দুই সেরি বাবা
ভুবন মানুষটা ভালো, কিন্তু তার কপাল ভালো নয়। কপালের ফেরে তার মা বসন্তকুমারী অতিশয় রগচটা মহিলা। মায়ের দাপটে আর গলাবাজির চোটে পাড়াপ্রতিবেশীরা কেউ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। আবার কপালের দোষে ভুবনের বউ নয়নতারাও হল সাংঘাতিক দজ্জাল।
নয়নতারাকে পছন্দ করে ভুবনের বউ করে এনেছিলেন মা বসন্তকুমারী। এখন শাশুড়ি-বউয়ে সকাল থেকে রাত ইস্তক রোজ এমন কুরুক্ষেত্র হয় যে, কহতব্য নয়। ঝগড়ার চোটে বাড়ির পোষা বেড়ালটা বিদায় নিল। পোষা নেড়ি কুকুরটাও মনের দুঃখে করালীবাবুর বাড়িতে গিয়ে জুটেছে। ডাকলেও আসে না। কাকপক্ষীরাও আনাগোনা বন্ধ করেছে। কাঙাল ভিখিরিরা অবধি এ-বাড়ির ছায়া মাড়ায় না।
ভুবনেরও মাঝে মাঝে সন্নিসি হওয়ার ইচ্ছে হয় বটে, কিন্তু ঠিক সাহস পায় না। সন্নিসি হলে লেংটি পরে থাকতে হবে, ভিক্ষে করে খেতে হবে। সাধনভজনের হ্যাপাও তো কম নয়। মা আর বউয়ের ঝাগড়ার চোটে অনেকদিন বাড়িতে রান্নাই হয় না। ভুবন না-খেয়েই দোকানে গিয়ে সারাদিন পরিশ্রম করে। দোকান তার ভালো চলে, আয়ও কম হয় না। তবে মনে সুখ নেই।
আজ ভোররাত থেকেই বসন্তকুমারী আর নয়নতারায় ঝগড়া লেগেছে। ভুবন বাড়িতে টিকতে না-পেরে সাতসকালেই এসে দোকান খুলে বসেছে। সন্নিসি হবে না গলায় দড়ি দেবে সে-কথাই বসে বসে ভাবছে। এত সকালে কর্মচারীরা আসে না, খদ্দেরও জোটে না। তাই নিরিবিলিতে বসে সুখরামের দোকান থেকে আনানো ভাঁড়ের গরম চা খেতে খেতে নিবিষ্ট মনে ভুবন ভাবছিল, সন্নিসি না গলায় দড়ি?
এমন সময় কে যেন বলে উঠল, ‘ব্রাহ্মণভোজন।’
ভুবন অবাক হয়ে দেখল, একজন আধবুড়ো, দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোক সামনে দাঁড়িয়ে। পরনে গেরুয়া রঙের একটা জোব্বামতো। মাথায় ঝুঁটি। সাধু-বৈরাগী হতে পারে। ফকির-দরবেশ কী আউলবাউল হওয়াও বিচিত্র নয়।
ভুবন বলল, ‘আপনি কে?’
লোকটা গম্ভীর মুখে বলল, ‘সন্নিসি হওয়া বা গলায় দড়ি দেওয়ার চাইতে ব্রাহ্মণভোজন করানো অনেক ভালো।’
ভুবন তাড়াতাড়ি উঠে লোকটার পায়ের ধুলো নিয়ে গদগদ হয়ে বলল, ‘আপনি কি অন্তর্যামী?’
লোকটা খ্যাঁক করে উঠে বলল, ‘অন্তর্যামী হওয়াটা কি খুব সুখের ব্যাপার বলে ভেবেছ নাকি হে বাপু? দিনরাত মানুষের মনের মধ্যে যত অকথা-কুকথা বুড়বুড়ি কাটছে সেগুলো কান দিয়ে ভেতরে এসে সেঁধোচ্ছে, সেটা কি ভালো হচ্ছে রে বাপু? দুটো কান অপবিত্র হচ্ছে রোজ। গঙ্গাজল দিয়ে রোজ পরিষ্কার করতে হয়। নাঙ্গাবাবা যে কী বিভূতিই দিলেন, এখন হয়েছে জ্বালা।’
ভুবন হেঁ: হেঁ: করে বলল, ‘আজ্ঞে, পাপীতাপীদের জন্য না-হয় একটু কষ্ট করলেনই মহারাজ।’
‘থাক, থাক, আর দাঁত বের করে বিনয় দেখাতে হবে না। বলি, খাঁটি সরষের তেল আছে?’
ভুবন হাতজোড় করে বলল, ‘আছে বাবা, আছে।’
‘তাই এক পলা বের করো তো বাপু। গায়ে খড়ি উঠছে। তা খড়ি ওঠারই বা দোষ কী? কৈলাস থেকে হেঁটে আসছি, চারদিন স্নান নেই।’
বলেই জোব্বাটা খুলে ফেলল লোকটা। আদুর গা হয়ে একটা টুল টেনে বসে বলল, ‘বেশ ডলাইমলাই করে তেলটা মেখে দাও তো হে বাপু।’
ভুবন যেন বর্তে গেল। খুব যত্ন করে তেল মাখতে মাখতে বলল, ‘তা বাবা, আপনার শ্রীনামটি কি শুনতে পাব না?’
‘তা পাবে না কেন? নাম তো পাঁচজনকে বলার জন্যই। তবে এ হল সাধনমার্গের নাম। আমাকে সবাই আদর করে ‘দু-সেরি বাবা’ বলে ডাকে। সকাল-বিকেল দু-সের করে খাঁটি গোরুর দুধ খাওয়ার অভ্যাস কিনা।’
চোখ বড়ো-বড়ো করে ভুবন বলল, ‘এক-এক বারে?’
‘ওরে বাপু, দুধ কি আর আমি খাই? সাধনভজনে আত্মার যে মেহনত হয়, তাতে দু-সের দুধ তো নস্যি। ওটা আত্মাই টেনে নেয়। ওরে বাপু, নতুন গামছা আছে?’
‘এখুনি আনিয়ে দিচ্ছি।’
‘ওই সঙ্গে একজোড়া নতুন ধুতি আর দু-খানা ভালো গেঞ্জিও আনিয়ে রাখো। আর আমি পুকুরে ডুব দিয়ে আসতে-আসতে যেন দু-সের দুধ তৈরি থাকে। দুপুরে ব্রাহ্মণভোজনে কী-কী লাগবে তা এসে বলছি।’
ভুবন খুব কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, ব্রাহ্মণসেবা করা তো ভাগ্যের ব্যাপার বাবা, কিন্তু আমার যে বাড়িতে বড়ো অশান্তি।’
হা: হা: করে হেসে দু-সেরি বাবা বলে, ‘সে কি আর জানি নারে মূর্খ! তোর জন্যই তো কৈলাস থেকে এত দূর কষ্ট করে আসতে হল। তোর দুঃখে স্বয়ং শিবের সিংহাসন নড়ে গেছে। বাবা শিবই তো আমাকে ডেকে বললেন, ‘যা তো দু-সেরি, গিয়ে একটু দেখে আয়, ছেলেটা এত কষ্ট পাচ্ছে কেন?’
ভুবন গদগদ হয়ে বলল, ‘বটে বাবা। স্বয়ং শিব পাঠিয়েছেন আপনাকে?’
‘তবে আর বলছি কী রে ব্যাটা! যা, দুধের জোগাড় দেখরে।’
দু-সেরি বাবা স্নান করে এসে কাচি ধুতি পরে দু-সের দুধ শেষ করে বললেন, ‘এবার চল ব্যাটা, তোর বাড়িতে ব্রাহ্মণসেবার ব্যবস্থা দেখিগে।’
ভুবনের বাড়ি কাছেই। খুব ভয়ে-ভয়ে ভুবন দু-সেরি বাবাকে নিয়ে গিয়ে বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই দেখতে পেল ভেতরের বারান্দায় বসন্তকুমারী আর নয়নতারার হাতে খুন্তি।
বসন্তকুমারী বলছে, ‘মুখপুড়ি, শাঁকচুন্নি…’
নয়নতারা বলছে, ‘ডাইনিবুড়ি, শনের নুড়ি…’
হঠাৎ দু-সেরি বাবা বাজখাঁই গলায় হাঁক মারল, ‘বসন্তকুমারী! নয়নতারা! তোমাদের এত অধঃপতন হয়েছে?’
অচেনা একটা লোককে হঠাৎ এরকম বজ্রগম্ভীর গলায় তাদের নাম ধরে ডাকতে দেখে দুজনেই থেমে গেল।
তারপরই বসন্তকুমারী তেড়ে এল, ‘কে রে তুই ড্যাকরা?’
খুন্তি উঁচিয়ে নয়নতারাও বলল, ‘কে এলেনরে গুরুঠাকুর!’
দু-সেরি বাবা অত্যন্ত ব্যথিত গলায় বলে উঠল, ‘ওরে, ঝগড়া করবি তো বাপের বেটির মতো কর। ও কীরকম ধারা মিনমিনে ঝগড়া তোদের? তোদের ঝগড়ার ছিরি দেখে কৈলাসে যে মা-দুর্গা হেসে কুটিপাটি। আমাকে ডেকে বললেন, ‘ওরে, এই দুজনের তো এখনও ঝগড়ার দুধের দাঁতই গজায়নি, তবু কেমন মিউমিউ করছে দ্যাখ। যা বাবা, ওদের একটু ঝগড়ার পাঠ দিয়ে আয়’।’
শাশুড়ি-বউ দুজনেই দুজনের দিকে একটু চেয়ে ঝগড়া ভুলে দু-সেরি বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘জোচ্চুরি করার আর জায়গা পাওনি! মা দুগ্গা পাঠিয়েছে তোমাকে! দেব ভূত ঝেড়ে।’
হাসি-হাসি মুখে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দু-সেরি বাবা বলল, ‘ওরে, তোদের হবে। প্রতিভা আছে, সাধনা নেই। তাই তো আমার আসা।’
বসন্তকুমারী ফোঁস করে উঠল, ‘এঃ, কোথাকার কে আমাকে ঝগড়া শেখাতে এলেনরে!’
নয়নতারাও ঝেঁঝেঁ উঠল, ‘দেব মুখে নুড়ো জ্বেলে।’
দু-সেরি বাবা মাথা নেড়ে বলল, ‘হচ্ছে না, হচ্ছে না। গলায় তোদের কোনো হুল নেই, বিষ নেই, ঝাঁঝ নেই, ধক নেই। কলজের জোর কম, দমেরও বালাই নেই। তা ছাড়া কোথায় দম পড়বে, কোথায় ফাঁক তারও তো ঠিকঠিকানা পাচ্ছি না। তোদের যে একেবারে গোড়া থেকে শেখাতে হবে। ওরে ভুবন, বাড়িতে তানপুরা নেই?’
‘আজ্ঞে না, মহারাজ।’
‘হারমোনিয়াম আছে?’
‘তা আছে একটা।’
‘শিগগির নামা। আর পারলে ওবেলা একজন খোলদার ধরে আনিস। ঝগড়ার সঙ্গে খোলটা জমে ভালো।’
ভুবন হারমোনিয়ামটা নামিয়ে দিয়ে টুক করে সরে পড়ে সটান দোকানে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল। বাড়িতে কী হচ্ছে ভেবে বুকটা বড়ো দুরুদুরু করল সারাক্ষণ।
দুপুরবেলা বাড়িতে এসে তাজ্জব। ভেতরের বারান্দায় দু-সেরি বাবা খেতে বসেছে। কাঁসার থালায় ভাত, থালা ঘিরে পঞ্চব্যঞ্জন। মাছের মুড়ো, তিনরকম মাছ, ধোঁকার ডালনা, বাটি-চচ্চড়ি, পায়েস, এলাহি আয়োজন। নয়নতারা ঘোমটা দিয়ে পরিবেশন করছে, বসন্তকুমারী কাছে বসে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছে দু-সেরি বাবাকে।
ভুবনকে দেখে দু-সেরি বাবা উদার গলায় বলে, ‘আয় বেটা, আয়। তোর ঘরে যে সাক্ষাৎ মা-মনসা আর চামুন্ডার বাস। তুই তো ভাগ্যবান রে। এ বলে আমাকে দ্যাখ, ও বলে আমাকে। তালিম দিতে গিয়ে দেখি দুজনেই ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা নিয়ে এসেছে। সাধনা করলে অনেক ওপরে উঠতে পারবে। তবে একটু সংযম, ধৈর্য আর পরিশ্রমের দরকার।’
‘যে আজ্ঞে, বাবা।’
দুপুরে দু-সেরি বাবা একটু টেনে দিবানিদ্রা দিল। ভুবন খেয়ে উঠে দেখল, তার মা আর বউ রান্নাঘরে মুখোমুখি বসে খাচ্ছে আর খুব ফিস ফিস করে নিজেদের মধ্যে কী যেন কথা কইছে।
দুপুরে একটু গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে উঠে ভুবন দেখল, দু-সেরি বাবা মাদুর পেতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে, তার একধারে বসন্তকুমারী, অন্যধারে নয়নতারা।
দু-সেরি বাবা বসন্তকুমারীর দিকে চেয়ে বলল, ‘এবার শুরু করো মা। মুখপুড়ি বলার সময় একটু শুদ্ধ নি লাগাতে হবে, মনে থাকে যেন।’
বসন্তকুমারী ভারি কুন্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমার কি আর বুড়োবয়সে ওসব হবে বাবা।’
‘আরে, হবে, হবে। আর নয়নতারা-মা, তুমি যখন ডাইনিবুড়ি বলবে তখন কড়ি মধ্যম…’
নয়নতারা লাজুক মুখে বলল, ‘বড্ড লজ্জা করছে যে বাবা…’
দৃশ্যটা দেখে ভুবনের চোখে জল এল। তার জীবনে যে এমন সুদিন আসবে তা সে কখনো কল্পনাও করেনি।
না, লোকটা যদি ঠকজোচ্চোরও হয় তো হোক। ভুবন দু-সেরি বাবাকে ছাড়বে না।