দু’চারটে চাওয়া
আমার এই ‘ভালোবাসো? ছাই বাসো’ বইটা খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছোয়নি। তখন ২০০৭ সাল, সরকারের রোষানলের শিকার আমি, আর তখনই আমাকে ভী ষণভাবে অবাক করে দিয়ে আমার এতকালের পুরোনো প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স, বিরানব্বই সাল থেকে যে আমার সব বই প্রকাশ করছে, আমার বই প্রকাশ বন্ধ করে দিল! নিজের চোখ কান কিছুকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। সরকারের বিরোধিতা সওয়া যায়, বন্ধুদের নয়, ঘরের লোকদের নয়। আনাড়ি দু একজন বইটা বের করেছিল। যথারীতি ডিস্ট্রিবিউশনের কায়দা কানুন না জানায়, বই চার দেওয়াল থেকে বেরোতে খুব একটা পারেনি। বইটার একটা কবিতা কী করে হঠাৎ হাতে এলো আজ, পড়ে মনে হল, শোনাই কবিতাটা সবাইকে। সবাই আবার কোথায়, হাতে গোণা কজন যারা আমার মুক্তচিন্তার লেখাগুলো পড়ে!
আমার কাছে এই জীবনের মানে কিন্তু আগাগোড়াই অর্থহীন,
যাপন করার প্রস্তুতি ঠিক নিতে নিতেই ফুরিয়ে যাবে যে-কোনওদিন।
গ্রহটির এই মানবজীবন ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসে
এক পলকের চমক ছাড়া আর কিছু নয়।
ওই পারেতে স্বর্গ নরক এ বিশ্বাসে।
ধম্মে কম্মে মন দিচ্ছে– কী হয় কী হয়– সারাক্ষণই গুড়গুড়ে সংশয়।
তাদের কথা বাদই দিই সত্য কথা পাড়ি,
খাপ খুলে আজ বের করিই না শখের তরবারি!
মানুষ তার নিজের বোমায় ধ্বংস হবে আজ নয়তো কাল,
জগত টালমাটাল।
আর তাছাড়া কদিন বাদে সূয্যিমামা গ্যাস ফুরিয়ে মরতে গিয়ে
দেখিয়ে দেবে খেলা,
সাঙ্গ হবে মেলা।
জানার পরও ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে কামড়ে তুচ্ছ কিছু বস্তু পাওয়ার লোভ,
ভীষণ রকম পরস্পরে হিংসেহিংসি ক্ষোভ।
মানুষের কই যাবে দুর্ভোগ।
তাকত লাগে ভবিষ্যতের আশা ছুঁড়ে করতে কারও মহানন্দে মুহূর্তকে ভোগ।
ভালোবাসতে শক্তি লাগে, হৃদয় লাগে সবকিছুকেই ভাগ করতে সমান ভাগে,
কজন পারে আনতে রঙিন ইচ্ছেগুলো বাগে?
ভুলে যাস এক মিনিটের নেই ভরসা,
তোর ওই স্যাঁতস্যাঁতে-সব-স্বপ্ন-পোষা কুয়োর ব্যাঙের দশা
দেখে খুব দুঃখ করি, দিনদিনই তোর বাড়ছে তবু
দিনরাত্তির কাদাঘাটা।
অরণ্য তুই কেমন করে এত বছর কামড়ে আছিস দেড় দুকাঠা?
ধুচ্ছাই,
সমুদ্দুরে চল তো যাই!
কবিতাটা, মনে আছে, লেখার পর খুব ভালো লেগেছিল। ভালো লাগার প্রধান কারণ ছিল, প্রেম বিরহের বিষয় থেকে বেরিয়ে আসা। একটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম। প্রেম কবিতার বড় একটা বিষয়, তবে একধরনের শেকলও বটে। কবিতাটা লেখার পর আনন্দের আরও একটি কারণ ছিল, ছন্দ। মাত্রাবৃত্ত আমাকে বড় আনন্দ দেয়। অক্ষরবৃত্ত যদি জীবন যাপন, স্বরবৃত্ত যদি খেলার মাঠ, মাত্রাবৃত্ত তবে প্রেম। আর, বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা? সে উতল হাওয়া। কোনও কিছু লেখার বছর দুতিন পর। এরকম খুব হয় আমার যে সেটি পদ্য হোক কী গদ্য থোক, আর ভালো লাগে না। বিষয় হয়তো ভালো, বিষয় নিয়ে সবসময় খুব বেশি আপত্তি করি না, শুধু প্রকাশ নিয়ে করি। প্রকাশ স্বচ্ছ নয়, স্পর্শ করছে না, বানের জল নেই, তুমুল তুফান নেই, আমি তাই দূরে সরাতে সরাতে যাই পুরোনো প্রাচীন যা কিছু আছে সব। নতুনের। দিকে যেতে চাই প্রতিদিন।
বেশ কয়েক বছর থেকে আমি ভাবছি, কবিতা আর ছোটখাটো নিবন্ধ প্রবন্ধ না হয় আমি লিখতে পারি নানা বিষয় নিয়ে, নিজের অভিজ্ঞতা, দর্শন, উপলব্ধি, ইত্যা দির ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু উপন্যাস কেন বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখিনা। এর কারণ, বিচিত্র বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নেই। এবার একজন বলেছিলেন, গ্রামের জীবন নিয়ে লেখো। আমি বলেছি, লিখবো কী করে, গ্রামে কোনওদিন যাইনি, থার্কিনি। গ্রাম দেখেছি মূলত ট্রেন থেকে, বা গাড়ি থেকে, আর শহরের গা ঘেঁষে যে গ্রামগুলো, সেখানে সব মিলিয়ে চারপাঁচ বার যে যাওয়া হয়েছে, তাও সামান্য ক্ষণের জন্য। খুব কাছ থেকে গ্রামের মানুষদের জীবন যাপন দেখিনি। বস্তির জীবন? সেও দেখা হয়নি। চোর, বদমাশ, ভিখিরি, নেশাখোর, শ্রমিক, রাজনীতির জগত, বিজনেস পাড়া, বেশ্যা বাড়ি, না, কিছুই কাছ থেকে দেখা হয়নি। ছোটবেলা থেকেই খুব জানতে চাইতাম জগতটাকে। খুব দেখতে চাইতাম, কিন্তু দেখতে দেওয়া হয়নি। মামারা কাকারা দাদারা কিশোর বয়স থেকেই টই টই করে শহর ঘুরতো। কত কোথাও যেত, বন্ধুর বাড়ি, এই পার্ক, ওই মাঠ, সার্কাস, ঘোড়দৌড়, বাজার, দোকানপাট, সিনেমা, থিয়েটার, বন বাদাড়, বস্তি, পুকুরপাড়, নদীর পাড়, এই মেলা, সেই মেলা — কত নানা রকম মানুষের সঙ্গেও মিশতো, কথা বলতো, বন্ধুত্ব করতো– অবাধ স্বাধীনতা ছিল ওদের, ছেলে হওয়ার স্বাধীনতা। আমাদের মেয়েদের তা ছিল না। শুধু ইস্কুল আর বাড়ি, এর বাইরে কোথাও যাওয়া বারণ ছিল। বাবার ওপর খুব রাগ হতো, যেহেতু বাড়ির বাইরেটা, জগতটা বাবা দেখতে দিত না। কিন্তু এখন আর সেই রাগটা হয় না, কারণ মেয়েদের জন্য বাইরেটা খুব খারাপ ছিল। আমিও যদি দাদারা যেভাবে ঘুরতো সেভাবে ঘুরতাম, আমাকে দুদিনেই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতো লোকেরা, অথবা ভীষণ বদনাম হতো আমার। বাবা পায়ের টেংরি ভেঙে চিরকালের জন্য হয়তো ঘরে বসিয়ে রাখতো। বাড়িতে বাবাদের মামাদের দাদাদের বন্ধুরা এলে ভেতরের ঘরে চলে যেতে হতো। মেয়েদের নাকি পুরুষলোকদের আলোচনার মধ্যে থাকতে নেই। ঘরের জীবন খুব চিনি বলে বাইরের অচেনাকে চেনার বড় ইচ্ছে ছিল। মেয়েদের ইস্কুল কলেজে পড়েছি। মেয়েদের সঙ্গেই মিশেছি। ছেলেরা বড় এক রহস্যের মতো ছিল। মেডিক্যাল কলেজে ছেলেরাও পড়েছে আমাদের সঙ্গে, কিন্তু শৈশব কৈশোরে একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেলে যা হয়, দূরত্বটা বড় হলেও বজায় থাকেই। সমাজটা যদি ছেলেদের মতো মেয়েদের ঘোরাফেশ্রাকে সহজে মেনে নিত, তাহলে মেয়েরা জগত দেখার সুযোগ থেকে এত ভয়ংকরভাবে বঞ্চিত হতো না। আর জুগত খুব খুঁটিয়ে না দেখলে জগত নিয়ে প্রবন্ধ বা পদ্য হয়তো লেখা যেতে পারে, কিন্তু উপন্যাস লেখা যায় না। উপন্যাসে বর্ণনা করতে হয় সব খুঁটিনাটি। জীবন যাপনের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সবকিছু। আমার উপন্যাসগুলোয়, আমি তাই লক্ষ করেছি বৈচিত্র্য নেই। মধ্যবিত্ত মেয়েদের ঘরের জীবন, তাদের দুঃখ সুখই আমার উপন্যাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফাঁকি দিতে পারলে বানিয়ে বানিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের, ক্ষেত খামারের, কলকারখানার, জাহাজঘাটের, অথবা অন্য কোনও বিশাল পটভূমি নিয়ে উপন্যাস লিখতে পারতাম। কিন্তু মুশকিল হলো, ওই ফাঁকিটাই আমি দিতে পারি না। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হলে শুধু উপন্যাসে নয়, অন্য লেখাতেও বৈচিত্র্য আসে। জানি কেউ কেউ বলবেন, ঘরের জীবনটা যখন জানি, ঘরের জীবনটাকেই ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলি না কেন। সে চেষ্টা আমি করি, কিন্তু দুঃখটা তো থেকে যায়। চার দেওয়ালের মধ্যে জীবনের বে শিরভাগ সময় কাটিয়ে দেওয়ার দুঃখ। একটা নারীবিদ্বেষী সমাজে জন্ম হলে মেয়েরা জীবনের কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত থাকে! ঘরের জীবনটা আমার দাদারা দেখেছে, বাইরের জীবনটাও দেখেছে। আর, আমি আর আমার বোন মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে শৈশব কৈশোর আর তারুণ্য জুড়ে শুধু ঘরের জীবনটাকেই দেখেছি। আমাদের তো অধিকার আছে সবকিছু দেখার এই পৃথিবীর! নাকি নেই?
শুধু জন্মের সময় শরীরে ছোট একটা পুরুষাঙ্গ ছিল না বলে কত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার দাদারা পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছে, দুনিয়া দেখেছে, কিন্তু লেখার ক্ষমতা নেই বলে কিছুই লিখতে পারেনি। হয়তো অন্য খাতে খাঁটিয়েছে অভিজ্ঞতা। লেখার হাত থাকলেও অভিজ্ঞতার অভাবে অনেক সময় আমি মন খারাপ করে বসে থাকি। সেদিন খুব ইচ্ছে হয়েছিল কনস্ট্রাকশান ওয়ার্কারদের নিয়ে, ট্রেড ইউনিয়নি স্টদের নিয়ে বড় একটা উপন্যাস লিখি। কিন্তু ওদের জীবন পুরুষ হয়ে বিচরণ করলে যতটা দেখা সম্ভব, মেয়ে হয়ে ততটা সম্ভব নয়। বাইরের পৃথিবীর প্রায় সবখানেই, প্রায় সবজায়গায় মেয়েরা অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত। যা কিছুই ঘটুক, পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্ম নিইনি বলে আমার কিন্তু দুঃখ হয় না, বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কারণ পুরু ষশাসিত সমাজে ওই ছোট্ট অঙ্গটা থাকা খুব ভয়ংকর, রীতিমত মাথা নষ্ট করে দেয়, নীতিবোধ বলে, বিচারবোধ বলে প্রায় কিছু থাকে না, ভাবার-চিন্তা করার শক্তি লোপ পাইয়ে দেয়, নিজেকে ঈশ্বরের মতো বড় বলে মনে হয়, মুখতা আর মূঢ়তার মুকুট পরেই বসে থাকা হয় কেবল। পুরুষ হয়ে জন্মালে আমি আর দশটা পুরুষের মতো হতাম না এ কথা নিশ্চয় করে কী করে বলবো, নাও যদি হতাম, পুরুষ জাতটা তো আমার জাত হতো, যে জাতের বেশির ভাগই অবিবেচক, কূপমণ্ডুক! হয়তো অনেকে বলবে বেশির ভাগ পুরুষই ভালো, সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, শুধু হাতে গোণা কজন পুরুষই করে না। তাই যদি হয়, বেশির ভাগ পুরুষই যদি সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, তবে সমাজে সমানাধিকারের আজও দেখা নেই কেন? কে বাধা দেয়? বেশির ভাগ পুরুষই যদি পুরুষতন্ত্র বিরোধী, তবে আজো কেন এত বহাল তবিয়তে, এত জাঁকিয়ে, সমাজ জুড়ে বৈষম্যের মূল অপশক্তি পুরুষতন্ত্র টিকে আছে?