দুই বন্ধু
আমাদের তেতলার এই ফ্ল্যাটের ঝুলবারান্দায় দাঁড়ালে বাড়িটা দেখা যায়। হাড়গোড় বের করা খুব পুরোনো একটা বাড়ি। পলেস্তারা কবে খসে গেছে। দেয়ালের ফাটলে গজিয়ে উঠেছে অশ্বথের চারা আর উঁচু-উঁচু ঘাস। কেউ না বললেও বুঝতে পেরেছিলুম, ওটা একটা পোড়োবাড়ি।
পোড়োবাড়িতে ভূত থাকে, তা সবাই জানে। ওই দোতলা বাড়িটার চারদিকে বস্তি এলাকা। নিচু টালির ছাদওয়ালা অজস্র ঘর আর গরু মোষের খাটাল। একটা পুকুরও আছে। সবসময় লোকজন গিজগিজ করে। প্রায়ই মাইক বাজে। মাইকের চোটে আমাদের কান ঝালাপালা।
তাই ভাবতুম, পোড়োবাড়ির ভূতগুলো টিকে আছে কীভাবে? চারপাশে এত সব লোক, এত গরুমোষ, তার ওপর সারক্ষণ দিনরাত মাইক।
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের গদাধরবাবু একজন ভূতবিশারদ। ভূতপ্রেত সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান অর্জন করেছেন সারাজীবন। করবেন না কেন? ভদ্রলোক ছিলেন জাঁদরেল দারোগা। থাকতেন মফস্বলের থানায়। চোর-ডাকাত ধরতে গাঁয়ে-গাঁয়ে রাতবিরেতে ঘুরতে হয়েছে। তার ফলে অসংখ্যবার ভূতের পাল্লায় পড়েছেন। ভূতেরাও তার পাল্লায় পড়েছে। যেমন বাঘা তেঁতুল, তেমনি বুনো ওল। কত ভূতকে যে বেদম রামধোলাই দিয়েছেন, কহতব্য নয়। একবার চোর ভেবে গেরস্থবাড়িতে আনাচে কানাচে ঘুরঘুর করা এক ভূতকেই পাকড়াও করে ফেলেছিলেন। থানায় নিয়ে আসার পথে তার সে কী কান্না মাইরি স্যার, আঁমি চোর নই, ভূত! যা প্রমাণ চাইবেন, পেঁব। আমায় ছেড়ে দিন।
গদাই দারোগা বলে,–শেষ অবধি অনেক প্রমাণ আদায় করে তবে ব্যাটাকে ছেড়েছিলুম।
–কী প্রমাণ জ্যাঠামশাই?
–সে অনেক। পরে বলবখন। ওরা ইচ্ছেমতো চেহারা ধরতে পারে। চেনা কঠিন। কলকাতার শহরে এত সব লোকের মধ্যে কত ভূত যে বেড়াচ্ছে, খবর রাখ? আমি টের পাই। কারণ, কে ভূত কে মানুষ, তার প্রমাণ আমার জানা।
পরে আর কথাটা জিগ্যেস করা হয়নি। উনিও তোলেননি। তবে এটুকু বুঝে নিয়েছিলুম, দারোগা জীবনে উনি সত্যি বড় দাপটওয়ালা পুলিশ অফিসার ছিলেন।
হ্যাঁ, ওঁকে আমি জ্যাঠামশাই বলেই ডাকি। এখন বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি। প্রকাণ্ড মানুষ। চুল গোফ দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। অনেক রকম অসুখ-বিসুখে ভোগেন। সবচেয়ে কষ্টদায়ক বাঁ-হাঁটুর বাত। বাতটা বৃষ্টির সময় আর শীতকালে চাগিয়ে ওঠে। তখন লাঠি ধরে খুঁড়িয়ে হাঁটেন।
তো এই গদাই জ্যাঠা-ই বলেছিলেন–ওই দোতলা বাড়িটা দেখছ! ওটা একটা হানাবাড়ি। আজকাল পাড়াগাঁয়ে ভূতপ্রেতগুলোও খুব শহুরে হয়ে উঠেছে কিনা। বাড়ি খালি পেলে কথাই নেই। গতমাসে আমরা ফ্ল্যাটে তালা এঁটে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলুম। ফিরে গিয়ে টের পেলুম, একগাদা ভূত এসে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক হাঙ্গামা করে তাড়াতে হল।
শুনে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। যদি কখনও বাইরে কোথাও যেতে হয়, কিছুতেই ফ্ল্যাট খালি রেখে যাব না। কাউকে রেখে যাব। ভূত বিশারদ গদাই জ্যাঠা অভিজ্ঞ মানুষ। ওঁর পরামর্শ কি অবহেলা করা যায়?
যাইহোক, জীর্ণ ওই দোতলা পোড়োবাড়ির ভূতগুলো সম্পর্কে গদাই জ্যাঠা অনেক খবরাখবর দিয়েছিলেন। ও বাড়ির ওপরে-নিচে মোটমাট দশখানা ঘর আছে নাকি। দশখানা ঘরে কমপক্ষে দশ ডজন ভূত বাস করে। বুড়োবুড়ি থেকে শুরু করে কাচ্চাবাচ্চা পর্যন্ত সব বয়সের ভূতই নাকি আছে। গদাই জ্যাঠা একদিন আলাপ করতে গিয়ে ব্যাজার হয়ে ফিরে এসেছেন। দারোগা ছিলেন শুনেই ভীষণ ভয় পেয়ে ওরা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
আমি জিগ্যেস করেছিলুম,–আচ্ছা গদাই জ্যাঠা, আপনার কাছেই তো শুনেছি, ভূতেরা নিরিবিলি থাকতে ভালোবাসে। হই-হল্লা আলো এসব পছন্দ করে না। অথচ ওই বস্তি এলাকায় এত মাইকের চ্যাঁচিমেচি, হই-হল্লা, ভিড়-ভাড়াক্কা! তাহলে ওরা টিকে আছে কীভাবে?
গদাই জ্যাঠা ফিক করে হেসে বলেছিলেন, বুঝলে না? এরা যে একেলে ভূত। এদের স্বভাব একেবারে উল্টো। এরা হই-হল্লা জেল্লাই পছন্দ করে। বিশেষ করে একেলে ভূতেরা হিন্দি ফিল্মের বড় ভক্ত। কলকাতার এত সব সিনেমাঘরে হিন্দি ফিল্ম দেখে মৌজে যারা বসে থাকে, তাদের শতকরা কতজন মানুষ আর কতজন ভূত জান?
–তা তো জানিনে জ্যাঠামশায়!
–ফর্টি পারসেন্ট। শতকরা চল্লিশজন।
–ওরে বাবা বলেন কী?
–হ্যাঁ। তাহলে খুলেই বলি। কাকেও বলো না কিন্তু।বলে গদাধর ফিসফিস করে জানিয়েছিলেন–একদিন একটা সিনেমা হলে টিকিট কাউন্টারে বিরাট লাইন দেখে সন্দেহ হল। শুনলুম, আগের রাত থেকে পরদিন বিকেল অব্দি এই লাইন জমে আছে। একি মানুষের পক্ষে সম্ভব? তার ওপর স্বচক্ষে দেখলুম, লাইনের লোকগুলোর মধ্যে কিছু লোক দিব্যি শূন্যে উড়ে এর কাধ ওর মাথার ওপর দিয়ে সটান গিয়ে হাত বাড়াচ্ছে এবং টিকিট নিয়ে নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। বলল, সন্দেহ হয় কিনা?
–নিশ্চয় হয়। হওয়ারই কথা।
–হুঁ-হুঁ। আমি সেই গদাই দারোগা। ভূত-মানুষকে একঘাটে জল খাইয়ে ছেড়েছি। আমিও লাইন দিলুম।
–তারপর, তারপর?
–লাইন দিলুম শুক্রবার রাত বারোটায়। শনিবার রাত বারোটায় দেখি যেখানে ছিলুম, সেখানেই আছি। বলো, ব্যাপারটা ভৌতিক নয়?
–নিশ্চয় ভৌতিক।
–যাইহোক, আমিও তখন ভূতের কায়দা দেখালুম। ওদের ব্যাপার-স্যাপার সবই তো জানি।
–কী করলেন জ্যাঠামশাই? কী করলেন?
–ওদের মতো ডিগবাজি খেয়ে শুন্যে উড়লুম। তারপর এর কাঁধ ওর মাথার ওপর দিয়ে এগিয়ে টিকিটের ফোকরে হাত গলিয়ে দিলুম।
ব্যাপারটা ভাবতে হৃৎকম্প হচ্ছিল আমার। এই আড়াই কুইন্টাল শরীরের চাপে কতজনের কাঁধের হাড় আর মগজের ঘিলু চিড়িক করে দুভাগ হয়েছে কে জানে! নির্ঘাৎ পরে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হয়েছিল।
গদাধর বললেন, সিনেমা হলে ঢুকে আরও প্রমাণ পেলুম। ভেবে দেখ, আমার ডাইনে আর বাঁয়ে দুপাশে দুই ভূত আবিষ্কার করে তখন আমি অবাক। ওরা কী করছে। জান? খালি হি-হি করে হাসছে আর চেয়ারে মচমচিয়ে নাচছে। স্বভাব যাবে কোথায়? আর ঠিক সেই সময় আচম্বিতে লোডশেডিং।
গদাধর চুপ করলেন। দু-চোখে হাসির ঝিলিক দিচ্ছে।
বললুম, হল অন্ধকার হয়ে গেল তো?
–হ্যাঁ। তারপর যা হওয়ার তাই হল। এমন সুযোগ ভূতেরা ছাড়বে কেন? সে এক ধুন্ধুমার বেধে গেল। অন্ধকারে নানারকম ভৌতিক আওয়াজ হতে থাকল। বেচারা মানুষগুলোর প্রাণান্ত! তাদের কারা কাতুকুকু দিচ্ছে। কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। নাক কান খামচে দিচ্ছে। চ্যাঁচিমেচিতে লুলু কাণ্ড!
গদাধর মাঝে-মাঝে কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে যান। গুম হয়ে কী ভাবেন। তখন আর হাজারবার প্রশ্ন করেও জবাব পাইনে।
এই ঘটনা বলতে বলতে উনি তেমনি চুপচাপ তুষোমুখে পোড়োবাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। গতিক দেখে আমি কেটে পড়েছিলুম সেদিন।…
এবার শীতটা খুব জাঁকিয়ে এসেছিল। এইতে গদাই জ্যাঠার বাঁ-হাঁটুর বাতটা খুব বেড়ে গেছে। চলাফেরা প্রায় বন্ধ। চুপচাপ শুয়ে থাকেন আর খবরের কাগজ পড়েন। কাপের পর কাপ চা খান। মাঝে-মাঝে গিয়ে দেখে আসি। ওঁর চাকর ভোঁদা বাতের জায়গায় কবরেজী তেল মালিশ করে দেয়। জানালায় রোদ্দুর পড়ে দুপুরবেলা। জ্যাঠামশাই বাতকে রোদ্দুরের ছ্যাকায় শায়েস্তা করেন।
একদিন গেছি, বললেন–অমু, এসো, এসো। তোমার কথাই ভাবছিলুম।
–কেমন আছেন জ্যাঠামশাই?
–সে কথার জবাব না দিয়ে গদাধর জানালা দিয়ে পোডড়াবাড়িটার দিকে আঙুল তুলে বললেন-অমু, এক কাণ্ড হয়েছে।
–কী হয়েছে জ্যাঠামশাই?
–তুমি কি লক্ষ করোনি?
–না তো?
–কাল থেকে ওই হানাবাড়িতে একজন ভাড়াটে এসেছে।
–বলেন কী!
–হ্যাঁ। প্রথমে ভেবেছিলুম, ভূতটুতই হবে। কিন্তু পরে সন্দেহ হল–না, মানুষ। কারণ, রোদ্দুরে রেলিঙে কাপড়-চোপড় শুকোতে দেখলুম। ভূতেরাও কাপড় শুকোতে দেয়। তবে রোদ্দুরে নয় অন্ধকারে। আমরা যেমন শীত করলে রোদ্দুরে বসি, ওরা শীত করলে অন্ধকারে বসে থাকে। তো, যা বলছিলুম শোন! আমার তো এই অবস্থা। তুমি গিয়ে আলাপ করে এসো তো ভাড়াটে ভদ্রলোকের সঙ্গে। কে উনি, কেন এ বাড়ি ভাড়া নিলেন–সব তন্নতন্ন করে জেনে আসবে কিন্তু। তোমাকে গোয়েন্দার দায়িত্ব দিলুম।
শুনে খুশিও হলুম, আবার ভয়ও লাগল। ওই ভূতের বাড়ির ত্রিসীমানায় কখনও পা বাড়াইনি!
পরে আমার ঘরে থেকে জানালা দিয়ে ভালো করে দেখে নিলাম বাড়িটা। হ্যাঁ, সত্যি একজন ভাড়াটে এসেছেন বটে। ফাটল ধরা দেয়াল আর ছাদ! তার মধ্যে কী সাহসে ভদ্রলোক বসবাস করতে এলেন ভেবে অবাক লাগল!
ভদ্রলোকের বয়স দূর থেকে যতটা আঁচ করলুম, গদাধরের প্রায় কাছাকাছি মনে হল। তবে উনি বেজায় ঢ্যাঙা এবং রোগা। অবশ্য গোঁফ আছে গদাধরের মতোই। বাতও আছে কিনা কে জানে!
সারা দুপুর ভদ্রলোকের গতিবিধি লক্ষ করে ভয়ের কিছু দেখলুম না। তখন বিকেলে ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে গেলুম।
বাড়িতে ইলেকট্রিক লাইন নেই। নিশ্চয় ছিল এক সময়! এখন নেই। তাই দরজায় কড়া নাড়তে হল। অনেকক্ষণ জোরে কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল। ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে বললেন, কাকে চাই?
তবু একটু ভয়েভয়ে বললুম, আপনি নতুন এসেছেন পাড়ায়। তাই আলাপ করতে এলুম।
ভদ্রলোক খুব খুশি হয়ে বললেন,–আসুন-আসুন। এসে অব্দি বড্ড একা লাগছে মশাই! আমিও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করার জন্যে হাপিত্যেশ করছি।
সেকেলে বাড়ি। এক টুকরো উঠোন আছে। রাজ্যের আবর্জনা আর জঙ্গল গজিয়ে রয়েছে সেখানে। বারান্দা ঘুরে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে ভদ্রলোক বললেন, সবে এসেছি। এখনও সাফ করতে পারিনি কিছু। আশা করি, দু-একদিনের মধ্যে বাড়িটার ভোল বদলে ফেলব!
ওপরে একটা বড় ঘরে ঢুকলাম। এই ঘরের ভেতরটা কিন্তু অক্ষত আছে। ভদ্রলোক চমৎকার সাজিয়ে ফেলেছেন। সেকেলে আসবাবপত্র সাফ করেছেন! একটা গদিআঁটা চেয়ারে বসলুম। উনি একটা আরাম কেদারায় বসলেন। তারপর আলাপ পরিচয় শুরু হল।
জানলুম, ওঁর নাম শূলপাণি চক্রবর্তী। উনিও পুলিশের দারোগা ছিলেন এবং রিটায়ার করেছেন শুনে আমি জ্যাঠার কথা তুললুম।
অমনি উনি হা-হা করে হেসে বললেন,–আঁ! বলেন কী! গদা ওই বাড়িতে থাকে? সেই গদা?
আমি অবাক। আপনি চেনেন গদাইজ্যাঠাকে?
–আলবাত চিনি। খুব চিনি। আরে মশাই, পাশাপাশি দুই থানাতে ছিলুম শত বচ্ছর। তার ওপর ও ছেলেবেলাতেও বন্ধু ছিল। একসঙ্গে চাকরিতে ঢুকেছিলুম। প্রায় একসঙ্গে রিটায়ার করেছি। গদা বহরমপুরের ছেলে। আমিও। একেবারে পাশাপাশি বাড়ি ছিল। যাক গে, খুব খুশি হলুম। গদাকে গিয়ে বলবেন আমার কথা। কেমন আছে সে?
–হাঁটুতে বাত। খুব ভুগছেন।
আহা রে। বরাবর ওর ওই বাতের অসুখ। এদিকে আমার আবার অম্বলের ব্যামো?
–আপনাকেও জ্যাঠামশাই বলব কিন্তু।
–একশোবার বলবে বইকী বাবা। যতবার খুশি বলবে।
শূলপাণির সঙ্গে শিগগির আমার ভাব হয়ে গেল। কিন্তু অভদ্রতা হবে ভেবে এ বাড়ির দুর্নামের কথা তুলতে পারলুম না। একথা-সেকথার পর শূলপাণি হাঁক দিলেন,–খ্যাঁদা! ওরে খাদা! বাবাজীর জন্যে চা-ফা আন! ও খ্যাঁদা! শুনতে পাচ্ছিস নে হতভাগাঁ?
বলার সঙ্গে সঙ্গে দরজার কাছ থেকে নাকিস্বরে কে বলে উঠল,–যাঁই স্যাঁর!
তারপর যে মূর্তিটি ঢুকল, তাকে দেখে আমার বুক কেঁপে উঠল। কালো কুচকুচে এবং চামচিকের মতো চেহারা একটা লোক। মাথায় বুরুশের মতো চুল। বড়-বড় কান, পরনে ঢোলা হাফপেন্টুল। একটা ট্রে রেখে সে আমার দিকে জুলজুল চোখে তাকাতে-তাকাতে বেরিয়ে গেল। শূলপাণি একটু হেসে বললেন,-খাদা খুব কাজের লোক। নাও বাবাজী, সন্দেশ খাও।
সন্দেশ থেকে কেমন ভুরভুর মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। মুখে পুরতেই কিন্তু অবাক হলুম! সঙ্গে সঙ্গে যেন উবে গেল। একি আজগুবি সন্দেশ রে বাবা! দিল্লিকা লাড়ু একেই বলে না তো? চায়ের স্বাদটাও খাসা। কিন্তু গলার কাছে যেতে কী একটা ঘটে যাচ্ছে। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পাচ্ছি, বিলকুল উবে গেছে। স্রেফ গন্ধটুকুই সার।
ওদিকে শূলপাণি তার বন্ধু গদাধরের ছেলেবেলার কথা বলছেন। আমি আনমনা হয়ে আছি। ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। একটু পরেই শীতের বেলা ফুরিয়ে এল। আমি উঠি-উঠি করছি, শূলপাণি কিছুতেই ছাড়বেন না। রাতের খাওয়াটাও খেয়ে যেতে হবে। শুনে আরও অস্বস্তিতে পড়েছি।
ঘরের ভেতরটা আবছা হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। বললুম,–আলো জ্বালাবেন না জ্যাঠামশাই?
শূলপাণি বললেন,–দেখ বাবা অমু, আলো তো আমরা সব সময়ই পাচ্ছি। অন্ধকার কতটুকু পাই। বলবে, অন্ধকার প্রায় ঘন্টা বারো থাকে। কথাটা ভুল। প্রথম কথা–অন্ধকারকে আমরা আলো জ্বেলে নিকেশ করি। তার ওপর ওই ব্যাটা চাঁদ বড় ধড়িবাজ। আকাশে লণ্ঠন ঝুলিয়ে দিতে ওস্তাদ! তাছাড়া মহা বিচ্ছু ওই ফুটকি ফুটকি তারা। এদিকে জোনাকি হারামজাদাগুলোও কম যায় না। হায় রে! প্রাণভরে অন্ধকারের স্বাধ কতটুকুই বা পেলুম? তাই তো এমন বাড়িতে এসে জুটেছি।
এই সময় দরজার একপাশে এক ঘোমটা-ঢাকা স্ত্রীলোক ঠিক সেই খ্যাঁদার মতো নাকিস্বরে বলে উঠল,-ঘঁরে ঝঁড় দেঁব বাবুমশাই!
শূলপাণি বললেন,–হ্যাঁ, সাফ করে দাও খ্যাঁদার মা! বাবা অমু, একটুখানি ঠ্যাং তুলে বসো এবারে। পুরনো বাড়ি। তাই সবসময় চুনবালি খসে মেঝে নোংরা হয়ে থাকছে।
দুজনে ঠ্যাং তুলে বসে আছি। খাদার মা ঝাড়ু বুলোচ্ছ। আবছা অন্ধকারে তার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। খালি ভাবছি, ঝাড়ু দিয়ে ঘরদোর সাফ করার সময় কি সন্ধ্যেবেলা? সে তো সকালের কাজ। এ বাড়িতে যেন সন্ধ্যা হচ্ছে না, আসলে সকালই হচ্ছে। উঁহু ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না।
একটু পরে সে আমার চেয়ারের কাছে এসে ঝাড়ু বুলোতে-বুলোতে হঠাৎ ঘোমটার ফাঁকে মুখ তুলে কে জানে কেন, ফিক করে হাসল।
সঙ্গে-সঙ্গে আমার হৃৎপিণ্ডে খিল ধরে গেল, আতঙ্কে! ওরে বাবা। এ কী দেখছি। এ যে কংকালের মুখ। দাঁত বের করে আছে। দুটি চোখের গর্ত ছাড়া আর কিছু নেই। নাকের ডগাতেও একটা গর্ত। এত কাছে প্রায় নাকের ডগায় বলে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
আর বসে থাকতে পারলুম না।
এক লাফে চেয়ার থেকে নেমে দরজা গলিয়ে দৌড়লুম। সিঁড়িতে পা হড়কে গেল। গড়াতে-গড়াতে নীচের বারান্দায় পড়লুম। ওপর থেকে শূলপাণি চ্যাঁচিচ্ছেন– অমু! অমু! পালাচ্ছ কেন? কী হল কী হল অমু? রাতে যে খাওয়ার নেমন্তন্ন তোমার!
আর খাওয়ার নিকুচি করেছে। ততক্ষণে আমি উঠোন পেরিয়ে সদর দরজায়। তারপর সেখান থেকে বস্তির গলিতে ঢুকে পড়েছি। আমাকে এভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে দেখে খাঁটিয়ায় বসে থাকা কয়েকজন লোক চোর-চোর! পাকড়ো-পাকড়ো! বলে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল।
তাই শুনে এপাশ থেকে ওপাশ থেকে পিলপিল করে লোকেরা বেরুতে শুরু করছে। বেদম চ্যাঁচিচ্ছে। কিন্তু ভাগ্যিস, বস্তিটায় ইলেকট্রিক লাইন নেই এবং সন্ধেরাতেই ঘন কুয়াশা জমে উঠেছে। আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। অনেক কষ্টে আমাদের বাড়ির সামনে যখন পৌঁছেছি, তখন জ্যামাপ্যান্টে গোবর আর কাদা যথেচ্ছ মেখে গেছে। ছিঁড়ে ফর্দাফাইও হয়েছে। এক পাটি জুতো নেই পায়ে। কেটে-ছড়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সটান গিয়ে প্রথমে গদাইজ্যাঠার ফ্ল্যাটের বেলের সুইচ টিপলুম। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেলুম।…
জ্ঞান হলে দেখি, গদাইজ্যাঠার বিছানায় শুয়ে আছি। সব ফ্ল্যাটের লোক জড়ো হয়েছে ঘরে। সস্নেহে বললেন,–আর ভয়ের কিছু নেই! এবার সবাই আসুন।…
কিছুক্ষণ পর ওঁকে আগাগোড়া সব জানালুম। তখন গম্ভীর হয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন, আমারই বোকামি হয়েছিল। জানি, শূলোটা মহা পাজী! এক নম্বর ফড়বাজ! মরে গেলেও স্বভাব যাবে কোথায়?
হতভম্ব হয়ে বললুম,–মরে গেলেও মানে?
গদাধর বললেন, হ্যাঁ। বছর সাতেক আগে শূলো ডাকাত ধরতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারা পড়েছিল। বড় গোঁয়ার ছিল ও। তবে কি জানো, আমার ছেলেবেলার বন্ধু তো। সবসময় ওর কথা ভাবি। যাক গে, ভালোই হল। কাছাকাছি এসে জুটেছে যখন, গিয়ে আলাপ করে আসব।…
একথা শোনার পর থেকে আমি আর গদাইয়ের ছায়া মাড়াইনে।