দুই সহস্রাব্দ: হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম কাশ্মীর

দুই সহস্রাব্দ: ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ ও মুসলিম কাশ্মীর

সভ্যতার বিকাশের ইতিবৃত্ত আলোচিত হয়েছে আগের অধ্যায়ে। এখানে প্রথম শতক থেকে শুরু করে নিকট অতীতের ঐতিহাসিক ধারাবর্ণনা প্রয়োজন। প্রথম এক শতক কাশ্মীরে মূলত ব্রাহ্মণবাদ ও বৌদ্ধ শাসনের আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। কুশান, হুন, কারকোটা, লোহারা এসব রাজবংশ প্রায় ১৩ শতকের শেষ। অবধি শাসন করে কাশ্মীরকে। এছাড়া মাঝে মধ্যে রাজবংশের বাইরেও কেউ কেউ শাসকের আসনে বসেছেন। এর প্রায় সবটা সময়ই ব্রাহ্মণবাদ (শিবপূজারি) বনাম বুদ্ধবাদের মধ্যে টানাপোড়েনের ইতিহাস বললে ভুল হবে না। কালহানের রাজরাঙ্গিনীসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিক দলিল বলছে, মৌর্য আমলের সম্রাট অশোকের সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হয়েছে কাশ্মীরে।

কাশ্মীর থেকে বৌদ্ধধর্ম ক্রমান্বয়ে লাদাখ ও চীনেও প্রসারিত হয়েছে। কাশ্মীরে বৌদ্ধ ধর্ম প্রথম প্রবেশ করে বানারাসের এক মঙ্কের মাধ্যমে। তার নাম মাঝাস্তিকা। তিনি আনন্দবর্ধনের সাগরেদ ছিলেন। সম্রাট অশোকের আমলে তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলনের শেষে ওই মঙ্ককে কাশ্মীর ও গান্ধারা অঞ্চলে পাঠানো হয় ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। শুরুতে তিনি কাশ্মীরের আদিবাসীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। পরে তাদের অনেককে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করতে সক্ষম হন। সে হিসেবে কাশ্মীরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। সম্রাট অশোকের রাজধানী ছিল পাটালিপুত্র। কাশ্মীর সেখান থেকে দূরে ছিল। তবুও সব ধরনের সুবিধাদি ছিল কাশ্মীরে।

তখন শ্রীনাগারি ছিল স্থানীয় রাজধানী। ওই শহরটিই এখনকার কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর। কেউ কেউ বলেছেন, বৌদ্ধ প্রচারক মধ্যন্তিকা ওই সময়েই কাশ্মীরে জাফরান চাষ চালু করেন। বৌদ্ধধর্ম ও শিবইজম অশোকের সময় পাশাপাশিই বিকাশ লাভ করে। সম্রাট উভয়কে সমসুযোগ দেন। কালহান লিখেছেন, অশোক দুটি শিবমন্দির তৈরি করেছিলেন বিজয়েশ্বর এলাকায় (এখনকার বিজবিহারা, অনন্তনাগ)। তিনিই আবার মধ্যাত্তিকাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের সুযোগ করে দেন। অশোকের পরের প্রজন্ম ছিল জালুকা ও দামাদর। সেই আমলে বিরাট সংখ্যক বৌদ্ধ বোদ্ধারা তর্কে হেরে গিয়েছিল জালুকার শুরু আভাদূতের কাছে। ফলে শিবধর্ম বা ব্রাহ্মণবাদের পুনর্জাগরণ ঘটে। তবে, জালুকা সেখানকার আদি বাসিন্দা নাগদের সমর্থন করতেন। তিনি বৌদ্ধধর্মকে তেমন পৃষ্ঠপোষকতা দেননি। যদিও জালুকাও

কিছু বিহার নির্মাণ করেছিলেন। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে নাগাসিনা নামের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে রাজা মাহেন্দ্রর আলাপ হয় বৌদ্ধদের বিশ্বাস সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। ওই আলাপে রাজা মুগ্ধ হন। ফলে বৌদ্ধধর্ম আবার প্রভাব ফিরে পায়। কালহানার রাজরাঙ্গিনীতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকেই শুরু হয় ইতিহাসের বর্ণনা। ১৩৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ১২৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রাজা প্রথম গোনানডার অভিষেক হয় কাশ্মীরের শাসক হিসেবে। তার অনেক পরের শাসক হলেন সুরেন্দ্র। তাকে বলা হয় কাশ্মীরের। প্রথম বৌদ্ধ শাসক। তিনি কাশ্মীরের সৌরায় (শ্রীনগরের একটি এলাকা) প্রথম বৌদ্ধ স্থাপনা নির্মাণ করেন। সম্ভবত, ওই স্থাপনার নাম ছিল সৌরাসা। সেখান থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ওই জায়গার নাম হয়েছে সৌরা।

জায়গাটি এখনও ওই নামে। পরিচিত। পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে (৫১৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) গ্রিকরা পার্সিয়া থেকে এসে গ্যান্ধারা দখল করে। আলেক্সান্ডার ৩২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারতে আসেন। ওই আমলে গ্রিকরা উত্তরপশ্চিম ভারতের কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়। যার মধ্যে কাশ্মীরও ছিল। দিমিত্রিয়াস বিশাল এলাকার সম্রাট হন তখন। তারপর সিংহাসনে বসেন মেনেন্দার। ওই মেনেন্দারই নাগাসেনার কাছে ধর্মীয় তর্কে হেরেছিলেন। এই তর্ক কাশ্মীরের কাছাকাছি কোনো স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের দিকে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, যা পরের কয়েক শতক পর্যন্ত ছিল। কাশ্মীরের বৌদ্ধ ধর্মের স্বর্ণযুগ বলা হয় কুশান রাজবংশের আমলকে (প্রথম ও দ্বিতীয় খ্রিষ্ট শতকে)।

তখন অগণিত বৌদ্ধ স্থাপনা নির্মিত হয়। কুশান শাসনামলের অন্যতম রাজা ছিলেন কানুশকা (খ্রিষ্টপূর্ব ৭৮)। ৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কানুশকা কাশ্মীর সফর করেন তার শাসক সত্যসিংহের আমন্ত্রণে, যিনি ক্ষমতারোহণের পর বৌদ্ধ মঙ্ক হয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত কানুশকা গ্রিক, পারস্য ও সুমেরিও দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। সত্যসিংহের সঙ্গে আলাপকালে কানুশকা বেশ কিছু কথায় বিমোহিত হন। ফলে তিনি বুদ্ধের শিক্ষার দীক্ষা নেন। ওই সময় সেখানে চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

হয়। হিউয়েন সাঙয়ের বর্ণনায় উল্লিখিত হয়েছে, চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনটি কাশ্মীরের শ্রীনগরের কাছাকাছি বুর্জমা এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই সম্মেলনটি হয়েছিল মূলত বৌদ্ধ ধর্মের ভিন্নমতগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে। সেখানে বিশেষজ্ঞ, মঙ্ক ও ভিক্ষু মিলে প্রায় দেড় হাজার বৌদ্ধ অংশ নেয়। ভারত, মধ্য এশিয়া, চীন ও তিব্বত থেকে বিশিষ্ট বৌদ্ধ মঙ্করা সেখানে যোগ দেন। তারপর ওইসব এলাকা থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাশ্মীর আসা যাওয়া বাড়তে থাকে।

দক্ষিণ ভারতীয় বিশিষ্ট বৌদ্ধ দার্শনিক নাগর্জুনা কাশ্মীরে ছিলেন কুশান আমলের শেষ দিকে। কালহানের বর্ণনা অনুসারে, ওই দার্শনিকের সঙ্গে ধর্মতর্কে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরা (শেভাইট) পরাজিত হয়েছিলেন। ফলে সে সময়ে উপত্যকার প্রায় সব লোকই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। এতে সেখানকার প্রচলিত ধর্মচর্চা বদলে যায়। মজার ব্যাপার হলো, কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরাও তাদের ধর্মরক্ষায় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরা ধীরে ধীরে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, লর্ড বুদ্ধা মূলত লর্ড বিষ্ণুর একটি দ্বিতীয় রূপ। ফলে, বিষ্ণুমূর্তির পূজার আদলে নতুন বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিতরা বৌদ্ধমূর্তির পূজা শুরু করে। বিশেষত তার জন্মদিনে।

কানুশকার পরে চন্দ্রদেবের আমলে পাতাঞ্জলি নামের অপর এক পণ্ডিত শিবাইট দর্শনের পুনর্জাগরণ ঘটায়। ফলে পুনরায় শিবধর্মের প্রভাব বিস্তার করে। অবশ্য পরের গুপ্ত বংশের শাসক প্রতাপাদিত্যের ধর্মীয় সংযোগ সম্পর্কে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে হান রাজবংশের আমলে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক সংকট ও বিপদ মোকাবিলা করে। বিশেষ করে হান শাসক মিহিরাকুলার আমলকে হিউয়েন সাং ও কালহানা বৌদ্ধধর্মের বিপর্যয়ের আমল বলে উল্লেখ করেন। মিহিরাকুলাকে মহান বৌদ্ধ হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন হিউয়েন সাং। মিহিরাকুলার মৃত্যুর পর কাশ্মীরের শাসক হন মেঘবান (৬ষ্ঠ শতক)। তিনি কাশ্মীরের পুরাতন রাজবংশের সন্তান ছিলেন।

তিনি আবার কট্টর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় এসে সব ধরনের পশু হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কানুশকার পরই তাকে বৌদ্ধধর্মে প্রীত কাশ্মীরি শাসক ধরা হয়। মেঘবানের স্ত্রী অমৃতপ্রভা ছিলেন বর্তমান আসাম এলাকার মেয়ে। ওই নারী বিদেশি মঙ্কদের জন্য একটি সুবিশাল বিহার স্থাপন করেন কাশ্মীরে। ওই সময়ের একাধিক রানীর নাম পাওয়া যায়, যারা কাশ্মীরে অসংখ্য বিহার নির্মাণ করেছিলেন। এমনকি তাদের কারও কারও নামের সঙ্গে কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানের নামের মিল লক্ষ্য করেছেন ইতিহাসবিদেরা। পরবর্তীতে ৯৫০-৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা কিসমাগুপ্ত ক্ষমতায় এসে অনেক বিহার ধ্বংস করেন। দ্বিতীয় যুধিষ্ঠীরের মন্ত্রীরা আবার বিহার নির্মাণকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। পরে রাজা রানাদিত্যের স্ত্রী মেঘবানের স্ত্রীর বানানো বিহারের উপর বুদ্ধের মূর্তি স্থাপন করেন। বিক্রমাদিত্যের আমলেও বিহার নির্মাণ হয়। কারকোটা রাজবংশের রাজা দুর্লভবর্ধনও (৬০০-৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দ) বিহার নির্মাণ করেন।

বিভিন্ন সূত্রমতে, রানী ডিডো (৯৮০ – ১০০৩ খ্রিষ্টাব্দ), লোহারা (১১০১ – ১৩৩৯) রাজবংশের আমলে জয়াশোহা, রাজদেব, রাজা উচালা প্রমুখ শাসক বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যদিও ১৫ শতকের পর বৌদ্ধ ধর্মকে কাশ্মীরের সক্রিয় ধর্ম হিসেবে আর দেখা যায়নি কিন্তু, এখনও উপত্যকার জনগণের সংস্কৃতিতে এর প্রভাব বিদ্যমান। কাশ্মীরি মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এ নিদর্শন মেলে। কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরা এখনও অষ্টমিবার্তা পালন করে। প্রতি চন্দ্র মাসের পূর্ণিমার অষ্টম দিনে এই অষ্টমিবার্তা পালিত হয়। এটি একটি বৌদ্ধচর্চা।

এমনকি এখনও অষ্টমিকে বুদ্ধাষ্টমি বলা হয়। কাশ্মীরি মুসলিম বুজুর্গদের মধ্যে ঋষি ধারাও বৌদ্ধ সংঘদের থেকে আসা বলে অনেকে মত দেন। কারণ, ঋষিদের অনেকে বিয়ে না করে সারা জীবন ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। আর তরুণ ঋষি যারা হতেন তারা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো চাঁদা সংগ্রহ করতেন। বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যশৈলী এখনও কাশ্মীরের মানুষের গৃহনির্মাণ সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যে কেউ এখন কাশ্মীরে গেলে দেখতে পাবে সেখানকার পুরনো মসজিদগুলোরও আকৃতি অনেকটা প্যাগোডার। মতো।” যদিও গত ২০-৩০ বছরে যেসব নতুন মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে তার মিনারের আকারে আরবীয় প্রভাব লক্ষণীয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সম্রাট অশোকের সময় থেকেই বারবার বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণবাদের মধ্যে তর্ক হয়েছে, প্রতিযোগিতা হয়েছে, দ্বন্দ্বও হয়েছে।

ক্রমান্বয়ে এই দুটি বিশ্বাসের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল শত্রুতা; সংঘাতও। শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল। এরই মধ্যে বৈষম্যে ভুগছিল সর্বসাধারণ। এমনই এক পরিবেশে সেখানে প্রবেশ করে জনপ্রিয় হয়েছিল ইসলাম, একেবারে নতুন একটি বার্তা নিয়ে। কাশ্মীরি ইতিহাসবিদরা লিখেছেন, ১৩৩৯ সাল পর্যন্ত লোহারা রাজবংশের শাসন ছিল সেখানে। তারপর থেকে শুরু হয় মুসলিম সুলতানী শাসনামল। যেকোনো সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিহাসের কিছু কিছু ঘটনা বা সময় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কাশ্মীরের চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের ইসলামী শাসনামল তেমনি। কারণ, ত্রয়োদশ শতকের দিকে কাশ্মীরি সমাজ ছিল বহুধাবিভক্ত।

সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ওপর শোষণ ও বৈষম্যের খড়গ তখন ছিল নৈমিত্যিক ব্যাপার। ঠিক সেই সময়ই ইসলামের আগমনের কারণে নতুন এক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল কাশ্মীরি সামাজ। বৌদ্ধধর্ম আর ব্রাহ্মণবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছিল। ফলে দুশ্চরিত্র ও বিবেকবর্জিত ছিল রাজা, রানী আর কর্মকর্তারা। হিন্দুবাদ যে শান্তি ও অহিংসায় বিশ্বাস করত, তা প্রত্যাশিত শান্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কাশ্মীরে ইসলামের আগমন কোনো রাজার শোষণ বা দখল করার মাধ্যমে হয়নি। বরং পীর ও ঋষিদের হাত ধরে ইসলাম এসেছিল ও বিকশিত হয়েছিল কাশ্মীরে। ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব আর সাম্যের বার্তা ছিল তখনকার সামাজিক সমস্যার মোক্ষম জবাব। সেই প্রেক্ষিতেই ইসলাম জোরপূর্বক দখলের পথে না এসে ক্রমান্বয়ে ধর্মান্তরের মাধ্যমে ধীরে ধীরে জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্য অর্জন করেছিল। তবে,

কাশ্মীরে ইসলামের ভিত্তি গড়ে তোলাটা চতুর্দশ শতকে হলেও মুসলমানদের আনাগোনা বহু পুরনো। অধ্যাপক ফিদা এম হাসনাইন লিখেছেন, ‘৬২৮ সালে ইসলামের মুহম্মদ (সাঃ) তার দূত পাঠাচ্ছিলেন বিভিন্ন সম্রাটের কাছে। ৬৩০ সালে তিনি এশিয়ার বিভিন্ন রাজার কাছে দূত পাঠান। আবু হুযাইফা ইয়ামানকে দিয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়েছিল চীনে। ওই আরব দূত সিল্করুট হয়ে চীনের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তীব্র তুষারপাতের কারণে কাশ্মীরে আটকা পড়েন। যেহেতু কাশ্মীর সিল্করুটের গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থলবন্দর ছিল, সেহেতু খোটাং, মিরান হয়ে সিয়ান (সম্ভবত চীন) যাওয়ার পথে তিনি কাশ্মীরে থেমেছিলেন।

আরব ওই দূতকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন কাশ্মীরি রাজা ভীনাদিত্য। এমনকি তিনি আবু হুযাইফা ইয়ামানকে ‘জালকার’ উপাধি দেন। পরের বছর নবী (সাঃ) দু’জন দূত পাঠান কাশ্মীরের রাজার কাছে। সঙ্গে দেন কিছু উপহার। এই তথ্যটির মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে, ইসলাম কাশ্মীরে আসে সপ্তম শতকেই। সরাসরি আরব থেকেই আসে। কিন্তু, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় না কাশ্মীরিরা তখনই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বরং, পরের শতকে, ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে আরবরা সিন্ধ বিজয় করে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়। তারা সিন্ধ ও মুলতান থেকে কাশ্মীরে আসার চেষ্টা চালায়। ললিতাদিত্য মুক্তাপিদ তখন কাশ্মীরের শাসক। ললিতাদিত্য চীনা রাজার কাছে আবেদন করেছিলেন ওই আরবদের মোকাবিলায় সামরিক সাহায্যের জন্য। পরে, আরবদের সামরিক অভিযান অবসান হয়।

এ তথ্যটিও প্রমাণ করে রাজনৈতিক বা সামরিক পথে কাশ্মীরে ইসলাম বা মুসলমানরা আসেনি। এবং সরাসরি আরবদের হাত ধরে ইসলাম কাশ্মীরে আসেনি। কাশ্মীরি ইতিহাসবিদ আবদুল আহাদ লিখেছেন, ইসলাম আরব থেকেই কাশ্মীরে এসেছে তবে তা মধ্য এশিয়ার ভায়া হয়ে।” মনজুর ফাজিলির বর্ণনামতে, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বহিঃআক্রমণগুলো ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। তবে, ললিতাদিত্যের উত্তরসূরিরা এমন সব চর্চা শুরু করেন যা হিন্দু শাসনকে দুর্বল করে। হিন্দু শাসনের দুর্বলতা কাশ্মীরের সমাজে সিন্ধ ও মুলতান থেকে আগত মুসলমানদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়, যা তারা ললিতাদিত্যের সময়ে বা তার আগে পারেনি।

তবে, ইসলাম কাশ্মীরিদের হিন্দু থেকে মুসলমান বানিয়ে দিল কিন্তু না কাশ্মীরের স্বাধীনতা বিনষ্ট করল আর না করল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থাবলীর পরিবর্তন। ইসলামের আগমনে সাংস্কৃতিক অবস্থায় সংস্কার সাধন হয়েছিল, তবে রাতারাতি বিপ্লব সাধন হয়নি। ইতিহাস বলে, ললিতাদিত্য কাশ্মীরের শাসক ছিলেন ৬৯৭-৭৩৮ খ্রিষ্টযুগে। অর্থাৎ, ইসলাম কাশ্মীরে তার গভীর প্রভাব নিয়ে আসে অষ্টম শতকের পরে। ইতিহাস গবেষকদের মতে, হজরত বুলবুল শাহ কলান্দার (রহ.)-এর আগমন ছিল কাশ্মীরের ইতিহাসে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। তার হাতেই বৌদ্ধ রাজা রিনচানা সপরিবারে মুসলমান হন। এটা ছিল একক ও নীরব পরিবর্তন। এর ফলে সর্বসাধারণও তাদের

শাসকের সঙ্গে সর্বোচ্চ শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যায়। রিনচানা কাশ্মীরের শাসক হন ১৩২০ সালে। মঙ্গলীয়দের আক্রমণে রাজা সুহাদেব তার সিংহাসন ছেড়ে পালিয়েছিলেন। মঙ্গল আক্রমণকারী জুলচো বিহার, মন্দির ও উপাসনালয়ে ঘিরে থাকা এবং বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছিল। সেই জুলচো কাশ্মীর থেকে চলে যাওয়ার পর ধ্বংসস্তুপের ওপরই রিনচানা ক্ষমতাসীন হন। রিনচানা লাদাখের অভিজাত পরিবারের সদস্য। সুতরাং, তিনি চেয়েছিলেন সর্বাধিক লোকের সমর্থন। ফিদা হাসনাইন লিখেছেন, তিনি ছিলেন বিশ্বাসের দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কিন্তু, উপত্যকায় তাদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল না।

অধিকাংশ কাশ্মীরি ছিল ব্রাহ্মণ তখন। ফলে, তিনি দেবস্বামী, ব্রাহ্মণ সমাজের প্রধানকে অনুরোধ করেছিলেন তাকে তাদের সম্প্রদায়ে গ্রহণ করতে। কিন্তু, তার আবেদন অগ্রাহ্য করা হলো। কারণ, হিন্দু বর্ণ ব্যবস্থায় কেউ উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণবাদ গ্রহণ করতে পারে না, যত যোগ্যতাই তার থাকুক না কেন। এটা জন্মগতভাবে পাওয়া যায় কেবল। ওই অবস্থায় তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইসলামের দিকে ধাবিত হলেন ১৩৩৯ সালে। তার নাম হলো শামসুদ্দীন। তখন থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে ইসলাম কাশ্মীরি সমাজ, সংস্কৃতিতে অবদান রেখে আসছে। শামসুদ্দীনের (রিনচান) পর নিরবচ্ছিন্নভাবে দুই শতক কাশ্মীর মুসলমানরা শাসন করে। তাদের মধ্যে অনেক শাসক ছিল জনদরদী, অনেকে আবার ছিল নিষ্ঠুর। অনেকে ছিল কাশ্মীরে জন্ম নেওয়া, অনেকে আবার ছিল বহিরাগত। কার্যত, মুসলিম শাসনামলও ছিল অস্বাভাবিক।

শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল খুবই কম। দখলপ্রতিদখল নিয়মিতই ঘটেছে। মোগলরা কাশ্মীরে আসে ১৫৮৫ সালে। মোগল শাসনামলও ছিল মুসলমান শাসনামল। তারা মঙ্গোলিয়া থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে ভারতে এসেছিল। মোগলদের আগের দুই শতকের মুসলিম শাসনামলে কাশ্মীর ব্যাপকভাবে মধ্য এশিয়ার সুফি ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থাও ব্যাপকভাবে মধ্য এশিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। শামসুদ্দীনের পরের শাসক ছিলেন সুলতান শিহাবউদ্দীন (১৩৫৫ – ১৩৭৩)। ফার্সি বর্ণনা মতে, সুলতান শিহাবউদ্দীন আরও কিছু এলাকা কাশ্মীরের সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি পাহলি, সোয়াত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন।

পরে তিনি সিন্ধের শাসককে পরাজিত করেছিলেন। তিনি কাবুল, কান্দাহার, বাদাখস্থান ও খোরাসান একের পর এক বিজয় করেন। তিনি অধীনে নেন গিলগিত, বালতিস্তান, লাদাখ, কিশওয়ার ও জম্মু। রাজনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার শাসনামল মুসলিম শাসনের মধ্যে সবচেয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল। পরের শাসক ছিলেন সুলতান সিকান্দার শাহ (১৩৯৩ – ১৪১৩)। তিনি সুফি সাইয়্যেদ আলী হামদানীর (রহ.) মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের প্রতি ছিলেন নিষ্ঠুর। তিনি হিন্দুদের উপাস্য মূর্তিগুলো ভাঙচুর করেছিলেন। ওই সময়ে তৈমুর লঙ মধ্য এশিয়া থেকে তার সীমানা বিস্তার করছিলেন ভারতমুখে। সিকান্দার শাহ কাশ্মীরকে

তৈমুর লঙের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করেছিলেন কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। তিনি তৈমুরের সঙ্গে সমঝোতা এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। সুলতান জাইনুল আবেদীন বাদশাহ (১৪২০ – ১৪৫৯) ছিলেন কাশ্মীরের ইতিহাসে সকল মুসলিম শাসকের মধ্যে উদারতম। তিনি অলঙ্কার ও বয়ন শিল্পীদের সমরখন্দ, বুখারা, খোরাসান থেকে নিয়ে এসেছিলেন প্রশিক্ষক হিসেবে। পাথরের কাজ, কাচের ওপর নকশা, কাগজ তৈরি, সেলাই ও বুনন, এবং সোনার কারিগরি তখন থেকে শুরু হয় কাশ্মীরে। জাইনুল আবেদীনের পর তার ছেলে অমুসলিমদের সেভাবে মূল্যায়ন করেনি।

কিন্তু, পরের সুলতান হাসান শাহ (১৪৭২ – ১৪৮৪), যিনি জাইনুল আবেদীনের নাতি, তিনি দাদার মতো উদার ও অসাম্প্রদায়িক মননে বিকশিত ছিলেন। পরে ছিলেন ফতেহ শাহ (১৪৮৭ – ১৪৯৯)। তারপর সোমাচন্দ্র, যিনি মীর শামসুদ্দিন ইরাকির অনুসারী হয়ে মন্দিরের পুরহিতদের বন্দি করেছিলেন। ১৫১৬ সালে সুলতান মোহাম্মদ শাহ বাইরে থেকে এসে ক্ষমতায় বসেন। সম্ভবত, তিনি মধ্য এশিয়া থেকেই এসেছিলেন। তিনি ছিলেন উদার ও ক্ষমাপ্রবণ। ১৫৪০ সালের মধ্যে চাক শাসনামল শেষ হয় হায়দার মির্জা কাসগরির হাতে। হায়দার মির্জাও ছিলেন অপর একজন মধ্য এশিয়ার যোদ্ধা। তখন সুলতান নাযুক শাহ ছিল নামকাওয়াস্তে শাসক। হায়দার মির্জা ছিলেন সর্বেসর্বা। তিনি ছিলেন কট্টর হানাফি-সুন্নী অনুসারী। তিনি অন্য সকল সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিলেন। অ-হানাফি মুসলমানদেরও ছাড় দেননি। এমনকি, তিনি শামসুদ্দীন ইরাকির কবর খুঁড়ে সেখানে একটা শৌচাগার নির্মাণ করেছিলেন।

১৫৫০ সালে এক কাশ্মীরি নাগরিক তাকে হত্যা করে। সেখান থেকে খানিকটা বিরতির পর সুলতান মো, গাজী শাহ চাক শাসক হন। তিনি কাশ্মীরে মোগল সৈন্যদেরও পরাজিত করেছিলেন। পরের জন ছিলেন পাদ শাহ গাজী হুসাইন শাহ চাক (১৫৬৫)। তিনি ছিলেন জনদরদী। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সুশাসন ‘বিরাজ করেছিল তার সময়ে। ইতিহাসে তাকে খসরু আদিল (ন্যায়পরায়ণ শাসক) বলা হয়। মজার ব্যাপার হলো, ইতিহাসবিদরা তাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে, রাজা নতুন শ্যারাব পিলেন। নারীদের সঙ্গে বিনোদন করলেন এবং খেললেন।

তার পরেই মোহাম্মাদ আলী পাদ শাহ গাজী ক্ষমতায় এলেন। তিনি ১৫৭০ সালে জহির উদ্দীন উপাধি ধারণ করেছিলেন। শ্রীনগর শহরের জামে মসজিদে তার অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল। অভিজাত লোকেরা সেখানে গিয়েছিল। এটা ছিল একটা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর, যা কাশ্মীরের ইতিহাসে খুবই কম ঘটেছে। তার অধীনে জনগণ সুখী ছিল। তিনি জোরপূর্বক শ্রমের ব্যবস্থা (বেগার বা Begar) ও নিষ্ঠুর শাস্তিগুলো বিলুপ্ত করেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ধর্মের বিষয়ে মাজহাব বা তরিকা নিয়েও তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ। তিনি নিজে শিয়া মুসলিম ছিলেন। কিন্তু, সুন্নীদের শত্রুর চোখে দেখেননি।

মুসলিম শাসনামলে কাশ্মীরের ইতিহাসের পরিক্রমায় শুধু শেষ তিনজন শাসকের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। এর আগে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংঘাত আর রক্তপাত হয়েছে। সহযোগিতা, সমঝোতা ও উদারতার নিদর্শন দেখা গেছে অনেকের মধ্যে। আবার ধর্মীয় বা গোষ্ঠীগত কট্টরপন্থাও অনেকের মধ্যে ছিল। কাশ্মীরের মুসলিম ইতিহাস কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি ও যোগাযোগের

ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু, সেখানে ছিল সংঘাত, দখল-প্রতিদখল আর রক্তপাতের ঘনঘটা।

শেষ শাসক ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ ইউসুফ শাহ গাজী (১৫৭৯)। তিনি ছিলেন বিজ্ঞদের পৃষ্ঠপোষক। ধার্মিক ও বুজুর্গদের বড় আপন ছিলেন। তার বেশ কজন রানী ছিল। সর্বশেষ জনের নাম ছিল হাব্বা খাতুন। এই সুলতান মোগল সাম্রাট আকবরের হেরেমের সঙ্গেও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু আকবরের কাছেই প্রতারিত হয়েছিলেন তিনি। উদার মনের ওই শাসক হিন্দু প্রজাদের ওপর আরোপিত জিজিয়া মওকুফ করে দিয়েছিলেন। তিনি গরু জবাই ও গাছকাটা নিষিদ্ধ করেছিলেন। কাশ্মীরি ইতিহাসবিদরা তাকে সর্বশেষ স্বাধীন কাশ্মীরের শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার শাসনের সমাপ্তি এবং মোগলদের কাশ্মীর দখলের ঘটনাকে ঐতিহাসিক ফিদা এম হাসনাইন উল্লেখ করেছেন শঠতা’ হিসেবে। কলামনিস্ট জাভেদ ইকবালের ভাষায় ছল-চাতুরি (Wile and guile)’। আকবর তখন দিল্লির সাম্রাট।

কাশ্মীর দখলের পাঁয়তারা করছেন। অন্তত দুইবার তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। পরে ১৫৮৬ সালে ইউসুফ শাহ চাকের কাছে একটি সমঝোতার প্রস্তাব পাঠালেন। এজন্য তাকে আমন্ত্রণ জানালেন লাহোর। সেখানে আকবর তার প্রতিনিধি ভগবান দাসকে পাঠালেন। ইউসুফ শাহকে তার জনগণ বলেছিলেন আকবর বিশ্বস্ত লোক নন। তবুও তিনি গেলেন। তাকে আটক করা হলো। তাকে বিহার রাজ্যে নির্বাসনে পাঠানো হলো। তবে, কাশ্মীরের দখল তখনই শেষ হয়নি। ইউসুফ শাহের ছেলে ইয়াকুব শাহ দক্ষিণ দিকে কিশতোয়ার এলাকায় তার বাহিনীর বেইস স্থাপন করেন। আকবর বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তিন বছর চলে এভাবে। অবশেষে পরাজিত হন ১৫৮৯ সালে। কাশ্মীরি লেখক, বাশারাত পীর তার কারফিউড নাইট উপন্যাসে লিখেছেন

‘It is a tragic story…. Yusuf Shah’s imprisonment and betrayal by Akbar has become a metaphor for the relationship between Delhi and Srinagar’

পরবর্তী ১৫৮৯ সাল থেকে ১৭৫২ সাল পর্যন্ত কাশ্মীরকে শাসন করেছেন মোগলরা। কাশ্মীরের এখনকার পর্যটন কেন্দ্রগুলো সিংহভাগ গড়ে তোলা তাদের। ওই সময়ের ইতিহাস মোগল হেরেমের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এগিয়েছে। মোগলদের ক্ষমতার জোর যখন দুর্বল হতে থাকে তখন কাশ্মীর দখল করে আফগান পাঠানরা। ১৭৫২ সাল থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীরে চলে পাঠান শাসনামল। আফগান শাসক আহমদ শাহ আবদালীসহ কাবুলের সুলতানরা কাশ্মীরে তাদের বিভিন্ন গভর্নর নিয়োগ করতেন। আবদুল্লাহ খান, নূরুদ্দীন বামজায়ী, বুলন্দ খান বামজায়ী, জান

মোহাম্মদ খান, খুররম খান, ফকির উল্লাহ খান, করিম দাদ খান, মিরদাদ খানসহ বেশ কিছু পাঠান শাসক সেখানে গভর্নর হিসেবে আসেন। কাশ্মীরে ৬৭ বছরের পাঠান শাসনামলকে বলা হয় চরম নিপীড়ন, নির্যাতনের সময়। পরে ১৮১৯ সালে লাহোরের খালসা দরবারের রাজা রঞ্জিত সিং আফগানদের পরাজিত করে কাশ্মীরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। বীরবল ধর নামে এক কাশ্মীরিকে আফগানদের ওই পরাজয়ের পেছনে খলনায়ক হিসেবে মনে করেন অনেকে।

শিখরা কাশ্মীর শাসন করেছে একজন গভর্নরের মাধ্যমে। ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশরা পরাজিত করে শিখ শাসককে। পরে তারা কাশ্মীরকে বিক্রি করে জম্মুর হিন্দু জমিদার গুলাব সিংয়ের কাছে। গুলাব সিংয়ের পরিবার জম্মু-কাশ্মীরকে শাসন করে পূর্ণ একশ’ বছর। এই সময়কে কাশ্মীরের শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির মানুষের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম অমানবিক শাসনামল হিসেবে কাশ্মীরি ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করে থাকেন। এবং এই জনসংখ্যার সিংহভাগ ছিল মুসলিম। তবে, ডোগরা আমলকে কাশ্মীরের পণ্যের আন্তর্জাতিক খ্যাতির দিক বিবেচনায় ধরা হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ই ইউরোপে কাশ্মীরি শালের ব্যাপক বাজার তৈরি হয়। কথিত আছে, নেপোলিয়ন বেনাপোর্টের গার্লফ্রেন্ড জোসেফাইন নিয়মিত কাশ্মীরি শাল গায়ে জড়িয়ে ফ্যাশন শোতে অংশ নিতেন।

নোট/সূত্র

১. কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও লেখকের সহপাঠী শারমিন তামান্না ২০১৫ সালে তার শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কাশ্মীরের বৌদ্ধধর্মের বিকাশ বিষয়ে সবিস্তার আলোচনা করেন একটি নিবন্ধে। অপ্রকাশিত ওই নিবন্ধ থেকে এই অধ্যায়ের ওপরের তথ্যাবলী নেওয়া হয়েছে। শারমিন তামান্নার প্রতি লেখক কৃতজ্ঞ। লেখক নিজে কাশ্মীরে ইসলামের বিকাশ ও মধ্য এশিয়া’ শীর্ষক বিষয়ে কাজ করেছেন একই শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে। ইংরেজিতে লেখা অপ্রকাশিত সেই নিবন্ধটি থেকে পরের তথ্যবলী সংযোজিত হয়েছে।

২. GM. Khawaja (Meem Hai Zaffar); Editorial of The Journal of Kashmir Studies, Volume III; 2009.

৩. Manzoor Fazili; Key note address of The Journal of Kashmir Studies, Volume III; 2009; P: 1-5.

৪. Fida M Hassnain; The Impact of Muslim Rule on the Kashmiri Society; Journal of Kashmir Studies (Vol: III), 2009, Pp: 6-36.

৫. Abdul Ahad; Replenishing Kashmir’s Civilizational Stocks; Journal of Kashmir Studies, Vol: V, 2011; Pp: 12-18.

৬. G. N Gauhar; Kashmir: Insurgency at Charar-e-Sharief (2001); New Delhi: Mans Publications; P5.

৭. Greater Kashmir; Sep 21, 2015, P1.

৮. সেখানেই পরে মারা যান ইউসুফ শাহ চাক। বিহারের নালন্দা জেলায় তার কবর রয়েছে। জেঅ্যান্ডকে সরকার ইউসুফ শাহ চাকের দেহাবশেষ ফিরিয়ে নিতে বিহার সরকারের কাছে আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল ২০১৫ সালে। সে সময় গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়। শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে এর আগে তার কবরের ওপর একটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয় (গ্রেটার কাশ্মীর, ২০১৫)।

৯. Zaved Iqbal; Zaldagar 1865; Greater Kashmir; May 2, 2015; P9.

১০. বিভিন্ন শাসক ও শাসনামলের নাম উচ্চারণের বৈচিত্র্যের কারণে ভিন্ন মনে হতে পারে। আবার, কাশ্মীরের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সবটুকু ভারতীয় ইতিহাসের সঙ্গে মেলে এর কারণ হলো, মাঝে মধ্যেই মধ্য এশিয়া থেকে অনেকে এসে কাশ্মীর শাসন করেছে। স্থানীয় শাসকরাও ছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *