দুই বন্ধু

দুই বন্ধু

তোকে আমি শো’রের বাচ্ছা বলেছি।

যাকে বলল, তার একটি নিশ্বাস পড়ল ফোঁস করে।

যে বলল, তার সামনের দাঁতগুলি নেই। গতকাল রাত্রের এক চিমটি তামাক পাতা ছিল তার নীচের মাড়িতে গোঁজা। সেটুকু চুষছে এখনও। লালা গড়াচ্ছে তার বাসি মাংসের মতো চোপসানো ফাটা ঠোঁটের কশ দিয়ে। ভোরের আলোয় কী যেন খুঁজছে মাটিতে হাতড়ে হাতড়ে।

আবার বলল, বুডঢা, তোকে আমি গীদধরের বাচ্ছা বলেছি।

বুডঢার আবার একটি নিশ্বাস পড়ল ফোঁস করে। কালো গলিত পাঁকের মতো থলথলে নীচের ঠোঁট তার ঝুলে পড়ল। দেখা গেল, বুডঢার দাঁত নেই একটিও থলথলে কালো মাড়িতে।

 যে বলল, সে যেন ডুব দিয়ে উঠেছে মানুষডোবা পাঁক থেকে। দলা দলা পাঁক গড়িয়ে, ঝুলে পড়ছে সর্বাঙ্গে। কিন্তু, ওগুলি পাঁক নয়, গায়ের মাংস আর চামড়া। লোল-শিথিল শরীর বুড়োর, মনে হচ্ছে ওইরকম। চোখ দুটি গলা গলা, একটু শাদাটে। নজর যে বিশেষ নেই, তা বোঝা যাচ্ছে। খানিকটা ন্যাকড়া আছে গোঁজা তার কোমরে। তাতে লজ্জা ঢাকেনি, বুড়ো যেন অচেতন শিশু হয়ে উঠেছে।

সামনে একটি হেলে-পড়া ভাঙা-বেড়া ঘর। মাথা নিচু করে, পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে বুডঢা। উপুড় হয়ে, হামা দিয়ে কী খুঁজছে বুড়ো। আবার বলল, তোকে আমি হারামি বলেছি, যা আমার দিল চেয়েছে। কখনও গোঁসা করে বলেছি, আবার সোহাগ করে বলেছি। এটা তামাম দুনিয়ার নিয়ম, একজনকে সে সবকিছু বলে। আমার বুড়িকে বলেছি, ব্যাটাকে বলেছি। কিন্তু ওরা যা, তা-ই থেকে গেছে। তুই যে ছেরুয়া, সেই ছেরুয়াই আছিস। তাই না?

ছেরুয়া বুডঢার পাহাড়ে-শরীর আকুঞ্চিত হল একবার। পিচুটি-গলা চোখ দুটি উদ্দীপ্ত হল। আরও। আর একটি নিশ্বাস পড়ল ফোঁস করে।

বুড়ো বলল, তবে। তুই আজ ফের তুক করেছিস। আমি লাঠি খুঁজে পাচ্ছি না। তুই যেদিন তুক করিস, সেইদিনই আমার লাঠি হারিয়ে যায়। হাঁ, তোকে আমি গালমন্দ করি। পেটাই ওই লাঠিটা দিয়ে। আমার বুড়িকে পিটিয়েছি, ব্যাটাদের পিটিয়েছি আর তোকে আজও পেটাই। কেন? না আমাকে একজন পেটায়। এটা দুনিয়ার নিয়ম। বুডঢা, তুই ভয় পাচ্ছিস মিছে। তোর তুক তুলে। নে, লাঠিটা আমাকে বার করে দে।

ছেরুয়া বুডঢার সারা শরীর আকুঞ্চিত হল আবার ঘন ঘন। দন্তহীন কালো মাড়ির পাশে, ফাটা কালো জিভ দিয়ে নাক চেটে নিল একবার।

বুড়ো তখন ঢুকেছে বুডঢার পায়ের তলায়। বলল, পেয়েছি। তোরই পায়ের তলায় রয়েছে।

বুডঢার পায়ের তলা থেকে বেরিয়ে এসে, লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াল বুড়ো। চোপসানো ঠোঁটের পাশ দিয়ে আবার গড়িয়ে পড়ল খানিকটা লালা। হাঁপ ধরে গেছে। সামলাতে হল খানিকক্ষণ সেই বাসি তামাকপাতাটুকু চুষে। যেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত, চুষছে সারা দেহটাই। বলল, বুডঢা, তোর তুক টেকে না। কেন না, তুই ছেরুয়া। আমি মানুষ।

বুডঢার গলনালী থেকে একটা চাপা শব্দ বেরুল, আঁ।

হাঁ। আর এই লাঠিটা আমার দরকার। তোকে আর আমাকে দুজনাকেই চালাবার জন্যে দরকার।

বুড়ো তাকাল সামনের দিকে। কেউ নেই। সবাই বেরিয়ে গেছে সেই ভোররাত্রে। মেয়ে-পুরুষ গাড়ি বলদ-ছেরুয়া, টিন বাঁকবুরুশ, সব চলে গেছে ধাওড়া থেকে। শুধু শুয়োর চরছে, বুড়ির বাচ্চারা ঘুরছে, বসে আছে।

বিষকাটারির ঝাড় আর ডোবা ছড়িয়ে আছে শুয়োরের জন্য। দূরের উঁচুনিচু টিলাগুলি পাহাড় নয়। কাগজকলের রাবিশ ফেলে ওইরকম হয়েছে। যেন সাদা পাথরের স্তূপ। তারপর একরাশ সবুজ লকলকিয়ে উঠেছে বাঁশঝাড় বেয়ে। আম জাম নারকেলের সারিতে। তার ওপারের আকাশে দেখা দিয়েছে একটু রক্তাভা।

বুড়ো বলল, সবাই চলে গেছে। আগে আমিও যেতাম বুডঢা, তুইও যেতিস। এখন দেরি হয়ে যায়। আমরা দুজনে বুড়ো হয়ে গেছি। এবার চল।

বুডঢা সামনের পা-টি তুলল একবার। বাড়াতে পারল না। আবার তুলল, পারল না।

বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই। এগুতে পারছে না। দুজনের কালো দন্তহীন মাড়ি বেরিয়ে পড়ল। বিলুলিত হল দুজনের শরীর।

এটা আমাদের মনের ভয়। আমরা দুজনেই ভয় পাচ্ছি। আমাদের বুকের মধ্যে বসে কারা। দাপাদাপি করছে, ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু আমরা বেঁচে আছি এখনও, রুটি বিচুলি খাই। তাই আমাদের যেতে হবে। কাজ করতে হবে। বুড়ো প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল ছেরুয়া বুডঢা!

সেই চিৎকার শুনে, বুডঢা দুপা এগিয়ে গেল। বুড়োও এগিয়ে এল!

দুজনেরই চোখ দুটি সমান গোল। একই রকম পিচুটি আকীর্ণ গলিত সিক্ত চোখ। চিৎকার করেছে বুড়োই। কিন্তু দুজনের মনে হল, যেন আর কেউ হাঁক দিয়েছে। দুজনেই এগিয়ে গেল ঘরের পিছন দিকে।

সেখানেই রয়েছে মিউনিসিপালিটির ভাগাড়ের পুরনো গাড়িটা। গাড়িটা ঝরঝরে হয়ে গেছে। ভেঙে, মরচে পড়ে হা হা করছে চারদিক। জোয়ালের কাঠ খেয়েছে পোকায়। চাকা দুটি টালমাটাল আছে এক রকম। তেল পড়ে না আর হুইলে, চলে কেঁদে ককিয়ে। এখন আর কোনও নম্বর বহন করে না গাড়িটা। ওটার আর কোনও অস্তিত্ব নেই মিউনিসিপালিটির খাতায়।

কারও নেই। বুড়োরও নেই।

একদিন ছিল। আমার নাম ছিল গাড়ি-টানাদের হাজিরা খাতার সকলের ওপরে। আমি ছিলাম সর্দার, নাম ছিল বটুয়া। তখন ছিলাম মানুষ। এখন বুড়ো। আমার নাম গেছে খারিজ হয়ে। কিন্তু এখনও আমি কাজ করি, তাই আমাকে খাবার জন্যে কয়েকটা টাকা দেয় মিউনিসিপালিটি থেকে। তাই নিয়ে আমাকে খাওয়ায় শেখো মরদের বউ।

গাড়িটাকে দেখলে মনে হয় না চলে! জোয়ালটার ভার বেশি নেই। কিন্তু বুড়োকে তুলতে হয় কাঁধ দিয়ে। তুলে ডাকে, বুডঢা আয়।

বুডঢা তাকাল উদ্দীপ্ত গলিত চোখে ছানি পড়েছে, বুড়োর মতোই কালো মণি দুটো ঘষা কাঁচের মতো সাদা দেখাচ্ছে! তার পাশে লাল জায়গাটুকুতে ভয় কাঁপছে থরথর করে। বিশাল কালো শরীরটা আর সম্মুখভেদী শিং দুটি যেন পাথর হয়ে গেছে। নড়ছে না, কান দুটি কাঁপছে শুধু। এখনই হড়হড় করে লালা ঝরছে নাক দিয়ে।

বুড়ো আবার চিৎকার করে উঠল, আয়।

বুডঢা দুবার চেষ্টা করল। সামনের পা দুটো যায় তো, পিছনের দুটো আসে না। তারপর পাছার ধাক্কায় যেন এগিয়ে দিল সামনেটা। ঢুকল জোয়ালে। বুড়ো বলল, হাঁ। তুই বুড়ো হয়েছিস, তবু ভয় পাস। এবার চল।

হাজিরা নেয় না আর বুড়োর। তবু বুড়ো হাজিরা দিয়ে যায় একবার মিউনিসিপালিটিতে।

চাকাতে টান পড়তেই কে যেন কেঁদে উঠল বুড়ো-গলায়, আঁ হো আঁউ…

বুড়ো বলল, হাঁ!

ওটা বুড়োর অভ্যাস। বুডঢার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে, চাকা দুটি এক পাক খায়, আর কঁকায় আঁ হো আউ…।

বুড়ো বলে, হাঁ।

অর্থাৎ ঠিক চলছে।

শব্দটা শোনা মাত্রই, আশেপাশে শুয়োরগুলি উঠল ফোঁস ফোঁস করে। একদল বাচ্চা উঠল ছড়া কেটে চেঁচিয়ে,

ছেরুয়া ছেরুয়া ছেরু–য়া
তোকে তেল মাখাব কেড়ু–য়া।

বুড়ো বলল, হাঁ, তেল মাখালে ছেরুয়া খুব তাগুদে হয়। তোকে আমি মাখাতে পারিনি। কেন , আমি নিজে কোনওদিন মাখতে পাইনি। তোর নাম ছিল আমার সঙ্গে, মিসিপালটির এক খাতায় বটুয়া সর্দার, এক গাড়ি, এক ছেরুয়া।

তুই ছিলি পাঁড়া, হতে পারতিস ভঁইসা। কিন্তু ভঁইসা গাড়ি টানে না, চাষ করে না, শুধু জন্ম দেয়, ঘোরে ইসীর পিছে পিছে। সামনে কোনও ভঁইসা এলে সে লড়ে। হয় মরে না হয় মারে। মানুষ তোর কাছ থেকে জন্ম দেওয়ার মরদপানাটা নিয়েছে ছিনিয়ে তাই তোকে বলে ছেরুয়া। তুই জানিস না, এই দুনিয়া কাজের জন্যে তোর কাছ থেকে কী ছিনিয়ে নিয়েছে। যে সময়ে নিয়েছে তখন তোর কিছু করার ছিল না। আমার নিলে, আমারও থাকত না।

দুধের দাঁত সবকটা পড়ার আগে তুই কাজে লেগেছিলি। এখন তোর জোয়ান বয়সের দাঁত নেই একটাও। আমার মতো বুডঢা। তখন ছিলি আমার বুকে বুকে, এখন কাঁধে কাঁধে। ঠিক বুড়ো যখন। ছিলি, তখন ছিলি হাড্ডিসার। এখন তুই বুড়ো নোস তারও বাইরে। এখন ফুলে হয়েছিস ঢোল, পাগুলো হয়েছে সরু কাঠি। তাই তোর নামটাও গেছে খারিজ হয়ে। এক আঁটি বিচুলি তোকে দেয় মিসিপালটি। কেন না, তুই কাজ করিস এখনও আমার সঙ্গে। এইটা নিয়ম।

ছেরুয়া, ছেরুয়া, ছেরু–য়া।

একটু একটু করে হারিয়ে গেল পিছনে বাচ্চাদের চিৎকার। সামনে রাস্তা। বৈশাখী সূর্য উঠে এসেছে খানিকটা। এর মধ্যেই ছড়াচ্ছে উত্তাপ।

বুড়ো চাকা গোঙাচ্ছে-আঁ হো আঁউ…

বুড়ো বলছে, হাঁ।…থামিসনে বুডঢা, চল। যেতে হবে বহুদূর। ঘুরতে হবে অনেক রাস্তা। ওই বুড়ো চাকা দুটো ডাকে, আমি ভাবি, তুই ডাকিস। বেলা যত বাড়ে, তত মনে হয়, ওটা আমারই গলা, আমিই ডাকি। আসলে ওটা আমাদের তিনজনের। তোর, আমার, গাড়িটার। তিন খারিজের বেঁচে থাকাটা ও জানান দিয়ে যায় সবাইকে।

বুড়ো সারা মুখ কাঁপিয়ে চুষছে তামাক পাতা। বাসি পাতার স্বাদ নেই আর। কাগজের মতো পানসে হয়ে গেছে। মাড়িতে মাড়িতে ঘষেও একটু রস পাওয়া যাচ্ছে না। তাই গিলতে ইচ্ছে করছে না, লালা গড়িয়ে পড়ছে কশ দিয়ে।

বুড়োটার নাক থেকেও গড়াচ্ছে লালা। চলছে খুব আস্তে। এক পা ফেলে, আর এক পা টানতে সময় লাগে। হাড়ে হাড়ে জং ধরে গেছে। পা তুলতে গেলে হাঁটু বাঁকে না, খাড়া হয়ে থাকে।

বুডঢার পা ফেলাটা বোঝা যায়, যখন চাকা দুটো আঁ বলে খানিকক্ষণ থামে। তারপর হো বলে আবার থামে। পরে, হঠাৎ আঁউ শব্দটা সবচেয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। তখন পিছনের পা দুটো যায়।

বুড়ো বলে, হাঁ।..আমি ওই ডাক শুনি। আর দেখি একটা পাহাড় চলেছে আমার পাশে পাশে। একটা কালো পাহাড়, বাঁয়ে হেলে ডাইনে হেলে, ঢেউ দিয়ে চলেছে। পাছায় তার বড় বড় পাথরের চাংড়া আছে খোঁচা খোঁচা হয়ে। তারপর উঁচু পাহাড়ের কোলে যেমন থাকে সমান জমি, তেমনি চলে গেছে তার পিঠ। আমার বুডঢা ছেরুয়া। ওর শিং দুটো আমার হাতের চেয়ে বড়। কখনও মনে হয়, একটা পেল্লায় কালো মেঘ চলেছে আমার পাশ দিয়ে।

কত বড়। তার পাশে, লাঠি হাতে আমি। মেঘ বলো, পাহাড় বলল, ওকে চালাই আমি। অথচ আমাকে দেখা যায় না ওর আড়ালে। দেখে নিশ্চয়ই ভগবান হাসে। কিন্তু চাকা কেন ডাকছে না। বুডঢা!

সামনের রাস্তাটি, নর্দমার কালভার্টের জন্য একটু উঁচু হয়ে উঠেছে। বুডঢা ঠেলছে, উঠতে পারছে না।

পারবি বুডঢা, পারবি। রোজ পারিস, আজও পারবি। আজ, হ্যাঁ আজ কী হয়েছে আমারও। আমারও মনে হচ্ছে, আমি যেন আমার গাঁয়ের সেই পাহাড়ের মন্দিরটার সামনে এসেছি। ওইখানে মহাদেব আছে। এত উঁচু তো মনে হয়নি কোনওদিন এ রাস্তাটা। আমার হাঁটুর শিরে টান ধরছে। দুহাতে আমাকে লাঠি ভর দিতে হচ্ছে। তোকে আমি ঠেলতে পারব না।

ঠিক যাব, বুডঢা, এটা আমাদের মনের ভয়। আমরা দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি। ছেরুয়া বুডঢা…! আ…আ…আঁ হো…আউ…

 হাঁ।…এইটা ভগবানের হাসি, ওই রাস্তাটা। আমি দেখেছি ভগবানের হাসি। আমার প্রথম ছেলেটা মরবার আগে যখন ধনুকের মতো বেঁকতে লাগল মেঝেয় পড়ে, দেখলাম ভগবান হাসছে। ধাওড়ার মারামারিতে যেদিন রামু চালুর মাথাটা কোদাল দিয়ে ফাঁক করে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, দেখলাম ভগবান হাসছে। কেন, শেখোর বাচ্চাটার পাতের ভাত যখন শোরে এসে কপকপ খেয়ে ফেলতে থাকে আর বাচ্চাটা কাঁদে, আমি দেখি ভগবান হাসে। দিব্যি করে বলছি, দেখেছি। বুডঢা, তুই দেখতে পাস না।

শিউরে উঠল একবার বুডঢার সারা গায়ের চামড়া। ল্যাজটা আন্দোলিত হল বারকয়েক। ঘাড়ের কাছে কয়েকগাছি চুল উড়ছে ফুরফুর করে।

বুড়ো বলল, তুই ঠিক দেখতে পাস। তুই আমাকেই তুক করিস, যাতে আমি কিছুতেই উঠে না দাঁড়াতে পারি। মিছে তুক করিস। দুনিয়ার নিয়মের কাছে তুক চলে না।

রাস্তা ঘিঞ্জি হচ্ছে, শহর বাড়ছে। দোকানপসার ছেকে ধরছে রাস্তার দুদিক থেকে। সূর্য হাসছে দপদপিয়ে। বাতাস হালকা লাগছে একটু একটু। রাস্তাটা তাতছে ধীরে ধীরে। ধুলো উড়ছে থেকে থেকে।

গাড়ি ঘোড়া ভেঁপু। থামিসনে বুডঢা, এ সবই তোর চেনা। মোটরের ড্রাইভার তোকে খিচোবে, রিকশাওয়ালা গালাগাল দেবে, বাচ্চারা ঢিল মারতে পারে, দল বেঁধে ভেংচাবে, আঁ হো আঁউ! হাঁ। সে শুধু তোকে নয়, গাড়িকে নয়, আমাকেও।

থামিস্ নে। রাস্তাটা তো বেশ আলকাতরা-ঢালা পেয়েছিস, চলে চল। ওই দেখা যায় মিসিপালটির অপিস। ওই লাল টকটকে ফুল, উড়ছে বাতাসে। তোর ভয় পাবার কিছু নেই, ওগুলি রক্ত নয়; ফুল। মনে হয়, যেন মাটির তলে আছে অনেক রক্ত, গাছে গাছে ফুটেছে বিন্দু বিন্দু হয়ে। তারপর ঝরে যাচ্ছে মাটিতে। সবাই ঝরে যায় একদিন।

এটা নিয়ম।

দাঁড়াল এসে মিউনিসিপালিটির ফটকের সামনে। সেখানেই দাঁড়িয়েছিলেন স্যানিটারি বাবু সাইকেলে হেলান দিয়ে। বললেন, আজও তুই বেরিয়েছিস বুড়ো।

কী আশ্চর্য কথা! ফোকলা মাড়িতে, বলিরেখাঙ্কিত শিথিল গালে বুড়ো হাসল। কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে জিভ। মাঝে মাঝে এই রকম হয়। তোমার হাত, তোমার পা তোমার চোখ জিভ তোমার কথা শোনে না।

জিভটাকে স্থির করে রাখল বুড়ো এক মুহূর্ত। লালা মুছে নিল হাতের চেটোয়। তারপরে বলল, হাজিরা দিতে হবে না?

বাবু বললেন ভ্রূ কুঁচকে, হাজিরা দিতে হবে?

হাঁ। তুমি যখন বাইরে আছ বাবু, হাজিরাটা নিয়ে নাও।

নিয়ে নিলুম।

হাঁ। ফিরে যাওয়ার সময় বুডঢার বিচুলি নিয়ে যাব।

নিয়ে যেয়ো।

বাবু!

বল।

একটু দাওয়াই দিতে হবে।

কার? তোর?

না, বুডঢার।

স্যানিটারিবাবু তেলচিটে টুপিটা মাথা থেকে খুলে, হেসে উঠলেন হা হা করে। তারপর ভারী অবাক হয়ে তাকালেন বুডঢার দিকে। বললেন, বুডঢার পেটটা তো রেল ইঞ্জিনের মতো হয়েছে।

হাঁ।

কী খায়?

মিসিপালটির বিচুলি!

তাই খেয়ে এত বড় হয়েছে পেটটা?

না। ফুলে যাচ্ছে রোজ, একটু একটু করে।

স্যানিটারিবাবু তাকিয়ে দেখলেন, বুড়োরও হাত পা ফুলেছে, মুখও ফুলেছে। বললেন, তুইও তো ফুলে গেছিস।

বুড়ো ভাবল, তা হতে পারে। এ সময়ে সবাই ফোলে।

বিশ্বের এক বিচিত্র বিস্ময় যেন দেখছেন স্যানিটারিবাবু। একবার দেখেন বুড়োকে, আবার একটু ফিরে দেখেন বুডঢাকে। বললেন, তোবে না তো রে। যে কালাপাহাড়, যেমন চাউনি। আর যা শিং বাবা।

না। ও যে ছেরুয়া। বয়েসকালে একটু আধটু বাগাত। ওর আসল জিনিস থাকলে, আপনাকে ওই রকম কাছে ঘেঁষতে দিত না। এতক্ষণে আপনার লাশ বাড়িতে রেখে আসতে হত।

উল্লুক।

হাঁ বাবু।

কী দাওয়াই দিতে হবে?

দুটো দাওয়াই। বুডঢার তেরোটা ঘা হয়েছে বাবু।

গুনে রেখেছিস।

হাঁ। এই যে, লাল দগদগে ফটকের এই ফুলের মতো। এক–দুই-তিন…মাছি ধরেছে। বুডঢা এখন আর তাড়াতে পারে না।

আর কীসের দাওয়াই?

ওর শরীলের সব কবজাগুলো জং ধরে গেছে। একটু মালিশ চাই।

মালকোঁচা-দেওয়া স্যানিটারিবাবু টুপি হাতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন বুড়োর দিকে। বললেন, ওই দাওয়াইগুলো তোর নিজের জন্যে চাইনে?

বুড়োর ভয়, বুডঢা তার আগে মরবে। সেইজন্যে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। নিজের জন্যে চায়। বলে, এটা দুনিয়ার নিয়ম। বলল, না।

স্যানিটারিবাবু মনে মনে বললেন, ব্যাটা এই ফটকেই না পড়ে এখুনি মরে।

বললেন, আচ্ছা যা, নিয়ে যাস।

বাবু, একটা বিড়ি দাও।

দিলেন একটি বিড়ি। বুড়ো সেটি ভেঙে, ছোট্ট এক টুকরো ফেলে দিল কশে। একটু নেশা চাই।

 এ সবই রোজকার ব্যাপার। বুড়ো বলল, বুডঢা, দাওয়াই বাবু দেবে না, ওই রকম বলে। চাকায় একটু তেল, তোকে একটু দাওয়াই। কিন্তু তার দাম আছে। খারিজের খাতায় ওগুলো নেই। আমি জানি। তবু কেন বলি। বলতে হয়, কেন না, আমি মানুষ। ৮৩২

সূর্য ক্রমে প্রচণ্ড হচ্ছে। চোখে আগুন, জটায় হলকা। মহামেদিনী কাঁপছে দাবদাহের ভয়ে।

তবু মানুষ ঘুরছে, পুড়ছে। ধুলো উড়ছে, মানুষ চোখ-মুখ ঢাকছে। আঙিনায় বারান্দায় সব জায়গায় তৈরি করছে ছায়া।

কিন্তু বুডঢা, আমাদের এ সব দেখলে চলবে না, যেতে হবে আমাদের। চল।

কাঁপছে এখনই বুডঢার নাসারন্ধ্র, ফুটো দিয়ে ঝরছে ঘাম। পিচুটি-গলা ভয়ার্ত চোখে গড়াচ্ছে জল। বুড়ো দেখল, শিঙের গোড়ায় পোকা কিলবিল করছে বুডঢার। তাই কাক বসেছে মাথায়। টুকরে ঠুকরে খাচ্ছে পোকা।

বুড়ো, থামলে চলতে পারবিনে। আমাদের যেতে হবে দূরে।

আমরা কোথায় যাব? আমরা যাব ভাগাড়ে।

বুডঢা শূন্য চোখে দূরে তাকিয়ে নিশ্বাস ফেলল ফোঁস করে।

 ভয় পাচ্ছিস বুড়োটা। কিন্তু এইটা আমাদের কাজ।

আমরা টহল দেব আমাদের এলাকাটা। যার নাম মিসিপালটির ওয়াড। পথে পথে পড়ে থাকবে যত মড়া, সবাইকে তুলে দিয়ে আসব ভাগাড়ে। এইটা আমাদের কাজ। কুত্তা, বেড়াল, ছাগল, গরু, ভঁইসী, ভঁইসা, ছেরুয়া…

 তুই ভয় পাচ্ছিস বুডঢা। মিছে ভয় তোর। সবাই যায়। কেউ যায় ভাগাড়ে, কেউ শ্মশানে কেউ কবরে। কিন্তু যেতে হয়। আমাকেও যেতে হবে একদিন শ্মশানে। তোকেও যেতে হবে একদিন ভাগাড়ে। আমি সঙ্গে যাব না, কেন না, তুই মরে গেলে, তোকে নিয়ে যাব কেমন করে।

তুই মিছে ভয় পাচ্ছিস। এ দুনিয়ায় এলে, থামবার জো-টি নেই, যেতেই হবে। এইটা নিয়ম।

 আমাকে পোড়াবে, তোকে খাবে শকুনে। কিন্তু আমরা সেটা জানতে পারব না। চল।

 চলে না। বুডঢার গলিত মাড়ি ঝুলে পড়ছে। তেমনি তাকিয়ে আছে ভয়ার্ত ব্যাকুল চোখে, দীপ্ত রোদের দিকে।

বুড়োর মনে হল, গরম বাতাস তাকে ঠেলে দিচ্ছে ফটকের দিকে।

আজ বড় দম নিতে হচ্ছে। ঠেলতে হচ্ছে বারবার, চাড় লাগছে হৃৎপিণ্ডে। ছেরুয়াটা তুক করছে নাকি। মনে হচ্ছে যেন, ভগবান হাসছে।

বুড়ো প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল, এই শো’রের বাচ্ছা, শুনতে পাচ্ছিস।

কে যেন হেসে উঠল হা হা করে। হাঁ, এমনি করে সবাই হাসে। ভয় দেখাচ্ছে আমাকে। আবার চিৎকার করে উঠল, ছেরুয়া–বুডঢা!….

আঁ-আঁ হো আঁউ!

হাঁ। তিন খারিজে ডাক ছেড়েছে।

দুজনেরই ছানিপড়া চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে রোদে। বড় রাস্তা পার হয়ে পড়ল পাড়ার মধ্যে। বাচ্চারা লাগল আবার পিছনে। কে একটা মরা ইঁদুর ছুঁড়ে ফেলল ভাঙা গাড়িতে, নে নিয়ে যা ভাগাড়ে।

হাঁ। কিন্তু বাচ্চারা, তোরা চড়িসনে। এ গাড়ি ভাগাড়ে যায়। ওটা কী রাস্তার কিনারে? মরা কুত্তা? না, ছেড়া বালিশ। ওটা ভাগাড় যাবে না ছেরুয়া, শুকে কে যা, যত মরার জঞ্জাল, সব নিয়ে যেতে হবে।

যদি সারা এলাকায় না পাই, তবু যেতে হবে। কেন? না, যদি সীমানার বাইরে কেউ পড়ে থাকে ভাগাড়ের জীব, তাকে ফেলে দিতে হবে ভাগাড়ে। তাই রোজ যেতে হয়। এটা আমাদের ডিপটি, অর্থাৎ কাজ।

আমরা জন্ম থেকে মরণে যাই। আঁতুড় থেকে ভাগাড়ে। এখানে সবাই বিয়োয়। ওই বউটা, ওই ভঁইসীটা, ওই কুত্তিটা। এই পথে রোজ আমাদের যাওয়া-আসা। রোজ দেখি, জীবনটা চলে অষ্টপোহর। মিছে তোর ভয় বুডঢা, সামনে চল।

সামনে বাঁক। আবার বাঁক। ছেরুয়ার বুড়ো পিঠের শিরদাঁড়া বাঁকে না। অনেকখানি জায়গা নিয়ে মোড় বেঁকতে হয়। বেধে যায়, পিছুতে হয়, আবার সামনে।

পথ এই রকম। বাঁকা…বাঁকা…বাঁকা। অনেক খানা খাদ পাবি বুডঢা, খবরদার! নেমে পড়িসনে। ওরা তোকে ডাকবে পরান জুড়োতে। জুড়োলে আর পারবিনে যেতে।

চাকার শব্দ ক্রমে বিলম্বিত হচ্ছে একটু একটু করে, সুদীর্ঘ নিঝুম দুপুরের বিলম্বিত লয়ের মতো।

মাথা নুয়ে পড়ছে ছেরুয়ার। পেটের দিকটা আরও ফুলছে যেন। মাছি ভরে গেছে ঘায়ে। হড়-হড় করে লালা গড়াচ্ছে।

বুড়োর বুকের মধ্যে বিদ্যুতের চমক লাগছে।

কেন, কী হয়েছে আমার। উরতের শিরায় টান পড়ছে আমার, তামাকপাতাটুকু বেরিয়ে পড়তে চাইছে কশ বেয়ে। আমার ঘাম ঝরছে। কেন, আমার তো ঘাম ঝরে না আর।

খং করে কী বেজে উঠল। বুডঢার সম্মুখভেদী শিঙের ঠোকা লেগেছে লাইটপোস্টে।

 বুডঢা ডাইনে বেঁকে চল। এখন কানা হলে চলবে না। একী, তোর চোখ কোথায়? ভয়ে উলটে ফেলেছিস। তোর চোয়াল দুটো লালায় হড়কে যাচ্ছে। থামিসনে বুডঢা। আগুন উঠছে জমি থেকে। তুই খারিজ ছেরুয়া, খুরে তোর নাল লাগানো হয়নি অনেক দিন। আমার নাগরা কবে ছিঁড়ে গেছে। পুড়ছে পায়ের তলা।

সামনে আর একটি পাড়া। শেষ পাড়া। ওটি ডোমপাড়া। বুডঢা , রোজ তোকে অভিশাপ দেয়। তুই মলে ওরা চামড়াটা ছাড়িয়ে নেবে। নেবে নেবে, তুই চোখ বুজে পার হয়ে চল। ওরা ছুরি শানাচ্ছে, হাসছে, দেখছে তুই কবে মরবি! চাকার ডাক শুনতে পাচ্ছিনে কেন। বুডঢা!

বুডঢার মাথার উপরে চলে গেছে জোয়াল। ফোঁস ফোঁস করছে। যেন কোনও শত্রু ওর সামনে এসেছে, তাই দাঁড়িয়েছে রুখে। কিন্তু বুড়ো জানে, ও ভয় পাচ্ছে, বুড়োকে তুক করছে।

এই গীদধরের বাচ্ছা!

লাঠি তুলল বুড়ো। ছেরুয়ার পেছনের পায়ে শিরে টান পড়েছে, এগুচ্ছে না বুঝি।

 বুড়ো মারল লাঠি দিয়ে। একবার, দুবার, তিনবার, বারবার।

আমাকে মারতে হয়। প্রাণপণে মারতে হয়। না মারলে আমি চলতে পারব না! তুই আমার ছেরুয়া। ওরে শোরের বাচ্ছা, মরে গেলেও তোকে মারব। ভীরু, মরণে তোর ভয়!

মারতে লাগল ঠাস ঠাস করে।

ছেরুয়ার চোখ দুটো প্রকাণ্ড হয়ে উঠল। গলগল করে ঝরে পড়তে লাগল জল।

এই…এই…এই!

দুটো ডোম এল। কেন মারছ এত। অবলা জীব।

বুড়ো দেখল, হাতে ওদের ছুরি আছে নাকি। মরলে ওরা ছুরি নিয়ে আসত।

মারতে লাগল বুড়ো। ডাক দিল, ছেরুয়া বুডঢা!…

আঁ–হো–আঁউ!

হাঁ।

বুড়ো তাকাল ডোম দুটোর দিকে। কিন্তু নিজে চলতে পারছে না। বলল, এই তোর তুক। তুই এমনি করে আমাকে মারবি। এমনি করে।

বাতাস পাক খাচ্ছে, তপ্ত বাতাস। হাঁপাচ্ছে বুড়ো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর চাকার লয়ে তাল দিচ্ছে, হাঁ। এবার তুই চল বুড়ো, নইলে তোকে মার খেতে হবে। এখনও বেঁচে আছিস, চলতে হবে!

ফাটা থ্যাবড়া ঠোঁট বুড়োর ঝুলে পড়েছে। রোদ পড়ে জিভটা দেখাচ্ছে শাদা। বুড়ো এগোল লাঠি ভর দিয়ে। কোমরের ন্যাকড়াটা অনেকখানি স্থানচ্যুত হয়েছে। বুড়ো এখন শিশু দিগম্বরের সামিল।

কাছে এল বুডঢার। মস্ত বড় কালো পাহাড় ঢেউ দিয়ে চলেছে। হাত দিল বুডঢার গায়ে।

 সামনে মাঠের পথ। ওই রেল লাইন। তার ওপারে ভাগাড় বৈশাখের রুদ্র কটাক্ষে কাঁপছে। থরথর করে।

পেটটা যেন ফুলে ফুলে উঠছে বুডঢার। মাথাটা ঠেলে ঠেলে তুলে তুলে এগুতে হচ্ছে। যেন পাহাড়ের খাদ থেকে, শিং-খোঁচা চুড়ো ঠেলে ঠেলে উঠছে। নাকের লালা সুতোর মর্তো গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে, হলদে ফেনায় ভরে যাচ্ছে থলথলে কালো পাঁকের মতো কশ। চোখে জল।

তুই কাঁদছিস বুডঢা। কাঁদিসনে।

বুড়ো হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছল। বুকে একটা হাত রাখল।

কাঁদিসনে বুডঢা। বুড়োদের কাঁদতে নেই।

কলো মেঘের মতো বড় হয়ে উঠছে ছেরুয়াটা। মস্ত বড়, দলাপাকানো বিশাল কৃষ্ণ জলধর। ঠিকরে পড়ছে চোখ। জল পড়ছে কোণ দিয়ে।

বুডঢা, চার বছর বয়সে তুই এসেছিলি আমার কাছে। তখন তোর দুধের দাঁত সব পড়েনি। আজ তোর বয়স হল, এক কুড়ি আট। ছেরুয়া হিসাবে তুই আমার চেয়ে বুড়ো। পঁচিশ বছর ছেরুয়ার অনেকখানি। তুই এককুড়ি আটে পড়লি, তুই কেন কাঁদিস। তোর কেন মরণের ভয়।

তুই যেবারে এলি, তখনও আমি জোয়ান। আমার বুড়ির তখনও অনেক রং। তিনটে বাচ্চার মা। হয়ে গেছে তখন। তবু, চোখে চোখ পড়লেই, মেয়েমানুষটার নজর আড় হয়ে যেত। চলত বনা ভঁইসীর মতে, আঁট ছিল ওই রকম। বাচ্চাগুলি ওর মরে যেত, আর ছুটত আমার পিছে পিছে। কেঁদে কেঁদে সোহাগ জানাত। জানতাম, বাচ্চা চায়। আমার মরদের শোক, ভাবতাম থাক, কী হবে আর! ওর মন মানত না। খালি কিনা খাঁ খাঁ করত! ভরে রাখতে চাইত। সবাই চায় ভরে। রাখতে। ও ছিল এই এলাকার ঝাড়ুদানী। কাজ ফাঁকি দিয়ে আসত ছুটে ছুটে।

একদিন পড়েছি এই মাঠের পথে। বউটা এল। এল তুমুল জল মাথায় করে। সেই প্রথম, আমি এই গাড়িটায়, বুডঢা, তোর গাড়িতে চাপলাম, বউয়ের কথায়। লোকজন নেই, ফাঁকা। তার উপরে বিষ্টি। ও তাকাতে লাগল ঘন ঘন, বিজলিহানা চোখে। বিজলি হানল ওর ফুলে-ওঠা নাকের পাটায়। আর কোমরে একটা এমন মোচড় দিয়ে বসেছিল। ও নয়, মরা ছেলের শোকটাই ওই রকম খেলার বেশ ধরে খেলছিল। আমি দেখলাম। কী বিষ্টি বুডঢা, তুই তখন জোয়ান ছেরুয়া। জল পেয়ে ছুটেছিস মহানন্দে। তখন তোর কোনও ভয় ছিল না।

আমি বউটাকে আদর করলাম। ভালবাসলাম। তখন আমার একবার আবার মনে হয়েছিল, ভগবান হাসছে।

বুডঢা, শব্দ নেই কেন বুড়ো চাকার।

 কিন্তু কালো মেঘটা তো ঠিক ভেসে চলেছে চোখের উপর দিয়ে। লালা দাগ রেখে চলেছে। ফেনা লালা গড়িয়ে, গলার তলা দিয়ে পা বেয়ে পড়ছে। একটা চাপা কাশির শব্দ যাচ্ছে শোনা।

 বুডঢা, তুই কি মুখ থুবড়ে পড়ছিস? তোর মাথা, পেল্লায় শিং দুটো নুয়ে পড়ছে কেন? তুই কি চলছিস না? চোখ দুটো তোর এত চকচক করছে কেন?

আঁ-আঁ-হো–আঁউ।

হাঁ…চলছে। আমি শুনতে পাচ্ছি না বোধহয়। যেন রেললাইন পার হয়েছে। ওই যে দেখা যায় কালো কালো সারি সারি–ওরা শকুন। এই গাড়িটাকে, মানুষ আর ছেরুয়াটাকে ওরা চেনে। তাই ছুটে আসতে লাগল কাছে।

ও! ওইজন্যে বুডঢা তোর চোখ ওই রকম দেখাচ্ছে। ভয় পাচ্ছিস। নিশ্বাস ফেলছিস ঘনঘন। মাথাটাকে তুলছিস আমি দেখছি, পাহাড় উঠছে সমুদ্রের তলা থেকে। ভয় নেই বুডঢা ওরা চেনা।

ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ। হাড্ডি আর জানোয়ারের দাঁতসুদ্ধ চোয়ালে ছড়ানো ঘাস-পোড়া মাটি। শকুনের বিষ্ঠায় আস্তীর্ণ সর্বত্র। মাংসখেকো কালো পিঁপড়ে থিকথিক করেছ।

বাতাস এখানে ঘূর্ণি বাতাসে ডাক ছেড়েছে। সুর্যের রক্তচক্ষুর দৃষ্টি এখানে ছাই করতে চাইছে। পুড়িয়ে।

 বুডঢা, সেই একদিন চেপেছিলাম গাড়িতে। আর একদিন দশ মাস বাদে চেপেছিলাম। ভরা পেটে ব্যথা নিয়ে বউটা এসে উঠেছিল গাড়িতে। গাড়িতে একটা মরা গাই, তার পাশে আবার বুড়ি কাতরাচ্ছিল। এইখানে এসে দেখলাম, বউটার একটা ছেলে হয়েছে।

ছেরুয়া বুডঢা, এই সংসার কী অদ্ভুত। দুনিয়ার আঁতুড়ঘরের কোল দিয়ে আসি মরার আসরে। সেইখানেও আঁতুড়ঘর করে গেল বউটা। আমার সেই ব্যাটা আছে বেঁচে। থাকে ভিনদেশে। গাড়ি টানে। জোয়ান বউ, তার এখন দুটো বাচ্চা। তুই সব জানিস বুডঢা, সে আমাকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তিন জন খারিজে রয়ে গেছি একত্রে। বুডঢা, তুই আমার ভাই আমার বন্ধু। তোর কেন ভয়? তুই কাঁদলে আমায় কাঁদতে হবে।

আগুন গলে গলে পড়ছে আকাশ থেকে। শকুনগুলি থেমে গেছে আসতে আসতে। কৌতূহলী উৎসুক চোখে দেখছে চেয়ে চেয়ে।

বুড়োর নাল কাটছে বুডঢার মতোই। বুডঢা কাঁপছে থরথর করে। ঘনঘন নিশ্বাসে দেখছে শকুনের দিকে। পায়ে ধরছে কালো ডেয়ো পিঁপড়ে।

বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি চাকা ধরে। আর একহাতে হাতড়াচ্ছে মরা ইঁদুরটা। তুলে ফেলতেই মুখে করে নিয়ে গেল একটা শকুন।

চল বুডঢা। কিন্তু, তুই এত বড় হচ্ছিস কী করে। কী করে! বড় হচ্ছিস, মস্ত বড়, কালো পাহাড় হয়ে আকাশে উঠছিস। বুডঢা! তুক করছিস তুই আবার। একী, ভাগাড়ের চেয়েও বড় হয়ে যাচ্ছিস। থাম, নইলে মরবি পিটুনি খেয়ে। ফিরে চল।

চল।

লাঠিটা পড়ে গেল বুড়োর হাত থেকে।

কেন?

চাকাটা চলে যাচ্ছে আপনি-আপনি।

কেন?

বুড়ো পড়ে গেল মাটিতে। চিত হয়ে পড়ল। গনগনে সূর্য জ্বলছে বুড়োর চোখে। বিড়ির টুকরোটা লেগে গেছে কশে।

বুডঢা, আমি তোকে ছাড়া কিছু দেখছি না। আমি দেখছি, সারাটা আকাশ ভরে তুই। আমি ভয় পাচ্ছিনে। দেখছি, তোর হাসি। এতদিন ভেবেছি, ভগবান হাসছে। এখন দেখছি সে তোর মুখে।

বুড়ো উঠল না আর। ছেরুয়াটা ছানিপড়া চোখে অবাক হয়ে দেখল বুড়োকে। দেখল শকুনগুলিকে! তারপর ঠেলতে লাগল নিজেকে।

আঁ… আ হহা–আঁউ।

বুডঢার মনে হল, বুড়ো বলছে, হাঁ।

 হাঁ। আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি বুডঢা, আঁ–হো-আউ। হাঁ। শুনছি..এখনও শুনছি।

বুডঢা এগিয়ে গেল। তারপর পাক দিয়ে ঘুরে এসে দাঁড়াল বুড়োর কাছে। মুখোমুখি। জোয়ালসুদ্ধ মুখটা নামিয়ে নিয়ে এল। ওর লালায় ভরে দিল বুড়োর মুখ।

দুটি চোখে দারুণ ভয়ার্ত অসহায়তা। দাঁতহীন কালো থলথলে মাড়ি বেরিয়ে পড়ল বিরাট হাঁ থেকে। চোয়াল কাঁপছে, ফোঁস ফোঁস করছে। পেটটা ফুলে ফুলে উঠছে। মোটা কালো জিভটা বের করে বুড়োর নাকের কাছে নিয়ে চাটল একবার।

তারপর ফিরে তাকাল দূরের পথে। চোখ দুটি ভরে উঠেছে জলে।

বুড়োকে না মাড়িয়ে পার হল চার পায়ে। ঠেকে গেল চাকা দুটি বুড়োর গায়ে। ভাঙা গাড়ির চাকা, তবু চাকা। আর ভারী।

বুডঢা টানল।

আ…আ…আঁ-হো -আঁউ!…

বুডোর বুক আর পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল চাকা দুটি।

রৌদ্রের দাবদাহ কথা বলছে ঘূর্ণি বাতাসের গোঙানিতে।

বুডঢা অনেকখানি গেল, অনেকক্ষণ ধরে। চেনা পথ। রেল লাইন পেরিয়ে আবার দাঁড়াল।

যেতে পারছে না। কেউ যে চালাচ্ছে না। মারছে না, কথা বলছে না, তিন খারিজের একটা নেই। বোধহয় ভাবছে, উঠে আসবে আবার।

ফিরে দাঁড়াল। ছানিপড়া চোখে তাকিয়ে দেখল, কালো কী কতকগুলি হেঁটে ফিরে বেড়াচ্ছে নড়ে চড়ে বুড়োকে ঘিরে। যেতে পারছে না বুডঢা। ভয়ার্ত ব্যাকুল চোখ দুটি তুলে, কাঁপতে লাগল দাঁড়িয়ে। হাঁ করল কাঁপানো চোয়ালে। অস্ফুট শব্দ বেরুল, আঁ–।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *