধরিনি। বর্গাপুর থেকে এবার একটা নূতন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরব।’
মোনা ভাইকে বলল, ‘পেয়ারা গাছে দেখ তো পিঁপড়ের ডিম পাস কিনা। কী মাছ ধরবেন তিনি না পুঁটি?’
‘তোমাদের পুকুরে ইলিশ নেই?’
‘কেন থাকবে না! আমাদের জানলা দরজা দেখছেন না, সব ধানগাছের তক্তায় তৈরি।’ মুখটিপে মোনা হাসল। রবিন্দু সরলমনে হাসিটা নিতে পারল না। এদের কথাবার্তা সেবাযত্নের মধ্যে অর্থ খুঁজে না পাবার জন্য তাঁকে নিজের সঙ্গে তর্ক করতে হচ্ছে।
পিঁপড়ের ডিম পাওয়া গেল। ছিপ আর খালুই হাতে সোনা পুকুরঘাটে এল, পিছনে রবিন্দু। ঘাটের নারকেল গুঁড়ি শ্যাওলায় পিছল। সোনা বারণ করল যেতে।
‘এখানে না বসে বরং ওদিকে নারকেল গাছটার পাশে বসুন।’ সোনা পরামর্শ দিল।
‘সোনা, পিঁড়িটা নিয়ে যা, মাটি এখনও ভিজে রয়েছে।’ খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে মোনা চেঁচিয়ে বলল। সোনা দৌড়ে গিয়ে দিদির হাত থেকে পিঁড়িটা নিয়ে এল। রবিন্দু যেখানে পিঁড়ি রাখল সেখানে জমি খাড়াভাবে পাড় থেকে পুকুরে নেমেছে। ঝাঁঝি আর নলখাগড়া পুকুরের ধারটাকে জঙ্গলের মতো করে রেখেছে। জায়গাটা রবিন্দুর পছন্দ হল না, এধার ওধার তাকিয়ে সে ভালো করে বসার মতো কোনো জায়গা দেখতে পেল না। কলাপাতায় মুড়ে ভাতের মতো কয়েকটা লাল পিঁপড়ের ডিম সোনা এনেছে, তার একটা সে বঁড়শিতে গাঁথল।
‘সোনা, মামা চা খাবেন কিনা জিজ্ঞাসা কর।’ খিড়কির দরজা থেকে মোনা আবার চেঁচিয়ে বলল।
রবিন্দু মুখ ফিরিয়ে অ্যাসশ্যাওড়া গাছের ফাঁক দিয়ে তুঁতে রঙের শাড়ি দেখতে পেল। মোনা দাঁড়িয়ে খিড়কির দরজায়। ‘না খাব না।’ রবিন্দু চিৎকার করে জানিয়ে পিঁড়িটা পাড়ের কিনারে টেনে নিয়ে গিয়ে বসল।
ছিপটা ধরে রবিন্দু পিছন থেকে সামনে ঝাঁকাল, বঁড়শি সমেত গিয়ে পড়ল নলখাগড়ার ঝোপের উপর। বিরক্ত হয়ে সে বলল, ‘এতটুকু সুতো দিয়ে কী মাছ ধরা যায়।’
কুণ্ঠিত স্বরে সোনা বলল, ‘একটু সরিয়ে ওই দিকটায় ফেলুন না।’
রবিন্দু কথাটা কানে না তুলে ছিপ হাতে এগিয়ে গেল পাড়ের একদম কিনারে। নরম পিছল মাটি, আঙুল দিয়ে আঁকড়ে সে দাঁড়াল। ছিপে ঝাঁকুনি দিয়ে সুতো ছুঁড়ল, আবার পড়ল নলখাগড়ার ঝোপে এবং বঁড়শি আটকে গেল খাগড়ায়। রবিন্দু সুতোয় জোরে টান দিতেই বঁড়শিটা খাগড়ায় গেঁথে গেল। বঁড়শি ছাড়াতে সুতোটা আলগা করার জন্য সে ঝুঁকল এবং আরও ঝুঁকল তারপরই পায়ের নীচের মাটি আলগা হয়ে পুকুরে ভেঙে পড়ে গেল রবিন্দুকে নিয়ে।
সোনা মজা দেখার মতো করে দেখছিল রবিন্দুর কাণ্ড। ওকে জলে পড়ে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠল, ‘দিদি শিগগির আয়…ডুবে যাচ্ছে মামা, ডুবে যাচ্ছে।’
খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল মোনা। সোনার ভীত চিৎকার শুনে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। রবিন্দু তখন দু—হাত তুলে ডুবছে আর উঠছে। হাঁ করে শ্বাস নিয়ে আর একবার যখন ডুবল মোনা তখন পাড়ে পৌঁছে গেছে। রবিন্দুর দিকে একবার তাকিয়েই সে হ্যাঁচকা দিয়ে পরণের শাড়িটা খুলে একটা প্রান্ত নিজের হাতে ধরে রেখে ছুঁড়ে দিল রবিন্দুকে লক্ষ্য করে।
‘ধরুন ধরুন শাড়ি ধরুন।’ মোনা চিৎকার করল। রবিন্দু তখন কোনো শব্দ শোনার বা শাড়ির কোনো অংশ ধরার মতো অবস্থায় নেই।
জল থেকে শাড়িটা টেনে তুলে ভাইয়ের হাতে ছুঁড়ে দিয়েই মোনা পুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার নিম্নাঙ্গে শুধু সবুজ রঙের সায়া। পাড় থেকে বেশি দূরে নয় কিন্তু জল সেখানে দেড় মানুষ গভীর। দু—তিনটি হাত পাড়ি দিয়ে সে যখন পৌঁছল রবিন্দু তখন নীচের দিকে নেমে চলেছে। মোনাও ডুব দিল। চার—পাঁচ সেকেন্ড পরই সে রবিন্দুকে তুলল চুলের মুঠি ধরে। নেতিয়ে পড়েছে রবিন্দু। এই সময় প্রাণ বাঁচাবার জন্য ডুবন্ত মানুষ হাতের নাগালে যা পায় সেটাই আঁকড়ে ধরে। মোনাকে আঁকড়ে ধরবে সেই ক্ষমতাটাও তখন তার নেই।
এক হাতে রবিন্দুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত তুলে মোনা ভাইকে চেঁচিয়ে বলল, ‘শাড়িটা ছোড়।’
সোনা একটা প্রান্ত ধরে রেখে শাড়িটা ছূড়ল মোনা এক হাতে ধরল। ‘টান এবার।’
সোনা শাড়ি টেনে আনল পাড়ে সেই সঙ্গে মোনা রবিন্দুকে। পাড়টা উঁচু ও খাড়াই। দু বগলের নীচে হাত রেখে উঁচু করে তুলে ধরার চেষ্টা করেও রবিন্দুকে তুলতে পারল না মোনা।
‘সোনা ছুটে বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাস কি না দেখ। আমি ধরে দাঁড়িয়ে আছি।’
সোনা ছুটল এবং আধ মিনিটের মধ্যে হস্তদস্ত হয়ে ছুটে এল বাসু। সে টেনে তুলল রবিন্দুকে। উপুড় করে শুইয়ে কোমরের কাছে বাসু দু—হাতে ধীরে ধীরে চাপ দিতেই রবিন্দুর মুখ থেকে জল বেরিয়ে আসতে লাগল। মোনা জল থেকে উঠে পা ছড়িয়ে বসে হাঁফাচ্ছে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রবিন্দুর দিকে সে তাকাল। তার চোখে কোনো ভাব নেই, কোনো আগ্রহ নেই। ঘটতে যাওয়া একটা বিশাল বিপর্যয় রোধ করার সাফল্যে সে আন্দোলিত হচ্ছে না। তার চাহনির শূন্যতা জানিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্ক অসাড় অবস্থায় রয়েছে। শাড়িটা তার গায়ের উপর রেখে সোনা বলল, ‘পরে নে।’ মোনা ফ্যাল ফ্যাল করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
কী যেন একটা হইচই হচ্ছে পুকুরঘাটের দিকে, অরুণা উৎকর্ণ হলেন। একতলায় নিজের ঘরের খাটে কোলে পাশবালিস নিয়ে সামনে ঝুঁকে বসে ছিলেন। সকাল থেকে আক্ষেপ করে যাচ্ছেন, এতদিন পর রবু এল দিদির হাতের রান্না খাওয়ার জন্য আর হাঁপের টানটা কিনা এই সময়ই বাড়ল। দু—চারটে রান্না যে রাঁধবেন তারও জোর শরীরে নেই। রেঁধে না দিতে পারার থেকেও তার দুশ্চিন্তা মোনাকে কী পছন্দ হবে রবুর? অমিয় চিঠিতে জানিয়ে ছিল মোনা সারাদিন যেভাবে থাকে ঠিক সেইভাবেই যেন রবুর সামনে থাকে, বাড়তি কোনোরকম সাজগোজ বা অতিরিক্ত সভ্য ভব্য হবার চেষ্টা যেন না করে। সাজগোজ যে করেনি সেটা তো ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু ঘরের বাইরে মোনা কী বলছে বা করছে সেটা তো দেখতে পাচ্ছেন না। এই নিয়েই তার আশঙ্কা। বারবার তিনি রাধাগোবিন্দকে স্মরণ করে মিনতি জানিয়েছেন ‘ওর দস্যিপনাটা এই কটা দিনের জন্য থামিয়ে রেখো, রবু যেন ওকে পছন্দ করে।’
হঠাৎ তার কানে এল সোনার ব্যস্ত উত্তেজিত গলা, ‘আমি যাচ্ছি ডাক্তারবাবুকে ডাকতে।’
অরুণা সোজা হয়ে বসলেন। কী ব্যাপার, সোনা কেন ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছে? দালানে সাইকেল বারকরার শব্দ পেলেন। গ্রামের ডাক্তারবাবুর চেম্বার আধমাইল দূরে হাটতলায়। সোনা—মোনা দুজনেই সাইকেল চালাতে জানে। মোনা কোথায়? কিছু করে বসেনি তো? খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বেরোতেই তিনি দেখলেন বাসু পাঁজাকোলা করে রবিন্দুকে এনে বাইরের রকে শুইয়ে দিল। রবিন্দু অজ্ঞানের মতো নেতিয়ে রয়েছে। সারা শরীর ভিজে সপসপে।
‘কী হয়েছে ওর বাসু?’ অরুণা চিৎকার করে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। থরথর করে কাঁপছেন, একি দৃশ্য। তিনি দেখছেন! রবু কী মারা গেছে? কী হয়েছে ওর?
বাসু বলল, ‘পুকুরে ডুবে গেছলেন। মোনাদিদি ঝাপ্পে পড়ে টেনে তুলল। দিদি না তুললি অ্যাতোক্ষণে—’ চোখদুটো উলটে বাসু আকাশের দিকে তুলল। আর্তনাদ করে উঠলেন অরুণা।
বাসু বলল, ‘এখন আর ভয়ের কিছু নেই। যে জল খেয়েছিল সব বার করি দিচি। এখন শুকনো জামাকাপড় পইরে শুইয়ে দিন।’
‘বাসু ওকে আমার ঘরে তুলে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দে। কাতুর মা দৌড়ে ওপরের ঘরের থেকে মামাবাবুর ধুতি জামা এনে দে।’ অরুণা ব্যস্ত হয়ে বললেন। জলে ডোবা মানুষের চিকিৎসা কী তিনি জানেন না। কখনো কাউতে জলে ডুবতে দেখেননি। উদবেগে আশঙ্কায় তিনি ভুলে গেছেন মোনার কথা। বারবার তিনি বলে যেতে লাগলেন, ‘কী সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছিল! দু—দিনের জন্য বেড়াতে এসে একি বিপদের মধ্যে আমাদের ফেলে দিল। ওর বাবা—মার কাছে মুখ দেখাতুম কী করে। বাড়িতে একটা লোকও নেই, অমিয় কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। মোনা গেল কোথায়? অ বাসু, দেখোতো মেয়েটা কোথায়?’
‘মোনা দিদি তো পুকুর পাড়ে বসে।’
বাসুর কথা শেষ হতে—না—হতেই মোনা এসে হাজির। পরনে ভিজে শাড়ি, ভিজে চুল দড়ির মতো পাকিয়ে রয়েছে। দু—চোখে ভয়।
‘বাসুদা, আছে কেমন?’
‘মনে তো হচ্ছে দুর্ভোগ কেটে গেছে। নাও পায়ের দিকটা ধরো, ঘরে নেই যাই।’
বাসু আর মোনা, রবিন্দুকে ধরে অরুণার ঘরে এনে মেঝেয় শুইয়ে রাখল। রবিন্দু চোখ খুলে তাকাল। তার গায়ের গেঞ্জিটা ধরে উপরের দিকে টেনে মোনা বলল, ‘হাত দুটো তুলুন, পারবেন তুলতে?’
জবাব না দিয়ে রবিন্দু উঠে বসতে গেল। পারল না। অসহায়ভাবে মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে দু—হাত তুলল আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে। মোনা গেঞ্জিটা মাথা দিয়ে গলিয়ে খুলে নিল। দোতলার বারান্দায় অমিয়র লুঙ্গি ও শার্ট শুকোচ্ছিল দড়িতে। কাতুর মা দৌড়ে দোতলায় উঠে চোখের সামনে তাই দেখে তুলে এনেছে। শার্টটা পরিয়ে দিল মোনা। পাজামার কোমরের দড়িটা খুলে দিয়ে মোনা বলল, ‘লুঙ্গিটা নিজে পরতে পারবেন?’
ঘাড়নেড়ে রবিন্দু বলল, ‘পারব।’
ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যেতে রবিন্দু উঠে বসে পাজামা ছেড়ে লুঙ্গি পরে নিল।
একটু পরেই সোনা ডাক্তারকে সাইকেল রিকশায় বসিয়ে, পিছু পিছু নিজে সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হল। ততক্ষণে রবিন্দু অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তার নাড়ি দেখলেন, বুক পরীক্ষা করলেন, পেট টিপলেন এবং যেহেতু চিকিৎসা করতে এসেছেন তাই একটা কাগজ চেয়ে নিয়ে দুরকম ক্যাপসুলও একটি টনিকের নাম লিখে দুবেলা একটি করে ক্যাপসুল ও দু—চামচ টনিক খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হেসে বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। শক্ত খাবার কিছু দেবেন না। গরম দুধ দিতে পারেন, দরকার এখন রেস্ট। ওষুধ খাওয়ার পর ঘুমোবে। শক পেয়েছে, কালকেই ঠিক হয়ে যাবে। বেশি কথা বলবেন না। জল অল্পই পেটে গেছে, মনে তো হয় না লাংয়ে জল গেছে। ভাগ্য ভালো খুব তাড়াতাড়িই জল থেকে তুলে ফেলা গেছে।’
রবিন্দু চোখ বুঁজে ডাক্তারের কথা শুনছিল। ওর শেষ কথাটিতে সে চোখ মেলে ঘরের এধার ওধার তাকিয়ে মোনাকে খুঁজে পেল না। মাথার খুলিতে চুলের গোড়ায় ব্যথা করছে। শক্ত মুঠিতে চুল ধরে হ্যাঁচকা দিয়ে তাকে টেনে তুলেছে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখের ভিতর থেকে…বাঁ হাতটা গলায় জড়িয়ে বুকের কাছে তাকে চেপে ধরে ডান হাত তুলে ভাইকে চেঁচিয়ে কী যেন বলল…কী যেন বলল…তখন আর শোনার মতো জ্ঞান তার ছিল না।…ডাক্তার বলল ভাগ্য ভালো…কার ভাগ্য, এদের না আমার? রবিন্দু আবার চোখ বুঁজল, তার ঘুম পাচ্ছে, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এখন আর সে কিছুই ভাবতে চায় না।
চারঘণ্টা টানা ঘুমোবার পর রবিন্দুর ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখল অমিয় খাটে তার পাশে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে। দিদি, সোনা আর মোনা দাঁড়িয়ে, ওদের চোখেমুখে উদবেগ। তাকে চোখ খুলতে দেখে অরুণা দু—হাত কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করলেন: ‘মুখ রেখেছ ঠাকুর।’
অমিয় বলল, ‘এখন কেমন বোধ করছিস।’
‘আমার কিছু হয়নি।’ বলে রবিন্দু উঠে বসতে গেল। অমিয় কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলে ওকে শুইয়ে দিল।
‘হয়নি বলছিস কী, যে কাণ্ড বাধিয়ে ছিলিস, প্রাণে যে বেঁচেছিস সেটা তোর সাতজন্মের পুণ্যের ফল।’
রবিন্দু ম্লান হাসল। তাকাল মোনার দিকে। মুখ নামিয়ে সে দাঁড়িয়ে রবিন্দু গভীর গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। মোনা একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। রবিন্দুর মনে হল মোনা যেন সতেরো—আঠারো বছরের কিশোরী নয় আজকেই ওর বয়স সাত—আট বছর বেড়ে গেছে।
‘তোকে নিয়ে আসাই আমার ভুল হয়ে গেছে।’ অমিয় ক্ষুব্ধ স্বরে বলল। ‘এমন একটা কাণ্ড বাধাবি জানলে আসতে বলতুম না।’
রবিন্দু হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘কাণ্ডটা না বাধালে আমিও নিজের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারতুম না। বকাঝকা পরে করবি অমিয়, এখন একটু চা খাওয়া। খুব খিদে পাচ্ছে, দিদি মুড়িটুড়ি আছে?’
‘ডাক্তারবাবু তো শক্ত জিনিস খেতে বারণ করেছেন, তুমি বরং দুধ খাও।’ অরুণা বললেন, ‘মোনা এক গ্লাস দুধ গরম করে আন।’
সোনা বলল, ‘ডাক্তারবাবু বলেছিলেন রবুমামা কেমন থাকেন সেটা ওকে জানিয়ে আসতে।’
‘কী আবার জানানোর আছে, আমি দিব্যি ফিট।’ গায়ের উপর রাখা পাতলা সুতির চাদরটা সরিয়ে রবিন্দু উঠে বসল। ‘একটা রিকোয়েস্ট তোকে, আমার এই কীর্তির কথাটা ঘুণাক্ষরেও যেন আমাদের বাড়িতে না পৌঁছয়।’
‘পৌঁছলে তো আমারই সর্বনাশ। মাসিমা আমার ওপর এমনিতেই চটা তার ওপর আমাদের বাড়িতে এসে তুই ডুবে মরতে বসেছিলি শুনলে জীবনে আর আমার মুখদর্শন করবেন না। লাভের মধ্যে হল কাল আমার কলকাতায় ফিরে যাওয়াটা আর হল না।
‘কেন?’
‘তোকে এখন ফেলে রেখে কী যাওয়া সম্ভব?’
‘খুব সম্ভব। তোর সঙ্গে আমিও যাব।’ রবিন্দু খাট থেকে নেমে মেঝেয় দাঁড়িয়েই টলে গেল। অমিয় তাকে ধরে খাটে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘থাক আর বাহাদুরি দেখাতে হবে না। কলকাতায় গিয়েই গোলদিঘিতে একটা ক্লাবে ভরতি হয়ে সাঁতারটা শিখে নিবি।’
দুধের গ্লাস হাতে মোনা এল। রবিন্দু উঠে বসে গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ করল মোনা ইসারায় সোনাকে ডেকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেল। দুধ শেষ করে সে আবার শুয়ে চাদরটা বুক পর্যন্ত টেনে দিল।
‘যাই একবার ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসি।’ অমিয় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সোনা ফিরে এল ডানহাতটা পিছন দিকে রেখে। মায়ের দিকে সে সন্তর্পণে তাকিয়ে খাটে বসে রবিন্দুর গায়ে ঢাকা চাদরের মধ্যে ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিল। রবিন্দুর হাতের তালু খুঁজে নিয়ে সে একমুঠো নারকোল নাড়ু তালুতে গুঁজে রাখল। রবিন্দু জিজ্ঞাসু কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই সে দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘দিদি দিল।’
.
দুর্গাপুরে রবিন্দু যখন চাদর মুড়ি দিয়ে একটা একটা করে ছ—টা নারকোল নাড়ু খেয়ে শেষ করছে তখন কলকাতায় আনন্দ নিকেতনের ফটকে একটা ট্যাক্সি এসে থামল। ট্যাক্সি থেকে নামল নবেন্দু। পায়ে এক্স—রে করে ফিরছে। সকালে প্র্যাকটিস ম্যাচে পিছন থেকে করা একটা ট্যাকলিংয়ে তার চোটের জায়গাটায় আবার লাগে। মাঠ থেকে সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে আসে। বিকেলে পার্ক স্ট্রিটে ক্লাবের ডাক্তারের চেম্বারে যায়। সেখান থেকে এক্স—রে ক্লিনিকে তারপর বাড়িতে।
ফটক থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে দুটো মোটরবাইকে চারজন লোক বসে। রাস্তায় আলো কম, পথচারী পাঁচ—ছ জন মাত্র। রাস্তার ধারে তিন—চারটি মোটর দাঁড়িয়ে। ফটকের সামনেটা নির্জন। নবেন্দু ট্যাক্সি থেকে নেমে মিটার দেখছে। তখন মোটরবাইক স্টার্ট করার শব্দে সে একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।
‘কত হয়েছে?’
‘বারো টাকা সত্তর পয়সা।’
নবেন্দু তেরোটা টাকা দিয়ে ‘ঠিক আছে’ বলে বাঁ পা আলতো করে ফেলে ফটকের দিকে এগোল। ট্যাক্সিওয়ালা মিটার ঘুরিয়ে নিয়ে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল আর তখনই মোটরবাইক দুটো এগিয়ে আসতে লাগল। নবেন্দু যখন লোহার ফটকে তখন বাইক দুটো তার কাছে এসে পড়েছে। দুটো বাইকে পিছনে বসা দুজন পরপর দুটো বোমা ছুড়ল নবেন্দুর দিকে। বিকট শব্দে ফেটে ধোঁয়ায় ভরে গেল এলাকাটা। এঞ্জিনের গর্জনতুলে বাইক দুটো মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হই হই করে দু—পাশের বাড়ির লোক বেরিয়ে এল। আনন্দ নিকেতন থেকে বেরোল জনা তিনেক। ফটকের কাছে পড়ে রয়েছে নবেন্দু। তার দুই পা থেকে ঝরঝর করে রক্ত বেরোচ্ছে, গালে কপালে গর্ত হয়ে রক্ত পড়ছে। একটা বোমা পড়েছে তার পায়ের কাছে অন্যটা ফটকের লোহার রেলিং—এ।
হাউজিংয়ে দরোয়ান ছুটে গেল খবর দিতে। বোমার শব্দে পূর্ণেন্দু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দরোয়ান বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘শিগগির আসুন, আপনার ছোটো ছেলেকে বোমা মেরেছে, গেটের কাছে পড়ে আছেন।’ শুনেই পূর্ণেন্দু অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘বাজে হুমকি দেয়নি।’
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মোটরগুলির একটির অবাঙালি মালিক তার ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে যখন বলছিলেন, ‘উঠাকে জলদি হসপিটালমে লে যাও।’ তখনই পূর্ণেন্দু ও মায়া ফটকে পৌঁছলেন। সেই গাড়িতে নবেন্দুর সঙ্গে তারা দুজনে উঠলেন। নবেন্দুর আঘাত বড়ো রকমেরই কিন্তু সে জ্ঞান হারায়নি।
‘সত্যি সত্যিই তোকে মারার চেষ্টা করেছে।’ গাড়িতে পূর্ণেন্দু ফিসফিস করে বললেন।
মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসা নবেন্দু বলল, ‘মারার চেষ্টা সত্যি সত্যি করলে এখনও বেঁচে থাকতুম না। এটা ওয়ার্নিং দিল।’
গাড়ি যখন আর জি কর মেডিক্যাল হসপিটালে ঢুকছে। পূর্ণেন্দু তখন বললেন, ‘তা হলে বিয়েটা করেই ফেল। আমাকে ঠিকানাটা দিস গিয়ে কথা বলে আসব।’
পূর্ণেন্দুকে আর স্মৃতিদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে হল না, পরদিনই দুপুর বারোটা নাগাদ স্মৃতিই এসে হাজির হল আনন্দ নিকেতনে। চোখমুখ শুকনো। কোনো প্রসাধনের চিহ্ন নেই মুখে, চাহনি এলোমেলো। পূর্ণেন্দু তাকে বসালেন খাওয়ার টেবলে। স্মৃতিকে দেখেই তিনি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন কোনোমতে নিজেকে সংযত রেখে বললেন, ‘তোমার দাদা একটা পলিটিক্যাল মাফিয়া জানি তাই বলে এটা কী করলেন? নবুকে শিক্ষা দিতে গিয়ে তো নিজের বোনের সর্বনাশ করলেন।’
‘সর্বনাশ!’ স্মৃতি প্রায় চমকে উঠল। ‘কী সর্বনাশ হয়েছে নবুর, এমন কেমন আছে? বিশ্বাস করুন আমি আজই সকালে শুনলাম ঘটনাটা। আমি বুঝতে পারিনি দাদা এমন একটা ব্যাপার ঘটাবে। দাদাও বোঝেনি সমরেশদা এতদূর পর্যন্ত যাবে। দাদা ওকে বলেছিল শুধু একটু কোড়কে দিতে, বোমা মারতে বলেনি। নবু এখন কোথায়, কেমন আছে?’
পূর্ণেন্দু তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাকালেন স্মৃতির মুখের দিকে। মেয়েটির মুখে চোখে সত্যিকারের উদবেগ ব্যাকুলতা আতঙ্ক দেখতে পেলেন।
‘ইনজুরি কী খুব মারাত্মক?’ স্মৃতি গলা নামিয়ে বলল।
‘হ্যাঁ।’ পূর্ণেন্দু গম্ভীর হয়ে জানালেন। ‘অপারেশন হয়েছে, গোড়ালির হাড় তিনটুকরো হয়ে গেছে, ওর ফুটবল কেরিয়ার শেষ। এ তুমি কী করলে? নিজের পায়ে তো নিজেই কুড়ুল মারলে।’
মায়া এসে বসলেন টেবলে স্মৃতির বিপরীতে। মুখ নীচু করে নিল স্মৃতি।
পূর্ণেন্দু বলে চললেন, ‘নবুকে এবার পরের দয়ার ওপর জীবন কাটাতে হবে, আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল। কোথায় কাজ পাবে, কে ওকে কাজ দেবে! লেখাপড়া তো মাধ্যমিক। লাখ লাখ মাধ্যমিক সক্ষম বেকার ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন ছেলেকে কী বিয়ে করবে? এখনও কী তুমি সেদিনের মতো বলবে, বিয়ে করতে চাই চাই চাই।’ পূর্ণেন্দুর স্বরে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ।
স্মৃতির চোয়ালের পেশি শক্ত হয়ে উঠল। মুখ নামিয়ে রেখেই সে বলল, ‘হ্যাঁ এখনও চাই, আরও বেশি করে চাই।’
পূর্ণেন্দু ও মায়া চোখাচোখি করলেন বিস্মিত হয়ে, দুজনের কেউই আশা করেননি এমন উত্তর শোনার জন্য।
‘বিয়ে করে আমার এখানে থাকার জায়গা হবে না। দুটো মাত্র শোবার ঘর আরও একটা ছেলে আছে তারও বিয়ে দিতে হবে।’ গলাটা কর্কশ করে মায়া বললেন।
‘যতদিন না দাদার বিয়ে দিচ্ছেন ততদিন থাকতে দিন তারপর নয় কোথাও চলে যাব।’ ধীরগলায় স্মৃতি বলল।
‘তা নয় যাবে কিন্তু চলবে কী করে, সংসার চালাতে তো রোজগার চাই।’ মায়া বাস্তব দিকটার দিকে আঙুল দেখালেন।
‘কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে, দাদার সঙ্গে কথা বলি আগে। দোষ আমারও যেমন তেমনি দাদারও। কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবে।’ স্মৃতির স্বরে প্রত্যয় নেই কিন্তু হতাশাও নেই। ‘কিছু না হলে আমিই রোজগারের চেষ্টা করব। হিস্ট্রি অনার্স গ্র্যাজুয়েট আমি। নবুর তো একটা পা অক্ষত আছে, তাই দিয়ে যতটা চলাফেরা করা যায় তাই করে রোজগারের চেষ্টা করবে। দোষ তো ওরও খানিকটা আছে।’
‘খানিকটা নয় পুরোটা।’ পূর্ণেন্দু স্বরে আর আগের কাঠিন্য নেই। স্মৃতির আন্তরিকতাপূর্ণ কথা আর অসহায় অবস্থাটা অনুভব করে তার মধ্যে সহানুভূতির প্রলেপ পড়ছে। ‘সব কিছুর মূলে তো সেই। ফুটবল খেলে লাখ লাখ টাকা কামাবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে মনের ব্যালান্স হারিয়ে নিজের আর সেই সঙ্গে একটা মেয়ের সর্বনাশ করে বসল।’
‘তুমি শুধু নবুরই দোষ দেখছ, আর একজন কী কচি খুকি?’ মায়া ধারালো গলায় কথাটা বলে স্মৃতির দিকে আগুন ঝরান চোখে তাকিয়ে রইলেন। মাথা নিচু করে স্মৃতি বসে রইল। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না।
‘কাল পুলিশ এসেছিল ইনভেস্টিগেট করতে।’ পূর্ণেন্দু নীরবতা ভাঙলেন। মুখ তুলে স্মৃতি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। ‘কাউকে সন্দেহ করছি কিনা জানতে চায়। আমি কারুর নাম করিনি, বলেছি দমদমে খেলতে গিয়ে মারপিট করেছিল বোধহয় সেখানকারই কেউ শোধ নিতে একাজ করতে পারে। আমি কোনো কমপ্লেন করতে চাইনি ওরা তাইতে হাঁফ ছেড়ে খুশি হয়েই চলে গেল। কেলেঙ্কারি বাড়িয়ে লাভ কী।’
‘নবু কোন হাসপাতালে আছে?’
‘আর জি কর—এ।’
‘কবে বাড়ি আসবে?’
‘আরও দিন দুয়েক তো থাকবে।’ পূর্ণেন্দু আন্দাজে বললেন।
‘নবুর চিকিৎসার সব খরচ দাদা দেবে বলেছে।’ স্মৃতি দ্বিধা জড়িত স্বরে বলল। সে যেন জানেই প্রত্যাখ্যাতা হবে।
‘জুতো মেরে গোরু দান!’ পূর্ণেন্দুর মুখ বিকৃত হয়ে উঠল রাগে, ‘তোমার দাদার স্পর্ধা তো কম নয়!’
মায়া বললেন, ‘বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি চুকে যায় ততই ভালো। লোকজন ডেকে নেমন্তন্ন করে নয়, এই ঘরে হবে। বিয়ের পরই বাচ্চচা হবে, শুনলে লোকে কী বলবে, আত্মীয়স্বজনের কাজে মুখ দেখাব কী করে। তুমি বাপু এখন থেকেই ঘরটর দ্যাখো।’
পূর্ণেন্দু বললেন, ‘তোমাদের ওদিকে তোমার দাদার তো খুব দাপট আছে তাকে বলোনা ঘর জোগাড় করে দিতে।’
স্মৃতি অস্ফুটে বলল, ‘তাই বলতে হবে।’
.
সেইদিনই বর্গাপুরে দোতলার বারান্দায় মুখোমুখি দুটো মোড়ায় বসে রবিন্দু আর অমিয় কথা বলছিল। রবিন্দুর ঘটনাটার পর অমিয় কলকাতায় ফেরার সিদ্ধান্ত বাতিল করে রয়ে যায়। মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে রবিন্দুর বেশি সময় লাগেনি। শুধু শরীরের উপর ধকলটা তাকে দুর্বল করে রেখেছে।
‘অমিয় আমার ছুটি কিন্তু অনন্ত কালের জন্য নয়। কাল দুপুরেই ফিরব।’
‘আর দুটো দিন থেকে যা।’
‘পরে এসে থেকে যাব। তোর মনে আছে কী, আমাদের বাড়িতে বসে আমাকে বলেছিলি যদি বিয়ে করিস তাহলে নবুর থাকার ব্যবস্থা আমি করে দেব গড়িয়ার নতুন বাড়িতে। নবুকে একটা ঘরে থাকতে দিবি বলেছিলিস। মনে আছে?’
‘আছে।’
‘অফারটা কী এখনও খোলা আছে?’
‘আছে।’
‘যদি থাকার লোকটা বদলে যায় তোর আপত্তি হবে?’
‘সেই বদলি থাকার লোকটা কে, না জেনে কথা দিতে পারব না।’
‘ধর আমি।’
‘হঠাৎ তোর থাকার ঘরের দরকার হল কেন?’
‘আমি বিয়ে করলে নবু থাকবে কোথায়? আমাদের ফ্ল্যাটটা তো দেখেছিস।’
শুনেই অমিয় দমে গেল। রবিন্দুকে বর্গাপুরে আনা তা হলে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেল। সে শুকনো গলা বলল, ‘বিয়ে কী ঠিক হয়ে গেছে?’
‘আমি হ্যাঁ বললেই হয়ে যাবে।’
‘কবে হ্যাঁ বলবি?’ অমিয় নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল।
‘আজই।’
অমিয় হতভম্ভ হয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইল রবিন্দুর মুখের দিকে। ‘আজই! আজ কলকাতা যাবার ট্রেন ধরতে হল তোকে এখনই বেরতে হবে।’ অমিয়র মুখ ব্যাজার হয়ে উঠল।
‘কলকাতায় যাবার দরকার নেই, বর্গাপুরেই বলা যায়।’ রবিন্দু হাই তোলার চেষ্টা করল নির্লিপ্তি দেখাতে।
‘বর্গাপুরে কোন বাড়িতে?’ অমিয় ঝুঁকে পড়ল ভ্রূ কুঁচকে ‘এখানকার সব বাড়িই আমি চিনি। কিন্তু তোর বিয়ে করার মতো মেয়ে তো—’অমিয় কথা শেষ করল না।
‘এই বাড়িটা অমিয় বর্গাপুরের মধ্যেই পড়ে। কাকে হ্যাঁ বলতে হবে, তোকে না দিদিকে? বড়ো করে তো মেয়ে দেখাতে এনেছিস, আমি কিছু জানি না ভেবেছিস? ওরে ব্যাটা একসের চালে চোদ্দোগুণ খই হয়, ঠাকুরের কথা! চাল আমি পেয়ে গেছি। খই মুড়কি চিবোবার মতো আহাম্মক আমি নই। এবার বল তোর গড়িয়ার ঘরটা কী পেতে পারি?’
অমিয়র এবারের হতভম্ব ভাবটা নিমেষে উধাও হল। দু—হাতে রবিন্দুর দুটো কাঁধ ধরে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘একটা কিরে দুটো তিনটে ঘর পেতে পারিস। হ্যাঁ—টা আমাকে নয় দিদিকে বলবি, চল।’
দু—হাতে চায়ের দুটো কাপ নিয়ে মোনা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল। অমিয় লাফাতে লাফাতে চিৎকার করে তার পাশ দিয়ে নেমে গেল।
‘দিদি দিদি, ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট পেয়ে ফাইনালে পাশ করেছে…পাঁজি, পাঁজি বার করো।’
একটা কাপ রবিন্দুর হাতে দিয়ে মোনা অবাক স্বরে বলল, ‘বড়োমামা হঠাৎ পাঁজি পাঁজি বলে বাড়ি মাথায় করে তুলল কেন! মাথা তো একটু আগেও ঠিক ছিল, বলল চা খাবো!’
চায়ে চুমুক দিয়ে রবিন্দু বলল, ‘মাথা ওর ঠিকই আছে বরং আমারটাই গোলমেলে হয়ে গেছে। হবে না? যে ভাবে চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছ এখনও ব্যথা করছে।’
অপ্রতিভ স্বরে মোনা বলল, ‘তা না হলে আপনাকে তো তুলতে পারতুম না।’
‘তুলেই তো আমার মাথাটা খারাপ করে দিলে। ওটা এবার থেকে তোমাকে ঠিকঠাক করে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে—আত্মজীবনের জন্য, রাজি?’
রবিন্দুর কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে মোনার দশ সেকেন্ড সময় লাগল এবং তারপরই হাত থেকে চায়ের কাপটা মেঝেয় পড়ে ভেঙে ছড়িয়ে গেল।