দুই বোন
ক্যাফের বিশেষ সিটটায় একটা মেয়ে চুপচাপ বসে আছে।
চেহারা দেখে মনে হচ্ছে হাইস্কুলের ছাত্রী হবে। আয়ত চোখ জোড়ায় মিষ্টি চাহনি। একটা ঘিয়া টার্টলনেক, টারটান-চেক মিনিস্কার্ট, কালো টাইটস আর বাদামি বুট তার পরনে। ডাফেল কোটটা চেয়ার থেকে ঝুলছে। পোশাকগুলো তুলনামূলক বয়স্কদের জন্য হলেও মেয়েটার আচরণে একটা ছেলেমানুষি ভাব আছে। ববকাট চুলে বেশ মানিয়ে গেছে তাকে। চেহারায় মেইক-আপের বালাই নেই, কিন্তু কমনীয় মুখটার কারণে চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছা করে না। লম্বা চোখের পাপড়িগুলো সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে সে। কিন্তু ক্যাফেটার বিশেষত্ব না জানা থাকলে কেউ ধরতেও পারবে না সত্যটা। তবে আগস্ট মাসে সচরাচর কেউ এমন পোশাক পড়ে না।
মেয়েটা কার সাথে দেখা করতে এসেছে সেটা অবশ্য একটা রহস্য। এই মুহূর্তে গোটা ক্যাফেতে নাগারে তোকিতা বাদে আর কেউ নেই। শেফ ইউনিফর্ম পরে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী লোকটা। কিন্তু অনেক ভেবেও মেয়েটার আগমনের হেতু বের করতে পারেনি সে।
বেশ কয়েকবার অবশ্য নাগারের দিকে তাকিয়েছে মেয়েটা। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে বিশেষ কোনো কিছু নেই। এত বড় একটা মানুষকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ক্যাফেতে এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। অগত্যা বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে মেয়েটার ওপরে নজর রাখছে ক্যাফে মালিক।
নাগারে আক্ষরিক অর্থেই বেশ বড়োসড়ো মানুষ। নির্জন কোনো স্থানে মেয়েরা সচরাচর তাকে দেখলে কিছুটা ভয়ই পায়। কিন্তু এই মেয়েটার কোনো বিকার নেই।
নাগারের সাথে কোনো প্রকার আলাপে জড়ায়নি সে। কিছুক্ষণ পরপর কেবল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, যেন কোথাও যাবার তাড়া আছে।
খানিক বাদে একটা পরিচিত গন্ধ নাকে এলো নাগারের। টোস্টারের পরিচিত ‘চিং’ শব্দটাও শুনতে পেলো ঠিক সেই সময়। খাবার প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। রান্নাঘরে গিয়ে দ্রুত কাজে লেগে পড়লো।
মেয়েটার অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। কফির কাপে চুমুক দিয়ে একবার আলতো করে মাথা নাড়লো। যেন বুঝতে পেরেছে যে হাতে আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় আছে। রান্নাঘর থেকে ট্রে হাতে বেরিয়ে এলো নাগারে। টোস্ট, মাখন, সালাদ আর দই সাজানো ওখানে। মাখনটা নাগারে নিজেই বানিয়েছে। এই জিনিসটা বরাবরই খুব ভালো হয় তার। বার হোস্টেস হিরাই তো একটা প্লাস্টিকের কন্টেইনারে করে এখান থেকে মাখন বাসায় নিয়ে যায়, এত পছন্দ তার।
আগত অতিথিদের নিজের বানানো মাখন তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখলে মনে মনে ভীষণ খুশি হয় নাগারে। সমস্যাটা হচ্ছে, মাখন বানানোর জন্য সবচেয়ে দামি সব উপকরণ ব্যবহার করে সে। কিন্তু অতিথিদের কাছ থেকে মাখনের কোনো দাম রাখা হয় না। মূল খাবারের সাথে আনুষঙ্গিক যা দেওয়া হয়, সেসবের দাম না রাখার ব্যাপারে বরাবরই বদ্ধপরিকর নাগারে। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে ব্যাপারটা ক্যাফের জন্য মোটেও সুবিধাজনক নয়।
ট্রে হাতে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ছোটোখাটো মেয়েটার পাশে রীতিমত দানবের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
“কার সাথে দেখা করতে এসেছ তুমি?” নীচের দিকে তাকিয়ে বললো নাগারে। এটাসেটা বলে সময় নষ্ট করার মানুষ নয় সে।
মুখ তুলে পর্বতপ্রতিম মানুষটার দিকে তাকালো মেয়েটা। সেই নির্মোহ দৃষ্টি দুই চোখে। নাগারে সাধারণত তার আশপাশের মানুষদের কিছুটা ভয় পেতে দেখে অভ্যস্ত; কিন্তু আজকে মেয়েটার এহেন আচরণ বেশ অদ্ভুত লাগছে তার।
“কী?”
কিন্তু মেয়েটা যেন পণ করেছে যে জবাব দেবে না। “ওরকম কেউ না, ‘ বলে কফিতে আবারো চুমুক দিলো সে। বোঝাই যাচ্ছে যে নাগারের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই তার।
মাথা একদিকে হেলিয়ে ট্রে’টা আস্তে করে টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখলো নাগারে। এরপর ফিরে এল কাউন্টারে পেছনে।
অস্বস্তি ফুটে উঠেছে মেয়েটার চেহারায়।
“এক্সকিউজ মি,” কিছুক্ষণ পর নাগারের উদ্দেশ্যে বললো সে।
“কী?”
“আমি তো এগুলো অর্ডার দেইনি,” সামনে রাখা টোস্টের দিকে দেখিয়ে বললো মেয়েটা।
“এটা ক্যাফের পক্ষ থেকে তোমার জন্য,” খানিকটা গর্বের সাথেই বললো নাগারে।
দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নিয়ে আবারো খাবারগুলোর দিকে তাকালো মেয়েটা। বুকের ওপর থেকে হাত নামিয়ে কাউন্টারের উপরে ঝুঁকে দাঁড়ালো নাগারে।
“তুমি এত কষ্ট করে ভবিষ্যৎ থেকে এসেছ। এভাবে খালি পেটে তো আর ফিরে যেতে দেওয়া যায় না,” মনে মনে হয়তো একটা ধন্যবাদ আশা করছিল নাগারে। কিন্তু মেয়েটা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একবার হাসলো না পর্যন্ত। অগত্যা নিজেই আবারো মুখ খুললো নাগারে, “কোন সমস্যা?”
“না। আমি খাচ্ছি।”
“লক্ষ্মী মেয়ে।”
“না খাওয়ার তো কারণ নেই।
দক্ষ হাতে টোস্টে মাখন মাখিয়ে নিলো মেয়েটা। দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল। দ্রুত মুখ-হাত চালাতে লাগলো। তবে তাড়াতাড়ি খেলেও দৃশ্যটা ভীষণ প্রীতিকর।
মেয়েটার অভিব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছে নাগারে। স্বাভাবিকভাবেই সে ভেবেছিল যে মাখন দেওয়া টোস্টটা মুখে দেওয়ার পর তৃপ্তি ফুটে উঠবে মেয়েটার চোখেমুখে। কিন্তু ওরকম কিছু হলো না। একই ভঙ্গিতে খেয়ে চলেছে মেয়েটা। টোস্ট শেষ করে সালাদ আর দইটুকুও খেয়ে নিলো।
সবকিছু খাওয়ার পর ধন্যবাদের ভঙ্গিতে একবার কেবল দুই হাত জড়ো করে মাথা নাড়লো, কিন্তু কিছু বললো না।
নাগারেকে দেখে মনে হবে কেউ বুঝি সপাটে চড় কষিয়েছে তাকে।
.
ক্যাফেতে ঢুকে প্রথমেই কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো নাগারের হাতে চাবির তোড়াটা তুলে দিলো কায়ু। “আমি ফি—” বাক্যটা শেষ করা হল না তার। বিশেষ সিটটায় বসে থাকা মেয়েটাকে দেখছে একমনে।
“হ্যালো,” চাবিটা পকেটস্থ করে বললো নাগারে। অন্য কোনদিন হলে ফেরার সময় হল তাহলে’ জাতীয় কিছু বলতো।
“মেয়েটা কে?” ভাইয়ের কবজিতে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বললো কাযু।
সাধারণত এসব বিষয়ে মাথা ঘামায় না কাযু। কাউকে ওই সিটটায় বসে থাকতে দেখলে ধরেই নেয় যে ভবিষ্যৎ থেকে কারো সাথে দেখা করতে এসেছে। আর এরকম ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো।
কিন্তু এর আগে কখনো এত কম বয়সি, রূপবতী কাউকে বসে থাকতে দেখা যায়নি চেয়ারটায়। চেষ্টা সত্ত্বেও চোখ সরাতে পারছে না কায়ু।
মেয়েটাও খেয়াল করলো যে তার দিকে তাকিয়ে আছে ও।
“হ্যালো!” দরাজ হেসে বললো সে।
কিছুটা বিরক্তই হলো নাগারে, এতক্ষণ অবধি তার উদ্দেশ্যে একবারের জন্যও হাসেনি মেয়েটা।
“আপনি কী এখানে কারো সাথে দেখা করতে এসেছেন?” কায়ু জানতে চাইলো।
“হ্যাঁ,” স্বীকার করলো মেয়েটা।
দু’জনের কথোপকথন শুনে মেজাজ আরো খারাপ হচ্ছে ক্যাফে মালিকের। দুই ঠোঁট শক্ত করে চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে এখন। কিছুক্ষণ আগে তার করা একই প্রশ্নের জবাবে মেয়েটা না বলেছিল।
“কিন্তু যার সাথে দেখা করতে চাইছো, সে এখানে নেই। তাই তো?” উলটোদিকে ঘুরে কিছুটা রুক্ষ্ম স্বরেই বললো নাগারে।
তাহলে কার সাথে দেখা করতে চায় মেয়েটা? চিবুকে হাত রেখে ভাবে কাযু। “ওনার সাথে নিশ্চয়ই নয়?” এক মুহূর্ত পর নাগারের দিকে নির্দেশ করে বলে ও।
“আমার সাথে?” নিজেকে আঙুল দিয়ে দেখায় নাগারে। এরপর বিড়বিড় করে বলে, “ইয়ে, মানে…” তাকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা যখন ক্যাফেতে প্রথম উদয় হয়, তখনকার দৃশ্যপট নিয়ে ভাবছে।
প্রায় দশ মিনিট আগে সিটটায় হঠাৎ বসে থাকতে দেখা যায় মেয়েটাকে। কেইকে গাইনোকোলজি ক্লিনিকে পৌঁছে দিতে গেছিল কায়ু। সাধারণত নাগারেই কেইকে সব জায়গায় নিয়ে যায়, কিন্তু আজ যায়নি। তার মতে গাইনোকোলজি ক্লিনিকে শুধু মেয়েদের জায়গা, কোনো পুরুষের সেখানে পা রাখা উচিত না। এজন্যেই ক্যাফের দায়িত্ব একা একা সামলাচ্ছিল সে।
(মেয়েটা কী ইচ্ছা করে এমন একটা সময় বেছে নিয়েছে, যখন আমি একা থাকবো ক্যাফেতে?)
চিন্তাটা মাথায় আসতেই কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো সে।
(তাহলে এতক্ষণ নিশ্চয়ই সরাসরি কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিল বেচারি…)
নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে একবার আনমনে মাথা নাড়লো নাগারে, যেন সবকিছু বুঝতে পারছে এবারে। কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে মেয়েটার মুখোমুখি বসলো সে।
শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো মেয়েটা।
কিছুক্ষণ আগের নাগারের সাথে এখনকার নাগারের অঙ্গভঙ্গির বেজায় পার্থক্য।
লজ্জার কারণে আমার সাথে ওরকম ব্যবহার করছিল মেয়েটা। আমার উচিত সবকিছু সহজ করে নেওয়া, মনে মনে ভাবে নাগারে। একটা হাসি টেনে নেয় মুখে।
“তাহলে, আমার সাথে দেখা করতে এসেছো তুমি?” আলাপচারিতার ভঙ্গিতে কনুইয়ে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে সে।
“অসম্ভব।”
“আমার সাথে দেখা করতে আসোনি?”
“না।”
“আমার সাথে?”
“না!”
“…”
নাগারেকে রীতিমতো উড়িয়ে দিলো মেয়েটা। তাদের কথোপকথন শুনে একদম নিশ্চিত হয়ে গেল কাযু।
“ভাইয়া, তোমার সাথে দেখা করতে আসেনি ও, এটা নিশ্চিত এখন।” আবারো মুষড়ে পড়লো নাগারে। “আচ্ছা…আমি না তাহলে,” বিমর্ষচিত্তে কাউন্টারে ফিরে গেল সে।
ক্যাফে মালিকের এই অবস্থা দেখে যেন মজা পাচ্ছে মেয়েটা। হেসে উঠলো খিলখিল করে।
.
বেল বাজার শব্দ হতেই মাঝের ঘড়িটার দিকে তাকালো মেয়েটা। একমাত্র মাঝখানের ঘড়িটাই ঠিকঠাক সময় দেয়। অন্য দু’টো কিছুটা এগোনো এবং পেছানো। তথ্যটা নিশ্চয়ই জানা আছে তার।
ক্যাফের সবার দৃষ্টি এখন প্রবেশপথের দিকে।
কিছুক্ষণ পর কেই পা রাখলো ভেতরে।
“ধন্যবাদ, কায়ু,” হাঁটতে হাঁটতে বললো ক্যাফে মালিকের স্ত্রী। একটা নীল রঙের ড্রেস আর স্যান্ডেল তার পরনে। খড়ের তৈরি একটা হ্যাট দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে। কাযুর সাথে ক্লিনিকে গিয়েছিল, কিন্তু হাতের ব্যাগটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে ফেরার পথে মুদি দোকানেও ঢুঁ মেরেছে। কেই বরাবরই নির্ঝঞ্ঝাট ধরনের। একদম গোমড়ামুখী কাস্টমারের সাথেও হাসি মুখে কথা বলে সে। এমনকি জাপানিজ না জানা কোনো বিদেশি এলেও কথার ফুলঝুরি ফোটে তার মুখে।
“হ্যালো! আশা করি আপনার সময় ভালো কাটছে,” বিশেষ সিটটায় মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললো সে। স্বাভাবিকের তুলনায় আজকে তার হাসিটা আরো বেশি উজ্জ্বল, গলার স্বরও চড়া।
চেয়ারে সোজা হয়ে বসে একবার মাথা ঝোকালো মেয়েটা, কেইয়ের দিক থেকে নজর সরাচ্ছে না।
তাকে আরেকটা হাসি উপহার দিয়ে কাউন্টারের পেছনের রুমটার দিকে এগোলো সে।
“কেমন গেল সবকিছু?” কেইকে জিজ্ঞেস করলো নাগারে।
সে কোনো বিষয়ে কথা বলছে এটা বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না কেই কিংবা কায়ুর।
“ভালো,” নিজের পেটে একবার আলতো চাপড় মেরে হাসিমুখে বললো কেই।
“ঠিক আছে।” ভ্রু কুঁচকে দু’বার মাথা ঝাকালো ক্যাফে মালিক। সাধারণত কোনো বিষয়ে মনে মনে খুশি হলেও সেটা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারে না সে। তবে কেই ঠিকই বোঝে।
বিশেষ সিটটায় বসে আমুদে দৃষ্টিতে ভাবের এই আদানপ্রদান দেখছে মেয়েটা। মুখে মুচকি হাসি। কেই অবশ্য বিষয়টা খেয়াল করলো না। আবারো পেছনের রুমটার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো সে।
ঠিক এই মুহূর্তে অপ্রত্যাশিতভাবে কথা বলে উঠলো মেয়েটা, “এক্সকিউজ মি?”
“হ্যাঁ?” থেমে কিছু না ভেবেই জবাব দিলো কেই। পেছনে ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালো। তার চোখও ওর মতোন উজ্জ্বল।
ইচ্ছা করেই যেন চোখ নামিয়ে নিলো মেয়েটা। টেবিলের উপরে হাত নাড়াচাড়া করছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে।
“কী হয়েছে?” আবারো প্রশ্ন করলো কেই।
এবারে মুখ তুললো মেয়েটা; দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা চায় সে। মুখে সেই মিষ্টি হাসিটা ফিরে এসেছে আবারো। নাগারের সাথে যেরকম শীতল আচরণ করছিল, তার ছিটেফোঁটাও নেই এখন।
“আসলে…”
“হ্যাঁ? কী?”
“আপনার সাথে একটা ছবি তুলতে চাই আমি।”
মেয়েটার কথা শুনে দৃশ্যতই অবাক হলো কেই। “আমার সাথে?”
“হ্যাঁ।”
“ওর সাথে?” প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে থামাতে পারলো না নাগারে। “হ্যাঁ,” প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো মেয়েটা।
“আপনি কী ওনার সাথে দেখা করতেই এসেছেন?” এবারে কায়ুর জিজ্ঞেস করার পালা।
“হ্যাঁ।”
অচেনা মেয়েটার এই সহজ স্বীকারোক্তি শুনে চেহারা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কেইয়ের। আর দশজন মানুষের মতোন অপরিচিত লোকজনের প্রতি কোনো প্রকার সন্দেহ কাজ করে না তার। তাই তো মেয়েটা কেন ছবি তুলতে চায়, সেই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে সে বললো, “তাই নাকি? আচ্ছা আমি একটু মেকআপ ঠিকঠাক করে নেই?”
কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা মেকআপ কেস বের করলো সে।
“আসলে, সময় খুব বেশি নেই আমার হাতে,” সংশয়মাখা কণ্ঠে বললো মেয়েটা।
“তাই তো!”
নিয়মগুলো সব ভালো করেই জানা আছে কেইয়ের। গাল দু’টো ঈষৎ রক্তিম হয়ে উঠলো বেচারির। মেকআপ কেসটা আগের জায়গায় ঢুকিয়ে ফেলতে দেরি করলো না।
কারো সাথে ছবি তুলতে চাইলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোটাই নিয়ম, কিন্তু এই ক্যাফের সময় পরিভ্রমণের বিশেষ নিয়মগুলোর কারণে মেয়েটা সিট ছেড়ে উঠতে পারবে না। হাতের প্লাস্টিক ব্যাগ আর হ্যাটটা কার হাতে তুলে দিয়ে কেই নিজেই তার দিকে এগিয়ে গেল।
“আপনার ক্যামেরা কোথায়?” কায়ু বললো।
জবাবে তার দিকে চিকন একটা জিনিস ঠেলে দিলো মেয়েটা।
“এটা? এটা ক্যামেরা?” বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কেই। দেখতে একটা বিজনেস কার্ডের মতোন লাগছে ওটাকে। একদম ওয়েফারের মতোন পাতলা, প্রায় স্বচ্ছ।
কেইয়ের মনে ধরেছে ক্যামেরাটা। “একদম পাতলা!” চারপাশ থেকে কয়েকবার দেখার পর বললো সে।
“আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে। সময় একদমই নেই,” মেয়েটা তাড়া দিলো এবারে।
“হ্যাঁ, সরি,” একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে দ্রুত মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ক্যাফে মালিকের স্ত্রী।
“ঠিক আছে, রেডি সবাই?” দু’জনের দিকে ক্যামেরা তাক করে বললো কাযু। জিনিসটা চালানো খুব কঠিন কিছু বলে মনে হচ্ছে না। স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নির্ধারিত বাটনটায় চাপ দিতে হবে শুধু।
ক্লিক।
“দাঁড়াও দাঁড়াও!” কেই বললো এসময়। কখন ছবিটা তুলবে তুমি?”
আসলে কেই তার চুল ঠিক করছিল, তখনই ছবি তুলে ফেলেছে কায়ু। ক্যামেরাটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলো সে।
“তুলে ফেলেছো! কখন তুললে?” মেয়েটা কিংবা কায়ু, কেউই বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি মাথা না ঘামালেও, কেইকে দেখে বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে।
“অসংখ্য ধন্যবাদ,” বলেই বাকি কফিটুকু এক চুমুকে শেষ করে ফেললো মেয়েটা।
“কী…? এক মিনিট,” কেই বললো। কিন্তু মেয়েটা ততক্ষণে ধোঁয়ার অংশ হয়ে গেছে। ধোঁয়াটুকু সিলিং অবধি উঠতে না উঠতেই সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা উদয় হলো সেখানে। দেখে মনে হবে যেন কোনো সুদক্ষ নিনজার কারসাজি।
ক্যাফেতে উপস্থিত প্রত্যেকেই অবশ্য এরকম দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত, তাই তাদের কোনো ভাবান্তর হলো না। অন্য কোনো কাস্টমার দেখলে ভয় পেতো নিশ্চিত। আর যদি কেউ দেখেও ফেলে তাহলে ক্যাফের লোকেরা বলবে যে এটা স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ানদের একটা জাদুর কৌশল। কিন্তু কৌশলটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তারা জুতসই কিছু বলতে পারবে না।
সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলা বরাবরের মতোনই তার হাতে ধরা বইটা পড়ে চলেছে, যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। কিন্তু টেবিলের উপরে রাখা ট্রে টার উপরে চোখ পড়তেই ডান হাত দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিলো। এর অর্থ পরিষ্কার-’সরাও এটা এখান থেকে!”
কেই ট্রে’টা সরিয়ে নিতে গেলে কাঁধে হাত রেখে তাকে থামালো নাগারে। এরপর নিজেই ওটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে।
“মেয়েটা কে ছিল কে জানে!” বিড়বিড় করে বললো কেই। কাযুর হাত থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ আর হ্যাটটা নিয়ে পেছনের রুমে চলে গেল সে।
এখনো ক্যাফের বিশেষ আসনটার দিকে তাকিয়ে আছে কায়ু। সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা টয়লেট থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছে সে।
বিশেষ সিটটার সাহায্যে যারা অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ থেকে ক্যাফেতে আসে, তাদের কেউই সাধারণত কায়ু, নাগারে কিংবা কেইয়ের সাথে গুরুত্ব দিয়ে কোনো কথা বলে না। এই প্রথম এরকম কিছু হলো। মেয়েটা কেইয়ের সাথে দেখা করতেই এসেছিল।
কেউ ভবিষ্যৎ থেকে এলে তাদের কোনদিন কারণ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেনি কায়ু। কোনো কুখ্যাত খুনিও যদি ফিরে আসে, তবুও বিষয়টায় নাক গলাবে না সে। সিটটার সাহায্যে সময় পরিভ্রমণের অমোঘ একটা নিয়ম হচ্ছে অতীতে যা-ই করা হোক না কেন, বর্তমানে কোনো কিছু বদলাবে না। যেমন, ভবিষ্যৎ থেকে বন্দুক নিয়ে এসে কেউ যদি ক্যাফের কোনো কাস্টমারকে গুলি করে, তবুও সেই কাস্টমার কোনো না কোনভাবে বেঁচে যাবে। কারণ, তার ভবিষ্যৎ সত্তা তখনও জীবিত। একটু অদ্ভুত হলেও এইটাই নিয়ম।
কাযু কিংবা ক্যাফের অন্য কোনো কাস্টমার হয়তো অ্যাম্বুলেন্সের জন্য জরুরি নম্বরে ফোন করবে। ক্যাফেতে আসার পথে অ্যাম্বুলেন্সটা কোনো জামে পড়বে না। যত দ্রুত সম্ভব গুলিবিদ্ধ কাস্টমারকে হাসপাতালে নেওয়া হবে। ধরা যাক হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীকে দেখে বললো, ‘বাঁচানো সম্ভব না’। তখন দেখা যাবে ঠিক সেদিনই কোনো এক বিশেষ কাজে হাসপাতালে উপস্থিত আছেন বিখ্যাত কোনো সার্জন। অপারেশন থিয়েটারে যমদূতের সাথে রোগীকে নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন তিনি। যত দুর্লভ রক্তের গ্রুপই হোক না কেন, হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যাবে সেই গ্রুপের পর্যাপ্ত রক্ত। সফল অপারেশন শেষে সার্জন বের হয়ে হাসিমুখে বলবেন ‘আর এক মিনিট দেরি হলেই বাঁচানো যেত না’ কিংবা ‘গুলিটা আর এক মিটার উপরে লাগলেই কোনো আশা ছিল না। কর্তব্যরত সব স্টাফ বলবে যে এরকম অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি তাদের।
তবে যে যতই অবাক হোক, যতই বিস্ময় প্রকাশ করুক-পুরো ঘটনার জন্য দায়ী ক্যাফের সেই নিয়ম।
এজন্যেই ভবিষ্যৎ থেকে কেউ এলে কোনো প্রকার আগ্রহ দেখায় না কাযু। আগন্তুক যতই চেষ্টা করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে।
.
“এটা একটু নিয়ে যেতে পারবে?” রান্নাঘর থেকে বললো নাগারে।
পেছনে ফিরে ক্যাফে মালিককে রান্নাঘরের দরজায় ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো কায়ু। সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলার জন্য কফি বানিয়ে এনেছে। ভাইয়ের হাত থেকে ট্রে’টা নিয়ে বিশেষ সিটটার দিকে পা বাড়ালো কায়ু।
এক মুহূর্ত ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে, মাথা কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েটা ভবিষ্যৎ থেকে এসেছিল কেন? কেইয়ের সাথে যদি ছবি তুলতেই হয়, তাহলে অতীতে পাড়ি জমানোর দরকারটা কী?
.
“স্বাগতম!” দরাজ গলায় বললো নাগারে। চিন্তায় লাগাম টেনে ভদ্রমহিলার সামনে কফি পরিবেশন করলো কায়ু।
(কিছু একটা চোখের সামনেই আছে, যা বুঝতে পারছি না।) ভাবনাটা দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য একবার মাথা ঝাঁকালো কায়ু।
“হ্যালো,” কোহতাকে এসেছে ক্যাফেতে। কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিল সে। আজ লেবু রঙা একটা পোলো শার্ট, সাদা স্কার্ট আর পামশু তার পরনে। কাঁধে সবসময়ের মতোন ক্যানভাস ব্যাগ।
“হ্যালো, কোহতাকে,” নাগারে বললো।
নামটা শোনামাত্র ঘুরে দাঁড়ালো সে, যেন বেরিয়ে যাবে ক্যাফে ছেড়ে।
“সরি, মিসেস ফুসাগি,” দ্রুত শুধরে নিলো নাগারে। এবারে হাসি ফুটলো কোহতাকের মুখে। কাউন্টারের সামনের সিটে এসে বসলো।
তিনদিন আগে অতীতে ফিরে গিয়ে ফুসাগির সেই চিঠিটা নিয়ে আসে কোহতাকে। সেদিনই সবাইকে বলে দিয়েছে তাকে যেন ‘মিসেস ফুসাগি বলেই ডাকা হয়।
ব্যাগটা চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখলো কোহতাকে। “কফি, প্লিজ।”
“এক্ষুনি দিচ্ছি,” একবার বাউ করে রান্নাঘরে চলে গেল নাগারে।
আড়মোড়া ভেঙে পুরো ক্যাফেতে নজর বুলালো কোহতাকে। এই মুহূর্তে সে-ই একমাত্র কাস্টমার। ভেবেছিল এখানে এসে হয়তো ফুসাগিকে দেখতে পাবে। কফি শেষ করে একসাথে ফিরবে বাসায়; কিন্তু ফুসাগি আসেনি। মনে মনে কিছুটা হতাশই হলো সে।
এতক্ষণ হাসিমুখে নাগারে আর কোহতাকের কথোপকথন উপভোগ করছিল কাযু। কেবলই ভদ্রমহিলার কাপে কফি ঢেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। “এখন আমার বিরতি,” বলে পেছনের রুমটায় চলে গেল।
“ঠিক আছে,” বলে তার উদ্দেশ্যে একবার হাত নাড়লো কোহতাকে। আগস্টের প্রথম দিক। তাপমাত্রার পারদ তুঙ্গে। তবে এই তাপদাহের মাঝেও গরম কফিই খাওয়ার অভ্যাস কোহতাকের। সদ্য বানানো কফির ঘ্রাণ খুব ভালো লাগে তার। আইসড কফি অতটা পছন্দ নয়। গরম কফির স্বাদের সাথে কোনো কিছুর তুলনা চলে না।
সাধারণত সাইফন মেথডে কফি বানায় নাগারে। প্রথমে ফুটন্ত পানি ঢালা হয় একটা ফ্লাস্কে। এরপর নিচ থেকে তাপ দেওয়ার ফলে বাষ্পগুলো একটা ফানেলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে জমা হয় অন্য একটা পাত্রে। কফি বিন রাখা থাকে সেই ফানেলে। তবে কোহতাকে কিংবা অন্য কোনো সাধারণ কাস্টমারের জন্য কফি বানানোর সময় এতটা কষ্ট করে না। ড্রিপারে ফিলটার রেখে, গুঁড়ো করা কফি বিনের উপরে পানি ঢেলে দেয় সরাসরি। এভাবে কফি বানালে পানির তাপমাত্রা অদলবদল করে স্বাদ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ক্যাফেতে কোনো সাউন্ড সিস্টেম না থাকায় ড্রিপার থেকে কফির প্রতিটা ফোঁটা পতনের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। শব্দটা কানে আসা মাত্র হাসি ফুটলো কোহতাকের চেহারায়।
কেই সাধারণত অটোমেটিক কফি মেকার ব্যবহার করে। মেশিনটায় বাটন চেপে নানা স্বাদের কফি বানানো যায়। কফি বানানোয় স্বামীর মতো দক্ষ না হওয়ায় মেশিনের ওপর নির্ভরশীল সে। ক্যাফের নিয়মিত কাস্টমারেরা তাই নাগারে না থাকলে কফি অর্ডার করে না। কারণ, কফি নাগারে বানাক কিংবা কেই-দাম একই। কাযুও সাধারণত সাইফন পদ্ধতিতে কফি বানায়। তবে স্বাদ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই তার, বরং ফানেলের মধ্যে দিয়ে বাষ্পের প্রবাহ দেখতে ভালো লাগে বলেই কাজটা করে। তাছাড়া হ্যান্ড-ড্রিপ পদ্ধতিতে কফি বানানো বড্ড বেশি ঝক্কির।
নাগারে কফির কাপটা কাউন্টারে নামিয়ে রাখলে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো কোহতাকে। এই মুহূর্তটা তার জন্য অমূল্য। নাগারের পছন্দ অনুযায়ী ইথিওপিয়ান মকা বিন থেকে বানানো কফির এই ঘ্রাণ অনেকের ভালো লাগে আবার অনেকের লাগে না। কোহতাকে প্রথম দলের অন্তর্গত 1 এই সুবাসের মাঝে সারাদিন বসে থাকতে পারবে সে।
নিজের বানানো মাখন কোনো কাস্টমারকে তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখলে যেমন খুশি হয় নাগারে, তেমনি এই কফির ঘ্রাণ উপভোগ করতে দেখলেও আনন্দিত হয় ভীষণ। দৃশ্যটা যতই দেখছে, ততই কুঁচকে যাচ্ছে তার ভ্রু-জোড়া।
“ওহ্, একটা ব্যাপার,” হঠাৎই বললো কোহতাকে, “হিরাইয়ের বার কালকে বন্ধ দেখেছিলাম। আজকেও দেখলাম খোলেনি। কিছু হয়েছে? জানেন নাকি?”
হিরাই যে ইজাকায়া কাম মিনি-হোস্টেস বারটা পরিচালনা করে, সেটা ক্যাফের একদম কাছেই। একটা কাউন্টারের চারপাশে সর্বসাকুল্যে মোট ছয়টা আসন। প্রতি সন্ধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, হিরাইয়ের মনমেজাজের উপর নির্ভর করে খোলে বারটা। তবে বছরের কোনো দিন বাদ যায় না। শুরু থেকেই প্রতিদিন অতিথিদের আপ্যায়ন করে চলেছে হিরাই। মাঝে মাঝে বার বন্ধ থাকলে বাইরে বসে অপেক্ষা করে অনেকে। কোনো কোনো রাতে ছোট্ট বারটায় দশ বারোজন ঢুকে পড়ে। প্রথম ছয়জন কেবল বসার সুযোগ পায়, বাকিরা দাঁড়িয়েই ড্রিংক করে।
আগত অতিথিদের সবাই যে পুরুষ, এমন নয়। নারীদের মাঝেও জনপ্রিয় হিরাই। তার চাঁছাছোলা কথা বলার ভঙ্গিতে অনেকে প্রথম দিকে বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারে যে কোনো প্রকার কূট উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলো বলেনি সে। তাই তো যা ইচ্ছা তা বলেই পার পেয়ে যায় হিরাই। কেউ কিছু মনে করে না।
কাপড়চোপড়ের বেলাতেও যথেচ্ছ মনোভাবের অধিকারী হিরাই। লম্বা বা খাটো, এসবের ধার ধারে না। তবে শিষ্টাচারের বিষয়টা কখনো ছোট করে দেখেনি সে। সবসময় সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। সেই কথাটা অযৌক্তিক হলেও কোনো বাধা দেয় না। বারে আগত অতিথি যেরকম বংশ বা পদমর্যাদারই হোক না কেন, উপযুক্ত কথা শোনাতেও কোনদিন পিছপা হয়নি। কেউ কেউ বিলের সাথে বাড়তি টাকা দিয়ে দেয় অনেক সময়। কিন্তু প্রাপ্য টাকাটুকু বাদে বাকিটা ফিরিয়ে দেয় হিরাই। অনেকে আবার দামি সব উপহার দিয়ে ওর মন জয় করতে চায়। কিন্তু কোনদিন কারো উপহার গ্রহণ করেনি ও।
বারে আগত পুরুষদের অনেকেই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে মার্সিডিজ, ফেরারি গাড়ি কিংবা হীরার আংটি অবধি কিনে দিতে চেয়েছে ওকে। কিন্তু জবাবে “আমি আগ্রহী নই”–শুনতে হয়েছে প্রত্যেককেই। কোহতাকে মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরে যায় হিরাইয়ের বারে। এখানে এসে ড্রিংক করার সময়টুকু যে ভালো কাটবে, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই কারো।
কোহতাকে খেয়াল করেছে যে বারটা সবসময় কাস্টমারে টইটম্বুর থাকে। এরককম জমজমাট একটা জায়গা পরপর দুই দিন বন্ধ থাকাটা অস্বাভাবিকই বটে। অতিথিদের কেউই এই বিষয়ে কিছু জানে না। একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছে তার
হিরাইয়ের কথা উঠতেই গম্ভীর হয়ে গেল নাগারের চেহারা।
“কী হয়েছে?” বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কোহতাকে।
ওর বোন…অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল,” কোমল গলায় বললো নাগারে।
“কী বলছেন!”
“বাঁচেনি।”
“সেদিনও দেখলাম ওকে।”
এরকম সংবাদ শোনার পর সচরাচর যা হয়, কোনো কিছু মুখে দেওয়ার ইচ্ছাটা বেমালুম উবে গেল কোহতাকের। হিরাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য প্রায়ই ক্যাফেতে আসতো কুমি, সেই সুবাদেই পরিচয়। হিরাই অবশ্য বোনের এরকম ঘনঘন আসাটা একদমই পছন্দ করত না। গত দুই বছরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কুমির সাথে দেখা করেনি সে। তা সত্ত্বেও প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও টোকিও ঘুরে যেত মেয়েটা। এই তো, তিনদিন আগেও বোনের সাথে দেখা করতে এসেছিল। এখান থেকে বাড়ি ফেরার পথেই দুর্ঘটনাটা হয়েছে।
হাইওয়েতে ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়ে যায় কুমির ছোট গাড়িটা। ড্রাইভার খুব সম্ভবত ঘুমে ঢলতে ঢলতে ট্রাক চালাচ্ছিল। যত দ্রুত সম্ভব অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে, কিন্তু পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বেচারি।
“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না,” এখন অবধি একবারও কাপে চুমুক দেয়নি কোহতাকে। কফিটুকু ঠান্ডা হচ্ছে পড়ে থেকে। বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে নাগারে, দৃষ্টি মেঝের দিকে।
ফোনে হিরাইয়ের পক্ষ থেকে একটা ই-মেইল পেয়েছে ক্যাফে মালিক। কেইয়ের সাথে যোগাযোগ করতেই বোধহয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত কুমির বড় বোন, কিন্তু তার নিজস্ব কোনো ফোন নেই। তাই নাগারেরটাই ভরসা। ই- মেইলে দুর্ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানিয়ে হিরাই বলেছে যে বারটা কিছুদিন বন্ধ থাকবে। পুরো ই-মেইলে উদাসীনতার ছাপ স্পষ্ট। যেন দুর্ঘটনাটা অন্য কারো জীবনে ঘটেছে। নাগারের ফোন থেকেই হিরাইকে ফিরতি ই-মেইল দেয় কেই, কিন্তু সেটার কোনো জবাব আসেনি। সেন্দাইয়ের উপকণ্ঠে অবস্থিত হিরাইদের পারিবারিক সরাইটার নাম তাকাকুরা।
পর্যটকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় একটা জায়গা সেন্দাই। এই জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ বাৎসরিক তানাবাতা উৎসব। উৎসব চলাকালীন সময়ে গোটা অঞ্চল সাজানো হয় বাঁশ এবং ঝালরের সাহায্যে বানানো প্রায় ত্রিশ ফিট উঁচু সাসাকাযারি দিয়ে। বিশাল বিশাল পাঁচটি রঙিন কাগজের বলও জুড়ে দেওয়া হয় এর সাথে। এছাড়া কাগজের তৈরি অন্যান্য সাজসরঞ্জাম, কিমোনো, অরিগ্যামি পেপার ক্রেইন-এসবেরও প্রবল চাহিদা পর্যটকদের কাছে। সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে এগুলো ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে বা বাসাবাড়িতে ঝুলিয়ে রাখে অনেকেই। প্রতি বছর ৬ থেকে ৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় তানাবাতা উৎসব। অর্থাৎ, এই বছর অনুষ্ঠানের আর খুব বেশি দেরি নেই। সাজসাজ রব পড়ে গেছে পুরো শহর জুড়ে। ডাউনটাউন আর সেন্দাই স্টেশনও নিশ্চয়ই বাদ যায়নি। এই তিনদিনে প্রায় বিশ লক্ষ পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হবে চারপাশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই হিরাইদের সরাইয়ের সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটে এই মৌসুমে। সেন্দাই স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে সরাইটা।
.
“স্বাগতম!” নাগারের কণ্ঠের উৎফুল্লতায় কিছুটা হলেও কাটলো ক্যাফের গুমোট ভাব।
বেলের শব্দে কোহতাকের ঘোরও কেটে গেছে। সোজা হয়ে বসে কফির দিকে হাত বাড়ালো সে।
“স্বাগতম,” বলতে বলতে অ্যাপ্রোন পরেই পেছনের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল কেই। বেলের শব্দ সে-ও শুনেছে। কিন্তু বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও কাউকে দেখা গেল না ক্যাফের দোরগোড়ায়। নাগারে কেবলই সামনে এগোতে যাবে এমন সময় একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো বাইরে থেকে।
“নাগারে! কেই! কেউ আছো? একটু লবণ নিয়ে এসো! লবণ!”
“হিরাই নাকি?”
সেন্দাই থেকে যে এত দ্রুত ফিরে আসবে হিরাই, তা কারো মাথাতেই আসেনি। কুমির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান অবশ্য শেষ।
বিস্ফারিত নয়নে নাগারের দিকে তাকালো কেই। নাগারেও কম অবাক হয়নি। হাজার হলেও, কেবলই হিরাইয়ের বোনের মৃত্যুর খবর কোহতাকে’কে জানিয়েছে সে।
নিশ্চয়ই কোনো ধর্মীয় আচার পালনের জন্য লবণ চেয়েছে হিরাই, কিন্তু শুনে মনে হচ্ছে যেন কেউ রান্নাঘরে ডিনার বানাতে ব্যস্ত, হঠাৎ লবণে টান পড়েছে।
“কোথায়!” আগের চেয়েও চড়া কণ্ঠে বলো হিরাই।
“দিচ্ছি! এক সেকেন্ড।” উপায়ান্তর না দেখে তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘর থেকে হাতে করে লবণদানিটা নিয়ে এলো নাগারে।
ক্যাফের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হিরাইয়ের কথা চিন্তা করছে কোহতাকে। এরকম পরিস্থিতিতেও নিশ্চয়ই নিজের মর্জিমত পোশাক পরেছে সে। তার চিন্তাধারা আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোন নয়। কেইয়ের সাথে একবার চোখাচোখি হলো কোহতাকের। দু’জনের মাথাতেই একই চিন্তা ঘুরছে।
“খুব ক্লান্ত লাগছে,” পা টেনে টেনে হাঁটছে হিরাই।
সবসময় এভাবেই হাঁটে সে। কিন্তু আজকে তার বেশভূষা কিছুটা অন্যরকম।
পোশাকের ক্ষেত্রে সাধারণত উজ্জ্বল রংই পছন্দ করে হিরাই। টকটকে লাল কিংবা গাঢ় গোলাপি। তবে আজ তার পরনের কাপড়েও লেগেছে শোকের ছায়া। চুলে গোজা কার্লারগুলোও নেই; বরং খোঁপায় বাঁধা অবাধ্য চুলগুলো। মাঝখানের টেবিলটায় বসে ডান হাত উঁচু করলো সে।
“বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, কিন্তু আমাকে কী এক গ্লাস পানি দেওয়া যাবে, প্লিজ?” কেইয়ের উদ্দেশ্যে বললো হিরাই।
“নিশ্চয়ই।”
দ্রুত রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা চালালো ক্যাফে মালিকের স্ত্রী।
“কী যে একটা অবস্থা,” আনমনে বললো হিরাই।
ব্যাগ ঘাড় থেকে না নামিয়েই হাত পা ছড়িয়ে একবার আড়মোড়া ভাঙলো সে। লবণদানিটা এখনো নাগারের হাতে। কাউন্টারের সামনে বসে বার হোস্টেসের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কোহতাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানির গ্লাস হাতে ফিরে এলো কেই
“ধন্যবাদ,” হ্যান্ডব্যাগটা টেবিলে নামিয়ে রেখে গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো হিরাই। এক ঢোকে পুরো পানিটুকু সাবাড় করে দিলো সে। লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো এরপর।
“আরেক গ্লাস, প্লিজ,” কেইয়ের হাতে গ্লাসটা তুলে দিয়ে অনুরোধ করলো হিরাই। আগের চেয়েও দ্রুত রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা চালালো কেই। কপাল থেকে ঘাম মুছে আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কুমির বড় বোন। নাগারে কিছু না বলে চুপচাপ দেখছিল তাকে এতক্ষণ।
“হিরাই?”
“কী?”
“কীভাবে কথাটা বলবো বুঝতে পারছি না।”
“কী বলতে চাইছেন?”
“মানে…মানে…”
“কী?”
“ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আমরা সবাই…”
হিরাইকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার পরিবারের কেউ সদ্য মারা গেছে। এজন্যেই আসলে ইতস্তত বোধ করছে নাগারে। কী বলবে দ্বিধায় ভুগছে সেটা নিয়ে। কোহতাকেও বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে মাথা নিচু করে নিয়েছে।
“কুমির জন্য?”
“হ্যাঁ।”
“আসলেই একটু অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো হিরাই। শুনে মনে হবে যেন খবরের কাগজে পড়া অপরিচিত কারো দুর্ঘটনার ব্যাপারে কথা বলছে। “দুর্ভাগ্য বলা যায়।”
আরেক গ্লাস পানি নিয়ে ফিরলো কেই। হিরাইয়ের মনে কী চলছে, তা বুঝতে না পারায় সে-ও মাথা নিচু করে রেখেছে।
“কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত,” দ্বিতীয় গ্লাসের পানিটুকুও নিমেষে সাবাড় করে ফেললো হিরাই। “ডাক্তাররা বলেছে যে খারাপ জায়গায় আঘাত পেয়েছিল…এজন্যেই বাঁচানো যায়নি।”
“আজকেই ছিল নাকি?” ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো কোহতাকে।
“কী আজকে?”
“শেষকৃত্য অনুষ্ঠান,” কোহতাকে বললো। হিরাইয়ের এহেন আচরণের কারণে সে-ও অস্বস্তিতে ভুগছে।
“হ্যাঁ, দেখছো না?” বলে উঠে দাঁড়িয়ে পরনে শোক পোশাকটা ওদেরকে দেখালো হিরাই। “আমাকে মানিয়েছে, তাই না? রংটা অবশ্য একটু চাপা।” মডেলদের মতো কয়েকবার পোজ দেওয়ার ভঙ্গি করলো সে। কে বলবে যে এই মানুষটার নিজের বোন মারা গেছে? এক এক মানুষের শোকের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ধরন এক এক রকম। তাই বলে এতটা নিরাবেগ কি করে থাকে কেউ?
সত্যি বলতে, হিরাইয়ের এরকম ব্যবহারে কিছুটা বিরক্তই হচ্ছে কোহতাকে। পরবর্তী কথাগুলো তাই কিছুটা রুক্ষ শোনালো। “এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে…?” আপনার বোনের প্রতি একটু অসম্মানজনক হয়ে গেল না ব্যাপারটা?—এই কথাটা বলা থেকে নিজেকে বেশ কষ্ট করে থামালো সে।
কথাটা শুনে অলস ভঙ্গিতে আবারো সিটে বসে পড়লো হিরাই। দু’হাত সামনে তুলে বললো, “ওরকম কিছু না। বারটার কথাও ভাবতে হবে আমাকে…” জবাব দিলো সে। কোহতাকে কী বলতে চেয়েছে তা সবার কাছেই স্পষ্ট।
“তবুও…।”
“প্লিজ, বাদ দিন। এসব নিয়ে কথা না বললেই ভালো।”
সামনে ঝুঁকে হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে আনলো সে।
“তুমি ঠিক আছো তাহলে?” হাতের লবণদানিটা নাড়াচাড়া করতে করতে বললো নাগারে।
“মানে?” হিরাই যেন পণ করেছে যে হেঁয়ালি ছাড়া কথা বলবে না। সিগারেটটা মুখে দিয়ে আবারো ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে সে। লাইটার খুঁজছে।
“অনেকক্ষণ খুঁজেও যখন জিনিসটা পাওয়া গেল না, নাগারে নিজের লাইটারটা পকেট থেকে বের করে এগিয়ে দিলো। তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। আর কয়েকটা দিন তাদের সাথে থেকে আসলে হতো না?”
নাগারের হাত থেকে লাইটারটা নিয়ে সিগারেট ধরালো হিরাই। “পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেরকমটাই করতাম নিশ্চয়ই…” সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ছাইটুকু সামনের অ্যাশট্রেতে ফেললো সে। ধোঁয়ার লম্বা একটা রেখা দোল খেতে খেতে উঠে যাচ্ছে সিলিং বরাবর। অভিব্যক্তিহীন চোখে সেই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে হিরাই। “কিন্তু ওখানে আমার কোনো জায়গা নেই।”
তার কথার নিগূঢ় অর্থটা বুঝতে একটু সময় লাগলো ক্যাফেতে উপস্থিত সবার। বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো কোহতাকে আর নাগারে।
“মানে?” কেইয়ের গলায় উৎকণ্ঠা।
জবাবে একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে পরবর্তী কথাগুলো বললো হিরাই। যেন সাধারণ কোনো বিষয়ে আলাপ করছে। “দুর্ঘটনাটা তো আমার সাথে দেখা করে ফেরার পথে ঘটেছে, তাই না? মা আর বাবা সেজন্যে আমাকেই দোষারোপ করবে কুমির মৃত্যুর জন্য, এটাই স্বাভাবিক।”
“তা কী করে সম্ভব?” বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কেই।
“এটাই সত্য,” ধোঁয়া ছেড়ে বললো হিরাই। “আর তাদের ধারণা যে ভুল, সেটাও বলা যাবে না। মানা করা সত্ত্বেও বারবার টোকিও আসতো কুমি…আর প্রতিবার ওকে ফিরিয়ে দিতাম আমি।”
শেষবার কেই হিরাইকে সাহায্য করেছিল কাউন্টারের নীচে লুকিয়ে থাকার ব্যাপারে। আফসোসের ভঙ্গিতে মুখ নামিয়ে নিলো সে। হিরাইয়ের চোখে অবশ্য ধরা পড়ছে না কিছুই। একমনে কথা বলে চলেছে সে।
“বাবা-মা আমার সাথে কথা বলেনি,” হাসিটা মুছে গেছে হিরাইয়ের মুখ থেকে। “একবারের জন্যও না।”
.
কুমির মৃত্যু সংবাদ হিরাইকে প্রথমে জানায় ওদের সরাইয়ের হেড ওয়েট্রেস। লম্বা সময় ধরে তাকাকুরাতে কাজ করছে সে। শেষবার কবে ওখান থেকে ফোন এসেছিল হিরাইয়ের নম্বরে, তা সে নিজেও বলতে পারবে না। কিন্তু দু’দিন আগে সকালবেলা নম্বরটা হঠাৎই ভেসে ওঠে ফোনের ডিসপ্লেতে। নামটা দেখে কেন যেন বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায় ওর। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্না জড়ানো কণ্ঠে কিছু একটা বলে হেড ওয়েট্রেস। পুরো বিষয়টা ধরতে একটু সময় লাগে হিরাইয়ের। “ওহ,” জবাবে কেবল এটুকুই বলতে পারে সে। ফোন নামিয়ে রেখে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটা একজন পার্টটাইম কমেডিয়ান। পুরো রাস্তা নানা রকম কৌতুক শোনায় সে। প্রতিটা কৌতুক শুনেই পেছনের সিটে হেসে গড়াগড়ি খায় হিরাই। হাসতে হাসতে পানি এসে যায় চোখে। লম্বা সময় পর অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছায় ওরা। তাকাকুরা, হিরাইয়ের আপন ঠিকানা।
শহর থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার দূরত্বে জায়গাটা। মিটারে ভাড়া দেখাচ্ছিল ১,৫০,০০০ ইয়েন। হিরাই নগদে ভাড়া মেটাতে চাইলে ড্রাইভার জানায় যে কাছাকাছি কিছু একটা দিলেই চলবে।
ট্যাক্সি থেকে নামার পর ওর খেয়াল হয় যে স্লিপার পায়েই চলে এসেছে। চুলে গোঁজা কার্লারগুলো খোলা হয়নি। পরনের ক্যামিজোলটা পাতলা হবার দরুন সূর্যের উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছিল ভালোভাবেই। দ্রুত ঘেমে ওঠে হিরাইয়ের পুরো শরীর। একটা রুমালের অভাববোধ করে প্রচণ্ড। পাথর বিছানো রাস্তাটা ধরে সরাইয়ের পেছন দিকের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে হিরাই। একটা পৃথক বাড়ি আছে ওখানটায়, সবাই সেখানেই থাকে। বাড়িটা খাস জাপানিজ স্টাইলে তৈরি। এখন অবধি একবারও সংস্কার করা হয়নি।
বড় গেইটটা পার করে মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো হিরাই। শেষবার এখানে ওর পা পড়েছিল তেরো বছর আগে। এখনো সবকিছু একদম আগের মতোনই আছে। জায়গাটায় যেন সময় স্থির হয়ে গেছে কোনো এক জাদুবলে। কাঁপা কাঁপা হাতে স্লাইডিং দরজাটা একপাশে সরানোর চেষ্টা করে হিরাই। তালা না থাকায় সহজেই খুলে যায় পাল্লা। ভেতরে কংক্রিটের মেঝেতে পা রাখে ও। চারপাশ বড্ড বেশি ঠান্ডা একবার কেঁপে ওঠে ওর পুরো শরীর। প্রবেশপথ থেকে হলওয়ে ধরে লিভিং রুমে চলে আসে হিরাই। গোটা ঘর অন্ধকার। প্রাণের কোনো ছোঁয়া নেই কোথাও। অবশ্য এরকমটাই স্বাভাবিক, পুরানো আমলের জাপানিজ বাড়িগুলোর ঘর সাধারণত অন্ধকারই হয়। কিন্তু আজ কেমন যেন অস্বস্তিকর ঠেকছে সবকিছু। হলওয়েতে ওর পদশব্দ বাদে আর কোনো শব্দ নেই। পারিবারিক প্রার্থনা কক্ষটা হলওয়ের শেষ মাথায়।
সেখানে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো হিরাই। ঘরটার সামনেই খোলা বারান্দা। ওখানে বাগানের দিকে বসে আছে ইয়াসুও, হিরাইয়ের বাবা। নজর সামনের বাগানের দিকে।
কুমিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে বেদির উপরে। একটা সাদা রোবে মোড়ানো পুরো শরীর। মাথার কাছে ঝুলছে গোলাপি রঙের কিমোনো, সরাই প্রধানের পোশাক এটা। ইয়াসুও নিশ্চয়ই এতক্ষণ মেয়ের পাশে বসে ছিল। মৃতের মুখ ঢেকে রাখার সাদা কাপড়টা শক্ত করে ধরে রেখেছে সে এক হাতে। ওদের মা, মিশিকোকে কোথাও দেখা গেল না।
হাঁটু মুড়ে বোনের পাশে বসলো হিরাই। দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। আলতো করে কুমির চেহারায় হাত রাখলো ও। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ফিসফিসিয়ে বললো একবার। যদি দুর্ঘটনায় চেহারার কোনো ক্ষতি হলে বদ্ধ কফিনে শুইয়ে রাখতে হতো কুমিকে। ফোনে দুর্ঘটনার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই মাথায় ঘুরছিল চিন্তাটা। ইয়াসুও এখন অবধি একবারও পেছনে ফিরে তাকায়নি।
“বাবা…” হিরাইকে বেশ কষ্ট করতে হলো শব্দটা বলার জন্য।
তেরো বছর আগে বাড়ি ছেড়ে যাবার পর থেকে এখন অবধি একবারও কথা হয়নি ওদের।
কিন্তু ইয়াসুও’র কানে ডাকটা পৌঁছালো না। একবার কেবল শব্দ করে নাক টানলো সে। কুমির চেহারার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে উঠে পড়লো হিরাই। বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
সেন্দাইয়ের মূল শহরতলিতে পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগলো না। গোটা শহর জুড়ে এখন তানাবাতা উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। চুলে কার্লার গোঁজা অবস্থাতেই সন্ধ্যা অবধি ঘুরে বেড়ালো হিরাই। শেষকৃত্যের পড়ার জন্য জুতসই পোশাক কিনে একটা হোটেলে চলে এল।
পরদিন কুমির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তেরো বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মাকে দেখলো হিরাই। পিঠ সোজা করে স্বামীর পাশে বসে আছে মিশিকো। ইয়াসুও অবশ্য সামলাতে পারেনি নিজেকে, কেঁদেই চলেছে একটানা। পরিবারের সদস্যদের জন্য বরাদ্দ আসনে না বসে আগত অতিথিদের মাঝে জায়গা করে নিলো হিরাই। একবার মাত্র মায়ের সাথে চোখাচোখি হলো ওর, কিন্তু কোনো কথা হলো না। বোনের আত্মার পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে ধূপ জ্বাললো হিরাই, এরপর কারো সাথে কথা না বলেই বিদায় নিলো।
হিরাইয়ের হাতের সিগারেটটায় ছাইয়ের ধারা লম্বা হচ্ছে তো হচ্ছেই। এক সময় নিঃশব্দে টেবিলের উপরেই খসে পড়লো ছাইটুকু। “এই তো পুরো ঘটনা,” সিগারেটের মাথাটা অ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে বললো হিরাই।
মাথা নিচু করে রেখেছে নাগারে। কাপ হাতে এখনো আগের জায়গাতেই বসে আছে কোহতাকে।
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে সরাসরি হিরাইয়ের দিকে তাকালো কেই। কিছু একটা বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে আটকালো নিজেকে।
তিনজনের চেহারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হিরাই। “আসলে এসব গম্ভীর বিষয়-আশয় নিয়ে ভাবতে কখনোই ভালো লাগে না আমার।”
“হিরাই…” কেই কথা বলতে শুরু করলেও হাত উঁচিয়ে তাকে থামালো হিরাই।
“মুখ গোমড়া করে রেখো না তো তোমরা। আর আমি ঠিক আছি কী না, এই প্রশ্নটাও বারবার করার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।”
কেইয়ের চেহারাতেই স্পষ্ট যে কিছু একটা বলতে চাইছে সে। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ দিলো না ও।
“আমাকে দেখে হয়তো বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু আসলেও আমার মন খারাপ। কিন্তু সারাজীবন মন খারাপ করে রাখলে তো আর চলবে না, তাই না?”
ওর কথা শুনে মনে হবে কোনো বাচ্চা ব্যথা পেয়েছে, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। হিরাই মানুষটাই আসলে এরকম। তার জায়গায় কেই হলে কান্নাকাটি করে চারপাশ ভাসিয়ে ফেলতো। কোহতাকে হলে চুপচাপ আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে কাটাতো সময়টা, সব আচার যথাযথভাবে পালন করত একসাথে। কিন্তু হিরাইকে কেই বা কোহতাকের সাথে মিলিয়ে ফেললে চলবে না।”
“আমি শোক পালন করবো আমার মতো করে,” বলে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো হিরাই। “আবার কিছু ঘটলে তোমাদের জানাবো। দরজার দিকে পা বাড়ালো সে।
“তাহলে এখন ক্যাফেতে এলে কেন?” নাগারের প্রশ্নটা শুনে মনে হবে যেন নিজেকেই করেছে। থমকে গেল হিরাই।
“সেন্দাই থেকে সরাসরি নিজের বাসায় না গিয়ে এখানে এসেছ কেন?” এবারে কোনপ্রকার রাখঢাক ছাড়াই জিজ্ঞেস করলো নাগারে। চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। আগের জায়গাতেই আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো হিরাই।
“এহহে, ধরা পড়ে গেলাম,” লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললো সে। এরপর ঘুরে আবারো আগের জায়গায় এসে বসলো।
নাগারে এখনো চোখ তোলেনি। লবণদানিটাই বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে বোধহয় তার কাছে।
“হিরাই,” একটা চিঠি হাতে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো কেই। “এটা রেখে দিয়েছিলাম আমি।”
“ফেলোনি?” চিঠিটা চিনতে কোনো অসুবিধে হলো না হিরাইয়ের। তিন দিন আগে এই ক্যাফেতে বসেই ওটা লিখেছিল কুমি। তখন অবশ্য সে কেইকে বলেছিল চিঠিটা ফেলে দিতে।
কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা নিলো ও। কুমির লেখা শেষ চিঠি।
“এরকম পরিস্থিতে চিঠিটা তোমাকে দিতে হতে পারে, এমনটা ভাবিনি কখনো,” মাথা নিচু করে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বললো কেই।
“আমিও ভাবিনি…থ্যাংক ইউ,” জবাবে বললো হিরাই।
খামের ভেতর থেকে এক ভাঁজ করা চিঠিটা বের করে আনলো। চিঠিতে ও যা ভেবেছিল, সেসবই লেখা। তবুও চোখে পানি এসে গেল।
“ওর সাথে দেখা পর্যন্ত করিনি আমি,” নাক টেনে বললো হিরাই। “কিন্তু কুমি জীবনের শেষ দিনটা অবধি চেষ্টা করে গেছে। বারবার টোকিওতে এসেছে আমার সাথে দেখা করার জন্য।”
প্রথমবার কুমি যখন টোকিওতে আসে, তখন তার বয়স ছিল আঠারো আর হিরাইয়ের চব্বিশ। ততদিন অবধি কুমি ছিল হিরাইয়ের ‘আদরের ছোট বোন’। বাবা-মা’র কাছ থেকে লুকিয়ে বোনের সাথে যোগাযোগ করত সে। সিনিয়র হাইস্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থাতেই পড়াশোনার ফাঁকে সরাইয়ের কাজকর্মে মা-বাবা’কে সাহায্য করত কুমি। হিরাই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ায় পরিবারের স্বপ্ন পূরণের ভারটা এসে পড়ে তার কাঁধে। প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই পুরানো সরাইটার মুখপাত্রে পরিণত হয় সে। ভবিষ্যৎ মালকিন। তখন থেকেই হিরাইকে সেন্দাইয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টার শুরু। ব্যস্ততা সত্ত্বেও প্রতি দুই মাসে একবার হলেও টোকিওতে আসতে শুরু করে সে। প্রথমদিকে প্রিয় ছোট বোনের মতোনই তার সাথে ব্যবহার করত হিরাই। পুরো কথা শুনতো। কিন্তু কিছু সময় পর একই কথাগুলো বড্ড একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। গত প্রায় দুই বছর ধরে তাই হিরাই পুরোপুরি এড়িয়ে চলতো বোনকে।
শেষবার কুমি যখন এই ক্যাফেতে আসে, হিরাই চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কাগজটা আবারো খামে ঢুকিয়ে নাগারের দিকে তাকালো সে। “নিয়মটা জানা আছে আমার। অতীতে গিয়ে যা-ই করা হোক না কেন, বর্তমানে কিছু বদলাবে না। তবুও ওই দিনটায় যেতে চাই আমি।”
“হিরাই…’”
“প্লিজ!” এর আগে কখনো এতটা গম্ভীর ভঙ্গিতে হিরাইকে কথা বলতে শোনেনি ওরা কেউ। মাথা নিচু করে রেখেছে বার হোস্টেস।
তাকে এই অবস্থায় দেখে সরু চোখজোড়া আরো সরু হয়ে এলো নাগারের। সে জানে কোন দিনটার কথা বলছে হিরাই। তিনদিন আগেই ক্যাফেতে এসেছিল কুমি। এখন অতীতে ফিরে বোনের সাথে দেখা করতে চায় বার হোস্টেস। নাগারের জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে কেই আর কোহতাকে। গোটা ক্যাফে একদম নিস্তব্ধ। একমাত্র সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলার আচার আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। একমনে উপন্যাস পড়ে চলেছে সে।
শব্দ করে হাতের লবণদানিটা কাউন্টারে নামিয়ে রাখলো নাগারে। এরপর কথা না বাড়িয়ে উধাও হয়ে গেল পেছনের রুমে।
মাথা তুলে লম্বা একটা শ্বাস নিলো হিরাই।
পেছনের রুমটা থেকে নাগারের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো কিছুক্ষণ পর। কাযুর সাথে কথা বলছে সে।
“কিন্তু, হিরাই-”
“হ্যাঁ, আমি জানি।”
কোহতাকের কথাটা শেষ করতে দিলো না হিরাই। সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলা যে টেবিলটায় বসে আছে, সেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ও। “আপনি কী একটু সরবেন, প্লিজ? আমি এখানে বসতে চাচ্ছিলাম।”
“হি-হিরাই,” ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো কেই।
“একটু সাহায্য করুন আমাকে, প্লিজ!” কোহতাকের ডাক আমলে না নিয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে দুই হাত জড়ো করে বললো হিরাই। দৃশ্যটা অদ্ভুত, সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর কণ্ঠের আবেগটুকু শতভাগ আসল।
কিন্তু সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলার কোনো কিছুতেই যায় আসে না। একবার ওর দিকে তাকালো না পর্যন্ত। এবারে কিছুটা বিরক্ত হলো হিরাই। “এই যে! আপনি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?” ভদ্রমহিলার কাঁধে হাত রেখে বললো।
“না! হিরাই! ওনাকে ধরবে না!”
“প্লিজ!” কেইয়ের কথাও গ্রাহ্য করলো না বার হোস্টেস। জোর করে মহিলাকে চেয়ার থেকে সরাতে চাইছে।
“হিরাই! থামো!” কেই অনুরোধ করলো আবারো।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ পাকিয়ে হিরাইয়ে দিকে তাকালো মহিলা। সাথে সাথে ওর মনে হলো একশো মন ওজন বুঝি হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর উপরে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেন বেড়ে গেছে বহুগুণে। ক্যাফের বাতির ঔজ্জ্বল্যও কমে গেল। এক অপার্থিব চিৎকারে ছেয়ে উঠলো চারপাশ। শরীরের একটা পেশিও নাড়াতে পারছে না হিরাই। হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য হলো।
“কী…কী হচ্ছে!”
“সাবধান করেছিলাম তোমাকে,” নাটুকে ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো কেই।
হিরাই নিয়মগুলো সম্পর্কে জানে ঠিকই, কিন্তু অভিশাপের বিষয়টা তার অজানা। তাছাড়া এই ক্যাফেতে যারা আসে, তাদের বেশির ভাগই জটিল নিয়মগুলো শোনার পর ফিরে যায়। তাদের মুখ থেকেও এরকম কিছু শোনেনি ও।
“ডাইনি বুড়ি!” চ্যাঁচিয়ে বললো হিরাই।
““না, ভূত,” নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো কেই। মেঝে থেকে মহিলাকে একের পর এক গালি দিয়েই চলেছে হিরাই, কিন্তু এসব একদমই অর্থহীন।
‘ওহহো…!” পেছনের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো কায়ু। দৃশ্যটা একবার দেখেই বুঝে গেছে যে কী ঘটেছে। দ্রুত রান্নাঘর থেকে এক ক্যারাফ ভর্তি কফি নিয়ে এলো সে।
“আপনি কী আরেক কাপ কফি নিবেন?” ভদ্রমহিলা যে টেবিলে বসেছে তার পাশে দাঁড়িয়ে বললো।
“অবশ্যই,” জবাব দিলো ভদ্রমহিলা। সাথে সাথে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো হিরাই। কোনো এক রহস্যজনক কারণে একমাত্র কাযুই ভদ্রমহিলার অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারে; কেই বা নাগারে চেষ্টা করে দেখেছে, কিন্তু কাজ হয়নি। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে হিরাই। বেশ ভড়কে গেছে বেচারি। তা সত্ত্বেও কাযুর দিকে তাকিয়ে বললো, “কাযু, ডার্লিং, ওনাকে এখান থেকে ওঠানোর ব্যবস্থা করো। প্লিজ!”
“আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি, হিরাই।’
“কিছু তো করতে পারবে, নাকি?”
হাতে ধরা ক্যারাফটার দিকে তাকালো কায়ু। কী যেন ভাবছে আনমনে।
“আমি আসলে ঠিক জানি না যে পদ্ধতিটা কাজে দিবে কি না….”
হিরাইয়ের অবস্থা হয়েছে খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করার মতোন।
“যেটাই হোক, একটু চেষ্টা করো আমার জন্য,” আকুতি ঝরছে তার কণ্ঠে।
“আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখা যাক,” বলে আবারো ভদ্রমহিলার টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো কায়ু। কেইয়ের সহায়তায় উঠে দাঁড়ালো হিরাই। কৌতূহলী চোখে কায়ুর দিকে তাকিয়ে আছে দুজনই।
“আপনি কী আরেক কাপ কফি নিবেন?” টেবিলে রাখা কাপটা কফিতে পূর্ণ হলেও পুনরায় জিজ্ঞেস করলো কায়ু।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো হিরাই আর কোহতাকে, কায়ুর উদ্দেশ্যটা ঠিক বুঝতে পারছে না।
তবে টেবিলে বসে থাকা ভদ্রমহিলা ঠিকই জবাব দিলো। “অবশ্যই,” বলে এক চুমুকেই কিছুক্ষণ আগে কায়ুর দিয়ে যাওয়া কফিটুকু শেষ করে ফেললো সে। খালি কাপটা আবারো কফিতে পূর্ণ করে দিলো কায়ু। ভদ্রমহিলা ততক্ষণে উপন্যাস পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে।
কিন্তু ঠিক তখনই…
“আপনি কী আরেক কাপ কফি নিবেন?” কায়ু জিজ্ঞেস করলো আবারো।
ভদ্রমহিলা এখনো সদ্য পূর্ণ কফির কাপটার দিকে হাত বাড়ায়নি। তা সত্ত্বেও, “অবশ্যই,” বলে ঢকঢক করে কফিটুকু শেষ করে নিলো সে।
“ওহ…” এতক্ষণে কোহতাকে ধরতে পারলো যে কী করতে চাইছে কাযু।
বারবার একই কাজের পুনরাবৃত্তি করতেই থাকলো মেয়েটা। “আপনি কী আরেক কাপ কফি নিবেন?” প্রতিবার এই প্রশ্নের জবাবে ইতিবাচক উত্তরই দিলো ভদ্রমহিলা। তবে কিছুক্ষণ পর একটু অস্বস্তি ফুটলো তার চেহারায়।
এখন আর এক ঢোকে কফি শেষ করছে না সে। বরং, কয়েক চুমুক দিচ্ছে। এভাবেই তাকে একে একে সাত কাপ কফি খাওয়ালো কায়ু।
দেখে তো লাগছে যে অসুবিধা হচ্ছে ওনার, তাহলে নিষেধ করছে না কে?” কোহতাকের কণ্ঠে সহানুভূতির ছাপ।
“নিষেধ করতে পারবে না আসলে,” কেই ফিসফিসিয়ে বললো তার কানে।
“কেন?”
“এটাই নিয়ম।”
“ঈশ্বর!” ভদ্রমহিলাকেও যে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, এটা জেনে বড্ড অবাক হয়েছে কোহতাকে। দুই চোখে আগ্রহ আরো প্রগাঢ় হলো তার। এ সময় অষ্টমবারের মতোন কাপে কফি ঢাললো কায়ু। দেখে মনে হচ্ছে যেন কাপ থেকে উপচে পড়বে কফি। সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠলো একবার। কিন্তু কায়ু হাল ছাড়বার পাত্র নয়।
“আপনি কী আরেক কাপ কফি নিবেন?”
কাযু নবমবারের মতো কফি সাধলে তড়াক করে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মহিলা।
“উঠে দাঁড়িয়েছে!” বাচ্চা মেয়েদের মতোন উৎসাহী কণ্ঠে বললো কোহতাকে।
“টয়লেট,” কায়ুর দিকে তাকিয়ে কোনোমতে কথাটা বলেই টয়লেটের দিকে ছুট দিলো ভদ্রমহিলা।
কিছুটা সময় লাগলেও বিশেষ সিটটা খালি হয়েছে অবশেষে।
“ধন্যবাদ,” কৃতজ্ঞ কণ্ঠে কাকে বলে টেবিলটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো হিরাই। সদ্য বোনকে হারানো বার হোস্টেসের বিচলিত ভাব সংক্রমিত হয়েছে ক্যাফের সবার মধ্যে। কয়েকবার লম্বা শ্বাস টানলো সে, এরপর চোখ বন্ধ করে সন্তর্পণে বসে পড়লো সিটটায়।
.
ছোটবেলা থেকে বড় বোনের নেওটা কুমি। ‘আপু’ ‘আপু’ বলে পেছনে ঘুরতো সারাদিন।
পুরানো সরাইটা ব্যস্ত থাকতো পুরো বছরই। ওদের বাবা-মা’ই ওখানকার সর্বেসর্বা। কুমির কয়েক দিন বয়স হতে না হতেই সরাইয়ের কাজে হাত লাগায় মিশিকো। তাই ছোট বোনকে দেখেশুনে রাখার দায়িত্বটা ছয় বছর বয়সি হিরাইয়ের কাঁধেই বর্তায়। এলিমেন্টারি স্কুল শুরু হলে কাঁধে করে বোনকে ক্লাসে পৌঁছে দিত ও। মফস্বলে স্কুল হওয়াতে শিক্ষক- শিক্ষিকারা অনেকটাই ছাড় দিতেন। কুমি ক্লাসে কান্নাকাটি শুরু করলে তাকে বাইরে নিয়ে যেত হিরাই। স্কুলে ছোটবোনের ঠিকঠাক খেয়াল রাখতো সে।
হিরাইকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেছিল ওর বাবা-মা। সবার সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারতো ও ছোট থেকেই। সরাইখানার ম্যানেজার হিসেবে তাই খুব একটা কষ্ট হতো না। তবে মেয়েকে ঠিকমতো চিনতে পারেনি মিশিকো আর ইয়াসুও। অন্যেরা কী ভাববে, সেসব নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতো না হিরাই। নিজের মর্জিমাফিক করত সবকিছু। তাইতো কুমিকে কাঁধে চাপিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতে কোনো সমস্যা হয়নি। নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই বাবা-মা’র প্রস্তাবে না করে দিতে গলা কাঁপেনি ওর।
বাবা-মা’কে ঘৃণা করে না হিরাই। সরাইটার প্রতিও তার কোনো রাগ নেই। কিন্তু সে বরাবরই স্বাধীনচেতা। আঠারো বছর বয়সে সে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, তখন কুমির বয়স বারো। স্বাভাবিকভাবেই বড় মেয়ের এরকম হঠকারী সিদ্ধান্তে প্রচণ্ড কষ্ট পায় মিশিকো আর ইয়াসুও। পরবর্তীতে সেই কষ্টই রূপ নেয় ক্রোধে। কুমির জন্যও কঠিন ছিল সময়টা।
তবে সে বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে আজ হোক বা কাল, সেন্দাই থেকে চলে যাবে হিরাই। সেজন্যেই খুব বেশি কাঁদেনি। হিরাইয়ের রেখে যাওয়া চিঠিটা পড়ে বিড়বিড় করে কেবল বলে, “স্বার্থপর।”
.
ট্রে’তে করে সাদা কাপ আর রুপালি কেতলিটা নিয়ে ফিরে এসেছে কায়ু। চেহারায় আগের সেই নিস্পৃহতা।
“নিয়মগুলো জানা আছে?”
“হ্যাঁ, জানি…”
কুমি মারা গেছে। অতীতে ফিরে যতই চেষ্টা করুক না কেন হিরাই, সত্যটা বদলাবে না। তা সত্ত্বেও বোনকে শেষবারের মতো দেখতে পাবে সে, হোক সেটা অল্প সময়ের জন্য। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য তৈরি ও।
তবে হিরাই মানসিকভাবে প্রস্তুত জেনেও থামলো না কাযু।
“একটা বিষয়, যারা সাধারণত সদ্য মৃত ঘনিষ্ঠ কারো সাথে দেখা করতে যায়, তাদের ক্ষেত্রে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করাটা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সময় অল্প, এটা জেনেও বিদায় জানাতে সমস্যা হয় তাদের। তাই আমি চাই এটা আপনার সাথে থাক,” বলে দশ মিটার লম্বা একটা কাঠির মতো জিনিস হিরাইয়ের কাপে ডুবিয়ে দিলো কায়ু।
“এটা কী?”
“কফির তাপমাত্রা কমে গেলে অ্যালার্ম বেজে উঠবে এটায়। তখন-”
“বুঝেছি।”
‘কফি পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই ফিরতে হবে’—এই কথাটা দ্বারা ঠিক বোঝা যায় না যে সময় আসলে কতটুকু। হিরাই একটু চিন্তিত বিষয়টা নিয়ে। কফির ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার বিষয়টা আপেক্ষিক। ওর কাছে যা একদম ঠান্ডা, তা হয়তো অনেকের কাছে কুসুম গরম। তাহলে এই সমস্যার সমাধান কী? আবারো এমনটাও হতে পারে যে ও হয়তো ভাবছে কফি গরমই আছে, কিন্তু ততক্ষণে সময় পেরিয়ে গেছে। সেই ক্ষেত্রে বর্তমানে ফিরবে কী করে? এই অ্যালার্মটা সেই চিন্তা থেকে মুক্তি দিলো ওকে। মন প্রশান্ত হলো কিছুটা।
কুমির কাছে কেবল ক্ষমা চাইতে চায় ও। এত কষ্ট করে মেয়েটা টোকিওতে আসতো প্রতিবার, আর হিরাই কি না বিরক্ত হতো বিষয়টায়। তবে এটা ছাড়াও আরো একটা কারণ আছে।
হিরাই বাড়ি ছেড়ে চলে আসলে স্বাভাবিকভাবেই কুমির ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে ওদের বাবা-মা। বড় হয়ে তাকাকুরা’র দায়িত্ব নিতে হবে, এই ভাবনাটা চাপিয়ে দেওয়া হয় বেচারির মাথায়। বাবা-মা’র বাধ্য মেয়ে হওয়াতে হিরাইয়ের মতো তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব হয়নি কুমির পক্ষে।
কিন্তু জীবন নিয়ে তার যে ভিন্ন কোনো স্বপ্ন ছিল না, এই নিশ্চয়তা কে দিবে?
আর যদি স্বপ্ন থেকেও থাকে, হিরাইয়ের স্বার্থপরের মতোন বাসা থেকে চলে যাওয়ায় সেই স্বপ্নটা চুরমার হয়ে যায় নিমেষে। খুব সম্ভবত এই কারণেই এত ঘনঘন ওকে ফিরিয়ে নিতে টোকিও আসতো সে। যাতে নিজের স্বপ্নটার পেছনে ছুটতে পারে।
হিরাইয়ের স্বাধীন জীবনযাপনের মূল্য যদি কুমির স্বপ্নের বিসর্জন হয়ে থাকে, তাহলে অনুতপ্ত বোধ করার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। আর সেই অনুতাপ চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে তাকে।
এটাই ক্ষমা প্রার্থনা করার মূল কারণ। বর্তমানের কিছু বদলাতে না পারলেও অন্তত, ‘স্বার্থপরের মতো আচরণ করার জন্য আপুকে মাফ করে দাও’—এটুকু বলতেই পারে হিরাই।
কাযুর চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়চিত্তে একবার মাথা নাড়লো ও।
কফির কাপটা হিরাইয়ের সামনে নামিয়ে রাখলো কায়ু। ডান হাত দিয়ে ট্রে থেকে রুপালি কেতলিটা উঠিয়ে নিলো। এই আচারটা কখনোই বদলাবার নয়, সিটে যে-ই বসুক না কেন। কায়ুর অভিব্যক্তিও সবসময় একই রকম।
“শুধু মনে রাখবেন…” একবার থেমে বললো সে। “ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই কফিটুকু শেষ করতে হবে।
কেতলির সরু মুখ থেকে নিঃশব্দে নেমে এলো উষ্ণ কফির ধারা। কাপটা ধীরে ধীরে ভরে উঠতে দেখছে হিরাই। তার আর তর সইছে না। যত দ্রুত সম্ভব বোনের সাথে দেখা করতে চায় সে। মাফ চাইতে চায়। কিন্তু কাপটা পূর্ণ হওয়া মাত্র ঠান্ডা হতে শুরু করবে ভেতরের তরলটুকু। সময় খুব অল্প।
এখন ধোঁয়া উঠছে কফি ভর্তি কাপটা থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঝিমুনি ভাব জেঁকে বসলো হিরাইয়ের চিত্তে। ধোঁয়ার সাথে একীভূত হয়ে গেল পুরো শরীর। মনে হচ্ছে যেন দুলছে চারপাশের সবকিছু। অভিজ্ঞতাটা প্রথমবারের জন্য হলেও কোনো প্রকার ভয় পাচ্ছে না হিরাই। মনের অস্থিরতা একপাশে সরিয়ে রেখে চোখ বুজলো সে।
.
এই ক্যাফেতে সাত বছর আগে প্রথম আসে ও। তখন সবে তেইশ পেরিয়ে চব্বিশে পড়েছে বয়স। তিন মাস ধরে নিজের ইজাকায়া খুলেছে। এক অলস রবিবারে আশপাশে হেঁটে বেড়ানোর সময় হঠাৎই ক্যাফেটা আবিষ্কার করে। ভেতরে সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা বাদে আর কোনো কাস্টমার ছিল না। বছরের সেই সময়টায় সাধারণত গলায় স্কার্ফ জড়ানো শুরু করে সবাই। কিন্তু মহিলার পরনে খাটো হাতার ফিনফিনে কাপড়ের একটা ড্রেস। বোধহয় তার গরম একটু বেশিই লাগে, এই কথা ভাবতে ভাবতে কাউন্টারের সামনে গিয়ে বসে হিরাই।
আশপাশে চোখ বুলিয়েও ক্যাফের কোনো স্টাফকে চোখে পড়ে না। ভেতরে ঢোকার সময় বেলে শব্দ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসেনি কেউ। ওর মনে হয় যে ক্যাফেটা কাস্টমারদের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন। তবে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না ভাবনাটা। সত্যি বলতে এরকম নিরিবিলি জায়গাই ওর পছন্দ, যেখানে নিভৃতে সময় কাটানো যায়। অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় হিরাই। হয়তো বেলের শব্দ শুনতে পায়নি ক্যাফের কর্মীদের কেউ। এরকমটা প্রায়ই হয় কি না, সেই প্রশ্নটা খোঁচাতে শুরু করে ওকে। তাছাড়া সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলা একবারও মুখ তুলে তাকায়নি ওর দিকে; এক মনে উপন্যাস পড়ে চলেছে। হিরাইয়ের একবার মনে হয় সে বুঝি ভুল করে এমন একটা ক্যাফেতে ঢুকে পড়েছে যেটা বন্ধ হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। পাঁচ মিনিট পর আবারো বেজে ওঠে প্রবেশপথের সামনে লাগানো বেলটা। বিশ সেকেন্ড পর যে মেয়েটা পা রাখে ক্যাফেতে, তার চেহারা দেখে মনে হয় জুনিয়র হাইস্কুলের ছাত্রী। হিরাইকে কাউন্টারের সামনে বসে থাকতে দেখেও অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হয় না মেয়েটার। একবার কেবল মাথা নেড়ে ‘স্বাগতম’ বলে চলে যায় পেছনের রুমে। এই বিষয়টা আরো কৌতূহলী করে তোলে হিরাইকে। সচরাচর আধুনিক কোনো ক্যাফেতে গেলে ওয়েটার বা অন্যান্য স্টাফেরা হুজুর হুজুর করা শুরু করে দেয়, যেটা একদমই অপছন্দ ওর। সেদিক থেকে এই ছোট্ট ক্যাফেটা আসলেও অন্যরকম। একটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ও।
কিছুক্ষণ পর পেছনের রুম থেকে বেরিয়ে আসে নীল কার্ডিগান আর সাদা রঙের লম্বা স্কার্ট পরিহিতা এক মহিলা। কার্ডিগানের উপরে লাল রঙের একটা অ্যাপ্রন চাপিয়েছে সে। উজ্জ্বল চোখ দু’টোই প্রথমে চোখে পড়বে সবার।
মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে জানিয়েছে যে বাইরে একজন কাস্টমার অপেক্ষা করছে। কিন্তু তার আচরণে তাড়াহুড়ার কোনো ছাপ নেই। একটা গ্লাসে পানি ঢেলে হিরাইয়ের সামনে রাখে সে। “স্বাগতম,”–হেসে একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে। যে কাস্টমারেরা ক্যাফের কর্মীদের কাছ থেকে তোয়াজ পেয়ে অভ্যস্ত, তারা হয়তো আশা করবে বসিয়ে রাখার জন্য তাদের সরি বলা হবে। কিন্তু হিরাই তাদের দলে নয়। তাছাড়া মহিলার উষ্ণ হাসিটা যে কারো মন জয় করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এর আগে কখনো এমন কোনো নারীর সাথে পরিচয় হয়নি হিরাইয়ের যে কি না নিজের মর্জিমাফিক সবকিছু করতে অভ্যস্ত। কাউন্টারের পেছনের মহিলাকে নিমেষে পছন্দ হয়ে যায় ওর।
তখন থেকেই হিরাই ফানিকুলি ফানিকুলার নিত্যদিনের কাস্টমার। সেই বছরের শেষ দিকে ও জানতে পারে যে ক্যাফেটা আগ্রহী কাস্টমারদের অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা সবসময় খাটো হাতার জামা পরে কেন, এই প্রশ্নটা সবসময়ই খোঁচাত ওকে। একদিন কেইকে জিজ্ঞেস করায় সে সবকিছু খুলে বলে। ভদ্রমহিলা যে সিটটায় বসে সবসময়, সেটার সাহায্যে পাড়ি জমানো যায় অতীতে। এই কথাটা যে কারো কাছেই অবিশ্বাস্য লাগাটাই স্বাভাবিক। হিরাইয়েরও লেগেছিল, কিন্তু সেই সাথে ও এটাও জানতো যে কেই অনর্থক মিথ্যে বলার মানুষ নয়। তাই ব্যাপারটা নিয়ে তখনকার মতো না ঘাঁটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী ছয় মাসে অবশ্য ক্যাফের কিংবদন্তিটা ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরজুড়ে। জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায় একই সাথে।
এতদিন ধরে বিষয়টা জানলেও কখনো অতীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি হিরাইয়ের। আসলে জীবনে কোনো কিছু নিয়ে আক্ষেপ কাজ করে না ওর। তাছাড়া, অতীতে ফিরে যদি কিছু বদলানোই না যায়, তাহলে গিয়ে লাভ কী? এমনটাই মনে হয়ে এসেছে সবসময়।
কিন্তু কুমির দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে সবকিছু।
.
ধোঁয়ার মধ্যে পাক খেতে থাকা অবস্থাতেই হিরাই খেয়াল করলো যে কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। গলার স্বরটা তার পরিচিত। চমকে উঠে চোখ খুলে দেখে কেই দাঁড়িয়ে আছে পাশে। মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে যে ওকে এই সিটে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে সে। ফুসাগি বসে আছে তার পছন্দের টেবিলটায়। মনে মনে এই দৃশ্যটার কথাই ভাবছিল হিরাই। সফল হয়েছে ও, ফিরে এসেছে সেই দিনটায়।
হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠলো ওর। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি চাপ দিয়ে ধরে আছে হৃদয়টা। শান্ত হতে হবে ওকে। কুমির সামনে একদমই কান্নাকাটি করা চলবে না। বুকে হাত রেখে লম্বা শ্বাস নিলো কয়েকবার।
“হ্যালো…” কিছুক্ষণ পর কেইয়ের উদ্দেশ্যে বললো।
পরিচিত কাউকে সিটটায় হঠাৎ উদয় হতে দেখে অবাক হয়ে গেছে কেই। একই সাথে বিস্ময় আর কৌতূহল খেলা করছে তার চোখে। এর আগে হয়তো চেনা কাউকে এই সিটে দেখেনি সে।
“তুমি…ভবিষ্যৎ থেকে এসেছো?”
“হ্যাঁ।”
“আসলেই? কেন!”
অতীতের কেই জানে না যে সেদিন কী ঘটবে। তাই নিরীহ মনেই প্রশ্নটা করেছে।
“ওরকম কিছু না। আমার বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি,” মিথ্যে বলার অবস্থানে নেই ও। হাতে ধরা চিঠিটা শক্ত করে চেপে ধরলো।
“তোমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বারবার আসে যে?”
“হ্যাঁ।”“
“বাহ! এতদিন তো দেখা করতে চাইতে না তুমি!”
“কিন্তু আজকে করবো!”
হিরাই চেষ্টা করলো যতটা সম্ভব উৎফুল্ল কণ্ঠে কথাটা বলতে। হাসতেও চেয়েছিল, কিন্তু হাসি আসছে না ভেতর থেকে। কোন দিকে তাকিয়ে কথা বলবে সেটাও বুঝতে পারছে না। একবার যদি কেই ভালো করে দেখে ওকে, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে যে কোনো একটা ঘাপলা আছে।
“কিছু হয়েছে হিরাই?” ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো কেই। হিরাইয়ের মনে হলো ধরা পড়ে গেছে ও। মুখই খুলতে পারলো না লম্বা একটা সময়। এরপর কোনমতে বললো, “না-না, কিছু হয়নি।”
পানি সবসময় উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানে প্রবাহিত হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ঠিক তেমনি, যখন আমরা ঘনিষ্ঠ কারো সান্নিধ্যে থাকি, তার কাছে সহজে মিথ্যে বলে পার পাওয়া যায় না। সত্যটা অনেক সময় আপনা থেকেই ঠোঁটের আগায় এসে যায়। কষ্টের কোনো সংবাদ লুকোনো তো আরো কঠিন। অপরিচিত মানুষদের সামনে তাও নিজেকে সামলানো যায়, কিন্তু পরিচিত মানুষদের সাথে বুকের হাহাকারটুকু ভাগাভাগি করে নিতে ইচ্ছা করে। কেই আর হিরাইয়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা গত সাত বছরে অনেকটুকুই বেড়েছে। অনেকটাই বোনের মতোন তারা।
কেই যদি এখন মমতামাখা কণ্ঠে কিছু একটা বলে হিরাইয়ের উদ্দেশ্যে, তাহলে নিজেকে সামলানো আর সম্ভব হবে না তার পক্ষে। চোখে উদ্বেগ নিয়ে ওর দিকে এখন তাকিয়ে আছে ক্যাফে মালিকের স্ত্রী। হিরাই অবশ্য মাথা নিচু করে রেখেছে ইচ্ছা করেই। তবুও কেইয়ের দৃষ্টিটা অনুভব করতে পারছে।
হিরাইয়ের সাথে ভালোমতো কথা বলার জন্য আরেকটু সামনে এগিয়ে এলো কেই। কিছু একটা আঁচ করেছে নিশ্চয়ই।
.
ঠিক সেই সময় বেজে উঠলো বেলটা।
“স্বাগতম,” কাউন্টারের সামনে থমকে গিয়ে বললো কেই।
হিরাই ভালো করেই জানে কে এসেছে। কুমি। মাঝখানের দেওয়ালঘড়িটা অনুযায়ী বিকেল তিনটে বাজছে এখন। হিরাই জানে যে দেওয়ালে ঝোলানো তিনটা ঘড়ির মধ্যে এই একটাই ঠিকঠাক সময় দেয়। তিন দিন আগে ঠিক এই সময়টাতেই ক্যাফেতে পা রেখেছিল কুমি।
সেদিন কাউন্টারের পেছনে তড়িঘড়ি করে লুকোতে বাধ্য হয় হিরাই। ক্যাফেটায় একটাই মাত্র প্রবেশপথ। তাই লুকিয়ে অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা সম্ভব ছিল না। সাধারণত দুপুরের খাবারের সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে প্রতিদিন ক্যাফেতে আসে হিরাই। কফির অর্ডার দিয়ে কেইয়ের সাথে গল্প করে কিছুক্ষণ, এরপর কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়। সেদিন বারটা একটু তাড়াতাড়ি খুলতে চেয়েছিল ও। তাই কফি শেষ করেই উঠে দাঁড়ায়। তখন মাঝের ঘড়িটা সময় দেখাচ্ছিল বিকেল তিনটা, মনে আছে ওর। বার খোলার জন্য সময়টা একটু তাড়াতাড়িই হয়ে যায়, কিন্তু বাড়তি সময়টায় নতুন কোনো স্ন্যাকস বানাবে ভেবেছিল। বের হয়ে যাওয়ার জন্য দরজায় হাত রাখা মাত্র ওপাশ থেকে কুমির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
কারো সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছিল ওর বোন। সময় নষ্ট না করে দ্রুত আবারো ক্যাফের ভেতরে ফিরে এসে কাউন্টারের পেছনে লুকিয়ে পড়ে হিরাই। ক্ল্যাং-ডং, বেলটার শব্দ কানে আসে তখনই। চকিতে একবার পেছনে তাকিয়ে কুমির ছায়া দেখতে পায়।
এভাবেই তিন দিন আগে বোনের কাছ থেকে পালিয়েছিল সে।
এখন হিরাই কুমির অপেক্ষায় সেই বিশেষ সিটটায় বসে আছে। কুমির পরনে সেদিন কী ছিল, সেটা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না ও। গত দেড় বছরে ভালো করে মেয়েটার চেহারাও দেখেনি। এখন পরিতাপে দগ্ধ হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। বোনের সাথে সাক্ষাৎ এড়ানোর জন্য যা যা করেছে, সেগুলো মনে পড়াতে নিজেকে ধিক্কার দিলো হিরাই।
কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো প্রকার কান্নাকাটি করা চলবে না। ছোট বোনের সামনে কখনো কাঁদেনি ও। তাই এখন যদি কাঁদে, কুমি বুঝতে পারবে যে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। নানা রকম প্রশ্ন করবে তখন। সেই অবস্থায় হিরাই নিজেকে সামলাতে পারবে কি না জানে না। বর্তমানে কোনো প্রভাব পড়বে না জেনেও ‘আজ বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়বে’ বা ‘গাড়িতে যেতে হবে না, ট্রেনে যাও’-বলা যায়। কিন্তু তাতে ক্ষতি বই লাভ হবে না। দুর্ঘটনাটা যে করেই হোক, ঘটবেই। বরং কুমি ওকে পাগল ঠাউরাবে। সেটা কোনভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। এই মুহূর্তে বোনকে কোনো কারণে কষ্ট দিতে চায় না হিরাই। লম্বা শ্বাস টেনে নিজের আবেগগুলোর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করলো ও।
“আপু?”
কণ্ঠস্বরটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল হিরাইয়ে হৃৎস্পন্দন কুমি। কুমির গলার স্বর। আজকেই শেষবারের মতো শুনতে পাবে এই কণ্ঠটা। মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো হিরাই। “হ্যালো…” এক হাত নেড়ে হেসে বললো। চেহারায় কষ্টের ছাপটা ঢাকার চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব। বামহাতে এখনো শক্ত করে চিঠিটা ধরে রেখেছে। কুমি অবশ্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ছোটবোনের এরকম বিভ্রান্ত হবার হেতু ভালো করেই জানা আছে হিরাইয়ের। গত দেড় বছর ধরে যতবার সামনাসামনি দেখা হয়েছে ওদের, প্রতিবারই শীতল আচরণ করেছে ও। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে কথা শোনার আগ্রহ বা সময় কোনটাই নেই। কিন্তু আজকের বিষয়টা ভিন্ন। কুমির চোখে চোখ রেখে হাসিটা আরো চওড়া করার চেষ্টা করলো ও।
“সূর্য কোনো দিক দিয়ে উঠেছে আজকে?”
“মানে?”
“তুমি তো আমাকে দেখলেই খালি পালিয়ে যেতে চাও।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ!”
“সরি, কুমি,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে হিরাই।
সাবধানে সামনে এগোচ্ছে কুমি, যেন তাড়াহুড়ো করলেই হিরাইয়ের মন বদলে যাবে।
“আমি কী এখনই অর্ডার করতে পারি? একটা কফি, টোস্ট, কারি রাইস আর মিক্সড পারফে হলেই চলবে আপাতত,” কেইয়ের উদ্দেশ্যে বললো কুমি।
“খুব বেশি সময় লাগবে না। নিয়ে আসছি,” বলে রান্নাঘরে যাওয়ার আগে একবার হিরাইয়ের দিকে তাকালো কেই। ওকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে সে।
“আমি কী এখানে বসতে পারি?” একটা চেয়ার টেনে হিরাইকে জিজ্ঞেস করলো কুমি।
“অবশ্যই,” হেসে জবাব দিলো হিরাই।
হাসি ফুটলো কুমির মুখেও। দ্বিধা ঝেড়ে বসে পড়লো চেয়ারটায়।
বেশ কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বললো না। একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে তন্ময় দৃষ্টিতে। কুমির চেহারায় অবশ্য অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু হিরাই চোখ নামালো না। মিষ্টি মুখটা মন ভরে দেখে নিচ্ছে।
“আজকে আসলেও একটু অদ্ভুত আচরণ করছো তুমি,” অবশেষে বললো কুমি।
“কী রকম?”
“শেষ কবে আমরা এভাবে মুখোমুখি বসে ভালো মানুষের মতো কথা বলেছি?”
“বলিনি?”
“গতবার তো তোমার বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি কয়েক ঘণ্টা। এর আগেরবার আমাকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেলে। এর আগে…”
“খুব খারাপ করেছি, তাই না?” হিরাই নিজেও একমত বোনের সাথে।
ও জানে যে কুমি চাইলে এমন আরো হাজারটা উদাহরণ দিতে পারবে। এরকমটাও হয়েছে যে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে বাতি জ্বলছে, তবুও দরজা খোলেনি। আবার মাতালের অভিনয় করে জিজ্ঞেস করেছে “তুমি কে?” কুমির একটা চিঠিও পড়ে দেখেনি, ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে। বড় বোন নামের কলঙ্ক হিরাই।
“তুমি এমনই।”
“সরি কুমি। সরি,” বলে পরিস্থিতি হালকা করার জন্য একবার জিভ বের করে ভেংচি কাটলো হিরাই।
তবে কুমি মন্তব্য না করে থাকতে পারলো না। “তাহলে এখন বলো, কী হয়েছে?”
“কী হবে?”
“উফ! বলো তো! কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে?”
“তাই?”
“আপু!”
“আরে…কিছুই হয়নি,” স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো হিরাই।
কুমির চেহারায় অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে হিরাইয়ের মনে হলো যে ও-ই বুঝি জীবন সায়াহ্নে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে এখন। সিনেমা-নাটকে দেখা যায় এমনটা। ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসে চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছে ওর। বাধ্য হয়েই মাথা নামিয়ে নিলো।
“এই নাও…” কফি হাতে কেই একদম ঠিক সময়টাতেই এসেছে। আবারো মুখ তুললো হিরাই।
“ধন্যবাদ,” কেইয়ের উদ্দেশ্যে বললো কুমি।
“আপনাকেও ধন্যবাদ,” কফিটা টেবিলে নামিয়ে একবার বাউ করে বিদায় নিলো কেই
তার হঠাত আগমনে কথার তাল কেটে গেছে। বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না হিরাই। কুমি ক্যাফেতে প্রবেশ করার পর থেকেই ওর ইচ্ছা করছে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে। “মরবে না খবরদার!”-এমনটা যদি বলতে পারতো! নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে।
নীরবতা দীর্ঘায়িত হওয়ায় আবারো উসখুস করতে শুরু করেছে কুমি। অস্থিত ভঙ্গিতে এটাসেটা নাড়াচাড়া করছে। খানিকক্ষণ পর কোলের উপরে রাখা চিঠির প্যাডটা চেপে ধরে ঘড়ির দিকে তাকালো সে।
হিরাই পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে বোনের মাথায় কী চলছে। ‘বাড়ি ফিরে চলে’—এই কথাটাই বলতে চায় সে। কিন্তু পেটের কথাটা মুখে আনতে পারছে না।
অবশ্য এর পেছনে কারণও আছে। গত দুই বছরে যতবার কথাটা তুলেছে সে, প্রতিবারই মুখের উপরে না করে দিয়েছে হিরাই। খুব ভদ্রভাবে যে মানা করেছে, এমনটাও নয়। কুমি অবশ্য হাল ছাড়েনি, আবার না শুনতে অভ্যস্তও হতে পারেনি। প্রতিবার হিরাই না বললেই চেহারায় আঁধার ঘনায় তার, কষ্ট পায়।
হিরাই এখন বুঝতে পারছে যে প্রতিবার নেতিবাচক জবাব শুনে কতটা খারাপ লেগেছে কুমির। নিজেকে সামলানো এখন আসলেও কষ্টকর হয়ে উঠছে ওর জন্য। লম্বা একটা সময় বুকের ভেতরে এই অনুভূতিগুলো লালন করেই বাঁচতে হয়েছে কুমিকে। এখন নিশ্চয়ই সে ভাবছে যে আবারো মুখের উপরে মানা করে দিবে হিরাই। প্রতিবার প্রশ্নটা করার জন্য নিজেকে সাহস জোগাতে হয় কুমির। তাই বলে দমে যায়নি কখনো। মুখ তুলে সরাসরি বড় বোনের চোখে চোখ রাখলো সে। হিরাইও চোখ নামালো না।
“আচ্ছা, বাড়ি ফিরবো আমি,” কুমি মুখ খোলার আগেই বললো ও। ভালো করেই জানে যে কী বলতে চাইছে ছোট বোন।
বিভ্রান্তি গাঢ় হলো কুমির চেহারায়। যেন হিরাইয়ের এই মাত্র বলা কথাটা বুঝতে পারছে না সে। “কী?”
“বললাম…তাকাকুরায় ফিরে যেতে কোনো আপত্তি নেই আমার,” শান্ত কণ্ঠে বললো হিরাই।
কুমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। “আসলেই?”
“আমি যে কাজে খুব বেশি সাহায্য করতে পারবো না এটা তো জানোই,” হিরাইয়ের কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনার সুর
“আরে! এটা কোনো সমস্যাই না। দেখে দেখে শিখে ফেলবে। মা- বাবাও অনেক খুশি হবে!”
“তাই?”
“অবশ্যই!” জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো কুমি। চেহারা লাল হয়ে উঠেছে মেয়েটার। দুই চোখে চিকচিক করছে পানি।
“কী হলো?”
বোনের এরকম প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা অবাকই হয়েছে হিরাই। তাকাকুরাতে ফিরে গেলে কুমি স্বাধীনভাবে নিজের স্বপ্নের পিছে ছুটতে পারবে, এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে এভাবে কান্নাকাটি শুরু করে দিবে, তা বুঝতে পারেনি। হয়তো এত বছরের নিরন্তর চেষ্টা সফলতার মুখ দেখায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
“ছোট থেকেই এটা আমার স্বপ্ন,” মুখ নিচু করে বিড়বিড় করে বলে কুমি। টেবিলে টপটপ করে পড়ছে অশ্রুর ফোঁটা।
হিরাইয়ের হৃৎপিণ্ডটা বুকের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসার পাঁয়তারা করছে। আসলেও নিজের জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে কুমি। কিন্তু ও স্বার্থপরের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে আসায় সেই স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেছে এখন অবধি।
“কী স্বপ্ন?” কুমিকে জিজ্ঞেস করলো ও।
লাল চোখে ওর দিকে তাকালো কুমি। “দুই বোন মিলে একসাথে সরাইটা চালানো,” হেসে জবাব দিলো সে।
এর আগে কখনো কুমিকে এভাবে হাসতে দেখেনি হিরাই।
তিন দিন আগে কেইকে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল ওর।
“আমাকে ঘৃণা করে ও।”
‘সরাইয়ের দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে চায় না।”
“আমি ওকে অনেকবার বলেছি যে তাকাকুরায় ফিরতে চাই না। তবুও বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করে গোয়ারের মতোন।”
“চিঠিটা পড়ার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। ওখানে কী লেখা সেটা ভালো করেই জানি। আমি বাড়ি থেকে চলে আসায় সরাইয়ের সব দায়িত্ব এখন ওকে পালন করতে হবে, যেটা কুমি চায় না। তাই আমাকে ভজিয়ে বাড়ি ফেরাতে চাইছে, যাতে নিজে পালাতে পারে।
“আমাকে চাপ দিচ্ছে ও।”
ফেলে দাও চিঠিটা!”
“নিশ্চয়ই লিখেছে-একা একা সরাই চালানো অনেক কষ্ট। তুমি ফিরে এসো। কাজ করতে করতে সব শিখে নিবে…”
কেইকে এই কথাগুলোই বলেছিল হিরাই। কিন্তু ওর ধারণা ভুল। কুমি মোটেও ওকে ঘৃণা করে না। সরাইয়ের দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক, এটাও ভ্রান্ত ধারণা। এতদিন হিরাইয়ের পেছন পেছন ঘুরেছে কারণ বড় বোনকে সাথে নিয়ে সরাই পরিচালনা করতে চায় সে। অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না এর পেছনে। বড় বোনকে গোটা শহরময় তাড়া করার মাধ্যমে নিজের স্বপ্নটাকেই তাড়া করেছে সে। এখন উলটোদিকের চেয়ারে বসে অঝোরে কাঁদছে মেয়েটা। এগুলো আনন্দ অশ্রু। বড় বোনকে মন থেকে ভীষণ ভালোবাসে সে। বাবা-মা ত্যাজ্য করলেও কুমি মনের মধ্যে এই বিশ্বাস পুষে রেখেছে যে হিরাই একসময় বাড়ি ফিরবে। এতটাই সহজ সরল মেয়েটা। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল ওর, যখন ‘আপু! আপু!’ বলে পুরো বাসা মাথায় তুলতো কুমি। আদরের ছোট বোনটার জন্য এরকম টান আগে কখনো অনুভব করেনি হিরাই।
কিন্তু কুমি বেঁচে নেই।
বুকের ওপর চেপে বসা অনুশোচনা নামের পাথরটা আরো ভারী মনে হচ্ছে এখন। ‘এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারো না তুমি!’
“কু-কুমি,” কোমল স্বরে ডাকলো হিরাই। জানে যে কোনো লাভ নেই, তবুও বোনের দুর্ঘটনাটা থামাতে চায় সে। কিন্তু কুমি ওর ডাকটা শুনতে পায়নি।
“একটু দাঁড়াও। ওয়াশরুম থেকে মেক-আপটা ঠিক করে আসি,” সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো কুমি।
“কুমি!” গলা চড়ালো হিরাই।
এভাবে ডাকায় ভয় পেয়ে গেল মেয়েটা। “কী হয়েছে?” জানতে চাইলো বিস্মিত কণ্ঠে।
“ইয়ে…কিছু না…সরি,” মিথ্যে বললো হিরাই।
যেও না প্লিজ! মারা যাবে তুমি! আমাকে ক্ষমা করে দাও! আমার সাথে দেখা করতে না আসলে দুর্ঘটনাটা হতো না!
এরকম অনেক কিছুই আছে বলার মতোন, ক্ষমা চাওয়ার মতোন। স্বার্থপরের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা, কুমির ছোট্ট কাঁধে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া, বাবা-মা’র খোঁজ না রাখা-এসবের জন্য এখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এখন। বেচারি সবকিছু কীভাবে সামলাবে সেটা নিয়ে কখনোই ভাবেনি। ভীষণ ব্যস্ততার মাঝেও সময় করে কেন টোকিও আসতো কুমি, সেটা কল্পনাতেও আসেনি হিরাইয়ের। আমাকে বড় বোন হিসেবে পেয়ে কত যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তোমাকে, সেটা বুঝতে পারছি এখন। সরি। কিন্তু এই কথাগুলো মুখে বলা সম্ভব না হিরাইয়ের পক্ষে। বুঝবে না কুমি। তাহলে ওর কী বলা উচিত?
অমায়িক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কুমি। অপেক্ষা করছে বড় আপুর মুখ থেকে কিছু শোনার। এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে যে কিছু একটা বলতে চায় হিরাই।
এত কিছুর পরেও এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো তুমি। তোমার সাথে ক্রমাগত খারাপ ব্যবহার করার পরেও? আমার প্রতি তোমার ভরসা উঠে যায়নি এখনো! দুই বোন মিলে সরাইয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেছো। আর আমি…
“ধন্যবাদ,” লম্বা একটা সময় চুপ থাকার পর কেবল এটুকুই বলতে পারলো হিরাই।
এই একটা মাত্র শব্দ ওর অনুভূতিগুলো ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারবে কি না সেটা জানে না। কিন্তু অন্তরের একদম অন্তঃস্থল থেকে কথাটা বলেছে।
বিভ্রান্তি ফুটলো কুমির মিষ্টি চেহারায়। এরপরেও একটা বড় হাসি উপহার দিলো সে। “হ্যাঁ, আসলেও একটু অদ্ভুত আচরণ করছো তুমি আজকে।”
“হতে পারে,” নিজের সবচেয়ে দরাজ হাসিটা বোনকে উপহার দেওয়ার চেষ্টা করলো হিরাই। কুমি যে ভীষণ খুশি এটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঘুরে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা দিলো সে।
তার গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো হিরাই। দুই চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রু। আর সামলানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবুও পলক ফেললো না। কুমি দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া মাত্র কাঁদতে শুরু করলো মাথা নিচু করে। কষ্টে দুমড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে পাগলের মতোন। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
কারণ এই ছোট্ট ক্যাফেটায় একটু জোরে কথা বললেই সবকিছু শোনা যায় ওয়াশরুম থেকে। মুখে হাত দিয়ে বোনের নাম ধরে ডাক দেওয়া থেকে নিজেকে থামালো হিরাই। কান্নার দমকে পুরো শরীর কাঁপছে এখন। ওর এই অবস্থা দেখে রান্নাঘর থেকে হাঁক ছাড়লো কেই।
“হিরাই, তুমি ঠিক আছো?”
বিপ বিপ বিপ বিপ বিপ বিপ বিপ বিপ বিপ বিপ …
কফির কাপটা থেকে শব্দ শুনতে পেল হিরাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই একদম ঠান্ডা হয়ে যাবে কফিটুকু।
“না!”
এক নিমেষে সব পরিষ্কার হয়ে গেল কেইয়ের কাছে। কাঠির মতো দেখতে এই অ্যালার্ম যন্ত্রটা কেবল তাদেরই দেওয়া হয়, যারা মৃত ব্যক্তিদের সাথে দেখা করতে আসে।
আহ-হা…এই লক্ষ্মী মেয়েটা…
“আমি যা ভাবছি…আসলেই কি…?” হিরাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিষণ্নচিত্তে বলে কেই।
কেইয়ের দিকে তাকিয়ে একবার মাত্র মাথা নেড়ে সায় জানালো হিরাই। আর লুকিয়ে লাভ নেই, কেই সত্যটা জেনে গেছে।
“হিরাই,” কেইয়ের ডাকের ভঙ্গিতে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট।
“জানি আমি,” হিরাই বললো কাপটা হাতে নিয়ে। “কফিটা শেষ করতে হবে তো আমাকে, নাকি?”
জবাবে কিছু বললো না কেই। আসলে বলতে পারলো না।
কাপটা হাতে নিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকলো হিরাই। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর অন্তর চিড়ে।
“আর একবার ওর মুখটা দেখতে চাই। কিন্তু সময় শেষ।’
কাঁপা কাঁপা হাতে কাপটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে এল হিরাই। কফিটা শেষ করতেই হবে। আবারো অঝোর ধারায় পানি ঝরছে দুই গাল বেয়ে। একসাথে অনেকগুলো চিন্তা আলোড়ন তুললো মনে আঙিনায়। কেন এমনটা হলো? ওকেই কেন মরতে হবে? আরো আগে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলোাম না কেন আমি?
কাপটা মুখের কাছে নিলেও চুমুক দিলো না ও। কিছুক্ষণ পর নামিয়ে রেখে বললো, “পারবো না আমি।” কেউ যেন বুঝি ওর শরীর থেকে সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে কুমি আর এই পৃথিবীতে নেই। আদরের বোনটাকে আর কক্ষনো ফিরে আসবে না।
আমি যদি কফিটা এখনই খেয়ে ফেলি, তাহলে ওর মুখটা আর কোনোদিন দেখতে পারবো না। কিন্তু হিরাই এটাও জানে যে কুমি একবার ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলে তার সামনে কফিটা খাওয়া সম্ভব হবে না ওর পক্ষে।
“হিরাই!”
“পারবো না আমি!”
কেই বুঝতে পারছি হিরাইয়ের যন্ত্রণা। ঠোঁট কামড়ে ধরে ওর দিকে তাকালো সে। “তুমি কিন্তু ওকে কথা দিয়েছো…” ধরা গলায় বললো। “সরাইয়ে ফিরে যাবে, এটাই বলেছো তো, নাকি?”
চোখ বন্ধ করলেই কুমির হাসিমুখটা ভেসে উঠছে হিরাইয়ের মনের পর্দায়।
“তুমি বলেছো দুই বোন মিলেমিশে সরাইটা চালাবে।”
দৃশ্যটা মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করলো হিরাই। দুই বোন হাসিমুখে তাকাকুরার সব কাজ সামলাচ্ছে।
কিন্তু সেদিনের সেই ফোনের শব্দটা বাস্তবতা মনে করিয়ে দিলো ওকে। “কুমি…”
এবারে কুমির নিথর দেহটা দেখতে পেল মানসচোখে। ওর বোন আর এই পৃথিবীর বাসিন্দা নয়।
বর্তমানে ফিরে কী করবে হিরাই? ফেরার ইচ্ছাই হারিয়ে গেছে একদম।
কেইও কাঁদছে। কিন্তু এরকম দৃঢ় কণ্ঠে তাকে কোনদিক কিছু বলতে শোনেনি ও। “অর্থাৎ, ফিরতেই হবে তোমাকে। অবশ্যই ফিরতে হবে।”
কিন্তু কেন?
“তোমার বোন যদি জানতে পারে কেবল আজকের দিনের জন্য তাকে কথা দিয়েছ তুমি, তখন কী খুশি হবে? তার মন ভেঙে যাবে না?”
হ্যাঁ! কেইয়ের কথায় যুক্তি আছে। কুমি আমাকে বলেছিল যে ওর স্বপ্ন আমার সাথে কাজ করা, আর আমি ওকে কথাও দেই। এর আগে কখনো ওকে কোনো কিছুতে এতটা খুশি হতে দেখিনি। এই হাসিটা উপেক্ষা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আবারো ওর মন ভাঙা সম্ভব নয়। বর্তমানে ফিরে তাকাকুরায় ফেরত যাবো। কুমি হয়তো মারা গেছে, কিন্তু ওকে দেওয়া কথাটার মর্যাদা রাখতেই হবে আমাকে।
কফির কাপটা আবারো হাতে নিলো হিরাই। কিন্তু…
ওর মুখটা আর একবার দেখতে চাই আমি।
কিন্তু এখন যদি ও কুমিকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে তাহলে বর্তমানে ফিরতে পারবে না। এটা হিরাই ভালো করেই জানে। তা সত্ত্বেও কাপটা মুখের কাছে আনতে পারছে না।
ক্ল্যাক।
টয়লেটের দরজা খোলার শব্দ কানে এলো এসময়। সাথে সাথে কফিটা ঢকঢক করে গিলে ফেললো হিরাই। এখন আর ইতস্তত করলে চলবে না।
কফিটুকু পেটে যাওয়ার সাথে সাথে সেই ঝিমুনি ভাবটা ফিরে এলো। পুরো শরীর আবারো ধোঁয়ার অংশ হয়ে যাচ্ছে। কুমিকে আর কোনদিন দেখতে পাবে না, এই সত্যটা অবশেষে মেনে নিলো হিরাই। কিন্তু ঠিক সেই সময় টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো সে।
ধোঁয়ার সাথে মিশে গেলেও হিরাইয়ের চেতনার একটা অংশ তখনও অতীতেই রয়ে গেছে।
“আপু?” কুমি অবশ্য দেখতে পাচ্ছে না ওকে। সিটটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, যেখানে কিছুক্ষণ আগেও বসে ছিল হিরাই।
কুমি!
হিরাইয়ের কণ্ঠস্বর ছোট বোনের কান অবধি পৌঁছুলো না।
কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো কেইয়ের দিকে তাকালো এবারে কুমি। “এক্সকিউজ মি, আপনি কী আমার বড় বোনকে দেখেছেন?” জিজ্ঞেস করলো।
মিষ্টি করে হাসলো কেই। “একটা জরুরি কাজে বেরিয়ে যেতে হয়েছে ওকে…”
কথাটা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল কুমির। নিশ্চয়ই হতাশ হয়েছে বেচারি। বাড়ি ফেরার ব্যাপারে হিরাই ওকে কথা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না সে। তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও একই দশা হতো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আগের চেয়ারটায় বসে পড়লো।
কেই মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছে সবকিছু। “চিন্তা করবেন না! আপনার বোন কথা রাখবে,” বললো সে।
কেই তোমার তুলনা হয় না! কথাটা শুনে কাঁদতে শুরু করলো ও। “আসলেই?” আবারো উঠে দাঁড়ালো কুমি। উজ্জ্বল একটা হাসিতে উদ্ভাসিত হলো মুখটা। “দারুণ! আমিও তাহলে বাড়ি ফিরি এখন!” একবার বাউ করে খুশিমনে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল সে।
“কুমি!”
ধোঁয়ার মধ্যে দিয়েই সবকিছু দেখলো হিরাই। ও কথা রাখবে শুনে হাসি ফুটেছিল কুমির মুখে।
হঠাৎই আশপাশের সবকিছু পাক খেতে শুরু করলো এসময়, যেন কেউ ফাস্ট ফরোয়ার্ড বাটনে চাপ দিয়েছে। কান্না থামায়নি হিরাই। কেঁদেই চলেছে একটানা।
.
টয়লেট থেকে ফিরে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা। কায়ু, নাগারে, কোহতাকে আর কেইও আছে তার পাশে। আবারো বর্তমানে ফিরে এসেছে হিরাই, যেখানে কুমির কোনো অস্তিত্ব নেই।
“সরুন!” হিরাইয়ের অশ্রুসিক্ত চেহারা কোনো প্রকার আমলেই নিলো না ভদ্রমহিলা।
“আচ্ছা,” বলে লাফিয়ে সিটটা ছেড়ে উঠে পড়লো হিরাই।
সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলা চেয়ারে বসে প্রথমেই ওর ব্যবহৃত কাপটা দূরে ঠেলে দিলো। এরপর উপন্যাসটা আবারো পড়তে শুরু করলো মনোযোগ দিয়ে, যেন কিছুই ঘটেনি।
হাত দিয়ে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করলো একবার হিরাই। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “আমি জানি না মা-বাবা এতদিন পরে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করবে। সরাইয়ের কাজ সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার।” বাম হাতে ধরে রাখা কুমির লেখা শেষ চিঠিটার দিকে তাকালো ও। “আমি যদি এভাবেই তাকাকুরায় ফিরে যাই, তাহলে তো কোনো সমস্যা হবে না, তাই না?”
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে সরাসরি সেন্দাইয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে হিরাই। বারটার কী হবে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। যারা ওকে চেনে, তারা অবশ্য জানে যে এরকম হুটহাট কাজ করেই অভ্যস্ত ও। চেহারাতে দ্বিধার ছিটেফোঁটাও নেই।
আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে একবার মাথা নাড়লো কেই। “কোন সমস্যা হবে না, আমি নিশ্চিত,” উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো সে। অতীতে কী ঘটেছে, সেই বিষয়ে হিরাইকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না সে। জিজ্ঞেস করার দরকারও নেই। কফির বিল মেটানোর জন্য পার্স থেকে ৩৮০ ইয়েন বের করলো হিরাই। নাগারের হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
.
কেইও হিরাইকে বিদায় জানানোর জন্য বাইরে বেরিয়েছে। “যাক, ভালোই হলো…” পেটে হাত রেখে বললো সে।
ক্যাশ রেজিস্টারে টাকাগুলো গুছিয়ে রাখার সময় বিমর্ষ দৃষ্টিতে স্ত্রী’র দিকে তাকালো নাগারে।
ও কী কাজটা করবেই শেষ পর্যন্ত?
আরো একবার বেলের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো ক্যাফের ভেতরে। কিন্তু কেইয়ের অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন এলো না।
ক্ল্যাং…ডং…