দুগাপুর হল্ট
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল সুবিমল ঘােষ। মেঝে থেকে চেয়ারের বসবার জায়গা অব্দি থাকে থাকে সাজানাে। সারা ঘর জুড়ে। এমনকি টেবিলের নীচে পা রাখবার জায়গাও নেই। সেখানেও। নােটের বান্ডিল। সব একশাে টাকার নােট।
বিশ বছরের চাকরি হলেও সুবিমল বেরিয়ে আসছিল। কেননা চেয়ার খালি। দরজা খােলা রেখে এভাবে কেউ এতগুলাে টাকা রেখে বেরােয় ? আজই অবশ্য ভ্যানে করে এ টাকা ব্যাংকে চলে যাবে। যেমন যায় রােজ। কাল রাত অব্দি বিক্রির টাকা।
দাঁড়ান।
দাঁড়াতে হল। অথচ চোখ মেলে তাকানাে যায় না। খালি গা। পরনে শুধু আন্ডারঅয়ার। ঘরের লাগােয়া টয়লেট থেকে ষাট বছরের একটি মােটাসােটা বালক যেন বেরিয়ে এসেছে এইমাত্র। ভিজে পা। ভিজে হাত। খালি পা। দেওয়ালে ধুতি-পাঞ্জাবি ঝুলছে। তাদের নীচেই পায়ের অপেক্ষায় চওড়া একজোড়া পাম্পসু।
যাচ্ছেন কেন? বসেন।
দরজা থেকে ভেতরে ঢুকে সুবিমল কোনােমতে একটা চেয়ারে বসল। তাকে পা রাখতে হল বােধহয় নােটের বান্ডিলে। ঘরের কোণে যে লাগােয়া টয়লেট আছে—তা জানা ছিল না তার।
ভুলে দরজা খােলা রেখেই বাথরুমে গিয়েছিলেন—
না। খােলা রেখেই যাই। কে নেবে? নিলে গেটেই তাে ধরা পড়বে বেরােনাের সময়। বিশ বছর আমি এ অফিসের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট। দেবেন সেন সবাইকে চেনে।
সুবিমল দেবেন সেনের গােল মুখখানায় তাকাল। মাথায় চুল নেই। চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানাে না। চোখে চশমা। চুলে ঢাকা চওড়া বুক। কিন্তু পরনে শুধু আন্ডারঅয়ার।
সেই অবস্থাতেই চেয়ারে বসে দেবেন সেন তার বিখ্যাত একসারসাইজ বুকখানা বের করল, কী ? আবার চাই? তাই না!
ওই দু নম্বর একসারসাইজ খাতাখানায় অফিসের প্রায় সবারই নাম দেবেন সেন সবুজ কালিতে লিখে রেখেছে। মাইনের দিন এই খাতা দেখে দেখে দেবেন সেন কিস্তিতে টাকা কেটে রাখে। মুখে মুখে এমন ধার নেবার ব্যবস্থা আর কোথাও আছে বলে সুবিমল ঘােষের জানা নেই। আর এ ধারের কোনাে সুদ নেই। দেবেন সেন খুব মন দিয়ে জিরজিরে খাতাখানায় সুবিমলের নামের জায়গাটা খুঁজছিল। ঝুঁকে পড়া গােল টাক। টেবিলের নীচেই লােমে ঢাকা দুই পায়ের উদোম থােড়া। ভাগ্যিস চোখে দেখতে হচ্ছে না। শুধু এই জন্যেই দেবেন সেনের কাছে সুবিমল মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল। তা ছাড়া এই সময়টায়—বিশেষ করে ধার করতে এসে, সুবিমল জানে—তার মুখে বিস্ময় আর ভক্তির মিশ্র ছায়া পড়ে। যেন সে পিরামিডের সামনে ডেকরেটরের কাছে থেকে ভাড়া করে আনা একখানা ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছে।
এই অবস্থাতেই সুবিমল ঘােষ কঁচা রাতেই সন্দেহবাইয়ে ভােগা কুকুরের মতােই ভুগ ভুগ করে ডেকে উঠল প্রায়।
কী হল? দেবেন সেন মাথা তুলে তাকাল। না। কিছু না। কাশি আসছিল—
এয়ারকন্ডিশনে তাে বসেন না। কমায়ে দেব ?—বলেই ষাট বছরের বালকটি টেবিলের তলা থেকে সেই পা দু খানা বের করে দেওয়ালের কাছে গেল। নােটের থাকের ভেতরের ফাঁকে ফাঁকে সাবধানে পা ফেলে। সুবিমলের দিকে পেছন ফিরে উবু হল দেবেন সেন। এয়ারকুলারের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি করল। তারপর একই ভাবে সাবধানে ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসল। পা দুখানা আবার টেবিলের নীচে চলে গেল।
আসলে সুবিমল হাসি চাপতে গিয়ে কেশে ফেলেছিল একটু আগে। মনে মনে সে অফিস গেটে দাঁড়িয়ে থাকা কাবুলিদের ভেতর দেবেন সেনকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভাবছিল—সিনটা দেখতে কেমন হবে। কাবুলি পিছু ছ-মিটার কাপড় গায়ে। আর দেবেন সেন পরে আছে শুধু দেড় মিটারের আন্ডারওয়ার। ওরা চড়া সুদে টাকা দেয় অনেক লিখেপড়ে। দেবেন সেন দেয় শুধু জিরজিরে খাতাখানায় নামটি লিখে। কোনাে লেখাপড়া নেই। নেই কোনাে সুদ। কী
আকাশপাতাল ফারাক।
কত?
চব্বিশ-বলতে গিয়ে গলা কেঁপে ওঠে সুবিমলের। সে বড়ােজোর সাত-আটশাে টাকা ধার নেয়। মাসে মাসে একশাে টাকা করে কেটে নিয়ে শােধও হয়ে যায়। এবার সে বুক ঠুকে চব্বিশশাে টাকা চাইল। কয়েকটা দেনা শােধ দেবে। দিয়ে সাত-আটশাে টাকা বাঁচলে একটা ছােটোমতে পুকুর কাটাবে। পুকুরের শখ অনেকদিনের তার। ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় চাকরিতে আসে। কলকাতার গায়েই ছােটোমতাে বাড়ির পাশে পুকুর কাটানাের
জন্যে তার কয়েক কাঠা জমি কেনা আছে। শস্তায়।
কী করবেন?
তখনাে খাতা থেকে মুখ তােলেনি দেবেন সেন। সুবিমল ফট করে বলে বসল, পুকুর কাটাতাম—
জায়গা কেনা আছে? টাকাটা বেশি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে ভেবে জমি কেনার খরচটাও যােগ দিয়ে সুবিমল বলল, আপনি দিলে কিনব।
খাতায় কী যেন খুঁজছিল দেবেন সেন। রুলটানা পাতার প্রতি লাইনে সবুজ কালিতে নিজের হাতে একজন করে খাতকের নাম লেখা। লেখা তার পাশে টাকার অঙ্ক। কথাও বলে না—মাথাও তােলে না—দেবেন সেন কি খাতকদের নামের জঙ্গলে হারিয়ে গেল ? ঠান্ডা ঘরে এমন উজ্জ্বল আলাের ভেতর চুপ করে কতক্ষণ বসে থাকা যায়। বিশেষ করে অন্যজন যদি আর একটা কথাও
বলে না তাকায়।
সুবিমল বুঝল, তার বেশি চাওয়া হয়ে গেছে। চুপ করে থাকা মানে—এত টাকা দেবেন সেন ধার দেবে না। এখনকার মতাে উঠে চলে যাওয়াই ভালাে। নাহয় ক-দিন পরে এসে বলবে—দিন, ষােলােশাে টাকা ধার দিন। মাসে দু-শাে করে কাটলে এক বছরেই শােধ হয়ে যাবে। জমিটা শস্তায় পাওয়া গেল। ঠিক এক্ষুনি আর কমিয়ে চাওয়া যায় না।
আমি যাব? টাকা নিয়েছেন? নেননি তাে! না। তবে বসে আছেন কেন?
এটা একটা কঠিন নিষ্ঠুর রসিকতা ভেবে সুবিমল ঘােষ উঠে দাঁড়াল। তাই তাে যাব বলছিলাম স্যার
যে টাকা দিতে পারে তাকে স্যার বলে ডাকা মানিয়েও যায়। হেসে ফেলল দেবেন সেন। টাকা নিয়ে যান। কীসে নেবেন?
পকেটে।—বলেই হাসল সুবিমল। এতক্ষণ সে একখানা ক্ষুরের ধারালাে লাইনের ওপরেই দাঁড়িয়ে ছিল।
অত টাকা তাে পকেটে ধরবে না— বলে কী লােকটা? চব্বিশখানা একশাে টাকার নােট ভঁজ করে দিব্যি পকেটে ঢুকিয়ে রাখা যায়।
এক কাজ করুন। ধুতির খোঁটে বেঁধে নিয়ে নিজের সিটে চলে যান। তারপর কলিগদের কারাের অ্যাটাচি ব্যাগ চেয়ে নিয়ে দিনে দিনে বাড়ি চলে যান। কাল অফিসে এসেই ব্যাগ ফেরত দিয়ে দেবেন। পারবেন না?
মনে মনে সুবিমল তখন বলছিল, দয়ার স্যার। ভেতরে ভেতরে আপনার মন যে এত নরম তা তাে জানতাম না। সদগুণ না থাকলে কেউ কি সামান্য জুনিয়র থেকে চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়! খুব পারব স্যার—
তাহলে দেওয়ালের কোণে ওই যে পঁচিশ হাজারের বান্ডিলগুলাে আছে—তার যে-কোনাে একটা থেকে গুণে এক হাজার টাকা বের করে আমার টেবিলে রাখেন। বাকি চব্বিশ হাজার মিলে গেল আপনার—
স্যার?
কেন? অসুবিধা হবে? আমি যে আবার খুব একটা নিচু হয়ে বান্ডিল খুলতে পারি না। কোমরের হাড়ে লাগে। তাই আপনাকে বলা—আমরা তাে আপনাদের চেয়ে ঝাড়া বিশ বছরের বড়াে হব। কী বলেন? এটুকু তাে বলতে পারি।
সে তাে নিশ্চয় স্যার, নিশ্চয়।—এর বেশি কথা সুবিমলের গলায় একসঙ্গে আর জোগাল না। তার সবকিছু গুলিয়ে গেছে। চেয়েছিল চব্বিশশাে টাকা। দেবেন সেন দিচ্ছে চব্বিশ হাজার। কোনােরকম মুখঝামটা বা অপমান না করেই রীতিমতাে ভদ্রভাবে—যেন, আমাদের গাই সদ্য বিইয়েছে—এক পােয়া দুধ নিয়ে যান—ঠিক এইভাবে।
ভূতুড়ে অন্ধকার বাড়ি থেকে ভূতে পাওয়া বােবা যেভাবে ছুটে পালায়—ঠিক সেইভাবেই সুবিমল ঘােষ ভীষণ তাড়াতাড়ি গােছা থেকে এক হাজার টাকা বের করে টেবিলে রাখল। রেখে বাকি চব্বিশ হাজার ধুতির খোঁটে বেঁধে ঝকঝকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল।
শােনেন। আধখােলা দরজায় মুখ বাড়িয়ে তাকাল সুবিমল।
মাসে মাসে চারশাে টাকা করে কেটে নেব।
মাথা নেড়ে সায় দিয়েই সুবিমল একদম বেরিয়ে যাচ্ছিল। আবার তাকে দাঁড়াতে হল।
আর শােনেন। এবার সুবিমল দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আবার ঘরের ভেতর এসে দাঁড়াল। আমরা কেউ কিন্তু কারাের না।
সুবিমল ঘােষ ভীষণ অবাক হয়ে তাকাল। তার শােনা আছে, দেবেন সেন বড়াে ফুটবল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। নিঃসন্তান। বাড়িতে বিরাট ফুলের বাগান। বহুমূত্রে ভুগছেন বলে ইদানীং সারা বিছানা জুড়ে অয়েলক্লথ পেতে শােন এবং কোনও গুরুর কাছে দীক্ষাও নিয়েছেন। বরানগর থেকে আসে পারচেজের শৈবাল দত্ত। সে নাকি দেখেছে—দেবেন সেন রবিবার রবিবার গাড়ি করে সকালের দিকে কাচমন্দিরে যায়। সেখানে গীতাপাঠ, আলােচনা সবই হয়।
দেবেন সেন আবার বলল, এই যে সম্পত্তি করছেন—পুকুর কাটাচ্ছেন—শেষে নারকেল গাছও বসাবেন—তাতে একদিন ডাবও ধরবে—কিন্তু আপনাকে চলে যেতে হবে।
সে তাে নিশ্চয় স্যার! তা আর বলতে!! ডাক এলে বসে থাকার উপায় নেই। সব-কিছু তখন পেছনে পড়ে থাকবে।
সে তাে অবশ্যই স্যার! কোথায় যাবেন ? সােনারপুরে নেমে দুর্গাপুর হল্টের কাছে আমার বাড়ি
ধ্যাৎ! আমি বলছি মরণের পরপারের কথা।
এতগুলাে টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার তাড়া তাে। তাই গুলিয়ে গেছে স্যার। বুঝেছি আমি।
কী বুঝলেন? টাকা দিলে লােকে ধমকও দেয়। তাই আবার গুলিয়ে যেতে পারে ভেবে সুবিমল চুপ করে গেল। দেবেন সেন নিজেই বলল, এ ডাকের কোনাে টাইমটেবিল নেই যে ৬টা চল্লিশের সােনারপুর লােকাল ৬টা চল্লিশেই হুইসেল দিয়ে ছাড়বে!
আজকাল স্যার কোনাে গাড়িই সময়মতাে ছাড়ে না। রেকের অভাব। মেইন্টেনান্স নেই। তারপর লাইন অবরােধ। কারেন্ট থাকে না।
আমি যে-ডাকের কথা বলছি—তা সময় হলেই আসবে কিন্তু। কেউ আটকাতে পারবে না। জীর্ণ শরীর থেকে আত্মা বেরিয়ে গিয়ে পৃথিবীর সব সম্পর্ক মুছে ফেলে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক হয়ে যাবে। কে কার বাবা! কে কার স্বামী ! সব ঘুচে যায়। তাই বলছিলাম, আমরা কেউ কারাের না। শুধু শুধু ছবি আর মূর্তি নিয়ে বাড়াবাড়ি।
সব গুলিয়ে গেল সুবিমলের। স্যার-ফের যদি একটু বলেন—
বলছিলাম, যে স্ট্যাচু নিয়ে আমরা হামলে পড়ি—সেই চেহারার ভেতরকার ‘আমি’ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাে অন্য ‘আমি’ হয়ে যায়। পুনর্জন্মে নতুন সম্পর্ক শুরু হয়। না জন্মালে সে তখন নিঃসম্পর্ক—অবিনাশী আত্মা—বা ‘আমি’—যা-ই বলুন।
এতটা বুঝতে পারলে তাে স্যার বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। যাদের নিয়ে মেতে আছি—এরা আমার কেউ নয়। কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাব—তাও জানি না।
তাই তাে বললাম, আমরা কেউ কিন্তু কারাের নয়। সেকেন্ড তিনেক দুজনই চুপ করে থাকল। তারপর দেবেন সেন বলল, আসুন। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ঠান্ডা ঘর থেকে বেরিয়ে অফিসের অর্ডিনারি লােকদের জায়গা মাড়িয়ে পেছনের লিফট দিয়ে একদম রাস্তায় এসে নামল সুবিমল। সে অফিসের কলমে লেখে। অফিসেরই সাবসিডাইজড ক্যান্টিনে টিফিন করে। জল খায় বারােয়ারি গ্লাসে। ঘাম হলে মুখ মােছে অফিসেরই প্যাডের কাগজে। তার কোনাে চাবি নেই। টেবিলের সব ড্রয়ার খােলা থাকে। খাতাপত্তর সে টেবিলেই রাখে। বােনাস পায় শতকরা ৮.৩৩। তাই হাতে তার কিছু থাকে না। শুধু বুক পকেটে থাকে ট্রেনের মান্থলি আর দু-এক টাকার নােট, খুচরাে।
কিন্তু কাপড়ের খোঁটে চব্বিশ হাজার টাকার নােট নিয়ে তাে হালকা হয়ে চলা যায় না। অফিসের উল্টোদিকের চেনা মনােহারি দোকান থেকে ধারে একটা জাবদা সাইডব্যাগ কিনল সুবিমল। কাল অফিসে ঢােকার আগেই টাকাটা দিয়ে যাব আমি কি চেয়েছি! আপনাকে বিশ বছর তাে দেখছি।
কাগজে মােড়া শেষের গােছা ব্যাগে ভরতে ভরতে দোকানির কথাগুলাে বড়াে ভালাে লাগল সুবিমলের। বেশ লুকিয়েই নােট ভরতে হল। পাছে দোকানদার দেখতে পায়—তাই এখানে সে গােছা বের করেনি। ব্যাগের দামটা বাকি রেখে কাল দিয়ে দেবে। রাস্তায় নামার আগে বলল, তা আপনার দোকানও তাে অনেকদিনের—
পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। বাবার পরে আমি বসছি। আপনাদের অফিসের সঙ্গে আমাদের অনেকদিনের সম্পর্ক।
ঘচ করে ঘুরে তাকাল সুবিমল ঘােষ। সম্পর্ক কথাটা তার ঘিলুর ভেতর নরম জায়গায় একটা বন্টু হয়ে গেঁথে গেল। তখনই তার চোখের সামনে ব্যস্ত মানুষের যাওয়া-আসা। কেউ কাউকে চেনে না। স্রেফ নিঃসম্পর্ক হাঁটাহাঁটি।
সুবিমল ঘােষ আর কথা বাড়াল না। সেই নিঃসম্পর্ক হাঁটাহাঁটির ভেতর এসে দাঁড়াল। কোনাে অদৃশ্য জলে ভাসা কুটো হয়ে মানুষ ভেসে যাচ্ছে। তবে দুদিকেই ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। নানান স্পিড়ে। যেখানেই দাঁড়াও—সেখান থেকেই যেন শুরু—দুদিকে দুটো অদৃশ্য তে চলেছে—একদম উল্টোমুখাে—দুই মােহনার দিকে।
এটা লক্ষ করে সুবিমল ব্যাপারটা যাচাই করতেই জায়গা বদলাল। প্যারাডাইস সিনেমার সামনে এসে দেখল, এখানেও সেই আগেরই মতাে। হনহন—হনহন করে মানুষ চলে যাচ্ছে। রাস্তার এক ধারে পর পর দুটো ছবিঘর। ওজন নেবার কলে লাল আলাে। মুসুম্বির শরবতের ব্যালকনিদার ফোল্ডিং দোকান। এখানে সে টের পেল, মানুষের কুটোগুলাে আরও জোরে ভেসে যাচ্ছে। আরও দিবিদিক।
এইভাবেই হাঁটতে হাঁটতে সুবিমল এবার নিজেকে গ্র্যান্ড হােটেলের গাড়িবারান্দার নীচে পেল। কাচের শােকেসে আরামের গদি-তােশক, ভালাে সােয়েটার, বরফি-কাটা সুটকেশ, দৌড়বার জুতাে, গলার নেকলেস—কত কী। ছােটো ছােটো ট্যাগে কুটি কুটি করে লেখা ফ্যানসি দাম।
আজ কোনাে দামই খুব একটা বেশি ঠেকল না সুবিমলের। সে তার হাতব্যাগের ভেতর এখন এমন এক অ্যাসিড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যাতে কি
যে-কোনাে দাম গালিয়ে জল করে দেওয়া যায়।
অনেকদিন পরে নিজের পায়ের নীচে হাঁটবার পাতা দুখানা আরও চটপটে মনে হল। কলকাতা তার নিজের মতাে করে সন্ধে হয়ে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে মিউজিয়ম। পার্ক স্ট্রিটের বাঁকের আগেই একটা বিখ্যাত বাড়ির গেটে কাঠ বা লােহা দিয়ে সংখ্যায় লেখা ১৮১৪—প্রতিষ্ঠা বছর। ওর সামনে দাঁড়িয়ে সুবিমল আজ হাতির পিঠে বসা অভিযাত্রী জিওলজিস্টদের কিচিরমিচির শুনতে পাচ্ছিল। সেই প্রথম ইন্ডিয়ার মাপ নেওয়া শুরু হয়।
এশিয়াটিক সােসাইটির গায়ে পৌঁছতে পৌছতে ঘাড় লটকানাে ঘুমন্ত গৃহস্থ গিন্নি-সামনে পাতা চাদরে দশ পয়সা সিকি আধুলি। যােগ দিলে বড়ােজোর চোদ্দো-পনেরাে টাকা। সেই সকাল থেকে এই সন্ধে অব্দি সরল পাটিগণিত কী বলে? চব্বিশ হাজার তাহলে কত বছরে ক-জন ঘুমন্ত গিন্নি লাগে। মুখে মুখে যেকোনাে ঐকিক অঙ্ক গুলিয়ে যেতে বাধ্য। শুধু মনে থাকে ঘাড় লটকানাে—নিরুপায় নির্বাক রমণীর চারধার ঘিরে থাকে বাড়ি গজানাে—সামনের অ্যাভিনু দিয়ে স্লিক স্নিক গাড়ি পিছলে যায়। এ পাড়াটা আনন্দ, খাদ্য, জামা, আইসক্রিম, মােপেড কেনার রাস্তা।
তার ভেতর দিয়ে ভাসতে ভাসতে সুবিমল ঘােষ খুব সহজেই এক খালি বাড়ির দোরে এসে দাঁড়াল। তখন তার মাথার ভেতর দিয়ে জিসের প্যান্ট, ফিতে প্যাটার্ন লেদার বেল্ট, কাথবার্টসনের ফুটের আলপনা তােলা সু জুতাে, চিরাগদিনের শার্ট, বন্ধ টিনের কৌটোয় ভরা ল্যাংড়া আমের রস, কিস্তিবন্দির মােপেড, পঁচিশ টাকা ডজন পিচ ফল অগােছালাে হয়ে আসছিল। এসব দোকানের সেলস গার্ল, ম্যানেজার, রিসেপশনিস্ট, সেলসম্যান একটু একটুর জন্যে সুবিমলকে হারিয়েছে। সে এত সিরিয়াসলি দর করে যে সবাই ভেবেই বসে দোতলা থেকে বাবু এইমাত্র কিনতে নেমে এসেছেন।
ওদের সবার হাত ফসকে সুবিমল এইমাত্র খালি বাড়ির দোতলায় ওঠার সিড়ির মুখে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির ডুমটা জ্বেলে দিয়ে মাগির-দালাল তার হাতখানা দুহাতে জাপটে ধরল, আসুন হুজুর। আসুন—
ধরা মানে এখানে টেনে তােলা। লােকটা সরু পাজামার ওপর ঝলমলে পাঞ্জাবি চড়িয়েছে। ফাস্ট-ব্রাকেট গোঁফ; সুবিমল বলল, হয়েছে। ছাড়াে।
সুবিমল নেমে যাচ্ছিল। লােকটা তার ব্যাগ ধরল। বাড়িটা পুরনাে হুজুর। তার সরু সিঁড়ি। আপনার উঠতে কষ্ট হয়েছে। আমি নিচ্ছি—বলে লােকটা ব্যাগটা হাতে তুলে নিল।
সুবিমল ঘােষ নিজের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে সরু রাস্তায় নেমে এল। লােকটা তখনাে নাছােড়। একটু শরবত খান বসে বসে। বঢ়িয়া শরবত। তারপর পসন্দ হয় বসবেন। না হয় চলে যাইবেন—জবরদস্তি কুছ নাহি।
পানে রাঙানাে ঠোটের ভেতর দিয়ে খানদানি ভদ্রতা বেরিয়ে আসছিল। সেইসঙ্গে জাফরানি জর্দার গন্ধ বাতাসে যােগ হচ্ছিল। আবছা আলােয় ছােকরা মতাে এই লােকটার চোখে কত বন্ধুত্ব। গলির মুখে পেঁয়াজির গন্ধে বৃষ্টির ছিচকে ছাঁট ধরা পড়ছে। মাথা বাঁচাতে সুবিমল সিঁড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়াল।
বাঁ-হাতে ব্যাগটা শক্ত করে ধরা। সে নিজের মনকে বলল, টাকা বের করার সময়েই তাে ধরা পড়ে যাব। সবই তাে বান্ডিলের গােছায় গার্ডার আটকানাে।
বৃষ্টি বরং চেপে এল। ছােকরার সঙ্গে এক সিঁড়ি ওপরে উঠে দাঁড়াল সুবিমল। সেদিকটাতেই তবু কিছু আলাে। রাস্তার আলাে জ্বলে বােধহয় নিভে গেল। জল এখন এক জুতাে।
কেন মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছেন হুজুর। আপনাদের মতাে লােক বারিষে ভিজবেন? না, ওপরে গিয়ে বসবেন—
না। না। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।
তাইলে ঝুটমুট ভিড় বাড়াচ্ছেন কেন ? পুলিশের ঝামেলা আছে। আসল খদ্দেরভি ভিড়বে না।
বৃষ্টি থামেনি তাে। একদম ভিজে যাব।
তা আমি কী করব বােলেন? এখােন কলকাত্তায় এক গ্লাস পিনে কা পানি দশ দশ পয়সা!
সুবিমল মনে মনে বলল, কী জায়গা রে বাবা! এ তল্লাটের রাস্তাঘাটে ইতিহাসের গন্ধ। তাতে বৃষ্টির জল পড়ে নালা, নদৰ্মা অল্পক্ষণে একাকার শেষমেশ স্বাস্থ্য নষ্ট। মুখে বলল, চল।
ওপরেই চল—
চলুন চলুন। হুজুর চলে আগাড়ি
ম্যায় চলে পিছাড়ি
—এরকমই কয়েকটা কথা সুর করে গুনগুন করে লােকটা পেছন পেছন উঠে এল। ঠুংরির চালে।
দোতলার মুখ থেকেই সব একদম আলাদা।। সাজানাে গােছানাে। দেওয়ালের রঙে চোখের আরাম। বড়াে পর্দা সরিয়ে সুবিমলকে বসার জায়গায় নিয়ে বসাল লােকটা। আরামসে বৈঠিয়ে—
আরামের বাবা। সুবিমল বলে ফেলল, এসব কী দরকার ছিল। বেশ তাে সিঁড়িতে ছিলাম—
তার কথার ভেতরেই ছ-সাতটি মেয়ে এসে সামনের সােফায়—তার সােফায় এসে বসল। ন-টিও হতে পারে। কেননা, সুবিমল আর গুনতে পারল তার ডান হাতের কবজিতে একটা শিরার ভেতর রক্ত বেশি এসে যাওয়ায় সে তার বুকের ভেতর দড়াম দড়াম আওয়াজ পেতে লাগল। তার বাঁ হাতের কবজিতেও সেই একই শিরা বেশি রক্ত পেয়ে ফুলল ঠিকই কিন্তু ঘড়ির মেটাল ব্যান্ডের নীচে চাপা পড়ে দাপাতে লাগল।
ওরা কজন একদম কথা না বলে সুবিমলের মুখে তাকিয়ে হাসছিল। যাতে কিনা সুবিমল অস্বস্তি বােধ না করে। কিন্তু ততক্ষণে লােভ, ভয়, কৌতুহল, লােকলজ্জা তার ভেতরে এলােপাথাড়ি ঘষা খাচ্ছিল। সে পা থেকে মাথা অব্দি একজন আস্ত উজবুক হয়ে উঠল। এখন কী করবে—বা কী করবে না—তার কোনােটাই ঠিক করার মতাে দশা আর ছিল না।
মেয়েদের পেটেই মানুষ জন্মায় বলে ওদেরই ভেতর একজন উঠে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে সুবিমলের থরথর করে কাপা হাতখানা ধরে টানল। সুবিমল উঠতে উঠতে ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়াল।
মেয়েটির বয়স তিরিশ হবে। সাঁইত্রিশ হতে পারে। চোখের নীচে কালি বা কাজল কে বলবে। সে চাপা গলায় বলল, ন্যাকা—
তারপর হ্যাচকা টানে সুবিমল তার সঙ্গে চলে গেল। ছােট্ট ঘর। ছােট্ট জলের কুঁজো। ছােট্ট খাট। তবে সাজানাে। সাঁই সাঁই পাখা। ভারী পর্দার ওপাশেই কলকাতা। বৃষ্টি।
যদি সারারাত থাকি।
এই তাে বােল ফুটেছে। তারপর খুব কাজের গলায় বলল, আমরা রাত আটটায় চলে যাব যে
খচ করে মনে পড়ল সুবিমলের, রাত আটটা চল্লিশে তার গাড়ি। দুর্গাপুর হল্টে থামার কথা স-নটায়। সে বলল, কত দিতে হবে?
কেন? কিছু বলেনি চিরঞ্জি? চিরঞ্জি কে?
ন্যাকা! দোরে যার সঙ্গে ওপরে উঠে এলে। আমার ঘাট। ঘর বারাে। সার্ভিস পাঁচ। একটা বিয়ার আনাই?
কত? ষােলাে টাকা। আমার আবার গলা না ভিজলে কিছু ভালাে লাগে না।
কে আনতে যাবে? এখানেই আনানাে আছে। পর পর মনে করছ কেন। বসাে।
খাটে বসল সুবিমল। তার বাড়ি শেয়ালদা থেকে চব্বিশ কিলােমিটার। সেখানে সে একটা পুকুর কাটাবে। পারলে পুকুরের পাড়ে সামনের বর্ষায় সজনে গাছ বসাবে একটা।
ভকাস করে বােতলের মুখটা খুলে দুটো গ্লাসে ঢেলে একটা সুবিমলকে এগিয়ে দিল। দিয়ে বলল, ভয় করে বুঝি!
নাঃ! তা কেন? এই তাে খাচ্ছি।—বলতে বলতে লম্বা গ্লাসটা এক চুমুকে ফুরিয়ে দিল।
মেয়েটি কিন্তু আস্তে আস্তেই খাচ্ছিল। খেতে খেতে ম্যাকসিটা ঘাড়ের কাছে ঢিলে করে দিল। দিয়ে বলল, গরম গরম কাবাব খাবে ? উল্টোদিকের দোকানেই পাওয়া যায়। রাস্তা পেরিয়ে—
তুমি খেতে পারাে। বলে খেয়াল হল সুবিমলের—এখন তাে ব্যাগের মুখ খুলে একশাে টাকার একখানা নােট বের করতে হবে। ভাঙিয়ে তবে বিয়ারের ষােলাে টাকা, কাবাবের দাম, ঘর ভাড়া—
মেয়েটা দোর খুলে লােক ডাকতে যেতেই রবারের গার্ডারে পেঁচানাে বান্ডিল থেকে একখানা একশাে টাকার নােট হেঁচড়ে বের করে ফেলল সুবিমল। কাবাব এলে ঠিক বউয়ের মতােই প্লেটে সাজিয়ে দিল মেয়েটি। সুবিমলের নিজের ঘরে বসে বেলপানা খাবার সময় সকালে সে জানলা দিয়ে দক্ষিণ দিককার দিগন্ত দেখতে পায়। মানে দুগগাপুর হল্টের দিগন্ত। যা কিনা অমাবস্যার রাতে অন্ধকারে মুছে যায়। লক্ষ্মীপূর্ণিমা ঝাপসা হলেও দূরে জেগে থাকে। আমি অ্যাতাে খাব না। তুমি নাও। কেন? কী হল? একদম পরিষ্কার।
আমি টিফিন করেছি বিকেলে। তুমি খাও— মেয়েটি হাঁ করে তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগল। আত্মীয় নয় এমন কোনাে মেয়েলােকের সঙ্গে সুবিমল এই প্রথম বন্ধ ঘরে বসে পােড়ানাে মাংস খাচ্ছিল। কাবাবের রং, মেয়েটির টাকরা, আলজিভের দিকটার রং—একই রকমের। এমনকি ছায়ার ভেতর বােতলের তলানির বিয়ারও একই রঙের। কাবাব মুখেই উঠে দাঁড়াল সুবিমল।
একি? কোথায় চললে? এক হ্যাচকায় ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সুবিমল। কোথায়? কোথায় যাবে?
এখুনি আসছি।-বলেই আঁ আঁ করে পর্দা তুলে সরু সিড়িতে গিয়ে পড়ল সুবিমল।
নােটের ভাঙানি—বলতে বলতে মেয়েটি সিঁড়ির মুখে। কথাগুলাে কানে ঢােকার মুখে সুবিমলের সামনে পড়ল চিরঞ্জি।
ক্যা বাবু?
সুবিমল তাকে প্রায় হুঁ মেরে রাস্তায় পড়ল। অমনি বাড়ির গায়ে চায়ের খুপরি থেকে বাচ্চা ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল, চোর—চোর—
তখন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের আকাশে তিনখানা মেঘ ছিড়ে গেল।
অগত্যা ব্যাগ হাতেই দৌড়। জল থেতলে পড়তে পড়তে সুবিমল বাঁ হাতে একটা বারের কাচের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে পড়ল। সামনেই খালি টেবিল দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল। হুইস্কি—
একবার পেছন ফিরে দেখল সুবিমল—বাইরে বৃষ্টি—তবু কাচের দরজাটা ঘেমে আছে।
শরীরটা যখন ভাসন্ত তখন ব্যাগ আঁকড়ে ধরে রিকশায় বসল সুবিমল।
শেয়ালদা সাউথ স্টেশনে ঢুকল যখন—-চাদ্দিক তখন একদম শুনশান। ঝক ঝক করছে আলাে। কিছু রেলপুলিশ। ভেন্ডারদের ঝকার পাহাড় টপকে সুবিমল একটা ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের কামরার হাতল ধরতে পারল কোনােক্রমে।
উঠবেন না। উঠবেন না। গার্ডের কথা কানেই নিল না সুবিমল। দরজাটা খুলুন। পড়ে যাব যে— যত্ত সব—বলতে বলতে গার্ড দরজা খুলল।
জলে আর ঘামে ভিজে ভিজে সুবিমল ব্যাগসুদ্ধ ভেতরে ঢুকল। ততক্ষণে ব্যাগের মুখ খুলে গেছে। ভেতরে ওলটানাে নােটের বান্ডিল তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছু করতে পারল না সুবিমল। সেই অবস্থাতেই গার্ডের মােটা লগবুকের ওপর ব্যাগটা কোনােক্রমে রাখল। তার গায়ে আর জোর নেই। হুইস্কির সঙ্গে শস্তার কাবাব, বারে খাওয়া কাটলেটের টুকরাে বমি হয়ে গলায় উঠে এল।
সঙ্গে সঙ্গে সুবিমল ওপাশের দরজার জানলা দিয়ে মাথা বের করে ফেলল। আরে। কী হচ্ছে। খাম্বায় গুঁতাে খাবেন—
সুবিমল ওয়াক করে বমি তুলতে গিয়েও তুলতে পারল না—খােলা ব্যাগের ডালা দিয়ে একশাে টাকার নােটের বান্ডিল তাকিয়ে আছে। বমি তুলতে গিয়ে পেটে অসম্ভব মােচড় খেল সুবিমল। সেই অবস্থাতেই বলল, আমার কোমরটা শক্ত করে ধরুন গাৰ্ডসাহেব।
গার্ড দুহাতে সুবিমলকে পেছন থেকে কোমরে জড়িয়ে ধরল।
এক পশলা বমি করেই মাথাটা আরাে এগিয়ে দিল সুবিমল। আরেক দমক বমি এসে গেল।
করছেন কী? পােস্টে ধাক্কা খাবেন যে মাথায়— শক্ত করে ধরুন স্যার। আমার ওপরের দিকটাই বেশি ভারি—। গার্ডসাহেব একটু উঠে সুবিমলকে জাপটাতে গিয়ে অসাবধানে পিঠের ধাক্কায় ব্যাগটাকে গুতিয়ে ফেলল। তখন ইলেকট্রিক ট্রেন পার্ক সার্কাস স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
সুবিমল ওয়াক তুলে হড়হড় করে বমি করল। গার্ড দেখতে পেল—তার পায়ের সামনেই কামরার মেঝেতেই একগাদা নােটের বান্ডিলে ব্যাগটা উলটো হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
সুবিমল তার বমির তেসরা পশলা ওগরাতে গিয়ে একটু কথা বলার ফাক পেল। শক্ত করে ধরবেন স্যার। আমার ওপরের দিকটাই বেশি ভারী—বলতে বলতেও সুবিমল টের পেল তার মাথা এইমাত্র একটা শক্ত খটখটে থাম্বা এক চুলের জন্যে মিস করল। গার্ডের সঙ্গে তার কোনাে সম্পর্ক নেই। তবু কেমন। দুহাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে ডিউটি দিচ্ছে।
আর তখনই লাইনে দুপাশের ট্যানারির গন্ধের ভিজে দমকার ভেতর গার্ডের মাথাটা ঘুরে গেল। সে দুহাতে নােটের বান্ডিলগুলাে কুড়ােতে লেগে গেল। দু-তিন মিনিটের ভেতরেই বালিগঞ্জ স্টেশন। আর সময় নেই যে—
ঠিক এই সময় গার্ডের কামরার বাইরে অন্ধকার ভিজে পাটির ওপর দিয়ে ট্রেনটা স্থির করে দেওয়া নিজের লাইন খুঁজে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। ভীষণ জোরে।
শরীরের ভারী দিকটা কামরার মেঝের সঙ্গে সুবিমলের হালকা দিকের সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিল। সে এখন আর কারাে নয়। লাইনের দুধারে অবিচল যেকোনাে থাম্বা এখন তার পরমাত্মীয় হয়ে উঠতে পারত। কামরার বাইরে তার এই শেকড়সুদ্ধ ওপড়ানাের শব্দ ট্রেনের আওয়াজে একদম চাপা পড়ে গেল। চার্দিক অন্ধকার। একই অন্ধকার দুগগাপুর হল্টেও ট্রেনটার জন্যে থানা গেড়ে বসে আছে।