দুই মাতালের গল্প
আপনাদের সকলের সঙ্গে বোধ হয় এঁদের দুজনের পরিচয় নেই। গল্প লেখার আগে এঁদের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই, তাতে এই ঝাঝালো তরল কাহিনি পান করা সহজ হবে।
প্রথম জন, যিনি এক হাত গালে দিয়ে আরেক হাতে গেলাস ধরে টেবিলের ডানপাশে বসে আছেন, যাঁর চোখে মোটা কাঁচের চশমা, একমাথা এলোমেলো সাদা কালো চুল, গালে জুলফির নীচে একটা লাল তিল–যিনি এইমাত্র এক চুমুকে পুরো গেলাসটা সাফ করে টেবিলে আধুলি ঠুকে বেয়ারাকে ডাকছেন তিনি হলেন জয়দেব পাল।
আর জয়দেববাবুর মুখোমুখি উলটোদিকের চেয়ারে বসে আছেন মহিমাময়, এঁর পদবির প্রয়োজন নেই, মহিমাময়ই যথেষ্ট, এরকম নামের খুব বেশি লোক নেই। মহিমাময়ের হাতেও গেলাস। মহিমাময় জয়দেবের চেয়ে মোটা এবং তাঁর মাথায় ছোটখাটো ঝকমকে একটা টাক। মহিমাময়ের গলার স্বর খুব ভারী এবং সবসময়েই তিনি উচ্চগ্রামে কথা বলেন।
জয়দেব এবং মহিমাময় দুজনেই বাল্যবন্ধু। নেবুতলা করোনেশন বয়েজ হাই ইংলিশ স্কুলে দুজনে ক্লাস থ্রি থেকে একই ক্লাসে পড়েছেন, দুজনেই প্রথম বছরের স্কুল ফাঁইনাল, তার মানে এই মুহূর্তে দুজনেই কিঞ্চিৎ উধ্ব পঞ্চাশ। এই ব্যাপারটা, মানে বয়েসের ব্যাপারটা বেশ জটিল। এখন জয়দেবের বয়েস বাহান্ন, মহিমাময়ের তিপ্পান্ন। জয়দেব বলেন, যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন। আর মহিমাময় বলেন, জানিস, ব্যাপারটা এত সোজা নয়। যখন তোর বয়েস ছিল এক–আমার বয়েস ছিল দুই, এক সময়ে আমার বয়েস তোর বয়সের ডবল ছিল, সে কথাটা ভুলবি না। বয়েসের ব্যাপারটা মহিমাময় আর জয়দেববাবুর নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা তার মধ্যে যাচ্ছি না। শুধু পরিচয় প্রদানে সামান্য ফাঁক রয়ে গেছে, সেটুকু বলি।
মহিমাময় বিবাদী বাগে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাঝারি মাপের চাকরি করেন। বিবাহিত এবং ইত্যাদি। জয়দেব আগে ছবি আঁকতেন, এখন সিনেমার লাইনে টুকটাক ছোটবড় কাজ করেন, বিবাহিত এবং ইত্যাদি। এই আমার এক দোষ। সুযোগ পেলেই বেশি বলে ফেলি।
পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে অযথা দেরি করে ফেললাম।
এদিকে জয়দেববাবুর আধুলির বাজনা শুনেও বেয়ারা এখন পর্যন্ত এ টেবিলে আসেনি। মহিমাময়ের পানীয়ও ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি এই মুহূর্তে আর পানীয় চান না, তিনি চান না জয়দেবও আর পানীয় নিক। আজকেই ঘটনাটা ঘটেছে।
জয়দেবের শরীরটা আজ কিছুদিন হল ভাল যাচ্ছে না। সারাদিন শরীর ম্যাজম্যাজ করে, বিকেলের দিকে গা গুলোয়, সকালে মাথা ধরে থাকে, পেটের বাঁ পাশে নীচের দিকে অনেক সময়েই একটা চাপা ব্যথা।
জয়দেব গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশেষে মুখ গম্ভীর করে বলেছেন, আপনাকে মদ খাওয়া ছাড়তে হবে।
সেই কথা শুনে মহিমাময় চেষ্টা করছিলেন জয়দেবকে বোঝাতে যাতে তিনি পান করা ছেড়ে দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। জয়দেব উদাসীন কণ্ঠে বললেন, বাজে বকিস না মহিমা, খবর নিয়েছিস, কোনওদিন ভেবে দেখেছিস পৃথিবীতে যত বুড়ো মাতাল আছে তার চেয়ে অনেক কম আছে বুড়ো ডাক্তার। মদের ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ আমি নেব না।
মদ খাওয়া এত সহজে জয়দেব ছেড়ে দেবেন, সামান্য ডাক্তারের ভয়ে, এ আশা অবশ্য মহিমাময় করেননি। তিনি তাঁর প্রাণের বন্ধুকে হাড়ে হাড়ে চেনেন।
জয়দেবের আধুলির বাজনা ইতিমধ্যে অতি উচ্চগ্রামে উঠেছে। এখন তার দু হাতে দুটো আধুলি, তিনি দ্রুতলয়ে টেবিলের কাঁচের উপরে বাজাচ্ছেন। বোধহয় গ্লাসটা ভেঙে যেতে পারে এই আশঙ্কায় অবশেষে বেয়ারা এল। তার দুহাতে দুটো পূর্ণ গেলাস, একটা অবশ্যি জয়দেবের অন্যটি মহিমাময়ের।
বিনা আপত্তিতে মহিমাময় আরেক গেলাস পানীয় নিলেন, একটু আগের মানসিক বাধা টিকল না।
তারপরে আরও এক গেলাস, আরও এক গেলাস; তরল বুদ্বুদময় পানীয়ের দ্রুত স্রোতে ভেসে চলল রাতের প্রহর।
রাত এখন কটা?
প্রায় প্রতিদিনই এরকম হয়। প্রথমে জয়দেব বেশি পান করে ফেলেন। তখন মহিমাময় একটু ভেবেচিন্তে, একটু টেনে খান। তারপর কিছুটা ওজর-আপত্তি ইত্যাদির পর মহিমাময় ধাতস্থ হন। তখন তিনি দ্রুতগতিতে পান করতে থাকেন, আস্তে আস্তে গেলাসের দৌড়ে তিনি জয়দেবকে ধরে ফেলেন। তারপর দুজনে সমান-সমান, কানায় কানায়। এই সমতাটা আসে রাত বারোটা নাগাদ। এর আধ ঘন্টা আগে পানশালার সামনের ঝাঁপ পড়ে গেছে। এদিক ওদিক দু-একটি টেবিলে জয়দেব মহিমাময়ের মতো দু-একজন ইতস্তত বসে আছেন। অধিকাংশ আলো নেবানো। অবশেষে কিঞ্চিৎ টলতে টলতে দুই ছায়ামূর্তি জয়দেব ও মহিমাময় পিছনের দরজা দিয়ে প্যাসেজে বেরিয়ে উলটো ঘুরে পানশালা থেকে রাস্তায় এসে পড়েন।
রাস্তার খোলা হাওয়ায় দুজনেরই মন বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। টা-টা বাই বাই, গুডনাইট, কাল দেখা হবে। ইত্যাদি বাক্য বিনিময় করে সাধারণত দুজনে যে যার বাড়ির দিকে রওনা হন।
আজ কিন্তু একটু গোলমাল হল।
কিছুক্ষণ ধরেই জয়দেব বেশ চুপচাপ ছিলেন, হঠাৎ রাস্তায় বেরিয়ে এসে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লেন, একটা ক্ষীণ কাতরোক্তি মুখ দিয়ে বেরোল।
এই রকম অবস্থায় খুব বিহ্বল হয়ে পড়েন মহিমাময়। চিরকালই তার স্বভাব হল সমস্যা থেকে। যথাসম্ভব দূরে থাকা। যদি কখনও সমস্যা ঘাড়ে এসে পড়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়েন। কোনও চেষ্টা করেন না উদ্ধার পাওয়ার।
আজও তাই করতে যাচ্ছিলেন। মহিমাময় জয়দেবের পাশেই পেটে হাত দিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সে কাজে বাধা পড়ল। পেছন থেকে কে একজন জামার কলার ধরে মহিমাময়কে আটকালেন।
ঘাড় ঘুরিয়ে মহিমাময় দেখেন পুরনো বন্ধু নন্দ। নন্দবাবু জয়দেব আর মহিমাময় দুজনেরই মোটামুটি বন্ধু। একই বারে, একই টেবিলে তারা একত্রে বহুবার মদ্যপান করেছেন। কাছাকাছি অন্য কোনও একটা পানশালায় নন্দবাবু বোধহয় ছিলেন। তিনিও এখন বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এভাবে এঁদের দুজনকে এ অবস্থায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছেন এবং মহিমাময়কেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। জয়দেব তখনও পেটে হাত দিয়ে রাস্তায় বসে, সেদিকে তাকিয়ে নন্দবাবু বললেন, মাঝেমধ্যেই তো এরকম হচ্ছে দেখছি। ডাক্তার দেখানো হয়েছে?
মহিমাময় বললেন, ডাক্তার তো দেখিয়েছে বলছে। কিন্তু তার কথা তো জয়দেব শুনছে না।
নন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কী বলেছে ডাক্তার?
মহিমাময় বললেন, ওই যা বলে মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে বলেছে।
নন্দবাবু শুনে বললেন, মদ খাওয়া ছাড়তে বললেই তো ছাড়া যায় না। মদ খাওয়া ছাড়াতে হয়। এ ব্যাপারে আলাদা ডাক্তার আছে। মদ খাওয়া ছাড়ানোর ডাক্তারের ব্যাপারটা ঠিক মহিমাময় বুঝতে পারলেন না। কিন্তু ততক্ষণে নন্দবাবু একটা ট্যাকসি ধরে ফেলেছেন। তিনি মহিমাময়কে ঠেলে দিয়ে, জয়দেবকে আলগোছে দাঁড় করিয়ে সামনে এগিয়ে ট্যাকসির মধ্যে ঠেলে দিলেন।
তিনজনে ওঠার পর ট্যাকসি ছাড়ল। নন্দবাবু বললেন, আগে জয়দেবকে নামাব। তারপরে আমি, সবশেষে তুমি। নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেও মহিমাময় বুঝলেন ট্যাকসি ভাড়াটা তাঁকেই মেটাতে হবে। তা হোক, নন্দ লোকটা মাতাল হলেও চিরকালই একটু কৃপণ কিন্তু তোক খারাপ নয়।
ট্যাকসিতে যেতে যেতে নন্দবাবু মদ খাওয়া ছাড়ানোর ডাক্তারবাবুর কথা আবার বললেন। যতটা বোঝা গেল, ঠিক ডাক্তারবাবু নয়, ডাক্তার সাহেব। ডাক্তার ভদ্রলোকটি বহুদিন মার্কিন দেশে ছিলেন। সেখান থেকে মাতলামি ছাড়ানোয় সিদ্ধহস্ত হয়ে ফিরে এসেছেন। ডাকসাইটে মার্কিনি মাতালদের তিনি সচ্চরিত্র, সাধুপুরুষে রূপান্তরিত করিয়েছেন। ভদ্রলোকের পুরো নাম এই গল্পে প্রয়োজন নেই, ডাক্তার মল্লিক বললেই চলবে। ডাক্তার মল্লিক মাত্র মাস কয়েক আগে দেশে ফিরে এসে বেহালায় ঠাকুরপুকুরের কাছে কোথায় যেন একটা নৈশ সেবাসদন, নৈশ মানে রাত্রিকালীন নয়, নেশা সংক্রান্ত চিকিৎসালয় স্থাপন করেছেন।
গাঁজা, ভাং, আফিম, চরস, কোকেন, হেরোইন, সাদা-সবুজ-লাল যত রকম নেশা আছে সেই সঙ্গে মদের নেশা এমনকী সিগারেটের নেশা পর্যন্ত এই সেবাসদনে নির্মূল করে সারানো হয়।
কিছুই না, মাত্র পনেরো দিন থাকতে হবে ওই সেবাসদনে। পনেরো দিন নিয়মিত শয়ন, বিশ্রাম ও আহার। সেই সঙ্গে সামান্য কিছু ওষুধ আর মানসিক চিকিৎসা। আগে এই শেষের ব্যাপারটা, মানসিক চিকিৎসাই মুখ্য। রোগীর মাথায় তার নেশার বস্তুর বিরুদ্ধে ভয়াবহ চিন্তাধারা প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। যে গেঁজেল, তার এরপর থেকে গাঁজার কলকের আগুন দেখলেই বিসুবিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের কথা মনে হবে। যে মাতাল, এর পর মদের বোতল দেখলেই নোয়ার প্লাবনের কথা স্মরণ হবে–সে ভয়ে কুঁকড়িয়ে যাবে, নেশার বস্তু দেখে থরথর করে কাঁপতে থাকবে। ডাক্তার। মল্লিকের চিকিৎসার এমনই মহিমা। নন্দবাবুর বক্তব্য শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরেও যখন ট্যাকসিটা জয়দেবের বাড়ির কাছে পৌঁছাল না, মহিমাময় বুঝলেন ট্যাকসিওলা হয় রাস্তা ভুল করেছে না হয় ইচ্ছে করে ঘুরপথে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়টাই স্বাভাবিক। কারণ পার্ক স্ট্রিটের মধ্যরাতের এমন কোন ট্যাকসিওলা আছে যে জয়দেবের বাড়ি চেনে না? তা ছাড়া লোকটা একবারও জিজ্ঞেস করেনি কোথায় যেতে হবে।
মহিমাময় ট্যাকসিওলাকে বললেন, সর্দারজি, (চিরদিন মত্ত অবস্থায় সমস্ত ট্যাকসি ড্রাইভারকে মহিমাময় কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সর্দারজি বলে সম্বোধন করেন, আজও অবশ্য ভুল হয়নি) জয়দেববাবুকা বাসা আপ নেহি জানতা হ্যায়?
সর্দারজি বিনীতভাবে বললেন, বহুত জানতা হ্যায়। এর পর পরিষ্কার বাংলায় বললেন, জয়বাবু বাসায় যাওয়ার আগে তিন-চার পাক হাওয়া খেয়ে নেন। তাতে ওঁর কষ্ট কমে, মনে ফুর্তি আসে। বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হয় না। আজ আড়াই পাক হয়ে গেছে, আর দেড় পাক দিলেই মনে হচ্ছে ঝামেলা মিটে যাবে। মহিমাময় প্রমাদ গুনলেন, জয়দেবের চারপাক, তারপর নন্দবাবুর কয়পাক কে জানে, তারপর নিজের বাড়ি যাওয়া–আজ কত টাকা ট্যাকসি বিল হবে, কী জানি? তবে মহিমাময় জানেন নিরানব্বই টাকা পঁচাত্তর পয়সার চেয়ে বেশি বিল ওঠা মিটারে সম্ভব নয়, সেটাই যা রক্ষা।
নন্দবাবু বোধহয় মহিমাময়ের চিন্তাধারা মনে মনে অনুসরণ করছিলেন। হঠাৎ তিনপাকের মাথায় একটা মোড়ে, রোকখে, রোকখে, বেঁধে, বেঁধে… বলে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দ্রুত নেমে পড়লেন। তারপর গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ গলিয়ে মহিমাময়কে বললেন, এখান থেকে আমার বাড়ির দিকে একটা শর্টকাট আছে, আমি যাচ্ছি। কিন্তু নৈশ সেবাসদনের কথাটা ভুলো না।
না, মহিমাময় নৈশ সেবাসদনের কথা বিস্মৃত হননি। বলা উচিত নিজেকে বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ দেননি।
সেই রাতে জয়দেবকে নামিয়ে দিয়ে, তারপর নিজের বাড়িতে ফিরে যখন পুরো একটা একশো টাকার নোট, ট্যাকসি ভাড়া সাতাশি টাকা আর তেরো টাকা সর্দারজির বখশিশ, মহিমাময়কে দিতে হল তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটার একটা ফয়সালা চাই, অবিলম্বে চাই।
পরের রবিবার সকালে জয়দেবের বাড়িতে গিয়ে জয়দেবের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেন। দেখা গেল মিসেস জয়দেব সব খবরই রাখেন, বোধহয় নন্দবাবুই ইতিমধ্যে এসে বলে গেছেন।
মিসেস জয়দেব বুদ্ধিমতী মহিলা। তাঁর ধারণা এসব নিতান্ত তুকতাক জাতীয় চিকিৎসা। এত সহজে, মাত্র এক পক্ষ সেবাসদনে বাস করেই তাঁর স্বামীর এতদিনের জটিল মত্ততার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে–একথা মিসেস জয়দেব কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। মহিমাময় মিসেস জয়দেবকে বোঝালেন যে এসব হল অমোঘ আমেরিকান চিকিৎসা, এমনকী রাশিয়ায় পর্যন্ত এখন এই চিকিৎসায় হাজার হাজার লোক ভদকা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তা ছাড়া নন্দবাবুর এক দূর-সম্পর্কের শালা মাত্র এক সপ্তাহের চিকিৎসাতেই চল্লিশ বছরের গাঁজার নেশা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সে দুবেলা শুধু দু গেলাস দুধ খায়, নেশার জিনিস বলতে নেহাতই সারাদিনে কয়েকটা গুণ্ডিপান। অনেক কষ্টে মিসেস জয়দেবকে নিমরাজি করানো গেল। কিন্তু এবার চিন্তায় পড়লেন। মহিমাময়, জয়দেব কি এই চিকিৎসায় রাজি হবে, নাকি শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসবে। কাল ছিল শনিবার। কাল নাকি অনেক রাতে জয়দেব বাড়ি ফিরেছে, এখন ভেতরের ঘরে ঘুমোচ্ছ। ভয়ে ভয়ে মহিমাময় মিসেস জয়দেবকে বললেন, এখন ভালয় ভালয় জয়দেবকে রাজি করাতে পারলে হয়।
মিসেস জয়দেব একটু হাসলেন, বললেন, সে নিয়ে আপনাকে ভাবনা করতে হবে না। ও একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে, বলছে, দিন পনেরো নিরিবিলি শান্তিতে একটু বিশ্রাম পেলে শরীরটা জুড়িয়ে যায়। বরং আমিই আপত্তি করছিলাম।
মহিমাময় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে আর কোনও বাধা নেই। এবার সেবাসদনে গিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলি। ঘুম থেকে উঠলে জয়দেবকে বলবেন যে আমি এসেছিলাম।
বন্ধুর সুচিকিৎসা ফেলে রাখা উচিত নয়। আর সপ্তাহে রবিবার মাত্র একটাই।
জয়দেবের বাড়ি থেকে মহিমাময় সরাসরি গেলেন মল্লিকের সেবাসদনে। সুন্দর জায়গা। একটা পুরনো বাগানবাড়ি ভাল করে সারিয়ে, চুনকাম করে, শক্ত লোহার গেট লাগিয়ে সেবাসদন তৈরি হয়েছে। বাইরে বড় বড় হরফে বিশাল সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে।
নৈশ সেবাসদন
এখানে সকল প্রকার প্রাচীন ও দুরারোগ্য
নেশার বিলাতি মতে চিকিৎসা করা হয়।
সাইনবোর্ডের আয়তন এবং সেবাসদনের বাড়িটি দেখে মহিমাময়ের মনে বেশ সম্ভ্রমের ভাব এল। তিনি গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে একজন উর্দিপরা দারোয়ান দরজা খুলে দিল এবং অফিসঘর কোথায় সেটা অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিল।
সুড়কি বাঁধানো সড়ক দিয়ে গাড়িবারান্দার নীচে একপাশে অফিসঘরে পৌঁছালেন মহিমাময়। সামনে টানা বারান্দা, তার মাঝবরাবর সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।
বারান্দার দুপাশে একেক ঘরের পাশে একেক রকম বস্তুর নাম লেখা–কোথাও লেখা গাঁজা, কোথাও ভাং, কোথাও সিদ্ধি, বাংলায় এবং পাশাপাশি ইংরেজি অক্ষরে এগুলির লাতিন নাম লেখা। দোতলায় সিঁড়ির পাশে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা আছে মদ, পাশে ইংরেজিতে লেখা কোহল সেকশন, সঙ্গে ব্র্যাজেট ওয়াইন, লিকার এটসেট্রা। অফিসঘরে বেশ কয়েকজন লোক কাজ করছেন, একজন মহিলা টাইপমেশিনে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। অন্য এক মহিলা একটা সাদা টেলিফোনে ফিসফিস করে কার সঙ্গে যেন খুব অন্তরঙ্গ কথা বলছেন।
অফিসের অধীশ্বরের নাম কুঞ্জলাল। তিনিই অফিসের বড়বাবু। মহিমাময়কে খুব আদর করে বসিয়ে কুঞ্জলাল জানতে চাইলেন, আপনার সমস্যাটা কীরকম? কঠিন, তরল না বায়বীয়?
কবে সেই বিহ্বল প্রথম যৌবনে কলেজে পদার্থবিদ্যার ক্লাসে এই রকম একটা বিভাজনের কথা শুনেছিলেন মহিমাময়। তিনি স্মৃতি উদ্ধার করে জিজ্ঞাসা করলেন, কঠিন, তরল এসব মানে কী?
কুঞ্জলাল বললেন, আপনাকে তো রোগী মনে হচ্ছে না?
মহিমাময় বললেন, না, আমি আমার বন্ধুর জন্যে খবর নিতে এসেছি।
কুঞ্জলাল বললেন, তা হলে এবার বলুন, আপনার বন্ধুটি কঠিন, তরল না বায়বীয়? অবশ্য ডাক্তার মল্লিকের কাছে একসঙ্গে দুটো-তিনটে উপসর্গ হলেও কোনও অসুবিধা হয় না।
মহিমাময়ের মুখ দেখে কুঞ্জলাল বুঝতে পারলেন তার কিছুই হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না। তখন বিশদ করে বললেন, আপনি তো নেহাৎ শিশু মশায়। কঠিন হল আফিম, ট্যাবলেট এইসব। তরল হল মদ, সিদ্ধি, আর বায়বীয় হল গাঁজা, চরস।
কুঞ্জলালের হেঁয়ালি শেষ হলে মহিমাময় যেটুকু খবর সংগ্রহ করতে পারলেন তার থেকে বোঝা গেল পনেরো দিনের চিকিৎসায় প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ হবে। বিফলে মূল্য ফেরত নয়, তবে এখনও পর্যন্ত কেউ বিফল হয়ে ফেরেনি।
ইতিমধ্যে গাঁজার ঘর থেকে একটি গাঁজাখোর মেয়ে ছোট এক গাঁজার কলকেতে ধোঁয়া টানতে টানতে বেশ কয়েকটা ফিকে নীল রিং ঠোঁট দিয়ে ছুঁড়ে অফিসঘরের মধ্যে এল। মহিলাকে দেখেই মহিমাময় চিনতে পারলেন, একটি বিখ্যাত সাবানের জনপ্রিয় মডেল মমতাজ চৌধুরী।
অফিসঘরের হাওয়ায় গাঁজার রিংগুলি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই শ্রীমতী মমতাজ অন্তর্হিত হলেন। তাঁর অন্তর্ধানপথের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে চোখ থেকে বাই-ফোকাল চশমাটা নামিয়ে পকেটের রুমাল দিয়ে চোখ এবং চশমা দুই মুছে নিয়ে কুঞ্জলাল বললেন, মমতাজ দেবী মাত্র তিনদিন এসেছেন। আগে দৈনিক দেড়শো গাঁজার ধোঁয়ার রিং ছাড়তেন, এই তিনদিনেই রিং-এর সংখ্যা একশো দশে এসে নেমেছে। পনেরো দিনের মাথায় ভ্যানিশ হয়ে যাবে। এমন সময় একটা গাড়ি এসে বারান্দার নীচে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই সচকিত হয়ে উঠল। যে ভদ্রমহিলা টাইপমেশিনে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি মেশিন থেকে মাথা তুলতে গিয়ে তাঁর চুলের বেণীটা মেশিনের কি-বোর্ডে আটকিয়ে গেল। যে মহিলা টেলিফোনে এতক্ষণ অন্তরঙ্গ বাক্যালাপ চালাচ্ছিলেন তিনি দুম করে ফোনটা বিনা নোটিশে ছেড়ে দিলেন।
ডাক্তার মল্লিক অফিস কক্ষে প্রবেশ করলেন। তার চোখে পুরনো আমলের বড় বড় গোল কাঁচের নিকেলের ফ্রেমের চশমা, এটাই হাল আমলের মার্কিনি ফ্যাশান। সেই সঙ্গে লালগোলাপি গেঞ্জি, তার পিঠে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা OH-HO-OH-HO, শব্দগুলোর চারপাশে সবুজ লতাপাতা। ডাক্তার মল্লিককে দেখে খুব ভক্তি হল মহিমাময়ের। খুব বিশ্বাস হল যে ইনি পারবেন জয়দেবের নেশা ছাড়াতে। ডাক্তার মল্লিক প্রবেশ করার পর সকলের সঙ্গে মহিমাময়ও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। শুধু সেই টাইপিস্ট মেয়েটি যন্ত্র থেকে বেণী ছাড়াতে না পেরে সম্পূর্ণ উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সে টেবিল ঘেঁষে তিন কোনাচে হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তার মল্লিক এসব হৃক্ষেপ করলেন। না, দ্রুত গতিতে গুডমর্নিং বলে পাশের ঘরে নিজের চেম্বারে চলে গেলেন।
মহিমাময়ও বেরিয়ে পড়লেন।
পরের শনিবারই জয়দেবকে স্থানান্তরিত করা হল নৈশ সেবাসদনে। অফিসের কাজে মহিমাময়কে কয়েক দিনের জন্যে কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল। সেবাসদনে যাওয়ার সময়ে তিনি জয়দেবের সঙ্গে যেতে পারেননি। মিসেস জয়দেব নিজেই নিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে এসে বাড়িতে-অফিসে নানা ঝামেলা। পাড়ার একটা বুড়ো হুলো বেড়াল কী কারণে কয়েকদিন আগে পাগল হয়ে গেছে, যখন তখন যাকে তাকে কামড়াচ্ছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে রাত জেগে পর পর কয়েক রাত সেই বেড়াল ধরার প্রয়াস। এদিকে বাসায় মেয়েটার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। মহিমাময় কয়েকদিন এত ব্যস্ত রইলেন যে জয়দেবের কথা প্রায় খেয়ালই ছিল না। আরও নানা ধরনের গোলমাল-গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না, তা ছাড়া আগে একটা সিলিন্ডারে একমাস যেত, এখন টেনেটুনে পনেরো দিনও যায় না। ওদিকে আগে ইলেকট্রিক বিল উঠত মাসে বড় জোর চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা, এখন দেড়শো-দুশোয় গিয়ে ঠেকেছে।
এত সব দিক সামলিয়ে সেই সঙ্গে আনাজ, তরকারি, মাছ, দুধ, ধোবা-নাপিত সব মিটিয়ে মদ খাওয়ার পয়সা সংগ্রহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। মহিমাময় চিন্তা করেন, চিকিৎসা করে জয়দেবের যদি নেশা ছুটে যায় তা হলে আমিও চিকিৎসা করে মদ খাওয়া ছাড়ব।
সুতরাং সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যেও শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে নয়, অনেকটা কৌতূহলবশতও জয়দেবকে এক সন্ধ্যায় দেখতে গেলেন মহিমাময়। তখন জয়দেবের সেবাসদনে বাস বারোদিন হয়েছে, আর দিন তিনেক বাকি আছে মুক্তির।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ সেবাসদনের দরজায় পৌঁছালেন মহিমাময়।
দরজার বাইরে ড্রেনের একপাশে একটা কালভার্টের উপরে সেবাসদনের বড়বাবু কুঞ্জলাল বসে রয়েছেন। তিনি অতি ঘন ঘন বিষম হেঁচকি তুলছেন। তার আশেপাশে সেবাসদনের আরও দু-চারজন কর্মচারী ইতস্তত বসে বা দাঁড়িয়ে। তারাও ক্রমাগত হেঁচকি তুলছে।
সমস্ত ব্যাপারটা দেখে কেমন খটকা লাগল মহিমাময়ের। অবস্থাটা খুব জটিল মনে হল তার।
তিনি গেটের দিকে এগোলেন, দেখলেন সেদিনের সেই উর্দিপরা দারোয়ান গেটের হাতল ধরে কোনও রকমে বহু কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে। এ লোকটাও ঘন ঘন হেঁচকি তুলছে। প্রত্যেকবার হেঁচকি তোলার ফাঁকে ওরে বাবা, মরে গেলাম, বাবারে এই সব কাতরোক্তি করছে।
মহিমাময় ভয়ে ভয়ে অতি সন্তর্পণে সেবাসদনের ভিতরে প্রবেশ করলেন। গাড়িবারান্দায় এবং ভেতরের প্যাসেজে মিটমিটে পঁচিশ পাওয়ারের আলো জ্বলছে। সেই মৃদু আলোয় মহিমাময় দেখতে পেলেন গাড়িবারান্দার নীচে এবং উপরে দোতলায় বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে মহিলাও রয়েছে, সেদিনের মমতাজ দেবীও রয়েছেন মনে হল।
এখানেও সকলের মধ্যে সেই একই বৈশিষ্ট্য, সবাই ভয়াবহ হেঁচকি তুলছে। সমবেত হিক্কা ধ্বনিতে চারদিক গুঞ্জরিত হচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে যথারীতি কেউ কেউ বিকট সব উক্তি করছে। মহিমাময় সবচেয়ে সামনের লোকটিকে জয়দেবের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটির পরনে ডোরাকাটা স্লিপিং সুট, নিশ্চয় এখানকার রোগী। একটা বিশাল হেঁচকিকে গলাধঃকরণ করে লোকটি বলল, জয়দেববাবুকে নিতে এসেছেন?
এই প্রশ্নে বিস্মিত হয়ে মহিমাময় বললেন, নিয়ে যাব কেন? জয়দেব ভাল হয়ে গেছে? ওর তো এখনও তিন দিন বাকি আছে!
আর একটি হেঁচকি তুলে লোকটি বলল, আরও তিন দিন? সর্বনাশ! সেবাসদন যে উঠে যাবে।
আর কথা না বাড়িয়ে মহিমাময় আগের দিনের দেখামতো কোহল সেকশনের দিকে পা বাড়ালেন। নিশ্চয়ই ওখানে জয়দেবের দেখা পাওয়া যাবে।
কোহল সেকশনে জয়দেবের দেখা পাওয়া গেল। ছোট ঘরের মধ্যে একটা খাট। তারই একটির প্রান্তে বালিশে হেলান দিয়ে জয়দেব বসে রয়েছেন। রীতিমতো গুম হয়ে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, খাটের অন্য প্রান্তে ডাক্তার মল্লিকও বসে রয়েছেন। বড় বড় গোল চশমার কাঁচের নীচে তার চোখ দুটো খুব বেশি গোল দেখাচ্ছে। তিনিও গুম মেরে থাকার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। হেঁচকি এসে বাধা সৃষ্টি করছে।
একমাত্র ব্যতিক্রম জয়দেব। মহিমাময় ভাল করে লক্ষ করে দেখলেন, জয়দেব কোনও হেঁচকি তুলছেন না।
সমস্ত ব্যাপারটা অত্যন্ত বেশি গোলমেলে মনে হল মহিমাময়ের। ঠিক কী ঘটছে, ঘটেছে, কেন ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছেন না। দরজার কাছে গোটা দুই বেতের চেয়ার রয়েছে, তারই একটা টেনে নিয়ে মহিমাময় জয়দেবের খাটের সামনে গেলেন। কিন্তু ডাক্তার মল্লিকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল না, পর পর কয়েকটি অতিদ্রুত হেঁচকির ধাক্কায় তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ও গড, ও গড বলতে বলতে দ্রুত বারান্দার দিকে চলে গেলেন।
এখন জয়দেব আর মহিমাময়, দুই পুরনো বন্ধু, এই শহরের দুই প্রাচীন মাতাল পরস্পরের মুখোমুখি।
না, কোনও ডুয়েল বা দ্বন্দ্বযুদ্ধ নয়। জয়দেব মহিমাময়ের দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলেন। মহিমাময়ও হাসলেন। মহিমাময় একবার মাথা ঘুরিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকালেন। জয়দেব বুঝতে পেরে বললেন, কেউ নেই। সব বাইরে গিয়ে কোথাও হেঁচকি তুলছে। তারপর উদার কণ্ঠে মহিমাময়কে বললেন, একটু মদ খাবি? জিনিসটা চোলাই কিন্তু খাঁটি চোলাই।
খাটের নীচ থেকে দুটো কাঁচের গ্লাস আর একটা রবারের ব্লাডার হামাগুড়ি দিয়ে বার করে আনলেন জয়দেব। বন্ধুর উপহার বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ করলেন মহিমাময়। দুজনে প্রাণের আনন্দে পান শুরু করলেন।
মদ খেতে খেতে দুই বহুদিনের প্রাণের বন্ধুর মধ্যে বহু কথা হল। হেঁচকির প্রসঙ্গও এল। হেঁচকি ব্যাপারটা সোজা নয়। হেঁচকির জন্যে ওষুধ লাগে।
ডাক্তার মল্লিক মার্কিন দেশ পরিত্যাগ করার সময় কয়েক বোতল হেঁচকির ওষুধ নিয়ে এসেছেন। ব্যাপারটা বে-আইনি কিনা, তা নিয়ে এঁদের দুজনের কেউই চিন্তিত নন। মহিমাময়কে জয়দেব মদ খেতে খেতে যা বললেন তা চমকপ্রদ। ঘটনার বিবরণ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি।
নেশা ছাড়ানোর ব্যাপারটা খুবই সোজা। শুধু ওই একটু হেঁচকির ওষুধ চাই। হেঁচকি সারানো নয়, হেঁচকি করানোর ওষুধ। জিনিসটা দেখতে সাদা টুথ পাউডারের গুঁড়োর মতো। ওই গুঁড়ো সামান্য একটু কোনও কিছুর সঙ্গে মিশ্রিত করে দিলে অবিশ্রান্ত হেঁচকি উঠতে থাকবে। এই ওষুধের আবিষ্কারক নাকি ডাক্তার মল্লিক স্বয়ং। তবে সব কেমিক্যাল এদেশে মেলে না। ডাক্তার মল্লিকের বিধান হল, যে যা নেশা করছে করুক, কোনও আপত্তির কারণ নেই। শুধু ওই নেশার সামগ্রীর সঙ্গে, সে হুইস্কি বা হেরোইন যা হোক না কেন, তার সঙ্গে এক বিন্দু ওই সাদা পাউডার মিশিয়ে দিতে হবে। আর গাঁজা জাতীয় ধোঁয়াটে নেশায় কলকেতে বা সিগারেটে একটু দিয়ে ধোঁয়ায় টেনে নিলেই কাজ হবে।
কাজ হবে মানে পাঁচ মিনিটের মধ্যে হেঁচকি শুরু হবে। চলবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
জয়দেব জানালেন যে এখানে এসেই তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন পানীয়ের এবং খুব কাছেই একটি নির্ভেজাল চোলাইয়ের দোকানের খবর পান। প্রতিদিন দারোয়ানকে দিয়ে তাই দু পাঁইট আনিয়ে নেন। এবং তাতেই তার একার চলে যায়।
প্রথম দিন খাওয়ার পর আর তিনি সেবাসদনের হেঁচকি করানো পানীয় গ্রহণ করেননি। সারারাত এবং পরের দিন সারা সকাল হেঁচকি উঠেছিল। তিনি নিশ্চিত যে পনেরো দিন কেন মাত্র এক সপ্তাহ যদি ওই পাউডার দেয়া নেশা কেউ করে, তা হলে সারা জীবনের মতো নেশা করার শখ তার কেটে যাবে।
গত এগারো দিন জয়দেব নিজে সন্ধ্যায় চোলাই খেয়েছেন আর ওই পাউডার দেয়া পানীয় তার জলের কুঁজোয় সঞ্চিত করে রেখেছেন। আজ সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার মল্লিক সমেত সেবাসদনের সমস্ত কর্মচারী এবং নেশার রোগীদের জয়দেব আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সবাইকে তার জন্মদিন এই কথা বলে। যারাই জয়দেবের পানীয় গ্রহণ করেছে তাদের পরিণতি মহিমাময় চোখের সামনেই দেখতে পেয়েছেন। ওই তো পিছনের বারান্দায় থাম ধরে দাঁড়িয়ে ডাক্তার মল্লিক নিজেই হেঁচকি তুলছেন। শুধু জয়দেব নিজে খাননি। তাই ঠিক আছেন।
মহিমাময়ের কেমন কৌতূহল হল। মদের নেশাটা ছেড়ে দেবার তাঁর নিজের অনেকদিনের ইচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না। জয়দেবকে তিনি বললেন, ওই পাউডার দেয়া মদ তোর আর আছে?
জয়দেব বললেন, একটু থাকতে পারে কুঁজোর নীচে। তুই খাবি নাকি? খুব হেঁচকি উঠবে কিন্তু। মদ খাওয়ার সব শখ মিটে যাবে।
মহিমাময় বললেন, আমি শখটা মেটাতেই চাই। এই বাজে নেশাটা ছাড়তে পারলেই বাঁচি। আর যা খরচা বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মদের দাম।
কুঁজোর তলা থেকে গেলাস দুয়েক পানীয় বেরোল, পানীয়টা উৎকৃষ্ট ভাল হুইস্কিই হবে। পাউডারের গুঁড়োর তলানি বোধহয় নীচে বেশি পড়েছিল, তাই একটু ঝঝ বেশি। প্রতিফল পেতে পাঁচ মিনিট কেন দু মিনিটও লাগল না। গগনচুম্বী সব হিক্কা উঠতে লাগল মহিমাময়ের, অস্থির বোধ করতে লাগলেন, গা গোলাতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন মহিমাময়। সেবাসদন থেকে বেরোনোর মুখে দেখলেন ডাক্তার মল্লিক আর মমতাজ দেবী সিঁড়ির প্রান্তে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যুগ্ম হিক্কা তুলছেন। সামনের গেটের উপরে দারোয়ান আর কুঞ্জলালবাবু বসে, তাদের হেঁচকির আন্দোলনে ভারি গেট কাঁপছে।
মহিমাময়ের অবস্থাও সুবিধের নয়। কোনও রকমে রিকশায় বড় রাস্তায় পৌঁছে, সোজা ট্যাকসি নিয়ে বাড়ি। তখন হিক্কার গমক আরও বেড়েছে।
বাড়ি ফিরে গেলাসের পর গেলাস সাদা জল খেলেন। মহিমাময়ের স্ত্রী তার মাথায় ব্রহ্মতালুতে জোরে জোরে চাপড় দিলেন। মহিমাময় বীভৎস সব সমস্যার কথা ভাবতে লাগলেন। কিন্তু হিক্কার গতিও তো বেড়েই চলল।
এমন সময় সামনের টেবিলে সেদিনের ডাকে আসা চিঠিপত্রগুলো মহিমাময়ের চোখে পড়ল। সবচেয়ে উপরে রয়েছে ইলেকট্রিক বিল। গত মাসে দুশো দশ টাকা হয়েছিল। এবার বিল খুলে দেখলেন উঠেছে সাতশো বারো টাকা চল্লিশ পয়সা। তবে ওই চল্লিশ পয়সা এ মাসে দিতে হবে না। পরের মাসের হিসেবে যাবে।
সাতশো বারো টাকা বিল পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারের উপরে বসে পড়লেন মহিমাময়। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেতে বাড়ির সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে সব ঘরের আলো-পাখা নিবিয়ে দিলেন। স্ত্রী রান্নাঘরে হিটারে মাছের ঝোল রাঁধছিলেন, মেয়ে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখছিল–সব সুইচ তিনি অফ করে দিলেন। এবং তার পরেই ঘোর অন্ধকারে হঠাৎ একটা মুক্তির আনন্দ অনুভব করলেন। তিনি টের পেলেন যে তার আর হিক্কা উঠছে না।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের কাছে গিয়ে ইলেকট্রিক বিলটা হাতে নিয়ে কপালে ঠেকালেন। তারপর সন্তর্পণে একটা আলো জ্বালিয়ে দেরাজের নীচের থেকে একটা ছোট রামের বোতল বার করে নির্জলা খেতে লাগলেন। এখন আর হিক্কা উঠল না।
দারুণ।