দুই বন্ধু – বুদ্ধদেব বসু

দুই বন্ধু – বুদ্ধদেব বসু

না, ঘুম পাচ্ছে—বর্বর ঘুম৷ হাত শিথিল, কলম চলে না, মন ঝাপসা৷ তার মন যেন গোধূলি, সেখানে কোনো রেখা নেই, সব থমথমে, মস্ত কালো থমথমে মেঘের মতো ঝুলে আছে—ঘুম৷ যেমন সন্ধ্যায় মশা, পোকা, বাদুড় ছিটকে ছিটকে উড়ে বেড়ায়, তেমনি তার মনের মধ্যে ধূসরভাবে নড়ে বেড়াচ্ছে কবিদের নাম, কবিতার লাইন, পড়ার স্মৃতি—এতদিন ধরে যা-কিছু পড়েছে, শুনেছে, ভেবেছে, তার চাপা, একটানা, অর্থহীন—ঝিঁঝির মতো আওয়াজ৷ অসম্ভব তাদের এখন স্পষ্ট করে তোলা৷ অসম্ভব কোনো-এক লক্ষ্যের দিকে চিন্তার সিঁড়ি গড়ে তোলা ঘুম৷ ঘুমোতেই হবে৷ আর পরীক্ষা তো এসে গেলো৷

খাতা বন্ধ করে উঠতে যাবে, এমন সময় ঘুমের চেয়েও ভারি চাপে তার শরীর অবশ হয়ে এল৷ ঘরে আর-একজন আছে, আর-একজন এসেছে৷ দরজার ধার থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে তার দিকে, খুব আস্তে, যেন অতি কষ্টে, আর একেবারে, একেবারে নিঃশব্দে৷ সুকুমারের ঘুম ছুটে গেল মুহূর্তে, বুদ্ধির তীক্ষ্নতা ফিরে এল যদিও একটু আঙুল নাড়ার ক্ষমতাও সে খুঁজে পেলো না নিজের মধ্যে, বিদ্যুৎবেগে সে অনেক কিছুই দেখে ফেললো৷ লোকটি চোর নয়, গুণ্ডা নয়—দেখেই বোঝা যায়৷ পায়ে কার্পেটের চটি, ধবধবে কোঁচানো ধুতি পরনে, গিলে-করা মিহি পাঞ্জাবি, আর পাঞ্জাবির ওপরে এক অতি ম্লান যুবকের মুখ বসানো৷ দেখে ভয় পাবার কিছু নেই, কিন্তু সেটাই সবচেয়ে ভয়ের৷ লোকটি এমন সুসজ্জিত ধীর নিঃশব্দ আর পরিপাটি যে সত্যি সে কোনো ‘লোক’ কিনা সেটাই সন্দেহ করা যায়৷ যেন পুতুল, যেন যন্ত্র, কোনো জাদুকর চালাচ্ছে৷

মেঝের কয়েক গজ পার হতে যতটুকু সময় লাগলো এই অতিথির, সুকুমারের সেটা মনে হল অনন্তকাল৷ সে চ্যাঁচাতে চাইলো, গলা বন্ধ উঠতে চাইলো, পায়ে যেন শেকল বাঁধা৷ অবশেষে দেখতে পেলো তার টেবিলের পাশের ইজিচেয়ারটিতে ‘লোকটি’ বসে আছে৷ এত হালকা হয়ে বসেছে, এত কম জায়গা নিয়ে, যেন তার শরীরের কোনো ওজন নেই৷ আর কী ফ্যাকাশে তার মুখ৷

ক্ষীণ আওয়াজ শুনলো, ‘ভয় পেলে নাকি?’

সুকুমার কথা শুনে একটু আশ্বস্ত হল, কিন্তু জবাব জোটাতে পারলো না৷ তার জিভ তখনো কাঠ৷

‘ভয় নেই৷ নির্জনে থাকি আমরা, একটু কথা বলতে এলাম৷’

‘আমরা’ শুনেই সুকুমার ব্যাপারটা বুঝে ফেললো৷ স্বপ্ন দেখছে? না সত্যি? ঘুমিয়ে আছে? না জেগে? সত্যি ভয় পাবার কিছু নেই? না, ভয় কিসের৷ কী করতে পারে আমাকে ঐ…ঐ৷

‘কথা বলতে এলাম৷ কিন্তু আসা কি সহজ? অনেক, অনেক, অনেক চেষ্টায়—তুমি কলেজে পড়ো?’

‘তা পড়ি বলা যায়৷’ এতক্ষণে আওয়াজ ফিরে পেলো সুকুমার৷

‘বলা যায়, মানে? হয় পড়ো, নয় পড়ো না—এর মাঝামাঝি কিছু তো নেই৷’

‘আমি এবার এম.এ. পরীক্ষা দিচ্ছি৷’

‘ও, এম.এ. দিচ্ছো৷ কোন সাবজেক্টে?’

‘বিষয়টার নাম কম্প্যারেটিভ লিটরেচার৷’

‘কী বললে? কম-প্যা-রে-টিভ…সে আবার কী?’

‘নতুন হয়েছে৷’

‘তা ব্যাপারটা কী? কী পড়তে হয়?’

‘এই—সাহিত্য আর কি…নানা দেশের সাহিত্য৷ বলতে পারো বিশ্বসাহিত্য৷’ সুকুমার থামলো, কিন্তু নিজের নতুন জ্ঞানের একটু নমুনা দেবার লোভ সামলাতে পারলো না শেষ পর্যন্ত—‘নানা দেশের সাহিত্য না পড়লে তো কোনো দেশের সাহিত্যই বোঝা যায় না৷’

‘নানা দেশের সাহিত্য? অনেক অলৌকিক গল্প পড়ো তাহলে?’

‘অলৌকিক মানে?’

‘মানে—দেহ থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা কোথায় যায়, কী করে, এই সব কথা৷ মানে—আমি এখন যে-অবস্থায় আছি, সেই অবস্থার বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা৷ এ সব পড়ো না?’

সুকুমার স্থির চোখে তাকালো এই অদ্ভুত আগন্তুকের দিকে৷ না, আমরা যাকে শরীর বলি তার কোনো চিহ্ন নেই, ফাঁপা একটা আকৃতি শুধু, যেন কাগজে তৈরি, নাক-চোখ-মুখ সবই আছে, কাপড়চোপড়ও দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ও-সবের পেছনে কোনো বাস্তব নেই যেন, এক ঝাপটা হাওয়া এলেই ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাবে৷ বেচারার জন্য কষ্ট হল সুকুমারের—কষ্ট হল এ-কথা ভেবে যে একে এক পেয়ালা চা খাইয়েও সুখী করা যাবে না—খাদ্য, পানীয়, বিশ্রাম, জ্ঞান—কিছুরই আর প্রয়োজন নেই এর৷

‘জবাব দিচ্ছো না যে?’

‘ও—হ্যাঁ৷ তা পড়েছি বইকি কিছু-কিছু৷’

‘হ্যামলেট?’

‘ও আর কে না পড়েছে৷’ একটু ঠাট্টার হাসি ফুটলো সুকুমারের ঠোঁটে৷ ‘আমি দশ বছর বয়সে প্রথম পড়েছিলাম৷’

‘দান্তে?’

‘পড়েছি৷’

‘কী মনে হয়েছে তোমার?’

‘কোন বিষয়ে?’

‘দান্তের পাপীদের বিষয়ে৷ কখনো কি মনে হয়েছে যে সব ধাপ্পা বুজরুকি, ওপর-চালাকি?’

‘মানে?’

‘যারা দেহ থেকে মুক্ত হয়েছে তাদের আবার শারীরিক শাস্তি দেবে কেমন করে? তাদের কি মাথা আছে যে মাথা ফাটিয়ে দেবে? চোখ আছে যে পাতার ফাঁকে পোকা ঢুকিয়ে দেবে? নাক আছে যে যন্ত্রণা দেবে দুর্গন্ধ ছিটিয়ে? নাকি মাংসপেশী আছে যে আগুনের হ্রদে ডুবিয়ে রাখবে? কাকে খাওয়াবে ডালকুত্তা দিয়ে? কাকে ভাজবে গরম তেলে? কার গলা থেকে বের করবে আর্তনাদ? সে তো অনেক আগেই ভস্ম হয়ে গেছে, বা মিশে গেছে মাটির তলায়, মাটির মধ্যে৷ এ-সব কথা ভেবেছ কখনো?’

‘এ তো তুমি গীতা বলছো৷ নতুন কিছু না৷’

‘গীতা? ঐ আর-একটি অতিকায় ধাপ্পা, বিরাট বুজরুকি৷ দেহের খাঁচা থেকে বেরুনোমাত্র, আত্মাটি টুপ করে পরম ব্রহ্মে লীন হয়ে যায়, এত বড় মিথ্যে আর কিছু নেই৷ যত বই পৃথিবীতে লেখা হয়েছে সব মিথ্যে৷ কেন জানো?’

‘বোধহয় এইজন্য যে শুধু জীবিতেরাই বই লেখে, আর না মরা পর্যন্ত পুরো সত্য জানা যায় না৷’

‘ব্রাভো! ঠিক বলেছো৷ বেশ বুদ্ধিমান ছেলে তুমি৷’

‘ধন্যবাদ৷—যদিও জানি না আমার পরীক্ষক মশায়েরও তা-ই মত হবে কিনা৷ একটা কথা জিজ্ঞেস করি৷ তুমি কে? কোনো আত্মা? প্রেত? বিশ্রী বাংলায় যাকে ভূত বলে, তা-ই? আমাকে বলছো, গীতা ভুল, দান্তে ভুল৷ সত্য কথাটা তাহলে কী?’

‘দ্যাখো ছোকরা, অতিচালাকি কোরো না—পরীক্ষায় ফল ভালো হবে না তাতে৷ যেটুকু জানো তার বাইরে ছায়া মাড়াবে না৷’

‘আমি প্রতিবাদ করছি৷ তুমিও আমার পরীক্ষক নও, আর আমিও কিছু অতিচালাকি করিনি৷ আমি শুধু জানতে চাচ্ছি তোমার কাছে৷ নচিকেতা যেমন যমের কাছে—তেমনি৷’

‘সেটি হচ্ছে না৷’ একটা হাসির মতো আওয়াজ শুনলো সুকুমার৷ ‘আমরা মরে গিয়ে যা জেনেছি তুমি ভাবছ বেঁচে থেকেই তা জেনে নেবে? না হে না, সে-আশা নেই৷’

‘তা বেশ৷ আমার জ্ঞানের স্পৃহা এত প্রবল নয় যে, তার জন্য ছটফটিয়ে এই দেহ থেকে বেরিয়ে যাব৷ নশ্বর দেহের সঙ্গে এক হয়ে থাকতে নেহাত মন্দ লাগছে না আপাতত৷’

‘স্বার্থপর! নিষ্ঠুর! জীবিতেরা সকলেই তা-ই৷ যারা মরে গেছে, কে আর ভাবে তাদের কথা?’

‘যুধিষ্ঠির ভেবেছিলেন৷ দান্তে ভেবেছিলেন৷ কবিরা অনেকেই ভেবেছিলেন৷’

‘তোমার বই-পড়া জঞ্জাল ভুলে যাও৷ আমার কথা শোনো৷ জানো, আমি ডাক্তারি পড়তুম?’

‘আচ্ছা! আমিও একবার ভর্তি হয়েছিলাম মেডিকেল কলেজে৷’

‘মড়া কাটার ভয়ে পালিয়েছিলে তো?’

‘কিছু আগেই পালিয়েছিলুম৷ শুরু করার আগেই৷’

‘কত ছেলেকে ভয় পেতে দেখেছি৷ কেউ অপারেশন-থিয়েটারেই বমি করে ফেলেছে৷ কেউ বাড়ি ফিরে ঘেন্নায় ভাত খেতে পারেনি৷ রাত্রে স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে কেউ-কেউ৷ আমার কিন্তু প্রথম থেকেই ভালো লাগত৷’

‘ভালো-মন্দ তো বাইরে কিছু নেই সবই আমাদের মনে৷’

‘দ্যাখো ছোকরা, আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না৷ কত বয়স তোমার, শুনি? কুড়ি? একুশ? আমারও তা-ই ছিলো—কিছু বেশি—সেই সময়ে৷ কিন্তু সে কতদিন আগে, জানো? তোমাদের হিসেবে পঞ্চাশ বছর৷ তাহলে আমার বয়স কত হল ভেবে দ্যাখো৷’

সুকুমার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, ‘পঁচাত্তর?’

‘তাও বলতে পারো, অনন্তকাল বললেও ভুল হয় না৷ এই অনন্তকালের মধ্যে কখনো কি তার সঙ্গে আবার দেখা হবে?’

‘কার কথা বলছো?’

‘আঃ—বাধা দিয়ো না বার-বার৷ আমাকে বলতে দাও৷’

সুকুমার বুঝলো ইনি আত্মজীবনীর একটি অংশ তাকে শোনাতে চান৷ সকলেই তা-ই চায়, সকলেই ভাবে তার জীবনের সুখ-দুঃখ শুনতে অন্যদেরও গরজ খুব৷ ম’রে গিয়েও এ রোগ মরে না৷

‘বলছিলাম আমার ভালো লাগত ডাক্তারি পড়া৷ ভালো লাগত মড়া কাটতে—ঐ ফোলা, শক্ত, ঠাণ্ডা মৃতদেহগুলোর পেটের মধ্যে ছুরি চালিয়ে শরীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কলকব্জা যখন চোখের সামনে দেখতে পেতাম, নিজেকে আমার মস্ত একজন কেউ-কেটা মনে হত৷ ভালোবাসতাম মুমূর্ষুর পাশে পাহারা দিতে, তাদের নাভিশ্বাসের যন্ত্রণা লক্ষ্য করতে—আর কয়েক ঘণ্টা, কয়েক মিনিটের মধ্যে এরা আর মানুষ থাকবে না, একটা জিনিসে পরিণত হবে, নেহাত জড়পদার্থ, যার পেটের মধ্যে ছুরি চালিয়ে জ্ঞানী হওয়া যায়৷’

একটু থেমে দম নিয়ে আবার শুরু করলো, ‘গর্ব হত আমার, উঁচুদরের জীব বলে মনে হত নিজেকে—কেন জানো? আর-কোনো কারণে নয়, শুধু বেঁচে আছি বলেই৷ এরা মরে যাচ্ছে, মরে গেছে—আর আমি বেঁচে আছি৷ একটি সপ্রাণ সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ শরীর আছে আমার৷ নিতে পারি খাদ্যের স্বাদ, সূর্যের স্বাদ, শরতের শিউলির গন্ধ, ভোরবেলার ভৈরবীর সুর৷ পারি সাঁতার কাটতে, আড্ডা দিতে, ঘুমের অলস বিছানায় জেগে উঠতে৷…আর এখন, এই তুমি চোখের সামনে যা দেখছ, তার মধ্যে স্বচ্ছন্দে হাত চালিয়ে দিতে পারো৷ এই ধুতি-পাঞ্জাবি, কার্পেটের চটি, সিঁথি-কাটা চুল, নাকের তলায় পাতলা সরু গোঁফ—এ সব কিছু না, কিছুই না—হাওয়া, মায়া৷ অনেক—অনেক—অনেক কষ্টে এটুকু মাত্র জোটাতে পারি এখন৷ সেই তখন আমি যা ছিলাম তার একটা স্মৃতি মাত্র, ছায়া মাত্র, ভান মাত্র৷ যদি আমাকে ধরতে যাও মুঠোর মধ্যে, হাওয়া ছাড়া আর-কিছু পাবে না৷ দ্যাখো—দ্যাখো একবার হাত দিয়ে৷’

‘মাপ করো, তোমাকে স্পর্শ করতে লুব্ধ হচ্ছি না আমি৷ কিন্তু সবই যদি মায়া, তাহলে তোমার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি কেমন করে?’

‘ঐ শুনতে পাওয়াটাও মায়া৷’ এই জ্ঞানগর্ভ ঘোষণার পরেই আগন্তুক আমাকে আলগোছে জিগেস করলো, ‘তোমার কোনো বন্ধু আছে কি?’

‘বন্ধু? অনেক আছে৷’

‘অনেক না—একজন, এক বন্ধু, অনন্য বন্ধু, প্রাণের বন্ধু৷ সবসময় থাকো যার সঙ্গে—কাজে, খেলায়, দুঃখে, আনন্দে, চিন্তায়৷ যাকে একবেলা না দেখলে নিজের অস্তিত্ব অর্থহীন মনে হয়৷’

‘এমন বন্ধুতা হয় নাকি কখনো—মধ্যযুগের কাহিনীতে ছাড়া?’

‘হয় না? আমি বলছি, হয়৷ আমার ছিলো তেমনি এক বন্ধু৷ তার নাম ছিলো বিনয়েন্দ্র৷ আমার সহপাঠী, আমার প্রতিযোগী, আমার চিরসঙ্গী৷ কলেজে যতগুলো পরীক্ষা হয়—আর জানো তো, মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার চাপ অনেক বেশি৷ কোনোবার সে ফার্স্ট, আমি সেকেন্ড—আর কোনোবার আমি ফার্স্ট, সে সেকেন্ড৷ এর কোনো নড়চড় হয়নি কখনো৷ ক্লাসে আমরা পাশাপাশি বসি, হাসপাতালে কাজ করি একসঙ্গে, একসঙ্গে বেড়াই, ছুটির দিনে একসঙ্গে যাই চন্দননগরের বাগানে, মাছ ধরি, খিচুড়ি রাঁধি, শীতের বিকেলে গাছের তলায় বসে বসে ওথেলো কিংবা ম্যাকবেথ আওড়াই৷

‘একটা বিষয়ে শুধু তফাত ছিলো ওর সঙ্গে আমার বিনয়ের হৃদয় ছিলো মেয়েদের মতো কোমল, আর আমি ছিলাম কোনো-কোনো বিষয়ে পাথরে গড়া৷ কষ্ট, আর্তনাদ, মৃত্যু—এ সব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার আমার পক্ষে ছিল কৌতূহলের বা গবেষণার বিষয়, কিন্তু রোগীর যন্ত্রণা দেখে বিনয়ের চোখে জল আসে, মৃত্যুর দৃশ্যে মুখ করুণ হয়ে যায়৷ এ-নিয়ে আমি অনেক ঠাট্টা করেছি তাকে৷

‘আর একটা বিষয়ে তফাত ছিল৷

‘আমি, শ্রীশিবশঙ্কর চৌধুরী, কলকাতার বনেদী বাড়ির দুলাল, আর বিনয় ছিল গরিবের ছেলে৷ জোড়াবাগানে তিন-পুরুষের বাড়ি আমাদের, তার দেউড়িতে দারোয়ান, আস্তাবলে জুড়িগাড়ি৷ আর বিনয় বীরভূম জেলার বিধবা মায়ের ছেলে, থাকে বউবাজারের মেস-এ৷ তার পড়া-খরচ চালাতে লাটে উঠেছে দেশের ছিটেফোঁটা জমিজমা, মা-র দু-চারটি গয়না গলে যাচ্ছে৷ এ-সব কথা তারই কাছে শুনতাম, কিছুই সে লুকোত না আমার কাছে, তাহলে কি আর বন্ধুতা হয়?

‘খুব বেশিদিন মানুষের সংসারে আমি ছিলাম না৷ কিন্তু যদি একশো বছর বেঁচে থাকার মতো ভাগ্য আমার হত, তাহলেও আমি জানি, বিনয়ের মতো নির্মল চরিত্রের মানুষ আর একটিও দেখতাম না৷ এমন সহজভাবে, চেষ্টাহীনভাবে, অনলসভাবে ভালো ছিলো বিনয়! তার উচ্চাশায় লুব্ধতা নেই, আত্মসম্মানে দম্ভ নেই, তার স্বাবলম্বিতা ভালোবাসাকে অপমান করে না৷ আমি পারি এক পলকে তার সব অভাব মিটিয়ে দিতে, পারি তাকে আমারই বাড়িতে আমারই মতো আরামে রাখতে, আর—কী বোকা আমি! —প্রথম-প্রথম ও-রকম কথা বলেছি তাকে, কান পাতেনি বলে অভিমান করেছি৷

‘শেষে একদিন বললো, ‘‘আমি যদি তোমাদের বাড়িতে থাকি, তাহলে তুমি তোমার বাড়ির কাছে ছোট হয়ে যাবে৷ আর তুমি যাতে ছোট হয়ে যাবে তেমন কাজ তুমি বললেও আমি করতে পারি না৷’’ হাসিমুখে বলেছে কথাটা, অথচ গম্ভীরভাবেই৷ গম্ভীর হলে কালো দেখায় না তাকে, হাসলে হালকা মনে হয় না৷ প্রায় সব কথাতেই সায় দেয়, আর যখন ‘না’ বলে তাও যেন পালকের মতো নরম, তবু গলার সুরে বুঝিয়ে দেয় যে ‘না’ মানে সত্যি ‘না’৷ এমনি মানুষ ছিল বিনয়, আমার বন্ধু সে৷

‘প্রায় সে আসে আমাদের বাড়িতে৷ মা যখন আমাদের দু-জনকে পাশাপাশি বসিয়ে খাওয়ান খুব আনন্দ করেই খায় ও ষষ্ঠীতে আর পুজোর সময় মা যে কাপড় দেন নেয় মাথা পেতে তা কিন্তু এটুকুর বেশি যদি আর-কিছু করতে চেয়েছি তার জন্য, তাহলে নিজের ভুলের জন্য নিজেকেই লজ্জা পেতে হয়েছে৷ আর সত্যিও—তার জন্য কিছু ‘করা’র প্রশ্ন যেন অবান্তর, নিজের মধ্যে এমন সম্পূর্ণ, এমন আত্মস্থ ও অনাবিল ছেলে বিনয়৷ দরকার-মতো আমার বই নিয়ে পড়তে তার কুণ্ঠা নেই, কিন্তু আমার কোনো শৌখিন জামা একদিনও পরাতে পারিনি তাকে৷ কম খরচে পরিচ্ছন্ন থাকার উপায় সে জানে, ভালো পুরোনো বই সস্তায় যোগাড় করতে সে ওস্তাদ৷ তার কখনো অসুখ করলেও আমার একটা সুযোগ হত, কিন্তু তার ছিপছিপে মজবুত শরীরে সর্দিরও প্রবেশের অধিকার ছিলো না৷ বরং আমারই নিউমোনিয়ার সময় রাত জেগে শুশ্রূষা করেছিলো সে৷

‘অতএব আমার দিক থেকেই চেষ্টা করলাম তার সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনতে৷ মেডিকেল কলেজে বাবুগিরিটাই রেওয়াজ ছিল তখন, ছেলেরা সবাই সেন্ট মাখে, ডবল আস্তিনের বিলেতি কামিজ গায়ে দেয়, শীতকালে পশমী কোট, রেশমী মাফলার, ব্লেজার পরে টেনিস খেলতে যায়৷ ক্রমে বিলাসিতা কমিয়ে আনলাম৷ বাড়ির গাড়ি পারতপক্ষে চড়ি না, বিনয়ের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে বেড়াই, দূরে যেতে হলে ভাড়া-গাড়ি নিই৷ রাত্রে মাঝে মাঝে বিনয়ের মেস-এ খেয়ে বাড়ি ফিরি, কখনো বা রাত্তির দুটো অবধি তার তক্তায় বসে ফিজিওলজির মর্মোদ্ধার করি৷ এমন আস্তে আস্তে, স্বাভাবিকভাবে অভ্যেসগুলো বদলেছিলাম যে বাড়ির কেউ তা লক্ষ্য করতে পারেনি৷ বিনয় হয়তো বুঝেছিলো, কিন্তু আমাকে বুঝতে দেয়নি যে সে বুঝেছে৷ সবই সহজভাবে নিয়েছে সে, আর আমিও তাই সহজ হতে পেরেছি৷ এমনি করে ছ’বছর কাটলো, কাছে এল ফাইনাল পরীক্ষা৷

‘কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ও’ব্রায়েন৷ নিম্নতম জমাদার থেকে উচ্চতম প্রোফেসর পর্যন্ত সবাই তাঁর নাম দিয়েছিলো পাগলা সাহেব৷

‘এই ও’ব্রায়েন আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার তিন মাস আসে এক অদ্ভুত বিজ্ঞাপন দিলেন৷ জানালেন, এই পরীক্ষায় যে ছাত্র ফার্স্ট হবে তাকে তিনি নিজে স্কলারশিপ দিয়ে চার বছরের জন্য এডিনবরায় পাঠাবেন, আর সেখানে পড়াশুনো ভালো করলে আরো এক বছর জার্মানিতে৷ শোনা গেল, পরের বছর তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন—আর ফিরবেন না, যাবার আগে ভারতের জন্য এটুকু তিনি করতে চান৷

‘খবরটা বেরোনোমাত্র সারা কলেজে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেলো কে পাবে এই স্কলারশিপ? বিনয়েন্দ্র না শিবশঙ্কর? তৃতীয় নাম ভুলেও উচ্চারিত হয় না, কিন্তু দু-জনের মধ্যে একজনের বিষয়ে কখনোই নিশ্চিন্ত হতে পারে না কেউ৷ দেখা গেলো, ঘোড়দৌড়ের মতো উত্তেজনা, ভারি মজা৷ কেউ এসে আমাকে বলে—আমাকে ডুবিয়ো না শঙ্কর, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বাজি রেখেছি ভূতনাথের সঙ্গে৷ আর অন্য কেউ পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে চেঁচিয়ে ওঠে—বিনয়, ঠিক আছ তো? দেবেনের রূপোর ছড়িটা জিতিয়ে দেবে তো আমাকে?

‘কিন্তু যে দু’জনকে নিয়ে এত কথা তাদের ওপর এর ফল কিছুই বোঝা গেল না৷ যেমন আগে ছিলো এখনো তেমনি রইলো আমাদের বন্ধুতা৷ বন্ধু, অবিচ্ছেদ্য, নিরন্তর৷— কিন্তু মনে মনে এ নিয়ে যে আমি ভাবিনি তাও নয়৷’

একটানা অনেকক্ষণ কথা বলার পর একটু জিরিয়ে নিয়ে আগন্তুক আবার আরম্ভ করলো : ‘শোনো এবার মন দিয়ে, বিনয়ের আর আমার কথাবার্তাগুলো৷ বন্ধুর কথাগুলো অবশ্য আমিই শোনাব তোমাকে৷

‘একদিন আমি তাকে বললাম—ও’ব্রায়েন এই এক মজার ফন্দি করেছে, তোমার আমার ছাড়াছাড়ি ঘটাবার৷

—বিনয় বললো, সে আর ক-দিনের জন্য!

—পাঁচ বছর, কম কী? ততদিনে কত-কিছু বদলে যেতে পারে৷

—তুমি কি বিলেতে যেতে চাও না?

—চাই না তা নয়, কিন্তু এখনই চাই না৷

—বিলেতে তো যেতেই হবে৷ তাড়াতাড়ি সেরে নিতে পারলে মন্দ কী৷

—যেতেই হবে কেন?

—বিলেতে না গিয়ে কেউ তো বড় হয়নি, আমাদের দেশে৷

—কেন, বিদ্যাসাগর? বঙ্কিমচন্দ্র?

—তাঁদের কথা আলাদা৷ তাঁরা সরস্বতীর বরপুত্র, আর আমরা হিপক্রেটিস-এর বংশধর৷ ভালো ডাক্তার হতে হলে বিলেতে যাওয়াই চাই৷

—তা তুমি যা-ই বলো এই মেডিকেল কলেজের ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে৷ আর একটা কথা মনে এনেও মুখে বললাম না, বিনয়কে ছেড়ে অত দূর দেশে যেতে হবে সে কথা ভাবতে ভালো লাগে না আমার৷

আগন্তুক বলতে লাগলো, আমি পরীক্ষার জন্য তৈরিও হচ্ছি আর এই কথাটা নিয়ে তোলপাড়ও করছি মনে মনে৷ শেষে একদিন লজ্জা কাটিয়ে বললাম—বিনয়, আমি যত ভাবছি ততই মনে হচ্ছে তোমাকে ছেড়ে বিলেতে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব৷

হয়তো একটু অভিমানের সুর ছিলো আমার কথায়৷ বিনয় যদিও মুখে কিছু বলেনি, আমি বুঝেছিলাম যে এ-বিষয়ে তার মনের ভাব ঠিক আমার মতো নয়৷ বিলেতে সে যেতে চায়৷ বন্ধুকে ছেড়ে যাওয়া, বিধবা মাকে ছেড়ে যাওয়া—এ সব কষ্ট সেখানে বড় হয়ে ওঠে না তার কাছে৷ সেটাই ঠিক, সেটাই স্বাভাবিক, আমার এই দুর্বলতাটাই দোষের—সব বুঝেও মনে মনে আমি ঈষৎ ব্যথিত হই৷

বিনয় বললো—এ সব ভেবে এখন সময় নষ্ট করা কি ভালো? পরীক্ষা এসে গেছে৷ মনকে তৈরি করে ফ্যালো বিলেতে যাবার জন্য, আর ঠেসে পড়ো৷ আর-কিছু ভাবতে হবে না৷

—আমি বললাম—বিনয়, আমার একটা প্রস্তাব আছে৷

—বলো৷

—আমি যদি স্কলারশিপ পাই, তুমিও আমারই সঙ্গে একই জাহাজে বিলেতে যাবে? এডিনবরায়? খরচ আমি যে করে হয় দেব৷

বিনয় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল—তা হতে পারে না৷

—কেন পারে না? আমি চাইলেই বাবা আমাকে ধার দেবেন৷

—তিনি হয়তো দান দিতেও পারেন৷ কিন্তু—

আমি তার চোখের দিকে তাকালাম৷ সে-চোখ কালো আর গভীর আর শান্ত৷ আমার মনের কথাটা গলা ছিঁড়ে বেরিয়ে এল এতক্ষণে—এত কম ভালোবাসো আমাকে৷

—এত বেশি ভালোবাসি তোমাকে৷…থাক, এ নিয়ে আর—

একটু চুপ করে থেকে আমি আবার বললাম—আমি এ-বছর পরীক্ষা দেব না, বিনয়৷

আমার চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিনয় বললো—কী বোকার মতো কথা বলছ তুমি!

জানতাম না, তখন কী সর্বনাশের বীজ আমি বপন করেছিলাম৷

পুজোর ছুটিতে বিনয় মা-র কাছে গেলো, আমি বাড়ির হট্টগোল এড়াবার জন্য বই-খাতা নিয়ে চন্দননগরের বাগানে আশ্রয় নিলাম৷ স্থির করলাম, একেবারে কালীপুজো কাটিয়ে ফিরব, কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর আগেই বাড়ির ব্যাপারে একদিন আসতে হল৷ বিকেলবেলা কলেজের লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি, বিনয় সেখানে বসে আছে৷

তাকে দেখে আমার বুকের ওপর হাতুড়ি পড়লো৷ কথা ছিলো, লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন সে দেশ থেকে ফিরবে৷ চন্দননগর স্টেশনে নেমে সোজা আসবে আমার কাছে, কালীপুজো পর্যন্ত সেখানেই থাকব আমরা, তারপর একসঙ্গে ফিরব কলকাতায়৷

বিনয় খুব নিবিষ্ট হয়ে পড়ছিলো, আমাকে দেখতে পায়নি৷ আমি নিঃশব্দে তার কাছে গিয়ে খুব আস্তে পিঠের ওপর হাত রাখলাম৷ হয়তো আমার কল্পনা, কিন্তু আমার মনে হল, মুখ তুলে আমাকে দেখে মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেলো সে৷ জিগেস করলাম—কী ব্যাপার, কখন এলে? চন্দননগরে যাওনি যে?

বিনয় বললো—সঙ্গে আমার এক খুড়ো এলেন, তিনি আগে কখনো কলকাতায় আসেননি৷ প্রথমে তাঁকে নিয়ে মেস-এ তুলতে হল৷ কাল কালীঘাট দেখিয়ে পরশু সকালে হাওড়ায় তাঁকে ট্রেনে তুলে দেব, আর আমিও সেই ট্রেনে—

—আসছ তো বাগানে?

—হ্যাঁ, আসব৷

দু-জনে ফিরে এলাম লাইব্রেরিতে৷ বিনয়ের পাশের জায়গা খালি ছিলো না, আমি একই টেবিলে একটু দূরে বসলাম৷ আমার সামনে অ্যানেস্থেটিক্স-এর বই, কিন্তু আমার চোখ বারে-বারে বিনয়ের মুখের ওপর পড়ছে, আর বারে-বারে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি৷ হঠাৎ এক বিষাদ নেমেছে আমার মনের ওপর কেন এই বিষাদ, তাও জানি না৷ দেখছিলাম, বিনয় তার বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছে, মাঝে মাঝে নোট নিচ্ছে খাতায়৷

আমার কিছু পড়া হল না শুধু সামনে বই খুলে বসে থাকলাম, বিনয়ের পড়া শেষ হবার অপেক্ষায়৷ প্রায় দু-ঘণ্টা পরে বই বন্ধ করলো বিনয়৷ যেন হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে ইশারা করল৷ একসঙ্গে বেরোলাম দু-জনে, কিন্তু—আশ্চর্যের বিষয়—দু-জনেই চুপ৷ বাইরে তখন কার্তিকের সন্ধ্যা, আকাশে রং নেই, বাতাস শিরশিরে ঠাণ্ডা৷ কলেজের গেট পর্যন্ত এসে আমি দাঁড়ালাম৷ জিগেস করলাম—কোথায় যাবে এখন?

—মেস-এ ফিরব৷

—আমাকে একবার যেতে হবে দিদির বাড়ি৷ আটটা নাগাদ ফিরব৷ এসো তখন৷

—আজ তো পারব না৷

—তবে কাল সকালে?

—কাল খুড়োকে নিয়ে ব্যস্ত থাকব৷ পরশু সকালে আটটা-কুড়িতে সিউড়ির গাড়ি৷ তুমি কি—

—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷ আমি ঐ একই ট্রেনে যাব৷ কিন্তু কাল কি সারাদিনই তুমি খুড়োকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে? না-হয় আমিও বেরোব তোমার সঙ্গে—কী বলো?

বিনয় চোখ নামিয়ে নিলো৷ আর তার সেই ভঙ্গিটা ছুরির মতো বিঁধলো আমাকে৷ মনের কথা আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না তার হাত চেপে ধরে বলে উঠলাম—বিনয়, তোমার কি হয়েছে?

—কিছু তো হয়নি৷ বিনয় হাসলো, কিন্তু সে-হাসিও ম্লান৷

—নিশ্চয় কিছু হয়েছে৷ কোনো অসুখ?

—অসুখ কেন করবে?

—দেশের বাড়িতে কোনো বিপদ?

—কিছু না৷

—তাহলে তুমি মনে মনে ভাবছো? বিনয় চুপ৷

—বলো! আমাকে বলো! বলতেই হবে আমাকে!

বিনয় আস্তে আস্তে আমার হাত ছাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো—তোমার কথাই ভাবছি, কত ভাগ্যে তোমার মতো বন্ধু পাওয়া যায়৷

এ-কথা শুনে আমি গলে জল হয়ে গেলাম৷

এবারে সে বললো—চলো আমাকে এগিয়ে দেবে একটু৷

হাঁটতে হাঁটতে একটি ছোট আলোচনা হল তার সঙ্গে৷ এবার দেশে গিয়ে তার মনে হয়েছে—আগেও হয়নি তা নয়—যে ডাক্তারি পেশা সবচেয়ে যেখানে সার্থক হতে পারে সে হল বাংলা দেশের গ্রাম৷ কলকাতা শহরে—যেখানে বড় ডাক্তার অনেকেই আছেন— সেখানে আর-একজন বড় ডাক্তার হয়ে বসাটা তার পক্ষে কি এতই জরুরি, যখন তারই গ্রাম উচ্ছন্নে যাচ্ছে ম্যালেরিয়ায়, ডিসেন্ট্রিতে, কুসংস্কারে, অশিক্ষায়? তার তো মনে হচ্ছে ওখানেই তার স্থান—যদি পারে মানুষগুলোকে বাঁচাতে—শুধু স্বাস্থ্য দিয়ে নয়, জ্ঞান দিয়েও৷

বিনয়ের কথা শুনে আমার হাসি পেলো৷

—বিলেত থেকে ফিরে পাড়াগাঁয়ে মন টিকবে কি তোমার?

ততক্ষণে তার মেস-এর দরজায় এসে পড়েছি আমরা৷ আমার প্রশ্নটার কোনো জবাব না দিয়ে বললো—তাহলে পরশু দেখা হচ্ছে হাওড়ায়?

—সে তো হচ্ছে, কিন্তু কালও এসো একবার৷ যে-কোনো সময়ে৷

আমি হালকা মনে দিদির বাড়ি গেলাম, কিন্তু পরের দিন সত্যি যখন সারাদিনেও বিনয় একবার এল না, রাত্রে আবার মেঘ করে এল আমার মনে৷ ওর কিছু হয়েছে, যা লুকিয়ে রাখছে আমার কাছ থেকে? কেমন যেন আনমনা আনমনা? তা নয় তো কী৷ আগের দিনের সমস্ত ঘটনা ভেসে উঠল আমার মনে লাইব্রেরিতে আমাকে দেখে চমকে ওঠা, পড়তে পড়তে একবারও না তাকানো, আমার কথার উত্তরে চোখ নামিয়ে নেয়া৷ না, না, এটা তার স্বাভাবিক অবস্থা নয়, নিশ্চয়ই কোনো গোপন দুশ্চিন্তায় সে কষ্ট পাচ্ছে৷ কী? ওর অসুখ? ওর মা-র? জমিদারের খাজনা বাকি পড়েছে? বসতবাড়ি নিয়ে টানাটানি? নাকি কোনো বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছে গোপনে? যদি কিছু হয়ে থাকে আমাকে বলছে না কেন? আমাকে বলতে পারে না এমন কিছু আছে নাকি ওর? নাকি সবই আমার কল্পনা?

এই সব ভাবতে ভাবতে অনেক রাত্রে ঘুম এলো৷ আ—সেই ঘুমিয়ে পড়ার সুখ! ভাবনাগুলো যেন পরস্পর গলে যায়, শান্তি নামে কালো হয়ে৷—কিন্তু তুমি ঘুমিয়ে পড়লে না তো? শুনছো?

সুকুমার সাড়া দিল, শুনছি৷ তারপর?

আগন্তুক আবার বলতে লাগল, পরের দিন হাওড়া থেকে গাড়ি ছাড়ল৷ প্যাসেঞ্জার গাড়ি, থার্ড ক্লাস কামরা, ছুটির পরে বেজায় ভিড় হয়েছে৷ বিনয়ের আধ-বুড়ো খুড়োকে কোনোরকমে বসিয়ে আমরা দু-জনে দরজার ধারে দাঁড়ালাম৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চলে যাওয়া যাবে৷

ভিড়, গোলমাল, ট্রেনের শব্দে কথা বলার সুবিধে নেই, কিন্তু চলতি ট্রেনে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে আমার৷ ওকে দেখতেই ভালো লাগছে৷ আজ সকালে ওর মুখে কোনো মালিন্য নেই, চোখ উজ্জ্বল, ঠোঁটের কোণে হাসি৷ একের পর এক সরে যাওয়া টেলিগ্রাফের তারগুলো দেখতে দেখতে আমার কালকের সব দুর্ভাবনা যেন বাষ্পের মতো মিলিয়ে গেলো৷

লিলুয়ার পরে ট্রেন যখন বেশ স্পিড নিয়েছে, বিনয় তখন বললো—দরজাটা খটখট করছে কেন? ভালো বন্ধ নেই?

আমি উদাসভাবে বললাম—ঠিকই আছে৷

—নাঃ, ঠিক মনে হচ্ছে না৷ একটু সরো তো৷ বাইরে হাত বাড়িয়ে হুড়কোটা আঁট করতে গেলো বিনয়, আর হঠাৎ আমি কানের মধ্যে শোঁ-শোঁ হাওয়ার আওয়াজ পেলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে তার জোরালো হাত জড়িয়ে ধরলো আমাকে৷

—আঃ! ও-রকম করে দাঁড়াতে হয় কখনো? তুমি কী!

আমি তাকিয়ে দেখলাম বিনয়ের মুখে আর রং নেই, ঠোঁট কাঁপছে, আর গাড়ির খোলা দরজাটা ঠকাশ-ঠকাশ করছে হাওয়ায়৷

—ও-রকম দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াতে হয় কখনো! ধমক দিয়ে উঠলো বিনয়—সরো! সরে দাঁড়াও!

আমাকে ছেড়ে দিয়ে ভালো করে এঁটে দিলো দরজাটা৷ বাকি পথ দরজাটা আগলে রইলো যেন—যাতে আমি কাছে ঘেঁষতে না পারি৷ তার অতি-সাবধানতায় আমার হাসি পেলো৷

চন্দননগরে চমৎকার কাটলো দিনগুলি, একটু চুপ করে থেকে আবার আরম্ভ করলো আগন্তুক৷ ‘একসঙ্গে পড়া, খাওয়া, বেড়ানো, একই সময়ে ঘুমিয়ে পড়া আর জেগে ওঠা৷ বাগানে স্থলপদ্ম, নদীতে ভরা জল, বাঁধানো বটতলায় ছায়া, বিকেলে মাঝে মাঝে ব্যাডমিন্টন৷ যেমন ছ-বছর ধরে হয়েছে, তেমনি করেই পরস্পরের সাহায্যে হু-হু করে এগিয়ে গেলো আমাদের পরীক্ষার পড়া৷

তবু মাঝে মাঝে হঠাৎ যেন কেমন হয়ে যায় বিনয়৷ পড়া বন্ধ করে উঠে গিয়ে পাইচারি করে বাগানে, বটতলায় চুপচাপ বসে থাকে, নয়ত দূরে ঘোষালের ঘাটে চলে যায়—আমি তাকে খুঁজে বের করি৷

—কী হয়েছে তোমার? বলো না, কী হয়েছে?

বিনয়ের সেই এক উত্তর—কিছু তো হয়নি৷ যত চেষ্টা করি, কিছুতেই সেই পর্দা সরে না৷ পর্দা নয়, দেয়াল৷ আর সেই দেয়ালে মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করে আমার৷ কিন্তু পরের দিন সে যখন আবার হাসে, সব ভুলে যাই৷

সারাদিন ধরে পড়ে বিকেলের দিকে মাথা যেন ঝিমঝিম করে, মাঝে মাঝে নদীতে বেড়াতে যাই৷ বাবা একটা বিলিতি শ্যালপ আনিয়েছিলেন, যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি বাইতে আরাম৷ একদিন সূর্যাস্তের সময় চলেছি দু-জনে নদীর জলে সোনা, মস্ত উঁচু আকাশ, জগৎ জুড়ে শান্তি৷ খেয়াল ছিলো না, কত দূরে চলে এসেছি৷ বিনয় মনে করিয়ে দিলো—এবার ফেরো, শঙ্কর৷ অনেকখানি এসে পড়েছি আমরা আজকে৷

আমি বললাম—এবার তুমি বাইবে৷

বিনয় দাঁড় হাতে নিলো, আমি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম৷ তারা-ফোটা আকাশের তলায় ঠাণ্ডা বাতাসে, জলের ছলছল শব্দে, আমার মনে ঘুমের মতো আবেশ নামলো৷ হঠাৎ কী-রকম একটা শব্দে চমকে উঠে বসলাম৷ অন্ধকার, দূরে মিটমিট করছে আলো, কালো আকাশে ভরে ঝকঝকে তারা৷ আর শোঁ-শোঁ একটা শব্দ৷ আর সেই শব্দের ফাঁকে ফাঁকে বিনয়ের বড়-বড় ভারি নিঃশ্বাস৷

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম—বিনয়!

—কিছু ভয় নেই৷ দাঁড় ধরো ওদিকে৷

—আমাকে আগে ডাকলে না কেন? এসে গেলো যে! বলতে বলতে হালকা শ্যালপ দুলে উঠল, গর্জনে ভরে গেলো আমার কান৷ চারদিকে জল—অন্ধকার—নিঃশ্বাস নেই—তারপর দুখানা সবল হাত বেষ্টন করলো আমাকে, পাটাতনে শুয়ে হাঁপাতে লাগলাম৷

ফিরে এলাম যখন, তখন রাত প্রায় ন-টা রামরতন লণ্ঠন নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে৷ সে কিছু লক্ষ্য করার আগেই তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ভিজে জামা-কাপড় ছেড়ে নিলাম দুজনে৷ গরম-গরম লুচি আর মাংস খাবার পরে দেহের তেজ ফিরে এল৷ হেসে বললাম—খুব একটা অ্যাডভেঞ্চার হল আজ৷

—হুঁ৷

—আমারই ভুল৷ আমারই জানা উচিত ছিলো আজ অমাবস্যা, বান আসবে৷

—এখন ভালো বোধ করছ তো?

—আমার কিছুই হয়নি৷ জানো তো, এই বানের ওপর দিয়ে কতবার সাঁতরে গেছি আমি৷ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলেই—আর একেবারে হঠাৎ—৷ তোমারই কত কষ্ট হল৷ কতক্ষণ একলা উজান বাইলে৷

বিনয় খুব নিচু গলায় বললো—আজ আর কথা না৷ ঘুমিয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি৷

এর পর যে-ক’দিন বাগানে ছিলাম, বিনয় আনন্দে উৎসাহে সাহচর্যে একেবারে ভরে রাখলো আমাকে৷ কালীপুজোর দিন কলকাতায় ফিরে এলাম দুজনে৷

আর এক মাস—আর কুড়ি দিন—পনেরো দিন—এমনি করে করে সেই সোমবার, যার পরের সোমবার পরীক্ষা আরম্ভ৷

শেষ সপ্তাহটি একসঙ্গে রাত জেগেছি আমরা—ঠিক তুমি যেমন এখন রাত জেগে পড়ছো৷ মা আর-একটা খাট আনিয়ে দিয়েছেন আমার ঘরে, দেয়াল ঘেঁষে কঙ্কাল, কাচের আলমারিতে মড়ার খুলি, হাড়ের টুকরো, টেবিলে মোটা মোটা বই-খাতা, অঙ্কের আর ল্যাটিন ভাষার হিজিবিজি৷ বারান্দায় রামরতন শোয়, তোলা উনুনে কাঠকয়লা জ্বলে, আমাদের দরকারমতো গরম চা তৈরি করে এনে দেয়৷

শুক্রবার রাত্রে আমি বললাম—বিনয়, আমার মনে হচ্ছে, তুমি আর আমি ব্র্যাকেটে ফার্স্ট হব৷ ডবল খরচ হবে ও-ব্রায়েন সাহেবের৷

বিনয়ের মুখে ছায়া পড়লো৷ ভুরু কুঁচকে বললো, তা কি আর হবে৷ দু-চার নম্বরের হলেও তফাত থাকবেই৷

—আর সে-তফাত তোমার দিকেই থাকবে৷ আমি হাসলাম৷ বিনয় বইয়ের ওপর চোখ নামিয়ে নিল৷

সে-রাত্রে বারোটায় যখন আমাদের জন্য চা এল, বিনয় পকেট থেকে একটি পুরিয়া বের করে তাতে একরকম সাদা গুঁড়ো মিশিয়ে নিলো৷ বললো—ঘুম তাড়াবার ওষুধ৷

—তোমারও তাহলে ঘুম পায়?

—আজ পাচ্ছে৷

—ঘুমের আর দোষ কী! ও-রকম রাতের পর রাত না-ঘুমিয়ে—সত্যি! থাক আজ, বরং ঘুমোই এসো৷

—কিন্তু এখন তো আর চার ঘণ্টার মধ্যে ঘুম পাবে না আমার৷

—তাহলে আমাকেও একটু দাও ওষুধটা৷

—নেবে? বিনয় পকেটে হাত দিলো৷ হঠাৎ কেমন সাদা দেখালো তাকে৷ পকেট থেকে যখন হাত বের করলো, আমার মনে হল তার আঙুল কাঁপছে৷

তার সাদা গুঁড়ো আমার চায়ে মিলিয়ে গেলো, আস্তে আস্তে দুজনে চা শেষ করলাম৷ টেবিলের দু-দিকে বসে আছি দুজনে, মাঝখানে প্যাথলজির বই খোলা৷ সে পড়ে যাচ্ছে, বুঝিয়ে বলছে, আমি শুনছি৷ মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছে আমাকে, আমি ঠিক-ঠিক জবাব দিয়ে যাচ্ছি৷ আবার খানিক পরে আমি জেরা করছি তাকে৷ এমনি চলতে চলতে হঠাৎ এক সময় বইয়ের পাতা ঝাপসা হয়ে এল আমার চোখে, আর সেই মুহূর্তে মনে হল বিনয়ের আর বইতে মন নেই, সে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ আস্তে আস্তে তার মুখটা বিকট হয়ে উঠল—চোখ গর্ত, গালে মাংস নেই, মাথার চাঁদি উঠে গেছে—ঠোঁট, নাক, দাঁতের বদলে সারা মুখ জুড়ে এক নিঃশব্দ বিদ্রূপ৷ প্রায় একটা ভয় ছড়িয়ে পড়ছিলো আমার স্নায়ুতে, কিন্তু তখনি পা-টা মেঝেতে ঠুকে গেলো, চমকে জেগে উঠলাম৷

—তোমার ওষুধে তেমন কাজ হল না, বিনয়৷ এর মধ্যে স্বপ্ন দেখেও উঠলাম৷

—কী স্বপ্ন দেখলে?

—ঐ কাঠের আলমারির কঙ্কালটা আমাকে তাড়া করেছে৷ আমি হাসলাম৷ ছ-বছর ডাক্তারি পড়ার পর এখন যদি ভূতের ভয় ধরে—

—তোমাকে অল্প দিয়েছিলাম৷ আচ্ছা, কাল হেভি ডোজ আনব৷

—তা-ই এনো৷ কিন্তু রোববারে আর রাত জাগব না কিন্তু৷

—না, রোববারে আর না! অদ্ভুত মোটা শোনালো বিনয়ের গলা৷

শনিবার৷ স্তব্ধ রাত, সারা বাড়ি ঘুমন্ত, সে আর আমি ছাড়া কেউ কোথাও জেগে নেই৷ দুজনের এক জ্ঞান, এক ধ্যান, এক লক্ষ্য৷ শুধু বন্ধু নয়, সত্যি যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছি দুজনে৷ কী আনন্দ, এমনি একজনকে আমার জীবনে আমি পেয়েছি! কী আনন্দ, এমনি কোনো কঠিন কাজের মধ্যে দিয়ে কারো সঙ্গে মিলতে পারা! পড়া, পরীক্ষা, সব ছাপিয়ে এই ভাবনাই বড় হয়ে উঠল আমার মনে—আমার মন যেন হিমালয়ের চূড়াকে স্পর্শ করলো, ছড়িয়ে পড়লো তারায়-তারায়৷ হঠাৎ আমি তার কব্জিতে হাত রাখলাম৷ যেন ঝাঁকুনি খেয়ে চমকে উঠল যে৷

—কী হল?

—আমারও বোধহয় ঘুম পাচ্ছে৷

—আমি বলতে চাচ্ছিলাম—আজ আর পড়া থাক৷

—এই তো হয়ে যাবে৷ আর-একটু৷

—আমার ইচ্ছে করছে না৷ তার চেয়ে এসো রবিবাবুর কবিতা পড়ি৷ ছাতে গিয়ে বসবে?

—না৷ বরং চা হোক৷

জল চাপানোই ছিল, বিনয় দুটি ভরা পেয়ালা নিয়ে এল টেবিলে৷ পকেট থেকে দুটি পুরিয়া বের করে আলোর কাছে দেখলো একবার, নিজেরটিতে সাদা গুঁড়ো মিশিয়ে বললো—আজ আরো কড়া করেছি৷ তোমাকে দেব?

—দাও৷

অন্য পুরিয়াটি আমার পেয়ালায় ঢেলে দিয়ে, সেই পেয়ালাটার দিকেই তাকিয়ে রইলো বিনয়৷ আমি হাত বাড়ালাম কিন্তু পেয়ালাটা ছুঁতে পারলাম না, এক কঠিন আঘাত অবশ করে দিলো আমাকে৷ টকটকে লাল বিনয়ের মুখ, পেশীগুলো বিকৃত, আগুনের মতো নিঃশ্বাস৷ তাকে মুচড়ে দিয়ে একটা বোবা, ভোঁতা, পাশবিক আওয়াজ বেরিয়ে এল, আমার পেয়ালাটা হাতে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে ফেললো৷

সে দাঁড়িয়েই ছিলো, আমার সময়ের কোনো জ্ঞান ছিল না৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছের মতো পড়ে যেতে দেখলাম তাকে, চেয়ার উল্টে গেলো, টেবিল কেঁপে উঠল, কপাল ফেটে রক্ত বেরোলো তার৷

তখন আমার চিৎকারে সারা বাড়ির ঘুম ভাঙলো৷

এল বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স, আমাদের অতি প্রিয় মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে সাড়া পড়ে গেলো৷…পুলিশও এল৷ আমাকে নিয়ে গেলো হাজতে৷

মর্গের রিপোর্ট : বিষপ্রয়োগে মৃত্যু৷ আর পুলিশের হাতে তার পকেটে পাওয়া চিঠি : ‘‘যে আমাকে সবচেয়ে ভালোবাসে, আমি যাকে সবচেয়ে ভালোবাসি, সে এখন আমার সফলতার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় এবং একমাত্র অন্তরায়ও সে৷ তাকে সরাতে পারলে আমার পথ পরিষ্কার৷ তাই এই রকম একটা ষড়যন্ত্র করলাম গোপনে গোপনে৷ ভাবলাম : তাহলে আর দশ বছরের মধ্যে আমি নীলরতনের দু-নম্বর হতে পারি, কুড়ি বছরের মধ্যে আর-একজন নীলরতন ডাক্তার৷ হতে পারি নয়, হবই৷ সে ছাড়া আমার সমকক্ষ কেউ নেই৷ তাই তাকে আমি সরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি—একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার৷ ট্রেন থেকে ফেলে দিতে গিয়েছিলাম, নিজের দুর্বলতার জন্য পারিনি৷ জলে ডুবিয়ে মারতে গিয়েছিলাম, নিজের দুর্বলতার জন্য পারিনি৷ তৃতীয়বার চায়ে বিষ মিশিয়ে—সেখানেও নিজের দুর্বলতা বাধা দিলো৷ মনের মধ্যে এই পাপ নিয়ে আমি আর বাঁচতে চাই না, তার জন্য নিজের তৈরি বিষেই নিজের প্রাণ সংহার করছি৷ তার ভালো হোক৷’’

কোর্টে দাঁড়িয়ে আমি বললাম যে চিঠির কথা সত্য নয়, আমাকে বাঁচাবার জন্য সে ও-রকম লিখেছিলো৷ আসলে আমিই তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিলাম৷ আমি কোনো করুণা প্রার্থনা করি না, আমাকে যথোচিত শাস্তি দেয়া হোক৷ এখন আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা—এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা৷

বাবা বড় বড় উকিল-ব্যারিস্টার লাগালেন, কোর্টে লোক ধরে না, সারা মেডিকেল কলেজ ভেঙে পড়ে৷ ছ-মাস পরে আমি বেকসুর খালাস পেলাম : যথেষ্ট প্রমাণ কোনোদিকেই ছিল না, কিন্তু আমার বয়স দেখে জুরিদের দয়া হল৷

উৎসব পড়ে গেলো আমি যেদিন বাড়ি ফিরলাম৷ আর পরের দিনই বুক চাপড়ে কান্না৷ অবশ্য সে-কান্না আমি কানে শুনিনি, কেননা তার আগের রাত্রে একখানা ধুতির সাহায্যে আমার দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম৷

আগন্তুকের অদ্ভুত কাহিনীটি শোনার পর সুকুমার জিগেস করলো, ‘চিঠিটা বিনয় কখন লিখেছিলো?’

কিন্তু সামনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না৷ সুকুমার আবার বললো, ‘নিশ্চয়ই আগেই এনেছিলো পকেটে?’ কিন্তু কী করে আগে থেকেই জানলো কে মরবে, বা দুজনের মধ্যে একজনও মরবে কিনা? বলেই ভাবলো, কাকে বলছি কথাটা? কে এই বিনয়? আর এই শিবশঙ্করই বা কে? আবার ভাবলো, মিছিমিছি দুটো জীবন নষ্ট হল৷ দুটো ভালো জীবন৷ কিন্তু তাও তো দরকার৷ সব যদি ঠিকমতো চলবে তাহলে সাহিত্য হবে কেমন করে? ভাগ্যিস মানুষ ভুল করে৷

আলো নিবিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো সুকুমার৷ চোখ ডুবে গেলো অন্ধকারে, কানে এল বৃষ্টির শব্দ, পাতার শব্দ৷ আরাম৷ ঘন, কালো, গভীর হয়ে ঘুম নামলো তার চৈতন্যের ওপর৷ ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ভাবলো, এই পরীক্ষা ব্যাপারটা কিন্তু বড় বাজে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *