দুইয়ে পক্ষ

দুইয়ে পক্ষ

মালব্যনগরের অ্যাসাইনমেন্ট চুকিয়ে দিল্লি ফেরামাত্র প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ প্রথমা লাহিড়ীকে তাঁর সাউথ ব্লকের অফিসে তলব করে বললেন,’প্র্যাট, তোকে একবার কলকাতা যেতে হবে।’

প্রথমা বলল, ‘কেন?’

‘মাননীয় রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জির হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের নাম ডক্টর চঞ্চল দুবে। পানিহাটিতে ওঁর একটা হার্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছে। নাম ‘চঞ্চলস হসপিটাল ইন পানিহাটি’ বা ‘চিপ’। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী চন্দ্রিমা চ্যাটার্জি একটা মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সেটার পরের সংখ্যার জন্যে চঞ্চলের সাক্ষাৎকার চাইছেন।’

‘আমি সাংবাদিক নাকি?’ হেসে ফেলেছে প্রথমা।

‘ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুরোধ মানে হুকুম। ইন্টারভিউটা তোকেই নিতে হবে। তুই চিপে ফোন করে চঞ্চলের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নে। তারপর বেরিয়ে যা। একদিনের কাজ। যাবি, ইন্টারভিউ নিবি, চলে আসবি। সিম্পল ব্যাপার!’

রঞ্জিত বুঝতে পারেননি, প্রথমাও পারেনি, ইন্টারভিউ নেওয়ার মতো সিম্পল ব্যাপার থেকে কত জটিল ঘটনা ঘটে যেতে পারে…

পেনেটিতে, গঙ্গার ধারে, দশ বিঘে জমির ওপরে গড়ে উঠেছে চিপ। তিনটে পাঁচতলা হাসপাতাল বিল্ডিং ছাড়াও রয়েছে ডাক্তারদের বাংলো; সেবিকা, কর্মচারী এবং রোগীর বাড়ির লোকেদের থাকার জন্যে কোয়ার্টার। গঙ্গার শোভা, নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ দেখলে হৃদয় আপনিই ভালো থাকে।

খোদ চঞ্চলের হৃদয় এই মুহূর্তে ভালো নেই। হার্ট ব্লকের কারণে বুকে পেসমেকার বসানো হয়েছে। অনেকগুলো ফোন করার পরে সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেয়েছে প্রথমা।

সে প্রথমবার ফোন করেছিল পেসমেকার বসানোর তিনদিন আগে। সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব শুনে হাসপাতালের ‘রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার’ বা ‘আরএমও’ ডক্টর বিকাশ দত্ত ফোন কেটে দেন। দ্বিতীয় দিন ফোন ধরেন চঞ্চলের স্ত্রী গায়ত্রী। তিনি ধৈর্য ধরে সবটা শোনেন এবং অপারেশানের পরে সাক্ষাৎকারের সময় দেন। আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন।

চঞ্চল রয়েছেন নিজের বাংলোর বেডরুমে। সাধারণ খাটের বদলে শুয়ে আছেন রোগীদের জন্যে বিশেষভাবে তৈরি করা ‘রেইলড কট’ বা রেলিং লাগানো বেডে। বেডের মাথার দিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে ভাঁজ করা। পেসমেকার বসানোর পরে চঞ্চল সম্পূর্ণ সুস্থ। তবে আপাতত বেডরেস্টে আছেন। বেডের পাশে রাখা রয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, আইভি স্যালাইনের পাউচ এবং স্ট্যান্ড, কার্ডিয়াক মনিটর এবং আরও নানা জটিল যন্ত্রপাতি।

‘তোমার নাম প্রথমা, আমার পদবি দুবে। তুমি ‘এক’ আর আমি ‘দুই’। কী ইন্টারেস্টিং ব্যাপার বল তো!’ প্রাথমিক আলাপের পরে বললেন চঞ্চল।

প্রথমা মৃদু হাসল। বেডের ডানপাশে বসে থাকা বছর তেরোর কিশোরের মাথায় হাত বুলিয়ে চঞ্চল বললেন, ‘চিপ আমার প্রথম সন্তান। আর এ আমার দ্বিতীয় সন্তান। শাশ্বত।’

শাশ্বত টুকটুকে ফরসা। ভাসাভাসা চোখ, গালে সদ্য ফোটা দাড়ির আভাস, ল্যাকপ্যাকে চেহারা। বয়ঃসন্ধির চৌকাঠে পা রেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। অ্যান্টেনাওয়ালা, রেডিও হার্ডওয়্যার লাগানো ঢাউস ল্যাপটপ বেডের ডানদিকে রেখে সে ভিডিও গেম খেলছে। কিবোর্ডের ওপরে হাত চলছে বিদ্যুতের গতিতে।

বেডের বাঁ-পাশে রাখা চেয়ারে বসে স্মার্টফোনের রেকর্ডার অন করে প্রথমা। স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ বেডের বাঁ-দিকে রেখে সাক্ষাৎকার শুরু করে। ‘রাষ্ট্রপতির কার্ডিয়োলজিস্ট মানে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের এক নম্বর কার্ডিয়োলজিস্ট। এই সাফল্যের রহস্য কী?’

‘জীবনে একমিনিট সময়ও নষ্ট করিনি। জীবনের সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি।’ ক্লান্ত গলায় বললেন চঞ্চল।

সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে গলায় বিষণ্ণতার সুর? সুযোগ বুঝে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করে প্রথমা। ‘কোনও রিগ্রেট আছে নাকি?’

‘পেশাদারি জগতে প্রথম হতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। এটাই একমাত্র রিগ্রেট।’

‘আপনার স্ত্রীও কি ডাক্তার?’

‘গায়ত্রী হোমমেকার হিসেবেই হ্যাপি।’

‘ছেলের কোন ক্লাস?’

‘শাশ্বতর এখন ক্লাস সেভেন। দিনরাত ভিডিয়ো গেম খেলে হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষায় ফেল করেছে। আমি ওকে বলি ‘ভিডিয়ট’। ভিডিয়ো গেমার আর ইডিয়টের কম্বিনেশান।’

মন্তব্য শুনে বাবার দিকে রাগী চোখে তাকায় শাশ্বত। চঞ্চল বলেন, ‘ভারচুয়াল ধাষ্টামো বন্ধ করে পড়াশুনোয় মন দে। আমাদের ফ্যামিলি তিন জেনারেশানের কার্ডিয়োলজিস্ট। তোকেও কার্ডিয়োলজিস্ট হতে হবে। সামনের মাসেই মেডিক্যাল এনট্রান্সের প্রিপারেটরি কোর্সে ভরতি করে দেব।’

কিবোর্ডের ওপরে চলতে থাকা শাশ্বতর হাত মুহূর্তের জন্যে থমকায়। সে বলে, ‘দুটো কথা মনে রাখো। এক নম্বর কথা হল, ভারচুয়াল ইজ রিয়্যাল। নাম্বার টু, আমি বড় হয়ে কার্ডিয়োলজিস্ট হব না। ইন ফ্যাক্ট ডাক্তারই হব না। আমি প্রোগ্রামার হব।’

‘দু-দু’বার সাইকায়াট্রিক কাউন্সেলিং করিয়েও কোনও লাভ হল না।’ ছেলের চুল ঘেঁটে দিলেন স্নেহময় পিতা, ‘ভারচুয়ালকে কেউ রিয়্যাল বলে? অনুভূতিহীন জোম্বি তৈরি হচ্ছে একটা!’

বাবা আর ছেলের কচকচি থেকে বেরোতে পরের প্রশ্নে ঢোকে প্রথমা। ‘এত বড় হাসপাতাল সামলান কী করে?’

‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশান আমি সামলাই না। তার জন্যে মেডিক্যাল সুপারইনটেনডেন্ট ডক্টর লক্ষ্মণ মিশ্র আছে। যে আমার পেসমেকার বসিয়েছে। আমার থেকে বছর পাঁচেকের জুনিয়র।’

চঞ্চলের কথার মধ্যে ঘরে ঢুকলেন লক্ষ্মণ। ছ’ফুট লম্বা, শ্যামলা গায়ের রং, একমাথা কোঁকড়া চুল, মোটা গোঁফ। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে স্টেথোস্কোপ বার করে প্রথমাকে বললেন, ‘আপনার ইন্টারভিউয়ের কথা গায়ত্রী এক্ষুনি আমাকে বলল। আগে জানলে অ্যালাও করতাম না। আপনাকে আর সময় দেওয়া যাবে না। চঞ্চল নিডস অ্যাবসলিউট বেড রেস্ট।’

প্রথমা বলল, ‘আমার আর পাঁচ মিনিট লাগবে…’

‘আপনি স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ বেডে রেখেছেন কেন?’ ভুরু কুঁচকে বললেন লক্ষ্মণ, ‘ওগুলো সরান।’

‘সরি!’ বিছানা থেকে যন্ত্র সরিয়ে প্রথমা ভাবে, শাশ্বতর কম্পিউটার বিছানায় থাকলে অসুবিধে নেই। আমার স্মার্টফোন থাকলেই দোষ?

পালস দেখে, প্রেশার মেপে লক্ষ্মণ বললেন, ‘সব প্যারামিটার স্টেবল আছে। চঞ্চল, তোমার কিছু লাগবে?’

‘চাঁদুকে পাঠিয়ে দাও। ওষুধ খাব।’ বললেন চঞ্চল।

‘আমি এখানেই আছি স্যার।’ প্রথমাকে চমকে দিয়ে বেডের পিছন থেকে উঠে দাঁড়াল বছর পঁচিশের এক যুবক। সে মেঝেতে চাদর পেতে শুয়েছিল। তার উপস্থিতি এতক্ষণে টের পাওয়া গেল।

চঞ্চল প্রথমাকে বললেন, ‘চাঁদু আমার ড্রাইভার কাম পারসোনাল সেক্রেটারি। টু-ইন-ওয়ান। চাঁদু, ওষুধ দে।’

লক্ষ্মণ বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললেন, ‘তোমার ইন্টারভিউ শেষ হলে গায়ত্রী খাবার নিয়ে আসবে।’

‘খাবার না পিণ্ডি! যত্তোসব ন্যাকামো!’ স্বগতোক্তি করেন চঞ্চল।

বউয়ের ওপরে এত রাগ কেন? ঝগড়া হয়েছে নাকি? ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক না গলিয়ে প্রথমা বলল, ‘কবে থেকে পুরো দমে প্র্যাকটিস শুরু করছেন?’

‘সবে গতকাল সন্ধেবেলা আইসিসিইউ থেকে ছাড়া পেয়েছি। এখন দুটো দিন রেস্ট নেব।’ বুকের বাঁ-দিকে হাত বোলাচ্ছেন চঞ্চল।

‘এই নিন ওষুধ,’ চঞ্চলের হাতে ট্যাবলেট আর জলের গেলাস তুলে দিয়েছে চাঁদু। ট্যাবলেট মুখে ফেলে এক ঢোঁক জল খেয়ে গেলাস ফেরত দেন চঞ্চল। চাঁদু জিজ্ঞাসা করে, ‘দেবীমাতার ক্যাপসুলটা দেব?’

‘ওর ক্যাপসুল আমি আর খাব না!’ ঘাড় নাড়েন চঞ্চল।

দেবীমাতার নাম শুনে প্রথমা ভাবে, কার্ডিয়োলজিস্টেরও গুরুমা আছেন? তার চিন্তার মধ্যে চঞ্চল বুকের বাঁদিকে মালিশ করতে করতে বললেন, ‘চাঁদু, লক্ষ্মণকে ডাক।’

‘কী হল?’ প্রথমা উৎকণ্ঠিত। চঞ্চল কুলকুল করে ঘামছেন। মুখ ফ্যাকাশে, শ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে।

চাঁদু চিৎকার করে বলল, ‘স্যারের শরীর খারাপ লাগছে!’

চিৎকার শুনে দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন লক্ষ্মণ আর গায়ত্রী। বছর চল্লিশের গায়ত্রীকে মা-মা দেখতে। টুকটুকে ফরসা, বেঁটেখাটো, গিন্নিবান্নি টাইপ। ওদের দু’জনকে দেখে শুকনো জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চঞ্চল বললেন, ‘স-ব শে-ষ হ-য়ে গে-ল…’

পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে হেলিয়ে রাখা বেড মেঝের সমান্তরাল করে দিলেন লক্ষ্মণ। চঞ্চলের নাকে অক্সিজেনের নল গুঁজলেন। হাতে স্যালাইনের সূচ ঢোকালেন। প্রথমা আর শাশ্বতকে ধাক্কা মেরে বেডের পাশ থেকে সরালেন, ল্যাপটপ বেড থেকে সরিয়ে পাশের টেবিলে রাখলেন, কার্ডিয়াক মনিটরের তার চঞ্চলের শরীরে জুড়ে দিলেন। চাঁদু মোবাইল ফোনে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকছে।

মনিটর হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠে সবুজ জীবনরেখা দেখাতে শুরু করেছে। পিঁকপিঁক করে হৃদয়ের শব্দ শোনাচ্ছে।

মনিটরের দিকে তাকিয়ে প্রথমা দেখল ঢেউয়ের মতো জীবনরেখা এক লহমায় স্ট্রেট লাইন হয়ে গেল। শিশুর হাতে আঁকা মাটি আর আকাশের মধ্যেকার দিগন্তরেখার মতো সোজা।

অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গায়ত্রী স্বামীর নিস্পন্দ বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

‘দেখুন ম্যাডাম, ব্যাপারটা সিরিয়াস,’ প্রথমার দিকে তাকিয়ে বললেন পানিহাটি থানার অফিসার ইনচার্জ পুলক দাস, ‘ডক্টর চঞ্চল দুবের আনন্যাচরাল ডেথ নিয়ে ওঁর স্ত্রী গায়ত্রী দুবে এবং ওঁর কোলিগ, ডাক্তার লক্ষ্মণ মিশ্র পানিহাটি থানায় আলাদা দুটো এফআইআর করেছেন। গায়ত্রীর অভিযোগ দেবীমাতার বিরুদ্ধে। লক্ষ্মণের অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে। দুটো এফআইআর-এই ধারা ৩০২ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ‘কালপেবল হোমিসাইড অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার’। দেবীমাতা বা আপনাকে আমি আপাতত জেরা করার জন্যে থানায় নিয়ে যাচ্ছি না। কিন্তু আপনি আমাকে হেল্প করুন।’

‘আমি আপনাকে কী ভাবে হেল্প করব?’ নিরীহ মুখে জানতে চায় প্রথমা।

‘আমার কাছে হোম ডিপার্টমেন্ট থেকে অলরেডি খবর চলে এসেছে যে আপনি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। কোন ডিপার্টমেন্ট, সেটা জানার অধিকার নাকি আমার নেই। প্লাস, আমার ওপরে চাপ আছে, যেন অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল আপনাকে ছেড়ে দিই। কিন্তু কেসটা র‌্যাপ আপ না করে কী করে ছাড়ি বলুন!’

প্রথমা মাথা নিচু করে ভাবছে। নিজেকে নিয়ে নয়। চঞ্চলকে নিয়ে। অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে চিপের আইসিসিইউতে নিয়ে গিয়েও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। লক্ষ্মণ ডেথ ডিক্লেয়ার করেছেন সকাল এগারোটায়। এখন রাত আটটা বাজে।

কান্নাকাটি, চিৎকার, থানায় ফোন, পুলিশ আসা, পোস্টমর্টেমের জন্যে বডি বারাসাত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, ময়না তদন্তের রিপোর্ট টেলিফোন মারফত আনফিশিয়ালি জানতে পারা—এইসব করতে করতে সন্ধে সাতটা বেজেছে। চঞ্চলের সেলাই করা দেহ এখন চিপের রিসেপশানে রাখা রয়েছে। আগামীকাল সৎকার হবে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া অনেকক্ষণ এসে গেছে। রাষ্ট্রপতির কার্ডিয়োলজিস্টের মৃত্যু মানে ধুন্ধুমার মিডিয়া সার্কাস।

চঞ্চলের মৃত্যু সংবাদ শোনার পরে প্রথমা চলে যেতে চেয়েছিল। লক্ষ্মণ যেতে দেননি। বলেছেন, ‘পুলিশ না আসা পর্যন্ত যেতে পারবেন না।’ প্রথমা বাধ্য হয়ে রঞ্জিতকে ফোন করেছিল। তিনি কী কলকাঠি নেড়েছেন প্রথমা জানে না।

প্রথমা আর পুলক বসে রয়েছে চঞ্চলের বাংলোর ড্রয়িংরুমে। প্রথমা বুঝতে পারছে, এই তদন্তে পুলককে সাহায্য করতে হবে। সে নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘হার্টের রুগির মৃত্যুকে ‘আনন্যাচরাল ডেথ’ কেন বলা হচ্ছে?’

‘ভালো প্রশ্ন। ডাক্তারের উপস্থিতিতে মৃত্যু হয়েছে। কার্ডিওলজির রোগী হৃদয় সংক্রান্ত সমস্যায় মারা গেছেন। কাজেই এটা ‘আনন্যাচরাল ডেথ’ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাড়ির লোক এবং চিকিৎসক থানায় এফআইআর করেছেন। মিডিয়ার চাপও আছে। আমাকে প্রসিড করতেই হবে,’ শ্রাগ করলেন পুলক। ‘পোস্টমর্টেম যিনি করেছেন তিনি ফোনে জানিয়েছেন যে পেসমেকার বন্ধ হয়ে হার্ট ব্লকের ফলে মৃত্যু। লিখিত রিপোর্ট কাল দেবেন। ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস রিপোর্টের প্রাইমারি ফাইন্ডিং আর কিছুক্ষণের মধ্যে ফোনে জানাবেন।’

প্রথমা বলল, ‘সময় নষ্ট করে লাভ নেই। গায়ত্রীকে ডাকুন। অভিযোগকারিনীকে দিয়ে জেরা শুরু করা যাক।’

ড্রয়িং রুমে ঢুকে গায়ত্রী বললেন, ‘আমাকে ডেকেছেন?’

গায়ত্রী সিঁদুর মুছে ফেললেও সিঁথির লাল আভা যায়নি। পরনে নীল নরুণপেড়ে শাড়ি। কান্নাকাটির ফলে চোখ জবাফুলের মতো লাল। পুলক বললেন, ‘আপনি বসুন।’

সোফায় বসে প্রথমার দিকে তাকিয়ে গায়ত্রী বললেন, ‘আপনি সকাল থেকে কিছু খেয়েছেন?’

‘না।’

‘চাঁদু! স্যান্ডউইচ আর কফি নিয়ে আয়,’ বললেন গায়ত্রী। ছেলের দিকে ফিরে বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘শত, তুমি খাবার জল নিয়ে এসো।’

ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসেছিল শাশ্বত। বাবা মারা যাওয়ার পরে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি। মায়ের কথা শুনে বলল, ‘চাঁদুদা…’

‘তুমি বোসো। আমি আনছি।’ মেঝে থেকে উঠে ঘর থেকে বেরোয় চাঁদু।

‘আপনি কেন মনে করছেন যে আপনার স্বামীকে খুন করা হয়েছে?’ গায়ত্রীকে প্রশ্ন করে প্রথমা।

আঁচলের খুঁট আঙুলের ফাঁকে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে গায়ত্রী বললেন, ‘দেবীমাতার নাম শুনেছেন?’

‘বিখ্যাত নিউ-এজ গুরুমা,’ বলে প্রথমা, ‘যোগব্যায়াম, প্রাণিক হিলিং, রিফ্লেক্সোলজি, বিপাসনা, নেচারোপ্যাথির খিচুড়ি বানিয়ে ‘আর্ট অফ লাইফ’ নামে বিক্রি করেন। ওঁর কাছে একটা সেশানের জন্যে কোটিপতিরা লাইন দেন। এলাহাবাদে বিশাল আশ্রম, অন্যান্য রাজ্যেও হেলথ হাব আছে। আছে নিজস্ব এফএম এবং টিভি চ্যানেল।’

‘গত ছ’মাস ধরে দেবী আমার বরের মাথা খাচ্ছে।’ নিচু গলায় বলেন গায়ত্রী।

‘দেবী কেন চঞ্চলের মাথা খাবেন? কী ভাবেই বা খাবেন?’

‘চঞ্চল মোটা হয়ে যাচ্ছিল। পেশেন্ট দেখার সময় দু’বার মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তখন ও দেবীকে চিপে আমন্ত্রণ জানায় ‘আর্ট অফ লাইফ’ সেশন করার জন্যে। দেবীকে পাশের বাংলোয় থাকতে দেয়। অন্য হার্ট পেশেন্টের সঙ্গে দেবীর সেশানে যোগ দেয়। এক মাস সেশান করার পরে চঞ্চল অনেকটা রোগা হয়। মাথা ঘোরাটা কমেনি। কেন না ওটা হার্ট ব্লকের জন্যে হচ্ছিল। আলটিমেটলি পেসমেকার বসাতেই হল। মাঝখান থেকে আমার সববোনাশ হয়ে গেল।’

‘সববোনাশ বলতে?’

‘সেশান করার সূত্রে দেবীর সঙ্গে চঞ্চলের ঘনিষ্ঠতা হয়। রোজ রাতে ডিনার সেরে চঞ্চল পাশের বাংলোয় চলে যেত। ব্রেকফাস্টের সময় এখানে ফিরত।’

গায়ত্রীর কথা শুনে প্রথমার অস্বস্তি হচ্ছে। সে শাশ্বতর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি পাশের ঘরে গিয়ে বোসো।’

‘কোনও দরকার নেই,’ গলা চড়িয়েছেন গায়ত্রী, ‘ও জানে যে ওর বাবা যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা দেবীর নামে করে দিয়েছে।’

‘সে কী?’ অবাক হয়ে পুলক বলেন, ‘এটাই প্রথম উইল?’

‘এটা দ্বিতীয় উইল! প্রথম উইলে যাবতীয় সম্পত্তির মালিক ছিলাম আমি আর শত। এই উইলে আমার নাম কেটে দেবীর নাম বসিয়েছে। ছেলের নামটা প্রাণে ধরে কাটতে পারেনি।’

চাঁদু একটা ট্রে টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ট্রেতে স্যান্ডউইচ, থার্মোফ্লাস্ক ভর্তি কফি, কাপ আর জলের বোতল সাজানো। গায়ত্রী সোফা থেকে উঠে প্রথমার হাতে স্যান্ডউইচ ধরিয়ে বললেন, ‘খাও।’ কাপে কফি ঢেলে পুলকের হাতে দিয়ে বললেন, ‘চঞ্চল মারা যাওয়ার পরে চিপের মালিক এখন দেবী। আমি সন্দেহ করব না, এটা মার্ডার?’

কফিতে চুমুক দিয়ে পুলক বললেন, ‘কিন্তু দেবী তো ক্রাইম সিনে ছিলেন না!’

‘ঘটনাস্থলে না থেকেও মার্ডার করা যায়, মিস্টার দাস। আজকাল নানা সাসটেইনড রিলিজ ক্যাপসুল বেরিয়েছে। খাওয়ার অনেক পরে অ্যাকশান শুরু হয়। চঞ্চল নিয়মিত দেবীর দেওয়া হারবাল ক্যাপসুল খেত।’

‘ইন্টারেস্টিং!’ প্রথমা গায়ত্রীকে বলল, ‘আপনি ডক্টর লক্ষ্মণ মিশ্রকে পাঠিয়ে দিন। আর দেবীকে বলে রাখুন, আমরা ওঁর সঙ্গে কথা বলব।’

‘সে এখন টিভি চ্যানেলকে ইন্টারভিউ দিতে ব্যস্ত।’ আঁচলে চোখ মুছে ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে যান গায়ত্রী।

‘দেখুন, আমার হাতে একদম সময় নেই। চিপের ম্যানেজমেন্ট সামলানো একটা হেডেক। তার কর্ণধারের অন্ত্যেষ্টি সামলানো আর একটা। এর মধ্যে আমাকে আর জ্বালাবেন না।’ ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসে পুলকের দিকে তাকিয়ে বললেন লক্ষ্মণ।

‘চঞ্চল তো প্রাক্তন কর্ণধার হয়ে গেছেন। বর্তমান কর্ণধার কে? আপনি?’ টুক করে প্রশ্ন ছোঁড়েন পুলক।

‘ট্যালেন্ট আর লেবারকে প্রায়রিটি দিলে সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু দেশটার নাম ভারতবর্ষ। এখানে ভড়ং আর বুজরুকির জয় হয়। আপনি দেবীমাতার নাম শুনেছেন?’

‘না শুনে উপায় আছে? টিভি খুললেই তাঁর ছবি!’

‘একদিকে মডার্ন মেডিসিন। অন্যদিকে ইন্ডিয়ান মিস্টিসিজম। এই দুই পক্ষের গাঁটছড়া বেঁধে দেবী ‘চিপ’কে ইন্টারন্যাশনাল ওয়েলনেস হাবে বদলে দিতে চান। যেখানে মেডিসিন বা সার্জারি ছাড়াই হৃদযন্ত্র ভালো থাকবে। দেবীর মোটো হল, ”বাইপাস দ্য বাইপাস”।’

‘দেবী চাইলেই তো আর বদল ঘটবে না! তার জন্যে চঞ্চলের অনুমতির প্রয়োজন।’

‘চঞ্চল উইল করে চিপের অর্ধেক মালিকানা দেবীর নামে করে দিয়েছে। আমি এখন ওই ফ্রডটার বেতনভুক কর্মচারী! কী হিউমিলিয়েটিং!’

‘বাকি অর্ধেক মালিকানা তো শাশ্বতর নামে। অত হিউমিলিয়েশানের কী আছে?’

‘শত এখনও জুনিয়র। সম্পত্তির অর্ধেক ওর নামে থাকলেও ওর লিগাল গার্জেন সেটা হ্যান্ডল করবে। চঞ্চল কাকে লিগাল গার্জেন করে গেছে কে জানে!’ শাশ্বতর মাথায় হাত বুলিয়ে, গলায় অপত্য স্নেহ মিশিয়ে লক্ষ্মণ বলেন, ‘ছেলেটা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনো করতে চায়। ওর বেসিক প্যাশনের জায়গা হল নতুন প্রোগ্রাম বানানো। আর চঞ্চল ওকে ডাক্তার করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। এই নিয়ে রোজ বাপ-ছেলের মধ্যে অশান্তি। একদিন শাসাল যে, ডাক্তারি না পড়লে ত্যাজ্যপুত্তুর করবে!’

মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে শাশ্বত হাসিমুখে লক্ষ্মণের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে হিরো ওয়রশিপ।

প্রথমা স্যান্ডউইচ খেতে ব্যস্ত ছিল। এতক্ষণে মুখ খুলল। ‘চঞ্চলের পেসমেকার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে?’

লক্ষ্মণ প্রথমার দিকে তাকিয়ে আঙুল নেড়ে বললেন, ‘আপনি চঞ্চলের বেডে স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ রেখেছিলেন। আপনি কি জানেন যে ইয়ার প্লাগ থেকে পেসমেকারের ড্যামেজ হতে পারে?’

‘সেটা ভেবেই আপনি আমার নামে এফআইআর করেছেন?’ অবাক হয়ে বলল প্রথমা।

‘পেসমেকারের সাইজ বিস্কুটের মতো।’ রাগি গলায় বলেন লক্ষ্মণ, ‘বুকের ডানদিকে, কলার বোনের তলায়, চামড়ার নীচে বসানো থাকে। পেসমেকার থেকে একটা তার ধমনী দিয়ে চলে যায় দক্ষিণ নিলয় ও দক্ষিণ অলিন্দে। পেসমেকারে ইমপালস তৈরি হলে, তারবাহিত সেই ইমপালস হৃদয়ে পৌঁছে তাকে ঠিক ছন্দে নাচায়। স্মার্টফোন সরাসরি পেসমেকারের ওপরে কোনও এফেক্ট না করলেও ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট পেসমেকারের ইমপালস জেনারেশানে ব্যাগড়া দিয়েছে। সেটাই চঞ্চলের মৃত্যুর কারণ।’

প্রথমার মনে সংশয় বাসা বাঁধছে। তার জন্যে যদি চঞ্চল মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে সে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না।

লক্ষ্মণ পুলককে বললেন,’আমি কেন এই জার্নালিস্টের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছি তার জাস্টিফিকেশান দিয়ে দিলাম। বাকি দায়িত্ব আপনার।’

পুলক নিচু গলায় লক্ষ্মণকে বললেন, ‘আপনি যান। দেবীকে পাঠিয়ে দিন।’

‘নমষ্কার। আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে?’ ড্রয়িং রুমে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে হাত জড়ো করলেন দেবীমাতা।

পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। ত্বক গমরঙা এবং নিখুঁত। চোখ এবং ঠোঁট যামিনী রায় এঁকে দিয়েছেন। পাতলা ফিনফিনে ওষ্ঠ এবং ঈষৎ মোটা অধরের ফাঁকে মুক্তোর সারি সাজানো। জিনস এবং নামাবলীর কুর্তি পরা দেবীকে দেখে পুলক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বসুন।’

পা মুড়ে সোফায় বসলেন দেবী। প্রথমা তাঁর হাতে এক কাপ কফি তুলে দিয়ে বলল, ‘গায়ত্রী অভিযোগ করেছেন যে আপনি সাসটেইনড রিলিজ ক্যাপসুল খাইয়ে চঞ্চলকে হত্যা করেছেন।’

‘ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট এলেই সত্যিটা বোঝা যাবে।’ কফিতে চুমুক দিলেন দেবী।

‘চঞ্চলের শেষ উইল অনুযায়ী ওঁর অবর্তমানে, যাবতীয় সম্পত্তির অর্ধেক মালিক আপনি। গায়ত্রীর অভিযোগ, এটাই আপনার খুন করার মোটিভ।’

‘অর্থ নিয়ে কথা বলা আমার জীবনদর্শনের বিরোধী।’

‘গায়ত্রীর অভিযোগ, রাতের বেলা চঞ্চল আপনার বাংলোয় কাটাতেন।’

‘ওয়াশিং ডার্টি লিনেন ইন পাবলিক ইজ নট মাই ডোমেন। কিন্তু কেউ যদি সবার সামনে কাদা ছোড়ে, তাহলে সবার সামনেই পরিষ্কার করতে হবে। চঞ্চল আমার কাছে রাতে থাকলে লক্ষ্মণ আর গায়ত্রীর সুবিধে হতো। এই কথা ওদের কেউ বলেছে কি?’

প্রথমা শাশ্বতর দিকে তাকায়। সে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকার অভিনয় করলেও সব কথা গিলছে। প্রথমা প্রশ্ন করল, ‘ওঁদের মধ্যে কি কোনও সম্পর্ক আছে?’

‘লক্ষ্মণ আর গায়ত্রী একে অপরকে ভালোবাসে। চঞ্চল সেটা জেনে ফেলায় মানসিক অত্যাচারের মাধ্যমে গায়ত্রী চঞ্চলকে ডিভোর্সের দিকে ঠেলছিল। গায়ত্রী রোজ রাতে ঝগড়া করত বলে চঞ্চল আমার কাছে চলে আসত। আমি আর চঞ্চল গল্প করে রাত কাটাতাম। চঞ্চল বলেছিল, গায়ত্রী আর লক্ষ্মণ বিয়ের প্ল্যান করছে। দু’নম্বর উইল হওয়ায় সেই প্ল্যান ঘেঁটে যায়।’

পুলকের ফোন এসেছে। তিনি মোবাইলে নিচু গলায় কথা বলছেন। ফোন কেটে বললেন, ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি থেকে জানাল, ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে কোনও পয়জন পাওয়া যায়নি। চাঁদুর দেওয়া যে দুটো ওষুধ চঞ্চলবাবু খেয়েছিলেন, সেগুলো ব্লাড প্রেশার কমানোর ওষুধ। রক্তে তাদের মাত্রা স্বাভাবিক।’

‘গায়ত্রীর সাসটেইনড রিলিজ পয়জন ক্যাপসুলের তত্ত্ব তা হলে বাতিল!’ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন দেবী, ‘আমি এবার উঠি?’

প্রথমা বলে, ‘চঞ্চল চাঁদুকে বলছিলেন যে আপনার হারবাল ক্যাপসুল উনি আর খাবেন না।’

দেবীর গমরঙা গালে উত্তেজনার লালিমা। যামিনী রায়ের আঁকা ভুরুতে সেকেন্ড ব্র্যাকেট। একপর্দা গলা চড়িয়ে বললেন, ‘পেসমেকার বসানোর দু’দিন আগে পর্যন্ত চঞ্চল হারবাল ক্যাপসুল খেয়েছে। পেসিং-এর পরে খেয়েছে কিনা জানি না। আইসিসিইউতে আমি যাইনি।’

‘আপনি এবার আসতে পারেন।’ নমষ্কার করে প্রথমা। তাকে পাত্তা না দিয়ে পুলকের দিকে তাকিয়ে দেবী বললেন, ‘লক্ষ্মণের মুখে শুনলাম, এই জার্নালিস্ট মেয়েটি চঞ্চলের বেডে স্মার্টফোন এবং ইয়ারপ্লাগ রেখেছিল। আমার ‘হেলদি হার্ট উইদাউট ডক্টর’ বইতে পরিষ্কার বলা আছে যে পেসমেকারের তিন সেন্টিমিটারের মধ্যে ম্যাগনেট থাকলে সেটা ইমপালস জেনারেশানে প্রবলেম করে। অন্যদের জেরা করা বন্ধ করে আপনি আগে একে জেরা করুন। চঞ্চলের মৃত্যুর কারণ খুঁজে পাবেন।’

পুলক বললেন, ‘আপনি চাঁদুকে পাঠিয়ে দিন।’

দেবী ঘর থেকে বেরোতেই প্রথমা হঠাৎ চনমনে! আগেকার সেই মনমরা ভাব আর নেই। এক টুকরো কাগজে খসখস করে এক লাইন লিখে পুলকের হাতে ধরিয়েছে। চাঁদু ঘরে ঢুকতেই কড়া গলায় বলল, ‘তুমি সারাদিন স্যারের সঙ্গে থাকতে?’

‘হ্যাঁ।’

‘চঞ্চল রোজ রাতে দেবীর বাংলোয় থাকতেন এটা ঠিক?’

চাঁদু মুখ খোলার আগে পুলক শাশ্বতকে বললেন, ‘বাথরুমটা কোথায়?’

‘আমি দেখিয়ে দিচ্ছি,’ বলল চাঁদু।

‘আমার কথার উত্তর না দিয়ে পালানোর চেষ্টা কোরো না!’ চাঁদুকে ধমক দেয় প্রথমা। শাশ্বত ব্যাজার মুখে পুলককে নিয়ে ড্রয়িং রুম থেকে বেরোয়।

শাশ্বতর ল্যাপটপের সামনে বসে প্রথমা বলল, ‘আমি চিরকুটে বড়বাবুকে লিখেছিলাম যে উনি যেন শাশ্বতকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে যান। তুমি বড়বাবুকে বাথরুম দেখাতে গিয়ে কেসটা ঘেঁটে দিচ্ছিলে। আমি যে প্রশ্নটা করেছি, তার উত্তর দাও। চঞ্চল কি দেবীর বাংলোয় রাতের বেলা থাকতেন?’

‘হ্যাঁ,’ মাথা নিচু করে বলে চাঁদু।

‘দেবী বলেছেন যে গায়ত্রী আর লক্ষ্মণের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। কথাটা ঠিক?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি দুটো উইলের কথাই জানতে?’

‘দুটো নয়,’ এদিক-ওদিক দেখে নিচু গলায় চাঁদু বলে, ‘উইল আসলে তিনটে।’

‘ভুল বকছ কেন?’ ল্যাপটপের ওয়েব হিসট্রি ঘাঁটছে প্রথমা।

‘ভুল বকছি না। তিনটে উইলেরই একজন সাক্ষী আমি। আর অন্যজন আরএমও বিকাশ দত্ত। উনি স্যারের ছোটবেলার বন্ধু।’

‘লাস্ট উইল, মানে তিন নম্বর উইলটা কবে হয়েছে?’

‘গতকাল রাতে। আইসিসিইউ থেকে বাড়ি আসার ঠিক আগে স্যার এই উইলটা করেছেন।’

‘এই উইলে উত্তরাধিকারী কে?’

‘প্রথম আর তিন নম্বর উইলে কোনও তফাত নেই। স্যার মরে যাওয়ার পরে সব সম্পত্তির মালিক এখন আবার গিন্নিমা আর খোকাবাবু।’

ওয়েব হিসট্রি ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রথমা বলল, ‘কার্ডিয়োট্রনিক্স!’

তাকে অবাক করে দিয়ে চাঁদু বলল, ‘ঠিক বলেছেন।’

‘কী ঠিক বলেছি?’ প্রথমা জানতে চায়।

‘স্যারের বুকে কার্ডিয়োট্রনিক্স কোম্পানির পেসমেকার বসানো হয়েছে। ওটাই এখন ওয়ার্ল্ডের বেস্ট।’

‘কার্ডিয়োলজিস্টের সঙ্গে বাস করে করে তুমিও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলে নাকি?’ প্রাণখোলা হাসে প্রথমা।

শাশ্বত আর পুলক ড্রয়িংরুমে ফেরত এসেছে। প্রথমাকে ল্যাপটপ ঘাঁটতে দেখে শাশ্বত গলা তুলে বলল, ‘ল্যাপটপ পারসোনাল জিনিস। অন্যেরটা ইউজ করা উচিত নয়।’

‘বিপদের সময় অন্য লোকের জিনিস ইউজ করতে হয়।’ কিবোর্ডে প্রথমার আঙুল চলছে। তাকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করছে শাশ্বত। বলছে, ‘আপনার কেন বিপদ হবে? বিপদ তো দেবীমাতার।’

‘কেন?’ ল্যাপটপ পুলকের হাতে তুলে দিয়ে বলে প্রথমা।

‘আমি ওই হারবাল ক্যাপসুল কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্যে মুম্বইয়ের ফার্মাকোলজি ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম,’ বলল শাশ্বত, ‘রিপোর্টে বলছে, হারবাল ক্যাপসুলের মধ্যে বেশি মাত্রায় স্টেরয়েড রয়েছে। সেই রিপোর্ট দেখার পরে বাবা আর মেয়েটার মধ্যে বিরাট বাওয়াল হয়!’

চাঁদু বলল, ‘তারপর থেকেই স্যার আর দিদিমণির দেওয়া ওষুধ খাননি। গতকাল রাতের উইলটাও ওই কারণে করেন।’

‘নতুন উইলের কথা কেকে জানে?’

‘স্যার, উকিলবাবু, ডাক্তার বিকাশ দত্ত, খোকাবাবু আর আমি। আমি কিন্তু কাউকে বলিনি।’ কাঁচুমাচু মুখে বলে চাঁদু।

‘আমিও বলিনি,’ ভাঙা গলায় বলে শাশ্বত।

‘তুমি যে কাউকে বলোনি এটা আমি জানি,’ শাশ্বতর মাথায় হাত বুলিয়ে প্রথমা বলল, ‘চাঁদু, সবাইকে একবার স্যারের বেডরুমে ডাকো। ফাইনাল কথাবার্তা বলে আমি উঠব।’

‘ফাইনাল কথা মানে?’ পুলক অবাক।

‘মানেটা খুব সোজা। ডক্টর চঞ্চল দুবের মৃত্যুতে আমার কোনও হাত নেই এইটা প্রমাণ করে আমি বেরোব। সেটা করতে গিয়ে যদি দেখা যায় যে এটা অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ নয়, মার্ডার—তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে আপনি আছেন।’

‘বেশি সময় নেব না। সংক্ষেপে বলি।’ চঞ্চলের বেডের চারপাশের চেয়ারে বসে থাকা গায়ত্রী, লক্ষ্মণ, আর দেবীর দিকে তাকাল প্রথমা। চাঁদু বেডের পিছনে, মেঝেয় বসেছে। শাশ্বত পুলকের পাশে বসে ল্যাপটপ নেওয়ার জন্যে ছোঁকছোঁক করছে। পুলক ল্যাপটপ হাতছাড়া করেননি।

‘চঞ্চল মারা গেলে কার লাভ?’ সবার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় প্রথমা, ‘গায়ত্রী এবং লক্ষ্মণ মনে করছেন দেবীর লাভ। কেন না চঞ্চলের যাবতীয় সম্পত্তির মালকিন এখন দেবী।’

‘টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলা আমার অপছন্দ। তাও বলি, দেবীমাতা ট্রাস্টের টাকার অভাব নেই।’ নরম গলায় বলেন দেবী।

‘আপনার হারবাল ক্যাপসুলে স্টেরয়েড মেশানো থাকে। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে ট্রাস্টের ওপরে মানুষের ট্রাস্ট চলে যাবে। চলে যাবে আপনার কোটি টাকার সম্পত্তি। মিডিয়ার কাছে মুখ খোলার আগে চঞ্চলকে খুন করিয়ে দেওয়া বিরাট বড় মোটিভ।’

‘শাট আপ! বেশি কথা বললে তোমার জিভ আমি ছিড়ে নেব!’ হুঙ্কার ছাড়েন দেবী।

পুলক চ্যাঁচালেন, ‘বেশি কথা বললে এক্ষুনি আপনার হাতে হাতকড়া পরিয়ে মিডিয়ার সামনে দিয়ে প্রিজন ভ্যানে তুলব।’

দেবী চুপ করে গেলেন।

প্রথমা বলল, ‘অন্যদের মোটিভে আসা যাক। দেবী মনে করেন, চঞ্চল মারা যাওয়ার ফলে লক্ষ্মণ আর গায়ত্রীর লাভ হল।’

‘আমাদের আবার কী লাভ?’ হাতা গুটিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন লক্ষ্মণ।

‘গায়ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথা আমরা জেনে গেছি,’ লক্ষ্মণের দিকে তাকিয়ে বলল প্রথমা, ‘এটাও জেনেছি যে প্রথম উইল অনুযায়ী চঞ্চলের মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পত্তি পেতেন গায়ত্রী আর শাশ্বত। কাজেই গায়ত্রীকে বিয়ে করলে রাজত্ব আর রাজকন্যা একসঙ্গে পাওয়া যেত। চিপের সুপারইনটেন্ডেন্ট হিসেবে আর কত দিন থাকবেন? রাষ্ট্রপতির হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হতে গেলে যদি কারও হৃদয় থামিয়ে দিতে হয়, তবে তাই সই! এর থেকে বড় মোটিভ আর হয় না। আর গায়ত্রীর মোটিভ কেয়ারিং হাজব্যান্ড পাওয়া। হোক না দ্বিতীয় পক্ষ!’

‘প্রথম উইল তো বাতিল। দ্বিতীয় উইল অনুযায়ী প্রপার্টি এখন দেবীর নামে,’ বললেন গায়ত্রী। গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তিনি ভয়ের চোটে ঠকঠক করে কাঁপছেন। লক্ষ্মণের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললেন, ‘চঞ্চলকে মেরে আমাদের কোনও লাভ নেই। তুমি ভুল বকছ!’

‘ভুল বকছেন আপনি। কেন না, গত রাতে, আইসিসিইউ থেকে বেরোনোর আগে, চঞ্চল তিন নম্বর উইল করেছেন। সেই উইল অনুযায়ী ওঁর সব সম্পত্তির মালিক আবার আপনি আর শাশ্বত।’

লক্ষ্মণ বললেন, ‘আমরা কেন চঞ্চলকে মারতে যাব? তিন নম্বর উইলের কথা তো আমরা জানিই না!’

‘আপনাদের দুজনের মুখেই ”আমরা” শুনে ভালো লাগল।’ মৃদু হাসল প্রথমা, ‘মোটিভ ভুলে গিয়ে এবার আমরা কজ অব ডেথে ঢুকি। চঞ্চলের মৃত্যু স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক? অস্বাভাবিক হলে এটা কি হত্যা?’

‘দিস ইজ মার্ডার! অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আপনাকে পালাতে দেব না!’ গর্জে ওঠেন লক্ষ্মণ। পুলককে বলেন, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম যে ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট থেকে পেসমেকার ডিঅ্যাকটিভেটেড হয়েছে। আপনি এই জার্নালিস্টকে অ্যারেস্ট করুন!’

‘আপনি ভুল বলেছিলেন!’ পুলক কিছু বলার আগেই প্রথমার গলা বেডরুম জুড়ে চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল, ‘কেন, সেটা জানার জন্যে আপনাকে চঞ্চলের বেডে একবার শুতে হবে। চাঁদু, স্যারের বেডটা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি করে দাও।’

চাঁদু বেডের মাথার দিক তুলে দিল। লক্ষ্মণ লালচোখে প্রথমাকে মেপে নিয়ে বিছানায় আধশোওয়া হলেন।

প্রথমা বলল, ‘ধরে নিন, আপনি চঞ্চল। আমি জার্নালিস্ট। আমার পুরনো জায়গায় বসছি,’ বেডের বাঁ-পাশের চেয়ারে বসে সে লক্ষ্মণকে বলল, ‘স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ পুরোনো জায়গায় রাখলাম। এবারে আপনার থেকে শেখা জ্ঞান আপনাকেই শোনানো যাক।’

‘কী?’ হুঙ্কার ছাড়লেন লক্ষ্মণ।

‘পেসমেকার বসানো থাকে বুকের ডানদিকে। ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট কাজ করে তিন সেন্টিমিটারের মধ্যে। আপনার বাঁদিকে থাকা ইয়ারপ্লাগ আপনার বুকের ডানদিকে বসানো পেসমেকারের থেকে অন্তত দু’ফুট দূরে। কাজেই ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট থেকে পেসমেকার বন্ধ হয়নি।’

লক্ষ্মণের বডি ল্যাঙ্গোয়েজে আগের আগ্রাসী ভাব আর নেই। বিড়বিড় করে বললেন, ‘তা হলে? চঞ্চল কীভাবে মারা গেল?’

‘সেটা জানার চেষ্টা করা যাক!’ লক্ষ্মণকে ছেড়ে শাশ্বতকে নিয়ে পড়েছে প্রথমা, ‘খোকাবাবু, তোমার ল্যাপটপের ওয়েব হিসট্রিতে কার্ডিয়োট্রনিক্সের লিঙ্ক কেন রয়েছে?’

‘তুমি আমার ল্যাপটপ ফেরত দাও।’ পুলককে মিনতি করে শাশ্বত।

শাশ্বতর কবজি ধরে বেডের ডানপাশে এনে প্রথমা লক্ষ্মণকে বলে, ‘আমি ডাক্তারি বুঝি না। ভুল বললে সংশোধন করে দেবেন। পেসমেকারের প্রাণভোমরা একটা মাইক্রোচিপ। তাতে পেশেন্ট এবং তার রোগ সংক্রান্ত যাবতীয় ডেটা ভরা থাকে। মাইক্রোচিপ থেকে এই ডেটা ওয়্যারলেস রেডিয়ো সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রান্সমিটেড হয়। দরকার পড়লে, বুকের চামড়া না কেটে, পেসমেকারে হাত না দিয়ে, পেশেন্টের হার্টরেট বাড়ানো বা কমানো হয় মাইক্রোচিপের সাহায্যে। তাই তো?’

লক্ষ্মণ নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লেন।

‘চঞ্চলের ডানদিকে বসে, রেডিয়ো হার্ডওয়্যার লাগানো ল্যাপটপের মাধ্যমে খোকাবাবু রেডিয়ো সিগন্যাল ইন্টারসেপ্ট করেছে। তারপর সেই ডেটার সাহায্যে কার্ডিয়োট্রনিক্সের সার্ভারে ঢুকে চঞ্চলের পেসমেকারের ইমপালস জেনারেশান বন্ধ করে দিয়েছে।’

পুলক বললেন, ‘বুঝতে পারলাম না। একটু সহজ করে বলুন।’

‘চেষ্টা করছি,’ বলে প্রথমা, ‘মোবাইল ফোন চুরি হলে, এয়ারটাইম প্রোভাইডারকে খবর দিলে ওরা যেভাবে চুরি যাওয়া সিমকার্ড ডিঅ্যাকটিভেট করে দেয়, এটা সেই পদ্ধতি। খোকাবাবু একজন ধুরন্ধর হ্যাকার।’

পুলক বলল, ‘এবার বুঝলাম। আমি এই ল্যাপটপ কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইম সেলে পাঠাচ্ছি। ওরা হার্ড ডিস্ক থেকে সব ডেটা উদ্ধার করে দেবে।’

শাশ্বতর গালে ঠাস করে চড় মেরে তাকে জড়িয়ে ধরেছেন গায়ত্রী। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘কেন এইরকম করলি? কেন?’

‘বাবাটা ওই নোংরা আন্টির সঙ্গে থাকত। আমার ভালো লাগত না মা।’ মায়ের কোলে মাথা রেখে তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে শাশ্বত। কৈশোরের ভাঙা গলায় বলছে, ‘বাবাটা খালি বলত, ”তোকে কার্ডিয়োলজিস্ট হতে হবে।” আমার ভালো লাগত না মা। বাবাটা আমাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছিল। স্কুলের বন্ধুরা এই নিয়ে আমায় ”বুলি” করে। আমার ভালো লাগে না মা। তুমি আর লক্ষ্মণ আঙ্কল কী সুন্দর বেস্ট ফ্রেন্ড! লক্ষ্মণ আঙ্কল আমারও বেস্ট ফ্রেন্ড। সফটওয়্যার নিয়ে পড়াশুনো করতে আমাকে এনকারেজ করে। ডাক্তার হওয়ার কথা বলে ”বুলি” করে না। ”জোম্বি” বলে গালাগাল দেয় না। পুরোনো বাবাটা আর নেই। তুমি আঙ্কলকে বিয়ে করো। আমরা তিনজনে মিলে মজা করে থাকব।’

প্রথমা নরম গলায় বলে, ‘শাশ্বত, তুমি কি জানো যে তুমি যা করেছ, সেটা মার্ডার?’

‘মার্ডার কেন হবে? দিস ইজ হার্ট হ্যাকিং।’ ভাসাভাসা চোখের নিষ্পাপ দৃষ্টি মেলে বলে শাশ্বত, ‘কার্ডিয়োট্রনিক্সের সার্ভারের সিকিয়োরিটিতে কিছু লুপহোল ছিল। সেটা ধরিয়ে দিয়ে আমি ওদের মেইল করে দিয়েছি। যাতে ওরা ভুলটা কারেকশান করে নেয়।’

পুলক প্রথমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা যে শাশ্বতর কাজ এটা তোমার কখন মনে হল?’

‘লক্ষ্মণ বলেছিল ম্যাগনেট থেকে পেসমেকারের ড্যামেজ হয়। দেবী যখন বললেন যে পেসমেকারের তিন সেন্টিমিটারের মধ্যে ম্যাগনেট থাকলে তবেই ড্যামেজ হবে, তখনই আমি নিজেকে সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখি। কেননা আমার ইয়ারপ্লাগ অনেক দূরে ছিল। কাছে ছিল শাশ্বতর ল্যাপটপ। ‘চিপ’ শব্দটা বারবার শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে হল, পেসমেকারেও তো চিপ থাকে। শাশ্বতর দৃষ্টিতে চঞ্চলের প্রতি ঘৃণা, লক্ষ্মণের প্রতি অ্যাডমিরেশান, দেবীর প্রতি গ্রাজ এই সবই আমাকে বাধ্য করে ওর ল্যাপটপে নাক গলাতে। আপনাকে ওই চিরকুট দেওয়ার আসল কারণ হল, আমি শাশ্বতকে মেশিন থেকে তুলতে চেয়েছিলাম।’

দেবী চুপ করে বসে আছেন। চাঁদু মেঝের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পাখির মায়ের মতো দুই পক্ষ দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন গায়ত্রী। শাশ্বত মায়ের কোলে বসে লক্ষ্মণের হাত ধরে আছে। লক্ষ্মণের মাথা নিচু। পুলক পানিহাটি থানায় ফোন করছেন।

একদল পরাজিত মানুষকে পিছনে ফেলে প্রথমা ঘর থেকে বেরোল। অডিয়ো ভিস্যুয়াল আর প্রিন্ট মিডিয়া—এই দুই পক্ষের নজর বাঁচিয়ে তাকে চিপ থেকে বেরিয়ে দিল্লি ফিরতে হবে। সামনে অনেক কাজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *