দুই শিষ্য

দুই শিষ্য 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে দৈনিক কার্য্য শেষ করিয়া মৃদুমন্দ মলয়মারুত সেবন করিতে করিতে আফিসের বারান্দায় পায়চারি করিতেছিলাম, এমন সময়ে একখানি তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়াটিয়া গাড়ি আফিসের ফটকের নিকট আসিয়া স্থির হইল। 

কিছুক্ষণ পরেই একজন কনেষ্টবলের সহিত এক যোগীপুরুষ আমার নিকটবর্ত্তী হইল। কনেষ্টবল অঙ্গুলি নিৰ্দ্দেশ দ্বারা আমাকে প্রদর্শন করিয়া, যোগীপুরুষকে তথায় রাখিয়া প্রস্থান করিল। আমি তখন তাঁহার নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার ন্যায় সাধুব্যক্তির এরূপ স্থানে আসিবার প্রয়োজন কি? বলুন, আপনার কোন্ কার্য্যে সাহায্যে করিব?” 

আগন্তুকের বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে দিব্য গৌরবর্ণ ও হৃষ্টপুষ্ট। অঙ্গের মাংস শিথিল হয় নাই। তাঁহার ললাট উন্নত ও প্রশস্ত, মস্তকে কেশ নাই–মুণ্ডিত, চক্ষুদ্বয় আকর্ণবিস্তৃত ও উজ্জ্বল। মুখশ্রী গম্ভীর অথচ সদাই প্রসন্ন। তাঁহার পরিধানে একখানি গৈরিক বস্ত্র, গাত্রে একখানি গৈরিক উত্তরীয়, পায়ে কাষ্ঠপাদুকা, গলায় কতকগুলি রুদ্রাক্ষমালা। 

আমার প্রশ্ন শুনিয়া তিনি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরে আমার মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “আপনার অনুমান যথার্থ। আমার ন্যায় সন্ন্যাসীর সহিত পুলিসের কোনরূপ সংস্পর্শ থাকা কৰ্ত্তব্য নহে; এ সকল কার্য্য গৃহীরই শোভা পায়। কিন্তু কি করিব? আমায় বাধ্য হইয়া আজ এই সায়ংকালে ঈশ্বরারাধনা ত্যাগ করিয়া আপনার আশ্রয়ে আসিতে হইয়াছে। শুনিয়াছি, আপনার দ্বারা এরূপ অনেক কাৰ্য্য সিদ্ধ হইয়াছে।” 

আমি আগন্তুকের কথা ভালরূপ বুঝিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ তাঁহার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার কি হইয়াছে বলুন? কিসে আপনার সাহায্য করিতে পারি বলিয়া দিন?” 

আগন্তুক পুনরায় আমার দিকে তীব্র কটাক্ষপাত করিলেন; আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। পরে কি ভাবিয়া বলিলেন “আমার নাম মনোহরগিরি। আমি কালভৈরবের মন্দিরের সেবায়েত।” 

কলিকাতার দক্ষিণে কোন এক গ্রামে কালভৈরবের এক মন্দির আছে। শুনিয়াছিলাম, তাঁহার সেবার জন্য মাসিক এক সহস্র মুদ্রা নিদ্দিষ্ট আছে। মনোহরগিরি যে তাঁহার তৎকালীন সেবায়েত তাহাও আমার জানা ছিল। কিন্তু এ পৰ্য্যন্ত আমি সেবায়েতকে স্বচক্ষে দেখি নাই, কিম্বা তাঁহার সহিত কোনরূপ সংশ্রবে আসি নাই। আগন্তুককে কালভৈরবের সেবায়েত জানিয়া তাঁহার প্রতি আমার ভক্তি শতগুণে বৰ্দ্ধিত হইল। আমি অতি বিনীত ভাবে বলিলাম “আপনার নাম এ অঞ্চলের অনেকেই অবগত আছেন। দুঃখের বিষয়, এতকাল আপনার সহিত আমার পরিচয় ছিল না। যাহা হউক, এখন কি হইয়াছে বলুন? আমি সাধ্যমত আপনার সাহায্য করিব।” 

যোগীপুরুষ পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন “আজ প্রাতঃকাল হইতে আমার প্রধান শিষ্য বেহারীগিরিকে দেখিতে পাইতেছি না। আপনি চেষ্টা করিয়া তাহার সন্ধান বলিয়া দিন।” 

মনোহরগিরির কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না। বেহারীগিরি তাঁহার শিষ্য, সুতরাং তিনিও একজন সংসার-বিরাগী ব্যক্তি। তাঁহার জন্য তাঁহার গুরুদেব এত চিন্তিত কেন? বেহারীগিরি হয় ত কোন কারণ বশতঃ অন্য কোথাও গিয়া থাকিবেন, হয় ত কোন পরিচিত লোকের সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায় তাঁহার সহিত মিলিত হইয়া ঈশ্বরারাধনায় নিযুক্ত আছেন। তাঁহার ন্যায় জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য মনোহরগিরির মত একজন বীর সংযমী লোকের এত উৎকণ্ঠা কেন? 

এই ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার শিষ্যটির বয়স কত?” 

মনোহরগিরি ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “আজ্ঞে তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর।”

আ। কতদিন তিনি আপনার শিষ্যত্ব লাভ করিয়াছেন? 

ম। প্রায় দশ বৎসর 

আ। এই দশ বৎসর কালই কি তিনি আপনার নিকটে বসবাস করিতেছেন? 

ম। আজ্ঞে হাঁ―বেহারীর পিতার সহিত আমার অত্যন্ত সদ্ভাব ছিল। তিনি সংসারে থাকিয়া ঈশ্বরারাধনা করিতেন। শোনা যায়, তাঁহার ন্যায় ক্রিয়াবান পুরুষ সে অঞ্চলে আর কেহ ছিলেন না। তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যে, আমি তাঁহার পুত্রকে শিষ্য করি। বেহারী নিজেও অতি সচ্চরিত্র সাধু ও সংযমী পুরুষ। এই সকল কারণেই আমি তাহাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং আমার নিকট রাখিয়া যথারীতি শিক্ষা দিতেছিলাম। 

আ। আর কখনও এরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল? 

ম। কই আমার ত স্মরণ হয় না। 

আ। আজ প্রাতে কখন আপনার সহিত বেহারীগিরির শেষ দেখা হইয়াছিল? 

ম। বেলা সাতটার পর আর আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় নাই। 

আমি কিছুক্ষণ ভাবিয়া পুনরায় অতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার কয়জন শিষ্য?” 

মনোহরগিরি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন “পূর্ব্বে অনেকগুলি ছিল কিন্তু এখন সৰ্ব্বশুদ্ধ পনর জন মাত্র।” আ। সকলেই কি আপনার সহিত একত্রে বাস করিতেছেন? 

ম। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। আপনার কিম্বা বেহারীগিরির কোন শত্রু আছে? 

মনোহরগিরি আমার প্রশ্ন শুনিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আমরা সংসারী লোক নহি। সংসারের সহিত আমাদের বিশেষ কোন সংস্পর্শ নাই। দুই বৎসর পূর্ব্বে বেহারীগিরির মাতা ঠাকুরাণীর গঙ্গালাভ হইয়াছে। সেই অবধি বেহারীরও সংসার-বন্ধন খুলিয়া গিয়াছে। আমাদের আবার শত্রু কে?” 

মনোহরগিরি যে ভাবে পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম না। তিনি মুখে কোন শত্রু নাই বলিলেও তাঁহার কথার ভাবে সেরূপ বুঝিতে পারিলাম না। আমার বোধ হইল, তিনি যেন আমার নিকট কোন কথা গোপন করিতেছেন। কিন্তু আমি সে কথা প্রকাশ করিতে সাহস করিলাম না বরং ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “যদি তাহাই হয়, তবে আর বেহারীগিরির জন্য এত চিন্তিত হইতেছেন কেন? যদি আপনাদের কোন শত্রু না থাকে, তাহা হইলে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন–আপনার শিষ্য শীঘ্রই প্রত্যাগমন করিবেন।” 

আমার উত্তরে মনোহরগিরি সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন “আপনার অনুমান বাস্তবিকই সত্য। কিন্তু কি জানি কেন আমার মনকে প্রবোধ দিতে পারিতেছি না। যতই আমি বেহারীর কথা ভাবিতেছি, ততই যেন আমার প্রাণ কাঁদিয়া উঠিতেছে। কেন এমন হয়? আর কখনও ত এরূপ হয় নাই?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম, “আপনি বেহারীগিরিকে বোধ হয় পুত্রাধিক স্নেহ করেন; সেই কারণেই আপনার মনে সদাই তাঁহার প্রাণের আশঙ্কা হইতেছে। যিনি যাহাকে স্নেহ করেন, তাহাকে দেখিতে না পাইলে তাঁহার মনে স্বতঃই একটা কুচিন্তার উদয় হয়। আপনারও সেইরূপ হইয়াছে।” 

মনোহরগিরি লজ্জিত হইয়া বলিলেন “আপনার অনুমান যথার্থ। বেহারীকে আমি বড় ভালবাসি, আমার অবর্তমানে তাহাকেই সেবায়েত করিব এই আমার অভিপ্রায়। হয়ত সেই কারণেই আমার এত চিত্তচাঞ্চল্য ঘটিয়াছে।” 

আ। আমারও সেইরূপ বোধ হয়। এতক্ষণ হয় ত তিনি মন্দিরে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। 

ম। আর যদি না ফিরিয়া থাকে? 

আমি সহসা কোন উত্তর করিলাম না। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলাম “চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাইতেছি। যদি তিনি ফিরিয়া থাকেন, মঙ্গল। আর যদি বাস্তবিকই না আসিয়া থাকেন, তাহা হইলে এখনই তাঁহার সন্ধানের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করা যাইবে।” 

আমার কথায় মনোহরগিরির মুখ প্রসন্ন হইল। তিনি তখনই হৃষ্টচিত্তে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন এবং আমাকে লইয়া সেই ভাড়াটীয়া গাড়িতে আরোহণ করিলেন। চালক সময় বুঝিয়া শকট চালনা করিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

যতক্ষণ গাড়িতে ছিলাম, ততক্ষণ মনোহরগিরি তাঁহার শিষ্য সম্বন্ধীয় কোন কথা কহেন নাই। আমিও সে বিষয়ে তাঁহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, গাড়িখানি তৃতীয় শ্রেণীর, ঘোড়া দুইটি দেখিতে অতি শীর্ণ—অস্থি চর্ম্ম সার বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু চালকের হট্‌ট্‌ শব্দে ও গাড়ির ঝন্ ঝন্ শব্দ শুনিয়া অশ্ব দুইটি পুচ্ছদ্বয় ঊর্দ্ধে উত্তোলন করিল এবং প্রায় এক ঘণ্টার পর কালভৈরবের মন্দিরে দ্বারে উপস্থিত হইল। 

গাড়িখানি স্থির হইলে মনোহরগিরি অগ্রেই অতরণ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িলাম। 

গাড়ির শব্দে মন্দিরের অভ্যন্তর হইতে কয়েকজন গৈরিক বসন-ধারী পুরুষ সত্বর দ্বারদেশে আগমন করিলেন এবং মনোহরগিরির সহিত আমাকে দেখিতে পাইয়া কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া ধীর ভাবে গুরুর আদেশ জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। 

মনোহরগিরি উপস্থিত শিষ্যগণের মধ্যে একজনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সঙ্কেত দ্বারা নিকটে আহ্বান করিলেন এবং তিনি নিকটে আসিলে, কোচম্যানকে ভাড়া মিটাইয়া দিতে আদেশ করিয়া, আমাকে লইয়া মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। 

যখন আমরা মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করিলাম, তখন রাত্রি প্রায় আটা। মন্দিরটী পূর্ব্বেই দেখিয়াছিলাম। দুই একবার ভিতরেও প্রবেশ করিয়াছিলাম। কিন্তু সে বহুদিন পূর্ব্বে। সে রাত্রে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। মন্দিরটী প্রকাণ্ড, ভিতরে কালভৈরব মূর্তি। মন্দিরের ঠিক দক্ষিণে একটি নাটমন্দির। সেখানে অনেক দীন দরিদ্র ভিক্ষুক শয়ন করিয়াছিল। মন্দিরের পূর্ব্বদিকে একটি অট্টালিকা ছিল। মনোহরগিরি আমাকে লইয়া সেই অট্টালিকায় প্রবেশ করিলেন। 

বাড়ীখানি দ্বিতল। মনোহরগিরি আমাকে লইয়া উপরে আরোহণ করিলেন এবং একখানি প্রশস্ত গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। 

ঘরখানি বড় বটে, কিন্তু আসবাবের কিছুই পারিপাট্য ছিল না। ঘরের মেজের উপর ব্যাঘ্রচর্ম্ম পাতা ছিল। মনোহরগিরি স্বয়ং সেই আসনে উপবেশন করিলেন এবং আমাকে তাঁহার সম্মুখে বসিতে অনুরোধ করিলেন। 

যোগীপুরুষের সহিত একাসনে উপবেসন করিতে আমার ইচ্ছা ছিল না। সেই কারণে তিনি উপবেশন করিতে অনুরোধ করিলেও, আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা না করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলাম। 

মনোহরগিরি আমার মনোভাব বুঝিতে পারিলেন। তিনি বলিলেন “আমাদের এখানে আপনার উপযুক্ত আসন নাই। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, আমিই এই মন্দিরের সেবায়েত। কালভৈরবের মাসিক আয়ও যথেষ্ট। আমিই তাহা ব্যয় করিয়া থাকি, অর্থাৎ আমারই আদেশে তাহা ব্যয় করা হয়। কিন্তু তাহা হইলেও কেবল আমার বা আমার শিষ্যগণের সুখ-সচ্ছন্দ্যের জন্য সে অর্থ ব্যয় করিতে পারি না। যাহার জন্য এই অর্থ সঞ্চিত আছে, আমাকে তাহারই জন্য উহা ব্যয় করিতে হয়। এইজন্য আমাদের এখানে অনাবশ্যকীয় কোন আসবার দেখিতে পাইবেন না। বিশেষতঃ, আমরা সকলেই সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসীমাত্র। ঈশ্বরোপাসনাই আমাদের কার্য্য এবং আত্মার উৎকর্ষ লাভই আমাদের অভিপ্রেত। তাই বলিতেছি, আপনি অনুগ্রহ করিয়া ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপরই উপবেশন করুন।” 

সেবায়েত মনোহরগিরির কথায় আমি লজ্জিত হইলাম। তাঁহার কথায় প্রথমে ভাবিয়াছিলাম, তিনি হয়ত আমার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার সকল কথা শুনিয়া আমার বড় দুঃখ হইল। তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি বুঝি অবজ্ঞা করিয়াই ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপর উপবেশন করিতেছি না। 

এই মনে করিয়া আমি লজ্জিত ভাবে উত্তর করিলাম, “আমি সে জন্য দাঁড়াইয়া নাই। আপনার সহিত কেমন করিয়া একাসনে উপবেশন করিব তাহাই ভাবিতেছি।” 

বাধা দিয়া মনোহরগিরি বলিলেন “সে কি কথা? আপনি আমাপেক্ষা নিকৃষ্ট কিসে?”

এই বলিয়া তখনই গাত্রোত্থান করিলেন এবং আমার হস্ত ধারণ করিয়া ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপর টানিয়া লইলেন এবং অগ্রে আমাকে বসাইয়া পরে আমার পার্শ্বে উপবেশন করিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে তিনি বলিলেন “আপনি ব্রাহ্মণ, আমার নমস্য। আমার সহিত একাসনে বসিবার আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।” 

আমি কোন উত্তর করিলাম না, ঈষৎ হাসিলাম মাত্র। পরে তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলাম “আপনার অপরাপর শিষ্যগণের মুখ দেখিয়া স্পষ্টই বেঝা যাইতেছে যে, বেহারীগিরি এখনও প্রত্যাগমন করেন নাই।” 

এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া মনোহরগিরি উত্তর করিলেন, “আপনার অনুমান সত্য। যদি বেহারী ফিরিয়া আসিত, তাহা হইলে কি এ মন্দির আজ এত নীরব থাকিত? বেহারী অভাবে আমার আর আর সকল শিষ্যই যেন মৰ্ম্মাহত হইয়া পড়িয়াছে। তাহারা মুখে কোন কথা না বলিলেও তাহাদের হৃদয় যে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, তাহাদের বাহ্যিক অবস্থা দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়।” 

তাঁহার কথা শেষ হইতে না হইতে দুইজন গৈরিক বসনধারী যুবক সেই গৃহে প্রবেশ করিল। মনোহর তাহাদিগকে নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন “এই দুইজনেই তাহারর বিশেষ বন্ধু। ইহারা যেন মৃতপ্রায় হইয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।” 

আমি মনে করিলাম, কেবল গৈরিকবসন পরিধান আর সংসার ত্যাগ করিতে পারিলেই যদি মায়ার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা যাইত, তাহা হইলে পৃথিবীতে এত কষ্ট থাকিবে কেন? কিন্তু মুখে কোন কথা প্রকাশ করিলাম না। 

আগন্তুক দুইজনের মধ্যে একজন মনোহরের দিকে চাহিয়া অতি বিনীত ভাবে বেহারীর সংবাদ জিজ্ঞাসা করিল।

মনোহর আমার পরিচয় দিয়া বলিলেন “এখন ইঁহারাই উপর আমাদের ভরসা, গৌরীলাল!”

দেখিতে দেখিতে আরও কয়েকজন শিষ্য তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি তখন গৌরীলালকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আজ বেহারীর সহিত কি আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?” 

গৌরীলাল সম্মতি সূচক উত্তর দিলে আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “কোন্ সময়ে আপনার সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল?” 

গৌরীলাল কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “আজ প্রাতে যখন আমি মন্দির হইতে বাহির হইতেছিলাম, সেই সময় বেহারীগিরিকে একজন অপরিচিত লোকের সহিত কথা কহিতে দেখি, আমি তখন অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম বলিয়া বেহারীকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি নাই।” 

আ। তখন বেলা কত? 

গৌ। প্রায় সাড়ে সাতটা। 

আ। তাহা হইলে আপনার গুরুদেবের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইবার পর আপনার সহিত দেখা হইয়াছিল—কেমন? গৌরীলাল সহসা কোন উত্তর করিলেন না। তিনি একবার মনোহরগিরির দিকে চাহিয়া, কিছুক্ষণ কি ভাবিলেন। পরে বলিলেন “আজ্ঞে আমি ত সে কথা বলিতে পারিলাম না। গুরুদেবের সহিত বেহারীর কখন দেখা হইয়াছিল?” 

আ। বেলা সাতটার সময়। 

গৌ। তাহা হইলে আপনার অনুমান যথার্থ। 

আ। আপনাদের মধ্যে আর কেহ কি বেহারীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন? 

গৌ। আজ্ঞে সে কথা বলিতে পারিলাম না। আমরা সকলেই বেহারীকে বড় ভালবাসি। তাহার সহসা অন্তৰ্দ্ধান হওয়ায় সকলেই আন্তরিক দুঃখিত হইয়াছি। আজ কাহারও আহার পর্যন্ত হয় নাই। এখনও সকলে মন্দির ফিরিয়া আইসেন নাই। 

আমি আর গৌরীলালকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া তাঁহার গুরুদেবের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, তিনি একমনে আমাদের কথোপকথন শুনিতেছেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার শিষ্যগণ কখন প্রত্যাগমন করিবেন বলিতে পারেন? যাঁহারা বেহারীর অন্বেষণে বাহির হইয়াছেন, তাঁহাদের কথা না শুনিয়া আমি কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারিতেছি না।” 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে এক মহা কলরব আমার কর্ণ গোচর হয়। আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, বুঝি বেহারী ফিরিয়া আসিয়াছেন। মনোহরগিরি আর নিশ্চিন্ত ভাবে বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। কলরবের কারণ জানিবার জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ আসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং শশব্যস্ত হইয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। আমি উৎকণ্ঠিত ভাবে তথায় বসিয়া রহিলাম। আমার নিকট এতক্ষণ যে সকল শিষ্য দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাঁহারা সকলেই তাঁহাদের গুরুদেবের অনুসরণ করিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

কিছুক্ষণ পরে মনোহরগিরি অতি বিষণ্ণবদনে পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন। তাঁহার শিষ্যগণ সকলেই তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই গৃহে প্রবেশ করিলেন এবং আমাদিগকে বেষ্টন করিয়া দণ্ডয়মান রহিলেন। 

আমি তখন অতি বিনীত ভাবে মনোহরগিরিকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার শিষ্যগণ কি সকলেই প্রত্যাগমন করিয়াছেন?” 

ম। আজ্ঞে হাঁ-কিন্তু কোন ফল হইল না। উহাদের সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হইল। 

আ। তবে সহসা সেই কলরব উঠিল কেন? 

ম। আমার অপরাপর শিষ্যগণ ভাবিয়াছিল, বুঝি বেহারীও ফিরিয়া আসিতেছে। 

আ। যাঁহারা বেহারীর সন্ধানে গিয়াছিলেন, তাঁহারা কি কোন সংবাদই পান নাই? 

ম। একজন বলিতেছেন যে, তাঁহার পরিচিত কোন লোক আজ বেলা একটার সময় বেহারীকে অপর এক সংসারী লোকের সহিত যাইতে দেখিয়াছেন। 

আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম “ তিনি কেথায়?” 

মনোহর আমার কথা শুনিয়া তখনই ‘বলদেব’ ‘বলদেব’ বলিয়া চীৎকার করিলেন। একজন গৈরিক বসনধারী পশ্চিম দেশবাসী যুবক তখনই আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। পরে অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “আমি নিকটেই আছি গুরুদেব!” 

মনোহর নিজে কোন কথা না বলিয়া আমাকে দেখাইয়া দিলেন। আমি তখন বলদেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার সহিত বেহারীগিরির সদ্ভাব আছে?” 

বলদেব অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে বিশেষ সদ্ভাব। যখন আমরা এক গুরুদেবের শিষ্য, তখন আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃস্নেহ রহিয়াছে। বিশেষতঃ আমরা সংসারের সমস্তমায়ায় বন্ধন ছিন্ন করিয়া গুরুদেবের আশ্রয়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। সংসার ত্যাগ করা, আর মায়ার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা এই উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। আমরা সংসার ত্যাগ করিয়াছি বটে, কিন্তু মায়ার হাত হইতে অব্যাহতি পাই নাই। গুরুদেবের নিকট আসিয়া অবধি তাঁহার অপরাপর শিষ্যগণের সহিত আমার বিশেষ সদ্ভাব হইল। বিশেষতঃ বেহারীর উদার স্বভাব, অমায়িক ভাব ও সরল এবং অকৃত্রিম আচরণে সকলেই তাহার উপর সন্তুষ্ট। তাহা না হইলে আজ তাহার বিহনে মন্দিরের সকলেই অনাহারে থাকিবেন কেন?” 

আমি বলদেবের কথায় আন্তরিক প্রীত হইলাম। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “আজ বেলা একটার সময় বেহারীর সহিত কাহার দেখা হইয়াছিল?” 

ব। আজ্ঞে আমার কোন পরিচিত লোকের। 

আ। তাঁহার বাড়ী কোথায়? 

ব। এখান হইতে অর্দ্ধক্রোশ দূরে। 

আ। নাম কি? 

ব। হৃষীকেশ চট্টোপাধ্যায়। 

আ। তিনি কি বেহারীগিরিকে চিনিতেন? 

ব। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। কোন্ সূত্রে তাঁহার সহিত বেহারীর আলাপ হইল? বেহারী একজন সংসার-বিরাগী পুরুষ, গৃহীর সহিত তাঁহার সংশ্রব কেমন করিয়া হইল? 

ব। হৃষীকেশ বড় ধর্ম্মভীরু লোক। ধর্ম্মে তাঁহার বিশেষ আস্থা আছে। যেখানে ধৰ্ম্ম-কথা হয়, ধৰ্ম্ম- চর্চ্চা হয়, সেইখানেই হৃষীকেশ থাকিতে ভালবাসেন। তিনি এখানেও অনেকবার আসিয়াছিলেন এবং এখনও আসিয়া থাকেন। গুরুদেবের মুখে ধর্ম্ম-কথা বা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা শুনিতে তাঁহার বড় আগ্রহ। 

আ। বেহারীগিরির কথা তিনি কি বলিয়াছিলেন? কেমন করিয়া আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল? 

ব। বেলা নয়টার পূর্ব্বেই আমি মন্দির হইতে বাহির হইয়া বেহারীর অন্বেষণ করিতে আরম্ভ করি। যেখানে যেখানে বেহারী যাইত, প্রথমে সেই সেই স্থানেই গমন করিয়াছিলাম। বেহারী কখনও কখনও হৃষীকেশের নিকট গমন করিত। সেই জন্য আমি তাঁহার বাড়ীতে গিয়া বেহারীর সন্ধান লই। 

আ। কখন আপনি তাঁহার বাড়ীতে গিয়াছিলেন? 

ব। তখন বেলা প্রায় তিনটা। 

আ। তিনি কি স্বয়ং বেহারীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন? 

ব। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। বেলা একটার সময়? 

ব। হৃষীকেশের মুখে ওই কথাই শুনিয়াছি। 

আ। বেহারী কি একা যাইতেছিলেন? 

বলদেব কোন উত্তর করিলেন না। তিনি মস্তক অবনত করিয়া আমার সম্মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন। পরে আমার মুখের দিকে চাহিয়া সলজ্জ ভাবে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে আমি সে কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। হৃষীকেশ ও আমায় সে বিষয়ে কোন কথা বলেন নাই।” 

আমি বলদেবের কথায় সন্তুষ্ট হইলাম না। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আমাকে তাঁহার নিকট লইয়া যাইতে পারেন? তাঁহার মুখের কথা না শুনিয়া আমি কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিব না।” 

আমার কথায় বলদেব তখনই সম্মত হইলেন। তিনি বলিলেন “আমি এখনই প্রস্তুত আছি, যাহাতে বেহারীর সন্ধান হয়, আমি প্রাণপণে তাহার সাহায্য করিব।” 

যে সময়ে বলদেব এই কথা বলিল, তখন রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছিল। সেই রাত্রে সেখান হইতে আরও অর্দ্ধক্রোশ পথ গিয়া একজন সংসারী লোককে বিরক্ত করা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না। বলদেবকে বলিলাম “আজ অনেক রাত্রি হইয়াছে। এমন সময় আর কোন কার্য্য হওয়া অসম্ভব। কাল প্রত্যূষে আপনি আমার নিকট যাইবেন। সেখান হইতে উভয়ে একত্রে হৃষীকেশের নিকট গমন করিব।” 

এই বলিয়া মনোহরগিরির দিকে চাহিয়া বলিলাম, “আজ চলিলাম। আমার বোধ হয়, ভিতরে কোন ভয়ানক গূঢ় রহস্য নিহিত আছে। নতুবা বেহারীগিরি বালক নহেন যে, পথ ভুলিয়া আর কোথাও গিয়া পড়িবেন। আমার বড় ভাল বোধ হইতেছে না।” 

এই বলিয়া আমি গাত্রোত্থান করিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনোহরগিরিও উঠিলেন এবং আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ মন্দিরের দ্বারদেশ পর্যন্ত আগমন করিলেন। দ্বারে আসিয়া দেখিলাম, একখানি সেকেণ্ড ক্লাসের ভাড়াটীয়া গাড়ি অপেক্ষা করিতেছে। মনোহর আমাকে তাহাতে আরোহণ করিতে অনুরোধ করিলেন। পরে বলিলেন “এখন আপনিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। যাহাতে বেহারীর সন্ধান হয়, তাহা আপনিই করিবেন। অর্থের অভাব বিবেচনা করিবেন না। যদি ইহার ভিতর কোনপ্রকার চাতুরী কি প্রতারণা দেখিতে পান, তাহা হইলে প্রতারক যাহাতে আইন অনুসারে দণ্ডনীয় হয়, সে বিষয়ে আপনি মনোযোগ করিবেন। আমরা অনেক দিন সংসার ত্যাগ করিয়াছি। সংসারের কুটিলতা অনেক কাল ভুলিয়া গিয়াছি। আপনারা যতদূর বুঝিতে পারিবেন, আমরা সেরূপ পারিব না। অধিক বলা বাহুল্য মাত্র।” 

মনোহরগিরি এই কথা বলিয়া এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম “তিনি বেহারীর শোকে কাতর হইয়া পড়িয়াছেন। মিষ্ট বাক্যে তাঁহাকে সন্ত্বনা করিলাম। বলিলাম, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করিব, এবং যাহাতে দোষী উচিতমত শাস্তি পায়, তাহার উপায় করিব। 

আমার কথায় তিনি কিছু বলিলেন। আমি কোচম্যানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করিলাম। প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় থানায় ফিরিয়া আসিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

রাত্রি প্রভাত হইবার কিছু পূর্ব্বে একজন কনেষ্টবল আমায় সংবাদ দিল, বলদেব নামে একজন পশ্চিমদেশীয় যুবক বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন। 

আমি নিদ্রিত ছিলাম। যখন কনেষ্টবলের কথা আমার কর্ণ গোচর হইল, আমি তখনই শয্যাত্যাগ করিলাম এবং মুখাদি প্রক্ষালন করিয়া বাহিরে আসিলাম। বলদেব আমার অপেক্ষায় অফিস ঘরের সম্মুখস্থ বারান্দার একখানি বেঞ্চের উপর বসিয়াছিলেন। আমায় দেখিবামাত্র সসম্ভ্রমে দণ্ডায়মান হইয়া নমস্কার করিলেন। আমিও প্রতিনমস্কার করিয়া, তাহার সহিত বাহিরে আসিলাম এবং থানার ফটকের নিকট গিয়া গাড়ির অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই একজন কনেষ্টবল একখানি সেকেণ্ড ক্লাস গাড়ি লইয়া তথায় উপস্থিত হইল। আমি বলদেবকে লইয়া তাহাতে আরোহণ করিলাম। পরে বলদেবের নিকট হইতে হৃষীকেশের সন্ধান জানিয়া লইয়া, কোচম্যানকে নির্দিষ্ট স্থানে যাইতে আদেশ করিলাম। 

কিছুদূর গমন করিলে পর, আমি বলদেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম “শুনিয়াছি, মন্দিরের আয় অনেক, কত টাকা হইবে অনুমান করেন?” 

বলদেব ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন “আপনি শোনেন নাই, মাসিক প্রায় দুই সহস্র মুদ্রা কালভৈরবের সেবার জন্য নিৰ্দ্দিষ্ট আছে।” 

আ। কিরূপে কোথা হইতে ওই টাকা আইসে?’ 

ব। কালভৈরবের নামে একটি বিস্তৃত জমীদারী আছে। তাহারই আয় বার্ষিক প্রায় তেইশ হাজার টাকা। 

আ। খরচ বাদ? 

ব। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। ওই টাকা কাহার নিকট থাকে? 

ব। সেবায়েতের নিকট। 

আ। তিনি কি উহা যথেচ্ছা ব্যবহার করিতে পারেন? 

ব। আজ্ঞে হাঁ—তবে বাৎসরিক একটা হিসাব দাখিল করিতে হয়। 

আ। কোথায়? 

ব। যিনি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন এবং দেবতার নামে এত টাকার সম্পত্তি উৎসর্গ করিয়াছেন তাঁহার নিকট এখন তিনি নাই—হিসাব তাঁহারই বংশধরের নিকট প্রেরিত হয়। 

আ। সেবায়েত নির্ব্বাচিত হয় কিরূপে? 

ব। বর্তমান সেবায়েত দ্বারাই নির্বাচিত হয়। তিনিই জীবদ্দশায় একজন শিষ্যকে তাঁহার পদের উপযুক্ত করিয়া যান। 

আমার কৌতূহল বৃদ্ধি হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “মনোহরগিরি কি আপনাদের মধ্যে কোন শিষ্যকে তাঁহার পদের উপযুক্ত নির্বাচন করিয়াছেন?” 

বলদেব আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ—তিনি বেহারীকেই ভাবী সেবায়েত করিবেন বলিয়া মনস্থ করিয়াছেন। গুরুদেব বেহারীকে পুত্রাধিক স্নেহ করিয়া থাকেন; বেহারী গুরুদেবের একান্ত ভক্ত।” 

কিছুক্ষণ পরে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “বেহারীর কোন শত্রু আছে আপনি জানেন?” 

আমার কথায় বলদেব চমকিত হইলেন। তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া চাহিয়া, পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন? আপনি সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? তবে কি বেহারীর কোনরূপ অনিষ্ট আশঙ্কা করিতেছেন?” 

আমি বলিলাম “সন্দেহ করিতেছি মাত্র। আপনি কি বেহারীর কোন শত্রুকে জানেন?” 

বলদেব আমতা আমতা করিয়া বলিলেন “পূর্ব্বে সে শত্রু ছিল বটে, কিন্তু এখন নয়। এক সময় সে বেহারীর উপর বড়ই রাগান্বিত হইয়াছিল।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন?” 

বলদেব ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “গুরুদেব বেহারীকে ভাবী সেবায়েত বলিয়া স্থির করিয়াছেন; এই অপরাধ।” বলদেবের মুখে এই নূতন সংবাদ পাইয়া আমি আন্তরিক আনন্দিত হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “সেই লোকটির নাম কি? তিনি কি এখনও আপনাদের গুরুদেবের শিষ্য আছেন?” 

ব। আজ্ঞে তাঁহার নাম কেদারনাথ ভট্টাচার্য্য। তিনি এক সময়ে গুরুদেবের বড় প্রিয় শিষ্য ছিলেন, কিন্তু কিছুদিন হইল, তিনি আর আমাদের মন্দিরে আইসেন না। 

আ। আপনাদের গুরুদেব কি এ সকল কথা জানেন? 

ব। বোধ হয় না। তবে তিনি জানেন যে, কেদারনাথ এখন আর তাঁহার শিষ্য নহেন। 

আ। কেমন করিয়া জানিলেন? 

ব। কেদারনাথ একদিন গুরুদেবকে পত্র লিখিয়াছিলেন। সেই পত্রে তিনি গুরুদেবকে জানাইয়াছিলেন যে, তিনি আর তাঁহার শিষ্য থাকিতে ইচ্ছা করেন না। 

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনাদের মন্দিরে যতগুলি শিষ্যা দেখিতে পাইলাম, তাঁহারা সকলেই পশ্চিমদেশবাসী ব্রাহ্মণ। কিন্তু কেদারনাথ নাম শুনিয়া ও তাঁহার ভট্টাচার্য্য পদবী জানিয়া বোধ হইতেছে, তিনি বাঙ্গালী। আপনাদের মন্দিরে কি আর কোন বাঙ্গালী শিষ্য আছেন?” 

ব। আজ্ঞে না। গুরুদেব এক কেদারনাথ ভিন্ন আর কোন বাঙ্গালীকে তাঁহার শিষ্য করেন নাই এবং আর করিবারও ইচ্ছা নাই। যখন কেদারনাথ তাঁহার শিষ্যত্ব লাভ করিবার জন্য বারম্বার অনুরোধ করেন, তখন গুরুদেব স্পষ্টই বলিয়াছিলেন যে, তিনি কোন বাঙ্গালীকে শিষ্য করিতে অভিলাষ করেন না। কিন্তু অবশেষে কেদারের নির্ব্বন্ধাতিশয় দেখিয়া অগত্যা সম্মত হন। 

আ। তিনি কি এখনও জীবিত আছেন? 

ব। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। তাঁহার নিবাস কোথায় জানেন? 

ব। আজ্ঞে ঠিক জানি না। কেদারনাথ পূর্ব্বে যেস্থানে বাস করিতেন, সে বাড়ী আমার জানা আছে বটে, কিন্তু তিনি এখন সেই বাড়ীতে বাস করেন কি না, বলিতে পারি না। 

আ। বেহারীর সহিত কি তাঁহার মৌখিক বিবাদ হইয়াছিল? 

বলদেব কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া উত্তর করিলেন “আজ্ঞে না। তবে তিনি বেহারীর সহিত কিছুদিন বাক্যালাপ করেন নাই।” 

আ। কতদিন? 

ব। প্রায় এক বৎসর। 

আ। তাহার পর? 

ব। আবার উভয়ের সদ্ভাব হইয়াছিল। 

আ। কোন্ সূত্রে? 

ব। সে কথা বলিতে পারিলাম না। তবে বেহারী যেরূপ সরল প্রকৃতির লোক, তাহাতে হয়ত কেদারনাথের মিষ্ট কথায় ভুলিয়া গিয়া পুনরায় তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিয়াছিলেন। 

আ। এ সকল কথা কি আপনাদের গুরুদেব জানেন? 

বলদেব ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “আজ্ঞে না। বিশেষ আবশ্যকীয় কথা না হইলে আমরা তাঁহাকে অপর কোন বিষয় অবগত করি না।” 

আ। কেদারনাথের সহিত আপনাদের সদ্ভাব আছে? 

ব। আজ্ঞে সদ্ভাব নাই– আলাপ পরিচয় আছে মাত্র। তিনি কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিলে আমরা উপযাচক হইয়া কোন কথা বলি না। 

আ। আপনাদের সহিত কি তাঁহার প্রায়ই দেখা হয়? 

ব। মধ্যে মধ্যে -মাসে অন্ততঃ একবার। 

আ। কিরূপে সাক্ষাৎ হয়? তিনি কি আপনাদের মন্দিরে আইসেন? 

ব। আজ্ঞে না—সে কথা ত পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি। দেখা করিবার ইচ্ছা হইলে তিনি মন্দিরের নিকট অপেক্ষা করেন।

আ। আপনাদের গুরুদেব কি সে অবস্থায় তাঁহাকে দেখিতে পান নাই? 

ব। সম্ভব নহে—কেন না, গুরুদেব সদাই নিজের গৃহে থাকেন; কদাচ কখন মন্দিরের দ্বারে যান। এইরূপ নানা কথায় গাড়িখানি হৃষীকেশের বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইল। তখন বলদেব যথাস্থানে কোচম্যানকে গাড়ি থামাইতে আদেশ করিলেন। শকট স্থগিত হইলে আমরা উভয়েই অবতরণ করিলাম। কোচম্যানকে একস্থানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমি বলদেবের সহিত হৃষীকেশের বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

যখন হৃষীকেশের বাড়ীর সদর দ্বারে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা আটটা বাজিয়াছিল, হৃষীকেশের বাড়ীখানি ক্ষুদ্র হইলেও দ্বিতল এবং বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ীতে যেন মূর্ত্তিমতী শান্তি বিরাজমানা। বাড়ীখানির অবস্থা দেখিয়া আমি বড়ই প্রীত হইলাম। 

আমাকে সদর দ্বারে অপেক্ষা করিতে বলিয়া বলদেব ভিতরে প্রবেশ করিলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই একজন প্রৌঢ়কে সঙ্গে লইয়া পুনরায় আমার নিকটে আগমন করিলেন। পরে বলিলেন “ইহাঁরই নাম হৃষীকেশ চট্টোপাধ্যায়।” 

আমাকে পুলিস-কৰ্ম্মচারী দেখিয়া হৃষীকেশ যেন আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। কিন্তু সে কেবল অল্পক্ষণের জন্য। পরক্ষণেই আমার দিকে চাহিয়া সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিলেন “বলদেবের মুখে শুনিলাম, আপনি কোন সংবাদ জানিবার জন্য কুটীরে পদার্পণ করিয়াছেন। অনুমতি করুন, কি জানিতে ইচ্ছা করেন? আমি অতি সামান্য লোক, আপনার ন্যায় লোকের আদর অভ্যর্থনা করিবার সামর্থ্য নাই।” 

হৃষীকেশকে দেখিতে বেশ সুপুরুষ। তাঁহার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর। দেহ হৃষ্টপুষ্ট, দেখিতে গৌরবর্ণ। শরীরের লাবণ্য দেখিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। বিশেষতঃ তাঁহার সরল কথায় আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। পরে বলিলাম “আমার মত সামান্য লোকের জন্য আপনার ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই। আপনাদের সহিত তুলনায় আমি অতি সামান্য লোক।” 

হৃষীকেশ আমার কথায় ঈষৎ হাস্য করিলেন। পরে অতি যত্নের সহিত একতলার একটি প্রশস্ত গৃহে লইয়া গেলেন। বলদেবও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিলেন। 

ঘরের মেঝের উপর টানা বিছানা ছিল। আমরা তিনজনে তথায় উপবেশন করিলাম। কিছুক্ষণ এইরূপে অতীত হইলে পর আমি হৃষীকেশের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “বেহারীগিরির সহিত আপনার সদ্ভাব আছে কি?” 

হৃষীকেশ অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে হাঁ―তাঁহার ন্যায় সাধু সচ্চরিত্র লোকের সঙ্গই আমি প্রার্থনা করিয়া থাকি। আপনার কথা শুনিয়া বোধ হইতেছে, তিনি এখনও মন্দিরে ফিরিয়া যান নাই।”

আ। আজ্ঞে না— আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য। শুনিলাম, কাল না কি আপনার সহিত বেহারীর দেখা হইয়াছি? সেইজন্যই আমরা আপনার নিকট আসিয়াছি। 

হৃ। আজ্ঞে হাঁ—বেহারীগিরির সহিত কাল বেলা প্রায় একটার সময় আমার দেখা হইয়াছিল। 

আ। কোথায়? 

হৃ। এই গ্রামের কিছু উত্তরে একটা প্রকাণ্ড মাঠ আছে; সেই মাঠের পার্শ্ব দিয়া সরকারী পথ। আমি বেহারীগিরিকে সেই পথ দিয়া যাইতে দেখিয়াছিলাম। 

আ। তিনি কি একাই ছিলেন? 

হৃ। আজ্ঞে হাঁ; একাই যাইতেছিলেন। 

আ। তখন সে পথে লোক সমাগম কেমন? 

হৃ। বড় অধিক লোক ছিল না। তবে আরও একজন পরিচিত ব্যক্তির সহিত আমার দেখা হইয়াছিল। 

আমার কেমন সন্দেহ হইল। কিছুক্ষণ ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার সেই পরিচিত ব্যক্তির সহিত কি বেহারীগিরির পরিচয় আছে বলিয়া বোধ হয়?” 

হৃষীকেশ অতি সরল ব্যক্তি, তিনি আমার কথায় তখনই বলিলেন, “আজ্ঞে হাঁ—আছে বৈ কি? কেদারনাথের সহিত বেহারীগিরির পরিচয় আছে। তবে সদ্ভাব নাই।” 

আমার সন্দেহ সত্যে পরিণত হইল দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম, “উভয়ের মধ্যে কতখানি পথ ব্যবধান ছিল?” 

হৃষীকেশ আমার কথায় যেন সন্দিগ্ধ হইলেন। আমি যে কেন তন্ন তন্ন করিয়া এত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তিনি ভাল বুঝিতে পারিলেন না। আমার মুখের দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ পরে বলিলেন ““বড় বেশী নয়। আপনার কথায় আমার যেন মনে পড়িতেছে, বেহারীগিরি একবার কেদারের দিকে চাহিয়াছিলেন। কেদারনাথ কি যেন সঙ্কেত করায় বেহারী সত্বর সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার কোনরূপ সন্দেহ হইল না? আপনিও জানিতেন যে কেদারনাথের সহিত বেহারীগিরির সদ্ভাব নাই। তবুও যখন আপনি কেদারনাথকে সঙ্কেত করিতে দেখিলেন, তখন আপনার কি কিছুই মনে হইল না?” 

হৃষীকেশ আমার কথায় নিতান্ত লজ্জিত হইলেন। কোনরূপ উত্তর কিম্বা প্রতিবাদ করিলেন না। তাঁহার মলিন মুখ দেখিয়া আমি তাঁহাকে আর কোন কথা না বলিয়া বলদেবের দিকে ফিরিয়া বলিলাম “আমি যেরূপ সন্দেহ করিয়াছিলাম, ঠিক সেইরূপই হইয়াছে। আমার বড় ভাল বোধ হইতেছে না। যখন বেহারীর অতীব শত্রুর সহিত তাঁহাকে শেষ দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, তখন বেহারীর অদৃষ্টে কি হইয়াছে বলিতে পারি না। এখন আপনাদের কাহারও সেই কেদারনাথের বাড়ী জানা আছে কি?” 

বলদেব আমার কথায় দুঃখিত হইলেন। তিনি বিষণ্ণ বদনে উত্তর করিলেন “আমি তাঁহার পূর্ব্বের বাসস্থান জানি। কিন্তু সেটা তাঁহার নিজের বাড়ী নয়। যদি তিনি ইতিমধ্যে আর কোথাও গিয়া থাকেন তাহা হইলে আমি সে ঠিকানা জানি না।” 

হৃষীকেশ বলিলেন, “আমি তাঁহার কোন বাড়ীই জানি না। তিনি যখন মধ্যে মধ্যে আপনাদের মদিরে যাইতেন সেই সময়ে তাঁহার সহিত আমার আলাপ হয় কিন্তু তাঁহার প্রকৃতি বড় উগ্র বলিয়া আমি তাঁহার সহিত বিশেষ সংশ্রষ রাখিতাম না।” 

আমি কোন উত্তর করিলাম না। দেখিতে দেখিতে বেলা দশটা বাজিয়া গেল দেখিয়া সেখানে আর সময় নষ্ট করা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না। সত্বর হৃষীকেশের নিকট বিদায় লইয়া বলদেবের সহিত বাহিরে আসিলাম এবং পুনরায় উভয়ে শকটে আরোহণ করিয়া কেদারনাথের বাড়ীর দিকে যাইতে লাগিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

প্রায় এগারটার সময় একখানি কুটীরের সম্মুখে আমাদের গাড়ি স্থির হইল, বলদেব তখনই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন এবং সেই কুটীরের দ্বারে গিয়া কেদারনাথকে ডাকিতে লাগিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে একটি বালক দৌড়িতে দৌড়িতে বাহিরে আসিল ও বলদেবকে কহিল, “আপনি কাহাকে ডাকিতেছেন?” 

বলদেব বলিলেন, “এখানে কেদারনাথ নামে কোন ব্রাহ্মণ বাস করেন?” 

বালক হাসিতে হাসিতে বলিল, “তিনিই ত আমার পিতাঠাকুর। এই বাড়ীতেই তিনি থাকেন।” 

বালকটির বয়স প্রায় পনের বৎসর। দেখিতে শ্যামবর্ণ হইলেও তাহার মুখশ্রী অতি সুন্দর; কথাবার্তায় চতুর বলিয়া বোধ হইল। বালকের মুখে যে সকল কথা শুনিতে পাইলাম, তাহাতে আমি আর নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না। তখনই শকট হইতে অবতরণ করিয়া সেই কুটীরদ্বারে বলদেবের নিকট গমন করিলাম। 

বালক এতক্ষণ বলদেবের সহিত বেশ কথা কহিতেছিল। কিন্তু আমাকে পুলিস কর্ম্মচারী দেখিয়াই হউক কিম্বা আর কোন কারণেই হউক, সে আর কোন কথা কহিল না। 

বালকের কার্য্য দেখিয়া আমি বিস্মিত হইলাম এবং অতি মিষ্ট কথায় তাহাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম ‘তোমার নাম কি বাবা?” 

আমার কথায় বালকের ভয় দূর হইল, সে অতি ধীরে ধীরে আমার নিকটে আমগন করিল এবং আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “আমার নাম সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।” 

আ। তুমি কি কাজ কর? 

সু। এখনও লেখাপড়া করি। 

আ। কোন্ শ্রেণীতে পড় বাবা? 

সু। আজ্ঞে-দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আর বৎসর প্রবেশিকা পরীক্ষা দিব। 

আ। তোমার পিতা কোথায় বলিতে পার? 

সুরেন্দ্রনাথ সহসা কোন উত্তর করিল না। কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া বলিল “আজ্ঞে সে কথা বলিতে পারিলাম না।” বালকের কথায় আমি স্তম্ভিত হইলাম। মনে করিলাম, বোধ হয় কেদারনাথ পূবর্ব হইতেই পুত্রকে সাবধান করিয়া দিয়া থাকিবেন। কিন্তু মুখে সে সকল কথা না বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কি কথা! তোমার পিতা কোথায় তুমি বলিতে পারিতেছ না? এ বড় লজ্জার কথা।” 

আমার কথায় বালক কিছুমাত্র লজ্জিত হইল না। সে হাসিতে হাসিতে বলিল, “আমি ত বাড়ীতে ছিলাম না। আজ প্রাতে আসিয়াছি মাত্র।” 

আ। কোথায় গিয়াছিলে? 

সু। মাতুলালয়ে। 

আ। কবে? 

সু। আজ চারি দিন হইল। 

আ। কি জন্য? 

সুরেন্দ্রনাথ আমার শেষ প্রশ্নে যেন বিরক্ত হইল। সে কর্কশস্বরে বলিল “এমন কিছু কারণ ছিল না। তবে আমার দিদিমার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ হইয়াছে। সেই উপলক্ষে জনকয়েক ব্রাহ্মণভোজনও হইয়াছিল। আমিও সেইজন্য গিয়াছিলাম।” 

আ। তোমার পিতা গিয়াছিলেন কি? 

সু। আজ্ঞে না—তাঁহার এখানে কি জরুরি কাজ ছিল, সেই জন্য আমার সহিত সেখানে যাইতে পারেন নাই।

আমি কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলাম “তোমার পিতার সংবাদ তুমি না জানিতে পার, কিন্তু বাড়ীর লোকে তা জানে। একবার ভিতরে গিয়া সংবাদটি আন দেখি।” 

সুরেন্দ্রনাথ আমার কথায় ভিতরে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল “কাল বৈকালে তিনি এক বন্ধুর বাড়ীতে গিয়াছেন, এখনও আসেন নাই।” 

সুরেন্দ্রনাথ যেরূপ করিয়া ওই কথাগুলি বলিল, তাহাতে আমার বিশ্বাস হইল না। আমার বোধ হইল, কেদারনাথ বাড়ীতেই আছেন। তিনিই তাঁহার পুত্রকে যে ওইরূপ শিখাইয়া দিয়াছেন, তাহাও আমার বুঝিতে বাকি রহিল না। আমি সুরেন্দ্রকে আর কোন কথা বলিলাম না। বলদেবকে সঙ্গে লইয়া তখনই তথা হইতে বাহির হইলাম এবং শকটারোহণে কিছুদূর প্রত্যাগমন করিলাম। 

কেদারনাথের বাড়ী হইতে প্রায় অৰ্দ্ধ ক্রোশ দূরে আসিয়া, আমি কোচম্যানকে গাড়ি থামাইতে আদেশ করিলাম। গাড়ি স্থগিত হইলে, আমি বলদেবকে সেই স্থানে রাখিয়া স্বয়ং নিকটস্থ থানায় গমন করিলাম এবং সেখানকার দারোগোবাবুর নিকট হইতে আবশ্যকীয় ছদ্মবেশ সংগ্রহ করিয়া সেইখানেই পরিধান করিলাম। 

যখন সেই ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া গাড়িতে বলদেবের নিকট আগমন করিলাম, তখন তিনি আমায় চিনিতে পারিলেন না। আমি গাড়িতে উঠিতে যাইতেছি দেখিয়া, তিনি অতি মিষ্ট কথায় নিষেধ করিলেন। বলিলেন “এখানি একজন পুলিস কর্মচারীর গাড়ি। তিনি আমাকে রাখিয়া নিকটে কোথাও গিয়াছেন। নিশ্চয়ই শীঘ্র ফিরিয়া আসিবেন।” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিলাম। আমার পরিধানে বলদেবের মত গৈরিক বসন, গৈরিক উত্তরীয়, পায়ে খড়ম্, হস্তে একগাছি লাঠি, গলায় ও হস্তে কতকগুলি রুদ্রাক্ষের মালা। তখন আমাকে দেখিতে ঠিক সন্ন্যাসীর মতই হইয়াছিল। 

আমাকে তাঁহার বাক্য অবহেলা করিতে দেখিয়া, বলদেব বিরক্ত হইলেন। তিনি কৃত্রিম কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক বলিলেন, “মহাশয় আমার কোন অপরাধ লইবেন না; দারোগাবাবু এখানে আসিয়া যখন আপনাকে গাড়ির উপর দেখিতে পাইবেন তখন নিশ্চয়ই তিনি রাগান্বিত হইবেন, এবং আপনাকে তিরস্কার করিবেন। 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “আপনার কোন চিন্তা নাই। আমি তাঁহার পরিচিত।” 

আমার কণ্ঠস্বরে বলদেব চমকিত হইলেন। তিনি ভাল করিয়া আমার মুখের দিকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। পরে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আমি আপনাকে চিনিতে পারি নাই? এমন অদ্ভুত ছদ্মবেশ আর কখনও দেখি নাই। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এ বেশে কি করিবেন?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “আবার কেদারনাথের বাড়ী যাইব। তাঁহার পুত্রের মুখে যে সকল কথা শুনিলাম, তাহা বিশ্বাস হইল না। আমার বোধ হয়, কেদারনাথ এখনও বাড়ীতে আছেন। পাছে পুলিসের বেশ দেখিয়া তিনি কিম্বা তাঁহার বাড়ীর লোক ভীত হয়, এইজন্যই আমার এই ছদ্মবেশ। এ বেশে যাইলে কেদারনাথ হয়ত সাক্ষাৎ করিতে অসম্মত হইবেন না।” বলদেব হাসিয়া বলিলেন, “আপনার অনুমান সত্য। যোগী, ঋষি ও সন্ন্যাসীর উপর কেদারনাথের বড় ভক্তি। আপনার ন্যায় সন্ন্যাসীকে দেখিলে তিনি নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ করিবেন। কিন্তু যদি আপনি গাড়ি করিয়া আবার সেখানে যান, তাহা হইলে হয়ত সেই বালকের সন্দেহ হইতে পারে। তাহাতে আপনার কার্য্যসিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটিবে।” আ। আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আমি অধিকদূর গাড়িতে যাইব না। কেদারনাথের বাড়ী হইতে কিছুদূরে আপনাকে গাড়িতে রাখিয়া আমি একাই পদব্রজে তাঁহার বাড়ীতে যাইব। 

ব। অতি উত্তম সংকল্প। 

আমি তখন আর কোন কথা না বলিয়া কোচম্যানকে পুনরায় কেদারনাথের বাড়ীর দিকে যাইতে আদেশ করিলাম। শকট চালিত হইল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

কেদারনাথের বাড়ী হইতে প্রায় একশত গজ দূরে এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ ছিল। সেই বৃক্ষের তলায় ভদ্রলোকের বসিবার উপযোগী দুই তিনখানি বেঞ্চও ছিল। নিকটস্থ ভদ্রমণ্ডলী প্রায় প্রত্যহই সায়ংকালে সেইখানে উপবেশন করিয়া গল্প গুজব করিয়া থাকেন! 

কোচম্যানকে সেই স্থানে গাড়ি রাখিতে আদেশ করিয়া স্বয়ং অবতরণ করিলাম এবং বলদেবকে গাড়িতে অপেক্ষা করিতে অনুরোধ করিয়া অতি ধীরে ধীরে কেদারনাথের বাড়ীর দিকে যাইতে লাগিলাম। 

যখন কেদারনাথের কুটীরের দরজায় উপস্থিত হইলাম, তখন অনেক বেলা হইয়াছিল। স্নানাহার না করিয়া প্রাতঃকাল হইতেই এই কার্য্যে নিযুক্ত ছিলাম। বেলা অধিক হওয়ায় ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হইয়া পড়িলাম। কিন্তু কি করিব, যে কাৰ্য্যে আসিয়াছি তাহা শেষ না করিয়া যাইতে পারি না। অগত্যা সেই কুটীর দ্বারে গিয়া চীৎকার করিয়া বলিলাম “ভিক মিলে গা মায়ী? একমুষ্টি আটা মিলেগা মায়ী?” 

আমার চীৎকারে একজন বাহিরে আসিলেন। তাহাকে দেখিয়াই আমার কেমন সন্দেহ হইল। বোধ হইল, তিনিই সেই বালকের পিতা। সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেই ব্যক্তির মুখের বেশ সাদৃশ্য আছে। তিনি নিকটে আসিয়া অতি কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি চাও বাপু?” 

আমি বলিলাম “একমুষ্টি আটা।”

তিনি হাসিয়া বলিলেন “আমিই খাইতে পাই না, তা ভিক্ষা দিব কি? যাও—এখানে কিছু হবে না।” 

আমি হিন্দি ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলাম “নিকটে কোন দেবালয় আছে কি না? তিনি কালভৈরবের মন্দির নির্দ্দেশ করিলেন। বলিলেন সেখানে গমন করিলে অনায়াসে আহার সংগ্রহ করিতে পারিবে।” 

আমিও সুবিধা পাইলাম। ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “যদি তাঁহার সহিত মন্দির-স্বামীর আলাপ থাকে, তাহা হইলে আমার নাম দিয়া একখানি পত্র দিলে ভাল হয়।” পত্রের কথায় তিনি যেন বিরক্ত হইলেন। আমিও আর সে কথা তুলিলাম না। 

কিছুক্ষণ পরে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “শুনিয়াছি, আমার পরম বন্ধু বেহারী নামে কোন সন্ন্যাসী নিকটস্থ কোন দেবালয়ে বাস করেন। আপনি জানেন কি, তিনি কোথায় থাকেন? তাঁহার ন্যায় সাধুব্যক্তির সহিত আপনার সদ্ভাব আছে কি?” 

আমার কথায় তিনি যেন কি সন্দেহ করিলেন। কোন উত্তর করিলেন না, আমার আপাদ মস্তক ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলেন। শেষে অতি কর্কশ ভাবে বলিয়া উঠিলেন “কে তোমার বেহারী? আমি কোন বেহারীকে জানি না।” 

কথাগুলি এরূপে উচ্চারণ করিলেন যে, আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, তিনি মিথ্যা বলিতেছেন; তিনি যে রাগান্বিত হইয়াছেন, তাহাও বুঝিতে পারিলাম। তত্রাপি বলিলাম “আপনি একবার ভাল করিয়া স্মরণ করুন। বেহারী নিশ্চয় একজন প্রসিদ্ধ লোক। তাঁহার ন্যায় লোককে আপনি জানেন না, এ কথা অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতেছে। আমি একজন সন্ন্যাসী, আপনি গৃহী ও পুত্রবান হইয়া আমার নিকট মিথ্যা বলিবেন না। ইহাতে পাপ আছে জানিবেন।” আমার কথায় তিনি যেন চমকিত হইলেন। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া অতি মিষ্ট কথায় জিজ্ঞাসা করিলেন “আমি পুত্রবান কেমন করিয়া জানিলেন?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “আপনার অদৃষ্টের ফলরেখা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। আপনি যে পুত্রের পিতা সে বিষয়ে জানিতে পারেন। আমারও যৎসামান্য জ্যোতিষ শাস্ত্র জানা আছে, সেই জন্যই আমি সহজেই আপনাকে পুত্রবান বলিয়া জানিতে পারিয়াছি।” 

এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে বলদেব পদব্রজে সহসা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে দেখিবামাত্র বলিয়া উঠিলেন “এই যে কেদারনাথ বাড়ীতেই আছেন দেখিতেছি। অথচ কিছুক্ষণ পূর্ব্বে এক বালকের মুখে শুনিলাম, ইনি বাড়ীতে নাই।” 

বলদেবকে দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। কিন্তু কোন কথা বলিলাম না। বলদেব একজন চতুর ব্যক্তি তিনি যে আমার সহিত পূর্ব্বে সেখানে আসিয়াছিলেন, সে কথার উল্লেখ করিলেন না; কিম্বা এমন কোন কথাও বলিলেন না যাহাতে কেদারনাথ আমাকে পুলিস-কৰ্ম্মচারী বলিয়া সন্দেহ করিতে পারেন। বলদেব এমন ভাবে তথায় অপেক্ষা করিতে লাগিলেন, যেন তিনি আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। 

সে যাহা হউক, বলদেব আমাকে বেহারীগিরির কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে না শুনিয়া তিনি স্বয়ং কেদারনাথের দিকে চাহিয়া অতি কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেদারনাথ! আমাদের বেহারীগিরি কোথায় গেলেন বলিতে পারেন?” 

বলদেবের কথায় কেদারনাথ যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। তিনি রাগতস্বরে চীৎকার করিয়া বলিলেন, “আমি কেমন করিয়া জানিব? আপনাদের বেহারীর সহিত আমার সদ্ভাব নাই; আপনি সে কথা বেশ জানেন।” 

কেদারনাথের কথায় বলদেব রাগান্বিত হইলেন। তিনি ক্রোধে অগ্নিশৰ্ম্মা হইয়া উত্তর করিলেন “কাল বেলা একটার পর আপনার সঙ্গে বেহারীগিরি কোথায় যাইতেছিলেন? তাহার পর তিনি আর মন্দিরে ফিরিয়া যান নাই।” 

কে। কে বলিল আমার সহিত বেহারীর কাল দেখা হইয়াছিল? বেহারীর সহিত বহুদিন হইতে আমার বাক্যালাপ নাই। 

ব। আবার ত সদ্ভাব হইয়াছে। কিছুদিন আপনাদিগের মনান্তর হইয়াছিল বটে কিন্তু সে ত আর এখন নাই। আপনাকে আরও কয়েকবার বেহারীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে দেখিয়াছি। 

কেদারনাথ আরও রাগিয়া গেলেন। তিনি ভয়ানক চীৎকার করিয়া বলিলেন “আপনার মিথ্যা কথা। আমার সহিত বেহারীর আলাপ নাই।”

বলদেবও ভয়ানক রাগান্বিত হইলেন। তিনি ক্রোধে অন্ধ হইয়া অত্যন্ত চীৎকার করিয়া বলিলেন “তবে আর আমাদের অপরাধ লইবেন না। আমরা পুলিসে সংবাদ দিয়া এখনই আপনাকে গ্রেপ্তার করাইয়া দিব।” 

পুলিসের নাম শুনিয়া কেদারনাথ যেন ভীত হইলেন; তাঁহার কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ মৃদু হইয়া আসিল। তিনি কোমলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন আপনি আমার উপর অন্যায় দোষারোপ করিতেছেন? বহুদিন হইল, আমার সহিত বেহারীর সাক্ষাৎ হয় নাই।” 

কেদারনাথের সহসা পরিবর্তনে বলদেব হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমরা সন্ন্যাসী মানুষ, মিথ্যা কথা বা অন্যায় আচরণ আমাদের দ্বারা সম্ভব নহে। আপনি যে কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতে আপনার উপরই ভয়ানক সন্দেহ হয়, এবং সেইজন্যই আমরা পূর্ব্বেই পুলিসের আশ্রয় গ্রহণ করি। আপনার সম্মুখে এই যে সন্ন্যাসী দেখিতেছেন, ইহাকে সামান্য লোক মনে করিবেন না। ইনি প্রকৃত সন্ন্যাসী নহেন।” 

বলদেবের কথা শেষ হইতে না হইতে কেদারনাথ একবার চারিদিক অবলোকন করিলেন এবং কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া সহসা বলদেবকে এমন এক ধাক্কা দিলেন যে, বলদেব তখনই পড়িয়া গেলেন। কেদারনাথ সেই সুযোগে সেখান হইতে পলায়ন করিতে চেষ্টা করিলেন। 

আমি প্রস্তুত ছিলাম, তখনই কেদারনাথকে ধরিয়া ফেলিলাম। কেদারনাথ বাস্তবিকই একজন বলিষ্ঠ লোক। আমি একা তাঁহাকে সহজে ধরিয়া রাখিতে পারিলাম না। বলদেব তখনও উঠিতে পারেন নাই যে, আমায় সাহায্য করিবেন। তাহার পর এই সকল গোলমাল শুনিয়া সেই বালক বাড়ীর ভিতর হইতে দৌড়িয়া আসিল এবং পিতাকে মুক্ত করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল। আমি প্রাণপণে কেদারনাথকে ধরিয়া রহিলাম। বলদেব তখনই গাত্রোত্থান করিলেন। 

সৌভাগ্যক্রমে সেই সময়ে একজন কনেষ্টবল সেইদিকে আসিতেছিল। সে দূর হইতে গোলযোগ দেখিয়া দৌড়িয়া নিকটে আসিল এবং আমার অনুরোধে কেদারনাথকে ধরিয়া ফেলিল। ইত্যবসরে বলদেব আসিয়া সেই বালককে গ্রেপ্তার করিলেন। 

আমি তখন সেই কনেষ্টবলের নিকট গিয়া আমার পরিচয় দিলাম। তখনই এক সুদীর্ঘ সেলাম ঠুকিয়া কনেষ্টবল আমার আদেশ অপেক্ষা করিতে লাগিল। 

আমি প্রথমতঃ বলদেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি সহসা এখানে আসিলেন কেন?” 

বলদেব লজ্জিত হইয়া বলিলেন “আপনার বিলম্ব দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল, ভাবিলাম, হয় ত কোন বিপদ ঘটিয়াছে, সেই কারণে কোচম্যানকে সেই বটবৃক্ষতলে অপেক্ষা করিতে বলিয়া, স্বয়ং ধীরে ধীরে এই দিকে আসিতে লাগিলাম। দূর হইতে কেদারনাথকে দেখিয়া আমার মনে বড়ই আনন্দ হইল, আমি দ্রুতগতি নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। কিন্তু পাছে প্রথমে আপনার পরিচয় দিলে আপনি রাগান্বিত হন, এই ভয়ে আপনার কোন কথা বলি নাই। অবশেষে যখন বুঝিলাম যে, কেদারনাথ বড় সহজ লোক নহেন, পুলিসের উৎপীড়ন ভিন্ন কেনো কথা স্বীকার করিবেন না, তখন অগত্যা সকল কথা প্রকাশ করিলাম।” 

বলদেবের কথায় আমি সন্তুষ্ট হইলাম। পরে কেদারনাথকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কি এখনও অস্বীকার করিতেছেন?” 

কেদারনাথ চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসে?” 

আ। কাল আপনার সহিত বেহারীগিরির সাক্ষাৎ হইয়াছিল কি না? 

কেদারনাথ কিছুক্ষণ ভাবিয়া উত্তর করিলেন “আজ্ঞে-হইয়াছিল।” 

আ। কখন? 

কে। ঠিক স্মরণ নাই—বোধ হয় দ্বিপ্রহরের পরে। 

আ। কোথায়? 

কে। এখান হইতে কিছু দূরে একটা প্রকাণ্ড মঠ আছে, সেই মাঠের নিকট দিয়া এক সরকারী পথ উত্তরাভিমুখে চলিয়া গিয়াছে; বেহারীর সহিত সেই পথেই দেখা হইয়াছিল। 

আ। আপনার সহিত সম্প্রতি তাঁহার সদ্ভাব আছে? 

কে। আজ্ঞে না—পূর্ব্বে ছিল। বিশেষ কোন কারণে আমাদের মনান্তর হয়। 

আমি হাসিয়া বলিলাম “সে সকল কারণ আমার জানা আছে। কিন্তু আপনাদের ত পুনরায় সদ্ভাব হইয়াছিল?” কে। সদ্ভাব নাই, তবে সামান্য আলাপ আছে মাত্র। 

আ। কাল যখন দেখা হইয়াছিল, তখন কোনরূপ কথাবার্তা হইয়াছিল? 

কেদারনাথ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন “আজ্ঞে না – কোন কথা হয় নাই। দেখা হইলে আমরা উভয়েই ঈষৎ হাসিয়া সম্ভাষণ করিয়াছিলাম, বাক্যালাপ করি নাই।” 

আ। বেহারী এখন কোথায় বলিতে পারেন? 

কে। নিশ্চয়ই মন্দিরে আছেন। 

আ। না-তিনি কাল প্রাতঃকাল হইতে মন্দিরে ফিরিয়া যান নাই। 

কেদারনাথ আশ্চর্যান্বিত হইলেন। তিনি ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “ধর্ম্মের ভাণ করিয়া বেহারী যে সকল কাৰ্য্য করেন, তাহাতে তাঁহাকে অতি নীচ প্রকৃতির লোক বলিয়া বেধ হয়। হয়ত তিনি কোন স্ত্রীলোকের প্রেমে মুগ্ধ হইয়াছেন।” বলদেব এতক্ষণ কোন কথা কহেন নাই। কিন্তু কেদারনাথের শেষ কথা শুনিয়া তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন “আপনার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা।” 

আমারও সেইরূপ বোধ হইল। আমি অতি কর্কশস্বরে বলিয়া উঠিলাম “যদি আপনি বেহারীর কোন সন্ধান বলিতে না পারেন, তাহা হইলে আপনাকে এখনই থানায় চালান দিব। আপনার পুত্রকেও ছাড়িয়া দিব না। আপনি পিতা হইয়া এই অল্পবয়স্ক বালককে যে প্রকার মিথ্যা কথা শিখাইয়াছিলেন, তাহাতে আপনাকেই প্রকৃত অপরাধী বলিয়া বোধ হইতেছে। হয় আপনি বেহারীর সন্ধান বলিয়া দিন, না হয় থানায় চলুন।” 

আমার কথায় কেদারনাথের ভয় হইল। তিনি অতি বিনীতভাবে বলিলেন “বেহারী কোথায় কেমন করিয়া বলিব?” আ। কখন আপনার সহিত তাঁহার শেষ দেখা হয়? 

কে। বোধ হয় তখন বেলা পাঁচটা। 

আ। এই বলিলেন, দ্বিপ্রহরের পর আপনাদের দেখা হয়। তবে কি আপনারা চারঘণ্টা কাল একত্রে ছিলেন? 

কে। আজ্ঞে না। দুইবার দেখা হইয়াছিল। শেষবার বেলা পাঁচটার সময়। 

আ। তাহার পর বেহারী কোথায় যান? 

কে। জানি না। 

আ। আপনি জিজ্ঞাসা করেন নাই? 

কে। না। 

আ। কোথয় শেষবার দেখা হইয়াছিল? 

কে। সেই পথ। 

আ। আপনিই বা ততক্ষণ সেখানে ছিলেন কেন? 

কে। বিশেষ কারণ ছিল। কেনো লোকের জন্য আমি সেখানে অপেক্ষা করতেছিলাম। 

আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া বলদেব ও কেদারনাথকে লইয়া শকটে আরোহণ করিলাম, পরে কনেষ্টবলের হস্তে সেই বালকের ভার অর্পণ করিয়া কেদারনাথের কথামত কোচম্যানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করিলাম। 

অর্দ্ধঘণ্টার পরই আমরা মাঠের ধারে সেই পথে উপস্থিত হইলাম। গাড়ি হইতে অবতরণ করিতেছি, এমন সময়ে কতকগুলি লোককে একস্থানে দাঁড়াইয়া গোলযোগ করিতে দেখিতে পাইলাম। একবার মনে হইল, শকট হইতে অবতরণ করিয়া ব্যাপার কি দেখি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, তাহা হইলে হয় ত কেদারনাথ পলায়ন করিবে। 

এই সাব্যস্ত করিয়া আমি বলদেবকে সেই জনতার নিকট পাঠাইয়া দিলাম। বলদেব তখনই আমার অনুরোধ রক্ষা করিলেন এবং তখনই সেই জনতার নিকট গমন করিলেন। কিন্তু অবিলম্বে দৌড়িতে দৌড়িতে আমার নিকট ফিরিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া বালকের মত রোদন করিতে লাগিলেন। 

আমি বলদেবের ব্যবহারে স্তম্ভিত হইলাম। কিন্তু তখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। কিছুক্ষণ পরে তিনি কিয়ৎ পরিমাণে শান্ত হইয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন “সর্বনাশ হইয়াছে দারোগাবাবু! যেখানে ওই জনতা দেখিতে পাইতেছেন, তাহারই নিকটে বেহারীর লাস পড়িয়া রহিয়াছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, কেদারনাথই উহাকে খুন করিয়া মাঠে ফেলিয়া দিয়াছে।” 

আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি আমার উত্তরীয় দ্বারা তাহাকে উত্তমরূপে বন্ধন করিলাম। পরে কোচম্যান ও বলদেবকে তাহার প্রহরী স্বরূপ রাখিয়া আমি সেই মৃতদেহের নিকট গমন করিলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই উহাকে যথাস্থানে প্রেরণ করিলাম। 

তাহার পর শকটের নিকট আগমন করিয়া কেদারনাথের দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এখনও কি অস্বীকার করেন?” 

কেদারনাথ কোন উত্তর করিলেন না। আমি তখন শকটে আরোহণ করিয়া কোচম্যানকে থানার দিকে যাইতে আদেশ করিলাম। 

উপসংহার 

যখন থানায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন বেলা প্রায় চারিটা। সমস্ত দিন অনাহারে থাকিলেও কাৰ্য্য সিদ্ধ হওয়ায় আমার মনে একপ্রকার আনন্দের উদয় হইল। 

থানায় আসিয়া কেদারনাথ আর কোন উচ্চবাচ্য করিলেন না। যেজন্য তাঁহার সহিত বেহারীর বিবাদ হইয়াছিল, যেজন্য তিনি বেহারীর সর্ব্বনাশ সাধন করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, সকল কথাই একে একে প্রকাশ করিলেন। বেহারীর অপরাধ কিছুই ছিল না। মনোহরগিরি তাঁহাকেই ভাবী সেবায়েত করিবেন মনস্থ করায় কেদারনাথের হিংসানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল; এবং তিনি সেই অবধি তাহার সর্ব্বনাশ সাধন করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু পাছে কেহ তাঁহার উপর সন্দেহ করেন, এই ভয়ে কেদারনাথ পুনরায় বেহারীর সহিত সদ্ভাব করিয়াছিলেন। গত কল্য প্রত্যূষে কেদারনাথ বেহারীকে মন্দির হইতে ডাকিয়া আনেন এবং কিছুক্ষণ নিজ বাড়ীতে তাঁহার সহিত ধৰ্ম্মচর্চা করিয়া উভয়ে সেই মাঠের দিকে গমন করেন। বেহারী অনেকবার মন্দিরে যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন কিন্তু কেদারনাথ কৌশলে যাইতে দেন নাই। বেলা একটার পর যখন উভয়ে সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন, তখন হৃষীকেশের সহিত সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কেদারনাথ হৃষীকেশকে দূর হইতে দেখিয়া স্বয়ং ইচ্ছা করিয়া বেহারীর নিকট হইতে কিছুদূর পিছাইয়া পড়েন। এইরূপে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত ঘুরিয়া যখন বেশ অন্ধকার হইয়া আসিল, তখন কেদারনাথ কৌশলে একটি প্রকাণ্ড গহ্বরের নিকট বেহারীকে লইয়া গিয়া সজোরে এমন এক ধাক্কা দিয়াছিলেন যে, বেহারী সেই পতনেই অজ্ঞান হইয়া পড়ে। আরও কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করিয়া কেদারনাথ যখন দেখিলেন, বেহারীর আর সাড়া-শব্দ নাই, তখন সেখান হইতে প্রস্থান করিয়াছিলেন। তাহার পর সেদিন আমি সেই গহ্বরের নিকটে জনতা দেখিয়া বলদেবকে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম, এ কথা পাঠক মহাশয়ের জানা আছে। 

কেদারনাথের কথায় তাঁহাকেই দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করা হইল। বিচারে তাঁহার ফাঁসী হইয়া গেল। তাঁহার পুত্র সুরেন্দ্রনাথের কোন দোষ পাওয়া গেল না। সে কেবল পিতাকে রক্ষা করিবার জন্য কেদারনাথের প্ররোচনায় মিথ্যা বলিয়াছিল; সুতরাং অব্যাহতি পাইল। 

বেহারীর মৃত্যু সংবাদে মনোহরগিরি মম্মাহত হইয়া পড়িলেন। মন্দিরের অনেক লোকই বেহারীর শোকে কিছুদিন ম্রিয়মাণ হইয়াছিলেন। 

সম্পূর্ণ 

[ পৌষ, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *