১৯
চিন ভ্রমণ শেষ হয়ে এসেছে। এবার ইন্দোচিন যাচ্ছি। হাইফং আমার লক্ষ্য। চারদিন পথে অনেক কষ্ট সহ্য করে ইন্দোচিন সীমান্তে পৌঁছলাম। ইন্দোচিন ফরাসিদেশের অধীনে। সীমান্তে ফরাসিরা কোনও রকম বেগ দিল না। ফ্রান্সে গিয়েছি সে কথা পাসপোর্ট উল্টোপাল্টে বের করে দেখল। সিরিয়ায় থাকতে ফরাসি ভাষা জানতাম না বলে অনেক অসুবিধা ভোগ করেছিলাম। এখন ভাষা শিখেছি বলে ইন্দোচিন দেশ দেখতে উৎসাহিত বোধ করলাম।
পরে ইন্দোচিনের নাম ভিয়েতনাম হয়েছে। লাউস ও কাম্বোজ দেশ স্বাধীন ও পৃথক হয়ে গেছে।
সীমান্তরক্ষীরা আমাকে অভিবাদন জানাল ও এক গ্লাস বিয়ার খেতে দিল।
হাইফং মস্ত বড় বন্দর ও শহর। একটা চিনা হোটেলে উঠলাম। এখানে একদিন থেকে ইন্দোচিনের উত্তরে বড় শহর হ্যানয় দেখতে যাব।
দেশটা তৈরি হয়েছে তিনটি খণ্ড দেশ নিয়ে যেমন উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাউস ও কাম্বোডিয়া। কাম্বোজ দেশের লোকেরা একটু ভিন্ন রকমের দেখতে যদিও চিনা ছাপ স্পষ্ট।
ছয় শতাব্দীতে ভারতীয়রা এই দেশে রাজত্ব বিস্তার করে। তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল। অসংখ্য মন্দির, পথ, ঘাট, প্রাসাদ, দুর্গ সে দিনকার সাক্ষ্য দেয়। কাম্বোজে ওঙ্কার মন্দির দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওঙ্কার মন্দির ভারতবর্ষের বাইরে সব চেয়ে বড় হিন্দু মন্দির এবং মানুষের তৈরি যতগুলি বিরাট ও আশ্চর্য সৃষ্টি আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম। কত মন্দির প্রাসাদ, বট ও অশ্বত্থ গাছের আবেষ্টনীতে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তার ঠিক নেই। যা আছে তাই আমাদের বিস্মিত করে।
রামায়ণের চরিত্র নিয়ে যুদ্ধের দৃশ্য এখানে পাথরে খোদাই করা আছে। খুব নিখুঁত সব কাজ।
দক্ষিণ ভারতবর্ষের করমণ্ডল অঞ্চলের লোকেরা বঙ্গোপসাগর পার হয়ে বর্মায় গিয়েছিল। তারপর শ্যাম, ইন্দোচিন, দক্ষিণ চিন, কাম্বোজ ও মালয় দেশ জয় করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রসার লাভ করতে করতে সুমাত্রা ও জাভা দেশ ছেয়ে ফেলে।
ঐতিহাসিকরা বলেন, হিন্দুরা দেশ জয় করে বিজিতদের সঙ্গে সমান সমান সম্পর্ক স্থাপন করত। এমনিভাবে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরা ভালোবেসে সেই সভ্যতা গ্রহণ করে।
চিনদেশে থেকে হান সম্রাটের বাহিনী ইন্দোচিন, লাউস ও কাম্বোজ অঞ্চল জয় করে হাজার বছর পরে। তারপর ভারতবাসীদের সব চিহ্ন লোপ পেয়ে গেল। অন্যদিকে চিনারা বিজিতদের দেশের মেয়ে বিয়ে করতে লাগল এবং তার নিজস্ব কৃষ্টি বিস্তার করল। যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোকেদের ওপর চৈনিক ছাপ পড়ল।
হ্যানয় শহর থেকে দক্ষিণে চলতে শুরু করেছি। পাহাড়ি দেশ। রাস্তা খারাপ। যেখানে রবার বাগিচা আছে, ফরাসিরা তার ভেতর দিয়ে ভালো রাস্তা তৈরি করেছে। সেজন্য বড় বড় রবার গাছ জোড়া বনানীর মধ্য দিয়ে চলেছি।
একদিন বনের মধ্যে ময়াল সাপের সামনে পড়েছিলাম। সাপটা ২১ ফুট লম্বা। চামড়া দিয়ে বাক্স ও জুতো তৈরি করব ভেবে পিস্তল দিয়ে সাপটাকে মারলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে কোথা থেকে দলে দলে স্ত্রী পুরুষ সাপটার কাছে উপস্থিত হল। তারা বন্দুকের শব্দে এগিয়ে এসেছে। সবাই কিছু মাংস চায়। আমি খুশি হয়ে বললাম যত পারো মাংস নাও এবং আমাকে চামড়াটা দাও। সাপের মাথাটা এক হাত লম্বা। ওজন অন্তত পনেরো সের। সেটা সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয়। চামড়াটার ওজন প্রায় দেড় মন, সেটারও মায়া ছাড়লাম। যারা মাংস কেটেছিল তাদেরই সব দিয়ে দিলাম। সবাই খুব খুশি।
রবার বিক্রি করে ফ্রান্স বহু টাকা রোজগার করে। এদেশের উদ্বৃত্ত চাল বিদেশে রপ্তানি হয়।
ইন্দোচিন, শ্যাম, কাম্বোজ ইত্যাদি দেশগুলির এককালে পরিচয় ছিল অন্য নামে। সুমাত্রার নাম ছিল সুবর্ণ দ্বীপ।
সাইকেল চালাতে চালাতে হয়ে অর্থাৎ ‘উয়ে’ নামে পুরাকালের রাজধানীতে পৌঁছলাম। এখানে গরম খুব, অসহ্য লাগছিল। একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঠান্ডা এক গ্লাস বিয়ার খেলাম। বিকালে শহরের মধ্যে একটা মিউজিয়াম দেখে তার সামনে থামলাম। বাড়িটায় যাবার পথে দুধারে অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর প্রস্তর মূর্তি দেখলাম। আমি আগ্রহ দেখিয়ে মূর্তিগুলি পরীক্ষা করতে বসলাম।
আমাকে দেখে মিউজিয়ামের ভেতর থেকে একজন ফরাসি ভদ্রলোক বেরিয়ে আমার কাছে এলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন আমি কি ভারতবর্ষের লোক? আমি হ্যাঁ বলাতে, তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন যে যদি আমি মূর্তিগুলির পরিচয় জানি তো তাকে বুঝিয়ে দিতে।
যেগুলি স্পষ্ট বোঝা যায়, আমি সেগুলির পরিচয় দিলাম। বেশিরভাগ, রামায়ণের চরিত্র ধরে খোদাই করা। কিউরেটর নামগুলি লিখে নিলাম। তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে খাবার ও থাকবার নিমন্ত্রণ জানালেন।
অনেকদিন পরে ফরাসি রান্না খেয়ে তৃপ্ত হলাম। গৃহকর্ত্রী অ্যান ফরাসি ছাড়া অন্যভাষা জানেন না। আমার সঙ্গে সহজেই ভাব হয়ে গেল। অ্যান রুয়াঁ শহরের মেয়ে। রুয়াঁ শহর জগদ্বিখ্যাত আরেক তরুণীর পরিচয়ে— তার নাম ‘জোন অব আর্ক’। একটি ছোট গেস্টরুমে আমার শোবার বন্দোবস্ত হয়েছিল। ডিনার খেয়ে পরিষ্কার সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা বিছানায় পরিতৃপ্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন অ্যান ও তার স্বামীকে বিদায় দিয়ে রওনা হলাম। এই দেশও জনাকীর্ণ। একদিন বাজারে গেলাম। মেয়েরা সবাই খড়ের টুপি পরে। হাজার হাজার মেয়ে কেনাবেচার জন্য হাটে উপস্থিত হলে এত টুপির সমাবেশ দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
চিনারা উপত্যকার আদিবাসী লোকদের হারিয়ে দিয়ে তাদের ওপরের পাহাড়ি অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়। হাটের দিন নানা উপজাতির স্ত্রী-পুরুষ উপস্থিত হয়। এদের গলায় পুঁতির মালা দেখে বলা যায় কে কোন জাতির লোক। চাল, ডাল ও নানা রকম মশলা, দড়ি, ঝাঁপি, ঝুড়ি ইত্যাদি হাটে বিক্রি হচ্ছে। বুনো হরিণের মাংস দুজায়গায় বেচছিল। হাঁস ও মুরগি অপর্যাপ্ত এবং ভীষণ সস্তা। এক টাকায় একটা হাঁস কিংবা বড় মুরগি পাওয়া যেত। শুয়োরের মাংস ইন্দোচিনের লোকেদের খুব প্রিয়। বলা বাহুল্য সে দেশে শুয়োর সযত্নে পালন করা হয় এবং তারা ঘৃণার পাত্র নয়। কুড়িদিন পরে দক্ষিণ ইন্দোচিনের রাজধানী সায়গন শহরে পৌঁছলাম। সায়গন শহর দেখে আমি মুগ্ধ। বড় বড় চওড়া রাস্তা যেমন প্যারিসে দেখেছি আর সুন্দর সুন্দর বাড়ি দুধারে। মনে হয় আরেক প্যারিস। বাড়িগুলির বিশেষত্ব, স্থানীয় স্থাপত্য বজায় রেখে আধুনিক বাড়ি তৈরি হয়েছে। হিন্দুরাজা খেমারদের আমলে যেমন স্থাপত্য শিল্প প্রসার লাভ করেছিল ঠিক সেই রূপটি সর্বত্র বজায় রাখা আছে।
সায়গন বন্দরে বেড়াতে গিয়েছি। আমাদের দেশের একটা জাহাজ দেখে আকৃষ্ট হয়ে সেদিকে গেলাম। জাহাজটির নাম আরকট, বি আই কোম্পানি মালিক। কাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করলাম কোনও বাঙালি নাবিক জাহাজে আছে কিনা। কাপ্টেন হেসে বলল, সবাই তো বাঙালি। আরও জিজ্ঞেস করল কী চাই এবং কেন বাঙালি খুঁজছি। আমি বললাম, সে অনেক কথা, আমি বহু বছর দেশ ছাড়া। আমি কলকাতার লোক। কারও সঙ্গে বাংলা ভাষায় কতদিন কথা বলিনি তার ঠিক নেই। কাপ্টেন মহম্মদ বলে একজন একটু উচ্চপদস্থ নাবিককে ডাকল। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মহম্মদ খুশি হয়ে বলল যে দেশবাসী আরও বিশজন আছে যারা আমার সঙ্গে পরিচয় করতে চাইবে।
কাপ্টেনের হুকুম নিয়ে আমাকে জাহাজে উঠতে দিল। তারপর কুড়িজন বাঙালির মধ্যে যে বাংলা শুনলাম তা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। আমার কাছে অনেক কথা দুর্বোধ্য রয়ে গেল। তবু কিছু না শোনার চেয়ে তো ভালো। লোকেরা সব চাটগাঁয়ের মুসলমান। এই সাধাসিদে লোকগুলিকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমি আমার হোটেলে ফিরলাম।
রাত্রে শোবার আগে ভাবছিলাম যে আসল বাংলা শুনতে পেলে কী ভালো লাগবে। কতদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিনি, তার ঠিক নেই। মনে হল আমার জীবন বৃথাই কাটছে। কবিগুরুর দেওয়া চয়নিকা খুলে অনেকগুলি কবিতা পড়লাম। তৃপ্তির সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন, তার ঠিক নেই।
সায়গন শহরের ভেতর দিয়ে মেকং নদী চলে গিয়েছে। আমাদের দেশে গঙ্গা যেমন পবিত্র ও অশেষ কল্যাণের আধার, ইন্দোচিনে তেমনই মেকং। গঙ্গার মতো মেকংয়ের জলও মাটি-গোলা ঘোলাটে। অসংখ্য ছোট ছোট নৌকো ফল ফসল যাবতীয় পণ্য নিয়ে জলপথে সারাক্ষণ ফেরি করে বেড়ায়।
এই শহরের একটি বিশেষ শোভা হল নদীর ধারে সার বাঁধা গাছ— যেমন অন্য দেশের বড় বড় শহরে দেখা যায়। ফরাসিরা সায়গনকে মনের মতো করে সাজিয়েছে। এখানেও প্যারিসের মতো সর্বত্র ফুটপাথে রেস্তোরাঁ। লোকেরা পানভোজন গল্পগুজব করছে। দেখতে সুন্দর লাগে। আমি একটা রেস্তোরাঁয় বসে কফির অর্ডার দিলাম।
একদিন সকালে ওরিয়েন্টাল মিউজিয়াম দেখতে গেলাম। বিশেষ দ্রষ্টব্য হল প্রস্তরে খোদাই করা অফুরন্ত হিন্দুদের দেবীর মূর্তি। দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, যারা তাদের তৈরি করেছে তারা দক্ষিণ ভারতবর্ষের লোক। তিনদিন পরে কাম্বোজের রাজধানী নমপেন আমার লক্ষ্য। নমপেনের কাছেই জগদ্বিখ্যাত হিন্দু মন্দির আঙ্কোরভাট আছে। ইউরোপে থাকতে একটা বই পড়েছিলাম। তার নাম ফোর ফেসেস অব শিব। ১৯৩০ সালে প্যারিসে কলোনিয়াল এগজিবিশনে আঙ্কোরভাট মন্দিরের অনুকরণে গড়া মন্দির দেখার পর থেকে আমার খুব ইচ্ছা হয়েছিল কাম্বোজ দেশে গিয়ে আসল ও অতুলনীয় ওঙ্কার মন্দির দেখবার।
সাত শতাব্দীতে এই মন্দিরটি হিন্দু খেমার রাজারা তৈরি করে। আশপাশে অনেক পথ, ঘাট, দুর্গ আর মন্দির, প্রাসাদ ইত্যাদি তৈরি হয়। নয় শতাব্দীর পর এই অঞ্চলের লোকেরা কোনও অজানা কারণে লোপ পেয়ে যায়। তারপর শত শত বছর কেটে গেছে গাছপালা জঙ্গলের মধ্যে। কেউ তাদের কথা জানত না বা ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এক ফরাসি সৈনিক ওঙ্কার মন্দির ও বায়ানের দেশ আবিষ্কার করে, যেমন হঠাৎ ওই একই সময়ে এক ইংরেজ সৈনিক অজন্তা গুহার মতো সৌন্দর্যের সোনার খনি আবিষ্কার করে। ওঙ্কার মন্দির যেমন বিশাল তেমনই সুন্দর। পৃথক কোনও দেবদেবীর মূর্তি দেখলাম না। অশ্বত্থ, বট প্রভৃতি বড় বড় গাছ কী পরিমাণ শিবমন্দির, বাড়ি ও সৌধচূড়া গ্রাস করেছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সমস্ত বাড়ি শ্বেত পাথরের ছিল। কিন্তু বিরাট সব গাছ আষ্টেপৃষ্ঠে শেকড় দিয়ে বেঁধে সেসব ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। কোনও অনির্দিষ্টকারণে এই অঞ্চলের লোকেরা দেশ ছেড়ে চলে যায়— কোথায় গেল বা কেন গেল তার হদিশ কেউ জানে না। যখন এটা নতুন করে দৃষ্টিগোচর হল তখন দুর্ভেদ্য জঙ্গল সৰ্বত্ৰ জাল বিস্তার করেছে।
জঙ্গল এখনও সাফ করা যায়নি, হয়তো কখনও করা যাবে না। মন্দিরের গায়ে সর্বত্র লেখা আছে সূর্যাস্তের পর এদিকে কেউ থাকবে না। আরও লেখা আছে সাবধান, বুনোজন্তু বাঘ, ভালুক আছে, তাই একা চলাফেরা বিপজ্জনক।
ওঙ্কার মন্দির মাদুরা ও ত্রিচিনপল্লির মন্দিরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একই ধরনের গোপুরম এবং গর্ভমন্দির।
কাম্বোজের লোকেরা অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত বলে মনে হয়। কাম্বোজ দেশটা ছোট। এখানে রাজতন্ত্র এখনও বিদ্যমান, লোকেরা ভাত ও মাছ খায়। এককালে এই দেশে নাগপঞ্চমী পুজো হত।
নমপেনে দুদিন থেকে আমি থাইল্যান্ড রওনা হলাম।
খুব খারাপ রাস্তা এদিকে, দুই দেশের মধ্যে চলাচল নেই। দেড়শো মাইল পার হতে সাত দিন লেগে গেল। পুবদিক থেকে কোনও লোক থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেনি বলে সীমান্তরক্ষীরা আমাকে নিয়ে কী করবে ঠিক করতে পারছিল না। আমি কোনও রকমে বোঝালাম যে ব্যাঙ্কক শহরে যেতে চাই। তখন তারা আশ্বস্ত হয়ে ছাড়পত্র দিল। শুল্ক বিভাগের কোনও লোক ছিল না। তারা অনর্থক বড় জ্বালাতন করে। সব জিনিসের কত দাম, কোথায় কিনেছি ইত্যাদি। থাইল্যান্ডে কিছু বেচব কিনা জিজ্ঞেস করবার লোকই ছিল না।
থাইল্যান্ড দেশটা বেশ বড়। পথে যেতে যেতে রাস্তার ধারে কয়েকটি পাথরে খোদাই করা হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি দেখলাম। তাদের মধ্যে সহজেই চেনা যায় গণেশকে।
থাইল্যান্ডের ভেতরে রাস্তা অপেক্ষাকৃত ভালো। খুব সাইকেল ব্যবহার হয়।
থাইরা ভিয়েটদের মতো দক্ষিণ চিনদেশ থেকে উদ্ভূত। কয়েক হাজার বছর আগে তারা দক্ষিণে ইন্দোচিন, থাইল্যান্ড, লাউস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, আরও দক্ষিণে মালয় ও জাভা দেশে যায়। ইতিমধ্যে নানা জাতির সঙ্গে সংমিশ্রণ হয়েছে। তারা ধান চাষ করতে শিখেছিল— এমনকী পাহাড়ি জায়গায় গিয়ে জলপথ বেঁধে ধানের খেত করে নিত। তারা শুয়োর, মোষ ও মুরগি পালন করতে শিখেছিল। এর ফল হল যুগান্তকারী। যাযাবর জীবন ছেড়ে তারা এক জায়গায় বসবাস করতে আরম্ভ করল এবং এমনিভাবে সূত্রপাত হল অনেক গ্রামের
গ্রাম গড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সামাজিক নিয়মাবলী তাদের সুদৃঢ় করল। দেখা যায় থাইদের মধ্যে চারুকলার চর্চা খুব বেশি। বিত্তবান লোকেরা শিল্পকলার পরিপোষক ছিলেন। রাজা (প্রথম) রাম, যাঁর বংশধর এখানের শাসক, রাজ পরিবারে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী রামায়ণ অবলম্বনে আঠারো শতাব্দীতে রামকীয়া প্রবর্তন করেন এবং তাদের নাচ সেই রচনার অঙ্গ। রাজা রাম ছিলেন বৌদ্ধ, সেজন্য তিনি রামায়ণের দেবদেবীকে বাদ দিয়ে বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের উপযুক্ত করে রামায়ণ রচনা করেন। আজও সর্বত্র সেই নাচ আদৃত।
ওঙ্কার মন্দিরের গায়ে পাথরে খোদাই করা নৃত্যরত অপ্সরীদের দেখেছি।
ব্যাঙ্কক মস্ত বড় শহর। এতকাল ঠান্ডা ও শীতের দেশে কাটিয়েছি। ব্যাঙ্ককে এসে মনে পড়ল ভারতবর্ষের গরমের দিনগুলির কথা। দিনেরবেলা রোদের তেজ খুব রাত্রে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বলে ঘুম হয় ভালো।
থাইল্যান্ডের সর্বত্র ভালো ভালো বাড়ি, প্রাসাদ ও মন্দির দেখা যায়। সবচেয়ে বড় মন্দিরের নাম প্রভাত অরুণ। নদীর জলে নৌকোয় বসে সুন্দর দেখায়। আমেরিকান স্কাইস্ক্রেপার জন্মাবার বহু আগে এই আকাশচুম্বী মন্দির তৈরি হয়। শহরে তিনশো মন্দির আছে।
রাজপ্রাসাদ দেখে এলাম। থাইদের বিশেষ এক ধরনের স্থাপত্য আছে।
ভারতবর্ষের সঙ্গে থাইল্যান্ডের এককালে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, তা বোঝা যায় লোকেদের নাম থেকে। বেশিরভাগ নাম সংস্কৃত থেকে নেওয়া।
ডেনমার্কে থাকতে দেখেছি থাইল্যান্ডের লোকেরা ওই দেশটাকে খুব আপনার মনে করে। থাইদের নৌবহর ডেনমার্কে তৈরি হয় এবং দলে দলে থাইরা নানা বিষয় শিক্ষানবিশি করতে যায় ডেনমার্কে। এমনিভাবে দুদেশের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যেমন আমাদের ও ইংল্যান্ডের মধ্যে গত দুই শতকে এক রকম যোগ ঘটেছে, শিক্ষা-দীক্ষার ভেতর দিয়ে। তবে আমাদের সম্বন্ধের মধ্যে যেমন শোষক ও শোষিতদের সম্পর্ক ছিল, ডেনমার্ক ও থাইল্যান্ডের মধ্যে তেমন নয়। দুই দেশের সব বিষয়ে সমান অধিকার।
এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হল। এদের নাম নন্দী। দুই পুরুষ ব্যাঙ্ককে আছেন। তাঁদের ওখানে পেট ভরে যেমন খেলাম দেশি খাবার তেমনই বাংলা কথা বলে আনন্দ পেলাম।
থাইরা ভাত শাক সব্জি মাছ খায়। চিন দেশ ছাড়বার পর যেকটি দেশ দেখলাম সব জায়গার বাসিন্দারা ভাত খায়। থাইদের ওপর অনেক অংশে চৈনিক ছাপ পড়েছে। উত্তরে বিরাট চিন দেশকে সবাই ভয়ের চোখে দেখে। থাইরা চিনাদের থেকে ভিন্ন, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অনেকরকম ফল যেমন আম, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, কলা থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়।
থাই জাতের লোকেরা, বিশেষ করে মেয়েরা খুব বেঁটে। আধুনিকা হবার ইচ্ছায় তারা হাইহিল জুতো ও ফ্রক পরে ঘুরে বেড়ায়
থাইরা আসলে শান্তিকামী যদিও সৈন্যাধ্যক্ষের নাম বিপুল সংগ্রাম।
দুই শতাব্দীতে থাইদের কয়েকটি দল মিলে নান চাও রাজ্য স্থাপন করেছিল দক্ষিণ চিন দেশে। তারা রাজ্য বিস্তার করতে করতে ইন্দোচিন লাউস কাম্বোডিয়া পর্যন্ত দখল করেছিল। ভিয়েতরাও দক্ষিণ চিন থেকে এসে ইন্দোচিন, লাউস কাম্বোডিয়াতে বসবাস করতে লাগল। তখন থাইরা আরও পশ্চিমে সরে গিয়ে শ্যামদেশ গড়ে তুলল। থাই মানে স্বাধীন। শ্যামদেশের বা থাইল্যান্ডের লোকেরা কখনও বিজিত হয়নি। এই সময়ের পর থেকে ভারতীয় নৌবহর বে অব বেঙ্গল পার হয়ে বর্মা ও মালয় দেশে উপস্থিত হল।
তারপর সিঙ্গাপুর ঘুরে সুমাত্রা, জাভা ও বালি দ্বীপে যায়। একদল ভারতীয় উত্তরে দেশ জয় করতে করতে মালয়, কাম্বোজ, লাউস, ভিয়েতনাম এখন যেখানে অবস্থিত এই সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক স্থানীয় শাসক ও দলপতির কন্যাকে বিবাহ করে এবং তাদের মাধ্যমে ধর্ম ও দেশাচার প্রচার করে।
পরিব্রাজক মার্কো পোলো তের শতাব্দীতে সুমাত্রায় উপস্থিত হয়ে বিজয় রাজ্যের ঐশ্বর্য দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন। তিনি তবু জানতেন না যে বিজয় রাজ্য তখন বিনষ্টের পথে। ছোট ছোট খণ্ড রাজ্য গড়ে উঠেছিল সারা দেশে।
থাইল্যান্ডে পাশ্চাত্যদেশের আধুনিক হাওয়া জোরে বইলেও থাইরা মনেপ্রাণে স্বদেশপ্রেমিক। বৌদ্ধধর্ম থাইদের সদাসর্বদা নিত্য-অনিত্যের মূল্যের প্রভেদ স্মরণ করিয়ে দেয়।
এক ছাত্র সম্মেলনে আমি অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানে এক বৌদ্ধ ভারতীয় ভিক্ষুকের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁর নাম স্বামী সত্যানন্দ।
পরদিন স্বামী সত্যানন্দর বাড়ি গেলাম। বাড়ি মানে একটা বড় ঘর। আসবাবপত্র কিছু নেই। ঘরের একপাশে একটা কঠিন কম্বলের বিছানা। এক জায়গায় জলের কলসি বিড়ের ওপর বসানো। আমি যাবার পর একটি দশ বারো বছরের মেয়ে দুটো গ্লাস ও এক কেটলি চা নিয়ে উপস্থিত হল।
ব্যাঙ্ককের ভারতীয়রা মনে করেন স্বামী সত্যানন্দ এক অদ্ভুত জ্ঞানী লোক, লেখাপড়া নিয়েই থাকেন। তিনি থাই ভাষায় বিশেষভাবে পাণ্ডিত্য লাভ করেছেন। বেদ পুরাণ উপনিষদ থাইভাষায় তর্জমা করেছেন এবং তার জন্য সম্মানিতও হয়েছেন। বয়স ৪৫-৪৬ হবে।
শুনেছি প্রথম যৌবনে তিনি কলকাতায় বিপ্লববাদী ছিলেন। পুলিশ যখন নিপীড়ন আরম্ভ করল, তখন সত্যানন্দ রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নেন। কবিগুরু গভর্নমেন্ট অনুমতি নিয়ে দেশপ্রেমিককে থাইল্যান্ডে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।
থাইল্যান্ড ছেড়ে দক্ষিণে মালয় দেশের দিকে রওনা হলাম। মালয় দেশের উত্তরাংশের অনেকখানি থাইল্যান্ডের অধীন। যত দক্ষিণে চলেছি ততই মনে হয়েছে দেশটা যেন ভূস্বর্গ। চারদিকে সবুজের সমারোহ। সারি সারি ধানখেতের শ্যামশ্রী সুদূর প্রসারিত। দিনের মধ্যে প্রায়ই এক পশলা বা তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি সমস্ত দেশটাকে ধুয়ে মুছে দেয়। প্রখর রৌদ্রের তাপ ও বৃষ্টি মিলে এই অঞ্চলটা সব সময় সজীব করে রাখে।
চারদিন কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে চলে থাইল্যান্ডের দক্ষিণ সীমান্তে পৌঁছলাম।
মালয় দেশ ইংরেজের অধীন। লোকেরা বেশিরভাগ মুসলমান কিন্তু উগ্র মুসলমান নয়। মালয় ছাড়া চিনা ও ভারতীয়রা প্রায় সমান সংখ্যায় এই দেশে বাস করে। এই তিন জাতির সমষ্টি নিয়ে আধুনিক মালয়।
অনেকগুলি ছোট ছোট রাজ্য আছে একেক সুলতানের অধীনে। পাম তেল, টিন, রবার ও কোপ্রা (নারকোলের ছোবড়া) প্রচুর রপ্তানি হয়। চাল জন্মায় নিয়মিত। ভারতবর্ষের মতো আকাশের মুখাপেক্ষী হতে হয় না, ধান লাগাবার জন্য বৃষ্টি নিয়মিতভাবে রোজই হয়।
লোকেদের আর্থিক অবস্থা ভারতবাসীদের চেয়ে উন্নত মনে হল।
মালয়ে এসে পর্যন্ত আমার খুব অসুবিধা হচ্ছিল, খাবারে ভীষণ লঙ্কার ঝাল। ডেনমার্কে থাকতে গ্যাস্ট্রিক আলসারের ব্যথা টের পেয়েছিলাম। অনেককাল পরে মনে পড়ল যে জীবন্ত বাড়িতে ফিরতে হলে খাওয়াদাওয়া খুব সাবধানে করতে হবে। ভাত, মাছসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ ও দই আমার নিত্যনৈমিত্তিক খাবার হয়ে দাঁড়াল।
মালয় দেশে রাস্তা অপেক্ষাকৃত ভালো, মোটামুটি পাকা। রবারের বড় বড় গাছ মাথা উঁচু করে পথের দুধারে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায়ই ময়াল সাপ ও অন্যান্য সাপ ও জন্তু দেখেছি। দুইদিন পর পেনাং বন্দরে পৌঁছলাম। পেনাং বড় শহর। অফুরন্ত কাঁচামাল রপ্তানি হয় এখান থেকে। অনেক ঘর বাঙালি থাকেন এই শহরে। আমার সঙ্গে কারও দেখা হয়নি। বেশিরভাগ লোক রবারের কারবারে প্রচুর পয়সা করেছেন। বাঙালি উকিল ও ব্যারিস্টারের সুনাম আছে। মালয় দেশে কোনও শিল্পের অস্তিত্ব আছে কিনা জানতে পারিনি।
পেনাং শহরে দ্রষ্টব্য হচ্ছে নাগমন্দির। একটা পাহাড়ের ওপর ওই মন্দির। সাপ যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক বিষধর সাপও দেখলাম। তারা আপনমনে থাকে, মানুষ দেখলেই তেড়ে কামড়াতে আসে না। কারও সঙ্গে কারও বিরোধ নেই।
পেনাং ছেড়ে কুয়ালালামপুর শহরের দিকে রওনা হলাম।
সুলতানদের মধ্যে যিনি সর্বপ্রধান তিনি কুয়ালালামপুর শহরে থাকেন। কুয়ালালামপুর শহরের বিশেষত্ব আছে। একদিকে জঙ্গল, অন্যদিকে গম্বুজওয়ালা বাড়ি ও আধুনিক বড় শহর। অনেক ইংরেজকে পথে দেখলাম। ভারতবর্ষে পরিচিত নামের অনেক বিলাতি কোম্পানির অফিসও রয়েছে। বিলাতি মালপত্র কাপড়- চোপড়ে সব দোকান ভর্তি।
এই অঞ্চলের নাম বাহারু। খুব সুন্দর দেশ কিন্তু এত গরম যে ঘেমে নেয়ে যেতাম। কাঠের বাড়িতে বড় বড় ঘর ও বারান্দা চিক দিয়ে সাজানো। জোহোর বাহারুর ভেতর দিয়ে তিনদিন পরে সিঙ্গাপুরে পৌঁছলাম। সিঙ্গাপুর মস্ত শহর, একটা দ্বীপের ওপর, তায় আবার বিরাট বন্দরও। সিঙ্গাপুর ইংরেজের খাস দখলের জায়গা। তার সবচেয়ে বড় এক নৌবাহিনীর ঘাঁটি এখানে। ঐশ্বর্যশালী ইংরেজ সমস্ত ধনরত্ন দিয়ে যুদ্ধ-জাহাজ তৈরি করেছে। এই কারণে ইংরেজের নৌবাহিনী পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
ব্রিটিশ সেলাস ক্লাবে আমি নিমন্ত্রিত হয়ে উঠলাম। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেশটা কিন্তু কী ভীষণ গরম। রাস্তায় যেখানে সেখানে ভারতীয় স্ত্রী-পুরুষ দেখলাম। মনে হচ্ছে মাদ্রাজ কিংবা কলকাতায় এসেছি। হাজার হাজার ভারতীয় মালয় দেশে এসেছিল রবারের আবাদে কাজ করবার জন্য। অনেকে টিনের খনিতেও কাজ করে। তারপর কয়েক যুগ কেটে গেছে। শ্রমিক সম্প্রদায় অনেক বড় হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা এই দেশেই মানুষ হচ্ছে। এখন ভারতীয়রা তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি মালয় দেশে। চিনারা প্রথম, তারপর মালয়ী।
অন্ধ্র দেশের চেট্টিয়াররা মালয় দেশে ও শ্যামদেশে গরিব চাষীদের বীজ কিনতে টাকা ধার দেয় উচ্চ হারে। ফসলের একাদশ ভাগ দিয়ে তা শোধ হয়, তেজারতি কারবার যাকে বলে। অন্য অনেক ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি রবার ব্যবসায়ে লাভবান হয়েছেন। কিছু লোক ওকালতি ও ব্যারিস্টারি করেন। দশদিন পরে এখানে আমার ফটোগ্রাফের প্রদর্শনী হবে। ছবিগুলি হংকং থেকে জাহাজে এসেছে টমাস কুকের অফিসে। আমি প্রথমেই গেলাম তাদের সন্ধানে। মিঃ হ্যারিসন হচ্ছেন পি এন্ড ওর ম্যানেজার। শনিবার একটার পর তিনি একটা ক্লাবে সাঁতার কাটতে যান। ক্লাবটি শহরের বাইরে। আমি গেলাম ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে ছবিগুলির খোঁজখবর নেওয়ার জন্য।
অনেক কাল পরে সাদা কালোর পার্থক্য টের পেলাম। বহু বছর অন্য দেশের লোকেদের কাছে এত ভালো ব্যবহার পেয়েছি যে সব সময় মনে হত আমি যেন তাদেরই একজন। ব্যতিক্রম ঘটল সিঙ্গাপুরে। ক্লাবের গেটে নেপালি দরোয়ান আমার পথ আটকে দাঁড়াল এবং আমাকে জানাল যে ভেতরে আমার প্রবেশ বারণ। হিন্দিতে বলল যে সেটা সাহেবদের অর্থাৎ সাদা চামড়ার লোকেদের জন্য –
গেট থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দিল। কিন্তু আমি এত অপমানিত বোধ করেছি যে কথা না বলে চলে এলাম।
সোমবার হ্যারিসনের সাহায্য না নিয়ে সব ছবি উদ্ধার করলাম এবং প্রদর্শনীর কাজে লেগে গেলাম, একটি গুজরাটি ফটোগ্রাফার যুবক আমাকে সাহায্য করল, ভালো আলোর ব্যবস্থাও করল। তার নাম প্যাটেল। সে কাগজে প্রদর্শনীর কথা জানাল। আনন্দের কথা যে প্রদর্শনীর প্রচার যথেষ্ট হল কিন্তু এক পয়সা সেজন্য আমাকে দিতে হয়নি।
যথাসময়ে প্রদর্শনীতে লোকের সমাগম হল। ইউরোপিয়ানরা বা ইংরেজরা বোধহয় সবাই এসেছিল। প্যাটেল আমার কাছে শুনেছিল হ্যারিসনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা। প্যাটেল সবাইকে চিনত। সে হঠাৎ হ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হল। আমি কী আর করি ‘হাউ ডু ইউ ডু’ করা ছাড়া। খুব খুশি হয়ে সে প্রদর্শনীর ছবি দেখেছে বলে আমাকে জানাল। ব্রিটিশ সেলার্স ক্লাবে আমি আছি জেনে সে একটু আশ্চর্য হল। আমাকে ডিনারে নেমন্তন্নও করল। আমিও জিদ ধরলাম, যাব না। ব্যস্ত আছি, একদিনও সময় হবে না ইত্যাদি বলে কাটিয়ে দিলাম। হ্যারিসন হয়তো ভাবল আমি কীরকম দুর্বিনীত লোক। নিমন্ত্রণ নিতে আমি অনিচ্ছুক সে কথা স্পষ্ট বুঝতে পারল।
সিঙ্গাপুরে আসার পর থেকে খুব ইচ্ছা করছিল একটা জাহাজ নিয়ে কলকাতায় বা কলম্বোতে যেতে। দীর্ঘ এগারো বছর বিদেশে, বিদেশে কাটিয়েছি। এবার বাড়িমুখো হব। ঘরের স্মৃতি, মা, বাবা, ভাই, বোন, বন্ধুদের কথা ভেবে সারাদিন মশগুল হয়ে কাটালাম। দুঃখও হল মনে করে যে আমি আগের চেয়ে অনেক বুড়ো হয়েছি। সাইকেল প্রতিযোগিতায় আর নামতে পারব না, পিঠের ওপর ও সাইকেলে ভারি মাল বয়ে বয়ে আমি নিজেই ভারি হয়ে গিয়েছি। প্রতিযোগিতায় সূক্ষ্ম তৎপরতা আমার আর নেই।
প্রদর্শনী শেষ হবার পর ছবি জাহাজে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলাম। কলকাতায় আমার ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে।
সিঙ্গাপুরে থেকে জাহাজ নিয়ে সুমাত্রায় গেলাম। মালাক্কা সে কালের বিখ্যাত পুরনো বন্দর। হিন্দু রাজারা এক কালে এই দেশে রাজত্ব করেছে। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি আজও যেখানে সেখানে দেখা যায়।
সুমাত্রায় এসে বুঝলাম যে সাইকেলে পরিভ্রমণ করবার দেশ নয়। ভীষণ জঙ্গল এবং রাস্তার একান্ত অভাব, সব রকম বন্যজন্তু, যেমন বাঘ ভালুক হাতি ইত্যাদি যথেষ্ট। সুন্দর সুন্দর পাখিও দেখলাম।
সাতদিন ঘোরাঘুরির পর একটা জাহাজ ধরলাম। জাভার রাজধানী বাটেভিয়া যাবার জন্য। আজকের নাম জাকার্তা। জাভার নামও বদলে ইন্দোনেশিয়া হয়ে গিয়েছে।
পৃথিবীতে যত সুন্দর দেশ আছে জাভা তাদের মধ্যে অন্যতম। আগেকার দিনে লোকে জাভা যেত সুগন্ধী মশলা জোগাড় করবার জন্য। সেই মশলা সুদূর দেশে, ইউরোপেও স্থলপথে যেত। মিশরি, গ্রিকরা, রোমানরা ব্যবহার করত এই মশলা। আজও যেমন গৃহকর্ত্রীরা করে থাকেন। ভারতবর্ষে চিরদিনই জাভা সুমাত্রা থেকে মশলা আমদানি করা হয়।
জাভাতে জন্মায় না এমন জিনিস খুব কম। পাট থেকে চা পর্যন্ত যথেষ্ট হয়। জাভার জমি খুবই উর্বর— অনেক আগ্নেয়গিরি থাকার জন্য। চাল উৎপন্ন হয় যথেষ্ট পরিমাণ। জাভাবাসীরা ভাত খায় এবং তার সঙ্গে মাছ ও শাক দিয়ে উদর পূর্তি করে। লোকেরা পরিশ্রমী। যে দিকে চাই, যেখানে যাই, সব জায়গায় লোকে লোকারণ্য, একটা ছোট দ্বীপের পক্ষে জনসংখ্যা খুব বেশি মনে হয়।
গ্রামের লোকেরা দলে দলে শহরের দিকে ছুটছে চাকরির সন্ধানে। কুলির কাজ করে, কারখানায় চাকরি করে। সাইকেল-রিকশা, পেডিক্যাব চালানো সোজা। পেডিক্যাব নিয়ে সারাদিন যাত্রীর পিছনে ছোটে।
আমাদের দেশে হাত-রিকশাওয়ালাদের মতো একই অবস্থা, সারাদিন পরিশ্রম করে দু-চার টাকা রোজগার হয়। রাস্তার ধারে কোনও দোকানে খায় এবং ফুটপাথের ওপর রাত কাটায়।
জাভা ডাচ কর্তৃত্বাধীনে। ডাচরা চিনির কারখানা বসিয়েছে। তাঁতশিল্প জোর চলে। পাহাড়ি জায়গায় চা জন্মায় এবং বিদেশে রপ্তানি হয়। জাভার কফি বিখ্যাত।
সন্ধ্যাবেলায় একটা কনসার্ট শুনতে গেলাম। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে দেখলাম অনেক গং বা কাঁসর বাজিয়ে একসঙ্গে সুন্দর সুরসৃষ্টি করছিল। মোটা চাদরের কাঁসরের গুরুগম্ভীর শব্দ রণিয়ে রণিয়ে বাজে, শোনবার মতো।
পরদিন সন্ধ্যায় রামায়ণ থেকে জটায়ু বধের পালা দেখতে গেলাম।
নয় শতাব্দীর পর আটশো বছর জাভা দ্বীপে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম পাশাপাশি সহাবস্থান করেছে। তারপর বাংলাদেশ ও গুজরাট থেকে এল ইসলামের প্রবল বন্যা, সমস্ত দেশবাসী মুসলমান হল কিন্তু অন্য ধর্মকে পরিত্যাগ করল না। তাই আজও রামায়ণ মহাভারত জাভাবাসীদের অশেষ আনন্দ দেয়। জাভার লোকেরা মুসলমান বটে কিন্তু আরব দেশের কুলীনদের কাছে তারা কলকে পাবে না।
মালয় দেশ থেকে জাভা দ্বীপে লোকেরা গিয়েছিল। কিছু সংখ্যক চিনা এই দেশে বসবাস আরম্ভ করেছে। তাদের সঙ্গে সংমিশ্রণও হয়েছে। যখনই চিন মহাদেশে যুদ্ধ অরাজকতা বা নিপীড়ন হয়েছে, দলে দলে লোকে দক্ষিণে ইন্দোচিন, মালয়, সিঙ্গাপুর ও সুমাত্রা এবং জাভা দ্বীপের দিকে ছুটেছে।
ডাচরা কঠিন হস্তে জাভায় রাজত্ব চালায়। মুক্তিকামী যুবকরা দক্ষিণ-মধ্য জাভায় আন্দোলন চালাচ্ছে স্বাধীনতার জন্য। দরকার হলে ধরা পড়া এড়ায় পুবদিকের পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে।
বাটেভিয়া শহরে বড় বড় বাড়ি, বড় বড় জাহাজ দেখে মনে হল, এই দ্বীপের লোকেরা অবস্থাপন্ন। আসলে সেসব ডাচ ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি। সাধারণ লোকেরা পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরে বাস করে। বেশিরভাগ বাড়ির মেঝে মাটি লেপা
জাভার বাটিক শিল্প জগদ্বিখ্যাত। কত অদ্ভুত চিত্র বিচিত্র এঁকে তবে বাটিক তৈরি হয়। রং খুব পাকা এবং অনেক লোক এই শিল্প আয়ত্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথ জাভায় বাটিক তৈরি দেখে খুব উৎসাহ করে সেটি শান্তিনিকেতনে প্রবর্তন করেন। এখন ভারতবর্ষের সর্বত্র বাটিক চর্চা করা হয়। জাভায় বাটিকের লুঙ্গি স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই ব্যবহার করে, যদিও যুবকদের মধ্যে পাৎলুন ব্যবহার করবার চেষ্টা চলছে।
সাতদিন বাটেভিয়ায় কাটল। প্রায় রোজই বৃষ্টি হয়। বিষুবরেখার কাছে বলে দেশটা খুব গরম। বৃষ্টির পর মনে হয় চারদিকে বাষ্প বেরোচ্ছে। এই কারণে জাভায় গাছপালা, বড় বড় জঙ্গল দেখা যায়। চারদিকে অপূর্ব শ্যাম সমারোহ।
বেশ কয়েকটি ভারতীয় পরিবার বাটেভিয়াতে বসবাস করে। তারা এক সন্ধ্যায় আমাকে ডাকল ভ্রমণকাহিনী শোনাবার জন্য। তারপর খুব উৎসাহ করে আমাকে ভারতীয় খানা খেতে আমন্ত্রণ জানাল। দুঃখের বিষয় খাবারে এত বেশি পরিমাণ লঙ্কা ব্যবহার করতে এ দেশের লোক অভ্যস্ত যে আমার খুবই কষ্ট হল। অনেক কষ্টে গ্যাস্ট্রিক আলসার সারিয়েছি। মনে হচ্ছে সেটা আবার ফিরে আসবে যদি এখনই সাবধান না হই।
বাটেভিয়া ছেড়ে রওনা হলাম বসরের দিকে। রাস্তা মোটামুটি মন্দ নয়। একরাত্রি বসরে থেকে দক্ষিণে বানডুঙের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। তিন দিন পর বানডুঙ পৌঁছলাম। এই শহরটি মধ্য জাভার পুরনো রাজধানী। এখনও প্রাসাদ, দুর্গ ও মন্দির দেখা যায়।
আমার গন্তব্যস্থান আরও উত্তর-পূর্বে প্রম্বানন ও পরে বরোবুদুর অভিমুখে। বানডুঙ ছাড়বার পর রাস্তা ক্রমশই খারাপ হতে লাগল। অতিকষ্টে সাইকেল চালাচ্ছি, খোঁচা খোঁচা পাথরের মধ্যে টায়ার বারবার জখম হল। আমি সারিয়ে দুয়েক মাইল যাবার পর আবার সারাতে বসতাম। টায়ারের কোনও অপরাধ নেই। আমার ঘাড়ের ওপর প্রকাণ্ড বোঝা, তার ওপর সাইকেলে বিরাট বোঝা নিয়ে খারাপ রাস্তায় পাথর এড়াতে না পারার জন্য বারবার এই দুর্দশা।
প্রম্বানন মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। মন্দিরটি বেশ উঁচু। দেখলেই বোঝা যায় হিন্দুদের তৈরি মন্দির। ১৫৪ ফুট উঁচু। হিন্দুরা ১,২০০ বছর জাভাতে রাজত্ব করে। মন্দির তৈরি হয় দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি। এই মন্দির ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর বা শিবের নামে উৎসর্গীকৃত। আমি দক্ষিণ ভারতে বেলুড়ে ও হ্যালেবিদে যেমন মন্দির দেখেছি ঠিক সেই রকম পাথরের তৈরি।
আরও পঞ্চাশ মাইল দূরে বৌদ্ধ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারুকীর্তি বরোবুদুর। মাঝখানের বৌদ্ধবিহারটি ১০৩ ফুট, চারপাশে অসংখ্য স্তূপ দিয়ে ঘেরা। ক্রমশই মাঝের দিকে পিরামিডের মতো উঠে গেছে। লোকেরা বলে সবচেয়ে উঁচু বিহারে বুদ্ধমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে যদি মূর্তিকে ছোঁয়া যায় তা হলে সৌভাগ্য আসে।
বরোবুদুর তৈরি হয়েছিল বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি এবং তিরোধানকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীসুদ্ধ বৌদ্ধ-ধর্মনেতাগণ মনে করেন যে বরোবুদুরে একবার যাওয়ার ফলে অনেক পুণ্য সঞ্চয় হয়। তারা দলে দলে সারা বছর এই পুণ্যতীর্থে যান। কাছেই যোগজাকর্তা শহরটি। বরোবুদুরের সঙ্গে প্রায় সমান বয়স। বরোবুদুর নির্মিত হয় নবম শতাব্দীতে।
এই অঞ্চলে রবারের চাষ হয় খুব। বড় বড় রবার গাছের জঙ্গল। তাছাড়া পাহাড় রাস্তা আট দশ হাজার ফুট উঠেছে নেমেছে। আমার মুশকিল হল এই কথা ভেবে যে কেমন করে দুরূহ পথের শেষে পৌঁছব। যোগজাকর্তা ছেড়ে সমুদ্রের দিকে চললাম। একটা ছোট বন্দরে পৌঁছলাম, সেখান থেকে অনেক মাছ ধরার বড় নৌকো বালি দ্বীপের কাছে যায় মাছ ধরতে। আমি একটায় উঠে পড়লাম। দুদিন তিন রাত পার হবার পর সেলাট বালি অর্থাৎ দুটি দ্বীপের মাঝখানে যে জলপথ আছে সেখানে পৌঁছলাম।
সকালবেলায় বালিদ্বীপে নামলাম। লোকেরা দেখলাম খুব অতিথিপরায়ণ। একটা চালা ঘরওয়ালা বাড়িতে উঠলাম। বাড়ির মালিক পর্যটকদের নিয়ে দ্বীপময় ঘুরে বেড়ান। ডাচ ভাষা ছাড়া একটু আধটু ইংরিজি ও ফরাসি বলতে পারেন। প্রথম জীবনে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এমন লোকের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা। নামও ভাগ্যবান। জাতিতে হিন্দু। জাভার অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জের মাঝখানে বালি কেমন করে তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। সমস্ত দ্বীপের অধিবাসীরা মুসলমান কিন্তু বালিদ্বীপের বাসিন্দারা হিন্দু। এখনও এখানে দেবদেবীর পূজা, স্ত্রীআচার ইত্যাদি পুরোদমে চলে। আজও দলে দলে পূজারিণী মেয়েরা থালায় ফল ফুল খাবার সাজিয়ে দেবতাকে দেখায় এবং তারপর খাবার বাড়ি নিয়ে যায় খাবার জন্য।
পরদিন ভাগ্যবান আমাকে একটি শিবমন্দিরে নিয়ে গেল। মেয়েরা দুদল মিলে সার করে, হাতে পূজার থালা নিয়ে চলেছে, চলার মধ্যে যেন ছন্দ বাজছে। এমন সুন্দর নিয়মবদ্ধভাবে সবাই চলেছে দেখলে চোখ জুড়োয়। আমাদের দেশের মন্দিরের কথা মনে পড়ল। সবাই ঠেলাঠেলি, মারামারি করে আগে যাবার জন্য। তার ব্যতিক্রম দেখে খুব ভালো লাগল।
বালিদ্বীপের আরেকটি বিশেষত্ব আছে। মেয়েরা যুবতী বা বৃদ্ধা কেউই উত্তমাঙ্গে কোনও আবরণ রাখে না। তারা নিঃসঙ্কোচে নিরাবরণ দেহে সব কাজ করে বেড়ায় ভারতবর্ষের কত ছবি কিংবা ভাস্কর্য দেখেছি পুরনো কালের রাম সীতা অথবা শকুন্তলা— সেখানে অনাবৃতা মেয়ে দেখেছি। তবে সেটা কাল্পনিক, এটা বাস্তব। প্যাসিফিকের অন্যান্য দ্বীপেও মেয়েরা ওপরের দিকে কিছু পরে না।
একটা জংলী জায়গায় দেখলাম পাথরে খোদাই করা সারবন্দী গণেশের মূর্তি মেয়েরা তাদের ফুল দিয়ে পুজো করে। বেশিরভাগই শিবমন্দির। মাঝে মাঝে ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণুর মন্দির আছে।
ভাগ্যবানের সঙ্গে একটা বাজার দেখতে গেলাম। চাল, ডাল, লঙ্কা ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। পেঁপে পাকা তো খায়ই, কাঁচাও রান্না করে খায়। পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা কর্মঠ। তারা নানা রঙের সারং পরে। তাদের রং বেশ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ এবং সুন্দর স্ত্রীসুলভ শ্রীসম্পন্ন চেহারা
তিনদিন বালিদ্বীপে থাকার পর একটা ছোট স্টিমার ধরলাম সুরাবায়া বন্দর যাবার জন্য। ভাগ্যবানই সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। সে যখন শুনেছিল যে আমি একজন হিন্দু, তারপর থেকে আমার প্রতি তার ব্যবহার খুব শ্রদ্ধাপূর্ণ হয়ে গেল। তার স্ত্রীর কাছে আমার যা পরিচয় দিল তা শোনবার মতো। আমি যেন দেবাদিদেব ইন্দ্রের রাজসভার একজন অনুচর, কোথায় বসতে দেবে, কী খেতে দেবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। দুজনের খুব ইচ্ছা পুরীর মন্দির দেখতে ভারতবর্ষে আসার। গৃহিণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের কপালে কি আর তা হবে!
বলা বাহুল্য ভাগ্যবান আমার কাছে একটা পয়সা নেয়নি।
জাভার পুবদিকে সব চেয়ে বড় বন্দর হল সুরাবায়া।
স্টিমার ছেড়ে এখানে একটি জাহাজ ধরলাম সিঙ্গাপুরের জন্য। ওরিয়েন্ট লাইনের জাহাজে একটা বার্থ পেলাম। বেশিরভাগ যাত্রী অস্ট্রেলিয়াবাসী, কাজকর্ম বা চাকরি করে তারা পয়সা করেছে এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। মনে হল যাত্রীরা লেখাপড়ার বিশেষ ধার পাশ দিয়ে যায়নি। লোকেরা ভালো এবং আমাকে সাইকেল নিয়ে জাহাজে উঠতে দেখে, সবার খুব উৎসাহ দেখলাম আমাকে জানবার ও চেনবার। তাদের সবার মুখে এক কথা, পৃথিবী ভ্রমণ থেকে আমি কেন অস্ট্রেলিয়া বাদ দিলাম। সেই দেশ খুব সুন্দর এবং সেখানে টাকা রোজগার করা যায় সহজে। আমার উত্তর ছিল একটি। অন্যান্য দেশে যা দেখেছি অস্ট্রেলিয়া সেই পশ্চিমি ছাঁচেই তৈরি। নতুন কিছু দেখবার নেই, জানবার নেই বা শেখবার নেই।
তখনকার দিনে অস্ট্রেলিয়াতে আমার যে প্রবেশ নিষেধ, সে কথা আর উল্লেখ করিনি। কালা আদমিকে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস বা চাকরি করতে দেওয়া হয় না। একদিন এই মনোভাবের যখন পরিবর্তন হবে তখন হয়তো অস্ট্রেলিয়ায়, বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডে বেড়াতে যাবার ইচ্ছা রইল।
আমার ভাই, নির্মল মুখার্জি বিখ্যাত হকি খেলোয়াড়, ধ্যানচাঁদের দলের সঙ্গে প্রথম ভারতীয় দলে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল। তার চিঠিতে পড়েছি যে দুই দেশের লোকেরা বিপুল সংবর্ধনা জানায় ভারতীয় দলকে। ভারতবর্ষ তখন হকি খেলার জগতে রাজা, সর্বত্র তার জয়।