দুটি চরিত্র
গড়িয়াহাট বাজারে একটি গেটের এক পাশে এক বৃদ্ধ দোকানী বসেন। পাকা মাথা, ছোটখাটো চেহারা। তিনি বিক্রি করেন শুধু নানারকম বড়ি, আর মাঝে-মাঝে বকফুল। তাঁর কথায় একটা টান আছে, যা নিশ্চিত পূর্ববঙ্গের, ঠিক কোন জেলার তা আমি ধরতে পারি না, তবে ফরিদপুর হওয়াই সম্ভব। উচ্চারণভঙ্গি বেশ চেনা লাগে। চেনা লাগে চেহারাটিও। মনে হয় যেন আমাদের মাইঝপাড়ার বাজারে খুব ছেলেবেলায় আমি এই দোকানীকেই দেখেছিলুম। সেখানে তিনি শুধু বড়ি বিক্রি করতেন না। তিনি ছিলেন মুদি। ঠিক যেন একই মুখ।
রোজ বাজারে গিয়ে আমার বড়ি কেনার দরকার হয় না, বাড়িতে কোন রান্নায় কবে বড়ি লাগে তা আমি খেয়ালও করি না, তা হলেও আমি ওই বাড়িওয়ালার সামনে একবার করে দাঁড়াই, এক টাকা চল্লিশ পয়সা দিয়ে একশো বড়ি কিনি, দু-চারটে কথা বলি। কথাগুলি শুনতে ভালো লাগে, যেন ওই সময়টুকুর জন্য ছেলেবেলায় ফিরে যাই।
বকফুল ভাজা অতি উপাদেয়, যেদিন বকফুল থাকে সেদিন আগ্রহ নিয়েই কিনি। আমার আগ্রহ দেখে উনি দু-তিন কুড়ি বকফুল আমাকে দিতে চান। আমাদের পরিবারে লোকসংখ্যা খুবই কম, অত বকফুল লাগে না, রেখে দিলে নষ্ট হয়, তবু আমি আপত্তি করতে পারি না। সামান্য ফুলের দামে যদি ছেলেবেলায় ফিরে যাওয়া যায়, তার মূল্য কে বুঝবে! আমাদের গ্রামে অনেক বকফুল ফুটত!
২.
গিয়েছিলাম বস্তার জেলার আদিবাসীদের গ্রামে। মধ্য প্রদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। জঙ্গলের মধ্যেও হঠাৎ-হঠাৎ বাংলা ভাষা শুনতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় দণ্ডকারণ্য থেকে ছিটকে যাওয়া দু-চার জনকে। কেউ রিকশা চালায়, কেউ ছোটখাটো ব্যাবসা করে।
গ্রামের হাটে ঘুরতে-ঘুরতে একপাশে, চোখে পড়ল একটা ভাতের হোটেল। খুবই ছোটখাটো ব্যাপার। নড়বড়ে টেবিল ও বেঞ্চি পাতা, মাটির সামনে উনুনে ভাত ফুটছে, এ ছাড়া পাওয়া যায় কলাইয়ের ডাল ও ঝিঙের তরকারি। আর কিছু না!
আমার সঙ্গের একজন বাঙালি চাকুরিজীবী বললেন, ফরিদপুরের একজন লোক এই ভাতের হোটেলটা খুলেছে কিছুদিন হলো। ভালো চলে না। কারণ, সপ্তাহে একদিন হাটবার ছাড়া। অন্যদিন খদ্দের জোটে না।
ডাক বাংলোতে আমাদের জন্য রান্না তৈরি ছিল, মুরগির মাংস-টাংস অনেক কিছু, তবু আমি বললুম, গরম-গরম ভাতের গন্ধ পেয়ে লোভ লেগে যাচ্ছে, এখানেই বসে পড়ি!
ফরিদপুরের মানুষের দোকান শুনেই কি আমার এরকম ইচ্ছে হল? তা তো খানিকটা বটেই। তা ছাড়া, লোকটির চেহারার সঙ্গে আমাদের মামাবাড়ির রান্নার ঠাকুরের চেহারার খুব মিল। মাথার চুল একেবারে ছোট ঘাসের মতন, নাকটা বোঁচা, মুখ দেখলেই মনে হয়, এইসব লোক সারাদিনে খুব কম কথা বলে।
সেই নড়বড়ে টেবিলে বসেও মনে হল অবিকল যেন সেই আমার ছোটবেলার মামাবাড়ির ঠাকুর ভাত বেড়ে দিচ্ছে! শুধু ডাল-ভাতের কী অপূর্ব স্বাদ!