দুই ভূত
লালু আর ভুলুর কোনো কাজ নেই। তারা সারাদিন গল্প করে কাটায়। সবই নিজেদের জীবনের নানা সুখ-দুঃখের কথা। কথা বলতে-বলতে যখন আর কথা কইতে ভালো লাগে না তখন দুজনে খানিক কুস্তি লড়ে। তাদের কুস্তিও খুব একঘেয়ে–কেউ হারে না। কেউ জেতে না। কুস্তি করে তাদের ক্লান্তিও আসে না, ঘামও ঝরে না। তার কারণ লালু আর ভুলু দুজনেই ভূত। প্রায় চোদ্দো বছর আগে দুই বন্ধু মনুষ্য জন্ম শেষ করে ভূত হয়ে লালগঞ্জের লাগোয়া বৈরাগী দিঘির ধারে আশ-শ্যাওড়ার জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে আছে। মামলা-মোকদ্দমা থেকেই বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয়, বুড়ো বয়সে মাত্র সাত দিনের তফাতে লালু আর ভুলু পটল তোলে। ভূত হয়ে যখন দুজনের দেখা হল তখন দু-জনের মনে হল পুরোনো ঝগড়া জিইয়ে রাখার আর কোনো মানেই হয় না। তাই দু-জনের বেশ ভালো ভাব হয়ে গেল। সময় কাটানোর জন্য তারা মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করেও দেখেছে। কিন্তু দেখা গেল ঝগড়াটা তেমন জমে না, আরও একটা আশ্চর্যের বিষয় হল তারা ভূত হয়ে ইস্তক এ তল্লাটে কোথাও কখনও আর কোনো ভূতের দেখা পায়নি।
ভুলু বলে, হ্যাঁরে লালু, গাঁয়ে গত চোদ্দো বছরে তো বিস্তর লোক মরেছে, তাদের ভূতগুলো সব গেল কোথায় বল তো?
সেটা তো আমিও ভাবছি, আমরা ছাড়া আর কাউকে তো কখনো দেখিনি! আরও কয়েকজন থাকলে সময়টা একটু কাটত ভালো।
ব্যাপারটা কিন্তু বড্ড গোলমেলে।
আমারও ভালো ঠেকছে না! বেশিদিন এরকম চললে আমাদের এ গাঁ ছাড়তে হবে। সেটা কি সোজা! আমি গাঁ ছাড়ার চেষ্টা করে দেখেছি, ভারি সূক্ষ্ম একটা বেড়া আছে। চোখে দেখা যায় না এতই মিহি, সেই বেড়া ভেদ করা অসম্ভব।
বটে, এ তো ভারী অন্যায় কথা! আমরা কি সব জেলখানার কয়েদি নাকি রে?
মনে হয় এক জায়গার ভূত অন্য জায়গায় গেলে হিসেবের গোলমাল হবে বলেই যমরাজা বেড়া দিয়ে রেখেছে।
তা অলপ্পেয়ে যমরাজটাই বা কোথায়? আজ অবধি তো তার দেখাঁটি পেলাম না।
হবে রে হবে। এই একঘেয়ে বসে থাকাটা আমার আর ভালো লাগছে না। বরং গাঁয়ের ভূতগুলো কোথায় গায়েব হচ্ছে সেটা জানা দরকার। আরও গোটা কয়েক হলে দিব্যি গল্পটল্প করা যেত। দল বেঁধে থাকতাম–
তাহলে খুঁজেই দেখা যাক।
তাই চলো।
দুই বন্ধু মিলে অতঃপর ভূত খুঁজতে বেরল। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে হয়রানিই সার হল। একটা ভূতের গায়ের আঁশও দেখা গেল না।
বড়ো চিন্তার কথা হল রে লালু!
বটেই তো এরকম তো হওয়ার কথা নয়।
একটা কথা বলি, যতীন মুৎসুদ্দির বয়স হয়েছে। অবস্থাও ক-দিন ধরে খারাপ যাচ্ছে। এখন তখন অবস্থা। চল তো গিয়ে তার শিয়রে বসে থাকি। আত্মাটা বেরলেই খপ করে ধরবখন।
কথাটা মন্দ বলোনি। তাহলে চলো যাই।
দুজনেই গিয়ে যতীন মুৎসুদ্দির শিয়রে আস্তানা গাড়ল। খুব সতর্ক চোখে চেয়ে রইল যতীনের দিকে। যতীন বুড়ো মানুষ। শরীর জীর্ণ, শক্তিও নেই।
দুদিন ঠায় বসে থাকার পরে তিনদিনের দিন যখন গভীর রাত তখন লালু আর ভুলু লক্ষ করল যতীনের আত্মাটা নাকের ফুটোর কাছে বসে সাবধানে বাইরে উঁকিঝুঁকি মারছে।
লালু চেঁচিয়ে উঠল, ওই বেরচ্ছে। সাবধান রে ভুলু, ঘ্যাঁচ করে ধরতে হবে কিন্তু।
হ্যাঁ, একবার বেরক বাছাধন।
তা আত্মাটা বেরল বটে, কিন্তু ধরা গেল না। শরীর ছেড়ে হঠাৎ এমন চোঁ করে এরোপ্লেনের মতোই উড়ে গেল নাকের ফুটো দিয়ে লালু-ভুলু হাঁ করে চেয়ে রইল। তারপর ধর-ধর করে ছুটল পিছনে।
যতীন মুৎসুদ্দির আত্মা সোজা গিয়ে গণেশ গায়েনের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। পিছু-পিছু লালু আর ভুলু।
গণেশ গায়েন যতীনের আত্মাকে দেখেই একগাল হেসে বলল, এসেছিস, তোকে নিয়ে সাত হাজার সাতশো পনেরোটা হল। দাঁড়া যতেন দাঁড়া তোর শিশিটা বের করি। মলমটলম ভরে একদম রেডি করে রেখেছি। এই বলে একটা দুই ইঞ্চি সাইজের শিশি বের করে যতীনকে তার ভিতরে পুরে কয়েকটা নাড়া দিয়ে ছিপি বন্ধ করে তাকে রেখে দিল। তারপর আপন মনেই বলল, আর দুটো হলেই কেল্লা ফতে। পরশু ঝুনঝুনওয়ালা লাখখানেক টাকা নিয়ে আসবে। সাত হাজার সাতশো সতেরোটা হলেই লাখ টাকা হাতে এসে যেত। টাইফয়েড হয়ে চোদ্দ বছর আগে শয্যা নিতে হল বলে লালু আর ভুলুর ভূত দুটো হাতছাড়া হল, নইলে আমাকে আজ পায় কে? সে দুটোকে পেলে হত।
লালু-ভুলু দরজার আড়াল থেকে কথাটা শুনে ভয়ে সিঁটিয়ে রইল।
গণেশ গায়েন ঘুমোলে তারা ঘরের তাকে জমিয়ে রাখা সাত হাজার সাতশো পনেরোটা শিশি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল প্রত্যেকটিতে একটা করে ভূত মলম মেঘে ঘুমিয়ে আছে।
লালু দেখেছিস!
দেখছি রে ভুলু, কী করবি?
আয়, শিশিগুলোকে তাক থেকে ফেলে আগে ভাঙি। তাই হল। দুজনে মিলে নিশুত রাতে ঝনঝন করে শিশিগুলোকে ঠেলে ফেলে দিল মেঝেতে। সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমন্ত ভূতেরা জেগে মহা কোলাহল শুরু করে দিল।
ভুলু তাদের সম্বোধন করে বলল, ভাই বোনেরা, তোমরা ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাদের উদ্ধার করতেই এসেছি।
সবাই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। গণেশ গায়েনও ঘুম ভেঙে উঠে ধমকাতে লাগল, চুপ চুপ বেয়াদব কোথাকার! তাদের তো মন্তর দিয়ে বেঁধে রেখেছি।
কে শোনে কার কথা! ভূতেরা মহানন্দে চিৎকার করতে-করতে লালু-ভুলুর সঙ্গে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল।
গণেশ দুঃখ করে বলল, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় রে! কত ভালো কাজ হত তোদের দিয়ে। ঝুনঝুনওয়ালা তোদের নিয়ে তার আয়ুর্বেদ ওষুধের কারখানায় চোলাই করে কর্কট রোগের ওষুধ বানাত, তা তোদের কপালে নেই। তা আমি আর কী করব?